১৬. অস্তরবির শেষ আশীর্বাদ

অস্তরবির শেষ আশীর্বাদ নিয়ে যে কয়েকটি মেয়ে এ যুগেও নিবু নিবু প্রদীপের সলতে উস্কে দিয়ে ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন বা এই সেদিন পর্যন্ত রেখেছিলেন তারা এসেছিলেন বধূরূপে। এঁদের নাম শ্ৰীমতী, অমিতা, অমিয়া, মেনকা ও পূর্ণিমা। এ প্রসঙ্গে আরেক জনের নাম করতে পারি তিনি নন্দিনী, রথীন্দ্র ও প্রতিমার পালিতা কন্যা। কবির আদরের পুপে দিদি সে গল্প এঁকে শোনানোর জন্যেই লেখা হয়েছিল। তিনিও বিভিন্ন নৃত্যগীতানুষ্ঠানে নিয়মিত যোগ দিতেন। এবার তাকানো যাক অন্যান্যদের মুখের দিকে।

ঠাকুরবাড়ির বৌ হবার অনেক আগেই শ্ৰীমতী রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে এসেছিলেন। আমেদাবাদের অভিজাত হাতিসিং পরিবারের মেয়ে শ্ৰীমতী মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে সেখানকার কলেজে পড়া ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। সেটা বোধহয় ১৯২১ সাল। উদ্দেশ্য ছিল ছবি আঁকা শেখা। শুরুও করেছিলেন কিন্তু তার প্রতিভা বিকাশের মাধ্যম হল চিত্র নয়, অন্য একটি শিল্প। শান্তিনিকেতনে তখন প্রতিমার তত্ত্বাবধানে ভাবনৃত্য শেখার ব্যবস্থা হচ্ছে, মণিপুর থেকে এসেছেন নৃত্যশিক্ষক নবকুমার তাদের দলেই ভিড়লেন শ্ৰীমতী। নৃত্যছন্দে নূপুরের ঝংকারে দেহভঙ্গিতে ফুটে উঠল নতুন রূপ। তবে নন্দিতা-যমুনা-নিবেদিতার মতো শ্ৰীমতীকে শান্তিনিকেতনের ছাত্রী বোধহয় বলা চলে না কারণ তার নৃত্য ছিল তার একান্ত নিজস্ব আবিষ্কার। তবু তাঁর শিক্ষা শুরু হয়েছিল শান্তিনিকেতনেই তাতে সন্দেহ নেই। প্রচলিত ধরাবাঁধা কোনো নাচের মধ্যেই শ্ৰীমতীর নৃত্যভাবনা সার্থক রূপ নিতে পারেনি। তাই তিনি নৃত্যকে নতুন রসে পুষ্ট করে সৃষ্টি করলেন নব্য আঙ্গিকের। সেই প্রথম পর্বে এটা কি করে সম্ভব হল কে জানে, তবে শ্ৰীমতীর নাচ আজও একটা ব্যতিক্রম বলেই মনে হবে।

শান্তিনিকেতনের শিক্ষা শেষ করে শ্রীমতী জার্মানীতে গিয়েছিলেন শিশুশিক্ষা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে। কিন্তু ওখানে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত পক্ষে যা শিখলেন তা হল নাচ। য়ুরোপে তিনি নানা জায়গায় ঘুরেছেন, নাচ দেখেছেন, দেখিয়েছেনও। বিদেশে তিনি দেখাতেন ভারতীয় নৃত্য—যার সবটাই তার নিজস্ব, মণিপুরী আঙ্গিকের ওপর গড়ে তোলা অভিনব নৃত্যভঙ্গিমা। শোনা যায়, এসময় তিনি য়ুরোপের মডার্ণ ডাসের আঙ্গিক আয় করেন মেরি উইম্যান প্রবর্তিত আধুনিক নাচের স্কুলে, জার্মানীতে। নাচের স্কুলে ধরাবাঁধা শিক্ষা তিনি খুব বেশি নেননি, তবে নাচ দেখেছেন প্রচুর। ভারতে ফিরে শ্ৰীমতী যখন তাঁর নতুন আঙ্গিকের ভাবনৃত্য রবীন্দ্রনাথকে দেখালেন তখন কবিও খুব আনন্দিত হলেন।

ভারতবর্ষে শ্ৰীমতী নৃত্য পরিবেশন করেন রবীন্দ্র-কবিতা আবৃত্তির সঙ্গে। সে এক নতুন জিনিষ। গানের সঙ্গেও নেচেছেন শ্ৰীমতী কিন্তু তেমন আনন্দ পাননি। ছন্দ-সুরের দোলায় মন যে আপনি নেচে ওঠে। শ্ৰীমতীর নৃত্যে যে অমিত বিত্ত রয়েছে তার চরম ঘূর্তি ঘটবে কিসে? প্রথমে ঝুলন কবিতা আবৃত্তির সঙ্গে নিজস্ব আঙ্গিকে নেচে শ্ৰীমতী সবাইকে মুগ্ধ করলেন। দেখা গেল, যে কবিতায় সুরের দোলা নেই, সেই কবিতাকে অবলম্বন করেই শ্ৰীমতীর ভাবনা রূপের মধ্যে আকার নিয়েছে। স্কুলনের পর শিশুতীর্থ আরো কঠিন। আরো দুরূহ! তা হোক। সহজের সাধনায় মন ভরে কই? শিশুতীর্থ কবিতা নাচের পক্ষে বড়ো শক্ত। কল্পনাটাই কষ্টকর। শ্ৰীমতী তাকেই বেছে নিলে উৎসাহিত হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথও। য়ুনিভারসিটি ইন্সটিটিউট হলে সব ব্যবস্থা। রবীন্দ্রনাথের আবৃত্তির সঙ্গে শ্ৰীমতী দেখালেন তার নিজস্ব আঙ্গিকে ঝুলন ও শিশুতীর্থের ভাবনৃত্য। এখনকার দিনেও এ পরিকল্পনা অসম্ভব রকমের আধুনিক কবিতার সঙ্গে ভাবনৃত্য পরিবেশনে শ্ৰীমতীর সঙ্গে আরো একজনের নাম অবশ্য আমরা করতে পারি। তিনি কবি অমিয় চক্রবর্তীর বিদেশিনী স্ত্রী হৈমন্তী। তিনি নেচেছিলেন কল্পনার দুঃসময় কবিতার সঙ্গে। কিন্তু এঁদের উত্তরসূরি হিসেবে আর কাউকে এখনও পাওয়া যায়নি। শ্ৰীমতীর নিপুণ নৃত্যভঙ্গি মুগ্ধ করেছিল কবিকে। মুগ্ধ হয়ে তিনি লিখলেন :

She takes delight in evolving new dance forms of her own in rythmic representation of ideas that offer scope to her spirit for revelling in its own everchangiug creations which according to me is the proper function of dance and a sure sigo of her geuius. It has often caused me great surprise to see how with perfect trutlı aid forcefuluess she has harmouised her movemeuts with my owu recitation of my poems–a most difficult task requiring not ouly a perfect Auency of techuique but sympathy which is creative in its adaptability. Her dance is never languid and suggestive of allurements that cheapen the art. She is alert and vigorous and the cadence of her limbs carries the expression of au inner meaning and never are ou exhibition of skill bound by some external canous of traditiou.

পরবর্তী জীবনে শ্ৰীমতী আরো রবীন্দ্র-কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন কম তবে নাচ দেখিয়েছেন অনেক জায়গায়, সুদূর মাদ্রাজে, সিংহলে। সর্বত্র পেয়েছিলেন অভাবিত সমাদর। নাচ দেখেওছেন—রুক্মিণী দেবীর নাচ শ্ৰীমতীর খুব ভাল লেগেছিল। তার নিজের বিশ্বচ্ছন্দ, লীলাবৈচিত্র কিংবা দি রোড টু ফ্রিডম্ ব্যালেও বেশ নতুন ধরনের। অভিসার কবিতা অবলম্বনে বাসবদত্তা নৃত্যানুষ্ঠানে নাম ভূমিকায় শ্রীমতীর অনবদ্য নৃত্য যারা দেখেছিলেন তারা ভুলতে পারেননি। তাঁর সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য নাচের অনুষ্ঠান হয় নিউ এম্পায়ারে ১৯৫০ সালে। সেখানে তিনি সৌম্যেন্দ্রনাথের আবৃত্তির সঙ্গে স্বপরিকল্পিত নাচ দেখিয়েছিলেন। এ কবিতাটি একটি অসাধারণ নির্বাচন কারণ ঝড়ের খেয়া কবিতার দূর হতে কী শুনিস মৃত্যুর গর্জন-কে নৃত্যভঙ্গিমায় ফুটিয়ে তোলা কষ্টসাধ্য। শিল্পকলার প্রতিটি শাখাই যেন শ্ৰীমতীর স্পর্শে শ্রীময়ী হয়ে উঠেছিল। তার মধুর কণ্ঠে গাওয়া ভজন শুনতে মহাত্মা গান্ধী খুব ভালবাসতেন। পরেও ভজন গানের কয়েকটা রেকর্ড করেছিলেন। শান্তিনিকেতনে শিখেছিলেন ছবি আঁকা। শেষ জীবনেও ছবি আঁকা, কারুশিল্প এসব নিয়েই থাকতেন। সব সময় চেষ্টা করতেন নিজের পারিপার্শ্বিককে কিভাবে সুন্দর করে ভোলা যায়। তাই মাঝে মাঝে লিখতেনও নাচ কিংবা ছবি সম্বন্ধে দু-চারটে প্রবন্ধ। গানের স্কুল, আর্ট স্কুল প্রভৃতির সঙ্গেও তার যোগ ছিল তবে আন্তরিক উৎসাহ ছিল নাচের বেলায়। কলকাতায় নিজের বাড়িতে একটা স্কুল খুলেও ছিলেন কিন্তু সত্যিকারের উৎসাহী ছাত্রের অভাবে হতাশ হয়েই তাকে বন্ধ করতে হল নৃত্যকলা। গতানুগতিকের পুনরাবৃত্তি তার কাছে ছিল অসহ্য।

শ্ৰীমতী ঠাকুরবাড়ির বৌ হয়েছিলেন ১৯৩৭ সালে। এই প্রথম ঠাকুরবাড়ির ছেলের সঙ্গে গুর্জর তনয়ার বিয়ে। রাজনৈতিক জীবনে সৌম্যেন্দ্র ছিলেন চরমপন্থী। কিন্তু শ্ৰীমতী যোগ দিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলনে, গিয়েছিলেন জেলে। তারপরের জীবনে শ্ৰীমতী সরে এসেছেন রাজনীতির জগৎ থেকে। সংগঠনের কাজে তার কৃতিত্ব কম ছিল না। চল্লিশের দশকে রচনা নামে নারী প্রতিষ্ঠান তারপর অভিযান, বৈতনিক, সবশেষে সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আট তার গঠনমূলক কাজের পরিচয় বহন করে। শিল্প জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ থাকলেও তার কোন সার্থক উত্তরাধিকারী নেই। বাংলা দেশে নৃত্য নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। এসেছেন উদয়শংকর ও অমলাশংকর। শান্তিনিকেতনেও হয়েছে রবীন্দ্র-নৃত্যধারার সযত্ন অনুশীলন তবু শ্ৰীমতীর প্রতিভা সার্থক হল না অন্যের মধ্যে। এখনও কবিতার সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন, ঝুলন, ঝড়ের খেয়া বা শিশুতীর্থের সঙ্গে ভাবনৃত্য পরিকল্পনা অসম্ভব রকমের আধুনিক।

 

অমিতার সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ বহুদিনের। তিনি একাধারে কবির নাতনী, নাতবৌ এবং মহিষী। অমিতা লাবণ্যলেখার মেয়ে। যাকে কবি নিজের মেয়েদের সঙ্গে পরম স্নেহে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। অকালবৈধব্যের অভিশাপ থেকে বাঁচাবার জন্যে পুনর্বিবাহ দিয়েছিলেন স্নেহাস্পদ অজিত চক্রবর্তীর সঙ্গে। অমিতা তারই মেয়ে, পরে তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রনাথের এক পৌত্র অজীনেন্দ্রনাথের। অভিনয় এবং গান শান্তিনিকেতনের অনুকূল পরিবেশে খুব সহজেই শিখতে পেরেছিলেন অমিতা। তবু শংকা ঘুচত না। একরকম জোর জার করেই রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথ তাকে স্টেজে নামাতেন। নন্দিতাকে লেখা কবির চিঠি পড়লে দেখা যায় তিনিও লিখছেন, বহু কষ্টে অমিতাকে সুদর্শনার পালায় নামাতে পেরেছি। শেষ পর্যন্ত টিকলে হয়।

অভিনয় অবশ্য ভালই করতেন অমিতা। নটীর পূজায় অমিত সাজতেন মালতী। আকন্দ ফুলের মালা জড়ানো বেণী চূড়ো করে বেঁধে, গলায় কুঁচ ফলের মালা, একটু উঁচু করে পরা শাড়ির আঁচলটি কোমরে জড়িয়ে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে আকুল স্বরে তিনি যখন বার ডাকে আমার ভাই গেল চলে। যার ডাকে আমার— বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়তেন তখন সমস্ত দর্শক যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত। অভিনয় শেখাতেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং।

তপতীর অভিনয় হয়েছিল আরো পরে। অমিত তখন জোড়াসাঁকোয় বৌ হয়ে এসেছেন। হঠাৎ ডাক এল। তপতীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য প্রথমে ইতস্ততঃ করেছিলেন। ও কি পারবে? এ. বেশ শক্ত মেয়ের কাজ। তবু দিনেন্দ্রনাথের প্রস্তাবে দ্বিধান্বিত মন নিয়ে ডেকে পাঠালেন অমিতাকে। অভিনয় দেখে অবশ্য খুব পছন্দ হয়ে গেল। এক নাগাড়ে মাস খানেক রিহার্সাল চলল। তারপর অভিনয়। রাজা বিক্রম রবীন্দ্রনাথ আর অমিতা তার মহিষী। সে অনবদ্য অভিনয় যারা দেখেছেন তারা ভোলেননি। একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী অবন ঠাকুর। তিনি নটীর পূজায় নন্দলাল বসুর মেয়ে গৌরীর অভিনয় দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন তেমন অভিভূত হয়েছিলেন তপতী দেখে। অমিতা তপতী সেজে অগ্নিতে প্রবেশ করেছে। সেও এক অদ্ভুত রূপ। প্রাণের ভিতরে গিয়ে নাড়া দেয়। সেই সঙ্গে স্বীকার করেছেন পরে যত অভিনয়ই হয়ে থাক অমন আর দেখলুম না।

এর একটা উল্টোদিকও ছিল অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে নতুন কিছু করতে বারবার বিরুদ্ধ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। রাজা ও রাণীর প্রথম অভিনয়ের সময় হয়েছিল, এবারও হল। এই যুগেও একজন সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করে লিখলেন, কবি রবীন্দ্রনাথ নিজে রাজার ভূমিকা গ্রহণ করিয়া ভ্রাতুস্পুত্রবধূকে রানী সাজাইয়া অভিনয় করিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথ যে দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন, অন্য সকলে তাহাই অনুসরণ করিতেছে মাত্র। কিংবা চুল দাড়িতে কলপ মাখিয়া কচি সাজিয়া তিনি কখনো কখনো কিশোরী কুমারীদের সঙ্গে নাট্যাভিনয় করেন। সুতরাং যুগ বদলালেও জ্ঞানদানন্দিনীকে যে পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল অমিতাকেও সেই পরিস্থিতিতে পড়তে হল। তবে। ঠাকুরবাড়ির কেউই এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাননি, অমিতাও না।

তপতী সাজবার পরে কবি অমিতাকে ডাকতেন মহিষী বলে। পাঠাতেন পত্রলিপি :

মহিষী
তোমার দুটি হাতের সেবা
জানি না মোরে পাঠালো কেবা
যখন হোলো বেলার অবসান–
দিবস যখন আলোক হারা
তখন এসে সন্ধ্যা তারা
দিয়েছে তারে পরশ সম্মান।

৩ বৈশাখ ১৩৪৬ বিক্রম।

অমির হাতের সেবা ছাড়াও আরো একটা দুর্লভ গুণ ছিল। তিনি লিখতে পারতেন। কিন্তু বড় সংকোচ। মা বকেন। কতজন এসে কবিকে লেখা দেখায়, ভুল শুধরে নিয়ে যায় আর অমিত পারবেন না? শেষে বাধ্য হয়েই ভীরু পায়ে গেলেন গুরুদেবের কাছে। কবি বললেন, তুই লিখিস, না? পড়ে খুশি হয়ে বললেন, এত সহজ তোর ভাষা যে আমি আর এতে হাত দিতে চাই নে।

উৎসাহ পেয়ে অমিতার খাতা ভরে ওঠে। ছাপা হয় অঞ্জলি আর জন্মদিন। আশ্চর্য সহজ সরল প্রাণের কবিতা :

যবে শুধায় সকলে মোরে, তুমি কি পেয়েছ
কই দেখালে না আজি?
মৌন নতমুখে থাকি, কি দিব উত্তর–
কি পেয়েছি আমি?…
অন্তহীন পাওয়া সে যে ঋতুতে ঋতুতে।
বর্ণে গানে বিচিত্রিতা মাঝে,
শূন্য পাত্র পূর্ণ করি রাখে যে সদাই
তাই মোর দুঃখ কিছুই নাই।

কবিতার মতো অমিতার গদ্য লেখার হাতও ভাল। মনেই হয় না যে প্রবন্ধ পড়ছি। প্রবন্ধ পড়তে পড়তে স্মৃতিকথা, ছবি আঁকা, গল্প বলা—একটার পর একটায় আপনি মন চলে যায়, পড়া শেষ হলে পর মনের কোণে মিশে থাকে মাধুরীর বেশ। দেখা যায়, অমিতা খুব সংক্ষেপে একটা চরিত্রকে চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। অথচ জীবনী-স্মৃতিকথা-প্রবন্ধ কোনটাই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। একবারও স্মৃতি এসে হাত চেপে ধরেনি প্রবন্ধের, তত্ত্ব এসে ঘুরিয়ে দেয়নি মাথা। অমিতার প্রবন্ধ থেকে রবীন্দ্রনাথের অভিনয় এবং অভিনয় সংক্রান্ত অনেক তথ্য পাওয়া যায়। যেমন, কবি কণ্ঠস্বরের ওপর জোর দিতেন। নজর রাখতেন। শেষের কথাগুলি অস্পষ্ট বা অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে না যায়। কবি প্রায়ই সংলাপ ভুলে যেতেন বলে সহ-অভিনেতাদের সব সময় কবির ডায়লগ মনে রাখতে হত, নয়ত তিনি নতুন কথা বানাতে শুরু করে দিতেন, আর তাল রাখতে হিমসিম খেতে হত অন্যদের। অমিতা এখনও বড় করে বিশেষ কিছু লেখেননি। ছোট ছোট প্রবন্ধেই অনেক কথা বলতে চেয়েছেন। রেকর্ডেও গেয়েছেন একটিমাত্র গান, সেও পঞ্চকন্যা নামক এল পি রেকর্ডে। গানটি হল তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে। অমিতার মেয়ে স্মিতাও অভিনয়ে পারদর্শিনী, অনেক অভিনয় করেছেন, এখনও করছেন। অমিয়ার স্মৃতিকথা কী ধ্বনি বাজে পড়ে জানা যা ছোট বেলা থেকেই স্মিতা গানের দলে যোগ দিয়েছিলেন।

 

পূর্ণিমার সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির যোগ অন্যান্য বৌয়েদের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি দ্বিপেন্দ্রনাথের দৌহিত্রী আবার সুরেন্দ্রনাথের পুত্রবধূ। মনে হতে পারে, কেমন করে সম্ভব হল। সাধারণত এত নিকট সম্বন্ধের মধ্যে বৈবাহিক সম্বন্ধ নিষিদ্ধ না হলেও প্রায়ই হয় না; কিন্তু ঠাকুরবাড়ি নিজেদের মধ্যেই একটা সমাজ গড়ে নিয়েছিল। না হলে পিরালী ও ব্রাহ্ম এই দুই বাধা অতিক্রম করতে অনেক সমষেই খুব কষ্ট হয়েছে। দ্বিপেরে মেয়ে নলিনীর বিয়ে হয়েছিল বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারে। অর্থাৎ নলিনী তার দুই পিসী প্রতিভা ও ইন্দিরার ছোট জা হয়েছিলেন। তার তিন মেয়ে সুরমা, অপর্ণা ও পূর্ণিমা। অপর্ণার কথা আগেই বলেছি। তার বিয়ে হয়েছিল গগন ঠাকুরের ছেলের সঙ্গে। পূর্ণিমার বিয়ে হয়েছিল সুবীরেন্দ্রের সঙ্গে। ডায়াসেশন থেকে বি এ পাশ করে পূর্ণিমাও যোগ। দিয়েছেন পারিবারিক গান ও অভিনয়ের আসরে। তবে খুব বেশি নয়। তার মেয়ে সুপূর্ণ। রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসরে সুপরিচিতা, নাতনী শ্রীনন্দার নামও ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্ণিমা ছোটখাট আসরেই যোগ দিতেন বেশি। লক্ষ্মীর পরীক্ষায় লক্ষ্মী, বাল্মীকি-প্রতিভায় বালিকা, মায়ার খেলায় অমর, চিরকুমার সভায় পুরবালা এই সব চরিত্রে অভিনয় করতেন। পূর্ণিমা গ্র্যাজুয়েট হবার পর রবীন্দ্রনাথ বললেন নলিনীকে, তোর মেয়েকে নিয়ে যাব। আমার স্কুলে ইংরেজী পড়াবে। স্কুলে পড়ানো ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েদের রক্তে আছে। তাই খুব সহজেই পূর্ণিমা শান্তিনিকেতনে এসে একটানা দেড় বছর ইংরেজী পড়ালেন। এসময় তার সঙ্গে আলাপ হল লীলা মজুমদারের। আজও তাঁদের মধ্যে নিবিড় সখ্য অটুট রয়েছে।

সুবীরেন্দ্রের সঙ্গে বিয়ে হয় গৌড় বিল অনুসারে, রেজিষ্ট্রি করে। সেজন্য পুরোহিত পাওয়া গেল না। পৌরোহিত্য করেন ঠাকুরবাড়িরই দুজন মহিলা সরলা ও হেমলতা। ঘটনাটি ইন্দিরা তার অপ্রকাশিত আত্মজীবনী শ্রুতি ও স্মৃতিতে উল্লেখ করেন। এর পরেও পূর্ণিমা শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘদিন। ঘরের কাজ ছাড়াও ছিল আলপিনী সমিতি ও নারী-কল্যাণ সমিতি। সব কাজেই তিনি সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেতেন তার। নমা অর্থাৎ ইন্দিরার কাছ থেকে। জন্ম থেকেই দেখছেন সেই মহিয়সী নারীকে। তাই ইন্দিরার মৃত্যুর পরে পূর্ণিমা নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন একটা গুরুতর কাজ। কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে তিনি শুরু করলেন ইন্দিরার প্রামাণ্য জীবনচরিত লিখতে। ইন্দিরা-সংক্রান্ত সমস্ত উপাদান ও স্মৃতিকথা জড় করা হল। সত্যি কথা বলতে কি, যে কাজে অনেকদিন আগেই হাত দেওয়া উচিত ছিল অথচ আজও মনোযোগ দেওয়া হয়নি ঠিক সেই কাজটাই ধরেছেন পূর্ণিমা। বান্ধবী লীলা মজুমদার উৎসাহ ও প্রেরণা জোগালেন। আপাতত লেখা শেষ, শুধু প্রেসে দেওয়া বাকি। তার লেখাটি মন দিয়ে পড়লে লক্ষ্য করা যাবে, অতি প্রিয়জনের জীবনী লিখতে বসেও পূর্ণিমা নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন অনেক দূরে। তিনি ইন্দিরার খুব কাছের মানুষ, স্বাভাবিক কারণেই বইয়ের মধ্যে একটি চরিত্র হয়ে উঠেছেন। কিন্তু কোথাও বিনা কারণে তাকে পাওয়া যাবে না। এই সংযম আছে তার লেখার মধ্যেও। ইন্দিরার জীবনী লিখছেন তিনি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ও চৌধুরীবাড়ির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে তিনি ইন্দিরার জীবনকথা আলোচনা করেছেন এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে যারা ইন্দিরাকে দেখেছেন তাঁদের রচনাংশও উদ্ধৃত করা হয়েছে। এর ফলে ইন্দিরার জীবনী যতটা প্রামাণ্য গবেষণাধর্মী হয়ে উঠেছে ততখানি সরস হয়ত হয়নি কিন্তু ঘরোয়া ইন্দিরাকে যেন এখানেই সবচেয়ে বেশি আপন করে পাওয়া গেল। পূর্ণিমার লেখার ভাষাটিও সাবলীল। অনাবশ্যক গল্প করে বইকে লঘু ও সরস করে তোলার প্রলোভন যেমন জয় করেছেন তেমনি মানবী ইন্দিরাকে জীবন্ত করে তুলেছেন। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বিশ্বভারতীর উপাচার্য। হিসেবে ইনিরাকে অনেক কাজ করতে হত। একবার এক অধ্যাপক, বিশ্বভারতীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। পুলিশ-এনকোয়ারী ইত্যাদি হলে তিনি খুব সরস করে অন্তরঙ্গদের বলতেন, দেখ, জীবনে নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছে দীর্ঘায়ু হবার দরুন—কিন্তু এ এক অভিনব পরিস্থিতি। শেষ বয়সে জেলে গিয়ে না লপসী খেতে হয়। পূর্ণিমার বই প্রকাশিত হলে ইন্দিরার সম্বন্ধে অনেক নতুন কথা জানা যাবে। পূর্ণিমার প্রসঙ্গে আরো তিনজনের কথা এখানে বলে নিতে পারি। সুরেন্দ্রের অপর তিন পুত্র প্রবীরেন্দ্র, মিহিরেন্দ্র ও সুণতেন্দ্র। প্রবীরেন্দ্রের স্ত্রী অণিমা, মিহিরেন্দ্রের স্ত্রী লীলা ও সুণতেন্দ্রের স্ত্রী সতীরাণী। এঁদের মধ্যে সতীরাণী সুগায়িকা হিসেবে যথেষ্ট পরিচিত।

 

হেমেন্দ্ৰপরিবারে এসেছেন ভিন্ন পরিবারের আরো পাঁচটি মেয়ে। অমিয়া, মেনকা, আরতি, পারুল ও স্মৃতি। শেষের তিনজনের কথাই আগে বলি। কারণ এঁরা ঠাকুরবাড়ির বৌ হলেও আমাদের নির্দিষ্ট কালসীমার একেবারে শেষ পর্বে তারা এসেছেন। শুভো ঠাকুরের স্ত্রী আরতি মুলেখিকা। লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়ার কয়েকটি বইয়ের অনুবাদ ছাড়াও আরতি লিখেছেন দু-তিনটি উপন্যাস অসমিয়া ও বাংলা উভয় ভাষায়। ছায়ারঙ্গ স্বচ্ছন্দ গতিতে লেখা অধুনিক উপন্যাস। তার অনূদিত বেজবড়ুয়ার আমার জীবন স্মৃতি ও লক্ষ্মীনন্দন বরার গাঙচিলের ডানা অত্যন্ত সুখপাঠ্য সরল অনুবাদ। সিদ্ধীন্দ্রনাথের স্ত্রী পারুল প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। তার মা প্রেমিকা দেবীও পাথুরেঘাটার ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। পারুল নিজেও প্রথম যুগের কয়েকটা ছবিতে অভিনয় করেন। তাঁকে আমরা কেশবচন্দ্র সেনের নাতনী সাধনা বস্তুর সমসাময়িক বলতে পারি। বাসবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী স্মৃতি জানেন ভাল ছবি আঁকতে। এঁরা তিনজনেই ঋতেন্দ্রনাথের তিন পুত্রবধূ। এরপর আমরা গান-পাগল ঠাকুরবাড়ির দুটি সুযোগ্যা বন্ধুর কথায় আসি। অমিয়া ও মেনকা দুজনেই সুগায়িকা, অসাধারণ সুকণ্ঠের অধিকারিণী।

হিতেন্দ্রনাথের পুত্রবধূ অমিয়া ঠাকুর বাড়িতে বৌ হয়ে আসার আগেই সুগায়িকারূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। অমিয়ার বাবা সুরেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন সঙ্গীতরসিক। তাই খুব ছোটবেলা থেকেই মুসলমান ওস্তাদের কাছে গান শিখতেন অমিয়া। উদ্ গজল, হিন্দুস্থানী গান—প্রথম প্রথম ভাল লাগত না কিন্তু গলা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আজও শুনলে প্রাণে বাজে। একবার শুনলে মনে হয় আবার শুনি। অমিয়াকে ঠাকুরবাড়িতে এনেছিলেন হেমেন্দ্রনাথের মেয়ে মনীষা। সরলা তখন মায়ার খেলার অভিনয়ের জন্যে মেয়ে খুঁজছেন। ভারী পছন্দ হয়ে গেল অমিয়াকে। প্রমদার ভূমিকায় সুন্দর মানাবে। যেমন রূপ তেমনি গলা। খুব ছোট থেকেই অভিনয় করছেন অমিয়া। বাল্মীকিপ্রতিভায় কখনও বালিকা সাজছেন কখনও সরস্বতী। বেথুনে পড়তেন অমিয়া। সেখানে স্কুল-কলেজের মেয়েরা মাঝে মাঝে নাট্যাভিনয় করত। সবেতেই অংশ নিতেন তিনিচন্দ্রগুপ্তে হেলেন, নূরজাহানে নূরজাহান। বাংলা দেশে তখন দ্বিজেন্দ্রলালের যুগ চলছে। সরলা দুদিনে অমিয়াকে প্রমদার সব গান শিখিয়ে নিয়ে গেলেন কবির কাছে। দুরুদুরু বুকে কবির কাছে এসে দাঁড়ালেন অমিয়া। তবে তিনি নিজেকে যতটা অপরিচিত ভাবছিলেন, তা নয়। কবি তার নাম আগেই –শুনেছিলেন স্নেহলতা সেনের কাছে। ১৩২৯ সালে প্রশান্ত মহলানবীশকে লেখা চিঠিতেও দেখা যাবে তিনি লিখছেন, বেথুন কলেজে অমিয়া রায় বলে একটি মেয়ে আছে; তার গলা ঝুনুর চেয়েও ভাল। সুতরাং কোন অসুবিধে হল না। সরলা কবিকে বললেন, অমিয়াকে প্রমদার গানগুলো সব শিখিয়ে দিয়েছি, তুমি গানগুলোর সঙ্গে অ্যাকশন দেখিয়ে দাও। রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হয়ে বললেন, সে কী? এর মধ্যেই সব গান তোলা হয়ে গেল! সরলা খুব জোরের সঙ্গেই বললেন, হ্যাঁ, ওর সব গানই ভোলা হয়ে গেছে! তুমি অ্যাকশন দেখিয়ে দাও। কবি তখন খুব ব্যস্ত তবু অনিন্দ্যসুন্দর ভঙ্গিতে নেচে নেচে অমিয়াকে শিখিয়ে দিলেন দে লো সখি দে, বলে রেখে দে, কে ডাকে আমি কভু ফিরে নাহি চাই, ওকে বলো সখি বলো, দূরে দাঁড়ায়ে আছে, আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, আর কেন আর কেন গান। এবার অবাক হবার পালা অমিয়ার। কী সুন্দর কোমল রমণীয় ভঙ্গি! দীর্ঘদিন রিহার্সাল চলার পর রক্সি সিনেমা হলে যে সেই মায়ার খেলার অভিনয় দেখেছে সেই শুধু বলতে পারে কি সুন্দর অভিনয় হয়েছিল। শান্তা সেজেছিলেন রুমা গুহের মা সতী দেবী। অমর সেজেছিলেন শান্তি দত্ত। কুমার বোধহয় সুধীন্দ্রনাথের মেয়ে রমা। মায়াকুমারীদের দলে ছিলেন রেবা রায়, জয় দাশ, মায়া রায়, সুমনা সেন, গৌরী দাশ। প্রধান মায়াকুমারী সেজেছিলেন রেবা রায়। সবাইকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন কবির পুত্রবধূ প্রতিমা; শাড়ি পরিয়ে দিলেন পারুল ঠাকুর আর সুজাত। সবার অভিনয় ছাপিয়ে চোখে পড়েছিল প্রমদাকে। মায়ার খেলার প্রথম প্রমদা—ইন্দিরা তো ভারি খুশি, এমনটি বুঝি আর দেখা যায় না।

এরপর বৌ হয়ে ঠাকুরবাড়িতে এলেন অমিয়া। নিভৃতে সবার চোখের আড়ালে চলে সঙ্গীত সাধনা। আগে শিখেছিলেন গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও যোগীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। এবার শিখলেন দিনেন্দ্রনাথ ও ইন্দিরার কাছে। কবি যখন শান্তিনিকেতন থেকে আসতেন ডেকে পাঠাতেন অমিয়াকে! গান শুনতেন, শেখাতেন—এভাবেই অনেক কিছু শেখা হয়ে গেল। কবির সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রথম প্রকাশ্যে গান করলেন অমিয়া। এ ব্যাপারে তার স্বামী বিশেষ আগ্রহ দেখাননি বলে অমিয়া আড়ালে থাকতেই ভালবাসতেন। অবশ্য গান শেখায় তিনি বাধা দেননি বরং উৎসাহই দিয়েছেন। য়ুনিভারসিটি ইন্সটিটিউট হলে অমিয়া প্রথমদিন গাইলেন মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে। শিখেছিলেন কবির কাছেই। আরো শিখেছিলেন কী রাগিনী বাজালে, বড় বিস্ময় লাগে, ওগো কাঙাল আমারে কাঙাল করেছ, আকুল কেশে আসে প্রভৃতি। অনুষ্ঠানে সঙ্গে এস্রাজ বাজালেন দিনেন্দ্রনাথ। সবাই। চিত্রার্পিত। এমন মধুর সাবলীল কণ্ঠ! যেন পাখির মতে! সুধীন্দ্রনাথের মেজ মেয়ে এ কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, সেকালে তিনি অন্যদের মুখে শুনেছিলেন অমিয়ার গলা নাকি অভিজ্ঞার কণ্ঠের মতো সুন্দর কিন্তু তিনি নিজে তো আর অভিজ্ঞার গান শোনেননি তাই তুলনা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথেয় খুব ভাল লেগেছিল অমিয়ার গান; তাই পরদিন আবার শুনতে চাইলেন। দ্বিতীয় দিন অমিয় গাইলেন ওগো কাঙ্গাল আমারে কাঙ্গাল করেছ।

এরপর যখনই কোথাও গিয়েছেন তখনই লোকে অমিয়ার কণ্ঠে শুনতে চেয়েছেন মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী উৎসব পরিষৎ-এর তরফ থেকে যখন শাপমোচন আর নটীর পূজা অভিনয়ের আয়োজন হয়েছিল তখন অমিয়াকে শচীর ভূমিকায় অভিনয় অভ্যাস করলেন দিনেন্দ্রনাথ। কবি স্বয়ং বললেন, অমিয়া সখি এ আঁধারে একেলা। ঘরে গাইবে। সম্প্রতি প্রকাশিত অমিয়ার স্মৃতিকথা কী ধ্বনি বাজে পড়লে। আরো অনেক কথা জানা যায়। তিনি বলেছেন, শেষ বয়স পর্যন্ত রবিদাদার সমান আগ্রহ ছিল হিন্দী গান শেখার। বলে বোলে যাওরে ভৈরবী সুরের গান শুনতে খুব ভালবাসতেন অথচ সেই গানটা ভেঙে কবি বাংলা গান লিখেছেন বলে জানি না। ভাঙা গান তৈরি করায় তার গুণপনার কথা আজ কারও অজানা নয়। কিন্তু আমার গলায় শুনে একটি হিন্দী গান ভেঙে বাংলা গান তৈরি আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি। রবীন্দ্রনাথ অমিয়ার কণ্ঠে পূরবীতে এ ধনি ধ্বনি চরণ পরসত খেয়াল গানটা শুনে কিছুক্ষণের মধ্যে একটা বাংলা গান তৈরি করে ফেললেন, সেই অসাধারণ গানটি হল কী ধ্বনি বাজে গহন চেতনা মাঝে। তাই অমিয়ার স্মৃতিকথার নামও কী ধ্বনি বাজে। একটা রেকর্ডও করেছিলেন অমিয়া। শৈলজারঞ্জন মজুমদার খুব যত্নে শিখিয়েছিলেন হে নূতন দেখা দিক ও সমুখে শান্তি পারাবার। কিন্তু স্বামীর অকালমৃত্যু হবার পর ছেলেমেয়েদের মানুষ করা, উড়িষ্যায় নিজেদের জমিদারী দেখাশোনা করার কাজেই ব্যস্ত ছিলেন অমিয়া। তারই মাঝে মাঝে গান শিখতে বা বুঝে নিতে এসেছে কেউ কেউ—শিখিয়ে দিয়েছেন তাদের। গানের ক্লাস নিয়ে নয়, গান শুনিয়ে। স্বরলিপি দেখে নয়, অমিয়া গান শিখতেন শুনে। কটকেও বোধহয় বর্ষামঙ্গল বা এইরকম আরো কয়েকটা অনুষ্ঠানে তিনি মেয়েদের গান শিখিয়েছিলেন।

ইদানীং আবার সকলের অনুরোধে গান গাইছেন অমিয়া। গান গাইতে তার ভালই লাগে। এণর মেয়ে কৃষ্ণা থাকেন প্যারিসে। সেবার এসে অমিয়ার কয়েকটা গান নিয়ে গেলেন টেপ করে। বললেন, নিয়ে যাব। ওখানে শোনাব। খালি গলায় গাওয়া, তার বয়স হয়েছে। কি জানি ওদের কেমন লাগবে। সংকোচ যায় না যেন। কৃষ্ণা শুনলেন না। তারপর ফ্রান্স থেকে এলো প্রশংসামুখর চিঠি। ভাষা বোঝে না। তবু অমিয়ার গানের দরদ নাড়া দিল বিদেশীর মনকে। এরপর এলেন সত্যজিৎ রায়। তার কাঞ্চনজঙ্ঘ ছবির জন্যে একটা গান গাইতে হবে। একেবারে খালি গলায়। কারণ ছবিতে ম্যালের এক নির্জন বেঞ্চে বসে গানটিতে ঠোঁট মেলাবেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার রেকর্ডিং করতে হবে? একেবারে ভাল লাগে না অমিয়ার। একবার বলে এটা হয়নি, আবার বলে ওটা হয়নি। ওসব ঝামেলা তার ভাল লাগে না। তাঁর মাসতুতো বোনেরা তো এককালের নামী-দামী অভিনেত্রী লীলা দেশাই ও মণিকা দেশই। তাঁরা বলতেন, তুমি যদি ফিল্মে গান কর অনেক নাম হবে। অনেক টাকা হবে। তাতেই অমিয়া কান দেননি। আর এখন! তবু সবার অনুরোধে গাইতে হল। কাঞ্চনজঙ্ঘার এ পরবাসে রবে কে গান রেকর্ডিং হবার পর দেখা গেল ভালই হয়েছে।

এই সেদিনও, ১৯৭৬ সালে গানের জন্যে তিনি মেডেল পেয়েছেন, কালিদাস নাগ মেমোরিয়াল কমিটি থেকে। এর আগে অবশ্য মেডেল পেয়েছেন অনেকবার সঙ্গীত সংঘ থেকে। বেথুন স্কুল ও কলেজ মিলিয়ে একটা প্রতিযোগিতায় ধ্রুপদ গেয়ে অমিয় পেয়েছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায় গোল্ড মেডেল। মাঝে মাঝে বেশ ভাল অনুষ্ঠানে তার গান শোনা যায়। সম্প্রতি নতুন এল. পি. রেকর্ডে বেরিয়েছে পঞ্চকন্যার গান, তাতে অমিয়া গেয়েছেন দুটি গান বড় বিস্ময় লাগে ও তবু মনে রেখো। এখনো অমিয়ার গান যারা একবার শোনে তারা আবার শুনতে চায়। অমিয়া এসব বিশ্বাস করতে চান না। তাঁর মতে, আজ যারা তার গান শুনতে চায় তারা শুনতে চায় সেযুগের গায়কী বৈশিষ্ট্য, কবির নিজের শেখানো গান। নয়ত এখন কি আর আমার গানে সেই মায়ার খেলার মাকে খুঁজে পাওয়া যায়? অমিয়ার সঙ্গে হয়ত কেউ-ই একমত হবেন না। এখনো তার গলায় মধু ঝরে, সাতটি সুরের পোষা পাখি তান-লয়মীড়ের সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখায়। একজন সাক্ষী উপস্থিত করি। এই সেদিন দেবব্রত বিশ্বাস তার ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত-এ লিখেছিলেন, অমিয়া ঠাকুর বোধহয় তার ৭০ বৎসর পার করে ফেলেছেন। তিনি এখনও গান করেন। এখনও তার গলায় যা স্বাভাবিক কাজ বেরোয় তা স্বরলিপি করা তো দূরের কথা, বর্তমান কালের অথরিটিরা কেউ তা নিজের গলায় গেয়ে দেখাতে পারবেন না। মেনকা অবন ঠাকুরের নাতনী, উমারাণীর একমাত্র মেয়ে। তার বাবা নির্মলচন্দ্রও ছিলেন সঙ্গীতরসিক। ফলে মেয়ে ছোটবেলা থেকেই গানের তামিল নিতে শুরু করেন। এখনকার দিনে এমন উদাত্ত কণ্ঠ বড় বেশি পাওয়া যায় না। গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও ওস্তাদ বচ্চন মিশ্রের কাছে গান শেখার পরে বেনারসে একদিন মেনকার গান শোনেন দিনেন্দ্রনাথ। শুনে মুগ্ধ হয়ে মেনকার বাবাকে বলেন, ওকে আমার কাছে দাও—দেখবে এ রত্নকে পালিশ করে কেমন ঝকঝকে করে তুলি। তুলেছিলেন। শেখাবার মতো গলা পেয়ে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন নিজের সমস্ত ঐশ্বর্য। মেনকাও শিখেছিলেন প্রাণভরে। গলা তৈরি হবার পর রেকর্ড বেরোল এসো এসো আমার ঘরে আর শেষ বেলাকার শেষের গানে। দিনেন্দ্রনাথ সঙ্গে বাজালেন এস্রাজ। আর একটা রেকর্ডও হল তোমার বীণা আমার মনোমাঝে ও তোমার সুরের ধারা কিন্তু আর নয়। কারণ এ সময়ে মেনকার বিয়ে হয়ে গেল ক্ষিতীন্দ্রনাথের একমাত্র পুত্ৰ ক্ষেমেন্দ্রের সঙ্গে। ১১ই মাঘের উৎসবে মেনকার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন ক্ষেমেন্দ্র। তাই গান শেখা বন্ধ হল না। অতি সম্প্রতি পঞ্চকন্যার গানে মেনকা আবার গেয়েছেন সেই পুরনো গানটি এসো, এসো আমার ঘরে।

রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তিনিকেতনে। তার কাছে গান শিখতে না পাওয়ার দুঃখ ঘুচিয়েছিলেন দিনেন্দ্রনাথ। তাই তো দিনেরে অভাবটা বড় বেশি বাজে মেনকার মনে। তাঁর নাম যেন লোকে ভুলেই গেছে। অথচ কবির সকল গানের ভাণ্ডারী ছিলেন তিনি, কাণ্ডারীও। তাকে নিয়ে কেন কিছু হয় না? নিজের গানের স্কুলের নাম দিনেন্দ্র শিক্ষায়তন দিয়ে তিনিই সেই ক্ষোভ। খানিকটা মেটাতে চেয়েছেন। মেনকার গানের স্কুল করাও বেশ মজার ঘটনা। জোড়াসাঁকোয় তারা যেদিকটায় থাকতেন সেখানেই ঠাকুরবাড়ির শেষ সীমানা। ওপাশের বাড়ির একটি মেয়ে সকাল-সন্ধ্যে বেসুরো গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধে। বিরক্ত হয়ে উঠলেন ক্ষেমেন্দ্র। দিনের পর দিন এ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে স্ত্রীকে অনুরোধ করলেন মেয়েটিকে গান শেখাতে। অর্থাৎ নিজেদের কানের দুঃখমোচনের জন্যেই মেনকাকে গানের ক্লাস খুলতে হল।

তারপর দিনে দিনে বড় হয়েছে তার প্রতিষ্ঠান। তিনিও যুক্ত হয়েছেন বৈতনিক ও পারাণি গানের স্কুলের সঙ্গে। ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দেখে রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য গীতিকারের গান শেখাতে শুরু করলেন। সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ, সৌম্যেন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারী, ইন্দিরা, প্রতিভা আরো অনেকেই তো গান লিখেছেন। চর্চা না রাখলে হারিয়ে যাবে যে। জীবনে অনেক সম্মান পেয়েছেন মেনকা। এখন শুধু চান ঠাকুরবাড়ির গানকে অন্যদের গলায় তুলে দিতে। একালে অবশ্য আরো কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ঠাকুরবাড়ির গান প্রচারে উৎসাহী।

কিছু-না-কিছু না করেও মেনক। কিন্তু আরেকটা কাজ করেছেন। সেটা হল উড়িষ্যায় তাঁর টেগোর ভবনে বহু ছাত্রছাত্রীকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাবার চেষ্টা। কটক-ভুবনেশ্বরে ঠাকুরবাড়ির সম্পত্তি আছে। সেখানে কিছুদিন থাকার সময় তার আগ্রহে ও উৎসাহে বেশ কিছু ওড়িয়া ও প্রবাসী বাঙ্গালী ছেলেমেয়ে এসেছিল গান শিখতে। দশ বছরে প্রায় চল্লিশ জনকে গান শিখিয়েছিলেন মেনকা। তারপর তারা আবার কত শিখিয়েছে কে জানে। এখনও দেখা যাবে ওড়িয়াদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার আগ্রহ খুব বেশি। অন্য কোন প্রদেশবাসী রবীন্দ্রনাথের গান

অত উৎসাহ নিয়ে কমই শেখে। মেনকা কলকাতাতেও অনেককে শিখিয়েছেন দিনেন্দ্রনাথের গান। এখনও গান করেন, তবে খুব ছোটাছুটি করতে আর ভাল লাগে না বরং ভাল লাগে গানের মধ্যে হারিয়ে যেতে।

 

অন্দরমহলের গল্প শেষ। আর ঠাকুরবাড়ির কথা? তার শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে। পতন-অভ্যুদয়ের বন্ধুর পথ পেরিয়ে এই বিশাল পরিবারের উত্তরাধিকারীরা এসে পৌছেছেন বর্তমান যুগে। কিন্তু এখন রবীন্দ্র ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার তো ঠাকুর পরিবারে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। তার হাতে গড়া শান্তিনিকেতনে, শিষ্য-প্রশিষ্য অনুরাগীদের মধ্যে। সেই পরিবারও বড় হতে হতে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ঠাকুরবাড়িতে গড়ে উঠেছে রবীন্দ্র ভারতী—পুরনো ঘর বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে নতুন বাড়ি। তবু এক একটা বিশেষ বাড়ি কৌটোর মতো জীবনের একটা নির্দিষ্ট সময়কে চার দেওয়ালের মধ্যে ধরে রাখে। এই পুরনো দেওয়ালগুলো কত ঘটনার নীরব সাক্ষী। কত সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জল্পনা-কল্পনা, উত্তেজনা-শিহরণ ঘরের কোণে কোণে জমে উঠেছিল তার হিসেব কে রাখে? আজ তো সে শুধু স্বপ্ন। যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে থাকে শুধু ইতিহাস। সে ইতিহাস তো আছেই, চিরকাল তার টানাপোড়েনে বোনা হয়ে থাকবে ঠাকুরবাড়ি থেকে কি পেয়েছি আর কি পাইনি তার হিসেবের নকশা। অবন ঠাকুর বলতেন, মানুষ হিসেব চায় না, চায় গল্প। স্মৃতির ছায়াবীথি বেয়ে আমরা সেই গল্পের জগতেই ফিরে যেতে চেয়েছি যেখানে নানা রঙের সুতোয় বোনা বালুচরী শাড়ির আঁচলার মতোই ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের জীবনের সঙ্গে বোনা হয়ে গেছে বাংলার নারী জাগরণের আলোছায়ার নকশা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *