৮. পোতাশ্রয়ের উপরে সুউচ্চ টাওয়ারে

পোতাশ্রয়ের উপরে সুউচ্চ টাওয়ারে অবস্থিত মেডিকেল সেন্টারে রুবেনের কলটিং রুম। টেবিল বে’র দিকে মুখ করে বানানো চেম্বার। পরিষ্কার দেখা যায় সাদা ফেনারাশি–দূরের মেঘ।

খুব যত্ন করে সাজানো হয়েছে রুমটি। পিয়ারনিফের আঁকা দুটি সত্যিকারের ছবি, কয়েকটা ভালো কার্পেট। সামারকন্দ আর গোল্ড ওয়াশ করা আবিদা–এমনকি রুবির রিসেপসনিস্টকে দেখে মনে হচ্ছে প্লে-বয় ক্লাবের হোস্টেস। ঝোলানো কান আর লেজ নেই অবশ্য। এটা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে ডা, ফ্রাইডম্যান জীবনের ভালো দিকগুলিকেই পছন্দ করে।

তাদের জন্য প্রস্তুত ছিল রিসেপনিস্ট। কিন্তু তারপরেও চোখ বড় বড় করে তাকানো পরিহার করতে পারল না আর ডেভিডের চেহারার দিকে তাকিয়ে মুখের রক্ত সরে গেল তার। ডা. ফ্রাইডম্যান আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন মি: ও মিসেস মরগ্যান। সরাসরি ভেতরে চলে যান প্লিজ।

পুরোদস্তুর পোশাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে ডেভিডকে। তারপরেও উষ্ণ আর আন্তরিক ভাবে ডেবরার হাত ধরল।

‘ডেভিড কী আমাদের সাথে থাকতে পারবে?’ ছদ্ম ভঙ্গিতে ডেবরার কাছে জানতে চাইল রুবেন।

‘হ্যাঁ, থাকবে।’ উত্তর দিল ডেবরা। এরপর ক্লিনিক্যাল ইতিহাস পড়ে দেখল রুবেন। এরপর গেল এক্সজামিনেশন রুমে। চেয়ার দেখে ডেভিডের মনে হলো এটা ডেন্টিস্টের রুমে থাকে। ডেবরাকে নিজের আরাম মতো শুইয়ে দিল রুবেন। এরপর সরাসরি দু’চোখের পিউটিলে আলো ফেলল।

 ‘সুন্দর সুস্থ, চোখ। অবশেষে মন্তব্য করল রুবেন। আর বেশ সুন্দর, তাই না ডেভিড?’

‘বিধ্বংসী।’ একমত হল ডেভিড। সামনের দিকে তুলে বসানো হল ডেবরাকে তারপর হাতে লাগানো হল ইলেকট্রডস। এরপর সামনের দিকে আনা হল জটিল একটা যন্ত্র। ই-সি-জি। অনুমান করল ডেভিড। মাথা নাড়ল রুবেন।

না-এটা বলতে পারো আমার আবিষ্কার। আমি এটা নিয়ে বেশ গর্বিত। কিন্তু সত্যিকারে যদি বল তাহলে এটা পুরাতন লাই-ডিডেক্টরের আধুনিক সংস্করণ।

প্রশ্ন-উত্তর পর্ব? জানতে চাইল ডেবরা।

না। আমরা তোমার উপর ফ্ল্যাশ লাইট ফেলবো। আর দেখবো অবচেতনে তুমি কীভাবে প্রতিক্রিয়া কর।

‘আমরা এটা জানি। জানাল ডেবরা। কণ্ঠের ধার কান এড়ালো না কারো।

 ‘সম্ভবত। কিন্তু এটা একটা রুটিন চেক-আপ আমাদেরকে করতে হবে। তাকে শান্ত করতে চাইল রুবি। এরপর ডেভিডকে বলল।

 ‘এখানে এসে দাঁড়াও প্লিজ। আলো বেশ কড়া। তাকাতে ভাল লাগবে না তোমার।

পিছনে সরে গেল ডেভিড। মেশিন অ্যাডজাস্ট করল রুবি। মনে হল কোন ধরনের গ্রাফ পেপার ঘোরা শুরু করল। আর প্রায় সাথে সাথে ছন্দের ভঙ্গিতে ওঠা-নামা শুরু করল। অন্য একটা পৃথক কাঁচের পর্দায় সবুজ বিন্দুর মতো আলো একই গতিতে স্পষ্ট হতে লাগল। ধূমকেতুর মতো পুচ্ছ আঁকা হতে লাগল স্ক্রিন জুড়ে। এটা দেখে ডেভিডের মনে পড়ে গেল মিরেজ জেটের ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলে থাকা ইন্টারসেপটার রাভার স্কিন। উপরের আলো বন্ধ করে দিল রুবি। পুরো রুম হয়ে গেল অন্ধকার। শুধু স্কিনে সবুজ বিন্দুগুলো দেখা গেল।

‘আমরা প্রস্তুত আছি ডেবরা? চোখ খোলা রেখে সামনের দিকে তাকাও ডেবরা। প্লিজ।

নিঃশব্দে নীল আলোয় ভরে গেল ঘর। সাথে সাথে সবুজ বিন্দুগুলো দৌড়াদৌড়ি শুরু করল দেখতে পেল ডেভিড। প্রথমে এক দু’বার দৌড়াদৌড়ি করে আবারো আগের মতো একই গতিতে চলতে লাগল। ডেবরা আলো দেখতে পেয়েছে। যদিও সে জানে না ব্যাপারটা। মস্তিস্ক ঠিকই গ্রহণ করেছে। আলোর সংকেত। প্রতিক্রিয়া রেকর্ড করেছে মেশিন।

আরো বিশ মিনিট ধরে উজ্জ্বল আলো নিয়ে খেলা করা হল। রুবি এর ভেতরে বিভিন্ন ভাবে অ্যাডজাস্ট করল ফোকাস। এরপর অবশেষে সন্তুষ্ট হয়ে উপরের আলো জ্বেলে দিল।

‘তো? জানতে চাইল ডেবরা তড়িঘড়ি। আমি পাশি করেছি?’ এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না আমি। জানাল রুবি। তুমি অসাধারণ ব্যবহার দেখিয়েছ, আমরা তো এটাই চেয়েছি।’

‘এখন যেতে পারি আমরা?

 ‘ডেভিড তোমাকে লাঞ্চ করতে নিয়ে যাবে। কিন্তু সন্ধ্যাবেলা রেডিওলজিস্টের কাছে যাবে। আমার রিসেপসনিস্ট ২.৩০ মি. অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে। কিন্তু তারপরেও আবার জেনে নিও তোমরা পরিষ্কার ভাবে।’ রবি জানিয়ে দিল যে তার সাথে এখন কথা বলতে পারবে না ডেভিড।

 ‘আমি এক্স-রের ফলাফল পাওয়া মাত্রই জানাব তোমাদেরকে। এখানে আমি রেডিওলজিস্টের ঠিকানা লিখে দিচ্ছি।’ নিজের প্রেশক্রিপশনের প্যাডে ঠিকানা লিখে ডেভিডের দিকে বাড়িয়ে দিল ডাক্তার।

‘আগামীকাল সকাল দশটায় আমার সাথে দেখা করবে, একা।

মাথা নেড়ে ডেবরার হাত ধরল ডেভিট। এক মিনিটের জন্যে চেষ্টা করল রুবির দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব বুঝতে। কিন্তু শুধুমাত্র কাঁধ ঝাঁকাল ডাক্তার। কমেডিয়ানের মতো অনিশ্চিত ভঙ্গিতে চোখ নাচালো।

.

মাউন্ট নেলসনের সুইটে লাঞ্চে আসল ব্রিগ। কেননা এখন পর্যন্ত পাবলিক প্লেসে সহজ হতে পারে না ডেভিড। ব্রিগ চেষ্টা করল দুজনকে সহজ করতে। তাই ডেবরার ছেলেবেলা আর আমেরিকা ছাড়ার পর প্রথম দিককার কাহিনী বলতে শুরু করল। প্রাণ খুলে হাসল ডেভিড আর ডেবরা।

কৃতজ্ঞ বোধ করল ডেভিড। সময় কেটে গেল দ্রুত। আর তারপর ডেবরাকে কে তাড়া দিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে বলল ব্রিগ।

‘আমি দু’ধরনের কৌশল ব্যবহার করব, মাই ডিয়ার

ডেভিড অবাক হয়ে ভাবতে লাগল যে চল্লিশের উপরে যে কোন পুরুষ ডেবরাকে এমন ভাবে ডাকে যেন সে বারো বছরের খুকী। প্রথমত আমরা পাঁচ রকম ভঙ্গী করব যাকে পুলিশরা বলে, শটস, ফ্রন্ট, ব্যাক, সাইড অ্যান্ড টপ রেডিওলজিস্ট লাল-মুখো, সাদা চুলের এক পুরুষ হাত দুটো বেশ বড়সড় আর কাধ বেশ চওড়া, ব্যায়ামবীরের মতো। আমরা এমনকি তোমার কাপড় খুলতেও বলব না’ বিড়বিড় করল লোকটা। কিন্তু ডেভিডের মনে হল খানিকটা মন খারাপ করল লোকটা। এরপর আমরা খুব দ্রুত তোমার মাথার ভেতরের কয়েকটা ছবি তুলব। এর নাম টমোগ্রাফী। তোমার মাথা স্থির হয়ে থাকবে। ক্যামেরা তোমার চারপাশে ঘুরতে থাকবে। ঠিক যেখানে সমস্যা সেখানেই ফোকাস করবে। তোমার সুন্দর মাথার মাঝে কী ঘটছে তা বের করে আনবো আমরা।’

আমি আশা করব এতে খুব বেশি অবাক হবেন না আপনি, ডাক্তার। বলে উঠল ডেবরা। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল জমে গেল ডাক্তার। তারপর কাজ শুরু করল। দীর্ঘ ক্লান্তিকর হল পুরো ব্যাপারটা। এরপর হোটেলে ফিরে আসার সময় ডেবরা ডেভিডের কাছে ঝুঁকে এলো। বলল, “চলো বাসায় ফিরে যাই ডেভিড। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’

‘ঠিক আছে যত তাড়াতাড়ি পারি।’ একমত হল ডেভিড।

ডেভিড চায় নি ব্যাপারটা এভাবে ঘটুক। তার পরেও জোর করে পরদিন সকালে ব্রিগও এলো তার সাথে ফ্রাইডম্যানের চেম্বারে। ডেবরার সাথে মিথ্যে কথা বলল ডেভিড। যেটা সে সচরাচর করে না। জানাল মরগ্যান ট্রাস্ট অ্যাকাউন্টান্টের সাথে দেখা করতে চলেছে সে। হোটেলের সুইমিং পুলে পাশে লেবু-সবুজ বিকিনি পরে শুয়ে রইল ডেবরা। সূর্যের আলোয় অসম্ভব সুন্দর দেখাল বাদামী, কৃশকায় রঙের দেহ।

রুবি ফ্রাইডম্যান বিজনেসম্যান সুলভ আচরণ করল। নিজের ডেস্কে বসে সোজা চলে এলো মূল আলোচনাতে।

 ‘জেন্টেলম্যান’, শুরু করল ডাক্তার। আমরা একটা সমস্যায় পড়েছি। কঠিন সমস্যা। প্রথমে এক্স-রে প্লেটগুলো দেখাতে চাই–’ রুবি চেয়ার ঘুরিয়ে বুক লাইট জ্বালিয়ে প্রিন্টগুলো স্পষ্ট করে তুলল। এই পাশের প্লেটগুলো আমাকে জেরুজালেম থেকে ইদেলমান পাঠিয়েছে। এখানে গ্রেনেড ফ্লাগমেন্ট দেখা যাচ্ছে। বেশ শক্ত একটা অংশ। হাড়ের মাঝে ছোট ত্রিকোণাকৃতির একটা বস্তু। এখানে অপটিক চিয়াসমার গতিপথ। হাড়ের মাঝে যেখানে বাধা পেয়েছে তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ইদেলম্যানের সত্যিকারের প্রাথমিক পরীক্ষা-~ এ প্লেটগুলোর উপর নির্ভর করে যেগুলো তৈরি, সেটা ছিল আলো ও আকার বুঝতে না পারাটা। এটাই চিরস্থায়ী ধরে নেয়া হয়েছিল। অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানেই সব কিছু শেষ ধরে নেয়া হয়েছে। দ্রুত প্লেটগুলো খুলে ফেলল ডাক্তার। অন্যগুলো স্ক্যানারে লাগিয়ে নিল। ঠিক আছে। এখন দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় এক্স-প্লেটগুলো। গতকাল ভোলা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে গ্রেনেডের অংশটা কীভাবে সংকুচিত হয়ে গেছে।’ তিক্ষ্ণ দাগটুকু মসৃণ হয়ে গেছে চারপাশে নতুন করে হাড় তৈরি হওয়ায়। এটা বেশ ভালো। এরকমটাই আশা করা হয়ে ছিল। এখানে চিয়াশমার চ্যানেল হাড়ের নতুন করে বৃদ্ধি যে কোন ভয় ডেকে আনতে পারে। স্ক্যানারে নতুন এক সেট প্লেট লাগিয়ে নিল ডাক্তার। অবশেষে এখানে দেখা যাচ্ছে টমোগ্রাফীর মাধ্যমে পাওয়া ছবি। এখানে চিয়াশমা চ্যানেলের গতিপথ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, শুধু ছোট্ট একটা অর্ধ গোলাকার অংশে স্পর্শ করল ডাক্তার এই ছোট্ট দাগটা খুলির প্রধান কেন্দ্রে চলে গেছে। মনে হচ্ছে বেঁকে গেছে ইউ। হতে পারে আমাদের পুরো পরীক্ষার প্রধান আবিষ্কার এটিই।’ স্ক্যানারে লাইট বন্ধ করে দিল রুবি।

 ‘আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারিনি।’ তিক্ষ কণ্ঠে বলে উঠল ব্রিগ। অন্য কোন পুরুষের বিশেষ জ্ঞান দক্ষতার কাছে নতি স্বীকার করতে নারাজ সে।

না, অবশ্যই। নরম হল রুবি।

‘আমি শুধুমাত্র আলোচনার ক্ষেত প্রস্তুত করলাম। আবারো ডেস্কে তাকাল। বদলে গেল ব্যবহার। এখন আর লেকচার দিচ্ছে না। এখানেই সে-ই যে প্রভু তা বোঝা গেল স্পষ্ট।

‘এখন আমার উপসংহার বলি। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে অপটিক নার্ভের কিছু অংশের সক্রিয়তা নষ্ট হয়নি। এখনো মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাতে সক্ষম। অন্তত কিছু অংশ এখনো অক্ষত। প্রশ্ন হচ্ছে কতটুকু। অথবা কতটুকু উন্নতি করা যাবে। হতে পারে নার্ভের মাঝে কেটে ফেলেছে গ্রেনেড—ছয়টা দড়ির পাঁচটিই ক্ষতি করেছে অথবা চারটা কী তিনটা। আমরা জানি না কতটা। আমরা শুধু জানি যে এই ধরনের আঘাত প্রতিহত করা কঠিন। এর থেকে বেঁচে থাকবে এখন যতটুকু আছে প্রায় কিছুই না।

.

থেমে গিয়ে একেবারে চুপ হয়ে গেল রুবি। অপর পাশে বসে থাকা পুরুষ দু’জন মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে রইল। নিজের আসন ছেড়ে সামনে ঝুঁকে বসে আছে দু’জনেই।

‘এটা হচ্ছে অন্ধকার দিক–যদি এটা সত্যি হয় ডেবরা তাহলে ব্যবহারিক অর্থে বলা যায় অন্ধই থাকবে। কিন্তু এ প্রশ্নের আরো একটি দিক আছে। এটাও হতে পারে যে অপটিক নার্ভ আদতে কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। প্লিজ গড়

 ‘তাহলে ও দেখতে পায় না কেন? রেগে গিয়ে প্রশ্ন করল ডেভিড। অনেক আগেই উন্মা জমেছে তার মনে। একসাথে দুরকম কথা তো বলা যায় না।

ডেভিডের দিকে তাকাল রুবি। প্রথমবারের মতো ক্ষত-বিক্ষত বিভৎস মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যথা উপলব্ধি করল। গাছ চোখে রাইফেলের স্টিলের মতো নীল বেদনা।

‘আমাকে ক্ষমা করো, ডেভিড। আমি পুরো ব্যাপারটাকে আমার মতো করে অ্যাকাডেমিক ওয়েতে চিন্তা করেছি। তোমার মতো ভাবিনি। আমি এখন চেষ্টা করব সোজা ভাবে বলতে। নিজের চেয়ারে হেলান দিল ডাক্তার। বলতে শুরু করল, “নিশ্চয়ই মনে আছে চিয়াশমাতে থাকা দাগের কথা। আমার মনে হয় এটা নার্ভ নিজে। জায়গা থেকে সরে গেছে। ধাতব বস্তুর কারণে চাপ পড়ায় মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাতে পারছে না।

‘মাথায় আঘাত?’ জিজ্ঞেস করল ডেভিড।

‘হা। মাথায় আঘাতের ফলে হাড়ের জায়গা থেকে সরে গেছে সেটা। তাই আবারো মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাবার মতো জায়গা পেয়েছে। যেমনটা হয় হোস পাইপের বেলায়। পাইপের উপর কিছু রেখে দিলে পানির প্রবাহ বাধা পায়। তারপর বাধা সরিয়ে নিলে আবারো নিয়মিত হয়।

সবাই চুপ করে গেল। প্রত্যেকে নিজের মাঝে ওজন করে দেখতে চাইলো শোনা কথাগুলো।

‘চোখ জোড়া? অবশেষে জিজ্ঞেস করল ব্রিগ। সুস্থ আছে?

‘একদম। মাথা নাড়ল রুবি।

কীভাবে বুঝবেন আপনি–মানে আমি বলতে চাইছি পরবর্তীতে কোন পদক্ষেপ নিতে চান আপনি? আস্তে করে জিজ্ঞেস করল ডেভিড।

‘একটাই পথ আছে কেবল। আমাদেরকে ট্রমার জায়গায় যেতে হবে।’

 ‘অপারেশন?’ আবারো জানতে চাইল ডেভিড।

‘হ্যাঁ।

 ‘ডেবরার মাথা উন্মুক্ত করে ফেলবেন?’ চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখা দিল

হ্যাঁ। আবারো মাথা নাড়ল রুবি।

 ‘ওর মাথা নিষ্ঠুর ছুরির কথা স্মরণ করল নিজের মাংসের উপর। মনের পর্দায় দেখতে পেল সুন্দর মুখটা কাটা-ছেঁড়া করা হচ্ছে। অন্ধ চোখ দুটোতে ব্যথা। ওর চেহারা’ কাঁপতে লাগল ডেভিডের গলা। না, ওকে কাটতে দেব না আমি। আমি.ধ্বংস করতে দেব না, যেভাবে আমার সাথে করেছে ওরা।’

 ‘ডেভিড! বরফ ভাঙার মতো কড়মড় করে বলে উঠল ব্রিগ। নিজের চেয়ারে হেলান দিল ডেভিড।

‘আমি বুঝতে পারছি তোমার কেমন লাগছে। নম্র ভাবে কথা বলে উঠল রুবি। ব্রিগের একেবারে উল্টো। আমরা চুলের পেছন থেকে এগোব। কোন কিছুই বোঝা যাবে না। চুল উঠে গেলে দাগ ঢেকে যাবে। কাঁটতেও হবে না বেশি।

 ‘আমি ওকে আর কষ্ট দিতে চাই না। নিজের গলার স্বর নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল ডেভিড। কিন্তু তেমন পারল বলে মনে হল না। ও এমনিতেই অনেক আঘাত সহ্য করেছে

‘আমরা ওকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে চাইছি।’ আবারো কথা বলে উঠল ব্রিগ। ভারী আর ঠাণ্ডা তার স্বর। একটুখানি ব্যথা দিয়েও বড় মূল্য পাবে এখানে।

 ব্যথা তেমন হবেই না, ডেভিড।’ আবারো চুপ হয়ে গেল তারা। দু’জন বৃদ্ধ পুরুষ তাকিয়ে রইল কম বয়সী ডেভিডের দিকে।

‘সম্ভাবনা কতটুকু? সাহায্যের আশায় তাকাল ডেভিড। চাইছে তার হয়ে সিদ্ধান্ত অনন্যরা নিয়ে নিক। চাইছে তার কাছ থেকে সরে যাক ব্যাপারটা।

‘এটা বলা কঠিন। মাথা নাড়ল রুবি।

‘ওহ গড, আমি যদি খারাপ দিকগুলো নাই জানি, তাহলে বিচার করব কীভাবে?’ চিৎকার করে উঠল ডেভিড।

ঠিক আছে। যেমন ধর–এখানে সম্ভাবনা আছে, নিশ্চয়তা নয় যে, সে তার দৃষ্টিশক্তি ব্যবহার করার মতো করে ফিরে পাবে।’ নিজের কথা শেষ করল রুবি। আর এ সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ যে দৃষ্টিশক্তির পুরোটা সে ফিরে পাবে।’

‘খুব বেশি হলে এটুকু হবে।’ একমত হল ডেভিড। আর যদি না হয়?

হতে পারে কোন পরিবর্তনই হবে না। একটুখানি ব্যথা পাবে। আর কিছু না।

নিজের চেয়ার থেকে প্রায় লাফ দিয়ে উঠল ডেভিড। এগিয়ে গেল জানালার কাছে। তাকিয়ে রইল উপসাগরের দিকে। যেখানে নোঙ্গড় করে আছে বিশাল সব ট্যাঙ্কার। আর তারও পরে নীল আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে টাইগারবার্গের পাহাড়।

তুমি জানো কোন পথ বেছে নিতে হবে, ডেভিড।’ নির্দয় হয়ে উঠল ব্রিগ। কোন পথ দিল না ডেভিডকে, বাধ্য করল ভাগ্য বরণ করে নিতে।

 ‘ঠিক আছে।’ আত্মসমর্পণ করল ডেভিড। ফিরে তাকাল। কিন্তু এক শর্তে। এর উপরেই জোর দিব আমি। ডেবরাকে জানান হবে না যে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার সম্ভাবনা আছে।

রুবি ফ্রাইডম্যান মাথা ঝাঁকালো। ওকে বলতেই হবে।

ভয়ঙ্করভাবে নড়ে উঠল ব্রিগের গোঁফ জোড়া। কেন নয়? কেন ওকে জানতে দিতে চাও না তুমি?

আপনি জানেন কেন। না তাকিয়ে উত্তর দিল ডেভিড।

কীভাবে আনবে তাকে তুমি যদি তাকে নাই বলো? জানতে চাইল রুবি।

 ‘ওর মাথা ব্যথা হয়–আমরা বলব যে কোন একটা যে আপনি কোন একটা কিছু খুঁজে পেয়েছেন–যেটা সরিয়ে ফেলতে হবে। এটাই তো সত্যি তাই না?

না। মাথা নাড়ল রুবি। আমি তাকে এটা বলতে পারব না। ওর সাথে ভণিতা করতে পারব না আমি।’

‘তাহলে আমি বলব।’ বলে উঠল ডেভিড। এখন বেশ দৃঢ় শোনাল তার কণ্ঠস্বর। যখন অপারেশনের পর ফলাফল পাওয়া যাবে তখন তাকে সব খুলে বলব আমি। ভাল অথবা মন্দ যাই হোক না কেন। আমিই ওকে জানাবো ঠিক আছে? এ ব্যাপারে একমত সবাই?

একটু পরে বাকি দুজন মাথা নাড়ল। বিড়বিড় করে মেনে নিল ডেভিডের শর্ত।

.

হোটেলের শেফের কাছ থেকে পিকনিক বাস্কেট তৈরি করিয়ে নিল ডেভিড। আর সার্ভিস বার থেকে দুই বোতল ঠাণ্ডা শ্যাম্পেন নিল।

ইচ্ছে হল আকাশে উড়ে বেড়াতে আবার একই সাথে এ কথাও মনে রাখল যে ডেবরাকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাই বারবার নিজের মনকে বোঝাতে বাধ্য হল যে এখন ডেবরার সাথে উড়ে বেড়ানোর সময় নয়। এর বদলে টেবল পর্বতের উপর কেবল ওয়েতে চড়লো দু’জনে। একদম উপরের স্টেশন থেকে মালভূমিতে যাবার পথ পেয়ে গেল। হাতে হাত রেখে চুড়ার কিনারে গিয়ে শহরের অনেক উপরে পাশাপাশি বসল দু’জনে। নিচে অসীম সমুদ্র।

দুই হাজার ফুট পার হয়েও শহরের শব্দ ঠিকই পৌঁছালো তাদের কাছে। বয়ে নিয়ে এলো বাতাস। বিভিন্ন ধরনের শব্দ। অটোমোবাইলের শব্দ, ট্রেন লাইনের উপর লোকোমোটিভ, মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি, শ্রেণীকক্ষে ছেলে মেয়েদের চিৎকার–এ সমস্ত শব্দ সত্ত্বেও মনে হলো তারা বড় একা। শহরের দূষিত বাতাসের চেয়ে ঠাণ্ডা মনে হল দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আসা মিষ্টি বাতাস।

একসাথে ওয়াইন খেল দু’জনে। কাছাকাছি বসে সাহস সঞ্চয় করল ডেভিড। কথা বলতে যাবে এমন সময় তাকে থামিয়ে দিল ডেবরা।

 ‘এভাবেই বেঁচে থাকা আর ভালোবাসাই ভালো, মাই ডার্লিং।’ বলে উঠল ডেবরা। আমরা অনেক ভাগ্যবান। তুমি এটা জানো ডেভিড?

একমত হবার মতো একটা শব্দ বের হতে চাইল গলা দিয়ে। কিন্তু পারল না।

‘যদি তুমি পারো, তাহলে পরিবর্তন করতে চাও কিছু? অবশেষে জিজ্ঞেস করল ডেভিড। হাসল ডেবরা।

 ‘ওহ্, নিশ্চয়ই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কেউ কী পুরোপুরি তৃপ্ত হয়? আমি ছোট ছোট অনেক জিনিস বদলে দেব–কিন্তু বড় কিছু নয়। তুমি আর আমি।

‘কী পরিবর্তন চাও?’

 ‘আমি, আরো ভালো করে লিখতে চাই।’

চুপচাপ ওয়াইনে চুমুক দিল দু’জনে।

সূর্য দ্রুত অস্ত যাচ্ছে। ডেভিড জানাল ডেবরাকে।

বলো।’ জানতে চাইল ডেবরা। সূর্যাস্তের রং বর্ণনা করার জন্য শব্দ খুজতে লাগল ডেভিড। মেঘের উপরের রং, সমুদ্রে রক্ত আর সোনার মতো রঙের মিশেলে তৈরি উজ্জ্বলতা জানে কখনো বলতে পারবে না। একটা বাক্যের মাঝেই থেমে গেল ডেভিড। বুঝিয়ে বলতে পারল না।

 ‘আমি রুবি ফ্রাইডম্যানের সাথে দেখা করেছি সকালবেলা। তাড়াহুড়া করে বলে উঠল ডেভিড। এর চেয়ে ভালো আর কোন পথ মাথায় এলো না। স্বভাবসুলভ নীরবতার ভঙ্গীতে চুপচাপ বসে রইল ডেবরা। মনে হল যেন শিকারির ভয়ে জমে গিয়ে স্থির হয়ে আছে কোন ছোট্ট বন্যপশু।

‘খারাপ হয়েছে ব্যাপারটা। অবশেষে বলে উঠল ডেবরা।

‘কেন?’ তাড়াতাড়ি জানতে চাইল ডেভিড।

কারণ এ কথা বলতে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে আর তুমি অনেক ভয় পাচ্ছ।

না। ব্যাপারটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল ডেভিড।

হ্যাঁ। আমি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছি। তুমি আমার জন্যে ভয় পাচ্ছ।’ ‘এটা সত্যি না।’ ডেভিড চাইল মেয়েটাকে আশ্বস্ত করতে। আমি একটু চিন্তিত এই-ই।

বলো আমাকে সবকিছু। জোর দিল ডেবরা।

‘ছোট্ট একটা জিনিস বেড়ে গেছে। এটা তেমন ক্ষতিকর কিছু না–এখন পর্যন্ত। কিন্তু তারা ভাবছে যে এ ব্যাপারে কিছু করা দরকার।’ সাবধানে পরিকল্পনা মতো ব্যাখ্যা করল ডেভিড। শেষ করার পর এক মুহূর্ত চুপ করে রইল ডেবরা।

‘এটা দরকারী, বেশি দরকারী?

 জানতে চাইলে ডেভিডের কাছে।

‘হা। জানালো ডেভিড, মাথা নাড়লো, বিশ্বাস করল ডেভিডের কথা। হেসে, হাত ধরে রাখল।

‘ভয় পেয়ো না ডেভিড, মাই ডার্লিং। ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। দেখবে আমাদের কিছু হবে না। আমরা এমন একটা জায়গায় থাকি যে ওরা আমাদের কিছু করতে পারবে না। এবার ডেবরা চাইছে ডেভিডকে শান্ত করতে।

‘অবশ্যই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। নিজের কাছে ডেবরাকে টেনে নিল ডেভিড। গ্লাস উপচে পড়ে গেল এক ফোঁটা ওয়াইন।

কখন?’ প্রশ্ন করল ডেবরা।

‘আগামীকাল যাবে তুমি। তার পরদিন সকালবেলা অপারেশন হবে।’

‘এত তাড়াতাড়ি?

‘আমার মনে হচ্ছে তাড়াতাড়ি হওয়াই ভালো।

 ‘হ্যাঁ। ঠিক বলেছো।’

ওয়াইনে চুমুক দিল ডেবরা। মনে হল সাহসী হওয়া সত্ত্বেও খানিকটা ভয় পেয়েছে।

‘ওরা আমার মাথা কেটে ফেলবে?”

 ‘হ্যাঁ। জানালো ডেভিড। কাঁধ ঝাঁকালো ডেবরা।

 ‘কোন রিস্ক নেই, ডিয়ার। আবারো আশ্বস্ত করতে চাইলো ডেভিড।

না। আমি নিশ্চিত এ ব্যাপারে। তাড়াতাড়ি একমত হয়ে গেল ডেবরা।

***

মাঝরাতে ঘুম ভেঙেই মনে হল ডেবরা পাশে নেই, ও একা শুয়ে আছে।

তাড়াতাড়ি উঠে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গেল ডেভিড। খালি। এরপর দ্রুত গিয়ে সিটিংরুমের আলো জ্বালালো ডেভিড।

 সুইচের ক্লিক শব্দ শুনতে পেল ডেবরা। মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। কিন্তু গালের উপর মসৃণ মুক্তোদানার মতো অশ্রুবিন্দু দেখতে পেল ডেভিড। তাড়াতাড়ি ডেবরার কাছে এগিয়ে গেল।

‘ডার্লিং’, ডেকে উঠল ডেভিড।

 ‘আমি ঘুমাতে পারছিলাম না। জানাল ডেবরা।

“ঠিক আছে।’ ডেবরার কাউচের সামনে হাঁটু মুড়ে বসল ডেভিড। কিন্তু ডেবরাকে স্পর্শ করল না।

‘আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি।’

বলে উঠল ডেবরা। ‘স্বচ্ছ পানির একটা পুল, তাতে সাঁতার কাটছে তুমি। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নাম ধরে ডাকছে। আমি তোমার সুন্দর মুখটা পরিষ্কারভাবে দেখেছি, হাসছ–

 ডেভিড বুঝতে পারল প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে সে নিজের মাঝে। কেননা পূর্বের ডেভিডকে স্বপ্নে দেখেছে ডেবরা, সুদর্শন ডেভিডকে। এখনকার কুৎসিত বিভৎস ডেভিডকে নয়। এরপর হঠাৎ করে ডুবে যেতে শুরু করেছ তুমি। নিচেঅনেক নিচে গলা ধরে এলো ডেবরার। এক মুহূর্ত চুপ করে রইল।

 ‘এটা ভয়ঙ্কর একটা স্বপ্ন। আমি চিৎকার করে কেঁদে তোমার কাছে যেতে চাইছি, কিন্তু নড়তে পারছিলাম না। আর তুমি ধীরে ধীরে গভীরে তলিয়ে গেছ। পানি হয়ে গেছে গাঢ় আর আমি জেগে উঠেছি মাথার মাঝে শূন্যতা আর অন্ধকার নিয়ে। কিছুই না, শুধু অন্ধকার আর কুয়াশা।

 ‘এটা শুধু একটা স্বপ্ন, আর কিছু না ডিয়ার ডেভিড বলে উঠল।

‘ডেভিড’, ফিসফিস করে উঠল ডেবরা। আগামীকাল যদি আগামীকাল কিছু হয়—

 ‘কিছু হবে না। প্রায় উঠে পড়তে যাচ্ছিল ডেভিড। কিন্তু হাত বাড়িয়ে ডেভিডের মুখে হাত রাখল ডেবরা। ঠোঁট খুঁজে পেয়ে হালকাভাবে স্পর্শ করল।

‘যাই ঘটুক না কেন, বলে উঠল ডেবরা, আমাদের আনন্দের দিনগুলো স্মরণ করবে। মনে রাখবে আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম।

.

গ্রুট শূর হাসপাতাল ডেভিলস পীকের নিচের দিকে অবস্থিত। এর চূড়া ধূসর রঙের পাথরে তৈরি। নিচে ঘন পাইনের বন আর খোলা এস্টেট। যেটা সিসিল জন রোডস্ জাতিকে দিয়ে গেছেন। খোলা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণ আর দেশীয় অ্যান্টিলোপের দল। দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে উড়ে আসা মেঘ ঢেকে রাখে পালকের মতো এ অঞ্চলকে।

 উজ্জ্বল সাদা রঙের দালান দিয়ে তৈরি বিশাল কমপ্লেক্স এই হাসপাতাল। চার্জে থাকা সিস্টার অপেক্ষা করছিল ডেবরার জন্য। ডেভিডের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হল ডেবরাকে। একা দাঁড়িয়ে রইল ডেভিড। কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় যখন ডেবরার সাথে দেখা করতে এলো ডেভিড, তখন বিছানার উপর নরম কাশ্মিরি জ্যাকেট পরে বসে ছিল ডেবরা। পুরো রুম ফুল দিয়ে ভর্তি করে ফেলল ডেভিড। ডেবরার হাতেও ধরিয়ে দিল একগুচ্ছ।

 ‘বেশ সুন্দর গন্ধ। ধন্যবাদ জানাল ডেবরা। মনে হচ্ছে বাগানে বসে আছি।’

মাথায় পাগড়ির মতো একটা কাপড় জড়িয়ে রেখেছে ডেবরা। শান্ত সোনালি চোখ জোড়া যেন বহুদূরের কিছু দেখছে তন্ময় হয়ে। রহস্যময়ীর মতো দেখাল মেয়েটাকে।

 ‘ওরা তোমার চুল কেটে ফেলেছে?’ একটু হতাশার ভাব এলো ডেভিডের মাঝে। মেনে নিতে পারছে না যে উজ্জ্বল গাঢ় রঙের কেশরাজি আর নেই। মনে হল ডেবরারও একই মনোভাব। উত্তর দিল না সে। এর পরিবর্তে ডেভিডকে জানাল সবাই তার সাথে কতটা ভালো আচরণ করছে। আর ওর জন্য কতটা কষ্ট করছে। মনে হচ্ছে আমি যেন একজন রানী।’ হেসে ফেলল ডেবরা।

ডেভিডের সাথে ব্রিগও এসেছে। চুপচাপ, গম্ভীর হয়ে আছে। মনে হলো সে নেই-ই। তার উপস্থিতিতে খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে আছে ডেভিড আর ডেবরা। তাই রুবি ফ্রাইডম্যান এলে স্বস্তি পেল দুজনে। হাসি-খুশিভাবে ডেবরাকে জানাতে লাগল সব প্রস্তুতি।

 ‘সিস্টার বলল তুমি ভালো আছো। সব কিছু প্রস্তুত। দুঃখিত তুমি কিছু খেতে পারবে না বা পান করতেও পারবে না। শুধু আমার দেয়া স্লিপিং পিল ছাড়া।

‘আমাকে থিয়েটারে কখন নেয়া হবে?

তাড়াতাড়ি। আগামীকাল সকাল আটটায়। আমি খুব খুশি হয়েছি যে সার্জন হিসেবে আসবেন বিলি কুপার। আমরা অনেক ভাগ্যবান যে তাকে পেয়েছি। আমি তাকে সাহায্য করব। আর তার সাথে থাকবে পৃথিবীশ্রেষ্ঠ সার্জিক্যাল টিম।

 রুবি, আপনি জানেন যে কোন কোন নারীর সাথে তাদের স্বামীরাও থাকে যখন তারা

হা। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে তাকাল রুবি। অবাক হয়ে গেছে প্রশ্ন শুনে।

 ‘তো। কাল আমার সাথে ডেভিড থাকতে পারবে না? আমরা একসাথে থাকতে পারব না, আমাদের দুজনের খাতিরে?

 ‘আমি সমস্ত শ্রদ্ধা বজায় রেখে বলতে চাই ডিয়ার, তুমি তো সন্তান প্রসব করতে যাচ্ছে না।’

‘আপনি ব্যবস্থা করতে পারেন না যেন ডেভিড সেখানে থাকতে পারে? আকুতি জানাল ডেবরা। এমন চোখ জোড়া দেখে পাথর হৃদয়ও গলে যেতে বাধ্য।

‘আমি দুঃখিত।’ মাথা নাড়ল রুৰি। এটা একেবারেই সম্ভব নয়– এরপরই উজ্জ্বল হয়ে উঠল চেহারা। কিন্তু আমি একটা কথা বলতে পারি। আমি তাকে শিক্ষার্থীদের রুমে নিয়ে যেতে পারি। এটাই হবে ভালো। আমি তাকে স্টুডেন্টদের রুমে নিয়ে যাবো। সত্যি কথা বলতে কী থিয়েটারে না থেকে সেখানে থাকলেই ও ভালো ভাবে সবকিছু দেখতে পাবে। ক্লোজ-সার্কিট টেলিভিশন দিয়ে সব দেখানো হয়। ডেভিড নির্বিঘ্নে সবকিছু দেখতে পাবে।’

 ‘ওহ প্লিজ। তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল ডেবরা। আমি জানতে চাই যে ও আশেপাশেই থাকবে। আমরা একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা হতে চাই না। তাই না ডার্লিং? হাসল ডেবরা। যেখানে ভাবল যে ডেভিড দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে অন্য পাশে সরে গেছে। তাই হাসিটা দেখতে পেল না ডেভিড।

 ‘তুমি সেখানে থাকবে, ডেভিড তাই না? জানতে চাইল ডেবরা। যদিও ছুরির কাজ দেখার কোন ইচ্ছে হল না; তাও হালকাভাবে উত্তর দিল, “আমি থাকবো। আর আরেকটু হলেই যোগ করতে যাচ্ছিল যে সবসময় কিন্তু বলল না শব্দটা।

.

এত সকালবেলা লেকচাররুমে এলো আরো দু’জন। ছোট্ট রুমে অর্ধ-বৃত্তাকারে বসানো চেয়ারের সারি। ছোট একটা টেলিভিশন স্ক্রিন। সুন্দর মুখশ্রীওয়ালা মোটাসোটা এক ছাত্রী আর কুকুরের মতো চুলের ভঙ্গি, লম্বা একটা ছাত্র গাত্রবর্ণ ফ্যাকাশে, দাঁতগুলো একেবারে বিশ্রী।

সাদা লিনেনের জ্যাকেটের মাঝ থেকে ঝুলে আছে স্টেথোস্কোপ। একবার বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখেই আর কোন আগ্রহ দেখাল না ডেভিডের প্রতি। চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষার কথা বলতে লাগল পরস্পর।

‘পেরিয়েটালের মধ্যে দিয়ে বিশেষ কাজ করতে যাচ্ছে কুপ।’

‘এটাই আমি দেখতে চেয়েছি’

নীল রঙের সিগারেট জ্বালালো মেয়েটা। বদ্ধ রুমের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। রাতে কম ঘুমানোর ফলে চোখ জ্বলতে লাগল ডেভিডের। ধোয়ায় আরো খারাপ লাগল। নিজের ঘড়ির দিকে বারবার তাকাতে লাগল ডেভিড। ভাবতে চেষ্টা করলে এই শেষ মুহূর্তগুলোতে ডেবরার সাথে কী ঘটছে। শরীরকে পরিষ্কার করা, সিডেটিভের জন্য সুই ফোঁটানো আর অ্যান্টি সেপসিস।

অতি ধীরে কাটতে লাগল সময়। অবশেষে পর্দা জুড়ে আলো দেখা গেল। থিয়েটারের ছবি ভেসে উঠল। রঙিন সেট, সবুজ রঙের থিয়েটারের পোশাক পরিহিত শরীরগুলো নড়াচড়া করতে লাগল। সবুজ দেয়ালের সাথে মিশে গেছে অপারেটিং টেবিল। উচ্চতাতে খাটো দেখাতে লাগল রোব পরিহিত মানুষগুলোকে। মাইক্রোফোনে শোনা গেল সার্জন আর সহযোগীদের মাঝের কথা-বার্তা।

‘আমরা এখনো প্রস্তুতি নেইনি মাইক?’

নিজের পাকস্থলীতে গুড়গুড় করে উঠল টের পেল ডেভিড। মনে হল নাশতা করে আসা উচিৎ ছিল। তাহলে হয়তো পেট ভরা থাকতত।

“ঠিক আছে। মাইক্রোফোনের দিকে ফিরতেই শোনা গেল সার্জনের তিক্ষ গলা। আমরা টেলি-তে চলে এসেছি?’

 ‘হ্যাঁ ডাক্তার। থিয়েটারের সিস্টার উত্তর দিল। সার্জনের কণ্ঠস্বরে স্বস্তি ফুটে উঠিল। এরপর অদেখা দর্শনার্থীদের উদ্দেশে বলে উঠল,

‘ঠিক আছে। তাহলে শুরু করছি। রোগী, ছাব্বিশ বছর বয়সী নারী। উপসর্গ হচ্ছে উভয় চোখের দৃষ্টিহীনতা। কারণ হচ্ছে অপটিক চিয়াশমার পাশে বা ভেতরে অপটিক নার্ভের ক্ষতি বা কার্য প্রবাহে বাধা। সে স্থানের সার্জিকেল তদন্ত হবে এখন। সার্জনের নাম ডা, উইলিয়াম কুপার, সহযোগিতা করছেন ডা. রুবেন ফ্রাইডম্যান।

কথা বলতে বলতে ক্যামেরা ঘুরতে লাগল টেবিলের উপর। বিস্ময়ের সাথে ডেভিড উপলব্ধি করল যে সে না জেনেও ডেবরার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখমণ্ডল আর মাথার নিচের অংশে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। মাথা পুরোপুরি কামানো। গোল একটা বলের মতো খুলি। দেখতে অমানবিক। ডিমের মতো। স্যাভলন অ্যান্টিসেপটিক মাখিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে মাথার উপরের আলো পড়ে চকচকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

‘স্কালপেল প্লিজ, সিস্টার।

নিজের সিটে টেনশনে ঝুঁকে বসল ডেভিড। হাতলে শক্ত করে এঁটে রইল হাত দু’টো। ফলে আঙুলের মাথাগুলো হয়ে গেল সাদা। কুপার নরম চামড়ার উপর প্রথম আঁচড় দিল। মাংস খুলে গেল। তৎক্ষণাৎ ছোট্ট রক্তবাহী শিরা দেখা গেল। টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেল কাজ শুরু করেছে ডাক্তারের হাত। গ্লাভস পরা থাকায় মনে হল রাবারের হাত। কিন্তু হলুদ রঙের গ্লাভস পরা হাতগুলো নিশ্চিত ভঙ্গিতে করে চলেছে তাদের কাজ।

ডিম্বাকৃতির এক অংশ মাংস আর চামড়া খুলে ফেলা হল কেটে। দেখা গেল হাড়। আবারো নড়েচড়ে উঠল ডেভিড। হাতে ড্রিল মেশিন তুলে নিল সার্জন। একই সাথে ধারাভাষ্য দিয়ে চলেছে ডাক্তার। খুলির ভেতরে ফুটো করাশুরু করল ড্রিল মেশিন। হাড়ের ভেতরে দ্রুত ঢুকে গেল স্টিল। চারবার ফুটো করল খুলি। চৌকোণা ঢাকনা মতন কাটা হলো।

‘পেরি-অস্টিল এলিভেটর, প্লিজ সিস্টার।

আবারো পাকস্থলী মোচড় দিল ডেভিডের। স্টিলের ফলা দিয়ে প্রতিটি ফুটোর এক মাথা থেকে অপর মাথা পর্যন্ত কাটলো সার্জন। এরপর করাতের মতো একটা যন্ত্র দিয়ে চারবারে পুরো চৌকোণা জায়গাটা কেটে নিয়ে তুলে ফেলল পুরো অংশ। ফলে ডেবরার খুলিতে তৈরি হল গোপন দরজা।

কাজ দেখতে দেখতে গলায় বমি উঠে এলো ডেভিডের। অনুভব করল কপাল জুড়ে ঠাণ্ডা ঘামের ফোঁটা। কিন্তু যখন খুলির ভেতরে উঁকি দিল ক্যামেরার চোখ বিস্ময়ে ভয় ভুলে গেল সে। মেমব্রেন, ডিউরামেটার সব দেখতে পেল ডেভিড। ডেবরার ব্রেইন। ডিউরাতে ফুটো করল কুপার।

 ‘এখন আমরা সম্মুখ ভাগ উন্মুক্ত করব। আর খুলি উন্মুক্ত করার জন্য এ অংশকে সরিয়ে ফেলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’

দ্রুত কিন্তু দক্ষতা আর যত্নের সাথে কাজ করে চলল কুপার। ব্যবহার করল স্টেইনস্টিলের রিট্রাকটর, দেখতে জুতোর সোলের মতো। ব্রেইনের মাঝে ঢুকিয়ে একপাশে সরিয়ে নিল। ডেবরার ব্রেইনের দিকে তাকিয়ে ডেভিড যেন দেখতে পেল ডেবরাকে, ওর নিজস্বতাকে। এ সব কিছুই ওকে তৈরি করেছে। ঠিক কোন অংশটা ওকে লেখক হিসেবে তৈরি করেছে ভেবে অবাক হল ডেভিড। এর মাঝে থেকেই তৈরি হয়েছে ওর কল্পনাশক্তি। কোথায় লুকিয়ে আছে ডেভিডের জন্য ওর ভালোবাসা। কোন নরম জায়গাটা লুকিয়ে রেখেছে ওর হাসি আর কোনটাই বা দায়ী ওর কান্নার জন্যে?

রহস্য ঘেরা এই অংশ মনোযোগী করে তুলল ডেভিডকে। রিট্রাকটর যেতে লাগল গভীর থেকে গভীরে। আর ধীরে ধীরে ক্যামেরা উঁকি দিতে লাগল ওর খুলির ভেতর।

কুপার ডিউরামেটারের শেষপর্যন্ত উন্মুক্ত করে জানাতে লাগল তার অবস্থান।

 ‘এখানে আমরা স্ফেনয়েড সাইনাস দেখতে পাচ্ছি, নোট রাখো যে এই পথে আমরা চিয়াশমাতে পৌঁছাবো।

সার্জনের কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন লক্ষ্য করল ডেভিড। খানিকটা টেনশন আছে সেই স্বরে, যত কাছে এগিয়ে আসছে লক্ষ্যস্থল।

‘এখন দেখো এ ব্যাপারটা বেশ মজার। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে? ইয়েস! পরিষ্কারভাবে হাড়ের নবজন্ম দেখা যাচ্ছে এখানে–’

সম্ভষ্ট কণ্ঠে বলে উঠল সার্জন। ডেভিডের পাশে বসা শিক্ষার্থী দু’জন বিস্ময় সূচক শব্দ করে সামনে ঝুঁকে এলো। ডেভিড দেখতে পেল নরম ভেজা টিস আর শক্ত, উজ্জ্বল উপরিভাগ, ক্ষত স্থানের একেবারে নিচে। স্টিলের গলা কাজ শুরু করল এখানে। মনে হলো ধাতু দিয়ে তৈরি মৌমাছি। গ্রেনেড ফ্রাগমেন্টের ভেতরে স্টিলের ফলা ঢুকিয়ে দিল কুপার।

এখন এখানে পাওয়া গেছে অপরিচিত অংশটা। এক্স-রে প্লেটগুলো আরেকবার আমরা দেখতে পারি সিস্টার?

দ্রুত এক্স-রে স্ক্যানারের ছবি উঠল। আবারো উত্তেজিত হয়ে উঠল শিক্ষার্থী দু’জন। তাড়াতাড়ি নিজের সিগারেটে টান দিল মেয়েটা।

‘ধন্যবাদ।

আবারো অপারেশন টেবিলের চিত্র ভেসে উঠল। এবার ডেভিড দেখতে পেল সাদা হাড়ের মাঝে গেঁথে আছে কালো একটি অংশ।

‘আমার মনে হয় আমরা এটাই খুঁজছি। তাই না ডা, ফ্রাইডম্যান?

হ্যাঁ। আমার মনে হয় আপনি এটা নিয়ে আসুন।

খুব সাবধানে লম্বা স্লেনডার স্টিল গাঢ় রঙের ফ্রাগমেন্টের চারপাশে গর্ত করে অবশেষে তুলে আনল এটাকে। সাবধানে তুলে ফেলল কুপার। অপেক্ষায় থাকা ধাতব ডিশের উপরে টিং করে ফ্রাগমেন্ট ফেলার শব্দ শুনতে পেল ডেভিড।

 ‘গুড! গুডং’ নিজেকেই উৎসাহ দিল কুপার। তাড়াতাড়ি হেমারেজ ঠেকাবার ব্যবস্থা করল। এখন অপটিক নার্ভ খুঁজে বের করব আমরা।

এখানে দুইটা সাদা অংশ আছে। পরিষ্কারভাবে দেখতে পেল ডেভিড। পৃথকভাবে গিয়ে একটা খালের মতো জায়গায় মিশে গেছে।

এখানে পরিষ্কারভাবে নতুন ধরনের হাড় দেখা যাচ্ছে। এই অংশই খালের কাজ বন্ধ করে রেখেছিল। আর সংকুচিত করে রেখেছিল নার্ভের কাজ। কোন পরামর্শ ডাক্তার ফ্রাইডম্যান?

 ‘আমার মনে হয় এ অংশটুকু পরীক্ষা করে দেখা দরকার যে নার্ভের কতটা ক্ষতি হয়েছে।

‘গুড। ইয়েস। এ ব্যাপারে আমি একমত। আমি এ অংশে পৌঁছানোর জন্যে চমৎকার একটা বোন নিলার ব্যবহার করব।’

আবারো ডাক্তারের হাতে এগিয়ে দেয়া হল উজ্জ্বল স্টিলের একটা যন্ত্র। এরপর কুপার কাজ শুরু করল সাদা হাড়ের উপর। মনে হলো ট্রপিক্যাল সাগরের কোরাল পাথর। স্টিল দিয়ে খুঁচিয়ে সাবধানে সব অংশ পরিষ্কার করে ফেলল।

‘এখানে আমরা দেখতে পাই যে একটা স্পিনটার খালের কাছে আটকে গেছে। বেশ বড় অংশ। বেশ চাপের মাধ্যমে এখানে আবদ্ধ করে ফেলেছে নিজেকে–

সাবধানে কাজ করতে লাগল ডাক্তার। ধীরে ধীরে নার্ভ দেখা গেল।

এখন, এ ব্যাপারটা বেশ মজার। বদলে গেল কুপারের গলার স্বর। ‘ইয়েস, তাকাও এদিকে। এদিকে আরেকটু ভালো করে দেখা যায় প্লিজ? ক্যামেরা আরো একটু সামনে এগিয়ে গেল। ফোকাস উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নার্ভ উপরের দিকে চাপ খেয়ে সমান হয়ে গেছে। বাধা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। চাপ দিয়ে রাখা হয়েছে কিন্তু কোন ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।’

কুপার আরো একটা হাড়ের বড় টুকরা সরালো একপাশে। এবার পুরো দেখা গেল অপটিক নার্ভ।

‘এটা সত্যিই মনে রাখার মতো। আমার মনে হচ্ছে এ ঘটনা বেশ দুর্লভ। হাজারে একবার বা কোটিতে একবার পাওয়া যায় এ সুযোগ। মনে হচ্ছে নার্ভের সত্যিকারের কোন ক্ষতি হয়নি। তারপরেও যেহেতু স্টিলের ফ্রাগমেন্ট খুব কাছ দিয়ে গেছে, তাই বলা যায় না কিছুই। নিদেনপক্ষে স্পর্শ তো করেছেই।

একটা প্রোবের মাথা দিয়ে আস্তে করে নার্ভ তুলে ধরল কুপার। পুরোপুরি অক্ষত, কিন্তু চাপ খেয়ে সোজা হয়ে গেছে। তারপরেও আমি কোন ক্ষয় দেখতে পাচ্ছি না ডা, ফ্রাইডম্যান।

 ‘আমার মনে হয় এ অংশের কাজ পুনরায় শুরু করার আশা করতে পারি আমরা।’

 মাস্ক পরা থাকলেও ডাক্তার দু’জনের বিজয়ীর ভঙ্গিমা স্পষ্ট বুঝতে পারল ডেভিড। আর তাদের দিকে তাকিয়ে নিজের অনুভূতি বুঝতে পারল সে। তার আত্মার উপর চাপ ফেলে উঠে দাঁড়াতে দেখল কুপারকে। ঠিকভাবে লাগিয়ে রাখা হলো ডেবরার খুলির অংশ। আর কাটা অংশ যথাস্থানে লাগিয়ে সেলাই করে দেয়ার পর বাইরের দিক দেখে বোঝাই গেল না যে কী কাণ্ড ঘটে গেল এতক্ষণ। স্ক্রিনের ছবি বদলে চলে গেল অন্য একটা থিয়েটারে। এখানে ছোট একটা মেয়ে হার্নিয়ার অপারেশনের জন্য শুয়ে আছে। এর সাথে সাথে বসে থাকা স্টুডেন্টদের মনোযোগও পরিবর্তন হয়ে গেল।

উঠে দাঁড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসল ডেভিড। এলিভেটরে চড়ে ডেবরার ফ্লোরে এসে ভিজিটরস রুমে বসে রইল। এরপর আবার খুলে গেল এলিভেটরের দরজা। সাদা পোশাক পরা দু’জন পুরুষ নার্স ডেবরার স্ট্রেচার ঠেলে নিয়ে গেল রুমের দিকে। মড়ার মতো ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজের পাগড়ি। খানিকটা বাদামী রক্ত চাদরে আর চলে যাবার পর খানিকটা অ্যানেসথেশিয়ার গন্ধ ভেসে রইল বাতাসে।

এরপর এলো ডা. রুবি ফ্রাইডম্যান। থিয়েটারের পোশাক বদলে পরে এসেছে দামী একটা হালকা ওজনের ধূসর স্যুট আর বিশ গিনি ডিওর সিল্ক টাই। বেশ টানটান, সুস্থ দেখাচ্ছে তাকে। নিজের অর্জনে বেশ তৃপ্ত বোঝাই যাচ্ছে।

 ‘দেখেছো তুমি? জানতে চাইল সে। ডেভিড মাথা নাড়তেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল, “অসাধারণ কাজ হয়েছে। আনন্দে হাতে হাত ঘসলো।

 ‘মাই গড, এরকম কিছু একটা তোমাকে ভালো লাগার অনুভূতি দিবে। যদি আর কিছু সারা জীবনে নাও করো কোন সমস্যা নেই। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। ডেভিডের কাঁধে চাপড় মারলো। অসাধারণ। আবারো বলে উঠল ডাক্তার।

কখন জানতে পারবেন আপনি?’ নিস্তব্ধভাবে জানতে চাইল ডেভিড।

 ‘আমি জানি। বাজি ধরতে পারি আমার সব সুখ্যাতি।

‘অ্যানেসথেটিক থেকে বের হয়ে আসা মাত্রই সব দেখতে পাবে ও? জানতে চাইল ডেভিড।

‘গুড লর্ড, নাহ! কিড়মিড় করল রুবি। বছরের পর বছর ধরে চাপা পড়ে ছিল এ নার্ভ। সুস্থ হতে খানিকটা সময় লাগবে।

কত সময়?

‘এটা এমন যে ধরো তুমি যদি ঠিক ভাবে না বসো তাহলে ঝিঁঝি ধরবে পায়ে। এরপর রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হলে আরো খানিকক্ষণ কাটলে তারপর স্বাভাবিক হবে পুরোপুরি।

কতক্ষণ পরে?’ আবারো একই প্রশ্ন করল ডেভিড।

‘সে জেগে উঠার পরপরই। নার্ভ সচল হয়ে উঠবে। সব ধরনের সংকেত পাঠাতে থাকবে ব্রেইনের মাঝে। রং আর আকার দেখতে পাবে যেন নেশার ঘোরে দেখা। তারপর স্থির হতে সময় লাগবে দুই সপ্তাহ থেকে এক মাস আমার তাই ধারণা—এরপর পরিষ্কার হবে সবকিছু। নার্ভ পুরোপুরি সেরে উঠে নিজের কাজ করা শুরু করবে। এরও পরে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে সে।’

 ‘দুই সপ্তাহ। বলে উঠল ডেভিড। মনে হলো বন্দী দশা থেকে মুক্তি পেল

 ‘তুমি তাকে জানিয়ে দিও শুভ সংবাদটা। আবারো খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল রুবি। আবারো ডেভিডের কাঁধে চাপড় মারার জন্য উদ্যত হয়েও নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে। কত সুন্দর একটা উপহার ওকে দিতে পারছো তুমি।

না।’ উত্তর দিল ডেভিড। আমি এখন তাকে জানাব না। পরে কোন এক উপযুক্ত সময়ে।

 ‘তোমাকে প্রথমে ওকে ব্যাখ্যা করে বলতে হবে প্রাথমিক ব্যাপারগুলো। নয়তো আঁতকে উঠবে ও।

‘আমরা ওকে শুধুমাত্র এটুকু বলব যে এটা অপারেশনের পরের এক ধরনের প্রভাব। এর সাথে মানিয়ে নেয়ার পরে পুরো ব্যাপারটা বলব তাকে।

 ‘ডেভিড, আমি–’ সিরিয়াস ভঙ্গিতে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল রুবি। কিন্তু থেমে গেল বিভৎস মুখোশের আড়ালে নীল চোখ দুটো জ্বলে উঠতে দেখে।

‘আমি জানাবো ওকে! কণ্ঠস্বরে এমন কিছু একটা ছিল যে এক পা পিছিয়ে গেল রুবি। আমিই জানাবো ওকে যখন সময় হবে। এটাই ছিল শর্ত।

.

অন্ধকারের মাঝে জ্বলে উঠল ছোট্ট হলুদ একটা আলো। মনে হল অনেক দূর থেকে দেখছে সে। এরপর আলোটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এরপর সেগুলো আবার ভেঙ্গে গেল। এভাবে পুরো পৃথিবী মনে হল তারায় ভরে গেল। উজ্জ্বল তারাগুলো জ্বলতে লাগল, নিভতে লাগল। এরপর হলুদ থেকে রং বদলে হয়ে গেল উজ্জ্বল সাদা। মনে হল দ্যুতি ছড়াতে লাগল হীরা। এরপর হয়ে গেল নীল সমুদ্রের বুকে সূর্যের মতো। এরপর নরম সবুজ, মরুভূমির মতো সোনালি-অন্তকালবিহীনভাবে একের পর এক দেখা দিতে লাগল রং। বদলে যাচ্ছে, বেঁকে-চুরে ভেঙ্গে যাচ্ছে, একে অন্যের সাথে মিশে যাচ্ছে।

এরপর—আকৃতি পেল রং। শক্তিশালী চাকার মতো ঘুরতে লাগল, এরপর মনে হল বিস্ফোরিত হয়ে ঝরে পড়তে লাগল নদীতে। এরপর আবারো মনে হল আলোর ঝরণা দেখা গেল।

আশ্বর্য হয়ে গেল ডেবরা রং আর আকৃতির খেলা দেখে। সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে গেল। এরপর যখন আর সহ্য করতে পারল না, চিৎকার করে উঠল।

সাথে সাথে অনুভব করল হাতের স্পর্শ। শক্তিশালী পরিচিত হাত। আর সেই কণ্ঠস্বর। ভরসা আর ভালোবাসার কেন্দ্র।

‘ডেভিড।’

‘আস্তে ডার্লিং, তোমার রেস্ট দরকার।’

 ‘ডেভিড। ডেভিড।’ কিছুই বলতে পারছে না ডেবরা। নিজের গলার মাঝে কী যেন দলা পাকিয়ে উঠে এলো বুঝতে পারল। এত রং, আকৃতি, বৈচিত্র্য দেখে অভিভূত হয়ে গেল সে।

‘আমি এখানে, ডার্লিং। এখানেই আছি।

কী হচ্ছে আমার সাথে, ডেভিড? কী হচ্ছে?

‘তুমি ঠিক আছে। অপারেশন সফল হয়েছে। তুমি একদম ঠিক আছে।

‘রং।’ আবারো চিৎকার করে উঠল ডেবরা। আমার পুরো মাথা ভরে গেছে। আমি কখনো আর এমনটা দেখিনি।’

‘এটা অপারেশনের প্রভাব। বোঝা যাচ্ছে সফল হয়েছে। ওরা সারিয়ে দিয়েছে সমস্যা।

‘আমার ভয় লাগছে ডেভিড।

না, ডার্লিং। ভয় পাবার কিছু নেই।

‘আমাকে ধরো ডেভিড। আমাকে ধরে রাখে। আস্তে আস্তে নির্ভার হল ডেবরা। সমুদ্রের মতো অন্তহীন ঢেউ আর রঙের মাঝে ভেসে বেড়াতে লাগল। এরপর বিস্ময় মেশানো আনন্দ নিয়ে মেনে নিল ব্যাপারটা।

‘এটা বেশ সুন্দর ডেভিড। আমার আর ভয় লাগছে না। তুমি ধরে রাখায় আর ভয় লাগছে না।’

‘আমাকে বলো কী দেখছো?

বলতে পারব না। বর্ণনা করা অসম্ভব। আমি শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।’

 ‘চেষ্টা করো।’ বলে উঠল ডেভিড।

.

স্যুইটে একা বসে আছে ডেভিড। মধ্যরাতের পর নিউইয়র্ক থেকে ফোন এলো। অনেক আগে থেকেই চেষ্টা করছিল সে।

‘রবার্ট ডগান বলছি।’ ব্যবসায়ীর মতো কণ্ঠস্বরে কথা বলে উঠল ববি

‘ডেভিড মরগ্যান।

‘কে?

‘ডেবরা মোরদেসাইয়ের পতি।’

‘ওয়েল, হ্যালো ডেভিড।’ বদলে গেল এজেন্টের গলার স্বর। ভাল লাগছে আপনার সাথে কথা বলে। কেমন আছে ডেবরা? স্পষ্ট বোঝা গেল যে ডেভিডের উপর ববির আগ্রহ শুরু ও শেষ হবে ডেবরাকে দিয়ে।

 ‘এই কারণেই আমি ফোন করছি। একটা অপারেশনের কারণে এখন হাসপাতালে আছে সে।

‘গড! তেমন সিরিয়াস নয় তো?’

‘ও ভালো হয়ে যাবে। কয়েকদিনের মাঝেই। আর কয়েক সপ্তাহের মাঝে কাজ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।’

‘শুনে ভালো লাগল ডেভিড।’

‘দ্যাটস গ্রেট!’

‘দেখুন আমি চাই আপনি এগিয়ে যান আর আ প্লেস অব আওয়ার ওন এর জন্য স্ক্রিপ্ট লেখার কাজের ব্যাপারে কথা-বার্তা শুরু করুন।

 ‘সে এটা করবে?’ ছয় হাজার মাইল দূরে বসেও ববির খুশি টের পেল ডেভিড।

‘ ও এটা করবে।

‘এটা তো বেশ ভালো খবর, ডেভিড।

‘একটা ভালো কন্ট্রাক্ট লিখে দেবেন।

‘এটা নির্ভর করে। আপনার এই লিটল গার্ল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি লক্ষ্য রাখবো যেন ওর কোন ক্ষতি না হয়। সত্যি!

কতদিন লাগবে এ কাজ শেষ হতে?

 ছয় মাস। অনুমান করল ববি।

‘যে প্রযোজক এটা করবে তিনি এখন রোমে একটা ছবি নিয়ে ব্যস্ত।

‘সম্ভবত ওখানেই ডেবরাকে ডেকে নিতে পারেন। জানাল ডুগান।

 ‘ভালোই হলো। ও রোম পছন্দ করবে। উত্তরে জানাল ডেভিড।

 ‘ওর সাথে আপনিও আসবেন ডেভিড?’

না।’ সাবধানে উত্তর দিল ডেভিড। ও একাই আসবে।’

 ‘ও একা আসতে পারবে? চিন্তিত শোনাল ববির কণ্ঠস্বর।

 ‘এখন থেকে নিজের সব কাজ নিজেই করতে পারবে সে।

 ‘আশা করি আপনি ঠিক কথা বলছেন। দ্বিধায় পড়ে গেল ববি।

‘আমি ঠিক বলছি। তাড়াতাড়ি বলে উঠল ডেভিড। আরেকটা কথা। লেকচার টুর, সে ব্যাপারটা?

‘ওরা তো দরজায় কড়া নাড়ছে। যেমনটা আমি বলেছিলাম পিস্তলের চেয়েও হট হয়ে গেছে এখন সে।

‘স্ক্রিপ্ট হয়ে গেলে কাজে ঠিক করে দেবেন।

‘হেই, ডেভিড। এই হলো ব্যবসা। এখন আমরা সত্যি গ্যাস নিয়ে রান্না করছি। আমরা আপনার ছোট্ট মেয়েটাকে সম্পদ বানিয়ে ফেলবো।’

‘তাহলে তাই করুন। মন্তব্য করল ডেভিড। ওকে বড় করে তুলুন। ব্যস্ত করে ফেলুন। যেন চিন্তা করার অবসর না পায়।

‘আমি ব্যস্ত রাখবো ওকে। এরপর মনে হল যেন কিছু একটা আঁচ করতে পারল। বলে উঠল, ‘কোন সমস্যা হয়েছে ডেভিড? কোন ঘরোয়া সমস্যা? কথা বলতে চান এ ব্যাপারে?

‘না, আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই না। আপনি শুধু ওর খেয়াল রাখবেন। ভালো ভাবে।

“ঠিক আছে। নম্র হয়ে গেল ববির গলা। আর ডেভিড’

কী?’

 ‘আমি দুঃখিত। যাই ঘটুক না কেন আমি দুঃখিত।

“ঠিক আছে। প্রায় সাথে সাথে আলোচনা থামিয়ে দিল ডেভিড। হাত কাঁপতে শুরু করায় টেলিফোনের রিসিভার পড়ে গেল হাত থেকে। চিড় ধরল প্লাস্টিকের গায়ে। এভাবেই সেটাকে ফেলে রেখে হোটেল থেকে বের হয়ে এলো ডেভিড। ঘুরে বেড়ালো ঘুমন্ত শহরের রাস্তায়। ভোর হবার আগে ফিরে এলো রুমে।

রঙের প্রবাহ ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আকৃতি নিতে লাগল। উজ্জ্বলতা দেখে প্রথমবার ভয় পাওয়ার মতো ব্যাপার আর ঘটল না। এরপর ধূসর অন্ধত্ব কেটে গিয়ে মাথা যেন ভরে গেল তুলোর বলে। নতুন ধরনের সৌন্দর্য আর উজ্জ্বলতা অনুভব করল ডেবরা। প্রথম কয়েকদিনের মাঝে মাথায় সার্জারির প্রাথমিক অস্বস্তি কেটে গেল। কেমন একটা ভালো থাকার মতো বোধ তৈরি হল তার মাঝে। কেমন একটা উচ্চাশা জেগে উঠল মনের মাঝে। মনে পড়ে গেল ছোটবেলাকার ছুটির দিনের জন্য অপেক্ষার কথা।

মনে হল মনের গহীনে কেউ একজন বলে উঠল যে তার দষ্টিশক্তি ফিরে আসছে। কিন্তু চেতন মনে পৌঁছালো না, এ সংবাদ। বুঝতে পারল পরিবর্তন ঘটেছে কোথায়। যাই হোক অন্ধকারের চেয়ে এই উজ্জ্বলতাকে স্বাগত জানাল সে।

কিন্তু সে জানে না রং আর কল্পনার পর আসবে আকৃতি আর বাস্তবতা।

প্রতিদিন ডেভিড অপেক্ষা করে থাকে যে ডেবরা এমন কিছু একটা বলবে যে বোঝা যাবে দৃষ্টি শক্তি ফিরে আসার ব্যাপারটা, বুঝতে পারছে সে। আশা আর সতর্কতা একসাথে দুলে ওঠে মনের মাঝে কিন্তু কিছুই বলে না ডেবরা।

হাসপাতাল যতটুকু মেনে নেয় ততটুকুর পুরো সময়টাই ডেবরার সাথে কাটায় ডেভিড। প্রতিটি মিনিট চেষ্টা করে ধরে রাখতে। যেমন করে কৃপণ গুণে। গুণে পয়সা খরচ করে। ডেবরার আনন্দ আর উত্তেজনা সঞ্চারিত তার মাঝে ও। একসাথে হাসে দু’জনে। কল্পনা করে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেই একসাথে ফিরে যাবে জাবুলানিতে।

কোন দ্বিধা নেই ডেবরার মাঝে। খুশির উপর ছায়া ফেলল না কোন আশংকা। আস্তে আস্তে ডেভিডও ভাবতে লাগল যে বোধ হয় এটাই সত্যি। তাদের আনন্দে কেউ কখনো নজর দিবে না, ভালোবাসা কখনো কমে যাবে না। যত আঘাতই আসুক না কেন? একসাথে হলেই এ বোধ অনুভব করে ডেভিড।

এরপরেও ঠিক করতে পারে না সে যে কখন বলবে ডেবরাকে। মনে হয় এখনো সময় আছে হাতে। দুই সপ্তাহ, রুবি ফ্রাইডম্যানের কথা মতো দুই সপ্তাহ সময় লাগবে বুঝতে যে ডেবরা আদৌ পুরো দেখতে পাচ্ছে কিনা। তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ আনন্দটুকু। কাঙালের মতো এই সবটুকু নিয়ে নিতে চায় ডেভিড।

একাকী রাতগুলোতে ভয়ঙ্কর সব চিন্তা ঘুমাতে দেয় না তাকে। মনে পড়ে যায় প্লাস্টিক সার্জন একবার বলেছিল যে তারা তাকে খানিকটা সহনীয় করে দিতে পারবে সার্জারির মাধ্যমে। তাই ফিরে গিয়ে আবারো ছুরির নিচে শুয়ে পড়ার কথা মনে এলো। যদিও কেঁপে উঠল সারা শরীর এহেন সম্ভাবনায়। হতে পারে ডেবরা তাহলে আরেকটু কম ভয়ঙ্কর একটা চেহারা দেখবে।

 পরের দিন আদারলী স্ট্রিটে শত শত আগ্রহী চোখ উপেক্ষা করে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গেল ডেভিড। উইগ ডিপার্টমেন্টের মেয়েরা প্রাথমিক ভয় কাটিয়ে উঠে তাকে নিয়ে গেল গম্বুজাকৃতির মাথা ঢাকার জন্য উইগ খুঁজে দিতে।

 নিজের ক্ষত-বিক্ষত জমে যাওয়া মুখের উপর পরার জন্য কোকড়া চুলের পরচুলা পছন্দ করে নিল ডেভিড। প্রথম বারের মতো আয়নায় নিজেকে দেখে হেসে ফেলল সে। যদিও ব্যাপারটা হয়ে উঠল আরো ভয়ঙ্কর। ঠোঁট বিহীন মুখে মনে হল ফাঁদে আটকা পড়া পশু।

‘গড!’ হেসে ফেলল ডেভিড।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইনও হার মেনে যাবে।

 নিজের অনুভূতির সাথে যুদ্ধ করতে থাকা সেলস গার্ল হিমশিম খেল অস্বস্তি চাপতে গিয়ে।

ডেভিডের মনে হল একথা জানায় ডেবরাকে, কৌতুক করে বলে আর একই সাথে তাকে দেখার জন্য তৈরি করে নেয়। কিন্তু কেন যেন কোন শব্দ খুঁজে পেল না সে। আরো একটা দিন কেটে গেল। কিছুই ঘটল না। শুধুমাত্র ফুরিয়ে আসতে লাগল একসাথে থাকার কাল।

পরের দিন প্রথমবারের মতো অধৈৰ্য্যভাব দেখা গেল ডেবরার মাঝে। ‘ওরা আমাকে কখন ছাড়বে হাসপাতাল থেকে ডার্লিং? আমি পুরো সুস্থ আছি। এভাবে বিছানায় শুয়ে থাকাটা ভয়ঙ্কর। আমি জাবুলানিতে ফিরে যেতে চাই অনেক কিছু করতে হবে আমাকে, অনেক কাজ পড়ে আছে। এরপর হেসে উঠল খিকখিক করে, দশ দিন হয়ে গেছে এখানে বন্দী আমি। এভাবে সাধু জীবন কাটাতে অভ্যস্ত নই আমি। আর তোমাকে সত্যি বলছি, আমি পারছি না তোমাকে ছাড়া।

দরজা বন্ধ করে দেবো?’ পরামর্শ দিল ডেভিড।

‘গড, আমি একটা জিনিয়াসকে বিয়ে করেছি।’ হাসতে লাগল ডেবরা। এরপর বলল, ‘প্রথম বারের মতো টেকনিকালার কিছু ঘটল আমার সাথে। ভালোই লাগছে।’

সেই দিন সন্ধ্যাবেলা রুবি ফ্রাইডম্যান আর ব্রিগ স্যুইটে অপেক্ষা করছিল ওর জন্য। ফেরার সাথে সাথে ধরল ডেভিডকে।

‘অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছ তুমি। ডেবরাকে আরো আগেই বলা উচিৎ ছিল। দৃঢ়ভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করল ব্রিগ। তিনি ঠিকই বলছেন, ডেভিড। তুমি ঠিক করছ না। ওকে জানানো উচিৎ। মানিয়ে নেয়ার ব্যাপারও আছে। জানাল ফ্রাইডম্যান। সুযোগ পেলেই ওকে জানাবো আমি।’ গোয়ার্তুমির স্বরে বলল ডেভিড।

‘কখন হবে সেটা?’ জানতে চাইল ব্রিগ। রাগের চোটে ঝিক করে উঠল স্বর্ণের দাঁত।

শীঘ্রই।

 ‘ডেভিড, বোঝাতে চাইল রুবি, এটা এখন যে কোন সময়ে ঘটতে পারে। ও বেশ উন্নতি করেছে এরই মাঝে। আমার আশার থেকেও শীঘ্ন ঘটছে। ব্যাপারটা।

‘আমি দেখবো কী করা যায়।’ বলে উঠল ডেভিড। প্লিজ আমাকে চাপ দিবেন না। আমি তো বলেছি আমি বলব। আর আমি তা করবও। শুধু আমাকে সময় দিন।

“ঠিক আছে। ক্ষেপে গেল ব্রিগ।

 ‘আগামীকাল দুপুর পর্যন্ত সময় দেয়া হল তোমাকে। যদি এর ভেতরেও না বল, তাহলে পরবর্তী দায়িত্ব আমার।’

 ‘আপনি তো একটা নিষ্ঠুর, তাই না? তিক্ততা ঝরে পড়ল ডেভিডের কণ্ঠ দিয়ে। সবাই বুঝতে পারল কতটা রেগে গেছে ব্রিগ। বহু কষ্টে নিজেকে দমন করল সে।

‘আমি বুঝতে পারছি তোমার কথা। সাবধানে বলে উঠল ব্রিগ। ‘আমিও সহানুভূতি প্রকাশ করছি এ ব্যাপারে। কিন্তু আমার প্রথম চিন্তা ডেবরাকে নিয়ে। তুমি তোমার কথাই ভাবছো। কিন্তু আমি চাই না ও আর আঘাত পাক। এমনিতেই যথেষ্ট সহ্য করেছে। আর নয়। তাকে জানিয়ে দাও এবার।’

হ্যাঁ।’ মাথা নাড়ল ডেভিড। সমস্ত যুদ্ধের মনোভাব চলে গেছে।

‘আমি জানাবো।

কখন?” আবারো চাপ দিল ব্রিগ।

কাল। জানাল ডেভিড। আগামীকাল সকালে ওকে জানাবো আমি।

দিনটা শুরু হলো বেশ উজ্জ্বলতা আর উষ্ণতা নিয়ে। তার রুমের নিচের বাগানে দেখা গেল রঙের খেলা। নিজের স্যুইটে নাশতা খেতে খেতে সকালের সব খবরের কাগজ পড়ে ফেলল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। এরপর যত্ন করে পোশাক পড়ল। গাঢ় রঙের স্যুট, লাইলাক শার্ট, এরপর যখন বের হতে যাবে, তখন আয়নায় দেখল নিজেকে।

‘অনেক দিন হয়ে গেছে–তারপরেও তোমার সাথে সহজ হতে পারছি। আমি।’ আয়নায় অবয়বকে বলে উঠল সে।

 ‘শুধু প্রার্থনা করি কেউ একজন যে তোমাকে ভালোবাসে সে পারবে।

পোর্টিকোর নিচে দারোয়ান ক্যাব ডেকে রেখেছে তার জন্য। পাকস্থলীতে গুড়গুড় ভাব নিয়ে পিছনের সিটে উঠে বসল ডেভিড। সকালবেলা দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে গেল গাড়ি। হাসপাতালের প্রধান প্রবেশ মুখে নামল সে। তাকাল ঘড়ির দিকে। এগারোটা বেজে কয়েক মিনিট। লবি পার হয়ে এলিভেটরে যাবার সময় আজ মনে হয় খেয়াল করল না উৎসাহী দৃষ্টিগুলোর প্রতি।

ডেবরার ফ্লোরের ভিজিটরস রুমে ওর জন্য অপেক্ষা করছে ব্রিগ। করিডোরে বের হয়ে এলো ব্রিগ। লম্বা, সিভিলিয়ান স্যুটে অচেনা লাগল তাকে।

 ‘আপনি কী করছেন এখানে? জানতে চাইল ডেভিড। কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ব্রিগের এ সময় এখানে থাকাটা।

‘আমি ভাবলাম সাহায্য করি তোমাকে।

‘ভালোই ভেবেছেন!’ বিদ্রুপাত্মকভাবে বলে উঠল ডেভিড। নিজের রাগ লুকানোর কোন চেষ্টা করল না। এ ব্যাপারটাকে পাত্তা দিল না ব্রিগ। তুমি কী চাও আমি তোমার সাথে থাকি?”।

‘না। কথা বলতে বলতে অন্য দিকে চলে যেতে উদ্যত হল ডেভিড।

‘আমি সব ঠিক করে নেব। ধন্যবাদ। করিডোর ধরে হাঁটতে লাগল সে। ডেভিড! নরম স্বরে ডেকে উঠল ব্রিগ। একটু দোনোমোনো করে ফিরে তাকাল ডেভিড। কী? জানতে চাইল সে।

দীর্ঘক্ষণ একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়ল ব্রিগ। না, কিছু না। তাকিয়ে দেখল দীর্ঘদেহী তরুণ, দানবীয় মাথা নিয়ে গটগট করে হেঁটে ঢুকলো ডেবরার রুমে। খালি করিডোরে শোনা গেল পায়ের শব্দ।

সমুদ্রের দিক থেকে আসা হালকা বাতাসে আরামদায়ক উষ্ণ হয়ে আছে সকালবেলাটা। খোলা জানালার কাছে নিজের চেয়ারে বসে আছে ডেবরা। বাতাস বয়ে নিয়ে আসছে পাইনের সুগন্ধ। এর সাথে মিশে গেছে সমুদ্রের মৃদু গন্ধ। চুপচাপ আত্মমগ্ন হয়ে কিছু একটা ভাবছে মেয়েটা। অথচ আজ দেরি করে এসেছে ডেভিড। একটু আগেই রুবি ফ্রাইডম্যানের সাথে কথা হয়েছে। রাউন্ড দিতে এসেছিল ডাক্তার, ডেবরাকে জানিয়ে গেছে যে এক সপ্তাহের মাঝে রিলিজ দেয়া হবে তাকে।

সকালবেলায় উষ্ণতার সাথে কেমন একটা ঘুম ঘুম আবেশও জড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে আপন মনে কোকুনের মতো করে আলোর খেলা দেখছে। তদ্ৰামতো এলো চোখে।

এভাবেই দেখতে পেল ডেভিড। পাশে পা ছড়িয়ে বসে আছে ডেবরা চেয়ারে। জানালা দিয়ে আসা আলো পড়েছে চোখে মুখে। মাথার পাগড়ি পরিষ্কার আর গায়ের পোশাক বিয়ের গাউনের মতোই সাদা।

 চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে ডেবরাকে দেখল ডেভিড। মুখটা পাণ্ডুর দেখাচ্ছে। কিন্তু চোখের ঘন পাপড়ি পরিষ্কার আর ঠোঁট দুটো শান্ত, সুন্দর।

স্নেহের বাৎসল্যে সামনে ঝুঁকে মেয়েটার গালে হাত দিল ডেভিড। ঘুম ঘুম চোখ মেলে তাকাল ডেবরা। মধুরঙা অনিন্দ্যসুন্দর সোনালি চোখ। কুয়াশা মাখা। দৃষ্টিহীন কিন্তু অসম্ভব সুন্দর। এরপর হঠাৎ করেই বদলে গেল সবকিছু। পরিষ্কার দেখতে পেল ডেভিড। তীক্ষ্ণ, সজাগ হয়ে উঠল সে দৃষ্টি। স্থির হয়ে গেল। তার দিকে তাকিয়ে আছে ডেবরা; ডেভিডকে দেখছে

গালে স্পর্শ পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠল, ডেবরা। এত হালকা যেন বসন্তের পাতার ছোঁয়া পেল। নরম সোনালি রঙা মেঘের মাঝে দিয়ে তাকাল যেন সে। এরপর হঠাৎ করেই মনে হলো সকালের বাতাস সরিয়ে নিয়ে গেল। কুয়াশা। মেঘ ভেসে গেল। তাকিয়েই দেখতে পেল দানবীয় একটা মাথা ঝুঁকে আছে তার দিকে। আকৃতিবিহীন মাথাটা মনে হল নরকের অংশ। চেয়ারে ধপ করে ধাক্কা খেলো ডেবরা। হাত তুলে মুখ ঢেকেই চিৎকার করে উঠল।

ঘুরে দৌড় দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ডেভিড। পিছনে ঠাশ করে বাড়ি খেল দরজা। প্যাসেজ বেয়ে নেমে গেল পদশব্দ। শব্দ শুনে এগিয়ে এলো ব্রিগ।

 ‘ডেভিড! হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইল। ডাকতে চাইল। কিন্তু তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো ছিটকে চলে গেল ডেভিড। বুকের মাঝে কিছু একটার বাড়ি খেয়ে যেন দেয়ালে গিয়ে আছাড় খেল ব্রিগ। ভারসাম্য ফিরে পেয়ে বুকে হাত ঘসে এগিয়ে আসতে আসতে চলে গেছে ডেভিড। সিঁড়ির উপর থেকেও শোনা যাচ্ছে উন্মাদের মতো পায়ের আওয়াজ।

 ‘ডেভিড! গলার স্বর জড়িয়ে যাচ্ছে শুনতে পেল ব্রিগ। দাঁড়াও!’ কিন্তু চলে গেছে ছেলেটা। আর শোনা গেল না পদশব্দ। যেতে দিল ব্রিগ। এর পরিবর্তে তাড়াতাড়ি করিডোরের ওপারে হিস্টিরিয়ার মতো চিৎকার করতে থাকা কন্যার দিকে দৌড় লাগাল।

হাত থেকে মুখ তুলে তাকাল ডেবরা। দরজা খোলার আওয়াজ পেল। চোখে দেখা গেল ভয়।

‘আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। আমি দেখতে পাচ্ছি।’

তাড়াতাড়ি মেয়ের কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরল ব্রিগ।

“ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি আশ্বস্ত করতে চাইল মেয়েকে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’

বাবাকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে থামাতে চাইল ডেবরা।

‘আমি দুঃস্বপ্ন দেখেছি। বিড়বিড় করতে লাগল ডেবরা। ভয়ানক দুঃস্বপ্ন। এরপর বাবাকে ধাক্কা দিল।

 ‘ডেভিড।’ চিৎকার করে উঠল সে। ডেভিড কোথায়? আমি ওকে দেখবো।

শক্ত হয়ে গেল ব্রিগ। বুঝতে পারল কিছুই বুঝতে পারেনি ডেবরা।

‘আমি ওকে দেখবো। বারবার একই কথা বলতে লাগল সে। ভারী কণ্ঠে উত্তর দিতে বাধ্য হল ব্রিগ, তোমার সাথে ওর দেখা হয়েছে, মাই চাইল্ড।’

কয়েক সেকেন্ড ধরে কিছুই বুঝতে পারল না ডেবরা। এরপর আস্তে করে বলে উঠল,

‘ডেভিড?’ ফিসফিস করে উঠল ডেবরা। ভেঙ্গে যাচ্ছে গলার স্বর, ডেভিড ছিল ওটা?’

মাথা নাড়ল ব্রিগ। দেখতে পেল ভয়ার্ত হয়ে গেল ডেবরার দৃষ্টি।

“ওহ্ ডিয়ার গড! কেঁদে উঠল ডেবরা। আমি কী করেছি? আমি ওকে দেখে চিৎকার করেছি। আমি কী করেছি এটা? আমি ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি।’

‘তো তুমি তাকে এখনো দেখতে চাও? জানতে চাইল ব্রিগ।

কী বলছো বাবা?’ ক্ষেপে উঠল ডেবরা। এই পৃথিবীর অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে বেশি। তুমি জানো এটা!

‘এমনকি ও এখন দেখতে যেমন তার পরেও?

‘যদি ভাবো যে এটা আমার মাঝে কোন পার্থক্য তৈরি করবে–তাহলে তুমি আমাকে চেনোই না। আবারো বদলে গেল ওর চেহারা। চিন্তিত হয়ে উঠল। ওকে খুঁজে বের করো। নির্দেশ দিল ডেবরা। তাড়াতাড়ি করো। নয়তো কিছু একটা করে বসবে।

 ‘আমি জানি না ও কোথায় গেছে। উত্তর দিল ব্রিগ। তার নিজের চিন্তা বেড়ে গেল ডেবরার কথা শুনে।

‘একটাই জায়গা আছে ওর যাবার। জানাল ডেবরা। ও আকাশে উড়ে গেছে।

‘হ্যাঁ, তাই হবে।’ একমত হলো ব্রিগ।

‘এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে জানাও। তাহলেই ওর সাথে কথা বলতে পারবে তুমি। দরজার দিকে এগোল ব্রিগ! আকুতি জানাল ডেবরা। ওকে খুঁজে আনো আমার জন্য, প্লিজ ড্যাডি।

.

নাভাজো উড়ে চলল দক্ষিণ দিকে। গোলাকার নাকটা কোর্সে স্থির হবার পর সোজা উঠে যেতে শুরু করল নীল স্বর্গের দিকে। ডেভিড জানে সে কোথায় যাচ্ছে।

 পেছনে পর্বতপ্রমাণ মেঘের দল সরে গেছে দূরে। এখানেই ভূমি শেষ হয়ে গেছে। সামনে পড়ে আছে শুধুই বরফ আর ঠাণ্ডা সমুদ্র।

নিজের ফুয়েল গজ চেক করে দেখল ডেভিড। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আছে। তারপরেও দেখতে পেল কাটাটা অর্ধেকের একটু উপরে উঠে কাঁপছে।

তিন ঘণ্টা ধরে উড়ছে সম্ভবত। চনমনে ভাব এলো ডেভিডের মনে যে যন্ত্রণা শেষ হতে চলেছে। পরিষ্কাভাবে দেখতে পেল যে সামনে কীভাবে শেষ হবে সবকিছু। উপরে উঠে যাবে শুধু। তারপর এক সময় ইঞ্জিন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেবে। এরপর সে নাকটাকে নিচে নামিয়ে দ্রুত নেমে যাবে। যেমন ভাবে ঝাঁপ দেয় ঈগল। তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যাবে সবকিছু। ধাতব ফিউজিলাজ তাকে এত নিচে নিয়ে যাবে যেখানে সে ততটা একা হবে না, যতটা এখন আছে।

রেডিও কড়কড় করে উঠল। শুনতে পেল এয়ার ট্রাফিকের ঘোৎঘোৎ. আওয়াজ। যেই না সুইচ টিপে বন্ধ করতে যাবে–সেই সময় শুনতে পেল পরিচিত কণ্ঠস্বর।

‘ডেভিড, ব্রিগ বলছি। ঠিক এই গলাতেই কথাগুলো শুনেছে ডেভিড অন্য ককপিটে, অন্য দেশে বসে।

‘তুমি একবার আমার কথা অমান্য করেছিলে। এবার করো না। আর।

মুখ শক্ত হয়ে গেল ডেভিডের। সুইচ বন্ধ করতে যাবে সে, বুঝতে পারল তারা রাডারে দেখছে তাকে। ওর কোর্স জানে, ব্রিগ অনুমান করেছে সে কী করতে চলেছে। যাই হোক কিছুই করার নেই তাদের আর।

 ‘ডেভিড’, নরম হল ব্রিগের গলা। কয়েকটা শব্দ বেছে নিল যেন ডেভিড শোনে তার কথা।

‘আমি এইমাত্র ডেবরার সাথে কথা বলেছি। ও তোমাকে চায়। তোমাকে সর্বস্ব দিয়ে চায়।’

 সুইচের উপরে হাত থেমে গেল।

‘আমার কথা শোন ডেভিড। তোমাকে ওর দরকার–সব সময় দরকার হবে।

চোখ পিটপিট করল ডেভিড। চোখ ভরে গেল পানিতে। দৃঢ়তা ভেঙ্গে যাচ্ছে।

‘ফিরে এসো ডেভিড। ওর জন্য ফিরে এসো।

বুকের ভেতরের অন্ধকার থেকে দেখা গেল ছোট্ট একটু আলো। আস্তে আস্তে উজ্জ্বলতা পেল এ বিন্দু। ভরে গেল ওর চারপাশ।

‘ডেভিড, ব্রিগ বলছি। আবারো শোনা গেল বৃদ্ধ সৈনিকের কর্কশ কণ্ঠস্বর।

‘এখনি বেসে ফিরে এসো।

হেসে ফেলল ডেভিড। মুখের কাছে ধরল মাইক্রোফোন। চাপ দিল ট্রান্সমিট বোতামে। পুরোন হিব্রু ভাষায় কথা বলে উঠল।

‘রিসেডার! ব্রাইট ল্যান্সের লিডার বলছি। ফিরে আসছি।’ খাড়া ভাবে ঘুরে গেল নাভাজো। দিগন্তের কাছে নীল হয়ে নেমে গেছে। পর্বতমালা। এর কাছে নাক নামিয়ে দিল ডেভিড। জানে এটা সহজ হবে না– সমস্ত সাহস আর ধৈর্য নিয়ে এ কাজ করতে হবে। আবার এও জানে যে সমাপ্তি অবশ্যই ভাল হবে। হঠাৎ করেই মনে হল জাবুলানিতে ফিরে গিয়ে ডেবরার সাথে একা হতে চায় সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *