১. প্রথম ভাগ – প্রাচীন কথা

প্রথম ভাগ
প্রথম পরিচ্ছেদ–প্রাচীন কথা

কঙ্কাবতীকে সকলেই জানেন। ছেলেবেলায় কঙ্কাবতীর কথা সকলেই শুনিয়াছেন।

কঙ্কাবতীর ভাই একটি অব আনিয়াছিলেন। আঁটি ঘরে রাখিয়া সকলকে সাবধান করিয়া, দিলেন,—আমার আবটি যেন কেহ খায় না। যে খাইবে, আমি তাঁহাকে বিবাহ করিব।-কঙ্কাবতী সে কথা জানিতেন না। ছেলে মানুষ! অত বুঝিতে পারেন নাই, আঁবটি তিনি খাইয়াছিলেন।

সে জন্য ভাই বলিলেন,—আমি কঙ্কাবতীকে বিবাহ করিব।

মাতা পিতা সকলে বুঝাইলেন,—ভাই হইয়া কি ভগিনীকে বিবাহ করিতে আছে?

কিন্তু কাহারও কথা শুনিলেন না। তিনি বলিলেন, কঙ্কাবতী আমার আর খাইল কেন? আমি নিশ্চয় কঙ্কাবতীকে বিবাহ করিব।

কঙ্কাবতীর বড় লজ্জা হইল। মনে বড় ভয় হইল। নিরুপায় হইয়া তিনি একখানি নৌকা গড়িলেন। নৌকাখানিতে বসিয়া খিড়কী পুকুরের মাঝখানে ভাসিয়া যাইলেন। ভাই আর তাঁহাকে বিবাহ করিতে পারিলেন না।

কঙ্কাবতীর গল্প এইরূপে। এ কথা কিন্তু বিশ্বাস হয় না। একটি আঁবের জন্য কেহ কি আপনার ভগিনীকে বিবাহ করিতে চায়? কথা সম্ভব নয়। যাহা সম্ভব তাহা আমি বলিতেছি।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ–কুসুমঘাটী

শহর অঞ্চলে নয়, বন্য প্রদেশে, কুসুমঘাটী বলিয়া একখানি গ্রাম আছে। গ্রামখানি বড়, অনেক লোকের বাস। গ্রামের নিকটে মাঠ। সেকালে এই মাঠ দিয়া অনেক লোক যাতায়াত করিত। সুবিধা পাইলে, নিকটস্থ গ্রামসমূহের দুষ্ট লোকেরা পথিকদিগকে মারিয়া ফেলিত ও তাহাদের নিকট হইতে যাহা কিছু টাকা-কড়ি পাইত, তাহা লইত। মাঠের মাঝখানে যে সব পুষ্করিণী আছে, তাঁহার ভিতর হইতে আজ পৰ্য্যন্ত মড়ার মাথা বাহির হয়। মানুষ মারিয়া দুষ্ট লোকেরা এই পুকুরের ভিতর লুকাইয়া রাখিত।

মৃতদেহ গোপন করিবার আর একটি উপায় ছিল। পথিককে মারিয়া, মড়াটি লইয়া, দুষ্ট লোকেরা এ গ্রাম হইতে সে গ্রামে ফেলিয়া আসিত। অপর গ্রামে মড়াটি রাখিয়া, এক প্রকার কুঃ শব্দ করিয়া তাঁহারা চলিয়া যাইত।।

সে গ্রামের চৌকিদার সেই কুঃ শব্দটি শুনিয়া বুঝিতে পারি যে, তাঁহার সীমানায় মড়া পড়িয়াছে। চৌকীদার ভাবিত,—যদি আমার সীমানায় মড়া পড়িয়া থাকে, তাহা হইলে, কাল প্রাতঃকালে আমাকে লইয়া টানা-টানি, হইবে।

এই কথা ভাবিয়া সেও আপনার বন্ধুবর্গের সহায়তায়, মৃত দেহটি অপর গ্রামে রাখিয়া সেইরূপ কুঃ শব্দ করিয়া আসিত।

এইরূপে রাতারাতি মড়াটি দশ বার ক্রোশ দূরে গিয়া পড়িত। কোথা হইতে লোকটি আসিতেছিল, কে তাঁহাকে মারিল, অত দূরে আর তাঁহার কোনও সন্ধান হইত না।

একে বন্য দেশ, তাহাতে আবার এইরূপ শত শত অপঘাত মৃত্যু! সে স্থানে ভূতের অভাব হইতে পারে না। অশ্বত্থ, বট, বেল প্রভৃতি নানা গাছে নানা প্রকার ভূত আছে, সেখানকার লোকের এইরূপ বিশ্বাস। সন্ধ্যা হইলে, ঘরে বসিয়া, লোকে নানারূপ ভূতের গল্প করে, সেই গল্প শুনিয়া বালক বালিকার শরীর শিহরিয়া উঠে।

গ্রামে ডাইনীরও অপ্রতুল নাই। পিতামহী-মাতামহীগণ বালক-বালিকাদিগকে সাবধান করিয়া দেন,—ডাইনীরা পথে কুটা হইয়া পড়িয়া থাকে, সে তৃণ যেন মাড়াইও না, তাহা হইলে ডাইনীতে খাইবে।

স্থলে, সেখানকার লোকের এইরূপ পদে পদে বিপদের ভয়। জলেও কম নয়। গ্রামের এক পার্শ্বে একটি নদী আছে। পাহাড় হইতে নামিয়া, কুল কুল করিয়া নদীটি সাগরের দিকে বহিয়া যাইতেছে। হাঙ্গর কুম্ভীর নাই সত্য, কিন্তু নদীটি অন্য ভয়ে পরিপূর্ণ। শিকল হাতে জটে-বুড়িত আছেই, তা ছাড়া নদীর ভিতর জীবন্ত পাথরও অনেক সুবিধা পাইলে এই পাথর মনুষ্যের বুকে চাপিয়া বসে। নদীর ভিতরও এইরূপ নানা বিপদের ভয়।

কুসুমঘাটীর অনতিদূরে পর্ব্বতশ্রেণী। পাহাড় বনে আবৃত। বনে বাঘ-ভাল্লুক আছে। বাঘে সৰ্ব্বদাই লোকের গরু-বাছুর লইয়া যায়। মাঝে মাঝে এক একটি বাঘ মনুষ্য খাইতে শিক্ষা করে। তখন সে বাঘ, মানুষ ভিন্ন আর কিছুই খায় না। লোকে উৎপীড়িত হইয়া নানা কৌশলে সে ব্যাঘ্রটিকে বধ করে।

এক একটি বাঘ কিন্তু এমনি চতুর যে, কেহ তাঁহাকে মারিতে পারে না। লোকে বলে যে, সে প্রকৃত বাঘ নয়–সে মনুষ্য! বনে এক প্রকার শিকড় আছে, তাহা মাথায় পরিলে মনুষ্য তৎক্ষণাৎ ব্যাঘ্রের রূপ ধরিতে পারে। কাহারও সহিত কাহারও বিবাদ থাকিলে, লোকে সেই শিকড়টি মাথায় পরিয়া বাঘ হয়, বাঘ হইয়া আপনার শত্রুকে বিনাশ করে। তাহার পর আবার শিকড় খুলিয়া মানুষ হয়। কেহ কেহ শিকড় খুলিয়া ফেলিতে পারে না। সে চিরকালই বাঘ থাকিয়া যায়। এই বাঘ লোকের প্রতি ভয়ানয় উপদ্রব করে।

কুসুমধাটীর লোকের মনে এইরূপ নানা প্রকার বিশ্বাস। কিন্তু আজ কাল সকলের মন হইতে এই সব ভয় ক্রমে দূর হইতেছে। এখানকার অনেকে এখন তসরের গুটি ও গালা লইয়া, কলিকাতায় আসিত। কেহ কেহ কলিকাতায় বাসা করিয়া থাকেন। কেহ কেহ অংরজীও পড়িয়াছেন। ভূত ডাইনীর কথা তাঁহারা বিশ্বাস করেন না। ভূতের কথা পাড়িলে, তাঁহারা উপহাস করেন,–পৃথিবীতে ভূত নাই। আর যদিও থাকে, তো আমাদের তাঁহারা কি করিতে পারে? তাঁহাদের দেখা-দেখি আজকালের ছেলে-মেয়েদের প্রাণেও কিছু কিছু সাহসের সঞ্চার হইতেছে।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ–তনু রায়

শ্ৰীযুক্ত রামতনু রায় মহাশয়ের বাস কুসুমঘাটী। রামতনু রায় বলিয়া কেহ তাঁহাকে ডাকে না, সকলে তাঁহাকে তনু রায় বলে। ইনি ব্রাহ্মণ, বয়স হইয়াছে, ব্রাহ্মণের যাহা কিছু কৰ্ত্তব্য, তাহা ইনি যথাবিধি করিয়া থাকেন। ত্রিসন্ধ্যা করেন, পিতা-পিতামহ-আদির শ্রাদ্ধতপর্ণাদি করেন, দেবগুরুকে ভক্তি করেন, দলাদলি লইযা আন্দোলন করেন। এখনকার ললাকে ভাল করিয়া ধৰ্ম্ম-কৰ্ম্ম করে না বলিয়া রায় মহাশয়ের মনে বড় রাগ।

তিনি বলেন,–আজ-কালের ছেলেরা সব নাস্তিক, ইহাদের হাতে জল খাইতে নাই।

তিনি নিজে সব মানেন, সব করেন। বিশেষতঃ কুলীন ও বংশজের যে রীতিগুলি, সেইগুলির প্রতি তাঁর প্রগাঢ় ভক্তি।

তিনি নিজে বংশজ ব্রাহ্মণ। তাই তিনি বলেন-বিধাতা যখন আমাকে বংশজ করিয়াছেন, তখন বংশজের ধর্ম্মটি আমাকে রক্ষা করিতে হইবে। যদি না করি, তাহা হইলে বিধাতার অপমান করা হইবে, আমার পাপ হইবে, আমাকে নরকে যাইতে হইবে। যদি বল বংশজের ধর্ম্মটি কি? বংশজের ধর্ম্ম এই যে,—কন্যাদান করিয়া পাত্রের নিকট হইতে কিঞ্চিৎ ধন গ্রহণ করিবে। বংশজ হইয়া যিনি এ কাৰ্য্য না করেন, তাঁহার ধর্ম্মলোপ হয়, তিনি একেবারেই পতিত হন। শাস্ত্রে এইরূপ লেখা আছে। শাস্ত্র অনুসারে সকল কাজ করেন দেখিয়া তনু রায়ের প্রতি লোকের বড় ভক্তি। স্ত্রীলোকেরা ব্রত উপলক্ষে ইহাকেই প্রথম ব্রাহ্মণ বলিয়া থাকেন। সকলে বলেন যে, রায় মহাশয়ের মত নিষ্ঠাবান্ ব্রাহ্মণ পৃথিবীতে অতি বিরল। বিশেষতঃ শুদ্রমহলে ইহার খুব প্রতিপত্তি।

তনু রায় অতি উচ্চদরের বংশজ। কেহ কেহ পরিহাস করিয়া বলেন যে, ইহাদের কোনও পুরুষে বিবাহ হয় না। পিতা-পিতামহের বিবাহ হইয়াছিল কি না, তাও সন্দেহ।

ফল কথা, ইহার নিজের বিবাহের সময় কিছু গোলযোগ হইয়াছিল। পাঁচ শত টাকা পণ দিব বলিয়া একটি কন্যা স্থির করিলেন। পৈতৃক ভূমি বিক্রয় করিয়া সেই টাকা সংগ্রহ করিলেন। বিবাহের দিন উপস্থিত হইলে, সেই টাকাগুলি লইয়া বিবাহ করিতে যাইলেন। কন্যার পিতা, টাকাগুলি গণিয়া ও বাজাইয়া লইলেন। বিবাহের লুগ্ন উপস্থিত হইল, কিন্তু তবুও তিনি কন্যা-সম্প্রদান করিতে তৎপর হইলেন না। কেন বিলম্ব করিতেছেন, কেহ বুঝিতে পারে না।

অবশেষে তিনি নিজেই খুলিয়া বলিলেন,–পাত্রের এত অধিক বয়স হইয়াছে, তাহা আমি বিবেচনা করিতে পারি নাই। সেই জন্য পাঁচ শত টাকায় সম্মত হইয়াছিলাম। এক্ষণে আর এক শত টাকা না পাইলে কন্যাদান করিতে পারি না।

কন্যা-কৰ্ত্তার এই কথায় বিষম গোলযোগ উপস্থিতি হইল। সেই লগ্ন অতীত হইয়া গেল, রাত্রি প্রায় অবসান হইল। যখন প্রভাত হয় হয়, তখন পাঁচজনে মধ্যস্থ হইয়া এই মীমাংসা করিয়া দিলেন যে, রায় মহাশয়কে আর পঞ্চাশটি টাকা দিতে হইবে। খত লিখিয়া তনু রায় আর পঞ্চাশ টাকা ধার করিলেন ও কন্যার পিতাকে তাহা দিয়া বিবাহকাৰ্য্য সমাধা করিলেন।–বাসর-ঘরে গাহিবেন বলিয়া তনু রায় অনেকগুলি গান শিখিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু বৃথা হইল। বাসর হয় নাই, রাত্রি প্রভাত হইয়া গিয়াছিল। এ দুঃখ তনু রায়ের মনে চিরকাল ছিল।

এক্ষণে তনু রায়ের তিনটি কন্যা ও পুত্র-সন্তান। কুল-ধৰ্ম্ম রক্ষা করিয়া দুইটি কন্যাকে তিনি সুপাত্রে অৰ্পণ করিয়াছিলেন। জামাতারা তনু রায়ের সম্মান রাখিয়াছিলেন। কেহ পাঁচ শত, কেহ, হাজার, নগদ গণিয়া দিয়াছিলেন। কাজেই সুপাত্র বলিতে হইবে।

সম্মান কিছু অধিক পাইবেন বলিয়া, রায় মহাশয় কন্যা দুইটিকে বড় করিয়া বিবাহ দিয়াছিলেন। তিনি বলিতেন,—অল্প বয়সে বিবাহ দিলে, কন্যা যদি বিধবা হয়, তাহা হইলে সে পাপের দায়ী কে হইবে? কন্যা বড় করিয়া বিবাহ দিবে। কুলীন ও বংশজের তাহাতে কোন দোষ নাই। ইহা শাস্ত্রে লেখা আছে।

তাই, যখন ফুলশয্যার আইন পাশ হয় তখন তনু রায় বলিলেন,—পূৰ্ব্ব হইতেই আমি আইন মানিয়া আসিতেছি। তবে আবার নূতন আইন কেন? আইনের তিনি ঘোরতর বিরোধী হইলেন; সভা করিলেন, চাঁদা তুলিলেন, চাঁদার টাকাগুলি সব আপনি লইলেন।

তনু রায়ের জামাতা দুইটির বয়স নিতান্ত কচি ছিল না। ছেলে মানুষ বরকে তিনি দুটি চক্ষু পাড়িয়া দেখিতে পারেন না। তাঁহারা এক শত কি দুই শত টাকায় কাজ সারিতে চায়। তাই একটু বয়স্ক পাত্র দেখিয়া কন্যা দুইটি বিবাহ দিয়াছিলেন। এক জনের বয়স হইয়াছিল সত্তর আর এক জনের পঁচাত্তর। জামাতাদিগের বয়সের কথায় পাড়ায় মেয়েরা কিছু বলিলে, তনু রায় সকলকে বুঝাইতেন—ওগো! তোমরা জান না, জামাইয়ের বয়স একটু পাকা হইলে, মেয়ের আদর হয়। জামাতাদিগের বয়স কিছু অধিক পাকিয়াছিল। কারণ, বিবাহের পর, বৎসর ফিরিতে না ফিরিতে দুইটি কন্যাই বিধবা হয়।

তনু রায় জ্ঞানবান্ লোক। জামাতাদিগের শোকে একেবারে অধীর হন নাই। মনকে তিনি এই বলিয়া প্রবোধ দিয়া থাকেন,–বিধাতার ভবিতব্য! কে খণ্ডাতে পারে? কতলোক যে বার বৎসরের বালকের সহিত পাঁচ বৎসর বালিকার বিবাহ দেয়, তবে তাহাদের কন্যা বিধবা হয় কেন। যাহা কপালে থাকে তাহাই ঘটে। বিধাতার লেখা কেহ মুছিয়া ফেলিতে পারে না।

তনু রায়ের পুত্রটি ঠিক বাপের মত। এখন তিনি আর নিতান্ত শিশু নন, পঁচিশ পার হইয়াছেন। লেখা পড়া হয় নাই, তবে পিতার মত শাস্ত্রজ্ঞান আছে। পিতা কন্যাদান করিয়া অর্থসঞ্চয় করিতেছেন, সে জন্য তিনি আনন্দিত, নিরানন্দ নন। কারণ, পিতার তিনিই একমাত্র বংশধর। বিধবা কথাটা আর কে বল? তবে বিধবাদিগের গুণকীৰ্ত্তন তিনি সর্ব্বদাই করিয়া থাকেন।

তিনি বলেন, আমাদের বিধবাবা সাক্ষাৎ সরস্বতী। সদা ধৰ্ম্মে রত, পরোপকার ইহাদের চিরব্রত। কিসে আমি ভাল খাইব, কিসে বাবা ভাল খাইবেন, ভগিনী দুইটির সৰ্ব্বদাই এই চিন্তা। তিন দিন উপবাস করিয়াও আমাদের জন্য পাঁচ ব্যঞ্জন রন্ধন করেন।

ভগিনী দুইটি আমার—অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরীস্তথা। প্রাতঃস্মরণীয়া।

আজকাল আর সহমরণ প্রথা নাই বলিয়া ইনি মাঝে মাঝে খেদ করেন। কারণ, তাহা থাকিলে ভগিনী দুইটি নিমিষের মধ্যেই স্বর্গে যাইতে পারিতেন। বসিয়া বসিয়া মিছামিছি বাবার অনুধ্বংস করিতেন না। সাহেবেরা স্বর্গের দ্বারে এরূপ আগড় দিয়া দেন কেন?

তনু রায়ের স্ত্রী কিন্তু অন্য প্রকৃতির লোক। এক একটি কন্যার বিবাহ হয়, আর পাত্রের রূপ দেখিয়া তিনি কান্নাকাটি করেন। তনু রায় তখন তাঁহাকে অনেক ভৎর্সনা করেন, আর বলেন,—মনে করিয়া দেখ দেখি তোমার বাপ কি করিয়াছিলেন? এই রূপ নানা প্রকার খোঁটা দিয়া তবে তাঁহাকে সান্ত্বনা করেন। কন্যাদিগের বিবাহ লইয়া স্ত্রীপুরুষের চির বিবাদ। বিধবা কন্যা দুইটির মুখপানে চাহিয়া সদাই চক্ষের জলে মায়ের বুক ভাসিয়া যায়। মেয়েদের সঙ্গে মাও একপ্রকার একাদশীর দিন কিছুই খান না, তবে স্বামীর অকল্যাণ হইবার ভয়ে, কেবল একটু একটু জল পান করেন। প্রতিদিন পূজা করিয়া একে একে সকল দেবতাদিগের পায়ে তিনি মাথা খুঁড়েন, আর তাঁহাদের নিকট প্রার্থনা করেন যে,–হে মা কালি! হে মা দুর্গা। হে ঠাকুর! যেন আমার কঙ্কাবতীর বরটি মনের মত হয়।

কঙ্কাবতী তনু রায়ের ছোট কন্যা। এখনও নিতান্ত শিশু।

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ–খেতু

তনু রায়ের পাড়ায় একটি দুঃখিনী ব্রাহ্মণী বাস করেন। লোকে তাঁহাকে খেতুর মা খেতুর মা বলিয়া ডাকে। খেতুর মা আজ দুঃখিনী বটে, কিন্তু এক সময়ে তাঁহার অবস্থা ভাল ছিল। তাঁহার স্বামী শিবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লেখা পড়া জানিতেন, কলিকাতায় কৰ্ম্ম করিতেন, দুপয়সা উপার্জন করিতেন।

কিন্তু তিনি অর্থ রাখিতে জানিতেন না। পরদুঃখে তিনি নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িতেন ও যথাসাধ্য পরের দুঃখ মোচন করিতেন। অনেক লোককে অন্ন দিতেন ও অনেকগুলি ছেলের তিনি লেখাপড়ার খরচ দিতেন। এরূপ লোকের হাতে পয়সা থাকে না।

অধিক বয়সে তাঁহার স্ত্রীর একটি পুত্রসন্তান হয়। ছেলেটির নাম ক্ষেত্ৰ রাখেন, সেই জন্য তাঁহার স্ত্রীকে সকলেই খেতুর মা বলে।

যখন পুত্র হইল, তখন শিবচন্দ্র মনে করিলেন—এইবার আমাকে বুঝিয়া খরচ করিতে হইবে। আমার অবর্তমানে স্ত্রী-পুত্র যাহাতে অল্পের জন্য লালায়িত না হয়, আমাকে সে বিলি করিতে হইবে।

মানস হইল বটে, কিন্তু কার্যে পরিণত হইল না। পৃথিবী অতি দুঃখময়, এ দুঃখ যিনি নিজ দুঃখ বলিয়া ভাবেন, চিরকাল তাঁহাকে দরিদ্র থাকিতে হয়।

খেতুর যখন চারি বৎসব বয়স, তখন হঠাৎ তাঁহার পিতার মৃত্যু হইল। স্ত্রী ও শিশু সন্তানটিকে একেবারে পথে দাঁড় করাইয়া গেলেন। খেতুর বাপ অনেকের উপকার করিয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ এখন বড়লোক হইয়াছেন। কিন্তু এই বিপদের সময় কেহই একবার উকি মারিলেন না। কেহই একবার জিজ্ঞাসা করিলেন না যে, খেতুর মা! তোমার হবিষ্যের সংস্থান আছে কি না?

এই দুঃখের সময় কেবল রামহরি মুখোপাধ্যায় ইহাদের সহায় হইলেন।। রামহরি হঁহাদের জ্ঞাতি, কিন্তু দূর-সম্পর্ক। খেতুর বাপ, তাঁহার একটি সামান্য চাকরি করিয়া দিয়াছিলেন। দেশে অভিভাবক নাই, সে জন্য কলিকাতায় তাঁহাকে পরিবার লইয়া থাকিতে হইয়াছে। যে কয়টি টাকা পান, তাহাতেই কষ্টে সৃষ্টে দিনপাত করেন।

তিনি কোথায় পাইবেন? তবুও যাহা কিছু পারিলেন, বিধবাকে দিলেন ও চাঁদার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরিলেন। খেতুর বাপের খাইয়া যাহারা মানুষ, আজ তাঁহারা রামহরিকে কতই

ওজর আপত্তি অপমানের কথা বলিয়া দুই এক টাকা চাঁদা দিল। তাহাতেই খেতুর বাপের তিল-কাঞ্চন করিয়া শ্রাদ্ধ হইল। চাঁদার টাকা হইতে যাহা কিছু বাঁচিল, রামহরি তাহা দিয়া খেতুর মা ও খেতুকে দেশে পাঠাইয়া দিলেন।

দেশে পাঠাইয়া দুঃখিনী বিধবাকে তিনি চাউলের দামটি দিতেন; অধিক আর কিছু দিতে পারিতেন না। ব্রাহ্মণী পৈতা কাটিয়া কোনও মতে অকুলান কুলান করিতেন। দেশে বান্ধব কেহই ছিল না। নিরঞ্জন কবিরত্ন কেবল মাত্র ইহাদের দেখিতেন শুনিতেন; বিপদে আপদে তিনিই বুক দিয়া পড়িতেন।

খেতুর মার এইরূপ কষ্টে দিন কাটিতে লাগিল। ছেলেটি শান্ত সুবোধ, অথচ সাহসী ও বিক্রমশীল হইতে লাগিল। তাঁহার রূপ-গুণে, স্নেহ-মমতায়, মা সকল দুঃখ ভুলিতেন। ছেলেটি যখন সাত বৎসরের হইল তখন রামহরি দেশে আসিলেন।

খেতুর মাকে তিনি বলিলেন-খেতুর এখন লেখা-পড়া শিখিবার সময় হইল, আর ইহাকে এখানে রাখা হইবে না। আমি ইহাকে কলিকাতায় সইয়া যাইতে ইচ্ছা করি। আপনার কি মত?

খেতুর মা বলিলেন,–বাপ রে! তা কি কখন হয়? খেতুকে ছাড়িয়া আমি কি করিয়া থাকিব? নিমিষের নিমিত্তও খেতুকে চক্ষুর আড়াল করিয়া আমি জীবিত থাকিতে পারিব লো। না বাছা! এ প্রাণ থাকিতে আমি খেতুকে কোথাও পাঠাইতে পারিব না।

রামহরি বলিলেন,—দেখুন, এখানে থাকিলে খেতুর লেখাপড়া হইবে না। মধুর চক্রবর্তীর অবস্থা কি ছিল জানেন তো? গাজনের শিবপূজা করিয়া করিয়া অতি কষ্টে সংসার প্রতিপালন করিত। গাজুনে বামুন বলিয়া সকলে তাঁহাকে ঘৃণা করিত। তাঁহার ছেলে যারে আপনার বাসায় দিনকতক রাঁধুনী বামুন থাকে। অল্পবয়স্ক বালক দেখিয়া শিব কাকার দয়া হয়, তিনি তাঁহাকে স্কুলে দেন। এখন সে উকীল হইয়াছে। এখন সে একজন বড়লোক।

খেতুর মা উত্তর করিলেন,চুপ কর! কলিকাতায় লেখা-পড়া শিখিয়া যদি ষাঁড়েশ্বরের মত হয়, তাহা হইলে আমার খেতুর লেখা-পড়া শিখায় কাজ নাই।

রামহরি বলিলেন,–সন্ত বটে, ষাঁড়ের মদ খায়, আর মুসলমান সহিমের হাতে নানারূপ অখাদ্য মাংসও খায়, আবার এ দিকে প্রতিদিন হরি-সঙ্কীৰ্ত্তন করে। কিন্তু তা বলিয়া কি সকলেই সেইরূপ হয়? পুরুষ মানুষে লেখা-পড়া না শিখিলে কি চলে? পুরুষ মানুষের যেরূপ বাঁচিয়া থাকার প্রার্থনা, বিদ্যাশিক্ষারও সেইরূপ প্রার্থনা।

খেতুর মা বলিলেন,–হাঁ সত্য কথা। পুত্রের যেরূপ বাঁচিবার প্রার্থনা, বিদ্যার প্রার্থনাও তাঁহার চেয়ে অধিক। যে মাতা-পিতা ছেলেকে বিদ্যাশিক্ষা না দেন, সে মাতাপিতা ছেলের পরম শত্রু। তবে বুঝিয়া দেখ আমার মার প্রাণ, আমি অনাথিনী সহায়হীনা বিধবা পৃথবীতে আমার কেহ নাই, এই এক রতি ছেলেটিকে লইয়া সংসারে আছি। খেতুকে আমি নিমেষে হারাই। খেলা করিয়া ঘরে আসিতে খেতুর একটু বিলম্ব হইলে, আমি যে কত কি কু ভাবি, তাহা আর কি বলিব? ভাবি, খেতু বুঝি জলে ড়ুবিল, খেতু বুঝি আগুনে পুড়িল, খেতু গাছ হইতে পড়িয়া গেল, খেতুকে বুঝি পাড়ার ছেলেরা মারিল। খেতু যখন ঘুমায়, রাত্রিতে উঠিয়া উঠিয়া আমি খেতুর নাকে হাত দিয়া দেখি,–খেতুর নিশ্বাস পড়িতেছে কি না? ভাবিয়া দেখ দেখি, এ দুধের বাছাকে দূরে পাঠাইতে মার মহাপ্রাণী কি করে? তাই কাঁদি, তাই বলি—না। পুনরায় খেতুর মা বলিলেন,–রামহরি! খেতু আমার বড় গুণের ছেলে। কেবল দুই বৎসর পাঠশালা যাইতেছে, ইহর মধ্যেই তালপাতা শেষ করিয়াছে কলাপাতা ধরিয়াছে। গুরুমহাশয় বলেন—খেতু সকলের চেয়ে ভাল ছেলে।আর দেখ রামহরি! খেতু আমার অতি সুবোধ ছেলে। খেতুকে আমি যা করিতে বলি খেতু তাই করে। যেটি মানা করি সেটি আর খেতু করে না। একদিন দাসেদের মেয়ে আসিয়া বলিল,–ওগো তোমার খেতুকে পাড়ার ছেলে বড় মারিতেছে। আমি উৰ্দ্ধশ্বসে ছুটিলাম। দেখিলাম, ছয় জন ছেলে একা খেতুর উপর পড়িয়াছে। খেতুর মনে ভয় নাই, মুখে কান্না নাই। আমি দৌড়িয়া গিয়া খেতুকে কোলে লইলাম। খেতু তখন চক্ষু মুছিতে মুছিতে বলিল,–মা! আমি উহাদের সাক্ষাতে কাঁদি নাই, পাছে উহারা মনে করে যে, আমি ভয় পাইয়াছি। একা একা আমর সঙ্গে কেহই পারে না। উহারা ছয় জন, আমি একা, তা আমি মারিয়াছি। আবার যখন একা একা পাইব, তখন আমিও ছয়জনকে খুব মারিব। আমি বলিলাম—না বাছা! তা করিতে নাই, প্রতিদিন যদি সকলের সঙ্গে মারামারি করিবে তবে খেলা করিবে কার সঙ্গে? খেতু আমর কথা শুনিল। কত দিন সে ছেলেদের খেতু একলা পাইয়াছিল, মনে করিলে খুব মারিতে পারিত; কিন্তু আমি মানা করিয়াছিলাম বলিয়া কাহাকেও সে আর মারে নাই।

আর এক দিন আমি খেতুকে বলিলাম,–খেতু! তনু রায়ের অব গাছে ঢিল মারিও। তনু রায় খিটখিটে লোক, সে গালি দিবে। খেতু বলিল,–মা! ও গাছের আঁব বড় মিষ্ট গো! একটি অব পাকিয়া টুক টুক করিতেছিল। আমার হাতে একটি ঢিল ছিল। তাই মনে করিলাম, দেখি, পড়ে কি না? আমি বলিলাম,—বাছা ও গাছের আঁব বড় মিষ্ট হইলে কি হইবে, ও গাছটি তো আর আমাদের নয়? পরের গাছে ঢিল মারিলে, যাদের গাছ, তাঁহারা রাগ করে; যখন আপনা-আপনি তলায় পড়িবে, তখন কুড়াইয়া খাইও, তাহাতে কেহ কিছু বলিবে না।

তাহার পর, আর একদিন খেতু আমাকে আসিয়া বলিল,–মা! জেলেদের গাবগাছে খুব গাঁব পাকিয়াছে। পাড়ার ছেলেরা সকলে গাছে উঠিয়া গাব খাইতেছিল, আমাকে তাঁহারা বলিল,–খেতু! আয় না ভাই। দূরের গাব যে আমরা পাড়িতে পারি না! তা মা আমি গাছে উঠি নাই। গাব গাছটি তো, মা! আর আমাদের নয়, যে উঠিব? আমি তলায় দাঁড়াইয়া রহিলাম। ছেলেরা দুটি একটি গাব আমাকে ফেলিয়া দিল। মা। সে গাব কত যে গো মিষ্ট, তাহা আর তোমাকে কি বলিব! তোমার জন্য একটি গাব আনিয়াছি, তুমি বরং, মা। খাইয়া দেখ! আমাদের যদি একটি গাব গাছ থাকিত, তাহা হইলে বেশ হইত। আমি বলিলাম,–খেতু! বুড়ো মানুষে গাব খায় না, ও গাবটি তুমি খাও। আর পরের গাছে পাকা গাব পাড়িতে কোন দোষ নাই, তার জন্য জেলেরা তোমাকে বকিবে না। কিন্তু গাছের ডগায় গিয়া উঠিও না, সরু ডালে পা দিও না, ডাল ভাঙ্গিয়া পড়িয়া যাইবে। গাব খাইতে অনুমতি পাইয়া বাছার যে কত আনন্দ হইল, তাহা আর তোমাকে কি বলিব।

দেখ, এ গ্রামে একবার এক জন কোথা হইতে সন্দেশ বেচিতে আসিয়াছিল। পাড়ার ছেলেরা তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। তাদের বাপ-মা, যার যেরূপ ক্ষমতা, সন্দেশ কিনিয়া আপনার আপনার ছেলের হাতে দিল। মুখ চুণপনা করিয়া আমার খেতু সেইখানে দাঁড়াইল ছিল। তাড়াতাড়ি গিয়া আমি খেতুকে কোলে লইলাম, আমার বুক ফাটিয়া যাইল, চক্ষুর জল রাখিতে পারিলাম না। আঁচলে চক্ষু পুছিতে পুছিতে ছেলে নিয়ে বাটী আসিলাম। খেতু নীরব, খেতুর মুখে কথা নাই। তার শিশুমনে সে যে কি ভাবিতেছিল, তাহা বলিতে পারি না। কিছুক্ষণ পরে আমার মুখে হাত দিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল,–মা! তুমি কাঁদ কেন? আমি বলিলাম,–বাছা! আমার ঘরে একদিন সন্দেশ ছড়া-ছড়ি যাইত, চাকরবাকরে পর্যন্ত খাইয়া আলিয়া যাইত। আজ যে তোমার হাতে এক পয়সার সন্দেশ কিনিয়া দিতে পারিলাম না, এদুঃখ কি আর রাখিতে স্থান আছে? এমন অভাগিনী মার পেটেও বাছা তুই জন্মেছিল! সাত বৎসরের শিশুর এবার কথা শুন! খেতু বলিল,–মা ও সন্দেশ ভাল নয়। দেখিতে পাও নাই, সব পচা! আর মা! তুমি তো জান? সন্দেশ খাইলে আমার অসুখ করে। সেই যে মা, চৌধুরীদের বাড়ীতে নিমন্ত্রণে গিয়াছিলাম, সেখানে সন্দেশ খাইয়াছিলাম, তার পরদিন আমার কত অসুখ করিয়াছিল! সন্দেশ খাইতে নাই, মুড়ি খাইতে আছে। ঘরে যদি মা! মুড়ি থাকে তো দাও আমি খাই।

খেতুর মার মুখে খেতুর কথা আর ফুরায় না। রামহরির কি নিকট কত যে কি পরিচয় দিলেন, তাহা আর কি বলিব?

অবশেষে রামহরি বলিলেন,—খুড়ী-মা! ভয় করিও না। আমার নিজের ছেলের চেয়েও আমি খেতুর যত্ন করিব। শিব কাকার আমি অনেক খাইয়াছি। তাঁহার অনুগ্রহে আজ পরিবারবর্গকে এক মুঠা অন্ন দিতেছি। আজ তাঁহার ছেলে যে মুখ হইয়া থাকিবে, তাহা প্রাণে সহ্য হবে না। খেতু কেমন আছে, কেমন লেখাপড়া করিতেছে, সে বিষয়ে আমি সৰ্ব্বদা আপনাকে পত্রে লিখিব। আবার, খেতু যখন চিঠি লিখিতে শিখিবে, তখন সে নিজে আপনাকে চিঠি লিখিবে। পূজার সময় ও গ্রীষ্মের ছুটীর সময় খেতুকে দেশে পাঠাইয়া দিব। বৎসরের মধ্যে দুই তিন মাস সে আপনার নিকট থাকিবে। আজ আমি এখন যাই। আজ শুক্রবার। বুধবার ভাল দিন। সেই দিন খেতুকে কলিকাতায় লইয়া যাইব।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ–নিরঞ্জন

তনু রায়ের সহিত নিরঞ্জন কবিরত্নের ভাব নাই। নিরঞ্জন তনু রায়ের প্রতিবেশী।

নিরঞ্জন বলেন,—রায় মহাশয়! কন্যার বিবাহ দিয়া টাকা লইবেন না, টাকা লইলে ঘোর পাপ হয়।

তনু রায় তাই নিরঞ্জনকে দেখিতে পারেন না, নিরঞ্জনকে তিনি ঘৃণা করেন। যে দিন তনু রায়ের কন্যার বিবাহ হয়, নিরঞ্জন সেই দিন গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া অপর গ্রামে গমন করেন। তিনি বলেন,কন্যা বিক্রয় চক্ষে দেখিলে, কি কর্ণে শুনিলেও পাপ হয়।

নিরঞ্জন অতি পণ্ডিত লোক! নানা শাস্ত্র তিনি অধ্যয়ন করিয়াছেন। বিদ্যা-শিক্ষার শেষ নাই, তাই রাত্রি দিন তিনি পুঁথি-পুস্তক সইয়া থাকেন। লোকের কাছে আপনার বিদ্যার পরিচয় দিতে ইনি ভালবাসেন না। তাই জগৎ জুড়িয়া ইহার নাম হয় নাই। পূর্ব্বে অনেকগুলি ছাত্র ইহার নিকট বিদ্যা শিক্ষা করিত। দিবারাত্রি তাহাদিগকে বিদ্যা-শিক্ষা দিয়া ইনি পরম পরিতোষ লাভ করিতেন। আহার পরিচ্ছদ দিয়া ছাত্রগুলিকে পুত্রের মত প্রতিপালন করিতেন। লোকের বাড়ী নিমন্ত্রণে গিয়া বিদায়ের জন্য ইনি মারামারি করিতেন না। কারণ, ইহার অবস্থা ভাল ছিল। পৈতৃক অনেক ব্রহ্মেত্তরভূমি ছিল।

গ্রামের জমিদার, জনার্দ্দন চৌধুরীর সহিত এই ভূমি লইয়া কিছু গোলমাল হয়। একদিন দুই প্রহরের সময় জমিদার এক জন পেয়াদা পাঠাইয়া দেন।

পেয়াদা আসিয়া নিরঞ্জনকে বলে,–ঠাকুর! চৌধুরী মহাশয় তোমাকে ডাকিতেছেন, চল। নিরঞ্জন বলিলেন,–আমার আহার প্রস্তুত, আমি আহার করিতে যাইতেছি। আহার হইলে জমিদার মহাশয়ের নিকট যাইব। তুমি এক্ষণে যাও।

পেয়াদা বলিল, তাহা হইবে না, তোমাকে এইক্ষণেই আমার সহিত যাইতে হইবে।

নিরঞ্জন বলিলেন,–বেলা দুই প্রহর অতীত গিয়াছে, ঠাঁই হইয়াছে, ভাত প্রস্তুত, ভাত দুইটি মুখে দিয়া, চল যাইতেছি। কারণ, আমি আহার না করিলে গৃহিণী আহার করিবেন না, ছাত্রগণের আহার হইবে না। সকলেই উপবাসী থাকিবে।

পেয়াদা বলিলেন,–তাহা হইবে না, তোমাকে এইক্ষণেই যাইতে হইবে।

নিরঞ্জন বলিলেন,–এইক্ষণেই যাইতে হইবে, বটে? আচ্ছা, তবে চল যাই। পেয়াদার সহিত নিরঞ্জন গিয়া জমিদার বাটীতে উপস্থিত হইলেন।।

জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,–কখন্ আপনাকে ডাকিতে পাঠাইয়াছি, আপনার যে আর আসিবার বার হয় না!

নিরঞ্জন বলিলেন,–আজ্ঞা হাঁ মহাশয়! আমার একটু বিলম্ব হইয়াছে।

জমিদার বলিলেন,–বামুনারীর মাঠে অপনার যে পঞ্চাশ বিঘা ব্রহ্মোত্তর ভূমি আছে, জরিপে তাহা পঞ্চান্ন বিঘা হইয়াছে। আপনার দলিল-পত্ৰ ভাল আছে, সে জন্য সবটুকু ভূমি আমি কাড়িয়া লইতে বাসনা করি না, তবে মাপে যেটুকু অধিক হইয়াছে, সেটুকু আমার প্রাপ্য।–নিরঞ্জন উত্তর করিলেন,–আজ্ঞা, হাঁ মহাশয়! দলিল-পত্র আমার ভাল আছে। দেখুন, দেখি; এই কাগজখানি কি না?

জনার্দ্দন চৌধুরী কাগজখানি হাতে লইয়া বলিলেন,–হাঁ, এই কাগজখানি বটে, ইহা আমি পূর্ব্বে দেখিয়াছি, এখন আর দেখিবার আবশ্যক নাই।

এই কথা বলিয়া নিরঞ্জনের হাতে তিনি কাগজখানি ফিরাইয়া দিলেন। নিরঞ্জন কাগজখানি তামাক খাইবার আগুনের মালসায় ফেলিয়া দিলেন। দেখিতে দেখিতে কাগজখানি জ্বলিয়া গেল। জমিদার বলিলেন,–হাঁ হাঁ করেন কি?

নিরঞ্জন বলিলেন,–কেবল পাঁচ বিঘা কেন? আজ হইতে আমার সমুদায় ব্রহ্মোত্তর ভূমি আপনার। যিনি জীব দিয়াছেন, নিরঞ্জনকে তিনি আহার দিবেন।

পাছে ব্রহ্মশাপে পড়েন, সেজন্য জনার্দ্দন চৌধুরীর ভয় হইল। তিনি বলিলেন, দলিল গিয়াছে গিয়াছে, তাহাতে কোনও ক্ষতি নাই। আপনি ভূমি ভোগ করুন, আপনাকে আমি কিছু বলিব না।

নিরঞ্জন উত্তর করিলেননা মহাশয়। জীব যিনি দিয়াছেন, আহার তিনি দিবেন। সেই দীন-বন্ধুকে ধ্যান করিয়া তাঁহার প্রতি জীবন সমর্পণ করিয়া কালাতিপাত করাই ভাল। বিষয় বৈভব চিন্তায় যদি ধৰ্ম্মানুষ্ঠানে বিঘ্ন ঘটে, চিত্ত যদি বিচলিত হয়, তাহা হইলে সে বিষয়-বিভব পরিত্যাগ করাই ভাল। আমার ভূমি ছিল বলিয়াই তো আজ দুই প্রহরের সময় আপনার যবন পেয়াদার নিষ্ঠুর বচন আমাকে শুনিতে হইল? সুতরাং সে ভূমিতে আমার আর কাজ নাই। স্পৃহাশুন্য ব্যক্তির নিকট রাজা, ধনী, নির্ধন, সবাই সমান। আপনি বিষয়ী লোক, আপনি আমার কথা বুঝিতে পারিবেন না। বুঝিতে পারিলেও আপনি সংসার-বন্ধনে নিতান্ত আবদ্ধন মরীচিকা-মায়াজালের অনুসরণ আপনাকে করিতেই হইবে। আতপ-তাপিত ভূষিত মরুপ্রান্তর হইতে আপনি মুক্ত হইতে পারিবেন না। এখন আশীৰ্ব্বাদ করুন, যেন কখনও কখনও কাহারও নিকট কোন বিষয়ের নিমিত্ত নিজের জন্য আমাকে প্রার্থী না হইতে হয়। এই কথা বলিয়া নিরঞ্জন প্রস্থান করিলেন।

নিরঞ্জলের সেই দিন হইতে মন্দ হইল। অতি কষ্টে তিনি দিনাতিপাত করিতে লাগিলেন। ছাত্রগণ একে একে তাঁহাকে ছাড়িয়া গোবর্ধন শিরোমণির চতুষ্পঠীতে যাইল।

গোবর্ধন শিরোমণি জনার্দ্দন চৌধুরীর সভাপণ্ডিত; অনেকগুলি ছাত্রকে তিনি অনুদান করেন। বিদ্যাদান করিবার তাঁহার অবকাশ নাই। চৌধুরী মহাশয়ের বাটীতে সকাল সন্ধ্যা উপস্থিত থাকিতে হয়, তাহা ব্যতীত অধ্যাপকের নিমন্ত্রণে সর্ব্বদা তাঁহাকে নানা স্থানে গমনাগমন করিতে হয়। সুতরাং ছাত্রগণ আপনা-আপনি বিদ্যা শিক্ষা করে।

সে জন্য কিন্তু কেহ দুঃখিত নয়। গোবর্ধন শিরোমণির উপর রাগ হয় না। অভিমানও হয় না। কারণ, তিনি অতি মধুরভাষী, বাক্যসুধা দান করিয়া সকলকেই পরিতুষ্ট করেন। বিশেষতঃ ধনবান লোক পাইলে শ্রাবণের বৃষ্টি ধারায় তিনি বাক্য-সুধা বর্ষণ করিতে থাকেন; তৃষিত চাতকের ন্যায় তাঁহারা সেই সুধা পান করেন।

একদিন জনার্দ্দন চৌধুরীর বাটীতে আসিয়া তনু রায় শাস্ত্ৰবিচার করিতেছিলেন। নিরঞ্জন, গোবর্ধন প্রভৃতি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

তনু রায় বলিলেন,–কন্যাদান করিয়া বংশজ কিঞ্চিৎ সম্মান গ্রহণ করিবে। শাস্ত্রে একেবারেই নিষিদ্ধ।–গোবর্ধন চুপি চুপি বলিলেন,—বল না? মহাভারতে আছে।

তনু রায় তাহা শুনিতে পাইলেন না। ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিলেন—দাতা-কর্ণে আছে।

এই কথা শুনিয়া নিরঞ্জন একটু হাসিলেন। নিরঞ্জনের হাসি দেখিয়া তনু রায়ের রাগ হইল।–নিরঞ্জন বলিলেন,–রায় মহাশয়! কন্যার বিবাহ দিয়া টাকা গ্রহণ করা মহাপাপ। পাপ করিতে ইচ্ছা হয়, করুন; কিন্তু শাস্ত্রের দোষ দিবেন না, শাস্ত্রকে কলঙ্কিত করিবেন না। শাস্ত্র আপনি জানেন না, শাস্ত্র আপনি পড়েন নাই।

তনু রায় আর রাগ সংবরণ করিতে পারিলেন না। নিরঞ্জনের প্রতি নানা কটু কথা প্রয়োগ করিয়া অবশেষে বলিলেন, আমিশা পড়ি নাই? ভাল? কিসের জন্য আমি পরের শাস্ত্র পড়িব? যদি মনে করি তো আমি নিজে কত শাস্ত্র করিতে পারি। যে নিজে শাস্ত্র করিতে পারে সে পরের শাস্ত্র কেন পড়িবে?

নিরঞ্জনকে এইবার পরাস্ত মানিতে হইল। তাঁকে স্বীকার করিতে হইল যে, যে লোক নিজে শাস্ত্র প্রণয়ন করিতে পারে, পরের শাস্ত্র তাঁহার পড়িবার আবশ্যক নাই।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ–বিদায়

যে দিন রামহরির সহিত কথাবার্তা হইল, সে দিন রাত্রিতে মা, খেতুর গায়ে স্নেহের সহিত হাত রাখিয়া বলিলেন,—খেতু! বাবা! তোমাকে একটি কথা বলি।

খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন,–কি মা?

মা উত্তর করিলেন,বাছা! তোমার রামহরি দাদার সহিত তোমাকে কলিকাতায় যাইতে হইবে।–খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন,—সে কোথায় মা!।

মা বলিলেন,–তোমার মনে পড়ে না? সেই যে, যেখানে গাড়ী ঘোড়া আছে?

খেতু বলিলেন—সেই খানে? তুমি সঙ্গে যাবে তো মা?

মা উত্তর করিলেন,—না বাছা! আমি যাইব না, আমি এইখানেই থাকিব।

খেতু বলিলেন,–তবে মা! আমিও যাইব না!

মা বলিলেন,–না গেলে বাছা চলিবে না। আমি মেয়েমানুষ, আমাকে যাইতে নাই। রামহরি দাদার সঙ্গে যাইবে তাতে আর ভয় কি?

খেতু বলিলেন,—ভয়! ভয় মা! আমি কিছুতে ভয় করি না। তবে তোমার জন্য আমার মন কেমন করিবে, তাই মা বলিতেছি যে, যাব না।

মা বলিলেন,–খেতু! সাধ করিয়া কি তোমাকে আমি কোথাও পাঠাই? কি করি, বাছা? না পাঠালেই নয়, তাই পাঠাতেই চাই। তুমি এখন বড় হইয়াছে, এইবার তোমাকে স্কুলে পড়িতে হইবে। না পড়িলে শুনিলে মূখ হয়, মুখকে কেহ ভালবাসেনা, কেহ আদর করে না, তুমি যদি স্কুলে যাও আর মন দিয়া লেখা পড়া কর, তাহা হইলে সকলেই তোমাকে ভালবাসিবে; আর খেতু! তোমার এই দুঃখিনী মার দুঃখ ঘুচিবে। এই দেখ, আমি আর সরু পৈতা কাটিতে পারি না, চক্ষে দেখতে পাই না। আর কিছুদিন পরে হয় তো মোটা পৈতাও কাটিতে পারিব না। তখন বল, পয়সা কোথায় পাইব? লেখা-পড়া শিখিয়া তুমি টাকা আনিতে পারিলে, আমাকে আর পৈতা কাটিতে হইবে না। আমি তখন সুখেস্বচ্ছন্দে থাকিব, পূজা-আচ্চা করিব, আর ঠাকুরদের কাছে বলিব,—খেতু আমার বড় সুছেলে, খেতুকে তোমরা বাঁচাইয়া রাখ।

খেতু বলিলেন,–মা! আমি যদি যাই, তুমি কাঁদিবে না?

মা উত্তর করিলেন,–না বাছা, কাঁদিব না।

খেতু বলিলেন,—ঐ যে মা! কাঁদিতেছ!।

মা উত্তর করিলেন,–এখন কান্না পাইতেছে, ইহার পর আর কাঁদিব না। আর খেতু সেখানে তোমাকে বারমাস থাকিতে হইবে না, ছুটী পাইলে তুমি মাঝে মাঝে বাড়ী আসিবে। আমি পথপানে চাহিয়া থাকিব, আগে থাকিতে দত্তদের পুকুর ধারে গিয়া বসিয়া থাকিব, সেইখান হইতে তোমাকে কোলে করিয়া আনিব। মন দিয়া লেখা পড়া করিলে, তুমি আবার আমাকে চিঠি লিখিতে শিখিবে। তুমি আমাকে কত চিঠি লিখিবে আমি সে চিঠিগুলি তুলিয়া রাখিব, কাহাকেও খুলিতে দিব না, কাহাকেও পড়িতে দিব না। তুমি যখন বাড়ীতে আসিবে, তখন সেই চিঠিগুলি খুলিয়া আমাকে পড়িয়া পড়িয়া শুনাইবে।

খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন,–মা! সেখানে মালা পাওয়া যায়?

মা বলিলেন,–মালা কি? খেতু বলিলেন,–সেই যে মা? তুমি একদিন বলিয়াছিলে যে, রাত্রিতে ঘুম হয় না, যদি একছড়া মালা পাই তো বসিয়া বসিয়া জপ করি।

মা উত্তর করিলেন—হ্যা বাছা! মালা সেখানে অনেক পাওয়া যায়।

খেতু বলিলেন,–আমি তোমার জন্য, মা! ভাল মালা কিনিয়া আনিব।

মা উত্তর করিলেন, তাই ভাল। আমার জন্য মালা আনিও।

মাতা-পুত্রে এইরূপ কথার পর, কলিকাতার বিষয় ভাবিতে ভাবিতে খেতু নিদ্রিত হইলেন। তাহার পরদিন সকালে উঠিয়া খেতু বলিলেন,–মা, এই কয়দিন আমি পাঠশালায় যাইব না, খেলা করিতেও যাইব না, সমস্ত দিন তোমার কাছে থাকিব।

মা উত্তর করিলেন,—-আচ্ছা, তাই ভাল, তবে তোমার নিরঞ্জন কাকাকে একবার নমস্কার করিতে যাইও।

খেতু বলিলেন,—তা যাব। আমি আর একটি কথা বলি। তোমার খাওয়া হইলে, এ কয়দিন আমি তোমার পাতে ভাত খাইব। পাতে ভাত রাখিতে মানা করি, কেন তা জান মা? যাহা তোমার মুখে ভাল লাগে, নিজে না খাইয়া আমার জন্য রাখ। তাই আমি বলি, দুপুর বেলা মা! আমার ক্ষুধা পায় না, আমার জন্য পাতে ভাত রাখিও না। ক্ষুধা, কিন্তু মা! খুব পায়। লোকের গাছতলায় কত কুল, কত বেল পড়িয়া থাকে, স্বচ্ছেন্দে কুড়াইয়া খাই। কিন্তু তোমার ক্ষুধা পাইলে তুমি তো মা, তা খাও না? তাই পাতে ভাত রাখিতে মানা করি, পাছে মা! তোমার পেট না ভরে!

ব্রাহ্মণী খেতুকে কোলে লইলেন, মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে কাঁদিতে লাগিলেন, আর বলিলেন,—বাবা! এ দুঃখের কান্না নয়! তোমা হেন চাঁদ ছেলে যে গর্ভে ধরিয়াছে, তার আবার দুঃখ কিসের? তোমার সুধামাখা কথা শুনিলে ভয় হয়, এ হতভাগিনীর কপালে তুমি কি বাঁচিবে?

সেই দিন আহারাদির পর খেতুর হেঁড়া খোঁড়া কাপড়গুলি মা সেলাই করিতে বসিলেন।

খেতু বলিলেন,—মা। আমি ছেড়ার দুই ধার এক করিয়া ধরি, তুমি ওদিক্‌ হইতে সেলাই কর, তাহা হইলে শীঘ্র হইবে। আর মা। যখন সূচ সূতা না থাকিবে, তখন আমি পরাইয়া দিব, তুমি ছিদ্রটি দেখিতে পাও না, সূততা পরাইতে তোমার অনেক বিলম্ব হয়।

এইরূপে মাতাপুত্রে কথা কহিতে কহিতে কাপড় সেলাই হইতে লাগিল। তাহার পর মা সেইগুলিকে ক্ষারে কাচিয়া পরিষ্কার করিয়া লইলেন। খেতু কলিকাতায় যাইবেন, তাঁহার আয়োজন এইরূপে হইতে লাগিল।–বৈকালবেলা খেতু নিরঞ্জনের বাটী যাইলেন। নিরঞ্জন ও নিরঞ্জনের স্ত্রীকে প্রণাম করিয়া পায়ের ধূলা লইয়া, কলিকাতায় যাইবার কথা তাহাদিগকে বলিলেন। রামহরির নিকট নিরঞ্জন পূৰ্বেই সমস্ত কথা শুনিয়াছিলেন।

এক্ষণে খেতুকে আশীর্বাদ করিয়া, নানারূপ উপদেশ দিয়া নিরঞ্জন বলিলেন,–খেতু! সর্ব্বদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা কখনও বলিও না। নীচতা ও নিষ্ঠুরতা পরিত্যাগ করিবে। জীবে দয়া করিবে। যথাসাধ্য পরোপকার করিবে, ইহাই সনাতন ধর্ম্ম। সুখ-দুঃখের সকল কথা তোমার রামহরি দাদাকে বলিবে, কোনও কথা তাঁহার নিকট গোপন করিবে না। অনেক বালকের সহিত তোমাকে পড়িতে হইবে, তাঁহার মধ্যে কেহ দুষ্ট, কেহ শিষ্ট। সুতরাং বালকে বালকে বিবাদ হইবে। অন্যায় করিয়া কাহাকেও মারিও না, দুর্বলকে মারিও না, পাঁচজন পড়িয়া একজনকে মারিও না, দুর্বলকে কেহ মারিতে আসিলে তাঁহার পক্ষ হইও। দুর্বলের পক্ষ হইয়া যদি মার খাইতে হয় সেও ভাল। প্রতিদিন রাত্রিতে শুইবার সময় মনে করিয়া দেখিবে যে, সেদিন কি সুকার্য কি কুকাৰ্য্য করিয়াছ। যদি কোনও প্রকার কুকাৰ্য্য করিয়া থাক, তো মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিবে, আর এমন কাজ কখনও করিব না।

এইরূপে খেতু, নিরঞ্জন কাকার নিকট হইতে বিদায়গ্রহণ করিলেন।

মঙ্গলবার রাত্রিতে মাতা-পুত্রের নিদ্রা হইল না। দুই জনে কেবল কথা কহিতে লাগিলেন, কথা আর ফুরায় না। কতবার মা বলিলেন,–খেতু! ঘুমাও, না ঘুমাইলে অসুখ করিবে।

খেতু বলিলেন,–না মা! আজ রাত্রিতে ঘুম হইবে না। আর মা কাল রাত্রিতে তো আর তোমার সঙ্গে কথা কহিতে পাব না? কাল কতদূর চলিয়া যাব। সে কথা যখন মা! মনে করি, তখন আমার কান্না পায়। মা বলিলেন,—পূজার ছুটির আর অধিক দিন নাই, দেখিতে দেখিতে এ কয়মাস কাটিয়া যাইবে। তখন তুমি আবার বাড়ী আসিবে।

প্রাতঃকালে রামহরি আসিলেন। খেতুর মা, খেতুর কপালে দধির ফোটা করিয়া দিলেন, চাদরের খুঁটে বিল্বপত্র বাঁধিয়া দিলেন। নীরবে নিঃশব্দে রামহরির হাতের উপর খেতুর হাতটি দিলেন। চক্ষু ফুটিয়া জল আসিতেছিল, অনেক কষ্টে তাহা নিবারণ করিলেন।

অবশেষে ধীরে ধীরে কেবল এই কথাটি বলিলেন,–দুঃখিনীর ধন তোমাকে দিলাম।

রামহরি বলিলেন,—খেতু! মাকে প্রণাম কর।

খেতু প্রণাম করিলেন, রামহরি নিজেও প্রণাম করিয়া দুইজনে বিদায় হইলেন।

যতক্ষণ দেখা যাইল, ততক্ষণ খেতুর মা অনিমেষ নয়নে সেই পথপানে চাহিয়া রহিলেন। খেতুও মাঝে মাঝে পশ্চাৎদিকে চাহিয়া মাকে দেখিতে লাগিলেন। যখন আর দেখা গেল না, তখন খেতুর মা পথের ধূলায় শুইয়া পড়িলেন। ধূলায় লুণ্ঠিত হইয়া-অবিরল ধারায় চক্ষের জলে সেই ধূলা ভিজাইতে লাগিলেন।

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ—কঙ্কাবতী

পথে পড়িয়া খেতুর মা কাঁদিতেছেন, এমন সময় তনু রায়ের স্ত্রী সেইখানে আসিলেন।

তাঁহার হাত ধরিয়া তুলিয়া ধীরে ধীরে তিনি বলিলেন,–দিদি! চুপ কর। চক্ষের জল ফেলিতে নাই। চক্ষের জল ফেলিলে ছেলের অমঙ্গল হয়।

খেতুর মা উত্তর করিলেন,–সব জানি বো! কিন্তু কি করি? চক্ষের জল যে রাখিতে পারি না, আপনা-আপনি বাহির হইয়া পড়ে। আমি যে আজ পৃথিবী শূন্য দেখিতেছি! কি করিয়া ঘরে যাই? আজ যে আমার আর কোন কাজ নাই। আজ তো আর খেতু পাঠশালা হইতে কালি ঝুলি মাখিয়া ক্ষুধা ক্ষুধা করিয়া আসিবে না? এতক্ষণ খেতু কতদূর চলিয়া গেল! আহা, বাছার কত না মন কেমন করিতেছে!

তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন,—চল দিদি! ঘরে চল। সেইখানে বসিয়া, চল, খেতুর গল্প করি। আহা! খেতু কি গুণের ছেলে! দেশে এমন ছেলে নাই। তোমার কপালে এখন বাঁচিয়া থাকে তবেই; তা না হইলে সব বৃথা।

এই বলিয়া তনু রায়ের স্ত্রী খেতুর-মার হাত ধরিয়া ঘরে লইয়া গেলেন। সেখানে অনেক্ষণ ধরিয়া দুইজনে খেতুর গল্প করিলেন।

খেতু খাইয়া গিয়াছিল, তনু রায়ের স্ত্রী সেই বাসনগুলি মাজিলেনও ঘর-দ্বার সব পরিষ্কার করিয়া দিলেন। বেলা হইলে খেতুর মা রাঁধিয়া খাইবেন, সে নিমিত্ত তরকারিগুলি কুটিয়া দিলেন, বাটনাটুকু বাটিয়া দিলেন।

খেতুর মা বলিলেন,—থাক বোন্ থাক! আজ আর আমার খাওয়া দাওয়া! আজ আর আমি কিছু খাইব না।

তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন,—না দিদি! উপবাসী কি থাকিতে আছে? খেতুর অকল্যাণ হয়, তা কি তিনি করিতে পারেন?-খেতুর অকল্যাণ হইবে। এই কথাটি বলিলেই খেতুর মা চুপ! যা করিলে খেতুর অকল্যাণ হয়, তা কি তিনি করিতে পারেন?

তনু রায়ের স্ত্রী পুনরায় বলিলেন,—এই সব ঠিক করিয়া দিলাম। বেলা হইলে রান্না চড়াইয়া দিও। কাজ-কর্ম সারা হইলে আমি আবার ও বেলা আসিব।অপরাহ্নে তনু রায়ের স্ত্রী পুনরায় আসিলেন। কোলের মেয়েটিকে সঙ্গে আনিয়াছিলেন।–খেতুর মা বলিলেন,–আহা! কি সুন্দর মেয়েটি বোন্ যেমন মুখ, তেমনি চুল, তেমনি রং।

তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন,–হা! সকলেই বলে, এ কন্যাটি তোমার গর্ভের সুন্দর। তা দিদি! এ পোড়া পেটে কেন যে এরা আসে? মেয়ে হইলে ঘরের মানুষটি আহ্লাদে আটখানা হন; কিন্তু আমার মনে হয় যে, আঁতুর ঘরেই মুখে নুন দিয়া মারি। গ্রীষ্মকালে একাদশীর দিন, মেয়ে দুইটির যখন মুখ শুকাইয়া যায়, যখন একটু জলের জন্য বাছাদের প্রাণ টা টা করে, বল দেখি, দিদি! মার প্রাণ তখন কিরূপ হয়? পোড়া নিয়ম। যে এ নিয়ম করিয়াছে, তাঁহাকে যদি একবার দেখিতে পাই, তো ঝাঁটা পেটা করি। মুখপোড়া যদি একটু জল খাবারও বিধান দিত, তাহা হইলে কিছু বলিতাম না।

খেতুর মা বলিলেন,–আর জন্মে যে যেমন করিয়াছে, এ জন্মে সে তার ফল পাইয়াছে; আবার এ জন্মে যে যেরূপ করিবে, ফিরে জন্মে সে তার ফল পাইবে।

তনু রায়ের স্ত্রী পুনরায় বলিলেন,–এক একবার মনে হয় যে, যদি বিদ্যাসাগরী মতটা চলে, তো ঠাকুরদের সিন্নি দিই।

খেতুর মা উত্তর করিলেন,— চুপ কর বোন্। ছি ছি! ও কথা মুখে আনিও না। বিদ্যাসাগরের কথা শুনিয়া সাহেবরা যদি বলেন যে, দেশে আর বিধবা থাকিতে পারে না, সকলকেই বিবাহ করিতে হইবে, ছি ছি! ও মা! কি ঘৃণার কথা! এই বৃদ্ধ বয়সে তাহা হইলে যাব কোথা? কাজেই তখন গলায় দড়ি দিয়া কি জলে ড়ুবিয়া মরিতে হইবে।

তনু রায়ের স্ত্রী হাসিয়া বলিলেন,–দিদি! এতদিন তুমি কলিকাতায় ছিলে, কিন্তু তুমি কিছুই জান না। বিদ্যাসাগর মহাশয় বুড়ো হাবড়া সকলকেই ধরিয়া বিবাহ দিতে চান নাই। অতি অল্প বয়সে যাহারা বিধবা হয়, কেবল সেই বালিকাদিগের বিবাহের কথা তিনি বলিয়াছিলেন। তাও যাহার ইচ্ছা হবে, সে দিবে; যাহার ইচ্ছা না হবে, না দিবে।

খেতুর মা বলিলেন,—কি জানি, ভাই। আমি অত শত জানি না।

তনু রায়ের স্ত্রীর দুইটি বিধবা মেয়ে, তাহাদের দুঃখে তিনি সদাই কাতর। সে জন্য বিধবা বিবাহের কথা পড়িলে তিনি কান দিয়া শুনিতেন। কলিকাতায় বাস করিয়া খেতুর মা যাহা না জানেন, তাহা ইনি জানেন।

তনু রায় পণ্ডিত লোক। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মতটি যেই বাহির হইল, আর ইনি লুফিয়া লইলেন। তিনি বলিলেন,–বিধবা বিবাহের বিধি যদি শাস্ত্রে আছে, তবে তোমরা মানিবে না কেন! শাস্ত্র অমান্য করা ঘোর পাপের কথা। দুইবার কেন? বিধবাদিগের দশ বার বিবাহ দিলেও কোন দোষ নাই, বরং পূণ্য আছে। কিন্তু এ হতভাগ্য দেশ ঘোর কুসংস্কারে পরিপূর্ণ, এ দেশের আর মঙ্গল নাই।

তনু রায়ের মত নিষ্ঠাবান্ লোক্রে মুখে এইরূপ কথা শুনিয়া প্রথম প্রথম সকলে কিছু আশ্চৰ্য্য হইয়াছিল। তার পর সকলে ভাবিল,—আহা! বাপের প্রাণ!, ঘরে দুইটি বিধবা মেয়ে, মনের খেদে উনি এইরূপ কথা বলিতেছেন। –কেল নিরঞ্জন বলিলেন,—হ্যা। বিধবা বিবাহটি প্রচলিত হইলে তনু রায়ের ব্যবসাটি চলে ভাল!

এই কথা শুনিয়া সকলে নিরঞ্জনকে ছি ছি করিতে লাগিল। সকলে বলিল,—নিরঞ্জনের মনটি হিংসায় পরিপূর্ণ। তা না হইলেই বা ওর এমন দশা হইবে কেন? যার দুই শত বিঘা ব্রােত্তর ভূমি ছিল, আজ সে পথের ভিখারী; কোনও দিন অন্ন হয়, কোনও দিন অন্ন হয় না।–খেতুর মাতে আর তনু রায়ের স্ত্রীতে নানারূপ কথাবার্তা হইতে লাগিল।

খেতুর মা জিজ্ঞাসা করিলেন,—তোমার এ মেয়েটি বুঝি এক বৎসর হইল?

তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন,–হ্যা! এই এক বৎসর পার হইয়া দুই বৎসরে পড়িবে?খেতুর মা বলিলেন,–কঙ্কাবতী। দিব্য নামটি তো? মেয়েটিও যেমন নরম নরম দেখিতে, নামটিও সেইরূপ নরম নরম শুনিতে।

এইরূপ খেতুর মাতে আর তনু রায়ের স্ত্রীতে ক্রমে ক্রমে বড়ই সদ্ভাব্য হইল। অবসর পাইলে তনু রায়ের স্ত্রী কঙ্কাবতীকে খেতুর মার কাছে ছাড়িয়া যান।

মেয়েটি এখনও হাঁটিতে শিখে নাই; হামাগুড়ি দিয়া চারিদিকে বেড়ায় কখনও বা বসিয়া খেলা করে কখনও বা কিছু ধরিয়া দাঁড়ায়। খেতুর মা আপনার কাজ করেন ও তাঁহার সহিত দুটি একটি কথা কন্। কথা কহিলে মেয়েটি ফিক ফিক্‌ করিয়া হাসে, মুখে হাসি ধরে না। মেয়েটি বড় শান্ত, কাঁদিতে একেবারে জানে না।

 

অষ্টম পরিচ্ছেদ—বালক-বালিকা

কলিকাতায় গিয়া খেতু ভালরূপে লেখা-পড়া করিতে লাগিলেন। শান্ত শিষ্ট, সুবুদ্ধি। খেতুর নানা গুণ দেখিয়া সকলে তাঁহাকে ভাল বাসিতেন।

রামহরির এক্ষণে কেবল একটি শিশু-পুত্র, তাঁহার নাম নরহরি। তিন বৎসর পরে একটি কন্যা হয়; তাঁহার নাম হইল সীতা।

রামহরি ও রামহরির স্ত্রী, খেতুকে আপনাদিগের ছেলের চেয়ে অধিক স্নেহ করিতেন। খেতুর প্রখর বুদ্ধি দেখিয়া স্কুলে সকলেই বিস্মিত হইলেন। খেতু সকল কথা বুঝিতে পারেন, সকল কথা মনে করিয়া রাখিতে পারেন। যখন যে শ্রেণীতে পড়েন, তখন সেই শ্রেণীর সর্বোত্তম বালক—খেতু; খেতুর উপর কেহ উঠিতে পারে না। যখন যে কয়খানি পুস্তক পড়ুন তাঁহার ভিতর হইতে প্রশ্ন করিয়া খেতুকে ঠকানো ভার। এইরূপে খেতু এক শ্রেণী হইতে অপর শ্রেণীতে উঠিতে লাগিলেন।

জল খাইবার নিমিত্ত রামহরি খেতুকে একটি করিয়া পয়সা দিতেন; খেতু কোনও দিন খাইতেন, কোনও দিন খাইতেন না। কি করিয়া রামহরি এই কথা জানিতে পারিলেন।

খেতুকে তিনি একদিন জিজ্ঞাসা করিলেন,–খেতু! তুমি জল খাওনা কেন? পয়সা লইয়া কি কর?

খেতু কিছু অপ্রতিভ হইলেন, একটুখানি চুপ করিয়া উত্তর করিলেন,–দাদা-মহাশয়। যে দিন বড় ক্ষুধা পায়, যে দিন আর থাকিতে পারি না, সেই দিন জল খাই; যে দিন না খাইয়া থাকিতে পাবি সেই দিন আর খাই না। যা পয়সা বাঁচিয়েছি, তাহা আমার কাছে আছে। যখন মার নিকট হইতে আসি, তখন মাকে বলিয়াছিলাম যে,! তোমার জন্য আমি এক ছড়া মালা কিনিয়া আনিব; সেই জন্য এই পয়সা রাখিতেছি।

যখন এই কথা হইতেছিল, তখন রামহরির নিকট খেতু দাঁড়াইয়া ছিলেন। রামহরি খেতুর মাথায় হাত দিয়া সম্মুখের চুলগুলি পশ্চাৎ দিকে ফিরাইতে লাগিলেন। খেতু বুঝিলেন দাদা রাগ করেন নাই আদর করিতেছেন।

কিয়ৎক্ষণ পরে রামহরি বলিলেন,–খেতু! যখন মালা কিনিবে আমাকে বলিও, আমি ভাল মালা কিনিয়া দিব।

পূজার ছুটি নিকট হইল। তখন খেতু বলিলেন,–দাদা মহাশয়! কৈ, এইবার মালা কিনিয়া দিন?-রামহরি বলিলেন,–তোমার কতগুলিয়সা হইয়াছে, নিয়ে এস, দেখি?

খেতু পয়সাগুলি আনিয়া দাদার হাতে দিলেন। রামহরি গণিয়া দেখিলেন যে, এক টাকারও অধিক পয়সা হইয়াছে। আট আনা দিয়া রামহরি একছড়া ভাল রুদ্রাক্ষের মালা কিনিয়া, বাকি পয়সাগুলি খেতুকে ফিরাইয়া দিলেন।

খেতু বলিলেন,–দাদা মহাশয়! আমি এ পয়সা লইয়া আর কি করিব? এ পয়সা আপনি নি। –রামহরি উত্তর করিলেন,—না খেতু। এ পয়সা আমার নয়, এ পয়সা তোমার, বাড়ী গিয়া মাকে দিও, তোমার মা কত অদ করিকেন।

বাড়ী যাইবার দিন নিকট হইল। এখানে খেতুর মনে, আর সেখানে মার মনে আনন্দ ধরে না। তসর ও গালার ব্যবসায়ীরা সকলে এখন দেশে যাইতেছিলেন। তাহাদের সহিত রামহরি খেতুকে পাঠাইয়া দিলেন, আর কবে কোন্ সময়ে দেশে পৌছবেন, সে সমাচার আগে থাকিতে খেতুর মাকে লিখিলেন।

দত্তদের পুকুরধারে কেন? খেতুর মা আরও অনেক দূরে গিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। দূর হইতে খেতু মাকে দেখিতে পাইয়া ছুটিয়া গিয়া তাঁহাকে ধরিলেন। খেতুর মা, ছেলেকে বুকে করিয়া স্বর্গসুখ লাভ করিলেন।

খেতু বলিলেন,–ঐ যা! মা! আমি তোমাকে প্রণাম করিতে ভুলিয়া গিয়াছি।

মা উত্তর করিলেন,—থাক, আর প্রণামে কাজ নাই। অমনি তোমাকে আশীর্বাদ করি, তুমি চিরজীবী হও, তোমার সোনার দোয়াত কলম হউক।

খেতু বলিলেন,–মা। আমি মনে করিয়াছিলাম, তুমি দত্তদের পুকুর ধারে থাকিবে, এত দূরে আসিবে, তা জানিতাম না!–মা বলিলেন—বাছা! যদি উপায় থাকিত, তো আমি কলিকাতা পর্যন্ত যাইতাম। খেতু! তুমি রোগা হইয়া গিয়াছ।

খেতু উত্তর করিলেন,–না মা! রোগা হই নাই, পথে একটু কষ্ট হইয়াছে, তাই রোগা রোগা দেখাইতেছে। মা! এখন আমি হাঁটিয়া যাই এত দূর তুমি আমাকে লইয়া যাইতে পারিবে না।–মা বলিলেন,–না না, আমি তোমাকে কোলে করিয়া লইয়া যাইব।

কোলে যাইতে যাইতে খেতু পয়সাগুলি চুপি চুপি মার আঁচলে বাঁধিয়া দিলেন। বাড়ী যাইয়া যখন খেতু মার কোল হইতে নামিলেন, তখন মার আঁচল ভারি ঠেকিল।

মা বলিলেন,–এ আবার কি? খেতু! তুমি বুঝি আমার আঁচলে পয়সা বাঁধিয়া দিলে?

খেতু হাসিয়া উঠিলেন আর বলিলেন—মা! রও, তোমাকে আবার একটা তামাসা দেখাই। এই বলিয়া খেতু মালা ছড়াটি মার গলায় দিয়া দিলেন, আর বলিলেন-কেমন মা! মনে আছে তো?–মা খেতুর গালে ঈষৎ ঠোনা মারিয়া বলিলেন,—ভারি দুষ্ট ছেলে! খেতু হাসিয়া উঠিলেন, মাও হাসিলেন।

পর দিন খেতু দেখিলেন যে, তাহাদের বাটীতে কোথা হইতে একটি ছোট মেয়ে

আসিয়াছে। খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন,—মা! ও মেয়েটি কাদের গা?

মা বলিলেন—জান না? ও যে তোমার তনু কাকার ছোট মেয়ে! ওর নাম কঙ্কাবতী। তনু রায়ের স্ত্রী এখন সৰ্ব্বদাই আমার নিকট আসেন। আমি পৈতা কাটি আর দুই জনে বসিয়া গল্পগাছা করি। মেয়েটিকে তিনি আমার কাছে মাঝে মাঝে ছাড়িয়া যান। মেয়েটি আপনার মনে খেলা করে, কোনওরূপ উপদ্রব করে না। আমার কাছে থাকিতে ভাল বাসে।–তনু রায়ের সহিত খেতুর কোন সম্পর্ক নাই, কেবল পাড়া প্রতিবাসী, সুবাদে কাকা কাকা বলিয়া ডাকেন। কঙ্কাবতীকে খেতু বলিলেন,—এস, এই দিকে এস।

কঙ্কাবতী সেই দিকে যাইতে লাগিল। খেতু বলিলেন,–দেখ দেখ, মা! কেমন এ ট টল করিয়া চলে!–খেতুর মা বলিলেন,–পা এখনও শক্ত হয় নাই।–একটি পাতা দেখাইয়া খেতু বলিলেন,–এই নাও।

-পাতাটি লইবার নিমিত্ত কঙ্কাবতী হাত বাড়াইল ও হাসিল।

খেতু বলিলেন,–মা! কেমন হাসে দেখ?–মা উত্তর করিলেন,–হাঁ বাছা! মেয়েটি খুব হাসে, কাঁদিতে একেবারে জানে না অতি শান্ত। খেতু বলিলেন মা! আগে যদি জানিতাম, তত ইহার জন্য একটি পুতুল কিনিয়া আনিতাম। মা বলিলেন-এইবার যখন আসিবে, তখন আনিও।

 

নবম পরিচ্ছেদ–মেনী

পূজার ছুটী ফুরাইলে, খেতু কলিকাতায় যাইলেন; সেখানে অতি মনোেযোগের সহিত লেখাপড়া করিতে লাগিলেন। বৎসরের মধ্যে দুইবার ছুটী হইলে তিনি বাটী আসেন। সেই সময় মার জন্য কোনও না কোনও দ্রব্য, আর কঙ্কাবতীর জন্য পুতুলটি খেলনাটি লইয়া আসেন। খেতুর মার নিকট কঙ্কাবতী সৰ্ব্বদাই থাকে, কঙ্কাবতীকে তিনি বড় ভালবাসেন।

খেতুর যখন বার বৎসর বয়স, তখন তিনি একটি বড় মানুষের ছেলেকে পড়াইতে লাগিলেন। বালকের পিতা খেতুকে মাসে পাঁচ টাকা করিয়া দিতেন।

প্রথম মাসের টাকা কয়টি খেতু, রামহরির হাতে দিয়া বলিলেন,দাদা মহাশয়! এ মাস হইতে মার চাউলের দাম আর আপনি নিবেন না, এই টাকা মাকে দিবেন। আমি শুনিয়াছি, আপনার ধার হইয়াছে, তাই যত্ন করিয়া আমি এই টাকা উপার্জন করিয়াছি।

রামহরি বলিলেন,–খেতু! তুমি উত্তম করিয়াছ। উদ্যম, উৎসাহ, পৌরুষ মনুষ্যের নিতান্ত প্রয়োজন। এ টাকা আমি তোমার মার নিকট পাঠাইয়া দিব। তাঁহাকে লিখিব যে, তুমি নিজে এ টাকা উপার্জন করিয়াছ। আর আমি সকলকে বলিব যে, দ্বাদশ বৎসরের শিশু আমাদের খেতু, তাঁহার মাকে প্রতিপালন করিতেছে।

এইবার যখন খেতু বাটী আসিলেন, তখন মার জন্য একখানি নামাবলী, আর কঙ্কাবতীর জন্য একখানি রাঙা কাপড় আনিলেন। রাঙা কাপড়খানি পাইয়া কঙ্কাবতীর আর আহ্লাদ ধরে না। ছুটিয়া তাঁহার মাকে দেখাইতে যাইলেন।

খেতু বলিলেন,–মা! কঙ্কাবতীকে লেখাপড়া শিখাইলে হয় না? মা বলিলেন,–কি জানি বাছা! তনু রায় এক প্রকার লোক। কি বলিতে কি বলিয়া বসিবে।

খেতু বলিলেন,–তাতে আর দোষ কি, মা? কলিকাতায় কত মেয়ে স্কুলে যায়; মা বলিলেন-কঙ্কাবতীর মাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিব।

সেই দিন তনু রায়ের স্ত্রী আসিলে, খেতুর মা কথায় কথায় বলিলেন,–খেতু বলিতেছে,–এবার যখন বাটী আসিব, তখন কঙ্কাবতীর জন্য একখানি বই আনিব, কঙ্কাবতীকে একটু একটু পড়িতে শিখাই। আমি বলিলাম—না বাছা! তাতে আর কাজ নাই, তোমার তনু কাকা হয় তো রাগ করিবেন।

তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন,–তাতে আবার রাগ কি, আজ কাল তো ঐ সব হইয়াছে। জামা গায়ে দেওয়া, লেখা পড়া করা, আজ কাল তো সকল মেয়েই করে। তবে আমাদের পাড়া-গাঁ তাই, এখানে ও সব নাই।

বাটী গিয়া কঙ্কাবতীর মা স্বামীকে বলিলেন,–খেতু বাড়ী আসিয়াছে। কঙ্কাবতীর জন্য কেমন একখানি রাঙ্গা কাপড় আনিয়াছে?

তনু রায় বলিলেন,–খেতু ছেলেটি ভাল! লেখা পড়ায় মন আছে। দুপয়সা আনিয়া খাইতে পারিবে। তবে বাপের মত বোকা না হয়।

স্ত্রী বলিলেন,–খেতু বলিতেছিল যে, এইবার যখন বাটী আসিব, তখন একখানি বই আনিয়া কঙ্কাবতীকে একটু একটু পড়িতে শিখাইব।–তনু রায় বলিলেন,–স্ত্রী লোকের আবার লেখাপড়া কেন? লেখাপড়া শিখিয়া আর কাজ নাই।

না বুঝিয়া তনু রায় এই কথাটি বলিয়া ফেলিলেন। কিন্তু যখন তিনি স্থিরভাবে বিবেচনা করিয়া দেখিলেন, তখন বুঝিতে পারিলেন যে লেখাপড়ার অনেক গুণ আছে।

আজকালের বরেরা শিক্ষিতা কন্যাকে বিবাহ করিতে ভালবাসে। এরূপ কন্যার আদর হয়, মূলাও অধিক হয়।

তবে কথা এই কাজটি শাস্ত্রবিরুদ্ধ কি না? শাস্ত্র সম্মত না হইলে তনু রায় কখনই মেয়েকে লেখাপড়া শিখাইতে দিবেন না। মনে মনে তনু রায় শাস্তুবিচার করিতে লাগিলেন।

বিচার করিয়া দেখিলেন যে স্ত্রীলোকের বিদ্যাশিক্ষা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ বটে, তবে—এ সত্য ত্রেতা দ্বাপর যুগের নিমিত্ত, কলিকালের জন্য নয়। পূৰ্ব্বকালে যাহা করিতে ছিল, এখন তাহা করিতে নাই। তাঁহার দৃষ্টান্ত, নরমেধ যজ্ঞ। এখন মানুষ বলি দিলে ফাসি যাইতে হয়। আর এক দৃষ্টান্ত,সমুদ্রযাত্রা এখন করিলে জাতি যায়। তাই তনুরায়ের মা যখন জীবিত ছিলেন, তখন তিনি একবার সাগর যাইতে ঢাহিয়াছিলেন। কিন্তু তনু রায় পাঠান নাই।

মাকে তিনি বুঝাইয়া বলিলেন,—মা! সাগর যাইতে নাই! সমুদ্র যাত্ৰ একে বারে নিষিদ্ধ। শাস্ত্রের সঙ্গে আর সমুদ্রের সঙ্গে ঘোরতর আড়ি। সমুদ্র দেখিলে পাপ, সমুদ্র ছুইলে পাপ। কেন মা পয়সা খরচ করিয়া পাপের ভরা কিনিয়া আনিবে? কেন মা জাতি কুল বিসর্জন দিয়া আসিবে?

এক্ষণে তনু রায় বিচার করিয়া দেখিলেন যে, পূৰ্ব্বকালে যাহা করিতে ছিল, এখন তাহা করিতে নাই। সুতরাং পূৰ্ব্বকালে যাহা করিতে মানা ছিল, এখন তাহা লোকে স্বচ্ছন্দে করিতে পারে। স্ত্রীলোকদিগের লেখা-পড়া শিক্ষা করা পূৰ্ব্বে মানা ছিল, তাই এখন তাহাতে কোনরূপ দোষ হইতে পারে না।

শাস্ত্রকে তনু রায় এইরূপ ভাঙ্গিয়া চুরিয়া গড়িলেন। শাস্ত্রটি যখন মনের মতন গড়া হইল, তখন তিনি স্ত্রীকে বলিলেন,–আচ্ছা! খেতু যদি কঙ্কাবতীকে একটু আধটু পড়িতে শিখায়, তাহাতে আমার বিশেষ কোনও আপত্তি নাই।

তনু, রায়ের স্ত্রী সেই কথা খেতুর মাকে বলিলেন। খেতুর মা সেই কথা খেতুকে বলিলেন। এবার যখন খেতু বাড়ী আসিলেন, তখন কঙ্কাবতীর জন্য একখানি প্রথমভাগ বর্ণপরিচয় আনিলেন। লেখা পড়া শিখিব, এই কথা মনে করিয়া প্রথম প্রথম কঙ্কাবতীর খুব আহ্লাদ হইল। কিন্তু দুই চারি দিন পরেই তিনি জানিতে পারিলেন যে লেখাপড়া শিক্ষা করা নিতান্ত আমোদর কথা নহে। কঙ্কাবতীর চক্ষে অক্ষরগুলি সব এক প্রকার দেখায়। কঙ্কাবতী এটি বলিতে সেটি বলিয়া ফেলেন।

খেতুর রাগ হইল। খেতু বলিলেন,—কঙ্কাবতী! তোমার লেখাপড়া হইবে না। চিরকাল তুমি মূখ হইয়া থাকিবে। কঙ্কাবতী অভিমানে কাঁদিয়া ফেলিলেন। তিনি বলিলেন,–আমি কি কবিব, আমার যে মনে থাকে না?

খেতুর মা বলিলেন,–ছেলেমানুষকে কি বকিতে আছে? মিষ্ট কথা বলিয়া শিখাইতে হয়। এস, মা! তুমি আমার কাছে এস। তোমার আর লেখাপড়া শিখিতে হইবে না।

খেতু বলিলেন,–মা! কঙ্কাবতী রাত্রি দিন মেনীকে লইয়া থাকে। তাতে কি আর লেখাপড়া হয়? মেনী কঙ্কাবতীর বিড়াল। অতি আদরের ধন মেনী।

কঙ্কাতী বলিলেন,—জেঠাই মা! আমি মেনীকে ক খ শিখাই; তা আমিও যেমনি বোকা, মেনীও তেমনি বোকা; কেমন মেনী, না? মেনীও পড়িতে পারে না, আমিও পড়িতে পারি না। আমিও ছেলে মানুষ, মেনীও ছেলে মানুষ। আমি বড় হইলে পড়িতে শিখিব, মেনীও বড় হইলে পড়িতে শিখিবে। না মেনী?

খেতু হাসিয়া উঠিলেন। খেতু বলিলেন,–কঙ্কাবতী! তুমি পাগল নাকি? যাহা হউক, ক্রমে কঙ্কাবতীর প্রথমভাগ বর্ণ-পরিচয় সারা হইল।

খেতু বলিলেন,—আমি শীঘ্ৰ কলিকাতায় যাইব। তাড়াতাড়ি করিয়া প্রথমভাগখানি শেষ করিলাম, কিন্তু ভাল করিয়া হইল না। এই কয় মাসে পুস্তকখানি একেবারে মুখস্থ করিয়া রাখিবে। এবার আমি দ্বিতীয়ভাগ লইয়া আসিব।

পুনরায় যখন খেতু বাটী আসিলেন, তখন কঙ্কাবতীর দ্বিতীয় ভাগ শেষ হইল। কঙ্কাবতীকে আর পড়াইতে হইল না! কঙ্কাবতী এখন আপনা-আপনি সব পড়িতে শিখিলেন। খেতু কঙ্কাবতীকে একখানি পাটিগণিত দিয়াছিলেন। তাহা দেখিয়া কঙ্কাবতী অঙ্ক শিখিলেন। মাঝে মাঝে খেতু কেবল একটু আধটু বসিয়া বলিয়া দিতেন।

কঙ্কাবতী পড়িতে বড় ভালবাসিতেন। কলিকাতা হইতে খেতু তাঁহাকে নানারূপ পুস্তক ও সংবাদপত্র পাঠাইয়া দিতেন। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনগুলি পর্যন্ত কঙ্কাবতী পড়িতেন।

 

দশম পরিচ্ছেদ—বৌ-দিদি

তের বৎসর বয়সে খেতু ইংরাজীতে প্রথম পাসটি দিলেন। পাস দিয়া তিনি জলপানি পাইলেন। জলপানি পাইয়া মার নিকট তিনি একটি ঝি নিযুক্ত করিয়া দিলেন। মা বৃদ্ধ হইতেছেন, মার যেন কোনও কষ্ট না হয়। এটি সেটি আনিয়া, কাপড়খানি চোপড়খানি কিনিয়া, রামহরির সংসারেও তিনি সহায়তা করিতে লাগিলেন।।

পনের বৎসর বয়সে যেতু আর একটি পাশ দিলেন। জলপানি বাড়িল। সজ্ঞে বৎসর বয়সে আর একটি পাস দিলেন। জলপানি আরও বাড়িল।

খেতু টাকা পাইতে লাগিলেন, সেই টাকা দিয়া মার দুঃখ সম্পূর্ণরূপে ঘুচাইলেন। মা যখন যাহা চান, তৎক্ষণাৎ তাহা পান। তাঁহার আর কিছুমাত্র অভাব রহিল না।

শিবপূজা করিবেন বলিয়া খেতুর মা একদিন ফুল পান নাই। তাহা শুনিয়া খেতু বাড়ির নিকট একটি চমৎকার ফুলের বাগান করিলেন। কলিকাতা হইতে কত গাছ লইয়া সেই বাগানে পুতিলেন। নানা রঙের ফুলে বাগানটি বার মাস আলো করিয়া থাকিত।

রামহরির কন্যা সীতার এখন সাত বৎসর বয়স। মা একেলা থাকেন, সেই জন্য দাদাকে বলিয়া, খেতু সীতাকে মার নিকট পাঠাইয়া দিলেন। সীতাকে পাইয়া খেতুর মার আর আনন্দের অবধি নাই।

কঙ্কাবতীও সীতাকে খুব ভালবাসিতেন। বৈকাল বেলা দুইজনে গিয়া বাগানে বসিতেন। কঙ্কাবতী এখন খেতুর সম্মুখে বড় বাহির হন না! খেতুকে দেখিলে কঙ্কাবতীর এখন লজ্জা করে। তবে খেতুর গল্প করিতে, খেতুর গল্প শুনিতে তিনি ভাল বাসিতেন। অন্য লোকের সহিত খেতুর কথা শুনিতে, লজ্জা করিত। এ সব কথা সীতার সহিত হইত। বৈকালবেলা দুইজনে ফুলের বাগানে যাইতেন। নানা ফুলে মালা গাঁথিয়া কঙ্কাবতী সীতাকে সাজাইতেন। ফুল দিয়া নানারূপ গহনা গড়িতেন। গলায়, হাতে, মাথায়, যেখানে যাহা ধরিত, কঙ্কাবতী সীতাকে ফুলের গহনা পরাইতেন। তাহার পর সীতার মুখ হইতে বসিয়া বসিয়া খেতুর কথা শুনিতেন।

নিরঞ্জন কাকাকে খেতু ভুলিয়া যান নাই। যখন খেতু বাটী আসেন, তখন নিরঞ্জন কাকার জন্য কিছু না কিছু লইয়া আসেন। নিরঞ্জন ও নিরঞ্জনের স্ত্রী তাঁহাকে বিধিমতে আশীর্বাদ করেন।–কঙ্কাবতী বড় হইলে, খেতু তাঁহাকে পুস্তক ও সংবাদপত্র ব্যতীত আরও নানা দ্রব্য দিতেন। আজকাল বালিকাদিগের নিমিত্ত যেরূপ শেমিজ প্রভৃতি পরিচ্ছদ প্রচলিত হইয়াছে, কঙ্কাবতীর নিমিত্ত কলিকাতা হইতে খেতু তাহা লইয়া যাইতেন।

রামহরির সংসারের খেতু সহায়তা করিতে লাগিলেন বটে, কিন্তু রামহরি এ কথায় সহজে স্বীকার হন নাই। একবার খেতু নরহরির জন্য একজোড়া কাপড় কিনিয়াছিলেন। তাহা জানিতে পারিয়া রামহরি খেতুকে বকিয়াছিলেন। খেতুর তাহাতে অতিশয় অভিমান হইয়াছিল। দাদাকে কিছু না বলিয়া তিনি রামহরির স্ত্রীর নিকট গিয়া নানারূপ দুঃখ করিতে লাগিলেন। রামহরির স্ত্রীকে খেতু বৌ-দিদি বলিয়া ডাকিতেন।

খেতুর অভিমান দেখিয়া বৌ-দিদি বলিলেন,—তোমার দাদাকে কিছু বলিতে না পারিয়া, তুমি বুঝি আমার সঙ্গে ঝগড়া করিতে আসিয়াছ?

খেতু উত্তর করিলেন,–বৌ-দিদি! তোমরা আমাকে প্রতিপালন করিয়াছ। তোমাদের পুত্ৰ নরহরি যেরূপ, আমাকেও সেইরূপ দেখা উচিত। পুত্রের মত আমাকে যখন না দেখিলে, তখন আমি পর। আমি যখন পর, তখন আবার তোমাদের সঙ্গে আমার ঝগড়া কি? দাদা মহাশয় আমাকে পর মনে করিয়াছেন, এখন তুমিও তাই কর, তাহা হইলে সকল কথা ফুরাইয়া যায়।

বৌ-দিদি বলিলেন,—তাহা হইলে কি হয়, খেতু?

খে? উত্তর করিলেন,—কি হয়? হয় আর কি? তাহা হইলে আমি আর অর্থোপার্জন করিতে যত্ন করি না। তোমাদের সহিত আর কথা কই না। তোমাদের বাড়ীতে আর থাকি না। মনে করি, আমার মাকে ভিখারিণী দেখিয়া ঘঁহারা ভিক্ষা দিয়াছিলেন। আমার এই শরীর, আমার এই অস্থি, মাংস সমুদায় ভিক্ষায় গঠিত। ভদ্রসমাজে আর যাই না, ভদ্রসমাজে আর মুখ তুলিয়া কথা কহি না। দুঃখিনী ভিখারিণীর ছেলে, ভিক্ষায় যাহার দেহ গঠিত, কোন্ মুখে সে আবার ভদ্র-সমাজে দাঁড়াইবে?

বৌ-দিদি বলিলেন,–ছি খেতু! অমন বলিতে নাই। সম্পর্কে তুমি দেবর বটে, কিন্তু পুত্রের চেয়ে তোমাকে অধিক স্নেহ করি। তুমি উপযুক্ত সন্তান, তুমি যাহা করিবে, তাহাই হইবে; তাঁহার আবার অভিমান কি?

খেতু বলিলেন,–বৌ-দিদি! মাকে সুখে রাখিব, তোমাদিগকে সুখে রাখিব, চিরকাল আমার এই কামনা। এক্ষণে আমার ক্ষমতা হইয়াছে, এখন যদি তোমরা আমাকে সে কামনা পূর্ণ করিতে না দাও, তাহা হইলে আমার মনে বড় দুঃখ হইবে।

বৌ-দিদি উত্তর করিলেন,—সার্থক তোমার মা তোমাকে গর্ভে ধরিয়াছেন। এখন আশীৰ্ব্বাদ করি, খেতু! শীঘ্রই তোমার একটি রাঙা বউ হউক।

সেই দিন রামহরির স্ত্রী, রামহরিকে আনক বুঝাইয়া বলিলেন,–দেখ! আমাদের সংসারের কষ্ট দেখিয়া খেতু বড় কাতর হইয়াছে। খেতু এখন দু পয়সা আনিতেছে। সে বলে,—যখন ইহারা আমাকে পুত্রের মত প্রতিপালন করিয়াছেন, তখন আমিও পুত্রের মত কাৰ্য্য করিব। সংসার খরচে খেতু যদি কোনওরূপ সহায়তা করে, তাহা হইলে খেতুকে কিছু বলিও না! এ বিষয়ে খেতুকে কিছু বলিলে, তাঁহার মনে বড় দুঃখ হয়।

স্ত্রীর কাছে সকল কথা শুনিয়া, রামহরির খেতুকে ডাকিলেন। খেতু আসিলে রামহরি তাঁহাকে বলিলেন,—রাগ করিয়াছ, দাদা? পৃথিবী অতি ভয়ানক স্থান। আমার মত যখন বয়স হইবে তখন জানিতে পারিবে যে, টাকা টাকা করিয়া পৃথিবীর লোক কিরূপ পাগল। সেই জন্য, খেতু, তোমাকে আমার সংসারে টাকা খরচ করিতে মানা করিয়াছিলাম। আমাদের দুঃখ চিরকাল। আমাদের কখনও নাই নাই ঘুচিবে না।

সে দুঃখের ভাগী তোমাকে আমি কেন করিব? অনেক দিন হইতে আমি জলখাবার খাই। জ্বর হইলে উপবাস দিয়া ভাল করি। তুমি দুধের ছেলে, তোমাকে কেন এ দুঃখে পড়িতে দিব? এই মনে করিয়া তোমাকে সংসারে টাকা খরচ করিতে মানা করিয়াছিলাম। আমি তখন ভাবি নাই, তুমি কিরূপ পিতার পুত্র। খেতু! অধিক আর তোমাকে কি বলিব, এই পৃথিবীতে তিনি সাক্ষাৎ দেবতাস্বরূপ ছিলেন। তোমাকে আশীর্বাদ করি, ভাই। যেন তুমি সেই দেবতুল্য হও।–রামহরির চক্ষু দিয়া ফোটায় ফোটায় জল পড়িতে লাগিল। রামহরির স্ত্রীও চক্ষু মুছিতে লাগিলেন। খেতুরও চক্ষু ছল ছল করিয়া আসিল।

খেতু তিনটা পাস দিলেন, আর কন্যা ভারগ্রস্ত লোকেরা রামহরির নিকট আনাগোনা করিতে লাগিলেন। সকলের ইচ্ছা খেতুর সহিত কন্যার বিবাহ দেন। ইনি বলেন,—আমি এত সোনা দিব, এত টাকা দিব; তিনি বলেন, আমি এত দিব, তত দিব; এইরূপে সকলে নিলাম-ডাকা ডাকি করিতে লাগিলেন।

রামহরি সকলকে বুঝাইয়া বলিলেন যে, যত দিন না খেতুর লেখাপড়া সমাপ্ত হয়, যত দিন না খেতু দু-পয়সা উপার্জন করিতে পারে, তত দিন তিনি খেতুর বিবাহ দিবেন না।

কিন্তু কন্যভারগ্রস্ত লোকেরা সে কথা শুনিবেন কেন? রামহরির নিকট তাঁহারা নানারূপ মিনতি করিতে লাগিলেন। অবশেষে রামহরি মনে করিলেন,–দূর হউক! এক স্থানে কথা দিয়া রাখি। তাহা হইলে সকলে আর আমাকে এরূপ ব্যস্ত করিবে না।

এই মনে করিয়া তিনি অনেকগুলি কন্যা দেখিলেন। শেষে জন্মেজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যাকে তিনি মনোনীত করিলেন। জন্মেজয় বাবু সঙ্গতিপন্ন লোক ও সদ্বংশ জাত। রামহরি কিন্তু তাঁহাকে সঠিক কথা দিতে পারিলেন না। খেতুর মার মত না লইয়া কি করিয়া তিনি কথা স্থির করেন?

 

একাদশ পরিচ্ছেদ–সম্বন্ধ

কঙ্কাবতীর যত বয়স হইতে লাগিল, ততই তাঁহার রূপ বাড়িতে লাগিল। কঙ্কাবতীর রূপে দশদিক্‌ আলো, কঙ্কাবতীর পানে চাওয়া যায় না। রংটি উজ্জ্বল ধবধবে, ভিতর হইতে যেন জ্যোতিঃ বাহির হইতেছে; জল খাইলে যেন জল দেখা যায়। শরীরটি স্কুলও নয়, কৃশও নয়, যেন পুতুলটি, কি ছবিখানি। মুখখানি যেন বিধাতা কুঁদে কাটিয়েছেন। নাকটি টিকালো টিকালো, চক্ষু দুটি টানা, চক্ষুর পাতা দীর্ঘ, ঘন ও ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। চক্ষু কিঞ্চিৎ নীচে করিলে পাতার উপর পাতা পড়িয়া এক অদ্ভুত শোভার আবির্ভাব হয়। এইরূপ চক্ষু দুইটির উপর যেরূপ সরু সরু কাল কাল, ঘন ভুরুতে মানায়, কঙ্কাবতীর তাহাই ছিল। গাল দুটি নিতান্ত পূর্ণ নহে, কিন্তু হাসিলে টোল পড়ে। তখন সেই হাসিমাখা টোল-খাওয়া মুখখানি দেখিলে শত্রুর মনও মুগ্ধ হয়। ঠোঁট দুটি পাতলা। পান খাইতে হয় না, আপনাআপনি সদাই টুকটু করে। কথা কহিবার সময় ঠোটের ভিতর দিয়া, সাদা দুধের মত দুই চারিটি দাঁত দেখিতে পাওয়া যায়, তখন দাঁতগুলি যেন ঝক্ঝক্ করিতে থাকে। কঙ্কাবতীর খুব চুল, ঘোর কাল, ছাড়িয়া দিলে, কোকড়া হইয়া পিঠের উপর গিয়া পড়ে। সম্মুখের সিথিটি কে যেন তুলি দিয়া ঈষৎ সাদা রেখা টানিয়া দিয়াছে। স্কুল কথা, কঙ্কাবতী একটি প্রকৃত সুন্দরী, পথের লোককে চাহিয়া দেখিতে হয়, বার বার দেখিয়াও আশা মিটে না। সমবয়স্কা বালিকাদিগের সহিত কঙ্কাবতী যখন দৌড়াদৌড়ি করিয়া খেলা করেন, তখন যথার্থই যেন বিজলী খেলিয়া বেড়ায়।

এখন কঙ্কাবতীর বয়স হইয়াছে। এখন কঙ্কাবতী সেরূপ আর দৌড়াদৌড়ি করিয়া খেলিয়া বেড়ান না। তবে কি জন্য একদিন একটু ছুটিয়া বাড়ী আসিয়াছিলেন। শ্রমে মুখ ঈষৎ রক্তবর্ণ হইয়াছে, গাল দিয়া সেই রক্তিমাআভা যেন ফুটিয়া বাহির হইতেছে, সমস্ত মুখ টন্ টন্ করিতেছে, জগতে কঙ্কাবতীর রূপ তখন আর ধরে না।

মা, তাহা, দেখিয়া, তনু রায়কে বলিলেন,–তোমার মেয়ের পানে একবার চাহিয়া দেখ! এ সোনার প্রতিমাকে তুমি জলাঞ্জলি দিও না। কঙ্কাবতী স্বয়ং লক্ষ্মী। এমন সুলক্ষণা মেয়ে জনমে কি কখনও দেখিয়াছ? মা যেরূপ লক্ষ্মী, সেইরূপ নারায়ণ দেখিয়া মার বিবাহ দিও। এবার আমার কথা শুনিও।।

তনু রায় কঙ্কাবতীর পানে একটু চাহিয়া দেখিলেন, দেখিয়া চকিত হইলেন। তনু রায়ের মন কখনও এরূপ চকিত হয় নাই। তনু রায় ভাবিলেন,—এ কি? একেই বুঝি লোকে অপত্যস্নেহ বলে?–স্ত্রীর কথায় তনু রায় কোনও উত্তর করিলেন না।

আর একদিন তনু রায়ের স্ত্রী স্বামীকে বলিলেন,—দেখ, কঙ্কাবতীর বিবাহের সময় উপস্থিত হইল। আমার একটি কথা তোমাকে রাখিতে হইবে। ভাল, মনুষ্যজীবনে তো আমার একটি সাধও পূর্ণ কর!–তনু রায় জিজ্ঞাসা করিলেন,–কি তোমার সাধ?

স্ত্রী উত্তর করিলেন,—আমার সাধ এই যে, ঝি-জামাই লইয়া আমোদ-আহ্লাদ করি। দুই মেয়ের তুমি বিবাহ দিলে, আমার সাধ পূর্ণ হইল না, দিবারাত্রি ঘোের দুঃখের কারণ হইল। যা হউক, সে যা হইবার তা হইয়াছে; এখন কঙ্কাবতীকে একটি ভাল বর দেখিয়া বিবাহ দাও। মেয়ে দুইটি বলে যে, আমাদের কপালে যা ছিল, তা হইয়াছে, এখন ছোট বোনটিকে সুখী দেখিলে আমরা সুখী হই।

স্ত্রী বল, পুত্র বল, কন্যা বল, টাকার চেয়ে তনু রায়ের কেহই প্রিয় নয়। তথাপি কঙ্কাবতীর কথা মনে পড়িলে, তাঁহার মন কিরূপ করে। সে কি মমতা, না আতঙ্ক? দেবীরূপী কঙ্কাবতীকে সহসা বিসর্জন দিতে তাঁহার সাহস হয় না। এদিকে দুরন্ত অর্থলোভও অজেয়। ত্রিভুবন-মমাহিনী কন্যাকে বেচিয়া তিনি বিপুল অর্থ লাভ করিবেন, চিরকাল এই আশা করিয়া আছেন। আজ সে আশা কি করিয়া সমূলে কাটিয়া ফেলেন? তনু রায়ের মনে আজ দুই ভাব। এরূপ সঙ্কটে তিনি আর কখনও পড়েন নাই।

কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া তনু রায় বলিলেন,—আচ্ছা। আমি না হয়, কঙ্কাবতীর বিবাহ দিয়া টাকা না লইলাম! কিন্তু ঘর হইতে টাকা তো আর দিতে পারিব না? আজ কাল

যেরূপ বাজার পড়িয়াছে, টাকা না দিলে সুপাত্র মিলে না। তা আর কি করিব?

স্ত্রী উত্তর করিলেন,–আচ্ছা! আমি যদি বিনা টাকায় সুপাত্রে সন্ধান করিয়া দিতে পারি, তুমি তাঁহার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবে কি না, তা আমাকে বল?

তনু রায় জিজ্ঞাসা করিলেন,—কোথায়? কে?

স্ত্রী বলিলেন,–বৃদ্ধ হইলে চক্ষুর দোষ হয়, বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ হয়। চক্ষুর উপর দেখিয়াও দেখিতে পাও না? তনু রায় বলিলেন,–কে বল না শুনি?

স্ত্রী উত্তর করিলেন,—কেন খেতু?

তনু রায় বলিলেন, তা কি কখনও হয়? বিষয় নাই, বন্ধু নাই, বান্ধব নাই; এরূপ পাত্রে আমি কঙ্কাবতীকে কি করিয়া দিই। ভাল, আমি না হয় কিছু না লইলাম, মেয়েটি যাহাতে সুখে থাকে, দুখানা গহনা-গাটি পরিতে পায়, তা তো আমাকে করিতে হইবে?

তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন,—খেতুর কি কখনও ভাল হইবে না? তুমি নিজেই বল না যে, খেতু ছেলেটি ভাল,খেতু দুপয়সা আনিতে পারিবে? যদি কপালে থাকে তখেতু হইতেই কঙ্কাবতী কত গহনা পরিবে। কিন্তু, গহনা হউক আর না হউক, ছেলেটি ভাল হয়, এই আমার মনের বাসনা। খেতুর মত ছেলে পৃথিবী খুঁজিয়া কোথায় পাইবে, বল দেখি? মা কঙ্কাবতী আমার যেমন লক্ষ্মী, খেতু তেমনি দুর্লভ সুপাত্র। এক বোঁটায় দুইটি ফুল সাধ করিয়া বিধাতা যেন গড়িয়াছেন।

তনু রায় বলিলেন,–ভাল, সে কথা তখন পরে বুঝা যাইবে। এখন তাড়াতাড়ি কিছু নাই।–আরও কিছুদিন গত হইল। কলিকাতা হইতে খেতুর মার নিকট একখানি চিঠি আসিল। সেই চিঠিখানি তিনি তনু রায়কে দিয়া পড়াইলেন। পত্র-খানি রামহরি লিখিয়াছিলেন। তাঁহার মর্ম এই–

খেতুর বিবাহের জন্য অনেক লোক আমার নিকট আসিতেছেন। আমাকে তাঁহারা বড়ই ব্যস্ত করিয়াছেন। আমার ইচ্ছা যে, লেখাপড়া সমাপ্ত হইলে, তাহার পর খেতুর বিবাহ দিই। কিন্তু কন্যাদায়গ্রস্ত ব্যক্তিগণ সে কথা শুনিবেন কেন? তাঁহারা বলেন, কথা স্থির হইয়া থাকুক, বিবাহ না হয় পরে হইবে। আমি অনেকগুলি কন্যা দেখিয়াছি। তাহাদিগের মধ্যে জন্মেজয় বাবুর কন্যা আমার মনোনীত হইয়াছে। কন্যাটি সুন্দরী, ধীর ও শান্ত। বংশ সৎ, কোন ও দোষ নাই। মাতা-পিতা, ভাই-ভগিনী বর্তমান। কন্যার পিতা সঙ্গতিপন্ন লোক। কন্যাকে নানা অলঙ্কারও জামাতাকে নানা ধন দিয়া বিবাহকাৰ্য্য সমাধা করিবেন। এক্ষণে আপনার কি মত জানিতে পারিলে কন্যার পিতাকে আমি সঠিক কথা দিব।

পত্রখানি পড়িয়া তনু রায় অবা। দুঃখী বলিয়া যে খেতুকে তিনি কন্যা দিতে অস্বীকার, আজ নানা ধন দিয়া সেই খেতুকে জামাতা করিবার নিমিত্ত লোকে আরাধনা করিতেছে।

খেতুর মা রামহরিকে উত্তর লিখিলেন,—আমি স্ত্রীলোক, আমাকে আবার জিজ্ঞাসা কর কেন? তুমি যাহা করিবে, তাহাই হইবে। তবে আমার মনে একটি বাসনা ছিল, যখন দেখিতেছি, সে বাসনা পূর্ণ হইবার নহে, তখন সে কথায় আর আবশ্যক নাই।

এই পত্র পাইয়া, রামহরি খেতুকে সকল কথা বলিলেন, আর এ বিষয়ে খেতুর কি মত, তাহা জিজ্ঞাসা করিলেন।

খেতু বলিলেন,–দাদা মহাশয়! মার মনে বাসনা কি, আমি বুঝিয়াছি। যতদিন মার সাধ পূর্ণ হইবার কিছুমাত্রও আশা থাকিবে, ততদিন কোনও স্থানে আপনি কথা দিবেননা।

রামহরি বলিলেন,হঁা, তাহাই উচিত। তোমার বিবাহ বিষয়ে আমি এক্ষণে কোনও স্থানে কথা দিব না।–খেতুর অন্য স্থানে বিবাহ হইবে, এই কথা শুনিয়া, কঙ্কাবতীর মা একেবারে শরীর ঢালিয়া দিলেন। স্বামীর নিকট রাত্রি-দিন কান্নাকাটি করিতে লাগিলেন।

এদিকে তনু রায়ও কিছু চিন্তিত হইলেন। তিনি ভাবিলেন, আমি বৃদ্ধ হইয়াছি। দুইটি বিধবা গলায়, পুত্রটি মূখ। এখন একটি অভিভাবকের প্রয়োজন। খেতু যেরূপ বিদ্যাশিক্ষা করিতেছে, খেতু যেরূপ সুবোধ, তাহাতে পরে তাঁহার নিশ্চয় ভাল হইবে। আমাকে সে একেবারে এখন কিছু না দিতে পারে, না পারুক; পরে, মাসে মাসে আমি তাঁহার নিকট হইতে কিছু কিছু লইব।

এইরূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া তনু রায় স্ত্রীকে বলিলেন,—তুমি যদি খেতুর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ স্থির করিতে পার তাহাতে আমার আপত্তি নাই। কিন্তু আমি খরচ পত্র কিছু করিতে পারিব না।-খেতুর মা বলিলেন,–কঙ্কাবতী আমার বৌ হইবে, চিরকাল আমার এই সাধ। কিন্তু বোন! দুই দিন আগে যদি বলিতে, অন্য স্থানে কথা স্থির করিতে আমি রামহরিকে চিঠি লিখিয়াছি। রামহরি যদি কোন স্থানে কথা দিয়া থাকে, তাহা হইলে সে কথা নড়িবার নয়। তাই আমার মনে বড় ভয় হইতেছে।

তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন,–দিদি! যখন তোমার মত আছে, তখন নিশ্চয় কঙ্কাবতীর সহিত খেতুর বিবাহ হইবে। তুমি একখানি চিঠি লিখিয়া রাখ। চিঠিখানি লোক দিয়া পাঠাইয়া দিব। –তাহার পরদিন খেতুর মা ও কঙ্কাবতীর মা দুই জনে মিলিয়া কলিকাতায় লোক পাঠাইলেন। খেতুর মা রামহরিকে একখানি পত্র লিখিলেন।

খেতুর মা লিখিলেন যে,—কঙ্কাবতীর সহিত খেতুর বিবাহ হয়, এই আমার মনের বাসনা। এক্ষণে তনু রায় ও তাঁহার স্ত্রী, সেই জন্য আমার নিকট আসিয়াছেন। অন্য কোনও স্থানে যদি খেতুর বিবাহের কথা স্থির না হইয়া থাকে, তাহা হইলে তোমরা কঙ্কাবতীর সহিত স্থির করিয়া তনু রায়কে পত্র লিখিবে।

এই চিঠি পাইয়া রামহরি, তাঁহার স্ত্রী ও খেতু, সকলেই আনন্দিত হইলেন।

খেতুর হাতে পত্রখানি দিয়া রামহরি বলিলেন,—তোমার মার আজ্ঞা, ইহার উপর আর কথা নাই।

খেতু বলিলেন—মার যেরূপ অনুমতি, সেইরূপ হইবে। তবে তাড়াতাড়ি কিছুই নাই। তনু কাকা তো মেয়েগুলিকে বড় করিয়া বিবাহ দেন। আর দুই তিন বৎসর তিনি অনায়াসেই রাখিতে পারিবেন। তত দিনে আমার সব পাসগুলিও হইয়া যাইবে।–তত দিনে আমিও দুপয়সা আনিতেও শিখিব। আপনি এই মর্মে তনু কাকাকে পত্র লিখুন।

রামহরি তনু রায়কে সেইরূপ পত্র লিখিবেন। তনু রায় সে কথা স্বীকার করিলেন। বিলম্ব হইল বলিয়া তাঁহার কিছুমাত্র দুঃখ হইল না, বরং তিনি আহ্লাদিত হইলেন।

তিনি মনে করিলেন,—স্ত্রীর কান্নাকাটিতে আপাততঃ এ কথা স্বীকার করিলাম। দেখি, খেতুর চেয়ে ভাল পাত্র পাই কি না? যদি পাই—আচ্ছা, সে কথা তখন পরে বুঝা যাইবে।–খেতুর মা, নিরঞ্জনকে সকল কথা বলিয়াছিলেন। নিরঞ্জন মনে করিলেন, বৃদ্ধ হইয়া তনু রায়ের ধৰ্ম্মে মতি হইতেছে।

কঙ্কাবতী আজ কয়দিন বিরসবদনে ছিলেন। সকলে আজ কঙ্কাবতীর হাসি-হাসি মুখ দেখিল। সেই দিন তিনি মেনীকে কোলে লইয়া বিরলে বসিয়া কত যে তাঁহাকে মনের কথা বলিলেন, তাহা আর কি বলিব! মেনী এখন আর শিশু নহে, বড় একটি বিড়াল। সুতরাং কঙ্কাবতী যে তাঁহাকে মনের কথা বলিবেন, তাঁহার আর আশ্চর্য কি?

 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ–ষাঁড়েশ্বর

একবার পূজার ছুটীর কিছু পূৰ্ব্বে, কলিকাতার পথে, খেতুর সহিত ষাঁড়েশ্বরের সাক্ষাৎ হইল। ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,–খেতু বাড়ী যাইবে কবে? আমি গাড়ী ঠিক করিয়াছি, যদি ইচ্ছা কর তো আমার গাড়ীতে তুমি যাইতে পার।

খেতু উত্তর করিলেন,—আমার এখনও কলেজের ছুটি হয় নাই। কবে যাইব, তাঁহার এখনও ঠিক নাই।–ষাঁড়ের জিজ্ঞাসা করিলেন,–খেতু! তোমার হাতেও কি?

খেতু উত্তর করিলেন,—এ একটি সিংহাসন। মা প্রতিদিন মাটীর শিব গড়িয়া পূজা করেন, তাই মার জন্য একটি পাথরের শিব কিনিয়াছি। সেই শিবের জন্য এই সিংহাসন।

ষাঁড়েশ্বর জিজ্ঞাসা করিলেন,—শিবটি তোমার কাছে আছে? কৈ দেখি?

খেতু শিবটি পকেট হইতে বাহির করিয়া ষাড়েশ্বরের হাতে দিলেন।

ষাঁড়েশ্বর বলিলেন, শিবটি পকেটে রাখিয়াছিলে? খুব ভক্তি তত তোমার?

খেতু উত্তর করিলেন,—শিবের তো এখনও পূজা হয় নাই। তাতে আর দোষ কি?

ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,—তাই বলিতেছি!

এই কথা বলিয়া যাঁড়েশ্বর শিবটি পুনরায় খেতুর হাতে দিলেন।

এ-কথা সে-কথায় যাইতে যাইতে ষাঁড়েশ্বর বলিলেন, এই যে পাদ্‌রি সাহেবের বাড়ী! পাদরি সাহেবের সঙ্গে তোমার তো আলাপ আছে! এস না? একবার দেখা করিয়া যাই!

যাঁড়েশ্বর ও খেতু, দুই জনে পাদ্‌রি সাহেবের নিকট যাইলেন।

পাদ্‌রি সাহেবের সহিত নানারূপ কথাবার্ত্তার পর, ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,–আর শুনিয়াছেন, মহাশয়? মা পূজা করিবেন বলিয়া খেতু একটি পাথরের শিব কিনিয়াছেন। সেই শিবটি খেতুর পকেটে রহিয়াছে।

পাদ্‌রি সাহেব বলিলেন,–অ্যাঁ! সে কি কথা! ছি ছি, খেতু! তুমি এমন কাজ করিবে, তা আমি স্বপ্নেও জানিতাম না। তোমাদের জন্য যে আমরা এত স্কুল করিলাম, সে সব বৃথা হইল। বড় এক জন লেখক লিখিয়াছেন যে, এই বাঙ্গালীজাতি মিথ্যাবাদী, ফেরেবী, জালিয়াত, ভীরু, দাসের জাতি।

খেতু বলিলেন,–আহা! কি মধুর ধর্মের কথা আজ শুনিলাম! সৰ্ব্বশরীর শীতল হইয়া গেল। ইচ্ছা করে, এখনি খৃষ্ঠান হই। যদি ঘরে জল থাকে তো নিয়ে আসুন, আর বিলম্ব করেন কেন? আমার মাথায় দিন, দিয়া আমাকে খৃষ্ঠান করুন। বাঙ্গালীদের উপর চারি দিক হইতে যেরূপ আপনারা সকলে মিলিয়া সুধা বর্ষণ করিতেছেন, তাতে বাঙ্গ লীদের মন খৃষ্ঠীয় ধৰ্মামৃতরসে একেবারে ভিজিয়া গিয়াছে। দেখেন কি আর? এই সব পট পট করিয়া খৃষ্ঠান হয় আর কি? আবার আমেরিকার কালা খৃষ্ঠানদিগের উপর আপনাদের যেরূপ ভ্ৰাতৃভাব, তা যখন লোকে শুনিবে, আর আফ্রিকার নিরস্ত্র কালা-আদমিদিগের প্রতি আপনাদের যেরূপ দয়া মায়া, তা যখন লোকে জানিবে, তখন এ দেশের জনপ্রাণীও আর বাকি থাকিবে না, সব খৃষ্ঠান হইয়া যাইবে। এখন সেলাম।

এই কথা বলিয়া খেতু সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন। ষাঁড়েশ্বরও হাসিতে হাসিতে তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিলেন। পথে খেতু ষাঁড়েশ্বরকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—শুনিতে পাই, আপনি প্রতিদিন হরিসঙ্কীৰ্ত্তন করেন। তবে পাদ্‌রি সাহেবের নিকট আমাকে ওরূপ উপহাস করিলেন কেন?

-ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,—উপহাস আর তোমাকে কি করিলাম? সে যাহা হউক, সন্ধ্যা হইয়াছে, হরি-সঙ্কীৰ্ত্তনের সময় হইল। এস না, একটু দেখিবে? দেখিলেও পুণ্য আছে।

ষাঁড়েশ্বরের বাসা নিকটে ছিল। খেতু ও ষাঁড়েশ্বর দুই জনে সেইখানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। খেতু দেখিলেন যে, ষাঁড়েশ্বরের দালানে হরি-সঙ্কীৰ্ত্তন আরম্ভ হইয়াছে। কিন্তু ষাঁড়েশ্বর সেখানে না যাইয়া, বরাবর উপরের বৈঠকখানায় যাইলেন। খেতুকে সেইখানে বসিতে গলিয়া যাড়েশ্বর বাটীর ভিতর গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে ষাঁড়েশ্বর ফিরিয়া আসিলেন ও খেতুকে বলিলেন,–খে! চল, অন্য ঘরে যাই।–খেতু অন্য ঘরে গিয়া দেখিলেন যে, ষাঁড়েশ্বরের আর দুইটি বন্ধু সেখানে বসিয়া আছেন। সেখানে খানা খাইবার সব আয়োজন হইতেছে।

নীচে হরি সঙ্কীৰ্ত্তন চলিতেছে। ষাঁড়ের হিন্দুধৰ্ম্মের ও হিন্দুসমাজের এক জন চাই।

অল্পক্ষণ পরে খানা খাওয়া আরম্ভ হইল। দুই জন মুসলমান পরিবেশন করিতে লাগিল।

খেতু বলিলেন,–আপনারা তবে আহারাদি করুন, আমি এখন যাই।

ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,—না না, একটু থাক না, দেখ না, দেখিলেও পুণ্য আছে। এখন যা আমরা খাইতেছি, ইহা মাংসের ঝোল, ইহার নাম সুপ; একটু সুপ্ খাইবে?

খেতু বলিলেন,–এ সব দ্রব্য আমি কখনও খাই নাই, আমার প্রবৃত্তি হয় না। আপনারা আহার করুন? আবার কিছুক্ষণ পরে যাঁড়েশ্বর বলিলেন,–খেতু! এখন যা খাইতেছি, ইহা ভেটকি মাছ। মাছ খাইতে দোষ কি? একটু খাও না?

খেতু বলিলেন,–মহাশয়! আমাকে অনুরোধ করিবেন না। আপনারা আহার করুন। আমি বসিয়া থাকি।–ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,—তবে না হয়, এই একটু খাও। ইহা অতি উত্তম ব্র্যাণ্ডি। পাদ্‌রি সাহেবের কথায় মনে তোমার ক্লেশ হইয়া থাকিবে, একটু খাইলেই এখনি সব ভাল হইয়া যাইবে।–খেতু বলিলেন,—মহাশয়! যোড়হাত করিয়া বলি, আমাকে অনুরোধ করিবেন না। অনুমতি করুন, আমি বাড়ী যাই।

ষাঁড়েশ্বরের একটি বন্ধু বলিলেন,—তবে না হয় একটু হ্যাম আর মুরগী খাও। এ হ্যামবিলাতি শুকরের মাংস। ইহা বিলাত হইতে আসিয়াছে। অভক্ষ্য, গ্রাম্য শুকর। বিলাতী শুকর খাইতে কোনও দোষ নাই। আর এ মুরগীও মহা-কুকুট, রামপাখী-বিশেষ। হপ্ সাহেবের বাজার হইতে কেনা, যে সে মুরগী নয়।

যাঁড়েশ্বরের অপর বন্ধু বলিলেন,–এইবার ভি-র কটলেট আসিয়াছেন। খেতু বাবু নিশ্চয় এইবার একটু খাইবেন।

খানসামা এবার কি দ্রব্য আনিয়াছিল, সে কথা আর শুনিয়া কাজ নাই। নীচে হরিসঙ্কীর্তনের ধূম। তাহাই শ্রবণ করিয়া সকলে প্ৰাণ পরিতৃপ্ত করুন।

কিয়ৎক্ষণ পরে দুই বন্ধুতে চুপি চুপি কি পরামর্শ করিলেন। তখন এক বন্ধু উঠিয়া গিয়া খেতুকে ধরিলেন, অপর জন খেতুর মুখে ব্রাণ্ডি ঢালিয়া দিতে চেষ্টা করিলেন। যাঁড়েশ্বর বসিয়া বসিয়া হাসিতে লাগিলেন।–খেতুর শরীরে বিলক্ষণ বল ছিল। এক এক ধাক্কায় দুই জনকেই ভূতশালী করিলেন। তাহার পর মেজটি উলটাইয়া ফেলিলেন। কাচের বাসন, কাচের গেলাস, সম্মুখে যাহা কিছু পাইলেন, আছাড় মারিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন। এইরূপ দক্ষযজ্ঞ করিয়া সেখান হইতে খেতু প্রস্থান করিলেন।

দেখিতে দেখিতে তিন বৎসর কাটিয়া গেল। খেতুর এক্ষণে কুড়ি বৎসর বয়স। যা কিছু পাশ ছিল, খেতু সব পাশগুলি দিলেন। বাহিরেরও দুই একটি পাশ দিলেন। শীঘ্র একটি উচ্চপদ পাইবেন, খেতু এরূপ আশা পাইলেন।

রামহরি ও রামহরির স্ত্রী ভাবিলেন যে, এক্ষণে খেতুর বিবাহ দিতে হইবে। দিন স্থির করিবার নিমিত্ত তাঁহারা খেতুর মাকে পত্র লিখিলেন।

পত্রের প্রত্যুত্তরে খেতুর মা অন্যান্য কথা বলিয়া অবশেষে লিখিলেন,–তনু রায়কে বিবাহের কথা কিছু বলিতে পারি নাই। আজকাল সে বড়ই ব্যস্ত, তাঁহার দেখা পাওয়া ভার। জনার্দ্দন চৌধুরীর স্ত্রীবিয়োগ হইয়াছে। জনার্দ্দন চৌধুরীর স্ত্রীর ধন্য কপাল পুত্র পৌত্র দৌহিত্র চারিদিকে জাজ্বল্যমান রাখিয়া, অশীতিপর স্বামীর কোলে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। ইহার চেয়ে স্ত্রীলোকের পুণ্যবল আর কি হইতে পারে? যখন তাঁহাকে ঘাটে লইয়া যায়, তখন আমি দেখিতে গিয়াছিলাম। সকলে এক মাথা সিন্দুর দিয়া দিয়াছে, আর ভাল একখানি কস্তাপেড়ে কাপড় পরাইয়া দিয়াছে! আহা! তখন কি শোভা হইয়াছিল! যাহা হউক, তনু রায়ের একটু অবসর হইলে, আমি তাঁহাকে বিবাহের কথা বলিব।-কিছু দিন পরে খেতুর মা, রামহরিকে আর একখানি পত্র লিখিলেন। তাঁহার মর্ম এই,

বড় ভয়ানক কথা শুনিতেছি। তনু রায়ের কথার ঠিক নাই। তাঁহার দয়া-মায়া নাই, তাঁহার ধর্মাধর্ম্ম জ্ঞান নাই। শুনিতেছি, সে নাকি জনার্দ্দন চৌধুরীর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবে। কি ভয়ানক কথা! আর জনার্দ্দন চৌধুরীও পাগল হইয়াছেন না কি? পুত্র পৌত্র দৌহিত্র চারিদিকে বর্তমান। বয়সের গাছ পাথর নাই। চলিতে ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপে। ঘাটের মড়া! আর আবার এ কুবুদ্ধি কেন? বিষয় থাকিলে, টাকা থাকিলে, এরূপ করিতে হয় না কি? তিনি বড় মানুষ জমীদার, না হয় রাজা! তা বলিয়া কি একেবারে বিবেচনাশূন্য হইতে হয়? বৃদ্ধ মনে ভাবে না যে, মৃত্যু সন্নিকট? যেরূপ তাঁহার অবস্থা, তাহাতে আর কয় দিন? লাঠি না ধরিয়া একটি পা চলিতে পারে না। কি ভয়ানক কথা! আর তনু রায় কি নিক! দুধের বাছা কঙ্কাবতীকে কি করিয়া এই অশীতিপর বৃদ্ধের হাতে সমর্পণ করিবে? কঙ্কাবতীর কপালে কি শেষে এই ছিল? সেই মধুমাখা মুখখানি মনে করিলে, বুক ফাটিয়া যায়। শুনিতে পাই, কঙ্কাবতীর মা না কি রাত্রি দিন কাঁদিতেছেন। আমি ডাকিতে পাঠাইয়াছিলাম, কিন্তু আসেন নাই। বলিয়া পাঠাইলেন যে, দিদির কাছে আর মুখ দেখাই না, এ কালা মুখ লোকের কাছে আর বাহির করিব না। এই বিবাহের কথা শুনিয়া আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে। আহা! তাঁহার মার প্রাণ! কতই না তিনি কাতর হইয়া থাকিবেন?

এই চিঠিখানি পাইয়া রামহরি খেতুকে দেখাইলেন।

খেতু বলিলেন,–দাদা মহাশয়! আমি এইক্ষণে দেশে যাইব। –রামহরি বলিলেন,–জনার্দ্দন চৌধুরী বড়লোক, তুমি সহায়হীন বালক তুমি দেশে গিয়া কি করিবে?

খেতু বলিলেন,–আমি কিছু করিতে পারিব না সত্য, তথাপি নিশ্চিন্ত থাকা উচিত নয়। কঙ্কাবতীকে এ বিপদ হইতে রক্ষা করিবার নিমিত্ত চেষ্টা করাও কৰ্ত্তব্য।

কৃতকাৰ্য্য না হই, কি করিব?

খেতু দেশে আসিলেন। মার নিকট ও পাড়া প্রতিবেশীর নিকট সকল কথা শুনিলেন। শুনিলেন যে, জনার্দ্দন চৌধুরী প্রথমে কিছুতেই বিবাহ করিতে সম্মত হন নাই। কেবল তাঁহার সভাপতি গোবর্ধন শিরোমণি তাঁহাকে অনেক বুঝাইয়া সম্মত করাইয়াছেন।

বৃদ্ধ হইলে কি হয়? জনার্দ্দন চৌধুরীর শ্রীচাঁদ আছে, প্রাণে সখও আছে। দুর্লভ পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষের মাল্য দ্বারা গলদেশ তাঁহার সর্ব্বদাই সুশোভিত থাকে। কফের ধাত বলিয়া শৈত্য নিবারণের জন্য চূড়াদার টুপি মস্তকে দিন-রাত্রি বিরাজ করে এইরূপ বেশ ভূষায় সুসজ্জিত হইয়া নিভৃতে বসিয়া যখন তিনি গোবন শিরোমণির সহিত বিবাহ-বিষয়ে পরামর্শ করেন, তখন তাঁহার রূপ দেখিয়া ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণকেও লজ্জায় অধোমুখ হইতে হয়।

খেতু শুনিলেন যে, জনার্দ্দন চৌধুরী বিবাহ করিবার জন্য এখন একেবারে পাগল হইয়া উঠিয়াছেন। আর বিলম্ব সহে না। এই বৈশাখ মাসের ২৪শে তারিখে বিবাহ হইবে। জনার্দ্দন চৌধুরী এক্ষণে দিন গণিতেছেন। তাঁহার পুত্র-কন্যা সকলের ইচ্ছা, যাহাতে এ বিবাহ না হয়। কিন্তু কেহ কিছু বলিতে সাহস করেন না। তাঁহার বড় কন্যা এক দিন মুখ ফুটিয়া মানা করিয়াছিলেন। সেই অবধি বড় কন্যার সহিত তাঁহার আর কথা-বার্তা নাই।

জনার্দ্দন চৌধুরীকে কন্যা দিতে তনু রায়ও প্রথমে ইতস্ততঃ করিয়াছিলেন। কিন্তু যখন জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন যে,—আমার নব-বিবাহিতা স্ত্রীকে আমি দশ হাজার টাকার কোম্পানীর কাগজ দিব, একখানি তালুক দিব, স্ত্রীর গা সোনা দিয়া মুড়িব, আর কন্যার পিতাকে দুই হাজার টাকা নগদ দিব। তখন তনু রায় আর লোভ সংবরণ করিতে পারিলেন না।–কঙ্কাবতীর মুখপানে চাহিয়া তবুও তনু রায় ইতস্ততঃ করিতেছিলেন। কিন্তু তাঁহার পুত্র টাকার কথা শুনিয়া, একেবারে উন্মত্ত হইয়া পড়িলেন। বকিয়া বকিয়া পিতাকে তিনি সম্মত করিলেন। টাকার লোভে এক্ষণে পিতাপুত্র দুই জনেই উম্মত্ত হইয়াছেন।

তবুও তনু রায় স্ত্রীর নিকট নিজে এ কথা বলিতে সাহস করেন নাই। তাঁহার পুত্র বলিলেন,–তোমাকে বলিতে হইল না, আমি গিয়া মাকে বলিতেছি।

এই কথা বলিয়া পুত্র মার নিকট যাইলেন। মাকে বলিলেন,–মা। জনার্দ্দন চৌধুরীর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ হইবে। বাবা সব স্থির করিয়া আসিয়াছেন।

মার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল। মা বলিলেন,–সে কি রে? ওরে, সে কি কথা! ওরে, জনার্দ্দন চৌধুরী যে তেকেলে বুড়ো! তার সে বয়সের গাছ পাথর নাই! তার সঙ্গে কঙ্কাবতীর বিবাহ হবে কি রে?

পুত্র উত্তর করিলেন,….. বুড়ো নয় তো কি যুবো? না সে খোকা? জনার্দ্দন চৌধুরী তুলো করিয়া দুধ খায় না কি? না ঝুমঝুমি নিয়ে খেলা করে? মা যেন ঠিক পাগল! মার বুদ্ধি সুদ্ধি একেবারে নাই। কঙ্কাবতীকে দশ হাজার টাকা দিবে, গায়ে যেখানে যা ধরে গহনা দিবে, তালুক মুলুক দিবে, বাবাকে দুই হাজার টাকা নগদ দিবে, আবার চাই কি? বুড়ো মরিয়া যাইলে, কঙ্কাবতীর টাকা গহনা সব আমাদের হইবে। থুড় খুঁড়ে বুড়ো বলিয়াই তো আহ্লাদের কথা। শক্তি সামর্থ্য থাকিলে এখন কত দিন বাঁচিত, তার ঠিক কি? মা! তোমার কিছুমাত্র বিবেচনা নাই।

এ কথার উপর আর কথা নাই! মা একেবারে বসিয়া পড়িলেন। অবিরল ধারায় তাঁহার চক্ষু হইতে অশ্রু বিগলিত হইতে লাগিল। মনে করিলেন, যে,….. পৃথিবী! তুমি দুই ফাঁক হও, তোমার ভিতর আমি প্রবেশ করি। মেয়ে দুইটিও অনেক কাঁদিলেন; কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। কঙ্কাবতী নীরব। প্রাণ যাহার ধূ ধূ করিযা পড়িতেছে, চক্ষে তাঁহার জল কোথা হইতে আসিবে?

মা ও প্রতিবেশীদিগের নিকট হইতে খেতু এই সকল কথা শুনিলেন।

খেতু প্রথম তনু রায়ের নিকট যাইলেন। তনু রায়কে অনেক বুঝাইলেন। খেতু বলিলেন,… মহাশয়। এরূপ অশীতিপর বৃদ্ধের সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবেন না। আমার সহিত বিবাহ না হয় না দিবেন, কিন্তু একটি সুপাত্রের হাতে দিন। মহাশয় যদি সুপাত্রের অনুসন্ধান করিতে না পারেন, আমি করিয়া দিব।

এই কথা শুনিয়া তনু রায় ও তনু রায়ের পুত্র, খেতুর উপর অতিশয় রাগান্বিত হইলেন। নানারূপ ভৎসনা করিয়া তাঁহাকে বাটী হইতে তাড়াইয়া দিলেন।

নিরঞ্জনকে সঙ্গে করিয়া খেতু তাহার পর জনার্দ্দন চৌধুরীব নিকট গমন করিলেন। হাত ঘোড় করিয়া অতি বিনীতভাবে জনার্দ্দন চৌধুরীকে বিবাহ করিতে নিষেধ করিলেন। প্রথমতঃ জনার্দ্দন চৌধুরী সে কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন। তাহার পর খেতু যখন তাঁহাকে দুই একবার বৃদ্ধ বলিলেন তখন রাগে তাঁহার সর্ব্বশরীর কাঁপিতে লাগিল। তাঁহার শ্লেষ্মার ধাত, রাগে এমনি তাঁহার ভয়ানক কাসি আসিয়া উপস্থিত হইল যে, সকলে বোধ করিল দম আট্রাইয়া তিনি না মরিয়া যান!

কাসিতে কাসিতে তিনি বলিলেন,—গলাধাক্কা দিয়া এ ছোঁড়াকে আমার বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দাও। অনুমতি পাইয়া পারিষদগণ খেতুর গলাধাক্কা দিতে আসিল।

খেতু জনার্দ্দন চৌধুরীর লাঠিগাছটি তুলিয়া লইলেন। পারিষদবর্গকে তিনি ধীরভাবে বলিলেন,–তোমরা কেহ আমার গায়ে হাত দিও না। যদি আমার গায়ে হাত দাও, তাহা হইলে এই দণ্ডে তোমাদের মুণ্ডুপাত করিব।

খেতুর তখন সেই রুদ্রমূৰ্ত্তি দেখিয়া, ভয়ে সকলেই আকুল হইল। গলাধাক্কা দিতে আর কেহ অগ্রসর হইল না।।

নিরঞ্জন উঠিয়া, উভয় পক্ষকে সান্ত্বনা করিয়া খেতুকে সেখান হইতে বিদায় করিলেন। খেতু চলিয়া গেলেন। তবুও জনার্দ্দন চৌধুরীর রাগও থামে না, কাসিও থামে না। রাগে থর থর করিয়া শরীর কাঁপিতে লাগিল, খক্‌ খক্ করিয়া ঘন ঘন কাশি আসিতে লাগিল।

গগাবর্ধন শিরোমণি বলিলেন,–না না! আপনি বৃদ্ধ কেন হইবেন? আপনাকে যে বুড়ো বলে, সে নিজে বুড়ো।

ষাঁড়েশ্বর সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ষাড়ের বলিলেন,–হয় তো ছোকরা মদ খাইয়া আসিয়াছিল! চক্ষু দুইটা যেন জবা ফুলের মত, দেখিতে পান নাই?

নিরঞ্জন বলিলেন,—ও কথা বলিও না! যারা মদ খায়, তারা খায়। কে মদ মুরগী খায়, তা সকলেই জানে। পরের নামে মিথ্যা অপবাদ দিও না।

ষাঁড়েশ্বর উত্তর করিলেন,—সকলে শুনিয়া থাকুন, ইনি বলিলেন,–যে, আমি মদমুরগী খাই আমি ইহার নামে মানহানির মকদ্দমা করিব। এর হাড় কয়খানা জেলে পচাইব।–গগাবদ্ধন শিরোমণি বলিলেন,—ক্ষেত্ৰচন্দ্র মদ খান, কি না খান, তাহা আমি জানি না। তবে তিনি যে যবনের জল খান, তাহা জানি। সেই যারে বলে বরখ, সাহেবেরা কলে যাহা প্রস্তুত করেন, ক্ষেত্ৰচন্দ্র সেই বরখ খান। গদাধর ঘোষ ইহা স্বচক্ষে দেখিয়াছে।

জনার্দ্দন চৌধুরী জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি কি? কি বলিলে?

ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,–সর্ব্বনাশ! বরফ খায়? গোরক্ত দিয়া সাহেবেরা যাহা প্রস্তুত করেন? এবার দেখিতেছি, সকলের ধর্ম্মটি একেবারে লোপ হইল। হায় হায়! পৃথিবীতে হিন্দুধৰ্ম্ম একেবারে লোপ হইল।

নিরঞ্জন বলিলেন,–ষাঁড়েশ্বর বাবু! একবার মনে করিয়া দেখ, খেতুর বাপ তোমার কত উপকার করিয়াছেন। খেতুর অপকার করিতে চেষ্টা করিও না।

জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,—ও সব বাজে কথা এখন তোমরা রাখ। গদাধর ঘোষকে ডাকিতে পাঠাও। গদাধর ঘোষকে ডাকিতে লোক দৌড়িল।

 

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ–গদাধর সংবাদ

গদাধর ঘোষ আসিয়া উপস্থিত হইল। চৌধুরী মহাশয়কে কৃতাঞ্জলিপুটে নমস্কার করিয়া অতি দূরে সে মাটীতে বসিল।

চৌধুরী মহাশয় বলিলেন,—কেমন হে গদাধর। এ কি কথা শুনিতে পাই? শিবচন্দ্রের ছেলেটা, ঐ খেতা, কি খাইয়াছিল? তুমি কি দেখিয়াছিলে? কি শুনিয়াছিলে? তাঁহার সহিত তোমার কি কথাবার্তা হইয়াছিল? সমুদয় বল, কোনও বিষয় গোপন করিও না।

গদাধর বলিল,–মহাশয়! আমি মুখ মানুষ অত শত জানি না। যাহা হইয়াছিল, তাহা আমি বলিতেছি।

গদাধর বলিল,–তার বৎসর আমি কলিকাতার গিয়াছিলাম। কোথায় থাকি? তাই রামহরির বাসায় গিয়াছিলাম। সন্ধ্যাবেলা বাহিরের ঘরে বসিয়া আছি, এমন সময় এক মিষে হাঁড়ী মাথায় করিয়া পথ দিয়া কি শব্দ করিতে করিতে যাইতেছিল। সেই শব্দ শুনিয়া রামহরি বাবুর ছেলেটি বাটীর ভিতর হইতে ছুটিয়া আসিল, আর খেতুকে বলিল,–কাকা, কাকা! কুলফী যাইতেছে, আমাকে কিনিয়া দাও। খেতু তাঁহাকে দুই পয়সার কিনিয়া দিলেন। আমি বলিলাম, না দাদাঠাকুর! আমি কুলফী খাই না। রামহরি বাবুর ছেলে খেতুকে বলিল—কাকা! তুমি খাইবে না? খেতু বলিলেন,–না, আমার পিপাসা পাইয়াছে, ইহাতে পিপাসা ভাঙ্গে না, আমি কাঁচা বরফ খাইব। এই কথা বলিয়া খেতু বাহিরে যাইলেন। কিছুক্ষণ পরে একটি সাদা ধবধবে কাঁচের মত ঢিল গামছায় বাঁধিয়া বাটী আনিলেন। সেই ঢিলটি ভাঙ্গিয়া জলে দিলেন, সেই জল খাইতে লাগিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–দাদা ঠাকুর! ও কি? খেতু বলিলেন,—ইহার নাম বরখ। এই গ্রীষ্ণকালের দিনে যখন বড় পিপাসা হয়, তখন ইহা জলে দিলে জল শীতল হয়। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,—দাদাঠাকুর। সকল কাচ কি জলে দিলে জল শীতল হয়? খেতু উত্তর করিলেন,–এ কাচ নয়, এ বরখ। জল জমিয়া ইহা প্রস্তুত হয়। ইহা জল। নদীতে যে জল দেখিতে পাও, ইহাও তাই, জমিয়া গিয়াছে এইমাত্র। আকাশ হইতে যে শিল পড়ে, বরখ তাহাই। সাহেবেরা বরখ কলে প্রস্তুত করেন। একটু হাতে করিয়া দেখ দেখি? এই বলিয়া আমার হাতে একটুখানি দিলেন। হাতে রাখিতে না রাখিতে আমার হাত যেন করাত দিয়া কাটিতে লাগিল। আমি হাতে রাখিতে পারিলাম না, আমি ফেলিয়া দিলাম। তাহার পর খেতু বলিলেন,–গদাধর! একটু খাইয়া দেখ না? ইহাতে কোনও দোষ নাই। আমি বলিলাম,–না দাদাঠাকুর! তোমরা ইংরেজি পড়িয়াছ, তোমাদের সব খাইতে আছে, তাহাতে কোনও দোষ হয় না। আমি ইংরেজী পড়ি নাই। সাহেবেরা যে দ্রব্য কলে প্রস্তুত করেন, যে দ্রব্য খাইলে আমাদের অধর্ম্ম হয়, আমাদের জাতি যায়।

চৌধুরী মহাশয়কে সম্বোধন করিয়া গদাধর বলিল,–ধর্ম্মাবতার! আমি যাহা দেখিয়াছিলাম, তাহা আপনাকে বলিলাম। তার পর খেতু আমাকে অনেক সেকালের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, অনেক সেকালের কথা-বার্তা হইল, সে বিষয় এখানে আর বলিবার আবশ্যক নাই।

জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,–না না, কি কথা হইয়াছিল, তুমি সমুদয় বল। কোনও কথা গোপন করিবে না।–গগাবর্ধন শিরোমণিকে সম্বোধন করিয়া গদাধর বলিল,–শিরোমণি মহাশয়। সেই গরদওয়ালা ব্রাহ্মণের কথা গো!

শিরোমণি বলিলেন,–সে বাজে কথা। সে কথা আর তোমাকে বলিতে হইবে না।

জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,–না না, খেতার সহিত তোমার কি কথা হইয়াছিল। আমি সকল কথা শুনিতে ইচ্ছা করি। গরদওয়ালা ব্রাহ্মণের কথা আমি অল্প-অল্প শুনিয়াছিলাম, গ্রামের সকলেই সে কথা জানে। তবে খেতা তোমাকে কি জিজ্ঞাসা করিল আর তুমি কি বলিলে, সে কথা আমি জানিতে ইচ্ছা করি।

গদাধর বলিতেছে,–তাহার পর খেতু আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,–গদাধর। আমাদের মাঠে সেকালে না কি মানুষ মারা হইত? আর তুমি না কি সেই কাজের এক জন সদ্দার ছিলে? আমি উত্তর করিলাম,–দাদাঠাকুর! উচা বয়সে কোথায় কি করিয়াছি, কি না করিয়াছি, সে কথায় এখন আর কাজ কি? এখন তো আর সে সব নাই? এখন কোম্পানীর কড়া হুকুম। খেতু বলিলেন,–তা বটে; তবে সে কালের ঠেঙ্গাড়েদের কথা আমার শুনিতে ইচ্ছা হয়। তুমি নিজে হাতে এ সব করিয়াছ, তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। তোমরা দুই চারি জন যা বৃদ্ধ আছ, মরিয়া গেলে, আর এ সব কথা শুনিতে পাইব না। আর দেখ, গ্রামের সকলেই তো জানে যে, তুমি এ কাজের এক জন সর্দার ছিলে? আমি বলিলাম,–না দাদাঠাকুর! আপনারা থাকিতে আমরা কি কোনও কাজের সদ্দার হইতে পারি? আপনারা ব্রাহ্মণ, আমাদের দেবতা! সকল কাজের সদ্দার আপনারা। তাহার পর খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন, তবে তোমাদের দলের সদ্দার কে ছিলেন? আমি বলিলাম…আজ্ঞা! আমাদের দলের সর্দার ছিলেন, কমল ভট্টাচার্য্য মহাশয়। এক সঙ্গে কাজ করিতাম বলিয়া তাঁহাকে আমার কমল কমল বলিয়া ডাকিতাম। তিনি এক্ষণে মরিয়া গিয়াছেন। খেতু তাহার পর জিজ্ঞাসা করিলেন,—গদাধর! তোমরা কখনও ব্রাহ্মণ মারিয়াছ? আমি বলিলাম,–আজ্ঞা, মাঠের মাঝখানে যারে পাইতাম, তাঁহাকেই মারিতাম। তাহাতে কোনও দোষ নাই। পরিচয় লইয়া মাথার লাঠি মারিতে গেলে আর কাজ চলে না। পথিকের কাছে কি আছে না আছে, সে কথা জিজ্ঞাসা করিয়াও মারিতে গেলে চলে না। প্রথমে মারিয়া ফেলিতে হইত। তাহার পর গলায় পৈতা থাকিলে জানিতে পারিতাম যে, সে লোকটি ব্রাহ্মণ, না থাকিলে বুঝিতাম যে, সে শূদ্র। আর প্রাপ্তির বিষয় যে দিন যেরূপ অদৃষ্টে থাকিত, সেই দিন সেইরূপ হইত। কত হতভাগা পথিককে মারিয়া শেষে একটি পয়সাও পাই নাই। ট্যাঁকে, কাচায়, কোঁচায় খুঁজিয়া একটি পয়সাও বাহির হয় নাই। সে বেটারা জুয়াচোর, দুষ্ট, বজ্জাৎ! পথ চলিবে বাপু, টাকা-কড়ি সঙ্গে নিয়া চল। তা না শুধু হাতে! বেটাদের কি অন্যায় বলুন দেখি, দাদাঠাকুর? একটি মানুষ মারিতে কি কম পরিশ্রম হয়? খালি হাতে রাস্তা চলিয়া আমাদের সব পরিশ্রম বেটারা নষ্ট করিত। খেতু আমাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, হাঁ, গদাধর! মানুষের প্রাণ কি সহজে বাহির হয় না? আমি বলিলাম,সকলের প্রাণ সমান নয়। কেহ বা লাঠি খাইতে না খাইতে উদ্দেশে মরিয়া যায়। কেহ বা ঠাশ করিয়া এক ঘা খাইয়াই মরিয়া যায়। আর কাহাকেও বা তিন চারি জনে পড়িয়া পঞ্চাশ লাঠিতেও মারিতে পারা যায় না। একবার এক জন ব্রাহ্মণকে মারিতে কষ্ট হইয়াছিল। খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন,–কি হইয়াছিল?গগাবর্ধন বলিলেন,–চৌধুরী মহাশয়! আপনার আর ও সব পাপ কথা শুনিয়া কাজ নাই। এক্ষণে ক্ষেত্ৰচন্দ্রকে লইয়া কি করা যায়, আসুন, তাঁহার বিচার করি! সাহেবের জল পান করিয়া অবশ্যই তিনি সাহেবত্ব প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,—না না! খেতার সহিত গদাধরের কি কি কথা হইয়াছিল, আমি সমস্ত শুনিতে চাই। ছোঁড়া যে গদাধরকে এত কথা জিজ্ঞাসা করিল, তাঁহার অবশ্যই কোনও না কোনও দুরভিসন্ধি থাকিবে। গদাধর! তাহার পর কি হইল, বল।

গদাধর পুনরায় বলিতেছে,–খেতু আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, যে, ব্রাহ্মণ মারিতে কষ্ট হইয়াছিল কেন? আমি বলিলাম,–দাদাঠাকুর, কোথা হইতে একবার তিন জন ব্রাহ্মণ আমাদের গ্রামে গরদের কাপড় বেচিতে আসেন। গ্রামে তাঁহারা থাকিবার স্থান পাইতেছিলেন না। বাসার অন্বেষণে পথে পথে ফিরিতেছিলেন। আমার সঙ্গে পথে দেখা হইল। একটি পাতা হাতে করিয়া আমি তখন ব্রাহ্মণের পদধূলি আনিতে যাইতেছিলাম। প্রত্যহ ব্রাহ্মণের পদধূলি না খাইয়া আমি কখনও জলগ্রহণ করি। ব্রাহ্মণ দেখিয়া আমি সেই পাতায় তাহাদের পদধূলি লইলাম, আর বলিলাম,—আসুন আমার বাড়ীতে, আপনাদিগকে বাসা দিব। তাঁহারা আমার বাড়ীতে বাসা লইলেন। আমাদের গ্রামে তিন দিন রহিলেন, অনেকগুলি কাপড় বেচিলেন, অনেক টাকা পাইলেন! আমি সেই সন্ধান কমলকে দিলাম। কমলেতে আমাতে পরামর্শ করিলাম যে, তিনটিকে সাবাড় করিতে হইবে। দলস্থ অন্য কাহাকেও কিছু বলিলাম না, কারণ, তাহা হইলে ভাগ দিতে হইবে। কমলকে বলিলাম, তুমি আগে গিয়া মাঠের মাঝখানে লুকাইয়া থাকা অতি প্রয্যে ইহাদিগকে আমি সঙ্গে লইয়া যাইব। দুই জনেই সেইখানে কাৰ্য্য সমাধা করিব। তাহার পরদিন প্রতুষ্যে আমি সেই তিন জন ব্রাহ্মণকে পথ দেখাইবার জন্য লইয়া চলিলাম। ভগবানের এমনি কৃপা যে সে দিন ঘোর কোয়াসা হইয়াছিল, কোলের মানুষ দেখা যায় না। নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র কমল বাহির হইয়া একজনের মাথায় লাঠি মারিলেন। আমিও সেই সময় আর এক জনের মাথায় লাঠি মারিলাম। তাঁরা দুই জনেই পড়িয়া গেলেন। আমরা সেই দুই জনকে শেষ করিতেছি, এমন সময় তৃতীয় ব্রাহ্মণটি পলাইলেন। কমল তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িলেন আমিও আমার কাজটি সমাধা করিয়া তাঁহাদিগের পশ্চাৎ দৌড়িলাম। ব্রাহ্মণ গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিলেন। শিরোমণি মহাশয়ের বাটীতে গিয়া,—ব্রহ্মহত্যা হয়! ব্রাহ্মণের প্রাণ রক্ষা করুন,—এই বলিয়া আশ্রয় লইলেন। অতি স্নেহের সহিত শিরোমণি মহাশয় তাঁহাকে কোলে করিয়া লইলেন। শিরোমণি মহাশয় তাঁহাকে মধুর বচনে বলিলেন,–জীবন ক্ষণভঙ্গুর! পদ্মপত্রের উপর জলের ন্যায়। সে জীবনের জন্য এত কাতর কেন বাপু? এই বলিয়া ব্রাহ্মণকে পাঁজা করিয়া বাটীর বাহিরে দিয়া শিরোমণি মহাশয় ঝনাৎ করিয়া বাটীর দ্বারটি বন্ধ করিয়া দিলেন। কমল পুনরায় ব্রাহ্মণকে মাঠের দিকে তাড়াইয়া লইয়া চলিলেন। ব্রাহ্মণ যখন দেখিলেন যে, আর রক্ষা নাই, কমল তাঁহাকে ধরধর হইয়াছেন, তখন তিনি হঠাৎ ফিরিয়া কমলকে ধরিলেন। কিছুক্ষণের নিমিত্ত দুই জনে হুটাহুটি হইল। হাতীর মত কমলের শরীরে বল, কমলকে তিনি পারিবেন কেন? কমল তাঁহাকে মাটীতে ফেলিয়া দিলেন, তাঁহাকে মারিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু সেই ব্রাহ্মণ-দেবতার এমনি কঠিন প্রাণ যে, তিনি অজ্ঞানও হয় না, মরেও না। ক্রমাগত কেবল এই বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিলেন,–হে মধুসূদন! আমাকে রক্ষা কর! হে মধুসূদন! আমাকে রক্ষা কর। আমি পশ্চাতে পড়িয়াছিলাম। কোন দিকে ব্রাহ্মণ পলাইয়াছেন আর কমল বা কোন দিকে গিয়াছেন, কোয়াসার জন্য তাহা আমি দেখিতে পাই নাই। এখন ব্রাহ্মণের চীৎকার শুনিয়া আমি সেই দিকে দৌড়িলাম। গিয়া দেখি, ব্রাহ্মণ মাটীতে পড়িয়া রইয়াছেন, কমল তাঁহার বুকের উপরে; কমল আপনার দুই হাত দিয়া ব্রাহ্মণের দুটি হাত ধরিয়া মাটীতে চাপিয়া রাখিয়াছেন, কমলের বাম পা মাটিতে রহিয়াছে, দক্ষিণ পা ব্রাহ্মণের উদরে, এই পায়ের বুড়ে আঙ্গুল ঘোরতর বলের সহিত ব্রাহ্মণের নাভির ভিতর প্রবেশ করাইতেছেন। পড়িয়া পড়িয়া ব্রাহ্মণ চীৎকার করিতেছেন। কমল আমাকে বলিলেন, এ বামুন বেটা কি বজ্জাৎ! বেটা যে মরে না হে! গদাধর! শীঘ্র একটা যা হয় কর। তা না হইলে বেটার চীৎকারে লোক আসিয়া পড়িবে। আমার হাতে তখন লাঠি ছিল না, নিকটে এ খানা পাথর পড়িয়া ছিল। সেই পাথরখানি লইয়া আমি ব্রাহ্মণের মাথাটি ছেঁচিয়ে দিলাম। তবে ব্রাহ্মণের প্রাণ বাহির হইল। যাহা হউক, এই ব্রাহ্মণকে মারিতে পরিশ্রম হইয়াছিল বটে, কিন্তু সেবার লাভও বিলক্ষণ হইয়াছিল। অনেকগুলি টাকা আর অনেক গরদের কাপড় আমরা পাইয়াছিলাম। কি করিয়া নশিরাম সদ্দার এই কথা শুনিতে পাইয়াছিলেন। নশিরাম ভাগ চাহিলেন। আমরা বলিলাম, এ কাজে তোমাকে কিছু করিতে হয় নাই, তোমাকে আমরা ভাগ দিব কেন? কথায় কথায় কমলের সহিত নশিরামের ঘোরতর বিবাদ করিয়া উঠিল; ক্রমে মারামারি হইবার উপক্রম হইল। কমল পৈতা ছিঁড়িয়া নশিরামকে শাপ দিলেন। কমল ভট্টাচাৰ্য্য ব্রাহ্মণ। সাক্ষাৎ অগ্নিরূপ। শিষ্য যজমান আছে। সেরূপ ব্রাহ্মণের অভিশাপ ব্যর্থ হইবার নহে। পাঁচ-সাত বৎসরের মধ্যেই মুখে রক্ত উঠিয়া নশিরাম মরিয়া গেল। যাহা হউক, সেই সব কাপড় হইতে এক জোড়া ভাল গরদের কাপড় আমরা শিরোমণি মহাশয়কে দিয়াছিলাম। যখন সেই গরদের কাপড়খানি পরিয়া, দোবজাটি কাঁধে ফেলিয়া, ফোঁটাটি কাটিয়া, শিরোমণি মহাশয় পথে যাইতেন, তখন সকলে বলিত,—আহা! যেন কন্দর্প পুরুষ বাহির হইয়াছেন! বয়সকালে শিরোমণি মহাশয়ের রূপ দেখে কে? না, শিয়োমণি মহাশয়?

শিরোমণি মহাশয় বলিলেন,–গদাধর! গদাধর! তোমার এরূপ বাক্য বলা উচিত নয়। তুমি যাহা বলিতেছ, তাঁহার আমি কিছু জানি না। পীড়া-শীড়ায় তোমার বুদ্ধি লোপ হইয়াছে, আমি তোমার জন্য নারায়ণকে তুলসী দিব। তাহা হইলে তোমার পাপক্ষয় হইবে।–নিরঞ্জন এই সমুদয় বৃত্তান্ত শুনিতেছিলেন, মাঝে মাঝে দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতেছিলেন, আর বলিতেছিলেন,–হা মধুসূদন! হা দীনবন্ধু!–জনার্দ্দন চৌধুরী কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, তাহার পর কি হইল গদাধর?

গদাধর উত্তর করিল,–তাহার পর আর কিছু হয় নাই। খেতু অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, অন্যমনস্কভাবে আমাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,–একটু বরফ খাবে গদর? আমি বলিলাম,–না দাদাঠাকুর! আমি বরফ খাইব না, বরফ খাইলে আমার অধর্ম্ম হইবে, আমার জাতি যাইবে।

জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,—তবে তুমি নিশ্চয় বলিতেছ, যে খেতু বরফ খাইয়াছে?

গদাধর উত্তর করিল,–আজ্ঞা হাঁ ধর্ম্মাবতার! আমি তাহা স্বচক্ষে দেখিয়াছি। আপনি ব্রাহ্মণ! আপনার পায়ে হাত দিয়া আমি দিব্য করিতে পারি।

 

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ–বিকার

গদাধরের মুখে সকল কথা শুনিয়া, জনার্দ্দন চৌধুরী তখন তনু রায় প্রভৃতি গ্রামের ভদ্রলোকদিগকে ডাকিতে পাঠাইলেন।

সকলে আসিয়া উপস্থিত হইলে, জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,—আজ আমি ঘোর সর্ব্বনাশের কথা শুনিলাম। জাতি কুল, ধৰ্ম্ম-কর্ম, সর্ব্ব লোপ হইতে বসিল। পিতা পিতামহদিগকে যে এক গণ্ডুষ জল দিব, তাঁহারও উপায় রহিল না। ঘোর কলি উপস্থিত।

সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি হইয়াছে, মহাশয়?

জনার্দ্দন চৌধুরী উত্তর করিলেন,—শিবচন্দ্রের পুত্র ঐ যে খেতা, কলিকাতায় রামহরির বাসায় থাকিয়া ইংরেজী পড়ে, সে বরফ খায়। বরফ সাহেবেরা প্রস্তুত করেন, সাহেবের জল। শিয়োমণি মহাশয় বিধান দিয়াছেন, যে বরফ খাইলে সাহেবত্ব প্রাপ্ত লোকের সহিত সংস্রব রাখিলে সেও সাহেব হইয়া যায়। তাই, এই খেতার সহিত সংস্রব রাখিয়া সকলেই আমরা সাহেব হইতে বসিয়াছি।

এই কথা শুনিয়া দেশ শুদ্ধ নোক একেবারে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন। সর্ব্বনাশ! বরফ খায়? যাঃ! এইবার ধর্ম্ম কর্ম্ম সব গেল।

সর্বের চেয়ে ভাবনা হইল ষাড়েশ্বরের। ডাক ছাড়িয়া তিনি কাঁদেন নাই সত্য, কিন্তু তাঁহার ধর্ম্মগত প্রাণে বড়ই আঘাত লাগিয়াছিল। কত যে তিনি হায়, হায়! করিলেন, তাঁহার কথা আর কি বলিব।

যাহা হউক, সৰ্ব্ববাদি-সম্মত হইয়া খেতুকে এক-ঘোরে করা স্থির হইল।

নিরঞ্জন কেবল ঐ কথায় সার দিলেন না। আমরা না হয় দুঘঘারে হইয়া থাকিব।

নিরঞ্জন আরও বলিলেন,—চৌধুরী মহাশয়! আজ প্রাতঃকাল হইতে যাহা দেখিলাম যাহা শুনিলাম, তাহাতে বুঝিতেছি যে, ঘোর কলি উপস্থিত। নিদারুণ নরহত্যার ব্রহ্মহত্যার কথা শুনিলাম। চৌধুরী মহাশয়! আপনি প্রাচীন, বিজ্ঞ, লক্ষ্মীর বরপুত্র; বিধাতা আপনার প্রতি সুপ্রসন্ন। এ কুচক্র আপনাকে শোভা পায় না; লোককে জাতিচ্যুত করায় কিছুমাত্র পৌরুষ নাই, পতিতকে উদ্ধার করাই মানুষের কাৰ্য্য। বিষ্ণু ভগবান্ পতিতকে উদ্ধার করেন বলিয়াই তাঁহার নাম পতিত-পাবন হইয়াছে। পৃথিবীতে সজ্জনকুল সেই পতিত-পাবনের প্রতিরূপ। এই ষাঁড়েশ্বরের মত সুরাপানে আর অভ্য-ভক্ষণে যাহারা উম্মত্ত, এই তনু রায়ের মত যাহাদিগের অপত্য-বিক্রয়-জনিত শুষ্ক গ্রহণে মানুষ কলুষিত, এই গোবর্ধনের মত যাহারা ব্রহ্মহত্যা মহাপাতকে পতিত, সেই গলিত নরককীটেরা ধর্মের মর্ম কি জানিবে? এই বলিয়া নিরঞ্জন সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন!

নিরঞ্জন চলিয়া যাইলে, গোবর্ধন শিরোমণি বলিলেন,—যাঁড়েশ্বর বাবাজীকে ইনি গালি দিলেন ষাঁড়েশ্বর বাবাজী বীর পুরুষ। ষাঁড়েশ্বর বাবাজীকে অপমান করিয়া এ গ্রামে আবার কে বাস করিতে পারে?–খেতু যে একঘোরে হইয়াছেন,….নিয়মিতরূপে লোককে সেইটি দেখাইবার নিমিত্ত, স্ত্রী মাসিক শ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে জনার্দ্দন চৌধুরী সপ্তগ্রাম সমাজ নিমন্ত্রণ করিলেন। চারিদিকে হৈ হৈ পড়িয়া গেল যে, কুসুমবাটী নিবাসী শিবচন্দ্রের পুত্র, ক্ষেত্র, বরফ খাইয়া কৃস্তান হইয়াছে।

সেই দিন রাত্রিতে ষাঁড়েশ্বর চারি বোতল মহুয়ার মদ আনিলেন। তারীফ শেখের বাড়ী হইতে চুপি চুপি মুরগী রাঁধাইয়া আনিলেন। পাঁচ ইয়ার জুটিয়া পরম সুখে পান ভোজন হইল। একবার কেবল এই সুখে ব্যাঘাত হইবার উপক্রম হইয়াছিল। খাইতে খাইতে ষাঁড়েশ্বরের মনে উদয় হইল যে, তারীফ শেখ হয় তো মুরগীর সহিত বরফ মিশ্রিত করিয়াছে। তাই তিনি হাত তুলিয়া লইলেন, আর বলিলেন,…আমার খাওয়া হইল না। বরফ-মিশ্রিত মুরগী খাইয়া শেষে কি জাতিটি হারাইব? সকলে অনেক বুঝাইলেন যে, মুরগী বরফ দিয়া রান্না হয় নাই। তবে তিনি পুনরায আহারে প্রবৃত্ত হইলেন। পান ভোজনের পর নিরঞ্জনের বাটীতে সকলে গিয়া চিল ও গোহাড় ফেলিতে লাগিলেন। এইরূপ ক্রমাগত প্রতি রাত্রিতে নিরঞ্জনের বাটীতে ঢিল ও গোহাড় পড়িতে লাগিল। আর সহ্য করিতে না পারিয়া, নিরঞ্জন ও তাঁহার স্ত্রী কাঁদিতে কাঁদিতে পৈতৃক বাস্তুভূমি পরিত্যাগ করিয়া অন্য গ্রামে চলিয়া গেলেন।

খেতু বলিলেন,—কাকা মহাশয়! আপনি চলুন। আমিও এ গ্রাম হইতে শীঘ্র উঠিয়া যাইব। খেতুর মার নিকট যে ঝি ছিল, সে ঝিটি ছাড়িয়া গেল। সে বলিল—মা ঠাকুরাণি! আমি আর তোমার কাছে কি করিয়া থাকি? পাঁচজনে তাহা হইল আমার হাতে জল খাইবে না।

আরও নানা বিষয়ে খেতুর মা উৎপীড়িত হইলেন। খেতুর মা ঘাটে স্নান করিতে যাইলে, পাড়ার স্ত্রীলোকেরা দূরে দূরে থাকেন; পাছে খেতুর মা তাঁহাদিকে ছুঁইয়া ফেলেন।

যে কমল ভট্টাচার্যের কথা গদাধর ঘোষ বলিয়াছিল, একদিন সেই কমলের বিধবা স্ত্রী মুখ ফাটিয়া খেতুর মাকে বলিলেন,—বাছা! নিজে সবধান হইতে জানিলে কেহ আর কিছু বলে না! বসিতে জানিলে উঠিতে হয় না। তোমার ছেলে বরফ খাইয়াছে, তোমাদের এখন জাতিটি গিয়াছে। তা বলিয়া আমাদের সকলের জাতিটি মার কেন? আমাদের ধর্ম্মকর্ম নাশ কর কেন? তা তোমার বাছা দেখিতেছি, এ ঘাটটি না হইলে আর চলে না। সেদিন মেটে কলসটি যেই কাঁকে করিয়া উঠিয়াছি, আর তোমার গায়ের জলের ছিটা আমার গায়ে লাগিল, তিন পয়সার কলসীটি আমাকে ফেলিয়া দিতে হইল। আমাকে পুনরায় স্নান করিতে হইল। আমরা তোমার বাছা কি করিয়াছি? যে তুমি আমাদের সঙ্গে এত লাগিয়াছ?

খেতুর মা কোন উত্তর দিলেন না। কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ী আসিলেন।

খেতু বলিলেন,…মা! কাঁদিও না। এখানে আর আমরা অধিক দিন থাকব না। এ গ্রাম হইতে আমরা উঠিয়া যাইব।

খেতুর মা বলিলেন,–বাছা। অভাগীরা যাহা কিছু বলে, তাহাতে আমি দুঃখ করি না। কিন্তু তোমার মুখপানে চাহিয়া রাত্রি দিন আমার মনের ভিতর আগুন জ্বলিতেছে। তোমার আহার নাই, নিদ্ৰা নাই; একদণ্ড তুমি সুস্থির নও! শরীর তোমার শীর্ণ, মুখ তোমার মলিন। খেতু! আমার মুখপানে চাহিয়া একটু সুস্থির হও, বাছা!

খেতু বলিলেন,–মা! আর সাত দিন। আজ মাসের হইল ১৭ তারিখ। ২৪শে তারিখে কঙ্কাবতীর বিবাহ হইবে। সেই দিন আশাটি আমার সমূলে নির্মূল হইবে। সেই দিন আমরা জন্মের মতো এ দেশ হইতে চলিয়া যাইব।

খেতু বলিলেন,–দাসেদের মেয়ের কাছে শুনিলাম যে, কঙ্কাবতীকে আর চেনা যায়। সে রূপ নাই, সে রং নাই, সে হাসি নাই। আহা! তবুও বাছা মার দুঃখে কাতর! আপনার সকল দুঃখ ভুলিয়া, বাছা আমার মার দুঃখে দুঃখী। কঙ্কাবতীর মা রাত্রি দিন কাঁদিতেছেন, আর কঙ্কাবতী মাকে বুঝাইতেছেন।

শুনিলাম, সেদিন কঙ্কাবতী মাকে বলিয়াছেন যে, মা। তুমি কাঁদিও না। আমার এই কয়খানা হাড় বেচিয়া বাবা যদি টাকা পান, তাতে দুঃখ কি মা? এরূপ কত হাড় শ্মশানঘাটে পড়িয়া থাকে, তাঁহার জন্য কেহ একটি পয়সাও দেয় না। আমার এই হাড় ক খানার যদি অত মূল্য হয়, বাপ ভাই সেই টাকা পাইয়া যদি সুখী হন, তার জন্য আর আমরা দুঃখ কেন করি মা? তবে মা! আমি বড় দুর্বল হইয়াছি, শরীরে আমার সুখ নাই। পাছে এই কয়দিনের মধ্যে

আমি মরিয়া যাই, সেই ভয় হয়। টাকা না পাইতে পাইতে মরিয়া গেলে, বাবা আমার উপর বড় রাগ করিবেন। আমি তো ছাই হইয়া যাইব, কিন্তু আমাকে তিনি যখনি মনে করিবেন, আর তখনি কত গালি দিবেন।

খেতুর মা পুনরায় বলিলেন,–খেতু কঙ্কাবতীর কথা যা আমি শুনি, তা তোমাকে বলি না, পাছে তুমি অধৈৰ্য্য হইয়া পড়! কঙ্কাবতীর যেরূপ অবস্থা শুনিতে পাই, কঙ্কাবতী আর অধিক দিন বাঁচিবে না।

খেতু বলিলেন,–মা। আমি তনু রায়কে, বলিলাম যে, রায় মহাশয়! আপনাকে আমার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিতে হইবে না, একটি সুপাত্রের সহিত দিন। রামহরি দাদা ও আমি ধনাঢ্য সুপাত্রের অনুসন্ধান করিয়া দিব। কিন্তু মা! তনু রায় আমার কথা শুনিলেন না, অনেক গালি দিয়া আমাকে তাড়াইয়া দিলেন। আমাদের কি মা? আমরা অন্য গ্রামে গিয়া বাস করিব। কিন্তু কঙ্কাবতী যে এখানে চিরদুঃখিনী হইয়া রহিল সেই মা দুঃখ! আমি কাপুরুষ, যে তাঁহার কোন উপায় করিতে পারিলাম না, সেই মা দুঃখ। আমি কাপুরুষ, যে তাঁহার কোন উপায় করিতে পারিলাম না, সেই মা দুঃখ! আর মা, যদি কঙ্কাবতীর বিষয়ে কোন কথা শুনিতে পাও, তো আমাকে বলিও। আমার নিকট কোনও কথা গোপন করিও না। আহা! সীতাকে এ সময়ে কলিকাতায় কেন পাঠাইয়া দিলাম। সীতা যদি এখানে থাকিত, তাহা হইলে প্রতিদিনের সঠিক সংবাদ পাইতাম।

খেতুর মা, তার পর দিন খেতুকে বলিলেন,—আজ শুনিলাম, কঙ্কাবতীর বড় জ্বর হইয়াছে। আহা! ভাবিয়া ভাবিয়া বাছার যে জ্বর হইবে, সে আর বিচিত্র কথা কি? বাছার এখন প্রাণরক্ষা হইলে হয়। জনার্দ্দন চৌধুরী কবিরাজ পাঠাইয়াছেন, আর বলিয়া দিয়াছেন যে, যেমন করিয়া হউক, চারি দিনের মধ্যে কঙ্কাবতীকে ভাল করিতে হইবে।

খেতু বলিলেন,—তাই তো মা! এখন কঙ্কাবতীর প্রাণটা রক্ষা হইলে হয়। মা! কঙ্কাবতীর বিড়াল আসিলে এ কয়দিন তাঁহাকে ভাল করিয়া দুধ-মাছ খাইতে দিবে। হাঁ মা! আমরা এখান হইতে চলিয়া যাইলে, কঙ্কাবতীর বিড়াল কি আমাদের বাড়ীতে আর আসিবে? না, বড়মানুষের বাড়ীতে গিয়া আমাদিগকে ভুলিয়া যাইবে?।

খেতুর মা কোনও উত্তর দিলেন না, আঁচলে চক্ষু মুছিতে লাগিলেন।

এইরূপ দিন দিন কঙ্কাবতীর পীড়া বাড়িতে লাগিল, কিছুই কমিল না। সাত দিন হইল। বিবাহের দিন উপস্থিত হইল।

সে দিন কঙ্কাবতীর গায়ের বড় জ্বালা, কঙ্কাবতীর বড় পিপাসা, কঙ্কাবতী একেবারে শয্যাধরা। কঙ্কাবতীর সমূহ রোগ। কঙ্কাবতীর ঘোর বিকার। কঙ্কাবতীর জ্ঞান নাই, সংজ্ঞা নাই। লোক চিনিতে পারেন না, কঙ্কাবতী এখন যা তখন যা!