১৩. বই-মালিনী

১৩. বই-মালিনী

রবি বিলেতে চলে যাওয়ার পর আন্নার আর কিছুতে মন লাগে না। রকমসকম দেখে আত্মারাম পাণ্ডুরং কিছুদিনের জন্য মেয়েকে কলকাতায় নিয়ে এলেন। বন্ধু মনোমোহন ঘোষের বাড়িতে উঠেছেন তারা। তারপর একদিন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এলেন মহর্ষি ও তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। পাণ্ডুরং বসলেন বৈঠকখানায় দেবেন ঠাকুরের কাছে আর আন্না চলে। গেলেন বাড়ির ভেতরে মেয়েমহলে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সকলকে আপন করে নিতে তার জুড়ি নেই। অন্দরে তেতলার ঘরে সহজভঙ্গিতে কাদম্বরীর গলা জড়িয়ে খাটে আধ-শোওয়া হয়ে গল্প করতে থাকেন আন্না। রবির ঘর কোনটা, রবি সারাদিন কী করে? কোথায় তার লেখার টেবিল, কী খেতে ভালবাসে– এ-সব অজস্র প্রশ্নে তিনি পাগল করে দেন কাদম্বরীকে।

কাদম্বরী তাঁর চাঁপার কলির মতো আঙুলে আন্নার গোলাপি থুতনি তুলে ধরে জানতে চান, আন্না তুমি মরেছ, রবি তোমার সব চুরি করেছে মনে হচ্ছে!

আন্না লজ্জা পান, মুখ ঘুরিয়ে বলেন, আহা, সে তো জানে শুধু নতুনবউঠান আর নতুনবউঠান। তুমিই তার মাথা খেয়েছ। তোমাকে আমি খুব ঈর্ষা করি।

কাদম্বরী ছাড়েন না, নিজের অস্বস্তি গোপন করে আন্নাকে বলেন, ও-সব। বলে পাশ কাটানো যাবে না, সত্যি বলল, তুমি রবিকে ভালবাসো?

লজ্জায় আন্নার মুখ নুয়ে পড়ে কাদম্বরীর বুকে। বলেন, আমি আগে কখনও এত কাছ থেকে কোনও কবিকে দেখিনি! তাকে ভাল না বেসে পারা যায় না!

আন্নার চোখে রবির এক নতুন চেহারার ছায়া দেখেন কাদম্বরী, সে আর তার সেই কিশোর উপাসক নয়, সে যে কোন অজান্তে এক রমণীমোহন পুরুষ হয়ে উঠেছে কাদম্বরী জানতেও পারেননি। মনের কোণে কোথায় ঈষৎ খচখচ করে, এতদিনকার একান্তই তার আঁচলে বাঁধা পোষা প্রাণীটি এখন অন্যত্র রাজ্যবিস্তার করছে। অন্য নারীর চোখের তারায় রবির ছায়া তিরতির করে কাঁপতে দেখে কাদম্বরী উদাস হয়ে যান একটু। কাদম্বরীর ছায়া কি কারও চোখের মণিতে ছায়া ফেলে?

পাণ্ডুরং মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন বলেই কলকাতায় এসেছেন। রবি চলে যাওয়ার পর থেকেই আন্না খুব উদাস। রবি যাওয়ার সময়ে যেন আন্নার হৃদয়টিকেও সঙ্গে নিয়ে গেছেন। এদিকে এত যুবক তার কৃপাপ্রার্থী, কিন্তু তাদের কাউকেই ঠিক মনে ধরেনি এই চঞ্চলা কন্যার। পাণ্ডুরং দেবেন ঠাকুরের সঙ্গে একথা-সেকথার পর জানতে চান রবির বিয়ের কথা কিছু ভাবছেন কি না মহর্ষি দেবেন্দ্র পাণ্ডুরংকে যত্নআত্তি করলেও রবির বিয়ের কথায় সায় দিতে পারেন না। রবি এখন বিলেতে পড়তে গেছে। আগে সে সব সম্পূর্ণ হোক, কাজ শুরু করুক, তারপর ভাবা যাবে। তা ছাড়া এই মরাঠি ভদ্রলোকের মনের ইচ্ছে অনুমান করলেও কোনওদিনই তাতে রাজি হতে পারবেন না দেবেন্দ্র। একে কন্যা বাঙালিনি নয় তার ওপর বয়সে রবির চেয়ে প্রায় পাঁচ-ছ বছরের বড়। গুজরাতি মরাঠিদের মধ্যে এমন অসম-বয়সি বিয়ে হলেও বাঙালিদের মধ্যে চল নেই। দেবেন ঠাকুর নানা কথায় বিয়ের প্রসঙ্গটি লঘু করে দেন। পাণ্ডুরং বুদ্ধিমান পুরুষ, বুঝতে পারেন এখানে বিয়ের সম্ভাবনা কম। বিষণ্ণ মনে আন্নাকে নিয়ে তিনি ঠাকুরবাড়ি থেকে বিদায় নেন।

আন্নার ছেড়ে যাওয়া বিষাদ যেন কাদম্বরীর ওপর ভর করে। তেতলার একলা ঘরে কখনও বিছানায় কখনও মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে তার দিনরাত যেন আর কাটতে চায় না। এখন আর ছাদের আসর বসে না। রবি চলে গেছে, অক্ষয় বা বিহারীলাল আর আসেন না। আসবেন কার কাছে? জ্যোতি এখন নাটক নিয়ে এমন মেতেছেন যে ঘরে আসার সময়ই হয় না। যখন ঘরে থাকেন, তখনও নতুন নাটক লেখায় ব্যস্ত। অশ্রুমতী মঞ্চস্থ হচ্ছে হইচই করে। জ্যোতি সারাদিন রিহার্সালেই পড়ে থাকেন। নায়িকাকে পার্ট শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। এখানেই কাদম্বরীর ব্যথা।

ব্যথা আছে জ্যোতির বুকেও। বিনোদিনী বেঙ্গল থিয়েটার ছেড়ে চলে গেছেন, সুতরাং অশ্রুমতীর নায়িকার ভূমিকায় তাকে পাওয়া গেল না। সুকুমারী বা বনবিহারিণীকে অনেক শিখিয়েও যেন বিনোদিনীর মতো হয় না। জ্যোতি ছুটে ছুটে কিশোরী বিনোদিনীর অভিনয় দেখতে যান ন্যাশনাল থিয়েটারে। কী তার অভিনয়! বিষবৃক্ষে কুন্দনন্দিনী, সধবার একাদশীতে কাঞ্চন, পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটানিয়া এবং মেঘনাদ বধে একসঙ্গে সাতটি চরিত্রে পার্ট করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। গিরিশ ঘোষের সাহচর্যে এবং নিজের ঐকান্তিক নিষ্ঠায় অন্যসব নায়িকাদের ছাপিয়ে ইতিমধ্যেই আগুনের শিখার মতো স্টেজ জ্বালিয়ে দিচ্ছেন বিনোদিনী। জ্যোতি বারবার তাকে অনুনয় করেন অশ্রুমতীর নায়িকা হওয়ার জন্য, কিন্তু বিনোদিনী ফিরিয়ে দেন। গিরিশ ঘোষকে ছেড়ে বেঙ্গল থিয়েটারে ফিরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। তবে কি বিনোদিনী গিরিশের প্রেমে পড়েছে? জ্যোতির মনটা ঈর্ষায় চিনচিন করে ওঠে।

রূপা আর কাদম্বরী বসে বসে কখনও রবির চিঠি পড়েন, কখনও থিয়েটারের রিভিউ। সেদিন বিনোদিনীর রূপগুণের ব্যাখ্যান পড়তে পড়তে হঠাৎ কাদম্বরী দেখলেন রূপা কিছুই শুনছে না, হাঁ করে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে।

কাদম্বরী পত্রিকা নামিয়ে রেখে বালিশে গা এলিয়ে বলেন, এই রূপা, কী দেখছিস রে অমন হাঁ করে?

রূপা বলে, তোমাকে দেখছি। দেখছি আর অবাক হয়ে ভাবছি এমন অপূর্ব রূপ তোমার, এমন শরীরের গড়ন, যেন হঠাৎ আসা আলোর মতো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তবু কেন জ্যোতিদাদার ঘরে মন টেকে না!

তুই যেন জানিস না, তিনি এখন বিনোদিনী, সুকুমারী, বনবিহারিণীদের রূপে মজেছেন! কাদম্বরী ঝামটা মেরে বলেন, আমার দিকে চাইবার তার সময় কোথায়? তবে আমাকে নিয়ে তুই বেশি বেশি আদিখ্যেতা করিস, সত্যি যদি অমন রূপসি হতাম তা হলে কি একা ঘরে পচে মরি?

ওমা, আমি কেন খামোখা মিথ্যে বলব নতুনবউঠান, রূপাও ঝংকার দেয়, তোমার বর যদি এখন আগুন দেখে পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দেন, তাতে তোমার কমলহিরের মতো রূপ তো আর মিথ্যে হয়ে যায় না।

তা হলে আমাকে ফেলে তিনি সেখানে ছুটে যান কেন? সেই বারাঙ্গনা নটীরা কি রূপে রুচিতে শিক্ষায় আমাকে ছাপিয়ে গেছে? সে কি বিহারীলালের কবিতা পড়ে?

শোনো বউঠান, রূপা জোর গলায় বলে, স্টেজের নটীরা সেজেগুজে সবার সামনে তাদের রূপ মেলে ধরছে, কিন্তু তারা কেউ তোমার চেয়ে রূপসিএ আমি বিশ্বাস করি না।

কাদম্বরী আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ান, গায়ের কাপড় ফেলে দিয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন তারও মনে হয়, রূপা সত্যি বলছে। নিজের লাবণ্য উচ্ছ্বাসে তার নিজেরই ঘোর লাগে যেন। কিন্তু বিনোদিনী, সে কেমন দেখতে? জানতেই হবে কাদম্বরীকে। অধীর হয়ে ওঠেন তিনি, বলেন, অনেকদিন তোর নতুনদাদাকে বলেছি থিয়েটারে নিয়ে যেতে, কিছুতেই সাহস পাননি বাবামশায়ের ভয়ে। চল তুই আর আমি লুকিয়ে বিনোদিনীকে দেখে আসি একদিন।

যাবে, সত্যি যাবে বউঠান? রূপাও উত্তেজিত হয়ে ওঠে নিষিদ্ধের স্বাদ নেওয়ার এমন লোভনীয় প্রস্তাবে।

প্রথমে মালিনীকে নিয়ে তুই বরং দেখে আয়, কাদম্বরী দ্বিধা করেন, আমি গিয়ে জানতে পারলে তো বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে বাকি রাখবে সকলে। এমনিতেই বাঁজা বলে উঠতে বসতে খোঁটা দেয়, তার ওপর এখন স্বামীসোহাগ কমে গিয়েছে ভেবে সবাই যেন আরও তেড়ে আসছে। যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ভয় পাচ্ছি রে।

কাদম্বরীকে জড়িয়ে ধরে রূপা বলে, না বউঠান, তা হবে না। চলো না, এমন ব্যবস্থা করব লুকিয়ে যাওয়ার, কেউ জানতে পারলে তো!

কী ব্যবস্থা করবি শুনি? কাদম্বরী আশার আলোর খোঁজে মরিয়া যেন। তুই।

কী করে করবি? খবরদার হ্যারিসাহেবকে এর মধ্যে টেনে আনিস না যেন!

না না, বউঠান, ওই যে তুমি বললে মালিনীর কথা, আমি ওকেই ডেকে আনছি। ওই সব ব্যবস্থা করে দেবে। আমরা তিনজনেই গোপনে দেখে আসি চলো।

ধুর যত সব অসম্ভবের আশা, কাদম্বরী প্রসঙ্গ পালটাতে চান ভয় পেয়ে। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মালিনী এসে হাজির। সব শুনে সে এক অদ্ভুত কথা বলে বসল- নতুনবউঠান জানো, ভবিষ্যতে তোমাকে নিয়ে যে গল্পটা লেখা হবে, মালিনী রহস্য করে বলে, তার লাইনগুলো এখনই তোমাকে শোনাতে পারি, যদি শুনতে চাও তো।

সে আবার কী রে মালিনী, ভবিষ্যতের লেখা আবার কী, কাদম্বরী বলেন, তুই কি নিজেই আজকাল আফিম খেয়ে গল্পটল্প লিখছিস নাকি?

আমি কেন লিখব, তোমার প্রিয়জনদের মধ্যেই কেউ হয়তো লিখবে, আমি চোখ বুজে বসলেই সে লেখার অক্ষরগুলো অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করে চোখের সামনে ভেসে উঠছে, শুনবে, শোননই না একটু গিরিবালার সৌন্দর্য অকস্মাৎ আলোকরশ্মির ন্যায়, বিস্ময়ের ন্যায়, নিদ্রাভঙ্গে চেতনার ন্যায়,… তাহার সন্তানাদি নাই, ধনিগৃহে তাহার কোনো কাজকর্মও নাই– সে কেবল নির্জনে প্রতিদিন আপনার মধ্যে আপনি সঞ্চিত হইয়া শেষকালে আপনাকে আর ধারণ করিয়া রাখিতে পারিতেছে না। স্বামী আছে কিন্তু স্বামী তার আয়ত্তের মধ্যে নাই। গিরিবালা বাল্যকাল হইতে যৌবনে এমন পূর্ণবিকশিত হইয়া উঠিয়াও কেমন করিয়া তাহার স্বামীর চক্ষু এড়াইয়া গেছে।

বরঞ্চ বাল্যকালে সে তাহার স্বামীর আদর পাইয়াছিল।… গোপীনাথ যাহাকে দাসখত লিখিয়া দিয়াছে তাহার নাম লবঙ্গ– সে থিয়েটারে অভিনয় করে– সে স্টেজের উপর চমৎকার মূৰ্ছা যাইতে পারে– সে যখন সানুনাসিক কৃত্রিম কঁদুনির স্বরে হাঁপাইয়া হাঁপাইয়া টানিয়া টানিয়া আধ-আধ উচ্চারণে প্রাণনাথ প্রাণেশ্বর করিয়া ডাক ছাড়িতে থাকে তখন পাতলা ধুতির উপর ওয়েস্টকোট পরা, ফুলমোজামণ্ডিত দর্শকমণ্ডলী এক্সেলেন্ট এক্সেলেন্ট করিয়া উচ্ছ্বসিত হইয়া ওঠে।

কাদম্বরী উসখুস করে আর থাকতে না পেরে এক ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন, যাঃ, কীসব গাঁজাখুরি গল্প বলছিস মালিনী, তোদের নতুনদাদা কি ওরকম ছাপোষা পোশাক পরেন, না কি আমার নাম গিরিবালা? কেন এ-সব গিরিবালা গোপীনাথ লবঙ্গদের গল্প আমাকে শোনাচ্ছিস?

 তুমি চিনতে পারলে না নতুনবউঠান, মালিনী বলে, ওটা তো তোমারই গল্প। দেখছ না সবটাই তোমার জীবনের আদলে লেখা!

সে তো তুই ইনিয়ে বিনিয়ে লিখেছিস, কাদম্বরী ফুঁসে ওঠেন, তোকে এত বিশ্বাস করি মালিনী, তুই কী করে পারলি আমাকে নিয়ে এমন কেচ্ছার গল্প ফঁদতে? আমার যন্ত্রণা তোর কাছে হাসির খোরাক হল? ছিঃ!

মালিনী কাদম্বরীর পায়ে মাথা রেখে বলে, নতুনবউঠান বিশ্বাস করো, আমি এ-সব মনে মনে ভাবিনি। আমি চোখ বুজলে অনেক অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটে, না-লেখা অক্ষরগুলো নেচে বেড়ায়, আমি পড়তে পারি। আজ তোমার সামনে বসতেই আমার মাথায় হুড়মুড় করে এ-সব লাইনগুলো আসছে। এ গল্প আমি লিখিনি, বিশ্বাস করো, এ ভাষায় আমি ভাবতেই পারি না। কে লিখবে কখন লিখবে আমি জানি না। কিন্তু জানি এ লেখা সত্যি।

যা যা, তুই আমার চোখের সামনে থেকে যা তো মালিনী, কাদম্বরী ওকে আর সইতে পারেন না, যত সব ভুতুড়ে কাণ্ড। রূপাকে বলেন, তুই রবির চিঠিগুলো আরেকবার পড়ে শোনা তো রূপা।

আর কতবার শুনবে নতুনবউঠান, রূপা যেন মজা পায়, পড়ে পড়ে আমারই তো মুখস্থ হয়ে গেল।

তবু পড়, কাদম্বরী বলেন, আমার ভাল লাগে, সেই যে মিস্টার আর মিসেস বেকার সারাক্ষণ ঝগড়া করেন, সেই চিঠিটা পড় না, বেশ মজা হবে। রূপা বিছানার ওপর তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে পড়তে থাকে–

‘আমি দিনকতক আমার শিক্ষকের পরিবারের মধ্যে বাস করেছিলুম। সে বড়ো অদ্ভুত পরিবার। মিস্টার ব–মধ্যবিত্ত লোক। তিনি লাটিন ও গ্রীক খুব ভালোরকম জানেন। তাঁর ছেলেপিলে কেউ নেই; তিনি, তার স্ত্রী, আমি, আর একজন দাসী, এই চারজন মাত্র একটি বাড়িতে থাকতুম। কর্তা আধবুড়ো লোক, অত্যন্ত অন্ধকার মূর্তি, দিনরাত খুঁতখুঁত খিটখিট করেন, নীচের তলায় রান্নাঘরের পাশে একটি ছোট্ট জানলাওয়ালা দরজা-বন্ধ অন্ধকার ঘরে থাকেন। একে তো সূর্যকিরণ সে ঘরে সহজেই প্রবেশ করতে পারে না, তাতে জানলার উপরে একটা পর্দা ফেলা, চার দিকে পুরোনো ছেঁড়া ধুলোমাখা নানা প্রকার আকারের ভীষণদর্শন গ্রীক-লাটিন বইয়ে দেয়াল ঢাকা, ঘরে প্রবেশ করলে একরকম বদ্ধ হাওয়ায় হাঁপিয়ে উঠতে হয়। এই ঘরটা হচ্ছে তার স্টাডি, এইখানে তিনি পড়েন ও পড়ান। তার মুখ সর্বদাই বিরক্ত। আঁট বুটজুতো পরতে বিলম্ব হচ্ছে, বুটজুতোর উপর চটে ওঠেন; যেতে যেতে দেয়ালের পেরেকে তার পকেট আটকে যায়, রেগে ভুরু কুঁকড়ে ঠোঁট নাড়তে থাকেন। তিনি যেমন খুঁতখুঁতে মানুষ, তার পক্ষে তেমনি খুঁতখুঁতের কারণ প্রতি পদে জোটে। আসতে যেতে হুচট খান, অনেক টানাটানিতে তাঁর দেরাজ খোলে না, যদি বা খোলে তবু যে-জিনিস খুঁজছিলেন তা পান না। এক-এক দিন সকালে তার স্টাডিতে এসে দেখি, তিনি অকারণে বসে বসে ভ্রুকুটি করে উ আঁ করছেন, ঘরে একটি লোক নেই। কিন্তু ব–আসলে ভালোমানুষ– তিনি খুঁতখুঁতে বটে, রাগী নন; খিটখিট করেন, কিন্তু ঝগড়া করেন না। নিদেন তিনি মানুষের উপর রাগ প্রকাশ করেন না, টাইনি বলে তার একটা কুকুর আছে তার উপরেই তার আক্রোশ। সে একটু নড়লে চড়লে তাকে ধমকাতে থাকেন, আর দিনরাত তাকে লাথিয়ে লাথিয়ে একাকার করেন। তাকে আমি প্রায় হাসতে দেখি নি। তার কাপড়চোপড় ছেঁড়া অপরিষ্কার। মানুষটা এইরকম। তিনি এককালে পাদরি ছিলেন; আমি নিশ্চয় বলতে পারি, প্রতি রবিবারে তার বক্তৃতায় তিনি শ্রোতাদের নরকের বিভীষিকা দেখাতেন। তার এত কাজের ভিড়, এত লোককে পড়াতে হত যে, এক-এক দিন তিনি ডিনার খেতে অবকাশ পেতেন না। এক-এক দিন তিনি বিছানা থেকে উঠে অবধি রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এমন অবস্থায় খিটখিটে হয়ে ওঠা কিছু আশ্চর্য নয়। গৃহিণী খুব ভালোমানুষ, রাগী উদ্ধত নন, এককালে বোধ হয় ভালো দেখতে ছিলেন, যত বয়স তার চেয়ে তাকে বড় দেখায়, চোখে চশমা, সাজগোজের বড়ো আড়ম্বর নেই। নিজে রাঁধেন, বাড়ির কাজকর্ম করেন, ছেলেপিলে নেই, সুতরাং কাজকর্ম বড়ো বেশি নয়। আমাকে খুব যত্ন করতেন। খুব অল্প দিনেতেই বোঝা যায় যে, দম্পতির মধ্যে বড়ো ভালোবাসা। নেই, কিন্তু তাই বলে যে দুজনের মধ্যে খুব বিরোধ ঘটে তাও নয়, অনেকটা নিঃশব্দে সংসার চলে যাচ্ছে। মিসেস ব কখনো স্বামীর স্টাডিতে যান না; সমস্ত দিনের মধ্যে খাবার সময় ছাড়া দুজনের মধ্যে দেখাশুনা হয় না, খাবার সময়ে দুজনে চুপচাপ বসে থাকেন। খেতে খেতে আমার সঙ্গে গল্প করেন, কিন্তু দুজনে পরস্পর গল্প করেন না। বর আলুর দরকার হয়েছে, তিনি চাপা গলায় মিসেসকে বললেন, some potatoes (please কথাটা বললেন না কিংবা শোনা গেল না)। মিসেস ব–বলে উঠলেন I wish you were a little more polite। ব– বললেন I did say please; মিসেস ব–বললেন I did not hear it; ব–বললেন it was no fault of mine। এইখানেই দুই পক্ষ চুপ করে রইলেন। মাঝে থেকে আমি অত্যন্ত অপ্রস্তুতে পড়ে যেতেম। একদিন আমি ডিনারে যেতে একটু দেরি করেছিলেম, গিয়ে দেখি, মিসেস ব, ব–কে ধমকাচ্ছেন, অপরাধের মধ্যে তিনি মাংসের সঙ্গে একটু বেশি আলু নিয়েছিলেন। আমাকে দেখে মিসেস ক্ষান্ত হলেন, মিস্টার সাহস পেয়ে শোধ তোলবার জন্যে দ্বিগুণ করে আলু নিতে লাগলেন, মিসেস তার দিকে নিরুপায় মর্মভেদী কটাক্ষপাত করলেন। দুই পক্ষই দুই পক্ষকে যথারীতি ডিয়ার ডার্লিং বলে ভুলেও সম্বোধন করেন না, কিংবা কারও ক্রিশ্চান নাম ধরে ডাকেন না, পরস্পর পরস্পরকে মিস্টার ব–ও মিসেস ব–বলে ডাকেন। আমার সঙ্গে মিসেস হয়তো বেশ কথাবার্তা কচ্ছেন, এমন সময় মিস্টার এলেন, অমনি সমস্ত চুপচাপ। দুই পক্ষেই এইরকম। একদিন মিসেস আমাকে পিয়ানো শোনাচ্ছেন, এমন সময় মিস্টার এসে উপস্থিত; বললেন, When are you going to stop? মিসেস বললেন, I thought you had gone out পিয়ানো থামল। তার পরে আমি যখন পিয়ানো শুনতে চাইতেম মিসেস বলতেন, that horrid man যখন বাড়িতে না থাকবেন তখন শোনাব, আমি ভারি অপ্রস্তুতে পড়ে যেতুম। দুজনে এইরকম অমিল অথচ সংসার বেশ চলে যাচ্ছে। মিসেস রাঁধছেন বাড়ছেন, কাজকর্ম করছেন, মিস্টার রোজগার করে টাকা এনে দিচ্ছেন; দুজনে কখনো প্রকৃত ঝগড়া হয় না, কেবল কখনো কখনো দুই-এক বার দুই-একটা কথা-কাটাকাটি হয়, তা এত মৃদুস্বরে যে পাশের ঘরের লোকের কানে পর্যন্ত পৌঁছয় না। যা হোক আমি সেখানে দিনকতক থেকে বিব্রত হয়ে সে অশান্তির মধ্যে থেকে চলে এসে বেঁচেছি।‘

শেষ পর্যন্ত রূপা আর মালিনী মিলে কাদম্বরীকে রাজি করিয়েই ফেলল। বিনোদিনীকে স্বচক্ষে দেখার জন্য কাদম্বরীও ছটফট করছিলেন সেই সরোজিনী নাটকের সময় থেকে। কৌতূহল আর যেন বাধ মানছে না।

এক সন্ধ্যায় নিষিদ্ধ কাজের গোপন উত্তেজনায় দুরু দুরু বুকে আটপৌরে ধনেখালি শাড়ির ছদ্মবেশে ঘোমটায় মাথা ঢেকে রূপা আর কাদম্বরী বেরিয়ে পড়লেন ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্দেশে অ্যাডভেঞ্চারে।

অবশেষে একদিন সন্ধ্যাবেলায় সুধোকে লইয়া (গিরিবালা) গোপনে থিয়েটার দেখিতে গেল। নিষিদ্ধ কাজের উত্তেজনা বেশি। তাহার হৃৎপিণ্ডের মধ্যে যে-এক মৃদু কম্পন উপস্থিত হইয়াছিল সেই কম্পনাবেগে এই আলোকময়, লোকময়, বাদ্যসংগীত-মুখরিত, দৃশ্যপটশোভিত রঙ্গভূমি তাহার চক্ষে দ্বিগুণ অপরূপ ধারণ করিল।… সেদিন মানভঞ্জন অপেরা অভিনয় হইতেছে… রাধার দুর্জয় মান হইয়াছে; সে মানসাগরে কৃষ্ণ আর কিছুতেই থই পাইতেছে না– কত অনুনয় বিনয় সাধাসাধি কাদাকাদি, কিছুতেই কিছু হয় না। তখন গর্বভরে গিরিবালার বক্ষ ফুলিতে লাগিল। কৃষ্ণের এই লাঞ্ছনায় সে যেন মনে মনে রাধা হইয়া নিজের অসীম প্রতাপ নিজে অনুভব করিতে লাগিল। কেহ তাহাকে কখনো এমন করিয়া সাধে নাই: সে অবহেলিত অবমানিত পরিত্যক্ত স্ত্রী, কিন্তু তবু সে এক অপূর্ব মোহে স্থির করিল যে, এমন করিয়া কাঁদাইবার ক্ষমতা তাহারও আছে।… অবশেষে যবনিকাপতন হইল, গ্যাসের আলো ম্লান হইয়া আসিল, দর্শকগণ প্রস্থানের উপক্ৰম করিল; গিরিবালা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসিয়া রহিল। এখান হইতে উঠিয়া যে বাড়ি যাইতে হইবে এ কথা তাহার মনে ছিল না।… এখন হইতে সে প্রতি সপ্তাহেই থিয়েটারে যাইতে আরম্ভ করিল।

প্রতি সপ্তাহে না হলেও কাদম্বরী তার দুঃসাহসী সঙ্গিনীদের নিয়ে আরও দু-চারবার ন্যাশনালে গোপন অ্যাডভেঞ্চার করলেন। ঠাকুরবাড়ির কেউ এই থিয়েটার-কাণ্ড টের পেল না সত্যিই।

তারা মেতেছিলেন অশ্রুমতী নিয়ে। এত শোরগোল পড়ে গেছে আর বাড়ির মেয়েরা দেখতে পাবে না! ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় একদিন অভিনয়ের ব্যবস্থা হল। কিন্তু তাতে সকলের মন ভরলেও থিয়েটারের আবহাওয়া পুরোপুরি উপভোগ করা গেল না যেন। কিছুদিনের মধ্যেই গুণেন ঠাকুরের আদেশে ১৮৭৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পুরো বেঙ্গল থিয়েটার ভাড়া নেওয়া হল শুধু ঠাকুর পরিবারের জন্য। আগে দু-একজন লুকিয়ে চুরিয়ে দেখে থাকতেও পারেন কিন্তু অভিজাত মেয়েদের সেই প্রথম সাড়ম্বরে থিয়েটারে পদার্পণ। হলের বেঞ্চি সরিয়ে বাড়ি থেকে আনা কাপের্ট, আরামচেয়ার ও নানা আসবাবে হল সেজে উঠল। ফুলের মালা, আলবোলা, মেয়েদের চিকের ব্যবস্থাও বাদ গেল না। ৫ এবং ৬ নং বাড়ির সকলেই এদিন মহা উৎসাহে থিয়েটার দেখতে গেলেন। কাদম্বরীও।

সেদিন নায়িকা হয়েছেন সুকুমারী। অন্যরা মুগ্ধ বিস্ময়ে নাটক উপভোগ করলেন কিন্তু কাদম্বরী আনমনা। তিনি ন্যাশনালে দেখে আসা বিনোদিনীর রূপমাধুর্যের স্মৃতিতে ঈর্ষাতুর বিষণ্ণতায় ডুবে রইলেন। জ্যোতির মুখে বিনোদিনীর প্রশংসাই তো সবচেয়ে বেশি শুনতে হয় তাকে।

.

আন্না তড়খড় ভগ্ন মন নিয়ে বোম্বাই ফিরে গেছেন। রবির প্রতি তীব্র অভিমানে তাকে চিঠি লেখেন না, কিন্তু কাদম্বরীকে দু-একটা চিঠি পাঠিয়ে নিজের কথা জানান। রবির দেওয়া নলিনী নামটি অবশ্য তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। আনাবাই নলিনী নাম নিয়ে তিনি পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করেন।

মনখারাপের মধ্যেও আনা বুঝতে পারছিলেন রবি অধরাই রয়ে যাবেন। কাদম্বরী চিঠিতে জানতে পারেন, আন্নার জীবনে এক নতুন পুরুষের কথা। দুজনের প্রথম দেখা ডবলিন শহরে, প্রায় প্রথম সাক্ষাতেই প্রেম। লিটলডেল তখন বরোদা কলেজের উপাধ্যক্ষ। তরুণ স্কটিশ অধ্যাপক হারল্ড লিটলডেলের সঙ্গে নভেম্বরের এক শীতসন্ধ্যায় বিয়ে হয়ে গেল আন্নার।

আন্না হয়তো এই ভাল করল, কাদম্বরী হাতের তাস ফেলে বললেন। রূপা আর স্বর্ণকুমারীর সঙ্গে বিছানার ওপর মাদুর পেতে গোল হয়ে বসে তাস খেলছেন তখন।

এ-কথা বলছ কেন? স্বর্ণ জানতে চান, ভাল খারাপ কীসে মাপছ নতুন বউঠান? রবির সঙ্গে বিয়ে হলেই বা কী খারাপ হত?

সে তো বাবামশায় রাজি হলেন না, কাদম্বরী বলেন। আর রবি কি তা চায়? চাইলে তো কিছু বলত আন্নাকে। আর আমি ভাবছিলাম, এ বাড়ির ছেলেরা তো অন্য নারীর রূপের মোহে স্ত্রীকে ভুলে যেতে পারে চট করে, তার চেয়ে ওর সাহেব বর ভাল।

এ তোমার অভিমানের কথা বউঠান, স্বর্ণ যেন মানতে চান না জ্যোতির প্রতি কাদম্বরীর চাপা ক্ষোভের কারণটা। ঠাকুরবাড়ির ছেলেদের চরিত্র খুব বলিষ্ঠ। এদের মতো সংবেদনা আর কোন বাড়িতে পাবে?

রূপা আর ক্ষোভ চেপে রাখতে পারে না, স্বর্ণদিদি তুমি সব জানো না। রোজ কত সেজেগুজে অপেক্ষা করে নতুনবউঠান, আর নতুন দাদা ঘরে এলেও টাকাপয়সা নিয়ে পোশাক পালটে আতর লাগিয়ে আবার চলে যান, বউঠানের দিকে তাকানোর দু মুহূর্ত ফুরসত নেই যেন।

কাল কী হল জানো ঠাকুরঝি? কাদম্বরীর চোখে জল ভরে আসে, আমি ওঁর পথ আটকে বললাম, যেতে দেব না, আজ সন্ধেটা আমার সঙ্গে থাকো।

তিনি বললেন, ছাড়ো বউ, আমাকে যেতেই হবে।

আমি আঁকড়ে ধরে বললাম, দেখি কেমন করে যাও!

তিনি বললেন, জেদ কোরো না।

আমি বললাম, করব।

তিনি নিষ্ঠুরভাবে আমার হাতটা ছাড়িয়ে দিলেন। ঠেলা লেগে আমি পড়ে গেলাম। তিনি চলে গেলেন। ওই কি আমার সেই স্বামী, যিনি লোকনিন্দা উপেক্ষা করে দিনের পর দিন আমাকে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে ময়দানে ঘুরেছেন, কত কাব্যপাঠ করে শুনিয়েছেন, গান শুনিয়েছেন? আমি যেন সেই স্বামীকে চিনতে পারি না।

বই-মালিনী বইয়ের কাঁপ নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়ায়, বলে আজ তোমার ঘরে ঢুকব, না, ঢুকব না নতুনবউঠান?

মেঘলা আকাশের মতো টলটলে চোখ তুলে তাকান কাদম্বরী। মালিনী এসেছিস, আয়, তোর কথাই ভাবছিলাম। তোর সেই গিরিবালার তারপর কী হল সেদিন শোনা হয়নি।

তুমি তো সেদিন রাগ করে তাড়িয়ে দিলে আমাকে, মালিনীর স্বর একটু অভিমানী শোনায়।

তা হোক, তুই শোনা মালিনী, কাদম্বরী কৌতূহলী, আমি সেদিন থেকে মাঝে মাঝেই ভাবি গিরিবালার কী হল!

তখন রাত্রি দশটা। বাড়ির আর সকলে আহারাদি সমাধা করিয়া ঘুমাইতে গিয়াছে। এমন সময় আতর মাখিয়া, উড়ানি উড়াইয়া, হঠাৎ গোপীনাথ আসিয়া উপস্থিত হইল– সুবধা অনেকখানি জিভ কাটিয়া সাত হাত ঘোমটা টানিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল।

গিরিবালা ভাবিল, তাহার দিন আসিয়াছে। সে মুখ তুলিয়া চাহিল না। সে রাধিকার মতো গুরুমানভরে অটল হইয়া বসিয়া রহিল। কিন্তু দৃশ্যপট উঠিল না;… সংগীতহীন নীরসকণ্ঠে গোপীনাথ বলিল, একবার চাবিটা দাও দেখি।… গিরিবালা সমস্ত মান বিসর্জন দিয়া উঠিয়া পড়িল। স্বামীর হাত ধরিয়া বলিল, চাবি দিব এখন, তুমি ঘরে চল।…

গোপীনাথ কহিল, আমি বেশি দেরি করতে পারিব না, তুমি চাবি দাও।…

গিরিবালা প্রস্তরমূর্তির মতো শক্ত হইয়া, দরজা ধরিয়া, ছাদের দিকে চাহিয়া, দাঁড়াইয়া রহিল। ব্যর্থমনোরথ গোপীনাথ রাগে গরগর করিতে করিতে আসিয়া বলিল, চাবি দাও বলিতেছি, নহিলে ভালো হইবে না।

গিরিবালা উত্তরমাত্ৰ দিল না। তখন গোপী তাহাকে চাপিয়া ধরিল এবং তাহার হাত হইতে বাজুবন্ধ, গলা হইতে কণ্ঠী, অঙ্গুলি হইতে আংটি ছিনিয়া লইয়া তাহাকে লাথি মারিয়া চলিয়া গেল।

এই পর্যন্ত শুনেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন কাদম্বরী। ওরে একটু থাম তুই। মালিনী, গিরিবালার কষ্ট আমি আর সইতে পারছি না।

রূপা কাদম্বরীকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে চায়। কাদম্বরীও পরম আশ্রয়ের মতো তার কাঁধে মাথা রাখেন।

স্বর্ণ বলে ওঠেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না মালিনী, তুই কী একটা আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে বসলি আর নতুনবউঠান এমন কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন! এ তো তোর বটতলার গল্প নয়, ভাষার কৌশল বেশ ভাল, বর্ণনাও চমৎকার। এ গল্প কে লিখেছে?

আমি জানি না স্বর্ণদিদি, মালিনীর অকপট স্বীকারোক্তি। নতুনবউঠানের সামনে এলেই আজকাল আমার মাথায় এই গল্পের লাইনগুলো কিলবিল

সেকী রে, স্বর্ণ অবাক হন, তুই এমন চোখ বুজে গড়গড়িয়ে কী বলে যাচ্ছিস, আরেকটু শোনা তো!

শোনো, আমি ছবির মতো দেখতে পাচ্ছি, মালিনী উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায়, গোপীনাথ থিয়েটারে গিয়ে গোলমাল পাকাচ্ছে, স্টেজের ওপর ফুলের তোড়া ছুঁড়ে দিচ্ছে, লবঙ্গ লবঙ্গ বলে চেঁচাচ্ছে। উপায় না দেখে থিয়েটারের মালিকরা গোপীনাথকে হল থেকে বের করে দিল। সেই রাগে থিয়েটারের দলকে শিক্ষা দেবার জন্য লবঙ্গকে নিয়ে পরদিন বোটে চড়ে পালিয়ে গেল গোপী।

ওমা, কী কাণ্ড, রূপাও উত্তেজিত, তারপর কী হল, আমার আর তর সইছে না মালিনীদিদি।

স্বর্ণ বিরক্ত হন, আঃ রূপা তুই থাম তো। মালিনী এভাবে নিজের ভাষায় বলিস না। ওই সাহিত্যের ভাষায় বল।

থিয়েটারওয়ালারা হঠাৎ অকূলপাথারে পড়িয়া গেল। কিছুদিন লবঙ্গের জন্য অপেক্ষা করিয়া অবশেষে এক নতুন অভিনেত্রীকে মনোরমার অংশ অভ্যাস করাইয়া লইল; তাহাতে তাহাদের অভিনয়ের সময় পিছাইয়া গেল।

কিন্তু বিশেষ ক্ষতি হইল না। অভিনয়স্থলে তোক আর ধরে না। শতশত লোক দ্বার হইতে ফিরিয়া যায়। কাগজেও প্রশংসার সীমা নাই।

সে প্রশংসা দূরদেশে গোপীনাথের কানে গেল। সে আর থাকিতে পারিল না। বিদ্বেষে ও কৌতূহলে পূর্ণ হইয়া সে অভিনয় দেখিতে আসিল।

মনোরমা যতক্ষণ মলিন দাসীবেশে ঘোমটা টানিয়া ছিল ততক্ষণ গোপীনাথ নিস্তব্ধ হইয়া দেখিতেছিল। কিন্তু যখন সে আভরণে ঝলমল করিয়া, রক্তাম্বর পরিয়া, মাথার ঘোমটা ঘুচাইয়া, রূপের তরঙ্গ তুলিয়া বাসরঘরে দাঁড়াইল এবং এক অনির্বচনীয় গর্বে গৌরবে গ্রীবা বঙ্কিম করিয়া সমস্ত দর্শকমণ্ডলীর প্রতি এবং বিশেষ করিয়া সম্মুখবর্তী গোপীনাথের প্রতি চকিত বিদ্যুতের ন্যায় অবজ্ঞাবজ্রপূর্ণ তীক্ষ্ণ কটাক্ষ নিক্ষেপ করিল– যখন সমস্ত দর্শকমণ্ডলীর চিত্ত উদ্বেলিত হইয়া প্রশংসার করতালিতে নাট্যস্থলী সুদীর্ঘকাল কম্পান্বিত করিয়া তুলিতে লাগিল– তখন গোপীনাথ সহসা উঠিয়া দাঁড়াইয়া গিরিবালা গিরিবালা করিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। ছুটিয়া স্টেজের উপর লাফ দিয়া উঠিবার চেষ্টা করিল– বাদকগণ তাহাকে ধরিয়া ফেলিল।

এই অকস্মাৎ রসভঙ্গে মর্মান্তিক ক্রুদ্ধ হইয়া দর্শকগণ ইংরাজিতে বাংলায় দূর করে দাও বের করে দাও বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিল।

গোপীনাথ পাগলের মতো ভগ্নকণ্ঠে চিৎকার করিতে লাগিল, আমি ওকে খুন করব, ওকে খুন করব।

পুলিশ আসিয়া গোপীনাথকে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেল। সমস্ত কলকাতা শহরের দর্শক দুই চক্ষু ভরিয়া গিরিবালার অভিনয় দেখিতে লাগিল, কেবল গোপীনাথ সেখানে স্থান পাইল না।

মালিনী চুপ করতেই হাততালি দিয়ে ওঠেন স্বর্ণকুমারী। এমন অপূর্ব ভাষা, এমন রসবোধ, আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি। বল না মালিনী কে লিখেছেন, কোথা থেকে মুখস্থ করলি এই লেখা?

কাদম্বরী কেমন ঘোরের মধ্যে বলেন, গিরিবালা জিতে গেল! সত্যি এমন করে শোধ নেওয়া যায়! কী আশ্চর্য!

রূপা হাততালি দিয়ে বলে, কী মজা, চাইলে তুমিও তো এমন পারো নতুন বউঠান।

চুপ কর, যা মুখে আসে তাই বলিস, রূপাকে ধমক দিয়ে অন্যমনস্ক কাদম্বরী আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কী যেন খুঁজতে থাকেন নিজের চেহারায়।

কার লেখা বল না, অধীর হয়ে ওঠেন স্বর্ণ, কেন হেঁয়ালি করছিস মালিনী। সে লেখকের আর কি কোনও লেখা আছে, এটাই বা কোথায় পেলি?

আমি জানি না দিদি, সত্যি বলছি, মালিনী বলে, আমার মাথায় মাঝে মাঝে কী যেন ভর করে, এগুলো বোধহয় এখনও লেখা হয়নি, কিন্তু কোথাও লেখা চলছে। গল্পটা আর নাম পড়তে পারছি, মানভঞ্জন; কিন্তু লেখকের নামের জায়গাটা খালি, আমার মাথাটা কেমন ঘুরছে দিদি। আমি যাই।

এই থিয়েটার-পর্বের রেশ কাটতে না কাটতেই এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল বাড়িতে। শীতের দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ঊর্মিলাকে নিয়ে কাদম্বরী শুয়েছিলেন। বিছানায়। কখন চোখ লেগে গেছে টের পাননি।

ঊর্মিলা পালঙ্ক থেকে নেমে খেলতে খেলতে কখন ছাদের বাঁকা সিঁড়ির দিকে চলে গেছে, তারপর নামতে গিয়ে গড়িয়ে পড়েছে সিঁড়ির নীচে। তার কান্নায় ঘুম ভেঙে কাদম্বরী যখন ছুটে এলেন, ততক্ষণে ব্রেন কনকাশন হয়ে নিথর ঊর্মিলার শরীর।

ঊর্মিলার দেহ কোলে নিয়ে মূৰ্ছা গেলেন কাদম্বরী। দাসীরা ছুটে গিয়ে যখন লেখার টেবিলে সাধনায় মগ্ন স্বর্ণকুমারীর কাছে খবর পৌঁছে দিল, সংবাদের আকস্মিক আঘাতে তিনিও অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

সারা বাড়িতে কালো ছায়া নেমে এল। বালক-বালিকাদের যে যার ঘরে আটকে রাখা হয়েছে, স্বর্ণর ছেলেমেয়েদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সতীশ পণ্ডিতের ঘরে। মৃত্যুর নিষ্ঠুর রূপ যেন তারা জানতে না পারে। ওদের বলা হল, ঊর্মিলা কোথায় বেড়াতে গেছে।

শোকাচ্ছন্ন পরিবারের মহিলারা সবাই জড়ো হয়েছেন মৃত বালিকাকে ঘিরে। সৌদামিনীর চিন্তা, জানকীনাথ বিদেশে, এই অবস্থায় এতবড় আঘাত কী করে সামলাবেন স্বর্ণ? কোনায় বসে থাকা অশ্রুমতী কাদম্বরীর দিকে তাকিয়ে তিনি বলে ফেললেন, দাসদাসীদের এত পয়সা দিয়ে রাখা হয়েছে, বাচ্চারা তো তাদের কাছেই ভাল থাকে বাপু, নজর রাখতে না পারলে এত আদিখ্যেতার দরকার কী ছিল?

কথাটা কাদম্বরীর বুকে শেলের মতো বেঁধে। তিনি বলেন, ঊর্মিলা কি আমার সন্তান নয়? পেটে ধরিনি বলে এতবড় নিষ্ঠুর কথাটা বলতে পারলে বড়ঠাকুরঝি?

তা হলেও নতুনবউ, নীপময়ী বললেন, তোমার আরেকটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল। খোলা সিঁড়ির সামনে বাচ্চা নিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লে, একবার দাসীদের ডাকা যেত না?

কাদম্বরী কাঁদতে কাঁদতে স্বর্ণর সামনে এসে কাধ ধরে নাড়িয়ে বলেন, তুমিও কি আমাকে দোষ দিচ্ছ স্বর্ণ ঠাকুরঝি? সত্যি বলো, আমার জানা দরকার তুমি কী ভাবছ।

স্বর্ণ উত্তর দেন না, কাঁদতে থাকেন, কাঁদতেই থাকেন। সৌদামিনী কাদম্বরীকে বলেন, ওকে বিরক্ত কোরো না, একটু কাঁদতে দাও। সন্তানের অপঘাত মৃত্যুর চেয়ে বড় শোক হয় না।

সৌদামিনীর কথায় অবাক হয়ে যান কাদম্বরী, তিনিও যে সদ্য তার একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন, তার সেই যন্ত্রণার কথা কেউ অনুভবই করছে না যেন? এরা কী নিষ্ঠুর অনুভূতিহীন! স্বর্ণ কোনও জবাব দিচ্ছে না কেন? সেও কি আমাকে দোষ দিচ্ছে?

পেছন থেকে কে যেন বলে ওঠে, নিজের পেটের মেয়ে হলে কি এমনি ঘুমিয়ে পড়তে পারতে ঠাকরুন? মায়ের চেয়ে কি কোনওদিন মাসির দরদ বেশি হয়, না হতে পারে?

হায়, হায়! এ-কথা শোনার আগে তাঁর মৃত্যু হল না কেন? আর কী মানে আছে বেঁচে থাকার? স্বর্ণর নীরবতা তাকে সবচেয়ে আঘাত করছে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছাড়ি পিছাড়ি কাঁদতে থাকেন সন্তানহীনা অপমানিতা কাদম্বরী।

রূপা কোথা থেকে ছুটে এসে কোলে তুলে নেয় কাদম্বরীর লুটিয়ে পড়া মাথা। তাকে জড়িয়ে তুলে ধরে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে সবার দিকে তাকিয়ে সে চিৎকার করে, তোমরা কি মানুষ? একেই নতুনবউঠান মৃত্যুশোকে যন্ত্রণা পাচ্ছেন, তার ওপর তোমরা বাক্যবাণে বিধছ? ছিঃ!

রূপার দুঃসাহসে বাড়ির মেয়েরা স্তম্ভিত পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তার কাঁধে ভর দিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে থাকেন অশ্রুমতী কাদম্বরী, পেছনের লম্বা বারান্দা জুড়ে তার গঙ্গাজলি ডুরে শাড়ির আঁচল লুটিয়ে চলে, যেন এক নদীর মতন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *