১০. বৃহত্তর–ক্ষুদ্রতর

বৃহত্তর–ক্ষুদ্রতর

আগেই জানিয়ে দিয়েছি আপনাকে, এক সাথে নয়, এক এক করে কাম্যবস্তু অর্জন করার মধ্যেই সাফল্য নিহিত।

একবারে একটি কাম্যবস্তু অর্জন করার চেষ্টা করবেন আপনি। যখন যে কাম্যবস্তুটি অর্জন করতে চাইবেন সেটিই হবে তখন আপনার প্রধান কাম্যবস্তু, একমাত্র চাওয়া বা মেজর অবজেকটিভ।

আপনার যে-কোনো কাম্যবস্তুকে আপনি প্রধান বা বৃহত্তর কাম্যবস্তু বলে মনে করুন। বৃহত্তর কাম্যবস্তুকে এবার ভাঙতে হবে ছোটো ছোটো টুকরোয়। এই ছোটো ছোটো টুকরোগুলো আপনার ক্ষুদ্রতর কাম্যবস্তু বা মাইনর অবজেকটিভ। ক্ষুদ্রতর কাম্যবস্তুগুলোকে এরপর গুরুত্ব অনুযায়ী লিখিতভাবে সাজান। এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে এক নম্বর থেকে সর্বশেষ ক্ষুদ্রতর কাম্যবস্তু বা অবজেকটিভ এক এক করে অর্জিত হলে ফলাফল দাঁড়াবে: বৃহত্তর অবজেকটিভটি অর্জনে সাফল্য।

মনে আছে তো, এর আগে আমরা শিখেছি, আমাদের অবজেকটিভ (এখন যাকে বলবো বৃহত্তর অবজেকটিভ) সম্পর্কে পরিষ্কার এবং বিশদ ধারণা থাকতে হবে আমাদের? আমরা ঠিক কি অর্জন করতে চাই তা জানতেই হবে নিখুঁত ভাবে।

আপনার এক নম্বর ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভটিকে ধরুন। যে পর্যন্ত সেটা অর্জিত না হচ্ছে, মনে করুন, সেটাই আপনার বৃহত্তর অবজেকটিভ।

এক নম্বর ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভটিই এখন পরিণত হলো আপনার বৃহত্তর অবজেকটিভে। এই বৃহত্তরে রূপান্তরিত অবজেকটিভকে বাস্তবায়িত করার আগে। আপনার এবং আপনার উক্ত অবজেকটিভের মাঝখানে কি কি বাধা আছে গবেষণা। করে বের করুন। বাধাগুলোকে সনাক্ত করা খুবই জরুরী। প্রত্যক্ষ এবং সম্ভাব্য। বাধাবিঘ্নগুলোকে টপকাবার জন্যে একটা তৎপরতামূলক সক্রিয় কার্যপদ্ধতি স্থির করুন, তারপর রচনা করুন কাজে হাত দেবার পরিকল্পনা। এই অবজেকটিভ অর্জিত হলে এরপর ধরুন দু’নম্বর ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভটিকে।

দুনম্বর ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভটিকে গ্রহণ করুন পূর্বের নিয়ম অনুযায়ী বৃহত্তর অবজেকটিভ হিসেবে। এটি এখন আর আপনার কাছে ক্ষুদ্রতর থাকছে না, হয়ে দাঁড়াচ্ছে বৃহত্তর।

আসুন, উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটাকে আরো পরিষ্কার করার চেষ্টা করা যাক।

ধরুন, আপনি কিছু একটা আবিষ্কার করতে চাইছেন। আবিষ্কার করার পর জিনিসটাকে আপনি নিজের কারখানায় তৈরি করে সারা দেশের মার্কেটে সাপ্লাই দেবেন–এই হলো আপনার অবজেকটিভ।

আপনি বর্তমানে কপর্দকহীন, একটা ফুটো পয়সাও নেই আপনার পকেটে।

বড় একটা কারখানার মালিক হতে গেলে রাশি রাশি টাকা লাগে। কারখানা। পরিচালনা করাটাও প্রচুর ব্যয় সাপেক্ষ। আপনার কাছে টাকা নেই। আছে শুধু একটা ইচ্ছা।

আপনার এই ইচ্ছাটাকে কি বাস্তবায়িত করা অসম্ভব? না, অসম্ভব নয়। আপনি যদি আপনার এই ইচ্ছাটাকে বৃহত্তর অবজেকটিভ বলে গ্রহণ করেন, এবং তারপর বৃহত্তর অবজেকটিভকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে অনেকগুলো ক্ষুদ্রতর

অবজেকটিভে পরিণত করেন, আপনার দ্বারা সাফল্য লাভ অবশ্যই সম্ভব।

আবিষ্কার না করেই মাঠে নেমেছেন আপনি। সুতরাং, আবিষ্কারটাই হোক অনিবার্য প্রয়োজনের খাতিরে আপনার এক নম্বর ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভ।

কোনো আবিষ্কারের মালিক হওয়া আপনার পক্ষে দুই ভাবে সম্ভব। হয় নিজের মাথা থেকে বের করুন আবিষ্কারটাকে, নয়তো কারো কাছ থেকে কিনে নিন। ধরা যাক, আপনার মধ্যে কিছু একটা সৃষ্টি করার তাগিদ আছে বলেই মাঠে নেমেছেন। আপনি, সৃষ্টি করার আনন্দ পেতে চান বলে জিনিসটার আবিষ্কারক হতে চান নিজেই, অন্য কোনো আবিষ্কারকের আবিষ্কার কিনতে চান না। বেশ, ভালো কথা।

আমরা সবাই জানি, প্রয়োজন আবিষ্কারের উৎস বা জনক। প্রয়োজন, অর্থাৎ অভাব। একটা নির্দিষ্ট জিনিসের অভাব খুঁজে বের করুন, তারপর অভাব পূরণ করবার জন্যে নির্দিষ্ট জিনিসটি আবিষ্কার করার চেষ্টা করুন।

অলসভাবে বসে থেকে যদি চিন্তা করেন, কিছু একটা আবিষ্কার করতে চাই আমি।’ চাওয়া পর্যন্তই, জিনিসটা আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

প্রথমেই জানতে হবে আপনাকে, কি আবিষ্কার করতে চান। নির্দিষ্ট একটা অভাব বা প্রয়োজন খুঁজে বের করুন তারপর পূরণ করুন সেটা।

আপনার প্রথম ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভ: বাজার ঘুরে খোঁজ খবর নিয়ে দেখলেন বাজারে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের জন্যে ছোটো তিন চাকাওয়ালা গাড়ি তেমন নেই, যেগুলো আছে সেগুলো টেকসই নয়, দেখতেও তেমন ভালো নয়, দামও গলাকাটা। এর চেয়ে ভালো জিনিস পাওয়া গেলে বাচ্চাদের অভিভাবকরা সেটাকে লুফে নেবে। আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বাচ্চাদের জন্যে গাড়ি তৈরি করবেন। মাথা ঘামিয়ে বা কোনো ডিজাইনারের সাহায্যে আপনার মনের মতো একটা নকশা তৈরি করুন গাড়ির। এই গাড়ির নকশা আপনার আবিষ্কার। আপনার প্রথম ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভ অর্জন করলেন আপনি। এবার দু’নম্বর ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভ অর্জন করার কাজ আপনার সামনে।

নিজের কারখানায় গাড়ি উৎপাদন-এটা আপনার দু’নম্বর ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভ।

নিজের একটা কারখানা গড়তে প্রচুর টাকার দরকার। টাকা আপনার নেই। উপায়?

উপায় হলো, আপনার দু’নম্বর ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভটিকে আপনার এই মুহূর্তের বৃহত্তর অবজেকটিভ বলে গ্রহণ করুন, এবং তারপর আপনার এই বৃহত্তর অবজেকটিভটিকে ভেঙে কয়েকটি ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভে পরিণত করুন।

যেহেতু আপনার টাকা নেই, তাই কারখানার মালিক হওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব নয় আপনার পক্ষে। আপনি অন্য কোনো কারখানার মালিকের সাথে আলোচনা। করুন, তার সাথে একটা ব্যবসায়িক চুক্তিতে আসুন। তার কারখানায় আপনি আপনার আবিষ্কৃত গাড়ি তৈরি করান, তৈরি করা গাড়ি বাজারে বিক্রি করুন। এতে লাভ হবে, ধীরে ধীরে টাকা জমবে আপনার। তারপর একদিন, সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, আপনি নিজে একটা কারখানার মালিক হবেন, নিজের কারখানায় তৈরি করবেন নিজের আবিষ্কৃত গাড়ি।

.

টুকরো বৃহত্তর সম্পর্কে

ক্লাব বা বিভিন্ন ধরনের সমাবেশে, আপনি হয়তো হীনম্মন্যতার পরিচয় দেন। নিজের পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে, সুন্দর শবভঙ্গি সহযোগে, চোখাচোখা যুক্তি দিয়ে বক্তৃতা করে যারা, তারা হয়তো আপনার ঈর্ষার পাত্র। আপনি হয়তো অবাক। হয়ে ভাবেন, অসংখ্য শ্রোতাদের সামনে লোকটা অমন সপ্রতিভ, সহজ থাকে। কিভাবে?

লোকটার মতো আপনিও চান সভা-সমাবেশে সহজ হতে, সাহসী হয়ে উঠতে, আত্মবিশ্বাসের সাথে কিছু বলতে। কিন্তু আপনি সেই সাথেই হয়তো অনুভব করেন: লোকটার মতো আমি কোনোদিনই অমন সহজ, সাবলীল, সপ্রতিভ হতে পারবো না। মঞ্চের উপর নিজেকে আসলে আপনি কল্পনা করতেই ভয় পান।

বৃহত্তর এবং ক্ষুদ্রতর থিওরি প্রয়োগ করে আপনি এই সমস্যার সমাধান বের করতে পারেন। লোক-সমাবেশে কথা বলা কারো জন্মগত গুণ নয়, এই গুণ নিজের মধ্যে তৈরি করতে হয়। বহুলোকে এই গুণ তৈরি করছে যার যার প্রয়োজনে, আপনিও ইচ্ছে করলে এই গুণের অধিকারী হতে পারেন।

কিভাবে? বৃহত্তর এবং ক্ষুদ্রতর থিওরি প্রয়োগ করে।

আলোচ্য ক্ষেত্রে আপনার এক নম্বর দ্রতর অবজেকটিভ কি? মঞ্চ ভীতির কবল থেকে মুক্তি পাওয়া। এই মুহূর্তে আপনি হয়তো নিজেকে প্রশ্ন করবেন, আমার মধ্যে ভয় ভয় একটা ভাব রয়েছে, এর থেকে রেহাই পাবো কি ভাবে? আপনার এই প্রশ্নের উত্তরটা এতোই সহজ যে শুনে শুধু আনন্দিতই নয়, বিস্মিতও হবেন। তার আগে, একটা প্রশ্ন করবে আপনাকে।

লোক সমাবেশে এমন একজন ব্যক্তি কি আছে যার সাথে ব্যক্তিগত ভাবে। কথা বলতে আপনি ভয় পান? পান না-বেশ। এখন, একটা সত্য প্রকাশ করি।

মনে করুন, দুশো লোকের একটা সমাবেশে উপস্থিত রয়েছেন আপনি। সুবিধের খাতিরে ধরুন, একজন লোকের বুদ্ধি এবং বিচার মমতা এক পোয়া।

দুশো লোকের বুদ্ধি এবং বিচার ক্ষমতা তাহলে কতো? অঙ্কটা কিন্তু খুবই সহজ।

কি বললেন? দুশো লোকের বুদ্ধি এবং বিচার ক্ষমতা একমণ দশ সের?

না, অঙ্ক মেলেনি আপনার। আলাদা আলাদা ভাবে ওজন করলে দুশো লোকের বুদ্ধি এবং বিচার ক্ষমতা দুশো পোয়া অর্থাৎ একমণ দশ সেরই হয় বটে কিন্তু একটা সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে অঙ্কটা কষতে হবে। সত্যটা কি? সত্যটা হলো, দুশো কেন, দু’হাজার মানুষ একত্রিত হলেও তাদের বুদ্ধি এবং বিচার ক্ষমতা দু’হাজার গুণে উন্নীত হয় না। দুশো লোকের একত্রিত হওয়ার মানে এই নয় যে তাদের বুদ্ধি এবং বিচার ক্ষমতা দুশো গুণ বেড়ে গেছে। আসলে ওই দুশো লোকের বুদ্ধি এবং বিচার ক্ষমতা এতোটুকু বাড়েনি, আছে সেই এক পোয়াই। অর্থাৎ এক ব্যক্তির বুদ্ধি-বিবেচনা যতোটুকু দুশো লোকেরও তাই, তার বেশি এক কণাও নয়। সতুরাং, যে-কোনো একজন লোকের সাথে যদি কথা বলতে দ্বিধা বোধ না করেন। আপনি, দুশো লোকের উদ্দেশে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করবেন কেন? একজনের সাথে কথা বলতে পারলে সকলের সাথে একযোগেও বলতে পারবেন। দুশো বা দু’হাজার লোকের সমাবেশে কথা বলার সময় আপনি ধরে নেবেন মাত্র এক পোয়া বুদ্ধি এবং বিচার ক্ষমতার উদ্দেশে কথা বলছেন আপনি।

শ্রোতামণ্ডলীকে ভয় পাবেন না। তাদেরকে ভালবাসুন। তারা আপনার কথা। শুনবে, সুতরাং তাদের জন্যে আপনার মধ্যে ভালো মনোভাব থাকা বাঞ্ছনীয়।

কিভাবে, কোন পরিবেশে কোন্ ভঙ্গিতে কথা বলবেন আপনি তার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। কথা বলার ভঙ্গি রপ্ত করা-এটা হোক আপনার দু’নম্বর ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভ।

খুব দ্রুত বা খুব ধীর ভঙ্গিতে, খুব জোরে বা খুব নিচু গলায় অবশ্যই কথা বলবেন না। সুর, উচ্চারণ, শব্দচয়ন, বাক্যগঠনরীতি ইত্যাদির দিকে তীক্ষ্ণ মনোযোগ দিতে হবে আপনাকে।

কণ্ঠস্বর সম্পর্কে সচেতন হোন। সচেতন থাকলেই কণ্ঠস্বরের ত্রুটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। জোর গলায় পড়বার চেষ্টা করুন, পরীক্ষা করুন নিজের কণ্ঠস্বরটিকে কতরকমভাবে পরিবর্তন করা যায়। পরিষ্কার কণ্ঠে উচ্চারণ করুন প্রতিটি শব্দ।

আপনার তিন নম্বর ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভ হতে পারে: ভাষার ত্রুটি কাটিয়ে ওঠা।

নির্ভুল ভাষায় কথা বলা শিখতে হবে আপনাকে। আপনি যদি আপনার বক্তব্য পরিষ্কার করে তুলে ধরতে চান, বড়সড় একটা শব্দের ভাণ্ডার একান্তভাবেই থাকা দরকার আপনার। মনের ভাব বা বক্তব্য প্রকাশ করার ক্ষেত্রে শব্দের দান সবচেয়ে বেশি। চিন্তার বাহক শব্দ। আপনি যা চিন্তা করছেন তা যদি প্রকাশ করতে চান, শব্দের সাহায্যেই শুধুমাত্র তা সম্ভব। সুতরাং, নিজের মধ্যে প্রচুর শব্দের একটা ভাণ্ডার তৈরি করুন।

.

ঈর্ষা কেন?

নিজের যোগ্যতা ও উপযুক্ততাকে যে খাটো করে দেখে সে অপরকে ঈর্ষা করে। ঈর্ষা হলো নিজের প্রতি সন্দেহের লক্ষণ। হীনম্মন্যতার পরিচায়ক।

এনাম যদি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতো যে সে-ও ইচ্ছা করলে মতিনের মতো অবস্থায় উঠতে পারে, তখন কি সে মতিনের সমৃদ্ধি দেখে ঈর্ষা করতে?

না।

পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে মার্কেটে গেলেন, গিয়ে দেখলেন অনেকে অনেক জিনিস কিনছে-এদের কেনাকাটা দেখে কি আপনার মধ্যে ঈর্ষাভাব জাগবে? না। কারণ, আপনিও তো কিনতে গেছেন, কিনছেন। ওরা যা কিনছে, আপনিও ইচ্ছা করলেই তা কিনতে পারেন।

আপনার বন্ধু আপনার চেয়ে ভালো বাড়িতে বসবাস করছে। আপনি যদি তার এই ভালো বাড়িতে বসবাস করাটাকে ঈর্ষার চোখে দেখেন তাহলে পরিষ্কার প্রকাশ হয়ে পড়ছে যে আপনি আপনার বন্ধুর মতো একটা ভালো বাড়ির ব্যবস্থা করার। ব্যাপারে নিজের যোগ্যতাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন।

অন্যকে, তাদের যা আছে তার জন্যে ঈর্ষা না করে, বৃহত্তর এবং ক্ষুদ্রতর থিওরি প্রয়োগ করে যে জিনিস দেখে পাবার ইচ্ছে হয় তা অর্জন করার চেষ্টা করুন।

ঈর্ষা করা মানে নিজেকে অযোগ্য বলে মেনে নেয়া। আপনার কোনো এক বন্ধুর কথা ধরুন। সে সকলের সম্মান পায়, ভালবাসা পায়, শ্রদ্ধা পায়। তার এতো সব পাওয়া দেখে আপনি ঈর্ষাবোধ করেন। অথচ ঈর্ষাবোধ করার কোনো কারণ নেই আপনার। কারণ, সম্মান, ভালবাসা, শ্রদ্ধা, প্রশংসা তার মতে, এমনকি তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে আপনিও পেতে পারেন-পাবার ইচ্ছে যদি আপনার মধ্যে থাকে।

ঈর্ষাবোধকে আপনি গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করতে শিখুন। যার যে জিনিসটি দেখে আপনার মধ্যে ঈর্ষার উদ্রেক হয় সেই জিনিসটি অর্জন করার জন্যে উদ্যোগী হোন। ওই জিনিসটিকেই আপনি গ্রহণ করুন আপনার কাম্যবস্তু হিসেবে। তারপর নিয়ম মেনে সেটি অর্জন করার জন্যে যা যা করা দরকার করুন। পেয়ে যাবেন জিনিসটি। আপনার মধ্যে কণা পরিমাণেও ঈর্ষাবোধ থাকবে না। জিনিসটা আপনার ছিলো না বলেই আপনি চেয়েছেন, তারপর অর্জন করে। নিয়েছেন, ঈর্ষা কেন?

.

কিভাবে ভাগ করে এগোবেন

যে-কোনো একটি কাজ সম্পূর্ণ করতে চান আপনি। কাজটা কোত্থেকে শুরু করবেন, জানা দরকার আপনার। প্রত্যেকটি কাজের শুরু এবং শেষ আছে। যে। কাজটি করবেন বলে স্থির রবেন সেই কাজটি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা, দরকার আপনার। একটা উদাহরণ দিয়ে বক্তব্যটাকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করা। যাক।

ধরুন, আপনি একটি বই ছাপতে চান।

বই ছাপার কাজটিকে এখানে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করছি বটে কিন্তু এই উদাহরণ অন্য যে-কোনো কাজের সাথে সঙ্গতি রাখবে। বই ছাপতে হলে আপনাকে যে-সব নিয়ম পালন করতে হবে সব জানিয়ে দিচ্ছি, অন্য কাজের বেলাতেও এই নিয়মগুলো প্রযোজ্য।

আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন: একটি বই ছাপবেন।

সিদ্ধান্ত নিলেন ছাপবেন, কেন সিদ্ধান্ত নিলেন? এটা একটা প্রশ্ন। কোনো কাজ করার সিদ্ধান্ত তখনই কেউ নেয় যখন সেই কাজটির দ্বারা সে উপকৃত হবার সম্ভাবনা দেখে। আপনি বইটি ছাপার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? বইটা বাজারে বিক্রি করে ব্যবসা করবেন, তাই। আপনার বই ছাপার উদ্দেশ্য, ধরা যাক, টাকা রোজগার করা।

সিদ্ধান্ত নেবার আগে আপনাকে জেনে নিতে হবে অনেকগুলো প্রয়োজনীয় ব্যাপার। কি বই ছাপাবেন? উপন্যাস, না প্রবন্ধের বই? গল্পের বই, না কবিতার বই? বাজারে এখন, ধরা যাক, আত্মোন্নয়নমূলক বইয়ের খুব চাহিদা। বেশ, ওই বিষয়ের উপর একটি বই ছাপবেন, স্থির হলো।

কাজে হাত দিতে যাচ্ছেন আপনি। তার আগে একটি ডেস্ক ক্যালেণ্ডার কিনুন। আজ মে মাসের এগারো তারিখ, ধরুন। ক্যালেণ্ডারের পাতায় এগারো তারিখের নিচে লিখুন: এক, লেখকের সন্ধান চাই।

আপনি যে ধরনের বই লেখাতে চান তা সব বা যে-কোনো ধরনের লেখকের পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। এই বিষয়ে কয়েকজন নির্দিষ্ট লেখক আছেন। তাঁদের সাথে। আপনার যোগাযোগ করতে হবে। কিন্তু তাদেরকে আপনি হয়তো চেনেন না। কারো হয়তো নাম জানেন, কিন্তু তার বাড়ির ঠিকানা জানা নেই। কি করবেন?

(১) লেখকের সন্ধান চাই।

এটি আপনার প্রথম বৃহত্তর অবজেকটিভ। মনে করুন একটি বড় কাজ। এটি আপনার বৃহত্তর অবজেকটিভ। এই বৃহত্তর অবজেকটিভটিকে আপনি কয়েকভাগে ভাগ করে কয়েকটি ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভে রূপান্তরিত করুন। কিভাবে তা সম্ভব?

* আপনার পরিচিত প্রকাশকদের কাছে যেতে হবে আপনাকে। কয়েকজনের নাম লিখে ফেলুন নোট বইতে। এঁরা হয়তো আপনাকে লেখকের সন্ধান বা তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিতে পারবেন। বাড়ি বা অফিস থেকে এখন আপনাকে। বেরুতে হবে। যেতে হবে কয়েকজন প্রকাশকের কাছে। প্রকাশকদের অফিস, ধরুন, বাংলাবাজার, বাংলাবাজারে যাওয়া কি খুব কঠিন? মোটেই নয়। রাস্তায় নেমে একটা রিকশা নিন, পৌঁছে দেবে সে আপনাকে বাংলাবাজারে।

ক) প্রকাশকদের সাথে দেখা করুন। তাদেরকে লেখক সম্পর্কে প্রশ্ন করুন।

খ) এখন আপনার বৃহত্তর অবজেকটিভ। খোঁজ নিয়ে, ধরুন, আপনি পাঁচজন। লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলেন।

গ) লেখকের কাছে যাওয়া এবং তাকে আপনার উদ্দেশ্যের কথা জানানো।

এটি আপনার আর একটি ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভ। এটিকে এখন আপনি বৃহত্তর অবজেকটিভ রূপে গণ্য করবেন। তারপর এটিকে কয়েকভাগে ভাগ করে ফেলে রূপান্তরিত করতে পারেন কয়েকটি ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভে।

পাঁচজন লেখকের সাথে এক এক করে, আলাদা আলাদা ভাবে দেখা করলেন। আপনি। তাঁদের সাথে কথা বললেন। যাকে আপনার পছন্দ হলো, যিনি আপনার নির্বাচিত বিষয়ের উপর আপনার নির্ধারিত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাণ্ডুলিপি লিখে দিতে সম্মত হলেন আপনি তাকে নিযুক্ত করলেন।

লেখকের সন্ধান চাই–এটি ছিলো আপনার এক নম্বর বৃহত্তর অবজেকটিভ। এই অবজেকটিভ অর্জিত হলো।

এরপর আর এক বৃহত্তর অবজেকটিভ।

(২) পাণ্ডুলিপি পড়া, সংশোধন করা, প্রেসে ছাপতে দেয়া।

দু’নম্বর বৃহত্তর অবজেকটিভ এটি আপনার। এটিকে ভাগ করতে হবে অনেকগুলো ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভে।

ক) লেখক পাণ্ডুলিপি দিলে সেটি পড়তে হবে।

খ) সংশোধনের জন্য পাঠাতে হবে আবার।

গ) সংশোধিত পাণ্ডুলিপি টেবিলে নিয়ে বসতে হবে হিসেব করার জন্যে। শব্দ গুণে স্থির করুন বইটা কতো ফর্মা হবে। হিসেব করে জেনে নিন কতো রীম। কাগজ লাগবে।

ঘ) প্রেস অনেক রকম আছে। বইটা কোন্ প্রেসে ছাপবেন স্থির করে সেই শ্রেণীর প্রেসে যান। ছাপার রেট সম্পর্কে আলোচনা করুন। তাদের সাথে একটা চুক্তিতে আসুন।

ঙ) পাণ্ডুলিপি প্রেসে জমা দেবার আগে ঠিক করুন ছাপা হবার পর প্রত্যেকটি বইয়ের জন্যে খরচ পড়বে কতত। তারপর মূল্য স্থির করুন। কমিশন বাদ দিয়ে। যা পাবেন তা খরচের চেয়ে বেশি হতে হবে, তবেই না লাভ করবেন বইটি ছেপে।

চ) কাভার ডিজাইন করান।

ছ) প্রেসে কাগজ দিন।

জ) প্রুফ দেখুন বা দেখান।

এখানে দেখা যাচ্ছে আটটি খণ্ড খণ্ড কাজের সমষ্টি হলো আপনার দু’নম্বর। বৃহত্তর অবজেকটিভ। এই আটটি খণ্ডের প্রত্যেকটিকে আপনি বৃহত্তর অবজেকটিভ ধরতে পারেন সুবিধের জন্যে। ধরুন প্রথম খণ্ডটির কথা। ক) লেখক পাণ্ডুলিপি দিলে সেটি পড়তে হবে। পড়তে হলে সময় চাই। কাজের মানুষ আপনি, সময়ের অভাব খুব। তবু সময় বের করতেই হবে। কিভাবে সময় বের করবেন স্থির করুন। ডেস্ক ক্যালেণ্ডারে লিখুন, দুপুরের ঘুম বাদ দিয়ে পাণ্ডুলিপি পড়বো। ক যদি হয় আপনার বৃহত্তর অবজেকটিভ তাহলে ‘দুপুরের ঘুম বাদ দিয়ে পাণ্ডুলিপি পড়বো’-এটি হবে আপনার ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভ। এইভাবে প্রত্যেকটি খণ্ডকে খণ্ডাংশে পরিণত করে নিতে পারেন আপনি।

ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। বইগুলো নির্দিষ্ট একটা তারিখে ডেলিভারি পাবেন আপনি। কিন্তু কাজ এখনও অনেক বাকি।

এরপর আপনার বৃহত্তর অবজেকটিভ হবে—

(৩) বিক্রয়।

বইগুলো দ্রুত বিক্রি করে ফেলতে হবে আপনাকে। যত তাড়াতাড়ি বিক্রি করতে পারবেন ততো তাড়াতাড়ি পুঁজিসহ লাভ উঠে আসবে আপনার। দ্রুত এবং অধিক সংখ্যক বই বিক্রি করার জন্যে এখন থেকেই একটা কার্যক্রম হাতে নিতে হবে আপনাকে।

বৃহত্তর অবজেকটিভটি ক ভাগ করুন।

ক) বিজ্ঞাপন।

খ) সংবাদপত্রে সমালোচনা বিভাগের সাহায্য নিন বইটিকে সর্ব সাধারণের কাছে পরিচিত করে তোলার জন্যে।

গ) পোস্টার ছেপে দেশের সম্ভাব্য সর্বত্র দেয়ালে দেয়ালে সাঁটার ব্যবস্থা করুন।

ঘ) বইয়ের দোকান, এজেন্ট বা ডিলারদেরকে চিঠি লিখে আপনার বইয়ের কথা জানান।

ঙ) আপনি যদি আপনার বইয়ের বিনিময়ে অন্য কোনো বই গ্রহণ করতে চান, যোগাযোগ করুন অন্য বইয়ের প্রকাশকের সাথে।

এগুলোর প্রত্যেকটিকে আপনি কাজের সুবিধের জন্যে বৃহত্তর অবজেকটিভ ধরতে পারেন। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটিকে ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভে পরিণত করুন ভাগ করে।

বইটা ছাপা শেষ হলো। এর আগেই আপনাকে ঠিক করে নিতে হবে, কোথায় বইটি বাইণ্ডিং করাবেন।

বাইন্ডিং করা হলে বই তুলবেন গোডাউনে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন এজেন্সী, বুক স্টল এবং পাঠক-পাঠিকার কাছ থেকে আপনার বইয়ের জন্য অর্ডার আসতে শুরু করেছে।

আপনি অর্ডার মোতাবেক রেলযোগে, লঞ্চযোগে, পোস্টযোগে, রেজিস্ট্রি যোগে, প্লেনযোগে, ট্রাকযোগে বই পাঠাতে শুরু করবেন।

প্রত্যেকটি কাজকে আলাদা আলাদা করে লিখে নিতে হবে আপনাকে। তারপর প্রত্যেকটি কাজকে বৃহত্তর অবজেকটিভ ধরে নিয়ে ভাগ করতে হবে, ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভে। তারপর, কাজটাকে আরো খণ্ড খণ্ড করার জন্যে এক নম্বর ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভকে ধরতে হবে বৃহত্তর অবজেকটিভ রূপে। তারপর সেটিকে ভাগ করতে হবে ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভে, প্রয়োজন মনে করলে সর্বশেষ ক্ষুদ্রতর অবজেটিভগুলোর প্রথমটিকে আবার, প্রত্যেকবার, বৃহত্তর অবজেকটিভ রূপে গণ্য। করতে পারেন। এইভাবে, লেখকের নাম জানার জন্যে রিকশাযোগে বাংলাবাজার যাওয়া, পরিচিত প্রকাশকদের সাথে দেখা করা, তাদের কাছ থেকে লেখক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা, রিকশা বা বাস যোগে গিয়ে লেখকের সাথে দেখা করা, তাকে প্রস্তাব দেয়া, তার সাথে একটা চুক্তিতে পৌঁছানো, পাণ্ডুলিপির জন্য তাগাদা দেয়া, সেটা যথাসম্ভব অল্প সময়ের মধ্যে আদায় করা, পাণ্ডুলিপি পড়া, সংশোধন করার জন্যে লেখকের কাছে ফেরত দেয়া, সংশোধিত পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে আনা, হিসেব করতে বসা, বইটি কতো ফর্মা হবে, কতো সংখ্যক ছাপা হবে, খরচ পড়বে কতো, কতো দাম রাখা চলবে, কাভার ডিজাইন কি রকম হবে, কোন্ শিল্পীকে দিয়ে করাবেন, প্রেসে কাগজ দেবেন কখন, প্রাফ দেখবেন কোন্ সময়, বাইণ্ডিং করবেন। কোথায়, গোডাউনে তুলবেন কবে, সাজিয়ে রাখবেন কিভাবে, অর্ডার অনুযায়ী সাপ্লাই দেবেন কি পদ্ধতিতে-ইত্যাদি আরো হাজারটা কাজকে আপনি বৃহত্তর অবজেকটিভ বলে মনে করতে পারেন, তারপর সেগুলোকে ভাগ করতে পারেন, কয়েক ভাগে, ক্ষুদ্রতর অবজেকটিভে।

সব কাজ একসাথে একবারে করতে যাবেন না। প্রথমে একটা কাজকে ধরুন। ডেস্ক ক্যালেণ্ডারে লিখুন সেই কাজের নাম। নির্দিষ্ট তারিখ এবং সময়ের। মধ্যে শেষ করুন সেই কাজটি। যতোক্ষণ না সেই কাজটি শেষ হচ্ছে ততোক্ষণ। অন্য কাজের কথা ভাববেন না, অন্য কাজে হাত দেবেন না।

কোনো কারণে নির্দিষ্ট কাজটি নির্দিষ্ট তারিখে যদি শেষ করতে না পারেন, কি করবেন? সেটি বাদ দিয়ে অন্য কাজে হাত দেবেন?

না। তা কক্ষনো করবেন না। ডেস্ক ক্যালেণ্ডারে যে কাজটির কথা লেখা আছে। সেটি আপনার বৃহত্তর অবজেকটিভ, যতো ছোটো বা নগণ্যই হোক সেই কাজ। সেটি আগে শেষ করুন। এই নগণ্য কাজটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। আপনাকে। নির্দিষ্ট তারিখে যদি শেষ করতে না পারেন, পরদিন শেষ করার চেষ্টা করুন। কাজটা পরে করবো বলে ফেলে রাখবেন না বা অন্য কাজে হাত দেবেন না। এই কাজটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনার অন্য কাজে হাত দেবার অধিকার নেই। আগে একটি শেষ করুন, তারপর অন্য কাজে হাত দিন। অন্য কাজটিতে যখন হাত দেবেন তখন সেটিই হবে আপনার প্রধান বা বৃহত্তর অবজেকটিভ।

লেখক সম্পর্কে জানতে পরিচিতদের কাছে যাবেন। এটি করবেন মে মাসের বারো তারিখে। ওই তারিখের সবচেয়ে বড় কাজ আপনার ওইটিই-রিকশা বা বাসযোগে কিংবা পায়ে হেঁটে বাংলাবাজারে যাওয়া। এটি আপনার বৃহত্তর অবজেকটিভ মনে করতে হবে। এইভাবে প্রত্যেকটি কাজকে আপনি প্রধান কর্তব্য। বলে মনে করে এগোতে শুরু করুন।

যখন কোনো অবজেকটিভ অর্জন করার চেষ্টা করছেন তখন সেটিকেই। আপনার বৃহত্তর অবজেকটিভ বলে মনে করতে হবে। একটি একটি করে কাজ সমাধা করুন। বিন্দু বিন্দুতে যেমন সিন্ধু হয় তেমনি খণ্ড খণ্ড অবজেকটিভের দ্বারা সম্পন্ন হবে একটি সম্পূর্ণ সৃষ্টি।

অর্জিত ক্ষুদ্রতর কাম্যবস্তুর সমষ্টি বৃহত্তর কাম্যবস্তু। অর্জিত বৃহত্তর কাম্যবস্তুর সমষ্টি-ফলাফল। বই প্রকাশ করা, বাড়ি কেনা, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, এই ধরনের প্রত্যেকটি মৌলিক কাম্যবস্তু আসলে অনেকগুলো বৃহত্তর অবজেকটিভ অর্জনের ফলাফল মাত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *