০৮. শেষজীবন ও মৃত্যু

০৮. শেষজীবন ও মৃত্যু

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ জীবন-যাপনে সুনিয়ন্ত্রিত ছিলেন না। শরীরের প্রতি যথেষ্ট অত্যাচার করতেন স্বেচ্ছায়। একমাত্র কবিতা ছাড়া সব কিছুর প্রতিই তার প্রবল ক্ষোভ। নিজের স্বাস্থ্যরক্ষার প্রতি তিনি মোটেই মনোযোগী ছিলেন না। মদ্যপানের নিয়মিত অভ্যাস ছিল। সিগারেটের প্রতি আসক্তি ছিল প্রবল। খাবারদাবারেও অনিয়ম করতেন। রুদ্রের পাকস্থলিতে আলসার হয়েছিল। পায়ের আঙুলে হয়েছিল বার্জাস ডিজিজ। কিন্তু চিকিৎসার জন্যে কোনো উদ্যোগ নেন নি। তার অসুখ সম্পর্কে চিকিৎসক-স্ত্রী তসলিমা নাসরিন জানিয়েছেন–

রুদ্রের পায়ের আঙুলে একবার বার্জার্স ডিজিজ হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন, পাটাকে আঁচাতে হলে সিগারেট ছাড়তে হবে। পা এবং সিগারেটের যে-কোনো একটাকে বেছে নিতে বলেছিলেন। রুদ্র সিগারেট বেছে নিয়েছিল। জীবন নিয়ে রুদ্র যতই হেলাফেলা করুক, কবিতা নিয়ে করে নি, কবিতায় সে সুস্থ ছিল, নিষ্ঠ ছিল, স্বপ্নময় ছিল। পাকস্থলিতে ক্ষত নিয়েও সে খাওয়ায় অনিয়ম করতো। কোনো অসুখই রুদ্রকে বশে রাখতে পারে নি। রুদ্র উড়েছে, ঘুরেছে, নেশায় মেতেছে। এই বয়সে রক্তচাপ সাধারণত বাড়ে না, রুদ্রের বেড়েছে, তবু সবচেয়ে বিস্ময় এই যে, কোনো রোগই রুদ্রকে রুগ্ন করে নি, রুদ্র সকল অসুস্থতা আড়াল করে অমলিন হেসেছে।(৪১)

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ মৃত্যুর কিছুদিন আগে ‘কাব্যসমগ্র’ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অনেক প্রকাশকের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন, কিন্তু কেউ সাড়া দেন নি। নির্বাচিত কবিতা কিংবা ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’-র সংকলন প্রকাশের আগে ‘কাব্যসমগ্র’ প্রকাশের উদ্যোগ কেন? তাহলে কি রুদ্র টের পেয়েছিলেন যে তার সময় ঘনিয়ে এসেছে!

শেযদিকে রুদ্র গান রচনার দিকে ঝুঁকেছিলেন। নিজের গানে নিজেই সুর দিতেন। সিনেমা বানানোর পরিকল্পনাও করেছিলেন। ১৯৯১ সালের বইমেলা শেষ হওয়ার দিনকয়েক আগে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে একদুপুরে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে বর্তমান লেখকের দেখা হয় নীলক্ষেতের মোড়ে। তিনি মতিঝিলের দিকে যাওয়ার জন্যে রিকসা খুঁজছিলেন। আমি তার কাছে জানতে চাইছিলাম নতুন কোনো বই বের হচ্ছে কিনা। তিনি বলেন, ‘এবারে কোনো আলাদা বই বেরুচ্ছে না। সমগ্র বেরুলে বেরোতে পারে। খুনসুটি সিরিজের কবিতাগুলো লেখা হলে আগামী বছর এই নামে বই করব।’ কথাপ্রসঙ্গে রুদ্র এক অভিনব পরিকল্পনার কথা জানান, ‘জন্মসুত্রে মানুষ কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের পরিচয় বহন করবে, আমি তা মানি না। তাই ভাবছি ‘ইসলাম-ধর্ম’ ত্যাগ করে মানবধর্মে দীক্ষা নেব এবং এ-ব্যাপারে উকিলের সঙ্গে আলাপ করছি।’ এরপর আর তার সঙ্গে এই লেখকের দেখা হয় নি। শুনেছি তার এই বিপ্লবী পরিকল্পনার কথা আরো অনেকের কাছে জানিয়েছেন।

সার্বক্ষণিক অসুস্থতা নিয়েও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে যেতেন। এ-সময়ের ভ্রমণ, অসুস্থতা এবং তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে পুনর্গঠিত অন্তরঙ্গতা সম্পর্কে বিশিষ্ট কথাশিল্পী রশীদ হায়দার জানিয়েছেন–

রুদ্রের সঙ্গে আমার সবচেয়ে আনন্দময় স্মৃতি ঝিকরগাছা ও পাবনায়। গত ডিসেম্বরে আমরা ঝিকরগাছার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ ফোরামে গিয়েছিলাম। আসাদ চৌধুরী, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, তসলিমা নাসরিন ও আমি গেলাম ঢাকা থেকে, যশোর থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলো সমুদ্র গুপ্ত ও জাহিদ হায়দার। তখন সদ্য এরশাদের পতন হয়েছে। গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আবহাওয়াই অন্যরকম। রুদ্র ঝিকরগাছার ও রকম শীতে রাত এগারোটা-বারোটায়ও অনুষ্ঠানে হাজার হাজার লোকের উপস্থিতি দেখে আনন্দ-উত্তেজনায় যেন ফেটে পড়ছিলো। ওকে যারা জানে, তারাই বোঝে তার সে মনোভাব প্রকাশে বাড়াবাড়ি নেই; ‘ঢাকার কবি’ বলে কোনো বাহাদুরি নেই, নিজেকে। জাহির করার কোনো প্রবণতা নেই। রুদ্র যে রাজধানীর নয়, বাংলাদেশের বৃহত্তর খুলনা জেলার মফস্বল এলাকারই মানুষ; মাটি ও মানুষের সঙ্গেই তার নিত্য ওঠানামা সেটা ওর কথা ও আচরণে ছিলো স্পষ্ট। নিঃসন্দেহে এজন্যেই ওর হাত দিয়ে মানুষের মানচিত্র বেরিয়েছে একের পর এক। নাগরিক জীবন ওর জীবন থেকে মাটি ও মানুষকে কেড়ে নেয় নি। ঝিকরগাছায় গিয়ে ওর স্বরূপটা মনে হয় আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।

ঢাকার ফেরার সময় কামারখালি ঘাটে ফেরির কারণে পাকশী-পাবনা হয়ে আমাদের ঢাকায় ফিরতে হয়। পাবনা শহরের উপকণ্ঠে আমাদের পৈত্রিক বাড়ি। সন্ধ্যার পরে বাড়ি গিয়ে ভাত খেয়ে রাত নয়টার দিকে ঢাকায় রওনা দিলাম। সঙ্গে আসাদ চৌধুরী ছিলেন না। সমুদ্র গল্পের রাজা, রুদ্রও কম যায় না, সারা রাস্তা মাতিয়ে রেখেছিলো, পথের ক্লান্তি বুঝতে দেয় নি। আমাদের বাড়িতেই ওকে দেখেছিলাম ভিন্ন চেহারায়। ওর ডানহাতের একটি আঙুলে ঘা হয়েছিলো বলে তসলিমা ওকে মুখে খাবার তুলে দিচ্ছিলো। অসহায় শিশুর মতো খাচ্ছিলো রুদ্র। এই খাওয়া নিয়ে সমুদ্র, জাহিদ ও আমি গাড়িতে ক্ষেপিয়েছি ওকে। ও মজা পেয়েছে।(৪২)

শেষদিকে অর্থাৎ ১৯৯০ সালের শেষ দিকে তসলিমা নাসরিন ও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে মেলামেশা বৃদ্ধি পায়। রুদ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসহাক খান, যিনি রুদ্রের সারা জীবনের অন্যতম সঙ্গী, তার একটি লেখায় রুদ্রের শেষজীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়–

গোটা নব্বই সাল রুদ্র ছিল সর্বত্র বিরাজমান। কবিতায়, গানে, মঞ্চে, আবৃত্তিতে,–এককথায় সবখানে তার সরব উপস্থিতি। সবই চলছিল আগের মতো। কাজ, আচ্ছা, হৈচৈ সবই।–

এর মধ্যে হঠাৎ করেই আবার ছন্দপতন ঘটল কাব্যের। রুদ্রের সাবেক স্ত্রী বড় আনাগোনা শুরু করল আবার। নববই বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে আমি আর রুদ্র মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, হঠাৎ দেখলাম ভিড় ঠেলে রুদ্রের সাবেক স্ত্রী আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে রুদ্রকে বলল, ‘চলো, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। রুদ্র আপত্তি তুলে বলল, এখন যেতে পারব না। আমি অনুষ্ঠান শুনব।’ কিন্তু ওর সাবেক স্ত্রী কোনো কথাই শুনছিল না। একরকম জোর করেই নিয়ে গেল রুদ্রকে। রুদ্র আমাকে বলল, ‘তুই থাকিস কিন্তু। আমি এক্ষুনি এসে পড়ব।’

রুদ্র কিন্তু এক্ষুনি আর আসতে পারে নি। সে-রাতে আমাদের কথা ছিল স্বৈরাচারমুক্ত বিজয় দিবসের উৎসবে আমরা দূরে কোথাও হারিয়ে যাব। অথচ আমার বাউল বন্ধুটির সঙ্গে দেখা হল একসপ্তাহ পর।

বললাম, কিরে কোথায় ডুবে ছিলি?

বলল, ওর (সাবেক স্ত্রী) সঙ্গে ছিলাম।

আমি বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম, পুরো সাতদিনই ওর সঙ্গে কাটালি?

সহজ গলায় বলল, হ্যাঁ, কাটালাম।

–বাসায় আর কেউ ছিল না?

–ওর মা ছিল।

–ওর স্বামী?

বলল, ওর স্বামীর খবর আমি জানি না।

তারপর ক্রমাগত দু’জনকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে দেখা গেল। বন্ধুরা অনেকেই আবার সংশয় প্রকাশ করতে লাগল। অনেকেই আমাকে বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত করেছে। বলেছে, ‘ওরা কি আবার বিয়ে করছে নাকি?’ আমি সোজা বলেছি, আমি কিছু জানি না।

একদিন কবি অসীম সাহার ইত্যাদি প্রেসে বসে আড্ডা দিচ্ছি। আমরা সাত/আটজন সেখানে বসে আছি, রুদ্রও ছিল। হঠাৎ ওর সাবেক স্ত্রী এসে হাজির। এসেই সে রুদ্রকে কোথাও যেতে বলল। রুদ্র যেতে অরাজি। তখনি ওর সাবেক স্ত্রী নাটুকে কায়দায় সবার উদ্দেশে বলল, ‘আপনাদের কবিকে আমি নিয়ে যাচ্ছি, যথাসময়ে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।’ বলেই হাত ধরে টানতে লাগল এবং শেষপর্যন্ত নিয়েই গেল রুদ্রকে।

বিষয়টি আমার ভালো লাগছিল না। রুদ্রকে একদিন বললাম, ‘কিরে, আবার কী ফাউল খেলা শুরু করলি?’ হেসে বলল, ‘অবজারভ করলাম। ভয়ের কোনো কারণ নেই দোস্ত। নেড়ে বেলতলায় একবারই যায়।’

 ‘আমিতো ভাবলাম, তোরা আবার বিয়ে করছিস। বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনে এরকম ঘটেতো। রিচার্ড বার্টন আর এলিজাবেথ টেলর দ্বিতীয়বার বিয়ে করে সাড়া জাগিয়েছিল। তোরাও করে ফেল।’

রুদ্র মাথা নেড়ে বলল, ‘জিনিস আগের মতোই আছে। কোনো উন্নতি হয় নি। ঘর করা সম্ভব নয়।’

কথাটা রুদ্র যেভাবেই বলুক আমি কিন্তু নতুন করে তার মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ করি। আবার সে বেহিসেবি হয়ে ওঠে।

সেই সময় বইমেলা চলছিল বাংলা একাডেমীতে। একসন্ধ্যায় ওকে খুশি খুশি দেখাচ্ছিল। হেসে বললাম, ‘কিরে, মেজাজে বড় রোশনাই, কেসটা কী?’ মুচকি হেসে চোখ ইশারা করল দূরে। দেখলাম একটি শ্যামলা মেয়ে খাবারের স্টলে খাবার পরিবেশন করছে। বলল, ‘প্রেমে পড়েছি দোস্ত।‘ আমি ঠাট্টার সুরে বললাম, ‘প্রেম কি একতরফা?’

হাসতে হাসতে বলল, ‘কৃষ্ণ দিয়েছে ডাক, রাধা কি মুখ ফেরাতে পারে!’

শুরু হল রুদ্রের আর-এক অধ্যায়। ততোদিনে রুদ্রের সাবেক স্ত্রী তৃতীয় বিয়ের আয়োজন শেষ করে ফেলেছে। সেই সময় রুদ্র নতুন প্রেম নিয়ে মশগুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শ্যামলা মেয়েটির সঙ্গে আমাদেরও বহুদিন আড্ডা হয়েছে। কথা হয়েছে। রুদ্রের পরিবারের সদস্যরাও ব্যাপারটি জানত। আমি অনেকদিন বাসায় গিয়েও। ওদের একসঙ্গে আবিষ্কার করেছি। সর্বশেষ রোজার ঈদের তিনদিন আগে আমরা। একসঙ্গে রুদ্রের রান্না করা খিচুড়ি খেয়েছি। কথা ছিল মেয়েটি তার গোপালগঞ্জের বাড়িতে ঈদের ছুটি কাটাতে যাবে। পিতামাতাকে সে বিয়ের কথা জানাবে। ফিরে এসে তারা বিয়ে করবে। দিন ঠিক হয়েছিল। ২৪ এপ্রিল। তাদের প্রথম আলাপ হয়েছিল ২৪ ফেব্রুয়ারি। এই জন্যে ২৪ তারিখটা তারা বিয়ে করবে বলে বেছে নিয়েছিল।

যথাসময়ে মেয়েটি ঢাকা ফিরে এসেছিল। কিন্তু রুদ্রের সঙ্গে সে আর যোগাযোগ করে নি।

আমি রুদ্রকে ঘটনার পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় বড় হতাশ কণ্ঠে ও বলেছিল, ‘হল না দোস্ত, খবর নেগেটিভ।’ আমি হতভম্ব মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার কষ্ট বাড়তে থাকে। কী অন্যায় করেছিল এই যুবকটি, যাকে শুধু ধূপের মতো জ্বলতে হচ্ছে?

ঘটনাটি খুব ছোট। খুবই স্বল্প সময়ের ঘটনা। কিন্তু ঘটনাটি রুদ্রের জীবনে দারুণ প্রভাব ফেলে। সত্যি-সত্যি এই মেয়েটিকে নিয়ে রুদ্র আবার স্বপ্ন তৈরি করেছিল। নিজেকেও প্রস্তুত করছিল সেইভাবে। একদিন বাসায় গিয়ে দেখি রান্নাঘর গোছাচ্ছে। বললাম, কিরে, ‘তুই আবার কী শুরু করেছিস?’ হেসে বলল, ঘর বাঁধছি দোস্ত। নতুন মানুষ আসবে। তাই তার আসার পথ প্রশস্ত করছি।’

অথচ মেয়েটি এল না। এই ছোট্ট ঘটনাটি তার ক্ষতে আবার নতুন করে হেমলক ঢেলে দেয়। আবারও অন্য মানুষ হয়ে যায় সে। বাইরে সে ধীরস্থির থাকলেও ভেতরটা তার পুড়ে অঙ্গার হতে থাকে। এই সময়ই তার শরীরে নানারকম উপসর্গ দেখা দেয়। ভয়াবহ আলসারটি মূলত তখন থেকে।(৪৩)

১৯৯১-র শুরু থেকে রুদ্রের অসুস্থতার মাত্রা বাড়ে। ফেব্রুয়ারিতে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কবিতা পরিষদের এক অনুষ্ঠানে অতিথি-কবি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ও আনিসুল হক। আনিসুল হক পূর্বাভাষ’ পত্রিকার তার নির্ধারিত কলামে রুদ্রের অসুস্থতা সম্পর্কে লেখেন–

ময়মনসিংহ নেমে আমরা হাঁটতে লাগলাম। রেললাইনের পাশ দিয়ে। কিছুটা পথ হেঁটে যাবো। তারপর উঠবো রিক্সায়। পথের মাঝখানে রুদ্র হঠাৎ দাঁড়ালেন। আমাকে বললেন–একটু দাঁড়াও। এইভাবে সামান্য পথ যেতেই দাঁড়াতে হচ্ছিলো রুদ্রকে। একনাগাড়ে বেশিক্ষণ হাঁটতে পারেন না তিনি। দাঁড়াতে হয়। একটা পা কাজ করে না তখন। আমি রুদ্রের মুখের দিকে তাকালাম। চোখে মুখে কষ্টের সামান্য চিহ্ন নেই। কী সাবলীল অভিব্যক্তি! অথচ কী কষ্টকর অসুখ বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি! খুব ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায় একটা পা একটু টেনে টেনে হাঁটছেন তিনি। কোত্থেকে পান রুদ্র এই মানসিক উদ্যম, ভেতরে বিষের বালি, অথচ মুখ বুজে মুক্তো ফলান তিনি। কী উজ্জ্বল তার চোখজোড়া, কী হাসিমাখা মুখ।

দুপুরে গেলাম ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে। ওখানে একটি হোটেল আছে। সেখানে বিরিয়ানি রান্না হয়। শহরের সৌখিন মধ্যবিত্ত আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রায়ই খেতে আসে এখানে। ঐ হোটেলে খেতে বসলাম আমরা। রুদ্রের ডান করতলে সামান্য ক্ষত ছিলো, সেদিনই নাকি ব্যান্ডেজ খুলেছিলেন তিনি। চামচ দিয়ে খেতে লাগলেন। খাবার শেষে বেরিয়ে এসে সিগ্রেট কিনলেন। সিগ্রেটে একটা বড়ো টান দিয়ে ছাড়লেন দীর্ঘতর এক শ্বাস। বললেন, আগে প্রায়ই আসতাম ময়মনসিংহে। এই প্রেসক্লাবের এই হোটলটিতে কতদিন দু’জনে খেয়েছি। তিনি অন্য এক জগতের মধ্যে থেকে যেন বলছিলেন কথাগুলো। সে জগৎ এক সুখের এবং এক অসুখের জগৎ। শুধু দেহে নয়, রুদ্রের মনের মধ্যেও এক মোহন অসুখ বাসা বেঁধেছিলো।

সন্ধ্যায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা পাঠের আসর হলো। রুদ্র পড়লেন, দুটি কবিতা, প্রায় অনুষ্ঠানেই ইদানীং পড়তেন তিনি ঐ কবিতা, ইশতেহার এবং রাস্তার কবিতা।

রাত্রি দশটার দিকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ কবিদের সঙ্গে খাবার খুঁজতে বেরিয়ে পড়া গেলো। কিন্তু রুদ্রকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। এরই মধ্যে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গীতিকার মিলন খানের সঙ্গে কোথায় গেছেন। হয়তো কোনো রুমে বসিয়েছেন আসর আমরা অনেক খুঁজে একটি হোটেলে ভাতের সন্ধান পেলাম। রুদ্রকে খুঁজতে গেলেন একজন। খানিকক্ষণ পর এলেন রুদ্র। ততক্ষণে হোটেলের খাবার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। রুদ্রের জন্যে সামান্য কিছু তরকারি আর ডাল ছিলো। ঠাণ্ডায় জমে হিম হয়ে যাওয়া খাবার। কিন্তু কোথাও চামচ পাওয়া গেলো না। রুদ্রের হাতে অসুখ, তিনি হাত দিয়ে খেতে পারবেন না। শেষে এক বিশাল চামচ, যা দিয়ে হাড়ি থেকে ভাত তোলা হতো, রুদ্রকে দেয়া হলো। ঐটি দিয়ে রুদ্র ভাত খেলেন। খুব বেশি খেতে পারলেন না। শেষে ডালটুকু ঢেলে নিলেন গ্লাসে। একগ্লাস ডাল চুমুক দিয়ে খেলেন।(৪৪)

জীবনের শেষপর্যায়ে তিনি নিয়মিত আসতেন নীলক্ষেত-বাবুপুরায় কবি অসীম সাহার ‘ইত্যাদি’-তে। এ-সময় কবি অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। কোথাও তেমন একটা যেতেন না। এই সময়ের কথা বলতে গিয়ে তসলিমা নাসরিন উল্লেখ করেছেন–

কেউ তাকে সামান্য আশ্রয় দেয় নি। কেবল অসীম সাহা দিয়েছিল, নীলক্ষেতে তার টেবিলের বা-পাশে রুদ্রকে একটি চেয়ার দিয়েছিল বসবার জন্য। রুদ্র সকাল, দুপুর, বিকেল ঐ একটি চেয়ারে নিমগ্ন বসে জীবন পার করতো।(৪৫)

তবে বিকেলে অসীম সাহার প্রেসের আড্ডাটি জমে উঠতো। অসীম সাহা ও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে মাঝে-মাঝে যোগ দিতেন কবি মহাদেব সাহা, কবি নির্মলেন্দু গুণ, সাহিত্যিক আহমদ ছফা, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, চিত্রকর সমর মজুমদার, সঙ্গীতশিল্পী কিরণচন্দ্র রায়, কবি কাজলেন্দু দে, সাহিত্যিক ইসহাক খান, সরকারি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান প্রমুখ। কবি তসলিমা নাসরিনও আসতেন কখনো কখনো। এই আড্ডাতেই রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ ঘটে। অসীম সাহার উদ্যোগে একটি পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। পরিচয়’ নামের সেই পত্রিকার একটি সংখ্যা বেরিয়েছিল প্রস্তুতি সংখ্যা হিসেবে। এ সম্পর্কে রুদ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি রেজা সেলিম জানিয়েছেন–

রুদ্রের শেষ সময়টা কেটেছে একাকী। অসীম’দার প্রেসে ও নিয়মিত একটি আড্ডা শেষের দিকে জমিয়ে তুলেছিল। কিছু করতেও চেয়েছিল। একটি যথার্থ কাগজ তৈরি করা নিয়ে অসীমদার সাথে যে-সব পরিকল্পনা সে গড়ে তুলেছিল তার প্রায় সবটাই আমাকে বলেছিল। আমিও উৎসাহী ছিলাম। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, যেভাবেই হোক, আমি তোমার সাথে থাকবো। থাকা হয় নি। ও যে ভেতরে ভেতরে এতো ধ্বংস হয়ে গেছে, আমরা বুঝতেই পারি নি। শরীর ভালো থাকে না, এটা শুনতাম। শুনেছি পায়ের অসুখ, ভালো করে হাঁটতে পারে না। ডাক্তার সিগেরেট খেতে নিষেধ করেছেন, কমিয়েও দিয়েছিল, বলেছিল একেবারে ছেড়েও দেবে।(৪৬)

এই আড্ডার সঙ্গী থাকতেই রুদ্র একদিন অনুপস্থিত থাকেন। অসুস্থ হয়ে রুদ্র তখন হলিফ্যামিলি হাসপাতালে। কবি অসীম সাহা-ই ঘনিষ্ঠজনদের জানান রুদ্রের অসুস্থতার কথা। হলিফ্যামিলির ২৩১ নম্বর কেবিনে অসুস্থ রুদ্রকে দেখতে যান অনেকেই।

রুদ্র যে-রোগের চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে ভর্তি হন তার নাম পেপটিক আলসার। এটি মারাত্মক কোনো রোগ নয়। সপ্তাহখানেক হাসপাতালে থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ২০ জুন। রুদ্র বাসায় ফেরেন। হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করে মাসিক নান্দনিক পত্রিকায় সাংবাদিক আবু মাসুম লেখেন–

কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত তেমন কোনো পরিচয় ছিলো না। কবি হিসেবেই জানতাম ওকে। ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রতন মাহমুদ জানালো ওর এই কঠিন অসুখ-সংবাদ।

আমি প্রথম যেদিন হলিফ্যামিলিতে ওকে দেখতে যাই, সেদিন অফিস থেকে সরাসরি গিয়েছিলাম। মধ্যদুপুরে। ২৩১ নম্বর কক্ষ খুঁজে পেতে কষ্ট হয় নি।

আমার হাতে রজনীগন্ধার ডাঁটি দেখে রুদ্র’র চোখজোড়া ভীষণ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো। দেখি, পাশে বসে আছেন আহমদ ছফা। রুদ্রর একটা হাত জড়িয়ে রেখেছেন তার হাতে। কথা বলছিল অল্প অল্প, মৃদুস্বরে। আহমদ ছফা বেরুনোর সময় রুদ্রর মাথায় হাত রেখে বললেন–তুমি তো ভালো হয়ে গেছো। আমি আবার আসবো। যাওয়ার সময় আহমদ ছফা একটা ইনভেলাপ রেখে গেলেন রুদ্র’র বালিশের নিচে।

আমি তখন বসলাম রুদ্র’র মাথার কাছে রাখা চেয়ারে। রতন দাঁড়িয়েছিলো রুদ্রর পায়ের কাছে। খুচরো কথাবার্তা বলছিলো ওরা পারিবারিক ঘটনার কিছু সংলাপ আমি বুঝতে পেরেছিলাম। রুদ্রর শরীরে তখনো চলছিলো স্যালাইন।

ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আগের দিন আবার গেলাম হলিফ্যামিলিতে, রুদ্রকে দেখতে। আশ্চর্য সে উঠে বসেছে এবং বেশ ফ্রেস লাগছিলো ওকে আমি মাসিক নান্দনিক-এর সদ্য প্রকাশিত প্রথম সংখ্যাটি বাড়িয়ে দিলাম। উল্টে, পাল্টে দেখে রুদ্র মন্তব্য করলো–বাহ, চমৎকার! বিশেষ করে শিল্পী সুলতানের সাক্ষাৎকারটির কথা বারবার উল্লেখ করলো রুদ্র। তারপর প্রায় দু’ঘন্টা টুকরো-টাকরা কথাবার্তা চললো আমাদের। আমি ওকে একটা ঈদকার্ড বাড়িয়ে দিলাম। কার্ডটা হাতে নিয়ে ম্লান হাসলো রুদ্র। তারপর বললো, ‘আজ ডাক্তার আমাকে সলিড কিছু খেতে দেবে। ওর প্রাণশক্তি যে কত দৃঢ়, বুঝতে পারলাম তখন। কারণ একটানা প্রায় তিনসপ্তাহ ওকে স্যালাইন দেয়া হয়েছে।

তাছাড়া আমার সদ্যপ্রকাশিত একটি কবিতা প্রসঙ্গে রুদ্র মন্তব্য করেছিলো, ‘কবিতার শেষ লাইনটা কেমন জানি ঝুলে গ্যাছে।’ এই অসুস্থ শরীরে ওর প্রখর কাব্যানুভূতিতে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম।(৪৭)

হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও রুদ্র মানসিক শক্তিতে বলীয়ান ছিলেন। হাসপাতালে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ চিকিৎসাধীন ছিলেন ডাক্তার কানিজ মাওলা-র। তাকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতেন ডাক্তার ওহাব, ডাক্তার প্রভাকর পুরকায়স্থ এবং কবিভ্রাতা ডাক্তার মুহম্মদ সাইফুল্লাহ। সুস্থ হয়ে রুদ্র ২০ জুন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন। পরের দিন ২১ জুন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃক্রিয়া সম্পন্ন করে দাঁত ব্রাশ করতে বেসিনে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ তিনি মুখ থুবড়ে বেসিনের উপর পড়ে যান। সিরামিকের বেসিন কবির ভর বইতে পারে না। ভেঙে গড়িয়ে পড়ে মেঝেয়। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। তখন সময় সাড়ে সাতটা। তার ভাই ডাক্তার মুহম্মদ সাইফুল্লাহ জানান, রুদ্র তখন আক্রান্ত। হয়েছিলেন Sudden Cardiac Arest-এ।

মুহূর্তের মধ্যে রুদ্রের মৃত্যুসংবাদ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের প্রতিটি কাগজে ‘ছবিসহ এ-সংবাদ প্রকাশিত হয়। তাঁর বন্ধু কবি কাজল চক্রবর্তীর সৌজন্যে এ-সংবাদ কোলকাতার পত্রপত্রিকায়-ও প্রকাশিত হয়। এসময় কোলকাতায় অবস্থান করছিলেন বাংলাদেশের কবি সমরেশ দেবনাথ। তিনি জানিয়েছেন–

২২ তারিখ বিকেলে আমরা কাজল চক্রবর্তীর বাসায় কথা বলছি। এমন সময় একজন (সম্ভবত কাজলের আত্মীয়) বললেন, আপনাদের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ মারা গেছেন। রাতে মোহন রায়হান ফোন করেছিলেন। কথাটা শুনে আমি অবশ হয়ে পড়ি। আমার ঠোঁট কঁপতে থাকে। কাজল বাসায় ছিলো না, মাসিমার কাছে একটি চিরকুট লিখে চলে আসি। কাজল বাসায় এসেই চলে যায় আমাদের হোটেলে—সাথে ও একটি প্রেসবিজ্ঞপ্তি লিখে নিয়ে যায় পত্রিকায় দেয়ার জন্য। পরদিন আমরা ‘কফি হাউজে’ খবরটি পরিবেশন করলাম এবং পাতিরামের সামনে রুদ্রের মৃত্যুসংবাদটি পোস্টার লিখে টাঙিয়ে দিলাম।(৪৮)

এদেশের প্রতিটি দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বিশেষ প্রতিবেদন, এ-সময় সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’শোক সংবাদ শিরোনামে লেখে–

সত্তর দশকের বিশিষ্ট দ্রোহী ও রোমান্টিক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ২১ জুন সকাল সাড়ে সাতটায় তার পশ্চিম রাজাবাজারস্থ বাসভবনে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে..রাজেউন)। তার বয়স হয়েছিল ৩৪ বছর।

তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল এই কবির মৃত্যুর খবরে রাজধানী ঢাকার লেখক, শিল্পী মহল ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। শেষদেখা ও শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য অনেকে তার বাসভবনে ছুটে যান। বাদ জুমা রুদ্রর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে। জানাজার পর অনেকক্ষণ তার লাশ টিএসসিতে রাখা হয়। আইসিডিডিআরবি’র মরচুয়ারি থেকে ২২ জুন রুদ্র’র লাশ দাফনের জন্য খুলনার মংলায় নিজ গ্রামে নিয়ে যাওয়া হবে।

রুদ্র কতিপয় জটিল ব্যাধিতে ভুগছিলেন। হলিফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসার পর তিনি বাসায় ফিরে গিয়েছিলেন। রুদ্র মা, বাবা, পাঁচ ভাই, তিন বোন রেখে গেছেন।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশালে। তার পৈত্রিক বাস বাগরেহাটের মিঠেখালি গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন।

রুদ্র’র প্রকাশিত কাব্যগন্থ সাতটি। এর মধ্যে রয়েছে উপদ্রুত উপকল, ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম, মানুষের মানচিত্র, মৌলিক মুখোশ, ছোবল ইত্যাদি। রুদ্র কিছু গল্প আর গানও লিখেছেন।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ছিলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্মসম্পাদক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রথম আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ সঙ্গীত পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রকাশনা সচিব। বিগত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে মরহুম রুদ্র সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংস্থা ও সংগঠন তরুণ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর অকালমৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর। সমবেদনা জানিয়েছেন।

বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা, সংগঠনের মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় পঁচদল, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ লেখক শিবির, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী, জাতীয় কবিতা পরিষদ ঢাকা জেলা শাখা, স্বরশ্রুতি, বাংলাদেশ ছড়া সাহিত্য পরিষদ, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, আবৃত্তি সংগঠন ক’জনা, বাংলাদেশ গীতিকবি সংসদ, অরণি-সাংস্কৃতিক সংসদ, বাংলাদেশ সঙ্গীত পরিষদ, জাতীয় কবিতা পরিষদ ঢাকা কলেজ শাখা ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (সা-সা)।(৪৯)

রুদ্রের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেন সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের প্রায় প্রতিটি ব্যক্তি এবং সংগঠন। ২২ জুন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর স্মরণে জাতীয় কবিতা পরিষদ জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এক শোকসভার আয়োজন করে। এই শোকসভার বিস্তৃত বিবরণ জানা যায় ‘অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই’, শীর্ষক এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটি রচনা করেন গল্পকার রিশিত খান। তিনি লিখেছেন–

জাতীয় কবিতা পরিষদ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র স্মরণে ২২ জুন এক শোকসভার আয়োজন করে। প্রেসক্লাবের এ-শোকসভায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সমাবেশ ঘটে। শামসুর রাহমান-এর সভাপতিত্বে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এ-শোকসভার শুরুতে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়।

শোকসভায় স্মৃতিচারণ করেন শওকত ওসমান, ফয়েজ আহমদ, রফিক আজাদ, আহমদ ছফা, সমুদ্র গুপ্ত, আনু মুহাম্মদ, অসীম সাহা, মোহাম্মদ রফিক, হাবিবুল্লাহ সিরাজী, কবির দীর্ঘ সতের বছরের বন্ধু কামাল চৌধুরী, মঈনুল আহসান সাবের প্রমুখ।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র অকালপ্রয়াণ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে শামসুর রাহমান বলেন, বুদ্ধদেব বসু তার একটি লেখায় বলেছেন, মাঝে মাঝে সাহিত্য ভোগ নিয়ে থাকে। তার এই উক্তির উপলক্ষ ছিলো অকালপ্রয়াত, উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতিশীল, অধুনা বিস্মৃত কবি সুকুমার সরকার। বাংলাদেশের কাব্যসাহিত্য প্রায় পনেরো বছর আগে ভোগ নিয়েছিল প্রতিভাবান তরুণ কবি আবুল হাসানকে। তার নামের সঙ্গে এ-বছর যুক্ত আরেকটি নাম, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। আহমদ ছফা শুধু বললেন, আহ আফশোস!

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে স্মরণ করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট একদিনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আগামী ৭ জুলাই অনুষ্ঠেয় জোটের কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে কাওসার চৌধুরী সংগৃহীত কবির জীবনের নানা দিক নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, আবৃত্তি, গণসঙ্গীত পরিবেশনসহ আলোচনাসভা। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র নিজগ্রাম খুলনার মিঠেখালি থেকে কবির প্রতিষ্ঠিত ‘অন্তর বাজাও’ সঙ্গীতদল কবির লেখা গান পরিবেশন করবে। এ উপলক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে কবির ছবিসম্বলিত একটি পোস্টার ও স্মরণিকা।

তাঁর সুহৃদদের হৃদপিণ্ড হতে এক ফোঁটা রক্তক্ষরণের মতো দুঃসহ অনুভবের যন্ত্রণা দিয়ে চলে গেছেন এই আপাদমস্তক কবি মানুষটি, যে-মানুষের অভাব বোধ হবে অনেকদিন। তার আত্মার শান্তি হোক।(৫০)

রুদ্রের মরদেহ তার গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয় ২২ জুন তারিখে। মরদেহের শেষযাত্রার অন্যতম সঙ্গী ছিলেন ইসহাক খান। প্রেসক্লাবের শোকসভার পরিস্থিতি এবং রুদ্রের মিঠেখালি যাত্রার পূর্বপ্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন–

প্রকৃতির অমোঘ নিষ্ঠুর ছোবলে একটি নক্ষত্র খসে পড়লো। ভেঙে গেলো তারার মেলা। সত্তরের রাগী, দ্রোহী, সময়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো। এ বেদনা কোথায় রাখি। এ-বেদনা ভোলার নয়। বন্ধুর লাশ নিয়ে চলেছি। তার বহুল আলোচিত মিঠেখালি গ্রামে। যেখান থেকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিলো, সেই উৎসমূলে তাকে ঘুম পাড়াতে চললাম। প্রাণবান উচ্ছল মানুষটি পরম শান্তিতে শিশুর মতো ঘুমিয়ে আছে। ফুলে ফুলে ঢেকে আছে তার নিথর লাশ। আর আমরা কালের সাক্ষী হয়ে সঙ্গী হয়ে চলেছি ভাটির দেশে, মহুয়ার বনে। যার হাতছানি প্রতিবাদী এই তরুণও উপেক্ষা করতে পারে নি কোনোদিন। আজ তারই কোলে চিরদিনের জন্য মাথা নোয়াতে আসছে, তারই সন্তান। সেদিন কি সুন্দরবনের সুন্দর গাছগুলো আনন্দে কলরব করে উঠেছিলো? না-কি অব্যক্ত বেদনায় হয়েছিলো নীল?

২২ জুন, বিকেল প্রেসক্লাব চত্বরে শত চেনামুখের ভিড়। সবগুলো মুখই তীব্র যন্ত্রণায় বিমর্য, বিধ্বস্ত। আর মাত্র একটু পরেই বন্ধুর শবযাত্রা শুরু হবে। মহাখালী হিমাগার থেকে সময়ের শ্রেষ্ঠকবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লার শেষযাত্রা শুরু হবে। আমার ভেতরে ভেতরে শুধু সেই ভাবনা। তবু প্রেসক্লাবে একটু আসতে ইচ্ছে হলো। রুদ্রের শোকসভায় খানিকটা উপস্থিতি দিয়ে যাই। যখন জেগে ছিলো তখনও তো সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলাম, ঘুমিয়ে থাকার মুহূর্তে সংগে থাকব না, তা কি হয়? তাহলে যে আমার অন্তর-আত্মা আজীবন হাহাকার করবে। বিকেল সাড়ে চারটা। প্রেসক্লাব মিলনায়তনে শোকাহত মানুষের ভীড়। করুণ ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছে সবাই। দেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিকরা এসেছেন তরুণ সম্ভাবনাময় অকালপ্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর স্মরণে শোক জানাতে। আমি যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই শোকবার্তাগুলো কুড়িয়ে পকেটস্থ করছি, বন্ধুর জন্য নিয়ে যেতে। যেন সময়মতো কানে কানে বলে দেব, তুই আছিস, তুই থাকবি, তোর মৃত্যু নেই।

ঘড়ির কাটা পঁচের ঘরে। শোকসভা তখনও শুরু হয় নি। আমাদের যাত্রা শুরু হবে আর একটু পর। বেরিয়ে পড়ব-পড়ব ভাবছি। তরুণ কবি ইস্তেকবাল হোসেন কাছে এসে বললো, ‘এখনই চলে যাবেন? আপনি রুদ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আপনি কিছু বলে যাবেন না?’ আমি জবাবে অপারগতা প্রকাশ করলাম। বললাম, ‘এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারব। নিজেকে ধরে রাখতে পারব না তাহলে।’

পাশ দিয়ে তরুণ কবি, বন্ধু তুষার দাশ যেতে যেতে বললো, ‘কী দেখছি ভাই, যারা একসময় রুদ্রের বিরোধিতা করেছে, আজ মঞ্চে তারাই বেশি ছুটোছুটি করছে।’

বললাম, ‘করুক। যার যে কাজ সে তাই করবে। আমরা আমাদের মতো করব।

‘হ্যাঁ তাই।’ তুষার সমর্থন জানালো।(৫১)

এরপর ইসহাক খান শোকসভা থেকে মহাখালি চলে যান। কিছুক্ষণ পরে সেখানে পৌঁছেন কবি আখতার হুসেন, কবি কামাল খ। সে-সময়ের বর্ণনা পাওয়া যায় কবি কামাল চৌধুরীর একটি তাৎক্ষণিক রচনায়–

পত্রিকার সংবাদ পড়ে ভেবেছিলাম রুদ্রের মরদেহ মিঠেখালিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রেসক্লাবের শোকসভায় এসে ইসহাক-এর কাছে জানতে পারলাম লাশ নিয়ে যাওয়া হয় নি। মহাখালির কলেরা হাসপাতালের ডিপ ফ্রিজে রেখে দেয়া হয়েছে। বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ সেখান থেকে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে নিয়ে যাবে। রুদ্রকে শেষবার দেখার জন্য অসমাপ্ত শোকসভা থেকে কবি আখতার হুসেন, মইনুস সুলতানসহ চলে গেলাম মহাখালীতে। সেখানে তখনও তার আত্মীয়-স্বজন পৌঁছে নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তারকে অনুরোধ করলাম একবার দেখার সুযোগ করে দিতে। তিনি রাজি হলেন না। সাড়ে সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম রুদ্রের আত্মীয়-স্বজনের জন্য। তারা কেউ তখনও আসে নি। আবার অনুরোধ করলাম কয়েকজনকে। এবার সুযোগ মিললো। ডিপ ফ্রিজে মাত্র একটি লাশ। দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ফ্রিজের পাশে আলমারির উপরে জাতীয় কবিতা। পরিষদ-এর পুষ্পস্তবক দেখে নিশ্চিত হলাম। পলিথিন সরিয়ে উন্মুক্ত করা হলো রুদ্রের মুখাবয়ব। সেই পরিচিত মুখ, জীবনের অনেকটা সময় যে ছিলো আমার নিত্যসঙ্গী, মৃত্যুতে একটুও মলিন হয় নি তার ঔজ্জ্বল্য। মনে হলো নৈঃসঙ্গ, বিরহ আর বিচ্ছেদের গভীর ক্ষত অতিক্রম করে এক প্রশান্তির ঘুমে সে শায়িত। আখতার ভাই বললেন, কামাল, আপনি তাকে স্পর্শ করুন। আপনার বন্ধু, স্পর্শ দিয়ে শেষ বিদায় জানান। আমি তার কপাল স্পর্শ করলাম, শীতল কপাল হিম ঘরে শুয়ে আছে প্রাণবন্ত উষ্ণ রুদ্র। তবু মনে হলো আমি তার হৃদয়ের উষ্ণতাকে স্পর্শ করেছি। নিশ্চপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। তার সাথে আমার আর কথা হবে না। তখন সন্ধ্যের পর আমাদের সব কথা বলা হয়ে গেছে–আমাদের সব গল্প, সব কথা, সব স্মৃতি বলা হয়ে গেছে’।(৫২)

এরপর রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ অন্তিমশয়ানে চলে যান তার চিরচেনা, শৈশবের স্মৃতিধন্য মংলার মিঠেখালিতে। সেখানে তাকে সমাহিত করা হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *