০১. বাংলায় ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা  (১৭৬৫-১৭৮৫)

প্রথম অধ্যায় – বাংলায় ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা  (১৭৬৫-১৭৮৫)

১. ইংরেজ আমলের আরম্ভ–দ্বৈত-শাসন

সিরাজউদ্দৌল্লাকে পদচ্যুত করিয়া নবাব হইবার জন্য মীর জাফর ইংরেজদের সঙ্গে ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ১লা যে গোপনে যে সন্ধি করেন তাহার একটি শর্ত ছিল এই যে, সুবে বাংলাকে ফরাসী ও অন্যান্য শত্রুদের আক্রমণ হইতে রক্ষার নিমিত্ত ইংরেজ কোম্পানি উপযুক্ত সংখ্যক সৈন্য নিযুক্ত করিবে এবং তাহার ব্যয় নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত জমি কোম্পানিকে দিতে হইবে। মীর কাশিম ইংরেজদের সঙ্গে যে গোপন সন্ধির দ্বারা মীর জাফরকে সরাইয়া নিজে নবাব হইলেন তাহার শর্ত অনুসারে তিনি ইংরেজসৈন্যের ব্যয় নির্বাহের জন্য বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম–এই তিন জিলার রাজস্ব কোম্পানিকে দিলেন। ইহার পর মীর কাশিমের সহিত যুদ্ধ বাধিলে মীর জাফর পুনরায় নবাব হইবার জন্য ইংরেজের সহিত যে সন্ধি করিলেন তাহার শর্ত অনুসারে ইংরেজ কোম্পানি ঐ তিনটি জিলা হস্তগত করিল এবং স্থির হইল যে বাংলার নবাব বারো হাজার অশ্বারোহী ও বারো হাজার পদাতিকের বেশী সৈন্য রাখিতে পারিবেন না। ইহার ফলে বাংলা দেশের সামরিক শক্তি ইংরেজদের হাতেই ন্যস্ত হইল। সুতরাং ইচ্ছা থাকিলেও নবাব তাহাদের বিরুদ্ধাচরণের ক্ষমতা হারাইলেন। ইংরেজের নির্দেশ অনুসারে চলা ভিন্ন তাহার কোন গত্যন্তর রহিল না।

মীর জাফরের মৃত্যুর পর ইংরেজ তাঁহার নাবালক পুত্র নজমুদ্দৌল্লাকে এই শর্তে নবাব করিলেন যে, তিনি নামে নবাব থাকিবেন, কিন্তু সমস্ত শাসনক্ষমতা একজন নায়েব-নাজিম বা নায়েব-সুবাদারের হস্তে থাকিবে এবং ইংরেজের অনুমোদন ব্যতীত নবাব কোন নায়েব-সুবাদার নিযুক্ত বা বরখাস্ত করিতে পারিবেন না।

১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই অগস্ট সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ইংরেজ কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ান নিযুক্ত করিয়া ফরমান দিলেন। ইহার ফলে সমগ্র দেশের রাজস্ব আদায়ের ভারও ইংরেজরা পাইল। স্থির হইল যে প্রতি বৎসর আদায়ী রাজস্ব হইতে দিল্লীর সম্রাট ও বাংলার নবাব বার্ষিক নির্ধারিত বৃত্তি পাইবেন–বাকী টাকা ইংরেজেরা ইচ্ছামত ব্যয় করিবে। এইরূপে ক্রমে ক্রমে মুর্শিদাবাদে ইংরেজের বৃত্তিভোগী একজন নামসর্বস্ব নবাব রহিলেন, কিন্তু সামরিক শক্তি, শাসনক্ষমতা ও ধনসম্পদ এ সকলই ইংরেজদের অধিকারে আসিল। সুতরাং একথা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে বাংলায় নবাবের রাজত্ব শেষ হইল এবং নামে না হইলেও কার্যতঃ ইংরেজ কোম্পানির রাজত্ব আরম্ভ হইল। ক্লাইব ১৭৬৫ সনে দ্বিতীয়বার বাংলার গর্ভনর হইয়া আসার পরই দিল্লীর বাদশাহের নিকট হইতে পূর্বোক্ত দেওয়ানির সনদ লাভ করেন। সুতরাং পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া ক্লাইব বাংলায় ইংরেজের যে প্রভুত্বের সূচনা করেন, আট বৎসর পরে তিনিই তাহা সুদৃঢ় ভিত্তির উপর ন্যায়সংগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। দিল্লীর বাদশাহের বৃত্তি ২৬ লক্ষ টাকা কয়েক বৎসর পরেই বন্ধ করা হইল। বাংলার নবাবের বার্ষিক বৃত্তি ৫৩ লক্ষ টাকা কমাইয়া ১৭৬৬ খ্রীষ্টাব্দে ৪১ লক্ষ এবং ১৭৬৯ খ্রীষ্টাব্দে ৩২ লক্ষ করা হইয়াছিল।

এইরূপে বাংলায় যে শাসনপ্রণালী প্রতিষ্ঠিত হইল তাহা সাধারণতঃ দ্বৈত শাসন নামে অভিহিত হয়। কারণ প্রত্যক্ষভাবে ও নামতঃ নবাবের শাসনই বজায় থাকিল, কিন্তু কার্যতঃ পরোক্ষভাবে প্রকৃত ক্ষমতা রহিল ইংরেজদের হাতে। ক্লাইব ইচ্ছা করিলে নবাবকে সরাইয়া সরাসরি ইংরেজরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিতেন কিন্তু সম্ভবতঃ তিনি মনে করিতেন যে এইরূপ করিলে স্বল্পসংখ্যক বিদেশী বণিকের আধিপত্যে দেশের লোকেরা অসন্তুষ্ট হইয়া নানাপ্রকার বিরোধ ও গোলযোগের সৃষ্টি করিবে এবং বিদেশী অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায়ও তাহাদের বিরুদ্ধে বাংলার অধিবাসীদের পক্ষ সমর্থন করিবে। এইজন্য তিনি ইংরেজপ্রভুত্বের উপর একটি আবরণ রাখিয়া দিলেন, যাহাতে প্রকৃত রাষ্ট্রবিপ্লবের চিত্রটি জনসাধারণের নিকট স্পষ্টরূপে প্রতিভাত না হইয়া ক্রমশঃ ধীরে ধীরে প্রকট হয়। ক্লাইবের এই বিচক্ষণ কূটনীতি অনেকেই সমর্থন করিয়াছেন।

ক্লাইব দ্বিতীয়বার গভর্নর হইয়া মাত্র দুই বৎসর কাল এদেশে ছিলেন। কিন্তু এই অল্পকালের মধ্যেই কোম্পানির আভ্যন্তরিক ব্যবস্থার অনেক সংস্কার সাধন করিয়াছিলেন। কোম্পানির কর্মচারীরা অসৎ উপায়ে ব্যবসা করিয়া বহু অর্থ উপার্জন করিত এবং প্রত্যেক নূতন নবাবের নিকট হইতে প্রচুর ‘উপঢৌকন’ অর্থাৎ উৎকোচ গ্রহণ করিত। বহু বাধা সত্ত্বেও ক্লাইব এই উৎকোচ প্রথা রহিত করিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন এবং কিছু পরিমাণে কৃতকার্য হন। কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের প্রথাও তিনি রহিত করেন। সৈনিক কর্মচারীরা বহুদিন যাবৎ বেআইনীভাবে বেতনের অতিরিক্ত যে ভাতা পাইয়া আসিতেছিল তাহাও তিনি বন্ধ করেন। ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া কর্মচারীরা একযোগে কর্মত্যাগ করিল। কিন্তু ক্লাইব দৃঢ়তার সহিত এই বিদ্রোহ দমন করিলেন এবং শীঘ্রই সৈন্যদলে শৃঙ্খলা ফিরিয়া আসিল।

১৭৬৭ সনের ফেব্রুআরি মাসে ক্লাইব স্বদেশে ফিরিয়া গেলেন। তিনি যে অদ্ভুত সামরিক প্রতিভা ও শাসনকার্যে দক্ষতার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহার জন্য তিনি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইবেন। উমিচাঁদকে প্রতারণা করিবার জন্য জাল উইল তৈরী করা তাঁহার চরিত্রে একটি দুরপনেয় কলঙ্ক। কিন্তু “জালিয়াৎ ক্লাইব”–এই আখ্যা সত্য হইলেও তাঁহার চরিত্রের মহৎ গুণগুলিও স্মরণ রাখা উচিত। তিনি যে মীর জাফরের নিকট হইতে বহু অর্থ ও সম্পত্তি লাভ করিয়াছিলেন তাহা কতটা বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত ছিল এ-বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। তাঁহার দৃষ্টান্ত অনুকরণ করিয়া অন্যান্য ইংরেজ গভর্নর ও কর্মচারীরা বাংলার নবাবের নিকট হইতে বহু অর্থ আদায় করিয়াছিলেন এবং তাহার ফলে মুর্শিদাবাদের রাজকোষে সঞ্চিত বিপুল সম্পদ প্রায় নিঃশেষিত হইয়াছিল। এই সমুদয় কারণে বিলাতের কর্তৃপক্ষ ক্লাইবকে যথোচিত সমাদর বা সম্মান করেন নাই, বরং অন্যায় কার্য ও অসদুপায়ে স্বার্থসিদ্ধির অভিযোগ আনিয়া তাঁহাকে যথেষ্ট লাঞ্ছিত করিয়াছিলেন। এই অসম্মান অসহ্য হওয়ায় অবশেষে ক্লাইব আত্মহত্যা করেন (১৭৭৪ খ্র.)। ক্লাইবের চরিত্রে দোষগুণ উভয়ই ছিল কিন্তু তাহার অসাধারণ প্রতিভাই যে ভারতে ইংরেজরাজত্বের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছিল ইহাতে কোন সন্দেহ নাই।

ক্লাইবের পর প্রথমে ভেরেষ্ট (Verelst) ও পরে কার্টিয়ার (Cartier) ১৭৬৯ সনে ইংরেজ কোম্পানির গভর্নর হইলেন। এই সময়ে ইংরেজ কর্মচারীরা নানা অসৎ উপায়ে প্রজাগণকে উৎপীড়িত করিয়া নিজেদের জন্য বহু অর্থ উপার্জন করিতে ব্যস্ত ছিলেন–দেশশাসনের কোন দায়িত্বই তাঁহারা পালন করিতেন না। কোম্পানি নামে দেওয়ান ছিলেন, কিন্তু বাংলায় দেওয়ানির কাজ প্রকৃতপক্ষে করিতেন নায়েব-দেওয়ান মুহম্মদ রেজা খা। কোম্পানি তাহার কুশাসন ও অসদুপায়ে অর্থ উপার্জন প্রভৃতির জন্য তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনিলেন, কিন্তু ইহা প্রমাণিত হইল না। বরং বাঙ্গালীর দুঃখ-দুর্দশা চরমে পৌঁছিল। কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী রিচার্ড বেচার ১৭৬৯ সনের ২৪শে মে বিলাতের কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিলেন : “কোম্পানির দেওয়ানি লাভের ফলে প্রজাসাধারণের যেরূপ দুর্দশা হইয়াছে ইহার পূর্বে কখনও সেরূপ হয় নাই। বহু স্বেচ্ছাচারী নবাবের আমলেও যে দেশ অতুল সুখ ও সম্পদের অধিকারী ছিল তাহা ধ্বংসের সীমানায় পৌঁছিয়াছে।” এই উক্তি যে কতদূর সত্য শীঘ্রই তাহা প্রমাণিত হইল। বাংলা ১১৭৬ সালে (১৭৬৯-৭০ খ্রীষ্টাব্দে) বাংলা দেশে এক ভীষণ দুর্ভিক্ষ হইল। ইহার ফলে প্রায় এক কোটি অর্থাৎ মোট অধিবাসীর এক-তৃতীয়াংশ লোক অনাহারে ও পীড়ায় মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং কৃষিযোগ্য জমির এক-তৃতীয়াংশ জঙ্গলে পরিণত হয়। একজন ইংরেজ কর্মচারী ১৭৭০ সনে লিখিয়াছিলেন “বাংলার দুরবস্থা কল্পনা ও বর্ণনার অতীত-এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে, বহুস্থানে মৃতের মাংস খাইয়া লোকে জীবনধারণের চেষ্টা করিয়াছে।” এই দুরবস্থার সুযোগে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরা চাউল কিনিয়া মজুত রাখিয়া পরে চড়া দামে বিক্রয় করিয়া বহু অর্থ লাভ করিয়াছিল। অথচ এই দুর্ভিক্ষপীড়িত লোকেদের নিকট হইতে জোরজবরদস্তি করিয়া খাজনা আদায় করা হইয়াছিল। চরম দুরবস্থার অজুহাতেও শতকরা পাঁচ টাকার বেশি খাজনা মাপ করা হয় নাই এবং পরের বৎসর শতকরা দশটাকা খাজনা বৃদ্ধি করা হইয়াছিল। বহু সম্ভ্রান্ত পরিবার ও সাধারণ গৃহস্থ সর্বস্বান্ত হইয়াছিল। প্রায় বিশ-ত্রিশ বৎসর পর্যন্ত বাংলা দেশে এই দুর্ভিক্ষের চিহ্ন লোপ পায় নাই। এই দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে প্রসিদ্ধ। সাহিত্যম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই করাল দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় তাঁহার প্রসিদ্ধ উপন্যাস ‘আনন্দমঠে’র কাহিনী রচনা করিয়া ইহাকে অমর করিয়া গিয়াছেন। তিনি অতুলনীয় ভাষায় এই দুর্ভিক্ষের যে ভয়াবহ চিত্র আঁকিয়াছেন তাহা বাস্তব ঘটনা-কাল্পনিক নহে।

এই দুর্ভিক্ষের দুই বৎসর পরেই (১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দ) ওয়ারেন হেস্টিংস (Warren Hastings) বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির গভর্নর নিযুক্ত হইলেন। তাঁহার আমলে বাংলার শাসনব্যবস্থায় গুরুতর পরিবর্তন সাধিত হয়।

২. ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৭২-১৭৮৫)

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলে বিলাতে কোম্পানির কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে কুশাসনের সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করিতে পারিলেন এবং প্রধানতঃ ‘দ্বৈতশাসন প্রণালীই যে ইহার জন্য দায়ী তাহাও হৃদয়ঙ্গম করিলেন। সুতরাং অতঃপর যাহাতে এদেশের শাসনভার ইংরেজ কর্মচারীর হস্তেই ন্যস্ত হয় এই নির্দেশ দিয়াই ওয়ারেন হেস্টিংসকে বাংলার গভর্নর নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন।

বাংলায় ইংরেজি আমলের ইতিহাসে দুইটি কারণে হেস্টিংসের শাসনকাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমতঃ এই সময়েই ইংরেজ কোম্পানি নিজের হাতে দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। দ্বিতীয়তঃ বাংলার বাহিরে যে সমুদয় স্বাধীন রাজ্য ছিল তাহাদের সহিত মিত্রতা ও সংঘর্ষের ফলে ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ভারতের অন্যতম প্রধান রাজশক্তিতে পরিণত হয়।

(ক) শাসনসংস্কার

বাংলার নবাবেরা একাধারে নাজিম ও দেওয়ান ছিলেন। নাজিম হিসাবে তাঁহারা শাসন ও বিচারকার্য করিতেন, রাজ্যের আভ্যন্তরিক শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখিতেন, এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ হইতে রাজ্য রক্ষা করিতেন। দেওয়ান হিসাবে তাঁহারা রাজস্ব আদায় করিতেন। নাজিমের ক্ষমতা নামে নবাবের হাতে থাকিলেও, নায়েব-নাজিমের নিয়োগ ইংরেজের হাতে থাকায় কিরূপে প্রকৃত ক্ষমতা ইংরেজের হাতে চলিয়া যায় পূর্বে তাহার উল্লেখ করিয়াছি। ১৭৬৫ সনে ইংরেজ কোম্পানি দেওয়ান নিযুক্ত হওয়ায় নবাবদের হাত হইতে রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ইংরেজদের হাতেই গেল। কিন্তু এই সমুদয় ক্ষমতাই এতদিন পর্যন্ত ইংরেজের অধীনে এদেশীয় কর্মচারীরাই পরিচালনা করিতেন। সুতরাং পুরাতন ঠাট বজায় থাকায় রাজ্যশাসনের প্রকৃত ক্ষমতা যে নবাবের হাত হইতে বিদেশী ইংরেজ কোম্পানির হাতে চলিয়া গিয়াছে সাধারণ লোকে ইহা সহজে বুঝিতে পারিত না। ইংরেজেরাও তাহাদের প্রকৃত রাজশক্তি একটি সূক্ষ্ম আবরণ দ্বারা লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখিতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন। কিন্তু সকল দেশের ইতিহাসেই দেখা যায় যে রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতা একজনের হাতে ও নামমাত্র দায়িত্ব আর-একজনের হাতে থাকিলে শাসনকার্যে নানা বিশৃঙ্খলা ঘটে এবং ক্রমশঃ শাসনযন্ত্র বিকল হইয়া যায়। বাংলা দেশেও তাহাই ঘটিয়াছিল এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে এই ভীষণ অবস্থা বিশেষভাবে প্রকট হইয়া উঠিয়াছিল। সুতরাং অনেক বিচার ও বাদানুবাদের পর ইংরেজ কোম্পানি নিজের হাতে শাসনভার গ্রহণ করা স্থির করিলেন। অতঃপর হেস্টিংস নানা উপায়ে ইহা কাজে পরিণত করিলেন।

হেস্টিংস গভর্নর হইয়াই দেওয়ানী কার্যের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী মুহম্মদ রেজা খা ও সিতাব রায়কে বরখাস্ত করিলেন এবং প্রতি জিলায় কলেক্টর (Collector) নামে ইহার জন্য একজন ইংরেজ কর্মচারী নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু রাজস্বকাজের খুঁটিনাটি বিষয়ে ইহাদের কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। মুঘল আমলের শেষভাগে বাংলা দেশে প্রজাগণের জমি মাপিয়া নির্দিষ্ট হারে খাজানা বন্দোবস্ত করা হইত না। এক একজন জমিদারের নিকট হইতে থোক টাকা লইয়া তাহার হাতে রাজস্ব আদায়ের ভার ছাড়িয়া দেওয়া হইত। মীর কাশিমের পর এ-ব্যবস্থা অচল হইল এবং তাঁহার প্রবর্তিত বর্ধিত হারে খাজানা দেওয়া দরিদ্র প্রজাদের পক্ষে অসম্ভব হইল। তখন সরকারী তহশীলদারগণ প্রজাদের মারপিট করিয়া খাজানা আদায় করিত। হেস্টিংস জমির অস্থায়ী বন্দোবস্ত করিলেন। প্রতি বৎসর নিলাম ডাকিয়া সর্বোচ্চ দরে এক এক জনকে এক এক জমিদারী ইজারা দেওয়া হইত। কেবল একবারমাত্র পাঁচ বৎসরের জন্য ইজারা দেওয়া হইয়াছিল। ইজারাদারেরা তাঁহাদের মেয়াদের কালের মধ্যে প্রজাদের নিকট হইতে যতদূর সম্ভব রাজস্ব সংগ্রহের চেষ্টা করিতেন। ইহার অবশ্যম্ভাবী ফল হইল প্রজার উৎপীড়ন, চাষের অবনতি, জমিদারী প্রথার ধ্বংস এবং সরকারের বার্ষিক রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ হ্রাস।

প্রত্যেক জিলায় একটি দেওয়ানী এবং একটি ফৌজদারী আদালত স্থাপিত হইল। রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রতি জিলায় যে ইংরেজ কর্মচারী (Collector) থাকিতেন তিনিই দেওয়ানী আদালতের বিচারকার্যও করিতেন। ফৌজদারী আদালতের নায়েব-নাজিমের অধীনে এদেশীয় লোকই ম্যাজিষ্ট্রেট ও বিচারকের কার্য করিতেন। কলিকাতায় দেওয়ানী বিচারের জন্য সদর দেওয়ানী আদালত এবং ফৌজদারী বিচারের জন্য সদর নিজামৎ আদালত নামে দুইটি আপিল আদালত প্রতিষ্ঠিত হইল। ইংরেজ গভর্নরই সদর দেওয়ানী আদালতের অধ্যক্ষ ছিলেন। সদর নিজামৎ আদালতে একজন মুসলমান অধ্যক্ষ নিযুক্ত হইতেন।

১৭৭৩ সনে নভেম্বর মাসে কলেক্টরের পদ উঠাইয়া দেওয়া হইল এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, দিনাজপুর, ঢাকা ও পাটনায় একটি করিয়া প্রাদেশিক সমিতি (Provincial council) এবং কলিকাতায় একটি রাজস্ব কমিটি (Committee of Revenue) স্থাপিত হইল। প্রত্যেক প্রাদেশিক সমিতিতে একজন অধ্যক্ষ (Chief) ও চারিজন অভিজ্ঞ ইংরেজ কর্মচারী থাকিতেন এবং ইহার সহিত একটি বিচারালয় যুক্ত হইত। সমিতির সভ্যগণ পালা করিয়া এক মাসের জন্য ইহার তদারক করিতেন।

(খ) অযোধ্যা ও রোহিলখণ্ড

অযোধ্যার নবাব শুজাউদ্দৌল্লা মীর কাশিমের পক্ষ অবলম্বন করিয়া ইংরেজদিগের সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি করেন, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। অযোধ্যা রাজ্য বাংলার একেবারে প্রান্তে অবস্থিত, সুতরাং মারাঠা বা আফগানদের আক্রমণ হইতে বাংলা দেশ রক্ষা করার। জন্য অযোধ্যার রক্ষণাবেক্ষণ বাংলা দেশের পক্ষে প্রয়োজনীয়। এই কারণে ইংরেজরা অযোধ্যার নবাবের সহিত মিত্রতা রক্ষা করিতে আগ্রহশীল ছিলেন। ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের সন্ধি অনুসারে নবাব এলাহাবাদ ও কোরা প্রদেশ ইংরেজদিগকে দিয়াছিলেন এবং ইংরেজ ইহা শাহ আলমকে দিয়া বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী পদ লাভ করিলেন। ঐ সন্ধির আর-একটি শর্ত ছিল যে অযোধ্যা বা ইংরেজের রাজ্য কোন বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হইলে অপরপক্ষ সৈন্য দিয়া সাহায্য করিবেন, এবং ইংরেজসৈন্য নবাবকে সাহায্য করিলে উহার অতিরিক্ত খরচ নবাব বহন করিবেন।

১৭৭২ সনে বাদশাহ শাহ আলম মারাঠাদের হস্তে পরাজিত হইয়া এলাহাবাদ ও কোরা প্রদেশ তাহাদিগকে দিতে স্বীকার করিলেন। অতঃপর মারাঠা সৈন্য দোয়াব প্রদেশে প্রবেশ করিল এবং নবাব শুজাউদ্দৌল্লা হেস্টিংসের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। একদল ইংরেজসৈন্য গঙ্গানদী পার হইবার পরেই মারাঠাসৈন্যদল দাক্ষিণাত্যে ফিরিয়া গেল। অতঃপর হেস্টিংস শুজাউদ্দৌল্লার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া এক নূতন সন্ধি করিলেন (১৭৭৩ খ্র.)। কোরা ও এলাহাবাদ প্রদেশ ৫০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নবাবকে ফেরত দেওয়া হইল। নবাব নিজের ব্যয়ে একদল ইংরেজসৈন্য নিজ রাজ্যে রাখিতে সম্মত হইলেন। আরও স্থির হইল যে একজন ইংরেজের রাজদূত নবাবের রাজধানী লখনউ নগরে বাস করিবেন। এই সন্ধির ফলে হেস্টিংসকে আর-একটি যুদ্ধে লিপ্ত হইতে হইল।

অযোধ্যার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত রোহিলখণ্ড অঞ্চলে রোহিলা নামে এক পাঠান উপজাতি রাজত্ব করিত। এই অঞ্চলটি স্বীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করিবার জন্য অযোধ্যার নবাব শুজাউদ্দৌল্লা হেস্টিংসের নিকট একদল ইংরেজসৈন্যের সাহায্য চাহিলেন। তিনি এই সৈন্যদলের সম্পূর্ণ ব্যয় নির্বাহ করিতে এবং তদুপরি চল্লিশ লক্ষ টাকা হেস্টিংসকে দিতে স্বীকৃত হইলেন। হেস্টিংস এই প্রস্তাবে সম্মত হইয়া একদল বৃটিশসৈন্য পাঠাইলেন। ইহাদের সহায়তায় শুজাউদ্দৌল্লা রোহিলখণ্ড জয় করিলেন।

(গ) অবৈধরূপে অর্থ সংগ্রহ

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও কুশাসনের ফলে ইংরেজ কোম্পানির প্রচুর ঋণ হইয়া পড়িয়াছিল। অনেকটা এই কারণেই হেস্টিংস নানা উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। অযোধ্যার নবাবের নিকট হইতে পূর্বোল্লিখিত রূপে অর্থ সংগ্রহ ছাড়াও তিনি এই উদ্দেশ্যে আর দুইটি উপায় অবলম্বন করিলেন। সম্রাট শাহ আলম মারাঠাদের সঙ্গে যোগ দিয়াছিলেন এই অজুহাতে তিনি তাঁহার প্রাপ্য বার্ষিক রাজস্ব ছাব্বিশ লক্ষ টাকা বন্ধ করিয়া দিলেন এবং বাংলার নবাবের বার্ষিক বৃত্তিও কমাইয়া অর্ধেক করিয়া দিলেন। এইভাবে সম্রাটের সহিত সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করিয়া এবং রোহিলা জাতির ধ্বংসসাধন করিয়া হেস্টিংস কোম্পানির ঋণ শোধ দিলেন এবং তহবিলে কিছু অর্থও সঞ্চিত হইল। কিন্তু অনেকেই হেস্টিংসের এই সকল কার্যের অতিশয় নিন্দা করিয়াছেন।

৩. ইংরেজ কোম্পানির নূতন শাসনপ্রণালী

এইরূপে কবিবর রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ড-রূপে।” এতদিন কোম্পানির প্রধান কার্য ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, কিন্তু ক্রমে ক্রমে এক বিস্তৃত রাজ্যশাসনের ভার ও দায়িত্ব তাহাদের হাতে আসিল। সুতরাং কোম্পানির কার্য নির্বাহের জন্য যে ভারতীয় প্রণালী এতদিন প্রচলিত ছিল তাহা পরিবর্তন করার প্রয়োজন অনুভূত হইল। এই উদ্দেশ্যে বিলাতে ইংরেজ সরকার ১৭৭৩ খ্রীষ্টাব্দে রেগুলেটিং আইন (Regulating Act) নামে এক নূতন বিধান প্রবর্তিত করিলেন।

রেগুলেটিং আইন দ্বারা সমগ্র ভারতে কোম্পানির অধিকৃত স্থানগুলির শাসন একজন গভর্নর জেনারেল বা বড়লাট এবং চারিজন সদস্যযুক্ত এক শাসন পরিষদের উপর ন্যস্ত হইল। বাংলার গভর্নর বা লাটসাহেব এই শাসন-পরিষদের সভাপতি এবং গভর্নর জেনারেল হইলেন। বোম্বাই ও মাদ্রাজের গভর্নর এবং শাসন-পরিষদ বাংলার বড়লাট ও তাঁহার শাসন-পরিষদের অধীন হইল। কোম্পানির কর্মচারীদের অপরাধের বিচার করিবার জন্য কলিকাতায় একটি উচ্চ আদালত (সুপ্রীম কোর্ট) প্রতিষ্ঠিত হইল। ইহাতে একজন প্রধান বিচারপতি এবং অপর তিনজন নিম্নতর বিচারপতি নিযুক্ত হইলেন।

এই নূতন আইনে বাংলার লাট ওয়ারেন্ হেস্টিংসই বড়লাট হইলেন এবং ফ্রান্সিস, মনসন, ক্লেভারিং ও বারওয়েলকে লইয়া নূতন শাসন-পরিষদ গঠিত হইল। এই চারিজনের মধ্যে কেবলমাত্র বাওয়েলের ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কিছু কিছু অভিজ্ঞতা ছিল। অপর তিনজন সদস্য এই প্রথম বিলাত হইতে আসিয়াছিলেন, এবং তাঁহাদের ন্যায়-অন্যায় ধারণা হেস্টিংসের ধারণা হইতে একেবারে ভিন্ন। ছিল। সুপ্রীম কোর্ট নামক উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি সার ইলাইজা ইম্পে হেস্টিংসের বন্ধু ছিলেন।

১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দ হইতে এই নূতন ব্যবস্থা অনুসারে কাজ আরম্ভ হইল। প্রথম হইতেই ইংলেণ্ড হইতে আগত নূতন তিনজন শাসন-পরিষদের সভ্য হেস্টিংসের বিরুদ্ধবাদী হইলেন এবং তাঁহার অতীতের কার্যাবলী ও ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তাবিত কার্যসমূহ প্রায়ই তাঁহারা অনুমোদন করিতেন না।

শাসন-পরিষদের নূতন সভ্যগণের সহিত হেস্টিংসের বিরোধ আরও এক বৎসর কাল চলিয়াছিল। ১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দে মসনের মৃত্যুতে, এবং আরও এক বৎসর পরে ক্লেভারিং-এর মৃত্যুতে, হেস্টিংস আবার স্বাধীনভাবে পূর্ণ ক্ষমতা পরিচালনা করিতে সমর্থ হইলেন।

লর্ড নর্থের রেগুলেটিং আইন প্রবর্তনের পর হেস্টিংসের শাসনকালেই ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা অনেক বাড়িয়া যায় এবং এই আইনের নানা ত্রুটিবিচ্যুতি পার্লামেন্টের গোচরীভূত হয়। অপরদিকে হেস্টিংসের নানা কার্যকলাপ পার্লামেন্ট সমর্থন করিতে পারে না। সুতরাং এই সকল দোষত্রুটি দূর করিয়া ভারতের শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব প্রধানভাবে পার্লামেন্টের অধিকারে আনিবার জন্য ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দে ইংলণ্ডের পার্লামেন্টে ইণ্ডিয়া অ্যাক্ট’ নামে এক নূতন আইন বিধিবদ্ধ হয়। এই আইনের বলে বিলাতে বোর্ড অব কনট্রোল নামে ইংরেজ গভর্নমেন্টের প্রতিনিধিস্বরূপ এক শাসন-পরিষদ্ প্রতিষ্ঠিত হইল, এবং কোম্পানিকে স্থায়িভাবে ও সম্পূর্ণরূপে এই পরিষদের অধীন করা হইল। এই পরিষদের ক্ষমতা শীঘ্রই উহার সভাপতির উপর ন্যস্ত হইয়া গেল। বোর্ড অব্ কট্রোলের সভাপতি অতঃপর ভারতীয় ব্যাপারে সর্বোচ্চ ক্ষমতা পরিচালন করিতেন। কোম্পানির কর্তৃপক্ষের হাতে সামান্য ক্ষমতা মাত্র রহিল।

গভর্নর জেনারেল শাসন-পরিষদের সদস্য-সংখ্যা কমাইয়া তিনজন করিলেন এবং যুদ্ধ রাজস্ব ও বৈদেশিক নীতি সম্বন্ধে বোম্বাই ও মাদ্রাজ গর্ভনমেন্ট সপারিষদ গভর্নর জেনারেলের অধীন হইল। আবশ্যক হইলে বড়লাট শাসন-পরিষদের মতামত অগ্রাহ্য করিয়াও নিজ দায়িত্বে কার্য করিতে পারিবেন, এইরূপ বিধানও করা হইল। বোর্ড অব কনট্রোলের অনুমোদন ব্যতীত স-কাউন্সিল গভর্নর জেনারেল ভারতে রাজ্যবিস্তারের উদ্দেশ্যে যুদ্ধাদিতে লিপ্ত হইতে পারিবেন না, এই আইনে এইরূপ নির্দেশও দেওয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রী লর্ড নর্থের ‘রেগুলেটিং আইন পাশ হইবার ফলে বাংলার আভ্যন্তরিক শাসনব্যবস্থার কিছু কিছু পরিবর্তন হইয়াছিল। পাঁচ বছরের জন্য রাজস্ব ইজারা দেওয়ার ফলে ইজারাদার, জমিদার ও প্রজা–সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছিল। এইজন্য ইহা রহিত করিয়া ১৭৭৭ সন হইতে জমিদারদের সহিত প্রতি বৎসর দেয় রাজস্বের পরিমাণ বন্দোবস্ত করা হইত।

সদর দেওয়ানী আদালত উঠাইয়া দেওয়া হইল। ইহার অধীনে যে সমুদয় মফঃস্বলের আদালত ছিল তাহাদের অধিকার ও ক্ষমতা লইয়া সুপ্রীম কোর্টের সহিত গভর্নমেন্টের প্রায়ই বাদ-বিসম্বাদ হইত। ইহা দূর করিবার উদ্দেশ্যে হেস্টিংস ১৭৮০ সনে পুনরায় সদর দেওয়ানী আদালত প্রতিষ্ঠা করিয়া সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইম্পেকে এই আদালতেরও অধ্যক্ষ নিযুক্ত করিলেন। স্থির হইল যে ইহার জন্য তিনি মাসিক পাঁচ হাজার টাকা অতিরিক্ত বেতন পাইবেন। কিন্তু বিলাতের কর্তৃপক্ষ এই ব্যবস্থা নাকচ করিয়া দিলেন এবং এই নূতন পদ গ্রহণের জন্য ইম্পেকে বরখাস্ত করিলেন। ইম্পে বিলাতে ফিরিয়া গেলেন।

১৮০৩ সনে সদর নিজামৎ আদালত আবার মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হইল এবং নায়েব-নাজিম তাহার অধ্যক্ষতা করিতেন। তাঁহার অধীনে ফৌজদারী আদালতের বিচারকগণ ম্যাজিষ্ট্রেটের এবং জমিদারগণ পুলিশের কাজ করিতেন। ১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দে এই ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন হইল। প্রাদেশিক সমিতি উঠাইয়া আবার রাজস্ব-সংগ্রহের জন্য কলেক্টর নিযুক্ত হইল।

কলিকাতার কাউন্সিল স্থির করিলেন যে অতঃপর প্রতি জিলার দেওয়ানী আদালতের ইংরেজ বিচারকই ম্যাজিষ্ট্রেটের কার্যও করিবেন এবং অপরাধীকে গ্রেপ্তার করিয়া তাহার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগপত্রসহ তাহাকে নিকটস্থ ফৌজদারী আদালতে বিচারের জন্য পাঠাইবেন। কলিকাতায় ইংরেজ গভর্নর জেনারেলের অধীনে একজন ইংরেজ কর্মচারী নিযুক্ত হইলেন–তাঁহার নিকট নায়েব-নাজিম প্রতি মাসে ফৌজদারী আদালতের কার্যবিবরণ পাঠাইতেন। সুতরাং প্রকারান্তরে ফৌজদারী বিচার বিভাগেও ইংরেজ গভর্নর জেনারেলই সর্বাধ্যক্ষ হইলেন। ১৭৯০ সনে হেস্টিংসের পরবর্তী গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিস নায়েব-নাজিমের হাত হইতে ফৌজদারী বিচারের ভার একেবারে উঠাইয়া নিয়া ইহার জন্য ইংরেজ বিচারকের অধীনে নূতন এক শ্রেণীর ভ্রাম্যমাণ আদালত (Courts of Circuit) সৃষ্টি করিলেন। এইরূপে নবাবী আমল শেষ হইয়া বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির শাসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইল। ভূতপূর্ব নবাবী আমলের একমাত্র নিদর্শন রহিল মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত নবাব-উপাধিধারী একজন ইংরেজের বৃত্তিভোগী মীর জাফরের বংশধর এবং বাদশাহ শাহ আলমের নামাঙ্কিত মুদ্রা। নবাবের ক্ষমতার মধ্যে রহিল উপাধি-বিতরণ।

মীর জাফরের পরবর্তী তিনজন নবাবের সহিত সিংহাসনে আরোহণের সময় নূতন সন্ধি করা হইয়াছিল। কিন্তু ১৭৯৩ সনে নবাব মুবারক-উদ্দৌল্লার মৃত্যুর পর তাঁহার উত্তরাধিকারী নসির-উল-মুল্ককে কোম্পানি ও বাদশাহ শাহ আলমের পক্ষ হইতে একটি স্বীকারপত্র (Credential) মাত্র দেওয়া হইল। বাংলার শেষ নবাব নাজিম বহু বৎসর বিলাতে বাস করেন। ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি নবাব নাজিমের পদ ত্যাগ করেন এবং নিজামতের শাসন-সংক্রান্ত কোন ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অধিকার থাকিবে না, এই মর্মে এক দলিল সম্পাদন করেন। ইহার বিনিময়ে দশ হাজার পাউণ্ড তাঁহার বার্ষিক বৃত্তি নির্ধারিত হইল; ইংরেজ সরকার আরও দশ লক্ষ টাকা নগদ দিলেন এবং বিলাতে তাঁহার যে সন্তানসন্ততি জন্মিয়াছিল তাহাদের ভরণপোষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা করিলেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হয়। তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র সৈয়দ হাসান আলি ‘মুর্শিদাবাদের নবাব’ এই উপাধিতে ভূষিত হন এবং তিনি বাংলার অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রধান বলিয়া পরিগণিত হন। তাঁহার জন্য বার্ষিক বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। ইংরেজরা দিল্লী অধিকার করার পর বড়লাট বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের সহিত কোন সন্ধি করেন নাই–কেবল তাহার জন্য একটি বৃত্তি নির্ধারিত করিয়া প্রকারান্তরে তাঁহার অধীনতা অস্বীকার করেন। এইরূপে বাংলায় মুঘল রাজত্বের অবসান হইল।

৪. মহারাজা নন্দকুমার

১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দে যে নূতন শাসন-পরিষদ্ (কাউন্সিল) নিযুক্ত হইয়াছিল তাহার চারিজন সভ্যের মধ্যে তিনজনই যে হেস্টিংসের বিরোধী ছিলেন তাহা পূর্বে বলা হইয়াছে। সুযোগ বুঝিয়া হেস্টিংসের শত্রুপক্ষ শাসন-পরিষদে হেস্টিংসের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আনয়ন করিল। নন্দকুমার নামে একজন সম্ভ্রান্ত প্রতিপত্তিশালী ব্রাহ্মণ শাসন-পরিষদের নিকট অভিযোগ করিলেন যে, হেস্টিংস মীর জাফরের পত্নী মণি বেগমের নিকট হইতে উৎকোচ গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহার অভিযোগের প্রমাণস্বরূপ তিনি লিখিত দলিলপত্রও উপস্থিত করিলেন। নূতন সভ্যগণ নন্দকুমারের পক্ষ লইলেন, কিন্তু হেস্টিংস এই অভিযোগ শাসন-পরিষদে উত্থাপিত হইতে দিলেন না। অবশেষে হেস্টিংস নন্দকুমারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনয়ন করিলেন। এই সময়ে মোহনপ্রসাদ নামক এক ব্যক্তি উচ্চআদালতে নন্দকুমারের বিরুদ্ধে জাল করার অভিযোগ করিল। আদালতের বিচারে নন্দকুমার দোষী সাব্যস্ত হইলেন এবং তৎকালে প্রচলিত ইংরেজি আইন অনুসারে তাহার প্রাণদণ্ড হইল।

বর্তমান কালে বাংলা দেশে মহারাজা নন্দকুমার একজন দেশপ্রেমিক ও ভারতে ইংরেজের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রামের শহীদ বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। ইহার কিছু ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কিনা তাহা বিচারের জন্য নন্দকুমার সম্বন্ধে যে সমুদয় তথ্য জানা যায় তাহা সংক্ষেপে বর্ণনা করিতেছি।

হেস্টিংসের শাসনকালে তাঁহার কাউন্সিলের সদস্য বারওয়েল ইংলণ্ডে তাঁহার এক বন্ধুর নিকটে চিঠিতে লিখিত নন্দকুমারের বাল্যজীবন সম্বন্ধে যে-বিবরণ দিয়াছেন তাহার অতিরিক্ত এ-বিষয়ে আর বিশেষ কিছু জানা যায় না। ইহার সংক্ষিপ্ত মর্ম এই : “নন্দকুমার তাঁহার পিতার অধীনে রাজস্ব বিভাগে সামান্য একটি চাকরী করিতেন, ক্রমে নবাব আলিবর্দির সময়ে হিজলী ও মহিষাদলের আমিন পদে নিযুক্ত হন। জমিদারদের উপর অত্যাচার ও ৮০ হাজার টাকা তসরুফ করার অপরাধে তাহার উপরওয়ালা তাঁহাকে বরখাস্ত করেন এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় কারাগারে রাখেন। সেখানে তাঁহাকে বহুবার বেত্রাঘাত করা হয়। নন্দকুমারের পিতা প্রাপ্য টাকা শোধ করিয়া তাহাকে খালাস করেন। পরবর্তীকালে সিরাজউদ্দৌল্লার হস্তেও তিনি বহু শারীরিক দণ্ড ভোগ করেন কিন্তু বহু চেষ্টার ফলে আলিবর্দির মৃত্যুর পর নবাবের অনুগ্রহভাজন ও হুগলীর ফৌজদার পদে নিযুক্ত হন।”

বারওয়েলের এই বিবরণ কতদূর সত্য বলা যায় না; কারণ তিনি হেস্টিংসের বন্ধু ছিলেন, সুতরাং নন্দকুমারকে শত্রুজ্ঞানে ঘৃণা করিতেন। নন্দকুমারের পরবর্তী জীবন সম্বন্ধে অনেকটা নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। ১৭৫৭ সনে পলাশী যুদ্ধের পূর্বে যখন ক্লাইব ফরাসী-অধিকৃত চন্দননগর আক্রমণ করেন, তখন ব্রিটিশসৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে ও ফরাসীসৈন্যদের সাহায্য করিবার জন্য নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা হুগলীর ফৌজদার নন্দকুমারকে আদেশ করেন। কিন্তু নন্দকুমার ইংরেজদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়া তো দূরের কথা, নবাবের অপর একদল সৈন্যকে ঐ কার্য হইতে প্রতিনিবৃত্ত করেন। তিনি যে ইংরেজের নিকট হইতে মোটা টাকা ঘুষ পাইয়া এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছিলেন ইহা কেবলমাত্র অনুমান নহে, সমসাময়িক ইংরেজ লেখকগণও ইহা স্বীকার করিয়াছেন। সেই সময়কার রাজনীতিক পরিস্থিতি আলোচনা করিলে এরূপ সিদ্ধান্ত করা মোটেই অসঙ্গত নহে যে, নন্দকুমার ইংরেজদিগকে বাধা দিলে তাহারা চন্দননগর দখল করিতে পারিত না এবং পলাশীর যুদ্ধ ও সিরাজউদ্দৌল্লার পতনও ঘটিত না। সুতরাং ইংরেজের বাংলা দেশ বিজয়ের জন্য নন্দকুমারের বিশ্বাসঘাতকতা যে অনেক পরিমাণে দায়ী তাহা অস্বীকার করা কঠিন।

সিরাজউদ্দৌল্লার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কারস্বরূপ নন্দকুমার ক্লাইব ও মীর জাফর উভয়েরই খুব প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইলেন এবং ইংরেজের অধীনে উচ্চপদে নিযুক্ত হইয়া কলিকাতায় বসবাস করিতে লাগিলেন।

অনেক ইংরেজলেখকের মতে নন্দকুমার অতঃপর নানা উপায়ে ইংরেজ কোম্পানির অনিষ্ট সাধনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন এবং নবাব মীর জাফরের দেওয়ান নিযুক্ত হইবার পর ইংরেজদিগকে বাংলা দেশ হইতে তাড়াইবার জন্য রাজ্যভ্রষ্ট মীর কাশিম, কাশীর রাজা বলবন্ত সিংহ এবং অযোধ্যার নবাব শুজাউদ্দৌল্লার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। এই সমুদয় অভিযোগ কতদূর সত্য, এবং সত্য হইলেও তিনি দেশপ্রেম অথবা স্বার্থসিদ্ধি এবং স্বাভাবিক ষড়যন্ত্রপ্রবণতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন, তাহা নির্ণয় করা কঠিন। এ-সম্বন্ধে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে যে আলোচনা করা হইয়াছে তাহার পুনরুক্তির প্রয়োজন নাই। জাল করিবার অপরাধে তাঁহার প্রাণদণ্ড যে অন্যায় বিচার হইয়াছিল প্রথমাবধি অনেকেই এই মত ব্যক্ত করিয়াছেন; কিন্তু নন্দকুমারের ফাঁসি হওয়ার পরবর্তী দেড়শত বৎসরের মধ্যে কেহ কল্পনাও করেন নাই যে তিনি দেশপ্রেমিক ছিলেন এবং দেশের মুক্তির জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়াছিলেন। বর্তমান যুগের এই ধারণার সমর্থনযোগ্য কোন প্রমাণ নাই। আধুনিককালে যে মনোবৃত্তির ফলে প্রাচীনযুগের মহীপালের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী কৈবৰ্তরাজ দিব্য অত্যাচারী রাজার দমনের নিমিত্ত জনগণের নির্বাচিত নায়ক বলিয়া পূজা পাইয়াছেন, এবং মধ্যযুগের মুঘলের অনুগত ও সাহায্যকারী প্রতাপাদিত্য স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নায়ক বলিয়া গণ্য হইয়াছেন, সেই মনোবৃত্তির ফলেই নন্দকুমার শহীদের গদীতে স্থান পাইয়াছেন। বর্তমান যুগে ইঁহাদের স্মৃতিপূজার ব্যবস্থা বাঙ্গালী তথা ভারতবাসীর প্রকৃত ইতিহাস বিস্মৃতিরই পরিচয় দান করে।

৫. ইংরেজের রাজ্য বিস্তার

রেগুলেটিং আইন প্রবর্তনের ফলে হেস্টিংসের সময় হইতেই বাংলাদেশ ভারতের বৃটিশ-রাজশক্তির কেন্দ্রে পরিণত হইল। এই সময় বাংলার বাহিরে চারিটি বড় স্বাধীন রাজ্য ছিল-মহারাষ্ট্র, মহীশূর, হায়দ্রাবাদ ও অযোধ্যা। প্রথম দুইটিকে একাধিকবার যুদ্ধে পরাজিত করিয়া এবং অন্য দুইটির সঙ্গে সন্ধি করিয়া ইংরেজ ত্রিশ বৎসরের মধ্যেই ইহাদের সকলের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করিল। তারপর ধীরে ধীরে অন্যান্য স্বাধীন রাজ্যগুলিও ইংরেজের প্রভুত্ব স্বীকার করিল। এইরূপে বাংলা দেশে রাজ্য স্থাপনের ফলে ইংরেজ ক্রমশঃ সমগ্র ভারতের অধীশ্বর হইল।

হেস্টিংসের আমলেই এই শক্তিবৃদ্ধির সূত্রপাত হয়। প্রথম সংঘর্ষ বাধিল প্রবলপরাক্রান্ত মহারাষ্ট্র রাজ্যের সঙ্গে। শিবাজীর বংশধর নামেমাত্র মহারাষ্ট্র সাম্রাজ্যের নায়ক (ছত্রপতি) ছিলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহা পাঁচটি বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত হইয়াছিল–মহারাষ্ট্রে পেশোয়া, গোয়ালিয়রে সিন্ধিয়া, বরোদায় গাইকোয়াড়, ইন্দোরে হোল্কার এবং নাগপুরে ভেঁসলা প্রায় স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করিতেন।

তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধে (১৭৬১ খ্রী.) পরাজয়ের ফলে মারাঠাশক্তি দুর্বল হইয়াছিল বটে, কিন্তু একেবারে নষ্ট হয় নাই। পরাজয়ের সংবাদ পাইয়া বালাজী বাজী রাও ভগ্নহৃদয়ে প্রাণত্যাগ করিলে তাঁহার সপ্তদশবর্ষীয় পুত্র মাধব রাও পেশোয়া হইলেন। এই অল্পবয়স্ক নূতন পেশোয়া পেশোয়াবংশের পূর্ব-গৌরব ও শক্তি অনেক পরিমাণে ফিরাইয়া আনিতে সমর্থ হইলেন। তিনি মহীশূরের রাজা হায়দার আলিকে দুইবার পরাজিত করিলেন এবং ভোঁস্‌লা যে-সমস্ত জায়গা জোর করিয়া দখল করিয়াছিলেন, তাহা তাঁহাকে ফিরাইয়া দিতে বাধ্য করিলেন। এই নবীন পেশোয়ার খুল্লতাত এবং অভিভাবক রঘুনাথ রাও তাহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হইলেন, কিন্তু পেশোয়া তাঁহাকে পরাস্ত করিয়াও ক্ষমা করিলেন।

এইরূপে নিজের রাজ্যের সুব্যবস্থা করিয়া এই নবীন পেশোয়া উত্তর-ভারতে বিনষ্ট সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধারে যত্নবান হইলেন। ১৭৬৯ সনে মারাঠাসৈন্য রাজপুত ও জাঠদিগকে পরাজিত করিয়া কর দিতে বাধ্য করিল। ইহার পর মারাঠাগণ দিল্লী অধিকার করিয়া শাহ আলমকে দিল্লীর সিংহাসনে বসাইল। তাহারা গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী দোয়াব প্রদেশ অধিকার করিয়া যখন অযোধ্যা ও রোহিলখও জয় করিবার উদ্যোগ করিতেছিল, সেই সময় ১৭৭২ সনের ১০ই নভেম্বর পেশোয়া মাধব রাওর মৃত্যু হওয়ায় তাহারা দাক্ষিণাত্যে ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হইল। তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধেও মারাঠা সাম্রাজ্যের যে ক্ষতি হয় নাই, মাধব রাওর মৃত্যুতে তাহা হইল। তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা নারায়ণ রাও পেশোয়া হইলে (ডিসেম্বর, ১৭৭২ খ্রী.) রঘুনাথ রাওর চক্রান্তে তিনি নিজের প্রাসাদেই ঘাতকের হস্তে প্রাণ হারাইলেন (অগস্ট, ১৭৭৩ খ্রী.)। এই দুবৃত্ত রঘুনাথ তখন নিজেকে পেশোয়া বলিয়া ঘোষণা করিয়া দিলেন। কিন্তু নারায়ণ রাওর গর্ভবতী বিধবা পত্নী এক পুত্র প্রসব করিলেন (এপ্রিল, ১৭৭৪ খ্রী.) এবং মাধব রাও নারায়ণ নামে এই শিশুই প্রকৃত পেশোয়া বলিয়া ঘোষিত হইলেন। তাঁহার অভিভাবক এবং তাহার পক্ষে প্রধান নায়ক ছিলেন নানা ফারুনবিশ নামে এক ব্রাহ্মণ। ইহার মতো কূটনীতিবিন্দু, তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও রাজনীতিজ্ঞ ব্যক্তি মারাঠারাজ্যে আর দ্বিতীয় ছিল না। মারাঠা নায়কগণের মধ্যে সিন্ধিয়া ও হোল্কার মাধব রাও নারায়ণের পক্ষ অবলম্বন করিলেন। গাইকোয়াড় পরিবারের কতক তাঁহার পক্ষে ও কতক রঘুনাথের পক্ষে রহিলেন।

অশুভ ক্ষণে রঘুনাথ নিজের বলবৃদ্ধির জন্য বোম্বাই গভর্নমেন্টের সাহায্য চাহিলেন। বোম্বাই গভর্নমেন্ট সল্‌সেটি দ্বীপ, বেসিন বন্দর এবং বোম্বাইর নিকটবর্তী আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের অধিকার যদি পায়, তবেই রঘুনাথকে সাহায্য করিবে বলিয়া স্বীকৃত হইল। রঘুনাথ এই সকল শর্তে স্বীকৃত হইয়া সুরাটের সন্ধি করিলেন (৬ই মার্চ, ১৭৭৫ খ্র.)। কিন্তু কলিকাতার শাসন-পরিষদ সুরাটের সন্ধি অগ্রাহ্য করিল, এবং মাধব রাও নারায়ণের পক্ষের সহিত সন্ধি করিবার জন্য কর্নেল আপটনকে পুণায় পাঠাইয়া দিল। আপটন পুরন্দরের সন্ধি করিয়া ইংরেজ কোম্পানির জন্য সসেটি লাভ করিলেন (১লা মার্চ, ১৭৭৬ খ্রী.)। অল্পকাল পরেই কোম্পানির ইংলন্ডস্থ কর্তৃপক্ষ সুরাটের সন্ধি অনুমোদন করিয়া পত্র লিখিলেন। রঘুনাথ রাওকে তখন বোম্বাই নগরীতে প্রকাশ্যে অভ্যর্থনা করিয়া তাঁহার উপযুক্ত মাসিক বৃত্তি স্থির করা হইল। এদিকে পুণার মারাঠা-নায়কদের মধ্যে বিবাদ বাধিলে বোম্বাই গভর্নমেন্ট রঘুনাথকে পেশোয়া পদে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করিবার উদ্যোগ করিল। হেস্টিংস তাহা অনুমোদন করিলেন। বোম্বাই হইতে পুণার বিরুদ্ধে একদল সৈন্য পাঠান হইল (ডিসেম্বর, ১৭৭৮ খ্রী.)।

বৃটিশসৈন্য পুণার কুড়ি মাইলের মধ্যে যাইয়া পৌঁছিলে একদল প্রবল মারাঠাসৈন্য তাহাদিগকে বাধা দিল। বৃটিশসৈন্য অমনি পশ্চাৎপদ হইতে লাগিল; কিন্তু মারাঠাগণ ওয়ারগাঁও নামক স্থানে তাহাদিগকে চারিদিক হইতে এমন করিয়া ঘিরিয়া ধরিল যে, অত্যন্ত অসম্মানজনক শর্তে সম্মত হইয়া ইংরেজদিগকে সন্ধি করিতে হইল (১৭৭৯ খ্র.)। সন্ধির শর্ত হইল, ইংরেজদিগকে রঘুনাথের পক্ষ পরিত্যাগ করিতে হইবে, এবং এযাবৎ তাহারা মারাঠাগণের নিকট হইতে যাহা কিছু লইয়াছে, সেই সমস্তই ছাড়িয়া দিতে হইবে। কিন্তু বৃটিশসৈন্য নিরাপদে বোম্বাইতে ফিরিয়া আসিবামাত্র বোম্বাই গভর্নমেন্ট এই অপমানজনক ওয়ারগাঁওর সন্ধি অস্বীকার করিল এবং মারাঠাদের বিরুদ্ধে নূতন করিয়া যুদ্ধের আয়োজন করিতে লাগিল। বাংলাদেশে হেস্টিংসও নিশ্চিন্ত ছিলেন না। তিনি গডার্ড নামক একজন সেনাপতির অধীনে পূর্বেই বঙ্গদেশ হইতে বোম্বাইতে একদল সৈন্য পাঠাইয়াছিলেন। এই সৈন্য অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সুরাট পৌঁছিল। গডার্ড সেখানে উপস্থিত হইয়া পরস্পর পরস্পরের শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্য করিবেন, এই শর্তে গাইকোয়াড়ের সহিত এক সন্ধি করিলেন (জানুআরি, ১৭৮০ খ্রী.)। সিন্ধিয়া এবং হোল্কারের অসতর্কতার জন্য গডার্ড আহম্মদাবাদ ও বেসিন অধিকার করিতে সমর্থ হইলেন। এবার পুণা অভিমুখে অগ্রসর হইলেন, কিন্তু শীঘ্রই মারাঠাদিগের সহিত সংঘর্ষে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া পশ্চাৎপদ হইতে বাধ্য হইলেন। এদিকে হেস্টিংস পপহ্যাম নামক সৈন্যাধ্যক্ষকে সিন্ধিয়ার রাজ্য আক্রমণ করিতে পাঠাইলেন। ইহাতে কতক মারাঠাসৈন্যের লক্ষ্য অন্যদিকে আকৃষ্ট হওয়ায় গডার্ডের অনেক সুবিধা হইল। পপহ্যাম গোয়ালিয়রের দুর্ভেদ্য দুর্গ অধিকার করিলেন। তখন সিন্ধিয়া নিজে ইংরেজের সহিত পৃথক সন্ধি করিলেন এবং তাঁহার মধ্যবর্তিতায় ইংরেজ ও মারাঠা সরকারের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হইল (১৭৮২ খ্রী.)। এই সন্ধি সাবাই-এর সন্ধি নামে খ্যাত। ইহাতে পুরন্দরের সন্ধির পরে ইংরেজগণ যত জায়গা অধিকার করিয়াছিল, সমস্ত ফিরাইয়া দিতে বাধ্য হইল এবং রঘুনাথ রাও বাৎসরিক তিন লক্ষ টাকা বৃত্তি পাইবেন, এইরূপ স্থির হইল।

মারাঠাযুদ্ধ শেষ হইবার পূর্বেই ইংরেজের সহিত মহীশূরের যুদ্ধ বাধিল। তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের পরাজয়ের সময়ে হায়দর নায়ক নামে এক ভাগ্যান্বেষী দুঃসাহসী সৈনিক যথেষ্ট শক্তিশালী হইয়া উঠিয়াছিলেন। তিনি মহীশূরের হিন্দুরাজাকে পদচ্যুত করিয়া মহীশূর অধিকার করেন (১৭৬৬ খ্রী.)। তখন তাহার নূতন নাম হইল হায়দর আলি। তিনি মারাঠাদের ও নিজামের রাজ্যাংশ দখল করিয়া মহীশূর রাজ্যের আয়তন অনেক বাড়াইয়া ফেলিলেন। এইরূপে মহীশূর দাক্ষিণাত্যের একটি প্রধান শক্তিতে পরিণত হইল। হেস্টিংস গভর্নর নিযুক্ত হইয়া আসিবার বহু পূর্বে ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির মাদ্রাজ কাউন্সিলের অপদার্থ কর্মচারীরা ঠিকভাবে প্রস্তুত না হইয়াই হায়দরের সহিত যুদ্ধ বাধাইয়া বসিল। হায়দর সম্পূর্ণ জয়লাভ করিয়া মাদ্রাজ শহরের নিকট পৌঁছিলেন। এবং নিজের ইচ্ছামত শর্তে ইংরেজদিগকে সন্ধি করিতে বাধ্য করিলেন (১৭৬৯ খ্রী.)। সন্ধির একটি শর্ত ছিল যে, মারাঠাগণ অথবা নিজাম যদি হায়দরকে আক্রমণ করে, তবে ইংরেজগণ তাঁহাকে সাহায্য করিবে। কিন্তু মাদ্রাজ শাসন পরিষদ্ এই শর্ত পালন করে নাই। ১৭৭১ খ্রীষ্টাব্দে যখন হায়দর মারাঠাদের দ্বারা আক্রান্ত হইয়া ইংরেজদের সাহায্য প্রার্থনা করিলেন, তখন তাহারা কিছুই করিল না, এবং হায়দর এই যুদ্ধে পরাজিত হইলেন। হায়দর ইংরেজগণের এই বিশ্বাসঘাতকতা কখনও ভুলেন নাই বা ক্ষমা করেন নাই। মাদ্রাজ গভর্নমেন্টের এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মহীশূর রাজ্যের সহিত ইংরেজদের ত্রিশ বৎসরকাল বিবাদ চলিয়াছিল। হায়দর মারাঠাদের হস্তে পরাজিত হইলেও ধীরে ধীরে নিজের রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি করিলেন, এবং কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণস্থ সমস্ত ভূভাগ তাঁহার করতলগত হইল। অধিকন্তু তাঁহার সৈন্যদল অতিশয় সুশিক্ষিত ছিল, এবং তিনি তখন ভারতের শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তিসমূহের অন্যতম ছিলেন।

১৭৭৮ খ্রীষ্টাব্দে ইউরোপে ইংরেজ ও ফরাসিতে যুদ্ধ উপস্থিত হওয়ায় ইংরেজগণ মালাবার উপকূলে ফরাসি-অধিকৃত মাহে অধিকার করিতে চাহিল। কিন্তু হায়দর বলিলেন, মাহে তাঁহার রাজ্যের অন্তর্গত ও তাঁহার আশ্রয়াধীনে আছে। হায়দরের প্রতিবাদে কর্ণপাত না করিয়া ইংরেজগণ মাহে অধিকার করিল। ইহার ফলে ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে জুলাই মাসে হায়দরের সৈন্যদল মাদ্রাজ প্রদেশের ইংরেজরাজ্য আক্রমণ করিল। দেড়মাস কাল হায়দরের সৈন্যগণ কামান ও তরবারির সাহায্যে সমস্ত দেশ বিধ্বস্ত করিয়া ফেলিল এবং লুণ্ঠন করিতে করিতে তাহারা প্রায় মাদ্রাজ্যের নিকটে পৌঁছিল। মাদ্রাজ গভর্নমেন্ট হায়দরকে কোন প্রকারে বাধা দিতে পারিল না।

হায়দরের আক্রমণের সংবাদ বাংলা দেশে পৌঁছিবামাত্র হেস্টিংস সার আয়ার কুটুকে মাদ্রাজে প্রেরণ করিয়া নষ্টগৌরব কিয়ৎ পরিমাণে পুনরুদ্ধার করিলেন। ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দের শেষভাগে হায়দর আলির মৃত্যুতে যুদ্ধের বেগ কতকটা কমিয়া গেলেও হায়দরের পুত্র টিপু সুলতান যুদ্ধ চালাইতে লাগিলেন। অবশেষে বহুদিনব্যাপী যুদ্ধে ক্লান্ত হইয়া মাদ্রাজ গভর্নমেন্ট অনেক কষ্টে টিপুর সহিত বর্তমান দক্ষিণ কানাড়া জেলার অন্তর্গত মাঙ্গালোরে সন্ধি করিলেন (১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দে)। উভয়েই পরস্পরের বিজিত স্থানগুলি ফিরাইয়া দিবে, এই শর্তে মাঙ্গালোরের সন্ধি হইল। এইরূপে ভারতে বৃটিশশক্তি এক গুরুতর সংকট হইতে রক্ষা পাইল এবং হেস্টিংসের কূটনীতির প্রভাবেই ইহা সম্ভবপর হইল।

৬. চৈৎসিংহ ও অযোধ্যার বেগম

মহীশূর ও মারাঠাদের সহিত সুদীর্ঘ যুদ্ধে হেস্টিংসের কোষাগার আবার শূন্য হইয়া গিয়াছিল, এবং অর্থাগমের পথও অনেকটা নষ্ট হইয়াছিল। বাধ্য হইয়া পুনরায় তাঁহাকে অর্থ-সংগ্রহের চেষ্টা করিতে হইল। অযোধ্যার নবাব শুজাউদ্দৌল্লা বৃটিশসৈন্যদলের যে খরচ দিতেছিলেন, তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র আসফউদ্দৌল্লা নবাব হইলে সেই খরচের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করা হইয়াছিল, এবং তাহার অধীন বারাণসী রাজ্যটিও ইংরেজদের অধিকারে আসিয়াছিল। এখন আবার হেস্টিংস বৃটিশ কর্মচারীর সাহায্যে নবাবের একদল সৈন্যকে সুশিক্ষিত করিবার ভার নিলেন। ইহার খরচের জন্য নবাব কতকগুলি জেলার রাজস্ব ইংরেজদিগকে ছাড়িয়া দিলেন।

বারাণসীর রাজা চৈসিংহ ইংরেজ সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব রীতিমত দিতেন। হেস্টিংসের দাবি অনুসারে বাৎসরিক পাঁচ লক্ষ টাকাও অতিরিক্ত দিয়াছিলেন। কিন্তু, এই দাবি মিটাইয়া দেওয়ামাত্র হেস্টিংস তাঁহাকে একদল অশ্বারেহী সৈন্য গঠন করিয়া দিবার জন্য আদেশ দিলেন। রাজা তাহা দিতে সমর্থ হইলেন না এবং এই অপরাধে হেস্টিংস তাঁহাকে চল্লিশ লক্ষ টাকা জরিমানা করিলেন। এই অন্যায় দাবিও আবার অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সহিত আদায় করিতে চেষ্টা করা হইল। হেস্টিংস নিজে বারাণসী গিয়া রাজাকে তাঁহার নিজের প্রাসাদে বন্দী করিলেন। রাজার সৈন্যগণ এই ব্যাপারে ক্রুদ্ধ ও বিদ্রোহী হইয়া হেস্টিংসের সৈন্যদলকে নিহত করিল। হেস্টিংস অতিকষ্টে প্রাণ লইয়া চুনারে পলাইয়া গেলেন। বিদ্রোহ তখন সমস্ত জেলায় ছড়াইয়া পড়িয়াছিল; কিন্তু সৈন্য সংগ্রহ করিয়া হেস্টিংস শীঘ্রই এই বিদ্রোহ দমন করিলেন। হতভাগ্য চৈৎসিংহ বুন্দেলখণ্ডে পলাইয়া গেলেন আর কাশীর সিংহাসনে একজন নূতন রাজা অধিষ্ঠিত হইলেন।

হেস্টিংসের পরবর্তী কার্যটি আরও গুরুতর। অযোধ্যার মৃত নবাব শুজাউদ্দৌল্লার মাতা ও বিধবা বেগম উত্তরাধিকারসূত্রে বিস্তর ধনসম্পত্তির মালিক হইয়াছিলেন। হেস্টিংস যখন অযোধ্যার নবাব আসফউদ্দৌল্লার নিকট কোম্পানির প্রাপ্য অর্থ চাহিলেন, তখন নবাব বলিলেন যে, তাঁহার পিতার সম্পত্তির অধিকাংশ তাঁহার মাতা ও পিতামহীর হস্তে পড়াতে তাঁহার নিজের কোষাগার শূন্য; অতএব তিনি ইংরেজদিগকে নিজের প্রতিশ্রুতি অনুসারে অর্থ দিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। ইহা শুনিয়া হেস্টিংস বেগমদের ধনসম্পত্তি জোর করিয়া দখল করিবার জন্য অযোধ্যার নবাবকে আদেশ দিলেন, এবং যাহাতে কোন বাধা উপস্থিত না হয়, সেজন্য নিজের একদল সৈন্য নবাবের কাছে পাঠাইলেন। হেস্টিংসের ব্যবস্থানুসারেই বেগমদের উপর ভীষণ অত্যাচার করা হইল এবং তাঁহাদের বিপুল ধনসম্পত্তি কাড়িয়া লওয়া হইল।

৭. হেস্টিংসের প্রাচ্য শিক্ষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা

ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতীয় শিক্ষা ও সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। মধ্যযুগের ফারসী ভাষা বহুকাল পর্যন্ত ভারতে বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। হেস্টিংস নিজেও ফারসী ভাষা আয়ত্ত করিয়াছিলেন। মধ্যযুগে প্রচলিত শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি ১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতা মাদ্রাসা’ (Calcutta Madrasa) স্থাপন করিয়াছিলেন। হেস্টিংসের প্রাচ্যশিক্ষা প্রসারের আগ্রহে ও উৎসাহে অনুপ্রাণিত হইয়া সার উইলিয়াস জোনস প্রাচ্য সাহিত্য, ইতিহাস প্রভৃতি আলোচনার জন্য কলিকাতায়। ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ (Asiatic Society of Bengal) প্রতিষ্ঠা করেন, এবং সংস্কৃত শিক্ষা বিস্তারের জন্য রেসিডেন্ট জোনাথান্ ডাকা ১৭৯২ সনে বারাণসীতে সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেন। হেস্টিংসের নির্দেশে হলহেড সাহেব কর্তৃক একখানি বাংলা ব্যাকরণ রচিত হয়, এবং তিনি হিন্দু-মুসলমানদের আইনশাস্ত্রও ইংরেজিতে অনুবাদ ও প্রকাশ করেন। হেস্টিংসের সমর্থন ও সাহায্যেই চার্লস্ উইলকিন্স্ বাংলা দেশে ছাপাখানার পত্তন করেন এবং ইংরেজি ভাষায় তাঁহার অনূদিত গীতা মুদ্রিত হয়। বাংলা টাইপে হলহেডের বাংলা ব্যাকরণই সর্বপ্রথম (১৭৭৮ খ্রীষ্টাব্দে) মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইয়াছিল। তবে একথা স্বীকার্য যে, হেস্টিংসের ভারতীয় শিক্ষা ও সাহিত্যের দিকে বিশেষ দৃষ্টি থাকিলেও, ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে ইংরেজ সরকার দেশবাসীর শিক্ষা-পরিচালনা বা উন্নতির জন্য তেমন কোনরূপ ব্যবস্থা বা দায়িত্ব গ্রহণ করেন নাই।

৮. হেস্টিংসের পদত্যাগ

এদিকে হেস্টিংসের নানাবিধ ঘোর অন্যায়-অত্যাচারের বিবরণ ইংলণ্ডে পৌঁছিবামাত্র, সেখানকার কর্তৃপক্ষ তাহার প্রতি বিষম ক্রুদ্ধ হইলেন। চৈৎসিংহের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পূর্ণ উল্টাইয়া দিতে হেস্টিংসের উপর আদেশ আসিল। এমনকি, সর্বপ্রকারে হেস্টিংসের অনুগত শাসন-পরিষও এতকাল পরে আবার বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। এই সকল গোলযোগের ফলে হেস্টিংস পদত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন (ফেব্রুআরি, ১৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দ)। তিনি ইংলণ্ডে গেলে তাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হইল। নানা অভিযোগের মধ্যে গুরুতর অভিযোগর বিষয় ছিল তিনটি–রোহিলা জাতি ধ্বংস, চৈৎসিংহের উপর অত্যাচার এবং অবোধ্যর বেগমদের সম্পত্তি লুণ্ঠন। বিলাতে হাউস অব্ লর্ডসের সম্মুখে হেস্টিংসের বিচার (Impeachment) হয় এবং হাউস অব কমন্স বাদী হইয়া হেস্টিংসের অপরাধ বর্ণনা করে। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে বার্ক, শেরিডন ইত্যাদি সেই যুগের শ্রেষ্ঠ বাগ্মীদিগের জ্বালাময়ী বক্তৃতা তাঁহার এই বিচারকে চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিয়াছে। সাত বৎসর ধরিয়া এই বিচার চলে এবং বিচারান্তে হেস্টিংস সমস্ত অভিযোগ হইতে নির্দোষ বলিয়া মুক্তিলাভ করেন (১৭৯৫ খ্রীষ্টাব্দ)। ইহার পরে হেস্টিংস আরও ২৩ বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন। তিনি ৮৫ বৎসর বয়সে ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে পরলোকগমন করেন।

ওয়ারেন হেস্টিংসের চরিত্র সম্বন্ধে সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী নানা মত প্রচলিত আছে। তৎকালীন বিখ্যাত বাগ্মী বার্ক, বিখ্যাত লেখক মেকলে ও ঐতিহাসিক মিল– এই বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ হেস্টিংসের নানা অসৎ কার্যের জন্য তাঁহার বহু নিন্দা করিয়াছেন। কিন্তু পরবর্তী কয়েকজন লেখকের মতে হেস্টিংসের বিশেষ কোন অপরাধ ছিল না। বরং তাঁহার অসাধারণ কর্মকুশলতা ও রাজনীতিজ্ঞানের ফলেই বৃটিশ রাজশক্তি দৃঢ় ও শক্তিশালী হইয়া উঠিয়াছিল।

৯. সন্ন্যাসী বিদ্রোহ-ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরাণী

হেস্টিংসের সময়কার একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা—’সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’। রাষ্ট্রবিপ্লব ও অরাজকতার সুযোগে অনেক সময়ই দলবদ্ধভাবে দস্যুবৃত্তির প্রাদুর্ভাব হয়। মুসলমান রাজত্বের অবসান ও ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা–এই দুইয়ের মধ্যবর্তীকালে বিহার ও উত্তর প্রদেশ হইতে আগত একদল নাগা সন্ন্যাসী উত্তরবঙ্গের নানা স্থানে লুটতরাজ করিয়া ফিরিত। ইহাদের কোন নির্দিষ্ট বাসস্থান ছিল না, ইহারা সাধুর বেশে নানা স্থানে ঘুরিত, হৃষ্টপুষ্ট ছেলে চুরি করিয়া দলবৃদ্ধি করিত, কেহ কেহ ব্যবসা-বাণিজ্যও করিত। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পর তাহাদের উপদ্রব বাড়িয়া চলে। নিঃস্ব কৃষক, সম্পত্তিভ্রষ্ট জমিদার ও বেকার সৈন্যদল তাহাদের সাথে যোগ দেয়। হিন্দুরা সন্ন্যাসীদের ভক্তি করিত, সুতরাং তাহাদের কোন সন্ধান গভর্নমেন্টকে দিত না। ফলে তাহারা অকস্মাৎ এক অঞ্চলে উপস্থিত হইয়া গৃহস্থের নিকট অর্থ দাবি করিত-না দিলে বিনা বাধায় লুটপাট করিত। তাহাদের ভয়ে দিনাজপুর, মালদহ, রংপুর, বগুড়া, ঢাকা প্রভৃতি জিলার লোকেরা সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকিত। ১৭৭২ সনে তাহারা রংপুরের সিপাহীদিগকে যুদ্ধে পরাস্ত করে এবং ইহাদের নায়ক কাপ্তেন টমাসকে হত্যা করে। ইহাতে উৎসাহিত হইয়া সন্ন্যাসীরা নানা দলে বিভক্ত হইয়া বিভিন্ন অঞ্চল আক্রমণ করে। প্রতি দলে একজন নায়কের অধীনে প্রায় পাঁচ-সাত হাজার নাগা সন্ন্যাসী ও অন্যলোক থাকিত। ১৭৭৩ সনে কাপ্তেন এডওয়ার্ডস ও সার্জেন্ট মেজর ডগলাস ৩০০ সিপাহী নিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন, কিন্তু পরাস্ত হইয়া উভয়েই নিহত হন এবং মাত্র বারোজন সিপাহী প্রাণ লইয়া ফিরিয়া আসে। ইহাদিগকে দমন করিবার জন্য হেস্টিংস ভুটানের সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং হেস্টিংসের অনুরোধে কাশীর রাজা চৈৎসিংহ সন্ন্যাসীদের দমনের জন্য পাঁচশত অশ্বারোহী সৈন্য প্রেরণ করেন। কাপ্তেন ব্রুক একদল পদাতিক সৈন্য লইয়া সন্ন্যাসীদের দমন করিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এই সমুদয় সত্ত্বেও কয়েক বৎসর পর্যন্ত সন্ন্যাসীদের উৎপাত চলিতে থাকে। অবশেষে তাহারা বাংলা ও বিহার ত্যাগ করে এবং সম্ভবতঃ মারাঠাদের সঙ্গে যোগ দেয়।

নাগা সন্ন্যাসীদের মত একদল সশস্ত্র মুসলমান ফকিরও এই সময়ে উত্তরবঙ্গে ডাকাতি ও লুটতরাজ করে। এই ডাকাতদলের সর্দার ছিলেন মদরি সম্প্রদায়ের ফকির মজনুন শাহ। বগুড়া জিলার ১২ মাইল দক্ষিণে গোয়াইল নামক স্থানের নিকট মদরগঞ্জে এবং মহাস্থানে তাঁহার প্রধান আড্ডা ছিল। দিনাজপুর ও রংপুরের দক্ষিণে এবং বগুড়ার পশ্চিমে তিনি তাঁহার দল লইয়া লুটতরাজ করিতেন। তাঁহার ভয়ে অনেক জমিদার ঐ অঞ্চল ত্যাগ করিয়া যাইতে বাধ্য হন। ১৭৭৩ সনে কাপ্তেন উইলিয়স তাঁহাকে পরাজিত করেন। সন্ন্যাসীদের উপদ্রব কমিলে ফকিরদের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। ১৭৭৬ সনে উত্তরবঙ্গে পরাজিত হইয়া মজনুন পলাইয়া যান কিন্তু ১৭৮৩ সনে মৈমনসিংহে উপস্থিত হন। সেখানেও পরাজিত হইয়া পলায়ন করেন। কিন্তু ইহার পরেও মাঝে মাঝে রংপুর, বগুড়া ও দিনাজপুরে উপদ্রব করেন। ১৭৮৬ সন পর্যন্ত তাঁহার উপদ্রব চলিতে থাকে। ১৭৮৭ সনে তাঁহার মৃত্যু হয়।

মজনুনের একজন সহযোগী ছিলেন ভবানী পাঠক। তিনি সাধারণতঃ বগুড়া, রংপুর ও মৈমনসিংহ অঞ্চলে জলপথে ডাকাতি করিতেন। ১৭৮৭ সনে তাহার মৃত্যু হইলে অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই সাতখানা বড় নৌকা ধরা পড়ে। তাঁহার সঙ্গে দেবী চৌধুরাণী নামে একজন স্ত্রীলোকও ডাকাতি করিতেন। তিনি নৌকাতেই বাস করিতেন এবং একদল বেতনভোগী বরকন্দাজ পোষণ করিতেন। সরকারী নথিতে এই দুইজনেরই উল্লেখ আছে।

মজনুন বা ভবানী পাঠক কেহই বাঙ্গালী ছিলেন না। মজনুন শাহ আলোয়ার রাজ্যের লোক, ভবানী পাঠক আরা জেলার বিহারী ব্রাহ্মণ। তাঁহাদের অনুচরগণও বাঙ্গালী ছিল না। কিন্তু সে-যুগে যে বাঙ্গালী জমিদারেরাও ডাকাতের সর্দার ছিলেন সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। দেবী চৌধুরাণী সম্ভবত বাঙ্গালী ছিলেন। এই সম্বন্ধে সমসাময়িক সরকারী দলিলে রংপুরের যে বিবরণ আছে তাহার সারমর্ম এই : “১৭৮৭ সনে লেফটেনান্ট ব্রেনান ভবানী পাঠক নামে প্রসিদ্ধ দস্যুসর্দারের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। তিনি একজন দেশীয় কর্মচারীর অধীনে ২৪ জন সিপাহী পাঠান। তাহারা অতর্কিতে ভবানী পাঠক ও তাহার ৬০ জন অনুচরের নৌকা আক্রমণ করে। তাহারা যুদ্ধ করে। যুদ্ধে ভবানী পাঠক ও তাঁহার তিনজন অনুচর নিহত, আটজন আহত এবং বিয়াল্লিশ জন বন্দী হয়। লেফটেনান্ট ব্রেনানের রিপোর্ট হইতে জানা যায় যে, দেবী চৌধুরাণী নামে একজন স্ত্রীলোক ডাকাতের সহিত ভবানী পাঠকের যোগাযোগ ছিল। দেবী চৌধুরাণী নৌকায় বাস সরিতেন এবং তাহার বহু বেতনভোগী বরকন্দাজ ছিল। তিনি নিজে ডাকাতি করিতেন, এবং ভবানী পাঠক ডাকাতি করিয়া যাহা আনিতেন তাহার অংশও পাইতেন। চৌধুরাণী এই উপাধি হইতে মনে হয় দেবী চৌধুরাণী একজন জমিদার ছিলেন।

 “উল্লিখিত রিপোর্ট পাইয়া রংপুরের কলেক্টর লেফটেনান্ট ব্রেনানকে লেখেন (১২ই জুলাই, ১৭৮৭ খ্রী.) যে আপাততঃ দেবী চৌধুরাণীকে গ্রেপ্তার করিবার প্রয়োজন নাই। তাহার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ পাইলে এ-সম্বন্ধে নির্দেশ দেওয়া যাইবে।”

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাহার ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ও ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসে ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরাণীকে অমর করিয়া গিয়াছেন। ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরাণী নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক ব্যক্তি, কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহাদের কাল্পনিক জীবনী ভিত্তি করিয়া উপন্যাস না লিখিলে আজ বাংলা দেশে কেহই তাহাদের নাম জানিত কিনা সন্দেহ। কিন্তু আনন্দমঠে তিনি সন্তানদের যে জীবন, আদর্শ চরিত্র ও অদ্ভুত স্বদেশপ্রেম বর্ণনা করিয়াছেন তাহার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই।

আচার্য যদুনাথ সরকার এ-সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি : “প্রথমেই তো গোড়ায় গলদ, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সন্তানেরা’ বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ কায়স্থের ছেলে, গীতা যোগশাস্ত্র প্রভৃতিতে পণ্ডিত; কিন্তু যেসব সন্ন্যাসী ফকিরেরা সত্য ইতিহাসের লোক, এবং উত্তরবঙ্গে (বীরভূম নহে) ঐসব অত্যাচার করে তাহারা এলাহাবাদ, কাশী, ভোজপুর প্রভৃতি জেলার পশ্চিমের লোক এবং প্রায় সকলেই নিরক্ষর, ভগবদ্গীতার নাম পর্যন্ত জানিত না। বঙ্কিমের সন্তান-সেনা বৈষ্ণব, আর আসল সন্ন্যাসীরা ছিল শৈব, আজ পর্যন্ত তাহাদের নাগা সম্প্রদায় চলিয়া আসিতেছে, যদিও ইংরেজের ভয়ে তাহারা এখন অস্ত্র রাখিতে বা লুট করিতে পারে না।…সত্যকার সন্ন্যাসী ফকিরেরা অর্থাৎ পশ্চিমে গিরিপুরীর দল, একেবারে লুঠেড়া ছিল, কেহ কেহ অযোধ্যা সুবায় জমিদারীও করিত; মাতৃভূমির উদ্ধার, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন উহাদের স্বপ্নেরও অতীত ছিল, এই মহাব্রত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের কল্পনায় সৃষ্ট কুয়াশা মাত্র।”

যদুনাথ আরও লিখিয়াছেন যে, যদিও ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরাণী’ “কোন মতেই ঐতিহাসিক, এই বিশেষণ পাইতে পারে না” ইহাদের মধ্যে “যে অমৃতরস আছে” তাহা ইহা “অপেক্ষা শতগুণ বেশী ‘সত্য’ ঐতিহাসিক কোন উপন্যাসে পাওয়া যায় না।”

সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছাড়া রংপুরেও একটি ছোটখাট বিদ্রোহ হয়। রাজা দেবীসিংহ দিনাজপুর ও রংপুর জিলার ইজারাদার ছিলেন এবং বর্ধিত হারে জমিদারগণের নিকট হইতে জোরজুলুম করিয়া বহু অতিরিক্ত টাকা আদায় করিতেন। ফলে এই সমুদয় জমিদারেরাও প্রজাদের উৎপীড়ন করিয়া অতিরিক্ত খাজনা আদায় করিত। ১৭৮২ সনে ইদ্রাকপুরের জমিদার এবং দিনাজপুরের রায়গণ গভর্নমেন্টকে এ বিষয়ে অভিযোগ করে। মালদহ হইতে চার্লস গ্র্যান্ট (Charles Grant) রংপুরের কলেক্টরকে এই বীভৎস অত্যাচারের যে-বিবরণ দিয়াছিলেন তাহা হইতে কিছু উদ্ধৃত করিতেছি : “দরজা খুলিয়া দেওয়ায় পাঁচ ছয়টি শীর্ণকায় কঙ্কালের আকৃতি মানুষ দৃষ্টিগোচর হইল। তাহাদের দুই পা বান্ধা, হাঁটিবার শক্তি নাই, মনে হইল কথা বলিতেও পারে না। ইহাদের অধিকাংশই আট দশদিন এইভাবে আটক ছিল এবং ইহার মধ্যে মাত্র দুই তিন বার দেবীসিংহের একটি চাকর দয়া করিয়া কিছু খাদ্য দিয়াছে। প্রতি সকালে ও সন্ধ্যায় তাহাদের প্রহার করা হইত, এবং পৃষ্ঠে তাহার দাগ পরিষ্কার দেখা যায়।”

বিদ্রোহীগণের আর্জিতে বর্ণিত হইয়াছে যে অন্যান্য অতিরিক্ত করের ভারে তাহারা সর্বস্বান্ত হইয়াছে, ঘরদুয়ার এমনকি সন্তান পর্যন্ত বেচিয়াছে, কিন্তু তবু আমলাদের দাবি মিটাইতে না পারায় এইরূপ কারাবদ্ধ হইয়া অমানুষিক যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছে।

এইরূপ অত্যাচারের ফলে নানা স্থানের রায়ঙ্গণ সমবেত হইয়া দুর্লভনারায়ণের পুত্র দুর্জয়নারায়ণকে নবাব ঘোষণা করিল এবং ডাকালিগঞ্জের কয়েদখানার ফটক খুলিয়া কয়েদীগণকে মুক্ত করিল। ক্রমে আরও অনেক রায়ৎ তাহাদের সঙ্গে যোগ দিল এবং সকলে মিলিয়া প্রতীকারের জন্য ডিমলার গোমস্তার নিকট গেল। গোমস্তার বরকন্দাজদের গুলিতে কয়েকজন রায়ৎ মরিল কিন্তু লড়াই আরম্ভ হইল এবং গোমস্তা ধৃত ও নিহত হইল।

ক্রমে ক্রমে বিদ্রোহ ছড়াইয়া পড়িল। দিনাজপুরে রায়গণ আমলাদিগকে মারিয়া কাছারী লুট করিল। তাহারা অস্ত্রশস্ত্র হাতে করিয়া দল বাঁধিয়া অগ্রসর হইল এবং দলে দলে নানা পরগণার রায়গণ তাহাদের দলে যোগ দিল। তখন সৈন্য পাঠাইয়া এই বিদ্রোহ দমন করা হইল। এই বিদ্রোহ দমনের পর যে সরকারী তদন্ত কমিশন বসান হয় তাহাতে দরিদ্র প্রজাদের উপর কিভাবে উৎপীড়ন করিয়া ন্যায্য খাজনা ছাড়াও অনেক টাকা আদায় করা হইত এবং তাহার ফলে প্রজাদের চরম দুর্দশার কাহিনী পরিষ্কাররূপে ব্যক্ত হইয়াছে। দেবীসিংহ হেস্টিংসের একজন প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং সেই কারণেই তিনি এতদূর অত্যাচার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। বিলাতে পার্লিয়ামেন্টে যখন হেস্টিংসের বিচার হয় তখন বার্ক (Edmund Burke) অপূর্ব বাগিতা সহকারে দেবীসিংহের অত্যাচার বর্ণনা করিয়াছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছেন : “পৃথিবীর ওপারে ওয়েষ্টমিনিষ্টর হলে দাঁড়াইয়া এদমন্দ বার্ক সেই দেবীসিংহকে অমর করিয়া গিয়াছেন। পর্বতোগীর্ণ অগ্নিশিখাবৎ জ্বালাময় বাক্যস্রোতে বার্ক দেবীসিংহের দুর্বিষহ অত্যাচার অনন্ত কাল সমীপে পাঠাইয়াছেন। তাহার নিজমুখে সে দৈববাণীতুল্য বাক্যপরম্পরা শুনিয়া শোকে অনেক স্ত্রীলোক মূর্হিত হইয়া পড়িয়াছিল–আজিও শত বৎসর পরে সেই বক্তৃতা পড়িতে গেলে শরীর রোমাঞ্চিত এবং হৃদয় উন্মত্ত হয়। সেই ভয়ানক অত্যাচার বরেন্দ্রভূমি ডুবাইয়া দিয়াছিল।”

‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্রের এই উক্তি খুবই সত্য। এই প্রসঙ্গে ভবানী পাঠকের মুখ দিয়া বঙ্কিমচন্দ্র মুসলমান ও ইংরেজ রাজত্বের সন্ধিক্ষণে বঙ্গদেশে যে অরাজকতা ও অত্যাচারের বর্ণনা করিয়াছেন তাহাও এ-স্থলে উল্লেখযোগ্য। “ভূম্যধিকারীর দুর্বিষহ দৌরাত্ম” নিম্নলিখিতরূপে বর্ণিত হইয়াছে :

“কাছারির কর্মচারীরা বাকিদারের ঘরবাড়ী লুঠ করে, লুকান ধনের তল্লাসে ঘর ভাঙ্গিয়া, মেঝা খুরিয়া দেখে, পাইলে এক গুণের জায়গায় সহস্র গুণ লইয়া যায়, না পাইলে মারে, বাঁধে, কয়েদ করে, পোড়ায়, কুড়ল মারে, ঘর জ্বালাইয়া দেয়, প্রাণবধ করে। সিংহাসন হইতে শালগ্রাম ফেলিয়া দেয়, শিশুর পা ধরিয়া আছাড় মারে, যুবকের বুকে বাঁশ দিয়া দলে, বৃদ্ধের চোখের ভিতর পিঁপড়ে, নাভিতে পতঙ্গ পূরিয়া বাঁধিয়া রাখে, যুবতাঁকে কাছারিতে লইয়া গিয়া সর্বসমক্ষে উলঙ্গ করে, মারে, স্তন কাটিয়া ফেলে, স্ত্রীজাতির যে শেষ অপমান, চরম বিপদ, সর্বসমক্ষেই তাহা প্রাপ্ত করায়।”

ইহার মধ্যে উপন্যাসোচিত অতিরঞ্জন থাকিলেও ইহা যে অনেকাংশেই সত্য, সমসাময়িক বিবরণগুলি পড়িলে তাহাতে সন্দেহ থাকে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *