ব্যাধি

ব্যাধি

বাবুদের বাড়িতে জন্মাষ্টমীর মেলা, তারসঙ্গে উৎসবের আয়োজন তো আছেই। বাবুরা পরম বৈষ্ণব, এ উপলক্ষ্যে দীয়তাং ভূজ্যতাং-এর সমারোহ পড়ে যাবে তাঁদের বাড়িতে।

মাঝখানে মন্দা পড়ে গিয়েছিল। কয়েকটা বড়ো বড়ো মামলার পাপচক্রে মালঞ্চের পালচৌধুরিরা একরকম ডুবে গিয়েছিল বললেই হয়। কোনোমতে নমো নমো করে পূর্বপুরুষের ক্রিয়াকর্মগুলো রক্ষা করা হত। শোনা যাচ্ছিল পৈতৃক ভিটেটাও দিন কয়েকের মধ্যেই নিলামে উঠবে।

কিন্তু হাওয়া বদলে গেল। যুদ্ধ বাঁধল, দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। আর আশ্চর্য, এই একান্ত দুর্বৎসরে যেন কোনো মন্ত্রবলে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল পালচৌধুরীরা। নোনাধরা দেওয়ালের কলি ফিরল, ভাঙা ঘরবাড়িগুলো নতুন করে গড়ে উঠল আবার। দশ বছর আগে হাতিটাও বিক্রি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এবারে এল মোটর,-একখানা নয়, দুখানা। বাবুর বাড়ি আবার পূর্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হল। বাণিজ্যে লক্ষী বাস করেন। যুদ্ধের বাজারে বাবুরা নাকি জমিদারির আশা ছেড়ে ব্যাবসা ধরেছিলেন। সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয়েছে, লক্ষী বর দিয়েছেন।

কলকাতায় লোহার কারবার করেন মেজোকর্তা। তিন বছর পরে তিনি দেশে ফিরেছেন। এবারে জাঁকিয়ে জন্মাষ্টমীর উৎসব করতে হবে। টাকার জন্যে পরোয়া নেই। নীলমণিকে স্পষ্টই বললেন, পাঁচ লাখ সাত লাখ টাকার জন্যে তিনি একবিন্দু মাথা ঘামান না। তিনি আজ ধুলোমুঠো ধরলেই তা সোনা হয়ে যাবে।

শুনে নীলমণি রোমাঞ্চিত হয়ে গিয়েছিল।

মেজোকর্তা গড়গড়ায় টান দিয়ে বললেন, বিশ হাজার টাকা খরচ করব এবার। তাক লাগিয়ে দেব আশপাশের বিশখানা গ্রামকে, সুন্দরগঞ্জের বাঁড়জ্যেদের। তোমার গাঁয়ের সব লোককে বলে দিয়ো নীলমণি, এখানে এবারে তাদের পাতা পড়বে। আর তুমি? তুমি তো ঘরের লোক, বাড়ির সবাইকে নিয়েই চলে এসো, কী বল?

চরিতার্থ হয়ে নীলমণি বলেছিল, আজ্ঞে আনব বই কী, নিশ্চয়।

ভাদ্রের ভরা বিল। ধানখেত আর ভুট্টার শিষের ভেতর দিয়ে নৌকো ঠেলে আসার সময় নীলমণির মনে হয়েছিল কপাল কি এমনি করেই ফেরে মানুষের! তিন বছর আগে এই মেজোকর্তাকেই আট হাত ধুতি পরে সুষ্ঠু কলমি শাক দিয়ে মোটা লাল বাগড়া ভাত খেতে দেখেছিল সে, এবং সেই রাঙা বাগড়া চালও যে কোথা থেকে আমদানি হয়েছিল সে-ইতিহাস নীলমণিই সব চাইতে ভালো করে জানে। সন্ধ্যার অন্ধকারে মেজোগিন্নির নাম লেখা রুপোর বাটিটাকে চাদর ঢাকা দিয়ে সে-ই বিক্রি করে এসেছিল হারান মুদির দোকানে, আর নিরানন্দ নিরালোক বাবুদের বাড়ির ভাঙা তুলসীমঞ্চটার পাশে দাঁড়িয়ে শুনতে পেয়েছিল ঘরের মধ্যে মেজোগিন্নি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।

বিলের জলে সন্ধ্যার বাতাস দোলা দিয়েছে। চারদিকে জল দুলে উঠছে, ফুলে উঠছে, ফেনায় ফেনায় ভেঙে পড়ছে সিন্ধুতরঙ্গের মতো। আর সমস্ত বিল জুড়ে পঞ্চমীর ম্লান অস্তোন্মুখ জ্যোৎস্নায় সেই ফেনা যেন গলিত পুঞ্জ পুঞ্জ রুপোর মতো ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে। অন্তহীন জল, সমুদ্রের মতো জল! মাঠ ডুবিয়েছে, পুকুর ডুবিয়েছে, ধানের খেত, ভুট্টা আর জোয়ারকে তলিয়ে দিয়েছে। ডুবিয়েছে মাঠের ছোটো-বড়ো গাছপালার কুঞ্জকে। এত জল কোথা থেকে এল হঠাৎ। শুকনো খটখটে মাঠ দিয়ে নৌকো যেত, পালকি যেত, পায়ে পায়ে লাগত ধারালো কুশের আচড়। কিন্তু তার পরেই দু-দিন দু-রাত টানা বর্ষাকালো মেঘ থেকে অবিরাম বৃষ্টি। দূরের নদী থেকে ঢালু মাঠের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে জল এল, জল এল কুন্ডলী-করা অসংখ্য কালো কালো অজগর সাপের মতো। দেখতে দেখতে মাঠ হল সমুদ্র। বারো হাত লগি আর থই পায় না, মাথাসুদ্ধ তলিয়ে যায় তার।

মেজোকর্তার সঙ্গে এই বিলের কোথায় কী যেন মিল আছে একটা। হঠাৎ জল—হঠাৎ সমুদ্র। তরঙ্গে তরঙ্গে রুপোর ফেনা।

জন্মাষ্টমীর মেলায় আসার জন্যে বাবু নিজে থেকে বার বার বলে দিয়েছেন। আসতেই হবে। পালচৌধুরিদের সঙ্গে সাত পুরুষের সম্পর্ক, বাবুদের ওঠা-পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নীলমণি নিজেও তার আন্দোলন অনুভব করেছে। কী আশ্চর্য লোক ছিলেন বড়োকর্তা! নীলমণিকে যেন ছেলের মতো ভালোবাসতেন। সুন্দরগঞ্জের বাঁড়জ্যেদের সঙ্গে বড়ো মামলাটায় হারার খবর পেয়ে আচমকা মারা গিয়েছিলেন তিনি। ডাক্তার বলেছিল, এত বড়ড়া একটা আঘাত হঠাৎ তিনি সহ্য করতে পারেননি।মাথার শিরা ছিঁড়ে গিয়ে প্রচুর রক্তপাতের ফলে মৃত্যু ঘটেছিল তাঁর। আর নীলমণি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছারি-পিছাড়ি খেয়েছিল, নিজের বাপ মরার পরেও অমন করে চোখের জল ফেলেনি সে।

মেজোকর্তা অবশ্য একটু আলাদা জাতের মানুষ। কথা বলতেন কম, কিছুটা লেখাপড়া জানতেন বলেই হয়তো প্রজাদের সঙ্গে মেশামেশি বা মাখামাখি করতে তাঁর রুচিতে বাঁধত। কখনো কখনো পুকুরে বসে মাছ ধরতেন, কখনো কখনো কাটাতেন নিজের-হাতে-তৈরি তাঁর কলমের বাগানে। চোখে সোনার চশমা আর গায়ে গেঞ্জি, এই লোকটির সঙ্গে বডোকর্তার অমিলটা বড়ো বেশি করেই চোখে পড়ত। প্রকান্ড ভুড়ি নিয়ে কাঁধে লাল গামছা জড়িয়ে আসর জমিয়ে বসতেন বড়োকর্তা। মোটা মানুষ ছিলেন, জামা গায়ে রাখতে পারতেন না। হোহোহা করে হাসতেন, অকারণে চেঁচিয়ে কথা বলতেন। হাসির ধমকে ভাঁজে ভাঁজে ভুড়িটা দোল খেত।

বড়োকর্তা যতদিন বেঁচেছিলেন, ততদিন মেজোকর্তা ছিলেন যেন পাহাড়ের আড়ালে। তারপর একদিন সে-আড়াল সরে গেল। এতদিন কী করে যে জোড়াতাড়া দিয়ে সংসার চলছিল, বজায় থাকছিল তার ঠাটঠমক, সে-রহস্য একমাত্র বডোকর্তারই জানা ছিল। কিন্তু চমক ভেঙে মেজোকর্তা দেখলেন অকুল পাথার। চারদিকে দেনা, বাস্তুভিটে যায় যায়। জমিদারি তো দূরের কথা, দু-মুঠো ভাতই এখন জোটানো শক্ত হয়ে উঠেছে।

তারপরে দুঃখের ইতিহাস। মেজোগিন্নির গায়ের সোনাদানা গেল, গেল রুপোর বাসন কোসন। কলমি শাকের চচ্চড়ি আর রাঙা চালের ভাত সম্বল। কোথায় রইল কলমের বাগান, কোথায় রইল জার্মান হুইল আর সখের বঁড়শি। মেজোকর্তার পঞ্চাশ ইঞ্চি ধুতি উঠল হাঁটুর ওপরে।

তারও পরে একদিন মেজোকর্তা কলকাতায় চলে গেলেন। ভাগ্যের চাকাটা ঘুরেছে, তিনি গ্রামে ফিরেছেন। এবারে জাঁকিয়ে জন্মাষ্টমীর উৎসব।

নীলমণির মনটা খুশিতে ভরে উঠেছে। বাবুরা উঠুক, আবার দপদপা ফিরে আসুক মালঞ্চের পালচৌধুরিদের। নীলমণি প্রকান্ড একটা গর্ব অনুভব করছে নিজের মধ্যে। বাবুর বাড়ির সাত পুরুষের চাকর সে, বাবুরা উঠলে তারও উত্থান।

তা ছাড়া আরও একটা আশ্চর্য জিনিসও নীলমণিকে চমৎকৃত করে দিয়েছে। দেশে দুর্ভিক্ষ গেছে, না খেয়ে মরে গেছে মানুষ, কিন্তু বাবুদের সঙ্গে ভাগ্যের একটা অলক্ষ সূত্রে যোগাযোগ থাকার জন্যেই হয়তো এই দুর্দিনে তারও কপাল ফিরেছে।

সামান্য মহাজনির কারবার ছিল। সুদে আর বন্ধকিতে যা আসত তাতে দিন চলে যেত। কিন্তু রোজগারের সেই সংকীর্ণ খাতে হঠাৎ যেন জোয়ার নেমে এল তার। নিরুপায় মানুষ নামমাত্র মূল্যে ধানের জমি বিক্রি করতে শুরু করে দিলে। বিলের যেসব ডুবোজমিতে বর্ষার পরে সোনার মতো ফলন হয়, আট-দশ টাকা বিঘা দরে লোকে সেসব জমি ছেড়ে দিলে নীলমণিকে। বিক্রির প্রথম মরশুমে অতি লাভের আশায় যারা খুদকুঁড়ো অবধি বিক্রি করে দিয়েছিল, তাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হল শেষপর্যন্ত জমি বিক্রি করে। আগে ছিল কুড়ি বিঘা, এখন নীলমণি একশো বিঘা ধানিজমির একচ্ছত্র মালিক।

দৈব, দৈব ছাড়া আর কী? মেজকর্তার ধুলোমুঠো সোনা হল, নীলমণির কুড়ি বিঘে হল একশো। হঠাৎ নীলমণির মনে হল বাবুদের সঙ্গে তার সম্পর্কটা শুধু সাতপুরুষের নয়, একেবারে জন্ম-জন্মান্তরের। অকারণেই মেজোকর্তার ওপরে তার শ্রদ্ধাটা বেড়ে গেল দ্বিগুণ। বাবুদের যত বাড়বে, তারও যেন সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলবে, সম্পর্কটা অঙ্গাঙ্গী।

সুতরাং জন্মাষ্টমীর উৎসবে যাওয়ার আহ্বানে নীলমণি উৎসাহিত হয়ে উঠল।

বউ কিছুদিন থেকে নানা জাতের অসুখে ভুগছে, বিছানা ছেড়ে নড়তে পারে না। ছেলেটাও ভুগছে ম্যালেরিয়ায়। অথচ মেজোকর্তা বলেছেন, নীলমণি, সবাইকে নিয়ে এসো, এ তো তোমার ঘরেরই কাজ।

নীলমণির রাগ হয়ে গেল। বউ কেন এভাবে পড়ে আছে বিছানায়, কেন অন্তত আজকের দিনটাতে সে মাথা তুলে উঠে বসতে পারে না, কেন খুশিতে ঝলমলে হয়ে যোগ দিতে পারে

বাবুর বাড়ির আনন্দোৎসবে? একটা প্রকান্ড ছন্দপতনের মতো বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। সে। অসুখেরও কি দিনক্ষণ থাকতে নেই একটা?

বিছানার মধ্যে শুয়ে শুয়েই বউ নীলমণির উত্মাটা অনুভব করতে পারে।

অমন করে চেঁচিয়ে মরছ কেন?

চ্যাঁচাব না? বাবু কত করে বলেছেন সবাইকে নিয়ে যেতে, অথচ তুই দিব্যি বিছানায় পড়ে রইলি।

কী করব বলে। মরতে মরতে তো যেতে পারি না।

দরকার হলে মরতে মরতেও যেতে হয়।

গজগজ করতে করতে এল নীলমণি। ছোটোমেয়েটা সামনে এসে পড়েছে, নাকি সুরে বললে, বাবা, আমি বাবুদের বাড়িতে যাব কিন্তু।

নীলমণি নিরুত্তরে তার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলে।

শেষপর্যন্ত ছোটোমেয়েটাকে নিয়েই নীলমণি রওনা হল বাবুর বাড়ির উদ্দেশে।

দেখতে দেখতে খাল পেরিয়ে নৌকো বিলে এসে নামল। আদিগন্ত সাদায় এবং শ্যামলে একখানা বিরাট চিত্রপট। জল দুলছে, জল ফুলছে, রুপোর ফেনা ছড়িয়ে নেচে উঠছে খুশিতে খেয়ালে। তার মাঝে মাঝে ধানের খেত। সাদা জলের ওপর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে শ্যামল শস্য। বিলের প্রাণরসে পরিপূর্ণ হচ্ছে বঙ্গলীর সোনার ঝাঁপি।

আধোজাগা ধানের শিষ থেকে, ভুট্টার আগা থেকে উড়ে আসছে বড়ো বড়ো ফড়িং। ছোটো-মেয়েটা দু-হাতে ফড়িং ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল।

হঠাৎ লগিতে জোরে একটা খোঁচা দিলে নীলমণি।

কেমন ধান হয়েছে রে পুঁটি?

ভালো ধান বাবা! ফড়িংয়ের দিকে মনোযোগে রেখেই পুঁটি জবাব দিলে।

আমার ধান, বুঝলি? আমার কথাটার ওপর অস্বাভাবিক একটা জোর পড়ল। কুড়ি বিঘে থেকে একশো বিঘেয় পদার্পণের আনন্দটা নীলমণির কণ্ঠ থেকে উছলে উঠল যেন। সব আমার ধান। ওই সামনে, ওই চকের ধারে, যত দেখতে পাচ্ছিস, সব আমার।

সব তোমার? পুঁটি চোখ বড়ো বড়ো করলে।

সব আমার। এবার ঘরে আমার লক্ষ্মী পা দেবেন। তোকে সোনার মাকড়ি গড়িয়ে দেব, কেমন?

পুঁটি এতক্ষণে বড়ো একটা লাল ফড়িংকে ছোটো ছোটো হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে ফেলেছে। ফরফর করে শব্দ করছে সেটা, পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। পুঁটি বললে, আর সোনার বালা?

সোনার বালা!

নীলমণি হো-হো করে হেসে উঠল। পুঁটি ছোটো হলেও বোকা নয়, বুদ্ধিসুদ্ধি তার আছে। মাকড়িতে কতটুকু সোনা থাকে আর! এক জোড়া সোনার বালার দাম যে অনেক বেশি সেটা সে এর মধ্যেই বুঝে নিয়েছে। শুধু দু-টুকরো মাকড়ি দিয়েই তাকে ভুলিয়ে দেওয়া যাবে না।

নীলমণি প্রসন্ন গলায় বললে, আচ্ছা আচ্ছা, সোনার বালাও দেব। কৃষ্ণের ইচ্ছায় এবারেও যদি ধানের দরটা চড়ে যায়…

একশো বিঘে জমির ঘন শ্যামল ধানের দিকে নীলমণি তাকাল। হঠাৎ নিজেকে মনে হল সম্রাট, মনে হল কী বিরাট ঐশ্বর্যের অধিস্বামী। সামনে যতদূরে তাকাও—তার ধান, তার শস্য, তার রাজকর। এই তো সূত্রপাত। সামনে এখনও দিন পড়ে আছে—পড়ে আছে যুদ্ধ। শেষপর্যন্ত নীলমণি কোথায় গিয়ে যে পৌঁছোবে কে বলতে পারে? তারপর একদিন হয়তো পাঁচ বছর, হয়তো-বা সাত বছর পরে একদিন সেও মেজোকৰ্তার মতো বড়ো হয়ে উঠবে। সেও একদিন জন্মাষ্টমীর উৎসবে দশখানা গ্রামকে নিমন্ত্রণ করতে পারবে।

শুধু একটা সমস্যা। সাত বছর ধরে যদি এমনি আকাল চলতে থাকে, তাহলে নিমন্ত্রণ খাওয়ার জন্যে মানুষ বেঁচে থাকবে তো? নইলে জন্মাষ্টমীর উৎসবটা জমে উঠবে কাদের নিয়ে? অথচ গত বছরের অভিজ্ঞতায় যা তার চোখে পড়েছে…

ওই যা, ফড়িংটা উড়ে গেল বাবা।

নীলমণি যেন আত্মস্থ হয়ে উঠল হঠাৎ। নৌকোটা ধানখেতের মাঝখানে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে, বাতাসে চারিদিকে শিরশির করছে সরস শিষ। এই খেত আগে ছিল কাশেম ফকিরের, মহাজনির প্যাঁচে নীলমণি এবারে আত্মসাৎ করেছে এটা। কোথা থেকে দমকা একটা বাতাস এল, ধানের বনের শিরশির শব্দটাকে ছাপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেজে উঠল যেন। মনে হল কাশেম ফকির অভিশাপ দিচ্ছে। জমিটা তুমি নিলে সরকারমশাই, কিন্তু ছেলেপুলেগুলো না খেয়ে মরে যাবে!

মনের প্রসন্নতাটা যেন মেঘের ছায়ায় কালো হয়ে গেছে। এমন জোরে লগিতে খোঁচা দিলে নীলমণি যে নৌকোটা প্রায় লাফিয়ে ছিটকে এল তিন হাত। অনেক দূরে কোথা থেকে বাজনার শব্দ, নিশ্চয় মেজোকর্তার বাড়িতে। ক্ষণিকের দ্বিধাগ্রস্ত মনটা হঠাৎ যেন আশ্রয় পেল, আশ্বাস পেল।

বাবা, ফড়িংটা পালিয়ে গেল।

পালাক। রূঢ়কণ্ঠে জবাব দিয়ে নীলমণি লগি উঠিয়ে বোঠে ধরলে। খেত ছাড়িয়ে এবার গভীর বিল। থইথই সাদা জল। বোঠের টানে নৌকো তরতরিয়ে এগিয়ে চলল। আর দূরে পিছনে বিকালের হাওয়ায় দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল কাশেম ফকিরের ধানের খেত।

বাবুর বাড়িতে পা দিয়েই নীলমণির তো চক্ষুস্থির।

হ্যাঁ, আয়োজন যদি করতে হয়, তাহলে এমনি করেই। বাড়ির সামনেকার মাঠটায় প্রকান্ড মেলা বসে গিয়েছে। বেলুন উড়ছে, ভেঁপু বাজছে, নাগরদোলা ঘুরে চলেছে। পোড়া তেলের কড়া গন্ধ ছড়িয়ে প্রকান্ড কড়াতে ভাজা হচ্ছে বেগুনি, নিমকি, জিলিপি। মাটির পাখি, কাঠের ঘোড়া। পুঁতির মালা, কাচের চুড়ি, মেটেসাবান, তাঁতের শাড়ি, রঙিন তোয়ালে। টিনের বাক্সে জার্মান বায়োস্কোপ :

দ্যাখো দ্যাখো যুদ্ধ হইল, কত মানুষ মরে গেল,
সাহেব বিবি চলে আইল–তামাশা লেও এক পইয়া—
পুঁটি আর চলতে চায় না।

বাবা, পাখি কিনব।

দু-পয়সার তেলেভাজা বাবা।

নীলমণি বললে, চল চল। আগে বাবুর সঙ্গে দেখা করি, প্রসাদ পাই ঠাকুরের, তবে না?

ঠাকুরবাড়িতে আরও বেশি ভিড়। আগে যখন নীলমণি দেখেছিল তখন রাধাশ্যামের আঙিনা জরাজীর্ণ। মন্দিরের দেওয়াল ফেটে গিয়েছে, ছাদ দিয়ে বর্ষার জল চুইয়ে পড়ে দেওয়ালের গায়ে গায়ে এঁকে দিয়েছে শ্যামল সরীসৃপ-চিহ্ন। কার্নিশে কার্নিশে আশ্রয় নিয়েছে। পারাবতের সংসার। কলকূজন আর আবর্জনায় তারা অত বড়ো মন্দিরটাকে পরিপূর্ণ করে রেখেছে। ঠাকুরের শীতল হয় নামে মাত্র, শুধু এক-একটা ক্ষীণ শঙ্খধ্বনি মন্দিরের ফাটলে ফাটলে অতীতের গোঙানির মতো মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে।

কত বার দেবালয়ের এই শ্মশানে প্রণাম করে গেছে নীলমণি। চোখে জল এসেছে মন্দিরের এই অবস্থা দেখে। অথচ বডোকর্তার আমলে কত সমারোহ ছিল এর, কত প্রাণ ছিল। সেদিনের শঙ্খগুলো ধুলো হয়ে ঝরে-পড়া বালি আর কাঁকরের সঙ্গে মিশে গিয়েছে, বড়ো বড়ো ঘণ্টাগুলো ভেঙে মরচে ধরে ছড়িয়ে আছে আনাচেকানাচে, ইঁদুরে কেটে নিয়েছে চামর ছত্র, ঠাকুরের গায়ের সোনাদানা অবধি বিক্রি হয়ে গেছে দেনায়।

কিন্তু আজ? আজ যেন চোখকে বিশ্বাস হয় না। বড়োকর্তা বেঁচে থাকলে তিনিও বিশ্বাস করতে পারতেন কি না বলা শক্ত। মন্দির আগে যা ছিল, তার শতগুণে উন্নতি লাভ করেছে। রাধাকৃষ্ণের গায়ে ঝলমল করছে জড়োয়ার গয়না। শুভ্র চামরের আন্দোলনে, ধূপ-ধুনো গুগগুলের গন্ধে, রাশি রাশি ফুলে আরতি হচ্ছে ঠাকুরের। থালায় থালায় বহুমূল্য ভোগ বেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই দুর্বৎসরে কোথা থেকে এত সব জোগাড় করলেন মেজোকর্তা!

নাটমন্দিরে নামসংকীর্তন চলছে বৈষ্ণবদের। খোল আর করতালের সঙ্গে সঙ্গে উঠছে নামকীর্তন। পদাবলির মাধুর্য উচ্ছলিত হয়ে পড়ছে ভক্তের আবেশবিহ্বল কণ্ঠস্বরে।

হেরিলাম নবদ্বীপে সোনার গৌরাঙ্গ,
 দেহ-মনে উছলিল প্রেমের তরঙ্গ—

নীলমণি বললে, প্রণাম কর পুঁটি, প্রণাম কর। জয় রাধেকৃষ্ণ…

বিচলিত হয়ে মন্দিরের মার্বেল-বাঁধানো রোয়াকে প্রণাম করলে পুঁটি। যতটা ভক্তিতে নয়, তার চাইতে অনেক বেশি বিস্ময়ে এবং ভয়ে। আর গলবস্ত্র হয়ে সেই জনতারণ্যের মাঝখানে মুদিত-চোখে দাঁড়িয়ে রইল নীলমণি।

এসো হে গৌরাঙ্গ আমার সংকীর্তন মাঝে…

ধূপ-ধুনো, বত্রিশটা ঝাড়লণ্ঠনের আলো। জড়োয়ার গহনা থেকে রাধাকৃষ্ণের শ্রীঅঙ্গ দিয়ে যেন দিব্যদ্যুতি ঠিকরে পড়ছে। আবেশবিহ্বল নীলমণি যেন স্বপ্নের চোখে দেখতে লাগল–বৃন্দাবনলীলায় আবার নতুন করে রাধাকৃষ্ণ ফিরে এসেছেন, আর ভাবে বিভোর সোনার গৌরাঙ্গ নাচতে নাচতে নবদ্বীপের কঠিন মাটিতে মূৰ্জিত হয়ে পড়েছেন।

জয় রাধেকৃষ্ণ।

হঠাৎ চমক ভেঙে গেল নীলমণির। চরণামৃতের পাত্র হাতে স্বয়ং মেজোকর্তা সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।

চরণামৃত?

জনতা একের-পর-এক ব্যগ্র ব্যাকুল হাত বাড়াতে লাগল, আর নীলমণি আশ্চর্য মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেজোকর্তার দিকে। সর্বাঙ্গে চন্দন সেবা করেছেন তিনি, গরদের ধুতিতে কী চমৎকার মানিয়েছে তাঁকে। সত্যিকারের বৈষ্ণব মেজোকর্তা—সত্যিকারের ভক্ত।

চরণামৃতের পাত্র এগিয়ে এল। আরও দশজনের সঙ্গে হাত বাড়াল নীলমণি, তুলে ধরলে পুঁটির ছোটো হাতখানা। ভিড়ের মধ্যে মেজোকর্তা নীলমণিকে চিনতে পারলেন না।

কিন্তু সেই মূহুর্তেই বত্রিশ ডালের ঝাড়লণ্ঠনের আলো মেজোকর্তার হাতের ওপরে এসে পড়ল। নীলমণি যা দেখল তা যেন বিশ্বাস করার মতো নয়। মেজোকর্তার হাতের পিঠে একটা সাদা উজ্জ্বল দাগ, তার ভেতরে রক্তের আভা। নিঃসন্দেহে কুষ্ঠ। অথচ বড়োকর্তার হাত, সে-হাত ছিল অম্লান চাঁদের মতো নিষ্কলঙ্ক।

মুখে-মাথায় দিতে গিয়ে চরণামৃত নীলমণির পায়ে পড়ে গেল। ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় কুষ্ঠের অনিবার্য নিঃসন্দেহ দাগটা পাঁচটা সোনার আংটির চাইতে বেশি জ্বলজ্বল করছে। নীলমণি শুনেছিল, বেশি সোনা-রুপো ঘাঁটলে নাকি হাতে কুষ্ঠ হয় মানুষের।

রাত্রের বিলের মধ্য দিয়ে নীলমণির নৌকো চলছিল।

পুঁটি একপাশে ছোটো আর ঘন হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। চারপাশে ছড়ানো রয়েছে তার খেলনাগুলো। অন্ধকার ধানবনের ভেতর দিয়ে নৌকো চলেছে নীলমণির।

নির্জন, নিস্তব্ধ পৃথিবী। চাঁদ-ডুবে-যাওয়া কালো আকাশ, শুধু তারার একটা তরল আলো জলের ভেতর থেকে প্রতিফলিত হয়ে পড়ছে। কোনোখানে জনমানবের সাড়াশব্দ নেই, শুধু নীলমণির নৌকোর লগি পড়ছে : ছপ—ছপ—ছপ–

কাশেম ফকিরের ধানবন। শিরশিরে বাতাস—ধানের শিষে শিষে যেন অশরীরী কান্না। লগির ঘষায় নীলমণির বুড়ো আঙুলের নীচে খচখচ করে জ্বালা করছে।

হঠাৎ নীলমণির যেন চমক লাগল। যে-জায়গাটার ছাল ছড়ে গিয়েছে সেখানে সাদামতো ওটা কীসের দাগ দেখা যাচ্ছে! চকচক করে উঠছে তারার আলোয়। ঝাড়লণ্ঠনের তীব্র শিখায় মেজোকর্তার হাতে সে যা দেখেছিল—এ কি তাই? কুষ্ঠ?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *