০৫. মেঘের গর্জনের মতো

মেঘের গর্জনের মতো বজ্র কণ্ঠে তকবীর ধ্বনীতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে এগিয়ে চলল বিন কাসিমের কাফেলা। “ঐ বুদ্ধটা কি এখনো এসে পৌছেনি?” ক্ষোভ ও হতাশা মিশ্রিত উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল রাজা দাহির।

“হয়তো আসছে মহারাজ!” জবাব দিলো মন্ত্রী। “নিরূন তো এতোটা দূর নয় যে, তিন দিনেও সে পৌছতে পারবে না। হয়তো আরবদের আনুগত্য স্বীকার করে আমরা যে ওকে প্রশাসক নিযুক্ত করে কিছু দায়িত্বভার দিয়েছি সেকথা ভুলে গেছে। ওকি জানে না, প্রশাসকের পদ যে কোন সময় আমরা ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারি।” বলল রাজা দাহির। দাহিরের কাছে আগেই খবর পৌঁছে গিয়েছিল আরব থেকে এবার বিপুল সংখ্যক সৈন্য বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে। তার কাছে এখবরও পৌছে গিয়েছিল কন্নৌজ ও আরমান ভিলা আরবরা দখল করে নিয়েছে। গত রাতে মায়ারাণী তাকে খবর দিয়েছিল তার নিয়োগকৃত তিন তরুণী ফিরে এসেছে এবং তার পরিকল্পনা বেকার হয়ে গেছে।

মায়ারাণীর প্রেরিত তরুণীদেরকে মুহাম্মদ বিন কাসিম হত্যা না করে সসম্মানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বিন কাসিমের সৈন্যরা যে পল্লীতে তরুণীদের রেখে গিয়েছিল পল্লীবাসীদের ওরা বলেছিল, তারা রাজার নিজস্ব লোক, তাদেরকে যেন খুব তাড়াতাড়ি রাজধানীতে পৌছার ব্যবস্থা করা হয়। দ্রুতগামী উটের ওপর বসিয়ে বারজন লোকের প্রহরাধীন দুই হিন্দু তরুণীকে উরুর পৌছানোর ব্যবস্থা করল গ্রামবাসী। গত রাতেই তরুণীদ্বয় রাজধানীতে পৌছে গিয়েছিল। মায়ারাণী রাতেই রাজা দাহিরের কাছে তাদের পৌছে দিয়েছিল। রাজা দাহির নিজে তরুণীদের কাছ থেকে তাদের চক্রান্ত ভণ্ডুল

হওয়ার কাহিনী শুনেছিল। রাজা দাহিরকে এক তরুণী বলল, “আমরা নিরপরাধ মহারাজ! আমরা আমাদের পরিকল্পনা মতোই কাজ করেছিলাম কিন্তু আমাদের জানা ছিল না আরবের লোকেরা মাটির নীচের খবরও বেমালুম জেনে নিতে পারে। আমরা ভেবেছিলাম মাকরানের আরব অধিবাসীরা যেভাবে আরব সৈন্যদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছিল, তারা আরব চৌকির সৈন্যদের ওপর হামলে পড়বে। আর তাতে আরব সৈন্যদের সাথে তাদের শত্রুতা সৃষ্টি হবে এবং সর্দার আলাফী তার দলবল নিয়ে মহারাজের সাথে সাক্ষাৎ করবে কিন্তু হঠাৎ আরব সেনাপতি সেখানে উপস্থিত হলো। তার সাথে বহু লোকজনও ছিল।

হ্যাঁ, এর পর যা ঘটেছে সে খবর আমি শুনেছি। বলল রাজা দাহির। আচ্ছা, তুমি কি আরব সেনাপতিকে নিজ চোখে দেখেছ?

হ্যাঁ, মহারাজ। আমরা আগেই জেনে নিয়েছিলাম, আরব থেকে যে সেনাদল এসেছে সেই সেনাবাহিনীর সেনাপতি কে? তার নাম কি? তিনি কেমন লোক ইত্যাদি। আমার স্বামী আমাকে বলেছিল।

তার নাম কাসিম! অনুচ্চ শব্দে উচ্চারণ করল দাহির। তোমরা ভুল নাম শোননিতো? হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তো নয়?

না, মহারাজ! আমরা ঠিকই শুনেছি। এতে কোন সন্দেহ নেই মহারাজ! আরব সেনাপতির নাম মুহাম্মদ বিন কাসিম। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নয়!

মহারাজ! সে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নয় তবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাতিজা। বয়সে আমাদের চেয়েও ছোট।

“সে একেবারেই বালক মহারাজ।” বলল অপর তরুণী। কিন্তু দেখতে খুবই সুন্দর। তাকে দেখে মনেই হয় না সে সেনাপতি। কিন্তু তাঁর যেসব নিরাপত্তা রক্ষী এসেছিল, তারা কথায় কথায় “সালারে মুহতারাম” বলে। সম্বোধন করত। সেই আমাদেরকে আমাদের স্বামী ও হারেস আলাফীর হাতে নিহত হওয়া থেকে প্রাণ বাঁচিয়েছে। সেই তাদের সৈন্যদেরকে নির্দেশ দিয়েছিল, নিকটবর্তী কোন পল্লীতে ওদের দিয়ে এসো। তা থেকে তাঁর সেনাপতি হওয়ার বিষয়টি আরো সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে।”

রাজা দাহির অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ল।

শুনেছি হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খুব বুদ্ধিমান লোক। কিন্তু বোকার মতো কাজ করেছে। সে এই বালকটিকে কেন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলো। সে মনে হয় এই

আত্মশ্লাগা অনুভব করতে চায় যে, অভিজ্ঞ সেনাপতিদের ব্যর্থতার পর অল্প বয়সী ভাতিজার হাতে বিজয় মাল্য পড়বে। আচ্ছা! রাণী বলল, সেই বালক সেনাপতি নাকি মহা রাজার কাছে বলার জন্য তোমাদের কাছে কি পয়গামও দিয়েছে?”

রাণীর এ কথায় তিন তরুণী পরস্পর চোখাচোখি করল। ওদের মনোভাব এমন যে, মহারাজার সামনে মুহাম্মদ বিন কাসিমের পয়গাম মুখে নিতে তারা ভয় পাচ্ছে এবং লজ্জাবোধ করছে। তারা সবাই মায়ারাণীর দিকে তাকাল। কি হলো, মহারাজকে বলো, আরব সেনাপতি মহারাজকে বলার জন্য কি পয়গাম দিয়েছে? বলল মায়ারাণী। “সে বলেছিল’ থমকে থমকে আড়ষ্ঠ কণ্ঠে বলল এক তরুণী। সে বলেছিল, লড়াই যুদ্ধক্ষেত্রে হয়ে থাকে, আর লড়াই হয় পুরুষে পুরুষে, আপনি যেন নারীদেরকে যুদ্ধে ব্যবহার না করেন…। সে আরো বলেছে, আপন বোনকে স্ত্রী করে ঘরে রাখার শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হবে। সে যেন কঠিন শাস্তির জন্য তৈরী থাকে।….

“ও, সে তো শুধু বালকই নয়, বহুত বড় কথা বলেছে?”

তরুণীদের বের করে দিয়ে রাজা দাহির মায়ারাণীকে বলল, এসব তরুণীদের ব্যাপারে এখন কি করা উচিত? “এরা এখন আর কোন হিন্দুর সংসার করার যোগ্য নয়” বলল মায়ারাণী। এরা মুসলমানের সাথে সংসার করে এসেছে। এদেরকে যে কোন মন্দিরে সেবিকা করে দেবো তাও সম্ভব নয়। আসার পর থেকেই আমি ওদের হাড়ি পাতিল আলাদা করে দিয়েছি। আমি এদেরকে আমার কাছেই রাখব। আমি ওদের পাঠিয়েছিলাম, আমি ওদের সাথে বেঈমানী করতে পারি না। কারণ ওরা আমার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।

“একথা ভুলে যেয়ো না মায়া। এই অস্বতী মেয়েগুলো আমাদের দেশের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনবে। ওদেরকে বেশী দিন তোমার কাছে রাখা ঠিক হবে না।”

সেই রাত শেষে দিনের প্রত্যুষে রাজ দরবারে বসে রাজা দাহির মন্ত্রীকে ‘ জিজ্ঞেস করল, সেই বৌদ্ধ কি এখনো পৌছেনি? রাজা দাহির জিজ্ঞেস করছিল নিরূনের শাসক সুন্দরীর কথা।

নিরূনের শাসক ছিল বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। তার নাম ছিল সুন্দরী। রাজা দাহির গোপনসূত্রে জানতে পেরেছিল সুন্দরী আরবদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু এনিয়ে সে শাসক সুন্দরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। কারণ এতে বিভিন্ন রাজ্যে গোলযোগ দেখা দিতে পারে। দাহিরের প্রতি অসন্তুষ্ট শাসকরা একের পর এক বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে। সাধারণত হিন্দুস্থানে এমন হয় না। কিন্তু বিলাসী ও আরাম প্রিয় শাসকরা বিদেশী আক্রমণে ভীত হয়ে লড়াই না করে আগাম বশ্যতা স্বীকার করে নেয়ার প্রবল আশঙ্কা ছিল। দাহির ছিল যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও কপট। বিদেশী আক্রমণ মুহূর্তে সে কোন সামন্ত শাসকের ওপর অত্যাচার চালানোর পক্ষপাতি ছিলনা। এতে রাজধানী থেকে বহু দূরে অবস্থিত কোন রাজ্যের শাসককে বাগে রাখার বিষয়টি যথেষ্ট কঠিন হয়ে যেত। দাহিরের বিশ্বাস ছিল, পূর্ববর্তী দুই আরব বাহিনীর মতোই তার সৈন্যরা মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাহিনীকেও ডাভেল অতিক্রমের সুযোগ দেবে না। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি ভিন্নতর হয়ে উঠল। এ কারণে সে সুন্দরীকে উরুঢ় ডেকে পাঠিয়েছিল। কথা মতো সেদিন থেকে দুই তিন দিন আগেই সুন্দরীর উরুঢ় পৌছে যাওয়ার কথা কিন্তু অতিরিক্ত তিনদিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও নিরূনের শাসক সুন্দরীর দেখা পাওয়া গেল না। সুন্দরীর অবস্থা দৃষ্টে রাজা দাহিরের দূত মারফত খবর পাওয়ার পরও তা তামিল করা জরুরী মনে করেনি। এদিকে নিরূনের শাসকের অনুপস্থিতিতে রাজা দাহির দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। সে তার উজির বুদ্ধিমানকে ডেকে পাঠালো।

“উজির! বৌদ্ধতো এখনো এলো না। এতে কি মনে হয় না সে আরবদের সাথে হাত মিলিয়েছে?”

“শত্রুদের সাথে হাত মিলাক বা না মিলাক। তবে সে যে কিছুটা বেপরোয়া হয়ে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। ..তবে চিন্তার কারণ নেই মহারাজ। সে অবশ্যই আসবে।”

“তোমার বিবেক বুদ্ধি কি বলে? ওর সাথে কেমন আচরণ করা উচিত?” জিজ্ঞেস করল রাজা দাহির। আমার বিরুদ্ধাচরণ কখনো আমি বরদাশত করব না।”

“এ মুহূর্তে বিরুদ্ধাচরণ সহ্য করা উচিত মহারাজ। সে যদি আসে, তাহলে তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ না করা ঠিক হবে যে, সে কেন আসতে বিলম্ব করল। তার সাথে আপনার এমন মনোভাব দেখানো উচিত, যেন সেও

আপনার মতোই একজন রাজা। কারণ আপনি তাকে বলতে চান সে যেন শত্রুদের সাথে হাত না মেলায়।”

হ্যাঁ, ঠিক বলেছ উজির। আমি তাকে ডেকে একথাই বলতে চাই।”

“আপনি তাকে একথাও বলে দিবেন, সে যেন, মুসলমানদেরকে আনুগত্যের প্রতারনায় ফেলে দেয়। শত্রুদের জন্য যেন শহরের দরজা খুলে দেয় এবং শহরে শত্রুদের স্বাগত জানায়। সকল শত্রু সৈন্য শহরে প্রবেশ করলে দরজা বন্ধ করে দিয়ে তার সেনাদের নিয়ে শত্রুদের ওপর হামলা করে। দুর্গ হাতে পাওয়ার কারণে মুসলিম সৈন্যরা লড়াইয়ে প্রবৃত্ত হতে চাইবে

সুন্দরীর যাতে শহরের বাসিন্দাদের বলে দেয়, প্রত্যেকেই যেন বাড়ীর ছাদে বড় বড় পাথর জমা করে রাখে। মুসলমান সৈন্যরা অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যখন দিক-বিদিক ছুটে অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়বে, তখন অধিবাসীরা ছাদের ওপর থেকে তাদের ওপর পাথর নিক্ষেপ করবে।”

“সে যদি আমার প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে আমি কি করব?”

মহারাজ! আপনি কি বিষাক্ত নাগিনীকে ঘরে পুষতে চান? আগুন আর নাগকে নিয়ে খেলার পরিণতি আপনি জানেন। আগুন সময় মতো পানি দিয়ে নিভিয়ে ফেলতে হয় আর কালনাগের মাথা সময় মতো কেটে ফেলতে হয়।

রাজধানীতে হবে না মহারাজ! সে যখন ফিরে যেতে চাইবে পথেই সাপের মাথা কেট দেবো। আর প্রচার করবো, ওকে মুসলিম গুপ্ত ঘাতকরা হত্যা করেছে।

এ কাজটি রাজধানীতে করা ঠিক হবেনা, উজির। “তার সাথে তো নিরাপত্তা রক্ষী থাকতে পারে।”

“নিরাপত্তারক্ষী থাকুক। গোটা সেনাবাহিনীতো আর নিয়ে আসবে না। হয়তো বারোজন নিরাপত্তা রক্ষী থাকবে। ওদের কোন বিশ্রাম শিবিরে হামলা হবে। ওরা যখন তাঁবু ফেলে রাস্তায় ঘুমাবে তখন আমার লোকেরা ওদের হত্যা করবে। সে ব্যবস্থা আমি করবো মহারাজ। আপনি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনি মনে করবেন এ ব্যাপারে আপনি কিছুই জানেন না।” সেই সন্ধ্যায় সুন্দশ্রী উরুঢ় পৌছল। রাজা দাহিরের কাছে যখন সংবাদ পৌছল নিরূনের শাসক আসছেন, তখন সে তাকে অভ্যর্থনার জন্য এগিয়ে গেল। নিরূনের শাসকের সাথে ছিল মাত্র ছয়জন নিরাপত্তারক্ষী। তার

আসবাবপত্র ছিল আটটি উটে বোঝাই করা। রাজা দাহির অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, সুন্দরীর নিরাপত্তারক্ষীরা এভাবে তাদের মাথায় পাগড়ী বেঁধেছে যে তাদের অর্ধেক চেহারাও ঢেকে গেছে। তাদের চোখগুলো শুধু নজরে পড়ছে।

এরা চেহারা ঢেকে রেখেছে কেন? দাহির সুন্দরীকে জিজ্ঞেস করল।

“আমার কাছে এদের এভাবে পাগড়ী পরাটাই ভালো লাগে। এজন্য এভাবে পাগড়ী পরতে বলেছি। জবাব দিলো নিরূন শাসক। এভাবে পাগড়ী পরলে বেশী ভীতিপ্রদ মনে হয়। নিরাপত্তারক্ষীদের পোষাক এমন হওয়া উচিত যাতে তাদের দেখলে ভীতিপ্রদ মনে হয়।

“দাহির তার কথায় হেসে হালকা ভাবেই গ্রহণ করল। কারণ তার সামনে এর চেয়েও আরো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে। তাই রাজা নিরূন শাসককে তার খাস কামরায় নিয়ে গেল।

“একথা কি সত্য যে তুমি মুসলমানদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছ।” দাহির জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ, মহারাজ। কথা সম্পূর্ণ সত্য। “তুমি কি কর দিতেও সম্মতি দিয়েছ?”

“হ্যাঁ, মহারাজ। আমি যে শহরের অধিবাসীদের শাসক, তাদের জানমালের নিরাপত্তার জন্য আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

“না সুন্দরী! এটা হতে পারে না। তুমি আমার মর্যাদা, সম্মান, তোমার ইজ্জত সম্মান আর শহরের অধিবাসী ও দেশের সম্মান শত্রুদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছ।” সেই সাথে খাজাঞ্চীখানার বিপুল সম্পদও শত্রুদের হাতে তুলে দিয়েছ। তুমি কি ভাবনি এরা বিধর্মী। আমাদেরকে গোলাম বাদী বানাতেই এরা আমাদের দেশে আক্রমণ করেছে?”

“মহারাজ! আমি একথাও ভেবেছি যে, এই বিধর্মীদেরকে আপনিই এদেশে ডেকে এনেছেন। এরা শুধু শুধু আমাদের দেশে সেনাভিযান চালায়নি।”

“সুন্দরী! তুমি আরবদের কোন দূত নও। তুমি আমার নিযুক্ত একটি অঞ্চলের শাসক। নিজের দেশের শাসকের মতো কথা বলো। তোমার তো উচিত নিজ দেশের জন্য লড়াই করে জীবন দেয়া।”

“আমার ধর্ম আমাকে লড়াই থেকে বিরত রেখেছে মহারাজ! তা ছাড়া আমরা নিজেরাই যেহেতু জালেম এমতাবস্থায় লড়াই করার শক্তি আমি পাইনি। মহারাজ কি বলবেন, নিজ দেশের গমনেচ্ছু আরবদের কোন্ অপরাধে কেন জেলখানায় বন্দি করে রেখেছেন?

“এদের সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই। ওদেরকে হয়তো ওরা লুট করেছে, যাদের ওপর আমার কোন শাসন নিয়ন্ত্রণ নেই।”

“আরব বন্দিরা ডাভেলের বন্দিশালায় রয়েছে মহারাজ! এখনও সময় আছে আপনি আরব বন্দীদের মুক্ত করে দিন।”

“আমি তোমার নির্দেশ মানতে বাধ্য নই, বরং তোমার উচিত আমার নির্দেশ মেনে চলা।”

“আমি মহাত্মা বৌদ্ধের হুকুম মানতে বাধ্য মহারাজ!” “তাই যদি হয়, তাহলে তুমি নিরূন ছেড়ে রাজধানীতে এসে পড়ো।”

“তাহলে আপনি নিরূনবাসীদের বলুন, তারা যেন আমাকে বিদায় করে দেয়। নিরূনের একটি অবোধ শিশুও যদি বলে সুন্দরীকে এখান থেকে প্রত্যাহার করে নিন, তাহলে আমি আরব সাগরের ঢেউয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দেবো। আমাকে যদি মহারাজ ওখান থেকে সরাতে চান, তাহলে নিরূনের জনগণ আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে।”

“কাদের কথা বলছো তুমি? এসব লোক আমার প্রজা, আমি ইচ্ছা করলে। ওদের না খাইয়ে মারতে পারি, ইচ্ছা করলে তাদের প্রচুর সম্পদ দিয়ে প্রাচুর্য এনে দিতে পারি।” “অহংকারে মত্ত হয়ে যাবেন না মহারাজ! এরা সেই সব লোক, যারা সৃষ্টিকর্তার প্রিয়। আপনি সৃষ্টিকর্তার ক্ষোভকে ভয় করুন। তাদেরকে অন্যায় যুদ্ধে ঠেলে দেবেন না। কারণ এমনটা যেন না হয় যে, মহারাজের রাজ্য দুই অপরাধের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। প্রভু তার সৃষ্ট মানুষের আবেদন শুনেন। প্রভুর কাছে তার সৃষ্টির শান্তি নিরাপত্তা পছন্দনীয়। বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির ধর্ম। ইসলামও সাধারণ মানুষের ধর্ম, যে ধর্ম মানুষে মানুষে প্রেম ভালোবাসার শিক্ষা দেয়।” “হু, তুমি কি সেই ইসলামের কথা বলছে, যে ধর্মের লোকেরা আমাদের পল্লীগুলোকে উজার করার জন্যে এসেছে?”

“তারা আমার শহরের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা দিয়েছে। তারা শান্তি ও নিরাপত্তার জবাবে ভালোবাসা ও হৃদ্যতাই প্রদর্শন করে থাকে। আপনি

তাদের পক্ষ থেকে সদাচরণের আশা করতে পারেন না। কারণ আপনার আগে আপনার পিতা, পিতামহ আরবদের পরাজিত করার জন্য পারস্য সম্রাটকে সামরিক সহযোগিতা করেছিল। অথচ পারস্য শাসকরা হিন্দুস্তানের সিন্ধু ও মাকরান অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে সব সময়ই অস্থির করে রাখতে। সিন্ধু অধিবাসী কয়েক হাজার জাটকে পারস্য বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে গোলামে পরিণত করেছিল। পারস্য শাসকরা ছিল আপনার বংশের শত্রু। কিন্তু আপনার পিতামহ মুসলমানদের শত্রুতার কারণে পারস্য শাসকদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করেছিল। সেই সাথে মাকরানের অধিবাসী মুসলমানদের সাথেও আপনার দাদা শত্রুতা শুরু করেন। তাদেরকে অস্থিতিশীল করার জন্য হিন্দু গোয়েন্দা ও লুটেরাদের সহযোগিতা দিতে শুরু করেন। আপনি নানা ভাবে আরব মুসলমানদের উত্তেজিত ও বিক্ষুব্ধ করার চেষ্টা করেছেন। আরব শাসকদের সাথে বিদ্রোহ করে যেসব মুসলমান হিন্দুস্তানে পালিয়ে এসেছিল আপনার পিতা ও পিতামহ তাদেরকে এখানে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়ে আরব শাসকদের সাথে শত্রুতাকে আরো শক্তিশালী করেন। বিদ্রোহীদেরকে আরব শাসকের বিরুদ্ধে সবসময়ই প্ররোচিত করেন। আপনার সময়ে আপনার অধীনস্থ লোকেরা আরবদের জাহাজ লুট করে তাদের মেয়ে শিশুসহ অধিবাসীদের কয়েদখানায় বন্দি করে রাখে। এতো সব করার পরও কি আপনার একথা বলা ঠিক যে, আরব সৈন্যরা আমাদের অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করতে এসেছে?

“হু, বুঝতে পেরেছি সুন্দর! তোমার ওপর মুসলমানদের ভূত সওয়ার হয়েছে।” বলল রাজা দাহির।

“মহারাজ বলছিলেন, আমি যেন নিরূনের শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে রাজধানীতে চলে আসি। এই সিদ্ধান্ত জনগণকে করতে দিন। আপনি যদি শক্তি প্রয়োগ করে আমাকে নিরূনের ক্ষমতাচ্যুত করেন, তাহলে নিরূনের অধিবাসীরা আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। জনগণ শান্তিতে বসবাস করতে চায়। এমনটাও হতে পারে যে, সৈন্যরাও জনতার কাতারে গিয়ে শামিল হবে।”

“রাজা দাহির সুন্দরীকে মুসলমানদের কর না দেয়ার জন্য সম্মত করাতে আপ্রাণ চেষ্টা করল এবং অনুরোধ করল, তিনি যেন মুসলমানদের আনুগত্য গ্রহণ না করেন। এক পর্যায়ে দাহির তার প্রধান উজির বুদ্ধিমানকে তলব করলেন।

“নিরূন শাসক সুন্দরী আজ রাতেই নিরূন ফিরে যাচ্ছে, তাকে সসম্মানে বিদায়ের ব্যবস্থা করো।

রাজার নির্দেশে উজির বুদ্ধিমান ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাজা দাহির নিরূন শাসককে তার ভোজন কক্ষে নিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসে আলাপ চারিতায় দীর্ঘক্ষণ কাটিয়ে দিলো। খাবার সময় রাজা দাহির নিরূন শাসককে এ প্রস্তাবও দিলো সে যদি মুসলমানদের আনুগত্য করা থেকে বিরত থাকে তাহলে তাকে নিরূনের স্বাধীন শাসক করে দেয়া হবে। কিন্তু সুন্দরী রাজার এ প্রস্তাব হাসি মুখে ফিরিয়ে দিলেন। ঠিক এ মুহূর্তে উজির বুদ্ধিমান ঘরে প্রবেশ করল।

রাজা দাহিরের দীর্ঘক্ষণ খাবার টেবিলে কালক্ষেপণের লক্ষ্য ছিল, সুন্দরীকে রাতেই বিদায় করে দিয়ে তার বিরুদ্ধাচরণের প্রতিশোধের ব্যবস্থা করা। সুন্দরী রাতেই ফিরে যাওয়ার কথা উত্থাপন করেন নি, কিন্তু রাজা আগ বাড়িয়ে তাকে সসম্মানে বিদায় করার মধ্যে উজির বুদ্ধিমানের সাথে আগের দিনের চক্রান্ত বাস্তবায়নের ইঙ্গিত ছিল। “উজির কক্ষে প্রবেশ করেই জানতে চাইলো, সম্মানিত নিরূন শাসক কি যাত্রার জন্য প্রস্তুত?

“সুন্দরী জবাব দিলো, হ্যাঁ বুদ্ধিমান, আমি প্রস্তুত।” কিছুক্ষণ পর রাজ প্রাসাদ থেকে সুন্দরী তার মুখ ঢাকা ছয়জন নিরাপত্তা রক্ষীসহ বের হলেন। তাদের আগে রাজার নিরাপত্তা বাহিনীর একটি দল যাচ্ছিল। উজির বুদ্ধিমান অশ্বারোহণ করে নিন শাসকের পাশাপাশি যাচ্ছিল। সময়টা ছিল রাতের প্রথম প্রহর। চাঁদনী রাতের চাঁদের জ্যোত্সা স্নাত শান্ত নিবিড় প্রকৃতি। রাজা দাহির নিরূন শাসককে বিদায় করার জন্য তার একান্ত নিরাপত্তা রক্ষীদের একটি দলকে পাঠিয়েছিল।

“নীরবে অভিযাত্রী দল এগুচ্ছিল। রাতের নীরবতা ভাঙছিল অশ্বখুরের আওয়াজে। দুর্গ থেকে কয়েক মাইল অগ্রসর হওয়ার পর উজির বুদ্ধিমান নিরূন শাসককে থামতে অনুরোধ করল। সে হাতজোড় করে নিরূন শাসককে প্রণাম করে বিদায় আরজ করল। দাহিরের নিরাপত্তারক্ষীরা ডানে বামে সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে গেল। নিরূন শাসকের ছয় নিরাপত্তারক্ষী তাদের মাঝ দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে অগ্রসর হলো। অতঃপর উজির বুদ্ধিমান নিরাপত্তারক্ষীদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজের ঘোড়া দুর্গের দিকে হাঁকালো। বুদ্ধিমানের পদাঙ্ক অনুস্মরণ করে দাহিরের নিরাপত্তা রক্ষীরা অশ্ব ছুটালো।

দুর্গে প্রবেশ করে প্রথমেই উজির বুদ্ধিমান রাজার প্রাসাদে প্রবেশ করল।

“তোমার আয়োজন ব্যর্থ হবে না তো বুদ্ধিমান?” আশঙ্কা মাখা কণ্ঠে বলল রাজা দাহির।

“সকালে ঐ বৌদ্ধ আর তার নিরাপত্তা রক্ষীদের মরদেহ দুর্গে প্রবেশ করবে মহারাজ! আমি নির্বাচিত বিশজন সৈন্যকে পাঠিয়েছি। এরা সেনাবাহিনীর পরীক্ষিত বীর যোদ্ধা। ওরা উটে সওয়ার হয়ে গেছে। কেউ যাতে সেনাবাহিনী হিসেবে সন্দেহ করতে না পারে এজন্য মুসাফিরের বেশে তাদের সাথে কয়েকজন নারীকেও দিয়েছি। বেলা ওঠার আগেই সুন্দরী কোন জায়গায় অবশ্যই তাঁবু ফেলবে। যেখানেই ওরা তাবু ফেলুক, সেখানে কিছুক্ষণ ঘুমাবে। আর তখন ওদের প্রহরীরাও ঘুমাবে সেটাই হবে ওদের শেষ ঘুম। সেই ঘুম থেকে আর উঠতে পারবে না।” “এ বৌদ্ধকে জীবিত নিরূন যেতে দেয়া ঠিক হবে না।” বলল রাজা দাহির।

“নিরূন যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না মহারাজ! আপনি নিরূনের জন্যে নতুন করে কাউকে প্রশাসক নিযুক্ত করুন।”

“নিরূনের এখনকার শাসক হবে আমার ছেলে জেসিয়া।

মহারাজ। সুন্দরীর সাথে যেসব প্রহরী এসেছিল এদেরকে দেখে এ দেশের অধিবাসী বলে মনে হয়নি। ওদের নাক, কপাল, মাথা, চেহারা সবই ঢাকা ছিল। শুধু চোখগুলো দেখা গেছে। সুন্দরীকে নিয়ে আপনি যখন বৈঠক করছিলেন তখন ওরা সারা দুর্গ জুড়ে পায়চারি করেছে আর ফিসফিস করে পরস্পর কথা বলতে দেখা গেছে। ওদের হাভভাবও আমার কাছে ভিন্ন রকম মনে হয়েছে। আমি ওদের ঘোড়ার জিনগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি এগুলো এদেশের তৈরী নয়। “হ্যাঁ, এজন্যইতো ওরা চেহারা ঢেকে রেখেছিল।” বলল দাহির। তার মানে এরা আরব? তাহলে ও বৌদ্ধ এরই মধ্যে আরবদের সাথে দোস্তি করে ফেলেছে এবং নিরাপত্তারক্ষী হিসাবে আরব লোক নিয়োগ করেছে।”

“যাই হোক। আজ রাত শেষে সেও আর থাকবে না, তার প্রহরীদেরও কোন পাত্তা থাকবে না।” বলল উজির বুদ্ধিমান। “উজির বুদ্ধিমান যখন রাজা দাহিরের সাথে সুন্দরীর জীবনাবসান নিয়ে কথা বলছে সুন্দরী তখন তার ছয় আরব প্রহরীকে নিয়ে নিরূনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নিরূন থেকে উরুঢ় যাতায়াতের জন্য মরুবিজন পথে একটি

পায়ে হাটার রাস্তা তৈরী হয়েছিল। এ পথেই সামরিক বাহিনীর লোকেরা যাতায়াত করত। পথিমধ্যে একটি জায়গা ছিল সবুজ শ্যামল। ওখানে পানির উৎস ছিল।

সুন্দরীর ছয় প্রহরীর সবাই ছিল আরব। তন্মধ্যে একজন ছিল হারেস আলাফীর নিজস্ব লোক। সে এখানকার পথঘাট জায়গা ও ভাষা জানতো। আর অন্য পাঁচজন ছিল মুহাম্মদ বিন কাসিমের সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ যোদ্ধা।

নিরূন শাসক সুন্দরী একদিন মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে একদূত মারফত খবর পাঠিয়েছিল, রাজা দাহিরের পক্ষ থেকে সে জীবননাশের আশঙ্কা করছে। তাই তার জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে তিনি উদ্বিগ্ন। এদিকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে সংবাদ পাঠিয়েছিলেন, নিরূন শাসক সুন্দরী আমাদের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে। তাই তার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে। সেই সাথে তার শহরের অধিবাসীদের জীবন সম্পদের নিরাপত্তার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সুন্দরশ্রীর চাহিদা পূর্ণ করা তখনো মুহাম্মদ বিন কাসিমের পক্ষে সহজ ছিল না। কারণ এক সাথে তার সকল সৈন্যকে নিরূন নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।

তাকে ধীরে ধীরে চতুর্দিক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সামনে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। তিনি অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য তার সেনা বাহিনীর বার জন চৌকস গোয়েন্দাকে হারেস আলাফীর দেয়া পথ প্রদর্শকের সাথে নিরূন পাঠিয়ে দিলেন। এদের পাঠানোর আগে তিনি এ ব্যাপারে আলাফীর সাথে অতি সঙ্গোপনে পরামর্শ করে নিলেন। আলাফী মুহাম্মদ বিন কাসিমকে বললেন, নিরূনে আপনার গোয়েন্দার অবস্থান খুব জরুরী। আপনি কয়েকজন লোক দিন তাদের সাথে আমিও একজনকে দিচ্ছি। সে নিরূন শাসককে বলবে, তিনি যেন এদের সবাইকে নিরাপত্তারক্ষী হিসাবে নিয়োগ দেন। যেহেতু সুন্দরীর সাথে শান্তিচুক্তি হয়ে গেছে, সে চুক্তি মেনে চলবে। আপনার ও আমার লোকেরা শহরের লোকদের গতিবিধি যেমন পর্যবেক্ষণ করবে তারা সুন্দরীকেও পর্যবেক্ষণ করবে, সে চুক্তিপত্র করে আমাদের সাথে কোন ধোকাবাজী করছে কিনা।

এই উসিলায় মুহাম্মদ বিন কাসিমের চার গোয়েন্দা সুন্দরীর একান্ত নিরাপত্তারক্ষী হিসাবে নিয়োগ লাভ করে। এদের পাঠানোর আগে বিন কাসিমের গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী তাদের বিশেষভাবে দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

উরুঢ়ের রাজার পক্ষ থেকে যখন সুন্দরীকে রাজধানীতে তলব করা হলো, তখনই সুন্দরী বুঝতে পেরেছিলেন, সেখানে কি ঘটতে পারে। কিন্তু রাজা দাহিরকে তখন তিনি মোটেও ভয় করেননি। তিনি ছিলেন যেমন বাস্তবদর্শী তেমনই সাহসী। তিনি তার সাবেক নিরাপত্তারক্ষীদের সাথে নিয়েই উরুঢ় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কিন্তু আলাফীর লোক তাকে বোঝালেন এরা সবাই হিন্দু। রাজা দাহিরের সাথে বিরোধ প্রশ্নে হিন্দু বিধায় ওরা দাহিরের পক্ষাবলম্বন করবে। তাই ওদের বাদ দিয়ে আমাদের সাথে নিয়ে চলুন। আরব গোয়েন্দারাই তাকে বুঝিয়েছিল, তারা চেহারা ঢেকে যাবে, যাতে তাদেরকে দেখে কেউ আরব হিসাবে চিনতে না পারে। এদিকে মুহাম্মদ বিন কাসিমের পাঠানো গোয়েন্দাদেরকে সুন্দরী নিরাপত্তা বাহিনীতে নিযুক্ত করে তার সভাসদ ও প্রজাদের কাছে প্রচার করেছিলেন, এরা সবাই মাকরানে বসবাসকারী আমাদের সহযোগী মুসলমান।

সেই রাত পেরিয়ে ভোরের আলো দেখা দিলো কিন্তু নিরূন শাসকের ছোট্ট কাফেলা কোথাও একদণ্ড যাত্রা বিরতি করল না। মরুভূমিতে সূর্য উঠে চতুর্দিকে আলো ছড়িয়ে দিয়ে বেলা বাড়তে লাগল, কিন্তু সুন্দরীর কাফেলা বিরতিহীন ভাবে অগ্রসর হতেই লাগল। এদিকে সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগেই রাজা প্রহরীদের জিজ্ঞেস করল উজির বুদ্ধিমান এসেছে কি? প্রহরীরা তাকে জবাব দিলো, না মহারাজ! উজির আসেননি!

“যখনই আসবে ভিতরে পাঠিয়ে দেবে” বেলা প্রায় মাথার ওপরে উঠে গেলেও বুদ্ধিমানের দেখা না পেয়ে রাজা দাহির আবারও জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার। বুদ্ধিমান এখনো আসেনি? তখন সে প্রহরীদের নির্দেশ দিলো তাকে ডেকে নিয়ে এসো। প্রহরীরা উজিরের বাড়ীতে গিয়ে তাকে পেলো না। এদিক সেদিক খোজা খোঁজির পর দুর্গপ্রাচীরের ওপরে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলো প্রহরীরা। উজির বুদ্ধিমান দুর্গপ্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে নিরূনের পথের দিকে তার পাঠানো সেনাদের আগমন প্রতীক্ষা করছিল। বেলা ওপরে উঠে যাওয়ায় মাঠের ধু ধু বালিকারাশি চমকাচ্ছিল, দূর দরাজ পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছিল তাতে বুদ্ধিমানের পাঠানো লোকদের দেখা যাচ্ছিল না। সে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে তার পাঠানো উষ্ট্রারোহীর আগমন প্রতীক্ষা করছিল, কারণ এতক্ষণে তাদের ফিরে আসার কথা কিন্তু তখনও পর্যন্ত কোন উষ্ট্রারোহীকেই এ পথে দেখতে পেলনা বুদ্ধিমান।

তাকে প্রহরীরা খবর দিলো, আপনাকে মহারাজ তলব করেছেন। আমরা আপনার খোঁজে দুর্গময় খোঁজ করেছি। ‘ ‘হতাশ ও ভগ্ন হৃদয়ে উজির বুদ্ধিমান দুর্গপ্রাচীর থেকে নেমে রাজার সকাশে হাজির হলো। “তুমি তো বুঝতেই পারছ, কিসের জন্য আমি তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি বুদ্ধিমান” “আমিও আপনার খবরের জন্যই দুর্গপ্রাচীরে অপেক্ষা করছিলাম মহারাজ। আমি তাদের আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মনে হয় ওরা অনেক দূরে চলে গেছে। মনে হয় রাতে সুন্দরী কোথাও থামেনি। রাতে না থামলেও দিনের বেলায় কোথাও না কোথাও সে অবশ্যই থামবে। দিনের বেলায় কোথাও তাবু ফেলে যদি ওর প্রহরীরা শুয়ে পড়ে তখনই ওদের খতম করে ফেলবে আমার সৈন্যরা। আজ রাত না থামলেও আগামী রাতে তো অবশ্যই সে কোথাও না কোথাও তাঁবু ফেলবে। তখনই তার জীবনাবসান করে দেবে আমার লোকেরা। আশা করি আজ রাতে না হলেও আগামী দিনের বেলায় ওরা ফিরে আসবে মহারাজ!

সেই দিন চলে গেল, রাত পেরিয়ে পরে দিনের বেলাও ওপরে উঠে গেল, বুদ্ধিমান আগের দিনের মতো সেদিনও দুর্গপ্রাচীরে গিয়ে তার পাঠানো সৈন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল কিন্তু কোন উষ্ট্রারোহীর কাফেলা এদিকে অ’তে দেখতে পেলো না বুদ্ধিমান। উজির বুদ্ধিমানের চেয়ে রাজা দাহির ছিল আরো বেশি পেরেশান। তৃতীয় দিন পেরিয়ে গেল। চতুর্থ দিন বুদ্ধিমানের পাঠানো লোকেরা ফিরে এলো। বুদ্ধিমানের পাঠানো সেনাদলের কমান্ডার নতশীরে বুদ্ধিমানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “মিশন সফল হয়নি মাননীয় উজির”। “কেন সফল হয়নি” গর্জে উঠলো উজির। তোমরা কি এই সুন্দরীদের নিয়ে মেতে উঠেছিলে? যাদেরকে তোমাদের সাথে পাঠিয়েছিলাম?” না মাননীয় উজির। আমরা কোথাও একদণ্ড স্বস্তির নিঃশ্বাস নেইনি। আমরাতো একেবারে নিরূনের কাছ থেকে ফিরে এসেছি। কিন্তু পথের কোথাও আমরা ওদের দেখা-ই পাইনি। মনে হয় তারা রাস্তা বদল করে অন্য কোন পথে চলে গেছে। ‘ব্যর্থতার খবর শুনে উজির বুদ্ধিমানের জিহ্বা শুকিয়ে এলো। সে শুষ্ক কণ্ঠে রাজাকে জানালো, শিকার হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে মহারাজ!

“শিকার যায়নি বলতে পারো নিরূন হাত ছাড়া হয়ে গেছে” উজিরের উদ্দেশে বলল রাজা দাহির। “ঠিক আছে। এখন অন্য কিছু ভাবো। যা হয়ে গেছে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা আর অনুশোচনা করে সময় নষ্ট করো না।” “তাই ভাবছি মহারাজ! বৌদ্ধটা গেল কোন পথে? তাহলে কি ওর মনে কোন আশঙ্কা ছিল?

“সাপ পালিয়ে গেছে। সাপকে বধ করতে না পেরে ওর গমণপথের চিহ্ন দেখে দেখে আফসোস করার মধ্যে মঙ্গল নেই। এখন চিন্তা করো নিরূনের লোকদেরকে কিভাবে ওর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা যায়। ওখানকার মানুষ এখন শান্তিবাদী হয়ে গেছে। সবাই শান্তি চায়। বুঝতে পারিনা, সুন্দরী নিরূনের অধিবাসীদের মধ্যে কি মন্ত্র ছড়িয়ে দিয়েছে। ওখানকার সব অধিবাসীই কাপুরুষ হয়ে গেছে। ওরা সবাই একবাক্যে ওর কথাই শোনে, ওরই আনুগত্য করে।” বলল রাজা দাহির।

“সুন্দরীর আনুগত্য দূর করতে একটা কিছু করতেই হবে মহারাজ!”

আর কবে করবে? আমারতো মনে হয় তোমার বুদ্ধিজ্ঞান এখন লোপ পেয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছে আমি যদি সুন্দশ্রীকে শাসকের পদ থেকে বরখাস্ত করি তাহলে সেখানে অগ্নোৎপাৎ শুরু হবে। আমি তাকে নিজের ঘরের মধ্যেই খুন করাবো। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে তাকে ছলেবলে রাজধানীতে নিয়ে আসবো। যদি সে নিরূন ত্যাগ করতে অস্বীকার করে তাহলে আমি তার বিরুদ্ধে সেনাভিযান করব।”

“আপনাকে কিছুই করতে হবে না মহারাজ! বলল উজির। পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে নয়। শত্রু বাহিনী ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে। এমতাবস্থায় আপনার সামান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও বিক্ষুব্ধদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। এখন যে কোন পদক্ষেপ আমাদেরকে ভেবে চিন্তে নিতে হবে। মহারাজা নিরূনের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমরাই দায়ী। আমরা বৌদ্ধদের উপাসনালয়গুলো গুড়িয়ে দিয়েছি। তাদের ওপর নানা জুলুম চালিয়েছি। তদুপরি মহারাজ এক বৌদ্ধকেই সেখানকার শাসক নিযুক্ত করেছেন। শুধু সুন্দশ্রীইতো নয়, বহু বৌদ্ধকে মহারাজ উচু ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছেন। বহু শহরের শাসন ক্ষমতায় রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোক। সবাই যদি সুন্দরীর মতো পর্দার আড়ালে মুসলমানদের সাথে আঁতাত করে ফেলে তাহলে পরিস্থিতি সামলানো আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

এতবেশি চিন্তার দরকার নেই। তুমি নিরূনের কথা বলো। আমি ভাবছি, আরব সৈন্যরা যদি ডাবেল থেকে আরো সামনে অগ্রসর হয়, তাহলে তারা নিরূন (হায়দারাবাদ) কেই তাদের সেনা ছাউনিতে পরিণত করবে। রাজার কথায় গভীর চিন্তায় পড়ে গেল উজীর বুদ্ধিমান। রাজা দাহির এক নাগাড়ে কথা বলেই যাচ্ছিল কিন্তু উজিরের কানে সেসব কথা প্রবেশ করছে বলে মনে হচ্ছিল না। সে কিভাবে হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া নিরূনকে কব্জা করা যায় সেই চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। রাজা দাহির আর উজির বুদ্ধিমান যখন নিরূনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চিন্তামগ্ন, সে সময় নিরূন শাসক নিরাপদে তার অনুগত প্রহরী বেষ্টিত অবস্থায় নিরূনের রাজাসনে উপবিষ্ট। নিরাপদে তিনি মৃত্যু এড়িয়ে হায়দারাবাদ পৌছতে পেরেছিলেন মুসলমান রক্ষীদের বুদ্ধিমত্তায়। রাজা দাহিরের উজীর বুদ্ধিমান তার সৈন্যদের নিয়ে নিরূন শাসককে বিদায় সংবর্ধনা দিয়ে সামরিক কায়দায় তরবারী নীচু করে তাকে সম্মান জানিয়ে বিদায় নেয়। এরপর কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পর নিরূন শাসকের ছয় নিরাপত্তা রক্ষীর কমান্ডার সবাইকে থামিয়ে দেয়। তার নাম ছিল ইবনে ইয়াসির। সে ছিল গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীর একান্ত লোক।

ইবনে ইয়াসির মাকরানবাসী নিরাপত্তা রক্ষীর মাধ্যমে সুন্দরীর কাছে জানতে চাইলো, “সম্মানিত নিরূন শাসক! রাজা কি প্রায়ই এভাবে আপনাকে ডেকে পাঠায়? আপনি কি প্রায়ই রাজধানীতে আসেন?” “মাঝে মধ্যে রাজা ডেকে পাঠায়, আবার কখনো কখনো গভর্নররা নিজ থেকেও রাজার সাথে দেখা করতে আসেন।”

“কখনো কি এমন হয়েছে যে, আপনি সন্ধ্যায় এখানে এসেছেন আর রাতেই আপনাকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে?”

“না, এমনটি আর কখনো হয়নি।” বললেন সুন্দরী। এই প্রথম আমার সাথে এমন আচরণ করা হয়েছে। সাধারণত যেসব গভর্নর এখানে আসে, তাদেরকে দুই তিন দিন রাজ প্রাসাদে রেখে খুব খাতির যত্ন করা হয়।

“আপনি কি রাতেই ফিরে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন?”

“না, রাজা নিজেই তার উজিরকে ডেকে বললেন, সুন্দরী রাতেই ফিরে – যাবে, তার ফিরে যাওয়ার বন্দোবস্ত করা হোক।”

“প্রতিবারই কি আপনাকে এমন সামরিক সম্মানের সাথে বিদায় জানানো হতো?”

“না, এমনটি আর কখনো করা হয়নি।” কিছুটা বিস্মিত কণ্ঠে জবাব দিলেন নিরূন শাসক। আমি নিজেও কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। আজ আমাকে এতোটা সম্মান করা হচ্ছে কেন? আমি মনে করেছি রাজা আমাকে তোমাদের আনুগত্য প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। উদ্দেশ্য অর্জনে হয়তো রাজা আমার মন জয় করার জন্য একটু বেশী সম্মান দেখাচ্ছেন।”

“তার অনুরোধে আপনি কি বলেছেন?”

“আমি রাজাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি, মুসলমানদের সাথে আমি যে মৈত্রী চুক্তি করেছি, তা থেকে আমি বিচ্যুত হবো না। আমি তাকে একথাও বলে এসেছি, আমি আমার শহরের নাগরিকদের বিবি বাচ্চার, জীবন সম্পদ আর মান-সম্মানের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি।” “তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই এপথ ত্যাগ করে অন্য পথে নিরূন ফিরতে হবে।”

“কেন! রাস্তা বদল করতে হবে কেন?” জিজ্ঞেস করলেন নিরূন শাসক সুন্দরী।

“রাতে কোন না কোন জায়গায় আপনার ওপর হামলা করা হবে। আপনাকে কোন অবস্থাতেই নিরূন ফিরে যেতে দেয়া হবে না।”

‘আমারতো মনে হয় রাজা দাহির এসময় এমন কোন পদক্ষেপ নেবে।” এটা হয়তো তোমার একটা আশঙ্কা মাত্র।” বললেন নিরূন শাসক।” ‘সম্মানিত শাসক। আমরা আপনাদের দেশের ধোকা প্রতারণার বহু কাহিনী শোনেছি। কিন্তু আপনি আরবদের দরদর্শিতা, তীক্ষ্ণধী ও প্রচার কাহিনী তেমন শুনেনি। আপনি যখন রাজ মহলে রাজার সাথে বৈঠক করছিলেন, তখন আমরা দুর্গময় চষে বেড়িয়েছি। আমি শাহি খান্দানের এক ব্যক্তিকে দেখেছি খুবই ব্যস্ততার সাথে দৌড়াদৌড়ি করতে। পরে জানতে পারি এই লোকটিই রাজার উজির বুদ্ধিমান। আমি দেখেছি আপনি রওয়ানা হওয়ার কয়েকঘন্টা আগে তিনি উষ্ট্রারোহী একটি কাফেলাকে দুর্গফটক পর্যন্ত এগিয়ে এসে বিদায় দিয়েছেন, সেই কাফেলায় কয়েকজন মহিলাও ছিল। আমি দেখেছি, উজির কাফেলার লোকদের অনেকক্ষণ কি যেন বলেছে এবং কাফেলার একজনকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে একাকীত্বে অনেক কথা বলেছে। উষ্ট্রারোহী কাফেলা যখন দুর্গফটক পেরিয়ে গেল উজিরও তাদের সাথে বেরিয়ে গেল। আমি তখন দুর্গফটকের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। কাফেলার যাত্রা ভঙ্গিটাই দেখে মনে হচ্ছিলো এই কাফেলা কোন সাধারণ

কাফেলা নয়। এজন্য আমি এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম উজির দুর্গে ফিরে এসে রাজার বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্রিফিং দিচ্ছে এবং তাদেরকে প্রস্তুত করছে। এই নিরাপত্তারক্ষীরাই পরবর্তীতে আপনাকে বিদায়ী সম্মান জানিয়েছে। এতে আমার সন্দেহ দৃঢ় হয়েছে যে, যে উদ্ভারোহী কাফেলা আগে বিদায় করা হয়েছে, সেই কাফেলা সাধারণ কোন মুসাফির কাফেলা নয়, অবশ্যই তারা সেনাবাহিনীর লোক এবং রাতের কোন না কোন প্রহরে তারা আমাদের ওপর আঘাত হানতে পারে!

“তোমার ধারণা অমূলক নয়।” বললেন সুন্দরী। আমাকে কোন না কোনদিন খুন করা হবে তা প্রায় নিশ্চিত। ঠিক আছে তুমি রাস্তা বদল করে নিতে পারো।” “আমরাতো এখানকার পথঘাট ঠিকমতো চিনি না, কোন পথে গেলে আমরা নিরাপদে নিরূন পৌছাতে পারব, তা আপনিই ভালো বলতে পারবেন।” বললেন ইবনে ইয়াসির।

“বিকল্প পথ অবশ্য একটা আছে কিন্তু পথটা খুবই জটিল এবং কণ্টকাকীর্ণ। টিলা, জঙ্গল আর ঝোপঝাড়ে ভরা। এমন হতে পারে যে, আমরা ঘুরে ফিরে একই জায়গায় চক্কর খাচ্ছি।”

হোক না ঝুকিপূর্ণ, আপনি সে পথেই চলুন।

“শাবান ছাকাফীর পরীক্ষিত গোয়েন্দা ইবনে ইয়াসির ছিল এ ধরনের জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ পথেও লক্ষ ও সুনির্দিষ্ট দিক নির্ণয়ে পারদর্শী। সে নতুন অজানা পথেই সুন্দরীকে নিরূন নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। এর কিছু দিন পরের ঘটনা। হঠাৎ এক রাতে নিরূনবাসী এক তরুণির বিকট আর্তচিৎকার শুনতে পেল। নারী কণ্ঠের আর্তচিৎকার শুনে কয়েকজন লোক ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো, কিন্তু তাদের পক্ষে ঠাহর করা সম্ভব হচ্ছিল না কোখেকে আসছে এই আর্তচিৎকার। লোকজন নারী কন্ঠের আর্তচিৎকার শুনে এদিক ওদিক দৌড়াতে লাগল, কোথেকে চিৎকারটা আসছে তাকে দেখার জন্য। এমন সময় হঠাৎ আওয়াজ এলো ওপরের দিকে তাকাও। লোকজন যখন ওপরের দিকে তাকালো তখন দেখতে পেল, বাতাসের মতো একটা আগুনের শিখা শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত কয়েকবার বয়ে গেছে। আগুনের শিখার ঘূর্ণনে শহরের লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো আতঙ্ক। অধিকাংশ লোক ঘরের দরজা বন্ধ করে ভয়ে আতঙ্কে জড়সড় হয়ে থাকল, আর কিছু লোক ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে শহরের বাইরে পালাতে লাগল।

শোরগোলের আওয়াজে গভর্নর সুন্দরীও ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি নিজ চোখে আকাশে আগুন শিখার ঘুর্ণন দেখতে পেলেন। যেহেতু তিনি ছিলেন শাসক এবং শহরের লোকদের নিরাপত্তা দানের কাজটি তিনি নিজের কর্তব্য মনে করতেন, তাই তিনি ভয়ে ঘরের ভিতরে না গিয়ে শহরে বেরিয়ে পড়লেন এবং আকাশে ঘূর্ণমান আগুন প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। আগুনের একটি শিখা শহরের আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল, আর আর্তনাদের মতো একটা আওয়াজ ভেসে আসছিল। পরিস্থিতি এমন হয়ে পড়েছিল যে, ভীত সন্ত্রস্ত লোকজন বিষয়টাকে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করল না, যে যেদিকে পারলো ভয়ে ছুটে পালাতে লাগল। আকাশে আগুন শিখার ঘূর্ণনের সাথে সাথে শহরের মন্দির ঘরগুলোতে বিপজ্জনক ঘন্টা অবিরাম বাজতে লাগল। সেই সাথে মন্দিরের পুরোহিতরা বিশেষ শিঙ্গা বাজাতে শুরু করল। মন্দিরের ঘন্টা আর পুরোহিতদের শিঙ্গার বেসুরো আওয়াজ আর আকাশের আর্তনাদ মিলে সত্যিকার অর্থেই রাতের নিস্তব্ধ শহরে একটা ভূতুড়ে পরিস্থিতির জন্ম দিল। সারা শহর কেঁপে উঠল অজানা আশঙ্কায়। এই ভয়ানক পরিস্থিতি কয়েক ঘন্টা অব্যাহত থাকল।

হিন্দু অধিবাসীরা তাদের ঘরে ঘরে পূজা অর্চনায় লেগে গেল, বৌদ্ধরা তাদের মতো করে ঘরে ঘরে উপাসনায় লিপ্ত হয়ে গেল। সুন্দরী পরিস্থিতি অবলোকন করে তার প্রাসাদের দিকে ফিরে এলেন। তিনি প্রাসাদের কাছে এসে দেখতে পেলেন, তার আরব নিরাপত্তারক্ষীরা প্রাসাদের বাইরে দাঁড়িয়ে অবস্থা অবলোকন করছে। নিরাপত্তারক্ষীদের উদ্দেশ্যে সুন্দরী বললেন, “বন্ধুরা উপস্থিত দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হিন্দু ও বৌদ্ধরা পূজা অর্চনা ও উপাসনায় লিপ্ত হয়েছে, তোমরা এই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য তোমাদের ইবাদতে লেগে যাও। বুঝতে পারছি না, কি বিপদ ঘনিয়ে আসছে! ভয় হচ্ছে, যেসব আগুনের কুণ্ডলী আকাশে দেখেছি, এসবের একটিও যদি জমিনে নেমে আসে, তাহলে সারা শহরে আগুন লেগে যাবে।”

“সম্মানিত শাসক। আমাদের প্রভু আমাদেরকে এ ধরনের বিপদ দিয়ে কখনো আতঙ্কিত করেন না।” বলল এক আরব নিরাপত্তারক্ষী।

“আরে! তুমি কি দেখতে পাচ্ছে না, এই বিপদ আসমান থেকে আসছে?”

“সম্মানিত গভর্নর। আপনি ভিতরে চলে যান। বিপদ না ছাই আমরা দেখছি।” বলল ইবনে ইয়াসীর।

সুন্দরী ঘরে প্রবেশ করতে না করতেই তরুণির আর্তচিৎকার বন্ধ হয়ে গেল। সেই সাথে আকাশে অগ্নিকুণ্ডের দাপাদাপিও বন্ধ হয়ে গেল। কিছু লোক রাতেই শহরের প্রধান মন্দিরে চলে গেল। যারা রাতে যেতে পারল না তারা ভোরেই প্রধান মন্দিরে গিয়ে জড় হতে লাগল। শহরের প্রধান মন্দিরটি ছিল বিশাল জায়গা জুড়ে আর অপেক্ষাকৃত উচু জায়গায়। মন্দিরটির চারপাশে ছিল খোলা আঙ্গিনা। টিলার মতো উঁচু মন্দিরে উঠতে কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভাঙতে হয়। সকাল বেলায় মন্দিরে এতো লোক জমায়েত হলো যে মন্দিরের ভিতরে বাইরে মন্দিরের আঙ্গিনায় ও সিঁড়ির কোথাও তিলধারনের জায়গা খালি ছিল না।

ছেলে বুড়ো নারী শিশু সব বয়সের মানুষে লোকে লোকারণ্য মন্দির প্রাঙ্গণ। মন্দিরের ভিতরে পুরোহিতরা মূর্তির সামনে হাত জোড় করে আর্ত কণ্ঠে প্রার্থনা করছে। আর মন্দিরের বাইরে সমবেত লোকজনও পুরোহিতদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে করজোড়ে দেবদেবীদের কাছে মিনতি করছে।

প্রার্থনা শেষে মন্দির আঙ্গিনায় সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে প্রধান পুরোহিত বলল, “হে লোকসকল! এই শহরের ওপর কঠিন মুসিবত নেমে আসতে পারে। মনে হচ্ছে, এই শহরে এমন কোন মানুষ এসেছে, যাদের উপস্থিতি আমাদের দেবদেবী পছন্দ করেন না। দৃশ্যত মুসিবত সমুদ্রের দিক থেকে আসছে। এই শত্রুদের মোকাবেলার জন্য তৈরী হয়ে যাও। তোমরা যদি এই শ্লেচ্ছাদের জন্য শহরের দরজা বিনা প্রতিরোধে খুলে দাও, তাহলে দেবতা এই শহর আগুনে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেবেন।”

প্রধান পুরোহিতের সতর্কবাণী শুনে ভীত বিহ্বল অবস্থায় লোকজন বাড়ী ঘরে ফিরে এলো। সারা দিন শহরময় রাতের ভয়ানক অগ্নিকুণ্ডলী নিয়েই সবাই পরস্পর আলাপ আলোচনা করল! আর ভয় আতঙ্ক সারা শহরবাসীকে আরো ভীত সন্ত্রস্থ করে তুলল। পরদিন মধ্যরাতে ঠিক পূর্বরাতের মতোই এক তরুণির আর্তনাদ শোনা গেল। আজকের আর্তনাদ ছিল গতরাতের চেয়েও আরো ভয়ার্ত। সেই সাথে আগুনের কুণ্ডলী সারা শহরের ওপর চক্কর দিতে লাগল। লোকজন ভয়ে আতঙ্কে নিজ নিজ ঘরে জড়সড় হয়ে বসে রইল আর মন্দিরগুলোতে বিশেষ ঘণ্টা ও শঙ্খধ্বনী বাজতে শুরু করল।

রাতটা কোনমতে ভয় আতঙ্কের মধ্যে অতিবাহিত হওয়ার পর সকাল হতেই লোকজন শহরের প্রধান মন্দিরে ভীড় জমালো। বিপুল হিন্দু জনগোষ্ঠির মধ্যে যেসব লোক বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল তারা বৌদ্ধ মঠে

জমায়েত হলো। সারা শহরজুড়ে একটা কথা চাওর হয়ে গেল যে, অবশ্যই এই শহরে এমন কোন অভিশপ্ত লোক এসেছে, যাদের উপস্থিতির কারণে এই মুসিবত নেমে আসছে। সেই সাথে একথাও আলোচিত হতে লাগল যে, গভর্নর সুন্দরী মুসলমানদের সাথে যে অহিংস নীতি অবলম্বন করেছে তা ঠিক নয়। এজন্যই দেবতা শহরবাসীকে সতর্ক করছেন। এর পরদিন দিনের বেলায় লোকজন যখন কাজ-কামে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় হঠাৎ রাতের তরুণির আর্তনাদ ভেসে এলো। শহরের মাঝখানে কিছুটা জায়গা ছিল খালি, জনশুন্য এবং বসতিহীন। সেই পরিত্যক্ত জনবসতিহীন জায়গা থেকে আগুনের কুণ্ডলী উঠে আকাশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। মানুষ ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে যে যেভাবে পারল কাজকর্ম ছেড়ে নিজেদের ঘরবাড়িতে পালাতে লাগল। শহরের পরিস্থিতি এতোটাই ভয়ানক হয়ে উঠল যে, মা তার কোলের সন্তানের খেয়াল করার অবকাশ পেল না। কেউ একবার এতটুকু ভাবার চিন্তা করেনি যে, এই আর্তনাদ কোথেকে আসছে আর আগুনের স্ফুলিঙ্গ কোথেকে আসছে? দিনটি এভাবে শেষ হলে রাতের বেলায় যখন সারা শহরের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ঠিক অর্ধরাতে আবার শুরু হলো সেই অজানা তরুণির আর্তনাদ। রাতের চিঙ্কার অনেকের কাছে মনে হলো কোন একজন চিত্তার করছে আর আর্তনাদকারিণী বাতাসে উড়ছে। অন্য রাতের মতো আকাশে সেই আগুনের কুণ্ডলীও ভেসে বেড়াতে লাগল কিন্তু এ রাতে জমিনের কয়েক জায়গা থেকেও আকাশে আগুনের স্ফুলিঙ্গ উঠতে দেখা গেল।

অন্যান্য রাতের মতোই কয়েক ঘন্টা চলল এমন অগ্নোৎপাত আর, চিকারের তাণ্ডব। রাত পোহালে সকাল বেলায় বড় মন্দিরের প্রধান দুই পুরোহিত নিরূন শাসক সুন্দরীর সাথে সাক্ষাত করতে এলো।

প্রধান পুরোহিত নিরূন শাসক সুন্দরীকে বলল, “মহারাজ! গত তিনরাত ধরে আমরা এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমাতে পারিনি। পরিস্থিতি জানার জন্য আমরা দুজন অভিজ্ঞ জ্যোতিষীকে ডেকে এনেছিলাম, তারা হিসাব কিতাব করে দেখেছে, আমরাও ভেবে চিন্তে এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছি যে, এসব হচ্ছে আমাদের দেবদেবীদের সতর্ক সংকেত। তার মর্মার্থ হলো, আমরা যেনো নিজেদের ধর্ম-কর্ম, মান-সম্মান অক্ষুন্ন রাখার জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিই। আমরা এই গায়েবী ইঙ্গিতও পেয়েছি যে, এই শহরের জমিনে হাজারো মহামনীষী ও ঋষি সাধু মহাত্মার দেহাবশেষ মিশে রয়েছে। আমরা শুনেছি,

আপনি নাকি এই শহরের নিরাপত্তার দায়িত্ব ভিনধর্মীদের হাতে তুলে দিয়েছেন। জানি না, আপনার ধর্ম কি বলে, তবে আমরা যতোটুকু জানি, আপনার ধর্মও এই শহরের নিরাপত্তার দ্বায়িত্ব পর ধর্মের কারো হাতে তুলে দেয়ার ব্যাপারটিকে সমর্থন করবে না।

যে ধর্ম আমাদের ধর্মের সম্পূর্ণ পরিপন্থী তাদের হাতে এই শহর তোলে দেয়া কোন মতেই সমর্থনযোগ্য মনে হয় না। জ্যোতিষী ও গণকরা বলছেন, শাসক সুন্দরী যদি এই শহরের নিয়ন্ত্রণ বিধর্মীদের হাতে তুলে দেয় তাহলে এই শহরের পতন অবশ্যম্ভাবী। এই শহরকে কেউ ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। মহারাজ! ইতোমধ্যে বহু লোক শহর ছেড়ে চলে গেছে এবং আরো কিছু সংখ্যক লোক শহর ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। “হ্যাঁঁ, আমাকে ভাবতে দাও পণ্ডিত, আমাকে চিন্তা-ভাবনা করতে দাও।”। বললেন সুন্দরী। “পুরোহিতদ্বয় চলে যাওয়ার পর সুন্দরী ইবনে ইয়াসীরকে ডেকে বললেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মন্দিরের প্রধান দুই পণ্ডিত তাকে কি বলে গেছে এবং এ ব্যাপারে তিনি কি ভাবছেন।”

“আমি যদি তোমাদেরকে বলি যে, তোমরা সবাই এখান থেকে চলে যাও, তাহলে তোমরা এ ব্যাপারে কি বলবে?” কারণ আমার কাছে শহরের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটাই সবচেয়ে বড়। আমি এই শহরের অধিবাসীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই তোমাদের সেনাপতির কাছে আত্মসমপর্নের প্রস্তাব করেছিলাম। তাছাড়া আমার ধর্মও খুনোখুনি, যুদ্ধ-বিগ্রহ পছন্দ করে না। কিন্তু যে মুসিবত এখন আমার মাথার ওপর পড়েছে, তাতে আমি কি-ইবা করতে পারি?”

“বেশি নয় মাত্র তিনটা দিন আমাদের সময় দিন সম্মানিত গভর্নর!” বলল ইবনে ইয়াসির। আমার বিশ্বাস এই মুসিবতকে আমরাই দূরীভূত করতে পারব।

“তোমরা দূর করবে এই মুসিবত?” বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন সুন্দরী। যে শক্তিকে দেখা যায় না, অদৃশ্য শক্তিকে তোমরা কিভাবে মোকাবেলা করবে?”

“মাত্র তিনটি দিন আমরা আপনার কাছে সময় চাচ্ছি সম্মানিত গভর্নর। তিনদিনের মধ্যেই আশা করি আমরা আপনাকে তা করেই দেখিয়ে দেবো।”

বিন কাসিমের গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীর অন্যতম সহযোদ্ধা অভিজ্ঞ গোয়েন্দা ইবনে ইয়াসিরের ওপর দায়িত্ব ছিল সে যেন সুন্দরী ও

বিন কাসিমের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু পানাহার সামগ্রী সাথে নিয়ে ইবনে ইয়াসির বিন কাসিমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। তখন মুহাম্মদ বিন কাসিম আরমান ভিলায় অবস্থান করে ডাভেলের দিকে অগ্রাভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন।

নিরূন থেকে মুহাম্মদ বিন কাসিমের অবস্থান আরমান ভিলার দূরত্ব একশ মাইল। ইবনে ইয়াসিরের হাতে সময় মাত্র তিন দিন। সে শুরু শা’বান ছাকাফীকে নিরূনের অবস্থা জানিয়ে তার দিক নির্দেশনার প্রয়োজন বোধ করল। ইবনে ইয়াসির কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না নিরূনের ওপর দেবতাদের অভিশাপ পড়েছে। কারণ মুসলমানরা দেবদেবীর ক্ষমতায় বিশ্বাস করে না। তারা জানে দেবদেবীদের ওপর বিশ্বাস সম্পূর্ণ অবাস্তব ভিত্তিহীন এবং মানুষের মনগড়া ধারণা মাত্র।

দিনের দ্বিপ্রহরের একটু আগে নিরূন থেকে রওয়ানা করে অর্ধরাতের কিছুক্ষণ পরেই গন্তব্যে পৌছে গেল ইয়াসির। কারণ তার গন্তব্য তার দিকেই এগিয়ে আসছিল। সেই রাতের শেষ প্রহরেই ডাভেলের দিকে অগ্রাভিযান করার জন্য সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিন কাসিম।

মুহাম্মদ বিন কাসিম সব কিছু না বুঝে কোন পদক্ষেপ নিতেন না। তিনি ছদ্মবেশে কিছু সৈনিক আগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যারা ভিনদেশী এই এলাকার সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে প্রতিনিয়ত তাকে খবর দিতো, সেই মোতাবেক তিনি সেনাবাহিনী পরিচালনা করতেন। কারণ ইতিমধ্যে দুইটি দুর্গ তিনি দখল করে নিয়েছিলেন। ডাভেল ছিল তার তৃতীয় টার্গেট। তাই প্রতিপক্ষ তাঁদের আগমন অপেক্ষা নির্বিকার দুর্গে বসে থাকবে এমনটি ভাবার কোনই অবকাশ ছিল না। বরং সম্ভাবনা ছিল শত্রু বাহিনী পথে পথে ওৎপেতে থাকবে এবং রাতের অন্ধকারে গুপ্ত হামলা চালাবে।

এই আশঙ্কা মাথায় রেখে মুহাম্মদ বিন কাসিমের কিছু সৈন্য রাতের প্রথম প্রহরেই ডাভেলের কি অগ্রসর হতে থাকে। এলাকাটি যেহেতু সামরিক দিক থেকে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল এজন্য অগ্রগামী দলের সাথে গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী নিজেই গিয়েছিলেন। আরমান ভিলা থেকে কয়েক মাইল অগ্রসর হলেই তাদের কানে ভেসে এলো অশ্বখুরের আওয়াজ। শাবান ছাকাফী তার সাথীদেরকে রাস্তা থেকে নামিয়ে বসিয়ে দিলেন এবং আগন্তুকের আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

আগন্তুকের ঘোড়া দ্রুত বেগে ছুটছিল। শা’বান ছাকাফী রাস্তায় এসে ধাবমান ঘোড়ার মুখোমুখি হয়ে তাকে থামিয়ে দিলেন। সাথে সাথে তার সহযোদ্ধারা এসে আগন্তুককে ঘিরে ফেলল।

“কে তুমি? কোথায় যাচ্ছ? দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন শা’বান ছাকাফী।

“আমি ইবনে ইয়াসির। এক লাফে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে বলল আগন্তুক। আমি আপনার আওয়াজ চিনতে পেরেছি। কেমন আছেন আপনি? বাকী সাথীরা কেমন আছে? সার্বিক অবস্থা কেমন?

ফজরের সাথে সাথেই সেনাবাহিনী ডাভেল অভিযান শুরু করবে। তুমি কি বুঝতে পারছো আমরা কেন এগিয়ে এসেছি?”

অগ্রগামী দল হিসাবে আমরা চলে এসেছি। তুমি এতোদূর কি করে এলে? বিশেষ কোন খবর আছে নাকি? ইবনে ইয়াসিরকে জিজ্ঞেস করলেন শাবান।

ইবনে ইয়াসির গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীকে নিরূনের উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানালো এবং নিরূন শাসকের উরুঢ় গমণ, সেখানে রাজার সাথে তার কথোপকথন ও রাজার প্রস্তাব সুন্দরীর প্রত্যাখ্যানের কথা সবিস্তারে জানালো। সবশেষে বলল, এ মুহূর্তে আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিরূনের আকাশে ঘূর্ণমান আগুনের কুণ্ডলী আর অজানা নারীকণ্ঠের আর্তনাদ। আমরা বুঝতে পারছি না, এই আগুন কি হতে পারে? এ ক্ষেত্রে আমাদেরই বা করণীয় কি? আগামী দুদিনের মধ্যে যদি আমরা এ ব্যাপারে যথার্থ ভূমিকা না নিতে পারি, তাহলে নিরূন আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে।

“এসো ইবনে ইয়াসির” গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী ইবনে ইয়াসিরকে রাস্তা থেকে নামিয়ে সুবিধামতো একটি জায়গায় বসিয়ে বললেন

“এই আগুনের রহস্য তোমাকে বলে দিচ্ছি।” আগুনের অন্তরালে কি কারসাজী রয়েছে এবং সাথীদের নিয়ে তোমাকে কি ভূমিকা পালন করতে হবে, গোয়েন্দা প্রধান পরিষ্কার ভাবে সবকিছু ইবনে ইয়াসিরকে বুঝিয়ে দিলেন।

“আমাকে এখনই ফিরে যেতে হবে সম্মানিত অধিপতি! আমার ঘোড়াটা বদলে দিতে হবে, আমি এটাকে বিশ্রাম দেয়ার অবকাশ পাইনি।” ক্লান্ত শ্রান্ত অনুচ্চ আওয়াজে বলল ইবনে ইয়াসির।

“তোমারও বিশ্রামের প্রয়োজন ইবনে ইয়াসির! কিন্তু তোমরা যদি অশ্বপৃষ্ঠ ছেড়ে আরামে ঘুমিয়ে পড়, তাহলে আমাদের ইতিহাস এবং জাতির ভাগ্যও ঘুমিয়ে পড়বে। জাতি ও মিল্লাত আমাদের ত্যাগের প্রত্যাশা করে। আমাদের এতটুকু ত্যাগ স্বীকার করা খুব জরুরী…। যাও বন্ধু.. আল্লাহ তোমার সাহায্য করবেন।” তাজা তাগড়া একটি আরবীয় ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে ইবনে ইয়াসির পায়ের গোড়ালী দিয়ে ঘোড়াকে আঘাত করল, উর্ধ্বঃশ্বাসে ছুটে চলছে ঘোড়া। মরুময় এলাকায় নিস্তব্ধ রাতে কিছুক্ষণ ইবনে ইয়াসিরের অশ্বখুরের আওয়াজ শোনা গেল। এরপর রাতের প্রকৃতি নীরব নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

পরদিনের শেষ প্রহরে ইবনে ইয়াসির নিরূন পৌছল। অতিরিক্ত ক্লান্তি ও শ্রান্তির কারণে সহকর্মীদের কাছে পৌছে চৌকিতে বসে দু’পা সোজা করে সটান শুয়ে পড়ল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। তার ঘোড়ার শরীর থেকে এভাবে ঘাম ঝরছিল যেন ঘোড়াটি মাত্র কোন জলাশয় সাতরে এসেছে। দিন শেষে অর্ধরাতের পর আবার শুরু হলো সেই নারীকণ্ঠের। আর্তচিৎকার। ইবনে ইয়াসিরের সাথীরা শোরগোলে ঘুম থেকে জেগে উঠল। ইতিমধ্যে ইবনে ইয়াসিরও বেশ সময় ঘুমিয়েছে। শোরগোলে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। চিকারের সাথে সাথে আকাশে কান্নার আওয়াজও শোনা গেল। ঘুম ভাঙতেই লাফিয়ে উঠল ইবনে ইয়াসির এবং তরবারি কোষমুক্ত করে বলল, বন্ধুরা! এসো আমার সাথে। আজকের পর আর কোন দিন এ ধরণের আগুনের কুণ্ডলী আকাশে ভেসে বেড়াতে তোমরা দেখবে না। নির্দেশ মতো পাঁচসঙ্গী তরবারী কোষমুক্ত করে তাকে অনুসরণ করল। তখনো মন্দিরে ঘন্টা ধ্বনী আর পণ্ডিতদের শিঙ্গার বাজনা অবিরাম বেজেই চলছে। মন্দিরের ওপর থেকেই আগুনের কুণ্ডলী আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। সারা শহর জন শুন্য। কোন একটা লোকও নেই ঘরের বাইরে। একাদশী চাদ তখনও আকাশে জোৎস্না ছড়াচ্ছে। চাদের আলোয় বেশ দূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

ইবনে ইয়াসিরের দু’দিন অনুপস্থিতির সময়েও এই ভয়ানক অবস্থা অব্যাহত ছিল। সেই সাথে দিনের বেলায় কিছু সময় মাটি থেকে আকাশের দিকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ উঠে যেতো আর ফোয়ারার পানির মতো ছড়িয়ে পড়তো চতুর্দিকে। শহরের বহু ঘরবাড়ি এই কয়েক দিনে খালি হয়ে গেছে। প্রথমে যখন এ ভয়ানক দৃশ্য দেখা যেতো মানুষ তা প্রত্যক্ষ করার জন্য ঘর ছেড়ে

বাইরে বেরিয়ে আসতো। কিন্তু এ কয়েক দিনে পরিস্থিতি এমন হয়ে গেছে, ভীত সন্ত্রস্থ লোকজন এখন আর ঘর ছেড়ে বাইরে আসার সাহস করে না। ইবনে ইয়াসির শহরের প্রধান মন্দিরের দিকে যেতে যেতে তার সহকর্মীদেরকে এ সম্পর্কে শাবান ছাকাফীর নির্দেশনার কথা ব্যক্ত করল। তারা যতোই মন্দিরের নিকটবর্তী হচ্ছিল নারীকন্ঠের চিৎকার ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছিল।”

মন্দিরের কিছুটা কাছে গিয়ে ইবনে ইয়াসির সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করল, “বন্ধুরা! বলো তো এই চিৎকার কি মন্দিরের ভিতর থেকে আসছে, না মন্দিরের বাইরে খালি আঙ্গিনা থেকে এ নারীকণ্ঠের আর্তনাদ ভেসে আসছে? সঙ্গীদের কাছ থেকে কোন সদুত্তর না পেয়ে ইবনে ইয়াসির তাদের জানালো, এই চিকার হিন্দুদের কোন দেবদেবী কিংবা জিন ভূতের নয়। এই আর্তনাদকারিণী জ্যান্ত মানুষ। এই নারী শয়তানীকেই আমাদের ধরতে হবে।”

“ইবনে ইয়াসির। বিস্মিত কণ্ঠে বলল তার এক সহকর্মী। গায়েবী কোন জিনিসকে তুমি ধরতে চাচ্ছে না তো? আমারতো ভয় হচ্ছে! আসমানী আগুনকে কিভাবে নিভাবে তুমি?” “তোমাদের কারো মনে যদি কোন ধরনের ভয়ের উদ্রেক হয় তাহলে মনে মনে সূরা ফাতিহা পড়তে থাকো। কুরআনের সামনে কোন জ্বিন-ভূতই টিকতে পারে না, সেই সাথে সূরা ফাতিহা পড়ে “ইয়য়াকা না’বুদু ওয়া ইয়য়াকা নাসতাঈন” “আমরা তোমারই ইবাদতকারি আর তোমার কাছেই সাহায্য চাই”। বারবার পড়তে থাকো। সাথীদের উদ্দেশে বলল কমান্ডার ইবনে ইয়াসির।

কমান্ডারের কথায় তার সাথীরা তাই করতে লাগল আর ইবনে ইয়াসির সাথীদের নিয়ে মন্দিরের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। অবশেষে শহরের প্রধান সড়কের শেষ প্রান্তে যেখানে প্রধান মন্দির অবস্থিত সেখানে সাথীদের নিয়ে পৌছে গেল ইবনে ইয়াসির। একাদশী চাঁদ তখন পূর্ণ জ্যোত্সা ছড়িয়ে দিচ্ছে। চাঁদের কিরণে চারদিকে ঝিকমিক করছে। রাস্তা পেরিয়ে মন্দির আঙ্গিনা থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই সে দেখতে পেল, এক নারীমূর্তি মন্দির প্রাঙ্গনের সিঁড়ি ভাঙ্গছে আর আর্তচিৎকার করছে। মন্দিরের প্রধান ফটকের কাছে একবার এসে সেই নারীমূর্তি মন্দিরের ভিতরের দিকে দৌড়ালো। এমন সময় মন্দিরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো দু’জন শক্ত সামর্থবান পুরুষ। তারা নারীটিকে ধরে টেনে হেঁচড়ে আবার

মন্দির প্রাঙ্গনের সিঁড়িতে নিয়ে এলো, এমতাবস্থায় নারীকণ্ঠের আওয়াজ আরো ভীতিপ্রদ হয়ে উঠল এবং নারীমূর্তিটি আবারো এলোপাতাড়ি সিঁড়িতে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল। মন্দির থেকে যখন দু’জন লোককে বেরিয়ে আসতে দেখল, তখন ইবনে ইয়াসির তার সাথীদেরকে নিয়ে একটি গাছের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে ফেলল। নারীমূর্তি এলোপাতাড়ি সিঁড়ি ভাঙ্গছিল আর চিৎকার করছিল, কিন্তু হঠাৎ করে সে পা পিছলে সিঁড়ির নীচে এসে পড়ল।

ঠিক এই মুহূর্তে আকাশে ছড়িয়ে পড়ল আগুনের কুণ্ডলী। এমন একটা ভীতিকর পরিস্থিতি যে কোন মানুষের মধ্যেই আতঙ্ক তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। ঘটনার আকষ্মিকতা আরব যুবকদের মধ্যেও কিছুটা ভীতির সঞ্চার করল। তারা সবাই সূরা ফাতিহা পড়তে লাগল। নারীমূর্তির নড়াচড়া থেকে ইবনে ইয়াসিরের বুঝতে অসুবিধা হলো না, এ কোন যুবতী বা বয়স্কা নারী নয়, একান্তই বারো তেরো বছরের কিশোরী। সে আবারো আর্তনাদ করে সিঁড়ি ভাঙ্গতে শুরু করল। এক পর্যায়ে মেয়েটি মন্দিরের দিকে রওয়ানা হলে চিঙ্কার থেমে গেল এবং মেয়েটিও পড়ে গেল এবং সাথে সাথে আকাশে ভাসমান আগুনের কুণ্ডলীও গায়েব হয়ে গেল। নিস্তব্ধ হয়ে গেল নিরূনের রাত। ইবনে ইয়াসিরের সাথীদের কাছে মনে হলো, তারা যেন দুনিয়াতে নয় কোন কবরস্থানে অবস্থান করছে। এমন সময় মন্দির থেকে আবার দু’জন বেরিয়ে এলো এবং মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গেল।

ইবনে ইয়াসির মন্দিরের প্রধান ফটকের সরাসরি সামনে দিয়ে মন্দির আঙ্গিনায় না গিয়ে অপর পাশের ছোট গেট দিয়ে প্রবেশ করল এবং মন্দিরের প্রধান দরজায় উকি দিলো। উঁকি দিয়ে দেখতে পেল, এখান থেকে একটি সুড়ং পথের মতো সামনে চলে গেছে এবং সুড়ং পথের শেষ প্রান্তে আলো দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে ভেসে আসছে পরস্পর কথা বলার আওয়াজ। ইবনে ইয়াসির সাথীদের কাছে ডেকে কানে কানে বলল, কোন শব্দ করা যাবে না, খুব সন্তর্পণে নিঃশব্দে এগুতে হবে। তারা সবাই সারি বেঁধে পা টিপে টিপে অগ্রসর হতে লাগল। এক পর্যায়ে সুড়ং পথ শেষ হয়ে দুদিকে চলে গেল এবং এক প্রান্ত থেকে মানুষের কথা বলার আওয়াজ পরিষ্কার শুনতে পেল তারা।

ইবনে ইয়াসির একপ্রান্তের দরজা পর্যন্ত গিয়ে দেখল শেষ প্রান্তের দরজার ওপাশে বড়সড় কক্ষে একটি মঞ্চের মতো জায়গায় একটি বিবস্ত্র নারীমূর্তি। কক্ষের চার পাশের দেয়াল গাত্রে প্রদীপ জ্বলছে। দেয়ালেও রয়েছে অনেকগুলো বিবস্ত্র পাথরের নারীমূর্তি।

ইবনে ইয়াসির ওখান থেকে সরে অপর দিকে অগ্রসর হলে দেখতে পেল আরেকটি অপেক্ষাকৃত ছোট কক্ষ। সেই কক্ষেও প্রদীপ জ্বলছে। সেখানে বসে আছে চার পুরোহিত আর দুই সুন্দরী তরুণী। এরা সবাই বৃত্তাকারে বসা। তাদের বৃত্তের ভিতরে বারো তেরো বছরের এক কিশোরী উপবিষ্ট। তার ভয়ার্ত দৃষ্টি আর পাণ্ডুর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তাকে কোন জায়গা থেকে জোর করে তুলে আনা হয়েছে এবং তার ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে। এক পুরোহিত হাত বাড়িয়ে তার মাথা কাছে নিলো এবং কিশোরীর কপালে চুমু খেলো। দেখে মনে হবে যেন সে তার আপন কন্যাকেই আদর করছে। সুন্দরী তরুণীদের একজন একটি পেয়ালা তুলে ধরল কিশোরীর দিকে। কিশোরী এক নিঃশ্বাসে পেয়ালার পানীয়দ্রব্য নিঃশেষ করল এবং বিকট আওয়াজে কাঁদতে শুরু করল। কিশোরী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল, “আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দাও, আমার শরীরে আগুন ধরে গেছে।”

প্রদীপের আবছা আলোয় ঘরের ভিতরের লোকগুলোকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল না ইবনে ইয়াসির। কারণ সে দরজার আড়ালে থেকে দেখছিল, যাতে ভিতরে তার ছায়া না পড়ে। আর ভিতরের লোকগুলো কিশোরীকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল তাই দরজার পাশে কেউ রয়েছে বা থাকতে পারে এটা ঘূর্ণাক্ষরেও তারা ভাবতে পারিনি। এমন সময় ইবনে ইয়াসির হাতের ইশারায় সাথীদের প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়ে উচ্চ আওয়াজে নারা লাগাল। তারা নারার প্রতিউত্তরে পাচ সঙ্গী একই সাথে তকবীর ধ্বনি দিয়ে একযোগে ভিতরে প্রবেশ করে বসা সবাইকে ঘিরে ফেলল। হঠাৎ তাদের সম্মিলিত তাকবীর ধ্বনী মন্দিরের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে মন্দিরের ভিতরেই ঘুরপাক খাচ্ছিল আর আকস্মিক এই তকবীর ধ্বনীতে হিন্দু পুরোহিত ও তরুণিরা সবাই নির্বাক হয়ে গেল। ইবনে ইয়াসির সকলের উদ্দেশ্যে নির্দেশের সুরে বলল, “জীবন বাঁচাতে চাইলে সবাই দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে যাও”।

নির্দেশ মতো সবাই দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে গেল। এদের মধ্যে তিনজনকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এরা মন্দিরের পুরোহিত কিন্তু চতুর্থ পুরুষটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারার আর দু’জন ছিল সুন্দরী তরুণী আর সেই ভীত বিহ্বল কিশোরী। ইবনে ইয়াসির মাকরানবাসী সঙ্গীকে কাছে ডেকে বলল, তুমি স্থানীয় ভাষায় আমার সাথে এদের কথা বলতে সাহায্য করো। মাকরানবাসী সঙ্গী ইবনে ইয়াসিরের দুভাষী হিসাবে কথা বলতে শুরু করল।

এমতাবস্থায় কিশোরী মেয়েটি দৌড়ে এসে ইবনে ইয়াসীরের পা জড়িয়ে ধরে বলল, “আমাকে ওরা ঘর থেকে জোর করে উঠিয়ে এনেছে। আমাকে প্রাণ ভিক্ষা দিন, প্রাণে রক্ষা করুন।”

এরা তোমাকে কি বলে? দুভাষী সহকর্মীর মাধ্যমে কিশোরী মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল ইবনে ইয়াসির। কিশোরী মেয়েটি ওই লোকটির দিকে তাকালো যার অবয়ব পুরোহিতের মতো ছিল না। এরপর সে দু’হাত প্রসারিত করে ওই বীভৎস চেহারাওয়ালা লোকটির দিকে ইঙ্গিত করে আবার ইবনে ইয়াসিরকে জড়িয়ে ধরল, যেন সে খুবই ভয় পাচ্ছে। লোকটির চেহারা সুরত এতোটাই বীভৎস ছিল যে, যে কোন মানুষই তাকে দেখলে ভয় পেতো। বিশাল বপুধারী লোকটির চুল ছিল লম্বা, সেই সাথে সাদাকালো দীর্ঘ দাড়ি। আর গোঁফগুলো পেচিয়ে কানের সাথে বাঁধা। চোখ টকটকে লাল। তার মাথা লাল কাপড়ের পাগড়ীর মতো পেঁচানো। কানে বড়বড় রিং আর গলায় দীর্ঘ হাজার দানার মালা পেঁচানো। দেখে মনে হচ্ছিল সে কোন ধর্মীয় গুরু। অবে তার চেহারা সুরত ছিল পুরোহিতদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ইবনে ইয়াসির কিশোরীকে একহাতে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে তাকে অভয় দিলো এবং দুভাষীকে বলতে বলল, “তুমি ভয় করো না। এরা তোমার আর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বলল এরা তোমার সাথে কি আচরণ করেছে?”

কিশোরী বললো, এই জটাধারী লোকটি আমাকে সামনে বসিয়ে এক হাতে আমার মাথা ধরে রাখতো আর অন্য হাতে আমার শরীরে হাত বুলাতো। আর আমার চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। এমতাবস্থায় আমার শরীরে আগুনের মতো জ্বালা শুরু হয়ে যেত। আমি বেহুশের মতো হয়ে যেতাম। আর কষ্ঠ থেকে বিকট চিৎকার বেরিয়ে আসত। এমতাবস্থায় এই পুরোহিতরা আমাকে মন্দিরের আঙ্গিনায় সিঁড়িতে ফেল আসত। আমি ভয়ে আতঙ্কে মন্দিরের দিকে পালিয়ে আসতে চাইতাম, কিন্তু এদিকে এলেই এরা আমাকে আবার টেনে হেঁচড়ে মন্দিরের সিঁড়িতে রেখে আসতো। আমি চিৎকার করতে করতে বেহুঁশ হয়ে যেতাম। বেহুঁশ হয়ে গেলে আমার শরীরের জ্বালা কিছুটা কমে যেত। এরা আমাকে এনে শরবতের মতো কি যেনো পান করাতো আর আমার সাথে অশ্লীল আচরণ করত। দয়া করে আপনারা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান। এরা আমাকে মেরে ফেলবে।”

বন্ধুরা! সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলল ইবনে ইয়াসির। উস্তাদ ‘বান ছাকাফী আমাকে একথাই বলে দিয়েছেন। তিনি আমাকে একথাও বলে দিয়েছিলেন, কিছুতেই ভয় পেয়ো না। এটা হচ্ছে এদেশের হিন্দুদের ধোকাবাজি। মনে সাহস করে রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করো, সফল হবে। তিনি আরো বলেছিলেন, তোমরা মুজাহিদ। দুনিয়ার সবচেয়ে সত্য শান্তির অধিকারী তোমরা, তোমাদের বুকের ভিতর আছে পবিত্র কুরআন। তোমাদেরকে কোন কুফরী যাদুই পরাস্ত করতে পারবে না। এই বদসুরত লোকটি পৌত্তলিক যাদুকর। ইবনে ইয়াসির আরবী ভাষায় তার সহকর্মীদের সাথে কথা বলছিল। যার ফলে হিন্দু পুরোহিত ও যুবতীদের তা বোঝার উপায় ছিল না। ইবনে ইয়াসির হিন্দু দুই যুবতী, যাদুকর ও দুই পুরোহিতের উদ্দেশ্যে বলল, সবাই মাথা নিচের দিকে করো। তোমাদের হত্যা করা হবে। ভয়ে সবাই মাথা নীচের দিকে করল। এমন সময় যাদুকর ভিড়ভিড় করে কোন মন্ত্র চালান দিতে চাচ্ছিল। যাদুকর দু’হাত ওপরের দিকে করে যাদু করার চেষ্টা করছিল।

ইবনে ইয়াসির তার হাতের তরবারীর পিঠ দিয়ে যাদুকরের এক হাতে জোরে আঘাত করল এবং অপর হাতে তার মুখে কষে একটা ঘুসি মারল। যাদুকর গিয়ে আঁছড়ে পড়ল দেয়ালে। ইবনে ইয়াসিরের দুই সাথী ওকে ধরে মেঝের ওপর ফেলে দিলো এবং ওর পিঠের ওপর পা দিয়ে চেপে ধরে তরবারীর আগা ওর ঘাড়ের ওপর রেখে বলল, “সত্যিকথা বল, তুই কি যাদুকর? নয়তো তোর মাথা এখনই আলাদা করে ফেলব”।

‘বীভৎস চেহারার লোকটি হাত জোড় করে মাথা ঝাকাল।” সে যে যাদুকর নীরব সম্মতি দিয়ে তা বোঝাতে চেষ্টা করল।

দুই পণ্ডিত একটু দূরে দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল আর প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছিল। ইবনে ইয়াসির তার সহকর্মী দুভাষীর মাধ্যমে স্থানীয় ভাষায় পণ্ডিতদের উদ্দেশ্যে বলল, “ওদের বলো, ওদের হত্যা করে মরুভূমিতে ফেলে দেয়া হবে। যাতে শিয়াল কুকুর ও বন্যপশুরা ওদের দেহ। চিবিয়ে খেতে পারে।”

ইবনে ইয়াসিরের সাথী যখন তার কথা স্থানীয় ভাষায় পুরোহিতদের জানাল, তখন প্রায় ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল তিন পুরোহিত। আর দু’হাত প্রসারিত করে প্রণাম করল। এমতাবস্থায় ইবনে ইয়াসিরের সাথীকে ইশারায় কাছে ডেকে কানে কানে বড় পুরোহিত বলল, তোমার সাথীকে বলো, তোমরা এই দুই যুবতীকে

নিয়ে যাও, সেই সাথে তোমরা যত নিতে পারো আমরা তোমাদের সেই পরিমাণ সোনা দানা দেবো, এর প্রতিদান স্বরূপ আমাদের প্রাণ ভিক্ষা দাও। ইবনে ইয়াসিরের দুভাষী সাথী হাসতে হাসতে পুরোহিতের কথা তাকে জানালে ইবনে ইয়াসির বলল, “আরে বেঈমানের দল, আমরা নারী ও মুদ্রার বদলে ঈমান বিক্রি করি না।”

যাদুকর যাদুর কথা স্বীকার করায় ইবনে ইয়াসির তাকে বলল, তোমাকে বলতেই হবে কিভাবে তুমি এসব করেছ। যাদুকর তার ভাষায় জানালো, অবশ্যই সে সব বলবে, শুধু বলবেই না করে দেখাবে।

“ঠিক আছে তাহলে এখানে নয়, ওদের সবাইকে সুন্দরীর কাছে নিয়ে যাবো। সেখানে বলবে, কেনো কিভাবে এরা এই তেলেসমাতি করেছে, কি উদ্দেশ্যে করেছে?”।

তিন পুরোহিতকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ইবনে ইয়াসির ও সাথীরা নিরূন শাসকের কাছে নিয়ে এলো। সুন্দরী ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ইবনে ইয়াসির বলল, গায়েবী আগুনের রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। ইবনে ইয়াসির নিরূন শাসককে একথাও জানালো যে, গত দু’দিনে সে কি কারণে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। সবিস্তারে ব্যক্ত করল, কি ভাবে সে সাথীদের নিয়ে এই ভয়ানক রহস্যের জট খুলেছে এবং এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কিভাবে সে মন্দিরে প্রবেশ করেছে। কিশোরী মেয়েটির সাথে পুরোহিত ও যাদুকর কি ব্যবহার করেছে তাও সে ব্যক্ত করল। সব শুনে সুন্দরী যাদুকর ও পুরোহিতের উদ্দেশ্যে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, “তোরা যদি একটুও মিথ্যা কথা বলিস তাহলে তোদের সবার দু’হাত কেটে দেয়া হবে এবং মরুভূমিতে ফেলে আসা হবে।”

সুন্দরীর হুমকিতে যাদুকর তার যাবতীয় কর্মতৎপরতা সবিস্তারে জানালো এবং কি কারণে, কার নির্দেশে সে এসব করেছে তাও ব্যক্ত করল। যাদুকর একথাও জানালো যে, সারা হিন্দুস্তানে এধরনের যাদুকর মাত্র তিনজন আছে। যাদুকর বলল, যে আগুনের কুণ্ডলী আপনারা আকাশে উড়তে দেখেছেন তা কারো কোন ক্ষতি করতে পারে না। এটা নিতান্তই একটা চোখের ভেলকি মাত্র। কিন্তু এটা সাধারণ কোন কাজ নয়। এ ধরণের ক্ষমতা অর্জন করতে কঠিন সাধনা করতে হয়। জমিন থেকে পানির ফোয়ারার মতো যে আগুনের ফুলিঙ্গ আপনারা আকাশে উঠতে দেখেছেন, তাও কোন ক্ষতি করতে পারে

এটাও নিতান্তই দৃষ্টি বিভ্রম। যে পানির ফোয়ারা আপনারা ভূমি থেকে আকাশে উঠতে দেখেছেন তাতে বিন্দুমাত্র পানি ছিল না, এই পানিতে হাত রাখলে আপনারা গায়ে মোটেও পানির কোন ছোঁয়া পেতেন না।

কেন তোমরা আমার রাজ্যে এসে এ ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে? জিজ্ঞেস করলেন সুন্দরী।

“সম্পদের লোভে করেছি মহারাজ! মহারাজা দাহির তার এক বন্ধু রাজার মাধ্যমে আমাকে ডেকে এনেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, নিরূনের অধিবাসী ও শাসকের মধ্যে ভীতি, চরম ভীতি সৃষ্টি করতে হবে। দাহির আমার সাথে আরো এক ব্যক্তিকে পাঠিয়েছিলেন, সে এসে এই পুরোহিতদের বলে গেছে, আমি যখন যাদু দেখাতে শুরু করবো, তখন পুরোহিতরা ভীতিকর আওয়াজের জন্য কি কি করবে। এরপর আপনার কাছে এসে কি কি বলবে তাও সেই ব্যক্তি ওদের বলে গেছে। মহারাজ! রাজা দাহির আমাকে এতো বিপুল পরিমাণ সম্পদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যা আমার সাত পুরুষও খেয়ে শেষ করতে পারবে না।

“এ নিরপরাধ অবোধ বালিকাটিকে তোমরা কেন এমন কষ্ট দিলে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সুন্দরী জিজ্ঞেস করলেন?” “এই বালিকাটি তার মায়ের সাথে মন্দিরে পূজা দিতে এসেছিল। হঠাৎ আমি ওকে দেখে পুরোহিতদের বললাম, এই মেয়েটি আমাদের কাজের উপযোগী। মেয়েটি তখন তার মায়ের সাথে পূজা দিয়ে চলে গেল। জানিনা, সন্ধ্যায় এক পুরোহিত কিভাবে যেন এই বালিকাকে মন্দিরে নিয়ে এলো।

মহারাজ। এটা আমাদের একটা পেশা। আপনাকে আমি বুঝতে পারবো কিভাবে মানুষের সাহায্যে এ ধরনের কাজ হয়ে থাকে। তবে একথা ঠিক মানুষের সহায়তা ছাড়া এ ধরনের যাদু দেখানো সম্ভব নয়। কোন জনগোষ্ঠিকে যদি এভাবে ভয় দেখাতে হয়, তাহলে সেই জনগোষ্ঠীর কোন লোকের ওপর এই যাদু প্রয়োগ করতে হয়। আগে সেই বাসিন্দাদের ওপর কিছু কাজ করতে হয়, এরপর যাদুকর সেখানে যদি পাথর নিক্ষেপ করতে চায়, আগুনের বৃষ্টি বর্ষণ করতে চায় তাই করতে পারে। আমি বলে আপনাকে তা বোঝাতে পারব, যদি অনুমতি দেন, তাহলে করে দেখাতে পারব।”

“আমরা যা দেখতে চেয়েছি তা দেখেছি। তোমরা সবাই এক্ষুনি এ শহর ত্যাগ করে চলে যাবে, কিন্তু নিজের দেশের দিকে যাবে, ভুলেও উরুঢ়ের দিকে পা বাড়াবে না।”

“সম্মানিত গভর্নর। আপনি এখনই এদের যেতে দেবেন না। শহরের লোকদেরকে এদের প্রতারণার কথা বোঝাতে হবে। তাদের বিশ্বাস করাতে হবে এটা কোন আসমানী গযব ছিল না। আপনি শহর জুড়ে ঢোল পিটিয়ে দিন, সকালে যেন শহরের সব লোক এক জায়গায় জড়ো হয়, সেখানে এদের ধোকাবাজির কথা তারা নিজেদের কানে শুনবে এবং ধোকাবাজি প্রত্যক্ষ করবে। বলল ইবনে ইয়াসির।

নিরূন শাসক তখনি নির্দেশ দিলেন, বাদক দলকে তলব করো, শহরের লোকজনকে ওমুক মাঠে জমায়েত হতে বলো।

সূর্য ওঠার সাথে সাথে নিরূনের ছোট বড় সকল অধিবাসী একটি মাঠে জমায়েত হলো। সুন্দরী শাসকের জাকজমক নিয়ে ময়দানে পদার্পণ করলেন। তার সাথে এলো তার একান্ত নিরাপত্তারক্ষী ইবনে ইয়াসিরের সঙ্গীরা, সেই সাথে ধৃত পুরোহিত ও যাদুকরকেও নিয়ে আসা হলো। সুন্দরীর নির্দেশে এক ঘোষক ঘোষণা করল, একটানা কয়েকদিন ধরে নিরূনের আকাশে আপনারা যে গায়েবী আগুনের কুণ্ডলী আর নারীর আর্তনাদ শুনতে পেয়েছেন, সেটি আসলে কোন আসমানী গযবের ইঙ্গিত ছিল না, সেটি ছিল এক যাদুকরের শয়তানী যাদু। সেই যাদু এখন আপনাদের সামনে দেখানো হবে। নিরূনের শাসক ও অধিবাসীদের ভীত সন্ত্রস্ত করে যুদ্ধে ফাঁসানোর জন্য এই চক্রান্ত করা হয়েছিল। আপনাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। স্থির ধীরভাবে এখন এই যাদুর প্রতারণা আপনারা প্রত্যক্ষ করুন।”

“যাদুকর ও পণ্ডিতকে নির্দেশ দেয়া হলো, তোমরা এখন তোমাদের যাদু দেখাও।”

যাদুকর একহাত কিশোরীর মাথার ওপর রেখে অপর হাতে তার মাথাসহ সারা শরীরে বুলাতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে তরুণী চিৎকার শুরু করল এবং আকাশে আগুনের কুণ্ডলী ভেসে বেড়াতে শুরু করল। অবস্থা দেখে মানুষ ভয়ে দূরে সরে যেতে শুরু করলে তাদেরকে বলা হলো, ভয়ের কিছু নেই সবাই স্থির হয়ে দাঁড়াও।”

যাদুকর দুই হাত প্রসারিত করে আকাশের দিকে তুলে কি যেনো বিড়বিড় করে বললো, তখন আকাশের আগুন গায়েব হয়ে গেল এবং জমিন থেকে ফোয়ারার মতো আগুনের স্ফুলিঙ্গ আকাশে উঠতে শুরু করল, একটু পরে অন্য একটি জায়গা থেকে পানির ফোয়ার উঠতে শুরু করল। জমিন

থেকে আগুন ও পানি আকাশের দিকে উঠে আসার জায়গার মধ্যে ব্যবধান ছিল মাত্র পনের বিশ হাত। সবই সাধারণ লোকের দৃষ্টি সীমার ভিতরে ছিল এবং সবাই তা প্রত্যক্ষ করছিল। ইবনে ইয়াসির শাসকের মঞ্চে থেকে নেমে প্রথমে আগুনের ফোয়ারার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে আবার ফিরে এলো। একটু পরে আবার পানির ফোয়ারার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে ফিরে এসে সুন্দরীকে জানালো, “আমিতো আপনাদের সামনেই আগুন ও পানির মধ্য দিয়ে হেটে গেলাম, আমার গায়ে আমি না কোন আগুনের তাপ পেলাম না পানির ছোঁয়া।”

এদিকে বালিকা তখনো চিৎকার করছিল। ওর বাবা মা চিৎকার করে বালিকার কাছে পৌছানোর জন্য চেষ্টা করছিল, কিন্তু যাদুকর তাদেরকে বালিকার কাছে ঘেষতে দিলো না। যাদুকর বালিকার দেহ থেকে হাত সরিয়ে নিতেই চিল্কার থেমে গেল। বেহুশ হয়ে পড়ে গেল কিশোরী। সেই সাথে জমিন থেকে আগুন ও পানির ফোয়ারা বন্ধ হয়ে গেল।

শহরের অধিবাসীদেরকে এই যাদুকর এবং পুরোহিতদের অপকর্মের উদ্দেশ্যের কথা আবারো জানানো হলো। বলা হলো কে তাদের বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত করেছে। যাদুকরকে শহর থেকে বের করে দেয়া হলো। আর নিরূন শাসক সুন্দশ্রী পুরোহিতদের বললেন, যে ধর্ম যাদুর সাহায্যে ধোঁকাবাজি করে টিকে থাকতে চায় মানুষের মনের মধ্যে সেই ধর্মের কোন প্রভাব থাকে না।

বরং মানুষের ঘৃণা সৃষ্টি করে। এবার আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে এ ধরনের কোন তৎপরতা চালালে ক্ষমা পাবে না।”

৯২ হিজরী সন মোতাবেক ৭১২ খৃস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম তার সেনাদের নিয়ে ডাভেলের কাছাকাছি ময়দানে পদার্পণ করলেন। শাবান ছাকাফী তাকে রিপোর্ট দিলেন, পথ পরিষ্কার। পথের কোথাও রাজা দাহিরের কোন সেনার অস্তিত্ব দেখা যায়নি। কোন বাধা বিপত্তির মুখোমুখি না হয়ে নির্বিবাদে বিন কাসিমের সৈন্যরা ডাভেল পৌছে গেল। রাজা দাহির আগেই তার অধীনস্থ সকল দুর্গশাসকদের বলে রেখেছিল, সকল সেনাকে দুর্গের ভিতরে রাখবে। বাইরের উন্মুক্ত ময়দানে মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। যদ্দরুন সকল শত্র বাহিনী দুর্গের ভিতরে রণ সজ্জার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিল।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, বিন কাসিম আগেই খবর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, অমুক দিন আমি ডাভেলের উদ্দেশে রওয়ানা করব। প্রত্যুত্তরে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তাঁকে পয়গাম পাঠিয়েছিলেন, আমার নির্দেশ পাওয়ার আগে তুমি আক্রমণ করবে না। হাজ্জাজ আরো লিখেছিলেন, শত্রু বাহিনী যদি তোমাকে নানা ভাবে উস্কানীও দেয় তবুও আক্রমণ থেকে বিরত থাকবে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, হাজ্জাজ বসরায় থেকেও সিন্ধু অভিযান নিয়ন্ত্রণের ভার নিজের হাতেই রেখেছিলেন। শুক্রবার দিনের জুমআর নামাযের আগেই মুহাম্মদ বিন কাসিমের সকল সৈন্য ডাভেল ময়দানে পৌছে গেল। বিন কাসিমের নির্দেশে এক দরাজ কণ্ঠের লোক উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে আযান দিলো। সম্ভবতঃ ডাভেলের জমিনে সেটিই ছিল প্রথম আযান। আযানের পর সকল সৈন্য নামাযের জন্য সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে গেল। সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী সেনাপতি নিজেই জুমআর নামাযের ইমামতি করলেন। জুমআর খুতবায় মুহাম্মদ বিন কাসিম বললেন

আল্লাহ তাআলার সাথে তোমরা এ ব্যাপারে অঙ্গীকার করো, এই জমিনে আজকের এ জুমআর নামায যেন শেষ জুমআ না হয়ে সূচনার জুমআ হয়। আল্লাহর কাছে দোয়া করো যেন আমাদের এই রুকু ও সিজদা কবুল করেন। শাহাদাতের আকাঙ্খী বন্ধুগণ! আমরা জীবন নিয়ে ফিরে যেতে এ অভিযানে আসিনি। আমরা আল্লাহর পয়গাম নিয়ে এই দেশে এসেছি। এদেশের শেষ সীমানা পর্যন্ত আল্লাহর পয়গাম পৌছে দিতে হবে। আমরা নিরপরাধ স্বজাতীয় বন্দীদের মুক্ত করতে এসেছি। রাজা দাহির বারবার ইসলামের প্রহরীদের হুমকি দিয়েছে। এ পাপী জানে না, মুসলিম বাহিনী যদি কোথাও আসে তারা সাথে করে ইসলামের মহানত্বও নিয়ে আসে। মুসলিম সেনারা পালিয়ে যাওয়ার জন্য যুদ্ধে আসে না। বন্ধুগণ! সেইসব বীর মুজাহিদদের কথা স্মরণ করো, যাদের কবরের মাটি এখনো শুকিয়ে যায়নি। তারা পারস্য সম্রাটের মতো অহংকারী শক্তিকে পরাজিত করে তাদের স্বর্গরাজ্যের সীমানা সংকোচিত করে দিয়েছিলেন। মাদায়েনে কেসরার রাজ প্রাসাদ আমাদের পূর্ব পুরুষদের তকবীর ধ্বনীতে আজো কাঁপে। রোম পারস্যের অজেয় শক্তির দিকে তাকিয়ে দেখো, আমাদের পূর্ব পুরুষরা ওদের বিশাল শক্তিকে খর্ব করে রাজত্ব দূরে সরিয়ে নিতে বাধ্য করেছিলেন। গভীর ভাবে চিন্তা করো সেই অজেয় শক্তির দাপট আমাদের পূর্ব পুরুষরা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন…।

আজ যে রাজা আমাদেরকে এখানে আসতে বাধ্য করেছে, সে রোম পারস্যের কায়সার কিসরার মতো শক্তিধর হওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারে না।

এতো পারস্য শক্তির এক দশমাংশও হবে না। আল্লাহর কসম! আমি অহংকার দেখাচ্ছি না তোমরা যাদের ছেলে সন্তান, নাতিপুতি তাঁরা ছিলেন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন বীর বাহাদুর নির্ভিক।

আমি বসরার শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পয়গাম তোমাদের শোনাচ্ছি। তোমরা সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করো। আল্লাহর কাছে সাহায্য ও বিজয়ের আবেদন করতে থাকো। অবসর পেলেই “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ” জপতে থাকো। আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের মদদ করবেন।” হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নির্দেশ মতো বিন কাসিম ডাভেল দুর্গের অদূরে তার সৈন্যদের তাঁবু ফেললেন। তিনি তাঁবুর চার দিকে চওড়া আর ছয় হাত গভীর খাল খনন করালেন। হাজ্জাজ নির্দেশ দিয়েছিলেন, রাতের বেলায় খুব সতর্ক থাকবে যাতে রাতের আধারে তোমাদের অজ্ঞাতে শত্রু বাহিনী অতর্কিতে তোমাদের ওপর হামলা চালাতে না পারে। বিশেষ করে যেসব সৈন্য হাফেযে কুরআন তাদেরকে রাত জেগে তেলাওয়াত করতে বলবে। আর যারা কুরআন পড়তে না পারে তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দেবে।

আর একদল সৈন্যকে রাতের বেলায় নফল নামাযে লিপ্ত রাখবে আর কিছু সৈন্যকে প্রদক্ষিণরত প্রহরায় নিযুক্ত রাখবে। মুহাম্মদ বিন কাসিম রাতের এই ইবাদতের কার্যক্রমের সূচনা করে দিয়েছিলেন। প্রতি রাতেই বিন কাসিমের তাঁবু থেকে কুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে সিন্ধের বাতাসে ভেসে ভেসে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত। সেই সাথে সাধারণ সিপাহী থেকে সেনাপতি সবাই নফল নামাযে লিপ্ত থাকতেন। রাতের সেনা শিবির থাকতো মশালের আলোয় আলোকিত। সেই সাথে মুজাহিদদের ইবাদত বন্দেগীর রৌশনীতে প্রৌজ্জ্বল। আলোমর প্রভা শুধু তারাই অনুভব করতে পারতো, মাতৃভূমি থেকে বহুদূরে এসে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে যারা নিধুম নিশি যাপন করে। আর স্বজাতির মজলুম বন্দীদের মুক্ত করতে আসে। তারা জগত্বাসীকে জানাতে এসেছিল, সত্যের পতাকাবাহী বীর যোদ্ধাদের পদানত করতে পারে এ শক্তি কারো নেই।

কয়েক দিন অতিবাহিত হওয়ার পর ডাভেল দুর্গ থেকে দু’একটি সৈন্যদল বেরিয়ে এসে দূর থেকেই তীর বর্ষণ করে আবার দ্রুত গতিতে

দুর্গে প্রবেশ করতো। বিন কাসিমের তাঁবুর চতুর্দিকের প্রতিরক্ষা খালের জন্য ওরা বেশী অগ্রসর হতে পারতো না। মুহাম্মদ বিন কাসিমের পক্ষ থেকে কোন জবাবী আক্রমণ চালানোর প্রতি হাজ্জাজের নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু শত্রু বাহিনীর তীরন্দাজদের হটিয়ে দেয়ার জন্য জবাবী তীর বর্ষণের তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল মুসলিম বাহিনী। হাজ্জাজ চাচ্ছিলেন, ছোট ছোট সংঘর্ষে যেন মুসলিম বাহিনীর শক্তি ক্ষয় না হয়। পক্ষান্তরে শত্রু বাহিনী দুর্গের বাইরেই মুসলিম বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রাখার কৌশল নিয়েছিল। শত্রুবাহিনীর অব্যাহত উস্কানীর মুখেও বিন কাসিম তাঁর সৈন্যদের প্রতি আক্রমণ থেকে নিবৃত রাখলেন। অপেক্ষার পর একদিন হাজ্জাজের পক্ষ থেকে পয়গাম এলো, ডাভেল দুর্গকে ঘেরাও করে নাও। আর দুর্গ জয় করার জন্য প্রয়োজন হলে জীবন বাজী রেখো।” এ নির্দেশের জন্যই বিন কাসিম অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই তিনি হুকুম দিলেন, আজ রাতেই ডাভেল দুর্গ ঘেরাও করতে হবে। দাভেল দুর্গ থেকে বিন কাসিমের সেনা শিবির দেখা যেতো। তাই দিনের বেলায় তারা তাবু উঠানোর কাজ থেকে বিরত থাকলেন। যাতে শত্রুরা তাদের তাঁবু উঠানোর বিষয়টি বুঝতে না পারে? বেলা ডুবে যাওয়ার সাথে সাথেই কাসিমের সেনা শিবিরে কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেল এবং সবাই তাবু গুটিয়ে পরিষ্কার এক জায়গায় পারাপারের জন্য অখননকৃত জায়গা দিয়ে সবাই বেরিয়ে যেতে লাগল।

ছোট ছোট্ট দলে বিভক্ত হয়ে বিন কাসিমের সৈন্যরা পূর্ব নির্দেশনা অনুযায়ী দুর্গ থেকে নিরাপদ দূরত্বে ঘেরাও বেষ্টনী রচনা করতে শুরু করল। অর্ধরাতের মধ্যেই ঘেরাও কাজ সমাপ্ত করা হলো। ছোট ছোট মিনজানিকগুলো দুর্গের সদর দরজা বরাবর রাখা হলো, যাতে প্রধান ফটকে এগুলো থেকে পাথর নিক্ষেপ করা যায়। ভোরেই দুর্গের প্রহরীরা চিৎকার করে বলতে শুরু করলো, শত্রু বাহিনী আমাদের দুর্গ ঘেরাও করেছে। সবাই সতর্ক হয়ে যাও। কেউ দুর্গের বাইরে যাবেনা। দুর্গফটকের প্রহরা মজবুত করো।

বিন কাসিম বাহিনীর ঘেরাও এর খবরে সারা দুর্গে হৈচৈ পড়ে গেল। ঘোষণা শোনা মাত্রই হিন্দু তীরন্দাজ ইউনিট দুর্গপ্রাচীরে এসে অবস্থান নিলো। শহরের যেসব বেসামরিক লোক লড়াই করার মতো ছিল তারাও বর্শা হাতে নিয়ে দুর্গপ্রাচীরে এসে অবস্থান নিলো।

মুহাম্মদ বিন কাসিম দুর্গের চতুর্দিকে অশ্ব হাঁকিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং দুর্গপ্রাচীরের অপেক্ষাকৃত দুর্বল জায়গাটি চিহ্নিত করার চেষ্টা করছিলেন। দুর্গের সার্বিক অবস্থা দেখে বিন কাসিম কিছুটা আশ্বস্থ হলো এই ভেবে যে, বুর্গপ্রাচীরের আগে কোন প্রতিরক্ষা খাল নেই। অবশ্য তাতে এটাও তিনি বুঝতে পারলেন যে, দুর্গ রক্ষার জন্য খাল খননের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি শত্রু বাহিনী। কারণ দুর্গপ্রাচীর খুব মজবুত। তিনি আরো প্রত্যক্ষ করলেন, দুর্গপ্রাচীরটি খাড়া নয় কিছুটা ঢালু। এতে এ বিষয়টিও তিনি বুঝে নিলেন, দুর্গপ্রাচীরের গঠনই বলে দিচ্ছে তা খুব শক্ত এবং অনমনীয় এবং চওড়া। এ ধরনের দেয়ালে সাধারণত কোন ছিদ্র থাকে না।

বিন কাসিম ছোট ছোট মিনজানিক থেকে দুর্গপ্রাচীরের অভ্যন্তরে পাথর নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। নির্দেশের সাথে সাথেই দুর্গাভ্যন্তরে পাথর নিক্ষেপ শুরু হলো। যেসব তীরন্দাজ দুর্গপ্রাচীরের ওপর অবস্থান নিয়েছিল তারা মিনজানিক উৎক্ষেপণকারী মুসলিম সেনাদের ওপর তীব্র তীর বর্ষণ শুরু করল। তাতে কয়েকজন মিনজানিক পরিচালনাকারী সেনা আহত হলো। ফলে মিনজানিক আরো পিছিয়ে আনা হলো। কিন্তু মিনজানিক দূরে সরিয়ে আনায় নিক্ষিপ্ত পাথর আর দুর্গাভ্যন্তরে নিক্ষেপ করা সম্ভব হচ্ছিল না।

হিন্দু যোদ্ধারা দারুন সাহসিকতার সাথে দুর্গের একটি ছোট গেট খুলে দ্রুত গতিতে ঘোড়া হাঁকিয়ে মুসলিম সৈন্যদের উপর তীর বর্ষণ করে আবার তড়িৎবেগে দুর্গের ভিতরে চলে যাচ্ছিল। মুসলিম যোদ্ধারাও তাদের ধাওয়া করত। কিন্তু তুলনামূলক ভাবে এই আক্রমণ প্রতি আক্রমণে মুসলিম বাহিনীই বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হতে লাগলো।

বিন কাসিম সকল সেনাপতিদের নির্দেশ দিলেন, এমন কিছু সংখ্যক যোদ্ধা বাছাই করতে যারা দুর্গাভ্যন্তরে প্রবেশের জন্যে আক্রমণে অবতীর্ণ হবে। তিনি বললেন, যখনই শত্রু বাহিনী দুর্গের দরজা খুলবে তখনই যাতে মুসলিম সৈন্যরা দুর্গে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও তাতে সফলতা এলো না। কারণ দুর্গফটক খোলার পরক্ষণেই আবার হিন্দুরা বন্ধ করে দিতো। অনেকবার হিন্দু আক্রমণকারীদেরকে মুসলিম যোদ্ধারা বেষ্টনীর মধ্যে আটকাতেও চেষ্টা করেছে কিন্তু আটকানোর জন্যে তাদের দুর্গপ্রাচীরের কাছে চলে যেতে হতো, আর সেই সময় দুর্গপ্রাচীরের উপর থেকে তাদের উপর শত্রুরা পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করত।

রাতের বেলায় কিছু সংখ্যক সৈন্য দুর্গপ্রাচীরে আঘাত করে প্রাচীর ভাঙ্গার চেষ্টা করল, কিন্তু তাতেও ফলোদয় হলো না। বরং মুসলিম বাহিনীর

ক্ষয়ক্ষতিই বৃদ্ধি পেতে থাকল। এভাবে আক্রমণ প্রতি আক্রমণে কেটে গেল কয়েক দিন।

অতঃপর নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা হলো। প্রতিটি মিনজানিকের সাথে বহু সংখ্যক তীরন্দাজ সৈন্য প্রেরণ করা হলো। তীরন্দাজ সেনারা মিনজানিকের সামনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে দুর্গপ্রাচীরের ওপরে অবস্থানরত শত্রুসেনাদের উপর তীব্র তীরবৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগলো, যাতে শত্রু সেনারা মাথা তুলে মিনজানিক পরিচালনাকারী সেন্যদের বাধাগ্রস্ত না করতে পারে। তাতে সুফল এই যে, শহরের ভিতরে মূহুর্মুহু পাথর বর্ষিত হতে লাগল এবং শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে ভীতি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। শুরু হলো দৌড় ঝাপ। তদুপরি শত্রুবাহিনী শহরের বাসিন্দাদের অভয় দিয়ে তাদের হৈচৈ দমাতে চেষ্টা করতে লাগলো। যোদ্ধা ও সৈন্যরাও বিপুল উদ্যমে প্রতিরোধ করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল।

এই শহরের প্রধান মন্দিরের নাম ছিল ডাভেল। মন্দিরের নামেই শহরের নামকরণ করা হয়। মন্দিরটি ছিল একটি উচু স্থানে অবস্থিত। কয়েকটি গম্বুজ বিশিষ্ট এই মন্দিরের কাঠামো ছিল চৌকোনা। মন্দিরের প্রধান গম্বুজটির উচ্চতা এতোটাই বিশাল ছিল যে, কয়েক মাইল দূর থেকে তা দেখা যেতো। কোন কোন ঐতিহাসিক এই মন্দির গম্বুজের উচ্চতা একশ ষাট গজের কথা উল্লেখ করেছেন। উঁচু মন্দির গম্বুজের ওপর একটি দীর্ঘ বাঁশের মধ্যে সবুজ পতাকা উড্ডীন ছিল। ডাভেল মন্দিরের পতাকার ব্যাপারে সেই অঞ্চলে এমন বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, যে সফরকারী দল যতো বেশী দূর থেকে মন্দিরের পতাকা দেখতে পেতো, তাদের ভ্রমন হতো ততোটাই নিরাপদ। হিন্দুরা বিশ্বাস করত, মন্দিরের সেই পতাকা এক দেবতা নিজের হাতে উড্ডীন করে রেখেছে। হিন্দুরা একথাও বিশ্বাস করতো যে, এই মর্যাদাজনক পতাকা ধারণকারী মন্দির ও শহরকে যেই আক্রমণ করতে আসবে সে বা তারা আর জীবিত ফিরে যেতে পারবে না। তাদের সকল যুদ্ধশক্তি ধ্বংস হয়ে যাবে।

আগে প্রেরিত দুই সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন মাবহান ও বুদাইল বিন তোফায়েল দুর্গ থেকে অনেক দূরে থাকাবস্থায়ই শাহাদাতবরণ করেছিলেন। এতে হিন্দুদের এই বিশ্বাস আরো বদ্ধমূল হয়েছিল। হিন্দুরা বিশ্বাস করতে শুরু করে ডাভেল শহর কারো পক্ষেই পদানত করা সম্ভব নয়, কারণ ডাভেলের হেফাযত খোদ দেবতা নিজে করেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম হিন্দুদের এসব ধারণা বিশ্বাস সম্পর্কিত কিছুই জানতেন না। তিনি ডাভেলকে একটি মন্দির ছাড়া আর কিছুই ভাবেন নি। প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও মুসলিম বাহিনীর পক্ষে দুর্গপ্রাচীরের কোথাও ভাঙ্গন সৃষ্টি করা সম্ভব হলো না। দুর্গপ্রাচীরে নীচের দিকে ছিল দশবারো হাত চওড়া আর ওপরে ছয় সাত হাত চওড়া। অনায়াসে দুর্গপ্রাচীরের ওপর দিয়ে সৈন্যরা ঘোড়া দৌড়াতে পারত।

এভাবে আরো কয়েক দিন চলে যাওয়ার পর নিজেদের অজেয় ভেবে হিন্দু সৈন্যরা মুসলমান সেনাদের প্রতি বিদ্রুপাত্মক অঙ্গভঙ্গি দেখাতে শুরু করল। এক হিন্দু সেনা দুর্গপ্রাচীরে দাঁড়িয়ে বলল, “স্নেচ্ছের বাচ্চারা। যেদিক থেকে এসেছে সে দিকেই ফিরে যাও। আগের দুই সেনাপতি ও সৈন্যদের পরিণতির কথা স্মরণ করো। এটা দেবতাদের শহর। দেবদেবীদের আক্রোশ থেকে জীবন নিয়ে পালাও।” আরো নানা ধরনের উত্তেজক ও বিদ্রুপাত্মক কথা মুসলিম বাহিনীকে শোনাতে লাগল হিন্দুরা।

তাতে মুসলিম সৈন্যরা হতোদ্যম না হলেও তাদের এ বিষয়টি বুঝে আসলো যে, বড় ধরনের আত্মত্যাগ ছাড়া এই দুর্গ জয় সম্ভব নয়।

দিন শেষে এলো রাত। নিশুতি নিস্তব্ধ রাত। সবখানে নীরব নিস্তব্ধতা। এর মধ্যে আহত কোন সৈন্যের হু, হা রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে দিচ্ছিল। সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী বিন কাসিম বাহিনীর কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্ত্রী সন্তানদের সাথে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের অবস্থান ছিল তাঁবুর ভিতরের দিকে। মহিলারা আহত সৈন্যদের সেবা শুশ্রুষা করত। দিনের বেলা সংঘর্ষে যেসব সৈন্য আহত হতো, সহকর্মী সৈন্যরা তাদেরকে সংরক্ষিত এলাকায় অবস্থিত তাবুতে রেখে আসত, আর মহিলারা তাদের ক্ষতস্থানে পট্টি বেধে দিতো, সেবা করত।

মুহাম্মদ বিন কাসিম সব সেনাপতিদেরকে তার তাবুতে ডেকে পাঠালেন। সবাইকে নিয়ে দুর্গ জয়ের প্লান নির্ধারনে ব্যস্ত ছিলেন এমন সময় এক প্রহরী তাঁবুতে প্রবেশ করে বিন কাসিমকে জানালো, এক হিন্দু ঋষিকে পাকড়াও করে আনা হয়েছে। হিন্দু ঋষি আমাদের অবরোধ বেষ্টনীর আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করছিল, তখন তাকে পাকড়াও করা হয়। ধৃত ঋষি এরপর জানায়, সে সম্মানিত সেনাপতির সাথে দেখা করতে চায়। সম্ভবতঃ সে গোয়েন্দা হয়ে থাকবে, বলল প্রহরী।

“ওকে ভিতরে নিয়ে এসো।” নির্দেশ দিলেন বিন কাসিম। দুভাষীকে ভিতরে পাঠিয়ে দাও।” ধৃত লোকটিকে যখন তাঁবুর ভিতরে নিয়ে আসা হলো, তাকে দেখেও ঋষী বা সন্নাসীই মনে হলো।

বিন কাসম দুভাষীকে বললেন, ওকে জিজ্ঞেস করো সে এখানে কি করছিল?”

“আপনাকে আল্লাহ অনুগ্রহ করুন” একথা আরবী ভাষায় বলে হেসে দিলো ঋষি। সাথে সাথেই জানালো, আমি মুসলমান। হারেস আলাফী আমাকে পাঠিয়েছেন।

“আচ্ছা, তাহলে এই ছদ্মবেশ ধারণ করলে কেন?

“ছদ্মবেশ ধারণ করার কারণ হলো, আমি দিনের বেলায় এদিকে এসেছি। আমাকে আসল সুরতে এদিকে আসতে দেখলে রাজা দাহিরের গোয়েন্দাদের নজর পড়তো, আর রাজার কাছে খবর পৌঁছে যেতো যে, রাজার আশ্রিত মুসলমানরা পর্দার আড়ালে মুসলমান সেনাদের যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। আর এই অভিযোগে আমাদের বসতিতে আক্রমণ চালানোর অজুহাত খাড়া করত।”

“ঠিক আছে, তবে বিশেষ কোন খবর আছে নাকি?”

“হ্যাঁ, সম্মানিত সেনাপতি! আলাফী বলেছেন, মন্দিরের প্রধান গম্বুজের ওপর যে পতাকা উড়ছে সেটিকে শীঘ্রই ভুলুণ্ঠিত করার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি শুনেছেন, আপনার কাছে নাকি একটা বড় ধরনের মিনজানিক আছে। সেটি দিয়ে পাথর নিক্ষেপ করলে মন্দিরের প্রধান গম্বুজে আঘাত হানা। সম্ভব। তবে মন্দিরের গম্বুজ ভাঙ্গা সহজ ব্যাপার না। খুবই শক্ত মন্দিরের কাঠামো। তবুও আপনি অবিরাম পাথর বর্ষণ করতে থাকুন। এই পতাকা ধুলিস্যাত হলেই বুঝবেন, দুর্গ আপনার দখলে চলে এসেছে।” এই বলে সংবাদ বাহক ঋষীরূপী লোকটি দাড়িয়ে গেল এবং বলল, আমি আমার কর্তব্য সম্পাদন করেছি এখন আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন।” সকাল বেলায় বিন কাসিম জাউনা সালমী নামের এক সেনাকে তলব করল। সে নির্ভুল লক্ষ বস্তুতে মিনজানিকের সাহায্যে পাথর নিক্ষেপে পটু ছিল। সে তাঁবুতে প্রবেশ করতেই বিন কাসিম তাকে তাবুর বাইরে নিয়ে মন্দিরের ওপর উড্ডীন পতাকা দেখিয়ে বললেন, জাউনা সালমী! মন্দিরের

ওপরে উড্ডীন পতাকা দেখতে পাচ্ছো? এই পতাকাটি ধুলিস্যাত করতে হবে। আমি জানি, পতাকা নামাতে হলে মন্দিরের চূড়া ভাঙ্গতে হবে কিন্তু আমি জানি না, তুমি ঠিক লক্ষ্যে পাথর নিক্ষেপ করতে পারবে কি-না।”

“প্রধান সেনাপতিকে আল্লাহ রহম করুন এবং আপনার হায়াত দরাজ করুন।” সম্মানিত সেনাপতি! আল্লাহ যদি আমাদের প্রতি সহায় হোন, তাহলে আপনাকে আমি এই আশ্বাস দিতে পারি যে, মাত্র তিনবার পাথর উৎক্ষেপণেই আমি মন্দির চূড়া ধ্বংস করে দেবো।” “তুমি যদি পাথর নিক্ষেপ করে মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পতাকা ফেলে দিতে পারো তাহলে আমি তোমাকে দশ সুগার দিরহাম পুরস্কার দেবো” বললেন বিন কাসিম।

“আর আমি যদি তিনবার মিনজানিক উৎক্ষেপণের দ্বারা এই মন্দির চূড়া ধ্বংস করতে না পারি তাহলে প্রধান সেনাপতি আমার দু’হাত কেটে দেবেন।” স্বীকারোক্তি করল সালমী।

“আল্লাহর কসম! তোমার মতো সাহসী যোদ্ধাই আমার দরকার জাউনা সালমী! তিনবার উৎক্ষেপণের কোন শর্তারোপের প্রয়োজন নেই। তুমি যেভাবে পারো মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পতাকাটি ফেলে দাও, আর পুরস্কার জিতে নাও।” বললেন বিন কাসিম। বিন কাসিমের নির্দেশে প্রধান মিনজানিক উরুসকে দুর্গের পূর্ব পাশে নিয়ে আসা হলো। কারণ তখন সূর্য উদিত হচ্ছিল মাত্র। পূর্ব দিক থেকেই মন্দির চূড়া পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে সৈন্যরা বিশালাকার পাথর জড়ো করল।

জাউনা সালমী আল্লাহর নাম নিয়ে মিনজানিকের নিশানা ঠিক করল। দূরত্বের পরিমাণু আন্দাজ করে মিনজানিকের পিছনের দিকে একটু জায়গার মাটি খুঁড়ে মিনজানিকের সম্মুখ ভাগ ওপরে তুলে নিলো। তাতে নিক্ষিপ্ত পাথর বেশী দূরে এবং ওপরে গিয়ে পড়বে। সিরিয়ার সেই অধিবাসী জাউনা সালমী হয়তো জানতো না, তার সেই নিক্ষিপ্ত পাথর ইতিহাস বদলে দেবে এবং সময়ের গতিকে ঘুরিয়ে দেবে।”

মিনজানিক উৎক্ষেপণকারী জাউনা সালমীর নির্দেশ মতো সৈন্যরা বড় বড় পাথর এনে মিনজানিকে স্থাপন করল, আর তার কথা মতো পাঁচশ’রও বেশী সৈন্য একসাথে মিনজানিকের রশি টানলো। মিনজানিকের পাথর উৎক্ষেপক

অংশ রশির টানে শেষপ্রান্ত স্পর্শ করলে জাউনা সালমী সৈন্যদেরকে ইশারা করতেই সবাই রশি ছেড়ে দিলো। বিশাল বিশাল পাথর মাটির ঢিলের মতো উড়ে উড়ে দুর্গপ্রাচীরের বহু উপর দিকে মন্দিরের প্রধান গম্বুজে আঘাত হানলো। বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠল চতুর্দিক, সেই সাথে মুসলিম সৈন্যরা সমকণ্ঠে তাকবীর দিলেন। এরপর জাউনা সালমীর নির্দেশে সৈন্যরা দ্বিতীয়বার মিনজানিকের মধ্যে পাথর স্থাপন করল। পাথর স্থাপনের সময়ই সালমী বলল, এবার আর মন্দির চূড়া দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। দ্বিতীয় বারের আঘাতে নিক্ষিপ্ত পাথর আর গম্বুজে আঘাত করে প্রতিধ্বনীত হলো না বরং গম্বুজ ভেঙ্গে পাথর ভিতরে প্রবেশ করলো। আর মন্দির চূড়ার পতাকা দণ্ড হেলে গেল। তৃতীয়বারের উৎক্ষেপণের সময় জাউনা সালমী মিনজানিকের নিশানা একটু বদল করে নিলো। সেই সাথে মিনজানিকে পাথর স্থাপন করে যখন নিক্ষেপ করল, পাথরের গমণ পথের দিকে তাকিয়ে জাউনা সালমী তাকবীর দিলো, নিক্ষিপ্ত পাথর দ্বিতীয় আঘাতের একটু ওপর মন্দির চূড়ায় আঘাত হানলো। তাতে মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পতাকাদণ্ডসহ লুটিয়ে পড়ল মন্দিরের ভিতরে। পতাকা পড়তে দেখে বিন কাসিমের সৈন্যরা তাকবীর ধ্বনীতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে ফেলল।

মন্দিরে প্রথম পাথর নিক্ষেপের আওয়াজে শহরের সকল বেসামরিক হিন্দু মন্দিরে গিয়েজড়ো হলো, আর পূজাপাঠ করতে শুরু করল। এমতাবস্থায় কিছুক্ষণ পর যখন দ্বিতীয়বার মিনজানিকের নিক্ষিপ্ত প্রস্তরাঘাতে মন্দির গম্বুজের একাংশ ভেঙ্গে পড়ল, তখন মন্দিরের ভিতরে থাকা পূজারী ও মন্দিরের পুরোহিতরা ভয়ে আতঙ্কে বেরিয়ে এলো। তৃতীয়বারের প্রস্তরাঘাতে যখন মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পতাকা ভূলুণ্ঠিত হলো তখন হিন্দুরা আতঙ্কে আর্তনাদ শুরু করে দিলো। সারা শহর জুড়ে দেখা দিলে চিৎকার চেচামেচি। তাদের দৃষ্টিতে মন্দিড়া ভেঙ্গে পড়া ছিল ধ্বংসের আলামত। হিন্দু নারী শিশুদের আর্তচিৎকারে দুর্গাভ্যন্তরে কেয়ামত সৃষ্টি হয়ে গেল। মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পড়তে দেখে সৈন্যরা দুর্গের প্রধান ফটক খুলে দিলো। সকল হিন্দু সৈন্য ও সামর্থবান পুরুষরা দুর্গের বাইরে চলে এলো জীবনের শেষ মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হতে। হিন্দুরা সব একসাথে মুসলিম সৈন্যদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। মুসলিম বাহিনী মুখোমুখি লড়াইয়ের জন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল, তারা কিছুটা পশ্চাৎপদ হয়ে হিন্দুদের অগ্রসর হতে দিয়ে হঠাৎ আক্রমণ করল।

হিন্দুরা ছিল আক্রোশে উন্মাদ। আবেগ উন্মাদনায় হিন্দুদের মধ্যে কোন সামরিক শৃঙ্খলা ছিলনা। তাই মুসলিম সৈন্যদের সুনিয়ন্ত্রিত আক্রমণে ওরা কচুকাটা হতে লাগল। অবস্থা বেগতিক দেখে হিন্দু আক্রমণ কারীরা পিছু হটে দুর্গাভ্যন্তরে প্রবেশ করে দুর্গফটক বন্ধ করে দিলো।

মুহাম্মদ বিন কাসিম তখন সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন সবগুলা মিনজানিক থেকে দুর্গের ভিতরে পাথর নিক্ষেপ করতে থাকো। তখন দুর্গপ্রাচীরের ওপরে আর কোন হিন্দু সৈন্য ছিল না। মন্দির চূড়ার পতাকা ভেঙ্গে পড়া দেখেই ওদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দুর্গপ্রাচীর শত্রু মুক্ত দেখে মুসলিম সৈন্যরা রশিতে বাধা আংটা নিক্ষেপ করে রশি বেয়ে দুর্গপ্রাচীরের ওপরে উঠতে শুরু করল। সবার আগে দুর্গপ্রাচীরে উঠার মতো সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে সাদী বিন খুজাইনা ইতিহাসের পাতায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ছিলেন কুফার অধিবাসী। দুর্গপ্রাচীরে আরোহণকারী দ্বিতীয় সৈনিক ছিলেন বসার অধিবাসী আজাল বিন আব্দুল মালিক।

দুর্গে অনবরত পাথর নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। তাতে শহরের অধিফসীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। লোকজন প্রাণ ভয়ে ছুটাছুটি শুরু করে দিল। এদিকে মুসলিম সৈন্যরা কয়েকটি আংটা দিয়ে দ্রুতগতিতে দুর্গপ্রাচীরে উঠতে লাগল। কিছু সংখ্যক সৈন্য দুর্গপ্রাচীর থেকে নীচে নেমে দুর্গের প্রধান ফটক খুলে দিলে প্লাবনের মতো বিন কাসিমের বাহিনী দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করল।

দুর্গে প্রবেশ করে প্রথমেই বিন কাসিম এক সেনাপতিকে নির্দেশ দিলেন আগে আমাদের বন্দীদের খোঁজ করো। তাদের যদি এই দুর্গে বন্দি করা হয়ে থাকে তাহলে আক্রোশে হিন্দুরা হত্যায় মেতে উঠতে পারে। ডাভেল দুর্গে মুসলিম বাহিনী প্রবেশের পর ব্যাপক হত্যাকাণ্ড শুরু হয়ে গেল। মুসলিম বাহিনীর সামনে হিন্দু সৈন্যরা প্রতিরোধ তো দূরে থাক কচুকাটা হতে লাগল। বিন কাসিম উচ্চ আওয়াজে হুংকার দিয়ে বললেন, কোন-শত্রু সেনাকেই রেহাই দেব না।” এই দুর্গের কোন পুরুষ ক্ষমার যোগ্য নয়। বিন কাসিমের এতোটা ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ ছিল এরা আগে দুইজন সেনাপতিসহ অসংখ্য মুসলিম সৈন্যকে হত্যা করেছিল। তাছাড়া নিরপরাধ মুসলিম নারী পুরুষ ও শিশুদের আটকে রেখেছিল। সর্বোপরি বিন কাসিমের সহযোদ্ধাদের প্রতি নানা ভাবে পি তাচ্ছিল্য করেছিল। বিন কাসিমের যোদ্ধারা হুংকার দিয়ে বলছিল, হে মূর্তি পূজারীরা। কোথায় গেল

তোমাদের গর্ব। এখন তোমাদের দেব-দেবীদের ডাকোনা কেন। তারা কেন তোমাদের রক্ষায় শক্তির মহড়া দেখায় না। ওদের বলো, পারলে দেবদেবীরা তোমাদের রক্ষা করুক। বিন কাসিম তার নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে শহরের কয়েদখানার দিকে ঘোড়া ছুটালেন। আসলে হিন্দু জাতিও ইহুদিদের মতো। ওদের মধ্যে কোন গভীর বুদ্ধি বিবেক কাজ করেনা। আসলে সত্যে উপণীত হওয়ার মতো ওদের বিবেক বুদ্ধিই নেই। ওরা অনেকটা জড়বস্তুর মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *