সবুজ বনের ভয়ংকর

সবুজ বনের ভয়ংকর

কথা বলা বন

মার্চের এক রবিবারের সকালে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ফ্ল্যাটে অভ্যাসমতো আড্ডা দিতে গিয়ে দেখি, বৃদ্ধ ঘুঘুমশাই অফিসের বড়কর্তার মতো একটা ফাইল খুলে গোমড়ামুখে বসে আছেন। কাছাকাছি বসে ফাইলের বিষয়বস্তু আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছু ঠাহর করা গেল না। আমার উপস্থিতিও যেন উনি টের পেলেন না।

একটু পরে ওঁর মুখ দিয়ে কী একটা কথা বেরুল। মনে হল বঙ্গভঙ্গ কিংবা এরকম কিছু। কথাটা উনি বিড়বিড় করে আওড়াতে শুরু করলে আর চুপ করে থাকা গেল না। বললাম, বঙ্গভঙ্গ ততো ১৯৪৭ সালে হয়ে গেছে। এতকাল বাদে ও নিয়ে দুঃখ করার কী আছে?

কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন এবার। ও তুমি এসে গেছ দেখছি ডার্লিং। তোমার কথাই ভাবছিলাম। একটু অপেক্ষা করো। কিছুক্ষণের মধ্যে এক ভদ্রলোক আসবেন এবং তোমার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য কিছু মালমশলা তার কাছে পেয়ে যাবে।

একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, আজ আমার ছুটির দিন। খবরের কাগজের জন্য আজ আমার এতটুকু মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আপনি হঠাৎ বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বিড়বিড় করে মরাকান্নার মতো শোকপ্রকাশ করছিলেন কেন?

বঙ্গভঙ্গ? কর্নেল ভুরু কুঁচকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর জোরে হেসে বললেন, না জয়ন্ত। রঙ্গো রঙ্গে। কোহাও রঙ্গে রঙ্গো।

তার মানে?

স্পিকিং উডস। কথা বলা বন। প্রশান্ত মহাসাগরের পলিনেশীয় এলাকার ছোট্ট দ্বীপ ইস্টার আইল্যান্ডের লুপ্ত ভাষায় কোহাও রঙ্গো রঙ্গো মানে যে বন কথা বলতে পারত।

এই সময় ষষ্ঠীচরণ এসে খবর দিল, এক সায়েব এসেছেন। তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা করে নিয়ে এলেন কর্নেল। তারপর পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার সঙ্গে। সায়েবের নাম কাপ্তেন জর্জ ব্যুগেনভিলি। সওদাগরী জাহাজে সারা পৃথিবী চক্কর মেরেছেন। নামটা শুনে বললাম, আপনার নামের সঙ্গে কি বুগানভিলিয়া ফুলের কোনও সম্পর্ক আছে?

সায়েব আমুদে স্বভাবের মানুষ। গড়ন প্রকাণ্ড কুমড়োর মতো। উঁড়ি দুলিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, আলবৎ আছে। বুগানভিলিয়া ফুল আসলে পলিনেশীয়। ১৭৬৮ সালে আমার মতো এক কাপ্তেন আঁতোয়াঁ দ্য বুগেভিলি ওই এলাকার একটা দ্বীপে এ ফুল আবিষ্কার করেন। ইউরোপে নিয়ে যান। তার নামেই ফুলের নাম চালু হয়।

কর্নেল যোগান দিলেন, উষ্ণ নিরক্ষরেখা অঞ্চলের উদ্ভিদ। নিস্টাজিনিসিয়া গোত্রের প্রজাতি।

মুচকি হেসে বললাম, কির্নেল, আপনার কোহাও রঙ্গো রঙ্গোর সঙ্গে বুগানভিলিয়া ফুল এবং মাননীয় অতিথি কাপ্তেন সায়েবের নামের এই যোগাযোগ সম্ভবত আকস্মিক নয়। তাই না?

কর্নেল সেই ফাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। কাপ্তেন ঝুগেনভিলি সেটার দিকে চোখ। বুলিয়ে বললেন, রাতারাতি জেরক্স কপি তৈরি দেখছি! কর্নেল, আপনার এই উৎসাহ দেখে আমার আশা হচ্ছে, এতদিনে কিওটা দ্বীপের বৃক্ষরহস্য ফাঁস করাটা আর কঠিন হবে না।

ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি রেখে গেল। ওঁরা কফি খেতে খেতে কথা বলছিলেন। আমি ফাইলে চোখ রাখলাম। তারপর যত পাতা ওল্টাই, তত চমক জাগে। একি সত্যি, না নিছক গালগল্প?

…তিন বছর আগে তাহিতি থেকে অস্ট্রেলিয়া হয়ে ফেরার সময় ইচ্ছা ছিল কিওটা দ্বীপ সম্পর্কে খোঁজখবর নেব। কিন্তু কোকোস দ্বীপপুঞ্জ এলাকা যেন গোলকধাঁধা। তার ওপর উল্টো বাতাস। এগোনো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। এ দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান ভারত মহাসাগরে। অক্ষাংশ ২০ ডিগ্রি, দ্রাঘিমাংশ ৮০ ডিগ্রি। পঞ্চাশ নটিকাল মাইল দূরত্বে পৌঁছতেই হঠাৎ প্রবল দক্ষিণগামী বাতাস আমার জাহাজ এনডেভার কে ঠেলে দিল বিপরীত পথে। চাগোস দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখান থেকে মরিশাস হয়ে কেপটাউন। তারপর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলাম। লন্ডনে পৌঁছে কিছুকাল মিউজিয়াম এবং লাইব্রেরি ছুঁড়ে কিওটা দ্বীপের রহস্য নিয়ে মাথা ঘামালাম…

সিঙ্গি ট্রিজ! সঙ্গীতকারী বৃক্ষ! কী অদ্ভুত কথা! অসংখ্য নাবিক এই উদ্ভট গল্পে বিশ্বাস করে। নিশ্চয় কানের ভুল। গাছপালার ফাঁক দিয়ে বাতাস বইলে অনেক সময় গানের সুর বলে ভুল হতে পারে। কিন্তু ঐতিহাসিক দলিলপত্রে দেখলাম, কিওটার গাছগুলো নাকি কথাও বলতে পারে।

আমার এবারকার অভিযান আন্টার্কটিকায়। নাবিকদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাগোেস থেকে দক্ষিণে। না এগিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে কোকোসের দিকে এগিয়েছিলাম। কাল সন্ধ্যায় কিওটার একমাইল দূরে নোঙ্গর বেঁধেছি আমার রেজিলিউশান জাহাজকে। ২৪ নভেম্বর কেপটাউন ছেড়েছি। আজ ১২ ডিসেম্বর। আবহাওয়া চমৎকার নাতিশীতোষ্ণ এখানে। সকালে একটা বোট নিয়ে তিনজন দ্বীপের দিকে এগিয়ে গেলাম। চমৎকার বেলাভূমি। ডাঙায় পৌঁছেই আমার যা অভ্যাস—বক ছুড়লাম একবার। তারপর ইউনিয়ন জ্যাক পুঁতে দিলাম। সমুদ্রপাখিরা কলরব করে উড়ে গেল। নিশ্চয় দ্বীপটাতে মানুষ বাস করে না। তাহলে বন্দুকের শব্দ শুনে তারা ছুটে এসে ভিড় করত। ডাক্তার স্মিথকে বললাম, চলুন তা হলে। ডাঃ স্মিথ কান খাড়া করে কী শুনছিলেন। বললেন, কে যেন চিৎকার করে কিছু বলল। হাসতে হাসতে উঁচু জায়গাটাতে উঠে গেলাম। আমার পেছনে ডাঃ স্মিথ আর দুজন সশস্ত্র নাবিক। সামনে ঘন জঙ্গল। বিশাল উঁচু সব অপরিচিত গাছ। স্বীকার করছি, গাছগুলো দেখে কেমন গা ছমছম করছিল। যেন তারা প্রাণীর মতো সচেতন এবং আমাদের নিঃশব্দে লক্ষ্য করছে। সেই গাছপালার ভেতর দিয়ে কয়েক পা এগিয়েছি, ঠিক যেন বাতাসের শব্দে শনশন করে কোথায় একদল মানুষ ইংরেজি ভাষায় গর্জন করে উঠল স্টপ ইট!… স্টপ ইট।

নিশ্চয় কানের ভুল। তারপর আর কোনও ভূতুড়ে আওয়াজ আমি শুনিনি। কিন্তু নাবিকরা আর এক পা বাড়াতে রাজি নয়। তারা আমাকে অগ্রাহ্য করে বোটে গিয়ে বসে রইল। ডাঃ স্মিথ আর আমি সতর্কভাবে ছোট্ট দ্বীপটা দুপুর পর্যন্ত ঘুরলাম। জনপ্রাণীটি নেই। ফেরার সময় ডাঃ স্মিথ বললেন, একবার যেন কাদের অস্পষ্ট ফিসফিস কথাবার্তা শুনেছেন। ভদ্রলোক বড় কল্পনাপ্রবণ।…

এখন রাত দশটা। রেজিলিউশন দক্ষিণ মহসাগরে ভেসে চলেছে আন্টার্কটিকার দিকে। কিওটা দ্বীপের ব্যাপারটা গাছপালার মর্মরধ্বনি ছাড়া আর কিছু নয়। আমার ধারণা, স্টপ ইট কথাটা কানের ভুল, সম্ভবত কাঠঠোকরা জাতীয় পাখি শুকনো কাঠে ঠোকরাচ্ছিল এবং তা থেকেই ওই আওয়াজ। বিদ্রোহী নাবিক দুজনকে শাস্তি দিয়েছি। পাঁচ ঘা বেত এবং ২৪ ঘন্টা অনাহারের শাস্তি। ডাঃ স্মিথ একটু আগে বলে গেলেন, ওদের গায়ে নাকি সবুজ রঙের অদ্ভুত অ্যালার্জি বেরিয়েছে। সবকাজেই ওঁর বাড়াবাড়ি।–ক্যাপ্টেন টমাস কুকের লগবুক। 12. 12. 1772

***

কীলিং (Keeling) দ্বীপপুঞ্জে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর ফসিল খুঁজতে যাওয়ার সময় দ্বীপের এক বৃদ্ধ আমাকে কিওটা নামে অদ্ভুত একটা দ্বীপের কথা বলে। সেটা নাকি মাইল ষাটেক দক্ষিণে। সেই দ্বীপের গাছগুলো নাকি কথা বলে। অবান্তর ব্যাপার। সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বিগল জাহাজের ক্যাপ্টেন রবার্ট ফিরয় বদরাগী মানুষ। এমনিতেই আমার কাণ্ডকারখানা দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে আছেন। তাকে যদি বা রাজি করাতে পারি, নাবিকদের পারব না। কিওটার কথা শুনেই তারা বলেছে, ওই ভূতের দ্বীপ অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত তাই কিওটা যাওয়া হল না। মনে ক্ষোভ রয়ে গেল।

— চার্লস ডারউইন, এইচ এম এস বিগল 23, 2, 1835

***

উদ্ধারপ্রাপ্ত নাবিকের নাম জন হিক্স। তাকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে ভারত মহাসাগরে জাহাজ ড়ুবি হয়ে একটা দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে গাছপালা কথা বলে। তাকে খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল একটা গাছ। হিক্সের বিবৃতির সময় প্রখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড হোম উপস্থিত ছিলেন। তিনি কোনও মন্তব্য করেননি। হিক্স আরও একটা অদ্ভুত কথা বলে। একটা গাছের সঙ্গে তার নাকি বিয়েও হয়েছিল। ডাক্তারদের মতে লোকটি উন্মাদ রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তবে ব্রিটিশ জাদুঘরের কিউরেটারে ডঃ ফক্স বলেছেন, খ্রিস্টপূর্ব একহাজার অব্দে ফিনিসীয় নাবিকদের প্যাপিরাসে লেখা যে লগবুক আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে গর্জনকারী গাছের কথা আছে। কোনও সমুদ্রে একটি দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা সেই ভৌতিক গর্জন শুনতে পেত। তাই দ্বীপে নামার সাহস পেত না। ডঃ ফক্স আরও বলেছেন, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে লেখা গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস সঙ্গীতকারী বৃক্ষের কথা বলেছেন। চৌদ্দ শতকে বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো লিখেছেন, ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গভীর রাত্রে তারা সেখানে কোলাহল শুনতে পান। জাহাজ দ্বীপের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সারারাত আশ্চর্য সব শব্দ শোনেন। সকালে পোললা বোটে করে দ্বীপটিতে পৌঁছন। কিন্তু আর একপা এগোতে পারেননি। প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয় এবং হাজার হাজার মানুষ যেন তাঁকে গর্জন করে এগোতে নিষেধ করে। পোললা লিখেছেন, গাছগুলো থেকেই ওই গর্জন ভেসে আসছিল। বোটে ফিরে গেলে, আশ্চর্য ব্যাপার ঝড়টা তক্ষুনি থেমে যায়।…

—দি ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড, লন্ডন 7.9. 1981

***

…কোহাও রঙ্গে রঙ্গো। কথা বলা বন। প্রশান্ত মহাসাগরের পলিনেশীয় এলাকার ছোট্ট দ্বীপ ইস্টার আইল্যান্ডে বিশপ জোসেন নামে এক খ্রিস্টীয় যাজক গত শতকে একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন। তাঁর লিপির সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার লিপির আশ্চর্য মিল। মেতেরো নামে তার স্থানীয় এক ভৃত্য পুঁথিটি পড়ে অনুবাদ করে দেয়। এই পুঁথির নাম কোহাও রঙ্গে রঙ্গো। এটি ইস্টার দ্বীপের আদিম অধিবাসীদের ধর্মীয় পুরাণ। এতে আছে এক অদ্ভুত বনের কাহিনী—যার গাছগুলো কথা বলতে পারত। তাদের উপাস্য দেবতার নাম ছিল রাঙ্গেতিয়া। তিনি আকাশের দেবতা। তার আশীর্বাদে গাছপালা কথা বলত মানুষের ভাষায়। বিশপ জোসেনের ধারণা, সেই কথা বলা বন বহু বছর আগে নির্মূল হয়ে গেছে কোনো কারণে।

-ইস্টার আইল্যান্ডের রহস্য : ই ডলফার, পৃষ্ঠা 5

প্যারিস ২০ জানুয়ারি—সম্প্রতি প্রখ্যাত অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন জর্জ ব্যুগেনভিলি তার সপ্তদশ নৌ অভিযানে আন্টার্কটিকা যাওয়ার সময় ঝড়ের মুখে পড়েন। জাহাজ ড়ুবে যায়। লাইফবোটের সাহায্যে ভাসতে ভাসতে সাত দিন পরে কোকোস দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপে ওঠেন। ক্যাপ্টেন ব্যুগেনভিলি জনহীন দ্বীপ থেকে গাছ কেটে ভেলা তৈরি করে সমুদ্র পাড়ি দেন। একমাস পরে কীলার দ্বীপে পৌঁছন। তিনি সেই নির্জন দ্বীপ সম্পর্কে এক অদ্ভুত বিবরণ দিয়েছেন। সেখানে নাকি গাছপালা মানুষের মতো কথা বলতে পারে।…

–রয়টার

ফাইল থেকে মুখ তুলে জর্জ ব্যুগেনভিলির দিকে তাকালাম। সায়েব মিটিমিটি হাসছিলেন।

.

উদ্ভিদের গোপনকথা

আমার বৃদ্ধ বন্ধুকে ইদানীং ক্যাকটাস এবং অর্কিড-জাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে কী সব বিদঘুটে ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেখতাম। একদিন গিয়ে দেখি, হেড-ফোন মাথায় এঁটে বসে আছেন এবং একটা অ্যামপ্লিফায়ার যন্ত্রের নব ঘোরাচ্ছেন। একটা অদ্ভুত আকৃতির নধর ক্যাকটাসের গায়ে পিন ফুটিয়ে রেখেছেন। পিনের মাথায় সূক্ষ্ম তামার তার বাঁধা। তারটা আরও একটা ক্ষুদে যন্ত্রের ভেতর দিয়ে এসে অ্যামপ্লিফায়ারে পৌঁছেছে। ক্ষুদে যন্ত্রটা জারে তরলপদার্থের ওপর ভাসছে। তারপর অবাক হয়ে দেখি, উনি চোখ বুজে থিরথির করে কাঁপতে লাগলেন। অমনি ভাবলাম, এই রে! বুড়ো নির্ঘাৎ তড়িতাহত হয়ে পড়েছেন।

যেই না মনে হওয়া, দৌড়ে গিয়ে মেন সুইচ অফ করে দিলাম। হাঁফাতে হাঁফাতে ফিরে এসে রুদ্ধশ্বাসে বললাম, কর্নেল! কর্নেল! আপনি সুস্থ তো?

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার গর্জন করে উঠলেন, শাট আপ ইউ ফুল!

কস্মিনকালে ওঁর কাছে এমন ধমক খাইনি। আমি তো থ! একটু পরে অভিমান দেখিয়ে বললাম, বা! এই আপনার কৃতজ্ঞতাবোধের নমুনা! ইলেকট্রিক শক খেয়ে থিরথির করে কঁপছিলেন। এতক্ষণে অক্কা পেয়ে যেতেন। বাঁচিয়ে দেওয়াটা বুঝি অন্যায় হল? ঠিক আছে এবার খাবি খেতে দেখলেও মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব-তবে না আমার নাম জয়ন্ত!

কর্নেল তখন ফিক করে হেসে ফেললেন। উত্তেজিত হয়ো না ডার্লিং! তোমার কোনও দোষ নেই। ষষ্ঠীচরণ! ও ষষ্ঠি! ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ পর্দা তুলে মুখ বের করলে বললেন, মেন সুইচটা অন করে দাও। আর শোনো, ঝটপট আমার তরুণ বন্ধুর জন্যে কড়া করে কফি বানাও।আমিও খাব।

শান্ত হয়ে বসলে বললেন, জয়ন্ত! ওই মেক্সিকান ক্যাকটাসের সঙ্গে আমি একটু বাতচিত করছিলাম।

অবাক হয়ে বললাম, বলেন কী!

হ্যাঁ ডার্লিং! আচার্য জগদীশ বোসের যুগান্তকারী আবিষ্কারের পর অনেকগুলো দশক কেটে গেল। এখন বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, উদ্ভিদের শুধু সুখদুঃখের অনুভুতি নয়, সাড়া দেওয়ার শক্তি আছে। সেই সাড়া দেওয়াটাকেই বলব উদ্ভিদের ভাষা। ভাষাটা কিন্তু শব্দ দিয়ে নয়, কম্পন দিয়ে তৈরি। বিভিন্ন স্তরে সূক্ষ্ম-অতিসূক্ষ্ম কম্পনে তার কথা প্রকাশ পায়। এই ক্যাকটাসটা সবে কথা বলতে শুরু করেছিল এবং আমিও তার ভাষায় জবাব দিচ্ছিলাম—হঠাৎ তুমি এসে সবটাই ভেস্তে দিলে।

হাসতে হাসতে বললাম, আপনাকে হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কঁপতে দেখছিলাম। কী আশ্চর্য! ওভাবেই বুঝি গাছপালার সঙ্গে কথা বলতে হয়?

কর্নেল জারে ভাসমান ক্ষুদে যন্ত্রটা দেখিয়ে বললেন এটা একটা গ্যালভানোমিটার। তুমি লাই-ডিটেক্টর যন্ত্রের কথা জানো—যা অপরাধী সত্য বলছে, না মিথ্যে বলছে, ধরিয়ে দিতে পারে। এটা তারই একটা অংশ। এর ভেতর একটুকরো গ্র্যাফ-পেপার আছে এবং একটা সূক্ষ্ম পেন্সিলের শিস আছে। গত শতকের শেষভাগে ভিয়েনার এক ধমর্যাজক ফাদার ম্যাক্সিলিয়ান হেল এর উদ্ভাবক। পরে ইতালীয় বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানি প্রাণীজ বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে যন্ত্রটা আরও উন্নত করেন। তাঁর নামে যন্ত্রটার নাম দেওয়া হয় গ্যালভানোমিটার। আরও পরে ইংরেজ বিজ্ঞানী স্যার চার্লস হুইটস্টোনের আবিষ্কৃত বিদ্যুৎ সার্কিট হুইটস্টোন ব্রিজ পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়েছে। তবে…?

বাধা দিয়ে বললাম, কিচ্ছু বুঝব না। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম না।

তা হলে গাছের পাতা নিয়ে ব্যাকস্টার নামে এক বিজ্ঞানীর পরীক্ষার কথা শোনো! তিনি অসংখ্য পরীক্ষার পর বলেছিলেন, উদ্ভিদেরা চক্ষু ছাড়াই দেখতে পায়—মানুষ যতটা দেখতে পায়, তারও বেশি। উদ্ভিদের যেন মন আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, সে এই বিশাল প্রাণীজগতের অন্যতম শরিক এবং সে সব প্রাণীর মনের কথা টের পায়।

সেই ব্যাকস্টার সায়েব বলেছেন এ কথা? আমি হাঁদারামের মতো তাকিয়ে বললাম। সর্বনাশ! যখন আপনার বাসায় আসি, ওইসব বিদঘুটে গড়নের উদ্ভিদগুলোকে দেখে মনে মনে কত হাসি এমনকী, একদিন আপনার পরীক্ষিত ওই অষ্টাবক্র ক্ষুদে উদ্ভিদটিকে দেখিয়ে যেদিন ষষ্ঠীচরণকে বলছিলাম, ব্যাটা যেন সার্কাসের ক্লাউন! ওরে বাবা! তা হলে তো ও বেজায় রাগ করছিল আমায় ওপর!

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, এই যে এখন তুমি এসেছ এবং তার কথাবার্তায় বাধা দিয়েছ, এতে ও কি ক্রুদ্ধ না হয়ে পারে?

কাছে গেলে প্যাঁক করে কাটা ফুটিয়ে দেবে বুঝি?

তা হয়তো দেবে না। কিন্তু তুমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রোড থেকে বিকিরণ বেড়ে গিয়েছিল এবং গ্যালভানোমিটার কাপছিল। একমিনিট। গ্রাফটা বের করি।

কর্নেল ক্ষুদে যন্ত্র থেকে একটুকরো কাজ বের করে দেখালেন। অসংখ্য আঁকাবাঁকা রেখা জটিল হয়ে আছে দেখলাম। বললাম, এই বুঝি ওর রাগের ভাষা?

কর্নেল আমার তামাশায় কান না দিয়ে বললেন, এই কাগজটার নাম পলিগ্রাফ। বিখ্যাত ব্যাকিস্টার এক্সপেরিমেন্টের সূত্র ধরে আমি এই জটিল রেখাগুলোকে বিশ্লেষণ করতে পারি। এগুলো কোড ল্যাঙ্গেয়েজ অর্থাৎ সাংকেতিক ভাষা। কোডগুলোকে শ্ৰেণীবদ্ধ করে অর্থোদ্ধার করা সম্ভব। যাই হোক, আপাতত কফি খাও। তারপর দুই বিজ্ঞানী স্যাক্স রোমার এবং বুলওয়ার লিটনের পরীক্ষার গল্প বলব। সে আরও বিচিত্র ঘটনা। তারা আমেরিকার নিউ জার্সিতে একটা কারখানার কাছে খুন হওয়া একটি মেয়ের খুনিকে ধরিয়ে দিতে পেরেছিলেন!

আপনার মতো তারা শখের গোয়েন্দাও ছিলেন বুঝি?

না, জয়ন্ত। ওঁরা নিছক বিজ্ঞানী। পদার্থ এবং জীববিদ্যার চর্চা করতেন। যেখানে মেয়েটি খুন হয়েছিল সেখানে ছিল একটা বুনো আপেল গাছ। গাছটাই ধরিয়ে দিয়েছিল খুনিকে।

চেঁচিয়ে বলেছিল পাকড়ো! পাকড়ো!

তামাশা নয়, ডার্লিং! এটা বাস্তব ঘটনা। একটুকরো পলিগ্রাফ আর একটা গ্যালভানোমিটার, একটা ইলেকট্রোড—ব্যস! এ তিনটি জিনিস গাছটার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে লোক জড়ো করা হয়েছিল গাছটার সামনে। একবার করে পাতা ছুঁয়ে যেতে বলা হয়েছিল প্রত্যেককে। তারপর দেখা গেল, একজনের ছোঁয়ার পর পলিগ্রাফে গাছটা তীব্রভাবে সাড়া দিয়েছে। কম্পনরেখা বিশ্লেষণ করে বোঝা গেল, সেই লোকটাই খুনি।

সেদিন কর্নেল সারাবেলা এইসব উদ্ভুট্টে কথাবর্তা বলেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, জয়ন্ত, তুমি ই এস পি কথাটা কি শুনেছ?

শুনেছি। এক্সট্রা সেনসরি পার্সেপসন। অর্থাৎ অতিরিন্দ্রিয় অনুভূতি।

উদ্ভিদের মধ্যে ই এস পি অধুনা সুপ্রমাণিত। তারা এমন জিনিস দেখতে পায় এবং বুঝতে বা জানতে পারে—যা আমরা দেখতে পাই না ও জানি না। ডার্লিং! আচার্য জগদীশ বসু যেখানে শুরু করেছিলেন, সেখান থেকে একালের সব উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর হাতেখড়ি। তোমার এত বেশি অবাক হওয়ার কারণ নেই। তামাশা করাও শোভা পায় না। আচার্য জগদীশচন্দ্র এই কলকাতারই মানুষ ছিলেন। তুমি কি তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা শোনোনি?

এই সব শোনার পর থেকে কর্নেলের বাসায় যখনই গেছি, ওঁর লালিত-পালিত উদ্ভিদ মশাইদের প্রতি সসম্ভ্রমে দৃষ্টিপাত করেছি। এমনকী একটা ক্যাকটাসকেও বলেছি, হ্যাল্লো, লিটলবয়! হাউ ড়ু ইউ ড়ু!

কর্নেলের সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎ চোখ গেছে ড্রয়িং রুমের কোনায় রাখা কয়েকটা টবের গাছের দিকে। অমনি বুকটা ধড়াস করে উঠেছে, যেন ক্যাটক্যাট করে তাকিয়ে আমাকে দেখছে –

মনের ভেতর কী যেন পেঁচানো মতলব পোষা!

স্বীকার করছি, গাছপালা অর্থাৎ উদ্ভিদ সম্পর্কে বুড়ো ভদ্রলোকটি আমার দৃষ্টিভঙ্গি আমূল বদলে দিয়েছিলেন যেন। রাস্তায় যেতে যেতে গাড়ি থামিয়ে কোনও বিশাল গাছের দিকে তাকিয়ে থেকেছি অবাক চোখে। তারপর মনে মনে বলেছি, হ্যাল্লো জেন্টলম্যান! ভাল আছেন তো? যেন মনে হত, বৃক্ষভদ্রলোক একটু করুণ হেসে বলছেন, খুব ভাল নয় মশাই! সি এম ডি এর হালচাল দেখে বড় তটস্থ আছি। কিছু বলা যায় না।

ঠিক এমনি করে চৌরঙ্গীতে টাটা বিল্ডিংয়ের সামনে একটা সুন্দর নাদুসনুদুস গড়নের বৃক্ষভদ্রলোক আমাকে ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন, দিনকাল ভাল না। আজ আছি, কাল নেই অবস্থা।

সে কী! কেন বলুন তো?

ওরা আসছে। পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। হাতে হাতে কুড়ুল। পেছনে পেল্লায় আর্থ এক্সক্যাভেটার গাড়ি!

কারা? কারা?

আবার কারা? পাতাল রেলের লোকেরা। আপনাদের মানুষ জাতটার ঠেলায় আমরা মশাই চিরকাল অস্থির। কোণঠাসা করতে করতে আমাদের শেষ করে ফেললেন প্রায়। বুঝবেন শেষে ঠ্যালাটা—যখন দেশটা মরুভূমি হয়ে যাবে।

সেই রবিবার কর্নেলের ঘরে জর্জ ব্যুগেনভিলির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর এই সব কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। কোকোস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত কিওটা দ্বীপের উদ্ভিদরহস্য আমাকে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিল। কোহাও রঙ্গে রঙ্গো—কথা বলা বন তা হলে সত্যি আছে পৃথিবীতে?

তা হলে সেখানে যেতে এতদিন বাধা কী ছিল বিজ্ঞানীদের? দ্বীপটা যখন সবাই চেনে তখন যায়নি কেন কেউ? আমার এসব প্রশ্ন শুনে ব্যুগেনভিলি বলেছিলেন, সমস্যা হল দ্বীপটা ঠিক কোথায় কেউ জানে না। কোকোস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত দ্বীপ বলা হয় বটে, কিন্তু যতবারই ওখানে

অভিযাত্রীদল গেছে, দুই দ্বীপপুঞ্জে তেমন কোনও অদ্ভুত দ্বীপ দেখতে পায়নি।

কিন্তু আপনি গিয়েছিলেন!

হ্যাঁ। কিন্তু সে তো ভাসতে ভাসতে দৈবাৎ গিয়ে পড়েছিলাম। উদ্ধার পাওয়ার পর জাহাজ নিয়ে গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে সেটাকে আর আবিষ্কার করতে পারিনি। এটাই আসল রহস্য।

তা হলে কোকোস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত বলা হয় কেন? ওখানকার আদিম অধিবাসীরা দাবি করে, কিওটা তাদেরই প্রতিবেশী। প্রাচীন যুগে তাদের রাজার রাজধানী ছিল ওই দ্বীপে। কিন্তু মুশকিল হল, ৮০° দ্রাঘিমাংশ এবং ২০° অক্ষাংশে ছোটবড় দ্বীপের সংখ্যা প্রায় এক হাজারেরও বেশি। বারো হাজার বর্গমাইল জুড়ে ছড়িয়ে আছে তারা। মাত্র দুটো দ্বীপে বসতি আছে—বাকিগুলো জনহীন। কারণ সব দ্বীপই মানুষের বসবাসের অযোগ্য। অস্বাস্থ্যকর এবং মারাত্মক পোকামাকড়ের ডিপো। সে সব দ্বীপে যে যাবে, সাংঘাতিক ভাইরাসে সে সংক্রামিত হয়ে জটিল অসুখে মারা যাবে।

আপনি কি কর্নেলকে নিয়ে কিওটা দ্বীপ খুঁজতে বেরুনোর উদ্দেশ্যেই এসেছেন?

জয়ঢাক সায়েব হাসির মাঝে ঘর কাঁপিয়ে বললেন, তা ছাড়া আর কী?

কর্নেল সরকার আমার পুরনো বন্ধু! উদ্ভিদের গোপন কথা নামে ওঁর একটা প্রবন্ধ পেয়েই ছুটে এসেছি কলকাতায়।

.

কাত্তি! কাত্তি!

এপ্রিলের এক ঝরঝরে বৃষ্টিধোয়া বিকেলে কোকোসের ৭২নং দ্বীপ রুবি আইল্যান্ডে পৌঁছে মনে হচ্ছিল একি স্বর্গে এলাম? এ দ্বীপ যেন প্রকৃতি নিজের হাতে যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন। কত ফুল কত পাখি কত প্রজাপতি!

কর্নেলের আবার প্রজাপতির পেছনে ছুটোছুটির বাতিক আছে। কিন্তু আশ্বস্ত হয়ে লক্ষ্য করলাম, উনি জর্জ ব্যুগেনভিলির সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলতে ব্যস্ত। সামোয়া এই দোতলা হোটেলের নাম। দক্ষিণের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। অদূরে সাদা বালিতে ঢাকা বেলাভূমি। ভারত মহাসাগরের ব্যাকওয়াটার এখানে বেশ শান্ত ও ভদ্র। কারণ মাইলখানেক দূরে দ্বীপটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কোরাল রিফ বা প্রবাল-পাঁচিল। পাঁচিলে জায়গায় জায়গায় ভাঙন আছে। সেই ভাঙন দিয়ে সমুদ্রের জল গর্জন করতে করতে ব্যাকওয়াটারে ঢোকামাত্র শান্ত হয়ে যাচ্ছে।

দীর্ঘ জার্নিতে আমি ক্লান্ত। কলকাতা থেকে বিমানে জাকার্তা। জাকার্তা থেকে সামরিক বাহিনীর ছোট্ট একটা বিমানে এই রুবি দ্বীপে পৌঁছেছি। সরকার কিওটা-রহস্য নিয়ে বরাবর মাথা ঘামান। তাই সবরকম সাহায্য তাদের কাছে পাওয়া যাবে।

কফি এবং একজাতীয় সামুদ্রিক মাছের কেক খাওয়ার পর কর্নেল জয়ঢাক সায়েবকে নিয়ে কোথায় যেন বেরুলেন। বলে গেলেন, ঘন্টা দুই পরে ফিরব। তুমি ইচ্ছে করলে বিচে ঘোরাঘুরি করতে পারো—কোনও ভয় নেই। রুবি খুব নিরাপদ জায়গা।

আমার আঁতে লাগল। আমি বুঝি ভীতু মানুষ? ওঁরা সরকারি স্টেশনওয়াগন গাড়িতে রওনা হয়ে গেলে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। উঁচু-নিচু সুন্দর পাহাড়ি রাস্তায় ওঁদের গাড়িটা গাছপালার

আড়ালে চলে গেল। একানড়ের মতো নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম।

বিচে মানুষজন খুবই কম। নারকেল বীথির পাশে দাঁড়িয়ে আছি। তারপর দেখি, একটা বোর্ডে কয়েকটি ভাষায় লেখা আছে, সাবধান! সামনে বিপদ। আর এগোবেন না।

আমি তো হকচকিয়ে গেছি। বিপদ! কিসের বিপদ? হঠাৎ আমার কয়েক ইঞ্চি তফাতে গদাম করে একটা নারকেল পড়ল। ওমনি বিপদটা টের পেয়ে গেলাম। ওই প্রকাণ্ড ঝুনো নারকেল আমার মাথায় পড়লে এখনই অক্কা পেতে হত!

রাগ হল। কর্নেল যে বলে গেলেন, খুব নিরাপদ জায়গা! নারকেল গাছগুলো থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে বিচে বসে পড়লাম। সামনে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। দূরের প্রবাল-পাঁচিলটা ঝলমল করছে। আদিবাসীদের নৌকা কালো হয়ে ভেসে আছে কোথাও। ওরা হয়তো বেলা শেষে মাছ ধরতে বেরিয়েছে!

পায়ের শব্দে ঘুরে দেখি, একজন বুড়োমানুষ। তোবড়ানো গাল, চিনাদের মতো মুখ বেঁটে—কিন্তু কাঠামোটি চওড়া। তার মাথায় নীল টুপি দেখেই বুঝলাম, লোকটা জাহাজি। একটু হেসে সে বলল, স্পিক ইংলিশ?

কিছুক্ষণের মধ্যে আলাপ হয়ে গেল। বুড়ো একজন প্রাক্তন তিমিশিকারি। নাম রাজাকো। বাড়ি ছিল একসময় বান্দুং-এর ওদিকে একটা ছোট্ট শহরে। এখানে এখন সে স্থায়ী বাসিন্দা। বুড়ো হয়ে আর তিমিশিকারে যেতে পারে না। কাছাকাছি সমুদ্রে আজকাল তিমি মেলে না এবং শিকারেও কড়াকড়ি আছে। তিমি শিকারে যেতে হলে সুদূর দক্ষিণে আন্টার্কটিকার তুষার অঞ্চলে পাড়ি জমাতে হবে। অগত্যা সে মাছের কারবারে মন দিয়েছে।

রাজাকো বুড়োকে আমার খুব ভাল লাগছিল। আলাপী মানুষ। তিমিশিকারের মারাত্মক সব গল্প বলল। শেষে বলল, তুমি বুঝি বেড়াতে এসেছ এদেশে?

বললাম, হ্যাঁ। কতকটা তাই তবে…

আমাকে হঠাৎ থামতে দেখে রাজাকো বলল, ব্যবসা-ট্যবসা করারও ইচ্ছে আছে বুঝি? সে তো ভালই। তোমার মতো জোয়ান ছেলের কি শুধু টো টো করে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ালে চলে?

এই দেখো না! আমার যদি তোমার মতো একটা ছেলে থাকত, তাকে আমি এক্ষুনি আমার মাছধরা জাহাজে চাপিয়ে দক্ষিণ সাগরে তিমি মারতে পাঠাতাম। একটা ছোটখাটো তিমি মারতে পারলেই রাজা। প্রচুর চর্বি আর হাড় বেচে একদিনেই সে ধনী হয়ে যেত।

রাজাকোর বেশি কথা বলার বাতিক আছে। বললাম, না না। ব্যবসা আমার পোষাবে না। আমি এসেছি সরকারের একটা কাজে।

রাজাকো ভড়কে গিয়ে বলল, ওরে বাবা! তুমি সরকারি লোক? তা হলে তো তোমার সঙ্গে আমার বনবে না। সরকারি লোকেরা বড্ড বাজে।

বলেই সে উঠে দাঁড়াল। তারপর হনহন করে চলতে শুরু করল! অদ্ভুত বেয়াড়া লোক তো!

সন্ধ্যার ধূসরতা ঘনিয়েছে ততক্ষণে! একটু-একটু করে শীত করছে। প্রবাল-পাঁচিল ঘিরে কুয়াশা জমে উঠেছে। নারকেল বনটার পাশ দিয়ে রাজাকো হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। ভাবলাম, ওর ভুলটা ভাঙিয়ে দেওয়া দরকার।

কিন্তু কয়েক পা এগোতেই একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেল। নারকেল বনের ভেতর থেকে দুটো নোক এসে রাজাকোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর দেখলাম রাজাকো পড়ে গেল। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম মাতৃভাষায় এই! এই! খবর্দার!

লোক দুটো আমাকে দেখামাত্র নারকেল গাছের ভেতর দিয়ে পালিয়ে গেল। দৌড়ে রাজাকোর কাছে গিয়ে দেখি, সে মুখ খুঁজে পড়ে রয়েছে। তাকে চিত করে দিতেই আমার সারা শরীর আতঙ্কে হিম হয়ে গেল। তার পেটে ছোরা মেরেছে আততায়ীরা। রক্তে জামাপ্যান্ট ভেসে যাচ্ছে।

বিচ এখন একেবারে জনহীন। আমার সবচেয়ে আতঙ্ক হল এই ভেবে যে, এখন এ অবস্থায় আমাকে কেউ দেখলে আমাকেই খুনি ঠাওরাবে। পুলিশের হাঙ্গামায় পড়তে হবে। অতএব এখনই কেটে পড়া দরকার। বরং হোটেলে গিয়ে ম্যানেজারকে খবর দেওয়া ভাল যে বিচে একটা রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। তারপর ওরা যা হয় করবে।

উঠে পঁড়িয়েছি, সেই সময় রাজাকো ঘড়ঘড়ে গলায় অতিকষ্টে উচ্চারণ করল, কাত্তি! কাত্তি! তারপর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওর শরীরটা স্থির হয়ে গেল।

কী বলল কে জানে! কাত্তি! কী? আমি আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালাম না। এমন হতে পারে, ওর দুই খুনিই এতক্ষণে খবর দিয়েছে যে একজন বিদেশি টাকা ছিনতাইয়ের লোভে রাজাকোকে খুন করেছে।

আমি পা বাড়াতেই শক্ত কিছুতে পা পড়ল। দেখি রাজাকোবুড়োর সেই নীল টুপিটা ছিটকে পড়ে রয়েছে। কিন্তু টুপিটা এত শক্ত ঠেকল কেন? হেট হয়ে টুপিটা তুলে নিলাম। তারপর অবাক হয়ে গেলাম। এতটুকু একটা চুপির ওজন এত। নিশ্চয় এর ভেতর কোনও ভারী ধাতব জিনিস আছে।

টুপিটা সঙ্গে সঙ্গে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম। তারপর অনেকটা ঘুরে বিচ এলাকা। পেরিয়ে হোটেলে পৌঁছলাম। রিসেপশনের ইন্দোনেশীয় মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল, কেমন লাগল আমাদের মিস রুবিকে?

সে এই রুবি দ্বীপের প্রশংসা শুনতে চাইছিল। কিন্তু এ অবস্থায় হাসিতামাশা করা অসম্ভব। বললাম, দেখুন, এইমাত্র বিচ থেকে আসছি। বিচে একটা লোক পড়ে আছে দেখলাম। ডাকলাম সাড়া দিল না। অন্ধকারে কিছু বোঝা গেল না। মনে হল…

নিশ্চয় কোনও মাতাল ট্যুরিস্ট।

তবু একটু খোঁজ নেওয়া দরকার নয় কি?

মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, আপনি ভাববেন না মিস্টার! বিচে এমন মাতাল পড়ে থাকা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের গা সওয়া। লোকটা যদি ট্যুরিস্ট না হয় তা হলে নিশ্চয় কোনও নাবিক। নাবিক যদি হয়, তা হলে আগামীকাল সূর্য ওঠার আগে ওর নেশা কাটবে না। ওকে ওঠানোও যাবে না।

আমার বিবেকে বাধছিল। বললাম, বরং পুলিশে খবর দিন না মিস…

আমার নাম তোতিলাবতী ত্রিসত্যজায়া।

এ যে ভারতীয় নাম!

ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলে আপনাদের সংস্কৃত ভাষার ছড়াছড়ি মিস্টার।…

আমার নাম জয়ন্ত চৌধুরি।

মিঃ চৌড্রি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

অদ্ভুত ব্যাপার তো! তেতিলাবতী ধরেই নিয়েছে আমি একটা বেহুঁশ মাতালকে দেখেছি। অগত্যা আর না বলে পারলাম না। মিস তোতিলাবতী…

আমায় তোতি বলে ডাকলে খুশি হব।

মিস তোতি! লোকটার গায়ে রক্ত আছে মনে হল। ওকে কেউ ছুরি মেরেছে!

তোতি এবার চোখ বন্ধ করে বলল, তাই বুঝি! তা হলে তো আগে কাউকে দেখতে পাঠাতে হয় ; তা না হলে পুলিশে খবর দিয়ে ঝামেলা হবে। বলে সে হোটেলের একজন লোককে ডেকে নিজের ভাষায় কিছু বলল। লোকটা আর একজনকে ডেকে নিয়ে টর্চ হাতে বেরিয়ে গেল।

ওপরে আমাদের ঘরে এসে টুপিটা বের করলাম। তারপর একটা ব্লেড দিয়ে চিরতেই বেরিয়ে পড়ল একটুকরো সঁাতলাধরা তামার ফলক। ফলকটা চাপরাসের মতো গোলাকার! তার ওপর আঁকাবাঁকা আঁচড় কেটে দুর্বোধ্য অক্ষরে কী সব লেখা রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে আকৃষ্ট করল ফলকের ঠিক মাঝখানে একটা অদ্ভুত গড়নের গাছ। গাছটার ডালে-ডালে ইংরেজিতে এ বি সি ডি এইসব অক্ষর আঁকা।

মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছিলাম না। কতক্ষণ পরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তারপর কর্নেল ও ব্যুগেনভিলি ফিরলেন। ঘরে ঢুকে কর্নেল বললেন, বিচে একটা রক্তাক্ত লাশ পেয়েছে পুলিশ। জয়ন্তকে আমি বলেছিলাম দ্বীপটা নিরাপদ। কথাটা খাটল না দেখছি। বলেই কর্নেলের চোখ পড়ল আমার হাতের ফলকটার দিকে। শ্বাসরুদ্ধ গলায় বললেন, এ তো দেখছি কাত্তি। কাত্তি তুমি কোথায় পেলে জয়ন্ত?

ব্যুগেনভিলি লাফিয়ে উঠলেন। কী আশ্চর্য! এ যে দেখছি একটা কাত্তি!

.

রাজাকোর মেয়ে রোমিলা

কর্নেলের এই স্বভাব বরাবর দেখে আসছি। একসময় ঝানু শখের গোয়েন্দা হিসেবে নামডাক ছিল। খুনি আর অপরাধীর পেছন পেছন ছুটতে পেলে আর কোনওদিকে ফিরে তাকাতেন না। পরিচিত মহলে ওঁকে জনান্তিকে বলা হত বুড়ো ঘুঘু। ইদানীংকালে পোকামাকড়-গাছপালা অর্থাৎ প্রকৃতিচর্চায় মেতে থাকলেও গোয়েন্দাগিরির সুযোগ পেলে ছাড়তে রাজি নন।

রাজাকো-হত্যার রহস্য নিয়ে যে মেতে উঠবেন, জানাই ছিল। আমার কাছে ঘটনাটা জেনে নিয়ে সেই যে বেরিয়ে গেলেন, রাত দশটা বাজতে চলল—ফেরার নাম নেই। বৃষ্টিটা হঠাৎ এসে হঠাৎ চলে গেছে। এ তল্লাটের আবহাওয়াই এরকম।

জর্জ ব্যুগেনভিলির সঙ্গে কথা বলছিলাম। তার কাছে জানা গেল, কাত্তি কথাটার মানে ফলক। পর্তুগিজ ভাষার শব্দ এটা। কিন্তু কাত্তি কথাটার মানে ফলক বোঝায় না। এর পেছনে আছে একটা খুব পুরনো রোমাঞ্চকর ইতিহাস। প্রাচীন যুগে যে-সব পর্তুগিজ জলদস্যুনেতা একশোটা বাণিজ্য জাহাজ লুঠের গৌরব অর্জন করত, তারা এই তামার গোলাকার ফলকে নিজের নাম লিখে ঝুলিয়ে রাখত। কিন্তু তার রোমাঞ্চকর অংশটা হল এই :

দস্যুনেতা লুণ্ঠিত ধনরত্নের যে মোটা ভাগ পেত, তা গোপনে কোথাও লুকিয়ে রাখত। সেই গুপ্তধনের সন্ধান সাংকেতিক চিহ্নে খোদাই করে রাখত ফলকে। মৃত্যুর সময় সে ফলকটা দলের পরবর্তী নেতার হাতে তুলে দিত। কিন্তু সাংকেতিক চিহ্নের অর্থ ফাঁস করত না। তার মানে তুমি যখন নতুন নেতা হচ্ছ, তখন তুমিই ওর অর্থ উদ্ধার করে গুপ্তধনের মালিক হও।

জলদস্যুদের অনেকরকম কুসংস্কার ছিল। ফলকটাকে তারা খুব পরিত্র মনে করত। একশোটি জাহাজ যে লুঠ করতে পারেনি, তার সাহস হত না ওটা গলায় পরতে। তাদের বিশ্বাস ছিল, অনধিকারী ওই পবিত্র ফলক পরলে তার সর্বনাশ হবে।

দেখা যাচ্ছে, রাজাকোবুড়ো কোথাও এই রহস্যময় ফলক পেয়ে গিয়েছিল। তাকে খুন করার পিছনে ফলকঘটিত কোনও উদ্দেশ্য আছে কি না কে জানে। এর মধ্যে নাকি সতেরো শতকের দুর্ধর্ষ এক পর্তুগিজ জলদসনে আর্ভেলার নাম রয়েছে। ব্যুগেনভিলি পর্তুগিজ ভাষা জানেন। কিন্তু সাংকেতিক চিহ্নগুলির অর্থ উদ্ধার করতে পারেননি।

ব্যুগেনভিলি বললেন, বিবর্তনবাদের প্রবক্তা চার্লস ডারউইন এই কোকোস দ্বীপপুঞ্জের উৎপত্তি সম্পর্কে ভারি অদ্ভুত কথা লিখে গেছেন। এটা নাকি লক্ষ বছর আগে ছিল আগ্নেয়গিরি। কালক্রমে জলের তলায় বসে যায়। তারপর অসংখ্য ক্রেটার বা জ্বালামুখ ঘিরে জলের তলায় জমতে থাকে। প্রবালকীট। মরা প্রবালকীট আরও লক্ষ বছরে গড়ে তোলে এই সব দ্বীপ। এগুলো আসলে প্রবালদ্বীপ। যাই হোক, এখন সমস্যা হল আদিবাসীদের কিংবদন্তিখ্যাত সেই কিওটা দ্বীপটা কোথায়? হাজারটা ছোট-বড় দ্বীপের সবই কোনও না কোনও সময় অভিযাত্রীরা খুঁজে হন্যে হয়েছেন। শেষে আমিও দৈবাৎ তার সন্ধান পেয়ে হারিয়ে ফেললাম। এই ফলকটা পেয়ে এখন মনে হচ্ছে, তা হলে রাজাকো কি ওটার খোঁজ রাখত?

ব্যুগেনভিলি তুম্বো মুখে পাইপ ধরালেন। আমার মনটা বেজায় খারাপ। কী চমৎকার একজন আলাপী মানুষের সঙ্গে চেনাজানা হল এবং নিজের বুদ্ধির দোষেই হয়তো তাকে এভাবে চিরকালের মতো হারিয়ে ফেললাম। যদি আমার সঙ্গেই সে থাকত, তা হলে তাকে আততায়ীরা

আক্রমণের সাহসই পেত না। তা ছাড়া পকেটে আমার গুলিভরা রিভলভারও ছিল।

ব্যুগেনভিলি পাইপের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, কাত্তিটার মাঝখানে একটা গাছ আঁকা আছে। কিওটা দ্বীপে অবিকল এইরকম গাছের জঙ্গল দেখেছিলাম।

জিজ্ঞেস করলাম, সেই গাছগুলোই কি আপনার সঙ্গে কথা বলেছিল?

না, না! আমি কি কখনও বলেছি যে আমার সঙ্গে কিওটা দ্বীপের গাছপালার কোনও কথাবার্তা হয়েছে? আসলে আমি তখন একনাগাড়ে জলের ঝাঁপটা খেয়ে ভীষণ ক্লান্ত। গাছগুলো কথা বললেও জবাব দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। গলার স্বর ভেঙে গিয়েছিল। সে এক সাংঘাতিক অবস্থা।

তা হলে কি করে বুঝেছিলেন যে সেটাই কিওটা দ্বীপ? জর্জ ব্যুগেনভিলি একটু হাসলেন। সাতরাত্রি দ্বীপে ছিলাম। বেলাভূমির ওপরে একটা পাহাড়ি গুহায় ছিল আমার ডেরা। অনেক রাত্রে হঠাৎ কানে আসত আশেপাশের জঙ্গলে অদ্ভুত সব শনশন শব্দ হচ্ছে। প্রথমে ভাবতাম ঝড়। পরে টের পেলাম, ঝড় নয়—যেন গাছপালা থেকে বাতাসের গলায় কারা কথা বলছে। গিয়ে পরীক্ষা করার সাহস হত না।

আপনার কানের ভুলও তো হতে পারে।

ভুল নয়। কেন তা বলি শুনুন। নিভে যাওয়া পাইপ আবার লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে ব্যুগেনভিলি বললেন, কিওটাও এমনি প্রবালপাঁচিলে ঘেরা। তা ছাড়া ওটার মাঝখানে একটা ছোট্ট লেক আছে। লেকটা কিন্তু মিঠে জলের। একদিন ব্রেডফুড বা পিঠে-ফল খেয়েছিলাম পেট ভরে। অনেক রাতে জলতেষ্টা পেল প্রচণ্ড। তখন লেকে জল খেতে গেলাম। জল খেয়ে অন্ধকারে ফিরে আসছি, হঠাৎ কেউ কোখেকে ফিসফিস করে বলে উঠল, অ্যানজেলো! অ্যানজেলো! আমি হকচকিয়ে গেলাম। তারপর শুনি একসঙ্গে অনেকগুলো কণ্ঠস্বর! অ্যানজেলো! অ্যানজেলো! অ্যানজেলো!

তারপর?

সাড়া দিয়ে বললাম, কে তোমরা? অ্যানজেলো বলে কাকে ডাকছ? আমার নাম জর্জ ব্যুগেনভিলি! বেশ চেঁচিয়ে কথাটা বলেছিলাম। অমনি সব চুপ করে গেল, তখন আমার অবস্থা শোচনীয়। এ নিশ্চয় ভূতপ্রেতের কাণ্ড! এই অভিশপ্ত দ্বীপ থেকে পালাতেই হবে। সারা রাত আর ঘুম হল না। পরদিন দ্বীপের প্রায় সবটাই খুঁজলাম যদি কেউ আমার সঙ্গে রসিকতা করে থাকে। কিন্তু কোথাও কোনও জনপ্রাণীটি নেই। পাখি বলতে হাঁস আর সারসজাতীয় পাখি আছে। কিন্তু তারা রাত্রিবেলা অমন শব্দ করবে কেন? করলে তো দিনেও করবে—তাই না?

ঠিকই বলেছেন।

ব্যুগেনভিলি একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, প্রবালপাঁচিলে ঘিরে থাকায় সমুদ্রে কোনও জাহাজ গেলেও দেখতে পেতাম না। ধরে নিয়েছিলাম ওখানেই রবিসন ক্রুশোর মতো নির্বাসিত জীবন কাটাতে হবে। লাইফবোটটা ফেঁসে গিয়েছিল। একদিন ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একখানে একটা মরচেধরা কুড়ুল কুড়িয়ে পেলাম। এসব কুড়ুলকে বলে, সেলার্স এক্স। এগুলি নিরাপত্তার জন্য সব জাহাজে থাকে। জাহাজড়ুবির সময় দৈবাৎ কোনও কামরায় কেউ আটকে পড়লে দরজা বা দেওয়াল কেটে তাকে বের করতে এই কুড়ুল কাজে লাগে। কুড়ুলটা পেয়ে বুঝলাম দ্বীপে কোনও নাবিক আশ্রয় নিয়েছিল কোনওকালে। যাই হোক, কুড়ুল দিয়ে গাছ কেটে ভেলা তৈরি করে পাড়ি দিয়েছিলাম।

কিওটার গাছপালার যদি মানুষের মতো চেতনা থাকে, তাহলে কুড়ুল হাতে দেখামাত্র আপত্তি করা উচিত ছিল।

আমার মন্তব্য শুনে ব্যুগেনভিলি গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, তা করেনি। কিন্তু একটা ব্যাপার সত্যি ঘটেছিল। গাছের গায়ে কোপ দেওয়ামাত্র প্রচণ্ড ঝড় উঠেছিল। কিন্তু আমি তো তখন মরিয়া হয়ে উঠেছি। একটা গাছ কুড়ুলের ঘায়ে ধরাশায়ী হওয়ার পর ঝড়টা থেমে গিয়েছিল। তারপর জানেন? যতক্ষণ ধরে ভেলা তৈরি করলাম, মনে হচ্ছিল—সারা বন যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। এবং যেন মাঝেমাঝে শোকসঙ্গীত গাইছে। অবশ্য ঝিঝি পোকাদের ডাকও হতে পারে। একজন মরিয়া মানুষের পক্ষে ও ব্যাপারে কোনও কৌতূহল থাকে কি?

আমরা কথা বলতে বলতে কর্নেল ফিরে এলেন। রেনকোট খুলে রেখে বললেন, এখানকার পুলিশের কাজকর্ম ভারি অদ্ভুত! বলে কী এরকম হয়েই থাকে জুয়াড়িদের মধ্যে। রাজাকো লোকটা ছিল পাকা জুয়াড়ি। তা ছাড়া এ বৃষ্টির মধ্যে খুনির খোঁজে বেরিয়ে পড়তে তারা রাজি নয়। সকালে দেখা যাবে।

ব্যুগেনভিলি বললেন, এতক্ষণ কি থানায় বসেছিলেন আপনি?

মোটেই না। ড্রাইভারকে বললাম, চলো তো বাছা, আবার একবার ডক্টর বিকর্ণের বাড়ি।

নাম শুনে বললাম, ভারতীয় নাম মনে হচ্ছে। এখানে তা হলে ভারতের লোকও বাস করে?

মোটেই না। উনি ইন্দোনেশীয় উদ্ভিদবিজ্ঞানী। তবে তুমি ঠিকই ধরেছ। নামটা সংস্কৃত ভাষায়। ইন্দোনেশীর উচ্চারণে বিয়েকার্নো। প্রাচীনযুগে হিন্দু-সংস্কৃতি সারা দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে প্রভুত্ব করত। একথা তোমার জানা উচিত ছিল, জয়ন্ত।

ব্যুগেনভিলি বললেন, ডঃ বিকর্ণের বক্তব্য কী?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, রাজাকোকে উনি চেনেন। কাত্তির কথা শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। এক্ষুনি আসতে চান আমার সঙ্গে। বললাম, এই বৃষ্টির মধ্যে কষ্ট করা কেন। সকালে আমরা কাত্তি নিয়ে আপনার কাছে আসছি।

রাতের খাবার টেবিলে ঢাকা দেওয়া ছিল। তিনজনে খেতে বসলাম। প্রকাণ্ড সামুদ্রিক চিংড়ির খোসা ছাড়িয়ে কর্নেল বললেন, বলো তো জয়ন্ত, ভেতরের এই সাদা জিনিসটা কী?

একটু খেয়ে দেখে বললাম, নারকেলের দেশ। ভেতরে নারকেলের পুর ভরে দিয়েছে।

হল না ডার্লিং। এগুলো চিংড়িরই মাংস!

বাজি রাখছি। এ হচ্ছে খাঁটি নারকেল শাঁস।

কর্নেল হাসতে লাগলেন। ব্যুগেনভিলি বললেন, বিচের ধারে গাছ থেকে নারকেল পড়ে অনেক সময় ভেঙে যায়। জোয়ারে সমুদ্র সেগুলো টেনে নেয়। তখন চিংড়িগুলো নারকেল শাঁস খেয়ে ফেলে। তাই এসব চিংড়ির মাংসে নারকেলের স্বাদ।

সেই অপূর্ব চিংড়ি-নারকেলের স্বাদের তুলনা নেই। তারিয়ে তারিয়ে খেতে দেখে কর্নেল মুচকি হেসে মন্তব্য করলেন, শোওয়ার সময় কিন্তু হজমি ট্যাবলেট খাওয়া দরকার… এ উপদেশ কানে না নেওয়ার ফলটা এ রাতে ভালই ভুগতে হল। শেষ রাতে ব্যুগেনভিলি একটা জব্বর ফরাসি ট্যাবলেট না খাওয়ালে কী ঘটত বলা কঠিন। সকালে যখন ওঁরা দুজনে ডঃ বিকর্নের বাড়ি গেলেন, তখন আমি শয্যাশায়ী। মন খারাপ হয়ে গেল। নটা নাগাদ উঠে দেখি, শরীর একেবারে ঘায়েল। এমন সময় নিচে থেকে মিস তোতি ফোন করে জানাল, একটি মেয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। খুব অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, পাঠিয়ে দিন।

একটু পরে বছর কুড়ি-বাইশের টুকটুকে ফর্সা একটি মেয়ে এসে ভারতীয় প্রথায় নমস্কার করে বলল, আমি রোমিলা। মিঃ রাজাকোর মেয়ে।…

.

রাজাকোর ঘরে হানা

রোমিলার পোশাকও একেবারে ভারতীয় মেয়েদের মতো। শাড়ি ও ব্লাউজপরা। শুধু খোঁপাটা মাথার মাঝখানে চুড়ো করে বসানো প্রাচীন যুগের মুনিকন্যাদের মতো। গলায় সেইরকম রুদ্রাক্ষের মালা।

আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে ইংরাজিতে সে বলল, আপনি নিশ্চয় অবাক হয়েছেন। আমার হতভাগ্য বাবার নাম রাজাকো বাদান, কাল যাঁকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে আপনারই সামনে!

দুঃখিতভাবে বললাম, কথাটা ঠিকই মিস রোমিলা! কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। দুজনের মধ্যে তখন প্রায় অড়াইশো গজ দূরত্ব। তা ছাড়া সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। আমি দৌড়ে যেতে যেতে খুনিরা পালিয়ে যায়।

রোমিলা বলল, না মিঃ চৌড্রি! আমি কোনও অভিযোগ নিয়ে আপনার কাছে আসিনি। এ সামোয়া হোটেলের রিসেপশনিস্ট তোতিলাবতী আমার বন্ধু। তার কাছেই আপনার কথা কাল রাতে শুনেছি। তোতিও খুব পস্তাচ্ছে। সে প্রথমে নাকি আপনার কথায় গুরুত্ব দেয়নি। আসলে বাবার খুবই বদনাম ছিল এখানে।

আগে আপনি বসুন প্লিজ।

রোমিলা বসে বলল, আপনার সঙ্গী ভদ্রলোকেরা নিশ্চয় ডঃ বিকর্ণের বাড়ি গেছেন?

আপনি কীভাবে জানলেন?

রোমিলা একটু হাসল। ডঃ বিকর্ণ যখন জাকার্তার বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যার প্রধান অধ্যাপক ছিলেন, তখন আমি তার ছাত্রী ছিলাম। উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। সত্যি বলতে কী, আমারই তাগিদে উনি কোকোসে এসে স্থায়ীভাবে বাড়ি করে বাস করছেন। ওঁকে বলেছিলাম, আমাদের এসব দ্বীপে উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। আমি ওঁকে সাহায্য করতে পারি।

খুব আগ্রহ জাগল রোমিলা সম্পর্কে। বললাম, আপনি এখন কী করেন?

রোমিলা বলল, আমার দুর্ভাগ্য মিঃ চৌড্রি! জাকার্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মা মারা যান। বাবা অসহায় হয়ে পড়েন। তাই বাধ্য হয়ে পড়াশুনো ছেড়ে ফিরে আসি এখানে। বাবার একমাত্র সন্তান আমি। ওঁর মাছের কারবার দেখাশোনা করছি এই একটা বছর। এর মধ্যে ডঃ বিকর্ণ রিটায়ার করে চলে আসেন আমার কথামতো। কিন্তু আমি ওঁর কোনও কাজে লাগবার সময়ই আর পাইনি। বাবা উড়নচণ্ডী মানুষ। খালি টো টো করে ঘুরে বেড়াতেন। তাই আমাকে সব দেখাশুনো করতে হয়েছে।

রোমিলার কণ্ঠস্বর সুমিষ্ট এবং আচরণ খুব নম্র। বললাম, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভাল লাগল রোমিলা! বিশ্বাস করুন, আপনার বাবার ব্যাপারটাতে…

কথা কেড়ে রোমিলা বলল, বুঝতে পারছি। কিন্তু কীভাবে বাবাকে ওরা খুন করল, আপনার মুখ থেকে জানার জন্যেই এসেছি মিঃ চৌড্রি। রুবি দ্বীপের পুলিশ মাথা ঘামাবে না জানি। বিশেষ করে আমার বাবার জুয়াড়ি মাতাল বলে ভীষণ বদনাম ছিল। আপনি কি দয়া করে কী ঘটেছিল বলবেন?

পুরো ঘটনা সবিস্তারে বললাম। শোনার পর রোমিলা চাপা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

কাত্তি শব্দটা বাবার মুখে শুনেছি। ঘুমের ঘোরে উচ্চারণ করতেন। পরে জিজ্ঞেস করলে বলতেন ও কিছু না। তা হলে দেখছি, মৃত্যুর মুহূর্তে বাবা কাত্তি শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন! আচ্ছা মিঃ চৌড্রি, কাত্তি জিনিসটা কী?

ওকে বলিনি যে, রাজাকোর টুপি আমি কুড়িয়ে এনেছিলাম এবং টুপির ভেতরে সত্যি কাত্তি পেয়েছি। বললাম, শুনেছি কাত্তি হল প্রাচীন পর্তুগিজ জলদস্যুনেতার তামার পদক। ফলকও বলতে পারেন। যে দস্যুনেতা একশো জাহাজ লুঠ করতে পারত, সে ওই পদক গলায় ঝুলিয়ে রাখত।

রোমিলার জন্যে ফোনে নিচের ক্যান্টিনে কফির অর্ডার দিলাম। রোমিলা অন্যমনস্ক রইল কিছুক্ষণ তারপর ফের চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবা মারা গেছেন। তাই আপনাকে জানাতে বাধা নেই। ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা জলদস্যুদের দলে ছিলেন একসময়।

উত্তেজনা চেপে রেখে বললাম, তাই বুঝি? আমাকে বলছিলেন, তিমিশিকার করে বেড়াতেন আন্টার্কটিকায়।

সে অনেক পরে। রোমিলা হঠাৎ আমার চোখে চোখ রেখে বলল, মিঃ চৌড্রি কি বলবেন আপনাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য নিছক বেড়ানো—নাকি অন্য কিছু?

কেন এ প্রশ্ন?

আপনার সঙ্গীরা কাল বিকেলে ডঃ বিকর্ণের বাড়ি গিয়েছিলেন মিলিটারি গাড়িতে। সকালেও ফের গেলেন দেখলাম। তাই সন্দেহ জাগছে।

কিসের সন্দেহ?

আমাদের সরকার ডঃ বিকর্ণকে বহুদিন আগে কিওটা নামে এক ভূতুড়ে দ্বীপের স্পিকিং উডস অর্থাৎ কথা বলা বনের রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব দিয়েছেন। ডঃ বিকর্ণ নিজেই আমাকে বলেছেন একথা। উনি সরকারি অর্থসাহায্যে এ নিয়ে রিসার্চ করছেন। আমাকে ওঁর অ্যাসিন্ট্যান্ট হওয়ার কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম কথা, আমার যোগ্যতা কম। দ্বিতীয় কথা, বাবার মাছের কারবার নিয়ে আমি ভীষণ জড়িয়ে আছি।

একটু ইতস্তত করে বললাম, আপনি বুদ্ধিমতী শিক্ষিতা মেয়ে রোমিলা। আপনাকে বলতে দ্বিধার কারণ দেখি না, আমরা এসেছি কিওটা দ্বীপের খোঁজে।

রোমিলা ম্লান হাসল। কিওটা রূপকথা বা নিছক কিংবদন্তি হতেও তো পারে। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি এই ভূতুড়ে দ্বীপের কথা। এখানকার আদিবাসীদের লোককথায় কিওটা দ্বীপের গল্প আছে। ওরা তা বিশ্বাসও করে। দুদিন পরে শুক্লপক্ষ আসছে। চাঁদ দেখা গেলেই ওরা ফুলের পোশাক পরে বন-দেবতার পূজায় মেতে উঠবে। নিছক ধর্মীয় সংস্কার মিঃ চৌড্রি!

কিন্তু আপনাদের সরকার তা হলে কেন ডঃ বিকর্ণকে কিওটার রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব দিয়েছেন—যদি এর মধ্যে কোনও সত্য নাই থাকবে?

সত্যটুকু কী, বলি শুনুন। বছর দুই আগে একদল জেলে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিল! তারা যখন ফিরে এল, তখন দেখা গেল, তারা এক অদ্ভুত রোগে ভুগছে। গায়ের চামড়ার জায়গায় জায়গায় সবুজ অ্যালার্জির মতো চিহ্ন। অবিকল গাছের পাতা আঁকা যেন। হাসপাতালে তাদের ভর্তি করা হল। কিন্তু একে একে সবাই মারা পড়ল। মৃত্যুর পর দেখা গেল প্রত্যেকটি লাশ ঘন সবুজ হয়ে গেছে। সেই থেকে আমাদের সরকার ব্যাপারটা নিয়ে উদ্বিগ্ন।

আশ্চর্য! আঠারো শতকে টমাস কুকের জাহাজি লগবুকে সবুজ অ্যালার্জির কথা আছে।

পরিচারক ট্রেতে কফি রেখে গেল। দুজনে কফি খেতে থাকলাম। তারপর রোমিলা বলল, বাবা ওদের দেখতে গিয়েছিলেন। বাবার কাছে শুনেছি, কখনও-কখনও এ অঞ্চলে জেলেদের এই অদ্ভুত অসুখ হয়। কেউ বাঁচে না। বাবাও খুব কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষ ছিলেন। বলতেন ওরা নিশ্চয় কিওটা দ্বীপে গিয়ে পড়েছিল।

তা হলে আপনার বাবাও বিশ্বাস করতেন একথা?

বাবার কথা ছেড়ে দিন। নিরলস মানুষ ছিলেন। চিরজীবন সমুদ্রচর। সমুদ্রে যারা ঘোরে, তারা অসংখ্য আজগুবি ব্যাপার বিশ্বাস করে।

আচ্ছা রোমিলা, আপনার বাবা কি কখনও কিওটা দ্বীপ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন?

হ্যাঁ। বললাম তো, বাবা ছিলেন বেয়াড়া আর বাতিকগ্রস্ত মানুষ। একবার আমাদের জেলেরা মাছ ধরে আনল ট্রলারে। বাবা সেবার সঙ্গে যাননি। হঠাৎ দেখা গেল, একটা মাছের রং সবুজ। বাবার অমনি বাতিক চাড়া দিল। বেরিয়ে পড়লেন ট্রলার নিয়ে সেই এলাকায়। কদিন পরে হন্যে হয়ে ফিরে এলেন। সেই সবুজ মাছটা আমি ডঃ বিকর্ণকে দিয়ে এসেছিলাম। ওটা এখনও ওঁর জারে জিয়ানো আছে।

রোমিলার সঙ্গে গল্প করতে করতে দশটা বেজে গেল। রোমিলাকে বিদায় দিতে দরজার বাইরে গেছি, হঠাৎ সে বলল, সময় থাকলে আসুন না আমার ওখানে। না-না। মাছের আড়তে যেতে বলছি না আপনাকে। সে একটু হাসল। আড়তে মাছের গন্ধে টিকতে পারবেন না এক মুহূর্ত। আমার বাড়িতে আসুন। অবশ্য যদি আপত্তি না থাকে!

কোনও আপত্তি নেই। বলে তাকে নিচে রিসেপশনে অপেক্ষা করতে বলে ঝটপট সেজে নিলাম। পকেটে রিভলভার নিতে ভুললাম না।

রোমিলা হাল্কা নীল রঙের একটা টুসিটার ছোট্ট মোটরগাড়ি এনেছিল। হোটেল এলাকা ছাড়িয়ে সমুদ্রের ধারে ধারে সুন্দর রাস্তা দিয়ে এগোল গাড়িটা। যেদিকে তাকাই, রংবেরঙের ফুল। বড় বড় ব্রেডফুডের গাছে তরমুজের মতো ফল ঝুলছে। পামগাছে বাহারি অর্কিডের ঝালর। সমুদ্র ডাইনে রেখে অনেক সবুজ টিলার গা ঘেঁষে এবং চড়াইউতরাই ভেঙে রোমিলাদের বাড়ি পৌঁছলাম। বাড়ি একটা টিলার মাথায়। রাজাকো যে পয়সাওলা লোক ছিল, বোঝা যাচ্ছিল এবার। বাড়িটা ছোট হলেও বড় সুন্দর। ফলবাগান আর বিচিত্র সব গাছপালার ভেতর ছবির মতো রঙিন বাড়িটা দেখে মনে হল, এর পেছনে যেন শিল্পীর স্বপ্ন রয়ে গেছে। কে সেই শিল্পী—রাজাকো, না তার মেয়ে?

গেটের কাছে গিয়েই রোমিলা বলে উঠল, বাড়িতে অতিথি এসেছেন মনে হচ্ছে।

দেখি, সেই মিলিটারি স্টেশনওয়াগনটা দাঁড়িয়ে রয়েছে লনের পাশে। ড্রইং রুমে ঢুকে রোমিলা বলল, কী সৌভাগ্য, কী সৌভাগ্য! আমার ঘরে এত সব গণ্যমান্য অতিথি। আর আমি কি না বাইরে কাটাচ্ছিলাম!

কর্নেল, ব্যুগেনভিলি এবং একজন অতিবৃদ্ধ ভদ্রলোক কফির পেয়ালা হাতে বসে রয়েছেন। রোমিলা বলল, মিঃ চৌড্রি, ইনিই আমার প্রফেসর ডঃ বিকর্ণ, আর এঁরা নিশ্চয় আপনার সঙ্গী!

ডঃ বিকর্ণ কর্নেল ও ব্যুগেনভিলির পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরস্পর আনুষ্ঠানিক পরিচয়পর্ব শেষ হলে ডঃ বিকর্ণ বললেন, রোমি! এঁদের তোমার কাছে নিয়ে এলাম একটা জরুরি দরকারে। তা ছাড়া তোমার বাবার শেষকৃত্যে পৌঁছতে পারিনি—একটা কৈফিয়ত দেওয়ারও প্রয়োজন ছিল।

রোমিলা মৃদু স্বরে বলল, আপনাকে আসতে তো নিষেধ করেছিলাম রাত্রে!

বললাম, শেষকৃত্য কি রাতেই হয়ে গেছে?

ডঃ বিকর্ণ বললেন, হ্যাঁ। একানকার পুলিশের ব্যাপার এরকম। মর্গে পর্যন্ত নেয়নি বডি।

সে কী!

কর্নেল বললেন, যস্মিন দেশে যদাচার। তো জয়ন্ত, তোমার শরীর নিশ্চয় যথেষ্ট সুস্থ?

রোমিলা ভেতরে চলে গেল। বললাম, সুস্থ না হলে এলাম কী করে? মিস রোমিলা গিয়েছিলেন ওঁর বাবার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে। তারপর ওঁর সঙ্গে চলে এলাম।

একটু পরে রোমিলা ব্যস্তভাবে এসে বলল, একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে। এইমাত্র হঠাৎ চোখে পড়ল—পেছনের একটা ছোট্ট ঘরে পুরনো আমলের কিছু জিনিসপত্র বাবা রাখতেন। সেই ঘরের দরজার সেফটি লক ভাঙা। আমার পরিচারিকা এবং অন্য কর্মচারী দুজন আছে, তারা কেউ কিছু বলতে পারছে না। তাছাড়া বাইরে থেকে বোঝাও যায় না দরজার লক ভাঙা হয়েছে। আমার কুকুর পাঞ্চো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কপাটে আঁচড় কাটছিল। তাই সন্দেহ হল। তখন ঠেলে দেখি, খুলে গেল দরজা। কিছু হারিয়েছে কি না তাও বুঝতে পারছি না।

ডঃ বিকর্ণ, কর্নেল এবং ব্যুগেনভিলি উঠে দাঁড়ালেন উত্তেজিতভাবে। কর্নেল বললেন, চলুন তো দেখি।…

.

শত্ৰুদলের কবলে

ঘরের ভেতর ঢুকে অবাক হয়ে গেলুম। একটা ছোট্ট মেরিন মিউজিয়াম! রোমিলা সুইচ টিপে বাতি জ্বেলে দিলে মনে হল এই জাদুঘর বহুকাল খোলা হয়নি। ঘরে কেমন একটা ঝাঁঝালো গন্ধ। একটা মোটা জানালা আছে। সেটা জাহাজের পোর্টহোলের মতো গোলাকার। কিন্তু আকারে বড়। মোটাসোটা লোহার গারদ আছে। সমুদ্রের মানুষের জীবনের অনেক স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। জংধরা নোঙর, কাছির বান্ডিল, নাবিকদের কুঠার, হালের টুকরো, এইরকম সব জিনিস। দেয়ালে পুরনো আমলের জলদস্যুদের ব্যবহৃত বন্দুক পিস্তল তলোয়ার ছুরি আর তিমিশিকারের হারপুন হুকে আটকানো রয়েছে। আর আছে সমুদ্রপ্রাণীদের অসংখ্য স্টাফকরা নমুনা। কতরকমের শঙ্খ, ঝিনুক, কাছিম, হাঙর, বারাকুদা মাছ, তিমির দাঁত এবং আরও কত প্রাণী। সমুদ্র অঞ্চলের কিছু পাখিও স্টাফ করা হয়েছে। দেখে মনে হয় ওরা জীবিত।

কর্নেল বললেন, মিঃ রাজাকো দেখছি ট্যাক্সিডার্মি অর্থাৎ চামড়াবিদ্যায় খুব দক্ষ ছিলেন।

ডঃ বিকর্ণ বললেন, এই অ্যালবাট্রস পাখিটাকে দেখুন। যেন ডানা মেলে এখুনি উড়ে যাবে।

রোমিলার কুকুর পাঞ্চো দেখতে কতকটা বেড়ালের মতো। গায়ে ঘন সাদা লোম। এমন ক্ষুদে কুকুর কস্মিন্‌কালে দেখিনি। সে হঠাৎ রোমিলার কোল থেকে নেমে হাঙরটার কাছে দৌড়ে গেল। এবার দেখলুম, হাঙরটার মুখে একটুকরো ব্যুমেরাং আকৃতির কাঠ আটকানো আছে। পাঞ্চো গিয়েই সেই বাঁকা ছোট্ট কাঠটা কামড়ে ধরে বের করল। রোমিলা বলল, আঃ! কী হচ্ছে পাঞ্চো? দুষ্টুমি করে না এখন।

তারপর ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। ব্যুমেরাং কাঠটা পাঞ্চোর মুখ থেকে প্রকাণ্ড পোকার মতো নড়াচড়া করতে করতে ছিটকে চলে গেল। পাঞ্চো ভয় পেয়ে রোমিলার পায়ের কাছে গুটিসুটি বসে পড়ল। কর্নেল এগিয়ে গিয়ে কাঠটা তুলেছেন, আবার ওটা কিলবিল করে নড়ে ছিটকে পড়ল। তারপর লাফাতে লাফাতে হাঙরটার মুখের ভেতর ঢুকে পড়ল। আমরা হাঁ করে দেখছিলুম ব্যাপারটা।

ডঃ বিকর্ণ বললেন, সর্বনাশ! এ আবার কী প্রাণী?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, এ যে দেখছি কেঠো পোকা। দেখতে কাঠ, আসলে পোকা।

ব্যুগেনভিলি কী যেন ভাবছিলেন। এতক্ষণে ব্যস্তভাবে বললেন, কী আশ্চর্য! কিওটা দ্বীপে ঠিক এই আজব পোকাই দেখেছিলুম। ঘাসের মধ্যে পড়েছিল। দেখে মনে হয়েছিল ব্যুমেরাং। কিন্তু যেই কুড়িয়ে নিয়েছি, অমনি হাত থেকে ছিটকে চলে গেল। কর্নেল, ডঃ বিকর্ণ, আমার দৃঢ় বিশ্বাস মিঃ রাজাকো কিওটা দ্বীপের সন্ধান জানতেন।

কর্নেল কোনও জবাব দিলেন না। র্যাক থেকে একটা বাঁধানো মোটা খাতা নামিয়ে পাতা ওল্টালেন। তারপর বললেন, জাহাজের লগবুক দেখছি। 1912 সালের লগবুক। সান্টা মারিয়া জাহাজ! ক্যাপ্টেনের নাম জিয়োভিল্লো সার্ভেন্টিস! পর্তুগিজ মনে হচ্ছে। রোমিলা, তুমি কি কখনও এ ঘরে ঢুকেছ?

রোমিলা বলল, না কর্নেল, বাবা বেঁচে থাকতে কাউকে এঘরে ঢুকতে দিতেন না।

র‍্যাকের একটা জায়গা দেখিয়ে কর্নেল বললেন, এখানে ধুলোময়লা নেই—এই চারকোনা অংশটাতে। অথচ র্যাকের সবখানে ধুলোময়লা প্রচুর। তার মানে এখানে চৌকো কোনও জিনিস—সম্ভবত আর একটি লগবুক ছিল। চোর সেটাই নিয়ে গেছে।

রোমিলা ক্ষুব্ধভাবে বলল, কে তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে একটা লগবুক নিয়ে গেল, বুঝতে পারছি না। আমার লোকেরা তো সবাই বিশ্বাসী!

ডঃ বিকর্ণ বললেন, তবু ওদের জিগ্যেস করা দরকার।

কর্নেল বললেন, রোমিলা এই লগবুকটা আমি নিয়ে যেতে চাই। দেখা শেষ হলে ফেরত দেব।

রোমিলা বলল, কোনও আপত্তি নেই কর্নেল। ব্যপারটা আমারও জানা দরকার। কেন বাবাকে খুন করা হল, এ ঘরের তালা ভেঙে কেন চোর ঢুকল—সব রহস্য না জানলে শান্তি পাব না।

ড্রয়িংরুমে ফিরে গেলুম আমরা। রোমিলা তার পরিচারিকাকে ডেকে জাদুঘরের দিকে লক্ষ্য রাখতে বলল। বুঝলুম, কর্মচারীদের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস।

একজন কর্মচারীর নাম বেনিয়া। সে রোমিলার প্রাইভেট সেক্রেটারি। অন্যজনের নাম পিওবেদেনে। সম্ভবত প্রিয়বর্ধন। বেনিয়া বলল, সে অনেকগুলি চিঠি টাইপ করতে ব্যস্ত ছিল। কিছু লক্ষ্য করেনি। পিওবেদেনে বা প্রিয়বর্ধন বলল, সে কিচেনে খাবার তৈরি করছিল। সেও কিছু লক্ষ্য করেনি।

লক্ষ্য করার কথাও নয়। ঘরটা পেছনের দিকে। ওপাশে ফুলবাগান ঝোপঝাড়, গাছপালা। কর্মচারীরা চলে গেলে ডঃ বিকর্ণ বললেন, তোমার পরিচারিকাকে ডাকো এবার।

পরিচারিকাটি রোমিলার বয়সী। সে ছেলেবেলা থেকে রোমিলার সঙ্গিনী। নাম মিত্ৰামা। দেখতে চিনাদের মতো। সে বলল কিচেনে প্রিয়বর্ধনের সঙ্গে কাজ করছিল। তবে পাঞ্চো একবার বসে তার পায়ে মুখ ঘষেছিল। এটা পাঞ্চোর ভয় পাওয়ার লক্ষণ। মিত্রামা ভেবেছিল, আজও বুঝি সাপটাপ দেখে ভয়ে পেয়েছে পাঞ্চো। এই টিলায় খুব সাপের উৎপাত আছে। মাঝে মাঝে বাগানে চলে আসে, মারাও পড়ে। মিঃ রাজাকো ছিলেন খেয়ালি মানুষ। না হলে এমন জংলা পাহাড়ে কেউ বাড়ি বানাতে চায়?

কর্নেল লগবুক নিয়ে মগ্ন ছিলেন। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, রোমিলা আমি আরেকবার জাদুঘরে যেতে চাই।

রোমিলা বলল, আসুন।

কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে তার সঙ্গে চলে গেলেন। ডঃ বিকর্ণ মুচকি হেসে বললেন, ওঁর যাওয়া দেখে মনে হল যেন শিকারের গন্ধ পেয়েছেন।

আমার প্রাজ্ঞ বন্ধুর প্রশংসার সূত্র পেলেই আমার মুখ খুলে যায়। বললুম, ওঁর পক্ষে কিছু অসম্ভব নয়, ডঃ বিকর্ণ। হয়তো দেখবেন, এখনই এসে বলবেন কিওটা দ্বীপের সন্ধান পেয়ে গেছেন।

ব্যুগেনভিলি বললেন, এবং মিঃ রাজাকোর হত্যারহস্যেরও।

ডঃ বিকর্ণ গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বললেন, রাজাকোর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কিওটা দ্বীপের যোগসূত্র আছে বলে মনে হয় না। অবশ্য ওই কাত্তির ব্যপারটা একটা গোল বাধাচ্ছে। তা হলেও বলব কাপ্টেন ব্যুগেনভিলি, রাজাকোর অনেক শত্রু ছিল। যেমন ধরুন ওঁর মাছের ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বী কিয়াং। একসময় দুজনে একই সঙ্গে কারবার করেছেন। দক্ষিণ সমুদ্রে তিমিশিকারেও গেছেন দুজনে। পরে কী নিয়ে বিবাদ হয়েছিল যেন। তারপর থেকে বিছপে প্রায়ই দুজনের সাঙ্গপাঙ্গরা খুনোখুনি করত পরস্পর। পুলিশ হিমশিম খেত দাঙ্গা থামাতে।

ক্যাপ্টেন ব্যুগেনভিলি বললেন, কিয়াং এখন কী করেন?

কিয়াং তো এ তল্লাটের সেরা ড়ুবুরি। ওর একটা স্কুনার (ছোট জাহাজ) আছে! মুক্তো খুঁজে বেড়ায় সমুদ্রের তলায়। সে এখন কোটিপতি লোক। থাকে পাশের দ্বীপে কারো আইল্যান্ডে।

এইসব কথাবার্তা বলতে বলতে কর্নেল এসে গেলেন রোমিলার সঙ্গে। খুব প্রত্যাশা নিয়ে ধুরন্ধর বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকালুম। এই বুঝি বলে ইউরেকা!

কিন্তু কোথায় কী! আরও তুম্বো মুখে চুপচাপ বসে বড়লেন। রোমিলা বলল, আরেকপ্রস্থ কফি বলে আসি।

সে চলে গেলে কর্নেল বললেন, কিওটার রহস্যময় স্পিকিং উডদের একটুকরো সেরা নমুনা ছিল ও ঘরে। ক্যাপ্টেন সার্ভেন্টিসের এই লগবুকে তার উল্লেখ আছে। ডঃ বিকর্ণ যে জিনিসটা ওঘর থেকে চোর নিয়ে গেছে, সেটা আরেকটা লগবুক নয়। কাঠের তৈরি একটা চমৎকার ভাস্কর্য। আর সে কাঠ কিওটা দ্বীপের গাছের। এই দেখুন, লগবুকে ক্যাপ্টেন সার্ভেন্টিস সেটা এঁকেও রেখেছেন।

আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়লুম। পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন ভদ্রলোক অপূর্ব ছবি আঁকতে পারতেন বটে! তবে ভাস্কর্যটি অসাধারণ! সুন্দর এক দেবীমূর্তি। হাতে বীণা কতকটা আমাদের দেবী সরস্বতীর মতো দেখতে। শুধু বাহন হিসেবে কোনও হাঁস নেই, এই যা তফাত। মূর্তিটা চৌকো একটা বেদিতে। বসানো ছিল।

কল্পনা করলুম, জনহীন কিওটা দ্বীপে জ্যোৎস্নার ওই রাতে দেবী আপন মনে বীণা বাজাচ্ছেন। তার পায়ের নিচে সমুদ্র সব উচ্ছ্বাস থামিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে শুনছে।

এই সময় ক্যাপ্টেন ব্যুগেনভিলি বলে উঠলেন, আশ্চর্য! আমার যেন মনে পড়ছে! অচ্ছন্নতার ঘোরে কিওটার বেলাভূমিতে শুয়ে মধুর বাজনা শুনেছিলুম। তা হলে কি স্বপ্ন নয়?

সঙ্গীতকারী বৃক্ষ! ডঃ বিকর্ণ বললেন, এ এলাকায় লোকেরা বংশপরম্পরায় বিশ্বাস করে আসছে সঙ্গীতকারী বৃক্ষের কথা। কিন্তু কোথায় সেই রহস্যময় দ্বীপ?..

রোমিলার কাছ থেকে এক সময় বিদায় নিয়ে আমরা হোটেলে ফিরলুম। ডঃ বিকর্ণ আমাদের পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন।

লাঞ্চের পর কর্নেল ব্যালকনিতে গিয়ে সেই লগবুক খুলে বসলেন। আমার বরাবর ভেতো বাঙালি-স্বভাবে খাওয়ার পর ঝিমুনি কেটে গেল ফোনের আওয়াজে। অপারেটর বলল, কথা বলুন!

রোমিলার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর কানে এল। কর্নেল? আমি রোমিলা। শুনুন কর্নেল…

না, আমি জয়ন্ত বলছি। ডেকে দেব কর্নেলকে?

দিন না প্লিজ!

কর্নেলের কানে গিয়েছিল। এসে ফোন ধরলেন। একটু পরে ফোন রেখে হাসলেন। ডার্লিং! রোমিলার পরিচারক-কাম-বাবুর্চি সেই প্রিয়বর্ধন বা পিওবেদেনে হঠাৎ নিপাত্তা হয়ে গেছে।

নিশ্চয় সে-ব্যাটাই চোর!

তা আর বলতে? বলে কর্নেল ব্যালকনিতে ফিরে গেলেন।

আমার ফের ঝিমুনি চাপল। অভ্যাস যাবে কোথায়? কখন ঘুমিয়ে গেছি—অথচ কর্নেল পই পই করে দিনে ঘুমোতে নিষেধ করেন। সামুদ্রিক নোনা আবহাওয়ায় দিনে ঘুমুলে নাকি শরীর ফুলে ঢোল হয়ে যায়।

একটা বিকট দুঃস্বপ্ন দেখছিলুম। যেন অথৈ সমুদ্রে পড়ে গেছি আর হাঙর হাঁ করে গিলতে অসছে। ভাগ্যিস ঘুমটা ভেঙে গেল। বহাল তবিয়তে আছি দেখে আশ্বস্ত হলুম।

কর্নেল বেরিয়েছেন কোথায়। একটু রাগ হল। এক সঙ্গে এসেছি। অথচ এমন করে কোথায় কোথায় চলে যাচ্ছেন, আমি একা মনমরা হয়ে ফুলো মুখে বসে থাকছি। কোনও মানে হয়?

নিচের রেস্তোরাঁয় চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লুম।

আজ বন্দর এলাকা দেখতে ইচ্ছে করছিল। বাজার ছাড়িয়ে একটু পুবে এগিয়ে গেলে ডক। অসংখ্য জেটি। তেমনি ছোট বড় জাহাজ। কোনও-কোনও জেটিতে সার সার মোটরবোট, লঞ্চ, স্টিমারও রয়েছে। লোকজন সে-তুলনায় কমই।

আজ বিকেলে আকাশ পরিষ্কার। সমুদ্রের জল রাঙা। নীল টুপিপরা নাবিকরা হল্লা করছে। একটা জেটিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম। সেখানে একটা ছোট্ট জাহাজ—যাকে স্কুনার বলা হয়, ভিড়ে রয়েছে। সংকীর্ণ ডেকে চেয়ার পেতে বসে বেশ লম্বা চওড়া একটা লোক বই পড়ছিল। সে হঠাৎ ঘুরে আমাকে দেখতে পেল। একটু হেলে মাথাটা সম্ভাষণ সূচকভঙ্গিতে দোলাল। তখন ভদ্রতা করে আমি বললুম, গুড আফটারনুন মিস্টার! লোকটা রাজাকোর মতোই দেখছি গায়ে পড়া। সম্ভাষণের প্রত্যুত্তর দিয়ে সে রেলিংয়ে ভর করে দাঁড়াল। বলল, মশাই স্থানীয় লোক নন নিশ্চয়?

না। আমি ভারতীয়।

নিশ্চয় ব্যবসায়ী?

না। পর্যটক।

আমার নাম ক্যারিবো। মশায়ের নাম?

ছোট্ট ডেকে বসে চা খেতে খেতে তার সঙ্গে গল্প করছি, পেছনের কেবিন থেকে কেউ বেরিয়েই আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। প্রচণ্ড চমকে উঠলুম। আরে! এ তো সেই রোমিলার কর্মচারী প্রিয়বর্ধন!

সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, আপনি প্রিয়বর্ধন না? রোমিলার বাড়িতে আপনাকে দেখেছি।

প্রিয়বর্ধন খিকখিক করে হাসল। কে প্রিয়বর্ধন? আমার নাম অ্যানথুপা পিদ্রু।

ক্যারিবো ভুরু কুঁচকে আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। বললুম, আশ্চর্য তো?

ক্যারিবো একটু হাসল! চেহারার এমন মিল হতেই পারে। একবার চিনে গিয়ে সব চীনাকে আমার একই নোক মনে হত।

কিন্তু এ ভুল আমার হতেই পারে না। জেদ করে বললুম, না মিঃ ক্যারিববা! ইনি তিনিই বটে। কারণ মিঃ রাজাকোর বাড়িতে আজ সকালে এঁকে দেখেছি। একটু আগে শুনলুম, উনি নিপাত্তা হয়েছেন…

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রিয়বর্ধন আমার ওপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি এর জন্য তৈরি ছিলুম না! শক্ত ডেকের ওপর বেকায়দায় পড়ে গেলুম। প্রিয়বর্ধন আমার বুকে বসে চেঁচিয়ে উঠল, ক্যারিববা! এ ব্যাটা সরকারি গুপ্তচর। এর মুখ বন্ধ করতে হবে। শিগগির!

ক্যারিবো চাপা গলায় কাদের ডাকল। আমি যথাসাধ্য লড়ে যাচ্ছি, কিন্তু আরও দুজন বেঁটে হিংস্র চেহারার লোক কেবিন থেকে বেরিয়ে এল। ক্যারিবো বিকৃত মুখে বলল, একে বেঁধে নিচে নিয়ে এস।

নাইলনের মজবুত দড়িতে আমাকে ওরা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। তারপর ধরাধরি করে সিঁড়ি বেয়ে জাহাজের খোলে নিয়ে গেল। নিচের কেবিনে পাটাতনের ওপর আমাকে ফেলে ক্যারিবো আমার পেটে জুতোসুদ্ধ একটা পা চাপিয়ে নিষ্ঠুর হেসে বলল, তা হলে তুমি সরকারি ঘুঘু? বোসো, দেখাচ্ছি মজা।

তারপর সে পকেট থেকে কী একটা বের করল। দেখেই আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেলুম। ক্যারিবোর হাতে একটা চকচকে বাঁকা ছুরি।…

.

অন্ধকার সমুদ্রে

জীবনে ভুলেও ঈশ্বরকে ডাকিনি। এখন মনে হল ঈশ্বরকে ডেকে দেখলে হয়। নইলে আমার মৃত্যুটা ঠেকানোর কোনও উপায় দেখছি না। অবস্থাটাও বড় বেকায়দা যে! ব্যাটারা নাইলনের দড়িতে আমাকে এমন করে বেঁধেছে, একটুও নড়াচড়া করা যাচ্ছে না, এদিকে শয়তান ক্যারিববা বাঁকা চকচকে ছুরিটা বাগিয়ে আমার বুকে তার থ্যাবড়া জুতোসুদ্ধু পা চাপিয়ে কুতকুতে চোখে তাকিয়ে আছে আর শাসাচ্ছে।

কিছুক্ষণ আগে কী ভদ্র আর অমায়িক চেহারা দেখেছিলুম লোকটার! এখন মনে হচ্ছে, বাস্তবিক যদি শয়তান বলে কেউ থাকে, তাহলে এই ব্যাটাই সে। এদিকে পিওবেদেনে ওরফে অ্যানথুপা পি পাশে দাঁড়িয়ে শিগগির আমার শ্বাসনালী কেটে ফেলার প্ররোচনা দিচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা করছি, এখনই বুঝি ক্যারিবো আমার গলায় ছুরি চালিয়ে দেবে।

মাথা ঠিক রাখার চেষ্টা করে বললুম, দেখুন মিঃ ক্যারিববা, আপনারা ভুল করছেন। আমি সত্যি সরকারি গুপ্তচর নই। আমার বুক পকেটে একটা কার্ড আছে। ওটা দেখলেই আমার পরিচয় পেয়ে যাবেন।

ক্যারিবো নূর হেসে বলল, পিওবের্দেনে যখন বলেছে, তখন তার কথাই ঠিক। তুমি সরকারি ঘুঘু।

না মিঃ ক্যারিবো আমি একজন সাংবাদিক মাত্র। আপনি ওর কথায় ভুল করবেন না।

পিওবের্দেনে বলল, তাহলে প্রফেসর বিকর্ণ আর ওই দাড়িওয়ালা বুড়ো কর্নেলের সঙ্গে কিসের সম্পর্ক তোমার?

কোনও সম্পর্ক নেই। আমি কিওটা দ্বীপে ওঁদের ভিযানের খবর নিতে এসেছি। সেই খবর কলকাতায় আমার কাগজে পাঠাতে হবে। বিশ্বাস না হলে আমা বুকপকেটের কার্ডটা আপনারা দেখুন।

পিওবেদেনে আমার বুকপকেট থেকে আইডেনটিটি কার্ডটা বের করে নেড়েচেড়ে দেখল তারপর ক্যারিববাকে কার্ডটা দিল সে। ক্যারিবো পড়ে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল এটা যে জাল নয় তার প্রমাণ? আমি জানি, সরকারি ঘুঘুদের জাল পরিচয়পত্র থাকে।

পিওবের্দেনে বলল, আর দেরি কোরো না ক্যারিববা আমাদের রওনা দেওয়ার সময় হয়ে এল।

ক্যারিবো কার্ডটা আমার পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বলল, পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে সরকারি ঘুঘু জাহান্নামে যাক। তবে পিওবেদেনে, আমার মনে হয় কাজটা মাঝদরিয়ায় সেরে ফেলাই ভাল। কারণ জল পুলিশ নজর রেখেছে। রক্তমাখা মড়া সমস্যা বাধাবে।

পিওবের্দেনে ভেবেচিন্তে বলল, ঠিক বলেছ। মাঝদরিয়ায় পৌঁছে ওর শ্বাসনালী কেটে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেব। আর কেউ খুঁজে পাবে না।

ক্যারিববা পা তুলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, তারপর ওর সদগতির কোনও অসুবিধে হবে না। হাঙরেরা খিদেয় ছটফট করে বেড়াচ্ছে।

ওরা বেরিয়ে যাচ্ছিল। ডেকে বললুম, মিঃ ক্যারিববা, মেরেই যখন ফেলবেন, তখন দয়া করে দড়ির ফাঁসগুলো একটু আলগা করে দিন না। বড় ব্যথা করছে যে!

পিওবেদেনে! মুখ ভেংচে বলল, ব্যথা করছে! করবেই তো! ঘুঘু দেখেছ বাছাধন, ফাঁদ তো দেখোনি!

মিঃ পিওবেদেনে! রোমিলার বাবার জাদুঘর থেকে যে দেবী মূর্তিটা নিয়ে এসেছেন, ওর ভেতর কিন্তু কিওটা দ্বীপের সন্ধান পাবেন না—যদিও ওটা কিওটা দ্বীপের কাঠ দিয়ে তৈরি।

আমার এই চালে কাজ কাজ হল। ওদের দুজনের মুখেই চমক জাগল। ক্যারিববা বলল, , তুমি তাহলে দেখছি অনেক খবর রাখো?

রাখি বৈকি! আমি সাংবাদিক যে!

পিওবেদেনে আমার পাশে এসে হাঁটু মুড়ে বসে বলল, যদি সত্যি তুমি কিওটা দ্বীপের সন্ধান জানো, তাহলে তোমার শ্বাসনালী কাটা যাবে না।

ক্যারিবো বলল, চালাকিতে ভুলো না পিওবেদেনে! গুপ্তচররা বড় ধূর্ত।

বললুম, রাজাকো কিন্তু তার চেয়েও ধূর্ত ছিলেন। তাই কিওটা দ্বীপে যাওয়ার ম্যাপখানা কাত্তির গায়ে এঁকে রেখে গেছেন।

দুজনে আবার চমকে উঠল। এক গলায় বলল, কাত্তি! কাত্তি!

হ্যাঁ, কাত্তি।

ক্যারিবো ব্যস্তভাবে বলল, কোথায় আছে সেই কাত্তি?

মিঃ কিয়াং তা হাতিয়ে নিয়েছেন রাজাকোকে খুন করে।

এই কথাটা বলার সময় আমি আদৌ জানতুম না এরা কিয়াং নামে সেই ধনী মৎস্যব্যবসায়ী ও রাজাকোর প্রতিদ্বন্দ্বীর অনুচর কি না। আন্দাজে ঢিলটা লেগে গেল। ক্যারিববা লাফিয়ে উঠে দাঁত কিনমিড় করে বলল, কিয়াং হাতিয়েছে তাহলে? সর্বনাশ!

পিওবের্দেনে মুখ চুন করে বলল, দেখলে তো ক্যারিববা? আমি তোমাকে বলেছিলুম রাজাকোকে খুন করেছে কিয়াংসায়েবের লোক। তুমি বিশ্বাস করোনি! তাছাড়া এও বলেছিলুম, রাজাকোর কাছে একটা কাত্তি আছে আমি জানি।

বললুম, হ্যাঁ, টুপির মধ্যে লুকোনো ছিল শুনেছি।

ক্যরিবো কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ দুমদুম শব্দে কাঠের সিঁড়ি কাঁপিয়ে একটা বেঁটে লোক এসে দরজায় উঁকি মেরে বলল, গতিক সুবিধের নয় কর্তা! হাঙরের ঝাক এসে পড়েছে।

ওরা ব্যস্ত হয়ে উঠল। ক্যারিববা বলল, পিওবের্দেনে, ওর কাছে থাকো! ৭০৩ নম্বরের দিকে রওনা দিচ্ছি।

সবাই ওপরের ডেকে চলে গেল। পিওবেদেনে দরজা বন্ধ করে পোর্টহোলে চোখ রেখে কিছু দেখতে লাগল। তারপর নোঙর তোলার ঘড় ঘড় শব্দ শুনতে পেলুম। তারপর স্কুনার দুলতে শুরু করল। যান্ত্রিক গর্জন কানে এল। বুঝলুম স্টার্ট দিয়েছে। আবছা জলের শব্দ, স্কুনারের প্রচণ্ড দুলুনি আর গর্জন মিলে একটা আলোড়ন শুরু হয়ে গেল।

কেবিনের ভেতর ততক্ষণে আলো কমে গেছে। একটু পরে আলো জ্বলে উঠল। পিওবের্দেনে পোর্টহোল থেকে হঠাৎ ছিটকে সরে এল। তারপর দুমদাম্ ফট্‌ ফট্টা এরকম অদ্ভুত সব শব্দ হতে থাকল। বললুম, ব্যাপার কী মিঃ পিওবেদেনে?

সে দাঁত মুখ খিচিয়ে বলল, চুপ ব্যাটা কলকাত্তাই ভূত!

গ্রাহ্য না করে বললুম, কারও সঙ্গে লড়াই বাধল বুঝি? পিওবেদেনে আমার কথার জবাব না দিয়ে কোনার দিকে কাঠের দেয়ালের একটা হুকে হ্যাঁচকা টান মারল। দেখি, ওটা একটা প্রকাণ্ড দেরাজ। দেরাজ থেকে সে যা বের করল, তা একটা স্টেনগান আর একটা কার্তুজের বেল্ট। সে পোর্টহোলের কাচটা সরিয়ে স্টেনগানের নল ঢুকিয়ে দিল। তারপর গুলি ছুড়তে শুরু করল।

বুঝলুম কাদের সঙ্গে জোর লড়াই বেধেছে। ছোট্ট জাহাজটা বেজায় দুলছে। মাঝে মাঝে ভীষণভাবে কাত হয়ে যাচ্ছে। আর আমি কাঠের মেঝেয় অসহায়ভাবে একবার এদিক একবার ওদিকে গড়িয়ে যাচ্ছি।

কিন্তু তাতে একটা লাভ হল। বাঁধনগুলো অনেকটা ঢিলে হয়ে গেল। একটু পরে পোর্টহোলের কাচটা ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল। পিওবের্দেনে মুখ বিকৃত করে লাফ দিয়ে সরে এল। তারপর সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিল। কেবিনে ঘরঘুট্টি অন্ধকার এবার। সেই সুযোগে বাঁধন খুলতে থাকলুম। পিওবের্দেনে পোর্টহোলের কাছে আছে তা বুঝতে পারছি। ভোলা পোর্টহোল গুলিগোলার আওয়াজ ক্রমশ কমে আসছে। কিন্তু সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাচ্ছি। এদিকে কেবিনে জল ঢুকে মেঝে জলময় হয়ে যাচ্ছে। বাঁধন খুলে সাবধানে উঠে বসলুম যখন, তখন কেবিনের ভেতর কয়েক ইঞ্চি জল। যখনই স্কুনার কাত হচ্ছে, তখনই বেশি করে জল ঢুকছে। আমার ভয় হল, এই লোনা জলে শেষ পর্যন্ত ড়ুবে মরব না তো?

তার আগেই একটা কিছু করা দরকার। পিওবেদেনের চেহারা আবছা দেখা যাচ্ছিল। সে পোর্টহোলে কী একটা চাপা দেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছি, সেইসময় দরজায় ধাক্কা পড়ল। জলের শব্দের মধ্যে কে চেঁচিয়ে ডেকে বলল, পিওবের্দেনে! বেরিয়ে এস! স্কুনারে জল ঢুকছে।

পিওবেদনে ঝটপট দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। ভাগ্যিস আলো জ্বালাল না। বিপদের মুখে তার এটাই স্বাভাবিক। খোলা দরজা দিয়ে এবার জলের প্রবল ছাঁট এসে ঢুকতে লাগল। মেঝেয় এখন প্রায় হাঁটু জল জমে উঠেছে। বুঝতে পারলুম স্কুনার ড়ুবতে চলেছে। প্রতিপক্ষের গুলিগোলায় নিশ্চয় ঝাঁঝরা হয়ে গেছে স্কুনারটার শরীর।

এতক্ষণে আমার সত্যিকার মৃত্যুভয় জেগে উঠল। ক্যারিবোর ছুরির মুখে তত বেশি ভয় পাই নি, কারণ জীবনে এমন অবস্থায় অনেকবার পড়েছি। কিন্তু এবার সাক্ষাৎ যম স্বয়ং সমুদ্র।

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঁকি দিলুম। মড়ার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। অন্ধকার সমুদ্র ভয়ঙ্কর গর্জন করছে। স্কুনারে কোথাও আলো নেই। কোনও সাড়া শব্দ নেই। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে আছে। স্কুনারটা অসহায়ভাবে মোচার মতো প্রচণ্ড দুলছে। প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে ছিটকে সমুদ্রে গিয়ে পড়ব। তার ওপর মুহুর্মুহু জলের ঝাঁপটানি। ভিজে নাকাল হয়ে গেছি। কাঁপুনি শুরু হয়েছে ঠাণ্ডায়।

তাহলে কি এই সমুদ্রসমাধিই বরাতে ছিল আমার? অতিকষ্টে ওপরের ডেকে হাঁটু দুমড়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে এগিয়ে গেলুম। সমুদ্রের গর্জনে কান পাতা দায়। বৃষ্টি ঝাঁকে ঝাঁকে সূচ বেঁধাচ্ছে শরীরে। ওপরের কেবিনের কাছে যেতেই বিদ্যুৎ ঝিলিক দিল। সেই আলোয় দেখলুম, একটা ছায়ামূর্তি কী একটা টানাটানি করছে।

আবার বিদ্যুৎ ঝিলিক দিল। লোকটাকে চিনতে পারলুম। পিওবেদেনে।

আসন্ন মৃত্যুর মুখে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না।

ঝাঁপিয়ে পড়লুম তার ওপর। তবে রে হতচ্ছাড়া বদমাস। এবার তোর কী হয়?

পিওবেদেনে বেকায়দায় পড়ে মাতৃভাষায় কী সব আওড়াতে থাকল। তাকে জাপটে ধরে ভিজে ডেকের ওপর ফেলে হাঁকতে হাঁকতে বললুম, কীরে ব্যাটা? আমার শ্বাসনলী কাটবি বলেছিলি যে বড়? এবার দ্যাখ, কে কার শ্বাসনালী কাটে!

পিওবেদেনে গোঙাতে গোঙাতে বলল, কিন্তু তুমিও কি রক্ষা পাবে ভাবছ? সমুদ্র তোমাকে। গিলে খাবে। বরং তার চেয়ে আমাকে সাহায্য করো। তাহলে দুজনেই প্রাণে বাঁচব।

কেবিনের কার্নিশে একটা রবারের নৌকো আটকানো আছে। ওটা টেনে বের করতে পারছি না।

তোর বন্ধুরা কোথায় গেল?

ওরা আমাকে ফেলে বোটে চেপে কেটে পড়েছে। ওরা আমার বন্ধু নয়, শত্রু! বলে সে কেঁদে ফেলল। উঃ! ক্যারিবো এমন করবে আমি ভাবতেও পারিনি!

ওর কান্না দেখে মনটা নরম হল। সমুদ্রের গ্রাস থেকে বাঁচতে হলে এখন ওর সহযোগিতাও দরকার। বললুম, তোমার স্টেনগানটা কোথায়, আগে দাও। তারপর কথা হবে।

বিশ্বাস করো, ওরা কেড়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু আর দেরি করা উচিত নয়, যদি প্রাণে বাঁচতে হয়। স্কুনারটা আর মিনিট কুড়ি-পঁচিশের মধ্যেই ড়ুবে যাবে হয়তো। চলো, আমরা রবারের নৌকোটা বের করি।

ওকে ছেড়ে সতর্কভাবে উঠে দাঁড়ালুম। এতক্ষণে মনে পড়ল আমার পকেটে রিভলভার আছে। জলে ভিজে গেলেও ওটার সাহায্যে পিওবেদেনেকে শায়েস্তা করতে অসুবিধে হবে না।

রিভলভারটা ওর বুকে ঠেকিয়ে বললাম, চলো! কোথায় নৌকো আছে দেখি।

পিওবের্দেনে কাকুতি-মিনতি করে বলল, বিশ্বাস করো! আমি ক্যারিববার মতো দুষ্টু লোক নই। ওর প্ররোচনায় পড়ে রোমিলার সঙ্গে নেমকহারামি করেছি। জানতুম না, নচ্ছার ঠগ আসলে মূর্তিটা হাতানোর জন্য আমার সঙ্গে ভাব জমাবে।

ঠিক আছে। চুলো, নৌকো কোথায় আছে দেখি।

স্কুনার একপাশে কাত হয়ে গেছে। বৃষ্টিটা ধরে এল। কিন্তু ঝোড়ো বাতাস থামল না। টলতে টলতে অনেক কষ্টে রবারের নৌকোটা টেনে বের করলুম দুজনে। তারপর পালাক্রমে ফুঁ দিয়ে ওটাকে ফোলাতে শুরু করলুম। ততক্ষণে স্কুনার আরও কাত হয়েছে। দুজনেরই দম ফুরিয়ে মারা পড়ার দাখিল। নৌকাটা আসলে গোল মোটরের টায়ারের মতো প্রকাণ্ড একটা চাকা এবং মধ্যিখানে আন্দাজ এক বর্গমিটার একটা রবারের বালিশ আটকানো। সেটাও দম দিয়ে ফোলানো হল। তারপর পিওবেদেনে বলল, তুমি আগে উঠে বোসো। আমি ঠেলে ভাসিয়ে দিয়ে তারপর উঠব।

স্কুনারের যেদিকটা কাত হয়ে সমুদ্রের ঢেউ ঢুকছে, সেদিকে ঠেলে দিল পিওবেদেনে। তারপর নিজে এক লাফে উঠে বসল। সে যেন নাগরদোলায় চড়া। স্কুনারের রেলিং হাত বাড়িয়ে ধরে সে রবারের এই অদ্ভুত ভেলাটাকে শেষ প্রান্তে নিয়ে গেল। লোকটার বুদ্ধি আছে বটে! শেষ দিকটায় নিয়ে গেলে ঢেউয়ের ঝাঁপটায় ভেলাসমেত আমরা আবার ডেকে গিয়ে পড়তুম।

সমুদ্র এবার আমাদের লুফে নিল। প্রতিমুহূর্তে আশঙ্কা হচ্ছিল তলিয়ে যাব, কিন্তু এই আশ্চর্য ভেলা দিব্যি ভেসে রইল ঢেউয়ের মাথায় একপার ওপরে একবার নিচে নাগরদোলার মতো।

ঢেউয়ের মাথায় পৌঁছুলে দিগন্তে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আলোর ঝক দেখতে পাচ্ছিলুম। আবার হারিয়ে যাচ্ছিল কালো জলের দেয়ালের পেছনে।

চেঁচিয়ে জিগ্যেস করলুম, পিওবেদেনে! ওটা কোন্ দ্বীপ?

জলের গর্জনের ভেতর পিওবেদেনে কী বলল, শুনতে পেলুম না। যদিও সে আমার মাত্র একহাত দূরে ফুলন্ত টায়ারের মতো ভেলার কিনারা আঁকড়ে বসে আছে।

মাথার ওপর এতক্ষণে নক্ষত্র ঝিকমিক করতে দেখা গেল। বাতাসটাও কমে এল ক্রমশ। কিছুক্ষণ আগে যে লোকটি ছিল আমার জঘন্য শত্ৰু, সে এখন বন্ধু হয়ে গেছে। কারণ প্রাণের দায় বড় দায়। রবারের ভেলায় দুজনেই ঠান্ডাহিম শরীরে ভেসে চললুম। কোথায় পৌঁছুব কে জানে!

.

ও কিসের আলো?

চোখ খুলে কয়েক সেকেন্ড কিছু বুঝতে পারলুম না। তারপর মনে হল, রুবি দ্বীপে আমাদের হোটেলেই শুয়ে আছি। কিন্তু এত আলো কেন? না—আলো নয়, রোদ ঝলমল করছে উজ্জ্বল রোদ। আমার পিঠের নিচে বালি। মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। আমি এখানে শুয়ে আছি কেন?

সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম কিছুক্ষণ। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? নিশ্চয় একা টানা অদ্ভুত ধরনের স্বপ্নের মধ্যে কাটাচ্ছি। বাঁদিকে নারকেল বন আর ঘন আগাছার জঙ্গল। ডানদিকে উঁচু বাঁধের মতো ন্যাড়া টিলা। সামনে ছোট্ট একটা হ্রদ। তারপর পেছনে তাকিয়ে প্রিয়বর্ধনকে দেখামাত্র আগাগোড়া সবটাই মনে পড়ে গেল।

প্রিয়বর্ধন একটা গাছের তলায় আগুন জ্বেলে কী একটা করছিল আমাকে উঠতে দেখে সে মুখ ফেরাল। তার মুখে কেমন একটা মিষ্টি-মিষ্টি হাসি। হ্যালো মিস্টার! শরীর ঠিক তো?

জবাব দিলাম না। এই লোকটা আমার জঘন্য শত্রু। সে ক্যারিবোর স্কুনারে আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। অথচ তারই সঙ্গে একই বেলায় অথৈ সমুদ্রে আমাকে ভাসতে হয়েছিল। ভাগ্যের তামাশা আর কাকে বলে? আমি অবাক হয়ে তাকে দেখছিলুম। ভাবছিলুম, ইচ্ছে করলেই সে আমাকে সমুদ্রে ফেলে দিতে পারত। কেন তা করেনি?

প্রিয়বর্ধন আমার হাবভাব দেখে হয়তো অবাক হল। বলল, কী হল? চলে এস এখানে। তোমার জন্য কিছু ব্রেকফাস্টের আয়োজন করেছি।

বলে সে হাসতে হাসতে একটা পোড়া মাছ দেখাল। সঙ্গে সঙ্গে আমার খিদে চনমন করে উঠল। তার সম্পর্কে রাগ আর শত্রুতার ভাবটাও কেটে গেল। তার কাছে গিয়ে বসে পড়লুম। সে একরাশ কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বেলেছে। আগুনের কুণ্ডের পাশে কয়েকটা পোড়া আর কয়েকটা তাজা মাছ। মাছগুলো দেখতে বাচ্চা ইলিশের মতো। আমার হাতে একটা পোড়া মাছ গুঁজে দিয়ে প্রিয়বর্ধন নিজেও একটা চিবুতে শুরু করল। চিবোতে চিবোতে বলল, তুমি অবাক হচ্ছ না মিস্টার?

বললুম, নিশ্চয় হচ্ছি। কারণ এতক্ষণে আমাদের হাঙরের পেটে থাকার কথা।

প্রিয়বর্ধন আরও জোরে হেসে বলল, বরাত জোরে এ যাত্রা জোর বেঁচে গেছি। আসলে কী জানো? ওই রবারের ভেলাগুলো খুব মজবুত এবং বিশেষ ধরনে তৈরি। যত ঢেউ থাক, কিছুতেই ওল্টাবে না। তাছাড়া আমি হলুম সমুদ্রের বাচ্চা। আজীবন সমুদ্রের মানুষ হয়েছি।

বাধা দিয়ে বললুম, কিন্তু এখানে এলুম কী ভাবে?

যেভাবে আসা উচিত। প্রিয়বর্ধন আগুনে আরেকটা মাছ রেখে বলল। সারা রাত আমরা ভেলায় কাটিয়েছি। তুমি তো ভিরমি খেয়ে পড়ে ছিলে ভয়ের চোটে। অগত্যা তুমি যাতে ভেলা থেকে ছিটকে হাঙরের পেটে ঢুকে না যাও, আমি তোমার পেটের ওপর পা চাপিয়ে ঠেসে রেখেছিলুম।

নচ্ছার লোকটা আমার পেটের ওপর পা চাপিয়েছিল ক্যারিববার মতো, ভাবতেই গা জ্বালা করে। কিন্তু লোকটাকে যতটা খারাপ মনে করেছিলুম, ততটা খারাপ নয়। বললুম, তারপর এখানে কীভাবে এলুম?

প্রিয়বর্ধন বলল, ভোর নাগাদ ভেলামশাই নিজের ইচ্ছে মতো এনে ফেলল এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে। আমি কি নিজের ইচ্ছেয় এসেছি? ওই যে বাঁধের মতো টিলা পাহাড় দেখছ, তার নিচে সমুদ্র। বাপস! কিনারা জুড়ে ড়ুবো পাথরে ভর্তি—ভেলাটার সঙ্গে ঠোক্কর লাগলে দুজনেই গুড়ো হয়ে যেতুম। বুঝলে মিস্টার? ভেলাটাকে পুজো করা উচিত। ওই দেখ, ওকে গাছে টাঙিয়ে রেখেছি।

গাছের গুঁড়ির মাথায় চুপসে যাওয়া প্রকাণ্ড টায়ারের মতো ভেলাটাকে দেখতে পেলুম। বললুম, আমি তাহলে সারারাত অজ্ঞান ছিলুম?

হুঁ, ছিলে। কাজেই তোমার ঠ্যাং দুটো ধরে টানতে টানতে বিচে নামাতে হল। তারপর একবার ভাবলুম, তোমাকে বিচেই ফেলে রাখি। কিন্তু এই জঘন্য দ্বীপে যা শকুনের উপদ্রব! তোমাকে একা ফেলে যে ক্ষিদে মেটাতে আসব, উপায় নেই। তবে তার চেয়ে বড় কথা, আমি নারকোল গাছে চড়তে পারিনে। সমুদ্রের বাচ্চা তো! তাই ভাবলাম, তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। তুমি নিশ্চয় নারকোল গাছে চড়তে পারো?

মোটেও পারি না।

প্রিয়বর্ধন লাফিয়ে উঠল। পারো না? তাহলে কেন তোমাকে কাঁধে করে এই নিরাপদ জায়গায় নিয়ে এলুম?

বুঝতে পারছিলুম, লোকটি খুব আমুদে প্রকৃতির। সে আমাকে বয়ে এনে এখানে শুইয়ে রেখেছে। তারপর হ্রদের জলে পাথর ছুড়ে একগাদা মাছ মেরে এনেছে। কিন্তু আগুন কোথায় পেল? জিগ্যেস করলে তার বুদ্ধির পরিচয়ও পেলুম। দুটো শুকনো কাঠে ঘষাঘষি করে শুকনো পাতা উলাই করে গুলতি বানিয়ে ফুঁ দিতেই আগুন জ্বলে উঠেছে। ব্যাপারটা ভারি সোজা। প্রথমে কাঠ দুটো জ্বলে উঠবে। তখন গুঁড়ো পাতার গুলতিটা ধরিয়ে নিলেই হল।

রোদে শুয়ে থাকার ফলে আমার ভিজে পোশাক যেমন শুকিয়ে গেছে তেমনি সারা রাতের সমুদ্র জলের হিমটাও গেছে ঘুচে। সূর্য মানুষের শরীরকে শক্তি জোগায়। আমি এখন সম্পূর্ণ ফিট হয়ে গেছি। একটুও দুর্বলতা টের পাচ্ছি না।

হ্রদটা ছোট। সমুদ্রের সঙ্গে তার যোগ নেই; বৃষ্টিজলের হ্রদ। তাই জলটা পান করা যায়। খুব স্বচ্ছ সেই জলে মাছের ঝাক দেখে তাক লেগে গেল।

জল খেয়ে সেই গাছের তলায় ফিরে প্রিয়বর্ধন বলল, একেই বলে বরাত। কাল সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত আমরা ছিলুম শত্রু। এখন হয়েছি বন্ধু। যাক্ গে, তোমার নামটা কী বলছিলে যেন কাল?

জয়ন্ত চৌধুরি।

জয়ন্ত, আমরা কোথায় এসে পড়েছি জানো? বলে সে ভয়ের চোখে চারদিক দেখে নিল। আমার খালি সন্দেহ হচ্ছে, এ যেন সেই ডাইনির দ্বীপ।

ডাইনির দ্বীপ মানে?

ছেলেবেলা থেকে নাবিকদের কাছে ডাইনির দ্বীপের ভয়ঙ্কর সব গল্প শুনেছি। থাগে, ওসব বলতে নেই। বললেই বিপদ হবে শুনেছি। আমাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্রও নেই। তোমার পকেটে একটা রিভলভার ছিল। সেটা কাছে রেখেছি। কিন্তু জলে ভিজে অকেজো হয়ে গেছে। গুলিগুলো পর্যন্ত বের করা গেল না।

আমার রিভলভার নিয়েছ কেন? ফেরত দাও।

মুচকি হেসে প্রিয়বর্ধন পকেট থেকে আমার অস্ত্রটা বের করে দিল। পরীক্ষা করে দেখলুম, সত্যি ওটা অকেজো হয়ে গেছে। প্রিয়বর্ধন বলল, আমার স্টেনগানটা কখন সমুদ্রে ছিটকে পড়েছে টের পাইনি। যাক দুটো লাঠি ভেঙে নিই গাছের ডাল থেকে। তারপর সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসব—যদি দৈবাৎ কোন জাহাজ চোখে পড়ে। নিদেনপক্ষে ভেলাটা তো রইলই। গায়ে জোর ফিরে পেলেই ভেসে পড়া যাবে।

সমুদ্রতীরে যাওয়ার সময় নারকোল বনের ভেতর অসংখ্য শুকনো নারকোল পড়ে থাকতে দেখলুম। কিন্তু প্রিয়বর্ধনের শুকনো নারকোল নাকি মুখে রোচে না। গাছের ডগায় ঝুলন্ত নরম নারকোল শাঁসের কথা বলতে তার জিভে জল এসে গেল। আমাকে গাছে চড়ানোর জন্য সাধাসাধি করেও যখন রাজি হলুম না, তখন তার মুখটা বেজার হয়ে উঠল। কিন্তু আমি জানি, এই দ্বীপ থেকে উদ্ধার না পেলে শুকনো নারকোলই খেতে হবে। কাহাতক মাছ পোড়া খেতে ভাল লাগবে ওর? আমি পাথরে আছাড় মেরে কয়েকটা নারকোল ভেঙে ফেললুম। তারপর টুকরো শাসগুলো জামা ও প্যান্টের পকেটে বোঝাই করলুম। ন্যাড়া পাথরের বাঁটে বসে যখন সেগুলো চিবোচ্ছি, তখন প্রিয়বর্ধন হাত বাড়িয়ে বলল, দেখি একটুখানি!

কিছু চিবিয়েই সে ফেলে দিল। তবে একথাও সত্যি এমন স্বাদ গন্ধহীন নারকোল জীবনে কখনও খাইনি। রুবিদ্বীপের নারকোল খেকো চিংড়িগুলোর কথা মনে পড়ছিল। আহা, সেই সুস্বাদু চিংড়ি সমুদ্র থেকে যদি ধরা যায়। লোভী চোখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলুম।

ড়ুবো পাথরে বহুদুর পর্যন্ত সমুদ্রের নীল জলে কালো কালো ছোপ পড়ে আছে। যেন অসংখ্য দানবের মাথা। কোনওটা হাতির মতো দেখাচ্ছে। পাথরগুলো ড়ুবে যাচ্ছে, আবার ভেসে উঠছে। সাদা ফেনার পুঞ্জ জমছে। জলের শব্দও প্রচণ্ড। ওই সব পাথরের ভেতর দিয়ে ঠোক্কর খেতে খেতে রবারের ভেলাটা ভদ্রলোকের মতো আমাদের তীরে পৌঁছে দিয়েছে। সত্যি, ভেলাবাবাজির পুজো দেওয়া উচিত।

দিগন্তে মাঝে মাঝে কালো রেখা ভেসে উঠেছিল। নিশ্চয় আর একটা দ্বীপ। কিন্তু দূরের দিকে কোনো জাহাজ বা নৌকো চোখে পড়ছিল না। প্রিয়বর্ধন ঠোঁট কামড়ে ধরে সমুদ্র দেখছিল। কিছুক্ষণ পরে ফেঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল, শয়তান ক্যারিববাকে যদি এখন পেতুম! ওর মুণ্ডুটা কচকচ করে খেয়ে খিদে মেটাতুম!

ক্যারিববা তোমাকে ফেলে পালিয়ে গেল কেন প্রিয়বর্ধন?

আমার প্রশ্ন শুনে প্রিয়বর্ধন চুপচাপ পাথরে লাঠিটা দিয়ে আঁচড় কাটবার ব্যর্থ চেষ্টা করল। তারপর বলল, কিয়াংকে ও ভীষণ ভয় পায়। কিয়াং কোটিপতি লোক। ওর দলবল বিরাট। ক্যারিববা তো এক সময় কিয়াংয়েরই ডান হাত ছিল।

দুজনের বিবাদের কারণ কী?

রোমিলার বাবা রাজাকোর ঘর থেকে যে দেবীমূর্তিটা চুরি করে এনে ক্যারিববাকে দিয়েছি, বিবাদ ওইটে নিয়ে। জিনিসটার আসল মালিক হল কিয়াং। ক্যারিববা ওটা কিয়াংয়ের বাড়ি থেকে চুরি করে রাজাকোকে বেচেছিল। কিয়াং ক্যারিবোকেই সন্দেহ করেছিল। তাই তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছিল। ক্যারিববা রাজাকোর সেই টাকায় স্কুনার কিনেছিল। তারপর যেভাবেই হোক, সে জানতে পেরেছিল, মূর্তিটার ভেতর কিওটা দ্বীপের সন্ধান লেখা আছে।

চমকে উঠলুম। কিওটা দ্বীপের? মানে—যে দ্বীপে গাছপালা কথা বলে?

প্রিয়বর্ধন হাসল। আমার ভুল শুধরে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, উঁহু—গান গায়।

বেশ। তারপর?

তারপর আর কী? ক্যারিবো আমাকে টাকার লোভ দেখাল। তাছাড়া প্রতিজ্ঞা করে বলল, আমাকে ও কিওটা দ্বীপে নিয়ে যাবে। আমি শয়তানটার কথায় পড়ে রোমিলার মতো ভাল মেয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেললুম। ওঃ! নরকে আমার জায়গা হবে না জয়ন্ত!

অনুতাপে সে চুল আঁকড়ে ধরল। বললুম, যাক গে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আর বলে লাভ নেই। কিন্তু কাল সন্ধ্যায় কিয়াংয়ের দলই কি ক্যারিবোর স্কুনারে হামলা করেছিল? কেন?

কিয়াং নিশ্চয় টের পেয়েছে, মূর্তিটা এতদিন রাজাকোর কাছে ছিল এবং আবার সেটা ক্যারিববার কাছে ফিরে এসেছে। কিয়াংয়ের চারদিকে চর।

তাহলে কি রাজাকোকে খুন করেছে কিয়াংয়েরই লোক?

তা আর বলতে?

এসব কথা শুনে মনমরা হয়ে বললুম, তাহলে এতক্ষণে ক্যারিবো কিওটা দ্বীপের দিকে রওনা হয়েছে। হয়তো পৌঁছেও গেছে।

প্রিয়বর্ধন জোরে মাথা নেড়ে বলল, অত সহজ নয়। মোটরবোট নিয়ে কিওটা যাবে! আমার মনিব রাজাকো একদিন নেশার ঘোরে আমাকে বলেছিলেন, কিওটা নামে একটা দ্বীপ আছে—তার চারদিকে পাহারা দেয় জলের ডাইনিরা। কাজেই বুঝতে পারছ, এতক্ষণে ক্যারিববার মাংস ডাইনিরা ছিঁড়ে খাচ্ছে।

কিন্তু প্রিয়বর্ধন, গান করে এমন সব গাছ দেখাতেই বা এত আগ্রহ কেন ক্যারিববার? কেন সেখানে কিয়াংই বা যেতে চায়?

প্রিয়বর্ধন চাপা গলায় বলল, ওই দ্বীপে নাকি প্রাচীন যুগের জলদস্যুদের বিস্তর ধনরত্ন লুকানো আছে।

হেসে ফেললুম।সেই চিরকেলে গল্প! গুপ্তধন আর গুপ্তধন! প্রিয়বর্ধন, গুপ্তধনের গল্প কখনও সত্য হয় না।

প্রিয়বর্ধন আমার পরিহাসে কান করল না। বলল, তুমি জানো না জয়ন্ত, কোকেস আইল্যান্ড কেন, সারা তল্লাটে যেখানে যাবে, তুমি কিওটা দ্বীপের অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প শুনতে পাবে। সেখানকার গাছপালা গান গেয়ে সেই গুপ্তধনের খোঁজ দেয়। গানের সুরে বলে, আয়, তোকে রাজা করে দিই!

প্রিয়বর্ধন কিওটা দ্বীপের বিচিত্র সব গল্প বলতে থাকল।

আমি ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছিলুম। এতদিন কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে কত অ্যাডভেঞ্চারে গিয়ে কত না বিপদে পড়েছি। কিন্তু চরম মুহূর্তে উনি ত্রাণকর্তার মতো আমার উদ্ধারে হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে হাজির হয়ে সহাস্যে সম্ভাষণ করেছেন, হ্যাল্লো ডার্লিং! এই দ্বীপে নির্বাসিত হয়েও তার আশা করতে দোষ কী?…

কিন্তু দিনটাই বৃথা কেটে গেল। উদ্ধার হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখলুম না। দুপুরে দুজনে হ্রদের জলে স্নান করলুম। আবার সেই পোড়ামাছের লাঞ্চ। আবার জাহাজের আশায় সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে থাকা। তারপর দিন ফুরিয়ে আসছে দেখে রাতের আশ্রয়ের কথা ভাবতে হল দুজনকে। কাল সকালে বরং ভেলায় ভেসে পাড়ি জমানোর কথা ভাবা যাবে।

এই দ্বীপটা খুবই ছোট। উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে সেটা বুঝতে পেরেছিলুম। হ্রদের অন্যদিকটায় জঙ্গলের ভেতর কালো পাথরের কয়েকটা পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। ওখানে আমরা আরামে রাত কাটানোর মতো একটা গুহা আবিষ্কার করে ফেললাম।

সারাদিন কোনও জনমানুষ দেখিনি। প্রাণী বলতে কয়েকটা গিরগিটি দেখেছি আর এক দঙ্গল শকুন! তারা কী খেয়ে বেঁচে থাকে কে জানে! গুহার ভেতর ঢুকে আগুন জ্বালিয়ে ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচা গেল। এখানকার শুকনো কাঠগুলোর আশ্চর্য গুণ। একটু ঘষলেই ধোঁয়া উড়তে থাকে। সহজে আগুন ধরে যায়।

গুহার ভেতরটা বেশ মসৃণ। দরজাটা বড়। দরজার কাছে বসে প্রিয়বর্ধন লাঠি হাতে পাহারা দিচ্ছিল। একরাশ কাঁচা পাতা আর ঘাস ছিঁড়ে এনে বিছানা করেছে। ক্লান্তিতে ঘুম এসে গিয়েছিল। আমার ঘড়িটা ভাগ্যিস অক্ষত আছে। প্রিয়বর্ধনের ঘড়িটাও অটুট, দিব্যি সময় দিচ্ছে। পালাক্রমে দুজনে ঘুমোব এবং পাহারা দেব।

সবে চোখ বুজেছি। বাইরে অন্ধকার ঘন হয়েছে। গুহার ভেতর আগুনটা ধিকিধিকি জ্বলছে এবং প্রিয়বর্ধন গুনগুন করে কী গান গাইছে অজানা ভাষায়। হঠাৎ তার গান থেমে গেল। চাপা গলায় সে বলে উঠল জয়ন্ত! জয়ন্ত! ঘুমলে নাকি?

 চমক খেয়ে উঠে বসে বললম, কী হয়েছে?

ঝটপট আগুনটা নিভিয়ে ফেলো। এদিকে একটা আলো এগিয়ে আসছে।

প্রিয়বর্ধনের গলার স্বর কঁপছিল। আমি আগুনের কুণ্ডে একরাশ কঁচা পাতা চাপিয়ে দিয়ে দরজায় উঁকি দিলুম। নিচে হ্রদের ধারে সত্যি একটা আলো। তবে আলোটা এগিয়ে আসছে না। থেমে আছে।

.

স্টপ ইট! স্টপ ইট!

একটু পরেই বুঝতে পারলুম ওটা এক স্পটলাইট। প্রিয়বর্ধনকে সেকথা বললে সে কিছুতেই বিশ্বাস করল না। ভয় পাওয়া গলায় বলল, ডাইনির দ্বীপে এমন আলো দেখা যায় শুনেছি। জয়ন্ত, চলো আমরা এ গুহা থেকে পালিয়ে পাহাড়ের পেছনে কোথাও লুকিয়ে পড়ি। ডাইনিটা ঠিকই আমাদের গন্ধ পেয়ে যাবে। শুনেছি, সে নাকি জলজ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে খায়।

সে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। আমার কোনও কথা আমল দিল না। বরং সে পালিয়ে নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার জন্য আমার হাত ধরে টানাটানি শুরু করল।

লোকটা এত কুসংস্কারের ডিপো, ভাবা যায় না! আলোটা যখন বৈদ্যুতিক, তখন আলোর মালিক অবশ্যই সভ্য জগতের মানুষ। শক্ৰমিত্র যেই হোক, মানুষ তো বটে। তাছাড়া এমনও হতে পারে, কোনও মোটরবোট অথবা জাহাজ এসে এই দ্বীপের কাছে ভিড়েছে। উদ্ধার পাওয়ার এমন সুযোগ ছাড়া নয়।

নিজেকে ওর হাত থেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে থাকলুম। প্রিয়বর্ধন পেছনে চাপা গলায় আমাকে যাচ্ছেতাই গালমন্দ দিতে লাগল। আতঙ্কে লোকটার মাথায় গণ্ডগোল হয়ে গেছে হয়তো।

অন্ধকারে চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ হতে পারত, কিন্তু স্পটলাইটটা চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। তাই বারবার হোঁচট খাচ্ছিলুম পাথরে। আছাড় খেতেও হল বারকতক। শেষে এমন আছাড় খেলুম যে গড়াতে গড়াতে একেবারে নিচের ঝোপঝাড়ে পড়ে পোশাক ছিঁড়ে ফর্দাফাই হল। কাটায় শরীরের

অনেক জায়গা ছেড়ে গেল। জ্বালা করছিল ভীষণ।

কিন্তু আমি মরিয়া। ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে দেখি, আলোটা যত কাছে ভেবেছিলুম, তত কাছে নয়। একটা পাথরের ওপর আলোটা রাখা আছে। কিন্তু জনমানুষ নেই। থমকে দাঁড়াতে হল। ওটা কি সত্যি স্পটলাইট?

হ্যাঁ, তাতে তো কোনও ভুল নেই। কারণ আলোর ছটা একটা দিকেই পড়েছে—যেদিক থেকে যাচ্ছি, সেদিকে। আমি এখন কিছুটা বাঁদিকে দাঁড়িয়ে আছি বলে আলোর নাগালে নেই। এবার সাড়া দেওয়া উচিত ভেবে যেই ঠোঁট ফাঁক করেছি, সেই মুহূর্তে হেঁড়ে গলায় কেউ গান গেয়ে উঠল।

তারপর গানটা দুকলি গাওয়া হয়েছে, কেউ তেমনি দুর্বোধ্য ভাষায় তেড়ে ধমক দিল। সঙ্গে সঙ্গে গানটা থেমে গেল। তারপর অনেকগুলো গলায় কারা হেসে উঠল।

তাহলে আলোটার ওপাশে পাথরের পেছনে একদঙ্গল মানুষ আছে। কারা তারা? একটু দোনামোনা হচ্ছিল আমার। ক্যারিবো কিংবা কিয়াংয়ের দলবল নয় তো? গিয়ে ওদের পাল্লায় পড়লে আমার ভাগ্য আবার অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।

প্রায় বুকে ভর করে, কখনও হামাগুড়ি দিয়ে পাথরটার পেছনে গেলুম। তারপর কান পেতে রইলুম। ওরা চাপা গলায় কথা বলছে। একবর্ণও বুঝতে পারছি না। পাথরের ফাঁক দিয়ে ওদের আবছা মূর্তিগুলো চোখে পড়ল। ওরা ছায়ায় হাত পা ছড়িয়ে কেউ বসে বা শুয়ে আছে। কী করা উচিত ভাবছি, আর দরদর করে ঘামছি উত্তেজনায়।

হঠাৎ পেছনে অস্পষ্ট একটা শব্দ শুনে চমকে উঠলুম। ঝটপট ঘুরে বসতেই প্রিয়বর্ধন ফিসফিস করে বলল, চুপ!

লোকটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। ভেবেছিলুম ডাইনির ভয়ে লেজ তুলে পালিয়ে গেছে। গুহা থেকে। অথচ সে দিব্যি আমার পেছন পেছন চুপিচুপি এসে হাজির। ঘাপটি মেরে বসে কিছুক্ষণ কান পেতে কথাবার্তা শোনার পর আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, শয়তান ক্যারিবো!

তাহলে ঠিকই অনুমান করেছিলুম। ভাগ্যিস, হুড়মুড় করে ওদের সামনে গিয়ে হাজির হইনি। আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা শোনার পর প্রিয়বর্ধন আমাকে অনেকটা দূরে নিয়ে গেল। হ্রদের ধারে হাঁটতে হাঁটতে চাপা গলায় বলল, শাপে বর হয়েছে, জয়ন্ত! ক্যারিববা মোটরবোট নিয়ে এখানে হাজির হয়েছে। ঠিক বুঝতে পারলুম না কী একটা গণ্ডগোল ঘটেছে। যতদূর মনে হল, ওরা কিওটা দ্বীপের হদিশ করতে পারছে না। তাই হতাশ হয়ে ঢকঢক করে মদ গিলে মাতাল হচ্ছে।

বললুম, কিন্তু আমরা কোথায় যাচ্ছি?

প্রিয়বর্ধন বলল, স্টেনগানটা থাকলে ক্যারিবো আর তার তিনজন সঙ্গীকে ওখানেই যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিতুম। তারপর দেবী মূর্তিটা উদ্ধার করে ওর মোটরবোট নিয়ে কিওটা অভিযানে পাড়ি জমাতুম! যাক্ গে, চুপচাপ এস। কী করি দেখো না।

হ্রদ্র ঘুরে পুবদিকে গিয়ে ক্যারিবো তার দলবলকে এড়িয়ে প্রিয়বর্ধন আমাকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে গেল। তখনও টের পাইনি ওর উদ্দেশ্য। একটু পরে সেটা জানলুম।

এদিকটায় সমুদ্রের খাড়ি। খাড়ির এককোণে মোটরববাটটা আবিষ্কার করতে দেরি হল না। মোটরববাটে কেউ পাহারা দিচ্ছে না। প্রিয়বর্ধন বলল, স্টার্ট দেওয়ার উপায় নেই। ক্যারিবোর পকেটে চাবি। কাজেই এসো, এটাকে আমরা কোথাও লুকিয়ে রেখে আসি। ওটার মধ্যে বৈঠা আছে। অসুবিধে হবে না। শিগগির!

খাড়ির জলটা অপেক্ষাকৃত শান্ত। দক্ষিণ ঘুরে আমরা মোটরবোটটা সেই গুহাওয়ালা পাহাড়ের পেছন দিকে নিয়ে গেলুম। তারপর সংকীর্ণ আরেকটা খাড়ির ভেতর পাহাড়ের তলার দিকে চওড়া ফাটলের ভেতর লুকিয়ে রাখলুম। প্রিয়বর্ধন মোটরবোটের অন্ধিসন্ধি খুঁজে নিরাশ হয়ে বলল,  ব্যাটারা বৈঠাগুলো বাদে কিচ্ছু রেখে যায়নি। না অস্ত্রশস্ত্র না খাবার-দাবার! মহাধড়িবাজ লোক ওই ক্যারিবো।

অন্ধকারে এবার আমার দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়েছে। বাঁদিকে পাহাড় ভাঙা চাঙড়ের ওপর দিয়ে উঠে যেতে অসুবিধা হল না। পাহাড়টা শদুয়েক ফুটের বেশি উঁচু নয়। এখানে পেছন দিকটা চমৎকার গড়ানে আবার হ্রদের দিকে পৌঁছে প্রিয়বর্ধন একটা প্ল্যান বাতলে দিল।

প্ল্যানটা মারাত্মক। কিন্তু প্রিয়বর্ধনের বুদ্ধিসুদ্ধির ওপর এখন আমার প্রচুর আস্থা জন্মে গেছে। স্পটলাইটটা তেমনি জ্বলছে। আমি চুপিচুপি তখনকার মতো ওটার কাছে এগিয়ে গেলুম। প্রিয়বর্ধন গেল বাঁদিকে হ্রদের কিনারা দিয়ে ঘুরে।

যে পাথরে আলোটা রাখা আছে, তার আড়ালে বসে রইলুম। ক্যারিববারা এখন চুপচাপ। তাদের নাক ডাকা শুরু হতে আরও ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হল। তারপর হাত বাড়িয়ে আলোর সুইচ অফ করে দিলুম এবং স্পটলাইটটা বাগিয়ে ফেললুম।

তারপর গুঁড়ি মেরে অন্য পাশে গিয়ে প্রিয়বর্ধনের শিসের অপেক্ষা করতে হল। একটু পরেই সেই শিস কানে এল। পাল্টা শিস দিলুম। তখন প্রিয়বর্ধন এসে হাজির হল। ফিসফিস করে বলল, মদের নেশায় কাহিল ব্যাটারা। আগে এই মালপত্রগুলো ধরো। তারপর অন্য কথা।

জিগ্যেস করলুম, চাবি হাতাতে পেরেছ তো?

হুঁউ। অনেক কিছুই। আমরা এখন রাজা হতে চলেছি!…

তখন রাত এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। আমাদের মোটরহোট ছুটেছে অকূল সমুদ্রে। প্রিয়বর্ধন যা সব হাতিয়ে এনেছে, তা হল : একটা স্টেনগান, একটা কিটব্যাগ, কিটব্যাগের ভেতর শতিনেক প্যাকেট করা কার্তুজ আর সেই চুরি যাওয়া দেবীমূর্তি। হ্যাঁ, আরও একটা জিনিস হাতিয়ে এনেছে প্রিয়বর্ধন। একটা খাদ্যদ্রব্যের প্রকাণ্ড প্যাকেট। তার ভেতর জ্যাম, জেলি, সসেজ, ফ্রায়েড ফিশের টুকরো, পাঁউরুটি পর্যন্ত। প্রিয়বর্ধন তবু পস্তাচ্ছিল। কেন যে ছাই ওদের কফির ফ্লাস্কুটা নিয়ে এলুম না। আহা, সমুদ্রের বুকে কফি খাওয়ার চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে নেই!

এক সময় জিগ্যেস করলুম, কিন্তু এভাবে আমরা যাচ্ছি কোথায়? একসময় জ্বালানি ফুরিয়ে যাবে, তখন মোটরবোট অচল হয়ে যাবে না?

প্রিয়বর্ধনের আনন্দের ঘোরটা এককথায় যেন কেটে গেল। ঝুঁকে পড়ে মোটরবোটের কম্পাস দেখে নিয়ে বলল, সর্বনাশ! উত্তরে যেতে গিয়ে যে দক্ষিণে চলেছি। জ্বালানি যা আছে, আর অন্তত ঘন্টা তিনেক চলবে।

সে মোটরবোটের মুখ ঘুরিয়ে দিল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, সমুদ্রের এই এলাকায় তীব্র স্রোত আর ঢেউগুলোও রুখে দাঁড়াচ্ছে। যতবার মোড় নেওয়ার চেষ্টা করে মোটরবোট উল্টে যাওয়ার তালে থাকে। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে প্রিয়বর্ধন বলল, যেখানে খুশি যাক্। আর কিছু করার নেই।

আসন্ন বিপদের মুখে আমার বুদ্ধি খুলে গেল। স্পটলাইটটা জ্বেলে দিয়ে বললুম, প্রিয়বর্ধন, তুমি বলছিলে মূর্তিটার ভেতর কিওটা দ্বীপে যাওয়ার নক্সা আছে। একবার সেটা দেখলে হত না? যদি জ্বালানি থাকতে-থাকতেই আমরা সেখানে পৌঁছে যেতে পারতুম।

 প্রিয়বর্ধন মুখ বেজার করে বলল, দেখতে পারো। তবে ক্যারিবোর মতো ঘুঘু যখন হুদিশ করতে পারেনি, তুমি পারবে বলে মনে হয় না।

মূর্তিটা সত্যি অপরূপ। অবিকল আমাদের দেবী সরস্বতীর মতো। হাতে বীণাও রয়েছে। মূর্তিটা পরীক্ষা করে উলটে পালটে দেখেও বুঝতে পারছিলুম না, ওর ভেতরে কিছু থাকতে পারে কি না। সাবধানে মোচড় দিয়ে দেখলুমও প্যাঁচ থাকলে যদি খোলা যায়। কিন্তু মূর্তিটা নিরেট।

হঠাৎ চোখ পড়ল ওটার মাথার পেছনে। একটা পেরেকের মতো। ওটাতে যেই চাপ দিয়েছি, তলার দিকের একটা জায়গা ঢাকনার মতো খুলে গেল। আর ঠকাস করে কী একটা পড়ল নিচের পাটাতনে। কুড়িয়ে দেখি, একটা কাত্তি!

অবিকল একই কাত্তি—যেমনটি রাজাকোর টুপির ভেতর পেয়েছিলুম। একই নকশা। প্রিয়বর্ধন বাঁ হাত বাড়িয়ে কাত্তিটা নিয়ে উলটেপালটে দেখে ফেরত দিল। বুঝলুম, কাত্তি জিনিসটা কী ও জানে না।

কাত্তিটাকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে আবিষ্কার করলুম, নকশাগুলো একদিকে নেমে গিয়ে যেন হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে বেখাপচাভাবে। মাঝখানে একটা তেমনি গাছ আছে, কিন্তু শেকড়গুলো কিনারায় হঠাৎ শেষ হওয়ায় মনে হল, জায়গার অভাবে পুরোটা আঁকা হয়নি, নাকি এটা আঁকিয়ের খেয়াল? ইংরেজি এ বি সি ডি ই এফের পর জিয়ের আধখানা কাটা।

তাহলে কি এটা অন্য একটা কাত্তির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার জন্য? অর্থাৎ রাজাকোর টুপির ভেতর পাওয়া কাত্তিটা না পেলে এটার রহস্য উদ্ধার করা যাবে না?

উলটো পিঠটা দেখামাত্র আমার সংশয় ঘুচে গেল। উলটো পিঠে গাছটা নেই শেকড়গুলো আছে। এ বি সি ডি ই এফ নেই, জি এইচ আই জে কে এল আছে। রাজাকোর কাত্তির উলটো পিঠটা ভাল করে লক্ষ্য করিনি। এর মানে দাঁড়াল : দুটো কাত্তি পরপর মিলিয়ে রাখলে দুপিঠে দুটো শেকড়ওলা গাছ দেখা যাবে এবং বারোটা রোমান হরফ দেখা যাবে চক্রকারে সাজানো।

প্রিয়বর্ধনকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলে সে আরও হতাশ হয়ে পড়ল!…

ভোর চারটেয় আমাদের মোটবোটের জ্বালানি ফুরিয়ে গেল। বৈঠা টানা নিরর্থক। তীব্র সমুদ্রস্রোত আর পেছনের ঢেউয়ের ধাক্কায় বোট গতিহারা হতে পারছে না।

দেখতে দেখতে দিনের আলো ফুটে উঠেছিল। সেই ধূসর আলোয় আমাদের এতক্ষণে চোখে পড়ল সামনে দীর্ঘ একটা কালো রেখা যেন। প্রিয়বর্ধন চেঁচিয়ে উঠল আনন্দে, মাটি! মাটি! আমরা মাটির দিকে চলেছি!

সমুদ্রের চারদিকে চাপচাপ লাল রং। প্রথম সূর্যের আভা ঝলমলিয়ে উঠেছে। প্রিয়বর্ধন মোটরববাটের সামনের ড্রয়ার খুঁজে একটা বাইনোকুলার পেয়ে গেল। দূরবীক্ষণ যন্ত্রটাতে চোখ রেখে সেই কালো রেখাটা দেখার পর সে গম্ভীর মুখে বলল, আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের মৃত্যু হবে জয়ন্ত! ঈশ্বরের নাম জপ করো! ওই মাটি কবরের মাটি।

ঝটপট ওর হাত থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে চোখে রাখলুম। দীর্ঘ আলো, রেখাটা প্রবাল বলয়। খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের ওপর। ডানদিকে অনেকটা জায়গা ভাঙা। আর ভেতর দিয়ে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। দ্বীপের বুকে ঘন জঙ্গল। প্রথম আলোয় সবুজের জেল্লাও চোখে পড়ছিল।

প্রিয়বর্ধন করুণ মুখে বলল, আমদের বোট কোরাল রিফে গিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে গুঁড়ো হয়ে যাবে। কী তীব্র স্রোত দেখতে পাচ্ছ না জয়ন্ত?

বললুম, ওই ভাঙা জায়গায় বোট নিয়ে গেলে বেঁচে যাব। এস প্রিয়বর্ধন, বৈঠা নাও!

প্রিয়বর্ধন অনিচ্ছাসত্ত্বেও বৈঠা নিল। দুজনে প্রাণপণে বৈঠা টেনে বোটের মুখ প্রবাল পাঁচিলের ভাঙা অংশটার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলুম। যত এগিয়ে যাচ্ছি, তত প্রবাল পাঁচিলটা উঁচু মনে হচ্ছে। আন্দাজ শদুই মিটার দূরত্বে পৌঁছে যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। ছিটকে গিয়ে সমুদ্রে পড়লুম। জলে না পড়লে গুড়ো হয়ে যেত এই মরদেহ।

সাঁতার কেটে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলুম ভাঙা অংশটার দিকে। ভেসে থেকে প্রিয়বর্ধনকে খুঁজছিলুম। দেখি, সেও আমার মতো সাঁতার কাটছে। বুঝলুম ড়ুবো পাথরে ধাক্কা লেগে বোটটা ভেঙে-চুরে গেছে। ওলটপালট খেতে কাঠের বড় বড় ফালি ফেনার ভেতর মাছের মতো ভেসে চলেছে প্রবাল পাঁচিলের দিকে। ঢেউ ভাঙার গর্জন, ফেনা, জলোচ্ছ্বাস—চারদিকে যেন প্রলয় চলছে।

তারপর পায়ে শক্ত পাথর ঠেকল। সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে প্রিবর্ধনকে আর দেখতে পেলুম না। কিন্তু তার কথা ভাবতে গেলে নিজের প্রাণ বাঁচানো সংশয়তাছাড়া যাকে দেখতে পাচ্ছি না, তাকে উদ্ধার করব কী ভাবে? জলের ধাক্কায় পিছলে যাচ্ছি বারবার। হাঁচড়-পাঁচড় করে জল ভাঙা অংশটা পেরিয়ে গেলুম। এবার জলটা শান্ত-নিস্তরঙ্গ। সাঁতার কেটে বিচের দিকে এগিয়ে যেতে আর অসুবিধা হল না। মাথা ঘুরছিল। তখন পা ছড়িয়ে চিত হয়ে শুয়ে রইলুম।

আচ্ছন্ন অবস্থায় কতক্ষণ শুয়ে ছিলুম জানি না, এক সময় মনে হল কোথায় যেন অনেক দূরে চাপা গম্ভীর অর্কেস্ট্রা বাজছে। নিশ্চয় এই দ্বীপে কোনও গির্জা আছে। সেখানে এক প্রার্থনা সঙ্গীতের আয়োজন বুঝি। আশ্রয় পাব। খাদ্য পাব। দেশে ফিরে যাব। আনন্দে মন ভরে গেল।

খুব আশা ও উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালুম। বেলাভূমির ওপর দিকে ঘন বনের ভেতর থেকে সেই চাপা গম্ভীর অর্কেস্ট্রাধ্বনি ভেসে আসছে। কিন্তু যেই কয়েক পা এগিয়ে গেছি, কেউ খ্যানখেনে গলায় চেঁচিয়ে বলল, স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে-স্টপ ইট!

.

অলীক আর্তনাদ

স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে-স্টপ ইট!

একবার নয়, বারবার কেউ ভূতুড়ে গলায় ধমক দিতে থাকল। সেই কণ্ঠস্বর যে মানুষের নয়, আমি হলফ করে বলতে পারতুম। থমকে দাঁড়িয়ে গেছি এবং ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে-স্টপ ইট-ঝাঁকুনি খেতে খেতে শব্দগুলো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। চারদিকে প্রতিধ্বনির মতো। তারপর তাদের তীব্রতা ক্ষয়ে যাচ্ছে। হেঁপা রোগীর মতো শ্বাস-প্রশ্বাস জড়ানো গলায় মাথাকুটে নিষেধ করার ভঙ্গিতে কেউ কাউকে কিছু করতে বারণ করছে। তারপর শব্দগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসে মিশে যেতে থাকল। স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে-স্টপ ইট! তারপর যেন বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে গেল।

সেই চাপা গম্ভীর অর্কেস্ট্রার বাজনার দিকে কান গেল এবার। বাজনাটাও ততক্ষণে ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মনে হল, যেন আমার মাথার ভেতরই সেই আশ্চর্য সুন্দর সঙ্গীত শুনছি…অসংখ্য ঝিল্লির ডাকের মতো, অতি মৃদু, শ্রুতিপারের সেই ধ্বনি।

তারপর তাও একইভাবে মিলিয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য আমার মনে কী এক অনুভূতি ঝিলিক দিল। এ আমি কোথায় এসে পড়েছি তাহলে? আমার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে সকাল-বেলার শান্ত নরম রোদে সবুজ বনভূমি ঝলমল করছে। উঁচু ও নিচু, ছোট এবং বড়, স্থূল এবং শীর্ণ নানা আকৃতির উদ্ভিদ। তাদের অনেকেই থরে থরে ফুলে ফুলে সাজানো। মাটির ঘাসে ফলের গয়না পরে পরীদের মতো পা ছড়িয়ে বসে আছে কেউ কেউ। সুগন্ধে বাতাস মউমউ করছে। চারদিকে এখন যেন শব্দহীন হাসি, যেদিকে তাকাই সেদিকেই বালক-বালিকারা খুশিখুশি মুখে এক বিদেশি অতিথিকে বরণ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে বলে ভুল হয়। কোথাও দেখি সারবদ্ধ ঋজু বৃক্ষ প্রাজ্ঞ মানুষের গাম্ভীর্য নিয়ে আমাকে নিরীক্ষণ করছে। কোনও-কোনও বৃক্ষ যেন ভ্রু কুঞ্চিত করেছে—সন্দেহকুটিল সংশয়ান্বিত ভঙ্গি। ফলভারে নুয়ে পড়া এক বৃক্ষ বুঝি জননীর স্নেহে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তরুণ বৃক্ষেরা তাদের বলিষ্ঠ পেশল বাহু বাড়িয়ে হয়তো আমাকে আলিঙ্গন করতে চাইছে। এ আমি কোথায় এলুম? প্রতিটি ঝোপঝাড়, গাছ, ঘাসের শব্দহীন ভাষা যেন আমার বোধের ভেতর স্পষ্ট হয়ে উঠছে। লক্ষ লক্ষ কথা নিঃশব্দে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমার মস্তিষ্কে—মস্তিষ্ক থেকে মনে সেই সব দুজ্ঞেয় কথা স্পন্দনের হ্রস্ব-দীর্ঘ তরঙ্গিত রেখায় বিচিত্র কোডের মতো জমে উঠছে আমার মস্তিষ্ককোষে। এ বুঝি এক অদৃশ্য বেতার তরঙ্গ। কিন্তু ডি-কোডিং পদ্ধতি আমার জানা নেই বলে অর্থ নিষ্কাশন করতে পারছি না। অসহায় ব্যর্থ বিষণ্ণ এক মানুষ ঘটনাচক্রে এসে পড়েছি এক বিরাট মৌন চেতনার দরজায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি আর তাকিয়ে আছি।

হঠাৎ আমার তন্ময়তা কেটে গেল। স্বপ্নবৎ আচ্ছন্নতা ঘুচে গেল। মুহূর্তের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠল একটা জ্ঞান—যা এতক্ষণ আমার নাগালেই ছিল, অথচ গ্রাহ্য করিনি। আর সেই জ্ঞান আমাকে কিছুক্ষণের জন্য উত্তেজনায় আনন্দে বদ্ধ উন্মাদে পরিণত করে ফেলল। আমি বিজ্ঞানী

আর্কিমিডিসের ইউরেকা বলে চিৎকার করে ছোটাছুটি করার ভঙ্গিতে কিওটা! কিওটা! বলে। চেঁচাতে চেঁচাতে এবং দুহাত তুলে লম্ফঝম্ফ করতে করতে দৌড়ে গেলুম। অপেক্ষাকৃত ফাঁকা তংশ দিয়ে ঢুকে একটা খোলামেলা সবুজ মাঠের ওপর ধপাস করে পড়ে বারকতক গড়াগড়ি খেলুম। তারপর আবার দৌড়ুতে শুরু করলুম। আমি সত্যি সত্যি বদ্ধ পাগলের মতো চিঙ্কার করছিলুম, কিওটা! কিওটা! কিওটা!

হ্যাঁ, এই সেই আশ্চর্য দ্বীপ কিটা। কোথাও রঙ্গো-রঙ্গো পুঁথিতে বর্ণিত স্পিকিং উডস—কথা বলা বনের দেশ। এই সেই প্রাচীনযুগের নাবিকদের কিংবদন্তির দ্বীপ সঙ্গীতকারী বৃক্ষের বাসস্থান কিওটা!

ঘাসের ভেতর লুকিয়ে থাকা পাথরে ঠোক্কর খেয়ে ছিটকে পড়লুম। সঙ্গে সঙ্গে উন্মাদনাটা কেটে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়ালুম। নিজের পাগলামির কথা ভেবে খারাপ লাগল। এবার আমার সবচেয়ে জরুরি জিনিস হল মানসিক সুস্থতা।

ঘাসের মাঠটা বিশাল। এখানে-ওখানে উজ্জ্বল নানা রঙের পাথর ছড়িয়ে আছে। কোথাও একলা কোনও গাছ বা ঝোপ, কোথাও নিবিড় উঁচু ঘাস। একটা নিচু ঝাকড়া গাছে আপেলের মতো ফল ধরে আছে দেখে সেদিকেই এগিয়ে গেলুম। ওগুলো ব্রেডক্রুট বলে মনে হচ্ছিল। কয়েক পা যেতেই এক অবাক কাণ্ড ঘটল। রুবিদ্বীপে রাজাকোর জাদুঘরে ব্যুমেরাং-আকৃতির যে জ্যান্ত জিনিসটা দেখেছিলুম, কর্নেলকথিত সেই কাঠকার-এর একটা ঝক ঘাসের ভেতর থেকে লাফিয়ে উঠল। তারপর দল বেঁধে লাফাতে লাফাতে উঁচু ঘাসবনের ভেতর গিয়ে ঢুকল।

ফলের গাছটার তলায় চওড়া বেদির মতো পাথর। সেটাতে চড়ে একটা ফল ভাঙতে হাত বাড়িয়েছি, একটা হাতে ডাল ধরে নুইয়ে রেখেছি, অমনি ডালটা আমার হাত ছাড়িয়ে সটান সোজা হয়ে গেল। নাগাল পেলুম না। তারপর যে ডালটা ধরতে যাই, একই কাণ্ড। গাছটা প্রাণীর মতো জ্যান্ত এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালনে সক্ষম দেখে হতবাক হয়ে গেলুম। একটু পরে গাছটার সবগুলো ডাল সোজা হয়ে গেল। প্রকাণ্ড এবং বেঁটে তালগাছের মতো দেখাল গাছটাকে। আমি তার দিকে চেয়ে কাকুতিমিনতি করে বললুম, লক্ষ্মী ভাইটি! বড্ড খিদে পেয়েছে। অমন কোরো না।

আমার দুর্ভাগ্য, মানুষের ভাষা ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারলুম না। ইশারা-ইঙ্গিত করে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে সত্যি আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। কিন্তু হতচ্ছাড়া গাছটা তেমনি সাধুর মতো ঊর্ধ্ববাহু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লোভনীয় রঙিন ফলগুলি আমার নাগালের বাইরে উঁচুতে দুলতে থাকল।

এতক্ষণে আমার মাথায় এল, এর মধ্যে হয়তো আজগুবি ব্যাপার নেই। লজ্জাবতী লতার মতো কোনও প্রকৃতিক নিয়মেই গাছটার মধ্যে সংকোচন ঘটেছে আমার ছোঁয়ায়। গাছটার খুঁড়িতে খোঁচাখোঁচা কাটাও রয়েছে। একটু তফাতে সরে গিয়ে একটুকরো পাথর কুড়িয়ে নিলুম। পাথরটা ছুঁড়তে যাচ্ছি, হাতের তালু ছ্যাক করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পাথরটা ফেলে দিলুম। তারপর দেখি, ও হরি! ওটা আদতে পাথরই নয়—ধূসর রঙের একটা প্রজাপতি। ডানা গুটিয়ে পড়েছিল ঘাসের ফাঁকে। ভারি অদ্ভুত প্রজাপতি তো!

এবার কালো রঙের সত্যিকার একটা পাথর কুড়িয়ে নিলুম। পাথরটা ফল লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলুম। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। ফলগুলোও যেন অসম্ভব ধূর্ত। পাথরের লক্ষ্যপথ থেকে কেমন ঝটপট সরে যাচ্ছে।

অনেকক্ষণ চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলুম। এতক্ষণে আবিষ্কার করা গেল, এই দ্বীপে নারকোল গাছ নেই। শুধু তাই নয়, এখানকার সব গাছ—সমস্ত উদ্ভিদ যেন অন্যরকমের। কোনওটাই আমি এর আগে দেখিনি কোথাও। এমনকী যে ঘাসগুলো আমি মাড়িয়ে এলুম, সেগুলোও আমার অচেনা। যত রকমের ঘাস আজীবন দেখেছি, তার সঙ্গে কোনও মিল নেই এ ঘাসের। ভেলভেটে বোনা পুরু এবং নকশাদার এই ঘাসের সৌন্দর্য বিস্ময়কর। লক্ষ্য করে দেখলাম, কোথাও রুগ্ণ, হাড়জিরজিরে কোনও গাছ নেই। প্রত্যেকটি সবল, নিটোল, বর্ণাঢ্য—যেন ছবিতে যত্ন করে আঁকা।

একটা প্রকাণ্ড গাছের গায়ে হাত রেখেই চমকে উঠলুম। কোনো প্রাণীর গায়ে হাত রাখলে যে। অনুভূতি অবিকল। বৃক্ষের প্রাণ আছে সে তো জানি। কিন্তু এত প্রাণ! এত তীব্র চেতনা! আমার দিকে তাকিয়ে আছে তীব্র চেতনাসম্পন্ন উদ্ভিদরূপী প্রাণীশূথ যেন।

একটা ঝোপে আঙুরের গুচ্ছ গুচ্ছ ফল দেখে সেদিকে ব্যস্তভাবে ছুটে গেলুম। গোলাপি রঙের সুন্দর ফলগুলি রসে টলটল করছিল। কিন্তু হাত বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল, কে যেন নিষেধ করছে।

কোনও কণ্ঠস্বর শুনিনি অস্বাভাবিক নির্জনতা ছমছম করছে চারদিকে। অথচ আমার মনে হল, আমার মাথার ভেতর ঝিঝি পোকার মতো শ্রুতিপারে এক অনুভূতিময় সুর একটা নিষেধাজ্ঞা শোনা যাচ্ছে। কে যেন বলছে, ওই সুন্দর ফলগুলো বিষাক্ত।

মন থেকে ধারণাটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলুম না। একি আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের বোধ? সঠিক বলা কঠিন। যে বোধ মানুষকে অনেক সময় বিপদের পূর্বাভাস দিয়ে সতর্ক করতে চায়, এ কি সেই বোধ? প্রাণীদের মধ্যে এই বোধ এখনও লুপ্ত হয়নি – প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষও হয়তো এই ক্ষমতার অধিকারী ছিল। কিন্তু সেই বোধ আমার মতো একজন সভ্য জগতের আধুনিক মানুষের মধ্যে টিকে আছে—নাকি কিওটা দ্বীপে পৌঁছনোর পর কোনও প্রকৃতিক নিয়মে তা ফিরে এসেছে। আমার মধ্যে?

ব্যাপারটা যাই হোক, ফলের ঝোপটার সঙ্গে আমার যেন একটা টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ ঘটছিল। আমি সেখান থেকে হতাশ হয়ে সরে গেলুম অন্যখানে।

খাদ্যের সন্ধান আমাকে করতেই হবে। বরং সমুদ্রের ধারে গিয়ে দেখি, যদি মাছ মারতে পারি।

গাছপালার ফাঁক দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছিল। এদিকটায় জঙ্গল খুব ঘন। অসংখ্য গাছ বুড়ো হয়ে ভেঙে পড়েছে কালক্রমে। তার ওপর আবার গাছের চারা গজিয়েছে। এতক্ষণে পাখির ডাক কানে এল। তাহলে কিওটাতে প্রাণীও আছে! মনে হল, দ্বীপের পাখিরা আমার মতো এক আগন্তুককে দেখে যেন ভয় পেয়ে এতক্ষণ আড়ালে সরে গিয়েছিল। ক্রমশ সাহস পেয়ে তারা একে একে বেরিয়ে আসছে এবং মন খুলে গান গাইতে শুরু করেছে। কিন্তু চেষ্টা করেও একটা পাখি আমার চোখে পড়ল না।

তারপর একটা ময়াল জাতীয় প্রকাণ্ড সাপকে একটা গাছের ডালে ঝুলতে দেখলুম! হ্যাঁ—সাপও আছে। কিওটা তাহলে মানুষের পক্ষে একটা নিরাপদ জায়গা নয়। এক দৌড়ে সমুদ্রের ধারে গিয়ে হাজির হলুম। এবার সাপের কথা ভেবে বুক ঢিপঢিপ করছিল।

সূর্যের অবস্থান দেখে বুঝতে পারলুম এদিকটা উত্তর দিক। আমি দ্বীপে এসেছি পূর্বদিক থেকে। সামনে বিস্তীর্ণ জলের পর প্রবাল পাঁচিল কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার বাঁদিকে টানা বিচ। ক্রমশ ঘুরে গেছে দক্ষিণে। বিচের বাঁকের মুখে পাহাড়ি খাড়ি। এখানে জলটা তত পরিষ্কার নয়। ঢেউয়ের চোটে বালি ভেসে উঠেছে। চাপচাপ শ্যাওলা জাতীয় গাছ আছে জলের ভেতর। তাই ভাবলুম, খাড়ির জলটা পরিষ্কার হতে পারে। ওখানে পাথরের ফাঁকে নিশ্চয় মাছের ঝাঁক চোখে পড়বে।

যেতে যেতে বাঁদিকে জঙ্গলের ভেতর বেহালার বাজনা শুনে থমকে দাঁড়ালুম। সত্যি বাজছে, নাকি কানের ভুল, ঠিক করতে পারলুম না। কিন্তু বড় করুণ সুর সেই অলীক বেহালার। এ এক আশ্চর্য মায়াজগৎ যেন, যেখানে যখন তখন বেজে ওঠে গম্ভীর, অর্কেস্ট্রাধ্বনি কিংবা বেহালা সুর। বিচিত্র অনুভূতি জেগে ওঠে মনে। আবেগে হৃদয় দুলতে থাকে। সুরটা শুনতে শুনতে আমার চোখে জল এসে গেল।

কিন্তু সব মিথ্যা পেট সত্য। বহুকাল আগেই পথের ধারে এক দেহাতী ম্যাজিশিয়ানের মুখে খেলার শেষে শুনেছিলুম এই পরম সত্য কথাটা। খিদে আর তেষ্টার কথা সম্ভবত যত ভাবা যায়, তত বেড়ে ওঠে। ক্যারিববার রুটি-জ্যাম-সসেজ সেই মধ্যরাতে সমুদ্রের বুকে সাবাড় করেছি। এখন সেকথা ভেবে জিভে জল আসছিল। অদৃশ্য বেহালাবাদক সেটা টের পেয়েই যেন হঠাৎ বাজনা বন্ধ করে দিল।

বাঁকের মুখে খাড়ির ধারে এসেই মন নেচে উঠল। পাহাড়ের মাথায় একখানে সাদা একটা রেখা দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলুম। না—চোখের ভুল নয়। ওটা একটা ঝরনা। সরু ফিতের মতো নেমে এসে লোনা খাড়ির জলে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে।

এরপর নিজের তৎপরতায় নিজেরই অবাক লাগছিল। খাড়িতে বড় বড় পাথর পড়ে আছে। তার ফাঁকে অতি স্বচ্ছ জলে ম্যাকারেল জাতীয় মাছের ঝাঁক খেলা করছিল। পাথর মেরে একটাকে বধ করতে দেরি হল না। মাছটার ওজন কমপক্ষে শদুই আড়াই গ্রাম না হয়ে যায় না।

প্রিয়বর্ধনের পদ্ধতিতে দু- টুকরো শুকনো কাঠ ঘষে আগুন জ্বেলে মাছটা পুড়িয়ে রাক্ষসের মতো খেলুম বিচে বসে। তারপর পাহাড়ে চড়া শুরু হল। মাউন্টেনিয়ারিং ট্রেনিং নেওয়াটা এভাবে কত জায়গায় কাজে লেগেছে বলার নয়। ঝরনার কাছ ঘেঁষে একটা চাতাল মতো জায়গা দেখতে পেলুম। সেখানে পৌঁছে প্রাণ ভরে জল খেয়ে দ্বীপের দিকে ঘুরে দাঁড়ালুম।

আগের দ্বীপটার চেয়ে এই দ্বীপটা বহুগুণে বড়। উঁচু থেকে ভূ-প্রকৃতি ঠাহর হচ্ছিল। মাঝে মাঝে ভোলা মাঠ, আবার বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসের জমি। পাখির ঝাক চোখে পড়ছিল। এই তাহলে সেই আশ্চর্য দ্বীপ কিওটা।

এবার একটু ভাবনায় পড়ে গেলুম। আমি হয়তো চেষ্টা করলে জর্জ ব্যুগেনভিলির মতো ভেলা তৈরি করে সমুদ্রে ভাসতে পারি—কোনও জাহাজ দৈবাৎ আমাকে দেখে উদ্ধার করলেও করতে পারে, নয়তো হাঙরের পেটে হজম হয়ে যেতে পারি। এই আশ্চর্য আবিষ্কার আমি লাগাতে পারব না। আমি বিজ্ঞানী নই। কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের মতো সাধারণ বিজ্ঞান সম্পর্কেও আমার তত বোধবুদ্ধি নেই। তাহলে এই অবিষ্কার মানুষের অতীতকালের এক কিংবদন্তিকে পুষ্ট করা ছাড়া আর কী কাজে লাগবে?

হতাশা পেয়ে বসল ক্রমশ। কর্নেলের কথা ভাবতে থাকলুম। ধুরন্ধর প্রাজ্ঞ বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি এখন কোথায়? আমার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া নিয়ে হয়তো সূত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে হন্যে হচ্ছেন রুবিদ্বীপে। কিওটা পৌঁছনোর যত চেষ্টা করুন, দ্বিতীয় কাত্তিটার অভাবে পথ খুঁজে পাবেন না—এটা নিশ্চিত।

শুধু একটাই আশা। কর্নেল চিরদিন রহস্যময় অজানার সন্ধানে পাড়ি জমাতে পিছপা হননি। অসাধারণ তাঁর বুদ্ধির চাতুর্য। তাঁর মেধা তুলনাহীন।

ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম কখন সেই চাতালে। ঘুম ভেঙে দেখি, বিকেল হয়ে গেছে। কী লম্বা ঘুম না ঘুমিয়েছি তাহলে। মাছটা দেখছি খিদে মেটাতে অদ্বিতীয়। কী মাছ কে জানে, মনে হচ্ছে খিদে জিনিসটা চিরকালের মতো শেষ হয়ে গেছে। শরীর ঝরঝরে লাগছে। স্ফূর্তিতে পেশি,  চনমন করছে! চাতাল বেয়ে সমুদ্রের বিচে নামতে থাকলুম। কেউ আমাকে দেখলে পাগল ভাবতে পারত। ফর্দাফাই পোশাক, খালি পা, রুক্ষ চিটচিটে চুল।

নিচে বড় বড় পাথরের টুকরোর ভেতর গাছপালা আর ঝোপ গজিয়ে রয়েছে। সেখানে যেই পৌঁছেছি, ডান দিকে জঙ্গলের ভেতর কেউ চেরা গলায় আর্তনাদ করে উঠল—ও ডোন্ট কিল মি! তারপরই কেউ গর্জন করে বলল, মাস্ট কিল ইউ! কিল ইউ…কিল ইউ.এবং আর্তনাদের পর আর্তনাদ-হেল্প! হেল্প! হেল্প!

সারা বনভূমি জুড়ে কিল এবং হেল্প কথা দুটো জড়িয়ে যেতে যেতে প্রতিধ্বনিত হতে হতে ছড়িয়ে পড়ছে। উত্তেজনায় আবার সেই উন্মাদনা আমাকে পেয়ে বসল। একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দৌড়ুতে শুরু করলুম। লোকটাকে বাঁচানোর জন্য আমি মরিয়া।…

.

স্বপ্ন কিংবা স্বপ্ন নয়

ফাঁকা মাঠে গিয়ে পড়তেই হত্যাকারীর অমানুষিক গর্জন আর আক্রান্তের আর্তনাদ ক্রমশ মিলিয়ে গেল। অমনি আমার সম্বিৎ ফিরে এল। মনে পড়ে গেল সকালের সেই স্টপ ইট বলে ধমকের কথা। কিওটা দ্বীপে এইসব অদ্ভুত চিৎকার-চেঁচামেচি যে নিছক অতীতের কিছু ঘটনার অলীক প্রতিধ্বনি, তাতে ভুল নেই। হাতের পাথরটা ফেলে দিলাম।

কিন্তু অবাক লাগল নিজের এই উত্তেজনা আর উন্মাদনা দেখে। আমি কি খুব শিগরির পাগল হয়ে যাব? এই অত্যাশ্চর্য দ্বীপ আমাকে বদ্ধ পাগলে পরিণত করে ফেলবে, যদি না আমি সচেতন থাকি প্রতিমুহূর্তে। খাড়ির ধারে যেতে যেতে সকালে করুণ বেহালার সুর শুনে আমি তো কেঁদে ফেলেছিলুম! ভাগ্যিস প্রচণ্ড খিদে আমার মানসিক সুস্থতা ফিরিয়ে দিয়েছিল।

শান্তভাবে দাঁড়িয়ে ভাবছিলুম, আমি জয়ন্ত চৌধুরি। কলকাতার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক। ঘটনাচক্রে এই ভূতুড়ে দ্বীপে এসে পৌঁছেছি। আমার মাথাটা ঠিক রাখতেই হবে। এইসব বিচিত্র, প্রাণবন্ত ও সচেতন উদ্ভিদের ব্যাপার-স্যাপার খুঁটিয়ে জানতে এবং বুঝতে হবে। ভড়কে যাওয়া চলবে না।

আমার খুব কাছেই একটা ফুট চারেক উঁচু চওড়া পাতাওয়ালা ঝোপ ছিল। তার ডগায় বেগুনি রঙের থোকা থোকা ফুল। ফুলের উঁটিগুলো শুড়ের মতো দেখতে। হঠাৎ সুড়সুড়ি খেয়ে চমকে উঠে দেখি, কয়েকটা ফুলওয়ালা শুড় আমার ছেড়া শার্টের ভেতর দিয়ে পাঁজরে ঘষা খাচ্ছে। একটু সরে গেলুম। শুড়গুলোও আমার নাগাল পেতে ঘুরে এল। কী করে দেখার জন্য আমি হাত বাড়িয়ে দিলুম। আমার হাতটা পেঁচিয়ে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে ছাড়িয়ে নিলুম এক ঝটকায়। তারপর দেখি ঝোপটা ভীষণ কাঁপতে কাঁপতে এপাশে ওপাশে লুটোপুটি খাওয়ার তাল করছে।

সঙ্গে সঙ্গে টের পেলুম, ঝোপটা তার নিঃশব্দ ভাষায় খিলখিল করে হাসছে। আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করছিল বুঝি—আমার ভয় পাওয়া দেখে এখন হেসে বাঁচে না। আমি ভেংচি কেটে বললুম, লজ্জা করে না হাসতে? আমার মতো দুর্ভাগার সঙ্গে রসিকতা করতে একটুও বাধছে না?

রাগ করে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা তফাতে চলে গেলুম। এখানে পায়ের তলায় ঘাস যেন ঘাস নয়। মখমলে মোড়া ফোম। কয়েক টুকরো পাথরের ভেতর থেকে একটা লিকলিকে গাছ। উঠেছে—আমার মাথার সমান উঁচু। পাতাগুলো দেবদারুর মতো দেখতে। গাছটায় পিচফলের মতো অজস্র ফল ধরে আছে। দেখা যাক, এই গাছটা আমাকে একটা ফল দেয় নাকি।

ভাবা মাত্র গাছটা আমার দিকে ঝুঁকে এল এমনকি একটা ফলে ভর্তি ডাল এগিয়ে এসে আমার ঠোঁট স্পর্শ করল। মুখ সরিয়ে নিতে গিয়ে মনে হল, এই দয়ালু বৃক্ষ মশায় আমাকে যখন তার ফল খাওয়াতেই চাচ্ছে, তখন প্রত্যাখ্যান করাটা উচিত হবে না। তাকে আরও পরীক্ষা করার জন্য আমি হাঁ করলুম। একটা থোকা এসে আমার মুখের ভেতর ঢুকে গেল।

আহা, কী অপূর্ব স্বাদ ফলগুলোর। কয়েক থোকা ফল সাবাড় করে গাছটাকে সাষ্টাঙ্গে একেবার প্রণিপাত করে ফেললুম। তারপর দারুণ স্ফূর্তি লাগল। খোলা বিরাট মাঠটায় দৌড়তে শুরু করলাম। কখনও ডিগবাজি খেয়ে, কখনও ছুটোছুটি করে একটি ধেড়ে শিশু হয়ে পাখির ঝকের পেছনে তাড়া করে সে এক উদ্দাম স্ফূর্তি।

তারপর গান গাইতে ইচ্ছে করল। তার পরে গান ধরলুম—মাথায় যা এল, সেই কথা দিয়ে অগড়ুম-বাগড়ুম একখানা বিকট গান।

স্বগ্‌গে এসে গেছি ভাইরে
স্বগ্‌গে এসে গেছি হো হো স্বগৃগে এসে গেছি।

কতক্ষণ পরে আমার সম্বিৎ ফিরল। থমকে দাঁড়ালুম। এ আমি কী করছি। সর্বনাশ পাগলামির লক্ষণ যে ফুটে বেরুচ্ছে আমার আচরণ! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। কখন বিকেলে গাঢ় পাটুকিলে রঙের রোদ ফুরিয়ে ধূসরতা ঘনিয়ে উঠেছে। চারপাশে নীলাভ কুয়াশা জমে উঠেছে। আমার পায়ের কাছে ঠাহর করে দেখি, ব্যুমেরাং গড়নের কাঠপোকাদের দল ঘাসে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে। আঁতকে উঠে সরে গেলুম।

তারপর সোজা পুবের বিচের দিকে হনহন করে চলতে থাকলুম। ওদিকটা ফঁকা। সমুদ্র জুড়ে আবছা লালচে আভা মিলিয়ে গেল। প্রবাল পাঁচিলের ভাঙা অংশটার ওপারে দিগন্ত রেখা আর চেনা যাচ্ছিল না। কিন্তু বাতাসটা কেমন যেন ঈষদুষ্ণ ফুলের সুন্দর গন্ধ সন্ধ্যার মুখে আরও ঝাঁঝালো হয়ে উঠেছে। ওপর দিকটায় পাথরের চওড়া চাতাল মতো একটা জায়গায় বসে পড়লুম।

শুঁড়ের মতো শিসওয়ালা সেই বেগুনি ফুলের আচরণের কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল। ফলদাতা শীর্ণ গাছটার কথাও। এর একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা থাকা উচিত বৈকি। কোনও লতানে গাছ কোনও জিনিসকে আঁকড়ে ধরে পেঁচিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করে। এতে তার বহুক্ষণ সময় লাগে। এমন যদি হয়, লতানে গাছটার এই গতিকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কী হবে? ওই বেগুনি ফুলের শিসের মতোই আচরণ করবে না কি? তাকে ঝাকুনি দিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছিলুম মনে। পড়ছে। একটা ব্যাখ্যা এ থেকে মেলে। আমার শরীর থেকে খানিকটা গতিশক্তি সঞ্চারিত হয়েছিল গাছটার মধ্যে। তার সঙ্গে যদি তার নিজের গতিশক্তি যোগ করা হয়, তাহলে দ্বিগুণ গতির চাপে সে কঁপবে, কিছুক্ষণ ধরে আন্দোলিত হবে। এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার।

আর ওই ফলের গাছটার মধ্যে এমন কোনও উপাদান আছে, আমার শরীরের কোনও উপাদান যাকে আকর্ষণ করতে পারে। হয়তো আমার মুখের ভেতর সেই আকর্ষণ জিনিসটা আছে—চুম্বকের মতো তার টান।

আমার সাধারণ বুদ্ধিতে এইসব ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেললুম। সেই চিৎকার-চেঁচামেচির একটা ব্যাখ্যা আগেই এসেছে। এ বিশ্বের স্পেস বলতে যা বোঝায়, তা কিন্তু আদতে শূন্য নয়। আধুনিক বিজ্ঞানীর মতে, শূন্যস্থান বলে কিছু নেই। আর স্পেসে সব ধ্বনি আসলে স্পন্দনের তরঙ্গরেখা হয়ে অনন্তকাল আঁকা থেকে যায়। তেমনি সব দৃশ্যের চিত্ররূপও হয়তো স্থানকালব্যাপী অক্ষয় হয়ে থাকে। হিরোশিমায় অ্যাটম বোমা পড়ার সময়কার দৃশ্যগুলি পরবর্তী সময়ে বহুরাত্রে ভেসে উঠতে দেখা গেছে। ঠিক তেমনি করে বহু বছর আগের কোনও চিকার এই কিওটা দ্বীপের উদ্ভিদের কোষে কোষে তরঙ্গরেখা হয়ে গ্রামোফোন রেকর্ড বা ক্যাসেট টেপের মতো আঁকা হয়ে গেছে। কোনও কোনও সময় প্রাকৃতিক কারণেই রেকর্ডগুলি বেজে ওঠে। প্রকৃতিতে তো সত্যি করে ধ্বংস বলে কিছু নেই। একদিক থেকে যা ধ্বংস, অন্যদিক থেকে তাই সৃষ্টি। কোনও কিছু শূন্যে নিঃশেষিত হওয়ার নয়। সবকিছুর রূপান্তর আছে, ধ্বংস নেই।

কিন্তু কবে কতবছর আগে কে কাকে নিষেধ করেছিল স্টপ ইট বলে? কী করছিল অন্য লোকটি যে, তাকে থামতে বলতে হয়েছিল? আর কেই বা আই মাস্ট কিল ইউ বলে হিংসায় গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কার ওপর? তারা কারা? ভাষা শুনে মনে হয় তারা ইংরেজ। নিশ্চয় দ্বীপের কোথাও তাদের কোনও চিহ্ন এখনও খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রিয়বর্ধন বলেছিল, এই দ্বীপে নাকি জলদস্যুদের গুপ্তধন লুকানো আছে। তারা কি একদল জলদস্যু? প্রবাল পাঁচিলে ধাক্কা লেগেই কি জাহাজ ড়ুবি হয়ে তারা এই দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিল?

হঠাৎ কোথায় ক্ষীণ সুরে মাউথ অর্গান বেজে উঠল। আমি আর বসে থাকতে পারলুম না। সুর লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলুম আবছা অন্ধকারে। সুরটা আসছে সোজাসুজি দক্ষিণ দিক থেকে। বিচ ধরে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে তাকালাম। তারপর চেঁচিয়ে বললুম, কে তুমি?

বাজনা থেমে গেল। কয়েকবার অকারণে ডাকাডাকি করে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলুম। জলের ধারে পৌঁছতেই কালো একটা জিনিস চোখে পড়ল। একটু ঝুঁকে দেখেই চমকে উঠলুম। মানুষই বটে। অমনি মনে হল, প্রিয়বর্ধন নয় তো? প্রিয়বর্ধন হতেও পারে, নাও পারে। কিওটা দ্বীপে সব কিছু উলটোপালটা ব্যাপার।

কিন্তু আজ সারাটা দিন একটা অদ্ভুত মানসিকতা নিয়ে কাটিয়েছি। প্রিয়বর্ধনের কথা যেন ভুলেই গিয়েছিলুম। কদাচিৎ তার কথা মনে পড়লেও আমল দিইনি। আসলে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থেকেছি। ইশ! কী অকৃতজ্ঞ আমি! আমি দিব্যি তীরে পৌঁছুতে পারলুম আর সে-বেচারা কোথায় অসহায় হয়ে ভেসে গেল—তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা দূরে থাক, তাকে খুঁজে দেখার চেষ্টাও করলুম না।

নিজের ওপর খাপ্পা হতে নিঃসাড় দেহটার গায়ে হাত রাখলুম। বুকে স্পন্দন অনুভব করে বোঝা গেল, যাই হোক, লোকটা মরেনি। কিন্তু এই অন্ধকারে যে প্রিয়বর্ধন কি না বোঝার উপায় নেই। লোকটিকে কিছুক্ষণ উত্তাপ দিতে পারলে তার জ্ঞান ফিরে আসবে। কিন্তু অন্ধকারে শুকনো কাঠ খুঁজে আনাই সমস্যা। পা দুটো জলে এবং শরীর ডাঙায় পড়ে আছে লোকটার। ঢেউ এসে তার পায়ের ওপর আছড়ে পড়ছে। তবে অনুমান, জোয়ার ও ভাঁটার মাছামাঝি সময়ে লোকটা এখানে পৌঁছেছে। কিংবা এমনও হতে পারে ঢেউয়ে ভেসে এসেছে। আবার ভেসে যেতে পারে জোয়ারের টানে।

বালির ওপর তাকে টানতে টানতে উঁচু জায়গায় নিয়ে গেলুম। তারপর কী করা যায় ভাবছি, হঠাৎ লোকটা অস্পষ্ট শব্দ করল।

তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে চেতনা ফেরানোর চেষ্টা করলুম। কিন্তু আর কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।

তাকে ফেলে চলে যেতে পারি না—আর যাবই বা কোথায়? একটু তফাতে আমি বালির ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়লুম। অচেতন হোক, কিংবা মরাই হোক, জনমানহীন দ্বীপে মাঝে মাঝে ওইসব ভৌতিক চিৎকার আর বাজনার মধ্যে অন্তত একজন মানুষের কাছে শুয়ে থাকাটা অনেক ভাল। মনে জোর পাওয়া যায়।

ঘুম ভাঙল রোদের তাপ লেগে। সঙ্গে সঙ্গে আমার সঙ্গীর কথা মনে পড়ল। ধুড়মুড় করে উঠে। দেখি, তার পাত্তা নেই।

এ-তো ভারি ভয়ের কথা! কোনও জন্তুজানোয়ারে তুলে নিয়ে যায়নি তো? এদিকে ওদিকে তাকিয়ে তাকে খুঁজছি, সেই সময় অজানা ভাষায় একটা চেঁচামেচি কানে এল! ঝটপট উঠে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল, ঘাসের মাঠে দু-হাত ওপরে তুলে চাঁচাতে চাঁচাতে এদিকেই দৌড়ে আসছে আমার মতো ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক পরা এক পাগলাটে মূর্তি এবং সে আর কেউ নয়, শ্রীমান প্রিয়বর্ধন!

আমাকে দেখে সে চেঁচিয়ে উঠল আগেকার মতো ভাঙাভাঙা ইংরেজিতে—পালাও, পালাও।

দৌড়ে আমার পাশ কাটিয়ে সে জলে ঝাঁপ দেওয়ার উপক্রম করলে আমি তাকে ধরে ফেললুম। প্রিয়বর্ধন হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ভূত! ভূত! এ দ্বীপে ভূতের আস্তানা আছে, জয়ন্ত!

তাকে ধাতস্ত করতে বেগ পেতে হল। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করার পর আগাগোড়া মোটামুটি সব ঘটনা বললাম। সে কানখাড়া করে শুনে একটু হাসল। তোমার সঙ্গে আমার ভাগ্য জড়িয়ে গেছে। তবে তুমি ওই যে বললে, সারা রাত আমাকে চিনতে পারনি—এটা তোমার উচিত হয়নি, জয়ন্ত। আমি হলে ঘোর অন্ধকারেও তোমাকে ছুঁয়েই টের পেতুম। সূর্যের তাপ পেয়ে আমার জ্ঞান ফিরে দেখি, পাশে তুমি। আমি তো হতভম্ব একেবারে। ঘুমোচ্ছ দেখে আর জাগালুম না। জলটা যা ঘোলা, একটাও মাছ দেখা গেল না। তখন ওদিকে গেলুম, দেখি কিছু খাদ্য জোগাড় করা যায় নাকি। অন্তত শুকনো নারকোল গোটাকতক। কিন্তু এমন অখাদ্য দ্বীপ কে কবে দেখেছে, সেখানে নারকোল গাছের বালাই নেই। খানিকটা গিয়ে চোখে পড়ল একটা আপেল গাছ! যেই হাত বাড়িয়েছি, বললে বিশ্বাস করবে না, গাছের একটা ছিপছিপে ডাল সাঁই করে চাবুকের মতো আমার ওপর পড়ল। তারপর আবার একটা—আবার! লোক নেই, জন নেই—অথচ আমাকে ছিপটি মারছে… বাক্স!

হাসতে হাসতে বললুম, আপেল গাছটার তোমাকে পছন্দ হয়নি। এস, আমি তোমাকে আমার বন্ধুর বাড়ি নিয়ে যাই। ফল খাইয়ে আনি।

সন্দিগ্ধ মুখে পা বাড়াল প্রিয়বর্ধন। বলল, এ দ্বীপে তোমার বন্ধু জুটেছে বুঝি? কিন্তু ঘর-বাড়ি বা মানুষজন তো চোখে পড়ল না!

এসোই না।বলে কয়েক পা এগিয়ে গেছি, সেই সময় ডান দিকের উঁচু উঁচু গাছগুলোর ভেতর থেকে সেই খ্যান খ্যান চিৎকার জেগে উঠল—স্টপ ইট! স্ট ইট! আই সে-স্টপ ইট! প্রিয়বর্ধন দাঁড়িয়ে গেল। বলল, ওরে বাবা! ওই শোনো কারা ঝগড়া করছে।

তাকে তখনও খুলে বলিনি, আমরা কিংবদন্তিখ্যাত কিওটা দ্বীপে আছি। বললে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, বুঝতে পারছিলুম না। কারণ, এ দ্বীপে নাকি গুপ্তধন আছে বলে তার বিশ্বাস আছে। ভেবেছিলুম, গুপ্তধনের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে আমার সঙ্গে তার বন্ধুতা চটে যেতে পারে।

একটু পরে মাঠের মাঝামাঝি গেলে বাঁ দিকের জঙ্গলের ভেতর আজও সেই চাপা গম্ভীর অর্কেস্ট্রার বাজনা বেজে উঠল। প্রিয়বর্ধন খুশিতে নেচে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। গির্জায় প্রার্থনাসঙ্গীত হচ্ছে জয়ন্ত! চলো, চলো—আমরা আগে ওখানে যাই!

প্রার্থনাসঙ্গীত শুনে প্রিয়বর্ধনের কেমন যেন ঘোর লেগেছে। অস্থির হয়ে বলল, আমি একজন খ্রিস্টান, জয়ন্ত। তুমি হিন্দু। ওই প্রার্থনা-সঙ্গীতের মর্ম তুমি বুঝবে না। তুমি আমার সঙ্গে যাবে তো এস, আমি চললুম। প্রার্থনায় যোগ না দিলে আমার পাপ হবে।

এই বলে সে দৌড়ুতে শুরু করল। আমি ওকে ডাকাডাকি করেও ফেরাতে পারলুম না। দেখতে দেখতে সে বনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।

অগত্যা সেই দয়ালু গাছটার উদ্দেশে এগিয়ে গেলুম। এখনই প্রিয়বর্ধন হন্যে হয়ে ফিরে আসবে।

তাই এল—যখন আমি রসালো পিচ জাতীয় ফল খাচ্ছি। খাচ্ছি মানে ঘাসের ওপর বসে হাঁ করছি, আর একটা করে থোকা আমার মুখে ঢুকছে।

প্রিয়বর্ধনকে দেখে বললুম, কী? খুঁজে পেলে গির্জা!

প্রিয়বর্ধন সে কথার জবাব দিল না। আমার কাণ্ডটা তার চোখে পড়েছিল। সে অবাক হয়ে  একটুখানি দেখার পর ধুপ করে বসে পড়ল এবং প্রকাণ্ড হাঁ করল।

মনে হচ্ছিল, আমার দাতা ভদ্রলোকের ভাঁড়ার এবেলাতেই সে উজাড় করে ছাড়বে। এক গাদা ফল গিলে পেটটা ঢাকের মতো ফুলিয়ে বিকট এক ঢেকুর ছেড়ে সে ফিক করে হাসল। বলল, জয়ন্ত! আমি স্বপ্ন দেখছি। তাই না?…

.

আবার শয়তানের কবলে

সেদিন দুপুর অব্দি প্রিয়বর্ধন স্বপ্ন স্বপ্ন করেই কাটাল! তার পাগলামি দেখে হাসি পাচ্ছিল। সে এই উৎকট স্বপ্ন ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে তার গায়ে চিমটি কাটতে বলেছিল। নিজেও চেষ্টা করছিল স্বপ্নটা যাতে ভাঙে। নিজের মাথায় চাঁটি মেরে, কখনও ডিগবাজি খেয়ে, কখনও বা গাছের গুড়িতে ঢু মেরে সে একসময় বাচ্চা ছেলের মতো ভ্যা করে কেঁদেও ফেলল।

তখন আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। হাসতে হাসতে বললাম, প্রিয়বর্ধন, তুমি কি এখনও টের পাচ্ছ না যে ব্যাপারটা স্বপ্ন নয় বাস্তব।

প্রিয়বর্ধন চোখ মুছে নাক ঝেড়ে বলল, অসম্ভব! জয়ন্ত, আমরা হয়তো আসলে কোনও ডাইনির দ্বীপে এসে পড়েছি। এসবই তার জাদুর খেলা। এরপর মন্ত্রবলে ডাইনিটা হয়তো আমাদের ওইরকম গাছপালা করে ফেলবে। আমাদের আর মানুষ হয়ে দেশে ফেরা হবে না।

প্রিয়বর্ধন, তুমি কান করে শোনো তো! বেহালার মতো সুর শুনতে পাচ্ছ না?

প্রিয়বর্ধন শুনতে শুনতে বলল, তা তো পাচ্ছি! ওই তো ডাইনির জাদু।

সকালে বনের ভেতর অর্কেস্ট্রার সুর শুনে তুমি গির্জা খুঁজতে গিয়েছিলে। গম্ভীরভাবে বললুম—বোকা কোথাকার! এখনও কি তুমি বুঝতে পারছে না এটা কোন দ্বীপ?

প্রিয়বর্ধন আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর নড়ে বসল। তার মুখটা কেমন যেন জ্বলে উঠল কী আভায়। দম আটকানো গলায় সে বলে উঠল, জয়ন্ত, জয়ন্ত! তবে কি এই সেই কোহাও রঙ্গো-রঙ্গো? আমরা কি তাহলে সত্যি কিওটা দ্বীপে বসে আছি?

হ্যাঁ, প্রিয়বর্ধন।

প্রিয়বর্ধনের পাগলামি ঘুচে গেল সঙ্গে সঙ্গে। উত্তেজনা দমন করে সে আমার হাত ধরে টানল। চাপা গলায় বলল, তাহলে আর দেরি না করে এস, আমারা রোজারিওর গুপ্তধন খুঁজে বের করি। চুপচাপ বসে থাকার মানে হয় না, জয়ন্ত। তাছাড়া যা শুনেছি, এই ভূতুড়ে দ্বীপে বেশিদিন মানুষ বাঁচতে পারে না। সবুজ রোগে মারা যায়।

সবুজ রোগ কী?

সে এক সাংঘাতিক অসুখ। সারা শরীর সবুজ হয়ে যায়।

অমনি আমার মনে পড়ে গেল, রুবিদ্বীপের জেলেদের গায়ে সবুজ অ্যালার্জি হওয়ার কথা শুনেছিলুম। এবার বুক কেঁপে উঠল। প্রিয়বর্ধন আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিল। বললুম, কোথায় যাচ্ছ এমন করে?

প্রিয়বর্ধন তেমনি চাপা স্বরে বলল, এবেলা থেকেই কাজ শুরু করা যাক। প্রথমে সারা দ্বীপের চৌহদ্দি দেখে নিই এস। চারদিক ঘুরে একটা ম্যাপ তৈরি করা দরকার। তারপর…

বাধা দিয়ে বললুম, ম্যাপ আঁকবে কিসে? কাগজ কলম তো নেই।

মাটির ওপর বা বালিতে আঁকব। সে তুমি ভেবো না। প্রিয়বর্ধন উৎসাহের সঙ্গে বলল। তারপর শুরু হবে তন্নতন্ন খোঁজা। এক ইঞ্চি জায়গা বাদ রাখব না।

আমার অবাক লাগছিল ভেবে, পৃথিবীতে কতরকম মানুষ আছে তাহলে! এই এক আশ্চর্য জনমানুষহীন দ্বীপ, যেখানে গাছপালা গান গায়, যেখানে গাছপালা প্রাণীদের মতো সজাগ, মানুষের মতোই তার দয়ালু এবং ফল তুলে দেয় ক্ষুধার্তের ঠোঁটে—এমন বিচিত্র এক ভূখণ্ডের বিস্ময়কর ঘটনাবলীর দিকে প্রিয়বর্ধনের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে লুকানো সোনাদানার প্রচণ্ড লোভে অস্থির হয়ে উঠেছে। বিড়বিড় করছে, রোজারিওর গুপ্তধন! রোজারিওর গুপ্তধন!

ঝাঁকে ঝাঁকে ব্যুমেরাং গড়নের কাঠপোকা বা কেঠো পোকা সবুজ ঘাসের মাঠে বসে ছিল। আমরা তাদের মধ্যে গিয়ে পড়তেই তারা লাফাতে লাফাতে কে কোথায় লুকিয়ে পড়ল। প্রিয়বর্ধনের চোখ সেদিকে নেই। মুখেচোখে ধূর্ততা ঠিকরে পড়ছে। মাঝে মাঝে বলছে, আমরা রাজা হয়ে যাব, জয়ন্ত! রোজারিওর ধনরত্ন পেলে আর পরোয়া নেই।

রোজারিও কে, সেকথা কয়েকবার জিগ্যেস করেও জবাব পেলুম না। তখন ভাবলুম, নিশ্চয় কোনও প্রাচীন জলদস্যু হবে। রাজাকো, ক্যারিবো, কিয়াং—সবাই তাহলে এই জলদস্যু পুঁতে রাখা গুপ্তধনের জন্য হন্যে হয়ে পরস্পর লড়াই করেছে। রাজাকোর প্রাণ গেছে। ক্যারিববা আর কিয়াং এখনও জীবিত। এখন কোথায় তারা কে জানে? ক্যারিববার সঙ্গে ডাইনির দ্বীপে আমাদের দেখা হয়েছে। তার মোটরবোট চুরি করে আমরা পালিয়ে এসেছি। ক্যারিববার দশা কী হয়েছে, তাও বলা কঠিন।

তারপর মনে পড়ল কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের কথা। ডঃ বিকর্ণ, কাপ্তেন ঝুগেনভিলি, আর রোমিলার কথা। মন অমনি খারাপ হয়ে গেল। নৌবাহিনীর সাহায্যে তাঁরা কি রুবি দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রে আমার মৃতদেহ খুঁজে বেড়াচ্ছেন এখনও? আচ্ছা, কাপ্তেন ঝুগনভিলি তো এ-দ্বীপে এসে পড়েছিলেন। তার কি পথের কথা মনে নেই একটুও?

কিওটো যে ছোট্ট দ্বীপ, সেটা ক্রমশ বুঝতে পারছিলুম। উত্তর থেকে সোজা দক্ষিণে দু-মাইল গিয়েই আবার সমুদ্র দেখা গেল। তারপর পশ্চিমে এগিয়ে গেলুম আমরা। পশ্চিম এলাকাটা ছোট-বড় পাহাড়ে দুর্গম হয়ে আছে। একেবারে ন্যাড়া পাথুরে পাহাড়। কিন্তু কী বিচিত্র রঙ তাদের। কোনওটা কালো, কোনওটা লাল, হলুদ, নীল। একটা সবুজ রঙের পাহাড়ও দেখতে পেলুম। এদিকে গাছপালা নেই বললেই চলে। একটা লাল টিলার ওপর পৌঁছে দ্বীপটা পুরো চোখে পড়ল।

দ্বীপটার গড়ন তিনকোনা। মধ্যিখানে বিরাট সবুজ ফঁকা মাঠ। মাঠ জুড়ে টুকরো পাথর পড়ে আছে। উত্তর ও দক্ষিণে ঘন বন। পুবে কিছুটা ফাঁকা। কিন্তু তিনকোনা দ্বীপটাকে ঘিরে রেখেছে প্রায় গোলাকার প্রবাল পাঁচিল। এটাকে বলয় দ্বীপ বলা যায়। প্রবাল পাঁচিলটা শুধু পুবের দিকে এক জায়গায় ভাঙা এবং সেটাই এই দ্বীপে ঢোকার গেট যেন। ওই গেট দিয়ে আমরা আসতে পেরেছি। বাকি সমস্ত বলয় উঁচু হয়ে ঘিরে রেখেছে পাঁচিলের মতো। তার গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে মহাসাগরের প্রচণ্ড সব ঢেউ। আছড়ে পড়ে ধুয়ে দিচ্ছে পাঁচিলকে। এতক্ষণে সামুদ্রিক পাখির ওড়াউড়ি চোখে পড়ল প্রবাল বলয়ের কাছে।

প্রিয়বর্ধন বলল, তাহলে মোটামুটি একটা ম্যাপ পাওয়া গেল। এবার জয়ন্ত, আমরা কিছু সূত্র খুঁজব।

কিসের সূত্র?

প্রিয়বর্ধন হাসল। রোজারিও যখন এ দ্বীপে ধনরত্ন পুঁততে এসেছিল, তখন নিশ্চয় কিছু চিহ্ন রেখেছিল। ধরো, জাহাজের একটুকরো কাঠ, কিংবা পেরেক। অথবা একটা হাতুড়ি।…… যাই হোক, খুঁজলে নিশ্চয় পেয়ে যাব কিছু। এখান থেকেই খুঁজতে শুরু করি।

প্রিয়বর্ধন, এ-দ্বীপে যেই এসেছে, তাকে আসতে হয়েছে পুবের ওই ভাঙা জায়গাটা দিয়ে। কাজেই….

আমার কথা কেড়ে প্রিয়বর্ধন বলল, ওহে বোকারাম! যেখান দিয়েই আসুক, গুপ্তধন লুকানোর জন্য দুর্গম জায়গা সে বেছে নেবে কি না?

তা ঠিক।

দুর্গম জায়গা বলতে দেখছি, এই পাহাড়ি এলাকা আর ওই ঘন জঙ্গল। এখান থেকেই শুরু করি। এস। বলে প্রবল উৎসাহে সে টিলা থেকে নামতে থাকল।

তাকে অনুসরণ করলুম। দুপুর গড়িয়ে গেছে। এত ঘোরাঘুরি করছি, অথচ একটুও ক্লান্তি লাগছে না। নিশ্চয় সেই ফলের গুণ। টিলার নিচে পৌঁছে একটা পাহাড়ি খাদের দিকে পা বাড়াল প্রিয়বর্ধন। ডান দিকে এক ছিপছিপে চেহারার গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই গাছটা হঠাৎ পিয়ানোর বাজনা বাজাতে শুরু করল। কী মনমাতানো সে সুর! আমি দাঁড়িয়ে পড়লুম।প্রিয়বর্ধন! শোনো, শোনো! বলে ডাকলুম। কিন্তু সে দাঁত মুখ খিচিয়ে বলল, কী শুনব? আমার এক খুড়ো ওর চেয়ে ভাল পিয়ানো বাজাতে পারে! দেখছ না? বাতাস বইছে বলেই গাছটা এমন বিচ্ছিরি ভূতুড়ে শব্দ করছে। চলে এস।

বেরসিক প্রিয়বর্ধনের টানে এগিয়ে যেতে হল। খাদটা ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে। খাদের দুধারে রঙিন পাহাড় দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক পা এগিয়ে প্রিয়বর্ধন হঠাৎ বসে পড়ল। তারপর উত্তেজিতভাবে বলল, পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে!

গিয়ে দেখি, একটা মরচে ধরা লোহার রড মাটির ভেতর কাত হয়ে ঢুকে রয়েছে। সেটা টানাটানি করতেই খানিকটা চাবড়া উঠে গেল মাটির। তারপর যা দেখলুম, ভয়ে বিস্ময়ে শিউরে উঠলুম। ওটা রড নয় আসলে একটা তলোয়ারের বাঁট। আর চাবড়ার তলায় একটা মানুষের কঙ্কাল দেখা যাচ্ছে। তালোয়ারটা কঙ্কালের ভেতর বিধে রয়েছে। রুদ্ধশ্বাসে বললুম, প্রিয়বর্ধন! কেউ এই মানুষটাকে তালোয়ার বিধিয়ে খুন করেছিল। সেই অবস্থায় পড়ে ছিল মৃতদেহটা। বছরের পর বছর বৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে ঢালু খাদে এসে জমেছে আর ওকে ঢেকে ফেলেছে।

প্রিয়বর্ধন বলল, এ তাহলে নিশ্চয় রোজারিওর দলের লোক। এস, এগিয়ে গেলে আমরা আরও সূত্র পাব।

আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ালুম। খাদে বিকেলের গাঢ় ছায়া জমে আছে। আর এখানে ওখানে পড়ে আছে আরও কয়েকটা নরকঙ্কাল। কোনওটা মুণ্ডুহীন। মুণ্ডটা পড়ে আছে। আলাদা হয়ে। কালো ছায়ায় কঙ্কাল আর খুলিগুলো ধপধপে সাদা দেখাচ্ছে। দেখলে আতঙ্কে শরীর হিম হয়ে যায়।

তারপর হঠাৎ আগে শোনা সেই চিৎকার বা গর্জন শুনতে পেলুম।স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে স্টপ ইট! দু-ধারের পাহাড়ে গম গম করে প্রতিধ্বনি উঠল। কানে তালা ধরে যাচ্ছিল। সেই সময় দেখলুম প্রিয়বর্ধন আতঙ্কে পাগলের মতো যে পথে এসেছি, সেই পথে দৌড়তে শুরু করেছে। আমি তাকে অনুসরণ করলুম।

শব্দগুলো যেন সারা দ্বীপ জুড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে। তারপর শোনা গেল, আই মাস্ট কিল ইউ!…কিল ইউ… কিল..কিল! তারপর আর্তনাদ! হেল্প! হেল্প! হেল্প! সেই সঙ্গে

অন্তিম আর্তনাদের পর আর্তনাদ!

প্রিয়বর্ধন জঙ্গলের ভেতর উদ্ভন্তের মতো দৌড়ুচ্ছিল। তার ধরে ফেললুম। বললুম, ও কিছু নয়, প্রিয়বর্ধন! অতীতের প্রতিধ্বনি মাত্র। অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

প্রিয়বর্ধন ধুপ করে ঘাসে বসে পড়ল। তারপর ভয়ার্ত মুখে বলল, রোজারিওর ভূত, জয়ন্ত! শুধু একা নয় ওর দলের সবাই ভূত হয়ে গেছে। আমাদের বরাত বড় মন্দ। তুমি বুঝতে পারছ না? ভূত হয়ে গেছে। ওরা ভূত হয়ে গুপ্তধন পাহারা দিচ্ছে।

ওকে টেনে ওঠালুম। কাল সকাল থেকে খোঁজা যাবে। আমরা পুব দিকের বিচে যাই। বেলা পড়ে আসছে। অচেনা জায়গার চেয়ে চেনা জায়গায় রাত কাটানোই ভালো।

দুজনে বাঁ দিকে ঘুরে কঁকা মাঠের দিকে এগিয়ে গেলুম। বনের ভেতর কোথাও ক্ষীণ সুরে বাঁশি বাজছিল। ক্রমশ সেই সুর চাপা দিয়ে গম্ভীর অর্কেস্ট্রা শুরু হল। প্রিয়বর্ধন ভয় পেয়ে লম্বা পায়ে হাঁটতে থাকল।

কিন্তু ফাঁকা মাঠের ধারে পৌঁছতেই এক বিচিত্র দৃশ্য চোখে পড়ল।

ক্যাকটাস জাতীয় একটা অদ্ভুত গড়নের প্রাণী কিংবা নিছক গাছ আস্তেসুস্থে হেঁটে যাচ্ছে। প্রিয়বর্ধন বলে উঠল, ও কী জয়ন্ত! ওটা গাছ, না কোনও জন্তু?

অবাক হয়ে বললুম, আশ্চর্য! ওটা যে দেখছি একটা ক্যাকটাস! চলো, তো দেখি।

প্রিয়বর্ধন আমার পিছনে কুণ্ঠিতভাবে এগুলো। সেই বিচিত্র চলমান ক্যাকটাসের হাত দশেক দূরে পৌঁছলে সেটা থেমে গেল। তারপর আরও অবাক হয়ে দেখলুম, ওটার নিচের দিক থেকে একরাশ শেকড় কেঁচোর মতো নেমে মাটিতে ঢুকে গেল।

সাহস করে কাছে গেলুম। সত্যি ক্যাকটাসই বটে। এমন বিদঘুটে চলমান ক্যাকটাস দেখে আমি হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম কিছুক্ষণ।

প্রিয়বর্ধনের তাড়ায় এগিয়ে যেতে হল। কিছু দূরে গিয়ে একবার পিছু ফিরে দেখলুম, অদ্ভুত ক্যাকটাস জীবটি আবার চলতে শুরু করেছে। বললুম, প্রিয়বর্ধন! তাহলে দেখা যাচ্ছে চলমান উদ্ভিদও পৃথিবীতে আছে। কে জানে এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে আরও কত বিচিত্র উদ্ভিদ দেখতে পাব।

প্রিয়বর্ধন সে কথায় কান না করে একটু হেসে বলল, আবার কিন্তু খিদে পেয়েছে!

মাঠের ভেলভেটের মতো নরম সবুজ ঘাসের ওপর সেই পিচ জাতীয় ফলের গাছ আরও অনেক আছে। একটা গাছের দিকে পা বাড়িয়েছি, সেই সময় প্রিয়বর্ধন বলে উঠল, জয়ন্ত! জয়ন্ত! ওটা কী দেখ তো?

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি, শেষ বিকেলের সমুদ্রের প্রবাল পাঁচিলের সেই ভাঙা অংশটার কাছে সাদা কী একটা ঢেউয়ে ভেসে উঠছে আবার যেন তলিয়ে যাচ্ছে। ভাল করে দেখে বুঝলুম, ওটা একটা মোটরবোটই বটে!

আনন্দে চিৎকার করে দৌড়ুতে যাচ্ছিলুম, হঠাৎ বাঁ পাশে পড়ে থাকা কয়েকটা পাথরের আড়াল থেকে তিনটে মূর্তি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যান্ডস্ আপ!

মূৰ্তিত্রয় এ-দ্বীপের কোনও আজব গাছ-মানুষ, না আমাদের মতো মানুষ লক্ষ্য করতে গিয়ে চোখে পড়ল, তাদের হাতে রিভলভার আর বন্দুকও আছে। সঙ্গে সঙ্গে দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে গেলুম।

তারপর প্রিয়বর্ধন দুহাত তুলে ফিসফিস করে উঠল, শয়তান ক্যারিববা!

এবার চিনতে পারলুম ক্যারিবোকে। সে এগিয়ে এসেই প্রিয়বর্ধনের চোয়ালে রিভলভারের বাঁট দিয়ে মারল। প্রিয়বর্ধন পড়ে গেল। তারপর ক্যারিবো আমার দিকে ঘুরে কুৎসিত হেসে বলল, এই যে কলকাতাওয়ালা বাঙালিবাবু। মোটর বোট চুরির শাস্তি কত ভয়ঙ্কর, একটু-একটু করে টের পাবে এবার। ফুতাং! একে বিচে নিয়ে চল্! আর উংচু, তুই ওই দোআঁশলা বদমাশটাকে তুলে নিয়ে আয়।

গরিলার মতো চেহারা—সম্ভবত মালয়ের লোক, সেই ফুতাং এসে আমার ঘাড় ধরল। ওর অন্য হাতে বন্দুক। কিছু করার নেই। উংচু নামে বেঁটে হিংস্র চেহারার লোকটার গায়ে যেন দৈত্যের বল। সে প্রিয়বর্ধনকে পুতুলের মতো কাঁধে তুলে নিয়ে চলল পুবের বিচের দিকে। প্রিয়বর্ধন অজ্ঞান হয়ে গেছে। কষায় রক্ত গড়াচ্ছে।

বিচের বালিতে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল ফুতাং। ক্যারিববা বিকট হেসে বলল, তারপর বাঙালিবাবু! প্রথমে বলো তো গুপ্তধনের হদিশ কতটা পেলে? তারপর অন্যকথা।

.

ক্যাকটাস-মাকড়সা ও বেতারযন্ত্র

ক্যারিববার চোখের ভেতর হিংসা যেমন, তেমনি লোভও ঝকমক করতে দেখছিলুম। সে আমাদের মেরে ফেলবে ঠিকই, কিন্তু তার আগে জেনে নিতে চায়, আমারা গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছি কি না। পেয়ে থাকলে ওকে আর কষ্ট করতে হবে না এবং আমরা সেখানে তাকে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সে আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।

তাই একটু হেসে বললুম, ক্যারিবো রোজারিওর গুপ্তধন যেখানে পোঁতা আছে, সেখানে যাওয়ার অনেক বিপদ।

ক্যারিবো আমার পাশে হাঁটু দুমড়ে বসে হিস হিস করে বলল, বাজে কথা রাখো। খোঁজ পেয়েছ কি না জানতে চাই। যদি পেয়ে থাকো, তোমার অন্তত বাঁচার আশা আছে। তবে ওই নচ্ছার বিশ্বাসঘাতকটাকে মেরে ফেলব। ডাইনির দ্বীপের একটা গাছে রবারের ভেলা টাঙানো আছে। দেখেই বুঝেছিলুম, কে আমাদের মোটরবোট চুরি করে পালিয়েছে। যাই হোক, সে-সব কথায় লাভ নেই। বলো, গুপ্তধনের খবর কী?

বললুম তো! সেখানে কোনও মানুষ যেতে পারে না।

কেন?

রোজারিও আর তার স্যাঙাতদের আত্মা সেই ধন পাহারা দিচ্ছে। তুমি কি এই দ্বীপে পৌঁছে তাদের চিৎকার শোনোনি?

ক্যারিবো একবার ভয়ের চোখে বিচের ওপরদিকটা দেখে নিয়ে বলল, শুনেছি। কিন্তু ভয় পাইনি। কারণ তখনই দেখতে পেলুম, তোমরা দুজনে দিব্যি আস্তেসুস্থে হেঁটে আসছ। তোমাদের যখন বিপদ হচ্ছে না, তখন আমাদেরও হবে না ভাবলুম।

তারপর আমাদের ঢিট করার জন্য পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রইলে!

ক্যারিববা ধমক দিয়ে বলল, ন্যাকামি ছাড়ো। চলো কোথায় আছে রোজারিওর সোনাদানা? হাসতে হাসতে বললুম, কিন্তু এখন তো দিন ফুরিয়ে গেল। রাতে সেখানে যাবে কেমন করে? সকাল হতে দাও, তবে তো।

ক্যারিবো কথাটা তলিয়ে দেখে বলল, ঠিক আছে। সকালেই যাব। কিন্তু জায়গাটা কতদূর?

পশ্চিম প্রান্তে। পাহাড়ি খাদের ভেতর। সেখানে অজস্র নরকঙ্কাল আর খুলি পড়ে আছে। তারা কিন্তু জীবন্ত মানুষ দেখলেই—

আমার কথা শেষ হবার আগেই উংচু ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল, কর্তা! কর্তা! ওই শুনুন কে বাজনা বাজাচ্ছে আবার!

ক্যারিববা তাকে ধমক দিয়ে বলল, তুই জানিস না ব্যাটা, কিওটা দ্বীপের গাছপালা গান গায় আর বাজনা বাজায়?

ফুতাং ফিক করে হেসে বলল, শুনেছি, ওরা ধেই ধেই করে নাচেও।

ক্যারিবো আমাকে বলল, কী হে বাঙালিবাবু? গাছের নাচ দেখতে পাওনি?

বললুম, দেখিনি। তবে অসম্ভব নয়। একটা ক্যাকটাসকে তখন হেঁটে বেড়াতে দেখেছিলুম। কাজেই নাচতেও অসুবিধে কিসের? যাই হোক, ক্যারিববা! গুপ্তধনের জায়গায় তোমাকে নিয়ে যাব বলেছি—ঠিকই নিয়ে যাব। কিন্তু তার বদলে এই কি তোমার অতিথি সৎকারের নমুনা? আমাদের অন্তত এককাপ করে কফি খাওয়াও।

ক্যারিবো অচৈতন্য প্রিয়বর্ধনের দিকে তাকিয়ে বলল, হতচ্ছাড়াটা তো দেখছি ভিরমি খেয়ে পড়ে রইল। ওহে ফুতাং বেঁচে আছে তো?

ফুতাং বলল, আছে কর্তা। পিট পিট করে তাকাচ্ছে!

ক্যারিবো উঠে দাঁড়াল। উংচু, ফুতাং! তোরা এবার বোটটা এখানে টেনে নিয়ে আয়। খাবার দাবার, তাঁবু সব কিছু ওতে রয়ে গেছে। এখানে না আনলে মেরামত করব কেমন করে?

ওরা দুজনে পোশাক খুলে সাঁতারু সেজে জলে নামল। গোধূলির আলো তখনও ফুরিয়ে যায়নি। প্রবাল পাঁচিলের দিকে ওরা সাঁতার কেটে এগিয়ে গেল।

ক্যারিবো প্রিয়বর্ধনের ঘাড় ধরে টেনে বসিয়ে দিল। প্রিয়বর্ধন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আমার ও ক্যারিবোর দিকে। ওর কাছে গিয়ে বললুম, যা হওয়ার হয়ে গেছে। ক্যারিবোর সঙ্গে মিটমাট করে নাও। তোমাকে গুপ্তধনের জায়গায় পৌঁছে দিলে আমাদের ছেড়ে দেবে ক্যারিবো?

প্রিয়বর্ধনকে চোখের ইশারা করতেই সে বুঝে নিল ব্যাপারটা। বলল, ঠিক আছে।

ক্যারিবো খুশির ভাব দেখিয়ে বলল, হ্যাঁ—পৌঁছে দিলেই তোমাদের ছুটি। শুধু তাই নয়, কিছু ভাগও পাবে। এমনকী, রুবি দ্বীপে পৌঁছেও দেব।

আমি যেমন জানি, তেমনি প্রিয়বর্ধনও টের পেল, ক্যারিবো আমাদের কী দশা করবে শেষ পর্যন্ত। বুদ্ধিমান প্রিয়বর্ধন মাতৃভাষায় কথা বলতে শুরু করল ক্যারিববার সঙ্গে। বুঝতে পারছিলুম, সে অনুনয়-বিনয় করে ক্ষমা চাইছে।

অনেক দেরি করে ফিরল ফুতাং ও উংচু। ততক্ষণে এক ফালি চাঁদ উঠেছে। সমুদ্রে ওপর ক্ষীণ জ্যোৎস্না খেলছে। বিচের ওপর সেই বেহালা বাজিয়ে গাছটা মাঝে মাঝে যেন বেহালার ছড়া টেনে করুণ সুর বাজাচ্ছে আবার থেমে যাচ্ছে। মোটরবোটটা টেনে বালিতে তুলল ওরা। ক্যারিবো রিভলভার হাতে নিয়ে আমাদের পাহারা দিচ্ছে। জিনিসপত্র নামিয়ে আনতে হুকুম দিল সে।

একটু পরে বিচের মাথায় উঁচু জায়গায় একটা তাঁবু খাটানো হল। তারপর স্টোভ জ্বেলে কফি বানাল ওরা। ফুতাং রাতের খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত হল। বুঝলুম, রীতিমতো তৈরি হয়েই এসেছে। কিন্তু কিওটা দ্বীপের সন্ধান কীভাবে পেল, বুঝতে পারলুম না।

তাই বললুম, ক্যারিবো, কফির জন্য ধন্যবাদ। এবার বলো, কেমন করে তোমরা এ-দ্বীপের খোঁজ পেলে?

ক্যারিবো ধূর্তের হাসি হেসে বলল, তোমরা যেভাবে পেয়েছিলে!

আমরা দৈবাৎ এখানে ভেসে এসেছি, ক্যারিবো। বিশ্বাস করো।

করছি না। কারণ আমি জানি, তোমরা সেই ছোট্ট মূর্তির ভেতর লুকিয়ে রাখা কাত্তির সংকেত সূত্র উদ্ধার করতে পেরেছ। ওতে কিওটা দ্বীপের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ লেখা আছে। তোমরা ভেবেছিলে আমি ভীষণ বোকা। জানো না যে আমি আগেই কাত্তিটার সব চিহ্ন কাগজে কপি করে রেখেছিলুম।

কিন্তু সংকেত সূত্রগুলো তো অর্ধেক মনে হয়েছিল। অন্য কাত্তিটা না পেলে…

আমার কথা কেড়ে ক্যারিবো বলল, না হে বোকারাম! তা নয়। রাজাকো আসল কাত্তিটার একটা নকল বানিয়েছিল। যদি দৈবাৎ একটা খোয়া যায়, অন্যটা থাকবে। ওর টুপির ভেতরকার কাত্তিটা নকল। আসলটা ছিল মূর্তিটার ভেতরে। কাত্তিতে যে চিহ্নগুলো আছে, তার অর্থ কেবলমাত্র জানে অভিজ্ঞ নাবিকরা। কিয়াংয়ের মতো অভিজ্ঞ সমুদ্রচর লোক, কিংবা এই দেখছ আমাকে—আমার মতোও যারা সমুদ্রে ঘোরে এবং অভিজ্ঞ নাবিকদের শাগরেদি করে বড় হয়েছে, তারা সবাই ওইসব চিহ্নের অর্থ বোঝে। কিন্তু বরাত মন্দ, পৌঁছুলুম বটে কিওটায়, মোটরবোটটা কোরাল রিবে (Coral Reeb) ধাক্কা খেয়ে বিগড়ে গেল। দেখা যাক, সারাতে পারি নাকি। তবে তার আগে রোজারিওর গুপ্তধন তো আগে হাতাই। তারপর দেখা যাবে।…

রোজারিওর গুপ্তধনের লোভে ক্যারিবো আমাদের এ-রাতে এত খাতির করছিল কহতব্য নয়। খাবারের ভাগ দিয়ে তো বটেই, আরও খিদে আছে কি না জিগ্যেস করে আতিথেয়তার চূড়ান্ত করল।

আমাকে ও প্রিয়বর্ধনকে দক্ষিণী মহাসাগর এলাকার নাবিকদের প্রিয় কড়া সিগারেটের প্যাকেট পর্যন্ত উপহার দিল। কিন্তু আমরা দুজনেই জানি, শয়তানটার মনে কী ক্রুর মতলব খেলা করছে।

প্রবাল বলয়ের দিকটা জ্যোৎস্নায় কালো পাঁচিলের মতো দেখাচ্ছিল। দূর থেকে আছড়ে পড়া জলের চাপা গর্জন কানে আসছিল। আমাদের পেছনে কোথায় সেই বেহালা বাজিয়ে গাছটা ঘুমঘুম সুরে বেহালা বাজাচ্ছিল। ক্যারিববা আমাদের দুজনকে ফুতাং ও উংচুর কড়া পাহারায় রেখে ছোট্ট তাঁবুর ভেতর ক্যাম্পখাটে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল। আমার চোখে ঘুম নেই। প্রিয়বর্ধনেরও নেই। দুজনে পাশাপাশি চিত হয়ে তাঁবুটার সামনে বালির ওপর শুয়েছিলুম। আমাদের দুপাশে দুই প্রহরী বসে সেই বিচ্ছিরি কড়া সিগারেট টানছিল আর চাপা গলায় নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলছিল।

এমন সময় কী একটা শব্দ হল। খসখস শব্দ। মুখটা সাবধানে ঘুরিয়ে দেখি, ক্যারিববার তাঁবুর পাশে কালো ঝোপ মতো—কোনও জন্তু নয় তো? কিওটায় এ পর্যন্ত ময়াল সাপ ছাড়া কোনও জন্তু দেখিনি। নাকি সত্যি একটা ঝোপ?

কিন্তু কাছাকাছি কোথাও ঝোপও তো দেখিনি। জায়গাটা অনেকটা খোলামেলা। তাহলে ওটা কী হতে পারে! নিশ্চয় কোনও জন্তু। প্রহরীরা আপন কথায় ড়ুবে আছে। একটু পরে দেখলুম, কালো জিনিসটা নড়ে উঠল এবং এগিয়ে আসতে থাকল। জ্যোৎস্না এতক্ষণে পরিষ্কার হয়েছে। এবার স্পষ্ট দেখতে পেলুম, দিনে যে ক্যাকটাসকে হেঁটে বেড়াতে দেখেছি, এটা সেই চলমান উদ্ভিদই বটে। খসখস শব্দে প্রহরীদের চমক জাগল। তারা যেই ঘুরেছে, অমনি সেই ক্যাকটাস-জন্তু (!) অক্টোপাসের অথবা মাকড়সার মতো একগুচ্ছের শুড় বাড়িয়ে উঁচু ও ফুতাংকে জড়িয়ে ধরল। দুজনেই বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠল। ক্যারিবোর ঘুম ভেঙে গেল। সে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল। তার হাতে টর্চ ছিল। টর্চের আলোয় দেখল, অদ্ভুত ক্যাকটাস-মাকড়সা উংচু ও ফুংকে নিয়ে খসখস আওয়াজ করতে করতে এগিয়ে চলেছে। ক্যারিবো বিস্ময়ে আতঙ্কে এমন হকচকিয়ে গেল যে টর্চ জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই।

আমি ও প্রিয়বর্ধন উঠে বসেছিলুম। প্রিয়বর্ধন কী বলে চেঁচিয়ে উঠল। নিশ্চয় গুলি ছুড়তে বলল ক্যারিবোকে। কারণ তারপরই ক্যারিববা রিভলভার উঁচিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে তাড়া করল।

কিন্তু আশ্চর্য, ক্যাকটাস-মাকড়সার গায়ে যেন গুলি বিধছে না। ক্যারিববার টর্চটা উত্তেজনার ফলে হাত থেকে পড়ে গিয়ে নিবে গেছে। প্রিয়বর্ধন দৌড়ে গিয়ে টর্চটা তুলে নিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে কোথা থেকে আরও কয়েকটা ক্যাকটাস-মাকড়সা খসখস শব্দ করতে করতে ক্যারিববাকে ঘিরে ফেলল। তারপর আর ক্যারিববাকে দেখতে পেলুম না। বিচিত্র উদ্ভিদ-প্রাণীর দল ব্যুহের ভেতর ঘিরে ওকে নিয়ে চলেছে। সেই দৃশ্য দেখে প্রিয়বর্ধনের হাতে টর্চ নিভে গেল এবং সে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, জয়ন্ত! জয়ন্ত! ডাইনিরা ওদের ধরে নিয়ে গেল।

বললুম, তাহলে এবার আশা করি, তুমি বুঝতে পেরেছ, গুপ্তধনের ললাভের শাস্তি পেল ওরা।

প্রিয়বর্ধন দিব্যি কেটে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ জয়ন্ত! আমার আর গুপ্তধনের লোভ করা উচিত নয়।

তাঁবুর কাছে ফিরে এসে বললুম, যাক গে। কিওটা থেকে ফেরার আর চিন্তা রইল না। মোটরবোটটা যদি তুমি মেরামত করতে পারো, আমরা সমুদ্র পাড়ি দেব।

তাঁবুর সামনে স্টোভ জ্বেলে আমরা আবার কফি তৈরি করলুম। কফি খেতে খেতে জ্যোৎস্নাভরা বনভূমির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, একটু আগের সেই বিভীষিকার কোনও আভাস নেই। বেহালা বাজিয়ে গাছটা একলা দাঁড়িয়ে কোথায় আপন মনে বেহালা বাজাচ্ছে। চারদিকে ঘুমঘুম আচ্ছন্নতা। কফি খেয়ে প্রিয়বর্ধন ভয়মাখানো গলায় বলল, জয়ন্ত, আমরা বরং পালা করে পাহারা দিই। যদি ওই ভূতুড়ে ক্যাকটাসগুলো আমাদেরও বন্দি করে নিয়ে যায়?

ওকে অশ্বাস দিয়ে বললুম, প্রিয়বর্ধন, কিওটার উদ্ভিদেরা মানুষের মনের কথা যেন টের পায়। আমাদের মস্তিষ্কের চিন্তাতরঙ্গ হয়তো ওদের স্নায়ুতে প্রতিধ্বনি তোলে। আমরা যদি এ-দ্বীপে কোনও খারাপ মতলব না আঁটি, ওরা আমাদের ক্ষতি করবে না। এস, আমরা আরাম করে ঘুমোই।…

এরাতে কোনও বিপদ ঘটল না। কখন একবার কিছুক্ষণের জন্য ঘুম ভেঙে কানে এসেছিল, কারা যেন দূরে মধুর সুরে গান গাইছে। এমন অপার্থিব সঙ্গীত পৃথিবীর মানুষের কণ্ঠে শোনা অসম্ভব। জ্যোৎস্নারাতে কিওটার বনভূমিতে বিশ্বপ্রকৃতি নিজের হৃদয় খুলে দিয়েছে যেন।

শেষ রাতে একবার যেন শুনলুম, কে কোথায় খিলখিল করে হেসে উঠল—যেন মেয়েদেরই হাসি। স্বপ্নও হতে পারে। বাস্তবও হতে পারে। পুরুষ উদ্ভিদের মতো মেয়ে উদ্ভিদও তো আছে।

সকালে ক্যারিবোরা প্রচুর খাদ্যদ্রব্য, দড়িদড়া, শাবল, হাতুড়ি, এমনকী একটা বেতার ট্রান্সমিশন সেট পর্যন্ত নিয়ে এসেছে দেখে খুব আনন্দ হচ্ছিল। প্রিয়বর্ধন যতক্ষণ ব্রেকফাস্ট তৈরি করছিল, ততক্ষণ আমি ওই বেতার যন্ত্রটাকে চালু করার চেষ্টা করছিলুম। চালু হতেই রিসিভিং কেন্দ্রে অস্পষ্টভাবে দুর্বোধ্য ভাষায় কোন কেন্দ্রের ব্রডকাস্টিং ভেসে এল। প্রিয়বর্ধন নেচে উঠল তার মাতৃভাষা শুনে। বলল, সিঙ্গাপুর কেন্দ্রে খবর হচ্ছে। নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটা করে কেন্দ্রের সাড়া পায় আর সে চেঁচিয়ে ওঠে উত্তেজনায়। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা দক্ষিণ এশিয়ার বহু ভাষা সে জানে। কিছুক্ষণ পরে সে কোন্ কেন্দ্র থেকে কান করে কিছু শোনার পর দম আটকানো গলায় বলে উঠল, জয়ন্ত জয়ন্ত! তোমার খবর হচ্ছে। রুবি আইল্যান্ডের নৌবাহিনীর ব্রডকাস্টিং সেন্টার থেকে জাহাজগুলোকে জানিয়ে দিচ্ছে তোমার নিরুদ্দেশের খবর। কিন্তু আমার কথা তো কেউ বলছে না!

এই বলে সে ফ্যাচ করে নাক ঝেড়ে কেঁদে ফেলল। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, ভেবো না প্রিয়বর্ধন। আমার উদ্ধার হলে তোমারও হবে। তাছাড়া মোটরবোটটা তো আছেই। বরং এবারে ট্রান্সমিশন চালু করে আমরা খবর পাঠাই বিভিন্ন ওয়েভলেন্থে। কোনও-না-কোনও কেন্দ্রে তা ধরা পড়বেই।

এদিন দুপুর পর্যন্ত ওই নিয়ে ব্যস্ত থাকলুম দুজনে। কখনও আমি ইংরেজিতে, কখনও প্রিয়বর্ধন বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন ওয়েভলেন্থে জানাতে থাকলুম, আমরা জয়ন্ত চৌধুরি আর পিওবেদেনে এই দুজন লোক কিওটা দ্বীপে আছি। অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ জানা নেই। তবে ডাইনির দ্বীপ থেকে আন্দাজ সাতশো নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে এটা একটা বলয়দ্বীপ। আমাদের উদ্ধার করো।

কোনও জবাব পাচ্ছিলাম না। মাত্র একবার সম্ভবত কোনও এমেচার বা শৌখিন বেতার ট্রান্সমিশন যন্ত্রের মালিক বলে উঠল, কিওটা? ফকুরি করা হচ্ছে? শোনো, ওই রসিকতা আমিও করে ভীষণ বিপদে পড়েছিলুম। নৌবাহিনীর গোয়েন্দারা এসে আমাকে ধরে বেদম ঠেঙিয়েছিল। সাবধান!

তাকে ব্যাকুলভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেও কাজ হল না। সরকারি কেন্দ্রের ওয়েভলেন্থে আমরা ধরতে পারছিলুম না। কিন্তু ধরতে পারলে তারাও হয়তো মস্করা ভেবে উড়িয়ে দেবে। শেষে হতাশ হয়ে বললুম, যাক গে। চলো প্রিয়বর্ধন, ক্যারিবো বেচারাদের খোঁজে বেরোই। হাজার হোক, ওরা মানুষ তো!

.

এনজেলো! এনজেলো!

প্রিয়বর্ধন আমার সঙ্গে এল না। বলল, শয়তান ক্যারিবো আর ওই দুই ওরাংওটাংকে উদ্ধারের একটুও ইচ্ছা আমার নেই জয়ন্ত! ওরা উচিত শাস্তি পেয়েছে। বরং ততক্ষণ আমি মোটরবোটটা মেরামত করতে থাকি।

আমার মন বলছিল, এ দ্বীপে আমি নিরাপদ। এই বিচিত্র সুন্দর বনভূমি আমার অসংখ্য বন্ধুতে ভরা। তারা মানুষের মতো করে কথা না বলতে পারলেও নিজেদের মতো করে কথা বলে। আমার চেতনায় অনুরণিত হচ্ছে তাদের মনের কথা। প্রতি মুহূর্তে টের পাচ্ছি, ওরা বলতে চাইছে, তুমি আমাদের বন্ধু, তুমি আমাদের প্রিয় অতিথি।

এক বিশাল গাছের সামনে দাঁড়িয়ে তার পায়ে হাত রাখলুম। আবার চমকে উঠলুম। যেন কোনও প্রাণীর শরীর। মনে মনে বললুম, আমি কোনও ক্ষতি করতে আসিনি তোমাদের। আমার মনে রোজারিওর গুপ্তধনের বিন্দুমাত্র লোভ নেই।

আশ্চর্য, আমার চেতনায় কী একটা বোধ সঞ্চারিত হল তখনই। যেন এই বৃদ্ধ প্রপিতামহ বৃক্ষের সস্নেহ কিছু আশীর্বাদ বাক্য অস্পষ্টভাবে অনুভব করলুম। তারপর গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চললুম বনের ভেতর দিয়ে। আমার সাহস চতুগুণ বেড়ে গেল।

কিছুক্ষণ পরে কেউ সামনের দিক থেকে হঠাৎ খুব চাপা গলায় ফিসফিস করে বলে উঠল, এনজেলো! এনজেলো অমনি থমকে দাঁড়ালুম। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলুম না।

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, কাপ্তেন জর্জ ব্যুগেনভিলিও ঠিক এই ডাক শুনেছিলেন কিওটা দ্বীপে। তাহলে এও প্রাচীন যুগের সম্ভবত কোনও নাবিকেরই কণ্ঠস্বরের ভূতুড়ে প্রতিধ্বনি। একটু হাসিও পেল। এক রাজার কান দুটো দেবতার অভিশাপে গাধার কানে পরিণত হয়েছিল। নাপিত ব্যাপারটা টের পেয়েছিল। কিন্তু কাউকে বললেই তো গর্দান যাবে। শেষে মাঠের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে ফিসফিস করে বলেছিল, রাজার কান দুটো গাধার! কিছুকাল পরে সেখানে গজালো একটা নলখাগড়ার ঝোপ। আর বাতাস বইলেই সেই ঝোপ থেকে ফিসফিস করে উচ্চারিত হত, রাজার কান দুটো গাধার! প্রাচীন এশিয়া মাইনরের হিটাইট দেশের মিতান্নি গোষ্ঠীর রাজা মিদাসের গল্প এটা। কিং মিদাস হ্যাজ অ্যাসেস ইয়ারস! নলখাগড়ার ঝোপটা ফিসফিস করে বাতাসের সুরে ঘোষণা করত।

তাহলে বোঝা যাচ্ছে, উদ্ভিদের এই বেয়াড়া স্বভাবের কথা যেন প্রাচীন যুগের মানুষরাও অন্তত আঁচ করতে পেরেছিল।

কিন্তু আরও কিছুটা এগিয়ে আবার সামনে থেকে কেউ ফিসফিসিয়ে উঠল, এনজেলো! এনজেলো। কাম অন! কাম অন!

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কে তুমি ডাকছ এনজেলো বলে? আমি এনজেলো নই।

এনজেলো! ফলো মি।

কেউ এনজেলোকে বলছে, আমাকে অনুসরণ করো। আমি অবাক হয়ে হাঁটতে থাকলুম। কথাগুলো ক্রমশ আমার আগে-আগে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কিছুক্ষণ অন্তর-অন্তর। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলেছি। একটু পরে টিলা পাহাড়ের কাছে পৌঁছলুম। সামনে একটা ফাটল। ফাটলের দুধারে কেয়াগাছের মতো দেখতে একরকম গাছ সারবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল, ওই গাছগুলোর ভেতর থেকে এনজেলো বলে ডাক ভেসে আসছে। এবার গা ছমছম করতে থাকল। এ যেন শেষ পর্যন্ত ভৌতিক ঘটনা হয়ে যাচ্ছে। কোনও অশরীরী মানুষ যেন আমাকে এনজেলো ভেবে কোথায় ডেকে নিয়ে চলেছে।

আবার ইংরেজিতে সেই অশরীরী ফিসফিসিয়ে বলে উঠল : এনজেলো, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। চলে এসো!

পেছন ফিরে বনভূমির দিকে তাকালুম। মনে বললুম, খাব কী? আগের মতোই আমার চেতনার ভেতর সূক্ষ্ম তরঙ্গের মতো এক বোধ সঞ্চারিত হল। ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না,

শুধু বুঝলুম, আমাকে যেতে হবে! তখন হনহন করে সেই ফাটলের ভেতর দিয়ে চলতে শুরু করলুম।

আন্দাজ কুড়ি-পঁচিশ মিটার পরে দেখি একটা গুহার মুখ। মুখের ওপর ঘন লাতাপাতার ঝালর পর্দার মতো ঝুলছে। অসংখ্য ফুল ফুটে রয়েছে নানা রঙের। সুগন্ধে মউ মউ করছে। এ জায়গাটা বেশ চওড়া। একটা ঝাকড়া গাছ যেন সূকুটি-কুটিল অজস্র চোখ দিয়ে আমাকে দেখছে। সাবধানে এগিয়ে ঝালরগুলো দুহাতে সারালুম। গুহার ভেতর ঘন অন্ধকার থমথম করছে। ভূতগ্রস্তের মতো আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমি এসেছি—আমি এনজেলো দস সান্তোস!

পরক্ষণে চমকে উঠলুম। এ আমি কী বলছি? আমার মুখ দিয়ে কার হয়তো পুরো নাম বেরিয়ে গেল—যাকে আমি চিনি না। জানি না। তার সঙ্গে আমার যুগের ব্যবধানও বিরাট। অথচ এনজেলো দস সান্তোস নামে সম্ভবত কোনও পর্তুগিজ নাবিকের নাম আমি উচ্চারণ করে ফেলেছি। কিন্তু এও বুঝতে পারছি যে এনজেলোকে ডেকে এখানে আনতে চাইছিল, সে ইংরেজ। কে সে?

এরপর আমার চেতনা যেন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একই শরীরে জয়ন্ত এবং এনজেলো কী করছে। ঠিক এভাবেই ব্যপারটা ব্যাখ্যা করা যায়।

হলফ করে বলতে পারি। ওই অন্ধকার গুহায় আমি কিছুতেই ঢুকতে পারতুম না। কিন্তু আমার আত্মায় এনজেলোর আত্মা ভর করেছে। আমি ঢুকে গেলুম ভেতরে। একটু পরে দৃষ্টি পরিষ্কার হল। ওদিকে কোনও ফাটল দিয়ে আলো আসছিল। প্রথমেই চোখে পড়ল দুটো গাছের ডাল আড়াআড়ি বেঁধে ক্রস গড়া হয়েছে এবং সেটা পোঁতা আছে গুহার মেঝেতে। নিশ্চয় একটা কবর। কবরের ওপর আবছা আলো এসে পড়েছে সরু ফাটল থেকে। তাই এক টুকরো তক্তা নজরে পড়ছিল। সেটা কবরে ক্রসের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো আছে। তাতে খোদাই করা আছে বড় বড় আঁকাবাঁকা হরফে :

ক্যাপ্টেন রোজারিও এনড্রস স্মিথ
মৃত্যু ১৬ জুন, ১৫৯১

ফলকটা তুলে ধরে পড়ছিলুম। সেই সময়, গুহায় যে দিক থেকে ঢুকেছি, তার উল্টোদিকে ফাটল থেকে আসা আলোয় একঝাক ব্যুমেরাং গড়নের সেই কাঠপোকাগুলোকে লাফিয়ে লাফিয়ে আসতে দেখলুম। আমার পায়ের কাছ দিয়ে ওরা লাফাতে লাফাতে গুহার দরজার দিকে চলে গেল। তারপর টের পেলুম ওদের পালিয়ে আসার কারণ। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলুম।

হনহন করে এগিয়ে আসছিল কেউ। ফাটলের আলোর কাছে সেও দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু ও কি মানুষ?

হ্যাঁ, মানুষই বটে। কারণ, আমার মতোই তার একটা মাথা, দুটো হাত, দুটো পা আছে। কিন্তু পরনে মাছের প্রকাণ্ড আঁশের মতো পাতার পোশাক যেন—পাতাবাহারের লাল-হলুদ চকরাবকরা রং ওই পাতাগুলোর। গলার কাছ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত এই বিচিত্র পোশাক। দুটো বাহু এবং পা খালি। সবচেয়ে অদ্ভুত ওর গায়ের রং। খসখসে সবুজ।

মুখটাও সবুজ। ভুরু ও চোখের পাতা খয়েরি রঙের। চোখের তারা লালচে, বাকি অংশ ছাই রঙের। তার মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো অবিকল উদ্ভিদের গুচ্ছ মূল যেন, —চুলের রং মেটে।

সেই অদ্ভুত মানুষটা নিষ্পলক তাকিয়ে আমাকে দেখছে।

আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলুম। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে সম্ভাষণের ভঙ্গিতে একটু হাসলুম। তখন তার মুখেও হাসি ফুটে উঠল। সেও মাথাটা একটু দোলাল।

এবার আমি আমার জানা কয়েকটা ভাষায় তাকে জিগ্যেস করলুম, কে তুমি? কিন্তু মনে হল, আমার কথা সে বুঝতে পারছে না। অথবা সে বোবা।

তারপর সে আমাকে হাতের ইশারায় তার সঙ্গে যেতে বলে যেদিক থেকে এসেছে, সেইদিকে পা বাড়াল। মনে অস্বস্তি নিয়ে তাকে অনুসরণ করলুম। একটু এগিয়ে গুহার অন্য মুখে পৌঁছলুম। এ মুখটা বেশ বড়। দেখলুম, মুখের ওপর যে লতার ঝালর ছিল, তা দুপাশে সরিয়ে আটকে রাখা হয়েছে! হয়তো এই সবুজ মানুষটাই এ কাজ করেছে। বাইরে বেরিয়ে জায়গাটা চিনতে পারলুম। কাল আমি ও প্রিয়বর্ধন এই পাহাড়ি-খাতেই এসেছিলুম। অনেক নরকঙ্কাল পড়ে আছে এখানে-ওখানে। কিন্তু কালকের মতো কোনও চেঁচামেচি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল না। ভীষণ স্তব্ধ হয়ে আছে পরিবেশ। সবুজ মানুষ আমাকে ইশারা করল ডাইনে খুব সংকীর্ণ একটা খাতের ভেতর যেতে।

সেই খাতের ভেতর কিছুটা যাওয়ার পর এক অভাবিত দৃশ্য চোখে পড়ল।

আমাদের সামনে নিচে চওড়া অর্ধবৃত্তাকার একটা বেলাভূমি। সেখানে একদল এমনি রঙিন পাতার পোশাকপরা সবুজ মানুষ কী যেন করছে। তাদের হাতে গাছের ডাল। একটা প্রকাণ্ড পাতাশূন্য ডাল মাঝখানে পোঁতা আছে।

তারপরেই চোখে পড়ল জলের ধারে চার-পাঁচখানা ছিপ নৌকা।

সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথা পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝতে পারলুম, এই সবুজ মানুষরা আসলে আমার মতোই মানুষ। তারা গায়ে রং মেখে চোখ-ভুরু এঁকে এই দ্বীপে এসেছে কোনও উৎসব বা পুজোআচ্চা করতে। এরা কোনও দ্বীপের অধিবাসী তাতে সন্দেহ নেই। ওই নৌকায় চেপেই ওরা এসেছে।

এটা কিওটার উত্তর-পশ্চিম দিক। দূরে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে প্রবাল পাঁচিল। তাহলে এরা ঢুকল কোন্ পথে? পুবদিকের প্রবাল বলয়ের ভাঙা জায়গাটা ছাড়া এ-দ্বীপে আসার পথ তো নেই।

আমার প্রশ্নের জবাব তখনই মিলে গেল। ঢোলের শব্দ ভেসে এল এবং তারপর আতঙ্কে চেয়ে, দেখলুম, ডানদিকের পাহাড়ে সেই ঝরনার পাশ দিয়ে ধাপে ধাপে আরও একদল সবুজ রং মাখা মানুষ কাকে বেঁধে কাঁধে বয়ে আনছে। বিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলুম বেচারা প্রিয়বর্ধনকে।

আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া হল পালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু আমার সঙ্গী সেটা আঁচ করেই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটার গায়ে অসম্ভব শক্তি। কিন্তু উৎকট দুর্গন্ধেই কাবু হয়ে গেলুম। ওর গায়ের দুর্গন্ধটা নিশ্চয় রঙের কড়া ঝঝ। সে আমাকে মাটিতে পেড়ে দুর্বোধ্য ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল। অমনি নিচের বিচ থেকে কয়েকজন ছুটে এল। অসহায় হয়ে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিলুম।

প্রিয়বর্ধন চোখ বুজে পড়েছিল পোঁতা ডালটার সামনে। লতা দিয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ততক্ষণে বেঁধে ফেলেছে এরা। সে চোখ খুলে আমাকেও একই দশায় দেখে ভীষণ বিপদের মধ্যে করুণ হাসল। তারপর ফিসফিস করে বলল, অন্যদিকে ঘুরে বোট সারাচ্ছি, ব্যাটাচ্ছেলেরা কখন পেছন থেকে এসে…

একটা লোকের মাথায় ফুলের মুকুট। তার হাতে একটা চওড়া কাস্তের মতো বাঁকানো চকচকে অস্ত্র। সে হুমহাম করে গর্জন করে অস্ত্রটা নাড়তেই প্রিয়বর্ধন চুপ করে গেল।

বালির ওপর অসংখ্য ফুল ছড়ানো আছে। সবুজ রং মাখা লোকগুলো বিকট নাচতে লাগল তার ওপর। ঢোল বাজছিল। সেটা দ্বিগুণ জোরে বাজতে লাগল। তারপর ওরা দুর্বোধ্য ভাষায় গান গাইতে শুরু করল।

মাথার ওপর সূর্য। বালি তেতে উঠছিল ক্রমশ। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল—লতা দিয়ে এমন শক্ত করে আমাদের বেঁধেছে যে রক্তস্রোত বন্ধ হয়ে গেছে যেন।

তাদের নাচগানবাজনা ক্রমশ চরমে পৌঁছল। মাঝেমাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলুম। এইভাবে কতক্ষণ কাটল জানি না, একসময় দেখি, ওরা আমাকে আর প্রিয়বর্ধনকে বয়ে নিয়ে চলেছে। ঠাহর করে বুঝলুম, সেই পাহাড়ি খাতের ভেতর দিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

সেই গুহার প্রকাণ্ড মুখের সামনে ওরা আমাদের নামিয়ে দিল। তারপর দুজনকেই উপুড় করে শোওয়াল। বেশ বুঝলুম, এবার আমাদের মাথাটা কাটা হবে। আমরা কিওটা দ্বীপের বৃক্ষদেবতার বলি হব। ভাবলুম, প্রিয়বর্ধনকে মৃত্যুর মুহূর্তে শেষ বিদায় জানাই। কিন্তু কথা বেরুল না। তালু শুকিয়ে গেছে। কথা বলার শক্তিটুকুও আর নেই। তখন চিন্তা করলুম,

ওই কাস্তের মতো বাঁকা অস্ত্রটা দিয়ে নিশ্চয় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গলাটা কাটবে ওরা, যন্ত্রণাটা কতখানি হতে পারে।

এখন কিন্তু ঢাক বাজছে না। কেউ কথা বলছে না। আড়চোখে যতটা দেখা যায়, লোকগুলোর হাবভাবে চঞ্চলতা আঁচ করা যাচ্ছিল। একজন আমার এবং আরেকজন প্রিয়বর্ধনের পাশে বসে পড়ল।

হঠাৎ আমার মস্তিষ্কে বিদ্যুতের গতিতে একটা বোধ দেখা দিল। এ-দ্বীপের কৃষকবন্ধুদের এ বিপদে ডাকছি না কেন? সেই মুহূর্তে তখনকার মতোই আমার আচ্ছন্ন চেতনা থেকেই যেন সাড়া এল। অনেক কষ্টে ফিসফিস করে বলে উঠলুম, আমি এনজেলো দস সান্তোস! আমাকে বাঁচাও?

অমনি গুহার দিক থেকে ঝড়বাতাসের শব্দের মতো শব্দে উচ্চারিত হল : এনজেলো! এনজেলো! এনজেলো!

আমাদের পাশে বসে থাকা লোকদুটো তড়াক করে উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। এনজেলো শব্দটা ক্রমশ বাড়ছিল। মনে হচ্ছিল ঝড় বইতে শুরু করেছে এনজেলো শব্দের।

তারপর শোনা গেল সেই প্রতিধ্বনি : স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে স্টপ ইট! উঁচু পাহাড়ের দেওয়ালে সেই ভীষণ চিৎকার বিকট প্রতিধ্বনি তুলল। আই কিল ইউ। কিল…কিল…কিল! তারপর হেল্প! হেল্প! হেল্প!

দড়বড় দড়বড় শব্দ করে সবুজ রং মাখা পাতার পোশাক-পরা আদিম লোকগুলো ততক্ষণে উধাও। চেঁচামেচি থামলে মুখ অতিকষ্টে ঘুরিয়ে দেখি, জনপ্রাণীটি নেই। আর সামান্য তফাতে সেই কাস্তের মতো বাঁকা অস্ত্রটা পড়ে আছে। বুঝলুম, দেবতা বলি খেতে চায়নি বলে কিংবা ঘাতকের চোটে ব্যাটাচ্ছেলেরা অস্ত্রটা ফেলেই পালিয়ে গেছে। আমার গলায় এতক্ষণে জোর ফিরে এল। শরীরেও।

কিন্তু প্রিয়বর্ধনকে ডেকে সাড়া পেলুম না। গড়াতে গড়াতে অস্ত্রটার কাছে গেলাম। তারপর ওটার বাঁট কামড়ে চিত করে দুটো পাথরের মাঝখানে বসালুম। ঠোঁট কেটে গেল একটু। এবার কাত হয়ে অস্ত্রটার ডগায় হাতের বাঁধনটা ঘষতে থাকলুম। বাঁধন কেটে গেল। এবার আর অসুবিধে হল না।

একটু পরে প্রিয়বর্ধনের বাঁধন কেটে তাকে চিত করে দিলুম। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, আমি বেঁচে আছি, মরে গেছি?

বেঁচে আছে। ওঠো। প্রিয়বর্ধন তবু সন্দিগ্ধভাবে বলল, আমার ধড়টা কোথায়? যথাস্থানে আছে। উঠে পড়ো। আমার খিদে পেয়েছে।

ওকে টেনে ওঠালুম। ও কিছুক্ষণ হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে এবং লাফালাফি করে রক্ত চলাচল ঠিক করে নিল। তারপর একটু হেসে বলল, তুমি তো জয়ন্ত। কেন বলছিলে আই অ্যাম এনজেলো দস সান্তোস? এনজেলো শুনেছি কাপ্তেন রোজারিওর ছেলের নাম ছিল। ওর বউ ছিল পর্তুগিজ।

বললুম, ওসব পরে শুনব। এখন চলো, খিদে পেয়েছে।

.

কিয়াংয়ের আবির্ভাব

অচল মোটরবোটটা হয়ে উঠেছে আমাদের উদ্ধারের আশায় প্রতীক। অথচ বুঝতে পারছিলুম, প্রিয়বর্ধন যত পাকা মিস্তিরির ভান করুক, ওটা সচল করার মতো জ্ঞানবুদ্ধি ওর নেই। তবু সময়টা বেশ কেটে যায় আশায় আশায়। প্রিয়বর্ধন নানা ভঙ্গিতে চিত-উপুড়-কাত হয়ে কিংবা হাঁটু দুমড়ে গম্ভীরমুখে খুটখাট করে এবং কোনও এক জলদস্যু কাপ্তেন রোজারিও, তার পর্তুগিজ বউ আর ছেলে এনজেলোর গল্প শোনায়। রোজারিও নাকি তার বউ আর ছেলেকে নিয়ে এই দ্বীপে বাস করতে এসেছিল। সঙ্গে ছিল সারাজীবনের লুণ্ঠিত ধনরত্ন। কিন্তু ওর চেলারা কীভাবে খোঁজ পেয়ে সারারাত এখানে হানা দেয়। ওদের হত্যা করে। তারপর নিজেদের মধ্যে মারামারি করে নিজেরাও খুন হয়ে যায়।

এই কাহিনী শুনে আমার মনে হচ্ছিল, কিওটা দ্বীপের উদ্ভিদ রহস্যের কিছুটা যেন আঁচ করতে পেরেছি। খুব উত্তেজনার সময় মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে যে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়, দ্বীপের গাছপালার কোষে কোষে যেন তা সাড়া তুলতে সমর্থ। সেই উত্তেজনার সময়কার সব কথাবার্তা তাই রেকর্ড হয়ে যায় কোষগুলিতে। তারপর সম্ভবত আবহাওয়ার তাপমাত্রার হেরফের ঘটলে সেটাই হয়ে ওঠে রেকর্ডগুলি বেজে ওঠার কারণ। লক্ষ্য করেছি, স্টপ ইট চিৎকার নির্দিষ্ট সময় অন্তর বেজে ওঠে না। বেজে ওঠে হঠাৎই। কাজেই আবহাওয়ার হেরফেরের মধ্যেই রহস্যটা লুকিয়ে আছে।

মানুষের চিন্তাতরঙ্গের চাপ যে উদ্ভিদের ভেতরও সাড়া জাগায়, তা আধুনিক বিজ্ঞানীরা তো প্রমাণ করেছেনই। কর্নেলের কাছে মার্কিন বিজ্ঞানী ক্লি ব্যাকস্টারের গবেষণার কথা শুনেছিলুম। ব্যাকস্টার প্রথমে ছিলেন অপরাধ-বিজ্ঞানী এবং লাই-ডিটেকটর পরীক্ষক। 1966 সালে একটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে গাছের সাহায্যে হত্যাকারীকে ধরে ফেলেন। ব্যাকস্টার গ্যালভানোমিটার যন্ত্র সেই গাছের সঙ্গে যুক্ত করে সন্দেহযোগ্য লোকদের একে একে যন্ত্রটার সামনে দাঁড় করান। তারপর একটা লোক সামনে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকস্টার দেখলেন, গ্যালভানো মিটারের সংকেত কাঁটা প্রচণ্ডভাবে কাঁপতে শুরু করেছে। অর্থাৎ সেই গাছটা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সেই লোকটাকেই এই গাছটা খুন করতে দেখেছিল। পরে সে সব স্বীকার করে। তারপর জগতে সাড়া পড়ে যায়।

প্রিয়বর্ধনকে কিওটা দ্বীপের গাছপালার রহস্য বোঝানোর চেষ্টা বৃথা। প্রাণের বিবর্তনের একটা স্তরে যখন উদ্ভিদ আর প্রাণী পৃথক হয়ে গিয়েছিল, সম্ভবত তখনই প্রকৃতির কী খেয়ালে এই দ্বীপে মাঝামাঝি একটা প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছিল, যারা প্রাণী এবং উদ্ভিদ দুই-ই! তাই তারা স্বাভাবিক উদ্ভিদের চেয়ে বেশিমাত্রায় চেতনাসম্পন্ন। তাদের বোধশক্তি প্রাণীদের মতোই, অথচ তাদের দেহ উদ্ভিদের মতো। আবার কোনও কোনও উদ্ভিদ প্রাণীদের মতোই চলাফেরা করতেও সমর্থ। যেমন ওই অদ্ভুত ক্যাকটাসগুলো—যারা ক্যারিবো, উংচু আর ফুতাংকে ধরে নিয়ে গেছে।

তিনদিন ধরে আমরা সারা দ্বীপ তন্নতন্ন খুঁজেও হতভাগ্য লোক তিনটিকে দেখতে পাইনি। কখনও মাকড়সা ক্যাকটাসগুলোকে একলা বা দলবেঁধে ঘুরতে দেখেছি। কিন্তু সাহস করে কাছে গেলেই তারা ঝটপট একগুচ্ছের শিকড় মাটিতে ঢুকিয়ে বকধার্মিক সেজে দাঁড়িয়ে থেকেছে—যেন কিছু জানে না। ক্যাকটাস না ক্যাকটাস। প্রিয়বর্ধন দাঁত মুখ খিচিয়ে বলেছে, ন্যাকা! কোথায় গুম করেছ বদমাশগুলোকে, বলো শিগগির! নইলে ঘ্যাচাং করে গোড়াটা কেটে ফেলব।

মাকড়সা-ক্যাকটাস নিশ্চয় বুঝতে পারে, প্রিয়বর্ধনের যত তড়পানি. শুধু মুখেই। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তবে আজ সকালে ভারি মজা হয়েছিল। যেই প্রিবর্ধন বকাবকি করতে গেছে, একটা মাকড়সা ক্যাকটাস আচমকা একটা শুড় বের করে ওকে জড়িয়ে ধরেছে। আর বেচারার সে কী ত্রাহি চিৎকার! শেষে আমি অনেক তোষামোেদ অনেক কাকুতিমিনতি করলুম। তখন খুঁড়টা খসে গিয়ে ছোট হতে হতে স্প্রিংয়ের মতো গুটিয়ে মাকড়সা-ক্যাকটাসটার ভেতর লুকিয়ে পড়ল। প্রিয়বর্ধন ল্যাজ তুলে  দৌড়ে ক্যাম্পে চলে গেল। সেই থেকে আর নড়তেও চায় না। আবার মোটরবোটটা নিয়ে খুটখাট করে যাচ্ছে।

এদিকে ক্যারিবোদের আনা খাবারদাবার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমরা একবেলা গাছের ফলে বা বলয়সাগরের মাছ ধরে খিদে মেটাচ্ছি। অবশ্য খিদেয় মারা পড়ার আশঙ্কা নেই। দ্বীপে অসংখ্য ফলের গাছ আছে এবং অনেক গাছই দয়ালুদাতা।

আরেকটা কাজ দুজনে নিয়মিত করে যাচ্ছি। তা হল রেডিও ট্রান্সমিশন যন্ত্রের নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিভিন্ন ওয়েভলেন্থে মেসেজ পাঠানো। কোনও কোনও কেন্দ্রে মেসেজ গণ্ডগোল ঘটাচ্ছে। দু পক্ষের কথাবার্তা জড়িয়ে-মুড়িয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রটা বিকট ঘড়ঘড় শব্দ তুলছে। বিগড়ে যাওয়ার ভয়ে বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। কখনও দৈবাৎ কোনও কেন্দ্রে যদি আমাদের মেসেজ ধরা পড়ছে, কড়া ধমক অথবা ঠাট্টাতামাশা করা হচ্ছে। কিওটা নামে দ্বীপটা সরকারি মতে রূপকথা। এটাই হয়েছে সমস্যা। রুবি আইল্যান্ডে নৌবাহিনীর বেতারকেন্দ্র যদি দৈবাৎ ধরতে পারি, আমাদের আশা আছে তারা আমাদের মেসেজকে উড়িয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু কিছুতেই ওই কেন্দ্র ধরতে পারি না।

একদিন দুপুরে বহুদূরে একটা হেলিকপ্টারকে উড়তে দেখলুম। দুজনে আনন্দ নেচে উঠলুম। নিচে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলুম ওটার দিকে। কিন্তু নচ্ছার হেলিকপ্টারটা দূর দিয়েই চলে গেল। প্রিয়বর্ধন রেগে গাল দিতে শুরু করল। ওকে বুঝিয়ে বললুম, ভেবে দেখ প্রিবর্ধন, কোকোস দ্বীপপুঞ্জ এলাকায় হাজার-হাজার এমন দ্বীপ আছে। কোন দ্বীপটা যে কিওটা, সেটা খুঁজে বের করা আর খড়ের গাদায় সঁচ খোঁজা একই কথা। ধৈর্য ধরো। ওই হেলিকপ্টার আবার হয়তো আসবে এবং এই দ্বীপের ওপর দিয়েও উড়ে যাবে। তখন আমাদের দেখতে পাবে।

এরপর আমরা ঠিক করলুম, হেলিকপ্টারের শব্দ পেলেই আমরা শুকনো পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালাব। ধোঁয়ায় আকৃষ্ট হয়ে এদিকে ওদের চোখ পড়বেই।

কিন্তু আরও দুদিন কেটে গেল বৃথা। হেলিকপ্টারটা আর এমুখখা হল না।

তিনদিনের দিন দক্ষিণের বনভূমি পেরিয়ে খাড়ির মাথায় আমি একা দাঁড়িয়ে আছি, প্রিয়বর্ধন ক্যাম্পে আছে, সেই সময় নিচের একটা চাতালমতো জায়গায় চোখ পড়তেই চমকে উঠলুম। তিনটি সবুজ রঙের মানুষের মতো কারা পড়ে আছে। একেবারে উলঙ্গ তারা। ঝুঁকে ভালভাবে লক্ষ্য করে দেখি, হতভাগ্য ক্যারিবো, ফুতাং আর উংচু!

দ্রুত তাদের কাছে নেমে গেলুম। উপুড় হয়ে পড়ে আছে তারা। সারা গায়ে সবুজ দাগড়া-দাগড়া ছোপ। তাদের দেহে প্রাণ নেই। তিনটি লোভী মানুষের এই ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখে শিউরে উঠেছিলুম। সেই মারাত্মক ক্যাকটাস-প্রাণীর পাল্লায় পড়ে শ্বাসরোধ হয়ে সম্ভবত এরা মারা পড়েছে। কিন্তু ওই বিকটা সবুজ ক্ষতচিহ্নগুলি কি রুবিদ্বীপে শোনা সেই সবুজ এলার্জি রোগের চিহ্ন?

হতভাগ্য মানুষ তিনটির জন্য দুঃখ হচ্ছিল। ক্যাকটাস-প্রাণীরা তাদের এখানে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এরা মানুষ এদের মরা পড়ে থাকবে, এটা খারাপ লাগল। তক্ষুনি দৌড়ে গিয়ে প্রিয়বর্ধনকে ডেকে আনলুম।

প্রিয়বর্ধন সব দেখে বলল, কীভাবে এদের সদগতি করবে ভাবছ? এখান থেকে ওঠানো অসম্ভব। ক্যারিবো খ্রিস্টান, ফুতাং আর উংচু বৌদ্ধ। বরং এক কাজ করা যাক। এদের ঠেলে নিচের জলে ফেলে দিই। জয়ন্ত, সব শাস্ত্রেই বলেছে জল জিনিসটা শুদ্ধ৷ এদের আত্মার মুক্তি হবে। তাছাড়া নাবিকদের মৃত্যু হলে সমুদ্রের জলেই তাদের ফেলে দেওয়া চিরকাল সবদেশেরই রীতি।

দুজনে মৃতদেহ তিনটি ঠেলে নিচে খাড়ির জলে ফেলে দিলাম।

কিন্তু তারপর যা ঘটল তাতে আমরা আতঙ্কে হতবুদ্ধি হয়ে হাঁচড়-পাঁচড় করে ওপরে পালিয়ে আসতে বাধ্য হলুম। বলয়-সাগরের জল থেকে ভোঁস করে একটা লম্বাটে বিরাট মাথা বেরিয়ে এল। মুখটা কতকটা উটের মতো, কিন্তু সুচালো। লম্বা গলা। ছোট মাথা। কিন্তু শরীরটা তিমির মতো বিশাল। স্বচ্ছ জলে তার চারটে পাখনার মতো পা দেখা যাচ্ছিল। সেই বিকটাকৃতি সামুদ্রিক প্রাণীটি মহানন্দে মরা তিনটিকে পাখনা-পায়ে আটকে নিয়ে ভোঁস করে তলিয়ে গেল।

ওমনি আমার মনে পড়ে গেল ব্রিটেনের লক নেস (Loch Ness) হ্রদের কিংবদন্তিখ্যাত জলচর প্রাণী নেসি (Nessie) এর কথা। এই রহস্যময় প্রাগৈতিহাসিক জলচর প্রাণীটির ছবি পর্যন্ত ক্যামেরায় তুলেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু বহু খোঁজ করেও তার পাত্তা পাওয়া যায়নি আজও। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ওই হ্রদের ভেতর কোনও গভীর সুড়ঙ্গে তার বসবাস।

এ কি তাহলে সেই নেসি?

বিকটাকার প্রাণীটির গলা এত লম্বা যে সে ইচ্ছে করলে অনায়াসে খাড়ির ওপর থেকে আমাদেরও টুপ করে মুখে তুলে নিতে পারে।

হয়তো সেই ভয়েই প্রিয়বর্ধন জঙ্গলের আড়ালে লুকোতে গেল। তারপর তাকে মাই গড বলে ছিটকে সরে আসতে দেখলুম। সরে এসে আবার চেঁচিয়ে উঠল সে। বললুম, কী হল প্রিয়বর্ধন?

প্রিয়বর্ধন একটা ঝোপের দিকে দেখিয়ে বলল, সাবধান জয়ন্ত, এই বিচ্ছু গাছগুলোকে চিনে রাখো। ব্যাটারা ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে সামুদ্রিক ঈল মাছের মতো। জোর বেঁচে গেছি।

ঝোপগুলোকে এড়িয়ে আমরা খোলা মাঠ ধরে ক্যাম্পে ফিরে গেলুম।…

সেদিন রাতে পূর্ণিমা। কিওটা বনভূমি যেন পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় মাতাল হয়ে উঠেছে। যেদিকে কান পাতি, সঙ্গীত শুনতে পাই। অপার্থিব যেন সেই সঙ্গীত। হু-হু করে হাওয়া দিচ্ছে আর মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে যেন পরীরা নেমে এসে নাচ-গানে জমিয়ে তুলেছে দ্বীপটাকে। প্রিয়বর্ধনের ওদিকে লক্ষ্য নেই। সে ক্যাম্পখাটে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। আমার পাহারা দেওয়ার পালা। কিন্তু কিসের জন্য এই সতর্ক পাহারা কে জানে? তবু মন মানে না বলেই ক্যারিববাদের ফেলে-যাওয়া একটা রাইফেল হাতে রেখেছি।

একসময় রাইফেলটা রেখে উঠে দাঁড়ালুম। পূর্ণিমারাতের বনভূমির মধুর অর্কেস্ট্রা প্রাণভরে উপভোগ করার জন্য কিছুটা এগিয়ে গেলুম।

তাহলে এমনি সব রাতেই প্রাচীন যুগে নাবিকরা কিওটা দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সঙ্গীত শুনতে পেত। সুদূর প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপে আদিম অদিবাসীরা এই দ্বীপের কথা শুনে হয়তো কোহাও রঙ্গো রঙ্গো পুঁথি রচনা করেছিল। কিন্তু এ-দ্বীপ এখনও সবাই খুঁজে পায় না—শুধু আমাদের মতো দৈবাৎ কেউ এখানে এসে পড়ে। তল্লাটের কোনও-কোনও দ্বীপে আদিম অধিবাসীরা অবশ্য এ-দ্বীপ কোথায়, তা ভালই জানে। তারা এখানে পুজো দিতে আসে। কিন্তু সভ্য মানুষের কাছে এর খোঁজ দিতে চায় না। আমরা সেদিন তাদের পাল্লায় পড়েছিলুম। আমার খোঁজে বেরিয়ে কর্নেল যদি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, তবেই এখান থেকে উদ্ধার হওয়ার আশা। নইলে বাকি জীবন এখানেই কাটাতে হবে।

আজ রাতে মনে হচ্ছিল, তা যদি হয়, তো হোক। কিওটার বৃক্ষরা আমার পরম বন্ধু হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যেই আমি আমৃত্য বরং থেকে যেতে রাজি।

জ্যোৎস্নায় খোলা মাঠ ঝলমল করছে। আবছাকালো দুধারের অরণ্যে অর্কেস্ট্রা বাজছে আর বাজছে। কত বিচিত্র সুর। গম্ভীর, সূক্ষ্ম। চড়া বা খাদে। ডাইনে এগিয়ে উঁচু উঁচু গাছগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে রইলুম। এলোমেলো হওয়া বইছে আর ডালপালা নড়ছে—ওই বুঝি তাদের নাচ। বৃক্ষমর্মরধ্বনির কথা কবিতায় পড়েছি। কিন্তু এতো তা নয়—এ এক আশ্চর্য মধুর ঐকতান। কে শেখাল এই সঙ্গীতের ভাষা। তা কানের ভেতর দিয়ে মর্মে গিয়ে আমাকে আবেগে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।

কতক্ষণ তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম জানি না, একসময় প্রিয়বর্ধনের চিৎকারে আচ্ছন্নতা কেটে গেল। সে উত্তেজিতভাবে ডাকডাকি করছিল, জয়ন্ত! জয়ন্ত! তুমি কোথায়?

কোনও বিপদ ঘটেছে ভেবে দৌড়ে ক্যাম্পে ফিরে গেলুম। প্রিয়বর্ধন পুবের দিকে হাত তুলে বলল, একটা আলো দেখতে পাচ্ছ, জয়ন্ত? নিশ্চয় কোনও জাহাজ নোঙর করেছে। আলোটা একজায়গায় রয়েছে তখন থেকে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে তোমাকে ডাকলুম। সাড়া না পেয়ে বেরিয়ে আসতেই চোখে পড়ছিল আলোটা।

আলোটা এক জায়গায় আছে। তবে মাঝে মাঝে ঢেউয়ে আড়াল হচ্ছে, আবার ভেসে উঠছে। প্রবাল-পাঁচিলের ভাঙা অংশটা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বহুদূরের ওই আলো। আমরা তাকিয়ে রইলুম সেদিকে।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে অবাক হচ্ছিলুম। হাওয়াটা ক্রমশ বাড়ছে। অথচ আকাশ পরিষ্কার। এদিকে সারা দ্বীপ জুড়ে অর্কেস্ট্রার বাজনাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। কিওটার বনভূমি যেন উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। একসময় হওয়ার ঝাঁপটানি এমন প্রবল হল যে ক্যাম্পের দড়ি ছিঁড়ে খুঁটি উপড়ে কোথায় উড়ে গেল। আমরা বালির ওপর উপুড় হয়ে পড়লুম ঝড়ের ধাক্কায়। দুহাতে কানও ঢাকতে হল। প্রচণ্ড ঝড়ের শব্দ আর অর্কেস্ট্রার শব্দ মিলে কানে তালা ধরে যাচ্ছিল। বলয়সাগরের জল উপচে এসে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছিল। একসময় ওই প্রলয় আলোড়ন যখন ধীরে ধীরে কমে গেল, তখন চাঁদ পশ্চিমে ঢলে পড়েছে।

শেষ রাতে সব শান্ত হয়ে গেল। তখন ক্ষীণ সুরে শুধু বেহালার বাজনা কানে আসছিল। বড় করুণ সেই সুর। এ যেন শোকসঙ্গীত শুনতে পাচ্ছি। কার হৃদয়ের গভীর শোক কান্নার সুরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে। দূরে থমথম করছে আবছাকালো বনভূমি। মৃত্যুশোকের স্তব্ধতা রূপ নিয়েছে বুঝি।

তখনও জানতুম না, জানার উপায় ছিল না, একই শোকসঙ্গীত কেন। কেনই বা এত আলোড়ন।

একটু বেলা হলে দূরের সমুদ্র থেকে কুয়াশা কেটে গেল। তখন জাহাজটা দেখতে পেলুম। আমরা শুকনো পাতা ডালপালা জড়ো করে আগুন জ্বেলে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলুম। কিন্তু ততক্ষণে তিনটে মোটর বোট প্রবাল পাঁচিলের কাছে এসে পৌঁছে গেছে। তিনটে বোটেই একদল করে মানুষ। বোটগুলো যেভাবে ওরা ভাঙন পার করল, তাতে বুঝলুম ওরা এর আগেও দ্বীপে সম্ভবত এসেছে। ওরা তাহলে কারা?

প্রিয়বর্ধন নিষ্পলক চোখে তাকিয়েছিল। এতক্ষণে ফিসফিস করে বলল, কিয়াং এসে গেছে! জয়ন্ত, একশোটা ক্যারিবো একটা কিয়াংয়ের সমান। তবে মাকড়সা-ক্যাকটাসের পাল্লায় পড়ে ওদেরও কী হয় দেখে নিও। আর একটা কথা। কিয়াংয়ের সঙ্গে আমরা ভাব জমাবো। ওরা যখন মারা পড়বে মাকড়সা-ক্যাকটাসের হাতে, তখন আমরা ওদের বোট নিয়ে ওদের জাহাজে চলে যাব।

কিয়াংয়ের চেহারা বেঁটে হলেও প্রকাণ্ড। সে নিচে লাফিয়ে পড়ে হা-হা করে হেসে বলল, আরে? রাজবংশের প্রাইভেট সেক্রেটারিমশাই যে! আর এই ছোকরা বুঝি সেই টেকো দাড়িয়ালা ঘুঘু বুড়োর শাগরেদ? কী? রোজারিওর গুপ্তধন হাতাতে পেরেছো তোমরা?

প্রিয়বর্ধন একগাল হেসে বলল, না স্যার! তবে গুহার ভেতর রোজারিওর কবর দেখতে পেয়েছি।

.

মহাশ্মশানের বেহালাবাদক

কিয়াং প্রিয়বর্ধনের কথা শুনে আরও হেসে বলল, রোজারিওর কবর আবিষ্কার করেছে, আর তার গুপ্তধন আবিষ্কার করতে পারোনি? আমি জানি, ওর কবরের তলায় সব ধনরত্ন পোঁতা আছে। চলো, সেই গুহাটা দেখিয়ে দাও।

প্রিয়বর্ধন আমাকে চোখের ইশারায় কী যেন বলে খুব উৎসাহ দেখিয়ে পা বাড়াল। কিন্তু ব্যাপারটা আমার ভাল মনে হল না। মাকড়সা ক্যাকটাসের হাতে খামোকা আবার এতগুলো লোকের মৃত্যু হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলুম না। তাই বললুম, মিঃ কিয়াং, শুনুন। ক্যারিববা আর তার দুই সঙ্গী এই দ্বীপে এসেছিল। তারা…

কথা কেড়ে কিয়াং বলল, সর্বনাশ! তাহলে তারাই সব হাতিয়ে কেটে পড়েছে।

বললুম, না। তারা এই দ্বীপের সাংঘাতিক মাকড়সা-ক্যাকটাসের পাল্লায় পড়ে মারা গেছে।

কিয়াং হাসল। জানি, জানি। সেবার ওদের পাল্লায় পড়ে আমার দলেরও পাঁচটা লোকের প্রাণ গেছে। তাই এবার আমি তৈরি হয়েই এসেছি।

মিঃ কিয়াং! ওদের গায়ে গুলি বেঁধে না!

কিয়াং তার কাঁধের ব্যাগ খুলে রিভলভারের মতো একটা জিনিস বের করে বলল, এটা কি জিনিস বুঝেছ? লেসার অস্ত্র। যে-কোনও সজীব পদার্থকে এক সেকেন্ডে ছাই করে ফেলবে। শুধু তাই নয়; পাথরের মতো নির্জীব পদার্থকেও গুঁড়ো করে দেবে। এর নল থেকে সাংঘাতিক লেসার রশ্মি বেরোয়। শুধু তাই নয়, ওই যে কামানের মতো জিনিসটা দেখতে পাচ্ছ, ওটা আরও শক্তিশালী লেসার বিম ছুড়ে মারে। কি, চলো প্রিয়বর্ধন! রুবি আইল্যান্ডের ঘুঘুগুলো হেলিকপ্টার নিয়ে সবসময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার জাহাজ দেখে তাদের সন্দেহ হতে পারে। ঝটপট কাজ সেরে ফিরে যাব। তার আগে অবশ্য ভূতুড়ে গাছপালাগুলোকে জ্বালিয়ে খতম করে দিয়ে যাব।

আমি দম আটকানো গলায় বলে উঠলুম, দোহাই মিঃ কিয়াং! কথা শুনুন—এই দ্বীপ বিজ্ঞানের এক ল্যাবরেটরি!

রাখো তোমার ল্যাবরেটরি! কিয়াং বিকট হাসল। আমি এবার এসেছি কিওটার ভূতগুলোকে খতম করতে। ওরা আমাকে খুব ভুগিয়েছে। আমার অনেক লোক মারা পড়েছে ওদের হাতে। আমি প্রতিশোধ নেবই।

বলে সে তার দলবল নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। প্রিয়বর্ধনকে ঠেলে নিয়ে চলল সে। কিন্তু আমার দিকে ঘুরেও তাকাল না।

একটু পরে শুরু হল কিয়াংয়ের পৈশাচিক কীর্তিকলাপ। যথারীতি স্টপ ইট! স্ট ইট চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতেই দেখলুম, তার এক সঙ্গী যেদিক থেকে চিৎকারটা আসছিল, সেইদিক লক্ষ্য করে লেসার কামান বসাল। তারপর দেখলুম, ডানদিকের জঙ্গল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। আমি দৌড়ে গিয়ে চেচিয়ে বললুম, স্টপ ইট! স্ট ইট! ওর এক অনুচর আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল।

কিয়াংয়ের মুখে পৈশাচিক হাসি। সে হুকুম দিল, এক চিলতে ঘাস পর্যন্ত আস্ত রাখবে না। ডাইনে-বাঁয়ে সব দিকের ওই ভূতুড়ে গাছপালাগুলোকে খতম করে দাও।

অসহায় চোখে দেখতে থাকলুম সে হত্যাকাণ্ড। লেসার কামানের মারাত্মক রশ্মিপুঞ্জ দেখতে। পাচ্ছি না—শুধু হিস হিস শব্দ হচ্ছে কামানটা থেকে আর ক্রমাগত আগুন ধরে যাচ্ছে গাছপালায়, ঝোপঝাড়ে। প্রকৃতির লক্ষ লক্ষ বছরের সাজানো সুন্দর উদ্যান জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছে। খোলা মাঠের সামনের দিকে সেই প্রাণী ক্যাকটাসের ঝক পাঁচিলের মতো এগিয়ে আসছিল। তারাও দাউদাউ জ্বলে কালো ছাই হয়ে ঘাসে মিশে গেল। ঘাসেও আগুন ধরে গেল। কালো চাপ-চাপ ধোঁয়ায় আকাশ কালো হয়ে গেল। বাতাসে কটু গন্ধ ছড়াল। সভ্যতার ভয়ঙ্কর মরণশক্তি চারপাশে তাজা সুন্দর সবুজ জীবনকে ধ্বংস করে চলল। লেসারকামান ঘুরে-ঘুরে হিস হিস শব্দে বিষের আগুন ওগরাচ্ছে। আর চোখের পলকে উজ্জ্বল আগুনের চোখ ধাঁধানো শিখা ছড়িয়ে পড়ছে।

আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। চোখের সামনে এই বিরাট ধ্বংসলীলা দেখেও আমার কিছু করার নেই। পাশে একটা ছিপছিপে তরুণ গাছ বুঝি দুঃখে কাতর হয়ে করুণ সুর বাজাতে শুরু করেছিল, নিষ্ঠুর কিয়াং তাকে লক্ষ্য করে লেসার পিস্তলের ট্রিগার টিপল। চোখের পলকে গাছটা কালো হয়ে খুঁড়িয়ে পড়ল এবং বাতাসে কয়েক মুঠো ছাই উড়ে যেতে দেখলুম। ধ্বংসের নেশায়  কিয়াং মাতাল হয়ে উঠেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে যেদিকে তাকাই, সেদিকেই শুধু কালো ছাই। ছোট্ট দ্বীপের সব সবুজ, কালো ভস্মস্তুপে পরিণত। এক বিশাল শ্মশানভূমিতে একদল নিষ্ঠুর পিশাচের কাছে দাঁড়িয়ে আছি।

এতক্ষণে প্রিয়বর্ধন ধরা গলায় বলে উঠল, কাজটা কি ঠিক হল স্যার? কিয়াং তার মাথায় গাঁট্টা মেরে বলল, চল ব্যাটা ছুঁচো, কোথায় রোজারিওর কবর, দেখি।

প্রিয়বর্ধন কাঁদোকাঁদো মুখে বলল, ছাইগুলোতে পা পুড়ে যাচ্ছে স্যার!

তোর পায়ে জুতো নেই দেখছি। ওহে রিংপো, ওকে তোমার জুতোজোড়া দাও বরং। আর তুমি বোটের কাছে গিয়ে পাহারা দাও।

প্রিয়বর্ধনের পায়ে জুতো দুটো ফিট করছিল না। বেঢপ রকমের প্রকাণ্ড জুতো পরে বেচারা থপ থপ করে এগিয়ে গেল ওদের সঙ্গে। রিংপো নামে লোকটা মুচকি হেসে বলল, এখানে একলা কান্নাকাটি করে কী হবে স্যাঙাত? এস—আমরা বরং বিচে গিয়ে গপ্পসপ্প করি।

বিচের ধারে একলা সেই বেহালা বাজিয়ে গাছটা করুণ চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখে বুঝলুম, শুধু এই ছোট গাছটাই বেঁচে আছে। পেছনদিকে পাথরের আড়ালে বিচের মাথায় আছে বলেই তার দিক চোখ পড়েনি কিয়াংয়ের। কিন্তু কেন সে বেহালা বাজাচ্ছে না? শোকে মূক হয়ে গেছে কি?

কাল রাতে তাহলে কিয়াংয়ের জাহাজ এসে পৌঁছনোর পর কিওটার উদ্ভিদ চেতনায় ওই উত্তেজনার সঞ্চার ঘটেছিল। পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় তাহলে আমি শোকসঙ্গীতই শুনেছিলুম।

রিংপো লোকটির মেজাজ ভাল। সে আমাকে ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢেলে দিয়ে বলল, নাও, খেয়ে ফেলো। দুঃখ করে কী হবে? গাছপালা বৈ তো নয়! তবে কি জানো। আমাদের কর্তাটি একেবারে শয়তানের অবতার। রোখ চাপলে আর ভালমন্দ জ্ঞানগম্যি থাকে না।

কফি খেতে ইচ্ছে করছিল না। তবু খেতে হল। ওর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করলুম। রিংপো রুবি দ্বীপেরই লোক। বউ ছেলেপুলে আছে। কিয়াংয়ের মাছের আর পুঁটকির মস্ত কারবার আছে। রিংপো অবশ্য মাছ ধরার কাজেই থাকে। তবে সে জানে, কর্তা বহুদিন আগে থেকে কিওটা দ্বীপের খোঁজ রাখে। রাজাকোর সঙ্গে একসময় তার খুব বন্ধু ছিল। রাজাকোও জানত সব। কিন্তু যতবারই ওরা কিওটা এসেছে, ভয়ঙ্কর কী বিপদ ঘটেছে। কোনওক্রমে প্রাণ নিয়ে ফিরে গেছে। তাই এবার সেজেগুজে মারাত্মক অস্ত্র সংগ্রহ করে এ-দ্বীপে পাড়ি জমিয়েছে।

কথায়-কথায় রিংপো বলল, এবার তোমার আর প্রিয়বর্ধনের ব্যপারটা বলো, শুনি। কীভাবে তোমরা এ-দ্বীপের খোঁজ পেয়েছিলে?

একে সংক্ষেপে সব কাহিনী শোনালুম। তারপর বললুম, রোমিলার খবর কিছু জানো? রিংপো বলল, জানি না। তবে শুনেছি, তুমি যাদের সঙ্গে রুবি দ্বীপে এসেছিলে, তারা তোমার মরা খুঁজে বেড়াচ্ছে সমুদ্রে।

বলে সে উঠে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখে নিল। তারপর চাপা গলায় ফের বলল, তোমার কথাবার্তা শুনে ভাল লোক বলে মনে হচ্ছে। তাই বলছি শোনো। বাইরের কেউ রোজারিওর গুপ্তধনের সাক্ষী থাক, সেটা সম্ভবত পছন্দ করবেন না কর্তামশাই। কাজেই তোমাকেও বাঁচিয়ে রাখবেন বলে মনে হয় না। অবশ্য প্রিয়বর্ধনের কথা আলাদা। সে রুবি দ্বীপেরই বাসিন্দা। তাকে দলে ভিড়িয়ে নিতেও পারেন। কিন্তু তোমার বাঁচোয়া নেই।

তার কথা শুনে শিউরে উঠে বললুম, তাহলে কী করতে বলছ আমাকে?

রিংপো একটু ভেবে বলল, জঙ্গলগুলো থাকলে লুকিয়ে থাকতে। কিন্তু কর্তামশাই তো সব ছাই করে ফেলেছেন। তুমি বরং এই সুযোগে সাঁতার কেটে দক্ষিণের প্রবাল পাঁচিলের কাছে চলে যাও। ওই পাঁচিলে অনেক গুহা আছে। লুকিয়ে থাকো গে। রুবি দ্বীপে ফিরে গিয়ে গোপনে আমি রোমিলাকে তোমার খবর দেব। সে তোমাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করবে।

দক্ষিণের প্রবল পাঁচিলে পৌঁছনো অসম্ভব রিংপো।

কেন? সাঁতার কাটতে পারো না?

পারি। কিন্তু স্বচক্ষে দেখেছি, ওদিকে বলয়সাগরের জলে ভয়ঙ্কর একটা জন্তু আছে।

তাহলে উত্তরের পাঁচিলে চলে যাও।

তার চেয়ে এ-দ্বীপের পশ্চিমে ওই পাহাড়গুলোর ভেতর গিয়ে লুকিয়ে পড়ছি বরং।

রিংপো লাফিয়ে উঠে বলল, কখনো না। কর্তার নজরে পড়ে যাবে। রোজারিওর কবরের তলায় যদি গুপ্তধন সত্যি সত্যি না থাকে, কর্তা সব জায়গা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে খুঁজবে। কী দরকার ঝুঁকি নিয়ে? আমার ধারণা, উত্তরের দিকটায় জল কম। আমি সারা জীবন জলে ঘুরছি। জল দেখে তার গভীরতা বলে দিতে পারি। তুমি কেটে পড়ো।

আমার জন্য তোমার ক্ষতি হবে না তো রিংপো?

রিংপো চটে গিয়ে বলল, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। সাধুগিরি ফলিও না তো বাপু। কর্তা কি আমাকে বলে গেছে তোমাকে পাহারা দিতে? সোজা বলে দেব, কেটে পড়েছে। কিংবা জঙ্গলদানবের পেটে গেছে।

একটু ইতস্তত করে বললুম, উপকার যদি করতে চাও, একটু বেশি করেই না হয় করলে ভাই রিংপো। তিনটে মোটরবোট এনেছ। একটায় চাপিয়ে আমাকে ওখানে পৌঁছে দিয়ে এস।

রিংপো পশ্চিম দিকটা ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, পারতুম। কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে কর্তা এসে পড়বে। তখন আমার প্রাণটাও যাবে।

অগত্যা জলে গিয়ে নামলুম। পুবের ভাঙন দিয়ে মহাসাগরের ঢেউ এসে ঢুকছে। তাই এদিকটায় ঢেউ আছে। কিন্তু উত্তরদিকটায় তত ঢেউ নেই। বাতাস বইছে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে। পোড়া দ্বীপের ছাই এসে পড়ছে জলে। কটু গন্ধ ঝাঁপটা মারছে নাকে। কোনাকুনি মাইলটাক সাঁতার কেটে কখনও ড়ুবো পাথরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলুম। প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল, এখনই জলদানব ভেঁস করে মাথা তুলে আমাকে তেড়ে আসবে। কিন্তু প্রবাল পাঁচিলে পৌঁছনো পর্যন্ত নিরাপদ রইলুম।

একটা চাতালে উঠে আবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলুম। তারপর অনেক কষ্টে পাঁচিলের মাথা পেরিয়ে ওপাশে গিয়ে আরেকটা চাতাল পাওয়া গেল। ঝাকে ঝুঁকে পাখি এখানে বসে আছে। উড়ে বেড়াচ্ছে। আমাকে দেখে ওরা গ্রাহ্য করল না। চাতালের একপাশে একটা ছোট্ট গুহাও পাওয়া গেল। এতক্ষণে ভাবনা হল, কবে ওদের জাহাজ ফিরে যাবে রুবি দ্বীপে, তারপর রিংপো খবর দেবে রোমিলাকে। ততদিন আমি বেঁচে থাকব তো? কী খেয়ে বাঁচব?

হ্যাঁ, এখানে পাখির ডিম প্রচুর। সমুদ্রের স্বচ্ছ জলে মাছও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কঁচা খাব কেমন করে? একটু পরে ভাবলুম, বরং ওদের জাহাজ চলে গেল আবার সাঁতার কেটে দ্বীপে ফিরে যাব। ক্যারিবোদের জিনিসপত্র কাল রাতের ঝড়ে উড়ে কোথাও পড়ে আছে। ওর ভেতর যদি একটা সিগারেট লাইটার পেয়ে যাই, তাহলে অন্তত মাছের রোস্ট খেয়েও বেঁচে থাকতে পারব।

কিন্তু দ্বীপে তো সব পুড়ে ছাই। আগুন জ্বালাব কিসে? আমার মনটা দমে গেল। এদিকে খিদেও পেয়েছে। একটা ডিম ভেঙে চোখ বুজে চোঁ-চোঁ করে গিলে ফেললুম। খিদের মুখে অমৃত লাগল। আরও গোটা তিনেক ডিম গিলে খিদেটা যদি বা দূর হল জলের তেষ্টা মেটাব কেমন করে? ঝরনা আছে কিওটা দ্বীপের পাহাড়ে। এখানে প্রবাল বলয়ের দুধারে নোনা জল।

চাতালের ওপর ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ মনে হল, কোনও গর্তে বৃষ্টির জল কি জমে নেই? মাউন্টেনিয়ারিং-এ ট্রেনিং নেওয়াটা এতকাল পরে দারুণ কাজে লাগল। অনেক খুঁজে একখানে গর্তের ভেতর জল পাওয়া গেল। জলটা চেখে একটু ঝাঁঝালো স্বাদ পেলুম। বিষাক্ত নয় তো? ভয় পেয়ে মুখে দিলুম না। প্রবাল অশোধিত অবস্থায় বিষাক্ত বলে শুনেছি। তবে এই পাঁচিল প্রবালকীট জমে তৈরি হলেও এর বয়স হাজার-হাজার বছর। এখন পাথরে পরিণত হয়েছে। কাজেই এখানে। প্রবালের বিষ না থাকাই সম্ভব। তবু মনে সন্দেহ এসেছে যখন না খাওয়াই ভাল। অগত্যা বৃষ্টি-মেঘের আশায় তাকিয়ে রইলুম।

বৃষ্টি এল বিকেল নাগাদ। তুমুল বৃষ্টি। ছেড়া জামা নিংড়ে জল খেলুম। সেই গুহার ভেতর কাটিয়ে দিলুম একটা রাত। পরদিন সকালে পাঁচিলের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে দেখি, দ্বীপের বিচে। মোটরবোটগুলো নেই। দূরের সমুদ্রে কিয়াংয়ের জাহাজটাকেও দেখতে পেলুম না। ওরা তাহলে গুপ্তধন উদ্ধার করে কখন ফিরে গেছে।

সাঁতার কেটে দ্বীপে ফিরে এলুম আবার।

দ্বীপ নয়, শ্মশান। ক্লান্ত, দুঃখিতভাবে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় বেহালা বেজে উঠল। সেই একলা বেহালা-বাজিয়ে গাছটা বেঁচে আছে শুধু। করুণ সুরে একলা বেহালা বাজাচ্ছে। তার কাছে। গিয়ে দাঁড়ালুম। কিওটার শ্মশানে দাঁড়িয়ে সে শোকসঙ্গীত বাজিয়ে চলেছে একা। তার কাছে বসে রইলুম।

আরও দুটো দিন কেটে গেল এই শ্মশানভূমিতে। ক্যারিববার কোনও জিনিস খুঁজে পাইনি। হয় ওরা কুড়িয়ে নিয়ে গেছে, নয়তো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ছাই হাতড়ে আমার চেহারা হয়েছিল ভূতের মতো। নোনা জলে ছাইগুলো ধুয়ে যাওয়া দূরের কথা, আরও চটচটে হয়ে এঁটে গিয়েছিল। পাথর ছুড়ে মাছ মেরেছি আর কাঁচা চিবিয়ে খেয়েছি। তৃতীয় দিনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলুম। একেবার চলচ্ছক্তিহীন অবস্থা। অতি কষ্টে সেই বেহালাবাদকের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়লুম, বুঝতে পারছিলুম, মৃত্যুর দেরি নেই। আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে পরম বন্ধুর মতো বেহালাবাদক গাছটি করুণ সুরে বেহালা বাজাচ্ছিল। তারপর আর বিশেষ কিছু মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, আমার চেতনার সঙ্গে ওই সুর একাকার হয়ে যখন গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিল, তখন কে যেন ডাকছিল, এনজেলো! এনজেলো! মাই সন! আমার সাড়া দিতে ইচ্ছে করছিল, এই তো আমি।…

চোখ মেলে কিছুক্ষণ বুঝতে পারলুম না কিছু। তারপর ভেসে উঠল পরিচিত একটা মুখ। সেই মুখে একরাশ সাদা দাড়ি আর স্নেহ। জয়ন্ত! ডার্লিং!

কর্নেল! আমি চমকে উঠে সাড়া দিলুম। আমি কোথায়? কর্নেল নীলাদ্রি সরকার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, রুবি আইল্যান্ডের মেরিন হসপিটালে। আশা করি, শিগগির শরীর সেরে যাবে। ভেবো না।

রোমিলাকে দেখতে পেলুম এতক্ষণে। সে একটু হেসে বলল, রিংপোর কাছে সব খবর পেয়ে কর্নেলকে জানিয়েছিলুম। আমরা ধরেই নিয়েছিলুম তোমাকে ওরা মেরে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে। যাই হোক, কর্নেল তক্ষুণি মিলিটারি হেলিকপ্টারে রওনা দিলেন। ওদিকে কিয়াংয়ের জাহাজকেও নেভির লোকেরা আটক করল। কিয়াং এখন জেলে।

কর্নেল বললে, কিওটার কালো রং দেখে আর চিনতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু বেহালার সুর শুনে যদি না ওদিকে এগিয়ে যেতাম, তোমাকে দেখতেই পেতুম না। যাই হোক, অন্তত একটা গাছ বেঁচে আছে ওখানে। ডঃ বিকর্ণ আর ক্যাপ্টেন ব্যুগেনভিলি ওখানে ক্যাম্প করে আছেন। ডঃ বিকর্ণের গবেষণার সুবিধে হবে।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *