১. হিরো

ছায়াপথিক (উপন্যাস)

হিরো
প্রথম পরিচ্ছেদ

এক

স্ত্রী হোন বা পুরুষ হোন, তাঁহার যদি রূপ থাকে তবে তিনি মনে মনে সে বিষয়ে সচেতন। থাকিবেন এবং গর্ব অনুভব করিবেন, ইহাই স্বাভাবিক নিয়ম। আমি কয়েকজন রূপবান পুরুষকে জানি, তাঁহারা আমাদের মত সাধারণ মানুষের সঙ্গে বেশ একটু অনুগ্রহপূর্বক কথা বলিয়া থাকেন। আর মেয়েদের তো কথাই নাই; তাঁহারা সর্বদা নিজেদের চেহারার সামনে অদৃশ্য আয়না ঝুলাইয়া রাখিয়াছেন এবং ঘুরিয়া তাহাই দেখিতেছেন।

কদাচিৎ এই বৈজ্ঞানিক নিয়মের বিপর্যয় দেখা যায়। সোমনাথ এইরূপ একটি বিপর্যয়। তাহার ডালিম-ফাটা রঙ, সুঠাম গঠন, নাক মুখ চোখ অনবদ্য; অথচ আশ্চর্য এই যে সে দিনান্তে একবারের বেশী দুইবার আয়নায় মুখ দেখে না; রূপবান বলিয়া গর্ব অনুভব করা দূরের কথা, সে এজন্য বেশ একটু কুণ্ঠিত। বেশী কথা কি, সিনেমার নায়ক সাজিয়া সকলের চোখে ধাঁধা লাগাইয়া দিবার কল্পনা। আজ পর্যন্ত তাহার মাথায় আসে নাই।

সে মধ্যবিত্ত ভদ্রগৃহস্থ সন্তান; কলিকাতার একটি ব্যাঙ্কে একশত পঁচিশ টাকা মাহিনার চাকরি করে। তাহার জন্মকর্ম সবই পশ্চিমাঞ্চলে; লক্ষৌ তাহার মাতৃভূমি না হইলেও ধাত্রীভূমি বটে। মাত্র দুই বৎসর সে চাকরি লইয়া কলিকাতায় আসিয়াছে। তাহার বয়স এখন ছাব্বিশ বৎসর; বর্তমানে সে যে পরিমাণ মাহিনা পাইতেছে তাহাতে বিবাহ করিলে দাম্পত্যজীবন সুখময় না হইতে পারে এই বিবেচনায় সে এখনও বিবাহ করে নাই।

সোমনাথের মাতা পিতা কেহ জীবিত নাই; একমাত্র আপনার জন আছেন—দিদি। তিনি বোম্বাইয়ে থাকেন; জামাইবাবু সেখানে বড় চাকরি করেন।

সব দেখিয়া শুনিয়া সোমনাথের চরিত্র সম্বন্ধে বলা যাইতে পারে যে সে নিরভিমান সাবধানী সচ্চরিত্র এবং ভালমানুষ। এরূপ চরিত্রের মানুষ জীবনে উন্নতি করিতে পারে কিনা সে গবেষণার প্রয়োজন নাই। আমরা জানি এ নশ্বর জগতে ভাগ্যই বলবান।

একদিন সোমনাথ সিনেমা দেখিতে গিয়াছিল। সিনেমা সে বেশী দেখিত না, তার উপর শিক্ষাদীক্ষার গুণে বাংলা ছবির চেয়ে হিন্দী ছবির প্রতি তাহার পক্ষপাত বেশী। বিশেষত এই ছবিটি বোম্বাই শহরে তৈয়ার হইয়া বছরখানেক যাবৎ কলিকাতার এই চিত্রগৃহে এমন শিকড় গাড়িয়া বসিয়াছিল যে অর্ডিনা জারি না করিয়া তাহাকে বন্ধ করার কোনও উপায় দেখা যাইতেছিল না। এই ছবির গান গৃহস্থ বাড়ির পোষাপাখিও কপচাইতে আরম্ভ করিয়াছিল। তাই জনমতের প্রবল বন্যায় ভাসিয়া সোমনাথও ছবিটি দেখিতে আসিয়াছিল।

সন্ধ্যার শো আরম্ভ হইতে তখনও মিনিট কুড়ি দেরি আছে; সোমনাথ চিত্ৰগৃহের দরদালানে ঘুরিয়া ঘুরিয়া অভিনেতা অভিনেত্রীদের ছবিগুলি দেখিতেছিল। ইনি অশোককুমার, উনি দেবীকারানী; ইনি লীলা চিটনী, উনি পৃথ্বীরাজ। প্রত্যেকেই যেন এক একটি রাজপুত্র, রাজকন্যা! কী তাঁহাদের বেশবাস, কী তাঁহাদের মুখের ভাবব্যঞ্জনা!

দরদালানে আরও অনেক চিত্র-দর্শনাভিলাষী নরনারী ছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে, সোমনাথ লক্ষ্য করিল, একটি লোক ক্রমাগত তাহার আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এবং চকিত আড়চোখে তাহার পানে তাকাইতেছে। লোকটি বাঙালী নয়, তাহার মাথায় কালো রঙের টুপি এবং গায়ে লংক্লথের লম্বা কোট। বোধহয় গুজরাতী। সোমনাথ একটু অস্বস্তি অনুভব করিতে লাগিল।

ছবি আরম্ভ হইতে যখন আর মিনিট পাঁচেক বাকি আছে তখন সোমনাথ প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করিবার উপক্রম করিল। এই সময় লোকটি আসিয়া তাহার বাহুস্পর্শ করিল, ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলিল—মশাই, আপনি হিন্দী উর্দু বলতে পারেন?

বিস্মিত হইয়া সোমনাথ বলিল—পারি বৈকি। বলিয়া পালিশ করা লক্ষ্ণৌয়া উর্দুতে বলিল—আমি লক্ষৌয়ে জীবন কাটিয়েছি। আমার সঙ্গে আপনার কি দরকার অনুমতি করুন।

উর্দু শুনিয়া লোকটি বিস্ময়ে কয়েকবার দ্রুত চক্ষু মিটিমিটি করিল, তারপর আগ্রহভরে বলিল—আমার নাম কুলীনচন্দ্র অমৃতলাল, আমি এই হাউসের ম্যানেজার। আপনার সঙ্গে আমার দুটো কথা আছে, আমার অফিসে আসবেন কি?

সোমনাথ বলিল—কিন্তু ছবি যে এখনি আরম্ভ হবে।

লোকটি হাসিয়া বলিল—তা হলেই বা। আপনি তো এ ছবি অনেকবার দেখেছেন। আজকাল যারা ছবি দেখে তারা সব রিপিট অডিয়েন্স।

সোমনাথ বলিল—আমি এ ছবি আগে দেখিনি।

লোকটি ক্ষণেক অবিশ্বাসভরে চাহিয়া রহিল, তারপর বলিল—আপনার টিকিট আমি রিফ করিয়ে দিচ্ছি। আমার অফিসে চলুন, আমি পাস লিখে দেব, যবে ইচ্ছে যখন ইচ্ছে ছবি দেখবেন। আজ আমার সঙ্গে কথা কইতে হবে।

সোমনাথ বলিল—বেশ চলুন।

চিত্রগৃহের দ্বিতলে সম্মুখের দিকে অফিস-ঘর, কুলীনচন্দ্র সোমনাথকে সেইখানে লইয়া গিয়া আদর করিয়া বসাইল। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড লোহার আলমারি, কাচ-ঢাকা প্রকাণ্ড টেবিল, চামড়ার গদিমোড়া চেয়ার। কুলীনচন্দ্র ভৃত্যকে দুই পেয়ালা চা আনিবার হুকুম দিয়া কথাবার্তা আরম্ভ করিল।

কুলীনচন্দ্র লোকটি কথায় অতিশয় নিপুণ। ভাঙা ভাঙা বাংলায় সে কথা বলিতে লাগিল, নিজের উদ্দেশ্য প্রকট না করিয়া সোমনাথের নিকট হইতে তাহার সমস্ত পরিচয় আদায় করিয়া লইল। সোমনাথের লুকাইবার কিছু ছিল না, সে অকপটে সমস্ত উত্তর দিল।

পরিচয় গ্রহণ করিয়া কুলীনচন্দ্র কিছুক্ষণ নীরবে চায়ে চুমুক দিল, শেষে বলিল—আপনার কাছে আমার একটা প্রস্তাব আছে। আপনি বোেম্বাই যেতে রাজি আছেন?

সোমনাথ সবিস্ময়ে বলিল—বোম্বাই!

কুলীনচন্দ্র বলিল—তবে সব খুলে বলি। বোম্বাইয়ে ন্যাশন পিকচার্স নামে একটি বড় ফিল্ম কোম্পানী আছে, এই কোম্পানীর কর্তা হচ্ছেন শ্রীনারায়ণ পিলে। পিলে সাহেব আমার খুব বন্ধু, আমার হাউসে ছাড়া তাঁর ছবি কোথাও দেখানো হয় না।

সোমনাথ জিজ্ঞাসা করিলএখন যে ছবি চছে সে তাঁরই ছবি?

হ্যাঁ। তিনি খুব ভাল ছবি তৈরি করেন। এক বছরের কমে তাঁর ছবি হাউস থেকে নড়ে না —দেখতেই তো পাচ্ছেন।

আপনার প্রস্তাব কি?

নারায়ণ পিলে সাহেব আমাকে চিঠি লিখেছেন। তিনি নতুন আর্টিস্ট চান। ক্রমাগত একই আর্টিস্টের মুখ দেখে দেখে দর্শকদের চোখ পচে যায়, তাই মাঝে মাঝে রকমফের করতে হয়। আপনাকে আজ দেখেই আমার মনে হল, আপনি যদি সিনেমায় নামেন খুব নাম করতে পারেন।

সোমনাথ স্তম্ভিত হইয়া বলিল—কিন্তু আমি যে জীবনে কখনও অভিনয় করিনি-সখের থিয়েটারেও না!

তাতে কোনও ক্ষতি নেই, পিলে সাহেব তালিম দিয়ে ঠিক করে নেবেন। তিনি বলেন, ভাল চেহারার গাধা পেলেও তিনি পিটিয়ে ঘোড়া করে নিতে পারেন।

কথাটা তাহার পক্ষে কতদূর সম্মানসূচক তা বিবেচনা করিবার মত মনের অবস্থা সোমনাথের ছিল, সে অত্যন্ত বিব্রতভাবে বলিল—তা ছাড়া সিনেমাতে দেখেছি সকলেই গান গায়; আমি তো গাইতে জানি না।

একেবারেই জানেন না?

সোমনাথ হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল—শীতকালে স্নানের সময় মাঝে মাঝে গেয়েছি বটে কিন্তু তার বেশী নয়।

কুলীনচন্দ্র বলিল—তাতেও কিছু আসে যায় না। আজকাল সব গানই ভাল গাইয়েকে দিয়ে প্লেব্যাক করিয়ে নেওয়া হয়। শুনুন, আমি আপনাকে সেকেণ্ড ক্লাস গাড়িভাড়া দিচ্ছি, আপনি বোম্বাই গিয়ে পিলে সাহেবের সঙ্গে দেখা করুন। আমি বলছি আপনার বরাত ফিরে যাবে। এখানে সোয়াশ টাকা মাহিনা পাচ্ছেন, ওখানে শুরুতেই পাঁচশ টাকা পাবেন।

লোভনীয় প্রস্তাব। কিন্তু সোমনাথ মাথা-ঠাণ্ডা লোক, সে তৎক্ষণাৎ রাজি না হইয়া বলিল—আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন। কাল আমি জবাব দেব।

কুলীনচন্দ্র বলিল—ভাল। কিন্তু এমন সুযোগ হারাবেন না সোমনাথবাবু। বাসায় ফিরিয়া সোমনাথ দীর্ঘকাল ধরিয়া কথাটা মনের মধ্যে তোলাপাড়া করিল। সে যে কাজ এখন করিতেছে তাহাতে মাহিনা কম, টিকিয়া থাকিতে পারিলে দশ বছরে আড়াইশ টাকা বেতন হইবে; জীবনের শেষের দিকে হয়তো কিছু স্বচ্ছলতার মুখ দেখিতে পাইবে। তার চেয়ে এই আকস্মিক সুযোগ গ্রহণ করিয়া যদি দুচার বছরে জীবনের স্বচ্ছলতার খোরাক যোগাড় করিয়া লইতে পারে তো মন্দ কি? টাকা ভাল জিনিস না হইতে পারে, কিন্তু অভাব তার চেয়েও মন্দ জিনিস। আজ সে অবিবাহিত, তার গুরুতর কোনও অভাব নাই। কিন্তু পরে?

অবশ্য বোম্বাই গেলেই যে কাজ জুটিবে এমন কোনও কথা নাই, পিলে মহাশয় তাহাকে পছন্দ না করিতে পারেন। কিন্তু কুলীনচন্দ্রের কথা শুনিয়া মনে হয়, কাজ পাইবার সম্ভাবনা বেশ প্রবল। সম্ভাবনা না থাকিলে গুজরাতী ভাই গাঁটের কড়ি খরচ করিয়া তাহাকে বোম্বাই পাঠাইতে চাহিত না। সুতরাং চেষ্টা করিয়া দেখিতে দোষ কি। যদি কাজ নাও হয় পরের খরচে বোম্বাই বেড়ানো তো হইবে। সেখানে দিদি আছেন—

অনেক চিন্তার পর সোমনাথ মনস্থির করিল, এক মাসের ছুটি লইয়া বোম্বাই যাইবে। যদি সেখানে পাকা ব্যবস্থা হয় তখন বিনা বেতনে ছুটির মেয়াদ বাড়াইয়া লইলেই চলিবে; কিম্বা অবস্থা বুঝিয়া ব্যাঙ্কের কাজে ইস্তফা দেওয়াও চলিতে পারে।

পরদিন বৈকালে সোমনাথ কুলীনচন্দ্রের সহিত দেখা করিল, বলিল—আমি রাজি আছি। কুলীনচন্দ্র দুহাতে তাহার করগ্রহণ করিয়া বলিল—বেশ বেশ। এর পরে যখন প্রকাণ্ড হিরো হবেন তখন আমাকে মনে রাখবেন। আসুন, পিলে সাহেবের কাছে আপনার পরিচয়পত্র লিখে দিই।

.

দুই

বোম্বাই পৌঁছিয়া সোমনাথ দিদির বাড়িতে উঠিল। বোম্বাই সে আগে দেখে নাই, সমুদ্রবেষ্টিত ততকে ঝকঝকে শহর দেখিয়া চমৎকৃত হইয়া গেল।

সমুদ্রের উপর শহরের শ্রেষ্ঠাংশে জামাইবাবুর বাসা। তিনি রেলওয়ে বিভাগের বড় চারে, সাহেবী কায়দায় থাকেন। দিদির বয়স ত্রিশ পার হইয়া গেলেও সন্তানাদি হয় নাই, স্বামী-স্ত্রী প্রায় নিঃসঙ্গভাবে বাস করেন।

জামাইবাবু খুশি হইয়া বলিলেন—যাক, তুমি এসেছ, বাড়ির একঘেয়েমী একটু কমবে। স্ত্রীকে বলিলেন-আর কি, ভাই সিনেমার হিরো হতে চলল, তুমিও এবার হিরোইন হয়ে নেমে পড়।

দিদি মুখ ঘুরাইয়া বলিলেন—হিরোইন তুমি হওগে যাও, আমি কোন্ দুঃখে হতে যাব? তোর জামাইবাবু ছবিতে নামলে দিব্যি মানাবে, না রে সোমু?

জামাইবাবুর চেহারাটি গুড়ের নাগরির মত, কিন্তু চেহারা সম্বন্ধে কোনও ব্যঙ্গবিপ তিনি গায়ে মাখেন না। বলিলেন–কম বয়সে আমার পানেও লোকে ফিরে ফিরে চাইত, খাস করে মেয়েরা। সে যাক, সোমনাথ, তোমাকে একটা উপদেশ দিই। সিনেমার মহিলারা শুনেছি তোক ভাল নয়, নিজের চরিত্রের প্রতি যদি মমতা থাকে একটু সাবধানে চোলো।

দিদি বলিলেন—সে আর ওকে বলতে হবে না। কিন্তু যাই বল, ও যখন হিরো হয়ে নামবে, ছবি দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে। বলিয়া সপ্রশংস মেহরসে সোমনাথকে অভিষিক্ত করিয়া দিলেন।

জামাইবাবু বলিলেন–সেই কথাই তো বলছি। তোমারই যখন চোখ জুড়িয়ে যাবে তখন অন্য মেয়েদের কি অবস্থা হবে ভাববা।

দিদি স্বামীর কথায় কর্ণপাত না করিয়া বলিলেন—মা গো, আজকাল যারা হিরো সাজে তারা কি পুরুষ মানুষ? যত সব পিলেয়োগা হাড়গিলের দল।

জামাইবাবু দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন—কাবুলিওয়ালা ছাড়া আর কাউকে তোমার দিদি পুরুষ বলেই জ্ঞান করেন না। বলিয়া তিনি অফিসে চলিয়া গেলেন। দিদি ও জামাইবাবুর মধ্যে প্রগাঢ় দাম্পত্যপ্রীতি থাকিলেও সর্বদাই কথা কাটাকাটি হইয়া থাকে।

পরদিন সকালবেলা সোমনাথ নারায়ণ পিলের সহিত দেখা করিতে গেল। ন্যাশন পিকচার্সের স্টুডিও বোম্বাই শহরের মধ্যেই। জামাইবাবু অফিস যাইবার পথে সোমনাথকে নিজের মোটরে স্টুডিওর ফাটক পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া গেলেন।

ফাটকে পাঠান সান্ত্রীর পাহারা। সোমনাথ পূর্বে কখনও সিনেমা স্টুডিওর সিংহদ্বার পার হয় নাই, সে মনে একটু উদ্বেগ লইয়া প্রবেশ করিল। পাঠান দ্বারপাল তাহাকে মোটর হইতে নামিতে দেখিয়াছিল, সুতরাং বাধা দিল না।

অনেকখানি জমির উপর স্টুডিও। মাঝখানে ইস্টিশানের মত প্রকাণ্ড উঁচু একটা করোগেটের ছাউনি; আশে পাশে পিছনে ছোট বড় অনেকগুলি বাড়ি। কোনও বাড়ির দ্বারে লেখা—-মিউজিক, কোনও বাড়িতে—এডিটিং, কোথাও বা—মেক-আপ। অনেক লোক চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, সকলেরই ব্যস্তসমস্ত ভাব; কিন্তু চেঁচামেচি হট্টগোল নাই। সোমনাথ দেখিল, কয়েকজন স্ত্রী পুরুষ রঙীন কাপড় পরিয়া মুখে রঙ মাখিয়া দাঁড়াইয়া আছে; তাহারা সম্ভবত অভিনেতা অভিনেত্রী। এই সময় একটা ঘণ্টা ঢং ঢং করিয়া বাজিতে আরম্ভ করিল। রঙ মাখা কুশীলবগণ তাড়াতাড়ি গিয়া ইস্টিশানে ঢুকিয়া পড়িল।

ওদিক ওদিক ঘুরিতে ঘুরিতে সোমনাথ দেখিল একটা বড় বাড়ির সম্মুখে লেখা আছে—অফিস। পিলে মহাশয়কে এইখানেই পাওয়া যাইবে বিবেচনা করিয়া সে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল।

একটি ঘরে টেবিল চেয়ার সাজানো, পিলে মহাশয়ের দর্শনভিক্ষু কয়েকজন লোক সেখানে বসিয়া আছে। সোমনাথ প্রবেশ করিতেই একজন ছোকরা সেক্রেটারি আসিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল—আপনার কি দরকার?

সোমনাথ সংক্ষেপে নিজের প্রয়োজন ব্যক্ত করিয়া কুলীনচন্দ্রের পরিচয়পত্র তাহাকে দিল। সেক্রেটারি বলিল—আপনি বসুন, আমি বসকে খবর দিচ্ছি।

সেক্রেটারি ভিতর দিকে অন্তর্হিত হইয়া গেল। কয়েক মিনিট পরে ফিরিয়া আসিয়া চুপি চুপি বলিল—ব এখন ভারি ব্যস্ত আছেন। আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে।

সোমনাথ বসিয়া রহিল। দর্শনপ্রার্থীরা একে একে দেখা করিয়া প্রস্থান করিল; আরও নূতন দর্শনপ্রার্থী আসিল। সোমনাথের মনে হইল সে যেন মধ্যযুগের ইংলন্ডে রাজ-সন্দর্শনে আসিয়াছে, anti-chamber-য়ে প্রতীক্ষা করিতেছে, সময় আসিলেই রাজ-দর্শন করিয়া ধন্য হইবে।

ক্রমে এক ঘণ্টা কাটিয়া গেল। সোমনাথ বিরক্ত হইয়া উঠিল। দর্শনপ্রার্থীরা, যাহারা পরে আসিয়াছিল, তাহারাও কাজ সারিয়া চলিয়া গিয়াছে, অথচ তাহার ডাক পড়িল না। ঘরে অন্য কেহ নাই, সেক্রেটারিও কিছুক্ষণ যাবৎ অদৃশ্য হইয়াছে। সোমনাথ ভাবিল, আর রাজ-দর্শনে কাজ নাই, ফিরিয়া যাই। এরা কি রকম লোক, খোসামোদ করিয়া ডাকিয়া পাঠাইয়া দেখা করে না?

সোমনাথ তখনও জানিত না, সিনেমা-সমাজর ইহাই এটিকেট। যে দেখা করিতে আসিয়াছে তাহাকে দীর্ঘকাল বসাইয়া রাখিতে হইবে, বা আজ দেখা হইবে না বলিয়া বারবার হাঁটাহাঁটি করাইয়া বুঝাইয়া দিতে হইবে যে তাহার কদর কিছু নাই। সিনেমাওয়ালাদের টাকা আছে, তাই গরজ নাই। ভাত ছড়াইলে কাকের অভাব?

সোমনাথ উঠিবার উপক্রম করিতেছে এমন সময় ভিতরের দরজার দিকে চোখ তুলিয়া অবাক হইয়া গেল। দ্বারের কাছে একটি অপূর্ব মূর্তি দাঁড়াইয়া আছে এবং মোহ-ভরা চোখে তাহাকে নিরীক্ষণ করিতেছে।

সোমনাথ ভাবিল, ছবি নাকি? বিচিত্র কবরীবন্ধ, দীঘল সুঠাম দেহে অপরূপ আভরণ, মুখখানি যেন প্রস্ফুটিত পদ্ম। কিন্তু ছবি নয়। পরক্ষণেই মৃদু হাস্যে কুন্দদন্ত ঈষৎ মোচন করিয়া তরুণী সোমনাথের দিকে অগ্রসর হইয়া আসিলেন, মধুপগুঞ্জরের মত মিষ্ট ইংরাজীতে বলিলেন—আপনিই কি মিস্টার সোমনাথ কলকাতা থেকে আসছেন?

সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইয়া সোমনাথ বলিল—হ্যাঁ।

তরুণীর মোহ-মোহ চক্ষু দুটি যেন বিগলিত হইয়া গেল, তিনি বলিলেন—আমি মিসেস পিলে, আমার নাম চন্দনা দেবী।

নামটা যেন চেনা-চেনা। তারপর সোমনাথের মনে পড়িয়া গেল, বহু প্রাচীরপত্রে ঐ নাম ঐ মুখ সে দেখিয়াছে—সিনেমা রাজ্যের অমুকুটিত সম্রাজ্ঞী চন্দনা দেবী। সোমনাথ করতল যুক্ত করিয়া। নত হইয়া নিজ কৃতার্থতা জ্ঞাপন করিল।

চন্দনা দেবী বলিলেন—আমার স্বামী এখনি আপনার সঙ্গে দেখা করবেন; আমিও থাকতাম, কিন্তু সেটে আমার কাজ আছে। আশা করি আবার দেখা হবে—টা টা!

একটু হাসিয়া একটু ঘাড় নাড়িয়া কুহকময়ী বাহিরের দরজা দিয়া নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন। সোমনাথের মনের ঘোর ভাল করিয়া কাটিবার আগেই সেক্রেটারি আসিয়া বলিল—আসুন–বস আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

বসিবার ঘরের পর সেক্রেটারির ঘর, তারপর বসের ঘর। দ্বারের ভারি পর্দা সরাইয়া সেক্রেটারি সোমনাথের প্রবেশের পথ করিয়া দিল। ঘরে প্রবেশ করিয়াই সোমনাথের নিশ্বাস রোধ হইবার উপক্রম হইল। ঘরে গুরুভার একটা সুগন্ধ সাঁঝাল ধোঁয়ার মত ভারি হইয়া বসিয়াছে। ঘরটি আধা-আলো আধা-অন্ধকার। সোমনাথের ইন্দ্রিয়গ্রাম এই নুতন পরিবেশে অভ্যস্ত হইলে সে দেখিল ঘরের কোণে টেবিলের সম্মুখে একটি লোক বসিয়া আছে।

লোকটিকে দেখিয়া সোমনাথ ক্ষণকাল স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল রহিল। ইনিই নারায়ণ পিলে—নটীশিরোমণি চন্দনা দেবীর স্বামী এবং দিগ্বিজয়ী চিত্র-প্রণেতা! গায়ের রঙ হুঁকার খোলর চেয়েও কালো; শীর্ণ খর্ব চেহারা, মুখখানি দেখিয়া মনে হয় একতাল কাদা কেহ দুই হাতে থাসিয়া স্কন্ধের উপর বসাইয়া দিয়াছে; এই কাদার তালের মধ্যে একজোড়া রক্তবর্ণ তির্যকচক্ষু; সর্বোপরি পরিধানে গাঢ় নীলরঙের কোট প্যান্ট।

সোমনাথ ইতস্তত করিতেছে দেখিয়া পিলে সাহেব উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন—আসুন, এই চেয়ারে বসুন।

হঠাৎ সোমনাথের একটি উপমা মনে পড়িল; লোকটি যেন একটি কালো রঙের ফাউন্টেন পেন। গলায় সোনালি রঙের টাই উপমাটিকে পূর্ণাঙ্গ করিয়া দিয়াছে। সোমনাথ পরে জানিতে পারিয়াছিল উপমাটি তাহার নূতন আবিষ্কার নয়, সিনেমা-সমাজের অনেকেই আড়ালে পিলে সাহেবকে ফাউন্টেন পেন বলিয়া উল্লেখ করে।

সোমনাথ পিলে সাহেবের সম্মুখের চেয়ারে বসিল; কিছুক্ষণ দুইজনের দৃষ্টি বিনিময় হইল। পিলে সাহেবের চক্ষু তির্যক ও রক্তবর্ণ হইলেও পর্যবেক্ষণে অপটু নয়, সৌষ্ঠবহীন মুখখানাতে বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। পর্যবেক্ষণ শেষ করিয়া তিনি আস্তে আস্তে কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন। নেহাত মামুলি কথা, এমন কি অসংলগ্ন ও উদ্দেশ্যহীন বলিয়া মনে হয়; তাঁহার কথা বলিবার ভঙ্গিও একটু নির্জীব ধরনের। সোমনাথ বসিয়া শুনিতে লাগিল—

কুলীনভাই আপনাকে পাঠিয়েছেন কুলীনভাই আমার প্রিয় বন্ধু। তাঁর আলাদা চিঠিও আমি এয়ার মেলে পেয়েছি। …আপনি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন লোক, শিক্ষিত ভদ্রসন্তান…নতুন রক্ত আমাদের দরকার, কিন্তু ভদ্রসন্তানকে এ পথে আনতে শঙ্কা হয়…সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি দিন দিন অধঃপাতে যাচ্ছে—প্রতিভা নেই, শিক্ষা নেই, চরিত্র নেই। এই সিনেমা জগৎ খুঁজলে আপনি এমন লোক পাবেন না যাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করা যায়। সবাই অর্থলোভী জোচ্চোর, চরিত্রহীন লম্পট। আপনি এ লাইনে নতুন আসছেন তাই আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি।

এই সময় সোমনাথ টের পাইল পিলে সাহেবের মুখ দিয়া ভন্ ভন্ করিয়া মদের গন্ধ বাহির হইতেছে। সকালবেলাই তিনি মদ্যপান করিয়াছেন। পরে সোমনাথ জানিতে পারিয়াছিল, পিলে সাহেব অহোরাত্র মদে চুর হইয়া থাকেন। ঘরে তীক্ষ্ণ সুগন্ধি দ্রব্য ছড়াইবার উদ্দেশ্য বোধহয় পিলে সাহেবের মুখনিঃসৃত মদের গন্ধকে চাপা দেওয়া।

পিলে সাহেব শান্ত কণ্ঠে বলিয়া চলিলেন—ছবি তৈরি করার একটা নেশা আছে, তার ওপর কাঁচা পয়সার লোভ…দুনিয়ার যত ঠক বদমায়েস এইখানে এসে জুটেছে। তাদের একমাত্র গুণ তারা মন জুগিয়ে কথা বলতে পারে। ভাল লোক এখানে আমল পায় না, যারা আসে তারা বিরক্ত হয়ে চলে যায়। ভদ্রলোকের জায়গা এ নয়। অথচ এই চিত্রশিল্পের যে কী অসীম সম্ভাবনা তা বলা যায় না—

পিলে সাহেবের মনে বোধহয় চিত্রশিল্প সম্বন্ধে বহু গ্লানি সঞ্চিত হইয়াছিল; তিনি সম্ভবত নূতন লোক পাইলে এইভাবে হৃদয়ভার লাঘব করিয়া থাকেন। কিন্তু এখন বাধা পড়িল। দরজায় টোকা দিয়া, একটি লোক ঘরে প্রবেশ করিলেন। ইনি জীবরাজ নাগর। গোলগাল মানুষ, পিলে সাহেবের সহকারী ডিরেক্টর। পিলে সাহেব ছবির ডিরেক্টর হইলেও কখনও সেটে যান না, তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী নাগর মহাশয় সেটের যাবতীয় কাজ করেন।

নাগর বলিলেন—একটা শট কি করে নেব বুঝতে পারছি না।

পিলে সাহেবের মুখের অলস নির্জীব ভাব মুহূর্তে কাটিয়া গেল। তিনি সোজা হইয়া বসিলেন, বলিলেন-কোন্ শট?

হিরোইন যাতে রাজাকে প্রণাম করছেন। ডায়লগ নেই, শুধু একটু ফোঁপানো।

আমি দেখিয়ে দিচ্ছি—

পিলে লাফাইয়া উঠিয়া মাঝখানে দাঁড়াইলেন; সোমনাথের উপস্থিতি কেহই গ্রাহ্য করিল না।

পিলে নাগরকে বলিলেন—তুমি মেঝেয় শোও।

জীবরাজ নাগর তৎক্ষণাৎ মেঝের উপর লম্বা শুইয়া পড়িলেন।

পিলে বলিলেন—এবার দ্যাখো এটা মিড শটক্যামেরা এইখানে বসবে। রাজা যুদ্ধক্ষেত্রে মুমূর্ষ হয়ে পড়ে আছেন—মেয়ে খবর পেয়ে ছুটে তাঁকে দেখতে আসছেন—কেমন? এইবার দ্যাখো-মেয়ে চারিদিকের মৃতদেহের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে আসছেন, এইবার রাজাকে দেখতে পেলেন, এইভাবে ছুটে এসে তাঁর পায়ের কাছে নতজানু হয়ে পড়লেন, তারপর ফোঁপাতে ফোঁপাতে তাঁর পায়ের ওপর এমনি ভাবে বুঝলে? পিলে নাগরের জুতাপরা পায়ের উপর লুটাইয়া পড়িলেন।

সোমনাথ চমকৃত হইয়া দেখিতে লাগিল। রাজকুমারীর প্রত্যেকটি ভঙ্গি প্রত্যেকটি মুখভাব এই কদাকার লোকটি এমন নিঃসংশয়ভাবে অভিব্যক্ত করিল যে সোমনাথ বিস্মিত হইয়া গেল। জীবরাজ নাগর গাত্রোত্থানপূর্বক গা ঝাড়া দিয়া প্রস্থান করিবার পর সে বলিল—আপনি অভিনয় করেন না কেন?

পলকের জন্য পিলের তিক্ত অন্তর প্রকাশ পাইল; তিনি নিজের চেয়ারে বসিয়া বলিলেন-পাবলিক অভিনয় চায় না, সুন্দর চেহারা চায়। হয়তো কোনও দিন আমি অভিনয় করব, যেদিন আমার চেহারার উপযুক্ত পার্ট পাব। কিন্তু ও কথা যাক।

দেরাজ হইতে একটা ছাপা ফর্ম বাহির করিয়া বলিলেন—আপনাকে আমি নেব। আপনি নতুন লোক, কিন্তু তোক আমি তৈরি করে নিতে পারি। নিন্ কন্ট্রাক্টে সই করুন।

সোমনাথ চুক্তিপত্র পড়িয়া দেখিল, তিন মাসের জন্য পাঁচশত টাকা বেতনে তাহাকে অভিনেতা নিযুক্ত করা হইল; কোম্পানীর অশান থাকিবে তিনমাস, পরে দীর্ঘতর মেয়াদে তাহাকে নিয়োগ করিতে পারিবে। আপত্তিজনক কিছু না পাইয়া সোমনাথ দস্তখৎ করিয়া দিল।

পিলে বলিলেন—অবশ্য আমি একটা risk নিচ্ছি। আপনার ফটোগ্রাফিক টেস্ট আর গলার সাউন্ড টেস্ট নিতে হবে, যদি ভাল না আসে তাহলে আপনাকে ব্যবহার করতে পারব না। আমার। দেড় হাজার টাকা অকারণে খরচ হবে।

সোমনাথ বলিল—আমার টেস্ট যদি পছন্দসই না হয় আমি কিছুই দাবি করব না।

পিলে উঠিয়া তাহার করমর্দন করিলেন–Thank you. I think I am going to like you. কাল এই সময় আসবেন, আপনার টেস্ট নেবার ব্যবস্থা করে রাখব।

পরদিন সোমনাথের টেস্ট লওয়া হইল। এমন বিষম পরীক্ষা তাহার জীবনে কখনও আসে নাই। সামনে ক্যামেরা, মাথার উপর মাইক ঝুলিতেছে, চারিদিকে চোখ ধাঁধানো উগ্র আলো; তাহারই মধ্যে দাঁড়াইয়া হাত মুখ নাড়িয়া ডায়লগ বলিতে হইবে। সোমনাথ সবই নির্দেশমত করিল বটে কিন্তু পরীক্ষা শেষ হইবার পর তাহার দৃঢ় ধারণা হইল সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পারিবে না। সিনেমার হিরো হওয়া তাহার কর্ম নয়। নিজের অক্ষমতায় মনমরা হইয়া সে বাড়ি ফিরিয়া আসিল।

দুইদিন পরে পিলে সাহেবের সেক্রেটারি টেলিফোনে খবর দিল—টেস্ট ভাল হয়েছে—আপনি আসুন।

সোমনাথের চিত্রজীবন আরম্ভ হইল।

.

তিন

পিলে সাহেব সোমনাথকে জানাইলেন, যে ছবিটি সদ্য আরম্ভ হইয়াছে তাহাতেই সে নায়কের ভূমিকা পাইবে। ছবির শুটিং আরম্ভ হইয়া গিয়াছে অথচ নায়ক নির্বাচিত হয় নাই ইহাতে সোমনাথ আশ্চর্য হইল। কিন্তু পিলে সাহেব গল্পটি যখন তাহাকে শুনাইলেন তখন সোমনাথ বুঝিল, নায়ক নামমাত্র, নায়িকা চন্দনা দেবীই ছবি জুড়িয়া আছেন। ইহাতে দুঃখিত না হইয়া সে বরং মনে মনে হাঁফ ঘড়িল। প্রথম ছবিতে তাহার ঘাড়ে বেশী ঝুঁকি পড়িবে না।

পিলে সাহেব তাহাকে কয়েকদিন তালিম দিলেন। তারপর সে রঙীন কাপড় পরিয়া মুখে রঙ মাখিয়া ক্যামেরার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল।

কাজ চলিতে লাগিল। ক্রমে স্টুডিওর সকলের সঙ্গে তাহার আলাপ পরিচয় হইল। সিনেমাক্ষেত্র জগন্নাথক্ষেত্র হিন্দু, মুসলমান, পার্সী, পাঞ্জাবী, মারাঠী, গুজরাতী, কেহই পুণ্যক্ষেত্র হইতে বাদ পড়ে নাই। একটি যুবকের সহিত সোমনাথের বিশেষ অন্তরঙ্গতা জন্মিল, সে কমিক অ্যাক্টর পাণ্ডুরঙ যোশী। পাণ্ডুরঙ ভাঁড়ামি করে বটে কিন্তু ভারি বুদ্ধিমান লোক।

বলা বাহুল্য কর্মসূত্রে চন্দনা দেবীর সঙ্গেও তাহার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা জন্মিল, কিন্তু স্ত্রীচরিত্রে অজ্ঞতার জন্যই হোক বা যে কারণেই তোক চন্দনা দেবীকে সে ভাল করিয়া চিনিতে পারিল না। তিনি সর্বদাই হাসিমুখে কথা বলেন, কখনও কখনও অন্তরঙ্গভাবে ব্যক্তিগত কথাও বলেন, অথচ মনে হয় তাঁহার প্রচ্ছন্ন মন ধরা দিতেছে না; তাঁহার সুন্দর চোখে যখন আন্তরিকতা জ্বলজ্বল করিতেছে তখনও সন্দেহ। হয় তিনি অভিনয় করিতেছেন।

তাই বলিয়া তাঁহার সম্বন্ধে কোনও মন্দ কথাও সোমনাথের মনে আসিল না। স্বামীর সহিত তাঁহার সম্পর্ক সে লক্ষ্য করিয়াছে, তাহাতে কোনও ত্রুটি দেখিতে পায় নাই। পিলে সাহেবের অফিস ঘরে যখনই চন্দনা দেবী দেখা দেন, স্বামীর চেয়ারের হাতলে বসিয়া তাঁহার স্কন্ধে হাত রাখিয়া কথা বলেন, অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেমন হওয়া উচিত তেমনই সহজ প্রীতির সম্পর্ক। সিনেমা অভিনেত্রীদের নামে যে সকল দুর্নাম আছে তাহা অন্যের পক্ষে সত্য হইতে পারে কিন্তু চন্দনা দেবী সম্বন্ধে কখনই সত্য নয়।

এদিকে ছবির কাজ চলিতেছে। সোমনাথকে প্রায়ই সেটের উপর চন্দনা দেবীর সহিত প্রেমালাপ করিতে হয়, তাঁহার অঙ্গস্পর্শ করিতে হয়। চন্দনা দেবীর প্রেমাভিনয় বিখ্যাত; হাসি চাহনি বাচনভঙ্গির দ্বারা তিনি এমন রোমাঞ্চকর সম্মোহ সৃষ্টি করিতে পারেন যে, দর্শক মাত্রেরই রক্ত চঞ্চল হইয়া উঠে। এরূপ ক্ষেত্রে বয়সের দোষে সোমনাথের যদি চিত্ত চঞ্চল হইত তাহা হইলে তাহাকে দোষ দেওয়া যাইত না; কিন্তু সোমনাথের একটি রক্ষাকবচ ছিল; বিবাহিতা নারী সম্বন্ধে তাহার মনে এই দৃঢ় সংস্কার ছিল যে পরস্ত্রী মাতৃবৎ। উপরন্তু সোমনাথ পিলে সাহেবকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিতে আরম্ভ করিয়াছিল, মনে মনে তাঁহাকে শিক্ষাগুরু বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছিল। সুতরাং গুরুপত্নী সম্বন্ধে তাহার মন যে সম্পূর্ণ অন্য ভাব পোষণ করিবে তাহা বলা বাহুল্য।

পিলে সাহেবও তাহার কর্তব্যনিষ্ঠা ও সরল বিনীত স্বভাব দেখিয়া তাহাকে স্নেহ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। তিনি মাঝে মাঝে বলিতেন—Somnath, my boy, leave everything to me. Ill make you the greatest leading man India has yet produced.

নূতন কাজে মাসখানেক বেশ আনন্দে কাটিয়া গেল। অবস্থা বুঝিয়া সোমনাথ ব্যাঙ্কের চাকরিতে ইস্তফা দিল।

হিরোর অধিকারে সে স্টুডিওতে একটি নিজস্ব ঘর পাইয়াছিল। ঘরটি টেবিল চেয়ার আয়না কৌচ প্রভৃতি দিয়া পরিপাটিভাবে সাজানো। কাজের ফাঁকে সে এই ঘরে আসিয়া বিশ্রাম করিত। পাণ্ডুরঙ যোশীও ফুরসত পাইলেই আসিয়া তাহার সহিত আড্ডা জমাইত।

একদিন দুপুরবেলা পাণ্ডুরঙ ঘরে ঢুকিয়া বলিল–বন্ধু, আমার অভিনন্দন গ্রহণ কর। জানতে পেরেছি তোমার বাত খুলেছে।

সোমনাথ কৌচে কাৎ হইয়া নভেল পড়িতেছিল, উঠিয়া বসিয়া বলিল—সে কি, কী হয়েছে?

তাহার পাশে বসিয়া পাণ্ডুরঙ ভর্ৎসনার সুরে বলিল—কেন মিছে ছলনা করছ দোস্ত! দেবী তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছেন, আমাদের দেখেই সুখ। এতে লুকোচুরির কি আছে?

কি দেবী? কার কথা বলছ?

দেবী এ স্টুডিওতে কটা আছে?

চন্দনা দেবীর কথা বলছ?

পাণ্ডুরঙ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সোমনাথের পানে চাহিল। সে সোমনাথের মন বুঝিতে আসিয়াছিল, সম্ভব হইলে বন্ধুভাবে তাহাকে সতর্ক করিয়া দিবার ইচ্ছাও ছিল; কিন্তু সোমনাথের ভাব দেখিয়া তাহার ধোঁকা লাগিল। সে বলিল-হ্যাঁ, সেই দেবীর কথাই হচ্ছে। ওঁর সম্বন্ধে তোমার ধারণা কি ঠিক করে আমায় বল দেখি।

সোমনাথ বলিল–ধারণা তো বেশ ভালই। মন্দ মনে করার কোনও কারণ হয়নি।

পাণ্ডুরঙ ভ্রূ তুলিল-হুঁ! কাল যখন তোমরা সেটের উপর অভিনয় করছিলে, উনি পিছন দিক থেকে এসে তোমার কাঁধে হাত দিয়ে মাথার উপর গাল রেখেছিলেন, তখনও কিছু মনে হয়নি?

না। অভিনয়—অভিনয়। তার আবার মনে হবে কি?

পাণ্ডুর কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, তারপর সোমনাথের কৌটা হইতে সিগারেট লইয়া ধরাইয়া ধীরে ধীরে বলিল—ভাই, সিনেমা সমুদ্রে তুমি নতুন ড়ুবুরি, হালচাল সব জানো না। আমি পুরোনো পাপী, দেবীকে অনেক দিন থেকে দেখছি। দেবী গভীর জলের মাছ।

সোমনাথ অসহিষ্ণু হইয়া বলিল—পাণ্ডুরঙ, যা বলবে পরিষ্কার করে বল, আমি অত বাঁকা কথা বুঝতে পারি না।

পাণ্ডুরঙ কয়েকবার সিগারেটে টান দিয়া বলিল-আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। দেবীর বয়স কত তোমার মনে হয়?

সোমনাথ বলিল—জানি না। পঁচিশ ছাব্বিশ হবে বোধ হয়?

পাণ্ডুরঙ বলিল—দেবীর বয়স কম-সেকম পঁয়ত্রিশ বছর। মেঘে মেঘে বেলা হয়েছে। তিনি গত পনেরো বছর ধরে ছবিতে হিরোইন সাজছেন, তার আগে দুবছর মাইনর পার্ট করেছেন। সুতরাং বয়স কত হিসেব করে দ্যাখো।

সোমনাথের সম্পূর্ণ বিশ্বাস হইল না, তবু সে বলিল—তাই যদি হয় তাতেই বা দোষ কি? বরং প্রশংসার কথা।

পাণ্ডুরঙ বলিল—ভাই, দোষ আমি কাউকে দিচ্ছি না। সতেরো বছর বয়স থেকে পেটের দায়ে ভাঁড়ামি করছি, এটুকু বুঝেছি কোনও কাজের জন্যেই কাউকে দোষ দেওয়া যায় না, সবই নিয়তির খেলা। আমি বুঝতে পেরেছি দেবীর মন তোমার দিকে ঢলেছে। তুমি যদি রাজি থাকো অভিনন্দন জানাচ্ছি; আর যদি রাজি না থাকো সাবধান হয়ো।

সোমনাথ বলিল—ও সবে আমার রুচি নেই এবং তোমার অনুমান যে ঠিক তাতেও আমার সন্দেহ আছে।

পাণ্ডুরঙ হাসিল—এসব বিষয়ে আমার ভুল হয় না। দেবীর মনে রঙ ধরেছে। এর আগেও বার তিনেক দেখেছি কিনা। বলিয়া সংক্ষেপে দেবীর পূর্বর্তন কয়েকটি রোমান্সের উল্লেখ করিল।

শুনিয়া সোমনাথ সবিস্ময়ে বলিল–বল কি। মিঃ পিলে জানতে পারেননি?

উহুঁ। ঐখানেই দেবীর মাহাত্ম। এমন সাফাই হাতে কাজ করেন ধরা-ছোঁয়া যায় না; কিন্তু এও বলে দিচ্ছি, ফাউন্টেন পেনের কাছে দেবী যেদিন ধরা পড়বেন সেদিন ওঁর নায়িকা জীবন শেষ হবে।

কেন?

দেবীর রূপ আছে, বুদ্ধি আছে, আর্টিস্টও ভাল, কিন্তু ওঁকে খাড়া করে রেখেছে পিলে। পিলে ছাড়া আর কেউ দেবীকে ব্যবহার করতে পারবে না। তাই বলছি, পিলে যদি কোনও দিন দেবীকে তাড়িয়ে দেয় তখন ওঁর দুঃখে শেয়াল কুকুর কাঁদবে। দেবীও সেকথা জানেন, তাই এত লুকোচুরি।

এই আলোচনার পর সোমনাথ একটু সতর্ক হইল। পাণ্ডুরঙ যে ইঙ্গিতজ্ঞ ব্যক্তি তাহা ক্রমে তাহার অনভিজ্ঞ চোখেও পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে লাগিল। চন্দনা দেবী প্রথম দর্শনেই সোমনাথের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিলেন এবং অতি কৌশলে সুক্ষ্ম প্রলোভনের জাল পাতিয়া ছিলেন, কিন্তু স্থূলবুদ্ধি সোমনাথ অত মিহি ইঙ্গিত বুঝিতে পারে নাই। চন্দনা দেবীও অনুভব করিয়াছিলেন যে সোমনাথ আনাড়ি। তাঁহার লিপ্সা আরও উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

একদিন চন্দনা দেবী বেশ স্পষ্ট ইসারা দিলেন; এমন ইসারা যে অন্ধ ব্যক্তিও দেখিতে পায়।

ছবির শুটিং অর্ধেকের অধিক শেষ হইয়াছে, পিলে সাহেব হুকুম দিলেন আউটডোর শুটিং আরম্ভ করিতে হইবে। বোম্বাইয়ের বাহিরে কিছু দূরে অনেক রমণীর নিসর্গদৃশ্য আছে, পাহাড়, জঙ্গল, হ্রদ, সমুদ্র কিছুরই অভাব নাই; স্থির হইল জঙ্গলপ্রধান একটি স্থানে গিয়া ছবি ভোলা হইবে। নায়ক নায়িকা জঙ্গলের মধ্যে লুকোচুরি খেলিবে এবং ড়ুয়েট গান গাহিবে।

স্থানটি শহরের বাহিরে প্রায় বিশ মাইল দূরে। যথাসময়ে মোটর সহযোগে শুটিং পার্টি ওকুস্থান অভিমুখে যাত্রা করিল। কর্মকর্তা নাগর; পিলে অভ্যাসমত আসেন নাই। অভিনেতাদের মধ্যে কেবল চন্দনা দেবী এবং সোমনাথ, তাছাড়া যন্ত্র এবং যন্ত্রী তো আছেই।

একটি ছোট মোটরে কেবল সোমনাথ ও চন্দনা চলিয়াছেন। আর কেহ নাই। দুজনেই রঙ মাখিয়া দৃশোপযোগী বেশ পরিধান করিয়া আসিয়াছেন, খোলা জায়গায় প্রসাধনের সুবিধা নাই। চন্দনা দেবীর চোখে বিলাতী কাজল, চোখের পক্ষ্মগুলি দীর্ঘ ও ছায়ানিবিড় দেখাইতেছে।

ধাবমান গাড়ির বায়ুপ্রবাহের মধ্যে থাকিয়া দুএকটি কথা হইতেছে; মাঝে মাঝে চন্দনা দেবী পাশে উপবিষ্ট সোমনাথের প্রতি অলস অপাঙ্গদৃষ্টি করিতেছেন। গাড়ি যখন মোড় ফিরিতেছে তখন একজন অন্যের গায়ে হেলিয়া পড়িতেছেন, কাঁধে কাঁধে ঠোকাঠুকি হইতেছে। সোমনাথ কিন্তু অনিচ্ছাকৃত অপরাধের জন্য হাসিমুখে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া চিত্তচাঞ্চল্যর কোনও লক্ষণই প্রকাশ করিতেছে না। চন্দনা দেবী তখন মোহ-মোহ দৃষ্টি ফিরাইয়া নীরবে তাহাকে দেখিতেছেন, দৃষ্টির অকথিত তিরস্কার তীক্ষ্ম হইয়া উঠিতেছে, এমন সুযোগ পেয়েও তুমি অবহেলা করছ? তুমি মানুষ না পাথর?

হঠাৎ চন্দনা প্রশ্ন করিলেন—আপনার বয়স কত?

সোমনাথ চকিতে তাঁহার দিকে ফিরিল, বলিল—ছাব্বিশে পড়েছি।

চন্দনা কিছুক্ষণ স্বপ্নালু চক্ষে চাহিয়া রহিলেন, তারপর অস্ফুটস্বরে বলিলেন—ছাব্বিশ বছর বয়সে মানুষের মন কেমন হয় তা কে জানে। খুব বেশী বুড়ো মনে হয় কি?

না—যদি বাধা না থাকে, আপনার বয়স কত?

চন্দনা সরলভাবে বলিলেন—আগামী ২৭শে আমার জন্মদিন বাইশ বছর পুরবে।

চোখে পাছে অবিশ্বাস ফুটিয়ে ওঠে তাই সোমনাথ তাড়াতাড়ি চোখ ফিরাইয়া লইল।

কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর চন্দনা বলিলেন-মিঃ পিলের বয়স কত জানেন?

সোমনাথ সাবধানে বলিল—ঠিক বলতে পারি না—চল্লিশের কাছাকাছি হবে বোধ হয়।

মিঃ পিলের বয়স পঞ্চান্ন। চন্দনা একটি গভীর নিশ্বাস ফেলিলেন; তাঁহার কাঁচুলি বাঁধা বক্ষস্থল উত্থিত হইয়া আবার পতিত হইল।

সোমনাথ চুপ করিয়া রহিল। বাকি পথটা আর কোনও উল্লেখযোগ্য কথা হইল না।

ওকুস্থলে পৌঁছিয়া সকলে কাজে লাগিয়া গেল। স্থানটি সত্যই ছবির মত; চারিদিকে গাছপালা, কোথাও জনমানব নাই—যুবক যুবতীর প্রণয় লীলার উপযুক্ত ক্রীড়াভূমি। যন্ত্রপাতি সাজাইয়া ছবি তুলিতে গিয়া কিন্তু এক বাধা উপস্থিত হইল। ইতিমধ্যে আকাশে কয়েক খণ্ড মেঘ দেখা দিয়াছিল, তাহারা কেবলি আসিয়া সূর্যকে ঢাকিয়া দিতে লাগিল। প্রখর একটানা সূর্যালোক না পাইলে ফটোগ্রাফ ভাল হয় না। জীবরাজ নাগর কয়েকবার চেষ্টা করিয়া শেষে বলিলেন—মেঘ কেটে না গেলে কিছু হবে না। অপেক্ষা করতে হবে।

চন্দনা গাছতলায় একটি টুলের উপর বসিয়াছিলেন, কিছুক্ষণ যেন চিন্তায় মগ্ন হইয়া রহিলেন; শেষে বলিলেন—উপায় কি? বসে বসেই বা কি করা যায়? চলুন মিঃ সোমনাথ, ঐদিকের জঙ্গলটা explore করে আসা যাক। নাগরজি, সময় হলে মোটরের হর্ন বাজাবেন, আমরা ফিরে আসব।

সোমনাথ আপত্তি করিল না। খোলা জায়গায় সুর্যের ঝাঁঝ বেশী, এখানে বসিয়া থাকার চেয়ে বনের ছায়ায় তবু ঠাণ্ডা পাওয়া যাইবে।

দুজনে বনের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। যতই দূরে যাইতে লাগিলেন বন ততই ঘন হইতে লাগিল। জংলী গাছপালার গাঢ় পত্রাবরণের নীচে একটি সজল স্নিগ্ধতা বিরাজ করিতেছে। বনভূমির উপর যেন চিত্রমৃগের অজিন বিছানো। আলোর রঙ ক্রমে সবুজ হইয়া আসিল।

একটি গানের কলি গুঞ্জন করিতে করিতে চন্দনা চলিয়াছেন, পাশে সোমনাথ। থাকিয়া থাকিয়া চন্দনা সোমনাথের দিকে হরিণায়ত দৃষ্টি ফিরাইতেছেন; কথাবার্তা কিছু হইতেছে না।

একটি গাছের ডাল হইতে সপুষ্প অর্কিডের লতা ঝুলিয়া ছিল, চন্দনা সেটি তুলিয়া খোঁপায় দিলেন। বলিলেন—এই রকম বনে এলে আমার মনে হয় আমি যেন বনের প্রাণী-সংসার নেই, সংস্কার নেই, একেবারে আদিম মানবী। আপনার মনে হয় না?

সোমনাথ বলিল—কই এখনও তো মনে হচ্ছে না। দেখুন দেখুন, জল! দ্রুত কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া সোমনাথ দেখিল, বনের নামাল জমির উপর তরুবেষ্টিত একটি ছোট্ট জলাশয়। কাকচক্ষু জল, তল পর্যন্ত দেখা যাইতেছে।

দুজনে জলাশয়ের কিনারায় গিয়া দাঁড়াইল। চন্দনা জলে হাত ড়ুবাইয়া বলিলেন-আঃ, কী ঠাণ্ডা জল! তাঁর চোখে সহসা বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল, আমি স্নান করব। আপনি করবেন?

সোমনাথ বলিল—সে কি, মেক-আপ ধুয়ে যাবে যে।

গলা পর্যন্ত জলে নামব, মেক-আপ ভিজবে না।

কিন্তু কাপড়-চোপড়? এখানে তো বদলানোও যাবে না।

চন্দনা অচপল দৃষ্টি সোমনাথের মুখের উপর রাখিয়া বলিলেন—কাপড়-চোপড় কিনারায় থাকবে।

সোমনাথ প্রথমটা বুঝিতে পারিল না; তারপর একঝলক রক্ত আসিয়া তাহার রঙ-মাখা মুখখানাকে আরও লাল করিয়া দিল। অন্যদিকে চোখ ফিরাইয়া সে কষ্টে গলা দিয়া আওয়াজ বাহির করিল—না, আমি নাইব না।

নাইবেন না?

না।

চন্দনা ভ্রূর একটি ভঙ্গি করিলেন—বেশ, আমি একাই নাই তাহলে। এমন জল পেয়ে আমি ছেড়ে দেব না।

চন্দনার কথাগুলা অদ্ভুত ইঙ্গিতপূর্ণ শুনাইল। সোমনাথ তাড়াতাড়ি জলের কিনারা হইতে চলিয়া যাইতে যাইতে বলিল—আমি ঐ গাছের আড়ালে দাঁড়াচ্ছি, আপনি স্নান করুন।

সোমনাথ একটা গাছের ডাল ধরিয়া জলের দিকে পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইল। ক্রমে পিছন হইতে জলের শব্দ আসিতে লাগিল। চন্দনা দেবী বৃন্দাবনের গোপিনীর ন্যায় লজ্জা সরম তীরে রাখিয়া জলে নামিয়াছেন। সোমনাথ আরও একটু দূরে-শব্দের এলাকার বাহিরে চলিয়া যাইবার জন্য পা বাড়াইল। অমনি পিছন হইতে আওয়াজ আসিল-বেশী দূরে চলে যাবেন না—আমার কাপড়-চোপড় কেউ যদি চুরি করে নিয়ে যায়।

সোমনাথের প্রবল ইচ্ছা হইল একবার পিছু ফিরিয়া তাকায়; কিন্তু সে দৃঢ়ভাবে ইচ্ছা দমন করিয়া ঘাসের উপর বসিল এবং তপ্তমুখে একটা সিগারেট ধরাইল।

দশ মিনিট কাটিয়া গেল। তারপর দূর হইতে মোটর হর্নের ধ্বনি ভাসিয়া আসিল।

.

চার

অপরাহ্নে যখন সোমনাথ বাড়ি ফিরিল তখন তাহার মাথার ভিতরটা ঝিম ঝিম করিতেছে।

এ এমন কথা যে দিদির কাছে বলা যায় না। অথচ একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ বিশেষ দরকার; নিজের বুদ্ধিতে সব দিক রক্ষা করিয়া বেড়াজাল হইতে বাহির হইতে পারিবে এমন সম্ভাবনা নাই। চন্দনা দেবী প্রবীণা শবরী, এত অল্পে শিকার ছাড়িয়া দিবেন না।

বাড়ি ফিরিয়া একটা সুরাহা হইল। দিদি মোটরে চড়িয়া বাজার করিতে গিয়াছিলেন; জামাইবাবু একাকী বারান্দায় বসিয়া চা সহযোগে জলযোগ করিতেছিলেন। সোমনাথ স্থির করিল জামাইবাবুকে ব্যাপারটা বলিয়া তাঁহার পরামর্শ চাহিবে। জামাইবাবুকেও বলিতেও লজ্জা করিবে; কিন্তু উপায় নাই।

সোমনাথের জন্য চা জলখাবার আসিল। দুজনে কিছুক্ষণ পানাহারে নিবিষ্ট রহিলেন। সোমনাথ কথাটা কিভাবে পাড়িবে মনে মনে গুছাইয়া লইতেছে এমন সময় জামাইবাবু বলিলেন—কলকাতা থেকে দাদা চিঠি লিখেছেন রত্না কাল আসছে।

রত্না জামাইবাবুর ছোট বোন; আই. এ. পরীক্ষা দিয়া মেজদার কাছে বোম্বাই বেড়াইতে আসিতেছে। রত্না তাহার দুই দাদা ও বৌদিদিদের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, তাই সকলের আদরিণী।

সোমনাথ অবশ্য রত্নাকে ছেলেবেলা হইতে দেখিয়াছে; কিন্তু তাহাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল না। রত্না বড় গম্ভীর প্রকৃতির মেয়ে, তাহার সহিত ঘনিষ্ঠতা করা সোমনাথের সাধ্য নয়। তবে দিদির এই স্বল্পভাষিণী স্বাধীন মনের ননদটিকে সে মনে মনে খুব পছন্দ করিত।

সে জিজ্ঞাসা করিল—কার সঙ্গে আসছে?

জামাইবাবু হাসিলেন-কার সঙ্গে আবার—একলা আসছে। রত্নার শরীরে কি ভয়-ডর আছে? তাছাড়া পথের হাঙ্গামাও কিছু নেই; দাদা হাওড়ায় গাড়িতে তুলে দিয়েছেন, কাল দুপুরে আমি ভি. টি-তে নামিয়ে নেব।

দুএকটা সাধারণ কথার পর সোমনাথ গলা ঝাড়া দিয়া বলিল—জামাইবাবু, আপনার সঙ্গে একটা পরামর্শ আছে— বলিয়া লজ্জাবিব্রত মুখে কতকটা অসংলগ্নভাবে চন্দনা দেবীর উপাখ্যান বলিল।

শুনিয়া জামাইবাবুর মুখ গম্ভীর হইল। মনে মনে কিছুক্ষণ তোলাপাড়া করিয়া তিনি শেষে বলিলেন—গোড়া থেকেই আমার ভয় ছিল। অবশ্য তুমি যদি শক্ত থাকতে পারো তাহলে কোনও ভয় নেই; কিন্তু মুশকিল হয়েছে এই যে বসের স্ত্রীকে তো আর অপমান করা যায় না। যাহোক, যথাসম্ভব সাবধানে চলবে। যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে।

পথনির্দেশ হিসাবে জামাইবাবুর পরামর্শ খুব মূল্যবান না হইলেও তাঁহার সহানুভূতি পাইয়া সোমনাথের মনের অস্বস্তি অনেকটা লাঘব হইল।

পরদিন সকালে চায়ের টেবিলে বসিয়া প্রাতরাশ গ্রহণের সময় দিদি হঠাৎ বলিলেন—এবার সোমুর বিয়ে দেওয়া দরকার।

সোমনাথের সন্দেহ রহিল না যে রাত্রে দিদি জামাইবাবুর কাছে সবই শুনিয়াছেন; কিন্তু বিবাহ করিলেই তো সকল সমস্যার সমাধান হইবে না! উপস্থিত যে শিরে সংক্রান্তি।

সোমনাথ সাড়াশব্দ না দিয়া টোস্ট চিবাইতেছে দেখিয়া দিদি আবার বলিলেন—তোর যদি মনে মনে কোনও মেয়ে পছন্দ থাকে তো বল, সম্বন্ধ করি।

সোমনাথ দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িয়া জানাইল কোনও মেয়ের প্রতি তাহার পক্ষপাত নাই, কাহাকেও সে এ পর্যন্ত হৃদয় দান করে নাই। কিছুক্ষণ নীরবে কাটিল; দিদি ও জামাইবাবু একবার দৃষ্টি বিনিময় করিলেন। তারপর দিদি বলিলেন-হ্যারে, রত্নাকে তোর কেমন লাগে?

নিঃসংশয় প্রশ্ন এবং ইহার পশ্চাতে একটা প্রস্তাব আছে। সোমনাথ আড়চোখে জামাইবাবুর পানে। চাহিল; তাহার মুখ দেখিয়া বুঝিল দিদি তাহার অনুমোদন পাইয়াই প্রশ্ন করিয়াছেন। সে কিছুক্ষণ নীরবে অর্ধসিদ্ধ ডিম্ব ভোজন করিয়া সতর্কভাবে বলিল—রত্না ভারি ভাল মেয়েবুদ্ধিমতী মেয়ে। তাহার কথার সুরে মনে হইল বিবাহের প্রস্তাবের সহিত এই মন্তব্যের কোনও সম্পর্ক নাই, ইহা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ চরিত্র সমালোচনা।

সোমনাথ আসল কথাটা এইবার চেষ্টা করিতেছে দেখিয়া জামাইবাবু হাসিলেন—রত্নাকে কি সোমনাথের পছন্দ হবে?—ওর পেছনে এখন হুরী-পরীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে! রত্না তো কালো মেয়ে।

দিদি তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করিলেন—কালো কেন হতে যাবে? রত্না উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ।

মহিলারা যাদের ভালবাসেন তাহারা কখনও কালো হয় না, সব উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ।

জামাইবাবু বলিলেন—তবে আমিও উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ।

দিদি রাগিয়া বলিলেন—বাজে কথা বলো না, রত্না তোমার চেয়ে ঢের ঢের ফরসা। আর অমন মুখ চোখ কটা পাওয়া যায়? কিরে সোমু, বিয়ে করবি?

সোমনাথ পূর্বে কখনও রত্নাকে নিজের বধুরূপে কল্পনা করে নাই; এখন কল্পনা করিয়া তাহার মনটি আনন্দে সরস হইয়া উঠিল। রত্না সুন্দরী নয় কিন্তু বধূরূপে সে পরম কমনীয়া। মনে মনে রত্নকে চন্দনা দেবীর পাশে দাঁড় করাইয়া রত্নাকে মোটেই ছোট মনে হইল না।

দিদি আবার প্রশ্ন করিলেন—কি বলিস, রাজি আছিস?

বিবাহে অমত থাকিবার আর কোনও কারণ ছিল না, সে এখন পাঁচশত টাকা মাহিনা পাইতেছে। সোমনাথ সলজ্জ হাসিয়া বলিল—আমি রাজি হলেই চলবে?

দিদি বলিলেন—না, রত্নারও মত নিতে হবে। তোর মতটা নিয়ে রাখলুম! আমার বিশ্বাস রত্না অমত করবে না। বলিয়া ভ্রাতার সুন্দর মুখের পানে চাহিয়া হাসিলেন।

জামাইবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন, যেন অন্যমনস্কভাবে বলিলেন—আমাদের সময় এত মন-জানা-জানি ছিল না; থাকলে কী ভালই হত।

দিদি বলিলেন-হতই তো।

প্রাতরাশ শেষ করিয়া সোমনাথ স্টুডিও চলিয়া গেল। আজও আবার আউটডোর শুটিং আছে; ড়ুয়েট গান কাল শেষ হয় নাই।

আজ কিন্তু ভাগ্যক্রমে কোনও হাঙ্গামা হইল না। জীবরাজ নাগর গাড়িতে তাহাদের সহগামী হইলেন এবং ওকুস্থলে পৌঁছিয়া আকাশ সারাদিন এমন নির্মেঘ হইয়া রহিল যে বনের মধ্যে যাইবার কোনও সুযোগই হইল না। পুরা দিন সবেগে শুটিং চলিল।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরিয়া সোমনাথ দেখিল রত্না আসিয়াছে। বারান্দায় বসিয়া দিদি, রত্না ও জামাইবাবু গল্প করিতেছেন।

সোমনাথ রত্নাকে মাঝে বছরখানেক দেখে নাই। উনিশ বছর বয়সে রত্না আগের মতই ছোটখাটো আছে, কিন্তু বেশ গোলগাল হইয়াছে। মুখের সুডৌল দৃঢ়তার উপর যেন আর একটু লাবণ্যের আভা ফুটিয়াছে। সমতল অবঙ্কিম ভুর নীচে চক্ষু দুটি আগের মতই শান্ত এবং অচপল। আর, দিদির কথাই ঠিক; রত্ন কালো নয়, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ।

রত্না উঠিয়া সোমনাথকে প্রণাম করিল, সোমনাথ একটু অপ্রস্তুতভাবে বলিল—কেমন আছ?

রত্ন উত্তর না দিয়া সহজভাবে বলিল—তুমি যে বম্বে চলে এসেছ সে খবর আমরা বৌদির চিঠিতে পেলুম।

কথার অন্তর্নিহিত বক্রোক্তিটা স্পষ্ট। রত্নারা কলিকাতায় থাকে, সোমনাথও এতদিন কলিকাতায় ছিল, অথচ চলিয়া আসিবার আগে তাহাদের সঙ্গে দেখা করে নাই। সোমনাথ আমতা-আমতা করিয়া বলিল-হঠাৎ চলে আসতে হল—

সে একটা চেয়ারে বসিয়া পড়িল। দিদি বলিলেন—রত্ন, সোমুর চা-জলখাবার এখানেই আনতে বল।

রত্না ভিতরে গিয়া নিজেই সোমনাথের খাদ্য পানীয় আনিয়া দিল। ভাবগতিক দেখিয়া সোমনাথ বুঝিল, প্রস্তাবিত বিবাহের কথা এখনও রত্নার কাছে উত্থাপিত হয় নাই, সোমনাথ বৌদিদির ভাই এই সম্পর্কে রত্না তাহার আদর যত্ন করিতেছে।

কিছুক্ষণ সাধারণভাবে বাক্যালাপ চলিবার পর রত্না সোমনাথকে জিজ্ঞাসা করিল-নতুন কাজ লাগছে কেমন? বেশ মন বসছে তো? তাহার গলার মধ্যে যেন ক্ষীণ ব্যঙ্গ লুকাইয়া আছে।

সোমনাথ তাড়াতাড়ি বলিল—লাগছে একরকম। আসল আকর্ষণ টাকা। তারপর যাহাতে কথাটা আর বেশীদুর না গড়ায় (জামাইবাবু কি বলিয়া বসিবেন কিছুই বলা যায় না) তাই বলিল—আই. এ. পাস করে তুমি বি. এ. পড়বে তো?

আগে পাস তো করি।

পাস তুমি করবেই। তারপর?

দিদি বলিলেন—তারপর বিয়ে, তারপর ঘর-সংসার। নে, তোকে আর ন্যাকামি করতে হবে। ওর লেখাপড়ার পালা শেষ হয়েছে।

রত্নার শান্ত চোখে প্রশ্ন জাগিয়া উঠিল।

পরদিন পুরুষেরা কাজে বাহির হইয়া গেলে দিদি রত্নার কাছে কথা পাড়িলেন। রত্না মন দিয়া। শুনিল, হাঁ-না কিছু বলিল না; তাহার মুখখানি আর একটু গম্ভীর হইল মাত্র।

দিদি উত্তরের জন্য জেদাজেদি করিলে সে বলিল—আমায় একটু ভাববার সময় দাও।

এতে ভাববার কি আছে? সোমুকে কি তোর পছন্দ নয়?

রত্না দিদির মুখের উপর চোখ পাতিয়া বলিল—বৌদি, তুমি চাও। মেজদা চান?

দিদি বলিলেন—আমাদের চাওয়া-না-চাওয়ার কথা নয় রত্না। তোর চাওয়াটাই আসল।

তবে আমাকে একটু সময় দাও।

এইখানে কথা মুলতুবি রহিল। দিদি নিরাশ হইলেন, কিন্তু আর চাপাচাপি করিতে পারিলেন না।

অতঃপর এক হপ্তা কাটিয়া গেল। ইতিমধ্যে সোমনাথের ভাগ্য লইয়া দুইটি নারীর মধ্যে অলক্ষ্যে যে দড়ি-টানাটানি চলিতেছে তাহার পুরা খবর অন্তর্যামী ছাড়া আর কেহ জানিলেন না। পাণ্ডুরঙ চন্দনা দেবীকে গভীর জলের মাছ বলিয়াছিল বটে কিন্তু রত্নার তুলনায় চন্দনা দেবী চুনোর্পটি।

স্টুডিওতে শূটিং স্থগিত আছে, কাজ কর্ম কিছু ঢিলা পড়িয়াছে। এমন মাঝে মাঝে হয়; একটা সেটের কাজ শেষ হইবার পর নূতন সে আরম্ভ হইবার ফাঁকে দুচারদিন বিশ্রাম পাওয়া যায়। তখন কেবল ছুতার মিস্ত্রিদের খটাখট শব্দে স্টুডিও মুখরিত হইতে থাকে।

দ্বিপ্রহরে সোমনাথ নিজের ঘরে কৌচে শুইয়া ঝিমাইতেছিল। হঠাৎ দ্বারে টোকা দিয়া যিনি ঘরে প্রবেশ করিলেন তাঁহাকে দেখিয়া সোমনাথ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল। চন্দনা এ পর্যন্ত তাহার কক্ষে পদার্পণ করেন নাই; সোমনাথ দাঁড়াইয়া উঠিয়া সসম্ভ্রমে বলিল—আসুন আসুন।

চন্দনা দেবীর হাবভাব আজ অন্য রকমের, যেন একটু লজ্জিত ও জড়সড়। তিনি বলিলেন—আপনাকে বিরক্ত করিনি তো? এক মিনিটের জন্য দরকার—

বিলক্ষণ–বসুন।

চন্দনা একটি চেয়ারের প্রান্তে বসিলেন, আস্তে আস্তে বলিলেন—কাল আমার জন্মদিন। বাড়িতে সামান্য ডিনারের আয়োজন করেছি। আপনি আসতে পারবেন কি?

সোমনাথ বিদ্যুদ্বেগে চিন্তা করিল। রাত্রে বাড়িতে নিমন্ত্রণ—নূতন ফাঁদ নয় তো? কিন্তু জন্মদিনের নিমন্ত্রণে অন্যান্য অতিথিও আসিবেন, পিলে সাহেবও অবশ্য উপস্থিত থাকিবেন? সুতরাং ভয়ের কারণ নাই।

সে হৃদ্যতা দেখাইয়া বলিল—যাব বৈকি, নিশ্চয় যাব।

চন্দনা দেবী কৃতজ্ঞ হাসি হাসিলেন—ধন্যবাদ। আমার বাড়ি কোথায় বোধহয় জানেন না। শহরের বাইরে বান্দ্রায় থাকি, একেবারে সমুদ্রের কিনারায়; কিন্তু আপনাকে বাড়ি খুঁজে বার করতে হবে না, কাল রাত্রি আটটার সময় আমি বান্দ্রা স্টেশনে মোটর পাঠিয়ে দেব।

ধন্যবাদ—অশেষ ধন্যবাদ।

চন্দনা দেবী হাসিমুখে বিদায় লইলেন।

বাড়ি ফিরিবার পথে সোমনাথের মনটা খুঁতখুঁত করিতে লাগিল। নিমন্ত্রণ গ্রহণ না করিলেই বোধ হয় ভাল হইত। সাবধানের মার নাই। তাছাড়া রত্না অবশ্যই জানিতে পারিবে। সে কি মনে করিবে কে জানে! হয়তো–

বাড়ি ফিরিয়া সোমনাথ আড়ালে জামাইবাবুকে নিমন্ত্রণের কথা বলিল। জামাইবাবু বলিলেন—কি আপদ, তুমি নেমন্তন্ন কাটিয়ে দিলে না কেন?

এখন যদি কোনও ছুতো করে–

এখন আর ভাল দেখাবে না, নেমন্তন্ন যখন স্বীকার করেছ তখন যেতে হবে। ভাল কথা, একটা কিছু উপহার নিয়ে যেও।

উপহারের কথা সোমনাথের মনে আসে নাই, সে বলিল—আচ্ছা। তাহলে যাওয়াই স্থির?

জামাইবাবু বলিলেন—া। তবে অন্য অতিথিদের সঙ্গে ফিরে এস, দেরি কোরো না। আর, যদি বিপদ হয় আমি তোমাকে রক্ষে করব—ভেবো না।

জামাইবাবু কি করিয়া তাহাকে বিপদে রক্ষা করিবেন তাহা কিছু ভাঙিয়া বলিলেন না; কিন্তু তাহার উপর সোমনাথের অগাধ বিশ্বাস ছিল, সে আশ্বস্ত হইল।

পরদিন শনিবার স্টুডিওতে ছুটি। কারণ, যেদিন মহালক্ষ্মীর মাঠে ঘোড়দৌড় থাকে সেদিন কোনও স্টুডিওতে ভাল করিয়া কাজ হয় না; বেশীর ভাগ অভিনেতা অভিনেত্রীর একটা না একটা অসুখ হইয়া পড়ে, যাঁহারা দয়া করিয়া স্টুডিওতে আসেন তাঁহাদের মনও সারাদিন এমন উদভ্রান্ত হইয়া থাকে যে কোনও কাজই হয় না। বুদ্ধিমান চিত্র-প্রণেতারা তাই রেসের মরসুমের কয় মাস শনিবারে স্টুডিও বন্ধ রাখেন।

সকালের দিকে সোমনাথ বাজারে গিয়া একটি রূপার ফুলদানি কিনিয়া আনিল, চন্দনা দেবীকে উপহার দিতে হইবে। তারপর সারাদিন সে বাড়িতে রহিল। রত্না আসার পর তাহার সারাদিন বাড়িতে থাকা এই প্রথম। রত্নার সহিত নানাসূত্রে তাহার অনেকবার দেখা হইল কিন্তু রত্না স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া কথা কহিল না; সে যেন নিজেকে নিজের মধ্যে বেশী করিয়া গুটাইয়া লইয়াছে। সোমনাথ বুঝিয়াছিল রত্না বিবাহের প্রস্তাব শুনিয়াছে, কিন্তু তাহার মনের প্রতিক্রিয়া কিরূপ তাহা সোমনাথ অনুমান করিতে পারে নাই। দিদিও কিছু বলেন নাই।

সন্ধ্যার পর সোমনাথ যখন সাজসজ্জা করিয়া রূপার ফুলদানিটি পকেটে পুরিয়া বাহির হইবার উপক্ৰম করিল তখন রত্না একবার সপ্রশ্ন নেত্রে তাহার পানে তাকাইল। সোমনাথ কোথায় যাইতেছে। তাহা সে জানিত না। সোমনাথ একটু কুণ্ঠিত হইয়া বলিল—আচ্ছা দিদি, আমি তাহলে বেরুই। কখন ফিরব তা—

দিদি দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন—তুই ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা জেগে থাকব।

সোমনাথ চলিয়া গেলে রত্না তাহার সপ্রশ্ন দৃষ্টি দিদির পানে ফিরাইল। দিদির পেটের মধ্যে অনেক কথা গজগজ করিতেছিল, আর চাপিয়া রাখা অসম্ভব বুঝিয়া তিনি বলিলেন—আয় রত্না, আমার ঘরে চল, তোর চুল বেঁধে দিই।

.

পাঁচ

সংস্কার এমনই জিনিস যে অতি উগ্ৰ জৈবধর্মকেও পোষ মানাইতে পারে। তাহা না হইলে সোমনাথ আজিকার দুর্নিবার প্রলোভন কখনই কাটাইয়া উঠিতে পারিত না। সংস্কারের প্রতি। আজকাল আমরা শ্রদ্ধা হারাইয়াছি। তাহাতে ক্ষতি ছিল না, কিন্তু মুশকিল হইয়াছে এই যে সংস্কারের পরিবর্তে এমন কিছুই পাই নাই যাহাকে দিশারী রূপে গ্রহণ করিতে পারি। বিজ্ঞান আমাদের দিগদর্শন যন্ত্র কাড়িয়া লইয়া হাতে আণবিক বোমা ধরাইয়া দিয়াছে।

রাত্রি সাড়ে আটটার সময় সোমনাথ চন্দনা দেবীর বাড়িতে গিয়া পৌঁছিল। বাগান-ঘেরা চমৎকার ছোট বাড়ি, সমুদ্রের বাতাস ও কল্লোলধ্বনি সর্বদা তাহাকে স্পন্দিত করিয়া রাখিয়াছে।

চন্দনা পরম সমাদরে সোমনাথুকে ড্রয়িংরুমে লইয়া গিয়া বসাইলেন। ড্রয়িংরুমে অন্য কোনও অতিথি নাই। সোমনাথ মনের অস্বস্তি এই বলিয়া শান্ত করিবার চেষ্টা করিল যে সে নির্ধারিত সময়ের আগে আসিয়াছে, অন্য অতিথিরা এখনও আসিয়া পৌঁছিতে পারেন নাই।

আজ চন্দনা দেবীর বেশভূষা অতি লঘু এবং সংক্ষিপ্ত, কোনও আড়ম্বর নাই। সাবানের ফেনার মত অর্ধ স্বচ্ছ লেসের শাড়ি গায়ে জুড়িয়া আছে; ব্লাউজ নামমাত্র। অলঙ্কারের মধ্যে কানে দুইটি হীরার দুল এবং গলায় মুক্তার কণ্ঠি। নিটোল বাহু দুটি সম্পূর্ণ নিরাভরণ, শুধু অঙ্গুলির প্রান্তে নখের উপর কিউটেক্সের গভীর শোণিমা। পায়ে মখমলের নরম শ্লিপার। সোমনাথের মনে হইল, চন্দ্রালোকিত রাত্রে তাজমহলের উপর যদি সূক্ষ্ম কুজ্বটিকার আবরণ নামিয়া আসে তবে বুঝি এমনই। দেখিতে হয়। তাজমহলের বয়স অনেক, কিন্তু সেজন্য তাহার সৌন্দর্যের কিছুমাত্র ক্ষতি নাই। চন্দনার বয়স যদি সত্যই পঁয়ত্রিশ বৎসর হয় তাহাতেই বা কী ক্ষতি হইয়াছে? যৌবনের সহিত বয়সের সম্পর্ক কি?

সোমনাথ সলজ্জভাবে ফুলদানিটি পকেট হইতে বাহির করিল, মনে মনে যে বাঁধা-গৎ সাধিয়া রাখিয়াছিল তাহাই আবৃত্তি করিয়া বলিল—আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি, আজকের এই দিনটি বারবার আপনার জীবনে ফিরে আসুক।

চন্দনা দেবী এমনভাবে ফুলদানিটি গ্রহণ করিলেন যেন উহ্য অমুল্য নিধি। গঙ্গদ কণ্ঠে বলিলেন–কি বলে ধন্যবাদ জানাব? আপনার এই উপহারটিকে আশ্রয় করে আজকের রাত্রের স্মৃতি চিরদিন আমার মনে ফুলের মত ফুটে থাকবে।

কবিত্বপূর্ণ এই অত্যুক্তিতে সোমনাথ অভিভূত হইয়া কি উত্তর দিবে ভাবিতেছে এমন সময় একটি উর্দিপরা ভৃত্য ট্রের উপর দুটি পূর্ণ পানপাত্র লইয়া প্রবেশ করিল। ভৃত্যটির মুখে কোনও ভাব নাই, সে বোবাকালা। চন্দনা দেবী জীবনে যত সৎকার্য করিয়াছেন এই বোবা কালা ভৃত্যটির নিয়োগ তাহার অন্যতম। সকার্য করিলেই পুণ্য ফল আছে; এই নির্বাক ভূত্যটি তাঁহার একান্ত অনুগত, বাড়ির আভ্যন্তরিক যাবতীয় কাজ সে একাই করে এবং ঘরের কথা বাহির হইতে দেয় না।

ভূত্যকে চন্দনা ইঙ্গিত করিতেই সে পানপাত্র দুইটি নামাইয়া রাখিয়া প্রস্থান করিল।

সোমনাথ সন্দিগ্ধভাবে বলিল—ওটা কি?

চন্দনা একটি পানপাত্র তাহার দিকে বাড়াইয়া ধরিয়া হাসিমুখে বলিলেন-ককটেল—নিন।

সর্বনাশ! আমি তো মদ খাই না।

চন্দনা তরল কৌতুক দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন—মদ নয়, ওতে একটু ক্ষুধাবৃদ্ধি হয় মাত্র, নেশা হয়। দেখুন না, আমিও খাব।

অগত্যা সোমনাথ পাত্র হাতে লইল। চন্দনা দেবী নিজের পাত্রটি তাহার পাত্রে একবার ঠেকাইয়া তাহার চোখে চোখ রাখিয়া পাত্রে অধর স্পর্শ করিলেন। সোমনাথও নিজের পাত্রে চুমুক দিল, দেখিল শীতল পানীয় উপাদেয় বটে কিন্তু ঝাঁজ আছে। ভয়ে ভয়ে সে বাকিটুকু শেষ করিয়া পাত্র রাখিয়া দিয়া বলিল—আপনার অন্য অতিথিরা কই এখনও এলেন না?

চন্দনা দেবী কুহককলিত কণ্ঠে বলিলেন—অন্য অতিথি নেই, আপনিই একমাত্র অতিথি। সোমনাথ চমকিয়া উঠিল—অ্যাঁ, আর মিঃ পিলে?

চন্দনা দেবীর অধর প্রান্ত একটু প্রসারিত হইল, তিনি বলিলেন—মিঃ পিলে বাড়িতেই আছেন। দেখবেন তাঁকে?

সম্মতির প্রতীক্ষা না করিয়া চন্দনা সোমনাথকে বাড়ির এক কোণের একটি ঘরে লইয়া গেলেন। ঘরে মৃদুশক্তির আলো জ্বলিতেছে, টেবিলের উপর হুইস্কির বোতল ও গেলাস; একটি কৌচের উপর পিলে সাহেব উম্মলিত বৃক্ষকাণ্ডের ন্যায় হাত-পা ছড়াইয়া পড়িয়া আছেন। ঘরের বদ্ধ বাতাস মদের গন্ধে বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছে।

চন্দনা দেবী পাশে দাঁড়াইয়া স্বামীর গায়ে কয়েকবার নাড়া দিলেন কিন্তু পিলে সাহেব সাড়া দিলেন না, অনড় হইয়া পড়িয়া রহিলেন। সোমনাথ দেখিল, চন্দনার মুখ নিবিড় বিতৃষ্ণায় বিকৃত হইয়া উঠিয়াছে। তিনি সোমনাথের দিকে ফিরিয়া বলিলেন-এটা নতুন কিছু নয়। প্রাত্যহিক ব্যাপার। আপনার বোধ হয় দম বন্ধ হয়ে আসছে, চলুন এ নরক থেকে বাইরে যাই।

সোমনাথ আবার ড্রয়িংরুমে আসিয়া বসিল। ককটেলের গুণে তাহার মাথার মধ্যে একটু রুমঝুম করিতে আরম্ভ করিয়াছিল, কিন্তু পিলে সাহেবের অবস্থা দেখিয়া তাহার নেশা ছুটিয়া গেল। প্রতিভাবান মানুষ কি করিয়া নিজেকে এমন পশুতে পরিণত করিতে পারে? চন্দনা দেবীর জন্য তাহার অন্তর সমবেদনায় ভরিয়া উঠিল। যাহার স্বামী এমন অমানুষ সে যদি পতিব্রতা না হয়, দোষ কাহার?

চন্দনা দেবীও তার পাশে বসিয়াছিলেন, তাঁহার মুখে ব্যথাবিদ্ধ হাসি। সোমনাথের একটা হাত নিজের হাতে তুলিয়া লইয়া তিনি করুণস্বরে বলিলেন–আমার দাম্পত্য জীবন কেমন মধুর দেখলেন তো?

সোমনাথ চন্দনার হাত চাপিয়া ধরিয়া গাঢ়স্বরে বলিল—চন্দনা দেবী, আমি-আমি কি বলে আপনাকে সান্ত্বনা দেব ভেবে পাচ্ছি না-আপনি

আমিও মানুষ, আমারও রক্তমাংসের শরীর, এইটুকু যদি আপনি মনে রাখেন তাহলেই আমি ধন্য হব সোমনাথবাবু!

চন্দনার মুখ দেখিয়া সোমনাথ সসঙ্কোচে তাঁহার হাত ছাড়িয়া দিল। সমবেদনা ও সহানুভূতি প্রদান করিতে সে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু যে উগ্ৰ দাবি চন্দনার মুখে ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহা সে পূরণ করিবে কি প্রকারে? তাহার অন্তর ছি ছি করিয়া উঠিল। স্ত্রীলোকের মুখে এরূপ অভিব্যক্তি সে পূর্বে কখনও দেখে নাই।

চন্দনা তাহার দিকে চাহিয়া প্রজ্বলিত চক্ষে আরও কিছু বলিতে যাইতেছিলেন এমন সময় দূরের একটা ঘরে টিং টিং করিয়া ঘন্টি বাজিয়া উঠিল।

চন্দনার মুখের ভাব নিমেষে পরিবর্তিত হইল, ঘড়ির দিকে চকিতে দৃষ্টি হানিয়া তিনি অধরে একটু হাসি টানিয়া আনিলেন—চলুন, ডিনারের সময় হয়েছে।

ভোজনকক্ষে টেবিলের উপর দুজনের ডিনার সজ্জিত ছিল; সোমনাথ চন্দনার সহিত মুখোমুখি বসিল। বোকালা ভৃত্য পরিবেশন করিল। সোমনাথ পূর্বে সাহেবী খানা খাওয়ার রীতি পদ্ধতি জানিত না, কিন্তু এ কয়মাস দিদির বাড়িতে থাকিয়া টেবিলের আদব কায়দা রপ্ত হইয়াছে, সে কোনও অসুবিধা বোধ করিল না।

আহারের প্রচুর আয়োজন; একটির পর একটি আসিতেছে। ডিনার শেষ হইতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগিল।

চন্দনা টেবিল হইতে উঠিয়া ভৃত্যকে ইঙ্গিত করিলেন, ভৃত্য ঘাড় নাড়িয়া চলিয়া গেল। চন্দনা বলিলেন–চলুন, ও ঘরে কফি দিয়েছে। আপনি আমার বাড়ি এখনও সবটা দেখেননি। আসুন দেখাই।

বাড়ির প্রত্যেকটি ঘর চন্দনা আলো জ্বালিয়া দেখাইলেন; গৃহকর্তীর মহার্ঘ রুচি ও সৌন্দর্যবোধের চিহ্ন প্রত্যেক ঘরেই বিদ্যমান। লাইব্রেরি ঘরটি সোমনাথের সবচেয়ে পছন্দ হইল; সে লুব্ধ মনে ভাবিল, কবে তাহার এত টাকা হইবে যে নিজের বাড়ি এমনি ভাবে সাজাইতে পারিবে।

সর্বশেষে চন্দনা একটি ঘরের আলো জ্বালিয়া বলিলেন-এটি আমার শোবার ঘর।

সবুজ আলোতে ঘরটি স্বপ্নালু হইয়া আছে। খাটের উপর শুভ্র বিছানা যেন সংশয়ক্লান্ত মানুষকে সস্নেহে নিজের কোমল ক্রোড়ে আহ্বান করিতেছে। সোমনাথ মুগ্ধ হইয়া দেখিতে লাগিল, তাহার। চোখে যেন ঘোর লাগিয়া গেল।

সহসা সোমনাথ অনুভব করিল তাহার হাতের উপর হাত রাখিয়া চন্দনা তাহার অত্যন্ত কাছে। আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।

সোমনাথ।

সোমনাথ মোহাক্রান্ত মনে অনুভব করিল, আর দুই দিক রক্ষা করিয়া চলিবার উপায় নাই; হয় চন্দনাকে অপমান করিয়া প্রত্যাখ্যান করিতে হইবে, নয়তো–

সে অস্ফুটস্বরে বলিল—মিঃ পিলে ও ঘরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন আমি ভুলতে পারছি না—

এই কথার সুত্র কোথায় গিয়া শেষ হইত বলা যায় না, কিন্তু এই সময় বাধা পড়িল। অদূরে একটা ঘরে টিং টিং করিয়া ঘন্টি বাজিয়া উঠিল। সোমনাথ যেন চমকিয়া সজাগ হইয়া উঠিল—কিসের ঘন্টি বাজছে?

চন্দনা অধর দংশন করিলেন—টেলিফোন।

টেলিফোন বাজিয়াই চলিল। তখন চন্দনা শয়নকক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। সোমনাথ তাঁহার অনুগমন করিল।

টেলিফোন তুলিয়া চন্দনা রুক্ষস্বরে বলিলেন-হ্যালো!

অপর প্রান্ত হইতে কি কথা আসিল সোমনাথ শুনিতে পাইল না। চন্দনা কিছুক্ষণ শুনিয়া বিস্মিত চক্ষু তাহার দিকে ফিরাইলেন।

আপনাকে কে ডাকছে।

সোমনাথ গিয়া ফোন ধরিল-হ্যালো!

জামাইবাবু বলিলেন—কি হে, খবর কি? কেমন আছ?

জামাইবাবুর কণ্ঠস্বর সোমনাথের কণ্ঠে সুধাবৃষ্টি করিল। সে একবার আড়চোখে চন্দনার প্রতি চাহিয়া বাংলা ভাষায় বলিল—ভাল নয়।

তাহলে শিগগির চলে এস। আমার ভয়ানক অসুখ করেছে, বাড়িতে ডাক্তার ডাকবার লোক নেই। আর দেরি কোরো না, বুঝলে?

সোমনাথ বুঝিল। টেলিফোন রাখিয়া দিয়া সে অত্যন্ত বিপন্নভাবে চন্দনার দিকে ফিরিল—আমাকে এখনি যেতে হবে। আমার আত্মীয়-যাঁর বাড়িতে আমি থাকি তাঁর হঠাৎ অসুখ করেছে, ঘন ঘন মূর্চ্ছা যাচ্ছেন— মুক্তির আশায় সোমনাথ কল্পনার রাশ ছাড়িয়া দিল।

চন্দনার মুখখানা একেবারে সাদা হইয়া গেল। তিনি আবার অধর দংশন করিয়া বলিলেন-কফি খেয়ে যাবেন না?

মা করবেন, আর এক মিনিট দেরি করা চলবে না। আমি না গেলে ডাক্তার ডাকা পর্যন্ত হবে। অনুমতি দিন।

.

ট্রেনে বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে সোমনাথের মন আবার অশান্ত হইয়া উঠিতে লাগিল। মুক্তি সে পাইয়াছে বটে কিন্তু সমস্যা যেন আরও জটিল হইয়া উঠিয়াছে। ঐ বাড়িখানা বারবার তাহার মানস-চক্ষে ভাসিয়া উঠিল। অনবদ্য রসবোধের দ্বারা সজ্জিত একটি সুখের নীড়; তাহাতে একটা মাতাল অচৈতন্য হইয়া পড়িয়া আছে। আর, একটি স্ত্রীলোক, স্ত্রীলোকটি কি করিতেছে? চন্দনা দুশ্চরিত্রা স্ত্রীলোক তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু তবু সোমনাথ তাহাকে অন্তর হইতে ঘৃণা করিতে পারিল না। হয়তো ইহা তাহার পুরুষোচিত দুর্বলতা; পুরুষ যে-নারীর ভালবাসা পাইয়াছে—তা সে ভালবাসা যতই নিকৃষ্ট হোক—তাহাকে কখনও ঘৃণার চক্ষে দেখিতে পারে না। বেদনার সহিত সোমনাথের মনে হইল, ভিন্ন অবস্থায় পড়িলে চন্দনা হয়তো এমন মন্দ হইত না।

বাড়ি পৌঁছিয়া সোমনাথের মন আবার শান্ত হইয়া গেল। এ বাড়ির আবহাওয়া যেন একেবারে ভিন্ন, এখানে দিদি আছেন রত্না আছে! মুক্তির আনন্দ তাহাকে নূতন করিয়া পুলকিত করিয়া দিল।

দিদি এবং জামাইবাবু ড্রয়িংরুমে ছিলেন, রত্না শয়ন করিতে চলিয়া গিয়াছিল। সোমনাথ আসিয়া ভক্তিভরে জামাইবাবুর পদধুলি লইল। জামাইবাবু হাসিয়া উঠিলেন—যাক, ঠিক সময় উদ্ধার করেছি তাহলে!

দিদি কিন্তু হাসিলেন না, বলিলেন—হাসির কথা নয়। সোমু, কি হয়েছে সব খুলে বল, লজ্জা করিসনি।

বিশদ ব্যাখ্যা করিবার বিষয় নয়, তবু সোমনাথ লজ্জা চাপিয়া যথাসাধ্য খোলসা করিয়া বলিল।

শুনিয়া দিদি বলিলেন—না, এসব ভাল কথা নয়। কথায় বলে মন না মতি। তুই এ কাজ ছেড়ে দে।

সোমনাথ বলিল—কন্ট্রাক্ট আছে, ছবি শেষ না হলে ছাড়ব কি করে। ওদিকে ব্যাঙ্কের কাজও ছেড়ে দিয়েছি

দিদি স্বামীকে বলিলেন—তাহলে তুমি বাপু যাহোক কর।

জামাইবাবু বলিলেন—বেশ যাহোক, তোমার সুন্দর ভাই জট পাকাবে আর আমি জট ছাড়াব!

দিদি বলিলেন—ওর দোষ কি? সব দোষ ঐ বজ্জাত মেয়েমানুষটার।

জামাইবাবু বলিলেন–তবু ভাল, মেয়েমানুষের দোষ দেখতে পেলে। যাহোক, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। সোমনাথ, তুমি যে অবিবাহিত একথা মহিলাটি জানেন?

বলতে পারি না–কখনও কথা হয়নি।

হুঁ। তিনি ঠিক বুঝেছেন তুমি কুমার ব্রহ্মচারী, তাই তোমার তপোভঙ্গ করবার এত আগ্রহ। এখন, তাঁকে যদি কোনও রকমে বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে তুমি বিবাহিত, তোমার ঘরে একটি প্রেমময়ী ভাষা আছেন, তাহলে তিনি হয়তো তাঁর মোহিনী মায়া সম্বরণ করতে পারেন।

দিদি বলিলেন—বেশ তত সোমু, তুই কালই কথায় কথায় ওকে বা যে তোর বিয়ে হয়েছে—

সোমনাথ দ্বিধাভরে বলিল—এতদিন বলিনি, এখন বললে কি—

জামাইবাবু মাথা নাড়িয়া বলিলেন—কোনও কাজই হবে না। একেবারে চাক্ষুষ প্রমাণ হাজির করতে হবে, নইলে তিনি বিশ্বাস করবেন না। শোনো, মহিলাটি সোমনাথকে ডিনারের নেমন্তন্ন করেছিলেন, সোমনাথ তার পাল্টা দিক, মহিলাটিকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে আসুক—তারপর বৌ দেখিয়ে দিক–

বিদ্যুৎ চমকের মত সোমনাথ বুঝিতে পারিল জামাইবাবুর গুঢ় অভিপ্রায় কি; কিন্তু দিদি অত সহজে বুঝিলেন না, বলিলেন—কি আবোল তাবোল বলছ? বৌ কোথায় যে দেখিয়ে দেবে।

জামাইবাবু হৃদয়ভারাক্রান্ত একটি নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া চেয়ারের উপর চিৎ হইয়া কড়ি বরগা নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। সোমনাথ অপ্রতিভভাবে উঠিয়া দাঁড়াইল—আমি কিছু জানি না। দিদি, তোমরা যা ভাল বোঝ কর। আমি শুতে চললুম।

সোমনাথ পলায়ন করিল। দিদি এতক্ষণে বুঝিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, স্বামীর কাছে সরিয়া আসিয়া খাটো গলায় বলিলেন—যাগা, কি বলছ স্পষ্ট করে বল না। রত্না?

জামাইবাবু ঊর্ধ্বে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া দিলেন—রত্না যদি একদিনের জন্যে বৌ সাজতে রাজি থাকে আমার আপত্তি নেই। ছোঁড়াকে কোনও রকমে বাঁচাতে হবে তো?

দিদি কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়া চিন্তা করিলেন, তারপর ধীরে ধীরে বলিলেন—রত্না কি রাজি হবে? ওকে কোনও কথা বলতে আমার সঙ্কোচ হয়। বিয়ের কথা ভাববার সময় দাও বলে সময় চাইলে, তারপর তো কিছুই বলেনি–

জামাইবাবু ঊর্ধ্ব হইতে দৃষ্টি নামাইয়া বলিলেন—বলে দ্যাখো যদি রাজি হয়। আর এ কথাটাও রত্নাকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে সোমনাথের মত স্বামী পাওয়া যে-কোনও মেয়ের পক্ষে ভাগ্যের কথা।

দিদি বলিলেন—ও কথা আমি তাকে বলতে পারব না, বলতে হয় তুমি বোলা। তবে এক রাত্রির জন্যে বৌ সাজতে বলে দেখতে পারি। যদি রাজি হয় খুব মজা হয় কিন্তু।

দিদির প্রাণে এখনও রোমান্সের রঙের খেলা মুছিয়া যায় নাই, জামাইবাবু তো বর্ণচোরা আম। তিনি একটা হাই তুলিয়া গাত্রোত্থান করিলেন—আমারও ঘুম পাচ্ছে।

দিদি ঘড়ি দেখিলেন, পৌনে বারোটা, তিনি বলিলেন—তুমি শোওগে, আমি আসছি। এত রাত্রে কি রত্না জাগিয়া আছে? যদি জাগিয়া থাকে আজ রাত্রেই কথাটার নিষ্পত্তি করিয়া ফেলা ভাল।

রত্নার ঘরে আলো জ্বলিতেছে। দিদি প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, রত্ন সম্মুখেই দাঁড়াইয়া আছে এবং অলস-হস্তে খোঁপা খুলিতেছে। তাহার চুল খুলিয়া শোয়া অভ্যাস, খোঁপা বাঁধা অবস্থায় সে ঘুমাইতে পারে না।

দিদি বলিল—ওমা, তুই এখনো ঘুমোসনি?

রত্না বলিল—এই শুতে যাচ্ছি।

দিদি রত্নার বিছানায় বসিয়া বলিলেন—তোর সঙ্গে একটা কথা আছে রত্না—

রত্না বলিল—কথা আমি সব শুনেছি।

দিদি গালে হাত দিলেন—আঁ, কি করে শুনলি? আড়ি পেতেছিলি নাকি?

রত্না শান্তস্বরে বলিল—আড়ি পাতবার দরকার হয়নি। এ বাড়িতে রাত্তির বেলা ফিফিস্ করে কথা কইলেও শোনা যায়। আমি তো রোজ রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তোমাদের নাক ডাকার শব্দ শুনি।

শুনেছিস্ তাহলে? ভালই হল। তা কি বলিস্?

দ্রুত অঙ্গুলি দ্বারা চুলের বিনুনি খুলিতে খুলিতে রত্না চোখ না তুলিয়াই বলিল—মেজদার যখন ইচ্ছে তখন তাই হবে, কিন্তু এসব আমার ভাল লাগে না।

.

ছয়

টেলিফোনে সোমনাথ চন্দনা দেবীর সহিত সংযোগ স্থাপন করিল। বলিল—অসভ্যর মত ডিনার শেষ হবার আগেই চলে এসেছিলাম। আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছেন কি?

চন্দনা দেবী সোমনাথের গলা শুনিয়া প্রথমটা বিমুঢ় হইয়া পড়িয়াছিলেন, পরে সামলাইয়া লইয়া বলিলেন—আপনার আত্মীয় কেমন আছেন?

সোমনাথ যেখানে বসিয়া টেলিফোন করিতেছিল, জামাইবাবু তাহার অদূরে বসিয়াছিলেন, সোমনাথ তাঁহার প্রতি কটাক্ষ করিয়া বলিল—আমার আত্মীয়ের মৃগী রোগ আছে, জানতাম না। হঠাৎ আক্রমণ হয়। উপস্থিত ভাল আছেন।

জামাইবাবু শ্যালকের উদ্দেশে মুখ বিকৃত করিলেন।

সোমনাথ টেলিফোনে বলিল—আজ রাত্রে আমার বাড়িতে আপনাকে আসতে হবে—অসমাপ্ত ডিনার সম্পূর্ণ করার জন্যে। আসবেন কি?

চন্দনার কণ্ঠস্বর এতক্ষণ অপেক্ষাকৃত নিরুত্সক ছিল, এখন তাহা আগ্রহে ঝঙ্কার দিয়া উঠিল—আপনি কি আমাকে ডিনারের নেমন্তন্ন করছেন?

হ্যাঁ। আপনাকে আর মিঃ পিলেকে।

চন্দনা কিয়ৎকাল নীরব থাকিয়া বলিলেন—মিঃ পিলেকে তো আপনি দেখেছেন। সন্ধ্যের পর তিনি–

তবে আপনি একাই আসুন।

চন্দনার চক্ষু উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তিনি মনে করিলেন, সুযোগ হারাইয়া সোমনাথ পস্তাইতেছে—তাই–। তবু নিশ্চয় হওয়া ভাল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন—আর কাকে নেমন্তন্ন করলেন?

সোমনাথ বলিল—আর কেউ না। আসবেন তো?

চন্দনা গদ্গদ স্বরে বলিলেন-আসব।

ধন্যবাদ—অসংখ্য ধন্যবাদ, বলিয়া সোমনাথ চন্দনাকে নিজের ঠিকানা দিল।

সেদিন সন্ধ্যার সময় দিদি রত্নাকে সাজাইতে বসিলেন। জাফরান রঙের নূতন বেনারসী শাড়ি আজই দিদি কিনিয়া আনিয়াছেন, তাহাই পরাইয়া, চুলে অশোক ফুলের বেণী জড়াইয়া, সিঁথিতে সিঁদুর দিলেন; মুখখানি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিয়া কোমল হাসিলেন—সিঁদুর পরে কি মিষ্টি যে তোকে দেখাচ্ছে রত্না। কিন্তু তুই মন শক্ত করে রাখিসনি। মনে কর না একটা খেলা।

তাই মনে করবার চেষ্টাই তো করছি বৌদি, কিন্তু পারছি কই?

কেন পারবি না! মনটাকে একটু হাল্কা কর, নরম কর, তাহলেই পারবি।

তুমি তো জানো কি বিচ্ছিরি পাচালো আমার মন।

বালাই ষাট, তোর মন বিচ্ছিরি প্যাচালো হতে যাবে কেন? তোর গঙ্গাজলের মত মন। বলিয়া দিদি সস্নেহে তাহার গণ্ডে চুম্বন করিলেন। রত্নার চোখ একটু ছলছল করিল।

দিদি বলিলেন—কিন্তু মনে থাকে যেন, শুধু বৌ সাজলেই হবে না, বৌয়ের মত অভিনয় করা চাই। নইলে সব ভেস্তে যাবে।

কি করব বলে দাও।

কি আর করবি, লজ্জা লজ্জা ভাবে ওর সঙ্গে কথা কইবি, কাছে ঘেঁষে দাঁড়াবি—মোট কথা ও যে তোর জিনিস তা যেন বেশ বোঝা যায়। খুব শক্ত হবে না—দেখি তখন। দিদি মুখ টিপিয়া হাসিলেন।

ঠিক সাড়ে আটটার সময় চন্দনা দেবীর মোটর আসিয়া দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইল। সোমনাথ নিজে গিয়ে মোটরের দরজা খুলিয়া তাঁহাকে নামাইয়া লইল। আজ চন্দনার বেশভূষা সম্পূর্ণ অন্য রকমের—আগাগোড়া লালে লাল। যেন সর্বাঙ্গে অনুরাগের ফাগ মাখিয়া তিনি অভিসারে আসিয়াছেন।

ড্রয়িংরুমের দ্বারে পৌঁছিয়া তিনি থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন; ড্রয়িংরুমে লোক থাকিবে তিনি কল্পনা করেন নাই। আজ চন্দনা দেবী মনে অনেক আশা লইয়া আসিয়াছিলেন। নির্জন গৃহে দুইটি নরনারীতে নিভৃত নৈশ আহার-তারপর অজানা পরিবেশের মধ্যে নূতনের আস্বাদ—

সোমনাথ মৃদুকণ্ঠে পরিচয় করাইয়া দিল—ইনি আমার দিদি, ইনি জামাইবাবু, আর ইনি— সোমনাথ সলজ্জ হাস্যে ঘাড় হেঁট করিল।

পূর্ণ এক মিনিট পরে চন্দনা দেবী কথা কহিলেন; তাঁর মুখে একটি অম্লকষায় হাসি ফুটিয়া উঠিল। দুই করতল যুক্ত করিয়া সকলের অভিবাদন গ্রহণ করিয়া বলিলেন—আজ আমার আশ্চর্য হবার দিন। সোমনাথবাবু যে এমন ভাগ্যবান পুরুষ তা আমাকে জানাননি।

সোমনাথ বলিল—উপলক্ষ্য হয়নি তাই বলিনি–

জামাইবাবু বলিলেন-সোমনাথ ভারি চালাক ছোকরা; মেয়ে মহলে পাছে কদর কমে যায় তাই বিয়ের কথা কাউকে বলতে চায় না।

সকলে উপবিষ্ট হইলেন। চন্দনা বলিলেন—সোমনাথবাবু যদি এত স্বার্থপর না হতেন তাহলে আপনাদের সঙ্গে আলাপের সৌভাগ্য আমার আগেই হত।

ক্ষণকালের জন্য একটা কেলেঙ্কারীর আশঙ্কা সোমনাথের মনে উঁকিঝুঁকি মারিয়াছিল, কিন্তু এখন সে নিশ্চিন্ত হইল। চন্দনা দেবী প্রথম ধাক্কা সামলাইয়া লইয়াছেন, এখন আর সুনিপুণা অভিনেত্রীর অভিনয়ে কেহ খুঁত ধরিতে পারিবে না।

কিন্তু তবু দুই পক্ষের মনেই যেখানে গলদ আছে সেখানে আলাপের ধারা খুব স্বচ্ছন্দ হয় না; এইখানে জামাইবাবু অপূর্ব কৃতিত্ব দেখাইলেন। তিনি এক মুহূর্তের জন্য বাক্যালাপের গতি শ্লথ হইতে দিলেন না, গল্প রসিকতা ফষ্টিনষ্টি করিয়া আসর জমাইয়া রাখিলেন। জামাইবাবু যে এতটা মজলিসি লোক সে পরিচয় সোমনাথ পূর্বে পায় নাই।

সোমনাথ ও রত্না পাশাপাশি একটি কৌচে বসিয়াছিল, কোনও প্রকার বাড়াবাড়ি না করিয়া দুজনে নিজ নিজ নির্দিষ্ট ভূমিকা অভিনয় করিতেছিল। সোমনাথের যদি বা অভিনয়ের কিছু অভিজ্ঞতা ছিল, রত্নার কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না। তবু উভয়ের মধ্যে রত্নাই বোধহয় সহজ অভিনয় করিতেছিল। সোমনাথের একটু আড়ষ্টতা মাঝে মাঝে তাহাকে আত্ম-সচেতন করিয়া তুলিতেছিল।

জামাইবাবুর বাকচাতুরী শুনিতে শুনিতে চন্দনা তাঁহার অর্ধনিমীলিত নেত্র তাহাদের পানে ফিরাইতেছিলেন। তাঁহার মনের মধ্যে কোন্ চিন্তার ক্রিয়া চলিতেছে কেহই বুঝিতে পারিতেছিল না; কিন্তু ঐ মদভঙ্গুর দৃষ্টি রত্না ও সোমনাথকে উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিতেছিল। রত্না তখন যেন নিজের পত্নীত্ব ভাল করিয়া প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্যই সোমনাথের দিকে ঘেঁষিয়া বসিতেছিল।

জামাইবাবুর বাক্যস্রোতের বিরামস্থলে চন্দনা দেবী একবার বলিলেন—সোমনাথবাবু, আপনার স্ত্রীকে সিনেমায় নামান না কেন? আমার বিশ্বাস উনি অভিনয় করলে বেশ নাম করতে পারবেন।

সোমনাথ ইতস্তত করিয়া বলিল—অভিনয়ে ওঁর রুচি নেই।

চন্দনা তখন রত্নকে জিজ্ঞাসা করিলেন-সত্যিই আপনার অভিনয়ে রুচি নেই?

রত্না একটু মুখ টিপিয়া থাকিয়া বলিল–অভিনয় দেখতে বেশ লাগে কিন্তু অভিনয় করবার প্রতিভা আমার নেই।

চন্দনা একটু হাসিলেন।

যথাসময়ে সকলে ডিনার টেবিলে গিয়া বসিলেন। এখানেও গৃহস্থের পক্ষ হইতে গৃহস্বামীই আসর সরগরম করিয়া রাখিলেন। চন্দনা দেবীরও ভাব দেখিয়া মনে হইল তিনি এই নিমন্ত্রণ খুব উপভোগ করিতেছেন। জামাইবাবুর চটুলতায় তাঁহার কলহাস্য থাকিয়া থাকিয়া উছলিয়া উঠিতে লাগিল।

ডিনার শেষে ড্রয়িংরুমে ফিরিয়া আসিয়া চন্দনা আর বসিতে চাহিলেন না। রাত্রি দশটা বাজিয়া গিয়াছিল, তিনি মণিবন্ধের ঘড়ির দিকে কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন-আমি এবার যাব, অনেক দূরে যেতে হবে। আপনাদের আতিথ্যের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ, আপনাদের সংসর্গে এসে অনেক নতুন আলো দেখতে পেয়েছি তাঁহার মুখের হাসি ক্ৰমে চোখা অম্নরসে ভরিয়া উঠিল, তিনি সোমনাথের দিকে চাহিয়া বলিলেন—আপনাকে আর ধন্যবাদ দেব না, শুধু বন্ধুভাবে সাবধান করে দিই। যার ঘরে নবপরিণীতা বধু তার কিন্তু বাইরের দিকে মন যাওয়া উচিত নয়। আচ্ছা, গুড় নাইট।

এইভাবে পরিহাসচ্ছলে বিষোদগার করিয়া চন্দনা বিদায় লইলেন।

.

সকালে প্রাতরাশের টেবিলে নীরবে আহার সম্পন্ন হইতেছিল। জামাইবাবু খবরের কাগজে চোখ বুলাইতেছিলেন; সোমনাথ আহার শেষ করিয়া উঠি-উঠি করিতেছিল, আজ তাহাকে নটার মধ্যে স্টুডিও পৌঁছিতে হইবে কারণ আবার পুরা দমে কাজ আরম্ভ হইয়াছে। হঠাৎ রত্না বলিল—মেজদা, আমি কলকাতায় ফিরে যাব, ব্যবস্থা করে দাও।

জামাইবাবু ভ্রূ তুলিয়া তাহার পানে চাহিলেন; রত্না বলিল—এখানে আর আমার মন টিকছে না, পরীক্ষার ফল বেরুবার সময় হল—

জামাইবাবু শান্তস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন—কবে যেতে চাও?

রত্না বলিল—যদি টিকিট পাওয়া যায়—আজই।

জামাইবাবু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তারপর কফির পেয়ালা শেষ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন—বেশ, অফিসে গিয়ে টিকিটের চেষ্টা করব। যদি পাওয়া যায় ফোনে তোমাকে জানাব, তুমি তৈরি হয়ে থেকো। বলিয়া অফিসে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে গেলেন।

কাল চন্দনা চলিয়া যাইবার পর বাড়ির সকলের মনের উপর যে অনির্দিষ্ট অস্বচ্ছন্দতা নামিয়া আসিয়াছিল এখন যেন তাহা আরও পীড়াদায়ক হইয়া উঠিল। কী যেন সহজেই হইতে পারিত অথচ হইল না; সোমনাথ মনের মধ্যে একটা চাপা ক্লেশ অনুভব করিতে লাগিল, কিন্তু তাহা প্রকাশ করিবার উপায় নাই। সে নিঃশব্দে স্টুডিও চলিয়া গেল।

স্টুডিওতে সারাদিন কাজ চলিল। ভাগ্যক্রমে চন্দনা দেবীর আজ কাজ ছিল না, তাঁহার সহিত দেখা হইল না। বৈকালের দিকে মিঃ পিলে তাহাকে অফিসে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সোমনাথের বুকের ভিতরটা ছাৎ করিয়া উঠিল। গত কয়েকদিন যাবৎ সে পিলে সাহেব সম্বন্ধে একটা অহেতুক সঙ্কোচ অনুভব করিতেছিল; যদিও তাহার কোনও দোষ ছিল না তবু সে সহজভাবে পিলে সাহেবের সম্মুখীন হইতে পারিতেছিল না।

অফিসে উপস্থিত হইলে পিলে সাহেব কিন্তু তাহার সহিত কাজের কথাই বলিলেন। একটা দৃশ্যে সোমনাথের অভিনয় কিছু নিরেশ হইয়াছিল, সেই দৃশ্যটি রি-টেক করিতে হইবে। কিভাবে সোমনাথ দৃশ্যে অভিনয় করিবে পিলে সাহেব তাহা নূতন করিয়া তাহাকে বুঝাইয়া দিলেন।

অফিস ঘর হইতে বাহির হইবার সময় সোমনাথ দ্বারের নিকট একবার ফিরিয়া চাহিল। দেখিল পিলে সাহেব রক্তাক্ত তির্যক চক্ষু মেলিয়া তাহার পানে তাকাইয়া আছেন; দৃষ্টিতে যেন বিষ মেশানো। চোখাচোখি হইতেই তিনি চক্ষু ফিরাইয়া লইলেন।

সোমনাথের মন আবার উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। কেহ কি তাঁহাকে কিছু বলিয়াছে? কিন্তু কি বলিবে? বলিবার আছে কি?

বাড়ি ফিরিয়া সোমনাথ দেখিল, রত্নার সুটকেস ও হোল যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইয়া বিরাজ করিতেছে। টিকিট পাওয়া গিয়াছে সন্দেহ নাই।

রত্না বলিল–চল তোমাকে খেতে দিই। বৌদির মাথা ধরেছে, শুয়ে আছেন।

খাবার ঘরে রত্না সোমনাথকে চা জলখাবার দিল। খাইতে খাইতে সোমনাথ বলিল—রত্ন, ঐ ব্যাপারের জন্যেই কি তুমি হঠাৎ চলে যাচ্ছ?

রত্না চুপ করিয়া রহিল। সোমনাথ বলিল—তোমার যাবার দরকার ছিল না। আমিই এ বাড়িতে বাইরের লোক, যেতে হলে আমারই যাওয়া উচিত।

রত্না বলিল—সে কথা নয়, আমিই চলে যেতে চাই। তোমাকে উদ্ধার করা তো হয়ে গেছে এখন আমি গেলেই বা ক্ষতি কি? বলিয়া একটু হাসিল।

সোমনাথ বলিল—চন্দনা যাবার সময় যে কথা বলে গেল তা কি তুমি বিশ্বাস করেছ? না। ওটা শুধু প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা।

সোমনাথ রত্নার মুখের পানে চাহিয়া দেখিল কিছু বোঝা যায় না। রত্নার মুখ দেখিয়া কিছুই বোঝা যায় না কেন? সোমনাথ একটা ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল-আমার জন্যে তোমার বোম্বাই বেড়ানোটাই নষ্ট হয়ে গেল।

রত্না বলিল-ও কথা থাক। আবার কবে তোমার সঙ্গে দেখা হবে কে জানে। তুমি বোধ হয় দুএক বছরের মধ্যে কলকাতায় যেতে পারবে না। যখন যাবে তখন হয়তো আমি কলকাতায় থাকব না।

থাকবে না কেন?

রত্না এবার একটু জোর করিয়া হাসিল—শোনো কথা। মেয়ে কি চিরদিন বাপের বাড়ি থাকে? কোথায় চলে যাব তার ঠিক কি?

সোমনাথের মুখে আর কথা যোগাইল না। দিদি যে প্রস্তাব করিয়াছিলেন ইহা তাহারই জবাব। রত্না অস্পষ্ট কিছু রাখিয়া যাইতে চায় না, চলিয়া যাইবার আগে কাটা-ছেঁড়া জবাব দিয়া যাইতে চায়।

বাইরে মোটরের শব্দ শোনা গেল। জামাইবাবু আসিয়া রত্নাকে বলিলেন—তৈরি আছো? তাহলে আর দেরি নয়। ঠিক আটটায় ট্রেন।

.

রত্ন চলিয়া যাইবার পর ঠিক একমাস পরে সোমনাথের ছবি শেষ হইল। এই একমাসের মধ্যে চন্দনা দেবীর সহিত অনেকবার দেখা হইয়াছে, কিন্তু চন্দনা দেবীর ব্যবহারে কোনও বৈলক্ষণ্য দেখা যায় নাই। সোমনাথের উপর আর কোনও নূতন চেষ্টা হয় নাই, চন্দনা দেবী নিশ্চয়রূপে তাহার আশা ছাড়িয়াছেন। জামাইবাবু ভাল বুদ্ধি বাহির করিয়াছিলেন। সব চেয়ে সুখের বিষয় চন্দনা রাগ করিয়া থাকেন নাই। যাহার সহিত সর্বদা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করিতে হইবে তাহার সহিত প্রীতির বিচ্ছেদ ঘটিলে কাজ করিয়া সুখ থাকে না। বিশেষত এই একটি ছবিতে কাজ করিয়া সোমনাথ বুঝিয়াছিল অভিনয়ে তাহার সত্যকার যোগ্যতা আছে, এ কাজ সে ভালভাবেই করিতে পারিবে।

যাহোক, সোমনাথের প্রথম ছবি শেষ হইল।

ছবির শেষ শট লওয়া হইয়া গেলে পিলে সাহেবের সেক্রেটারি সোমনাথের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, গম্ভীর মুখে বলিল-মিঃ পিলে অফিসে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। তাঁর সঙ্গে দেখা করে চলে যাবেন না।

চন্দনা দেবী অদূরে দাঁড়াইয়া ছিলেন, তিনি মুখ টিপিয়া একটু হাসিলেন। সোমনাথ তাঁহার দিকে ফিরিতেই তিনি হঠাৎ পিছু ফিরিয়া নাগরজির সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে অন্যদিকে প্রস্থান করিলেন।

সোমনাথ কিছু বুঝিতে পারিল না। হঠাৎ স্টুডিওর আবহাওয়া বদলাইয়া গিয়াছে। সে তাড়াতাড়ি মুখের রঙ ধুইয়া পিলে সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে গেল।

পিলে সাহেব নিজের ঘরে বসিয়া আছেন; কিন্তু তাঁহার চেহারা দেখিয়া সোমনাথ চমকিয়া উঠিল; সর্বাঙ্গ দিয়া যেন ক্রোধের ফুলকি ঠিকরাইয়া পড়িতেছে। তিনি সোমনাথের পানে চাহিলেন, মনে হইল রক্তবর্ণ চক্ষু দিয়া আগুন ছুটিতেছে।

সোমনাথ টেবিলের কাছে গিয়া দাঁড়াইতেই তিনি তাহার সম্মুখে একখণ্ড কাগজ ফেলিয়া দিয়া বলিলেন—এই নাও তোমার ছাড়পত্র। তোমাকে আর আমার দরকার নেই।

সোমনাথ বুদ্ধিভ্রষ্টের মত চাহিয়া রহিল।

আমাকে আর দরকার নেই?

পিলে হুঙ্কার দিয়া উঠিলেন—না। তোমাকে আমি ভদ্রলোক মনে করেছিলাম কিন্তু দেখছি তুমি জঘন্য চরিত্রের লোক। অসভ্য—বর্বর–

দৃঢ়ভাবে নিজেকে সম্বরণ করিয়া সোমনাথ বলিল—আমার নামে আপনি কী শুনেছেন বলবেন কি?

তোমার যদি একতিল লজ্জা থাকত তাহলে এ কথা জিজ্ঞাসা করতে না। আমার স্ত্রীকে রাত্রে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে তাকে অপমান করবার চেষ্টা করেছিলে, প্রেম নিবেদন করতে গিয়েছিলে। দুশ্চরিত্র স্কাউড্রেল।

এ কথা কে আপনাকে বলেছে?

কে বলেছে? যাকে প্রেম নিবেদন করতে গিয়েছিলে সেই বলেছে। যাও—বেরোও এখনি আমার স্টুডিও থেকে

চন্দনা দেবী বলিয়াছেন। তাহার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করিয়া নিজের চরিত্র ঢাকা দিয়াছেন। ইহাই বুঝি তাঁহাদের রীতি। সোমনাথের ইচ্ছা হইল, চন্দনার সমস্ত ছলাকলার ইতিহাস ব্যক্ত করিয়া কে প্রকৃত অপরাধী তাহা পিলে সাহেবকে জানাইয়া দেয়; কিন্তু তাহাতে কী লাভ হইবে? পিলে সাহেব বিশ্বাস করিবেন না, শুধু এই কদর্য কলহ আরও পঙ্কিল হইয়া উঠিবে।

আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। নমস্কার।

পিলে সাহেব প্রতিনমস্কার করিলেন না, তর্জনী তুলিয়া দ্বারের দিকে নির্দেশ করিলেন।

ঘর হইতে বাহির হইবার সময় সোমনাথ দেখিল, পদার্টাকা দ্বারের পাশ হইতে একটা চওড়া শাড়ির পাড় চকিতে সরিয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *