৫০. বাস্টার্ড তার মিশনে সফল

অধ্যায় ৫০

জেফরি বেগ জানে বাস্টার্ড তার মিশনে সফল হয়েছে কিন্তু তার নিজের মিশন এখনও সফলতার মুখ দেখে নি । তবে এটাও ঠিক এতো সহজে সে হাল ছেড়ে দিচ্ছে না। কোলকাতার পুলিশকে বাস্টার্ডের ছবি দিয়ে দিয়েছে, ওরা নিশ্চয় এই ভয়ঙ্কর খুনিকে ধরার জন্য সব চেষ্টা করবে। বিশেষ করে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফকে অ্যালার্ট করার পাশাপাশি সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের পুলিশকে সতর্ক করে দেয়া হবে। খুনির ছবি অতিদ্রুত ফ্যাক্স করে সবগুলো থানায় পাঠিয়ে দিতে পারলে বাস্টার্ডের পক্ষে সীমান্তে পাড়ি দেয়া সম্ভব হবে না।

ব্ল্যাক রঞ্জুর লাশ পুলিশ নিয়ে গেছে। মাউন্ট অলিম্পাস নামের রিস্টুরেন্টটা বন্ধ করে রেখেছে তারা। এর মালিক মৃণাল বাবু পলাতক। পুলিশ যতোটুকু জানতে পেরেছে, মৃণাল বাবু নামেমাত্র মালিক হলেও ব্ল্যাক রঞ্জুই আসল মালিক। তার হয়তো একজন স্থানীয় লোকের দরকার ছিলো, সেই প্রয়োজন মিটিয়েছে মৃণাল বাবু । রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার শীতল বাবুকে গ্রেফতার করা হয়েছে, আশা করা যায় মৃণাল বাবুকেও শীঘ্রই গ্রেফতার করা হবে।

কোলকাতার পুলিশ কমিশনার জেফরি বেগকে জানিয়েছে কিভাবে চতুর খুনি পুলিশে ঘিরে থাকা ভবন থেকে সুকৌশলে বের হতে পেরেছে। জেফরি অবশ্য অবাক হয় নি, সে জানতো এরকম কিছু হবে। সেজন্যে আগেই বলে দিয়েছিলো তাদেরকে, বাস্টার্ড খুবই ইনোভেটিভ। অবশ্য যা ঘটেছে তাতে করে কোলকাতার পুলিশকে দোষ দেয়া যায় না। তারা তো খুব বেশি প্রস্ততি নেবার সময় পায় নি। জেফরির রিকোয়েস্টের জবাবে দ্রুত রিঅ্যাক্ট করেছে তারা।

তারপরও সারা রাত ঘুম হয় নি জেফরি বেগের। পর দিন সকালে অফিসে গিয়ে দেখা করলো তার বস ফারুক আহমেদের সাথে।

“যা-ই বলো না কেন, একটা বিরাট উপকার হয়ে গেছে এ ঘটনায়,” ফারুক আহমেদকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে।

জেফরি জানে তার বস কি বলতে চাচ্ছে। “তা ঠিক, একান্ত অনিচ্ছায় বসের সাথে তাল মেলালো সে। কিন্তু সে খুশি হতে পারছে না। তার ব্যক্তিগত মিশনটা এখনও সফলতার মুখ দেখে নি।

“তুমি মনে হয় অতোটা খুশি হও নি?” জানতে চাইলো হোমিসাইড প্রধান।

“বাস্টার্ড কিন্তু এখনও ধরা পড়ে নি,” আস্তে করে বললো সে।

“কিন্তু ব্ল্যাক রঞ্জু মারা গেছে, আই মিন তাকে খুন করা হয়েছে, যাকে হন্যে হয়ে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছিলো এতোদিন, যে ছিলো আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারচেয়েও বড় কথা, বিরাট একটি ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে গেছে। আমরা এখন হাফ ছেড়ে বাঁচতে পারি। সে তুলনায় তোমার ঐ বাস্টার্ডের ধরা পড়া আর না পড়া একেবারেই তুচ্ছ ঘটনা।” একটু সামনের দিকে ঝুঁকে মহাপরিচালক বললো, “ইনফ্যাক্ট, ব্ল্যাক রঞ্জুর মতো একজন ক্রিমিনালকে খুন করার জন্য ঐ খুনিকে তুমি বাহবা দিতে পারো।”

জেফরি স্থির চোখে চেয়ে রইলো হোমিসাইডের মহাপরিচালকের দিকে। এটা জেফরিও জানে। শুধুমাত্র ব্ল্যাক রঞ্জু নিহত হবার খবরটাই সেলিব্রেট করার জন্য যথেষ্ট। আর যে গোপন ষড়যন্ত্রটি বানচাল হয়ে গেছে সেটা বিশাল সাফল্য হলেও এ নিয়ে সেলিব্রেট করার মতো লোক বলতে তারা দুজন। তারপরও নতুন আরেকটা প্রশ্ন তাকে খোঁচাচ্ছে কাল রাত থেকেই।

“তাছাড়া তুমি তো ঐ বাস্টার্ডের ছবি, আঙুলের ছাপ বের করেই ফেলেছো। আজ হোক কাল হোক সে ধরা পড়বেই। এ নিয়ে চিন্তা কোরো না।” ফারুক আহমেদ তাকে আশ্বস্ত করলো ।

জেফরি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললো, “স্যার, বাস্টার্ডকে এবার কে নিয়োগ দিলো?” ফারুক আহমেদের কাছ থেকে যে এ প্রশ্নের জবাব পাবে না সেটা ভালো করেই জানে ।

“উমমম…সেটা তো ভাবনার বিষয়। এই খুনি কেন ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের বিরুদ্ধে, আই মিন রঞ্জুকে খুন করতে এতে মরিয়া হয়ে উঠলো?…কে তাকে এ কাজের কন্ট্রাক্ট দিলো, অ্যাঁ?”

“তারচেয়ে বড় কথা বাস্টার্ড এমন একটা খুনের কন্ট্রাক্ট জেনেশুনে নিতে পারলো!…এতোবড় ঝুঁকি, এত বড় একটা ষড়যন্ত্রের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেললো শুধুমাত্র টাকার জন্যে?”

“হি ইজ অ্যা প্রফেশনাল হিটম্যান, মাইবয় । মানি ডাজ ম্যাটার টু হিম,” বিজ্ঞের মতো বললো ফারুক আহমেদ।

জেফরিও জানে কথাটা সত্যি। হয়তো তাকে প্রচুর টাকা অফার দেয়া হয়েছে। এতে বিপুল পরিমাণের টাকা যে ফিরিয়ে দিতে পারে নি। কিন্তু আরেকটা প্রশ্ন জন্ম দেয়-এতো টাকা কে তাকে দেবে?

গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চয় প্রচুর পরিমাণের টাকা খরচ করে এমন একজন খুনিকে ভাড়া করবে না কাজটা করার জন্য। বিগত সরকার যে এমন কাজের পেছনে থাকবে না সেটা নিশ্চিত। এ দেশের প্রধান দুটি দল কোনোভাবেই একে অন্যের বিরাট উপকার করতে মাঠে নামবে না। পারলে তারা একে অন্যেকে ধ্বংস করে দিতে মরিয়া।

তাচেয়েও বড় কথা, কোনো পেশাদার খুনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজও করবে না। কারণটা খুব সহজ : তারা একে অন্যেকে বিশ্বাস করে না। বিশেষ করে কোনো প্রফেশনাল কিলার এরকম কোনো সংস্থার হয়ে কাজ করবে না। অতীতে হাতে গোনা কিছু নীচুশ্রেণীর সন্ত্রাসীদের দিয়ে এরকম কাজ করিয়ে নেবার পর সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে দুনিয়া থেকে। কথাটা নিশ্চয় বাস্টার্ডের অজানা নয়। এরকম কাউকে সে বিশ্বাস করবে না। কোনো দিনই না। তাহলে কে তাকে এমন কন্ট্রাক্ট দিলো?

“চা খাবে?”

ফারুক আহমেদের কথায় সম্বিত ফিরে পেলো জেফরি বেগ । “জি, স্যার।”

ফারুক আহমেদ দুকাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে দিলো। “কাল সবগুলো দৈনিক পত্রিকায় যখন খবরটা ছাপা হবে তখন কি বুঝতে পারছো?”

গতকাল ব্ল্যাক রঞ্জুর নিহত হবার খবর হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট অবগত হলেও এ দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো এখনও সেই খবর জানে না । তবে আজকের মধ্যে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট কোলকাতার পুলিশের কাছ থেকে অফিশিয়ালি সব জানতে পারবে, নিহতের ছবিসহ বিস্তারিত সবই তাদের কাছে পাঠানো হলে তারা সেটা সরকারী সংবাদসংস্থায় পাঠিয়ে দেবে। নিঃসন্দেহে বিরাট একটি খবর । সবগুলো পত্রিকা হেডলাইন করতে পারে ।

“আমি ভাবছি কোলকাতা থেকে সব জানতে পারলে এ নিয়ে একটা প্রেসকনফারেন্স করবো।”

ফারুক আহমেদের এ কথায় জেফরি অবাক হলো। আমাদের কি প্রেসকনফারেন্স করা ঠিক হবে, স্যার?” বললো সে।

“কেন ঠিক হবে না? তুমি যদি ওভাবে খুনিকে ট্র্যাকড্রাউন না করতে তাহলে কি ব্ল্যাক রঞ্জুর অবস্থান সম্পর্কে কেউ জানতে পারতো? এর পুরো কৃতিত্ব তোমার, আই মিন আমাদের ডিপার্টমেন্টের।”

“কিন্তু আমাকে এসব প্রেসকনফারেন্সে থাকতে বলবেন না, স্যার।”

ফারুক আহমেদ হাসতে লাগলো। সে জানে তার এই প্রিয়পাত্র মোটেও সাংবাদিকবান্ধব নয়। এদেরকে এড়িয়ে যায় সব সময়। তারপরও এতোবড় কৃতিত্ব নেবে না?

“কিন্তু এবার তোমার প্রেসকনফারেন্সে থাকা উচিত। শুধু ব্ল্যাক রঞ্জুর ঘটনাই নয়, তুমি যে নতুন একটি টেকনিক উদ্ভাবন করেছে আর সেটা যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড স্বীকৃতি দিয়েছে সেটা সবাইকে জানানোর উপযুক্ত সময় এসে গেছে।”

আৎকে উঠলো জেফরি বেগ। “স্যার, আপনি কী বলছেন?” একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এলো সে। “এই টেকনিকের কথা কাউকে বলা যাবে না। একদম না।”

ফারুক আহমেদ ভুরু কুচকে তাকালো তার দিকে। “কেন? জানালে সমস্যা কি?”

“স্যার, প্রচার পেলে অপরাধীরা সাবধান হয়ে যাবে। তারা পিস্তল রিভলবারে গুলি ভরার সময়ও অতিরিক্তি সতর্ক হয়ে উঠবে। এটা বিজ্ঞাপন করার মতো বিষয় না।”

কপালের একপাশ চুলকে নিলো ফারুক সাহেব। ঠিকই তো বলেছে জেফরি। এমন সময় ঘরে একটা ছেলে ঢুকে চা দিয়ে গেলো ।

“ওকে, কেউ জানবে না। তোমার কথাই মেনে নিলাম। তাহলে শুধু ব্ল্যাক রঞ্জুর ব্যাপারে একটা প্রেস কনফারেন্স করি, কি বলো?”

চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে জেফরি বেগ বললো, “যেটা ভালো মনে করেন, স্যার।” কথাটা শেষ না হতেই তার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। বের করে দেখলো একটা এসএমএস।

টি-প্যালেস। ৫টা। আই উইল বি দেয়ার। লাভ ইউ।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে জেফরি মেসেজটা পড়লো।

লাভ ইউ টু।

.

অধ্যায় ৫১

চায়না টাউন থেকে পালিয়ে আসার পর রেন্ট-এ-কারটা যখন তার হোটেলের সামনে আসে দেখতে পায় গেটের কাছে মৃদুল দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই মৃদুলের মুখে চওড়া হাসি ফুটে ওঠে। ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে হোটেলে ঢোকে বাস্টার্ড ।

“তুমি আমার আগে কিভাবে এলে?” রুমে আসার পর জানতে চায় সে।

“আমি তো বস্ এক দৌড়ে চলে যাই মেইনরোডে, সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলে আর দেরি করি নি।”

“গুড,” বাস্টার্ড তার পিঠ চাপড়ে বলে।

“বস, খুনখারাবির কেস নাকি?” এই প্রথম মৃদুল জানতে চায়। তার স্বভাবে বাড়তি কৌতূহল বলে কিছু নেই। তবে আজকের ঘটনাটা ব্যতিক্রম। রেস্টুরেন্টে সুপের বাটি থেকে আরশোলা পাওয়া নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধানোর যে ভূমিকা শুধু তাই পালন করে নি, বাস্টার্ডকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে ঝুঁকি নিয়ে রক্ষাও করেছে। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় মৃদুলকে সত্যি কথাই বলবে।

“হুম। ব্ল্যাক রঞ্জু।”

ভুরু কপালে উঠে যায় মৃদুলের। “খালাস?” হাত দিয়ে গলা কাটার ভঙ্গি করে সে।

মাথা নেড়ে সায় দেয় বাস্টার্ড ।

“বাপরে!” শুধু এটুকুই বলেছিলো আর কিছু জানতে চায় নি।

“কালই আমরা চলে যাচ্ছি, তুমি ব্যবস্থা করো।”

“ওকে, বস্।”

“রেন্ট-এ-কারটা ছেড়ে দাও। পাওনা-টাওনা যা আছে মিটিয়ে ফেলো।”

“ঠিক আছে। আমি তাহলে যাই। কাল খুব সকালে রওনা দেবো। উমমম…আটটা?”।

“ঠিক আছে।”

মৃদুল চলে গেলে বিছানার উপর সটান শুয়ে পড়ে সে। বুঝতে পারে কোলকাতার পুলিশ হন্যে একজন ফেরারিকে খুঁজবে এখন। চায়না টাউনের এক রেস্টুরেন্টে খুন করে পালিয়ে যাওয়া সেই ফেরারিকে ধরার জন্য ব্যাপক পুলিশী অভিযান শুরু হবে সন্দেহ নেই।

কিন্তু এখানকার পুলিশ কিভাবে তার মিশনের খবর জানতে পারলো, কিভাবে তারা অলিম্পাসে এসে হাজির হলো?

এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর তার জানা নেই। কোনো অনুমাণ ও করতে পারে নি। মাথা থেকে ভাবনাটা আপাতত সরিয়ে রাখতে জামাকাপড় পাল্টে গোসল করে নেয়। রুমের বাতি নিভিয়ে সটান পড়ে রয় বিছানায়।

ঠিক কততক্ষণ ঘুমিয়েছিলো জানে না, কাঁচাঘুম ভাঙে দরজায় জোরে জোরে টোকার শব্দে।

বুকটা লাফিয়ে ওঠে তার। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে নি। তার দরজায় এভাবে টোকা মারার তো কথা নয়। একমাত্র মৃদুল ছাড়া কেউ তার এখানে আসারও কথা নয়। কিন্তু ছেলেটা তো একটু আগেই চলে গেছে এখান থেকে।

“বস্!” মৃদুলের ফিসফিসে কণ্ঠটা শুনে আরো ঘাবড়ে যায় সে। এভাবে কেন তাকে ডাকছে!

“বস! জলদি খোলেন!” মৃদুলের কণ্ঠে তাড়া।

ড্রয়ার থেকে পিস্তলটা হাতে নিয়ে আস্তে করে দরজা খুলে দিতেই মৃদুল ভেতরে ঢুকে পড়ে।

“বস! সর্বনাশ হয়ে গেছে।”

“কি হয়েছে?” বাস্টার্ডের মাথায় কিছুই ঢোকে না।

মৃদুল নিজেই দরজা বন্ধ করে ফেলে। “পুলিশ আপনাকে খুঁজছে।”

“কি!”

“হ্যাঁ, আমি নিজের চোখে দেখেছি। আপনার ছবি তাদের হাতে…”

“কোথায়?”

“একটা কাজে বাইরে গেছিলাম, পথে পুলিশবক্সের এক পুলিশ কিছু লোকজনকে থামিয়ে আপনার একটা ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছে চেনে কিনা। আমি কাছে গিয়ে ছবিটা দেখেছি।”

মাইগড! “আমার ছবি?” অবিশ্বাসে বলে সে। কিভাবে তার ছবি এদের হাতে এলো কে জানে। তার কাছে পুরো ব্যাপারটাই পুরোটাই গোলকধাঁধার মতো মনে হতে লাগলো।

“ভাবেন একবার! ভাগ্য ভালো যে আমি আগ্রহ নিয়ে দেখতে গেছিলাম।”

“তার মানে এখানে থাকা একদম নিরাপদ না।”

“একদমই না।”

“তাহলে এখন কোথায় যাবো?” বাস্টার্ড সত্যি সত্যি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।

“এখনই রওনা দিতে হবে।”

“কোথায়?”

“বর্ডারে। দেরি করলে আর যাওয়া যাবে না।”

এরপর মৃদুল যা করলো তা এক কথায় অসাধারণ।

প্রথমেই সে বাস্টার্ডকে নিয়ে হোটেলের কাছেই তার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গেলো। বাস্টার্ডের মাথা কামিয়ে গেরুয়া রঙের একটি পাঞ্জাবি জাতীয় পোশাক আর ধূতি পরিয়ে কপালে চন্দনের তিলক লাগিয়ে তাকে রীতিমতো হরেকৃষ্ণ-হরে-রাম ভক্ত বানিয়ে ফেললো। এরপর সে নিজেও ওরকম সাজে সজ্জিত হলো।

ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসাসনেস-ইসকন!

মৃদুল নিজেও নাকি ইকনের সদস্য, তবে সক্রিয় নয়। তার অনেক আত্মীয়স্বজন ইসকনে আছে।

রাতের শেষ বাসটায় করে তারা রওনা দিলো পশ্চিমবঙ্গের হাবরা জেলায়। ভোরের দিকে হাবরায় নেমে খালি পায়ে খাঁটি ইসকন ভক্ত সেজে দু’জনে চলে এলো বর্ডারের কাছে।

ভারতবর্ষে সাধুসন্তদের জন্যে কোনো কালেই সীমান্ত বলে কিছু ছিলো না। এই আধুনিক যুগেও তারা অনেক জায়গায় চলে যেতে পারে বিনা বাধায়। ইসকনের অনেক সদস্য সীমান্তবর্তী এলাকায় এভাবেই এপার-ওপার করে। বিএসএফ আর বিডিআর এদের ব্যাপারে সহমর্মি। মৃদুল অতীতে অনেকবার এটা ব্যবহার করেছে যখন সে সর্বহারার সাথে সক্রিয় ছিলো । বর্ডারে খুব কড়াকড়ি, কোনোভাবেই ঘুষ দিয়ে সীমান্ত পার হওয়া যাবে না এরকম সময়গুলোতে ইস্কন সেজে নির্বিঘ্নে পাড়ি দিয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাই এখন কাজে লাগাচ্ছে সে।

বাস্টার্ড অবাক হয়ে দেখতে পেলো বিএসএফ হাসি হাসি মুখে তাদেরকে বর্ডার ক্রশ করতে দিলো। একই ঘটনা ঘটলো বিডিআর’র বেলায়ও।

“প্রতিদিন ইসকনের অনেক সদস্য এভাবেই বর্ডার ক্রশ করে,” সীমান্ত পার হয়ে একটা ভোলা মাঠ দিয়ে নগ্নপদে হেঁটে যাবার সময় বললো মৃদুল। “এইসব ইসকনের লোকজন কখনওই ভিসা-পাসপোর্টের ধার ধারে না।”

অবাক হয়ে শুনতে লাগলো বাস্টার্ড। সে এটা জানতো না।

“তাদের ভিসা-পাসপোর্ট এক কথায়ই শেষ-হরে কৃষ্ণ হরে রাম!”

পায়ে হেঁটে, নৌপথে তারা দু’জন সাতক্ষীরা জেলায় এসে হাজির হলো । মৃদুলের এক পরিচিত আত্মীয়ের বাড়িতে উঠলো তারা। একরাত থেকে ওখান থেকে চলে গেলো মৃদুলের বাড়িতে।

ঐদিনই দুপুরের দিকে মৃদুল কিছু দৈনিক পত্রিকা নিয়ে এলো। সবগুলোর শিরোনাম ব্ল্যাক রঞ্জুর নিহত হবার খবর, সেইসাথে নিহত রঞ্জুর ছবি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে কুখ্যাত সন্ত্রাসী চিৎ হয়ে পড়ে আছে। তার চোখ দুটো আধখোলা; মুখটা হা করা । ঠিক ডান চোখের উপরে গুলির ফুটো। কমবেশি সবগুলো পত্রিকায়ই বিভিন্ন ভঙ্গিতে রঙুর ছবি ছাপা হয়েছে। কোনোটা ক্লোজআপ কোনোটা বুক থেকে মাথা পর্যন্ত; বুকে আর পেটেও যে গুলি লেগেছে সেটা দেখানোর উদ্দেশ্যে।

তবে মজার বিষয় হলো এই হত্যাকাণ্ডকে তার নিজের দলের কোন্দলের ফল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমে ঢাকায় ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে তারই এক সময়কার সঙ্গিরা। পরে সেটার জের ধরে কোলকাতায় ঘটে আরেকটি হত্যাকাণ্ড। আর সেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। স্বয়ং রঞ্জু।

চমৎকার।

ঢাকায় রঞ্জুগ্রুপের লোকজনের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ন্যস্ত করা হয়েছিলো হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে। দক্ষ ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ এইসব খুনখারাবির সূত্র ধরেই নিশ্চিত হয় ব্ল্যাক রঞ্জু কোলকাতার কোথায় অবস্থান করছে। তার উদ্যোগেই কোলকাতার পুলিশকে ব্যাপারটা জানানো হলে সেখানকার পুলিশ ঝটিকা অপারেশন চালায়, কিন্তু পুলিশ পৌঁছানোর আগেই রঞ্জু তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের হাতে প্রাণ হারায়।

কথাটা পুরোপুরি সত্য নয় কিন্তু সব কিছুর মূলে যে জেফরি বেগ আছে সেটা বুঝতে পারে বাস্টার্ড ।

তাহলে তুমিই কোলকাতা পর্যন্ত আমাকে পুলিশ দিয়ে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে!

.

ওদিকে পুরনো ঢাকার নবাবপুরের এক সুরক্ষিত কক্ষে বসে শুটার সামাদও পত্রিকা পড়ছিলো। রঞ্জুর নিহত হবার খবরটা অবশ্য কাল রাতেই সে পায় দুটি টিভি চ্যানেলের সংবাদে। তার ওখানে যে বোবা ছেলেটা থাকে তাকে দিয়ে পাঁচ-ছয়টি পত্রিকা কিনে আনিয়েছে সংবাদটার ডিটেইল জানার জন্য।

প্রায় সবগুলো পত্রিকাই একই রকম খবর ছেপেছে। কিন্তু শুটার সামাদ ভালো করেই জানে এটা রঞ্জুর দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দল নয়, কাজটা করেছে বাস্টার্ড। সে খুব অবাক হলো বাস্টার্ড সুদূর কোলকাতায় গিয়ে সফলভাবে ব্ল্যাক রঞ্জুকে খুন করতে পেরেছে বলে। তার ধারণা ছিলো বাস্টার্ড কোনোভাবেই রঞ্জুর নাগাল পাবে না। ছেলেটা তাকে আবারো বিস্মিত করলো।

পাঁচটা পত্রিকা পড়ার পর ছয় নাম্বারটা হাতে নিতেই তার চোখ আঁটকে গেলো এক জায়গায়। ভালো করে চেয়ে দেখলো সে। কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলো। পাঁচ মিনিট পর টেলিফোনটা তুলে নিয়ে একটা জায়গায় ফোন করলো শুটার সামাদ।

* * *

মৃদুলের বাড়িতে দু’দিন থেকে ইসকনের বেশভূষা নিয়েই ঘুরপথে ঢাকায় চলে এলো বাস্টার্ড । প্রথমে সাতক্ষীরা থেকে মংলায় চলে যায়, ওখান থেকে ট্রলারে করে বরিশাল, সেখান থেকে লঞ্চে করে সোজা ঢাকায়। এই নিরাপদ ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে মৃদুল। আগে ভেবেছিলো ছেলেটাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবে, কিন্তু যে কাজ সে করেছে তাতে বাস্টার্ড খুশি হয়ে দু’লাখ টাকা দিয়ে দিয়েছে। টাকা পেয়ে মৃদুল যারপরনাই খুশি। তারপরও বাস্টার্ড ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে জানায় তার কাছে সে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।

ঢাকায় আসার পর টানা একদিন নিজের বাড়িতে কাটিয়ে দিয়ে দ্বিতীয় দিন তার ট্রাস্টিকে ফোন করলে লোকটা দারুণ সন্তুষ্ট হলো। তাকে জানালো কন্ট্রাক্টের টাকা দু’একদিনের মধ্যেই তার একাউন্টে চলে যাবে।

ফোনটা যে-ই না রাখতে যাবে অমনি বেজে উঠলো আবার । ডিসপ্লে’তে দেখলো শুটার সামাদ। তার কাছ থেকে নেয়া সাইলেন্সারটা চায়না টাউনেই ফেলে চলে এসেছে । ঢাকায় আসার পর তার সাথে আর যোগাযোগও হয় নি। পত্রিকা মারফত সামাদ ভাইও নিশ্চয় জেনে গেছেন তার মিশনের কথা।

“হ্যালো, ভাই কেমন আছেন?”

“ভালো। তেমাকে ফোন করেছি অনেকবার, ফোন বন্ধ ছিলো…কবে এসেছো?” জানতে চাইলো শুটার সামাদ।

“এই তো আজই,” একটু মিথ্যে বললো। সত্যিটা বললে সামাদ ভাই হয়তো মনে কষ্ট পাবেন।

“তুমি ঠিক আছে তো?”

“জি, ভাই।”

“আমি তোমাকে নিয়ে একটু টেনশনে আছি। গত দু’দিন ধরে অনেকবার ফোন করেছি…”।

“টেনশন করার কোনো দরকার নেই, ভাই । পত্রিকায় সব দেখেছেন নিশ্চয়?”

“হ্যাঁ। সবগুলো পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলে খবরটা ভালোমতোই প্রচার করেছে। আমি অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম তুমি এরকম একটা কাজ করতে যাচ্ছো …”

“আপনি যে বুঝতে পেরেছেন সেটা আমিও জানতাম কিন্তু আপনাকে বলতে পারি নি। আশা করি মনে কিছু করেন নি?”

“আরে, না। মনে করবো কেন। সব বিজনেসেরই গোপনীয়তা আছে।”

“আসলে আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম কাজটা ভালোমতো করে আসতে পারলে আপনাকে জানাবো। কিন্তু ঘটনাটা এমন হয়ে গেলো যে-”।

তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললেন শুটার সামাদ, “তোমাকে একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোনো…”

“জি, বলেন।” বাস্টার্ড একটু অবাক হলো সামাদ ভায়ের কাছ থেকে উচ্ছ্বসিত কোনো কথা শুনতে না পেয়ে।

“তুমি যাকে মেরেছো সে ব্ল্যাক রঞ্জু না।”

“কি!” বাস্টার্ডের কাছে মনে হলো লোকটা ঠাট্টা করছে।

“ওটা ব্ল্যাক রঞ্জ না।” কথাটা আবার বললেন শুটার সামাদ। “আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত!”

চুপ মেরে রইলো সে। শুটার সামাদের কথাটা হজম করতে বেগ পেলো।

“পত্রিকায় তার ডান হাতটা দেখেছি, একদম ঠিক আছে। তাছাড়া ওর এক সময়ের ঘনিষ্ঠ এক লোককে ফোন করে কনফার্ম হয়েছি।” একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন সামাদ। “রঞ্জু খুবই ডেঞ্জারাস লোক। ঢাকা শহরে তার প্রচুর লোকজন আছে। তুমি একটু সাবধানে থেকো।”

.

অধ্যায় ৫২

জেফরি বেগ জানে না বাস্টার্ড দেশে ফিরে এসেছে কিনা। তবে তার ধারণা এ মুহূর্তে তার পক্ষে কোলকাতায় থাকা সম্ভব নয়। তাকে বাধ্য হয়েই দেশে ফিরে আসতে হবে। ওখানকার পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে তাকে। তাদের কাছে তার ছবি রয়েছে।

ব্ল্যাক রঞ্জুর নিহত হবার খবরে স্বস্তি নেমে এসেছে ঢাকা শহরে। তার চাঁদাবাজির ভয়ে যাদের রাতের ঘুম হারাম হতো তারা এখন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। এরকম একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তার দলের বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর সংবাদে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও খুশি।

রঞ্জুর সহযোগী ঝন্টু শেষপর্যন্ত সঠিক ঠিকানা বলে দেয়াতে অনেক উপকার হয়েছে। ঝন্টু শুধু রঞ্জুর ঠিকানাই বলে নি, ষড়যন্ত্রের কথাও স্বীকার করেছে। দেশের ভেতর কারা কারা এতে জড়িত সবার নাম বলেছে সে।

ঝন্টুর জবানবন্দী থেকে যা জানা গেছে তাতে করে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হবে অচিরেই। ব্ল্যাক রঞ্জুর দলটি প্রায় শেষ হবার পথে। এ কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী । এটা নিয়ে সে মোটেও চিন্তিত নয়। তার একটাই চিন্তা : বাস্টার্ডকে ধরা। যদিও এই খুনির হাতে ব্ল্যাক রঞ্জু নিহত হয়েছে, সাধারণ জনগণের মাঝে স্বস্তি বয়ে যাচ্ছে, নস্যাৎ হয়ে গেছে বিরাট একটি ষড়যন্ত্র, তারপরও সে তাকে ছাড়বে না।

জেফরি বেগ এখনও জানতে পারে নি বাস্টার্ডকে কে নিয়োগ দিয়েছে। সে জানে, এই খুনি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কাজ করে। রঞ্জুর দলের বিরুদ্ধে সে যেভাবে হত্যা-খুন করেছে তাতে মনে হচ্ছে প্রচুর টাকার একটি কন্ট্রাক্ট ছিলো সেটা। কিন্তু এতো বিপুল পরিমাণের টাকা দিয়ে কে তাকে নিয়োগ দিলো, কেন দিলো?

এসব অমীমাংসিত প্রশ্নের জবাব একভাবেই পাওয়া সম্ভব; বাস্টার্ডকে জীবিত ধরা। সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভুত করে ভাবতে লাগলো কিভাবে এই ধূর্ত খুনিকে দ্রুত ধরা সম্ভব। নিজের অফিসে একা বসে আছে। চোখ দুটো বন্ধ করে একটানা ভেবে গেলো বেশ কিছুটা সময়। হঠাৎ চোখ খুলে ইন্টারকমটা হাতে নিয়ে যখন সহকারী জামানকে ডেকে পাঠালো তখন বুঝতে পারলো না ঠিক কতোক্ষণ সময় গড়িয়ে গেছে। তবে চোখ খোলার পর থেকে তার মধ্যে নতুন প্রাণশক্তি ফিরে এলো যেনো। বাস্টার্ডকে ধরার সহজ একটা বুদ্ধি মাথায় চলে এসেছে।

জামান তার বসের ফোন পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ছুটে এলো। বসলো জেফরির ডেস্কের সামনে। বুঝতে পারছে হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটরের মাথায় নতুন কোনো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।

“জামান, ঢাকা শহরের পাঁচচল্লিশটি থানায় প্রতিদিন অনেক লোককে গ্রেফতার করা হয়, তাই না?”

জি, স্যার।”

“সংখ্যাটা কি রকম হয়?”

একটু ভেবে বললো তার সহকারী, “উমমম…গড়ে দশ পনেরো জন?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “এইসব লোকজনের মধ্যে বেশিরভাগই ত্রিমিনাল।”

“জি, স্যার…তবে নিরীহ লোকজনও থাকে।”

“তারা তো কোনো না কোনো এলাকায় বাস করে, তাই না?”

এবার জামান মাথা নেড়ে সায় দিলো। সে বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে থানা-পুলিশ নিয়ে তার বস কেন আগ্রহী হয়ে উঠলো।

“বাস্টার্ড কিন্তু এ শহরেরই কোথাও না কোথাও থাকে।”

“তাতো ঠিকই, স্যার।”

“ঢাকা শহরের সবগুলো থানায় বাস্টার্ডের ছবিটা পাঠিয়ে দিলাম… প্রতিদিন গ্রেফতার হওয়া লোকজনকে সেই ছবি দেখিয়ে পুলিশ জানতে চাইলো এই লোকটাকে তারা কেউ দেখেছে কিনা…তাহলে কেমন হয়?”

খুব সহজ সরল একটি কাজ কিন্তু জামান সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলো আইডিয়াটা দারুণ। খুব দ্রুত আর কার্যকরী। কোনো থানায় গ্রেফতার হওয়া পনেরো-বিশজন লোকজনকে ছবি দেখিয়ে জানতে চাওয়াটা তেমন কোনো কঠিন কাজই না। তাদের কিছুই করতে হবে না। শুধু ছবি দিয়ে বলে দিতে হবে লোকটার পরিচয় জানার জন্য। কেউ না কেউ ঠিকই তাকে চিনতে পারবে। খুব সম্ভবত তিন চার দিনের মধ্যেই একটা ফল যাবে যদি বাস্টার্ড ঢাকা শহরে থেকে থাকে।

“আমার মনে হয় আইডিয়াটা কাজ করবে, স্যার,” বললো জামান।

“তাহলে দেরি না করে কাজে নেমে পড়ো।”

উঠে দাঁড়ালো জেফরির সহকারী। “আমি এক্ষুণি সবগুলো থানায় ছবি আর ইট্রাকশন ফ্যাক্স করে দিচ্ছি, স্যার।”

জামান রুম থেকে বের হয়ে গেলো। জেফরি বেগের মন বলছে, বাস্টার্ডের খোঁজ পাওয়া যাবে। এ শহরের অনেক লোকই তাকে চেনে। জানে সে কোথায় থাকে । আজ হোক কাল হোক, তাদের মধ্যে কেউ না কেউ থানায় গ্রেফতার হবেই। সেই সম্ভাবনা অনেক বেশি।

.

শুটার সামাদের কাছ থেকে সব শুনে বাস্টার্ড যারপরনাই অবাক। যাকে সে খুন করেছে সে ব্ল্যাক রঞ্জু নয়! শুটার সামাদ একেবারে নিশ্চিত হয়েই তাকে ফোন করেছে। প্রথমে পত্রিকায় নিহত ব্ল্যাক রঞ্জুর ছবি দেখে তার সন্দেহ জাগে। সেই ছবিতে রঞ্জুর পেট থেকে মুখ পর্যন্ত একটা ছবি ছিলো, ছবিতে দেখা গেছে শরীরের দু’পাশে হাত ছড়িয়ে পড়ে আছে রঞ্জু। শুটার সামাদ দেখতে পায় বোমার আঘাতে এই সন্ত্রাসীর ডান হাতে যে ক্ষত হয়েছিলো তার কোনো চিহ্নই নেই।

প্লাস্টিক সার্জারি হতে পারে? পারে না? হ্যাঁ, এটা সামাদ নিজেও ভেবেছে। আর সেজন্যেই আরেকজনের কাছে ফোন করে নিশ্চিত হয়েছে সে। এমন এক লোক যে কিনা এক সময় ব্ল্যাক রঞ্জুর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলো। পরে মনোমালিন্য হলে রঞ্জুর দল ছেড়ে চলে যায় সে। কিন্তু রঞ্জু তাকে হত্যা করার চেষ্টা করলে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায়, বুঝতে পারে রঞ্জুর হাত থেকে বাঁচা সম্ভব নয়। সেজন্যে তড়িঘড়ি দেশ ছাড়ে, চলে যায় মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে। এই লোকটার সাথে শুটার সামাদের পরিচয় আছে। সামাদ জানতে কয়েক দিন আগে সে দেশে ফিরে এসেছে এক মাসের ছুটিতে। তাই নিশ্চিত হবার জন্য তাকে ফোন করলে সে জানায়, পত্রিকায় সেও ছবিটা দেখেছে, সামাদের ধারণাই ঠিক, এটা ব্ল্যাক রঞ্জু না। কোনোভাবেই না । ছবিটা কার সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই।

তাহলে যাকে খুন করলো সে কে? এ প্রশ্নের উত্তর এখন জানা সম্ভব নয়। বাস্টার্ডের সাথে ঐ শিল্পপতির যে কন্ট্রাক্ট ছিলো সেটা শেষ হয়ে গেছে । তার পাওনা টাকাও দিয়ে দেয়া হয়েছে, সেদিক থেকে এ নিয়ে তার খুব একটা ভাবনার দরকার নেই। কিন্তু দুদিন পর যখন সেই শিল্পপতি জানতে পারবে রঞ্জু খুন হয় নি তখন তার ট্রাস্টির কাছে সে মুখ দেখাবে কি করে? ব্যাপারটা কোনোভাবেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলো না।

ঐ শিল্পপতি দেশে ফিরে এসেছে, ব্ল্যাক রঞ্জুর মৃত্যুর কথা জেনে নিশ্চিন্তে হয়েছে ভদ্রলোক। নির্বাচনে মনোনয়ন পাবার জন্যে ব্যস্ত আছে এখন। রঞ্জু যদি তাকে খুন করে ফেলে? তাহলে কি ট্রাস্টির মাধ্যমে জানিয়ে দেবে রঞ্জু খুন হয় নি? আগ বাড়িয়ে এটা বলে দেয়াটা কি ঠিক হবে? না। শুটার সামাদ তাকে যে কথা বলেছে সেটাই যে একশ ভাগ সত্যি তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। সে নিজে যদি নিশ্চিত হতে পারতো তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু নিশ্চিত হবার উপায়টা কি?

রঞ্জুর দলের অসংখ্য সদস্য এখনও বহাল তবিয়তে আছে। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই শহরেই। প্রায় প্রতিটি থানায় রয়েছে তাদের ছোটো ছোটো গ্রুপ। তার দরকার এমন একজন, যে কিনা রঙুর খুব ঘনিষ্ঠ। রঞ্জুকে সচক্ষে দেখেছে। পিং সিটির ম্যানেজার?

সম্ভবত।

.

নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রেবার সাথে এসএমএস আদান প্রদান করছে জেফরি । বিকেলের পরই আজ অফিস থেকে ফিরে এসেছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে এই এসএমএস খেলা চলছে। তার খুব ভালো লাগে। ফোনে কথা বলার চেয়ে এটা অনেক বেশি মজার। পাঁচ মিনিট এক নাগারে ফোনে কথা বললেই তার বিরক্ত লাগে কিন্তু ঘন্টার পর ঘণ্টা এসএমএস-এ কোনো ক্লান্তি নেই। সবচাইতে বড় কথা ফোনে কিংবা সামনাসামনি যা বলা যায় না সেটা এসএমএস-এ লিখে দেয়া যায় খুব সহজেই!

রেবার সাথে এসএমএস-এ যখন চূড়ান্ত রোমান্টিক পর্ব চলছে ঠিক সে সময় বেরসিকের মতো জামানের ইনকামিং কলটা এসে পড়াতে একটু বিরক্ত হলো সে কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলো জরুরি কিছুই হবে। শহরে আরেকটা খুন?

কলটা রিসিভ করতেই জামান উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, “স্যার! বাস্টার্ডের খোঁজ পাওয়া গেছে!”

.

বিশ মিনিট পরই জেফরি চলে এলো ইরাকি কবরস্তান নামের ছোট্ট একটি গোরস্থানের সামনে। এটা আজিমপুর গোরস্তানের ঠিক পেছনেই । জামান আর স্থানীয় থানার বেশ কয়েকজন পুলিশ আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলো তার জন্য। তারা সবাই দাঁড়িয়ে আছে বৃত্তাকারের কবরস্তানের পাশে দোতলা একটি বাড়ির সামনে। ঘরের বাসিন্দাসহ অন্য একজন লোক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের পাশে। বুঝতে পারছে না পুলিশ কেন তাদের বাড়িতে এসেছে। এখানে আসার আগেই জামানের কাছ থেকে কিছুটা জেনে নিয়েছে জেফরি । নিউমার্কেট থানায় গ্রেফতার হওয়া এক আসামী বাস্টার্ডের ছবিটা দেখে চিনতে পেরেছে। তার কাছ থেকেই এই ঠিকানাটা জানা গেছে। কিন্তু এখানে এসে যা দেখতে পাচ্ছে সেটা একেবারেই হতাশাজনক। সেজন্যে অবশ্য লোকটাকে দোষ দেয়া যায় না। দু’মাস জেল খেটে বের হয়ে এসেছিলো গতকাল, নিজের এলাকায় আসার আগেই মামলার বাদীকে টেলিফোনে হুমকি দেয়ার অভিযোগে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়।

“স্যার, এই লোক বলছে দেড়-দু’মাস আগে সে ভাড়া নিয়েছে…এর আগে এখানে কে থাকতো সে জানে না,” জেফরিকে বললো জামান।

“ঘরের মালিক কে?” কাচুমাচু হয়ে থাকা দু’জন লোককে জেফরি বললো।

“স্যার, মজিবর,” দু’জনের মধ্যে বয়স্কজন জবাব দিলো। “পুলিশের কথা শুইনা পলাইছে…একটু ডরফাচ্চু টাইপের লোক।”

জামানের দিকে ফিরলো জেফরি । “দেড়-দু’মাস আগে…মানে জায়েদ রেহমানের খুনের পর পরই এ জায়গা ছেড়ে দিয়েছে তাহলে…”

“স্যার, এই লোকটা অনেক আগে থেকে এখানে থাকে, বাড়ির বাসিন্দার পাশে যে আরেকটা লোক দাঁড়িয়ে আছে তাকে দেখিয়ে বললো জামান। “সে বলছে দেড়-দু’মাস আগে একদিন হুট করেই বাস্টার্ড আর তার অসুস্থ বাবা এখান থেকে চলে যায়। তাদেরকে আর দেখা যায় নি।”

জেফরি লোকটার দিকে তাকালে সে জোরে জোরে মাথা নেড়ে সায় দিলো। “জি, স্যার, মালসামান নিয়া চইলা গেছে। আর দেহা যায় নি।”

একটু ভেবে বললো জেফরি, “মালপত্র কিসে করে নিয়ে গেছে?”

“গাড়িতে কইরা…কভার্ড ভ্যান আছে না…ওইরকম একটা গাড়ি লইয়া আইছিলো।”

এর বেশি আর কিছু জানা গেলো না। জানার কথাও নয়। কারণ বাস্টার্ড এখানে খুব বেশি দিন হয় নি এসেছিলো। জেফরি বুঝতে পারছে এই খুনি এক জায়গায় বেশি দিন থাকে না।

আবারো হতাশায় ডুবে গেলো জেফরি বেগ। তবে সে জানে একদিন না একদিন বাস্টার্ডকে সে ধরতে পারবেই। থানার পুলিশ আর জামানকে নিয়ে ওখান থেকে বের হতে হতে ভাবছিলো সে। ঠিক এমন সময় রাস্তার বাম দিকের একটি ইলেক্ট্রক পোস্টের গায়ে কিছু একটা তার চোখে পড়লে হঠাৎ করে থেমে গেলো।

“কি, স্যার?” বুঝতে না পেরে বললো জামান।

মনে হলো কথাটা শুনতে পায় নি জেফরি । আস্তে আস্তে ইলেক্টক পোস্টের দিকে এগিয়ে গেলো সে। জামান কাছে এসে দেখতে পেলো হলুদ রঙের এ ফোর সাইজের কাগজে একটি কম্পিউটার প্রিন্টআউট পোস্টের গায়ে সাটানো আছে। বাড়িঘরের মালপত্র আনা নেয়ার কাজে যেসব কভার্ড ভ্যান আছে। সেরকম একটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন।

“স্যার, কোন কোম্পানির ভ্যান ব্যবহার করেছে কে জানে,” বললো জামান।

ফিরে তাকালো সহকারীর দিকে। “ভ্যান ভাড়া করার জন্য কেউ এতোটা সতর্ক থাকবে না। তাছাড়া হাতের কাছে যেটা পাবে সেটাই ব্যবহার করবে। আমার মনে হয় বাস্টার্ড এখান থেকেই ভাড়া করেছে। তার জায়গায় আমি হলেও তা-ই করতাম…একটু খোঁজ নিয়ে দেখতে সমস্যা কোথায়।”

জামান কিছু বললো না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিজ্ঞাপনটা কম করে। হলেও দু’তিনমাস পুরনো। তার বসের কথা ঠিকও হতে পারে।

“ফোন করো,” বিজ্ঞাপনে দেয়া দুটো ফোন নাম্বার দেখিয়ে জামানকে বললো জেফরি ।

জামান একটা নাম্বারে ডায়াল করতে শুরু করে দিলো। কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে এটা কোনো কাজে লাগবে না। এরকম অনেক কোম্পানি আছে। বাস্টার্ড ঠিক কোন কোম্পানির কভার্ড ভ্যান ব্যবহার করেছে কে জানে।

“শুধু বলো তাদের অফিসটা কোথায়?” পাশ থেকে বললো জামানকে। “আমরা তাদের সাথে দেখা করবো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান। ফোনালাপটি খুব সংক্ষিপ্ত হলো। জামান শুধু জেনে নিলো তাদের অফিসটা কোথায়।

খুব কাছেই, হাটা দূরত্বে ভ্যান কোম্পানির অফিসটি। সঙ্গে থাকা পুলিশদের বিদায় দিয়ে জামান আর জেফরি চলে এলো সেই অফিসে। অফিস বলতে ছোট্ট একটা ঘর, একটা ডেস্ক আর তিন-চারটা চেয়ার। মাঝবয়সী এক লোক বসে আছে। তাদের পরিচয় পেয়েই লোকটা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নাভাস হয়ে গেছে।

“ঘাবড়ানোর কিছু নেই, আপনাদের রেকর্ডবুকটা একটু দেখবো,” লোকটাকে আশ্বস্ত করে বললো জেফরি। দুটো চেয়ার টেনে বসে পড়লো তারা। জেফরি জানে এরকম ভ্যান কোম্পানিগুলো তাদের প্রতিটি ট্রিপের হিসেব রাখে । এটা মূলত রাখা হয় মালিকের সুবিধার জন্য, তবে তার মানে এই নয় যে, সব ট্রিপের হিসেবই তারা রাখে। ড্রাইভারের সাথে যোগসাজশে দুয়েকটা ট্রিপের হিসেব যে বেমালুম চেপে যাওয়া হয় সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

লোকটা থতমত খেয়ে একটা টালি খাতা বাড়িয়ে দিলো জেফরির দিকে কিন্তু খাতাটা হাতে তুলে নিলো জামান।

“সব হিসেব রাখেন তো?” জেফরি বললো লোকটাকে।

“জি, স্যার…আমার দুলাভাই এটার মালিক। খুব হিসাবি লোক।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। কয়টা ভ্যান আছে আপনাদের?”

“তিনটা।”

জামান দু’মাস আগের তালিকা থেকে ট্রিপের হিসেব দেখে যাচ্ছে একমনে।

“স্যার, সমস্যাটা কি কওয়া যাইবো?” হাত কচলাতে কচলাতে বললো লোকটি।

“একটা লোকের ঠিকানা জানতে চাচ্ছি…দেড়-দু’মাস আগে ইরাকি কবরস্তান থেকে মালামাল নিয়ে অন্য কোথাও গেছে।”

লোকটা কিছু বলার আগেই জামান বলে উঠলো, “স্যার?” খাতাটা বাড়িয়ে দিলো সে। “এই যে, এখানে মাত্র একটা ট্রিপই ইরাকি কবরস্তানের ঠিকানায় আছে।”

জেফরি খাতার হিসেবটা দেখলো। ইরাকি কবরস্তান থেকে কলাবাগান! কাস্টমারের নাম তওফিক আহম্মেদ। লোকটার দিকে খাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো সে, “এই ট্রিপটার ড্রাইভার কে ছিলো?”

খাতাটা ভালো করে দেখে লোকটা বললো, “এইটা তো ১৬২৩ নম্বরের গাড়িটা…মনু মিয়া চালায়।”

“মন মিয়া কোথায় আছে এখন?”

“বাড়িতে…একটা ট্রিপ মাইরা কাম শেষ কইরা একটু আগেই গেছে।”

“তার সাথে ফোন আছে না?”

“আছে না মাইনে, দুইটা মোবাইল রাখে…ডেরাইবার অইলে কি অইবো, ফুটানি আছে,” লোকটা বললো।

“ফোন নাম্বারটা দিন।”

মনু মিয়ার সাথে ফোন কথা বলার পর জানা গেলো ঐ ট্রিপটার কথা তার মনে আছে তবে বাড়িটা ঠিক মনে করতে পারছে না। শুধু গলিটার কথা মনে আছে। ঠিক আছে, তাহলে মনু মিয়া যেনো দেরি না করে এক্ষুণি চলে আসে তার কোম্পানির অফিসে।

আধঘণ্টা পর মনু মিয়া নামের কভার্ড ভ্যান ড্রাইভার এসে হাজির হলো। জেফরি বেগ আর জামান লোকটাকে নিয়েই রওনা দিলো কলাবাগানের দিকে। যাবার পথে কলাবাগান থানায় ফোন করে জানিয়ে দিলো কিছু পুলিশ যেনো রেডি করে রাখা হয় বিশেষ একটা কাজে।

.

ঘরের বাতি নিভিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভেবে গেলো বাস্টার্ড, অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো ব্ল্যাক রঞ্জু যে এখনও বেঁচে আছে সেটা অমূল্য বাবুকে জানিয়ে দেবে। ভালো করেই বুঝতে পারছে, রর অন্য কোনো ঘনিষ্ঠ লোককে ধরে আগের মতোই জেনে নেবার সুযোগ এখন আর নেই। রঞ্জু সতর্ক হয়ে উঠেছে। সে নিশ্চিত কোলকাতা ছেড়ে চলে গেছে অন্য কোথাও। নেপাল? ব্যাঙ্কক? কে জানে। তার বর্তমান ঠিকানা অনেক দিন পর্যন্ত অজানা থেকে যাবে। নিজেকে রক্ষা করার জন্য এই সন্ত্রাসী দীর্ঘদিন অন্তরালে চলে যাবে সন্দেহ নেই। অমূল্য বাবুকে সব খুলে বলাই ভালো।

ঠিক এমন সময় পাশের ঘর থেকে শোনা গেলো তার বাবার বাজখাই কণ্ঠটা। ভগ্ন স্বাস্থ্য হলেও লোকটার কণ্ঠের তেজ এখনও অটুট আছে। মজিদ মজিদ’ বলে ডেকে যাচ্ছে শয্যাসায়ী বুড়ো। বাস্টার্ড জানে একটু পরই জঘন্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে দেবে। কিন্তু না, বাস্টার্ডকে অবাক করে দিয়ে বুড়ো এবার মজিদের স্ত্রী আমেনাকে ডাকছে। সেই ডাকে যতোটা না ক্রোধ তারচেয়েও বেশি উৎকণ্ঠা।

“আমেনা!…আমেনা…!” বুড়ো হাপিয়ে উঠেছে ডাকতে ডাকতে।

কি ব্যাপার, আমেনা তার বাবার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না কেন? সাধারণত আমেনাকে দুবারের বেশি ডাকতে হয় না। ঠিক তখনই মনে পড়ে গেলো, কিছুক্ষণ আগে একটা কাজে বাইরে গিয়ে সে যখন বাড়িতে ঢুকছিলো তখন মজিদের বখে যাওয়া ছেলেটাকে দেখেছে নীচের তলায় তার মায়ের সাথে কথা বলছে। বাস্টার্ডকে দেখে মা-ছেলে দুজনেই কাচুমাচু হয়ে যায়। মনে মনে মুচকি হেসে বাস্টার্ড নিজের ঘরে চলে আসে। এখন হয়তো সেই ছেলেকে নীচের তলায় কোনো ঘরে বসিয়ে নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে। বাস্টার্ড এর আগেও এরকম দৃশ্য দেখেছে।

সে নিজেই তার বাবার ঘরে যাওয়ার জন্যে বিছানা থেকে নামতেই শুনতে পেলো তার বাবার গালাগালি ।

“তোরা কারা? আমার ঘরে ঢুকেছিস ক্যান?…কি চাস-”

বাস্টার্ডের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো। তার বাবার ঘরে অচেনা লোকজন ঢুকেছে? অসম্ভব! তারচেয়ে বড় কথা, মনে হচ্ছে কেউ তার বাবার মুখটা চেপে ধরেছে। মাঝপথেই বুড়োর কথা থেমে গেলো আচমকা!

দৌড়ে ড্রয়ার থেকে দুটি ম্যাগাজিন বের করে কোমরে গুঁজে নিলো, তারপর পিস্তলটা হাতে নিয়ে দরজার কাছে এসে আস্তে করে উঁকি মারলো বাইরে।

এই বাড়িটা একটু পুরনো ধাঁচের। দোতলা। চারদিকে বড় বড় চারটা ঘর, মাঝখানে বিশাল ফাঁকা জায়গা। তার বাবার ঘরটা চারকোনা ভবনের সিঁড়িঘরের ঠিক পাশেই, আর ঠিক তার কোণাকুণি বিপরীত দিকে তার ঘরটা। বাবার ঘর থেকে তার ঘরে যেদিক দিয়ে আসা হোক না কেন, এল’ আকৃতির বেলকনি পেরিয়ে আসতে হবে । দরজা দিয়ে উঁকি মেরে এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে পেলো সে।

তার বাবার ঘরের সামনে দু’জন অস্ত্রধারী দাঁড়িয়ে আছে । নিঃসন্দেহে ভেতরে রয়েছে আরো কয়েকজন। সিঁড়ি দিয়ে নামার কোনো উপায় নেই। তার ঘরের বাতি বন্ধ থাকায় লোকগুলো এখনও বুঝতে পারছে না সে কোন্ ঘরে আছে তবে ভালো করেই জানে একটু পরই তারা এ ঘরের দিকে ছুটে আসবে।

পুলিশ!

যারা এসেছে তারা সাদা পোশাকের পুলিশ হতে পারে। তবে সে নিশ্চিত নয়। পুলিশ ছাড়া অন্য কেউ হবার কথা নয়। হোমিসাইডের জেফরি বেগ হয়তো তাকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তার বাবার ঘরের দরজা লক্ষ্য করে পর পর তিনটি গুলি চালালো সে।

দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দু’জনের মধ্যে একজন তাকে আগেই দেখে ফেলেছিলো, সে হুরমুর করে ঘরে ঢুকে পড়ে কিন্তু অন্যজন সে সময় পায় নি। একটা গুলি সম্ভবত তার তলপেটে লেগেছে। লোকটা দরজার কাছে পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু পাল্টা গুলি চালাতে ভুললো না। বেলকনির রেলিংয়ের জন্য বাস্টার্ড তাকে পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে না। পুরনো দিনের রেলিং, একেবারে সলিড ইটের তৈরি, কোনো ফাঁকফোকর নেই।

পাল্টা গুলি ছোঁড়া হলো বাস্টার্ডকে লক্ষ্য করে। গুলিটা তার ঘরের দরজার উপরে বিদ্ধ হলো। তার বাবার ঘর থেকে একটা চিৎকার ভেসে এলো তখনই।

“শূয়োরের বাচ্চা! তোর বাবাকে শেষ করে ফেলবো…আর একটা গুলিও চালাবি না!”

তার বাবাকে জিম্মি করা হয়েছে।

“বাবলু! তুই আমার কথা ভাবিস না…চলে যা!” তার বাবা চিৎকার করে বললো কথাটা। সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্তনাদ। তারপর আবারো মুখে চাপা দেবার শব্দ। তার বাবাকে আঘাত করা হয়েছে! মুখ চেপে রাখা হয়েছে যাতে কোনো কথা বলতে না পারে।

আবার সেই কণ্ঠটা শোনা গেলো। “অস্ত্র ফেলে হাত তুলে সারেন্ডার কর, মাদারচোদ্দ! তোর খেল খতম!”

কথাটা শেষ হতে না হতেই তার ঘরের দরজা লক্ষ্য করে পর পর তিন চারটা গুলি করা হলো। বাস্টার্ড কোনো জবাব দিলো না। চুপ মেরে দরজার কাছে নীচু হয়ে বসে রইলো, লক্ষ্য রাখলো তার ঘরের দিকে কেউ আসছে। কিনা। সে জানে নীচু হয়ে থাকলে তাকে কোনোভাবেই ওখান থেকে গুলি করে ঘায়েল করতে পারবে না।

“শূয়োরের বাচ্চা! আমার ভাইকে খুন করেছিস…আমার বউকে খুন করেছিস… গিয়াস… সুলতান… ঝন্টু… বিনয় বাবু!” চিৎকার করে বললো কণ্ঠটা ।

ব্ল্যাক রঞ্জু।

একটু থেমে আবার গর্জে উঠলো। “তোর বাপকে এখন নিজের হাতে মারবো। নিজের হাতে!” উদভ্রান্ত নয় কণ্ঠটা, যেনো উন্মাদগ্রস্ত।

বাস্টার্ড দ্রুত ভেবে গেলো। সে যদি আত্মসমর্পণও করে তার বাপকে খুন করবে, সেও মারা যাবে। এ নিয়ে তার মধ্যে কোনো ভ্রান্তি নেই। তারপরও কিছু একটা করতে হবে। দ্রুত মাথাটা খাটাতে লাগলো। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো নিজের বাড়িতেই সে সবচাইতে বেশি অসহায় বোধ করছে। চায়না টাউনের অলিম্পাস হোটেলে আটকা পড়েও তার কাছে এমন মনে হয় নি। ওখানে গিয়েছিলো প্রস্ততি নিয়ে কিন্তু এখানে সে একদম অপ্রস্তত । ব্ল্যাক রঞ্জু শুধু বেঁচেই নেই, তাকে কতো দ্রুতই না খুঁজে বের করে ফেলেছে!

আরেকটা গুলি করা হলো। সেই সঙ্গে গর্জন। “আমি তোকে শেষবারের মতো বলছি…অস্ত্র ফেলে দে!” রঙুর গলাটা শোনা গেলো। তাদের ফাঁকা । বাড়িতে সেটা যেনো প্রকম্পিত হলো আরেকবার।

মুহূর্তেই তার মাথায় একটা আইডিয়া চলে এলো।

“আমি তিন গুনবো, শূয়োরের বাচ্চা। তারপর তোর বাপকে গুলি করে মারবো?”

“বাবলু চলে যা-” সঙ্গে সঙ্গে তার বাবার মুখ চেপে ধরলো কেউ।

“বুড়োর মুখ চেপে রাখ, হারামজাদা!”

ব্ল্যাক রঞ্জুর ক্ষিপ্ত কণ্ঠটা শুনতে পেলো সে।

“এক!”

সে বুঝতে পারলো তার একটু সময় দরকার।

“দুই!”

“আমি আসছি…” চিৎকার করে বললো রর উদ্দেশ্যে। “কিন্তু কথা দিতে হবে…” ঘরের ভেতর কিছু একটা খুঁজতে লাগলো নিঃশব্দে।

“কি কথা, মাদারচোদ্দ?”

“আমার বাবাকে প্রাণে মারবে না,” বললো সে, কিন্তু মনোযোগ একটা ছোট্ট জিনিস খুঁজতে।

হা-হা-হা করে উন্মাদের মতো হাসি দিলো রঞ্জু। “ঠিক আছে, তোর বাপকে মারবো না, শূয়োর…জলদি অস্ত্র ফেলে সারেন্ডার কর।”

ডেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা জেমস ক্লিপ খুঁজে পেলো সে। কিন্তু আমি গ্যারান্টি চাই!” চিৎকার করে বললো নিজের ঘর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে জেমস ক্লিপটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে টেনে লম্বা করে ফেললো। পুরোপুরি লম্বা হলো না কিন্তু যা হয়েছে তাতে কাজ হবে।

“গ্যারান্টি!” কথাটা বলেই আবার অট্টহাসি দিলো রঞ্জু। “তুই আসলেই বাস্টার্ড!”

আমার নাম জানে! দ্রুত ক্লিপটার দু’মাথা বাঁকিয়ে ইংরেজি সি অক্ষরে মতো করে নিলো।

“শূয়োরের বাচ্চা, কী গ্যারান্টি দেবো?” রঞ্জু পরিহাস করে বললো। “আর কোনো কথা না। এক্ষুণি…”

রঞ্জুর কণ্ঠটা থেমে গেলো আচমকা। সঙ্গে সঙ্গে এলোপাতারি গুলি। কিছুই বুঝতে পারছে না। চারদিক ঘন অন্ধকারে ডুবে গেছে।

সেই অন্ধকারে আরেকটা অট্টহাসি শোনা গেলো। তবে সেটা রঞ্জুর নয় । বাস্টার্ড অবাক হয়ে শুনতে পাচ্ছে তার শয্যাসায়ী বুড়ো বাপ জীবনের সমস্ত শক্তি দিয়ে পিশাচের মতো হাসি দিচ্ছে। অন্ধকারে রঙুর লোকজন সম্ভবত উদভ্রান্ত হয়ে পড়েছে, এতোক্ষণ তার বাপের মুখ চেপে রেখেছিলো যে সে হয়তো নিজেকে রক্ষা করার জন্য অন্ধকারে এদিক ওদিক ছুটে গেছে।

বাস্টার্ড পর পর তিনটি গুলি চালালো দরজার কাছে পিস্তলটা মেঝেতে চেপে রেখে। অন্ধকারে ফায়ারিংয়ের যে আলো হলো সেটা রঞ্জুর দলকে বিভ্রান্ত করার জন্য যথেষ্ট । তা-ই হলো। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা জবাব দেয়া হলো দরজা লক্ষ্য করে। তবে এবার একটি দুটি নয়, সাত-আটটা। বাস্টার্ড ফায়ারিং করার টাইমিং থেকে আন্দাজ করলো কমপক্ষে পাঁচজন অস্ত্রধারী আছে, তার মধ্যে একজন আহত।

রঞ্জুর দল ভড়কে গেছে। বাস্টার্ড জানে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আবার সামলে উঠবে এ অবস্থা থেকে। কিভাবে বিদ্যুৎ চলে গেলো তারা হয়তো বুঝতে পারছে না। তবে কাজটা যে সে করেছে সেটা নির্ঘাত বুঝতে পারছে।

খুব সহজেই কাজটা করেছে সে। জেমস ক্লিপটা ঘরের সুইচবোর্ডের সকেট প্লগে ঢুকিয়ে দিয়ে সুইচ টিপে দিয়েছে। বিদ্যুতের পজিটিভ আর নেগেটিভ জেমস ক্লিপের কারণে এক হয়ে যাওয়াতে মেইনসুইচের সেফটি ফিউজ কেটে গিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সঙ্গে সঙ্গে।

দ্রুত আরেকটা কাজ করলো অন্ধকারে। এটা তার নিজের বাড়ি, নিজের ঘর । অন্ধকারে সে অন্যদের চেয়ে বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। ঘর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হবার আগে বেডসাইড টেবিল থেকে দুটো মোবাইল ফোন নিয়ে দরজার কাছে একটা রেখে নিঃশব্দে চলে গেলো বাম দিকে। এখন তার বাবার ঘরটা ঠিক তার বিপরীতে। মাঝখানে ত্রিশ ফুটের মতো ফাঁকা জায়গা। চারকোনা বাড়ির ফায়দা লুটতে হবে।

এখনও হামাগুড়ি দিয়ে আছে । নিজের কাছে থাকা মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটা কল করেই মাথাটা তুলে রেলিংয়ের উপর দিয়ে তাকালো।

সঙ্গে সঙ্গে তার ঘরের দরজার কাছে থাকা মোবাইলটা সশব্দে বেজে উঠলো। ভড়কে গিয়ে তার বাবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সেই মোবাইলের আলো লক্ষ্য করে দুই রাউন্ড গুলি করলো রঙুর দলের এক ক্যাডার। কিন্তু অবাক ব্যাপার, শব্দ হলো তিনটি।

“শূয়োরের বাচ্চা!” একটা আর্তনাদ শোনা গেলো। তবে সেটা কার সে জানে না।

এরপরই রঞ্জুর কণ্ঠটা, “কেউ গুলি করবি না। শূয়োরের বাচ্চা টের পেয়ে যাবে!”

আরেকটা কণ্ঠ, “ভাই, ইসহাক গুলি খেয়েছে!”

“চুপ!” রঞ্জুর চাপা কণ্ঠ।

“ভাই, খানকির পোলায় মনে হয় সামনের দিকে আছে, ওইদিক থেইকা ফায়ারিংয়ের আলো দেখছি!” চাপা একটা কণ্ঠ বললো কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পেলো বাস্টার্ড ।

“চুপ!” রঞ্জু বললো। সে জানে কথা বললে বাস্টার্ড টের পেয়ে যাবে তাদের অবস্থান। সুনসান। কবরের নীরবতা নেমে এলো পুরো বাড়িটাতে।

বাস্টার্ড বুঝতে পারলো পাঁচজনের মধ্যে এখন রঞ্জুসহ তিনজন আছে। দু’জন গুলিবিদ্ধ, তাদের মধ্যে একজন বেঁচে আছে কিনা বুঝতে পারছে না। তবে তাকে হিসেবের বাইরে রাখা যায়। এখানে যারা এসেছে তাদের সাহস অনেক বেশি থাকতে পারে কিন্তু রঞ্জুর মতো ঠাণ্ডা মাথার কেউ নেই। সে বুঝতে পেরেছে এই অন্ধকারে শব্দ করলে কিংবা ফায়ার করলে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়া হবে। এখন তারা চুপ মেরে আছে, কিন্তু বাস্টার্ড জানে তারা বসে নেই, কিছু একটা করছে।

কি করছে?

চারকোণা বাড়ি। মাঝখানে ফাঁকা জায়গা। চারদিক দিয়ে বেলকনি সদৃশ্য প্যাসেজ। সে আছে অস্ত্রধারীদের ঠিক বিপরীতে। বেলকনির রেলিং সাড়ে তিনফুটের মতো উঁচু। রঞ্জুও তার মতো উপুড় হয়ে কিংবা হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে হয়তো। দু’দিক দিয়ে দু’জন এগোতে থাকলে সে ফাঁদে পড়ে যাবে। অন্ধকারটা এখন অনেকটা সহনীয় হয়ে উঠেছে। বাড়িটার বিভিন্ন অংশ আবছা আবছা চোখে পড়ছে। বুঝতে পারলো কিছু একটা করতে হবে। দুদিকে দু’জন এগোতে থাকলেও একজন বাকি থেকে যায়। না। তার বাবার মুখ বন্ধ। তার মানে একজন বুড়োর মুখ চেপে রেখেছে। তাহলে দুদিক থেকে দু’জন বেড়ালের মতো চুপিসারে এগিয়ে আসতে পারে হামাগুড়ি দিয়ে। সে জানে দু’জনকে একসাথে মোকাবেলা করতে পারবে না।

যেকোনো একজনকে…

আর কিছু ভাবলো না। তার একটা সুবিধা হলো তার ঘরের দরজাটা খোলা আছে। মনে মনে ঠিক করে নিলো কি করবে। হাতে থাকা মোবাইল ফোনটা ছুঁড়ে মারলো ডান দিকে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি। দুটো।

ফায়ারিংয়ের আলোতে বুঝে গেলো লোকটার অবস্থান। বিদ্যতগতিতে ডান দিকে এমনভাবে ঝাঁপ দিলো যাতে করে তার ডান কাঁধটা মেঝেতে ল্যান্ডিং করে, সেই অবস্থায়ই যেখান থেকে ফায়ারিংয়ের আলো হয়েছিলো সেই জায়গা লক্ষ্য করে দুটো গুলি করে শরীরটা গড়িয়ে খোলা দরজা দিয়ে আবারো ঢুকে পড়লো তার ঘরের ভেতর।

একটা গগনবিদারি আর্তনাদ!

লেগেছে! হ্যাঁ, গুলিটা নিশ্চয় লক্ষ্যভেদ করেছে।

ঘরে ঢুকেই দরজার পাশে চলে গেলো সে। সঙ্গে সঙ্গে তার বাম দিক থেকে যে অস্ত্রধারী চুপিসারে এগিয়ে আসছিলো সে গুলি চালালো উদভ্রান্তের মতো। শুনতে পারলো না ক’টা গুলি করা হলো। কানে তালা লাগার জোগার হলো। সবগুলো গুলি তার দরজা লক্ষ্য করে করা হয়েছে ।

“শাহজাহান!” একটা কণ্ঠ চিৎকার করে বললো। এটা রঞ্জুর কণ্ঠ না।

বাস্টার্ড আরো একটা গুলি করলো দরজার বাইরে, যাতে কেউ তার ঘরের দিকে এগিয়ে আসতে না পারে। দ্রুত ম্যাগাজিনটা রিলিজ করে কোমর থেকে একটা লোডেড ম্যাগাজিন ভরে নিলো পিস্তলে ।

“শাহজান!” কণ্ঠটা আবারো ডাক দিলো।

সে যাকে গুলি করেছে তার নাম শাহজাহান! এখন তাহলে বাকি আছে। দু’জন। সে নিশ্চিত ব্ল্যাক রঞ্জু তার বাবার ঘরে আছে। এই সন্ত্রাসী তার সঙ্গিদের ঠেলে দিয়ে তার বাবার মুখটা চেপে রেখেছে তাহলে! আরো বুঝতে পারলো একটু আগে সে যেখানে ছিলো অন্য লোকটা এখন ঠিক সেখানেই অবস্থান করছে। এই লোক তার ঘরের দিকে এক্ষুণি ছুটে আসবে না। তার এক সঙ্গি ঘায়েল হয়েছে, সুতরাং একটু সময় নেবেই।

বুঝতে পারলো একটা সুযোগ এসে গেছে। তার ঘরের দরজা থেকে বাম দিকে থাকা লোকটার অবস্থান এমন জায়গায় আছে যে একটা পুরনো কৌশল খাটাতে পারে সে।

দরজা থেকে চার-পাঁচ ফুট বামে গিয়ে বেলকনিটা সোজা নব্বই ডিগৃ কোণাকোণি চলে গেছে। অস্ত্রধারী যেখানে আছে সেখানে গুলি করা যাবে না । কিন্তু অন্যভাবে তাকে ঘায়েল করা যেতে পারে।

হামাগুঁড়ি দিয়ে দরজার কাছে এসে উঁকি দিলো। আবছা অন্ধকারে আন্দাজ করে নিলো একটা জায়গা । তারপর পিস্তলটা অটো করে নিয়ে তাক করলো সেই কল্পিত জায়গা লক্ষ্য করে। এখন এক টুগারে পুরো ম্যাগাজিনটা খালি হয়ে যাবে । ব্রাশ ফায়ারের মতো সবগুলো গুলি বের হয়ে যাবে এক নিমেষে। এটা একটা জুয়া, কিন্তু সে জানে এই জুয়াটা তাকে খেলতেই হবে।

পিস্তলটা নীচু করে টুগার টিপে দিলো।

ধিম্‌! ধি! ধি! ধিম্….

একনাগারে দশটি বুলেট বের হয়ে গেলো তার পিস্তল থেকে। সবগুলোই আঘাত করলো কল্পিত সেই জায়গায়।

একটা আর্তনাদ। যন্ত্রণাদায়ক গোঙানি।

জুয়া খেলায় সে জিতে গেছে। বাম দিকের রেলিংয়ের নীচে যে অস্ত্রধারী ছিলো সে ঘায়েল হয়েছে। তার পিস্তল থেকে বের হওয়া গুলি অস্ত্রধারীর ডান দিকের দেয়ালে লেগে পিছলে গেছে কারণ বাস্টার্ড কোণাকোণি ফায়ার করেছে। পিছলে যাওয়া দশটি গুলির মধ্যে কমপক্ষে একাধিক গুলি বিদ্ধ করেছে রঞ্জুর অস্ত্রধারীকে।

“শূয়োরের বাচ্চা!” রঞ্জুর কণ্ঠটা শোনা গেলো তার বাবার ঘর থেকে। সেই কণ্ঠে যতোটা না ক্ষোভ তারচেয়ে বেশি অসহায়ত্ব। সেও তার সঙ্গির গোঙানিটা শুনতে পেয়েছে। “তোর বাবাকে কথাটা আর বলতে পারলো না, একটা যন্ত্রণাদায়ক চিৎকার দিয়ে উঠলো রঞ্জু। সঙ্গে সঙ্গে তিনটা গুলি।

কি হলো! বাস্টার্ড বুঝে উঠতে পারছে না। তার বাবা! স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে তার বাবার অস্ফুট আর্তনাদটা। বুড়ো আর নেই। রঞ্জু তাকে গুলি করেছে। কিন্তু রঞ্জু চিৎকার দিলো কেন? এখনও সে যন্ত্রণাদায়ক শব্দ করে যাচ্ছে তবে চেষ্টা করছে চেপে রাখার জন্য। খুব সম্ভবত তার বাবা কিছু একটা দিয়ে রঞ্জুকে আঘাত করেছে। রঞ্জু এখন আহত!

এই সুযোগ।

সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো সে। এক দৌড়ে ছুটে গেলো তার বাবার ঘরের দিকে।

“শূয়োরের বাচ্চা!” রঞ্জুর ক্ষুব্ধ কণ্ঠ। পর পর দুটো গুলি । ছিটকে দরজার বাইরে রেলিংয়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো বাস্টার্ড। দরজার কাছে আসতেই তাকে লক্ষ্য করে গুলি করেছে রঞ্জু। মরিয়া হয়ে আরো গুলি করতে চাইলো সে।

ক্লিক! ক্লিক! ক্লিক!

মেঝেতে পড়ে থেকেই উদভ্রান্তের মতো রঞ্জুর টুগার চেপে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলো সে। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না। টের পেলো গুলি খেয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়লেও পিস্তলটা এখনও বেহাত হয়ে যায় নি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা অবয়বটা লক্ষ্য করে গুলি চালালো ।

ক্লিক! ক্লিক!

সর্বনাশ। রঞ্জুর একার নয়, তারও গুলি ফুরিয়ে গেছে। একটু আগে পুরো পিস্তল খালি করে ব্রাশ ফায়ার করেছিলো, তারপর আর ম্যাগাজিন ভরতে পারে নি।

রঞ্জু অট্টহাসি হেসে সজোরে একটা লাথি মরলো তার বুক লক্ষ্য করে । ককিয়ে উঠলো সে। পর পর বেশ কয়েকটি লাথি । তারপর পিস্তলের বাট দিয়ে তার মাথা আর মুখে এলোপাতারি আঘাত করতে লাগলো । উন্মাদের মতো আচরণ করছে সে। যেনো খালি হাতেই শেষ করে ফেলবে তাকে। বাস্টার্ড কোনো প্রতিরোধই করতে পারলো না। সে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তবে গুলিটা কোথায় লেগেছে এখনও বুঝতে পারছে না, শুধু বুঝতে পারছে সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। তার উপর রঙুর লাথি আর পিস্তলের বাটের আঘাতে একেবারে পর্যদস্ত। বুঝতে পারছে তার মাথা, নাক-মুখ ফেঁটে রক্ত পড়ছে। ঝাপসা হয়ে আসছে দু’চোখের দৃষ্টি। কানের উপর রঞ্জুর কয়েকটা লাথি পড়তেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো ।

রঞ্জু তার হাতে পিস্তলটা ফেলে দু’হাতে রেলিং ধরে ম্যানিয়াকের মতো লাথি মেরে যেতে লাগলো। শরীরটা কুকড়ে এলোপাতারি লাথি থেকে নিজেকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো সে।

“শূয়োরের বাচ্চা! আমাকে খুন করতে চেয়েছিলি!” রঞ্জু লাথি মারছে আর বলছে। “কে তোকে আমার পেছনে লাগিয়েছে…বল?”

একটা লাথি তার ঠোঁটের উপর লাগার সাথে সাথে টের পেলো একটা দাঁত ভেঙে গেছে, অন্য আরেকটা বেঁকে গেছে কিছুটা।

“বাস্টার্ড! এই যে আমি এসে গেছি!” গর্জে উঠে রঞ্জু দ্বিগুন শক্তিতে লাথি মারতে লাগলো। পেটে, বুকে, মুখে । “বল, শূয়োরের বাচ্চা!”

দুহাত দিয়ে মুখটা কোনো রকম আড়াল করে রক্ষা করে গেলেও বুক আর পেটে উপুর্যপরি আঘাতে সে বিধ্বস্ত। রেলিংটা দুহাতে শক্ত করে ধরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লাথি মারছে ব্ল্যাক রঞ্জু ।

হঠাৎ সাইরেনের শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে উঠলো সন্ত্রাসী। মারামারি থামিয়ে আশেপাশে তাকালো উদভ্রান্তের মতো ।

পুলিশ!

সঙ্গে সঙ্গে শরীরের শেষ শক্তিটুকু জড়ো করে বাস্টার্ড শুধু একটা কাজই করলো : ব্ল্যাক রঞ্জুর দু’পা খপ করে ধরে ফেললো সে। তার ডান হাত আর ডান কাঁধের মাঝখানে রঞ্জুর পাদুটো চেপে ধরে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। দু’পা কিছুটা শূন্যে উঠে যেতেই ভারসাম্য হারিয়ে ভড়কে গেলো ব্ল্যাক রঞ্জু। দু’হাতে রেলিংটা শক্ত করে ধরে রাখলো সে। বুঝতে পারলো বেকায়দা পড়ে গেছে, কিন্তু কিছু একটা করার আগেই বাস্টার্ড শরীরের সবটুকু শক্তি প্রয়োগ করে এক ঝটকায় রেলিংয়ের উপর দিয়ে উল্টে ফেলে দিলো সন্ত্রাসীকে। চার হাত-পা ছড়িয়ে সোজা নীচে পড়ে গেলো রঞ্জু।

একটা গগনবিদারি চিৎকার।

বাস্টার্ড ধপাস করে আবারো পড়ে গেলো মেঝেতে। সাইরেনের শব্দটা কানে এলেও চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। যেনো শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। হঠাৎ ক্ষীণ একটা কণ্ঠ শুনে বোঝার চেষ্টা করলো। কণ্ঠটা এখন কাশছে। মরণকাশি!

তার বাবা! মৃত্যুর আগে কিছু বলতে চাচ্ছে যেনো, কিন্তু মুখ দিয়ে যে শব্দ বের হচ্ছে সেটা একেবারেই জড়ানো আর ক্ষীণ। আবারো ভয়ানকভাবে কাশির আওয়াজ শোনা গেলো ।

“বাবলু…তোর মা…!”

স্তব্ধ হয়ে গেলে কণ্ঠটা। সাইরেনের শব্দটা এখন প্রকট হয়ে উঠেছে।

তার বাবার শেষ কথাটা কি ছিলো? নিশ্চিত হতে পারলো না। জীবনের শেষ সময়ে হয়তো তার বাবা সত্যি কথাটা বলে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু তার কপালটাই খারাপ। বুড়ো বলতে পারলো না। কী বলতে চেয়েছিলো? তার মা বেশ্যা ছিলো না?

গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে শুধু ভাবতে পারলো সে মারা যাচ্ছে। তারপরই গাঢ় অন্ধকার আর শব্দহীন হয়ে পড়লো তার জগতটা। শরীরের সমস্ত যন্ত্রণা আর ভয় দূর হয়ে এক স্বস্তিদায়ক বিবশতা গ্রাস করলো তাকে।

দু’চোখ খুলে নতুন জগতটা দেখার চেষ্টা করলো।

এক মায়াবী মুখের নারী উপুড় হয়ে তার দিকে চেয়ে আছে। পরম মমতায় তার কাঁপালে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। সেই বিবশতা, সেই ঘোরের মধ্যেও টের পেলো মহিলার হাতের পরশে তার শরীরে অনাবিল সুখের অনুরণন ছড়িয়ে পড়ছে। খুব ভালো লাগছে তার। এই জীবনে এতো ভালো আর কখনও লাগে নি।

মা।

.

অধ্যায় ৫৩

কলাবাগান থানার পুলিশের একটি দল নিয়ে জেফরি বেগ আর জামান সংকীর্ণ একটা গলিতে ঢুকতেই শুনতে পায় ব্যাপক গোলাগুলির আওয়াজ। লোকজন ভয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে; কেউ কেউ উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছে। ছোটোখাটো একটা ভীড় লেগে আছে গলির মাঝামাঝি জায়গায়। সঙ্গে সঙ্গে সাইরেন বাজিয়ে দেয় পুলিশ। ভীড়টা ভেঙে যায় মুহূর্তে।

পুলিশের গাড়ি আরেকটু এগোতেই দেখতে পায় তিন-চারজন সাহসী লোক একটি দোতলা বাড়ির দিকে চেয়ে আছে, তাদেরকে দেখেই হাত তুলে বাড়িটা দেখিয়ে দেয় তারা। এই বাড়ির ভেতর থেকেই গোলাগুলি হচ্ছে। পুলিশ দ্রুত পজিশন নিয়ে নেয় বাড়ির আশেপাশে।

তবে ভেতরে ঢোকার আগেই জেফরি বেগ বুঝে গিয়েছিলো দেরি করে ফেলেছে। একটা আর্তনাদ হতেই সেটা থেমে যায়। হুট করেই যেনো কবরের নিস্তব্ধতা নেমে আসে সেখানে।

ভেতরে ঢোকার পর নীচ তলা থেকে এক মহিলাকে হাত-পা-মুখ বাধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, মহিলা আর কেউ না, মজিদের স্ত্রী আমেনা। মজিদ একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলো ফিরে এসে দেখে পুরো বাড়ি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। দোতলায় পাঁচটি লাশ পড়ে আছে।

বাস্টার্ডের বাবার নিথর দেহটা আবিষ্কার করা হয় তার বিছানায়। বুড়োর বুকে তিনটি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। মারা যাবার আগে মুখ দিয়ে রক্ত বমি করেছে সে। তার বিছানার সাইডটেবিলে একটা প্লেটে পেপের টুকরো আর পনির ছিলো। চামচ থাকলেও কাটা চামচটা পাওয়া যায় রক্তাক্ত অবস্থায় দরজার কাছে। দোতলা থেকে পড়ে মারাত্মক আহত লোকটার ডান উরুতে একটা আঘাতের ক্ষত আছে। পুলিশ বুঝতে পারে এটা ঐ কাটা চামচের আঘাতের কারণেই হয়ে থাকবে।

রঞ্জুর চার সহযোগীর লাশ দোতলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া গেছে। তারা সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। প্রত্যেকের সাথে অস্ত্র ছিলো। বোঝ গেছে। এদের সাথেই গানফাইট হয়েছিলো বাস্টার্ডের। সব দেখে পুলিশ বিস্মিত না হয়ে পারে নি, একজন মানুষ কিভাবে পাঁচজন অস্ত্রধারীকে ঘায়েল করতে পারলো! তবে হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ জানালো বাস্টার্ড খুবই ভয়ঙ্কর প্রকৃতির খুনি। তারপক্ষেই কেবল সম্ভব এ কাজ করা। আর যেসব সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে তারা যে সবাই ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের লোক সে ব্যাপারে জেফরির মনে কোনো সন্দেহ নেই।

বাস্টার্ডের নিথর দেহটা খুঁজে পায় তার বাবার ঘরের দরজার ঠিক বাইরে। বুকে গুলিবিদ্ধ । অবস্থা একেবারে সংকটাপন্ন। তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও জেফরির ধারণা এই আঘাত থেকে সেরে উঠতে পারবে না। হয়তো হাসপাতালে নেবার পথেই সে মারা যাবে ।

অবশেষে জেফরি বেগ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তার মিশন শেষ হয়েছে। লেখক জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠেছে সে। এতোগুলো খুনের বীভৎসতার মাঝেও এক ধরণের সম্ভষ্টি পেলো, তবে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও অপরাধ বোধে আক্রান্ত হলো তুখোড় এই ইনভেস্টিগেটর।

সব আলামত সংগ্রহ করে, ঘটনাস্থল দেখে যখন মাঝরাতের দিকে গাড়িতে করে বাড়িতে ফিরছে তখন বুঝতে পারলো, আজ অনেক দিন পর তার ভালো ঘুম হবে।

* * *

“মা!” অস্ফুট কণ্ঠে বললো সে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতে পেলো একটা মায়াবি মুখ তার দিকে চেয়ে আছে উপুড় হয়ে। মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছে। নরম হাতের পরশ পেলো কপালে। সারা দেহে বয়ে গেলো অদ্ভুত এক ভালো লাগার অনুভূতি।

চারপাশটা দেখার চেষ্টা করলো। যতোটুকু দেখতে পেলো শুধু সাদা আর সাদা। যে মুখটা তার দিকে চেয়ে আছে সেও সাদা পোশাক পরে আছে । ধবধবে সাদার জগতে আছে সে। এতো ভালো তার কখনই লাগে নি। আবার চোখ বুজে ফেললো। তবে কপালে নরম হাতের পরশ ঠিকই টের পাচ্ছে। সে জানে সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছে। তার মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। স্বপ্নটা ভেঙে বাস্তবে ফিরে আসতে চাইছে না। এই সুন্দর, নরম, সাদা স্বপ্নে হারিয়ে যেতে চায় সে।

একটা শব্দ শুনে চোখ খুলে তাকালো সে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো স্বপ্নটা এখনও দেখছে। চারদিক ধবধবে সাদা। মায়াবী মুখটা এখনও চেয়ে আছে তার দিকে। পরম মমতায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে তার কপালে ।

মুখটা চেনা চেনা লাগছে। চোখ দুটো অনেক মায়াবী। অতীতের কোনো এক সময় এ চোখ দুটো প্রবল আকুতি জানিয়েছিলো তার কাছে।

“এখন কেমন লাগছে?” নারীকণ্ঠটা বললো।

কী মিষ্টি কণ্ঠটা। সে কিছু বললো না। শুধু চেয়ে রইলো।

“ভগবানের কৃপায় বেঁচে গেছেন।” মিষ্টি করে হাসলো মায়াবী মুখটা ।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে।

উমা!

* * *

ঘটনার চার দিন পর বাস্টার্ডের জ্ঞান ফিরে আসে। যে গুলিটা তার বুকের বাম দিকে বিদ্ধ হয়েছে সেটা ফুসফুস ভেদ করলে বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠতো। কিন্তু ভাগ্য ভালো, গুলিটা ফুসফুস ঘেষে তার পিঠ ভেদ করে চলে গেছে। দ্রুত অপারেশন করতে হয়েছিলো। গুলি ছাড়াও তার শরীরে মারাত্মক আঘাত ছিলো বেশ কয়েকটি। পাঁজরের হাড় ভেঙেছে কমপক্ষে দুটো। নাক-মুখ একেবারে থেতলে গেছে। দুটো দাঁতও পড়ে গেছে। মুখমণ্ডল ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ডাক্তার বলেছে এ রোগীর সেরে উঠতে কমপক্ষে এক মাস লাগবে।

পাঁচদিনের দিন জেফরি বেগ হাসপাতালে আসে বাস্টার্ডকে দেখতে। তাকে দেখে অবাক হয় নি সে। কারণ ইতিমধ্যেই জেনে গেছে পিজি হাসপাতালের প্রিজনসেলে রয়েছে সে। তার এক হাত স্টিলের বেডের সাথে হ্যান্ডকাফ দিয়ে বাধা থাকে সব সময়। প্রিজনসেলের দরজায় প্রহরীও থাকে সার্বক্ষণিক।

“এখন কেমন লাগছে?” তার বিছানার কাছে একটা চেয়ার টেনে বসে জানতে চাইলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ।

“ভালো,” সেলাই করা ঠোঁট একটু ফাঁক করে কোনোমতে বলতে পারলো সে। একদৃষ্টে চেয়ে রইলো সামনের লোকটার দিকে।

“বিশাল বাঁচা বেঁচে গেছো,” কথাটা বলে ঘরের দিকে চেয়ে দেখলো এককোণে নার্সের ইউনিফর্মে উমা দাঁড়িয়ে আছে। তার উদ্দেশ্যে বললো সে, “তুমি একটু ঘর থেকে বাইরে যাও, আমি ওর সাথে কিছু কথা বলবো।”

বাস্টার্ড জানে না এই মেয়ে এখানে কিভাবে এলো। নার্সই বা হলো কেমন করে। উমা চুপচাপ চলে গেলো ঘর থেকে।

“ও থাকলে সমস্যা হতো না,” নীচু কণ্ঠে বললো বাস্টার্ড । তার ঠোঁটে মৃদু হাসি।”ও অনেক ঘটনাই জানে।”

“সেটা আমিও জানি,” জেফরি বেগ বললো। তবে এখন যে কথাটা বলবো সেটা তার শোনার দরকার নেই।”

“কি কথা?”

“আছে। লম্বা একটা গল্প,” মাথা নেড়ে বললো সে। “ব্ল্যাক রকে কোলকাতায় গিয়ে মারার কন্ট্রাক্টটা কে তোমাকে দিয়েছিলো?”

রঞ্জু। এ নামটা তার মনেই ছিলো না। জ্ঞান ফিরে আসার পর এই প্রথম নামটা শুনলো । রঞ্জু কি বেঁচে আছে? নাকি মরে গেছে?

“রঞ্জু কোথায়?” উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো সে।

ভুরু কুচকে তাকালো জেফরি বেগ। “তুমিই তো কোলকাতায় গিয়ে ওকে খুন করে এসেছো…”

আৎকে উঠলো বাস্টার্ড । এরা দেখি জানে না। সর্বনাশ। “ওটা রঞ্জু ছিলো না!”

“কি?!” রীতিমতো ভিমরি খেলো জেফরি বেগ।

“ওটা রঞ্জু ছিলো না…কোলকাতায় যাকে মেরেছি…”

“তাহলে?” টেরই পেলো না চেয়ার থেকে উঠে গেছে সে।

“দোতলা থেকে যাকে নীচে ফেলে দিয়েছি…ও-ই রঞ্জু। আসল রঞ্জু!”

“মাইগড!” জেফরি বেগ বাস্টার্ডের কাঁধটা ধরে ফেললো। “তুমি এসব কী বলছো?”

“আমি সত্যি বলছি। ওটাই রঞ্জু । আমার বাড়িতে এসেছিলো আমাকে মারতে…নীচে ফেলে দিয়েছি…ও কোথায়..বেঁচে আছে, নাকি…?” বাস্টার্ড উত্তেজিত হয়ে বলে গেলো কথাগুলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো বোকাচোদা : পুলিশ নিশ্চয় আহত রঞ্জুকে চিনতে না পেরে ছেড়ে দিয়েছে। হাত ফসকে বের হয়ে গেছে ভয়ঙ্কর সেই সন্ত্রাসী।

জেফরি বেগ ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লো। তাকে দেখে বাস্টার্ড যারপরনাই হতাশ। একদৃষ্টে চেয়ে রইলো হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটরের দিকে।

“তুমি যা বলছো, সত্যি বলছো তো?” বেশ শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো জেফরি বেগ।

“একদম সত্যি।”

“কিভাবে জানলে কোলকাতার ঐ লোকটা আসল রঞ্জু নয়?”

মুখটা সরিয়ে অন্য দিকে চেয়ে রইলো বাস্টার্ড। তার খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কথা বলতে ভালো লাগছে না। কয়েক মিনিট এরকম নীরবতায় কেটে গেলো।

“রঞ্জু বেঁচে আছে।”

জেফরি বেগের কথাটা শুনে ফিরে তাকালো সে।

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আবার বললো, “হাসপাতালে আছে…তোমার মতোই প্রিজনসেলে।” চওড়া একটা হাসি ফুটে উঠলো জেফরি বেগের মুখে।

বাস্টার্ডের নিষ্প্রভ চোখ দুটো প্রাণ ফিরে পেলো যেনো।

“তার অবস্থা তোমার চেয়েও খারাপ। দুই পা ভেঙে গেছে…কোমরের অবস্থাও ভালো না। বেঁচে থাকলেও এ জীবনে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। ডাক্তার সেরকমই বলেছে।”

ভালো লাগার অনুভূতিটা আবার ফিরে এলো বাস্টার্ডের মধ্যে।

“আমরা অবশ্য তাকে রঞ্জু হিসেবে নয়, রঞ্জুর সহযোগী হিসেবে বন্দী করে রেখেছি।”

বাস্টার্ড কিছু বললো না, যদিও কথাটা তাকে দারুণ স্বস্তি দিয়েছে।

একটু চুপ থেকে জেফরি বেগ আবারো জানতে চাইলো, “রঞ্জুকে হত্যা করার কন্ট্রাক্টটা কে তোমাকে দিয়েছে?”

“আমি আমার ক্লায়েন্টের নাম বলি না,” দূর্বল কণ্ঠে বললেও কথাটার মধ্যে দৃঢ়তা আছে।

জেফরি একদৃষ্টে চেয়ে রইলো তার দিকে। “তুমি কি জানো, তোমার ক্লায়েন্টরা কেন তোমাকে দিয়ে রঞ্জুকে হত্যা করাতে চেয়েছিলো?”

“জানি,” আস্তে করে বললো সে ।

“তাই নাকি?” অবাক হলো জেফরি। “সব জেনেও এরকম একটি ষড়যন্ত্রে নিজেকে জড়িয়ে ফেললে?”

বিস্ময়ে তার দিকে তাকালো বাস্টার্ড। “ষড়যন্ত্র?…একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী মোটা অঙ্কের চাঁদা চেয়ে কাউকে হুমকি দিলো, আর সেই লোক যদি তাকে খুন করতে চায় তাহলে সেটা ষড়যন্ত্র?”

ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো জেফরি বেগ। “চাঁদাবাজি?”

“হ্যাঁ। চাঁদাবাজি। এর বেশি কিছু বলবো না।”

“ওহ্।” মাথা দোলাতে লাগলো জেফরি বেগ। তার মানে তুমি কিছুই জানো না!”

জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে রইলো বাস্টার্ড ।

“ব্ল্যাক রঞ্জু যে কিছুদিন পর ভয়াবহ একটি অপারেশন করতে যাচ্ছিলো সে সম্পর্কে তুমি আসলেই কিছু জানো না?”

“অপারেশন?” বাস্টার্ড কিছুই বুঝতে পারছে না। এই ইনভেস্টিগেটর এসব কী বলছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো জেফরি, “এতো দেখি ভয়াবহ ষড়যন্ত্র!”

“আপনি এসব কী বলছেন?”

জেফরি বেগ বুঝতে পারলো বাস্টার্ড আসলেই কিছু জানে না । স্পেশাল ব্রাঞ্চের সেই গোপন ইন্টেলিজেন্স রিপোের্ট সম্পর্কে তাকে বিস্তারিত বলে গেলো। আরো জানালো, ব্ল্যাক রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ঝন্টুও এই ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করেছে।

সব শুনে থ বনে গেলো বাস্টার্ড ।

.

একটি ষড়যন্ত্রের ব্যবচ্ছেদ

মি: টেন পার্সেন্ট হিসেবে খ্যাত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্বামীর দুর্নীতির কারণে গত নির্বাচনে বর্তমান বিরোধী দল জনগনের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয় । স্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে এক ধরণের দ্বৈতশাসন চালিয়েছিলো ভদ্রলোক। সব ধরণের কাজ আর সিদ্ধান্ত তার অনুমতি ছাড়া হতো না। সে-ই হয়ে উঠেছিলো ক্ষমতার আসল কেন্দ্রবিন্দু। ভদ্রলোক নিজের এই অবৈধ ক্ষমতার পুরোটাই ব্যবহার করে টাকা কামানোর কাজে। এমন কি প্রধানমন্ত্রীর দলের ভেতর প্রচুর অনুগামীও তৈরি করে ফেলে সে।

পরবর্তী নির্বাচনে ভরাডুবি হলে মি: টেন পার্সেন্টের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির মামলা করে নতুন সরকার। সেই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্বামী দীর্ঘদিন ধরে জেলে আছে। তার অনেক মামলার বিচার কাজ শুরুও হয়ে গেছে এরইমধ্যে। এভাবে পাঁচটি বছর কেটে যাবার পর, আরেকটি নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে যখন দেশ তখন মি: টেন পার্সেন্টের সাথে তার স্ত্রী, অর্থাৎ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়ে যায় । মহিলা দেরিতে হলেও নিজের ভুল বুঝতে পারেন। স্বামীর পছন্দের লোকজনকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে তিনি সৎ ও যোগ্য লোকজনকে অধিষ্ঠিত করতে থাকেন। স্বামীর দুর্নীতির সব কিছু জানতে পেরে এই কলঙ্ক থেকে নিজেকে এবং দলকে উদ্ধার করার জন্য ব্যাপক সংস্কার হাতে নেন।

জেলে বসে মি: টেন পার্সেন্ট বুঝতে পারে তার স্ত্রী সামনের নির্বাচনে জিতলেও দুর্নীতির মামলা থেকে সে মুক্তি পাবে না। এমনকি তার স্ত্রী তাকে ডিভোর্স করার চিন্তাভাবনা করছে বলেও তার কাছে খবর আসতে থাকে। অন্য দিকে বর্তমান সরকার পুণরায় নির্বাচিত হলে তার আর কোনো আশাই থাকবে না।

এরকম পরিস্থিতিতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখা মি: টেন পার্সেন্ট অস্থির হয়ে ওঠে। এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করে ভদ্রলোক।

কুখ্যাত সন্ত্রাসী ব্ল্যাক রঞ্জুর সাথে মি: টেন পার্সেন্টের আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থেকে রঞ্জুও হাপিয়ে উঠেছে। প্রস্তাবটা পাওয়া মাত্র লুফে নেয় সে। পুরো পরিকল্পনাটি সফল হলে দেশে ফিরে আসতে পারবে, চলে যেতে পারবে ক্ষমতার অনেক কাছাকাছি।

মি: টেন পার্সেন্টের ষড়যন্ত্রটি ছিলো এরকম :

বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে। দেশে বইবে নির্বাচনী হাওয়া। শুরু হবে প্রধান প্রধান দলগুলোর নির্বাচনী ক্যাম্পেইন। ঠিক এমন সময় তার স্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনী জনসভা করার সময় ব্ল্যাক রঞ্জুর দল হত্যা করবে। মহিলা খুন হলে সন্দেহের তীর গিয়ে পড়বে বিগত সরকারী দলের উপর। জনগণের সেন্টিমেন্ট চলে যাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং তার দলের অনুকূলে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাধ্য হবে মি: টেন পার্সেন্টকে প্যারোলে মুক্তি দিতে। মুক্তি পেয়ে সে পাবলিক সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে আর প্রচুর টাকা খরচ করে স্ত্রীর দলের আপদকালীন প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত হবে। তার নেতৃত্বে দল নির্বাচনে যাবে আর বলাই বাহুল্য এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক লিগ্যাসির কারণে জনগণের আবেগকে পুজি করে নির্বাচনে নির্ঘাত জয় লাভ করতেও সক্ষম হবে। মি: টেন পার্সেন্ট হয়ে যাবে এ দেশের সর্বেসর্বা। নতুন প্রধানমন্ত্রী।

মোক্ষম একটি চাল। ভয়ঙ্কর একটি পরিকল্পনা । ঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশের ইতিহাস পাল্টে যেতো। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয় নি।

হাসপাতালের এক ডাক্তারের সহায়তায় প্রিজনসেলে বসে মোবাইল ফোন হাতে পেয়ে মি: টেন পার্সেন্ট বাথরুম থেকে ব্ল্যাক রঞ্জুকে যখন ফোন করে তখন দেয়ালের ওপাশ থেকে তৃতীয়শ্রেণীর এক কর্মচারি মিরাজ শেখ সব শুনে ফেলে। মিরাজ শেখ হাসপাতালের এক মহিলা কর্মচারির সাথে অবৈধকাজে লিপ্ত হবার জন্যে একটা স্টোররুমে অপেক্ষা করছিলো সেই সময়। আর সেই স্টোর রুমটা ছিলো প্রিজনসেলের বাথরুমের দেয়ালের ওপাশে। এক সময় ওটাও ছিলো একটা সেল। পরে দেয়াল ভেঙে বাথরুমসহ পুরো সেলটাকে পরিণত করা হয় স্টোররুমে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা খবর পেয়েছিলো, হাসপাতালের এক ডাক্তার শিডিউলের বাইরে মি: টেন পার্সেন্টের কাছে গেছে। তারা কিছুটা আঁচ করতে পেরে তড়িঘড়ি ছুটে এলেও মি: টেন পার্সেন্টকে থামাতে পারে নি। বাথরুমের দরজা ভেঙে যখন তারা ঢোকে তার আগেই লোকটা কথাবার্তা সেরে ফেলে মমাবাইল ফোনটা কমোডে ফ্ল্যাশ করে দেয়। কিন্তু গোয়েন্দাদের একজনের তীক্ষ্ম চোখে প্রিজনসেলের বাথরুমের দেয়ালের ফুটোয় কিছু একটা ধরা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গোয়েন্দাবাহিনীর লোকজন ছুটে যায়, হাতেনাতে ধরে ফেলে মিরাজ শেখকে।

গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে মিরাজ শেখ বলে দেয় মি: টেন পার্সেন্টের ফোনালাপে সে কি শুনতে পেয়েছে। তারপর, যে ডাক্তার মি: টেন পার্সেন্টকে মোবাইল ফোন সরবরাহ করেছিলো তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও এর সত্যতা মেলে। সামান্য একটা ফোন কলের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য পাঁচলক্ষ টাকা দেয়া হয়েছিলো সেই ডাক্তারকে । কথাটা জানতে পেরে গোয়েন্দারা নড়েচড়ে ওঠে। সুইপার দিয়ে পিজি হাসপাতালের সুয়ারেজ লাইন থেকে বহুকষ্টে মি: টেন পার্সেন্টের মোবাইল ফোনটা উদ্ধার করে তারা। ফোন সেটটা নষ্ট হয়ে গেলেও এর ভেতরে থাকা সিমটা অক্ষত ছিলো। সেই সিমের সূত্র ধরে তারা জানতে পারে মি: টেন পার্সেন্ট আসলেই কোলকাতায় একটি ফোন করেছে।

এই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রটি উন্মোচিত হলে তারা রিপোের্ট আকারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠায়। রিপোর্ট পড়ে প্রধানমন্ত্রী দুটো কাজ করেন : প্রথমত তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করার নির্দেশ দেন। দ্বিতীয়ত, রিপোর্টে যে ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে সেটা নিজের প্রতিপক্ষকে জানিয়ে দেন দু’পক্ষের কাছে বিশ্বস্ত এক লোকের মাধ্যমে ।

ঠিক এমন সময় ব্ল্যাক রঞ্জু চাঁদা চেয়ে টেলিফোনে হুমকি দেয় ঐ দুই ব্যবসায়ীকে। এ নিয়ে ব্যবসায়ী দু’জন বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ঢাকা ক্লাবের এক আড্ডায় কথাটা তারা শেয়ার করে অমূল্য বাবু আর প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোকটির সাথে। ব্যবসায়ীরা অবশ্য জানতো না ব্ল্যাক রঞ্জুর দল সামনে কী করতে যাচ্ছে।

ঐ দুই ব্যবসায়ীকে বিদায় দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোক আর অমূল্য বাবু যখন একই গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছিলো তখনই অমূল্য বাবুকে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোকটি ষড়যন্ত্রের কথাটা জানায়। ভদ্রলোক এ থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় কি জানতে চাইলে অমূল্য বাবু প্রস্তাব দেয় একজন প্রফেশনাল হিটম্যানকে দিয়ে ব্ল্যাক রঞ্জুকে খুন করার জন্য। কিন্তু এরকম কেউ কি আছে-এ প্রশ্নের জবাবে অমূল্য বাবু মুচকি হেসে জানায়, একজন লোকই এটা করতে পারবে। আর সেরকম একজন লোকের খোঁজ তার কাছে আছে।

শুরু হয় পাল্টা একটি ষড়যন্ত্রের ।

.

উপসংহার

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগে বাস্টার্ডকে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট থেকে ঘুরে আসতে হয়। ইন্টেরোগেশন রুমে তাকে টানা তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে জেফরি বেগ । কিন্তু খুব কম কথাই সে স্বীকার করে ।

জেফরি বেগের কাছে যখন সে জানতে চায় ব্ল্যাক রঞ্জু তাকে কিভাবে খুঁজে বের করলো এতো দ্রুত, তখন ইনভেস্টিগেটর জানায় সমগ্র ঢাকা শহরের প্রায় সবগুলো এলাকায়ই কমবেশি ব্ল্যাক রঞ্জুর লোকজন রয়েছে। তো বাস্টার্ড যেখানে থাকে সেই কলাবাগানেও তার কিছু লোকজন আছে, আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাস্টার্ডের বাড়িতে থাকা বিশ্বস্ত লোক মজিদ আর আমেনার বখে যাওয়া একমাত্র ছেলে রিপন রঞ্জু গ্রুপের ছোটোখাটো সদস্য।

কোলকাতায় বাস্টার্ড যাকে খুন করেছে তারও নাম রঞ্জু। তার ছবিই ঢাকার সবগুলো থানায় রয়েছে। এটা ব্ল্যাক রঞ্জুর একটি অভিনব কৌশল। তার বস্ রঞ্জুর সাথে থাকার সময়েই বুঝতে পেরেছিলো একই দলে এক নামের দু’জন সন্ত্রাসী থাকলে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়।

অন্য একজনকে পাপেট বানিয়ে নির্বিঘ্নে ঢাকা-কোলকাতা আসা যাওয়া করতে ব্ল্যাক রঞ্জু। তার দলের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া বাকিরাও তাকে চিনতো না। কোলকাতায় আর ঢাকায় সে রঞ্জুর আশ্রয়দাতা মৃণাল হিসেবেই পরিচিত ছিলো তার দলের কাছে। বাস্টার্ড নকল রঞ্জুকে খুন করার কিছুক্ষণ আগে কাকতালীয়ভাবে মাউন্ট অলিম্পাস থেকে ব্ল্যাক রঞ্জু অর্থাৎ মৃণাল বের হয়ে যায়। তারপর যখন জানতে পারে অলিম্পাসে খুনখারাবি হয়ে গেছে, তার গোপন আস্তানার কথা ঢাকা এবং কোলকাতার পুলিশ জেনে গেছে তখন সে দেরি না করে ঢাকায় চলে আসে। এখানে এসেই রঞ্জু খোঁজ নেয় কে তার পেছনে লেগেছে। ঢাকা শহরের বেশ কয়েকটি থানার কিছু দুর্নীতিবাজ পুলিশ অফিসার রঞ্জুর হয়ে কাজ করতো, তাদেরই একজন হোমিসাইড থেকে পাঠানো বাস্টার্ডের পরিচয় আর ছবি সরবরাহ করে রঞ্জুকে।

ছবি আর পরিচয় জানার পর ব্ল্যাক রঞ্জুর জন্য কাজটা খুব সহজ হয়ে যায়। ঢাকায় তার পুরো নেটওয়ার্কটাকে ব্যবহার করে সে। খুব দ্রুতই খোঁজ পেয়ে যায় বাস্টার্ড নামের খুনি বাস করে কলাবাগানের একটি দোতলা বাড়িতে। খবরটা আর কেউ নয়, ঐ বাড়িরই কেয়ারটেকার মজিদের ছেলে রিপন তাকে দেয়। সে একেবারে নিশ্চিত করে, বাস্টার্ড বর্তমানে ঐ বাড়িতেই আছে। চরম প্রতিহিংসায় জ্বলতে থাকা ব্ল্যাক রঞ্জু তার বিশ্বস্ত চারজন ক্যাডার নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় কলাবাগানের ঐ বাড়িতে। তারপরই ঘটে এইসব খুনখারাবির ঘটনাগুলো।

তার কাছ থেকে কিছু জানতে না পেরে হতাশ হয়ে জেফরি বলে, “জানি, তুমি কিছু বলবে না, তবে মনে রেখো, একদিন না একদিন আমি ঠিকই সেটা জানতে পারবো।”

কথাটা বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। “জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে তোমাকে হয়তো আঁটকাতে পারবো না, কিন্তু ব্ল্যাক রঞ্জর ঘনিষ্ঠ লোকদের হত্যা করার জন্য তোমার বিরুদ্ধে মামলা হবে। মনে রাখবে, তুমি শেষ পর্যন্ত একজন প্রফেশনাল খুনি। স্রেফ খুনি।” কথাটা বলে দরজার কাছে গিয়ে ফিরে তাকায় জেফরি বেগ। “এই উমা মেয়েটার বোধহয় তোমার প্রতি এক ধরণের মায়া জন্মে গেছে,” বলে সে। “আমি জানি না তোমার মতো একজনের প্রতি তার এই মায়ামমতার কারণটা কী।”

স্থিরচোখে তাকিয়ে থাকে বাস্টার্ড ।

“তবে এটা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। এটা নিতান্তই তোমার সমস্যা, মি: তওফিক।” কথাটা বলেই চলে যায় জেফরি বেগ।

* * *

আহত হবার বিশ দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাস্টার্ড সোজা চলে গেলো জেলখানায়। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি হত্যার অভিযোগ তদন্ত করছে হোমিসাইড। মামলা করারও প্রস্তুতি চলছে। জেলখানায় চলে যাবার পর তার সাথে শুধুমাত্র তিনজন লোক দেখা করতে এলো। তাদের মধ্যে উমা বেশ কয়েকবার, শুটার সামাদ আর অমূল্য বাবু একবার করে। অমূল্য বাবু তাকে আশ্বস্ত করে বলে যায় আর কিছু দিন অপেক্ষা করার জন্য। তবে সে জানতো না অপেক্ষা করলে কী এমন হবে।

উমা মেয়েটি কেন তার সাথে জেলখানায় দেখা করতে আসতো সে জানতো না। তবে মেয়েটা এলে তার খুব ভালো লাগতো।

দীর্ঘ দুই মাস তাকে জেলে থাকতে হলো। এই সময়ে দেশে অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় নির্বাচন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যাকে তার নিজের স্বামী হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলো, সবাইকে অবাক দিয়ে তার দলই নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলো। নতুন সরকার গঠিত হবার দু’মাসের মাথায় অদৃশ্য এক ইশারায় বাস্টার্ডের জামিন হয়ে যায় । জেল থেকে বের হয়ে এলে অমূল্য বাবু তাকে জানায় দেশে না থেকে সে যেনো বিদেশে কোথাও চলে যায় দু’একবছরের জন্য। তারপর ফিরে এসে স্বাভাবিক জীবনযাপন করলে তার কোনো সমস্যা হবে না। এই ফাঁকে তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করা হবে । জেফরি বেগও তার পেছনে লাগতে পারবে না।

* * *

বাস্টার্ড আর উমা বসে আছে এক রেস্তোরাঁর নির্জন কোণে। দিনের এ সময়টাতে খুব একটা ভীড় নেই। আজ উমার ডিউটি অফ। নার্সের চাকরিটা পারমানেন্ট করতে গিয়ে বরখাস্ত হয়েছিলো তারা অনেকেই। তাদের মধ্যে কয়েকজন সেই বরখাস্তের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করলে শেষ পর্যন্ত রায় তাদের পক্ষে যায়। চাকরিতে পুণর্বহাল হয় তারা সবাই। হোমিসাইড থেকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিধ্বস্ত অবস্থায় ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরেই জানতে পারে এই সুখবরটা। খুব দ্রুতই ফিরে যায় পুরনো চাকরিতে।

উমা এখনও রামপুরায় থাকে। চাকরিতে জয়েন করার কারণে তার ব্যস্ততা বেড়ে যায় ফলে বাড়ি বদলানোর সময় আর পায় নি। কাকতালীয়ভাবে উমার ডিউটি পড়ে ক্রিমিনাল ওয়ার্ডে, আর বাস্টার্ড আহত হয়ে ঠিক সেই ওয়ার্ডেই ভর্তি হয়। হাসপাতালে দীর্ঘ বিশ দিন থাকার কারণে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আরো গাঢ় হয়ে ওঠে। যদিও তারা দুজনেই জানে না তাদের সম্পর্কটা আসলে কি। কেউ কাউকে মুখে কিছু বলে না কিন্তু দু’জন দু’জনের সঙ্গ পছন্দ করে । কথা না হলে ভালো লাগে না। দেখা না হলে অস্থির হয়ে ওঠে।

“কালকেই তোমার ফ্লাইট?” আস্তে করে বললো উমা । বাস্টার্ড খেয়াল করলো মেয়েটার দুচোখ ছলছল করে উঠেছে ।

মাথা নেড়ে সায় দিলেও কিছু বলতে পারলো না সে। তারও করুদ্ধ হয়ে এলো।

“আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে নিয়মিত?” চোখে চোখ রেখে বললো উমা । সেই চোখ ভেজা ।

আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। তার বুক ফেঁটে যাচ্ছে। কান্না চেপে রেখেছে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। জীবনে এতোটা ভঙ্গুর কখনই ছিলো না। এতোটা আপন করে কাউকেই ভাবতে পারে নি। এরকম সুখও বোধহয় কখনও পায় নি সে। হাসপাতাল থেকে জেলে চলে যাবার পর যে লোক বের হয়ে এসেছে সে একেবারেই ভিন্ন মানুষ ।

উমা শাড়ির আঁচল দিয়ে তার চোখ মুছে দিলো । সে বাধা দিলো না।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর একটা সিএনজি করে উমাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এলো। উমার সাথে দেখা করার আগে থেকেই একটা কথা বলার জন্য মনস্থির করে রেখেছে কিন্তু বলতে পারছে না। অবাক হয়ে বুঝতে পারলো, তার হৃদপিণ্ডটা রীতিমতো লাফাচ্ছে। মানুষ খুন করতেও এরকম হয় নি কখনও।

উমা যখন সিএনজি থেকে নামবে তখনই মনে হলো এ জীবনে বোধহয় কথাটা আর বলা হবে না। কিন্তু হঠাৎ করেই তার মুখ দিয়ে একটা কথাটা বের হয়ে গেলো।

“আমি যদি বলি তোমাকে ভালোবাসি তুমি কি কিছু মনে করবে?”

স্থির চোখে চেয়ে রইলো উমা। তার চোখ দুটো কেমন যেনো দেখাচ্ছে। কিছু না বলে সিএনজি থেকে আস্তে করে নেমে গেলো সে। জীবনে এই প্রথম তার হৃদপিণ্ডটার কোনো শব্দ শুনতে পেলো না। চারপাশটা কেমন জানি অচেনা হয়ে উঠলো মুহূর্তে।

হঠাৎ উপুড় হয়ে সিএনজির ভেতরে তাকালো উমা।

“না, বাবলু!”

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *