১০. হেড মিস্ট্রেসের ঘরে

দশ

হেড মিস্ট্রেসের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ঝিনুক। ভিতরে এক গাট্টাগোট্টা চেহারার লোক বসে আছে। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স। মাথার চুল কুচি কুচি করে কাটা।

সুনীতা ডাকল,—আয়। চিনিস এঁকে? তোর ক্লাসের যুধাজিতের বাবা। এঁর একটা কমপ্লেন আছে।

খিদেয় পেট চিনচিন করছে ঝিনুরে। সকালবেলা বাবা-মা’র সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এত দেরি হয়ে গেল, কিছু খেয়ে বেরোনো হয়নি। তিন দিন ধরে রোজ রাত বারোটা নাগাদ একটা ভুতুড়ে ফোন আসছে। দু দিন বাবা ধরেছে, এক দিন মা। ধরার সঙ্গে সঙ্গেই কেটে যায় ফোনটা। ঝিনুক পাত্তা দিতে চায়নি, বাবা-মা’র দুশ্চিন্তা দেখে শুধু একবার বলেছিল, চাও তো থানায় গিয়ে জানিয়ে আসতে পারি, বাবা-মা’র উত্তেজনা তাতে বেড়ে দ্বিগুণ।

সুনীতা জিজ্ঞাসা করল,—কাল তোর ক্লাসে কী হয়েছিল?

কী হয়েছিল? ঝিনুক চট করে মনে করতে পারল না। তীব্র খিদের সঙ্গে হালকা ঘামের মতো লেপে আছে উদ্বেগ। মাথাটা তার ঠিক কাজ করছে না।

—তুই নাকি কাল লাস্ট পিরিয়ডে বাচ্চাদের খুব মারধর করেছিস? এঁর ছেলেকে নাকি…!

—ও কথা তো আমি বলিনি ম্যাডাম। হাঁড়িমুখো লোকটা নড়ে বসল, —আমি বলছিলাম, কাল উনি কী বলেছেন তাতে আমার ছেলে ভীষণ টেরর হয়ে গেছে। কিছুতেই স্কুলে অ্যাটেন্ডেন্স করতে চাইছে না।

ইংরিজির ভুলভাল প্রয়োগ শুনে হাসি চাপতে গিয়ে ঝিনুকের মনে পড়ে গেল কালকের ব্যাপারটা। শেষ পিরিয়ডে দুটো ছেলে স্কেল নিয়ে মারপিট করছিল, স্কেল কেড়ে যেই না ঝিনুক অন্য বাচ্চাদের লেসনে চোখ বোলাতে শুরু করেছে, অমনি ছেলে দুটো বাঘ আর বুনো শুয়োর। খালি হাতেই লড়াই। আঁচড় কামড়। শেষ পিরিয়ডে এমনিতেই ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে, কড়া শাসনে না রাখলে কিছুতেই তাদের তখন বাগে রাখা যায় না। ঝিনুক জোরে কান মুলে দিয়েছিল ছেলে দুটোর। তার জন্য একজনের বাবা স্কুলে ছুটে এসেছে! আর সেই গার্জেনের সামনেই কৈফিয়ৎ চাইছে সুনীতা আন্টি!

ঝিনুক ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,—বাচ্চারা দুরন্তপনা করলে একটু শাসন করতে হয়। সেই অছিলায় স্কুলে আসবে না এ তো ঠিক কথা নয়!

ভদ্রলোক ঝিনুকের দিকে তাকাল না। সুনীতাকে বলল,—আমার ছেলে বলছিল উনি নাকি বলেছেন, তুমি ভীষণ গুণ্ডা হয়ে গেছ। তোমার মত গুণ্ডাদের আমি শায়েস্তা করতে জানি।

ভদ্রলোকের বাচনভঙ্গিও যথেষ্ট অমার্জিত। ঝিনুকের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল,—বলেছি। কি হয়েছে তাতে?

এবারও ভদ্রলোক সুনীতাকে উত্তর দিল,—আরও অনেক আন্টি তো বকাঝকা করেন, আমাকে কখনও ইন্টারফিয়ারেন্স করতে দেখেছেন? এমনিতেই এখন বাচ্চারা ওনাকে একটু বেশি ভয় পায়। বিশেষ করে টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের ইন্সিডেন্সটার পর।

রাগবে না হাসবে ভেবে পেল না ঝিনুক।

সুনীতা ভদ্রলোককে বলল,—ঠিক আছে, আপনার কথা তো শুনলাম। কাল থেকে ছেলেকে পাঠিয়ে দিন। আমার মনে হয় না আর কোনও প্রবলেম হবে।

—না হলেই মঙ্গল। আমি উঠি। পার্কে ছেলেরা গিনিপিগ খরগোশের গার্ডেন করেছে। ওপেনিং করতে হবে। ভদ্রলোক চেয়ার ছাড়ল,—ছেলের আমার বড্ড প্রেস্টিজে লেগে গেছে। ভয় দেখানো ও একদম টলারেন্স করতে পারে না।

ঝিনুকের মুখচোখ লাল। সুনীতা পেপারওয়েট নিয়ে নাড়াচাড়া করছে,—শুনলি গার্জেনের কমপ্লেন?

—আপনি…আপনি…আপনি ওই সিলি কমপ্লেনটা এনটারটেন করলেন! একটা অশিক্ষিত অভদ্র লোক…!

—মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ শ্রবণা। আমাদের কাছে গার্জেনস আর গার্জেনস। ভদ্র অভদ্র বলে কিছু নেই। ভদ্রলোক কে জানিস? করপোরেশনের কাউন্সিলার। দরকার অদরকারে আমাদের কাজে লাগে। সুনীতা ডেস্ক ক্যালেন্ডারে চোখ রাখল, —কমপ্লেনটা আমি ধরছি না। বাট আই মাস্ট সে, তোর কথাবার্তা অ্যাটিচিউড রিসেন্টলি কেমন বদলে গেছে। তুই তো আগে এত রুক্ষ ছিলি না! এত অ্যাগ্রেসিভ!

—আমি অ্যাগ্রেসিভ!

—অ্যাগ্রেসিভ মানে কমনীয়তার অভাব। বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য কেন মেয়েদের প্রেফার করা হয় জানিস? বাচ্চারা যাতে একটা কোমল স্নেহের সান্নিধ্যে বড় হয়ে উঠতে পারে। টিচারদের মধ্যে তারা মাকে দেখতে চায়। আই মিন মায়ের মত একজনকে। টেন্ডার। অ্যাফেকশনেট।

ঝিনুক তো একই ঝিনুক আছে! হঠাৎ এ কথা কেন!

সুনীতা মাথা দোলালো,—মিস্টার সেনগুপ্ত বলছিলেন বাচ্চাদের হ্যান্ডল করা খুব ডেলিকেট কাজ।

রাক্ষুসে খিদে হাতুড়ি মারছে মাথায়। ঝিনুক নিজেকে যথাসম্ভব ঠাণ্ডা রাখতে চাইল,—কমপ্লেনটা নিয়ে মিস্টার সেনগুপ্তর সঙ্গে আপনার কথা হয়ে গেছে!

সূক্ষ্ম বিদ্রূপ গায়ে মাখল না সুনীতা,—না এটা নিয়ে কথা হয়নি। উনি জেনারেল ভাবেই বলছিলেন। প্রেজেন্ট-জেনারেশন বাচ্চাদের সামলাতে গেলে অনেক কৌশলী হয়ে উঠতে হবে। ফিফটিনথ অগাস্ট তোকে ওভেশান দেওয়া হচ্ছে, সেদিনই উনি এ ব্যাপারে টিচারদের একটা গাইডলাইন দেবেন।

স্টাফরুমে ফিরেও ঝিনুকের ব্ৰহ্মতালু জ্বলছিল। সঙ্গে খিদের অসহ্য মোচড়। টিফিনবাক্স খুলে ঝিনুক কচকচ করে পাঁউরুটি চিবোতে শুরু করল। সেদ্ধ ডিমের খোলা টেবিলে ঠুকে ঠুকে ভাঙল। ছাড়ানো ডিমে কামড় দিয়েই কটমট করে তাকাল ডিমের দিকে। পোলট্রি। ফ্যাটফেটে সাদা কুসুম। গোবিন্দর মা জানে ঝিনুক পোলট্রির ডিম খায় না তবুও…। মুখের ডিম পিছনের জানলা দিয়ে থু থু করে ফেলে এসে আবার কামড় দিয়েছে নেতানো মাখন-পাঁউরুটিতে।

ঘরের অপর প্রান্তে উচ্চকিত জটলা চলছে। মাধুরী ছুটিতে রয়েছে কদিন। গীতালি ঝিনুককে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল,—তোর মুখটা এরকম লাগছে কেন রে? ওই লোকটা কী বলতে এসেছিল?

—কাউন্সিলারটা! ঝিনুক চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, গীতালি চোখ পাকিয়ে থামিয়েছে তাকে,—আস্তে। এ ঘরের টেবিল বেঞ্চেরও কান আছে।

কথাটা মিথ্যে নয়। সুনীতার অনেক গোপন গোয়েন্দা এ ঘরে কান খাড়া করে থাকে। গ্লাস-ভর্তি জল ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল ঝিনুক।

গীতালি ঝিনুকের কানের কাছে মুখ আনল,—এখন কাউন্সিলার হয়েছে। আগে তো মস্তানি করত। এই বাজারে ময়ূরপুচ্ছ লাগিয়ে নেতা হয়েছেন। খটাশ থেকে ব্যানার্জিদা। ওর লোক তো এখনও মার্কেটে মার্কেটে তোলা তুলে বেড়ায়।

সুনীতা আন্টির ডেকে পাঠানোর কারণ পরিষ্কার হচ্ছে এতক্ষণে। কাজ না হাতি! ভয়। স্রেফ ভয়। স্কুলটাকে তো চালাতে হবে।

ঝিনুকের মুখে সব শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল গীতালি,—যাক, অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। তবে তোকেও একটা কথা বলি শ্রবণা, তুইও বড্ড ডোন্ট কেয়ার টাইপের হয়ে গেছিস। চ্যাটাং চ্যাটাং বুলি বেড়েছে তোর।

ঝিনুক ঝট করে একটা বাবলগাম ছিঁড়ল,—কেন আন্টি? আমি কী করেছি?

—কদিন আগেও একটা গার্জেনের সঙ্গে তুই মিসবিহেভ করেছিস। সুনীতাদি জানে না। আমি জানতে দিইনি।

ঝিনুক পায়ের বুড়ো আঙুল মেঝেতে ঘষল,—আমি মিসবিহেভ করিনি। বাচ্চাটার পকেটে একটা একশ টাকার নোট পাওয়া গিয়েছিল, আমি তার মাকে ডেকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিলাম।

—আমি জানি।

—সবটা আপনি জানেন না আন্টি। ওই ভদ্রমহিলা উল্টে আমাকে কথা শুনিয়ে দিয়ে গেলেন। বললেন, আমার ছেলের পকেটে পাঁচ টাকা থাকবে কি পাঁচশ টাকা সেটা দেখাও কি আপনাদের বিজনেস? আমি শেষে বাধ্য হয়ে বলেছিলাম এটা স্কুল, আপনার টাকা দেখানোর জায়গা নয়। অনুগ্রহ করে পকেটে টাকা গুঁজে ছেলেকে স্কুলে পাঠাবেন না। এটাই আমাদের স্কুলের ডেকোরাম। আমি কি অন্যায় করেছি, আন্টি?

—অন্যায় তো বলিনি। গীতালি অসহিষ্ণু হল,—ভদ্রমহিলাও আমার কাছে অনেক দুঃখ করে গেছেন। তোর কথা বলার টোনটা ভাল ছিল না। তোকে তো ছোট থেকে দেখছি, এখনও লক্ষ করছি। তোর মধ্যে এখন যেন সব ব্যাপারেই বেশি যুক্তি যুক্তি ভাব। একটু বেশি তর্ক করার প্রবণতা। আমি তোকে ঠিক বোঝাতে পারছি না শ্রবণা। কেমন যেন রাফ…পুরুষালি পুরুষালি হয়ে গেছিস।

চকিত আক্রমণে ঝিনুক হতবাক। আঘাতটা যে ঠিক কোথায়! অসংখ্য কাচের গুড়ো রক্তের সঙ্গে মিশে বনবন চক্কর খেয়ে চলেছে। হৃৎপিণ্ড ফুসফুস সব বিষিয়ে এল।

সকাল থেকে আকাশ আজ আস্তাকুঁড়ের মতো ময়লা। ট্রামডিপো থেকে মন্থর পায়ে হাঁটছিল ঝিনুক। ডানদিকে স্টুডিওর গেটে বড়সড় এক জটলা। কেউ একজন মারা গেছে। লরিতে তাঁর শবদেহ। এক তরুণী চিত্রাভিনেত্রী গগলসে চোখ ঢেকে মালা দিচ্ছে মৃতদেহে। নায়িকাকে দেখার জন্য বাইরে রীতিমত ঠেলাঠেলি পড়ে গেছে। যিনি মারা গেছেন তাঁকে নিয়ে কণামাত্র কৌতূহল নেই জনতার।

অন্য দিন সিঁড়িতে ওঠার আগে একতলার ল্যান্ডিং-এ কিছুক্ষণ দাঁড়ায় ঝিনুক। নিজেদের লেটারবক্স নিয়মমাফিক খুলে দেখে একবার। আজ এতটুকু আগ্রহ বোধ করল না। ফ্ল্যাটে ফিরেও নিঃশব্দে খাওয়াদাওয়া সারল। তারপর শুয়ে পড়েছে বিছানায়।

মেয়ের গুমোট মুখ চোখে পড়েছে সুজাতার,—কি হয়েছে রে তোর?

—এমনিই। ভাল লাগছে না।

—নীলাঞ্জনা এসেছিল সকালে। তোকে নেমন্তন্ন করে গেছে। সুজাতা টেবিলে রাখা হলুদ-ছোঁওয়ানো কার্ড ঝিনুকের হাতে দিল।

ঝিনুক ভাঁজ খুলে পড়ল কার্ডটা। আঠাশে শ্রাবণ। তেরোই অগাস্ট। মানে সামনের শুক্রবারের পরের শুক্রবার। খামের ভিতরে আলাদা চিরকুটে তূণীরকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছে নীলাঞ্জনা।

—তুই কি শেষ পর্যন্ত থানাতেই গিয়েছিলি?

পালকির ছাঁদে কাটা বাহারী কার্ডটাকে উল্টেপাল্টে দেখছিল ঝিনুক। মায়ের প্রশ্ন পুরোপুরি তার মগজে যায়নি। অন্যমনস্ক মুখে বলল,—থানায় কেন?

—সকালে বলছিলি না থানায় যেতে পারিস! ফোনের কথাটা জানাতে!

—একবার বলেছিলাম বলেই দৌড়ব? আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই? কি না কি একটা কল আসছে, রঙ নাম্বার না টেলিফোনের গণ্ডগোল তার ঠিক নেই। অত ভয় থাকলে রাত্তিরে শোওয়ার সময় রিসিভার নামিয়ে রেখে ঘুমিয়ে।

সুজাতা আশ্বস্ত হল কিনা বোঝা গেল না, গজগজ করে উঠল, —তাও ভাল। সুমতি হয়েছে। থানায় ছোটনি। যা হেক্কড় হয়েছ এখন! ব্যাটাছেলের বাপ। ইচ্ছে হল দুদ্দাড় থানায় চলে গেলে। ইচ্ছে হল কোর্টে গিয়ে গুণ্ডাবদমাশদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেলে। মেয়েলিত্ব কিছু আর আছে তোমার!…

সুজাতার কথার মালগাড়ি চলছে তো চলছেই। বন্ধ ঘরে পাখার হাওয়া গরম ক্রমশ। ঝিনুক দাঁতে দাঁত চাপল। মা’র কথার প্রতিবাদ করার প্রবৃত্তি হচ্ছে না তার। কিন্তু কথাগুলো তাকে দংশন করে চলেছেই। শ্রবণা, তুমি বড় পুরুষালি হয়ে যাচ্ছ! শ্রবণা তুমি রুক্ষ! শ্রবণা তুমি অ্যাগ্রেসিভ! ব্যাটাছেলের বাপ! এতটুকু মেয়েলিত্ব নেই তোমার!

ঝিনুকের বুকে ধস নামল।

পাথরচাপা বুকে দিন কাটছে ঝিনুকের। এক দিন। দু দিন। তিন দিন। স্কুলে যায়। আসে। বাকি সময় ঠায় বাড়িতে। লক্ষ বার ড্রেসিংটেবিলের সামনে, বাথরুমের আয়নায়, স্কুলের টয়লেটের ছোপ ছোপ দর্পণে নিজেকে দেখেছে ঝিনুক। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আঁতিপাতি করে। সত্যিই কি সে বদলে গেছে? মন তো আগে ছাপ ফেলে মুখে। কই তার শারীরিক লাবণ্য তো বিন্দুমাত্র টসকায়নি! তবে কি এই পরিবর্তন আরও নিগূঢ় কিছু! পুরুষালি বলতে কী বোঝে মানুষজন? মেয়েলিত্বই বা বলে কাকে? আত্মবিশ্বাসহীনতাকে? প্রশ্নহীন আনুগত্যকে? নাকি ঝিনুক একই আছে, একটা ব্যতিক্রমী কাজ তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে নিজের গণ্ডী থেকে?

তূণীরটারও কদিন ধরে দেখা নেই। ঝিনুক অফিসে ফোন করেছিল, তূণীর খুনখারাপি রকমের ব্যস্ত। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কোম্পানির চেয়ারম্যান মিস্টার জোনস্ এসেছেন। তূণীর এখন যম এলেও ফিরিয়ে দেবে। ইঁদুর দৌড়! এই মরিয়া সময়ে সেকেন্ডের জন্য পায়ের পেশী কেঁপে গেলে ট্র্যাক থেকে ছিটকে যেতে হবে তূণীরকে।

উইক এন্ডে ছোটন বাড়িতে আসার পর ঝিনুক কিছুটা ধাতে ফিরল। ছোটন অনর্গল খুনসুটি করে যাচ্ছে, সুযোগ পেলেই টাকার জন্য হাত লম্বা করে দিচ্ছে দিদির কাছে। সদ্য সিগারেটে দীক্ষা হয়েছে তার। নেশার পয়সা জোগাতে দিদিই তার প্রধান বলভরসা। ঝিনুক কাঁইমাই করে, রেগে যায়, আবার দেয়ও। খুশি মনেই দেয়।

রবিবার দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ল ঝিনুক। নীলাঞ্জনার বিয়ের উপহার কিনতে হবে; একবার বিশাখার বাড়ি যাওয়া দরকার। কলেজ থেকেই এসব কেনাকাটার দায়িত্ব বিশাখার ওপর ছেড়ে রেখেছে বন্ধুরা। বিশাখাকে চাঁদাটা দিয়ে দিতে পারলে ঝিনুক ঝাড়া হাত-পা।

দিনটা আজ বেশ সুন্দর। ফিনফিনে মেঘের চাদর জড়িয়ে সূর্য বিশ্রাম নিচ্ছে। হুশহাশ হাওয়া। গরম নেই।

বিশাখার ছোট্ট ঘর জুড়ে গাদা গাদা কাগজ ছড়ানো। কাগজের স্তূপে উপুড় হয়ে চলন্ত টেপরেকর্ডারে ডুবে আছে বিশাখা। গভীর মনোযোগে কি এক বিটকেল ক্যাসেট শুনছে। ঝিনুক কথা শুরুর উপক্রম করতেই বিশাখা তাকে চোখের ইশারায় চুপ করে বসতে বলল।

ঝিনুক কয়েক সেকেন্ড মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করল ক্যাসেটটা। চিংড়িমাছ, পরিবেশ দূষণ, আবহাওয়া নিয়ে ইংরিজিতে কাঠখোট্টা আলোচনা চলছে। ঝিনুক টেপ অফ করে দিল।

—ইসস, গুলিয়ে দিলি তো! আবার গোড়া থেকে শুনতে হবে।

ঝিনুক ঠোঁট ফোলালো,—তুই কি আমাকে বোর করার প্ল্যান করেছিস?

ঢাউস কাফতান পরা বিশাখা গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে,—ট্রান্সক্রিপশনের কাজ। উফ, যা বোরিং।

—কি বকবক করছিল রে লোকগুলো?

—চিল্কায় চিংড়ি চাষ নিয়ে গ্রুপ ডিসকাশান।

—চিংড়িতে তোর কবে থেকে ইন্টারেস্ট হল?

—চিংড়ি নয়, আমার ইন্টারেস্ট রোকড়ায়। মানি। সুইট মানি। পার্টটাইম জব। যা উপরি আসে। লাস্ট উইকে ট্রাক ট্রায়ারের ওপর কাজ করলাম। বল তো দেখি টায়ারের গুটি কাকে বলে?

ঝিনুক একটুও উৎসাহ পেল না।

বিশাখা বলল,—নারে, মালকড়ি ভাল দেয়। পার টপিক আড়াইশো টাকা। কাজ শুধু ডেটা কমপাইল করা। মৈনাকও করছে।

—মৈনাকটার চাকরির কিছু হল?

—কই আর! এসব করেই খুঁটে খেয়ে বেড়াচ্ছে। গত সপ্তাহে কাগজের পাতায় একটা ফিচার লিখল। আবার বোধহয় একটা উইকলিতে অ্যাসাইনমেন্ট পাচ্ছে।

—তোরা এবার একটা কিছু সেটল কর। মাসিমা খুব টেনশানে থাকেন।

—দাঁড়া। আগে পায়ের তলায় ও একটু মাটি পাক।

—তুই তো চাকরি করছিস? তাতে দুজনের সংসার চলবে না?

—তা হয়ত টেনেটুনে চলবে। বিশাখা শ্যাম্পু করা চুল আলগা ঘাঁটল,—কিন্তু মৈনাকের ইগোটা সামলাব কি করে? মুখে যতই প্রগতির ঝাণ্ডা ওড়াক, বউ-এর পয়সায় খেতে হবে এটা ও মানতে পারবে?

বিশাখা ছড়ানো কাগজ গুছিয়ে এক জায়গায় করল। টেপরেকর্ডার থেকে ক্যাসেট বার করে বিছানার কোণে রেখেছে।

ঝিনুক ব্যাগ থেকে টাকা বার করল,—নীলাঞ্জনার জন্য কী কিনবি ঠিক করলি?

—মিউজিকাল ক্লক। বাজলেই ঘণ্টায় ঘণ্টায় আমাদের কথা মনে পড়বে নীলুর। বিশাখা টাকাটা চাপা দিয়ে রাখল,—এই, তুই নীলুকে কি বলেছিস রে? তোকে তেড়ে গালাগাল দিয়ে গেল।

—বরাবরই তো দেয়। নতুন কি-করলাম?

—বোস্টনের কাছে তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, তুই নাকি রিফিউজ করেছিস? ট্রু?

—ট্রু। কিন্তু সে তো বহু দিন আগের কথা! এখনও নীলু মনে রেখেছে?

—নীলাঞ্জনা ঘোষ কোনও কথা ভোলে না। ও নাকি বোস্টনকে বলে রেখেছিল, এমন এক বন্ধুকে শো করবে যে নীলুর মত ললিতলবঙ্গলতা নয়। দরকার হলে সে গুণ্ডাদের সঙ্গে লড়ে যায়। ডাকাবুকো। মারকুট্টা। কাগজে ছবি বেরোয়।

—তো?

—মারকুট্টা বন্ধুকে দেখাতে পারেনি বলে নীলুর প্রেস্টিজে গ্যামাকসিন।

—অ্যাই, তুই বার বার আমাকে মারকুট্টা মারকুট্টা বলছিস কেন রে?

—বারে, তুই মারপিট করিসনি?

—লাফাঙ্গাদের বজ্জাতিতে বাধা দেওয়া আর মারপিট করে বেড়ানো দুটো কি এক?

—ওয়াও। কী লজিক বস্। বিশাখা হেসে লুটিয়ে পড়ল। ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে কপট ত্রাসে হাতের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে,—শ্রবণা, প্লিজ ওভাবে তাকাস না। আমার বুক কাঁপছে।

ঝিনুক হাসল না। নিষ্পলক দেখছে বিশাখাকে। বন্ধু!

—তুমি জানো না বস্, তোমার মধ্যে বেশ একটা ম্যাচো ব্যাপার ডেভেলাপ করেছে। জোরে জোরে বাতাস শুঁকল বিশাখা,— হুঁউউ, একটা মেল অ্যারোগেন্স-এর গন্ধ পাচ্ছি যেন? সোঁদা সোঁদা? ঝাল ঝাল?

হাওয়ায় কে যেন বেহালার ছড় টেনে দিয়ে চলে গেছে। মোড়ায় পড়ে থাকা একটা মেয়েদের ম্যাগাজিন তুলে দু-চার পাতা ওল্টালো ঝিনুক। বাইরের মেঘলা আকাশ নতুন করে মনে ঢুকে পড়ছে। ঘরের ভিতর ছড়িয়ে গেল শ্রাবণ মাস।

বিশাখা লক্ষই করল না ঝিনুককে,—আর একটা টপিক আসছে আমার হাতে। আসবি? একসঙ্গে কাজ করা যাবে? তোরও ভাল লাগবে টপিকটা।

ম্যাগাজিনের একটা ছবিতে ঝিনুকের চোখ গেঁথে আছে। ছবি নয়, সোয়েটারের নকশা। ছেলেদের। নেভি ব্লু মেরুন আর সর্ষে-হলুদের কম্বিনেশান। তূণীরের ছিপছিপে ফিগারে ডিজাইনটা দারুণ মানাবে। ছবি থেকে সোয়েটারপরা তূণীরের ঘ্রাণ ভেসে এল যেন। তূণীর কী করছে এখন? ঠিক এই সঘন মুহূর্তে? ছবিতে চোখ রেখেই মেঘমগ্ন ঝিনুক প্রশ্ন করল,—কি টপিক?

—হ্যারাসমেন্ট অফ ওয়ার্কিং উইমেন ইন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। ভাল না টপিকটা?

—ভালই তো। মন্দ কি। ঝিনুক ম্যাগাজিনটা যথাস্থানে রাখল।

—আসছিস তা হলে?

—না।

বাবলগাম টাগরায় আটকে নিল ঝিনুক।

—এসেই উঠছিস যে? তূণীরের সঙ্গে প্রোগ্রাম?

ঝিনুক গলার কাছে জমাট নিশ্বাসটাকে গিলে নিল। তূণীর এখন সিঁড়ি খুঁজছে। খুঁজুক। ক্রমশ নির্বান্ধব হয়ে উঠছে এই পৃথিবী। নিঃসঙ্গ। নির্জন। কোথায় যে এখন যায় ঝিনুক!

.

এগারো

শান্তি পারাবারের কাছে এসে মনটা থিতিয়ে এল ঝিনুকের।

পুরনো আমলের পাঁচিলঘেরা দোতলা বৃদ্ধাশ্রম। গেটের পাশে এক ফালি জমি। পাঁচিলের গায়ে এক বিশাল আমগাছ। নিষ্ফলা। ঝাঁকড়া। এত ঝাঁকড়া যে দোতলার বারান্দা থেকে পশ্চিমের ছুটন্ত পৃথিবী প্রায় অদৃশ্য। সামনের বড় রাস্তা বেয়ে বিরামহীন গাড়িঘোড়ার আনাগোনা। সকাল থেকে রাত, দৃশ্য নেই, শুধু শব্দ আর শব্দ। ওই শব্দই যা ভিতরের নিশ্চল পৃথিবীর সঙ্গে বাইরের টগবগে দুনিয়ার একমাত্র যোগসূত্র।

মৃণালিনী দোতলার বারান্দায় বসেছিলেন। রোজ বিকেলেই যেমন থাকেন। ঝিনুককে হঠাৎ দেখে তাঁর মুখে শঙ্কা টলমল,—তুই আজ যে বড়? বাড়ির খবর ভাল তো? রুমকি? পিসিরা?

—বাবারে বাবা, সব্বাই ভাল। ঝিনুক হাত তুলে বরাভয় দিল, —তোমার মেয়ে আলিপুরদুয়ারের ফ্লাডে কদিন একটু সাঁতার কাটছিল, এখন ব্যাক টু প্যাভিলিয়ান। বাবুয়া সরেজমিন করে পরশু ফিরেছে। আজ আমাদের বাড়ি আসবে। হোলনাইট ছোটনের সঙ্গে ওর আজ ভিডিও দেখার প্রোগ্রাম। অনন্ত নাচগান। আর ইলিশমাছ।

সময়ের আঁকিবুকি-কাটা মৃণালিনীর শুভ্র মুখে হাসি ফুটল। ফুটেই আছে শুধু। এই হাসিটুকু ঠিক যেন অন্তরের নয়। খুশি দেখাতে হাসি ধরে রাখতে হয়, তাই বুঝি ঠোঁটদুটো অল্প ছড়ানো। তাঁর ছেলে, ছেলের বউরা যাও বা নিয়মমাফিক দর্শন দেয় কখনও সখনও, ছোটন বাবুয়া তো একেবারেই না। আষাঢ় মাসে তাও একবার ছোটনকে চোখের দেখা দেখেছিলেন। বাবুয়াটাকে যে কত দিন দেখেননি! যেভাবে চোখের জ্যোতি কমে আসছে দিন দিন, এরপর হয়ত দেখেও আর চিনতে পারবেন না!

আরও জনা কয়েক বৃদ্ধা পশ্চিমের বারান্দায় বসে আছেন। নিঝুম। তাঁদের পায়ের কাছে জোব্বাজড়ানো সূর্যের ম্লান রশ্মিমালা।

ঝিনুক একটা চেয়ারের দিকে তাকিয়ে হাসল, —হাঁটুর ব্যথাটা কমেছে?

চেয়ারে প্রাণসঞ্চার হল,—নারে ভাই, নাটুর ছেলে এ হপ্তাতেও এল না।

—দূর থেকে কমিউনিকেশান হবে না ম্যাডাম। প্রভা-মা’র কান একেবারেই গেছে। ডায়ালটোন নেই। রিসিভার ডেড্।

পুরুষকণ্ঠ শুনে ঝিনুক চমকে তাকাল। শরৎ। মেঘ ছিঁড়ে এল নাকি! নাকি উদোবুধোর মত মাটি ফুঁড়ে!

—আপনি রোব্বারে? আপনারতো আজ ডেট নয়?

শরৎ ঘোষাল যেন আরও বেশি অবাক,—আপনি রোব্বারে? আপনার তো আজ ডেট নয়?

দুজনে একসঙ্গে শব্দ করে হেসে উঠেছে। শব্দের স্পন্দনে সব কটা চেয়ার যেন নড়েচড়ে উঠল। তারপর আবার নিথর।

মৃণালিনী ঝিনুককে বারান্দায় বসিয়ে কি একটা কাজ সারতে নিজের ঘরে গেছেন, ঝিনুক শরতের সঙ্গে গল্প করছিল। গত দেড়-দু মাসে শরৎ ঘোষালের সঙ্গে তার আলাপ বেশ জমে উঠেছে। শরৎ আইনকানুনের নানান প্যাঁচপয়জার শিখিয়েছে ঝিনুককে। শরৎ সম্পর্কে ঝিনুক জেনেছে অনেক কিছু। কোর্টের চাকরিতে আসার আগে স্কুলমাস্টারি করত লোকটা। উস্থির কাছে রামরামপুরে একাই থাকে। বই পড়ে পড়ে হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। কোর্টের চাকরিতে তেমন আঠা নেই। তবে পছন্দসই কেস পেলে জান লড়িয়ে দেয়।

ঝিনুক জিজ্ঞাসা করল,—আপনার আশ্রম খোলার কদ্দুর?

শরৎ বলল,—সর্বনাশ! ফাঁস হয়ে গেছে প্ল্যানটা?

—ঠাম্মাদের কাছে এসে এসে আপনারও দেখছি ঠাম্মাদের দশা। সঙ্গদোষে স্মৃতিলোপ। ঝিনুক ভ্রূকুটি হানল,—আপনি নিজেই আমাকে বলেছেন। ঠিক ওই চেয়ারে বসে। আজ থেকে ধরুন গিয়ে দিন বারো আগে।

—বলেছিলাম বুঝি? তা হলে আপনার নামও যোগ হল।

—কিসে?

—ডোনেশান লিস্টে। মৃণাল-মা’র সঙ্গে কথা হচ্ছিল। যাদের যাদের প্ল্যানটার কথা বলব তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ডোনেশান নিতে হবে।

ঝিনুক ভুরু কুঁচকে তাকাল।

শরৎ হাত-পা নেড়ে বুঝিয়ে চলেছে,—ল্যান্ড একটু আছে ঠিকই, কিন্তু শুধু জমিতে তো আর আশ্রম হয় না। নিদেনপক্ষে চালাঘর চাই। গ্রামে পাকাবাড়ি না হলেও চলবে। যারা ওখানে থাকবে, তাদের পাকা ঘরে ঘুমই আসবে না।

—ঠাম্মা কত দিচ্ছে?

শরৎ যেন ঝিনুকের সুর ধরে ফেলল, —আপনি টাকা ডোনেশানের কথা ভাবলেন নাকি? টাকা লোকে দেবে কোন ভরসায়? আমিই বা কোন স্পর্ধায় নেব? আপনারা খালি একটু শ্ৰম ডোনেট করবেন ব্যস। ঘরখেদানো মেয়েদের পাশে একটু দাঁড়ানো, দু-চারটে অনাথ বাচ্চার জন্য একটু দরদ, অল্পসল্প লেখাপড়া শেখানো…। কেতাবী নয়, পৃথিবীকে চিনতে শেখে এমন পড়াশুনো। পারলে মেয়েদের সেলাই ফোঁড়াই। বিশ্বসংসারে কেউ যে ওদের পাশে নেই সেটা যেন ওরা ভুলতে পারে, এই আর কি।

মৃণালিনী চেয়ারে এসে বসলেন। স্বগতোক্তির মত বিনবিন করে চলেছেন,—যা সামান্য টাকা জমিয়েছিল, সব এখন এভাবে ওড়াবে।

—মোটেই মৃণাল-মা’র কথায় কান দেবেন না। উনি নিজে গিয়ে ওখানে থাকবেন বলেছেন। মেয়েদের হাতের কাজ শেখাবেন।

—শান্তিপারাবার ছেড়ে ঠাম্মা চলে যাবে! যাহ্!

মৃণালিনী নিরাসক্ত স্বরে বললেন,—এ ঘাটে তো অনেক দিন হল রে। বড় ভিড় বাড়ছে এখানে। দেখিস না, নিচের নোটিস বোর্ডে আজকাল ওয়েটিং লিস্টে নাম ঝোলে? যারা এখানে আছে তারাই সব ওয়েটিং লিস্টের প্যাসেঞ্জার, আবার এখানে আসার জন্যও ওয়েটিংলিস্ট! মজাটা ভাব।

ঝিনুক বলল,—আমার মজা লাগছে না। তুমি কেন চলে যাবে?

—দুর পাগলি। যাচ্ছি কোথায়? শেষ কদিন নয় আরেক ঘাটে নৌকো ভেড়ালাম।

ঝিনুকের মুখ আমসি। কোন এক অজগাঁয়ে চালচুলোহীন এক আধবুড়োর পাগলামিতে এই বয়সে মেতে উঠবে ঠাম্মা! তবে ঠাম্মা যদি মনঃস্থির করে থাকে তো যাবেই। ঝিনুক জানে।

শরৎ বলল,—এত ঘাবড়ে গেলেন কেন? এখন শুধু গোঁফে তেল মাখানোই চলছে। এঁচোড়ের দেখা নেই তো পাকা কাঁঠাল! তার চেয়ে বরং আপনার কেসের কথা ভাবুন। দিন তো ঘনিয়ে এল। শুনলাম, ওরা আরও বড় উকিল লাগাচ্ছে।

—জামিনের দিনও তো নামী উকিল ছিল!

—তিনি তো থাকছেনই। নতুন যিনি আসছেন, তাঁর কাছে ইনি চুনোপুঁটি। হোমরাচোমরা বাড়ির মামলা বলে কথা। রবীনদা বলছিল ডাক্তারটার নাম নাকি বছর তিনেক আগে শেরিফ হওয়ার জন্য উঠেছিল।

—হবে। অত খবর রাখি না।

—না রাখলে চলবে কেন? প্রতিপক্ষের শক্তির আন্দাজ না পেলে কোমর বাঁধবেন কি করে?

—আমি ঠিক আছি। শুধু রমিতা চৌধুরী যদি গুবলেট না করে, সুপ্রিম কোর্টের পয়লা নম্বর ল’ইয়ারও ওদের শ্রীঘরবাস আটকাতে পারবে না।

শিশুর মুখে বাঘ মারার গপ্পো শুনে বড়রা যেভাবে হেসে ওঠে, শরৎ অবিকল সেভাবে হেসে উঠল। পিঠ চাপড়ানোর ভঙ্গিতে বলল,—ভাল। কনফিডেন্স্ উইনস্ হাফ দা ওয়ার। আমার হিসেব মতো রমিতা চৌধুরী পাল্টি খেলেও শুধু আপনার সাক্ষ্যের জোরে শাস্তি হতে পারে। তেমন কড়া না হলেও কিছুটা তো বটেই। তবে আরেকটা কথাও আপনাকে কিন্তু মনে রাখতে হবে। আত্মবিশ্বাস অর্ধেক যুদ্ধ হারিয়েও দেয়। জঙ্গল শান্ত থাকলে ভাববেন না জঙ্গল ফাঁকা। বাঘ ঘুমিয়েও থাকতে পারে। অথবা শিকারের প্ল্যান ভাঁজছে। ভুলবেন না ওদের নখ দাঁত অনেক বেশি হিংস্র। শান দেওয়া। একটা খবর জানেন? আপনার সেই ওসিটি বদলি হয়ে গেছে। ইন্ দা ইন্টারেস্ট অফ পাবলিক সার্ভিস।

—সে কি! উনি তো সবে মার্চে এসেছেন শুনেছিলাম!

—আরে বাবা, নবাবজাদাদের ধরে ফেলল, কোর্টে কড়া রিপোর্ট পাঠিয়ে দিল, পনেরো দিন হাজতে পুরে রাখল, তার খেসারত দিতে হবে না? অবশ্য রুটিন ট্রান্সফারও হতে পারে। পুলিশে এ রকম হয় মাঝে মাঝে।

ঝিনুকের পলকে মনে হল ভূতুড়ে কলটার কথা বলে শরৎকে। থাক্, শরৎ ঘোষাল শুনলে ভাববে ঝিনুক ভয় পেয়েছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে প্রশ্ন করল,—আচ্ছা আপনার সেই বউটার কী হল?…ওই দুটো বাচ্চাওয়ালা? খোরপোষ চাইতে গিয়েছিল? স্বামী পিটিয়েছে? কেসটার রায় বেরনোর কথা ছিল না?

—আর বলবেন না, সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড। পরশু জাজমেন্ট বেরিয়েছে। এক বছর জেল হয়েছে লোকটার।

—বাহ্, এতো সুখবর।

—শুনে প্রথমটায় আমারও তাই মনে হয়েছিল। শরৎ হাসছে মিটিমিটি,—ম্যাজিস্ট্রেটের ঘর থেকে বেরোতেই বউটার কী গালাগাল আমাকে। খোরপোষ দেয় না, বাচ্চাদের দেখে না, ওই তো বর! সেই বরকে নাকি আমিই জেল খাটাচ্ছি। পেটে অন্ন নেই, সিঁদুরের দোহাই পেড়ে কান্না!

একতলা থেকে একটা চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছিল। অনেকক্ষণ ধরেই। হঠাৎই আওয়াজ আরও উচ্চগ্রামে। শরৎ উঠে রেলিং-এর ধারে গেল।

মৃণালিনী বললেন,—অনুর গলা। এমন চেল্লায়! কে মাথায় ঢুকিয়েছে ওর ছেলেমেয়ের চিঠি নাকি নিচের অফিস মেরে দিচ্ছে। এমনিই দিন-মাসের বোধ ছিল না, এখন সময়ের বোধটাও গেছে। আজ যে পোস্ট অফিস বন্ধ…

শরৎ ঘুরে তাকাল,—সত্যিই কি এ বাড়িতে রবি সোম মঙ্গল, সকাল সন্ধে, এ সবের কোন অর্থ আছে মৃণাল-মা?

—আছে বইকি। মৃণালিনী হেসে ফেললেন,—এই দ্যাখ না, রোববার বিকেল শেষ হতে না হতেই গোটা দোতলা খালি। সব অফিসঘরে টিভির সামনে গিয়ে বসেছে। বিজ্ঞাপনও গিলবে।

শরতের কালো চোখ ঝিকমিক করে উঠল,—যাই বলুন মৃণাল-মা, টিভির বিজ্ঞাপন দেখলে লোম খাড়া হয়ে ওঠে। আপনার মনে হয় না, পুরনো দিনগুলো আবার ফিসে আসছে? অ্যাট লিস্ট ফেরার স্মেল্ আনছে? বলেই দৌড় লাগিয়েছে শরৎ,—আজ চলি। সুশীলা-মা’র ঘরে একটা ঢুঁ মেরে স্ট্রেট বাড়ি।

বিকেল মরে গেছে। ঝিনুকের দৃষ্টি অনেকক্ষণ ধরে আমগাছে স্থির। নিস্ফলা গাছের ডালে ডালে পাখিদের গৃহে ফেরার উল্লাস। শব্দটা কান পেতে শুনছে ঝিনুক। শুনতে শুনতে আচমকা মৃণালিনীর হাত চেপেছে,—তোমার কখনও একা লাগে না ঠাম্মা?

মৃণালিনী ঝিনুকের হাত ধরেই উঠে দাঁড়ালেন, —ঘরে চল।

তিনটে খাট। তিনটে ছোট ছোট কাঠের টুল। প্রতিটি খাটের পাশে একটা বেঁটে আলমারি। আলমারির গা বেয়ে উঁচু করে সাজানো তোরঙ্গ। দেওয়ালের খাঁজে কাঠের র‍্যাকে আয়না। কাপড় ঝোলানোর আলাদা আলাদা দড়ি। ঠাকুরের আসন। সদ্য কলি-ফেরানো দেওয়ালে পেরেক গজালের জঙ্গল। জঙ্গল থেকে ঝুলছে তিন বাসিন্দার ছেলেমেয়ে নাতিনাতনি। স্বামীরাও। মালপত্রে ঠাসা ঘরে হাঁটাচলার জায়গা নেই।

মৃণালিনী ধূপ জ্বালিয়ে ঠাকুরের সামনে আসনপিঁড়ি হয়ে বসেছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলে মিনিট পাঁচেক ধ্যানে বসা তাঁর দীর্ঘকালের অভ্যাস। ঝিনুক জানে ঠাম্মার ঠাকুরদেবতায় তেমন আস্থা নেই, তবু ওই ধ্যানে বসা কেন? হয়তো নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলার জন্যই! মূর্তিটা হয়ত উপলক্ষ!

ঝিনুক দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দেখছিল। বেশিরভাগই রঙজ্বলা। ঝাপসা ঝাপসা। মৃণালিনীর ভাগের দেওয়ালে একটা বড় গ্রুপ ফটো। এই ছবিটা শুধু ঠাম্মার কাছেই আছে। ঠাম্মা দাদু মা বাবা কাকামণি কাকিমা আর ছোট্ট পাঁচ বছরের গালফোলা ঝিনুক। কাকার বিয়ের ঠিক পর-পরই ভোলা। চারু-মার্কেটের বাড়ির বারান্দায়। সেই স্বপ্নে দেখা বারান্দা! ওই ছবির সব চেহারা এখন বদলে গেছে। মা অনেক ভারিক্কি, কাকিমা শীর্ণ। কাকামণির প্রাণবন্ত মুখটা একদম বুড়োটে। বাবার চেহারা প্রায় একই আছে তবু যেন ছবির মানুষটা বাবা নয়। সময়ের একই ব্যবধান একই ছবির মানুষদের কত ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বদলে দিয়েছে! সময়ের গতি যদি উল্টোদিকে বইয়ে দেওয়া যায়, তবে কি ছবির চেহারায় আর ফিরতে পারবে সকলে? ঝিনুকের গা শিরশির করে উঠল।

মৃণালিনীর ধ্যান ভেঙেছে,—অ্যাই, তুই চা খাবি?

—না। ঝিনুকের গলা কেন যে ধরে এল!—তুমি একটু আমার পাশে বোসো তো।

—খা না। তাহলে আমারও একটু নেশা করা হয়।

মৃণালিনী ব্যস্ত ভাবে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

ঝিনুক বারান্দায় এসে দাঁড়াল। পিছনের ঘর থেকে আলো পড়ে শুনশান বারান্দার একটা অংশ উজ্জ্বল। বাকিটা আবছায়ায় রহস্যময়।

মৃণালিনী দু কাপ চা নিয়ে ফিরলেন। এ বাড়ির প্রত্যেক সক্ষম বৃদ্ধাই নিজের কাজ নিজে করেন। রান্নাবান্না ঘরদোরের কাজেও যৌথভাবে হাত লাগান সকলে। রুগীর সেবাতেও। এ নিয়ম মৃণালিনীরই তৈরি করা।

বেতের চেয়ারে পাশাপাশি বসেছে দুজনে। ঝিনুক মৃণালিনীর কাঁধে মাথা রাখল। আহ্হ্। আবার সেই সুবাস। তূণীর ঝিনুকের এই ঠাম্মাকে দেখেনি। বেচারা!

ঝিনুক বলল,—তূণীর এর মধ্যে একদিন তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে।

—হুঁহ্। সে আর এসেছে! তুই নিশ্চয়ই তাকে ভয় দেখিয়েছিস! নিশ্চয়ই বলেছিস বুড়িটা খুব রাগী। দজ্জাল।

—তুমি আর রাগী দজ্জাল কোথায়। ঝিনুকের স্বরে প্রচ্ছন্ন বিষাদ,—ওই সব বিশেষণ তো লোকে আমাকেই দিচ্ছে আজকাল।

মৃণালিনী ঝিনুকের মাথায় হাত রাখলেন,—বালাই ষাট। আমার এত সুন্দর নাতনিকে কে এ কথা বলে, হ্যাঁ?

—সবাই বলছে। স্কুলে বলছে। বন্ধুরা বলছে। শুধু তাই নয়, বলছে আমার ভেতর নাকি ব্যাটাছেলে ব্যাটাছেলে ভাব এসেছে।

—তোর নিজের কি মনে হয়?

—জানি না। আমি কি বদলে গেছি ঠাম্মা? নাকি সবাই ভুল বলছে?

—ভুল কেন বলবে? মৃণালিনীর হাসি নিবে এল,—যতটা দেখতে পায় তাই দিয়েই বিচার করে। জলের মাছ যেমন জলের বাইরে মুখ তুললেও চতুর্দিক সম্পূর্ণ দেখতে পায় না, আমরাও সে রকম। আঁশের মতো সংস্কার লেগে আছে গায়ে। আর সংসার হল সেই জল, যেখানে আমরা মাছেদের মতো খেলে বেড়াই। রোজ যা দেখছি তার বাইরে কিছু দেখলে আমরা সেটাকে মানতেই পারি না। গণ্ডারের মত তেড়ে যাই। নিজেদের সংস্কার দিয়ে দেগে দিয়ে বলি, এটাকে বলে পুরুষালি, এটাকে বলে মেয়েলি। জোয়ান অফ আর্কের গল্প পড়িসনি? যাদের জন্য লড়াই করল, তারাই তাকে পুড়িয়ে মারল!

টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে এলোমেলো বাতাস। চিনচিনে জমাট কষ্টটা কমছে আস্তে আস্তে। ঝিনুক বলল,—আমি তো জোয়ান অফ আর্ক নই ঠাম্মা। আমি একটা অতি সাধারণ মেয়ে। আমার মা বলে আমি ব্যাটাছেলের বাপ, বাবা তো চায়ই না আমি নিজের ইচ্ছেমতো এগিয়ে যাই।

—বাবা মা কি ছেলেমেয়ের জীবন ঠিক করে দেওয়ার মালিক? তারা একটা দূরত্ব অবধি বড় জোর রাস্তা দেখাতে পারে। প্রত্যেকের নিজের জীবন বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আছে। মৃণালিনীর গলা কর্কশ শোনাল,—আমার ছেলেরা তাদের মতো হয়েছে তাদের নিজেদের ইচ্ছেয়। আর তুই মেয়ে বলেই যেটা তুই ঠিক ভাবিস, সেটা করার তোর জোর থাকবে না? মনে রাখবি তুই যা, তুই ঠিক তাই। নিজের কাছে পরিষ্কার থাকাটাই সব।

—তুমি ঠাম্মা নিজের কাছে পরিষ্কার থাকতে পেরেছ চিরদিন?

—উহুঁ, পারলে কি আর আমার সন্তানরা একই গণ্ডীতে জীবন কাটিয়ে দিতে পারত? আমার ভেতরেও নিশ্চয়ই প্রচুর ফাঁক ছিল।

ঝিনুক চুপ করে রইল। জীবজগতের সব্বাই নিজের তৈরি গর্তেই সেঁধিয়ে থাকতে চায়। কজন আর বেরোতে পারে!

মৃণালিনী নাতনিকে কাছে টানলেন,—তোর তূণীর কী বলে? সে কী চায়?

দমকা বাতাসে আমগাছের পাতাগুলো কেঁপে উঠল। আলো পড়ে সিক্ত পাতারা চিকচিক কছে এখান সেখানে।

ঝিনুক দু দিকে মাথা নাড়ল,—জানি না ঠাম্মা।

.

বারো

ভরদুপুরে দিনটা হঠাৎ হারিয়ে গেল তূণীরের। বেলা বারোটা নাগাদ ফ্যাক্স মেসেজ। ডিরেক্টর বোর্ডের এক মেম্বার কাল রাতে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। ব্যাঙ্গালোরে। খবরটা আসার পর থেকেই অফিস জুড়ে চাপা ছুটির মেজাজ। ছোট্ট একটা কনডোলেন্স মিটিং সেরে যে যার ব্যাগ-ঝোলা গোছাতে শুরু করেছে। কিন্তু হায়! তূণীর এখন এই আলটপকা আসমান থেকে ঝরে পড়া হিসাবের বাইরের দিনটাকে নিয়ে কি যে করে! টেবিলে বেশ কিছু অ্যাকাউন্টসের কাজ জমে আছে। কাগজপত্র নিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসলে হুশ করে পার হয়ে যেত দিনটা। তবে আজকের পক্ষে সেটা বোধহয় বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।

নীলম টয়লেট থেকে কাচঘেরা কিউবিক্‌ল্‌-এ ফিরল। যে কোনও ছুটি পেলেই সে খুশিতে রঙিন হয়ে ওঠে। কাঁধের দোপাট্টা গোছাতে গোছাতে টেবিলের কিছু ফাইলকাগজ ড্রয়ারে চালান করল নীলম। তারপর তূণীরের দিকে ঘুরেছে,—হাই তূণীর। আর কি? চলো কাটি।

নীলমের চকচকে বাদামি চোখে চোখ রাখল তূণীর,—কাটতে তো হবেই। কিন্তু যাই কোথায় বলো তো?

—যেখানে খুশি যাও। জাহান্নমে যাও। সেকেন্ড হুগলি ব্রিজ থেকে ঝাঁপ কাটো। ব্রিগেডে গড়াগড়ি খাও। ভিক্টোরিয়ায়… ভিক্টোরিয়ায়…। নীলম তুরন্ত বাংলা বললেও মাঝে মাঝে সঠিক শব্দ খুঁজে পায় না, তখন হাতের মুদ্রাই তার মনের ভাব। তার দু হাত নাড়া দেখে তূণীর বুঝতে পারল তাকে ভিক্টোরিয়ার মাথায় হামা টেনে উঠে যেতে বলছে নীলম।

তূণীর হেসে ফেলল,—দেন? চুড়োয় ওঠার পর?

—হ্যাভ ফান উইথ দ্যাট কালো পরী। কালো পরীই বা কেন! তোমার তো একটা পরী আছেই। ব্রেভ অ্যান্ড বিউটিফুল। রিঙ হার আপ।

তূণীরের মনেও সেরকমই একটা ইচ্ছা খেলছিল। নীলমের সামনে অবশ্য নিজেকে নিস্পৃহই রাখল,—সে নয় আমার একটা বন্দোবস্ত হতে পারে। তুমি কি করছ?

—সোজা জয়ের অফিসে গিয়ে টেনে বার করব ওকে। দেন মুভি টুভি এনিথিং। নন্দনে কী চলছে?

—নো আইডিয়া। কিন্তু ম্যাডাম, তোমার বর যদি না বেরোয়?

—ঘাড় ধরে টেনে বার করব। না বললে টেংরি তোড় দুংগী উসকা। যাবে নাকি আমাদের সঙ্গে? তোমার গার্লফ্রেন্ডকেও ডাকো। গঙ্গার ধারে স্কুপে জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে।

—না থাক। টু ইজ কম্পানি ফোর ইজ র‍্যালি।

—বাত মত বনাও। শাদির এক বছর বাদ টু ইজ কম্পানি আর থাকে না ইয়ার। সচ বলো তোমারই গার্লফ্রেন্ডকে অকেলা পাওয়ার জন্য দিল হুম হুম করছে।

তূণীর কাঁধ ঝাঁকাল যার উত্তর হ্যাঁও হয়, নাও হয়।

—বাআই। নীলম টুকুস করে চোখ টিপে উড়ে যাচ্ছে। তূণীর প্যাট প্যাট করে নীলমের দোদুল্যমান নিতম্বের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড।

পাশের কিউবিক্ল্-এ সান্যাল হুটপাট করে টেবিল গোছাচ্ছে। বিয়ের পর থেকে অফিসে এক মিনিট বাড়তি সময় থাকতে রাজি নয় ছেলেটা। আগে তূণীর বললেই আটটা-নটা অবধি কাজ করত। এখন সারাক্ষণ বাহানা। গুলগাপ্পি।

নিজের মনে হাসল তূণীর। হাসি হাসি মুখেই ঝিনুকদের নম্বর ডায়াল করেছে। নরম গদিমোড়া চেয়ারে ছেড়ে দিয়েছে শরীরটাকে।

ও প্রান্তে ঝিনুকের মা।

—কে, তূণীর? এ মা, ঝিনুক এইমাত্র বেরিয়ে গেল।

—কোথায় গেছে জানেন?

—সে কি আর আজকাল কাউকে বলে বেরোয়! তার এখন লম্বা লম্বা পা! শুধু বলে গেল বিকেলে ফিরবে। তোমার নাকি আজ সন্ধেবেলা আসার কথা?

—হ্যাঁ, সেরকমই একটা কথা হয়েছিল।

—শুনেছ তো, ওর বন্ধু নীলাঞ্জনা পরশু বোস্টন চলে যাচ্ছে? কী তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট ভিসা করে ফেলল! বর নিয়ে কাল দেখা করতে এসেছিল। তা ঝিনুক নেই, আমার সঙ্গেই বসে বকবক করে গেল। বরটা যেন কেমন! ক্যাবলা ক্যাবলা। কি করে যে ওদেশে গেল! তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে?

সুজাতা টেলিফোনে কথা বলার সময় উত্তরের প্রত্যাশায় থাকে না। যত কথা আছে সব একসঙ্গে বলে ফেলবেই। পিকপিক করে এক্সচেঞ্জ থেকে ঘণ্টা বাজিয়ে গেলেও। সে বলেই চলেছে,—এই জানো তো, তোমার এনে দেওয়া অ্যাডেনিয়ামটায় কী সুন্দর লাল ফুল এসেছে। ঠিক লাল নয়, গোলাপি গোলাপি। তবে যাই বলো, গাছের তুলনায় ফুলগুলো বড় বড়। বেমানান লাগে। আর ওই এক মানুষ আছে ঝিনুকের বাবা, কিছু জানে না, বোঝে না, কোথায় কার কাছে শুনেছে অ্যাডেনিয়ামের ফুল নাকি টকটকে লাল হয়।

তূণীরের অসহ্য লাগছিল। চার পাঁচদিন দেখা না হলেই এত বেশি কথা জমে যায় ভদ্রমহিলার! সে প্রায় অভদ্রভাবে সুজাতাকে থামাতে চাইল,—ঠিক আছে গিয়ে শুনব। এখন রাখি।

—আরে আরে এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড। তুমি আজ রাসেল স্ট্রিট থেকে একটা বার্ড অফ প্যারাডাইস এনে দেবে? ঝিনুক বলছে ওটা নাকি টবে হয় না, আমি করে দেখিয়ে দেব। আনবে?

—দেখি যদি পাই। তূণীর টুক করে নামিয়ে রাখল রিসিভারটা। ওফ্, কী বকবক! কী বকবক! সকাল থেকে দিনটা আজ যা যাচ্ছে! বাড়ি থেকে বেরোনর আগে দিদির সঙ্গে এক চোট হয়ে গেল। বিয়ে দিয়ে পার করা হয়েছে তোকে, থাক তুই বর বাচ্চা নিয়ে তোর সংসারে, নয় যখন তখন বাপের বাড়ি এসে হামলা! খবরদারি! মৌলালি থেকে রোজ একবার ছুটে আসছে ঢাকুরিয়ায়। মা, ওই হলুদ পদা আবার টাঙিয়েছ কেন? ঘরের রঙের সঙ্গে মোটেই মানাচ্ছে না। বাবা, তুমি মোগলাই খাচ্ছ যে? তোমার না কাল অম্বল হয়েছিল! ডিসগাস্টিং। তূণীরকে তো মোটে পাত্তাই দিতে চায় না তনিমা। মাত্র পাঁচ বছরের বড়, তাতেই যা কর্তারি! সকালে আজ কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ এসে হম্বিতম্বি, বাবাকে নিয়ে বিকেলে ডাক্তারের কাছে যাবি। ধর্মতলা স্ট্রিটে। ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়ন্টমেন্ট করা আছে। ঠিক চারটেয়। নিজে উনি যাবেন জামাইবাবুর কোন বন্ধুর বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে, তূণীরকে ওঁর হুকুম তামিল করতে হবে! তূণীর যত বোঝায় বাবার তেমন কিস্যু হয়নি, চাকরি ফুরোবার আগে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক হলে সকলেই ও রকম একটু ভেঙে পড়ে। বাবার অসুখ শরীরে নয়, মনে। সাইকোসোম্যাটিক কেস। বিনা কারণে বুক ধড়ফড়। পান থেকে চুন খসলে নাগাড়ে ট্যাকট্যাক, ঝুপুৎ করে বুড়োটে মেরে যাওয়া, সবই সিমটম। আরে বাবা, পুরুষমানুষের কাছে চাকরি হল লাইফফোর্স। মেয়েরা তার বুঝবেটা কি! কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে মানুষটাকে। মেয়েদের মতো তো ঘরমোছা বাসনমাজা রান্নাবান্না নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকতে পারবে না! মার মতো সরকারী চাকরিও করা নয়! উলবোনা আর পরনিন্দা পরচর্চার চাকরি! মেয়েদের সার্ভিস লাইফ আর ছেলেদের সার্ভিস লাইফে আকাশপাতাল তফাত। নীলম যে নীলম সেও তো ফাঁক পেলে মার্কেটিং-এর লিস্ট তৈরি করছে! তূণীরের এ সব যুক্তি মানবে তার দিদি! তা হলেই হয়েছে। সোজা বলে দিল,—কথার প্যাঁচ ছাড়। সংসারের কোনও দায়িত্ব নিতে চাস না সেটাই বল।

তারপরেই জোর ঝগড়া।

তূণীর বলল,—আমার সময় নেই। আমি তোমার মত ন মাস ছুটির চাকরি করি না। আমার অফিসে ডিসিপ্লিন আছে। হুট বললেই বেরিয়ে পড়া যায় না।

—হুঁহ, করিস তো যোগবিয়োগ আর খাতা লেখার কাজ। তার এত ফুটুনি কিসের রে?

—তোর কলেজে পড়ানোর চাকরির থেকে অনেক বেশি রেসপন্সেবল কাজ। গোটা হেড অফিসের অ্যাকাউন্টস সামলায় এই শর্মা। বুঝলি? আর আমি অফিসে কি করি না করি তাই নিয়ে তুই কথা বলার কে? আমার টাইম নেই, আমি যেতে পারব না ব্যাস। তুই আমাকে জিজ্ঞেস করে অ্যাপয়ন্টমেন্ট করেছিস? অন্যের বাড়ি এসে ফোঁপরদালালি করতে তোর লজ্জা করে না?

—অন্যের বাড়ি মানে? এটা আমারও বাড়ি।

—ভাগ। যদ্দিন বিয়ে হয়নি তদ্দিন তোর বাড়ি ছিল। এখন যা, বরের ঘর সামলাগে যা। বুবাই-এর পড়াশুনো দ্যাখ, বিজনদার শরীরস্বাস্থ্যের খবর রাখ, ভালমন্দ রান্নাবান্না কর আর মাঝে মাঝে কলেজ গিয়ে মাইনেটা তুলে নিয়ে আয়। তোদের প্রিন্সিপালের তো আবার মেয়ে দেখলেই নাল পড়ে। ক্লাস তো তোদের না নিলেও চলে। ফের যদি তুই এখানে এসে দালালি মারিস…

—কি করবি তুই অ্যাঁ? অসভ্য কোথাকার। ঝিনুকের মত একটা সেন্সেটিভ মেয়ে কি করে যে তোকে স্ট্যান্ড করে!

পিত্তি জ্বালানো কথা! মা মাঝখানে এসে না পড়লে হয়তো ছেলেবেলার মতো চুলোচুলিই হয়ে যেত আজ! দিদিটা ভাবে কি! ঝিনুক যে একটা সাহসী কাজ করে ফেলেছে তা কি তূণীর জানে না! নাকি তূণীর কম আনন্দ পেয়েছে তাতে! তূণীর মোটেই মধ্যযুগীয় বর্বর পুরুষ নয়। একটা মেয়ের কৃতিত্বকে সে মন খুলে হাততালি দিতে জানে। এ অফিসের সবাইকে সে গর্ব করে বলে বেড়ায়নি ওই শ্রবণা সরকার তারই নিজস্ব নারী! শুধু তারই। ঝিনুকেরও বলিহারি। তোর কি দরকার ছিল নাচতে নাচতে আমাদের বাড়িতে এসে স্কুলের মেডেল দেখানো! এমনিতেই তো গুণ্ডা দমন করে তোর দর হেভি হাই। আগে কানই পাতা যেত না, মাঝে কথাটা থিতিয়ে এসেছিল, আবার শুরু হয়ে গেল। প্রাইজ পেয়েছে ; পেয়েছে। তাই নিয়ে তূণীরকে উঠতে বসতে খোঁচা মারা কেন? উঁহু বাবা, যতই তূণীরকে খোঁচাও আর যতই ঝিনুককে গ্যাস দিয়ে বাচেন্দ্র পাল করে তোলো, একটা কথা তো ভুললে চলবে না, বিছানাতে ঝিনুক তূণীরের নিচেই থাকবে।

তূণীর টানটান হল। বাড়ি থেকে বেরোতেই আরেক কিস্যা। আরেক দফা মাথা গরম। ভদ্রলোকের মতো লাইন দিয়ে শেয়ার ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে আছে, চোখের সামনে একটা ধুতিপরা মাঝবয়সী ভিজে বেড়াল বেলাইনে স্স্যাট করে উঠে বসলো ট্যাক্সিতে! তূণীরের জায়গাই বেদখল। তূণীরও ছাড়বে না, লোকটাও গ্যাঁট। একবার তূণীর টান মেরে দরজা খোলে, লোকটা ঘ্যাচাং করে বন্ধ করে দেয়। ব্যাটা ভিজে বেড়ালকে তূণীর টেনে নামাতই, ট্যাক্সি-ড্রাইভারটা ভট করে বলে বসল,—দোর মসাই, টাসকির গেট নিয়ে মাস্তানি মারছেন। কেন? যান যান। পরের গাড়িতে আসবেন। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে হুক্কাহুয়া,—আরে মোশাই। যেতে দিন। ফালতু ঝামেলা পাকিয়ে সবার লেট কাচ্ছেন কেন? পেছনে তো আরেকটা এসে গেছে, উঠে পড়ন না। তূণীরকে ঘাড় নিচু করে পরের ট্যাক্সিতেই উঠতে হল। শালা। নেলসন অ্যান্ড বেরির অ্যাকাউন্টস এগজিকিইউটিভ, সাতাশ বছরের টগবগে সি এ তূণীর মজুমদার, বিলকুল হিন্দি ফিল্মের বোকা ভিলেন বনে গেল। অফিসেও সাত মিনিটের ওপর লেট। এত কিস্যা চটকে যে অফিসে আসা, সে অফিসও আজকের মত চৌপাট। শ্রীমতী বাচেন্দ্র পালও বাড়ি থেকে ভ্যানিশ। কাঁহাতক ভাল লাগে!

তূণীর টেবিলের কম্পিউটারটার দিকে তাকাল। সবুজে পর্দায় আবছা ভেসে রয়েছে তার মুখ। মুখের পিছনে সার সার কিউবিক্ল্-এর ছায়া। খসখস টাঙানো কাচের জানলা। জানলার কোলে এয়ারকুলার। তূণীর যন্ত্রগণকের চোখ দিয়ে দেখছে চতুর্দিক। অফিস প্রায় ধু-ধু। মোলায়েম হিমেল সুখ অলসভাবে গড়াচ্ছে কাচের খোপে ভরা প্রকাণ্ড হলঘরে। এই পরিবেশে কাজ ছাড়া বসে থাকলে আপনাআপনি চোখ বন্ধ হয়ে আসে।

…মিহি তন্দ্রায় গন্ধটা নাকে আসছিল তূণীরের। শালফুলের গন্ধ। মিষ্টি। কিন্তু ঝাঁঝালো। ধোঁয়া ধোঁয়া বাতাসের আড়াল সরিয়ে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে পিচঢালা রাস্তা। কোটি কোটি সাদা, শালফুলে আদিগন্ত বয়ে যাওয়া রাস্তার কালো রঙ নিশ্চিহ্নপ্রায়। রাস্তা ধরে চঞ্চল বালিকা হয়ে ছুটছে ঝিনুক। ছুটছে। ছুটছে আর শালফুল কুড়োচ্ছে। আঁচলভরা ঘ্রাণ নিয়ে তূণীরের সামনে এসে দাঁড়াল ঝিনুক। সুখের উত্তেজনায় তার নাকের পাটা কাঁপছে তিরতির। থুতনির খাঁজে, ছোট্ট চিবুকে, ঘন আঁখিপল্লবে বাষ্পবিন্দু। তূণীর ছুঁতে গেল ঝিনুককে। ঝিনুকের মুখমণ্ডলে এ কিসের কণা! স্বেদ! কামনা! নাকি শালফুলের রেণু! ঘন নীল আকাশ ছায়া ফেলেছে ঝিনুকের চোখের তারায়। ম্যাসানজোরের হ্রদ দুই মণিতে টিলটিল।

কে যেন শব্দ করে কেশে উঠল। ভেঙে দুমড়ে গোটা দৃশ্য খানখান। রাস্তা নেই। রাস্তার দু পাশের অনন্ত শালবন উবে গেছে। তূণীর চমকে চোখ খুলল। বুক ভরে জোর জোর নিশ্বাস টানল কয়েকবার। নাহ্, শালফুলের গন্ধও নেই। চারদিকে শুধু বিদেশি রুমম্প্রের রাসায়নিক সবাস। আবার খাস টানল। কলেজজীবনের দৃশ্যটা কেন আজ অফিসেও এসে হাঁটু গেড়ে বসল!

ছোট একটা আড়মোড়া ভেঙে টয়লেটে গেল তূণীর। মুখে ঘাড়ে জল দিল ভাল করে। এ বার! এ বার সে করেটা কী? তার খুব একটা নিজস্ব বন্ধুবান্ধব নেই। বড় জোর ডালহাউসি পাড়ার সৌম্য বা অনীশের অফিসে যাওয়া যেতে পারে। সে নিজে অফিসে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে ভালবাসে না। গত সপ্তাহে সৌম্যর অনুরোধে দুপুরে রেস্তোঁরায় খেতে বেরোতে রাজি হয়নি। তার কি উচিত অন্যের অফিসে গিয়ে আসর জমানো?

অফিসের টয়লেটেও মনের চিন্তার প্রতিফলন মুখে পড়তে দেয় না তূণীর। তার সূক্ষ্ম ধারণা আছে হয়তো বা আয়নাটাও অদৃশ্য গোয়েন্দা হয়ে ম্যানেজমেন্টকে পৌঁছে দেবে তার প্রতি মুহূর্তের চিন্তার ডেটা। চার্লি চ্যাপলিনের মর্ডান টাইমস-এর সেই টয়লেটের মতো। প্রসন্ন মুখভঙ্গি করে তূণীর আয়নার দিকে তাকাতে চাইল। ভঙ্গিটা ঠিক হল না যেন। ফর এ চেঞ্জ বাড়ি ফেরা মন্দ কি! দশ বিশ মিনিট গড়িয়ে বাবাকে ডাক্তারের কাছেই নয় নিয়ে গেল!

নিজের কিউবিকল-এ ফিরতে গিয়ে দাঁড়াতে হল তূণীরকে। বেয়ারা। ফিনান্স ম্যানেজার ডাক পাঠিয়েছে। আশ্চর্য! রজত রায় এখনও যায়নি!

তূণীরকে দেখে রজত হৈহৈ করে উঠল,—আরে মজুমদার এসো এসো। কদিন ধরেই তোমায় একটু ফাঁকায় ধরব ভাবছিলম। আজ চান্স এসে গেল। বাসো।

তূণীর ভুরু তুলল,—এনি প্রবলেম স্যার? বালাসোরের অ্যাকাউন্টস-এর ঝামেলাটা তো মিটে গেছে।

—আই নো। রজত সিগারেট ধরিয়ে কিং সাইজ প্যাকেট এগিয়ে দিল তূণীরের দিকে,—ও সব কিছু না।

তূণীর বড় একটা সিগারেট খায় না, তবু ধরাল, —দেন?

—তাড়া কিসের? বোসো।

রজত তূণীরের চেয়ে বছর পনেরোর বড় হলেও তাদের সম্পর্ক বেশ খোলামেলা। এ অফিস পুরো আমেরিকান কায়দায় চলে। বয়স স্ট্যাটাস এ সব নিয়ে তেমন কোনও ছুঁৎমার্গ নেই।

রজত তরল গলায় বলল,—কফি চলবে?

তূণীর কাঁধ ঝাঁকাল।

বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে কফির অর্ডার দিল রজত। তারপর রিভলভিং চেয়ারে আয়েস করে বসেছে। দু হাতলে হাত বিছিয়ে। ঘরের বাতানুকূল যন্ত্র ঝিনঝিনে ঠাণ্ডা ছড়াচ্ছে। এমন উগ্র শীতল কক্ষেও রজতের জামার দু তিনটে বোতাম খোলা। একটু বেশি মদ্যপান করে বলে তার গরম বোধ বেশ চড়া।

ধীরে সুস্থে কথা শুরু করল রজত,—তোমার জন্য একটা খবর আছে। সিক্রেট। অ্যান্ড কনফিডেনশিয়াল।

তূণীরের শিরদাঁড়া সোজা হল।

রজত চোখ টিপল,—তোমার বেটার হাফ চলে গেছে? নীলম দি ইরোটিকা?

—অনেকক্ষণ। তূণীর হাসার চেষ্টা করল।

—তুমি লাকি আছ মজুমদার। ও রকম একটা ভলাপচুয়াস লেডির সঙ্গে ঘর শেয়ার করছ। অল মোস্ট টেন আওয়ারস আ ডে।

তূণীর রজতকে দেখছিল। রজত যথেষ্ট ঝানু লোক। তার ভারী মুখে সহজে কোন প্রতিক্রিয়া ফোটে না। হাসতে হাসতে বলছে,—জানো ও রকম একটা বেডপার্টনার পেয়েও ওর বরটা একটা অন্য মেয়েছেলে নিয়ে ঘোরে?

এই কথা বলার জন্য ডেকেছে রজত? তূণীর অবাক হওয়ার ভান করল,—তাই নাকি! স্ট্রেঞ্জ!

রজতও দেখছে তূণীরকে। মাপছে। সে অবলীলায় মেয়েদের নিয়ে অশ্লীল আলোচনা চালাতে পারে।

অন্য সময় হলে তূণীর মজা পায়। এক-আধটা রসিকতাও করে। আজ একটু অধৈর্য বোধ করছিল।

রজত হঠাৎই ভাবলেশহীন মুখে বলল,—সেই বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটা মনে আছে মজুমদার?

তূণীরের হৃৎপিণ্ড দড়াম করে লাফিয়ে উঠেছে,—আছে।

—তোমার চান্সটা ব্রাইট হয়েছে। মিস্টার জোনস ওয়াজ অল প্রেইজ ফর ইউ। তোমাকে দেখে চোখে লেগে গেছে। কি হে, চান্স পেলে যাবে তো?

অপ্রত্যাশিত আনন্দসংবাদে তূণীর বাক্যহারা। কলের পুতুলের মতো শুধু মাথা নেড়ে চলেছে।

—ক্যালিফোর্নিয়ায় তিন বছর! হাউ ইজ দা আইডিয়া ম্যান?

গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা হল তূণীরের,—দ্যাটস মাই ড্রিম স্যার।

—প্রবলেম একটাই। রজত জামার আর একটা বোতাম খুলে দিল। তার নির্লোম বুকের অনেকটাই উদ্ভাসিত,—আচ্ছা মজুমদার, নীলম নাকি টয়লেটে বহুক্ষণ সময় কাটায়? রিসেপশনের নীনা বলছিল?

রজতের নারীদোষের কথাও এ অফিসের সবাই জানে। নীলম সম্পর্কে ইদানীং তার আগ্রহ খুব বেড়েছে। হয়তো পাত্তা পায় না বলেই।

তূণীর দায়সারা জবাব দিল,—আমি ঠিক নোটিস করিনি।

—দ্যাটস দা গুড থিং ইন ইউ। ওই জন্যই আমি তোমাকে বেশি পছন্দ করি। কুরুভিলার থেকেও। রজত কফিতে চুমুক দিল,—হ্যাঁ যা বলছিলাম। প্রবলেম হল, ডাইরেক্টার পারসোনেল কুরুভিলার কিরকম রিলেটিভ হয়। খুব ক্লোজ নয়, কিন্তু লতাপাতায় একটা ফ্যামিলি টাই আছে।

তূণীর নিবে গেল সামান্য। এ তথ্য তার জানা ছিল না।

রজত কলেপড়া ইঁদুর দেখে যেন মজা পেয়েছে,—আরে চিয়ার আপ। কুরুভিলা মেননকে খুব ধরেছে। বাট আই ডোন্ট থিংক হি ক্যান উইন। আমি আমার সমস্ত ওয়েট তোমার জন্য ফেলব। বিকজ কুরুভিলার থেকে তুমি অনেক বেশি সিনসিয়ার। যেতে হলে তুমিই যাবে।

—থ্যাংক ইউ স্যার। তূণীর নিজেকে যথাসম্ভব সামলে ধীরে ধীরে কাপে চুমুক দিল। ভয়ে ভয়ে বলল,—আমি কি তবে বাড়িতে বলতে পারি, আই অ্যাম সিলেক্টেড?

—বলবে বলবে: গ্র্যাজুয়ালি ভাঙবে। রজত হেসে উঠল,—আমি যখন ফার্স্ট স্টেটসে যাই, ইন দা ইয়ার নাইনটিন সেভেনটি সিক্স, জানো, আমি আমার বউকে কী ভাবে সারপ্রাইজ দিয়েছিলাম? তখন মাই বউ ওয়াজ মাই গার্লফ্রেন্ড। কি করেছিলাম জানো? তিন বন্ধুকে সঙ্গে করে সোজা ওকে ম্যারেজ রেজিস্টারের অফিসে হাজির করলাম। রুনা তো ঘাবড়ে একসা। বলে, বাবাকে বলে আসিনি, কি করে বিয়ে করব! আমি স্ট্রেট চিঠিটা সামনে ফেলে দিলাম। যখন ওর ঘোর কাটল, তখন সই কমপ্লিট। রুঁনার অবশ্য পাসপোর্ট ভিসা পেতে একটু দেরি হয়েছিল। বাট দ্যাট ওয়াজ আ রিয়েল হানিমুন। একটা নতুন দেশ… ডিসেম্বর মাস…ক্যালিফোর্নিয়ায় সারা দিন রাত স্নো ফল চলছে। বরফ পড়াটা যে কী রোমান্টিক! শিমুল তুলোর মত…। ব্লু মুন…। বাই দা বাই, তুমি বিয়ে করছ কবে? বলতে বলতে রজত আচম্বিতে উঠে দাঁড়িয়েছে,—এক মিনিট। আসছি। বলেই অ্যাটাচড্ টয়লেটে ঢুকে গেল।

তূণীরের চোখের সামনে ক্যালিফোর্নিয়া। কাচের ঘরে বসে তুষারপাত দেখছে তূণীর। গায়ের খুব খুব কাছে ঝিনুক। ঝিনুকের দুপুরাইটিস সেরে যাচ্ছে। শালফুলের গন্ধে ভরে গেল ক্যালিফোর্নিয়া।

প্যান্টের জিপার আটকাতে আটকাতে ফিরল রজত,—সুগারটা বোধহয় বেড়েছে মজুমদার। চেকআপ করাতে হবে।

তূণীর শুনতে পেল না।

রজত ঘুরনচেয়ারে বসে পাক খেয়ে নিল একটা,—তোমার গার্লফ্রেন্ডের কি যেন নাম? আরে খুব ফেমাস নাম…নিউজ পেপারে বেরিয়েছিল…

তূণীর স্বপ্নের ঘোরেই উত্তর দিল,—শ্রবণা।

—হ্যাঁ হ্যাঁ শ্রবণা। আচ্ছা শ্রবণা মানে কী মজুমদার? এনিথিং রিলেটেড টু হিয়ারিং?

তূণীর হেসে ফেলল,—না না। শ্রবণা একটা নক্ষত্রের নাম।

—তাই বুঝি? ভেরি অ্যাপ্রোপ্রিয়েট নেম। সত্যিই শি ইজ এ স্টার। আমি বোধহয় তোমার সঙ্গে ওকে একদিন দেখেছি। নিউ এম্পায়ারের দোতলায়। ঠিক না?

—আপনার মেমারি তো দারুণ স্যার! কদ্দিন আগে দেখেছেন, এখনও মনে আছে!

—কম্পিউটার মেমারি। ডিটেলড ডেসক্রিপশন দিতে পারি। ভেরি সুইট লেডি। চার্মিং। অ্যান্ড স্মার্ট অলসো। ডেয়ারিং। রজত হাসতে হাসতে আবার চোখ টিপল,—ফিগারটা ভাল। ইউ আর এ লাকি উগ।

শেষ ইঙ্গিতটুকু ভাল লাগল না তূণীরের। তবু মুখে বলল, —থ্যাংক ইউ স্যার।

রজত কুঁকল তূণীরের দিকে। তার মুখ অকস্মাৎ গম্ভীর,—লেটস কাম টু দা পয়েন্ট। ঝোপেঝাড়ে লাঠি চালিয়ে লাভ নেই। শোন, ফিনান্স ডিরেক্টারের একটা প্রোপোজাল আছে। রিকোয়েস্টও বলতে পারো। তুমি রাধেশ্যাম গুপ্তাকে চেনো? আর জি? দা রিনাউনড় প্রোমোটার?

কলিং বেল টিপতে গিয়ে হাত কেঁপে গেল তূণীরের। মাত্র চারতলা উঠেই এত শ্রান্তি আজ!

ঝিনুক ড্রয়িং-স্পেসে একজন লোকের সঙ্গে বসে কথা বলছিল। তূণীরকে দেখেই ঝিনুকের চোখে ঝাড়বাতি জ্বলে উঠেছে। পরিচয় পালার অপেক্ষা না করেই লোকটাও উঠে দাঁড়িয়েছে,—আপনি নিশ্চয়ই তূণীর? আমি শরৎ ঘোষাল।

ক্লান্ত তূণীর সোফায় বসল। শুকনো হেসে বলল,—আপনার কথা ঝিনুকের মুখে অনেক শুনেছি।

সুজাতা তূণীরকে দেখে নিরাশ। তূণীরের হাতে কোনও স্বর্গের পাখি নেই।

শরৎ আর ঝিনুকের সামনে এক গোছা কাগজের কাটিং। ঝিনুক ফুটছে উল্লাসে। এত খুশি এত উচ্ছ্বস ঝিনুকের মুখে বহুদিন দেখেনি তূণীর। সেই শালফুলের রেণুসিক্ত মুখ। সেই আঁচলভরা সুঘ্রাণ। তূণীরের দু চোখ ঘুরে ফিরে ঝিনুককেই দেখছে। চঞ্চল বালিকার মত এই নারী শুধু তার। তারই। এই মুহূর্তে ওই নারীকে ছুঁয়ে ছেনে দেখতে ভারি লোভ জাগছিল তূণীরের।

ঝিনুক কাগজের গোছা সরিয়ে তূণীরের দিকে তাকিয়েছে,—অ্যাই, আজ অফিসে তুই মারধর খেয়েছিস নাকি রে? জানেন শরৎবাবু, ওদের ফিনান্স ম্যানেজার ওকে মাঝে মাঝেই কান ধরে টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখে।

শরৎ হো হো করে হেসে উঠল,—সে তো আপনার ঠাকুমাও আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখেন। টেবিলে নয়, রাস্তায়। রোদ্দুরে। দু হাতে থান ইট দিয়ে।

তূণীর স্বাভাবিক হতে চাইছে। বলল,—আপনার অপরাধ?

—আমার ওষুধে সাতদিনের বদলে এক হপ্তায় জ্বর ছাড়ে, সেটাই আমার অপরাধ।

গেঁয়ো রসিকতা। তূণীর মনে মনে নাক কুঁচকোল। উপেক্ষা করতে চাইল লোকটাকে। সরাসরি ঝিনুকের সঙ্গে কথা শুরু করল,—বুঝলি, আজ ডিসিশান মোটামুটি ফাইনাল হয়ে গেল। আমিই যাচ্ছি। হয়তো ডিসেম্বরেই।

—তাআই! ঝিনুক বাচ্চা মেয়ের মত তূণীরের পাশে এসে বসে পড়ল,—এত বড় খবরটা এতক্ষণ চেপে আছিস?

ঝিনুকের উল্লাসে সুজাতাও ছুটে এসেছে। সব শুনে স্বর্গের পাখির দুঃখ বেবাক হাপিশ। সঙ্গে সঙ্গে নতুন চিন্তা,—আর তো তোমার ওজর আপত্তি চলবে না। কবে যাব তোমার বাবা মার কাছে?

ঝিনুকের মুখে রক্তের আভা। আড়চোখে শরৎকে দেখে আলতো ধমক দিল মাকে,—এত হুটোপাটি করছ কেন? তুমি না সত্যিই…!

তূণীর মৃদু হাসছে। শরৎ উঠে দাঁড়াল,—আমি আজ বরং উঠি। আপনারা গল্পসল্প করুন। গুড নিউজ দুটো কালই মৃণালমাকে পৌঁছে দেব।

চাষাড়ে লোকটার কথায় আগ্রহ নেই তূণীরের। সে চশমা খুলে রুমালে মুখ মুছছে।

ঝিনুক বলল,—সত্যিই আজ দিনটা দারুণ। তোর এমন একটা গ্র্যান্ড নিউজ, আমারও। জানিস গতকাল পুলিশ চার্জশিট ফাইল করেছে। শরৎবাবু নিয়ে এসেছেন খবরটা।

নিমেষে তূণীর ক্যালিফোর্নিয়ার বরফের স্তূপ। ঝিনুকে সেদিকে নজরই নেই। সে আজ কথার নেশায় মাতাল,—শরৎবাবু বলছিলেন এ সব কেসে ডেট বেশ তাড়াতাড়ি পড়ে। অন্তত ওই ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরে। বাছাধনদের এ বার খাঁচাতে ঢুকতেই হবে।

শরৎ! শরৎ! শরৎ! তূণীর হাঁটুতে মুঠো ঘষছে। এক্ষুনি লোকটাকে ঘাড় ধরে বার করে দেওয়া যায় না?

শরৎ যাওয়ার আগে দরজায় দাঁড়াল একবার মনে হয় আপনার ডেট সেপ্টেম্বরেই পড়বে। আমি আপনাকে পরে জানিয়ে যাব।

নির্জন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে তূণীর। ঝিনুক পাশে এসে দাঁড়াল,—কি ভাবছিস?

তূণীরের প্রায় বুকের কাছে তার প্রিয়তম নারী, তুষার তবু গলতেই চায় না। সহসা অস্ফুটে বলে উঠল,—ঝিনুক, তুমি আমাকে একটা কথা দেবে?

সচকিত হরিণীর মত থমকেছে ঝিনুক,—তুই! তুই…! তুই হঠাৎ! কি হয়েছে তোর? হয়েছেটা কি!

তূণীরের গলা দুলে গেল,—আগে তুমি আমাকে কথা দাও।

নিচের কম্পাউন্ডে আলো জ্বলছে না। কাঁঠালিচাঁপা গাছ শুকনো হাত পা মেলে আঁধারে দাঁড়িয়ে।

তূণীর রেলিং-এ ভর দিল,—ও সব শরৎ ডাক্তার, ফরৎ ডাক্তার তুমি ছাড়ো। যত সব মাথা চিবোনোর লোক।

—মানে?

—এ কেস থেকে তুমি নিজেকে অ্যালুফ করে নাও ঝিনুক। কথা দাও। নেবে তো?

নিশ্বাস আটকে এল ঝিনুকের। গলা কাঁপছে,—হঠাৎ এ কথা কেন?

তূণীর ঢোঁক গিলল, —কার না কার নোংরা একটা কেসে এত বেশি নিজেকে জড়িয়ে ফেলা তোমাকে মানায় না ঝিনুক।

পৃথিবী গতি হারাল। সন্ধ্যা নিথর।

.

তেরো

স্বামীর বিহনে নারী যাইবে কোথা।

স্বামী সহচর বন্ধু স্বামী সে দেবতা॥

স্বামী ভিন্ন গতি অন্য নাহি নারীগণে।

ব্ৰত তীর্থ পূজা হোম স্বামীর চরণে॥

নাকি সুরে দুলে দুলে সত্যনারায়ণের পাঁচালি পড়ছে বৃদ্ধ পুরোহিত। তাকে ঘিরে অর্ধবৃত্তাকারে নানান বয়সী সুবেশা নারী। কেউ কেউ পাঁচালির ছন্দে দুলছে মৃদু মৃদু। অধিকাংশেরই পাঠে মন নেই, যে যার নিজস্ব সঙ্গী খুঁজে পার্শ্ব আলাপে রত। ড্রয়িংরুমের সোফাসেট দেওয়ালের গায়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নীল কালো মোজাইকের মেঝে জুড়ে আজ নারায়ণ পুজোর আয়োজন।

রমিতার শাশুড়ি গরদের শাড়ি পরে গরমে হাঁসফাঁস করছিল। লাল টুকটুকে স্লিভলেস ব্লাউজের স্ট্র্যাপ আঙুলে চেপে ধরছে বার বার। ইশারায় সে বড় ছেলের বউকে ফ্যানদুটো চালিয়ে দিতে বলল।

পাখা ঘুরে উঠতে রমিও স্বস্তি পেল। বহুক্ষণ ধরে তার গা গুলোচ্ছে, চার মাস হতে চলল, এখনও বমি বমি ভাবটা যায়নি। ধূপধুনো, গুগ্গুলের গন্ধে একটা চোরা স্বাসকষ্টও হচ্ছিল তার। পাঁচালি পাঠ ছেড়ে এ সময় উঠে যাওয়াও যায় না। শাশুড়ি অসন্তুষ্ট হতে পারে। বিশেষত তার আর পলাশের জন্যই যখন আজ এই অনুষ্ঠান।

বেনারস থেকে পুরী যাওয়ার পথে গুরুদেব তিন দিনের জন্য এ বাড়িতে অধিষ্ঠান করেছিলেন। তাঁর মতে প্রকীর্ণপাতকে দুষ্ট হয়েছে এই গৃহ। রমিতাকে তিনি স্বহস্তে নবগ্রহ কবচ পরিয়ে দিয়ে গেছেন। দোষ কাটানোর জন্য বিধানও দিয়ে গেছেন কিছু। প্রতিদিন স্নান সেরে শুদ্ধ শরীরে পাখিদের এক মুঠো করে আতপ চাল খাওয়াতে হবে রমিতাকে। স্টিল নয়, কাঁসা বা কাচ নয়, কদলীপত্রে আহার করতে হবে বাড়ির সকলকে। এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমা। শনি মঙ্গলবার রমিতার স্বামীসহবাস নিষিদ্ধ। এ ছাড়া তিন মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে একদিন গোমাতাকে স্বহস্তে পূর্ণ ভোজন করাতে হবে। গোমাতাই। ষাঁড় বা বলদ চলবে না।

দময়ন্তী রমিতার কানে ফিসফিস করে বলল,— এত উশখুশ করছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে?

রমিতার তসরের শাড়ি খালি খালি গা থেকে নেমে যাচ্ছে। কোমরে আঁচল খুঁজে সে পিঠ সোজা করল,— না, ঠিক আছি। কটা বাজে গো?

দময়ন্তী পলাশের জাঠতুতো দিদি। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স। বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপিকা। রমিতার বিয়ের সময়ও তার এক ঢাল চুল ছিল, সম্প্রতি সে পুরোপুরি ববছাঁট। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের শাড়ি জমানো তার প্রিয় নেশা। আজও তার পরনে জমকালো আঁচল বাসন্তী রাজকোট। মানানসই ব্লাউজের পিঠ অনেকখানি কাটা। এ বছরই সে গুরুদেবের কাছে দীক্ষা নিয়েছে। ব্রেসলেট প্যাটার্নের কোয়ার্টজ ঘাড় দেখে নিয়ে সে বলল,— বারোটা দশ। তোর ক্ষিদে পেয়েছে বুঝি?

রমিতা দু দিকে মাথা নাড়ল। তার আজকাল একদমই ক্ষিদে পায় না। ডাক্তার একগাদা টনিক দিয়েছে, তাতেও না।

দময়ন্তী রমিতার দিকে আরও ঘেঁষে এল,— হ্যাঁরে, গুরুদেব নাকি পুলুর কুষ্ঠি দেখে বলে গেছেন তোর ছেলেই হবে!

—হুঁ।

রমিতা-দময়ন্তীর সংলাপ লীনা কান খাড়া করে শুনছিল। পিছন ঘুরে সে মন্তব্য করল,— সঙ্গে অবশ্য বলেছেন, যদি কোন গ্রহের গণ্ডগোল না হয় তবেই।

দু তিনটে বাচ্চা খেলা করতে করতে দৌড়ে ঘরে ঢুকেই বেরিয়ে গেল। পাঁচালি পাঠ প্রায় শেষ। পুরোহিত গলা চড়িয়েছে, —বদন ভরিয়া সবে বল হরি হরি।…হরি বল।…হরি বল।

কৃথা থামিয়ে সকলে একসঙ্গে মেঝেতে প্রণিপাত। ঘর জুড়ে চাপা গুঞ্জন,—হরি বলো। হরি বলো। সেই গুঞ্জনের মাঝে হঠাৎ হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছে এক জিনস্পরা কিশোরী,—ওহ্ নো! শেষ হয়ে গেল! মা যে প্রসাদ চড়ানোর জন্য সুইটস্ পাঠিয়ে দিল!

রমিতার মাসিশাশুড়ি বিরক্ত মুখে তাকাল,—এত দেরি করলি কেন? রিনিকে তো বলেছিলাম বারোটার মধ্যে পুজো শেষ হয়ে যাবে। বোস্। শান্তির জল নিয়ে যা।

কিশোরী কসরত করে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। মিষ্টির বাক্স হাতে হাতে পৌঁছে গেছে শালগ্রামশিলার চরণে। শান্তির জল নিতে রমিতার শ্বশুরও দরজায়। পা বাঁচিয়ে শান্তির জল মাথায় নিচ্ছে সকলে।

পুরোহিত পুঁটলি বাঁধছিল, রমিতার শাশুড়ি বলল,—ঠাকুরমশাই, আপনি ছোট বৌমার সঙ্গে গিয়ে সব ঘরেই একটু করে শান্তির জল ছিটিয়ে আসুন। আমার ছেলেদের জন্যও ঘটে একটু রেখে দেবেন।

লীনা বলল,— তুলতুলিকেও একটু দেখে আসিস তো। ঘুম থেকে উঠে গেলে আমায় ডাকি।

পুরোহিতকে নিয়ে গোটা বাড়ি ঘুরছে রমিতা। দোতলার সব ঘরে গঙ্গার জল ছিটিয়ে নিচে নামল। একতলার রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর শ্বশুরের বৈঠকখানা আর টানা বারান্দা পেরিয়ে সদর দরজায় এসেছে। দরজার পরে বাঁধানো উঠোন। পুরোহিত সেখানে জল ছিটিয়ে এসে রমিতাকে বলল, —দ্যাখো তো মা, কে যেন ডাকছে বাইরে!

মানুষসমান পাঁচিল তোলা বাড়ির বাহারি গেটে মাধবীলতার সংসার। ধুতিশার্ট পরা এক আধবুড়ো গেটের বাইরে থেকে উঁকিঝুকি মারছে।

রমিতা গেটের সামনে এল,—কাকে খুঁজছেন?

—এটাই তো তেইশের বি গলফ্ ক্লাব অ্যাভিনিউ?

—হ্যাঁ। বলুন?

—রমিতা চৌধুরী, পলাশ চৌধুরী এ বাড়িতে থাকেন?

—আমি রমিতা। পলাশ চৌধুরী আমার স্বামী।

—আলিপুর কোর্ট থেকে সমন আছে।

খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি লোকটা চেনছেঁড়া ফোলিও ব্যাগ থেকে একতাড়া কাগজ বার করে ঘাঁটছে। রমিতার মেরুদণ্ড বেয়ে ঠাণ্ডা ধারা বয়ে গেল। চকিত হ্রাসে শরীর অবশ। পলকের জন্য ভাবল শ্বশুরকে ডাকবে কিনা।

লোকটা দুটো কাগজ এগিয়ে দিল। সঙ্গে একটা বাঁধানো ময়লা খাতা।

—এখানে সাইন করুন। আপনার স্বামীরটাও আপনাকে দিয়ে যাচ্ছি।

রমিতা ক্ষীণ বাহানা জুড়বার চেষ্টা করল,— একটু দাঁড়ান, ভেতর থেকে পেন নিয়ে আসি।

—আমাদের কি দাঁড়ানোর টাইম আছে দিদি? এখনও কতগুলো সমন সার্ভ করতে হবে জানেন? বলতে বলতে লোকটা পকেট থেকে একটা ডটপেনের রিফিল বার করেছে। যত্ন করে তেল চটচটে মাথায় ঘষে নিল রিফিল, —সই করার নাম করে কত জন ভেতরে সেঁধিয়ে যায়, আর বেরোয়ই না, জানেন?

রমিতার স্নায়ু অবশ, তবু লোকটার কথা গায়ে লেগে গেল তার,—আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমি পালিয়ে যাব?

—দেখে কি আর মানুষ চেনা যায় দিদি? লোকটার ঘাঁটা মুখে নির্বিকল্প ভাব,— এই তো গত পরশু কুঁদঘাটে একটা সুন্দরপানা মেয়েছেলে ‘আসছি’ বলে অন্দরমহলে ঢুকে গেল। পাঁচ মিনিট যায়, দশ মিনিট যায়, মেয়েছেলেটা আর বেরোয় না! শেষে মরিয়া হয়ে ঢুকে পড়েছি বাড়িতে, ওমনি একটা বাছুরের মত কুকুর ঘাঁউ ঘাঁউ করে তেড়ে এল। উরি ব্বাস, সে কী সাইজ! বাঘ বলে দূরে থাক্। প্রাণ হাতে করে বাঁচা।…মাঝখান থেকে আমার নতুন ডট পেন চোট।

রমিতা ঝোঁকের মাথায় হাত বাড়িয়ে ফেলল, —দিন কোথায় সই করতে হবে।

লোকটা প্রায় রমিতার গায়ের ওপর ঝুঁকে সই করার জায়গা দেখাচ্ছে, —কিছু মনে করবেন না দিদি, পস্ট কথায় কষ্ট নেই। অনেকে আসবে, পাঁচ-দশ টাকা নিয়ে সমন না-ধরিয়ে চলে যাবে। আমি ওরকম ছিচকে বেলিফ্ নই। দরকার হলে দু পয়সা চেয়ে নেব, কিন্তু বেআইনী কাজ যুধিষ্ঠির পাখিরা করে না।

লোকটা চলে যাওয়ার পর সম্বিৎ ফিরল রমিতার। লোকটা কি প্রকারান্তরে টাকা চাইছিল? টাকা দিলে কি সমন নিতে হত না? কিন্তু সে তো ঘুষ? একটা অচেনা লোককে ঝপ করে ঘুষ দেওয়া যায় নাকি? যাক গে, নেওয়া যখন হয়ে গেছে ভেবে আর কী লাভ!

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে শ্বশুরের বৈঠকখানা ঘরে চোখ পড়ল রমিতার। শ্বশুরমশাই ইজিচেয়ারে বসে কাগজ পড়ছে। ঘরটা পেরিয়ে গিয়েও দুরু দুরু পায়ে ফিরে এল রমিতা। কম্পিত গলায় ডেকেছে, —বাবা।

রমিতার শ্বশুর চোখ থেকে কাগজ নামাল।

—বাবা কোর্ট থেকে একটা লোক এসেছিল।

—কোথ্থেকে?

—আলিপুর কোর্ট থেকে। গুটি গুটি পায়ে রমিতা আরেকটু এগিয়েছে। ঢোঁক গিলে বলল,— দুটো সমন দিয়ে গেল।

কাগজ দুটো ভাল ভাবে নিরীক্ষণ করে রমিতার শ্বশুর বিড়বিড় করে উঠল,— তোমাদের সাক্ষীর সমন! তেইশে সেপ্টেম্বর ডেট্। তুমি এটা নিতে গেলে কেন? আমাকে ডাকতে পারতে।

—লোকটা এমন ভাবে সামনে পড়ে গেল⋯আমি ঠিক সাহস করে…আমি কি ভুল করেছি বাবা?

—পুলু তোমাকে কিছু বলে রাখেনি?

—কই…তেমন কিছু…না তো!

—এত ক্যালাস ছেলে! আদিখ্যেতা ছাড়া কিছু মাথায় নেই। কত বার বলে দিলাম…ল’ইয়ারও এত করে বুঝিয়ে দিল…সেই সমনটা ধরা হয়ে গেল! তুমিও একটু চিন্তাভাবনা করলে না!

রমিতা আঙুলে আঁচল পাকাচ্ছে। বিনীত স্বরে বলল,— কিন্তু বাবা, কোর্ট ডাকলে তো সাক্ষী দিতে যেতেই হবে।

—সমন না ধরলেই আর কোর্ট ডাকে না। রমিতার শ্বশুরের গম্ভীর মুখে চরম বিরক্তি,—তুমি দেখছি বেশি বুঝে গেছ।

রমিতার মাথা ঝুলে গেল।

—নিয়ে যখন ফেলেছই, কি আর করা যাবে। যাও, রেখে দাও।

রমিতা ফিরতে যাচ্ছিল, শ্বশুর আবার ডেকেছে,— তোমার শাশুড়ি জানে?

—না।

—তিনি করছেনটা কী? এখনও দঙ্গল নিয়ে হরি হরি চলছে?

—আমি কি মাকে ডেকে দেব?

—থাক। সব মেয়েছেলেরই বুদ্ধি সমান।

মলিন মুখে সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল রমিতা। সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ একটা সরু রঙিন কাচের জানলা। বন্ধ। কাচ বিদীর্ণ করে নীল হলুদ আলো সিঁড়ির অন্ধকারে গা মেলেছে। সেই আলোতে রমিতার ছায়া। একটা করে ধাপ ওঠে, ছায়াও দীর্ঘায়িত হয়। আরেক ধাপ উঠল, ছায়া আরও লম্বা। রমিতার গা ছমছম করে উঠল। বাড়ি ভর্তি এত লোক, তবুও। এ যেন, ছায়া নয়, তার সদ্য ফেলে আসা অতীত। সে না চাইলেও থাকবে সঙ্গে সঙ্গে। প্রলম্বিত হবে ক্রমশ। দিনে দিনে।

শেষ কটা ধাপ রমিতা দৌড়ে উঠে গেল। মেয়েমহলের হাসিগল্প সেতারের ঝালার মত কানে বেজে উঠেছে। রমিতা পিছন ফিরে তাকাল একবার। ছায়াটা আর নেই।

রমিতার খাটে মামাতো মাসতুতো ননদ আর জায়েরা জোর আড্ডা জমিয়েছে। রমিতা ঘরে ঢুকতেই মাসতুতো জা হেসে উঠল খিলখিল করে, —এই, তোর বিছানা দখল।

রমিতা সামান্য চোয়াল ফাঁক করল।

মামাতো ননদ বলল,— দেখেছ, শুনেই কেমন মুখ শুকিয়ে গেছে! নারে বাবা, দখল করতে হলে লীনাবৌদির খাট রয়েছে। ওটা পুরনো পাপী।

রমিতা নীরবে আলমারি খুলল। কাগজ দুটো যে কোথায় রাখে! পলাশের জামাকাপড় ঝোলানোর ওয়াবের তাকে! উঁহু। পাল্লা আড়াল করে লকার খুলল রমিতা। ছোট্ট একটা জুয়েলারি বক্সে টুকটাক কয়েকটা গয়না আছে। এখানে সেখানে পরে যাওয়ার জন্য। কাগজদুটোকে কাঁপা কাঁপা হাতে চালান করল সেখানে। লকার বন্ধ করতে গিয়ে থমকাল একটু। আবার হাত বাড়িয়েছে ভিতরে। বেডসাইড বক্স থেকে খবরের কাগজের কাটিংটা লকারে তুলে রেখেছিল। লোকজনের চোখ এড়িয়ে শ্রবণা সরকারের ছবিতে হাত বোলালো কয়েক সেকেন্ড। ছবিটা ছুঁলেই তার স্নায়ু অনেক সতেজ হয়ে ওঠে। একটা মেয়ে অন্ধের মত এলোপাথাড়ি ব্যাগ চালাচ্ছে। ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে জানোয়াররা…।

—অ্যাই, কি করছিস রে আলমারিতে মুখ ডুবিয়ে?

রমিতা লঘু হাতে লকার বন্ধ করে খাটে এসে বসল। সে এখন অনেকটা প্রফুল্ল। হাসিমুখে বলল, —ওমা জানো না, ওখানে যে আমার প্রাণভোমরা লুকনো আছে!

—গয়নার বাক্সে?

—কোন গয়নাটায় রে? তোকে পলাশদা ফুলশয্যায় যে হিরের নাকছাবি দিয়েছিল, সেই বাক্সটায়?

রমিতা মুখ টিপে হাসল।

লীনা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, —নিচে বাবা খেতে বসে গেছেন। অ্যান্ডা বাচ্চাদেরও বসিয়ে দিয়েছি। ওপরের টেবিলে যেকজন হয়, খেয়ে নিবি আয়।

খেতে বসে পিসতুতো জা কথাটা তুলল,— তখন তুই গেটের ধারে কার সঙ্গে কথা বলছিলি রে রমিতা?

রমিতা পরিবেশন করছিল। হাত ফস্কে শাশুড়ির পাতে অনেকটা ডাল পড়ে গেল,—কখন?

—ওই যে দেখলাম তুই কি একটা সই করে নিলি?

—নাগো মালাদি, ভুল দেখেছ। অম্লান বদনে মিথ্যে বলল রমিতা,—আমি তো শান্তির জল ছিটিয়ে রান্নাঘরে গেছিলাম।

শ্যেনচক্ষু মালা হারবার পাত্রী নয়। আত্মীয়মহলে মুখরা হিসাবে তার প্রসিদ্ধি আছে। বলল, —আমি তো মাইমাদের জন্য শরবত আনতে রান্নাঘরে গেলাম, তোকে তো দেখলাম না!

রমিতার শাশুড়ি বুঝি বিপদের গন্ধ পেল। তাড়াতাড়ি বলে উঠল,—নারে মালা, রমিতা ঠিকই বলছে। আমিই ওকে রান্নাঘরে পাঠিয়েছিলাম, ভাজাভুজি সব হয়েছে কিনা দেখতে।

পরিবেশ টলমলে। দময়ন্তী হাল ধরল,—অনেক দিন পর বেশ হৈচৈ হচ্ছে। যাই বলো, ধূপ ধুনো মন্ত্র এসবে বাড়ির পরিবেশটাই কেমন বদলে যায়। মন্দির মন্দির ভাব আসে, তাই না কাকিমা?

—এটা আমাদের ঠাকুরমশাইয়ের গুণ। এমন সুন্দর মন্ত্র উচ্চারণ করেন…

রমিতার শাশুড়ির প্রিয় বান্ধবী, বিউটিপার্লারের মালকিন বলে উঠল,—মন্ত্রের তো একটা এফেক্ট আছেই। আমি তো ভাবছি পার্লারে একটা মেডিটেশানের ক্লাস শুরু করব। স্যান্স্ক্রিট হিম্স্গুলো খুব লো টোনে স্টিরিওতে বাজতে থাকবে, তার সামনে বসে ধ্যান। আইডিয়াটা কেমন দময়ন্তী?

—গ্রেট। মন্ত্রের যদি কোন এফেক্টই না থাকে তো মুনিঋষিরা কষ্ট করে লিখেছিলেন কেন? অশুভ শক্তি মন্ত্রের কাছে ঘেঁষতেই পারে না।

জিনসপরা কিশোরী নখ দিয়ে আলুর দম চিরছে। বড়দের কথার মাঝে সে আর চুপ থাকতে পারল না,—পায়েল তেরি কসমে তাই তো দেখাল। গমগম করে তান্ত্রিক মন্ত্র রিসাইট করছে আর অশুভ আত্মারা অমৃতা সিংকে ছেড়ে চোঁ-চাঁ।

—আমার তো মনে হয় এসব পুরনো শাস্ত্র-টাস্ত্র নিয়ে আরও রিসার্চ হওয়া উচিত। দময়ন্তী নিজের প্রসঙ্গে ফিরল,—সে দিন নাগার্জুনের ওপরে একটা পেপার উল্টোচ্ছিলাম। ভাবতে পারবে না কী সব কাজ করে গেছে দু-আড়াই হাজার বছর আগে। চরক শুশ্রূৎ জীবক এঁরা তো সব আয়ুর্বেদের জিনিয়াস। গাছপালা থেকে এত অজস্র চিকিৎসার ফরমুলেশান করে গেছেন! আরে বাবা, গাছপালার যদি গুণ নাই থাকবে, তাহলে ভগবান এত গাছপালা সৃষ্টি করলেন কেন?

—আমার পালারে তো তাই শুধু হার্বাল। রমিতার চোখের কোণে অত কালি পড়েছিল, কোন চিহ্ন আছে? কেমিকাল কিছু লাগালে ওর অত সুন্দর স্কিনটা নষ্ট হয়ে যেত না? ওর দিদিরও তো সে দিন এক সিটিং-এ সব ব্ল্যাকহেডস তুলে দিলাম।

—সত্যিই, রমিতাটার ওপর দিয়ে যা ঝড় গেল! মালা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার নিজের কথা খুঁজে পেয়েছে। নিরীহমুখে রমিতার শাশুড়িকে খোঁচাল,—মাইমা, ওই কেসটার কী হল?

—কে জানে। রমিতার শাশুড়ি দায়সারা উত্তর দিল,—পুলু আর পুলুর বাবা দেখছে। ওরাই জানে।

রমিতার মামাতো ননদের মুখ কাঁদ-কাঁদ,—ইশশ, পেটে বাচ্চা রয়েছে, ওরকম একটা মেয়ের সঙ্গে অসভ্যতা! কোন মানে হয়!

লীনা ছোট গামলায় রসগোল্লা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে বলে উঠল,—না না, তখন পেটে বাচ্চা ছিল না। তার তিন-চার দিন আগেই তো ওর…।

রমিতার মাসিশাশুড়ি বলল,—তোমরা আজকালকার মেয়েরা একটা কথা মানতে চাও না। মেয়েদের নিজেদের সম্মান নিজেদের হাতে। কোর্ট কাছারিতে গিয়ে, একগাদা লোকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অপমানের কথা ঘোষণা করলে এমন কিছু সম্মান বৃদ্ধি হয় না। নিজেদেরই সামলেসুমলে চলতে হয়। মহাভারতে দ্যাখোনি, দ্রৌপদীকে রাজসভায় এনে দুর্যোধনরা যে কাণ্ডটা করল, অত বড় বীরেরা সব সভায় বসে, কেউ কোন প্রতিবাদ করতে পেরেছে? করবে কি করে? দ্রৌপদী কর্ণকে অপমান করেনি? দুর্যোধনকে টিজ করেনি? দ্রৌপদীরও অনেক দোষ ছিল।

—ঠিক বলেছ দিদা। কিশোরী সায় দিল,—রূপা গাঙ্গুলি স্বামীগুলোর সঙ্গেও কী খারাপ ব্যবহার করত!

দময়ন্তী ধমকে উঠল,—এই গেঁড়ি, তুই থাম্।

মালা বলল,—আমি বাবা দ্রৌপদীর দোষ দেখি না। একটা স্বামী সামলাতেই হাড়মাস কালি হয়ে যায়! পাঁচ-পাঁচটাকে সামলানো মুখের কথা!

দময়ন্তী বলল,—তাও দ্রৌপদীর মধ্যে ভক্তিভাব ছিল; শ্রীকৃষ্ণ তাকে রক্ষা করেছিলেন। সে জন্যই তো রমিতাকে বলছিলাম, এর পর গুরুদেব এলে দীক্ষাটা নিয়ে নে। মনে আর কোন গ্লানি থাকবে না।

লীনা দময়ন্তীর পাতে রসগোল্লা দিচ্ছিল। হিম গলায় সে বলল,—হ্যাঁ হ্যাঁ, গুণ্ডা বদমাশরাও তো ঠাকুরদেবতার কম ভক্ত নয়, ওরা গন্ধ শুঁকেই বুঝে ফেলবে কোন মেয়েটার দীক্ষা নেওয়া আছে। আর ইষ্টমন্ত্রের জোরে তো মেয়েদের সব অপমানই ধুয়ে যায়, না দময়ন্তীদি?

এক লহমায় গোটা ঘরের আবহাওয়া ভারী। রমিতার সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। ছোটবেলা থেকে সে যথেষ্ট ভূক্তিমতী, বিয়ের আগে শিবরাত্রির উপোস করেছে, দূর্গা পুজো সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দিয়েছে, স্কুলে বাইবেল পড়েছে মন দিয়ে, তাহলে? তাহলে তার কেন এই বিড়ম্বনা?

বাড়ি ফাঁকা হতে হতে বিকেল গড়িয়ে এল। পরশু ভাদ্র সংক্রান্তি। তবু আকাশ এখনও শ্রাবণকে ভুলতে পারেনি। দুপুরের চিড়বিড়ে রোদ্দুরের আর চিহ্নমাত্র নেই। আকাশ এখন আবার মলিন স্লেট।

ক্লান্ত শাশুড়ি নিজের ঘরে গড়াতে গেছে। শ্বশুর বিশ্রাম নিচ্ছে নিচের বৈঠকখানায়। মেয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করেছে লীনাও। নিস্তব্ধ বাড়িতে শুধু রমিতারই আঁখিপাতা সজাগ। একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়ছে তার বুকে। কেন যে সে নিয়ে ফেলল সমনটা? কিন্তু কোর্টের লোকটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তখন তো সরবার ক্ষমতাও ছিল না রমিতার। ক্ষমতা ছিল না? নাকি তারই মনের অতলে একটা সূক্ষ্ম ইচ্ছের জন্ম হয়েছিল সেই মুহূর্তে? ওই নোংরা ছেলেদের শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে। বিশ্বসংসারের সামনে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ইচ্ছে। সাবানের বুদ্বুদের মতো ক্ষণস্থায়ী, তবু তো ইচ্ছে। হায় রে, ইচ্ছে যদি জাগেই, তবে কেন রমিতা তাকে হৃদয়ে অনির্বাণ রাখতে পারে না? কেনই বা নির্বাপিত ইচ্ছেগুলো অহরহ জ্বলে জ্বলে উঠতে চায়? যন্ত্রণা দেয় রমিতাকে? কেন?

রমিতা বিছানা ছেড়ে জানলায় গিয়ে দাঁড়াল। ঝমঝম বৃষ্টি নেমেছে। অতিকায় কৃষ্ণচূড়ার কাণ্ড বেয়ে অঝোরে জল পড়ছে। গাছটার নিচে, মোটা গুড়ি ঘেঁষে জড়সড় দাঁড়িয়ে একটা কুকুর। কুকুরটা ক্ষণে ক্ষণে অসহায় চোখে তাকাচ্ছে ওপর দিকে। ঝরঝর ধারার উৎস খুঁজছে। গাছতলায় দাঁড়িয়েও কুকুরটা এক্কেবারে ভিজে জাব। মরিয়া হয়ে গাছতলা থেকে কয়েকবার বেরিয়ে পড়ার চেষ্টা করল। পারল না। মুষলধারার বল্লমখোঁচায় আবার পালিয়ে এসেছে গুঁড়ির কাছে। বেচারা। একবার যদি সাহস করে বেরিয়ে পড়তে পারে বৃষ্টিতে, হয়তো বা কোথাও বেশি নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে যাবে। নইলে আর কি হবে? ভিজবে। এমনিও তো ভিজছে কুঁকড়ে-মুকড়ে। ওইভাবে গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে ভেজার থেকে বিশাল আকাশের নিচে স্বাধীনভাবেই নাহয় ভিজল! রমিতা গ্রিলের খাঁচায় মুখ চেপে ধরল। অস্ফুট চিৎকার করছে,—যাহ্ যাহ্। বেরো। বেরিয়ে যা। কুকুরটা আর একবার বেরনোর চেষ্টা করল। আবার লেজ গুটিয়ে ফিরে গেছে গাছের নিচে। রমিতার ডাক সে শুনতে পায়নি। গুড়ির অন্য প্রান্তে, রমিতার চোখের আড়াল হয়ে, এবার তৃপ্তমনে গাছের জলে ভিজছে সে।

সন্ধ্যা দ্রুত নামছিল। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রমিতা খেয়াল করেনি কখন পলাশ ফিরেছে অফিস থেকে। কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে।

ভিজে জামাকাপড়ে পলাশ জড়িয়ে ধরল রমিতাকে,—রাজকন্যা কি গবাক্ষে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির গান শুনছে?

রমিতা বলল,—ছাড়ো। ভিজে যাচ্ছি।

—ভেজো। ভেজো। সিক্ত হও। এই বৃষ্টিতে গান গাইতে ইচ্ছে করছে না তোমার?

রমিতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিল,—আমার কিচ্ছু ভাল লাগছে না।

—ভাল লাগছে না বললে তো চলবে না সখী। আমার যে এখন ভীষণ ভীষণ ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে করছে তোমাকে।

রমিতা চোখ বুজল। পলাশ আবার দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। লাজুক পলাশও বুঝে গেছে সেই স্থির করবে, কখন সে রোমান্টিক হবে, কখনই বা দস্যু। অথবা নিস্পৃহ যোগী। এখানে রমিতার কোন ভূমিকা নেই। থাকলেও সেটা পলাশের ইচ্ছানির্ভর।

রমিতা উদাসীন গলায় প্রশ্ন করল,—কি গান গাইলে তোমার এখন ভাল লাগবে?

—এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর…

রমিতা চোখ না খুলেই বলল,—আজ সমন এসেছে।

পলাশের মনমেজাজ আজ খুব ভাল। প্রোমোশানের ফাইলটা ক্যাবিনেটে গেছে। সমন শব্দটা প্রথমটা সে গায়েই মাখল না। রামপ্রসাদী সুরে গুনগুন ভেঁজে উঠেছে,—তিলেক দাঁড়া রে সমন, নয়নভরে বউকে দেখি…সায়নকালে রুমু আমার হাসে কিনা হাসে দেখি…

রমিতার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল,—আমাদের দুজনেরই সমন এসেছে আলিপুট কোর্ট থেকে।

পলাশ চাবুক খেয়ে সিধে হল,—কখন এল? কখন? কে রিসিভ করেছে?

রমিতা আলমারি খুলে শুকনো পাজামা পাঞ্জাবি বার করে দিল পলাশকে,—দুপুরে এসেছিল। আমি নিয়েছি।

—তুমি নিয়ে নিলে?

—কোর্টের লোকটা ধরিয়ে দিল যে।

পলাশ অশান্ত পায়ে ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পায়চারি করছে,—বেলিফকে ফিরিয়ে দিতে পারতে। বলতে পারতে এখানে রমিতা চৌধুরী পলাশ চৌধুরী বলে কেউ থাকে না। ঠিকানা ভুল আছে।

—মিথ্যে কথা বলব?

—ও। তোমরা মেয়েরা তো আবার মিথ্যে বলতে পার না! মিথ্যে না বলতে পার কয়েকটা টাকা হাতে গুঁজে দিতে পারতে।

পলাশের রূঢ় স্বরে রমিতা কুঁকড়ে গেল। চলন্ত ট্রেনের আয়নায় যেভাবে ভেঙে ভেঙে যায় নিজের মুখ, সেভাবে সমস্ত ভাবনা চিন্তাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে বলল,—আমি বাবাকে বলেছি, ভুল হয়ে গেছে।

—ব্যস্, তাহলেই সাত খুন মাপ। পলাশ চিবোচ্ছে কথাগুলোকে,—কোথায় সমন? দেখি?

রমিতার হাত থেকে ছোঁ মেরে কাগজ দুটো নিল পলাশ। পড়ছে। ভিজে কুকুরটা মরিয়া হয়ে আরেকবার গাছতলা থেকে বেরোতে চাইল,—কোর্টে যখন যেতেই হবে, ছেলেগুলোকে আমরা ছাড়ব না। হতে পারে বড় বাড়ির ছেলে, আমার মানসম্মান নেই?

পলাশ জ্বলন্ত চোখে রমিতার দিকে তাকাল,—তেইশ তারিখ! মানে নেক্সট্ উইক! বলেই ভেজা জামাকাপড়ে ছুটে চলে গেছে নিচে।

রমিতা সিঁড়ির মুখে এসে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করছিল নিচটা। একতলার কোন শব্দই ওপরে আসছে না। ড্রয়িংরুমের দেওয়াল-ঘড়ি বাজনা বাজিয়ে ছ’টা বাজাল। প্রতিটি ঘণ্টার শব্দ ঢং ঢং করে বাজছিল রমিতার মাথায়।

রমিতার শাশুড়ি ঘর থেকে বেরিয়েছে,—কি হল! ওভাবে দাঁড়িয়ে কেন? পলাশ ফিরেছে বুঝি?

রমিতা নিশ্বাস বন্ধ করে মাথা দোলাল।

—মনে করে শান্তির জলটা গায়ে ছিটিয়ে দিও। মনোর মা চা দিল না যে বড়? লীনা কোথায়?

—দিদি বোধহয় নিচে। রমিতা আনমনে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল।

—দ্যাখো না একটু গিয়ে। নেশার সময় চা না পেলে…এমনিই উপোস করে মাথা ধরে আছে…

রমিতা মাটি কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল। পলাশ উঠে আসছে।

.

চোদ্দ

ঝিনুক ধৈর্য হারাল,— কে আপনি? কথা বলেন না কেন? কেন বার বার টেলিফোন করেন এভাবে?

ওপাশ থেকে যথারীতি সাড়াশব্দ নেই।

—কি মতলব বলুন তো আপনার? ভিতুর মত থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকেন!…বুকের পাটা থাকলে উত্তর দিন।

এবার শুধু একটা নিশ্বাসের শব্দ। দীর্ঘ। গাঢ়।

ঝিনুক চেঁচিয়ে উঠল,—ভেবেছেনটা কি? এভাবে বার বার ফোন করলে আমি ভয়ে কেন্নোর মত গুটিয়ে যাব? কান খুলে শুনে নিন। শ্রবণা সরকারকে এখনও আপনারা চেনেননি। যত হাজার বার খুশি উত্যক্ত করতে পারেন, শ্রবণা সরকার যা ঠিক করেছে, তা থেকে এক চুল নড়বে না। আমি আপনাদের কেয়ার করি না। আমি ভয় পাচ্ছি না।

ফোনে ঝিঁঝিঁর ডাক শুরু হল। লাইন কেটে গেছে।

ঝিনুক ক্রেড্লের ওপর আছড়ে রাখল রিসিভারটা। মাঝে মাসখানেক বেশ বন্ধ ছিল, গত সাত দিন ধরে আবার শুরু হয়েছে ভূতুড়ে কল। আগে রাতের দিকেই আসত, এখন আর সময় অসময় নেই, সকাল দুপুর সন্ধে যখন তখন ঝনঝন। মানস সুজাতা তুললে সঙ্গে সঙ্গে কেটে যায়। ঝিনুক তুললে দু-এক মিনিট পর। যেন কেউ চুপিসাড়ে পরীক্ষা করছে ঝিনুকের ধৈর্য।

এগারোটা বাজে। আজ মানসের দেরিতে ক্লাস। এখন তার আয়েশ করে খাওয়ার সময়। আচমকা আতঙ্কে ভাতের থালা ফেলে উঠে এসেছে টেলিফোনের কাছে। সুজাতা আটকে গেছে ডাইনিং টেবিলের সামনে। দুজনেরই মুখ পাণ্ডুর।

—গলা পেলি কারুর? কথা বলল?

—না।

মানসের স্থৈর্য চূর্ণবিচূর্ণ। উদভ্রান্ত স্বরে বলল,— চল্, আজ থানাতেই যাই চল্। যা হওয়ার হবে।

—আমি থানায় যাব না।

সুজাতা হাউমাউ করে উঠল,—কেন যাবি না! কেসের আগের দিন এভাবে ভয় দেখাচ্ছে…আগে তো তুইই থানায় যাওয়ার কথা বলতিস?

—অ্যাট্ লিস্ট্ কালকের জন্যও তো একটা প্রোটেকশান চাওয়া দরকার।

ঝিনুক সোফায় বসল। থানা থেকে সে পরশুই ঘুরে এসেছে। স্কুল ছুটির পর। মাধুরীকে সঙ্গে নিয়ে। নতুন ও. সিটা অতিশয় অভদ্র। বসতে পর্যন্ত বলে না! কী বিশ্রী টিটকিরি মারা কথাবার্তা! কি বলে থ্রেট করছে আপনাকে? ও, গলা শোনা যাচ্ছে না! শুধু বাঁশি শুনেই…! আপনি তাতেই ধরে নিলেন আপনাকেই শাসানো হচ্ছে! সেই ভয়ে সিঁটিয়ে থানায় দৌড়ে এলেন! ছেলেগুলো তো এমনিতেই যথেষ্ট ফেঁসে আছে ম্যাডাম, তিলকে তাল করে আরও বেশি ফাঁসাতে চাইছেন? মেয়েদের নিয়ে এই হচ্ছে ঝামেলা। ছেলেদের সমান হবে বলে বাইরেও বেরোন চাই, আবার সব সময় মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ গায়ে হাত দিয়ে দিল! ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ভাব! ঘরে বসে থাকলেও নিজে নিজেই ভয় বানিয়ে…! শুনুন ম্যাডাম, এ কমপ্লেনটা ঠিক পুলিশের আওতায় আসে না। আপনি বরং টেলিফোন অফিসে গিয়ে দেখতে পারেন। ওরা হয়তো বলতে পারবে গণ্ডগোলটা কোথায়। লাইনে, না রিসিভারে। হয়তো ব্যাটাচ্ছেলেরা অন্য কারুর লাইন আপনার সঙ্গে ভিড়িয়ে রেখেছে।…মাধুরীর সামনে সে কী বেইজ্জৎ অবস্থা!

ঝিনুক ঠোঁট কামড়ে ধরল। ওই লোকটার কাছে আবার যাবে? কখখনো না। চিন্তার শেষ অংশ মুখ থেকে ছিটকে এল ঝিনুকের,—কখখনো না।

—কখখনো না মানে? এত জেদ কিসের তোমার অ্যাঁ? আমরা ভয় পাচ্ছি, আমরা পুলিশ প্রোটেকশান চাইব, তাতেও তোমার আপত্তি?

—দ্যাখো মা, থানায় যেতে আমি ভয় পাই না। হাঁটু কেঁপেছিল তোমাদেরই। এখন তোমরাই…

—ঠিক আছে, ঠিক আছে। মানস মাঝে পৃড়ে শান্ত করতে চাইল দুজনকে,—ওকে তো কাল কোর্টে একা ছাড়ছি না। আমি যাব। ছোটনকেও বলা আছে, ও রাত্রে এসে যাবে। দু-দুজন সঙ্গে থাকলে…

—চলো, তুমি খাওয়া শেষ করবে চলো। সুজাতা মানসের হাত ধরে টানল,—আমি তূণীরকেও কাল সঙ্গে যেতে বলে দেব।

—তূণীর কেন? দুটো পাহারাদারেও হবে, না? ব্যাটেলিয়ান লাগবে?

—আমরা যদি মনে করি লাগবে, তো লাগবে। সুজাতা ঘুরে দাঁড়াল, তোকে একটা কথা পরিষ্কার বলে দিচ্ছি, তূণীর যেভাবে বলবে, সেভাবে কোর্টে সাক্ষী দিবি। নিজে থেকে বেশি বকবক করবি না।

ঝিনুক কোর্টে কি বলবে না বলবে সেটা ঠিক করার মালিকও তূণীর? ঝিনুক তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল—তা কী বলতে বলেছেন তিনি?

—খারাপ কথা কিছুই বলেনি। বলেছে না গিয়ে যখন উপায় নেই তখন যাক্। গিয়ে বউ আর ছেলেটা যা বলবে তাই বলুক। ওরাই যা সাক্ষী দেওয়ার দেবে। তুই শুধু ডিটো দিয়ে যাবি। এই হয়েছিল… ওই হয়েছিল…আগ বাড়িয়ে বেশি ওস্তাদি একদম না। তোর এত কিসের দায় রে? তোর সঙ্গে অসভ্যতা করেছিল ওরা? বাঁচিয়েছিস মেয়েটাকে এই না ঢের!

সুজাতাকে চোখ দিয়ে ভস্ম করতে করতে ঝিনুক নিজের ঘরে এল। পৃথিবীতে কাউকে এক সেন্টিমিটার জমি ছাড়লে সে সঙ্গে সঙ্গে হাঁহ করে পাঁচ-দশ ফুট ভিতরে ঢুকে আসবে! বাবা মা ভাই বোন সব্বাই! যেই ঝিনুক দাঁতে দাঁত চেপে বাবা আর ভাই-এর পাহারাদারি মেনে নিয়েছে, ওমনি নতুন চাপ! তূণীরের কথা মত সাক্ষ্য দিতে হবে! ইল্লি রে, তূণীর কি বিনুকের প্রভু?

পিছনের গাছপালা গাঢ় সবুজ মেখে নিবিড়। নারকেল গাছের পা জড়িয়ে শুকনো আগাছারাও সতেজ জঙ্গল। ঝোপঝাড় থেকে মাথা তুলেছে দু-চারটে কাশফুল। নীল আকাশে আশ্বিনের ছোট ছোট মেঘেরা সামুদ্রিক ফেনার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। ছোট্ট ডোবা সবুজ জলে থৈথৈ। ডোবার জলে পল্কা মেঘের ছায়া।

ঝিনুক কিছুতেই স্থিত হতে পারছিল না। ফালতু দুদিন ছুটি নিল। শুধু কালকের দিনটা নিলেই ভাল হত। জানালা থেকে সরে এল ঝিনুক। হাড় পাঁজরার গভীরে কোথাও একটা আহত সাপ সংগোপনে ফণা তুলছে। মা হঠাৎ তূণীরের কথা বলল কেন! তূণীর কি মাকে কিছু বলেছে! কোন গোপন শলাপরামর্শ হয়েছে দুজনের! অথচ ঝিনুকের কাছে এই এক মাস ধরে কী আশ্চর্য রকমের নীরব তূণীর! সেই যে একদিন কেসটা নিয়ে অদ্ভুত রহস্য করল, তারপর থেকে মুখে কুলুপ! শরৎ ঘোষালের নাম করলে আকাশের দিকে তাকায়। ফুল পাখি দেখে। ঠাম্মার কাছে সেদিন যেতে বলল, তূণীর স্পিকটি নট্, বাদাম ভেঙেই চলেছে। উল্টে তুচ্ছ ছুতোনাতায় হঠাৎ হঠাৎ মেজাজ। গত রোববার সিনেমাহলে ঝিনুক দশ মিনিট লেট; তূণীর হলে দারুব্রহ্ম হয়ে বসে রইল। ঝিনুক কথা বলবে কি, হাতে হাতে ছোঁয়া লাগলেই সে কী বিরক্তি! রাস্তায় হাঁটার সময় মাঝে মাঝে বেমালুম ভুলে যায় আর একটা দুপেয়ে প্রাণী পাশে আছে। আরে বাবা, হলটা কি তোর খোলসা করে বল্? অফিসে প্রবলেম? বাড়িতে? মেসোমশাই-এর শরীর খারাপ? বিদেশ যাওয়া নিয়ে গণ্ডগোল? ঝিনুকের কেস্ নিয়ে তোর মাথায় যদি কোন গুবরে পোকা ঢুকে থাকে, ঝেড়ে বার কর্ সেটাকে। ঝিনুককে কিছু না বলে ঝিনুকের মার সঙ্গে গুজুর গুজুর কেন? তবে কি ঝিনুকের লড়াইটাই নিচ্ছিদ্র ইস্পাতের দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মাঝখানে? ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝি কি ভালবাসার মাঝখানে দেওয়াল তুলতে পারে? হ্যাঁ, ঝিনুক একটু একগুঁয়ে, ঝিনুক জেদী, ঝিনুক বেপরোয়া, এসব কি তূণীর জানে না? তূণীরও তো হিসাবী, কাজমাতাল, একটা সোশাল ক্লাইম্বার! সব জেনেশুনেই তো গড়ে উঠেছে ভালবাসা। তাদের দুজনের কেউই অবুঝ নয়, তবে কেন গোপন যন্ত্রণা ঝিনুকের কাছে উজাড় করতে পারছে না তূণীর? বিশ্বাস যদি নাই থাকে, ভালবাসা মাটি পাবে কি করে?

দুপুরবেলা সুজাতাকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ল ঝিনুক। ট্রামডিপো অবধি হেঁটে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। আবার কখন হাঁটতে শুরু করেছে। আচমকা মেট্রোস্টেশন চত্বরে নিজেকে আবিষ্কার করে নিজেই অবাক। কতক্ষণ ধরে এখানে ঘুরছে সে! এমন বোকার মত! তাল বেতাল! কাগজ ছিঁড়ে একটা বাবল্গাম মুখে পুরল ঝিনুক। ওই তো সেই সিঁড়ি! যেখান থেকে লাফ দিয়ে নেমে এসেছিল সে! ওই বাঁদিকের কোণে দাঁড়িয়েছিল রমিতা! সামনের জায়গায়টায় ঝিনুকের হাত মুচড়ে ধরেছিল কালো টি শার্ট! এখানটায় সারবন্দী ছিল মোটরসাইকেলগুলো! দুপুরের বাতাসে সেদিনের সন্ধ্যা যেন ত্রিমাত্রিক ছবি। ক্রিমিনালরা নাকি অপরাধের জায়গায় ফিরে ফিরে আসে? কিন্তু ঝিনুক তো ক্রিমিনাল নয়! তবে! তবে কি এটাও এক ধরনের অপরাধবোধ? অপরাধবোধ, না দায়বদ্ধতা?

ঝিনুক তীরবেগে বাসস্টপে ছুটল। এক্ষুনি কোর্টে যাবে। শরতের সঙ্গে একটু বসা দরকার। সরকারি উকিল রবীনবাবুর সঙ্গেও। কাল যেন কোনভাবেই বিপক্ষের দুঁদে উকিলরা ঘাড়ে থাবা বসাতে না পারে।

কোর্টে পৌঁছে ঝিনুক হতাশ হল। রবীন দত্ত দুজন সরকারি অফিসারের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। শরৎ চেয়ারে নেই।

কথা বলতে বলতে রবীন দত্তর চোখ পড়েছে ঝিনুকের দিকে,—আপনি আজ হঠাৎ? শরৎ নেই। দিন পাঁচেকের ছুটি নিয়েছে।

ঝিনুক ফিকে হাসি হাসল,—আমি আপনার কাছেই এসেছি।

—ও হ্যাঁ হ্যাঁ। রবীনের অন্যমনস্কতা কেটেছে,—আপনার কেসটা তো কাল উঠছে। সমন পেয়েছেন?

—পেয়েছি।

—একটু বসুন। এই কাঁটা-বাটখারার কেসটা একটু দেখে নিই।

ঝিনুক খুব সাবধানে নড়বড়ে চেয়ারটায় বসল। দুই কাঁটা-বাটখারা অফিসার একটা সব্জে রঙের বাঁধানো বই খুলে কিসব দেখাচ্ছে রবীনকে। রবীন বই-এ চোখ রেখেই হেঁকে উঠল,— এই সুশীল, চারটে চা দিয়ে যা। স্পেশাল।

আশপাশে কোন চা-ওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে না, তবু কয়েক মিনিটের মধ্যে এক খালি-গা বাচ্চা কাপ-কেটলি নিয়ে হাজির। ঝিনুক মুগ্ধ চোখে রবীনের দিকে তাকাল। গলায় ইন্টারকম ফিট করা নাকি!

বোম্বেটে চেহারার দুই বাটখারাবাবু বেরোনোর আগে ঝিনুককে টেরিয়ে দেখে নিল। ঝিনুক ওড়নাটাকে ভাল করে বিছিয়ে নিল কামিজের ওপর।

—আমি কালকের কেসটা নিয়ে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে এসেছিলাম।

—আপনার সব ডিটেলে মনে আছে তো? ডেট? টাইম? সিচুয়েশান?

—তা আছে। কিন্তু প্রথম কোর্টে উঠছি…ওদের নামী উকিল…

রবীন আমল দিল না,—ছাড়ুন তো। আপনি স্টেডি থাকবেন, তাহলেই সব ঠিক আছে। আমি যা প্রশ্ন করব, ঠিক ঠিক উত্তরটা দিয়ে যাবেন। ব্যস্ তাহলেই কেস দাঁড়িয়ে যাবে।

—না…একটু আন্ইজিনেস আর কি। ঝিনুক সহজ হওয়ার চেষ্টা করল— শরৎবাবু হঠাৎ ছুটি নিলেন কেন? অসুখবিসুখ করল নাকি?

—ওই পাগলের কাছে অসুখ-বিসুখ ঘেঁষে? রবীন মৌজ করে সিগারেট ধরাল,—ওর আশ্রমের গল্প শোনেননি? তাই নিয়ে এখন কাঁহা কাঁহা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

—আশ্রম তাহলে শুরু হয়ে গেল?

—হয়নি। তবে ক্ষ্যাপা যখন প্ল্যান করেছে, চালু করে দেবেই। খুব ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার। গল্প লিখতে জানলে, ওকে নিয়ে একটা নভেল লিখে ফেলতাম।

ঝিনুক স্মিত মুখে বলল,—জানি। স্কুলমাস্টারি করতেন। হোমিওপ্যাথি জানেন। সোশ্যাল সার্ভিসের নেশা আছে।

রবীন চোখ কোঁচকাল,—আর কিছু বলেনি?

—আরও কিছু আছে নাকি?

—আছে মানে? আপনি যা শুনেছেন সে তো শুধু টিপ অফ দা আইসবার্গ। রবীন পায়ে ঘষে সিগারেট নেবাল,—স্কুলমাস্টারি ছেড়েই এখানে আসেনি। মাঝে ক্যানিং-এ গিয়ে লঞ্চে সারেঙগিরি শুরু করেছিল। বিয়েও করেছিল একটা। ওখানকারই এক গরীব মেয়েকে।

—তাআই! শরতবাবু ম্যারেড!

—নো। বিপত্নীক। রবীন সামনে ঝুঁকল,—ভেরি স্যাড কেস। একদিন রাতে গোসাবায় লঞ্চ খারাপ হয়ে গেল। শরৎ ফিরতে পারেনি। বউটা বাড়িতে একা ছিল। অ্যান্ড শি ওয়াজ বুটালি রেপড অন দ্যাট নাইট। দিন পনেরো পরে বউটা সুইসাইড করে।

ঝিনুক নিমেষে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে শুধু। তাকিয়েই আছে।

—শরৎ অবশ্য তারপর আর ওখানে থাকেনি। কলকাতায় চলে এল। প্রথমে হাইকোর্টের এক ল’ইয়ারের কেরানিগিরি করেছিল কিছুদিন। সেই সময় ল’ পাশ করে। তারপর এই চাকরি। তাও প্রায় পনেরো বছর হয়ে গেল। রবীন দত্ত চোখ ঘোরাল,—ওই তিন নম্বর কোর্টের পেশকার, ক্যানিং-এ থাকে, ওর মুখেই সব শোনা।

জিনে-পাওয়া মানবীর মত ঝিনুক উঠে দাঁড়িয়েছে। মাথা তার সম্পূর্ণ ফাঁকা। চতুর্দিকের এত কোলাহল, সামনে বসে থাকা রবীনবাবু, কালকের কেস, বাবা মা ঠাম্মা কিছুই আর তার মস্তিষ্কে নেই। তূণীরের জন্য গড়ে ওঠা বিষণ্ণতা, কেস নিয়ে অত মানসিক দ্বন্দ্ব, সব কিছুই কী তুচ্ছ হয়ে গেছে ওই হাস্যমুখ খ্যাপাটে লোকটার বুকের গভীর ক্ষতের কাছে। শি ওয়াজ বুটালি রেপড!

রবীন বলল,—কাল ঠিক দশটার মধ্যে চলে আসবেন।

ঝিনুক বধির। টলমলে পায়ে কোর্ট থেকে বেরিয়ে এল। এলোপাথাড়ি হাঁটছে। হাঁটছে। হাঁটছে।

দুপুর ছুটে চলে গেল। বিকেলটাও। অন্ধকার মাড়িয়ে ঘরে ফিরছে ঝিনুক। শ্রান্ত পা সিঁড়ি ভাঙছে। ভাঙছে। দরজায় এসে স্থবির। তূণীর সোফায় বসে। পাশে মা বাবা।

সুজাতা মেয়েকে দেখে শিউরে উঠল,—কি হয়েছে তোর? মুখ-চোখের এই দশা কেন? কোথেকে আসছিস?

ঝিনুকের কথা বলার ইচ্ছে লোপ পেয়ে গেছে বহুক্ষণ। সোফায় হাত পা ছেড়ে দিল।

মানস ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে উঠেছে —রাস্তায় কিছু হয়েছে? বল না, কথা বলছিস না কেন?

ঝিনুক রক্তশূন্য মুখে মাথা নাড়ল,—টায়ার্ড। ভাল লাগছে না।

সুজাতা জিজ্ঞাসা করল,—তুই কোর্টে গিয়েছিলি? তূণীর বলছিল, তুই নাকি তিনটে নাগাদ কোর্ট থেকে বেরিয়েছিস? এতক্ষণ কোথায় ছিলি?

ঝাঁকুনি খেয়ে বাস্তবে ফিরল ঝিনুক। তূণীর জানল কি করে? পুরনো খটকা আবার ধাক্কা দিচ্ছে।

মানস বলল,—তোর আজ রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর কি দরকার ছিল? ছেলেটা কখন থেকে এসে বসে আছে…

প্রিয়জনদের স্বাভাবিক কথাও কখনও কখনও এত তিক্ত লাগে! এত অসহ্য! ঝিনুক নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল,—অ্যাই তূণীর, যাওয়ার আগে একবার ডাকিস তো। কথা আছে।

ঘরে ঢুকে ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে দিল ঝিনুক। আলো জ্বালাল না। জানলার ওপাশে মধ্যাহ্নের সবুজ পৃথিবী এখন কালিমালিপ্ত। কালি মেখে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে নারকেলগাছ। স্বপ্নের সেই ঋজু গাছ। গাছও অন্ধকারে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে।

হঠাৎ ঝিনুকের ঘোর কেটেছে। আলো। তূণীর।

ঝিনুক এক ঝটকায় উঠে বসল,—নিচে চল। এখানে বাবা মা আছে।

কম্পাউন্ডের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে দুজনে। পাশে নিঃশব্দ শুকনো কাঁঠালিচাঁপা গাছ। অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। বাতাসের জোলো ভাব এখনও পুরোপুরি যায়নি।

ঝিনুকের সন্দিগ্ধ স্বর একদম নিচু তারে বাঁধা,—তুই কি করে জানলি আমি আজ কোর্টে গেছিলাম?

তূণীরও যথেষ্ট প্রস্তুত,—আমাদের অফিসের একজন দেখেছে।

—কে সে?

—তুই কি আমাদের অফিসের সবাইকে চিনিস?

—বাহ, আমি চিনি না, সে আমাকে চেনে?

—কাগজে তোর ছবি দেখেছে।

—চার মাস আগে দেখা ছবি এখনও মনে রেখেছে? মেমারি খূব শার্প তো? থাকে কোথায়? চল তো, তার সঙ্গে এক্ষুনি আলাপ করে আসি।

—তুই কি আমার কথা বিশ্বাস করছিস না?

—বিশ্বাস করার কি কোনও কারণ আছে? তোর চোখ বলে দিচ্ছে তুই মিথ্যে কথা বলছিস।

তূণীরের চোয়াল শক্ত হল,—তুই কিন্তু আমাকে ইনসাল্ট করছিস।

—তুই আমাকে অপমান করিসনি? আমার আড়ালে মার সঙ্গে আমাকে নিয়ে গুজগুজ করাটাকে কী বলে?

তূণীর প্রথমটা নিরুত্তর। কম্পাউন্ডের পাঁচিলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর নিজের মনে কাঁধ ঝাঁকাল,—তোকে তা হলে বলেই ফেলি। আগে তোকে একবার রিকোয়েস্ট করেছিলাম, ভেবেছিলাম তাতেই তুই থামবি! তুই আমাকে কেয়ার করলি না।

—তুই বা ওরকম রিকোয়েস্ট করবি কেন?

—কেন শুনবি? ওই ছেলে চারটের মধ্যে একজনের বাবা আমাদের ফিনান্স ডিরেক্টরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রজত আমাকে রাধেশ্যাম গুপ্তার বাড়িতে নিয়েও গেছে। আমি রাকেশ ছেলেটার সঙ্গে কথা বলেছি। হিট অফ দা মোমেন্টে ওই কাজটা করে ফেলে ছেলেটা এখন ভীষণ অনুতপ্ত। মে বি সঙ্গদোষ। তার জন্য শাস্তিও কম পায়নি। দু সপ্তাহ হাজতবাস করেছে। রাধেশ্যামজী তো ভাবনায় ভাবনায় হাফ ম্যাড। শুধু মারতে বাকি রেখেছে ছেলেকে। ভেবে দ্যাখ, এত ভাল বাড়ির ছেলে এর পর কি জেল খাটবে?

তূণীর যেন নিজের কাছে নিজে কৈফিয়ত দিচ্ছে। ঝিনুক বাকশূন্য। বহু কষ্টে শুধু উচ্চারণ করতে পারল,—তুই কি ওদের হয়ে প্লিড করছিস?

—না। আমারও কিছু অবলিগেশান আছে। ইন্টারেস্ট। আমার একার ইন্টারেস্ট নয়, আমাদের দুজনের ইন্টারেস্ট। তূণীর দ্বিধা সংকোচ সম্পূর্ণ ফেড়ে ফেলেছে,—আমার বিদেশ যাওয়ার প্রোপোজালটা পাস করানোর জন্য ফিনান্স ম্যানেজার, ফিনান্স ডিরেক্টর লড়ে যাবে; আমি তাদের একটা অনুরোধ রাখতে পারব না?

বাতাস কি হঠাৎ কমে গেল? রাস্তার আলোগুলো হঠাৎ এমন টিমটিম কেন? ঝিনুক বিড়বিড় করে বলল,—রিকোয়েস্ট বলিস না। বল ডিল।

—সে তুই যেভাবে দেখবি।

—ওরাই বুঝি আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে? টেলিফোনে ভয় দেখাচ্ছে.?

—ছি ছি, ওদের তুই কী ভাবিস বল তো? ওরাও তোর কাজটাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করে। আমার কাছে দারুণ প্রশংসা করছিল তোর। এমনকি রাধেশ্যামজীও। তবে বুঝিসই তো ওদের অনেক পয়সা, প্রচুর ইনফ্লুয়েন্স…থানা কোর্ট সব জায়গাতেই ওদের চোখ রয়েছে…

ঝিনুক সোজা হচ্ছে,—তুই নিজে কী চাস?

—সেটা তো তোকে বলেইছি। তোর মত একটা মেয়ের ওসব নোংরা কেসে ইনভলভড থাকা মানায় না। তূণীর ঝিনুকের হাত ছুঁল,—ভাব তো ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে আমরা ক্যালিফোর্নিয়ায়…! কমপক্ষে তিন বছরের জন্য!

ঝিনুক ছিটকে সরে গেল,—তুই ভাবলি কি করে আমি এভাবে তোর সঙ্গে বিদেশে যাব? এর চেয়ে আমার নরকে যাওয়া ভাল। অন্যায়ের সঙ্গে লড়তে গিয়ে আরও বড় অন্যায় করব?

—কিসের অন্যায়? আমি পলাশ চৌধুরীর সঙ্গেও কথা বলেছি। আমি। মাইসেলফ। ওরও অনেক প্রেশার আছে, সোশ্যাল প্রেস্টিজের ব্যাপার আছে, ওরা মোটেই এই কেস নিয়ে আর চটকাতে ইচ্ছুক নয়।

ঝিনুক কি করে বোঝায় এ কেস এখন আর রমিতা চৌধুরীর কেস নেই। এটা এখন একটা মৌলিক প্রশ্ন। একজন নারীর এই সামাজিক পরিবেশে প্রতিবাদ করার অধিকার আছে কি নেই, সেটা জানার প্রশ্ন। বমিতারা কি বলল, না বলল তাতে আর কিছুই যায় আসে না ঝিনুকের।

ঝিনুক দীর্ঘশ্বাস ফেলল,—তা এখন আর হয় না রে। আমার বিবেক আমাকে বেঁধে ফেলেছে। আমার ফেরার পথ নেই।

—আমার মুখের দিকে তাকিয়েও নয়?

ঝিনুকের চোখে জল এসে গেল,—এভাবে আমাকে দুর্বল করে দিস না। গোটা পৃথিবী অন্য দিকে যায় যাক, তুই অন্তত আমার পাশে থাকিস। প্লিজ তূণীর। প্লিজ। তুই ওই চাকরিটা ছেড়ে দে। তোর যা কোয়ালিফিকেশান, এফিশিয়েন্সি, অনেক ভাল ভাল চাকরি পাবি। বিদেশ যাওয়াও কোনও ব্যাপার না। তা ছাড়া আমাদের বিদেশ যেতেই হবে, তার কি মানে আছে? বিদেশ না গেলে কি জীবন ব্যর্থ হয়ে গেল? আমরা দুজনে এই শহরেই থাকব। একটা ক্লিন অনেস্ট লাইফ, একটা মিশন নিয়ে বাঁচা…এর বেশি আর কি চাওয়ার থাকতে পারে?

—গরু ভেড়ারাও তো ক্লিন। অনেস্ট। তূণীর অধৈর্য হয়ে উঠছে,—মনে রাখিস, বিহাইন্ড এভরি ফরচুন দেয়ার ইজ আ সিন।

—আমি ফরচুনে বিশ্বাস করি না। পাপের পার্টনারশিপেও আমার উৎসাহ নেই। ঝিনুক নিজেকে প্রাণপণে সামলে রাখার চেষ্টা করছে,—জানিস শরৎ ঘোষাল সমস্ত সঞ্চয় ঢেলে ডেস্টিটিউট মেয়েদের জন্য হোম তৈরি করছে? জানিস, লোকটার বউ রেপড হয়েছিল? কথাটা শোনার পর থেকে সারাদিন আমি…

—অন্যের পিছনে আদাজল খেয়ে লাগলে ওরকমই হয়। তূণীর নির্বিকার বলে দিল, —রজত বলছিল তোকেও ওরা রাস্তা থেকে যে কোনও দিন তুলে নিয়ে গিয়ে রেপ করতে পারে। ওদের সেই মাসল পাওয়ারও আছে, কানেকশানও আছে। তোর জন্য যদি ছেলেগুলোকে জেলে ঢুকতে হয়, ওরা তোকে ছাড়বে না।

—তেমন হলে আমার জন্য তই তো আছিস। তুই লড়ে যাবি। আমরা দুজনে একসঙ্গে লড়ব। নাকি তোরও রেপ করা বউ নিয়ে ঘর করতে সম্মানে লাগবে?

—ডোন্ট টক রট। তূণীর ধমকে থামাল ঝিনুককে। নিজেও থমকে কি যেন ভাবল। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলছে,—ঠিক আছে আয়, আমরাও তা হলে একটা ডিল করি। আমি তোর ইচ্ছে মেনে নেব। ওই চাকরি ছেড়ে দেব। বিদেশ যাব না। তুইও আমার ইচ্ছে মেনে নে। পলাশ-রমিতা কোর্টে যা বলবে, তুইও তাই বলবি। নাথিং মোর নাথিং লেস।

একটা অন্যায় দাবির বিনিময়ে একটা ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার কী জঘন্য কৌশল! নিজের অহম তৃপ্ত করার সুনিপুণ অপপ্রয়াস! ঝিনুক তূণীরের মুখ থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। এই সেই তূণীর! তার জন্ডিসের সময় ছলছল চোখে এসে বসে থাকত! তিয়াত্তর পাতার প্রেমপত্র লিখেছিল তাকে। ছত্রে ছত্রে একই নিবেদন! তোর জন্য আমি সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারি। সে-ই কিনা ঝিনুককে বিষপান করে মরে যেতে বলছে! নিজের চুরি করা রাজভোগ ফেলে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে!

ঝিনুক মরা কাঁঠালিচাঁপা গাছটার দিকে তাকাল,—যদি তোর চুক্তি না মানি?

—তা হলে আমাকে অন্য কিছু ভাবতে হবে। তূণীরের মুখের একটি পেশীও কাঁপল না। আহত পৌরুষ লুকনো থাবা প্রকাশ্যে চাটতে শুরু করেছে,—হয়তো আমার পক্ষে আর সম্পর্ক রাখা সম্ভব হবে না। জীবন শুরু করার আগেই এত ঔদ্ধত্য আমার পক্ষে স্ট্যান্ড করা সম্ভব নয়।

আদিম পুরুষ পুরোপুরি নগ্ন।

ঝিনুক এক পা এক পা করে পিছোচ্ছে সিঁড়ির দিকে। অশ্রুমাখা চোখে তূণীর ঝাপসা ক্রমশ,—তুমি চলে যাও। আর কখখনো এসো না আমার কাছে। কখখনো এসো না।

তূণীর তবু এগোচ্ছে—মেয়েদের এত তেজ ভাল নয় ঝিনুক।

ঝিনুক মিলিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *