ধেয়ান

ধেয়ান

গাঁয়ের রাস্তায় বাচ্চারা

বাগানের বেড়ার অন্য পাশ দিয়ে দু-চাকার ঘোড়াগাড়িগুলো চলে যাওয়ার শব্দ কানে এল, এমনকি মাঝেমধ্যে গাড়িগুলো দেখতেও পেলাম গাছের পাতার মৃদু সরে যেতে থাকা ফাঁক দিয়ে। ওগুলোর চাকার স্পোক আর ঘোড়া জুড়বার ডান্ডা কী কাঁচকাঁচ শব্দ-ই না করছে গ্রীষ্মের তাপে! খেত থেকে মজুরেরা ফিরে আসছে, তারা হাসছে নির্লজ্জের মতো।

আমি বসে আছি আমাদের ছোট দোলনাটাতে, পৈতৃক বাগানের গাছগাছালির মধ্যে বসে জিরিয়ে নিচ্ছি একটু।

বেড়ার ওপাশে হইচই চলছে তো চলছেই। দৌড়াতে থাকা বাচ্চাগুলো এক নিমেষেই হাওয়া, গমের গাড়িগুলোতে রাখা গমের আঁটিগুলোর উপরে আর চারপাশ ঘিরে বসে থাকা পুরুষ মহিলাদের ছায়াতে ঢেকে যাচ্ছে ফুলের বাগানগুলো; সন্ধ্যার কাছাকাছি এক ভদ্রলোককে দেখলাম হাতে দড়ি নিয়ে একটু হাঁটতে বেরিয়েছেন, আর রাস্তার অন্য দিক থেকে হাত ধরাধরি করে আসতে থাকা একদল মেয়ে তাকে সালাম জানিয়ে সরে গেল পাশের ঘাসে।

এরপর পাখিরা আকাশে উড়ে গেল একটা স্ফুলিঙ্গের বৃষ্টির মতো, আমার চোখ অনুসরণ করল ওগুলোকে, দেখলাম এক শ্বাসে কীভাবে ওরা উপরে উঠে গেল, একসময় মনে হলো ওরা আর উঠছে না, আমি বরং নামছি, আর দোলনার দড়ি শক্ত হাতে আঁকড়ে মূৰ্ছা যাওয়ার অনুভূতি নিয়ে আমি দুলতে শুরু করলাম খানিকটা। শিগগিরই, চারপাশের বাতাস আরো যত ঠান্ডা হচ্ছে ততই আমি আরো জোরে দোল খাচ্ছি, আর উড়তে থাকা পাখিগুলোর জায়গায় তখন আকাশে কাঁপা-কাঁপা অনেক তারা।

মোমের আলোয় আমাকে দেওয়া হলো রাতের খাবার। প্রায়ই আমি আমার হাত দুটো রাখছি টেবিলের কাঠের উপরে আর ঢুলু ঢুলু চোখে কামড় বসাচ্ছি রুটি ও মাখনে। হাতে-বোনা খসখসে পর্দাগুলো ঢেউ খেলে দুলছে গরম বাতাসে, আর কখনো-সখনো বাইরে দিয়ে হেঁটে যাওয়া কেউ দুই হাতে পর্দাগুলো ধরে চাইছে আমাকে আরো ভালো করে দেখতে কিংবা আমার সঙ্গে দু-একটা কথা বলতে। সাধারণত মোমবাতি একটু পরেই নিভে যাবে, তখন জড়ো হওয়া পোকাগুলো আরো কিছুক্ষণ ঘুরপাক খাবে মোমের কালো ধোঁয়ার মধ্যে। জানালা থেকে আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে তার দিকে এমনভাবে তাকাব যেন দূরের পাহাড় দেখছি কিংবা আকাশ দেখছি, তবে সে-ও যে আমার উত্তরের জন্য খুব ব্যাকুল তা-ও বলা যাবে না।

কিন্তু তাদের কেউ যদি লাফ দিয়ে জানালার চৌকাঠ পেরিয়ে আসে, বলে যে অন্যরা সবাই অপেক্ষা করে আছে বাড়ির সামনে, তাহলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওঠা ছাড়া আমার আর উপায় থাকে না।

‘আরে আসো না, দীর্ঘশ্বাস ফেলছ কেন? কী হয়েছে? ভয়ংকর কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি তো? সেটা কি –কাটিয়ে ওঠার মতো না? সত্যিই কি সব শেষ বলতে চাচ্ছ?”

কিছুই শেষ না। আমরা দৌড়ে যাই বাড়ির সামনেটায়। ‘থ্যাংক গড, শেষমেশ এলে তুমি?’– ‘সবসময় তুমি দেরি করো!’– ‘কী বল? আমি?’– ‘তুমি। যদি বাইরে আসতে না চাও তো বাসাতেই থাকো।– ‘কোনো মাফ নেই।’– ‘কী? মাফ নেই? এটা আবার কী ধরনের কথা?’

আমরা মাথা নুইয়ে চুঁ মেরে ঢুকে পড়ি সন্ধ্যার মধ্যে। দিন বলে কিছু নেই, রাত বলেও না। এই আমাদের জ্যাকেটের বোতামগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা দাঁত ঠকঠকানির মতো আওয়াজ তুলছে, এই আমরা দল বেঁধে দৌড়ে যাচ্ছি আমাদের মধ্যে একটা নিয়মিত দূরত্ব রেখে, গ্রীষ্মদেশের পশুদের মতো আগুন ঝরাচ্ছি আমাদের নিশ্বাসে। পুরোনো দিনের যুদ্ধের বর্ম পরা ঘোড়ায় চড়া যোদ্ধাদের মতো পা ঠুকে আর লাফিয়ে লাফিয়ে আমরা একজন আরেকজনকে ধাওয়া করছি গাঁয়ের ছোট গলিপথে আর তারপর, পায়ের উপরই দৌড়ে, সোজা দূরে গাঁয়ের বড় রাস্তায়। আমাদের কেউ কেউ পড়ে গেল। রাস্তার পাশের খাদে, অন্ধকার বাঁধের ওপাশে ঠিকমতো তারা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগেই আবার দাঁড়িয়ে গেল মেঠো পথের উপরে, অচেনা লোকের মতো, নিচে তাকিয়ে আছে।

‘নিচে নেমে আসো!’– ‘আগে তোমরা আমো উপরে!’– ‘তাহলে বেশ আমাদের ধাক্কা নিয়ে নিচে ফেলবে, সেটা হচ্ছে না, অত বোকা না আমরা।‘– ‘তার মানে তোমরা ভয় পেয়েছ। আরো উপরে আসো, আসো না!’– ‘ভয় পেয়েছি? তোমাদের? মনে করছ যে আমাদেরকে নিচে ফেলতে পারবে, তাই না? আশাও বটে তোমাদের!’

আমরা আক্রমণ করে বসলাম, বুকে ধাক্কা খেলাম, গিয়ে পড়লাম ঘাসে ভরা খাদে, মনের খুশিতে ওখানে পড়ছি। সবকিছু একই রকম নরম-কোমল, ঘাসে আমাদের না লাগছে গরম, না ঠান্ডা, স্রেফ মনে হচ্ছে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

এমন যে, আমরা যদি শরীরটা ডান কাতে ঘোরাই আর কানের নিচে একটা হাত রাখি, তাহলে খুব ইচ্ছা হবে ঘুমিয়ে পড়ি। তার পরও আমরা চাচ্ছি থুতনিটা শূন্যে বাড়িয়ে আবার কষ্ট করে হলেও দু পায়ে খাড়া হতে, তবে তা স্রেফ আরো গভীর কোনো খাদে পড়ার জন্যই। আমরা চাচ্ছি এমনই চলতে থাকুক সারা জীবন।

আমরা আমাদের শেষ বিশ্রামের গর্তটায় সত্যি কী করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ব, পুরো সোজা হয়ে, বিশেষ করে দুই পা টান টান করে, তা কিন্তু এমন একটা জিনিস যা আমরা কেউই বলতে গেলে ভাবি না, এমনকি যখন পিঠের উপর শুয়ে আছি মড়ার মতো, কেঁদে ফেলব ফেলব অবস্থা। আমরা শরীর কুঁচকে ফেলছি যখনই বাঁধের ওখান থেকে কোনো ছেলে আমাদের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে পড়ছে রাস্তার উপর, তার পায়ের তলাটা কালো, হাত দুটো শরীরের পাশে এঁটে রাখা।

এরই মধ্যে আকাশে দেখা যাচ্ছে চাঁদ বেশ উপরে উঠে গেছে; এর আলোতে একটা ডাকগাড়ি চলে গেল পাশ দিয়ে। চারপাশে মিষ্টি একটা হাওয়া উঠল, খাদের মধ্যে শুয়েও সেটা ভালোই অনুভব করা যাচ্ছে আর কাছের বনে গাছপালার ঝিরঝির শব্দ শুরু হয়েছে। একা থাকবার ইচ্ছা আমাদের সবার মন থেকে একদম চলে গেছে।

‘তোমরা সব গেলে কোথায়?– ‘এই দিকে!’- ‘সবাই একসঙ্গে হও!’– ‘আরে লুকাচ্ছ কেন, বোকার মতো কোরো না!’—’দেখোনি যে একটু আগে ডাকগাড়ি চলে গেল?’—‘ওহ্ না! চলে গেছে? এত তাড়াতাড়ি?’- ‘কোনো সন্দেহ নেই, তুমি যখন ঘুমাচ্ছিলে সেই সময় চলে গেল।‘– ‘আমি ঘুমাচ্ছিলাম? কী ফালতু বলছ!’ –“ওহ্, শাট আপ, যে কেউ বলবে ঘুমাচ্ছিলে তুমি।’–‘না, সত্যি বলছি, না।– ‘ওহ্, রাখো তো! চলো!’

এবার দৌড়ের সময় আমরা ঘেঁষাঘেঁষি করে আছি, আমাদের অনেকেই হাত ধরাধরিও করে রয়েছে; আমরা আমাদের মাথা বেশি উঁচুতে রেখে দৌড়াতে পারছি না; কারণ, রাস্তা এখন নিচে নেমে যাচ্ছে। কে যেন একটা রেড-ইন্ডিয়ান যুদ্ধের চিৎকার দিয়ে উঠল, আমাদের পাগুলো ঘোড়ার মতো টগবগ করে ছুটছে এখন, আগে এমনটা করিনি আমরা, আমরা যখন শূন্যে লাফ দিয়ে উঠছি, বাতাস এসে আমাদের কোমর উপরে ভাসিয়ে দিচ্ছে। কোনোকিছুই আমাদের থামাতে পারত না; এত জোরেই ছুটছি আমরা যে একজন যখন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছি, তখনো আমাদের হাত দুটো ভাঁজ করা আর চারপাশে তাকাচ্ছি কেমন শান্ত ভঙ্গিতে।

পাহাড়ি ছড়াটার উপরের সেতুতে আমরা থামলাম; যারা সামনে এগিয়ে গিয়েছিল, ফিরে এল। আমাদের নিচে পাথর ও শেকড়বাকড়ের গায়ে পানি আছড়ে পড়ছে; মনেই হচ্ছে না যে এরই মধ্যে রাত নেমে এসেছে। আমাদের মধ্যে কেউ-যে লাফ দিয়ে সেতুর রেলিংয়ে উঠে গেল না, সেটা একটা অবাক করা ব্যাপার।

দূরে গাছগুলোর ঘন ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে একটা রেলগাড়ি বেরিয়ে এল, এর সবগুলো। বগিতেই আলো জ্বলছে; কোনো সন্দেহ নেই, জানালাগুলো নামানো। আমাদের একজন। খুব চালু একটা গান গাইতে শুরু করল, তবে ততক্ষণে সবাই চাইছে গান গাইতে। রেলগাড়িটা যে গতিতে যাচ্ছে তার চেয়ে দ্রুত গান গাইছি আমরা, আমাদের হাতগুলোও দোলাচ্ছি কারণ শুধু গলা দিয়ে আর চলছে না, সবার গলা একসঙ্গে মিলে একটা হুটোপুটি অবস্থা খুব মজা পেলাম তাতে। কারো গলা যদি আরেকজনের গলার সঙ্গে মিশে যায়, তাহলে মনে হয়, বঁড়শিতে মাছের মতো আটকে গেছি।

এভাবেই আমরা গেয়ে চললাম, বনটা আমাদের পেছনের দিকে, আমরা গাইছি দূরে যারা সফরে আছেন তাদের জন্য। গায়ে বড়রা এখনো জেগে আছে; আমাদের মায়েরা রাতে ঘুমানোর জন্য বিছানা তৈরি করছে।

এবার সময় হয়ে এল। আমার সবচেয়ে কাছে দাঁড়ানো ছেলেটাকে একটা চুমু খেলাম আমি, পরের তিনজনকে শুধু হাত বাড়িয়ে দিলাম আর তারপর বাড়ির পথে দৌড় শুরু করলাম, কেউই আমাকে ডাকল না পেছন থেকে। প্রথম চারমাথায় এসে, আমাকে ওরা কেউ আর দেখতে পাচ্ছে না, আমি ঘুরে গেলাম আর মেঠো পথ ধরে আবার ফিরে যেতে লাগলাম বনের দিকে। আমি যাচ্ছি দক্ষিণের সেই ছোট শহরের দিকে, যেটা নিয়ে আমাদের গ্রামে গল্প আছে যে :

‘অদ্ভুত সব লোক থাকে ওখানে। শুধু ভাবো, ওরা কখনো ঘুমায় না!’

‘কেন, কী কারণে?’

‘কারণ ওরা কখনো ক্লান্ত হয় না।’

‘কেন, কী কারণে?’

‘কারণ ওরা সব বোকা।‘

‘বোকারা কি ক্লান্ত হয় না?’

‘বোকারা আবার কী করে ক্লান্ত হবে!

সাধু সাজা এক ফেরেববাজের মুখোশ উন্মোচন

শেষমেশ রাত দশটার দিকে আমি বিশাল বাড়িটার দরজায় পৌঁছালাম, ওখানে আমাকে দাওয়াত করা হয়েছে একটা পার্টিতে, আমার সঙ্গে এক লোক, তাকে আমি খুবই সামান্য চিনি, আগে এক-দুবার দেখা হওয়ার পরে কোত্থেকে তিনি এসে আবার আমার গায়ে পড়লেন আর পুরো দুটো ঘণ্টা আমাকে অলিগলি ধরে টেনে নিয়ে এলেন এখানে।

‘ঠিক আছে!’ আমি বললাম, আর দুই হাতে তালির মতো বাজিয়ে বোঝালাম যে আমাদের আলাদা হওয়াটা এখন খুবই জরুরি। এর আগেও আমি বেশ ক’বার একটু ইনিয়ে বিনিয়ে একই চেষ্টাটা করেছি, যথেষ্ট হয়েছে, আর পারছি না।

‘আপনি কি সোজা উপরে যাচ্ছেন?’ তিনি জানতে চাইলেন। তার মুখ থেকে দাঁত ঠকঠক করার একটা আওয়াজ হলো।

‘হ্যাঁ।’

কথা হচ্ছে, এখানে আমার দাওয়াত আছে, শুরুতেই কিন্তু সে কথা তাকে বলেছি আমি। আমার দাওয়াত সিঁড়ি বেয়ে ঐ উপরে যাওয়ার (ওখানে পৌঁছানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি), দাওয়াতটা নিচে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার উল্টোদিকের এই লোকের কান পেরিয়ে সামনে তাকিয়ে থাকার জন্য না। কিংবা এজন্যও না, এই যেমন এখন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি এই লোকের সঙ্গে (মনে হচ্ছে যেন ঠিক এখানে লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা)। কী এক নীরবতা– চারপাশের বাড়িঘরগুলো আর আকাশের তারা পর্যন্ত উঠে যাওয়া অন্ধকার, সব তাতে যোগ দিয়েছে। আর রাস্তায় দেখা-যাচ্ছে-না-এমন পথচারীদের পায়ের শব্দ (তারা কোথায় যাচ্ছে তা আন্দাজ করার ইচ্ছা কারোই নেই), রাস্তার অন্য পাশটা চেপে ধরেছে যে হাওয়া তার শব্দ, কোনো এক ঘরের বন্ধ জানালায় গ্রামোফোনে বাজতে থাকা এক গানের শব্দ –এই নীরবতায় সবকিছু কানে বাজছে স্পষ্ট হয়ে, যেন নীরবতার মালিক এরাই, আগের চিরদিন আর ভবিষ্যতের চিরদিনও।

আর আমার সঙ্গী ভদ্রলোক এই নীরবতায় নিজেকে সঁপে দিয়েছেন নিজের গরজেই এবং– একটু মুচকি হেসে– আমার পক্ষ থেকেও; তিনি দেয়ালের উপরে তার ডান হাত রাখলেন আর চোখ বন্ধ করে ওখানেই ঠেকালেন তার গালটাও।

কিন্তু তার এই হাসিটার শেষ পর্যন্ত দেখা হলো না আমার, কারণ হঠাৎ একটা লজ্জায় মাথা ঘুরে উল্টোদিকে ঘুরে গেলাম আমি। স্রেফ ঐ হাসি দেখেই আমি চিনে ফেলেছি যে এই লোক একজন ভণ্ড সাধু, এ ছাড়া আর কিছুই না। হায় খোদা, এই শহরে কত মাস হলো আমার, আমি ভেবেছিলাম সাধু সাজা ধাপ্পাবাজগুলোকে আমি মাথা-থেকে-পা-পর্যন্ত চিনে ফেলেছি– যেভাবে তারা রাতের বেলায় পাশের গলিগুলো থেকে উদয় হয় আমাদের সামনে, তাদের দুই হাত সরাইখানার মালিকদের মতো দুদিকে বাড়িয়ে; আর যেভাবে তারা কাচুমাচু ঘুরঘুর করে বেড়ায় (মনে হয় যেন পলাপলি খেলছে) বিলবোর্ডের খুঁটির চারপাশে যখন আমরা ওখানের বিজ্ঞাপনগুলো তাকিয়ে দেখছি; যেভাবে তারা অন্তত এক চোখ খুলে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দেখে থামের বাঁকের পেছন থেকে; আর আমরা যখন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মাত্র ভীত-বিচলিত হওয়া শুরু করেছি, তখন যেভাবে তারা হঠাৎ উড়ে এসে পড়ে আমাদের সামনে, ফুটপাতের কিনারে! এদের আমি যে কী ভালোভাবে বুঝি, সত্যি বলতে এই শহরে, এখানকার ছোট পানশালাগুলোতে, আমার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়া লোক এরাই, আর এদের কারণেই আমি প্রথম খোঁজ পাই একরোখা’ শব্দটার, যা এত দিনে আমার জীবনের এত বড় একটা অংশ হয়ে উঠেছে যে মনে হয় আমি নিজের মধ্যেও একই স্বভাব খুঁজে পাওয়া শুরু করেছি। কী রকম নাছোড়বান্দার মতো এরা লেগে থাকে আমাদের সঙ্গে, এমনকি এদের থেকে পালিয়ে বাঁচার অনেক দিন পর অবধিও, তখন যদি আমাদের ঠকানোর আর কোনো ফন্দি এদের হাতে না থাকে তো তা-ও। কীভাবে তারা বসতেও রাজি। হয় না, ভেঙে পড়তেও রাজি হয় না, এর বদলে তখনো (এবার একটু দূরের থেকেই) তারা কীভাবে আমাদের দিকে এত কিছুর পরও বিশ্বাস জাগানো চোখে বিরামহীন তাকিয়েই থাকে। আর এদের তরিকাগুলো সব সময় একই রকম : আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবে, যতটা পারা যায় জায়গা নিয়ে; যেখানে যাচ্ছিলাম সেখানে যেন না যাই সেজন্য পীড়াপীড়ি করবে; বলবে যে তার বদলে আমাদের বুকে আসো, আর যদি তখন আমাদের মধ্যে জমে ওঠা চাপা ক্ষোভটা শেষমেশ জ্বলে উঠল তো তারা সেটা মেনে নেবে আলিঙ্গনের মতো, তার ভেতরে সবার প্রথমে মুখটা বাড়িয়ে নিজেদের সঁপে দেবে তারা।

আর আমার কিনা এবার এই লোকটার সঙ্গে এতক্ষণ লাগল তাদের এই পুরোনো খেলাগুলো বুঝে উঠতে। আমার আঙুলের মাথাগুলো আমি একসঙ্গে জোরে ঘষতে লাগলাম, ওভাবে চেষ্টা করলাম এই লজ্জা মুছে ফেলতে।

তার পরও আমার এই লোক আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল দেয়ালে হেলান দিয়ে, এখনো ভাবছে সে তো সাধুরূপী ফেরেববাজিতে ওস্তাদ; নিজের এই কাজ নিয়ে পরিতৃপ্তি গোলাপি আভা ছড়াল তার আমার দিকে ফেরানো গালে।

‘চিনে ফেলেছি!’ আমি বললাম, তার কাঁধে একটা আলতো টোকা মারলাম। তারপর ঝটপট উঠে গেলাম সিঁড়ি বেয়ে, আর অতিথিদের অপেক্ষা করার ঘরে চাকর-নকরদের চেহারায় বাড়াবাড়ি রকমের আত্মনিবেদন দেখে আমার মন ভরে গেল এক মধুর বিস্ময়ে। আমি তাদের সবার দিকে তাকালাম এক-এক করে, তারা তখন আমার কোট খুলছে আর জুতোর ধুলো ঝাড়ছে। তারপর শরীরটা নিজের পুরো উচ্চতায় খাড়া করে নিয়ে, স্বস্তির এক নিশ্বাস ফেলে লম্বা পায়ে ঢুকলাম হলরুমটাতে।

হঠাৎ হাঁটতে বেরোনো

অবশেষে আপনি যখন মনস্থির করেছেন যে সন্ধ্যাটা বাড়িতেই কাটাবেন, তারপর ঘরে পরার জ্যাকেটটা গায়ে চাপিয়ে রাতের খাবারের পরে বসেছেন বাতি-জ্বলা টেবিলে সেই কাজটা করতে বা সেই খেলাটা খেলতে, যা শেষ করেই সাধারণত আপনি বিছানায় যান, যখন বাইরের আবহাওয়া এতই বিশ্রী যে ঘরে বসে থাকাটাই স্বাভাবিক, যখন টেবিলে আপনি চুপচাপ এতটা বেশি সময় ধরেই বসেছেন যে এখন যদি বাইরে যান তো সবাই খুব অবাক হয়ে যাবে, যখন সিঁড়িঘর এমনিতেই অন্ধকার আর সামনের দরজায় তালা দেওয়াও শেষ, যখন এই এতকিছুর পরেও হঠাৎ মুহূর্তের এক অস্থিরতায় আপনি দাঁড়িয়ে পড়েছেন, জ্যাকেট বদলেছেন, বেশি দেরি হয়নি আপনাকে এবার দেখা যাচ্ছে রাস্তায় বেরোনোর পোশাকে, আপনি বোঝাচ্ছেন যে আপনাকে বাইরে যেতেই হবে এবং একটুখানি গুডবাই ইত্যাদি বলে আসলেই আপনি বাইরে বেরোলেন, আন্দাজ করছেন। যেভাবে ফ্ল্যাটের দরজা দড়াম করে বন্ধ করলেন তাতে ঘরের লোকজন কতটা বিরক্ত হলো, তারপর যখন নিজেকে রাস্তায় ফিরে পেলেন আপনি, আপনার হাত-পা কী এক চটপটে ভঙ্গিতে সাড়া দিচ্ছে আপনার ওদেরকে উপহার দেওয়া এই আচম্বিত স্বাধীনতায়, যখন দৃঢ়ভাবে এই একবার সিদ্ধান্ত নিতে পারার ঘোরে নিজের অনেক গভীরে আপনার এই অনুভূতি হচ্ছে যে সিদ্ধান্ত নিতে আপনি পিছপা হন না, যখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি পরিষ্কারভাবে আপনি এটা বুঝলেন যে সবচেয়ে আচমকা পরিবর্তনগুলো ঘটানোর এবং তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য যেটুকু শক্তি মানুষের দরকার আপনার তার চেয়ে বেশিই আছে, আর যখন এরকম এক মানসিক অবস্থায় আপনি হেঁটে বেড়াচ্ছেন শহরের দীর্ঘ রাস্তাগুলোয়– তখন ঐ রাতটার জন্য আপনি আসলে নিজেকে পুরোপুরি ছাড়িয়ে নিলেন পরিবারের শৃঙ্খল থেকে, পরিবার বিষয়টা হারিয়ে গেল অনাবশ্যকতায়, আর তখন আপনি নিজে পাথরের মতো দৃঢ়তা নিয়ে (আপনার শরীরের আকারটা দেখাচ্ছে ধারাল কালো) নিজের পাছায় চাপড় মারতে মারতে জেগে উঠলেন আপনার সত্যিকারের মাপে।

আর এই পুরো ব্যাপারটার গাঢ়তা আরো বেড়ে যাবে যদি রাতের ওরকম এক সময়ে আপনি কোনো বন্ধুকে সে কেমন আছে দেখার জন্য খুঁজে ফেরেন।

সংকল্পগুলো

নিজেকে দুর্দশার গহ্বর থেকে তুলে আনা মনে হয় না কঠিন কোনো কাজ, এমনকি জোর করে শক্তি সঞ্চয় করেও যদি করেন। চেয়ার থেকে আমার শরীরটা তুলতে হবে ঝটকা টানে, টেবিলটা ঘিরে তারপর ঘুরব দুলকি চালে, আমার মাথা ও ঘাড় ঢিলে করে দেব, চোখের মধ্যে ভরে নেব আগুন, চোখের চারপাশের পেশিগুলো টান টান করব। আমার সহজাত সব অনুভূতির উল্টো গিয়ে, যদি ক. আসে তো তাকে মহা খুশিতে স্বাগত জানাব, নির্বিবাদে খ.-কে সহ্য করে যাব আমার এই ঘরে, আর গ.-এর সঙ্গে– পেরেশানি ও যন্ত্রণা দুই ই উপেক্ষা করে –সে যা বলবে সব হজম করে যাব লম্বা ঢোক গিলে।

কিন্তু এর সব যদি আমার পক্ষে করা সম্ভবও হয়, তবু একটা কোনো ভুল (আর ভুল তো হবেই) পুরো চেষ্টাটাকে, যত কঠিন বা যত সহজই হোক, হোঁচট খাইয়ে দেবে; তখন আমাকে আবার সেই প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।

এ কারণেই সবচেয়ে ভালো উপদেশ হচ্ছে, যেটাই ঘটুক মেনে নাও, যদি দেখো যে কোনোকিছু তোমাকে উড়িয়ে নিচ্ছে তবু আচরণ করো জড় বস্তুপিণ্ডের মতো, ভুলেও লোভে পোড়ো না একটাও কোনো অহেতুক পা ফেলার, অন্য লোকদেরকে দেখো পশুর চোখ দিয়ে, কোনো অনুশোচনা কোরো না– এক কথায় বললে নিজের হাত দিয়ে দুমড়ে দিয়ো জীবনের একটা অশরীরী টুকরোও যদি তোমার মধ্যে বেঁচে থাকে, তার মানে, কবরে যে শেষ শান্তি মিলবে তাকে আরো গাঢ় কোরো এবং এর বাইরে কোনোকিছুকে আর টিকতে দিয়ো না।

এ ধরনের মানসিক অবস্থায় সাধারণত যে শারীরিক ভঙ্গিটা করতে দেখা যায় তা হলো নিজের কড়ে আঙুল দিয়ে ভ্রু ডলতে থাকা।

পাহাড়ে দল বেঁধে বেড়ানো

‘আমি জানি না,’ এই ছিল আমার নিঃশব্দ চিৎকার, ‘আমি সত্যি জানি না। যদি কেউ না আসে তো, বেশ, কেউ না আসবে। আমি কারো ক্ষতি করিনি, কেউ আমার ক্ষতি করেনি, তবু কেউ আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না। কেউ না, কেউ না, কেউ না। তবে ব্যাপারটা যদিও ঠিক এরকম না। কথা এটুকুই যে কেউ আমাকে সাহায্য করে না –তা ছাড়া কিন্তু এই অনেক কেউ-না ব্যাপারটা আমার ভালোই লাগে। আমার সত্যিই ভালো লাগবে (না-লাগার তো কারণ নেই) একদল কেউ-না নিয়ে একসঙ্গে বেড়াতে যেতে। পাহাড়ে, অবশ্যই, তা ছাড়া আর কোথায়? কীভাবে এই কেউ-না’র দল একসঙ্গে হয়ে ধাক্কাধাক্কি করে! কত কত হাত শরীরের দুই পাশে ছড়ানো আর একসঙ্গে ধরাধরি করা; ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটতে থাকা কত কত পা, আলাদা আলাদা! এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা সবাই রাতের পোশাক পরা। আমরা দল বেঁধে ভালোই এগোচ্ছি, তখন সজোরে বাতাস বয়ে যাচ্ছে আমাদের একে অন্যের মাঝখানের আর আমাদের হাত পায়ের ফাঁকগুলো দিয়ে। পাহাড়ে আমাদের গলা কত পরিষ্কার হয়ে যায়। এটা বিস্ময়ের ব্যাপার যে আমরা গান গাইতে শুরু করিনি।’

ব্যাচেলরের নিয়তি

ব্যাচেলর থেকে যাওয়ার কথা ভাবতে কত ভয়ংকর লাগে : বুড়ো বয়সে যখন ইচ্ছা করবে মানুষের সান্নিধ্যে সন্ধ্যাটা কাটাতে, তখন নিজের মান-মর্যাদার মাথা খুইয়ে কীভাবে ভিক্ষা চাইতে হবে যে আমাকে সঙ্গে নাও; অসুস্থ হলে কীভাবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে শূন্য ঘরের কোনায় নিজের বিছানায় শুয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে হবে; সব সময় গুডবাই বলে যেতে হবে রাস্তার দিকের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে; সিঁড়িতে কখনোই পাশে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে উপরে উঠতে হবে না; নিজের ঘরে শুধু পাশ-দরজাই থাকবে, যেটা দিয়ে অন্য মানুষের ফ্ল্যাটে যাওয়া যায়; রাতের খাবার হাতে করে বয়ে আনতে হবে বাইরে থেকে; অন্য লোকেদের বাচ্চাকাচ্চাদের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাতেই হবে আর ‘না, আমার নিজের বাচ্চা নেই’ এ-কথাটা লোকজন বারবার করে বলতেও দেবে না; আর তরুণ বয়সে দেখা দু-একজন ব্যাচেলর মানুষের কথা মনে রেখে সেই আদলে নিজের পোশাক-আশাক ও ব্যবহার ঠিক করে নিতে হবে।

ব্যাপারটা হবে এমনই, কোনো সন্দেহ নেই, শুধু এটুকুই যোগ করা যায় যে ব্যাচেলর মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে এবং থাকবে- আজ ও সামনের সব দিনগুলোয়– এক কঠিন বাস্তবতার মধ্যে, একটা দেহ আর একটা সত্যিকারের মাথা নিয়ে, তার মানে একটা কপালও থাকবে তাতে, নিজের হাত দিয়ে চাপড়ানোর জন্য।

ব্যবসায়ী

সম্ভবত কেউ কেউ হয়তো আমার জন্য দুঃখ বোধ করেন, যদিও আমি তা ঠিক ধরতে পারি না। আমার ছোট ব্যবসাটা আমাকে দুশ্চিন্তায় ঘিরে রাখে (তাতে আমার ভুরুর ওখানে আর কপালের পাশ পর্যন্ত ব্যথা করে), ব্যবসাটার আকার এতই ছোট যে আমি তাতে ভবিষ্যতে সন্তুষ্টির কোনো আশা খুঁজে পাই না।

বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, আমার এই দোকানদারের স্মৃতি সব সময় সতেজ রাখতে হয়, নিজেকে সাবধান করতে হয় সেইসব ভুল থেকে যা আমার করার আশঙ্কা রয়েছে, আর প্রত্যেক মৌসুমেই মাথা ঘামাতে হয়। সামনের মৌসুমের ফ্যাশন নিয়ে, আমি যাদের সঙ্গে চলি তাদেরটা নিয়ে না, গ্রামগঞ্জে যাওয়া-যায়-না-এমন দূরের লোকজনের ফ্যাশন নিয়ে।

আমার আয়-ইনকাম সব অচেনা লোকজনের হাতে; তাদের পরিস্থিতি নিয়ে আমার অনুমান করার কোনো ক্ষমতা নেই, কোনো ধারণাও নেই তারা কোনো দুর্ভাগ্যের শিকার হতে পারে কি না, অতএব ওটা এড়ানোর কোনো উপায়ও আমার নেই! হতে পারে তারা দুই হাত খুলে টাকাপয়সা ওড়াচ্ছে আর কোনো গার্ডেন-রেস্তোরাঁয় পার্টি দিয়ে চলেছে; অন্যেরা এই পার্টিতে এসে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে যাচ্ছে আমেরিকায় নতুন জীবনের খোঁজে পাড়ি দেওয়ার আগে।

কোনো কাজের দিনের শেষে সন্ধ্যায় আমি যখন আমার দোকান বন্ধ করতে আসি, আর হঠাৎ মুখোমুখি হই সামনের ঘণ্টাগুলোর যখন আমি জানি যে আমার ব্যবসার নিরন্তর চাহিদা মেটানোর মতো কোনোকিছু আমার করার ক্ষমতার মধ্যে নেই, তখন সেদিন সকালে যে উত্তেজনা আমি ভবিষ্যতের কথা ভেবে তুলে রেখেছিলাম তা আমার গায়ে আছড়ে পড়ে ধেয়ে আসা ঢেউয়ের মতো, ওখানেই থামে না বরং আমাকে সঙ্গে টেনে নিয়ে যায়, লক্ষ্যহীনভাবে, কোথায় তা আমার জানা নেই।

তার পরও আমি এই মানসিক পরিস্থিতি আমার কোনো কাজে লাগাতে পারি না, শুধু পারি ঘরে চলে যেতে, কারণ আমার মুখ ও হাত দুটো ময়লা হয়ে আর ঘামে ভিজে আছে, আমার জামাকাপড় দাগে আর ধুলায় ভরে গেছে, আমার মাথায় কাজের-সময়ে পরার টুপি আর আমার জুতো ভরা প্যাকিং বাক্সের পেরেকের দাগ। ও রকম সময়ে আমি হাঁটি কোনো ঢেউয়ে ভাসা মানুষের মতো, কটকট দুই হাতের আঙুল ভাঙতে ভাঙতে আর পথে দেখা বাচ্চাদের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে।

বাসার পথটা খুব সামান্য। মুহূর্তের মধ্যে আমি বাসায় পৌঁছে যাই । লিফটের দরজা খুলি আর ভেতরে ঢুকি।

হঠাৎ দেখি যে আমি এখন একেবারে একা। অন্য লোকজন যাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হচ্ছে তারা উঠতে উঠতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েন; হাঁফিয়ে শ্বাস নিতে নিতে তারা অপেক্ষা করেন যে কেউ তাদের ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলে দেবে, এতে তারা বিরক্ত ও অধৈর্য হন বটে; তারপর তারা বাসার হলঘরে ঢোকেন, ওখানে তাদের হ্যাট ঝুলিয়ে রাখেন; এর পরও যতক্ষণ না তারা বারান্দা ধরে বেশ কটা কাঁচের দরজার সামনে দিয়ে হেঁটে তাদের নিজ কামরায় পৌঁছাচ্ছেন, ততক্ষণ তাদের একা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

কিন্তু আমি লিফটের ভেতরে ঢোকামাত্রই একা, আর আমার হাঁটুতে দুই হাত ঠেকা দিয়ে সরু আয়নায় দেখছি নিজেকে। লিফট উপরে উঠতে শুরু করলে আমি বলি:

‘চুপ করো, তোমরা সবাই; এবার পেছনে যাও; গাছের ছায়ায় হারিয়ে যেতে কি মন চায় না, জানালার ঐ পরদার পেছনে, পাতার শামিয়ানার মধ্যে?’

আমার দাঁতকে কথাগুলো বলি আমি, আর দেখি সিঁড়িঘরের হাতলগুলো ঝাপসা কাঁচের ওপাশে নিচে ভেসে চলে যাচ্ছে কোনো জলপ্রপাতের মতো।

‘উড়ে যাও তাহলে তোমার ডানাগুলো, যা আমি আজও কখনো দেখিনি, তোমাকে বয়ে নিয়ে যাক গায়ে, উপত্যকার ওখানে, কিংবা সোজা প্যারিসে, তোমার মন যদি তা-ই চায়।

তবে জানালা দিয়ে যতটুকু দেখার তা কিন্তু দেখে নিয়ো, যখন তিনটে রাস্তা থেকে একই সময়ে মানুষের মিছিল এসে একসঙ্গে মেলে, কোনোটাই কোনোটাকে পথ দেয় না, শুধু একটার মধ্যে দিয়ে আরেকটা চলে যায় আর তাদের শেষ চলে যেতে থাকা অংশগুলোর মাঝখানে দেখা যায় স্কোয়ারটা আবার ফাঁকা হয়ে এসেছে। তুমি কিন্তু তোমার রুমাল নাড়িয়য়া, ভয় পেলে পেয়ে, মন ছুঁয়ে গেলে যেতে দিয়ো, পাশ দিয়ে গাড়িতে সুন্দরী মহিলা গেলে তার তারিফ কোরো।

কাঠের সেতু ধরে পানির ছড়াটা পার হয়ে যেয়ো, গোসল করতে থাকা বাচ্চাদের দিকে মাথা নাড়িয়ে সম্ভাষণ জানিয়ে, আর দূরের যুদ্ধজাহাজে হাজার নাবিকের জেগে উঠতে থাকা উল্লাস শুনে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যেয়ো।

যাও, ওই সাদাসিধা চেহারার ছোট মানুষটার পেছন নাও, আর যখন তাকে ওখানে কোনো দরজা পথে ঠেসে ধরতে পেরেছ, তাকে লুটে নাও আর তারপর তোমার দু-পকেটে দুই হাত দিয়ে দেখতে থাকো সে কেমন মন খারাপ করে বাঁ-হাতের রাস্তা ধরে চলে যায়।

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পুলিশেরা তাদের জোরে ছুটতে থাকা ঘোড়াগুলোর লাগাম টানবে আর তোমাকে বাধ্য করবে পিছিয়ে দাঁড়াতে। করতে দাও; ফাঁকা রাস্তাগুলো দেখে তাদের উৎসাহ দমে যাবে, আমি জানি। কি, তোমাকে বলিনি তারা জোড়ায় জোড়ায় এরই মধ্যে চলে যেতে লেগেছে, ধীরে চলে যাচ্ছে রাস্তার কোনার ওখান দিয়ে, উড়ে যাচ্ছে স্কোয়ারের মাঝ দিয়ে।

তারপর আমাকে লিফট থেকে বেরোতে হলো, লিফটটা আবার নিচে ফেরত পাঠাতে হলো; আমি দরজার ঘন্টি বাজালাম আর কাজের মেয়েটা দরজা খুলতে তাকে শুভ সন্ধ্যা জানালাম।

জানালা থেকে আনমনা বাইরে তাকিয়ে

এই দ্রুত এসে পড়তে থাকা বসন্তের দিনগুলোয় আমরা করবটা কী? আজ ভোরে আকাশ ছিল ধূসর, কিন্তু এখন যদি আপনি জানালার ওখানে যান, একদম অবাক হয়ে যাবেন,

জানালার খিলে গাল ঠেকিয়ে রাখবেন আপনি।

নিচে রাস্তায় দেখবেন এই এখন ডুবতে থাকা সূর্যের আলো পড়েছে একটা অল্পবয়সী মেয়ের গালে, সে হেঁটে যাচ্ছে, কাঁধ বাঁকিয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে, আর একই সময়ে দেখবেন তার পেছনে এক লোক আরেকটু দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে আসছে, তার ছায়া পড়ছে মেয়েটার গায়ে।

তারপর লোকটা চলে গেল মেয়েটাকে পেরিয়ে আর বাচ্চা মেয়েটার মুখটা বেশ ঝলমলে।

বাড়ির পথে

কোনো ঝড়তুফানের পরে বাতাসের কী এক ক্ষমতা মানুষের মনে বোধ জাগানোর। আমার গুণগুলো তখন মনে হয় আমি ধরতে পারি, ওগুলো আমাকে আচ্ছন্ন আর অভিভূত করে দেয়, যদিও স্বীকার করছি আমিও তেমন কোনো বাধা দিই না।

আমি হাঁটতে থাকি, এমনভাবে পা ফেলে হাঁটি যা রাস্তার এ পাশের সঙ্গে যায়, এই রাস্তার পুরোটার সঙ্গে, শহরের এই অংশের সঙ্গে। আমি যথার্থ কারণেই দায়ী সব দরজায় সব টোকার জন্য, সব টেবিলে সব চাপড়ের জন্য, পানের আগে সব পানপাত্র তুলে শুভ কামনা জানানোর জন্য, সব প্রেমিকযুগলের জন্য যারা আছে বিছানায়, আছে তৈরি হতে থাকা দালানগুলোর রাজমিস্ত্রিদের তক্তার উপরে, অন্ধকার গলিঘুপচির দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে, পতিতালয়গুলোর সোফার মধ্যে।

আমি আমার অতীতকে মূল্যায়ন করি আমার ভবিষ্যতের সঙ্গে তুলনা করে, দেখি যে দুটোই দারুণ, দেখি যে একটাকে আরেকটার চেয়ে বেশি পছন্দ করা যাচ্ছে না, আর কোনোকিছু নিয়ে আমার সমালোচনা নেই, আছে শুধু ভাগ্যবিধাতার অন্যায় নিয়ে যিনি আমার প্রতি এভাবে পক্ষপাত দেখিয়ে গেছেন।

কেবল যখন ঘরে পা দিয়েছি, তার পরেই কিছুটা গভীর ভাবনা আসে আমার মনের মধ্যে, যদিও সিঁড়ি দিয়ে যখন উপরে উঠছিলাম তখন কিন্তু ওরকম ভাবার মতো কোনো বিষয় পাইনি। আর এই যখন জানালা পুরোপুরি খুলে দিলাম, শুনছি কোনো বাগানে এখনো গান বাজছে, তা কিন্তু আমার বিশেষ কোনো কাজে আসছে না।

পাশ দিয়ে দৌড়ে যাওয়া মানুষ

যখন রাতের বেলায় কোনো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আর অনেক দূরে দেখতে পাচ্ছি (কারণ আমাদের সামনে রাস্তার ঢালটা উপরের দিকে উঠে গেছে এবং আকাশে পূর্ণিমা) এক লোক আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে, তখন আমাদের ঠিক হবে না তাকে ধরে থামানো, সে যদি দুর্বল ও ছেঁড়া কাপড় পরা হয় তা-ও, এমনকি যদি দেখি যে অন্য আরেকজনও চিৎকার করে দৌড়ে আসছে তাকে ধরতে তবুও; বরং ঠিক হবে তাকে বাধা না দিয়ে দৌড়ে যেতে দেওয়া।

কারণ এটা রাতের বেলা, আর যদি গোল চাঁদের আলোয় রাস্তার ঢালটা সত্যিই সামনে উপরের দিকে উঠে যায়, সেটা তো আর আমাদের দোষ না, আর তা ছাড়া এমনও তো হতে পারে এই দুজন মজা করতেই এই ধাওয়াধাওয়ির আয়োজন করেছে, হতে পারে তারা দুজনই আসলে অন্য কোনো তৃতীয় লোককে তাড়া করছে, হতে পারে প্রথম লোকটাকে অন্যায়ভাবে ধাওয়া করা হচ্ছে, হতে পারে দ্বিতীয়জন চায় তাকে মেরে ফেলতে, তাহলে আমরা তো সেই খুনের মধ্যে জড়িয়ে যাব, হতে পারে দুজন একে অন্যকে চেনেও না, আর দুজনেই যার যার মতো করে স্রেফ দৌড়ে যার যার বাসায় যাচ্ছে ঘুমানোর জন্য, সম্ভবত এরা দুজনেই ঘুমের-মধ্যে-হাঁটা মানুষ, সম্ভবত প্রথমজনের কাছে অস্ত্র আছে।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, আমাদেরও তো ক্লান্ত হওয়ার অধিকার আছে, নাকি? আর আমরা কি ওই অতগুলো ওয়াইন খাইনি? আমরা খুশি হলাম যে দ্বিতীয় লোকটাকে আর দেখতে পাচ্ছি না।

যাত্রী

আমি দাঁড়িয়ে আছি ট্রামের প্ল্যাটফর্মে, পুরোপুরি অনিশ্চিত লাগছে এই পৃথিবীতে, এই শহরে এবং আমার পরিবারে আমার অবস্থান বিষয়ে। এদের কারো কাছ থেকেই আমার যৌক্তিক প্রত্যাশা কী, সে বিষয়ে মোটের ওপর কিছু বলার মতো ক্ষমতাও আমার নেই। আমি এমনকি এই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি কেন, কেন এই ফিতেটা ধরে আছি, নিজেকে কেন ছেড়ে দিচ্ছি ট্রামটার হাতে– সে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে, কেন লোকজন সরে যাচ্ছে ট্রাম চলারপথের থেকে কিংবা নীরবে হেঁটে যাচ্ছে রাস্তায় কিংবা থেমে তাকাচ্ছে দোকানের জানালায় –এমনকি এসবের যৌক্তিকতা নিয়েও কিছু বলতে আমি অপারগ।– এমন না যে কেউ আমাকে বলতে বলছে, কিন্তু কথা সেটা নয়।

ট্র্যাম সামনের একটা স্টপেজে থামতে চলেছে, একটা মেয়ে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল, নামার জন্য তৈরি। তাকে আমি এতই সাফ সাফ দেখতে পাচ্ছি যে মনে হচ্ছে যেন তার সারা গায়ে আমার হাত দেওয়া হয়ে গেছে। কালো পোশাক পরে আছে সে, তার স্কার্টের ভাঁজগুলো একরকম স্থির হয়ে আছে, তার ব্লাউজটা আঁটসাট, ওটার কলার সাদা সূক্ষ্ম লেসের, তার বাঁ হাত ট্রামের পাশে চ্যাপটা করে ধরা, তার ডান হাতে ধরা ছাতাটা সিঁড়ির উপর থেকে দ্বিতীয় ধাপে ঠেকানো। তার চেহারা বাদামি রঙের; তার নাক দুই পাশটায় একটু চাপা, আকারে চওড়া আর নাকের আগাটা গোল। তার মাথাভরা বাদামি চুল, এর কয়েকটা পথ হারানো গোছা কপালের ডান পাশে উড়ে পড়েছে। তার ছোট কান মাথার পাশে এঁটে বসানো, তার পরও যেহেতু আমি তার একদম কাছে দাঁড়িয়ে, তাই তার ডান কানের পুরো পেছনটা ও সেই সঙ্গে কান যেখানে মাথার খুলিতে যোগ হয়েছে সেখানের ছায়াটা ভালোমতোই দেখতে পাচ্ছি।

তখন আমি ভাবলাম : কী করে সম্ভব যে সে নিজেকে নিয়ে বিস্ময়বিমুগ্ধ নয়, কী করে সে তার মুখ বন্ধ করে আছে আর এই বিস্ময় নিয়ে কিছুই বলছে না?

পোশাক

আমি যখন দেখি যে নানা কুঁচির, নানা ঝালরের, নানা পাড় দেওয়া পোশাকগুলো সুন্দর শরীরে কী সুন্দর জড়িয়ে আছে, তখন ভাবি এগুলো বেশি দিন ওরকম সুন্দর থাকবে না, ওতে এমন ভাঁজটাজ পড়বে যে ইস্তিরি করেও দূর করা যাবে না, ওদের নকশার কাজগুলোতে এমন পুরু হয়ে ধুলো জমবে যে তা আর ওঠানো যাবে না, আর তা ছাড়া কোনো মহিলাই চাইবেন না একই দামি পোশাক প্রতিদিন সকালে পরে, আবার প্রতি রাতে খুলে রেখে সমাজের কাছে রোজ রোজ নিজেকে হেয় ও হাসাহাসির পাত্র করতে।

তার পরও আমি এমন অনেক মেয়ে দেখি যারা নিঃসন্দেহে সুন্দর, তাদের শরীরে অনেক পুলকিত হওয়ার মতো ছোট পেশি, ছোট সুন্দর হাড়, টান টান ত্বক, মাথাভরা মসৃণ চুল; কিন্তু তাতে কী, তারা রোজ পরে আসে এই একটাই অনুমেয় ছদ্মবেশ, রোজই এই একই হাতের তালুতে রাখে এই একই মুখ, আর তাদের হাতের আয়নায় তাকিয়ে দেখে একই প্রতিমূর্তি।

শুধু মাঝেমধ্যে, যখন তারা রাতে কোনো পার্টি থেকে ঘরে ফেরে দেরি করে, তখন আয়নায় দেখে তাদের মনে হয় যে পোশাকটার সুতোনাতা সব বেরিয়ে গেছে, হয়ে গেছে ঢলঢলে, ধুলোভরা, সবাই বহুবার দেখে ফেলেছে এই পোশাক এবং ওটা আর পরার মতো নেই।

রূঢ় প্রত্যাখ্যান

যখন আমার কোনো সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় আর আমি তাকে মিনতি করে বলি : ‘প্লিজ, আমার সঙ্গে চলো’, সে আমার কাছ থেকে সরে যায় একটাও কথা না বলে, তখন সে আসলে যা বলতে চায় তা হলো:

‘আপনি কোনো বিশাল নামওয়ালা ডিউক নন; রেড ইন্ডিয়ানদের মতো শরীরের গড়ন নিয়ে কোনো চওড়া আমেরিকানও নন, যার দৃষ্টি শান্ত অবিচলিত, যার গায়ের চামড়া মালিশ হয়েছে প্রেইরির খোলা হাওয়ায় আর এর মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা নদীর জলে; আপনি কখনো সাত সমুদ্রের কাছে যাননি (ওরা কোথায় তা কে জানে) আর তাতে পাল খাঁটিয়ে ঘুরেও বেড়াননি। তাই আমি জানতে চাচ্ছি, আমার মতো একটা সুন্দর মেয়ে কেন আপনার সঙ্গে যাবে?

‘তুমি ভুলে যাচ্ছ যে তোমাকেও তো কোনো লিমুজিন লম্বা ধাক্কায় দোল খাইয়ে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যায় না; এটাও তো দেখি না যে সুট-বুট-পরা সম্ভ্রান্ত কোনো দেহরক্ষীর দল তোমার পেছন পেছন কঠিন আধা-বৃত্ত তৈরি করে হাঁটে আর তোমার মাথায় বিড়বিড় করে আশীর্বাদ-বাণী ঢালে; বুঝলাম তোমার বডিসের মধ্যে বুক দুখানা সত্যিই সুন্দর পরিপাটি করে রাখা কিন্তু তোমার দুই উরু আর পাছার যে আকার, তাতে ও দুটোর সংযমের তো বারোটা বেজে গেছে; তোমার গায়ে ঐ যে কড়কড়ে রেশমি পোশাক, স্কার্টটা ভাজ ভাঁজ, গেল শরতে ওরকমই একটা দেখে আমরা সবাই খুশিতে হইচই করেছিলাম, ঐটা পরেও– ওই ভয়ংকর জিনিসটা গায়ে চাপিয়েও– তুমি সময়ে সময়ে হাসছ।’

‘হ্যাঁ, আমরা দুজনেই ঠিক; আর এই সত্যটা অকাট্যভাবে আমাদের মাথায় ঢোকার আগেই আপনি কি মনে করেন না যে ভালো হয় আমরা বরং এখন যার যার পথে বাড়ি যাই গিয়ে।’

শৌখিন ঘোড়সওয়ারদের বিবেচনার জন্য

যদি চিন্তা করেন তো দেখবেন যে কাউকে রেসে জেতার জন্য লোভ-জাগানোর মতো কোনো কিছু আসলে নেই।

ব্যান্ডদলের বাজনা বেজে ওঠার মধ্যে আপনার দেশের সেরা ঘোড়সওয়ার হিসেবে খেতাব পাওয়ার যে গৌরব, তার যে আনন্দ, তা আসলে বেশ উকট, এতটাই যে পরের দিন সকালে আপনার অনুতাপ হতে বাধ্য।

আমরা এই যখন ঘোড়ার পিঠে চড়ে, স্বাগত জানাতে থাকা মানুষের ভিড়ের মধ্যে সরু পথ করে খোলা মাঠে গিয়ে পড়েছি, একটু পরই যখন দূরে দিগন্তরেখার দিকে ছুটে যাওয়া কিছু পরাস্ত ঘোড়সওয়ারের বিন্দুতে পরিণত হয়ে ওঠা আকৃতি বাদে আমাদের সামনে আর কিছু নেই, তখন আমাদের প্রতিপক্ষদের যে ঈর্ষা (ওরা ধূর্ত আর প্রভাবশালীও। বটে) তা আমাদের মন খারাপ করে দেবেই।

আমাদের অনেক বন্ধুর কত তাড়া বাজিতে জেতা টাকা পাওয়ার জন্য, ওরা কোনোমতে শুধু দূরে ঘোড়দৌড়ের বাজির স্টলগুলো থেকে কাঁধ বাঁকিয়ে আমাদের দিকে চিৎকার দিয়ে তাদের হুরেটা জানাল; কিন্তু আমাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধুরা তো কখনো আমাদের ঘোড়াগুলোর ওপর বাজিই ধরেনি, তারা ভয় পাচ্ছিল আমরা হেরে যাব, তখন আমাদের সঙ্গে তাদের খুব রাগারাগি হয়ে যাবে; আর এখন যখন আমাদের ঘোড়া প্রথম হলো আর তারা এক পয়সাও জিততে পারল না, তখন তাদের পাশ দিয়ে আমরা হেঁটে যাওয়ার সময় তারা ঘুরে দাঁড়াল, দর্শক-স্ট্যান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকাটাই বেছে নিল।

আমাদের পেছন দিকে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা, জিনের উপর শক্ত করে বসে আছে, ওদের ওপর যে দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে তার আকার-প্রকারটা বোঝার চেষ্টা করছে, আর ওদের ওপর যেভাবেই হোক যে-অন্যায়টা করা হয়েছে তা-ও বুঝতে চাইছে; ওরা একটা চনমনে চেহারা বানাল, মনে হচ্ছে এখনই যেন নতুন করে আবার রেসটা শুরু হবে– এবার আগেরবারের ছেলেখেলাটার পরে একটা সিরিয়াস রেস।

উপস্থিত অনেক ভদ্রমহিলাই বিজয়ীকে নিয়ে হাসি-তামাশা করছেন, কারণ তাদের চোখে বিজয়ী মানুষটা গর্বে ফেটে পড়ছে, ওদিকে সে জানেও না যে কী করে অবিরাম হ্যান্ডশেক, সালাম, ভক্তিতে গদগদ হয়ে লোকজনের মাথা নোয়ানো আর দূর থেকে হাত নাড়ানো এসব সামাল দিতে হয়; এ সময় হেরে যাওয়া ঘোড়সওয়াররা দেখুন কেমন মুখ বন্ধ করে তাদের ঘোড়াগুলোর (ওগুলোর বেশির ভাগই হেষাধ্বনি করছে) ঘাড়ে আনমনা আদরের চাপড় দিয়ে যাচ্ছে।

আর এতেও যেন হয়নি, তাই আকাশও মেঘমলিন হয়ে উঠেছে, এমনকি বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে।

রাস্তার ধারের জানালা

এমন কারো কথা ভাবুন যে মানুষ জীবন কাটাচ্ছে নিঃসঙ্গভাবে, কিন্তু মাঝেমধ্যেই চাচ্ছে। অন্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটুক; যে মানুষ দিনের বিভিন্ন সময়ের, আবহাওয়ার, তার চাকরিসংক্রান্ত পরিস্থিতির এবং এ রকম আরো অনেক কিছুর অবিরাম পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে চাচ্ছে কোনো একটা বাহু বা অমন কিছু আঁকড়ে ধরতে –ওরকম কোনো মানুষ বেশিদিন টিকতে পারবে না রাস্তার পাশে একটা জানালা ছাড়া। আর এমনকি ধরা গেল যে সে আসলে কোনোকিছুই চাচ্ছে না, স্রেফ তার জানালার পাশে দাঁড়িয়েছে, ক্লান্ত একজন মানুষ, তার দৃষ্টি উপর দিকে আর নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষজন ও আকাশের মধ্যে, সেটাও সে করছে নিতান্ত অনিচ্ছায়, তার মাথা বরং পেছনদিকে সামান্য ঝোকানো– তার পরেও দেখবেন ঐ নিচের ঘোড়াগুলো তাকে টেনে নিয়ে যাবে ওদের ঘোড়ার গাড়ি আর ওদের হই-হট্টগোলের মধ্যে, মানে শেষমেশ মানবজাতির সঙ্গে একাত্মতার ভেতরে।

রেড ইন্ডিয়ান হওয়ার বাসনা

আহ্, কেউ যদি রেড ইন্ডিয়ান হতে পারত, সঙ্গে সঙ্গে তৈরি, টগবগ করে ছুটতে থাকা ঘোড়ার উপরে বসে, বাতাসের মধ্যে শরীর ঝুঁকিয়ে, কাঁপতে থাকা মাটির উপর দিয়ে উড়ে যেত দ্রুত কাঁপন তুলে, যেত আর যেত যতক্ষণ না ঘোড়া চালানোর জুতোর নালের আর দরকার নেই, কারণ নাল খুলে চলে যেত, যতক্ষণ না ছুঁড়ে ফেলত ঘোড়ার লাগাম, কারণ লাগাম বলতে কিছু আদতে ছিলই না, আর বলতে গেলে দেখতেই পেত না যে সামনের বিশাল প্রান্তরটি তার সামনে খুলে গেছে এক সুন্দরভাবে ঘাস-ছাঁটা বিরানভূমি হয়ে, যখন কিনা ঘোড়ার গ্রীবা ও মাথা– দুই-ই এরই মধ্যে হাওয়া।

গাছ

যেহেতু আমরা হচ্ছি তুষারে গাছের গুঁড়িগুলোর মতো। আপাতদৃষ্টিতে ওগুলো মাটিতে, তুষারের উপরে, কী সুন্দর পড়ে আছে আর সামান্য একটা ধাক্কাতেই আমরা যেন ওদের সরাতে পারব মনে হয়। না, আপনি তা পারবেন না, কারণ ওরা শক্ত করে মাটিতে গাঁথা। কিন্তু দেখুন, সেটাও স্রেফ আপাতদৃষ্টিতেই।

বিমর্ষতা

নভেম্বরের এক সন্ধ্যার দিকে যখন সবকিছু এরই মধ্যে অসহ্য হয়ে উঠেছে, আর আমি আমার ঘরের সরু কার্পেটের উপরে (যেন এটা কোনো ঘোড়দৌড়ের মাঠ) দৌড়ে হাঁটা শুরু করেছি, বাইরের আলো-জ্বলে-ওঠা রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে পেছন ফিরেছি, আর ঘরের উল্টো পাশটায়, আয়নার গভীরে, আমার জন্য খুঁজে পেয়েছি একটা নতুন লক্ষ্য, আর জোরে চিৎকার করে উঠেছি (আমার কানে ফিরে এসেছে নিজেরই চিৎকার, এমন চিৎকার যার উত্তরে কিছুই শুনবেন না, কোনোকিছুই পারে না যে-চিৎকারের শক্তিকে খাটো করতে, যার ফলে চিৎকারটা সমানে বাড়তেই থাকে উল্টো কোনো শক্তির অভাবে, আর চিৎকারের শব্দ মরে গেলেও চিৎকারটা থেকে যায়)– সে সময়ে দড়াম করে দরজাটা খুলে গেল ভেতরের দিকে, কী যে বিদ্যুদ্গতিতে (কারণ একমাত্র গতিরই দরকার ছিল), আর নিচের রাস্তায় এমনকি চার-চাকার ঘোড়াগাড়িগুলোর সব ঘোড়া। তাদের গলা মেলে ধরে পেছানোর জন্য পায়ের উপর খাড়া হয়ে গেল, যেন যুদ্ধের মাঠে পাগলা হয়ে ওঠা ঘোড়া ওরা।

গাঢ়-অন্ধকার বারান্দা থেকে, যেখানে এখনো বাতি জ্বলানো হয়নি, একটা ছোট বাচ্চাছেলের ভূত বেরিয়ে এল, তারপর ওটা একটা হালকা দুলতে থাকা মেঝের তক্তায় থামল বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে। ঘরটার আধো-আলোতে সঙ্গে সঙ্গে ধাঁধিয়ে গেল তার চোখ, সে এমন একটা ভঙ্গি করল যে দুই হাতের মধ্যে মুখ ঢাকবে, কিন্তু তখনই হঠাৎ জানালার দিকে এক পলক তাকিয়ে বিরাট শান্তি পেল সে, এখানে জানালার শিকের বাইরে দেখা যাচ্ছে নিচে রাস্তা থেকে উঠে আসা অস্পষ্ট আলো এসে শেষমেশ মিশে গেছে ঘন অন্ধকারের সঙ্গে। ওখানেই খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল সে, তার ডান কনুই দেয়ালে ঠেস দিয়ে– বাইরে থেকে আসা বাতাস খেলা করছে তার গোড়ালিতে আর বয়ে যাচ্ছে তার ঘাড় ও কপালের দুপাশে।

আমি তার দিকে খানিকক্ষণ তাকালাম, তারপর বললাম, ‘শুভ সন্ধ্যা আর ওখানে অর্ধেক ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাচ্ছি না বলে উনানের সামনেটা ঘের দেওয়া জাফরি থেকে আমার জ্যাকেট হাতে তুলে নিলাম। কিছুক্ষণের জন্য আমি মুখটা হাঁ করে খুলে রাখলাম যেন আমার ভেতরকার উত্তেজনা বেরিয়ে যাওয়ার একটা পথ পায়। আমার মুখে কেমন একটা বাজে স্বাদ পেলাম, আর দেখলাম যে আমার চোখের পাতা থিরথির করে কাঁপছে; আসলে ওর এই এসে হাজির হওয়াটা (স্বীকার করছি আমি তার আশাই করছিলাম) আমার জন্য দরকার ছিল খুবই।

বাচ্চাটা এখনো দেয়ালের পাশে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে; ডান হাত সে হেলান দিয়ে রেখেছে প্লাস্টারের গায়ে আর গাল দুটো লাল বানিয়ে খুবই অবাক হয়ে গেছে যে সাদা রং করা দেয়ালের উপরটা এ রকম আঁশ-আঁশ, আর তাতে করে তার আঙুলের

ডগাগুলো কেমন যেন ছিলে যাচ্ছে। আমি বললাম : ‘তুমি কি সত্যি আমাকেই খুঁজছ? ভুল হয়নি তো তোমার? এই বিশাল বিল্ডিংয়ে ভুল করার চেয়ে সোজা আর কোনো কাজ নেই। আমার নাম হলো অমুক-অমুক আর আমি তিনতলায় থাকি। এখন বল, তুমি কি আমার সঙ্গেই দেখা করতে চাচ্ছ?

‘চুপ, চুপ। বাচ্চাটা বলল দুশ্চিন্তার স্বরে, ‘সব ঠিক আছে।’

‘তাহলে ভিতরে আসো। আমার দরজা বন্ধ করতে হবে।’

‘এই যে আমিই বন্ধ করে দিলাম। তোমার চিন্তা করতে হবে না। একদম শান্ত হও।’

‘চিন্তা-টিন্তার কোনো ব্যাপার না এটা। এই বারান্দার সঙ্গে লাগোয়া ঘরগুলোয় অনেক মানুষ থাকে, আমি তাদের সবাইকেই চিনি; মোটামুটি এদের সবারই কাজ থেকে বাসায় ফেরার সময় হয়ে গেছে; এরা যদি কোনো একটা ঘরে কথাবার্তা চলছে শোনে তো ভাবে যে সোজা ঐ ঘরে ঢুকে গিয়ে কী হচ্ছে তা দেখার তাদের পুরো অধিকার আছে। এরকমই নিয়ম এখানে। এদের সবার সারা দিনের কাজকর্ম শেষ; এখন এদের এই সন্ধ্যাবেলার স্বাধীনতার সময়টাতে, মোটামুটি নিজের সময়টাতে, এরা কি আর কারো আদেশ শুনবে! আমি যেমন সেটা বুঝি, তুমিও বোঝে। আমাকে দরজা আটকাতে দাও।’

‘কী বলতে চাচ্ছ? তোমার সমস্যাটা কী? সারা বাড়ির সবাই এখানে চলে আসলেও তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আর আবারও বলছি : আমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছি, তোমার কি মনে হয় যে দরজা তুমি একাই বন্ধ করতে পারো? আমি এমনকি তালায় চাবিও দিয়ে দিয়েছি।’

‘ঠিক আছে তাহলে। আমার চাওয়া এটুকুই। তালা দেওয়ার কোনো দরকার ছিল না। আর তুমি যখন এখানে এসেই গেছ, তাহলে আরাম করে বসো। তুমি আমার মেহমান। আমাকে তুমি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারো। আমার ঘরে আরাম করে বসা নিয়ে কোনো ভয়টয় পেয়ো না। আমি তোমাকে থাকতেও জোর করবো না, যেতেও না। আমার কি সেটা সত্যি বলে দিতে লাগবে? তুমি কি আমাকে এত কম চেনো?’

‘না। তোমার সত্যিই এ কথাটা বলার দরকার ছিল না। তার চেয়ে বড় কথা, কথাটা তোমার বলা উচিত হয়নি। আমি একটা বাচ্চা ছেলে; আমাকে নিয়ে এত নাটক করার কী আছে?’

‘তা আমি করছি না। বাচ্চা ছেলে, অবশ্যই। কিন্তু তাই বলে অত ছোটও তুমি না। ভালোই বড় হয়েছ তুমি। যদি তুমি মেয়ে হতে, তাহলে এভাবে আমার সঙ্গে একটা ঘরে তালা মেরে থাকা সমস্যা হয়ে যেত।’

‘ওটা নিয়ে আমাদের চিন্তা না করলেও চলবে। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি : তোমাকে যে এত ভালোভাবে চিনি, তাতে আমার খুব যে বিপদ কেটে যায় তা না; এতে করে স্রেফ তোমার আর আমাকে মিথ্যা বলার কষ্টটা করতে হয় না। ওটুকুই। তার পরও কিনা তুমি আমার প্রশংসা করে যাচ্ছ। বন্ধ করো, আমি তোমাকে জোর দিয়ে বলছি ওসব বলা বন্ধ করো। তা ছাড়া, আমি তোমাকে সব সময় সবখানে চিনতেও পারি না, বিশেষ করে এই যেমন এই অন্ধকারে। খুব ভালো হয় তুমি যদি বাতি জ্বালাও। না, তাতে মনে হয় কাজ হবে না। যা-ই বল না কেন, আমি এটা ভুলছি না যে তুমি আমাকে হুমকি-ধমকি দিয়েছ।’

‘কী বললা? তোমাকে হুমকি দিয়েছি? প্লিজ। আমি শুধু খুশি যে তুমি শেষমেশ এসেছ। “শেষমেশ” বলছি কারণ বেশ দেরি হয়ে গেছে –এরই মধ্যে। আমি বুঝতে পারি না যে তুমি এত দেরি করে কেন এলে। এমনটা হওয়া খুব সম্ভব যে তোমাকে দেখে খুশি হওয়ার চোটে আমি একটু তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি, সেজন্যই আমার কথাটা তুমি ভুল বুঝেছ। আমি আরো দশ-দশবার বলব যে আমি আসলেই গোল পাকিয়ে ফেলেছি; হ্যাঁ, ঠিক আছে, তোমাকে অনেক হুমকি-ধমকি দিয়েছি আমি।– কোনো ঝগড়াঝাটি আমরা না করি, খোদার দোহাই!– কিন্তু তুমি এটা বিশ্বাস করতে পারলে কী করে? আমাকে এভাবে আঘাত দিতে পারলে তুমি? তোমার এই সামান্য সময়ের জন্য বেড়াতে আসাটা গুবলেট না করলে কি তোমার চলছে না? একেবারে অচেনা কেউও তো আমার সঙ্গে এর চেয়ে ভালোভাবে মানিয়ে নিতো।’

‘তোমার এ কথাটা মানলাম, কিন্তু এটা বলার জন্য কোনো বিরাট বুদ্ধি লাগে না। অচেনা কেউ তোমার যত কাছেই আসুক না কেন, আমি স্বভাবগতভাবে এমনিই তোমার অতটা কাছাকাছি। আর তা ছাড়া তুমি এটা জানো, অতএব এত হা-হুঁতাশ করছ কেন? তুমি যদি সত্যি নাটক করতে চাও, সোজাসুজি বলে দাও, আমি এক্ষুনি বেরিয়ে যাব।’

‘বাব্বা। এমনকি আমাকে এটা বলতেও তোমার বুকে কুলাল? একটু বেশি সাহস হয়ে যাচ্ছে না তোমার? ভুলে যেয়ো না, তুমি এখন আমার ঘরে। ওটা আমার দেয়াল যেটাতে তুমি পাগলের মতো আঙুল ডললে । আমার নিজের ঘর, আমার নিজের দেয়াল! আর তা ছাড়া, তুমি যা বললে তা শুধু ধৃষ্টতাই না, হাস্যকরও। তুমি বললে কী যে, তোমার স্বভাবের কারণে তুমি বাধ্য হয়েছ আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে। তাই নাকি? তোমার স্বভাব তোমাকে বাধ্য করেছে? তোমার স্বভাবকে তো তাহলে ধন্যবাদ দিতে হয়! তোমার স্বভাব হচ্ছে আমার স্বভাব, আর আমি যদি স্বভাবগতভাবে তোমার সঙ্গে বন্ধুর আচরণ করি, তাহলে তোমাকেও আমার সঙ্গে তা-ই করতে হবে।’

‘এটাকে তুমি বলছ বন্ধুর মতো আচরণ?’

‘আমি আগের কথা বলছি।’

‘তুমি কি জানো আমি পরে কী রকম হব?’

‘আমি কিছুই জানি না।’

আমি হেঁটে গেলাম বিছানার পাশের টেবিলের কাছে, আর মোমবাতি জ্বালালাম। সে সময়ে আমার ঘরে না আছে গ্যাস, না আছে বৈদ্যুতিক বাতি। তারপর টেবিলটাতে বসলাম কিছুক্ষণ, একসময় তাতেও বিরক্তি ধরে গেল, ওভারকোট গায়ে চাপালাম, সোফা থেকে আমার হ্যাটটা তুলে নিলাম আর মোমবাতি নিভিয়ে দিলাম ফুঁ দিয়ে। বাইরে যাওয়ার সময়ে চেয়ারের একটা পায়ায় হোঁচট খেলাম।

সিঁড়িতে আমার তলারই এক ভাড়াটের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

‘পাজির পাজি, তুমি আমার বাইরে যাচ্ছ?’ সিঁড়ির দুই ধাপে দুই পা রেখে বলল সে।

‘তা ছাড়া করব কী?’ আমি বললাম, আমার ঘরে এইমাত্র একটা ভূত এসেছিল।‘

‘এমন বিতৃষ্ণা নিয়ে বলছ যেন তোমার স্যুপের মধ্যে তুমি একটা চুল পেয়েছ।‘

‘ঠাট্টা করতে পারো। কিন্তু শুনে নাও : ভূত ভূতই।‘

‘মানলাম সত্যি। কিন্তু ধরো, কেউ যদি ভূতে বিশ্বাসই না করে?’

‘তুমি নিশ্চয় ভাবছ না যে আমি ভূতে বিশ্বাস করি? তবে আমার বিশ্বাস না করাটা কি আমার কোনো কাজে আসছে?’

‘খুব সোজা। সেটা হলে পরের বার যখন সত্যি তোমার কাছে ভূত আসবে, তখন তুমি ভয় পাবে না।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু সেই ভয় তো ফালতু একটা ভয়। সত্যিকারের ভয় তো হচ্ছে মরা মানুষের আত্মা কী কারণে ভূত হয়ে এল তা নিয়ে ভয়। আর ওই ভয়টা থেকেই যায়। আমি এখন ওই ভয়টাতে ডুবে আছি, ভয়টার সব রং-রসের মধ্যে। আমার প্রচণ্ড উদ্বেগ থেকেই আমি আমার সবগুলো পকেট হাতড়াতে লাগলাম।‘

‘কিন্তু ভূতটাতে যেহেতু তুমি ভয় পাওনি, তুমি তো আরামসে ভূত হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে ওর কাছে জানতে চাইতে পারতে?’

‘পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তুমি কখনো ভূতের সঙ্গে কথা বলনি। ওদের কাছ থেকে কখনোই কোনো সোজা উত্তর পাওয়া যায় না। ওরা সবই কথা বলে এরকম-ওরকম। নিশ্চিত করে কিছু বলে না। এই ভূতগুলো দেখলে মনে হয় নিজেদের অস্তিত্বের ব্যাপারে আমাদের চেয়েও ওদের অনিশ্চয়তা অনেক বেশি, ওদের ওই ভাঙাচোরা অবস্থা দেখলে তাতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু থাকে না।‘

‘তবে আমি শুনেছি, ওদের খাইয়ে ঠিকঠাক মোটাতাজা করা সম্ভব।‘

‘এটা তুমি সত্যি ঠিক শুনেছ, তা করা যায়। কিন্তু কেউ কি আছে যে তা করবে?’

‘কেন না? ধরো, ভূতটা যদি মেয়ে-ভূত হয় তো, কেন না? সে বলল, দুলে গিয়ে দাঁড়াল উপরের ধাপটায়।

‘ওহ্ বুঝেছি, আমি বললাম, কিন্তু তার পরও পোষাবে না, কোনো মানে হয় না।‘

ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলাম আমি। এরই মধ্যে আমার প্রতিবেশী সিঁড়ির এত উপরেই উঠে গেছে যে সিঁড়িঘরের একটা বাঁক থেকে তাকে ঝুঁকে দেখতে হচ্ছে আমার। তার পরও, আমি চেঁচিয়ে বললাম, তুমি যদি আমার ভূতটা আমার কাছ থেকে নিয়ে যাও, ঐ উপরে, তাহলে আমার সঙ্গে তোমার সব সম্পর্ক শেষ– চিরদিনের জন্য।’

‘ওহ্, আমি তো স্রেফ ঠাট্টা করছিলাম,’ সে তার মাথা পেছনে সরিয়ে নিয়ে বলল।

‘তাহলে ঠিক আছে,’ আমি বললাম, এখন আর আমার শান্ত মনে বাইরে গিয়ে একটু হেঁটে আসতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু আমার এত বেশি একা লাগল যে সিঁড়ি দিয়ে উপরে ফেরত গেলাম, আমার বিছানায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *