০২. সারদাসুন্দরীর সংসার

০২. সারদাসুন্দরীর সংসার

ঠাকুরবাড়িতে সদর ও অন্দর সম্পূর্ণ আলাদা। সামনের দিকে লোহার ফটক পেরিয়ে পাশাপাশি দুটি বাড়ি। আদতে দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলির এই একটি বাড়ির দুটি ভাগ ছিল, বসতবাড়ি আর বৈঠকখানা বাড়ি। কিন্তু কিছুদিন আগে দেবেন আর গিরীন দুই ভাইয়ে বাড়ি ভাগাভাগি হয়ে গেছে। এখন দেবেন সারদার সংসার দোতলা বসতবাড়িতে। তার মধ্যেও সদর অন্দরে কড়া বিভাজন। বারবাড়িতে কর্তাদের মহল, ছেলেদের মহল, চাকরদের মহল।

ভেতরমহল গিন্নিদের। সেই উঠোনের একধারে গোলাবাড়ি, সেখানে সারাবছরের ধান, ডাল মজুত থাকে। কিন্তু ঘি নুন তেল মশলার ভাণ্ডার বারবাড়িতে, সরকারদের হাতে। তারাই প্রতিদিনের মাপ অনুযায়ী বামুনদের হাতে বার করে দেয়। বিশাল রান্নাঘরে দশ-বারোজন বামুনঠাকুর ভোর থেকে রান্না চাপায়। রসুইঘরের দুদিকে পরিষ্কার সাদা কাপড় পেতে পাহাড়প্রমাণ ভাত রাখা হয়। সেই পরিমাণ ডাল, তরকারি, মাছের ঝোল রান্না করে পাথরের থালাবাটিতে সাজিয়ে তোক গুনে মহলে মহলে দিয়ে আসে বামুনরা। রাত্রে অবশ্য লুচি তরকারি খাওয়া হয়। এই ঢালাও রান্নার স্বাদ সবসময় পছন্দ হত না দেবেন্দ্রনাথের, তিনি বহুদিন প্রবাসে প্রবাসে কাটিয়ে ঘরে ফেরেন প্রিয় মানুষ আর প্রিয় রান্নার টানে। শুধু বামুনের হাতের রান্না খেলে তিনিও খাবারের স্বাদ ভুলে যাবেন আর ঘরের বউ-ঝিরাও রান্না ভুলে যাবে। তিনি সারদাসুন্দরীকে হুকুম দিলেন বউদের রান্না শেখাও। কত্তামশায় বাড়ি থাকলে সারদা তার গোলগাল চেহারা নিয়েও কষ্ট করে রান্নাঘরে গিয়ে বসতেন তদারকির জন্য। এবার কত্তার নির্দেশে অন্দরে বউমহলে মহা উৎসাহে শুরু হল রান্না নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা। সরকারি রসুইঘরের ঢালাও ডালঝোলের সঙ্গে বউদের সযত্নে রাঁধা ব্যঞ্জনের স্বাদে আকাশপাতাল তফাত। ঠাকুরবাড়ির রান্নার বিশিষ্ট ঘরানা গড়ে উঠছিল এইসব বিশেষ যত্নের রান্নাতেই।

সকালে উঠে সব মেয়ে-বউদের নিয়ম হল চান সেরে পট্টবস্ত্র পরে উপাসনাগৃহে জড়ো হওয়া। সমবেত উপাসনার শেষে যে যার ঘরে গিয়ে চেলি খুলে রেখে ধোয়া তাঁতের শাড়ি পরে এসে বসবেন ভাঁড়ারঘরের দাওয়ায়। সেই ভাঁড়ারঘরের বৈঠকটাই মেয়েমহলের প্রাণের আড্ডা। কত্তামা তক্তপোশে বসে নির্দেশ দেবেন আর গিন্নিরা বউরা মেয়েরা সব রান্নার জন্য তরকারি গুছিয়ে দেবেন। বৈষ্ণব আমল থেকেই তরকারি কাটা কথাটা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, কাটা বললে পাছে হিংস্রতা প্রকাশ হয়। তাই বলা হত তরকারি বানানো। গিন্নিদের হাতে আছে সবজি ফলমূল আমসত্ত্ব নাড়ু বড়ি তিলকুটা সন্দেশের ভাঁড়ার। বউরা তো বটেই, বিবাহিতা ও অবিবাহিতা কন্যারাও এই আসরের তৎপর সদস্যা। সৌদামিনী, শরৎকুমারী, বর্ণকুমারীরা মায়ের তত্ত্বাবধানে কাজ শেখেন।

শরৎকুমারীর সবে বিয়ে হয়েছে, স্বামীসহ এখানেই থাকছেন। ইতিমধ্যেই রাঁধুনি হিসেবে তাঁর খুব নাম হয়েছে। তিনি আহ্লাদ করে বলেন, মা একটা নতুন সুপ রান্না শিখেছি, ডিম দিয়ে মুলিগাতানি সুপ। আজ বাবামশায়ের জন্য সেই সুপ করে দেব ভাবছি।

দেখ বাছা, সারদা বলেন, কত্তাকে এই দু-চারদিনে কিছু ভালমন্দ খাইয়ে খুশি করতে পার কিনা। ও সুপ কোত্থেকে শিখলি?

সেই যে সেদিন ও বাড়ির মেজোকাকিমা, রেসিপি লিখে পাঠিয়েছেন, উনিই কোথা থেকে শিখে এসেছেন। সত্যি মা, মেজোকাকিরা চলে গিয়ে বাড়িটা কেমন খালি খালি লাগে।

সারদাও বিমর্ষ গলায় বলেন, হ্যাঁ রে ওদের কথা ভাবলে কষ্ট হয়। এক বাড়িতে হেসে-খেলে একসঙ্গে কাটিয়েছি, ছোটবেলায় শ্বশুরবাড়ি এসে ওই তো সঙ্গী ছিল আমার। ধম্মো ধম্মে করে কী গোল শুরু করলেন কত্তা, লক্ষ্মীজনার্দনকে বিদেয় করতে চাইলেন বলেই তো এত গোল বাধল! আর এতদিনের অধিষ্ঠিত দেবতাকে উঠিয়ে নিয়ে ওরা ও-বাড়ি চলে গেল।

আগে যেটা ছিল দ্বারকানাথের সন্ততিদের একান্নবর্তী বসতবাড়ি, সেখানেই দেওয়াল উঠল। ৫ নং আর ৬ নং বাড়ি আলাদা হয়ে গেল। বাগান ভাগ হল, পুকুরের ঘাট আলাদা হল। দ্বারকানাথের সময় থেকেই ঠাকুরপরিবারে ব্রাহ্মধর্মের আনাগোনা শুরু হয়েছিল। রামমোহন বিলেত গেলে দ্বারকানাথের অর্থসাহায্যেই ব্রাহ্মসমাজের কাজকর্ম চলছিল। ইতিমধ্যে লন্ডনে বিপুল সমাদর পেয়ে দ্বারকানাথ ক্রমশ কলকাতার জীবনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন এবং বিলেতে গিয়ে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। দেবেন তখন থেকে ব্রাহ্মসমাজের ভার। নিলেন। ১২৫০ বঙ্গাব্দের ৭ পৌষ ভাই গিরীন ও আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে দেবেন্দ্র ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিলেন। কিন্তু দেবেন যতটা ধর্ম ধর্ম করে মেতে উঠলেন গিরীন্দ্রনাথ কোনওদিনই ততটা জড়িয়ে পড়েননি। বাড়ির হিদুয়ানির ধারা তখনও পুরোমাত্রায় চালু ছিল। প্রথম ধর্মসংকট বাধল লন্ডন থেকে দ্বারকানাথের মৃত্যুসংবাদ এলে। দেবেন ব্রাহ্মমতে বাবামশায়ের শেষসংস্কার করলেন, শালগ্রাম শিলা এনে পৌত্তলিকতার চর্চা করতে তার মন সায় দিল না। তাই নিয়ে সমাজে দারুণ শোরগোল শুরু হল, আত্মীয়স্বজন এবং হিন্দুসমাজের মাথারা অনেকেই দেবেনবাবুকে সামাজিকভাবে বর্জন করলেন। গিরীন্দ্রনাথ অবশ্য ব্রাহ্ম হয়েও হিন্দুশাস্ত্রমতে শ্রাদ্ধ না করে পারেননি। অন্দরে তার স্ত্রী যোগমায়া কিছুতেই স্বামীকে অধর্ম করতে দেবেন না, তেজস্বিনী পত্নীকে অগ্রাহ্য করার সাহস গিরীন্দ্রর ছিল না।

কুটনো বানানো তদারকি করতে করতে সারদা একটু মুখ ঝামটা দিয়ে বলেন, তবে মেয়েমানুষের যোগমায়ার মতো অত তেজ বাপু ভাল না। গৃহদেবতাকে উঠিয়ে দেওয়ার কথা শুনে আমিও তো ভয়ে মরছিলাম, তা বলে কি ঘর ভেঙে আলাদা হয়ে যাবি?

বড়মেয়ে সৌদামিনী জানতে চান, মেজোকাকি তো চলে গেলেন, তুমিও মনে মনে বাবামশায়ের মতো বেম্ম হয়ে গেলে নাকি মা?

সারদা ঈষৎ বিব্রত হন। তোর বোন সুকুমারীর বিয়ে নিয়েই তো কী কাণ্ড! কত্তা জেদ ধরে বেম্মো-বিয়ে দিলেন। অগ্নিসংস্কার হল না, শালগ্রামসাক্ষী হল না। সেই তো শেষে অকালে মরে গেল মেয়েটা!

সে নিয়ে আমরা সকলেই দুঃখ পেয়েছি। কিন্তু মা ব্রাহ্ম-বিয়ের দোষ দিচ্ছেন কেন? ব্রাহ্মমন্ত্রে বিয়ে হলেও অগ্নি-নারায়ণ সাক্ষী ছাড়া আর সব হিদুপাৰ্বণ তো হয়েছিল মা, সেজোবউ নীপময়ী বলে ওঠেন। এদিক ওদিক দুই ছিল। সুকু মারা গেল বাচ্চা হতে গিয়ে, অমন তো কত হয়, আপনি মনে খুঁতখুঁত করবেন না মা।

আমার জ্বালা তোরা বুঝবি না সেজোবউ, সারদা বিরক্ত হন। দেখ, আমার তো উভয়সংকট। তোদের বাবামশায় কত পড়াশোনা করা মান্যিগন্যি লোক, তিনি যা বলছেন তা তো খারাপ হতে পারে না। আবার ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে এসে ইস্তক পঁয়ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত শাশুড়ি, দিদিশাশুড়ির কাছে যে পূজাপাঠ শিখেছি সে শিক্ষেও তো ফেলে দিতে পারি না। কী যে করি! আমার হয়েছে যত মরণ।

ঈষৎ বাঁকা চোখে নীপময়ীকে দেখেন সারদা, আর সেজোবউ, তুই এত কথা বলছিস, তোর বিয়েতে যে হাঙ্গামা হয়েছিল তা তো আমি জন্মে দেখিনি। বিয়ের রাতে আমার ছেলেকে মারতে গোঁড়া হিন্দুরা লেঠেল পাঠিয়েছিল। শেষে পুলিশ ডেকে এনে বে দিতে হল। কত্তা আর বেয়াইমশায় দুজনের জেদ ছিল বলেই অত বাধাবিপত্তির মধ্যেই তোদের বে হল। কিংবা আমার ঠাকুরপূজার জোরে, সে-কথা বললে কত্তা যতই রাগ করুন!

প্রিয় বন্ধু হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের দুই মেয়ে নীপময়ী আর প্রফুল্লময়ীর সঙ্গে হেমেন্দ্র আর বীরেন্দ্রর বিয়ে দিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। কিন্তু কুলীন ব্রাহ্মণ হরদেব যখন ব্রাহ্মমতে পিরালি বামুনের ঘরে মেয়ের বিয়ে দেবেন ঠিক করলেন, জ্ঞাতিরা খেপে লাল। উঠেপড়ে তারা লাগল বিয়ে বন্ধ করতে, হলে যে তারাও জাতিচ্যুত হবে। এমনকী তাদের চাপে হরদেবের বড় ছেলে পরিবার নিয়ে আলাদা হয়ে গেল। তবু তার সংকল্প ভাঙল না, দেবেনের মতো জ্ঞানী, সচ্চরিত্র, সমৃদ্ধ বন্ধুকে কথা দিয়ে আত্মীয়দের অন্যায় আবদারে তিনি পিছিয়ে আসতে পারেন না। বড়ছেলে তার পাশে না দাঁড়ালেও তিনি আদর্শত্যাগ করবেন না। বিরোধীপক্ষ জোট বেধে বিয়ে আটকানোর ফন্দি করতে লাগল। নীপময়ীর জন্য এক বুড়ো কুলীন পাত্রও বেছে রাখল তারা। ঠিক হল যে বিয়ের রাতে একশো লেঠেল পাঠিয়ে বর হেমেন্দ্রের মাথায় লাঠির বাড়ি মেরে কনে নীপময়ীকে তুলে আনা হবে, বিয়ে দেওয়া হবে ওই বুড়ো বরের সঙ্গেই। জানতে পেরে দেবেন্দ্রনাথ পুলিশে খবর পাঠালেন, তাদের পাহারাদারিতে বিয়ে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হল।

ব্রাহ্ম বিয়ে হলেও সপ্তপদীতে কোনও বাধা দেননি মহর্ষি। বরণডালা সাজিয়ে বরণ করার অনুষ্ঠান ও ব্রহ্মোপাসনা সেরে বাসরঘরে ঢুকলেন বরবউ। কিন্তু অব্রাহ্ম নারীপুরুষেরা কেউ বিয়েতে যোগ দেননি। হেমেন্দ্র গম্ভীর প্রকৃতির যুবক কিন্তু রূপ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। বেনারসি জোড়ের সঙ্গে নানা অলংকার পরে তাঁকে যেন দেবরাজ ইন্দ্রের মতো লাগছিল। ছোটবোন প্রফুল্লময়ী অবশ্য দিদির বরকে সাক্ষাৎ শিব ভেবে বসেছিলেন। পরে অন্য বালিকারা তাঁকে বোঝাল, শিব তো সর্বত্যাগী, তিনি কেন হিরের কণ্ঠি, মুক্তোর মালা, পান্নার আংটি পরবেন? ঠাকুরবাড়ি থেকে আসা এই জামাইবাবু আসলে ছদ্মবেশী ইন্দ্র। দিদির রূপে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করতে এসেছেন।

বাসরে পাছে মেয়েদের হালকা ঠাট্টার সামনে পড়তে হয় সেই ভয়ে হেমেন আগে থেকেই একটা উপায় ভেবে রেখেছিলেন। ঘরোয়া মেয়েদের চটুল ঠাট্টাইয়ার্কির ওষুধ হিসেবে তিনি স্ত্রীশিক্ষার বিষয়ে আলোচনা শুরু করলেন। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা শুধু বাংলাই পড়ে না, অনেকেই সংস্কৃত ও ইংরেজি পড়তে পারে শুনে উপস্থিত কমশিক্ষিত ব্রাহ্মিকারাও অবাক।

হেমেন লজ্জায় জড়সড় কনে নীপময়ীকে বললেন, তোমাকেও শিখতে হবে। বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত সাহিত্য।

নীপময়ী সেদিন লজ্জায় উত্তর দেননি। সকলের সামনে নববিবাহিত স্বামীর সঙ্গে কথা বলা যায় নাকি! তবে এ স্বামী তাঁর দেখা অন্যান্য বরেদের মতো নয়, প্রথম থেকেই আলাদা। বাসরের মেয়েদের অনুরোধে গান গাইতে গাইতে হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে নীপময়ীকে হেমেন বললেন, তোমার গলায় যদি সুর থাকে, বাবামশায়ের অনুমতি নিয়ে গানও শেখাব।

এবার সত্যি শিউরে ওঠেন মেয়েরা। পাগল নাকি এ ছেলে? বলে কী, ঘরের বউ গান গাইবে? তা হলে বউ আর বাইজিতে তফাত থাকবে কী করে?

ক্রমশ কিন্তু হেমেন তার কথা কাজে পরিণত করছেন। নীপময়ী ও অন্তঃপুরের অন্য মেয়ে-বউদের নিয়ে জোড়াসাঁকোর অন্দরে তিনি নিজেই শুরু করেছেন ঘরোয়া পাঠশালা। সেখানে সৌদামিনী, শরৎকুমারী, জ্ঞানদানন্দিনী, স্বর্ণকুমারী, বর্ণকুমারী সবাই নিয়মিত ছাত্রী। হেমেনের কড়া শাসনে তাদের পড়া এগোচ্ছে তরতরিয়ে।

নীপময়ীকে গান শেখানোর অসম্ভবকেও তিনি সম্ভব করেছেন। বাবামশায় প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে সম্মতি দিয়েছেন। বহু সমালোচনা উপেক্ষা করে বাড়ির গায়ক বিষ্ণু চক্রবর্তীকে নীপময়ীর গানের শিক্ষক নিয়োগ করলেন দুর্জয় সত্যেন্দ্রনাথের দুঃসাহসী ভাই হেমেন্দ্রনাথ। সেই কবে ঘরের মেয়েদের গলা থেকে গান কেড়ে নিয়েছিলেন অওরংজেব, এতদিন পরে সেই গানকেই যেন নীপময়ীর কণ্ঠে ফিরিয়ে আনলেন হেমেন।

ঠাকুরবাড়িতে জন্ম এবং বিবাহ অবশ্য লেগেই থাকে। এই সেদিন ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছে দেবেন্দ্রের প্রিয়কন্যা স্বর্ণকুমারীর। সুদর্শন, সমাজ-সংস্কারক জানকীনাথকে কৃষ্ণনগর থেকে খুঁজে এনেছেন দেবেন্দ্র। ঠাকুরদের সঙ্গে কেউ ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে চায় না, তাই ভাল ছেলে দেখলেই কন্যাদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তাদের আপন করতে চান তিনি। এই বিয়ের জন্য জানকীনাথ পিতা জয়চন্দ্র ঘোষালের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত ও ত্যাজ্যপুত্র হলেন। কিন্তু বাবামশায়ের ক্রোধ উপেক্ষা করেও ঠাকুরবাড়ির আলোর হাতছানিতে সুন্দরী, বিদুষী স্বর্ণকুমারীর আকর্ষণে বাঁধা পড়লেন জানকীনাথ।

স্বর্ণর বিয়ে হল তেরো বছর বয়সে। সে তুলনায় ঠাকুরবাড়ির বউরা সবাই অনেক কমবয়সে এসেছে। বিয়ের আগে মাকে জড়িয়ে ধরে স্বর্ণ জানতে চেয়েছিলেন সারদার বিয়ের গল্প।

নিজের বিয়ের প্রায় ভুলে যাওয়া বেত্তান্ত মনে করে সারদা বলেন, আমি ছিলাম যশোরের পাড়াগাঁয়ের মেয়ে। আমার এক কাকা কলকেতা থেকে শুনে গেলেন কত্তার জন্য সুন্দরী মেয়ে খোঁজা হচ্ছে। ব্যস ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে।

সে কী গো? তার মানে আমাদের বাড়ির বউ-মেয়েরা কেউ তোমাকে দেখতে যায়নি? স্বর্ণ অবাক হন। ঠাকুরদের চিরদিনের রীতি ছিল প্রথমে দাসী পুতুল নিয়ে মেয়ে দেখতে যাবে, পছন্দ হলে সুযোগসুবিধে মতো যাবে। বাড়ির মেয়েরা।

শোন, আমার কাকার বোধহয় ভয় ছিল পাত্র হাতছাড়া হয়ে যাবে। তিনি বাড়িতে ঢুকেই দেখলেন আমি দাওয়ায় বসে রান্নাবাটি খেলছি। টেনে তুলে কোনওরকমে একটা পরিষ্কার কাপড় পরিয়ে তৎক্ষণাৎ নিয়ে চললেন কলকেতায়। আমার মা তখন নদীতে নাইতে গেছিলেন। আমার মাত্র ছবছর বয়স। কেঁদেকেটে বললাম, মা আসুক তবে যাব। কাকা কোনও কিছু না শুনে আমাকে নিয়ে এলেন। মায়ের সঙ্গে শেষ দেখাটাও হল না। শুনেছি মা আমার ফিরে এসে মেয়ের শোকে উঠোনের গাছতলায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই মরে গেলেন। এই তো আমাদের কালের মেয়েদের জীবন। তোরা অনেক ভাগ্য করে এই বাটিতে জন্মেছিস মা, অমন দেবতার মতো বাবামশায় পেয়েছিস, তাই লেখাপড়া শিখলি, বাইরের হাওয়াবাতাস গায়ে মাখতে পারলি।

এখনও সারদা ভাবছিলেন, কত্তা অমন দেবতার মতো মানুষ বলেই ওঁর ধর্ম মানি আবার আমারটাও। মেয়ে-বউরা কি তা বোঝে না!

বর্ণকুমারী বালিকা, বেশি কিছু না বুঝেই সে বলে ওঠে, মা তুমি তো সেদিন মেজোকাকির কাছে লক্ষ্মীজনার্দনের জন্য পুজো দিয়ে পাঠালে। আমিই তো নিয়ে গেলাম মা, বাবামশায় কি তাতে রাগ করবেন?

ছোটকন্যার কথায় বিরক্ত হন সারদা, আঃ বন্নো, অত কথায় তোর কী কাজ, যা বলব, করবি ব্যস। যা তো এখেন থেকে।

সত্যিই লক্ষ্মীজনার্দনের চলে যাওয়ার দুঃখ ভুলতে পারেননি সারদাসুন্দরী। গোপনে ওবাড়িতে গৃহদেবতার জন্য পুজো পাঠান আবার স্বামীর বেম্মো উপাসনাতেও যোগ দেন। কেন, গিরীন তো বেম্মে হয়েছে আবার দেবপূজাও করে। তাতে দোষ হয় না? প্রথম প্রথম পূজা তুলে দেওয়ার কথা ভাবেননি কত্তা, কেবল দুগ্নাপুজোর সময়ে বাড়ি থাকতেন না, বাইরে ভ্রমণে চলে যেতেন। সেই দুঃখে সারদা পুজোর আনন্দে অংশ নিতে পারতেন না, সবাই যখন আনন্দে মাতোয়ারা, তিনি ঘরের কোণে বন্দি করে রাখতেন নিজেকে। যোগমায়া এসে টানাটানি করত পুজোর দালানে যাওয়ার জন্য। একবার কত্তামশায় পশ্চিমে বেড়াতে গেছেন আর তখন শুরু হয়ে গেল সেপাই বিদ্রোহ। কোনও চিঠি নেই, খবর নেই, চিন্তায় নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন সারদা। কত্তা হিমালয়ে বেন্মোচিন্তা করছেন আর আমি এদিকে হেদিয়ে মরি। তবু সে একরকম ছিল, পুজো হত, উনি পুজোয় থাকতেন না। তাই বলে পুজো উঠিয়ে দিতে হবে? এমন কথা বললেন বলেই তো গিরীন আর যোগমায়া লক্ষ্মীজনার্দনের মূর্তি নিয়ে আলাদা হলেন। তাই তো আমি বেম্মে উপাসনার বেদিতে বসেও নিজের ইষ্টমন্ত্র জপ করি আবার কত্তার ধম্মোকথাও শুনি। আকবরের হারেমে বসে যোধাবাই যেমন শিবপুজো করতেন।

এর জন্য স্বামীর প্রতি সারদার প্রেম অবশ্য কমেনি। এখনও কর্তা বাড়ি থাকলে সারদা উদগ্রীব হয়ে থাকেন তার রাতের ডাকের জন্য। ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়লে সেই ডাক আসে। সারদা গা ধুয়ে উজ্জ্বল রঙের একটি নরম তাঁতের শাড়ি পরেন, কানে গলায় একটু আতর মাখেন। কখনও চুলে একটা বেলকুঁড়ির মালা জড়ান, কখনও না হলেও চলে। এটুকুই তাঁর সাজ। বাড়ির বউদের মতো এক গা গয়না পরে, খোঁপায় গোরেমালা, আলতা সিঁদুরে পরিপাটি সাজ তার দরকার নেই। কত্তাও সাদাসিধে সাজই পছন্দ করেন। সারা বছর পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান আর ফিরে আসেন বাড়ির টানে, সারদার টানে। প্রথম যেবার দেবেন ঠাকুর বিষয়বৈরাগ্যে গঙ্গাবক্ষে দিন কাটাবেন স্থির করলেন, সারদা কেঁদেকেটে তার সঙ্গে যাওয়ার বায়না জুড়লেন। দেবেন্দ্র তার জন্য গঙ্গার বুকে পিনিস ভাড়া করলেন, তিন শিশুপুত্রকে নিয়ে কত্তার পিছু পিছু সেই পিনিসে গিয়ে উঠলেন অসূর্যম্পশ্যা সারদা। সেই তাঁর অবারিত গঙ্গাদর্শন। সান্ত্বনা এই যে বেম্মেজ্ঞান কত্তাকে বিবাগী করেনি। বরং বছর বছর সারদার কোলজুড়ে সন্তান এসেছে। সবাই বাঁচেনি, সবার দিকে সমান নজর দিতেও পারেন না সারদা। কর্তার সেবা করে আর সোহাগ পেয়েই খুশি থাকেন স্বামীসোহাগিনী।

১৮৪০ থেকে পরবর্তী তেইশ বছরে নয় ছেলে ও ছয় মেয়ের জন্ম দিয়েছেন সারদা, তাদের মধ্যে বেঁচে আছেন মাত্র দশজন। দ্বিজেন্দ্রর জন্মর দু’বছর পরে সত্যেন এল, তার দু’বছর পরে হেমেন, একবছর দশমাসের মাথায় বীরেন, আরও দু’বছর পরে কন্যা সৌদামিনী, তারপর জ্যোতিরিন্দ্র। দ্বিতীয় কন্যা সুকুমারী মাত্র চোদ্দো বছর বয়সেই মারা যায়। তার পরের ছেলে পুণ্যেন্দ্র জলে ডুবে মারা গেল মাত্র ছ বছরে। এরপর তিনটি কন্যা শরৎকুমারী, স্বর্ণকুমারী ও বর্ণকুমারী। সোমেন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের পরেও জন্মেছিল বুধেন্দ্র, কিন্তু সেও শৈশবে মারা যায়। এতগুলি ছেলেমেয়ের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল দাসী ও চাকরদের হাতে। সেকালের ধনীঘরের নিয়ম ছিল জন্ম থেকেই শিশুরা ধাইয়ের স্তন্যদুগ্ধে লালিত হত। প্রত্যেক শিশুর জন্য একটি স্তন্যদাত্রী ধাই ও একটি পালিকা দাসী নিযুক্ত হত, জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে শিশুদের বিশেষ সম্পর্ক থাকত না। সারদার ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রেও তাই হয়ে আসছে। তবে যতদিন যোগমায়া একসঙ্গে ছিলেন, তাঁর সান্নিধ্যই ছিল ছোটদের আশ্রয়, তার কাছেই ছিল তাদের যত আবদার আহ্লাদ। এখনও তাঁরা তাই মেজোকাকির অভাব বোধ করেন। যদিও পরে জন্মানোর জন্য বর্ণ, সোম ও রবি মেজোকাকির স্নেহের ভাগ থেকে একেবারেই বঞ্চিত। তাঁদের কোনও অভাব বোধ নেই কারণ তাঁরা জানেনই না মাতৃস্নেহের ঘনিষ্ঠ রূপ কীরকম।

ইতিমধ্যে সারদার কুটনোর আসরে এসে উপস্থিত হয়েছেন সদ্যবিবাহিতা স্বর্ণকুমারী। ঠাকুরবাড়ির অন্য বিবাহিতা মেয়েদের মতো তিনি পিতৃগৃহে থাকেন না। ঠাকুররা একে পিরালি তায় ব্রাহ্ম। এঘরে বিয়ে হলে বাপের ঘরে ত্যাজ্য হতে হয়। মেয়ে-জামাইরা তাই বিয়ের পর এখানেই থাকেন। ছেলের বউ এলে তার বাপের বাড়ির লোকদেরও ঠাঁই দিতে হয়। স্বর্ণর স্বাধীনচেতা বর জানকীনাথ ঘোষালকেও তাঁর বাবা ত্যাগ করেছিলেন কিন্তু প্রথম থেকেই জানকীর শর্ত ছিল যে তিনি ব্রাহ্ম হবেন না, ঘরজামাইও থাকবেন না। দুটি শর্তই সসম্মানে মঞ্জুর করেন দেবেন্দ্রনাথ। কিন্তু স্বর্ণ নিজের আলাদা সংসার থেকে প্রায় রোজ জোড়াসাঁকোয় ঘুরে যান। আজ তিনি পরেছেন পেস্তা রঙের ক্রেপ শাড়ি, তাতে পারশি এমব্রয়ডারি করা পাড়। গায়ে লেস লাগানো জ্যাকেট। স্বর্ণ নিজেও বোম্বাই-ধাঁচের শাড়ি পরা আয়ত্ত করেছেন। এব্যাপারে জ্ঞানদার সহযোদ্ধা তিনি। ব্রোচ লাগানো ছোট আঁচলে ঘোমটা টানতে অসুবিধে বলে মাথায় একটি কারুকাজ করা টুপি পরা চালু করেছেন, এটা তার নিজস্ব উদ্ভাবন। স্বর্ণ এসে একটি জলচৌকিতে বসে গল্প করেন। সবাই কৌতূহল নিয়ে তাঁকে দেখতে থাকে।

স্বর্ণ এসেছেন শুনে দোতলার ঘর থেকে জ্ঞানদাও নেমে আসেন। ওঁদের দুটিতে খুব ভাব। স্বর্ণ তাঁর দিকে প্রীতির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, কী গো মেজোবউঠান, শুনেছ আমাদের সাজপোশাক নিয়ে কত রগড় লেখা হচ্ছে?

হ্যাঁ স্বর্ণ, সেদিন নতুনঠাকুরপো বলছিল, কয়েকটি কলেজের ছোকরা নাকি বলাবলি করছে ঠাকুরবাড়ির বউবিবি আরও কত কী!

তবু তোদের হাওয়া খেতে যেতে হবে? সারদা বিরক্তি চেপে রাখেন না। ঠাকুরবাড়ির এত বদনাম আমার প্রাণে সয় না বাপু।

কেন মা, পত্রিকায় মেজোবউঠানের দেওয়া বিজ্ঞাপন দেখে কত ব্রাহ্মিকা শাড়ি-পরা শিখতে আসছেন দেখছ তো! আগে এঁরা গাউন পরে বাইরে বেরনোর কথা ভাবছিলেন। কেউ কেউ তো গাউনের ওপর আঁচল জুড়ে কিম্ভুত পোশাক তৈরি করে ফেলেছেন। তার চেয়ে বোম্বাই কায়দায় শাড়ি পরার দিশি ঢং অনেক ভাল।

বছর আটেকের একটি বালিকা কোথা থেকে হঠাৎ দৌড়ে এসে সারদাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। মেয়ে-বউরা সব সচকিত হয়, কে এই মেয়েটা?

 সারদা ওর হাত ছাড়িয়ে মুক্ত হতে চেষ্টা করেন, এই, কে রে তুই? কোত্থেকে এসে আমার গায়ে উঠে পড়লি? আমার এ-সব একদম ভাল্লাগে না, তোরা জানিস না? সর, সরে যা বলছি।

মেয়েটি মুখ তুলে বলে, আমাকে ওরা ধরে নিয়ে যেতে আসছে, তুমি বাঁচাও কর্তামা। আমি তোমার কাছে থাকব।

এই মানদা, এটা কে রে? ওপাশের কুটুমদের কারও মেয়ে নিশ্চয়? দাসীদের কাছে জানতে চান সারদা। সরিয়ে নিয়ে যা ওকে।

মানদা টেনে মেয়েটিকে সারদার কাছ থেকে সরিয়ে আনে। ঠাস করে থাপ্পড় দিয়ে বকে ওঠে, এই বেহায়া মেয়ে, কে রে তুই?

বালিকা ফুঁপিয়ে উঠে বলে, আমি তো রূপা, আমি এখেনে এসে রোজ বসে থাকি তোমাদের পেছুনে, দেকনি আমাকে?

বালিকার মুখটি ভারী মিষ্টি, মায়াময়। সারদা জানতে চান, তুই কোথায় থাকিস, মা কে রে তোর?

তুমিই আমার মা। সরিয়ে দিচ্ছ কেন, আমি আর ওভেনে যাব না। ওরা আমায় ভালবাসে না কেউ।

ঘোমটায় জড়সড় একটি বউ ছুটে এসে মেয়েটাকে টানতে যায়। সারদা গম্ভীর গলায় বলেন, দাঁড়াও, কে তুমি? আর মেয়েটাই বা কে? তোমার মেয়ে?

হাত জোড় করে বউটি জানায়, অপরাধ নেবেন না কত্তামা, আমরা আপনার আশ্রিত, কুটুমদের মহলে থাকি। এটি আমার সোয়ামির আগের পক্ষের মা-মরা মেয়ে। এমন দজ্জাল, কোনও কথা শোনে নাকো। মারতে মারতে আমার শাখা ভেঙে যায়, ওর শিক্ষে হয় না।

সারদা হুকুম দেন, খবরদার ওকে মারবে না বলছি। সতীনের মেয়ে বলে মেরে হাতের সুখ করছ? আমার এখানে থাকতে হলে এ-সব চলবে না। মানদা তুই নজর রাখ তো কুটুম মহলে। গুষ্টির লোক আমাদের খাচ্ছেদাচ্ছে আর বাড়ির নিয়ম মানছে না, এ আমি সইব না। আমার ছাতের নীচে কোনও মেয়ের গায়ে কেউ হাত তুলবে না।

রূপা সৎমায়ের হাত ছাড়িয়ে সারদার দিকে ছুটে আসতে চায় আবার। দূর থেকে দেখে দেখে সে বুঝেছে এই মহিলার দয়া পেলে সে বেঁচে যাবে। এখানকার আলো-হাওয়া, হাসি-গল্প আনন্দের জগৎ ছেড়ে সে আর ওই কুটুম মহলে অন্ধকার, কলহ, ঝগড়াঝাটির মধ্যে ফিরে যেতে চায় না।

তবু যেতে হয়। যাওয়ার আগে তার করুণ দৃষ্টি দেখে একটু মায়া হয় সারদার। তিনি বলেন, তুই রোজ সকালে এখানে এসে আমাকে প্রণাম করে যাস রূপা। এই একটি কথায় বালিকার জীবন যেন বদলে যায়। সে বোঝে, আর তাকে মার খেতে হবে না।

আসর সেদিন ক্রমশই জমে উঠছিল। ইতিমধ্যে বই-মালিনী এসে হাজির হতে সোনায় সোহাগা। ধনী ঘরের মেয়েদের বই বিক্রি করে বেড়ায় সে। অন্দরে বাইরে অবাধ গতি। সে এলেই ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা যেন নেচে ওঠে, তাদের ঘরবন্দি জীবনে রহস্যময়ী মালিনীর আসা যেন ঠিকরে আসা আলোর মতো। শুধু বই নয়, মেয়েরা মালিনীকে ঘিরে ধরে কারণ তার কাছে রাজ্যের গল্পের ঝাপি। বাবুবিবিদের কেচ্ছা থেকে বামাবোধিনীর নতুন কিস্যা।

তাকে দেখে জ্ঞানদা এগিয়ে এসে হাত ধরেন, এসো এসো, কতদিন পরে আমাদের কথা মনে পড়ল বই-মালিনী। গল্পগাছা করতেও তো আসতে পারো মাঝে মাঝে।

আমার কি আর গল্প করার ফুরসত আছে বউঠান, এ-বাড়ি থেকে সেবাড়ি, বটতলা থেকে বইপাড়া, একাল থেকে ত্রিকাল ছুটে বেড়াই। আগামীদিনে যে বই লেখা হবে তাও আমি শুনিয়ে দিতে পারি, তবে সে গুহ্যকথা, সবাইকে জানানো যায় না। মালিনী কৌতুক করে।

জ্ঞানদা হেসে উঠে বলেন, তুমি বেশ কথা বলো বই-মালিনী, কেমন রহস্যের গন্ধ! যেন আমাদের জগৎ থেকে বহুদূরের কোন জাদুলোকে তোমার বাস। কথা বললে মনে হয় আমিও সেই জাদুর জগতে ঢুকে পড়েছি। তোমার বইয়ের চেয়েও তোমার কথা শোনার লোভে ডেকে পাঠাই।

যাবে নাকি একদিন আমার জাদুলোকে মেজোবউঠান? চাও তো তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারি। মালিনী হেসে হেসে বলে, তুমি তো যে-সে লোক নও, তোমার কথা এখন শহরের লোকের মুখে মুখে ফিরছে, যেখানে যাই লোকে তোমার কথা শুধোয়। তুমি সেই গবর্নর হাউসের পার্টিতে গিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছ। অনেকে নাকি তোমাকে দেখে বিশ্বেস করতে পারেনি, ভেবেছিল ভোপালের বেগম। বড়ঘরের এদেশি মেয়েদের মধ্যে তিনি একাই তো এতদিন বাইরে বেরোতেন।

সারদা রাগ করে বলেন, তুই আর ধুনো দিস না মালিনী। সেখেনে একদল গোরা সাহেবমেমের মধ্যে মেজোবউমাকে দেখে লজ্জায় ছ্যা ছ্যা করে আমাদের জ্ঞাতির লোকেরা পালিয়ে এসেছেন সেদিন। প্রসন্ন ঠাকুর কত্তার কাছে কত রাগ করেছেন।

সে যাই বল মা, স্বর্ণ বলেন, মেজোবউঠানকে দেখে সেদিন এমন গর্ব হচ্ছিল, আমি তো নিজে হাতে সাজিয়ে দিয়েছিলাম। মাথায় সিঁথি পরালাম, গয়না পরালাম। আশমানি বেনারসি শাড়িতে, অলংকারে, ঋজু ভঙ্গিতে তাকে ঠিক রাজরানি মনে হচ্ছিল। মেজদা যেতে পারলেন না বলে এক মেমসাহেবের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন। সে কী মহাব্যাপার, শত শত ইংরেজ মহিলার মধ্যে একজন বঙ্গরমণী। মেজদাদা কত গর্ব করছিলেন সেজন্য।

বই-মালিনী একটি পত্রিকা খুলে ধরে, এই দেখো, সোমপ্রকাশের পৌষ সংখ্যায় কী লিখেছে পড়ে শোনাই, গত বৃহস্পতিবার গবর্ণর জেনেরলের বাটীতে রাত্রিকালে যে মজলিস হয়, তাহাতে বাবু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী আমাদিগের জাতীয় বস্ত্র পরিধান করিয়া উপস্থিত ছিলেন। ইতিপূর্বে কোন হিন্দু রমণী রাজ প্রতিনিধির বাটীতে গমন করেন নাই।

সে যদি গেলেই বাছা, স্বামীর সঙ্গে গেলেই কি ভাল হত না! সারদা বলে ওঠেন। জ্ঞানদা মনে মনে ভাবেন সংস্কার তা হলে ভাঙছে; এই সেদিন গাড়ি চেপে বাড়ি আসার জন্য যে কত্তামায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল সেই তিনিই এখন মৃদু আপত্তি জানাচ্ছেন স্বামী সঙ্গে না থাকায়, যেন যাওয়াটা তিনি বাধ্য হয়ে মেনে নিলেন। জ্ঞানদা জানেন বাঙালি মেয়েদের মন থেকে এইভাবে এক এক করে অনেক অন্ধকার কাটাতে হবে। এই তো সবে শুরু!

ইতিমধ্যে মালিনীর ঝাপি থেকে অনেক বই বেরিয়ে পড়েছে। জ্ঞানদা একটা একটা করে উলটে পালটে দেখতে থাকেন। বটতলার একগাদা নতুন বই, উপন্যাস, কাব্য, আষাঢ়ে গল্প এনেছে। মানভঞ্জন, রতিবিলাপ, কোকিলদূত, বস্ত্রহরণের সঙ্গেই আছে গীতগোবিন্দ, আরব্য রজনী, পারস্যোপন্যাস, লায়লা মজনু, বাসবদত্তা।

একটি বই হাতে নিয়ে স্বর্ণ অবাক হন, ওমা এ যে রবিনসন ক্রুশো। মালিনী তুমি বিলিতি বইয়ের বঙ্গানুবাদ এনেছ, কী মজা! আবার সচিত্র বই, ছবিগুলো কিন্তু ভালই এঁকেছে।

কই দেখি দেখি, বালিকা বর্ণ এসে টানাটানি করে ছবি দেখতে চান। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা মালিনীর বই জমিয়ে জমিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ ভাল লাইব্রেরি করে ফেলেছেন, সেখান থেকেই ছোট মেয়েদের গল্প উপন্যাস পড়া শুরু হয়। বাড়ির বালকেরা এই রসভাণ্ডারের খোঁজ পায় দেরিতে কারণ শিশুবয়সে বাইরের চাকরদের মহলেই তাদের থাকার নিয়ম। বিশেষ কোনও মাসিমা মামিমা বউঠানদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে না পারলে অন্দরে ঢোকা যায় না। নিয়মমতো বিয়ের পর ছেলে-বউয়ের জন্য একটি ঘর নির্দিষ্ট হলে তবেই ভেতরমহলে ছেলেরা ঢুকতে পারে। বিয়ের পর থেকে সত্যেন এই লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক। সত্য আর রবি কোনও ছুতোয় ভেতরে ঢুকতে পারলেই মেয়েদের পাঠাগারের বই নাড়াচাড়া করেন। যে-সব বই তাঁদের পড়তে বারণ করা হয় সেগুলো লুকিয়ে পড়ার জন্য নানারকম উপায় খোঁজেন। সারদা নিজে পড়েন কম, প্রায়ই ছেলেদের ডেকে রামায়ণ বা চাণক্যশ্লোক পড়ে শোনাতে বলেন। সেই সূত্রেই সেজো আর ছোটর অন্দরের লাইব্রেরির সঙ্গে পরিচয়।

ছবছরের রবি কদিন আগেই বইয়ের লোভে এক দুঃসাহসিক কাণ্ড ঘটাল। দূর সম্পর্কের এক মাসিমা দীনবন্ধু মিত্রের জামাইবারিক পড়ছিলেন, রবি সে-বই পড়তে চাইলে বয়স হয়নি বলে তাঁকে নিষেধ করা হল, চাবি দেওয়া আলমারিতে বই তুলে রেখে চাবি আঁচলে বেঁধে পিঠে ফেললেন মাসিমা। বালক রবি সেই চাবি চুরি করতে গিয়ে ধরাও পড়লেন। মাসিমা কোলের ওপর চাবি রেখে মেয়েদের সঙ্গে গোল হয়ে বসে তাস খেলতে লাগলেন। এবার কী হবে, বইটা তো পড়তেই হবে রবিকে! কিন্তু কী উপায়ে? বাধ্য হয়েই বালককে কুটিল কৌশল নিতে হল।

মাসিমার হাতের কাছে পানদোক্তার পাত্র এনে রাখলেন রবি। পানের নেশায় অন্যমনস্ক মাসিমা ঝুঁকে পিক ফেলতেই কোল থেকে চাবিটি মাটিতে পড়ল, মাসিমা চাবি মেঝে থেকে কুড়িয়ে অভ্যাসমতো আবার আঁচলে বেঁধে পিঠে ফেললেন। এবার আর রবির চাবি চুরি করতে কোনও অসুবিধে হল না। চাবি নিয়ে আলমারি খুলে বই বার করে পড়া হল এবং চোর ধরা পড়ল না। পরে রবি নিজে ধরা দিতে সবাই চেঁচামেচি শুরু করল কিন্তু শাস্তি কিছু হল না।

এখন বই নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে থাকা মেয়েদের দিকে তাকিয়ে সারদা বলেন, ওরে শুধু তোরাই দেখবি, না আমাকে কিছু পড়ে শোনাবি? স্বল্লো এদিকে আয়, আমাকে চাণক্যশ্লোকের কপাতা পড়ে শোনা দেখি।

মালিনী বলে, চাণক্যশ্লোক তো রোজ শোন কত্তামা, আজ তোমাকে নতুন একটা কাহিনি শোনাব। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত সীতার বনবাস। শুনলে তোমার চোখে জল আসবে গো মা। কিংবা যদি চাও বামাবোধিনীতে একটা মজার লেখা বেরিয়েছে, সেটা শোনাই…।

স্বর্ণ বিরক্ত হয়ে বলেন, আবার তুই সেই বামাবোধিনীর গা জ্বালানো লেখাগুলো এনেছিস! বলেছি না ও-সব স্ত্রীর প্রতি স্বামীর উপদেশমার্কা লেখা আনবি না, হাজার বছর ধরে ও-সব শুনে শুনে কান পচে গেছে। যেন মনে হয় মেয়েদের শিক্ষা দেবার একমাত্র উদ্দেশ্য সুমাতা, সুভার্যা, সুগৃহিণী তৈরি করা। ও-সব আর শুনতে চাই না।

স্বর্ণদিদি, তোমাদের নতুন মেয়েদের নতুন যুগের ধরন ধারণ দেখে যাদের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তারাই ও-সব লেখাচ্ছেন। তারা ভয় পাচ্ছেন লেখাপড়া শিখে একে মেয়েরা মাথায় উঠেছে, এখন বাইরে বেরতে শুরু করলে তাদের আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। মেয়েরা আর ঘরের কাজ করবে না, ছেলে মানুষ করবে না, পতিভক্তি উঠে যাবে, শাশুড়ি সেবা পাবেন না। দেখোনা, বঙ্কিমবাবু কেমন দেবী চৌধুরানীকে প্রথমে শক্তিরূপা করে এঁকেও আবার স্বামীর পদতলে নামিয়ে দিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছেন, পশ্চিমের মেয়েরা প্রধানত পত্নী, এদেশের মেয়েরা মূলত মা। লিখেছেন, মায়েদের কর্তব্য স্বাস্থ্যবান, শৌর্যপরায়ণ, দেশপ্রেমিক, আর্যজনোচিত সুসন্তান গঠন।

বাবারে বাবা, সব দায় যেন মেয়েদের, স্বর্ণ বলেন, মেয়েরা যদি ঘরকন্নার কাজে সারা দিনরাত বাধা পড়ে থাকে তো তারা শিল্পসাহিত্য করবে কী করে? দেশের কাজে যোগ দেবে কীভাবে?

মালিনী বলে, অন্তঃপুর, ভারতমহিলা সব পত্রপত্রিকার দেখো মেয়েদের কর্তব্য নিয়ে যেন চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না। প্রগতিশীল বাবুমশায়রা বিবিদের শিক্ষিত করতে চান, কিন্তু গেরস্থালির নিগড় থেকে মুক্তি দিতে নারাজ। আর রক্ষণশীলেরা স্ত্রীশিক্ষার নামেই কেঁপে উঠছেন। প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখ অনেকে প্রচার করছেন প্রাচীন ভারতে নারীর স্থান ছিল সুউচ্চ। তাই যদি হবে স্বর্ণদিদি, তা হলে অন্দরমহলে এত অন্ধকার কেন?

আচ্ছা মালিনী, তুই তো এত জানিস, সারদা জানতে চান, বল তো বিলিতি মেমরা কি খুব সুখী আর স্বাধীন?

ওরা আমাদের মেয়েদের চেয়ে হাজার গুণ স্বাধীন কত্তামা, কিন্তু ওদেরও অনেক দুঃখ আছে, পরাধীনতা আছে। মালিনী জানায়, মারি উলস্টোনক্রাফট নামে এক বিবির লেখা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে খুব হইচই হচ্ছে, তিনি লিখেছেন, স্ত্রী স্বামীকে ভালবাসবে সহযোগীর মতো কিন্তু তার শাসনদণ্ডের কাছে মাথা নোয়বে না। এ-সব লেখার জন্য তাঁর বর ছেড়ে গেছে। সমাজ টিটকিরি দিয়েছে, কিন্তু তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন। এখন তাঁর মতামতের কিছু শিষ্যা তৈরি হয়েছে। ভাবো কত্তামা, আমরা ওদেশের মেয়েদের স্বাধীন ভাবছি আর ওরা সেই স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। তা হলে আমরা কোথায় আছি?

 উফ, তুই কী যে বলিস অদ্ধেক আমার মাথায় ঢোকে না মালিনী। বিলেতে বসে কোন মেমসাহেব কী লিখছে, কী বলছে আর তুই জেনে ফেললি!

 মালিনী হাসে, কত্তামা, আমি বলেছি না জাদু জানি। কী শুনতে চাও বলো না। সময় আমাকে বাঁধতে পারে না। আমার বয়স বাড়ে না। কালিদাসের কথা জানতে চাও, আমিই হয়তো ছিলাম তার মালঞ্চের মালিনী। হয়তো ভবিষ্যতে তোমার ছোট ছেলে রবি কী লিখবে তাও আমার চোখের সামনে ফুটে উঠবে। বলো, শুনতে চাও? বিলিতি মেমদের গুহ্যকথা চাও না দুশ বছর পরের কলিকাতা? বিক্রম বেতাল না বামাবোধিনী?

জ্ঞানদা এতক্ষণ শুনছিলেন, এবার বললেন, ঠাট্টা ছাড় মালিনী, ঠিক করে বল তো বামাবোধিনীর মতো পত্রিকাগুলি কি তা হলে বিবিসাহেবের কথামতো শুধু দাসত্বের পাঠক্রমই শেখাচ্ছে? আবার মেয়েরা সব গৃহকাজ তুলে দিলে কাজটা করবেই বা কে? ইংরেজ মেয়েরা কিন্তু খুব নিপুণ ভাবে সংসার করে। সেটাও কি শিক্ষণীয় নয়? # ঘরের কাজ নিয়মিত অভ্যেসে নিপুণ করে তোলাটাকেও একটা আর্ট বলে মানেন জ্ঞানদা। সংসারের সবদিকে তার পরিপাটি নজর। রুচিশীল পোশাক যেমন পরতে হবে, ভারতীয় সংস্কৃতির ভাল দিকটাও রাখতে হবে। আবার তার সঙ্গে মেশাতে হবে ইংরেজ কেতার ভাল অংশটিকে। তিনি নিজেকে যেমন ফিটফাট রাখেন, নিজের ঘরকেও।

স্বর্ণকুমারী কিন্তু জ্ঞানদার মতো গুছিয়ে ঘরের কাজ করা পছন্দ করেন না, তার মনে হয় গৃহকর্ম করলে সময় নষ্ট, তার চেয়ে অনেক জরুরি কাজ তার করার আছে। তিনি প্রতিবাদ করেন, কেন মেজোবউঠান, মেয়ে হয়ে জন্মালেই কেন ও-সব করতে হবে? মিসেস স্মিথের কাছ থেকে মারি উলস্টোনক্রাফটের ওই বইটা আনিয়ে নিয়ে পড়েছিলাম, এ ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইটস অফ উইমেন। ওঃ, সে কী তেজস্বিনী লেখিকা, কী আগুনঝরা কথাবার্তা! আমিও শুনেছি, এজন্য তাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, বিলেতে কেউ তার কথাবার্তা ভালভাবে নেয়নি, সভা বয়কট করেছে, স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে, তবু তিনি দমেননি।

জ্ঞানদা বললেন, বোম্বাই থাকতে আমিও মারির কথা শুনেছি। সাধারণ ইংরেজ মহিলারা তার নাম শুনলে ভয় পান আর পুরুষরা রেগে ওঠেন। ঠাকুরঝি, আমরা বোধহয় তাঁর চেয়ে ভাগ্যবতী, আমাদের দুজনের স্বামীরা আমাদের সঙ্গে আছেন, এবং তারাই স্ত্রী স্বাধীনতার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। মারিকে কিন্তু বিলেতে বসেও ঘরে বাইরে যুদ্ধ করতে হয়েছে। ঘরের কাজে মন না দিয়ে লেখালেখির চর্চা করে তিনি সে দেশে কোণঠাসা হয়েছেন আর এ দেশে বামাবোধিনী শিক্ষিত মেয়েদের ঘরের কাজে অবহেলা করতে না বলে কী এমন অপরাধ করছে?

মালিনী বলে ওঠে, আমাদের এখানেও দুয়েকজন মুখ খুলছেন স্বর্ণদিদি, এই তো দু-তিন বছর আগে সোমপ্রকাশে বেরিয়েছিল স্ত্রীলোকের পরাধীনতা বিষয়ে বামাসুন্দরীর চিঠি। মেয়েরা কী করবে সেটা মেয়েরাই ঠিক করুক না!

ঠিকই তো, দাসী চাকরদের দিয়ে যে কাজ করানো যায় তার জন্য শিক্ষিত পত্নীর কেন দরকার না করলেই কেন সাড়ে সর্বনাশ হবে? আমি কী করব সেটা বামাবোধিনীর জ্ঞান শুনে ঠিক করতে হবে? স্বর্ণকুমারী রাগত স্বরে বললেন।

একটু হেসে মালিনী বলে, এই বিতর্ক বেশ জমে উঠেছে। কিন্তু স্বর্ণদিদি, বামাবোধিনীর এ-লেখা সে-লেখা নয়। আধুনিকা আর পুরাতনীর বিরোধ নিয়েই একটা মজার কথোপকথন, শোনোই না–

সরমা সুশীলার কথোপকথন

সরমা। ভাই, আজিকালি মেয়েমানুষে লজ্জা সরমের মাথা খেয়েছে। শ্বশুর, ভাসুর, শাশুড়ী ননদ দেখিয়া একটু ভয়সমীহ করে না। আর অধিক কি বলিব, স্বামীর সঙ্গে নির্লজ্জ হয়ে কথাবার্তা কয়।

সুশীলা। সরমা মেয়েমানুষেরা কি গারোদে বাঁধা চোর? দেখ দেখি, ঈশ্বরের এতবড় জগতে সকল জীবজন্তু ইচ্ছায় ভ্রমণ করিয়া মনের সুখ লাভ করিতেছে। কিন্তু ইহাদিগকে চারি পাঁচিলে ঘেরা অন্তঃপুরের মধ্যে রুদ্ধ থাকিতে হয়। পাখীরা যে পিঁজরাতে বদ্ধ থাকে, তার মধ্যে তাহাদের একটু স্বাধীনতা আছে, চারি পাঁচিলের মধ্যেও নারীগণ একটু স্বাধীনতা না পাইলে তাদের বাঁচিয়া থাকা কেবল যন্ত্রণা মাত্র। আর আমি বলি কেবল ঘোমটা দিয়া জুজু হইয়া থাকিলেই যে মেয়েমানুষ খুব ভাল হইল তাহা নয়। যাহার রীত চরিত্র ভাল, তাকেই ভাল বলি।

স। তোমরা কালের মত মেয়ে। তোমাদের ভাব গতিক আলাদা। কোন কালে মেয়েরা বেহায়া হলে ভাল রীত চরিত্র আবার দেখাতে পেরেছে? কোনকালে আবার মেয়েরা লজ্জা খেয়ে গুরুলোকের সঙ্গে স্পষ্টাস্পষ্টি কথা কয়ে বেড়ায়েছে?

সু। যথার্থ লজ্জা, নম্রতা, বিনয়, সুশীলতা তাহা স্ত্রীলোকের অলঙ্কার সন্দেহ নাই। কিন্তু যদি মনে সেরূপ ভাল ভাব না থাকে, বাহিরের লজ্জা কি কোন কাজের হয়? কত মেয়ে খুব লজ্জা দেখাত, কিন্তু দুঃখের কথা কি বলবো তারা অনায়াসে আবার বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছে, খুব তিলক ফোঁটা কাটিয়া যারা বাহিরে ধার্মিক দেখায়, তাদের মধ্যেই ভণ্ড বেশী। যাহা হউক তুমি জেন, এখন স্ত্রীলোকদের মধ্যে যেরূপ ভণ্ড লজ্জা দেখা যায়, পূৰ্ব্বকালে এ রূপ ছিল না। সীতার ন্যায় সতী কে? কিন্তু তিনি রামচন্দ্র বনে গেলে কাহার কথা না শুনিয়া পতির অনুসরণ করিলেন এজন্য ত কেহ তাহাকে বেহায়া বলিল না। সাবিত্রী, দময়ন্তী প্রভৃতি যত বিখ্যাত রমণীর কথা শুনা যায়, কেহ ত পরিবারের মধ্যে ঘোমটা দিয়া বসিয়া ছিলেন না, অথচ তাহাদের ন্যায় পতিভক্তিপরায়ণা ও গুণবতী রমণী কোথায় দেখা যায়? বেদ পুরাণ ও আর আর প্রাচীন শাস্ত্র যত পাঠ করা যায়, ততই দেখা যায় শাশুড়ী ননদ স্বামী কি শ্বশুর ভাসুরের সঙ্গে কোন স্ত্রীলোক কথাবার্তা কহা পাপ বিবেচনা করিতেন না। আজি কালি মেয়েদের ভাল গুণ থাকুক না থাকুক তাহারা বাহিরে লজ্জা দেখাইয়া বাহাদুরী করিতে চান!!

স। আমরা রামায়ণ মহাভারতের এ সব কথা শুনেছি বটে, কিন্তু তুমি বল দেখি সে কালের ব্যাভার কি একালে খাটে? আর এরকম না কল্লেই বা ক্ষতি কি?

সু। এই তুমি বলিতেছিলে কোন কালে মেয়েরা এরূপ ছিল, কথা উল্টাইয়া লইলে। ভাল, পূৰ্ব্বকালে এখনকার মত ভণ্ড লজ্জা দেখাইবার প্রথা ছিল না তাহা ত বুঝিয়াছ। সেকালের ভাল প্রথা একালে ঘটিবে না কেন তাহাত বুঝিতে পারি না। বর্তমান প্রথায় কি ক্ষতি, বলিতেছি। জগদীশ্বর মুখ দেছেন কেননা মনের ভাব প্রকাশ করিবার জন্য। মেয়ে মানুষেরা কথা কহিতে পায় না বলিয়া ত তাহাদের মন চুপ করিয়া থাকেনা। মনের কথা কাহার সঙ্গে প্রকাশ করিতে না পাইলে তার চেয়ে দুঃখ কি আছে? কত সময় তাহাদের পীড়া ও অনেকপ্রকার কষ্ট উপস্থিত হয়, প্রথমে প্রকাশ করিতে না পারিয়া শেষে বিপরীত ঘটিয়া উঠে। বাঘা শাশুড়ী ননদের ঘরে নববধূদিগের যে দুরবস্থা, তাহা কে বর্ণনা করিতে পারে? এই কারণে অনেকের অপঘাত মৃত্যু ও অপথে পদার্পণও হইয়া থাকে। আর মনে কর হিন্দুর ঘরের ৮/১০ বৎসরের একটী শিশু বাপ মা ভাই ভগিনী সকল পরিত্যাগ করিয়া শ্বশুরগৃহে আসিল। সেখানে সে যদি আপনার লোক না পায়, তাহাকে সর্বদা কুণ্ঠিত হইয়া মুখবন্ধ করিয়া থাকিতে হয়, কাহার মুখপানে চাহিয়া স্নেহ পাইবার আশা না থাকে সে কিরূপে জীবনধারণ করিতে পারে? অনেক গৃহে নববধূদের যে কষ্ট তাহা তাহারাই জানে আর সেই অন্তর্যামী পুরুষই জানেন। শাস্ত্রমতে পতির গৃহই স্ত্রীলোকের গৃহ, পতির পিতা মাতা ভাই ভগিনী তাহারাও পিতামাতা ভাই ভগিনী। তবে তাহাদের নিকট এত লজ্জা কেন? লজ্জা পর বা পাপ বোধ করাইবার চিহ্ন৷ গৃহ, পিতা মাতা, ভাই ভগিনী আপনার সামগ্রী সকল যাহা দ্বারা পর বোধ হয়, এমন লজ্জার ন্যায় শত্রু আর কে আছে? আর পিতা মাতা ভাই ভগিনী আত্মীয়গণের নিকট সরল ভাবে মনের কথা প্রকাশ করিলে তাহাতে যে পাপ আরোপ করে তাহার ন্যায় কু আচার বা জগতে কি আছে?

লজ্জা থাকাতে যাহার প্রতি যে কর্তব্য তাহা প্রতিপালন করিবার অনেক ব্যাঘাত হয়। স্ত্রীলোকেরা যদিও হীনবল, কিন্তু তথাপি তাহারা অশেষ প্রকারে পরিবারের সাহায্য করেন ও করিতে পারেন। কিন্তু অনেক সময় কুৎসিত লজ্জা আসিয়া আপনার মত অতি আত্মীয় জনের বিপদ পীড়া ও দুর্ঘটনার সময় সাহায্য করিতে দেয় না। কত সময় বধূ বা ভাদ্রবধূদের সম্মুখে শ্বশুর বা ভাসুর যদি প্রাণত্যাগ করেন, তথাপি তাহার হস্ত প্রসারণ করিবার ক্ষমতা নাই, একটী সান্ত্বনার কথা বলিবার উপায় নাই। একি সামান্য দুঃখের কথা! এসকল শাস্ত্র ছাড়া–যুক্তি ছাড়া।

স। লজ্জা দ্বারা অনেক ক্ষতি হয় তাহার সন্দেহ কি? কিন্তু তুমি যে বলিলে ইহা শাস্ত্র ছাড়া, যুক্তি ছাড়া তবে সকলে ইহা ধরিয়া চলেন কেন?

সু। এতদিন স্ত্রীলোক লেখাপড়া শিখত না কেন? হিন্দুরা জাহাজে চড়িয়া বিদেশ যাইত না কেন? বিধবা বিবাহ মন্দ ও সহমরণ ভাল বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিল কেন? দেশাচার ও কুসংস্কারে কিনা করে? তবে যে প্রথাটী হয় তাহার একটা না একটা কারণ থাকে। স্ত্রীলোকের নম্রতা থাকা উচিত ইহা বেশী করিতে গিয়া এবং পুরুষেরা একটু আপনাদের কর্তৃত্ব বাড়াইতে গিয়া স্ত্রীলোকদিগকে জুজু করিয়া ফেলিয়াছেন। এ প্রথা কোন দেশে নাই এদেশেও থাকিবে না।

স। আচ্ছা, বাড়ীর আর আর লোকের সঙ্গে কথা কহুক, কিন্তু বল দেখি বৌ হইয়া স্বামীর সঙ্গে স্পষ্টাস্পষ্টি কথাবার্তাটা কি ভাল দেখায়?

সু। পতিই স্ত্রীলোকের গতি, পতিই সুহৃদ বন্ধু সকলই। পতির ন্যায় আত্মীয় কে হইতে পারে? পূৰ্ব্বকালে সতীরা পতির জন্য কি না করিয়াছেন? কিন্তু কি আশ্চৰ্য্য একেলে সংস্কার! এমন পরম আত্মীয় পতির সহিত কথা কও দুষ্য। পতি ও পত্নীর মধ্যে যে ধর্ম সম্বন্ধ আছে তাহা না দেখিয়া লোকে কুৎসিত ভাব গ্রহণ করে এবং তাহারাও পরস্পরকে দেখিয়া লজ্জিত হন ইহা অপেক্ষা আমাদের সমাজের জঘন্যতার পরিচয় আর কি আছে? আমি তোমাকে পূৰ্ব্বকালের যে সকল সতী রমণীর কথা বলিয়াছি, তাহাদের দৃষ্টান্ত দেখিয়া সকলেরই চলা উচিত। স্বামীর সঙ্গে এক হৃদয় হওয়াই সতীর লক্ষণ, স্বামীর সুখে সুখ, দুঃখে দুঃখ বোধ করা, ছায়ার ন্যায় সকল কার্যে, তাহার অনুবর্তিনী হওয়া এবং সখীর ন্যায় তাহার হিতকৰ্ম্ম করা, শাস্ত্রমতে এই ত সতীর প্রধান ধৰ্ম্ম। যদি স্বামী ও পত্নীর মধ্যে লজ্জা আসিয়া পরস্পরকে পর করিয়া দেয় এবং পাপের ভার সঞ্চার করে তাহা হইলে প্রকৃত দাম্পত্য ধৰ্ম্ম। কোন রূপেই রক্ষা পাইতে পারে না। আজি তোমাকে এই অবধি বলিলাম, পরে আর আর কথা বলিব, আমার ইচ্ছা স্ত্রীলোকেরা এরূপ জঘন্য লজ্জা পরিত্যাগ করিয়া গৃহে স্বাধীনভাবে আত্মীয়গণের প্রতি যথা কর্তব্য সাধন করুন্। ইহা কি তোমার ইচ্ছা নয়?

স। তুমি যে কথাগুলি বলিলে তাহা অকাট্য এবং তাহার মত যতদিন আমরা চলিতে না পারি ততদিন আমাদের ভণ্ডামী এবং সকল বিষয়েই কষ্ট তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। নম্রতা, বিনয়, সুশীলতা এই সকলই প্রকৃত লজ্জা যে তুমি বলিলে তাহা সত্য এবং তাহা কেবল সাত হাত ঘোমটা দিলেও হয় না, মুখে গো দিয়া থাকিলেও হয় না। ভাল কাৰ্য্য দ্বারাই ভাল গুণ প্রকাশ পায়।

.

বামাবোধিনী পর্ব মিটতে বেলা দুপুর গড়িয়ে গেল। ইতিমধ্যে মেয়েরা অনেকেই উঠে গেছেন। এই কচকচি সবার ভাল লাগে না। দাওয়ার নীচে দাসীরা রাশিকৃত মাছ নিয়ে কুটতে বসেছিল, তাদের কাজও প্রায় শেষ। এবার রসুইঘরে বামুনঠাকুরেরা রান্না চাপাবে। তার আগে সবাই নারকেলের নাড়ু, দইচিড়ে কলা বাতাসার ফলার দিয়ে জলখাবার খাওয়া শুরু করলেন।

কর্তাদের ও ছেলেদের মহলে মহলে পাথরের থালা-বাটিতে জলখাবার পাঠানো হয়ে গেছে। কোনও বাচ্চা খাওয়া নিয়ে গোল করলে দাসীরা চড়থাপ্পড় দিয়ে খাওয়ায়, ও নিয়ে বাড়ির গিন্নিদের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। প্রতিটি ছেলেমেয়ে অন্নপ্রাশনে উপহার পায় একসেট জয়পুরি সাদা পাথরের থালা, বাটি, গেলাস। আর দুধের জন্য একটা রুপোর বাটি। দাসীরা সেই বাসনে রান্নাঘর থেকে খাবার এনে বালক বালিকাদের খাওয়ায়। দুধের ঘর আলাদা। সাদা থালা-বাটি ভাঙলে ক্রমে ক্রমে আসে মুঙ্গেরের কালো পাথরের বাসন। কাসা-পেতলের বাসনে খায় সরকার, বামুন, ঝি, চাকর। তখনও কাঁচের বাসন চালু হয়নি।

মালিনী সবার সঙ্গে পাথরের বাটিতে ফলার খেয়ে প্রচুর বই বিক্রি করে বিদায় নেওয়ার আগে ঠিক হল সে পরের হপ্তায় স্বর্ণকুমারীর বাড়িতে যাবে। বলাই বাহুল্য জোড়াসাঁকোর মেয়েরাও সেদিন স্বর্ণর পালঙ্কে আসর জমাবেন। তার সিমলের বাড়ির শোবার ঘরের বিরাট পালঙ্কে প্রায় দুপুরেই জোড়াসাঁকোর বোন, বোনঝি, বউঠানদের নিয়ে আসর বসে। বিকেল হতেই তাসখেলা, গল্পগুজব, আবৃত্তি, কবিতাপাঠের সঙ্গে চলে মুড়ি-ফুলুরি-বেগুনির ঢালাও সরবরাহ। তার সঙ্গে বই-মালিনীর সঙ্গ যোগ হলে তো ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা। একটি আসর শেষ হতে হতেই পরবর্তী আড্ডার সম্ভাবনায় চনমনে হয়ে ওঠে মেয়েরা।

মেয়েমহলের প্রাণসঞ্জীবনী এই আর ছোট ছোট সুখ-দুঃখের কোনও খবরকেই মহাজ্ঞানী কর্তামশাইরা অবশ্য গুরুত্ব দেন না। তাঁদের অজান্তে ও অবহেলায় ঘরের কোণে কোণে মেয়েমহলে বিতর্কের আলো জ্বালিয়ে আসে বই-মালিনী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *