॥ চল্লিশ ॥
মাথায় ধপধপে সাদা পাগড়ি বাঁধা, ছোটখাটো কালো-কোলো, গোপাল-গোপাল চেহারার একটি বছর তেইশ-চব্বিশের ছোকরা সেদিন সকালে এ গাঁয়ের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল। সঙ্গে পাঁচ-সাতজন লোক। সঙ্গীরা সব বয়সে বড়, কিন্তু হাবভাবে বোঝা যাচ্ছিল ওই ছোকরাই ওদের সর্দার, সঙ্গে সাপের ঝাঁপি।
রাতটা ভাল কাটেনি বহেরুর। গন্ধ বিশ্বেস এখনও বেঁচে আছে; আশি কি নব্বুই পার হয়ে গেল বুঝি। এই সব বয়সে সে মানুষ বড় জ্বালাতন করে। বোধ-বুদ্ধি সব জল হয়ে যায়। গন্ধ বিশ্বেস তার ওপর আবার চোখে দেখে না। দিনরাত লোকজনকে হাঁকডাক পাড়ে। সবচেয়ে বেশি জ্বালায় খাওয়া আর হাগা-মোতা নিয়ে। তার ওপর আছে মিথ্যে কথা। খেয়ে বলে খাইনি। বিছানায় হেগে-মুতে ফেললে বেড়াল কুকুরের ঘাড়ে দোষ চাপায়। নিপাট ভালমানুষের মতো এইসব করে। কাছেপিঠে ছেলেপুলেদের হাতে মোয়াটা নাড়ুটা আছে টের পেলে কেড়ে খেয়ে ফেলে। অশ্রাব্য গালাগাল দেয় আজকাল রেগে গেলে। ভয় পায় বহেরুকে।
বহেরু আজকাল কেমন চুপসে গেছে। এই গরমকালটায় উঠোনে কি দাওয়ায় তাড়ির ওপর এক ছিলিম গাঁজা চড়িয়ে গামছার ওপর পড়ে থাকত। বড়জোর একটা খাটিয়ায় একটু শক্ত একটা বালিশ। তাতেই খুব বড়মানুষি। খুবই অথৈ ঘুম তার। তবু একটু-আধটু শব্দ হলেই কুকুরের মতো উঠে বসে। নেশা-টেশা ঘুম-টুম কোথায় কেটে যায়। হাঁক ছেড়ে বৃন্দাবনকে ডাকে। বৃন্দাবন এক সময়ে দোস্তো-মানুষ ছিল বহেরুর। জাতে নমঃশূদ্র। এখন সে বহেরুকে মনিব বলে মানে। বহেরু গাঁ রাত-বিরেতে পাহারা দেয়। হাঁক ছাড়তেই দুটো চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই এসে যায় বৃন্দাবন। গহীন রাতে আর চাকর-মনিবের সম্পর্ক থাকে না বটে, তবু লাঠি-গাছটা আর লালটেম নামিয়ে রেখে একটু দূরে বসে সে। গাঁজা সাজে। প্রথমটায় বহেরু টানে, পরে বৃন্দাবন। বিষয়ী কথাবার্তা হয় দু-চারটে। বন্দাবন কম কথার মানুষ। এই রাতবিরেতেই যা তার পেট থেকে কিছু কথা বেরোয়। বহেরুর গোটা দুই খুনের সে জলজ্যান্ত সাক্ষী আছে। কিন্তু ‘রা’ কাড়ে না কখনও। এমনকী কখনও বহেরুর চোখে চোখও রাখে না। ওই এক ধারার মানুষ। বিশ্বাসী, কর্মঠ, কিন্তু একটু আবছামতো। দুনিয়ায় সে কী জন্য আছে, কী তার ভবিষ্যৎ, কার জন্য করছে কম্মাচ্ছে তা বোঝাই যায় না। মুখে টিকিট আঁটা আছে। সারাদিন তার দেখা পায় না বহেরু। শুধু এই রাতে দু-একবার। দু-একবারই ওঠে বহেরু। আবার ঘুমোয়। ভোরবেলা, আলো ফোটার অনেক আগে প্রথম জাগে খুড়োমশাইয়ের পবিত্র খোল। কালীপদর প্রভাতী শোনা যায়—জাইগতে হবে, উইঠতে হবে, লাইগতে হবে কাজে…। পেছুতে তিনটে লাথি কষাতে হয় জামাই শালার। কোনওকালে বহেরুর কোনও কম্মে লাগেনি। মাগ-ছেলের টানে পড়ে আছে। তিনটে লাথি ওর বহুকাল ধরে পাওনা হয়ে আছে, দিনক্ষণ দেখে একদিন সেই তিনটে ঝাড়বে বহেরু, বিদেয় করে দেবে বহেরু গাঁ থেকে। কালীপদর পর বা আগে ওঠেন ব্রজকর্তা। ততক্ষণে ভোরের জানান পড়ে যায়।
এইরকমই ছিল নিয়ম। কিন্তু বহেরুর ঘুমটাকে পেঁচোয় পেয়েছে আজকাল। তাড়ি-গাঁজার চাপান সত্ত্বেও পয়লা প্রহরটায় শেয়ালের হুড়ড়া শুনে কাটে। তারপর ঝিমুনি আসে। কিন্তু সে কতক্ষণ? হঠাৎ যেন বুকের মধ্যে ধড়াধ্বড় ধাক্কা খেয়ে উঠে বসে। চারদিকে কোনও রাতে জ্যোৎস্নার দুধ চলকে ভেসে যায়। কোনও রাতে বা শ্যামা মায়ের এলোকেশ। বহেরু সেই নিশুত রাতের মধ্যে জেগে উঠেই কেমন একা-বোকা বোধ করে। ভয় হয় হঠাৎ সব মরেটরে গেল নাকি! এত নিঝুম কেন চারদিক! নাকি আমিই মরে এলাম পরকালের রাজ্যে! হাঁক পাড়লে বৃন্দাবন আসে ঠিকই, গাঁজার চাপানও হয়। কিন্তু গা বড় ছমছম করে আজকাল, গুণীন এসে খুব কষে ঝাঁটাপেটা করে গেছে নয়নতারার ভূতকে। আজকাল নয়ন খুব নিঃসাড়ে পড়ে থাকে সারাদিন। কথাবার্তা কয় না, খেতে চায় না, উঠতে চায় না, চুল বাঁধে না। মেঘুর ভূত যদি ছেড়েও থাকে তবু অন্য কোন্ ভূত আবার চেপে বসেছে কে জানে! ছলছলে চোখে চেয়ে থাকে, কাঁদে মাঝে মাঝে। বিপদ বুঝে জামাইয়ের সন্ধানে একদিন গিয়েছিল বহেরু। আগের দিনে পেয়াদারা বাবু হত না কোনওদিন। আজকাল হয়। বিষড়ের এক কেমিক্যাল কোম্পানিতে লোকটা পিওন ছিল, এখন কেরানি। কী ভেবে সে শ্বশুরকে তুমি-তুমি করে বলতে লাগল। মেয়েকে ফিরে নেওয়ার কথা বলতেই খুব রাগ, বলে—ওকে ঠান্ডা করা আমার কর্ম নয় বাপু। তোমাদের ঘরের ধাত আলাদা। আমাদের সঙ্গে মেলে না।
সুমুন্দির পো। নিল না। ফিরে বিয়ে করেছে, নেওয়ার জো-ও নেই। তবু নয়নতারা যে কাঁদে তা বোধ হয় সেই লোকটার কথা ভেবেই। যৌবন বয়সে অনেক ছটফটানি ছিল। এখন সে সব মরে টান এসেছে বুঝি। রাতে ঘুম ভেঙে সেই কান্নার গোঙানি মাঝেমধ্যে শোনে বহেরু। দুঃখ বড় একটা হয় না, কেবল নিশুতরাতে ওই কান্না শুনে কেমন একটা ধন্ধভরা ভয় লাগে।
কদিন হল আর একা শোয় না সে। দোকা লাগে। কিন্তু দোকা পাওয়াই মুশকিল। বড় বড় ছেলেপুলে নাতিপুতি নিয়ে শোয়, বয়সের মানুষ, তার কথা ওঠে না। বিন্দুর মাও লজ্জা পায় বোধ হয়। রাজি হয় না। লোকলজ্জা বলে কথা আছে। ব্রজ বামুন থাকেন গাঁয়ে। বলবেন। কী! অগত্যা বড় ছেলে কপিল বাপের কাছে-পিঠে বিছানা ফেলে শোয়। এরা বাবু মানুষ। গদি ছাড়া ঘুম হয় না। তোষক বালিশ কত কী লাগে, বউ এসে মশারি গুঁজে দিয়ে যায়। তার ওপর রাতবিরেতে উঠে উঁকি মেরে দেখো, বাবু হাওয়া। কখন গিয়ে বউয়ের পাশবালিশ হয়ে পড়ে আছে। এখন এই দোকা পাওয়াটাই একটা সমস্যা। নিশুত রাতটা বড় নটখটে জিনিস। চাষার দুর্বল মাথায় কত আকাশ-পাতাল ঢুকিয়ে দেয়! হাঁক পাড়লে বৃন্দাবন আসে ঠিকই, কিন্তু সে তো ওই রকম বিটকেল মানুষ। রসকষ নেই। তা ছাড়া আপনজনা কেউ তো নয়। দূরের মানুষ দূর হয়ে বসে থাকে। বহেরুর বড় দোকা হতে ইচ্ছে করে আজকাল। মাঝলা ছেলে কোকাকে বললে সে এসে শোয়। কিন্তু বড় ভয় বহেরুর গায়ে খুনের রক্ত, বাপকেও ভাল চোখে দেখে না। টুঁটি টিপে ধরে যদি ঘুমের মধ্যে। যদি কৈফিয়ত চায়?
রাতে উঠে তাই আজকাল বহেরু ছমছম করা চারধারের মধ্যে বসে বসে ভাবে। কাল রাতেও ভাবছিল, দোকা ছাড়া পৃথিবীতে বাঁচা যায় না। এই যে এত জমি-জোত, ধান-পান, কার জন্য! দশভূতে খাচ্ছে। সে খাক, একা খাওয়ারও তো মানে হয় না, সে খাওয়ার আনন্দ নেই। কিন্তু কেবলই মনে হয়, একজন বুকের কাছের আপনজন হলে তার জন্য সব-কিছুর একটা আলাদা আনন্দ থাকত। কত ফিসফিসানো কথা জমে আছে বুকের মধ্যে! বলত। সে থাকলে এই রাতের ভয় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারত। কিন্তু সে মনিষ্যিটা কে! মেয়েমানুষ কোনও? নাকি ছেলেপুলে? নাকি নাতিপুতি? কে? কার জন্য এত সব করেও কিছুই নেই বলে তিন প্রহর রাতে উঠে বসে থাকে বহেরু? বুকের ফাঁকা জায়গা থেকে শ্বাসবায়ু বেরিয়ে এলে মনে হয় ফের বুঝি বাতাস টানতে পারবে না। গেল দম ফুরিয়ে কলের পুতুলের। নয়নতারার ঘাড়ে ভর করে মেঘু যে শাপশাপান্ত করেছিল তা কি ফলে গেল নাকি! এত ফাঁকা ফাঁকা তো লাগত না কখনও!
পাঁচ রবিবারে এবারের বোশেখ মাস গেছে। ঝড়া কিংবা খরায় যাবে। ঝড়ার লক্ষণ নেই। খরায় ধরেছে বছরকে। সে সবও ভাবে বহেরু। জোত-জমি ধান-পান, গরু-ছাগল ছেলে-পুলে, বউ-নাতি। সব ভেবেও একটা জায়গায় এসে থেমে যায়। জীবনের একটু বৃত্তান্ত জানা হল না। কার জন্য? কে সেই আপনজনা!
কাল রাতে ঘুমটা এসেছিল সময়মতো। একটু আফিং দিয়েছিল বৃন্দাবন। সেইটে খাওয়াতে ঠিক যেমন চেনা লোক মজা করতে পিছন থেকে থেকে চোখ টিপে ধরে, বিন্দুর মায়ের সঙ্গে যখন দেওর-বউঠান সম্পর্ক ছিল তখন বিন্দুর মাও এসে ও-রকম ধরত পিছন থেকে, ঠিক তেমনি ঘুমটা এসে পিছন থেকে চোখ টিপে ধরল। মাইরি-ঘুম একেবারে। সেই সময়ে একঝাঁক শিয়াল চেঁচিয়ে উঠেছিল, আর সেই সঙ্গে গন্ধ বিশ্বেস। কোথাও কিছু না, ‘চোর, চোর বলে চেঁচাল খানিক। লাঠি ঠুকে ঠুকে কেসে বুকের গয়ের তুলে ফেলল ঘরের মেঝেয়। পেচ্ছাপের হাঁড়ি ওলটাল একটু বাদে। বেড়াল কুকুরদের শ্রাদ্ধ করতে লাগল। হাঁড়িটা যে বেড়ালে উলটিয়েছে সেটা প্রমাণ করার জন্যই বোধ হয় লাঠি দিয়ে ঘা-কতক বসাল ওদিকে। বেড়ালে, কুকুরে, গন্ধ বিশ্বেসে সে এক তুলকালাম কাণ্ড। বেড়ালরাই বা ছাড়বে কেন, কার লেজ মাড়িয়েছে, সেও ফ্যাঁস করে দিয়েছে আঁচড়ে, মাঝরাতে গন্ধর তখন হাপুস নয়নে কান্না। বহেরু তখন উঠে গিয়ে ইঞ্জিনের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে গন্ধর ঘরের ঝাঁপের দড়ি খুলে ঢুকেছে। গন্ধ চোখে দেখে না বলে হারিকেনের রেওয়াজ নেই। অন্ধকারে মাটির ভিটেয় তরল পদার্থ গড়িয়ে পিছল, তার মধ্যে পা হড়কাল বহেরুর। দাঁতে দাঁত কড়মড় করে বহেরু গিয়ে গন্ধ বিশ্বেসকে টেনে তুলল মেঝে থেকে। বসাতে যাচ্ছিল ঘা কতক। প্রথম থাবড়াটা মেরেই খেয়াল গেল, আরে, এ লোকটাও যে একা! সারাদিন খাই-খাই করে, হাগে-মোতে, কাঁদে, যাই করে, সেও তো দোকা নয় বলেই। গন্ধ তখন ভয়ে কাঁপছে, আর ধরা গলায় বলে—আমি কিছু জানি না বাবা, আমি কিছু জানি না বাবা…
বুড়ো বয়সে বাপ ভাইয়ের তফাত গুলিয়ে ফেলেছে ভয়ে। গন্ধকে তাই মায়াবশে ছেড়ে দিল বহেরু। বেড়ালগুলোকে অন্ধকারেই সাঁত সাঁত করে কয়েকটা লাথি কষাল। বড় রাগ। চারধারে পৃথিবীটার ওপরেই বড় রাগ তখন বহেরুর। দুর্গন্ধের চোটে গন্ধর ঘরে টেকা যায় না, তবু অন্ধকারে খানিক দাঁড়াল বহেরু। গন্ধর বুড়ো হাতটা এসে তার হাত ধরল। নাকের জলে চোখের জলে ফঁত ফঁত শব্দ করতে করতে গন্ধ বলে—তুমি মা-বাপ বাবা, মেরো না গো। কাঁকালের হাড়টায় মটাং করে বড় লেগেছে।
বহেরু হাতটা ধরে বিছানায় তুলে দিল। বলল—ফের চেঁচাবে না। পড়ে থাকো মটকা মেরে।
তারপর বৃন্দাবনকে ডেকে গাঁজা টেনে আবার পড়ে থেকেছে বহেরু। ঘুম আসেনি। দাদার গায়ে হাত তোলাটা ঠিক হল না। ভাবল। আবার ভাবে, ওই রকমভাবে সেও বেঁচে থাকবে নাকি! পাগল! বয়সে যখন ভাঁটি বুঝবে তখনই পোকামারা বিষ তাড়ির সঙ্গে গুলে খেয়ে রাখবে একদিন। ব্রহ্মময়ী, মরণটা যেন সুন্দর হয়।
কথাটা ছ্যাঁৎ করে নিজেকেই লাগে। মরণ! ও কথাটা এতকাল ভাবার ফুরসত হয়নি তো!
রাতটা ভাল গেল না। হিজিবিজি হয়ে কেটে গেল। সকাল ইস্তক দাওয়া গরম করে উঠে পড়া বহেরু। সাঁওতালটা কদিন ধরে শ্বাস টেনে যাচ্ছে। মরেনি। কমাস ধরেই পড়ে আছে। যাই-যাচ্ছি করে এখনও ঠেকিয়ে রেখেছে অন্তিমকাল। সময় মাপা আছে, সেটা ফুরনোর ওয়াস্তা। ইচ্ছে করলেই তো মরা যায় না। তার ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে বহেরু। বিড়-বিড় করে বলে—বেঁচে থাকো বাপু, টিঁকে থাকো। একটা বেঁটে বক্কেশ্বরকে আনাচ্ছি, দুজনে মিলে বাহার হয়ে ঘুরবে।
আলো ফুটতে না ফুটতেই ছোকরাটাকে দেখা গেল, বহেরুর খামারবাড়ির আশে-পাশে ঘুরঘুর করছে। ঝোপঝাড়ে উঁকিঝুঁকি মারছে, গোয়ালঘরের পেছুতে গিয়ে কি খুঁজছে। কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে ছুটে গেছে, কাচ্চা বাচ্চারাও মুখের এড়ানি, চোখের পিঁচুটি ধোয়ার সময় পায়নি, মজা দেখে জুটে গেছে।
গোয়ালঘরের সামনেটায় এসে দাঁড়িয়েছিল বহেরু, লোকটা সে সময়ে এসে কপালে হাত ঠেকিয়ে একটু সম্মান দেখাল। বলল—এ হচ্ছে নাগভিটে। বাস্তু আমরা ধরি না। অন্য সাপ থাকলে ধরব?
বহেরু লোকটার দিকে চেয়েই বুঝতে পারে, গুণি লোক। তার চোখ চকচক করে। বলে—ধরো। দেখি।
এক গ্লাস জল আর একটা তুলসিপাতা চেয়ে নিল লোকটা। পোঁটলা থেকে একটা এতটুকুন মা কামরূপ কামাখ্যার ছবি বের করে ধরল গ্লাসটার ওপর। রেলগাড়ির মতো মন্ত্র পাঠ করতে লাগল। স্যাঙাতরা সব ঘিরে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ কামাখ্যার ছবির দর্পণে কী দেখে চেঁচিয়ে বলল—গোয়ালের পিছনে, খড়ের গাদায়। যাঃ।
স্যাঙাতদের হাতে একটা শুকনো শিকড়। তারই টুকরো-টাকরা ভেঙে গোয়াল ঘরের চারধারে ছিটোতে থাকে। ছানাপোনারা ভিড় করে সঙ্গে সঙ্গে এগোয়। বহেরু হাঁক ছাড়ে— তফাত যা।
ওদের কজনা গোয়ালের ভিতরে ঢুকে যায়। একজন গোয়ালঘরের পিছন দিকে গিয়ে দাঁড়ায়। ভিতরে খড়ের গাদায় একটা সর-সর শব্দ ওঠে, ফোঁসানি শোনা যায়। গায়ে কাঁটা দেয় বহেরুর। আজকাল বড় একটা ভয়-ভয় ভাব ধরেছে তাকে। গোয়ালে খড়ের গাদায় সাপখোপ, বিছে তো থাকবেই। জানা কথা। না ঘাঁটালে ওরা ওদের মতো থাকে। তবু এখন কেমন ভয় খায় সে। নিত্যি তিরিশ দিন দোবেলা গোয়াল ঘাঁটে সে, যদি কোনওদিন দিত। ঠুকে! ভাবতেই গা হিম।
পিছনের বেড়ায় একটা টিন আলগা লাগানো। বাইরে দাঁড়ানো লোকটা সটান সেই টিনটা টেনে খুলে ফেলল মড়াত করে। সাঁত করে হাত ঢুকিয়ে দিল ফোকর দিয়ে। একটা হ্যাঁচকা টানে হাতটা বের করে আনতেই সবাই দেখে, মাঝারি লম্বা একটা গোখরো। লেজের দিকটা ধরে আছে, মাথাটা শূন্যে ঝুলছে, একটু একটু তোলার চেষ্টা করছে মাত্র। ঝাঁপি নিয়ে একজন এগিয়ে আসে। পাগড়ি বাঁধা লোকটা সাপের গায়ে মন্ত্র পড়ে হাত বুলিয়ে দেয়। সাপটা ঝাঁপিতে পড়ে থাকে।
বহেরুর গা কাঁটা দেয়। মাগো! সাক্ষাৎ যমদূত।
আবার তুলসিপাতা আর জলের ওপর কামরূপ কামাখ্যার ছবি রেখে লোকটা কি যেন দেখতে পায়। দক্ষিণের কলাবাগানের দিকে হাত তুলে বলে—এই মোটা, মস্ত একটা ওখানে রয়েছে। কতগুলো ডাঁড়াশ সাপ আছে, আশে-পাশে, তাড়িয়ে দিস। বড়টাকে ধরবি।
লোকগুলো ঠিক জায়গায় চলে যায়। ঘিরে ধরে শিকড় ছিটিয়ে ছিটিয়ে এগোতে থাকে। বহেরু দেখে, ঠিকই কতগুলো ডাঁড়াশ সাপ পালাচ্ছে। তারপরই ফোঁসানি শোনা যায়। মাটি ফুঁড়ে মাথা তোলা দেয় এক গোক্ষুরো। মা গো! কী তার চেহারা। তেল-পিছল গায়ে বাদামি আলো ঠিকরোচ্ছে। ধাঁই করে বেরিয়ে পালাচ্ছে, বেঁটে মতো কালো একটা লোক লেজটা নিচু হয়ে ধরে তুলে ফেলল। হাত উঁচু করে ধরেছে, তবু মাথাটা মাটি ছুঁই-ছুঁই। বাচ্চাগুলো, মানুষজন সব ঘিরে ধরেছে লোকটাকে। বড্ড কাছাকাছি চলে গেছে। বহেরু হাঁক ছেড়ে সবাইকে সতর্ক করে দেয়—তফাত যা, তফাত যা।
পাগড়ি মাথায় ওস্তাদ ছেলেটা হেসে বলে ভয় নাই, ভয় নাই বাবু, আমি তো আছি। সুনীল নাগা জুহুরি আজ্ঞে, সাতপুরুষের পেশা।
বহেরু ধাতস্থ হয়ে তাকে ডেকে দাওয়ায় বসাল। বিড়ি দিলে লোকটা হাত তুলে বলল— এখন নয়।
—সাপ খেলাও নাকি? বহেরু জিজ্ঞেস করে।
লোকটা মাথা নেড়ে বলে—না। চাষবাস, আছে। এ পৈতৃক পেশা। বছরে এক-দুবার বেরোই। আসাম পর্যন্ত চলে যাই আমরা সাপ ধরতে। খেলাই না।
—ধরে করো কী?
—বেচে দিই। সরকার কেনে। এক ভরি বিষ তিনশো আশি টাকা। যোলোটা সাপে এক ভরি হয়।
লোকটার বয়স ভারী কম বলে মনে হয়। গোঁফদাড়ি এখনও ওঠেনি তেমন। লাউয়ের গায়ের রোঁয়ার মতো নরম কিছু রোঁয়া উঠেছে গালে। গোঁফের কাছে আবছা রেখা দেখা যায়। সেখানে ঘাম জমেছে। মুখের ডৌলটুকু বড় মিঠে। বহেরু তার কাছ ঘেঁষে বসে, বলে—বাড়ি কোথা?
—বহরমপুর। এই বলে লোকটা উঠে যায়। তার স্যাঙাতরা চারধারে ঘুরছে। এখান-সেখান থেকে মাটি খুঁটে হাতে নিয়ে শুঁকছে। সতর্ক চোখ।
বহেরু উঠে গিয়ে নাগা জহুরির সঙ্গ ধরল, বলল—শোঁকো কী?
নাগা জহুরির মুখে হাজির হাসি। বলে—এ হচ্ছে নাগভিটে। বাস্তু সাপ-টাপ থাকতে পারে। তাই দেখছে সব।
—শুঁকে কী বোঝে সব?
—বাস্তু সাপ যেখানে থাকে সেখানকার মাটিতে সুন্দর গন্ধ পাওয়া যায়। যে সে অবশ্য বোঝে না। গুণিন ঠিক পায়। আর এমনি বিষের সাপ যেখানে থাকে সেখানে পচাটে গন্ধ।
—বাস্তু সাপ আছে নাকি? দেখিনি তো কখনও।
নাগা জহুরি মাথা নাড়ল। একটু বিমর্ষভাব দেখিয়ে বলল—ছিল। বড় পবিত্র প্রাণী। একটা জোড়া ছিল। কখনও এঁটো জলটল কিছু ছিটে লেগেছিল বোধ হয়, তাই জোড়া ভেঙে চলে গেছে।
বহেরু চেয়ে থাকে। বড় একটা শ্বাস ফেলে বলে—কবে গেল?
তুলসির জলের ওপর কামাখ্যার কালীর ছবি ধরে থেকে নাগা জহুরি বলে— বছরখানেক হবে।
—গেলে হয়টা কী?
—সংসারে নানা অশান্তি লাগে।
বহেরু নীরবে মাথা নাড়ল। বুঝেছে। একটা শ্বাস ফেলে বলল—তোমরা সব দুপুরে এখানেই খেওখন। বুঝলে! এখন চা খাও।
বলে বিন্দুকে ডাকাডাকি করতে থাকে বহেরু। হেলেদুলে বিন্দু আসে, মুখে একটু হাসির আভা ছড়ানো! টস্ টস্ করছে লোভি ঠোঁট। একটা চোখ হানল নাগা জহুরিকে। বহেরু একবার চোর-চোখে দেখে নিল, নাগা জহুরির কলজেটা কেমন। দেখল, খুব মজবুত নয়। বাচ্চা ছেলে, রোঁয়া ওঠেনি। একটু ভ্যাবলা বনে গেছে মেয়েটাকে দেখে। বহেরু এসব খুব উপভোগ করে। মেয়েটা তারই ঔরসের। তেজি আছে। বহেরু অন্যদিকে চেয়ে বলে—চা করে নিয়ে আয়।
বিন্দু মাথা নেড়ে চলে গেল। সেই দিক পানে চেয়ে আছে নাগা জহুরি। বহেরু সুযোগটা ছাড়ল না। বলল—এখানে থাকবে নাকি?
নাগা জহুরি মুখ ফিরিয়ে বলে—থাকবে মানে?
—জমিটমি দেব। ঘর করে দেব। বলে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে—বিয়েশাদিও করতে পারো, এখানেই। বলে আবছা ইঙ্গিতটা হজম করতে দিল জহুরিকে। বিড়ি ধরিয়ে মিটমিট করে চেয়ে চেয়ে দেখছিল জহুরির মুখে কেমন ভাব খেলা করে।
তা অনেক ভাব খেলল। বিন্দু হারামজাদি জানে বটে রঙ্গরস। একেবারে কাম্নী ডোম। বহেরুর মনটা হে-হে করে হাসছিল। পাণ্ডুয়ার বামনবীরটা আসতে চাইছে না। চিড়িয়াখানাটা জমছে না তেমন। সাঁওতালটাও টেঁসে যাবেই। এ লোকটা যদি থাকতে রাজি হয় তো বেশ হবে। কিন্তু বেশি ঝোলাঝুলি করলে টানের সুতো ছিঁড়ে যায়। তাই প্রস্তাবটা দিয়েই বহেরু কিছুক্ষণ পরে অন্য কথা পাড়ে। লোকটা বাঁ হাতের তেলোয় এক ডেলা শিকড়। সেটা দেখিয়ে বলে—ওটা কী বস্তু?
জহুরি অদূরে উবু হয়ে বসে পড়ে। পরনের ফেরত দেওয়া কাপড়ের কোনাটা তুলে মুখ মুছে নেয়। বলে—এ হচ্ছে বিদ্যাসুন্দর গাছের শিকড়। দুর্লভ বস্তু কিছু নয়। জঙ্গল-পঙ্গলে একটু খুঁজলেই পাওয়া যায়।
—দেখি। বলে হাত বাড়াল বহেরু।
লোকটা নির্দ্বিধায় দিয়ে দিল, বলল—শুঁকে দেখুন।
দেখল বহেরু। ভারী মিষ্টি ধূপের গন্ধের মতো মৃদু গন্ধ।
জহুরি বলে বেশ গন্ধটা না। কিন্তু সাপ ও গন্ধ সইতে পারে না। গন্ধ পেলেই গর্ত থেকে বেরিয়ে পালায়। তখন আমরা ধরি।
—তা হলে এ জিনিস সঙ্গে থাকলে সাপে ঠুকবে না বলো।
জহুরি মাথা নেড়ে বলে—তার ঠিক নেই। কথায় বলে সাপের লেখা বাঘের দেখা। শিকড় ছিটোলে পালায় জানি। তা বলে সঙ্গে রাখলে কামড়াবে না তা নয়। তবে ও বস্তুর আরও গুণ আছে। গায়ে রাখলে বাত, অম্বল আর হাঁপানির বড় উপকার।
বহেরু একটা শ্বাস ফেলে বলে—এ দিয়ে কী হবে! তুমি থাকলে বরং বল ভরসার কথা।
লোকটা উত্তর দিল না। চেয়ে রইল।
সারাদিন কেরামতি দেখাল অনেক। বুড়ো আঙুলের নখে কখনও সিঁদুর কখনও কালি লাগিয়ে নখদর্পণ দেখাল। ফণা তোলা দাঁতাল সাপের মুখের কাছে মুঠো করে হাত এগিয়ে দিয়ে দেখাল সাপটি কেমন মিইয়ে যায়। একটা পয়সাও নিল না। তার স্যাঙাতরা অবশ্য গোটা কুড়ি সাপ ধরে নিয়ে গেল। এইটুকু জায়গায় এত সাপ ছিল কে জানত!
ব্রজগোপাল সবটাই লক্ষ করেছেন। রাতের বেলা বসে সাপ ধরার বৃত্তান্তটা লিখে রাখছিলেন ডায়েরিতে। লিখতে লিখতে একটা শ্বাস পড়ল। কার জন্য লিখছেন? কাকে দিয়ে যাবেন এইসব কুড়িয়ে পাওয়া মণিমুক্তা? ছেলেরা বিজ্ঞানের যুগে বাস করে। এ সব দেখলে হাসবে।
এ সময়ে বহেরু এসে বসল পায়ের কাছে মাটিতে। মুখখানা তুলে দুঃখের স্বরে বলে—জহুরি চলে গেল কর্তা। রাখা গেল না।
ব্রজগোপাল বললেন—হুঁ।
—রাখতে পারলে হত। বুকটা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
ফের ব্রজগোপাল বলেন—হুঁ।
বহেরু বুক কাঁপিয়ে একটা শ্বাস ছেড়ে বলে—মানুষজন সব যেন দূরে দূরে হেঁটে চলে যাচ্ছে বহেরু গাঁ থেকে। কবে আসবে সব! কাতারে কাতারে!
॥ একচল্লিশ ॥
আকাশে ছমছম করছে মেঘ। গম্ভীর মেঘধ্বনি। ঘন কালো ছায়ায় দুপুরেই ডুবে গেল কলকাতা। যেন বা প্রলয় হবে। ঠান্ডা একটা বাতাস এল, তাতে ভেজা মাটির গন্ধ।
রাস্তা পার হবে বলে রণেন দাঁড়িয়েছিল ফুটপাথে। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের সরু ফুটপাথ, দাঁড়ানোর পক্ষে সুবিধের নয়। ক্রমান্বয়ে চলমান মানুষ গা ঘেঁষে ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছে। রাস্তায় গায়ে গায়ে গাড়ি, ট্রাম, ঠেলা সব দাঁড়িয়ে। জ্যাম। চিনেদের জুতোর দোকান থেকে চামড়ার কটু গন্ধ আসছে। একঝলক হাওয়া রাস্তার ধুলো কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারল মুখেচোখে। জীবাণুতে ভরতি কলকাতার বিষাক্ত ধুলো।
রণেন আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখল। বাড়ির চূড়ায় চূড়ায় বিঁধে আছে সরু একফালি আকাশ। কিংবা আকাশের গলি। তার মধ্যে মুশ্কো কালো শরীর বাড়িয়ে দিয়েছে প্রলয়ংকর মেঘখানা। রণেন ঘাম মুছল রুমানে। হাতের ভারী ব্যাগটা হাত বদল করল একবার। শরীরটা ভাল নেই। মেঘ করলে মাথার মধ্যে কেমন যেন করে।
নীল একটা ঝলক চাবুকের মতো খেলে গেল চারধারে। তারপরই কানের কাছ বরাবর সর্বনাশের শব্দ হয়। রণেনের বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে হৃৎযন্ত্র নড়ে ওঠে। শরীর অবশ লাগে। ঘাম হয়। প্রেসারটা বেড়েছে। কদিন আগে ডাক্তার ডেকেছিল বীণা। ডাক্তার প্রেসার দেখল, বুক দেখল, পেচ্ছাব পরীক্ষা করাল। কটা দিন বাড়িতে আটকে রেখেছিল বীণা। সে এক অসহ্য যন্ত্রণা। ঘরের মধ্যে আজকাল রণেন থাকতেই পারে না। রাতে যখন সদরদরজা বন্ধ হয়, তখনই রণেন ভারী ভয় পেয়ে যায়। কেবলই মনে হয়, রাতে ঘুমোলে যদি ভূমিকম্প হয় কি, আগুন লাগে, তা হলে বেরোবো কি করে তাড়াতাড়ি? বীণা যখন শোয়ার ঘরের দরজা দেয় রাত্তিরে, তখনও একটা বোবা ভয় তাকে ভালুকের মতো এসে ধরে। ঘরের ভিতর থেকে যেন বা সে আর কোনওদিন বেরোতে পারবে না। ভিতরকার চৌখুপির বাতাস বড় কম। বুক ভরে কবার দম নিলেই তা ফুরিয়ে যায়। তারপর আসবে দমবন্ধ করা এক অস্বস্তি, শ্বাসকষ্ট। মৃত্যু? হ্যাঁ। তাই।
সে ককিয়ে উঠে বলে—দরজা খুলে দাও।
বীণা দাঁতে ঠোঁট চেপে বলে—কেন?
—আমার অস্থির লাগে। দরজা জানালা সব খুলে দাও।
বীণার একটু ঠান্ডার বাই আছে। এই ঘোর গ্রীষ্মেও নাকি শেষ রাত্রে হিম পড়ে। বাচ্চাদের ঠান্ডা লাগে যদি! বীণার নিজেরও ইসিনোফেলিয়া শতকরা নয়। ভাগ। ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস। বীণা দরজা খুলে দেয়, কিন্তু জানালা সব খুলতে রাজি হয় না। কেবল ড্রেসিং টেবিলের ধারের জানালার একটা পাট খুলে রাখে। বিছানার ধারের জানালা খোলে না। ঘরে সবজে একটা ঘুম-আলো জ্বলে। সেই ঘোর সবুজ রঙের মধ্যে শুয়ে থেকে রণেন সেই এক-পাট খোলা জানালার দিকে চেয়ে থাকে। ওই একটু এক চিলতে ফাঁক—ওইটুকু যেন তার প্রাণ, তার পরমায়ু, তার শ্বাসের বাতাস। রাতে ঘুম হয় না। প্রেসারের বড়ি আর ট্রাংকুলাইজার খায়। তাতে হয়তো প্রেসার কমে, টেনশনও কমতে পারে। কিন্তু শরীরটা বড় দুর্বল লাগে। সারাদিন অবসাদ। মা এসে বুকে হাত বুলিয়ে দেয়, মাথার তালুতে তেল চাপড়ে দেয়। দিতে দিতে চোখের জল ফেলে বলে— আজকাল কচিবয়সেই এ-সব তোদের কী রোগ হয় রে?
কচি বয়স? মায়ের কাছে অবশ্য ছেলের বয়স বাড়ে না। কিন্তু বয়স কথাটা আজকাল বড় ধাক্কা দেয় রণেনকে। তার বোধ হয় আটত্রিশ পেরিয়ে উনচল্লিশ চলছে। আর একটা বছর ত্রিশের কোঠায়। তারপরই চল্লিশ। মধ্যবয়স, প্রৌঢ়ত্ব। সে ধাপটা পেরোলেই বুড়ো। বড় সাংঘাতিক। বয়স যত ঘনায় তত একে একে প্রিয়জন খসে পড়তে থাকে। বাবা যাবে, মা যাবে, বয়স্করা যাবে। একদিন তারও যাওয়ার সময় এসে পড়বে।
কেমন হবে সেই দিনটা? মেঘলা? নাকি রৌদ্রোজ্জ্বল? শীত? না কি গ্রীষ্ণকাল? বর্ষা হবে না তো! দিন, না রাত্রি? ভাবতে ভাবতে বিছানায় উঠে বসে রণেন। খুব কাছে কে যেন বলে ওঠে—সব মরে যাবে। চমকে ওঠে রণেন। কে বলল ও কথা? পরমুহূর্তেই বুঝতে পারে যে, সে নিজেই বলেছে। তার ঠোঁট নড়ে উঠল এইমাত্র। আবার বলল—উঃ, মা গো!
নিজের ঠোঁটে হাত রাখে রণেন। সে এই একা-একা কথা বলাকে বড় ভয় পায়। সন্দেহ করে। কিন্তু ঠেকাতেও পারে না। আজকাল মাঝে মাঝে সে টের পায়, তার ঠোঁট নড়ে, জিব নড়ে, কথা উঠে আসে বুক থেকে। আপনিই চমকে ওঠে রণেন। ঠোঁট চাপা দেয়, নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে। আর তখনই আবার বলে ওঠে—ক্যাডাভ্যারাস, ক্যাডাভ্যারাস, ইউ…ইউ…ইউ…
কথাগুলোর অর্থ কী! তবু বুক থেকে, মাথা থেকে ওইরকম সব অর্থহীন শব্দ উঠে আসছে আজকাল। কী হয়েছে তার? খুব শক্ত অসুখ? ঘোর সবুজ আবছা আলোয় সে আয়নার দিকে তাকিয়ে মুখ ভ্যাঙচার। হাসে। ওই মৃদু আলোতেও বুঝতে পারে, তার চোখে না ঘুমোনোর ক্লান্তি। একটু ঝুঁকে গেছে মোটা শরীর। ঘুম ভেঙে কখনও বীণা উঠে ধমক দেয়—কি হচ্ছে কি পাগলামি? বিছানায় এস। ঘুমোও।
রণেন বিছানায় যায়। শুয়ে থাকে। ঘুমোয় না। বিড়বিড় করে বলেচছক্যাডাভ্যারাস, ক্যাডাভ্যারাস, ইউ..ইউ…ইউ…
কদিন ঘরবন্দি রেখেছিল বীণা আর মা। এখন আবার বেরোয় রণেন। জোর করেই বেরোয়। শরীর খারাপ বলে আজকাল আর তাকে বাইরে ঘুরতে হয় না। অফিসেরই একটা সেকশনে বসে থাকে চুপচাপ। কিন্তু অফিসের লোকজন আজকাল তাকে বড় বেশি লক্ষ্য করে। হঠাৎ হঠাৎ কথা বলে ওঠে রণেন। সবাই তার দিকে ফিরে তাকায়। এও এক জ্বালাতন। তাই আবার আজকাল বাইরে বেরোয় সে। শরীর খারাপ লাগলেও মনটা একরকম থাকে।
একদিন অফিসে ঘোষের কাছে গিয়ে হাক্লান্ত রণেন বলেছিল—ঘোষদা, একটা কথা বলতে পারেন?
ঘোষ অফিসের ফাইল আজকাল প্রায় ছোঁয় না। ডিসেম্বরে রিটায়ারমেন্ট, কাজ করে হবে কী? বসে বসে পুরনো টেস্ট পেপার থেকে খুঁজে পেতে অঙ্ক কষছিল অফিসের কাগজে। অঙ্কটা কষতে কষতেই বলল কী?
—মানুষ মরার পর কি হয় বলুন তো, আত্মা-টাত্মা বলে কিছু আছে নাকি সত্যিই?
ঘোষ চোখ তুলে তাকে একবার দেখে নিয়ে মিচকে হাসে। বলে—বাঃ। বেড়ে প্রশ্ন। আজকাল এ-সব নিয়ে কেউ ভাবে নাকি আপনার বয়সে?
ঘোষ জানে অনেক। ভারী স্থির বুদ্ধি। তবে কথাবার্তায় সবসময়ে একটু বাঁকাভাব থাকে।
রণেন বলেছিল—বলুন না ঘোষদা।
ঘোষ কাগজপত্র সরিয়ে রেখে চেয়ারে পা তুলে বসল, বলল—মশাই, আপনি যে আছেন, এটা কি সত্যি?
রণেন মাথা নাড়ে—সে তো আছিই।
ঘোষ তখন মৃদু হেসে বলে—আপনার থাকাটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে আপনি যে ছিলেন, এও সত্যি। আর, আপনি যে থাকবেন, তাও সত্যি। এটা লজিক্যালি প্রুভড। আপনি ছিলেন না, আপনি থাকবেন না, অথচ আপনি আছেন—তা হয় কী করে? যুক্তিতে আসে না। সুতরাং জন্মের আগেও আপনি ছিলেন, মৃত্যুর পরেও আপনি থাকবেন। এটা থিয়োরেটিক্যালি প্রমাণ করা যায়।
রণেন কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে বলে—কিন্তু কীভাবে থাকব, কীভাবে ছিলাম।
ঘোষ অন্যমনস্ক ও গম্ভীরভাবে বলে—বলা মুশকিল। তবে শুনেছি, অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ আত্মা একটা ভাবভূমিতে অবস্থান করে। তার অঙ্গও থাকে, বোধও থাকে তবে সে মর্ত্যের মতো নয়। অন্যরকম।
রণেন একটু কেঁপে উঠে বলেছিল—সে জায়গা কেমন?
ঘোষ একটু হেসে বলে—কী করে বলি? না মরলে তো জানতে পারা যাবে না। তবে শুনেছি, সেখানে আলো-অন্ধকার নেই, শীত-গ্রীষ্ম নেই।
তবে সে কি অনন্ত গোধূলির দেশ? চিরবসন্ত? ঠিক বিশ্বাস হয় না, কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। পরমুহূর্তেই ঘোষের দিকে চেয়ে থেকে তার আবার সেই একাকীত্বের কথা মনে পড়ে। লোকটার বউ নেই, ছেলেরা আত্মসর্বস্ব। এ লোকটা চাকরি শেষ হওয়ার পর একদম একা হয়ে যাবে। প্রাণের কথা বলা মানুষ না থাকলে মানুষ বড় কষ্ট পায়। তার গভীর মনের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীটার কোনও সম্পর্ক থাকে না। ঘোষের দিকে চেয়ে তাই একরকম ভয় পায় রণেন। বলে—ঘোষদা, রিটায়ার করে কী করবেন?
ঘোষ প্রশ্ন শুনে হাসল। চেয়ার থেকে ঠ্যাং নামিয়ে ঝুঁকে অঙ্ক কষার কাগজপত্র টেনে নিল আবার। বলল—বসে থাকব, যতদিন না মরি।
কথাটা বড় ন্যাংটো, কড় কঠিন সত্য। বসে থাকব, যতদিন না মরি। রণেন বড় অস্থির বোধ করেছিল। উঠে আসছিল, ঘোষ পিছন থেকে ডেকে বলল—ব্রজদা আছেন কেমন?
—ক্ষেত খামার নিয়ে থাকেন! ভালই আছেন।
ঘোষ বুঝদারের মতো মাথা নাড়ল। হঠাৎ বলল—মাঝেমধ্যে শ্মশানে গিয়ে বসে থাকবেন। দেখবেন তাতে মৃত্যু সম্পর্কে জড়তা কেটে যায়। আমি এখনও সময় পেলে নিমতলার গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসে থাকি। সন্ধেবেলাটায় বেশ লাগে।
তাও গিয়েছিল রণেন। কেওড়াতলাটা কাছে হয়। দুপুর-দুপুর একদিন চলে গেল। দেয়ালঘেরা বদ্ধ জায়গা, রোদের তাপ, চিতার আগুন, সব মিলিয়ে বীভৎস গরম। ছাই, ধোঁয়া চারদিক অন্ধকার করে রেখেছে। পোড়া ঘিয়ের কটু গন্ধ। মানুষের পোড়া-আধপোড়া-না পোড়া শরীর চারধারে। মাথার মধ্যে একটা ভয়-ভাবনা ঘুলিয়ে উঠল। একধারে একটা টিনের টুকরো চাপা গাদির মড়া পড়ে আছে। টিনের তলা থেকে সিঁটোনো দুজোড়া সাদা পা বেরিয়ে আছে। ঠিক তার পাশেই সাদা পাকানো গোঁফঅলা একটা পশ্চিমা লোকের মাথা। সবগুলো রাতে এত চিতায় দাহ হবে। রণেন পালিয়ে এল। সে-রাতে জেগে থেকে অনেক রকম শব্দ করেছিল সে। মনে হচ্ছিল, ওরকম আগুনে পুড়ে যেতে সে কোনওদিন পারবে না।
রাতের বেলাটা একা ভয় করে জেগে থাকতে। কিন্তু সঙ্গে জেগে থাকার কেউ তো নেই। বীণা মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে উঠে ধমক দেয়, শুয়ে পড়তে বলে। কখনও-কখনও একটু আদরও করে কাছে ডেকে। তারপরই বীণার কাজ ফুরোয়। পুরনো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আর কিই বা কথাবার্তা থাকবে। রণেন জানে, তার কেউ নেই।
রাস্তাটা পার হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে রণেন। পার হতে পারছে না। দুদিকের দুমুখো গাড়ির আঁটো জ্যাম। আকাশে মুখ তুলে দেখে, বৃষ্টি এল বলে। কালো মেঘ নিচু হয়ে ঢলে যাচ্ছে রেলগাড়ির মতো। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ। খড়কুটো, ধুলোবালি উড়ে ঝাপটা মারছে। ফুটপাথের দোকানিরা দ্রুত মালপত্র তুলে নিচ্ছে। কলকাতার ড্রাইভারদের মনুষত্ববোধ কিছু কম। রাস্তা ফাঁকা পেলে মানুষজন মানে না। রণেন রাস্তা পার হওয়ার সময়ে যদি সামনের গাড়ি দুহাত এগোয় তবে পিছনের গাড়িও হয়তো রণেনকে উপেক্ষা করে দুহাত এগোবে। ড্রাইভারদের ঠিক বিশ্বাস করে না রণেন। এমনিতে তারা হয়তো তোক সবাই খারাপ না। কিন্তু কলকাতার জ্যাম, লক্ষ গাড়ি আর কোটি মানুষের ভিড়ে ভরা সরু অকল্পনীয় রাস্তা, পদে পদে থেমে থাকা—এসব থেকে মানুষ খ্যাপাটে হয়ে যায়—আসে রাগ বিরক্তি, অধৈর্য ক্লান্তি। তখন আর স্বত্ব স্বত্ত্ব জ্ঞান থাকে না। শুধু ড্রাইভার কেন, কলকাতার সব মানুষই কি তাই নয়? বিরক্ত, রাগী, উদাসীন ও নিষ্ঠুর। রণেনের চারদিকটা তাই ভয়ে ভরা।
রাস্তা পার হতে না পেরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে রণেন। মেঘ ডাকছে সিংহের মতো। জোর বাড়ছে হাওয়ার। টপাস করে একটা ফোঁটা এসে ফাটল রণেনের ডান গালে। কী ঠান্ডা ফোঁটা! রণেন ব্যাগটা হাতবদল করে নিয়ে ফুটপাথ ধরে আস্তে আস্তে হাঁটে। যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত রাস্তা আটকে সারা সার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অথচ রাস্তাটা পার হওয়া দরকার।
পান খাওয়া ডাক্তার বারণ করে গেছে। রণেন তবু খায়। কালাপাতি, পিলাপাতি আর মোহিনী দেওয়া কড়া পান। প্রথম প্রথম মুখ জ্বলে যেত, গলায় ধক্ লেগে মাথা ঘুরত। আজকাল সয়ে গেছে। সকাল থেকে আজ পান খায়নি। চড়বড় করে বৃষ্টির ফোঁটা হেঁটে যাচ্ছে চারধারে। এখনও মুষলধারে নামেনি। কিন্তু প্যারেডের সৈন্যর মতো তারা এগিয়ে আসছে। আরও কবার নীল চাবুক ঝলসে গেল চারধারে। মেঘলা আর বৃষ্টির দিনে রণেনের মাথা বড় ভার হয়। বুকের ভিতরটা অন্ধকার লাগে।
পানের দোকানের অল্প একটু ছাউনির ভিতরে মাথাটা গুঁজে রণেন দেখল, বিশুষ্ক সব দেয়ালে বৃষ্টির প্রথম কয়েকটি ফোঁটা অনেকগুলো তেরচা দাগ টেনেছে। ভেজা দেয়ালের চুণ-চুণ একরকম গন্ধ। পানের প্রথম ঢোঁকটা গিলে ফেলল রণেন। কড়া জর্দার পান। মাথাটা একবার পাক খেল। সামলে গেল। পিক ফেলে দিয়ে গলাটা ঝাড়ল একটু। প্রেসারটা বেড়েছে, রক্তে চিনি আছে, হার্টও ভাল না। কী হবে? মাথাটা নাড়ল রণেন। বলল-দূর ফোসকা পড়বে। বলেই চমকে উঠল। এখনও সে চিতার আগুনের কথা ভাবছে।
থেমে থাকা ট্রাম থেকে অধৈর্য কয়েকজন মানুষ নেমে পড়ল। তাদের মধ্যে একটি কিশোরী মেয়ে। কিশোরী? না, ঠিক কিশোরী নয়, তবে রোগা বলে ওইরকম দেখাল বোধ হয়। বাঁ হাতে খাতা উঁচু করে মুখ আড়াল দিয়ে নামল। সামনেই বাটার রিডাকশান সেল-এর দোকান। এক দৌড়ে উঠে গেল দোকানে, যেখানে মাথা বাঁচাতে ইতিমধ্যে জড়ো হয়েছে কিছু লোক।
হেঁটে আসছে বৃষ্টি। দেয়ালে দ্রুত ফোঁটার দাগ মিলিয়ে যাচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে ময়লা দেয়াল। বিবর্ণতা। পানের দোকান থেকে রণেন সরে আসে। বাটার দোকানে উঠে দাঁড়ায়। বৃষ্টি দেখে। কী গভীর বৃষ্টিপাত!
মেয়েটা হাতের খাতা বুকে চেপে দাঁড়িয়ে আছে। খুব দূরে নয়। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লম্বা, রোগাটে চেহারা। কিন্তু চামড়ায় কচি বয়সের চিকণতা। বয়সের দাগধরা, ছোপধরা নয়। মুখখানায় বয়সের অহংকার। পাতলা নাক, একটু মোটা ঠোঁট, দুখানা চোখ চঞ্চল, মাথায় তেলহীন নরম চুল, তাতে এখনও কয়েক ফোঁটা জল লেগে আছে। ডানধারে ঠোঁটের ওপরে একটা আঁচিল। ফরসা মুখে আঁচিল পাগল করে দেয় না, যদি জায়গা মতো হয়?
রণেনের দোষ সে যখন কোনও মেয়েকে দেখে তখন আর বাহ্যজ্ঞান থাকে না, ভদ্রতাবোধ লোপ পায়। তাই চেয়ে ছিল রণেন। সময়ের জ্ঞান ছিল না। ওই রকম লাগাতার চেয়ে থাকার জন্যই বোধ হয় মেয়েটা তার দিকে তাকাল। একবার স্বাভাবিক কৌতূহলে, পরেরবার ভ্রূ কুঁচকে। গহীন চুলের মধ্যে পথরেখার মতো সিঁথি ডুবে গেছে। মুখখানা লম্বাটে, থুতনির খাঁজ গভীর। কাপড় বা শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনে অনেকটা এরকম মুখের ছবি ছাপা হয়। বাঙালি মুখ, তবু যেন বিদেশি কাটছাঁটে তৈরি।
রণেনকে পছন্দ হয়নি মেয়েটির। ভ্রু কোঁচকানো মুখ ফিরিয়ে নিল ঝামড়ে। তাতে অবশ্য রণেনের কিছু যায় আসে না। মেয়েদের মনের মতো চেহারা তার নয়, সে জানে না কি! তবু একটা শ্বাস ফেলে রণেন। এখনকার দিনকাল বড় ভাল। সোমেনের কথা একবার মনে এল। কেমন শ্রীমান চেহারা ভাইটার! ওদের সময়টাও ভালো, মেয়েদের সঙ্গে হুল্লোড় করে বেড়ায়, বকবক করে। রণেনের কলেজ জীবন কেটেছে নন কো-এডুকেশনে, ইউনিভার্সিটিতে যায়নি। বরাবরই তার চরিত্রের খ্যাতি ছিল। সে নাকি মেয়েদের দিকে তাকায় না। সারা যৌবনকালটা সেই খ্যাতি রক্ষা করে গেছে রণেন। মেয়েদের উপেক্ষা করেছে। তাকায়নি। কেবল বহেরুর খামারবাড়িতে এক-আধবার নয়নতারার সঙ্গে…। কিন্তু সেও কিছু নয়। যৌবন বয়সের ভাল ছেলে রণেন আজও একরকম বাঁধা আছে নিয়তির কাছে। বয়স ফুরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পৃথিবী জুড়ে এখনও নেমে আসছে সুন্দর, কচি, হৃদয়বতী মেয়েরা।
রণেন দুপা পিছিয়ে গেল। ছাঁট আসছে। চশমা ভিজে গেছে। রুমালে কাচ দুটো মুছে নিয়ে ভাল করে তাকাল। মেয়েটা ঘাড় ঈষৎ সামনের দিকে বাঁকিয়ে বড় বড় অন্যমনস্ক চোখে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক উত্তেজক।
নিজের শ্বাসের ঝোড়ো শব্দে চমকে ওঠে রণেন। ভিতরে ভিতরে এক তীব্র কামবোধ আনন্দম্পৃহা জেগে ওঠে। চামড়ার তলায় শরীরের ভিতরকার অন্ধকারে ঝিঁঝি করে লুকনো বীজ। মাথার সব চিন্তা লোপাট হয়ে যায়। চোখের পাতা নড়ে না। ভিতরে ভিতরে ভালো ছেলে রণেন কি নারীধর্ষণকারী নয়? যেদিন বীণাকে মেরেছিল সেদিন সোমেন আর মা না চেঁচালে বীণা খুন হয়ে যেত তার হাতে। তা হলে, ভিতরে ভিতরে সে কি খুনিও?
রণেন নিজের মনে মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, সে যেমন খুন করতে পারে তেমনি নারীধর্ষণ করতে পারে। আরও পারে বহু কিছু। মানুষের অস্পৃশ্য অনেক পাপ। ভয়ে বা লজ্জায় বা অনভ্যাসে করে না। কিন্তু পারে।
মেয়েটা তাকাচ্ছে না, কিন্তু লক্ষ্য করেছে ঠিকই যে একজন মধ্যবয়সি মোটা লোক তাকে নজর দিচ্ছে। কচি বয়স, এ বয়সে যে কোনও পুরুষেরই চোখে নিজেকে জরিপ করে নিতে ইচ্ছে যায়। মেয়েটা তাই রণেনের উদ্দেশ্যেই বোধ হয় আঁচল টেনে টান করে দিল কিছুটা। স্পষ্ট ফুটে ওঠে বুকের ডৌল। নাভির নীচে কাপড়, খাটো ব্লাউজ। পেটের অনেকখানি দেখা যায় নীলচে একটা জার্মানি জর্জেটের শাড়ি পরনে। ভাবা যায়?
বৃথা গেল বয়স। বৃথা গেল সময়, মাথা খুঁড়লেও ফিরে আসবে না।
রণেন তাই নিজের মনের কাছে বলে রাখল—আমি কিছুই পাইনি জীবনে।
মেয়েটি বৃষ্টির দিকে চেয়েছিল। চুল নড়ছে হাওয়ায়। মোটা বেণী। নীরবে সেই যেন উত্তর দিয়ে দিল রণেনকে—আহা।
—আমি মোটা মানুষ, ব্যক্তিত্বহীন, হাবা।
—একটু বয়সের পুরুষই ভাল। তারা হৃদয়বান হয়, চঞ্চলতা থাকে না। তুমি ভাল।
রণেন মাথা নাড়ে, বলে—সবাই তাই বলে। কিন্তু আমি আর ভাল থাকতে চাই না। ভাল থাকা বড় একঘেয়ে ক্লান্তিকর। একটু খারাপ হয়ে দেখি না! আমাকে খারাপ করবে? প্লিজ!
মেয়েটা মৃদু হাসল। সৌরভময় শ্বাস ফেলে বলে—মোটা তো কী! কেমন ফরসা তোমার রং, কেমন ঠান্ডা মাথা। চাকরিও ভাল।
—কেমন লাগছে আমাকে? ভাল?
মেয়েটা চোখ তুলে তাকাল, শুভদৃষ্টির সময়কার মতো চোখ। কী লজ্জা ও শিহরনে ভরা বিদ্যুৎ! কথা বলল না।
রণেন বলে—আমি আর একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করব।
—তার মানে কি দুটো জীবন?
রণেন মাথা নাড়ল—শুধু বউ হলে আনতাম। কিন্তু বাচ্চাগুলো রয়েছে যে। বড় মায়া।
মেয়েটি বুঝেছে। মাথা নাড়ল। তৎক্ষণাৎ একটা নাম দিল রণেন—লীনা। এই নামের একটা মেয়েকে বালকবয়সে ভালবেসে ছিল রণেন, যার সঙ্গে কোনওদিন কথাবার্তা হয়নি। লীনা করুণ চোখে চেয়ে মাথা নয়াল। বলল—তাই হবে।।
হবে! বাঃ! চমৎকার! সব সমস্যার কেমন সমাধান হয়ে গেল। সবাই থাকবে। বাচ্চারা, বীণা, আলাদা ফ্ল্যাটে লীনাও! বাঃ।
ভারী খুশি হয়ে ওঠে রণেন।
দুঘণ্টার বৃষ্টি কলকাতাকে লণ্ডভণ্ড করে গিয়ে গেল। ট্রাম বন্ধ, বাসে লাদাই ভিড়, ট্যাক্সির মিটার সব লাল কাপড়ে ঢাকা। বৃষ্টির পর কলকাতা থেমে যায়, কিংবা খুব আস্তে চলে। রথের মেলার মতো মানুষ জমে আছে সর্বত্র। থিকথিক করছে জীবাণুর মতো মানুষ।
রণেন অফিসের হলঘরে তার ভেজা জামা আর গেঞ্জি ফ্যানের তলায় চেয়ারের পিঠে মেলে দিয়েছে। বসে আছে চুপচাপ। অফিসে এখনও কিছু লোকজন আছে। জনা ছয়েক লোক একধারে ফিস খেলছে। অন্যধারে ব্রিজের আড্ডা বসেছে। শুধু মুখোমুখি ঘোষ বসে নীরবে অঙ্ক কষছে। রণেন চোখ বুজে ছিল। ভাবছিল সবাইকে ডেকে বলে দেবে, মরবার পর যেন তাকে না পুড়িয়ে কবর দেওয়া হয়: পোড়ানোটা বড় বীভৎস ব্যাপার। আবার পরক্ষণেই মনে হল,কবর! ওরেব্বাস, সেও তো মাটি চাপা হয়ে দমবন্ধ হবে। হাঁসফাঁস করতে হবে কেবলই।
ভেবেই সে হঠাৎ জোরে বলল—না না।
বলেই চমকে ওঠে। ঘোষ একবার মুখ তুলেই চোখ নামিয়ে নিল। কিছু জিজ্ঞেস করল না।রণেন লজ্জা পেল বটে, কিন্তু ঘোষ বড় বিবেচক মানুষ বলে লজ্জাটাকে সামলে গেল।
সাতটা বেজে গেছে। ফিসের আড্ডা থেকে দুজন বেরিয়ে গেল। একজন চেঁচিয়ে বলল—ঘোষদা, এই বৃষ্টিতে কি ভাল জমে বলুন তো?
ঘোষ উত্তর দিল না। ব্রিজের আড্ডা থেকে একজন চেঁচিয়ে বলল—ভূতের গল্প, খিচুড়ি আর মেয়েছেলে।
—দূর। ঘোষদাকে বলতে দিন।
ঘোষ উত্তর দিল না। একটু হাসল কেবল, অঙ্ক কষতে লাগল।
আর একজন বলে—ইলিশ।
—কত করে কেজি জানিস? ওই লাহিড়ি জানে, জিজ্ঞেস কর।
কে একজন চেঁচিয়ে ডাকে—লাহিড়ি, ও লাহিড়ি।
রণেন তাকাল। অ্যাকাউন্টসের বিপুল সেন। ভ্রূ কুঁচকে রণেন বলে—কী?
—ইলিশ মাছ কত করে যাচ্ছে?
—কী জানি!
—আমাদের মধ্যে তো এক আপনাকেই দেখছি যিনি ইলিশটিলিশ খান। আমরা তো আঁশটাও চোখে দেখি না। ইন্সপেক্টর না হলে সুখ কী!
রণেন মুখটা ফিরিয়ে নেয়। ব্যক্তিত্ব না থাকলে এরকম হয়। যে-সে যা খুশি বলে সারতে পারে।
কে একজন বলল—ইলিশ খেয়ে পয়সা নষ্ট করবে কেন! লাহিড়ি লকারে রাখছে। টালিগঞ্জে বাড়ি হাঁকড়াচ্ছে, সব খবর রাখি।
হলঘরের দরজাটা খোলা। কে একজন ছাতা মুড়ে, গা থেকে বর্ষাতি খুলতে খুলতে দরজা দিয়ে ঢুকে এল। দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে চারধারে চাইছে।
রণেন চিনতে পারল৷ সোমেন। বুকটা কেঁপে উঠল হঠাৎ। সোমেন অফিসে কেন? কোনও খারাপ খবর নেই তো! বাবা, মা, বীণা, বুবাই, টুবাই, খুকি, শীলা, অজিত—কত প্রিয়জনের নাম ঘাই মারে বুকের মধ্যে।
রণেন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।
সোমেন তাকে দেখে এগিয়ে আসে।
॥ বিয়াল্লিশ ॥
মা আর বউদি দুজনে ঠেলে পাঠিয়েছে সোমেনকে দাদার ফিরতে দেরি হচ্ছে কেন তা দেখে আসতে। বৃষ্টি বাদলায় মানুষের দেরি হয়, কিন্তু কে বুঝবে সে কথা। সোমেন তাই খুব বিরক্তির সঙ্গে এসেছে।
মনটা ভাল নেই। গতকাল অণিমা এসেছিল বাসায়। সাদাখোলের শাড়ি পরা, চেহারাটা অনেক ভাল হয়েছে আজকাল। অনেক ধীরস্থির আগের চেয়ে। একটা চমৎকার হ্যান্ডমেড কাগজের কার্ডে ছাপা বিয়ের চিঠি দিয়ে বলল—যেও না সোমেন। সব নিমন্ত্রণে যেতে নেই।
এরকম কথা কখনও শোনেনি সোমেন। কেউ নেমন্তন্ন করতে এসে বারণ করে যায় নাকি!
ঘরে বসে কথা বলার সুবিধে নেই। তাই অণিমার সঙ্গে বেরিয়ে এল সোমেন। কোনও দিন নিজেদের গাড়িতে চড়ে কোথাও অণিমাকে যেতে দেখেনি সোমেন। অণিমার রুচিবোধ বড় প্রবল। গাড়ি আছে—এটা কাউকে দেখাতে চায়নি কখনও। কাল কিন্তু গাড়ি করে এসেছিল। সাদা অ্যামবাসাডার। অণিমার সঙ্গে পিছনের সিটে উঠে বসল। সামনে ড্রাইভার।
কথা হচ্ছিল না। একটা লালরঙা নাইলনের খাপে-ভরা নিমন্ত্রণের চিঠিগুলি সোমেন আর অণিমার মাঝখানে পড়েছিল। অণিমা দরজার কাছে অনেকটা সরে বসেছে। আলগা দূরের মানুষ, প্রায় পরস্ত্রী। সোমেন বলে—আমাকে গড়িয়াহাটায় নামিয়ে দিয়ো অণিমা।।
অণিমা উত্তর দিল না। অনেকক্ষণ বাদে বলল—পরীক্ষাটা দেবে না?
সোমেন হাসল, বলল—তুমি বড় বেরসিক। পরীক্ষাটা কোনও ফ্যাক্টর নয়। দিলেও যা, না দিলেও তাই। একজন গ্র্যাজুয়েট বেকার আছি, তখন না হয় এম-এ পাস বেকার হবো।।
—তা কেন? প্রফেসারির জন্য অ্যাপ্লাই করতে পারবে।
সোমেন হাসল। গড়িয়াহাটা ব্রিজের ঢালু বেয়ে গাড়িটা গড়িয়ে নামছে তখন। অণিমা বাইরের দিকেই চেয়েছিল। যেন অন্যমনস্ক। আসলে তা নয়। চেহারা ভাল হলেও অণিমার মুখে একটা খড়ি-ওঠা বিষন্নতার গুঁড়ো মাখানো। সোমেনের বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড নেচে ওঠে। একই সঙ্গে একটা জয়ের আনন্দ ও হারানোর দুঃখ তাকে মুহূর্তের জন্য পাগল করে দেয়। একটু ঝুঁকে সে প্রশ্ন করে—বিয়ের পর কোথায় অণিমা?
অণিমা ভারী চশমার ভিতরে তার ছোট হয়ে আসা চোখে তাকাল সোমেনের দিকে। বলল—সিন্ধ্রি।
—অনেক দূর।
—দূর! বলে একটু ভাবে অণিমা। পরে হেসে বলে—তেমন দূর নয়। তবে দূরত্বটা রাখাই ভাল।
ব্যগ্র, লোভী সোমেন বলল—কেন অণিমা?
—গড়িয়াহাটা এসে গেল, সোমেন নামবে না?
—আর একটু যাই।
অণিমা শ্বাস ফেলে বলে—চলো।
গাড়ি চলে। খুব মৃদু ইন্টিমেট সুগন্ধীর একটা বাসি গন্ধ গাড়ির ভিতরে। স্নো-পাউডার কখনও মাখত না অনিমা। এখন কি মাখে? মৃদু সুবাস তার চারদিকে। মহীয়সীর মতো দেখাচ্ছে সাদা খোলের শাড়িতে। চওড়া পেটা জরির পাড়। এত দুর্লভ কখনও অণিমাকে দেখাত না। ঠাট্টা-ইয়ারকি একদম কি ভুলে গেল অনিমা?
—অনিমা, তোমার কাছে টাকা আছে?
অনিমা অবাক হয়ে বলে—কেন?
—ধার দেবে? একটা জিনিস কিনব?
সোমেন কোনওদিন ধার চায় না। অনিমা ব্যাগ খুলে দেখেটেখে বলে—কত বলল তো!
—জানি না। জিনিসটা শো-কেশে দেখলাম একটা দোকানে, ফেলে এসেছি পিছনে। গাড়িটা ঘোরাতে বলো।
গাড়ি ঘুরল। গড়িয়াহাটার দিকে ফিরে আসতে একটা দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল সোমেন। শো-কেসে একটা চওড়া লালপেড়ে বিষ্ণুপুরী শাড়ি। সোমেন নেমে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করল। দেড়শো টাকা।
গাড়ির কাছে ফিরে এসে বলল—দেড়শো টাকা দেবে?
কী একটা সন্দেহ করে অনিমা। একটু ইতস্তত করে টাকা বের করে দিয়ে বলল—মাঝে মাঝে পাগলামির ভূত চাপে, না?
সোমেন তার ভুবনজয়ী মিষ্টি হাসি হেসে বলল—পাগলই তো।
শাড়িটা কিনে এনে প্যাকেটটা গাড়ির সিটে রেখে উঠে বসল গাড়িতে। বলল—তোমাকে সাদা খোলের শাড়িতে বড় মহীয়সী মনে হয়।
—তাই নাকি?
বিয়ের দিন ওই কারণেই তোমাকে না দেখা ভাল। ওইদিন তো তোমাকে রঙিন বেনারসি পরাবে, ফুলের সাজ, চন্দন—এ সব তোমাকে মানায় না।
অনিমা সত্যিকারের হাসি হাসল একটু। বলল—সেটা দৃষ্টিভঙ্গির তফাত বলে। তোমার সঙ্গে যদি হতো তা হলে কী করতে? শুভদৃষ্টির সময়ে তাকাতে না সোমেন?
এ কথাটায় ঠাট্টা ছিল হয়তো। তারা হাসলও। কিন্তু হাসি কারও ঠোঁটের গভীরে গেল না।
দেশপ্রিয় পার্কের কাছে সোমেন নেমে গেল। অনিমা পিছন থেকে বলল—এই শাড়ির বাক্স পড়ে রইল যে!
সোমেন দরজাটা দড়াম করে ঠেলে দিয়ে বলল—তোমার জন্য। বিয়েতে তো যাওয়া। বারণ, তাই আজ দিয়ে রাখলাম।
—যাঃ। এই সোমেন, শোনো, শোননা…
সোমেন শোনেনি। চলে এসেছে।
কাল থেকে সারাক্ষণ মনটা তাই খারাপ। কেমন যেন। পিপাসা পায়, বুক খালি-খালি লাগে। আবার একটা ভূতুড়ে আনন্দে রক্তে আগুন ধরে যায়। মনের এই অবস্থায় একা বসে ভাবতে ভাল লাগে, আর কিছু ভাল লাগে না। কালকেও বিকেলে পড়াতে গিয়েছিল গাব্বুকে। অণিমা বাড়িতে ছিল না। গাব্বর কাছে একটা সাঁটা খাম রেখে গেছে। বাড়িতে ফিরে সেটা খুলে দেখেছে সোমেন। প্যাডের একটা কাগজের ঠিক মাঝখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা—নিলাম। মনে থাকবে। ভুলে যেয়ো। অ।
বাড়িতে একটা টেনশন চলছে আজকাল। সারাদিন সোমেন থাকে না। দুপুরে একটু থাকে, আর রাতে। প্রায় রাতেই মা আজকাল ঘুমনোর আগে দাদার কথা বলে। দাদার শরীর ভাল নেই। বউদির সঙ্গে গোলমাল হয়ে থাকবে, মনটাও তাই বোধ হয় ভাল থাকে না। বউদি মানুষটা খারাপ নয়, দাদা তো ভালই। কিন্তু দুজন ভালর জাত আলাদা। মা কিন্তু বরাবর দাদার পক্ষে। সোমেনকে রাত জাগিয়ে রেখে মা এক কাঁড়ি কথার হাঁড়ি খুলে বসে। সোমেন বিরক্ত হয়। সংসারের এত সব কথার মধ্যে বরাবর ডুবে মরে মন। তখন মনে হয়, অনিমা কিংবা রিখিয়ার কথা কত অবাস্তব! সংসারটা এত রোমাঞ্চহীন!
আজ বিকেল থেকে আকাশ কুঁসছে। বৃষ্টি এল। সোমেন বেরোতে পারেনি। সন্ধেবেলা প্রথমে মা, তারপর বউদি এসে ধরল। দাদা কেন ফিরছে না! সোমেন একটা কবিতার খসড়া তৈরি করছিল, এ সময়ে এই ঝামেলা। অত বড় লোকটা, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন, সে যাবে কোথায়, তার হবেটাই বা কী! কিন্তু কেউ বুঝল না। বৃষ্টির ধারাটা কমতেই তাই সোমেনকে বেরোতে হয়েছে। বউদি ট্যাক্সির ভাড়া দিয়েছিল। কিন্তু ট্যাক্সি পাওয়া যায়নি। গড়িয়াহাটা থেকে ট্রাম ধরে এসেছে। মনে বিরক্তি রাগ।
কিন্তু এখন অফিসের দরজা পার হয়ে যখন দাদাকে দেখতে পেল সোমেন তখনই বড় চমকে উঠল। খালি গায়ে দাদা দাঁড়িয়ে, পরনে শুধু আধভেজা ফুলপ্যান্ট, আড়া-আড়ি বুকের ওপর ময়লা পৈতে। মোটা গোল গণেশ মুখ। ভুঁড়িটা ঠেলে বেরিয়ে আছে। শরীরটা ঢিলেঢালা, চামড়ার ভাঁজ। মুখেচোখে একটা ভ্যাবলা বোবা ভাব। বড় বড় চোখে সোমেনের দিকে চেয়ে আছে। চাউনিতে একটা নির্বোধ ভয়। দাদার এমন চেহারা কখনও দেখেনি সোমেন। সোমেন কাছে যেতেই বলল—কী হয়েছে? অ্যাঁ! কী হয়েছে?
সোমেন ভ্রূ তুলে বলে কী হবে!
—কার অসুখ? না কি অ্যাকসিডেন্ট?
সোমেন বুঝতে পারল না দাদা কী বলতে চাইছে। একটু অবাক হল। বলল—কী বলছে দাদা! আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
—নিয়ে যাবি?
—মা বউদি সব ভাবছে দেরি দেখে।
এতক্ষণে যেন বা একটু স্বাভাবিক হল চোখ। দু-পা ফাঁক করে গম্বুজের মতো দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ অবসন্নের মতো বসে পড়ে বলল—ও।
—চলল। প্রায় আটটা বাজে।
রণেন মাথা নাড়ল। তারপর ভেজা জামা গেঞ্জি তুলে পরতে লাগল। হাত অল্প অল্প কাঁপছে। দৃশ্যটা দেখে সোমেনের সমস্ত হৃদয় বহুকাল বাদে দাদার দিকে ধাবিত হল একবার। কী হয়েছে দাদার? বহুদিন হয় এই লোকটাকে সে লক্ষই করেনি। লক্ষ করেনি, তার কারণ, রণেন কখনও লক্ষ করায়নি। বরাবর দাদা একটু গম্ভীর মানুষ, একটু চুপচাপ। নীরবে সে সংসারের দায়িত্ব বহন করে। সোমেন একটু বড় হওয়ার পর থেকেই দেখেছে, এই লোকটা সংসারের অভিভাবক। দু-ভাইতে কথা হয় খুব কম। কিন্তু আজও নিজের কোটটা প্যান্টটা, সাধ-আহ্লাদের নানা জিনিস সোমেনকে নিঃশব্দে দিয়ে দেয়। দাদা কখনও কাউকে খারাপ জিনিস দেয় না। বাজার থেকে কখনও সস্তা জিনিস আনে না। সোমেনের ফিরতে রাত হলে চৌরাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই দাদা। শান্ত, উদার, স্নেহশীল। দাদাকে কেন এতকাল লক্ষ করেনি সোমেন? দাদার কী হয়েছে?
হাওয়াই শার্টের বোতাম এঁটে রণেন ব্যাগটা তুলে নিল। বলল—ঘোষদা, যাই।
ঘোষ মুখ তুলে বলে—এটি কে? ভাই?
—হ্যাঁ।
ঘোষ মাথা নাড়ল। বলল—যান। বাড়ির সবাই ভাবছে। বলে একটু ব্যাঙ্গের হাসি হাসল যেন। আবার মাথা নেড়ে বলে—আমাদেরই ভাবাভাবির কেউ নেই। বাঁচা গেছে।
বৃষ্টির কলকাতায় জীবাণুর মতো থিকথিক করছ মানুষ, এখনও এই রাত আটটায়। বৃষ্টি কমে গেছে, তবু ঝিরঝির চলছে এখনও। গাড়িবারান্দার তলায় তলায় ভিড় জমে আছে। মানুষের পিণ্ড।
রণেন চারদিকে চেয়ে বলে—কী করে যাবি?
—দাঁড়াও একটা ট্যাক্সি যদি ধরতে পারি।
রণেন মাথা নেড়ে বলল—পাবি না।
—তা হলে? মা আর বউদি ভাববে।
রণেন উদাস গলায় বলে—ভাবুক। আয় কিছু খাই। খিদে পেয়েছে।
—খাবে?
দাদার সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার কোনও অভিজ্ঞতা সোমেনের নেই। তার বড় লজ্জা করছিল। রণেনের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। গদাই লস্করের মতো হেঁটে বৃষ্টি ছাঁট উপেক্ষা করে সে ঢুকে গেল একটা রেস্টুরেন্টে। পিছু পিছু সোমেন। কিন্তু সেখানেও ভিড়। টেবিল খালি নেই। চারদিকে হতাশভাবে চেয়ে রণেন সোমেনের দিকে চেয়ে যেন নালিশ করল—খিদে পেয়েছে।
—বাড়িতে গিয়ে খেয়ো।
অধৈর্যের সঙ্গে রণেন বলে—সে তো অনেক দেরি। বলে সোমেনের দিকে রাগ আর নালিশভরা একরকম চোখে চেয়ে থাকে।
এ-কদিনেই দাদার ভিতরে একটা ওলটপালট হয়ে গেছে। সেটা সোমেন এই টের পেল। স্বাভাবিক রণেন এভাবে কথা বলে না তাকায় না। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে সোমেন বলে— শেয়ারের ট্যাক্সি মেট্রোর উলটোদিকে দাঁড়ায়। চলো, যদি পেয়ে যাই।
রণেন কিছু বলল না। কিন্তু সোমেনের সঙ্গে হাঁটতে লাগল।।
দুদিন বৃষ্টির পর কলকাতা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেল। এখানে-সেখানে কিছু জল দাঁড়িয়ে আছে। তবু রোদ উঠেছে। আকাশ গভীর নীল। দুদিন সাংঘাতিক বৃষ্টি হয়ে গেল। সবাই ঘরবন্দি। এই দুদিন সোমেন কেবলই শুনেছে দাদার ঘর থেকে দাদা মাঝে মাঝেই চেঁচিয়ে বলছে—দরজা খুলে দাও। জানালা খোলা রাখো।
—বৃষ্টির ছাঁটে ঘর ভিজে যাচ্ছে। বউদি রাগ করে বলে।
দাদা তখন ভীষণ হতাশভাবে বলে—ওঃ হোঃ হোঃ। ইস কী অন্ধকার। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
মা প্রায় সারাক্ষণ ওই ঘরে। এ ঘরে একা সোমেন। বুকের মধ্যে দুশ্চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। দাদার কী হয়েছে? মাঝে মাঝে ও ঘরে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে আসে। দাদা নির্জীব হয়ে শুয়ে আছে কিংবা মাথা হাঁটুর ফাঁকে রেখে বসে। ছেলে-মেয়েদের মুখ করুণ, শুষ্ক। তার মধ্যেই মাঝে মাঝে বাবার কাণ্ড দেখে হেসে ফেলে। বেশির ভাগ সময়েই বাইরের ঘরে খেলা করে। বউদি ভাল করে খায় না। রাতেও বোধ হয় ঘুম নেই। শরীর এ-কদিনেই শুকিয়ে গেছে। একটা বিপদের আশঙ্কায় থমথম করে ঘরের আবহাওয়া। ঘরে তাই সোমেনের মন টেকে না।
সোমেন এ কয়দিন খুব সিগারেট খেল। ভাবল। কেমন যেন মনে হয় এবার সংসারে একটা পরিবর্তন আসবে, ছক পালটাবে। সেই আগের মতো নিশ্চিন্ত জীবন আর থাকবে না।
গভীর রাতে একদিন ঘুম ভেঙে শুনল কলের গান বাজছে। খুব আস্তে বাজছে, আর সেই সঙ্গে বাইরের ঘরে কার যেন নড়াচড়ার শব্দ, গভীর শ্বাস আর ‘আঃ উঃ শব্দ’।
দরজা খুলে সোমেন অবাক হয়ে দেখে, অদ্ভুত দৃশ্য। আলো জ্বালা হয়নি, তবু জানালা সব খোলা বলে বাইরের আলো এসে পড়েছে। রেডিয়োগ্রামের চৌকো ব্যান্ডে আলো জ্বলছে, স্থির হয়ে আছে সবুজ ম্যাজিক আই। আর রেডিয়োর সেই আলো চৌখুপির কাছে একটা মাথা অনড় হয়ে আছে। প্রথমটায় আবছায়ায় বুঝতে পারেনি সোমেন। তারপর দেখে, দাদা একটা আন্ডারওয়ার মাত্র পরে মেঝের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে। রেডিয়োর স্পিকারটা নিচুতে। স্পিকারের সঙ্গে কান লাগিয়ে শুনছে রবিঠাকুরের গলায় গাওয়া গানের রেকর্ড—‘অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহে প্রাণ…’
সোমেন আস্তে করে ডাকল—দাদা!
রণেন মুখটা ঘুরিয়ে তাকে দেখল, তর্জনী ঠোঁটের কাছে তুলে বলল—চুপ।
আবার গান শুনতে লাগল। রেকর্ড ফুরিয়ে গেলে আবার ফিরে চালিয়ে দিল। সোমেনের দিকে ফিরেও তাকাল না। বোধ হয় ভুলে গেল যে কেউ তাকে দেখছে। দীর্ঘকাল সে যেন গান শোনেনি। আকণ্ঠ পান করে নিচ্ছে। যেন চৈত্রের মাঠ শুষে নেয় বৈশাখের বৃষ্টি। এখন ওর আর কেউ নেই, ওই গানটুকু, ওই কাঁপা কাঁপা রিক্ত কণ্ঠস্বর ছাড়া।
বহুকাল কাঁদে না সোমেন। কোনওকালে তার চোখে জল আসে না সহজে। এখন হঠাৎ হাতের পিঠে চোখ মুছল। গলা, কণ্ঠা অবরোধ করে কান্না উঠে আসে। সোমেন ঘরে এসে অন্ধকার হাতড়ে সিগারেট ধরায়। বসে থাকে। ঘুম হয় না।
দুদিন বৃষ্টির পর রোদ উঠতেই সে বেরিয়ে পড়ল সকালে। খাওয়ার জায়গা অনেক আছে। কিন্তু ঠিক কোথায় যে যেতে ইচ্ছে করছে তা বুঝতে পারছিল না। বুকের মধ্যে টনটন করে গুপ্ত ব্যথা। একা থাকতে ইচ্ছে করে। মেঘভাঙা রোদে ভ্যাপসা গরম। বাতাস নেই। এদিক-ওদিক কিছুক্ষণ হেঁটে সোমেন যখন আবার বাড়ির রাস্তায় ঢুকতে যাচ্ছিল তখনই দেখে পূর্বা আগে আগে যাচ্ছে।
সোমেন ডাকল—এই।
পূর্বা চমকে ফিরে তাকিয়েই হেসে ফেলল—ইস, এমন ভয় পাইয়ে দিস না!
—ভয়ের কী?
—রাস্তায় কেউ আচমকা ডাকলে ভয় করে না? তোর কাছেই যাচ্ছিলাম।
—সে বুঝেছি, নইলে এ পাড়ায় তোর আর কে লাভার আছে!
—গাঁট্টা খাবি। ছ্যাবলা কোথাকার!
—সংবাদ কী শুনি বৃন্দেদূতী।
পূর্বা মুখ ভ্যাঙাল। বলল—জানি না। অনিল রায় তোকে ডেকেছেন।
—কেন?
—বললেন, সোমেনের নাকি চাকরি দরকার! আমার ডিপার্টমেন্টে একটা পোস্ট খালি আছে, ওকে দেখা করতে বলো।
সোমেন ভ্রূ কুঁচকে বলে—আমার চাকরি দরকার সে কথা ওকে বলল কে?
পূর্বা উদাস গলায় বলে—কে জানে! তোমার তো হিতৈষী আর হিতৈষিণীর অভাব নেই। আমাদের জন্যই কেউ ভাবে না।
সোমেন খুব নাক উঁচু গলায় বলে—কি চাকরি জানিস?
—না। তবে প্রফেসারি নয় এটুকু বলতে পারি।
—এম এ পরীক্ষা দিইনি বলে ঠেস দেওয়া হচ্ছে?
—আহা, কী এমন বালিশটা যে ঠেস দেবো?
সোমেন হাসল। বলল—চা খাবি?
—তোর বাসায়? না বাবা, রাস্তায় দেখা হয়ে গিয়ে ভাল হল। একদিন তোর বাড়ি গিয়েছিলাম, অনেক দিন আগে, তুই ছিলি না। তোর মা সেদিন আমার জাত গোত্র জিজ্ঞেস করে অস্থির করে তুলেছিল। পালিয়ে বাঁচি। আজও ভয়ে ভয়ে যাচ্ছিলাম, নেহাত চাকরির খবর না দিলে নয়।
—আমার চাকরির খবরে তোর অত ইন্টারেস্ট কেন? সোমেন মিচকে হেসে বলে।
—আহা! বেকার বসে আছিস না!
—থাকলেই কী?
হাঁটতে হাঁটতে দুজনে বাসস্টপে চলে এল। রবিবার। বাস ফাঁকা যাচ্ছে। সোমেন একটা আটের বি থামতে দেখে বলল—ওঠ!
অবাক হয়ে পূর্বা বলে—কোথায় যাবি?
—হাওড়া। তারপর ট্রেন ধরব।
—ওমা। কেন?
—তোকে নিয়ে আজ পালিয়ে যাচ্ছি।
॥ তেতাল্লিশ ॥
আটের বি বাসটা ছেড়ে গেল। পূর্বা উঠল না। একটু পিছিয়ে দাঁড়িয়ে হেসে বলল— পালাব কেন? বাড়িতে বলেকয়ে এলেই তো হয়। কেউ আটকাবে না।
সোমেন ভ্রূ কুঁচকে একটু তাকায় পূর্বার দিকে। গম্ভীর হয়ে বলে—চান্সটা মিস করলি৷
—বয়ে গেল।
দুজনে আস্তে আস্তে হেঁটে ব্রিজের ওপর উঠতে থাকে। কোথায় যাওয়া নয়, কেবলমাত্র হাঁটা। বৃষ্টির পর রোদ বড় তেজি। ভ্যাপসা গরম। ব্রিজের ঢালু বেয়ে ওপরে উঠতে একটু হাওয়া লাগল। রেলিঙের ধার ঘেঁষে দুজনে দাঁড়ায়। সোমেন বলে—লোকে আমাদের কী ভাবছে বলতো!
—যা খুশি ভাবুক গে। কত হাজার হাজার জোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে কলকাতায়, লোকের ভাবতে বয়ে গেছে।
—তোর বাবা যদি এখন বাসে যেতে যেতে আমাদের দেখে ফেলে? সোমেন একটু কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে।
পূর্বা চোখ বড় বড় করে বলে—দেখেনি নাকি? কতবার কত ছেলের সঙ্গে দেখেছে। প্রথম প্রথম মার ওপর রাগারাগি করত। এখন ভাবেই না।
একটা ইলেকট্রিক ট্রেন তলা দিয়ে চলে গেল শিস টেনে। রেললাইনের ধারে বস্তি। আপ-লাইনের ওপর কাঁথা কাপড় শুকোচ্ছে রোদে, বাচ্চা-কাচ্চারা খেলছে, রোগা রোগা কালো চেহারর কজন মেয়েছেলে বসে আছে লাইনের ওপর, খুব নিশ্চিন্ত। ট্রেন এলে একটু সরে বসবে, ট্রেন চলে গেলে আবার লাইনের ওপর হামা টানবে দুধের শিশু, কাঁথা কাপড় শুকোবে।
দৃশ্যটা দেখিয়ে পূর্বা বলে—ভেবেছিস, কী সাহস! আমার হাত-পা শিরশির করছে।
—ওদের কিছু হয় না। রেললাইন ওদের উঠোন।
পূর্বা চুপ করে দৃশ্যটা দেখে একটু। ঠিক মুখের ওপর রোদ পড়ছে। হাতের মুঠোয় এক কণা রূমাল দিয়ে মুখটা মুছে বলল—অণিমার বিয়েতে কি দেওয়া যায় বলত। আমরা সবাই একসঙ্গে দেবো, শ্যামল বলেছে পারহেড কুড়ি টাকা। বড্ড বেশি না?
সোমেনের বুকের মধ্যে সেই কাঁপুনিটা ওঠে। একটা ব্যথা, একটা আনন্দ। মুখটা পূর্বার চোখের আড়াল করার জন্যই ঘুরিয়ে নিয়ে বলল—বেশি আর কী?
পূর্বা রাগের গলায় বলে—বেশ বেশি।
কথাটা কাউকে বলার নয়। চিরকাল এক বুক অন্ধকারে চাপা থাকবে অনিমার ভালবাসার কথা। সোমেন আর অণিমা ছাড়া আর কেউ জানবে না। কিন্তু সেটা সহ্য করা যায় কি? অণিমা যে তাকে ভালবাসত এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে তার নিজের জয়। কাউকে না বলে থাকে কী করে সোমেন? বুকের ভার একা বওয়া যায় না। বলবে না বলে বার বার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল সোমেন। তবু মনটা তরল হয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে একটু হেসে বলল—অণিমাটা না একটা পাগল? জানিস?
পূর্বা মুখ তুলে বলল—কেন?
‘বোলো না, বোলো না পূর্বা সবাইকে বলে দেবে।’ এই বলে নিজেকে মনে মনে ধমকাল সোমেন। কিন্তু সামলাতে পারল না। ভাবল, অণিমা তো বলতে বারণ করেনি!
মুখে সে পূর্বাকে বলল—কাউকে বলবি না? গা ছুঁয়ে বল।
পূর্বা তার হাত ছুঁয়ে বলল—প্রমিস।
—একদিন না…
বলে ফেলল সোমেন। অনর্গল বুক থেকে কথা বেরিয়ে গেল। আটকানো গেল না। পূর্বা অবাক হয়ে চেয়েছিল। কিন্তু পূর্বাকে নয়, গোটা পৃথিবীকেই যেন জানানোর দরকার ছিল।
বলে ফেলেই হঠাৎ যেন নিবে গেল সোমেন। গভীর এক ক্লান্তি মনের ভিতরে। বলা উচিত হল না, বলা উচিত হল না। সবাই জেনে যাবে। অণিমার কানেও উঠবে কোনওদিন। ভাববে, সোমেন কেমন পুরুষ? হায় ঈশ্বর, ওকে আমি কেন ভালবেসে ছিলাম!
সোমেনের বড় ভয় করল! অণিমার বিয়ে হয়ে যাক, ভিন্ন পুরুষের ঘর করুক, তবু চিরকাল মনে মনে সোমেনকে ভালবাসুক—এই কি চায় না সোমেন? যদি সে কোনওদিন জানতে পারে যে অনিমার সেই গোপন ভালবাসা ফুরিয়েছে, তা হলে কি গভীরভাবে হতাশ হবে সোমেন?
পূর্বাকে বাসে তুলে দিয়ে ফিরে এল সোমেন। সারাটা দুপুর কেবল ভাবল। সে এত দুর্বল কেন? কেন বলে দিল পূর্বাকে। নিজেকে বড় ছোট মানুষ বলে মনে হয়।
নিজের ওপর বিরক্তিটাই ইদানীং বড় প্রবল। বড় রেগে থাকে সোমেন। বাড়ির লোকেরা কথা বলতে সাহসই পায় না। বউদি এসে একদিন বলল—টুবাইটার ট্রিপল অ্যান্ডজেন-এর শেষ ডোজটা বাকি আছে, চারু ডাক্তারের দোকান থেকে দিইয়ে আনবে সোমেন?
—পারব না। বলে রেগে উঠে গেল সোমেন। একটু বাদে ফিরে এসে দেখল বউদি রান্নাঘরে উবু বয়ে বসে আছে, দু-হাঁটুর ভিতরে গোঁজা মাথা, চোখের জল মুছছে। বড় মায়া হল। নিঃশব্দে টুবাইকে কোলে নিয়ে চারু ডাক্তারের ডিসপেন্সারিতে গেল সোমেন।।
এই রকম হয়েছে তার আজকাল। হঠাৎ রাগ উঠে পড়ে, হঠাৎ বড় মায়া হয়। বাসায় সবসময়ে এক শোকের মতো স্তব্ধতা। দাদা অফিসে যায় না। বড় একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখে ওষুধ দিয়েছে। চেঁচামেচিটা একটু কম করে। কিন্তু ভ্যাবলা ভাবটা যায়নি এখনও। তেমন গুরুতর কিছু নয় বোধ হয়। কিন্তু মা আর বউদি অনেকটা রোগা হয়ে গেছে। সারাদিন তাদের মুখ শুকনো। এই গুমোট, কথাশূন্য, মন-খারাপ বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। এখনও রোগ, শোক, দুঃখ-টুঃখ ঠিক নিতে পারে না সোমেন। পালিয়ে বেড়ায়। কিন্তু যাওয়ার তেমন কোনও জায়গা নেই। বন্ধুরা অধিকাংশই চাকরি করে। আড্ডা দেয় সন্ধের পর। কিন্তু সারাদিনটা সোমেন করে কী! এক-আধদিন বন্ধুদের অফিসে গিয়ে হানা দেয়। বেশি যেতে লজ্জা করে। অহংকারে লাগে।
ম্যাক্স এখনও কলকাতায় আছে। মাসখানেকের মধ্যে দেশে ফিরে যাবে। কয়েকদিন বেনারসে কাটিয়ে এল। মুখচোখ খুব উদাস। আরও একটু রোগা হয়ে গেছে। পেটে ফাংগাস হয়েছে। সোমেনকে একদিন বুঝিয়ে বলল—আই হ্যাভ এ গার্ডেন ইন মাই স্টমাক। পেটের মধ্যে শ্যাওলা পড়েছে। লাল রিংঅলা দুটো সিগারেট দিল একদিন, বলল—পিওর টোবাকো নয়। একটু গাঁজা আছে কিন্তু।
সোমেনের তাতে কিছু যায় আসে না। গাঁজা খেলেই কী! দুটো সিগারেট একঘণ্টায় শেষ করে দিল সোমেন। দেখে একটু হাসল ম্যাক্স। কিছু বলল না। অনেকক্ষণ হালকা ওজনশূন্য শরীর আর ভাসন্ত মাথার এক অদ্ভুত নেশা রইল সোমেনের। মনটা টল টল করে। আরও দুটো সিগারেট চেয়ে রেখে দিল সোমেন, বদলে পাঁচ প্যাকেট দিশি সিগারেট কিনে দিল ম্যাক্সকে। গঙ্গার ধার ধরে দুজনে বিস্তর হাঁটল।
—ম্যাক্স।
—উঁ।
—তুমি অণিমাকে ভালবাসো?
ম্যাক্সের মাথায় পাখির বাসার মতো চুলের ঝোপড়া। গঙ্গার দিক থেকে মুখ ফেরাল ম্যাক্স। অমনি দুরন্ত বাতাসের ঝাপটায় চুলের রাশি এসে পড়ল গালে। কপালে। একটু পিঙ্গল দাড়ি গোঁফের ভিতরে আচ্ছন্ন মুখ। চোখের ফসফরাস আজও জ্বলে ওঠে। কিন্তু ওকে বিপজ্জনক মানুষ বলে মনে হয় না।
ম্যাক্স একটু হাসল, বলল —বাঙালি মেয়েরা বিদেশিকে ভয় পায়।
—তুমি প্রোপোজ করেছিলে?
ম্যাক্স মাথা নাড়ল। বলল—হুঁ—হুঁ। কিন্তু ও রাজি হয়নি, আমিও সেজন্য দুঃখিত নই। অণিমা ভাল মেয়ে, কিন্তু বড় মর্যালিস্ট।
—তোমার ওকে ভাল লাগে না?
—লাগে। সো হোআট? বলে আবার একটু হাসে ম্যাক্স, বলে—আই হ্যাভ স্লেপট উইথ ওভার টু হ্যান্ড্রেড গার্লস। নো অ্যাটাচমেন্ট। আই অ্যাম অলমোস্ট এ সেইন্ট।
এই রোগা সাহেবটা দুশো মেয়ের সঙ্গে শুয়েছে? ভারী অবাক হয়ে তাকায় সোমেন, বলে—লায়ার!
—ওঃ নো। বলে ম্যাক্স হাসে, বলে—আমার একটা নোটবই আছে। প্রত্যেকটা মেয়ের নাম আর ডেট তাতে লিখে রেখেছি। ইট ওয়াজ এ হবি। অবশ্য এসব বেশিরভাগই ঘটেছিল অস্ট্রেলিয়ায়।
ফুচকাওলার সামনে দাঁড়িয়ে গেল তারা। গঙ্গার বাতাসে জলের ছলাৎছল ভেজা শব্দ আসে। বাজে জাহাজের ভোঁ, ডাক দিয়ে যায় দশদিকে ছড়ানো মহাবিশ্বের অপার বিস্তারে। গাঁজার নেশা আর ফুচকার ঝাল-টক স্বাদ ভেদ করে মর্মমূলে একটা গুপ্ত পেরেকের যন্ত্রণা নড়েচড়ে ওঠে।
—আর, ইন্ডিয়ায়? সোমেন প্রশ্ন করে।
—এ ফিউ। বেশির ভাগই প্রস্টিটিউটস। মেয়ে মাত্র কয়েকজন।
হঠাৎ বিষম খায় সোমেন। কয়েকজন! কে সেই কয়েকজন? বুকটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে। ম্যাক্সের একটা হাত ধরে বলে—কারা? আমাদের চেনা মেয়ে?
ম্যাক্স শালপাতার ঠোঙা উলটে ফুচকার জল খাচ্ছিল। প্রচণ্ড ঝাল। নীলচে চোখ ভরে জল এসেছে, ঝালের চোটে কাশল খানিক। মুখ ছুঁচলো করে শিসাতে শিসাতে বলে-ওঃ লিভ দ্যাট। মেয়েছেলের ব্যাপারে আমি খুব ক্লান্ত। এখন একটু মজা পাই নেশায়, অন্য কিছুতে নয়। গার্লস উইল বি, গার্লস। দে অলওয়েজ টিজ ইউ।।
ম্যাক্সের হাতটা আরও শক্ত করে ধরল সোমেন। বলল—বলো ম্যাক্স। আমি জানতে চাই।
—কেন?
—সোমেন হাসল, বলল-মেয়েগুলোকে চিনে রাখব?
—কেন?
—চিনে রাখা ভাল, যদি ওদের কারও সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে যায়।
ম্যাক্স সোমেনের হাতটা ছাড়িয়ে দিল। মুখটা কিছু গম্ভীর, বিষন্ন। বলল—তুমি বড় অর্থডক্স সোমেন।
এই বলে ম্যাক্স আবার ফুচকা নেয়। দ্রুত খেতে থাকে। ঝালের জন্য জিভে রাখতে পারে না, গিলে ফেলে কোঁত করে। বলে—তোমাকে বলি, আমি এখন রক্ষণশীল মানুষদেরই বেশি পছন্দ করি।
সোমেন হাতের শালপাতা ফেলে দিয়ে রুমালে হাত মুছতে মুছতে বলে—পূর্বা নয়তো!
—ওঃ নো।
—অপালা?
—গুডনেস, নো।
একটু ইতস্তত করে সোমেন। বড় ভয় করে। বুক কাঁপে। অবশেষে দাঁতে দাঁত চেপে বলে—অণিমা?
আকাশের দিকে মুখ তুলে ম্যাক্স ফুচকাটা মুখের মধ্যে ফেলে দেয়। গলা ঝাড়ে। উত্তর দেয় না। সোমেন চেয়ে থাকে। নেশাটা কেটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। হাতে পায়ে ঝিমঝিমিনি ভাব। একটু দুর্বল লাগে।।
ম্যাক্স তারদিকে তাকায়। গম্ভীর চোখে। সোমেন সেই চোখ দুটোর দিকে চেয়ে থাকে।
তারপর আস্তে আস্তে, দুর্বলভাবে ঘাসের ওপর বসে পড়ে সোমেন, ফুচকাঅলার পায়ের কাছে। এবং বসে বসে যেন রসাতলে নেমে যাচ্ছিল সে।
গঙ্গার ধার ঘেঁষে ঘাসজমির ওপর চুপচাপ কিছুক্ষণ পড়ে রইল দুজন। নেশা কাটছে।
অনেকক্ষণ বাদে সোমেন মাথা তুলে বলে-ও আমাকে ভালবাসত।
ম্যাক্স পাশ ফিরে একটু দেখল সোমেনকে। চোখে কৌতুক ঝিলিক দেয় বলল—তাই নাকি? তারপর আবার উদাসী চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে—তুমি ভাগ্যবান।।
—তুমি ওকে কী করছ সাহেব?
ম্যাক্স চিত হয়ে শুয়ে আছে, মাথার নীচে দুই হাতের তেলো, আকাশে চোখ। উদাস গলায় বলে—নাথিং।
—লায়ার।
ম্যাক্স হাসল। মিষ্টি, বিষন্ন হাসি। বলল—তোমার খুব নেশা হয়েছে।
—আলবত হবে! বলে উঠে বসে সোমেন। আর একটা লাফ রিংঅলা সিগারেট বের করে ধরাতে যাচ্ছিল, ম্যাক্স হাত বাড়িয়ে ঠোঁট থেকে কেড়ে নিল, বলল—আর নয়। তা হলে মুশকিলে পড়বে।
সোমেন হামাগুড়ি দিয়ে সাহেবের কাছে আসে। বলে—সত্যি কথা বলে।
ম্যাক্স একটু অবাক হয়ে চেয়ে রইল। বলল—আমার লুকনোর কিছু নেই সোমেন। আমি নক্সালাইটদের সঙ্গে দু-তিনমাস আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলাম অ্যান্ড আই হ্যাড ট্রাবল উইথ দি পলিস। কিছুদিন আমাকে জেলেও রাখা হয়েছিল। আমার সময় ছিল না যে কিছু করি।।
তবু সোমেনের মনে হচ্ছিল, ম্যাক্স মিথ্যে কথা বলছে। বললেই বা কী! অণিমার জন্য সোমেনের আর কী আসে যায়! সে তো ভালবাসত না অণিমাকে? এই তো কদিন পরে অণিমা এক সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের সঙ্গে বাস করবে, তখনই বা কী করার থাকবে সোমেনের?
তবু সোমেন ম্যাক্সের গলার কাছে জামাটা আলগা হাতে মুঠো করে ধরে বলে—সত্যি কথা বলো ম্যাক্স। আমি জানতে চাই।
ম্যাক্স জিভ দিয়ে চুক চুক একটা শব্দ করল। মাথা নেড়ে বলল—ইউ আর এ চাইল্ড। আমি বিদেশি বলেই তুমি আমাকে সন্দেহ করো সোমেন। তুমি ভাবো, যৌনতার ব্যাপারে আমাদের কোনও বাছবিচার নেই। সেটা সত্যিও বটে।
বলতে বলতে উঠে কনুইয়ের ওপর ভর রেখে একটু কাত হয়ে সোমেনের মুখের দিকে তাকায় ম্যাক্স। বলে—এর আগের বার বেনারসে স্যানক্রিট শেখার জন্য আমি এক পণ্ডিতের কাছে যেতাম। সে লোকটা বুড়ো, কিন্তু খুব স্বাস্থ্যবান, সুপুরুষ। সে লোকটা আমাকে একটা শ্লোক শিখিয়েছিল। তোমাদের যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণে আছে, স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলনের আগে স্বামী-স্ত্রীর নাভিতে হাত রেখে বলবে প্রসীদ জগজ্জননী। হে জগতের মা, তুমি প্রসন্ন হও। আমাকে তোমার ভিতরে গ্রহণ করো। আমি যেন তোমার ভিতর দিয়ে পুত্ররূপে আবার জীবন লাভ করি। ওইভাবে আমার সত্তা অনন্ত ও অখণ্ড হোক। ওই হচ্ছে গর্ভধারণের মন্ত্র, প্রসীদ জগজ্জননী। তুমি জানো?
সোমেন মাথা নাড়ল। জানে না।
ম্যাক্স আবার তেমনি চিত হয়ে শোয়। উদায় হয়ে যায় বুঝিবা। গঙ্গার বানডাকা বাতাস বয়ে যায় বুকের ওপর দিয়ে। অনন্ত আকাশ ঝুঁকে আছে মুখের ওপরে উদাসীন ভাবে। সেখানে ফিরোজা রং ধীরে মুছে দিচ্ছে গোধূলির বেলা। নক্ষত্রের জগৎ ভেসে উঠতে থাকে। ম্যাক্স বলে—আমরা সৃষ্টিকর্তা নই সোমেন। আমাদের ভিতর দিয়ে যে পুত্র কন্যারা আসে আমরা তাদের সৃষ্টি করি না। আমরা কেবল প্রজননের উপলক্ষ। যৌনতা আমাদের যে আনন্দ দেয় তা একটা প্রলোভন মাত্র, ওই প্রলোভনে আমরা নারীর সঙ্গে মিলিত হই, কিন্তু আসলে ওই ভাবে প্রলুব্ধ করে প্রকৃতি আমাদের দিয়ে তার কাজ করিয়ে নেয়। উই রিপ্রোডিউস। এ হচ্ছে বায়োলজি। আমি বায়োলজি জানি। কিন্তু যৌনতার কোনও দর্শন আমার ছিল না। দুশো মেয়ের সঙ্গে শুয়েছি, কিন্তু তারা আমাকে শেখায়নি। একটা ছোট্ট শ্লোকে আমি তা শিখে গেছি।
সোমেন অধৈর্যের সঙ্গে বলে—তুমি এত জানো কেন ম্যাক্স?
ম্যাক্স তেমনি উদাসীনভাবে শুয়ে রইল। চোখ বোজা। বলল—তোমাদের জানবার জন্য আমি মাইলের পর মাইল ঘুরে বেড়িয়েছি, গ্রামে-গঞ্জে হাটে-বাজারে পড়ে থেকেছি, ভিখিরিদের সঙ্গে থেকেছি। খুঁজেছি, যতভাবে খোঁজা যায়। বেনারসে একবার একটা রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছি। দুপুরবেলা। আমার টেবিলে একটা ছেলে আর মেয়ে এসে বসল। হিপি টাইপ। ছেলেটির চুল দাড়ি আছে, বিশাল চেহারা। মেয়েটার ভারী কম বয়স। একটু রোগা, সারা গায়ে ময়লা। সে একটা লম্বা ঝুলের ফ্রক পরেছিল। তার ফ্রকের নীচে কাঁচুলি ছিল না, স্তনের বোঁটা ফুটে আছে জামার ওপর। আমেরিকান। তারা ব্যাগ থেকে জ্যাম-এর কৌটো বের করে রুটিতে মাখিয়ে খাচ্ছিল। আমার সঙ্গে কয়েকটা কলা ছিল, আমি তাদের দিলাম। তারা আমার রুটিতে তাদের জ্যাম মাখিয়ে দিল। ওইভাবে পরিচয়। আমাদের কোনও পিছুটান নেই, তাই তক্ষুনি দল বেঁধে ফেললাম। সেই রাতে আমি আমার ধর্মশালা ছেড়ে ওদের ধর্মশালায় গিয়ে উঠলাম। একটু বেশি রাতে মেয়েটা আমার বিছানায় চলে এল। আমি তখন খুব উত্তেজিত ছিলাম, কারণ ওই মন্ত্র তখন আমার ভিতরে ঘুরছে। একটি মেয়ের ওপর ওই মন্ত্রটার প্রভাব লক্ষ করা আমার দরকার ছিল। তখন নিশুতিরাত। মেয়েটি নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে, আমি বসে তার নাভিতে হাত রেখে বললাম—প্রসীদ জগজ্জননী। সে জিজ্ঞেস করল এর অর্থ কী! বুঝিয়ে বললাম। মেয়েটা অনেকক্ষণ কথা বলতে পারেনি। যৌন মিলনের আগে এ রকম ভারী কথা শুনে সে কেমন হয়ে গেল। নিশুত রাত, এক বিছানায় আমরা দুটি নরনারী, ন্যাংটো। তবু আমরা মিলিত হতে পারছিলাম না। আমি বার বার জিজ্ঞেস করছিলাম—ডু ইউ ফিল লাইক জগজ্জননী? তুমি কি প্রসন্ন হয়েছ? সে বার বার মাথা নেড়ে বলে—ওঃ নো। আই ফিল রেস্টলেস। অবশেষে আমি তাকে বললাম- তা হলে তোমার সঙ্গীর কাছে যাও। ও তোমাকে তৃপ্ত করুক। মেয়েটা আমাকে আঁকড়ে ধরে বলল—ও লোকটা ইম্পোটেন্ট। আমি ওর কাছে যাব না। অবাক হয়ে বলি—ইম্পোটেন্ট হয়ে থাকলে ওর কাছে আছ কেন? আমেরিকানরা সহজে কাঁদে না। মেয়েটাও কাঁদল না, কিন্তু ওর গলার স্বরে শুকনো কান্না ছিল। বলল—হোয়েন আই ফিল লো অ্যান্ড ডাউন, যখন আমি ভয়ংকর ভাবে ভেঙে পড়ি, তখন ও আমাকে একটা ট্যাবলেট দিয়ে বলে—সোয়ালো ওয়ান, অ্যান্ড ইউ ফিল ডিভাইন। সেই ট্যাবলেট খেলে আমি সত্যিই স্বর্গে পৌঁছে যাই। বুঝলাম, ও ড্রাগ খায়। এল-এস-ডি, ককেইন বা ওইরকম কিছু। আইওয়া ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ছিল, একদিন হঠাৎ ওর মনে হয়েছিল, বেঁচে থাকাটা বড় একঘেয়ে। মাত্র আঠারো কি উনিশ বছর বয়সে সব রকম যৌন মিলনের আনন্দ সে পেয়েছে, ভাল পোশাক, ভাল গাড়ি, গান, শিল্প, সাহিত্য-সবরকমের আনন্দ উপভোগ করেছে। নেচেছে, সাঁতার কেটেছে, প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখেছে, দেশ ভ্রমণ করেছে। মৃত্যুশোক পায়নি, প্রেমে ব্যর্থ হয়নি, তবু জীবনটা বড় একঘেয়ে। একদিন মনে হল, জীবনে কিছু নেই। মাথার ওপর পুরনো আকাশ, নদীর ওপর শীতের একঘেয়ে কুয়াশা জমে থাকে, তুষারপাতে ঢেকে যায় সবকিছু, আবার বসন্ত আসে, আসে গ্রীষ্মকাল। একই রকম ভাবে। হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চলে অবিরল, স্থির হয়ে থাকে মাথা উঁচু বাড়িঘর। নিত্য নতুন সঙ্গী জোটে, কিন্তু সেই একই রকম লাগে। কিছুতেই বুঝতে পারে না পৃথিবীতে সে জন্মগ্রহণ করেছে কেন! রাত জেগে কখনও-সখ- নও পুঁথির পাতায় খুঁজে হাজারো জবাব পেয়েছে, গেছে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। অবশেষে একদিন এই ছেলেটির কাছ থেকে পেয়ে গেল জবাব। একটা সাদা ইনোসেন্ট ট্যাবলেট। খাও, স্বর্গে পৌঁছে যাবে। কিন্তু মুশকিল এই যে, একবার ট্যাবলেটের স্বর্গে পৌঁছলে আর পৃথিবীকে কিছুতেই অন্য অবস্থায় সহ্য করা যায় না। সেই নেশা কেটে যায় তখনই মনে হয়, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মধ্যে কোনও সুখ নেই; সে বড় দুঃখী। ফালতু মানুষ। নানা দুঃখের হাওয়া এসে বুকে ধাক্কা দেয়। মনে হয় জীবন এক এমন নৌকো যা মৃত্যুনদী ভেদ করে চলেছে। চারদিকে মৃত্যুর বাতাস, মৃত্যুর গন্ধ। বেঁচে থাকা এক প্রগম্ভতা মাত্র। তাই আবার ট্যাবলেট খাও, পৌছে যাও তুরীয় আনন্দে, কুঁদ হয়ে থাকো। সিগারেট, কফি বা মদ কোনও নেশাই এর ধারেকাছে আসতে পারে না। এ নেশা যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ। নেশা কেটে গেলেই দিন দিন পৃথিবী আরও বীভৎস হতে থাকে। মেয়েটা তাই ওর সঙ্গীকে ছাড়তে পারে না। তারা মৃত্যুর চুক্তিতে আবদ্ধ। পৃথিবী জুড়ে মানুষ নানাভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার অস্তিত্ব, তার প্রয়োজনীয়তা, তার জন্মের কারণ। সে চার্চে যায়, শুঁড়িখানায় যায়, মেয়েমানুষের কাছে যায়, সে পৃথিবী লোপাট করে টাকা কুড়িয়ে আনে। সে অসুরের মতো খাটে, নাচে, সাঁতার কাটে। বিপ্লব করে, যুদ্ধে যায়, চাঁদের মাটি কুড়িয়ে আনে। তবু তার নিজের ভিতরে অনড় হয়ে থাকে কুয়াশায় ঢাকা একটু রহস্য—সে কে? সে কেন? এই রাতে ছোট্ট কম্বলের বিছানায় আমরা দুই অনাবৃত নারী-পুরুষ বসে রইলাম। আমাদের মাঝখানে ওই কুয়াশা, ওই রহস্য। আমি তাকে বার বার জিজ্ঞেস করলাম—তুমি কি বুঝতে পারছ তোমার মধ্যেই সৃষ্টির নিহিত রহস্য? তোমার ভিতর দিয়েই আসে প্রাণ? তুমি জগতের জননী? সে মাথা নেড়ে ততবার বলে—না, আই ডোন্ট ফিল লাইক মাদার মেরি। আই ফিল রেস্টলেস। আমি হতাশ হয়ে অবশেষে তাকে জিজ্ঞেস করলাম—তুমি মেয়েমানুষ, এটা অনুভব করো কি? ওইভাবেই রাত কেটে গেল। একটা রাত, হয়তো বা একটা যৌন ব্যর্থতার রাত। পরদিন আমি মেয়েটাকে নিয়ে ধর্মশালা থেকে চলে এলাম, ওর সঙ্গী বাধা দিল না। তাকিয়ে একটু দেখল কেবল। আর একটা বিশ্রি গালাগাল দিল। মেয়েটাকে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। ধর্মশালায়, হোটেলে, রাস্তায়। আমাদের যৌন মিলন হয়নি যে তা নয়। না হলে মেয়েটাকে নিয়ে আমার এক্সপেরিমেন্ট সম্ভব হত না। বড় রেস্টলেস ছিল মেয়েটি। বেনারসে থাকবার সময়ে সে প্রায়ই আমাকে ফাঁকি দিয়ে তার পুরুষ সঙ্গীর কাছে চলে যেত, ট্যাবলেট খেয়ে আসত। কিন্তু থাকত আমার সঙ্গেই। প্রতি রাতেই আমি তার নাভিতে হাত রেখে বলতাম—প্রসীদ জগজ্জননী। সে মাথা নাড়ত। না। সে কিছু অনুভব করছে না। ড্রাগের নেশাডুদের যে সব দোষ থাকে সবই তার ছিল। মাঝে মাঝে সে আমাকে প্রচণ্ড গালাগাল করত, চিৎকার করত। আবার ট্যাবলেট খেলে তার মুখে চোখে অদ্ভুত তৃপ্তি আর আনন্দ ফুটে উঠত। সে আমাকে প্রায়ই বলত—ম্যাক্স, তুমিও খাবে ট্যাবলেট? খাও, ইউ ফিল ডিভাইন। সে আমাকে ট্যাবলেট দিত।
ম্যাক্স উঠে বসে কেতরে প্যান্টের পকেট থেকে একটা নাইনলের ফোল্ডার বের করে আনে। হাতের তেলায় ঢালে কয়েকটা ট্যাবলেট। আতঙ্কিত সোমেন চেয়ে থাকে।
ম্যাক্স আবার ফোল্ডার রেখে দিয়ে বলে—বয়ে বেড়াচ্ছি। স্মৃতিচিহ্ন। মেয়েটাকে শেষবার দিল্লির হাউজ খাস-এ একটা বাড়িতে গাড়িবারান্দার তলায় ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে চলে আসছিলাম। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, ভোরের আবছা আলোয় কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে। উওম্যান, মেয়েছেলে। সমস্ত অবয়বে কোনও ঘাটতি নেই। মেয়েমানুষের সব অঙ্গই অটুট। তবু ও ঠিক মেয়েমানুষ নয়। যুদ্ধের সময়ে সোলজারদের একরকম রবারের পুতুল দেওয়া হয়, উইথ ফেমিনিন অর্গানস। ও অনেকটা সে রকম। তবু ও পুতুলও নয়। ও চেঁচায়, গাল দেয়, ইচ্ছা অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তাই পুরুষেরা ওকে ওই রকমভাবে ফেলে ফেলে যায়। অন্য কেউ এসে ফের তুলে নেয়। কেবল সেই পুরুষ সঙ্গীটি, যে ইম্পোটেন্ট তার সঙ্গেই ও বাঁধা আছে। মৃত্যুচুক্তি। সুইসাইডাল প্যাক্ট। যেখানেই থাকুক, ঠিক তার কাছে ছুটে যায়। কোথায় তার মধ্যে জগজ্জননী! কোথায় প্রসন্নতা! এরপরও অনেকবার অনেক বেশ্যাকে ওই মন্ত্র বলেছি, দু-একজন ভারতীয় মহিলাকেও। তারা হেসেছে। না, তারাও জানে না ওই মন্ত্র। কখনও শোনেনি। বরং আমি ভারতবর্ষে ঘুরে দেখেছি উইমেনস লিবারেশন আন্দোলন চলছে। ইয়োরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় মেয়েছেলে বলতে আর কেউই প্রায় নেই, যারা আছে অল আর মেন উইথ ফিমেল অর্গানস। মহিলার অঙ্গলক্ষ্মণযুক্ত পুরুষ, তাদের লিবারেশন ঘটে গেছে। তাই পুরুষেরা আর মেয়েছেলে খুঁজে পায় না। পায় যৌন অঙ্গ, আর পার্টনার। সেই হাওয়া আসছে এ দেশেও। পৃথিবী থেকে মেয়েমানুষ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে সোমেন। একদিন একটা বাঙালি মেয়েকে টেনিস খেলতে দেখে আমি সোজা গিয়ে তাকে বললাম—তুমি টেনিস খেল কেন? এ তো তোমাদের খেলা নয়। মেয়েটা অবাক। বলে—কী করে বুঝলে যে এ আমাদের খেলা নয়! আমি তাকে বোঝাতে পারলাম না। কিন্তু আমার কেবলই মনে হয়, কোথায় যেন ভুল হচ্ছে। ভীষণ ভুল হচ্ছে। মেয়েরা দুনিয়া জুড়ে কী একটা ভুল করছে, তাই এই অবস্থা। একদিন অণিমা বলেছিল—ম্যাক্স, তুমি সমাজপতিদের মতো কথা বললো কেন? মেয়েদের লিবারেশন তোমার ভাল না লাগতে পারে, কিন্তু জেনো মেয়েরা যে বেহায়া হয়ে উঠছে তা পুরুষেরা তাদের ওইরকম চায় বলেই। এখনও মেয়েরা পুরুষদেরই ক্রীতদাসী। তারা যেমন চায় তেমনই হয়ে ওঠে মেয়েরা। তোমরা যদি জগজ্জননী চাও তো মেয়েরা একদিন তাই হবে। একথা শুনে আমি অণিমার প্রেমে পড়েছিলাম। ও যে আমাকে রিফিউজ করেছে তাতেও আমি খুশি। শি ওয়াজ অর্থডক্স। আর, রক্ষণশীল মানুষ আমি খুব পছন্দ করি সোমেন।
সোমেন তর্ক করল না। কেবল শুনল। মাথাটা টালমাটাল। হাওয়ায় শুয়ে থাকতে বড় ভাল লাগছিল। ঠান্ডা বাতাসে একটু জলীয় গন্ধ। বয়ার গায়ে জলের শব্দ। মাঝগাঙ থেকে মাল্লাদের সুর ভেসে আসে কখনও। দেয়ালের মতো উঁচু একটা জাহাজ দক্ষিণ থেকে উত্তরে চলে যায়।
॥ চুয়াল্লিশ ॥
কাল অণিমার বিয়ে। শাড়ির দামটা এখনও অণিমাকে দেওয়া হয়নি। ভাবলেই লজ্জা করে সোমেনের। পাগলামিটা না করলেও চলত। দেড়শোটা টাকা হুট করে খরচ করা কি তার উচিত? হাতে টাকা নেই বহুদিন। মাসের প্রথমে অণিমাদেরই বাসা থেকে খামে করা একশো টাকা পেয়ে যায় সে, তারপর সারা মাস অনাবৃষ্টি। কী ভীষণ খরচ করতে ইচ্ছে করে সোমেনের, হাত পা নিশপিশ করে খরচ করার জন্য। টাকা থাকলে কত কী করত সে। দাদা, বউদি, মা আর ভাইপো-ভাইঝিদের জন্য রাজ্যের জিনিস কিনত। দিত বাবাকেও, এক আধ প্যাকেট গোল্ডফ্লেক কিনতে ইচ্ছে করে, কিছু বই মাঝে মাঝে ট্রামবাসের ভিড় ছেড়ে ট্যাক্সি করতে। সামান্য ইচ্ছে। কত লোকের কত বেশি টাকা আছে। কিনে শেষ করতে পারে না। কালো টাকা। যাদের নেই তারা আক্রোশে আক্ষেপে গভর্নমেন্টকে গালাগাল দেয় ট্রামে বাসে আড্ডায়। প্রতি বছর বাজেটের খবর বেরোলে হতাশায় দেখে, আবার সিগারেটের দাম বাড়ল, জামাকাপড় মহার্ঘ হয়ে গেল, সিলিং ফ্যান আর কেনা যাবে না। পূর্ব এসপ্ল্যানেডে অবরোধ জোরদার হয়, মিছিল বাড়ে, ছায়াময়ী হতাশার মেঘ গুমোট করে রাখে সারা দেশকে। লাথি মারতে ইচ্ছে করে সোমেনের। লাথিতে লাথিতে ভেঙে ফ্যালে কলকাতা, বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ।
বউদির খোঁজে একবার দাদার ঘরে উঁকি দিল সোমেন। বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। খেয়াল ছিল না, এ সময়ে বউদি টুবাইকে ইস্কুল-বাস থেকে নামিয়ে আনবার জন্য রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বড় দুজন আরও পরে ফেরে। ফাঁকা ঘরে একা দাদা বসে আছে বিছানায়। উঁকি দিতেই চোখে চোখ পড়ে গেল। দাদার চোখ দুটো কিছু অস্বাভাবিক, ঘোলা এবং উজ্জ্বল লালচে আভাযুক্ত। তাকিয়ে বলল—কে রে? সোমেন?
—সোমেন পরদা সরিয়ে একটু হেসে বলে—কেমন আছো দাদা?
রণেন যেন অবাক হয় প্রশ্ন শুনে। বলে—কেমন থাকব! ভালই আছি। আমার হয়েছেটা কী যে, জিজ্ঞেস করছিস কেমন আছি?
ভুলটা বুঝতে পারে সোমেন। প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। বলল—শরীর খারাপ শুনেছিলাম।
রণেন মাথা নেড়ে বলে—না। বেশ আছি। এরা সব কোথায় গেল? আমাকে এখনও সকালের চা দেয়নি।
সোমেন অবাক হয়ে বলে—তুমি এই ঘুম থেকে উঠলে নাকি?
রণেন ভ্রূ কুঁচকে বলে হ্যাঁ। কেন, খুব বেলা হয়ে গেছে নাকি! বলে টেবিলের ওপর ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলে—তাই তো! কেউ ডেকে দেয়নি, অনেক বেলা হয়ে গেছে। ওরা কোথায় গেল?
—বউদি বাচ্চাদের আনতে গেছে। মা পুজো করছে।
রণেন একটু বিরক্তির সঙ্গে চেয়ে থাকে সোমেনের দিকে। তারপর মুখটা বিকৃত করে বলে—বাচ্চাদের ইস্কুলে পাঠাতে বারণ করেছি, তবু পাঠিয়েছে?
সোমেন ঠিক বুঝতে না পেরে বলে—বারণ করেছিলে কেন?
রণেন একটু উত্তেজিতভাবে বলে—রাস্তাঘাটে আজকাল বাচ্চাদের বেরোতে আছে! কলকাতায় কীরকম অ্যাকসিডেন্ট দেখিস না। বলে রণেন পাশে পড়ে থাকা খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে বলে—দ্যাখ, সব দাগিয়ে রেখেছি। কাছে আয়।
সোমেন কাছে গিয়ে দেখে খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় দুর্ঘটনার খবরগুলিতে লাল পেন্সিলের দাগ।
রণেন মুখ তুলে বলে—দেখেছিস?
সোমেন মাথা নাড়ল।
রণেন উত্তেজিতভাবে বলে—কীরকম ভাবে মানুষ মরে যাচ্ছে! আর তোর বউদি কোন সাহসে বাচ্চাদের ঘরের বার করে? যদি কিছু হয়?
সোমেন মৃদু স্বরে বলে—কিছু হবে না। ওরা তো বাস-এ যায়।।
রণেন মাথা নেড়ে সেই ঈষৎ উঁচু গলায় বলে—বাস অ্যাকসিডেন্ট করে না? কে গ্যারান্টি দিয়েছে? বলতে বলতে উঠে ঘরময় পায়চারি করে রণেন। বিড়বিড় করে বলে—আমি ঘুমোচ্ছিলাম, সেই ফাঁকে বাচ্চাদের বের করেছে। কোনওদিন সর্বনাশ ঘটে যাবে। একটাও ফিরবে না।
বলতে বলতে যেন দৃশ্যটা চোখের সামনে দেখে একটা ঝাঁকি খায় রণেন। দাঁড়িয়ে পড়ে। আবার পায়চারি করে।
সোমেন বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর চা-এর কথা মনে পড়তেই বলে—দাঁড়াও, মাকে তোমার চা-এর কথা বলে আসি।
জপের সময় কথা বলেন না ননীবালা। সোমেন পিছনে থেকে বার দুই ডাকল, ননীবালা হাতের ইশারায় ডাকতে বারণ করলেন।
সোমেন একটু ইতস্তত করে। দাদার জন্য সে বহুকাল কিছু করেনি। দাদাকে সে লক্ষই করে না আজকাল। আজ তাই একটু কিছু করতে ইচ্ছে হল।
চা চিনি দুধের ঠিকানা জানে না সোমেন। কেটলিটা রান্নাঘরের ট্যাপ-এর কাছে খুঁজে পেল। গ্যাস উনুন কখনও জ্বালেনি। একটু ভয়-ভয় করছিল, তবু কল ঘুরিয়ে গ্যাস ছেড়ে দেশলাই জ্বেলে দিল।
কেটলি বসিয়ে অনেক কৌটোটৌটো নেড়ে চা-পাতা আর চিনি খুঁজে পেল, দুধের ডেকচিটা মিটসেফ থেকে বের করছিল, এ সময়ে রণেন এসে দাঁড়ায়, বলে—কী করছিস?
—একটু চমকে উঠেছিল সোমেন, হেসে বলল—তুমি ঘরে গিয়ে বসো, আমি চা করে আনছি।।
—তুই করবি! রণেন অবাক হয়ে বলে—গ্যাস ফেটে কত লোক মরে যায় জানিস? বলে মুখ ফিরিয়ে নিল। হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে আপনমনে বলল—সিকিউরিটি! সিকিউরিটি! মানুষ তার বেশি আর কিছু চায় না।
এই বলে ঘরে চলে গেল রণেন। ঘরে বসে ভাববে। একা একা কত কথা আর বলবে।
চা-পাতা বেশি পড়ে গেছে, লিকারটা হয়েছে ঘন কাথের মতো। ননীবালা উঠে এসে দেখে বললেন—এই কি পুরুষমানুষের কাজ! বউমা তো চৌপর দিন চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ঘরসংসার ভেসে যায় তো যাক।
চা নিয়ে রণেনের ঘরে ঢুকে সোমেন দেখে দাদা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে। খুব সজাগ ভাব, যেন দূরের কোনও শব্দ শুনবার চেষ্টা করছে কিংবা অস্পষ্ট কোনও গন্ধ শুঁকছে বাতাসে।
চা দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে—ইচ্ছে করছে না। নিয়ে যা।
সোমেন হেসে বলে—তোমার জন্য কত কষ্ট করে করে আনলাম, নাও।
ভ্রূ কুঁচকে আবার রণেন সোমেনের দিকে চায়, বলে—বাসায় কেউ নেই?
—কাকে চাইছ?
—মা।
এমনভাবে মা কথাটা উচ্চারণ করল যেমনভাবে টুবাই ঘুম থেকে উঠে করে। রান্নাঘর থেকে ননীবালার স্বর শোনা যাচ্ছিল, একা-একা বউমাকে বকছিল। সেই স্বরটাই বোধ হয় উৎকর্ণ হয়ে শুনল রণেন। প্রাণে জল এসেছে এমন হঠাৎ-পাওয়ার মতো বলল—ওই তো মা!
—মাকে পাঠিয়ে দেব? সোমেন জিজ্ঞেস করে।
রণেন চায়ের কাপ তুলে চুমুক দেয়। ভ্রূ কোঁচকানো। বলে—মার কত বয়স হয়ে গেল! আর কতদিন বাঁচবে? অ্যাঁ! যদি মরে যায় তা হলে থাকব কি করে মা ছাড়া!
সোমেন বিছানার ওপর বসে দাদার দিকে চেয়ে থাকে। দাদাকে এক প্রকাণ্ড শিশুর মতো লাগে। বলে—ওসব ভাববা কেন?
—ভাবব না? বলিস কী! চা খেয়ে কাপটা নামিয়ে রেখে বলে—সবাই থাকবে আমি চলে যাব, সেটাই ভাল। কারও মরা আমি সহ্য করতে পারব না সোমেন।।
—দাদা।
—যদি মার মরার সময় হয় তো তার আগে মরে যাব।
দাদা একটা সিগারেট ধরায়। নিজের হাতের তালুর দিকে নিবিষ্টভাবে চেয়ে থেকে বলে—মা ম্রিয়স্ব, মা জহি, শক্যতে চেৎ মৃত্যুমবলোপয়।
শ্লোকটা সোমেন বাবার কাছে কতবার শুনেছে। মেরো না, মোরো না, পারো তো মৃত্যুকে অবলুপ্ত করো। পরের দুর্দশা দেখে, মৃত্যু দেখে নিজের দুর্দশা ও মৃত্যুর কথা মানুষের মনে পড়ে। সেটাই দুর্বলতা। যার হৃদয় সবল সে তা ভাবে না, বরং ওই সব অবস্থায় যেন আর কেউ বিক্ষিপ্ত না হয়, তারই উপায় চিন্তা করে। ওই হচ্ছে সবল হৃদয়ের দৃষ্টান্ত, বুদ্ধদেবের যেমন হয়েছিল। বাবা বলতেন। বাবার কথা আজকাল সোমেনেরও বড় মনে হয়। সেদিন যখন ম্যাক্স তার জগজ্জননীর গল্প বলছিল তখনও অস্পষ্টভাবে কেবলই বাবার কথা ভেবেছিল সোমেন। ওই সব মন্ত্র-তন্ত্র ওই সব প্রাচীন ভারতীয় মনোভাবের সঙ্গে যেন বাবার নাড়ির যোগ। বংশধারা বেয়ে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যধারা যেন বা ব্রজগোপাল পর্যন্ত আসতে পেরেছিল বহু কষ্টে। তারপর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। স্তব্ধ হয়ে গেছে। ভারতবর্ষ আর নেই। যে দেশটা পড়ে আছে সে দেশকে লাথি মেরে রসাতলে পাঠিয়ে দিতে ইচ্ছে করে কেবল। মনে হয়, লক্ষ্মণদা আমেরিকায় কত মজায় আছে। এরকম পালিয়ে যেতে পারলে বেশ হত। কে চায় ভিখিরি ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব, কে চায় এ দেশের আজন্মমৃত্যু বন্দিদশা?
বউদি ফিরতেই সোমেন আড়ালে ডেকে টাকাটা চাইল৷ ক্ষণকাল বউদি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকক্ষণ রোদে দাঁড়িয়েছিল বীণা। মুখটায় তাই তামাটে রক্তাভা, কপালে ঘাম, ঠোঁটে বিশুষ্ক ভাব। একটু অস্বস্তির সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল—হঠাৎ এত টাকার আবার কী দরকার পড়ল?
—একটা প্রেস্টিজের ব্যাপার। খুব আটকে গেছি। দেবে?
বউদি মুখটা নত করে বলে—তোমার দাদা যদি নর্মাল থাকত তবে কি ভাবতাম ভাই? ও বেরোলেই টাকা। মাইনের টাকা আর কদিন! কিন্তু সে সব তো বন্ধ। আমার লুকনো-চুরনো কিছু থাকতে পারে, কিন্তু বেশি নেই আর, খরচ তো হচ্ছে। দেখি।
মনটা খারাপ হয়ে গেল আবার।
সোমেন একটু ভেবে বলল—আচ্ছা থাক। দেখি, যদি অন্য কোথাও পাই।
বউদি ঘরে চলে যেতে যেতেই হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বলল—মার কাছে চাও না। মার তো ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে টাকা পড়ে আছে।
তাই তো! মনে পড়ে গেল সোমেনের। জমির টাকাটা পড়ে আছে এখনও। দাদার অসুখের জন্য পিছিয়ে যাচ্ছে তারিখ। এ ক’টা টাকা মাও দিয়ে দিতে পারে। মায়ের ঘরের দিকে ফিরেও থেমে গেল সোমেন। মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা বাধা। চাইলেই যে মা দেবে তা নয়, অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করবে, সন্দেহজনক সব প্রশ্ন করবে। তারপর সোমেন রেগে গেলে লক্ষ্মী মেয়ের মতো সুড়সুড় করে চেক কেটে দেবে সেটা সোমেন জানে। কিন্তু বাধা অন্য জায়গায়। টাকাটার ইতিহাস মনে করলে আর চাইতে ইচ্ছে করে না। বাবার কত কষ্টের টাকা! কত বছরের অপেক্ষার পর পাওয়া। টালিগঞ্জের জমিটুকু ঘিরে কত সুখের স্বপ্ন মায়ের।
সোমেন টাকা চাইল না। বেরিয়ে পড়ল সন্ধেবেলায়। দেড়শো টাকার সমস্যাটা তেমন কঠিন হওয়া উচিত নয়। টাকাটা বাইরে কোথাও থেকে ঠিক পেয়ে যাবে সোমেন।
অনিল রায় স্থলিত গলায় গান গাইছিলেন। অথবা গান গাওয়া এ নয়। গলা সাধাই হবে হয়তো। চাকর দরজা খুলে দিতেই শব্দটা কানে এল। শ্লেষ্ম কিংবা কান্নায় আবিষ্ট গলা, সঙ্গে তানপুরার আওয়াজ, সুর মিলছে না। তিনশো টাকা ভাড়ার চমৎকার সরকারি ফ্ল্যাট, প্রচুর জায়গা। খোলামেলা। প্রথম ঘরটায় একটা গোদরেজের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর ডাঁই করা বই, আলমারি ঠাসা কেবল বই। দ্বিতীয় ঘরটা শোওয়ার। সেখানে একটা বেতের চৌকিতে তুচ্ছ বিছানা। মেঝেয় কার্পেটের ওপর তানপুরা হাতে বসে আছেন অনিল রায়, পিঠে কাঁধে প্রচুর লোম, কানের লম্বা লোমগুলো ছেটে ফেলেন অনিল রায়। পাশে মদের বোতল, গেলাস, সোডা, কিছু চিজ লাগানো নোনতা বিস্কুট।
সোমেনকে দেখে তানপুরা শোয়ালেন, গেলাস তুলে নিয়ে বললেন—খাও, ঢেলে নিয়ে খাও। ষষ্ঠী, আর একটা গেলাস দিয়ে যা।
—না স্যার, মা টের পেলে বকাবকি করবে।
অনিল রায় উত্তর দিলেন না। ষষ্ঠী বিনা শব্দে এসে গেলাস রেখে গেল। বাড়িটা অসম্ভব স্তব্ধ। কানে তালা লেগে যায়। নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ পাওয়া যায়।
অনিল রায় বসে বসেই টলছিলেন। বললেন, তা হলে কফি?
—তা একটু খেতে পারি।
কিন্তু কফির কথা ষষ্ঠীকে বলতে ভুলে গেলেন অনিল রায়। কার্পেটের ওপর এক ধারে একটা পাশবালিশ পড়ে আছে, সেইটাতে ঠেসান দিয়ে বসে বললেন—গান কাকে বলে জানো? অ্যাটমসফেরিক ডান্স অব দি ভয়েস, বুঝলে?
—না স্যার।
—বাংলায় কী বলে! বাংলা নিয়ে আমার বড় মুশকিল। ও ভাষাটা বড় আদুরে বাবু ভাষা। এক্সপ্রেশন হয় না। বলা যায়, কণ্ঠস্বরের আবহনৃত্য। সুরের পাখিরা বেরিয়ে এসে চারদিকে নেচে নেচে বেড়ায়।
সোমেন একটু হাসল।
অনিল রায় হাতের পিঠে ঠোঁট মুছে নিয়ে বলেন—একটু নেশা করে গাইতে বসলে ঠিক টের পাই, পাখিগুলো চারদিকে উড়ে উড়ে নাচছে, নামছে, আনন্দে চিৎকার করছে। তারপর পাখিগুলো ঠোকরাতে শুরু করে। ঠুকরে ঠুকরে খায়। আমাকে খায়। খেয়েটেয়ে কিছুক্ষণ পরে বোধ হয় ভাল লাগে না, আধ-খাওয়া করে ফেলে রেখে যায়। তখন ভারী মুশকিল। আধ-খাওয়া হয়ে পড়ে থাকি, বড় ভয় করে তখন। ষষ্ঠীচরণ ঘুমোয়, আর বাড়িটা খাঁ-খাঁ করতে থাকে। নিজেকে মনে হয় কেবলমাত্র মাতাল, বলে অনিল রায় গেলাস শেষ করেন। আবার সোডার আর মদের মিশ্রণ তৈরি করে নিয়ে বলেন—শালা মাতাল। বাস্টার্ড।
টাকার কথাটা আর ভোলা যাবেনা, সোমেন বুঝল। মাতালদের একটা অন্য চোখে দেখে সোমেন। যেমন সবাই দেখে। মাতাল অবস্থায় কারও কাছ থেকে কিছু চাইতে বা নিতে সংকোচ হয়। মনে হয়, লোকটাকে ঠকাচ্ছি, ওর তো মনে থাকবে না।
অনিল রায় একটু ঝুঁকে বললেন—দেরি করে এলে। চাকরিটায় অন্য লোক নেওয়া হয়ে গেছে। অবশ্য তেমন কিছু নয়, একটা ক্ল্যারিক্যাল জব।
সংবাদ শুনে সোমেন দুঃখিত হল না। ছোটখাটো চাকরির জন্য তার মাথাব্যথা নেই। সে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে চায়, অনেক বেশি খরচ করতে চায়। এ চাকরি না হলেই কী? বলল—ঠিক আছে।
অনিল রায় গেলাস তুলে চোখের সামনে ধরে আছেন। গেলাসের স্বচ্ছ কাচে একটু হলুদ মদ। তার ভিতর দিয়ে সোমেনকে দেখলেন একটু। বললেন দাঁড়াও, দাঁড়াও। তোমার প্রোফাইলটা তো অদ্ভুত। বায়রনের মতো। দাঁড়াও, তোমার একটা ছবি তুলে রাখি।
বলে টলতে টলতে উঠলেন অনিল রায়। বিছানার বালিশের খাঁজ থেকে একটা চামড়ার খাপ টেনে বের করলেন। সোমেন চমকে উঠে বলে—স্যার, ওটা রিভলবার।
অনিল রায় স্তম্ভিত হয়ে হাতের খাপসুদ্ধ রিভলভারটার দিকে চেয়ে থাকেন একটু। একটু ম্লান হেসে মাথা নেড়ে বলেন—তাই তো। দাঁড়াও, ক্যামেরাটাও এখানেই আছে। এ অবস্থায় নত্বসত্ব জ্ঞান থাকে না, বুঝলে।
খুঁজে পেতে খাপসুদ্ধ ক্যামেরাটা বার করেন অনিল রায়। দুর্ধর্ষ জাপানি মিনোল্টা ক্যামেরা। ঝকঝক করছে। ফ্ল্যাশ গান লাগানো, ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে অনিল রায় তাক করছেন। হাত টলছে, শরীর টলছে।
সোমেনেরও বুক টলে হঠাৎ। শেষ বেলায় সবুজ ক্ষেতের ওপর দিয়ে সূর্যাস্তের রং মেখে একটা একা পাখি যেন বহু দূর পাড়ি দিয়ে ফিরে যাচ্ছে ঘরে। আধো অন্ধকার জমে ওঠা খড়কুটোর বাসা। ওম্, নিরাপত্তা, বিশ্রাম। পাখি ফেরে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা আসাহি পেন্টাক্স ক্যামেরার নিপ্রাণ চোখ। অলক্ষ্যে ডেকে ওঠে একটা অন্ধ কুকুর।
অনিল রায় স্থলিত গলায় বলেন—তোমার মুখটা কোথায়? অ্যাঁ! খুঁজে পাচ্ছি না।
সোমেন ম্লান একটু হাসে।
অনিল রায় বলেন—ওঃ, এই তো।…তোমার দুটো মুখ, অ্যাঁ! দুটো!…ডাবল ফেসেড বাস্টার্ড! না না, তোমাকে নয়। নিজেকেই বলছি। এ ডাবল ফেসেড বাস্টার্ড।
দুঃখিত চিত্তে সোমেন ওঠে, অনিল রায় ঝুঁকে পড়ে যেতে যেতে সামলে নেন। ক্যামেরায় চোখ। বলেন—হ্যাঁ। ঠিক আছে। বাঃ!
সোমেন ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে। বড় সদর দরজাটা খোলা। চৌকাঠে পা দিয়ে শুনতে পেল, একা ফাঁকা ঘরে অনিল রায়ের গলার স্বর—হ্যাঁ, তোমাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তুমি ফাঁকা, তুমি শূন্য, এ বায়রনিক ভ্যাকুয়াম। ঘাড় ঘুরিও না। ঠিক আছে।
একটা অস্পষ্ট আলোর ঝিলিক ঘরের মধ্যে চমকে উঠল। টের পেল সোমেন। ফাঁকা ঘরে অনিল রায় তার ছবি তুললেন। সোমেন সিড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে এল। রাত হয়ে যাচ্ছে। সময় নেই। মুহুর্মুহু ডাকে এক অন্ধ কুকুর। আসাহি পেন্টাক্স ক্যামেরার একটিমাত্র চোখ চেয়ে আছে প্রতীক্ষায়।
সোমেন যাবে।
॥ পঁয়তাল্লিশ ॥
খুব ভোরবেলা। এখনও আকাশে ঝিলমিল করছে নক্ষত্র। পুবের দিকে আকাশটা একটু ফিকে ফিরোজা। ভূতুড়ে সব গাছের ছায়া। ভোর ভোর বেলায় এখন একটু জুড়িয়ে যাওয়া মিঠে ভাব চারদিকে। বহেরুর খামার ছেড়ে ব্রজগোপাল টর্চের আলো ফেললেন আলের ওপর। এ রাস্তাটা ভাল নয়, তবু অনেক তাড়াতাড়ি হয় ইস্টিশন। কলকাতামুখো প্রথম গাড়িটা এতক্ষণে বর্ধমান ছেড়েছে। ঘুর পথে বড় রাস্তায় গেলে ধরা যাবে না।
পিছনে বহেরু দাঁড়িয়ে। উঁচু বাঁধের মতো ঢিবি, খামারের শেষ সীমানা। তার ওপর আলিসান ছায়ামূর্তি। আজকাল বড় সন্দেহের বাতিক। কাল থেকে ব্রজগোপালকে পাখি পড়া করে বলছে—চলে যাবেন না ঠাকুর, আসবেন কিন্তু।
চলে যাওয়ার কি তা তা ব্রজগোপাল বোঝেন না। চলে তিনি যাবেন কোথায়? কিন্তু বহেরুর ওই এক ভয় ঢুকেছে আজকাল। কর্তা বুঝি বউ-ছেলে সংসারের টানে এতটা ভাঁটেন বুঝি আবার উজিয়ে যান। পাগুলে কথা সব। গেলেই কি আটকাতে পারে বহেরু? পারে না, তর কাঙাল ভিখিরির মতো কেবলই হাত কচলে ওই কথা পাড়ে। ব্রজগোপাল বিরক্ত হন। তোর সঙ্গে আমার গূঢ় সম্পর্কটা কী, না কি দাসখত লিখে দেওয়া আছে! আবার ফেলতেও পারেন না বহেরকে। কদিন আগেই এ সংসারে ও ছিল কর্তাব্যক্তি, হাঁক ডাকে চারদিক কাঁপত। কিন্তু বয়সে পায় মানুষকে, ভাগ্যে পায়, গাছগাছালির পোকামাকড়ের মতো কর্মফলেরা এসে কুট কুট করে খায়। সেই ক্ষয়ে ধরেছে বহেরুকে। আমান মানুষটা তখনও খাড়া হয়ে দাঁড়ালে দশাসই, কিন্তু তার আগুনটা নিভে গেছে। ছেলেরা শকুনের মতো নজর রাখছে। কদিন বাদে গন্ধ বিশ্বেসে বহেরুতে তফাত থাকবে না।
টর্চ বাতিটা একবার ঘুরিয়ে ফেললেন ব্রজগোপাল। বহেরু এখনও দাঁড়িয়ে। একা। একটু কী যেন বুকে বেঁধে। ওবেলাই ফিরে আসবেন তবু মনে হয় এই যে যাচ্ছেন, আর হয়তো ফিরবেন না।
পরশু চিঠিটা এসেছে। জমি রেজিস্ট্রি হয়ে গেল। ভিত পুজোও সারা। তবু কাজ আটকে আছে। ননীবালা লিখেছেন—তুমি একবার এস। রণোর বড় শরীর খারাপ। মাথাটার একটু গণ্ডগোল হয়েছে বুঝি। আমার মন ভাল নেই।
এমন কিছু একটা আন্দাজ করেই এসেছিলেন ব্রজগোপাল সেবার। মাঝখানে বহুকাল যাওয়া হয়নি। জোর একটা বর্ষা গেল। চারধারে চাষের উৎসব লেগে গিয়েছিল। সে উৎসব ছেড়ে কোথায় যাবেন?
ফ্যাকাশে আয়নার মতো জল জমা ক্ষেত পড়ে আছে চিত হয়ে। তাতে চিকচিকে অঙ্কুর। পায়ের নীচে আঠালো জমি, কাদা, জল। দুর্গম রাস্তা। ব্রজগোপাল টর্চের আলো ফেলে হাঁটেন। উঁচুতে তোলা কাপড়, পায়ে রবারের জুতো, বগলে ছাতা। চারদিকে ঘাস, ফসল জমির একটা নিবিড় উপস্থিতি। কাছেই হাতের নাগালে তারাভরা আকাশ। অন্ধকারে বাতাসের স্পর্শ মায়ের হাতখানার মতো। গভীর মায়া মাখানো এই বিশালতা। মনের মধ্যে একটা প্রণাম তৈরি হয়ে যায় আপনা থেকেই। বুড়ো বামুনের গায়ের গন্ধ যেন চারদিকে ছড়ানো। আয়ুর বেলা ফুরিয়ে এল। টের পান, অলক্ষ্যে বৈতরণীর কুলকুলু শব্দ ক্রমে কাছে এগিয়ে আসছে। যত এগিয়ে আসে শব্দ তত মায়া বাড়ে। তবু সেই আবছায়া নদীর শব্দ আসে, আসে। আর ততই মনে হয়, লতানে গাছ যেমন আঁকুশি দিয়ে যা পারে আঁকড়ে ধরে, তেমনি এই শরীর পৃথিবীর মাটি বাতাসে আবহের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছে আঁকুশি। বাপ- পিতামোর কাছ থেকে পাওয়া প্রাণ, এই ব্যক্ত জীবন, এ ছেড়ে কার যেতে ইচ্ছে করে?
হাঁটতে হাঁটতে পুবের আকাশ ফরসা হয়ে এল। নিবে যাচ্ছে নক্ষত্রেরা। বেলদার বাজারের কাছে ব্রজগোপাল টিউবওয়েলে জুতোজোড়া আর কাদা মাখা পা দুখানা ধুয়ে নেন। চায়ের দোকানের ঝাঁপ খুলেছে ভোরেই, দিন মজুর আর কামিনরা বসে ধোঁয়াটে চা খাচ্ছে, সঙ্গে সস্তা বিস্কুট। আসাম-চায়ের কড়া লিকারের গন্ধে জায়গাটা ম ম করে। মানুষজনের দিকে একটু চেয়ে থাকেন ব্রজগোপাল। বুকের মধ্যে বড় মায়া। মানুষেরা সব বেঁচে থাক।
অফিসের ভিড় শুরু হওয়ার আগেই কলকাতায় পৌছে গেলেন। বাসটাও ফাঁকা রাস্তায় চল্লিশ মিনিটে ঢাকুরিয়ায় নামিয়ে দিয়ে গেল। সংকুচিত ব্রজগোপাল সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেন। একটু সকাল সকালই এসেছেন ইচ্ছে করে। বেলায় এলে দুই ছেলেকে পাওয়া যায় না।
দরজা খুলল বীণা। দেখে খুশি হল না বিরক্ত হল তা বোঝা গেল না। চেহারাটা কিছু রোগা হয়ে গেছে, হনুর হাড় উঁচু হয়ে আছে শ্রীহীনভাবে। মুখে হাসি ছিল না। একটু তাকিয়ে রইল, যেন চিনতে পারছে না। তারপর সরে গিয়ে বলল—আসুন।
ঘরে ঢুকতেই এক বদ্ধ চাপা ভ্যাপসা ভাব। বাসি ঘরদোরের গন্ধ। পরিষ্কার দেখতে পান পরদার ফাঁক দিয়ে এখনও বিছানায় মশারি ফেলা। সবাই ঘুম থেকে ওঠেনি। ঠিকে ঝিয়ের বাসনমাজার শব্দ আসছে। বেলা পর্যন্ত ঘুমোয় সব। খারাপ অভ্যাস।
সোফার ওপর একটু হেলান দিয়ে বসলেন। কলকাতার এইসব বাক্স-বাড়িতে এরা দিনের পর দিন কি করে থাকে তা আজকাল ভাবতে বড় অবাক লাগে। এ শহরে যারা আছে, ব্যাপারি-ফড়ে-দালাল তারা চিবিয়ে চিবিয়ে রস নিংড়ে নিচ্ছে অহরহ। পড়ে আছে একটা ছিবড়ে শহর। কলকাতার প্রতি মানুষের মোহ আছে, মায়া নেই। মায়া জন্মায় বড় অদ্ভুতভাবে। যেখানে জনপদে মানুষ চাষ করে, গাছ লাগায়, গৃহপালিত পশু পাখিকে ভুক্তাবশিষ্ট দেয়, যেখানে মাটির সঙ্গে সহজ যোগ, মায়া সেখানে জন্মায়।।
ব্রজগোপাল বললেন—কেউ ওঠেনি এখনও?
বীণা বলে—মা উঠেছেন। জপ করতে বসলেন এইমাত্র। আর কেউ ওঠেনি, মোটে তো সাতটা বাজে।
গোবিন্দপুরের সকাল সাতটা মানে অনেক বেলা। ব্রজগোপাল গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বলেন—রণো?
—ওঠেনি। ওষুধ খেয়ে ঘুমোয়। নিজে থেকে না উঠলে ডাক্তার ডাকতে বারণ করেছে।
—হয়েছে কী?
বীণার ভিতরের রাগ আর ক্ষোভ চাপা ছিল। হঠাৎ যেন এই প্রশ্নে সেটা আগুনের মতো উসকে উঠল। একটু চাপা গলায় বলে—হবে আর কী! বংশের রোগ।
ব্রজগোপাল একটু অবাক হন। মেয়েটা বলে কী? বংশের রোগ? তাঁদের বংশে কারও কোনও মানসিক রোগ ছিল বলে তিনি জানেন না। রণোরই প্রথম মানসিক ভারসাম্যের অভাব দেখা দিয়েছিল সেই ছেলেবেলায়, টাইফয়েডের পর। বীণার দিকে চেয়ে অন্যমনস্ক ব্রজগোপাল বললেন—বংশের রোগ। সে কীরকম?
বীণা উত্তর দিল না। বাথরুমের দরজায় গিয়ে ঝিকে ধমক দিল- কতদিন বলেছি সকালবেলাটায় বাথরুম বেশিক্ষণ আটকে রাখবে না!
ব্রজগোপাল অসহায়ভাবে একা বসে থাকেন। সবাই ঘুমোচ্ছে, কেবল ছোট নাতিটা বোধ হয় এইমাত্র উঠে ‘মা’ বলে কাঁদছে। বীণা পলকে দৌড়ে গেল। ব্রজগোপাল শুনলেন গুমুর গুমুর দুটো-তিনটে কিল ছেলের পিঠে বসিয়ে বীণা বলল—কতদিন বলেছি সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঁদবে না। কোন মা মরা ছেলে যে কাঁদতে বসেছ? বাবা ঘুমোচ্ছে দেখছ না! ছেলেটা ভয়ে চুপ করে গেল।
ব্রজগোপাল শুনলেন। কিছু করার বা বলার নেই। চুপচাপ বসে থাকা। কতক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হবে তা বোঝা যাচ্ছে না। বোধ হয় ওদের সময়ের অনুসারে একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন। এতটা সকালে না এলেই হত। বংশের রোগ। কথাটা মন থেকে তাড়াতে পারেন না তিনি। বউটা এ কথা বলল কেন? তাঁদের বংশে কার ওই রোগ ছিল?
বসে বসে ভাবছিলেন ব্রজগোপাল। বড় ছেলের ঘর থেকে একটা কোঁকানির শব্দ এল। বিকট ‘উফ’ করে কে যেন পাশ ফেরে। বোধ হয় রণোই। বীণা চাপা স্বরে বলে—উঠছ কেন? শুয়ে থাকো!
রণোর গলার স্বর পাওয়া গেল—উঠব না! ক’টা বাজে?
গলার স্বরটাই অন্যরকম। কেমন অবাকভাব, শিশুর মতো। ব্রজগোপাল নিবিষ্ট হয়ে শুনছিলেন।
বীণা বলে—বেশি বাজেনি। আর একটু ঘুমোও।
রণো বলল—ঘুম হবে না। বাথরুমে যাব।
বীণা ধমক দিয়ে বলে—আঃ এখন উঠবে না।।
আবার একটা ককিয়ে ওঠার শব্দ পান ব্রজগোপাল, তখন ব্রজগোপাল একটু কাশলেন। ইঙ্গিতবহ কাশি। রণো যদি শুনতে পায়, ঠিক বুঝবে যে বাবা এসেছে।
রণেন শুনল। জিজ্ঞেস করল—বাইরের ঘকে কে?
বীণা চাপা স্বরে কী যেন বলে।
রণার স্বর শোনা যায় বলোনি কেন এতক্ষণ?
একটা বড় শরীর বিছানা থেকে উঠল, শব্দ পেলেন ব্রজগোপাল। পর মুহুর্তেই নীল লুঙ্গিপরা খালি-গা রণো পরদা সরিয়ে চৌকাঠ জুড়ে দাঁড়াল।
—বাবা!
ব্রজগোপালের এ বয়সে বোধ হয় একটু ভুলভ্রান্তি স্বাভাবিক। হঠাৎ যেন বা আত্মবিস্মৃত ব্রজগোপাল চোখ তুলে তাঁর দিকে ছোট রণোকে দেখতে পান। যেভাবে শিশু পুত্রের দিকে হাত বাড়ায় বাপ তেমনি হাত বাড়িয়ে বললেন—আয়।
রণেন দৌড়ে এল না। কিন্তু এক-পা দু-পা করে কাছটিতে এসে পাশে বসল। ব্রজগোপালের মুখের দিকে নিবিড় দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে প্রবল উৎকণ্ঠাভরে বলল—কেমন আছো?
এটা নিছকমাত্র কুশল প্রশ্ন নয়, এর মধ্যে যেন-বা জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। ব্রজগোপাল রণেনের মাথায় আলতো হাত রেখে বললেন—বাপকু সোনা, কেমন আছো বাবা?
বাপকু সোনা বলে সেই রণোর ছেলেবেলায় ডাকতেন তিনি। বহুকাল অব্যবহারে নামটা ভুলে গিয়েছিলেন। এক্ষুনি মনে পড়ল।
রণেনের ঠোঁট দুখানা একটু কাঁপে। পরমুহূর্তেই দুহাতের পাতায় মুখ ঢেকে মাথা নাড়ে প্রবলভাবে। অর্থাৎ ভাল নেই।
ব্রজগোপাল অন্যদিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলেন—তুমি বড় ভাল ছেলে বাবা, সংসার তোমার কাঁধে ফেলে রেখে আমি চলে গেছি, তুমি সব টেনেছ। বড় অপরাধী আছি তোমার কাছে বাবা।
রণেন নিস্তব্ধভাবে বসেছিল হাতের পাতায় মুখ ঢেকে। অনেকক্ষণ বাদে হঠাৎ সে একটু ফুপিয়ে ওঠে। ধরা গলায় বলে—এরা আমাকে আটকে রেখেছে।
ব্রজগোপাল ছেলের দিকে নিৰ্ণিমেষে তাকিয়ে ছিলেন, বললেন—তোমারই সংসার। আটকে কেন রাখবে? ওসব ভাবো কেন? কেউ আটকে রাখেনি।
বীণা ছেলে কোলে করে এ-ঘরে এল। দৃশ্যটা একপলকে তাকিয়ে দেখে বলল—বাথরুম খালি হয়ে গেছে। যাও।
রণেন মুখ তুলে বীণার দিকে তাকাল, চোখে ভয়। বলল—যাই।
—যাও। ব্রজগোপাল বললেন, হাত ধরে তুলে দিলেন ছেলেকে। বাথরুমের দিকে যতক্ষণ গেল ততক্ষণ চেয়ে রইলেন। রণেন খুব ধীরে ধীরে থপ থপ করে হেঁটে যাচ্ছিল, গায়ে যেন জোরবল নেই। প্রকাণ্ড শরীরের ভার যেন টানতে পারছে না।
কাল রাতে সোমেন যখন এল তখন তার সঙ্গে চুলদাড়িঅলা রাঙা এক সাহেব। বগুড়ার ছেলেবেলায় অনেক সাহেব দেখেছেন ননীবালা, কী সুন্দর সাজপোশাক কেমন ঝলমলে চেহারা। কিন্তু এ কি একটা সাহেবকে ধরে এনেছে সোমেন? রোগা, পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি, সারা গায়ে ধুলোময়লা, চোখে মুখে ভীতু-ভীতু ভাব।
এসেই বলল—মা, আজ রাত্রে ম্যাক্স আমার কাছে থাকবে।
শুনে কপালে চোখ তুলেছেন ননীবালা। সাহেব মানুষরা বাংলাটাংলা বোঝে না, তাই তার সামনেই ননীবালা বলে ফেলেছিলেন—ও মা! সে কিরে, ওরা খ্রিস্টান…
সোমেন গলা নামিয়ে বলে—ও কিন্তু বাংলা জানে।
ননীবালা সামলে গেছেন। কিন্তু ছেলের আক্কেল দেখে অবাক। হিন্দু বাড়ির অন্দরমহলে কেউ সাহেবসুবো ধরে আনে? আচারবিচারের কথা না হয় ছেড়েই দিলেন, ঘরদোর জায়গাও নেই তেমন, রণোর অসুখের পর খাওয়া-দাওয়ারও আয়োজন তেমন নেই, দু-বেলা দুটো ডালভাত কি একটু মাছের ঝোল মাত্র রান্না হয়। এ দিয়ে কি অতিথিকে খাওয়াতে আছে! বীণাও খুশি হয়নি সাহেব দেখে। কেবল নাতি-নাতনিরা খুব ঘুরেফিরে সাহেব দেখছিল।
সাহেব হলেও ছেলেটা ভালই। এ-বাড়ির কেউ যে তাকে দেখে খুশি হয়নি তা বুঝতে পেরেই বোধ হয় বাইরের ঘরে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল। চোখেমুখে ভারি ভালমানুষি আর ভয় মাখানো। মা-বাবা ছেড়ে কতদূরে পড়তে এসেছে। দেখেশুনে বুকের ভিতরটা ‘আহা’ করে উঠল ননীবালার।
রান্নাঘরে তাকে আর ঢোকাননি ননীবালা, বাইরের ঘরেই সোমেনের পাশে ঠাঁই করে খেতে দিলেন। আসনপিঁড়ি হয়ে বসে বেশ খেল। ঝিঙেপোস্ত, মুগের ডাল আর ট্যাংরার ঝাল। কোনও আপত্তি করল না। মাঝে মাঝে নীল রঙের চোখটা যখন তুলে তাকাচ্ছিল তখনই টের পাওয়া যাচ্ছিল যে বাঙালি ঘরের ছেলে নয়, নইলে ভাবভঙ্গি সব বাঙালির মতো। এতক্ষণ কথা বলেনি, বোবার মতো চুপ করেছিল। খেতে বসে কথা বলল—মা, ঝিঙেপোস্ত খুব ভাল হয়েছে।
মা! ননীবালা বড় অবাক। সাহেব ছেলেটা তাকে মা বলে ডাকছে! ননীবালা বিস্ময়টা সামলে নিয়ে বলেন—মা বলে ডাকছ বাবা? কার কাছে শিখলে-
ছেলেটা হেসে বলল—এখানে সবাই ডাকে। মেয়ে মাত্রই মা। আমার দেশে এরকম ডাকে না। আমি এ দেশে শিখেছি।
ননীবালা নিবিষ্টভাবে রোগা ছেলেটার দিকে চেয়ে থাকেন। ছেলেটা চেহারার যত্ন করে না, চুলদাড়িতে কেমন জঙ্গল হয়ে আছে মুখ। একটু যত্ন করলে গৌরাঙ্গের মতো চেহারাখানা চোখ জুড়িয়ে দিত।
ননীবালা শ্বাস ফেলে বলেন—মা বলে ডেকোনা বাবা, তা হলে ছেড়ে দিতে কষ্ট হবে। বলে একটু চুপ করে থেকে বলেন—মা হওয়ার জ্বালাই কী কম! সামনের জন্মে ছেলে হয়ে জন্মব, তা হলে আর মা হতে হবে না।
ছেলেটা চোখ তুলে বলে আবার জন্ম হবে? ঠিক জানেন?
ননীবালা অবাক হয়ে বলেন—জন্মব না? কর্মফল যতদিন না কাটে—
ম্যাক্স দুঃখিতভাবে বলে—আমরা খ্রিস্টানরা জন্মাই না, আমরা মাটির নীচে শুয়ে থাকি। টিল দ্য ডে অব জাজমেন্ট।
ননীবালা ফাঁপরে পড়ে বললেন—সাহেবরা জন্মায় না? তা হলে এত সাহেব জন্মাচ্ছে কোথা থেকে বাবা?
সোমেন বেদম হাসতে গিয়ে বিষম খেল। সঙ্গে বীণাও। ননীবালা বিরক্ত হয়ে বলেন—ওতে হাসার কী! সাহেবরা হয়তো জন্মায় না, কিন্তু আমরা হিন্দুরা ঠিক জন্মাই।
এইভাবে ছেলেটার সঙ্গে দিব্বি আলাপ-সালাপ হয়ে গেল। সাহেব হলেও নেইআঁকড়ে ভাব। দু-চোখে সব সময় কী যেন খুঁজছে, কী যেন দেখছে। সোমেন রণেন যেন অল্প বয়সেই বুড়িয়ে যাওয়া সবজান্তা ভাব, চোখের আলো নিবে যাওয়া রকম, ও তেমন নয়। ওর মনের কোনও আলিস্যি নেই।
ননীবালা নিজের বিছানায় সোমেনকে শুতে দিলেন, সোমেনের বিছানায় ম্যাক্স। ওরা নাকি রাত জেগে গল্প করবে। ননীবালা তাই বাইরের ঘরের সোফা-কাম-বেড-এ বিছানা পেতে নিলেন। সোফা-কাম-বেড-এ বড় অস্বস্তি, মাঝখানের দাঁড়াটা বড় পিঠে লাগে। এক কাৎ-এ শুয়েছিলেন, হঠাৎ মাঝরাতে দেখেন, আধো অন্ধকারে রণেন আন্ডারপ্যান্ট পরা অবস্থায় রেডিয়োর সামনে বসে। আস্তে রেডিয়ো ছেড়ে গান শুনছে, ওইরকমই সব করে আজকাল। উঠে বসে ছেলেকে ডাকলেন। সাড়া দিল না। থাক শুনুক। কিন্তু ননীবালার আর ঘুম হল না।।
ননীবালার জপ সারতে একটু সময় লাগে। জপ করতে করতেই সংসারের নানান শব্দের দিকে কান রাখেন। রাখতে হয়। আজও শব্দ পেলেন। মানুষটা এসেছে। জপ তাই জমল না। সময়টা পার করে দিয়ে উঠেই প্রথমে ছোট ছেলেটাকে ঠেলে তুলে দিলেন—ওঠ, ওঠ, তোদের বাপ এসেছে।
সোমেন উঠল। বসে টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই আর অ্যাশট্রে সরিয়ে চৌকির তলায় ঠেলে দিতে দিতে বলল—এ ঘরে উঁকি দেননি তো?
ননীবালা লক্ষ করে বলেন—দিলেই কী! বয়সের ছেলে, বিড়িটা সিগারেটটা তো খাবেই! এতে লজ্জার কী! বাসি বিছানাটা বরং তুলে ফেলো তাড়াতাড়ি, বেলা পর্যন্ত ঘুমনো উনি পছন্দ করেন না।
এইটুকু বলে ননীবালা এ ঘরে এলেন। মুখটুখ ধুয়ে রণেন এসে আবার বাপের কাছে বসেছে। খুবই ঘনিষ্ঠ ভঙ্গি। ব্রজগোপালের চোখমুখের ভাব কিছু দৃঢ়, কঠিন। একটু চাপা, তীব্র স্বরে বলছেন, বলো, আমি অক্রোধী, আমি অমানী, আমি নিরলস, কাম-লোভ-জিৎ বশী, আমি ইষ্টপ্রাণ, সেবাপটু, অতি-বৃদ্ধি-যাজন-জৈত্র পরমানন্দ, উদ্দীপ্ত শক্তি-সংবৃদ্ধ, তোমারই সন্তান, প্রেমপৃষ্ট, চিরচেতন, অজর, অমর, আমার গ্রহণ করো, আমার প্রণাম হও।
রণেন বলল। ব্রজগোপাল আবার বললেন। আবার রণেন বলল, ব্রজগোপাল ছেলের দিকে তীব্র চোখ চেয়ে বলেন—কথাগুলো মনের মধ্যে গেঁথে নাও। রোজ সকালে নিজেকেই নিজে বলবে। সারাদিন বলবে। বলতে বলতে ওর একটা পলি পড়ে যাবে মনের ওপর। বুঝেছ?
রণেন মাথা নাড়ল। বুঝেছে।
ননীবালা স্বামীর দিকে চেয়েছিলেন। সেই পাগল। চোখে চোখ পড়তেই বললেন-ওটা শেখাচ্ছ ওকে?
ব্রজগোপাল স্ত্রীর দিকে চেয়ে একটু যেন সামলে গেলেন। দীপ্তিটা চোখ থেকে নিবে গেল। বললেন—ও হচ্ছে অটো সাজেশান। স্বতঃ অনুজ্ঞা। যখন মানুষের কেউ থাকে না তখন এই অনুভা থাকে। এই চালিয়ে নেয় মানুষকে।
ননীবালা শ্বাস ফেলে বলেন—ওর কে নেই? আমরা ওকে বুক বুক করে রাখি।
ব্রজগোপাল একলহমায় উত্তর দিলেন না। একটু ভেবেচিন্তে বললেন—আছে। সবাই আছে।
—তবে?
—তবু কেউ নেই।
কথাটা ঠিক বুঝলেন না ননীবালা। তবু ইঙ্গিতটা ধরে নিলেন। এই সকালে ঝগড়া করতে ইচ্ছে যায় না। নইলে ক’টা কথা মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে এখন। বলা যেত। বলা যে যায় না তার আরও কারণ আছে। জমিটা কিনেও অনেক টাকা বেঁচে গেছে ননীবালার। বাড়ির ভিতটা উঠে যাবে। বাথরুম থেকে ঘুরে এসে ননীবালা অবাক হয়ে দেখেন, সাড়াশব্দে কখন নিঃশব্দে উঠে এসেছে সাহেব ছেলেটা। কোনও সংকোচ নেই, বেশ ব্রজগোপালের পাশটিতে বসেছে। ব্রজগোপাল তাকে অটো সাজেশান শেখাচ্ছেন।
বাণীর সঙ্গে ননীবালার একটা জায়গায় বড় মিল। ননীবালা জানেন যে এ হচ্ছে পাগলের বংশ। বংশের ধাত অনুযায়ী কম-বেশি পাগলামি এদের সবার। স্বামীর দিকে চেয়ে থেকে তার এই কথাটা আজ আমার মনে হল।
মাঝরাতেই ঠিক পলকা ঘুম ভেঙে যায় ব্রজগোপালের। ঝিঁঝি ডাকছে। চোরের পায়ের মতো হালকা পায়ে কে হেঁটে যায়, ব্রজগোপাল জানেন, শেয়াল। ঘুম ভাঙলেই মনের বিষণ্ণতা টের পান। ঘুমের মধ্যে কার একটা শ্বাস যেন মুখে এসে লেগেছিল। কেউ নয়। ঘুমের মধ্যে কত কী মনে হয়।
তাঁতি লোকটা আজকাল তাঁতঘরে জায়গা নিয়েছে। এখন এ-ঘরে বহেরু শোয়। ঘরে শোয়া কোনওকালে অভ্যাস নেই বহেরুর। শীতকালটা ছাড়া। বড় ভয়ে ধরেছে আজকাল ওকে। কেবলই বলে—কত পাপ করেছি, কতজনার কত সর্বনাশ! কে এসে ঘুমের মধ্যে কুপিয়ে রেখে যায়, কী নলিটা কুচ করে কেটে দেয়, কে জানে!
মেঝের উপর পোয়ালের গাদিভরা চটের গদি, তার ওপর শতরঞ্চি, বালিশ-টালিশ নেই। পড়ে আছে। ছেলেরা বড় হয়েছে, কোকা ছাড়া পেয়ে এসে জুটেছে। বহেরু আর শান্তিতে ঘুমোতে পারে না। কেবল এই ঘরে এসে ঘুমোয়। তার ভাবখানা—বামুনকর্তা তো সারারাত জেগেই থাকেন। চোখে চোখে রাখবেনখন।।
তা ঠিক। ব্রজগোপাল জেগেই থাকেন আজকাল। বড় ঘুমের সময় আসছে। একটা আবছায়া নদী, তার পারাপার দেখা যায় না, ঘোর কুয়াশার ঢাকা। সেই নদীর শব্দ পান। উঠে বসেন নিঃঝুম মাঝরাতে। মশারির বাইরে মশাদের বিপুল কীর্তন। শিরদাঁড়াটা সোজা করে বসেন। বীজমন্ত্রের ধারা নেমে উঠে সারা শরীর আর সত্তায় ছড়িয়ে পড়ে। নাসামূলে ইঞ্চিটাক গভীরে তেসরা তিল। সেখানে দয়াল দেশ। বুড়ো বামুনের মাভৈঃ মুখ।
ধ্যানের মধ্যেই ব্রজগোপাল হাসেন। হারিয়ে যান।
তবু হারিয়ে যাওয়াও যায় না। সে তো ধর্ম নয়।
॥ ছেচল্লিশ ॥
ম্যাক্সের পুরনো জুতোজোড়া ছিঁড়ে গেছে। পোঁটলা-পুঁটলিও ওর বেশি কিছু নেই। আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে যখন থাকত তখনও ওর কিছু শৌখিন জিনিস ছিল। ক্যামেরা, একটা টেপ রেকর্ডার, দামি কিছু স্যুট, ঘড়ি। তার বেশিরভাগই চুরি হয়ে গেছে। রাস্তায় ঘাটে পড়ে থাকত ছেলেটা কিংবা ধর্মশালায়, শ্মশানে। সেই সময়েই গেছে। বাকি যা ছিল তা বিলিয়ে দিয়েছে কাঙালদের। এখন ওর যা কিছু সম্পত্তি তা একটা শান্তিনিকেতনি ঝোলা ব্যাগে এঁটে যায়।
সোমেনের বাড়িতে দুরাত্তির কাটিয়ে সকালবেলায় ব্যাগটা গুছিয়ে নিল ম্যাক্স। সোমেন তাকিয়ে দেখছিল। একটা দাঁত মাজার ব্রাশ, একটা বাড়তি পায়জামা, একটা বাঁকুড়ার গামছা, একটা গেঞ্জি, একটা পাঞ্জাবি, দুটো ডায়েরি, আর তিনটে কি চারটে ডটপেন। বুকপকেটে পাশপোর্ট থাকে একটা প্ল্যাস্টিকের ফোল্ডারে, তাতেই গোঁজা আছে কিছু টাকা, গায়ের পাঞ্জাবির পকেটে একটা রুমাল, কিছু খুচরো পয়সা, দেশলাই আর কয়েক প্যাকেট সিগারেট, একপ্যাকেট সস্তা চুয়িং গাম। ব্যস। এত অল্পে একটা লোকের চলে কী করে! ম্যাক্স এত উঞ্ছবৃত্তি শিখল কোথায়?
মাকে বলল—মা, চললাম। বউদিকে বলল, বউদি, আসি। দাদার কাছ থেকেও বিদায় নিল। বাচ্চাদের কাছ থেকেও।
সোমেন ওকে খানিক দূরে এগিয়ে দেবে বলে সঙ্গে চলল। রাস্তায় নেমেই ম্যাক্স ছেঁড়া স্যামসন জুতোজোড়া পা থেকে খুলে সোমেনকে দেখিয়ে বলল—হোপলেস। বলে ফুটপাথে ছুঁড়ে ফেলে দিল।।
সোমেন বলল—আমার বাড়তি একজোড়া আছে, পরে যাও।।
ম্যাক্স মাথা নাড়ল, নো। এই ভাল, ভারতবর্ষের সঙ্গে এই শেষ ক’টা দিন আর্থ কন্ট্যাক্টে থাকি। ইয়োরস ইজ এ গুড কান্ট্রি।
সোমেন ভারতবর্ষ কী তা জানে না। শুনেছে, এ-এক মহান দেশ, সে- এক সমৃদ্ধ সভ্যতার উত্তরাধিকারী। কিন্তু সোমেনের কোনও ধারণা নেই, সে কিছু বোধ করে না। তবু ম্যাক্স যখন ওই কথা বলল তখন তার বুকের মধ্যে এক ঘুমিয়ে থাকা দেশপ্রেম যেন আধো জেগে উঠে একটু অস্পষ্ট কথা বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
সোমেন বলল—কোথায় যাবে?
খালি পায়ে বেলা দশটার তড়পানো রোদে পিচের ওপর হাঁটতে হাঁটতে ম্যাক্স একটু অন্যমনস্কভাবে বলে, কলকাতায় যখন প্রথম এলাম সোমেন, তখন এখানে ভিখিরি আর অভাগাদের দেখে আমি পাগল হয়ে যাই। প্রথম কয়েক মাস আমি লেখাপড়া করতে পারিনি; আমি খুব অবাক হয়ে যাই দেখে যে, এইরকম জঘন্য যেখানকার সামাজিক অবস্থা, সেখানে যুবক-যুবতীরা প্রেম করে বেড়ায়, সিনেমা দেখে, সাজপোশাক করে। বড়লোকেরা নির্বিকারভাবে বিদেশি গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ায়। আর কেউ কেউ দেশের অবস্থায় দুঃখিত হয়ে চায়ের দোকানে বসে মাথা গরম করা তর্ক করে। ওই অবস্থায় আমি পাগলের মতো খুঁজে বেড়াতাম, একজনও ভারতীয় আছে কি না যে সক্রিয়ভাবে দেশের জন্য কিছু ভাবছে বা করছে। অনেক খুঁজে আমি একজনকে পেয়েছিলাম। সত্যিকারের একজন ভারতীয় এবং দেশপ্রেমিক। মাদার টেরেসা। আমি আজকাল তোমাদের জন্মান্তরে বিশ্বাস করি সোমেন। আমার মনে হয় মাদার টেরেসাই হচ্ছেন মেরি ম্যাকডেলিন, আর আমরা যত হতভাগা আছি সবাই তাঁর খ্রিস্ট। আমি তক্ষুনি তাঁর দলে ভিড়ে যাই। সে সময়ে আমি তার জন্য কিছু টাকা তুলেছিলাম, আর কিছু নিজের স্কলারশিপ থেকে জমিয়েছিলাম। মাদারের সঙ্গে কাজ করতে করতে আমার কিছুদিন পরে মনে হয়েছিল, সমস্যার উৎসমুখ খুলে রাখা আছে। তুমি যতই করো, অভাব বা দ্রারিদ্র ঘুচবার নয়, তখন সশস্ত্র বিপ্লবের কথা ভাবতাম। আই জয়েনড নক্সালাইটস। টাকাগুলো আর মাদারের হাতে দেওয়া হয়নি। আজকের দিনটা তাই মাদার টেরেসার জন্য টাকা তুলব।
—কীভাবে?
ম্যাক্স মৃদু হেসে বলে, ভিক্ষে করব। আমার অভ্যাস আছে। তা ছাড়া খারাপও লাগে না। আমি যতবার ভিক্ষে করেছি সব সময়েই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। ভারতবর্ষে ভিক্ষে করায় বাধা নেই। মস্ত সুবিধা। যখন তোমার কিছু থাকে না, ইউ মে অলওয়েজ বেগ। ভিক্ষের কোনও শেষ নেই এখানে। তা ছাড়া মাদার টেরেসাকে আমি ঠকাতে চাই না। তাকে দেখলেই মহত্বের কথা মনে হয়, চোখে জল আসে। আর মানুষ নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে মহৎ কিছুর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে।
ব্রিজের গোড়া পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিল সোমেন। ম্যাক্স বাসে উঠল না। খালি পায়ে ব্রিজের চড়াই ভাঙতে ভাঙতে মুখ ফিরিয়ে একটু হেসে বলল—আজ বড় ভাল দিন। না?
রেলিঙের ধার ঘেঁষে উঠে যাচ্ছিল ম্যাক্স। নীল আকাশের গায়ে ওর মাথা। সোনালি বড় বড় চুল হাওয়ায় উড়ছে। সোমেন সেদিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল একটুক্ষণ, হঠাৎ আবেগে চোখে জল আসে৷ গলা রুদ্ধ হয়ে যায়। সে নিজে ভারতবর্ষের জন্য কিছু করেনি।
রিখিয়ার জন্য ‘রেড’টা পকেটের মুখে রেখে দিল সোমেন। ফেলল না। স্ট্রাইকার ভুল জায়গায় লেগে ঘুরে চলে গেল অন্যদিকে।
রিখিয়া নিবিষ্ট মনোযোগে চেয়েছিল গুটিটার দিকে। সোমেন পারল না দেখে মুখ তুলে বলল—ইস, পারলেন না! বলে একটু হাসল।
সোমেন মাথা নাড়ল দুঃখিতভাবে। স্ট্রাইকার এগিয়ে দিয়ে দেখল রিখিয়ার মুখখানা। ও কি এখনও বালিকা! লাল গুটিটার জন্য কি শিশুর মতো লোভ ওর! বয়সকালের আগুনগুলি এখনও জ্বলে ওঠেনি ওর ভিতরে! শৈশবের তুষ ঢেকে রেখেছে সেই তাপে। বড় ছেলেমানুষ। পকেটের মুখে আলগা হয়ে বসে আছে গুটিটা, রিখিয়ার দিকে চেয়ে হাসছে, টোকা লাগলেই পড়ে যাবে।
রিখিয়া স্ট্রাইকার বসিয়ে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য স্থির করে।
সোমেন গম্ভীরভাবে বলল—দেখো, ডবল ফাইন কোরো না।
রিখিয়া টোকা দেওয়ার মুহূর্তে থেমে মুখ তুলল। ভ্রূ কোঁচকাল। স্ট্রাইকারটা সরিয়ে দিয়ে বলল—খেলব না আপনার সঙ্গে।
—কেন, কী হল?
—ডবল ফাইনের কথা বললেন কেন? এখন ঠিক আমার ডবল ফাইন হবে।
এই বলে গম্ভীর রিখিয়া নিজের হাতের নোখ দেখতে লাগল। মুখখানা কান্নার আগেকার গাম্ভীর্যে মাখা।
সোমেন খুব শান্ত গলায় বলে—হলেই বা কি! যখনই হোক রেডটা তুমি ঠিক ফেলতে পারবে।
রিখিয়া সতেজ গলায় বলে—আমার জন্য ‘রেড’ বসে থাকবে, না? আর একটা চান্স পেলেই তো আপনি ফেলে দেবেন।
সোমেন মাথা নেড়ে বলল—কোনওদিন পারিনি। আমার রেড অ্যালার্জি আছে, নার্ভাস হয়ে পড়ি।
লম্বা সোফার ওপর একটা মেয়ে শুয়ে এতক্ষণ জুনিয়র স্টেটসম্যান, ফেমিনা, ফিলম ফেয়ার আর ইলাস্ট্রেটেড উইকলি একগাদা নিয়ে ডুবেছিল। সে সোমেনকে ফিরেও দেখেনি এতক্ষণ। বোঝা যায়, ও বড় ঘরের মেয়ে। ফরসা আদুরি-আদুরি চেহারা, চোখে বিশাল ফ্রেমের চশমা, পরনে বেলবটম আর কামিজ, রিখিয়ারই বয়সি৷ ওর বন্ধুটন্ধু কেউ হবে। এবার সে মুখের সামনে থেকে পত্রিকাটা সরিয়ে বলল—অবজেকশনেবল। রেড অ্যালার্জি কথাটা ভীষণ অবজেকশনেবল।।
অবাক হয়ে সোমেন বলে-কেন?
মেয়েটা তার গোলপানা মুখটায় বিরক্তি ঘেন্নার ভাব ফুটিয়ে যেন বাতাসের গন্ধ শুঁকে বলল—স্টিনকস উইথ ব্যাড পলিটিকস। আপনি রি-অ্যাকশনারি।
সোমেন অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখছিল। উত্তর দেবে কি দেবে না, তা ঠিক করতে পারছিল না। অতটুকু মেয়ে!
রিখিয়া তার ডান হাতটা ঝাড়ছিল, আঙুলগুলো টেনে ঠিকঠাক করে নিচ্ছিল রেড ফেলার আগে। সোমেনের দিকে একপলক তাকিয়ে বলল—মধুমিতা না ভীষণ লেফটিস্ট, জানেন! ও কিছুদিন আন্ডারগ্রাউন্ডেও ছিল। অ্যাকশনও করেছে।
সোমেন মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলে—ওঃ! আজকাল সবাই দেখছি পলিটিক্স করলেই আন্ডারগ্রাউন্ডে যায়। আন্ডারগ্রাউন্ডে কী আছে?
মেয়েটা হাতের ম্যাগাজিনটা সপাট করে টেবিলে রেখে স্প্রিংয়ের গদিতে উঠে বসে। শরীরটা উত্তেজনায় দোল খায়! বুকের ওপর থেকে বেণীটা পিঠের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে— মোটেই আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলাম না, অপরাজিতা। সবাই জানে সে সময়ে আমি বাপির সঙ্গে জয়পুরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ইটস এ স্টিংকিং লাই।
সোমেন বুঝল, মেয়েটা স্টিংক কথাটা ব্যবহার করতে ভালবাসে। ও বোধ হয় ওর চারদিকে একটা পচা পৃথিবীর দুর্গন্ধ পায় সব সময়ে। এতক্ষণ মেয়েটার গোলপানা মুখ আর আদুরি চেহারার মধ্যে তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু এখন হঠাৎ তার ফরসা মুখে রাগের একটা আগুনে রং যখন ফুটে উঠে, দুটো ভ্রূ যখন দুটি নিক্ষিপ্ত তীরের মতো মুখোমুখি পরস্পরকে চুম্বন করে আছে, কপালের মাঝখানে যখন রাজটিকার মতো একটি শিরা জেগে উঠেছে তখনই তার অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্যটা ফুটে উঠল। মেয়েটা যে ঠিক ওর চেহারার মতোই নয়, তা চেহারা পালটে ফেলে বুঝতে দিল। সোমেন মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রয়োজনের চেয়ে কয়েক পলক বেশি চেয়ে রইল সে।
তখন রিখিয়া হঠাৎ গম্ভীর মুখে স্ট্রাইকারটা বোর্ডে রেখে বলে ওঠে—’রেড’ ফেলছি কিন্তু।
সোমেন চোখ সরিয়ে এনে বলে—ওঃ হ্যাঁ!
রিখিয়া গম্ভীর মুখেই বলে—ডবল ফাইন হলে কী হবে?
সোমেন বলে—দুটো সাদা গুটি উঠবে, আর রেড।
ফের স্ট্রাইকার থেকে হাত সরিয়ে রিখিয়া বলে—মোটেই না।
—তবে?
—একটা সাদা গুটি, আর রেড।
—সোমেন মাথা নাড়ে—উঁহু, দুটো সাদা আর রেড।
রিখিয়া কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে—ইস, বললেই হল! এই মধুমিতা, তুই বল তো! রেড আর স্ট্রাইকার পড়লে….
মধুমিতা আবার শুয়ে পড়েছে, একটা হাঁটুর ওপর অন্য পা নির্লজ্জভাবে তোলা, মাথার নীচে একটা হাত, অন্য হাতে ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনের আড়াল থেকেই বলল—জানি না। ক্যারম নিয়ে কে মাথা ঘামায়!
ঘরে আর কেউ নেই। রিখিয়া আর কার কাছে নালিশ করবে! নীচের ঠোঁট দাঁতে চেপে সে অসহায়ভাবে সোমেনের দিকেই তাকাল। সোমেন মৃদ্যু হেসে বলল—আচ্ছা আচ্ছা। একটা সাদা, আর রেড।
রিখিয়া হাসল না, খুশিও হল না। থমথমে মুখ। স্ট্রাইকারটা ফের সরিয়ে দিয়ে বলে— আগে কেন বললেন না!
বলেই হঠাৎ মধুমিতার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে—তুই বুঝি অ্যাকশন করিসনি! স্কুলের ক্লাসরুমে মাও সে-তুঙের টেনসিলের ছাপ দিয়েছিল কে?
মধুমিতা একবার অবহেলাভরে তাকিয়ে বলে—তাতে কি! ওটা বুঝি অ্যাকশন! তা হলে ক্যারম খেলাটাও অ্যাকশন। ফুঃ!
রিখিয়া চুপ করে থাকে একটুক্ষণ। সোমেন অপেক্ষা করে। রিখিয়া কী ভেবে হঠাৎ নিচু হয়ে স্ট্রাইকারটা বসিয়ে পাকা ফলের মতো পকেটের মুখে ঝুলে থাকা রেডকে ফেলার জন্য টোকা দিল। সোমেন অবাক হয়ে দেখল, রিখিয়া ঠিক ডবল ফাইন করেছে। পটপট করে রেড আর স্ট্রাইকার চলে গেল পকেটে।
দুঃখিত সোমেন রিখিয়ার দিকে তাকাল না। রেড আর সাদা গুটি তুলে চমৎকার একটা চাপ সাজিয়ে দিল রিখিয়াকে। স্ট্রাইকার এগিয়ে দেওয়ার সময়ে সন্তর্পণে চেয়ে দেখল, রিখিয়া হাতের পিঠে চোখের জল মুছছে।
—এই, কী হল?
—আমি খেলব না। রিখিয়া মাথা নেড়ে বলে।
—কেন?
রিখিয়া রাগ আর ফেঁপানির গলায় বলে—আপনি ডবল ফাইনের কথা বললেন কেন?
বলে রিখিয়া স্ট্রাইকার ছুঁড়ে ফেলে দিল।
সোমেন মাথা নাড়ল আপনমনে। খেলা নয়, এ তো খেলা নয়। হেরে গেছ? কে বলে ও-কথা? বিজয়িনী, তুমি বিজয়িনী। এখনও তোমার বয়স কম। ছোট্ট খুকি, নইলে এক্ষুনি আমি কী যে করতাম!
ছোট্ট সোপায় গিয়ে বসল রিখিয়া। ক্যারম খেলার আগে সে অ্যালবাম থেকে সোমেনকে ছবি দেখিয়েছিল সেইটা আবার খুলে বসল গম্ভীরভাবে।
পকেট থেকে গুটিগুলো তুলে টুকটাক করে সাজাচ্ছিল সোমেন। আড়চোখে রিখিয়া একবার চেয়ে দেখল। পৃথিবী থেকে মেয়েমানুষ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, দুঃখ করে বলেছিল ম্যাক্স। কই? এই তো শতকরা একশো ভাগ একটা মেয়ে। ভীষণ মেয়ে। মেয়েমানুষ ছাড়া আর কিছু নয়। ভাবতে ভাবতে সোমেন একটু হাসে।
রিখিয়া ছবি দেখছে। সোমেনের ছবি। একটা অন্ধ কুকুরের পিছনে চোখ বুজে হাঁটছে সোমেন, যুধিষ্ঠিরের মতো। কিংবা রাগী মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছবিগুলো দেখতে দেখতে রিখিয়া একটু হাসল। মুখ তুলে বলল—বোকা।
ছবিগুলো একটু আবছা হয়ে গেছে। ঠিকমতো ফোকাস করার সময় পায়নি। এর আগের. দিন যখন এসেছিল তখনই আবার পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে রেখেছিল। সেদিনই ক্যারমে উনত্রিশ-কুড়ি পয়েন্টে গেম খেয়েছিল সোমেন। প্রথমবার হারতে হয়।
ম্যাগাজিনটা ফেলে উঠে বসল মধুমিতা। চশমাটা বেঁকে গিয়েছিল, সোজা করে বসাল নাকে। আধুনিক ফ্যাশনের চশমা, চোখে এঁটে থাকে না, একটু নেমে আসে নাকের ওপর। শেয়াল-পণ্ডিতের মতো দেখায়। ঢিলা কামিজের তলায় বিদ্রোহী দুটি কিশোরী স্তন, কামিজটা টান হওয়ার পর ফুটে উঠল। কপালের চুল সরিয়ে মধুমিতা গম্ভীর মুখে একটু চাইল সোমেনের দিকে। দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্য। একটা হাই তুলে বলল—অপরাজিতা, ম্যাগাজিনগুলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।
—যা।
—ক’টা বাজল, সাতটা? আটটায় আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট। কবজির ঘড়িটা কানে তুলে একটু শব্দ শুনল মধুমিতা। আবার তাকাল সোমেনের দিকে। এবার চোখটা অন্য রকম। একটু যেন মেপে দেখল সোমেনকে। চোখে কোনও মায়া-মোহ বা রহস্য নেই। কেমন যেন পুরুষমানুষের মতো তাকায় মেয়েটা। বেশ লম্বা, অথচ নরম-সরম চেহারা। মুখে তেলতেলে একরকমের পেইন্ট, কপালে টিপ নেই, কানে দুল বা গলায় হার নেই, দুহাতে শুধু দুগাছা গালার চুড়ি, ডান হাতে ঘড়িটা। সব মিলিয়ে মেয়েটা নিজের অস্তিত্বকে চারধারে ছড়িয়ে দিয়েছে। রিখিয়াকে ওর পাশে অনেক লাজুক, ম্লান আর ছোট্ট লাগে।
মেয়েটা আর একটা হাই বাঁ-হাতের তিনটে আঙুলে চাপা দিল। চমৎকার আঙুল। নখগুলোর পালিশ ঝিকিয়ে উঠল। হাইটা চেপে দিয়ে বলল—আপনি কোথায় থাকেন?
সোমেন খানিকটা অবহেলার ভাব করে বলে—ঢাকুরিয়া।
মধুমিতা বলল—আমি যোধপুরে, আপনাকে একটা লিফট দিতে পারি। যাবেন। রিখিয়া ভ্রূ কুঁচকে অ্যালবামের দিকে চেয়ে আছে, সেখানে সোমেনের আবছা ছবি।
মধুমিতা উঠে বলল—আপনার রেড অ্যালার্জিটা সারানো দরকার।
সোমেন হেসে বলল—আমার অ্যালার্জিটা পলিটিক্যাল নয়।
—নয়? বলে একটু অবাক হওয়ার ভাব করল মধুমিতা। তারপরই হাসল। এই প্রথম ওর হাসি দেখল সোমেন। কি পরিষ্কার দাঁত, কেমন ভরপুর হাসি। তবু হাসিটাও ঠিক মেয়েমানুষের মতো নয়। পুরুষঘেঁষা। বলল—আপনার কালার কী?
সোমেন চোখটা সরিয়ে নিয়ে তার নিজস্ব ভুবনজয়ী হাসিটা হেসে বলল—হোয়াইট, এ কালার অফ সারেন্ডার।
॥ সাতচল্লিশ ॥
—সারেন্ডার! শুনে চোখ দুখানা ফের গোল করে একবার রিখিয়ার দিকে তাকাল, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল আবার সোমেনের মুখে। যেন কিছু একটা টের পেল এই মাত্র, সোমেন আর রিখিয়ার মধ্যবর্তী শূন্যতায়।
বোগেনভেলিয়ার লালচে পাপড়িগুলি অবিরল ঝরে পড়ছে নীচের চাতালে, একটা ইউক্যালিপটাসের চারাগাছ উঁকি মারছে জানালা দিয়ে, সারা গায়ের বাকল খসছে। রিখিয়াদের ছোট্ট বাগানের এই সব দৃশ্য একটু দেখল সোমেন।
মধুমিতা ম্যাগাজিনের একটা গোছা হাতে তুলে নিয়ে বলল—আপনি খুব সহজেই সারেন্ডার করেন, না?
সোমেন মুখ ফেরাল। রিখিয়া সেই রকমভাবেই মাথা নত করে বসে। কোলে খোলা অ্যালবাম। সোমেন মুখ টিপে হেসে বলল—করি।
মধুমিতা অখুশি হল বোধ হয় কথাটা শুনে। বলল—মোটেই ভাল নয় ওরকম। চলুন।
সোমেন রিখিয়ার নতমুখের দিকে চেয়ে একটু হালকা গলায় বলে—হবে নাকি আর এক গেম?
রিখিয়া মুখ না তুলেই মাথা নাড়ল। খেলবে না।
একটু ইতস্তত করে সোমেন। এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার জন্য সে আসেনি। কিন্তু রিখিয়া থাকতে না বললে থাকে কী করে?
মধুমিতা ঘাড়টা একবার তুলেই ছেড়ে দিয়ে বলল—ক্যারাম আবার একটা খেলা। খুটখাট গুটি ফেলা দুচোক্ষে দেখতে পারি না। খেলা হল বাস্কেট।
একটা চাপা ঝগড়া পাকিয়ে উঠছে, সোমেন বাতাসে বারুদের গন্ধ পায়।
রিখিয়া মুখ তুলল। চোখে তীব্র চাউনি। বলল—আহা, ক্যারাম খেলা নয়, না। তোর তো সব ছেলেদের খেলা ভাল লাগে।
—লাগেই তো! অ্যাটাক, কাউন্টার অ্যাটাক আর অ্যাগ্রেসিভনেস না থাকলে আবার খেলা কী! আই লাইক ম্যাসকুলিন গেমস।
রিখিয়া রেগে গিয়েছিল, কিন্তু তেমন স্মার্ট কথাবার্তা বোধ হয় ওর আসে না, রিফ্লেক্স কিছু কম, কেবল বলল—হ্যাঁ তোকে বলেছে!
মধুমিতা তার পাম্প-শু-র মতো দেখতে জুতোর একপাটি খুলে বোধ হয় একটা কাঁকর ঝেড়ে ফেলল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল—আমি সোমেনবাবুকে নিয়ে যাচ্ছি। ফর কম্প্যানি।
এটা জিজ্ঞাসা নয়, সিদ্ধান্ত। সোমেন অসহায়ভাবে একবার রিখিয়ার দিকে তাকাল। ও কি একবারও মুখ ফুটে সোমেনকে আর একটু থাকতে বলবে না! না বললে, সোমেন তেমন নির্লজ্জ নয় যে থাকবে।
মধুমিতা তার গোলগাল চশমার ভিতর দিয়ে গোল চোখ করে চেয়ে আছে। মুখখানাও গোল। সোমেন টেনশন টের পেল। তাকে নিয়ে একটু দড়ি টানাটানি চলছে। দড়িটা টেনেই নিয়েছে মধুমিতা। সোমেন ঘাড় নেড়ে বলে—চলুন।
বলে রিখিয়ার দিকে একপলক চাইল সোমেন, চাপা গলায় বলল—আজ তা হলে যাই রিখিয়া।
রিখিয়া উত্তর দিল না।
মধুমিতা বলল—অপরাজিতা ভীষণ সেন্টিমেন্টাল। একটুতেই ওর গাল ভারী হয়। ইস্কুলে সবাই ওকে তাই খ্যাপাই।
বলে হাসল মধুমিতা। চোখ ঠারল সোমেনকে। অর্থাৎ ইচ্ছে করে রিখিয়াকে রাগাতে চায়। চোখ ঠেরে সোমেনের সঙ্গে একটা সন্ধি করে নিল।
সোমেন একটু হাসল বটে, কিন্তু এ খেলায় সে নেই। ওই নতমুখী, একটু আনস্মার্ট মেয়েটিকে কেউ খ্যাপায় এটা সে চায় না। ইস্কুলে ওর বন্ধুরা ওকে খ্যাপায় জেনে মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। কেন, ওরা রিখিয়াকে খ্যাপাবে কেন?
মধুমিতা দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বলল—একটুতেই কেঁদে ফেলে অপরাজিতা। গতবার ডিবেটে ওর উলটোদিকের ডিবেটারদের মধ্যে কে যেন বলেছিল অপরাজিতা একটা ভুল কোটেশন দিয়েছে। সেটাকে ও পারসোনাল অ্যাটাক মনে করে…বলে মধুমিতা কোমরে হাত দিয়ে মুখ ছাদের দিকে তুলে ঠিক পুরুষ ছেলের মতো হাসল, তারপর মুখে হাতচাপা দিয়ে বলল—কেঁদে ভাসিয়েছিল।
বিপদের গন্ধ পাচ্ছিল সোমেন। মধুমিতা নিশ্চয়ই খুব শক্ত প্রতিপক্ষ, বোধ হয় ভাল ডিবেট করে, রিখিয়াকে ইচ্ছা করলেই ও নাস্তানাবুদ করতে পারে। রিখিয়া পলকা মেয়ে। যদি রেগে যায় তা হলে হয়তো এখন এমন কিছু বলে ফেলবে যা মেয়েমানুষি রাগে ভরা। হয়তো নিতান্তই ছেলেমানুষি কিছু বলে ফেলতে পারে। তা হলে মধুমিতা ওকে আরও অপমান করবে। তাই মনে মনে সোমেন টেলিপ্যাথি পাঠাতে লাগল রিখিয়াকে—রেগো না রিখিয়া, মাথা স্থির রাখো। দোহাই প্লিজ, আমার সামনে যেন ও তোমাকে অপমান না করতে পারে। ওকে সুযোগ দিয়ো না।
আশ্চর্য এই রিখিয়াকে সেই তরঙ্গ স্পর্শ করল বোধ হয়। টেলিপ্যাথির বার্তা পৌঁছল নাকি!
রিখিয়া মধুমিতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তার অভিমানী মুখখানা তুলে সোমেনকে বলল—মাকে দেখে গেলেন না তো? মা কত আপনার কথা বলে!
এই তো! এরকমই কিছু শুনতে চাইছিল সোমেন। মধুমিতার কাছ থেকে তাকে কেড়ে রেখে দিক রিখিয়া। মধুমিতার হাতের দড়ি ঢিলে হয়ে গেল, রিখিয়া টানছে।
সোমেন গম্ভীর মুখে বলল—ওঃ তাই তো। একদম ভুলে গিয়েছিলাম।।
বলে একটু অসহায় মুখ করে তাকাল মধুমিতার দিকে।
মধুমিতা তার কবজির ঘড়িটা দেখল, মুখটায় সামান্য বিরক্তির ভাব করে বলল—আই ক্যান গিভ ইউ টেন মিনিটস।
রিখিয়া হঠাৎ ঝামরে উঠে বলে—তোর তাড়া থাকলে তুই যা না। ও পরে যাবে।
ও! সোমেনের হঠাৎ আন্তরিকভাবে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে, ‘ও’ সর্বনামটি বোধ হয় সবচেয়ে রোমাঞ্চকর। বিদ্যুৎবাহী।
মধুমিতা আর একবার কাঁধ ঝাঁকাল। সোফায় আবার ধপ করে বসে পড়ে বলল—না, আমি সোমেনবাবুর জন্য ওয়েট করব। বলে সোমেনের দিকে চেয়ে আর একবার চোখ ঠারল, মধুমিতা চাপা হাসি হেসে বলল—ডোন্ট মেক মি ওয়েট ফর এভার দেখা করে আসুন। একসঙ্গে যাব।
শৈলীমাসির ঘরের পরদাটা পার হয়েই রিখিয়া চাপা রাগের গলায় বলল—ভীষণ পুরুষচাটা মেয়ে। একদম পাত্তা দেবেন না।
সোমেনের হৃদয়ের স্তব্ধতার ভিতরে যেন এইমাত্র বোঁটা খসে একটা ফুল এসে পড়ল। সোমেন তার হৃদয়ের মধ্যেই কুড়িয়ে নিল সেই ফুল, সুঘ্রাণে ভরে গেল ভিতরটা।
বলল—পাত্তা! না, না, তাই কি হয়……
আসলে কথা হারিয়ে যাচ্ছিল সোমেনের। কত মেয়ের সঙ্গে কত অনায়াসে মিশেছে সোমেন, তবু এই একটা মেয়ের কাছে এখন কথা হারিয়ে যাচ্ছিল।
শৈলীমাসি বই রেখে আধশোয়া হলেন। পিঠের নীচে বালিশের ঠেকনো দিয়ে দিল রিখিয়া। তারপর খাটের মাথার দিকে চুপ করে দাঁড়িয়ে একটু করুণ চোখে চেয়ে রইল। সোমেনের দিকে। ভারী অন্যরকম লাগছিল ওকে। বড়লোকের মেয়ে দামি ক্যামেরায় ছবি তোলে, গাড়ি চালায়, কত কী করে, তবু যেন ও সে নয়। যেন বা দুর্বল, সহানুভূতি পেতে ও ভালবাসে, কেউ ওকে দেখে ‘আহা’ বললে বুঝি খুশি হয়।
শৈলীমাসি উঠে বসে বললেন—ও ঘরে ক্যারম খেলা হচ্ছিল। খবর পেয়েছি। তখন থেকে অপেক্ষা করে আছি। ননীর ছেলে কখন এ ঘরে আসবে, দুটো কথা বলে বাঁচব। এতক্ষণে এলে?
সোমেনের বড় লজ্জা করছিল, আর একটু হলেই সে চলে যাচ্ছিল মধুমিতার সঙ্গে। শৈলীমাসির অপেক্ষা শেষ হত না।
চওড়া জানালাগুলো আজ খোলা রয়েছে। এয়ারকুলার বন্ধ। শৈলীমাসি বাইরের আবছা অন্ধকারে একটু গুলঞ্চ গাছের ডালপালার দিকে চেয়ে থেকে বললেন—মানুষের সঙ্গে যে কত কথা বলতে ইচ্ছে করে! যেতে তো পারি না, তাই যে দু-চারজন আসে তাদের সঙ্গে সাধ মিটিয়ে বলে নিই, তুমি কিন্তু বড় মুখচোরা ছেলে, একটুও কথা বলো না। তোমাদের কত কথা জানতে ইচ্ছে করে।
সোমেন তার স্বভাবসিদ্ধ সুন্দর হাসিটা হাসে। উত্তর দেয় না। শৈলীমাসির মাথার পিছনে রিখিয়া দাঁড়িয়া আছে। দেখছে।
শৈলীমাসি মুখ না ফিরিয়েই বোধ হয় টের পেলেন যে রিখিয়া তাঁর মাথার পিছনে দাঁড়িয়ে। তাই মাথাটা পিছনে একটু হেলিয়ে হাতটা একবার পিছনপানে বাড়িয়ে বললেন—এই মেয়েটা আমার, এও কথা বলার সময় পায় না আজকাল।
রিখিয়া বলল—উঃ, রোজ কত কথা বলি।
শৈলীমাসি স্নিগ্ধ হেসে মুখ ফিরিয়ে মেয়েকে দেখলেন। সোমেনের দিকে চেয়ে বললেন—আগে ওর যত কথা ছিল আমার সঙ্গে। কোনও কথা গোপন করত না। সব বলত, বন্ধুবান্ধবদের কথা, স্কুলের কথা, পাড়ার দুষ্ট ছেলেদের কথাও। সব বলে দিত।
—এখন বুঝি বলি না। রিখিয়া চাপা গলায় বলে।
—কম বলিস। বলে শৈলীমাসি গেলাস তুলে একঢোক জল খেলেন। সোমেনকে বললেন—তোমার সম্বন্ধে কি বলেছে জানো?
রিখিয়া হঠাৎ বিড়বিড়িয়ে উঠে বলে—উঃ মাঃ বোলো না, বোলো না। তুমি ভীষণ খারাপ।
বলেই পিছন থেকে হাত চাপা দিল মায়ের মুখে। শৈলীমাসি হাতটা আস্তে করে সরিয়ে দিয়ে স্মিতমুখে বলেন—বলব না। সোমেনের দিকে চেয়ে বললেন—তুমি বাবা, শুনতে চেয়ো না। ও লজ্জা পায়।
সোমেন তটস্থ হয়ে বলে—নিন্দে নয় তো!
রিখিয়া বলে—নিন্দে তো নিন্দে।
—না, নিন্দে নয়। শৈলীমাসি বলেন—ওকে খেতে দিয়েছিস রিখি?
—না।
—দে।
সোমেন আপত্তি করে বলে—না, কিছু খাব না, রোজই খেতে হবে নাকি!
—একটু খাও। বলেন শৈলীমাসি। বড় সুন্দর শান্তস্বরে বলেন। স্বরটা মিনতিতে ভরা। আবার বলান—তুমি খাওয়ার ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে, না?
সোমেন হেসে বলে—একটু।
—তাই শরীরটা সারেনি। খাওয়ায় খুঁতখুঁতে হলে শরীর ভাল হয় না। আমার ছেলেটারও ওরকম ছিল। কালো মাছ খাবে না, আঁশ ছাড়া মাছ খাবে না, সবজি খাবে না, খাসির মাংস খাবে না, নেমন্তন্ন বাড়িতে গেলে ভারী মুশকিল ছিল ওকে নিয়ে। রোগা, রাগী আর অহংকারী ছিল খুব। তা এখন শুনি বিদেশে সব খায়।
বলতে বলতে একটা কান্নার মেঘ করে এল বুঝি ভিতরে। সেটা চাপা দেওয়ার জন্যই বললেন—বগুড়া স্টেশনের কাছে মুটে মজুররা কদমগাছের তলায় বসে ছাতু মেখে খেত। একটা প্রকাণ্ড ছাতুর দলা পেতলের কানা-উঁচু থালায়, শালপাতায় একটু চাটনি, ঘটিভর জল। কী তৃপ্তি করে যে খেত কাঁচা লঙ্কার কামড় দিয়ে। সেই সস্তাগণ্ডার দিনেও ওই সব খেত, আমরা দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখতুম। সেই খাওয়া দেখার মধ্যেই একটা ভীষণ সুখ ছিল। একবার একটা সাঁওতালকে দেখেছিলুম জুতোর বাক্সের ঢাকনায় একটা মাঝারি বড় আলুসেদ্ধ তেল ছাড়া কেবল নুন আর মরিচ দিয়ে খুব যত্ন করে মাখছে, পাশে জুতোর বাক্সে একবাক্স ভাত। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম সেই সাঁওতালটা ওই অনেক ভাত একটুখানি আলুসেদ্ধর টাকনা দিয়ে টাউ টাউ করে খেয়ে নিল। ঠান্ডা জল খেল পুকুর থেকে। ব্যস তৃপ্তি। ফের কাজে লেগে গেল। কী স্বাস্থ্য! আমরা গরিবের দুঃখের কথা ভেবে কত চেঁচামেচি করি বাবা, কিন্তু সে সব বুঝি মনগড়া কথা! ও খাওয়া দেখলেই বোঝা যায় কী সতেজ সুখী মানুষ সব। নিজেদের দুঃখের ধারণা ওদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে দুঃখী ভাবলে কী হবে, আমাদের চেয়ে ঢের সুখী ওরা। বলে আবার একটু চুপ করে থাকেন শৈলীমাসি, ফের বলেন—আমি চাকর দারোয়ানদের মাঝে মাঝে সামনে বসে খেতে বলি, দেখব। তা তারা সব আমার সামনে লজ্জা পায়, ভাল করে খায় না। খুব ইচ্ছে করে রাস্তায় ঘাটে, স্টেশনে ঘুরে ঘুরে ওই সব মুটে মজুরদের খাওয়া দেখি। কত তুচ্ছ জিনিস কী যত্ন করে খায়। ফেলে না, ছড়ায় না, শেষ দানাটি পর্যন্ত খুঁটে খায়। কিন্তু যেতে তো পারি না। জেলখানায় আটকে আছি।
সোমেনের কিছু করুণার উদ্রেক হয়েছিল। বলল—কী অসুখ শৈলীমাসি?
—সে বলার নয়। মেয়েমানুষ হচ্ছে রোগের আধার। যখন বিয়ের সময় হবে তখন খুব দেখে বুঝে বিয়ে করো। বাঙালি মেয়েরা বড্ড রোগা রোগা। বলে নিজের ঠাট্টায় একটু হাসলেন। বললেন—অসুখ কখন হয় জানো। যখন মনের মধ্যে অসুখের ভাবটা আসে তখনই শরীরে অসুখ ভর করে। মনটা পরিষ্কার থাকলে, অসুখের ভাবনা না ভাবলে বড় একটা অসুখ হয় না। আমি সারাদিন রোগের ভাবনা ভেবে রোগ ডেকে এনেছি। এই শরীরটুকুর ওপর পাঁচবার ছুরি কাঁচি চালিয়েছে। কতক রোগ ধরা পড়েছে, কতক পড়েনি। আমি ভুগি সেই সব আর্নট্রেইসেবল ডিজিজে। রোগবন্দি। মেয়েমানুষ খাড়া না থাকলে সংসার ভেসে যায়। আমারটাও গেছে।
সোমেন কথা খুঁজে পায় না। উৎসারিত ওই বেদনা তাকে স্পর্শ করে না ঠিকই, কিন্ত অপ্রতিভ করে দেয়। হয়তো দু-চারটে সাত্ত্বনার কথা আছে যা খুঁজে পায় না সে। নিস্তব্ধ ঘরে সে যেন অস্পষট টের পায় শৈলীমাসির অস্তিত্ব থেকে বায়ুবাহী বিষন্নতার জীবাণুরা তার দিকে এগিয়ে আসছে। ছেকে ধরেছে তাকে। একটা শ্বাসরোধকারী প্রতিক্রিয়া হতে থাকে তার মধ্যে। এইরকম অবিরল বিছানায় পড়ে থাকা কী ভয়ংকর, কী মারাত্মক, যখন বাইরে অসীম আকাশের প্রসার, শহর-বন্দর-মাঠ-ঘাটে বিস্তৃত জীবন, তখন এ কেমন কয়েদ? শৈলীমাসির অস্তিত্ব যেন তাকে অস্থির করে তোলে।
উনি বললেন—ছেলেটার রাশ ধরতে পারলাম না, রোগা মাকে ছেড়ে পালিয়ে গেল। রোগের বাড়িতে আর ফিরে আসবে না। আর মেয়েটা এ লোনলি চায়ল্ড, ছেলেবেলা থেকে সঙ্গীসাথী নেই, মা রোগে পড়ে থাকে, বাবা ব্যস্ত। বড় একা। আপনমনে বড় হয়েছে মেয়েটা। কঁদত না, কাঁদলে কে থামাবে। হাসতও না তেমন, হাসবার মতো কিছু তো দেখত না। তাই মেলাংকলিক, অভিমানী। একটু বড় হয়ে যখন স্কুলে যায় তখনও ওর একাচোরা স্বভাব। তাই কারও সঙ্গে সহজে মিশতে পারত না। আজও ওর তেমন কোনও বন্ধু নেই। তাই আপনমনে ক্যামেরায় ছবি তোলে, গান গায়, গাড়ি চালানো শেখে, কিন্তু লোনলি, অসম্ভব একা। আমি তো মা, তাই বুঝি!
সোমেন মাথা নাড়ল। হঠাৎ বলল—আপনাল ইংরেজি উচ্চারণগুলি কী সুন্দর। কোথায় শিখলেন?
মুখের বিষন্নতা, লেবুর রস ফেললে যেমন গরম দুধ ছানা কেটে যায়, তেমনি কেটে গেল। হাসলেন, বললেন—বগুড়ায় ইংরেজি মিডিয়ামে বাড়িতে পড়তাম। বাড়িতে মেমসাহেব রেখে শিখিয়েছিলেন বাবা। তার কাছে শিখেছি। এখনকার সব ইংলিশ মিডিয়ামে যেমন নামকোবাস্তে ইংরেজি শেখায় তখন তেমন ছিল না। খাঁটি সাহেব মেমসাহেবরা খাঁটি ইংরেজি শেখাত।
শৈলীমাসির এই তৃপ্তিটুকু থাকতে থাকতেই সোমেন বেরিয়ে আসতে পারল সেদিন। রিখিয়া এসে ডাকল। পাশের আর একটা ঘরে রিখিয়ার মুখোমুখি বসে অনেক খেল সোমেন। রিখিয়া একটু গম্ভীর। সোমেনও তেমন কথা বলতে পারল না। যখন উঠল তখন মনে এক হর্ষ ও বিষাদ।
পরদার ওপাশে মধুমিতা বসে আছে এখনও। ও ঘরে পা দেওয়ার আগে রিখিয়া বলল—আবার আসবেন।
ঘরে পা দিতেই হাতের পত্রিকাটা ফেলে উঠে দাঁড়াল মূর্তিমতী উইমেনস লিব। মধুমিতা ঘড়ি দেখে বলল—দ্যাট ওয়াজ ওয়েটিং ফর গোডো।
॥ আটচল্লিশ ॥
বাইরে মেঘধ্বনি। পরদাটা ওড়ে হঠাৎ হাওয়ায়। উড়ে আসে খড়কুটো, ধুলো, গাছের পাতা, বোগেনভেলিয়ার পাপড়ি, বাতাসে ঠান্ডা জলগন্ধ। বৃষ্টির প্রথম একটা দুটি ফোঁটা গাছের পাতায় পড়ে। একটা আহত নীল বাঘ ঝাপিয়ে পড়ে মাটিতে, তীব্র গর্জনে কেঁপে ওঠে ঘরের মেঝে।
নীল আলোটা ঝলসাতেই কানে আঙুল দিয়েছিল রিখিয়া। চোখে ভয়।
মধুমিতার ভয় নেই। ব্যাগ খুলে সে মাথা ধরার বড়ির স্ট্রিপ থেকে একটা বড়ি ছিঁড়ে নিল। শুকনো বড়িটা মুখে ফেলে গিলে ফেলল। জল ছাড়াই। ভ্রূটা একটু কেঁচকানো।
বৃষ্টি এল। রিখিয়া কান থেকে হাত নামিয়ে বলে। মুখে একটু হাসি। সোমেনের দিকেই চেয়েছিল, বলল—যাওয়া হবে না।
মধুমিতার নিশ্চয়ই মাথা ধরার রোগ আছে। ডান হাতের বুড়ো আর মাঝের আঙুলে কপালের দুধার টিপে ধরে থেকে বলল-বৃষ্টি তো কী?
—কেমন ঝোড়ো বাতাস! রিখিয়া কুণ্ঠিতভাবে বলে।
জানালা দরজা তাড়াতাড়ি বন্ধ করছে চাকরেরা। দুর্যোগের আভাস পেয়ে কোথা থেকে কুকুরটা একবার ডাকল, সঙ্গে শেকলের ঠুন ঠুন শব্দ। আজ কুকুরটাকে বেঁধে রেখেছে। খর বৃষ্টির শব্দ উঠল চারধারে, ভাষাহীন কোলাহল। হামাল বাতাস বন্ধ কপাট নাড়া দিচ্ছে মুহুর্মুহু। আকাশের নীল বাঘেরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে মাটিতে।
মধুমিতা ঠোঁটটা একটু রাগের ভঙ্গিতে টিপে বলল—ব্রিজের নীচে ঠিক জল জমে যাবে। গাড়ি আটকে গেলে মুশকিল।
বলে সোমেনের দিকে তাকাল, কোমরে হাত রেখে একটু তেরছা চেয়ে বলল—আপনার জন্যই তো। যা দেরি করালেন!
সোমেন সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল—তোমার খুব মাথা ধরে?
মধুমিতা একটু অসহায়ের মতো বলল—খুব। যখন শুরু হয় তখন পাগল পাগল হয়ে যাই ব্যথায়। মুঠো মুঠো ট্যাবলেট খেতে হয়।
—তাই দেখছি। জল ছাড়া ট্যাবলেট খাও কী করে?
—সব সময়ে খাই তো, অভ্যেস হয়ে গেছে। রাস্তায় ঘাটে হরঘড়ি জল তো পাওয়া যায় না।
—এত ট্যাবলেট খাওয়া ভাল নয়।
মধুমিতা ধৈর্যহীন গলায় বলে—সবাই ওকথা বলে। কিন্তু ট্যাবলেট ছাড়া ব্যথা কী করে সারে তা কেউ বলতে পারে না। ডাক্তাররাও বলে—ট্যাবলেট খেয়ো না।
বলে যেন এক অসহায় তীব্র রাগে সোমেনের দিকে চেয়ে রইল। দাঁতে ঠোঁট টিপে বলল—কতবার মাথা এক্সরে করেছে ডাক্তাররা, রোগ পরীক্ষা করেছে। রোগ ধরতে পারে না। সামনের মাসে ভেলোরে যাচ্ছি।
—কেন?
তেমনি এক অসহায় রাগে, এবং বুঝি একটু অভিমানে বলল—ডাক্তাররা সন্দেহ করছে, ব্রেনে টিউমার, অপারেশন হবে। ভেলোরে ছাড়া ওসব অপারেশন হয় না।
বলে একটু হাসল। বড় করুণ হাসিটি। ওই গোল চশমা, ছটফটে ভাব, স্মার্ট পোশাক সব ভেদ করে একটা ব্যথা-বেদনা ফুটে উঠল। বলল-শক্ত অপারেশন। বাঁচে না। আজকাল মা আর বাপি আমাকে খুব আদর করে জানেন! বাঁচব না তো!
সোমেনের মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। এক পরদা মেঘ ঢেকে দিল মনটাকে। বলল— কে বলল বাঁচবে না? এটা বিজ্ঞানের যুগ, অত সহজে লোকে মরে না।
সান্ত্বনাটুকুর কোনও দরকার মধুমিতার নেই, এ-ওরদিকে চেয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এ বয়সে মৃত্যুর ভয় বড় একটা থাকে না, ‘মরে যাব’ একথা ভাবতে একরকমের রোমহর্ষময় রহস্য জেগে ওঠে। সকলের করুণা, চোখের জল, শোক—এই সব পেতে ইচ্ছে করে, চারদিকের ওপর ঘনিয়ে ওঠে অভিমান। সোমেন জানে।
—এখন কে বেশি সেন্টিমেন্টাল শুনি। বলে রিখিয়া সোমেনের দিকে তাকায়—সব বোগাস, জানেন। আমারও কত মাথা ধরে।
মধুমিতা কারও কথারই উত্তর দিল না। গোল চশমার ভিতর দিয়ে চেয়ে রইল ক্যারামবোর্ডে সাজানো ঘুটিগুলোর দিকে। ঠোঁটে থমকানো হাসি লেগে আছে।
হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে রিখিয়ার দিকে চেয়ে বলল—অপরাজিতা, আমি বাড়িতে একটা ফোন করব।
—আয়।
—এক মিনিট। আসছি। বলে একটা চাউনি সোমেনের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। মধুমিতা।
আরও জোর বাতাস এল। চারধারে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, লোহার বিম, কাচের শার্শি সব ভেঙে পড়ছে বৃষ্টিতে, কলকাতার সাজগোজ ধুয়ে গেল। অজ পাড়াগাঁর মতো অসহায়ভাবে কলকাতা ভিজছে।
একাকী সিঁড়ির মুখে দাড়িয়ে আছে রিখিয়া। দেখছে, মধুমিতা নিয়ে গেল সোমেনকে।
মধুমিতা সোমেনকে নিয়ে যাচ্ছে, ঠিক এইভাবেই কি দৃশ্যটা দেখল রিখিয়া? সোমেন তা জানে না। তবু আর একবার টেলিপ্যাথি পাঠাল—আমি তো নিজের ইচ্ছেয় যাচ্ছি না, তুমি তো জানো।
সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে একবার ঘাড় ঘোরাল সোমেন। রিখিয়া তাকিয়ে আছে। কী করুণ চোখ! অন্ধ কুকুরটা ওর গা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে, মুখটা ওপরে তোলা কি যেন গভীরভাবে বুঝবার চেষ্টা করছে, একটা গোঙানির শব্দ করল।
দেখে পা ফেলেনি সোমেন। শেষ ধাপে পা’টা ঘুরে পড়ল। আচমকা একটা ঝাঁকুনি খেল সোমেন।
তক্ষুনি হেসে ফেলল রিখিয়া, বলল—বেশ হয়েছে।
সোমেন ঠোঁট উলটে একটা অগ্রাহ্যের ভঙ্গি করে। একটু হাসে।
রিখিয়া রেলিং থেকে ঝুঁকে বলে—আপনার ফটোগুলো নিয়ে গেলেন না?
সোমেন ফটোগুলো ইচ্ছে করে নেয়নি, সব শোধবোধ হয়ে যাওয়া কি ভাল? কিছু থাক। তাই হেসে বলল—আর একদিন নিয়ে যাব।
—ফটোগুলো ভাল হয়নি, না? তাই নিলেন না। রিখিয়ার যে কতরকম কমপ্লেকস, মুখখানায় ফের অন্ধকার ঘনিয়ে এল।
সোমেন সিঁড়ির গোড়া থেকে মুখ তুলে বলে—ভাল হয়নি, কে বলল? আমি যেমন, ঠিক তেমনি হয়েছে। আবার আসব তো, তখন নিয়ে যাব।
রিখিয়া একটু হাসল, অন্ধকার মুখে সেই হাসিটুকু জোনাকির মতো একটু আলো ছড়িয়ে দিল।
ওই হাসিটুকু বুকের মধ্যে পদ্মপত্রে জলবৎ টলটল করছিল।
খোলা গেট দিয়ে মধুমিতার ছোট্ট গাড়িখানা ব্যাক করে এল গাড়িবারান্দার তলায়। বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গেছে গাড়িটা। হেডলাইটের আলোয় অজস্র কাজের নলের মতো বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে দেখা যায়, পিছনের দরজাটা ভিতর থেকেই খুলে দিল ড্রাইভার। একদৌড়ে মধুমিতা ঢুকে গেল, পিছনে সোমেন।
মধুমিতা তার চশমার কাচ কামিজের কোনা দিয়ে মুছতে মুছতে বলল—এ গাড়িটা বাপি আমাকে অলমোস্ট দিয়ে দিয়েছে। যেখানে খুশি যাই, কেউ কিছু বলে না। কেন জানেন? ওই অসুখটার জন্য। অসুখবিসুখ হলে খুব ইম্পর্ট্যান্স পাওয়া যায়।
বলে হাসল, কয়েকটা গোল চাকতির মততা, আর গোটা দুই ছোট পাশবালিশের মতো গদি পড়েছিল সিটের ওপর। তার দুটো সোমেনের কোলের ওপর ফেলে দিয়ে মধুমিতা বলল—রিল্যাক্স প্লিজ। সিগারেটও খেতে পারেন।
মধুমিতা দুটো বালিশ তলপেটে চেপে ধরে কুঁজো হয়ে বসল। মুখখানা হাতের তেলোয় রেখে পাশ ফিরিয়ে চেয়ে রইল সোমেনের মুখের দিকে। গাড়ির ভিতরে অন্ধকার, কাজ বন্ধ বলে ভ্যাপসা গরম। কাচের গায়ে ভাপ লেগে আবছা। সেই আবছা কাচ দিয়ে বাইরে একটা ভূতুড়ে শহরের অস্পষ্ট আলো-আঁধার দেখা যায়।
সোমেন বালিশ দুটো ফেলে রেখে কনুইয়ের ভর দিয়ে বসল। যথেষ্ট আরামপ্রদ গাড়ি, গভীর বসবার গদি। তবু আবার বালিশের কী দরকার তা বোঝা মুশকিল। বড়লোকদের কত বায়নাক্কা থাকে। গাড়ির পিছনের আর সামনের কাছে ছোট ছোট পুতুল সুতোয় বাঁধা হয়ে ঝুলছে। টেডিবিয়ার, মিকিমাউস, জাপানি মহিলা, ব্যালেরিনা।
—এইমাত্র বাপিকে ফোন করলাম তো! মধুমিতা বলল—বাপি একটুও রাগ করল না, খুব অ্যাংশাস। অসুখ না হলে কিন্তু দেরি হওয়ার জন্য রাগ করত।
—তোমার অসুখ কবে থেকে?
—একবছর, আগে অল্প অল্প মাথা ধরত। পরে সেটা খুব বেড়ে গেল।
—ব্রেন টিউমার, ঠিক বলছ?
—কী জানি! ওসব থাক। আপনি আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করবেন?
সোমেন অবাক হয়ে বলে—কেন, কোনও দরকার আছে?
মধুমিতা মাথা নেড়ে বলে—না, লোকজনের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে ইচ্ছে করে। আমার অনেক পেন-ফ্রেন্ড আছে, আবার অনেক টেলিফোন ফ্রেন্ডও আছে। টেলিফোন গাইড খুঁজে যে নামটা ভাল লাগে তাকে ফোন করি। এভাবে আমার অনেক বন্ধু জুটে গেছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বয়সে আমার অনেক বড়। কিন্তু তারা ঠিক ফ্রেন্ডশিপ রাখে। মাঝে মাঝে ফোন করে। অনেকে বাড়িতে আসে, প্রেজেন্টেশন বা বোকে দিয়ে যায়।
—তোমার তো এমনিতেই অনেক বন্ধু।
—আমি আরও বন্ধু চাই। অনেক বন্ধু। করবেন তো ফোন?
বলে হাসল মধুমিতা।
—করব।
মধুমিতা খুব খুশি হল। হঠাৎ একটা হাত বাড়িয়ে সোমেনের পড়ে-থাকা হাতটা চেপে ধরে বলল—কমরেড।।
হাতটা ছাড়ল না। নিবিড় আঙুলগুলি জড়িয়ে ধরে রইল। সামনের ড্রাইভার নিবিষ্ট হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। কেউ দেখছে না। তবু একটু শিউরে উঠল সোমেন।
মধুমিতা যুবতী নয়। এখন কৈশোরকাল। শরীরের চেতনাগুলি এখনও লাজুক থাকে। মনে থাকে ভয় ও কুণ্ঠা। এখনকার মেয়েরা কিছু বেশি প্রগলভ। তবু প্রথম চেনায় এতটা করে না। মধুমিতার যে ভয় বা লজ্জা নেই তা বুঝি ওই অসুখের জন্য। এখন ওর লজ্জা করার মতো সময় নেই। এখন ওকে তাড়াতাড়ি সম্পর্ক তৈরি করে নিতে হয়। কিংবা এও হতে পারে যে, স্বভাব পুরুষের মতো, মেয়েদের স্বাভাবিক লজ্জাবোধ ওর নেই।
আঙুলগুলি, হাতের উষ্ণ প্রসারটি সোমেন টের পেল না। তার মনে হল, হাতটা বড় শীতল। মৃত্যুর হিম লেগে আছে। সেই শীতলতা গ্রাস করে নিচ্ছে শরীর। শৈলীমাসির ঘরে যেমনটা হয়েছিল এখনও সেরকমটা হচ্ছিল তার। যেন মধুমিতার শরীর থেকে মৃত্যুর জীবাণু সংক্রামিত হচ্ছে তার স্বাসের বাতাসে। এগিয়ে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে। অধিকার করে নিচ্ছে তাকে। সে একটা অস্ফুট শ্বাসকষ্টজনিত শব্দ করল। বলল—জানালাটা খুলে দিই?
মধুমিতা বলল—ওমা! বৃষ্টি আসবে না!
তাই তো! অঝোর বৃষ্টি, সামনের উইন্ডস্ক্রিনে ক্রমান্বয়ে পাক খেয়ে খেয়ে জলস্রোত মুছে ফেলতে পারছে না ওয়াইপার। কাচের ভিতর দিয়ে এক ভঙ্গুর, বিমূর্ত শিল্পের মতো শহরকে দেখা যায়। তবু জানালাটা খোলা দরকার। কিছু পরিষ্কার বাতাসের একটু স্বাস বড় প্রয়োজন সোমেনের।
—আপনি খুব ঘামছেন। এই বলে মধুমিতা খুট করে সুইচ টিপতেই একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের খেলনা ফ্যান বোঁ বোঁ করে ঘুরে বাতাস দিতে লাগল। ও মুখখানা আবার সোমেনের দিকে ঘুরিয়ে চেয়ে থেকে বলল—অপরাজিতা বড্ড গুডি-গুডি। পৃথিবীর কোনও খবর রাখে না।
সোমেন একটু হাসে। উত্তর দেয় না।
মধুমিতা ফের বলে—আমি কিন্তু ওরকমই নই। আই লিভ আপ টু দি টুয়েন্টিয়েথ, সেঞ্চুরি। অপরাজিতার সঙ্গে আমার মেলে না। খুব ঝগড়া হয়। আবার ভাবও হয়ে যায়।
সেই পুরুষালি স্বভাবের ডঁটিয়াল মেয়েটি আর নেই। গাড়ির সিটে পা তুলে বসেছে এখন। তেলচোখে খুঁটে খুঁটে দেখছে সোমেনকে। আবছা আলোয় এই প্রথম ওর চোখে একটু মেয়েমানুষি কটাক্ষ দেখতে পেল সোমেন। তার অস্বস্তি হচ্ছিল।
মধুমিতা হাতটা সরিয়ে নিল হঠাৎ। হাঁটু দুটো দুহাতে জড়িয়ে ধরল বুকের সঙ্গে। ওই ভাবেই একটু দোল খেল।
সামনের দিকে চেয়ে বলল—আপনি কি এনগেজড?
সোমেন প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। বলল—কী বলছ?
—আপনার কি কেউ আছে?
সোমেন এই প্রশ্নে হাসল। ভয়ও পেল। তার বয়স মাত্র চব্বিশ পূর্ণ হয়েছে। পঁচিশে পা। সদ্য যুবা পুরুষ। তবু মনে হয় তাদের যৌবনকালকে নস্যাৎ করে পরবর্তী যুবক-যুবতীরা দ্রুত জমি দখল করে নিয়েছে। মাঝখানে একটা যোগাযোগহীন শূন্যতা জেনারেশন গ্যাপ। তারা কখনও এত অল্প পরিচয়ে কাউকে এই প্রশ্ন এত অকপটে করতে পারেনি।
সোমেন মিথ্যে করে বলল—ন্নাঃ কেন?
—একটা কথা বলব? রাগ করবেন না?
—কী কথা?
—প্লিজ, রাগ করবেন না।
—না।
হাতটা আবার নরম বিসর্পিল আঙুলে চেপে ধরল মধুমিতা। নিবিড় উষ্ণ আঙুল, হাতের তেলোয় জ্বরাক্রান্তের তাপ। মৃত্যুর হিম আর নেই।
বলল—আই লাভ ইউ।
॥ উনপঞ্চাশ ॥
সেদিন শীলাকে সাধ দিলেন ননীবালা। সাধটুকু দিতেই কত না কষ্ট হল।
এখন এ সংসারে আর তেমন স্বচ্ছলতা নেই। রণেনের মনটা বড় ভাল, কোনও উদ্যোগ আয়োজন হলেই রাশিকৃত টাকা খরচ করে বাজার আনবে, জিনিস আনবে, হইচই করে হাট বাঁধিয়ে ফেলবে বাসায়। রান্নাঘরের চৌকাঠের ওপর উবু হয়ে বসে সবকিছু চাখবে। পালেপার্বণে বা নেমন্তন্নে যেদিন বাসায় ভালমন্দ হয় সেদিন ননীবালাকেই তাগাদা দেবে রণেন—ও মা, আজ তুমি হাতা-খুন্তি ধরো। তুমি হাতা ছুঁলেই রান্নার স্বাদ পালটে যায়।
রাঁধতে ননীবালার তেমন কষ্ট হয় না। প্রেশারটা বাড়লে একটু অসুবিধে হয়। ট্যাবলেট আর ট্রাংকুইলাইজার খেয়ে রাঁধতে বসেন গিয়ে। কিন্তু আজকাল সে সুখও গেছে। রণেনের অসুখটা হওয়ার পর থেকেই নেমন্তন্নের পাট গেল উঠে। রণেন আর মাকে রাঁধতে বলে না, কারণ রণেনও আর খাবারের স্বাদ পায় না। কোথায় যে ওর মনটা পড়ে দাপাচ্ছে তা কে জানে! ননীবালা জানেন না।
তবে এ নেমন্তন্নটা করতেই হয়। ছোট মেয়ে ইলারও ছেলে হল কিছুকাল আগে। ওরা মুম্বইতে থাকে বলে সাধ দিতে পারেননি, কেবল শতখানেক টাকা পাঠিয়েছিলেন একটা শাড়ি কেনার জন্য। বড় মেয়ের তো হবেই না ধরে নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত হচ্ছে। ভেবেছিলেন, খুর ঘটা করে সাধ দেবেন। রণোর এ-রকম না হলে দিতেনও।
ভয়ে ভয়ে কথা পেড়েছিলেন বীণার কাছে-বউমা, শীলুর একটা সাধ না দিলে কেমন দেখাবে?
—দিন। বীণা সংক্ষেপে উত্তর দিল।
—ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে খুব ভাল সাধ দিয়েছে শুনলাম। সাদা খোলের কেটের শাড়ি দিয়েছে, অনেক সধবা খাইয়েছে।
বীণা এ কথার উত্তর দিল না।
কিন্তু ননীবালা বুঝলেন। তিনি তো অবুঝ নন। ছেলের উপরি বন্ধ, সংসারটা মাইনের ক’টা টাকায় কেবলমাত্র চলে যায়। তার ওপর চিকিৎসার খরচও বড় কম নয়। বাড়িতে খরচ কোথা থেকে আসবে! তবু মনটা খুঁত খুঁত করে। শীলাকে ভালরকম একটা সাধই দেওয়ার কথা। এতকাল পরে সন্তান হচ্ছে, সেও বটে। আবার অন্যদিকটাও দেখার আছে। লুকিয়ে-চুরিয়ে শীলা ননীবালাকে চাটা-কে-টাকা, গুচ্ছের শাড়ি, একজোড়া সোনার বালা, ভাল চটি কত কী দিয়েছে! জামাই বোধ হয় এ-সব খুব একটা পছন্দ করে না, কিন্তু শীলা ঠিক চুপেচাপে নানা জিনিস পাঠিয়ে দেয়। বাড়িতে ভাল ঘি এল কী কোনও খাবার হল, কী বড় মাছের টুকরো এল, সঙ্গে সঙ্গে পাঠায়। এ সবের পালটি দিতে হয়, সে দেওয়ার ক্ষমতা তো ননীবালার নেই তাই সাধের সময় ভাল একটা কিছু দেবেন, ভেবেছিলেন।
হল না।
রণেনের কাছে এ সব কথা তুলতে চান না ননীবালা। ওর বোধ হয় কষ্ট হবে। কাউকে নেমন্তন্ন করে ভাল আয়োজন না করতে পারলে ও বড্ড খুঁত খুঁত করে। তাই বললে হয়তো দাপাবে মনে মনে। মনের কষ্ট বেড়ে যাবে। অথচ সাধের আগের দিনও বীণা তেমন গা করছিল না। জামাই মেয়েকে নেমন্তন্ন করা হয়ে গেছে, অথচ উদ্যোগ আয়োজন নেই। মনে মনে ভয় পেলেন ননীবালা।।
দুপুরে সোমেন বাড়িতে খেতে এল। খাওয়ার পর যখন সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে বসল, তখন ননীবালা তার কাছেই নালিশটা করলেন—কী করি বলো তো, কাল ওরা সব আসবে, অথচ কোনও উদ্যোগ আয়োজন নেই।
ছেলেটা বড্ড রাগী। কোনও কাজ নেই, তাই প্রায় সময়ই সব আবোলতাবোল কী যেন ভাবতে বসে। সে সময় কেউ ডেকে কথা বললে বড় রেগে যায়। তেমনি রাগের ঝাঁঝ দিয়ে বলল—নেমন্তন্ন করতে গেলে কেন? যত সব সেকেলে সংস্কার। সাধ! সাধ আবার কী? ওসব উঠে গেছে।
ননীবালাও রেগে গিয়ে বলেন-কী বলছিস যা তা? এতকাল পর মেয়ে পোয়াতি হল, সাধ দেব না?
—দেবে তো দাও। আমাদের যা রান্না হবে তাই খেয়ে যাবে। সংসারের অবস্থা তো ওরাও জানে।
ননীবালা আহাম্মক ছেলেটির কথা শুনে গায়ের জ্বালা টের পেলেন। বলেন—সংসারের কোনও ব্যাপারেই থাকিস না, এ ভাল নয়। একটা শাড়ি-টাড়ি কিছু না দিলে কেমন দেখায়?
সোমেন বলল—দাদা পারবে না।
—তবে?
সোমেন তখন ননীবালার দিকে চেয়ে খুব ঠান্ডা কিন্তু কঠিন গলায় বলল—তোমার টাকা তো ব্যাঙ্কে পচছে। চেক কেটে দাও, তুলে এনে দিই।
ননীবালা সঙ্গে সঙ্গে মিইয়ে যান। জমি কেনার পরও হাজার সাতেক টাকা পড়ে আছে ব্যাঙ্কে। সকলেরই নজর ওইদিকে। অথচ জমির ভিত পত্তনের জন্য যে টাকা দরকার তার জোগাড় নেই। ওইটুকুই ভরসা।
ননীবালা অসহায়ের মতো বললেন—ও টাকা ভেঙে ফেললে তোদের বাড়ি কোন দিন উঠবে?
—ও টাকাতেও বাড়ি উঠবে না। কেন বাজে কথা বলছ মা? আমাদের বাড়ি-টাড়ি হবে বরং বেশি দামে জমিটা বেচে দিয়ে। আর টাকাটা যক্ষী বুড়ির মতো আগলে বসে থেকো।
কী কথা ছেলের! ননীবালার দু-চোখে জল এল। সংসারে এরকম শাস্তি পেটের শত্রু ছাড়া কে দিতে পারে? কার ওপর রাগ অভিমান করবেন, কার কাছেই বা নিজের নানা সুখ-দুঃখ সাধ আহ্লাদের কথা জানাবেন? শেষ পর্যন্ত বুঝি একটা মানুষ ছাড়া পৃথিবীতে মেয়েদের আর কেউ থাকে না! কিন্তু ননীবালার সেই মানুষটা যদি মানুষের মতো হত।
অসহায়ের মতো ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। কী সুন্দর মুখখানা ছেলের। কাটা কাটা নাক মুখ, দিঘল চোখ, এক ঢল চুল, রোগার ওপর ভারী লক্ষ্মীমন্ত চেহারা। তবু ওর মনটা এত নির্দয় কেন? তবু তো এখনও বিয়ে করিসনি ছেলে, বিয়ে করলে আরও কত পর হয়ে যাবি!
অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন—হাতের পাতের দুটো টাকা। মানুষের কত বিপদ-আপদ আসে। দুর্দিনের জন্য রাখতে হয় না? হুট করে টাকা তুলে আনলেই হল?
সোমেন বিরক্তির সঙ্গে বলে—আর কত বিপদ আসবে? এটাই তো বিপদ। আসলে তুমি এ সংসারের জন্য নিজের টাকা খরচ করতে চাও না। তুমি ভীষণ সেলফিশ।
এই বলে সোমেন জামা-কাপড় পরে বেরিয়ে গেল গনগন করতে করতে। ভয়ে ননীবালা আর উত্তর করলেন না। কিন্তু ছেলেটা বেরিয়ে গেলে একা ঘরে কত কান্না যে কাঁদলেন! ভগবানকে কখনও দেখেননি, তবু ভগবানকে ডেকে কত কথা বললেন মনে মনে। এক সময়ে দেখেন ভগবানের বদলে সেই ব্রজগোপাল বলে মানুষটার মুখ মনের মধ্যে ভাসছে। সঙ্গে সঙ্গে মনটায় যেন রাগ-অভিমানের ঝড় এল। বললেন—তুমি যদি আমার মাথার ওপর থাকতে তা হলে ওরা আমাকে অত কথা বলার সাহস পায়? দেখো, আমাকে কি আঁস্তাকুড়ের বেড়ালছানার মতো ফেলে গেছ তুমি। পুরুষমানুষ হয়ে তোমার লজ্জা করে না?
এমনি সব কথা। কথার পর কথা। গভীর মেঘের স্তর যেমন বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে আর শেষ হতে চায় না, তেমনি, এত বছর ধরে শুধু রাগ আর অভিমান মনের মধ্যে স্তরের পর স্তর জমে থেকেছে। তাই অনেক সময় লাগল ননীবালার সামলাতে।
কালকে সাধ। একটা কিছু করতেই হয়। নইলে ছেলেদের কী, জামাই-মেয়ের সামনে তিনিই লজ্জায় বেরোতে পারবেন না। আবার শুধু সাধই তো নয়, প্রথম বাচ্চা হওয়ার সময়ে মেয়েদের বাপের বাড়ি থাকার কথা। খরচপত্রও বাপের বাড়ির কিন্তু সে কথা কার কাছে তুলবে ননীবালা?
বীণা ছেলেমানুষ নয়, তিন ছেলেমেয়ের মা। কানে যখন কথাটা তুলেছে তখন বীণা একটা শাড়ি-টাড়ি কিনে আনবে ঠিকই। কিন্তু তাতেও ভয় পান ননীবালা। তেমন ভাল দেখনসই শাড়ি কি কিনবে? শীলুর কত দামি দামি শাড়ি, নিজে রোজগার করে কেনে, বরও ঢেকে দেয় শাড়িতে। কত দামি শাড়ি ঝিয়েদের বিলিয়ে দেয়। আজেবাজে শাড়ি দিলে পরবেই না হয়তো। জামাইও কী ভাববে?
এই সব চিন্তায় পাগল-পাগল হয়ে গেলেন তিনি। এ সব আর কেউ ভাববে না। দায়দায়িত্ব সবই যেন তার একার।
তখনও দুপুর যায়নি। গরমের দুপুর তো, অনেকটা বেলা পর্যন্ত তার আঁচ থাকে। বীণা একটু ঘর বার করে কী ভেবে একটু বেরলো। সাজ-গোজ করেনি বেশিদুর যাবে না। যাওয়ার সময় আজকাল সব সময়ে বলে যায় না। কখনও খেয়াল হলে, মেজাজ ভাল থাকলে বলে—মা একটু অমুক জায়গা থেকে ঘুরে আসছি। আজ বলল না। বোধ হয় শিলুর সাধ নিয়ে মনে মনে একটু আড় হয়ে আছে।
বীণা বেরিয়ে গেলে ফাঁক পেয়ে ননীবালা রণেনের ঘরে এলেন। আর, ঘরে ঢুকেই বড় করুণ দৃশ্যটা দেখলেন। মস্ত বিছানায় বাচ্চাগুলো যে যার মতো ছড়িয়ে শুয়ে আছে। অঘোরে ঘুম। তাদেরই মাঝখানে শুয়ে রণেন। গরমে গায়ে কাপড় রাখতে পারে না, তাই আন্ডারপ্যান্ট পরে শোয়। ননীবালা দেখলেন, আন্ডারপ্যান্ট পরা রণেনকে ঠিক তার ছেলেদের মতোই দেখাচ্ছে। ও রকমই শিশু যেন। শুধু চেহারাটাই যা একটু বড়। একটা হাত ভাঁজ করে তার ওপর মাথা রেখে শুয়েছে। পা দুটো ভাঁজ করা গুটিসুটি। পাখার তলাতেও ওর কপালে, থুতনিতে, পিঠে টোপা টোপা ঘামের ফোঁটা ফুটে আছে।
ননীবালা শুনলেন ঘুমের মধ্যেই রণেন একটা বড় কষ্টের, বড় কাতরতার শব্দ করল। যেন শ্বাস টানতে পারছে না। শরীরটা একবার কেঁপে উঠল। ননীবালা তাড়াতাড়ি গিয়ে আঁচলে ছেলেটার পিঠের ঘাম মুছতে লাগলেন। স্নেহভরে ডাকলেন—রণো! ও রণো!
রণেন দেখছিল একটা বাগান। কী সুন্দর বাগান। চারদিকে হিম কুয়াশায় ভেজা গাছপালা। কী নিস্তব্ধ! এরকম গাছপালা আর কখনও দেখেনি রণেন। মোচার মতো বড় বড় ফুল ফুটে আছে গাছে। একটা নিমগাছের মতো কিন্তু নিমের চেয়েও অনেক সরল ও সুন্দর গাছ দেখল রণেন। বড় বড় ঘাস হাঁটু পর্যন্ত উঠে এসেছে। চারদিকে একটা গভীর সুঘ্রাণ। বেশ লাগছিল রণেনের। এমন বাগান সে জীবনে দেখেনি। মনটা জুড়িয়ে গেল। হাঁটু সমান ঘাস ভেদ করে আস্তে আস্তে ঘুরছিল সে ইতস্তত। হঠাৎ একবার আকাশের দিকে চোখ তুলে সে স্থির হয়ে গেল। ওইখানে, ওই আকাশে এতক্ষণ তারজন্যই একটা ষড়যন্ত্র তৈরি হয়ে ছিল। রণেন দেখে, আকাশের অনেকখানি জুড়ে এক মহা চাঁদ স্থির হয়ে আছে। এমন বিশাল অতিকায় চাঁদ সে আর কখনও দেখেনি। সেই চাঁদ তারদিকে গম্ভীর, নিস্তব্ধতাময় এক স্থির চাউনিতে চেয়ে আছে। কেবলমাত্র তারদিকেই, কারণ এ বাগানে বা আর কোথাও কেউ নেই। ভীষণ চমকে উঠল রণেন এবং হঠাৎ বুঝতে পারল, আকাশের ওই চাঁদটা চাঁদ নয়। ওই মহাকায় গোলকটিই পৃথিবী। মাধ্যাকর্ষণের কোন ফাঁকে সে পৃথিবী থেকে গলে পড়ে গেছে বহু দূরবর্তী এই বাগানে। যেখানে চেনা গাছ, চেনা ফুল, চেনা গন্ধ, কিংবা চেনা মানুষ কেউ নেই। আচমকা ভয় খেয়ে এক ভাষাহীন চিৎকার করে ‘আঁ—আঁ’ বলে ছুটতে লাগল রণেন। কিন্তু হাঁটু সমান উঁচু ঘাসগুলির ভিতরে ডুবে যায় পা, কিছুতেই সে নড়তে পারে না। আবার দৌড়োতে গিয়েই স্বপ্নটা পালটে যায়। দেখতে পায়, খুব নির্জন একটা মেঠো স্টেশন থেকে একটা ছোট্ট কালো রেলগাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে। রেলগাড়ির জানালায় ব্রজগোপালের হাসিমুখ দেখা যাচ্ছে। রণেন মাঠের ভিতর দিয়ে প্রাণপণে দৌড়চ্ছে গাড়িটার উদ্দেশ্যে। পারছে না। কেমন যেন খিল ধরে আসছে হাতেপায়ে। যত জোরে দৌড়োয় তত আস্তে হয়ে যায় গতি। প্রাণপণে হাত উঁচু করে চেঁচিয়ে বলে—থামাও, থামাও, গাড়ি থামাও। বাবার সঙ্গে আমার কথা আছে। কিন্তু গলায় চিৎকার ফোটে না। এক অসহায় ফিসফিসানির শব্দ হয় কেবল। জরুরি কথাটা যে কী তা কিছুতেই মনে পড়ছে না। জনমানবহীন স্টেশনে কোন প্রেত ঢং ঢং করে গাড়ি ছাড়বার ঘণ্টা বাজিয়ে দিচ্ছে। ইঞ্জিনের শিস কানে আসে। দৌড়োতে দৌড়োতে দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা নামে রণেনের। সে প্রচণ্ড কাঁদে, ছোটে। অন্তহীন মাঠটা আর পার হতে পারে না। ব্রজগোপাল আগ্রহভরে চেয়ে আছেন জানালা দিয়ে। জানতে চাইছেন, রণেন কী বলতে চায়। কিন্তু অত দূর! এত দূর থেকে কী করে বলবে রণেন? কথাগুলিও মনে পড়ে না। কেবল মনে হয়, বড় জরুরি কথা। বড় ভীষণ জরুরি কথা। এ স্বপ্ন থেকে পাশ ফিরতেই সে বড় ভয়াবহ আর একটা দেখল। কী সাংঘাতিক স্পষ্ট, কী বাস্তব দৃশ্য! ব্রজগোপালের মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে, শববাহকদের সঙ্গে সেও। নদীর পাড়ে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে নামাল। চুল্লি সাজানো। শববাহকদের মধ্যে একজন বুড়ো লোক একটা নুড়ো জ্বেলে তার হাতে দিয়ে বলল—কেঁদে আর কী হবে বাবা! বৃষ্টি আসছে। মুখাগ্নিটা করে ফেলে। এবং রণেন মুখাগ্নি করল। চিতা ধীরে ধীরে জ্বলে উঠল তলা থেকে। আগুনের শিখাগুলি উঠে আসছে ওপরে। হলুদ সাপের মতো। কী স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবকিছু। কোথাও এতটুকু অস্পষ্টতা বা রহস্য নেই।
ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন ভেঙে উঠে বসেই সে সামনে মাকে দেখতে পায়। দেখে অবাক হয়। এখনও কেন মায়ের হাতে শাঁখা, কেন চওড়া পাড়ের শাড়ি, কেন সিঁদুর? সে হাত বাড়িয়ে মার হাতটা ধরে বলে—মা, গয়ায় গিয়ে পিণ্ডিটা দিয়ে আসতে হবে। ভেবো না। বলে আবার মায়ের দিকে চায়। বড় বেভুল লাগে। স্পষ্টই একটু আগে চিতাটা জ্বলছিল। কোনও ভুল নেই।
ননীবালা বললেন—কার পিণ্ডি দিবি? কী বলছিস, ও রণো?
জাগ্রত রণেন তখন মার দিকে চেয়ে থেকে ভুলটা বুঝতে পারল। স্বপ্ন! অত স্পষ্ট স্বপ্ন কেউ দেখে? অত নিখুঁত? সে চারধারে চেয়ে দেখল, না এ তো স্বপ্ন নয়। এই তো সে জেগে আছে!
হঠাৎ দু-হাতে মুখ চাপা দিল রণেন। ননীবালা উঠে গিয়ে পাখাটা আরও বাড়িয়ে দিলেন।
রণেন জিজ্ঞেস সরল—বাবা কেমন আছে মা?
—কেমন আছে কী করে বলি! কতকাল তো আসে না।
—চিঠিপত্র পাওনি ইদানীং?
—কই! সে চিঠিপত্র দেওয়ার মানুষ কিনা।
রণেন বিছানা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে বলল—আমি বাবার কাছে যাব।
এমনভাবে বলল যেমন দু-বছরের ছেলে বায়না করে বলে।
—যাবি কি! আসবেখন সে নিজেই।
—না। মাথা নাড়ল রণেন। ঠোঁট কেঁপে গেল থরথর করে কান্নায় বিকৃত গলায় বলল—বাবা মরে গেছে মা। আমি এই মাত্র স্বপ্ন দেখলাম।
ননীবালা বড় চমকে গেলেন। স্বপ্ন! স্বপ্ন কী ফ্যালনা নাকি! কত কী হয়! ব্যগ্র হয়ে বললেন—কী দেখলি?
—ওঃ! বলে প্রকাণ্ড আন্ডারপ্যান্ট পরা চেহারাটা নিয়ে সামনে দাঁড়াল রণেন। দু-হাতে কচলে চোখ মুছতে মুছতে বলল—আমি বাবার কাছে যাব। আমার সঙ্গে চলো মা।
সেই থেকে বুক কাঁপছে ননীবালার। সংসারে আর কত অশান্তি বাকি আছে, তার খেই পান না। জন্মাবার পর থেকেই বুঝি তাঁর হেন মেয়েমানুষের তপ্ত কড়াইতে বাস করা শুরু হয়। এ-ধারে পাশ ফিরলেও ছ্যাঁক, ও-ধারে পাশ ফিরলেও ছ্যাঁক।
বলেকয়ে রণেনকে শান্ত করলেন বটে। রাতটা কাটল ভয়ে-ভাবনায়, দুশ্চিন্তায় পরদিন সাধের রান্না বাঁধতে রাঁধতে অন্তত তিনবার উঠে গিয়ে ট্রাংকুইলাইজার খেলেন। সঙ্গে একখানা অ্যাডোলফেন বড়ি। প্রেশারটা বেড়েছে বোধ হয়।
রণেনও সারাদিন অস্থির। কেবলই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ‘ওঃ হোঃ হোঃ’ বলে চিৎকার করে। পায়চারি করতে করতে হঠাৎ থেমে বলে ‘বাবা’! একবার ননীবালা শুনলেন রণেন ঘরে বসে ‘মধুবাতা ঋতায়তে…’ মন্ত্র বলছে। এত চমকে গিয়েছিলেন ননীবালা যে সেই সময়েই তাঁর স্ট্রোক হয়ে যেতে পারত। মাথাটা ঘুরে, বুক অস্থির করে, পেটে একটা গোঁতলান দিয়ে শরীরটা যেন হাতের বাইরে চলে গেল। একটু সময় দেয়ালে ঠেস দিয়ে সামলে গেলেন।
রণেন ঘুরে ঘুরে রান্নাঘরের দরজায় এসে মাকে দেখে যায়। চোখ দুটো করুণ ছলছলে।
শীলা ওরাও ব্যাপারটা আঁচ করছিল বোধ হয়। শীলা একবার চুপি চুপি এসে জিজ্ঞেস করল—দাদা আজ ওরকম করছে কেন মা?
ননীবালা মাথা নেড়ে বলেন—ওরকমই করে তো।
—আজ যেন বেশি অস্থির।
সব কথা পেটের মেয়েকেই কি বলা যায়? বিয়ের পর ও তো একটু পর হয়েও গেছে। কত কথাই চেপে রাখতে হয় ননীবালাকে। এই কথা চেপে চেপেই বুঝি একদিন দমবন্ধ হয়ে মারা যাবেন।
বললেন—শাড়িটা দেখেছিস?
—বউমা এনেছে। দাম-টাম জিজ্ঞেস করিনি। দেখাল, একবার দেখলাম।
শীলা একটু হেসে বলে—তুমি যা ভাবছ তা নয়। ওই শাড়ির কিন্তু অনেক দাম। বউদি কম দামি জিনিস আনেনি। গড়িয়াহাটায় সেদিন একটা দাম করেছিলাম, একশো কুড়ি টাকা চাইল।
মনটা হঠাৎ তখন ঠান্ডা হল ননীবালার। মেয়েটার মুখের দিকে চাইলেন, উঁচু পেটটা হাঁটুতে একটু চেপে বসেছে। মুখটায় শ্রীহীন কর্কশ ভাব, কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে আছে। ঠোঁট শুকনো। ননীবালা নিরীক্ষণ করে বললেন—তোর তো ছেলে হবে।
—বলছ?
—বলছি। ও আমরা বুঝতে পারি।
ভালমন্দে সাধের দিনটা কেটে যেতেই রাতে তিনি বীণাকে ডেকে বললেন—বউমা, রণেনটা বড় অস্থির।।
—শুনেছি। কেবল বাবার কথা বলছেন।
—কী করবে? ননীবালা জিজ্ঞেস করলেন।
—আমি তো যেতে পারব না, বাচ্চাদের ইস্কুল। বরং আপনি ওঁকে নিয়ে যান, বাবার কাছ থেকে ঘুরে আসুন। বেড়ানোও হবে। আর ওখানে এক ফকির সাহেব আছেন শুনেছি, ওষুধ দেন।
সেই ঠিক হল। তারপরই মায়ে-পোয়ে চলে এসেছেন।
এসে ফাঁকা ঘর দেখে বুকটা সেই থেকে হু-হু খরার বাতাসে জ্বলে যাচ্ছে যেন।
ঘরের কী শ্রী! মাচানের বিছানাটা দেখলেই তো কান্না পায়। গুটিয়ে রাখা তোশকটা ফালা ফালা হয়ে ছিঁড়ে তুলোর চাপড়া বেরিয়ে আছে। মশারিটা কয়েক জায়গায় সেফটিপিন আটকানো, ননীবালার চোখ ছল ছল করে।
রামভক্ত হনুমানের মতো জোড়হাতে সামনে দাড়িয়ে বহেরু কেবল—মাঠান, মাঠান, করে যাচ্ছে। তারদিকে বড় বড় চোখে চেয়ে ননীবালা একবার বললেন—বহেরু, তুই বড় পাপী। বামুন মানুষটাকে এইভাবে রেখেছিস!
বহুকাল পরে যেন ননীবালার বুকের মধ্যে মায়া-মমতা মাথা-তোলা দিল।
বহেরু মাটিতে বসে পড়ে দুর্বল গলায় বলে—ওনারে আমি রাখব! কি বলেন। কারও কড়ি ধারেন নাকি! বরং উনিই আমাদের রেখেছেন।
থাকবেন, না ফিরে যাবেন তাই নিয়ে মুশকিলে পড়েছিলেন ননীবালা। কিন্তু বুকের মধ্যে কু-পাখি ডাকছে। তাই দোনামোনা করে থেকে গেলেন। বহেরুর লোকজন সব ভেঙে এল সেবা-যত্ন করতে। ঘরদোর সাফ করা হল নতুন করে, একটু সাজানো হল। তার ফাঁকে কাকে বহেরু বলছিল—কাউবে ঘকে ঢুকতে দেন না। জিনিসপত্র কেউ ধরলে ভারী চটে যান।
ননীবালা শোনেন। মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে অবোলা ভয় শ্বাসযন্ত্রকে চেপে ধরে—লোকটা বেঁচে আছে তো! ফিরবে তো!
এই করেই কেটেছে অসহ্য দিনটা। কাটতে কি চায়! মনে মনে কত মানত, কত ঠাকুরদেবতার কাছে প্রার্থনা করেছেন ননীবালা।
Leave a Reply