০১. জীবন-কথা

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৯৫৬-১৯৯১) – তপন বাগচী

(জীবনী গ্রন্থমালা)বাংলা একাডেমী ঢাকা
প্রথম প্রকাশ: জ্যৈষ্ঠ ১৪০৫/জুন ১৯৯৮
প্রকাশক সেলিনা হোসেন
পরিচালক
গবেষণা সংকলন ফোকলোর বিভাগ
বাংলা একাডেমী ঢাকা-১০০০

.

প্রসঙ্গ-কথা

বাংলা একাডেমীর জীবনী গ্রন্থমালা প্রকল্পের আওতায় পর্যায়ক্রমে নতুন নতুন জীবনী গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। জীবনী গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের গবেষক ও ইতিহাস-রচয়িতাগণ যে উপকৃত হচ্ছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, গবেষণা ও সাহিত্যের ইতিহাস রচনার জন্যে যেসব প্রামাণ্য উপাদান আবশ্যক, বাংলা একাডেমীর জীবনী গ্রন্থমালা প্রকল্প সেই অভাব পূরণ করছে। ফলে, একাডেমীর এই বিশেষ প্রকল্পটি দেশ-বিদেশের বিদ্বৎসমাজ কর্তৃক অভিনন্দিতও হয়েছে। এই প্রকল্পের গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রতি বছরের মতো এবারও আমরা জীবনী গ্রন্থ প্রণয়নের ও প্রকাশনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। বরণীয় ব্যক্তিত্বের জীবনালেখ্য পাঠককে উপহার দিচ্ছি। দেশের প্রথিতযশা সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিল্পীর জীবন-কথাই প্রধানত আমাদের এই ক্ষুদ্র-পরিসর জীবনী গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত। ভবিষ্যতেও বাংলা একাডেমী এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখবার চেষ্টা করবে। ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে আমাদের সশ্রদ্ধ নিবেদন একাডেমীর এই বিশেষ জীবনী গ্রন্থমালা।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, সত্তর দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। প্রতিশ্রুতিশীল এই কবির কাব্যক্ষমতা পূর্ণ বিকশিত হওয়ার আগেই মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে লোকান্তরিত হন। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ মূলত কবি হলেও কাব্য চর্চার পাশাপাশি সঙ্গীত, নাটক, ছোটগল্প তথা গদ্য চর্চায়ও ছিলেন সমান উৎসাহী। রুদ্র চেয়েছিলেন বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠুক। ফলে ব্যক্তি রুদ্র ও কবি রুদ্রের সমগ্র শিল্প সাধনা ছিল দেশ, মানুষ ও মনুষ্যত্বের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। অকাল প্রয়াত এই কবির জীবন-কথা লিপিবদ্ধ করেছেন শ্রী তপন বাগচী।

এই গ্রন্থ প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত সকল সহকর্মীকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
মহাপরিচালক
বাংলা একাডেমী ঢাকা

.

সূচিপত্র

জীবন-কথা
পরিবার পরিচিতি
শিক্ষাজীবন
সংসার জীবন
কর্মজীবন / সাহিত্যজীবন
সাময়িকপত্র সম্পাদনা
কতিপয় চরিত্র বৈশিষ্ট্য
শেষজীবন ও মৃত্যু
রচনাপঞ্জি পরিচিতি
সমকালীন প্রতিক্রিয়া
জীবন দর্শন ও সাহিত্য বৈশিষ্ট্য
রচনা নিদর্শন  

.

জীবন-কথা

আমাদের মুক্তিযুদ্ধধন্য বাংলাদেশের গোটা সত্তর দশক জুড়েই ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্থান-পতন, ধ্বংস-নির্মাণ, ত্যাগ-প্রাপ্তি এবং প্রত্যাশা-আশাভঙ্গের এক অনিবার্য অস্থিরতা। দেশের এই সংকটময়তার ছায়া পড়ে প্রতিটি শান্তিকামী বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনক্রিয়ায়। উপর্যপুরি রক্তপাত আর পরাজিত শক্তির উত্থানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীসহ সচেতন মহল। এই সময়ের সাহিত্য-পরিস্থিতি সম্পর্কে সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন–

সত্তরের দশকে অসম্ভব উল্লাস আর অসম্ভব হতাশা আশ্চর্য কূটাভাসে জড়িত-মিশ্রিত হয়ে আছে। বন্দী বাংলাদেশের মুক্তি ছিলো উল্লাসের কেন্দ্রে আর হতাশার উৎস রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক আশাভঙ্গ। উল্লাসের একটি ফোয়ারা উচ্ছিত হয়েছে সৃষ্টিশীলতায়–প্রধানত কবিতায়–যে-কবিতা আমাদের আবেগের মুক্তির রাজপথ। তাই এই দশকে আমাদের সব দশকের কবিরাই নবীভূত হয়েছেন আর-একবার, আর-একবার নতুন রক্তে সঞ্জীবিত হয়েছেন। কিন্তু বিশেষ করে এ-দশক সত্তরের নতুন কবিদেরই দখলে। আমি মনে করি না, তারা অসাধারণ কাব্যিক সাফল্য অর্জন করেছেন। কিন্তু এই সময়ের জ্যোৎস্না-রৌদ্র, সময়ের দায়ভাগ, ভালো-মন্দ, মূল্যবোধের দ্রুত পরিবর্তনের সব কটি স্বরগ্রাম বাদিত হয়েছে এঁদেরই কবিতায়।(১)

এই এঁদের মধ্যকার উল্লেখযোগ্য একজন, ‘জাতির পতাকা খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন’ বলে যিনি দেশবাসীকে জাগিয়ে তোলার ব্রত কাঁধে তুলে নেন, তিনিই কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৯৫৬-১৯৯১)।

.

জন্ম ও বংশ পরিচয়

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশাল রেডক্রস হাসপাতালে। রুদ্রের মেজমামির বাপের বাড়ি ছিল বরিশাল রেডক্রস হাসপাতালের সামনে। রুদ্রের মা বরিশালে ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে অবস্থানকালে ঐ হাসপাতালে রুদ্র ভূমিষ্ঠ হন। রুদ্রের মায়ের নাম শিরিয়া বেগম, বাবার নাম শেখ ওয়ালীউল্লাহ। তাদের স্থায়ী নিবাস বাগেরহাট জেলার মংলা থানার অন্তর্গত সাহেবের মেঠ গ্রামে। শেখ ওয়ালীউল্লাহর জন্ম ১৯৩৩ সালের ১৬ নভেম্বর। পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ঢাকা থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে নিজ এলাকায় ফিরে যান এবং মংলা ডক লেবার হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেন। আমৃত্যু তিনি ডক লেবার হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবেই দায়িত্ব পালন করেন। রুদ্রের মা শিরিয়া বেগম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শেষ ধাপ পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। ঘরকন্নায় জড়িয়ে পড়ে আর এগোন নি। রুদ্রের বাবা ছিলেন রুদ্রের মায়ের থেকে নয় বছরের বড়। সেই হিসেবে তার মায়ের বয়স এখন আনুমানিক ৫৫ বছর(২) রুদ্রের মা এখনো জীবিত।

রুদ্রের পিতামহের নাম শেখ মুহম্মদ ইউসুফ। উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি তার পিতা শেখ মঙ্গল হাজীর বিপুল পরিমাণ ভূসম্পত্তির মালিক হন। শেখ মঙ্গল হাজীর পিতা ধোনাই খা এই ভূসম্পত্তির অধিকারী হন দখল-সূত্রে। এ প্রসঙ্গে তরুণ কবি ও গবেষক রহিমা আখতার কল্পনা ‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : কবি-পরিচিতি’ শীর্ষক রচনায় উল্লেখ করেছেন–

আনুমানিক উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়। ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গ, বর্তমান বাংলাদেশ। খুলনা জেলার তৎকালীন বাগেরহাট মহকুমার রামপাল থানার বিশাল এলাকা সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত। সেখানে জঙ্গল কেটে সদ্য বাসযোগ্য করে তুলেও গ্রামটিকে পুরো গ্রাম বলা যায় না। অত্যন্ত সাহসী পরিশ্রমী কিছু মানুষ সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে জায়গাটিকে আবাদ ও বাসের যোগ্য করে তুলেছেন। এসময় যশোর থেকে খুলনার বাগেরহাটে পির খান জাহান আলীর মাজারে প্রায়ই আসতেন তার মুরিদ ধোনাই খা। একসময় তিনি সাহেবের মেঠ-এ বসতি স্থাপন করেন, জঙ্গল কেটে জমি আবাদযোগ্য করতে শুরু করেন এবং প্রথামতো তার প্রস্তুত করা আবাদযোগ্য জমির মালিক হন। ক্রমে তিনি বিশাল এলাকার অধিকারী হয়ে ভূস্বামী বলে পরিচিত হন।(৩)

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। সম্ভান্ত শেখ পরিবার এখনো বাগেরহাট জেলার মধ্যে অত্যন্ত প্রতাপশালী ও প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত। এদের আদি নিবাস যশোর জেলায়। বাগেরহাটের মংলা অঞ্চলে এরাই প্রথম পত্তনী গড়ে। মংলা অঞ্চলের সেই ঝোঁপ-জঙ্গল আর জলাভূমি এখন আগের মতো নেই। দেশের অন্যতম সমুদ্রবন্দর হিসেবে এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক দিয়েও যথেষ্ট উন্নত। বাগেরহাট জেলা-সদর থেকে মংলা থানার দূরত্ব ৫১ কিলোমিটার। মংলা শুধু থানাই নয়, এটি এখন পৌরসভায় উন্নীত। মংলা থেকে ৪/৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লার গ্রামের বাড়ি সাহেবের মেঠ। এটি মিঠেখালি ইউনিয়নের অন্তর্গত। সাহেবের মেঠ একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এই গ্রামে একটি উচ্চবিদ্যালয় এবং তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। রুদ্রর মৃত্যুর পরে ১৯৯২ সালে এলাকাবাসীর উদ্যোগে মিঠেখালি গ্রামে নতুন যে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছে তার নাম রাখা হয়েছে ‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যাপীঠ’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *