মাতঙ্গী

মাতঙ্গী

তিতির তিতির করে বয়ে চলেছে ধন্যা নদী। পাশে কিছুটা ফাঁকা, ঘাস, ছোট ছোট ঝোপঝাড়, তার পেছনে বন। এখানে এখন পাখি ডাকছে। ফুল ফুটছে। ফুল ঝরছে। কিন্তু রাতে? রাতে এখানে খুব বিপদ। দিনেও মানুষের শান্তি নেই। নানা জন্তুজানোয়ার ওত পেতে থাকে। এই তো সেদিন শুক্কো বলে কাদামাখা গেঁড়াটাকে তরক্ষু টক করে তুলে নিয়ে গেল। তবু তাদের ভয়-টয় করে না। ও সব তো আছেই। জন্তুর মুখে, কি স্রোতের মুখে, বৃষ্টির ধারায় কি আগুনের হলকায় যে চলে যায় সে স্তব্ধ, অদৃশ্য হয়ে যায়। সেটা মেনে নেওয়াই তো ঠিক। ঘন বনের মাঝে এইখানটা একটু হালকা। জলের ওপর আলো চমকায়, অনেক দূর থেকে জল-জল বাস পায় সবাই। জল খেতে আসে জন্তুজানোয়ার, পাখি, মানুষ, যে যেখানে আছে। পায়ে পায়ে ধুলো ওড়ে। পিষে যায় ঘাস, ঝোপ, ফিরতি হাতের পায়ের মুখের জলে ভিজে যায় মৃৎ, ছোট ছোট ঘাসফুল রাতারাতি তারার মতো গজিয়ে ওঠে, কেউ রেয়াত করে না, তাই পায়ে পায়ে আবার দলে যায়। এই গজানো আর পিষে যাওয়া অবিরাম অবিরল চলেইছে চলেইছে। তার মাঝ দিয়ে তিতির তিতির করে বয়ে চলেছে ধন্যা। তার কোনও হেলদোল নেই।

—রঙ্কা… আ, রঙ্কা— আ… হঠাৎ ডাক ভেসে এল বনভূমির প্রাচীর ভেদ করে। রঙ্কা— আ। যে ডাকছে সে তার মুখের দু পাশে হাত জড়ো করে ডাকছে। শিঙার মতো শক্তিশালী কণ্ঠ। মাতঙ্গী। মাতঙ্গী ডাকছে। ডাকের মধ্যে একটা ভীষণ তাড়া, একটা ক্রোধও কি? ক্রোধ অবশ্য থাকতেই পারে। মাতঙ্গী আর রঙ্কার মধ্যে অবাধ্যতার একটা জলাভূমি আছে বটে, সেখানে আলেয়ার মতো হঠাৎ-হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠতে পারে ক্রোধ। কিন্তু তাড়া কেন? ভাবনাও কি? ভাবনা কী তারা খুব অস্পষ্টভাবে জানে। শুক্কোকে যখন পাওয়া গেল না, তিনটে সূর্য তিনটে চাঁদের পর মাতঙ্গীর খেয়াল হল, শুক্কো কোথায় গেল? শুক্কোকে দেখছি না! সে কার কাছে দুধ খাচ্ছে!

অর্যা খুব নিশ্চিন্ত স্বরে বলেছিল— শুক্কোকে তো তরক্ষু নিয়ে গেছে।

—সে কী? তুই দেখলি? কিছু করলি না?

—আমি তো শস্যক্ষেত্র পাহারা দিচ্ছিলাম। এক লহমার জন্য জল খেতে নদীতে যাই। দূরে হরিণের দল চরছিল। নিশ্বাস ফেলবার ফুরসত পেয়েছি! হরিণগুলো যা চতুর। ও খেলছিল ধুলোমাটি নিয়ে। তরক্ষুটা পেছন থেকে ঘাড় খামচে ধরে নিয়ে গেল। ও চেঁচাবার সময় পায়নি। ঘাড়টা তখনই মটকে লটকে গিয়েছিল।

—একজন মানুষ কমে গেল— মাতঙ্গী ক্রুদ্ধ নিশ্বাস ফেলেছিল—এই যে শস্য যারা মাটিতে পড়ে আবার গজায়, শনশন করে বেড়ে ওঠে, সোনালি ফলায় চমৎকার সাদা দুধ জমিয়ে আমাদের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করে, সেই সব শস্য যত্ন-আদর করবার জন্য, পাহারা দেবার জন্য, তাদের ধরনধারণ লক্ষ করার জন্য, বীজবপন, ফলাগুলো তোলা, ঝাড়াই-মাড়াইয়ের জন্য লোক চাই না? অনেক অনে—ক মানুষের দরকার। ছোটদেরও কত কাজ থাকে, আমাদের আরও আরও মানুষ চাই। অথচ নিছক একটা ছোট্ট মানুষকে তরক্ষু নিয়ে গেল আর অর্যা তুই খবর দিচ্ছিস— এই তিন চাঁদ পরে? ছিঃ! হুংকার করল মাতঙ্গী… তারপর হঠাৎ একটা অস্ফুট কলকল ধ্বনি বেরোল তার মুখ দিয়ে। ‘মাতঙ্গী কাঁদছে, মাতঙ্গী কাঁদছে’— একটা রব উঠল। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা অমনি ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। কে তার ঊরু বেয়ে কোলে উঠতে চাইছে, কে কাঁধের ওপর থেকে সামনে ঝুঁকিয়ে দিয়েছে মুখ, কে তার হাত বা পায়ে ঠোঁট ঘষছে, তার বিশাল কঠিন পর্বতশৃঙ্গর মতো বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ক’জন। চুচুকে চুমুক দিচ্ছে। আসলে এই ভাবে তারা মাতঙ্গীকে শান্ত করতে চায়। তাকে দেখাচ্ছিল শাবক পরিবৃত সিংহীর মতো। ‘যা, যা তোরা অর্যার কাছে যা’, ধরা গলায় বলেছিল মাতঙ্গী। ‘রঙ্কা যা অদ্রির কাছে যা, অদ্রি তোকে দুধ দেবে।’

রঙ্কার একটা অচেনা অনুভূতি হচ্ছিল। শরীর জ্বালা করছিল, মনটা কীরকম যেন বেঁকে দাঁড়িয়েছিল। পেটের মধ্যে চিনচিন, বুকের মধ্যে হা হা। সে চিৎকার করে বলেছিল— আমি অদ্রির কাছে যাব না। অর্যার কাছেও না, আমি শুক্কো চাই, আমি ছন্দর কাছে চললাম। —শুক্কোর মুছে যাওয়া, মাতঙ্গীর প্রথম কান্না, তার নিজের ভেতরের সব আশ্চর্য ঘটনা তাকে বিহ্বল দুর্বোধ্য করে তুলেছিল। ছন্দ দু হাত বাড়িয়ে তাকে আঁকড়ে ধরেছিল— আমি তোকে শুক্কো দোব একটা, আমি তোর চুচুকে রস এনে দেব রঙ্কা।

তারা দুজনে নির্ভয়ে চলে গিয়েছিল ঘন বনের ভেতর। তরক্ষু কি শিবা কি ঋক্ষর ভয় তাদের হয়নি। তারা হরিণ-হরিণীর মিলন দেখেছিল পরম তৃপ্তিতে, ঘুর্ঘুর পাখিদের মিলন দেখেছিল। এবং ওই ভাবে পিঠের ওপর থেকে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল ছন্দ। সেই থেকে রক্ষা মাতঙ্গীর কাছে ঘেঁষে না। দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে— এদিক থেকে, ওদিক থেকে। ছন্দ আর সে সব সময়ে জোড়ে ঘোরে। কেউ তাদের বিরক্ত করে না। শুধু শম মাঝে মাঝে হেসে বলে— যখন ছন্দকে আর ভাল লাগবে না তখন আমার কাছে আসিস, আমিও তোকে শুক্কো দেব, দুধ দেব।

মাতঙ্গী ডাকছে। বৃহৎ সব বনস্পতির প্রাচীরে ধাক্কা খেতে খেতে গর্গল গর্গল করে, সেই ডাক ভেসে আসছে। দলনেত্রী, বৃহদাকার, বৃহৎ চক্ষু, অস্ত্রপটু অদ্বিতীয় মাতঙ্গী ডাকছে। রঙ্কা ডাক লক্ষ্য করে ছুটল। হরিণের মতো জোরকদমে। ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে, খরগোশ বাঁদর ভাম এড়িয়ে চড়াং চড়াং করে ছুটে চলল। কেননা মাতঙ্গী ডাকছে। অনেক দিন পর মাতঙ্গী ডাকছে। রঙ্কাকে।

কতখানি ছুটেছে তার খেয়াল নেই। হঠাৎ এক দমকে থমকে গেল। যেখানে ফাঁকা জায়গা শুরু হবার কথা সেখানে মানুষের প্রাচীর। পেছনে আলোয় আলো সেই শস্যময় মাঠের আনন্দ। কিন্তু সামনে সে সব আড়াল করে দাঁড়িয়ে শম, অদ্রি, অৰ্যা, অলম্বুষ, গৃধ্ন, অর্যমা, রাত্রি, সম্বা, কুটিল, হবন, সর্ব, জগৎ, যে যেখানে ছিল তাদের পাড়ার মেয়ে পুরুষ সব। মুখ উৎকণ্ঠ, কঠিন, কাঁধে তির-ধনুক, হাতে বর্শা, লাঠি।

অলম্বু থেমে থেমে বলল— আমাদের বোধহয় পেছু হটে এই শস্যবন পেরিয়ে দূরে আরও দূরে পেছিয়ে যেতে হবে, কী বলো সিংহ!

—না— মাতঙ্গী গর্জন করে উঠল।

সিংহ হুংকার দিল, ওরে বাবা সে কী হুংকার!

—রঙ্কা। তুই কোনও অচেনা লোককে নদীর ধারে দেখেছিস? ওপারের সুদূর থেকে চরতে চরতে এসেছে! তুই তো সব সময়ে ওখানেই থাকিস! —মাতঙ্গী উদ্‌বিগ্ন কিন্তু কোমল স্বরে বলল।

—অচেনা লোক?

—হ্যাঁ, ধর আমাদেরই মতো, কিন্তু একটু অন্যতর। দেখলেই বোঝা যায় বিদেশি। বি-গোষ্ঠী।

অদ্রি বলল— রঙ্কার ওপর আবার ভরসা! ও ধন্যার স্রোতের সঙ্গে ভেসে ভেসে চলে যায়— কোথায় ফল, মৎস্য, শৈবাল। ও ধন্যার তীরে একটা বকের মতো নির্নিমেষ দাঁড়িয়ে থাকে। বসে থাকে। কিছু দেখে না, কিছু শোনে না। রঙ্কা একটা আনমনা।

আর তখনই রঙ্কার দপ করে মনে পড়ে গেল। নিমেষ, ওর নাম নিমেষ। সে যেখানে সাঁতার দিচ্ছিল, জলজ গাছপালার মধ্য থেকে ছোট ছোট মাছ ধরছিল, আবার ফেলে দিচ্ছিল, সেইখানে বুদ্‌বুদের মতো ভেসে উঠেছিল মুখটি। খুব ছোট। চুল পিঠ অবধি নেমেছে, কোমরে ভেড়ার চামড়ার ছোট পরিধান।

—কে তুমি? —সে আশ্চর্য, একটু বা সন্ত্র্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।

—আ-আমি… তু… তুমি কে?

—তুমি আগে বলো তুমি কে, আমিই প্রথম জিজ্ঞেস করেছি।

—নিমেষ— আমি নিমেষ।

—আমি রঙ্কা।

—রঙ্কা মনে রেখো আমি নিমেষ, মনে রাখবে তো? বলতে বলতে মাছেরই মতো পিছলে পিছলে দূরে অপর তীরের দিকে চলে যাচ্ছিল লোকটি। একবার জল থেকে মুখ তুলল, লম্বা চুল সেঁটে গেছে মাথায়, জল ঝরছে ঝুঁঝিয়ে বলল— কাউকে বোলো না কিন্তু রঙ্কা আমাদের এ দেখার কথা।

আবার মুখ তুলে বলল, আমি তোমার জলের বন্ধু। পরে আবার দেখা হবে জলে। গোপনে, তখন…

এ সাত চাঁদ আগের কথা, কি তারও বেশি। রঙ্কা সত্যিই আনমনা। সে ভুলে গিয়েছিল। যেমন করে ভুলে গিয়েছিল ছন্দকে, শমকে, অরি, সূদন ও রামকে। তার এই সব সঙ্গী কেউই তাকে বেশি দিন পায়নি। তার ভাল লাগে অনেককে। কিন্তু কী যে অদ্ভুত! সকালের ভাললাগা বিকেলে মিলিয়ে যায়, আজকের চাওয়া কালকে বদলে যায়। কী করা যাবে! সবাই জানে সে এইরকমই। এই মুহূর্তে নিমেষের জন্য এক প্রবল ঈপ্সা জেগে উঠল তার উদরে, নিম্নাঙ্গে। চুচুকে। সে মাটির ওপর পড়ে শীৎকার করে উঠল।

মাতঙ্গী বিরক্ত স্বরে বলল—এটার দ্বারা কিচ্ছু হবার নয়, তোরা কেউ একে গহনে নিয়ে যা। নয়তো দশা ওকে পাগল করে দেবে।

কেউ আর রঙ্কার দিকে নজর দিল না। সবাই তাকিয়ে আছে সিংহর দিকে। মাতঙ্গীর দিকে। সবাইকার মুখে উৎকণ্ঠা।

সিংহ বলল— আর কিছু নয়, আমি নিশ্চিত ওরা জেনেছে আমাদের শস্যের কথা। আমরাই এখানে একমাত্র শস্য খাই, মাটির ভাঁড়ে জল রাখি, আমাদের মতো কেউ নেই। বুনোরাও কিছু জানে না। মাটি দিয়ে ফুল উঠছে, ঘাস উঠছে। তবু বোঝে না। কিন্তু জানল কী ভাবে? ধন্যা আমাদের সীমানা, ধন্যা আমাদের রক্ষা করে। ধন্যার ওপার থেকে… কারও নজরে পড়ল না…?

মাতঙ্গী তীব্র গলায় বলল— কেন, আমরা যে ভাবে জেনেছি। কুকুরগুলো, নকুলগুলো ধন্যার দিক থেকে ছুটতে ছুটতে এল না, বাতাসে মুখ, নকুলগুলোর চিকচিক চিক চিকানি তো কুকুরদের ঘেউ ঘেউ-এর মধ্যে দিয়েও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। লোম খাড়া হয়ে উঠেছিল ওদের! ওদেরও তেমন কুকুর কি নকুল কি আর কিছু কি আর নেই! তা ছাড়া—শস্য? তার সৌরভ? বাতাস? ওমুখো বাতাস কি শস্যের গন্ধ ওদিকে বয়ে নিয়ে যায়নি? বাতাসের মতো বিশ্বাসঘাতক আর কে আছে?

সিংহ বলল— এতগুলি চাঁদ-সূর্য পার হলাম, বুঝলি অর্যমা। বুনোদের সঙ্গে, দস্যুদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। ওরা আবার গোপন যুদ্ধ করে। কোথাও কিছু নেই, তুমি দেখবে একটা তির তোমার বুকে কি হাতে কি পিঠে এসে লাগল, ব্যস। কিন্তু ওরা কখনও শস্যে হাত দেয় না। ওরা খায় না এমন ফলমূল নেই, বহু কন্দের গুণাগুণ ওরা জানে, শিকারের জন্তু আর গাছের ফল ফুরিয়ে গেলে অন্য জায়গায় চলে যাবে, মাটি খোঁড়ো, বীজ পোঁতো, জল দাও, শস্য ভোলা, ঝাড়ো— এ সব ওদের পোষায় না। এ নিশ্চয় ওই অজানা দিক থেকে আসছে।

সেই দিনই, চাঁদ সবে আকাশের প্রাচীর বেয়ে উঠতে শুরু করেছে, অন্ধকারে ধন্যার জল চিকচিক করছে, হঠাৎ বানর, শিয়ালের ডাকে ভরে গেল বনস্থল। সম্পূর্ণ অচেনা এক হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ বিজাতীয় ডাক আর খটাখট খটাখট, হরিণের চেয়েও ভারী তুরুকের আওয়াজ কাঁপিয়ে দিল পাড়া। তির-ধনুক, বর্শা বাগিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে ধন্যার দিকে ছুটে চলল সিংহ মাতঙ্গীর দল। পুরোভাগে মাতঙ্গী ও সিংহ। তাদের কেন্দ্র করে অর্ধচন্দ্রাকারে আর সবাই। ধন্যার অপর পাড়ে খটাখট খটাখট পায়ের শব্দ তুলে একদল যোদ্ধা এসে দাঁড়াল। আকাশে মুখ তুলে জন্তুগুলি—হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ শব্দ তুলল। প্রাণ কাঁপানো সে শব্দ।

একজন মুখের দু পাশে হাত রেখে চিৎকার করে বলল— সরে দাঁড়াও, অস্ত্র রাখো, আমাদের সঙ্গে অশ্ব আছে, লাফিয়ে পার হয়ে যাব নদী। সাঁতরাতে লাগবে না। কথা শোনো।

সিংহ সিংহনাদ করে উঠল। বন কাঁপিয়ে প্রতিধ্বনি করে উঠল মাতঙ্গী। শত তির বল্লম আকাশ ফুঁড়ে উড়ে গেল। চিৎকার, যাতনার গোঙানি, কান্না, তারপর ওদিক থেকে উড়ে এল তির, বল্লম। মাতঙ্গীরা বসে পড়ল। মাথার ওপর দিয়ে শনশন করে চলে গেল শত্রুপক্ষের অস্ত্র। পলকের মধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে আবার শরবর্ষণ করল মাতঙ্গীর দল। আর সেই শরজালের মধ্যে দিয়েই ধন্যা নদী লম্বা লম্বা লাফে ঝড়ের মতো পার হতে লাগল শত্রুবাহিনী, বল্লম বিঁধিয়ে দিতে লাগল ওপর থেকে, ধারালো অসি দ্বারা ছিন্ন করতে লাগল মুণ্ড, শুধুমাত্র জন্তুটির ধারালো জোরালো পদাঘাতে পিষ্ট হয়ে আহত নিহত হতে লাগল মাতঙ্গীর দল।

—লোকগুলিকে তন্তু দিয়ে বাঁধো—অচেনা গলা। ভরাট। চিৎকার করে বলছে, যেন বাজ।

রঙ্কার ডান হাত ফুঁড়ে তির চলে গেছে। যন্ত্রণায় সে পিপ্পল গাছের তলায় লুটিয়ে পড়েছিল। মাতঙ্গীর দলের অন্যদের মতো সে কষ্টসহিষ্ণু নয়। কাতরতা বেশি। সে খুবই কোমলঙ্গী। সদ্য দোয়া দুধের ওপর রক্তের ফোঁটা মিশলে যেমন হয় তেমন তার দেহবর্ণ। চেরা চোখের মধ্যবর্তী নীলচে কনীনিকা। মাতঙ্গী তাকে কঠিন কাজ দিতে ইতস্তত করত, তাই সে যখন মাটি মেখে ধন্যার জলে স্নান করে উঠে এসে, বাকলটি শুকিয়ে নিয়ে, বৃক্ষরস দিয়ে তার ওপর নানা ফুল এঁটে, বাকলটি পরে দাঁড়াত, মাতঙ্গী স্নেহ ও তাচ্ছিল্য মেশানো দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাত। বলত— “এ তৈরি হচ্ছে না। রঙ্কা কিছু শিখছে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ যদি মাতঙ্গীর মেয়েটাকে ধরে নিয়ে যায় সে কিচ্ছু করতে পারবে না। আনমনা মেয়ের এই ভবিতব্য। কিন্তু মাতঙ্গী তার পশ্চাদ্ধাবন করবে। তার হাত থেকে মেয়েকে রক্ষা করতে প্রাণটাও হয়তো দিয়ে ফেলবে। যদিও তাতে সবার ক্ষতি, সবার…সিংহর, শমের, অদ্রির, অর্যার… সবার, কেননা মাতঙ্গীর মতো বীর, মাতঙ্গীর মতো বুদ্ধিমান এখানে আর কেউ নেই। পরামর্শ করার হলে একমাত্র সিংহর সঙ্গেই করে মাতঙ্গী। কিন্তু সে শুধুই পরামর্শ। এসব কথা যেন রঙ্কা মনে রাখে।”

সূর্য উঠেছে। মৃদু কমলা আলোয় চরাচর ভেসে যাচ্ছে। তীব্র যন্ত্রণায় চোখ মেলে তাকাল রঙ্কা। এখনও তার চোখ থেকে তমসা-ঘোর কাটেনি। সে সূর্যের রং অনুভব করছে। কিন্তু সে ভাবে দেখতে পাচ্ছে না। চুলে, দাড়িতে আচ্ছন্ন একটি মুখ তার ডান বাহুর পাশে, তিরটি একটানে টেনে বার করেছে। সেই যন্ত্রণায় মুখ ভেসে যাচ্ছে তার জলে। পিষ্ট ওষধির প্রলেপ পড়ল বাহুতে, তারপর পাতলা গাছের পাতা দিয়ে বাঁধা হল জায়গাটা। আস্তে আস্তে চোখে দৃষ্টি ফিরছে রঙ্কার। —আমি নিমেষ, চিনতে পারছ রঙ্কা!

—নিমেষ! নিমেষ! নিমেষ!

ক্রমেই তার প্রশ্ন ভয়ানক থেকে ভয়ানকতর হচ্ছে। দুর্বল থেকে সক্ষম, তারপর সবল। তুমি এখানে কী করে এলে? জানো এখানে বি-গোষ্ঠীর লোকেরা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। আমাদের সর্বনাশ করে গেছে!

—হ্যাঁ! —যেন মৃদু হেসে তার দেওয়া তথ্য সমর্থন করে নিমেষ।

—জানো এক বিজাতীয় ঘৃণিত পশুর সাহায্য নিয়েছে তারা…

—ঘৃণিত নয় অতি প্রিয়— অশ্ব, রঙ্কা। ওদের অশ্ব বলে। যেমন বলবান, তেমন ক্ষিপ্র, তেমন সুন্দর। আমরা অশ্বারোহী।

—আমরা? তুমিও…

—হ্যাঁ, আমিও…

—তুমি তা হলে গুপ্তচর? সেদিন লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের পল্লি দেখতে এসেছিল?

—নিজের গোষ্ঠীর আহার-আশ্রয়ের জন্য যেটুকু পারি সেটুকু তো আমাদের করতেই হবে।

নিমেষ দু হাতে আহত রঙ্কাকে তুলে নিল। চলছে সাবধানে যাতে রষ্কার আঘাত না লাগে। শস্যমাঠ আর ধন্যা নদীর মাঝখানের পরিষ্কার জমিতে মৃতদেহ ছড়ানো, কিছু আহত মানুষ গাছের সঙ্গে লতা দিয়ে দৃঢ়ভাবে বাঁধা। সকলেই নতমুখ, অজ্ঞান। —নিহত অদ্রিকে দেখতে পায় রঙ্কা, সিংহের মুণ্ড গড়াচ্ছে, শম উলটে পড়ে গেছে, অজ্ঞান। ইতস্তত অশ্বগুলি ঘুরছে, তাদের ওপর আরোহীরা। রণভূমির মধ্য দিয়ে তাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে নিমেষ। সে হঠাৎ দাঁড়াল। চিৎকার করে বলল—সঙ্গীগণ, ধন্যা নদীর ধারে আমরা এই অপূর্ব উদ্ভেদ পেয়েছি। মাটি খুঁড়ে এরা উঠে আসে, আমাদের আহার্য হয়, বল দেয়, বীর্য দেয়, বন্দিরা আমাদের শেখাবে কী করে এই উদ্ভেদ হয়, কী করে তাদের লালন করতে হয়। ধন্যা নদীর তীরে প্রাপ্ত তাই এই উদ্ভেদ-এর নাম দিলাম ধান্য। আমরা ধান্যজয় করেছি। আর আমি জয় করেছি এই নারী। আমাদের গোষ্ঠীর মধ্যে আমি এর মতো মনোহর কাউকে দেখিনি। এ আমার নারী। আজ থেকে এই কথা সব সময়ে মনে রাখবে, এ ‘আমার’ গুহায় থাকবে, ‘আমার’ শিশু ধারণ করবে… বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে, নিমেষ এবং তার নিজের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত নিয়ে লেপে দিচ্ছে তার কপালে। এই দেগে দিলাম। রঙ্কা অবাক হয়ে শুনছে। ভাল বুঝতে পারছে না কী বলছে আর ঠিক সেই সময়েই একটা প্রবল ঝাঁকুনি খেল রঙ্কা—একটি অতি বৃহৎ বনম্পতির মূলে চিত হয়ে পড়ে আছে রক্তাক্ত মাতঙ্গী। তার দুই বিশাল চোখ আকাশের দিকে, কিন্তু সে দৃষ্টিহীন, তার চুচুক দুটি ঊর্ধ্বমুখী, তার বাকল ছিন্নভিন্ন— অনতিদূরে কুণ্ডলীকৃত হয়ে পড়ে রয়েছে। ‘মাতঙ্গী…মাতঙ্গী…মাতঙ্গী’ চিৎকার করতে করতে নিমেষের কোল থেকে লাফিয়ে নামে রঙ্কা। কেউ সতর্ক হবার আগেই ছুটে চলে যায়। আছড়ে পড়ে স্থির দেহটির ওপর। শিউরে ওঠে দেহ, মৃদু খুব মৃদু নিশ্বাসের মতো স্বর ফিসফিস করে বলে— রঙ্কা… আ… আকাশে মিলিয়ে যায়।

—মাতঙ্গী, মাতঙ্গী… যেয়ো না মাতঙ্গী… জেগে ওঠো… মাতঙ্গী… মা-আ-আ-আ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *