৫. কথা অনেক রকমের আছে

কথা অনেক রকমের আছে, শুধু বলার ধরনের উপর ভালমন্দ ফলাফল নির্ভর করে। নরেশদার কথায় সমীর বেশ চটেই জবাব দিলে, আব্দার অনুরোধ নয় মশাই, যেটা আপনাদের করতে দেওয়া হবে না সেইটে জানিয়ে দিলাম।

কৃতান্তবাবু মধ্যস্থ হয়ে আর বেশি দূর এগোতে দিলেন না। নরেশদাকে ধরে ঘরের মধ্যে বসিয়ে দিয়ে বাইরে এসে সমীরকে বললেন, ছিঃ সমীর। ওঁরা কলকাতা থেকে আমাদেরই কাছে এসেছেন। তোমাদের ভরসাতেই আমি ওঁদের এতখানি সাহস দিতে পেরেছি। কোথায় তোমরা সবাই মিলে সাহায্য করবে যাতে নির্বিবাদে সিনগুলো তুলে নিতে পারেন, তা নয় উল্টে বাধা দিচ্ছ?

সমীরের রাগ তখনও পড়েনি, বলল, নরেশবাবুর কথা শুনলে গা জ্বলে যায়। আমরা ওঁদের সৎ পরামর্শই দিতে এসেছিলাম। কেননা এখানকার যমুনা সম্বন্ধে ওঁদের কোনও আইডিয়াই নেই। উনি চাইছেন মাঝনদীতে ঐ একফোঁটা মেয়েকে নৌকোসুদ্ধ ডুবিয়ে রিয়েলিস্টিক সিন তুলতে। এ তো রীতিমত মার্ডার স্যার!

–মার্ডার! আঁতকে উঠলাম।

–নয়তো কী ধীরাজবাবু? মেয়েটি সাঁতার জানলে তবু খানিকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যেত, কিন্তু এ অবস্থায় ওঁকে বাঁচানো নামকরা সাঁতারুদেরও সাধ্যের বাইরে।

কৃতান্তবাবু বললেন, কিন্তু মাঝদরিয়ায় নৌকাডুবি না করে কাছাকাছিও তো হতে পারে।

সমীর বললে, কাছাকাছি হলেও যদি স্রোত বা টান থাকে তাহলে ঐ একই অবস্থা হবে।

–তাহলে উপায়? এবার হতাশভাবে নরেশদার চেয়ারটায় বসে পড়লেন কৃতান্তবাবু। সুনীলা দেবীর সঙ্গে আর একটি ফুটফুটে বোড়শী মেয়ে কাছে এসে দাঁড়াল, চমৎকার স্বাস্থ্যবতী মেয়েটি একদৃষ্টে চেয়ে আছি। আমাদের সবার উপর চোখ বুলিয়ে সমীরকে বলল মেয়েটি দাদা, সুনীলাদিকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, এখুনি ঘুরে আসব। তোমাদের নৌকাটা একবার দাও না।

গম্ভীরভাবে সমীর বলল, ঐ তো বারান্দার থামে বাঁধা আছে–নিয়ে যা।

অভিজ্ঞ মাঝির মতো ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ল জয়া নৌকার উপর, তারপর হাত ধরে আস্তে আস্তে সুনীলাকে তুলে নিল নৌকায়।

নৌকার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে সমীর বলল, একা অসহায় অভিভাবকশূন্য মেয়েটিকে নিয়ে আপনারা যদি যা খুশি তাই করতে চান আমরা তাতে বাধা দেব।

অবাক হয়ে জয়ার দিকে চেয়ে আছি। দেখলাম থাম থেকে মোটা দড়ির কাছিটা খুলে নিয়ে নৌকার পাশে মাটিতে পোঁতা লম্বা বাঁশটা অনায়াসে একটানে তুলে নিল জয়া। তারপর আশেপাশে বাঁধা অসংখ্য ডোঙা আর নৌকাগুলোর ভিতর দিয়ে নৌকা বেয়ে চোখের নিমেষে দক্ষিণদিকে ঘন গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ডোঙায় করে দুটি ছেলে এসে সমীরকে ডেকে চুপি চুপি কী বললে। পরক্ষণেই দেখি ছেলের দল ঝুপঝাঁপ করে লাফিয়ে নৌকায় আর ডোঙায় উঠে জোরে লগি মারতে মারতে স্টেশনের দিকে চলে গেল।

অবাক হয়ে কৃতান্তবাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কী মশাই?

কৃতান্তবাবু বললেন, ওদের রিলিফের ব্যাপার বোধহয়, রাতদিন ছেলেগুলো ঐ করে বেড়াচ্ছে।

ঘরের ভিতর গিয়ে দেখি একটা মোটা তাকিয়া বালিশের উপর হাতের কনুই দুটো রেখে দুহাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছেন নরেশদা। পাশে বসে পড়তেই ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন নরেশদা, তারপর বললেন, সুনীলার কোনও অভিভাবক সঙ্গে না এনে কী সর্বনাশই যে করেছি, তাই ভাবছি। অনেক মাথা খাঁটিয়ে রাজহন্সের হাত থেকে রেহাই পেয়ে ভাবলাম–যাক, ফাড়াবোধহয় কাটল। ও বাবা! এবার পড়েছি ব্যায়াম সমিতির পাল্লায়!

বললাম, সমীরের কথাগুলো সব শুনেছেন?

সব, গোটা সিরাজগঞ্জই এখন সুনীলার অভিভাবক। বোনটাকে দিয়ে ফুসলে নিয়ে গেল মেয়েটাকে, দ্যাখো আবার কি ভুজুংভাজুং দ্যায়, হয়তো আটকে রেখে দেবে, নয়তো–।

কৃতান্তবাবু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, আর একবার চায়ের ব্যবস্থা করি, আর দেখি গিন্নিকে বলে যদি কিছু হালুয়া–দুপুরে যা খাবেন তাতো বুঝতেই পারছি।

কৃতান্তবাবু ভিতরে চলে যেতেই নরেশদাকে বললাম, তাহলে কী ব্যবস্থা করবেন নরেশদা, কাল সকালে তো শুটিং করতেই হবে।

–আর শুটিং। আসল কননসুদ্ধ-নৌকাডুবির সিনটা যদি তুলতে না দেয় কী হবে অন্য সিন নিয়ে।

কিন্তু ওরা যে কথাটা বলছে সেটাও তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না নরেশদা।

হুঁ। বলে ঘাড় গুঁজে বসলেন নরেশদা।

উঠে বারান্দায় এসে দেখি গিরিজা ও যতীন পাশাপাশি দুখানা চেয়ারে বসে আছে। বললাম, কী যতীন, ব্যাপার কেমন বুঝছ?

ম্লান হেসে যতীন জবাব দিলে, আমি শুধু ভাবছি, কোম্পানির দামি ক্যামেরাটা অক্ষত অবস্থায় কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে না পারলে যে কী হবে?

গিরিজা বললে, হবে যা তাতো বুঝতেই গারছি, পেটে খেলে পিঠে খানিকটা সইত, কিন্তু খালিপেটে-রাজহাঁটা থাকলে তবু খানিকটা লড়তে পারত, তা সবাই মিলে দিলে তাকে–।

বাধা দিয়ে বললাম, ছাই, কাল ওর সাহসের যা নমুনা পেয়েছি তাতে গোলমালের সূত্রপাতে সবার আগে ওই চম্পট দিত।

দূরে দেখা গেল যমুনার ধার ঘেঁষে দুরন্ত স্রোতের অনুকূলে বইঠা বেয়ে তীরবেগে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে জয়া। একটু কাছে এলে দেখা গেল সুনীলা বসে আছে নৌকোর মাঝখানে, ভয়ে বিবর্ণ মুখ। কাছে এসে অনায়াসে নদিকে দুহাতে বইঠা ধরে নৌকা ঘুরিয়ে নিল জয়া কৃতান্তবাবুর বাড়িমুখো, তারপর নিমেষে বইঠা রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বাঁশের লগি বেয়ে নৌকো নিয়ে দাঁড়াল এসে বারান্দার ধারে। দড়ির কাছিটা ছুঁড়ে বারান্দায় ফেলতেই সেটা নিয়ে জড়িয়ে দিলাম থামের সঙ্গে।

যতীন, আমি, গিরিজা তিনজনেই অবাক হয়ে দেখছিলাম এই মেয়েটার কাণ্ডকারখানা। শাড়িটাকে গাছকোমর করে বেঁধে নিয়ে নৌকো থেকে একরকম লাফিয়ে উঠল জয়া বারান্দায়। তারপর বারান্দা থেকে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে বলল, এসো সুনীলাদি।

দোলায়মান নৌকোর উপর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না সুনীলা। উঠে দাঁড়িয়েই ঝুপ করে বসে পড়ে। কোনও রকমে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এসে উঠে দাঁড়িয়ে খপ করে জয়ার প্রসারিত হাত দুটো ধরে ফেলল। অসাধারণ শক্তি ধরে ঐ একফোঁটা মেয়ে জয়া, একরকম টেনেই সুনীলাকে বারান্দায় তুলে নিল। সাড়া পেয়ে কৃতান্তবাবু ও নরেশদাও বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। জয়া মিনিটখানেক আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বলল, আপনিই নায়ক ধীরাজবাবু?

লজ্জা পেলাম, চোখ নামিয়ে অপরাধীর মত বললাম, হ্যাঁ।

সেই একইভাবে আমার দিকে চেয়েই জয়া বলল, আপনার নায়িকাকে সবাই মিলে ডুবিয়ে মারার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে, আর আপনি বিনা প্রতিবাদে তাতে সম্মতি দিচ্ছেন?

ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন, জবাবটাও সেই রকম দিলাম, সম্মতি না দিলে বা বাধা দিলে ছবিটার নাম নৌকাডুবি পালটে রাখে কেষ্ট মারে কে গোছের একটা দিতে হয়।

খুশি হল না জয়া। কৃতান্তবাবুকে বলল, কাকাবাবু! সুনীলাদিকে না ডুবিয়ে আমায় ডোবান না কেন? আমি বলছি দাদা বা কারও আপত্তি হবে না। আপনারা মাঝদরিয়ায় ভরাডুবি করলেও আমি ডুব সাঁতার দিয়ে অনায়াসে চলে আসতে পারব।

উত্তর দিলেন নরেশদা। কাছে এসে জয়ার কাঁধে হাত দিয়ে মান হেসে বললেন, তাতে যদি আমার কাজ হত মা তাহলে কখনই এত ঝঞ্জাট পোয়াতে যেতাম না। বাড়ি থেকে বর-কনে নৌকায় উঠবার আগে ঘোমটার ভিতর দিয়ে কনের মুখ দেখিয়ে দর্শককে জানিয়ে দিতে হবে যে, বিয়ের কনেই নৌকায় উঠল। নৌকোর সঙ্গে সঙ্গে, ক্যামেরাও এগিয়ে যাবে। তারপর লোকালয় ছেড়ে মাঝনদীতে ঘটবে দুর্ঘটনা।

ভিতর থেকে চিড়ে-ভাজা, হালুয়া আর চা এসে গেল। কথা বন্ধ করে সবাই সেগুলোর সদ্ব্যবহারে মন দিলাম। জয়া বলল, সুনীলাদি কিছু খাবেন না। আমাদের ওখান থেকে ভাত খেয়ে এসেছেন। দ্বিরুক্তি না করে গিরিজা সুনীলার প্লেটখানা টেনে নিল।

খাওয়া-দাওয়া সেরে যথারীতি বিদায় নমস্কার করে কৃতান্তবাবুকে সন্ধ্যেবেলায় গাধাবোটে আসতে বলে আমরা নৌকায় উঠলাম। দেখি একপাশে ম্লান মুখে থামে হেলান দিয়ে জয়া দাঁড়িয়ে আছে।

নৌকা চলতে চলতে শুনলাম কৃতান্তবাবু জয়াকে বলছেন, খুব দুঃখ পেলে মা?

জয়া বললে, হা কাকাবাবু! তিন-তিনবার সাঁতারে ফাস্ট হয়েও এমন চমৎকার একটা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারলাম না, আর দুঃখ হচ্ছে সুনীলাদির জন্যে।

আর কিছু শুনতে পেলাম না। নৌকা তখন স্রোতের টানে এগিয়ে চলেছে স্টেশনের দিকে।

সন্ধ্যার কিছু আগে কৃতান্তবাবু এলেন আমাদের বোটে। পরদিন সকালে শুটিং এ কাকে কাকে বরযাত্রী নেওয়া হবে, কখানা নৌকা ভাড়া করতে হবে ইত্যাদি প্রয়োজনীয় লিস্ট তৈরি হয়ে গেল।

বরকনে বিদায় দেওয়ার সিনে উলু দেওয়া, শাঁখ বাজানো প্রভৃতি মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে কতকগুলি মেয়ের বিশেষ প্রয়োজন। কৃতান্তবাবু বললেন, সেজন্য আপনি চিন্তা করবেন না, আমার স্ত্রী, জয়া, জয়ার মা এরা তো থাকবেনই। আরও কাছাকাছি কয়েকটি পরিবার থেকে মেয়েদের আমি সকালে নৌকা করে আনিয়ে নেব।

বরের চেলির জোড়, গরদের পাঞ্জাবি, টোপর, কনের বেনারসি, গয়নামায় আলতা-সিঁদুর পর্যন্ত স্টুডিওর ড্রেসার নারাণ একটি টিনের তোরঙ্গে সাজিয়ে দিয়েছে। গিরিজার উপর সেগুলোর ভার। নরেশদা বললেন, একবার দ্যাখো সব ঠিক আছে কি না।

সব ঠিকঠাক করে কৃতান্তবাবু নরেশদাকে বললেন, আপনার সঙ্গে একটা দরকারি কথা আছে।

দুজনে উঠে ডেকের অপর প্রান্তে অন্ধকারে চলে গেলেন। অনুমানে বুঝলাম টাকাকড়ির ব্যাপার। আধঘন্টা বাদে কৃতান্তবাবু চলে গেলেন। নরেশদা আমাকে বললেন, তোমার নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়াটা ভাবছি কলকাতায় গিয়ে কোনও পুকুরটুকুরে নেব।

বিস্মিত হয়ে বললাম, বলেন কী নরেশদা! এ রকম একটা ন্যাচারাল ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে সে সিন মোটেই খাপ খাবে না। তাছাড়া আমি পাড়াগেঁয়ে ছেলে, সাঁতার জানি। আপনি কিছু ভাববেন না, দেখবেন আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব।

–তাতো নেবে। কিন্তু কী ভাবছি জান? যদি দৈবাৎ একটা অঘটন কিছু ঘটে যায় তাহলে এখান থেকে মারধোর না খেয়ে যেতে হয়।

হেসে বললাম, আপনি অনর্থক তিলকে তাল করছেন নরেশদা, কিচ্ছু হবে না। বাধা-বিপদকে ভয় করে এড়িয়ে চলি বলেই আজ বাংলা ছবির এ অবস্থা। আমেরিকান ছবিগুলোর কথা একবার ভাবুন তো, এলমো দি ফিয়ারলেস ছবির নায়ক লেমো লিঙ্কনের যে অদ্ভুত দুঃসাহসিক কার্যকলাপ দেখেছি তাতে মনে হয় আমাদের অভিনয় করাই ছেড়ে দেওয়া উচিত।

রাত ঠিক দশটায় গোয়ালন্দের স্টীমার এল। পেট ভরে রাইসকারি খেলাম। দুতিন দিনের মধ্যে এই প্রথম এক ঘুমে রাত কেটে গেল।

সকালে উঠে তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে সদলবলে যখন কৃতান্তবাবুর বাড়ি পৌঁছলাম তখনও আটটা বাজেনি। কৃতান্তবাবুর বাড়িতেও সাজসাজ রব পড়ে গিয়েছে। ঘরের মধ্যে অপরিচিত মেয়েদের ভিড়, বাইরে ষণ্ডা-ষণ্ডা ছেলের দল। ছোট বড় মাঝারি নৌকা আর ডোঙার ভিড়ে সামনে খানিকদূর পর্যন্ত জল দেখা যায় না। ছেলের মধ্যে অনেক খুঁজে সমীরকে দেখতে পেলাম না। মনটা একটু দমে গেল।

ব্যস্তসমস্তভাবে নরেশদা এসে আমাকে বললেন, ওহে ধীরাজ, কৃতান্তবাবুকে চট করে পাউডার মেক-আপ করে দাও। উনি কন্যাকর্তা, আগে ওঁকে দরকার।

মেক-আপ বাক্স খুলে রেডি হয়ে বসলাম, পরম উৎসাহে কৃতান্তবাবু এসে সামনে দাঁড়ালেন। হেসে মনে মনে বললাম–এ রঙকে দাবিয়ে রাখতে পাউডারের বাপের সাধ্যি নেই। একমাত্র পারে সবেদা ও পিউড়ি, ভেসলিনের শিশি থেকে খানিকটা নিয়ে দুহাতে ঘষে পাতলা করে মুখে মাখিয়ে দিলাম। তারপর পাফ দিয়ে বেশ পুরু করে পাউডার লাগালাম। কুচকুচে কালো ভুরুটাকে কালো পেন্সিল দিয়ে আরও সজাগ করে দিয়ে বললাম, যান, মেক-আপ হয়ে গেছে। ছোট আরশিতে মুখখানা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিয়ে খুশি মনে নরেশদার সন্ধানে চলে গেলেন কৃতান্তবাবু।

এইবার আমার পালা। ঐ একই প্রক্রিয়ায় পাউডার মেখে, চোখে ভুরু এঁকে, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে তিন মিনিটে মেক-আপ শেষ করলাম। গোল বাঁধল ফোঁটা কাটা নিয়ে। নরেশদা বিশেষ করে বলে দিয়েছেন কপালে ভুরুর উপর থেকে শুরু করে গাল পর্যন্ত ফোঁটা কাটতে হবে। যতীন ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত, গিরিজাকে বললাম, বর-ফেঁটা কাটতে জানিস? তাড়াতাড়ি ঘাড় নেড়ে কাজের অছিলায় বরযাত্রীদের দলে মিশে গেল গিরিজা।

মহা বিপদে পড়লাম। নরেশদা ও কৃতান্তবাবু এসে হাজির। নরেশদা বললেন, এখনও তোমার মেক-আপ শেষ হয়নি? তোমার হয়ে গেলে সুনীলার মেক-আপ হবে।

বললাম, ফেঁটা কাটতে আমি জানি না নরেশদা।

মুখের কথাটা লুফে নিয়ে কৃতান্তবাবু বললেন, বর-ফেঁটা তো? তা এতক্ষণ বলেননি কেন? ওরে জয়া বলতে বলতে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন কৃতান্তবাবু।

তিনখানা ঘর কৃতান্তবাবুর। প্ৰথমখানা বাইরের ঘর। সকাল সন্ধ্যা মক্কেল নিয়ে বসেন কৃতান্তবাবু। রাত্রে চাকর পাঁচু ও তার মা শোয়। দ্বিতীয় ঘরখানি ছেলেদের। পড়াশুনা, শোয়া সব ঐ ঘরে। তার পরের ঘরখানি কৃতান্তবাবুর শোবার ঘর। সেই ঘর থেকে বন্ধ দরজার ভিতর দিয়ে অনেকগুলি মহিলার সম্মিলিত কণ্ঠের চাপা গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ গুঞ্জন থেমে গেল, কৃতান্তবাবুর গলা শুনতে পেলাম, জয়া, একবার এইদিকে আয় তো মা। পরমুহূর্তে একরকম ঠেলে জয়াকে নিয়ে এসে আমার সামনে বসিয়ে দিয়ে বললেন–ধীরাজবাবুকে ফোঁটা-তিলক কেটে বর সাজিয়ে দাও।

জয়া একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। বার দুই চেয়ে আমিই চোখ নামিয়ে নিলাম লজ্জায়। এরকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে জীবনে পড়িনি।

জয়া বলল, লবঙ্গ আছে?

জবাব না দিয়ে অবাক হয়ে চাইলাম।

হেসে ফেলল জয়া। বললে, বর-ফেঁটা কাটতে লবঙ্গ দরকার।

কৃতান্তবাবু তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতর থেকে একমুঠো লবঙ্গ এনে জয়ার হাতে দিতেই জয়া বললে, এত কী হবে? একটা কি দুটো হলেই চলবে। দুটো লবঙ্গ বেছে নিয়ে মেক-আপ বক্সের ভিতরে, তারপর আশেপাশে চেয়ে কী যেন খোঁজে জয়া, একটু ইতস্তত করে বলে, শ্বেতচন্দন খানিকটা চাই যে কাকাবাবু!

এইবার বেশ বিব্রত হয়ে পড়লেন কৃতান্তবাবু। জবাবটা আমিই দিলাম, দেখুন, সত্যিকার বরের জন্য দরকার হয় শ্বেতচন্দনের। কিন্তু সাজা বরের জন্যে এই দিয়েই চলবে।

মেক-আপ বাক্স থেকে একটা লিচনারের সাদা স্টিক বার করে জয়ার হাতে দিয়ে বললাম, তা ছাড়া আপনার ঐ শ্বেতচন্দন ক্যামেরায় ঠিক আসে না। এটা কটকটে সাদা, ছবিতে স্পষ্ট আসবে।

নিপুণ হাতে লবঙ্গ দিয়ে ফোঁটা কাটতে শুরু করল জয়া। বন্যাবিধ্বস্ত সিরাজগঞ্জে এরকম সর্বকর্মনিপুণা একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হবে কল্পনাও করিনি। চুপ করে কখনও চোখ চেয়ে কখনও চোখ বুজে থাকি, কথা কইবার অছিলা খুঁজে পাই না, অস্বস্তি লাগে।

বললাম, সমীরবাবুকে সকাল থেকে দেখতে পাচ্ছি না। ব্যাপার কী? তিরস্কারের ভঙ্গিতে ফোঁটাকাটা বন্ধ করে জয়া বলল, দিলেন তো নড়ে সব মাটি করে? দেখুন তো কী হয়ে গেল? ছোট আয়নাখানা মুখের সামনে তুলে ধরে জয়া। দেখলাম ছোট্ট রুইতনের টেকার চারটে ধার সরু করে একটু বাড়িয়ে দিলে যেমন দেখায় তেমনি তরঙ্গায়িত ঢেউ-এর সারির মতো এক মাপের সুন্দর ফোঁটাগুলোর একটি ফেটে চৌচির হয়ে লাইন ছেড়ে কপালে গিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করলাম। আঁচল দিয়ে থ্যাবড়ানো ফোঁটাটাকে মুছতে যাচ্ছিল জয়া। তাড়াতাড়ি মেক-আপ বক্স থেকে রং তোলার একটা ঝাড়ন এগিয়ে দিয়ে বললাম, এইটে দিয়ে তুলুন। দুতিন সেকেন্ড আমার মুখের দিকে চেয়ে ঝাড়নটা দিয়ে যত্ন করে নষ্ট হয়ে যাওয়া ফোঁটাটা তুলে ফেলে আবার শুরু করল জয়া। একটু পরেই ফোঁটাকাটা পর্ব শেষ হল। শেষে জয়া বলল, দেখুন, আপনাদের ছবিতে চলবে তো?

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে নরেশদা বললেন, খুব চলবে, এখন চট করে সুনীলাকে পাউডার মেক-আপ করে দাও ধীরাজ। সেই ব্যস্তভাবে যতীনকে ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

লজ্জার পাহাড় ভেঙে পড়ল মাথায়। চেয়ে দেখি জয়ার চোখে দুষ্টুহাসির চাহনি। আমতা আমতা করে বললাম, দেখুন, মানে পাউডার মেক-আপটা খুব সোজা। মানে আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি, কোন অসুবিধা হবে না। জয়াকে কিছু বলার অবসর না দিয়েই তাড়াতড়ি ভেসলিন থেকে পাউডার মেক-আপের পর কালো পেন্সিল দিয়ে চোখ-ভুরু আঁকা এবং সব শেষে লিপস্টিক লাগানো সব একনিশ্বাসে বলে গেলাম।

কোনও কথা না বলে ঈষৎ হেসে মেক-আপ বাক্সটি হাতে নিয়ে ভেতরে চলে গেল জয়া। রোদ্দুর বেড়ে উঠেছে। তাড়াতাড়ি উঠে গরদের লাল চেলি পরতে শুরু করলাম। কাছা কেঁচা দিয়ে দেখি দেড়হাত কেঁচা মাটিতে ললাটাচ্ছে। বুদ্ধিমান ড্রেসার বেছে বেছে বারো হাত কাপড় আমার জন্যে দিয়েছে। এখন উপায়? ঐ রকম জবড়জং কাপড় পরে নদীতে লাফিয়ে পড়া, সাঁতার কাটা অসম্ভব। নরেশদাকে বলে এখন কোন ফল হবে না। কোমরের কাছে খানিকটা কাপড় জড়িয়ে নিয়ে বেশ শক্ত করে দুতিনটে গেরো দিয়ে পরে, মালকোঁচা দিয়ে কোনো রকমে ম্যানেজ করলাম।

গরদের পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে, গলায় কাগজের ফুলের মালা ঝুলিয়ে ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম। বাইরে বারান্দা থেকে শুরু করে বহুদূর পর্যন্ত শুধু মাথা আর মাথা। সামনের বাগান ভর্তি হয়ে গেছে নৌকায় ড্ডাঙায় ভেলায়। গাছের ডাল পর্যন্ত খালি নেই। কে বলবে মাত্র তিন-চারদিন আগে এদের এতবড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। নরেশদা এসে ডাকলেন, এই যে তুমি রেডি? এসো, আর দেরি করলে সিনগুলো শেষ করতে পারব না। কৃতান্তবাবুর দিকে ফিরে বললেন, একটু দেখুন না মশাই, কনে সাজানো কদুর হল!

বারান্দায় এসে দেখি ফুলমিঞার নৌকোতে স্ট্যান্ডসুদ্ধ ডেবরি ক্যামেরাটা ফিট করে মোটা দড়ি দিয়ে স্ট্যান্ড-এর সঙ্গে নিজের কোমরে জড়িয়ে বেঁধে যতীন দাস চারদিকে অবাক হয়ে চাইছে।

লাল বেনারসি শাড়ি পরে, ঘোমটা দিয়ে, মাথায় সোলার মুকুট ও গলায় কাগজের ফুলের মালা পরে সুনীলা এসে দাঁড়াল বারান্দায়, একপাশে কৃতান্তবাবু, অন্যপাশে হাস্যময়ী জয়া। জনসমুদ্রে গুঞ্জনের ঢেউ উঠল। নরেশদা চিৎকার করে উঠলেন, স্টার্ট! যতীন ক্যামেরা ঘোরাতে লাগল। আর দেরি না করে আমি নির্দিষ্ট নৌকায় আট-দশ জন বরযাত্রী নিয়ে উঠে পড়লাম। আমাদের কেনা পুরোেনো নৌকোতে সবাই মিলে সুনীলাকে উঠিয়ে দিলে। দেখলাম জয়াও উঠল কনের নৌকাতে। কেন বলতে পারব না, নিজের অজ্ঞাতে একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল। নরেশদার নির্দেশমতো মেয়েরা বারান্দায় এসে শাঁখ বাজাতে লাগল, অন্যরা দিল উলুধ্বনি। আমাদের নৌকা ছেড়ে দিল।

যতীনের পিছনে দাঁড়িয়ে নরেশদা চিৎকার করে বললেন, বরের নৌকা আগে যাবে, তারপর কনের নৌকা।

তাই হল। লোকালয়ের সীমানা ছাড়িয়ে একটুখানি উত্তরমুখো গিয়ে মোড় ঘুরিয়ে নৌকা স্রোতের অনুকূলে তরতর করে এগিয়ে চলল পশ্চিমমুখো। একটু গিয়েই কাট বলে চিৎকার করে উঠলেন নরেশদা।

পেছনে চেয়ে দেখি বিরাট জনতা অসংখ্য নৌকা আর ভোঙা করে সঙ্গে সঙ্গে আসছে। নৌকা কাছে এলে নরেশদা বললেন, আগে শুকনো সিনগুলো শেষ করে ফেলতে চাই।

বললাম, শুকনো সিন?

নরেশদা বললেন, হ্যাঁ, মানে জলে ডোবার আগের শটগুলো। একবার জলে ডুবলে আর অন্য সিন নেওয়া যাবে না।

সিনগুলো বুঝিয়ে দিলেন নরেশদা। বরের নৌকা ক্যামেরার সামনে দিয়ে পাস করে যাবে, হারমোনিয়াম তবলা বাজিয়ে বরযাত্রীদল গান বাজনায় মত্ত, শুষ্কমুখে মাঝখানে বসে আছে রমেশ। তারপর যাবে কনের নৌকা। এইভাবে কাছে-দূরে ক্যামেরা বসিয়ে অনেকগুলো পাসিং শট নিয়ে পরে ধরা হবে নৌকাডুবি। তাই হল। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে নানাভাবে অনেকগুলো শট নেওয়া হয়ে গেল। সারা দুপুর কড়া রোদে একরকম খালি পেটে শুটিং করে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। দেখলাম যতীন, গিরিজা, এমনকি নরেশদা পর্যন্ত তৃষ্ণায় বেশ কাহিল হয়ে পড়েছেন। শট নিতে নিতে স্রোতের টানে কৃতান্তবাবুর বাড়ির সামনে এসে গিয়েছিলাম। আধ ঘন্টার জন্য ব্রেক ফর ওয়াটার করা হল। সুনীলা দেবীকে নিয়ে জয়া ভেতরে চলে গেল। আমরা সবাই বাইরের ঘরে ঢালা সতরঞ্চির উপর শুয়ে পড়লাম।

জল খেয়ে আর বিশ্রাম নেবার অবসর পেলাম না। তিনটে বেজে গেছে, যতীন তাগাদা দিতে লাগল। আবার রেডি হয়ে যে যার নৌকোয় উঠলাম। জয়া সুনীলাকে নিয়ে উঠল ভাঙা নৌকাটায়। কী এক অজানা ভয়ে বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। জনতার মধ্যে থেকে তিন-চারজন চিৎকার করে বলল, কোনও ভয় নেই সুনীলা দেবী, আমরা আছি। আর যদি কিছু দুর্ঘটনা হয় নরেশ মিত্তিরকে আমরা সিরাজগঞ্জ ছেড়ে যেতে দেব না।

নরেশদার দিকে ভয়ে ভয়ে চাইলাম। নির্লিপ্ত কঠিন মুখ–মাথায় একটা ভোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যতীনের পাশে।

প্রথমে আমার নৌকা ক্যামেরার কাছ দিয়ে যাবে–যতীন আমার নৌকা ফলো করে সঙ্গে সঙ্গে যাবে। হঠাৎ বরযাত্রীদের মধ্যে একজন পিছনে চেয়ে চীৎকার করে উঠবে–রমেশ, কনের নৌকো ডুবে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাইরে এসে একবার ডুবন্ত নৌকাটার দিকে চেয়ে নিয়ে লাফিয়ে পড়ব আমি নদীতে। তখন ক্যামেরা প্যান করে চলে যাবে কনের নৌকার উপর। মোচার খোলার মতো চক্ষের নিমেষে ডুবে যাবে নৌকা কনে বরযাত্রী সবাইকে নিয়ে।

নরেশদা স্টার্ট দিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে বরযাত্রী চিৎকার করে উঠল। আমিও এক লাফে বাইরে এসে গরদের চাদরটা কোমরে জড়িয়ে লাফিয়ে পড়লাম নদীর মধ্যে। বাইরে অসহ্য গরম, নদীর জল কনকনে ঠাণ্ডা। সারা দেহের উপর দিয়ে একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে গেল। তারপর জমাট অন্ধকার, আর কিছু মনে নেই।

জ্ঞান হল ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা বাদে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, চোখ মেলতে কষ্ট হয়। সারা দেহ ব্যথায় টনটন করছে। বহুদূর থেকে ভেসে আসার মতো কৃতান্তবাবুর কথা কানে এল, আর ভয় নেই, জ্ঞান হয়েছে।

তিন-চারজন সামনে এসে ঝুঁকে পড়ে। চোখ চেয়ে দেখবার চেষ্টা করি, পারি না। কৃতান্তবাবু বলেন-মা জয়া, এক কাপ গরম হরলিকস্ চট করে নিয়ে এসো তো মা। আগের দিনের ঘটনা ভাববার চেষ্টা করি, তালগোল পাকিয়ে যায়। মাথার যন্ত্রণা দ্বিগুণ বেড়ে ওঠে। চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে হরলিকস্ খাই, তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ি।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম বলতে পারব না, মাথার কাছে চাপা গলায় নরেশদা ও কৃতান্তবাবুর কথোপকথন কানে এল। সাড়া না দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে শুনলাম

নরেশদা বলেছেন যা ভাবনা হয়েছিল মশাই। এই সেদিন বেচারার বাবা মারা গেছেন, বলতে কি একরকম জোর করে ওর মায়ের কাছ থেকে নিয়ে এসেছি ওকে।

কৃতান্তবাবু–গুরুবল যে ধীরাজবাবু বুদ্ধি করে চেলির কাপড়খানা গেরো দিয়ে পরেছিলেন।

আস্তে আস্তে আগের দিনের ঘটনা মনে পড়ে গেল। কিন্তু গেরো দিয়ে চেলির কাপড় পরার মধ্যে কী গুরুবল লুকিয়ে থাকতে পারে বুঝতে পারলাম না। একবার ইচ্ছে হল জিজ্ঞাসা করি, সুনীলা দেবীর কী হল। লাফিয়ে পড়ার আগে আমি স্পষ্ট দেখেছি, ওদের সবাইকে নিয়ে নৌকা ডুবেছে। তারপর কী হল? কেমন লজ্জা করতে লাগল। চুপ করে রইলাম।

কৃতান্তবাবু বললেন, সমীরের দলকে বোকা বানাতে দিয়ে নিজেরাই যে এরকম উজবুক বনে যাব ভাবতেও পারিনি। যাক, আপনার শটগুলো মনোমত হয়েছে তো?

পারফেক্ট, ধীরাজ নদীতে লাফিয়ে পড়ার পর ক্যামেরা চলে গেল কনের নৌকোর উপর। যতীনকে ইশারা করতেই ক্যামেরাসুদ্ধ নৌকা নিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। কনে, বরযাত্রী সবসুদ্ধ নৌকা মিনিটখানেকের মধ্যে ভুস করে ডুবে গেল। বরযাত্রীদের দল সাঁতার কাটতে শুরু করল, ব্যস্। যতীনের ক্যামেরাও থেমে গেল।

কৃতান্তবাবু বললেন, তার পরের ব্যাপারটা মনে হলে এখনও হাসি চাপতে পারি না। দুজনে হো হো করে হেসে উঠলেন।

আমিও কৌতূহল চাপতে পারলাম না। বললাম, তারপর কী হল নরেশদা? হাসি থামিয়ে দুজনে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে বসলেন আমার বিছানার পাশে। কৃতান্তবাবু বললেন, দাঁড়ান, কোনো কথা নয়। আগে আর এক কাপ হরলিক এনে দিই।

একটু বাদেই একটা কাঁচের গ্লাসে খানিকটা গরম হরলিকস্ নিয়ে এসে কৃতান্তবাবু বললেন–দুধ মাথা খুঁড়লেও মেলে না। অনেক কষ্টে একটা হরলিকস্ যোগাড় করে রেখেছিলাম, তা দেখছি ভাল কাজেই লেগে গেল।

হরলিকস্ খেয়ে অনেকটা সুস্থ হলাম। বললাম, ব্যাপারটা আমায় সব খুলে বলুন তো, কিছুই বুঝতে পারছি না।

নরেশদা বললেন, কনের নৌকা ডোবার পর সমীরের দল হৈহৈ করে লাফিয়ে পড়ল জলে। সমীরই পাণ্ডা। একটু বাদেই ডুবসাঁতার দিয়ে জয়া ভেসে উঠল জলের উপর ঘটনাস্থল থেকে খানিকদূরে। কাছেই নৌকো ছিল, তাতেই উঠে পড়ল জয়া। জলে সাঁতার দিতে দিতেই সমীর চিৎকার করে উঠল–তুই একা যে জয়া? সুনীলা দেবী কোথায়? জোরে হাওয়া বইছিল, অত দূর থেকে জয়া কী বলল বোঝা গেল না। দ্বিগুণ উৎসাহে ডুবে, ভেসে, ওরা খুঁজতে শুরু করল সুনীলাকে। সমীর ওরই মধ্যে আমাদের নৌকোর কাছে এসে বলল–এটা যে হবে আমি জানতাম। সুনীলা দেবীকে যদি না পাই ফল ভাল হবে না, এও বলে গেলাম। একটু বাদে ওদেরই দলের একজন ভুস করে ভেসে উঠে চেঁচিয়ে বলল–পেয়েছি। আর যায় কোথায়, সবাই সাঁতার দিয়ে ছেলেটির কাছে গিয়ে ডুব দিলে জলের মধ্যে। একটু বাদেই লাল গরদের শাড়ি পরা কনেকে পাঁচ-সাতজনে ভাসিয়ে তুলল জলের উপর। মাত্র এক মিনিট, পরক্ষণেই রাগে আমাদের উদ্দেশে একটা অস্ফুট গালাগাল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল সুনীলাকে চার-পাঁচ হাত দুরে নদীর মধ্যে। তারপর নিঃশব্দে সাঁতার দিয়ে নৌকোয় উঠে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছি, বললাম, বুঝলাম না।

এবার আমায় বলতে দিন, বলে কৃতান্তবাবু শুরু করলেন।

–ওরা রেগে যাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে নদীর মধ্যে সে সুনীলা দেবী নয়। আমারই বাচ্চা চাকর পাঁচু। ছোটবেলা থেকেই পাঁচু জলের পোকা। আধঘণ্টার উপর ডুবে থাকতে পারে নদীতে। নৌকোডুবির ব্যাপারটা নিয়ে যখন সমীররা বাড়াবাড়ি শুরু করল তখনই আমার মাথায় আসে।

বললাম, কিন্তু জয়া? জয়া তো সুনীলার নৌকোতেই ছিল।

জয়াকে দলে না টানলে এ প্রহসন এতদূর গড়াত না। বলে হো হো করে হেসে উঠলেন কৃতান্তবাবু।

–এইবার তোমার প্রসঙ্গে আসছি। সমস্ত নৌকাডুবির ব্যাপারটা ঘটতে বোধ হয় তিন মিনিটও লাগেনি। হঠাৎ আমার খেয়াল হল–ধীরাজ, ধীরাজ কোথায়? সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, কেউ বলতে পারে না। তখনই নৌকা নিয়ে যেখানটায় তুমি লাফিয়ে পড়েছিলে সেইখানে গেলাম। সমীরের দল চলে গেছে, সেই সঙ্গে ভাল সাঁতারু ছেলেগুলোও সরে পড়েছে। এখন উপায়? চার-পাঁচখানা নৌকো এনে চারপাশ ঘিরে ফেলে একটা ছোকরা মাঝিকে টাকার লোভ দেখিয়ে জলে নামিয়ে দিলেন কৃতান্তবাবু। ডুব দিয়ে এদিক-সেদিক খুঁজে সে বললে পালাম না কর্তা! আমি আর নেই। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম নৌকার উপর।

চুপ করলেন নরেশদা। একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার শুরু করলেন–হঠাৎ দূর থেকে জয়ার চিৎকার শুনলাম–পেয়েছি কাকাবাবু, এই দিকে আসুন। নৌকা নিয়ে সবাই ছুটলাম উত্তরদিকে। অসম্ভব টান স্রোতের, নৌকা এক জায়গায় দাঁড় করানোই শক্ত। কাছে গিয়ে দেখলাম, জয়ার হাতে তোমার গরদের চেলির একটা কোণ। জয়া বলল–হাওয়ায় ফুলে জলের উপর এই কাপড়ের কোণটা ভেসেছিল। নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও আছেন। আমার নৌকাটা দেখবেন কাকাবাবু। বলেই চোখের নিমেষে ঐ কাপড়ের খুঁট ধরে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল জয়া। এক মিনিট, দু মিনিট, তিন মিনিট, মনে হচ্ছিল তিন বছর। নৌকা থেকে হাতদশেক দূরে ভেসে উঠল জয়া তোমাকে নিয়ে। কোনও কথা না বলে নিয়ে এলাম তোমায় কৃতান্তবাবুর বাড়ি। তারপর নানা প্রক্রিয়ায় জল বার করে কম্বল চাপা দিয়ে তোমার জ্ঞান ফিরে আসার অপেক্ষায় বসে রইলাম।

শুনতে শুনতে উত্তেজনায় উঠে বসেছিলাম। বললাম, স্রোতের অত টানের মধ্যে আমায় পেলেন কী করে?

কৃতান্তবাবু বললেন, সেও এক মজার ব্যাপার। যেখানটায় আপনাকে পাওয়া গেল, বন্যার আগে সেটা ছিল ত্রিলোচন পালের বাড়ি। ভেরেণ্ডা আর বাঁশ দিয়ে বাড়িটার চারদিকে বেড়া দেওয়া ছিল। বন্যায় সব নিয়েছে, পারেনি শুধু ঐ জ্যান্ত ভেরেণ্ডা গাছের বেড়াটাকে। তারই ফোকরে আপনার মাথাটা আটকে গিয়েছিল। আর কাপড়খানা বুদ্ধি করে গেরো দিয়ে পরেছিলেন বলে আপনাকে খুঁজে পাওয়া গেল।

বললাম, জয়া দেবীকে একবার ডাকুন না!

কৃতান্তবাবু বললেন, যতক্ষণ তোমার জ্ঞান হয়নি এ বাড়িতেই ছিল। আজ সকালে বাড়ি গেছে। অদ্ভুত মেয়ে।

সত্যি অদ্ভুত মেয়ে জয়া। তুচ্ছ বায়োস্কোপের ছবি তুলতে এসে মাতৃজাতির এক অভাবনীয় রূপ দেখে গেলাম বন্যাবিধ্বস্ত সিরাজগঞ্জে।

.

কলকাতায় ফিরে এসেছি। জলের রাজ্য থেকে ইট-কাঠ-গাড়ি-ঘোড়া গোলমালের রাজ্যে। সিরাজগঞ্জে দেখে এলাম জলের বন্যা, কলকাতায় এসে দেখি টকির বন্যা। সারা কলকাতা সরগরম। ম্যাডান স্টুডিও ছাড়াও চামারিয়া ব্রাদার্স দুটো স্টুডিও খুলে দিয়েছেন। বড় রাধাকিষণ চামারিয়া রাধা ফিল্মস, ছোট মতিলাল খুলেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্মস। এছাড়া নিউ থিয়েটার্স, ভারতলক্ষ্মী পিকচার্স ইত্যাদি নিত্য নতুন স্টুডিও গজিয়ে উঠতে লাগল।

সবাক ছবির সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই চলল। ম্যাডান থিয়েটার্স ও নিউ থিয়েটার্সই এর মধ্যে অগ্রণী। বাংলা ও হিন্দী সবাক ছবিতে বাজার সরগরম। সবাক ছবির দৌলতে মঞ্চশিল্পীদের কদর বেড়ে গেল, তার উপর যে গান গাইতে পারে তার তো কথাই নেই–মঞ্চের পঁচাত্তর টাকা মাইনের শিল্পী পাদপ্রদীপ ছেড়ে পর্দায় মাসে পাঁচশ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে হাসিমুখে অভিবাদন করে দাঁড়ালেন। প্রতিযোগিতায় বাঙালি শিল্পীদের তুলনায় হিন্দী শিল্পীদেরই চাহিদা বেশি। এই সময়ে নিউ থিয়েটার্সে সাইগল ও ম্যাডানে মাস্টার নিশারও কজ্জন বাঈ-এর আবির্ভাব হিন্দী সবাক ছবিতে বেশ একটা আলোড়ন এনে দিল। অভিনয়-ক্ষমতা বাদ দিলেও শুধু গানের জন্য এঁদের প্রসিদ্ধি ও জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই উঠতে লাগল।

নির্বাক নৌকাডুবি শেষ করে চুপচাপ বসে আছি। নদীর ঢেউ-এর মতো দিনগুলো একটার পর একটা এগিয়েই চলল। ইতিমধ্যে ম্যাডানে অনেকগুলো হিন্দী–বাংলা সবাক ছবি ভোলা হয়ে গেল, ক্রাউনে নয়তো অ্যালফ্রেডে সেগুলো রিলিজও হল। আমার আর ডাক পড়ে না। ভাবলাম, আমার নায়ক জীবনের ছেদ বোধ হয় নির্বাক যুগেই পড়ে গেল। রঙমহল থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় করি আর মধ্যে মধ্যে স্টুডিওতে গিয়ে দুর থেকে সবাক ছবির শুটিং দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ি ফিরে আসি।

জ্যোতিষবাবু সবাক বিষ্ণুমায়া তুলতে আরম্ভ করলেন। ভাবলাম, যাক, এইবার একটা পার্ট নিশ্চয়ই পাব। ও হরি–অহীনদা, নরেশদা, শ্ৰীমতী উমাশশী, শিশুবালা প্রভৃতি সবার ডাক পড়ল, পড়ল না শুধু আমার। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, শ্রীমতী উমাশশীর প্রথম সবাক চিত্রে অবতরণ এই বিষ্ণুমায়াতেই। এর ঠিক পরেই নিউ থিয়েটার্স ওঁকে স্থায়ীভাবে চুক্তিবদ্ধ করে নেন।

১৯৩২ সালের ২৫শে মার্চ বিষ্ণুমায়া এক সঙ্গে শ্যামবাজারে ক্রাউন সিনেমায় ও ভবানীপুর এম্প্রেস থিয়েটারে মুক্তিলাভ করল। এইসময়ে একদিন স্টুডিওতে জাহাঙ্গীর সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। সাহেব এখন আর শুধু স্টুডিও ম্যানেজমেন্ট নিয়ে থাকেন না। নিজেই পরিচালক সেজে পাঁচ-ছখানি হিন্দী ছবি তুলে ফেলেছেন এবং একমাত্র কজ্জন ও নিশারের গানের জন্যই প্রচুর পয়সা পেয়েছেন সেগুলো দেখিয়ে। সাহেবের ঘরে ঢুকে নমস্কার করে দাঁড়ালাম। ঘরভর্তি লোক। তার মধ্যে বেশিরভাগই হল কোরিন্থিয়ান এবং আলফ্রেড থিয়েটারের অ্যাক্টর-অ্যাকট্রেস। দেখলাম, সবাক ছবির দৌলতে ওদের বরাত ফিরে গেছে। কোরিন্থিয়ান থিয়েটারের অডিটোরিয়ামে ছেঁড়া প্যান্ট পরে আগে যাদের বিড়ি খেতে দেখেছি, আজ তারা নতুন স্যুট পরে সিগারেটের টিন হাতে নিয়ে সাহেবের সঙ্গে হেসে কথা কইছে।

ঘণ্টাখানেক বাদে ভিড় একটু কমলে সাহেবের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

সাহেব বললেন, কী ধীরাজ! কিছু বলবে?

বললাম, হ্যাঁ স্যার। আমায় যদি কোনও পার্ট না দেওয়া হয় তাহলে শুধু মাস মাইনে দেওয়ার কোনও মানেই হয় না। আমায় ছেড়ে দিন।

একটু চুপ করে থেকে সাহেব বললেন, জ্যোতিষবাবু, মিঃ গাঙ্গুলী এঁরা সব স্টেজের বড় বড় আর্টিস্ট নিয়ে মেতে উঠেছেন, কিন্তু তুমি আমাদের পুরানো লোক। তোমায় এভাবে অ্যাভয়েড করছেন কেন বুঝলাম না। যাই হোক, তুমি এক কাজ কর। হিন্দীটা শিখে ফেল। আমার ছবিতে তোমায় নায়কের পার্ট দেব।

ডায়লগ মাস্টার আব্বাস আলিকে ডেকে হাতিলি দুলাল ছবির নায়কের পার্টটা আমায় লিখে দিতে বললেন। উর্দু সংলাপ বাংলায় লিখে নিলাম। কড়া উর্দু, মানে তো বুঝলামই না, উচ্চারণ করতেও প্রাণ ওষ্ঠাগত। তিন-চারদিন বাড়ি বসে প্রাণপণে মুখস্থ করে একদিন স্টুডিওতে গিয়ে হাজির হলাম। সেদিন ফুল রিহার্সাল। কজ্জন বাঈ, মুক্তার বেগম, পেসেন্স কুপার, ললিতা দেবী ছাড়াও কোরিন্থিয়ান ও অ্যালফ্রেড থিয়েটারের একগাদা মুসলমান আর্টিস্ট। বেশ নারভাস হয়ে পড়লাম।

একটু পরেই আব্বাস আলী সাহেব এলেন। পায়ে জরির নাগরা, ঢিলে পায়জামা, কলিদার আদ্দির পাঞ্জাবি। তার উপর জরিদার জহর কোট, মাথায় ফুলদার মুসলমানী টুপি। একগাল পানদোক্তা মুখে জাবর কাটতে কাটতে মেয়েদের সামনে এসে একটা মোটা তাকিয়া হেলান দিয়ে বসলেন। রিহার্সালের নাম গন্ধ নেই, খালি খোশগল্প। হাসি তামাশা রসিকতায় ঘরের আবহাওয়া গরম হয়ে উঠল।

বাইরে মোটরের হর্ন শোনা গেল। একজন ছুটে এসে জানালে, জাহাঙ্গীর সাহেব এসে গেছেন। ব্যস সবাই এলার্ট হয়ে বসলেন। আব্বাস আলি মোটা খাতা খুলে রিহার্সাল শুরু করে দিলেন।

একটু পরেই আমার ডাক পড়ল। পেসেন্স কুপার ও মুক্তার বেগমের সঙ্গে একটা দৃশ্য। ডায়লগ মুখস্থ ছিল, গড়গড় করে বলে গেলাম। আব্বাস আলি বললেন, কুছু নেহি হুয়া, বিলকুল গলৎ হ্যায়। চুপ করে রইলাম। আবার প্রশ্ন হল, আপ গানা গা সকতে হয়?

বললাম, জী নেহি।

–তব ক্যায়সে চলেগা? ইস নাটকমে হিনোকা কমসে কম এক ডজন গানা হ্যায়!

আর দ্বিরুক্তি না করে ঘর থেকে বাইরে চলে এলাম। বেশ বুঝতে পারলাম, এখানে আমার চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। বাড়ি চলে আসছিলাম, পথে জ্যোতিষবাবুর সঙ্গে দেখা। পাশ কাটিয়ে চলে আসছি, খপ করে আমার হাতখানা ধরে জ্যোতিষবাবু বললেন, এই যে ধীরাজ। তোমাকেই খুঁজছিলাম।

–এতদিন বাদে হঠাৎ?

–অভিমান তুমি আমার উপর করতে পার, কিন্তু তুমি তো জান না, ভূমিকা বণ্টনের ব্যাপারে আমার হাত-পা বাঁধা!

বললাম, ১৯৩১ সাল। এই পুরো একটা বছরে হিন্দী-বাংলা, মিলিয়ে সবসুদ্ধ দশখানা সবাক ছবি ম্যাডান থেকে বেরিয়েছে, হিন্দীগুলো ছেড়েই দিলাম। কিন্তু আপনার পরিচালনায় ভোলা তিনখানা–জোর বরাত, ঋষির প্রেম ও বিষ্ণুমায়াতে ইচ্ছে করলে আমাকে একটা পার্ট দিতে পারতেন না?

এখানে উল্লেখযোগ্য, অধুনাপ্রসিদ্ধ কানন দেবী সবাক চিত্র জোর বরাত ছবিতেই প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন।

জ্যোতিষবাবু বললেন, তুমি বিশ্বাস করবে না ধীরাজ, স্টেজে যাদের বেশ নাম আছে তাদের উপরই সাহেবদের ঝোঁক। যথা–দুর্গাদাস, জয়নারায়ণ, অহীন্দ্রবাবু, শিশিরবাবু, নরেশবাবু। দুর্গাকে পাওয়া যাবে না, নিউ থিয়েটার্স মোটা মাইনেতে ওব দীর্ঘ চুক্তিপত্রে সই করিয়ে নিয়েছে। নিউ থিয়েটার্সের প্রথম সবাক ছবি শরৎচন্দ্রের দেনা-পাওনাতে জীবানন্দের ভূমিকায় ওর খুব নাম হয়েছে। এখন চিরকুমার। সভায় পূর্ণর ভূমিকায় অভিনয় করছে। বাকি যারা আছে তাদের মধ্যে কয়েকজনকেও নিয়ে নেবার মতলবে আছে। তাই নরেশবাবু, নির্মলবাবু, জয়নারায়ণ এদের সঙ্গে সাহেব নতুন করে কনট্রাক্ট করে নিয়েছেন। তুমি শোননি বোধহয়, আমি সবাক চিত্রে কৃষ্ণকান্তের উইল তুলছি?

বললাম, না।

জ্যোতিষবাবু বললেন, এই নিয়ে গাঙ্গুলীমশাই-এর সঙ্গে কোম্পানির বেশ একটু মন কষাকষি হয়ে গেছে। আমার ভূমিকালিপি হল: কৃষ্ণকান্ত–অহীন্দ্রবাবু, গোবিন্দলাল নির্মলেন্দুবাবু, ভ্রমর-শান্তি গুপ্তা, রোহিণী–শিশুবালা। কেমন হবে?

আমতা আমতা করে বললাম, ভালই, তবে নির্বাক ছবিতে গোবিন্দলালের ভূমিকায় দুর্গাদাস অসম্ভব নাম করেছিলেন। ওঁকে দিলেই–

কথা কেড়ে নিয়ে জ্যোতিষবাবু বললেন, সে চেষ্টা করিনি ভাববা? বহু টাকা অফার করেছি। কিন্তু নিউ থিয়েটার্স ছাড়বে না। যাই হোক, নিশাকরের ভূমিকাটি ছোট হলেও ভাল। ঐটে আমি তোমায় দেব ভাবছি। সাহেবও মত দিয়েছে। কাল একটু সকাল-সকাল স্টুডিওতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করো।

উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই হনহন করে জ্যোতিষবাবু জাহাঙ্গীর ম্যাডানের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেলেন।

নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল যুক্তিটাকে মেনে অপেক্ষাকৃত খুশি মনে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। গেট পেরিয়ে দেখি, থামের পাশে আত্মগোপন করে দাঁড়িয়ে আছে মনমোহন। আমায় দেখেই একগাল হেসে বলল, আব্বাস আলির ছবিতে পার্ট পেলি?

বললাম, না।

–আমি আগেই জানতাম তোকে দেবে না!

–মানে?

–মানে হিন্দী-উর্দু ছবি ওরা একচেটে করে রাখতে চায়। সেখানে কোনো বাঙালিকে মাথা গলাতে দিতে নারাজ। অনেক কথা আছে। আয়, মোড়ের দোকানে চা খেতে-খেতে সব বলছি। জোরে পা ফেলে চলতে শুরু করেছে মনমোহন।

ইচ্ছে বিশেষ না থাকলেও ওর পিছু নিলাম।

.

টালিগঞ্জের তেমাথায় সেই সবেধন নীলমণি চায়ের দোকানটির পাশে আরও দুটি দোকান গজিয়ে উঠেছে। দুটিতেই খুব ভিড়। অপেক্ষাকৃত কম ভিড় যে দোকানটিতে, তাতে ঢুকে একটা অন্ধকার কোণে বেঞ্চির উপর দুজনে বসলাম। দুকাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে মনমোহন বললে,অনেক কথা জমা হয়ে আছে, কোন্টা আগে বলব বল?

বললাম, যা তোর খুশি।

মুখের দিকে একবার চেয়ে নিয়ে মনমোহন বলল, তোর কথা থেকেই শুরু করি। হাতিলি দুলালে যে তোকে কোন পার্ট দেবে না, তা আমি চার-পাঁচদিন আগেই জানতাম। চা এসে গিয়েছিল, খেতে খেতে মনমোহন আবার বলল, দিনকয়েক আগে দুপুরবেলা কিছু টাকা অ্যাডভান্স নিতে গিয়েছিলাম হেড অফিসে। দেখি কোরিন্থিয়ান অডিটরিয়ামে মিটিং হচ্ছে। আমায় জানিস তো? নিঃশব্দে পাশের দরজা খুলে ঢুকে পড়লাম। তারপর সবার অলক্ষে পিছনে একটা চেয়ারে ঘাপটি মেরে বসলাম। মাস্টার মোহন, নিশার, সোরাবজী কেরাওয়ালা, আবদুল্লা কাবুলি, নর্মদা শঙ্কর, আব্বাস আলী থেকে শুরু করে কোরিন্থিয়ান আর অ্যালফ্রেডের সব চুনোখুঁটি পর্যন্ত হাজির। সবাই বেশ উত্তেজিত, কড়া উর্দুতে হাত পা নেড়ে আব্বাস আলী কী সব বলছে, একবিন্দুও বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ তোর নামটা কানে যেতেই আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বসলাম। একটু পরেই ব্যাপারটা বুঝলাম।

আমি কিছুই বুঝলাম না। বললাম, তারপর?

চা শেষ হয়ে গিয়েছিল। দুটো পান মুখে পুরতে পুরতে মনমোহন বললে, জাহাঙ্গীর সাহেব নাকি আব্বাস আলীকে বলেছে, তোকে হাতিলি দুলাল-এ নায়কের পার্ট দিতে, এই ওদের গাত্রদাহ। আব্বাস ওদের বোঝাচ্ছে যে, এই রকম ছুতোনাতায় যদি বাঙালি লোক আমাদের উর্দু রাজত্বে ঢুকে পড়ে, তাহলে সবার অন্ন গেল, দুদিন বাদেই দেখতে পাবে হিন্দী-উর্দু ছবিতে নামছে সব বাঙালিরা। সবাই বেশ উত্তেজিত, কভি নেহি, কভি নেহি ভাব। মাস্টার মোহন ও নিশার বলল, এক কাজ করো আব্বাস, ফুল রিহার্সালে দুএকটা সিন বলিয়ে বলে দেবে কিছু হচ্ছে না। তারপর বলবে দশ-বারোখানা গান আছে। আব্বাস আলী একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল কিন্তু আমি পার্ট লিখে দেবার সময় যে বলেছিলাম, নায়কের গান নেই। মাস্টার মোহন বলল, কুছ পরোয়া নেহি, সেদিন বলে দিও গান নইলে হিন্দী ছবি চলে না, তাই পরে ওটা ঠিক হয়েছে। আস্তে আস্তে পিছনের দরজা দিয়ে সরে পড়লাম। তারপর কদিন ধরে তোকে গরু-খোঁজা করছি, কিন্তু দেখাই পাইনি।

বললাম, আমি ঐ কদিন খেয়ে-না-খেয়ে বাড়ি বসে ডায়লগ মুখস্থ করেছি।

-সত্যি তোর জন্যে দুঃখ হয়। বলেই দুঃখটা কিঞ্চিৎ লাঘব করবার জন্যেই আরও দুকাপ চায়ের অর্ডার দিল মনমোহন।

সন্ধে হয়ে গেছে। জনবিরল তেমাথা রাস্তার দিকে চেয়ে বসে আছি। মনমোহন বলল, যাকগে, যা হয়ে গেছে, তার জন্যে দুঃখ করে লাভ নেই। হ্যাঁ রে, মেসোমশাই একটু আগে তোকে কী বলছিলেন রে?

ম্লান হেসে বললাম সবাক কৃষ্ণকান্তের উইলে নিশাকরের পার্ট দেবার জন্যে আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।

মেসোমশাই? মিথ্যে কথা। বলেই সজোরে লম্বা টেবিলটার ওপর ঘুষি মারতে গিয়ে ভর্তি চায়ের কাপ দেখে অতিকষ্টে সামলে নিল মনমোহন।

অবাক হয়ে শুধু বললাম, বলিস কী মনমোহন?

মনমোহন টেবিলের উপর রাখা চায়ের কাপটায় ঝুঁকে মুখ লাগিয়ে দু-তিন সিপ খেয়ে বলল, কাস্টিং-এর ব্যাপারে জাহাঙ্গীর সাহেব কখনও ইন্টারফেয়ার করেন না। শুধু নিশাকরের পার্ট যখন উনি জয়নারায়ণকে দেবার জন্যে সাহেবকে জানালেন, তখন সাহেব একদম বেঁকে বসলেন। বললেন–না ব্যানার্জি, এটা ধীরাজকে দাও। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আমি নিজের কানে শুনে এসেছি।

ভাবছিলাম, ফিল্মি দুনিয়ার কথা। এই আজব দুনিয়ায় সবই সম্ভব। কাকে বিশ্বাস করব? দু-তিনজন বাইরের লোক চা খেতে ঢুকল। আমায় দেখেই ঢুকেছে বুঝলাম। চা খাওয়াটা অছিলা মাত্র। মনমোহনকে ইশারায় কোনও কথা না কইতে বলে নিঃশব্দে দুজনে চা খেতে লাগলাম।

নবাগত ছেলে তিনটি তিন কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে দিল :

১ম। দেনা-পাওনা দেখেছিস পটলা?

পটলা মাথা নাড়াল।

১ম। দেখিস, দুর্গাদাস কী পার্ট করেছে মাইরি! পয়সা উশুল হয়ে যাবে।

৩য়। স্টুডিও বলতে ঐ একটাই তো হয়েছে নিউ থিয়েটার্স। অন্যগুলো, বিশেষ করে ম্যাডান, তো হরি ঘোষের গোয়াল।

১ম। যা বলেছিস কেষ্টা। সেদিন ক্রাউনে জোর-বরাত দেখতে গেলুম। কী বিচ্ছিরি ছবি। ঠিক স্টেজের মত সিনের পর সিন তুলে গেছে। তার উপর অর্ধেক কথা বোঝা যায় না।

৩য়। বাংলা তো তবু পদে আছে। দেখে আয় ম্যাডানের প্রথম উর্দু ছবি। শিরী ফরহাদ, নিশার আর কজ্জনকে এক জায়গায় বসিয়ে খান দশ-বারো গানই শুনিয়ে দিলে।

পটলা এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। নির্বাক শ্রোতার মতো চায়ের কাপটি শেষ করে বলল, আচ্ছা, ধীরাজ ভট্টাচার্যকে টকিতে একদম দেখা যাচ্ছে না, কেন বল তো?

১ম। টকি জিনিসটা কি এতই সহজ মনে করিস পটলা? রীতিমত শিখতে হয়, পরীক্ষা দিতে হয়। হয়তো ওর গলা টকির উপযুক্ত নয় বলে হেঁটে দিয়েছে।

আলোচনা হয়তো আরও কিছুক্ষণ চলত। সামনের তেমাথায় কী একটা গণ্ডগোল তাল পাকিয়ে উঠতেই ওরা চায়ের পয়সা দিয়েই তাড়াতাড়ি সেই দিকে ছুটল।

চুপ করে বসে মনে করবার চেষ্টা করছিলাম, আজ কার মুখ দেখে উঠেছি, একটার পর একটা এতগুলো সুসংবাদ। চিন্তায় বাধা পড়ল মনমোহনের কথায়, চল বাড়ি যাই-রাত্রি হয়ে যাচ্ছে।

ম্লান হেসে বললাম, এরই মধ্যে বাড়ি কি রে? বস্। একতরফা আমাকে নিয়েই তো এতক্ষণ কাটল, এইবার তোর কথা বল। এতদিন ছিলি কোথায়? স্টুডিওতেও দেখা পাই না।

কথা কইতে পেলে বেঁচে যায় মনমোহন। বলল, দেখা পাবি কী করে? আমি তো এখানে ছিলাম না। মার্কনির সঙ্গে বেনারসে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম।

হেঁয়ালিতে কথা বলছে মনমোহন। হাত ধরে বেশ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, কী যা তা বলছিস। মার্কনির সঙ্গে ছবি তুলতে তুই বেনারসে গেলি কিসের জন্যে? বেশ খানিকটা হেসে নিয়ে দোকানের বাচ্চা বয়টাকে দুখিলি গুন্ডি-পান আনতে বলে মনমোহন বলল, আমি আর এডিটিং ডিপার্টমেন্টে নেই। ইতালীয়ান ক্যামেরাম্যান টি. মার্কনির অ্যাসিস্টেন্ট।

অবাক হলাম না। মনমোহনের পক্ষে সবই সম্ভব। কৌতূহল হল, বললাম, ব্যাপার কী?

মনমোহন বলল, মধ্যে যতীন দাস, মংলু, পল ব্রিকে এদের চাকরি যায়-যায় হয়ে উঠেছিল জানিস?

–ঐরকম একটা গুজব শুনেছিলাম বটে, তবে আসল ব্যাপারটা কিছুই জানতে পারিনি। দুখিলি পান মুখে পুরতে পুরতে বলল মনমোহন, সাইলেন্ট ছবি এডিট করার চেয়ে উঁকি এডিটিং ঢের ইন্টারেস্টিং ও সোজা। সামনে সিনারিওর খাতা খোলা আছে শট কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় শেষ হয়েছে সব লেখা আছে; শুধু এডিটিং মেশিনে চালিয়ে দেখে আর অ্যাপ্লিফায়ারে শুনে নিয়ে কাঁচি দিয়ে কেটে জুড়ে দেওয়া, ব্য। সত্যি বলতে কি, নির্বাক ছবি এডিট করতে মন বসত না-খালি ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। টকি ভারি মজার, ধর নিশার কি কজ্জনের একখানা গান খুব ভাল লাগল–পাঁচ-সাতবার সেটা চালিয়ে শুনে নিলাম।

অসহিষ্ণু হয়ে বললাম, আসল ব্যাপার থেকে তুই অনেক দূরে চলে গেছিস। আমি তোর কাছে সবাক ছবির এডিটিং শিখতে চাইনি। ক্যামেরাম্যানদের চাকরি নিয়ে টানাটানি কেন হল, তাই বল।

রেগে গেল মনমোহন, গোড়া থেকে না শুনলে ছাই বুঝবি। পরক্ষণেই হেসে ফেলে বলল, আসল ব্যাপার থেকে দুরে যাইনি। সবটা শোন্ আগে। ছবি যেমন যেমন ভোলা হতে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে লেবরেটারিতে পাঠিয়ে ডেভলপ করে সোজা চলে এল আমার এডিটিং রুমে। ক্ল্যাপস্টিক টু ক্ল্যাপস্টিক জয়েন করে আবার পাঠিয়ে দিলাম লেবরেটারিতে রাশ প্রিন্টিং-এর জন্যে। এইভাবে তিন-চারটে রোল প্রিন্ট হয়ে গেলে পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, লেবরেটারির লোক সব প্রাইভেটে ছবি চালিয়ে দেখে নেয় কেমন হচ্ছে। হিন্দী লয়লা মজনু আর বাংলা ঋষির প্রেম ছবি দুটোর ছটা রিল প্রোজেকশন দেখে সবার আক্কেলগুড়ুম। সারা ছবিতে তারা ভর্তি–কোনটায় নিশারের নাক নেই, লম্বা স্ক্র্যাচ, কোনটায় কজ্জনের চোখ নেই, এমনি ছটা রিলে কিছু না কিছু আছেই। প্রথমেই দোষ লেবরেটারির উপর। নিশ্চয় ডেভলপ বা প্রিন্ট করবার সময় অসাবধানে ওরাই কিছু একটা করেছে।

লেবরেটারি ইনচার্জ মিঃ সুলম্যান তখনই সবাইকে ডেকে নিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে, একই সলিউশন বাথ-এ মিঃ গাঙ্গুলীর প্রাদ ছটা রীল ডেভলপ ও প্রিন্ট হয়েছে তাতে কোনও দাগ নেই, পরিষ্কার ছবি। তবে? তাহলে নিশ্চয়ই খারাপ ফিল্ম। মার্কনি প্রহ্লাদের ক্যামেরাম্যান, সে তখনি দেখিয়ে দিলে একই নম্বরের ফিল্ম থেকে তিনটে ছবিই ভোলা হয়েছে। তাহলে? ক্যামেরাম্যানদের মুখ শুকিয়ে গেল। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে সবাই পরীক্ষা করতে বসল নেগেটিভ। এই পর্যন্ত বলেই চুপ করল মনমোহন।

আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। বললাম, তারপর কী হল বল?

নিজের মনেই খানিকটা হেসে নিয়ে হঠাৎ মনমোহন বললে, এখনও বুঝতে পারিসনি ব্যাপারটা?

সত্যিই পারিনি, মাথা নাড়লাম।

মনমোহন বলল, পরদিন সকাল দশটার আগে হেড অফিসে চলে গিয়ে রুস্তমজীর সঙ্গে দেখা করলাম। সব শুনে সাহেব হেসে ফেলল, বলল, এখন তাহলে তুমি কী করতে চাও? সোজা বলে দিলাম আমাকে ক্যামেরা ডিপার্টমেন্টে দিন। মার্কনি সাহেবের সঙ্গে কাজ করতে চাই। সাহেব তখনি একটা কাগজে অর্ডার দিয়ে দিলেন। অমন মনিব হয় না রে ধীরাজ! ব্যস, আর আমায় পায় কে? ধুতি পাঞ্জাবি ছেড়ে খাকি প্যান্ট ও হাফ শার্ট পরে পরদিন থেকেই মার্কনির ক্যামেরার কাজে লেগে গেলাম। কোম্পানির খরচায় আজ এদেশ কাল সেদেশ দেখা, তোফা ঘুরে বেড়াচ্ছি–

বাধা দিয়ে বললাম, তাতে বেড়াচ্ছিস, কিন্তু আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছিল বললি না তো?

–বলছি দাঁড়া বলে উঠে বাইরে গিয়ে পান আর খানিকটা দোক্তা মুখে পুরে বার দুই পিক ফেলে আমার পাশে এসে বসল মনমোহন। তারপর অপেক্ষাকৃত নিচু গলায় বলল, জানিস তো আমি পানটা একটু বেশিই খাই। এডিটিং করবার সময় নিশার, কজ্জন আর যে কোনো গাইয়ের গান আমার ভাল লাগত, সেগুলো অনেকবার করে অ্যামপ্লিফায়ারে বাজাতাম আর সেই সঙ্গে গলা ছেড়ে গাইতাম গানটা শিখে নেবার জন্যে। নেগেটিভের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে লিপ মুভমেন্ট দেখে মশগুল হয়ে গাইতাম। এদিকে মুখ থেকে ছররার মতো ছিটকে পানের পিক আর ছোট ঘোট সুপুরির কুচি সারা নেগেটিভটিকে চিত্তির-বিচিত্তির করে দিত। ফিল্ম জড়াবার সময় এই সুপুরীর কুচির ঘষা লেগে নেগেটিভে স্ক্র্যাচ্‌ হয়ে যেত। শুধু চোখে দেখা যেত না। কাজেই লেবরেটারি কিছু বুঝতে না পেরে নেগেটিভ তেল দিয়ে পরিষ্কার করে প্রিন্ট করে যেত। গাঙ্গুলীমশাই-এর প্রহ্লাদ ছবিতে স্ক্র্যাচ হয়নি কারণ সেটা এডিট করেছিল মুখুজ্যে। এইবার ব্যাপারটা বুঝলি হাঁদারাম?

এইবার হাসবার পালা আমার। ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট সব ভুলে অনেকদিন বাদে হাসলাম।

কৃষ্ণকান্তের উইল ছবিতে নিশাকরের পার্ট সত্যিই পেলাম। ছোট্ট ভূমিকা কিন্তু আমার বেশ ভাল লাগল। এই সময়ে এমন একটি ঘটনা ঘটল যাতে শুধু আমি কেন, ম্যাডান স্টুডিওর অনেকেই বিস্ময়ে থ হয়ে গেল। মিঃ গাঙ্গুলী ম্যাডানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে স্থায়ীভাবে যোগ দিলেন মতিলাল চামারিয়ার স্টুডিও ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্মস-এ। কেউ কেউ বলল সবাক ছবির বাজারে সাহেবরা হিন্দী ছবিকে প্রাধান্য দেওয়ায় উনি ক্ষুণ্ণ হয়েছেন। আবার কেউ বলল, আগে ফিল্ম ডিপার্টমেন্টে একরকম সর্বময় কর্তা ছিলেন-টকি আসায় হিন্দী ডিপার্টমেন্ট ওঁর হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। গুজব যাই হোক, মিঃ গাঙ্গুলী যে দীর্ঘদিন বাদে ম্যাডান ছাড়লেন এইটেই সত্যি। এর কিছুদিন বাদেই শুনলাম যতীন দাসও ম্যাডান ছেড়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া ফিল্মস-এ যোগ দিয়েছে। ভাঙন শুরু হল এই থেকেই। আজ লেবরেটারির দুজন কর্মী, কাল পেন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে চারজন, এইভাবে রোজ একটা না একটা কিছু ঘটতেই লাগল। আগে ম্যাডান ছাড়া কোনও স্থায়ী স্টুডিওই ছিল না, কাজেই মাইনে বাড়ানোর কথা বলতে কারও সাহস হত না। সবাক যুগে এসে চারদিকে স্টুডিও গজিয়ে উঠতে লাগল, কর্মীদেরও কদর আর মাইনে গেল বেড়ে।

কৃষ্ণকান্তের উইলের শুটিং শেষ করে বাইরে একটা বেঞ্চে বসে এইসব কথাই মনে মনে আলোচনা করছিলাম আর সেই সঙ্গে আমার পাথর-চাপা অদৃষ্টের কথা ভেবে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিলাম। অপরিচিত একটি লোক সামনে এসে নমস্কার করে বলল-আপনার নামই তো ধীরাজবাবু? বললাম, হ্যাঁ। লোকটি কাছে এসে চুপিচুপি বলল, আপনাকে ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্মসএর ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিঃ খেমকা একবার ডেকেছেন। ওঁদের প্রথম দোভাষী রাধাকৃষ্ণ ছবিতে আপনাকে শ্রীকৃষ্ণের পার্ট দেবেন ঠিক করেছেন।

নিজের কানকে বিশ্বাস করতেও ভয় হচ্ছিল।

.

ম্যাডান স্টুডিও থেকে বেরিয়ে গড়িয়াহাট রোড ধরে সোজা পুবমুখো মাইলখানেক হেঁটে, দাঁড়িয়ে ডানদিকে চাইলেই প্রথমে নজরে পড়বে, সামনে বহুদূর পর্যন্ত ধু ধু করছে বৃক্ষলতাহীন বিস্তীর্ণ পোডড়া জমি। তারও ওপর দিয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করে দিলে দেখা যাবে দূরে–ঐ বিস্তীর্ণ মাঠের পশ্চিম প্রান্তে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছবির মত একটা বাড়ি। একটু চেষ্টা করলে পড়াও যাবে সামনে বড় গেটটার মাথা জুড়ে একটা সাইনবোর্ড, বড় বড় হরফে লেখা, ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্মস লিঃ। গেটের সামনে সদ্য তৈরী করা লাল সুরকির পথটা সোজা এসে মিশেছে বড় রাস্তায়, দেখলেই মনে হবে স্বাগতম জানাচ্ছে।

লাল সুরকির পথ বেয়ে এসে বাধা পেলাম গেটে, দরওয়ানের কাছে। বন্ধ গেটের বাইরে টুল পেতে বসে আছে মোটা খাকি কোট পরা মাথায় পাগড়ি দরওয়ান, ভিতরে ঢুকতে হলে কার্ড বা স্লিপ চাই। দরওয়ানের কাছ থেকেই একটা কাগজ পেন্সিল চেয়ে নিয়ে খোকাবাবুর নাম লিখে নিচে সই করে দিলাম। একটু পরেই ভিতরে যাবার অনুমতি এল। ঢুকেই সামনে পড়ে গোল ফুলের বাগান, তার দুপাশ দিয়ে লাল সুরকির পথ মিশেছে গিয়ে গাড়ি বারান্দার নিচে। মোটরে গেলে সেইখানে নামতে হয়। চারদিক চেয়ে দেখলাম, প্রায় দশ-বারো বিঘে বাগানের উপর বাড়িটা। শুনেছিলাম, বাড়িটা ভবানীপুরের তখনকার দিনের বিখ্যাত উকিল দ্বারিকানাথ চক্রবর্তীর বাগানবাড়ি। দীর্ঘমেয়াদী লিজ নিয়ে মতিলাল চামারিয়া স্টুডিও করেছেন। গেটের ঠিক উত্তরে একটি সাউন্ড ফ্লোর তৈরী হচ্ছে। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম স্টুডিও। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। গাড়িবারান্দার পাথরের সিঁড়ি বেয়ে একটু উপরে উঠেই ডানদিকে যে বড় ঘরটি পড়ে সেইটে হল আফিস। কেরানী, টাইপিস্ট, ক্যাশিয়ার সব বসে সেই ঘরটায়। বাঁদিক দিয়ে চওড়া কাঠের সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। উঠেই প্রথমে ডানদিকে একটা পার্টিশন দেওয়া ঘর, মাঝেই সুইং ডোরটার ঠিক উপরে চকচকে পিতলের হরফে লেখা–মিঃ বি. এল. খেমকা, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। দরজা ঠেলে ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখি, তিনটি অবাঙালি মেয়ের সঙ্গে হেসে গল্প করছেন মিঃ খেমকা। আমায় দেখেই বললেন–একটু পরে এসো ধীরাজ, এদের সঙ্গে কথাটা সেরে নিই।

পার্টিশনের বাইরে একটা পরিষ্কার বেঞ্চি পাতা ভিজিটার্সদের জন্যে। সেটায় না বসে এগিয়ে গাড়ি-বারান্দার ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। দূরে গড়িয়াহাট রোডের দিকে চেয়ে আনমনে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশা-নিরাশার নাগরদোলায় দুলছিলাম। বেয়ারা এসে সেলাম দিল সাহেব ডাকছেন।

ঘরে ঢুকে নমস্কার করে দাঁড়াতেই অতি পরিচিতের মতোই হেসে খেমকাবাবু বললেন, বোসো ধীরাজ।

ম্যাডান স্টুডিওতে সাহেবদের সঙ্গে বার দুই-তিন দেখেছিলাম খেমকাবাবুকে। বয়স ত্রিশ-বত্রিশের মধ্যে। সুন্দর স্বাস্থ্যবান চেহারা, সবসময় মুখে হাসি লেগেই আছে। একবার কাছে গেলেই অপরিচয়ের বাধা লজ্জা পেয়ে দূরে সরে যায় আপনা থেকেই।

সিগারেটের টিনটা আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে খেমকাবাবু বললেন, তোমাকে আমার প্রথম ছবি রাধাকৃষ্ণতে শ্রীকৃষ্ণের পার্ট দেব বলে ঠিক করেছি।

কিছু না বললে খারাপ দেখায়, বললাম, কাগজে কিন্তু ডলি দত্তের নামে বিজ্ঞাপন দেখলাম।

ওটা গাঙ্গুলীমশায়ের ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আমি আপত্তি করেছি। মেয়েছেলেকে দিয়ে কেষ্টর পার্ট ছবিতে অন্তত চলে না বলেই আমার ধারণা। যাই হোক, হিন্দী-বাংলা দুটো ছবিতেই তোমায় কেষ্টর পার্ট করতে হবে। আমি তোমার সঙ্গে ছমাসের কনট্রাক্ট করতে চাই, মাসে দেড়শো টাকা দেব। তোমার কিছু বলবার থাকে তো বলল ভাই।

স্পষ্টবাদী লোক, মনে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। খুব ভাল লাগল খেমকাবাবুকে। তখনই রাজী হয়ে কনট্রাক্ট সই করে দিয়ে এলাম।

বেয়ারাকে দিয়ে ড্রাইভারকে ডাকিয়ে এনে খেমকাবাবু বলে দিলেন, ধীরাজকে ট্রামডিপোয় ছেড়ে দিয়ে এসো।

নমস্কার করে চলে আসছি, খোকাবাবু বললেন, বেলা এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ট্রামডিপোয় কোম্পানির গাড়ি অপেক্ষা করবে। তারপর এলে তোমায় হেঁটে বা নিজের পয়সায় রিক্সা বা ট্যাক্সি করে আসতে হবে। শুটিং থাকলে গাড়ি তোমায় বাড়ি থেকে নিয়ে আসবে, পৌঁছে দেবে।

সামনের মাস থেকে ইস্ট ইন্ডিয়ার কনট্রাক্ট শুরু, এখনও আট-ন দিন বাকি। পরদিন দুপুরে ম্যাডান স্টুডিওয় গিয়ে জ্যোতিষবাবুকে সব বললাম।

শুনে কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন জ্যোতিষবাবু, তারপর বেশ একটু অভিমানক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ভালই করেছ। বুঝতে পারছি, ভাল ভাল সব আর্টিস্টগুলোকে এইভাবে ভাঙিয়ে নিয়ে গাঙ্গুলীমশাই ম্যাডানকে জব্দ করছেন।

হেসেই বললাম, ভালর দলে আমাকে টানবেন না। আজ দেড় বছরে এতগুলো ছবি তুললেন আপনারা। আশি টাকা মাইনের আর্টিস্টকে ছোটখাটো একটা পার্ট দেবার কথাও মনে হয়নি কারও। এ লাইনে বেঁচে থাকতে হলে একটা কিছু করা ছাড়া আমার আর উপায় কী ছিল বলুন?

জাহাঙ্গীর সাহেব পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, জ্যোতিষবাবু এগিয়ে গিয়ে বললেন ধীরাজকে গাঙ্গুলীমশাই ইস্ট ইন্ডিয়ায় নিয়ে নিয়েছেন।

কিছুক্ষণ চুপ করে আমার মুখের দিকে চেয়ে সাহেব হেসে বললেন–আই অ্যাম গ্ল্যাড ধীরাজ। উইশ ইউ সাকসেস।

বহুদিনের পুরোনো কর্মস্থল, কেমন মায়া পড়ে গিয়েছিল। চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। জঙ্গলে যেখানটায় মাধবাচার্য পর্ণকুটির দাহ করেছিলেন–সেখানটায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে প্রকাণ্ড আর একটা সাউন্ড ফ্লোর, জাল সাহেব বীণার পায়ে রিস্টওয়াচ বেঁধে যে ন্যাড়া সিমেন্টের ফ্লোরটায় নাচিয়েছিলেন, সেখানটায় গজিয়ে উঠেছে প্রকাণ্ড একটা গুদাম ঘর। ছোট-বড় কাঠ কেটে সেটিং মিস্ত্রীরা রাতদিন তৈরী করছে সেটের ফ্রেম-সিঁড়ি, বাড়ির দরজা, জানলা, টেবিল চেয়ার। খুটখাট শব্দে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে কানে তালা লেগে যায়। আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে পুবদিকে মেক-আপ রুমের সামনে দাঁড়লাম। একটিও চেনা মুখ পেলাম না। চারিদিকে কিলবিল করছে কোরিন্থিয়ান আর অ্যালফ্রেড থিয়েটারের অভিনেতা অভিনেত্রীর দল। প্রকাণ্ড লম্বা মেক-আপ রুম, চারপাশে দেওয়ালে কাত করে রাখা দামী লম্বা আয়না। তার উপরে পাশে অসংখ্য বেশি পাওয়ারের দামী ইলেকট্রিক বাতির মালা। মেক-আপের জিনিসও দেখলাম বদলে গেছে। জার্মানির লিচেনারের স্থান অধিকার করেছে আমেরিকার বিখ্যাত ম্যাক্সফ্যাক্টারের মেক-আপ পাউডার, পেন্সিল-লিপস্টিক সব। আয়নার সামনে অসংখ্য চেয়ারগুলোতে বসে আছে রংবেরং-এর বিচিত্র পোশাক পরা শিল্পীর দল। পাঁচ সাতজন নতুন মেক-আপ ম্যান গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে মেক-আপ করতে। একজন উঠতে না উঠতেই আর একজন এসে বসছে। মেক-আপ করতে করতে চোখ বুজে কেউ দেখি বিড়বিড় করে সংলাপ আওড়াচ্ছে, আবার কেউ গানের তান ও গমক রপ্ত করতে ব্যস্ত। কতক্ষণে ফ্লোরে গিয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি সংলাপ অথবা গলা ভর্তি তানগুলো উগরে দিয়ে নিশ্চিত হবে, এই এক চিন্তা সবার মনে।

নয়া ফিল্ম দুনিয়ার এই আজব চিড়িয়াখানার কথা ভাবতে ভাবতে এক নম্বর ফ্লোরের সামনে এসে হাজির হলাম। আজ চেনা মুখ একটাও দেখতে পাচ্ছি না। মনমোহন, জয়নারায়ণ, মুখুজ্যে, লেবরেটারির দু-তিনটে বাঙালি ছেলে–কারও দেখা নেই। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ভাবলাম–অদূর ভবিষ্যতে ম্যাডান স্টুডিওতে সবাক ছবির তরঙ্গাঘাত সহ্য করে ভেসে থাকা বাঙালির পক্ষে খুব শক্ত। কানের কাছে তারস্বরে ইলেকট্রিক হটা আর্তনাদ করে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে পাশের সাউন্ড ট্র্যাকের অ্যামপ্লিফায়ারে ভেসে এল জাহাঙ্গীর সাহেবের গলা–খামোশ! মনিটার। সবাক ছবির শুটিংএ মনিটার কথাটা রিহার্সালের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়। কেন হয়, বলতে পারব না।

অ্যামপ্লিফায়ারে মাস্টার নিশার ও কজ্জন বাঈ-এর গলা শুনতে পেলাম। এক লাইন সংলাপ বলে নিশার শুরু করে গান। সেটা শেষ হতেই কজ্জনের সংলাপ শোনা যায়, তার পরেই গান। শুনেছিলাম ছবিটার নাম চক্র-বাকাওলে–দুটি প্রেমিক-প্রেমিকার অমর উপাখ্যান। মনিটার শুনে অবাক হয়ে ভাবলাম, এই গানের কুরুক্ষেত্রে প্রেম কোথায় আত্মগোপন করে থাকতে পারে, আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির অগম্য। মনিটার শেষে জাহাঙ্গীর সাহেব বেরিয়ে এলেন সাউন্ড ট্র্যাকের কাছে রেকর্ডারের কিছু বক্তব্য আছে কিনা জানতে। সাহস করে সামনে গিয়ে ইংরেজিতে বললাম আমি শুটিং দেখতে চাই স্যার!

সাহেব তখনই বললেন–কাম ইন ধীরাজ।

ভেতরে ঢুকে পাশের দিকে একখানা চেয়ারে ঝুপ করে বসে পড়লাম।

শুটিং না গানের জলসা? সমস্ত ফ্লোরটার অর্ধেকেরও বেশী জুড়ে সেটা। নানা কারুকার্য করা রংবেরং-এর থাম, সমস্ত দেওয়ালগুলোয় লতাপাতা আঁকা। তারই মধ্যে নগ্নবক্ষ দুতিনটে সুন্দরী মেয়ে ফুল হাতে অর্ধনিমীলিত চক্ষে এক বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। সামনে প্রকাণ্ড হল ঘর। ঘর না বলে উঠোনও বলা চলে। তার ঠিক মাঝখানে প্রকাণ্ড বেদীর মতো ফরাশ, মেঝে থেকে দশ-বারো ইঞ্চি উঁচু। তার উপর বিচিত্র কারুকাজ করা মখমলের জাজিম পাতা। ফরাশের চারপাশে প্রকাণ্ড মখমলের তাকিয়া, তাতেও জরির কাজ। মাঝখানে তাম্বুলাধার, গোলাপ জলাধার, সুরাপাত্র। দুধারে দুটো মূল্যবান ফুলদানিতে বড় বড় বাসরাই গুলাব (কাগজের)। একদিকে তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসে আছে নায়ক মাস্টার নিশার। পরনে সাটিনের ঢিলে পায়জামা, তার উপর ঢিলে হাতা জরির নকশা করা সাটিনের পাঞ্জাবি, তার উপর সাচ্চা জরির জ্যাকেট, মাথায় সোনালী জরির টুপি, হাতে গড়গড়ার নল। নলের উৎস খুঁজতে গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে বেশ খানিকটা ঘুরে তাকালে দেখতে পাওয়া যাবে দূরে সেটের শেষ প্রান্তে রাখা প্রকাণ্ড একটা পিতলের তাওয়া দেওয়া কলকে। অপর প্রান্তে আর একটা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে চোখ-ধাঁধানো জরির সামলা পায়জামা, ওড়না ও একরাশ জড়োয়া গহনা পরে বসে আছেন হাড়সার ডিগডিগে রোগা কোকিলকণ্ঠী কর্জনবাঈ, হাতে মখমলের উপর জরির কাজ করা পাখা। তার পাশে বসে আছেন অপেক্ষাকৃত কম জলুসদার পোশাক ও গহনা পরে পেসেন্স কুপার, মিস শীলা ও মুক্তার বেগম, বোধ হয় কজ্জনের সখি। সিনসিনারি, পোশাক আশাক সব মিলিয়ে এটা মোগল বাদশাহের আমলের কাহিনী, না বাগদাদের তরুণ অল-রসিদের সময়ের ঘটনা বলা খুব শক্ত।

এদের উপর থেকে চোখ সরিয়ে চারপাশের অসংখ্য থামওয়ালা বারান্দায় দৃষ্টিপাত করলে প্রথমটা অবাক হয়ে যেতে হবে। সাধারণ মুসলমানী পোশাক–লুঙ্গি, পায়জামা, ঢিলে পাঞ্জাবি, মাথায় পাতলা সাদা মুসলমানী টুপি পরে এক-একটি থামের আড়ালে এক একটি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে শিকারী বেড়ালের মতো ওত পেতে বসে আছে একটি করে মুসলমান বাদ্যযন্ত্রী। পরে বুঝলাম ক্যামেরার ফোকাসের বাইরে রাখতে হবে বলে ওদের ঐভাবে থামের আড়ালে আত্মগোপন করে বসানো হয়েছে। আর একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, আওয়াজ যার তীক্ষ্ণ তাকে বসানো হয়েছে তত দূরে। যেমন ক্ল্যারিওনেট, বাঁশের বাঁশি, করনেট, তবলা ইত্যাদি। এছাড়া বেহালা, সারেঙ্গী ও পিয়ানো মাইক্রোফোনের কাছে।

পরিচালক জাহাঙ্গীর সাহেবের সহকারী কোরিন্থিয়ানের একটি মুসলমান অভিনেতা মোটা বাঁধানো খাতা হাতে নিশার ও কজ্জনকে সংলাপ পড়াতে শুরু করলেন। সব কথার মানে না বুঝলেও ভাবার্থ এই–

নিশার–তোমাকে দেখার পর বেহেস্তের হুরী এসেও যদি আমায় প্রেম নিবেদন করে, আমি ফিরেও চাইব না। বলেই গান ধরবে নিশার। গান শেষ হলে তাকিয়া থেকে সোজা হয়ে উঠে বসে কজ্জন বলবে–যাও যাও, তোমাদের পুরুষ জাতটাই বেইমান। মুখে বলছ এক, এখান থেকে বেরিয়েই বলবে অন্য কথা। তারপর চলবে গান। দু-তিনবার মনিটার হল, কে বলবে এটা প্রেমের সিন, এ যেন কে বড় গাইয়ে তারই চরম পরীক্ষা। গানের বাণী স্পষ্ট বোঝা যায় না, শুধু তান আর গিটকিরির খণ্ডযুদ্ধ। বাদ্যযন্ত্রীরাও কম যায় না। প্রাণপণে বাজিয়ে প্রতিপন্ন করতে চাইছে তারা প্রত্যেকেই এক-একটি যন্ত্রবিশারদ, ফলে সবাই লাউড। গান, সংলাপ, বাজনা সব মিলিয়ে শুধু মনে হবে–সুরের কালবৈশাখীতে অসুরের তাণ্ডব নাচ।

ঘন্টা দিয়ে সবাইকে নিস্তব্ধ করে যথারীতি শুটিং আরম্ভ হল। একটা জিনিস স্পষ্ট উপলব্ধি করলাম, হিন্দী ছবির পারিপার্শ্বিক সব কিছু দৃষ্টিকটু হলেও নিশার ও কজ্জনের অপূর্ব সুরেলা কণ্ঠের ঝংকার শ্রবণে মধু বর্ষণ করে, গান থেমে গেলেও মনে হয় আর একবার শুনি। নিশার গান শেষ করে হাসিমুখে কজ্জনের দিকে চাইতেই উঠে বসে সংলাপ বলে নিশারের দিকে হাত বাড়িয়ে তান শুরু করলো কজ্জন। উঁচু পর্দা থেকে গিটকারির গমকে গড়িয়ে গড়িয়ে নামতে শুরু করলো সুর। তারপর তানে লয়ে গান আরম্ভ হল। হঠাৎ বিকট বেসুরো আর্তনাদ করে ইলেকট্রিক হর্ন বেজে উঠল। সবাই অবাক, চমৎকার হচ্ছিল শটটা, এভাবে থামিয়ে দেওয়ার মানে কী?

নিস্তব্ধ ফ্লোরে বোধহয় জোরে নিশ্বাস নিলে আওয়াজ শোনা যায়, হুড়মুড় করে দরজা খুলে দু-তিনটি পাৰ্শি ভদ্রলোক ঢুকে পড়লেন ফ্লোরে। চুপিচুপি জাহাঙ্গীর সাহেবকে কী বলতেই দেখলাম একরকম ছুটে চললেন সাহেব বাইরে গেটের দিকে। ব্যাপার কী? বাইরে এসে দেখলাম, কারও মুখে কথা নেই, সবাই ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। গাড়ি গেটের কাছেই ছিল, ছুটে গিয়ে উঠে স্টার্ট দিয়ে চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলেন জাহাঙ্গীর সাহেব। লেবরেটারি বন্ধ করে মিঃ সুলম্যান ছুটে চলেছেন গেটের দিকে। যাকে জিজ্ঞাসা করি, উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে সরে পড়ে। এক নম্বর ফ্লোরের ভিতরে উত্তরদিকে পুরু কাঁচের পার্টিশনে ক্যামেরাম্যান চার্লস কীড প্রকাণ্ড সুপার পারভো ডেব্রি ক্যামেরায় শুটিং করেছিলেন। ক্যামেরা ঘরের দরজা বন্ধ করে ব্যস্ত হয়ে গেটের দিকে চলেছেন দেখে তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম-ব্যাপার কী?

অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে কীড সাহেব বললেন-তুমি শোননি ধীরাজ? এই মাত্র হার্টফেল করে মারা গেছেন রুস্তমজী সাহেব।

.

আমার যোগসূত্রহীন বিক্ষিপ্ত নায়ক জীবনে যে কটি স্মরণীয় চরিত্রের নিকট-সান্নিধ্যে আসবার সৌভাগ্য হয়েছিল, পরোপকারী কর্মবীর রুস্তমজী সাহেব তার মধ্যে অন্যতম। এর বেশী কিছু বলতে গেলে সেটা বাড়াবাড়ির মতো শোনাবে, নয়তো তাকে ছোট করা হবে। তাই সেদিন সবার সঙ্গে সমারোহ করে সমবেদনা ও কৃতজ্ঞতা জানাতে ৫ নং ধর্মতলায় যেতে পারিনি, জনশূন্য স্টুডিও-শ্মশানে একা প্রেতের মতো অনেকক্ষণ বসে থেকে সোজা বাড়ি চলে এসেছিলাম।

হঠাৎ নোঙর-ছেঁড়া নৌকা দুরন্ত স্রোতের মুখে পড়লেও সজাগ মাঝির পাকা হাতের গুণে আবার নিরাপদে তীরে ভিড়তে পারে, কিন্তু মাঝির অভাবে তার অনিশ্চিত পরিণামের কথা চিন্তা করতেও ভয় হয়। সারা ভারতব্যাপী বিবিধ ব্যাবসায়ে লব্ধপ্রতিষ্ঠ জে. এফ. ম্যাডান কোম্পানির অবস্থা একমাত্র রুস্তমজীর অভাবে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই জটিল পরিস্থিতির ভয়াবহ আবর্তে ঘুরপাক খেতে লাগল। শুরু হল ভাঙন। ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝগড়া বিবাদ মনোমালিন্য এতদিন যা প্রচ্ছন্ন ছিল তারই রূঢ় প্রকাশ দেখা দিল–ভিন্ন হয়ে সবকিছু ভাগ-বাঁটোয়ারা করে পৈত্রিক বাসস্থান ৫ নং ধর্মতলা ছেড়ে যে যার আলাদা-আলাদা বাড়ি ভাড়া করে বা কিনে বাস করার মধ্য দিয়ে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল ফলতেও দেরি হল না। এক এক করে বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো দেনার দায়ে নয়তো দেখাশোনার অভাবে উঠে যেতে লাগল। স্টুডিওর অবস্থা দাঁড়াল সরকারী মায়ের মতো। ভাইয়েদের যার যখন খুশি এসে খানিক কর্তৃত্ব করে যান। মাসদেড়েকের মধ্যেই শোনা গেল, পুরোনো ও নতুন পাওনা ঋণের উপর আরও কিছু দিয়ে স্টুডিওর সর্বস্বত্ব কিনে নিয়েছেন ধনকুবের রায়বাহাদুর সুখলাল কারনানি। দিনপনেরোর মধ্যেই দেখলাম ম্যাডান স্টুডিওর বড় গেটের মাথায় হলিউডের অনুকরণে বড় বড় হরফে লেখা টলিউড স্টুডিও। পরে নাম পালটে রায়বাহাদুরের নাতি ইন্দ্রকুমারের নামানুসারে রাখা হয়-ইন্দ্রপুরী স্টুডিও। শুরু থেকে বাংলার ফিল্ম শিল্পের অগ্রগতির একটানা ইতিহাসের পূর্ণচ্ছেদ এইখানে পড়ে গেল। নতুন করে লেখা আরম্ভ হল এক অনাগত বৈচিত্র্যময় মুখর অভিযানের ভূমিকা। যাক, সে পরের কথা।

নির্দিষ্ট দিনে ইস্ট ইন্ডিয়া স্টুডিওয় গিয়ে হাজির হলাম। নতুন ভাড়াটের মতো চারদিকে ঘুরে ঘুরে সব দেখে বেড়াচ্ছিলাম, খোকাবাবুর বেয়ারা এসে জানালে যে, বাবু ডাকছেন। উপরে খেমকাবাবুর ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সামনের চেয়ারে দামী স্যুট পরে হাতে ৫৫৫ সিগারেটের টিন নিয়ে গম্ভীরভাবে বসে রয়েছে রাজহল। খেমকাবাবুর হাতে একটা লম্বা ফর্দ। সেইটের উপর চোখ বোলাতে বোলাতে বললেন-বসো ধীরাজ।

আমার দিকে একনজর চেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কোনও কথা না বলে টিন থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরিয়ে টানতে লাগল রাজহন্স। কেমন একটা অস্বস্তিকর আবহাওয়ার মধ্যে চুপ করে বসে রইলাম। একটু পরে ফটার নিচে নাম সই করে সেটা রাজহন্সকে দিতে দিতে খেমকাবাবু বললেন–তোমার সঙ্গে ধীরাজের আলাপ নেই?

কাগজখানা পকেটে রাখতে রাখতে অম্লানবদনে রাজহল বলল-ইয়েস, উই ওয়ার্কড অ্যাট ম্যাডান। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুটের ভঙ্গিতে নমস্কার করে গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কৌতূহল চাপতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম–রাজহন্স কি এখানে আসছে?

–হ্যাঁ, আমার প্রথম উর্দু সবাক King for a day বা এক দিনকা বাদশা ছবিটা ওরই লেখা এবং পরিচালনাও ওই করবে। তারই এসটিমেটেড লিস্টটা অ্যাপ্রুভ করে সই করে দিলাম।

অদ্ভুত ছেলে এই রাজহল। মনে মনে ভাবলাম, সেদিন রাত্রে সিরাজগঞ্জে সুনীলার কেবিনে ঢুকে অসার দম্ভ যে করেনি, তার প্রমাণ তো হাতে-হাতে পেলাম। অর্ধেক রাজত্ব যখন পেয়েছে তখন রাজকন্যার দেখা পেতেও যে বেশি দেরি হবে না, এটাও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল এবং সেটা যে সম্পূর্ণ ঈর্ষার, এটা স্বীকার না করলে সত্যের অপলাপ করা হবে।

খেমকাবাবু বললেন–তোমায় দেড়শ টাকা মাইনেতে নিয়েছি শুনে গাঙ্গুলীমশাই খুব খুশী হননি।

-কেন?

–উনি বললেন–ম্যাডানে ওকে মাত্র ষাট টাকা মাইনেতে নিয়েছিলাম আমি, আমায় একবার জিজ্ঞাসা না করে ডবলেরও বেশী মাইনে দিলেন আপনি?

একটা জব্বর উত্তর ঠোঁটের ডগায় এসে গিয়েছিল, কষ্টে সংবরণ করলাম। ভাবলাম–ওঁরই অধীনে এখন আমায় কাজ করতে হবে, সুতরাং

খেমকাবাবু বললেন–উত্তরে আমি কী বললাম জান?

খেমকাবাবুর দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলাম।

আমি বললাম–দেখুন, আমরা মাড়োয়ারির ছেলে, ব্যবসা আমাদের অস্থিমজ্জাগত। ম্যাডানে ওর মাইনের খবর নিয়েই দেড়শো টাকা ঠিক করেছি। নইলে আমি তিনশো টাকায় কনষ্ট্রাক্ট করতাম ওর সঙ্গে।

-শুনে কী বললেন উনি?

হেসে জবাব দিলেন খোকাবাবু,-শুনে রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাকগে, দরকারি কথাটা শোন। বাংলা ভারসন-এর নাম হয়েছে যমুনা পুলিনে আর হিন্দীটার রাধাকৃষ্ণ। দুটো ভারসনে সবসুদ্ধ চারখানা গান আছে তোমার। নিচে মিউজিক রুমে গিয়ে কেষ্টবাবুর কাছ থেকে সুরটা তুলে নাও। রোজ এসে রিহার্সাল দেবে। তোমার যা কিছু অসুবিধা হবে আমায় এসে বোলো। যাও নিচে গিয়ে দেখো, কেষ্টবাবু বোধহয় এতক্ষণ এসে গেছেন।

নমস্কার করে নিচে চলে এলাম। সিঁড়ি থেকে নেমেই ডানদিকে একটা ঘর, তার প্রকাণ্ড দুটো দরজা, সব সময় বন্ধ থাকে। তারই ভিতর দিয়ে অস্ফুট চাপা গানের সুর কানে এল। দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করে বন্ধ দরজায় দু-তিনটে টোকা দিলাম। একটা চাকর দরজা খুলে দিতেই ভিতরে ঢুকে পড়লাম, আবার দরজা বন্ধ করে দিলে। অন্ধকার ঘর। সদ্য কেনা দামী ইলেকট্রিক আলো ও যন্ত্রপাতিতে ভর্তি। চাকরটা বলল এ ঘর সব সময় বন্ধ থাকে-গান ঘরে ঢুকতে হলে দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে যেতে হয়। বাবুর হুকুম, সব সময় এ ঘর চাবি বন্ধ থাকবে আর একজন পাহারা দেবে।

লজ্জা পেয়ে বেরিয়ে এসে দক্ষিণ দিকে ঘুরে সামনে বারান্দায় উঠে দাঁড়ালাম। সামনে প্রকাণ্ড বড় হল ঘর। ঘর জুড়ে কার্পেট পাতা, তার উপর সাদা চাদর বিছানো। তিন চারটে তাকিয়াও ইতস্তত ছড়ানো দেখলাম। অত বড় হল ঘর মেয়ে-পুরুষে প্রায় ভর্তি। ইন্দুবালা, আঙুরবালা, কমলা (ঝরিয়া), বীণাপাণি (রেডিও), ধীরেন দাস, তুলসী লাহিড়ী (কাহিনী ও গীতিকার) ছাড়াও আরও পাঁচ-ছটি অচেনা মেয়ে, বোধহয় কোরাস গানের জন্য একপাশে বসে আছে। অন্যধারে বাদ্যযন্ত্রের মেলা–পিয়ানো, হারমোনিয়াম থেকে শুরু করে ক্লারিনেট, বাঁশের আড়বাঁশি, করনেট চেলো, সারেঙ্গী, পাঁচ-ছখানা বেহালা, একগাদা চীনে মাটির বাটি সাজিয়ে জলতরঙ্গ, তবলা, খোল, মৃদঙ্গ, করতাল। এককথায় দেশী-বিদেশী মিলিয়ে প্রায় সব বাদ্যযন্ত্রই আমদানি হয়েছে। এ যেন এক বিরাট গানের জলসা। মাঝখানে একটা বক্স হারমোনিয়াম নিয়ে গুনগুন করে গানের সুর দিচ্ছেন বিখ্যাত অন্ধ-গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে, পাশে বসে খাতা পেন্সিল নিয়ে সুরের নোটেশন তুলে নিচ্ছেন সহকারী কালী ভট্টাচার্য। একটু পরে গান থামিয়ে পান খেয়ে, সিগারেট ধরালেন কেষ্টদা। দেশলাই জ্বালাতে জ্বালাতে কালী কী বলতেই অনুমানে আমার দিকে ফিরে বললেন-ধীরাজ? তা ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয়।

কাছে গিয়ে বসলাম। কেষ্টদা বললেন-তোর গানেরই সুর দিচ্ছিলাম।

চুপি চুপি বললাম–কিন্তু চারখানা গান, আমি কি পারবো কেষ্টদা?

–আলবত পারবি। শ্রীরামপুরের বসন্তলীলা প্লের কথা আশা করি এত শিগগির ভুলে যাসনি। সেদিন আমিই তোকে জোর করে নামিয়েছিলাম, আজও বলছি, তোর বদনাম হবে না। গানের সুর তো আমি দেব রে। তুই কিছু ভাবিসনি।

ভাবনা তবুও গেল না। আস্তে আস্তে বললাম–এত সব নাম-করা গায়ক গায়িকার মধ্যে আমার অবস্থাটা কী দাঁড়াবে অনুমান করতে পারছো কেষ্টদা?

পারছি, আর সেইজন্যেই আবার বলছি, মাভৈঃ, কথায় আছে রাখে কেষ্ট মারে কে। আর একটা কথা মনে রাখিস, এখন থেকে ডবল কেষ্ট তোকে ব্যাক করবে, এক রাধিকার কেষ্ট, দুই তোর কেষ্টদা।

ঘরসুদ্ধ সবাই হেসে উঠল। ভারি লজ্জা পেলাম। চুপ করে আছি, গম্ভীরভাবে আমার দিকে ঝুঁকে চাপা গলায় বললেন কেষ্টদা, ওরে মূর্খ, এই গানের অজুহাতে তোকে বাতিল করে দিচ্ছিল। আমিই জোর করে বললাম যে, গানের ভার আমার। খোকাবাবুও আমাকে খুব সাপোর্ট করলেন। ওদের ইচ্ছে ছিল–

কথা শেষ হল না। পাশের ঘর থেকে ঈষৎ নাকিসুরের সঙ্গে কান্নার আওয়াজ মিশিয়ে মেয়েলি কণ্ঠে কে বলে উঠল, ছকি, হামার কুনো দুঃখ নাই।

সবাই চুপ। চুপিচুপি কেষ্টদাকে বললাম, ব্যাপার কী?

হেসে জবাব দিলেন কেষ্টদা, পাশের ঘরে শ্রীরাধিকা তোমার বিরহে হা-হুঁতাশ করছেন।

আবার একটা হাসির গুঞ্জন উঠল ঘরে। একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, সত্যিই ব্যাপারটা কী বলবে?

ইশারায় কাছে ডেকে ফিসফিস করে কেষ্টদা বললেন, ব্যাপারটা প্রকাশ্যে আলোচনা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মোদ্দা কথা হল, গাঙ্গুলীমশাই আর মুখুজ্যের ধারণা বাঙালি মেয়েদের মধ্যে রাধার পার্ট করার যোগ্যতা ও রূপ নেই বললেই চলে। তাই অনেক গবেষণা করে নির্বাক যুগের নামকরা অ্যাংলো নায়িকা সবিতা দেবীকে (মিস্ আইরিশ গ্যাসপার) রাধিকার ভূমিকায় মনোনীত করেছেন। সবিতাকে বাংলা শেখাবার ভার নিয়েছে গাঙ্গুলীমশায়ের সহকারী জ্যোতিষ মুখুজ্যে। রোজ দুপুর থেকে বেলা পাঁচটা পর্যন্ত মুখুজ্যে আদা-জল খেয়ে লেগেছে। যা শুনলি তা হল আট-দশ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের একটা সুপক্ক ফল। যাক, অনেক বাজে কথায় সময় নষ্ট হল, এইবার তোমার গান চারখানা লিখে নাও তো মানিক।

কালীর কাছ থেকে কাগজ-পেন্সিল চেয়ে নিয়ে গান চারখানা লিখে নিলাম। কেষ্টদা বললেন-তোর একখানা গানের সুর হয়ে গেছে। গানের সিচুয়েশনটা শুনে নে। কেষ্টর ভয়ে রাধিকাকে বাড়ির বার হতে দেয় না, জটিলা-কুটিলা সব সময় কড়া নজরবন্দী করে রাখে। এমনি সময় একদিন তুই মেয়েছেলে সেজে একতারা হাতে গান গাইতে-গাইতে আয়ান ঘোষের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে চলছিস। গানটা হল, আজকে আমার একতারাতে (শুধু তোমারি নাম বাজিয়ে চলি।

গানটা পুরো গেয়ে গেলেন কেষ্টদা, চমৎকার লাগল। সাদাসিধে সুর, তান বা লয়ের প্যাঁচ নেই। বার দুই গেয়ে অনেকটা ভরসা পেলাম।

কেষ্টদা বললেন, এখন পালা, রোজ এসে দু-একবার গেয়ে যাবি। অন্য গানগুলোর সুর এখনও দিইনি, পরে তুলে দেব। ইন্দুবালাকে কাছে ডেকে কুটিলার গানের রিহার্সাল দিতে শুরু করলেন কেষ্টদা।

অনেকদিন মুখুজ্যের সঙ্গে দেখা হয়নি, তাছাড়া এই অছিলায় সবিতা দেবীর সঙ্গে আলাপের লোভটাও সামলাতে পারছিলাম না। উঠে বারান্দা দিয়ে ঘুরে পাশের ঘরের ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, মে আই কাম ইন?

ভেতর থেকে মুখুজ্যে বলল, কাম ইন।

ঘরে ঢুকে দেখি, ধবধবে সাদা লাল-পেড়ে শাড়ি পরে ঘর আলো করে বসে আছেন সবিতা দেবী। সামনে একটা ছোট টেবিল, তার পাশে একখানা চেয়ারে ঘর্মাক্ত কলেবর সাদা পাঞ্জাবি গায়ে প্রকাণ্ড একখানা খাতা হাতে বসে আছে মুখুজ্যে। আমায় দেখেই বলে উঠল, এই যে ধিনি-কেষ্ট। তোমার কথাই হচ্ছিল।

বললাম, কেন?

সবিতা দেবী বললেন, আই ওয়াজ জাস্ট এনকোয়ারিং–।

হুংকার দিয়ে উঠল মুখুজ্যে, সবিতা, আবার?

–ও, আই অ্যাম সরি। জানেন মিঃ ভট্টচার্য, হামার গুরুদেবের আদেশ, ইংরেজি বলা একদম বন্দ।

মুখুজ্যের পাশে খালি চেয়ারটায় বসে বললাম, কেন, এরই মধ্যে আপনি তো বাংলা বেশ ভালই শিখে ফেলেছেন। পাশের ঘরে গানের রিহার্সাল দিতে দিতে আপনার ডায়লগ শুনছিলাম। আমি তো ভেবেছিলাম কোনও বাঙালী মেয়ে–মুখুজ্যের দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেলাম। ভুরু কুঁচকে চোখ ছোেট করে বেশ একটু রেগেই বলল মুখুজ্যে, ই, ঠাট্টা হচ্ছে। আর সাতটা দিন বাদে দেখো, তাক লাগিয়ে দেব। রোজ বেলা বারোটা থেকে পাঁচটা-ছটা পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে খাটুনি খাটছি সেটা বৃথা যেতে দেব ভেবেছ?

ঘরটায় তখনও পাখা ফিট হয়নি, বন্ধ ঘরে এমনিতেই ঘেমে উঠতে হয়। মুখুজ্যের কপালটা ঘামে ভরে উঠেছে, বিন্দু বিন্দু ঘাম কপাল থেকে বুকে পড়ে সাদা পাঞ্জাবির বুকের কাছটা ভিজে সপসপ করছে। বললাম, মাথার ঘাম পায়ে না পড়লেও কপালের ঘাম বুকে ফেলে যে খাটুনিটা তুমি খাটছ, তা যেন সার্থক হয় এই কামনা করি।

সবিতা দেবী খিলখিল করে হেসে উঠতেই মুখুজ্যে সত্যিই রেগে গেল, বলল, সরে পড়ো দেখি, এটা আড্ডা দেওয়ার জায়গা নয়, সখিদের সঙ্গে ওর পুরো সিনের ডায়লগটা আজ তৈরী করে না দিলে গাঙ্গুলীমশাই ভীষণ রাগ করবেন।

সবিতা দেবীকে বিদায় নমস্কার করে উঠে দাঁড়ালাম। পুরো উদ্যমে খাতা খুলে ডায়লগ পড়াতে শুরু করল মুখুজ্যে। মনে হল, মুখুজ্যে প্রাণপণে চেষ্টা করছে বাংলা মাকে বাঙালি পাড়ায় ধরে রাখতে আর সবিতা চাইছে টেনে হিঁচড়ে চৌরঙ্গীতে অ্যাংলো পাড়ায় নিয়ে গিয়ে গাউন পরাতে। একটু দাঁড়ালেই হেসে ফেলতাম। তাড়াতাড়ি পশ্চিমদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় পড়লাম। রাস্তাটা উত্তরমুখো খানিকটা গিয়ে বেঁকে পুবদিকে গিয়ে পড়েছে গেটের কাছে। বাড়িটার পশ্চিমদিকের তিনখানা বড় বড় ঘর নিয়ে হয়েছে লেবরেটারি। দেখলাম, নতুন নতুন যন্ত্রপাতি সব ফিট করতে লেগে গেছে মিস্ত্রীরা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখে আবার চলতে শুরু করলাম। হাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, আকাশের দিকে চেয়ে দেখলাম, কালো মেঘ একটু একটু করে ছেয়ে ফেলছে সমস্ত আকাশটা। ঝড় অথবা বৃষ্টি, নয়তো দুই-ই আসবার সম্ভাবনা। জোরে পা চালিয়ে দিলাম গেটের দিকে। কানে এল, ধীরাজ! পরিচিত গলা। বাঁ দিকের লতাকুঞ্জের ভেতর থেকে আওয়াজটা এল। একবার ভাবলাম, চলেই যাই–কী ভেবে দাঁড়ালাম, তারপর আস্তে আস্তে ঘন লতার গেটের ভিতর ঢুকে পড়লাম। দেখি, চারপাশে নয়নাভিরাম নানা জাতের ফুলের গাছ, মাঝখানে ঘন সবুজ ঘাস, সেই ঘাসের ওপর একটি সুন্দরী অবাঙালি মেয়েকে ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে বসে আমার দিকে চেয়ে হাসছে, ইস্ট ইন্ডিয়ার একাধারে নট, নাট্যকার ও পরিচালক রাজহন্স।

.

মেয়েটি নতুন বলেই মনে হল। বয়েস কুড়ি-বাইশের বেশি নয়। ফরসা রং, স্বাস্থ্যও ভাল। বোধহয় অদূর ভবিষ্যতে একাধারে হিরোইন ও জমিদার-গৃহিণী হবার তালিম নিচ্ছিল রাজহন্সের কাছে। আমায় দেখে লজ্জা পেয়ে আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে সরে বসতে চায় মেয়েটি। রাজহল জোর করে আরও নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিয়ে বলল, তারপর, খবর কী ধীরাজ, তুমি একা যে? সুনীলা দেবীকে সঙ্গে আনননি?

রাগে আপাদমস্তক জ্বলে উঠল। বললাম, আনব কি! সিরাজগঞ্জে কী যে গুরুমন্ত্র কানে দিয়ে এসেছ, কলকাতায় এসেই ছুটেছে লাহোরে। যাবার সময় আমায় বলে গেল–আমি লাহোর যাচ্ছি রাজহলের জমিদারি দেখতে, যদি পছন্দ হয় ফিরে এসেই বরমালা গেঁথে নিয়ে স্টুডিওয় গিয়ে মালাবদল করব। আপনি দয়া করে রাজহন্সকে বলবেন আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত যেন হিরোইন ঠিক না করে ফেলে।

অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম, নির্লজ্জ হাসিতে প্রকাণ্ড মুখখানা কদর্য হয়ে উঠছে রাজহন্সের। কোম্পানির বাস স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ পেলাম। একরকম ছুটে গিয়ে উঠলাম বাসে। বাইরে তখন ঠাণ্ডা হাওয়ার সঙ্গে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।

টালিগঞ্জের ট্রামডিপো পর্যন্ত তর সইল না। মুষলধারে বৃষ্টি, সেই সঙ্গে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়ে গেল। কেষ্টদা ও অন্যান্য কর্মীরা ঝড়ের আভাস পেয়ে আগেই সরে পড়েছেন। বাসের ভিতর আমি ও তিন চারটি কাঠের মিস্ত্রী। থেমে, আস্তে চালিয়ে প্রায় আধঘন্টা পরে বাস টালিগঞ্জের তেমাথায় পৌঁছল। রাস্তায় জল থৈথৈ করছে। দু-তিনটে গাছ উপড়ে আড় হয়ে পড়েছে ট্রাম লাইনের উপর। বুঝলাম কপালে দুঃখ আছে। অন্ধকার জনশূন্য রাস্তা। একা হেঁটে চলেছি। একটু এগিয়ে পুলিশ ফাড়ি। তেমাথার মোড়ে কতকগুলো লোক জটলা করছে। বুঝলাম ট্রাম বা রিকশার আশায় দাঁড়িয়ে আছে। একটু থেমে আবার উত্তরমুখো চলতে লাগলাম। জামা-জুতো ভিজে সপসপে হয়ে গেছে। একবার ভাবলাম শখের দামী জুতোটা অন্তত হাতে নিয়ে নিই। পরক্ষণেই ভাবলাম টালিগঞ্জ পাড়ার চেনা অচেনা কেউ না কেউ দেখে ফেলবেই যে, নায়ক জুতো হাতে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে চলেছে। এ খবরটা শাখাপল্লবিত হয়ে রটতেও দেরি হবে না, তখন? জুতোর মায়া ত্যাগ করে জল ভেঙে হেঁটেই চললাম। পুলিশ ফাঁড়ি ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে বাঁ দিকে পড়ে প্রকাণ্ড একটা বস্তি, ঐ বস্তির একটা সংকীর্ণ অন্ধকার গলির মাথায় একটি মেয়েকে ধরে টানাটানি করছে একটা লোক।

অদ্ভুত অবাস্তব কিছু নয়। পুলিশে চাকরি করার সময় পল্লীবিশেষে এর চেয়েও বীভৎস নাটকীয় দৃশ্য চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি। এসব ক্ষেত্রে না দাঁড়িয়ে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ, করছিলামও তাই। কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম মেয়েটির কথায়, শুনুন, দেখুন না এরা আমায় জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

এরা? গলিপথে দৃষ্টি প্রসারিত করেও জনপ্রাণীকে দেখতে পেলাম না; শুধু একটি লোক মেয়েটার হাত ধরে টানাটানি করছে। লোকটা মাতাল, জড়িতস্বরে বলল, কেন মিছেমিছি লোক ডাকাডাকি করছ, লক্ষ্মী মেয়ের মতো সুড়সুড় করে চলে এসো, কাছেই আমাদের ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে, ঘণ্টাখানেক বাদে নামিয়ে দিয়ে চলে যাব।

কিছুদূরে অন্ধকার গ্যাসপোস্টের নিচে আলো নিবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একখানা ট্যাক্সি। মনে হল ভিতরে লোকও রয়েছে তিন-চারজন। কী করি? বীরত্ব প্রকাশের এরকম একটা সুযোগ ছাড়তেও মন চাইছিল না। আবার স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে সাহসও হচ্ছিল না। দোটানায় পড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

জড়িতস্বরে মাতালটা বলল, কেউ তোমায় রক্ষে করতে আসবে না মানিক! ভাল কথা বলছি, চলে এস। এক ঘন্টায় পাঁচ টাকা–আচ্ছা, কুছ পরোয়া নেহি দশ টাকাই দেব–

–চাই না আপনার টাকা, আমায় ছেড়ে দিন।

-তা কি হয়? একটু আগে বলছিলে–মায়ের অসুখ, দুটো টাকা দিন, এর মধ্যেই–

ছোট ড্রেনটা লাফ দিয়ে পার হয়ে একেবারে সামনে গিয়ে পড়লাম। মাতালটা আশা করতেই পারেনি এই দুর্যোগে নোংরা গলিতে ততোধিক নোংরা ব্যাপারে আর কেউ মাথা গলাতে আসবে।

বললাম, হাত ছেড়ে দাও।

চুরচুরে মাতাল, ঠিক হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। মেয়েটার হাত ধরে কোন মতে টাল সামলে বলল, ভাল চাও তো সরে পড়। আমি একা নই, গাড়িতে আমার লোক বসে আছে।

বড় রাস্তায় দেখলাম-এরই মধ্যে জনকয়েক হুজুগপ্রিয় নিষ্কর্মা লোক মজা দেখতে দাঁড়িয়ে গেছে। তাদেরই একজনকে উদ্দেশ্য করে বললাম, পাশে পুলিশ ফাঁড়িতে একটা খবর দিন তো।

কাজ হল। হাত ছেড়ে দিয়ে টলতে টলতে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বলল লোকটা, আচ্ছা, এর ফল দু-এক দিনের মধ্যেই পাবে। অস্ফুটস্বরে কয়েকটা অশ্লীল গালাগালও আমার উদ্দেশে ছুঁড়ে দিয়ে গেল। প্রতিবাদ করে কেলেঙ্কারি করতে সাহস ও প্রবৃত্তি হল না। কাছ থেকে ভাল করে দেখলাম মেয়েটিকে। বয়েস পনেরো ষোলো বলেই মনে হল। শীর্ণ চেহারা, পরনে ঈষৎ ময়লা একখানা শাড়ি, ভিজে লেপটে গেছে দেহের সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করলাম, নাম কী তোমার?

কাঁদছিল মেয়েটা, আবার জিজ্ঞাসা করলাম। ময়লা কাপড়ের আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে জবাব দিল, রাধা।

-এখানে কোথায় থাক?

চুপ করে থাকে মেয়েটা। রাগ হয়, বললাম, কথার জবাব দাও।

বেশ একটু অনিচ্ছা ও সংকোচের সঙ্গেই বলে, এই বস্তির ভিতরে, কালিদাসী বাড়িউলির বাড়িতে।

হুজুগপ্রিয় নিষ্কর্মা দর্শকের দল দেখলাম রাস্তার উপরে বেড়েই যাচ্ছে। গলির পশ্চিমদিকে অপেক্ষাকৃত অন্ধকার জায়গায় রাধাকে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলাম, কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে আছ?

–অনেকক্ষণ, সন্ধ্যের আগে থেকে।

–ঐ মাতালটার কাছে তুমি দুটাকা চেয়েছিলে? বুঝিবা লজ্জায় চুপ করে থাকে রাধা। দর্শকদের মধ্যে থেকে সরস বাক্যবাণ বর্ষণ শুরু হয় আমাদের উদ্দেশে। কেউ বলে, এ যে বাবা অতিথ এসে গেরস্থকে তাড়ায়। কেউ বলে, নতুন কি আর, এ তো এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

মরিয়া হয়ে গেলাম, এর একটা হেস্তনেস্ত না করে আজ আর বাড়ি যাচ্ছিনে। রাধার কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে রুস্বরে বললাম, টাকা চেয়েছিলে?

অন্ধকারেও বুঝলাম ভয় পেয়ে গেছে রাধা, বলল, হ্যাঁ।

–কেন চেয়েছিলে?

–আমার মায়ের অসুখ, ওষুধ-পথ্যি কেনবার পয়সা নেই।

–বাড়িতে কে কে আছে?

-–মা আর আমার ছোট ভাইবোন চার-পাঁচটি।

–ঝড়বৃষ্টির সময় কোথায় ছিলে?

–এইখানেই।

কেমন একটা খটকা লাগল। দেহের বিনিময়ে সওদা করতে যারা আসে, অত জলে ঝড়ে এই নোংরা গলিতে তাদের আবির্ভাব আকস্মিক দুর্ঘটনার সামিল। তবুও এই অনাবৃত গলিপথে দুঘন্টার উপর কীসের আশায় দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা ঝড়জল তুচ্ছ করে?

-তোমার বাবা কোথায়?

জবাব না দিয়ে চুপচাপ থাকে মেয়েটা। আবার বলি, তোমার বাবা বেঁচে নেই?

আবার কান্না শুরু হয়ে যায় রাধার, কাঁদতে কাঁদতে বলে, বাবা আমাদের দেখে না, কারখানায় কাজ করে। কদাচিৎ বাড়ি আসে, দু-এক টাকা দেয়। তাতে চলে না।

অনুমানে ব্যাপারটা যেন মোটামুটি অনেকটা বুঝলাম, তবে এটা বুঝতে মোটই কষ্ট হল না যে টাকার প্রত্যাশায় রাস্তায় দাঁড়ানো রাধার আজ নতুন নয়।

বললাম, চলো তোমাদের বাড়ি, মাকে দেখে আসি।

আঁতকে উঠে তিন-পা পিছিয়ে গেল রাধা, তারপর ভয়ে ভয়ে বলে, আপনি দয়া করে দুটো টাকা দিন, ওষুধ কিনে নিয়ে না গেলে মা বাঁচবে না।

বললাম, বেশ তো, চলো না তোমাদের বাড়ি গিয়ে তোমার মাকে দেখে টাকা দিচ্ছি।

অন্ধকারে কান্নায় পায়ের উপর ভেঙে পড়ল মেয়েটা, দোহাই আপনার, সেখানে আপনি যাবেন না, নোংরা ঘরে এক মিনিটও দাঁড়াতে পারবেন না। কী একটু ভেবে নিয়ে বলল, বেশ শুধু হাতে যদি টাকা না দিতে চান, তাহলে চলুন বাড়িউলির একখানা খালি ঘর আছে। ঘন্টায় চার আনা, পরিষ্কার–।

আর শোনার প্রবৃত্তি হল না। রাগে ঘেন্নায় সর্বাঙ্গ রিরি করে উঠল। সজোরে রাধার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললাম গলি বেয়ে, বললাম, ভাল চাও তো কোন ঘরখানা তোমাদের দেখিয়ে দাও, নইলে আমি তোমায় থানায় নিয়ে যাব। এই বয়েস থেকে যে ব্যবসা শুরু করেছ তা শুনলে তোমায় জেলে আটকে রেখে দেবে।

আর আপত্তি করে লাভ নেই বুঝতে পেরেই বোধহয় অনিচ্ছার সঙ্গে চলতে লাগল মেয়েটা। অন্ধকারে দেড়হাত চওড়া গলি, পাশে অপরিষ্কার ড্রেন, বৃষ্টির জল পড়ে ছাপিয়ে উঠেছে রাস্তায়। দুর্গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত। গলিটার মাঝামাঝি এসে ডানদিকে একটা খোলর ঘরের বন্ধ দরজা হাত দিয়ে দেখিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মেয়েটা। ভিতরে হারিকেন বা কেরোসিনের লম্ফ জ্বলছিল বোধহয়, তারই অস্পষ্ট কয়েকটা রেখা ভাঙা দরজার ফাটল দিয়ে বাইরে এসে পড়েছিল। একটু ইতস্তত করে দরজায় টোকা দিলাম।

ভেতর থেকে ভারী গলার আওয়াজ পেলাম, কে রে? রাধি এলি? ভীত করুণ কণ্ঠে রাধা জবাব দেয়, হ্যাঁ বাবা, আমি। আবার আওয়াজ আসে, আমার ওষুধটা এনেছিস? এবার কোনও জবাব দেয় না রাধা। ভিতর থেকে চিৎকার শোনা যায়, কথার জবাব দে হারামজাদি?

ভয়ে এতটুকু হয়ে যায় রাধা, আস্তে বলে, না বাবা!

-না বাবা! তোকে না বলেছি দুটো টাকা না নিয়ে বাড়ি আসবিনি–যা, যেখান থেকে পারিস নিয়ে আয়, নইলে দরজাও খুলব না, খেতেও দেব না।

চুপিচুপি রাধার হাতে দুটো টাকা দিয়ে যদি সরে পড়ি, ব্যাপারটার সাম্প্রতিক মীমাংসা হয়ত তখনই হয়ে যায়, হল না। বেপরোয়া ভূতে পেয়েছে তখন আমায়! বেশ একটু জোরে দরজায় ঘা দিলাম। মনে হল মাটির দেওয়াল পর্যন্ত থরথর করে কেঁপে উঠল। ভিতরে একদম চুপ। একটু পরে দরজা ইঞ্চি-দুই ফাঁক হল, সেই সঙ্গে সংশয়াকুল গলায় প্রশ্ন, কে?

বললাম, চিনবেন না–দরজা খুলুন।

দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ভিতর থেকে একটা চাপা ফিসফাস আওয়াজ শুনতে পেলাম।হাত ছাড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করছিল রাধা। জোর করে ধরে বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

আস্তে আস্তে দরজা খুলে, একটা মিটমিটে কালিপড়া ভাঙা হ্যারিকেন-লণ্ঠন হাতে নিয়ে ছেঁড়া তালি দেওয়া একটা ময়লা লুঙ্গি পরে মোটাসোটা গোছের একটা লোক দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে আমার দিকে চেয়ে কঠিন স্বরে বলল, কে আপনি?

পরক্ষণেই রাধার দিকে নজর পড়তেই গলায় মধু ঢেলে বলল, ওঃ রাধি, সঙ্গে করে এনেছিস বুঝি বাবুকে? বাড়িউলির ঘর খালি নেই বুঝি? তা একটু দাঁড়া

অকল্পিত বিস্ময়ে রাধার হাত ছেড়ে দিয়ে দুপা পিছিয়ে পাশে ড্রেনে পড়তে পড়তে কোনও মতে সামলে নিলাম। আপনা হতেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, হারু!

অন্ধকারে তখনও চিনতে পারেনি আমায়। হারিকেনটা উঁচু করে ধরে মুখের দিকে চেয়েই ভয়ে বিস্ময়ে বাকরোধ হয়ে গেল হারুর।

হারু, ইন্দ্রপুরি স্টুডিওতে সেটিং মাস্টার বটু সেনের অধীনে কাজ করে, মাইনে চল্লিশ টাকা। সেট তৈরির ব্যাপারে রং দিয়ে দেওয়ালে ফ্রেসকো পেইন্টিং-এর কাজে হারু বটুবাবুর ডান হাত ছিল। সমস্ত স্টুডিওর মধ্যে ভালমানুষ বলে একটা খ্যাতিও হারুর ছিল। অল্প মাইনে, একপাল ছেলেপুলে। তার উপর একটার না একটার অসুখ লেগেই আছে। এইসব কারণে আমরা মধ্যে মধ্যে চাঁদা তুলে দু-পাঁচ টাকা হারুকে দিতাম। ভাবতাম সত্যই একটা সৎকাজে টাকাটা দিচ্ছি। প্রয়োজনবোধে ইচ্ছে থাকলেও হারুর আসল নামটা গোপন করে গেলাম।

বিস্ময়ের ধাক্কাটা একটু সামলে নিয়ে বললাম, আজ কলম্বাসের চেয়েও মস্ত একটা আবিষ্কার করলাম হারু। যে কোনও নামজাদা অভিনেতা তোমার পায়ের কাছে বসে এখনও দশ বছর তালিম নিতে পারে।

ভয়ে পাংশুমুখে দাঁড়িয়ে থাকে হারু। রাধা একবার আমার দিকে, একবার ওর বাবার দিকে চেয়ে রহস্যের কিনারা করবার চেষ্টা করে, পারে না। ভিজে কাপড়ের খুঁটটা দাঁতে কামড়ে অর্থহীন ফ্যালফেলে চাউনি মেলে অন্ধকার গলিপথের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ঘরের ভিতর থেকে নারীকণ্ঠের ক্ষীণ আওয়াজ শোনা গেল, শোনো!

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে হ্যারিকেনটা দরজার কাছে রেখে তাড়াতাড়ি ভিতরে চলে গেল হারু। পরমুহূর্তে রুগ্ন ক্ষীণকণ্ঠ হলেও স্পষ্ট শুনতে পেলাম, তুমি কী? রাস্তায় জল কাদায় ওঁকে দাঁড় করিয়ে না রেখে ভিতরে এনে বসাও।

সংকোচে লজ্জায় এতটুকু হয়ে হাত কচলাতে কচলাতে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল হারু। প্রবৃত্তি ছিল না। একবার ভাবলাম যথেষ্ট হয়েছে, এদের এইসব নোংরা ব্যাপার নিয়ে আমার মাথা ঘামাবার দরকার কী? বাড়ি চলে যাই। গেলাম না। ঘরে ঢুকে পড়লাম।

লম্বায় খুব বেশি যদি হয় আট হাত, চওড়া পাঁচ হাত। ঐ একটি মাত্র দরজা ছাড়া ঘরে আর জানলা নেই। বাঁশের বেড়ার উপর মাটি লেপে দেওয়াল, উপরটা খোলা দিয়ে ছাওয়া। মেঝেটা সিমেন্ট করা, মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে মাটি বেরিয়ে পড়েছে। ঘরের পুব দিকে ময়লা তেলকুচে একটা ছেঁড়া কাঁথায় সর্বাঙ্গ ঢেকে রক্তশুন্য পাংশু মুখ আর কোটরে ঢোকা চোখ দুটো বার করে শুয়ে আছে একটা মেয়ে। অনুমানে বুঝলাম হারুর স্ত্রী। তারই কোল ঘেঁষে লোভাতুর চোখে চেয়ে আছে তিন-চারটে নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছেলেমেয়ে। ঐ ঘরেরই পশ্চিমদিকে রান্নার ব্যবস্থা। একটা ভোলা উনুন, কালিপড়া মাটির হাঁড়ি, এঁটো কলাইওঠা দুতিনটে থালা-বাটি চারপাশে ছড়ানো। মাঝখানে একটা ছেঁড়া মাদুর পাতা, তার উপর কয়েকটা শালপাতার ঠোঙা, কয়েকটা পেঁয়াজি, বেগুনি ইতস্তত ছড়ানো। এরকম একটা নোংরা ঘরে মানুষ বাস করতে পারে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। একটা পচা ভ্যাপসা গন্ধের সঙ্গে দেশী ধেনো মদের গন্ধ মিশে একটা উৎকট আবহাওয়া জমে আছে ঘরের মধ্যে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। অবাক হয়ে চারদিকে চাইছিসজরে পড়ল তোলা উনুনটার পাশে লুকিয়ে রাখা একটা খালি দেশী-মদের পাঁট ও কানাভাঙা একটা ময়লা কাঁচের গ্লাস। রাধাকে দিয়ে ওষুধ আনানোর ব্যাপারটা এতক্ষণে পরিষ্কার বুঝতে পারলাম।

ইংরেজী পত্র-পত্রিকায় নাটকে নভেলে লন্ডনের নোংরা বস্তি সম্বন্ধে অনেক কথাই পড়েছিলাম, কিন্তু ভদ্রঘরের ছেলে হারু একফোঁটা মেয়ের দেহবিক্রির টাকায় মদ খায়, এটা কল্পনা করতে কষ্ট হয়। বললাম, উপদেশ দিয়ে, ধমকে অথবা ভাল-ভাল নীতিকথা বলে তোমাকে শোধরাতে যাওয়া আর বেনাবনে মুক্তো ছড়ানো একই কথা, সেদিক দিয়ে যাব না। শুধু একটা কথা তোমাকে বলে যাচ্ছি হারু, মাত্র সাতদিন সময় দিলাম তোমায়। এর মধ্যে যদি এ ধরনের ঘটনা কিছু ঘটে–আমি সোজা জাহাঙ্গীর সাহেবকে বলে তোমার চাকরি খতম করে দেব। যদি মনে কর আমি জানব কী করে, সেইজন্য বলছি-পাশের পুলিশ ফাঁড়িতে আমার একটি পরিচিত লোক আছে। তাকে বলে যাব তোমাদের ওপর নজর রাখতে।

মুখ নিচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইল হারু। দেখি এরই মধ্যে রাধা ওর মায়ের কোল ঘেঁষে বসে নীরবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পকেটে হাত দিয়ে দেখি গোটা আড়াই টাকা আছে। তা থেকে দুটো টাকা নিয়ে হারুর হাতে দিয়ে বললাম, আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। এ নিয়ে খাবার কিনে এনে তোমার ছেলেমেয়েদের আর স্ত্রীকে খেতে দাও।

টাকা নিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল হারু।

মহান পরোপকার ব্রত উদযাপন করে বেশ খানিকটা আত্মপ্রসাদ নিয়ে বাড়ি ফিরতে সেদিন রাত দশটা বেজে গেল। ভেবেছিলাম সবাই শুয়ে পড়বে, চুপিচুপি গিয়ে ভিজে কাপড় ছেড়ে আমার জন্য রাখা খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ব। এসে দেখি মায়ের ঘরে আলো জ্বলছে, সাড়া পেতে আস্তে আস্তে দরজা খুলে বেরিয়ে এল ছোট বোনটা। বাবার মৃত্যুর পর আমার পারিবারিক জীবনে একমাত্র উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, মাসতিনেক আগে ছোট বোনটির বিধবা হওয়া। জামাকাপড় খুলতে যাচ্ছি, কাছে এসে চুপিচুপি বোনটি বলল, ছোড়দা, মায়ের টাইফয়েড।

আঁতকে উঠলাম। তখনকার দিনে টাইফয়েড-নিউমোনিয়া দুরারোগ্য ব্যাধি। কোনও ওষুধ নেই, শুধু শুশ্রূষা ও পথ্যের দিকে নজর দিয়ে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে বসে থাকা ছাড়া। কয়েকটা বছর, কিন্তু মনে হয় এই সেদিন, এইরকম একটা গোলমেলে জুরে বাবাকে হারিয়েছি। আজ মা-ও যদি বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন! আর ভাবতে পারছিলাম না। সব তালগোল পাকিয়ে গেল। ঝুপ করে বিছানার এক পাশে বসে পড়ে দেওয়ালের দিকে চেয়ে রইলাম।

বোনটা বলেই চলল, কদিন ধরে অল্প অল্প জ্বর হয়, মা গ্রাহ্য করেন না, তার উপরই নাওয়াখাওয়া সব করেন। কাল থেকে জ্বরটা খুব বেড়েছে, উঠতে পারেননি। আজ পাশের বাড়িতে ডাক্তার নৃপেন সেন এসেছিলেন, শুনলাম ওঁর বাড়ি আমাদের দেশের কাছে। সাহস করে পাশের বাড়ির জ্যাঠাইমাকে দিয়ে বলাতেই উনি এসে অনেকক্ষণ ধরে মাকে দেখে বলে গেলেন–জ্বর টাইফয়েডে দাঁড়িয়েছে। খুব সাবধানে শুশ্রূষা করতে হবে আর পথ্যের দিকে নজর রাখতে হবে। রোগী দেখে বাইরে এসে আর একটা কথা বিশেষ করে আমাকে বলে গেছেন। যেন কোনও কারণে মা উত্তেজিত না হন। হার্ট খুব দুর্বল। একটু উত্তেজনাতেই হার্টফেল হতে পারে।

জবাব দেবার কিছুই নেই, শুনে গেলাম। কথা শেষ করে আস্তে আস্তে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলে বোনটা। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি আর কিছু নেই, চুপ করে বসে আছি। ঘরের পশ্চিম দিকের দেওয়াল ঘেঁষে ছোট একখানা তক্তপোশে ছোট ভাই রাজকুমার ঘুমোচ্ছিল। পাশ ফিরতে গিয়ে চোখে আলো পড়তেই ঘুম ভেঙে উঠে বসল। তারপর কোনও কথা না বলে বালিশের নিচে থেকে একখানা খাম বার করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললে, রঙমহল থিয়েটারের একটা পিওনগোছের লোক দিয়ে গেছে, আমি সই করে নিয়েছি।

আঘাত খেয়ে-খেয়ে মানুষ এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছয় যেখানে আর কোনও অনুভূতিই সাড়া জাগাতে পারে না। আমার অবস্থাও তাই। চিঠিটা পড়লাম।কর্তৃপক্ষের মূল বক্তব্য হল, সম্প্রতি আমেরিকা বিজয় করে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার কলকাতায় ফিরে এসে সদলবলে রঙমহলে স্থায়ীভাবে যোগদান করেছেন। সামনের মাসেই যোগেশ চৌধুরীর নাটক বিষ্ণুপ্রিয়ায় তিনি দীর্ঘদিন বাদে নাট্যপিপাসু দর্শকদের অভিবাদন জানাবেন। সুতরাং বাড়তি, অকেজো, পরগাছা শিল্পীদের একমাসের সময় দিয়ে চাকরি যাওয়ার নোটিশ। বলা বাহুল্য ঐ সব অবাঞ্ছিত শিল্পীদের মধ্যে আমি ব্যতিক্রম নই, অন্যতম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *