০১. জ্ঞানদানন্দিনী

০১. জ্ঞানদানন্দিনী

সন ১৮৬৬। ঠাকুরবাড়ির দেউড়ির সামনে একটি ঘোড়ার গাড়ি এসে থামল। গাড়ির দরজা খুলে মাটিতে নেমে এল বিলিতি জুতো মোজা পরা সুললিত একটি পা, পরে আর-একটি। পায়ের ওপর লুটিয়ে আছে নকশি পাড় মরচেরঙা শাড়ির কুঁচি। তারপর মাটিতে নেমে দাঁড়ালেন শাড়ি পরা এক ষোড়শী বিদ্যুৎলতা। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে তিনি পা বাড়ালেন বাড়ির অন্দরের দিকে। প্রকাশ্য আঙিনায় চাকর-বেহারাদের চোখের সামনে মেজোবউ জ্ঞানদানন্দিনীর এই অকুণ্ঠ অলজ্জ আবির্ভাবে জোড়াসাঁকোর অন্দরমহলে সেদিন যেন ভূমিকম্প ঘটে গেল। পুরনো চাকরবাকরেরা এই অনাসৃষ্টি কাণ্ড দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল। মানদা দাসী অন্দর থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে এমন দৃশ্য দেখে কর্তামাকে খবর দেবার জন্য পড়িমরি ছুট লাগাল। বেজার মুখে নায়েব গোমস্তা পুরুষেরা দাঁড়িয়ে রইলেন। এতদিন পর বোম্বাই থেকে ফিরে মেজোবাবু স্বয়ং যখন বউমাকে পাশে নিয়ে এইভাবে অন্দরে ঢুকলেন, তখন কারও কিছু বলার থাকতে পারে না, বিশেষত কর্তা দেবেন্দ্রনাথ যখন বাড়ি নেই। কিন্তু এহেন সৃষ্টিছাড়া কাহিনির জল যে অনেকদূর গড়াবে তাতে কোনও সন্দেহ রইল না কারওরই।

ঠাকুরবাড়ির মেজোছেলে সত্যেন্দ্রনাথ বেশ কৃতি ও মেধাবী। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আই সি এস। নারীপ্রগতির বিষয়েও তিনি অতি সক্রিয় চিন্তাভাবনা করতেন। বিয়ের সময় তখনকার নিয়ম অনুসারে সত্যেন্দ্রর নববধূ জ্ঞানদার বয়স ছিল সাত। তাঁর গৌরীদান হয়েছিল। বাপের বাড়িতে সবে তাঁর অক্ষর পরিচয় হয়েছে। নোলক পরা, ঘোমটা টানা সদ্য সাক্ষর সেই বালিকাবধূকে নিয়েই শুরু হল স্ত্রীস্বাধীনতার জন্য সত্যেন্দ্রর লড়াই। উনিশ শতকের বউ-মেয়েদের বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে যেভাবে বন্দি করে রাখা হত, সত্যেন্দ্র তরুণ বয়স থেকেই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। মা সারদাদেবীকেও তিনি প্রায়ই বলতেন ঘরে বন্দি হয়ে না থেকে বাইরে বেরোতে। রক্ষণশীল সারদা অবশ্য মেজোছেলের এ-সব কথায় গুরুত্ব দেননি, বরং ধমক দিয়ে বলতেন, তুই মেয়েদের নিয়ে মেমেদের মতো গড়ের মাঠে বেড়াতে যাবি নাকি?

কী বা এমন দোষ হয় মেয়েরা গড়ের মাঠে গেলে? সত্যেন্দ্র জানতে চান।

 ঘরের শুচিতা নষ্ট হয়। জানিস না, বাড়ির পুরুষেরাও রাতে শোবার সময়ে ছাড়া যখন-তখন অন্দরে ঢুকতে পারেন না! আর সেই বাড়ির মেয়েরা বেটাছেলের সঙ্গে বাইরে গিয়ে হাওয়া খাবে, এমন কাণ্ড কেউ কখনও শুনেছে? লোকে ছি ছি করবে যে!

মা ছেলের এই কথোপকথনের পর অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে মা আরও কট্টর হয়েছেন, ছেলে আরও প্রগতিশীল। সেদিনের সেই লজ্জাবতী মেজোবউ বহু বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বেপরোয়া আই সি এস স্বামীর সঙ্গে দু’বছর বোম্বাইতে কাটিয়ে এখন রীতিমতো আলোকিত নারী। কিন্তু সারদাদেবীর গম্ভীর মুখ জ্ঞানদার এই আধা-মেম মূর্তিতে আবির্ভাব দেখে আরও অন্ধকার হল। মেজোছেলে ও মেজোবউ অন্দরে পৌঁছলে কর্তামা অখুশি মুখে তাদের বরণ করতে এলেন। তাকে ঘিরে ঠাকুরবাড়ির চোদ্দো পনেরো জন নানা বয়সের মেয়ে বউ কিশোরী বালিকা। তারা গভীর বিস্ময়ে বোম্বাইয়ের জাহাজে-চড়া বউ দেখতে থাকে। জ্ঞানদার মনেও হিল্লোল ওঠে তাদের জবুথবু ভাবভঙ্গি সাজপোশাকের দিকে তাকিয়ে। এই রূপসি মেয়ে বউদের ব্যক্তিত্ব যেন শাড়ি-গয়নার স্তূপে চাপা পড়ে আছে। কোনও কিশোরীর পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে যেমন তেমন করে পরা ভারী বেনারসি, কোনও বধূর সোনার অঙ্গ ঢেকে গেছে সোনার গয়নার নির্লজ্জ ঝমঝমানিতে। কিন্তু শাড়ি গয়নার সম্ভারে তাদের উপচে পড়া যৌবন বাধ মানছে না। এই পোশাকে পুরুষের চোখের সামনে সত্যিই বেরনো যায় না।

জ্ঞানদার মনে হল, এজন্যই বোধহয় বাড়ির পুরুষদেরও যখন-তখন অন্দরে আসা বারণ। সারদাসুন্দরীদেবী আগের মতোই বিরাট চৌকির ওপর তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসেছেন, চন্দনরঙের মিহি মসলিন শাড়ি যেন তার। গায়ের রঙে মিশে গেছে। শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক কষামিঠে শস্মৃতি জ্ঞানদার মনে পড়ে যায়। মনের মতো পোষমানা বউ হতে পারেননি বলে তাঁকে শাশুড়ির কাছে নাজেহাল হতে হয়েছে বহুবার। বালিকাবয়সে বউ হয়ে আসার পর শাশুড়ি নিজে সামনে বসে তাঁর পরিচর্যা করাতেন। সারদা বসে থাকতেন চৌকিতে আর তাঁর সামনে দাসীরা বউদের কষে সর-ময়দার রূপটান মাখাত। শ্যামরঙা জ্ঞানদার রোগা চেহারা সারদার পছন্দ হয়নি, তাই তাঁকে রংরূপে ঠাকুরবাড়ির উপযুক্ত করে তোলায় মন দিয়েছিলেন। একবার অন্যবাড়ির কজন মেয়ে-বউ দেখা করতে এল। তাদের রসেবশে চেহারা দেখে সারদা আক্ষেপ করে বললেন, এরা কেমন হৃষ্টপুষ্ট দেখ দেখি, আর তোরা সব যেন বৃষকাষ্ঠ। তারপর কিছুদিন ধরে শুরু হল জ্ঞানদাকে মোটা করার চেষ্টা। নিজ হাতে ভাত মেখে খাইয়ে দিতে লাগলেন। একমাথা ঘোমটা পরা বালিকাবধূ না পারতেন গিলতে, না ফেলতে। ভাতের দলা নিয়ে সুন্দর চাপার কলির মতো কর্তামার আঙুলগুলি এগিয়ে আসত জ্ঞানদার মুখের দিকে আর বালিকার কেবল মনে হত কখন মা উঠে যাবেন আর তিনি দালানে গিয়ে বমি করবেন।

এ তো গেল তাঁর আদরযত্নের পালা। কিন্তু সত্যেন্দ্রর আই সি এস পরীক্ষা দিতে বিলেত যাওয়াটা বোধহয় মায়ের পছন্দ হয়নি। মেজোছেলে চলে গেলে কর্তামা কী এক অজানা রাগে মেজোবউ জ্ঞানদার গয়না নিয়ে দুই মেয়েকে বিয়ের উপহার দেন। নিয়ে নেওয়া সেইসব গয়নার জন্য অবশ্য জ্ঞানদা শোক করেন না। কিন্তু বাবামশায় যখন শুনলেন, তিনি মায়ের ওপর খুব রাগ করেন আর জ্ঞানদার জন্য একটি হিরের কন্ঠি পাঠিয়ে দেন। আসলে চিরদিন অন্তঃপুরবাসিনী সারদা সেখানকার কোনও পরিবর্তন মানতে পারতেন না। জ্ঞানদা যেভাবে অন্দরমহলের রীতিনীতি না মেনে আধুনিকতার আমদানি করছিলেন তা সারদাকে রাগিয়ে তুলত। আর ঘরের বউয়ের জাহাজে পাড়ি দিয়ে বোম্বাইযাত্রা এবং সেই বিদেশবিভূঁইতে দু’বছর কাটিয়ে আসা যে তিনি কোনওমতেই হজম করতে পারবেন না সে তত জ্ঞানদা বুঝতেই পারছেন, এবার মায়ের সঙ্গে বসবাস আরও কঠিন হবে।

কিন্তু বোম্বাই যাওয়ার অনুমতি পেতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল তাঁকে। সত্যেন বিলেত যাওয়ার পর থেকেই স্ত্রীকে ঘরের বাইরে বিশ্বের আলোকিত নারীদের মাঝখানে নিয়ে যেতে চাইতেন। সে যুগে পুরুষেরা কার্যসূত্রে বা ভ্রমণে বাইরে গেলেও স্ত্রীদের সঙ্গে নেওয়ার চল ছিল না। কিন্তু সত্যেন কোনওদিনই জ্ঞানদাকে ঘরে বন্দি রেখে নিজে প্রবাসে থাকতে চাননি। চিঠির পর চিঠিতে তিনি জ্ঞানদাকে ডাক পাঠাতেন। একবার লিখলেন, এখানে জনসমাজে যাহা কিছু সৌভাগ্য, যাহা কিছু উন্নতি, যাহা কিছু সাধু সুন্দর, প্রশংসনীয় স্ত্রীলোকদের সৌভাগ্যই তাহার মূল।… আমার ইচ্ছা তুমি আমাদের স্ত্রীলোকের দৃষ্টান্তস্বরূপ হইবে কিন্তু তোমার আপনার উপরই তাহার অনেক নির্ভর।

এ সব চিঠি পড়ে মনে মনে নিজেকে সেই আলোকযাত্রার জন্য প্রস্তুত করছিলেন কিশোরী জ্ঞানদা। কিন্তু শেষপর্যন্ত বাবামশায়ের অনুমতি পাওয়া গেল না। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে বোম্বাইয়ের কর্মস্থলে প্রবাসী হলেন সত্যেন আর জ্ঞানদা নিজেকে তৈরি করতে লাগলেন আরেকভাবে। সেজোদের হেমেন্দ্রনাথের কাছে বাড়ির মেয়ে-বউরা তখন বাংলা শিখতে শুরু করেছে। সেজোজা নীপময়ী আর ননদ সুকুমারী, স্বর্ণকুমারী, বর্ণকুমারীদের সঙ্গে জ্ঞানদাও যোগ দিলেন সেই পাঠশালায়। শাশুড়ি অবশ্য মাঝেমাঝেই রাগ করে কথা বন্ধ করে দিতেন অবাধ্য মেজোবউয়ের সঙ্গে, কখনও শাস্তি দিতেন অন্য মেয়েদের তাঁর সঙ্গে মিশতে না দিয়ে। তাই নিয়ে দূর থেকে উদ্বিগ্ন হতেন সত্যেন্দ্র। জানতে পারলে রাগ করতেন দেবেন্দ্রনাথ। হয়তো এ-কারণেই দ্বিতীয়বার সত্যেন্দ্রর আবেদনে সম্মতি দিতে দেরি করেননি মহর্ষি। সেই সম্মতি বাঙালি মেয়ের জন্য বিশ্বের দরজা খুলে দিয়েছিল।

এর জেরে শাশুড়ির মনে জমা যত তিক্ততা অবশ্য সামলাতে হল। জ্ঞানদাকেই। তবু সংস্কারের সীমায় বাধা সারদাকে বুঝতে পারেন বলেই শাশুড়ির ওপর রাগ করেন না, ধমক খেতে হবে জেনেও একটু ঝুঁকে তাকে প্রণাম করেন জ্ঞানদা।

তক্তপোশে বসে বিরক্তি নিয়ে জ্ঞানদার বেশবাস দেখতে থাকেন সারদা, জানতে চান, এ আবার কী ছিরির শাড়ি পরা হয়েছে?

জ্ঞানদা উত্তর করেন, মা এ হল বোম্বাই দস্তুর শাড়ি-পরা। এভাবে পরলে বাইরের লোকের সামনে বেরনো যায়।

আর গায়ে ওটা কী পরেছ? মেমেদের মতো জ্যাকেট?

জ্ঞানদার মুখ একটু অপ্রতিভ হয়ে যায়। সত্যেন্দ্র উত্তর দেন, কেন মা তোমার ভাল লাগছে না দেখতে? এখন অভিজাত ভদ্র স্ত্রীলোকেরা এভাবেই শাড়ি পরে পশ্চিমে। এবার আমাদের মেয়ে-বউরাও পরবে।

সারদা মুখঝামটা দেন, থাক নিজের বউকে সঙ সাজাচ্ছ, আবার আমার ভালমানুষ বউ-মেয়েদের নিয়ে টানাটানি করতে হবে না। চিরকাল যেভাবে চলে এসেছে তাই চলবে। অন্দরের শুচিতা নষ্ট করতে আমি দেব না। মা ছেলের তরজা শুনতে শুনতে মেয়েরা মন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে মেজোবউয়ের সাজ। মেমেদের মতো ভারী না হলেও জ্যাকেটটি বেশ লেস বসানো কায়দাকানুন করা। কোমরে জ্যাকেট যেখানে শেষ আর শাড়ির বাঁধন শুরু সেখানে উঁকি মারলে পাতলা কাপড়ের সেমিজ দেখা যাচ্ছে। মরচেরং রেশমের শাড়ির ওপর কালোসোনালিতে পারশি কাজ করা পাড় বসানো। শাড়ি পরার ধরনটি বেশ আলাদা, কোমরে কুঁচি দিয়ে পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে সামনে এনে আঁচলটি বাঁ কাঁধের ওপর ব্রোচ দিয়ে আটকানো, পায়ে মোজা ও বিলিতি জুতো। কারও কারও বেশ ভালই লাগল। সনাতনপন্থী কেউ কেউ মনে মনে সারদার পক্ষ নিলেন।

সারদা আবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, জানি না কী অলুক্ষুনে কাণ্ড হবে, বউকে গাড়ি চড়ালি, জাহাজে চড়ালি, ভিটেছাড়া করে বিদেশে নিয়ে রাখলি। নিন্দায় কান পাতা যাবে না। যত জ্বালা তো আমাকেই সইতে হবে।

হঠাৎ উঠোন থেকে দালানে ছুটে এসে জ্ঞানদাকে জড়িয়ে ধরে হইচই করে ওঠে এক পসারিণী। ওঃ মেজোবউঠান তুমি আজ যে কাণ্ড করে দেখালে, ইতিহাস হয়ে গেল গো। বাঙালি মেয়েরা একশো বছর পরেও তোমায় ধন্য ধন্য করবে।

জ্ঞানদা চমকে উঠে বলেন, ওমা, বই-মালিনী। তুই কখন এলি?

সারদা রাগে লাল হয়ে হাতপাখা ছুঁড়ে মারেন বইওলিকে। যাঃ ভাগ, তোর আর নাটক করতে হবে না। ও সব আদিখ্যেতা করলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেব। ইতিহাস! ওফ কী আমার ইতিহাসের ব্যাখ্যাতা এলেন রে! যা ভাগ।

সত্যেন মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলেন, মাগো অত রাগ করছ কেন? সত্যিই তো এটা ইতিহাস। বাইরে বেরলে দেখতে মরাঠি মেয়েরা হাবভাব চালচলনে বাঙালিনীদের চেয়ে কত এগিয়ে গেছে, তাদের দেখলে তুমিও বুঝতে কোমলেকঠিনে গড়া সেই ব্যক্তিত্বই বাঙালি নারীর আদর্শ হওয়া উচিত। মায়ের পাশটিতে চুপ করে বসে থাকা শাড়ি জড়ানো এক বালিকার ঝুটি নেড়ে দিয়ে সত্যেন বলেন, হারে বর্ণ, তুই সত্যি করে বল তো মেজোবউঠানের মতো করে সাজতে চাস কি চাস না?

ছোটবোন বর্ণকুমারী চুপ করে থাকে, তার আশেপাশের বালিকা কিশোরীরা উসখুস করেও সারদার ভয়ে কিছু বলতে পারে না। তবে প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে তারা একজন দুজন করে জ্ঞানদার কাছে গিয়ে কথাবার্তা শুরু করল। এই মেজোবউঠান অন্যরকম বলে চিরদিনই তাদের আকর্ষণের কেন্দ্র, তা ছাড়া তিনি সবাইকে নিয়ে চলতে জানেন। নতুনের প্রতি গোপন টান উসকে দিতে জানেন। বই-মালিনী জ্ঞানদার হাত ধরে গোমড়া মুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

দু’বছর আগে মেজোবউয়ের বোম্বাইযাত্রা উপলক্ষে সাড়া পড়ে গিয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে। নানা প্রশ্ন, উদ্বেগ, উৎসাহ। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল কী পোশাক পরে যাবেন তিনি। অনেক ভেবেচিন্তে ফরাসি দরজির দোকানে অর্ডার দিয়ে তাঁর জন্য করানো হল অত্যাশ্চর্য এক ওরিয়েন্টাল ড্রেস। সে-ড্রেস অনভ্যস্ত বাঙালিনীর পক্ষে এমনই জটিল যে তিনি নিজে পরতে পারেননি, বাড়ির মেয়েরাও যখন সেই অদ্ভুত পোশাকে সাহায্য করতে পারল না, স্বয়ং সত্যেন হাত লাগালেন।

তখনই জ্ঞানদার মনে হয়েছিল যে, নারীমুক্তির জন্য সবার আগে দরকার বাঙালি নারীর পোশাকের সংস্কারমুক্তি। পশ্চিমি ড্রেসের দ্বারস্থ না হয়ে শাড়ি-পরার কেতাদুরস্ত ভঙ্গি খুঁজে বার করার কথা তখন থেকেই তাঁর মাথায়। ঢোকে। বোম্বাইয়ের পারশি মহিলাদের সহজ স্বচ্ছন্দ শাড়ি-পরার কেতা থেকেই তিনি পেয়ে গেলেন বাঙালিনির শাড়ির ধারণা।

ঠাকুরবাড়ির চার দেওয়ালে বন্দি মেয়েদের কাছে এখন তো তিনিই দুনিয়া দেখার জানালা। কত কী শেখার আছে, শোনার আছে তাঁর কাছে। একদিকে কর্তামার রক্তচক্ষুর ভয় আর অন্যদিকে জ্ঞানদার দুর্নিবার আকর্ষণ। গল্প করতে করতে তারা জ্ঞানদাকে তাঁর জন্য প্রস্তুত শোওয়ার ঘরের দিকে নিয়ে যায়। বই-মালিনীও তাদের সঙ্গ নিল। জ্ঞানদা নতুন বই দেখবেন।

সেদিকে তাকিয়ে সারদা বলেন, দেখ সত্যেন, তোর বাবামশায় ধর্ম। পরিবর্তন করে আমার জীবনের অর্ধেক অশান্তিতে ভরে দিয়েছেন, এখন। তুই আর স্ত্রীস্বাধীনতার ধুয়ো তুলে আমার মাথা খাস না।

ঠাকুরবাড়ি আদতে ছিল ঘোর বৈষ্ণব। লক্ষ্মীজনার্দন তাঁদের গৃহদেবতা। বাড়ির বউ-ছেলেরা বংশানুক্রমে পূজাপার্বণ পালন করে এসেছেন। দিদিশাশুড়ি অলকাসুন্দরী ও শাশুড়ি দিগম্বরীর কাছে নিষ্ঠাভরে পূজাপাঠের নিয়মকানুন শিখছিলেন সারদা। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ যখন হিন্দুয়ানির সব পৌত্তলিকতা বর্জন করে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিলেন তখন শুরু হল সারদার আত্মিক সংকট। না পারলেন স্বামীর ধর্মকে অস্বীকার করতে, না পারলেন হিন্দুয়ানির সংস্কার বর্জন করতে। অথচ এই টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত হলেন সারাজীবন। সত্যেন বুঝতে পারেন, মা সেই কথাই বলছেন। কিন্তু তিনি যেন পণ করেছেন জননীকে সংস্কারমুক্ত করার।

মা তুমি কেন বুঝতে চাও না, না পালটালে, সভ্যতা এগোয় না। তা সে ধর্মেই হোক আর সমাজজীবনে। যে দেশের মেয়েরা ঘরের চার দেওয়ালে বন্দি, সে দেশ অন্ধকারে ডুবে থাকে। আর যদি শুধু পোশাক সংস্কারের কথা বলল, সে তো বাবামশায় নিজেই বোনেদের পোশাক নিয়ে কত পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন, আজ পেশোয়াজ তো কাল দিশি গাউন। মুসলমান দরজির তৈরি সে-সব পোশাক তুমিও তো তোমার মেয়েদের পরিয়েছ।

সারদা বলেন, সে তত বাধ্য হয়ে, ঢাকা পোশাক না হলে আদুল গায়ে শাড়ি জড়িয়ে তো বাড়ির মেয়েরা বাইরের পণ্ডিতমশায়ের কাছে পড়াশোনায় বসতে পারবে না।

ঠিক সেরকম মা, ঢাকা পোশাক না পরলে তোমার মেজোবউ কী করে সমাজে মিশবে? আমাদের স্ত্রীলোকেরা যেরকম কাপড় পরে তা না পরার মতোই। ওই পোশাকে ভদ্রসমাজে যাওয়া চলে না। আমার চাকরিসূত্রে কত বড় বড় লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে ওকে। সত্যেন উৎসাহে বলেন।

সারদা মুখ গোমড়া করে বলেন, মেয়েমানুষের এত মেশামেশির দরকার কী বাপু বুঝি না। আমরা তো কোনওদিন বাড়ির বাইরে পা ফেলিনি, অনেক বলেকয়ে গঙ্গাচানে যাবার অনুমতি পেলে যেতে হয়েছে ঘেরাটোপে ঢাকা পালকি চেপে। ছোটবেলায় দু-চারবার তুই তো আমার সঙ্গে গিয়েছিস। দেখেছিস তো, বেহারারা পালকি সুষ্ঠু গঙ্গায় চুবিয়ে দিত দু-চারবার, সেই আমার গঙ্গাস্নান। আর সেই বাড়ির বউকে তুই কিনা নিয়ে এলি গাড়ি চাপিয়ে, তারপর চাকরবাকরের চোখের সামনে দিয়ে বেহায়া বেপরদা বউমানুষ হেঁটে হেঁটে বাড়িতে ঢুকল! এই অনাছিষ্টি দেখার জন্য আমি বেঁচে রইলাম কেন?

ওহ মা, আমাদের বাড়িতে মুসলমানি পরদাপ্রথা থাকারই বা কী দরকার বলো তো? আমাদের মেয়েরা আর কতকাল নবাবি কয়েদখানায় বন্দি থাকবে?

সারদা বিরক্ত হন। যা তো এখন, আমাকে আর জ্বালাস না। ঘরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে একটু কিছু মুখে দে। এত পথ পেরিয়ে যাত্রা করে এসে কোথায় মায়ের সঙ্গে দুটো ভালমন্দ কথা কইবি তা না, তর্ক জুড়েছিস। যা ঘরে যা। ও মানদা, ওদের ঘরে খাবার পাঠানো হয়েছে কি না দেখ তো।

মানদা দাসী জানায় খাবার যাচ্ছে কর্তামা। সত্যেন ঘরের দিকে পা বাড়ালে তাঁর চোগা-চাপকান পরা দীর্ঘ অবয়বের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মানদার কাছে সারদা জানতে চান, কী রে, যেভাবে বলেছি তাই পাঠানো হল?

হ্যাঁ মা, মানদা জানায়, রুপোর রেকাবিতে নারকেলের মিষ্টি, আনন্দনাড়ু, লুচি, বেগুনভাজা সাজিয়ে লেসের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে পাঠানো হয়েছে রুপোর গেলাসে বরফ দেওয়া তরমুজের শরবত।

ঈষৎ চিন্তিত মুখে রুপোর মকরমুখী পানবাটা থেকে পান মুখে দিয়ে তাকিয়ায় হেলান দেন সারদা। মানদা দাসী তার পা টিপতে থাকে।

ওদিকে সত্যেন ঘরে পৌঁছে দেখেন পালঙ্কের পাশে কাঠের ছোট জলচৌকির ওপর রুপোর রেকাবি ভরা খাবার ও শরবতের বিপুল আয়োজন। ওদিকে সামনের বারান্দায় মাদুর পেতে জ্ঞানদাকে ঘিরে জমিয়ে বসেছে মেয়ে-বউয়ের দল। থাক ওরা, একটু প্রাণ খুলে গল্পগাছা করুক। সত্যেন হাতমুখ ধুয়ে খাবারে হাত ঠেকান। তার মনে পড়ে যায় জ্ঞানদাকে এই দালান থেকে বার করতে কী বেগ পেতে হয়েছিল তাঁকে। প্রথম যেবার আই সি এস পরীক্ষা দিতে লন্ডন গেলেন, সেখানকার স্বাধীন বিদেশিনিদের দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। তার মনে হয় এই তো আদর্শ সমাজ। মেয়েরা যে এত সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরে বাইরে তাতে তো কই সংসারের ছন্দে বিন্দুমাত্র ঘা লাগছে না, বরং শিক্ষিত রুচিশীল সব কাজে পটু এই বিলিতি মেয়েরা যেন পুরুষের যোগ্য সঙ্গিনী হয়ে উঠেছে। আমাদের বাঙালি মেয়েরাই বা কেন এমন হবে না! তখন থেকেই তার মাথায় চিন্তা শুরু হল কী করে জ্ঞানদাকে বিলেতে আনা যায়। সে যখন এখানে এসে এইসব বিলিতি মেয়েদের স্বাধীনতার আনন্দ নিজের চোখে দেখবে তখন সেও নিজেকে পালটাতে চাইবে।

ইংরেজ মেয়েদের দেখে মুগ্ধ হলেও সত্যেন এক মুহূর্তের জন্যও নিজের তেরো বছর বয়সি স্ত্রীকে ভোলেননি। দাদামশায় দ্বারকানাথও লন্ডনে গিয়ে বিলিতি মেয়েদের দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। রানি ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে মিষ্টিমধুর মেলামেশায় বা টেমসের বুকে বিলাসনৌকো ভাসিয়ে মেমদের সঙ্গে নৌকোবিহারে তিনি জীবনের স্বাদ উপভোগ করেছেন। সে ছিল তার নিজের মুক্তি। ম্লেচ্ছ সংসর্গে ধর্মনাশের আশঙ্কায় স্ত্রী দিগম্বরী তাঁকে প্রায় ত্যাগ করেছিলেন। বহু ধনসম্পদ কীর্তি ও মানমর্যাদা সত্ত্বেও স্ত্রীকে তিনি নিজের মতে আনতে পারেননি। রাজকীয় মেজাজের দ্বারকানাথের বেলগাছিয়া ভিলার পার্টিতে সুরা ও মাংসের ফোয়ারা আর মেমসাহেবদের কোমর জড়িয়ে বল ডান্স নিয়ে সেকালে কেচ্ছা কেলেঙ্কারি ছড়া প্রশস্তির বন্যা বয়ে যেত। রূপচাঁদ পক্ষী মশাই ব্যঙ্গ করে ছড়া বেঁধেছিলেন,

কি মজা আছে রে লাল জলে জানেন ঠাকুর কোম্পানি
মদের গুণাগুণ আমরা কি জানি, জানেন ঠাকুর কোম্পানি।

তবু দ্বারকানাথের থেকেও সত্যেনকে মুগ্ধ করেন দিগম্বরী। জগদ্ধাত্রীর মতো রূপ ছিল তাঁর কিন্তু সত্যেন জানেন দিদিঠাকুরানির তেজও কম ছিল না। তিনি লোকের কথায় আস্থা না রেখে একদিন রাতে পার্টি চলাকালীন ঘেরাটোপের পালকি চেপে সদলবলে হানা দেন বেলগাছিয়া ভিলায়। সেদিনের এক অভিজাত পরদানশিন মহিলার পক্ষে কাজটা ছিল যথেষ্ট বেপরোয়া। অথচ শুরুতে তাদের সম্পর্কটা যথেষ্ট মধুর ছিল। তখন বৈষ্ণব দ্বারকানাথ নিজ হাতে বাড়ির লক্ষ্মী জনার্দনের পূজা করতেন আর তার যোগ্য সহধর্মিণী ছিলেন রাইকিশোরী দিগম্বরী। ধূপধুনোর আঁচে তাঁর দুধেআলতা মুখে যে অপরূপ ভক্তি ও লাবণ্য ফুটে উঠত সেদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হতেন রূপের পূজারি দ্বারকানাথ। সেসময় তারা এত গোঁড়া ছিলেন যে বাড়িতে পেঁয়াজ রসুন মাছ মাংস কিছুই ঢুকত না। ব্যাবসায় অভাবনীয় সাফল্য আসা শুরু হতে সাহেবমেমদের সঙ্গে মেলামেশার প্রয়োজন বাড়ল দ্বারকানাথের, নবযুগের চিন্তার ছোঁয়ায় আর বাবুয়ানির আকর্ষণে সেই গোঁড়া হিন্দুয়ানির প্রতি আস্থা ক্রমশ টলে গেল। বামুন পণ্ডিতেরা জানিয়ে দিলেন দ্বারকার নিজে হাতে পুজো করা আর চলবে না, সাহেবদের সংস্পর্শে তিনি অশুচি হয়েছেন। তারপর দিগম্বরী যা যা করেছেন, সবই ইতিহাস।

বিলেত যাবার আগে সত্যেন একদিন কিশোরী জ্ঞানদাকে উসকানি দেওয়ার জন্য দিগম্বরীর সেই আশ্চর্য কাণ্ডের কথা বলছিলেন, আমার দিদিঠাকরুন কী দস্যি মেয়ে ছিলেন সে তোমরা ভাবতেও পারবে না জ্ঞেনু। কিছুদিন ধরেই তার কানে আসছিল দাদামশায় নাকি ইদানীং বেলগাছিয়া ভিলায় সাহেবমেমদের সঙ্গে পানাহার করেন, মুসলমান বাবুর্চির রান্না মাংস খান। ঠানদিদি প্রথমে বিশ্বাস করেননি। শুনতে শুনতে উত্ত্যক্ত হয়ে একদিন ঠিক করলেন স্বচক্ষে দেখবেন কী হয় সেখানে। তখনকার পরদানশিন গৃহবধূর পক্ষে কী দুঃসাহসিক কাণ্ড ভাবো!

ওরে বাবা, আমার তো শুনেই বুক ঢিবঢিব করছে। জ্ঞানদা জানতে চান, ঠানদিদি একা একাই গেলেন সেখানে?

না, সঙ্গে নিলেন আমার মা আর অন্তঃপুরের দু-একজন মহিলাকে। হলুদ পাড় লাল সাটিনের ঘেরাটোপ দেওয়া ঠাকুরবাড়ির তিনটি পালকি গিয়ে থামল বেলগাছিয়া ভিলায়। মা তো তখন খুব ছোট। পরে মায়ের কাছে। শুনেছি সেদিন নাকি ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল।

তারপর কী হল? কী দেখলেন সেখানে?

পালকির ঘেরাটোপ ভেঙে বেরিয়ে যা দেখলেন তা জীবনে দেখেননি বেচারি ঠানদিদি। আলোয় আলোয় রাতকে দিন করে ফেলা হয়েছে বেলগাছিয়া ভিলায়। ফোয়ারা আর নগ্নিকা নারীমূর্তি দিয়ে সাজানো বাগান, বিশাল স্তম্ভ ও বিরাট দালানের অসাধারণ কারুকার্য ভেদ করে দিদিঠাকরুন যখন সদলবলে ঢুকে পড়লেন হলঘরে, সে এক দৃশ্য। কাঁচের গেলাসের ঠুংঠাং শব্দ, বেলোয়ারি ঝাড়ের ঝলকানি ও মহার্ঘ বিদেশি আসবাবের মাঝখানে নৃত্যরত নারীপুরুষেরা হঠাৎ থেমে গেল। ঠানদিদি দেখলেন, সত্যিই মুসলমান বাবুর্চিরা টেবিলে টেবিলে মাছ মাংসের নানা পদ পরিবেশন করছে আর সাদা সাহেবগুলো বেহায়া মেমসাহেবদের কোমর জড়িয়ে নাচছে। আর স্বয়ং দ্বারকানাথকে দেখে তার চক্ষুস্থির হয়ে গেল। একহাতে মদের গেলাস আর অন্য হাত এক গোরি মেমের কোমরে রেখে ইংরেজি গানের সঙ্গে সঙ্গে পা মিলিয়ে তিনি নাচছেন। এই অভাবনীয় দৃশ্যের সামনে স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দিদিঠাকরুনের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। বালুচরী ঘোমটার আড়াল থেকেও ঠানদিদির রণচণ্ডী মেজাজ বোধহয় টের পেলেন দাদামশায়, একমুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলেন। তারপর এগিয়ে এসে ক্রুদ্ধ পত্নীকে সামলানোর চেষ্টা করতেই তীব্র ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকে বিদ্ধ করে সদম্ভে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন দিদিঠাকরুন।

তা হলে ঠানদিদিই এই বাড়ির সবচেয়ে সাহসী স্ত্রীলোক, জ্ঞানদা বলেন, আমি তার মতো হতে চাই। তুমি একচুল বেচাল কিছু করলেই সংসর্গ ত্যাগ করব, সাবধান থেকো।

সত্যেন হেসে বলেন, আমি ভুল করলে সত্যিই কি তুমি তার মতো কঠোরহৃদয়া হতে পারবে? তিনি এরপরেও কী করেছিলেন জানো? দাদামশায় যখন নিত্যপূজার অধিকার হারালেন তখন দিদিঠাকুরানির মনে প্রশ্ন এল, স্বামী সংসর্গ করলে তিনিও কি ধর্মচ্যুত হবেন না? তখন তিনি ব্রাহ্মণদের পরামর্শ নিয়ে ঠিক করলেন স্বামীর যত্নআত্তি করবেন, তারপর স্নান করে শুদ্ধ হবেন, কিন্তু রাতে স্বামীসংসর্গ করবেন না।

ওমা সে কী গো? তোমাদের গোঁড়া সংসারে দিদিঠাকুরানি এমন কাজ করলেন কী সাহসে? জ্ঞানদা অবাক হন।

সত্যেন জ্ঞানদার মাথা নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলেন, তার যা সাহস ছিল সে তোমাদের নেই জ্ঞেনু। তিনি ক্রমশ দাদামশায়ের অন্দরে প্রবেশ বন্ধ করে দিলেন, তাঁর জন্য নির্দিষ্ট হল বৈঠকখানাঘরের একটি শয্যা। আলাদা রান্নার ব্যবস্থা হল তার জন্য। ঠানদিদি আর দাদামশায়ের সংসারের হাঁড়ি ভিন্ন হয়ে গেল।

বারো বছরের জ্ঞানদা অবাক হয়ে বলেছিলেন, এমা, স্বামীকে আলাদা করে দেওয়া কি ভাল? মেয়েমানুষের এমন অধর্মের কাজ করতে বাধল না?

দেখো জ্ঞেনু, ধর্ম অধর্মের বিচার করা বড় কঠিন, সত্যেন সেদিন বলেছিলেন, আমার দিদিঠাকুরানি ভোর চারটে থেকে পুজো শুরু করতেন। স্বপাক নিরামিষ আহার করতেন। এক বামুন ঠাকুর তার পুজোর ও রান্নার উপকরণ গুছিয়ে দিত। একাদশীতে ফলমূল খেয়ে কাটাতেন, উপোসও করতেন কোনও কোনও একাদশীতে। তাঁর সাত্ত্বিক জীবনের সঙ্গে দাদামশায়ের ভূমিকা মেলাতে পারেননি বলেই স্বামীসহবাসের সুখ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। স্বামীর চেয়েও তার কাছে বড় ছিল ধর্ম।

সধবার আবার একাদশী কী? জ্ঞানদা আরও অবাক হয়ে সেদিন বলেছিলেন।

 শুনেছি দিদিঠাকরুন বিশ্বাস করতেন তার উপোসে স্বামীর অমঙ্গলের চেয়ে মঙ্গলই বেশি হবে, কারণ স্বামীর কল্যাণের জন্যই তো তার ব্রতপালন। সেই অনুরক্ত পত্নী কেন এত কঠোর হয়ে উঠলেন সেটাও তো ভেবে দেখতে হবে জ্ঞানদা।

এ-সব পুরনো কথা ভাবতে ভাবতেই ক্লান্তিতে একটু চোখ বুজে এসেছিল সত্যেনের। ঘুমের চটকা ভাঙল জ্ঞানদার কোমল করম্পর্শে। অন্য মেয়েরা কখন চলে গেছে। স্নান সেরে মিহি তাঁতের নীলাম্বরী শাড়ি পরেছেন জ্ঞানদা। খোঁপার বকুলফুলের মালা থেকে আসা গন্ধ সদ্য প্রবাসফেরত সত্যেনকে যেন বাংলামাটির পক্ষ নিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে। ঘরের নিভৃতে আর জ্যাকেট গায়ে দেননি জ্ঞানদা, কিন্তু আদুল গায়েও তিনি আর থাকতে পারেন না। তাতে নিজেকে কেমন গ্রামীণ মনে হয়। পাতলা মলমলের সেমিজের ওপর তিনি সুন্দর পরিপাটি করে শাড়ি জড়িয়েছেন। সামান্য আতর তার সাজকে আরও মোহময় করেছে। যাকে তিনি এই প্রাসাদের চৌহদ্দি থেকে বার করে বোম্বাই নিয়ে গিয়েছিলেন এ মেয়ে সে মেয়ে নয়। জ্ঞানদার কোমর জড়িয়ে ধরে সত্যেন বলেন, মনে পড়ে জ্ঞেনু, বোম্বাইতে আমাদের সেই প্রথম ডিনার পার্টিতে তুমি কী করেছিলে?

আহা, তখন আমি সবে চৌকাঠ পেরোনো চোদ্দো বছরের এক বাঙালি বউ, আমি কী করে গোরা সাহেবদের কায়দাকানুন বুঝব? আমি প্রথম থেকেই ঠিক করেছিলুম টেবিলে খাবার দাবার সব সাজিয়ে দেব অতিথিদের জন্য, কিন্তু আমি টেবিলে বসব না। ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে একসঙ্গে খানাপিনার কথা ভাবতেই পারিনি। আর সেই গোরা সাহেবটা যেই আমার হাত তার হাতের মধ্যে নিয়ে টেবিলের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইল, আমি ভাবলাম এ কী অসভ্য লোক রে বাবা! হাত ছাড়িয়ে দিলেম ছুট।

তারপর সেই বন্ধ দরোজা খোলানোর জন্য আমাকে কম সাধ্যসাধনা করতে হয়নি! সত্যেন হা হা করে হেসে ওঠেন, সেদিনের জন্য আমি তোমাকে দোষ দিই না, কিন্তু পরে তুমি যে ক্রমশ আদবকায়দা শিখে নিয়ে প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ানের যোগ্য স্ত্রী হয়ে উঠেছ সেজন্য আমার গর্ব হয়।

সেদিনের সেই লজ্জাবতী ভীরু বালিকার মধ্যে এখন সত্যেন উদিত সূর্যের মতো এক নতুন নারীকে আবিষ্কার করেন। প্রবল আশ্লেষে ষোড়শী পত্নী জ্ঞানদাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করেন তিনি।

আঃ, ছাড়ো না, তুমি কি ছেলেমানুষ হয়ে গেলে? জানলা দরোজা সব খোলা, এখনই যে কেউ এসে পড়বে, জ্ঞানদা লজ্জা পান।

সত্যেন বলেন, কী বলেছিলাম মনে নেই বউ?

 কত কী বলেছ, কোন কথাটা বলছ কী করে বুঝব এখন? জ্ঞানদা কটাক্ষ করেন।

সেই যে বিলেত থেকে চিঠিতে লিখেছিলাম, তুমি যে পর্যন্ত বয়স্ক, শিক্ষিত ও সকল বিষয়ে উন্নত না হইবে, সে পর্যন্ত আমরা স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধে প্রবেশ করিব না।

জ্ঞানদার মনে পড়ে, সেই রাতের পর রাত জোড়াসাঁকো বাড়ির ছাতে নিরালা জ্যোৎস্নায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তিনি স্বামীর এইসব কথার মানে খুঁজেছেন। বালিকার মনে অজানা ভয়, স্বামী কেন তাকে পুরোপুরি গ্রহণ করছেন না! কেন শুধু ওপর ওপর আদর করে দূরে সরে যান? কেন লেখেন, আমরা স্বাধীনতাপূর্বক বিবাহ করিতে পারি নাই। আমাদের পিতামাতারা বিবাহ দিয়াছিলেন। তবে কি এখন সেই পরমলগ্ন এসেছে?

জ্ঞানদা নববধূর মতো রাঙা হয়ে ওঠেন। বলেন, সে-কথা এখন কেন?

বউ, এখনই তো সময় সে-কথা বলার। সত্যেনের গলা আবেগে কেঁপে ওঠে, এই সেই দাম্পত্যের নির্জন ঘর, এই সেই পুরাতন প্রণয়প্রার্থী, এই সেই স্থগিত ফুলশয্যার পালঙ্ক। আজ আর তুমি নিছক গৃহবধূ নও। হে স্বাধীনা, আজ আমি মিলনপ্রার্থী, আমার আবেদন কি মঞ্জুর করবেন দেবী?

এই অভাবিত মুহূর্তে কী করবেন ভেবে না পেয়ে জ্ঞানদা সত্যেনের বুকে ঢলে পড়ে বলেন, যাও আর নাটক করতে হবে না।

সত্যেন তীব্র কামনায় তার কোমর জড়িয়ে ধরেন। লজ্জানত মুখ তুলে ঠোঁটে প্রগাঢ় চুম্বন করেন। বহু প্রতীক্ষিত সেই মুহূর্তে দুজনের থরোথরো শরীর তীব্র আবেগে দলিত মথিত ঘর্ষিত হতে থাকে। গরম বোধ করায় সত্যেন গায়ের ফতুয়া খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে দেন। জ্ঞানদার শাড়ি ধুলোয় লুটোয়। সত্যেনের অধীর আঙুলগুলি যেন নীড় খুঁজে পায় সেমিজ ঢাকা জ্ঞানদার উদ্ভিন্ন স্তনে। তখন দুজনের শরীরের মাঝখানে একটি সুতোর ব্যবধানও যেন বাহুল্য মনে হয়।

সত্যেন বলে ওঠেন, বউ তোমার এই সেমিজ বস্তুটি বিবাহিতাদের পক্ষে খুব সুবিধের হবে না। এ নিয়ে তোমাকে একটু ভাবনাচিন্তা করতে হবে মনে হচ্ছে।

সত্যেনের দুষ্টবুদ্ধিতে ছদ্মরোষে ঘুষি দেখান জ্ঞানদা। সত্যেন তা দেখে বলেন, সেকী বউ, স্বাধীন হয়ে প্রথমেই স্বামীপ্রহার করবে নাকি? গোঁড়া হিন্দুরা তো সে ভয়েই স্ত্রীলোকদের চারদেয়ালে বন্দি করে রাখে!

এবার দেখো না কী করি তোমায়, বলে অনেকটা ধাতস্থ জ্ঞানদা হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে সত্যেনের দিকে এগিয়ে এসে তার পুরুষালি ঠোঁটের ওপর নিজের কোমল ঠোঁটজোড়া স্থাপন করেন।

বুঝলেন স্বামী, এই শুরু হল স্বাধীনা নারীর স্বাধীন অভিসার। দীর্ঘ চুম্বনের পর ঠোঁট তুলে ঘোষণা করেন জ্ঞানদা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *