॥ পঞ্চাশ ॥
মাটির উঠানে সাদা রোদ পড়ে আছে। ধান সেদ্ধ করার জোড়া উনুন, বড় মেটে হাঁড়ি কয়েকটা। ঝিঙে মাচানে ফুলের যুদ্ধু লেগে গেছে। ভিতরের ঝুঁঝকো আঁধারে উঁকি দিলে দেখা যায় সুঠাম শিশুরা ফুল ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে।
মাটির দোতলা বাড়ি। ওপরে খোড়ো চাল। উঠানে পা দিতেই মণ্ডলরা তিন ভাই খবর পেয়ে বেরিয়ে এল। সঙ্গে ছেলেপুলে। সব উপুড় হয়ে পড়ল পায়ে। মুখে ভক্তি মেশানো হাসি।
ব্রজগোপাল হাতজোড় করে বলেন—সব ভাল তো?।
—আপনার যজমান, ভাল রাখবেন তো আপনি। মোজোভাই একথা বলল। বি-এ পাস ছেলে, ইস্কুলে পড়ায়।
কথাটা শুনে ব্রজগোপাল খুশি হন। বাড়ির মায়েরা সব আসে। বড় বড় ঘোমটা, দূর থেকে না ছুঁয়ে প্রণাম করে। বাড়িতে একটা চাপা আনন্দের বিদ্যুৎ খেলা করছে।
বড় ভাইয়ের গায়ে কাপড়ের খুঁট জড়ানো। গোটা কয় শশা তুলে আনল পটাপট বাগান থেকে। মুখখানা হাসিতে ভিজে আছে। কপালে কণ্ঠায় ঘাম। মমতার চোখে চেয়ে থাকেন ব্রজগোপাল। এইসব তাঁর মানুষ। তাঁর সম্পদ। বুড়ো বামুনের নাম দিয়ে বেড়ান তিনি। বদলে এঁদের পান। আর কিছু নেই।
দোতলার মাদুর পেতে দেওয়া হয়েছে বারান্দায়। ব্রজগোপাল কাঠের মই বেয়ে উঠে এলেন। পোঁটলাটা পাশে রাখলেন। বাচ্চা একটা ছেলে পাড় লাগানো হাতপাখা টানতে লাগল বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে। অন্য হাতে ঢিলে পেন্টুল সামলাচ্ছে।
—পুরনো তেঁতুল চেয়েছিলেন সেবার। মনে করে আনলাম। বলে ব্রজগোপাল পোঁটলার মুখ খুলে শালপাতায় জড়ানো আফিঙের মতো কালো পুরনো তেঁতুল বের করে দেন। শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে, মুখে দিলে টক লাগে না, মিষ্টি।
—বড় মণ্ডল অবাক হয়ে বলে—মনে রেখেছেন! আমিই তো ভুলে গেছি।
—তোদের ভুলো মন, কাজেকম্মে থাকিস। আমার তো ভুললে চলে না, তোদের নিয়ে কারবার। তোর খুকির একটা সম্বন্ধও এনেছি। বাশুলী গাঁয়ে।
বড় মণ্ডল একটু ইতস্তত করে বলে—এখানেও একটা ছিল। গয়লা ঘোষ। নিজেরা প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
ব্রজগোপাল একবার তাকান। বড় মণ্ডল চুপ করে যায়। ব্রজগোপাল ধীর গম্ভীর স্বরে বলেন—ওসব মাথা দিবি না। বিয়ে দেওয়ার মালিক তুইও না, আমিও না। বর্ণাশ্রম ভাঙবি কেন? যোগেযাগে এই ঘুরে বেড়াচ্ছি দেশ-দেশান্তর, কত বিয়ে ঘটাচ্ছি, এ বড় পুণ্যকর্ম, ঠিক ঠিক বিয়ে ঘটালে দেশের কাজ হয়। ঘটকরা একসময়ে ভাল বামনুই ছিল। বর্ণে, গোত্রে, শিক্ষায়, চরিত্রে ঠিক বিয়েটি ঘটিয়ে দিত। সেইসবের জন্যই জাতটা এতদিন টিকে গেল। ঘটকালিতে পয়সা ঢুকে সর্বনাশ। বাশুলী গাঁয়ের পাত্রও ভাল, তোদেরই স্বঘর মাহিষ্য।
লোকটা তর্কটর্ক, কী প্রতিবাদ জানে না। একগাল হাসল, বলল—আজ্ঞে।
ওই হাসিটুকু দেখে ব্রজগোপাল ভরসা পান। দু-মাস তিন-মাস ফাঁক দিয়ে এলে দেখেন ব্যাটারা রাজ্যের অনাচারী কর্ম করে বসে আছে। সব ঠিকঠাক করে মেরামত করে দিয়ে যান। মানুষ যন্ত্রটাই সবচেয়ে গোলমেলে। বিগড়োলে, ভুল কাজ করে যেতে থাকে। তাই বার বার আসতে হয়। ঘুরে ঘুরে আসেন, ঘড়ির কাঁটার মতো। তবে গেঁয়ো লোক, বিশ্বাসটা বড় সরল। খুব বেশি খাটতে হয় না পিছনে। ধর্মভয়ে কথা মেনে চলে।
হাত পা ধুয়ে দু-টুকরো শশা মুখে দিয়ে বিশ্রাম করছেন। উনুনে আগুন দিয়ে দুটো ফুটিয়ে নেবেন একটু বাদে। দোলনায় একটা বাচ্চা ঘুমোচ্ছে। অন্য একটা মেয়ে দোলাচ্ছে দোলনাটা। ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ আসে। বীজমন্ত্র জপে একটু বাধা হয়। তারপর বীজমন্ত্রের স্পন্দনটা আপনই দোলনার শব্দের সঙ্গে মিলে গেল। চার অক্ষরী বীজমন্ত্রটা আর দোলনার ক্যাঁচকোঁচ শব্দ, এই দুইয়ে যেন একটু লড়াই চলল খানিক। তারপর দোলনার শব্দটা মিলিয়ে গেল। কলকাতার স্বামীচরণ মুখুজ্জে তার হাওড়ার লোহার কারখানায় একটা লোককে কুড়ি টাকা বেশি মাইনে দেয়। কারণ নাকি, লোকটা যখন হাতুড়ি পেটায় তখন সেই শব্দের মধ্যে স্বামীচরণ বীজমন্ত্রের ধ্বনি শুনতে পান। ব্যাপারটা এখন বুঝলেন ব্রজগোপাল।
সেজো মণ্ডল এক আণ্ডিল ডাব কেটে নিয়ে এল। ডাব কেটে কেটে এগিয়ে দেয়। ব্রজগোপাল দুটো ডাব খেয়ে বলেন—ও নিয়ে যা।
—এ ক’টা খাবেন না?
—পাগল নাকি! দশটা ডাব খেলে পেটে সহ্য হবে না।
—আগে কিন্তু খেতেটেতে পারতেন। বলে মেজো মণ্ডল দুঃখিত চিত্তে নিজে গোটা চারেক খেল, একটু ফিরে বসে।
আকাশের দিকে মুখ করে যোজন জুড়ে পড়ে আছে চিতেন ঠাকুর। চিত হয়ে পড়ে থাকে বলেই ব্রজগোপাল ওই নাম দিয়েছেন। লোকে বলে মা-বসুন্ধরা, ব্রজগোপাল বলেন চিতেন ঠাকুর। শনির মতো বদমেজাজি দেবতা। বুক চিতিয়ে পড়ে থাকে বটে ভালমানুষের মতো, কিন্তু বুকখানার মধ্যে নানা রসিকতার বাসা। ফুক করে শ্বাস ছাড়লেন তো বীজ ছাই হয়ে গেল, আবার চোখের ইশারায় মেঘ তাড়িয়ে আনলেন ভেড়ার পালের মতো, ভাসালেন সেবার।
মণ্ডলদের বুড়ো বাপ এখনও বেঁচে। খবর পেয়ে মই বেয়ে উঠে এল। রোগা মানুষ। বয়সের যেন গাছপাথর নেই। উবু হয়ে সামনে বসে পড়ল। আজকাল একটু ভীমরতি হয়েছে। বলল—ছেলেরা বোরো চাষ দিয়েছে। মানা শুনল না। মাঠ দেখে এসেছেন? সব লাল হয়ে গেল। বীজধানটাই নষ্ট।
ব্রজগোপাল ব্যাপারটা জানেন। খরায় তিনটে-চারটে বড় পুকুর যখন মজে এসেছে তখন তাইতে বোরো লাগিয়েছিল মণ্ডল ভাইরা। বোরো চাষে জল লাগে। তাই খুব বুদ্ধি খাটিয়ে মজা পুকুরে চাষ দিয়েছিল। তলানি জলটুকু চোঁ করে টেনে নিয়েছে চারাগাছ। তারপর এখন শুকনো টনটনে হয়ে খরখর শব্দ তুলছে হাওয়ায়। বহেরুর মতো বড় চাষা এরা নয় যে পাম্পসেট কিনবে, কী ডিপ টিউবওয়েল বসাবে। আগের বার ব্রজগোপাল দেখে গেছেন তিন পো পথ দূর দিয়ে খাল গেছে। সেখান থেকে খাত কেটে আনা যায়। বড় মণ্ডল বলল—তা অন্যের জমির ওপর দিয়ে নালা কাটতে দেবে কেন?
ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন—জমির মালিকদের বলেকয়ে দেখেছিস? সবার সঙ্গেই কী তোদের ঝগড়া নাকি?
বড় মণ্ডল মাথা চুলকে বলেছিল—তা বলিনি বটে। কিন্তু লোকের মন বুঝি তো, জমি ছাড়বে না।
ব্রজগোপাল বলেছিলেন—ছাড়বে। ছাড়াতে জানতে হয়। তোরা ব্যাটা কেবল স্বার্থের সময়ে লোকের খোঁজ করিস। এমনিতে খবর বার্তা নিস না। নিজেদের সামলাতে ব্যস্ত। পরের জন্য তোর যদি কিছু করা থাকে তো দরকারেও পরেই এসে বেগার দিয়ে যাবে। পাঁচহাত জমি ছাড়া তো কোনও ত্যাগই না। যা গিয়ে লোককে বোঝা গে, জল আনলে তাদেরও জমি সরেস হয়। আর বছর সীতাশাল ধান করা চাই।
কিন্তু কোথায় নালা! কোথায় কী? বোরো গেছে, বৃষ্টি না হলে বড় চাষও যাবে। চিতেন ঠাকুরের মতলব এবার ভাল না। টেরা চোখে চায় যদি! পরিবেশটা অনুকূল করে নিলে মানুষের কষ্ট থাকে না। প্রকৃতির সবদেওয়া আছে, মানুষে মানুষে আড় হয়ে সব নষ্ট করে। এইটে কতবার বুঝিয়েছেন, ওরা ভুলে যায়। লোককে সেবা দিয়ে সাহায্য দিয়ে নিজের মানুষ করে নিতে হয়। পরিবেশের রসকষ টেনে বেঁচে আছিস, পরিবেশটাকে রসস্থ রাখতে হবে না? নইলে ছিবড়ে হয়ে গেলে পরিবেশ তো রস ওগরাবে না, বাঁচবি কাকে নিয়ে?
বুড়ো মণ্ডল কপালে হাত চেপে কোঁকানির শব্দ করতে করতে বলে—আপনার চিতেন ঠাকুর আমাকে স্বপ্নে দেখা দেয়। বলে, মাটির সতীত্ব নাশ করেছিস হারামজাদা, ফসলে বিষ দিলি, নিজেরাই খেয়ে আস্তে আস্তে মরবি। তা বাবামশাই, পোকাও লাগে বটে। জন্মে এত পোকা দেখিনি।
ব্রজগোপাল বিরক্তির শব্দ করেন। চিতেন ঠাকুরের আর কাজ নেই, বুড়ো মণ্ডলকে স্বপ্নে পেয়ে গুহ্যকথা সব বলতে গেছেন। তবু ওর মধ্যে একটু সত্যি কথা আছে।
বুড়ো মণ্ডল বলে—ভয়ানক স্বপ্ন বাবা। শশা কাটছি তাতে পোকা বিজবিজ, আলু কাটছি তো পোকা বিজবিজ, রসাল চেহারার ঝিঙে কাটলুম তো ভিতর থেকে ঝুরঝুরিয়ে পোকা বেরিয়ে গেল হাসতে হাসতে। এই স্বপ্ন। তারপর দৌড়ে এসে দোলনার খোকাটাকে তুলতে গিয়ে দেখি তারও চোখে কানে নাকে মুখে পোকা থিকথিক করে ধরেছে। কী ভয়ানক বলুন দিকি। ওই যে সব কেমিকেলি সার দেয়, কলের লাঙল দিয়ে চাষ, বিষ ছড়ায়, ও হচ্ছে চিতেন ঠাকুরের বুকে হাঁটু দিয়ে ফসল আদায়। ওইতেই ঠাকুর ক্ষেপে যান। পচানো সার, বৃষ্টির কি খালের জল, কাঠের লাঙলে হেলেবলদ—এই হল গে লক্ষ্মীমন্ত চাষ। জোর করে ফসল ফলালে মাটি রক্ত উগরে দেয়। ভাল হয় না তাতে। না কি বলেন?
ব্রজগোপাল হাসেন। পুরনো দিনের লোক বুড়োমণ্ডল। সেই হেলেবলদে চাষ ভুলতে পারে না। তবে পোকার উপদ্রব বাড়ছে বটে। কেমিক্যাল সারের জন্যই।
জলের ব্যবস্থা একটা করে দিয়ে যেতে হয় এবার। বড় ভাইকে ডেকে বলেন—জলের কী করলি?
—উরেব্বাস, জল নিয়ে মারামারি। খাল থেকে জল চুরি যাচ্ছে। সেই নিয়ে মারদাঙ্গা। আমরা সে সবে গেলাম না এবার। বোরোটা ক্ষতি হল।
জলের কথাটা সারাদিন বসে ভাবেন ব্রজগোপাল। এই বুদ্ধিহীন যজমানগুলি ভেসে না যায় দুর্দিনে। গ্রাম ঘুরে কথাটথা বলেন লোকজনের সঙ্গে। লোকের তেমন গা নেই। যে যার ধান্ধায় আছে।
পরের দিন বড় আর ছোট দুভাই ব্রজগোপালকে তুলে দিতে এল বাসরাস্তায়। বাসের দেরি আছে, ব্রজগোপাল দুভাইকে দুদিকে নিয়ে বসেন গাছতলায়। বলেন—চাষবাস যো হোক গে, মানুষকে বুকে ঠেসে ধর, মানুষগুলোকে যদি অর্জন করতে পারিস তো তোদের ভাত উপচে পড়বে, এই বেলা মেখে ফ্যাল বাবা, একটু মিষ্টি কথা, একটু, হাসি, একটু দরদ সিঁচে সিঁচে দিয়ে মেখে ফ্যাল মানুষগুলোকে। খুব আকাল যখন আসবে তখন পাশে দাঁড়ানোর মতো জন পাবি।
—আকাল কি আসবেই?
—আসবেই।
ইদানীং কী হয়েছে। বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। বাস গোবিন্দপুরমুখো চলেছে। কিন্তু কেবলই সেই খুপরিতে গিয়ে উঠতে একটা অনিচ্ছা হতে থাকে। মাঝরাস্তায় শিবপুরে নেমে পড়েন। এখানেও যজমানদের বাড়ি। দিন সম্পূর্ণ হয়ে সন্ধ্যা লাগছে। তবু কিছু চিন্তা হয় না। পৃথিবীটা বেশ বড়সড় হয়ে উঠছে আজকাল। মাধ্যাকর্ষণ কি বেড়ে গেল এক লহমায়? মাঝে মাঝে ভাবেন, শেষ দিনটা আসার আর বুঝি দেরি নেই। তাই এত মায়া ভাবতে এখন আনন্দই হয়। মরে যেতে তেমন কষ্ট হবে না। তবে কাজ ঢের বাকি রয়ে যাবে না কি?
একটা ঢিবির উপর উঠে দাঁড়ান তিনি। বেশ জায়গাটা বাঁ ধারে একটা বাঁশবন। অবিকল পুজোর ঘণ্টার শব্দ করে একটা ঘন্টানাড়া পাখি ডেকে চলেছে। তপ্ত দিনের শেষে ঝিল থেকে ভাপ উঠে আসছে। তাতে জোলো গন্ধ। নিথর জলে একটা ডিঙি দাঁড়িয়ে আছে। তাতে একটা কালো মানুষ পিঁপড়ের মতো দাঁড়িয়ে, তার পিছনেই গলিত সোনার ঝোরা গলে গলে জলে মিশে যাচ্ছে। কী অপরূপ সন্ধ্যা। ব্রজগোপাল দাঁড়িয়ে থাকেন। তারা ফোটা দেখেন। ওই যে মেঘখণ্ডের ওপর তারা, ব্রাহ্মীমানুষেরা ওইরকম।
দু-দিনের নাম করে বেরিয়েছিলেন। ফিরে এলেন সাত দিন পরে।
বাড়ির হাতায় পা দিতে না দিতেই বহেরুর নাতি এসে হাঁটু পেঁচিয়ে ধরল—ও দাদু, একটা ধাপানী লাট্টু কিনে দেবে?
বাচ্চা সবে বেড়ে উঠেছে। ব্রজগোপালকে পেলে আর ছাড়তে চায় না। গায়ে গায়ে পুলটিশের মতো লেগে থাকে। কোথা থেকে সব আসে, কোন শূন্য থেকে শরীর ধারণ করে। জন্মে এক লহমায় পৃথিবীতে চারদিকে মায়ার আঠা মাখিয়ে দেয়। এই সেদিনও এটা ছিল না, আর আজকে কী গভীরভাবে আছে!
ব্রজগোপাল ছাড়িয়ে দিতে দিতে বলেন—দেব রে দাদা।
—মুকুন্দর দোকানে পাওয়া যায়।
—দেবখন। হাত মুখ ধুই, কাপড়-টাপড় ছাড়ি, কী লাট্টু বললি?
—ওই যে সুতো বাঁধা চাকতি, ছুঁড়ে দিলে ফের হাতে চলে আসে পালটি খেয়ে।
—বটে! তাজ্জব জিনিত তো!
ছেলেটা করুণ মুখ করে বলে—কিনে দেবে?
—তুই আমাকে কী দিবি তোর বদলে?
—পুজোর ফুল তুলে দেব সকালে। সাদা ফুল।
—যে ছড়াগুলো শিখিয়েছিলাম, বল তো! মনে আছে?
ছেলেটা একগাল হেসে মাথা নাড়ে। গম্ভীর হয়ে দাঁড়ায়। একটু দোল খেয়ে বলে—মানুষ আপন, টাকা পর, যত পারিস মানুষ ধর। ধর্মে সবাই বাঁচে বাড়ে, সম্প্রদায়টা ধর্ম না রে। মাতৃভক্তি অটুট যত, সেই ছেলেই কৃতী তত। মুখে জানে, ব্যবহারে নাই, সেই শিক্ষার মুখে ছাই। বাঁচা বাড়ার উলটো চলে, ম্লেচ্ছ জানিস তাদের বলে।
আরও চলত। ব্রজগোপাল থামালেন। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় দোরগোড়ায় এসে পড়েছেন, ছেলেটা বলল——দাদু, তোমার মা বড় রাগী।
—কে রাগী? ব্রজগোপাল জিজ্ঞেস করেন।
—তোমার মা। কাল এসেছে তো! তোমার ঘরে আমার সব খেলনাপত্র রেখেছি, যতবার নিতে যাই বকে দেয়। আর একটা মোটা মানুষ এসেছে, সেও ভারী রাগী। হাসে না।
ব্রজগোপাল বুঝতে পারলেন না কে এসেছে। মা? মা সেই কবে চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে।
কপাট ভিতর থেকে বন্ধ। শেকল নাড়া দিলেন ব্রজগোপাল। বুকের মধ্যে কেমন একটা উলটো রক্তস্রোত বইছে। কে এল! কে এল!
—কে? একটু গম্ভীর বয়স্কা নারীকণ্ঠ সাড়া নেয়।
ও স্বর ভুলবার নয়। কতকাল বাদে এতদূর আসতে পারল মানুষটা। কোনওদিন আসবে না, ভেবেছিলেন ব্রজগোপাল।
—আমি। বলতেই গলার স্বর একটু কেঁপে গেল। প্রদীপের শিখা যেমন দোল খায়।
ননীবালা দরজা খুলে সামনে থেকে সরে গেলেন। ঘোমটা টেনে কপাল ঢেকে বললেন—এই এলে?
—হুঁ।
—আমি আর রণো কাল থাকে বসে দুর্ভাবনায় মরে যাচ্ছি। দু-দিনের নাম করে সাত দিন! এরকমই চলছে বুঝি আজকাল? দেখার কেউ নেই।
ব্রজগোপাল ঘরে ঢুকে দেখেন, তাঁর বিছানায় রণেন ঘুমোচ্ছে। একবার তাকালেন সেদিকে। তারপর ননীবালার দিকে ফিরে বললেন—কে থাকবে?
ননীবালা মুখটা ফিরিয়ে নিলেন।
॥ একান্ন ॥
ঠিক দুপুর বেলাতেই সুভদ্র আসে আজকাল। দুপুরটাই নিরাপদ সময়।
শীলার ইস্কুলের গ্রীষ্মের বন্ধ শেষ হয়ে এল। দুপুরে সে ঘুমোয় না ঠিক। শুয়ে থাকে। ঘুমোবে কি? পেটের মধ্যে ছেলেটা ফুটবল খেলছে সব সময়ে। কলকল করে জল নড়ে। ছেলেটা মায়ের শরীরের মধ্যে সাঁতরায়। ছেলেটা কি খেলোয়াড়ই হবে, নাকি সাঁতারু। এই ছেলে জন্মাবে, বড় হবে, বিয়ে করে বউ আনবে। ভাবা যায়? শীলা নিজের মুখ চেপে ধরে। মনটাই অলুক্ষুণে, উঠে পড়ে। ঘরদোরে ঘুরে ঘুরে জিনিস নাড়ে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখে, একটু হাঁটাচলা করে। আর ক’টা দিন। তারপর ইস্কুল খুললে দুপুরটা আর একা লাগবে না।
লাগেও না। সুভদ্র প্রায়ই আসে৷ কড়া নাড়ে না। বাইরে থেকে এ রকম শিসের শব্দ করে। দোর খুলে প্রায়ই শীলা বিরক্ত ভাব করে ভ্রূ কুঁচকে তাকায়। বলে—ও কী অসভ্যতা। শিস দিয়ে ডাকে কেউ? পাঁচজনে কী মনে করবে?
পাঁচজনের মনে করাকরি নিয়ে ভাবতে বয়ে গেছে সুভদ্রর। সে একথা শুনে কেবল হাসে। দাড়িটাড়ি বড় একটা কামায় না, মাঝেমধ্যে গালে ঝোপঝাড় গজায়, চুল বেড়ে হিপি হয়ে যায়। ইচ্ছে ক’রে করে না এসব, আলসেমি ক’রে করে। সাজুক বা না সাজুক, দাড়ি থাক বা নাই থাক, ও জানে সব অবস্থাতেই ওকে দারুণ সুন্দর দেখায়। গার্লস স্কুলে ওকে চাকরি দেওয়াটা খুব বিপজ্জনক কাজ হয়েছিল।
শীলা ওকে বাইরের ঘরে বসিয়ে শোওয়ার ঘরে চলে আসে। আয়নায় মুখখানা দেখে। কী শ্রী হয়েছে! চেনা যায় না। পেতনি একটা। চুলটা ফেরায়, মুখটা মুছে নেয়, পাউডারের পাফটা একটু বুলিয়ে নেয়, ব্লাউজটা পালটায় কখনও-সখনও। এটুকু করতেই হয়। মনে পাপ নেই। তবু।
ধৈর্যশীল সুভদ্র ততক্ষণ বসে থাকে। শীলা ফের ঘরে আসতেই বলে—কেস্ পাচ্ছি না এজেন্সিটা চলে যাবে।
—খাটতে হয়।
—খাটি না নাকি! সারাদিন ঘুরছি। গোটা কয়েক বড় কনসার্নে স্যালারি সেভিংস ধরতে পারলে খুব কাজ হত। কিন্তু কোনও জায়গাতেই চান্স পাচ্ছি না। সব জায়গায় আগে গিয়ে কে যেন কাজটা অলরেডি করে ফেলেছে। আমি লেট লতিফ।
শীলা মৃদু হেসে বলে—দুপুরে রোজ তো এখানে এসে আড্ডা হয়। ঘোরেন কখন?
সুভদ্র বলে—ইস্, রোজ নাকি? তাহলে আর বরং আসব না৷ উঠি।
শীলা পা নাচায়। নিশ্চিন্ত মনে বলে—রোজ না হোক, প্রায়ই।
—ঠিক আছে, আর আসব না।
—আসতে কে বারণ করেছে? এসে কাজের কথা তুলে গুচ্ছের মিছে কথা না বললেই হয়। আসলে এজেন্ট মানে তো দালাল, ওসব করতে আপনার ভাল না লাগবারই কথা।
সুভদ্র হাসে, বলে—ভাল লাগে না কে বলল! ঘুরতে ঘুরতে কত লোকের সঙ্গে আলাপ হয়! বেশ লাগে।
—তবে হচ্ছে না কেন?
—হবে কী করে! যাঁদের পলিসি করার তারা সব তিন চারটে করে পলিসি করে ফেলেছে। যারা করেনি তারা অন প্রিন্সিপল করবে না। তার ওপর এখন ব্যাঙ্কে রেকারিং ডিপোজিট-টিট করে এল আই সি-র পপুলারিটি কমিয়ে ফেলেছে। বললাম না, আমি সব জায়গায় লেট লতিফ।
শীলা হারের লকেকটা মুখে তুলে বলে—তা হলে কী করবেন?
—ভাবছেন কেন? কিছু একটা হয়ে যাবে।
এই রকমই সব কথা হয়। নির্দোষ কথা। কেউ সাক্ষী থাকে না অবিশ্য। ঝি-মেয়েটা ঘুমোয়। পড়শিরা কেউ কান পাতে না। চারদিকে তবু কী যেন একটা ওত পেতে থাকে। লাফ দেবে, ছিঁড়ে খাবে। ঘরসংসার ভেঙে ফেলবে। বাতাসে তড়িৎক্ষেত্র রচিত হয়।
ভাল নয়। ভাল নয়। তবু কী ভীষণ ভাল!
কদিন আগে শীলার স্কুলে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা হয়ে গেল। গার্ড দেওয়ার লোকের অভাব ছিল না। কিন্তু মুশকিল হল, আজকাল মেয়েরা পরীক্ষা দিতে যখন আসে তখন তাদের সঙ্গে আসে ছেলে-বন্ধু, প্রেমিক বা পাড়ার দাদারা। বাইরে থেকে তারা হামলা করে, শাসায়, স্কুলের ঘরে ঘরে এসে অনায়াসে ঢুকে যায়। বড় দিদিমণি যদিও খুব কড়া লোক, তবু এ এবস্থায় তেমন কিছু করতে পারেন না আজকাল। পুলিশ পাহারা দিচ্ছে, তার মধ্যেই বাইরের ছেলেরা ঢুকছে স্কুলে, বাইরে থেকে নকল পাচার করছে ভিতরে।
সুভদ্রর তেমন কোনও কাজ নেই, তাই শীলা বড় দিদিমণিকে গিয়ে বলল—সুভদ্রকে গার্ড দেওয়ার জন্য ডাকুন না। ও তত বেকার বসে আছে। এক-আধজন পুরুষমানুষ থাকলে আমাদের সুবিধে হয়।
বড় দিদিমণি রাজি হলেন, এবং সুভদ্র গার্ড দিতে এল।
পরীক্ষার গার্ড দেওয়া বড় একঘেয়ে কাজ। কেবল ঘুরে বেড়ানো, কাগজ দেওয়া, স্টিচ করা, আর মাঝে মাঝে মৃদু ধমক দেওয়া। সময় কাটে না। কিন্তু সুভদ্র এল বলে চমৎকার কাটছিল সময়টা। যে তিনটে স্কুলে সিট পড়েছিল তার মধ্যে দুটো স্কুলই সুভদ্রর পাড়ার। প্রায় সবকটি মেয়ে ওকে চেনে। পরীক্ষা শুরু হওয়ার তিন দিনের দিন সুভদ্র স্কুলে পা দিতেই চারদিকের মেয়েদের মধ্যে চাপা বিদ্যুৎ খেলে গেল। তারপরই ডাকাডাকি—মিন্টুদা, এদিকে আসুন। মিন্টুদা, কোশ্চেন বুঝতে পারছি না। মিন্টুদা জল খাব। এমনকী বাইরে যে সব ইতর টাইপের ছেলে রোজ এসে জড়ো হয় তারাও হকে নকে এসে সুভদ্রকে ডাকাডাকি করে, গোপনে কথা বলে, খাতির জমানোর চেষ্টা করে। সুভদ্র তাদের তাড়া দিলে চলে যায়।
পাড়ায় যে সুভদ্রর যথেষ্ট প্রতিপত্তি তা বুঝতে কষ্ট হয় না। মেয়েরা পরীক্ষা দিতে দিতেও অনেকে মুখ তুলে সুভদ্রর দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতের হাসি হাসে, ছলে ছলে তাকে ডাকে, অকারণে কথা বলে। শীলার ভিতরটা জ্বালা করে ধিংগী মেয়েদের কাণ্ড দেখে। কী নির্লজ্জ বাবা! কোমরে আঁচলের আড়ালে, ব্লাউজের ফাঁকে সব বইয়ের পাতা, চোথা কাগজ নিয়ে বসেছে। তবু সিকিভাগ মেয়ে লিখতেই পারছে না। কিছুই পড়েনি, কোথা থেকে টুকতে হবে তাও জানে না। কলম কামড়ে বসে থাকে তখনই তাদের কারও কারও সুভদ্রকে বড্ড বেশি দরকার হচ্ছে। মিন্টুদা, ও মিন্টুদা।
অবশেষে শীলা একদিন ঠাট্টা করে বলল—মিন্টুদা, আপনি হল্,-এর বাইরে থাকুন। নইলে বড্ড মিস ম্যানেজমেন্ট হচ্ছে।
সুভদ্র গাঢ় চোখে তাকিয়ে বলে—দোহাই, ওদের একটু লিখতে-টিখতে দিন। ওদের অনেকের একমাত্র ভরসা হায়ার সেকেন্ডারির সার্টিফিকেটখানা। আপনারা কড়া হলে ওদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
শীলার এটা সহ্য হয় না। ডিসিপ্লিন জিনিসটাকে সে বুক দিয়ে ভালবাসে। স্কুলে তারা ভীষণ ডিসিপ্লিন মেনে চলে। ক্লাস ফুরিয়ে গেলেও সবাই সাড়ে চারটে পর্যন্ত স্কুলে থাকে, আগে বেরোয় না। অ্যানুয়েল পরীক্ষার পর যখন ক্লাস থাকে না, তখনও তারা স্কুলে বসে এগারোটা থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত উল বোনে, গল্প করে, তবু আগে চলে যায় না। মেয়েদের ব্যাপারেও তাই। ইউনিফর্ম ঠিক না থাকলে, ক্লাস-ওয়ার্কের খাতা না আনলে, কিংবা এ-রকম সামান্য কোনও ত্রুটি বিচ্যুতি হলে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়।
সুভদ্রর উদার নীতি দেখে তাই শীলা রেগে গিয়ে বলে—আপনাকে ডেকে আনাই ভুল হয়েছিল সুভদ্র।
সেই রাগ থেকেই শীলা একদিন একটা মেয়ের খাতা কেড়ে নিল। বের করে দিল ঘর থেকে। মেয়েটা প্রথমে শীলার সঙ্গে তর্ক করল, তারপর মিন্টুদার খোঁজ করল। সুভদ্র ছিল নীচের তলার ঘরে, তাই তাকে ডেকে না পেয়ে সোজা গিয়ে বাইরের ছেলেদের কাছে নালিশ করল। তারপরই ইস্কুলে ঢিল পড়তে শুরু করে, সেই সঙ্গে শাসানি। মেয়েটার গার্জিয়ান পরিচয় দিয়ে এক বয়স্কা মহিলা দুজন ছোকরাকে নিয়ে এসে শীলাকে ঘিরে কী তম্বী! সেই হাঁকডাক শুনে হেডমিস্ট্রেস উঠে এলেন, অন্য দিদিমণিরাও। কিন্তু মিটমাট করতে পারছেন না। এমন সময় সুভদ্র উঠে এল। শীলাকে সরিয়ে নিজে দাঁড়াল প্রতিপক্ষের মুখোমুখি। দুমিনিটে মিটিয়ে দিল ব্যাপারটা। মেয়েটি ফের এসে বস্ল পরীক্ষা দিতে।
ইস্কুলে একটা ছোট্ট ঘর আছে তিন তলার ল্যাবরেটরির পাশে। তাতে মেয়েদের গান বাজনা শেখার বাদ্যযন্ত্র থাকে, প্রাইমারি সেকশনের অফিস হয় সকালে। সেই ঘরে এসে শীলা টেবিলে মাথা রেখে কাঁদছিল। কী অঝোর কান্না! সেই মেয়েটা বা তার গার্জিয়ানের ওপর ততটা নয়, যতটা রাগ বা অভিমান তার সুভদ্রর ওপর। ও কেন এসে মাঝখানে পড়ল? ওর জন্যই তো নষ্ট হচ্ছে পরীক্ষা, আবহাওয়া দূষিত হয়ে যাচ্ছে।
একা ঘরে কাঁদতে কাঁদতেই টের পেল সুভদ্র এসেছে। ওর লজ্জা সংকোচ কিছু কম, সাহস বড্ড বেশি। পিঠে অনায়াসে হাত রাখল সে, বলল—এ মা, ছি ছি! কাঁদছেন কেন?
শীলা এক ঝাপটায় হাত সরিয়ে দিয়ে ফণা তুলে বলল—আপনি যান। আর ভালমানুষ সাজতে হবে না।
সুভদ্র গেল না। উলটোদিকের চেয়ারে বসল মুখোমুখি। শীলা কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। অভিমানের বান ডেকেছে বুকে। কান্না কি ফুরোয়? টেবিলের ওপর তার পড়ে-থাকা একখানা হাত দুহাতে ধরে সুভদ্র গাঢ় স্বরে বলল—ক্ষমা চাইছি, লক্ষ্মী মেয়ে। কাঁদে না। আপনি বরং আমাকে একটা চড় মারুন, বা যা খুশি করুন। তবু প্লিজ শান্ত হোন। আপনি কেন বুঝতে পারছেন না যে দিনকাল পালটে গেছে! যে কোনও স্কুলে গিয়ে দেখে আসুন, সকলের চোখের সামনে আনফেয়ার মিনসে চলছে। আপনি আমি ঠেকাব কী করে!
শীলা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল। মুখ তুলে বলল—আপনি ঠেকাচ্ছেন না কেন? আপনাকে তো ওরা চেনে, মানে।
সুভদ্র চুপ করে চেয়ে রইল একটু। তারপর চমৎকার দীনতার হাসি হেসে বলে—ওটা আপনার ভুল ধারণা। ওপর ওপর খাতির দেখাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু যদি আমি কড়া হওয়ার চেষ্টা করি সঙ্গে সঙ্গে মস্তানদের ছুরি বেরোবে, বোমা ফাটবে। আপনি তাই চান?
না শীলা তা চায় না। তবু চুপ করে অভিমানভরে বসে রইল। উত্তর দিল না।
সুভদ্র ফের বলে—তা ছাড়া, আমি ওদের প্রতি সিমপ্যাথিটিক। জানি তো আমাদের এডুকেশনটা একটা ফোর্স। সেই প্রহসনের স্বরূপটা এবার লোকে ভাল করে জেনে যাক। দেশ-বিদেশে রটে যাক, এ দেশে শিক্ষার নামে কী চলছে। আপনি বাধা দেবেন না।
শীলা আর বাধা দেয়নি। বরং গার্ড দেওয়ার ছলে ঘুরতে ঘুরতে সুভদ্রর সঙ্গে আড্ডা মেয়েছে করিডোরে, বারান্দায়, তেতলার নির্জন ঘরে। মেয়েরা সুভদ্রকে ডাকলে খুব বিরক্ত হয়েছে। কী এত কথা ওদের সুভদ্রর সঙ্গে! কেবল মিন্টুদা, আর মিন্টুদা!
বলেছে—মেয়েরা আপনাকে অত খোঁজে কেন?
সুভদ্র হাসে, বলে—হিংসে হচ্ছে?
কী অকপট কথা! হিংসে! হিংসেই তো। শীলা তাই লজ্জায় লাল হয়।
সুভদ্র তখন বলে—পাড়ায় সবাই চেনে, তাই ডাকে। জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করে নেয় আর কী, পড়াশুনো তো করে না।
বড্ড বেশি উদার আপনি।
ভীষণ অসভ্য হয়ে গেছে সুভদ্র আজকাল। সাহসও বেড়েছে। প্রশ্রয় পায় তো। তাই দিব্যি চোখ হেনে বলল-কারও উদারতা বাড়ছে, কারও উদর।
শুনে শীলা লুকোবার পথ পায় না। হাতে একটা সাবমিট করা খাতা ছিল, পাকিয়ে হাতে নিয়ে ঘুরছিল, সেইটি দিয়ে ঠাস ঠাস মারে সুভদ্রকে। আর তখন একটা তাৎক্ষণিক আবেগে সুভদ্র একটা কাণ্ড করে ফেলেছিল, স্কুলের মধ্যে। চারদিকে লোকজন। তিনতলার নির্জনতা খুবই ক্ষণভঙ্গুর তখন, যেকোনও সময়ে লোকজন চলে আসতে পারে। তবু দুরন্ত পুরুষটি দু-হাতে খামচে ধরল কাঁধ, বুকের মধ্যে টেনে নিল। শীলা ঢেওয়ের মতো পড়ে গেল বুকের মধ্যে। তারপর তীব্র বিস্ময় অসহ্য একটা ধাঁধার মধ্যে সুভদ্রর জ্বরতপ্ত শুকনো ঠোঁট একপলকের জন্য স্পর্শ করেছিল তার গাল। শীলা পালিয়ে এসেছিল।
পরে দেখা হতে বলেছিল—আপনার সঙ্গে আর মিশব না।
সুভদ্র যথেষ্ট লজ্জিত, ভীত। চোখে আনত দৃষ্টি। খুব ভয় পেয়েছে। শীলা মনে মনে খুশি হল। কিন্তু ওর অত ভয়ের কী? ‘মিশব না’ কথাটা মুখের কথা মাত্র, কি কি ও বোঝে না? শীলার মুখে যে প্রশ্রয়ের হাসি, চোখে যে উজ্জ্বল দৃষ্টি তা কি অন্য কথা বলে না!
সুভদ্র আসে ঠিক দুপুরবেলায়। প্রচণ্ড গরমের দুপুর। বসে থাকে দরজা জানালা বন্ধ- করা শীলাদের ঠান্ডা বৈঠকখানায়। শীলা মুখোমুখি। রাজ্যের আজেবাজে কথা হয় দু-জনের। যা বলে না তা বুঝে নিতে কারও অসুবিধে হয় না।
শীলা জানে, শীলা ওকে ভালবাসে। ভীষণ ভালবাসে। বলে না। দরকার হয় না। সুভদ্র জানে সুভদ্র ওকে ভালবাসে। বলে না। দরকার কী?
অজিত আজকাল বড্ড ব্যস্ত। অফিসে তেমন কাজকর্ম নেই। আজকাল খুব ম্যাজিকের শো করার ডাক পায়। কথা ইংরেজি, হিন্দি আর বাংলায় আজকাল অনর্গল ম্যাজিকের প্যাটার বলে যেতে পারে। ‘শো’ করে স্কুল-কলেজে, ক্লাবে, পাড়ায়। বার দুই খবরের কাগজে ছোট্ট করে তার ম্যাজিকের খবর বেরিয়েছে। সবাই বলে, এবার নিউ এম্পায়ার বা আকাদেমি হল ভাড়া করে নিজের শো করতে। তাতে বড় করে খবর বেরোবে, জাতে উঠে যাবে। অজিতের ইচ্ছে করে না।
ম্যাজিক দেখানোর খবরটা কোন চিঠিতে যেন লক্ষ্মণকে লিখেছিল অজিত।লক্ষ্মণ জাহাকে এক প্যাকিং বাক্স ভরতি ম্যাজিকের জিনিস পাঠিয়েছে। নানারকমের তাস, জাম্বো কার্ড, হরেক অ্যাপারেটাস। সেইসঙ্গে কালো একটা ম্যাজিসিয়ানের স্যুট, টুপি সমেত। কাস্টমস থেকে বাক্সটা চাড়িয়ে এনে গলদঘর্ম হয়ে কদিন জিনিসগুলো নিয়ে ম্যাজিক অভ্যাস করল সে। কিন্তু বড্ড ক্লান্তি লাগে। তার ভাগ্য কেন তাকে ম্যাজিসিয়ান হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কেন? জনতার সামনে দাঁড়িয়ে অবিরল মুখস্ত প্যাটার বলে যেতে যেতে, চোখমুখের নানা মেধাবী ভঙ্গি করে অবিরল ম্যাজিক দেখাতে তার ইচ্ছে করে না। তবু দেখাতে হয়। আজকাল সে ম্যাজিক দেখালে টাকা পায়। গত বছর পর্যন্ত পঞ্চাশ-ষাট টাকা পেত একটা ‘শো’য়ে। এ-বছর দুশো তিনশো টাকা না চাইতেই অগ্রিম দিয়ে যায় তোক। এও একটা ঝামেলা। টাকা দিলে ফেরানো যায় না। নিতে হয়। টাকার প্রয়োজন তো ফুরোয় না কখনও। কিন্তু ওই টাকাটাই তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে ম্যাজিকের সঙ্গে। কিন্তু জীবনের কোথাও কোনও ম্যাজিক নেই, রহস্য নেই। সব রহস্য যেন তার জানা হয়ে গেছে। তাই বিস্বাদ।
॥ বাহান্ন ॥
কুমুদ বোস একদিন বলেছিল—ম্যাজিসিয়ান, তুমি শালা কী আর ম্যাজিক জানো? কুমারস্বামীর কাছে নিয়ে যাব তোমাকে একদিন, ব্যোমকে যাবে। তার হাতের পাঁচ আঙুলে গ্রহ-তারা নড়েচড়ে।
অজিত আগ্রহ বোধ করে না। কুমারস্বামীর কথা সে আগেও শুনেছে। অফিসের অনেকেই তার কাছে যায়। সেনদা এম এসসি পাশ, সায়েন্স কলেজে রিসার্চ করত, সেও একদিন এসে বলেছিল—ওরকম সিদ্ধপুরুষ দেখিনি। মিনিস্টার, বড় বড় মার্চেন্ট, ফিলমের লোকজন সব মাছির মতো জমে আছে। আমি ঘরে ঢুকতেই নাম ধরে ডেকে বলল— এতদিনে আসার সময় পেলি?
অজির হেসেছে। ভারতবর্ষে সিদ্ধপুরুষদের সংখ্যা ইদানীং খুব বেড়ে গেছে। তাদের গ্ল্যামার এখন সবয়েচে বেশি। তাদের কেউ ভোটে যদি দাঁড়ায় তো পি-এম পর্যন্ত হেরে যাবে। অবশ্য ভোটে দাঁড়ানোর দরকার হয় না, ভোটে জিতলে যা পাওয়া যায় তারা তার একশো গুণ পেয়ে যাচ্ছে ভক্তদের কাছ থেকে। টাকা, যশ, ভক্তি। এদের রবরবা যত বাড়ছে তত বোঝা যাচ্ছে যে জাতটার মেরুদণ্ড কত নমনীয়, ভঙ্গুর। জনসাধারণের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন চোর, একজন ফাঁকিবাজ, তৃতীয়জন মস্তান। শতকরা হিসেব করলে পুরো একজনকেও পাওয়া যাবে না যে সৎ এবং চরিত্রবান। এই সব লোভী, স্বার্থপর, হৃদয়হীন মানুষদের সব সময়ে বিবেক পরিষ্কার রাখার জন্য সিদ্ধপুরুষরূপী একটা খুঁটির দরকার হয়। সেইখানে নিজেকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে ইচ্ছেমত চরে বেড়ায়। যে যতবড় ম্যাজিকওয়ালা সে তত বড় মহাপুরুষ। ম্যাজিক না দেখালে লোকের ভক্তি টসকে যায়।
এইসব কথা অজিত যখন বলে তখন কুমুদ বোস ভারী চটে যায়। সে একসময়ে গোবরবাবুর কাছে নাড়া বেঁধে কুস্তি শিখেছিল। হাতের গুলি দেখানোর জন্য হাফহাতা জামার হাতাও অনেকখানি গুটিয়ে তুলে রাখে। প্রকাণ্ড স্তম্ভের মতো হাত দু-খানা টেবিলের ওপর প্রদর্শনীর জন্য রেখে বলে—পাপ কথা মুখে আনবে তো ঝাপড় মারব। পি সি সরকারেরও একজন ধর্মীয় গুরু ছিলেন, সেটা জানো?
অজিত মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলে—বোসদা, কটা কথা খুব ধীরস্থির ভাবে জেনে রাখুন। একনম্বর, ভগবান বলে কোথাও কিছু নেই। দু-নম্বর, একবার মরলে আর কেউ জন্মায় না। তিন নম্বর, ধর্ম হচ্ছে ব্ল্যাক মার্কেটিং, ভেজাল ঘুষ এসবের মতোই আর একটা জোচ্চুরি।
—আর, তুমি যে পলিটিক্স করতে সেটা জোচ্চুরি নয়? তুমি যে ম্যাজিক করো, সেটা জোচ্চুরি নয়?
অজিত একটুও উত্তেজিত না হয়ে বলে—বটেই তো, পলিটিক্স যে জোচ্চুরি তা সবাই জানে। তবু করতাম কেন জানেন? জোচ্চোরদের সঙ্গে লড়বার জন্য ওটাই সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্র। আর আপনারা জানেনই না যে জোচ্চোরদের পাল্লায় পড়ে যাচ্ছেন। তফাতটা এখানেই। আমি যে ম্যাজিক করি, সেটাও একরকম লোক ঠকানো জোচ্চুরিই। লোকে জেনেশুনেও পয়সা খরচ করে দেখতে আসে। সে তবু ভাল। আমি তো ম্যাজিক দেখানোর সময়ে বলেই দিই যে ম্যাজিকে মন্ত্র-টন্ত্র কিছু নেই, সবই হাত সাফাই। আপনার কুমারস্বামীর সে কথা বলার সাহস আছে?
কুমুদ বোসের চেহারাটা যেমন, বুদ্ধিটা তেমন নয়। তর্কে ঠিক যুৎ করতে পারে না সে। মাথা গরম করে চেঁচামিচি শুরু করে দেয়। তখন সবাই বলে—অজিতের সঙ্গে তুমি পারবে কেন বোসদা? ইউনিয়ন করে করে ও তর্কে পাকা হয়ে গেছে। তার ওপর বারেন্দ্র। ওদের মহা কূটবুদ্ধি।
অজিত টের পাচ্ছিল সে যত তর্কই করুক, ইদানীং কুমারস্বামীর একটা হাওয়া বইছে অফিসে। দুজন চারজন করে কুমারস্বামীর ভক্ত বাড়ছে। যারা সাতদিন আগেও ঠোঁট বেঁকিয়েছে তারা আজ গুজ গুজ ফুস ফুস করে কুমারস্বামীর মিরাকলের গল্প করছে। দু-চারজন তাকেও এসে ভজাবার চেষ্টা করে। খুবই ঠান্ডা চোখে তাকায় অজিত, ঠান্ডা গলায় কথা বলে। তারা সরে পড়ে।
শীলার বন্ধু সুভদ্র নামে সেই ছেলেটা দু-চারবার অফিসে এসে দেখা করে গেছে। বার দুই এসেছিল কমিশনের জন্য। তারপর একদিন এসে বলে—অজিতদা, আপনার তো অনেক জানাশুনো। আমাকে একটা অফিস বা স্কুল-কলেজ যাহোক স্যালারি সেভিংস ধরিয়ে দিন। সিংগল পলিসি করিয়ে লাভ হয় না।
ছেলেটার চেহারাটা এত সুন্দর যে চট করে মায়া বসে যায়। অজিত তাই ছেলেটাকে এড়িয়ে যায়নি। সেনদা একটা স্কুলের সেক্রেটারি, তাকে ধরে স্যালারি সেভিংস করিয়েও দিয়েছে। ওই সূত্রেই ছেলেটার সঙ্গে কিছু ঘনিষ্ঠতা। সুভদ্র কার্ল মার্কস-এর ভক্ত, অজিতও তাই। খানিকটা প্রশ্রয় অজিত তাকে দেয়। অফিস থেকে ফিরে কখনও-সখনও দেখে সুভদ্র বাইরের ঘরে বসে আছে, খুশি হয়েছে অজিত। ছেলেটাকে তার ভাল লাগে।
আবার এও ঠিক তার মনের মধ্যে একটা কাঁটা মাঝেমধ্যে খচ করে বেঁধে। ছেলেটাকে বড্ড বেশি পছন্দ করে শীলা। নইলে সুভদ্র যেদিন আসে সেদিন শীলার একটু সাজগোজ কেন? খুব বেশি কিছু নয়, তবু অজিত ঠিকই লক্ষ করে, শীলার মুখে হালকা ফাউন্ডেশন মেক-আপ লাগানো, ঠোঁটে পিলস্টিকের বিলীনপ্রায় রং পরনে একটু বেশি নির্লজ্জ ব্লাউজ, শাড়িটা সাধারণ হলেও পাটভাঙা, চুল এলো খোঁপায় বাঁধা, চোখে কাজল। সুভদ্রর সামনে ও একটু বেশি বড় বড় করে তাকায়, একটু বেশি ধীরে চলাফেরা করে, একটু বেশি সুরেলা গলায় কথায় বলে। এগুলো টের পাওয়া যায়। শীলা ওই সময়টায় আটপৌরে থাকে না।
সন্দেহটা প্রথমে মাঝেমধ্যে উঁকি মারত, তারপর নানা ভাবনা চিন্তা, কাজকর্ম আর ম্যাজিকের দমকা হাওয়ায় উড়ে যেত মন থেকে। কিন্তু ওই একফোঁটা বিষ—ও কখনও ফিকে হয় না। দিনে দিনে ঘনীভূত গাঢ় হয়ে ওঠে, ছড়ায়। একদিন নয়, বেশ কয়েকবারই অজিত অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছে। কিছু তেমন দেখতে পায়নি। প্রতিদিনই যে সুভদ্র ছিল, তাও নয়। দুদিন ছিল, কিন্তু ওরা দুজন দুদিকে বসে গল্প করছিল মাত্র। বেশ কয়েকবার অফিস কামাই করেও লক্ষ্য করেছে অজিত। মাঝে মাঝে আসে সুভদ্র। রোজ নয়।
একদিন শীলাকে বলল—ও এসে ওরকম শিস দেয় কেন বাইরে থেকে?
শীলাও বিরক্ত হয়ে বলেছে—দেখ না। ওইরকমই স্বভাব। কতবার বারণ করেছি, শোনে না।
শিস দিয়ে ডাকে। খুব সরলভাবে হাসে। চমৎকার কথা বলে। আর ওই সুন্দর চেহারা, যা দেখলে পুরুষেরও বুকে মায়া জন্মায়! ভাবতেই গায়ে একটা শিরশিরানি ওঠে অজিতের। বুকে ভয়। আর একটা কূট তীব্র সন্দেহ মাঝে মাঝে সাপের দাঁদের মতো ঝিকিয়ে ওঠে বিষভরা। শীলার পেটে যে বাচ্চাটা….!
একদিন বলল—সেনদা, আপনি তো বায়োলজিক্যাল সায়েন্স পড়েছিলেন, না?
সেনদা মাথা নেড়ে বলেন—পড়েছিলাম। সেসব কিছু মনে নেই।
—হেরিডিটি ব্যাপারটা কী বলুন তো!
সেনদা হেসে বলেন—তোমার কার্ল মার্কস কী বলেন? হেরিডিটি কি তোমরা তেমন মানো?
অজিত চিন্তান্বিত মুখে বলে—মার্কস অবৈজ্ঞানিক ছিলেন না। যা মানা যুক্তিসঙ্গত তা মানতেন।
কুমারস্বামীর ব্যাপার থেকে সেনদা অজিতের ওপর একটু চটা। মাঝে মাঝে মার্কসকে খুঁচিয়ে কথা বলেন। কিন্তু অফিসের অন্য সকলের মতোই সেনদাও মার্কস-বিষয়ে কিছুই জানেন না, কথা বললেই বোঝা যায়। শুনে শুনে সবাই মার্কসিজম বা কমিউনিজিম সম্পর্কে এক একটা মনগড়া ধারণা সৃষ্টি করে নিয়েছে। সেই ধারণা থেকেই তর্ক করতে আসে, আর হেরে যায়।
সেনদা একটু বুদ্ধি রাখেন, তর্কে না গিয়ে বললেন—তুমি কী জানতে চাও?
—ছেলে বাপের কাছ থেকে কী কী পায়। রক্ত? স্বভাব? সংস্কার?
সেনদা হেসে বলেন—সেই হেরিডিটি আর এনভিরনমেন্টের প্রশ্ন তুলবে নাকি? তা হলে একটা কথা বলে নিই। সেদিন রিডার্স ডাইজেস্টে একটা হিউমার পড়ছিলাম, একজন বলছে—হেরিডিটি আর এনভিরনমেন্ট বিচার করা খুব সোজা। তোমার সন্তানের মুখে যদি তোমার আদল থাকে তবে সেটা হল হেরিডিটি, আর যদি তোমার সন্তানের মুখে তোমার প্রতিবেশীদের কারও আদল থাকে তবে তা হল এনভিরনমেন্ট।
কথাটা শুনেই অজিদ কেমনধারা হয়ে গেল। হাসির কথা, তবু সে হাসলও না তেমন। খুব অন্যমনস্ক আর অস্থির লাগছিল তার। সেনদা কিছু জেনে বলেনি, তবু তার মনের কোন গুপ্ত গভীরে ঠিক এইরকমই একটা প্রশ্ন ছিল। শীলার পেটের বাচ্চাটা…।
কোনওকালে কোথাও বেড়াতে-টেড়াতে যায় না অজিত। হঠাৎ এক রবিবারে একা বেরিয়ে পড়ল। বহুদূর পর্যন্ত একা একা ঘুরল সাবারবান ট্রেনে উঠে, বাসে, হেঁটে। মনটা বড় অস্থির। ঘুরে ঘুরে সে অনেক ভাবল। আর ভাবতে ভাবতে হঠাৎ টের পেল, পৃথিবীতে লক্ষণ ছাড়া তার আর একটাও আপনার জন নেই। এমন একটা লোক নেই তার নিজস্ব যার কাছে মনের সব দুঃখ বেদনার কথা, সব সন্দেহ ক্ষোভ আর হতাশার বীভৎস চেহারাটা খুলে দেখানো যায়। এই চল্লিশ বছর ধরে প্রতিদিন সে কত মানুষের সঙ্গে মিশেছে, কত ঝগড়া ভালবাসা হয়েছে, তবু কেউ লক্ষ্মণের মতো আপন হল না, ওই যে শীলা, যার দেহের আনাচকানাচ পর্যন্ত তার মুখস্ত হয়ে গেছে, যার আলজিবের স্বাদটি পর্যন্ত তার জানা, তাকেও কত কথা গোপন করে চলতে হয়। পৃথিবীতে এখন এমন একজন মানুষকে তার চাই যে তার হৃদয় থেকে ওই সব বিষ হরণ করে নেবে। তাকে শুদ্ধ করবে। লক্ষ্মণ ছাড়া আর কে আছে? কিন্তু লক্ষ্মণ কত দূরে! কত ভীষণ দূরে। সে যেন মৃত্যু নদীর পরপার এক বিদেশ। কবে আসবি লক্ষ্মণ?
লক্ষ্মণের শেষ চিঠিটা এসেছে নিউইয়র্ক থেকে। খুব বেশি কিছু লেখা নেই। তবু একটা খুব জরুরি খবর লুকিয়ে আছে চিঠিটায়। লক্ষ্মণ নিউইয়র্কে একটা পেল্লায় ভাল চাকরি পেয়েছে, কানাডায় আর ফিরবে না। কিন্তু ওর বউ কানাডায় ফিরে গেছে, সে নাকি নিউইয়র্ক সহ্য করতে পারেনি। এটাই সবচেয়ে জরুরি খবর। এমন নয় যে ওর বউ ছেড়ে গেছে চিরদিনের মতো, কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। তবু অজিতের প্রাণে একটা সুবাতাস লাগে। যদি তাই হয় তবে কি আবার দেশে ফেরার কথা মনে পড়বে লক্ষ্মণের? অজিতের কথা মনে পড়বে?
চিঠিটা সারাদিনে কতবার পড়ল অজিত! ছোট চিঠিটায় কত রহস্যময় সংকেত রয়েছে যেন। দুর্গ্রহগুলো সরে যাচ্ছে আকাশ থেকে, শুভগ্রহেরা সন্নিবেশিত হচ্ছে অজিতের ভাগ্যে। লক্ষ্মণ কি আসবে? চমকে ওঠে অজিত। সে তো ভাগ্য মানে না। তবু কি মানুষের সুসময়, দুঃসময় বলে কিছু নেই!
লক্ষ্মণের কথা ভাবতে ভাবতে শীলা আর সুভদ্রর কথা প্রায় ভুলেই গেল সে। কয়েকটা দিন লক্ষ্মণই রইল মন জুড়ে। খুব সুন্দর দীর্ঘ একটা চিঠি লিখল সে লক্ষ্মণকে। লিখল…মেয়েমানুষদের কাছ থেকে আমরা কী চাই বলো তো! কিছু ঠিক পাই না। আমরা ভাবি, বউ বুঝি আমার নিজস্ব মেয়েমানুষ। কিন্তু তাই কি কখনও হয়? আমি এক খণ্ডিত মানুষ। ও-ও এক খণ্ডিত মেয়ে। আমাদের ভাঙা অংশগুলো যদি ঠিক ঠিক জোড় না মেলে তবে? আমি ওকে সব দিতে পারি না, ও-ও পারে না। কী করে তবে এক হই বলো তো!
গুছিয়ে লিখতে পারল না। কিন্তু আবেগ দিয়ে লিখল। অনেকটা। লিখে একরকমের স্বস্তি পেল।
তবু একধরনের অবিশ্বস্ততার ওপরে তার গড়া সংসার এখন দাঁড়িয়ে আছে। যে সন্তান আসছে মায়ের কোল জুড়ে—সেই বা কে? এই কঠিন ক্রুর প্রশ্নের কোনওদিন সঠিক উত্তর হয় না। তাই অজিত বড় অস্থির। কেবলই সিগারেট খায়। ঘুরে বেড়ায়। অফিসের পর অনেকক্ষণ বসে তাস খেলে, কাজ করে, রাত দশটার আগে বাড়ি ফেরে না। খাওয়া কমে গেছে। ঘুম কমে গেছে। যতটুকু সময় বাড়িতে থাকে ততক্ষণ অবিরল ম্যাজিকের পর ম্যাজিক দেখায় একা-একা, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে—সোরসারার ওঃ সোরসারার ইউ আর নট গড। তারপর মাথা নেড়ে বলে—আমার ওপর নেই ভুবনের ভার…। এক প্যাকেট তাস খুলে সে নিজেকে দেখায়, বাহান্নখানা তাস রয়েছে, পলকে সেই তাসটাই আবার উলটোবাগে মেলে ধরে দেখায় বাহান্নখানা তাসই এক, হরতনের বিবি। বিদেশি ম্যাজিক কার্ড। লক্ষ্মণ পাঠিয়েছে।
অজিতকে আজকাল বড় ভয় পায় শীলা। খুব নরম গলায় কথা বলে, খুব ভদ্র ব্যবহার করে। যেন অতিথি সজ্জন কেউ। মাঝে মাঝে বলে—তোমার কী হয়েছে বলো তো!
—কী হবে! অফিসে বড্ড কাজের চাপ।
—শরীর ভাল আছে তো?
—ভালই।
শীলা আর বেশি কথা বাড়ায় না। তাদের সম্পর্ক এইরকমই। কখনও আদরে সোহাগে উজ্জ্বল, উচ্ছল। কখনও বা তারা পরস্পর প্রায় অপরিচিত। নিস্পৃহ।
—ম্যাজিসিয়ান, চলো একবার কুমারস্বামীর কাছে তোমাকে নিয়ে যাব। কুমুদ বোস একদিন বলল।
অজিত খুব অন্যমনস্ক মুখ তুলে হঠাৎ হেসে বলল—যাব। আজই চলুন। বলেই উঠে পড়ল।
॥ তিপ্পান্ন ॥
ঘর-সংসারের যে ছবিটা হারিয়ে গিয়েছিল সেটাই কি ফিরে পেলেন ব্রজগোপাল!
গেঁয়ো ছুতোরের তৈরি দুটো ভারী চৌকি ঘরে এনে ফেলেছে বহেরু। তোশক, মশারি, চাদর, বালিশ, সবই জোগাড় করে এনেছে। ফাঁকা ঘরটা সংসারের সামগ্রীতে ঠাসাঠাসি। ব্রজগোপাল দেখেন।
ননীবালা বলেন—একটা দুটো দিনের জন্য এত ঝামেলা করছিস কেন বহেরু? মাটিতে খড়ের গদি পেতে দিবি শোওয়া যায়।
বহেরু চোখ কপালে তুলে বলে—একটা-দুটো দিন কি বলেন মা! তেরাত্তির কম সে কম থেকে যেতে হবে। কর্তামশাই একাবোকা পড়ে থাকেন, ওইভাবে জীবনটা কেটে গেল। এসে যখন পড়েছেন মা দুর্গা, একটু সব সিজিল মিছিল করে দিয়ে যান। ওঁর দেখবার কেউ নেই, আমাদের ছোঁয়া জলটুকু পর্যন্ত খান না। রোগেভোগে বড় মুশকিল।
ননীবালা উত্তর করেন না। এ লোককে কে দেখবে! কার দেখার তোয়াক্কা করেছে লোকটা?
হা ক্লান্ত ব্রজগোপাল পুকুর থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে আহ্নিক সেরে নিয়েছেন। শুদ্ধবস্ত্রটা ছাড়ছেন এমন সময় মাথায় আধ-ঘোমটা দিয়ে ননীবালা পাথরের বাটিতে কাটা পেঁপে সাজিয়ে আনলেন।
—খাও।
—এই কি খাওয়ার সময়!
—তবে কখন খাবে?
—এ সময়ে খাই না, একেবারে রাতে খই দুধ খাব।
ননীবালা একটা শ্বাস ফেললেন, বহুকাল ঘর করেননি, তাই লোকটার অভ্যাস-টভ্যাসগুলো জানা নেই। বললেন—না খেয়ে-খেয়ে শরীরটা যাচ্ছে।
—খেয়েই যায়। একটা বয়সের পর খাওয়ার সংযম ভাল।
—আমার হাতে রান্না খাবে তো! নাকি ছোঁয়া বারণ আছে?
উদাসভাবে ব্রজগোপাল বলেন—খাওয়া যায়।
রণেন ঘুম থেকে উঠল সন্ধ্যা পার করে। এখানে ফ্যান নেই, ঘরটাতেও বেশ গুমোট, তবু বহুকাল বাদে রণেন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে। বড় এক শিশুর মতো ঘুম-চোখে উঠে বাবার দিকে চেয়ে রইল একটু। চোখ কচলে ফের দেখে একগাল হেসে বলল-বাবা!
ব্রজগোপাল উঠে এলেন কাছে। পিঠে হাতখানা রেখে বললেন—শরীরটা কেমন লাগে বাবা? ভাল?
রণেন মাথা নেড়ে বলে—ভাল।
—তুমি বড় ভাল ছেলে বাবা। সংসার তোমাকে নষ্ট করছে।
রণেন চেয়ে থাকে বাবার দিকে। চোখে এখনও অবোধ ভাব। বলে-বাবা, এবার আমাদের কাছে চলুন।
ব্রজগোপাল একটু বিষন্ন হেসে বললেন—কেন, তোমরা কি সেখানে খুব সুখে আছো?
রণেন কথাটা হয়তো বুঝতে পারে না। হয়তো পারে, বলে—আপনাকে কে দেখবে এখানে?
ব্রজগোপাল শ্বাস ফেলে বলেন—বাপকুসোনা, আমাকে দেখার জন্য তো লেকের দরকার নেই, বরং তোমাদেরই দেখাশোনা করার মানুষ চাই।
অনেকদিন বাদে রণেন বুদ্ধি খাটিয়ে একটা কথা বলতে পারল। বলল—সেইজন্যই তো আপনি যাবেন। আপনি না দেখলে কে দেখবে আমাদের?
ব্রজগোপাল একটু হাসলেন, বললেন—আমার ভালমন্দের বুঝ কি তোমাদের বুঝের সঙ্গে মেলে? দুদিন পর যখন মিলবে না, তখন আবার সম্পর্ক নষ্ট হবে। এই বেশ আছি। আমাকে বাবা ডাকার লোক আছে, এইটুকু জেনেই সন্তুষ্ট আছি।
—যাবেন না? করুণস্বরে রণেন জিজ্ঞেস করে।
—দূরে তো থাকি না। একদৌড়ের রাস্তা। যখনই মুশকিলে পড়বে তখনই চলে আসবে আমার কাছে। আমিও তো যাই মাঝে মাঝে।
দুঃখিত চিত্তে রণেন ঝুম হয়ে বসে রইল। ননীবালা বাইরে গেছেন। রণেন হঠাৎ জলভরা চোখ তুলে বলে—বাবা, সংসারে শান্তি নেই।
ব্রজগোপাল কথাটা আগেও শুনেছেন। একটু দৃঢ়স্বরে বললেন—শোনো। যেমন একটা সিঁড়ি, তা বেয়ে ওঠাও যায়, নামাও যায়, সংসারও তেমনি। তোমার বউ খারাপ তুমি ভাল, একথা আমার মনে হয় না। আসলে তোমরা দুজনেই ভালমন্দের মানুষ। জোড়টা ঠিক মেলেনি, তাই অশান্তি। হিসেব করলে আমিও সংসারকে শান্তি দিতে পারিনি, তাই পালিয়ে আছি। লোকে হাসে। তোমারও সংসার টানতে কত কষ্ট হয়েছে। অশান্তি আছে তো আছে, তুমি মনটা অন্যদিকে পেলে রাখো।
একদিন গায়ে হাত তুলেছিলাম বাবা।
ব্রজগোপাল তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে স্নিগ্ধস্বরে বলেন—ও আর কোরো না। বলে গলাটা একটু নামিয়ে ব্রজগোপাল বলেন—আজকালকার মেয়েরা স্বামীকে পুরোপুরি একলা-একলি চায়, বুঝলে। স্বামীটা যে সংসার বা সমাজের একজন তা হিসেব করে না। কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। স্বার্থপরতার যুগ তো, নিজের বুঝ বুঝে নিতে চায়। তুমি ওরকম ভাবটা হয়ো না বাপকু। বউয়ের গালে ঠোনা মেরে আদর দেখাবে, তলে তলে নিজের কাজ সারবে। হাত পা চালালেই কি পুরুষসিংহ হওয়া যায় বাবা! বরং ওতে মেয়েমানুষ আরও বেহাত হয়ে যায়।
খানিক চুপ করে থেকে বলেন—বাবা যেতেন বিদেশে। সারাটা বছরই প্রায় বাইরে বাইরে কাটত। মা শতখানটা হয়ে সংসার চালাতেন। এখনকার মতো সব ক্ষুদে সংসার তো নয়। বিশ ত্রিশ পাত পড়ত এক-এক বেলায়। বলতেন, বিয়ে হয়ে এসে যেন সংসার সমুদ্রে পড়ে গেলাম। পরের ঘরের মেয়ে, তাকে তো কেউ ছেড়ে কথা কইবে না। মা দেখলেন, বেশ প্রতিকূল অবস্থা। কিন্তু হাল ছাড়বার পাত্রী ছিলেন না। কোমর বেঁধে সবাইকে খুশি করতে লেগে গেলেন। শ্বশুর কেমন রান্না ভালবাসে, ভাসুরের কোনটা পছন্দ, দেওরদের কোনদিকে ঝোঁক। এই করতে করতে নামডাক ছড়িয়ে পড়ল। ঝগড়া করে নয়, লোকের প্রীতি অর্জন করে করে বছর খানেকের মধ্যে দেখা গেল সেজ-বউ না হলে কারও চলে না। তিনদিন বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতে পারেন না, শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক গিয়ে হাজির হয়। নিজেও পারতেন না থাকতে। এইভাবেই দুবছরের মাথায় শাশুড়িকে পর্যন্ত বশ করে ফেললেন। বড় জায়েদের চপকে সংসারের কর্ত্রী হয়ে গেলেন। তখন বাবা বিদেশে থাকতে মার দেখেছি সব সময়ে সেই মানুষের চিন্তা। আমরা মায়ের মুখেই বাবার কথা শুনে শুনে মানুষটাকে চিনেছিলাম। তাঁর স্বভাব, চরিত্র, পরোপকারিতা সব। বাবা রাগী মানুষ ছিলেন, রাগটাগ করতেন বটে কিন্তু মা রা কাটতেন না। বাবাকে ঘিরে তিনি সম্মোহিত থাকতেন বেশ। সেই বাবাও মায়ের প্রশংসা করে বেড়াতেন পাঁচজনের কাছে। আমাদের শরীর স্বাস্থ্য এ সবের জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হয়নি কখনও। মা কতগুলো নিয়ম আমাদের মন-সই করে দিয়েছিলেন। নাকে, মুখে হাত দিলে হাত ধোয়া, হাত পা না ধুয়ে ঘরে না-ঢোকা, পরিষ্কার থাকা—এমনি অনেক। আজও মেনে চলি। অসুখবিসুখ হলে মা গিয়ে পাতাটাতা বেটে ওষুধ করে দিতেন। ছেলেপুলেদের জন্য সজাগ থেকে থেকে তাঁর স্বাভাবিক জ্ঞান অনেক বেড়ে যায়। পরে দেখেছি, তাঁর কাছে ওষুধ নিতে পাড়ার বউ-ঝিরা এসে ভিড় করে। এক কাজ করতেন সারাদিন, তবু কখনও তাঁকে অপরিচ্ছন্ন দেখিনি, মাথার ঘোমটাটি পর্যন্ত খসত না। আর কী করে যে একা হাতে অত কাজ করতেন সে এক রহস্য। আর সব কিছুর মধ্যেও তাঁর ছিল বাবার চিন্তা। একটা দোলন-চাঁপা গাছ বাবা রুয়ে গিয়েছিলেন, সারা বছর সেটাতে জল দিতেন মা, আর প্রতিদিন তাতে জল দিতে গিয়ে তাঁর একটা ফুস করে শ্বাস বেরিয়ে পড়ত। বুঝলে বাবা, সেই মাকে দেখে আমি মেয়েমানুষ চিনেছি। তাই আমার সহজে মন ভরে না। কিন্তু মেয়েমানুষ দেখলে আজও মাথাটা নুয়ে পড়ে। মনটা ‘মা’ বলে ডেকে ওঠে। মায়ের কথা শুরু করলে আর থামতে ইচ্ছে করে না। রেলগাড়ির মতো কেবল কথা বেরিয়ে আসতে থাকে গলার নল বেয়ে।
ব্রজগোপাল সামনের দিকে চেয়েছিলেন, সেখানে একটা তাজমহলের ছবিঅলা বাংলা ক্যালেন্ডার। কিন্তু সেই ক্যালেন্ডার ভেদ করে বহু দূরে মগ্ন হয়ে আছে চোখ। বললেন—বাবা, পৃথিবীজোড়া ভিড় দেখছ, কিন্তু লক্ষ করে দেখো মানুষ কত কমে গেছে। কাজের মানুষ, চরিত্রবান মানুষ, ব্রাহ্মী মানুষ আর চোখে পড়ে না। স্ত্রীর ভিতর দিয়ে স্বামীই প্রসূত হয়, তাই স্ত্রীকে বলে জায়া। স্ত্রী সন্তানকে মেপে দেয়। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর টান ও গুণগ্রহণমুখরতা যতটা এবং যেমন, ততটুকু ও তেমনই সে পারে সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত করতে। এটাই হচ্ছে পরিমাপ। তেমন বিয়েও হয় না, তেমন ভালবাসাও দেখি না। তাই ‘শ্রদ্ধাহীন’ প্রবৃত্তিপরায়ণ, ক্ষীণ মস্তিষ্ক আর প্রতিভাহীন মানুষে দেশ ছেয়ে যাচ্ছে।
ননীবালা চা করে নিয়ে এলেন। রণেনকে দিলেন, ব্রজগোপালকেও।
ব্রজগোপাল একটু ইতস্তত করছিলেন দেখে ননীবালা বলেন—চা খাও না?
ব্রজগোপাল হঠাৎ উদার হাসি হেসে বলেন—দাও, করেছ যখন।
দরজার কাছে কোকা এসে দাঁড়িয়ে আছে। বলল—দাদাবাবু, বেড়াতে যাবেন না?
রণেন মাথা নাড়ল—যাব।
—চলেন। খালপাড় থেকে ঘুরে আসি।
কোকার সঙ্গে রণেন বেরিয়ে গেলে ব্রজগোপাল আর ননীবালা একা হলেন বহুকাল এ-রকম একা ঘরে দুজনের দেখা হয়নি।
বাতিটা একটু কমিয়ে ননীবালা চৌকির একধারে বসে আছেন। ব্রজগোপাল এখনও অন্যমনস্কভাবে চেয়ে আছেন সুমুখে। বেড়াল ঢুকে রণেনের এঁটো কাপটা চেটে পায়ের ধাক্কায় টং করে ফেলে দিয়ে গেল। শব্দটা কেউ খেয়াল করলেন না।
ব্রজগোপাল জিজ্ঞেস করলেন—হঠাৎ সব আসা হল কেন? জমিজমা সব বিক্রি করে দিতে নাকি! না ধানের দায় বুঝতে!
—তোমার তো ওসবই মনে হবে। আমি স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বুঝি না নাকি!
ব্রজগোপাল ক্ষণেক চুপ করে থেকে বলন—সেও খারাপ কথা নয়, কেউ যদি তোমরা না-ই আসতে পারো তো বরং বিক্রি করে দেওয়া ভাল। আমি আর কদিন। বিক্রি করতে চাইলে বহেরুই কিনে নেবে।
ননীবালা ঘোমটাটা তুলে দিয়ে হাতপাখা নাড়তে নাড়তে বলেন—সে সব ভাবনা ছিল না।রণো তোমার জন্য হঠাৎ অস্থির হল। কী সব কু স্বপ্ন দেখেছিল, মুখে আনা যায় না। একবার চোখের দেখা দেখতে আসা।
—ভাল। ব্রজগোপাল বললেন।
—শরীর তো ভাল দেখছি না।
শরীর তো পুষে রাখার জিনিস নয়, কাজে লাগাতে হয়। সব সময়ে তেল চুকচুকে কি রাখা যায়?
—কাজ তো জানি। পরের গোয়ালে ধোঁয়া দিয়ে বেড়ানো।
—সেইটেই আসল কাজ। নিজের গোয়াল যদি না থেকে। ধোঁয়া তো দিতে হবে।
ননীবালা এই চুরি ছিনতাইয়ের দিনেও মোটা বালা পরেন, ছগাছা করে চুড়ি রয়েছে হাতে, গলায় একটা বিছে হার। গয়নাগাটির একটু শব্দ হল, শাড়ির মাড় খস খস করল, শ্বাসপ্রশ্বাসের একটু টান শোনা গেল। অর্থাৎ ননীবালা আছেন। এই অস্তিত্বটুকু কতকাল টের পাননি ব্রজগোপাল।
অন্ধকারে একবার ঠাহর করে ননীবালাকে দেখে ব্রজগোপাল বললেন—ছেলেরা সব কে কেমন?
—তোমারই ছেলে।
—বনিবনা করে থাকতে পারবে?
—কে! আমি, না ছেলেরা?-সকলের কথাই জিজ্ঞেস করি।
—আমার আর থাকার কী! বাড়িটা তুলতে যদি পারি তো দুভাগে ভাগ করে দিয়ে যাব, দুই ছেলে থাকবে।
—ভাগাভাগির কথা আগেভাগেই ভেবে রেখেছ?
—সেইটেই তো বুদ্ধির কাজ। বলে ননীবালা উঠে পিক ফেলে এলেন বাইরে। বললেন—আগে থেকেই ভাগাভাগি করে দেওয়া ভাল।
ব্রজগোপাল বললেন—তার মানে, তোমার ছেলেরা মানুষ হয়নি।
ননীবালা পুত্রগতপ্রাণ। এ কথার একটা কড়া উত্তর দিতেন। কিন্তু এমন সময়ে নয়নতারা বাইরে দরজার কাছে এসে ডাকল৷ ভারী মিষ্টি ডাকটি—মা!
—কী রে? ননীবালা উঠলেন।
—বাবা মাছ পাঠিয়ে দিল। রান্নাঘরে রেখে যাব?
—দেখি। ননীবালা বাতিটা তুলে নিয়ে গিয়ে দেখেন—ওমা! এ কত মাছ রে! এত খাবে কে?
—এই তো কখানা।
—তোদের বাপু বড্ড গেঁয়ো ভাব। বলেন ননীবালা। তবু খুশি ঝরে পড়ে গলায়। কলকাতার বাড়িতে আজকাল আর বড় মাছের টুকরো আসে না। রণেনটা বড় মাছ ভালবাসে। কিন্তু সোমেন নয়। সে কেবল মুরগি মুরগি করে পাগল। বললেন—রান্নাঘরে রাখো। আসছি।
ননীবালা ঘরে আলোটা রেখে চলে গেলেন রান্নাঘরে। রান্নাঘরই আজকাল ভাল লাগে তাঁর। সেখানে বসে নয়নতারাকে ডেকে বললেন—তুইও বসে থাক না, কথা বলি। তোর স্বামীটা নাকি আবার বিয়ে করেছে শুনলাম!….
ঘরে বসে ব্রজগোপাল সেই কথার শব্দ শোনেন। অদ্ভুত লাগে। ননীবালা পাশের রান্নাঘরে বসে কথা বলছেন, এ যেন ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। এ কি সম্ভব? এ কি হয়?
রাত্রিবেলা শোওয়ার সময় ননীবালা বললেন—ও বাড়িতে কী হচ্ছে কে জানে! একা বীণার হাতে সংসার।
—কী করবে? ব্রজগোপাল মাচানের বিছানায় শুয়ে থেকে জিজ্ঞেস করেন।
—কালই চলে যাব।
—যেয়ো, ব্রজগোপাল বলেন। একটা শ্বাস চেপে রাখেন কষ্টে।
॥ চুয়ান্ন ॥
তিন বিঘের ওপর বহেরু একখানা বাগান করেছে। চুন-সুরকি দিয়ে গাঁথা ইটের দেওয়াল ঘেরা। ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন ননীবালা। কাঁঠালের কী ফলন। আগাপাশতলা ছেয়ে আছে ফলে। গাছের গোড়ায় খেজুর কাঁটার বেড়।
বহেরু বলল—শেয়ালের জন্য নয় মাঠান, কাঁটা দিলে ফলন ভাল হয়। গাছ শিউরে ওঠে তো।
জামরুল দেখে অবাক মানেন ননীবালা। আমগাছে যত পাতা তত ফল বলে ভ্রম হয়। বললেন—তোর হাতে মন্ত্র আছে বহেরু। কী ফলন! চোখ জুড়িয়ে যায়। বহেরু হাসে। বলে—ব্রাহ্মণের আশীর্বাদ।
গাছে ফল ফলে, এ বহুকাল দুচোখে দেখেননি ননীবালা। কলকাতায় সবই মেলে, কিন্তু সে শুধু ফলটুকু। গাছের ফল গাছে দেখার আনন্দই আলাদা। কলকাতায় আসার আগে পর্যন্ত গাছগাছালির সঙ্গে যাহোক সম্পর্ক ছিল। এখন পায়ের নীচে কদাচিৎ মাটির স্পর্শ পান।
ঘুরে ঘুরে ঘেমে গেছেন। মুখচোখ লাল। কোথা থেকে একটা ছাতা নিয়ে এসে নয়নতারা পাশে পাশে চলতে থাকে, ননীবালার মাথায় ছাতাখানা ধরে। ভারী লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটা। মুখখানায় কি লাবণ্যের ঢল! বহেরুর ঘরে সবই বেশ ফলে।
হাঁটতে হাঁটতে ননীবালা বলেন—তুই কেন হুট করে বুড়ো হয়ে গেলি বহেরু? চেহারাটা কেমন দুলদুল করে।
বহেরু গম্ভীরভাবে বলে—সময় হল। খোলস পালটাবে।
বহেরু নিয়ে গিয়ে বাস্তুজমিটা দেখাল। বলল—এইখানে কর্তা বাড়ি করবেন বলে ঠিক ছিল।
বলে খুব প্রত্যাশা নিয়ে তাকাল ননীবালার মুখের দিকে।
ননীবালা ফস করে বললেন—এখানে জমির দাম কী?
বহেরু শ্বাস ফেলে বলে—গাঁ গঞ্জ জায়গা, দাম আর কী হবে!
তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা জায়গাটায় রোদ পড়েছে। একটা পাতকুয়া। কয়েকটা গাছ। ননীবালার চোখে বালি পড়ল বোধ হয়। চোখটা করকর করে ওঠে। মনটাকে শক্ত করে বললেন—জমির দাম তো সব জায়গায় বাড়ছে।
বহেরু একটু ভয়-ভয় চোখে তাকায় ননীবালার দিকে। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে-কর্তামশাইয়ের জমি, তিনি তো বেচবেন না। দাম যাইহোক।
ননীবালা বে-খেয়ালে বলে ফেললেন—চিরকাল কি সে-ই থাকবে। জমিটা ভোগ করবে কে?
বলেই ননীবালা অন্তরে শিউরে ওঠেন। কী কথাটা বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে। মনটা কত বড় পাপী। সামলে নিয়ে বললেন—আমিও থাকব না, তুইও থাকবি না। তাই এখন ছেলেপুলেদের সুখ-সুবিধে বুঝে এসব জমি-জোত করতে হয়। দেখাশোনার কেউ না থাকলে, বাড়িঘর না হলে এ জমি ধুয়ে জলটা খাবে কে? বেচবে না বলে গোঁ ধরলে কি হয়?
বহেরু শুনে হঠাৎ তার বুড়ো মুখে যুবকের হাসি হেসে মাথা নাড়ল। বলল—কর্তারে বোঝায় কে?
—তুই বোঝাবি।
—উরে বাস রে। এসব বললে খেয়ে ফেলতে আসেন।
পাশ থেকে নয়নতারা হঠাৎ তার নরম গলায় বলে—মা, জমিটা ব্রজকর্তা ষষ্ঠীপদর নামে লিখে দিয়েছেন।
ঠিক বুঝতে পারেন না ননীবালা। হাঁ করে তাকিয়ে বললেন—কে? কার নামে লিখে দিযেছে বললি?
—ষষ্ঠীপদ। নিবারণী দিদির ছেলে। ওই যে যেটা সবসময়ে ব্রজকর্তার কাছে ঘুরঘুর করে আর ছড়া কাটে।
—ও। বলে স্তম্ভিত হয়ে থাকেন ননীবালা। বহুকষ্টে ভিতরের জ্বলুনিটা সামলে নিয়ে বলেন- কেন?
বহেরু একটা ধমক দিল নয়নকে। বলল—তোর এসব খোলসা করে বলার দরকার কি?
ননীবালা একটু কঠিন চোখে বহেরুর দিকে চেয়ে বলে—আমার কাছে লুকিয়ে কি হবে? লুকোস না। আর কী কী লিখে দিয়েছে বল।
উত্তরটা নয়নতারাই দিল—আর কিছু নয়। ষষ্ঠীপদর বাপ তো এখানেই ঘরজামাই থাকে। তার কিছু নেই। কপিলদাদা কোকাভাই সব ঠিক করেছে ওদের এখান থেকে তাড়িয়ে দেবে। তাড়িয়ে দিলে আর যাবে কোথা, জায়গা তো নেই, পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াবে। ব্রজকর্তা বড় ভালবাসে ষষ্ঠীকে। তাই মায়া হল, লিখে দিলেন।
খোল বগলে দিগম্বর চলেছে। বাদামতলা থেকে ছেলেপুলেরা পিছু নিয়েছে, হাততালি দিয়ে খ্যাপাচ্ছে—খোল হরিবোল, খোল হরিবোল…
দিগম্বর গালমন্দ পাড়ে না। ভারী অসহায় বোধ করে, আর ছুটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পৃথিবীতে আর এমন নির্জন জায়গা খুঁজে পায় না দিগম্বর যেখানে নিরিবিলিতে খোলখানা নিয়ে বসবে। আজকাল খোল নিয়ে বসলে গুরুর ছায়া এসে পড়ে খোলে। আশ্চর্য সব শব্দ ফোটে। হরি-হরি বলে খোল কাঁদে, খোল আহ্লাদে আটখানা হয়। কোন মহাজগৎ থেকে সব অজানা বোল ভেসে এসে খোলের শব্দের মধ্যে ফুটে ওঠে। দিগম্বরের বাহ্যজ্ঞান থাকে না। শ্রীকৃষ্ণ যখন রাসলীলা করেছিলেন, কুঞ্জবনে গোপিনীদের সঙ্গে খেলা করতে করতে কোথায় হঠাৎ মিলিয়ে গেলেন ঠাকুর। চারদিকে তখন কেবল আলো, আর স্বর্গীয় এক শব্দ। হা কৃষ্ণ কোথা -কৃষ্ণ বলে পাগল গোপিনীরা কৃষ্ণকে খোঁজে, পায় না, পাবে কী করে! কৃষ্ণ যে তখন শব্দব্রহ্মে মিলিয়ে আছেন। তাঁর অস্তিত্বের নাদ শুধু শব্দ হয়ে ঘিরে আছে তাদের। ব্রজবামুন বলেন—রাসলীলা মানে হল শব্দলীলা। দিগম্বর সেটা আগে বুঝত না,এখন বোঝে, শব্দ কখন ভগবান হয়ে ওঠে, শব্দ কখন যে দুনিয়াছাড়া করে দেয় দিগম্বরকে। বাবা রে, কোথা থেকে যে সব শব্দ এসে ভর করে খোলে। দিগম্বর তাই আজকাল মাঝে মাঝে খোলখানা জড়িয়ে ধরে, তার গায়ে মাথা ঘরে, কাঁদে আর বলে— আরবার যেন শব্দ হয়ে জন্মাই হরি হে।
ট্যাটন ছেলেগুলো পিছুতে লাগে। কোথাও বসতে দেয় না। যেখানেই গিয়ে খোল নিয়ে বসে দিগম্বর সেখানেই গিয়ে হাততালি দিয়ে নেচে নেচে চেঁচায়—খোল হরিবোল, খোল হরিবোল…। শব্দের যোগ ছিঁড়ে গেলে বড় যন্ত্রণা হয়। চারধারে একটা ময়লা পৃথিবী, তার মধ্যে যেন মুখ থুবড়ে ভাঙা হাঁড়ির মতো পড়ে আছে, এমন মনে হয়।
কতবার বহেরুকে ডেকে বলেছে—ভাইয়ের পো, তার গাঁয়ে এত লোক আলো কমনে? আগে তো দেখতাম না এতসব কাচ্চা বাচ্চা। বড় ঝঞ্ঝাট করে। আমারে শব্দ শুনতে দেয় না।
বহেরু বলে—গুষ্টি তো বাড়েই খুড়ামশাই, কবো কী? দেবোনে আপনারে একটা টংগী ঘর করে। মাচানের ওপর বসে বাজাবেন, কেউ নাগাল পাবে না।
সেই ঘরটা আর করে দেওয়া হয়নি।
পিছনে কাচ্চা-বাচ্চা লেগেছে, দিগম্বর খোল-বগলে ছুটে আসছিল বাদামতলা থেকে। ননীবালার মুখোমুখী পড়ে হকচকিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি রাস্তা থেকে নেমে দাঁড়াল পাশে। হাত দুখানা জোড় করে মহা অপরাধীর মতো বোকা মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠোঁট দুখানা কাঁপছে। দুনিয়াতে এই যে আছে দিগম্বর, এই যে শ্বাস টানে ছাড়ে, রাস্তায় পা ফেলে হাঁটে এ সবই তার নিজের কাছে মহা মহা আস্পদ্দার কাজ।
বাচ্চাকাচ্চাগুলো একটু পিছনে আসছিল, হাততালি দিয়ে মহানন্দে খোল হরিবোল বলতে বলতে। বহেরুরই নাতিপুতি জ্ঞাতিগুষ্টি সব। তবু বহেরু হঠাৎ হাঁকাড় ছেড়ে দৌড়ে যায়। বড় বড় মাটির ঢেলা আর চাঙড় তুলে দুই হাতে বাচ্চাগুলোর দিকে ছুঁড়তে থাকে। বাচ্চাগুলো ভয়ে আর্তনাদ করতে করতে দৌড়য়। দুটো একটা পড়ে যায়। একটার ন্যাড়ামাথায় বহেরুর ঢেলা গিয়ে লেগে ভেঙে পড়ে। সেটা মাথায় হাতচাপা দিয়ে ‘বাপরে’ বলে ইঞ্জিনের মতো বেগে ছোটে। চারধারেই নানাজনের ঘর গেরস্তালি, গাছগাছালি, সেসবের মধ্যে পলকে মিলিয়ে যায় সব। দুটো একটা নেহাৎ পুঁটে পুঁটে শিশু পালাতে পারেনি, গুট গুট করে দৌড়চ্ছে। বহেরু তাদের ধাওয়া দিয়ে চেঁচায়—সুমুন্দির পো, খুন করে ফেলব। সেই হাঁক শুনে তারা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে।
বহেরু হাত ঝেড়ে ফিরে আসে, গামছায় মুখ মুছে দিগম্বরের পিঠে হাত দিয়ে ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে বলে–যান খুড়োমশাই, বাগানের মধ্যে চলে যান, জামতলায় বেশ ছায়া আছে। বসে বাজান। সুমুন্দির পোয়েরা আপনার খোলের দাম কী বুঝবে। ওদের কানে গু-মুত ঢুকবে। আপনি যান।
—আহা রে! ননীবালা বলেন—বাচ্চাগুলোকে অমন ধাওয়া দিলি। তুই বড় পাষণ্ড বহেরু |
—ওগুলান মানুষের বাচ্চা নাকি মাঠান? সব কাউয়া। পাপীর বংশ তো। গুণী মানুষের মর্যাদা জানে না।
—তোর সব বাড়াবাড়ি। বাচ্চা মানুষ, ওরা কি ওসব বোঝে!
—বড় হলেও বুঝবে না। আমার ছেলেগুলান তো সব পাকাপোক্ত মানুষ এখন, তারাই কী বোঝে! আমি চোখ বুজলে খুড়োমশাইকে তাড়াবে, বামুনকর্তারে উচ্ছেদ করবে, যত সব আশ্রয় নিয়ে আছে তাদের হাঁকিয়ে দেবে। তারপর নিজেরা সুন্দ উপসুন্দের লড়াই করবে এখানে। আমার দাপে এখনও কিছু করতে পারে না।
ননীবালা হেসে বলেন—তোর এত জ্ঞাতিগুষ্টি, অতিথি-টতিথি, জোটে কোত্থেকে? সবাইকে খাওয়াস-ই বা কী করে?
—আমার গরজেই জোটে সব। মানুষের বড় শখ আমার। ব্রজকর্তাও কন-বহু পালক হও, বহু পোষক হও। তাই করি। গুণী মানুষ পাওয়া-ও চাট্টিখানি কথা নয়। কলের যুগ তো, গুণীরা সব মরে হেজে শেষ হয়ে যাচ্ছে। খুড়োমশাই বা ব্ৰজকর্তা গেলে আর তেমন মানুষ পাওয়া যাবে না। এই সেদিনও উজিরপুরের এক কামারকে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলাম। ওদের পূর্বপুরুষ নাকি এমন পোলাদ দিতে পারত যে বিলিতি ইস্পাতও হার মানে। এমন কামান বন্দুক তৈরি করতে যে শ’ শ’ বছরে জং ধরত না। বংশগত বৃত্তি, ব্যাটা কাজও জানে, কিন্তু সে এখন হাওয়ার ফ্যাক্টরিতে বাঁধা মাইনে পায়, এল না।
বলে বহেরু দুঃখমাখা মুখে তাকায়। ননীবালা বোঝেন, এসবই ব্রজগোপালের মাথার পোকা, এর মাথায় ভর করেছে।
বাস্তুজমিটা ষষ্ঠীচরণের নামে লিখে দেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করবেন, ননীবালার এমন ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ব্রজগোপাল ঘরে ছিলেন না। দুপুরে ফিরলেন। স্নান করে খেতে বসলেন বাপ-ব্যাটায় পাশাপাশি। সে এক সুন্দর ছবি। বহুকাল মানুষটাকে নিজের হাতে খাওয়াননি ননীবালা। কথাটা বুকে ঠেলাঠেলি করছিল, অম্বলের ঢেঁকুরের মতো উঠে আসত জিভে, ননীবালা কষ্টে ঠেকিয়ে রাখলেন। ব্রাহ্মণ মানুষের দুপুরের খাওয়াটা নষ্ট হয় যদি।
খেয়ে উঠতে না উঠতেই এলেন ফকির সাহেব। মধ্যবয়সি, বেশ ভাল চেহারা, গালে ছাঁটা দাড়ি, চোখে সুরমা, মাথায় ফেজ। পরনে সাদা লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবি। রণেনকে দেখতে এসেছেন।
কিন্তু রণেনকে দেখার ধার দিয়েই গেলেন না, ব্রজগোপালের দেখা পেয়েই গম্ভীর হয়ে বললেন—মোস্তাফা চরিত আর কোরাণে যে নূর আর আওয়াজের কথা আছে সে সম্বন্ধে আপনি ঠিকই বলেছিলেন। আর ইমান মোফাচ্ছেলে আছে—আল্লাহ, তাঁহার ফেরেস্তাগণ, কেতাবসকল, প্রেরিত রসুলগণ, কেয়ামত তকদীয় এবং মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন লাভ—এ সকলের ওপর আমি ইমান আনলাম। বিশ্বাস করলাম। কলেমায় একেশ্বরবাদের কথা বলা হচ্ছে। আর্যরাও তাই। ‘এরিয়া’ কথাটার মানে খুঁজে দেখলাম একেশ্বরবাদ। একেশ্বরবাদীরাই এরিয়ান। আল্লাহ নির্গুণ ঈশ্বর। রসুল ঈশ্বরের মূর্ত অভিব্যক্তি। আর্য হিন্দুদের পুরুষোত্তম। ইসলামে কলেমা তৈয়ব রসুল আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন। রসুল ভিন্ন আল্লাহ অব্যক্ত। গীতায় অব্যক্তের উপাসনার কথা বলা হয়েছে। প্রত্যেকটি কলেমারই মর্মবাণী ঈশ্বরের ও ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ রসুলের প্রতি পূর্ণ আত্মনিবেদন, আর এই আত্মনিবেদনই ইসলাম। ইসলামের সঙ্গে আর্যধর্মের খুব মিল। আপনি বলছিলেন ইসলামই আর্যধর্ম—যা বেদে ও কোরাণে, বব্বর, তৌরাৎ, ইঞ্জিল এইসব ঐশী কেতাবেও প্রচারিত হয়েছে।
ব্রজগোপাল মুখোমুখি বসে খুব নিবিষ্টভাবে শুনছিলেন। একটা শ্বাস ফেলে বললেন— ইমান মোফাচ্ছেলে পুনর্জীবন লাভের কথা আছে না?
ফকিরসাহেব বলেন—প্রেরিত পরম্পরা আছে, ধর্মগ্রন্থ, অদৃষ্ট ফেরেস্তা, আর দেবদূতদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, এই হল ইমান মোফাচ্ছেল। মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ হতে পারে কি! আর যদি রোজ কেয়ামতের কথা তোলেন-
এইভাবে নিবিষ্ট আলোচনা চলতে লাগল। ননীবালা পান খেলেন, রণেন বাইরে গিয়ে দুবার সিগারেট খেয়ে এল। আলোচনা তবু শেষ হয় না। দুজনেই একটা জায়গায় আটকে গেছেন, মিল হচ্ছে না। কিন্তু দুজনেই মিল বের করার জন্য নানা আলোচনা করছেন। পুনর্জীবন ও পুনরুত্থান এক কিনা, পোলশেরাৎ আর বৈতরণী কি অভিন্ন, এইসব নিয়ে কথা হচ্ছিল। সেইসব কথার মাঝখানে ননীবালা বাধা দিয়ে বললেন—ফকির বাবা, আমার ছেলেটাকে দেখবেন না? আমরা সন্ধের ট্রেনে চলে যাব।
ফকিরসাহেব এই প্রথম হাসলেন। চমৎকার হাসিটি। বললেন—হ্যাঁ মা, দেখব। এই বামুনবাবার সঙ্গে আমার খুব জমে। দুই ফকির তো।
রণেনকে একঝলক দেখলেন ফকির সাহেব। মুখখানা গম্ভীর করে ফেলেছেন ফের। একটু গলা খাকারি দিয়ে বললেন—কী হল বাবা?
ননীবালা আগ বাড়িয়ে বলেন—ওর মাথার অসুখ।
—বটে! বলে হাসলেন ফকিরসাহেব। বলেন—মা, ও কি পাগলামি করে?
ননীবালা উত্তর দিতে পারেন না। কারণ রণেন তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। কী করে বলেন যে ও পাগল! রণেন তা হলে ভীষণ ঘাবড়ে যাবে।
তাঁকে সে-দায় থেকে উদ্ধার করে ফকিরসাহেব বলেন—কেউ কেউ পাগল সাজে মা।
—না বাবা, ও তা নয়,
ফকিরসাহেব হাত তুলে বলেন—সেও আমি জানি।
বলে কিছুক্ষণ অন্যমনস্কভাবে চুপ করে রইলেন ফকিরসাহেব।
ননীবালা হাতপাখা নেড়ে তাঁকে বাতাস দিচ্ছিলেন। ফকিরসাহেব মাথা নেড়ে বললেন— কোনও কোনও মানুষের মধ্যে পাগল হওয়ার একটা ইচ্ছে থাকে। অবশ্য ঘুমন্ত ইচ্ছে। সে নিজেও হয়তো জানে না যে, মনের গভীরে ওরকম একটা ছোট্ট চাওয়া আছে। কখনও কখনও সেই ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। দেখবেন মা, দুর্বল মনের লোকেরা অনেক সময়ে সংকটে পড়লে পাগল হয়ে যায়। এটা ঠিক রোগ নয়, গা-ঢাকা দেওয়ার উপায়। কিন্তু যখন পাগল হয় তখন খাঁটি পাগলই হয়। আমারও একবার হয়েছিল—
বলে ব্রজগোপালের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন—রঘুনাথপুরে এক পাগল ছিল। লোকে বলত সে নাকি গুপ্ত সন্ন্যাসী। যা বলে তা হয়। মাথায় একটা হাঁড়ি নিয়ে ঘুরত। লোকে সেই হাঁড়িতে চাল ডাল তরকারি মিষ্টি সব দিত। দিনের শেষে হাঁড়ির সব জিনিস একসঙ্গে সেদ্ধ করে খেত। তার পিছু পিছু খুব ঘুরলাম ক’দিন বিভুতি দেখব বলে, কিছু দেখি না। একদিন নদীর ধারে বসে আছি একা, মনটা খুব উদাস, কি ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে ডেকে উঠল একটা ইচ্ছা—আচ্ছা, পাগল হলে কেমন লাগে। যদি পাগল হই তো কেমন হয়! সেই যে মাথায় ভূত চাপল তো চাপলই, ইচ্ছে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা কেমন ঘুলিয়ে উঠল, চারদিকটা কেমন ওলটপালট দেখতে লাগলাম। সবই অবাস্তব মনে হতে লাগল। আল্লা-রসুল ডাকতে ডাকতে মাথা চেপে ধরলাম, কিন্তু সে ইচ্ছে বান্দার বাচ্চার মতো মাথায় ভর করে আছে। তখন কেবল চিৎকার করে বলছি— না আমি পাগল হতে চাই না। চাইনা। সে বিকেলটা বেঁচে গেলাম, কিন্তু ইচ্ছেটাকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে দিয়েছি, তাই সহজে সে আমাকে আর ছাড়ে না। ঘুমোতো ঘুমোতে হঠাৎ স্বপ্ন দেখি, পাগল হয়ে যা তা করে বেড়াচ্ছি। অমনি উঠে বসে ভয়ের কালঘাম ছাড়ি, জেগেও বুঝতে পারি মনের মধ্যে পাগলামির পোকা কিলবিল করছে। এইরকম ভাবখানা কিছুদিন চেপে থাকতে থাকতে একদিন আর পারলাম না, সকালে উঠে একদিন বেমক্কা পাগলামি শুরু করে দিলাম। বহু ওষুধপত্রে মাসখানেক বাদে সেটা সারে।
ননীবালা ধরিয়ে দিয়ে বললেন—ওর টাইফয়েডের পর ছেলেবেলায় একবার সত্যিকারের হয়েছিল।
ফকিরসাহেব মাথা নেড়ে বলেন—এটা সে রোগ নয়। ভাববেন না, ওষুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি, সেরে যাবে।
বলে রণেনের দিকে তাকিয়ে ফিক করে একটু হাসলেন, হাসিটা যেন রণেনের সঙ্গে একটা গোপন বোঝাবুঝির হাসি। কী একটা অভিনয়, ষড়যন্ত্র কী একটা যোগসাজস হয়ে গেল কে জানে। রণেনও একটু হাসল। তারপর গম্ভীর হয়ে গেল।
যাওয়ার সময়ে ফকিরসাহেব ব্রজগোপালকে বললেন—আবার দেখব, রোজ কেয়ামতের মধ্যে পুনর্জন্মের একটা গন্ধ পাচ্ছি বটে।
কোরাণেও আছে। ব্রজগোপাল সোৎসাহে বলেন—একটু দেখবেন।
ফকিরসাহেব ঘাড় নেড়ে চলে গেলেন।
এতকিছুর পরও ননীবালার বুকের মধ্যে কথাটা কাঁটার মতো কুটকুট করে। বাস্তুজমির কথা ভোলেননি। কিন্তু রণেনের সামনে তুলতে ইচ্ছে করে না। বড় নরম মন ছেলেটার। মা-বাপের ঝগড়ায় ফের যদি মনটা বিগড়োয়। তার ওপর আজই চলে যাবেন। যাওয়ার আগে তেতো করে যেতে ইচ্ছে হয় না।
বুকে এই চাপ দুশ্চিন্তাটা নিয়েই দুপুরে একটু গড়িয়ে নিলেন ননীবালা।
দুপুর গড়িয়ে উঠেই টের পেলেন রোদের মুখে কালো ঠুলি পড়েছে। বাইরে এসে দেখেন, স্তরের পর স্তর কালো মেঘ জমেছে আকাশে। গুমোট ভেঙে একটা দমকা হাওয়া দিল। কুটোকাটা আর ধুলোবালি উড়ছে। প্রকাণ্ড মাঠের ওপর প্রকাণ্ড আকাশ। কত দূর পর্যন্ত কালি ঢালা ঘুটঘুটে মেঘের ছায়া পড়েছে। এতদূর পর্যন্ত, এত ব্যাপ্ত মেঘ বহুকাল দেখেননি। মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলেন। নয়নতারা দৌড়ে এসে বাইরে মেলা জামাকাপড় তুলে দিয়ে গেল ঘরে। কাছে এসে হাসিমুখে বলল—আজ যাওয়া হবে না মা।
ননীবালা মুখ ফিরিয়ে নয়নের মুখে তাকিয়ে বললেন—না হোক গে। জলে পড়েছি নাকি?
—থেকে যান।
—থাকব।
বলে হাসলেন ননীবালা। বলে হাসলেন ননীবালা। ‘থাকব’ কথাটায় যেন তাঁর বুক হঠাৎ আজ হালকা হয়ে গেল।
॥ পঞ্চান্ন ॥
যেদিন প্রথম কুমারস্বামীর কাছে গিয়েছিল অজিত সেদিন ঘরে ঢুকেই সে এক ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে পায়।
গর্চার সেকেন্ড বাই লেনে দোদলায় এক ব্যাবসাদার শিষ্যের ফ্ল্যাটে তখন ছিল কুমারস্বামী, ঘরে ঢুকবার আগে খুব সতর্ক গলায় কুমুদ বোস বলল—ভিতরে ঢুকে কোনওরকম বদমায়েশি করবে না বলে দিচ্ছি। টিটকিরি-ফিটকিরি দিয়োছ কী ঘাড় ভেঙে ফেলব।
জুতো খুলতে খুলতে অজিত হাসল। আর তখন টের পেল বহুকালের অবিশ্বাস ভেদ করে বুকের ভিতরে একটা ভয় ধুকপুক করে নড়ছে। ভক্তি নয়, বিশ্বাসও নয়, কেবলমাত্র একটা ভয়। এইসব ভয় থেকেই ভক্তিরে জন্ম, অজিত জানে।
বন্ধ দরজায় মৃদু শব্দ করতেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে একটা একতরফা প্রবল স্বর শোনা যাচ্ছে। চৌকাঠে পা দিয়েই অবাক হয়ে গেল অজিত।
একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে চিত করে ফেলে বুকে হাঁটু দিয়ে বসে আছে কুমারস্বামী। চাপা প্রবল গলায় অলৌকিক চিৎকার করে বলছে—পাপী! পাপী! মহাপাপী। অবিশ্বাসী পাষণ্ড!
পড়ে থাকা লোকটা হাত-জোড় করে ভয়ে নীল হয়ে বলছে— বাবা, রক্ষা করো, রক্ষা করো।
এই দৃশ্য একটু পরে জানতে পেরেছিল অজিত যে, ওই ম্যাজিষ্ট্রেট সেদিনই প্রথম এসেছিল কুমারস্বামীর কাছে। লোকটা ঘরে ঢুকতেই কুমারস্বামী আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে এসে দক্ষ কুস্তিগীরের মতো তাকে ধরে চিতপটাং করে ফেলেছিস।
তারা ঢুকতেই কুমারস্বামী লোকটাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। একটু আগের প্রবল রাগ আর ঘৃণা ধুয়েমুছে গেছে মুখ থেকে। কী স্নিগ্ধ হাসি হাসল! কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল, তাতে জটা। পরনে হালকা গেরুয়া বহির্বাস আর জামা। গালে যিশুর দাড়ির মতো দাড়ি। বয়স পঞ্চাশ হতে পারে। খুব ফরসা, লম্বা চেহারা। চোখ দুটি দিঘল। অর্থাৎ চেহারাতে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কাজ বাগিয়ে বসে আছে। দুহাত বাড়িয়ে বলল—আয়! আয়!
এক বুকে কুমুদ বোস, অন্য বুকে অজিতকে জড়িয়ে ধরল অনায়াসে। তখন কুমারস্বামীর গা থেকে এত তীব্র চন্দনের গন্ধ প্রায় শ্বাসরোধ করে দিল অজিতের। তার গালে-দাড়িটা ঘসে দিয়ে কুমারস্বামী বলল—তোর বুকটা বড় ফাঁকা। না রে?
প্রথম রাউন্ডে কুমারস্বামীই জিতে গেল। ওই যে কথাটা! তোর বুকটা বড় ফাঁকা, না রে? ওই কথাটাই অজিতের ভিত ভেঙে ফেলে আর কী।
ম্যাজিস্ট্রেট লোকটা উঠে বসে চারদিকে ভ্যাবলার মতো চাইছে। একটা কষ্টের শব্দ করে হঠাৎ কাতরভাবে বলল—বাবা, আমাকে আশ্রয় দিন।
তখন অজিত আর কুমুদ বোসকে ছেড়ে কুমারস্বামী তার দিকে হাত বাড়িয়ে তুলে আনল তাকে। কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলল—হাত মুঠো কর।
লোকটা তাই করে। কুমারস্বামী তার মুঠোর ওপর একবার বুড়ো আঙুল বুলিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলে—এবার মুঠো খুলে হাতটা শোঁক তো।
লোকটা শুঁকেই চেঁচিয়ে বলে—এ তো গোলাপের গন্ধ! আঃ, কী সুন্দর গোলাপের গন্ধ!
বহু লোক ঘরে বসে আছে। প্রায় সবাই জোড়হাত, আর তাদের চোখ অর্ধেক বোজা। মুখে লোভলালসার ভাবের ওপর একটা ভয়-ভক্তির সাময়িক প্রলেপ পড়েছে। সবই লক্ষ কারণ অজিত। ম্যাজিস্ট্রেট লোকটা বসে বসে হাঁফাচ্ছে, আর হাত শুঁকছে। আর যারা বসে আছে তারাও কোনও না কোনও জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। বাইরে বিস্তর পার্ক করা গাড়ি দেখে এসেছে অজিত। এটা গরিব গুর্বোর জায়গা নয়। দু-চারজন ঝুঁকে ম্যাজিস্ট্রেটের হাতের গোলাপের গন্ধ শুঁকল। কুমুদ বোস সেই হাতটা টেনে এনে অজিতের নাকে ধরে বলল—শোঁকো শালা। স্বর্গের গন্ধ।
একধারে তক্তপোশের ওপর বাঘের গায়ের মতো কালো-হলুদ ডোরা কাটা চাদর পাতা, তার ওপর তাকিয়া। সেখানে কুমারস্বামী বসে, আর ভক্তদের জন্য মেঝেয় ঢালাও কার্পেট পাতা। কুমারস্বামী তক্তপোশে গিয়ে বসেছে, মুখে হাসি। ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর চড়াও হওয়াতে ঘরের আবহাওয়ায় ভক্তিভাবের ইলেকট্রিসিটি বয়ে যাচ্ছে। সবাই বেশ চাঙ্গা।
একজন অচেনা লোক অজিতকে চাপা স্বরে বলল—এখানে বসে কুকথা ভাববেন না, অবিশ্বাসী হবেন না। বাবা সব ভাইব্রেশন টের পান।
তাতে বুকে ভয়ের পাখিটা ফের নড়েচড়ে ওঠে। অফিসে সে অনেক ঠাট্টা-ইয়ারকি করে, কিন্তু এখানে আসার পরই কী যেন ঘটছে তার ভিতর। বড় দুর্বল লাগছে নিজেকে, অসহায় লাগছে। সে একটা মন দিয়ে বুঝতে পারছে যে এই ঘরের পরিবেশ, ফুল ও চন্দনের গন্ধে, কুমারস্বামীর রাগ হাসি, বুক-টেনে-নেওয়া এই সব সব কিছুর মধ্যেই একটা অত্যন্ত নিপুণ কৌশল আছে, অন্য একটা মন আবার এই সব কিছুকেই বিশ্বাস করতে চাইছে। অন্য মনটা বলছে এই যে সব সমাজের উঁচুতলার লোক, এরা কী সবাই বোকা? অশিক্ষিত? কোনও চালাকি থাকলে এরা নিশ্চয়ই টের পেত।
তাকে প্রচণ্ড চমকে দিয়ে এই সময়ে কুমারস্বামী বলল—অজিত এস।
বলে হাত বাড়ায় কুমারস্বামী। অজিত মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাছে এগিয়ে যায়। মেঝেয় চৌকির নীচে বসে মুখ তুলে তাকায়। কুমারস্বামী সহাস্য মুখে বলে—তুমি ম্যাজিক জানো?
অজিত মাথা নেড়ে বলে—একটু।
কুমারস্বামী তার শূন্য ডান হাতখানা অজিতের দিকে বাড়িয়ে বলল—পামিং আর পাসিং জানো?
অজিত মাথা নাড়ে।
কুমারস্বামী হাতটা অজিতের চোখের সামনে একটা কূট মুদ্রায় ঘুরিয়ে দেখায়, বলে— ম্যাজিসিয়ান দ্যাখো।
অজিত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বিন্দুমাত্র কৌশল, সামান্য মাত্র পেশির সংকোচন বা প্রসারণ সে টের পাবেই।
—দেখছ? কুমারস্বামী বলে।
দেখছে অজিত। হাতে কিছু নেই।
কোনও কৌশল নয়, কুমারস্বামী খুব স্বাভাবিক ভাবে যেন এক অদৃশ্য বাগান থেকে একটা সাদা স্থলপদ্ম চয়ন করে নেয়, অজিতের চোখের সামনে।
—নাও এটা কাছে রাখো। ঝুঁকে কুমারস্বামী তার হাতে ফুলটা দেয়। আর খুব আলতো হাতে তার বুকে নিজের ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা ঘষে দেয় একবার। অমনি ম ম করে উঠল চারধারে চন্দনগন্ধের ঢেউ। কী গন্ধ! কী গন্ধ! এমন তীব্র, অসম্ভব চন্দনগাছ জীবনে কখনও পায়নি অজিত। শ্বাস রোধ হয়ে আসে। গন্ধ সম্মোহিত করে রাখে তাকে।
সেই গন্ধ আর সম্মোহন নিয়েই প্রথমদিন ফিরেছে অজিত। এমনই তার বুকের সেই গন্ধের তীব্রতা যে, যখন সে কুমারস্বামীর কাছ থেকে ফেরার পথে বাসে উঠেছে তখন সবাই চনমনে হয়ে চারদিকে চেয়েছে। দু-একজন বলে ফেলল—কী দারুণ গন্ধ! কোত্থেকে আসছে?
শীলাও অবাক। বার বার তার বুক শুঁকে বলল—উঃ! কী গন্ধ মেখে এসেছ! কে মাখালে?
অজিত কুমারস্বামীর কথা চেপে গেল। বলল—কেউ একজন হবে।
—কে গো?
—গোপন প্রেমিকা। অজিত তীব্র একটু হেসে বলে।
শীলা পায়জামা এগিয়ে দিতে হাত বাড়িয়ে বলল—আহা্। প্রেমিকা যদি অত সস্তা হত।
অজিতের কী হল, হঠাৎ বলে ফেলল—কেন অন্যের প্রেমিক থাকতে পারে, আর আমার প্রেমিকাতেই দোষ?
শীলা থমকে গিয়ে বলে— কী বলছ?
—শুনলেই তো। অজিত নিস্পৃহ মুখে বলে।
—শুনলাম। কিন্তু আমাকে বলছ কী?
—তবে আর কাকে?
শীলা স্তম্ভিত ভঙ্গিতে চেয়ে থেকে খুব মৃদুস্বরে বলে—আমার প্রেমিক কে?
অজিত এ কথার উত্তর না দিয়ে বাথরুমে চলে গেল। কিন্তু শীলা তাতে ক্ষান্ত হয়নি।
রাতে যখন শুতে গেছে শীলা অজিত তখন তার একা ম্যাজিকের ঘরে চুপ করে বসে আছে সিগারেট জ্বেলে। এই একা, বিষণ্ণমনে জেগে থাকা, তার বড় প্রিয়। সামান্য একটু ইনসোমনিয়ার মতো আছে অজিতের। রাত করে শোয়, বেলা করে ওঠে। রাতে যেটুকু সময় জেগে থাকে সে সময়টুকুই তার নিজস্ব। সারাদিনের খানিকটা অফিসের, খানিকটা শীলার, কিছুটা দাড়ি কামানো, স্নান করা, খাওয়ার মতো বাজে কাজের। শুধু এই সময়টুকু তার। এ সময়ে শীলা তাকে শুতে ডাকলে সে ভারী বিরক্ত হয়। গভীর রাত পর্যন্ত সে শুধু জেগে বসে থাকে। নিবিড় একাকী লাগে নিজেকে। তখন টের পায়, তার চারধারে এক অনন্ত অন্ধকার মহাজগৎ।
সেদিনও বসেছিল। ছোট্ট একটা নাইট ল্যাম্প জ্বলছে দেয়ালে। সে সময়ে হঠাৎ মহিমময়ীর মতো শীলা ঘরে এসে দাঁড়াল। মহিমময়ী, কারণ কান্নার জলে তার চোখ ঝলসাচ্ছে, ওঠাপড়া করছে প্রবল বুক, মুখে তীব্র অভিমান থমথম করছে। রাগলে শীলা আর আটপৌরে থাকে না।
তুমি ওকথা কেন বললে? শীলা রুদ্ধ গলায় বলে—আর একদিনও ইঙ্গিত করেছিলে তুমি কি আমাকে সন্দেহ করো?
—করি।
—কেন? শীলা হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে মুখ তুলে বলল।
অজিত একটু ম্লান হাসি হেসে বলে—তার কারণ, আমার বয়স প্রায় চল্লিশ, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। অনেকদিন একসঙ্গে ঘর করার পর তোমার কাছে আমার চার্মও আর নেই। তা ছাড়া আমি সঙ্গ দিতে পারি না, স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা নাই। আমাকে যে তুমি আর পছন্দ করবে না, এটাই স্বাভাবিক।
শীলা উন্মুখ হয়ে বলে—কে বলল পছন্দ করি না! তুমি কি আমার মনের কথা জানো?
—না। অজিত মাথা নাড়ল, বলল-না জানাই ভাল। মনে কত পাপ থাকে। আমরা দুর্বল মানুষ সব পাপকে ক্ষমা করতে পারি না।
শীলা আস্তে মাথা নেড়ে বলে—আমার মনে কোনও পাপ নেই। বিশ্বাস করো। আমি তোমাকে ভালবাসি। ভীষণ।
এইসব কথার পর শীলা তার হাঁটুতে মুখ গুঁজে কেঁদেছিল। তারা কেউ সেদিন সুভদ্রর নাম উচ্চারণ করেনি। ওই নামটা উচ্চারণ করায় কোথায় যেন একটা লজ্জা ছিল, সংকোচ ছিল, আর ছিল ভয়।
শীলার সঙ্গে সেই রাতে শুয়ে তাকে অনেক আদর করেছিল অজিত। অনেক আবেগ দিয়ে ভালবেসেছিল। আর তাদের আদরে, আবেশে, রতিক্রিয়ায় সারাক্ষণ আবহের মতো কাজ করেছিল সেই চন্দনের পাগল- করা- গন্ধ।
তিন দিন পরও সেই গন্ধ রইল অজিতের বুকে। অফিসের অনেকেই এসে অজিতের বুকে শুঁকে দেখে যেতে লাগল। সেনদা বললেন—অজিত, তুমি বড় ভাগ্যবান। কুমুদ বোস সারা অফিসে তড়পাতে লাগলবলেছিলুম কিনা শালা যে কুমারস্বামীই হচ্ছে আসল লোক! ম্যাজিক হলে আমাদের ম্যাজিসিয়ান ধরে ফেলত না? ওসব যোগের ক্রিয়াকর্ম বাবা, দৈব শক্তি, ইয়ারকির কথা নয়।
শীলার সময় কীভাবে কাটে তা জানে না অজিত। সারাদিনের মধ্যে শীলার সঙ্গে দেখা হয় কতক্ষণ?
আজ কয়েক দিন হল ইস্কুল খুলেছে। শীলা বন্ধের পর ইস্কুলে গিয়েই শুনেছে, মনীষা দিদিমণি রিটায়ার করার আগে দুমাস ছুটি নিয়েছেন। ছুটির শেষে জয়েন করেই রিটায়ার করবেন। তাঁর জায়গায় ফের সুভদ্রকে নেওয়া হবে।
সুভদ্রকে নেওয়া হবে কেন? কারণ, সুভদ্র হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার সময়ে খুব ভাল ম্যানেজ করেছিল সব কিছু।
খবরটা পেয়েই শীলার শরীরের ভিতরে অন্ধকারে আলো জ্বলে উঠল। রঙিন সব আলো। একটা অসহনীয় সুখবোধ। মেয়েদের অনেক ব্যথা স্বামীকে বলতে নেই, কাউকে বলতে নেই। সে সব কথা তাদের মনের মধ্যে চন্দনের হাতবাক্সে লুকনো থাকে।
খুবই উদাসীন সেজে সুভদ্র এল ইস্কুলে একদিন। সেদিন শীলা অখণ্ড মনোযোগে খবরের কাগজ পড়েছে, অবসর সময়ে। তাকায়নি। তাকাতে ভীষণ লজ্জা করছে। সুভদ্রও এড়ানোর ভাব করছে। যেন চেনেই না।
কেবল ছুটির পর ঠিক বড় রাস্তায় এসে সঙ্গ ধরল শীলার। বলল- কী খবর গরবিনী?
শীলা মুখ লাল করে উত্তর দিল—কীসের গর্ব আবার। কথা খুঁজে পান না নাকি? কেবল বাজে কতা।
সুভদ্র উদাস গলায় বলে—কত অহংকার থাকে মানুষের! কারও বা রূপে আছে, কারও বা স্বামী বড় চাকরি করে, কেউ বা টাকার মালিক। এরকম কত রকম।
—সুভদ্র, মারব থাপ্পড়!
এইরকম ভাবে তাদের ফের ভাব হয়ে গেল। ইস্কুলে রোজ দেখা হয়। ঠারেঠোরে দুজনে দুজনের দিকে তাকায়। ভালমানুষের মতো কথা বলে। একটা পিপাসার নিবারণ হয় তাতে। আবার তৃষ্ণা বাড়েও। ইস্কুলের শেষে প্রায়দিনই তারা একসঙ্গে বেরোয়।
তারপর দুজনে ট্রামে বা রিকশায় ওঠে। ভারী পেটটা নিয়ে শীলার একটু হাসিহাসি লাগে, সুভদ্রর সামনে লজ্জাও করে। তবু বেরতে খুব রোমাঞ্চকর আনন্দ হয়।
একদিন সুভদ্র বলে—এই যে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কোনওদিন যদি অজিতদা দেখে ফেলেন, কী ভাববেন?
শীলা একটু ভ্রূ কুঁচকে বলল- কী ভাববে আবার!
—অনেক ভাবার আছে।
—কী ভাববে?
—হয়তো ভাববেন, আপনি আমার সঙ্গে প্রেম করছেন।
শীলা মুখটা ফিরিয়ে বলেছে-ফাজিল!
সেটা মুখের কথা। কিন্তু তাদের ভিতরে ভিতরে এই সব কথাই গুপ্তঘাতকের মতো, চোরের মতো ঘোরে। তাই রিকশায় বসলেই পরদা ফেলে দেয় শীলা, ট্রামে বাসে উঠলে পাশাপাশি বসতে চায় না। বলে—গা-ঘেঁষা পুরুষ আমি দুচোখে দেখতে পারি না।
এক-একদিন সুভদ্র বলে—এবার চাকরিটা তো পাকাই হয়ে গেল আমার। এজেন্সির কমিশনও শতখানেক করে আসছে। এবার ভাবছি একটা বিয়ে করলে কেমন হয়!
শীলা বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলে—ও মা, করুন না। খুব ভাল হয়। পাত্রী দেখব?
সুভদ্র ভয়ংকর অসভ্যের মতো হেসে বলে-বুকে সইবে তো?
শীলা লাল হয়, তেড়ে মারতে আসে। আবার কখনও গভীর রাতে বা নির্জনে ভেবে দেখলে বুঝতে পারে, সুভদ্র মিথ্যে বলেনি। বুকে সইবে না। একদিন সুভদ্র মাইনে পেয়ে বলল—চলুন, একটা শার্ট কিনব। পুরনোগুলোতে আর চলছে না। শীলা রাজি। সুভদ্র ফুটপাথ থেকে কিনবে, শীলা রাজি নয়। সে বলে-না, বড় দোকানে চলুন। গড়িয়াহাটায়। গিয়েছিল তারা। অনেক রঙের, স্ট্রাইপের, চেক-এর শার্ট-এর মধ্যে পছন্দ করতে হিমসিম খাচ্ছিল তারা। অনেক রঙের, স্ট্রাইপের, চেক-এর শার্ট-এর মধ্যে পছন্দ করতে হিমসিম খাচ্ছিল তারা। ক্লান্ত দোকানদার একটা শার্ট তুলে দেখিয়ে শীলাকে বলল—আপনার হাজব্যান্ডকে এইটে পরিয়ে দেখুন, খুব মানাবে। যান না, ট্রায়াল রুমে চলে যান দুজনে, পরিয়ে আনুন।
খুব লজ্জা পেয়েছিল শীলা। সুভদ্র অবশ্য দোকানদারের ওপর এক ডিগ্রি যায়। গলা বাড়িয়ে বলল—আমার ওয়াইফ স্ট্রাইপ পছন্দ-করেন। এটা চেক, এটা ওঁর পছন্দ নয়।
এ সব কি খেলা! কেমন খেলা? খুব বিপজ্জনক? সে যাই হোক, দোকানদারের ভুল আর ভাঙেনি তারা। ওইরকমই রয়ে গেল তাদের সম্পর্ক, ওই দোকানে। হয়তো চিরকালের মতো।
অজিত কিছুই জানে না। কিন্তু একবার সে গোপনে ডাক্তার মিত্রের কাছে গিয়ে নিজেকে পরীক্ষা করিয়েছে। তার ঘোর সন্দেহ ছিল, তার নিজের হয়তো সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা নেই। ডাক্তার মিত্র তাকে পরীক্ষা করেছে। রিপোর্ট দেওয়ার সময়ে বলেছে—ডিফেক্টটা মাইনর। এতে আটকানোর কথা নয়। তবু কয়েকটা ওষুধ দিচ্ছি।
সেই কূট সন্দেহটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শীলার পেটের বাচ্চাটা…।
অজিত আজকাল প্রায় দিনই কুমারস্বামীর কাছে যায়। অনেকক্ষণ থেকে রাত করে ফেরে। তার মুখে চোখে একটা অদ্ভুত তদগত ভাব। বিরলে শ্বাস ফেলে সে। গভীর শ্বাস, চোখ বুজে আবেগভরে বলে—বাবা।
॥ ছাপ্পান্ন ॥
চারদিকে মাইল মাইল জুড়ে মেঘের ঘুটঘুট্টে ছায়া।-বহেরুর খামারবাড়ির ধারে দাঁড়ালে কত দূর যে চোখ চলে যায়। ননীবালা দেখলেন, সেই অফুরান ফাঁকা জমির ওপর দিয়ে একটা ধুলোর পরদা উড়ে আসছে। বাতাসে ভ্যাপসা গরম ছিল এতক্ষণ, হঠাৎ সেই বাতাসে একটা ভেজাল ঢুকে গেল। উত্তুরে বাতাসের মতো ঠান্ডা আর জলগন্ধী হাওয়া এল কোখেকে। মুঠো মুঠো ধুলো কাঁকর এসে পড়ছে চোখেমুখে। ছেঁড়া কাগজ, গাছের পাতা, পাখির বাসার খড়কুটো উড়ছে চারধারে। বড় গাছগুলো যেন ধনুষ্টঙ্কারে বেঁকে যাচ্ছে। এক-একবার। প্রবল বাতাস ঠেলে দিচ্ছে তাঁকে, ননীবালা জোর পায়ে ঘরে এসে হুড়কো দিলেন। বাতাসের এত চাপ যে কপাটের পাল্লা দুটো ঠেসে দিতে পারছিলেন না।
ব্রজগোপাল উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছিলেন। একবার বললেন—ঝড় আসছে। এখন আলো-টালো জ্বেলো না।
ননীবালা দেখেন ঘরময় ধুলোবালি পড়েছে পুরু হয়ে, বিছানায় রাজ্যের কাঠিকুটো নোংরা এনে ফেলেছে বাতাস। বিছানা দুহাতে ঝাড়তে ঝাড়তে শুনতে পেলেন, বাইরে বাতাস গোঙাচ্ছে। বেড়ার ওপর সপাট করে এসে পড়ছে বাতাস, ঠিক যেন চোর ডাকাত ভেঙে ফেলছে ঘর। টিনের চালে একরকমের গুমগুম শব্দ। ঘরটা কেঁকে কেঁপে ওঠে। কলকাতার পাকা বাড়িতে ঝড়বৃষ্টি তেমন টের পান না। এখানে এই কাঁচাঘরে, খোলা মাঠের মধ্যে এমন প্রবল ঝড়ের আভাস দেখে বুকটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। বাইরে কারা চেঁচামেচি দৌড়োদৌড়ি করছে। সামাল সামাল ভাব। একবার বহেরু এসে দরজায় কিল দিয়ে চেঁচিয়ে বলল—মাঠান, ঘরে আছেন তো সব?
তখনই ননীবালার খেয়াল হল, রণো তো ঘরে নেই! গেল কোথায় ছেলেটা?
আতঙ্কিত ননীবালা ব্রজগোপালের দিকে চেয়ে বলেন—রণো কোথায় গেল?
ব্রজগোপাল ঘরের আবছায়ায় মুখটা ফিরিয়ে ননীবালার দিকে চেয়ে বললেন-দেখছি।
—দেখবে! কোথায় দেখবে? এই ঝড়ে বেরোবে নাকি?
এই সময়ে প্রচণ্ড শব্দে টিনের চালের ওপর নারকোল পড়ল। বাজের শব্দ হল উত্তরের মাঠে। আর তার আগুনের ঝলক হলুদ আলোয় বিপদের গন্ধ ছড়িয়ে গেল ঘরে।
ব্রজগোপাল হুড়কো খুলতে খুলতে বললেন—দেখি সব কে কী করছে। রণোকেও খুঁজে আনি।
ননীবালা এসে হাত চেপে ধরে বললেন—বয়সটা ভুলে যাও কেন? অন্য ক্ষতি না হলেও এই বাতাসে ঠান্ডা লাগিয়ে আসবে। আমিই বরং দেখছি।
ব্রজগোপাল ঠান্ডা গলাতেই বললেন তুমি তো খামারটা ভাল চেনো না, অন্ধি সন্ধি আমি জানি। আমার ঠান্ডা লাগবে না, অভ্যাস আছে। ছেলেটার মন স্থির নেই, কোথায় চলে যায়।
সে কথাও ঠিক। উদ্বেগ বুকে নিয়ে ননীবালা সরে দাঁড়ালেন। ব্রজগোপাল হুড়কো খুলতেই ঝড়ের ধাক্কায় পাল্লা দুটো পাখনার মতো উড়ে খুলে গিয়ে কাঁপতে থাকে। বাইরে চারদিকে ধুলোটে অন্ধকার। খোলা দরজা দিয়ে রাশি রাশি ধুলো এসে অন্ধ করে দেয় ননীবালাকে। ঠাহর করে তিনি পাল্লা দুটো বন্ধ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ডাকাতে ঝড় তাঁকে সুদ্ধু ঠেলে ফেলে দেয়, দামাল হয়ে ঘর লুটপাট করতে ঢুকে পড়েছে। ব্রজগোপাল বাইরে থেকে পাল্লা দুটো টেনে ধরেন, তাই অতি কষ্টে ননীবালা দরজা বন্ধ করতে পারলেন। জানলার ঝাঁপগুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে গেছেন ব্রজগোপাল, তবু সেগুলো বাঁধন ছেঁড়ার জন্য আকুলি-বিকুলি করছে। হা-হা শব্দে আকাশ পাতাল জুড়ে প্রলয় চলে আসছে। আবার আগুনের আভা, তারপরই কামানের শব্দ করে বাজ ডাকল। শিউরে ওঠে ঘর। কোথায় পড়ল বাজটা। কার সর্বনাশ করল কে জানে! এত কাছে পড়ল। পুবের জানালার ঝাঁপ ফাঁক করে ননীবালা কষ্টে দেখলেন, ভূতপ্রেতের মতো মানুষ দৌড়চ্ছে চারধারে।
বেড়াল কোলে করে উঠোনে বসে আছে গন্ধ বিশ্বেস। মাজায় জোর নেই যে নিজে থেকে উঠবে। বাতাসে উলটে যাচ্ছে বেড়ালের ললাম। তিন-তিনটে ঘেয়ো কুকুর ছুটে গিয়ে ঝড়-বাতাসকে ঘেউ ঘেউ করে দিয়ে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ফিরে আসছে গন্ধের কাছে থুপ থুপ বসে থাকা একপাল বেড়াল আলিস্যি ভেঙে উঠে ঘরদোরের ভিতর চলে গেল। কুকুরদের যাওয়া বারণ, একমাত্র গন্ধ বিশ্বেসের ঘর ছাড়া। কিন্তু ঝাঁপ বন্ধ বলে যেতে পারছে না।
গন্ধ চেঁচিয়ে বাতাসের শব্দের ওপর গলা তুলবার চেষ্টা করে—আমারে একটু ঘরে দিয়ে আয় শালার পুতেরা! হে-ই কেডা যায় রে?
নয়নতারা হাঁস তাড়িয়ে এনে বাক্সবন্দি করতে করতে চেঁচিয়ে বলল—ও জ্যাঠা, ঘরে যাও। বাতাস দিল।
গন্ধ খেঁকিয়ে ওঠে—আমারে নিবি তো!
—নিই। বলে নয়নতারা এসে হ্যাঁচকা টানে তুলে ফেলে গন্ধকে। গন্ধ উঃ উঃ করে ব্যথায় চেঁচিয়ে ওঠে। সেদিকে কান না দিয়ে নয়নতারা তাকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে গিয়ে হাঁসের মতোই ঘরে পুরে দেয়। বন্ধ দরজার বাইরে কুকুরগুলো আকাশমুখো চেয়ে চিল্লোতে থাকে। ঝড় দুর্যোগকে ধমক মারে। দাওয়ায় উঠলে গেরস্ত দূর দূর করে। তারা যাবে কোথায়!
নয়নতারা ধুলোর ভিতরে ডুবন্ত মানুষের মতো আবছায়া হয়ে ছুটে আসে চিড়িয়াখানার কাছে। ঘেরা পরদা কিছু নেই। জাল দেওয়া খাঁচার ময়ুরটা কর্কশ স্বরে চেঁচাচ্ছে। একটু আগে পেখম ধরেছিল, এখন বুজিয়ে ফেলে একবারটায় বসে আছে ভয় খেয়ে। পাখিগুলো চেঁচাচ্ছে। হনুমান আর বাঁদর কুক কুক ডাক ছেড়ে লাভ দিচ্ছে এধার থেকে ওধার। বিন্দু কয়েকটা চট জালের গায়ে বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করছে। পারছে না। বাতাসে চট উড়ে যায়।
হেসে ফেলে বিন্দু বলে—ও দিদি, এ মুখপোড়াগুলোর কী হবে?
—খাঁচা খুলে দে, পালিয়ে যাক। নয়নতারা নির্দ্বিধায় বলে।
বিন্দু চোখ গোল করে বলে—জঙ্গুলে জীব, ওরা কত ঝড়বৃষ্টি দেখেছে। ঠিক গাছে-টাছে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকবে। নইলে বন্ধ জায়গায় আঁকুপাঁকু হয়ে মরবে।
নয়নতারাকে দরজা খুলতে হয় না। খোলা মাঠের ওপর দিয়ে একটা ঝাপটা আসে। একমুখ ধুলো খেয়ে দুই বোন বেসামাল। খাঁচার পলকা পাল্লা খুলে যায় মড়াৎ করে। আর একসময়ে ধুলোর ঝড় ভেদ করে দৈববাণীর মতো ব্রজকর্তার গলার স্বর শুনতে পায় নয়নতারা। ব্রজগোপাল চেঁচিয়ে বলছেন—কোথাও কেউ আগুন জ্বালিস না। বাতিটাতি সব নিবিয়ে ফেল।
বেজিটা নিরিক থিরিক দৌড়োচ্ছে। বহেরুর পোষা বেজি, কিন্তু ও ঠিক পোষ মানে না কখনও। সুযোগ হলে, মন করলে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। বিন্দু চেঁচিয়ে বলে—ও দিদি, বেজিটাকে ধর।
পরপুরুষের মতো দামাল বাতাস এসে আঁচল উড়িয়ে দেয় গা থেকে। নিশেনের মতো শূন্যে আঁচল উড়িয়ে হাসে হা-হা করে। নয়নতারা আঁচল কোমরে বাঁধে আর তা করতে বেজির পিছু পিছু বিন্দু ধুলোর আস্তরণে কোথায় ঢেকে যায়। একা নয়নতারা একবার দৌড়ে যায় ব্রজগোপালের ঘরের দিকে। চেঁচিয়ে ডাকে—ও মা, ঘরে আছে তো?
ননীবালা ভয়ের গলায় চেঁচিয়ে বলেন—আমি আছি, কিন্তু ছেলে আর বাপ কোথা গেল দ্যাখ।
নয়নতারা হাসে। কে কাকে দেখে, দুর্যোগে আর বিপদে সবাই একা। এই ধুলোটে ঝড় আর মেঘ-বাদলে আজ যেন আবার এক প্রেত তাকে ডাকে। সংসারে পোঁতা তার খুঁটো আজ উপড়ে দিয়েছে ঝড়। নয়নতারা ধুলোর মধ্যে ডুব দেয়, বাতাসে ভাসে। খোঁপা খুলে এলো চুল মুঠো করে ধরেছে দুরন্ত পুরুষের মতো ঝড়। নয়নতারা দৌড়ে যায় এধার-সেধারে। অবিরল হাসে। আগুনের একটা ধমক নেমে আসে আকাশ থেকে। মাটি কেঁপে ওঠে। উত্তরের মাঠে একটা নীলচে বাজ পড়ল, স্পষ্ট দেখতে পেল নয়নতারা। একটু পরে শব্দটা হবে। সে কান চেপে ধরে। আর হি হি করে হাসে।
দমকে দমকে বাতাস বেড়ে গেল। উড়িয়ে আনছে গভীর ঘন গহীন মেঘ। কী বিপুল আকাশ জুড়ে আসছে প্রলয়। এইবার পৃথিবীর সর্বশেষ মহাপ্রলয়টি আসছে। কোনও নোয়া আর নৌকো তৈরি করেনি। টুবাই বুবাই আর মেয়েটাকে শেষবারের মতো চোখের দেখা হল বীণার সঙ্গে ফের ভালবাসার সম্পর্কে ফিরে যাওয়ার সময় হল না মহাপ্রলয় আসছে।
এক মহাভয়ে রণেন জামরুলতলায় দাঁড়িয়ে প্রকাণ্ড ঝড়ের চেহারাটা দেখছিল। চোখ দুটো বড় বড়, ঘন নিশ্বাস পড়ছে তার। বিড় বিড় করে একবার শিশুর মতো ডাকল- বাবা!
জামরুলের পাতায় পাতায় প্রবল শব্দ। পাখির বাসা ভেঙে পড়েছে পায়ের কাছে। প্রথমে লক্ষ করেনি রণেন, হঠাৎ চোখে পড়ল। ভাঙা ডিম ছড়িয়ে ছত্রখান। নিচু হয়ে দেখল ডিমের খোলা থেকে তলতলে তরল পদার্থ বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, আর তার মধ্যে না-হওয়া বকের ছানা গলা টানা দিয়ে মরছে। হায় ঈশ্বর! চমকা ভয়ে রণেনের বুক আঁকুপাঁকু করে ওঠে। ব্যাকুল হাত বাড়িয়ে সে বকের ছানার দলদলে শরীরটা তুলে নেয় হাতে। ন্যাতানো রোমহীন, লাল একটু অদ্ভুত জেলির মতো। হাতের তেলোর দিকে সভয়ে ঘেন্নায় কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে সে। তার দীর্ঘ চুলগুলিকে আঁচড়ে, বিলি কেটে চলে যাচ্ছে বাতাস, ফের মুঠোভর ধরে ছুঁড়ে মারছে কপালে। চুলের চিকের ভিতর দিয়ে নিজের হাতের তেলোর বীভৎস দৃশ্যটা দেখে হঠাৎ আবার হাতঝাড়া দিয়ে ফেলে দিল রণেন।
জামরুলতলা থেকে কয়েক পা হাঁটলে পুকুর। হাত ধুতে এসে অবাক হয়ে রণেন দেখে, কী গহীন গভীর কালো জল। মেঘের নিবিড় ছায়া বুকে ধরে কখন পাতাল-গভীর হয়ে গেছে জল। আর জলের ওপর একটা থিরথির কাঁপন। ক্রমে ঢেউ দুলে দুলে ওঠে। ছপাৎ করে জল উঠে জলে পড়ে যাচ্ছে। রণেন সেই অতল জলের কাছে এসে হাত ধুতে গিয়েও থমকে থাকে। পুকুরটা এক রহস্যময় পাতালের সুড়ঙ্গের মতো তাকে ডাকছে, টানছে, জল ছুঁলেই চুম্বকের মতো টেনে নেবে তাকে। গভীর গভীর এক তলহীন অসীম পাতালে নিয়ে যাবে।
তীব্র ভয়ে উঠে এল রণেন। আর্তস্বরে ডাকল, মা।
ধুলোর ঝড়ের প্রথম দমকটা এল। চোখে হাত চেপে বসে পড়ে রণেন। দুরন্ত বাতাস আসে মহাপ্রলয়ের অগ্রদূত হয়ে। এরপর সমুদ্রের আকাশপ্রমাণ জলরাশি আসবে। একশো তালবৃক্ষের উচ্চতা নিয়ে সমস্ত পৃথিবী ডুবিয়ে দিয়ে যাবে। কেউ থাকবে না। কেবল খুব উঁচু পাহাড়ের ওপর যারা আছে তারা বেঁচে থাকবে। বড় আফসোস হল রণেনের। আগে জানা থাকলে সে এ সময়ে ঠিক দার্জিলিঙে গিয়ে বসে থাকত সবাইকে নিয়ে।
চারদিকে ধূসরতার এক প্রবল রহস্য। তার মধ্যে সব কিছুই ছায়ার মতো অলীক হয়ে যাচ্ছে। গোঙানির শব্দ করে রণেন সাবধানে হাতের পাতার আড়াল করে চোখ খোলে। নাক দিয়ে হুড় হুড় করে তেজি বাতাস ঢুকে বেলুনের মতো ফুলিয়ে তুলছে ফুসফুস। শ্বাস টানতে হচ্ছে না, আপনা থেকেই বাতাস ঢুকে যাচ্ছে বুকের মধ্যে। তীব্র দমবন্ধ করা এক অনুভূতি হয়। ফুসফুসটা একটা পলকা লাল বেলুনের মতোই না ফটাস করে ফেটে যায়।
এখানে বহেরুর খড়ের গাদা। হামাগুড়ি দিয়ে সেই গাদায় উঠে আসে রণেন। মাচাটা মচমচ শব্দ করে। আর গাদার মাচার তলায় কয়েকটা ঘেয়ো কুকুর আর্তস্বরে চিৎকার করতে থাকে। রণেন খড়ের মধ্যে একটা গভীর খাঁজ দেখতে পেয়ে উঠে বসে। চারদিকে প্রকাণ্ড এক শব্দ হচ্ছে, খড় উলটে যাচ্ছে বাতাসে, উড়ে যাচ্ছে। একটা গুলঞ্চ গাছের ডাল মড়াৎ করে ভেঙে পড়ল। গাছে গাছে হাহাকার বেজে যাচ্ছে অবিরল।
অবোধ চোখে খানিকক্ষণ দেখল রণেন। ডানহাতের চেটোয় এখনও সেই ডিমভাঙা তরল পদার্থের চটচটে ভাব। খড়ের গায়ে হাতটা ঘাসে নিয়েও চটচটে ভাবটা যায় না। বড় ঘেন্না। বড় ভয়। কত পাখির বাসা ভাঙছে, ডিম ভাঙছে। কত বাড়িঘর ভেসে জলের অতিকায় ঢেউয়ের মতোই একটা মেঘ দিগন্তে উঠে আসছে। রণেন তীব্র একটা চিৎকার দিয়ে চোখ বুজল। ফের খুলল। ফের বুজল।
আপন মনে নিজেকে বলল—ওই আসছে।
এই সেই ভয়ংকর শেষ দিন। মহাপ্রলয়ের ঢেউ কি ওই? বোজা চোখ ফের খুলে ফেলল রণেন। দেখল, পর্বতপ্রমাণ একটা ঢেউ আকাশে মাথা তুলছে। তার কলকল ঘোর নিনাদ শুনতে পায় রণেন। বিশাল প্রবাহের মতো জলরাশি এসে গেল প্রায়।
এ সময়ে কে যেন চিৎকার করে ছুটে ছুটে বলছে—তোরা সব ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়া, ঘরে থাকিস না, গাছগাছালির কাছে যাস না।
বাবার গলা না! হ্যাঁ, বাবার গলাই। উৎকর্ণ হয়ে শোনে রণেন। চিৎকার করে ডাকে— বাবা!
কেউ উত্তর দেয় না। কিন্তু বাতাসের শব্দ ছুঁড়ে একটা অদ্ভুত শব্দ রণেনের কানে আসে। কে যেন এই দুর্যোগে খোল বাজাতে বসেছ। কী তীব্র বোল! রণেন শোনে খোল বলছে- ভয় নাই, ভয় নাই, ভয় নাই..
কী বলছে! বলছে—হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল…আয় ব্যাটা, আয় ব্যাটা, আয় ব্যাটা…হরিবোল….
রণেন লাফ দিয়ে নামল। একটা শেষ সাহস তার বুকের মধ্যে জ্বলে উঠেছে মশালের মতো। মরবই যখন, ভয় কী? আয়, জল, আয় ঝড়, আয়…
মুহুর্মুহু আগুনে আগুনে রং ছড়িয়ে বাজ পড়ছে চারধারে। কী প্রবল শব্দ! মহাপ্রলয়ের তীব্র ক্রোধ চারধারে আগুনের রং ধরিয়ে দিল। কে যেন ‘ভগবান’ বলে চেঁচিয়ে উঠে মূক হয়ে গেল। গভীর ধুলোর স্তরের মধ্যে আবছা হয়ে যায় সব কিছু।
রণেন পরনের কাপড়টায় কাছা মেরে নেয়। তারপর গুটি গুটি খোলা মাঠের মধ্যে এগিয়ে যেতে থাকে। তার সামনে দিয়ে এক বিশাল পেখমের বোঝা টেনে দৌড়ে যায় ময়ূর। কর্কশ একটা ডাক দেয়। আর বাতাসের তুমুল হট্টগোলের মধ্যে কাদের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। একবার কে যেন বুকফাটা চিৎকার দিয়ে ডাকল—রণো।
সে-ডাক শোনার সময় রণেনের নেই। মহাপ্রলয় তাকে ডাকে যে। ওই মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে একবার মুখোমুখি মৃত্যুর প্রকৃত স্বাদ জেনে নেবে। মাঠের মাঝখানটির দিকে বাতাস ভেদ করে রণেন দৌড়োয়।
টিনের চালে টুং টাং করে প্রথম কয়েকটা শিল পড়ল। তারপরেই হুড়মুড় করে পাথরের টুকরোর মতো বড় বড় খাঁজকাটা, হিংস্ৰ শিল পড়তেই লাগল। কয়েক পলকে সাদা হয়ে যাচ্ছিল মাঠ-ঘাট খামারবাড়ি। ভূতের ঢিলের মতো শিল এসে পড়ছে অন্তরীক্ষ থেকে, গড়িয়ে যাচ্ছে মাটির ওপর, লাফাচ্ছে। বরফের ঘর খুলে কে যেন উপুড় করে দিয়েছে।
শিলের প্রথম চোটটা গেল বহেরুর ওপর দিয়ে। কেলে গোরুর বোকা বাছুরটা গোয়ালে যায়নি। সেটাকে টেনে আনতে গিয়ে আধলা ইটের মতো একটা শিল তার বাঁ হাতের কবজি থেঁতলে দিয়ে গেল। আর গোটা দুই পড়ল মাথায় বাঁধা গামছা ভেজ করে ঘিলুতে। দাঁতে দাঁত চেপে বহেরু প্রথমটা সামলে নিল। গোয়ালে ঢুকে বিড় বিড় করে গাল দিল দুর্যোগকে।
কপাল থেকে রক্তের ধারা নেমে ভাসিয়ে দিচ্ছিল নয়নতারার মুখ। রক্তের নোনা স্বাদ জিভে ঠেকাতেই তার সম্বিত ফিরে আসে। ভূতটা ছেড়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে আচম্বিতে একটা বন্ধ দরজায় ধাক্কা দেয়। কার দরজা ঠিক ঠাহর হয় না।
ননীবালা দরজা খুলে চেঁচিয়ে বলেন—ও মাগো! কী হল তোর?
—কিছু নয় মা, শিল পড়েছে।
ননীবালা তাকে ঘরে টেনে নিয়ে দরজাটা ফের বন্ধ করে বলেন—ছেলে আর ছেলের বাপের জন্য বুক শুকিয়ে যাচ্ছে মা। কোথায় যে গেল।
—ফেরেনি?
ঘটির জলে কপালটা ধুয়ে নিল নয়নতারা। ননীবালা দেখে বললেন—অনেকটা কেটে গেছে। খুব ফুলেছে। একটু ডেটল দে।
নয়নতারা হেসে মাথা নেড়ে বলল—ওতে কিছু হবে না। যাতে চোপাট, তাতেই লোপাট।
এই বলে ঘোমটা দিয়ে বাইরে থেকে একটা শিল কুড়িয়ে আনল। সেইটে কপালের কাটা জায়গায় চেপে ধরে বলল—ব্রজকর্তার জন্য চিন্তা নেই মা, তবে রণেনবাবু..
শিল পড়ার শব্দ শেষ হয়নি তখনও, বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। দামাল বাতাস পৃথিবীর সব মেঘ উড়িয়ে আজ আকাশে। কলের জলের মতো মোটা ধারায় জল নেমে আসছে। অবিরাম, অবিশ্রাম। চারদিক গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যায়। আর তখন ব্রজগোপাল রণেনকে মাঠ থেকে তুলে আনছেন। তার কানের কাছে বলছেন-না বাবা, তোমার খুব চোট হয়নি। শিলটা জোর পড়েছিল। বাবলা গাছটার জন্য বেঁচে গেছ!
—বাবা, মহাপ্রলয় হবে। রণেন বলে। তার ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। একটা চোখ ফুলে আছে। ব্রজগোপালের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটছে।
ব্রজগোপাল অজস্র বৃষ্টির ধারায় ভিজে যাচ্ছেন রণেনের সঙ্গে। তবু হেসে বললেন—হবে হলে। ভয় কী?
—বড় ভয় বাবা। সব মরে যাবে।
ব্রজগোপাল তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন—বিশ্বাস বাবা, বিশ্বাসই সব সার কথা। যতক্ষণ না মরণ আসছে ততক্ষণ তো তাঁর দয়ায় বেঁচে আছি। আর যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণ কিছুতেই মৃত্যু নেই।
বৃষ্টি থেমে যায়নি তখনো। পড়ছে। তবে এখন একটানা, একঘেয়ে জলের শব্দ। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া দিচ্ছে। ঘরের মধ্যে হারিকেনের আলো উসকে উঠছে সেই বাতাসে।
রণেন শুয়ে আছে বিছানায়, তার পাশে পা ঝুলিয়ে বসে ননীবালা। মেঝেয় বসে এক বাটি দুধ স্টোভে গরম করছে নয়নতারা। এখনও তার কপাল আব হয়ে ফুলে আছে। বলল—মা, রান্নাঘর তো ভেসে ভেসে গেছে। এ ঘরেই আজ তোলা উনুন জ্বেলে দিই?
ননীবালা পানের পিক ফেলে এসে বললেন—দে। বহেরুকে বলব কালই রান্নাঘরটা মেরামত করতে।
রণেন চোখ বুজে শুয়ে হিজিবিজি ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ভাবল—নয়নতারা কেন তার মাকে মা ডাকে। অ্যাঁ! ভাবতে ভাবতে খুবই উত্তেজনা বোধ করল সে। পাশ ফিরে নয়নতারার দিকে তাকাল।
ব্রজগোপাল ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে এলেন। ছাতা মুড়ে রাখলেন দরজার পাশে।
ননীবালা একবার চেয়ে দেখে বললেন—নিউমোনিয়াটি না বাঁধালে আর চলছে না? এই বয়সে অত ভেজা কি সইবে? কে শোনে কার কার কথা!
ব্রজগোপাল গায়ের পিরানটি খুলে ফেললেন। বললেন—প্রতিবারই ঝড়জলে নানা ক্ষয়ক্ষতি হয়। কাল সকালে সব বোঝা যাবে। বলে ননীবালার দিকে চেয়ে চেয়ে কুণ্ঠিতভাবে বললেন—আজ তো আর যেতে পারলে না। কলকাতার বাসার জন্য খুব চিন্তা করছিলে!
—যাওয়া আর হল কই?
ব্রজগোপাল শুকনো কাপড় পরতে পরতে বললেন—তা হলে কাল যাবে? কখন যাওয়া জানিয়ে রাখলে রিকশা বলে রাখবে বহেরু।
ননীবালা উত্তর দিলেন না। নয়নতারাকে বললেন—কী এক রসকষ ছাড়া পান সেজেছিস বল তো! আর একটা ভাল করে সাজ।
নয়নতারা দুধের বাটির জ্বাল রেখে পান সাজতে বসে।
ব্রজগোপাল ফের বলেন—কল কখন যাওয়া?
ননীবালা হঠাৎ ঝেঁঝে উঠে বলেন—না গেলে তাড়িয়ে দেবে নাকি? কেবল যাওয়া-যাওয়া করছ কেন?
॥ সাতান্ন ॥
বীণা বিরক্ত হয়ে এসে বলে—একটু আগে কে একটা মেয়ে তোমার কাছে এসেছিল বলো তো!
সোমেন ছুটকো কাগজে কিছু লিখবার চেষ্টা করছে, হচ্ছে না। সিগারেটের ধোঁয়ায় চারদিক আবছা। বুকে বালিশ চেপে উপুড় হয়ে শুয়েছিল সোমেন, বীণার দিকে একবার অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে বলল—চা খাওয়াবে নাকি এক কাপ?
বীণা বলে—বেলা এগারোটায় চা? এটা কি রেস্টুরেন্ট! যাও, চান করে এস, ভাত খাবে। এখন আমার অনেক কাজ।
সোমেনের অন্যমনস্কতাটা কেটে গেল, হেসে বলল—মা আর দাদা আউট হওয়ার পর থেকেই তো তোমার সামার ভ্যাকেশন চলছে। অত কাজ দেখিয়ো না।
—ইস, সামার ভ্যাকেশন! তিনটে বাচ্চা আর তুমি একটা বুড়ো খোকা, মোট চারটের ঝামেলা কি কম নাকি! টুবাইটা মার খুব ন্যাওটা, ওটাকে আমি সামলাতেই পারি না। ঠাকুমা গল্প বলে খাওয়ালে বেশ খেত, যেই ঠাকুমা চলে গেছে অমনি ওকে অরুচিতে ধরেছে। আমিও গল্প বলি, কিন্তু সে গল্প ওর পছন্দ নয়। সারাদিন ওকে খাওয়ানোর জন আমার হাড় কালি হয়ে গেল। ওঁরা যে কবে আসবেন!…তিনদিনের নাম করে গেলেন, পাঁচদিন হয়ে ছদিন চলছে।
—চায়ের কথাটা দিব্যি ম্যানেজ করে চাপা দিলে কিন্তু।
বীণা স্নিগ্ধ চোখে দেওরটির দিকে চেয়ে একটু হাসে। এই ছেলেটির প্রতি তার একরকম মা-ভাব আছে। বুবাই টুবাইয়ের মতোই যেন আর একজন।
বীণা ননীবালার চৌকিটায় বসে বলে—আর তুমি যে ওই মেয়েটার কথা চেপে যাচ্ছ! কে মেয়েটা? খুব গাড়ি হাঁকড়ে আসে।
সোমেন কাগজে হিজিবিজি লিখতে লিখতেই বলল—খুব বড়লোকের মেয়ে, বুঝলে! প্রসপেকটিভ!
—সে হোকগে। মেয়েটার কিন্তু মাথায় ছিট আছে।
—কেন? সোমেন হেসে জিজ্ঞেস করে।
বীণা মুখটা গোমড়া করে বলে—বাসায় আসে তো প্রায়ই, একদিনও আমার সঙ্গে কথা বলল না। এমনকী বাচ্চাগুলো কাছে গেলে একটু আদর করা কী কথা বলা দূরে থাক, একবার ভাল করে তাকায় না পর্যন্ত। এ বাড়িতে ও কেবল তোমাকে দেখে, কেন আমরা কী নেই? পুরো ছিটিয়াল।
—ছিট আছে কিনা কে জানে, তবে মাথায় টিউমার আছে। বলে সোমেন বউদির দিকে চেয়ে একটু হাসে, পরমুহূর্তেই হাসিটা মিলিয়ে একটু বিষন্নতার মেঘের ছায়া পড়ে মুখে। বলল—ব্রেন টিউমার। বোধ হয় বাঁচবে না।
—যাঃ। বীণা বিশ্বাস করতে চায় না।
—সত্যি।
বীণা চোখ দুখানা বড় করে বলতে আমি ভাবলাম বুঝি এই মেয়েটাই একদিন আমার জা হয়ে আসবে। তাই আনসোশ্যাল দেখে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
সোমেন খুব হাসল, বলল—মেয়েদের সঙ্গে একটু মিশলেই প্রেম হয়, আর প্রেম হলেই বিয়ে হয়, না? তুমি একদম সরল অঙ্ক।
—আহা, দোষ কী! ভাব হলে বিয়ে হওয়াই তো ভাল। মেয়েটা তোমাকে খুব পছন্দ করে। তোমাকে ছাড়া কাউকে চেনেই না। বিয়ে হলে বেশ হত। আমি তো গরিব ঘরের মেয়ে, তোমার বউ অন্তত বড়ঘরের মেয়ে হলে ব্যালান্স হয়ে যেত। সত্যি বলছ ব্রেন টিউমার?
—সত্যি। না হলে কি আমাকে পাত্তা দিত নাকি? অসুখ হয়েছে বলেই মনটা নরম। সবাইকেই পছন্দ করে ফেলে। যাও, অনেক বকিয়েছ, চা দাও তার বদলে।
বীণা উঠে গেল।
বিকেলে গাব্বুকে পড়াতে গেছে সোমেন। পড়ার ঘরে ঢুকেই চমক খেল। গাব্বু যে চেয়ারে বসে সেখানে খুব সুন্দর মতো একটি মেয়ে বসে আছে। পরনে চমৎকার একটা লালপেড়ে সাদা খোলের বিষ্ণুপুরী শাড়ি। মেয়েটি টেবিলের ওপর ঝুঁকে কী যেন পড়ছে। তার এলোচুলের ঢল নেমে এ পাশে মুখটাকে আড়াল করেছে। সোমেন ঘরে ঢুকতে মেয়েটা মুখ ফেরাল না।
তারপর সেই নিবিড় নরম এলোচুলে ঢেউ দিয়ে মুখটা নড়ে উঠে সোমেনের দিকে চকিতে ফিরল। তখনই ভারী পাওয়ারের চশমাটা চিনতে পারে সোমেন।
অণিমা হেসে বলে—এস সোমেন।
অণিমাকে চেনাই যায় না। ইউনিভার্সিটিতে থাকতে একটু রুক্ষ ছিল, বিয়ের আগে দিল্লি ঘুরে এসে একটু ভাল হয়েছিল চেহারা। কিন্তু এখন কে যেন ওকে নতুন করে গড়েছে। শরীরে মাংস বা চরবি লাগলেই মানুষ সুন্দর হয় না। সুন্দর হওয়া এক রহস্যময় অ্যালকেমি। সৌন্দর্যের সবটুকু শরীরে থাকে না বুঝি। অণিমার শরীরকে ঘিরে এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের আবহ। তার চারধারের বাতাসটুকু, আলোটুকু গন্ধটুকু সবই যেন সুন্দর হয়ে আছে। বড় বেশি দূরের আর বড় বেশি অভিজাত হয়ে গেছে অণিমা।
সোমেন হাঁ করে চেয়েছিল। একটা ঢোঁক গিলে বলল—কবে এলে?
কাল।
সোমেন মুখোমুখি চেয়ারে বসে বলল—সিন্ধ্রির জলবায়ু তো বেশ ভালই অণিমা।
অণিমা খুব শান্ত ও সুখী একরকম হাসি হাসল। এবং সোমেন খুব দুঃখের সঙ্গে বুঝতে পারল, অণিমার মনে আর কোনও দুঃখ নেই। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ও সোমেনের ঘটনাটা থেকে মুক্ত হয়েছে।
অণিমা বলল—হাওয়া বদল করতে সিন্ধ্রিতে যেয়ো একবার।
সোমেন খুব বিষণ্ণ বোধ করছিল হঠাৎ, তবু যথেষ্ট চতুর হওয়ার চেষ্টা করে বলে-ভাল আছ তো দেখতেই পাচ্ছি। তবু জিজ্ঞেস করি—অণিমা, কেমন আছ?
অণিমা ভ্রু কুঁচকে বলে—ও আবার কী রকম প্যাঁচালো কথা সোমেন?
সোমেন স্থির চোখে চেয়ে বলে—অণিমা, কেমন আছ?
অণিমা খুব হাসল, তারপর হাসি থামিয়ে একটু স্মিতভাবে বলল—ভাল আছি বলতে ভয় করে সোমেন। বললে যদি আর ভাল না থাকি।
সোমেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—অণিমা, পৃথিবীতে মেয়েদের মতো এত সুখী কেউ নেই।
—ওমা! কী বলে রে ছেলেটা!
—সত্যি। যদি মেয়ে হতাম তবে চাকরির চিন্তা থাকত না। এই বয়সে একটা বিয়ে হয়ে যেত। আর বিয়ের আগেকার সব কিছু ভুলে গিয়ে সুখী হতে সময় লাগত না।
—অ্যাই! বলে ধমক দিল অণিমা—বিয়ের আগে তোমার আবার কী ছিল, যন্ত্রণা যা ছিল তা তো আমার ছিল।
সোমেন সেটা জানে, তবু দুঃখও তো কত রকমের হয়। আজ যেমন মনে হচ্ছে সে অণিমাকেই ভালবাসত। ভালবাসাটা আজ যেন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। এক তীব্র টান আজ কূল ভাঙছে, পায়ের নীচের মাটি সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বলল—সে তুমি বুঝবে না।
—মিথ্যে কথা বোলো না সোমেন।
বলে অণিমা চেয়ে রইল সোমেনের দিকে। চোখে বুঝি একটু অনুযোগ, একটু স্নেহ।
সোমেন বলল—অণিমা, এখনও চাঁদ-টাঁদ ওঠে, ফুল-টুল ফোটে, লোডশেডিং হয়…
অণিমা দুটি গায়ে হলুদের সময়কার মতো সুন্দর লালচে-হলুদ রঙের হাতের পাতায় লজ্জায় মুখ ঢাকল। বলল—অ্যাই।
সোমেন ঝুঁকে বলে— কথাটা এখনও বলা হয়নি স্পষ্ট করে। তবু জিজ্ঞেস করি—অণিমা, এখনও কি আমাকে…
অণিমা মাথা নেড়ে বলে—না অমরনাথ, লোকে পাখি পুষিলে যে স্নেহ করে, ইহলোকে তোমার প্রতি আমার সে স্নেহও কখনও হইবেনা। বলে একটু দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বলল—বলো তো কোথা থেকে বললাম।
সোমেন মৃদু হেসে বলে— রজনী। তারপর গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলে—এই বুঝি মনের কথা?
—নয় কেন? বলে অণিমা উঠল। টেবিলে ভর রেখে ঝুঁকে বলল—তুমি আমার কে জানিতে চাও? এ পৃথিবীতে তুমি আমার কেহ নও। কিন্তু যদি লোকান্তর থাকে—
কেউই তেমন হাসতে পারল না। চেষ্টা করল অবশ্য।
অণিমা বলল—দাঁড়াও গাব্বুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
বলে চলে গেল অণিমা। আর তখন অপসৃয়মান অণিমার পরনের শাড়িটা লক্ষ করে কী যেন মনে পড়ি-পড়ি করছিল সোমেনের। ভ্রূ কুঁচকে একটু ভাবল সে। তারপর হঠাৎ মাথার ভিতরে বজ্রাঘাতের মতো মনে পড়ল, এ শাড়িটা সে অণিমার কাছ থেকে টাকা ধার কিনে দিয়েছিল অণিমাকেই। সেই দেড়শো টাকা আজও শোধ দেওয়া হয়নি। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল সোমেন। ওই শাড়িটা কি ইচ্ছে করেই পরে বসেছিল অণিমা, সোমেনকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য? ছি ছি, তা নয়। অণিমা ছোট মনের মানুষ ছিল না কোনওদিনই।
গাব্বু আসতেই সোমেন দাঁড়িয়ে বলল—আজ পড়ব না গাব্বু। শরীরটা ভাল নেই।
হতাশা, ব্যর্থতা আর বিস্বাদে ভরা ভিতরটাকে নিয়ে সোমেন বেরিয়ে পড়ল। উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরতে লাগল। দেড়শোটা টাকা এমন কিছু নয়। যখন দেওয়ার কথা মনে করেছে তখন হাতে টাকা ছিল না, যখন টাকা ছিল তখন দিতে ভুলে গেছে। এইসব তুচ্ছ কর্তব্যের অবহেলা কী ভয়ংকর! নিজেকে দেউলিয়ার মতো লাগে। অপমান করতে আর চাবকাতে ইচ্ছে করে নিজেকে। একটু আগে অণিমার সঙ্গে যে চমৎকার সাংকেতিক সংলাপ হচ্ছিল তার সেইটুকুর রেশ গেল কেটে। নিজেকে বড় ছোট লাগছে তার। সোমেন খুব উত্তেজিতভাবে মনে মনে বলল—আই মাস্ট পে হার ব্যাক। আই মাস্ট…
এতই স্তিমিত ছিল সোমেন যে রাতে ঘুমই হল না। নিজেকে অসহ্য বলে মনে হচ্ছে। মানুষের মুশকিল এই যে, দরকার পড়লে সে সব মানুষকে এড়িয়ে থাকতে পারে, কিন্তু কিছুতেই নিজেকে এড়াতে পারে না। অহরহ সোমেনকে একটা অপদার্থ, ছোটলোক সোমেনের সঙ্গ করতেই হবে, মৃত্যু পর্যন্ত।
নির্ঘুম রাতের শেষে সকালের দিকে একটু বুঝি ঘুমিয়েছিল, বউদি এসে তুলে দিয়ে বলল, বাজারে যাও।
চোখ খুলেই সোমেন বলল—দেড়শোটা টাকা দেবে বউদি?
বীণা অবাক চোখে চেয়ে বলল—আগেও একবার চেয়েছিলে। কী ব্যাপার, প্রায়ই দেড়শো করে টাকার দরকার হচ্ছে কেন?
—সেই দরকারটাই। টাকাটা তখন কারও কাছে পেলাম না। দেবে?
বীণা থামল। যদিও হাসিটা বড় কষ্টের। বলল—খুব দরকার থাকলে দেব।
—খুব দরকার, খুব। না হলে সুইসাইড করব।
—আচ্ছা আচ্ছা, তোমার দাম দেড়শো টাকার ঢের বেশি। ওঠো।
সোমেন ঘুমচোখে শুয়ে থেকেই সিগারেট ধরাল। বলল—যাঃ। দেড়শো টাকার দাম আমার চেয়ে অনেক বেশি বউদি, আমি একটা ফ্রড।
—তার মানে?
—অচল পয়সা। তুমি ইংরেজি জানো না কেন বলো তো! সব কথার মানে বলতে গেলে মুড নষ্ট হয়ে যায়।
—যাওয়াই ভাল। আজ তোমার মুড খুব খারাপ। কালও বিকেলে দেখেছি একদম মৌনিবাবা হয়ে আছে। কী হয়েছে?
—আমার মৃত্যু হয়েছে বউদি। আই অ্যাম ডেড।
—সকলবেলাটায় আকথা বলছ? বাজারে যাও তো।
—দেড়শো টাকা দিতে তোমার খুব কষ্ট হবে?
বীণা আবার হাসল। বলল—এসব তোমাকে ভাবতে হবে না। দেব বলেছি যখন ঠিক দেব। আর দিয়ে মরে যাব না।
বাজার করে যখন ফিরছিল সোমেন তখন হঠাৎ একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। বাড়ির দরজায় যখন প্রায় পৌঁছে গেছে, তখন দেখল, বড় রাস্তার দিক থেকে মা আর দাদা হেঁটে হেঁটে আসছে। মার হাতে একটা পুঁটুলি, দাদার হাতে চামড়ার ব্যাগ। দুজনেরই পোশাক কেমন আধময়লা। উদ্বাস্তুর মতো ভিখিরির মতো আসছে। সম্ভবত বাসে এ সে নেমেছে, তারপর এই রাস্তাটুকু হেঁটে আসছে। অথচ একসময়ে দাদা ট্যাক্সি ছাড়া আর কিছু চোখে দেখত না।
সোমেন সিগারেটটা ফেলে দিয়ে এগিয়ে দাদার হাত থেকে ব্যাগটা নিল। মা তাকে দেখে বলল—ইস্ অফিস টাইমে সব বাসে কী ভিড় কী ভিড়! ট্রেনেও থিকথিক করছে লোক। বাব্বাঃ!
খুব একটা খুশি হল না সোমেন। যেন অচেনা লোকজন এল বাড়িতে। এ কয়দিন নিরিবিলিতে বেশ ছিল। এবার উৎপাত হবে।
মাকে কিছু গম্ভীর ও অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। ঘরে এসেই তিনি ছোট নাতিকে কোল-সই করে নিয়ে পানের বাটা খুলে বসলেন। রণেনের মুখে কিছু কাটা দাগ, ক্লান্তির চিহ্ন। সোমেন সবই দেখল, কোনও প্রশ্ন করল না। মনটা শুধু আর এক পোঁচ কালো হয়ে গেল।
ভাইঝিটার নাম আদর করে রেখেছিল বেলকুঁড়ি। বেলকুঁড়ি একটু হইচই ভালবাসে। রেডিয়োগ্রাম ছেড়ে গলা মিলিয়ে গান গায়, নাচে, বাড়িতে লোকজন এলে খুব খুশি হয়। ঠাকুমা আসাতে সে সারা বাড়ি নেচে বেড়াচ্ছে। একবার দৌড়ে এসে ঠাকুমার বুকের মধ্যে হাত পুরে মুনু ধরে গেছে, এখন হাততালি দিয়ে সুর করে গাইছে-‘ঠানু এসেছে, বাবু এসেছে, ঠানু এসেছে, বাবু এসেছে…’
সোমেন তাকে একটা কর্কশ ধমক দিয়ে বলে-যা তো এখন।
ননীবালা পানের রসে রসস্থ মুখটা ঊর্ধ্বপানে তুলে পানের পিক যাতে বের না হয় এরকম সতর্ক হয়ে বলেন—যাবে কোথায়! কলকাতার বাড়িঘরে থাকে, যা বললেই তো আর হুট করে বেরিয়ে যেতে পারে না। কোন মাঠঘাট ময়দানটা আছে এখানে যে যা বলতেই যাবে।
সোমেন গম্ভীরভাবে জামা পরতে পরতে বলে—তা হলে আমিই যাই।
ননীবালা বড় চোখে তাকিয়ে বলেন—কোথায় যাবি?
—তাতে তোমার কী দরকার! যাব কোথাও।
ননীবালা পিক ফেলে এসে বললেন—বাড়িতে এখনও ভাল করে পা দিইনি, ওমনি সব বিষ হয়ে গেল!
সোমেন বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ল ফের।
কিন্তু জায়গা নেই। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
অনেক ভেবেচিন্তে মধুমিতাকে একটা ফোন করল সোমেন।
ফোনের কাছেই সারাদিন বসে থাকে মধুমিতা। হয় ওকে কেউ ডাকে, অনেকক্ষণ কেউ না ডাকলে ও-ই কাউকে ডাকে।
মধুমিতার উৎসুক গলা, বলল—কে?
—আমি সোমেন। একবার আসব? আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে।
—এক্ষুনি। উঃ, কতক্ষণ একা বসে আছি।
কী চমৎকার বাড়ি মধুমিতাদের! সোমেনদের পচা ভাড়াটে বাড়ি থেকে মাত্র সাত মিনিট হাঁটলেই এই স্বর্গের বাড়ি। রিখিয়াদের চেয়েও এরা অনেক বড়লোক।
মধুমিতা তার ঘরে নিয়ে গেল। চাকরকে ঠান্ডা কিছু দিতে বলে মুখোমুখি বসল সোফায়। ওর প্রিয় ভঙ্গী পা তুলে হাঁটু দুহাতে জড়িয়ে বসা। বসে বলল—ডেট ঠিক হয়ে গেছে।
—কীসের?
—ইমপ্রিজনমেন্ট টিল ডেথ। কাল ভেলোরে চলে যাচ্ছি। সব ঠিক হয়ে গেছে—
—ওঃ। বলে চুপ করে থাকল সোমেন।
মধুমিতাকে খুব বিষন্ন দেখাচ্ছিল না। ওর গোল মুখখানায় একটা চাপা হাসির আলো খেলা করছে। হঠাৎ খুব জোর একটা শ্বাস ফেলে বলল-রিলিফ। একটা একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি।
—সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো। সোমেন সান্ত্বনা দিয়ে বলে।
মধুমিতা তার বড় চোখে চেয়ে বলল—শোনো তুমি কিন্তু বড্ড মেয়েদের সঙ্গে মেশো।
—কে বলল?
—আমি জানি। তোমার অনেক মেয়ে বন্ধু।
সোমেন এই পুঁচকে মেয়েটার মুখে জ্যাঠা কথা শুনে একটু উত্তপ্ত হয়ে বলে—তাতে কী?
—পুরুষমানুষ মেয়েদের সঙ্গে বেশি মিশলে খারাপ দেখায়। অপরাজিতার সঙ্গে যেদিন তুমি ক্যারাম খেলছিলে, আমার খুব খারাপ লাগছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা মেয়ের সঙ্গে একটা পুরুষ খুটখাট ক্যারম খেলছে, এই কি পুরুষের মতো কাজ?
সোমেন আর রাগে না। হাসে। বলে—শোনো মধু, তুমি বড় পাকা। আমার বয়স কত জানো?
মধুমিতা মাথা নেড়ে বলে—সে যাই হোক, আমি জানতে চাই না। আমার ওয়েলউইশারদের সকলের ভাল হোক, মরবার আগে আমি সেটুকু চাই।
সোমেন হতাশভাবে চেয়ে থেকে বলে—আমার জন্য কী চাইলে তুমি।
—মেয়েদের সঙ্গে মিশো না। যখন একা লাগবে তখন একাই থেকো। আর একা বসে চিন্তা কোরো যে, তোমার চারদিকে একটা বিশাল দেশ। সে দেশটা কাঙাল আর ভিখিরিতে ভরা। থিংক সামথিং গুড ফর দেম।
সোমেন হেসে বলে—তুমি বড় পাকা মধু।
মধুমিতা মাথা নাড়ল। চাকর ট্রেতে করে ঠান্ডা আমের শরবত দিয়ে গেল। গেলাসটা সোমেনের হাতে তুলে দিয়ে মধুমিতা বলে—সব সভ্য দেশেই আমার বয়সি ছেলেমেয়েরা আরও অনেক বেশি কনশাস। একে পাকা বলে না, জাস্ট ওয়েল ইনফর্মড। সোমেনদা, তোমার কোনও আইডিয়াল নেই কেন? আইডিয়াল না থাকলে মানুষটা স্ট্রং ওপিনিয়ন তৈরি হয় না। ব্যক্তিত্বও থাকে না।
সোমেন ঠান্ডা শরবত খেতে খেতে আবার উত্তপ্ত হল। কান আগুনের মতো গরম। বলল—তাই বুঝি?
মধুমিতা মৃদু একটু হেসে চুলগুলো সরিয়ে দিল পিছনে। কোলের বালিশটা একবার ছুঁড়ে ফেলে ফের কুড়িয়ে নিল। বলল—তুমি টের পাও না যে তুমি কত ডিটাচড? তোমার চারদিকের সঙ্গে তোমার কোনও সম্পর্কই তৈরি হয়নি। কোনও ব্যাপারেই তোমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। কেবল মাঝে মাঝে চাকরির কথা বলো। চাকরিই কি সব? কত ছেলে জেলখানায় পচছে তা জানো? ওরা কিছু করতে চেয়েছিল। ইউ মাস্ট বি কনশাস অ্যাবাউট ইয়োর এনভিরনমেন্ট।
—মধু, আজ তোমাকে কথায় পেয়েছে।
মধুমিতা উঠে এল সোমেনের পাশে। অনায়াসে পুরুষ বন্ধুর মতো কাঁধে হাত রেখে বলল—শোনো সোমেনদা। উই আর কমরেডস। নই কি? অ্যান্ড কমরেডস আর অলওয়েজ লাভারস। আমি সব সময়ে চাই, আমি যাদের ভালবাসি তারা সবাই আরও লাভেবল হোক। তুমি রাগ কোরো না।
সোমেন মুখ ফিরিয়ে মধুমিতার মুখ দেখল। খুব কাছেই ওর মুখ। গোলপানা, সুন্দর। এত কাছে বসে আছে বলে ওর গা থেকে মেয়েদের শরীরের অবধারিত রূপটান এবং সুগন্ধীর গন্ধ আসছে। আর সে গন্ধ ভেদ করে আরও একটা মাদক গন্ধ আসে। কিশোরীর শরীরের স্বেদগন্ধ।কিন্তু তবু ওর প্রতি কদাচিৎ শরীরের আকর্ষণ বোধ করেছে সোমেন।কোথাও যেন ওর মেয়েমানুষির মধ্যে পুরুষালির একটু ভেজাল ঢুকে আছে। প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই মনে হয়। মধুমিতার হাঁ মুখ থেকে মৃদু শ্বাসবায়ু এসে স্পর্শ করল সোমেনের মুখ। সোমেন মাথা নেড়ে বলল—ঠিক মধু। তুমি ভুল বলোনি। আই হেট মিসেলফ। নিজের ওপর আমার মাঝে মাঝে বড় ঘেন্না হয়। কিন্তু নিজের সঙ্গ কি করে ছাড়ি বলো তো।
মধুমিতা তার চুল নেড়ে দিয়ে বলে—তুমি একটু ‘নাটি’ সোমেনদা। সেইজন্যই তোমাকে ভালবাসতাম।
—বাসতে! এখন বাসো না?
মধুমিতা হেসে বলে—বাসি। এখন আমি কত লোককে যে ভালবাসতে পারি। মরে যাব তো, তাই এখন বড্ড সবাইকে ভালবাসতে ইচ্ছে করে।
মধুমিতার মুখখানা আর একবার ভাল করে দেখে নিল সোমেন। দেয়ালের গায়ে টেলিফোন বাজছে। মধুমিতা চমকে উঠে দাঁড়াল, বলল—কে ডাকছে!
বলে ছুটে গেল। কী গভীর আগ্রহে তুলে নিল টেলিফোন, বলল—জয়! ওঃ জয়! কমরেড, কাল চলে যাচ্ছি। আই লাভ ইউ ডারলিং, ইউ নো…
ঠান্ডা স্রোত নেমে যাচ্ছে কণ্ঠনালী বেয়ে। তবু ভিতরের জ্বর উপশম হচ্ছে না সোমেনের।
সোমেন উঠে দাঁড়াল। টেলিফোন রেখে চলে এল মধুমিতা, অবাক হয়ে বলল—চলে যাচ্ছ! আড্ডা মারবে বললে যে!
—না, যাই। বেলা হল, মা বসে থাকবে।
মধুমিতার চোখ একটু ছলছলে হয়ে এল, কিন্তু হাসিটা অনাবিল রইল মুখে হঠাৎ ডান পাশের গালটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল—কিস মি গুডবাই।
সোমেন ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করল না, হাত দিয়ে ছুঁল ওর গাল, বলল—ভাল হবে। তোমার ভাল হবে।
মধুমিতা তার হাতটা দুহাতে চেপে নিজের গালে ঘষল খানিক। আবেগে, ভালবাসায়। বলল—আর কখনও দেখা হবে না। মধুমিতাকে মনে রেখো।
কোনওদিন কাঁদে না সোমেন। আজ রাতে একা শুয়ে চোখের জলে বালিশ ভেজাল। নিজের মনে নিজেকে ডেকে বলল—কিল ইয়োরসেলফ, কিল ইয়োরসেলফ রাস্কেল।
॥ আটান্ন ॥
কুমারস্বামী সবাইকে জিজ্ঞেস করছেন—কি খাবি তোরা? অ্যাঁ! আম খাবি, নাকি রসগোল্লা? অজিত, তুই?
অজিত আজকাল একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। জলে ডুব দিলে যেমন চারদিক আবছায়া দেখায়, তেমনি তার বাস্তববোধ বড় আবছা। সে অপলকে কুমারস্বামীর দিকে চেয়েছিল। প্রশ্ন শুনে একটু নড়ে উঠে গভীর শ্বাস ছেড়ে বলে—আপনি যা দেবেন।
ভক্তবৃন্দ অপলকে চেয়ে আছে কুমারস্বামীর দিকে। সবাই জানে, এবার বাবা বিভূতি দেখাবেন। কারও শ্বাস পড়ে না। কুমারস্বামী খুব সপ্রতিভ হেসে হাতটা শূন্যে তুলে এত দ্রুত আঙুলের একটা ঘূর্ণায়মান মুদ্রা তোলেন যে আঙুলগুলো যেন অদৃশ্য হয়ে যায় বাতাসে। পরমুহূর্তেই দেখা যায় তাঁর হাতে একটা ভ্যাকুয়াম প্যাকড রসগোল্লার টিন।
—জয় বাবা! জয় বাবা! ধ্বনি করে ওঠে ভক্তেরা। সেই প্রথম দিন এসে অজিত যে ম্যাজিস্ট্রেটকে চিত হওয়া অবস্থায় দেখেছিল আজ সে পাশেই বসেছে। সে লোকটা অজিতের উরু খামচে ধরে বলে উঠল—দেখেছেন! ইনিই হচ্ছেন দি গড। দি গড!
এই বলে লোকটা সম্মোহিতের মতো এগিয়ে গিয়ে কুমারস্বামীর পা ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু তাঁর সব সময়ের জন্য যাঁরা সেবায় নিযুক্ত আছেন এমন অন্তরঙ্গ শিষ্যদের একদল ধমক দিয়ে বলল—ছোঁবেন না! ছোঁবেন না!
লোকটা ফিরে এসে অজিতের পাশে বসে বলল—মনে ছিল না, হাইপারসেনসিটিভ অবস্থায় ওঁকে ছুঁতে নেই।
কুমারস্বামী আবার হাত বাড়িয়ে একই মুদ্রায় দ্রুত কয়েকটা আম পেড়ে আনলেন শূন্য থেকে। ডাকলেন—অজিত!
অজিত মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিল। পামিং নেই পাসিং নেই, কোটের ভিতর থেকে কোনও গুপ্ত ইলাস্টিকের ব্যান্ড দিয়েও আনা হচ্ছে না, তবু কোথা থেকে আম আসছে। রসগোল্লার টিন আসছে! এই কি তা হলে বহুশ্রুত অলৌকিক? এই কি সিদ্ধপুরুষ!
—আজ্ঞে। অজিত নীলডাউনের ভঙ্গিতে বসে বলল।
—কী খুঁজছিস? পামিং আর পাসিং? বলে চমৎকার ভরাট প্রাণময় হাসি হাসেন কুমারস্বামী। মাথা নেড়ে বলেন—ওসব নয় রে!
বলে কুমারস্বামী খুব অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইলেন। যিশুর মতো সুন্দর মুখশ্রী কেমন বিষন্ন হয়ে গেল! তাঁর অন্তরঙ্গ শিষ্যরা কৌটো খুলে রসগোল্লা বিতরণ করছে সবাইকে, আম ভাগ করে দিচ্ছে। মহাপ্রসাদ বলে সবাই কাড়াকাড়ি করে। ঠিক এই সময়ে কুমারস্বামী খুব নিচু, অদ্ভুত কান্নায় ভরা মাদক গলায় গাইতে থাকলেন—হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে…। কোথা থেকে একটা ছোট্ট খঞ্জনির শব্দ হতে লাগল। ঘরের আলোটা পালটে সবুজ হয়ে গেল। কী সুর! কী সুর! বুক নিঙড়ে যেন কান্না আর ভালবাসা তুলে আনা হচ্ছে।
অজিত চোখ মুছল। তার সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে একটা উতরোল ঢেউ। সব ময়লা আবর্জনা ধুয়ে গেছে, একাকীত্ব মুছে গেছে! আর সংসারে ফিরতে ইচ্ছে করে না অজিতের। কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।
গান শেষ হল। কুমারস্বামী অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। রাত হয়েছে, একে একে প্রণাম করে চলে যাচ্ছে সবাই। অজিত একটু এগিয়ে বসে বলল—বাবা, আমার যেতে ইচ্ছে করে না। আর কোথাও এমন শান্তি নেই।
কুমারস্বামী হাসলেন। বললেন—থাকবি? বলে অন্তরঙ্গ একজন শিষ্যের দিকে চেয়ে বললেন—অজিত আজ থাকবে ব্যবস্থা করে দিস।
অজিত একটা শ্বাস ফেলল। শীলা ভাববে, সে কথাটাও খোঁচা দিচ্ছে মনে কুমারস্বামী সেটা টের পেয়েই যেন যারা চলে যাচ্ছিল তাদের একজনকে ডেকে বললেন—অরুণ, তুই তো টালিগঞ্জের দিকেই থাকিস, অজিতের বাড়িতে একটা খবর দিয়ে যাস। ও আজ আমার কাছেই থাকবে।
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুমারস্বামী বিদায়ী মানুষজনের দিকে চেয়ে বললেন— কারও বাড়িতে আমি বেশিদিন থাকতে পারি না। পচা সংসারের নষ্ট গন্ধ পাই। অন্তরাত্মা ঘুলিয়ে ওঠে। তাই ভাবছি এবার চলে যাব।
ম্যাজিস্ট্রেট সুষ্ঠু সব লোকজন ফিরে দাঁড়ায়। চলে যাবেন? কুমারস্বামী চলে যাবেন?
অরুণ ঘোষাল ফিরে এসে প্রায় আছড়ে পড়ে সামনে—কেন বাবা? আমরা কার কাছে যাব তা হলে?
কুমারস্বামী মিষ্টি করে হেসে বলেন—কলকাতায় একটা আশ্রম তৈরি করে দে। থাকব।
—দেব। কথা দিলাম। দেব। ম্যাজিস্ট্রেট বলল।
পেটের মধ্যে বাচ্চাটা নড়েচড়ে। মাঝখানে বর্ষাকালটা শরতের গোড়ার দিকেই ছেলে হওয়ার কথা। বর্ষাটাও এবার জোর নেমেছে। কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। সন্ধের কিছু পর একটা লোক গাড়ি করে এসে খবর দিয়ে গেল অজিত আজ ফিরবে না। কুমারস্বামীর কাছে থাকব।
রাতে শীলার ভাল ঘুম হয়নি। দুশ্চিন্তা। কুমারস্বামীর কথা সে আজকাল খুব শোনে অজিতের মুখে। অজিত বলে—এতদিনে একটা যথার্থ মানুষ দেখলাম, যার ক্ষমতা আছে।
শীলা দেখেনি। কিন্তু মনের ভিতর কেমন একটা সন্দেহ মাথা চাড়া দেয়। সে শুনেছে এই ধরনের মানুষেরা সম্মোহন জানে, গুপ্তবিদ্যা জানে। মারণ উচাটন কত কী করতে পারে। তাই একটা অনির্দিষ্ট ভয় আর সন্দেহ হয়। অজিত আজকাল সন্ধের পর ওইখানেই থাকে, অনেক রাতে ফেরে। কাল ফিরল না। তার মানে এখন প্রায় রাতেই এরকম হবে। মাঝে মাঝে ফিরবে না। কালক্রমে একেবারেই ফিরবে না হয়তো। কে জানে!
আজ সকাল থেকেই শরীরটা খারাপ করেছে। অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে শীলা অনেক বেলায় উঠল। পেটের মধ্যে সারারাত দস্যি ছেলে ফুটবল খেলে আজকাল। পরিষ্কার টের পাওয়া যায়, ছেলেটা একবার পেটের এপাশে ঠেলে উঠছে, একটু বাদেই আবার ওপাশে মাথা চাড়া দেয়। ওর কি গরম লাগে পেটের ভিতর? ওর কি খিদে পায়? ও কি মাকে দেখার জন্য খুব অস্থির?
পরদিন রবিবার। সারাসকাল অজিত এল না। দুপুর গড়িয়ে গেল। শীলা অল্প একটু খেয়ে এসে শুয়ে রইল। খাওয়ার ইচ্ছেই ছিল না, কিন্তু সে না খেলে ছেলেটাও পেটের মধ্যে উপোসী থাকবে, সেই ভয়ে খেল। প্রাণটা বড় আনচান করে আজ। বিয়ের পর কখনও এমন হয়নি যে তারা প্রায় বিনা কারণে পরস্পরকে ছেড়ে থেকেছে। খুব ভেবে দেখল শীলা, না তারা একদিনও কেউ কাউকে ছেড়ে থাকেনি। কাল রাতেই প্রথম।
ঠিক দুপুর গড়িয়ে সদরের কড়া নড়ে উঠল। একটু ঝিমুনি এসেছিল শীলার, তবু ঝাঁকি খেয়ে উঠল। এতই ত্রস্ত পায়ে ছুটে এল যে আঁচলটা পর্যন্ত কুড়োনোর সময় হয়নি। দীর্ঘ আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছিল। আগ্রহে ব্যর্থতায় সে তাড়াতাড়ি ছিটকিনি খুলে খুব হতাশ হল। অজিত নয়। সুভদ্র।
সুভদ্র একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে। অথচ শীলা তখন হাঁ করে তাকিয়ে। যেন বা তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে, অজিত আসেনি। শীলার মুখের দিকে চেয়েই সুভদ্রর হাসি মিলিয়ে গেল। বলল কী হয়েছে?
শীলা সচেতন হয়ে তার আঁচল কুড়িয়ে নিল। কোনও কথা না বলে পিছু ফিরে চলে এল ভিতরে। পিছনে সুভদ্র। একবার অস্ফুট গলায় সুভদ্রকে বসুন’ বলে শীলা বাথরুমে চলে গেল সোজা। দরজায় ছিটকিনি তুলে দিল। দুপুরে যা খেয়েছে সব অম্বল হয়ে উঠে আসছে গলায়। বুকে চাপ ব্যথা। গলায় আঙুল দিয়ে টক জল বমি করল শীলা। ঠান্ডা জলে মুখচোখ ঘাড় গলা ভিজিয়ে নিল।
অনেকক্ষণ বাদে ফিরে এসে বলল—সুভদ্র, আমাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দেবেন?
—কেন বলুন তো! সুভদ্র খুব উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে—কী হয়েছে আপনার?
এতক্ষণ কেবল দুশ্চিন্তা ছিল। শুকনো গলা শুকনো মুখ নিয়ে সময় কাটিয়েছে শীলা। সুভদ্রর প্রশ্ন শুনে হঠাৎ বুকেরমধ্যে কান্নার বিদ্যুৎ চমকায়। বৃষ্টি আসে।
কান্নাটা কিছুতেই চাপতে পারে না শীলা। ঠোঁট কেঁপে ওঠে, চোখ ভরে নির্লজ্জ জল জমে উঠে গাল ভাসিয়ে নামে। আঁচলে মুখ ঢেকে কিছুক্ষণ থম ধরে থাকে সে তারপর বলে— বাপের বাড়ি যাব।
—কেন?
—ও কাল রাতে ফেরেনি। বলে শীলা শূন্যের দিকে একটু চেয়ে থাকে। সুভদ্র ‘ফেরেনি?’ বলে যে বিস্ময় প্রকাশ করে তার কোনও উত্তর দেয় না শীলা। অন্যমনস্কভাবে বলে—আমার ছোট ভাইকে পাঠাব একটু খোঁজ নিতে।
—অজিতদা কোথায় গেছেন আপনি জানেন?
—জানি। কুমারস্বামী নামে একজন সিদ্ধপুরুষের কাছে।
সুভদ্র ভারী অবাক হয়ে বলে—কুমারস্বামী? গর্চা লেনের কুমারস্বামী নাকি? ডাক্তার হেমেন বিশ্বাসের বাড়িতে যে থাকে!
শীলা বড় বড় চোখ তুলে বলে—আপনি জানেন?
মুখটা বিকৃত করে সুভদ্র বলে—জানব না কেন? একটা ফ্রড। আমার বাবাও ওর পাল্লায় পড়েছিল। অনেক কষ্টে ছাড়িয়েছি।
শীলা আগ্রহের সঙ্গে বলে—ফ্রড?
সুভদ্র হঠাৎ অদ্ভুত হেসে বলে—অজিতদা ওর পাল্লায় পড়লেন কী করে? উনি তো পলিটিক্স করা লোক, এল আই সিতে ট্রেড ইউনিয়ন করেছেন, পাক্কা মার্কসিস্ট মানুষ, উনি ধাপ্পায় ভুলবার লোক তো নন!
শীলা একটু অসন্তুষ্ট হয়। বলে—সুভদ্র, অত কথা বলছেন কেন? এখন কথার সময় নেই। দেরি হলে আমি গিয়ে সোমেনকে পাব না। ও বেরিয়ে যাবে।
সুভদ্র সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে বলে—আপনার ভাইকে পাঠানোর দরকার কী? প্রয়োজন হলে আমিই যেতে পারি, আপনিও সঙ্গে চলুন, সোজা কুমারস্বামীর ডেরায় গিয়ে কেলো করে দিয়ে অজিতদাকে ধরে আনব। ইয়ারকি নাকি! কার্ল মার্কসের ভক্তকে একটা ফ্রড হামবাগ হিপনোটাইজ করে রেখে দেবে? দরকার হলে….
শীলা ধমক দিয়ে বলল—খুব হয়েছে। এটা কার্ল মার্কস ভারসাস কুমারস্বামীর লড়াই নয় সুভদ্র। এটা আমার খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি আমার স্বামীকে চিনি, ও ঝট করে কাউকে শ্রদ্ধাভক্তি করে না। হইহই করে ওকে ফেরানো যাবে না।
সুভদ্র বিরক্তির শব্দ করে বলে—সে না হয় হইচই না করলাম, কিন্তু অজিতদা তো খুব লজিক্যাল লোক, ওঁকে তো ব্যাপারটা বোঝাতে পারি! যে লোকটা রিজন মানে তাকে বোঝানো সহজ।
শীলা মাথা নেড়ে বলে—সুভদ্র, ওসবে দরকার নেই। আমি কুমারস্বামীকেও চটতে চাই না। বহুকাল বাদে আমাদের সন্তান হতে যাচ্ছে, আমরা খুব ভয়ে ভয়ে আছি। এ সময়ে কারও অভিসম্পাত আমাদের পক্ষে ভাল হবে না।
সুভদ্র দাঁড়িয়েছিল। হতাশভাবে বসে পড়ে বলল—আপনিও এরকম? অভিসম্পাত বলে কিছু আছে, কিংবা তাতে কারও কোনও ক্ষতি হয় এটা কি আজকাল কেউ মানে?
শীলা বিরক্ত হয়ে বলে—আমি তর্ক করতে চাই না। এটা তর্কের সময় নয়। বিয়ের পর এই প্রথম আমরা একসঙ্গে থাকিনি। প্রবলেমটা আপনি বুঝবেন না। একটা ট্যাক্সি ডেকে আনুন, আমি গিয়ে সোমেনকে পাঠাব।
—যাচ্ছি। বলে সুভদ্র উঠল। দরজার কাছ বরাবর গিয়ে ফিরে বলল—আপনি নিজে যাবেন না?
শীলা মাথা নেড়ে বলল—না।
—কেন? আপনার কিন্তু যাওয়া উচিত।
—না সুভদ্র, আমার এ অবস্থায় ওসব লোকের কাছে যাওয়া উচিত নয়। ওরা কত কী করতে পারে! হয়তো রেগে গিয়ে আমার সন্তান নষ্ট করে দেবে। আমি যাব না।
সুভদ্র একটু হাসল, বলল—কিন্তু অজিতদা আপনি গিয়ে দাঁড়ালেই চেঞ্জ হয়ে যাবেন।
শীলা বড় বড় চোখে সুভদ্রর দিকে চেয়েছিল। কিন্তু সে সুভদ্রকে দেখছিল না। সে চেয়ে থেকে বহুদূর পর্যন্ত নিজের বিবাহিত জীবনটাকেই দেখতে পাচ্ছিল। ক্রমান্বয়ে একসঙ্গে এক বিছানায় থেকেও এই দীর্ঘকালে তারা যেন কিছুতেই স্বামী-স্ত্রী হয়ে উঠতে পারেনি। কোথাও একটা তার আলগা হয়ে আছে। একটা স্ক্রু ঢিলে, তারা পরস্পরের প্রতি গভীর বিশ্বস্ত নয়।
শীলার ঠোঁট কাঁপল, মাথাটা নড়ে উঠল। অস্ফুট গলায় বলল—ও আমাকে ভালবাসে না সুভদ্র। নইলে কেন কাল রাতে ও ফেরেনি? কেন ফেরেনি…।
বলতে বলতে শীলা উঠে দৌড়ে চলে গেল শোওয়ার ঘরে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুতে গিয়েই ভুল করল শীলা। আবেগে খেয়াল ছিল না। মস্ত বড় হয়েছে পেট, তার মধ্যে ছেলে। উপুড় হতে গিয়ে বিছানার কানায় একটু ব্যথা পেল শীলা। ব্যথাটা খেয়াল করল না। কাঁদতে লাগল।
একটু বাদে ট্যাক্সির ভেঁপু বাজতে উঠে শাড়ি পালটাতে লাগল। তখনও পেটে একটা ফিক ব্যথা লেগে আছে। ব্যথার অস্ফুট শব্দ করল শীলা। সাড়ে আটমাস চলছে। আয়নায় দেখল, তার ঠোঁট দুখানা সাদা, মুখটাও কেমন যেন। ক্লিষ্ট একটু হেসে আপন মনে বলল— ও ছেলে, তোর বাপটা এমন পাগল কেন রে? আমাকে কেন একটুও ভালবাসে না বল তো! আমি কি হ্যাক ছিঃ?
ট্যাক্সির এক কোনে সুভদ্র, অন্য কোনে শীলা। মাঝখানে অনেকটা দূরত্ব। শীলার চোখ দুটো এখনও চাপা কান্নায় লাল হয়ে আছে। মাঝেমধ্যে আঁচলে চোখ মুছছে। এ সময়ে কান্না লুকনো যায় না। কাল রাতে বাসায় না ফিরে অজিত যেন শীলার পায়ের তলার মাটি ভয়ংকর ভূমিকম্পে কাঁপিয়ে দিয়েছে। ও কেন অমন করল কাল? ও কি জানে না শীলা ওকে কত ভালবাসে?
—কুমারস্বামী সম্বন্ধে আপনি কী জানেন সুভদ্র? শীলা খুব গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল।
সুভদ্র সস্তা সিগারেট খায়। আজকাল কোনও কোনও গন্ধ শীলার সহ্য হয় না। ছেলেটা পেটে আসার পর থেকেই সে যেমন ভাতের গন্ধ সহ্য করতে পারে না, সেন্টের গন্ধ, সিগারেটের গন্ধ, দেশলাইয়ের গায়ের গন্ধ পেলেই বমি পায়। সুভদ্র সিগারেট ধরিয়েছে, শীলা নাকে রুমাল চাপল। একবার ওয়াক করল। সামলে গেল। সুভদ্র তাকিয়ে আছে। শীলা দ্রুত, নিচু গলায় বলল—সিগারেট ফেলে দিন, প্লিজ।
সুভদ্র সঙ্গে সঙ্গে সিগারেট ফেলে দেয়। বলে—শরীর খারাপ নয়তো শীলাদি৷
বহুকাল শীলাকে দিদি বলে ডাকে না সুভদ্র। আজ ডাকল। শীলা একবার তাকিয়ে ফের কাঁপা ঠোঁটে বলল—আমি আর বেশিদিন বাঁচব না, জানেন? এই বাচ্চাটার জন্ম দিতেই আমার সব ভাইটালিটি শেষ হয়ে যাবে।
—কী সব আবোলতাবোল বলছেন!
শীলা বাইরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বলে—মরে গেলে খুব ভাল হবে। ও বুঝবে আমি ওর কী ছিলাম। সারা জীবন বুক চাপড়াবে। একথা বলেই শীলা আবার ভ্রু কোঁচকায়। মাথা নাড়ে। আপন মনেই বলে—অবশ্য তা হয় না। পুরুষ-মানুষদের তো চিনি। মাসখানেক কান্নাকাটি করবে, হা-হুতাশ করবে, তারপর ফের টোপর মাথায় ছাঁদনাতলায় গিয়ে দাঁড়াবে। ততদিন যদি বাচ্চাটা থাকে তো সেটা গিয়ে পড়বে সৎমায়ের হাতে। মাগো! ভাবতে পারি না
সুভদ্র খুব হাসল, বলল—কত ভাবনা ভেবে রেখেছেন! মরেই যদি যাবেন তো অত ভাবনা কেন? মরার পর যা খুশি হোক, আপনি তো দেখতে আসছেন না।
শীলা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে—কে বলল দেখতে আসব না! ঠিক আসব। দরকার হলে ভূত হয়ে এসে সতীনের ঘাড় মটকাব।
সুভদ্র বেসামাল হেসে বলে—একেই বলে উইল পাওয়ার।
শীলা গম্ভীর হয়ে বলে—কুমারস্বামী সম্বন্ধে আপনি কী জানেন বললেন না!
সি এম ডি এ আনোয়ার শা রোড খুঁড়ে ফেলেছে, চওড়া হচ্ছে রাস্তা। তাই ট্যাক্সি রসা রোড ধরে অনেক ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে।
সুভদ্র মৃদু হেসে বলে—লোক ঠকানোর জন্য যা যা দরকার এ লোকটার সব আছে। সুন্দর চেহারা, চমৎকার কথাবার্তা, খুব ভাল কীর্তন করে। একবার’ওর কীর্তন শুনে আমার মতো পাষণ্ডের চোখেও জল এসেছিল।
—বলেন কী! কীর্তন শুনে! তা হলে আপনারও ওসব দুর্বলতা আছে!
সুভদ্র মাথা নেড়ে বলল—না। কিছুমাত্র ধর্মীয় দুর্বলতা আমার নেই। একজন বাঙালি হিন্দু পরিবারের ছেলের পক্ষে যতখানি অবিশ্বাসী হওয়া সম্ভব আমি ততখানি অবিশ্বাসী। তবে কী জানেন শীলাদি, ওই কীর্তন-টির্তন যারা বানিয়েছে তারা ছিল মস্ত সাইকোলজিস্ট। মানুষের প্রবণতা এবং সেন্টিমেন্টের জায়গায় ঘা দেওয়ার মতো করেই তারা ওইসব গান তৈরি করে গেছে। তেমন তেমন কীর্তন শুনলে ঘোর নাস্তিকেরও চোখে জল আসবে। তার কারণ ধর্মভাব নয়, কতগুলি মানবিক ভাবপ্রবণতা। আর আমিও তো পাষণ্ড নই। বলে হাসল সুভদ্র, হঠাৎ চমৎকার সুরেলা গলায় একটা লাইন গাইল শীলাকে চমকে দিয়ে— রন্ধনশালাতে যাই, তুয়া বঁধু গুণ গাই, ধূয়রি ছলনা করি কাঁদি…গেয়ে উঠেই বলল—এ গান শুনলে কার না হৃদয় কোমল হয়।
শীলা মাথা নেড়ে বলল-বুঝেছি।
সুভদ্র বেখেয়ালে আবার সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল, শীলার চোখে চোখ পড়ায় ‘সরি’ বলে আবার প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখল সিগারেট। বললে—ওই লোকটা, ওই কুমারস্বামীর এরকম কিছু গুণ আছে। খুব স্মার্টও বটে। একবার শুনেছি কালকা মেল-এ কোথাও যাওয়ার জন্য। হাওড়ায় গেছে। টিকিট-ফিকিট নেই। করল কী, গার্ডের ব্রেকের সামনে গিয়ে পায়চারি করতে লাগল। পরনে গেরুয়া পোশাক, গেরুয়া পাগড়ি, ভাল চেহারা। গার্ড সাহেব বোধ হয় গাড়ি ছাড়বার আগে কাগজপত্র দেখছিলেন। গার্ডকে জানালা দিয়ে ভাল করে স্টাডি করে নিল লোকটা। মানুষকে স্টাডি করার ক্ষমতা এদের অসাধারণ। বুঝল গার্ড লোকটা দুঃখী, চিন্তাগ্রস্ত।কী একটু অনুমান করে নিয়ে হঠাৎ গার্ডের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল—ভাবছিস কেন, সেরে যাবে। শুনে গার্ড আত্মহারা হয়ে এসে চেপে ধরল কুমারস্বামীকে—বাবা, তুমি কে? আমাকে বাঁচাও বাবা। কুমারস্বামী তখন ভারী মজার হাসি হেসে বললেন—তোর টানে আটকা পড়েই এখানে ঘোরাফেরা করছিলাম। আমি সাউথ ইস্টার্নের গাড়ি ধরতে যাব, কিন্তু কিছুতেই তোর কামরা আর ছাড়তে পারি না। এই শুনে গার্ড কি আর ছাড়ে! জোর করে নিজের ব্রেকভ্যানে তুলে নিল কুমারস্বামীকে। বলল—বাবা, ওসব হবে না। আমি তোমাকে মাথায় করে রাখব। আমার সব সমস্যার কথা তোমাকে শুনতেই হবে। কুমারস্বামী তখন কেবলই কাতরভাবে বলে—ওরে, এগারো নম্বর প্ল্যাটফর্মে আমার শিষ্যরা সব দাঁড়িয়ে আছে ফার্স্ট ক্লাশের টিকিট কেটে, আমাকে আজ রাতেই জগন্নাথধাম রওনা হতে হবে যে! কে শোনে কার কথা! গার্ড সাহেব কুমারস্বামীকে ব্রেকভ্যানে তুলে নিয়ে গেল। পরে শুনেছি, সেই গার্ডের বউ ভাল হয়েছে, গার্ডেরও প্রমোশন হয়েছে। কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু তাতে কুমারস্বামীর নাম যা ফেটেছিল!
শীলা খুব মৃদু একটু হেসেই গম্ভীর হয়ে গেল। খুব চাপা কিন্তু দৃঢ়স্বরে বলল—সুভদ্র, আপনাদের অজিতদা কিন্তু গার্ড সাহেব নন। ওঁকে ঠকানো অত সোজা নয়।
সুভদ্র ঈষৎ গম্ভীর হয়ে ঘাড় হেলিয়ে বসে বলল—বুঝলাম, আপনি পতিগর্বে গরবিনী। অজিতদাকে আমিও খুব শ্রদ্ধা করি ওঁর পলিটিক্যাল আইডিয়ালের জন্য। তাই খুব অবাক হয়েছি। কিন্তু আমি জানি শীলাদি, কুমারস্বামী ইজ এ ফ্রড।
ট্যাক্সি ঢাকুরিয়া ব্রিজ পার হতেই শীলা বল—সুভদ্র, আপনি কি আমার সঙ্গে যাবেন আমার বাপের বাড়িতে?
সুভদ্র কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল—যেতে পারি।
শীলা কিন্তু অস্বস্তি বোধ করছিল। তার বাড়িতে কেউ সুভদ্রকে চেনে না। মা, বউদি এরা সবাই একটু সেকেলে। হুটহাট ছেলেছোকরাদের সঙ্গে ওঠা বসা ভাল চোখে দেখে না। কে কী মনে করবে কে জানে! সুভদ্রই বা ওরকম বেহায়া কেন? ও কি বুঝতে পারছে না যে, এখন শীলা ওর সঙ্গ চাইছে না? পুরুষেরা চিরকালই কি একটু ভোঁতা, কম সেনসিটিভ? না শীলা ভেবে দেখল তা নয়। তার স্বামী অজিত খুব আত্মসচেতন। কখনও মেয়েদের সঙ্গে গায়ে পড়ে মেশে না। মরে গেলেও কোনও মেয়ের সঙ্গে কখনও যেচে আলাপ করেনি অজিত। শীলার মনে পড়ল, বিয়ের পর দীর্ঘকাল অজিত শীলার কাছে শরীরের দাবিই করেনি। তারা এক বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আদরে সোহাগে গল্প করত। অজিত শরীর চাইত না। সেটা শীলার খুব ভাল লেগেছিল। প্রথম কত সংকোচ থাকে মেয়েদের। সেটা কেটে গেলে একদিন শীলাই অজিতের বুকে মুখ রেখে আধোস্বরে বলেছিল—এবার পাথরটা ভাঙুক। তুমি নাও আমাকে।
মনে পড়ার পরই শীলা আপনমনে একটু হাসল। বড় সুখের স্মৃতি। পরমুহূর্তেই মনে পড়ল, কাল রাত থেকে অজিত ফেরেনি। ঠোঁট কেঁপে উঠল শীলার। পোড়া চোখ গলে যায় বুঝি কাঁদতে কাঁদতে। এত কান্না শীলা কখনও কাঁদেনি। পেটের দুধার থেকে চিন চিন ব্যথা উঠছে।
॥ উনষাট ॥
তিন দিন যেন এই সামান্য পৃথিবীর কেউ ছিল না অজিতের। তার জীবনের সাধারণত্ব থেকে ওই তিন দিন সে বিদায় নিয়েছিল। রবিবারে অজিত ফেরেনি। সোমবারেও না। ফিরতে ফিরতে বুধ হয়ে গেল। সোমবার থেকেই সে কীর্তনের দল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। সুখচরে আশ্রমের জন্য জমি দেখা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটই খবর এনেছে। হাজার দশেকের মতো জমির দাম পড়বে, আশ্রমের জন্য আরও না হোক ষাট-সত্তর হাজার টাকা কুমারস্বামী হেসে বললেন—ওসব তোমরা বোঝো গিয়ে। টাকার হিসেব আমি জানি না। শুধু বলি, আমার বড় ইচ্ছে তোমাদের কাছে থাকি। তোমরা কীভাবে রাখবে তা তোমরা জানো।
পরের সকালেই অজিত পাঁচ হাজার টাকার চেক কেটে দিল। যখন চেক সই করছিল তখন হঠাৎ একটু দুর্বলতা এল বুঝি! এত টাকা, রক্ত জল করা টাকা চলে যাচ্ছে! কুমারস্বামী তারদিকেই চেয়েছিলেন। তীব্র কিন্তু বরদা, শঙ্কাহরণ দৃষ্টি। অজিত সই করে দিল। আরও অনেকেই দিয়েছিল। দুই দিনে জমির দাম উঠেও হাজার দশেক টাকা বাড়তি হল। ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই জমি কিনতে চলে গেলেন। সবাই বলাবলি করছিল, শুভ কাজ আটকে থাকা ঠিক নয়, জমি কিনলেই ভিতপত্তন করতে হবে। বাকি টাকা আসবে কোথেকে? একজন মেজো-মধ্যম ফিলম স্টার আসেন রোজই। বয়স্ক লোক। তার বাজার পড়তির দিকে। তিনি বললেন—এ আর বেশি কথা কী? বাবার জন্য না হয় রাস্তায় নেমে পড়ব। আমি একসময়ে স্ট্রিট সিংগার ছিলাম, সেই অবস্থা থেকে উঠেছি। আমার কোনও সংকোচ নেই। যদি সবাই রাজি থাকে তো কীর্তনের দল নিয়ে ভিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
তো তাই হল। অজিত গানবাজনা প্রায় জানেই না। তবু এক ভক্তের কাছ থেকে ধুতি চেয়ে নিয়ে পরল, খালি গায়ে খুঁটটা জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল দলের সঙ্গে। সে কী উল্লাস! কী আনন্দ! দুধারে গৃহস্থ মানুষেরা দোকান পসারে ঘুরছে, সওদা করছে, বিষয়কর্মে রত রয়েছে, আর সে এক সুমহান উদ্দেশ্যে পথের ধুলোয় নেমে মহানন্দে ভিক্ষা করতে করতে চলেছে। নিজেকে এই প্রথম বড় মহৎ লাগল অজিতের। কীর্তনের সঙ্গে গলা মেলানোর কষ্ট নেই। সেই উদ্দণ্ড কীর্তনে গলা ছাড়লেই মিলে যায়। চোখে জল আসে। গায়ের কাপড় খসে খসে পড়ে। আর মনে হয়, আমিই তো নিমাই। ঘরে শচীমাতা কাঁদছেন, বিষ্ণুপ্রিয়া মূৰ্ছিতা, তবু নিমাই চলেছে প্রেম বিতরণে। নদীয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছেন নদের নিমাই।
সেই যে ভাব এল অজিতের তিন দিন সে আর স্বাভাবিক অজিত ছিল না। অফিস থেকে এসে কুমুদ বোস আর সেনদাও দেখে বলে গেছে—তাজ্জব! অজিতের মধ্যে যে এত বড় ভক্ত লুকিয়ে ছিল কে জানত! তুমি বড় ভাগ্যবান হে অজিত আমরাই পিছটান ছিঁড়ে আসতে পারলাম না। এই বলে কুমুদ বোস কেঁদেও ফেলেছিল।
তিন দিন অফিস করেনি অজিত। বাড়িতে আসেনি। তিন দিন বাদে বিকেলের দিকে সে ট্যাক্সিতে ফিরছিল টালিগঞ্জে। বুকটা অল্প কাঁপছে। যদিও নিশ্চয়ই শীলাকে কেউ না কেউ খবর পাঠিয়েছে, তবু মনটা বড় অশান্ত লাগে। শীলাকে ছেড়ে সে কখনও থাকেনি। একা বাড়িতে শীলা ভয় পায়নি তো! পা পিছলে পড়েটড়ে যায়নি তো! শীলা কি ভাল আছে? বুকটা কাঁপে, একটা শ্বাসকষ্ট হয়। আবার কুমারস্বামীকে দেওয়া পাঁচ হাজার টাকার কথা ভাবে। এ টাকাটার কথা শীলার কাছে গোপন করতে হবে। শীলা টের পেলে…।
বাড়িতে এসে অজিত অবাক। বাচ্চা ঝিটা দরজা খুলেই সরে গেল। অজিত ঢুকে দেখে ঘরদোর খাঁ খাঁ করছে। অজিত বলল—কী রে? তোর বউদি কোথায়?
মেয়েটা খুব বিপন্ন মুখ করে বলে—বউদি নেই।
—কোথায় গেছে?
—হাসপাতালে।
অজিত স্তম্ভিত হয়ে থাকে। কিছু জিজ্ঞেস করতে আর সাহস হয় না।
মেয়েটা নিজ থেকেই বলে—সোমবার সেই যে দাদাবাবু আসে, তার সঙ্গে ট্যাক্সিতে চলে গেল। আর আসেনি। বউদির ছোট ভাই রাতে এসে খবর দিল—বউদি হাসপাতালে। বউদির ভাই এসে রাতে থাকে, আর সারাদিন আমি একা।
অজিত ধপ করে বসে চোখ বুজে বলল—কী হয়েছে জানিস?
—না। বউদির ভাই শুধু বলে, খুব খারাপ অবস্থা।
অজিতের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে আতঙ্কের। একবার তড়িৎ গতিতে উঠে বসল ও। যাবে! এক্ষুনি যাবে! পরমুহূর্তেই বুঝল, তার হাত পা কাঁপছে, অবশ লাগছে। তিন দিনের সুগভীর ক্লান্তি কাকের কালো ডানার মতো শরীর আর মনের সব শক্তিতে ঢেকে রেখেছে। সে একবার ককিয়ে উঠল যন্ত্রণায়। চুপ করে বসে রইল। ঘড়িতে সময় দেখল, কিন্তু কটা বেজেছে তা বুঝতেও পারল না। ঢক ঢক করে অনেক জল খেয়ে গেল, তবু বুকটা যেমন শুকনো ছিল তেমনই রইল। শীলা কি বেঁচে আছে এখনও?
টেবিলের ওপর কয়েকটা চিঠি পড়ে আছে। তার মধ্যে একটা লক্ষ্মণের এয়ারোগ্রাম। সেটা খুলে অজিত আরও অবাক। প্রথমেই লিখেছে—বুধবার সকালে দমদমে পৌঁছেছি। এয়ারপোর্টে থাকিস।
ফের লাফিয়ে উঠল অজিত। বুধবার! বুধবারটা কবে?
তারপরই হতাশ হয়ে বসে পড়ল ফেরা সময় নেই। আজই বুধবার। লক্ষ্মণ আগে এসে গেছে।
তিনদিন ধরে রোজ ননীবালা তিন বেলা খাবার সাজিয়ে টিফিনের বাক্সে ভরে দেন। তিনবেলা খাবার বয়ে নিয়ে হাসপাতালে আসছে সোমেন। কিন্তু খাবে কে? শীলার ভাল করে চেতনা আসছে না। যতক্ষণ ভাল থাকে ততক্ষণ যন্ত্রণায় চিৎকার করে। দম ফুরিয়ে গেলে গোঙায়। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যায়। বিকেলের ভিজিটিং আওয়ারসে ননীবালা। এসে বসে থাকেন মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে। জ্ঞান থাকলে শীলা মায়ের হাঁটু চেপে ধরে ফুপিয়ে উঠে বলে—মাগো, আমাকে বিষ এনে দাও। নয়তো ডাক্তারকে বললা বাচ্চাটাকে নষ্ট করে দিক। এ যন্ত্রণা সহ্য হয় না।
ননীবালা পাঁচবার মা হয়েছেন, তার মধ্যে একটা সন্তান বাঁচেনি। সেই রণো হওয়ার সময়ে একরকমই চার-পাঁচদিন ধরে ব্যথায় কষ্ট পেয়েছেন তিনি। আঁতুড়ঘরের চারধারে সে এক গেঁয়ো বর্ষা নেমেছিল সেবার। অকালের বর্ষা, সৃষ্টি রসাতলে যায় যায়। ব্রজগোপাল বাউণ্ডুলেপনা করতে কোন মুলুকে উধাও হয়েছেন, সাতদিন ধরে পাত্তা নেই, শ্বশুর-ভাসুরদের উকি দেওয়া বারণ, এক জগদ্ধাত্রীর মতো শাশুড়িই তখন আগলে রেখেছিলেন ননীবালাকে। একজন হোমিওপ্যাথ ওষুধ দিত। আর ধাই ছিল মোতায়েন,কিন্তু হুট বলতেই পেট কেটে ছেলে বের করে দেবার যে রেওয়াজ এখন চালু হয়েছে সে সব তখন কারও মাথাতেও আসেনি গাঁয়েগঞ্জে, ছেলে হতে গিয়ে কত মা মরেছে। চারদিন ধরে নাগাড়ে ব্যথা সহ্য করার পর পাঁচদিনের দিন চাঁদমুখ দেখে সব জ্বালা জুড়িয়ে গেল। কোলজোড়া শান্তশিষ্ট ছেলে। শাশুড়িকে এইটুকুই দেখাতে পেরেছিলেন ননীবালা। সেই অকালের বর্ষা থামল, আর শাশুড়িও চলে গেলেন। যেন রণোকে নিজের আত্মা দান করে গেলেন।
ননীবালা মেয়ের মাথায় জপ করে দিতে দিতে বলেন—ওসব বলিস না। হলে দেখবি, বাচ্চার কত মায়া। চাঁদমুখ দেখলে সব ব্যথার কথা ভুল পড়বে।
শীলা ব্যথায় নীল হয়ে মার গায়ে কিল মেরে বলে—উঃ মা, ওসব বোলো না, বোলো না এ ব্যথা যেন শত্রুরও না হয়। আমি বাচ্চা চাই না, আমার ব্যথা সারাতে বলো ডাক্তারদের। আবার ওই ব্যথার মধ্যেও অনুযোগ দেয় শীলা—আমাকে কেন নার্সিং হোমে রাখোনি তোমরা? হাসপাতালে কেউ থাকতে পারে? আমি ঠিক মরে যাব। তোমাদের জামাইকে খবর দাও, সে ঠিক এসে ভাল নার্সিং হোমে নিয়ে যাবে আমাকে, সে কখ্খনো এভাবে হাসপাতালে ফেলে রাখত না আমাকে? কেন তোমরা ওকে খবর দিচ্ছ না? নিশ্চয়ই ওর কিছু হয়েছে। বলতে বলতে ফের জ্ঞান হারায় শীলা। আবার যখন চেতনা আসে তখন পূর্বাপর কিছু ভাবতে পারে না, যন্ত্রণার কথা বলে, আবার যখন মনে পড়ে তখন অজিতের কথা বলে কেঁদে ওঠে—ওর ঠিক অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আমার এ সময়ে নাহলে ও আসছে। না কেন? ওর এত সাধের সন্তান, ও আসছে না কেন?
ননীবালা এ সবের কী উত্তর দেবেন? অজিতকে কতবার খুঁজতে গিয়ে ফিরে এসেছে সোমেন আর সুভদ্র। গর্চার কোন গলিতে সে সাধু থাকে। সেখানে অজিত আছে বটে কিন্তু কেউ তার হদিশ দেয় না। ওরা থানা-পুলিশের ভয় পর্যন্ত দেখিয়েছে, উলটে ওদের ভয় দেখিয়েছে এক ম্যাজিস্ট্রেট যে বাড়াবাড়ি করলে মানহানির মামলা করবে। অজিতের মতো ছেলে সাধু-সন্নিসির পাল্লায় কী করে যে গিয়ে পড়ল তা কে জানে? হয়তো অজিতকে গুণ করে রেখে দিয়েছে সাধু, আর আসতে দেবে না। অজিত যে পলিটিকস করত সেটা ননীবালা পছন্দ করতেন না বটে, কিন্তু এর চেয়ে সেটা বরং শতগুণে ভাল ছিল। মেয়েকে নার্সিং হোমে রাখার কথা, কিন্তু সে সাধ্য এখন আর নেই। রণো যখন এরকমটা হয়ে যায়নি তখন হলে কলকাতার ভাল নার্সিং হোমেরই ব্যবস্থা হত। কিন্তু এখন তা পারেন না ননীবালা, অনেক লজ্জার মাথা খেয়ে মেয়েকে হাসপাতালেই পাঠাতে হয়েছে। সে বিকেলটাও বড় ভয়াবহ। বাইরে ট্যাক্সি থামবার আওয়াজ হল, তারপরই সিড়িতে জুতোর শব্দ। দরজায় কড়া নড়তে বীণা গিয়ে খুলল। শীলা ঘরে এসে দাঁড়াল, পিছনে, একটা সুন্দরপানা ছেলে। শীলার মুখ খানিকটা গম্ভীর, বলল—সোমেন কই বলো তো মা! ওকে আমার ভীষণ দরকার। বলতে বলতেই হঠাৎ দু’পা এগিয়ে এসে ননীবালাকে আঁকড়ে ধরল দুহাতে, তীব্র ফিসফিসানির স্বরে কানে কানে বলল—মা, ব্যথা উঠেছে, আর পারছি না, বলতে বলতে ঢলে পড়ল গায়ে। ব্যথা ওঠার কথা নয়। এখনও সময় তো হয়নি। আধ ঘণ্টার মধ্যেই ডাক্তার এসে দেখল, বলল—হাসপাতালে পাঠান। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ডেলিভারি হবে।
তাই পাঠালেন ননীবালা। সুভদ্র সোমেন ট্যাক্সি করে নিয়ে এল, সঙ্গে ননীবালাও। সুভদ্রর জোরেই পি জি হাসপাতালে জায়গা পাওয়া গেল। ছেলেটা খুব দাপুটে, চেনাজানাও অনেক। একে ধমকে, তাকে হাত করে চোখের পলকে সব ব্যবস্থা করে ফেলল। একটা দিন অবশ্য মেঝেতে থাকতে হয়েছে শীলাকে। সকালেই ভাল বেড পাওয়া গেছে। কিন্তু তিন দিন ধরে ছটফট করছে মেয়েটা। দুবেলা ডাক্তার দেখে বলে যাচ্ছে—এ ব্যথা ডেলিভারির পেইন নয়। তা ছাড়া ম্যাচুরিটিও খানিকটা বাকি ছিল, অন্তত আরও চার পাঁচ সপ্তাহ। নার্সদের ডেকে বলে গেছে—ওয়াচ করবেন। মেমব্রেন যদি বার্স্ট করে আর ডেলিভারি পেইন যদি না হয় তা হলে সিজারিয়ান করতে পারে।
ননীবালা পাঁচ সন্তানের মা হয়েছেন। ডাক্তারদের কথায় বড় একটা ঘাবড়ান না। ওরা কত অলক্ষুণে কথা বলে। রাস্তায় পড়ে গিয়ে বাচ্চা বুড়ো কারও হাত পা ছড়ে কেটে গেলে ধনুষ্টঙ্কারের ইঞ্জেকশন দেয়। জ্বরজারি হলেই পেনিসিলিন ঠাসে, হুট বলতেই টিকা নিতে বলে। ওসব বড় বাড়াবাড়ি। ননীবালা ছেলে হওয়া নিয়ে ভাবেন না। তিনি মেয়ে জামাইয়ের সম্পর্কটা নিয়ে ভাবেন। অজিত কেন সাধুর কাছে গিয়ে পড়ে আছে, মেয়ের যখন এখন-তখন অবস্থা! তবে কি ওদের সম্পর্ক এখন ভাল নয়? ঠিক বটে, তিনি নিজেও এক বাউণ্ডুলের সংসার করছেন চিরকাল। তবু সে তোক কিন্তু এরকম ছিল না। নিজের সংসারের দিকে না তাকালেও পরের সংসারের জন্য করেছে অনেক। কোমর বেঁধে মানুষের দায়ে দফায় খাটত। না ডাকলেও গিয়ে হাজির হত। সংসারে থেকেই সে ছিল সন্ন্যাসী। কিন্তু তার বুকে ভালবাসা বড় কম ছিল না। আর আজকাল হুট বলতেই ডিভোর্স, না কি যেন ছাই মাটি হয়। স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে যায়। ভাবতে পারেন না ননীবালা। বুকটা বড় কাঁপে। অজিত কেন এ বয়সে সাধু-সন্নিসির পিছনে ঘুরে মরছে। এর মধ্যেই কবে যেন টুকাই তার ইস্কুল থেকে ফেরার পথে বাস থেকে দেখেছে যে পিসেমশাই গড়িয়াহাটা দিয়ে কীৰ্ত্তন করতে করতে একটা দলের সঙ্গে যাচ্ছে। টুকাই ছেলেমানুষ, দেখার ভুল হতে পারে, কিন্তু যদি সত্যি হয় তো ভাবনার কথা। অমন চালাক চতুর চৌখোস ছেলে, সে কেন কীৰ্ত্তন গাইবে রাস্তায়? এসব ভাবেন ননীবালা, আর কেবলই মনে হয়—আর না এবার সংসারের ভাবনা সংসারকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি ছুটি নেবেন। আর না। যা হয় হোক গে। তিনি দেখতে আসবেন না।
ভিজিটিং আওয়ারস শেষ হলে ননীবালা ফিরে আসেন বাড়িতে। আসতে বড় কষ্ট হয়। বাসে তখন অফিসের ভিড়। তবু নিজের চিন্তায় এত বিভোর থাকেন যে শরীরের কষ্ট টের পান না। তিন দিন ধরে এসে ফিরে যাচ্ছেন। মেয়েটা কাটা পাঁঠার মতো দাপাচ্ছে। এ সময়ে জামাই এসে শিয়রে দাঁড়ালেও মেয়েটা ভরসা পেত। জামাইয়ের কথা ভাবতেই ফের বুকটা মোচড় দেয়। আজকাল তাই ননীবালা বড় গম্ভীর। বাসায় ফিরে কথাটথা বলেন না। জপ সেরে ছোট নাতিকে কোলে করে বসে থাকেন।
সুভদ্রর সঙ্গে এই তিন দিনে খুব ভাব হয়ে গেছে সোমেনের। বয়সে সুভদ্র কিছু বড়, কিন্তু তাতে বন্ধুত্ব আটকায় না। তিনবেলা সোমেন আসে। শুধু দুপুরটা বাদ দিলে, দুবেলাই সে সুভদ্রকে দেখতে পায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। কার্ডফার্ড ছাড়াই ও ওয়ারডে ঢুকে যেতে পারে, যখন-তখন ডাক্তার ডেকে আনতে পারে। সিস্টারদের সঙ্গে ও দু-মিনিটে ভাব জমিয়ে ফেলে। কখনও সুভদ্র অপ্রস্তুত হয় না। চেহারাটা চমৎকার বলেও বোধ হয় ওর সুবিধে আরও বেশি। সোমেন জানে যে, সে নিজেও সুন্দর। কিন্তু তার চেহারায় বা সৌন্দর্যে কোথাও একটা মেয়েলিপনা আছে, একটু দুর্বলতা বা লজ্জাসংকোচের ভেজাল আছে। সুভদ্রর তা নেই। ও শতকরা একশো ভাগউপুরুষ৷ টান জোরালো চেহারা, মারকুট্টা ভাবভঙ্গি, গলা বজ্রগম্ভীর। যে কোনও পরিস্থিতিতে চেঁচামেচি করে লোক জমিয়ে ফেলতে ওর সংকোচ নেই। প্রথম দিন শীলাকে ভরতি করতে এসে ও এমার্জেন্সিতে তাণ্ডব করে ফেলে। এমার্জেন্সির কাউন্টার চাপড়ে আলটিমেটাম দিয়ে বলল—আধ ঘণ্টার মধ্যে আমার রুগি ভরতি না হলে হেলথ মিনিস্টারকে এখানে আসতে হবে। তাতে এমার্জেন্সির লোকেরা আপত্তি করায় তাদের ফোন তুলে নিয়ে সুভদ্র বাস্তবিক ফোন করেছিল মিনিস্টারকে। তারপর পুলিশ কমিশনারকে, এক বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকার সম্পাদককেও। কাউকেই পায়নি, অবশেষে ওর এক রিপোর্টার বন্ধু এসে হাজির হল, আর একজন ডাক্তারও বেরিয়ে পড়ল চেনা। তাতেই কাজ হয়ে গেল। কিন্তু তাতে না হলেও সুভদ্রর ওই রুদ্রমূর্তি দেখেই হাসপাতালে একটা শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। বিস্তর রবাহূত লোকজন কোথেকে এসে জড়ো হয়ে সুভদ্রর পক্ষ নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করে। তখন শীলার মাথা কোলে নিয়ে অসহায়ভাবে বসে আছেন ননীবালা, আর সোমেন ভেবে পাচ্ছে না কী করবে। তাদের কিছু করতে হয়নি। সুভদ্র, অনাত্মীয় এবং অচেনা সুভদ্রই সব করে দিয়েছিল। তাই সুভদ্রর সামনে সোমেনের একটা কমপ্লেকস কাজ করে। নিজেকে সুভদ্রর চেয়ে ছোট বলে মনে হয়
কুমারস্বামীর ডেরায় গিয়েও সুভদ্র একটা কেলো করেছিল। কিন্তু সেটা কাজে লাগেনি। সোমবার শীলাকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত ছিল, অজিতের খোঁজ করার সময় হয়নি। কিন্তু হাসপাতালে ভরতি হওয়ার পর থেকেই শীলা ওই ব্যথা-যন্ত্রণার মধ্যেও কেবলই বলেছে— ওরে, তোরা ওকে খবর দে। ও না এলে আমি বাঁচব না।
মঙ্গলবার শীলার বেড পাওয়া গেল। খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে সুভদ্র বলল—চলুন সোমেনবাবু, আজ কুমারস্বামীর ডেরায় হুটোপাটি করে আসি। জোর কেলো করে আসব। বাস্তুঘুঘুদের সব ক’টা বাসা ভেঙে দেওয়া দরকার।
সোমেন দাঙ্গাহাঙ্গামায় ভয় পায়। খুব সাহসের কাজ সে কিছু করেনি কখনও। তা ছাড়া কুমারস্বামীর কিছুই সে জানে না যাতে লোকটার ওপর রাগ করা যায়। তবু বিকেলের দিকে সে সুভদ্রর সঙ্গে গর্চার গলিতে এক বড়লোকের বাড়িতে হানা দিয়েছিল। সুভদ্রর প্রথম চালটাই ছিল ভুল। দোতলায় উঠে সে বন্ধ দরজায় প্রচণ্ড শব্দ করে চেঁচাতে লাগল—কে আছেন, দরজা খুলুন।
দরজা খুলল। একটি বিস্মিত বিরক্ত মুখ উঁকি দিয়ে বলল—আস্তে। বাবা বিশ্রাম করছেন, ব্যাঘাত হবে। কাকে চাইছেন?
সুভদ্র অনায়াসে বলল—আমরা এই বাড়ি সার্চ করতে এসেছি। এখানে আমাদের একজন লোককে আটকে রাখা হয়েছে।
লোকটা ভীষণ অবাক হয়ে বলে—এখানে কাউকে আটকে রাখা হয়নি।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! সুভদ্র তখন গলা তুলে চেঁচাচ্ছে—আলবাত আটকে রাখা হয়েছে। এখানে বহু লোককে হিপনোটাইজ করে আটকে রাখা হয়, সব আমরা জানি। আমাদের দেখতে দিন, নইলে পুলিশে খবর দেব।
হুজ্জৎ করার ইচ্ছে সোমেনের ছিল না। সে ভেবেছিল বড়দির অসুখের খবর দিয়ে জামাইবাবুকে নিয়ে যাবে। কিন্তু অসুখের খবরটাই দেওয়া হল না। সুভদ্র ব্যাপারটাকে এত বেশি বাড়িয়ে তুলেছিল যে সেখানেও লোকজন জুটে গেল। অবশেষে এক বেঁটে মতো ভদ্রলোক কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে বলল—আমি হাওড়ার ম্যাজিস্ট্রেট। বেশি বাড়াবাড়ি করলে পুলিশে ধরিয়ে দেব, মানহানির মামলাতেও পড়ে যাবেন।
এত গোলমালেও কুমারস্বামী বেরিয়ে আসেনি। সোমেন ম্যাজিস্ট্রেট দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সুভদ্র অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে আরও কিছু বিতর্ক করতে যাচ্ছিল। কিন্তু ম্যাজিষ্ট্রেট আঙুল তুলে সিঁড়ি দেখিয়ে দিয়ে বলল—ক্লিয়ার আউট ক্লিয়ার আউট। এটা গুণ্ডামির জায়গা নয়।
আশ্চর্যের বিষয়, দুজন কনস্টেবলও কোখেকে এসে গেল সে সময়ে। তাড়া খেয়ে সোমেন আর সুভদ্র নেমে এল। সুভদ্র অপমান-টান গায়ে মাখে না, একটু হেসে বলল— লোকটা জেনুইন ম্যাজিস্ট্রেট। আমি ওকে চিনি। একবার ওর এজলাসে যেতে হয়েছিল। খুব কড়া লোক। বলে একটু চিন্তিতভাবে চুপ করে থেকে বলল—কুমারস্বামীর ক্ষমতা দেখলেন। সব রকম সেফগার্ড রেখে দিয়েছে!
সোমেন হতাশ হয়ে বলে—কিন্তু অজিতদা? দিদির অসুখের কথা বলে অজিতদাকে আনা উচিত ছিল।
সুভদ্র ঠোঁটে প্রচণ্ড তেতো বিরক্তির ভঙ্গি করে বলে—অসুখের কথা-টথা বলে নিচু হয়ে ভিক্ষে চাইতে হবে নাকি! দাঁড়ান না, এবার অন্য রকম কেলো করব।
সুভদ্রর এই মনোভঙ্গি সোমেনের পছন্দ ছিল না। কিন্তু সুভদ্র ওই রকম।
কখন কী হয়, তাই সোমেন প্রায় সারাদিনই হাসপাতালে থাকল বুধবারে। সকালেই শীলার আয়া জানাল—জল ভাঙছে। কথাটার মানে সোমেন জানে না, তাই ভয় পেয়ে নার্সকে গিয়ে ধরল। নার্স গা করল না, বলল—ও তো হবেই।
শীলা অসহনীয় যন্ত্রণায় বার বার বেঁকে যাচ্ছে। সোমেনকে দেখেও যেন চিনতে পারল না, শুধু বলল—আমাকে এখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যা। কিছু করছে না, আমি মরে যাব।
অবস্থা দেখে মরে যাওয়ার কথাটা বিশ্বাস হচ্ছিল সোমেনের। কিন্তু এ অবস্থায় কী করা উচিত তা ঠিক করতে না পেরে সে কেবলই নার্স আর ডাক্তারদের কাছে ছোটাছুটি করল।
কাল রাতেও অজিতদা ফেরেনি। অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে সোমেন। আজ কদিন সোমেন ওদের বাসায় রাতে গিয়ে শোয়।
একটু বেলায় সুভদ্র এল। সোমেন সব কথা বলতে খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় সুভদ্র ডাক্তার ডেকে আনল কোথা থেকে। ডাক্তার দেখে-টেখে বলে—মেমব্রেনটা বার্স্ট করেছে, কিন্তু ডেলিভারির পেইন শুরু হয়নি। আমি এটাকেই ভয় পাচ্ছিলাম। একটা ইঞ্জেকশন লিখে দিচ্ছি, এনে দিন। যদি তাতে না হয় তবে কাল সকালে সিজারিয়ান হবে। এঁর হাজব্যান্ডকে দরকার, বন্ডে সই করতে হবে।
এই বলে গম্ভীর ডাক্তার চলে গেলেন। কিন্তু চলে যাওয়ার সময়ে তাঁর গম্ভীর মুখশ্রী থেকে সোমেনের ভিতরে একটা ভয় জন্ম নেয়। সে পরিষ্কার বুঝতে পারে ডাক্তার উদ্বিগ্ন, চিন্তিত। কোথাও একটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ করছেন উনি। সোমেন বুঝল, বড়দির অবস্থা ভাল নয়।
বুঝতে পেরেই তার হাত পায়ে একটা শিউরানি খেলে গেল। বারান্দায় তখনও দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল সুভদ্র। তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে সোমেন সিগারেট ধরিয়ে বলল— সামথিং ইজ ভেরি মাচ রং।
সুভদ্র একবার চোখ কুঁচকে তাকাল মাত্র। তারপর মাথা নেড়ে বলল—ভাববেন না। প্রেসক্রিপশনটা দিন, ওষুধ এনে দিচ্ছি। বলে প্রেসক্রিপশন নিয়ে চলে গেল।
সোমেন চুপ করে রইল। সামনে একটু লন, তারপর লাল রঙের হাসপাতালের বাড়ি। কয়েকটা গাছগাছালি। খুব বৃষ্টি গেছে কাল, আজ গাছপালা ঘন সবুজ। ছেঁড়া বাদলমেঘের ফাঁকে ফাঁকে গভীর নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সবকিছুই একটা বিষন্নতায় মাখানো। এই বিপুল পৃথিবীতে সোমেন বড় একা ও অসহায় বোধ করে। আজ সে বড় বেশি নিজের অপদার্থতা বুঝতে পারছে। কিছু শেখেনি সে। যদি অন্তত ডাক্তারিটা পড়বার চেষ্টা করত তবে আজ এত অসহায় লাগত না। অচেনা এক সমবেদনাহীন যান্ত্রিক ডাক্তারের হাতে দিদির আয়ু—ভাবতেই কেমন লাগে! যদি কোনও ভুল করে ডাক্তার? যদি ঠিকমতো ব্যথার কারণটা ধরতে না পারে? যদি নার্সরা সময় মতো ডাক্তারকে খবর না দেয়? সমস্ত হাসপাতালের ব্যবস্থার মধ্যেই একটা রুক্ষ উদাসীন এবং বিরক্তির ভাব রয়েছে। যেন এরা রুগি কিংবা রোগ পছন্দ করে না। যেন এদের সবাইকে জোর করে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো হয়েছে। ছেলেবেলা থেকে যে বড়দিকে সে চেনে যাকে নানা সুখে-দুঃখে, রাগে-অভিমানে আপনার লোক বলে জেনেছে, তাকে এরা তো সেভাবে চেনে না। এদের কাছে বড়দি এক অচেনা রুগি মাত্র, যার বেঁচে থাকা দরকার, তা বুঝবে কি করে? রাগে অসহায়তায় সোমেনের হাত পা নিশপিশ করে। দারোয়ান গোছের কিছু লোক বাইরের লোকজনকে সরিয়ে দিচ্ছে। সোমেন তাই নীচে নেমে এল। সামনের মাঠে দাঁড়িয়ে রইল বোঝার মতো। তার কিছু করার নেই। সে ডাক্তারির কিছুই জানে না, এই ভেবে তার চোখে জল এল হঠাৎ।
দুপুরের আগেই সুভদ্র চলে গেল, ইস্কুল আছে। সোমেন কোথাও গেল না। খোলা মাঠের মধ্যে বসে ভাবতে লাগল, বড়দিকে সে বরাবর খুব অবহেলা করেছে। কত ডাকত বড়দি, কতবার বলেছে—একা থাকি, আমাদের কাছে এসে কদিন থাক না সোমেন! কতবার বড়দি তাকে দামি জামা প্যান্ট দিয়েছে, নগদ টাকাও দিয়েছে অনেক। সেই বড়দি কোথায় কোন বিপুল অলক্ষ্যে মিশে মিলিয়ে যাবে! আর কখনও, কোনওদিন দেখা হবে না।
দুপুরে শীলার খাবার নিতে একবার বাসায় ফিরল সোমেন। খাবার নেওয়া বৃথা। বড়দি তো খায় না, আয়াই খেয়ে নেয়। তবু খাবার নিতে বাসায় না গেলে ননীবালা চিন্তা করবে। বাসায় এসে কোনওক্রমে কাকস্নান সেরে দু-গ্রাস অনিচ্ছের ভাত খেয়ে নিল সোমেন। ননীবালা উদ্বেগের গলায় জিজ্ঞেস করেন—কেমন আছে রে?
ভেঙে বলল না সোমেন। কেবল বলল—ওইরকমই।
টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ফের হাসপাতালে এসে ওয়ার্ডে ঢুকে ভয়ংকর চমকে গেল সোমেন। বড়দির বিছানার পাশে স্ট্যান্ডে সেই স্যালাইন বা গ্লুকোজের ওলটানো শিশি, রবারের নল ঝুলছে। লাল কম্বলে দিদিকে চেপে ধরে আছে বুড়ি আয়া। আর বড়দির প্রচণ্ড একটা কাঁপুনি উঠেছে। মুখ সাদা, ঠোঁট মরা মানুষের মতো ফ্যাকাশে, দুটো চোখে দৃষ্টি নেই। কেবল মুখে একটা অবিরল ‘হু—হু—হু—হু’ শব্দ করছে। আয়া বলল, শিরায় ছুচ ফোটানোর সঙ্গে সঙ্গে রিগার উঠেছে। তাই উঁচ খুলে ফেলা হয়েছে। কিন্তু একটু বাদেই আবার দেবে। ইঞ্জেকশনটা ওই শিশির তরল পদার্থের সঙ্গে মেশানো আছে।
সোমেন দৃশ্যটা দেখতে পারল না। খাবার রেখে বেরিয়ে এল। কী অমানুষিক কষ্ট পাচ্ছে বড়দি, ভেবে বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সোমেন ফের চোখের জল মুছল।
বিকেলের দিকে ওয়ার্ড ভরে গেল লোকে। রণেন, ননীবালা, সুভদ্র, আর সুভদ্রর সঙ্গে শীলার স্কুলের আরও পাঁচ ছজন দিদিমণি। এত লোককে ঢুকতে দেয় না। কিন্তু সুভদ্র কী করে ম্যানেজ করেছে। শীলার জ্ঞান প্রায় নেই। মুখে গ্যাঁজলা উঠছে। আর গভীর বেদনার দীর্ঘ ধ্বনি বুক থেকে উঠে আসছে কখনও।
একবার সেই অবস্থাতেই বড় বড় চোখ মেলে কাকে যেন খুঁজল চারদিকে। পেল না। ব্যথায় প্রচণ্ড মুখ বিকৃত করে চোখ বুজল। দুটো হাতের মুঠো মাঝে মাঝে ভীষণ শক্ত হয়ে যাচ্ছে। বালিশের ওয়াড় খিমচে ধরে টানছে এক-একবার। ফের নরম হয়ে যাচ্ছে শরীর। আবার ব্যথার ঢেউ আসছে।
ননীবালা শীলার হাতের আঙুল টেনে দিচ্ছেলেন। মাঝে মাঝে মেয়ের কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলছেন—ও শীলা, ব্যথাটা কি একটু অন্যরকম টের পাস? ঝলকে ঝলকে ব্যথা আসছে কি?
শীলা সে কথা শুনতে পায় কিনা কে জানে! এক-একবার ককিয়ে ওঠে। শুধু ননীবালার হাতটা খিমচে ধরে বলল—ও কোথায় মা? ও কেন আসছে না? যার জন্য আমার এত কষ্ট সে একবার এসে দেখে যাক যে আমি মরে যাচ্ছি। ও কি রাগ করেছে মা? অ্যাঁ!
বলেই ফের ব্যথায় ডুবে গেল শীলা। প্রবল ককিয়ে উঠল।
সোমেন পালিয়ে এল। পিছন থেকে সুভদ্র এসে ধরল তাকে। সামনের লনে দাঁড়িয়ে দুজনে সিগারেট ধরায়।
Leave a Reply