আধকপালে

আধকপালে

সকলেই কেমন ভাল ভাল গল্প লেখে। প্রেমের, ভালবাসার, বিরহ-বিচ্ছেদের গল্প। জীবনের জয় পরাজয়, বাঁচার লড়াইয়ের গল্প। কত আর্থসামাজিক প্রশ্ন। বর্তমানের সমস্যাবলি সেই সব গল্পের মধ্যে ফুটে ওঠে।

সুখ-দুঃখের নিটোল গল্প সেসব। তার মধ্যে পাত্র-পাত্রী, চরিত্রাবলি রয়েছে, কথোপকথন অর্থাৎ চোখা চোখা লাগসই সব ডায়ালগ আছে। সব চেয়ে বড় কথা সেখানে কাহিনি আছে। সেই কাহিনির গতি আছে। পরিণতি আছে।

আমার গল্পগুলো কিছুতেই কেন যেন, সেরকম হয় না। হাজার চেষ্টা করলেও না। কী রকম ন্যালাখ্যাপা, উলটোপালটা গল্প হয়ে যায় আমার। সেগুলোর কারণ নেই, কাহিনি নেই শুধু ফ্যা-ফ্যা করে হাসি। কেন যে দয়ালু পাঠক, দয়াবতী পাঠিকা সেই হাঘরে গল্প পড়েন, কেন যে সম্পাদক মহোদয় অনুগ্রহ বশত সেই ফাপা গল্প ছাপেন, সেটা আমি যেমন বুঝতে পারি না, আরও অনেকেই পারেন না। এমনকী আমার স্ত্রী পর্যন্ত পারেন না।

বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির মতো একটা যৎকিঞ্চিৎ গল্পে তিন অনুচ্ছেদ ভূমিকা ফেঁদে বসার পরে খেয়াল হল যে এরকম ভাবে কালক্ষেপণ করা উচিত হচ্ছে না কারণ আমাদের বর্তমান কাহিনির নায়কের আধকপালে হয়েছে। তাঁকে বেশিক্ষণ ঝুলিয়ে রাখা উচিত হবে না।

আমাদের এই কাহিনির নায়কের নাম সুদর্শন পাল। সুদর্শনের আধকপালে হয়েছে।

আধকপালে ব্যাপারটা যাঁরা জানেন না তাদের বোঝানোর চেষ্টা করব না। তবে যেটা আশঙ্কা করেছিলাম যে এই আজব শব্দটি কোনও অভিধানেই থাকবে না, সেটা ঠিক নয়। শব্দটি দেখছি সব অভিধানেই রয়েছে, খুব সম্ভব অভিধানকারেরা সঙ্গত কারণেই এই আধকপালে ব্যারামে খুব ভোগেন, সে জন্যেই শব্দটি অভিধানে চলে গেছে।

অভিধানের কথাই যখন উঠল, আগে আধকপালে শব্দটার অভিধানগত মানেটা দেখে নিই। চলন্তিকায় আধকপালে মানে রয়েছে এক দিকে মাথা ধরা। আর সংসদ বিস্তারিত করে বলেছেন, অর্ধেক বা আংশিক মাথা বা কপাল জুড়িয়া আছে এমন মাথাধরা।

আধকপালে খুব গোলমেলে ব্যারাম। সহজে সারতে চায় না। মাথার একদিকে বাঁয়ে বা ডাইনে একটা মাথাধরা সদাসর্বদা লুকিয়ে থাকে। কিছুতে যেতে চায় না। সারা দিনমান ধরে খুব কষ্ট দেয়। সেই সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে শোয়া পর্যন্ত যন্ত্রণা, কখনও কম, কখনও বেশি।

কিন্তু আমাদের এই কাহিনির নায়ক সুদর্শনবাবুর আধকপালে অসুখটা অভ্যেস হয়ে গেছে। তিনি প্রায় বছরখানেক ধরে এই অসুখে ভুগছেন। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট, খাওয়া-পরা, অফিস-কাছারি করা, টিভি দেখা, খবরের কাগজ পড়া, সব কিছুতেই কষ্ট হত। সব সময় মাথার মধ্যে একটা যন্ত্রণা। কপালের বাঁদিক ঘেঁষে একটা অসহ্য টনটনানি। অডিকলোনের পট্টি কপালে দিলে দরজা জানলা বন্ধ করে চোখ বুজে অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকলে একটু আরাম হত।

মাথা ধরাটা এখনও সব সময়ই মাথার মধ্যে আছে, কিন্তু ব্যাপারটা সহ্য হয়ে গেছে সুদর্শনবাবুর। মাথায় একটু ঝাঁকি লাগলেই যন্ত্রণাটা চিড়িক দিয়ে ওঠে, তা ছাড়া অন্য সময়ে তেমন কষ্ট হয় না। কোনও রকমে কাজকর্ম, দিনগত পাপক্ষয় করে যাওয়া যায়। ব্যথাটা থাকলেও জানান দেয় না।

গত বছরের গোড়ায় যখন প্রথম আধকপালে হল সুদর্শনবাবুর, তিনি দু-চারবার পাড়ার ডাক্তারের কাছে যাতায়াত করে অবশেষে একশো টাকা ভিজিটের বড় ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। বড় ডাক্তার নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মেডিকেল টেস্ট করেও যখন অসুখটার প্রকৃত কারণ নিরূপণ করতে পারলেন না, তিনি সুদর্শনবাবুকে বললেন, সরি, আপনার অসুখটা সহজে সারবে না। ওষুধপত্র খেয়ে কিছু সুরাহা হবে বলে মনে হয় না। অপেক্ষা করে দেখুন। একা একা সেরে যায় কিনা।

কালক্রমে অসুখটা সম্পূর্ণ সেরে যায়নি বটে, তবে তার দাপট অনেকটা কমেছে। সুদর্শনবাবু টের পান যন্ত্রণাটা মাথার মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে, মাথা নড়া-চড়া করলে, বিশেষ করে জোরে হাসলে মাথায় লাগে। তা ছাড়া মালুম হয় না। 

সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহ আগে সেই বড় ডাক্তারবাবুর কাছে আবার গিয়েছিলেন সুদর্শনবাবু। আরেকবার একশো টাকা ভিজিট দিয়ে দেখালেন। সব শুনে ডাক্তারবাবু বললেন, তাহলে তো এখন আর আপনার কষ্ট নেই।

সুদর্শনবাবু বললেন, না স্যার কষ্ট আছে, ওই যে বললাম না হাসলে পরে মাথায় কঁকি লাগলে ব্যথা লাগে। যন্ত্রণা হয়। ডাক্তারবাবু বললেন, এর কিছু করা যাবে না। আপনি হাসা ছেড়ে দিন। এখন থেকে হাসবেন না।

সেই থেকে সুদর্শনবাবু হাসা ছেড়ে দিয়েছেন। মানে ছাড়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু হাসা ছেড়ে দেয়া সহজ কাজ নয়। হাসি সম্পূর্ণ বন্ধ করার আগে এ নিয়ে আরও একদিন আরও একশো টাকা ভিজিট দিয়ে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন, সুদর্শনবাবু। সুদর্শনবাবুর জিজ্ঞাসা ছিল একটা, হাসা ছেড়ে দিলে কোনও ক্ষতি হবে না তো? সুদর্শনবাবু বলেছিলেন, অতি বড় বেয়াড়া বদমাইস, শয়তান লোক পর্যন্ত হাসে। হার্টের রোগী, ফঁসির আসামি, জজসাহেব, মন্ত্রী, উকিল, পুলিশের দারোগা, ডাক্তার পর্যন্ত হাসে। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে, থানার লক-আপে, শ্মশানে পর্যন্ত তোক হাসে। এ অবস্থায় যদি আমি হাসি বন্ধ করি আমার কোনও ক্ষতি হবে না তো?

অনেক রকম ভেবেচিন্তে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, আপনার কথার মধ্যে একটা যুক্তি আছে। কিন্তু আপনি তো ইচ্ছে করে বা শখ করে হাসি বন্ধ করছেন না। হাসতে আপনার কষ্ট হয়, যন্ত্রণা বাড়ে তাই আপনি হাসি বন্ধ করছেন। তা ছাড়া আরও একটা কথা আছে হাসতে যে হবেই এমন কোনও কথা নেই। কোথাও কোনও বইতে, ডাক্তারি শাস্ত্রে এমন কথা লেখা নেই যে হাসতে হবেই, প্রতিদিন এতক্ষণ না হাসলে মানুষ মরে যাবে বা তার কোনও কঠিন অসুখ হবে।

সুদর্শনবাবু বললেন, একদম হাসে না এমন কোনও রোগী আপনি দেখেছেন কি?

ডাক্তারবাবু বললেন, না। সেরকম দেখেছি বলে হলফ করে বলতে পারব না। তবে অনেক রোগীর মধ্যে দু-চারজন এরকম ঘটতেই পারে। সে হয়তো হাসে না কখনওই, কোনও কারণেই হাসে না। সে হয়তো নিজেই জানে না, যে সে কখনও হাসে না। অন্যেরাও হয়তো খেয়াল করে না। এই রকমভাবে না হেসে সে দিব্যি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, কাটিয়ে দেয়। খায়-দায়-ঘুমোয়, বাজার করে, অফিস করে কেউ কিছু টের পায় না। কেউ ধরতে পারে না যে এই লোকটি একদম হাসে না। এই পর্যন্ত একদমে বলে একটু থেমে খুবই দার্শনিকের মতো গলায় ডাক্তারবাবু বললেন, আর ধরবেই বা কী করে। কেউ তো আর সব সময় হাসে না। কথায় কথায় তো আর সর্বদা হাসার দরকার পড়ে না। কেউ যদি একেবারেই কখনও না হাসে সেটা ধরা সহজ নয়। যে লোকটাকে এখন হাসতে দেখা যাচ্ছে না সে যে কখনওই হাসে না সেটা কী করে বোঝা যাবে?

ডাক্তারবাবুর সুপরামর্শ শুনে খুবই দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন সুদর্শনবাবু।

বলা বাহুল্য ডাক্তারবাবুর কথা শুনে তার খুব হাসি পাচ্ছিল। বহু কষ্টে ডাক্তারবাবুর সামনে হাসির বেগ দমন করেছিলেন।

কিন্তু ডাক্তারবাবুর ওখান থেকে ফিরে এসে যখনই ডাক্তারবাবুর উপদেশ তার মনে পড়ছে তিনি অনর্গল হাসির দমকে ফেটে পড়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মাথার মধ্যে বাঁদিকের কপালটা যন্ত্রণায় মুচড়িয়ে উঠেছে। তীব্র ব্যথায় হাসি থেমে গেছে। কিন্তু হাসির কারণটা থেকে গেলে, যত যন্ত্রণাদায়কই হোক হাসি বন্ধ করা কঠিন।

এ ছাড়া আরেকটা গোলমেলে ব্যাপার আছে। সুদর্শনবাবুর ঠাকুরদা ছিলেন হেড পণ্ডিত। বাবা ছিলেন হেডমাস্টার। দুজনেই মোটাসোটা লম্বাচওড়া, কৃষ্ণকায় পুরুষ। আর, সুদর্শনবাবু রোগা, ফরসা চিকন চেহারার মানুষ।

আসলে সুদর্শনবাবু হলেন, মা-গঠনী মানুষ। মায়ের মতো গঠন পেয়েছেন। সুদর্শনবাবুর সেই কৃশকায়া অনতিদীর্ঘা পরমা সুন্দরী জননীর জননী অর্থাৎ তাঁর দিদিমাও একই রকম ছিলেন।

সুদর্শনবাবুর পিতা-পিতামহ ছিলেন স্বভাবত এবং বৃত্তিগত কারণে গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। দৈনন্দিন পৃথিবীতে তাঁরা হাসির কারণ খুঁজে পাননি। বিশেষ কখনও হাসতেন না।

আদতে এটা একটা শৃঙ্খলার নিয়মানুবর্তিতার ব্যাপার। সব কিছু নিয়মমাফিক, শৃঙ্খলার মধ্যে চললে এমন কিছু ঘটা বা ভাবা সম্ভব নয়, যাতে হাসি পেতে পারে।

সুদর্শনবাবু যদি পিতৃপিতামহের সরাসরি উত্তরাধিকার পেতেন তাহলে হাসি বন্ধ করার ব্যাপারে তাকে অত কষ্ট করতে হত না।

কিন্তু ওই যে বলেছি, সুদর্শনবাবু মা-গঠনী সন্তান। তার জিন-কোষ, চিন্তা-ভাবনা সবই মাতৃতান্ত্রিক। ফলে হাসির ব্যাপারটা তিনি জন্মসূত্রে পেয়েছেন মায়ের দিক থেকে।

সুদর্শনবাবুর দিদিমা ছিলেন সুখে-দুঃখে দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে সদারসিকা। দুয়েকটা ছোট উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা প্রমাণ হবে।

দিদিমা ছাদে আমসত্ত্ব শুকোতে দিয়েছেন হালকা বাঁশের ফাঁক ফাঁক ঝুড়ি চাপা দিয়ে। সেই ঝুড়ি উলটিয়ে কালো পাথরের অতিকায় থালা ভরতি আমসত্ত্ব নামাতে গিয়ে ওলটানো ঝুড়ি এবং শূন্য থালা দেখে দিদিমা হেসে আকুল হয়ে গেলেন। সেদিন কেন যে তিনি অত হেসেছিলেন সুদর্শনবাবুর সেটা আজও বোধগম্য নয়।

আরেকবার একটা ব্যাঙ উঠোন থেকে বার বার লাফ দিয়ে ঠাকুরদালানের বারান্দায় উঠবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুতেই প্রয়োজনীয় উচ্চতায় উঠতে না পারায় বার বার বারান্দার নীচে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল। দিদিমা পুজোর ঘরে পুজো বন্ধ করে হাসতে লাগলেন।

সুদর্শনবাবুর মায়ের ব্যাপারে একটা ঘটনার উল্লেখ করলেই যথেষ্ট।

সুদর্শনবাবুর মা একদিন পা পিছলিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। সে সাংঘাতিক পড়া। এক ঘর লোকের সামনে ভারী শরীর নিয়ে মেঝেতে মাথা ঠুকে গিয়েছিল। সাধারণত কেউ হঠাৎ পা পিছলিয়ে পড়ে গেলে যে পড়ে সে ছাড়া বাকি সবাই হেসে ওঠে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা ব্যতিক্রম হয়েছিল। সকলের সঙ্গে নিজের পতনে তিনিও হেসেছিলেন, তখন কিন্তু তাঁর মাথা ফেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে কপাল দিয়ে।

মা-দিদিমার ধাতটা সুদর্শনবাবুও পেয়েছেন। সব কারণেই তার হাসি পায়। ডাক্তারবাবুর হাসতে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও সুদর্শনবাবু ভেবে দেখলেন যে তার মা যদি মাথা ফেটে গেলেও হাসতে পারেন তিনি কেন মাথা ধরা নিয়ে হাসতে পারবেন না। কিন্তু ব্যাপারটা বেশ কষ্টের ব্যাপার।

পূর্বজন্মের গুণ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। সুদর্শনবাবু নিশ্চয়ই বড় ডাক্তারবাবুর কাছে আগের জন্মে অনেক টাকা ধার করেছিলেন। এ জন্মে সেটা শোধ না দিয়ে অব্যাহতি নেই।

তাই এর পরেও আরেকদিন সেই বড় ডাক্তারবাবুর কাছে যেতে হল সুদর্শনবাবুকে। তিনি ইতিমধ্যে সুদর্শনবাবুকে মোটামুটি বুঝে ফেলেছেন। আজ ভদ্রতার খাতিরে আর ভিজিট নিতে চাইলেন না। কিন্তু সুদর্শনবাবু জোর করে একটা একশো টাকার নোট ডাক্তারবাবুর টেবিলে পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে রেখে দিলেন। তিনি বিচক্ষণ লোক। তিনি জানেন ডাক্তারের ভিজিট আর উকিলের ফি সব সময়েই দেওয়া উচিত। তাতেই মঙ্গল হয়। 

সে যা হোক, আজ মহা দুর্যোগের দিন। বাইরে চারদিক কালো করে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। ডাক্তারবাবুর চেম্বারে আজ ভিড় নেই। সর্বশেষ রোগী এক সুদর্শনবাবুই রয়েছেন। আজ সুযোগ পেয়ে তিনি ডাক্তারবাবুর সঙ্গে মন খোলসা করে আলোচনা করলেন।

সুদর্শনবাবু বললেন, ডাক্তারবাবু আপনার পরামর্শ মেনে যে চলা যাচ্ছে না।

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কী পরামর্শ?

সুদর্শনবাবু বললেন, ওই যে আপনি বলেছিলেন না, ওই যে না-হাসতে বলেছিলেন।

 ডাক্তারবাবু বললেন, হাসলে আপনার কষ্ট হয় তাই আপনাকে হাসতে বারণ করেছিলাম।

সুদর্শনবাবু বললে, না হেসে যে পারি না। হাসব না ভাবলে আমার যে আরও বেশি হাসি পায়।

ডাক্তারবাবু প্রশ্ন করলেন, কিন্তু আপনি বলেছিলেন না বেশি হাসলে আপনার যন্ত্রণা বেশি হয়, ব্যথা বাড়ে।

সুদর্শনবাবু জানালেন, খুব কষ্ট হয়। খুব ব্যথা হয়।

ডাক্তারবাবু বললেন, তা হলে আপনি হাসবেন কেন? এত কী হাসির ব্যাপার আছে। কীসে আপনি হাসেন।

সুদর্শনবাবু স্বীকার করলেন যে, বাজারে জিনিসপত্রের দাম শুনলে তার হাসি পায়। খবরের কাগজের খবর পড়লে, নেতাদের বক্তৃতা শুনলে তার হাসি পায়। হাসির গল্প পড়লে, হাসির সিনেমা বা সিরিয়াল দেখলে তার হাসি পায়। দুঃখের গল্প পড়লে, দুঃখের সিনেমা বা সিরিয়াল দেখলে তিনি হাস্য সম্বরণ করতে পারেন না।

সব শুনে ডাক্তারবাবু বললেন, কিন্তু আপনাকে তো হাসলে চলবে না। একটু সাবধানে থাকতে হবে। আচ্ছা আপনি কি ভেবে দেখেছেন এই যে এত পশুপাখি এরা কখনও হাসে না। কুকুর হাসে না, বিড়াল হাসে না, কাক হাসে না, কোকিল হাসে না, গোরু-ঘোড়া, বাঘ-সিংহ এমনকী হায়েনা পর্যন্ত হাসে না। অথচ এদের না হেসে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। যে যার মতো বেশ তরতাজা থাকছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে। না হেসে জীব জগতের এদের কারও বিন্দুমাত্র অসুবিধে বা ক্ষতি হচ্ছে না। তা হলে আপনি কেন হাসবেন? লতা-পাতা গাছ কেউ কখনও হাসে না, তবু আপনাকে হাসতে হবে?

ডাক্তারবাবুর এই বক্তৃতা শুনে ছোট করে অট্টহাস্যে ভেঙে পড়লেন সুদর্শনবাবু। হাসতে হাসতে মাথার যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠতে উঠতে সুদর্শনবাবু বললেন, কিন্তু আমি যে মানুষ। না হেসে আমার যে কোনও গতি নেই। না হেসে আমার কোনও উপায় নেই।

এই বলে ডাক্তারবাবুর চেম্বারের মেঝেতে পেটে হাত দিয়ে হেসে গড়াতে গড়াতে সেই সঙ্গে মাথার ঝুঁকিতে অসহ্য যন্ত্রণায় গোঙাতে লাগলেন সুদর্শনবাবু। তাঁর বক্তৃতার পরিণতি দেখে ডাক্তারবাবু স্তম্ভিত। এর চেয়েও অবাক কাণ্ড হো-হো করে হাসতে হাসতে হঠাৎ এক সময় যন্ত্রণার গোঙানিটা থেমে গেল সুদর্শনবাবুর। তিনি টের পেলেন যন্ত্রণাটা মাথা থেকে চলে গেছে। ডাক্তারবাবুও বুঝতে পারলেন তার সেই পুরনো রোগী এই মাত্র রোগমুক্ত হয়েছেন।

কিন্তু কী করে সেটা সম্ভব হল সেটা তিনি ধরতে পারলেন না।

ধরতে পারলেও তেমন কোনও সুবিধে ছিল না।

শুধু হাসতে হাসতে আধকপালের কঠিন অসুখ সেরে যেতে পারে ডাক্তারবাবুর পক্ষে সেটা ভাবা কঠিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *