১০. বুবলি কোথায়

১০.

চাপা গলায় নবেন্দু জিজ্ঞেস করলেন, —বুবলি কোথায়?

—ওই তো। ব্যালকনিতে।।

—কী করছে?

—বসে আছে চুপচাপ।

—আজ খাওয়াদাওয়া করেছে ঠিক মতো?

—মা তো বলছিলেন করেছে। এই তো একটু আগে দুধমুড়িও খেল।

—দুধমুড়ি কেন? একটু ভাল খাবারদাবার বানাতে পারছ না?

—খেলে তো বানাব। ওই একটু ভাতই যা জোর করে… দেখলে না, পরশু চাইনিজ ফ্রায়েড রাইস বানালাম… খেতে কী ভালই না বাসত… দু’ চামচ খেয়েই…

—হুম্। প্রবলেম।

চিন্তিত মুখে সোফায় বসলেন নবেন্দু। জুতো ছাড়ছেন। ঝুঁকে ফিতে খুলতে খুলতে শ্বাস ফেললেন একটা। পনেরো দিন হয়ে গেল, এখনও মেয়েটা কেমন হয়ে আছে। ভাল করে খায় না, নিজে থেকে দুটো কথা বলে না, কী ভীষণ আনমনা হয়ে থাকে সর্বক্ষণ। বাচ্চা নষ্ট হওয়ার ধাক্কাটা এখনও সামলে উঠতে পারল না। কবে যে পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে?

মহাশ্বেতা সামনে দাঁড়িয়ে। দেখছিলেন স্বামীকে। জিজ্ঞেস করলেন, —তোমার আজ এত দেরি হল?

—আর বোলো না। কী বিচ্ছিরি একটা মিছিল বেরিয়েছিল। এস্‌প্ল্যানেড থেকে পার্ক স্ট্রিট গোটাটা জ্যাম। তুমি আটকাওনি?

—আমি তো এখন রোজই তাড়াতাড়িই চলে আসছি। তখন তো নর্মালই ছিল।… চা খাবে তো?

—করো।

চলে যেতে গিয়েও মহাশ্বেতা ঘুরে এলেন। প্রায় ফিসফিস করে বললেন,—আজও নাকি আবার ফোন করেছিল!

নবেন্দু সোজা হলেন, —কখন?

—দুপুরবেলা। মা ধরেছিলেন। বুবলি নাকি আজও কথা বলেনি।

—হুম্। প্রবলেম।

জুতোজোড়া সরিয়ে রেখে নবেন্দু হেলান দিলেন সোফায়। দু’ হাত ডানায় মতো ছড়িয়ে দিয়েছেন। গলা নিচু রেখেই বললেন,—ব্যাপারখানা কী বলো তো? মেয়ে এমন জেদ ধরে আছে কেন?

—কী করে বুঝব বলো? বুবলি তো কিছু বলছেই না।

—জিজ্ঞেস করো। চাপ দিয়ো না। ভাল ভাবেই জানতে চাও। তুমি মা, তোমাকে হয়তো খুলে বলতে পারে।

—তোমারই তো মেয়ের সঙ্গে বেশি মনের প্রাণের কথা হত। তুমিই জিজ্ঞেস করতে পারো।

এ যেন একে অন্যের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া নয়, যেন দু’জন মানুষ থমকে আছেন, দু’জনেই শঙ্কিত যেন এমন কিছু তাঁদের শুনতে হবে যার জন্য তাঁরা প্রস্তুত নন।

নবেন্দু বললেন,—থাক। আর একটা-দুটো দিন যাক।

মহাশ্বেতা বললেন,—হ্যাঁ। সময় তো পালাচ্ছে না। বুবলি হয়তো নিজে থেকেই বলবে। খোঁচাখুঁচি করলে যদি হিতে বিপরীত হয় ?

কথাটা বলে দু’জনেই যেন একটু স্বস্তি অনুভব করলেন। যেন সময়ের আড়াল দিয়ে ভারমুক্ত হলেন খানিকটা।

মহাশ্বেতা রান্নাঘরে চলে গেলেন। ঘরে গিয়ে পোশাক বদলানোর আগে একবার ব্যালকনিতে উঁকি দিলেন নবেন্দু। গলা যথাসম্ভব সহজ রেখে বললেন,—কী রে, এখানে বসে কেন?

—এমনিই। রাস্তা দেখছি।

শরণ্যার স্বরও সহজ। তবু কেমন যেন কৃত্রিম ঠেকল নবেন্দুর কানে। যেন মেয়ের স্বর প্রবোধ দিতে চাইছে বাবাকে, বলছে সে ঠিক আছে।

নবেন্দু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,—অন্ধকারে বসে আছিস, মশা কামড়াচ্ছে না? বৃষ্টির পর তো খুব বেড়েছে মশা।

—হুঁউ।

—তো বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছিস কেন? ভেতরে আয়। টিভি দেখ।

—দূৎ, টিভি আমার ভাল্লাগে না।

—তো বইটই পড়। ও রকম অন্ধকারে বসে থাকিস না।

বলে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলেন নবেন্দু। শরণ্যার সামান্য নড়াচড়া দেখে সরে এলেন ঘরে। পোশাক বদলে বাথরুম। আজ বৃষ্টি হয়নি বলে একটা ভ্যাপসা গরম আছে, তার ওপর বাসে দীর্ঘক্ষণ ঠায় বসে থাকা। ঘামে গা চিটপিট করছে, ঘাড়ে গলায় জল ছিটোলেন ভাল করে। আজকাল আর রোজ ফিরে স্নান করতে সাহস হয় না। শরীরটা যেন হঠাৎ কমজোরি হয়ে গেছে, অল্পেই ঠান্ডা লেগে যায়। বুবলিই যেন এই ক’মাসে বয়সটা বাড়িয়ে দিল।

বুবলির কী দোষ? বুবলি তো ছেলে পছন্দ করেনি। দায়ই হোক, আর ভুলই হোক, সে তো সবটাই নবেন্দু আর মহাশ্বেতার। মেয়ে খোলাখুলি না বললেও তাঁরা কি টের পান না বিয়েটা আদৌ সুখের হয়নি? দেবু রবিবার এসেছিল, একটা দামি কথা বলে গেল। দাদা, আমাদের মুশকিলটা কী জাননা? মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময়ে আমরা ভাল পাত্র খুঁজি, ভাল ছেলে খুঁজি না। বুবলির বেলায় তো পাত্রর গুণাগুণ বিচারেও ভুল হয়েছিল। শুধু পরিবারটা দেখেই নবেন্দুরা গলে গিয়েছিলেন। আহা, কী বনেদি বাড়ি, ছেলের বাবা কত পণ্ডিত, মা’র কত খ্যাতি, ফার্ন রোডে অত বড় একটা বাড়ি আছে, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, আর কী চাই! মহাশ্বেতা তো নিবেদিতাকে দেখেই গদগদ। নবেন্দু মুগ্ধ হয়েছিলেন পেডিগ্রি দেখে। এটা বোঝেননি, রেসের মাঠ আর ডগ্-শো ছাড়া অন্য কোথাও পেডিগ্রি ব্যাপারটা মূল্যহীন। একমাত্র অন্নপূর্ণাই যা একটু খুঁতখুঁত করেছিলেন। টাকাপয়সা যতই থাক, যে বাড়ির কর্তাই ঘরজামাই, সে বাড়ি কি খুব জুতের হবে রে! নবেন্দুর মা তাঁর পুরনো আমলের চোখটা দিয়েই দিব্যি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন ফ্যামিলিটাকে। ফক্কা, এক্কেবারে ফক্কা পরিবার। সাত মাস ধরে বুবলিকে শুধু কাটাপোনা খাইয়ে রাখল! ভাবলে নবেন্দুর নিজের গালেই ঠাস ঠাস চড় কষাতে ইচ্ছে করে। সাতটা নয়, পাঁচটা নয়, একটা মাত্র মেয়েকে এ ভাবে জলে ভাসিয়ে দিলেন?

বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে কটমট চোখে তাকালেন নবেন্দু। তিনি একা কেন, দোষী তো মহাশ্বেতাও। একদিন তুলোধোনা করতে হবে মহাশ্বেতাকে। ওই নিবেদিতা দেবী নাকি সমাজসেবিকা! কথায় বলে চ্যারিটি বিগিন্‌স অ্যাট হোম, ঘরে তিনি কী গড়েছেন?

দুটি ছেলে দুটি স্যাম্পল্। একটি পাগল, একটি গোঁয়ার। গোঁয়ার তো কোন জাহান্নমে গিয়ে পড়ে আছে তার ঠিক নেই। তাতে অবশ্য নবেন্দুর কাঁচকলা। কিন্তু পাগলটি তো এই ক’মাসে নবেন্দুর হাড়ে ঘুন ধরিয়ে দিল। কী একলষেঁড়ে ছেলে! ভদ্রতা সভ্যতা বোধ নেই, সহবত জ্ঞান নেই, শ্বশুর-শাশুড়িকে সম্মান করতে জানে না…। শুধু বুবলির মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে সব হজম করে যাচ্ছেন নবেন্দু। বুবলির মতো একটা সেন্সেটিভ শান্ত মার্জিত মেয়ের পক্ষে ওই রকম একটা অসভ্য ছেলেকে সহ্য করা নিশ্চয়ই খুব সহজ হয়নি। এবং ওই ছেলে নিশ্চয়ই এমন আচরণ করেছে যার জন্য বুবলি তার গলার স্বর পর্যন্ত শুনতে চাইছে না।

কী হয়েছিল বুবলির সঙ্গে? ছোকরা কি সন্দেহপ্রবণ? বুবলির চাকরি করায় আপত্তি ছিল? নাকি নিজে চাকরি খুইয়ে খেঁকি কুকুর হয়ে গিয়েছিল? নিজের রোজগার নেই, বউ কাজ করছে, তাই নিয়ে খুঁচিয়েছে বুবলিকে? কী চাপা মেয়ে, বাবা-মার কাছে সব গোপন করেছে? হয়তো ওই ভয়ংকর দিনটাতেই দু’জনের মধ্যে তুমুল ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল! সাংঘাতিক অপমানজনক কিছু বলেছিল বুবলিকে! হয়তো মাথার ঠিক ছিল না বলেই বুবলি অসাবধানী হয়ে আছাড় খেয়েছিল বাথরুমে!

সবই সম্ভব। সব হতে পারে।

হে ঈশ্বর, তার চেয়ে বেশি যেন কিছু না হয়। অন্তত নবেন্দুকে যেন শুনতে না হয়। তা হলে হয়তো তিনি ওই ছেলেকে…

ক্রোধ ছাপিয়েও হঠাৎ একটা বিষণ্ণতা চারিয়ে গেল নবেন্দুর বুকে। আহা রে, বুবলির মতো মেয়ের কি একটা সুস্থ বিবাহিত জীবন প্রাপ্য ছিল না? বিয়ের বোধহয় আট মাসও পেরোয়নি, তার মধ্যেই বাচ্চা নষ্ট হওয়ার মতো আঘাতও বেচারিকে সইতে হল? ভগবান যে কার কপালে কী লিখে রাখেন!

উফ্, সেই রাতটা! মনে পড়লে এখনও নবেন্দুর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। নিবেদিতার টেলিফোন পেয়ে সেদিন কী ভয় যে পেয়েছিলেন। মহাশ্বেতা আর অন্নপূর্ণারও নাড়ি ছেড়ে যাওয়ার দশা। তিনজনেরই প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল বুবলি বুঝি মরে গেল! বউকে আর মাকে জোর করে বাড়িতে রেখে নবেন্দু উদ্‌ভ্রান্তের মতো ছুটেছিলেন নার্সিংহোমে। ওটিতে নিয়ে গিয়ে তখন ওয়াশ করা হচ্ছে শরণ্যাকে। বাইরে দাঁড়িয়ে ঠকঠক কাঁপছিলেন নবেন্দু। ও বাড়ির লোকজনও ছিল। নিবেদিতা আর্য নীলাচল… অনিন্দ্যও। তবু মনে হয় কেউ নেই পাশে। একদম একা। মাঝে মাঝে নিবেদিতা এসে নবেন্দুর হাতটা ধরছিলেন। বি স্টেডি! ডাক্তারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। শরণ্যার কোনও বিপদ নেই। তবু যতক্ষণ না ডাক্তার বেরিয়ে এসে আশ্বস্ত করলেন, নবেন্দু কি এতটুকু শান্ত হতে পেরেছিলেন? মাত্র আধ ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট তো সময়, অথচ মনে হচ্ছিল যেন হাজার ঘন্টা!

ওই রাতের ছবিটাই চোখে নিয়ে নবেন্দু বেরিয়ে এলেন বাথরুম থেকে। দেখলেন ডাইনিং টেবিলে চা ঢাকা রয়েছে, সঙ্গে বিস্কুট। ওপাশে মহাশ্বেতা কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন টেলিফোনে। টিভি বন্ধ, শরণ্যা আসেনি বসার জায়গায়। নিজের ঘরে গিয়ে আবার কি শুয়ে পড়ল? সারাক্ষণ দেওয়ালের দিকে ফিরে কী ভাবে? কী দেখে? শূন্যতা?

চা শেষ না হতেই পাশে মহাশ্বেতা। মুখ ঈষৎ ভাবিত,—আজ তো রাতে ডিমের ডালনা… মেয়েটার জন্য একটু স্টু বানিয়ে ফেলি? ফ্রিজে তো চিকেন রয়েছেই।

—সবজিটবজি আছে তো?

—আছে। বিন গাজর…

—করো।… কার সঙ্গে কথা বলছিলে?

—কণাদি। বুবলি এখন কেমন আছে জিজ্ঞেস করছিল।

নবেন্দুর কপাল কুঁচকে গেল, —উনি জানেন বুবলির কথা?

—জানে তো। আগেও তো ফোন করেছিল। বুবলি এখনও মনমরা হয়ে আছে শুনে দুঃখ করছিল খুব।

—এখন আর দুঃখ করে কী হবে? শুনিয়ে দিতে পারলে না, সম্বন্ধটা মোটেই ভাল দেননি? ছেলে মোটেই সুবিধের নয়?

—সে আমি মিষ্টি মিষ্টি করে আগের দিনই শুনিয়েছি।

—বলেছ, এমন ব্যবহার করেছে মেয়ে আর তার বরের সঙ্গে কথা বলতেও চায় না?

—ঘরের সব কথা সবাইকে বলার দরকার কী? তা ছাড়া সত্যি তো আমরা জানি না বুবলি অনিন্দ্যর মধ্যে কী হয়েছে। তবে বলেছি, ওই ছেলে নর্মাল নয়।

—বেশি বেশি করে বললে পারতে। নবেন্দু উঠে পড়লেন,—মাকে দেখছি না কেন? গাঙ্গুলিদের ফ্ল্যাটে গেছে নাকি?

—মা ঘরে। সন্ধে থেকেই বেশ চুপচাপ। কী যেন একটা হয়েছে!

—কী হল?

—বলতে পারব না। আমি নিজে মরছি নিজের জ্বালায়…

নবেন্দুর কপালে আবার ভাঁজ। চুপ করে কী যেন ভাবলেন একটু। তারপর গেছেন অন্নপূর্ণার ঘরে। ডাকলেন, —মা?

অন্নপূর্ণা চোখ ঢেকে শুয়েছিলেন। হাত সরালেন, —ও। তুই?

—সন্ধেবেলা শুয়ে কেন? হাঁটুর ব্যথা?

—না এমনিই।

—তুমি তো এমনি এমনি শুয়ে থাকার মানুষ নও মা। নবেন্দু পাশে গিয়ে বসলেন, —হয় তুমি এখন মেগায় বসবে, নয় গুটি গুটি পায়ে এ ফ্ল্যাট ও ফ্ল্যাট করবে।

—আমার ভাল্লাগছে না রে নবু।

—কেন? কী হল?

দু’ হাতে ভর দিয়ে চেপে চেপে উঠে বসলেন অন্নপূর্ণা। অপ্রসন্ন স্বরে বললেন, —আমার কিন্তু বুবলির ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না। ছেলেটা রোজ এত করে ফোন করে, বুবলি একটি বারের জন্য কথা বলে না!

—নিশ্চয়ই কারণ আছে। তুমি কি জানো সব?

—যে কারণই থাক, ছেলেটার বুবলির ওপর টানটা তো আছে। হ্যাঁ, সে একটু অন্য ধারার…তা বলে শুধু বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে বলে বরের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করবে? তারও তো কত খারাপ লাগছে! ঝগড়াঝাঁটিও যদি হয়ে থাকে , তার সঙ্গে দুটো কথা বললে কী বুবলির মান ক্ষয়ে যাবে?

—ছাড়ো না মা। বুবলির ব্যাপার বুবলিকেই ভাবতে দাও। এমনিতেই মেয়েটা এত আপসেট হয়ে আছে…

—বুবলির কষ্ট কি আমার বাজছে না? কিন্তু তা বলে…আমি আজ বুবলিকে খুব বকেছি।

—ও। তাই এখন নিজেই মনখারাপ করে শুয়ে আছ? নবেন্দু মৃদু হাসলেন, —ওঠো, ওঠো। নাতনিকে ডেকে নিয়ে বসে টিভি দেখো। বাড়িটাকে শোকপুরী করে তুলো না।

অন্নপূর্ণার কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বেরিয়ে এলেন নবেন্দু। ব্যালকনিতে এসে একটা সিগারেট ধরালেন। একবার দেখলেন প্যাকেটটাকে। দুটো আর পড়ে আছে। আজ এই দ্বিতীয় প্যাকেট। মাঝে সিগারেট খাওয়াটা একদম কমিয়ে দিয়েছিলেন, দিনে চার-পাঁচটার বেশি খেতেন না, আবার বেড়ে গেছে। এত ধরণের ভাবনাচিন্তা…কখন যে খাওয়া হয়ে যাচ্ছে সিগারেটগুলো! অন্নপূর্ণার কথাগুলো টোকা মারল মাথায়। একটু নৈর্ব্যক্তিক হওয়ার চেষ্টা করলেন নবেন্দু। এই মুহূর্তে বাবা হিসেবে তাঁর কী চাওয়া উচিত? বুবলির বিয়েটা ভাল হয়নি, এ তো প্রায় প্রথম থেকেই বোঝা গেছে। তা সত্ত্বেও তো নবেন্দু-মহাশ্বেতা দু’জনেই চেয়েছেন মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে ঠিকঠাক থাকুক। অনিন্দ্য রাগ করে চলে গিয়েছিল বলে নিজেরা গিয়ে বুবলিকে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন। বুক ভেঙে গেছে, তবু অনিন্দ্য চায় না বলে মেয়েকে নিজেদের কাছে এনে রাখার বাসনা নিয়ন্ত্রিত করেছেন। নিবেদিতা-আর্যর সম্পর্কেও তো মহৎ ধারণাগুলো ভেঙে গেছে অনেক আগেই, তবু গত রবিবার নিবেদিতা যখন শরণ্যাকে দেখতে এ বাড়িতে এলেন, তাঁকে তো যথেষ্ট আপ্যায়ন করলেন তাঁরা। কেন করলেন? একটা ভাবনাই তো ক্রিয়া করেছে, বাবা-মা হিসেবে তাঁরা এমন কিছু করবেন না যাতে বুবলির বিবাহিত জীবনে বিঘ্ন আসে। সেই ভাবনারই পরিপূরক হিসেবে এখন তাঁর কী কর্তব্য? বুবলিকে বোঝানো? অনিন্দ্যর সঙ্গে তেমন কোনও গন্ডগোল হয়ে থাকলে তার মিটমাট করে দেওয়া? অন্নপূর্ণা তো ঠিকই বলেছেন, নার্সিংহোমে সেদিন ওই ঢ্যাঁটা ছেলেটাও তো মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে ছিল।

আকাশে হেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। এক-আধটা তারা দেখা যায় আবছা ভাবে। সামান্য বাতাস বইছে এখন। হাওয়াটা তেমন গায়ে লাগছে না। নীচে এক প্রাণচঞ্চল শহর। বাস মিনিবাস প্রাইভেট কার ট্যাক্সি লরি টেম্পোর ভেঁপু শোনা যাচ্ছে ঘন ঘন। মানুষের কোলাহল রাগী মৌমাছিদের গুঞ্জন হয়ে ধেয়ে আসছে ওপরে। মাথার মধ্যে বিনবিন করছে।

সিগারেট নিবিয়ে পায়ে পায়ে মেয়ের ঘরে এলেন নবেন্দু। টিউবলাইট জ্বলছে। শরণ্যার বুকের ওপর খোলা পড়ে আছে একটা ম্যাগাজিন, চোখ আলোতে স্থির।

নবেন্দু কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলেন, —বুবলি?

শরণ্যা ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছে। এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে। কিংবা ঠিক হাসি নয়, হাসির মতো কিছু। দু হাঁটু মুড়ে গুটিসুটি হয়ে বসল।

নবেন্দু অপলক দেখছিলেন মেয়েকে। সেই তাঁর ছোট্ট বুবলি, যে টলমল পায়ে হাঁটত, বাবার কোলে এলে আর কারুর কাছে যেতে চাইত না, কথায় কথায় অভিমান, বায়না আবদার… এই তো সেদিনও বিয়ের কথা যেদিন পাকা হয়ে গেল, হঠাৎ বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ফোঁচ ফোঁচ করে কেঁদেছিল,…! মুখ তো একই আছে, অথচ ভেতরে ভেতরে কত ভূমিকম্প হয়ে গেছে মেয়েটার। সেই মেয়ে, কিন্তু এ যেন সে নয়। কত বড় বড় লাগে!

মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই আজকাল গলার কাছে কেন যে একটা ডেলা আটকে যায় ? নবেন্দু গলা ঝেড়ে নিয়ে বললেন, —তোকে বললাম একটু বসে টিভি দ্যাখ, সেই ঘরে এসে একা একা শুয়ে থাকলি?

—এই তো, এই ম্যাগাজিনটা পড়ছিলাম।

—কোথায়? ড্যাব ড্যাব করে তো নিয়ন গ্যাস জ্বলা দেখছিলি।

শরণ্যা ফের হাসল, — দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোসো না।

খাটে নয়, চেয়ার টেনে বসলেন নবেন্দু। বললেন, —শরীরে এখন একটু স্ট্রেংথ্‌ পাচ্ছিস?

—হ্যাঁ। ভালই তো আছি এখন। ভাবছিলাম সামনের সোমবার থেকে কাজে জয়েন করব।

—পারবি? এখান থেকে অতটা পথ…?

—পারতেই হবে। শুনলে না, শুভ্র কাল কী বলে গেল? পি-এস-বি খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন। আমার ইরেগুলারিটি নিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন।

শুভ্র ছেলেটিকে মন্দ লাগেনি নবেন্দুর। শুধু কাল নয়, আগেও একদিন এসেছিল। বুবলি নার্সিংহোম থেকে ফেরার পর পরই। মজার মজার কথা বলে সাংঘাতিক ভারী আবহাওয়াকেও লঘু করে দিতে পারে। কালই তো বলছিল ওর এক মামা নাকি বেজায় ঘুমোয়, ঘুমোতে ঘুমোতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সেই ক্লান্তি কাটাতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। হাসতে হাসতে বুবলিকে বলছিল তুইও সে ভাবে দিন কাটাবি নাকি?

নবেন্দু মাথা দুলিয়ে বললেন, —তা শুভ্রই তো পি-এস-বিকে বলেছে সব?

—তা বলেছে। তবে আমার নিজেরও খারাপ লাগছে।

—দ্যাখ। যা ভাল বুঝিস। বললে, প্রথম দিন আমি তোর সঙ্গেও যেতে পারি।

মাঝে তো আরও তিন দিন আছে। চিন্তা করছ কেন, একদম ফিট হয়ে যাব।

সামান্য ইতস্তত করে নবেন্দু আসল কথায় ঢুকতে চাইলেন। বললেন, হ্যাঁ, এখান থেকেই যা যাতায়াতের অসুবিধে। ও বাড়ি থেকে তো কাছেই।

শরণ্যার মুখ সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাকাশে। মাথা নাড়ছে দু’ দিকে। অস্ফুটে বলল, —আমি আর ওখানে যাব না বাবা।

সে কী ? কেন? নবেন্দু মুখটা হাসি হাসি রাখতে চাইলেন।

শরণ্যা কোনও উত্তর দিল না। মাথা দুলিয়েই চলেছে।

নবেন্দু ফস করে আর একটা সিগারেট ধরালেন। মেয়ের চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করলেন, —তোর তো ও বাড়ি পছন্দই হয়েছিল। অবাধ স্বাধীনতা, কেউ গার্জেনি করার নেই…? নিবেদিতাদি আর্যবাবু সবাই তোকে কত ভালবাসেন…

—তোমরা কষ্ট পাবে বলে বলিনি বাবা। ও বাড়িতে কেউ কাউকে ভালবাসে না। নিজেকে ছাড়া। তোমাদের নিবেদিতাদি একটা কাঠের মানুষ। হৃদয় বলে কিচ্ছু নেই।

—অনিন্দ্য তো তোকে ভালবাসে।

শরণ্যা চুপ।

—তুই তো বলিস, তোকে ছাড়া সে থাকতে পারে না!

শরণ্যা এবারও চুপ।

নবেন্দু একটুক্ষণ নিরীক্ষণ করলেন মেয়েকে। প্রশ্নটা আজ করবেনই না ঠিক করেছিলেন, তবু করে ফেললেন। টেরচা চোখে বললেন, —সত্যি করে বল তো বুবলি, অনিন্দ্য কি তোর সঙ্গে কোনও মিস্‌বিহেভ করেছে?

এবারও রা নেই।

নবেন্দু সামান্য অসহিষ্ণু বোধ করলেন, —চুপ করে থাকলে চলবে কেন বুবলি? আমাদের তো বুঝতে হবে কী হয়েছে! মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়াটা খুবই শকিং। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট। একটা বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে তো কী হয়েছে? আবার হবে বাচ্চা।

—হবে না। হবে না। শরণ্যা হঠাৎ ডুকরে উঠল। দু’হাতে মুখ ঢেকে মাথা ঝাঁকাচ্ছে পাগলের মতো, —অনিন্দ্য কিছুতেই হতে দেবে না।

.

১১.

অনেকদিন পর ফুলিয়া থেকে তাঁতি এসেছে। চেনা লোক। বছরে বার দু’-তিন আসে নিবেদিতার কাছে। বিশেষ করে জুলাই আগস্ট মাসটা রাজেনের বাঁধা সময়। পুজোর আগে এই সময়টাতেই নতুন নতুন ডিজাইন বেরোনো শুরু হয়। নিজের জন্য বাছাই করা দু’-চারখানা শাড়ি রাখেন নিবেদিতা। তবে রাজেনের মূল লক্ষ্য থাকে সুহাসিনী। পুজোর সময়ে সুহাসিনীর মেয়েরা শাড়ি পায়। কম দামি হলেও এক লপ্তে অনেকগুলো কাপড় বিক্রি হয় রাজেনের। নিবেদিতাই সুহাসিনীর ব্যবসাটা ধরিয়ে দিয়েছেন, রাজেনের কাছে তাই নিবেদিতার খুব খাতির।

অনিন্দ্যর বিয়ের আগেও এসেছিল রাজেন। নমস্কারি শাড়ি, একে তাকে দেওয়ার শাড়ি সবই প্রায় রাজেনের কাছ থেকে রেখেছিলেন নিবেদিতা। তাঁর ধারণা তিনি রাজেনের কাছে কম ঠকেন।

গাঁটরি খুলে ড্রয়িংরুমের কার্পেটে বসেছে রাজেন। খুলে খুলে দেখাচ্ছে শাড়ি। একখানা কাঁচা হলুদের ওপর সিলভার জরি বার করে বলল, —বউদিরে ডাকেন মাসিমা। বউদির জন্য এখানা এস্পেশাল বানায়ে আনছিলাম। কম্পুটারের ডিজাইন।

নিবেদিতা সোফায় পা গুটিয়ে বসেছেন। হেসে বললেন, —সে তো এখন নেই। বাপেরবাড়ি গেছে।

—রংখানা কেমন খুলছে?

—মন্দ নয়। তবে তোমার ওই সিলভার জরি আমার ভাল লাগে না।

—এটাই তো এখন ফেশান মাসিমা। গোল্ডেন পুরাতন হয়ে গেছে। নতুন বউদির জন্য রাখেন। খুব মানাবে।

—তুমি তো তাকে দেখোইনি। নিবেদিতা হেসে ফেললেন, —রাখো। পাশে রাখো। ওই মাখন রংটা বার করো তো। হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই ঢাকাইটা।

শাড়ি দেখার ফাঁকে ফাঁকে গল্প চলছে রাজেনের সঙ্গে। বছর তিনেক আগে একবার ফুলিয়া গিয়েছিলেন নিবেদিতা, এই রাজেনের আমন্ত্রণেই। ঘুরে ঘুরে দেখেছেন তাঁতঘর। রঙিন সুতোর টানাপোড়েনে নক্‌শা বোনা। রাজেনের বাড়ির মেয়ে বউদের সঙ্গেও তখন আলাপ হয়েছিল। এখনও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সকলের কথা মনে আছে। নাম ধরে ধরে নিবেদিতা প্রত্যেকের খবর নিচ্ছিলেন। গত বছর বন্যায় তাঁতিদের খুব ক্ষতি হয়েছিল। মেরামতির কাজ পুরোপুরি হল কিনা, লোকসান সামাল দেওয়া গেছে কিনা, সব শুনছিলেন মন দিয়ে।

নীলাচল চা এনেছে। পরশুই দেশ থেকে ফিরেছে নীলাচল। এবার অবশ্য বেশি দিন ছুটি দেননি নিবেদিতা। মাত্র সাতদিন। তবে অঘ্রানে সে আবার যাবে। বিয়ের ঠিক হচ্ছে।

লাজুক লাজুক মুখে নীলাচল বলল, —আমার জন্যও একটা ভাল শাড়ি রাখুন মা।

নিবেদিতা হাসতে হাসতে বললেন, —তোর এখন কী? তোর বউয়ের শাড়ি তো পরে কিনব।

—আপনি তো বেনারসি দেবেন।… আমি একটা-দুটো নিজে কিনব না?

শুধু শাড়ি নয়, নীলাচলের বউকে একটা গয়নাও দিতে হবে। নিবেদিতা কথা দিয়েছেন। নিজের একজোড়া দুলটুল নয় পালিশ করে দিয়ে দেবেন। ওয়ার্ড্রোবে পড়ে থাকা সাদা বেনারসিটাও কি চালান করে দেওয়া যায় না? যাহ্, তা কী করে হয়? নতুন বউকে সাদা শাড়ি?

নীলাচল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হুকুম ছুড়ছে, —মাকে দেখান না, তিন-চারটে বেছে দেবেন। আমি দাম দিয়ে দেব।

—বুঝেছি। তোর অনেক টাকা হয়েছে।

শাড়ি কেনাবেচার পর্ব চলল আরও খানিকক্ষণ। রাজেন উঠল প্রায় এগারোটায়। আজ রবিবার, নিবেদিতার বিশেষ তাড়া নেই, ধীরেসুস্থে শাড়ি গোছাচ্ছেন ওয়ার্ড্রোবে। শরণ্যার জন্য রাখা শাড়িখানা আলাদা করে হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন আর একবার। রংটা সত্যিই খুব উজ্জ্বল। শরণ্যাকে মানাবে।

এবার নিবেদিতা স্নানে যাবেন। এমনি দিনে তাড়াহুড়ো করে বেরোতে হয়, ছুটির দিনের স্নান তাঁর কাছে একটা বিলাস। অনেকটা সময় নিয়ে চুলে শ্যাম্পু করবেন, জলে সুগন্ধ ছড়িয়ে শুয়ে থাকবেন বাথটবে। রবিবারের স্নানের এই সময়টুকুতেই তিনি সোমশংকরের মেয়ে হয়ে যান।

আজ সাপ্তাহিক শৌখিনতায় বাধা পড়ল। বাথরুমে ঢুকতে যাবেন, হঠাৎ জ্যোতিশংকর আর স্বরূপা হাজির। জ্যোতিশংকরের সঙ্গে নিবেদিতার সম্পর্কটা এখনও বেশ নরমে গরমে চলছে। কয়েকদিন আগেও টেলিফোনে যথেষ্ঠ বরফ ছোড়াছুড়ি হয়েছে।

তবে জ্যোতিশংকর আজ বাড়িতে অতিথি। সোমশংকরের মেয়ের অতিথি অভ্যাগতদের প্রতি সৌজন্যবোধ অতি প্রবল। বাবার কাছ থেকে শেখা। দারুণ আন্তরিক ভাবে নিবেদিতা বললেন, —আরে, তোমরা হঠাৎ? কী সৌভাগ্য!

জ্যোতিশংকরও সোমশংকরের ভাইপো। একই গোত্রের শিক্ষা তাঁরও রক্তে আছে। তাঁরও মুখে অমায়িক হাসি, —তোর বউদির এক কাকা মারা গেছেন। আজ শ্রাদ্ধ। পূর্ণদাস রোডে। ভাবলাম শ্রাদ্ধবাড়ি ঢোকার আগে তোর বাড়ি একবার ঘুরে যাই।

—খুব ভাল করেছ। ক’দ্দিন পর এলে। বলেই মুখটা করুণ করে নিবেদিতা স্বরূপার দিকে ফিরেছেন, —তোমার কোন কাকা গো?

—বড়কাকা। সেই যে, যিনি জার্মানিতে ছিলেন।

—ও। খুব ভুগছিলেন বুঝি?

—বয়স হয়েছিল। জ্যোতিশংকর বললেন, —পঁচানব্বই।

—না গো। প্রায় সাতানব্বই। স্বরূপা বলে উঠলেন, —অসম্ভব ফিট ছিলেন। চাকরের সঙ্গে রোজ সকালবেলা লেকে যেতেন। আমরা তো ভেবেছিলাম একশোই পূর্ণ করবেন। হল না।

সম্পূর্ণ অচেনা সেই কাকাটিকে নিয়ে পরিমিত কৌতূহল দেখালেন নিবেদিতা। বললেন, —কী খাবে বলো? শরবত? না চা কফি?

—শরবতই বল। জ্যোতিশংকর সোফায় ছড়িয়ে বসেছেন, —তোর সঙ্গে আমার একটা কথাও আছে।

নিবেদিতা জানেন জ্যোতিশংকর অকারণে আসার বান্দা নন। বললেন, —বলো।

স্বরূপা তাড়াতাড়ি বললেন, —তোমরা ততক্ষণ কথা সেরে নাও। আমি বরং আর্যদার সঙ্গে দেখা করে আসি।

স্বরূপা চলে গেলেন ম্যাজেনাইন ফ্লোরে। নীলাচলকে শরবত বানাতে বলে এসে বসলেন নিবেদিতা। বললেন, —মিনু তে এসে গেছে।

—তুই খবর পেয়েছিস?

—হ্যাঁ এসেই মিনু ফোন করেছিল।… তুমি তা হলে এবার রেজিষ্ট্রির ডেটটা ফাইনাল করে ফ্যালো।

—সেই কথাই তো বলতে আসা। লাখোটিয়া তো এখন আবার একটু বেগড়বাই করছে।

—কেন? ওর সঙ্গে তো কথা হয়েই আছে!

—ও একটু টাইম চাইছে। গড়িয়ায় একটা হাউজিং কমপ্লেক্স করেছে, সেখানে নাকি করপোরেশানের সঙ্গে ওর কী সব ঝামেলা চলছে। জলের কানেকশান পাচ্ছে না, কাউকে তাই পজেশানও দিতে পারছে না। বলছিল প্রচুর টাকা নাকি আটকে গেছে।

—ওসব গল্প শুনে আমাদের লাভ নেই। লাখোটিয়ার সঙ্গে যা এগ্রিমেন্ট আছে, তাতে আমরা রেজিষ্ট্রির দিন ঠিক করলে সে টাকা দিতে বাধ্য।

—আহা, লাখোটিয়া তো সে কথা অস্বীকার করছে না। শুধু আরও মাসখানেক সময়…

—তা কী করে হয়? আমরা কেন ওয়েট করব? সে মারবে দাঁও, তারপরও সবকিছু তার ইচ্ছে মতো হবে…

—আমিও লাখোটিয়ার ওপর কাল খুব চেঁচামিচি করেছি।

—জানি না কী করেছ। পুরো ব্যাপারটা তোমার ওপর ছেড়ে দিয়েছি, এখন তুমি যা বলবে তাই মানতে হবে।

—তুই বার বার আমার দিকে আঙুল তুলিস কেন বল তো খুকু? আমি তো সব সময়ে তোর সুবিধেই দেখার চেষ্টা করছি। মিনুর তো আসার কথা ছিল পুজোর মুখে মুখে, আমিই তো ওকে তোর কথা বলে আগে আগে আনালাম।

—তাই কি? মিনু যে বলল ভিসার টাইম শেষ হয়ে গিয়েছিল? আর নাকি এক্সটেনশান পায়নি?

—ও। তা হবে। জ্যোতিশংকর যেন সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন, —তা তুই এখন কী করতে চাস?

—তুমিই বলো।

—এক কাজ কর না, লাখোটিয়াকে ছেড়ে দিই। তোর এত জানাশুনো, তুই একটা অন্য প্রোমোটার দ্যাখ। অবশ্য তাকেও অন্তত লাখোটিয়ার প্রাইসটা দিতে হবে।

—বাহ সোনাদা, উলটো কোর্টে বল ঠেলে দিচ্ছ? ভাল করেই জানো এসব নেগোসিয়েশান হুট বললেই হয় না।

—তা হলে একটু ধৈর্য ধর। এক-দেড় মাসে কী এমন পৃথিবী উলটে যাবে?

পৃথিবী নয়, সুহাসিনী তো উলটে যেতে পারে। অ্যানুয়াল জেনারেল মিটিংয়ের জন্য এখন থেকেই উঠে পড়ে লেগেছে দময়ন্তীরা। একদিন দীপালির বাড়িতে নাকি একটা গ্যাদারিং-ও হয়ে গেছে। এবার এক্সিকিউটিভ বডির খোলনলচেটা ওদের বদলে দেওয়ার প্ল্যান। নিবেদিতা টের পাচ্ছেন। অর্চনাকে হয়তো সরাবে না, অর্চনার বরের উঁচুমহলে দহরমমহরম… তা ছাড়া অর্চনা ওদেরই তালে তাল দেয়। বাকি ভাইটাল পোস্টগুলোতে ওরা…

নিবেদিতা মনে মনে হিসেব কষলেন। সামনের মাসের শেষেও টাকাটা হাতে এলে হপ্তা দুয়েক টাইম থাকে। চোদ্দো-পনেরো দিনের ক্যাম্পেনে হাওয়া ঘোরাতে পারবেন না?

চোখ সরু হল নিবেদিতার, —ঝেড়ে কাশো তো সোনাদা। এক মাস? না দেড় মাস?

—লাখোটিয়া বলছে এক। আমি ধরছি দেড়।

—যদি লাখোটিয়া কথা না রাখে? লাস্ট মোমেন্টে ডোবায় ?

—আমি তো ওপেন অফার দিলাম। তুই পারলে অন্য পোমোটার ফিট কর।

ওফ, খেলোয়াড় বটে। ভেতরে ভেতরে চিড়বিড় করে উঠলেন নিবেদিতা। তবে ঠোঁটের হাসিটি নিবল না। নীলাচলের রেখে যাওয়া শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিলেন খুড়তুতো দাদাটিকে। কমলা পানীয়ে চুমুক দিচ্ছেন জ্যোতিশংকর, নির্বিকার মুখে।

স্বরূপা ফিরেছেন। কৌতূহলী মুখে বললেন, —অনিন্দ্য, সুনন্দ কাউকে দেখছি না কেন? বাড়ি নেই?

—ছুটির দিন তো। কথাটা আলগা ভাবে ভাসিয়ে দিলেন নিবেদিতা, — বেরিয়েছে সবাই যে যার মতো।

—দ্যাখো কাণ্ড, কী সব উলটোপালটা কথা রটে!

—কী রটেছে?

—সুনন্দ নাকি রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে…

—কে বলল?

—কে যেন বলছিল। ননীদি, না শ্যামাদা…

এসব সংবাদ কি হাওয়ায় ওড়ে? কত সতর্ক ভাবে কেলেঙ্কারিটা গোপন রেখেছেন নিবেদিতা, সেই ছড়িয়ে গেল আত্মীয়মহলে?

উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে নিবেদিতা বললেন, —তুৎ, বাজে কথা। সুনন্দ গেছে এক বন্ধুর বাড়িতে। হাওড়ায়। ওদের ক্যাসেট বেরোবে তো, এখন দিনরাত ওখানে রিহার্সাল চলছে।

জ্যোতিশংকর গ্লাস শেষ করে পাশে রাখলেন, —তবে যে তুই বললি ছুটির দিন বলে এধার ওধার বেরিয়েছে?

—ওমা, তাই বললাম নাকি? নিবেদিতা রাজনীতিকদের মতো হাসলেন,— আমি অনিন্দ্যর কথা বলছিলাম।

—ও। তাই বল।… হ্যাঁ রে, সুনন্দদের দলটার যে কী নাম?

—কী যেন একটা। উদাসী ব্যান্ড, না কী যেন।

—খাসা নাম! তোর উদাসী ছেলের উদাসী ব্যান্ড!

হুঁহ, উদাসী ছেলে! হাড়ে সেয়ানা। এই তো সেদিন হাতচিঠি দিয়ে পাঠিয়েছিল বন্ধুকে, ছেলেটা এসে সুনন্দর জামাপ্যান্ট নিয়ে গেল। এখনও তেজে মটমট করছে ছেলে। থাক গিয়ে যেখানে খুশি, দেখি বন্ধুরা ক’দ্দিন খাওয়ায়! পেটে টান পড়লে তো ফিরতেই হবে।

মনে মনে ভাবলেন বটে নিবেদিতা, তবে চিন্তাটায় তেমন জোর পেলেন না। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। ছেলে দুটো তাঁর একটুও মাথা নোয়াতে শেখেনি।

ভেতরটা একটু খচখচও করছিল নিবেদিতার। নির্জলা মিথ্যেটা বলে দিলেন বটে, ধরা পড়ে যাননি তো? কিছু বিশ্বাস নেই, আর্যর কাছেই হয়তো সুনন্দ-সমাচার শুনে এসেছে স্বরূপা, নিবেদিতার সঙ্গে একটু খেলে নিল, বাড়ি গিয়ে স্বামী-স্ত্রী হয়তো তুমুল হাসাহাসি করবে।

সুনন্দটা যে কেন এমন বেকায়দায় ফেলল?

জ্যোতিশংকরদের উপস্থিতি আর মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না নিবেদিতার। কাজের কাজ কিছু করে না, বাড়ি এসে ঘোঁট পাকায়। মাঝখান থেকে নিবেদিতার স্নানটা মাথায় উঠল। নিবেদিতা ইচ্ছে করেই দেওয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন, যদি ইঙ্গিতটা বোঝে।

জ্যোতিশংকরও কবজি উলটোচ্ছেন। স্বরূপাকে বললেন, —এবার তো উঠতে হয় গো। তা তোমার কী বলার ছিল বললে না খুকুকে?

—হ্যাঁ কথাটা বলব কিনা ভাবছিলাম। স্বরূপা নড়েচড়ে বসেছেন, কণা হঠাৎ পরশুদিন আমার কাছে এসেছিল।

—কোন কণা?

—শরণ্যার মাসি। একগাদা কথা শুনিয়ে গেল আমাকে। আমার একদম ভাল লাগল না।

—কী বলেছে?

—শরণ্যার বাবা-মার নাকি তোমাদের ওপর খুব গ্রিভান্স। শরণ্যার মিসক্যারেজের জন্য ওরা তোমাদেরই দায়ী করছে।

—আমাদের? নিবেদিতা অবাক, —কেন?

—তোমরা মানে… মেইনলি অনিন্দ্যকেই।

—স্ট্রেঞ্জ! অনিন্দ্য কী করবে? অ্যাক্সিডেন্ট হয় না?

—সে আমি কী করে বলব ভাই? তোমাদের ইন্টারনাল ব্যাপার… ওরা বলছে, জানিয়ে দিয়ে গেলাম। কণা আমাকেও তো খুব অ্যাকিউজ করে গেল। আমি নাকি অনেক কিছু চেপে গেছি, অনিন্দ্যর নেচারের কথা আগে ওদের বলিনি, শুনলে হয়তো ওরা আদৌ এ বিয়েতে এগোত না…

—অনিন্দ্যর নেচার? মানে?

স্বরূপা ঠোঁট উলটোলেন। ভঙ্গিটা এমন, সে আমি আর মুখে কী বলব!

মাথা দুলিয়ে বললেন, —যাক গে, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এবার কিন্তু তুমি ট্যাক্টফুলি ব্যাপারটা সামলে দাও। তোমারও তো সমাজে একটা মানসম্মানের ব্যাপার আছে। সর্বত্র গিয়ে যদি এ রকম কুৎসা করে বেড়ায়…!

স্বরূপা-জ্যোতিশংকর চলে যাওয়ার পর নিবেদিতা গুম হয়ে বসে রইলেন। ভাবছেন। স্বরূপার কথা শুনে এখন কেন যেন মনে হচ্ছে অনিন্দ্য কিছু একটা গণ্ডগোল বোধহয় করেছে। নইলে ছেলে এত গুমসুম মেরে থাকে কেন? নীলাচলের ওপর হাঁকডাক নেই, গজগজ নেই, মার মুখোমুখি হলে ক্যাটোস ক্যাটোস ঝগড়াও নেই…! বাড়িতেও নাকি থাকে না সারাদিন। নীলাচল বলছিল মদের মাত্রাও নাকি বেড়েছে। নিবেদিতা ভাবছিলেন ছেলে বুঝি মনোকষ্টে আছে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছেন…। নার্সিংহোমেও অনিন্দ্য সেদিন কেমন চোরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল না?

ক্ষীণ ভাবে একটা ছবি মনে পড়ল নিবেদিতার। দু’মাসের সুনন্দকে শুইয়ে রেখে নিবেদিতা বাথরুমে ঢুকেছেন, হঠাৎ নির্মলার আর্ত চিৎকার, ওরে বাবা রে, কী খুনে ছেলে রে, বাচ্চাটাকে মেরে ফেলল রে…! কী হয়েছে? না পাঁচ বছরের অনিন্দ্য ভায়ের বুকে চড়ে বসে খিমচোচ্ছে ভাইকে! হিংসে। তার প্রতি মনোযোগে ঘাটতি পড়েছে বলে।

সাম্প্রতিক ছবিটাও ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল নিবেদিতার কাছে। নীলাচলের কাছে শুনেছেন বাথরুম সেদিন ভীষণ পিছল হয়ে ছিল! অনিন্দ্যই কি তবে ইচ্ছে করে সাবানজল…?

নিজের অনাগত বাচ্চাকেও হিংসে করতে শুরু করেছিল অনিন্দ্য?

বিশ্বাস করতে মন চায় না। তবে সব মায়ের হৃদয়েই, গান্ধারী না থাক, একজন ধৃতরাষ্ট্র তো থাকেই। নিবেদিতার মতো মহিলাও তার ব্যতিক্রম নন। ক্রমশ নিবেদিতার মনে হতে থাকল তার ছেলের নামে মিথ্যে অভিযোগও তো আনা হতে পারে। সাবানজল যদি অনিন্দ্য ফেলেও থাকে, শরণ্যা খেয়াল করেনি কেন? পেটের বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তো তারই! আহা রে, অনিন্দ্যটার কী চেহারা হয়েছে! রুক্ষ্ম চুল, চোখমুখ বসে গেছে, গাল চুপসে এতটুকু। অন্যায় যদি কিছু করেও থাকে, মনে মনে পুড়ছেও তো ছেলেটা!

নাহ, একটা কিছু করা দরকার। শরণ্যা এ বাড়িতে না ফিরলে আজেবাজে কথা রটতেই থাকবে। আত্মীয়স্বজনদের তো গুনে নুন দিতে নেই, তারাও ঘোঁট পাকাবে নানান রকম৷ আড়ালে যথেচ্ছ নিন্দামন্দ করবে অনিন্দ্যর। এবং নিবেদিতারও। তা করুক, নিবেদিতা কেয়ার করেন না। আড়ালে তো রাজার মাকেও লোকে ডাইনি বলে। কিন্তু এক কান থেকে পাঁচ কান, পাঁচ কান থেকে সাত কান চললে তো মুশকিল। সুহাসিনী অবধি গুজবটা পৌঁছে গেলে নিবেদিতা মুখ দেখাবেন কী করে?

সাতপাঁচ ভেবে কর্ডলেসটা হাতে নিলেন নিবেদিতা। মানিকতলার নম্বর টিপলেন টক টক।

মহাশ্বেতা ফোন ধরেছেন, —হ্যালো?

—আমি নিবেদিতাদি বলছি।

—ও।…বলুন?

—কেমন আছ তোমরা?

—চলছে একরকম। আপনি ভাল ?

মহাশ্বেতার স্বরটা বেশ আড়ষ্ট ঠেকল নিবেদিতার। জোর করে উচ্ছ্বসিত হলেন, —আর বোলো না। কাজের চাপে দম বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। তোমাদের একটা ফোন পর্যন্ত করে উঠতে পারছি না।

—ও।

—এই তো সকাল থেকে যতবার ভাবি, বাধা পড়ে যায়। দুম করে আমার তাঁতি এসে গেল। ওর কাছ থেকে প্রতি বছর সুহাসিনীর মেয়েদের জন্য শাড়ি রাখি তো। আজ শরণ্যার জন্যও একটা রাখলাম। ও কাঁচা হলুদ রং ভালবাসে তো?

—আপনার ছেলের বউয়ের পছন্দ অপছন্দ আপনারও তো জানা উচিত নিবেদিতাদি। নয় কি? বুবলিকে তো আমরা আপনার জিম্মাতেই দিয়েছিলাম।

নিবেদিতা ঠোক্কর খেলেন। নরম করে বললেও মহাশ্বেতার সুরটি বক্র।

তবু নিবেদিতা আপোষের স্বরেই বললেন, —না না, আমিও জানি। ওকে তো ইয়েলো পরতেও দেখেছি…। শরণ্যা কোথায়? দাও তো একটু, ওর সঙ্গে কথা বলি।

কয়েক সেকেন্ড ও প্রান্তে শব্দ নেই। তারপর ফের স্বর বেজেছে, —বুবলি এখন শুয়ে আছে। ঘুমোচ্ছে।

—এখনও উইকনেস কাটল না?

—না, এখন সুস্থই। কাজে জয়েন করে গেছে। এমনিই ঘুমোচ্ছে।

—বাহ, ভাল খবর। কাজকর্মে থাকলে মনটাও তাড়াতাড়ি চাঙা হয়ে যাবে।

—হুঁ।

—তা কবে গাড়ি পাঠাব? শরণ্যা আসছে কবে?

—বুবলি এখন যাবে না নিবেদিতাদি।

—সে কী? কী হল? ও তো এখন…?

নিবেদিতার প্রশ্ন শেষ হল না, হঠাৎই এক পুরুষকণ্ঠ ঠিকরে এসেছে রিসিভারে। নবেন্দুর কর্কশ স্বর ঝনঝন করে উঠল, —আমার মেয়ে আর আপনাদের বাড়ি কোনও দিনই যাবে না। শুনতে পেয়েছেন? শি হেট্‌স টু গো দেয়ার।

নিবেদিতা পলকের জন্য বিমূঢ়। গলা দিয়ে বেরিয়ে গেল, —কিন্তু কেন?

—সেকথা আবার মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করছেন? যান, আপনার শয়তান ছেলেটাকে গিয়ে প্রশ্ন করুন। সে তো আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। হি ইজ আ মার্ডারার। খুনি।

আঘাতের তীব্রতা সহ্য করতে নিবেদিতার মতো পোড় খাওয়া মানুষেরও সময় লেগে গেল। খানিকটা আত্মরক্ষার সুরে বলে উঠলেন, —আপনি কী বলছেন কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না। এত উত্তেজিত হয়ে গেলেন কেন? যদি ভুলভ্রান্তি কিছু ঘটেই থাকে, সেটা তো শুধরেও নেওয়া যায়। উই ক্যান সিট অ্যান্ড টক। আফটার অল আমরা ভদ্রলোক…

—কায়দা মারা কথা বলবেন না। নবেন্দুর গলা আছড়ে পড়ল,— আপনাদের ভদ্র চেহারা দেখা হয়ে গেছে। নিজেদের মুখটা আয়নায় দেখুন।… হুঁহ, ঘরে একটা ক্রিমিনাল পুষে সমাজসেবা হচ্ছে!

আর কত সহ্য হয়? নিবেদিতারও গলা চড়ে গেল, —আপনি কিন্তু লিমিট ক্রস করে যাচ্ছেন নবেন্দুবাবু। আপনি এ ভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন না।

—গায়ে বিঁধছে, অ্যাঁ? শুনুন, আপনার কপাল ভাল আমরা থানাপুলিশ করিনি। আপনার ওই ছেলেকে হাজতে পোরা উচিত ছিল। আপনিও বেঁচে গেলেন, কোমরে দড়ি পড়ল না। এখনও যদি ভাল চান, ছেলেকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান। অ্যান্ড ডোন্ট ট্রাই টু ডিসটার্ব মাই ডটার এগেন। ছেলেকেও বলে দেবেন, যদি আর কোনও ভাবে বুবলিকে উত্যক্ত করার চেষ্টা করে, আমি ওকে জুতোপেটা করব।

নিবেদিতার কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। অপমানে জ্বলছে সর্ব শরীর। সোমশংকরের মেয়েকে এ ভাবে চড় মারল একটা পেটি মিডল্‌ক্লাস লোক? কী স্পর্ধা!

.

১২.

পার্থসারথি আজ দুপুরে এসেছিলেন চেতনায়। ছিলেন অনেকক্ষণ। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন কাজের অগ্রগতি। প্রশ্ন করছিলেন ঘন ঘন, জেরার ভঙ্গিতে। তবে কাজকর্মের খতিয়ান দেখে তিনি সন্তুষ্ট না বিরক্ত তা পরিষ্কার বোঝা গেল না। আবার তাঁর ডাক এসেছে আমেরিকা থেকে। বেশ কয়েকটা সিমপোসিয়ামে যোগ দিতে হবে, ভিজিটিং প্রফেসার হিসেবে কিছু ক্লাসও নেবেন এদিক সেদিক। এ মাসের শেষে তিনি পাড়ি দিচ্ছেন ও দেশে, ফিরতে ফিরতে সেই ক্রিসমাস। ইতিমধ্যে শুভ্র আর শরণ্যা কী কাজ করবে তার একটা খসড়াও বানালেন বসে বসে। আরও একজনকে প্রোজেক্টের কাজে নিয়োগ করছেন পার্থসারথি। তাঁরই ছাত্র, তবে এখন এক কলেজের অধ্যাপক। তাঁর কাজের পরিধিটাও শরণ্যাদের বুঝিয়ে দিলেন। শরণ্যাকে ই-মেল করতে বললেন নিয়মিত, মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করে যাওয়ার উপদেশ দিলেন। শুভ্রকে বললেন কাজে এতটুকু অসুবিধে হলে কোথায় কখন কার সঙ্গে দেখা করতে হবে। আরও একটা নির্দেশ। এতদিন যা হয়েছে, চটপট তার একটা সিনপ্‌সিস বানিয়ে দাও। সাতদিনের মধ্যে। ডিটেলেও নয়, আবার খুব শর্টেও নয়, যেন চোখ বুলোলেই গোটা ছবিটা স্পষ্ট হয়ে যায়। আমেরিকায় ইউনেস্কোর দপ্তরে যাবেন তিনি, সংক্ষিপ্তসারটা অবশ্যই সেখানে জমা করা দরকার।

প্রায় ছ’টা নাগাদ বিদায় নিলেন পার্থসারথি। শুভ্র আর শরণ্যা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এতক্ষণ যেন নিঃশ্বাস ফেলা যাচ্ছিল না। শুভ্র তো টেবিল ধরে ওঠবোস করে নিল একটু, সামনে হেলে পিছনে হেলে কোমর ছাড়াচ্ছে।

শরণ্যা ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছিল। বলল, —স্যার আর একজনকে গুঁজে দিলেন কেন বল তো?

—বুঝলি না, খোঁচড় ফিট করে দিয়ে গেলেন। ও তোমাদের এই কাজ দেখবে, ওই ডাটা কমপাইল করবে, ওই রিপোর্ট প্রসেস করবে… এসব কথার তো একটাই মানে। একটা ওয়াচডগ বসে গেল।

—চিনিস ভদ্রলোককে? কী যেন নাম বললেন… জয়ন্ত সিনহা না কে…?

—বিলক্ষণ চিনি। ডিপার্টমেন্টে তো ভদ্রলোকের খুব যাতায়াত। দেখিসনি? মোটা মতন কালো মতন, হাতে সবসময়ে ইয়া বড় ফোলিও ব্যাগ…? দেখে মনে হয় বিছানাপত্র পুরে নিয়ে ঘুরছে…! হি ইজ আ মাদুরে।

—মাদুরে, মানে?

—বুঝলি না? মাস্টারদের মধ্যে প্রাইভেট টিউশন যারা করে, তাদের দুটো টাইপ আছে। একটা ভাদুবে, আর একটা হল মাদুরে। যারা ধর টাকার দরকার পড়ল বলে কিছুদিন প্রাইভেট পড়াল, তারপর ছেড়ে দিল, তারা হচ্ছে ভাদুরে টাইপ। সিজনাল। আর একদল আছে যারা সারা বছর ধরে সকাল সন্ধে…। জয়ন্ত সিনহা পড়ায় সেন্ট্রাল ক্যালকাটার একটা কলেজে, তবে ওর মাদুর ছড়ানো আছে সেই সুন্দরবন পর্যন্ত। দুটো-চারটে বাঘও নাকি পড়তে আসে। এখন টিউশনি নিয়ে হুড়কো চলছে তো, তাই ওদিকটা কমিয়ে এদিকে ধান্দা করছে।

—যাহ। কোত্থেকে এসব খবর পাস বল তো?

কাঁধ ঝাঁকাল শুভ্র। উত্তর না দিয়ে বলল, —চ চ। আমার আবার বাড়ি গিয়ে মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।

সন্ধে এখনও তেমন গাঢ় হয়নি। স্ট্রিট লাইট জ্বলে গেছে, দিনশেষের মিহি আলোকে ঢেকে দিয়েছে নিয়নবাতি। আকাশে মেঘ আছে থোকা থোকা। ভারী ভারী। বৃষ্টি ক’দিন হচ্ছে না, সারাদিনই একটা চিটপিটে গরম। বাতাস প্রায় নেইই। ঘাম যেন শুকোতেই চায় না।

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মা’র কথাই বলছিল শুভ্র, —মার পেটের পেইনটা কিছুতেই যাচ্ছে না, বুঝলি?

—ডাক্তার কী বলছে?

—ডাক্তাররা তো কিছু বলে না। করে। কিংবা বলতে পারিস করায়। একের পর এক টেস্ট করিয়েই চলেছে। ব্লাড স্টুল ইউরিন এক্সরে আলট্রাসোনো বেরিয়াম…। আজ সাড়ে আটটায় স্পেশালিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। দেখি, তিনি আবার কী কী লিস্ট ধরান।

—এনডোস্কোপি হয়েছে?

—নাহ। বললে করাব। আমি তো লাস্ট ডাক্তারকে স্ক্যানের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বললেন এক্ষুনি দরকার নেই। কী বিচ্ছিরি লাগে বল তো, কিচ্ছু মুখে তুলতে চায় না। ঠান্ডা দুধ খেলেও নাকি পেটে ব্যথা হয়। তাও তো আমি জোরজার করে ইনটেক করাচ্ছি। গলা ভাত, নয় খিচুড়ি… লিকুইড নিক, সেমিসলিড নিক…

শরণ্যা কিছু শুনছিল, কিছু শুনছিল না। তার চোখ ঘুরছে এদিক ওদিক। নাহ, নেই। সেদিনের ডোজটায় কাজ হল তা হলে?

বিচ্ছিরি ধরণের উৎপাত শুরু করেছিল অনিন্দ্য। বাড়িতে ফোন করে কলকে না পেয়ে শেযে অফিসে ফোন। কী নাকি কথা আছে বলতে চায়! শোনার এতটুকু প্রবৃত্তি হয়নি শরণ্যার, ঘটাং করে টেলিফোন নামিয়ে রেখেছিল। এক ঘণ্টার মধ্যেই অফিসে হাজির। ভেতরে ঢুকতেই দেয়নি শরণ্যা, দরজা থেকেই তাড়িয়ে দিয়েছিল। তাতেও কি নিস্তার আছে? ক’দিন পর থেকেই শুরু হল নতুন উপদ্রব। শরণ্যার অফিসের আশেপাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনও দিন দেশপ্রিয় পার্কের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে, কখনও পানের দোকানে, কখনও বাসস্টপে। শরণ্যা তার অস্তিত্বকে আমলই দিতে চায়নি, অনিন্দ্যকে দেখিয়ে দেখিয়ে বেশি উচ্ছল হয়ে গল্প করত শুভ্রর সঙ্গে। একটু অস্বচ্ছন্দও লাগত, ওই ছেলেটার দৃষ্টি যেন গায়ে লেগে থাকত বিষ্ঠার মতো।

দুম করে গত শুক্রবার শরণ্যা মুখোমুখি হয়েছিল মূর্তিমান উপদ্রবের। কাঁহাতক আর এই নিঃশব্দ অত্যাচার সহ্য করা যায়? শুভ্র বার বার বলেছিল, ইগনোর কর ইগনোর কর! কদ্দিন আর টেনাসিটি থাকবে, অ্যাঁ? ধরে নে না, অফিসের বাইরে একটা বিনি মাইনের চৌকিদার পেয়ে গেছিস!

শুভ্রর উপদেশ অগ্রাহ্য করে গটমট চলে গেল শরণ্যা, —তোমার মতলবটা কী বলো তো? তুমি কি আমায় কিছুতেই মুক্তি দেবে না?

অনিন্দ্য বুঝি আশা করেনি শরণ্যা এগিয়ে আসবে। থতমত খেয়ে টান টান। গালভরতি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কোটরে ঢোকা দুটো চোখ জ্বলছে যেন। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, —আমি তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই।

—কতবার তোমায় বলব, তোমার কোনও কথা আমার শোনার ইচ্ছে নেই? সব শেষ হয়ে গেছে। ফিনিশড। বুঝেছ?

—কিন্তু আমি যে বলতে চাই।

—আমি শুনব না।

—কেন শুনবে না? কেন শুনবে না তুমি? অনিন্দ্যর স্বর হঠাৎই বদলে গেল। মুখ বিকৃত করে বলল, —বুঝেছি। খুব মস্তিতে আছ এখন, অ্যাঁ?

—কী-ই? শরণ্যার চোখে আগুন, —লজ্জা করল না নোংরা কথা বলতে?

—গায়ে লাগল বুঝি? অনিন্দ্যও হিসহিস করছে, —এতই যখন আমায় অপছন্দ, তখন ভালবাসার ন্যাকামোটা করেছিলে কেন?

—আমি ন্যাকামো করেছি? তোমার সঙ্গে?

—করোনি? বলোনি, অনি, আমি তোমার? তুমি আমার সব? দার্জিলিংয়ের ম্যালে তোমায় একা রেখে চলে এসেছিলাম বলে কাঁদোনি তুমি?

পথচলতি লোকজন ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। তাদের টেরাবেঁকা দৃষ্টি যেন বিঁধছিল শরণ্যাকে। বুঝতে পারছিল না, অনিন্দ্য কি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে? নাকি পাগলের অভিনয় করছে? মন ভিজিয়ে খাঁচায় পুরে ফেলার এও কি এক কৌশল?

রুক্ষ থেকে রূঢ় হল শরণ্যা। চাপা অথচ তীক্ষ গলায় বলল, — রাস্তায় সিন্ ক্রিয়েট কোরো না। আমি যদি চেঁচিয়ে এখন লোক জড়ো করি, তোমার কী হবে আন্দাজ করতে পারো? ফের যদি তোমায় এই চৌহদ্দিতে দেখি, আমি পুলিশে রিপোর্ট করব।

—পুলিশ দেখাচ্ছ? পুলিশ? অনিন্দ্য যেন আরও ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। রাগে গরগর করছে, হাতের মুঠো পাকাচ্ছে, পা ঠুকছে ফুটপাতে, —আমিও দেখে নেব। আমিও দেখে নেব।

—যা খুশি করো। জাহান্নমে যাও।

বলেই ঘুরে উলটো মুখে হাঁটা। শেষ কয়েক পা প্রায় দৌড়েই শুভ্রর কাছে। ঝট করে ঘুরে দেখল একবার। না, অনিন্দ্য আর নেই।

সেই থেকেই আর নেই। বিদেয় হয়েছে আপদটা। তবু যে কেন অফিস থেকে বেরিয়েই শরণ্যার চোখ দুটো একবার চারদিকে ঘুরবেই?

শরণ্যার ক্ষণিক অন্যমনস্কতা নজরে পড়েছে শুভ্রর। মা’র গল্প থামিয়ে টেরচা চোখে তাকাল, —কী রে, খুব হতাশ হলি মনে হচ্ছে?

—যাহ্। হাড় জুড়িয়েছে আমার।

—বেচারাকে মনটা জুড়োনোর স্কোপটা দিলি না ? বলে ফেললে অনিন্দ্যও মুক্তি পেত, তোরও রোজ রোজ চোখের ব্যায়াম হত না।

—ফাজিল কোথাকার। হেসে ফেলল শরণ্যা। পায়ে পায়ে এগোচ্ছে বাসস্টপের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে বলল, —ওর বলার আর ছিলটা কী? হয় বলতো, আমি নিরপরাধ, আমায় তুমি ভুল বুঝো না! নয়তো, আমি ভুল করেছি, আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও!

—তাই নয় শুনে নিতিস৷ কান তো ক্ষয়ে যেত না।

—শুনে কী লাভ? আমি তো ছেলেটাকে চিনে গেছি।

—মানুষকে কি আদৌ চেনা যায়?

—অনিন্দ্যকে যায়। একটা আদ্যন্ত ক্রুকেড ছেলে। সবসময়ে ব্রুড করছে, কারুর ওপর সন্তুষ্ট নয়, চাকরি টিঁকিয়ে রাখতে পারে না, অফিসে কথায় কথায় ঝগড়া বাধায়, মা-বাবার সম্পর্কেও যা মুখে আসে তাই বলে… মিনিমাম ফিলিংটা পর্যন্ত নেই। ভাব তুই সিচুয়েশানটা! বাচ্চা হবে তুই চাস না, ঠিক আছে চাস না। কিন্তু সংসার করতে গেলে কিছু তো তোকে মেনে নিতেই হবে। আদার হাফেরও তো ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে একটা ব্যাপার আছে। উদ্ভট বায়না জুড়লে চলবে কেন? অনিন্দ্যর প্রবলেম, সে কিছু মানতেই শেখেনি। শরণ্যা মাথা ঝাঁকাল, —সব চেয়ে বড় কথা, সেদিন সন্ধেবেলায় কী সাংঘাতিক অ্যাক্টিংটা করল! দিব্যি হাসিখুশি, দেখে মনে হয় কী নর্মাল, অথচ ভেতরে ভেতরে প্ল্যান ভেঁজে চলেছে!

—কুল কুল। শুভ্র একটা সিগারেট ধরাল। লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, —দ্যাখ শরণ্যা, আমি বলছি না অনিন্দ্য মুখার্জি একটা ভাল মানুষ। আমি এও বলছি না অনিন্দ্যকে তুই ক্ষমা করে দে। বোঝাই যায় সে অ্যাবনর্মাল। একটু নয়, ভাল মতোই। কিন্তু সে তো সব সময়ে অ্যাবনর্মাল থাকত না। থাকত কি? বল?

—কী বলতে চাইছিস? শরণ্যা ঝটিতি ঘুরেছে।

—এমন তো হতেই পারে, ওই দিন সে অ্যাক্টিং করেনি। ওটা তোর মনের ভুল।

—মানে?

—তুই তো নিজেই বলেছিস, অনিন্দ্য হয়তো কিছু করবে এই ভয়ে তুই কাঁটা হয়ে থাকতিস। ঠিক কি না?

—বটেই তো। আমার প্রেগনেন্সিটা ও আদৌ মেনে নিতে পারেনি।

—কেন পারেনি?

—ওভার পোজেসিভ।

—রাইট। অন্তত তোর ব্যাপারে ও খুব বেশি সেন্সেটিভ ছিল। সে ইচ্ছে করে, ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান ভেঁজে তোর কোনও ক্ষতি করে দেবে…

—আমার ক্ষতি তো করতে চায়নি। ও বাচ্চাটাকে মারতে চেয়েছিল।

—তাতে তোরও তো বিপদ হতে পারত। সব জেনে বুঝে ও সাবানজল ছড়িয়ে রেখেছে, তোকে ফেলে দেবে বলে…

এ ধন্দটা তো শরণ্যার মনেও আছে। সেদিন শরণ্যা যখন আছাড় খেয়ে পড়ল, অনিন্দ্য তো দৌড়ে এসেছিল, পাঁজাকোলা করে মেঝে থেকে তুলেছিল শরণ্যাকে। নার্সিংহোমে যাওয়ার পথেও সারাক্ষণ শরণ্যার হাত চেপে ধরে ছিল। তবু সেদিন অনিন্দ্যর সেই অস্বাভাবিক রকমের স্বাভাবিক আচরণ, হঠাৎ বাচ্চাটার সম্পর্কে জানার কৌতূহল, তারপরই তোয়ালেটা রেখে আসতে বলা—এগুলো কী প্রমাণ করে? সব চেয়ে বড় কথা, অপরাধ যদি সে নাই করে থাকে, তবে পরদিন নবেন্দু যখন শরণ্যাকে নার্সিংহোম থেকে মানিকতলায় নিয়ে চলে এল, অনিন্দ্য একবারও আপত্তি করল না কেন? পরদিনই বা মানিকতলায় ছুটে যায়নি কেন? কেন চোরের মতো খালি ফোন করত?

তবু একটা সংশয় যেন থেকেই যায়। কীটের মতো কুটকুট কামড়ায়। যদি দুয়ে দুয়ে চার না হয়? মানুষ তো।

ওই কীটটাই কি ভালবাসা?

শরণ্যা জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল। বুঝি ওই কীটটাকেই সরাচ্ছে মস্তিষ্ক থেকে। তেতো গলায় বলল, —ও সব পারে। ওর কোনও হিউম্যান ইমোশানই নেই। সেন্সই নেই। ওর ছিল শুধু কিছু অ্যানিম্যাল ইন্সটিংক্ট। ব্যস।

—তার জন্য তুই অনিন্দ্যকে পুরোপুরি দায়ী করতে পারিস না। শুভ্রকে তর্কে পেয়ে গেছে। হাত নেড়ে নেড়ে বলল, —বাবা মা হ্যাড ফেল্‌ড টু পারফর্ম দেয়ার ডিউটিজ। তাঁরা ছেলেকে সোশালাইজ করতে পারেননি। মে বি তাঁদের সময় ছিল না, মে বি তাঁদের সে বোধটাই ছিল না…

—মানতে পারলাম না। অনিন্দ্যর ছোট ভাইটা তা হলে অন্য রকম হল কী করে?

—খুব অন্য রকম হয়েছে কি? ডিমান্ড মেটেনি বলে সেও তো বাড়ি ছেড়ে ভাগলবা। দু’জনের ডিগ্রির তফাত থাকতে পারে, তবে দু’জনেই একই জাতের চিড়িয়া। বড় জন মিশতে পারে না বলে তার একরকম চেহারা, ছোটজন বাইরের পরিবেশে মেশে বলে তার আর একরকম চেহারা।

—কিন্তু ওই রকম একটা ফ্যামিলিতে পড়ে আমি সাফার করব কেন?

—তোকে তো পড়ে থাকতে বলিনি। শুভ্র হো হো করে হেসে উঠল, —তুই তো জেনেবুঝেই পড়ে ছিলি।

—না রে, আমি চেষ্টা করছিলাম। যদি ওকে নর্মাল করা যায়। হল না।

—বাজে কথা বলিস না। তুই অনিন্দ্য মুখার্জির প্রেমেও পড়েছিলি।

এর চেয়ে বড় সত্যি যে আর কিছু নেই এ তো শরণ্যাও জানে। কিন্তু এখন সে মনেপ্রাণে অনিন্দ্যকে ঘৃণা করে, এটাও তো সত্যি। তবে প্রেম আর ঘৃণা, দুটোই যে সমান অন্ধ এই সত্যিটুকুই শুধু শরণ্যা জানে না।

মুখ বেঁকিয়ে শরণ্যা বলল, —ভালবাসা না ছাই। জাস্ট দেখে সিম্‌প্যাথি হত…

—ভুলে যা, ভুলে যা। সিম্‌প্যাথিটুকুও ভুলে যা। নইলে আরও সাফার করবি।

শরণ্যা ছোট্ট করে শ্বাস ফেলল। আলতো মাথা নেড়ে বলল, —হুঁ। যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।

—আর বেলতলায় যাবি?

—মাথা খারাপ!

—বেলগাছ যদি প্রমিজ করে তোর মাথায় বেল ফেলবে না, তাও না? বলে জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরোটা টোকা মেরে ফেলে দিল শুভ্র। শরণ্যার মাথায় ছোট্ট চাঁটি মেরে বলল, —যা, বাড়ি যা। আমাকেও যেতে দে। গিয়েই তো এখন মা আর ডাক্তারের চার চক্ষুর মিলন ঘটাতে হবে।

বাসে বসে শুভ্রর কথাগুলোই ভাবছিল শরণ্যা। ছেলেটা ফাজলামি ইয়ার্কি করে বটে, তবে সুন্দর যুক্তি দিয়ে কথাও সাজাতে পারে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে কেন যে শুভ্রর সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা ছিল ? কাছাকাছি না এলে কোনও মানুষকেই ঠিক ঠিক চেনা যায় না। শুভ্র বলছিল, মানুষকে নাকি আদৌ চেনা যায় না। সত্যিই কি তাই? শরণ্যার তো মনে হয় শুভ্রর মধ্যে একটা সংবেদনশীল হৃদয় আছে। তার বিপন্নতাটাকে শুভ্র অনুভব করতে পারে। শরণ্যার ধারণাটা কি ভুল? আলগা আলগা সহৃদয়তা দেখায় শুভ্র? হঠাৎ বেলতলার প্রসঙ্গটা তুলল কেন? নিছক ঠাট্টা? না ভেবেচিন্তেই বলল? তুৎ, ঠাট্টাই।

মৃদু টোকাটা তবু সামান্য উদাস করে দিল শরণ্যাকে। তাকিয়ে আছে জানলার বাইরে। দেখছে আলোময় শহর, প্রায়ান্ধকার কবরখানা, ট্রামগুমটি, রেলস্টেশন। আবার কিছুই যেন দেখছে না। যেন ঘষাকাচের ওপারে আবছা হয়ে যাচ্ছে সব। শরণ্যার চোখে কি বাষ্প জমছে? কেন যে থেকে থেকে কান্না পায়?

বাড়ি ফিরে শরণ্যা দেখল ফ্ল্যাট সরগরম। কাকা-কাকিমা এসেছেন। সঙ্গে ঝিমলিও। জোর গুলতানি চলছে ড্রয়িংরুমে।

মেয়েকে দেখেই নবেন্দু বলে উঠলেন, —এই তো, বুবলি এসে গেছে। …বুবলি, তোর কাকিমা একটা জব্বর হিট করেছে রে।

শরণ্যা চটি ছাড়তে ছাড়তে বিস্মিত মুখে বলল, —কাকে?

—দ্যাট লেডি। নিবেদিতা মুখার্জি।

—কাকিমা তাকে পেল কোথায় ?

অঞ্জলি চোখ নাচিয়ে বললেন, —সে এক কাণ্ড।…তুই অর্চনা বলে কাউকে চিনিস? ওই সেই সুহাসিনীর?

—অর্চনা মৈত্র ? মানে অৰ্চনামাসি?

মহাশ্বেতা বলে উঠলেন —আর যাকে তাকে মাসি বলতে হবে না।

শরণ্যা মার দিকে একটু ভ্রূকুটি করল। তারপর অঞ্জলির দিকে ফিরে বলল, —তুমি অর্চনামাসিকে চেনো নাকি?

—কাল আলাপ হল। বড়দির নাতির অন্নপ্রাশন ছিল, সেখানে এসেছিল মহিলা। বড়দির বউয়ের পিসি না মাসি কী যেন হয়।

—ওমা, তাই নাকি?

—বাবাহ্, কী তার সাজ! বাচ্চার অন্নপ্রাশনে এসেছে হিরের সেট পরে! বড়লোকের গিন্নি বলে সবাই খুব তেল মারছিল। তিনি আবার নাকি অনুষ্ঠান বাড়িতে খান না কিছু! অত সুন্দর ভাপা ইলিশমাছ হয়েছিল… সবাই এত করে বলল, মুখেই তুলল না!

—তুমি কিন্তু কর্ডলাইনে চলে গেছ। দিব্যেন্দু পাশ থেকে বললেন, —আসল গল্পটা শোনাও বুবলিকে।

—হ্যাঁ। …বড়দি আলাপ করিয়ে দিল আমার সঙ্গে। তখনই শুনি উনি নাকি সুহাসিনী ওয়েলফেয়ার সোসাইটির একজন হোমরাচোমরা। সুহাসিনী নামটা শুনেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি নিবেদিতা মুখার্জিকে নিশ্চয়ই চেনেন? …ব্যস্, তারপরই সঙ্গে সঙ্গে আমি যা বলার সব বলে দিয়েছি।

—কী বলেছ?

—নিবেদিতা কী, নিবেদিতার ছেলেটি কী, সব। তোর সঙ্গে কে কী ব্যবহার করেছে সমস্ত খুলে বলেছি।

—কিন্তু মামণি তো আমার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করেননি!

—থাক, আর মামণি মামণি করে আদিখ্যেতা করতে হবে না। মহাশ্বেতা বললেন, —ওই মহিলা মামণি ডাকের যোগ্য নয়।

— তুমিই কিন্তু ওঁর বেশি ভক্ত ছিলে মা।

—ভণ্ড চিনতে পারিনি।

শরণ্যা কথাটা যেন পুরো মানতে পারল না। অনিন্দ্যর মা হিসেবে নিবেদিতার ওপর তার আর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই, কিন্তু নিবেদিতার অন্য পরিচয়টাকে সে অস্বীকার করে কী ভাবে? সমাজসেবা বা সুহাসিনীর কাজে নিবেদিতা তো সত্যিই আন্তরিক। সেখানে অন্তত তাঁর কোনও ফাঁকি নেই।

শরণ্যা অবশ্য প্রতিবাদে গেল না। তার শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে মা-বাবার স্নায়ু এখন সর্বদাই টান টান। ও বাড়ির কারুর সামান্যতম প্রশংসাও এখন নিষিদ্ধ। এমনকী নীলাচলেরও। তাও তো ভাগ্যিস অনিন্দ্যর ওই হানা দেওয়ার খবরটা কেউ জানে না। যদি একবার কানে যেত, নবেন্দু বোধহয় গিয়ে অনিন্দ্যর ঘাড়টাই মটকে দিতেন।

নবেন্দু নড়ে বসেছেন। বললেন, —যাক গে, হ্যাং দ্যাট লেডি। …আমাদের যা কথা হচ্ছিল…

অন্য কথায় দিব্যেন্দু ভুলেই গিয়েছিলেন প্রায়। বললেন, —কী নিয়ে কথা হচ্ছিল বলো তো?

—লইয়ার নিয়ে। নবেন্দু মনে করিয়ে দিলেন, —তুই তা হলে কাল-পরশুই গিয়ে তোর কে চেনা উকিল আছে তার সঙ্গে কথা বল। ফ্যাক্টটা স্টেট্ কর। তারপর বল, উই ওয়ান্ট ইমিডিয়েট রিলিফ ফ্রম দোজ বাগারস।

অন্নপূর্ণা এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, —হ্যাঁ হ্যাঁ, কাটান ছেঁড়ান হয়ে যাক। আমরা মনে করব আমাদের বুবলির বিয়েই হয়নি। ধরে নেব, মাঝের ক’টা মাস মিথ্যে ছিল। দুঃস্বপ্ন।

মহাশ্বেতা দিব্যেন্দুকে জিজ্ঞেস করলেন, —বুবলিকেও কি যেতে হবে তোমার সঙ্গে?

—দেখি। প্রথমদিন তো একলাই কথা বলে আসি।

—ছেলে আর মা দুটোকেই কিন্তু কোর্টে নাস্তানাবুদ করতে হবে।

দিব্যেন্দু হেলান দিয়েছেন চেয়ারে। চশমা খুলে কাচ মুছছেন। ঈষৎ চিন্তিত মুখে বললেন, —কিন্তু দাদা, বুবলির কথাটাও তো আমাদের ভাবতে হবে। কোর্ট, কাঠগড়া, কাদা ছোড়াছুড়ি…

—ওরা কী কাদা ছুড়বে? আমরা ওদের মুখে পাঁক লেপে দেব।

—স্টিল… জানোই তো, কোর্ট মানে সত্যি বা ন্যায় প্রতিষ্ঠার জায়গা নয়। কে কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনল, সাক্ষীসাবুদ দাঁড় করিয়ে কে কতটুকু এস্‌ট্যাবলিশ করতে পারল, ব্যস। ওরাও কি এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? নিজেদের ডিফেন্ড করতে বুবলির নামেও কত আজেবাজে কথা বলবে তার ঠিক কী! হয়তো চরিত্র তুলেই কিছু একটা বলে দিল। বানিয়ে বানিয়ে বলতে তো আর ট্যাক্স লাগে না।

—হুঁহ্, বললেই হল? প্রমাণ করতে হবে।

—করবে না প্রমাণ। পারবে না। কিন্তু বুবলির গায়ে নোংরাটা তো লাগল।

—হুম। এটা একটা ভাববার মতো কথা বটে। নবেন্দু একটু থিতোলেন। চোখের কোণ দিয়ে তাকালেন শরণ্যার দিকে, —কী রে বুবলি, তুই কী বলিস?

শরণ্যা মাথা নিচু করে ওড়নার খুঁট পাকাচ্ছিল। তাকে ঘিরে বাড়িতে এত তুলকালাম চলছে ভাবলেও তার অস্বস্তি হয়। অস্ফুটে বলল, —সুতোটা তো ছিঁড়ে ফেলাই ভাল। তবে যতটা পিসফুলি হয়।

দিব্যেন্দু বললেন, —আমি কি লইয়ারকে মিউচুয়াল সেপারেশানের কথা বলব?

পলকের জন্য অনিন্দ্যর কথা মনে পড়ল শরণ্যার। ফুঁসছে! দেখে নেব! বলল, —ওরা কি মিউচুয়ালে রাজি হবে?

—আমাদের লইয়ার ওদের কনট্যাক্ট করুক। বাজিয়ে দেখুক। চিঠি পাঠাক। ছ’মাসের মধ্যে ব্যাপারটা তা হলে মিটে যায়।

—দেখ তবে। মামলা করার রাস্তা তো খোলা রইলই।

শরণ্যা উঠে পড়েছিল। ঘামে প্যাচপ্যাচ করছে শরীর, এবার স্নান করতে হবে। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, —এসব কিছু করার আগে আমার কয়েকটা জিনিস কিন্তু ও বাড়ি থেকে আনিয়ে নেওয়া দরকার বাবা।

—কী বল তো? তোর জামাকাপড়?

—হ্যাঁ। সে তো আছেই। তা ছাড়া… আমার প্রোজেক্টের সব কাগজপত্র যে ওখানে পড়ে। এদিকে স্যার এক সপ্তাহের মধ্যে গোটা কাজের সিনপ্‌সিস করে দিতে বলছেন।

নবেন্দু বললেন, —আমি যাব? গিয়ে নিয়ে আসব?

মহাশ্বেতা বললেন, —না না, তোমার গিয়ে কাজ নেই। যা মাথাগরম মানুষ! ওরা হয়তো ওখানে কিছু বলল, উত্তরে তুমি একটা বললে, শেষে হয়তো লাঠালাঠি লেগে যাবে। আর ওই খুনেটার সামনে তুমি তো মোটেই যাবে না।

দিব্যেন্দু বললেন, —বুবলি, তুই একটা কাজ কর। কী কী আনতে হবে তার একটা লিস্ট বানিয়ে দে। আমি আর ঝিমলি নয় গিয়ে এই রোববার…

ঝিমলি সোফায় বসে রিমোট হাতে টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখছিল। ভলিয়্যুমটা একদম কমিয়ে দিয়ে। ঘাড় ফিরিয়ে বলল, —হ্যাঁ হ্যাঁ চলো। সরেজমিনে সিচুয়েশনটা একবার দেখে আসি।

অঞ্জলি বললেন, —ওখানে গেলে একবার মিউচয়ালের কথাটাও পেড়ে দেখতে পারো। নিবেদিতা দেবীরও তো কেচ্ছার ভয় আছে, রাজি হয়ে যেতেও পারেন।

আলোচনা চলছে। শরণ্যা নিজের ঘরে এল। আশ্চর্য, এই মুহূর্তে হঠাৎ একটা মানুষের মুখই মনে পড়ছে তার। যার কথা কেউ তোলে না। যাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না কেউ। না নবেন্দু-মহাশ্বেতা, না নিবেদিতা-অনিন্দ্য।

আর্য। মুখার্জিবাড়ির গৃহকর্তা!

মানুষটা একদিন ফোন করেছিলেন শরণ্যাকে। একদিনই। অফিসে। বেশি কথা বলার তো অভ্যেস নেই, শুধু বলেছিলেন, —ভাল থেকো।

কেমন আছেন শ্বশুরমশাই? ওই চক্রব্যূহে?

.

১৩.

—দ্যাখ, আজ বাপটা এসেছে!

চাপা স্বর, তবু শুনতে পেলেন আর্য। তরল সিসের মতো যেন প্রবেশ করল কানে। এই বয়সে পৌঁছে ইন্দ্রিয়গুলো ক্রমশ ভোঁতা হওয়ার কথা। তাঁর ক্ষেত্রে কেন যে তীক্ষ্ণ হচ্ছে দিন দিন?

ঘাড় না ঘুরিয়েও স্বরের উৎসটিকে চিনতে পেরেছেন আর্য। শরণ্যার বাবা।

আর্য গুটিয়ে গেলেন ভেতরে ভেতরে। আজ এই রণক্ষেত্রে উপস্থিত থাকার তাঁর একটুও ইচ্ছে ছিল না, তবু নিবেদিতার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলেন কই! অনুরোধ, না নির্দেশ ? নাকি আদেশ? যাই হোক না কেন, আর্য তো মুখের ওপর না বলে দিতে পারতেন। ইদানীং অল্পস্বল্প না বলার জোরও তো এসেছে তাঁর। তাও পারলেন না। সেই অদৃশ্য সুতোটায় আবার টান পড়ল যে। কখনও কখনও বিবেকও এত অসহায় হয়ে পড়ে!

নিবেদিতাও কি একই দংশনে ভুগছেন এখন? বাইরে প্রকাশ নেই, তবে আর্য পরিষ্কার টের পান সোমশংকরের মেয়ে ভাঙছে। কী ভীষণ বিধ্বস্ত যে দেখায় আজকাল নিবেদিতাকে! শোক, তাপ, দুঃখ, হতাশা সবই বুঝি সইতে পারে মানুষ, কিন্তু অহংয়ে যদি ফাটল ধরে তা সহ্য করা বড় কঠিন। অস্তিত্বের ভিতটাই যে নড়ে যায়।

চেয়ার টেনে বসেছেন নবেন্দুরা। টেবিলের ওদিকটায়। বাবা-কাকার মধ্যিখানে শরণ্যা। এপাশে আর্য অনিন্দ্য নিবেদিতা। মাঝে একখানা চেয়ার ফাঁকা ছিল, সেখানে এসে বসলেন শ্যামল রায়। অনিন্দ্যর পক্ষের লইয়ার। বিভাজন রেখাটা স্পষ্ট হয়ে গেল। আর্যর চোখ চলে গেল শরণ্যার দিকে। নতমুখে বসেছে মেয়েটা। কাঁপছে যেন একটু একটু। আপন হতে এসেছিল, দুম করে কেমন পর হয়ে গেল!

দিব্যেন্দু কথা শুরু করলেন, —সরি বরুণদা, দেরি হয়ে গেল।

টেবিলের ওপারে ঘুরনচেয়ারে বরুণ সান্যাল। শরণ্যার পক্ষ। কবজি উলটে ঘড়ি দেখে বললেন, —না না, তোমরা রাইট টাইমেই এসেছ। ওঁরাই বরং একটু আর্লি…

শ্যামল হাসলেন, —আমাদের তো একটু আগে আগে আসতেই হয় দাদা। প্রতিপক্ষ বলে কথা। কোথায় জ্যামে ফেঁসেটেসে যাই…

—প্রতিপক্ষ আবার কী? আমরা তো সবাই আজ এক দলে। কথার প্যাঁচে বরুণও দড়। তাঁর বিত্তের প্রলেপ মাখা সৌম্য মুখে পেশাদার হাসি, —স্টার্ট করা যাক তা হলে?

কারুর মুখে শব্দ নেই। পাথরের মতো বসে আছেন নিবেদিতা। পাশে অনিন্দ্যর মুখও থমথমে। অন্যমনস্ক হওয়ার জন্যই বুঝি চোখ ঘুরছে দেওয়ালে দেওয়ালে। আইনের মোটা মোটা বই ঠাসা ওয়াল ক্যাবিনেটে। হোয়াটনটে জমে থাকা ব্রিফের স্তূপে। দরজার মাথায় সাজানো সিংহবাহিনীর ছবিতে।

আশ্চর্য ছেলে! সেদিনও নিবেদিতার সঙ্গে শির ফুলিয়ে ঝগড়া করছিল, —কেন ভয় পাব, অ্যাঁ? কে বলেছে আমি সাবানজল ফেলেছিলাম? প্রমাণ করো!

ভাঙে তবু মচকায় না। অবিকল মায়ের ধারা পেয়েছে ছেলেটা। সুনন্দটা বুঝি পালিয়ে বাঁচল। একটু হলেও সুনন্দর মধ্যে আর্য কী রয়েছেন কোথাও? কে জানে!

টেবিলে ফাইল তৈরি। বরুণ রিডিংগ্লাস পরে নিলেন। গলা খাকারি দিয়ে বললেন, —আমার ড্রাফটটাই পড়ি আগে? নাকি আপনি আগে রিড আউট করবেন?

—আপনারটাই চলুক। ব্রিফকেস থেকে শ্যামলও ফাইল বার করেছেন। চোখ বুলোত বুলোতে বললেন, —কোনও পয়েন্টে ডিফারেন্স হলে তখন শর্ট আউট করা যাবে।

ক্ষণিক নৈঃশব্দ্য।

নিবেদিতা সোজা হয়েছেন। নব্যেন্দুর চোয়াল শক্ত। অনিন্দ্য আঙুল মটকাচ্ছে। দিব্যেন্দুর ভুরুতে ভাঁজ। শরণ্যা কোলের ব্যাগটিকে দু’হাতে জাপটে ঝুঁকল।

আর্য চোখ বুজলেন। ধর্মক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসব :….। উকিলের চেম্বারকে কি পুণ্যভূমি বলা যায়? যুযুধান দু’পক্ষই প্রস্তুত, তিনি কি এই মুহূর্তে শিখণ্ডী ? শিখণ্ডীও তো যুদ্ধ করেছিল! তা হলে আজ এই কুরুক্ষেত্রে তাঁর কী ভূমিকা?

বরুণ পাঠ আরম্ভ করেছেন,— কোর্ট অফ দি সো অ্যান্ড সো। ম্যাট্রিমোনিয়াল স্যুট নাম্বার সো অ্যান্ড সো। পিটিশনার নাম্বার ওয়ান, শ্রীঅনিন্দ্য মুখার্জি, সান অফ শ্ৰীআর্য মুখার্জি, বাই ফেথ হিন্দু, রিসাইডিং অ্যাট সতেরোর তিন ফার্ন রোড, কলকাতা…।কী মিস্টার মুখার্জি, অ্যাড্রেসটা ঠিক আছে তো?

নিবেদিতাই সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন, —হুঁ।

—পিটিশনার নাম্বার টু, শ্রীমতী শরণ্যা মুখার্জি, ওয়াইফ অফ শ্ৰীঅনিন্দ্য মুখার্জি অ্যান্ড ডটার অফ সো অ্যান্ড সো, বাই ফেথ হিন্দু, রিসাইডিং অ্যাট সো অ্যান্ড সো। দিস ইজ অ্যান অ্যাপ্লিকেশান অফ ডিভোর্স আন্ডার মিউচুয়াল কনসেন্ট, সেকশান তেরোর বি, হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট, অ্যামেন্ডেড ঊনিশশো ছিয়াত্তর। বরুণ সামান্য দম নিয়ে গলা তুললেন, —এগুলো মিয়ার ফরম্যালিটি। লিখতে হয়। কার সঙ্গে কার আপোষে বিচ্ছেদ হচ্ছে, সেটাই জাস্ট…

আপোষে বিচ্ছেদ! কথাটা কানে লাগল আর্যর। অনেকটা সোনার পাথরবাটির মতো শোনায় না?

শ্যামল বললেন, —আপনি ডাইরেক্ট পয়েন্টে চলে আসুন দাদা।

বরুণ বললেন, —হ্যাঁ। খসড়াটা মোটামুটি যা করেছি বলি। পিটিশনার নাম্বার ওয়ান আর পিটিশনার নাম্বার টু-র বিয়ে হয়েছিল গত বছর নভেম্বরের বাইশে। কারেক্ট?

—কারেক্ট।

—তারপর থেকে পিটিশনার নাম্বার টু পিটিশনার নাম্বার ওয়ানের বাড়িতে বাস করতেন। একত্রে দাম্পত্য জীবনযাপনের সূত্রে মার্চের মাঝামাঝি পিটিশনার নাম্বার টু প্রেগন্যান্ট হন। তারপর থেকেই দু’জনের মানসিক অমিল শুরু হয়।…

—অবজেকশান। ও ভাবে একটা পার্টিকিউলার টাইম ধরে মানসিক অমিলের কথা লিখছেন কেন? শ্যামলের আপত্তি শুরু হল, —জেনারেল একটা কমেন্ট করে দিন।

—কী রকম?

—বলতে পারেন বিয়ের পর থেকে স্বামী-স্ত্রীতে মনের মিল হচ্ছিল না।

—ক’মাস বিয়ে হয়েছে মশাই, অ্যাঁ? অমিল হতেও তো সময় লাগে। অবশ্য বিশেষ কোনও রিজন না থাকলে…

নিবেদিতা চোখ সরু করে শুনছিলেন। হঠাৎ গুমগুমে স্বরে বলে উঠেছেন, —রিজন দেওয়ার কোনও কথা ছিল না। বলা হয়েছিল, স্রেফ মেন্টাল অ্যাডজাস্টমেন্টের অভাব দেখালেই…

—তা হলেও একটা ইন্সিডেন্টের পর থেকেই তো…? কী নবেন্দুবাবু, আপনি কী বলেন?

নবেন্দু নয়, দিবেন্দুর জবাব, —দিন ঘুরিয়ে। মিস্টার রায় যে ভাবে বলছেন।

সঙ্গে সঙ্গে টুক করে নবেন্দুর একটা তির, —হ্যাঁ, মিস্টার রায়ের ক্লায়েন্টের মিহি চামড়ায় যখন লাগছে…!

নিবেদিতা কটমট তাকালেন। তবে চোখ ঘুরিয়েও নিলেন।

মাথা নিচু করে খস খস পেন চালাচ্ছেন বরুণ। শ্যামলের ঠোঁটে আত্মপ্রসাদের হাসি। আর্য মনে মনে একটু আশ্বস্ত হলেন। যাক, প্রথম শর নিক্ষেপটা সামলে গেছে তা হলে।

পড়ে চলেছেন বরুণ। নিরাবেগ স্বরে।

হঠাৎ অনিন্দ্য ফস করে উঠল, —মিস্টার সান্যাল, আপনি আগের পয়েন্টটা রিপিট করুন তো।

—কোনটা ভাই?

—ওই যে, প্রফেশানের ব্যাপারটা।

বরুণ খুঁজে খুঁজে পড়লেন ফের, —এইটা? দ্যাট দি পিটিশনার নাম্বার ওয়ান ইজ অ্যান ইঞ্জিনিয়ার, প্রেজেন্টলি আনএমপ্লয়েড, হোয়াইল দি পিটিশনার নাম্বার টু ইজ আ প্রোজেক্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ইন আ ননগভর্নমেন্ট অরগানাইজেশান…?

—ইয়েস। আনএমপ্লয়েড লেখার কী দরকারটা ছিল?

নব্যেন্দুর চোখ বরুণে, কিন্তু লক্ষ অনিন্দ্য, —চাকরি নেই বলেই লেখা হয়েছে। ভুল তো কিছু না।

নিবেদিতার দৃষ্টিও বরুণে, —এটা কী কথা? আমার ছেলের আজ চাকরি নেই, কালই সে কোথাও জয়েন করতে পারে।

শ্যামল আবার মক্কেলদের হয়ে আপত্তি জুড়লেন, —আমার মনে হয় ওটা না লিখলেও চলে দাদা। তার চেয়ে শুধু বাই প্রফেশান ইঞ্জিনিয়ার বলাই তো যথেষ্ট।

শরণ্যা ফস করে বলে উঠল, হুঁহ্, বাই প্রফেশান ইঞ্জিনিয়ার! কোনও দিন চাকরি পাবে ও?

অনিন্দ্যর মুখ আজ নিখুঁত কামানো। তার ফরসা গাল সঙ্গে সঙ্গে লাল হয়ে গেছে, —এগুলো কিন্তু ডিরোগেটারি কমেন্ট হচ্ছে!

শরণ্যা আবার বলল, —হুহ্।

আর্য ফের তাকিয়ে ফেললেন শরণ্যার দিকে। ওই মেয়েটি নিশ্চুপ থাকলেই কি ভাল হত না এখন? অবশ্য যুদ্ধে নেমে কে’ই বা নীতি মানে!

দিব্যেন্দু হাতের ইশারায় শান্ত করেছেন শরণ্যাকে। ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি। ভাবটা এমন পাঞ্চটা তো মেরেই দিলি, এবার চেপে যা! হাসির সরটুকু ঠোঁটে রেখেই বললেন,—বলছে যখন, মেনে নিন বরুণদা৷ বেকার তো, ইগোয় লাগছে।

—ও কে। ও কে। বাই প্রফেশানই করে দিলাম। বরুণ ঝুঁকলেন ফাইলে,— ওই লাইনগুলোও বদলে দিলাম সামান্য। শুনুন, কী লিখেছি… বিয়ের পর থেকেই শ্রীমতী শরণ্যা আর শ্রীমান অনিন্দ্যর মনের মিল হয়নি। দু’জনেই অশান্তিতে থাকতেন। আই মিন মেন্টাল ডিস্টার্বেন্স। গত জুন মাসের উনিশ তারিখে শ্রীমতী শরণ্যার একটি গর্ভপাত ঘটে, তার পরই দু’জনের মানসিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ রূপে বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে। এবং শ্রীমতী শরণ্যা উনিশে জুন নার্সিংহোম থেকেই তাঁর পিত্রালয়ে ফিরে আসেন। উনিশে জুনের পর থেকে দু’জনে আর একত্রে বাস করেননি। ঠিক আছে তো?

—না। ঠিক নেই। আবার কেন একটা ইন্সিডেন্ট মেনশান করছেন?

—বা রে, কিছু তো একটা বলতে হবে। প্রেগনেন্সি বলা যাবে না, মিসক্যারেজ বলা যাবে না…। দিব্যেন্দু পিন ফোটালেন,—বিয়েটা বলা যাবে তো?

নিবেদিতা যেন শুনেও শুনলেন না। রাগত স্বরে বললেন,—মিস্টার রায়, আপনি না বলেছিলেন ওরা কোনও ঘটনারই উল্লেখ করবেন না? বার বার কেন এক কথা উঠছে?

—মিসক্যারেজটা থাকবেই।

—তা হলে রইল আপনাদের মিউচুয়াল, আমরা উঠছি। কেসই হোক। চলুক। দেখব ওই মেয়ে কী ভাবে ডিভোর্স পায়।

—তাতে কি সুবিধে হবে? কোর্টে কিন্তু মা-ছেলের কাপড় খুলে নেব।

—কী ফিল্‌দি ল্যাঙ্গুয়েজ! এই ফ্যামিলিতে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলাম? ছি।… মিস্টার সান্যাল, আইদার আপনি আপনার ক্লায়েন্টকে রেসট্রিক্ট করুন, নয় তো আমরা চললাম।

—আহাহা, উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন কেন? বসুন। বসুন। বরুণ ফিরেছেন দিব্যেন্দুর দিকে,—দেবু, শান্তিতে ড্রাফ্‌টটা ফাইনালাইজ করতে দাও। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে, সেপারেশানের দরখাস্তে মিসক্যারেজ থাকলে কী আর এমন সান্ত্বনা হবে? লিভ ইট।… কী মিসেস মুখার্জি, তা হলে আপনারা সন্তুষ্ট তো?

নিবেদিতা গোঁজ।

—ডেট কিন্তু আমায় একটা দিতেই হবে। এটা এসেনশিয়াল।

—দিন। ওই উনিশ একুশ যা ইচ্ছে রাখুন।

আর্যর ভারী অবাক লাগছিল নিবেদিতাকে দেখে। এত অপমানের পরও উঠি চলি বলে বসে রইল! মুখে যাই বলুক, মনে মনে কী ভীষণ ভাবে আপোষে মীমাংসাটা চাইছে সোমশংকরের মেয়ে। পাঁচজনের চোখে ছোট হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে ভুগছে। নইলে নিবেদিতার মতো মহিলা প্রতিপক্ষ উকিলের চেম্বারে আসতে রাজি হয়? সোমশংকরের জুনিয়াররা অনেকেই এখন নামী আইনজ্ঞ, অথচ তাঁদের কারুর কাছে যায়নি নিবেদিতা। উকিলও লাগিয়েছে এক অতি সাধারণ। প্রায় অচেনা। যত চুপিসাড়ে ব্যাপারটা সেরে ফেলা যায়।

মনে মনে হাসলেন আর্য। বিষণ্ণ হাসি। লোকের চোখে তাকে কেমন দেখাবে তার বাইরে এখনও কিছু ভাবতে শিখল না নিবেদিতা। মায়াও হয়। দম্ভকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে কত কী যে হারাল জানতেও পারল না।

ড্রাফ্‌ট বদল হয়েছে। নিবেদিতার কথা মতোই। একবার পড়ে শুনিয়েও দিলেন বরুণ। এসেছেন প্রায় শেষ ধাপে। বললেন,—এবার লাস্ট পয়েন্টটাও বলে নিই? শ্রীমতী শরণ্যা শ্ৰীমান অনিন্দ্যর কাছে কোনও মেইনটেনেন্স বা অ্যালিমনি দাবি করছেন না। …কী দেবু, তাই তো বলেছিলে?

—আমাদের তরফ থেকে ঠিক আছে। আমাদের মেয়ে রোজগার করে। দিব্যেন্দুর গলা মাখনের ছুরি, —তবে শ্যামলবাবুকে জিজ্ঞেস করে নিন, ওঁর ক্লায়েন্ট আমাদের মেয়ের কাছ থেকে ভরণপোষণ চায় কিনা।

অনিন্দ্য চমকে তাকিয়েছে। একবার দিব্যেন্দুকে দেখল, একবার শরণ্যাকে। চোখ ফের লাল,—আমরা কি ফালতু কথা শুনব? না কাজটা শেষ হবে?

—বেশ বেশ। ড্রাফ্‌ট তা হলে ফাইনাল তো? টাইপে দিয়ে দিই? অবশ্য তাড়াহুড়োর কিছু নেই। অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়বে তো সেই পুজোর পর…

—সে তো বটেই। বিয়ের একবছরের মধ্যে তো মিউচুয়াল সেপারেশনের প্রেয়ার করা যায় না।

—তার মানে এন্ড অফ নভেম্বর…

দুই উকিলে কেজো বাক্যালাপ চলছে নিরাবেগ স্বরে।

যাক, নিশ্চিন্ত। আর্য হেলান দিলেন চেয়ারে। তাল ঠোকাঠুকি হলেও মোটামুটি থেমেছে যুদ্ধটা। এবার যে যার ঘরে ফিরলেই হয়।

তখনই প্রবল বিস্ফোরণটা ঘটল।

নবেন্দু বুঝি বদলগুলো এখনও হজম করতে পারছিলেন না। হঠাৎই ফুঁসে উঠেছেন,—দাঁড়ান দাঁড়ান। ওদের আগে ইন রাইটিং দিতে বলুন ওরা এই ড্রাফটে এগ্রি করছে। সই করার আগে আবার যেন কোনও ফ্যাকড়া না ওঠে।

—আহা, উনি তো মেনেই নিয়েছেন।

—আপনি আপনার ক্লায়েন্টকে চেনেন না মিস্টার রায়। ওরা সব পারে। ওদের কোনও চোখের চামড়া নেই।

নিবেদিতা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেন নবেন্দুকে। বরুণকে বললেন,— আমাদের কাজ তা হলে শেষ? আমরা যেতে পারি? আপনি শ্যামলবাবুর কাছে ফাইনাল ড্রাফট পাঠিয়ে দেবেন?

—পালাচ্ছেন ? কালা সাজার ভান করছেন?

নিবেদিতা নিরুত্তর।

—এত সহজে আমি আপনাদের ছাড়ছি না। নবেন্দুর আঙুল কাঁপছে ঠকঠক, —উত্তর দিন। কেন আপনি আমার ভাই আর ভাইঝিকে ইনসাল্ট করলেন সেদিন? কেন?

—আমি? নিবেদিতা আকাশ থেকে পড়লেন, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, —আপনি কী বলছেন নিজেও জানেন না! আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

—আমার মাথা খারাপ? সেদিন আপনারা চামারের মতো আচরণ করেননি, বুবলির ক’টা ফাইল আর জামাকাপড় আনতে গিয়েছিল…জানেন জানেন, ওই নীচ মহিলা তার রসিদ লিখিয়ে নিয়েছে! আর ওই বাঁদর ছেলে ব্যাগ খুলে সার্চ করছিল কী কী নিল ওরা! আমরা কি চুরি করতে গেছি? চোর?

—ভালর জন্যই তো করেছি। পরে তো ওই নিয়েও ডিসপিউট হতে পারত।

—হুঁহু্‌, ডিসপিউট! আমার মেয়ের সর্বস্ব পড়ে আছে ওখানে…

—আছে তো পড়ে খাট বিছানা। নিয়ে যাবেন। তখনও লিস্ট বানিয়ে সই করিয়ে নেব।

—শুধু খাট বিছানা নেই, আছে আরও অনেক কিছু। আলমারি ওয়ার্ড্রোব ড্রেসিংটেবিল বুককেস…

—নিয়ে যাবেন সাত দিনের মধ্যে। নইলে টান মেরে রাস্তায় ফেলে দেব।

—সাত দিন নয় মা, তিন দিন। বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে ঘর সাফ না হলে আমি কিন্তু ওগুলো লাথি মেরে মেরে ভাঙব।

—ভাঙা ছাড়া আর কিছু শিখেছিস? শিক্ষা পেয়েছিস বাড়ি থেকে? পয়সা খরচ করে জীবনে কিনেছিস কিছু?

—বাবা, চুপ করো। ছোটলোকটার সঙ্গে কথা বোলো না।

—আপনাদের ওই রদ্দি মালগুলোর চেয়ে আমাদের অনেক বেশি দামি জিনিস আপনাদের গব্বায় আছে। বিয়েতে যে ভারী ভারী গয়নাগুলো দিয়েছি সেগুলো কোথায় শুনি ? কার লকারে ঢুকে আছে ওগুলো?

—ওই গয়নায় আমার মেয়ে পেচ্ছাপ করে। ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসব।

—দেবেন। গুনে গেঁথে দেবেন।

—আমাদেরও গুনে গুনে প্রত্যেকটি জিনিস ফেরত চাই। যা যা দিয়েছি। চাদর বালিশ জামা কাপড় শাল সোয়েটার….। আপনার ছেলে হাতে যে ঘড়িটা পরে আছে, ওটাও তো আমাদের দেওয়া। ওই আংটিটাও তো আমাদের। গায়ের শার্টটাও এই জামাইষষ্ঠীতে দিয়েছি।

সম্পর্ক ভাঙার এ কী বীভৎস চেহারা! আর্য স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছিলেন। বাইরের দুটো লোক মুখ টিপে হাসছে, তাও কি কারুর খেয়াল নেই?

আর্য জীবনে বোধহয় এই প্রথম চিৎকার করে উঠলেন,—থামো, থামো। থামো এবার।

.

১৪.

অর্চনার সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষ হতেই দময়ন্তী নিচু গলায় বলল, —আমি কি কিছু বলতে পারি নিবেদিতাদি?

ডায়াসে পাশাপাশি পাঁচখানা চেয়ার। নিবেদিতা বসেছেন মধ্যমণি হয়ে। সুহাসিনীর বার্ষিক সাধারণসভা প্রায় সমাপ্তির মুখে, একটু আগে চুকে গেছে নির্বাচনপর্ব। এখনও নিবেদিতার বুকে টাইফুন, তবে বাইরে তিনি অচঞ্চল। মাথা নেড়ে বললেন, —হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বলো।

একদম ধারের চেয়ারটি ছেড়ে সপ্রতিভ ভঙ্গিতে উঠল দময়ন্তী। টুকরো হাসি উপহার দিল স্টেজে উপবিষ্ট দীপালি আর সুপ্রিয়াকে। স্টেজের টেবিলে হাইব্রিড রজনীগন্ধার ঝাড়, মাইক্রোফোন অভিমুখে যাওয়ার সময়ে মহার্ঘ ক্রেপসিল্ক শাড়ির আঁচলের ছোঁয়ায় ফুলদানিটা উলটে যাচ্ছিল, ধরে স্বস্থানে বসিয়ে দিয়েছে। আঁচল কোমরে পেঁচিয়ে গলা ঝাড়ল একটু। তারপর রিনরিনে গলায় বক্তৃতা শুরু করেছে, —আমার আগে আমাদের সুহাসিনীর সম্পাদিকা অর্চনাদি যা বলে গেলেন, তারপর আমার আর কিছুই বলার নেই। তবু নতুন কর্মসমিতিতে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হওয়ার পর আপনাদের দুটো-একটা কথা বলার লোভ আমি সামলাতে পারছি না। আমরা সবাই মিলে এই সুহাসিনীতে মিলেছি কীসের জন্যে? গরিব দুঃখী অনাথা অবহেলিতা অত্যাচারিতা মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে চাই আমরা। তাদের কষ্টের বোঝা কিছুটা লাঘব করতে চাই। পূর্বতন কর্মসমিতি যে ভাবে ঐকান্তিক নিষ্ঠার সঙ্গে এই কাজ করে গেছেন, তার কোনও তুলনা নেই। নতুন কর্মসমিতিও সেই নিষ্ঠার ধারাটিকে বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে আপনারা ধরিয়ে দেবেন এবং আশা করব আপনারা সকলেই আমাদের পাশে থাকবেন। আমাদের পাশে মানে সুহাসিনীর পাশে। সুহাসিনীতে আমরা নতুন রক্ত আনতে চাই। সুহাসিনীর কাজে আমরা আরও গতি আনতে চাই। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুহাসিনীকে আমরা আরও বড় করতে চাই। আপনাদের সকলের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া এই কাজ সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় আশার কথা, আমাদের সভানেত্রী, আমাদের সবার প্রিয় শ্রদ্ধেয়া নিবেদিতাদি আমাদের মাথার ওপর আছেন। নিবেদিতাদি সুহাসিনীর প্রাণ। নিবেদিতাদি ছাড়া সুহাসিনী অচল। ইদানীং কিছু কিছু পারিবারিক সমস্যায় তিনি যথেষ্ট বিব্রত আছেন বটে, তবু তিনি প্রবল ভাবেই আমাদের মধ্যে আছেন। অত্যাচারিতা মেয়েদের কথা তাঁর মতো করে আর কে ভাবতে পারবে? তাঁর মতো একজন সমাজসচেতন মহীয়সী মহিলার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমরা…

গায়ে যেন জলবিছুটি লাগছিল নিবেদিতার। কুটকুট করছে সর্বাঙ্গ, জলে যাচ্ছে গা। তাঁকে নির্মম ভাবে হারিয়ে দিয়েও তৃপ্তি হয়নি, এখনও চিমটি কাটা কথা বলে যাচ্ছে ওই মেয়ে! তাঁর পারিবারিক সমস্যা নিয়ে সহানুভূতি দেখাচ্ছে, অথচ ঘুরে ঘুরে ওই মেয়েই সর্বত্র রাষ্ট্র করে বেড়িয়েছে তাঁর পরিবারের কেচ্ছা! দুঃখী মেয়েদের জন্য নিবেদিতাদির চোখ দিয়ে টসটস জল পড়ে, আর ওদিকে বাড়িতে নিজের ছেলের বউকেই তিনি প্রোটেকশন দিতে পারেন না। শুধু ব্যক্তিগত আক্রমণ করেই তাঁকে জব্দ করে ফেলল! পুরো প্যানেলটাই হেরে গেল নিবেদিতার! সংবিধান পালটাতে পারলে তাঁকেও হয়তো সুহাসিনী থেকে ছুড়ে ফেলে দিত ওই মেয়ে। আর থেকেই বা তিনি এখন কী করবেন? দময়ন্তীরা তো ইচ্ছে মতন কাজ করবে, কত তিনি বাধা দেবেন?

এখনও দময়ন্তী থামেনি। তার স্বর উঠছে, নামছে। আবেগঘন গলায় বলল, —আমাদের বৃদ্ধাশ্রমের কাজ আমরা এগিয়ে নিয়ে যাবই। আশা করছি দু’বছর পর কর্মসমিতির পরবর্তী নির্বাচনের ঢের আগেই আমরা বৃদ্ধাশ্রমের কাজ সম্পূর্ণ করতে পারব। এ প্রসঙ্গে একটা খবর উল্লেখ না করে পারছি না। আপনারা হয়তো অনেকে জানেনও, তবু বলি, বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিতাদি সম্প্রতি এক লাখ এক টাকা দান করেছেন। আসুন, আমরা করতালি দিয়ে নিবেদিতাদিকে সকলে অভিনন্দন জানাই…

ওফ্, নিবেদিতা কেন যে বধির হয়ে যাচ্ছেন না! হাততালি নয়, যেন কানের পরদায় উচ্চিংড়ে লাফাচ্ছে! সোনাদার পিছনে লেগে থেকে থেকে, কত ঝামেলা হুজ্জোত করে বাড়িটা বেচা হল, তার থেকে পুরো এক লাখ দিয়েও এখন ঠুঁটো হয়ে বসে থাকতে হবে নিবেদিতাকে?

মিটিং ভাঙল প্রায় চারটেয়। সাধারণ সদস্যরা উঠে পড়েছে চেয়ার ছেড়ে, ছোট ছোট জটলায় গুলতানি চলছে। এই ধরনের সভা অনুষ্ঠানে সকলের সঙ্গে সকলের দেখা হয়ে যায়, তাই পরিবেশটাই বেশ আনন্দঘন। টুং টাং হাসি নেচে বেড়াচ্ছে সুহাসিনীর হলে।

মঞ্চ থেকে নামার আগে নিবেদিতা সোমশংকরের ছবিটার দিকে তাকালেন। টাটকা জুঁইয়ের গোড়ে মালা ঝুলছে। ফুলের বেষ্টনীতে বাবার হাসিমুখ। ঠাঁট্টার মতো লাগছিল হাসিটাকে। বাবাও কি নিবেদিতার পরাজয়ে খুশি ?

সুহাসিনীর একতলার ঘরগুলো আজ ফাঁকা। বার্ষিক সাধারণসভা উপলক্ষে মেয়েদের আজ ছুটি। দোতলায় গানবাজনার রিহার্সাল চলছে, আওয়াজ ভেসে আসছিল। মহালয়ার দিন একটা জলসা মতন হবে। শারদোৎসব। মেয়েরাই করবে। সময় আর বেশি নেই। ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে নিবেদিতার মনে হল একবার ওপরে ঘূরে আসেন। মেয়েরা তাঁকে দেখলে উৎসাহ পাবে। কতক্ষণ আর দঙ্গলের মাঝে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন?

তবু খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন নিবেদিতা। কে কী ভাবে! এমনিতেই তো প্রতিটি চোখ আজ কেমন অন্য রকম ঠেকছে! হয়তো মনের ভুল, হয়তো এখনও তাঁর শ্রদ্ধার আসনটা টলেনি, তবু একটা কাঁটা যেন ফুটছেই। নীরবে বেরিয়ে এলেন একসময়ে। পায়ে পায়ে হাঁটছেন। অন্য মনে। কখন যেন রান্নাঘরের দিকটায়।

রেখা তাঁকে দেখেই বেরিয়ে এসেছে, —কী গো নিবিদি, সব সাঙ্গ হল?

নিবেদিতা মনে মনে বললেন, সাঙ্গই বটে।

মুখে বললেন, —এত তাড়াতাড়ি কী? এখন কত গপ্প হবে, আড্ডা হবে…

—আমার মাছের চপটা আজ কেমন হয়েছিল?

—খুব ভাল। খুব প্রশংসা হয়েছে। পুরি আলুরদমও চমৎকার।

—বেশি করে টোমাটো দিয়ে সোয়াদ এনেছি।

—হ্যাঁগো, দীপ্তি কোথায়? দেখছি না?

—এই তো ছিল।… বোধহয় রিহাস্যালের ওখানে গেছে।

—ওকে বলে দিয়ো আলপনাটা আজ খুব সুন্দর হয়েছিল।

—তুমি তো সবই সুন্দর দেখো নিবিদি। তোমার কাছে তো সবই ভাল। আমরা সবাই ভাল। বলেই রেখা কানের কাছে মুখ এনেছে। প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, —নিবিদি, এসব কী শুনছি গো?

—কী?

—সবাই বলাবলি করছে তুমি নাকি হেরে গেছ?

নিবেদিতা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন। এই প্রথম কেউ তাঁকে সরাসরি কথাটা বলল! তাও সখীরা নয়, সঙ্গীরা নয়, বলল কিনা এই রেখা? কৃত্রিমতার পালিশ নেই বলেই বুঝি সত্যিটা এ ভাবে উচ্চারণ করতে পারল।

জোর করে হাসলেন নিবেদিতা। বললেন, —দূর হার জিত আবার কী? আমরা সবাই মিলে কাজ করি, একদল আসবে, একদল যাবে, এটাই তো নিয়ম। ওরা নতুন, ওরা অনেক ছোটাছুটি করে কাজ করতে পারবে, কীসে তোমাদের আরও ভাল হয় ভাববে…। তা ছাড়া আমি তো থাকছিই।

—ও। তুমি আছ? কৃষ্ণা আমায় যা ভয় দেখিয়ে দিয়েছিল।

—ভয় পেলে চলবে কেন? আমারও তো বয়স হচ্ছে, একসময়ে না একসময়ে বিশ্রাম তো নিতেই হবে।

—হ্যাঁ, আমাদের তো এবার ধীরে ধীরে যাওয়ার পালা। সময় হয়ে এল। রেখার মুখে ছায়া পড়ল। নিবেদিতাকে দেখতে দেখতে বলল, —সত্যি তোমার চেহারাটা হঠাৎ খুব ভেঙে গেছে গো।

—মানছ? বুড়ো তা হলে হয়েছি?

—না গো নিবিদি, বুড়ো নয়, অন্য রকম। রেখা ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল, —তোমার বউটা তা হলে আর ফিরল না?

—বনিবনা যখন হচ্ছে না, পৃথক হয়ে যাওয়াই তো ভাল। নিবেদিতাকে নিস্পৃহ দেখাল।

—মেয়েটা খাসা ছিল গো…

রেখার যেন আরও কিছু বলার ছিল, কিন্তু চুপ করে গেছে সহসা। নিবেদিতাও আর কথা বাড়ালেন না, মাথা নাড়তে নাড়তে সরে গেলেন। শরণ্যার ওপর রাগটা আবার ফিরে আসছিল। ওই মেয়েটার জন্যই তো আজ হারতে হল নিবেদিতাকে। অথচ ওই মেয়েকেই তিনি কিনা সুহাসিনীতে তাঁর উত্তরসূরী ভেবে রেখেছিলেন! একটু ট্যাক্টফুল হতে পারল না মেয়েটা? সামলে রাখতে পারল না খ্যাপা ছেলেটাকে? উলটে কী অসভ্য ব্যবহার! গয়নাগুলো ওই মিচকে কাকাটাকে দিয়ে ফেরত পাঠাল, সঙ্গে চিরকুট—ওজন মেপে দেখে নেবেন! আশীর্বাদের গিনিটাও পাঠালাম, বুঝে নেবেন! হাতের লেখাটা শরণ্যারই। নিবেদিতা চেনেন। আশ্চর্য, তাঁকেও শত্ৰু ঠাওরাল শরণ্যা? ছেলের যাতে বিপদ না হয় সেইটুকুই তো তিনি শুধু দেখেছেন! ছেলেকে ঘাড় ধরে মা হাজতে ভরলে তোর কি খুব পুলক হত? তুই নিজে মা হলে পারতিস? কত আশা নিয়ে তোকে ঘরের বউ করে এনেছিলাম, কী প্রতিদানটা দিলি তুই?

অর্চনা আর দময়ন্তী গল্প করতে করতে এদিকেই আসছে। নিবেদিতাকে দেখে হাঁটার গতি বেড়ে গেল যেন। সেক্রেটারি আর ট্রেজারারে মাখো মাখো জুটি তৈরি হয়েছে তো!

সামনে এসে দময়ন্তী আহ্লাদি সুরে বলল, —আপনাকেই খুঁজছিলাম নিবেদিতাদি।

—হঠাৎ?

—আপনার একটা অ্যাপ্রুভাল দরকার ছিল।

—কীসের?

—স্বাগতাদি আর কাকলিদিকে অ্যাডভাইসারি বডিতে নিতে চাই। আপনার কি অমত আছে?

কী বিচ্ছু মেয়ে! স্বাগতা কাকলি তাঁর প্যানেলে ছিল, দময়ন্তী এখন তাদেরও গিলতে চায়! এবং সিদ্ধান্তটাও নিয়েই ফেলেছে। নিবেদিতার এখন পাঁচন না খেয়ে উপায় কী!

তবু নিবেদিতা চোখ টেরচা করলেন, —ওদের সঙ্গে কথা হয়েছে?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, ওঁরা তো খুব রাজি। একটু দোনামোনা করছেন… আপনি কী বলেন না বলেন…

নিবেদিতা শ্বাস গোপন রেখে বললেন, —ওমা, ওরা রাজি থাকলে আমার কীসের আপত্তি?

—অনুমতি দিচ্ছেন তা হলে?

—নিশ্চয়ই। সবাই দলাদলি ভুলে কাজ করবে এটাই তো কাম্য।

—বটেই তো। আমরা সবাই এক। আমরা সবাই সুহাসিনীর জন্য, বলুন?

—হুঁ।

অর্চনা পাশ থেকে বললেন, —কয়েকটা দরকারি সইটই করার ছিল নিবেদিতাদি। আজ করবেন?

—আজ থাক। কাল হবে। আজ একটু বাড়িতে কাজ…

কিছুই ইচ্ছে করছে না। কিচ্ছু ভাল লাগছে না। জীবনে এই প্রথম নিবেদিতার এক পলও তিষ্ঠোতে মন চাইছিল না সহাসিনীতে।

গেটের ভেতরে গাড়ির লাট লেগে গেছে। সুহাসিনীর বেশিরভাগ সদস্যই গাড়ির অধিকারিনী, ভেতরে জায়গা না পেয়ে অনেকেই এদিক ওদিক গলিতে রেখেছেন নিজস্ব যান। নিবেদিতা অবশ্য সকাল সকালই এসেছিলেন, তাঁর অ্যাম্বাসাডার অপেক্ষা করছে অন্দরেই।

নিবেদিতা গিয়ে দেখলেন সুরেন গাড়িতে ঘুমোচ্ছ। প্রমীলাকুলের কর্মকাণ্ডে সে কোনও দিনই তেমন উৎসাহী নয়। চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠল। আড়মোড়া ভাঙছে।

সিটে বসে নিবেদিতা জিজ্ঞেস করলেন, —খেয়েছ?

—বাইরে থেকে ভাত খেয়ে এসেছি।

—কেন, পুরি আলুরদম খেলে না?

—দুপুরে পোষায় না। অম্বল হয়। সুরেন স্টার্ট দিল, —সোজা বাড়ি?

নিবেদিতা, —না। অন্য কোথাও চলল।… গঙ্গার ধারে।

যৎপরোনাস্তি অবাক হয়েছে সুরেন। ঘুরে একবার দেখে নিল মালকিনকে। গেটের বাইরে এসেই বলল, —তেল নিতে হবে কিন্তু।

—কালই তো ভরলাম তেল!

—তারপর তো কত জায়গায় গেলেন। নিউআলিপুর টালিগঞ্জ যাদবপুর…

ক’দিন ধরেই চরকি খাচ্ছেন নিবেদিতা। সদস্যদের বাড়ি বাড়ি। টেলিফোনের চেয়ে সামনে গিয়ে বোঝাতে সুবিধে হয় বেশি। কী লাভ হল?

অপ্রসন্ন স্বরে নিবেদিতা বললেন, —একদম নেই?

—শুধু গঙ্গার পাড়ে গেলে কুলিয়ে যেতে পারে।

—তা হলে চলো।

সুরেনের চোখ গাড়ির আয়নায়, —মারুতিটা কেনার কী হল মাসিমা ?

নিবেদিতা জবাব দিলেন না।

—কিনলে কিন্তু ওই মারুতিটাই… সেদিন যেটা গ্যারেজে দেখলেন।

এবারও সাড়াশব্দ নেই।

—বুঝছেন তো কোনটা বলছি? ছাই রং… ডাক্তার নিজে চালাত…।

—তুমি চুপচাপ চালাবে? নিবেদিতা হঠাৎই ঝেঁঝে উঠেছেন, —খালি বকবক! খালি বকবক!

ধমক খেয়ে থমকেছে সুরেন। মুখে কুলুপ আঁটল, অবতল আয়নায় পড়তে চাইছে মালকিনের মুখ। নিবেদিতা হেলান দিয়েছেন সিটে। চোখ বুজছেন, চোখ খুলছেন। দৃষ্টি কখনও ঊর্দ্ধপানে, কখনও বা নেমে আসে মাটিতে।

শরৎ এসে গেল। বিকেলের নীল আকাশে সাদা সাদা ছোপ। সরে সরে যাচ্ছে সাদারা। দ্রুত। পরশু বিশ্বকর্মা পুজো, আকাশে ঘুড়ির মেলা। শহর জুড়ে বাঁশের খাঁচা। এবার পুজো আগে, সামনের সপ্তাহে মহালয়া, শুরু হয়ে গেছে বড় বড় প্যান্ডেল বাঁধার কাজও। বাতাসে ভাসছে হালকা ছুটির আমেজ। দোকানপাটে থিকথিকে ভিড়, উপচোননা মানুষে থমকে থমকে যাচ্ছে যানবাহন।

জাজেসঘাটের পাশটিতে এসে গাড়ি দাঁড় করালেন নিবেদিতা। ছোটবেলায় এক এক দিন বায়না চাপত, দুপুরে গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন সোমশংকর, কোর্ট ছুটি হওয়ার আগেই নিবেদিতা চলে আসতেন বাবার কাছে। এই ঘাটটা খুব পছন্দ ছিল সোমশংকরের, মেয়েকে নিয়ে এখানেই হাওয়া খেতে আসতেন ছুটির পর। দেখাতেন জাহাজ-নৌকো-স্টিমার-বয়া, জোয়ার ভাঁটার আশ্চর্য লীলা।

সেই স্মৃতি কি টেনে আনল নিবেদিতাকে? হয়তো।

ঘাটে সিমেন্টের বেঞ্চি, বসলেন নিবেদিতা। লাল সূর্য ডুবছে, ওপারে বাড়িঘরের সিল্যুয়েট। হাওয়া বইছে, কখনও স্নিগ্ধ, কখনও হুহু। বাতাসের ঝাপটায় চুল উড়ছে নিবেদিতার। শেষে দময়ন্তীর কাছে হেরে গেলেন তিনি? সেই সেদিনের মেয়েটা? সুহাসিনীই যদি চলে যায়, তবে নিবেদিতার আর রইলটা কী? এখন থেকে দময়ন্তীদের প্রতিটি কাজে অসুবিধের সৃষ্টি করলে কেমন হয়? প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর তো ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আছেই, প্রতি পদে দুর্লঙ্ঘ্য পাঁচিল হয়ে দাঁড়াতে পারেন। অতিষ্ঠ করে তুলবেন দময়ন্তীদের?

গঙ্গার গেরুয়া জলে ভাঁটির টান। খড়কুটো কচুরিপানা নিয়ে স্রোত চলেছে সাগরের পানে। মাঝে মাঝে আটকে যায় ঘূর্ণিপাকে, আবার এগোয়। মাঝগঙ্গায় জল কাটছে লঞ্চ, ঢেউ এসে ঠেকছে পাড়ে। দুলছে।

এই তো জীবন। এই ঘূর্ণিপাক। এই স্রোতে ভেসে চলা। এই ঢেউয়ের ওঠাপড়া।

সূর্য অস্ত গেল। ক্ষণিকের জন্য লাল আভা লেগেছিল জলে, এখন জল মলিন ক্রমশ। রাগটাও যেন থিতোচ্ছে একটু একটু করে। রাগ, না ঈর্ষা? তাঁর অধিকারে ভাগ বসাচ্ছে বলেই কি তিনি দময়ন্তীকে সহ্য করতে পারছেন না? সুহাসিনী কবজায় থাকবে না বলে তিনি সুহাসিনীর ক্ষতির চিন্তাও করতে পারলেন? দময়ন্তীরাও তো সুহাসিনীর ভালই চায়, তাদের মত করে। নিবেদিতার তাতে আঁতে লাগে কেন? বাবা গড়েছিলেন বলেই কি সুহাসিনী তাঁর একলার? কেন তিনি সুহাসিনীর মেয়েগুলোর কথাও ভুলে গেলেন?

কোনটা তাঁর কাছে বড় ছিল তবে? সমাজসেবা, না ক্ষমতা? সুহাসিনী, না সুহাসিনীর দখলদারি? অসহায় মেয়েদের কল্যাণচিন্তা কি তবে শুধুই আত্মবিনোদন ছিল? নেশা? কেউ ছোটে রেসের মাঠে, কেউ মদে মাতাল হয়… সে রকমই কি? তলিয়ে দেখলে দময়ন্তীর কী দোষ পাওয়া যাবে? খারাপ আচরণ করেছে কখনও? নিবেদিতাকে অসম্মান করেছে? তাঁর পরিবারের কোনও ঘটনা চাউর হয়ে গেলে দময়ন্তীর তা গোপন রাখার কী দায়? তিনি নিজে দময়ন্তীর জায়গায় থাকলে কী করতেন? শরণার ওপর কুপিত হওয়া তো আরও অর্থহীন। তিনি সুহাসিনীর একচ্ছত্র অধিপতি থাকবেন বলে শরণ্যাকেও একটা নষ্ট হয়ে যাওয়া সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখতে হবে? তাঁর গরিমা বজায় রাখতে আদৌ গড়ে না ওঠা সম্পর্কটাকে বয়ে বেড়াবে শরণ্যা —দাবিটা কি অযৌক্তিক নয়?

এই নদীর সামনেই বুঝি নিজেকে দেখা যায়। চেনা যায়। এই নদীর সামনেই বুঝি স্বীকার করা যায় নিজের ফাঁকিটাকে।

অন্ধকারে শব্দ শোনা যায় ক্ষীণ। স্রোতের শব্দ? কোথায় বাজছে? কানে, না হৃদয়ে? কীসের জন্য নিবেদিতা ছুটেছেন এতদিন? রেখা বলছিল, সময় হয়ে এল…। কী পড়ে থাকল পিছনে? সুহাসিনীতে একখানা ছবি, কিংবা পাথরের গায়ে একখানা নাম, ব্যস? একসময়ে মনে হত তিনি গড্ডলিকার মানুষ নন, বিশাল একটা কিছু নিয়ে আছেন তিনি। কী অসার ভাবনা! মানুষ যদি ভাবে সে মহৎ কিছু করছে, তা হলে কিছুই কি তার করা হয় আদৌ? এ তো শুধু আত্মতৃপ্তির খেলায় মাতা। মহত্ত্বের মালা গলায় পরে বুঁদ হয়ে থাকা।

বিনিময়ে জুটল কী? আপনজনেরা কী দিল?

নিবেদিতার বুকটা টনটন করে উঠল। সুনন্দ আর ফিরবে না। বন্ধুর বাড়ি ছেড়ে কোথায় যেন পেয়িংগেস্ট আছে এখন। একটা নাকি ছোটমোট চাকরিও জুটিয়েছে। নীলাচল যায় তার কাছে। একবারও নাকি নিবেদিতার কথা জিজ্ঞেসও করে না সুনন্দ। আর অনিন্দ্য ফাঁকা ঘরে বসে একা একা মদ খায়। একটি কথা বলে না মা’র সঙ্গে। নিবেদিতা ঘরে পা রাখলে খুনে চোখে তাকায়।

রেখা বলছিল, সময় হয়ে এল…!

যাওয়ার সময়ে কী নিয়ে যাবেন নিবেদিতা? কোন সুখটা? কোন তৃপ্তিটা ? কোন দম্ভটা? কোন মহত্ত্বটা?

আর একটু ভাগ করে দেওয়া যেত না কি নিজেকে ? সংসারে আর সুহাসিনীতে?

ঠুলি পরা চোখে একবগ্গা ছুটে নিবেদিতা এ কোথায় এসে পৌঁছোলেন? ফার্ন রোড আর সুহাসিনীর মাঝে মেঘলা বুকে পেন্ডুলামের মতো দুলে চলাই কি তবে তাঁর নিয়তি এখন?

চোখ খুলে তাকালেও কেউ কি আর পাশে এসে দাঁড়াবে?

নদীর জলে চিকচিক করছে আলো। ভাঙা চাঁদ কাঁপছে। প্রচণ্ড জোরে আওয়াজ তুলে হর্ন বাজাল একটা খুদে জাহাজ।

রেখা বলছিল, সময় হয়ে এল…!

ফেরার পথে গোটা রাস্তাটাই চোখ বুজে রইলেন নিবেদিতা। বাড়ি ঢোকার মুখে নীচের ভাড়াটের সঙ্গে দেখা, কী যেন একটা সমস্যার কথা বললেন ভদ্রলোক, নিবেদিতা শুনতে পেলেন না। রেলিং ধরে ধরে ক্লান্ত পায়ে সিঁড়ি ভাঙছেন।

ল্যান্ডিংয়ে এসে থামলেন। ম্যাজেনাইন ফ্লোরের ঘরে সেই চিরপুরাতন ছবি। চেয়ারে আর্য। টেবিলল্যাম্প জ্বলছে। চতুর্দিকে বই কাগজ কলম। টেবিলের কোণে সোনালি পানীয়। আর্য লিখে চলেছেন।

চৌকাঠ টপকে একবার কি ওই গুহায় ঢুকতে পারেন না নিবেদিতা?

আর্যর কলম থেমেছে আচমকাই। নিবেদিতার পায়ের শব্দ কি শুনলেন আর্য? ঘাড় ঘোরাচ্ছেন না কেন একবারও ?

নিবেদিতা সরে এলেন। উঠছেন আবার। আরও শ্রান্ত পায়ে। সময়ের চাকা কি উলটো দিকে ঘোরানো যায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *