০৪. সংসার-জীবন

০৪. সংসার-জীবন

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ২৯/১/১৯৮১ তারিখে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ-বিয়েতে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। স্ত্রীর নাম লীমা নাসরিন। পরবর্তীকালে তসলিমা নাসরিন নামে লেখালেখি করেন। লেখালেখির কারণে তিনি আলোচিত ও জনপ্রিয় হন। একপর্যায়ে বিতর্কিত হয়ে পড়েন। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠলে দেশ ছেড়ে তিনি আত্মনির্বাসিত। তসলিমা নাসরিন ‘নির্বাচিত কলাম’ গ্রন্থের জন্যে পশ্চিমবঙ্গের আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। তার অন্যান্য গ্রন্থ হচ্ছে শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা, অতলে অন্তরীণ, লজ্জা, শোধ, আমার মেয়েবেলা, নির্বাসিত নারীর কবিতা প্রভৃতি। ‘লজ্জা’ উপন্যাসটি সরকার নিষিদ্ধ করেছে। তসলিমার মূল পেশা ছিল চিকিৎসা। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার হিসাবে কাজ করতেন। তাঁর পিতা ডাক্তার রজব আলী, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সার্জন।

রুদ্র ও তসলিমার পরিচয় লেখালেখির সূত্র থেকে। পরিচয় রূপ নেয় প্রেমে। এসময় তাদের সঙ্গী ছিলেন কবি আলমগীর রেজা চৌধুরী। কবি হিসেবে রুদ্র তখন মোটামুটি পরিচিত। নাসরিনও মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস-কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চায় অগ্রণী, ছাত্রছাত্রী সংসদের নির্বাচিত সদস্য (সাহিত্য বিভাগ)। সম্পাদনা করতেন ‘সেঁজুতি’ নামের অনিয়মিত সাহিত্যপত্র। তাদের প্রণয় ও পরিণয় সম্পর্কে রুদ্রের কবি-বন্ধু আলমগীর রেজা চৌধুরী লিখেছেন,

আমার প্রিয় মফস্বল শহর ময়মনসিংহের বাসার দু’গলি পর রুদ্রের প্রেমিকা, পরবর্তীকালে স্ত্রী, তসলিমা নাসরিনের বাসা। তসলিমার বড়ভাই রেজাউল করিম কামাল আমার পরিচিতজন। সেই সূত্রে নাসরিনের সাথে পরিচয়। নাসরিন কবিতা ভালোবাসতো। মেডিকেলশাস্ত্র পড়তো, কাব্যপ্রেম হিসেবে ‘সেঁজুতি’ নামে একটি অনিয়মিত কবিতাপত্র বের করতো। নাসরিন প্রথম রুদ্র-সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়। আমি তার কেমন বন্ধু ইত্যাদি ইত্যাদি।

ঠিকানা দিয়েছিলাম রুদ্রকে লেখার জন্যে। এভাবে নাসরিনের যোগাযোগ। রুদ্রের সঙ্গে নাসরিনের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে আমার বোনের বাসায় ২৮ কালীশংকর গুহ রোডে তার দু’বছর পর ওরা বিয়ে করে প্রচলিত প্রথা ভেঙে একা-একা। সাক্ষী শুধু কবি নির্মলেন্দু গুণ, নাট্যশিল্পী শাহদাত হোসেন হীলু, কবি মাসুদ বিবাগী আর আমি। তারও অনেকদিন পরে ওরা ঘর-ঘর খেলা শুরু করলো রাজারবাগের এক বাসায়। নাসরিন ডাক্তারি পাস করে রুদ্রের ঘরে। আমি জীবিকার কারণে টাঙ্গাইলে। তারপরও ওদের দুজনের সঙ্গে অনেক দিনরাত্রির স্মৃতি আছে, যা মধুর। ওদের বিবাহ উৎসব বড় চমৎকার বেজিং চিনে বেঁস্তোরায়। এদেশের অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক উপস্থিত ছিলেন। আসলে রুদ্র জীবনের জন্যে বর্ণাঢ্যতা পছন্দ করতো।(৯)

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বিয়ে করেছিলেন অভিভাবকের অমতে। তার পিতার সঙ্গে মানসিক দূরত্ব ছিল। এ-অবস্থায় সামাজিক প্রথার বাইরে গিয়ে বিয়ে করায় তার পিতা হয়তো কষ্ট পেয়েছিলেন। তবে ভাইবোনেরা এ-বিয়ে মেনে নিয়েছিল সানন্দে। তাদের বিয়ে হয় ১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারি। রুদ্র তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তসলিমাও পাস করে বেরোন নি। তসলিমার পরিবারও এ-বিয়ে মেনে নিতে পারে নি। ডাক্তারি পাস করার পরে তসলিমা তার পরিবারের বন্ধন ছিঁড়ে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। তারা মোহাম্মদপুরে বাসা নিয়ে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। বিয়ের প্রায় আড়াই বছর পরে রুদ্র সস্ত্রীক বাগেরহাটে গ্রামের বাড়িতে যান। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুদ্রের বাবা তাদেরকে গ্রহণ করেন। ঢাকায় ফিরে রুদ্র তার বাবাকে একটি চিঠি লেখেন। এই চিঠিতে পিতা-পুত্রের আদর্শিক দূরত্বের কথা প্রকাশিত হয়েছে। পিতামাতার মতের বাইরে গিয়ে রুদ্রের এভাবে বিয়ে করার যৌক্তিক ব্যাখ্যাটাও চিঠিতে প্রকাশিত হয়েছে।

১৮.৬.৮৩
মুহম্মদপুর

আব্বা, পথে কোনো অসুবিধে হয় নি। নাসরিনকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গত পরশু ঢাকা ফিরেছি। আপনাদের মতামত এবং কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আমি বিয়ে কোরে বউ নিয়ে বাড়ি যাওয়াতে আপনারা কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আমিতো আমার জীবন এইভাবেই ভেবেছি। আপনার সাথে আমার যে ভুল বোঝাবুঝিগুলো তা কক্ষনোই চ্যালেঞ্জ বা পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব নয়। স্পষ্টতই তা দুটি বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। ব্যক্তি আপনাকে আমি কখনোই ভুল বুঝি নি। আমি জানি না, আমাকে আপনারা কিভাবে বোঝেন।

এ তো চরম সত্য কথা যে, একটি জেনারেশনের সাথে তার পরবর্তী জেনারেশনের অমিল এবং দ্বন্দ্ব থাকবেই। যেমন আপনার আব্বার সাথে ছিলো আপনার। আপনার সাথে আমার এবং পরবর্তীতে আমার সাথে আমার সন্তানের। এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এই সংঘাতকে যুক্তিসংগত কোরতে পারি। অথবা পারি কিছুটা মসৃন কোরতে। সংঘাত রোধ কোরতে পারি না। পারলে ভালো হতো কিনা জানি না তবে মানুষের জীবনের বিকাশ থেমে যেতো পৃথিবীতে।

আমার মনে পড়ে না, আমার এই ছাব্বিশ বছরে–একদিনও আপনি পিতা হিসাবে আপনার সন্তানকে আদোর কোরে কাছে টেনে নেন নি। আশেপাশের অন্য বাবাদের তাদের সন্তানদের জন্যে আদোর দেখে নিজেকে ভাগ্যহীন মনে হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কখনো কষ্ট প্রকাশ করি নি।

ছোটবেলায় আমার খেলতে ভালোলাগতো, খেললে আমি ভালো খেলোয়াড় হতাম। আপনি খেলতে দিতেন না। ভাবতাম, না খেল্লেই বোধহয় খুব ভালো, ভালো মানুষেরা বোধহয় খেলে না। আবার প্রশ্ন জাগত, তাহলে আমার খেলতে ভালো লাগে কেন? আমি কি তবে খারাপ মানুষ! আজ বুঝি, খেলা না-খেলার মধ্যে মানুষের ভালোমন্দ নিহিত নয়–কষ্ট লাগে!

আমিও স্বপ্ন দেখতাম আমি ডাক্তার হবো। আপনার চেয়ে বড় ডাক্তার হয়ে আপনাকে ও নিজেকে গৌরব দেবো। সন্তান বড় হলে পিতারই তো সুখ। আমি সেভাবে তৈরিও হচ্ছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কী যে এক বিরাট পরিবর্তন এলো। একটি দেশ, একটি নোতুন দেশের জন্ম হলো। নোতুন চিন্তার সব কথা হতে লাগলো। নোতুন স্বপ্ন এলো মানুষের মনে। সবাই অন্যরকম ভাবতে শুরু করলো। আমিও আর আমার আগের স্বপ্নকে ধরে রাখতে পারি নি। তারচে’ বেগবান এক স্বপ্ন আমাকে টেনে নিলো। আমি সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করলাম। আগেও একটু-আধটু লিখতাম, এবার পুরোপুরি।

আমি আমার আগের সব চিন্তা-ভাবনার প্রভাব ঝেড়ে ফেলতে লাগলাম নিজের চিন্তা থেকে, জীবন থেকে, বিশ্বাস, আদর্শ থেকে। অনেক কিছুর সঙ্গে সংঘর্ষ লাগতে লাগলো। অনেক কিছুর সাথে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হলো। কখনো ক্ষোভে আমি অপ্রত্যাশিত কিছু করে ফেলতে লাগলাম। আবার আমার বিশ্বাসের সাথে মিল, এমন অনেক মানুষের দেখা পেলাম। তাদের সাথেও সংঘাত হলো। একি, সবার সাথেই সংঘর্ষ হয় কেন? মনে মনে আমি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লাম। তাহলে কি এপথ ভুলপথ? আমি কি ভুলপথে চলেছি? কখনো মনে হয়েছে আমিই ঠিক, এই-ই প্রকৃত পথ। মানুষ যদি নিজেকে ভালোবাসতে পারে তবেই সে সবচে’ সুন্দর হবে। নিজেকে ভালোবাসতে গেলেই সে তার পরিবারকে ভালোবাসবে। আর পরিবারকে ভালোবাসলেই সে একটি গ্রামকে ভালোবাসবে, এক গোষ্ঠীর মানুষকে ভালোবাসবে। আর একটা গ্রাম মানেই তো সারা পৃথিবী। পৃথিবীর সব মানুষ সুন্দর হয়ে বাঁচবে। আমি আমার বিশ্বাসে স্থির হয়েছি।

আমি আমার নিজের কথা সব ক্ষেত্রে বুঝিয়ে বলবো, যতভাবে সম্ভব। না বুঝতে চাইলে বোঝাবো কিন্তু বুঝে না-বোঝার ভান কোরলে তাকে চিহ্নিত করে দেয়া এবং পরমুহূর্ত থেকেই তার সাথে সংঘাতে যাওয়া। কারণ সত্যতো একটা। একটা সত্য। যে-কোনো একটি মুহূর্তের জন্য মাত্র একটিই মুহূর্ত নির্ধারিত। একটি মুহূর্তই সত্য। পৃথিবীতে কতো বড় বড় কাজ করছে মানুষ–একটা ছোট পরিবারকে সুন্দর করা যাবে না! অবশ্যই যাবে। একটু যৌক্তিক হলে, একটু খোলামেলা হলে কতো সমস্যা এমনিতেই মিটে যাবে। সম্পর্ক সহজ হলে, কাজও সহজ হয়। আমরা চাইলেই তা করতে পারি। জানি না, এই চিঠিখানা আপনি ভুল বুঝবেন কিনা।

ঈদের আগে আগে বাড়ি আসবো। আম্মাকে বলবেন যেন বড়মামার কাছ থেকে হাজার চারেক টাকা নিয়ে আমাকে পাঠায়। বাসায় রান্নার কিছুই কেনা হয় নি। বাইরে খাওয়ার খরচ বেশি। এবং অস্বাস্থ্যকর। আম্মার তদারকিতে দেয়া সম্পত্তির এতটকই তো মাত্র রিটার্ন। আপনার সেন্টিমেন্ট থাকা স্বাভাবিক, কারন আপনার শ্বশুরবাড়ি। আমাদের কিসের সেন্টিমেন্ট। শিশু মোংলায় পড়বে। বাবু ইশকুলে। আপনারা না চাইলেও এসব করা হবে। দোয়া করবেন।

শহিদুল্লাহ(১০)

রুদ্র ও তসলিমার দাম্পত্য জীবন বেশ ভালোই কাটছিলো। রুদ্রের উৎসাহ, প্রেরণা ও সহযোগিতায় তসলিমাও লেখালেখির জগতে পুরোমাত্রায় জড়িয়ে পড়েন। কবি হিসেবে তসলিমার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তাও হয়েছিল বেশ। আর এই কবি-খ্যাতির পেছনে রুদ্রের যথেষ্ট অবদানকে তসলিমাও অস্বীকার করেন নি–

রুদ্রকে আমি আমার সতেরো বছর বয়স থেকে চিনি। সেই সতেরো বছর বয়স থেকে রুদ্র আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে ছিল। আমাকে যে-মানুষ অল্প অল্প করে জীবন চিনিয়েছে, জগৎ চিনিয়েছে–সে রুদ্র। আমাকে যে-মানুষ একটি একটি অক্ষর জড় করে কবিতা শিখিয়েছে–সে রুদ্র।(১১)

কিন্তু রুদ্র-তসলিমার সংসারযাপন স্থায়ী হয় নি। ছয় বছরের দাম্পত্য জীবন শেষে তারা আলাদা হয়ে যান। ১৯৮৬ সালে উভয়ের সম্মতিতেই তালাক হয়। তালাক হওয়ার পরে রুদ্রের বিরুদ্ধে তসলিমা নানারকম অভিযোগ করেছেন। একপর্যায়ে গোটা পরুষজাতির বিরুদ্ধেই তাঁর কলম সক্রিয় হয়ে ওঠে। সে-সময়ে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ‘পূর্বাভাস পত্রিকায় একটি চিঠি লেখেন–

আর্ত আবেদন

আশির দশকের তরুণ লিখিয়েদের মধ্যে তসলিমা নাসরিন ইতিমধ্যে তরুণ কবি হিসেবে নিজেকে স্বতন্ত্রভাবেই উপস্থাপিত করতে পেরেছেন। অগভীর ছুঁয়ে যাওয়া হলেও তার ভাষা মেদহীন এবং বেশ জোরালো। মোটেই মেয়েলি গন্ধ নেই।

সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর কলাম-বন্দি রচনাগুলোর ভেতর পুরুষ বিকারগ্রস্ততা লক্ষ করছি। লেখাগুলো ঝগড়াটে মেজাজের।

অগ্রজ লেখক হিসেবে আমার, তার সম্ভাবনার প্রতি একধরনের দুর্বলতা রয়েছে। আমরা সবাই জানি তার দাম্পত্য জীবন সংঘাতময়। তার জন্যে প্রথমত দায়ী রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে আমি মোটামুটি সকল পুরুষদের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রচন্ড ধিক্কার জানাচ্ছি।

আশা করছি, এরপর আপনার ক্ষুরধার লেখনি থেকে পুরুষেরা রেহাই পাঝে আপনি বরং সৃজনশীল লেখার ব্যাপারে সিরিয়াস হন।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ(১২)
ঢাকা।

পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠিতে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেন নি কিংবা তসলিমা নাসরিনের উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগের জবাবও দেন নি। বিয়ে-বিচ্ছেদ রুদ্রকে কষ্ট দিয়েছে। নানাভাবে সে-কথা তিনি বলেছেন। এমনকি এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে চিঠিও লিখেছেন। তাদের এই বিয়ে-বিচ্ছেদ নিয়ে বাজারে নানা মতবাদ চালু থাকলেও রুদ্র এক সাক্ষাৎকারে নিজের মতামত ব্যাখ্যা করেছেন। সাপ্তাহিক ‘পূর্ণিমা’ একবার ‘বিয়ে বিচ্ছেদ’ বিষয়ে একটি প্রচ্ছদকাহিনী প্রকাশ করে। সেখানে রুদ্রের সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক একটি প্রতিবেদনে তরুণ সাংবাদিক শিহাব মাহমুদ লিখেছেন–

সাত-আট বছর আগের কথা। তরুণ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তখন লিখছেন বেশ। এরকম লেখালেখির সূত্রে একবার ময়মনসিংহ যেতে হয় তাকে কবিতা পড়বার জন্যে। ময়মনসিংহে সেই সময় খুবই পরিচিত ছিলেন একটি মেয়ে তসলিমা নাসরিন। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি তখন লিখতেন চিঠি। চিঠিগুলি থাকতো চমকে ভরা, সাহসী কখনো সখনো। রুদ্রর সঙ্গে পরিচয় হলো তসলিমার। পরিচয় থেকে দু’জনের প্রেম। বছর দেড়েক ধরে এই প্রেম চলে, যোগাযোগ থাকতো চিঠিতে। মাঝে-মধ্যে এঁদের দুজনকে একই সঙ্গে দেখা যেত। হয়তো ঢাকায় তসলিমা এসেছেন, কিংবা রুদ্র চলে গেছেন ময়মনসিংহ। দু’জনের এই চুটিয়ে প্রেম করবার দর্শক ছিলেন ঢাকার অসংখ্য লেখক, কবি এবং ময়মনসিংহের তরুণ লেখকরা। দেড় বছর এরকম চলার পর রুদ্র-তসলিমার বিয়ে হয় কোর্টশিপের মাধ্যমে। এরপর দু’জনের আড়াই বছর অপেক্ষা, তারপর দাম্পত্য জীবনের শুরু। পাঁচ বছরের এই দাম্পত্য জীবনও একসময় শেষ হয়ে গেল বিয়ে-বিচ্ছেদের মাধ্যমে। কিন্তু কেন ভাঙলো এই বিয়ে? রুদ্রর নিজের মুখেই শুনুন সেই কথা : ‘যদি এককথায় বলতে হয়, তাহলে বলবো অ্যাডজাস্টামেন্ট না হওয়া। বিয়ের আগে পরস্পরকে কাছ থেকে জানা বা বোঝার অবকাশ আমাদের একেবারেই ছিলো অল্প কারন মেয়েটি থাকতো ময়মনসিংহে এবং আমি ঢাকায়। দুমাস-তিনমাস পর পর আমাদের দেখা হতো। চিঠিই ছিল আমাদের যাবতীয় আশ্রয়। যখন একসাথে থাকা শুরু হলো, তখনি আমি দেখলাম আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তার বিস্তর ব্যবধান। জীবন এবং বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আমার অবস্থান হলো অ্যান্টি-এশটাবলিশমেন্ট। উড়নচন্ডী স্বভাব আমার মজ্জাগত। তাছাড়া জীবনাচরনের ক্ষেত্রে আমি যাবতীয় সংস্কার এবং প্রচলিত নিয়ম-নীতির বিরুদ্ধ শিবিরবাসী।’ রুদ্র এবং তসলিমার মধ্যে এই নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। তবে রুদ্র তার জীবনাচরণ ও বিশ্বাসের কোনো কিছুই তসলিমার কাছে গোপন করেন নি। কিন্তু তসলিমা কি এসব জানতেন না? জানতেন না কি যে রুদ্র তথাকথিত সংসারের শিকলে জড়িয়ে পড়বার নয়?

অথচ রুদ্র ভেবেছিলেন তসলিমার মানসিকতাও তারই মতো। তার নিজের কথায় : ‘মেয়েটির মধ্যে প্রচলিত নিময়-নীতির প্রতি অবজ্ঞা আমি দেখতে পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সে আমারই মতো মানস-গঠনের। কিন্তু বাস্তবের ক্ষেত্রে এসে দেখলাম তার ভেতরে এক গোঁড়া, সংকীর্ন রমনীর বসবাস। এবং সে তার মতো করেই আমাকে গড়ে নিতে চায়। তো সংঘাত অনিবার্য।’ আর এই সংঘাতের পরিণাম হিসেবেই রুদ্র ও তসলিমার বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে যায়। বিয়ে ভেঙে গেলে, রুদ্রের পরিচিতজনরা কেউই সেই ভাঙনকে সহজে মেনে নিতে পারে নি। অধিকাংশই দোষারোপ করেছিলো রুদ্রকেই। আসলে সাধারণ মানুষ বিচ্ছেদের কারণ কখনো খতিয়ে দেখার সুযোগ পায় না বলেই এমন হয়, বললেন রুদ্র। বিচ্ছিন্ন হবার পর একধরনের অভ্যস্ততার কারণে রুদ্রর খুব এলোমেলো লেগেছিলো। কষ্টও পেয়েছেন। কিন্তু এখন তার তেমন খারাপ লাগে না। রুদ্র বললেন, ‘সম্প্রতি মেয়েটির সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। একজন পরিচিতার মতোই মনে হয়েছে তাকে। এর বেশি কিছু নয়।’

বিচ্ছেদ ঘটে গেলেও রুদ্র মেয়েদের ঢালাওভাবে দোষারোপ করতে চান না, যদিও জীবন সম্পর্কে মেয়েদের ধারণা খুবই সংকীর্ণ বলে তার মনে হয়েছে। আসলে রুদ্র চেয়েছিলেন প্রচলিত দাম্পত্য সম্পর্কের পরিবর্তে একধরনের মুক্ত দাম্পত্য সম্পর্ক পালন করতে। কিন্তু তসলিমা শেষপর্যন্ত তা মেনে নিয়ে টিকে থাকতে পারে নি বলে জানালেন রুদ্র।

তবে এই দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য দু’জনেই চেষ্টা করেছিলেন। একটা সন্তান থাকলে সেই সন্তানের কারণে সংসার টিকতে পারে এই ধারণায় একসময় সন্তান চেয়েছিলেন ওঁরা। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় নি।’

রুদ্র বললেন, ‘জানি না কার ত্রুটি! কারন ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয় নি। রুদ্র এখন বিয়ের আগের মতোই যাপন করছেন একধরনের মুক্ত জীবন। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিয়ে করছেন না কেন? উত্তরে রুদ্র বললেন : ‘এখনো এমন কোনো মেয়ের সাথে পরিচয় হয় নি, যার সাথে একত্রে থাকতে পারি।’(১৩)

বিয়ে-বিচ্ছেদ সত্ত্বেও শেষদিকে দু’জনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক আবার প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। রুদ্র সম্পর্কে তসলিমার ভুল ধারণা কিছুটা কমে এলে তারা বিভিন্ন আড্ডায়-আসরে ঘনিষ্ঠ হন। বিশেষত কবি অসীম সাহার ‘ইত্যাদি’-র আড্ডায় তাদের দেখা যেত। রুদ্র যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে, তসলিমা তখন তাকে দেখতেও গিয়েছিলেন। তসলিমা এ-সম্পর্কে লিখেছেন–

অসীমদার কাছে রুদ্রের অসুখের খবর পেয়ে আমি হলিফ্যামিলির দুশ’ একত্রিশ নম্বর কেবিনে রুদ্রকে দেখতে গিয়েছি। অসুখ তেমন কিছু নয়, শতকরা তিরিশজন যে অসুখে ভোগে, পাকস্থলিতে না-খাওয়ার ক্ষত। রুদ্রের খুব নিকটে বসে আমি বলেছি, রুদ্রের চুলে কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে আমি বলেছি–ভেবো না, তুমি শিগরি সেরে উঠবে। শুনে রুদ্র বলেছে,–’কী জানি, এই যাত্রাই শেষ যাত্রা কিনা। আমি হেসেছিলাম।(১৪)

তসলিমার ভুল যখন ভেঙেছে, রুদ্র তখন আর নেই। রুদ্র সম্পর্কে তসলিমার যতই ক্ষোভ–নিন্দা-অপবাদ থাক, মৃত্যুর পরে লেখা ‘রুদ্র ফিরে আসুক’ শীর্ষক লেখা থেকে তসলিমার কলমেই রুদ্রকে চিনে নেয়া যেতে পারে।

আমি এক অমল তরুণী, রুদ্রের উদোম উদগ্র জীবনে এসে স্তম্ভিত দাঁড়িয়েছিলাম। যে কবিকে আমি নিখাদ ভালোবাসি, যে প্রাণবান যুবককে ভালোবেসে আমি সমাজ-সংসার তুচ্ছ করেছি, হৃদয়ের দু’কূল ছাওয়া স্বপ্ন নিয়ে যাকে প্রথম স্পর্শ করেছি–তাকে আমি অনিয়ন্ত্রিত জীবন থেকে শেষ অব্দি ফেরাতে পারি নি। নিরন্তর স্খলন থেকে, স্বেচ্ছাচার থেকে, অবাধ অসুখ থেকে আমি তাকে ফেরাতে পারি নি। তার প্রতি ভালোবাসা যেমন ছিল আমার, প্রচণ্ড ক্ষোভও ছিল তাই। আর রুদ্র সেই মানুষ, সেই প্রখর প্রশস্ত মানুষ, যে একই সঙ্গে আমার আবেগ এবং উম্মা আর ভালোবাসা এবং ঘৃণা ধারণ করবার ক্ষমতা রেখেছে। রুদ্রকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, দূর থেকেও রুদ্র সেই মানুষ, রুদ্রই সেই মানুষ, যে-কোনো দূরত্ব থেকে তাকে ভালোবাসা যায়।

যৌথজীবন আমরা যাপন করতে পারি নি। কিন্তু যত দূরেই থাকি, আমরা পরস্পরের কল্যাণকামী ছিলাম। রুদ্রের সামান্য স্থলন আমি একদিনও মেনে নিই নি, রুদ্রের দু’চারটে অন্যায়ের সঙ্গে আমি আপোষ করি নি–পরে সময়ের স্রোতে ভেসে আরো জীবন ছেনে, জীবন ঘেঁটে আমি দেখেছি, রুদ্র অনেকের চেয়ে অনেক বড় ছিল, বড় ছিল হৃদয়ে, বিশ্বাসে। রুদ্রের ঔদার্য, রুদ্রের প্রাণময়তা, রুদ্রের অকৃত্রিমতার সামনে যে কারুকে দাঁড় করানো যায় না।(১৫)

[এর পরের ২৪নং পৃষ্ঠাটি মিসিং]

…অথচ পূর্ণকালীন লেখক ছিলো সে। ‘পূর্ণকালীন’–কেননা লেখা ছাড়া আর কোনো পেশায় ওকে নিয়োজিত থাকতে দেখি নি। শুনেছি মোংলায় সে চিংড়ির চাষ করেছিলো, শুনেছি মৃত্যুপূর্বের দিনগুলোতে সে ঢাকায় একটি চাকরির সন্ধানে ব্যাপৃত ছিলো। কিন্তু শেষাবধি কোনো কিছুই করা হয় নি তার,–কবিতা ছাড়া, লেখা ছাড়া। রুদ্রর কবি জীবনের জন্য এই বাহ্যিক পেশাহীনতা প্রকারান্তরে সুফলই বয়ে এনেছিলো। এই বয়সের একজন লেখকের কাছে পরিমাণগতভাবে যেটুকু আমাদের স্বাভাবিক প্রত্যাশা, রুদ্র তার চেয়ে বেশিই দিয়েছে। স্বভাবগতভাবে অতিপ্রজ এই কবির কাছে থেকে এই প্রাপ্তি, আমাদের সাহিত্যের জন্য কম-বড় সুসংবাদ নয়।(১৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *