০৩. জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে

জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে সব কাজেই জড়িয়ে মিশিয়ে আছেন স্বর্ণকুমারী, ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক। মেয়েরা কেউ কেউ সবে যখন কিছু করবার কথা ভাবছেন তখন স্বর্ণকুমারী এসেছেন একেবারে ঝোড়ো হাওয়ার মতো। লেখাপড়ার পাঠ ভালভাবে শেষ হতে না হতেই তিনি তরতর করে লিখে ফেললেন একেবারে আস্ত একখান উপন্যাস। সবাই অবাক। তা উনিশ শতকটপ তো অবাক হবারই যুগ। কঁচা ভিতের ওপর পাকা ইমারত গড়তে দেখলে কে না বিস্মিত হয়? এই তো সেদিন, মাঝে দশটা বছর গেছে কি যায়নি, প্রথম সার্থক বাংলা উপন্যাসখানি লিখে বঙ্কিমচন্দ্র তার ঔপন্যাসিক জীবন শুরু করেছেন। এখনও সবার মনে দুর্গেশনন্দিনীর অমলিন স্মৃতি। চারপাশে শুধু নাটক-প্রহসন আর নকশার ভিড়। কখন উপন্যাস লেখায় হাত দিলেন এই অষ্টাদশী তরুণীটি? এ তো শুধু প্রথম লেখা নয়। এ যেন আবির্ভাব!

আবির্ভাবই বটে। ১৮৭৬ সালে ডিসেম্বর মাস, শীতার্ত সন্ধ্যা উজ্জ্বল হয়ে উঠল এক অনামিকার শুভ আবির্ভাবে। বইয়ের নাম দীপনির্বাণ। সকলেই উলটে পালটে দেখে। সকলের মনেই নানারকম প্রশ্ন। লেখকের নামহীন বইটি নিয়ে জল্পনা চলছে। কার লেখা বই? কার লেখা হতে পারে? এরই মধ্যে কানাঘুষো শোনা গেল বইখানি একটি মেয়ের লেখা।

মৌচাকে যেন ঢিল পড়ল এবার।

একজন মেয়ের লেখা? পড়ে বিশ্বাস হয় না। ভাষায় এমন বাঁধুনি, লেখায় এমন মুন্সিয়ানার ছাপ! মেয়েলি জড়তা-সংকোচ কুণ্ঠা কোথাও কিছু নেই। এ কি কোন মেয়ের লেখা হতে পারে? সাধারণী কাগজ সমালোচনা করলে :

…শুনিয়াছি এখনি কোন সম্ভাবংশীয় মহিলার লেখা। আহলাদের কথা। স্ত্রীলোকের এরূপ পড়াশোনা, এরূপ রচনা, সহৃদয়তা, এরূপ লেখার ভঙ্গি বঙ্গদেশ বলিয়া নয় অপর সভ্যতর দেশেও অল্প দেখিতে পাওয়া যায়! প্রশংসা ঠিকই। কিন্তু তারই মধ্যে লুকিয়ে রইল সন্দেহের কাঁটা। খচখচ করে বেঁধে মহিলার লেখা।

সত্যিই কি মহিলার লেখা?

কে সেই মহিলা? কী তাঁর পরিচয়?

মহিলার নামে পুরুষের লেখাও তো হতে পারে।

স্বর্ণকুমারীর মেজদাদা সত্যেন্দ্র তখন বিদেশে; তিনি ভাবলেন এ নিশ্চয় তার ভাই জ্যোতিরিন্দ্রর লেখা। অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি পাঠালেন, জ্যোতির জ্যোতি কি প্রচ্ছন্ন থাকিতে পারে? সত্যিই পারে না। স্বর্ণকুমারীর বর্ণালী দীপ্তিও অজানা খনির নতুন মণির আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। সন্দেহের আর অবকাশ রইল না।

স্বর্ণকুমারীকে নিয়ে এত আলোড়ন উঠেছিল কেন? তিনিই কি প্রথম বাঙালী লেখিকা না প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক? ইতিহাস বলবে, এর কোনটাই ঠিক নয়। ঠাকুরবাড়ির মতো শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকেই প্রথম লেখিকার আবির্ভাব হওয়া অসঙ্গত নয়, অসম্ভবও ছিল না। কিন্তু দীপনির্বাণ প্রকাশের আগেই মার্থা সৌদামিনী সিংহের নারীচরিত কিংবা নবীনকালী দেবীর কামিনী কলঙ্ক লেখা হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে হেমাঙ্গিনী দেবীর মনোরমা কিংবা সুরঙ্গিণী দেবীর তারাচরিত। যতদূর জানি, প্রথম বাংলা কাব্য-লেখিকার নাম কৃষ্ণকামিনী দাসী। তার চিত্তবিলাসিনী ১৮৫৬ সালে প্রকাশিত হয়। ফুলমণি ও করুণার বিবরণ-কে বাদ দিলে এটিই বাঙালী মেয়ের লেখা প্রথম গ্রন্থ। এরপর প্রবন্ধ-জাতীয় রচনা প্রথম লেখেন পাবনার বামাসুন্দরী দেবী ১৮৬১ সালে। তার পুস্তিকাখানির নাম ছিল কি কি কুসংস্কার তিরোহিত হইলে এদেশের শ্রীবৃদ্ধি হইতে পারে। প্রথম মহিলা নাট্যকার কামিনীসুন্দরী দেবী উর্বশী নাটক লেখেন ১৮৫৬ সালে। অনেকের মতে প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিকের নাম শিবসুন্দরী দেবী। তার তারাবতী প্রকাশিত হয় ১৮৬৩ সালে (মতান্তরে ১৮৭৩ সালে), শিবসুন্দরী ছিলেন পাথুরেঘাটার হরকুমার ঠাকুরের স্ত্রী। তার কনিষ্ঠ পুত্র শৌরীন্দ্রমোহন তারাবতীর ইংরাজী অনুবাদ করে (১৮৮১) নিজের গানের বইয়ের সঙ্গে বিভিন্ন দেশে উপহার পাঠিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভাল, পাথুরেঘাটা-ঠাকুরবাড়ির মহিলারাও কিছু কিছু সাহিত্যচর্চা করতেন। সংখ্যায় কম হলেও আমরা ঐ বাড়ির ছ-সাতজন মেয়ে ও বৌকে কবিতা কিংবা নাটক লিখতে দেখেছি। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের ছোট মেয়ে মনোরমা লিখেছিলেন কবিতায় পিতৃদেবচরিত। এছাড়া বিরজামোহিনী ও অনিরুদ্ধ মিলন নাটক এবং গৌরগীতিকা ও মানকুঞ্জ কাব্যগ্রন্থ। ঘরে বসেই তিনি কাকার কাছে শিখেছিলেন সুরকানন বাজাতে। শৌরীন্দ্রমোহনের দুই মেয়ে শ্রীজয়ন্তী ও জয়জয়ন্তীও কিছু কিছু লিখেছেন, প্রকাশিতও হয়েছিল। জয়জয়ন্তী লিখেছিলেন জয়ন্তী দেবী নামে। তার দুখানি গ্রন্থের নাম মহামিলন ও জীবনমুক্তি। কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের স্ত্রী সৌদামিনী লেখেন ভক্তিরসতরঙ্গিনী। প্রথম মহিলা আত্মজীবনীকার রাসসুন্দরী দেবী (১৮৭৬)। বামা রচনাবলীর প্রথম ভাগেও (১৮৭২) বেশ কয়েকজন লেখিকার সন্ধান পাওয়া যায়। তবে সেগুলির অধিকাংশই প্রবন্ধ। সমাজ সংস্কার, স্ত্রীশিক্ষা, নীতি প্রভৃতি গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে একসময় প্রবন্ধ লিখেছেন কামিনী দত্ত, স্বর্ণলতা ঘোষ, মধুমতী গঙ্গোপাধ্যায়, বিবি তাহেরণ লেছ, গোলাপমোহিনী দাসী, রমাসুন্দরী ঘোষ, ক্ষীরদা মিত্র, শ্ৰীমতী সৌদামিনী ও আরো অনেকে। এরা কেউই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। শিবসুন্দরী প্রমুখ কয়েকজন ছাড়া অন্যরা কোন বিখ্যাত সন্ত্রান্ত পরিবার থেকেও আসেননি। তবু তাদের বিদ্যানুরাগ ও সাহিত্যপ্রতি আমাদের মুগ্ধ করে। যাক সে কথা, এই তথ্যের দিকটিকে বাদ দিলে স্বর্ণকুমারীর পূর্ববর্তিনীদের কাউকেই সাহিত্যিক হিসেবে গ্রহণ করা চলে না। পরম গৌরবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করলেও মেয়েদের সাহিত্য এতদিন ছিল শুধু হাস্যকর এবং অনুকম্পার বস্তু। অথচ বিশ্বসাহিত্যে প্রথম উপন্যাসের স্রষ্টা কোন পুরুষ নন, একজন মহিলা। তাঁর নাম মোরাকিসিকিবু (১৮৭৮-১৯৩১)। এই জাপানী মহিলাই লিখেছিলেন গেঞ্জি মনোগাতারি নামে প্রথম উপন্যাস। যাই হোক বাংলা সাহিত্যের আসরে স্বর্ণকুমারী এসে আদায় করে নিলেন প্রার্থিত সম্মান। হাসি আর করুণার বদলে দেখা দিল শ্রদ্ধামেশানো বিস্ময়! মেয়েদের চলার পথ, আত্মপ্রকাশের পথ আরো বুঝি একটু সুগম হল।

উপন্যাস ছাড়াও স্বর্ণকুমারী লিখেছিলেন গল্প, নাটক, প্রহসন, কবিতা, গাথা, গান, রম্যরচনা, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, গীতিনাট্য, স্মৃতিকথা, স্কুলপাঠ্য বই— একজন মহিলার পক্ষে যা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। আশ্চর্যের কথা এই যে তিনি তার পূর্ববর্তিনীদের দ্বারা বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হননি। তার আদর্শ লেখক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, যদিও তার ইতিহাসনিষ্ঠা রমেশ দত্তকেই মনে করিয়ে দেয়। বঙ্কিমের মতো লেখক আদর্শ হওয়ায় স্বর্ণকুমারীর রচনায় রমণীয় লাবণ্যের কিছু অভাব ঘটেছে। অবশ্য তাতে খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। আর যেখানেই হোক। সাহিত্যে মেয়েলি ভঙ্গির আদর নেই। স্বর্ণকুমারীর অধিকাংশ রচনাই পুরুষালি টংএ লেখা। অথচ তিনি গল্প-উপন্যাস লিখতে শুরু করেন বেশ অল্প বয়সে। এই বয়সে উপন্যাস লেখার নজির অবশ্য আরো আছে। তরু দত্তের কথাই ধরা যাক না। মাত্র একুশ বছর বয়সে দুরোগ্য ব্যাধিতে তরুর মৃত্যু হয় কিন্তু সেই স্বল্প কটি দিনের মধ্যেই তিনি লিখেছিলেন অনেক গুলো মনে রাখবার মতো না।

কবিতা আর দুটি উপন্যাস, লিখেছিলেন ইংরেজী ও ফরাসী ভাষায়। সে যুগে ইংরেজী ভাষায় নাটক, নভেল অনেকেই লিখতেন। বিদেশিনী শিক্ষয়িত্রীদের শিক্ষার ফলে ইংরেজী শেখার পথও হয়েছিল সরল। স্বর্ণকুমারীও তার নিজের গল্প ও উপন্যাসের অনুবাদ করেছেন, তবে সে অনেক পরে।

মাঝে মাঝে স্বর্ণকুমারীকে অসাধারণ সৌভাগ্যবতী বলে মনে হয়। পথের কাঁটাও বুঝি তার পায়ের তলায় ফুল হয়ে ফুটেছে। নতুন কিছু করার জন্যে জ্ঞানদানন্দিনীকে যত ঝড়ঝাপ্টা সইতে হয়েছিল তাকে সে সব দুর্যোগ স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি পেলেন শুধুই শ্রদ্ধা, শুধুই সম্মান, শুধুই অভিনন্দন। একেই বলে ভাগ্য! সত্যিই কি কোন বাধা ছিল না? না, স্বর্ণকুমারী কোন বাধাকে বাধা মনে করেননি। আপাতভাবে সংসারে উদাসীন হওয়ার জন্য স্বর্ণকুমারী সবসময় এক নিরাসক্ত দূরত্বের মধ্যে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। বাকিটুকু ঘিরে রেখেছিল জানকীনাথ ঘোষালের ভালবাসা। স্ত্রীকে তিনি সমস্ত দুঃখ-বিপদের হাত থেকে সরিয়ে চেষ্টা করেছেন সাহিত্যক্ষেত্রে সার্থক করে তুলতে। স্বর্ণকুমারীর সাহিত্যিক খ্যাতি চিড় ধরায়নি তাদের দাম্পত্য জীবনে।

স্বর্ণকুমারী যখন নিজেকে লেখিকা হিসাবে তৈরী করে নিচ্ছেন তখন অন্যান্য মেয়েরা কি করছিলেন? অন্যান্য বাড়ির অন্দরমহলের খবর সংগ্রহ করা সহজ নয়। আগে ঠাকুরবাড়িটাই দেখা যাক। স্বর্ণকুমারীর দিদি-বৌদিদিরা মগ্ন থাকতেন ঘরের কাজে। সকাল থেকৈ, তাদের বসত তরকারি বানানোর আসর, সেই সঙ্গে মেয়েলি আড্ডা—এই আসরে যোগ দিতেন সৌদামিনী, শরৎকুমারী, বর্ণকুমারী, প্রফুল্লময়ী, সর্বসুন্দরী, কাদম্বরী আরো অনেকে। মহর্ষি বাড়ি ফিরলে তদারক করতে আসতেন সারদাদেবী। এছাড়া বাড়ির অন্যান্য আশ্রিতা মহিলারাও যোগ দিতেন। হাতের কাজের সঙ্গে জমে উঠত গল্প। বাড়ির ছোট ছোট মেয়েরা গল্পের টানে হাজির হত সেখানে। সরলাও প্রায়ই যেতেন কিন্তু নিজের মাকে কোনদিন সে আসরে যেতে দেখেননি।

শরৎকুমারী ভালবাসতেন রূপচর্চা করতে। সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে রূপটান মেখে চৌবাচ্চার জলে সাঁতার কেটে তিনি অনেকটা সময় কাটিয়ে দিতেন। তার স্বামী যদুনাথ (যদুকমল) মুখোপাধ্যায় ছিলেন সুরসিক ব্যক্তি। শোনা যায়, অনেকেরই কৌতূহল ছিল ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েদের রূপ রঙ নিয়ে। একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন যদুনাথকে। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন দুধে আর মদে। কেউ কেউ মনে করতেন ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েদের এই দুটি পদার্থ দিয়ে স্নান করানো হত জন্মাবার পরই। যদুনাথের রহস্যপ্রিয়তার এই ছোট্ট ছবিটি উপহার দিয়েছেন সত্যেন্দ্র-দুহিতা ইন্দিরা, তার অপ্রকাশিত গ্রন্থ শ্রুতি ও স্মৃতিতে। ঠাকুরবাড়িতে মেয়েরা রন্ধনচর্চাও করতো, শরৎকুমারী ছিলেন রন্ধন-পটিয়সী। অন্যান্য বাড়ির মেয়েরাও যে অন্যভাবে জীবন কাঁটাতেন তা নয়। বিনয়িনীর অপ্রকাশিত আত্মকথা কাহিনী পড়ে জানা যায় তাদের বাড়িতে অর্থাৎ অবন-গগন ঠাকুর পরিবাবের মেয়েদের অনেক সময় কেটে যেত ঠাকুরঘরে। অন্যান্য বাড়িতেও অধিকাংশ মেয়ে এমনি ভাবেই সময় কাঁটাতেন। এছাড়া কেউ দিতেন পুতুলের বিয়ে, কেউ খেলতেন তাস-পাশা কিংবা দশ-পঁচিশ। স্বর্ণকুমারী এভাবে জীবন কাঁটাননি : নিজেকে অন্য সব দিক থেকে সরিয়ে এনে তিনি অনেক অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।

দীপনির্বাণ উপন্যাসের পরে প্রকাশিত হল বসন্ত-উৎসব, প্রায় একই সঙ্গে আত্মপ্রকাশ করল ছিন্নমুকুল! এবার যশের মুকুট তার মাথায় পরিয়ে দিলেন পাঠকসমাজ। ইদানীংকালে হয়ত অনেকেই ভুলে গেছেন যে, বাংলায় অপেরাধর্মী গীতিনাটিকা লেখার ব্যাপারেও স্বর্ণকুমারী পথিকৃতের গৌরব দাবি করতে পারেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের বাল্মীকি-প্রতিভ এমনকি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মানময়ীরও আগে রচনা করেন বসন্ত-উৎসব। লেখার সঙ্গে সঙ্গে অভিনয়। ঠাকুরবাড়িতে তখন সুবর্ণ যুগ চলছে। বাড়িতে রয়েছেন স্বর্ণকুমারীর নাট্যরসিক দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্যপ্রেমিকা স্ত্রী কাদম্বরী। সত্যেন্দ্র-জ্ঞানদানন্দিনী মাঝে মাঝে আসতেন ঝোড়ো হাওয়ার মতো; জীর্ণ পুরাতনকে ভাসিয়ে দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে। প্রচণ্ড উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে হয়ে গেল হিন্দুমেলা। এরপর ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েরা মেতে উঠলেন একটা নতুন পত্রিকা প্রকাশের জন্যে। পাঁচ বছর আগে বেরিয়েছে বঙ্গদর্শন। ঘরে ঘরে বঙ্কিমের বঙ্গদর্শনের আদর। ওই রকম ভাল কাগজ বার করা যায় না কি? মহর্ষির বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্র একটু প্রাচীনপন্থী, তার ইচ্ছে তত্ত্ববোধিনীকেই আরো জঁকিয়ে তোলা। নব্যপন্থী জ্যোতিরিন্দ্রের সে ইচ্ছে নয়। পুরনো জিনিষকে নতুন করা যায় না। শেষে তারই জয় হল। ভাই-বোনেরা মিলে খসড়া করেন, পরিকল্পনা হয়, রাত বাড়ে।

কি নাম দেওয়া হবে?

সুপ্রভাত?

না, কেমন যেন শোনাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ভোটে যে নামটি গৃহীত হল সেটি যেমন সুন্দর, তেমনি অর্থবহ।

কী নাম?

ভারতী।

প্রথম দিকে ভারতী ছিল জ্যোতিরিন্দ্র-কাদম্বরীর মানসকন্যা, পরে স্বর্ণকুমারীই ছিলেন ভারতীর প্রকৃত কর্ণধার। অবশ্য সে অনেক পরের কথা, ১৮৮৪ সালের কথা। তার বছর সাতেক আগে ভারতীর প্রথম সম্পাদক হন দ্বিজেন্দ্রনাথ। প্রথম সংখ্যা থেকেই কিশোর রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন মেঘনাদবধের কঠোর সমালোচনা। আবার ফিরে আসা যাক পূর্ব প্রসঙ্গে।

ঠাকুরবাড়িতে নিম্নমানের নাচ-গান হত না বটে তবে রসের ভোজে কেউ কোনদিন বাদ পড়তেন না কারণ রসস্রষ্টা ছিলেন তারা নিজেরাই। বাড়ির যে কোন আনন্দ-উৎসবের সময় নানারকম অনুষ্ঠান হত। এর উদ্যোক্তা ছিলেন স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বছর দশেক আগেকার জোড়াসাঁকো থিয়েটারের উদ্যোক্তা ছিলেন গণেন্দ্র, গুণেন্দ্র, সারদাপ্রসাদ ও জ্যোতিরিন্দ্র। এখন সে থিয়েটারের পাট চুকে গেছে কিন্তু বদলায়নি নাট্যামোদীর মন। তাই আবার নতুন করে নাটক জমিয়ে তুললেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। পুরনো থিয়েটারি মজলিশ বাড়িতে ঢুকতে পেলে না বটে তবু নাটক জমে উঠল। জোড়াসাঁকো থিয়েটারের সেই কুশলী অভিনেতা জ্যোতিরিন্দ্র, যিনি নটীর ভূমিকায় অভিনয় করে সবার মন। ভুলিয়ে ছিলেন, তিনিই আসর সাজালেন। পুরনো কুশীলবরা নেই, কেউ বা পরলোকে। এবার নতুন করে যোগ দিলেন বাড়ির মেয়েরা। যদিও ঘরোয়া অনুষ্ঠান, দর্শকরাও আত্মীয় স্বজনেরা। তবু এ ঘটনায় চমকে উঠল সবাই। অভিনয়কে বাড়ির উঠোনে টেনে আনা ও সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েদের মঞ্চে এসে দাঁড়ানো দুটোই ছিল অসম্ভব ব্যাপার।

স্বর্ণকুমারীর বসন্ত-উৎসবের অভিনয় হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির ঘরোয়া আসরে। একদিন বারান্দার জমাটি আড্ডায় বসে কথা উঠল, সেকালে বসন্ত-উৎসব কেমন হত? আসর জমে উঠল তর্কে বিতর্কে। সব কাজের উদ্যোক্তা জ্যোতিরিন্দ্র প্রস্তাব করলেন, এসো না, আমরাও একদিন সেকেলে ধরনের বসন্ত-উৎসব করি। কারুর উৎসাহ তো কম নয়। দেখতে দেখতে পিচকারী আবীর কুঙ্কুম প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম এসে গেল। রঙিন আলোয় ছাদের বাগানে খুব আবীর খেলা হবে। আমোদ-প্রমোেদ বাদ যায় কেন? স্বর্ণকুমারী লিখে ফেললেন বসন্ত-উৎসব। গীতিনাটিকার সূচনা হল স্বর্ণকুমারীর হাতে। এই বিরাট আনন্দযজ্ঞে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন না। তিনি তখন সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে বিলেতে বসে কোন এক মরা সাহেবের বিধবা গিন্নীকে বেহাগ-সুরে শোকগীত শোনাচ্ছেন।

বসন্ত-উৎসবের নায়িকা লীলা সাজলেন কাদম্বরী। আর যে সন্ন্যাসিনীর কৃপায় লীলা তার প্রেমিককে ফিরে পেল সেই সন্ন্যাসিনী সাজলেন স্বর্ণকুমারী নিজে। গেরুয়া সাজের সঙ্গে তার উদাসিনী প্রকৃতিটি সুন্দর খাপ খেয়েছিল। নায়ক হয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তবে বসন্ত-উৎসবের পরবর্তী অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথও প্রতিনায়ক হয়ে টিনের তলোয়ার ঘুরিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। এরপর কিছুদিন ধরে তিন ভাইবোনে গীতিনাট্য লেখা এবং অভিনয় চালিয়ে গেলেন নিয়মিতভাবে। পরে স্বর্ণকুমারী লেখেন বিবাহ-উৎসব।

অবিরাম ঝর্ণার মতো বয়ে চলল স্বর্ণকুমারীর লেখার স্রোত। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে ঠাকুরবাড়ির আর কেউই বোধহয় এত বেশি লেখেননি। তার সাহিত্য-আলোচনার ক্ষেত্র এটি নয়। বাংলা সাহিত্যে স্বর্ণকুমারী তার যোগ্য আসন আজও পাননি। অথচ একদিকে বঙ্কিমচন্দ্র অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ এই দুটি ভিন্ন কোটির মধ্যবর্তী সেতু হিসেবে আমরা স্বর্ণকুমারীর নাম করতে পারি। ঐতিহাসিক গল্প ও উপন্যাস রচনায় টড কাহিনী অনুসরণ করেও তিনি যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তার তুলনা হয় না।

স্বর্ণকুমারীর ঐতিহাসিক উপন্যাসের সংখ্যা কম নয়। দীপনির্বাণ, মিবাররাজ, বিদ্রোহ, ফুলের মাল্য, হুগলীর ইমামবাড়া—প্রত্যেকটিই জনপ্রিয় হয়েছিল। ইতিহাসের ফাঁক ভরিয়ে তোলার জন্যে তিনি মাঝে মাঝে যে কৌশল অবলম্বন করতেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। যেমন ধরা যাক, কুমার ভীমসিংহ গল্পের কথা। রাজসিংহের প্রথম পত্নী কমলকুমারী ও দুই রাণীর দুই পুত্র ভীমসিংহ ও জয়সিংহের কথা টড কাহিনীতে আছে। কিন্তু রাজসিংহের দ্বিতীয় স্ত্রীর কোন নাম নেই। কিন্তু স্বর্ণকুমারী যখন গল্প লিখছেন তখন বঙ্কিমের রাজসিংহ উপন্যাস লেখা হয়ে গেছে। কিষাণগড়ের চারুমতীকে বঙ্কিম রূপনগরের বীরাঙ্গনা চঞ্চলকুমারী করে তুললেন। এর পাঁচ বছর পরে গল্প লিখতে বসে স্বর্ণকুমারী অবলীলায় জয়সিংহ-জননীর নাম দিয়ে দিলেন চঞ্চলকুমারী। টডের ইতিহাস একটু ক্ষুন্ন হল বটে কিন্তু হোঁচট খেলে না পাঠকের মন। কল্পনা বাস্তবে মেশা ছায়া-ছায়া নামহারা একটা চরিত্র ব্যক্তিত্ব লাভ করল স্বর্ণকুমারীর হাতে।

ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখলেও সামাজিক গল্প-উপন্যাস লিখে স্বর্ণকুমারী নাম করেন বেশি। যদিও ঠাকুরবাড়ির বিশেষতঃ এ বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে সাধারণ বাঙালী সমাজের ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল না বলে তাদের লেখায় বাস্তব জীবনের ছাপ বিশেষ পাওয়া যায় না, এমন একটা ধারণা বহুদিন থেকেই আমাদের মনে বাসা। বেঁধে আছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন পৃথিবীর সঙ্গে যথার্থ পরিচয়ের অভাব তাদের পঙ্গু করে রেখেছে। তিনি সম্ভবতঃ সেজন্যেই স্বর্ণকুমারীর রচনাগুলির অনুবাদ-প্রকাশে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন। পারিবারিক জীবনের ছোটবড় খুঁটিনাটি ব্যাপারের দিকে চোখ তুলে না তাকালেও স্বর্ণকুমারী বাস্তব। জীবন সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেন না। সমাজ-সংসার সব কিছুর উর্ধ্বে যে মানুষের মন, তিনি তার নাগাল পেয়েছিলেন। তাই তার সর্বশ্রেষ্ঠ দুটি উপন্যাসই সামাজিক উপন্যাস।

প্রথমে ধরা যাক স্নেহলতার কথা। বিশ শতকের সমালোচকদের ভাষায়, বাঙালী সমাজে আধুনিকতার সমস্যা লইয়া এই প্রথম উপন্যাস লেখা হইল। আগেই বলেছি, স্বর্ণকুমারী সব বিষয়েই অতি ভাগ্যবতী, নয়ত বিধবা-সমস্যা নিয়ে এর অনেক আগে থেকেই তো লেখালেখি চলছে, স্বর্ণকুমারীর ভাগ্যে অভিনন্দন জুটবে কেন? তবে এ বিষয় নিয়ে স্বর্ণকুমারীকে ভাবতে দেখে একটু অবাক লাগে কারণ মহর্ষি স্বয়ং বিধবা বিবাহের বিরোধী ছিলেন। বিধবা স্নেহলতাও অবশ্য বিষবৃক্ষের কুন্দনন্দিনীর পন্থা অনুসরণ করেছে কিন্তু চোখের বালির বিনোদিনীই কি নতুন পথ দেখাতে পেরেছিল? যাক সে কথা, স্বর্ণকুমারী বিধবা-সমস্যাকে দেখেছেন সমাজ-সংস্কারকের দৃষ্টিতে নয়, নারীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। নারীর প্রেম-ভালোবাসা-সংশয়-লজ্জা সংকোচ-ভয়-সংস্কার সব কিছুর মধ্য দিয়েই তিনি মেয়েদের সমস্যাকে দেখতে চেয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে এই দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্রই বৈশিষ্ট্য এনেছিল।

উনিশ শতকে বিধবা-সমস্যা নিয়ে অনেকেই ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছিলেন। শুধু ভাবনা-চিন্তা নয়, সক্রিয় হয়ে কাজে যোগ দিয়েছিলেন আরো অনেকে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৬ সালের এই ডিসেম্বর প্রথম বিধবা-বিবাহ দেবার পর উৎসাহ-উদ্দীপনা অনেক বেড়ে গেল। বালবিধবা কালীমতীকে বিবাহ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের প্রিয়পাত্র ঐশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। এ ব্যাপারে অবশ্য ব্রাহ্ম সমাজ অসাধারণ আগ্রহ দেখিয়েছে। আদি ব্রাহ্ম সমাজে বিধবা-বিবাহের প্রবর্তন হয় অনেক পরে কিন্তু দুর্গামোহন দাস, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ উৎসাহী ব্রাহ্ম যুবকেরা অনেক অসাধারণ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। আমরা সত্যেন্দ্রনাথের উদার দৃষ্টি ও স্ত্রীস্বাধীনতাপ্রয়াসী মনটির কথা জানি। দুর্গামোহন দাসের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আরো উদাত্ত, আরো বলিষ্ঠ। সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে তিনি নিজের তরুণী বিমাতার সঙ্গে একজন বন্ধুর বিয়ে দিয়েছিলেন। তার স্ত্রী ব্ৰহ্মময়ীও ছিলেন অসাধারণ মহিলা। শিবনাথ শাস্ত্রীও কম যান না। তিনি প্রথম জীবনে পিতার আদেশে প্রথমা স্ত্রী প্রসন্নময়ী থাকা সত্ত্বেও বিবাহ করতে বাধ্য হয়েছিলেন বিরাজ মোহিনীকে। পরে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করে স্থির করেন তিনি বিরাজমোহিনীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ না করে আবার তার নতুন করে বিয়ে দেবেন। অবশ্য বিরাজমোহিনীর প্রবল আপত্তিতে ব্যাপারটা বেশি দূর গড়াতে পায়নি। ঠাকুরবাড়ি থেকে এই ধরনের মনোভাব কোন সময়ই সমর্থন পায়নি। ১৮৭২ সালে কেশব সেন অসবর্ণ বিবাহকে যখন বৈধ ঘোষণা করে বিশেষ বিবাহনীতি (তিন আইন) চালু করলেন, তখন ঈশ্বরচন্দ্র রাজনারায়ণ বসুর মেয়ে লীলাবতী মিত্রের কাছে কয়েকজন অসহায় বিধবাকে পাঠান যাতে তিনি তাদের পুনর্বিবাহের ব্যবস্থা করতে পারেন। লীলাবতীও কম সাহসের পরিচয় দেননি। তিনি ১৮৮৩ থেকে ১৮৯০-এর মধ্যে আটটি বিধবা মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন।

স্বর্ণকুমারীও যে বিধবাদের কথা ভাবেননি তা নয়। তিনি নারীকল্যাণমূলক কাজ আরম্ভ করেছিলেন সখিসমিতির মধ্যে দিয়ে। নামটি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। স্বর্ণকুমারী তার বান্ধবীদের নিয়ে এই সমিতি পরিচালনা করতেন! এই সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিধবা ও কুমারী মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে অন্তঃপুরের শিক্ষয়িত্ৰী করে ভোলা। তখনও মেয়েরা বিশেষতঃ বিবাহিতারা স্কুলে পড়তে আসত না অথচ লেখাপড়া শেখার আগ্রহ বেড়ে গেছে। তাই ঘরে ঘরে শিক্ষয়িত্রীর প্রয়োজন-তাদের অভাবে শিক্ষক কিংবা বিদেশিনী মিশনারী মেম সাহেব নিয়োগ করা হত। স্বর্ণকুমারী দেখলেন বাঙালী মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে অনায়াসেই এই কাজটি পেতে পারে। অর্থোপার্জনে স্বনির্ভর হলে অনাথ বিধবাদের জীবনযাত্রা যে সহজতর হবে তাতে সন্দেহ ছিল না। সখিসমিতি যে এ ব্যাপারে খুব সফল হয়েছিল তা নয়, তবে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে ও মেয়েদের আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার জন্য সখিসমিতির মতো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ছিল। সত্যি কথা বলতে কি আজও সে প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি।

আবার ফেরা যাক স্নেহলতা প্রসঙ্গে। স্বর্ণকুমারী বিধবাদের লেখাপড়া শিখিয়ে তাদের আত্মনির্ভর করে তুলতে চাইলেও তাদের পুনর্বিবাহ দেবার চেষ্টা করেননি। তবে এভাবে বিধবা-সমস্যার সমাধান সত্যিই হয় কিনা সে নিয়েও চিন্তা করেছিলেন। সেই চিন্তার ফসল স্নেহলতা। তাই স্নেহের মৃত্যুর পরে জগৎবাবুর চিন্তার সূত্র ধরে আমরা যখন লেখিকার ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হই তখন চমকে উঠি। জগৎবাবু এই উপন্যাসের একটি প্রধান চরিত্র। স্নেহের মৃত্যুর পর তার মনে হয়েছিল, স্নেহকে লেখাপড়া না শিখাইলে সে বেশ সন্তুষ্ট চিত্তে আপনার অদৃষ্ট বহন করিতে পারি, আপনার অধঃপতন। মৃত্যু আপনি ডাকিয়া আনিত না। এ কথা লেখিকারও কথা। যুক্তি যদি ভেতর থেকে মনকে নাড়া দেয় তাহলে উপেক্ষিত জীবনের বঞ্চনা ও ক্ষোভকে অদৃষ্ট বলে মেনে নেবার অপরিসীম শক্তির ভিত আসে দুর্বল হয়ে। নারী হয়ে স্বর্ণকুমারী এই সত্যকে অস্বীকার করতে পারেননি। তাই বিধবাদের আত্মনির্ভরতা এবং অর্থোপার্জনের পথ দেখিয়ে দিলেই যে সব হল না সেটা তিনি জানতেন। হিরন্ময়ী বিধবা শিল্পাশ্রমের জন্যে লেখা নিবেদিতা নাটকেও তিনি এই সমস্যার আরেকটি কুৎসিত রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে কোথাও তিনি সমাধানের পথ দেখাতে পারেননি এমনকি সে চেষ্টাও করেননি। তবু মনে হয় তিনি বিধবা মেয়েদের সমাজের মধ্যে সসম্মানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। সম্মানের পরিবর্তে শুধু অন্নের সংস্থান, অর্থোপার্জন, শিক্ষা এমন কি পুনর্বিবাহও তার মতে, কোন নারীকে পূর্ণ করে তুলতে পারে না। স্বর্ণকুমারীর সমসাময়িক আরো কয়েকজন লেখিকা সামাজিক উপন্যাস লিখে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এঁদের একজনের নাম কুসুম কুমারী দেবী ও অপরজন শরৎকুমারী চৌধুরাণী। কুসুমকুমারীর স্নেহলতা, প্রেমলতা ও শান্তিলত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্রের প্রশংসা লাভ করেছে। শরৎকুমারীকে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

স্বর্ণকুমারীর অপর জনপ্রিয় উপন্যাসটির নাম কাহাকে। এখানে স্বর্ণকুমারী সমস্ত পুরুষালি ঢং বিসর্জন দিয়ে শুধু একটি মেয়ের ভালবাসার কথা শুনিয়েছেন। স্বর্ণকুমারীর লেখায় যারা নারীসুলভ রমণীয়তা পাননি কাহাকে তাদের সন্তুষ্ট করেছে। অন্য কোন সমস্যা এখানে নেই, আছে শুধু একটি আধুনিকার আত্মকথন। শিক্ষিত আধুনিক নায়িকা নিজেকে বিশ্লেষণ করে ভালবাসার স্বরূপ সন্ধান করেছে। নারীসুলভ স্বাভাবিক লজ্জা ও সংস্কারকে বর্জন করে স্বর্ণকুমারী যেভাবে নারীমনকে বিশ্লেষণ করেছেন তার তুলনা এ যুগেও খুব বেশি মেলে না। সাধারণ জীবনের দৈনন্দিন বাস্তবতার সঙ্গে হয়ত তার পরিচয় কিছু কম ছিল কিন্তু মনোবিশ্লেষণ দিয়ে তিনি সেই অভাবকে পূর্ণ করে দিয়েছেন। অনেকেই কাহাকে উপন্যাসে লেখিকার নিজস্ব পরিবেশ অর্থাৎ তৎকালীন শিক্ষিত ও সম্ভান্ত পরিবারের পরিবেশ খুঁজে পেয়েছেন। লেখিকার নিজের পরিবেশ বলেই কাহাকে এত জীবন্ত এ ধারণাও করা হয়। স্বর্ণকুমারীর নিজের জীবনের সঙ্গে নায়িকার সাদৃশ্য না থাকলে এ পরিবেশে তিনি যে খুব স্বচ্ছন্দ সে কথা অস্বীকার করে লাভ নেই। কাহাকে শুধু বাঙালী পাঠকদের ভাল লেগেছিল তা নয়, বিদেশীদেরও মন ছুয়েছিল।

উনিশ শতকে ইংরেজীতে নভেল লেখার একটা রেওয়াজ ছিল। সে সময় অনেকেই ইংরেজী উপন্যাস লিখতেন, কেউ কেউ নিজেদের বাংলা লেখা অনুবাদ করে নিতেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নেওয়া যায় ইংরেজী ভাষাটা তখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে শক্ত ছিল না। যে কোন ধনী পরিবারে ছোট বেলা থেকেই ছেলেমেয়েদের ইংরেজী পড়ানো হত। পড়ার বইও লেখা হত ইংরেজীতে। গভর্নেস বা শিক্ষয়িত্ৰী হতেন বিদেশিনী। কাজে কাজেই ইংরেজী ছিল শাসক ইংরেজের মতোই বাঙালীর কাছের জিনিস। মহিলারাও ইংরেজী ভাষায় উপন্যাস লিখতেন। এ সময় কতজন বাঙালী লেখিকা ছিলেন প্রশ্ন জাগতে পারে। ১৮৫৪ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে ১৯৪ জন লেখিকার নাম পাওয়া যায়। তাছাড়া বোধহয় আরো জন পঞ্চাশেক লেখিকা ছিলেন যারা নাম প্রকাশ করতে চাননি! সুতরাং স্বর্ণকুমারীকে একাকিনী ভাবলে ভুল করা

যাইহোক, কথা হচ্ছিল উপন্যাসের অনুবাদ নিয়ে। এ ব্যাপারে স্বর্ণকুমারী বেশ উৎসাহী ছিলেন। তাঁর দুটো উপন্যাস, চোদ্দটা গল্প ও একটা নাটক অনূদিত হয়। সবচেয়ে আগে ক্রিস্টিনা আলবার্স অনুবাদ করেন ফুলের মালা। মডার্ণ রিভিউ-এ দি ফ্যাটাল গারল্যাণ্ড নামে ছাপা হয়। ফুলের মালা উপন্যাস হিসাবে খুব সার্থক হয়নি! খুব সম্ভব সেজন্যেই রবীন্দ্রনাথের এই অনুবাদ সম্বন্ধে ভাল ধারণা ছিল না। ১৯১৩ সালে কবি যখন ইংলণ্ডে তথন স্বর্ণকুমারী তাঁর কাছে এই বইটি পাঠান, হয়তো বিদেশের বাজারে একটু পরিচিত হবার জন্যেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিমত জানালেন।

আমি জানি এ বই প্রকাশ করবার চেষ্টা এখানে সফল হবে না। তাছাড়া তর্জমা খুব ভালো হয়েছে তা নয়—অর্থাৎ ইংরেজী রচনার উচ্চ আদর্শে পৌঁছয়নি। [ ২৮. ১. ১৯১৩ ]

তাঁর একই মন্তব্য শোনা গেছে ইন্দিরাকে লেখা চিঠিতেও। কবি তাঁকে। লিখেছেন :

নদিদি আমাকে তার ফুলের মালার তর্জমাটা পাঠিয়েছিলেন। এখানকার সাহিত্যের বাজার যদি দেখতেন তাহলে বুঝতে পারতেন এসব জিনিস এখানে কোন কোনমতেই চলতে পারে না। এরা যাকে reality বলে সে জিনিসট। থাকা চাই। [ ৬.৫, ১৯১৩]

কবির পক্ষে এ নিয়ে কথা বলা মুস্কিল হয়েছিল এইজন্যে যে, তাঁর কবিতা সে সময় বিদেশে যথাযোগ্য সম্মান পেয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে তো আর কারুর তুলনা চলতে পারে না। অথচ এ কথা বলতে গেলে ভুল বোঝার শংকা বেশি। তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর অনেক বাঙালী লেখকের ধারণা হয়েছিল যে তাদের গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশ হলে তারাও উপযুক্ত সম্মান পেতে পারেন। এই ধরনের লেখকদের কথা বলবার সময় রবীন্দ্রনাথ স্বর্ণকুমারী সম্বন্ধেও শ্রদ্ধাপোষণ করেননি। তিনি রোটেনস্টাইনকে লিখেছিলেন,

She is one of those unfortunate being who has more ambition than abilities. But just enough talent to keep her mediocrity alive for a short period. Her weakness has been taken advantage of by some unscrupulous literary agents in London and she has had stories translated and published. I have given her no encouragement but I have not been successful in making her see things in their proper light.

কবি এ চিঠিটা কবে লিখেছিলেন জানা যায়নি। মনে হয়, এ সময় স্বর্ণকুমারীর আরেকটি উপন্যাসের অনুবাদ এ্যান্ আফিনিস্ট সঙ লণ্ডনে প্রকাশিত হয়েছে। এই উপন্যাসটি কাহাকের অনুবাদ, অনুবাদিকা স্বর্ণকুমারী স্বয়ং। কোন কারণেই দমে না গিয়ে স্বর্ণকুমারী কাহাকে অনুবাদ করেছিলেন। লণ্ডন থেকেই বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালের ডিসেম্বরে। ১৮৭৬-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯১৩-র ডিসেম্বর দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে স্বর্ণকুমারী এসে দাঁড়ালেন শীল রজনীর তুষার-কুয়াশাঢাকা লণ্ডনবাসী পাঠকের কাছে। তাঁরা দেখলেন, একটি বিদেশী বই, শেষ করে মনে হল অসমাপ্ত গানের কলি যেন। ঝরে পড়ল মুগ্ধ পাঠকের প্রশংসাবাণী।

Remarkable for the picture of Hindu life the story is overshadowed by the personality of the authoress, one of foremost Bengali writer to-day. (Clarion) আর একটু সোচ্চার প্রশংসা করলেন ওয়েস্ট মিনিস্টার গেজেটের সম্পাদক :

Mrs. Ghosal, as one of pioneers of the women movement in Bengal, and fortunate in her own upbring, is well qualified to give this picture of a Hindn maiden development.

রবীন্দ্রনাথ যে কেন এত আশংকা করেছিলেন বোঝা যায় না। তাঁর সমস্ত অনুমানকে অমূলক প্রমাণ করে ১৯১৪ সালে এ্যান্ আনফিনিস্ট সঙ-এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ঐ একই কোম্পানী থেকে। সুতরাং সাময়িকভাবে হলেও স্বর্ণকুমারী বিদেশীদের আকৃষ্ট করেছিলেন। কাহাকের আরো একটি অনুবাদ হয়েছিল। সেটি কলকাতা থেকে ১৯১০ সালে টু হুম নামে প্রকাশ করা হয়। টু হুমের অনুবাদিকা স্বর্ণকুমারীর ভাইঝি শোভনা। দুটো অনুবাদের মধ্যে স্বর্ণকুমারীর লেখাটিই বেশি স্বচ্ছন্দ। এছাড়াও দিব্যকমল নাটকটি অনূদিত হয় জার্মান ভাষায় প্রিন্সেস কল্যাণী নামে এবং বেশ কয়েকটি ছোট গল্প শর্ট স্টোরিজ নামে ইংরেজীতে। সুতরাং স্বদেশে-বিদেশে সর্বত্রই স্বর্ণকুমারী লেখিকার সম্মান অর্জন করেছিলেন।

আমাদের দেশে সাধারণত লেখক খ্যাতি তারাই পান যারা উপন্যাস লেখেন। স্বর্ণকুমারী সফল উপন্যাস রচয়িত্রী হলেও তিনি আরো অনেক কিছু লিখতেন। তাঁর লেখা ছোটগল্পও বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। যদিও বাংলা সার্থক ছোটগল্প প্রথম লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। তার আগে যারা গল্প লিখেছেন তারা জানতেনও না তাদের নতুন রচনাটিকে কি নামে ডাকা হবে। তাই স্বর্ণকুমারীর লেখা গল্প কুমার ভীমসিংকে কখনও বলা হয়েছে ঐতিহাসিক উপন্যাস আবার কখনও ঐতিহাসিক নাটক। বাংলা ছোটগল্পের যখন এই রকম অবস্থা তখন স্বর্ণকুমারী বাঙালী মেয়েদের নিয়ে বেশ কয়েকটা ছোটগল্প লিখেছিলেন। মালতী, লজ্জাবতী, গহনার ভাবিনী, যমুনা প্রতিদিনের শত তুচ্ছের আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে থাকে, হারিয়ে যায়। স্বর্ণকুমারী আঁকলেন তাদেরই লজ্জানত-দ্বিধাজড়িত মুখের ছবি। এসব ছবি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন সমাজসেবা করতে করতে।

সখিসমিতির কথা আগেই বলেছি। স্বর্ণকুমারী অন্যান্য লেখিকাদের সব সময়েই উৎসাহ যোগাতেন। সেযুগে লেখিকার প্রায়ই ছিলেন একে অপরের সখি বা সই। পুরুষের ক্ষেত্রে হয়ত প্রতিযোগিতা ছিল কিন্তু মেয়েরা ছিলেন মেয়েলি ঈর্ষার ঊর্ধ্বে। একজন লেখিকাকে কোন সময়েই অপর লেখিকার কঠোর সমালোচনা করতে দেখা যায়নি। স্বর্ণকুমারীর অনেক সখি—শরৎকুমারী তার বিহঙ্গিনী সই, মহিলা কবি গিরীন্দ্রমোহিনী তার মিলন-বিরহ সই—এরকম আরো অনেক সখি ছিল। সখিসমিতির উদ্যোগেই সর্বপ্রথম শিল্পমেলা হয়। স্বর্ণকুমারী চেয়েছিলেন মেয়েদের হাতের কাজকে শিল্পের মূল্য দিয়ে সকলের চোখের সামনে তুলে ধরতে। এতদিন হাতের কাজ শুধু ঘরের শোভা বাড়িয়েছে, সমাজে কৌলিন্য পায়নি। শিল্পীও পায়নি প্রাপ্য সম্মান। শিল্পমেলায় সেই সুযোগ এল। বেথুন কলেজ-প্রাঙ্গণে বসল মেলা। রবীন্দ্রনাথ লিখে দিলেন অভিনয়োপযোগী একটা নাটক মায়ার খেলা। মেয়েরাই অভিনয় করলেন তাতে; দর্শকও শুধুই মেয়েরা। তাঁদের সেই উৎসাহ-আনন্দ-উদ্দীপনার বুঝি তুলনা হয় না। অভিনয় ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাই করলেন, বাইরের দু-একজনও হয়ত ছিল। কিন্তু হাতের কাজের পুরস্কার পাবার সময় দেখা গেল ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের হারিয়ে দিয়ে প্রথম পাঁচটি পুরস্কারই পেলেন ভিন্ন পরিবারের মেয়েরা। প্রথম বছর (১২৯৫) যারা শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁদের নাম ও শিল্পকর্মের বিবরণ পাওয়া গেছে। যেমন,

প্রথম পুরস্কার—মিস মানুক রঞ্জিতের বেলসেতুর ছবি

দ্বিতীয় পুরস্কার-শ্ৰীমতী ভুবনমোহিনী দাসী ক্ষীরের ফুলশয্যা ও খোদিত প্রস্তরছাপ

তৃতীয় পুরস্কার—শ্ৰীমতী গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী মাটির গ্রাম্যছবি ও কার্পেটে দেবী চৌধুরানী

চতুর্থ পুরস্কার—মিস সরকার সুতার সুক্ষ্ম কারুকার্য

পঞ্চম পুরস্কার—শ্ৰীমতী বসন্তকুমারী দাস জরীর কাজ

এঁদের মধ্যে তৃতীয় পুরস্কার পান কবি গিরীন্দ্রমোহিনী। পঞ্চম পুরস্কারপ্রাপ্ত বসন্তকুমারী সখিসমিতির কত্রীসভার একজন। অন্যান্য কত্রীরা হলেন, স্বর্ণলতা ঘোষ, বরদাসুন্দরী ঘোষ, ললিতা রায়, সরলা রায়, মনোমোহিনী দত্ত, থাকমণি। মল্লিক, সৌদামিনী গুপ্তা, প্রসন্নতারা গুপ্তা, হিরন্ময়ী দেবী, সৌদামিনী দেবী, চন্দ্রমুখী বসু, মৃণালিনী দেবী, বিধুমুখী রায়, প্রসন্নময়ী দেবী, সুরবালা দেবী, গিরীন্দ্রমোহিনী দেবী ও স্বয়ং স্বর্ণকুমারী।

সখি গিরীন্দ্রমোহিনীর মতো স্বর্ণকুমারীও কবিতা লিখতেন, গান লিখতেন আর লিখতেন গাথা। আজকাল গাথা লেখার দিন শেষ হয়ে গেছে কিন্তু উনিশ শতকে একটা কাহিনী নিয়ে কবিতা লেখাকে বলা হত গাথা। শরৎকুমারীর স্বামী অক্ষয় চৌধুরী গাথা রচনার সূত্রপাত করলে রবীন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারী ও আরো অনেকে গাথা লেখায় মন দিয়েছিলেন। স্বর্ণকুমারীর গাথা পড়ে দু-একটা পত্রিকা বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু আজকের দিনে সে সব রচনা মোটেই সাড়া জাগাতে পারে না এমন কি তার সুন্দর গানগুলোও না। তবে এখনও যে স্বর্ণকুমারী কয়েকটা ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আছেন তার প্রথমটি হল পত্রিকা সম্পাদনা ও দ্বিতীয়টি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ রচনা। আজও কোন লেখিকা কোন নীরস তথ্যভারাক্রান্ত বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে রাজী হবেন কিনা সন্দেহ। এই দুটি ক্ষেত্রে স্বর্ণকুমারী যেন পুরুষোচিত বলিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন।

বাংলায় মহিলা পরিচালিত সাময়িকপত্রের সংখ্যা কম নয়! ১৮৭৫ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অন্ততঃ ২৬ জন সম্পাদিকার আবির্ভাব হয়েছিল। বলাবাহুল্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন স্বর্ণকুমারী। ঠাকুরবাড়ির আরো অনেক মেয়ে এবং বৌ পত্র-পত্রিকা সম্পাদনার কাজে এগিয়ে এসেছেন, তবে সে অনেক পরে। জ্ঞানদানন্দিনীর কথা আগেই বলেছি। তিনি ছাড়াও ইন্দিরা, হিরণায়ী, সরল, প্রতিভা, প্রজ্ঞা, হেমলতা ও আরো অনেকে সম্পাদিকা হিসেবে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

১৮৭৫ সালের জুলাই মাসে থাকমণি দাসীর সম্পাদনায় প্রথম মহিলা। পরিচালিত পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তবে থাকমণি বোধহয় ছিলেন নামে মাত্র সম্পাদিকা। তাঁর বাবা এই পত্রিকা বার করেছিলেন। এর বছর দুই পরে ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত হয় ভারতী। সাত বছর পরে, কাদম্বরীর আকস্মিক মৃত্যুর পর স্বর্ণকুমারী এই পত্রিকার পরিচালনভার গ্রহণ করেন। তিনি যে একজন ভাল সম্পাদিকা একথা হয়ত জানাই যেত না, যদি না কাদম্বরীর আকস্মিক মৃত্যু ঘটত। শরৎকুমারীর ভাষায় এই দুর্দিনে তিনি নারীর পালন শক্তির পরিচয় দিলেন। শুধু কি তাই? এই ভারতীর জন্যেই স্বর্ণকুমারীকে লিখতে হল নতুন নতুন প্রবন্ধ, নাটক, প্রহসন কত কী!

মহিলা নাট্যকারের কথা বলেছি। কিন্তু তারা যে কোনদিন প্রহসন লিখবেন সেটা অনেকেই আশা করেনি। স্বর্ণকুমারী অনেকগুলো নাটক ছাড়া লিখেছেন দুটি প্রহসন। কারুণিক প্যাটার্নের গল্প-উপন্যাস লিখতে লিখতে তিনি যে হাসাতেও পারেন তারই দুটি সার্থক উদাহরণ হয়ে দাঁড়াল পাকচক্র আর কনেবদল। এছাড়া তিনি লিখেছেন অনেকগুলো শারাড! শারাড কথাটা শুনতে যত অপরিচিত লাগছে আসলে তা নয়। খানিকটা রঙ্গকৌতুক পরিবেশনই এর লক্ষ্য। অভিনয়ের মধ্যে থেকে দর্শককে হেঁয়ালিটি বার করতে হয়। যেমন ধরা যাক পাহাড় কথাটি। একজন সাজলেন বোগী, তার পায়ের হাড় ভেঙেছে। ডাক্তার এসে তার পা টিপে টাপে দেখলে; দর্শক বুঝল এর মধ্যে পাহাড় কথাটি লুকিয়ে আছে। স্বর্ণকুমারীর বৈজ্ঞানিক বর ও লজ্জাশীলা শারাড হিসেবে অতুলনীয়। প্রথম মহিলা শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও স্বর্ণকুমারী স্মরণীয়। তার গল্পস্বল্পে (১৮৮৯) ছোটদের মনের কথা সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে।

বঙ্কিমচন্দ্রের মতো স্বর্ণকুমারীও একসঙ্গে সৃষ্টি ও সংস্কারের কাজে হাত দিয়ে উপন্যাসের রম্যজগৎ ছেড়ে নেমে এসেছিলেন প্রবন্ধ লেখার দুরূহ কাজে। তাই, পৃথিবীর মতো কষ্টসাধ্য প্রবন্ধ লেখার পেছনেও তার আন্তরিকতাটুকু চোখে পড়ে। এমন বিষয় নিয়ে, এই রকেট নিয়ে গ্রহান্তরে ছুটে যাবার যুগেও, মেয়েরা বড় একটা প্রবন্ধ লেখেন না। হয়ত মহাবিশ্বলোকে ইশারায় কেঁপে ওঠে তাদের অন্তর। অথচ স্বর্ণকুমারী বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লেখার কাজে হাত দিয়েছিলেন বঙ্কিমের বিজ্ঞানরহস্য প্রকাশের মাত্র সাত বছর পরে, রামেন্দ্রসুন্দর তখনও সাহিত্যের আসরে নামেননি। এমন সময় স্বর্ণকুমারী বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভূবিজ্ঞানীদের মতামত সংকলন করে সাতটি প্রবন্ধ লিখে বাঙালী মেয়েদের মধ্যে বিজ্ঞানালোচনার সূত্রপাত করেন। এসময় স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগে স্কুলপাঠ্য ভূগোল ও বিজ্ঞানের নানারকম বই বেরিয়েছে। কিন্তু স্বর্ণকুমারী প্রবন্ধগুলি লেখেন নবজাগ্রত বাঙালী-মানসে পৃথিবী সংক্রান্ত যাবতীয় প্রশ্নের যথাসম্ভব ভাল উত্তর দেবার জন্যে।

বাংলায় বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লেখবার সময় স্বর্ণকুমারী একটা কঠিন বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন সেটি হল বাংলা পরিভাষার অভাব। পারিভাষিক শব্দের অভাবে বাংলায় লাপলা, হারসেল, টমস, নর্মাণ, লাকিয়ার, গডফ্রে, ব্যালফোর, ফিগুয়ে প্রভৃতি ভূবিজ্ঞানীর মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে স্বর্ণকুমারী প্রথম বেশ বিপদে পড়েছিলেন। তাই নিজেই কিছু পরিভাষা সৃষ্টি করেন। তার তৈরি করা পরিভাষার সংখ্যা কম নয়, তবে তার ঝোঁক ছিল সহজ ও সুশ্রাব্য শব্দের দিকে। যেমন :

ফার্ণ=পর্ণীতরু
পেনামব্রা=উপচ্ছায়া
সেন্সিটিভ = মোহিষ্ণু
সোলর স্পট =সূর্যবিম্ব
পিগমি = বালখিল্য
ট্রায়াসিক = ত্রিস্তর
য়ুনিভার্স= বিশ্বাকাশ
হিপনোটিস্‌ম্‌ =স্বাপ্নিকতা
ডিডাসন = অবরোহ

এইজাতীয় পরিভাষা সুনির্বাচিত শব্দচয়নে স্বর্ণকুমারীর কৃতিত্বের পরিচয় দেয়।

সাহিত্যচর্চা ও সমাজসেবার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্ণকুমারী যোগ দিয়েছিলেন কংগ্রেস অধিবেশনে। তার স্বামী জানকীনাথ ছিলেন ভারতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান নেতা। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কর্মক্ষেত্র ছিল ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস। কংগ্রেসের জন্ম থেকে আরম্ভ করে অনেকগুলো বছর তিনি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনিই হয়েছিলেন কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি। স্বামীর সঙ্গে স্বদেশপ্রেমে দীক্ষা নিয়েছিলেন স্বর্ণকুমারী। তিনি কংগ্রেসের পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধিবেশনে যোগদান করেন। ঐ অধিবেশনে আরেকজন মহিলাও যোগ দিয়েছিলেন, তিনি প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তারও কোন যোগ ছিল না তবে তৎকালীন নারী সমাজে তিনি রীতিমতো আলোড়ন জাগিয়েছিলেন। কাদম্বিনী যেখানে যেতেন, সেখানেই ভিড় জমে যেত তাকে দেখবার জন্য। স্বর্ণকুমারীর স্বদেশ চিন্তা তাঁর শেষ জীবনে লেখা উপন্যাসত্রয়ীতে যেমন প্রতিফলিত হয়েছে তেমনি প্রতিফলিত হয়েছে তার ছোট মেয়ে সরলার জীবনে। এমনকি তিনি ভেবেছিলেন সরলার বিয়ে দেবেন না, তাকে স্বদেশসেবায় উৎসর্গ করবেন। বিদেশের বিশেষত ইংলণ্ডে মেয়েদের স্বাধীনতা, আত্মনির্ভরতা এমনকি রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ সব কিছুই স্বর্ণকুমারীর ভাল লাগত। তিনি জানতেন পুরুষেরা এজন্য বিরক্তি প্রকাশ করে, ঠাট্টা তামাসা করে কিন্তু তাদের সম্মানের চক্ষেই দেখে, তাদের হাতেই কলের পুতুলের মতো নাচে। ভারতের মেয়েরা কি এভাবে এগিয়ে আসবে না। যদিও স্বর্ণকুমারীর সাহিত্যকৃতি কোন পুরস্কারের মুখাপেক্ষী ছিল না তবু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সর্বোচ্চ সম্মান জগত্তারিণী স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। এই পদকের প্রথম প্রাপক স্বর্ণকুমারীর ছোট ভাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। যতদূর জানি তিনিই প্রথম নারী, যিনি এই স্বর্ণপদক লাভ করলেন। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে স্বর্ণকুমারীর উজ্জ্বলতাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *