৬. ষষ্ঠ গল্প

ষষ্ঠ গল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ–সাহেবের কাজ

ডমরুধরের বাস কলিকাতার দক্ষিণে, যেখানে অনেক কাটি গঙ্গা আছে। প্রথম অবস্থায় ইনি দরিদ্র ছিলেন। নানা উপায় অবলম্বন করিয়া এক্ষণে ধনবান হইয়াছেন। এলোকেশী ইঁহার তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী। ডমরুর বৃদ্ধ, সুপুরুষ নহেন। তথাপি এলোকেশীর সর্ব্বদাই সন্দেহ। গত বৎসর দুর্লভী বাগজিনী ডমরুধরকে ঝটাপেটা করিয়াছিল। সেই উপলক্ষ্যে এলোকেশীও তাঁহাকে উত্তম-মধ্যম দিয়াছিলেন। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে ডমরুর সন্ন্যাসিবিভ্রাটে পড়িয়াছিলেন। সেই অবধি ইনি দুর্গোৎসব করেন। সুন্দরবনে ডমরুধরের আবাদ আছে। প্ৰজাদিগের নিকট হইতে চাউল, ঘৃত, মধু, মৎস প্রভৃতি আদায় করেন। প্রতিমাটি গড়া হয়, কিন্তু পূজার উপকরণ,—প্রায় সমস্তই কাটিগঙ্গার জল। আজ পূজার পঞ্চমীর দিন, দালানে প্রতিমার পার্শ্বে বন্ধুগণের সহিত বসিয়া ডমরুধর গল্প-গাছা করিতেছেন।

লম্বোদর বলিলেন,–এবার তুমি মরিয়া বাঁচিয়াছ, ঐ ভয়ানক রোগ হইয়াছিল, তাহাতে পূজার সময় তোমার গল্প যে আবার শুনিব, সে আশা আমরা করি নাই।

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—হ ভাই। এবার আমি মরিয়া বাঁচিয়াছি। মা দুর্গার আমি বরপুত্র। সেবার সন্ন্যাসি বিভ্রাট হইতে তিনি আমাকে রক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহার কৃপায় গত বৎসর বাঘের মুখ হইতে আমি বাঁচিয়াছিলাম। এবার উৎকট রোগ হইতে তিনি আমাকে মুক্ত করিয়াছেন। সমুদয় দুর্ঘটনা নষ্টচন্দ্র দেখিয়া ঘটিয়াছিল।

আধকড়ি জিজ্ঞাসা করিলেন,–নষ্টচন্দ্র দেখিয়া কি হইয়াছিল?

ডমরুর উত্তর করিলেন,–সে কথা এতদিন আমি প্রকাশ করি নাই। কি হইয়াছিল তাহা শুন। একবার আমি নষ্টচন্দ্র দেখিয়াছিলাম। নষ্টচন্দ্র দেখিলে চুরি করিতে হয়। মনে করিলাম যে, দুর্লভীর উঠানে যে শসা গাছের মাচা আছে, তাহা হইতে শসা চুরি করিয়া আনি। বাহিরে যাহাই বলুক, কিন্তু দুর্লভীর মনটা আমার উপর আছে। শসা চুরি করিতে গিয়া যদি ধরা পড়ি, এলোকেশী যদি কিছু বলেন, তাহা হইলে আমি বলিব যে, নষ্টচন্দ্র দেখিয়া চুরি না করিলে কলঙ্ক হয়।

চুপে চুপে আমি শসা চুরি করিতে যাইলাম। কিন্তু দূর হইতে দেখিলাম যে, দুর্লভী কেরোসিনের ডিবে জ্বালাইয়া ঠেঙা হাতে করিয়া দাওয়াতে বসিয়া আছে। তাঁহার উগ্রমূর্তি দেখিয়া আর অগ্রসর হইতে আমি সাহস করিলাম না।

সে রাত্রিতে আমার চুরি করা হইল না। মনে করিলাম যে, আজ রাত্রিতে না হউক, তিনদিনের মধ্যে কিছু চুরি করিলেই নষ্টচন্দ্রের দোষ কাটিয়া যাইবে। কোথায় কি চুরি করি, রাত্রিতে শুইয়া শুইয়া তাহা ভাবিতে লাগিলাম। দুর্লভীর বাড়ীর পার্শ্বে গদাই ঘোষের পুষ্করিণী আছে। তাহাতে অনেক মাছ আছে। গদাই ঘোষ দুর্লভীর জিম্মায় পুষ্করিণী রাখিয়াছে। মনে করিলাম যে, কাল বৈকালবেলা ছিপ ফেলিয়া সেই পুষ্করিণী হইতে মাছ চুরি করিব।

সুন্দরবনে আমার আবাদের নিকট একবার জনকয়েক সাহেব শিকার করিতে আসিয়াছিলেন। তাঁহারা একটি টুপি ফেলিয়া গিয়াছিলেন। টুপিটি কুড়াইয়া আমি বাড়ী আনিয়াছিলাম। পরদিন সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে সেই টুপিটি বগলে লইয়া ছিপ হাতে করিয়া আমি গদাই ঘোষের পুষ্করিণীর পাড়ে উপস্থিত হইলাম; যে ধার দিয়া লোক যাতায়াত করে, তাঁহার বিপরীত দিকে এককোণ বনে পূর্ণ ছিল। ঝোপের ভিতর গিয়া আমি সাহেবদের সেই কালো রঙের ধুচুনির মত লম্বা টুপিটি মাথায় দিলাম। আজকালের বাবুদের মত গায়ে আমি জামা পরি না। কোমরে কেবল ধুতি ছিল। আমি ভাবিলাম যে, আমাকে কেহ চিনিতে পারিবে না। সকলে মনে করিবে সে সাহেব মাছ ধরিতে আসিয়াছে। সাহেব দেখিলে কেহ কিছু বলিবে না।

নিকটের জল–নাল-ফুল ও কলমি শাকের গাছে পূর্ণ ছিল। কেবল এক স্থানে একটু ফাঁক ছিল। ময়দার টোপ গাথিয়া আমি সেই পরিষ্কার স্থানে ছিপ ফেলিলাম। কিছুক্ষণ পর বোধ হইল যেন মাছে ঠোকরাইল। আমি টান মারিলাম। বঁড়শি জলের ভিতর নাল গাছে লাগিয়া গেল। অনেক টানাটানি করিলাম, অনেক চেষ্টা করিলাম, কিছুতেই খুলিতে পারিলাম না।

তখন বুঝিলাম যে, জলে নামিয়া না খুলিলে আর উপায় নাই। কিন্তু কাপড় ভিজিয়া যাইবে, জলে কি করিয়া নামি। চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম-কেউ কোথাও নাই। কাপড় খুলিয়া উলঙ্গ হইয়া জলে নামিলাম। একবুক জল হইল। অতি কষ্টে নাল গাছের ডাটো হইতে বঁড়শি খুলিয়া উপরে উঠিয়া কাপড় পরিতে যাই—সর্ব্বনাশ! যে স্থানে কাপড় রাখিয়া গিয়াছিলাম সে স্থানে কাপড় নাই। বনের ভিতর চারিদিকে অনেক খুঁজিলাম, কাপড় দেখিতে পাইলাম না।

তখনও সম্পূর্ণ সন্ধ্যা হয় নাই। সে উলঙ্গ অবস্থায় আমি বাটী ফিরিয়া যাইতে পারি। কি করিব। চার করিয়া পুনরায় ছিপ ফেলিলাম। মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম যে, এ সেই কেষ্টা ছোঁড়ার কর্ম, সে আমার টাকের বর্ণনা করিয়া আমাকে ক্ষেপায়। সে দূর হইতে আমাকে বলে-টাক-চাদ, টাক বাহাদুর, টাক টাক টাকেশ্বর।।

কেষ্টা ছোঁড়ার অগম্য স্থান নাই। যখন জলে নামিয়া পিছন ফিরিয়া এক মনে আমি বঁড়শি খুলিতেছিলাম, সেই সময় সে আমার কাপড় লইয়া গিয়াছে। কেবল তাহা নহে। সে দুর্লভীকে গিয়া সংবাদ দিয়াছিল। কারণ, অল্পক্ষণ পরেই দুর্লভী ও হিরী বাগদিনী আসিয়া পুষ্করিণীর অপর পাড়ে দাঁড়াইল।

কিছুক্ষণ একদৃষ্টে আমার দিকে চাহিয়া দুর্লভী বলিল,–একটা সাহেব।

হিরী বাগদিনী বলিল,–সাহেবটার গায়ের রং কালো মিশমিশে। যাহারা পাখী মারিতে আসে, সেই সাহেব। দুর্লভী বলিল,–তা নয়। ওটা নেঙটা গোরা।

হিরী বলিল,–সর্ব্বনাশ! নেঙটা গোরা। তবে আমি পাই; যাকে বলে ব্রাখি, তাই উহারা খায়।–দুর্লভী বলিল,–চল গদাই ঘোষকে গিয়া বলি।

আমি ভাবিলাম,–ঘোর বিপদ হইল। সমস্ত গ্রামের লোককে সঙ্গে লইয়া গদাই ঘোব হয়তো এখনি আসিয়া উপস্থিত হইবে। আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ, মাথায় কেবল এক সাহেবি টুপি। এ অবস্তায় সকলে হয় তো আমাকে এলোকেশীর নিকট ধরিয়া লইয়া যাইবে। সাহেবের পোষাক পরিয়া দুর্লভীর নিকট আমি গিয়াছিলাম, তা নিলে এলোবেশী আয় রক্ষা রাখিবেন না।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ–নারিকেলের বোরা

ছিপগাছটা আমি ফেলিয়া দিলাম। প্রথম বনের ভিতর দিয়া, তাহার পর পুকুরপাড়ের নীচে দিয়া দুর্লভীর ঘরের পশ্চাৎদিকে উপস্থিত হইলাম। ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়া উকি মারিয়া দেখিলাম যে, তাঁহারা ঘরে কেহ নাই। দ্বারটি কেবল ভেজানো আছে। চুপ করিয়া আমি তাঁহার ঘরে প্রবেশ করিলাম। ঘরের ভিতর অন্ধকার। চারিদিক চাহিয়া দেখিলাম। একখানি কাপড় কি একখানি গামছা দেখিতে পাইলাম না। কি করি টুপি মাথায় দিয়া উলঙ্গ অবস্থায় ঘরের এককোণে বসিয়া রহিলাম। মনে করিলাম যে একটু অন্ধকার হইলে পলায়ন করিব। আর যদি দুর্লভী দেখিতে পায়, তাহা হইলে আমার সাহেবের পোক দেখিয়া তাঁহার মনে আনন্দ হইবে।

ওদিকে যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহাই হইল। গদাই ঘোষ গ্রামের চৌকিদার ও অন্যান্য লোক লইয়া পুষ্করিণীর ধারে উপস্থিত হইল। মহা গোল পড়িয়া গেল। ঘরের ভিতর বসিয়া আমি তাহা শুনিতে পাইলাম। ভয়ে সর্ব্বশরীর আমার কাপিতে লাগিল। পুকুরের সেই কোণে বনের ভিতর তাঁহারা অনেক অনুসন্ধান করিল। ছিপ দেখিতে পাইল। কিন্তু সাহেবকে তাঁহারা দেখিতে পাইল না। হতাশ হইয়া সকলে বাড়ী ফিরিয়া গেল। তখন দুর্লভী আসিয়া আপনার দাওয়ায় পিড়িতে বসিল।

এমনসময় রসকের মা আসিয়া বলিল,–দুর্লভী। আমাকে শসা দিবি বলিয়াছিলি, কৈ দে।–দুর্লভী বলিল,–শসা তুলিয়া রাখিয়াছি। ঘরের বাম কোণে ডালায় আছে, গিয়া লও।

আমি ঘরের বাম কোণে বসিয়াছিলাম। আমার ভয় হইল। কোণের দিকে আরও ঘেঁসিয়া বসিলাম। রসকের মা ঘরের ভিতর আসিয়া কোণের কাছে অন্ধকারে হাতবাড়াইতে লাগিল। সহসা ঝনাৎ করিয়া কি একটা শব্দ হইল। সে চীৎকার করিয়া উঠিল, বাম হাত আমার দিকে বাড়াইয়া দিল। আমার গায়ে তাঁহার হাত ঠেকিয়া গেল।

সে চীৎকার করিয়া বলিতে লাগিল, ঘরের ভিতর একটা ভূত বসিয়া আছে। সে আমার হাতে কামড় মারিয়াছে। আমার আঙ্গুলগুলা চিবাইতেছে। এখন আমার সর্ব্বশরীর খাইয়া ফেলিবে।

পরে নিলাম, ঘরে যে দুর্লভীর রাতে ইরকল পাতিয়া রাখিয়াছিল, রসকের মায়ের হাত তাহাতে পড়িয়া গিয়াছিল। কি হইয়াছে, কি হইয়াছে বলিয়া দুর্লভী দৌড়িয়া আসিল। দ্বারের নিকট তাঁহাকে ঠেলিয়া আমি ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম। তখন দুর্লভী আমাকে দেখিতে পাইল। কিন্তু চিনিতে পারিল না। সে চীৎকার করিয়া বলিল,–ভূত নহে ভূত নহে, এ সেই নেঙটা গোরা; আমার ঘরের ভিতর বসিয়াছিল।

তাঁহার চীৎকার শুনিয়া চারিদিক হইতে লোক ছুটিয়া আসিতে লাগিল। আমি আর বাটী পলাইতে অবসর পাইলাম না। কিছু আগে পথের বামদিকে বিন্দু ব্রাহ্মণীর ঘর। বিন্দু ব্রাহ্মণী তখন গোয়ালে বসিয়া ঘুঁটে ধরাইয়া ধোঁয়া করিতেছিল। তাঁহার সেই একখানি মেটে ঘরের দ্বার খোলা ছিল। তাড়াতাড়ি আমি সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম।

ঘরের ভিতর মিটমিট করিয়া এক কেরোসিনের ডিবে জুলিতেছিল। বিন্দু ব্রাহ্মণীর কেহ নাই। একলা সে সেই ঘরে বাস করে। তাঁহার অনেকগুলি নারিকেল, আম, কাঁঠাল ও আতা গাছ আছে। তাঁহার ফল বেচিয়া সে দিনপাত করে।

আমি দেখিলাম যে, ঘরের এককোণে অনেকগুলি নারিকেল পাকার হইয়া আছে। তাঁহার পার্শ্বে পাঁচ বোরা বা গুণের থলি নারিকেল পূর্ণ করিয়া তাহাদের মুখ বন্ধ করিয়া বিন্দু সারি সারি উচ্চভাবে বসাইয়া রাখিয়াছে।

ইতিমধ্যে বাহিরে গোল পড়িয়া গেল। সকলে বলিল, নেঙটা গোরা এইদিকে আসিয়াছে। এস, বিন্দুর ঘরের ভিতর দেখি। হয় তো এই ঘরের ভিতর সে বসিয়া আছে। আমি তখন মা দুর্গাকে ডাকিতে লাগিলাম। আমি বলিলাম যে,–মা। নষ্টচন্দ্র দেখিলে লোককে কি এত সাজা দিতে হয়? প্রতি বৎসর আমি তোমার পূজা করি, এ বিপদ হইতে তুমি আমাকে রক্ষা কর।

তোমাদিগকে আমি বার বার বলিয়াছি যে, আমার উপর মায়ের অপার কৃপা। মা তৎক্ষণাৎ আমার মনে বুদ্ধি দিলেন। নিকটে একটি খালি বোরা পড়িয়াছিল। সেই বোরার মুখে আমি আমার মাথা গলাইয়া দিলাম, তাহার পর টানিয়া আমার সর্ব্ব শরীর পা পর্যন্ত তাহা দিয়া ঢাকিয়া ফেলিলাম! অবশেষে নারিকেলপূর্ণ থলির ন্যায় অপর, পাঁচটি বোরার পার্শে আমিও বসিয়া রহিলাম। তিন চারিজন গ্রামবাসী ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। এদিকে-ওদিকে চাহিয়া দেখিল যে, নেঙটা গোরা ঘরের ভিতর নাই। কেবল হাট নারিকেলপূর্ণ থলি সারি সারি বসিয়া আছে।

ঘরের ভিতর নেঙটা গোরা দেখিতে না পাইয়া সকলের ভয় হইল। একজন বলিল,–তাঁহাকে এই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে আমি নিশ্চয় দেখিয়াছি। তবে এখন কোথায় গেল? এ নেঙটা গোরা নহে; এই বর্ষাকালে জল-কাদায় নেঙটা গোরা কোথা হইতে আসিবে? তাহার পর নেঙটা গোরা এত মিশমিশে কালো হয় না। এ নেঙটা গোরা নহে, এ নেঙটা ভূত।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ–বলাই চিত্তির বিবরণ

ভূতের কথা শুনিয়া সকলে ভয়ে আপন আপন গৃহে চলিয়া গেল। বিন্দু আপনার দাওয়াতে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। সে বলিল যে, কি কপাল করিয়া যে পৃথিবীতে আসিয়াছিলাম, তাহা বলিতে পারি না। আজ রাত্রিতে ভূতে আমাকে খাইয়া ফেলিবে। যাহ হউক, এমন সময় একখানি গরুর গাড়ী লইয়া বলাই চিঙি বিন্দুর গৃহু আসিয়া উপর্ষিত হইল। বলাই জাতিতে সদগোপ। আমাদের গ্রাম হইতে আধক্রোশ মাঠ পরে আমডাঙ্গায় তাঁহার বাস। বিলুর ফল-পাকড় সে হাটে বিক্রয় করে।

বলাই বলিল,–মা ঠাকুরাণি। গাড়ী লইয়া আমি নিশ্চিন্তপুর গিয়াছিলাম। বাড়ী ফিরিয়া যাইতেছি। নারিকেল দিবে বলিয়াছিলে, কই দাও। আজ আমার বাড়ীতে রাশিয়া দিব। কাল ভোরে হাটে লইয়া যাইব।

বিন্দু বলিল,–ঘরের ভিতর বোরা করিয়া আমি একশত নারিকেল রাখিয়াছি। আজ তাহা লইয়া যাও। বাকী পরে দিব।

আমি সম্মুখেই বসিয়াছিলাম আমার থলিটি সে প্রথম তুলিয়া লইল। পা দুইটি আমি থলির ভিতর গুটাইয়া লইলাম। সব ঝুনো, একবার বোঁটা দেখে, এই কথা বলিয়া সে আমাকে গাড়ীর সম্মুখভাগে বসাইয়া দিল। তাহার পর আর পাঁচটি নারিকেলের থলি আনিয়া আমার পশ্চাতে উচ্চভাবেই বসাইয়া দিল।

নারিকেল লইয়া বলাই গাড়ী হাঁকাইয়া দিল। বাড়ী যাইতেছে, সেজন্য গরু দ্রুতবেগে চলিতে লাগিল। গ্রাম পার হইয়া মাঠে গিয়া উপস্থিত হইল। গাড়ীর ভিতর বসিয়া থলির ভিতর যে স্থানে আমার চক্ষু দুইটি ছিল, সেই দুইটি স্থানে আঙ্গুল দিয়া আমি অল্প ফাঁক করিয়া লইলাম। তাহার পর থলির ভিতর হইতে আমি আমার হাত দুইটি বাহির করিতে চেষ্টা করিলাম। এমন সময় আমার মাথা দিয়া বলাইয়ের পিঠে ঢু লাগিয়া গেল। বলাই আপনা-আপনি বলিল,–সম্মুখের থলিটা নড়িতেছে। এখনি পড়িয়া যাইবে। ভাল করিয়া রাখি।

এই কথা বলিয়া সে গাড়ী থামাইল ও বাম পার্শ্বে নামিয়া পড়িল। সেই অবসরে আমিও দক্ষিণ পাশ দিয়া নামিয়া পড়িলাম। বলাই ভাবিল যে, থলিটা পড়িয়া গেল। গরুর সম্মুখ দিয়া ঘুরিয়া সে আমাকে তুলিতে আসিল। তাহার পর সে যাহা দেখিল, তাহাতে তাঁহার আত্মা-পুরুষ শুকাইয়া গেল। নিশ্চয় সে মনে মনে ভাবিয়াছিল যে–এতকাল নারিকেল বেচিতেছি, নারিকেলপূর্ণ বোরার ভিতর হইতে কালো কালো দুইটা পা বাহির হইতে কখনও দেখি নাই। সেই কালো কালো পা দুইটা দিয়া নারিকেলের বোরা যে ছুটিয়া পালায়, তাহাও কখনও দেখি নাই।

কিছুকাল সে সেই পা-ওয়ালা বোরার দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। তাহার পর বাপু এইরূপ শব্দ করিয়া মাঠের মাঝখানে গাড়ী ফেলিয়া অ-পথ দিয়া ক্ষেতের আলি দিয়া পুনরায় আমাদের গ্রামের দিকে দৌড়িল। কিন্তু সে যে আমার ভয়ে সোজা পথ দিয়া আসিতে সাহস করে নাই, তখন তাহা আমি জানিতাম না। পাছে সে আসিয়া আমাকে ধরে, সেজন্য শরীর হইতে বোরা খুলিবার নিমিত্ত, আমি আর দাঁড়াইলাম না। গুণে আবদ্ধ শরীরেই যথাসাধ্য দ্রুতবেগে সোজাপথে আমি গ্রাম অভিমুখে দৌড়িলাম।

গ্রামে প্রবেশ করিলাম। ক্রমে নেকে পালের দোকানের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। গুণের ঈষৎ ফাঁক দিয়া দেখিলাম যে, তাঁহার দোকান খোলা রহিয়াছে, দোকানে আলো জ্বলিতেছে। অনেকগুলি লোকের কথাবার্তা আমার কানে প্রবেশ করিল। দেখিলাম যে, দোকানের সম্মুখে একখানি খালি পাক্তি রহিয়াছে। এমন সময় একজন মানুষের সহিত আমার ধাক্কা লাগিয়া গেল। সেও পড়িয়া গেল, আমিও পড়িয়া যাইলাম। তাড়াতাড়ি আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম। সেও উঠিয়া পাছে চীৎকার করে, সেজন্য পথের দক্ষিণ পাশে একটা বনে গিয়া আমি প্রবেশ করিলাম। বন দিয়া আরও কিছুদূর গিয়া মেনী গোয়ালাবাড়ীর ঘরের পার্শ্বে গিয়া উপস্থিত হই। শরীর হইতে গুণটা খুলিয়া কোমরে জড়াইলাম। গুণ হইতে একটু সূতা বাহির করিয়া কোমরে বাঁধিলাম। এখনও আমার মাথায় সেই সাহেবী টুপী ছিল। তাহার পর হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া চারিদিক আমি দেখিতে লাগিলাম।

টুপিটি এখন আমি ফেলিয়া দিলাম। তাহার পর দেখিলাম যে, নেকোর দোকানের সম্মুখে সে পাক্তি নাই। কিন্তু সে স্থানে অনেকগুলি লোক একত্র হইয়াছে। তাঁহারা সকলেই বলাই চিন্তির বিবরণ শুনিতেছে। বলাই বলিতেছে,–বিন্দু ঠাকুরাণীর নারিকেলের বোরার ভিতর ভূত ছিল। ভূত লইয়া আমি গাড়ীতে বসিয়াছিলাম। মাঠের মাঝখানে সে আমার ঘাড় ভাঙ্গিয়া রক্ত খাইবার উপক্রম করিয়াছিল। অতি কষ্টে আমার প্রাণরক্ষা হইয়াছিল। এমন সময় কেষ্টা ছোঁড়া সেই স্থানে আসিয়া সকলকে জিজ্ঞাসা করিল, আমার ঠাকুরমা কোথায়? অনেকক্ষণ হইল তেল লইতে আমার ঠাকুরমা দোকানে আসিয়াছিলেন। আমার ঠাকুরমা কোথায়?

কিছুদিন পূর্ব্বে কেষ্টা আমার বাগানে বাতাবি লেবু চুরি করিয়াছিল। সেজন্য তাঁহাকে পুলিশে দিতে আমি উদ্যত হইয়াছিলাম। অনেক মিনতি করিলে তাঁহাকে ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। কিন্তু বলিয়া দিয়াছিলাম যে, পুনরায় যদি সে আমার কোন বস্তু চুরি করে, অথবা আমাকে ক্ষেপায়, তাহা হইলে তাঁহার নামে আমি নালিশ করিব। আজ আমার কাপড় লইয়া সে কোথায় ফেলিয়া দিয়াছিল। পাছে আমি নালিশ করি, সেই ভয়ে সে কাহারও নিকট আমার নাম করে নাই। ঐ পুকুরে কে মাছ ধরিতেছে দুর্লভীকে কেবল এই কথা বলিয়া সে সরিয়া পড়িয়াছিল।

এখন কেষ্টার ঠাকুরমা কোথায় গেল? কেষ্টার বাপ ও প্রতিবেশিগণ লণ্ঠন লইয়া চারিদিকে অনুসন্ধান করিতে লাগিল, ক্রমে হৈ হৈ পড়িয়া গেল। সকলে বলিল যে, নেঙটা ভূত কেষ্টার ঠাকুরমাকে লইয়া গিয়াছে। গোল শুনিয়া মেনী গোয়ালা-ড়ী ঘর হইতে বাহির হইল। মেনীর বয়স দশ বৎসর। ছয় বৎসর বয়স্ক একটি ভাই ব্যতীত সংসারে তাঁহার আর কেহ নাই। কয় বৎসর হইল, তাহাদের বাপ ও মা মরিয়া গিয়াছে। তাহাদের মাসী কলিকাতায় এক বাবুর বাড়ীতে চাকরাণী ছিল। মাসী ইহাদিগকে টাকা দিত। মাসীও এখন মরিয়া গিয়াছে।

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ–মেনী ও জিলে

মেনীর ছয় বৎসর বয়স্ক ভাইয়ের নাম ভিলে। ভিলের হাত ধরিয়া মেনী ঘর হইতে বাহির হইল। পথের ধারে গিয়া দাঁড়াইল। আমি যে বনের ভিতর বসিয়াছিলাম, কোর ঠাকুরমাকে অনুসন্ধান করিতে পাছে লোকে সেই স্থানে আসে, সেই ভয়ে মেনীর ঘর খালি পাইয়া আমি তাঁহার ভিতর প্রবেশ করিলাম। মনে করিলাম যে, গোলটা এই মিছিলে মেনী ও তাঁহার ভাই নিদ্রিত হইলে আস্তে আস্তে আমি ঘরে ফিরিয়া যাইব; গুণ পরিয়া বাহির হইলে লোকে আমাকে সন্দেহ করিবে।

ভিলের হাত ধরিয়া মেনী পথের ধারে গিয়া দাঁড়াইল। সুগন্ধী গোয়ালিনী ও অন্যান্য লোক পথ দিয়া যাইতেছিল। মেনী জিজ্ঞাসা করিল,—গন্ধী মাসি। কি হইয়াছে? চারিদিকে এত গোল কেন?

সুগন্ধী উত্তর করিল,–আর বাছা, বলিব কি, সর্ব্বনাশ হইছে। কোথা হইতে একটা নেঙটা গোরা ভূত আসিয়াছে। বলাই চিন্তিকে সে খাইতে গিয়াছিল। তাঁহাকে খাইতে না পাইয়া কোর ঠাকুরমাকে লইয়া গিয়াছে। কিন্তু আমি বলি যে, সে কেষ্টার ঠাকুরমাকে খাইবে না। সেটা গোরা ভূত, কেষ্টার ঠাকুরমাকে মেম করিবে, সেই জন্য তাঁহাকে লইয়া গিয়াছে।

স্কুলের নাম শুনিয়া মেনী তাড়াতাড়ি ভাইকে লইয়া ঘরে আসিল ও ঘরের দ্বার বন্ধ কী দুইজন শয়ন করিল। আমি ঘরের এককোণে বসিয়া রহিলাম। ভিলে বলিল,–দিদি। রায়েদের বাড়ী হইতে আর ভাত আন না কেন? কাল কেবল একটা তাল খাইয়া আমরা ছিলাম। আমাকে সমস্ত দিয়াছিলে, তুমি কেবল একটুখানি খাইয়াছিলে। আজ আমরা কিছুই খাই নাই। রায়েদের বাড়ী হইতে কবে ভাত আনিবে?

মেনী কেনারাম রায়ের শিশু-পুত্রকে লইত, তাঁহারা দুইবেলা দুইটি ভাত দিতেন। বাড়ীতে আনিয়া সেই ভাত ভাই-ভগিনীতে ভাগ করিয়া খাইত। আজ দুইদিন হইল রায়ের শিশুপুত্র এক সোঁ-পোকা ধরিয়াছিল, মেনী তাহা দেখে নাই, সেজন্য মেনীকে তাঁহারা ছাড়াইয়া দিয়াছেন।

মেনী উত্তর করিল,—রায়েদের খোকা সোঁ-পোকা ধরিয়াছিল। সেজন্য তাঁহারা আর আমাকে ভাত দিবেন না। —ভিলে বলিল,–তবে দিদি আমাদের কি হবে? ভাত কোথা হইতে আসিবে? ক্ষুধায় আমার পেট জুলিয়া যাইতেছে।

মেনী উত্তর করিল,–দেখ ভিলু। পাড়ার লোকের নিকট হইতে কাল তোমাকে দুইটি ভাত আনিয়া দিতে পারি। কিন্তু চাউলের দাম বাড়িয়াছে, বোজ বোজ লোকে দিবে কেন? আমাদের দশা কি হইবে, তাহাই ভাবিতেছি!

ভিলে বলিল,–তবে দিদি কি হবে, ভাত না খাইয়া আর আমি থাকিতে পারি না। আজ সমস্ত দিন কিছু খাই নাই, আমার বড় ক্ষুধা পাইয়াছে। স্কুথায় আমার পেট জুলিয়া যাইতেছে।

মেনী বলিল,–আর বত্সর ভড়েদের বাড়ী দুর্গা ঠাকুর দেখিয়াছিলে! সেই দশ হাত আর কত রাঙতা? ভড়েরা তোমাকে মুড়কি ও নারিকেল নাড়ু দিয়াছিল? পূজা হইয়া গেল বোসেদের গঙ্গার ভিতর আছেন। কাল যদি তোমাকে দুইটি ভাত দিতে না পারি, তাহা হইলে আমরা দুইজনে বোসেদের গঙ্গায় যাইব। তোমাকে কোলে লইয়া আমি জলে ঝাঁপ দিব: জলের ভিতর মা দুর্গা আছেন; তাঁহার কাছে আমরা যাইব। তিনি আমাদিগকে অনেক ভাত দিবেন, আমাদের সকল দুঃখ ঘুচাইবেন।

ঘরের কোণে বসিয়া ভাই-ভগিনীর কথোপকথন আমি শুনিতেছিলাম। অল্পক্ষণ পরেই দুইজনে ঘুমাইয়া পড়িল। ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয়া আমি গৃহে প্রত্যাগমন করিলাম। রাত্রি তখন কেবল নয়টা হইয়াছিল, আমার বাড়ীর দ্বার বন্ধ হয় নাই। চুপি চুপি ঘরের ভিতর গিয়া গুণ ফেলিয়া কাপড় পড়িলাম। তাহার পর এলোকেশীর মুখে শুনিলাম যে, কোর ঠাকুরমাকে লোকে তখনও খুঁজিয়া পায় নাই।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ–ডমরুধরের হীরক লাভ

মেনী গোয়ালা-ছুঁড়ীর ঘর ঠিক আমার বাগানের পাশে। ঐ স্থানটিতে আমার বাগানে একটু খোঁচ হইয়া আছে। মেনী ও তাঁহার ভাই মরিয়া গেলে ঐ ভূমিটুকু আমি লইব। তাহা হইলে আমার বাগানের খোঁচটি ঘুচিয়া যাইবে। তাঁহারা সত্য সত্যই বোসেদের গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়া মরিবে কি না, তাহা জানিবার নিমিত্ত পরদিন প্রাতঃকালে বেলা দশটার সময় আমি ঘর হইতে বাহির হইলাম। পথে দেখিলাম যে, কেষ্টাদের বাড়ীতে হু হু করিয়া একখানা পাল্কী আসিয়া লাগিল, পাল্কীর ভিতর হইতে কেষ্টার ঠাকুরমা বুড়ী বাহির হইল; তাহার পর লাঠি ধরিয়া ঠুক টুক করিয়া গৃহে প্রবেশ করিল।

বুড়ী কোথায় গিয়াছিল ও কোথা হইতে আসিল, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমি সে স্থানে যাইলাম। শুনিলাম যে গোবর্ধনপুর হইতে একজনদের বৌ লইয়া একখানা পাখী নিশ্চিন্তপুর গিয়াছিল। বৌ রাখিয়া খালি পাল্কী সন্ধ্যার পর ফিরিয়া নেকোর দোকানে পাক্ষী রাখিয়া বেহারাগণ তামাক খাইতেছিল। সেই সময় কেষ্টার ঠাকুরমা তেল লইতে দোকানে আসিতেছিল। বোরার ভিতরে থাকিয়া যে নেঙটা ভূতটা বলাই চিন্তিকে খাইতে গিয়াছিল, সেই ভূতটা আসিয়া কোর ঠাকুমাকে ধাক্কা মারিয়া ফেলিয়া দিল। কিন্তু দোকানে অনেক লোক দেখিয়া কোর ঠাকুরমাকে লইয়া যাইতে পারিল না। তৎক্ষণাৎ সে বাতাসে মিশিয়া গেল। কেষ্টার ঠাকুরমা উঠিয়া ঘোরতর ভয়বিহুল হইয়া, সম্মুখে একখানা পাল্কী ও তাঁহার দ্বার খোলা দেখিয়া তাঁহার ভিতর প্রবেশ করিল। তাহার পর দ্বার বন্ধ করিয়া পাকীর ভিতর সে অজ্ঞান হইয়া পড়িল। বেহারাগণ তাহা জানিতে পারে নাই। বলাই চিন্তির নিকট ভূতের গল্প শুনিয়া তাড়াতাড়ি পাঞ্জী তুলিয়া তাঁহারা চলিয়া গেল। রাত্রি দুই প্রহরের সময় তাঁহারা গোবর্ধনপুর পৌঁছিল। সেই স্থানে গিয়া পাকীর ভিতর বুড়ীকে দেখিতে পাইল। কিন্তু ভূতের ভয়ে সে রাত্রিতে বুড়ীকে ফিরিয়া আনিতে পারিল না। কারণ, এ সামান্য ভূত নহে, এ নেঙটা গোরা ভূত! আজ প্রাতঃকালে বুড়ীকে বাড়ী ফিরিয়া আনিল। আমি ভাবিলাম যে, সামান্য একটা সাহেবের টুপি পরিয়াছিলাম, তাহাতে কি কাণ্ড না হইল। এ সব নষ্টচন্দ্রের খেলা।

গোয়ালা-মুড়ী মেনীর বাড়ী গিয়া দেখিলাম যে, যাহারা শিশি বোতল ক্রয় করে, সেইরূপ একটা লোক সে স্থানে বসিয়া আছে। ঘরের ভিতর হইতে একটা বোতল ও একটা শিশি আনিয়া মেনী তাঁহাকে দেখাইতেছে। শিশির ভিতর ছোট একখণ্ড কাচের ন্যায় কি ছিল। ভিলে তাহা বাহির করিয়া খেলা করিতে লাগিল। আমি দেখিলাম যে, সেই ক্ষুদ্র কাচটাতে পল কাটা আছে, আর সেই পল হইতে নানা বর্ণের আভা বাহির হইতেছে। আমি ভাবিলাম যে এরূপ কাচ ইহাদের ঘরে কোথা হইতে আসিল, যে স্থান হইতে আসুক, এ সামান্য কাচ নহে। বোতল ও শিশির লোকটা মেনীকে চারিটি পয়সা দিল। ভিলের নিকট হইতে আমি কাচখণ্ড চাহিলাম। ভিলে দিতে সম্মত হইল না। এই পয়সা দিয়া তাহা আমি কিনিতে চাহিলাম। তখন মেনী বলিল,–দাও, দাদা, দাও। কাচটুকু লইয়া তুমি কি করিবে? ডমরুবাবু দুই পয়সা দিলে আমাদের ছয় পয়সা হইবে। ছয় পয়সার চাউল কিনিলে দুইদিন তোমাকে পেট ভরিয়া ভাত দিতে পারি।

ভিলে বলিল,–বড় ক্ষুধা পাইয়াছে। আমি কলাপাতা কাটিয়া আনি?

মেনী বলিল,–না ভাই, এখন নয়। রও, আগে নেকোর দোকান হইতে চাউল কিনিয়া আনি, ভাত রাঁধি তখন কলাপাতা কাটিয়া আনিও।

শিশি বোতল লইয়া লোকটা চলিয়া গেল। কাচখণ্ড লইয়া আমিও বাটী আসিলাম। মনে করিলাম, কখনই কাচ নহে। এবার কলিকাতা গিয়া কোন জহুরীকে দেখাইব।

কিন্তু সেই বৈকালবেলা আমি বিষম গোলযোগে পড়িলাম। কলিকাতা হইতে একটি লোক আসিয়াছিল। সে কেষ্টার বাপ, গ্রামের চৌকিদার, শিশি-বোতল ক্রেতা; মেনী ভিলে ও অন্যান্য গ্রামবাসীকে সঙ্গে করিয়া আমার বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। কলিকাতার সেই লোকটা বলিল,—আমি যোগেশবাবুর সরকার। আমার বাবুর বাড়ীতে এই বালিকার মাসী চাকরাণী ছিল। যোগেশবাবুর স্ত্রী ঘোরতর পীড়িত হইয়াছেন। ইহার মাসী তাঁহার অনেক সেবা করিয়াছিল। যোগেশবাবুর স্ত্রীর কানে দুইটি হীরার টপ ছিল। কিছুদিন পূর্ব্বে একটি টপ হারাইয়া গিয়াছিল। ভালরূপ জোড়া মিলাইতে না পারিয়া অপর টপটি তাঁহার বাজতে তিনি ফেলিয়া রাখিয়াছিলেন। পুরস্কার স্বরূপ ইহার মাসীকে তিনি সেই টপটি দিয়াছিলেন। তাঁহার সোনাটুকু ইহার মাসী বোধ হয় বেচিয়া ফেলিয়াছিল। কাচ মনে করিয়া হীরকখণ্ড শিশির ভিতর ফেলিয়া রাখিয়াছিল। তাঁহার মূল্য চারিশত টাকা। আপনি দুই পয়সায় তাহা ফাকি দিয়া লইয়াছেন। যে টপটি হারাইয়া গিয়াছিল, এক্ষণে তাহা মিলিয়াছে। সেজন্য জোড়া মিলাইবার নিমিত্ত এই বালিকা ও তাঁহার ভ্রাতাকে চারিশত টাকা দিয়া হীরকখণ্ড লইতে বাবু আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন। হীরকখণ্ড আপনি আমাকে প্রদান করুন।

পয়সা দিয়া কিনিয়াছি, কেন আমি দিব, এইরূপ বলিয়া প্রথম আমি দিতে সম্মত হই নাই। কিন্তু পরে বুঝিলাম যে, যোগেশবাবু আমাকে সহজে ছাড়িবেন না। চিরকাল মামলা মোকদ্দমা করিয়া আসিতেছি। মামলা মোকদ্দমা আমি বিলক্ষণ জানি। আমি বুঝিলাম যে, মোকদ্দমা হইলে হীরা আমি রাখিতে পারিব না, চাই কি আমার সাজা হইলেও হইতে পারে। ফলকথা, হীরা আমাকে ফিরিয়া দিতে হইল। যোগেশবাবু হীরার মূল্য চারিশত টাকা মেনী ও ভিলের নামে একস্থানে জমা রাখিয়াছেন। এক্ষণে প্রতি মাসে তিনি আহলিশকে পাঁচ টাকা করিয়া দিতেছেন।

হীরকও গেল, বাগানের খোঁচটিও ভাঙ্গিল না। মনে আমার ঘোরতর দুঃখ হইল। মা দুর্গাকে ভৎসনা করিয়া আমি বলিতে লাগিলাম,–মা! কেন আমার এরূপ হরিষে বিষাদ করিলে? চারিশত টাকা আমার হাতে দিয়া কেন আবার কাড়িয়া লইলে? এবার হইতে আর মা, তোমার আমি পূজা করিব না।

পূজা করিব না শুনিয়া মা দুর্গার বোধহয় রাগ হইল। আমাকে আক্রমণ করিবার নিমিত্ত পরদিন তিনি জরাসুরকে প্রেরণ করিলেন। কম্প দিয়া আমার জ্বর আসিল। একদিন গেল, দুই দিন গেল, জ্বর ক্রমেই বাড়িতে লাগিল। তিন দিনে আমি বেচু ভুকে ডাকিতে পাঠাইলাম। বেচু জাতিতে কৈবর্ত। প্রথম সে চাষ করিত, এখন কবিরাজ হইয়াছে। চারি পাঁচখানা গ্রামে বেচুর বিলক্ষণ পসার হইয়াছে। আমার হাত দেখিয়া বেচু শ্লোক পড়িয়া বলিল,–

কম্প দিয়া জ্বর আসে কম্প দেয় নাড়ী।
ধড় ফড় করে রোগী যায় যম-বাড়ী।।

ইহাকে বিষ-বড়ি দিতে হইবে।

এলোকেশী নিকটে ছিলেন। তিনি বলিলেন,–সে কি! তিন দিনের জ্বরে বিষ-বড়ি?

বেচু বলিল,–এ সামান্য বিষ-বড়ি নয়। এ নূতন ঔষধ সম্প্রতি আমি নিজে মনগড়া করিয়া প্রস্তুত করিয়াছি। ইহাতে কোন দোষ নাই। ইহার গুণ অনেক। এই দেখ, আমি নিজে আস্ত দুইটা খাইয়া ফেলি।

এই কথা বলিয়া বেচু নিজে দুইটা বড়ি গিলিয়া ফেলিল। তাহার পর মধুর সহিত খলে মাড়িয়া আমাকে কটা বড়ি খাইতে দিল।

বেচু চলিয়া গেল। তিন ঘণ্টা পবে তাঁহার ঔষধের গুণ প্রকাশিত হইল। আমার চক্ষু দুইটি লাল হইয়া উঠিল। বুক ধড়ফড় করিতে লাগিল। শরীর অবসন্ন হইয়া আসিল। প্রাণ যায় আর কি! এলোকেশীর মেজাজটা কড়া বটে, কিন্তু শরীরে অনেক গুণ আছে। মাটীতে পড়িয়া তিনি কাঁদিতে লাগিলেন।

ডমরুধরের বন্ধু আধকড়ি বলিলেন,হাঁ, সেই সময় আমি তোমার বাড়ীতে আসিয়াছিলাম। তোমার সেই অবস্থা দেখিয়া তাড়াতাড়ি আমি বেচু ভুকে ডাকিতে যাইলাম। বেচু ঘরে ছিল না। খুজিতে খুঁজিতে দেখিলাম যে, সে এক পানা-পুকুরের জলে গা ড়ুবাইয়া বসিয়া আছে। তাঁহার চক্ষু দুইটি জবাফুলের ন্যায় হইয়াছে। পানা-পুকুরের পচা পাক তুলিয়া মাথায় দিতেছে! আমি বলিলাম,–বেষ্ণু! করিয়াহ কি? ডমরুধরকে তুমি কি ঔষধ দিয়াছ? তোমার ঔষধ খাইয়া ডমরুর মারা পড়িতে বসিয়াছে। মাথায় কাদা দিতে দিতে বাজখাই স্বরে বেচু উত্তর করিল,–বড়ি খাইয়া আমিই বা কোন ভাল আছি। আমি বুঝিলাম যে সে অবস্থায় তাঁহাকে আর কোন কথা বলা বৃথা। পুনরায় তোমার বাটীতে আসিয়া মাথায় অনেক জল দিয়া সে যাত্রা তোমার প্রাণ আমরা রক্ষা করিলাম।

গুমরুর বলিলেন,–বেচুর ঔষধ হইতে প্রাণ রক্ষা হইল বটে কিন্তু জ্বর আমার গেল না। পীড়া কঠিন হইয়া উঠিল। তোমরা সকলেই আমাকে দেখিতে আসিতে। তোমরা সকলেই মনে করিয়াছিলে যে, সে যাত্রা আমি আর রক্ষা পাইব না। একদিন রাঘব ও নকুল ভট্টাচাৰ্য মহাশয় আমাকে দেখিতে আসিয়াছিলেন। বিছানার দুইপার্শ্বে দুইজনে বসিয়া আমাকে অনেক আশ্বাস ও ভরসা দিতে লাগিলেন।

রাঘব বলিলেন,–দেখুন ভট্টাচাৰ্য মহাশয়, অঙ্গদ মজুমদারকে আপনি জানিতেন? তাঁহার শরীরটি ঠিক ডমরুধরের মত ছিল। এইরূপ কাটি কাটি হাত, এইরূপ কাটি কাটি পা, শরীরে চর্বি একটুও ছিল না। তাঁহার পীড়াটিও ঠিক এইরূপ হইয়াছিল। চিতার উপর তাঁহাকে শোয়াইয়া যখন আমরা আগুন দিলাম, তখন সেই আগুনের তাতে তাঁহার শরীরটি শটকে উঠিল। ধনুকের মত হইয়া তাঁহার মাজাটা চিতার উপর উঠিয়া পড়িল। কাঠ সব পুড়িয়া গেল। কিন্তু অঙ্গ পুড়িল না।

তাঁহাকে আমরা জলে ফেলিয়া দিলাম। কিন্তু আমরা স্নান করিয়া উঠিতে না উঠিতে, পাঁচ ছয়টা কুকুর ও শৃগাল আসিয়া জলে ঝাপাঝাপি করিয়া তাঁহাকে খাইয়া ফেলিল। ডমরুবাবু তোমার শরীরটিও ঠিক সেইরূপ। কিন্তু তোমার ভয় নাই। আমরা অধিক কাঠ দিয়া দেখিব। তবে নিতান্তই যদি তুমি পুড়িয়া না যাও, তাহা হইলে কাজেই তোমাকে আধপোড়া করিয়া ফেলিয়া দিতে হইবে।

নকুল ভট্টাচার্য আমাকে বলিলেন,–তোমার পুববাহিতের বাড়ী এ স্থান হইতে দুই ক্রোশ। মন্ত্র পড়াইতে রাত্রিতে যদি আমাকে ঘাটে যাইতে হয়, তাহা হইলে শ্রাদ্ধ আমাকে দিয়া করাইতে হইবে। নিজের পুরোহিতকে দিয়া করাইতে পারিবে না। তুমি সে কথা বাড়ীতে বলিয়া রাখ। মৃত্যু হইয়া গেলে আর কথা বলিতে পারিবে না,–

মনে কর শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর।

অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর।

এলোকেশী পাশের ঘরে বসিয়া এইসব কথা শুনিতেছিলেন। সহসা খেঙরা হস্তে উগ্রচণ্ডীর ন্যায় রণমূর্তিতে আসিয়া সস্ পরিয়া এক ঘা নকুলের পিঠে বসাইয়া দিলেন। তাহার পর আর এক ঘা রাঘবের মাথায়। ঘর হইতে দুইজনে পলাইলেন। এলোকেশী তাহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়া আরও দুই চারি ঘা বসাইয়া দিলেন।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ–ডমরুধরের বুকে প্যাঁচ

ঈষৎ হাস্য করিয়া আমি বলিলাম,এলোকেশী! তুমি যাহা করিলে, তাহাতে আমার অর্ধেক রোগ ভাল হইয়া গেল। আর আমাকে কোনরূপ ঔষধ খাইতে হইবে না। এলোকেশী সে কথা শুনিলেন না। পরদিন গোবর্ধনপুরে তিনি ডাক্তার আনিতে পাঠাইলেন।

ডাক্তার আসিয়া আমার নাড়ী দেখিলেন, জিয়া দেখিলেন, পেট টিপিয়া দেখিলেন। বুকের উপর বামহন্ত রাখিয়া দক্ষিণ হস্তের আলির ডগা দিয়া ঠাকুইকি করিলেন। তার পর আমার বুকে চোঙ বসাইলেন। চোঙের অন্যদিকে কান দিয়া তিনি বলিলেন,–এখানে একটা প্যাঁচ আছে। এইরূপ তিন চারিটা প্যাচের কথা বলিলেন। প্যাঁচ আছে শুনিয়া আমার মনে ভরসা হইল। আমি ভাবিলাম যে, আমার যখন এতগুলি প্যাঁচ আছে, তখন আমি মরিব না, বহুকাল আমি বাঁচিব।

ডাক্তার তাহার পর পুলটিস ও ঔষধের ব্যবস্থা করিলেন। খাইবার নিমিত্ত আমাকে সাবু দিতে বলিলেন। সাবুর নাম শুনিয়া আমার সর্ব্বশরীর জুলিয়া উঠিল। আমি বলিলাম,–কি! সাবুদানা? বিলাতি জিনিষ। তাহা কখনই খাইব না। চিরকাল আমি পরম নিষ্ঠাবান হিন্দু। অখাদ্য খাইয়া আমি অধর্ম্ম করিতে পারিব না। ডাক্তারবাবু। আপনি বোধ হয় জানেন না যে, কয়েক বৎসর পূর্ব্বে সন্ন্যাসী-বিভ্রাটে পড়িয়া আমার সূক্ষ্ম শরীর যমের বাড়ী গিয়াছিল। যখন আমার বিচার হয়, তখন আমি যমকে বলিয়াছিলাম যে, একাদশীর দিন কখন আমি পুইশাক ভক্ষণ করি নাই। যম সেই কথা শুনিয়া প্রসন্নবদনে হর্ষোফুল লোচনে পুলকিত মনে বলিলেন,–সাধু সাধু সাধু! এই মহাত্মা একাদশীর দিন পুইশাক ভক্ষণ করেন না। ইহার পদার্পণে আজ আমার যমপুরী পবিত্র হইল। শীঘ্র তোমরা যুমনীকে শঙ্খ বাজাইতে বল। যমকন্যাগণকে পুষ্পবৃষ্টি করিতে বল। বিশ্বকর্মাকে ডাকিয়া আন। ভুঃ ভুবঃ স্বঃ মহঃ জনঃ তপঃ সত্যলোক পারে ধ্ৰুলোকের উপরে এই মহাত্মার জন্য মন্দাকিনী কলকলিত, পারিজাত-পরিশোভিত, কোকিল কুহরিত, ভ্রমর-গুঞ্জরিত, অপ্সরা পদ-নুপুর বুনিত, হীরা-মাণিক-খচিত, নূতন এক স্বর্গ নির্মাণ করিতে বল। শুনিলেন ডাক্তারবাবু! খাদ্যাখাদ্যের বিচার করিলে কত ফল হয়? আমি আশ্চর্য হই যে, টিকিনাড়ারা এখানেওখানে যায় কেন, ধর্ম্মকথা শিখিতে আমার কাছে আসে না কেন?

আমি পুনরায় বলিলাম,–ডাক্তারবাবু! বুকে আমি তোমারও জগদ্দল পাথর মনের পুলটিস চাপাইব না, তোমার ঔষধও আমি খাইব না। কেবল আমি মা দুর্গাকে ডাকিব, আর আমাদের কাটিগঙ্গার জল খাইব। আমাদের কাটিগঙ্গার জল মকরধ্বজের বাবা।

আমি কাহারও কথা শুনিলাম না। সেইদিন হইতে আমি কেবল কাটিগঙ্গার জল খাইতে লাগিলাম। সেই রাত্রিতে মা দুর্গা শিয়রে বসিয়া আমার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন,–ডমরুধর। বাছা! তুমি আমার বরপুত্র। কেন তুমি বলিয়াছিলে যে, আর আমার পূজা করিবে না? সেই জন্য তোমাকে এই রোগ দিয়াছি। কিন্তু ভয় নাই, তোমাকে রোগ হইতে মুক্ত করিলাম। তাহার পর আরও একটুও নূতন বুদ্ধি তোমাকে আমি দিলাম। এই বুদ্ধিটুকু তুমি খেলাইবে। তাহা হইলে হীরাখও হাতছাড়া হইয়া তোমার যে ক্ষতি হইয়াছে, তাঁহার দশগুণ তোমার লাভ হইবে। কিন্তু বাছা, তোমার পূজায় আমি যে তৃপ্তিলাভ করি, বঙ্গদেশে কাহারও পূজায় সেরূপ তৃপ্তিলাভ করি না।

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ–ডমরক্সের নূতন বুদ্ধি

সেই দিন হইতে আমার রোগ দূর হইয়া গেল। জ্বর গেল। দিন দিন শরীরে বল পাইতে লাগিলাম। রোগের পর আমার যেন নূতন শরীর হইল। এখন মা যে নূতন বুদ্ধিটুকু আমাকে দিয়াছেন, তাহা খেলাইয়া হীরকের দশগুণ টাকা আদায় করিতে আমি চেষ্টা করিতে লাগিলাম।

একদিন বসিয়া বুদ্ধি খেলাইতেছি এমন সময় আমার মনে কোন বিষয় উদয় হইল। আমি একটু হাসিয়া ফেলিলাম। এলোকেশী জিজ্ঞাসা করিলেন,–হাসিতেছ কেন? আমি বলিলাম,–চুপ কর। বুদ্ধি পাকিয়া আসিতেছে।

খুলনা জেলায় বাঘেরহাটের নিকট নীলামে আমি এক মহল কিনিয়াছিলাম। তাহা লইয়া আজ কয়েক বৎসর ধরিয়া ত্রিশঙ্কুবাবুর সহিত মোকদ্দমা চলিতেছিল। অন্য বিষয়ে আমি টাকা খরচ করি না বটে, কিন্তু মোকদ্দমার জন্য টাকা খরচ করিতে কখনও কাতর হই না। এক একটা দলিল জাল করাইতে আমি পাঁচশত টাকা ব্যয় করি। এক এক জন মিথ্যা সাক্ষীকে আমি পাঁচ হইতে দশ টাকা দিয়া বশ করি। মিথ্যা মোকদ্দমা আমি যেমন সাজাইতে পারি, মিথ্যা সাক্ষীদিগকে আমি যেমন শিখাইতে পারি, এমন আর কেহ পারে না। আদালতে হলফ করিয়া আমি নিজে যখন মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করি, তখন কোন উকীল জেরা করিয়া আমাকে ঠকাইতে পারে না। ত্রিশঙ্কুবাবু আমার সহিত পারিবেন কেন? দুটো আদালতে তিনি হারিয়া গিয়াছিলেন।

মহলের একস্থানে বনের ভিতর প্রাচীন ইটে গাঁথা একটি প্রাচীর ও শানের চাতাল ছিল। সেই চাতালের কথা আমার মনে পড়িল। আমি কলিকাতায় যাইলাম। কোন লোককে টাকা দিয়া একখানি তামার পাতে সে কালের বাঙ্গালা ভাষায় অনেকগুলি কথা ক্ষোদিত করাইলাম। তাহা লইয়া ঘিটটু ধাঙ্গড়ের সহিত আমি বাঘেরহাট মহলে গমন করিলাম। ঘিটটুকে সেই চাতালের উপর সপরিবারে বাস করিতে বলিলাম! গাছের ডালপালা দিয়া তাঁহার উপর সে এক ঝুপড়ি প্রস্তুত করিল। ত্রিশঙ্কুবাবু বন্দুক লইয়া একটি কুকুরের সহিত প্রায় প্রতিদিন প্রাতঃকালে সেই পথ দিয়া গমন করেন। আমি টোপ ফেলিলাম। ত্রিশঙ্কুবাবু এখন কি করেন, তাহা দেখিবার নিমিত্ত আমি খুলনায় আসিয়া বাসা ভাড়া করিয়া বসিয়া রহিলাম।

একদিন প্রাতঃকালে ত্রিশঙ্কুবাবু মহলের নিকট সেই পথ দিয়া যাইতেছিলেন। তিনি দেখিলেন যে, বিটটু ধাঙ্গড়ের বৃদ্ধ মাতা ছোট একখানি তামার পাত মাজিয়া পরিষ্কার করিতেছে। ত্রিশঙ্কুবাবু তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,–তোর হাতে ওটা কি?

চবৃদ্ধা উত্তর করিল,–জানি না বাবু কি! উনুন করিবার নিমিত্ত চাতালের শান খুড়িতে খুঁড়িতে এইটা আমি পাইয়াছি।

ত্রিশবাবু হাতে করিয়া দেখিলেন। পুরাতন বাঙ্গালা ভাষায় তাহাতে যে কথাগুলি লেখা ছিল তাঁহার একটু দেখিয়াই তিনি চমকিত হইলেন। এক টাকা দিয়া তামার পাতটি বৃদ্ধের নিকট হইতে তিনি কিনিয়া লইলেন। তাহার পরদিন খুলনার বাসায় তিনি আমার নিকট আসিয়া বলিলেন,—ডমরুধরবাবু সামান্য ঐ মহলটা লইয়া মিছিমিছি আর মোকদ্দমা কেন? আপনারও টাকা খরচ হইতেছে, আমারও টাকা খরচ হইতেছে। দুইশত টাকায় আপনি মহলটি কিনিয়াছেন, পাঁচশত টাকায় মহলটি আমাকে ছাড়িয়া দিন।

আমি উত্তর করিলাম,–মহলটির জন্য আমাকে অনেক কষ্ট পাইতে হইয়াছে। আমি উহা ছাড়িব না।।

ত্রিশঙ্কুবাবু মূল্য বৃদ্ধি করিতে লাগিলেন। হাজার, দুই হাজার, তিন হাজার, চারি হাজার পর্যন্ত উঠিলেন। তথাপি আমি সম্মত হইলাম না। চারি হাজার পর্যন্ত উঠিয়া তিনি বলিলেন,–আর আমি পারি না। আর আমার ক্ষমতা নাই।

অবশেষে সাড়ে চারি হাজার টাকায় আমি তাঁহাকে মহলটি বিক্রয় করিলাম। ধাঙ্গ ড়ুদিগকে লইয়া আমি গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলাম। পরে শুনিলাম যে, ত্রিশঙ্কুবাবু প্রায় বিশহাত গভীর করিয়া সেই চাতাল ও নিকটবর্তী স্থান খুঁড়িয়া ফেলিয়াছিলেন। তাহার পরিশ্রম বৃথা হইয়াছিল। মাটীর ভিতর হইতে একটি পয়সাও বাহির হয় নাই।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–কেন? কি পাইবেন তিনি আশা করিয়াছিলেন?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—পুরাতন বাঙ্গলা ভাষায় সেই তাম্রফলকে লেখা ছিল–

বিসমিল্লা। আমি মহম্মদ তাহির প্রথমতঃ ব্রাহ্মণ ছিলাম। এক্ষণে পীরখাঞ্জে আলি সাহেব হইয়া মুসলমান হইয়াছি। আমার পুত্রগণ ব্রাহ্মণ আছে। তাহাদের বংশধরগণের ভরণপোষণের নিমিত্ত এই চাতালের দশহাত নিচে আমি এক লক্ষ রৌপ্যমুদ্রা পুঁতিয়া রাখিলাম। এই অর্থ জিন্দাগাজী সাহেবের আশ্রয়ে রাখিলাম। যখন আমার বংশধরগণ নিতান্ত দরিদ্র হইবে, তখন তিনি এই অর্থ তাহাদিগকে প্রদান করিবেন। ইতি ১৫ই জিলহিজ্জা ৮৬২ হিজরি। ঐ তাম্রপত্র আমি লেখাইয়া আনিয়াছিলাম। ত্রিশঙ্কুবাবুকে দেখাইবার নিমিত্ত আমি বাঙ্গড় বুড়ীকে দিয়াছিলাম। মায়ের কৃপায় বুদ্ধি খেলাইয়া হীরার দশগুণ মূল্য আমি লাভ করিলাম।

লম্বোদর বলিলেন,—ভাদ্র মাসে ভূত বলিয়া গ্রামে একটা গোল উঠিয়াছিল বটে, কিন্তু তুমি যে তার গোঁসাই, তাহা জানিতাম না।

সকলে বলিল,–ধন্য ডমরুধর, ধন্য তুমি।

ডমরুধর বলিলেন,–তাই তোমাদের সকলকেই আমি বলি, মা দুর্গাকে তোমরা ভক্তি কর। মা দুর্গা তোমাদিগকে ধন দিবেন, মান দিবেন আর হাওয়াখোর বাবুদের আমি বলি যে, মায়ের পূজা ছাড়িয়া বিদেশে তোমরা হাওয়া খাইতে যাইও না। ঘরে থাকিয়া ভক্তিভাবে মায়ের পূজা কর। যত হাওয়া চাও, মা তোমাদিগকে দিবেন। ঘরে বসিয়া স্বচ্ছন্দে পেট ভরিয়া হাওয়া খাইতে পারিবে।