রূপান্তর

রূপান্তর

১.

এক সকালে গ্রেগর সামসা অস্বস্তিকর সব স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখে সে তার বিছানায় পড়ে আছে এক দৈত্যাকার পোকায় রূপান্তরিত হয়ে। তার কঠিন খোলার মতো পিঠের উপর সে শুয়ে আছে চিৎ হয়ে, আর মাথা অল্প তুলতেই তার চোখে পড়ল গম্বুজ আকারের বাদামি পেট, শক্ত ধনুকের মতো বাঁকানো অসংখ্য শিরায় ভাগ ভাগ, আর তার উপর লেপটা ঝুলে আছে কষ্টেসৃষ্টে, মনে হচ্ছে পুরোপুরিই পিছলে পড়বে যেকোনো সময়। তার অগুনতি পা, শরীরের বাকি অংশের তুলনায় শোচনীয় রকম সরু সরু, অসহায়ভাবে লাফাচ্ছে চোখের সামনে।

‘কী হলো আমার? ভাবল সে। কোনোকিছুই স্বপ্ন না। এই তো তার ঘর, মানুষ থাকার সাধারণ একটা কামরা, তবে আয়তনে খানিক ছোটই– শান্ত পড়ে আছে পরিচিত চার দেয়ালের মাঝে। টেবিলের উপরদিকে, টেবিলটায় মোড়কখোলা অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাপড়ের গাদা গাদা নমুনা– সামসা একজন ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যান –দেয়ালে ঝুলছে সেই ছবিটা যা সে কদিন আগে একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিন থেকে কেটে রেখে দিয়েছিল সুন্দর গিল্টি করা ওই ফ্রেমের মধ্যে। ওতে দেখা যাচ্ছে ফারের টুপি আর ফারের গাউন পরা এক মহিলা টান টান বসে দর্শকের দিকে বাড়িয়ে ধরেছে পুরু এক ফারের দস্তানা যার মধ্যে হারিয়ে গেছে তার হাতের প্রায় পুরোটাই।

এরপর গ্রেগরের চোখ ঘুরল জানালার দিকে, বাইরের বিশ্রী আবহাওয়া– জানালার ধাতব কার্নিশে শোনা যাচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ– খুব বিষণ্ণ করে তুলল তার মন। ‘ফের খানিকটা ঘুমিয়ে নিলে বেশ হয়, এই আজগুবি ব্যাপারটা ভুলে থাকা যাবে, ভাবল সে। কিন্তু তা পুরোপুরি অসম্ভব, কারণ তার অভ্যাস ডান কাতে শোয়া আর এই অবস্থায় ডান দিকে ফেরার মতো ক্ষমতা তার নেই। যতই জোরে সে ডানদিকে ঘোরার চেষ্টা করছে

কেন, বারবার পিঠের ওপরেই পড়ে যাচ্ছে চিৎ হয়ে। কম করে হলেও ১০০ বার হবে এই চেষ্টাটা সে করেছে, দুই চোখ বন্ধ করে থেকেছে যাতে করে ছটফট করা ওই পাগুলো দেখতে না হয়। শেষমেশ শুধু তখনই ক্ষান্ত দিল সে, যখন পিঠের পাশটায় শুরু হলো এক মৃদু, ভোঁতা যন্ত্রণা– অনুভূতিটা তার কাছে একেবারেই নতুন।

‘ও খোদা’, ভাবল সে, কী এক ক্লান্তির কাজই না আমি বেছে নিয়েছি! দিনের পর দিন চলছি তো চলছিই। অফিসে বসে কাজ করার চাইতে এ কাজের ব্যবসার দিকটা কত কত বেশি ঝামেলার, তার ওপর আছে এই এত এত ঘুরে বেড়ানোর অমানুষিক কষ্ট, ট্রেন পাওয়া-না-পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা, বাজে আর নিয়মছাড়া খাওয়াদাওয়া, আর নিয়মিত নতুন নতুন সব মুখের সঙ্গে পরিচয়, যাদের সঙ্গে কোনো রকম উষ্ণ স্থায়ী বন্ধুত্বের সম্ভাবনা কখনোই নেই। ওহ্, জাহান্নামে যাক এসব। পেটের উপর খানিক চুলকানি অনুভব করল সে; পিঠে ধাক্কা মেরে ধীরে ধীরে যাওয়ার চেষ্টা করল খাটের মাথার দিকটায় যাতে মাথা তোলাটা আরেকটু সহজ হয়; খুঁজে পেল চুলকানির জায়গাটা, দেখল ওখানটা ভরে আছে অসংখ্য ছোট সাদা সাদা ফোঁটায়, এর কোনো ব্যাখ্যা পেল না সে; এরপর পাগুলোর একটা দিয়ে এই জায়গাটা পরীক্ষা করতে চাইল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই টেনে নিল পা, কারণ ওখানে প্রথম ছোঁয়াতেই তার মধ্যে বয়ে গেছে ঠান্ডা একটা কাঁপুনি।

পিছলে নেমে আবার সে তার আগের আসনে ফিরে গেল। এই সাতসকালে ঘুম থেকে উঠলে লাগে আহাম্মকের মতো,’ ভাবল সে। ঘুম সবারই দরকার। অন্য সেলসম্যানরা তো জীবন কাটায় হারেমের মেয়েদের মতো। যেমন, সকালবেলা আমি যখন অর্ডারগুলো লিখতে হোটেলে ফিরে যাই, তখনো ঐসব ভদ্রলোকেরা দেখা যায় বসে বসে নাশতা করছে। অমন চেষ্টা আমি যদি কখনো আমার বড়কর্তার সঙ্গে করি, তক্ষুনি আমার চাকরি খাওয়া হবে। অবশ্য তা যে আমার জন্য ভালোই হবে না, তা কে বলতে পারে! বাবা মায়ের কথা ভেবে যদি আমাকে আঁকড়ে থাকতে না হতো, তাহলে কবেই ইস্তফা দিয়ে দিতাম, চিঠিটা নিয়ে সোজা চলে যেতাম বড়কর্তার কামরায় আর তার মুখের ওপর ঝেড়ে আসতাম মনের কথাগুলো। চেয়ার থেকে উল্টে ফেলে দিতাম তাকে, স্রেফ কথা দিয়েই! ও ব্যাটার কাজকামের ধরনই তো কেমন হাস্যকর –নিজের বেঞ্চে বসে ঐ উপর থেকে কথা বলে নিচে দাঁড়ানো কর্মচারীদের সঙ্গে, তাও আবার কানে খাটো বলে সবাইকেই উঁচু হয়ে এগিয়ে যেতে হয়। হুঁ, এখনো আমি সব আশা ছাড়িনি; ওর কাছে আমার বাবা-মায়ের যা ধার আছে তা শোধ করার মতো টাকা একবার জমুক না– পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে তা হয়ে যাওয়ার কথা –তখন কোনো ভুল নেই আমি ইস্তফা দিচ্ছি। আবার নতুন করে সব শুরু করব তখন। যাকগে, এখন বরং ওঠা যাক, কারণ ট্রেন ছাড়বে পাঁচটায়।

বিছানার পাশে টেবিলের উপর টিকটিক করতে থাকা অ্যালার্ম ঘড়িটার দিকে তাকাল সে, ‘হায় খোদা!’ সে ভাবল। সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে, ঘড়ির কাঁটা নীরবে এগিয়ে যাচ্ছে আরো সামনে, আসলে সাড়ে ছয়টার বেশিই হবে, প্রায় পৌনে সাত বলা যায়। অ্যালার্ম কি বাজেনি তাহলে? বিছানা থেকে দেখা যাচ্ছে, ঠিকঠাক চারটের অ্যালার্মই দেওয়া আছে; তার মানে নিশ্চিত বেজেছিল ওটা। হুঁ, কিন্তু ওই রকম কান-ফাটানো আওয়াজের মধ্যে কি শান্তিমতো ঘুমিয়ে থাকতে পারে কেউ? আসবাবগুলো খুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্যও তো ওই আওয়াজ যথেষ্ট। না, শান্তির ঘুম সে ঘুমায়নি, তবে সম্ভবত ওই আওয়াজ না-শোনার বেহমতো ঘুম ছিল ওটা। কিন্তু এখন সে করবে কী? পরের ট্রেন ছেড়ে যাবে সাতটায়; ওটা ধরতে হলে সব সারতে হবে পাগলের মতো, আর কাপড়ের নমুনাগুলো এখনো বাধাছাদাই হয়নি; সেই সঙ্গে নিজেকেও তো ঝরঝরে আর সক্রিয় বলে মনে হচ্ছে না কোনো বিচারেই। আর যদি ঐ ট্রেনটা ধরা সম্ভব হলো, তবু তো বড়কর্তার গালিগালাজ এড়ানো যাবে না, কারণ ওর পিয়নটা নিশ্চিত পাঁচটার ট্রেন ধরেছে, আর এতক্ষণে জানানো হয়ে গেছে সে আসেনি। ও হচ্ছে স্রেফ বড়কর্তার চামচা, মেরুদণ্ডহীন একটা গবেট। আচ্ছা, ধরা যাক সে আজ অসুস্থ বলে কাজে গেল না? কিন্তু তা খুব বেখাপ্পা আর সন্দেহজনক দেখাবে, কারণ গ্রেগর তার চাকরির পাঁচ বছরে অসুস্থ হয়নি একবারও। বড়কর্তা নিশ্চিত তাহলে নিজেই এখানে হাজির হয়ে যাবেন স্বাস্থ্যবিমার ডাক্তার সঙ্গে নিয়ে, তার বাবা-মাকে খোটা দেবেন তাদের পুত্রের আলসেমির জন্য, আর বিমা-ডাক্তারের কথার উল্লেখ করে করে সব রকম অজুহাত নাকচ করতে থাকবেন, যে ডাক্তারের মতে কিনা এ পৃথিবী সব রীতিমতো সুস্থ কিন্তু কাজ ফাঁকি দেওয়া লোকে ভর্তি। তবে, খুব কি ভুলও হবে যদি তিনি অমনটা করেন? কারণ গ্রেগরের তো আসলেই নিজেকে বেশ সুস্থ বলেই মনে হচ্ছে, শুধু যা একটু ঢুলুঢুলু ভাব– অমন লম্বা ঘুমের পরে যা সত্যি বেশ বাড়াবাড়িই বটে, আর এমনকি অস্বাভাবিক রকমের খিদেও লেগেছে তার।

খুব দ্রুত সে এসব নিয়ে ভাবছে, বিছানা ছেড়ে ওঠার ব্যাপারে মনস্থির করে উঠতে পারেনি –অ্যালার্ম ঘড়িটায় এইমাত্র পৌনে সাতটার আওয়াজ হলো –তখনই বিছানার মাথার দিকের দরজায় শোনা গেল একটা সতর্ক টোকা। গ্রেগর, তার মায়ের গলা, ‘পৌনে সাতটা বাজল যে। তুমি কি ট্রেন ধরবে না নাকি?” সেই স্নিগ্ধ গলা! উত্তর দিতে গিয়ে নিজের কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল গ্রেগর, কোনো ভুল নেই এ তার সেই পুরোনো কণ্ঠস্বর, কিন্তু এর সঙ্গে মিশে আছে –যেন বা কোন্ নিচ থেকে আসছে –এক অদম্য, যন্ত্রণাকাতর চিঁ চিঁ শব্দ; ওই শব্দের তোড়ে মাত্র মুহূর্ত খানিক পষ্ট থাকল তার কথা, তার পরই তারা এমন বিকৃত হয়ে গেল যে কেউ তা ঠিকভাবে শুনতে পেল কি না, তা আর বলা সম্ভব না। গ্রেগরের ইচ্ছে বিস্তারিত উত্তর দেয় আর সবকিছু বুঝিয়ে বলে ব্যাখ্যা করে, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনা করে শুধু এটুকুই বলল সে: ‘হা, হ্যাঁ, থ্যাংক ইউ মা, এই এক্ষুনি উঠছি আমি। মাঝখানের কাঠের দরজার জন্য গ্রেগরের স্বরের এই পরিবর্তন মনে হয় বাইরে থেকে। বোঝা গেল না, কারণ তার মা ওই কথাতে আশ্বস্ত হয়ে চলে গেলেন পা টেনে টেনে। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত বাক্যবিনিময়ে পরিবারের অন্যরা জেনে গেল যে গ্রেগর– এমনটা তারা আশা করেনি– এখনো বাড়িতে, আর তার বাবা এরই মধ্যে পাশের দরজার একটার গায়ে মুঠি দিয়ে হালকা টোকা দিতে লাগলেন। গ্রেগর, গ্রেগর, তিনি ডাকলেন, “কী হয়েছে? আর খানিক পরই আরো গাঢ় স্বরে ফের জানাতে লাগলেন তার তিরস্কার: গ্রেগর! গ্রেগর! এরই মধ্যে অন্য পাশ-দরজা থেকে ভেসে এল তার বোনের মৃদু বিলাপের গলা: গ্রেগর? তোমার কি শরীর খারাপ করেছে? কোনোকিছু লাগবে?’ ‘আমি আসছি এক্ষুনি, দু-দিকেরই উত্তর দেওয়ার মতো করে বলল গ্রেগর, খুব সাবধানে কথাগুলো উচ্চারণ করে, প্রতিটা শব্দের মধ্যে লম্বা বিরতি দিয়ে দিয়ে সাধ্যমতো চেষ্টা করল নিজের কণ্ঠ যদুর সম্ভব স্বাভাবিক রাখার । আসলেই তার বাবা নাশতার টেবিলে ফিরে গেলেন, তবে তার বোন ফিসফিসিয়ে তখনো বলল: ‘দরজা খোলো, গ্রেগর, প্লিজ দরজা খোলো। কিন্তু দরজা খোলার কোনো ইচ্ছা গ্রেগরের নেই, বরং সে নিজেকে ধন্যবাদ জানাল রাতে শোয়ার সময়, এমনকি যখন বাড়িতে আছে তখনো, সবগুলো দরজায় তালা দিয়ে ঘুমানোর যে বিচক্ষণ অভ্যাসটা সে ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যান হিসেবে রপ্ত করেছে তার জন্য।

প্রথম যে কাজটা সে করতে চাইছে তা হলো, চুপচাপ ও শান্তিতে বিছানা ছেড়ে ওঠা, কাপড়চোপড় পরে নেওয়া, আর সবচেয়ে দরকার– নাশতাটা সারা; কেবল তার পরই সে ভাববে পরের কাজগুলো নিয়ে, কারণ তার কাছে এটা পরিষ্কার, বিছানায় শুয়ে চিন্তা করে কোনো সুবিবেচনার সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না। তার খেয়াল হলো, আগে বহুবার বিছানায় অল্পস্বল্প অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার অভিজ্ঞতা তার আছে, ওগুলো খুব সম্ভব বেকায়দায় শোয়া থেকেই, কারণ পরে বিছানা ছেড়ে উঠলে দেখা গেছে ও রকম কিছু আসলে নেই, আর এখন সে দেখার জন্য ব্যগ্র হয়ে আছে কীভাবে আজ সকালের কল্পনাটাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। সেই সঙ্গে তার গলার স্বর বদলে যাওয়াটাও যে স্রেফ একটা কঠিন ঠান্ডা লাগারই পূর্বলক্ষণ– ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যানদের এই এক স্থায়ী অসুখ– সে ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

গা থেকে লেপ সরাতে কোনো ঝামেলাই হলো না; নিজেকে শুধু খানিক ফোলাতে হলো তার, আর আপনা-আপনিই গড়িয়ে পড়ল লেপটা। কিন্তু এর পরে সবকিছু হয়ে উঠল কঠিন, বিশেষ করে তার আকার যেহেতু এমন অস্বাভাবিক চওড়া। নিজেকে উঠে বসানোর জন্য লাগত হাত আর বাহু; কিন্তু বদলে তার আছে শুধু এই অসংখ্য পা, বিরামহীন যেগুলো নড়াচড়া করছে নানা আলাদা কায়দায়, আর আরো বড় কথা, ওদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই তার। যেই-না সে ওদের একটাকে বাকাতে চেষ্টা করছে, অমনি সবার আগে টান টান হয়ে যাচ্ছে সেটা; আর যদি শেষমেশ এই পাটাকে সে নিজে যা চায় তা করানোও গেল, তো দেখা যাচ্ছে এরই মধ্যে অন্য সব কটা পা নাচানাচি শুরু করেছে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো– যন্ত্রণাদায়ক অস্থিরতার এক চূড়ান্ত অবস্থায়। এমন অলসের মতো বিছানায় পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না, আপন মনে বলল গ্রেগর।

সবার আগে সে চেষ্টা করল শরীরের নিচের অংশ বিছানা থেকে নামাতে, কিন্তু এই নিচের অংশ, যা আসলে সে এখনো দেখেনি আর এমনকি খুব একটা আন্দাজও করতে পারছে না, নড়াচড়া করানো খুবই কষ্টসাধ্য ঠেকল; খুব ধীরে আগাচ্ছে সে; আর শেষমেশ যখন প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে, সমস্ত শক্তি জড়ো করে বেপরোয়া নিজেকে ছুঁড়ে মারল সামনের দিকে, দেখল তার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে, ধপাস করে সে গিয়ে পড়েছে বিছানার পায়ের দিকটায়; সেই সঙ্গে শরীর অসাড় করা এক যন্ত্রণা তাকে জানিয়ে দিল– এই এখন শরীরের ঠিক এই নিচের অংশটাই সম্ভবত তার সবচেয়ে স্পর্শকাতর অঙ্গ।

অতএব প্রথমে শরীরের উপরের দিকটা বরং বাইরে নামানোর চেষ্টা করল সে, আর সাবধানে মাথা বাঁকাল বিছানার কিনারার দিকে। এটুকু করতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না; আর শেষে তার শরীরের আসল ভারী অংশ, যথেষ্ট চওড়া আর ওজনদার হওয়া সত্ত্বেও, ধীরে অনুসরণ করল মাথার গতিপথ। কিন্তু সর্বশেষে যখন মাথাটা খাটের কিনারা থেকে বাইরে শূন্যে নিয়ে যেতে পেরেছে, তখন আর সাহস হলো না সামনে এগোনোর, কারণ এভাবে যদি সে নিচে গিয়ে পড়ে তাহলে মাথায় আঘাত না-পাওয়াটা হবে রীতিমতো এক অলৌকিক ঘটনা। আর এখন এ মুহূর্তে কোনো অবস্থাতেই তার সংজ্ঞা হারানো চলবে না; তার চেয়ে বরং বিছানাতেই, যেখানে আছে সেখানেই, শুয়ে থাকা ভালো।

কিন্তু একই রকম আরেকবার চেষ্টার পর যখন সে তার আগের জায়গায় শুয়ে হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে, ফের দেখছে যে তার অতি খুদে পাগুলো সম্ভবত আগের চেয়েও বেশি প্রচণ্ডতায় জড়াজড়ি করছে একটা আরেকটার সঙ্গে, আর ওদের এই হুটোপুটি কমিয়ে ওগুলোকে কোনো ধরনের শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার কোনো পথই তার জানা নেই, তখন সে আবার নিজেকে বলল –বিছানায় শুয়ে থাকাটা অসম্ভব, আর সবচেয়ে বিচক্ষণ কাজ হবে বিছানা ছেড়ে ওঠার সামান্যতম আশা যদি থাকে তবে সেটুকুর জন্যই সর্বস্ব পণ করে ঝুঁকি নেওয়া। কিন্তু একই সঙ্গে নিজেকে এ কথা মনে করিয়ে দিতেও সে ভুলল না যে ঠান্ডা মাথায়, একেবারে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে কাজ করাটা বেপরোয়া কোনো সিদ্ধান্তে যাওয়ার চেয়ে অনেক শ্রেয়। যখন সে এমন ভাবছে তখন তার দৃষ্টি, যতখানি স্থিরভাবে সম্ভব, নিবদ্ধ রয়েছে জানালার উপর, যদিও দুর্ভাগ্য সকালবেলার কুয়াশার সেই দৃশ্য দেখে– এতই ঘন কুয়াশা যে সরু রাস্তার ও পাশটা পর্যন্ত অস্পষ্ট– কোনো ভালো উৎসাহ বা সাহস পাওয়া গেল না। এরই মধ্যে সাতটা বেজে গেছে’ অ্যালার্ম ঘড়ি আরো একবার ঘণ্টা বাজাতেই আপন মনে সে বলল, “সাতটা বাজল, আর এখনো কি না ও রকম কুয়াশা। এবার কিছুক্ষণ স্থির শুয়ে রইল সে, শ্বাস নিতে লাগল নিঃশব্দে, যেন অমন নিঃশব্দতার মধ্য দিয়ে আশা করছে ফিরে যেতে পারবে স্বাভাবিক, রোজকার বাস্তবে।

কিন্তু তারপর সে নিজেকে বলল: ‘সোয়া সাতটা বাজার আগেই যে করে হোক বিছানা ছেড়ে উঠতে হবে, উঠতেই হবে। তা ছাড়া, ততক্ষণে, অফিস থেকেও কেউ-না-কেউ চলে আসবে আমার খোঁজ নিতে, অফিস তো খোলে সাতটার আগেই। আর এবার সে মন দিল পুরো শরীর একই তালে দোলাতে দোলাতে বিছানার বাইরে নিয়ে যাওয়ার কাজে। যদি সে এভাবে খাট থেকে নিচে পড়ে তাহলে তার মাথা– যা সে চাচ্ছে পতনের সময় ঝট করে উঁচুতে তুলে ফেলবে– মনে হয় আঘাত থেকে বেঁচে যাবে। পিঠটা বেশ শক্ত বলেই মনে হচ্ছে; কার্পেটের উপর গিয়ে পড়লে খুব একটা ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তার মূল চিন্তা ওই পড়ার প্রচণ্ড আওয়াজটা নিয়ে, ওটা ঠেকানোর কোনো উপায় তার জানা নেই; দরজার ওপাশে ওই আওয়াজ আতঙ্ক না হলেও অন্তত দুশ্চিন্তার জন্ম তো দেবেই। কিন্তু এ ঝুঁকিটুকু তাকে নিতেই হচ্ছে।

এরই মধ্যে গ্রেগর যখন শরীরটা খাট থেকে অর্ধেক বাইরে নিয়ে এসেছে –তার এই নতুন পন্থা যতটা না শারীরিক কসরত তার চেয়ে বেশি খেলা, কারণ তাকে স্রেফ এপাশে ওপাশে দুলতে হচ্ছে শুধু –তখন তার মনে হলো, কেউ যদি একটু সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসত তাহলে কত সহজই না হয়ে যেত কাজটা। দুজন শক্তপোক্ত কেউ তার বাবা আর ঝিয়ের কথা ভাবল সে –হলেই যথেষ্ট হতো; তাদের শুধু তার বাঁকানো পিঠের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে, ওভাবেই খাট থেকে তুলে, বোঝাটাসহ নিচের দিকে ঝুঁকে, তারপর সাবধানে তাকে মেঝের উপর ডিগবাজি খেয়ে পড়তে দিলেই চলত; ওখানে আশা করা যায় তার এই ছোট ছোট পাগুলো তখন কাজে আসবে। তাহলে কি (যদিও সবগুলো দরজাই বন্ধ) সত্যিই তার উচিত সাহায্যের জন্য ডাক দেওয়া? এই কথা ভেবে, এ রকম চরম দুর্দশার মধ্যেও, হাসি চাপতে পারল না সে।

ইতিমধ্যে এমন এক অবস্থানে সে পৌঁছে গেছে যেখানে সে যদি জোরের সঙ্গে এভাবে দুলতে থাকে তাহলে আর বেশিক্ষণ নিজের ভারসাম্য বজায় রাখা যাবে না; আর শিগগিরই এখন তাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেই হবে, কারণ পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সোয়া সাতটা বাজবে– তখনই সামনের দরজার ঘণ্টি বেজে উঠল। অফিসের কেউই হবে, মনে মনে এ কথা বলতেই আতঙ্কে সে প্রায় জমে গেল; তার ছোট ছোট পাগুলো তখন নাচতে লাগল আরো চটপট। এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু নিশ্চুপ। ওরা কেউই দরজা খুলবে না,’ এক যুক্তিহীন আশায় বুক বেঁধে বলল গ্রেগর। কিন্তু এর পরই, অন্য সময়ের মতোই, ঝি’টা তার ভারী পা ফেলে দরজার কাছে গেল, খুলে দিল দরজা। গ্রেগরকে শুধু অতিথির সম্ভাষণের প্রথম শব্দটা শুনতে হলো মাত্র, তখনই সে বুঝে গেল লোকটা কে– প্রধান কেরানি স্বয়ং। হায় এ কী ভাগ্য, এমন এক অফিসে কাজ করার শাস্তি কেন সে ভোগ করছে যেখানে সামান্য বিচ্যুতিও সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে গভীর সন্দেহের জন্ম দেয়? এ মানুষটার কাছে তাহলে কি সমস্ত কর্মচারীই বদমাশ; তাদের মধ্যে কি এমন একজনও বিশ্বস্ত, নিবেদিতপ্রাণ কর্মচারী নেই যে কিনা এক সকালে অফিসকে এক কি দুই ঘণ্টা শ্রম দিতে না পারার ব্যর্থতায় অনুশোচনায় পাগল হয়ে যায়,– এতই অনুশোচনা যে বিছানা ছেড়ে ওঠার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলে? ধরে নিচ্ছি এভাবে খোঁজ নেওয়ার আদতেই দরকার আছে, তবুও কি সেই কাজে একজন নিচের কাউকে পাঠানোই আসলে যথেষ্ট হতো না? স্বয়ং প্রধান কেরানিকেই কি আসা লাগত, এটা কি এই পুরো নিরপরাধ পরিবারটাকে দেখানোর জন্যই যে ঘটনাটা এত বেশি সন্দেহজনক, অতএব তার তদন্তকাজ একমাত্র অমন উচ্চপদস্থ কারোর বিচারবুদ্ধির ওপরই ছাড়া যায়? কোনো খাঁটি সিদ্ধান্ত থেকে না, বরং এসব চিন্তায় উত্তেজিত হয়ে এবার গ্রেগর শরীরের সমস্তটা দিয়ে নিজেকে ছুঁড়ে দিল বিছানার বাইরে। জোরে ধপাৎ করে শব্দ হলো একটা, যদিও কোনোকিছু ভেঙেচুরে পড়ার মতো শব্দ না। তার এই পতন খানিকটা সহনীয় হয়েছে। কার্পেটের কারণে, আর সেই সঙ্গে পড়ার পরে পিঠটায় গ্রেগরের আন্দাজের থেকে বেশি দোল হয়েছে –সে কারণেই এই ভোতা, তুলনামূলক মার্জিত ধপাৎ আওয়াজ। শুধু বিষয় হলো, মাথাটা যথেষ্ট সাবধানের সঙ্গে উঁচু করা যায়নি আর তাই ওটা আঘাত পেয়েছে। হব্যথা আর বিরক্তির সঙ্গে মাথাটা ঘুরিয়ে কার্পেটের উপর ডলতে লাগল সে।

‘কিছু একটা পড়েছে ওই ঘরে, বাঁ পাশের ঘর থেকে প্রধান কেরানি বলে উঠলেন। আজ তার ভাগ্যে যা ঘটেছে, অমন কিছু একদিন প্রধান কেরানির ভাগ্যেও ঘটতে পারে কি না, তা ভাবতে লাগল গ্রেগর; মানতেই হবে– তেমন ঘটা অসম্ভব না। কিন্তু এ প্রশ্নেরই কড়া জবাব হিসেবে যেন পাশের কামরায় প্রধান কেরানি কয়েকবার জোর পায়ে হাঁটাহাঁটি করলেন, তার বার্নিশ করা চামড়ার বুট জুতো থেকে শব্দ উঠল মচমচ। ডান পাশের কামরা থেকে গ্রেগরের বোন তাকে অবস্থাটা জানানোর জন্যই ফিসফিসিয়ে বলল: গ্রেগর তোমার বস্ এসেছেন। আমি জানি, নিজের মনে জবাব দিল গ্রেগর, তার বোনের শোনার মতো জোরে কথা বলা সাহসে কুলাল না তার।

‘গ্রেগর, বাঁ-পাশের ঘর থেকে এবার বলে উঠল তার বাবা, ‘প্রধান কেরানি সাহেব এসেছেন, উনি জানতে চাচ্ছেন কেন তুমি ভোরের ট্রেনে রওনা দাওনি। আমরা তাকে কী বলব বুঝতে পারছি না। তা ছাড়া উনি তোমার সঙ্গে নিজে কথা বলতে চান। তাই প্লিজ, দরজা খোলো। ভয় নেই, তোমার ঘরের অগোছানো অবস্থা দেখে উনি কিছু মনে করবেন না।’ ‘সুপ্রভাত, হের সামসা, প্রধান কেরানি এর মধ্যে বলে উঠলেন সদাশয় ভঙ্গিতে। ‘ওর শরীরটা আসলে ভালো নেই, তারা বাবা যখন দরজার ওপাশ থেকে কথা বলে যাচ্ছেন, তখন প্রধান কেরানিকে বলল তার মা। ওর শরীরটা ভালো নেই, সত্যি বলছি। তা না হলে গ্রেগর ট্রেন মিস করবে কেন? ও তো নিজের কাজ ছাড়া অন্যকিছু নিয়ে ভাবেই না। সন্ধ্যায় কখনো বেড়াতে পর্যন্ত বেরোয় না, আমি তো প্রায় রেগেই যাই; গত সপ্তাহের পুরোটাই ও এই শহরে ছিল আর প্রত্যেক সন্ধ্যা ঘরে বসেই কাটিয়েছে। হয় ঐ বসায় ঘরের টেবিলে বসে চুপচাপ খবরের কাগজ পড়েছে, না হয় খুঁটে খুঁটে তার রেলের সময়সূচি দেখেছে। শখ বলতে ওর তো ওই একমাত্র কাঠের নকশার কাজ। এই তো, দু-তিন সন্ধ্যা ধরে একটা ছোট ছবির ফ্রেম বানাল; আপনি দেখলে অবাক হয়ে যাবেন কত সুন্দর হয়েছে ওটা। ছবিটা ওর ঘরে ঝোলানো; গ্রেগর দরজা খুললেই আপনি দেখতে পাবেন। আপনি এসেছেন, আমি সত্যিই খুশি হয়েছি স্যার। আমরা নিজেরা মনে হয় ওকে দরজা খুলতে রাজি করাতে পারতাম না কখনোই; কী যে গেয়ার ও। আর ও যে অসুস্থ, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই, যদিও সে বলছে সকালের দিকে ভালোই ছিল শরীর।’ ‘আমি এক্ষুনি আসছি,’ ধীরে এবং চেপে চেপে বলল গ্রেগর, নিঃসাড় পড়ে থাকল, যেন ঐ কথাবার্তার একটা শব্দও তার কান এড়িয়ে না যায়। আমি নিজেও তো ম্যাডাম এ ছাড়া অন্য কোনো কারণের কথা ভাবতে পারছি না’, বললেন প্রধান কেরানি, ‘আশা করছি, খুব সিরিয়াস কিছু না। যদিও অন্যদিকে বলতে বাধ্য হচ্ছি আমরা যারা বিজনেসে আছি– আমাদের দুর্ভাগ্যই বলুন আর সৌভাগ্যই বলুন– বিজনেসের স্বার্থেই আমাদের যাবতীয় টুকটাক অসুস্থতা ঝেড়ে ফেলতে হয়। আচ্ছা, তাহলে প্রধান কেরানি সাহেব কি তোমার ঘরে এখন ঢুকতে পারেন?’ অধৈর্যের সঙ্গে বললেন তার বাবা, ফের টোকা দিতে লাগলেন দরজায়। ‘না’, বলল গ্রেগর। বাঁ-পাশের কামরায় নেমে এল এক অস্বস্তিকর নীরবতা: আর ডান পাশের কামরায় তার বোন ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।

কেন যে তার বোনটা ঐ ঘরে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে না? মনে হয় মাত্র সে বিছানা ছেড়ে উঠেছে আর এখনো কাপড়চোপড়ই ঠিকমতো পরে ওঠেনি। আর সে কাঁদছে কী জন্য? এ জন্যই কি যে গ্রেগর বিছানা থেকে ওঠেনি, প্রধান কেরানিকে ঘরে ঢুকতে দেয়নি এবং এবার তার চাকরিটা যাওয়ার ভয় আছে, আর এখনই তার অফিসের বড়কর্তা তার বাবা-মাকে চাপতে শুরু করবেন পুরোনো ধার-দেনাগুলো শোধ করতে? এগুলো সব। অযথা আশঙ্কা, আপাতত অযথাই। গ্রেগর এখনো পাশেই আছে আর নিজের পরিবারকে ছেড়ে যাওয়ার সামান্য ইচ্ছাও তার নেই। হুঁ, ঠিক এ মুহূর্তে সে শুয়ে আছে কার্পেটের উপর; আর তার এখনকার অবস্থা সম্পর্কে জানে না এমন যে কেউ তো আশা করতেই পারে যে মুখ্য কেরানিকে সে ঘরে ঢুকতে দেবে। তাই বলে এই সামান্য অসৌজন্যতা– পরে কিনা ভালোমতোই যার কারণ ব্যাখ্যা করা যাবে –তো কোনোভাবেই গ্রেগরের তাৎক্ষণিক বরখাস্তের কারণ হতে পারে না। গ্রেগরের মনে হলো, তারা যদি এখন তাকে এসব কান্নাকাটি আর অনুরোধ-উপরোধে বিরক্ত করার বদলে একটু শান্তিতে থাকতে দিত, সেটাই অনেক বেশি বিচক্ষণতার কাজ হতো। তবে সত্যি যে, অনিশ্চয়তার ব্যাপারটাই ওদের অমন অস্থির করে তুলেছে, সে কারণেই ওদের এমন আচরণ।

‘সামসা সাহেব’, এবার প্রধান কেরানি খানিক উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হলোটা কী আপনার? আপনি নিজেকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখেছেন, কোনো জবাবের বেলায় শুধু হা-না বলে যাচ্ছেন, আপনার বাবা-মাকে রেখেছেন এক অহেতুক মহা দুশ্চিন্তার মধ্যে, আর তা ছাড়া– কথা প্রসঙ্গে বলতেই হচ্ছে –পরিষ্কার দৌরাত্ম দেখিয়ে নিজের অফিসের প্রতি দায়িত্বে অবহেলা করে যাচ্ছেন। আমি এখানে আপনার বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে, আপনার নিয়োগকর্তার পক্ষ থেকে বলছি, আপনাকে সত্যিই মিনতি জানাচ্ছি, আমাকে এক্ষুনি এর একটা পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিন। আমি অবাক, অবাক। আপনাকে আমি সব সময়ই একজন শান্ত আর যুক্তিপরায়ণ মানুষ বলে ভেবে এসেছি, আর আপনি কিনা হঠাৎ এসব অদ্ভুত বাতিক দেখানো শুরু করে দিলেন। অবশ্য, আপনার অফিসে না-আসার। একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা ইঙ্গিতে আজ সকালে আমাকে বড় বস্ বলেছেন– পাওনা টাকা আদায়ের যে কাজটা কিছুদিন হয় আপনাকে দেওয়া হয়েছে, ইঙ্গিতটা তা নিয়েই –কিন্তু আমি আমার কথার সম্মানের দোহাই পর্যন্ত পেড়ে ওনাকে বলেছি, এটা ঠিক না। তবে এখন আপনার এই অবিশ্বাস্য গোঁয়ার্তুমি নিজ চোখে দেখার পর সত্যি বলছি, আপনার কোনো রকম পক্ষ নেওয়ার ইচ্ছা আমার চলে গেছে। আর নিশ্চয়ই জানেন, অফিসে আপনার অবস্থা কোনোভাবেই সুরক্ষিত না। আমার আসলে ইচ্ছা ছিল এসব কথা আপনাকে গোপনে বলি, কিন্তু আপনি যে রকম অনর্থক আমাকে এখানে সময় নষ্ট করতে বাধ্য করছেন, তাই আমি এখন আর কোনো কারণই দেখছি না যে কেন আপনার নিরীহ বাবা-মাও এসব শুনবেন না। সুতরাং আমাকে বলতেই হচ্ছে –বেশ অনেক দিন ধরে আপনার কাজকর্ম পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে; মানছি যে ব্যবসা করার এটা কোনো দারুণ মৌসুম না। হ্যাঁ, এ কথা আমরা মানছি তবে কোনো ব্যবসার জন্যই এটা কোনো মৌসুমই না, তা তো আর হতে পারে না সামসা সাহেব, তা হতে দেওয়া যায় না।’

‘কিন্তু স্যার, খুব বিচলিত হয়ে আর উত্তেজনায় বাকি সবকিছু ভুলে গিয়ে বলে উঠল গ্রেগর, ‘আমি এক্ষুনি দরজা খুলে দিচ্ছি, এই এখনই। সামান্য একটু অসুস্থতা, সামান্য মাথা ঝিমঝিম, এ কারণেই আজ ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি। এখনো বিছানায় শোয়া। তবে ঠিক এখন আবার বেশ সুস্থ বোধ করছি। এই তো, এক্ষুনি উঠে পড়ছি। বিছানা ছেড়ে। আধা সেকেন্ড ধৈর্য ধরুন! না, যতটা ভেবেছিলাম ততটা সুস্থ না আমি। তবে সত্যি ঠিকঠাকই আছি। কেমন হঠাৎ করেই না এসব অসুখ মানুষকে ধরে বসে। এই তো গত রাতেও বেশ সুস্থ ছিলাম, আমার বাবা-মাকে আপনি জিগ্যেস করে দেখুন। তবে গত রাতে অসুখের আভাসও খানিকটা আঁচ করতে পেরেছিলাম বটে। নিশ্চয়ই কিছু আভাস আমার মধ্যে দেখা দিয়েছিল। হায় রে, খোদা জানে কেন যে আমি নিজে থেকে অফিসে খবর পাঠাইনি। মানুষ তো সব সময়ই ভাবে নিজে নিজে অসুখ থেকে সেরে ওঠার জন্য বাড়িতেই যে থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ওহ্ স্যার! আমার বাবা-মাকে রেহাই দিন! যেসব অভিযোগ আপনি এখন করলেন, সব সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন; এর আগে এসব নিয়ে আমাকে কেউ কোনো দিন একটা কথাও বলেনি। মনে হচ্ছে, আপনি এখনো আমার শেষের পাঠানো অর্ডারগুলো দেখেননি। যাক, আটটার ট্রেন ধরে কাজে যাচ্ছি আমি; এই অল্প ক’ঘণ্টার বিশ্রামে বরং খানিক উপকারই হলো। আপনাকে স্যার আর আটকে রাখতে চাচ্ছি না; অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে নিজে নিজেই পৌঁছে যাচ্ছি অফিসে, দয়া করে বসকে গিয়ে বলবেন সে-কথাটা আর ওনাকে আমার সালাম জানাবেন!’

গ্রেগর যখন বোকার মতো ঝটপট এসব কথা বলে যাচ্ছে– কী বলছে সে ব্যাপারে নিজেরই কোনো চেতন নেই– তখন বেশ সহজেই আলমারিটার কাছে পৌঁছে গেল সে, খুব সম্ভব বিছানায় শুয়ে এরই মধ্যে যে-অভ্যাসটা রপ্ত করেছে সে জন্যই কাজটা সহজ হলো এত, আর এখন সে চেষ্টা করছে আলমারির গায়ে শরীরটা খাড়া করে তুলতে। মনেপ্রাণেই সে দরজাটা খুলতে চাইছে, মনেপ্রাণেই চাইছে বের হতে আর প্রধান কেরানির সঙ্গে কথা বলতে; অন্যেরা –যারা তার জন্য একান্ত অপেক্ষায় –তাকে দেখে কী বলবে তা জানার জন্য উৎসুক সে। যদি তারা আতঙ্কিত হয়, তাহলে তো আর গ্রেগরের কোনো দায়িত্ব থাকে না, তখন সে বিশ্রাম নিতে পারে শান্তিতে । কিন্তু যদি তারা সবকিছু শান্তভাবে মেনে নেয়, তখন তারও তো আর উত্তেজিত হওয়ার কোনো কারণ থাকবে না, আর তখন সবকিছু একটু জলদি সারলে সত্যিই সে আটটার মধ্যে স্টেশনে পৌঁছাতে পারবে। শুরুর দিকটায় মসৃণ আলমারির গা বেয়ে বারকয়েক পিছলে পড়ল সে, কিন্তু শেষমেশ শরীর উপর দিকে একটা চূড়ান্ত ধাক্কা দিয়ে খাড়া হলো; এখন আর শরীরের নিচের দিকের ব্যথাতে তার কোনো মনোযোগ নেই, যদিও ব্যথা বেশ তীব্রই। এবার সে শরীরটা ফেলল কাছেই দাঁড়ানো এক চেয়ারের পেছনটায়, তার ছোট পাগুলো আঁকড়ে ধরল এর কিনার। সেই সঙ্গে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণও এল তার, চুপ করে থাকল সে; প্রধান কেরানি এবার কী বলেন এখন তা ভালোমতো শোনা যাবে।

‘আপনারা কি ওর একটা কথাও বুঝতে পারলেন?’ প্রধান কেরানি জিগ্যেস করছেন তার বাবা-মাকে, সে আমাদের বোকা বানানোর চেষ্টা করছে না তো? ওহ্ খোদা, কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে উঠল তার মা, মনে হচ্ছে খুবই অসুস্থ ও, আর আমরা কি ওকে এখানে বসে জ্বালাচ্ছি। গ্রেটি! গ্রেটি!’ তিনি ডাকতে লাগলেন। মা? অন্য পাশ থেকে জবাব দিল তার বোন। গ্রেগরের কামরার দুই পাশ থেকে কথা বলছে দুজনে। ‘এক্ষুনি ডাক্তার ডেকে আন। গ্রেগর অসুস্থ। ডাক্তারের কাছে দৌড়া, জলদি। গ্রেগর কীভাবে কথা বলছিল শুনেছিস?’ ‘পশুর গলার মতো শুনাচ্ছিল,’ বললেন প্রধান কেরানি, তার মায়ের তীক্ষ্ণ চিৎকারের তুলনায় ওনার স্বর লক্ষণীয় রকমের নিচু। আন্না! আন্না! হলঘরটার মধ্য দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন তার বাবা, হাততালি দিচ্ছেন তিনি, এক্ষুনি একটা তালাওয়ালা ডেকে আনো!’ এরই মধ্যে এই দুই মেয়ে। স্কার্টের শোঁ-শোঁ শব্দ তুলে হলঘর দিয়ে দৌড়ে যেতে লেগেছে –তার বোন এত তাড়াতাড়ি কাপড় পরতে পারল কী করে? –আর ধড়াম করে সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল তারা। দরজা বন্ধ করার কোনো শব্দ হলো না; অনুমান করা যায়, ওরা দরজা খুলেই রেখে গেছে, ঠিক যেমনটা ঘটে কোনো বাড়িতে বিরাট কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে।

তবে গ্রেগর অনেকখানি শান্ত হয়ে এসেছে। সত্য যে, তার কথাগুলো আসলেই আর বোধগম্য হওয়ার মতো নেই, যদিও তার কাছে যথেষ্ট স্পষ্ট বলেই মনে হয়েছে, আগের চেয়ে স্পষ্ট তো বটেই, মনে হয় তার কান ঐ ধ্বনির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যা হোক, এতক্ষণে অন্য সবাইকে অন্তত এটুকু তো বোঝানো গেল যে তার কিছু একটা সমস্যা সত্যিই হয়েছে, আর সে কারণেই তারা এখন তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। যে রকম সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে প্রথম নির্দেশগুলো দেওয়া হলো, তাতে স্বস্তি পেল গ্রেগর। তার মনে হতে লাগল, আবার সে ফিরে এসেছে মনুষ্য-সঙ্গে আর সে আশা করতে লাগল, ডাক্তার ও তালাওয়ালা– এদের মধ্যে যথার্থ কোনো পার্থক্য না টেনেই –দুজনের কাছ থেকেই চমৎকার ও বিস্ময়কর কোনো সফলতার। আসন্ন চূড়ান্ত আলাপটার কথা ভেবে গলা যদুর সম্ভব সাফ করে নিতে একটু কাশল সে, যদিও সাবধান থাকল খুব নিঃশব্দে ওটা করার ব্যাপারে, কারণ তার কাশিও তো পুরোপুরি মানুষের মতো শোনাতে না পারে, আর এ ব্যাপারে নিজের বিচারবুদ্ধির ওপরেই তার আর ভরসা নেই। এরই মধ্যে পাশের ঘরে। নেমে এসেছে একদম নীরবতা। হতে পারে, প্রধান কেরানির সঙ্গে তার বাবা-মা বসে। আছেন টেবিলে, ফিসফিস করছেন; হতে পারে, তারা সবাই ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার উপর আর কান পেতে শুনছেন।

নিজেকে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিয়ে দরজার কাছে নিয়ে যেতে লাগল গ্রেগর, চেয়ারটা আঁকড়ে ধরে থেকে; তারপর ওটা ছেড়ে দিয়ে শরীর ছুঁড়ে দিল দরজার গায়ে, ওখানে ঠেস দিয়ে খাড়া হলো এবার –তার পাগুলোর তলার দিকটা খানিক আঠালো মতো –এই খাটুনির ফলে এখন জিরিয়ে নিতে হচ্ছে খানিকক্ষণ। এরপর মুখ দিয়ে তালায় চাবি ঘুরানোর কাজে এগিয়ে গেল সে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা গেল, তার ঠিক দাঁত বলতে কিছু নেই– তাহলে চাবিটা সে শক্ত করে ধরবে কী দিয়ে? –তবে অন্যদিকে, দাঁতের বদলে, নিশ্চিত খুবই শক্তিশালী এক চোয়াল পেয়েছে সে; চোয়াল দিয়ে চাবিটা সে এমনকি ঘুরাতে সফলও হলো, কিন্তু নিঃসন্দেহে এতে যে তার বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে সে ব্যাপারে কোনো হুঁশই ছিল না –তার মুখ থেকে বের হতে লাগল বাদামি একটা রস, চাবির গা বেয়ে তা ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে মেঝের উপর। ঐ শুনুন, পাশের ঘরে বলে উঠলেন প্রধান কেরানি, উনি চাবি ঘুরাচ্ছেন। সন্দেহ নেই, এই কথাটা গ্রেগরের জন্য বিরাট উৎসাহের; কিন্তু তাদের সবারই উচিত তাকে সরবে উৎসাহিত করে যাওয়া, উচিত তার বাবা-মায়েরওঃ ‘চালাও গ্রেগর, চালিয়ে যাও, তাদের সবারই উচিত চিৎকার করে বলতে থাকা, ধরে থাকো, চাবি ঘুরাতে থাকো। সবাই তার এই চেষ্টাটা তীব্র উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ করছে, এমনটা কল্পনা করে সে মরিয়া হয়ে চোয়াল দিয়ে সেই মুহূর্তের সবটুকু শক্তিতে চেপে ধরে থাকল চাবি। যেই না ওটা ঘুরতে শুরু করল, সেও অমনি গোল হয়ে ঘুরতে লাগল তালার চারদিকে; এখন শুধু মুখ দিয়ে ধরেই সে শরীর ঝুলিয়ে রেখেছে শূন্যে, আর হয় চাবি ধরে ঝুলে থাকছে নয়তো শরীরের সব শক্তি দিয়ে আবার চাবি দরকারমতো ঠেসে ধরছে নিচের দিকে। শেষমেশ তালাটার খট করে খুলে যাওয়ার পরিষ্কার আওয়াজ আক্ষরিক অর্থেই গ্রেগরকে জাগিয়ে তুলল। স্বস্তির এক গভীর শ্বাস ফেলে সে নিজেকে বলল: “তাহলে তালাওয়ালার আর দরকার পড়ল না আমার, আর সেই সঙ্গে দরজা টেনে খোলার জন্য মাথাটা রাখল হাতলের গায়।

যেহেতু এই কায়দায় দরজা খুলতে হলো তাকে, তাই ওটা হাট হয়ে খুলে যাওয়ার পরে গ্রেগর কিন্তু রয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে। এখন প্রথম তাকে দরজার এই পাল্লাটা ঘিরে আস্তে আস্তে এগোতে হচ্ছে, খুব সতর্কতার সঙ্গে তাকে করতে হচ্ছে এই কাজ, কারণ ওই ঘরে ঢোকার সময় পিঠের উপর চিৎ হয়ে পড়ে যাওয়া চলবে না কোনোমতেই। এই কঠিন কাজে গ্রেগর যখন মগ্ন, অন্য কোনোদিকে মনোযোগ দেওয়ার কোনো ফুরসত নেই, তখন সে শুনল প্রধান কেরানি একটা সুউচ্চ ‘ওহ!’ শব্দ করলেন– দমকা বাতাসের মতো শোনাল তা –আর এখন সে ওনাকে দেখতেও পাচ্ছে– হাঁ করা মুখটায় হাত চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার খুব কাছেই, তারপর পেছাতে শুরু করেছেন ধীরে ধীরে, যেন-বা অদৃশ্য কোনো শক্তির অটল চাপে তাড়িত। তার মা– প্রধান কেরানির উপস্থিতি সত্ত্বেও এখনো রাতের চুল ঠিকঠাক না করে ও রকম এলোমেলো চুলেই দাঁড়িয়ে আছেন– শুরুতে নিজের দুই হাত এঁটে থেকে তাকালেন তার স্বামীর দিকে, তারপর গ্রেগরের দিকে দুই পা

এগিয়ে এসেই ঢলে পড়লেন মেঝেয়; স্কার্টটা গোল হয়ে ঢেউ খেলে থাকল মহিলার চারপাশে আর তার মুখ ডুবে গেল বুকের আড়ালে, দেখা যাচ্ছে না মুখটা। গ্রেগরের বাবা একটা ভীতি-জাগানো ভঙ্গি করে নিজের মুঠো পাকালেন, যেন তিনি পিটিয়ে গ্রেগরকে তার ঘরে ফেরত পাঠাতে চাচ্ছেন, তারপর এক অনিশ্চিত দৃষ্টি নিয়ে দেখতে লাগলেন বৈঠকখানার চারপাশটা, হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন, কান্নায় ফুলে উঠতে লাগল তার চওড়া বুক।

এরপর গ্রেগর আর ঢুকল না ওই ঘরে, দরজার অন্য পাল্লার হুড়কার গায়ে হেলান দিয়ে থাকল সে, এ কারণে তার শরীরের শুধু অর্ধেকটাই দেখা যেতে লাগল, ধড়ের উপরে মাথাটা একদিকে কাৎ করা, অন্য সবাইকে দেখছে পিটপিটিয়ে। এরই মধ্যে বাইরে অনেক বেশি ফরসা হয়ে উঠেছে; রাস্তার ওপারে উল্টোদিকে অফুরন্ত লম্বা, কালো-ধূসর দালানটার একাংশ এখন দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার –ওটা একটা হাসপাতাল –ওটার সামনের অংশে শক্ত খোপ খোপ সারি করে জানালাগুলো বসানো; বৃষ্টি পড়ছে এখনো; বড় ফোঁটাগুলো দেখা যাচ্ছে আলাদা আলাদা করে, আর মনে হচ্ছে একটা একটা করেই যেন মাটির দিকে নেমে আসছে ফোঁটাগুলো। টেবিলের উপর সাজানো রয়েছে অনেক পদের নাশতা, কারণ গ্রেগরের বাবার কাছে সকালের নাশতাটাই সারা দিনের প্রধান খাবার, ওগুলো খেতে খেতে তিনি কত রকমের যে খবরের কাগজ পড়বেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঠিক উল্টোদিকের দেয়ালে ঝুলে আছে গ্রেগরের সেনাবাহিনীর দিনগুলোর একটা ছবি, এতে দেখা যাচ্ছে সে একজন লেফটেন্যান্ট, তরবারির উপর রাখা এক হাত, আর মুখে এক ভাবনাহীন হাসি, তার ভাবসাব আর গায়ের উর্দির কারণে দেখতে শ্রদ্ধাই জাগছে। হলঘরের দিকে যাওয়ার দরজাটা খোলা আর যেহেতু ফ্ল্যাটের সদর দরজাও খোলা, তাই সিঁড়ির ল্যান্ডিং আর সিঁড়িঘরের ওপরের দিকটাও দেখা যাচ্ছে এখান থেকে ।

‘আচ্ছা,’ বলল গ্রেগর –শুধু তারই যে মানসিক সুস্থিতি অক্ষুণ্ণ আছে, এ বিষয়ে সে পুরোপুরি সচেতন– ‘এক্ষুনি ঝটপট জামাকাপড় পরে, কাপড়ের নমুনাগুলো বেঁধে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি আমি। আমাকে যেতে দেবেন তো, নাকি? দেখতেই তো পারছেন স্যার, আমি গোঁয়ার লোক না, আমার কাজ আমার অনেক পছন্দের; ঘুরে বেড়ানোর এই চাকরিতে ক্লান্তি অনেক, কিন্তু এটা ছাড়া বাঁচব না আমি। স্যার, আপনি যাচ্ছেন কোথায়? অফিসে চললেন? সত্যিই এই ঘটনার একটা সাচ্চা রিপোর্ট জমা দেবেন তো? যে-কেউই কাজ করতে সাময়িক অক্ষম হয়ে যেতে পারে, কিন্তু তখনই তো তার অতীতের সেরা কাজগুলো মনে করার সঠিক সময় আর সেই সঙ্গে এমনটা ভাবারও যে, পরে যখন তার সমস্যা আর থাকবে না, তখন কোনো সন্দেহ নেই আরো বেশি শক্তি আর মনোযোগ নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে কাজে। বসের প্রতি আমার নৈতিক বাধ্যবাধকতা খুবই বিরাট, তা আপনি ভালোমতোই জানেন। অন্যদিকে বাবা-মা আর বোনটার ওপরও আমার। দায়িত্ব কম না। কঠিন অবস্থার মধ্যে আছি আমি, তবে এ থেকে বেরোনোর পথ ঠিকই করে নেব। আপনি শুধু আমার কঠিন অবস্থাকে দয়া করে আরো কঠিন করে তুলবেন না। অফিসে আমার পক্ষ নিয়ে দাঁড়ান! আমি জানি, ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যানদের সবাই পছন্দ করে না। লোকের ধারণা ওরা বাক্স বাক্স টাকা কামায় আর বিলাসের জীবন কাটায়। এ রকমই সবাই ভাবে, আর ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখারও কারো কোনো গা নেই। কিন্তু আপনার তো স্যার অফিসের অন্য কারো চাইতে সবকিছু নিয়ে বেশি দখল আছে, সত্যি বলতে কি– খুব গোপনেই বলছি– বসের চেয়েও বেশি দখল রাখেন আপনি; বস্ মালিক বলে সহজেই তার বিচার-বিবেচনা যেকোনো কর্মচারীর প্রতি অবিচার ঘটিয়ে বসতে পারে। এটাও তো আপনি ভালোমতোই বোঝেন, কত সহজেই একজন ভ্রাম্যমাণ সেলস্ম্যান, যে কিনা প্রায় সারাটা বছরই কাটায় অফিসের বাইরে বাইরে, কত সহজেই সে নানা গুজব, দুর্ভাগ্য আর ভিত্তিহীন অভিযোগের শিকার হতে পারে– যেসবের হাত থেকে রক্ষা পেতে তার কিছুই করার থাকে না, কারণ সাধারণত এর কিছুই তার কানে পৌঁছায় না, শুধু যখন সে ঐসব লম্বা ঘোরাঘুরি শেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ফেরে, তখনই তাকে হঠাৎ এসবের পরিণতির মুখে পড়তে হয়– তদ্দিনে মূল কারণগুলোর কোনো হদিস বের করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না। কিন্তু স্যার, আপনি যাবেন না। আমার কথাগুলোর অন্তত কিছুটা হলেও যে ঠিক বলে আপনি মনে করছেন, সে রকম কিছু না বলে আপনি চলে যাবেন না!

তবে গ্রেগরের প্রথম কথাগুলো শুনেই প্রধান কেরানি এরই মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, শুধু পেছন ফিরে তার কাঁপতে থাকা কাঁধের উপর দিয়ে মুখটা হাঁ করে, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। আর গ্রেগর যখন কথা বলছিল, তখন এক মুহূর্তের জন্যও স্থির দাঁড়াননি তিনি, তার ওপর থেকে চোখ না-সরিয়েই দরজার দিকে পিছু হটছিলেন, হয়েন কোনো গোপন আদেশ তাকে নিষেধ করছিল এই ঘর ছেড়ে যেতে। তবে এরই মধ্যে তিনি দরজা আর হলঘরের সংযোগের জায়গায় পৌঁছে গেছেন, তবে যে রকম হঠাৎ তাড়ার সঙ্গে তিনি বৈঠকখানা থেকে তার শেষ পা’টা ফেললেন, তাতে মনে হবে– এই এক্ষুনি যেন তিনি পুড়ে ফেলেছেন তার পায়ের তলা। হলঘরে পৌঁছে তিনি নিজের সামনের দিকে সিঁড়ির উদ্দেশে বাড়িয়ে দিলেন তার ডান হাত, মনে হচ্ছে যেন এখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে কোনো অলৌকিক মুক্তি।

গ্রেগর বুঝতে পারল, যদি অফিসে নিজের অবস্থানটা মারাত্মক কোনো বিপদের আশঙ্কা থেকে বাঁচাতে হয়, তাহলে কোনোমতেই প্রধান কেরানিকে এ রকম মানসিক অবস্থা নিয়ে এখান থেকে যেতে দেওয়া যাবে না। তার বাবা-মা অবস্থাটা ভালোভাবে বুঝতে পারছেন না; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মে গেছে যে, এ অফিসে গ্রেগরের চাকরি আজীবনের জন্য সুরক্ষিত আর তা ছাড়া তাদের এ মুহূর্তের দুশ্চিন্তাগুলো নিয়েই তারা এত মগ্ন যে সামনের দিকে দেখার সব শক্তি তাদের লোপ পেয়েছে। কিন্তু এ শক্তি গ্রেগর হারায়নি। প্রধান কেরানিকে থামাতেই হবে, শান্ত করতে হবে, বোঝাতে হবে আর সবশেষে তার মনটা জয় করতে হবে; গ্রেগর ও তার পরিবারের পুরো ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এর ওপর! আহ, শুধু যদি তার বোনটা থাকত এখন! যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে সে, গ্রেগর যখন চুপচাপ বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল, এমনকি তখনই সে কাঁদছিল। প্রধান কেরানির মতো একজন মেয়েপাগল মানুষ যে ওর মাধ্যমে গলে যেতেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই; বোনটা ঠিকই সদর দরজা বন্ধ করে দিয়ে ওনার সঙ্গে হলঘরে কথা বলে ওনার আতঙ্ক কাটিয়ে দিত। কিন্তু বলে কী লাভ, বোনটা তো এখানে নেই; তাই গ্রেগরের নিজেকেই সবকিছু করতে হচ্ছে। চলার ক্ষমতা তার কতখানি আছে, সে সম্বন্ধে তার কোনো ধারণা নেই আর তা নিয়ে চিন্তা করার জন্য না থেমে, এমনকি তার কথাগুলো যে এবারও কেউ বুঝতে পারেনি সে সম্ভাবনার কথা –সম্ভাবনা কেন? নিশ্চিতই পারেনি– বিবেচনা না করেই গ্রেগর ছেড়ে দিল দরজাটা; ফাঁকের মধ্য দিয়ে সজোরে ঠেলা দিল শরীর; আর আগানোর চেষ্টা করল প্রধান কেরানির দিকে, যিনি এরই মধ্যে খুবই এক হাস্যকর কায়দায় দুই হাতে আঁকড়ে ধরে আছেন সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের হাতল; ঠিক তক্ষুনি ভর দেওয়ার জন্য একটা কিছু হাতড়াতে হাতড়াতে ছোট্ট এক চিৎকার দিয়ে গ্রেগর পড়ে গেল তার অগুনতি পায়ের উপর। পড়া মাত্রই পুরো সকালে এই প্রথমবারের মতো সে বোধ করল শারীরিক সুস্থতার একটা অনুভূতি; তার পাগুলো শক্ত করে বসা মেঝের উপর; আনন্দের সঙ্গে সে খেয়াল করল, ওগুলো পুরোপুরি মানছে তার কথা; এমনকি যেদিকে তার পছন্দ সে দিকেই তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে ওরা; এতক্ষণে গ্রেগর নিশ্চিত হলো, সমস্ত ভোগান্তি থেকে তার চূড়ান্ত মুক্তি একবারে হাতের নাগালের মধ্যে এসে গেছে। কিন্তু ঠিক তখনই –যখন সে তার মায়ের মোটামুটি কাছে আর ঠিক উল্টোদিকে মেঝের উপর দুলছে ধীর, চাপা তালে– তখনই তার মা। (ওনাকে মনে হচ্ছিল পুরোপুরি আত্মমগ্ন হয়ে হাঁটু গেড়ে আছেন) হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে আর আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন; চিৎকার করে। বললেন: ‘বাঁচাও, দোহাই খোদার, বাঁচাও!’; সামনের দিকে তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন। মাথা, যেন চাচ্ছেন আরেকটু ভালোভাবে গ্রেগরকে দেখতে, তার পরই পুরো বেমানান

এক ঢঙে গ্রেগরের কাছ থেকে তিনি পাগলের মতো পিছু হটতে লাগলেন; ভুলে গেলেন। যে নাশতার সাজানো টেবিলটা তার ঠিক পেছনেই; ওখানে পৌঁছেই ঝটপট গিয়ে বসলেন টেবিলের উপর, যেন মন্ত্রমুগ্ধ; আর ততক্ষণে বড় কফিপাত্রটা যে ঠিক তার পাশেই উল্টে গিয়ে এক বিরামহীন ধারায় নিজেকে খালি করতে লেগেছে কার্পেটের উপর, সে বিষয়ে মনে হলো ওনার কোনো হুঁশই নেই।

‘মা, মা, মৃদু গলায় বলল গ্রেগার আর উপরমুখো হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। এখন প্রধান কেরানির কথা তার মন থেকে পুরোপুরি মুছে গেছে; অন্যদিকে, কফি বয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখে চোয়ালগুলোর শূন্যে কয়েকবার কটুকটু করে ওঠা সে থামাতে পারল না কিছুতেই। তা দেখে তার মা আরেকটা তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে টেবিল ছেড়ে পালাতে লাগলেন, গিয়ে পড়লেন গ্রেগরের বাবার দুই বাহুর মধ্যে, যিনি স্ত্রীর দিকে এগিয়ে আসছিলেন তড়িঘড়ি করে। কিন্তু এখন ঠিক বাবা-মায়ের পেছনে নষ্ট করার মতো সময় গ্রেগরের হাতে নেই; প্রধান কেরানি এরই মধ্যে সিঁড়িতে পৌঁছে গেছেন; সিঁড়ির হাতলে থুতনি রেখে শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছেন পেছন দিকটা। তাকে ধরাটা যতখানি পারা যায় সুনিশ্চিত করতেই দৌড়ে গেল গ্রেগর; প্রধান কেরানি নিশ্চিত কিছু একটা আঁচ করতে পারলেন, কারণ তা দেখে তিনি সিঁড়ির বেশ কটা ধাপ একটা লাফ দিয়ে নেমে অদৃশ্য হয়ে। গেলেন, তখনো তিনি চেঁচিয়ে যাচ্ছেন ‘উউহ!’ আর পুরো সিঁড়ি জুড়ে প্রতিধ্বনি হচ্ছে। সেটার। দুর্ভাগ্যক্রমে এ সময় গ্রেগরের বাবা, এতক্ষণ যিনি ছিলেন তুলনামূলক শান্ত, প্রধান কেরানির এই পালানো দেখে যেন পুরো তালগোল পাকিয়ে ফেললেন সবকিছু, কারণ ঐ লোকের পেছনে দৌড়ানোর বদলে কিংবা অন্তত গ্রেগরকে ছুটে যাওয়ায় বাধা দেওয়ার বদলে তিনি ডান হাতে তুলে নিলেন প্রধান কেরানির হাঁটার ছড়িটা– কেরানি এটা একটা চেয়ারের উপর ফেলে রেখে গেছেন তার হ্যাট ও ওভারকোটের সঙ্গে– আর বাঁ হাতে টেবিলের উপর থেকে টেনে নিলেন বিরাট এক খবরের কাগজ; এবার তিনি মেঝেতে জোরে পা ঠুকতে ঠুকতে ছড়ি আর খবরের কাগজটা নেড়ে গ্রেগরকে তাড়িয়ে ফেরত পাঠাতে লাগলেন তার কামরায়। গ্রেগরের ওজর-আপত্তিতে কোনো কাজ হলো না, আসলে সেগুলো বোধগম্যই হলো না ওনার; যতই দ্রভাবে গ্রেগর তার মাথা নাড়ায়, ততই জোরের সঙ্গে তিনি পা ঠোকেন মেঝেয়। ঘরের অন্যদিকে তার মা বাইরের ঠান্ডা সত্ত্বেও একটা জানালা খুলে দিলেন, হাতের মধ্যে মুখ ঢেকে তিনি ঝুঁকে আছেন জানালার বাইরে। রাস্তা থেকে সিঁড়িঘর বেয়ে ধেয়ে এল একটা প্রচণ্ড দমকা হাওয়া, পর্দাগুলো উঠে গেল উঁচুতে, টেবিলের উপর খবরের কাগজগুলো ফফ শব্দ করতে লাগল, আর আলগা পাতাগুলো মেঝেজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল এদিক-ওদিক। নির্মমভাবে তার বাবা তাকে খেদিয়ে যাচ্ছেন পেছনের দিকে, জংলির মতো হিসৃহিস্ আওয়াজ করছেন তিনি। পেছনদিকে হাঁটার অভ্যাসটা এখনো গ্রেগরের হয়ে ওঠেনি, তাই সে পেছাচ্ছে আসলেই খুব ধীরে। শুধু যদি তাকে একটু উল্টো ঘোরার সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে মুহূর্তের মধ্যে নিজের কামরায় চলে যেতে পারত সে; এখন এই এত সময় নিয়ে চক্রাকারে ঘোরাটা তার বাবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে পারে এই ভয়ে সে ভীত, কারণ তার মনে হচ্ছে ওনার হাতের ঐ ছড়ি যেকোনো সময় তার পিঠে কিংবা মাথায় মারাত্মক আঘাত হেনে বসতে পারে। শেষমেশ গ্রেগরের অবশ্য আর কোনো বিকল্প রইল না, কারণ সে আতঙ্কের সঙ্গে দেখল পেছনে চলতে গিয়ে সে এমনকি নিজের গতিপথ ঠিক রাখতে পারছে না; তাই সে শুরু করল, বারবার বাবার দিকে ভয়ার্ত টেরা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে, যত দ্রুত পারা যায় –আসলে হচ্ছে খুবই ধীরে –শরীরটা উল্টো ঘোরানোর। মনে হয় তার বাবা তার এই সদিচ্ছা বুঝতে পারলেন, তিনি তার এ কাজে কোনো রকম বাধা দিলেন না, বরং একটু পর পরই দূর থেকে ছড়ির মাথা দিয়ে কাজটা পরিচালনা করতে লাগলেন যেন। শুধু যদি তার বাবার মুখ থেকে বেরোনো ঐ অসহ্য হিসৃহিস্ আওয়াজটা না থাকত! গ্রেগরকে পুরো দিশেহারা করে দিচ্ছে ওটা। তার ঘোরা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন ঐ হিসৃহিস্ শব্দে পুরো মগ্ন থাকার কারণেই সে একটা ভুলও করে বসল– বাবার দিকেই বরং ঘুরে গেল খানিকটা। তবে শেষমেশ যখন সে তার মাথা দরজাপথের ঠিক সামনে নিয়ে এসেছে, দেখা গেল ঐ ফাঁকের মধ্য দিয়ে তার অতিরিক্ত রকমের চওড়া এই শরীরটা ঢুকবে না। তার বাবাও, নিজের এখনকার মানসিক অবস্থার কারণেই, গ্রেগরকে দরকারি জায়গাটুকু করে দিতে একটু ভাবলেনও না যে দরজার অন্য পাল্লাটা খুলে দেওয়া উচিত। তার স্রেফ একটাই চিন্তা– যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্রেগরকে নিজের ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া। অন্যদিকে গ্রেগর যে শরীরটা খাড়া করে উপরে তুলে ওভাবেই দরজার ভেতর দিয়ে ঢুকে যাবে– সেটুকু করতে যে পরিমাণ বিশদ প্রস্তুতির দরকার, তিনি তা গ্রেগরকে দেবেন না কোনোমতেই। এর বদলে তিনি এখন গ্রেগরকে এমনভাবে তাড়াতে লাগলেন যেন দরজাটা গ্রেগরের জন্য কোনো বাধাই না, আর সেই সঙ্গে অসম্ভব বেশিরকম আওয়াজ করতে লাগলেন মুখ দিয়ে; গ্রেগরের আর মনে হচ্ছে না যে তার পেছনে এটা স্রেফ মাত্র একজন বাবার আওয়াজ; এখন আর কোনোকিছু নিশ্চিতই ঠাট্টা-তামাশার পর্যায়ে নেই, তাই যা হওয়ার হোক এই ভেবে গ্রেগর তার শরীর ছুঁড়ে মারল দরজাপথের ভেতর দিয়ে। উঁচু হয়ে থাকল তার শরীরের একটা পাশ, দরজাপথে কাৎ হয়ে পড়ে রইল সে, শরীরের পাশগুলো ঘষা খেয়ে রীতিমতো ছাল-চামড়া উঠে গেল, সাদা দরজা ভরে গেল কুৎসিত সব দাগে, পরক্ষণেই সে আটকে গেল পুরোপুরি, নিজে নিজে নড়ার কোনো ক্ষমতাই আর তার নেই, এক পাশে ছোট ছোট পাগুলো শূন্যে কাঁপছে থিরথিরিয়ে আর অন্য পাশেরগুলো খুব ব্যথা নিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে পড়েছে মেঝের উপর –ঠিক এ সময়ে তার বাবা পেছন থেকে তাকে প্রচণ্ড একটা গুঁতো দিলেন, যথার্থই সেটা মুক্তি দিল তাকে, সে ছিটকে পড়ল ঘরের একেবারে ভেতরের দিকে, প্রচুর রক্ত ঝরছে তখন। ছড়িটা দিয়ে সশব্দে বন্ধ করা হলো দরজা, আর তারপর অবশেষে সবকিছু নীরব-নিথর।

২.

গভীর এক ঘুম থেকে যখন গ্রেগর জাগল, ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে, ঘুম নয়, মূৰ্ছা বলাই ঠিক। কোনো সন্দেহ নেই কিছুক্ষণ পরে এমনিতে নিজেই জেগে উঠত সে, অন্য কেউ তার ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটালেও, কারণ যথেষ্টই ভালো ঘুম আর বিশ্রাম হয়েছে বলে মনে হচ্ছে তার; তবে তার অনুমান, হন্তদন্ত একটা পায়ের আওয়াজ আর হলঘরে যাওয়ার দরজা চুপিসারে বন্ধ করার শব্দই জাগিয়ে তুলেছে তাকে। ঘরের সিলিঙে এখানে-ওখানে আর আসবাবের উপরের দিকটায় রাস্তার বৈদ্যুতিক বাতির আলো কেমন বিষণ্ণ রশ্মি ফেলেছে, কিন্তু নিচে যেখানে গ্রেগর শুয়ে আছে সে জায়গাটা অন্ধকার। ধীরে ধীরে –তখনো সে জবুথবু হাতড়ে বেড়াচ্ছে তার শুঙগুলো দিয়ে, ওগুলোর উপকারিতা প্রথমবারের মতো সে বুঝতে শুরু করেছে– সে শরীরটা ঠেলে নিল দরজার দিকে, ওদিকে কী হচ্ছে তা দেখতে চায়। শরীরের পুরো বাঁ পাশ তার এক লম্বা, অসহনীয় টনটনে ঘা বলে মনে হচ্ছে, আর তাকে চলতে হচ্ছে দুই সারি পায়ের উপর নিয়মিত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তার ওপর সকালের ঐ ঘটনায় তার একটা পা জখম হয়েছে মারাত্মক –প্রায় অলৌকিক ব্যাপার যে শুধু একটা পা-ই জখম হলো আর সেটা অকেজো অবস্থায় হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে আসছে তার পেছনে।

দরজার কাছে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত সে বুঝতে পারেনি আসলে কোন জিনিসটা তাকে এদিকে প্রলুব্ধ করে নিয়ে এল: খাবারের গন্ধ। মেঝেতে পড়ে আছে এক পাত্র সর ওঠা দুধ, তাতে ভাসছে সাদা পাউরুটির ছোট ছোট টুকরো। খুশির চোটে গ্রেগর প্রায় হেসেই ফেলছিল, কারণ সকালের চেয়েও এখন সে অনেক বেশি ক্ষুধার্ত; একটুও দেরি

করে দুধের মধ্যে সে চুবিয়ে দিল তার মাথা, প্রায় একেবারে চোখ অবধি। কিন্তু একটু পরেই মাথা তুলে আনল হতাশ হয়ে; শুধু এ না যে শরীরের বাঁ পাশের কাঁচা অবস্থার কারণে খেতে কষ্ট হচ্ছে তার –আর তার মুমূর্ষ গোটা শরীরটা একসঙ্গে নড়লেই কেবল খেতে পারছিল সে–, সেই সঙ্গে দুধটা খেতেও বিস্বাদ লাগছে, যদিও দুধ তার সব সময়ই প্রিয় আর তার বোন যে সে কথা ভেবেই দুধ রেখে গেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই; আসলেই, প্রায় এক গা-ঘিনঘিন ভাব নিয়ে সে সরে গেল পাত্রটা থেকে আর হামা দিয়ে দিয়ে গেল ঘরের মাঝখানে।

এর মধ্যে বসার ঘরে জ্বলে উঠেছে গ্যাসবাতি, দরজার ফাটলের মধ্য দিয়ে তা দেখতে পাচ্ছে গ্রেগর; কিন্তু এ সময়ে তার বাবার যেখানে অভ্যাস সন্ধ্যার খবরের কাগজের বাছাই অংশগুলো জোরে তার মা আর মাঝেসাঝে বোনকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়া, সেখানে এখন বিরাজ করছে এক পিনপতন নীরবতা। তার মানে, ওনার জোরে জোরে পড়ার এই অভ্যাসটা –যা নিয়ে বোনটা সব সময়ই তাকে বলত কিংবা চিঠিতে লিখে জানাত– ইদানীং যেভাবেই হোক তিনি ছেড়েছেন। কিন্তু সব দিকেই যে একই রকম নীরবতা, যদিও নিশ্চিত বাসাটায় লোকজন অবশ্যই আছে। কী শান্তির এক জীবনই না কাটাচ্ছে। এই পরিবারটা,’ আপন মনে বলল গ্রেগর, আর ওখানে বসে যখন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে, তখন তার গর্ব হলো এ রকম সুন্দর একটা বাসায় নিজের বাবা-মা ও বোনকে এমন একটা জীবনের ব্যবস্থা করে দিতে পারার কারণে। কিন্তু এখন যদি এই যাবতীয় শান্তি, যাবতীয় আরাম-আয়েশ আর তৃপ্তির কোনো ভয়ংকর সমাপ্তি ঘটে? এসব চিন্তার মধ্যে নিজেকে না ডুবিয়ে গ্রেগর বরং হাঁটা শুরু করল আর হামা দিয়ে ঘুরতে লাগল তার ঘরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা।

দীর্ঘ সন্ধ্যায় একবার এদিকের, আরেকবার ওদিকের দরজা সামান্য ফাঁক করে খোলা হলো, ফের বন্ধ করে দেওয়া হলো জলদি মনে হয় কেউ প্রথমে ভেতরে আসার তাড়া বোধ করেছিল, কিন্তু পরে অস্বস্তি বোধ করে বসে। গ্রেগর এবার সোজা বৈঠকখানার দরজার কাছে গিয়ে বসে থাকল, ঐ দ্বিধান্বিত দর্শনার্থীকে যে করেই হোক ভেতরে আনার ব্যাপারে সে বদ্ধপরিকর, অন্তত মানুষটা কে তা সে দেখতে চায়; কিন্তু দরজা এর পরে আর খোলা হলো না একবারও, আর বৃথাই অপেক্ষা করতে লাগল সে। সকালে দরজাগুলো যখন তালা দেওয়া ছিল, তখন তো সবাই তাকে দেখতে ভেতরে ঢুকতে চেয়েছে; আর এখন, নিজে সে একটা দরজার তালা খোলার পরও, সেই সঙ্গে অন্যসব দরজা পরিষ্কার সারা দিন তালা খোলা অবস্থায় পড়ে থাকা সত্ত্বেও, কেউই আর আসছে না; এমনকি চাবিগুলো নিয়ে যাওয়া হয়েছে, বাইরের দিকে তালায় লাগিয়ে রাখা হয়েছে ওগুলো।

বৈঠকখানার বাতি নিভিয়ে দিতে দিতে অনেক রাত নেমে এল, গ্রেগর খুব সহজেই বলতে পারে তার বাবা-মা আর তার বোনটাও এত রাত পর্যন্ত জেগেই আছে, কারণ তাদের তিনজনেরই পা টিপে টিপে চলার শব্দ শোনা যাচ্ছে পরিষ্কার। এটা এখন নিশ্চিত, সকালের আগে কেউই আর গ্রেগরের কাছে আসছে না; সুতরাং জীবনটা কী করে সবচেয়ে ভালোভাবে ঢেলে সাজানো যায়, তা নিয়ে চুপচাপ শান্তিতে ভাবার তার হাতে এখন প্রচুর সময়। কিন্তু এই উঁচু, বিশাল ঘরটা– যার মধ্যে কিনা মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে হচ্ছে তাকে –এমন এক উদ্বেগের মধ্যে তাকে ফেলে দিল যার কোনো ব্যাখ্যা সে খুঁজে পাচ্ছে না– যেহেতু আর যা-ই হোক, এ তার নিজেই ঘর, গত পাঁচ বছর ধরে সে বাস করে আসছে এখানে–, এবং প্রায় নিজের অজ্ঞাতসারে নড়ে উঠে, কিছুটা লজ্জার অনুভূতি নিয়েই, সে তড়িঘড়ি প্রায় পালিয়ে ঢুকল সোফার নিচে। ওখানে তার পিঠটা যদিও খানিক চাপাচাপির মধ্যে থাকল আর মাথা তোলা হয়ে দাঁড়াল অসম্ভব, তবু সঙ্গে সঙ্গেই বেশ আরাম বোধ করল সে, শুধু একটাই আক্ষেপ– শরীরটা এতই চওড়া যে পুরোটা সোফার নিচে ঢোকানো যাচ্ছে না।

ওখানেই সে থাকল সারা রাত, কখনো তন্দ্রায় –যা থেকে ক্ষুধার জ্বালা তাকে জাগিয়ে তুলল বারবার, কখনো শঙ্কা আর অনিশ্চিত আশায় ডুবে । এর সবই একই উপসংহারে গিয়ে ঠেকল যে আপাতত তাকে শান্ত থাকতে হবে, আর ধৈর্য ও পরম বিবেচনার সঙ্গে তার পরিবারকে এই ঝামেলার ভার বহনে সাহায্যের চেষ্টা করতে হবে, তার এখনকার অবস্থার বিচারে যে-ঝামেলা পরিবারের ঘাড়ে না চাপিয়ে তার কোনো উপায়ও নেই।

পরদিন খুব ভোরে, আলো ফোঁটারও খানিক আগে, গ্রেগরের সুযোগ মিলে গেল নিজের নতুন সিদ্ধান্তগুলোর শক্তি পরীক্ষা করার, যখন তার বোন, প্রায় ফিটফাট হয়ে হলঘরের দিক থেকে একটা দরজা খুলে বিচলিতভাবে উঁকি দিল ভেতরে। গ্রেগরকে সে প্রথমে দেখতে পেল না, কিন্তু যখন সোফার নিচে তাকে খুঁজে পেল– হায় খোদা, কোথাও তো তাকে থাকতে হবে, সে তো আর উড়ে চলে যেতে পারে না –তখন এত বেশি চমকে উঠল যে, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল আবার। কিন্তু যেন নিজের ব্যবহারেই অনুতপ্ত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফের সে দরজাটা খুলল, তারপর পা টিপে টিপে ঢুকল ভেতরে, যেন সে দেখতে এসেছে খুব অসুস্থ কাউকে কিংবা একদম অচেনা কোনো মানুষকে। গ্রেগর সামনের দিকে ধাক্কা দিয়ে তার মাথা সোফার একেবারে কিনারায় নিয়ে এসেছে আর দেখছে তার বোনকে। তার বোন কি দেখতে পাচ্ছে যে সে দুধ খায়নি, আর তা কোনোমতেই এ কারণে না যে তার খিদে নেই; তার জন্য আরেকটু জুতসই হয় এমন অন্য কোনো খাবার সে কি দেবে না তাকে? তার বোন নিজে থেকেই যদি এটা না করে, তাহলে বোনকে এটা দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টার বদলে সে বরং উপোস করেই মরবে; তবে সত্যি হচ্ছে, সোফার নিচ থেকে ছুটে বেরিয়ে তার বোনের পায়ের কাছে নিজেকে ছুঁড়ে দিয়ে ভালো কোনো খাবারের মিনতি জানানোর এক প্রচণ্ড তাড়না অনুভব করছে গ্রেগর। ঠিক এ সময়ই তার বোন বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করল দুধের পাত্র তখনো ভরা, শুধু কিনারগুলোর আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দু-একটা ফোঁটা; তখুনি সে তুলে নিল পাত্রটা –না, খালি হাতে না, বরং একটা ন্যাকড়া দিয়ে ধরে– আর বাইরে নিয়ে গেল। দুধের বদলে সে তার জন্য কী নিয়ে আসে, তা জানতে খুব কৌতূহলী হয়ে রইল গ্রেগর আর এ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনায় মগ্ন হলো। কিন্তু তার বোন, বিশাল উদারতা দেখিয়ে বাস্তবে যা করল, তা গ্রেগরের অনুমানের বাইরে। কী সে পছন্দ করে তা বুঝতে নানা ধরনের একগাদা খাবার সে নিয়ে এসেছে তার জন্য, ওগুলো বিছানো একটা পুরোনো খবরের কাগজে। ওতে আছে বাসি, আধা-পচা শাকসবজি; সাদা জমাট সসে ঢাকা গত রাতের খাবারের হাড়গোড়; কয়েকটা বাদাম আর কিশমিশ; কদিন আগে খাওয়ার অযোগ্য বলে গ্রেগরেরই ঘোষণা করা কিছু পনির; শুকনো রুটির একটা টুকরো, মাখন দেওয়া এক ফালি পাউরুটি, আর আরেক ফালির সঙ্গে খানিক লবণ। এগুলোর সঙ্গে আগের পাত্রটাও সে নামিয়ে রাখল– এখন থেকে এ পাত্রটা সম্ভবত স্থায়ীভাবে গ্রেগরেরই জন্য –ওর মধ্যে সে ঢেলে রেখেছে অল্প একটু পানি। তারপর বেশ বুদ্ধির সঙ্গেই সে– যেহেতু সে জানে তার উপস্থিতিতে গ্রেগর খাবে না –চলে গেল ওখান থেকে; আর এমনকি গ্রেগর যেন বুঝতে পারে এখন সে নিজের খুশিমতো খাওয়া শুরু করতে পারে, তাই তালাটাও লাগিয়ে দিল। যেহেতু খাবার দেওয়া হয়েছে, তাই তার ছোট ছোট পা ওদিকে ছুটল সরসর করে। তার ঐসব আঘাত নিশ্চয়ই সেরে গেছে, কারণ চলতে গিয়ে কোনো বাধাই অনুভব করল না সে ব্যাপারটা অবাক করল তাকে, সে ভাবতে লাগল কীভাবে, এক মাস আগে, ছুরিতে সামান্য আঙুল কেটে গিয়েছিল তার আর কীভাবে মাত্র এই গত পরশু দিনও, ব্যথা করছিল সেখানে। তাহলে কি মনে হয় আমার অনুভূতিশক্তি আগের চাইতে কমে গেছে? ভাবল গ্রেগর; ততক্ষণে লোভাতুর হয়ে চুষতে লেগেছে পনিরটা, ওটার দিকে সে তৎক্ষণাৎ আর যেন বাধ্যের মতো আকর্ষিত হয়েছে অন্য যেকোনো খাবারের চেয়ে বেশি। পালা করে খুব ঝটপট, দুচোখে তৃপ্তির কান্না ঝরাতে ঝরাতে সে সাবাড় করল পনির, শাকসবজিগুলো আর সসটা; অন্যদিকে তাজা খাবারগুলোতে তার রুচি হলো না, সে আসলে ওগুলোর গন্ধও সহ্য করতে পারছে না, আর তাই তার পছন্দের খাবারগুলো সে এমনকি সরিয়ে নিয়ে গেল খানিক দূরে। অনেকক্ষণ হলো তার খাওয়া শেষ হয়েছে, ওই জায়গাতেই সে পড়ে আছে অলসের মতো আর এ সময় তার বোন– তাকে সরে যাওয়ার সংকেত জানাতেই যেন –চাবি ঘুরানো শুরু করল ধীরে ধীরে। হঠাৎ তাকে চমকে তুলল সেই শব্দ, তার প্রায় ঝিমুনিমতো এসে গিয়েছিল, আর আবার সে শাই করে ছুটে গেল সোফার নিচে। মাত্র অল্পক্ষণ তার বোন থাকল এই ঘরে, কিন্তু ঐটুকু সময়ও সোফার নিচে থাকতে গ্রেগরকে বিরাট মানসিক শক্তির পরিচয় দিতে হলো, কারণ এত খাওয়ার পর তার শরীর খানিক কেঁপে ওঠায় সোফার নিচের ঐ ঠাসাঠাসি জায়গায় তার শ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল।

দম আটকে আসা অনুভূতির ফাঁকে ফাঁকেই গ্রেগর তার অল্প ফোলা চোখ দুটো দিয়ে দেখতে লাগল তার বোন– এসবে অসন্দিহান মেয়েটা –একটা ঝাড় হাতে নিয়ে ঝট দিয়ে শুধু তার খাওয়া উচ্ছিষ্টগুলোই সরাচ্ছে না, সেই সঙ্গে সরিয়ে নিচ্ছে এমনকি তার না-ছোঁয়া খাবারগুলোও, যেন ওগুলোও আর কোনো কাজে আসবে না; তারপর সবকিছু তাড়াতাড়ি একটা বালতির মধ্যে ফেলে, কাঠের এক তক্তা দিয়ে বালতি ঢেকে সে ওটা নিয়ে চলে গেল ঘর থেকে। যাওয়ার জন্য তার বোন ঘোরামাত্রই সোফার নিচে থেকে শরীর টেনে বাইরে নিয়ে এল গ্রেগর– একটু লম্বা হয়ে পেটটা ফোলাবে বলে।

এভাবেই রোজ চলতে লাগল গ্রেগরকে খাবার দেওয়া, প্রথমবার ভোরে যখন তার বাবা-মা আর কাজের মেয়ে তখনো ঘুমিয়ে, আর আরেকবার সবার দুপুরের খাওয়া হয়ে যাওয়ার পরে, যখন তার বাবা-মা আরেকবার দুপুরের ছোট ঘুম দিতেন আর মেয়েটাকে তার বোন পাঠিয়ে দিত বাইরে কোনো একটা কাজে। গ্রেগর উপোস করে থাকুক, এটা নিশ্চিত তার বোনের মতোই অন্যেরাও কেউ চায় না, কিন্তু সম্ভবত তার খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে ওই পরোক্ষ জ্ঞানটুকুই তাদের বহন ক্ষমতার শেষ সীমা; কিংবা খুব সম্ভব তার বোন তাদের সামান্য পীড়াদায়ক কোনো অভিজ্ঞতাও দিতে চাচ্ছে না, কারণ এটা সত্যি যে তারা এমনিতেই রয়েছেন যথেষ্ট ভোগান্তিতে।

সেই প্রথম সকালে ডাক্তার ও তালাওয়ালা ফ্ল্যাটে আসবার পরে কী বলে তাদের আবার বিদায় করা হয়েছিল। তা জানা গ্রেগরের পক্ষে সম্ভব হয়নি; অন্যরা যেহেতু তার কথা বোঝে না তাই তাদের মাথায়, এমনকি তার বোনের মাথায়ও, এটা কখনোই ঢোকেনি যে গ্রেগর তাদের কথাবার্তা বুঝতে পারছে; তাই তার বোন যখন এ ঘরে আসে তখন গ্রেগরকে সন্তুষ্ট থাকতে হয় কেবল তার হঠাৎ হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস আর সেইন্টদের নাম জপা শুনেই। কেবল পরের দিকেই, যখন তার বোন নতুন অবস্থাটায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে শুরু করল –তাই বলে কখনোই পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে ওঠার তো কোনো প্রশ্নই আসে না–, তখন গ্রেগর কখনো-সখনো শুনতে পেত তার দু-একটা মন্তব্য, ওগুলোর মধ্যে দরদ কিংবা অমন কিছুর সুরটা বুঝতে পারত সে। আজ দেখি খাবারটা ওর সত্যিই পছন্দ হয়েছে, সে হয়তো বলত যখন দেখা যেত গ্রেগর মানুষের মতো পেট পুরে খেয়েছে, আর যখন উল্টোটা ঘটত– ইদানীং তেমনই খুব ঘন ঘন হওয়া শুরু হয়েছে– তখন সে প্রায় বিমর্ষ হয়ে বলত: ‘আজ তো দেখি আবার সব পড়ে আছে।’

যদিও কোনো খবর সরাসরি পাওয়া গ্রেগরের পক্ষে সম্ভব না, তবু পাশের ঘরগুলোর বেশ কিছু কথাবার্তা ঠিকই তার কানে এসে পৌঁছাত, আর যখনই কোনো গলার আওয়াজ পেত সে, অমনি সোজা দৌড়ে যেত সেই দরজার দিকে, পুরো শরীর ঠেসে ধরত এর গায়। বিশেষ করে প্রথমদিকের দিনগুলোয় এমন কোনো আলাপই হতো না যা কোনো-না কোনোভাবে, স্রেফ পরোক্ষভাবে হলেও, গ্রেগরের বিষয়ে না। পুরো দুই দিন প্রত্যেক বেলা খাবার সময়ই এখনকার করণীয় নিয়ে শলাপরামর্শ শোনা যেত; আর খাবারের মাঝখানের সময়েও একই বিষয়ে আলোচনা চলত; সব সময়ই পরিবারের অন্তত দুজন বাড়িতে থাকতই, হয়তো এ কারণে যে কেউই একা থাকতে চাইত না এ ফ্ল্যাটে, আর ফ্ল্যাট পুরোপুরি খালি ফেলে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এ ছাড়া কাজের মেয়েটাও গ্রেগরের মায়ের কাছে এসেছিল একেবারে প্রথম দিনেই –এই ঘটনা বিষয়ে তার জ্ঞান কতটুকু ছিল তা পুরো স্পষ্ট না –আর হাঁটু গেড়ে মিনতি করেছিল যেন তাকে এক্ষুনি বিদায় করে দেওয়া হয়; মিনিট পনেরো পরে তার বিদায়ের সময় কাঁদতে কাঁদতে সে ধন্যবাদ দিয়েছিল সবাইকে –যেহেতু তাকে এই কাজ থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে, এ বাড়িতে যেন তার প্রতি করা এটাই আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় উপকার–, সেই সঙ্গে কেউ কিছু তাকে না বললেও নিজের থেকেই ধর্মের নামে কঠিন শপথ করে সে বলেছিল যে এ বিষয়ে কাউকেই কখনো কোনোকিছু বলবে না।

অতএব এখন গ্রেগরের বোনকে, তার মায়ের সঙ্গে সঙ্গে, রান্নাবান্নার কাজও করতে হচ্ছে; যদিও সত্যি হলো, এটা কোনো বিরাট পরিশ্রমের কাজই না, কারণ এই পরিবারের কেউ এখন বলতে গেলে কিছুই খায় না। গ্রেগর সব সময়ই শোনে তারা একে অন্যকে খাওয়ার নিষ্ফল অনুরোধ করে যাচ্ছে, আর কখনো উত্তর পাচ্ছে না কোনো, স্রেফ: ‘না থ্যাংকস্, যথেষ্ট খেয়েছি আমি,’ কিংবা এ রকমই কিছু। মনে হয়, তারা এমনকি কোনো ড্রিংকস্ও ছোঁয় না। প্রায়ই তার বোন বাবাকে জিগ্যেস করে তিনি একটু বিয়ার খাবেন কি না, যথেষ্ট দরদ দিয়ে নিজে বাইরে গিয়ে সেটা নিয়ে আসারও কথা বলে; আর যখন তার বাবা কোনো জবাব দেন না তখন ওনার সব দ্বিধা দূর করার জন্যই সে বলে, ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকারকে এই কাজে যেকোনো সময়ই বাইরে পাঠানো যায়; কিন্তু শেষমেশ তার বাবা একটা দৃঢ় ‘না’ বলে দেন আর সেই সঙ্গে শেষ হয় এ নিয়ে সব আলাপ।

ঘটনার একেবারে প্রথম দিনেই তার বাবা তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে তার মা ও বোনের কাছে একটা বিশদ বিবরণ দিলেন। একটু পর পরই তিনি টেবিল ছেড়ে উঠলেন আর ছোট সিন্দুকটা থেকে বের করে আনলেন কোনো রসিদ বা নোট বই, পাঁচ বছর আগে তার ব্যবসা বসে যাওয়ার সময় থেকে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন ওগুলো। এই শোনা গেল তার জটিল তালা খোলার শব্দ, আর যা খুঁজছেন তা বের করে নিতেই আবার বন্ধ হয়ে গেল সিন্দুক। তার বন্দিদশা শুরু হওয়ার পর তার। বাবার দেওয়া এই বিবরণটাই, পুরোটা না হলেও অন্তত এর কিছুটা, ছিল গ্রেগরের শোনা প্রথম আশ্বস্ত হওয়ার মতো কথা। সে ধরে নিয়েছিল বাবার পুরোনো ব্যবসায় একটা পয়সাও আর অবশিষ্ট নেই, অন্তত এ ধারণার উল্টো কোনোকিছু তার বাবা কখনোই বলেননি, যদিও এ-ও সত্য গ্রেগর তাকে কখনো কিছু জিগ্যেসও করেনি। সে সময় গ্রেগরের একমাত্র চিন্তাই ছিল সম্ভাব্য সবকিছু করে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় পরিবারটাকে ঐ ব্যবসা বসে যাওয়ার ধাক্কা ভুলতে সাহায্য করা, যে ধাক্কা তাদের সবাইকে ছুঁড়ে দিয়েছিল চরম এক হতাশ অবস্থার মধ্যে। আর তাই অস্বাভাবিক এক উদ্যম নিয়ে কাজে নেমে পড়েছিল গ্রেগর, ফলে প্রায় রাতারাতি এক সামান্য কেরানি থেকে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিল ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যান– এর ফলে তার সামনে এল টাকা কামানোর পুরো নতুন এক পথ যেহেতু সেলসম্যানের চাকরিতে কাজের ফলাফল, যদি সে সফল হয়, সোজা রূপান্তরিত হয়ে যায় কমিশন হিসেবে পাওয়া মোটা টাকায়; যা সে বাড়িতে নিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রাখতে লাগল তার পরিবারের বিস্মিত ও আনন্দিত দৃষ্টির সামনে। কত সুখে ভরা সব দিন ছিল সেগুলো, সেসব দিন আর ফিরে আসেনি কখনোই, অন্তত ওরকম জাঁকজমক নিয়ে না; যদিও পরে এত টাকাই গ্রেগর কামাতে লাগল যে একসময় তার পরিবারের পুরো ব্যয়ভার তার পক্ষেই বহন করা সম্ভবপর হয়ে উঠল, আর সে তা করতেও লাগল। একসময় সবাই ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেল, পরিবার ও গ্রেগর– দুই পক্ষই; তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েই টাকাটা নেওয়া হতো তার হাত থেকে, আর খুশি মনেই সে পরিবারের হাতে তুলে দিত ওটা, কিন্তু খুব বেশি দিন আলাদা কোনো আর উষ্ণতা থাকল না ব্যাপারটাতে। একমাত্র তার বোনের সঙ্গেই যা অন্তরঙ্গ রয়ে গেল গ্রেগর। তার একটা গোপন সংকল্প ছিল যে বোনকে –যে কিনা খুবই সংগীতপ্রিয় (গ্রেগর একদমই না) আর বেহালা বাজাতে পারে একেবারে হৃদয়ছোঁয়া সুরে– পরের বছর সংগীত-বিদ্যালয়ে পাঠাবে সে, তাতে খরচ অনেক লাগলে লাগবে, সে জানত কোনো-এক-রকমভাবে চেষ্টা করে খরচটা সামলানো যাবে। মাঝেমধ্যে সামান্য কদিনের জন্য যখন গ্রেগরের কাজ পড়ত এই শহরে, তখন তার বোনের সঙ্গে আলাপের সময় প্রায়ই উঠত সংগীত-বিদ্যালয়ের কথাটা, অবশ্য সব সময়ই সুন্দর কোনো এক স্বপ্ন হিসেবেই, যে-স্বপ্নের বাস্তবায়ন অসম্ভব, আর এ নিয়ে এমনকি এসব নির্দোষ পরোক্ষ কথাবার্তাও তার বাবা-মা খুব একটা পছন্দ করতেন না; তবে এ বিষয়ে মনে মনে খুব স্পষ্ট করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল গ্রেগর, সে চাচ্ছিল এই ক্রিসমাসেই বেশ আনুষ্ঠানিকভাবে সে ঘোষণা করবে তার সংকল্পের কথা।

এসব চিন্তাই –তার বর্তমান অবস্থার বিচারে একেবারে অন্তঃসারশূন্য চিন্তা– ওখানে দরজা ধরে খাড়া হয়ে দরজার সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে অন্যদের কথা শোনার সময় ঝড় তুলত ন্ট গ্রেগরের মনে। কখনো হয়তো বা স্রেফ ক্লান্তি থেকেই সে আর মনোযোগ রাখতে পার না, আর অসাবধানে দুম করে মাথাটা ঠুকে বসত দরজায়, কিন্তু তক্ষুনি আবার সোজা হয়ে যেত, কারণ দেখা যেত এই সামান্য শব্দই পাশের ঘরের সবার কানে যাওয়ার জন্য আর তাদের আলাপ থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এখন আবার কী চাচ্ছে ও? একটু থেমে তার বাবা বলতেন, নিশ্চিত দরজার দিকে ঘুরে; শুধু তার পরই তাদের থেমে যাওয়া আলাপ আস্তে আস্তে শুরু হতো আবার।

গ্রেগর এখন খুব ভালোমতো বুঝতে পারল যে– কারণ তার বাবা একই জিনিস বারবার করে ব্যাখ্যা করলেন, কিছুটা এ কারণে যে বহুদিন হয়ে গেছে তিনি এসব নিয়ে শেষবার মাথা ঘামিয়েছেন আর কিছুটা এ কারণে যে গ্রেগরের মা সব সময় সবকিছু প্রথমবারে ধরতে পারেন না –সর্বনাশা সেই বিপর্যয় সত্ত্বেও কিছু পরিমাণ টাকা, সত্যি যে খুবই সামান্য কিছু, বেঁচে গেছে সেই পুরোনো দিনগুলো থেকে, আর এই এত দিনের জমতে থাকা সুদের কারণে তা খানিকটা বেড়েছেও বটে। এর পাশাপাশি, প্রতি মাসে যে টাকা গ্রেগর বাড়িতে দিত– সামান্য কিছু খুচরো পয়সাই কেবল সে ফেলে রাখত নিজের জন্য– তার পুরোটা খরচ করা হয়নি, আর সেটাই জমতে জমতে রূপ নিয়েছে একটা মোটামুটি মূলধনে। গ্রেগর, দরজার পেছনে শরীর রেখে, অধীর হয়ে মাথা ঝাঁকালো, এই অভাবনীয় মিতব্যয়িতা আর দূরদৃষ্টির কথা শুনে সে উল্লসিত। সে আসলে এই বাড়তি টাকাটা বসের কাছে তার বাবার ঋণ আরো বেশি বেশি করে শোধ করার কাজে ব্যবহার করতে পারত, তা করলে তার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার দিনটা হয়তো আরো খানিক এগিয়ে আনা যেত, কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে তার বাবা যা করেছেন সেটাই নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ঠিক কাজ ছিল।

এই সামান্য কটা টাকার সুদের ওপর কিংবা ও-ধরনের কিছুর ওপর নির্ভর করে অবশ্য এই গোটা পরিবারের খুব বেশি দিন চলবে না; এতে এক বছর টিকে থাকা যাবে, কিংবা খুব বেশি হলে দুই বছর, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। সত্যি বলতে, এ-ঠিক এমনই কয়টা টাকা যা ছোঁয়া উচিত না, বরং জরুরি দরকারের জন্য রেখে দেওয়াই উচিত; তাই রোজকার খবরের ব্যাপারে কথা হলো, তা কামাই করা ছাড়া অন্য পথ নেই। গ্রেগরের বাবা সত্যিকার অর্থে এখনো স্বাস্থ্যবান আছেন, কিন্তু এই বুড়ো মানুষটা গত পাঁচ বছর ধরে কোনো কাজ করেননি, আর এখন যে খুব বেশি কিছু করতে পারবেন সে আশা করা তার নিশ্চিত উচিত না; এই পাঁচ বছরে –যা তার কঠোর খাটুনির কিন্তু ব্যর্থ এই জীবনের প্রথম বিশ্রাম–, শরীরে তিনি অনেক চর্বি জমিয়ে ফেলেছেন, ফলে তার চলাফেরা হয়ে গেছে চোখে পড়ার মতো ঢিমেতালের। আর গ্রেগরের বৃদ্ধ মায়ের ব্যাপারে বলতে হয়, হাঁপানির রোগী তিনি কী করে তিনি পয়সা রোজগার করবেন যখন কিনা এমনকি ফ্ল্যাটে হেঁটে বেড়াতেও কষ্ট হয় তার, আর প্রতি একদিন পর পর জানালা খুলে সেখানে পাশের সোফায় বেহশুয়ে দম ফুরিয়ে শ্বাস নিতে হয় তাকে? তাহলে কি কাজ করার জন্য তার বোনই বেরোবে ঘর থেকে, যে এখনো সতেরো বছর বয়সের একটা বাচ্চার বেশি না; ও যেভাবে দিন কাটায় তাতে বাধা দেওয়া হবে তো অপরাধেরই শামিল– সুন্দর জামাকাপড় পরা, অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমানো, ঘরের কাজে টুকটাক সাহায্য করা, ছোটখাটো আমোদ-আহ্লাদে যোগ দেওয়া আর, সবার ওপরে, বেহালা বাজানো, এই তো তার জীবন? দরজার ওপাশের কথাবার্তা যখনই টাকা রোজগারের আবশ্যিকতার দিকে ঘুরে যায়, গ্রেগর তখন সঙ্গে সঙ্গে দরজা থেকে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে, ছুঁড়ে দেয় পাশের ঠান্ডা চামড়ার সোফার উপর, কারণ তখন তার সারা শরীরে সে বোধ করতে থাকে লজ্জা ও মর্মপীড়ার তাপ।

প্রায়ই সে সারা রাত পড়ে থাকে ওখানে, একফোঁটা ঘুমায় না, আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু আঁচড় কাটে সোফার গায়ে। কিংবা জানালার কাছে একটা হাতলওয়ালা চেয়ার ঠেলে নেওয়ার কষ্টকর কাজে ব্যস্ত হয়, একসময় বুকে ভর দিয়ে উঠে যায় জানালার চৌকাঠে, চেয়ারের উপরে শরীরের ভার ঠেকিয়ে শার্সি গায়ে ঝুঁকে থাকে, আর স্পষ্টই উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে মুক্তির সেই স্বাদের স্মৃতিচারণা করে, জানালার বাইরে তাকিয়ে যে স্বাদটা সে আগে সব সময় পেত। আর এখন দেখা যাচ্ছে সামান্য দূরের জিনিসও দিন দিন আরো ঝাপসা হয়ে আসছে তার চোখে; এখন আর সে রাস্তার ওপাশের হাসপাতালটা একদমই দেখতে পায় না, আগে যেটা সব সময় চোখের সামনে পড়ে থাকত বলে গালিও দিত সে; যদি সে একেবারে নিশ্চিতভাবেই না জানত যে এটা শান্ত, আর পুরো শহুরে সেই শার্লট স্ট্রিট, তাহলে হয়তো সে ধরে নিত জানালার বাইরে ওটা বরং কোনো বিরানভূমি, যেখানে ধূসর আকাশ আর ধূসর মাটি একেবারে একাকার হয়ে গেছে। তার সুবিবেচক বোনটার শুধু দুই বার দেখতে হলো যে হাতলওয়ালা চেয়ারটা পড়ে আছে জানালার পাশে; তার পর থেকে সে কামরা সাফ করা শেষ হলেই যত্নের সঙ্গে ফের চেয়ার ঠেলে রাখত জানালার ওখানে আর এমনকি জানালার ভেতর দিকের শার্সিও শুরু করল খুলে রেখে যাওয়া।

শুধু যদি গ্রেগর তার বোনের সঙ্গে একটু কথা বলতে পারত, আর তার বোন দয়া করে তার জন্য যা কিছু করছে সেজন্য খানিক ধন্যবাদ জানাতে পারত– তাহলে তার এসব সেবাযত্ন নেওয়া কিছুটা সহজ হতো গ্রেগরের পক্ষে; ওটা ছাড়া এগুলো তাকে মানসিক চাপ দিচ্ছে। পুরো ব্যাপারটার অপ্রীতিকরতা ধামাচাপা দেওয়ার সব চেষ্টা, বলতেই হয়, তার বোন করে যাচ্ছে, আর স্বাভাবিক যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ কাজে সে আরো পটু হয়ে উঠছে, কিন্তু সমানভাবে, যত সময় যাচ্ছে গ্রেগর আরো ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারছে সবকিছু। যেভাবে তার বোন ঘরে ঢোকে সেটাই তার কাছে রীতিমতো আতঙ্কের; ঘরে ঢুকতে-না-ঢুকতেই, দরজা বন্ধ করার জন্যও না-থেমেই –অন্যদের যেন গ্রেগরের ঘর কখনো দেখতে না হয় সেজন্য তার সব সময় কী চেষ্টা– সে সোজা ছুটে যায় জানালার কাছে আর অস্থির হাতে হুড়মুড় করে খুলে দেয় জানালা, যেন তার দম বন্ধ হয়ে গেছে; আর বাইরে এত ঠান্ডা সত্ত্বেও গভীর শ্বাস নিতে নিতে ওখানে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে খানিকক্ষণ। এসব শব্দ আর তাড়াহুড়া দিয়ে প্রতিদিন দুবার সে আতঙ্কিত করে গ্রেগরকে; পুরো সময় ভয়ে কেঁপে সে পড়ে থাকে সোফার নিচে; সে ভালো করেই বোঝে যে এই অত্যাচার থেকে তার বোন তাকে ঠিকই রেহাই দিত শুধু যদি তার পক্ষে সম্ভব হতো গ্রেগর আছে এমন কোনো ঘরে জানালা বন্ধ করে থাকাটা।

একদিন –নিঃসন্দেহে গ্রেগরের রূপান্তরের এক মাস পেরিয়ে গেছে, তাই তার চেহারা দেখে বিস্মিত হওয়ার কোনো বিশেষ কারণ তার বোনের থাকার কথা নয়– সে স্বাভাবিকের চেয়ে খানিকটা আগে এসে ঢুকল এই ঘরে আর গ্রেগরকে দেখল জানালায় ঠেস দিয়ে, স্থির হয়ে আর সবচেয়ে ভয়ার্ত এক চেহারা নিয়ে, তাকিয়ে রয়েছে বাইরে। তার বোন যদি ভেতরে আসার সিদ্ধান্ত না নিত, সেটাই স্বাভাবিক লাগত গ্রেগরের কাছে, কারণ জানালার ওখানে গ্রেগরের থাকার কারণে তক্ষুনি জানালাটা খোলা তার পক্ষে আর সম্ভব ছিল না; কিন্তু সে যে শুধু ভেতরে এল না তা-ই নয়, এমনকি ভয়ে লাফিয়ে পিছিয়ে গেল আর দড়াম করে আটকে দিল দরজা; অপরিচিত কেউ হলে এটা দেখে নিশ্চিত ভেবে বসত, তাকে কামড়ানোর ইচ্ছা নিয়েই যেন ঘাপটি মেরে গ্রেগর বসে ছিল ভেতরে। কালবিলম্ব না করে সে লুকিয়ে গেল সোফার নিচে, কিন্তু দুপুর পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করে থাকতে হলো তার বোনের ফিরে আসার, আর যখন সে এল, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি অস্বস্তিতে আছে সে। এ থেকেই গ্রেগর বুঝে নিল, তার চেহারাটা এখনো তার বোনের কাছে ঘিনঘিনে কিছুই আর সেটা তা-ই সেটাই থেকে যাবে; সোফার নিচ দিয়ে বেরিয়ে থাকা তার শরীরের ওই অল্প একটুখানিক দেখেই তার বোনকে নিশ্চয় ভীষণ কষ্টে দমিয়ে রাখতে হচ্ছে ছুটে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা। তাই এ দৃশ্যটুকু থেকেও তাকে রেহাই দিতেই একদিন গ্রেগর পিঠে করে সোফার কাছে বয়ে নিয়ে এল একটা চাদর –এ কাজটুকু করতেই তার লেগে গেল চার ঘণ্টা– চাদরটা এমন এক কায়দায় সে বিছাল যার ফলে তার পুরো শরীর ঢাকা পড়ে গেল এর নিচে, এখন তার বোন। যদি এমনকি নিচের দিকে ঝুঁকেও পড়ে, তাহলেও তাকে দেখতে পাবে না। তার বোনের কাছে যদি এই চাদরটা অপ্রয়োজনীয় বলেই মনে হতো, তাহলে সে তো তা সরিয়ে দিত কোনো দ্বিধা না করেই, কারণ এটা তো পরিষ্কার, গ্রেগরের মনে এমন কোনো ফুর্তি লাগেনি যে অমনভাবে নিজের শরীর পুরো ঢেকে রাখবে; কিন্তু দেখা গেল চাদরটা যেখানে আছে সেখানেই থাকতে দিল তার বোন, আর এই নতুন ব্যবস্থাটা সে কীভাবে নিয়েছে তা দেখার জন্য যখন গ্রেগর সাবধানে মাথা দিয়ে চাদর অল্প তুলল, তখন মনে হয় তার বোনের চোখে এমনকি একবার একটু কৃতজ্ঞতার ছাপও সে দেখতে পেল যেন।

প্রথম দুই সপ্তাহ গ্রেগরের বাবা-মা তার কাছে আসার ব্যাপারে সাহস করে উঠতে পারলেন না; প্রায়ই গ্রেগর শুনত যে তারা তার বোনের এখনকার কাজের বিরাট প্রশংসা করছেন, যেখানে আগে প্রায়ই তারা বোনটার ওপর বিরক্ত থাকতেন, ওকে নিষ্কর্মা এক মেয়ে বলেই মনে করতেন। কিন্তু এখন তারা দুজনেই, তার বাবা ও মা, বোন ঘর সাফ করার সময় প্রায়ই অপেক্ষা করে থাকেন দরজার বাইরে, আর তার বোন বের হওয়া মাত্রই তাদের কাছে নিখুঁত বর্ণনা করতে হয় ঘরটা সে আজ কেমন দেখল, গ্রেগর কী খেয়েছে, আজ কেমন ব্যবহার করেছে, আর সামান্য উন্নতি কি দেখা যাচ্ছে– এসব। এর মধ্যে তার মা বেশ তাড়াতাড়িই বায়না শুরু করে দিলেন গ্রেগরকে দেখবেন; গ্রেগরের বাবা ও বোন প্রথমে নানা যুক্তি দেখিয়ে নিরস্ত করলেন তাকে; যুক্তিগুলো গ্রেগর শুনল খুবই মনোযোগ দিয়ে আর একমত হলো। কিন্তু পরের দিকে তার মাকে আটকে রাখতে বলপ্রয়োগের দরকার পড়ল; এরপর যখন তিনি চিৎকার শুরু করলেন: ‘গ্রেগরের কাছে আমাকে যেতে দাও, ও যে আমার দুর্ভাগা নিজের সন্তান! তোমরা কি দ্যাখো না আমাকে ওর কাছে যেতেই হবে?’ গ্রেগর তখন ভাবতে লাগল, তার মা যদি ভেতরে ঢোকেন তাহলে খুব মন্দ হয় না, অবশ্য রোজ রোজ না, মোটামুটি সপ্তাহে এক দিন হলেই চলবে; নিঃসন্দেহে তার মা তার ঐ বোনটার চেয়ে সবকিছু অনেক ভালো বোঝেন, যথেষ্ট মনের জোর থাকা সত্ত্বেও বোনটা তো একটা বাচ্চা মেয়েই মাত্র, আর সবকিছুর পরও মনে হয়, সে এ রকম কষ্টদায়ক একটা কাজ ঘাড়ে তুলে নিয়েছে স্রেফ বাচ্চাদের বেপরোয়া মানসিকতা থেকেই।

মাকে দেখার ইচ্ছা গ্রেগরের শিগগিরই পূর্ণ হলো। দিনের বেলা শুধু তার বাবা-মায়ের কথা বিবেচনা করেই জানালার সামনে দাঁড়ানোটা এড়িয়ে চলত সে, অন্যদিকে মেঝের এই অল্প কয়েক গজ জায়গাও বুকে ভর দিয়ে হাঁটাহাঁটির জন্য যথেষ্ট মনে হতো না তার; আর সটান শুয়ে থাকাটা, এমনকি রাতেও, একরকম অসহ্যই লাগত তার, ওদিকে বেশি দিন লাগল না খাওয়াদাওয়া থেকে তার পুরো রুচি উঠে যেতে, সুতরাং, বিনোদনের স্বার্থেই, দেয়াল আর ছাদের সবটা জুড়ে বুকে ভর দিয়ে চলার অভ্যাস গড়ে নিল সে। বিশেষ করে ছাদ থেকে ঝুলে থাকতে বেশ মজা লাগে তার; মেঝেতে শুয়ে থাকার সঙ্গে এর বিরাট ফারাক; আরো ভোলামেলা শ্বাস নেওয়া যায় ওখানে, সারা শরীরে কেমন যেন মৃদু এক কাপ ওঠে, আর ওখানে খুশির চোটে আনমনা হয়ে কখনো-সখনো সে নিজেকেই দারুণ অবাক করে দিয়ে, হাত পা ছেড়ে ধপাস করে পড়ে মেঝের উপর। এখন সন্দেহ নেই আগের থেকে সে অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে তার শরীর, তাই দেখা যায় অত উঁচু থেকে পড়লেও তার কোনো ক্ষতি হয় না। শিগগিরই গ্রেগরের বোনের চোখে পড়ল তার অবসর-বিনোদনের এই নতুন পন্থা, তাকে বুকে ভর দিয়ে চলতে হয় বলেই তার পেছনে পেছনে, এখানে-ওখানে থেকে যায় আঠালো শরীরের কিছু চিহ্ন। এর পরই বোনটা তাকে তার চলাফেরার জন্য যতখানি পারা যায় জায়গা করে দেওয়ার কথা ভাবল, ভাবল তার চলার পথে দাঁড়িয়ে থাকা আসবাবগুলো সরিয়ে ফেলার কথা, যার মানে সবার আগে আলমারি আর লেখার টেবিলটা। যা হোক, তার একার পক্ষে তো আর এ কাজ করা সম্ভব না; সাহায্যের জন্য বাবাকে বলারও সাহস হলো না তার; ওদিকে কোনো সন্দেহ নেই, ঝি-টা কোনো রকম সাহায্যই করবে না, কারণ আগের রান্নার মেয়েটা চলে যাওয়ার পর থেকে এই ষোলো বা সে রকম বয়সের বাচ্চা মেয়েটা যথেষ্ট সাহসের সঙ্গে এখানে। লেগে আছে ঠিকই, কিন্তু সে এক বিশেষ অনুমতি চেয়ে বসেছে যে, রান্নাঘরের দরজা সে সব সময় তালা দিয়ে রাখবে আর কেবল কোনো জরুরি কারণে তাকে বিশেষভাবে ডাকা হলেই সে খুলবে ওই দরজা। সুতরাং একদিন তার বোনের জন্য, যখন বাবা বাড়িতে নেই, তার মাকে ডেকে নেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প রইল না। তার মা বিরাট আনন্দ আর উত্তেজনা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে এলেন বটে, কিন্তু গ্রেগরের ঘরের দরজায় পৌঁছেই নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। ভেতরে সব ঠিকঠাক আছে কি না সে ব্যাপারে তার বোন অবশ্য প্রথমেই নিশ্চিত হয়ে নিল; কেবল তার পরই সে ঢুকতে দিল তার মাকে। ঝটিকা গতিতে গ্রেগর আরো নিচে টেনে নামাল তার গায়ের চাদর, ভাজ বানাল আরো অনেক কটা; পুরো জিনিসটা সত্যিই এমন দেখাল যে যেন কেউ সোফার উপর বেখেয়ালে ফেলে রেখেছে চাদরটা। এ দফায় চাদরের তলা দিয়ে উঁকি মেরে তাকানো থেকেও নিরস্ত থাকল গ্রেগর; তার মায়ের এখানে এই প্রথম আসা সত্ত্বেও মায়ের মুখটা দেখা থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখল সে, তিনি যে শেষমেশ এসেছেন স্রেফ তাতেই সে খুশি। আসো, ভেতরে আসো, ওকে দেখা যাচ্ছে না, বলল তার বোন, আক্ষরিক অর্থেই মাকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে। এবার গ্রেগর শুনতে পেল এই দুই রোগা মহিলা আগের জায়গা থেকে সরাচ্ছেন পুরোনো আলমারিটা, ওটা সত্যি ওজনে খুব ভারী, আর মায়ের সতর্কবাণী সত্ত্বেও তার বোন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একগুয়ের মতো সামলে চলেছে এই কাজের মূল ধাক্কা, তার মা উদ্বিগ্ন মেয়েটার পেশিতে না আবার টান পড়ে। কাজটা করতে খুব লম্বা সময় লাগল। সম্ভবত মিনিট পনেরো চেষ্টার পরে তার মা বললেন, আলমারি যেখানে ছিল সেখানেই বরং থাক, কারণ প্রথম কথা ওটা ওজনে খুব ভারী, তার বাবা বাড়ি আসার আগে তারা কোনোমতেই শেষ করতে পারবে না এই কাজ আর তখন দেখা যাবে গ্রেগরের চলাফেরা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়ে ওটা ফেলে রাখতে হচ্ছে ঘরের মাঝখানে; আর দ্বিতীয় হচ্ছে, এমনও তো মোটেই নিশ্চিত না যে আসবাবগুলো সরিয়ে তারা গ্রেগরের আসলেই কোনো উপকার করছেন। তার মায়ের কাছে মনে হলো উল্টোটাই বরং সত্যি; দেয়ালের ঐ ন্যাংটো চেহারা তার কাছে রীতিমতো মর্মঘাতী ঠেকল; আর গ্রেগরের প্রতিক্রিয়াও তো একইরকম হবে, সে তো এই আসবাবে অভ্যস্ত আজ বহুদিন, শূন্য ঘরে নিজেকে তো পরিত্যক্ত বলেই মনে হবে তার। এ রকম কি লাগবে না যে, খুব নিচু স্বরে উপসংহার টানলেন তার মা, আসলে পুরোটা সময় ধরেই তিনি কথা বলেছেন ফিসফিস করে, যেন তিনি নিশ্চিত করতে চাইছেন যে গ্রেগর যে জায়গাতেই থাকুক না কেন, তার গলার আওয়াজ যেন সে না শোনে, কারণ তিনি এক শ ভাগ বিশ্বাস করেন, সে তাদের কথা বুঝতে পারবে না, এ রকম কি লাগবে না যে আমরা তার আসবাবগুলো সরিয়ে তাকে এটাই বোঝাতে চাচ্ছি– তার সুস্থ হয়ে ওঠা নিয়ে আমরা সব আশা ছেড়ে দিয়েছি আর তাকে নিষ্ঠুরের মতো ছেড়ে যাচ্ছি স্রেফ তার নিজের ওপরেই? আমার মনে হয় সবচেয়ে ভালো হবে যদি আমরা ঘরটা ঠিক আগের অবস্থায়ই রাখার চেষ্টা করি, কারণ তাহলে গ্রেগর যখন আবার আমাদের কাছে ফিরে আসবে তখন সে দেখবে কিছুই বদলায়নি আর তখন এই মাঝখানের সময়টায় যা কিছু ঘটল, সব সে ভুলে যেতে পারবে আরো সহজে।

মায়ের কথাগুলো শুনে গ্রেগরের উপলব্ধি হলো, এই দুই মাস মানুষের সঙ্গে কোনো রকম সরাসরি সম্পর্ক না হওয়াতে আর সেই সঙ্গে পরিবারের চার দেয়ালের মধ্যে থাকার একঘেয়েমি মিলে তার চিন্তাভাবনা নিশ্চিত গুলিয়ে গেছে, নতুবা তার ঘর খালি করা হোক এমনটা সে আসলেই কী করে মন থেকে চাচ্ছিল সে কথার ব্যাখ্যা মাথায় এল না তার। সে কি আসলেই চায় যে পুরোনো পারিবারিক আসবাবে এত আরাম করে সাজানো তার এই উষ্ণ ঘরটা কোনো গুহায় রূপ নিক, যেখানে নিঃসন্দেহে সে সারা ঘর বাধাহীন ঘুরে বেড়াতে পারবে বুকে ভর দিয়ে– কিন্তু তার বদলে তার মনুষ্য অতীতটাও মুছে যাবে আরো দ্রুত ও সম্পূর্ণভাবে? এটা ঠিক, এরই মধ্যে সেই অতীত ভুলে যাওয়ার কিনারাতেই এসে পৌঁছে গেছে গ্রেগর, শুধু তার মায়ের গলা, সেই গলা যা সে বহুদিন ধরে শোনেনি, তাকে ফিরিয়ে আনল চেতনায়। না, একটা জিনিসও সরানো যাবে না; অবশ্যই সবকিছু থাকবে; নিজের অবস্থাটার ওপর আসবাবের সুপ্রভাব সে কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবে না; আর এসব আসবাব যদি তার অনর্থক বুকে ভর দিয়ে চলাচলতিতে কোনো বাধাও সৃষ্টি করে, তা বরং ভালোই, কোনো অসুবিধা নেই তাতে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য, তার বোন অন্য রকম চিন্তা করল; গ্রেগরের ব্যাপার নিয়ে যেকোনো আলোচনায় সে– অবশ্য তার এ আচরণের পেছনে যুক্তিও আছে বটে– এখন অভ্যস্ত তার বাবা-মায়ের সঙ্গে বিশেষজ্ঞের মতো কথা বলতে; তাই তার মায়ের এ প্রস্তাবে নেই ঠেলার জন্য তার তো কোনো কারণের অভাব নেই; কেবল আলমারি ও লেখার টেবিলটা সরানোই না –যদিও প্রথমে শুধু এটুকুই ইচ্ছে ছিল তার– সে বরং জোর করতে লাগল একমাত্র ঐ অবশ্য প্রয়োজনীয় সোফা ছাড়া এই ঘরের আর সব আসবাব সরিয়ে ফেলতে হবে। নিশ্চিত, তার এমন দাবির পেছনে শুধু তার শিশুসুলভ একগুঁয়েমি কিংবা তার সেই আত্মবিশ্বাসই– ইদানীং যে আত্মবিশ্বাস সে অর্জন করেছে খুব আকস্মিক আর বেদনাদায়ক এক পথে– কাজ করেনি, সেই সঙ্গে পরিষ্কার অর্থেই সে দেখছিল যে, গ্রেগরের চলাফেরা করে বেড়ানোর জন্য যথেষ্ট জায়গা দরকার, আর অন্যদিকে আসবাবগুলো যে গ্রেগরের বিন্দুমাত্র কোনো কাজে আসছে তারও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া সম্ভবত তার বয়সী মেয়েদের রোমান্টিক চিন্তাভাবনাও, যা কিনা সুযোগ পেলেই বের হওয়ার পথ খোঁজে, এ ক্ষেত্রে কিছু ভূমিকা রেখেছে– গ্রেটিকে তা উৎসাহিত করেছে ভাইয়ের দুর্দশা আরো বেশি ভয়াবহ করে তুলতে, যাতে করে আরো বড় বড় সব কৃতিত্ব দেখিয়ে তার উপকার সে করে যেতে পারে। সে জানে, এমন একটা ঘরে, গ্রেগর যেখানে একা শূন্য দেয়ালগুলোয় রাজত্ব করে বেড়ায়, সম্ভবত সে ছাড়া আর কেউই কখনো সাহস পাবে না পা ফেলার।

না, তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারলেন না তার মা, তিনি স্রেফ গ্রেগরের ঘরে আছেন এ-থেকেই প্রচণ্ড উদ্বেগে মনে হয় নিজে কী চান তা-ই ঠিকমতো আর বুঝতে পারছেন না। তাই বেশি দেরি হলো না যে চুপ করে গেলেন তিনি আর আলমারিটা বাইরে টেনে নিতে তার মেয়েকে সাধ্যমতো সাহায্য করতে লাগলেন। ঠিক আছে, উপায়ন্তর না থাকলে আলমারি ছাড়াও গ্রেগর নিজের কাজ চালিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু এর বেশি কিছু না; লেখার টেবিলটা এ ঘরে থাকতেই হবে। আর এই দুই মহিলা গোঙানি ও হাঁসফাঁস করতে করতে আলমারি ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে-না-যেতেই সোফার নিচ থেকে গ্রেগর বের করল তার মাথা; সে চায় সাবধানে, যদুর সম্ভব কৌশলে ওদের বাধা দেবে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ থাকলে যা হয়, গ্রেটিকে পাশের ঘরে ছেড়ে –সেখানে সে দুই হাতে আলমারিটা বেড় দিয়ে ধরে একা দোলাচ্ছে সামনে-পেছনে, যদিও নড়াতে পারছে না এক ইঞ্চিও– তার মা-ই প্রথমে ফিরে এলেন এ ঘরে। তার মায়ের তো আর গ্রেগরকে দেখার অভ্যাস নেই; এই চেহারা তাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে, এ রকম আশঙ্কায় গ্রেগর দ্রুত সোফার শেষ মাথার দিকে পিছু হটতে লাগল কিন্তু সামনের দিকে চাদরটার সামান্য দুলে ওঠা ঠেকাতে তার যথেষ্ট দেরি হয়ে গেল। তার মায়ের চোখে পড়ে গেল সে। তিনি থেমে গেলেন, এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলেন পাথর হয়ে, তারপর ফিরে গেলেন গ্রেটির কাছে।

যদিও গ্রেগর নিজেকে আশ্বস্ত করছে অস্বাভাবিক কোনো কিছুই ঘটছে না, শুধু কয়েকটা আসবাব এক পাশে সরিয়ে রাখা হচ্ছে মাত্র, তবু শিগগিরই তাকে মানতে হলো এই দুই মহিলার আসা-যাওয়া, একজন আরেকজনকে এই ডাকাডাকি, মেঝের উপর আসবাবের টানাহেঁচড়ার আওয়াজ– এসব কিছু তাকে জ্বালাচ্ছে চারদিক থেকে ফুঁসে ওঠা কোনো বিশাল গোলযোগের মতো; আর তাই যত সে চেষ্টা করছে হাত-পা গুটিয়ে, মেঝের ভেতর শরীরটা নিয়ে সেঁধিয়ে যেতে, তত তাকে অত্যাবশ্যক এই উপসংহারে আসতেই হচ্ছে যে, আর বেশিক্ষণ এসব সহ্য করতে পারবে না সে। ওরা তার ঘর থেকে সবকিছু সরিয়ে নিচ্ছে; তার প্রিয় সব জিনিস থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে তাকে; আলমারিটা, যার মধ্যে আছে তার সরু করাত ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি, এরই মধ্যে সরানো হয়ে গেছে; এখন ওরা আলগা করে আনছেন তার লেখার টেবিলও, মেঝেতে প্রায় গেঁথেই বসে ছিল টেবিলটা, ওটাতেই গ্রেগর সব সময় –বাণিজ্য অ্যাকাডেমির ছাত্র থাকতে, ব্যাকরণ স্কুলের ছাত্র হিসেবে, হ্যাঁ, এমনকি তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিনগুলোতেও– তার হোমওয়ার্ক করে এসেছে; আর এখন এই দুই মহিলার সৎ উদ্দেশ্য পরিমাপ করার মতো সময় তার হাতে নেই, সত্যি হচ্ছে এ দুজন যে এখানে আছেন সে কথাই সে প্রায় ভুলতে বসেছে, কারণ তারাও এখন ভীষণ ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার কারণে কাজ করছেন নীরবে আর তাদের শ্রান্ত, হোঁচট খেয়ে চলা পায়ের আওয়াজ ছাড়া অন্যকিছুই শোনা যাচ্ছে না।

অতএব গ্রেগর তার গোপন জায়গা থেকে ছুটে বেরিয়ে এল –দুই মহিলা তখন পাশের ঘরে টেবিলের গায়ে হেলান দিয়ে মাত্র খানিক জিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন– চারবার সে তার দিক বদলাল, কারণ সে সত্যিই বুঝে উঠতে পারছে না কোন জিনিসটা প্রথম আগলাতে হবে, তারপর তার চোখ আটকাল সেই পুরো ফারে ঢাকা মহিলার ছবিটাতে, খুবই নজরকাড়াভাবে ওটা ঝুলে আছে একদম শূন্য দেয়ালে, দ্রুত হামা দিয়ে ওটার কাছে উঠে গেল সে, শরীর চেপে ধরল কাঁচের উপরে, কাঁচটা তাকে এঁটে রাখল শক্ত করে আর তার তপ্ত পেটটাতে আরাম দিল খানিকটা। হু, অন্তত এই ছবিটা– গ্রেগরের শরীর যা এখন পুরোপুরি ঢেকে রেখেছে– তাহলে সরাতে পারছে না কেউ। বৈঠকখানার দরজার দিকে সে ঘুরিয়ে রাখল তার মাথা যেন মহিলা দুজন ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সে দেখতে পায়।

বেশিক্ষণ বিশ্রাম নিলেন না তারা, ফিরে আসা শুরু করলেন; তার মাকে দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরে এককথায় বয়ে নিয়ে আসছে গ্রেটি। আচ্ছা, এবার কী নেব আমরা?’ এ কথা বলে গ্রেটি তাকাল চারদিকে। তখনই তার সঙ্গে চোখাচোখি হলো গ্রেগরের, দেয়াল থেকে নিচে বোনের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। সম্ভবত তার মা আছে বলেই নিজেকে সংবরণ করে নিল গ্রেটি, মায়ের মাথার কাছে ঝুঁকিয়ে নিয়ে এল নিজের মাথা, মায়ের দেখার পথে যাতে বাধা পড়ে সেটাই তার উদ্দেশ্য, আর সেই সঙ্গে খানিকটা হড়বড় করে কাঁপা গলায় বলল: ‘আসো মা, আমরা বরং কিছুক্ষণের জন্য বসার ঘরে ফিরে যাই?’ বোনের উদ্দেশ্য গ্রেগরের কাছে পরিষ্কার: সে তার মাকে আগে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে চাইছে, এরপর তাকে সে দেয়াল থেকে তাড়িয়ে নামাবে। হু, আসুক না তাড়াতে! তার ছবিটার গায়ে এঁটে থাকবে সে, ওটা ছাড়বে না কোনোমতেই, বরং উড়ে গিয়ে বসবে গ্রেটির মুখে।

কিন্তু গ্রেটির কথাগুলো তার মাকে বরং আগের চেয়েও উদ্বিগ্ন করে তুলল; তিনি এক পাশে সরে গেলেন, এবার ফুলের নকশা করা ওয়াল পেপারের গায়ে বিশাল বাদামি বস্তুটা তার চোখে পড়ল, আর তিনি যা দেখছেন তা আসলে গ্রেগর, একথ সত্যিকার তার মাথায় আসার আগেই ভাঙা আর সুতীক্ষ এক গলায় তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন: “ওহ্ খোদা! ওহ্ খোদা!’ সেই সঙ্গে হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে ঢলে পড়লেন নোফার উপর যেন তিনি সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়েছেন; আর পড়ে রইলেন মড়ার মতো। তুমি। গ্রেগর!’ দুই হাত মুঠো পাকিয়ে তার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠ তার বোন। গ্রেগরের রূপান্তরের পর তার উদ্দেশে বলা এই-ই তার প্রথম সরাসরি কথা। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মায়ের জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে এবার সে ছুটে গেল পাশের ঘরে, চেনো সুগন্ধি তেলটেল জাতীয় কিছু আনার জন্য; গ্রেগরও চাচ্ছে সাহায্য করতে, ছবিটা বাঁচানোর সময় পরেও অনেক পাওয়া যাবে, কিন্তু কাঁচের উপর এত শক্ত হয়েই সে এঁটে গেছে যে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য তাকে অনেক মোচড়ামুচড়ি করতে হলো; তারপর সেও দৌড়ে গেল পাশের ঘরে, যেন তার বোনকে অতীতের মতো আজও কোনো উপদেশ দেবে; ওখানে পৌঁছে তাকে অলসভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো বোনের পেছনে অগুনতি ছোট ছোট বোতল হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ তার বোন মাথা ঘোরাল, চমকে উঠল ভয়ে; একটা বোতল ভেঙে গেল মেঝেতে পড়ে; এক ধরনের ঝাঝালো ওষুধ ছলকে পড়ল গ্রেগরের চারপাশে; তারপর গ্রেটি, আর কোনো রকম দেরি না করেই, যতগুলো ছোট বোতল হাতের মধ্যে ধরা যায় তা নিয়ে দৌড়ে গেল মায়ের কাছে আর তার পেছনে দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিল পা দিয়ে। গ্রেগর এখন মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন, যিনি সম্ভবত তারই কারণে মরতে বসেছেন; দরজা খোলার সাহস তার হলো না, পাছে তার বোন ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়, ওকে এখন মায়ের কাছে থাকা অবশ্যই প্রয়োজন; অপেক্ষা করা ছাড়া গ্রেগরের আর কিছুই করার নেই; আত্মধিক্কার আর দুশ্চিন্তার পীড়নে অস্থির হয়ে সে বুকে ভর দিয়ে চলতে শুরু করলে, সব জিনিসের গা বেয়ে হামা দিতে লাগল সে –দেয়াল, যাবতীয় আসবাব, ছাদ– যতক্ষণ না শেষমেশ পুরো ঘরটাই বন্বন্ করে ঘুরতে শুরু করল তার চারপাশে আর হতাশায় বিদ্ধ হয়ে সে ধপাস্ করে পড়ে গেল বড় টেবিলটার মাঝখানে।

কিছুটা সময় পার হলো; নিস্তেজ হয়ে গ্রেগর পড়ে আছে ওখানেই; চারদিকে সবকিছু একদম শান্ত; মনে হচ্ছে এটা কোনো সুলক্ষণ। তারপর বেজে উঠল দরজার ঘণ্টি। ঝি টা নিশ্চয়ই তালা মেরে পড়ে আছে রান্নাঘরে, তাই গ্রেটিকেই গিয়ে উত্তর দিতে হলো। তার বাবা ফিরেছেন। কী হয়েছে? এই তার প্রথম কথা; নিশ্চিত গ্রেটির চেহারাই তাকে সব বলে দিয়েছে। চাপা গলায় জবাব দিল গ্রেটি, তার বাবার বুকে মুখ গুঁজে বলল: ‘মা মূৰ্ছা গেছিলেন, তবে এখন অনেকটা ভালো। গ্রেগর বেরিয়ে পড়েছে। ঠিক যা আমি ভেবেছিলাম’, বললেন তার বাবা, ‘ঠিক যা আমি তোমাদের বলতাম, কিন্তু তোমরা মহিলারা তো তা শুনবে না।’ গ্রেগরের কাছে এটা পরিষ্কার, তার বাবা গ্রেটির এই অতি সংক্ষেপ বক্তব্যের সবচেয়ে বাজে এক ব্যাখ্যা করে বসেছেন, তিনি ধরে নিয়েছেন গ্রেগর কোনো একটা হিংসাত্মক কিছু করে বসেছে। তার মানে, গ্রেগরকে এখন অবশ্যই তার বাবাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে হবে, সবকিছু তাকে বুঝিয়ে বলার মতো সময় কিংবা সুযোগ, কোনোটাই গ্রেগরের নেই। তাই সে নিজের ঘরের দরজার কাছে ছুটে গেল, ওটার গায়ে ঠেসে রাখল শরীর, যাতে করে তার বাবা বারান্দা থেকে এ ঘরে ঢোকামাত্রই দেখতে পান যে সোজা নিজের ঘরে ফেরত যাওয়ার মতো সদিচ্ছা গ্রেগরের রয়েছে, তাই তাকে তাড়িয়ে ঢোকানোর কোনোই দরকার নেই; শুধু যদি দরজাটা খোলা থাকত, তাহলে সে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারত এক্ষুনি।

কিন্তু ও রকম সূক্ষ্ম বাছবিচার লক্ষ করার মতো মানসিক অবস্থা তার বাবার নেই; ‘আহ!’ ঘরে ঢুকতেই তিনি এমন এক গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন যা একই সঙ্গে ক্রুব্ধ আর মহা-উল্লসিত। দরজার কাছ থেকে মাথাটা টেনে নিল গ্রেগর আর বাবার দিকে উঁচু করে ধরল। তার বাবাকে সে যেমনটা কল্পনা করেছিল, ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ওই লোকটার তো মোটেই তেমন চেহারা নয়; অবশ্য, মানতেই হবে, ইদানীং বুকে ভর দিয়ে হাঁটাহাঁটির এই নতুন খেলা নিয়ে সে এতটাই মগ্ন যে বাড়ির অন্যখানে কী ঘটছে, সে ব্যাপারে আগের মতো আর খোঁজখবর নেওয়া হয়ে ওঠেনি; তার আসলেই উচিত ছিল পরিস্থিতি যে বদলে গেছে সে বিষয়ে প্রস্তুত থাকা। তার পরও, তার পরও এ লোকই কি আসলেই তার বাবা? ইনি কি সেই একই মানুষ, যিনি কিনা গ্রেগরের ব্যবসার কাজে বেরিয়ে পড়ার দিনগুলোয় ক্লান্ত শরীরে ডুবে থাকতেন নিজের বিছানায়; সব সময় তার ড্রেসিং গাউন পরে বসে থাকতেন নিজের আরামকেদারায় আর সন্ধ্যাবেলা গ্রেগর ফিরে এলে তাকে সম্ভাষণ জানাতেন; যিনি সত্যিকার বলতে গেলে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতেই পারতেন না, তাই খুশি প্রকাশের জন্য কেবল হাত দুটোই তুলতেন; আর যিনি, সেই দুর্লভ দিনগুলোতে যখন প্রতিবছর অল্পকিছু রোববার আর লম্বা ছুটিগুলোয় পুরো পরিবার একসঙ্গে বেড়াতে বেরোত, নিজের পুরোনো ওভারকোটটায় শরীর মুড়ে সব সময় খানিকটা ধীরগতিতে কষ্ট করে, প্রতিবার পা ফেলার জন্য যত্নের সঙ্গে তার বাঁকানো হাতলওয়ালা ছড়ি সামনে ঠুকে ঠুকে হাঁটতেন গ্রেগর ও তার মায়ের মাঝখানে– যারা নিজেরাই হাঁটত ধীরে ধীরে –আর যখনই কিছু বলার থাকত প্রায় অবধারিত থেমে দাঁড়িয়ে পুরো বাহিনীকে জড়ো করতেন তার চারপাশে? অন্যদিকে এখন, তাকে লাগছে কী চমৎকার, ঋজু শরীরের কেউ, পরনে গিল্টি করা বোতাম বসানো নীল রঙের এক আঁটসাট ইউনিফর্ম, যেমনটা পরে থাকে ব্যাংকের পিয়নেরা; জ্যাকেটের উঁচু শক্ত কলারের উপর দিয়ে ফেটে বেরোচ্ছে তার মোটা জোড়া-চিবুক; তার জংলি দুই ভ্রুর নিচের কালো চোখ দুটো থেকে বেরোচ্ছে তার সতর্ক আর বিদ্ধকরা দৃষ্টি; তার সাদা চুলগুলো, আগে যা থাকত খুবই এলোমেলো, আঁচড়ানো সুন্দর করে আর সেগুলো চিকচিক করছে একদম নিখুঁত করে কাটা সিঁথির দুই পাশে। চওড়া এক বৃত্ত বানিয়ে ঘরের পুরো দৈর্ঘ্য ছাড়িয়ে সোফার দিকে তিনি ছুঁড়ে দিলেন তার টুপিটা, ওতে লাগানো একটা সোনালি মনোগ্রাম, সম্ভবত কোনো ব্যাংকের হবে; আর দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে, লম্বা ইউনিফর্মের জ্যাকেটের কোনা পেছনে ভাঁজ করে নিয়ে এক হিংস্র মুখভঙ্গি করে তিনি এগিয়ে এলেন গ্রেগরের দিকে। মনে হচ্ছে, নিজেই জানেন না কী করতে যাচ্ছেন তিনি; তার পরও তিনি তার পা’টা তুললেন অস্বাভাবিক উঁচুতে; তার বুট জুতোর তলার প্রকাণ্ড আকৃতি দেখে বিস্মিত হলো গ্রেগর। কিন্তু এ মুহূর্তে তার এই ভাবনাটা আর দীর্ঘ করল না সে; তার এই নতুন জীবনের একেবারে শুরুর দিন থেকেই সে জেনে এসেছে, তার সঙ্গে আচরণের বেলায় তার বাবা শুধু সবচেয়ে কঠিন পন্থাগুলোই ঠিক বিবেচনা করে আসছেন। সুতরাং সে তার বাবার আগে আগে ছুটল, যখন তিনি থামলেন তখন সেও থামল, আর তিনি সামান্য নড়ে উঠতেই, সে ছুট লাগাল আবার। এভাবে কোনো চূড়ান্ত কিছু ঘটা ছাড়াই তারা ঘরটায় গোল হয়ে ঘুরল কয়েকবার আর এত ধীরে চলতে লাগল এই ঘোরা যে পুরো ব্যাপারটা দেখলে মনেই হবে না কেউ কাউকে তাড়াচ্ছে। গ্রেগর আপাতত ঠিক করল মেঝেতেই থাকবে, কারণ সে ভয় পেল দেয়াল বা ছাদের দিকে তার কোনো রকম উড়াল দেওয়াটা তার বাবা সাক্ষাৎ কোনো বদমায়েশি বলেই ধরে না বসেন। তবে গ্রেগরকে মানতেই হচ্ছে, এ রকম অলস দৌড়াদৌড়িও তার পক্ষে আর বেশিক্ষণ চালানো সম্ভব নয়; কারণ তার বাবা যেখানে মাত্র একটা পা ফেলছেন, সেখানে তাকে করে উঠতে হচ্ছে পুরো একগাদা নড়াচড়া। দম ফুরিয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে তার, আর সত্যি বলতে আগের জীবনেও ফুসফুস দুটো তার কখনোই পুরোপুরি ভরসা করার মতো ছিল না। এভাবেই সে যখন টলমলিয়ে চলছে, দুই চোখ বলতে গেলে বুজেই রেখেছে যাতে করে সমস্ত শক্তি স্রেফ দৌড়ের ওপরই নিবিষ্ট রাখা যায়, এমনকি এই হতবুদ্ধি অবস্থার মধ্যে দৌড় ছাড়া উদ্ধারের অন্য কোনো উপায় নিয়ে চিন্তাও করছে না, আর দেয়ালগুলো যে তার আয়ত্তের মধ্যে আছে সে কথাও প্রায় ভুলেই গেছে –যদিও মানতে হবে তীক্ষ্ণ সব কোনা আর পেরেকে ভরা সুন্দর খোদাইয়ের কাজ করা নানা আসবাবে পথ আটকে আছে দেয়ালগুলোর –ঠিক তখন হঠাৎ তার পাশ দিয়ে কিছু একটা ধেয়ে এল, হালকা করে ছুঁড়ে দেওয়া কিছু একটা; সেটা পড়ল মেঝেতে, তারপর গড়াতে লাগল তার সামনে। একটা আপেল; প্রথমটার পরই সঙ্গে সঙ্গে উড়ে এল আরেকটা; আতঙ্কে জমাট বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল গ্রেগর; আর কোনো ছোটাছুটি এখন অর্থহীন, কারণ তার বাবা তাকে বিধ্বস্ত করার ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্প হয়েছেন। খাবার ঘরের পাশের তাকে রাখা ফলের পাত্র থেকে নিয়ে তিনি তার পকেটগুলো ভরেছেন আর এখন ছুঁড়ে মারছেন একটার পর একটা আপেল, তেমন নিখুঁত নিশানা ছাড়াই। ছোট এই আপেলগুলো গড়াচ্ছে মেঝে জুড়ে, মনে হচ্ছে ওগুলো বিদ্যুতায়িত, লাফিয়ে পড়ছে একটার গায়ে আরেকটা। একটা আপেল, হালকা জোরে ছোঁড়া, গ্রেগরের পিঠে আলতো ছোঁয়া দিয়ে কোনো ক্ষতি না করেই ছুটে গেল তির্যকভাবে। কিন্তু আরেকটা, যেটা উড়ে এল আগেরটার পরপর, আসলেই গেঁথে বসল তার পিঠে; শরীর সামনে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করল গ্রেগর, যেন বা জায়গা বদলালেই দূর হয়ে যাবে এই সাংঘাতিক, অবিশ্বাস্য ব্যথা; কিন্তু মনে হলো ওই জায়গাতেই যেন পেরেকে গাঁথা সে; এবং তার সব ইন্দ্রিয় অনুভূতির এক চরম তালগোল পাকানো অবস্থায় শরীরটা মেঝেতে সোজা ছড়িয়ে দিল গ্রেগর। শেষ সজ্ঞান দৃষ্টি দিয়ে সে তার ঘরের দরজা খুলে যেতে দেখল, দেখল তার মা ছুটে আসছেন তার চিৎকার করতে থাকা বোনের আগে আগে; মায়ের পরনে একটা শেমিজ, কারণ তিনি যখন জ্ঞান হারান তখন তাকে শ্বাস নিতে সাহায্য করার জন্য তার বোন তার পোশাক খুলে দিয়েছিল; সে দেখল তার বাবার দিকে দৌড়ে আসছেন তার মা, পেছনে মেঝেতে একটার পর একটা ছেড়ে আসছেন তার ঢিলে করে দেওয়া পেটিকোটগুলো; আর কেমন করে তিনি সেগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে নিজেকে ছুঁড়ে দিলেন তার বাবার গায়ের উপর, জড়িয়ে ধরলেন তাকে, পুরোপুরি এক হয়ে গেছেন তার সঙ্গে– কিন্তু এরই মধ্যে ঝাপসা হয়ে এসেছে গ্রেগরের দৃষ্টি –আর দুই হাত দিয়ে তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে মিনতি জানাচ্ছেন যেন গ্রেগরকে প্রাণে মারা না হয়।

৩.

গ্রেগরের সেই গুরুতর ক্ষত, এক মাসেরও বেশি যা তাকে নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়ে এসেছে– আপেলটা এখনো তার মাংসে গেঁথে আছে কোনো চাক্ষুষ স্মারক হয়ে, কারণ ওটা সরিয়ে নেওয়ার সাহস কারোরই নেই, এমনকি তার বাবাকেও যেন ভালোমতো বোঝালো যে তার এখনকার শোচনীয় ও ঘেন্না-জাগানো আকৃতি সত্ত্বেও সে এই পরিবারেরই একজন সদস্য, তাই তাকে শত্রু হিসেবে দেখাটা অনুচিত, বরং পারিবারিক দায়িত্ববোধের শর্ত মেনে তাদের উচিত তাদের ঘৃণার ভাবটা হজম করে যাওয়া, আর তাকে ধৈর্যের সঙ্গে, স্রেফ ধৈর্যের সঙ্গে, সহ্য করে যাওয়া।

অন্যদিকে এই ঘায়ের ফলে যদিও গ্রেগর সম্ভবত তার চলাফেরার ক্ষমতা চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলেছে –আজকাল এই ঘরের মধ্যে চলতে ফিরতে তার অথর্ব বুড়োদের মতো কষ্টকর লম্বা সময় লেগে যায়, আর দেয়াল ও ছাদে আগের মতো বুকে ভর দিয়ে হাটার তো কোনো প্রশ্নই আসে না–, তবু তার মনে হলো সে তার এই অবস্থার পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পেয়ে গেছে: প্রতিদিন সন্ধ্যায় বৈঠকখানার দরজা, যেটার দিকে এক-দুই ঘণ্টা আগে থেকেই সে তাকিয়ে থাকে গভীর মনোযোগে, খুলে দেওয়া হয় যেন সে তার ঘরের অন্ধকারের মধ্যে শুয়ে –বৈঠকখানা থেকে তাকে দেখা যায় না– দেখতে পায় পুরো পরিবারটাকে, তারা বসে আছে বাতি-জ্বালানো টেবিলটা ঘিরে, আর সে শোনে তাদের কথাবার্তা, সবার সাধারণ সম্মতি নিয়েই যেন; অন্য কথায়, আগের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিস্থিতি।

সত্য যে এসব আলাপ-আলোচনা আর আগের দিনের মতো প্রাণবন্ত না, তার মনে আছে সে সব সময় ওগুলোর কল্পনা করত যখন তাকে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে শুয়ে পড়তে হতো কোনো সস্তা ছোট হোটেলঘরের স্যাঁতসেঁতে বিছানায়। এখন বেশির ভাগ সময়ই সবকিছু খুব চুপচাপ। রাতের খাবারের পরই তার বাবা ঘুমিয়ে পড়েন আরামকেদারায়; তার মা ও বোন একজন আরেকজনকে সাবধান করে চুপ থাকার জন্য; তার মা, একেবারে বাতির নিচের দিকে ঝুঁকে, কোনো একটা সুন্দর অন্তর্বাস সেলাই করতে থাকেন একটা ফ্যাশন দোকানের জন্য; তার বোন, যে কিনা সেলস্ গার্লের চাকরি নিয়েছে, নিজের অবস্থার ভবিষ্যৎ উন্নতির আশায় সন্ধ্যারাত থেকে শিখতে থাকে শর্টহ্যান্ড আর ফরাসি ভাষা। কখনো কখনো তার বাবা জেগে ওঠেন, তিনি যে এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলেন সে ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই নেই, ওভাবেই গ্রেগরের মাকে বলেন: “আজ আবার তুমি সেই একগাদা সেলাইয়ের কাজ নিয়ে বসেছ!’ আর সোজা আবার ডুবে যান ঘুমের মধ্যে, তখন দুই মহিলা নিজেদের মধ্যে হাসেন একটুখানি ক্লান্তির হাসি।

স্বেচ্ছাচারী একটা একরোখামি নিয়ে গ্রেগরের বাবা এমনকি ঘরেও তার পিয়নের পোশাকটা খুলতে রাজি হন না; তার ড্রেসিং গাউন দেখা যায় অলস ঝুলে আছে কাপড় রাখার হুকে, অন্যদিকে তিনি আরামকেদারায় ঘুমাচ্ছেন পুরোদস্তুর পোশাক-আশাক পরে, যেন বা যেকোনো মুহূর্তেই কাজে বেরিয়ে পড়ার জন্য তৈরি আর এমনকি ঘরে বসেও অপেক্ষায় আছেন তার বসের হুকুমের। এর ফলে, গ্রেগরের মা ও বোনের সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও, ইউনিফর্মটা– অবশ্য শুরুতেও যেটা পুরো আনকোরা ছিল না– তার চকচকে ভাব হারাতে শুরু করল; আজকাল গ্রেগর প্রায়ই পুরো সন্ধ্যা কাটিয়ে দেয় এই ইউনিফর্ম জ্যাকেটের দিকে তাকিয়ে, পুরোটা ভরে আছে দাগে দাগে আর স্থায়ীভাবে পালিশ-করা বোতামগুলো কিছুটা উজ্জ্বল, আর ওটার মধ্যে বুড়ো মানুষটা বসে আছেন খুব অস্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে কিন্তু একই সঙ্গে ঘুমাচ্ছেন শান্তিতে।

ঘড়িতে দশটার ঘণ্টা বাজতেই তার মা হালকা দু-একটা কথা বলে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন গ্রেগরের বাবাকে, তারপর তাকে বিছানায় যাওয়ার জন্য রাজি করাতে থাকেন, কারণ ওখানে তার একদমই ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না; ঘুমই তার সবচেয়ে বেশি দরকার যেহেতু ঠিক ভোর ছটায় তাকে কাজে বেরিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু সেই একই একরোখামি নিয়ে– ব্যাংকের পিয়ন হওয়ার পর থেকেই তার মধ্যে এটা চেপে বসেছে –তিনি সব সময় আরো বেশিক্ষণ আরামকেদারায় থাকার জন্য জেদ করে যান, যদিও এরপরই আবার ঘুমিয়ে পড়েন। এবার তাকে আরামকেদারা ছেড়ে বিছানায় যেতে রাজি করানোর কাজটা হয়ে পড়ে ভয়ংকর কষ্টকর। গ্রেগরের মা ও বোন যতই তাকে ছোটখাটো বকা দিয়ে অনুরোধ করুক না কেন, পুরো পনেরো মিনিট তিনি ধীরে ধীরে দোলাবেন তার মাথা, বন্ধ করে রাখবেন চোখ দুটো আর উঠতে রাজি হবেন না। গ্রেগরের মা তার জামার হাত ধরে টানতে থাকবেন, ফিসফিস করে মিষ্টি কথা বলবেন তার কানে, বোন হোমওয়ার্ক রেখে চলে আসবে মাকে সাহায্য করতে, কিন্তু তার পরও উনি পড়ে থাকবেন অসাড় হয়ে– বরঞ্চ আরো গভীরভাবে ডুবে যাবেন আরামকেদারার মধ্যে। যতক্ষণ না দুই মহিলা তার হাতের নিচ দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরছেন, চোখ খুলবেন না তিনি। এরপর দুজনের দিকে পালা করে তাকিয়ে আউড়ে যাবেন রোজকার কথাটা: ‘কী এক জীবনই না কাটাচ্ছি। এই হচ্ছে আমার বুড়ো বয়সের শান্তি। শেষমেশ দুই মহিলার উপর ভর দিয়ে তিনি উঠে দাঁড়াবেন অনেক কষ্টে, যেন তিনি নিজেই নিজের দুর্বহ বোঝা, দরজা পর্যন্ত শরীরটা ছেড়ে রাখবেন ও-দুজনের উপর, ওখানে পৌঁছে হাত নেড়ে বিদায় দেবেন তাদের আর এবার আগাবেন নিজে নিজে; তখন গ্রেগরের মা তার সেলাই আর বোন তার কলম ফেলে বাবার পেছন পেছন ফের ছুটে যাবেন আরো একটু সাহায্য করার জন্য।

এই হাড়ভাঙা খাটুনি আর ক্লান্তিতে ডোবা পরিবারে, একদম প্রয়োজনীয়টুকু বাদে কার সময় আছে গ্রেগরকে নিয়ে আর বেশি ভাবার? আস্তে আস্তে কমিয়ে আনা হয়েছে সংসারের খরচ; ঝি-টাকে শেষমেশ বিদায় করে দেওয়া হয়েছে; এখন এক বড়সড়, হাড় বের করা ঠিকে-ঝি, ঘন একঝক অগোছালো সাদা চুলে মাথা ভরা, রোজ সকাল ও সন্ধ্যায় আসে ভারী কাজগুলো করে দিতে; বাদবাকি সবকিছু তার মা-ই করেন সেলাইয়ের কাজের পাশাপাশি। এমনকি বেশকিছু পারিবারিক অলংকার– যেগুলো আগে নানা পার্টি আর উৎসবে তার মা ও বোন পরত দারুণ আনন্দ নিয়ে– বেঁচে দেয়া হলো; কত দাম পাওয়া গেছে তা নিয়ে কথাবার্তা শুনে এক সন্ধ্যায় সেটা জানতে পারল গ্রেগর। কিন্তু সব সময় আসল অভিযোগ এটাই যে, তারা ফ্ল্যাটটা ছেড়ে যেতে পারছে না –তাদের বর্তমান অবস্থার বিচারে এই ফ্ল্যাট তাদের জন্য বেশি বড় হয়ে যায়– কারণ গ্রেগরকে কী করে সরানো হবে তা মাথায় আসছে না তাদের। তবে গ্রেগর খুব ভালোমতোই দেখতে পাচ্ছে তাদের এই বাড়ি না-ছাড়ার পেছনে সেই একমাত্র কারণ না– বাতাস চলার জন্য কিছু ফুটো আছে এমন কোনো উপযুক্ত বাক্সে তো তাকে খুব সহজেই নেওয়া যায়; তাদের আসলে বরং যে-জিনিসটা ঠেকিয়ে রাখছে তা হলো তাদের চূড়ান্ত নিরাশার ভাব, এ রকম এক অনুভূতি যে, যে দুর্ভাগ্যের শিকার তারা হয়েছেন, তার সঙ্গে তাদের সব বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়-পরিজন কারো দুর্ভাগ্যেরই কোনো তুলনা চলে না। দরিদ্র লোকদের কাছ থেকে পৃথিবী যা-কিছু দাবি করে থাকে তার সবই তারা পূরণ করে যাচ্ছেন চরম সীমা অবধি: ব্যাংকের নিচের দিকের অফিসারদের জন্য তার বাবা বয়ে নিয়ে যান সকালের নাশতা, তার মা নিজেকে উৎসর্গ করেছেন অচেনা লোকজনের জন্য অন্তর্বাস বানানোর কাজে, তার বোন খদ্দেরদের হুকুম তামিল করতে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছে কাউন্টারের পেছনে; এর বেশি আর করার শক্তি এই পরিবারের নেই। গ্রেগরের পিঠের ব্যথাটা ফের তাকে পীড়া দিতে শুরু করে– যেন বা তার ঘাটা খুলে যায় আবার– যখনই তার মা ও বোন ফিরে আসে বাবাকে বিছানায় পৌঁছে দিয়ে, ওভাবেই ফেলে রাখে তাদের কাজ, চেয়ার দুটো টেনে নেয় কাছাকাছি আর ওখানে বসে থাকে একজন আরেকজনের গালে গাল ঠেকিয়ে; তারপর তা মা গ্রেগরের ঘরের দিকে দেখিয়ে বলেন: “গ্রেটি, ওই দরজাটা বন্ধ করে দাও, আর সে ফের ডুবে যায় অন্ধকারে, তখন হয়তো পাশের ঘরে ঐ দুই মহিলা তাদের চোখের পানি এক করে দিচ্ছেন কিংবা শুকিয়ে যাওয়া চোখে হয়তো তাকিয়ে আছেন টেবিলটার দিকে।

দিন আর রাতগুলো গ্রেগর পার করে দিতে লাগল প্রায় পুরো নিঘুম অবস্থায়। মাঝেমধ্যে সে ভাবে, পরের বার যখন দরজা খোলা হবে তখন সে আবার হাতে তুলে নেবে সংসারের যাবতীয় দায়ভার, ঠিক সেই পুরোনো দিনের মতো; আবার একবার, এক দীর্ঘ বিরতির পর, তার ভাবনার মধ্যে আসে তার অফিসের বস্ ও প্রধান কেরানি, ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যান ও শিক্ষানবিশরা, অসম্ভব বোকা সেই পিয়ন ছেলেটা, অন্য কোম্পানির দু তিনজন বন্ধু, মফস্বলের এক হোটেলের এক পরিচারিকা– এক মধুর ও ক্ষণস্থায়ী স্মৃতি, একটা হ্যাঁটের দোকানের এক ক্যাশিয়ার মেয়ে, যার অনুরাগের জবাব সে দিয়েছিল মন থেকেই কিন্তু একটু বেশি গা-ছাড়া ভাবে– এরা সবাই তার সামনে হাজির হয় অচেনা লোকজন কিংবা এরই মধ্যে ভুলে যাওয়া লোকজনের সঙ্গে মিলে, কিন্তু তাকে ও তার । পরিবারকে কোনো সাহায্য করে না এরা, রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে; তাই গ্রেগর খুশিই হয় যখন অদৃশ্য হয়ে যায় এসব লোকজন। এ ছাড়া অন্য সময়গুলোতে পরিবারকে নিয়ে চিন্তা করার মতো মানসিক অবস্থা তার মোটেই থাকে না, কত বিশ্রীভাবে তার যত্ন নেওয়া হচ্ছে তা দেখে স্রেফ ক্রোধে ভরে ওঠে তার মন; যদিও তার ক্ষুধা জাগাতে পারে এমন কোনো খাবারের কথা তার মাথায় আসে না, তবুও যে করেই হোক ভাড়ার ঘরে গিয়ে তার জন্য বরাদ্দ করা খাবারটুকু– যদি সে ক্ষুধার্ত নাও থাকে তবুও– আদায় করে নেওয়ার পরিকল্পনা এঁটে চলে গ্রেগর। আজকাল গ্রেগরের পছন্দ-অপছন্দ কোনো রকম বিবেচনা না করেই তার বোন সকালে ও দুপুরে কাজে দৌড়ানোর সময় পা দিয়ে গ্রেগরের ঘরে যেকোনো বাসি-পচা খাবার ঢুকিয়ে চলে যায়; তারপর সন্ধ্যাবেলা, খাবারটা সে একটুও চেখে দেখেছিল নাকি ছোঁয়ইনি– সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য ঘন ঘন এমনটাই ঘটতে লাগল, সেসব কোনো রকম গ্রাহ্যের মধ্যে না এনে, ঝাটার এক বাড়ি দিয়ে তার বোন। খাবারটা ঠেলে নিয়ে যায়। গ্রেগরের ঘর সাফ করার কাজটা, যা এখন সে সব সময় সন্ধ্যাবেলায় করে, এর থেকে তড়িঘড়ি আর করা সম্ভব নয়। দেয়ালের গায়ে ধুলো-ময়লার আঁকাবাঁকা দাগ হয়ে আছে, এখানে-সেখানে পড়ে আছে ময়লার দলা। এই আচরণের শুরুতে তার বোন যখন ঘরে ঢুকত, তখন ঘরের ভেতর গ্রেগর এমন কোনো কোনায় গিয়ে দাঁড়াত যেখানে নোংরা ময়লা পড়ে আছে বেশি বেশি। এর মাধ্যমে বোনের প্রতি একধরনের তিরস্কার করাটাই ছিল তার উদ্দেশ্য। কিন্তু সে দেখল, যদি সে ওখানে সপ্তাহের পর সপ্তাহও বসে থাকে, তবু তার বোনের আচরণে কোনো পরিবর্তন আসবে না; ওসব নোংরা-ময়লা সে যেমন দেখতে পাচ্ছে, তার বোনও নিশ্চয়ই তেমনি দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু মেয়েটা সাফ সাফ মনস্থির করে রেখেছে ওই নোংরা-ময়লা ওভাবেই ফেলে রাখার। একই সঙ্গে তার বোন আবার এ ব্যাপারেও একরোখা যে –তা আবার এমন এক অভিমানী ঢঙে যা তার নিজের কাছেই নতুন আর যা আসলে পুরো পরিবারের ওপরই প্রভাব ফেলছে– গ্রেগরের ঘর সাফ করার কাজটা স্রেফ তার একার এখতিয়ারেই থাকবে। একদিন গ্রেগরের মা ঠিক করলেন ঘরটা পুরোদস্তুর সাফ-সুতরো করবেন, স্রেফ কয়েক বালতি পানি ঢেলে তিনি ভাবলেন কাজটা করা হয়েও গেল বটে –তবে এই সঁতসেঁতে ভাবটাতে মহা বিরক্ত হলো গ্রেগর, সোফার উপর সে শুয়ে থাকল রাগে মুখ ভার করে আর স্থির হয়ে– কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষা পেতে তার মায়ের খুব দেরি হলো না। সেই সন্ধ্যায়ই গ্রেগরের বোনের চোখে পড়ল ঘরের এই পরিবর্তন, সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড খেপে রাগে সে ছুটে গেল বসার ঘরে, আর তার মা দুই হাত উঁচু করে মিনতি করা সত্ত্বেও ফেটে পড়ল ফোঁপানিতে, তখন তার বাবা-মা দুজনেই– স্বাভাবিক, তার বাবা চমকে উঠে বসেছেন আরামকেদারাটায়– প্রথমে অসহায় বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন তার বোনের দিকে, তারপর তারাও শুরু করলেন উত্তেজিত হওয়া; তার বাবা ডানদিকে দাঁড়ানো মাকে গালমন্দ করতে লাগলেন যে কেন। তিনি গ্রেগরের ঘর সাফ করার কাজটা ওর বোনের ওপরেই ছেড়ে দেননি; আর ওদিকে বায়ে দাঁড়ানো বোনটার উদ্দেশেও চেঁচিয়ে বললেন, তাকে আর কখনোই গ্রেগরের ঘর সাফ করতে দেওয়া হবে না; এরই মধ্যে গ্রেগরের মা শোবার ঘরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছেন তার রাগে-প্রায়-দিশেহারা বাবাকে; গ্রেগরের বোন, ফেঁপাচ্ছে কেঁপে কেঁপে আর ছোট মুঠো দুটো দিয়ে বাড়ি মারছে টেবিলে; সেই সময় ভীষণ চটে গিয়ে জোরে হিস্ হিস্ আওয়াজ করে উঠল গ্রেগর কারণ এদের কারো মাথায়ই দরজা একটু বন্ধ করে দেওয়ার, আর এই দৃশ্য, এই হইচই থেকে তাকে রেহাই দেওয়ার কথাটা আসেনি।

যদিও তার বোন আগের মতো যত্ন করে গ্রেগরের দেখাশোনা করছে না– তার প্রতিদিনের চাকরি তাকে একেবারে ক্লান্ত করে ফেলেছে, তাই বলে এমনটা তো কথা হয় না যে, গ্রেগরের অবহেলা না হওয়ার ভার তার মাকে নিতে হবে, ওনাকে নিজেই সব কাজ করতে হবে। কারণ এখন সেই ঠিকে ঝিটা তো রয়েছে। এই বয়স্কা বিধবা, শরীরের শক্ত হাড় ওঠা কাঠামোটা যাকে নিশ্চিত দীর্ঘজীবনের বিশ্রী সব ঝড়-ঝাঁপটা পেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে, গ্রেগরকে দেখে সত্যিই কোনো ঘেন্না বোধ করে না। বিশেষ কোনো কৌতূহল ছাড়াই সে একদিন ঘটনাক্রমে তার ঘরের দরজা খুলে ফেলল, আর গ্রেগরকে দেখে– যদিও তাকে কেউ তাড়াচ্ছে না তবুও পুরোপুরি বিস্মিত হয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিল গ্রেগর– হাত দুটো সামনে ভাজ করে সে শুধু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সেখানেই। তারপর থেকে রোজ সকালে ও সন্ধ্যায় দরজা সামান্য ফাঁক করে গ্রেগরকে একনজর দেখে নিতে সে ভোলে না কখনোই। প্রথমদিকে সে গ্রেগরকে কাছে ডাকত পর্যন্ত, এমন সব কথা বলে ডাকত যা স্নেহ-ভালোবাসারই ইঙ্গিত, যেমন: ‘এদিকে আসো তো দেখি, আমার বুড়ো গুবরে পোকা!’ কিংবা ‘দেখো, এখন আমাদের বুড়ো গুবরেটাকে দেখো!’ এমনতরো সম্ভাষণের গ্রেগর কোনো জবাব দিত না, যেখানে আছে সেখানেই নিথর পড়ে থাকত সে, যেন দরজা আদৌ খোলাই হয়নি। শুধু যদি এই ঠিকে-ঝিটাকে যখন মন চাচ্ছে তখনই তাকে এ রকম অর্থহীন জ্বালাতন করতে দেওয়ার বদলে তার ঘরটা রোজ ঝাড়-মোছা করার আদেশ দেওয়া হতো! একদিন, খুব ভোরে –জোর বৃষ্টির ঝাঁপটা এসে পড়ছিল জানালার শার্সিতে, খুব সম্ভব বসন্ত যে আসছে তারই ইঙ্গিত –যখন ঠিকে-ঝি আবার তার সেই গল্বধা কথাগুলো আওড়াতে শুরু করেছে, গ্রেগর এত বেশি খেপে উঠল যে সে ছুটে গেল তার দিকে, যেন তাকে আক্রমণ করতে চায়, তবে তার গতি ছিল ধীর আর খুব নিস্তেজ। কিন্তু ভয় পাওয়ার বদলে বরং ঠিকে-ঝি দরজার পাশে পড়ে থাকা চেয়ারটা তুলে ধরল অনেক উঁচুতে, আর মুখ হাঁ করে যখন সে ওখানে দাঁড়িয়ে রইল তখন এটা স্পষ্ট হয়ে উঠল, ওই মুখ বন্ধ করার কোনো ইচ্ছে তার ততক্ষণ পর্যন্ত নেই যতক্ষণ না হাতের চেয়ারটা ভেঙেচুরে পড়ছে গ্রেগরের পিঠে। তাহলে, আর তো কাছে আসছিস না, না কি? গ্রেগর উল্টো ঘুরতেই সে জিজ্ঞাসা করল, তারপর চেয়ারটা আস্তে ফের নামিয়ে রাখল কোনায়।

আজকাল বাস্তবে গ্রেগর প্রায় কিছুই খায় না। শুধু যখন তার জন্য রাখা খাবারের পাশ দিয়ে ধরা যাক সে হেঁটে যাচ্ছে, তখন হয়তো স্রেফ মজা করতেই একটা কামড় বসায় ওতে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুখেই রেখে দেয় ওটা, আর বেশির ভাগ সময়ই থু করে ফেলে দেয় আবার। প্রথমদিকে সে ভাবত, তার ঘরের অবস্থা দেখে মন খারাপ থাকার কারণেই বুঝি সে খেতে পারছে না, কিন্তু আসলে এর পেছনে ঘরটার ইদানীংকার পরিবর্তনগুলোই দায়ী, যদিও ওসবের সঙ্গে খুব দ্রুতই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে সে। আজকাল পরিবারের সবার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন সব মালপত্র এ ঘরে ভরে রাখা যেগুলো অন্য কোথাও রাখার জায়গা মিলছে না, আর এ ধরনের মালপত্রেরও কমতি নেই কোনো, কারণ ফ্ল্যাটের একটা ঘর ভাড়া দেওয়া হয়েছে তিন ভদ্রলোকের কাছে। এই গম্ভীর তিন ভদ্রলোক– তিনজনেরই দাড়ি আছে, গ্রেগর একদিন দেখেছে দরজার ফাঁক দিয়ে– পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে, আর তা যে শুধু তাদের নিজেদের ঘরের বেলায় তা ই না, সেই সঙ্গে– যেহেতু এখন তারা এখানে এ বাড়িরই সদস্যের মতো আছেন– পুরো বাড়িরই, বিশেষ করে রান্নাঘরের। সামান্য কোনো ফেলে দেওয়া বাতিল জিনিসই, আর তা নোংরা হলে তো কথাই নেই, তারা বরদাশত করতে পারেন না। তাদের নিজেদের সংসারের অধিকাংশ জিনিসই তারা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। ফলে অসংখ্য জিনিস বাড়তি হয়ে গেছে– সেগুলো বিক্রি করার মতো না বটে, তবু ফেলেও তো দেওয়া যায় না। এ ধরনের সমস্ত জিনিসই ঠাই পেল গ্রেগরের ঘরে। আর ওভাবেই, রান্নাঘর থেকে ছাইয়ের বালতি আর আবর্জনা ফেলার টুকরিটাও। এখন কাজে লাগছে না এমন যেকোনো কিছুই ঠিকে-ঝিটা, যে সব সময়ই আছে প্রচণ্ড তাড়ার মধ্যে, ছুঁড়ে দেয় গ্রেগরের ঘরে; ভাগ্য ভালোই বলতে হয় যে তাকে সাধারণত শুধু ছুঁড়ে দেওয়া ঐ জিনিস আর ওটা ধরে রাখা ঝিয়ের হাত ছাড়া অন্য কিছু দেখতে হয় না। হতে পারে সময়-সুযোগমতো মালপত্রগুলো আবার সরিয়ে নেওয়ার কিংবা সবগুলো একসঙ্গে ধরে বাইরে ফেলে দেওয়ার ইচ্ছে ঠিকে ঝিটার আছে; কিন্তু বাস্তবে ওগুলো ঠিক যেখানে শুরুতে রাখা হয় সেখানেই পড়ে থাকে; এর একমাত্র ব্যতিক্রম ঘটে তখন যখন গ্রেগর আবর্জনার স্তূপের মধ্য দিয়ে ঠেলে ঠেলে চলে আর ওগুলো নড়েচড়ে যায়; প্রথমদিকে প্রয়োজনের তাগিদেই এমনটা করত গ্রেগর, কারণ চলাফেরার জন্য আর কোনো খোলা জায়গাই রইল না তার, কিন্তু পরে সে তা করতে লাগল নিয়মিত বেড়ে চলা আনন্দের সঙ্গে, যদিও ওই অভিযানগুলোর পর তাকে নিশ্চল শুয়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ক্লান্তিতে মৃতপ্রায় আর শোচনীয় অবস্থায়।

যেহেতু এই ভাড়াটেরা প্রায়ই তাদের রাতের খাওয়াটাও বাড়িতে সারেন– সবাই ব্যবহার করে যে বসার ঘরটা, সেখানেই– তাই সেই সন্ধ্যাগুলোতে বন্ধ রাখা হয় বসার ঘরের দিকের দরজা; তবে দরজা বন্ধ আছে বলে কোনো কষ্টবোধ করে না গ্রেগর; সত্যি বলতে, এরই মধ্যে অসংখ্যবার এমন হয়েছে যে ওটা সন্ধ্যায় খুলে দেওয়া হয়েছে কিন্তু তাতে গ্রেগরের কিছুই যায় আসেনি, বরং সে পরিবারের সবার চোখের আড়ালে শুয়ে থেকেছে তার ঘরের সবচেয়ে অন্ধকার কোনো কোনায়। কিন্তু একদিন তাদের ঠিকে-ঝি বসার ঘরের দিকের দরজা সামান্য খোলা রেখে চলে গেল, আর এমনকি ভাড়াটেরা সন্ধ্যাবেলায় যখন ওই ঘরে গিয়ে বসলেন, বাতি জ্বালালেন, তখনো ভোলাই রয়ে গেল দরজাটা। তারা বসলেন টেবিলের মাথার দিকে, যেখানে আগে গ্রেগরের বাবা-মা ও গ্রেগর বসত, তারপর ন্যাপকিনের ভাজ খুলে হাতে তুলে নিলেন ছুরি ও কাঁটা চামচ। একটু পরই তার মা দরজার মুখে হাজির হলেন একটা মাংসের বাটি নিয়ে, ঠিক পেছনেই তার বোন, হাতে ধরা একটা উঁচু করে বোঝাই আলুর বাটি। খাবার থেকে উঠছে ঘন ধোঁয়া। ভাড়াটেরা সামনে রাখা বাটির উপরে ঝুঁকলেন, যেন খাওয়া শুরু করার আগে ওগুলো তারা পরীক্ষা করে নিতে চাচ্ছেন, আর সত্যিই মাঝখানে বসা লোকটা –যাকে দেখতে অন্য দুজনের বস্ বলে মনে হয় –বাটিতে রাখা অবস্থায়ই এক টুকরো মাংস কাটলেন, স্পষ্টই তিনি দেখে নিতে চাচ্ছেন ওটা যথেষ্ট নরম হয়েছে না কি আসলে রান্নাঘরে ফেরত পাঠানো উচিত। তিনি সন্তুষ্ট হলেন, আর মা ও বোন দুজনেই– যারা শঙ্কাকুল হয়ে লক্ষ করছিল।– আবার সহজ শ্বাস ফেলে হাসতে লাগল।

গ্রেগরের পরিবারের লোকজন আজকাল রান্নাঘরে সারে তাদের খাওয়াদাওয়া। তার পরও, রান্নাঘরে যাওয়ার আগে গ্রেগরের বাবা একটু বসার ঘরে এলেন আর টুপিটা হাতে নিয়ে, মাথা নিচু করে লম্বা সালাম জানিয়ে, টেবিলের চারপাশে ঘুরলেন একবার। ভাড়াটেরা তিনজনই একসঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন, দেখতে মনে হলো তারা একটা মাত্র মানুষ, আর তাদের দাড়ির আড়ালে বিড়বিড় করে বললেন কিছু একটা। ফের যখন আর অন্য কেউ নেই, তারা খাওয়া শুরু করলেন একদম চুপচাপ। গ্রেগরের কাছে অদ্ভুত বলে মনে হলো যে, খাওয়ার নানা রকম শব্দের মধ্যে বিরামহীনভাবে তার কানে আসছে দাঁত দিয়ে চিবানোর শব্দটা, যেন তারা গ্রেগরকে দেখাতে চাচ্ছেন যে খাওয়ার জন্য দাঁত লাগে আর সবচেয়ে সুন্দর চোয়ালও যদি দাঁতহীন হয়, তাহলে কোনো কাজে আসে না। অনেক খিদে আছে আমার, দুঃখ করে নিজেকে বলল গ্রেগর, কিন্তু ওই সব খাওয়ার জন্য নয়। এই ভাড়াটেগুলো কী রকম গিলে চলেছে, আর আমি কি না শুকিয়ে মরছি!’

সেদিনই সন্ধ্যায়– এত দিনে একবারও কখনো বেহালা শুনেছে কি না মনে করতে পারল না গ্রেগর– রান্নাঘরের দিক থেকে ভেসে এল বেহালার সুর। এরই মধ্যে ভাড়াটেদের খাওয়া শেষ হয়েছে, মাঝখানের জন একটা খবরের কাগজ বের করেছেন আর অন্য দুজনকে দিয়েছেন তার একটা করে পাতা; আর এবার তারা চেয়ারে হেলান দিয়ে পড়ছেন আর ধূমপান করে যাচ্ছেন। এবার বেহালা যখন বাজানো শুরু হলো, তারা কান খাড়া করলেন, উঠে দাঁড়ালেন, পা টিপে টিপে গেলেন হলঘরের দরজার ওখানটায়, ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলেন একজোট হয়ে। রান্নাঘর থেকে নিশ্চয় তাদের আওয়াজ টের পাওয়া গেছে, কারণ গ্রেগরের বাবা ডেকে উঠলেন: আপনারা কি বেহালাতে বিরক্ত হচ্ছেন। জনাব? চাইলে এক্ষুনি থামিয়ে দেব। বরং উল্টোটাই’, মাঝখানের ভাড়াটে জবাব দিলেন, ‘আপনার মেয়ে কি এখানে, বসার ঘরে এসে বাজাতে পারে না, এখানে তো কত খোলামেলা আর আরাম আছে? ওহ্, সে তো খুশির কথা, চিৎকার করে বললেন তার বাবা, যেন তিনিই বেহালাবাদক। ভাড়াটেরা বসার ঘরে ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তাদের পেছন পেছন এসে ঢুকলেন গ্রেগরের বাবা, হাতে মিউজিক-স্ট্যান্ড; তার মা, হাতে স্বরলিপির খাতা; আর তার বোন, সঙ্গে বেহালা। বাজানোর জন্য চুপচাপ সবকিছু সাজিয়ে নিল তার বোন; তার বাবা-মা –যারা আগে কখনো ঘর ভাড়া দেননি বলে ভাড়াটেদের সঙ্গে অতিরিক্ত বিনয়ী ব্যবহার করছেন –এমনকি নিজেদের চেয়ারে বসারও সাহস করে উঠতে পারছেন না; দরজার গায়ে হেলান দিয়ে আছেন তার বাবা, পরনে বোতাম-আঁটা ইউনিফর্মের জ্যাকেট, তার ডান হাত দুই বোতামের মধ্য দিয়ে ঢোকানো; তার মাকে, যাক, একজন ভদ্রলোক একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন, আর যেখানে তিনি চেয়ারটা রাখলেন তার মা বসে পড়লেন ঠিক সেখানেই, একটা কোনার মধ্যে ঠেসে।

বাজাতে শুরু করল গ্রেগরের বোন; তার বাবা ও মা, বোনের দুই পাশ থেকে, মন দিয়ে লক্ষ করছেন তাদের মেয়ের হাতের নড়াচড়া। গ্রেগর, বাজনার সুরে আকৃষ্ট হয়ে, সাহস করে খানিকটা সামনে এগিয়ে এল, এরই মধ্যে তার মাথাটা ঢুকে পড়েছে বসার ঘরে। আজকাল যে অন্যের প্রতি তার বিবেচনাবোধ অনেক কমে এসেছে, সেটা তাকে খুব একটা বিচলিত করে না; যদিও আগে নিজের এই বিবেচনাবোধ নিয়ে গর্ব হতো তার। এখন তো তার আগের চেয়েও বেশিই লুকিয়ে থাকা উচিত, কারণ তার ঘরে পুরু হয়ে থাকা ঐসব ধুলোময়লায় –যা কিনা সামান্য নড়াচড়ায় ওড়াউড়ি শুরু করে দেয় –সে নিজেও পুরো মুড়ে আছে নোংরা হয়ে; তার পিঠ ও শরীরের দুই পাশে সে আজকাল বয়ে নিয়ে চলে সুতো-ন্যাতা, চুল আর খাবারের উচ্ছিষ্ট; সবকিছুতে তার উদাসীনতা এতই বেড়ে গেছে যে চিৎ হয়ে শরীরটা ঘষে খানিক সাফসুতরো হতে আর ইচ্ছে হয় না তার, যেমনটা একসময় সে দিনে বহুবার করত। নিজের এই হাল সত্ত্বেও ধীরে বসার ঘরের তকতকে মেঝের দিকে একটু এগিয়ে যেতে কোনো রকম লজ্জা বোধ করল না সে।

নিশ্চিত, কেউই তাকে খেয়াল করল না। পরিবারের সবাই পুরো ঝুঁদ হয়ে আছে বেহালার সুরে; তবে ভাড়াটে তিনজন, প্রথমে যারা পকেটের মধ্যে দুই হাত ঢুকিয়ে তার বোনের মিউজিক-স্ট্যান্তের পেছনে জড়ো হয়েছিলেন –এতই কাছে চলে এসেছিলেন যে স্বরলিপিগুলো পর্যন্ত পড়তে পারছিলেন, আর নিশ্চিত তার বোন বিরক্ত হচ্ছিল এতে– একটু পরে তারা চলে গেলেন জানালার কাছে, মাথা নিচু করে নিজেদের মধ্যে বিড়বিড় করে কিছু বলতে লাগলেন, আর ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলেন; ওদিকে গ্রেগরের বাবা তখন চিন্তিত মুখে দেখতে লাগলেন তাদের। এটা এখন খুবই পরিষ্কার যে, চমৎকার কিংবা উপভোগ্য কোনো বেহালা শোনার আশাটা তাদের পূরণ হয়নি; এটা বাজানো তাদের যথেষ্টই শোনা হয়ে গেছে, এখন তারা স্রেফ ভদ্রতার খাতিরেই সহ্য করে যাচ্ছেন শান্তি নষ্ট করা এই অত্যাচার। বিশেষ করে, যেভাবে তারা নাক ও মুখ দিয়ে ছাদের দিকে সিগারের ধোঁয়া ছুঁড়ে দিচ্ছেন, তা চরম বিরক্তিরই ইঙ্গিত। কিন্তু তার পরও কত সুন্দরভাবে বাজিয়ে চলেছে তার বোন। তার মুখটা একদিকে হেলানো, আর সন্ধানী ও বিষণ্ণ এক দৃষ্টি নিয়ে তার চোখ দুটো অনুসরণ করে যাচ্ছে স্বরলিপি। হামা দিয়ে আরেকটু সামনে এগোল গ্রেগর, মাথাটা সে মেঝের সঙ্গে চেপে রেখেছে, যাতে বোনের সঙ্গে তার চোখাচোখি সম্ভব হয়। সংগীত যদি তার মনকে এভাবে নাড়া দেয়, তাহলে কী করে হয় যে সে একটা পশু? তার মনে হলো সেই অজানা খাদ্য, যা সে এতদিন ধরে খুঁজে আসছিল, সেটার দিকে যাওয়ার পথ বুঝি আজ খুলে গেছে। গ্রেগর পণ করল তার বোনের কাছে সে পৌঁছাবেই, তার স্কার্ট ধরে টান দেবে আর অমনি করেই তাকে বুঝিয়ে দেবে, তার উচিত বেহালাটা সঙ্গে নিয়ে গ্রেগরের ঘরে চলে আসা, কারণ এখানে উপস্থিত কেউই তার বেহালা শোনার যোগ্য নয়, যতখানি যোগ্য সে। তারপর গ্রেগর তাকে আর কখনোই ঘরটা থেকে বেরোতে দেবে না, অন্তত যত দিন সে বেঁচে আছে তত দিন তো নয়ই; হ্যাঁ, এই প্রথমবারের মতো শরীরের ভয়ংকর আকৃতিটা তার কোনো কাজে আসবে; তার ঘরের সবগুলো দরজায় একযোগে সে দাঁড়িয়ে যাবে, হিহিস্ শব্দ তুলবে আর থুতু ছিটাবে সব অনধিকার প্রবেশকারীদের দিকে; তবে বোনকে তার সঙ্গে থাকার ব্যাপারে কোনো জোর খাটানো উচিত হবে না, থাকলে সে তার নিজের ইচ্ছাতেই থাকবে; সোফাতে সে বসবে গ্রেগরের পাশে, তার মুখের কাছে ঝুঁকে নামিয়ে আনবে কান, তারপর গ্রেগর তাকে জানাবে গোপন কথাটা– তাকে সংগীত বিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যাপারে সে জোর সংকল্প করেছে, শুধু এই দুর্ভাগ্যটা যদি মাঝপথে এসে বাধা না দিত তাহলে কবেই গত ক্রিসমাসে– নিশ্চয়ই ক্রিসমাস এত দিনে পার হয়ে গেছে, না কি?– সে সবার উদ্দেশে ঘোষণা করত এটা, কারো আপত্তিতে কোনো রকম ভ্রূক্ষেপ না করেই। এই কথা শুনে তার বোন এতই অভিভূত হয়ে পড়বে যে সে ভেঙে পড়বে কান্নায়, তখন গ্রেগর শরীরটা বোনের কাঁধ পর্যন্ত তুলবে, চুমু খাবে তার গলায়, যা এখন সে বাইরে কাজ করে বলেই আর কোনো ফিতা বা কলার দিয়ে ঢাকা থাকে না।

‘সামসা সাহেব!’ মাঝখানের ভাড়াটে চেঁচিয়ে উঠলেন গ্রেগরের বাবার উদ্দেশে, এবং আর কোনো শব্দ খরচ না করে তর্জনী তুলে দেখালেন ধীরে এগিয়ে আসতে থাকা গ্রেগরকে। বেহালা থেমে গেল, মাঝখানের ভাড়াটে প্রথমে তার মাথা ঝাঁকিয়ে মুচকি হাসলেন বন্ধুদের উদ্দেশে আর তারপর আবার তাকালেন গ্রেগরের দিকে। গ্রেগরকে তাড়িয়ে বের করার বদলে বরং ভাড়াটেদের শান্ত করাই বেশি জরুরি মনে হলো তার বাবার কাছে, যদিও ওদের মোটেই বিক্ষুব্ধ দেখাচ্ছে না, বরং মনে হচ্ছে বেহালা-বাদনের চাইতে তারা গ্রেগরকেই উপভোগ করছেন বেশি। গ্রেগরের বাবা জলদি তাদের কাছে। এগিয়ে গেলেন, সামনে দুই হাত বাড়িয়ে চেষ্টা করলেন তাদের ঘরে যেতে রাজি করানোর আর একই সঙ্গে নিজের শরীর দিয়ে গ্রেগরকে তাদের দৃষ্টির আড়াল করে রাখার। এবার তারা সত্যি একটু রেগে উঠলেন –তবে এটা স্পষ্ট না যে তাদের এই রাগের পেছনে গ্রেগরের বাবার আচরণটা দায়ী নাকি এ মুহূর্তে তাদের মনে জাগতে থাকা এই উপলব্ধি যে, গ্রেগরের মতো অমন এক পাশের ঘরের পড়শি আছে তাদের আর তারা কিনা তা এদ্দিন জানতেনই না! গ্রেগরের বাবার কাছে তারা ব্যাখ্যা দাবি করলেন, তার মতো করে হাত দুটো উপরে তুলে তুলে; অস্বস্তি নিয়ে নিজেদের দাড়ি ধরে টানতে লাগলেন আর নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে নিজেদের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলেন। এতক্ষণে গ্রেগরের বোন জেগে উঠেছে তার আনমনা ভাবটা থেকে, তার বেহালা-বাদন অমন রূঢ়ভাবে বাধা। পাওয়ার পর যে ভাবটা ঘিরে ধরেছিল তাকে; বেহালা ও ছড়িটা এক মুহূর্ত নিজের ঝুলন্ত হাতে আলগা করে ধরে আর স্বরলিপির দিকে একটু তাকিয়ে, যেন সে বাজাচ্ছে এখনো, হঠাৎ সে উঠে পড়ল, বেহালাটা রাখল তার মায়ের কোলে– তিনি এখনো বসে আছেন চেয়ারে, হাঁপ উঠেছে বলে খুব কষ্ট করে শ্বাস নিতে চেষ্টা করছেন –আর একদৌড়ে গিয়ে ঢুকল ভাড়াটেদের ঘরে, গ্রেগরের বাবার তাড়া খেয়ে ভাড়াটেরা এখন যেটার দিকে আরো তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলেছেন। দেখা গেল, তার বোনের পাকা হাতের ছোঁয়ায় তাদের লেপ আর বালিশগুলো শূন্যে উঠে গিয়ে ফের সুন্দর সাজিয়ে পড়ল জায়গামতো। ভাড়াটেরা তাদের ঘরে পৌঁছাতেও পারেননি, এর আগেই তার বোন বিছানা গোছানো সেরে বেরিয়ে এল চুপচাপ। তার বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে নিজের একগুয়েমিতে তিনি এতখানি আচ্ছন্ন যে ভাড়াটিয়াদের প্রাপ্য সামান্য সম্মানটুকু দেখাতেও তিনি পুরোপুরি ভুলে গেছেন। তাদের তিনি ঠেলছেন তো ঠেলছেনই, যতক্ষণ না ঠিক শোবার ঘরের দরজায় পৌঁছে মাঝখানের ভাড়াটে প্রচণ্ড জোরে এক পা মেঝেতে ঠুকে তাকে থামালেন। এই আমি আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিলাম যে, তিনি বললেন, হাত উঁচুতে তুলে আর গ্রেগরের মা ও বোনকেও যেন দেখতে পান সে জন্য চোখটা চারপাশে ঘুরিয়ে, ‘এ বাড়ি আর এই পরিবারে বিদ্যমান জঘন্য অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে’ –এ পর্যায়ে তিনি উত্তেজিতভাবে থুতু ফেললেন মেঝের উপর– ‘এখনই আমি ঘর ছাড়ার নোটিশ দিচ্ছি। খুব স্বাভাবিক, এই যে কদিন এখানে থাকলাম তার জন্য একটা পয়সাও আমি দেব না; বরং উল্টো আপনাদের বিরুদ্ধে কোনো ক্ষতিপূরণের অভিযোগ আনব কি না, তা আমি ভেবে দেখব, যা প্রমাণ করা– নিশ্চিত থাকতে পারেন– একদমই কোনো কঠিন কাজ হবে না।’ তিনি থামলেন, সোজা সামনের হদিকে তাকালেন, যেন কোনো একটা কিছুর আশা করছেন। আর সত্যিই, তার দুই বন্ধু চটপট এই কথার সুরে তাল মেলালেন: “আমরাও এই এক্ষুনি, আমাদের নোটিশও দিয়ে দিলাম। এর পরই তিনি দরজার হাতলটা ধরে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

গ্রেগরের বাবা টলমলে পায়ে, হাত দিয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে তার আরামকেদারার কাছে গেলেন আর ভেঙে পড়লেন ওটার উপর; দেখে লাগছে তিনি যেন তার রোজকার সন্ধ্যার ঘুমে গা এলিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তার মাথার ভয়ংকর দুলুনি দেখে– যেন তা পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে– বোঝা যাচ্ছে তিনি জেগে রয়েছেন। এতক্ষণ ধরে গ্রেগর ঠিক সে জায়গাতেই নিথর পড়ে আছে যেখানে তাকে প্রথম দেখেছিলেন ভাড়াটেরা। তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার দুঃখ আর সম্ভবত দীর্ঘদিন উপোস থাকার ফলে দুর্বলতা– দুয়ে মিলে তার পক্ষে নড়াচড়া করাটা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। সে এখন মোটামুটি নিশ্চিত এক আতঙ্কের মধ্যে আছে যে এই এক্ষুনি সবকিছু দল বেঁধে ভেঙেচুরে পড়বে তার মাথার উপর, আর সেটারই অপেক্ষা করতে লাগল সে। এমনকি বেহালাটা যখন তার মায়ের কাঁপতে থাকা আঙুল থেকে পিছলে কোল থেকে মেঝেতে গিয়ে পড়ল, তখনো একটুও নড়ে উঠল না গ্রেগর ।

‘প্রিয় বাবা, মা,’ বলল তার বোন, হাতটা টেবিলের উপর চাপড়াল তার কথার ভূমিকা হিসেবে, এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। মনে হচ্ছে, আপনারা বুঝতে পারছেন না, কিন্তু আমি পারছি। এই দৈত্যের সামনে আমার ভাইয়ের নাম উচ্চারণ করতে আমার মুখে বাধে, তাই আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই: এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা আমাদের করতেই হবে। এর দেখভাল মানুষের পক্ষে যেটুকু করা সম্ভব তা আমরা করেছি, একে সহ্য করে গেছি, আমি বিশ্বাস করি না আপনাদেরকে কেউ এ ব্যাপারে সামান্য কটু কথাও শোনাতে পারবে।

‘ওর কথা দশ গুণ সত্য’, আপন মনে বললেন গ্রেগরের বাবা। তার মা, যিনি এখনো শ্বাস নেওয়ার জন্য হাঁপাচ্ছেন, চোখে এক উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে একটা ফাঁপা শব্দ করে, মুখে হাত চেপে, কাশতে শুরু করলেন।

গ্রেগরের বোন মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে তার কপালে একটা হাত রাখল। মনে হচ্ছে। তার বোনের কথাগুলো শুনে গ্রেগরের বাবার চিন্তা-ভাবনা আগের থেকে পরিষ্কার হয়ে এসেছে; পিঠ সোজা করে বসে তিনি তার ইউনিফর্মের টুপিটা নিয়ে খেলা করছেন ভাড়াটেরা খেয়ে ওঠার পর থেকে এখনো টেবিলের উপর পড়ে থাকা প্লেটগুলোর ফাঁকে; আর থেকে থেকে তাকাচ্ছেন গ্রেগরের নিশ্চল মূর্তিটার দিকে।

‘আমাদের অবশ্যই একে বিদায় করার চেষ্টা করতে হবে’, বলল তার বোন, এবার শুধু তার বাবাকে লক্ষ করে, যেহেতু তার মা কাশির চোটে শুনতে পাচ্ছেন না একটা কথাও, আপনারা দুজনেই এর কারণে মারা পড়বেন, আমি সেটার আভাস দেখতে পাচ্ছি। আমাদের মতো যারা এত পরিশ্রম করে, কীভাবে তাদের পক্ষে সম্ভব ঘরেও এমন স্থায়ী অত্যাচার সহ্য করে যাওয়া? আমি অন্তত আর পারছি না। এই কথা বলে তার বোন এমন প্রচণ্ড কান্নায় ভেঙে পড়ল যে তার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল তার মায়ের মুখের উপরেও, যন্ত্রের মতো সে হাত দিয়ে মুছে দিল তা।

‘কিন্তু মা, দরদ আর স্বচ্ছ বোধশক্তি নিয়ে বললেন তার বাবা, ‘আমরা কী করতে পারি বলো?’

গ্রেগরের বোন শুধু কাঁধ ঝাঁকালো, তার আগের আত্মবিশ্বাসের উল্টো এ-এমনই এক অসহায়ত্বের প্রকাশ যেটা তার ওপর চেপে বসেছে কান্নার ঐ দমকের সময়।

‘যদি ও বুঝতে পারত যে আমরা কী বলছি,’ অর্ধেকটা প্রশ্নের মতো করে বললেন তার বাবা; কিন্তু সেটা কতখানি অসম্ভব এক ব্যাপার তা দেখাতে গ্রেগরের বোন– তখনো ফোঁপাচ্ছে– প্রবলভাবে তার হাত নাড়তে লাগল।

‘আহ্, যদি ও বুঝত যে আমরা কী বলছি, আবার বললেন বুড়ো লোকটা আর দু চোখ বন্ধ করে তার বোনের বিশ্বাসকেই মেনে নিলেন যে, তা ঘটা অসম্ভব, তাহলে মনে হয়, ওর সঙ্গে কোনো একটা দফারফায় আসতে পারতাম আমরা। কিন্তু যেমন দেখছি–’

‘ওকে যেতেই হবে, চিৎকার করল তার বোন, এটাই একমাত্র সমাধান বাবা। আমাদের শুধু এই ধারণাটা মুছে ফেলার চেষ্টা করতে হবে যে ও গ্রেগর। ওটাই আমাদের সত্যিকারের সর্বনাশ, এই যে আমরা এতদিন ধরে ওকে গ্রেগর বলে বিশ্বাস করে এসেছি। কিন্তু ও কী করে গ্রেগর হয়? যদি ও গ্রেগরই হতো, তাহলে অনেক আগেই বুঝত যে মানুষের পক্ষে ওরকম একটা জন্তুর সঙ্গে একসঙ্গে বাস করা অসম্ভব আর ও তার নিজের ইচ্ছেতেই বিদায় হতো। তখন আর আমাদের কোনো ভাই থাকত না, কিন্তু আমরা তো তার স্মৃতি সম্মানের সঙ্গে মনে রেখে স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারতাম। কিন্তু কী ঘটছে? এই জানোয়ারটা আমাদের হয়রান করে মারছে, আমাদের ভাড়াটেদের তাড়িয়ে দিচ্ছে, পরিষ্কার চাচ্ছে পুরো ফ্ল্যাট দখল করে নিয়ে আমাদের পথে বসাতে। দেখুন বাবা, হঠাৎ সে তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘আবার শুরু করেছে ও!’ আর ভয়ে দিশেহারা হয়ে– কেন, তা গ্রেগরের কাছে মোটেই বোধগম্য নয়– সে তার মায়ের পাশ থেকে উঠে গেল, চেয়ারের পেছনটা ধরে ওনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে লাগল, যেন গ্রেগরের কাছে থাকার চেয়ে বরং মাকে ফেলে দিতেও সে রাজি; তারপর ছুটে গেল তার বাবার পেছনে, যিনি নিজেও তার মেয়ের আচরণে খুব ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন আর মেয়েকে বাঁচানোর জন্যই যেন ওর সামনে নিজের দুই হাত অর্ধেক তুলে ধরেছেন।

কিন্তু গ্রেগরের সামান্য ইচ্ছাও নেই কাউকে ভয় দেখানোর, তার বোনকে তো নয়ই। ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য সে ঘুরাতে শুরু করল তার শরীর; মানতেই হবে, দেখার মতো এক দৃশ্য হলো তা, কারণ শারীরিক দুর্বলতার জন্য এই কষ্টকর কাজে তাকে তার মাথারও সাহায্য নিতে হচ্ছে, বারবার মাথা উপরে তুলে আর মেঝের সঙ্গে বাড়ি মেরে মেরে। সে থামল, তাকাল চারপাশে। তার সদিচ্ছাটা মনে হয় সবাই বুঝতে পারল; তাদের আতঙ্ক কেটে গেল একটু পরেই। এখন তারা সবাই নিঃশব্দে ও বিষণ্ণ চোখে তাকে দেখছে। দুই পা একসঙ্গে চেপে রেখে সামনে ছড়িয়ে দিয়ে তার মা শুয়ে আছেন চেয়ারটায়, ক্লান্তিতে প্রায় বুজে আসছে তার চোখ দুটো; তার বাবা ও বোন বসে আছে পাশাপাশি, বোনটা হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে বাবার গলা।

‘মনে হচ্ছে এখন আমার ঘুরতে কোনো অসুবিধা নেই, ভাবল গ্রেগর আর ফের শুরু করল তার চেষ্টা। কষ্টের চোটে একধরনের ফোঁসফোঁস শব্দ বেরোচ্ছে তার মুখ থেকে, ওটা সে চেপে রাখতে পারছে না, আর একটু পর পর জিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে সে। এমন না যে কেউ তাকে হয়রান করছে কোনোভাবে, পুরোপুরি তার নিজের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সব। ঘোরা শেষ হওয়া মাত্র, একটুও দেরি না করে, সে তার যাত্রা শুরু করল একটা সরলরেখায়। তার ও তার ঘরের মাঝখানের দূরত্বটা দেখে সে খুব অবাক হলো, তার মাথায় আসছে না যে কিছুক্ষণ আগে এই দুর্বল শরীর নিয়ে সে কীভাবে এতটা পথ পেরিয়েছিল, একদম টেরই পায়নি সে। সেফ জোরে বুকে ভর দিয়ে হেঁটে যাওয়া নিয়ে সে এতটাই মগ্ন যে তার খেয়ালই হলো না কেউ বা কোনো কিছুই তার এগিয়ে যাওয়াতে বাধা দিচ্ছে না –না একটা কোনো কথা, না তার পরিবারের কারো মুখ থেকে কোনো বিস্ময়ধ্বনি। কেবল ঘরের দরজার কাছে পৌঁছে যাওয়ার পরই সে ঘোরাল তার মাথা, অবশ্য পুরোটা না, কারণ সে টের পেল তার ঘাড়টা শক্ত হয়ে গেছে; কিন্তু যতটা ঘোরাল তা-ই এটুকু দেখার জন্য যথেষ্ট যে তার পেছনের সবকিছু– শুধু তার বোনটার উঠে দাঁড়ানো ছাড়া– আগের মতোই আছে। শেষ দেখল সে তার মাকে, এরই মধ্যে তিনি গভীর ঘুমে।

গ্রেগর তার ঘরে পুরো ঢুকতেও পারেনি, প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হলো দরজাটা, খিল তুলে লাগিয়ে দেওয়া হলো তালা। পেছনের এই আকস্মিক শব্দে গ্রেগর এতটাই চমকে গেল যে শরীরের নিচে অবশ হয়ে গেল তার পাগুলো। এই তাড়াহুড়াটা করেছে তার বোন। ওইখানে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে আর অপেক্ষা করছিল, তারপর সে লাফিয়ে এসেছে সামনের দিকে, গ্রেগর মোটেই শুনতে পায়নি তার এগিয়ে আসা; আর তালায় চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে সে চিৎকার দিল তার বাবা মায়ের উদ্দেশে: এতক্ষণে!’

‘এখন?’ চারপাশের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে গ্রেগর নিজেকেই জিজ্ঞাসা করল। একটু পরই বুঝতে পারল যে এখন সে নড়াচড়ায় পুরো অক্ষম। এতে অবাক হলো না সে একটুও; তার কাছে বরং এটাই অস্বাভাবিক ঠেকল কীভাবে সে তার এই সরু, ছোট ছোট পায়ে ভর দিয়ে এতক্ষণ ধরে শরীরটা ঠেলে এগিয়ে নিতে পেরেছে। এটুকু ছাড়া তার বরং আগের থেকে ভালোই লাগছে। এটা সত্যি যে তার সারা শরীরে সে বোধ করছে যন্ত্রণা, কিন্তু মনে হলে ক্রমেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে ব্যথাগুলো, আর শেষমেশ তা পুরো দূর হয়ে যাবে। তার পিঠের উপরের পচতে থাকা আপেল আর এর চারপাশের দগদগে জায়গাটুকু– পুরোটাই ঢেকে আছে নরম ধুলোয়– তাকে আর তেমন কোনো ব্যথাই দিচ্ছে না। স্নেহ আর ভালোবাসা নিয়ে তার ভাবনা আবার ফিরে গেল নিজের পরিবারের দিকে। তাকে যে অবশ্যই চলে যেতে হবে এ ব্যাপারে তার নিজের সিদ্ধান্ত– যদি সম্ভব হয় তো –তার বোনের চেয়েও দৃঢ়। টাওয়ারের ঘড়িতে রাত তিনটে বাজার ঘণ্টা পড়া পর্যন্ত সে ডুবে থাকল এ রকম শূন্য ও প্রশান্তি ভরা ভাবনার মধ্যে পুঁদ হয়ে, তার জানালার বাইরে সবকিছু আলো হয়ে আসার প্রথম আভাসটুকু দেখার মতো চেতনা তার তখনো ছিল। তারপর আপনা থেকেই নিচে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল তার মাথা আর নাসারন্ধ্র বেয়ে বের হলো তার ক্ষীণ শেষ নিঃশ্বাস।

ভোরবেলা যখন ঠিকে-ঝি এসে হাজির– গায়ের জোর আর অধৈর্য মিলে সে সব সময়ই অনেকবার তাকে মানা করা সত্ত্বেও, দরজাগুলো এমন জোরে বন্ধ করে যে সে আসার পরে ফ্ল্যাটের কারোই আর শান্তিতে ঘুমানো সম্ভব হয় না –তখন শুরুতে, রোজকার মতো একটু খানিকের জন্য গ্রেগরের কাছে গিয়ে কোনো অস্বাভাবিক কিছুই তার চোখে পড়ল না। সে ভাবল গ্রেগর ইচ্ছে করেই অমন নিথর শুয়ে আছে, একটু অভিমান দেখাচ্ছে মাত্র; ঝি-টা গ্রেগরকে সব রকম ধূর্ততায় পাকা বলেই মনে করে। ঘটনাক্রমে যেহেতু তার হাতে লম্বা ঝাঁটাখানা রয়েছে, তাই ওটা দিয়ে সে দরজা থেকেই চেষ্টা করল গ্রেগরকে খানিক সুড়সুড়ি দেওয়ার। যখন তাতেও কোনো সাড়া মিলল না, চটে গেল সে আর গ্রেগরের গায়ে খোঁচা মারল কয়েকটা, তারপর যখন সে গ্রেগরকে ধাক্কা মেরে ওই জায়গা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে তবু কোনো বাধা পাচ্ছে না, কেবল তখনই সে বুঝতে পারল ব্যাপারটা। প্রকৃত ঘটনা বুঝে নিয়ে সে তার দুই চোখ বিস্ফারিত করে একটা নিচু শিস দিল; তারপর কোনো রকম সময় নষ্ট না করে শোবার ঘরের দরজাটা জোরে খুলে ভেতরে ঢুকল আর সবচেয়ে জোরের সঙ্গে চিৎকার দিয়ে উঠল অন্ধকারের মধ্যে: ‘আসুন গো, দেখে যান, ওটা শেষ; ওইখানে মরে পড়ে আছে, একদম শেষ!

সামসা-দম্পতি উঠে বসলেন তাদের বিয়ের দিনের বিছানায়; আর ঠিকে-ঝি কী বলছে তা বুঝে ওঠার আগে তাদের প্রথমে কাটিয়ে উঠতে হলো ঐ মহিলার চেঁচামেচির ধাক্কাটা। তারপর, যা হোক, হের ও ফ্রাউ সামসা দ্রুত উঠে এলেন বিছানা ছেড়ে, দুজনে দুই পাশ থেকে; হের সামসা কাঁধ বেড় দিয়ে জড়িয়ে নিলেন একটা কম্বল, ফ্রাউ সামসা চলে এলেন স্রেফ তার রাত্রিবাসটা পরেই; এ পোশাকেই দুজনে পা রাখলেন গ্রেগরের ঘরে। এরই মধ্যে বসার ঘরের দরজাও খুলে গেছে, ভাড়টেরা আসার পর থেকেই ওখানে ঘুমায় গ্রেটি; পুরো পোশাক পরা আছে সে, যেন বা একটুও ঘুমায়নি সারা রাত, আর তার মলিন মুখখানা সাক্ষ্য দিচ্ছে এই অনুমানের পক্ষে। মরে গেছে?’ বললেন ফ্রাউ সামসা, জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন ঠিকে-ঝির দিকে, যদিও তিনি নিজেই পরীক্ষা করতে পারেন ব্যাপারটা; তার আসলে ঠিক দরকারও নেই, কারণ সবকিছু তো তিনি পরিষ্কার দেখতেই পাচ্ছেন। আমার তো তা-ই মনে হয়,’ বলল ঠিকে-ঝি, আর তা প্রমাণ করতে হাতের ঝাঁটাটা দিয়ে গ্রেগরের মৃতদেহ ধাক্কা দিয়ে এক পাশে ঠেলে সরাল বেশ অনেকটা দূর। ফ্রাউ সামসা নড়ে উঠলেন, যেন ঝাঁটাটাকে বাধা দিতে চান, কিন্তু পরক্ষণেই থেমে গেলেন তিনি। বেশ,’ বললেন হের সামসা, এবার খোদাকে ধন্যবাদ।’ তিনি ক্রুশচিহ্ন আঁকলেন আর তিন মহিলা অনুসরণ করল তাকে। গ্রেটি, যার দৃষ্টি একবারও মৃতদেহ থেকে সরেনি, বলল: “দেখো, দেখো কত শুকিয়ে গেছিল ও। অনেক দিন হয় কিছুই খায়নি। খাবারটা যেমন দিতাম ঠিক তেমনই ফেরত আসত। সত্যিই গ্রেগরের দেহটা পুরো সমান আর শুষ্ক; আর সত্যিই এখন প্রথমবারের মতো দেখা যাচ্ছে, তার ছোট ছোট পাগুলো শরীরের ভার বওয়া ছেড়ে দিয়েছিল, এ ছাড়া ওই শরীরখানায় দেখার মতো আর কিছু নেই।

‘গ্রেটি, তুমি একটু আসো তো আমাদের সঙ্গে, দুঃখের এক হাসি দিয়ে বললেন ফ্রাউ সামসা, এবং গ্রেটি তাদের পেছন পেছন ঢুকল তাদের শোবার ঘরে, পেছন ফিরে একবার মৃতদেহটার দিকে তাকাল সে। ঠিকে-ঝি দরজাটা বন্ধ করে হাট করে খুলে দিল জানালা। এমন ভোর সকালেও ঠান্ডা হাওয়াটার মধ্যে একধরনের কোমলতা রয়েছে। কারণ মার্চ মাস তো প্রায় শেষ এখন।

তিন ভাড়াটে বেরিয়ে এলেন তাদের ঘর থেকে, বিস্ময়ের চোখে চারদিকে তাকালেন তাদের সকালের নাশতার জন্য; ওদের কথা কারোই মনে নেই। আমাদের নাশতা কই? কর্কশ গলায় ঠিকে-ঝির কাছে জানতে চাইলেন মাঝখানের ভাড়াটে। কিন্তু সে তার ঠোঁটে আঙুল চাপা দিল, আর একটাও কথা না বলে তাদের জলদি ইশারা করে ঢোকাল গ্রেগরের ঘরের মধ্যে। তারা ঢুকলেন আর সেখানে –এতক্ষণে ঘর পুরো আলো হয়ে এসেছে –গ্রেগরের লাশটা ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়ালেন, তাদের হাত ঢোকানো প্রায় মলিন হয়ে যাওয়া জ্যাকেটের পকেটগুলোয়।

এ সময় সামসাদের শোবার ঘরের দরজা খুলে গেল, আর হের সামসা এক বাহুতে তার স্ত্রী, অন্য বাহুতে কন্যাকে ধরে বেরিয়ে এলেন ইউনিফর্মটা গায়ে চাপিয়ে। তাদের সবাইকে কিছুটা অশ্রুসিক্ত দেখাচ্ছে; একটু পর পর গ্রেটি তার মুখ চেপে ধরছে বাবার জামার হাতায়।

‘এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান!’ বললেন হের সামসা, আর মহিলা দুজনকে ধরে রেখেই দরজার দিকে আঙুল দেখালেন। কী বলতে চাচ্ছেন আপনি? খানিকটা হকচকিত হয়ে, মুখে একটা মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বললেন মাঝের ভাড়াটে। অন্য দুজন পেছনে হাত রেখে তা ঘষতে লেগেছেন, যেন তারা অনেক খুশি নিয়ে অনুমান করতে পারছেন কোনো সত্যিকারের লড়াইয়ের, যে লড়াই থেকে তারা নিশ্চিত বেরিয়ে আসবেন বিজয়ীর বেশে। আমি যা বলেছি ঠিক তা-ই বলতে চাচ্ছি, জবাবে বললেন হের সামসা, দুই মহিলাকে পাশাপাশি রেখেই তিনি এগিয়ে গেলেন মাঝখানের ভাড়াটের দিকে। শুরুতে ওই ভদ্রলোক একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন, তার দুই চোখ মাটির দিকে নামানো, যেন তার মনের মধ্যে নতুন কোনো ধাঁচে রূপ নিচ্ছে সবকিছু। হ্যাঁ, তাহলে মনে হচ্ছে চলেই যেতে হবে আমাদের,’ বললেন তিনি আর এমনভাবে চোখ তুলে হের সামসার দিকে তাকালেন যে মনে হলো, বিনয়ের হঠাৎ তোড়ে তিনি এখন তার এই পুরোনো সিদ্ধান্তটার জন্য যেন নতুন করে অনুমোদন কামনা করছেন। হের সামসা তার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে স্রেফ কবার একটু মাথা ঝাঁকালেন লোকটার উদ্দেশে। তা দেখে এই ভাড়াটে সত্যিই রওনা দিলেন হলঘরটার দিকে লম্বা লম্বা পা ফেলে; তার বন্ধু দুজন, যারা এই এতক্ষণ পুরো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন সবকিছু– একদম থেমে গেছে তাদের হাত-ঘষাঘষি– এখন পরিষ্কার লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটলেন তার পেছনে, যেন তাদের ভয় যে হের সামসা আগেই দরজার ওখানে পৌঁছে যাবেন আর তাদের আলাদা করে দেবেন তাদের নেতা থেকে। হলঘরে তারা তিনজনই কোট রাখার তাক থেকে তুলে নিলেন যার যার হ্যাট, ছাতা রাখার জায়গাটা থেকে বের করে নিলেন যার যার ছড়ি, কোনো শব্দ না করে কুর্নিশ জানালেন আর বেরিয়ে গেলেন ফ্ল্যাট থেকে। দুই মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে হের সামসা– পরে অবশ্য বোঝা গেল, এই অবিশ্বাসের কোনো দরকার ছিল না– তাদের পেছন পেছন গেলেন একেবারে সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত; সিঁড়ির হাতলের উপর ঝুঁকে তারা দেখতে লাগলেন ঐ তিন ভদ্রলোক আস্তে আস্তে কিন্তু সুনিশ্চিত লম্বা সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে যাচ্ছেন, প্রতিটা তলায় এসে সিঁড়িপথের একটা নির্দিষ্ট বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন তারা আর কয়েক মুহূর্ত পরই আবির্ভূত হচ্ছেন আবার; যত তারা নিচে নামতে লাগলেন, তাদের ব্যাপারে সামসা-পরিবারের আগ্রহও ততই কমতে লাগল; আর যখন এক কসাই বালক মাথায় ট্রে নিয়ে গর্বিত ভঙ্গিমায় উঠে আসতে লাগল তাদের দিকে আর পাশ কাটিয়ে দুলে দুলে উঠে গেল উপরে, তখন সিঁড়ির হাতল ছেড়ে চলে এলেন হের সামসা ও মহিলারা; তারা সবাই, যেনবা বোঝামুক্ত, ফিরে গেলেন ফ্ল্যাটে।

তারা সিদ্ধান্ত নিলেন আজ দিনটা বিশ্রাম করে ও একটু বেড়িয়ে কাটাবেন; এত দিন পরিশ্রমের পর এই বিশ্রামটুকু শুধু তাদের প্রাপ্যই না, খুব দরকারিও বটে। তাই তারা বসলেন টেবিলে গিয়ে, মাফ চেয়ে লেখা শুরু করলেন তিনটে চিঠি– হের সামসা তার ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের কাছে, ফ্রাউ সামসা সেই লোকের কাছে যিনি তাকে সেলাইয়ের কাজ পাঠান, আর গ্রেটি তার দোকানের মালিকের কাছে। তারা যখন লিখছেন, ঠিকে-ঝি ভেতরে ঢুকল যাওয়ার কথা বলতে, কারণ সে তার সকালের কাজ শেষ করে এনেছে। তিন চিঠি-লেখক প্রথমে চোখ না তুলেই শুধু মাথা নাড়লেন, কিন্তু ঠিকে-ঝি যখন ওখানেই ঘুরঘুর করতে লাগল, তখন তারা বিরক্তি নিয়ে মাথা তুলে তাকালেন। “হ্যাঁ, বলো?” বললেন হের সামসা। ঠিকে-ঝি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকল দরজার কাছে, যেন এদের জন্য তার কাছে এক মহা ভালো খবর আছে –কিন্তু যতক্ষণ-না তাকে ঠিকভাবে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, ততক্ষণ সে বলবে না কিছু। তার হ্যাঁটে লাগানো ছোট অস্ট্রিচ পাখির পালকটা– ওটা এখন প্রায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে– হের সামসা ওটার ওপর মহা বিরক্ত এই ঠিকে-ঝি কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকেই –ধীরে দুলছে সব দিকে। তুমি চাচ্ছটা কী? জিগ্যেস করলেন ফ্রাউ সামসা, যাকে ঠিকে-ঝি অন্য সবার চেয়ে বেশি সম্মান করে। হ্যাঁ, মানে,’ জবাবে বলল ঠিকে-ঝি আর এমন নিরীহ রস করা হাসি হাসতে লাগল যে

খানিকক্ষণ কথাই বলতে পারল না, ‘পাশের ঘরের ঐ জিনিসটার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার ব্যাপারে বলছিলাম, মানে, আপনাদের আর ও নিয়ে ভাবতে হবে না। ব্যবস্থা করে ফেলেছি।’ ফ্রাউ সামসা ও গ্রেটি তাদের চিঠির উপরে ঝুঁকল, যেন তারা চাচ্ছে স্রেফ লেখাটা চালিয়ে যেতে; হের সামসা বুঝতে পারলেন ঠিকে-ঝি এখন খুব চাচ্ছে সবকিছু বিস্তারিত খুলে বলতে, তিনি একটা হাত সামনে বাড়িয়ে শক্ত করে থামিয়ে দিলেন তাকে। গল্পটা বলার অনুমতি যেহেতু পাওয়াই গেল না, তাই ঠিকে-ঝির মনে পড়ে গেল তার খুবই তাড়া আছে; স্পষ্টই মন খারাপ করে সে বলে উঠল, ‘গুডবাই সবাই’, শাঁ করে ঘুরল প্রচণ্ডভাবে আর ভয়ংকর শব্দে দরজাগুলো বন্ধ করতে করতে বিদায় হলো ফ্ল্যাট ছেড়ে।

‘এ মহিলাকে আজ সন্ধ্যায়ই চলে যেতে বলব,’ বললেন হের সামসা, কিন্তু তার স্ত্রী। বা মেয়ে, কারো কাছ থেকে কোনো উত্তর পেলেন না; মনে হচ্ছে ঠিকে-ঝি এদের দুজনের এই কিছুক্ষণ আগে পাওয়া মানসিক প্রশান্তি একদম ভেঙে দিয়ে গেছে। তারা উঠলেন, জানালার কাছে গেলেন, আর একজন আরেকজনকে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সেখানে। হের সামসা চেয়ারে বসেই তাদের দিকে ঘুরলেন, তাদের চুপচাপ দেখলেন খানিকক্ষণ। তারপর তিনি ডেকে উঠলেন: ‘এদিকে আসো, এদিকে আসো এখন। এসব পুরোনো ঝামেলা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো তো! আমার জন্যও তো খানিকটা চিন্তা করবে, নাকি? দুই মহিলা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন তার ইচ্ছা পূরণে, দ্রুত কাছে গেলেন তার, হাত বুলিয়ে আদর করলেন তাকে, তারপর ঝটপট শেষ করলেন তাদের চিঠি।

তারপর তারা তিনজন একসঙ্গে বের হলেন ফ্ল্যাট থেকে– বেশ কয়েক মাসের মধ্যে এই-ই প্রথম –আর ট্রামে চেপে যেতে লাগলেন শহরের বাইরে খোলা গ্রামাঞ্চলের দিকে। তাদের কামরাটা, ওখানে তারাই একমাত্র যাত্রী, বেশ ভরে আছে উষ্ণ সূর্যের আলোয়। আরামের সঙ্গে তারা যার যার আসনে হেলান দিয়ে ভবিষ্যতের নানা সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন, আর খুঁটিয়ে দেখার পর মনে হলো, ভবিষ্যৎ একদম খারাপ না, কারণ তারা তিনজনই চাকরি করছেন– যদিও একজন আরেকজনের কাছে সত্যি বলতে কখনোই এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানতে চাননি তারা –যথেষ্ট ভালো চাকরিই বলা যায়, আর বিশেষ করে ভবিষ্যতে উন্নতি লাভের সম্ভাবনা আছে ওগুলোতে। তাদের অবস্থার উন্নতিটা –একেবারে প্রধান ও তাৎক্ষণিক উন্নতি –নিঃসন্দেহে স্রেফ বাসাবদল করার মাধ্যমেই সহজে চলে আসবে; এবার তারা এখনকারটার চেয়ে –যেটা গ্রেগর খুঁজে দিয়েছিল– ছোট ও সস্তা, কিন্তু একই সঙ্গে আরো সুবিধাজনক এক জায়গায়, সব মিলে আরো ভালোভাবে দেখে রাখা যায় এমন একটা ফ্ল্যাট নেবেন। যখন তারা এসব নিয়ে আলাপ করছেন, তখন হের ও ফ্রাউ সামসার মাথায় –তাদের মেয়ের বাড়ন্ত উচ্ছলতা লক্ষ করতে-করতে– প্রায় একই সময়ে এই ভাবনাটা এল যে, এত খাটাখাটনিতে মেয়েটার গাল দুটো কেমন মলিন হয়ে গেলেও ইদানীং সে এক সুশ্রী ও সুগঠন তরুণী হিসেবে পুষ্পিত হয়ে উঠেছে। এবার তারা আরো চুপ হয়ে গিয়ে, আর অনেকটা নিজেদের অজান্তেই চোখে চোখে কথা বলে, একমত হয়ে ভাবতে লাগলেন যে, ওর জন্য একটা ভালো বর দেখে দেওয়ারও উপযুক্ত সময় এসে গেছে। এবং তাদের এই নতুন স্বপ্ন ও সদিচ্ছার এক নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবেই যেন, যাত্রার শেষে তাদের কন্যাই উঠে দাঁড়াল সবার আগে আর টান টান করল তার তরুণী শরীর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *