ভোরবেলায় পূরণ বাহাদুর এল গরম জল নিয়ে। অর্জুন দেখল তার তুলনায় ওর শরীরের শীতবস্ত্র কিছুই নয়। এই ঠান্ডায় গরম জল ছাড়া মুখ ধোওয়া অসম্ভব ছিল। মেজরকে ঘুম থেকে তুলতে হল। প্রথমে বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন পরে ঘড়ি দেখে বললেন, মাই গড! মেজর পরামর্শ দিলেন, প্রকৃতি না ডাকলে এখন প্রাতঃকৃত্য না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সেটা ভরদুপুরে করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
এখন অন্ধকার নেই তবে আলো ফোটেনি। ওরা তৈরি হয়ে বাইরে দাঁড়িয়েছিল। মালবাহকরা নিজেদের মালপত্র, তাঁবু গুটিয়ে নিয়ে অর্জুনের তাঁবু তুলতে এল। এবং তখনই ওদের চিৎকার শুনতে পেল অর্জুনরা। অর্জুন দেখল পূরণ বাহাদুর বাইরে এসে চারিদিকে তাকাচ্ছে। অর্জুন চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?
পূরণ বাহাদুর সেই গলায় উত্তর দিল, এখানে ডেডবডি নেই।
অর্জুন দৌড়াল যতটা দ্রুত সম্ভব। পূরণ বাহাদুর দেখাল যে দুটো কাপড়ে মোড়া ছিল সেগুলো মাটিতে পড়ে আছে কিন্তু মৃতদেহটি নেই।
স্যার, আপনারা কিছু টের পাননি? পূরণ বাহাদুর জিজ্ঞাসা করল।
না। অর্জুন মাথা নাড়ল। তারপর সামনের নরম মাটির ওপর পড়ে থাকা কাঁচের মতো জমা জল পরীক্ষা করল। কোনও দাগ নেই। কেউ যদি মৃতদেহ টেনে নিয়ে যেত তা হলে অবশ্যই দাগ লম্বা হয়ে পড়ে থাকত। বোঝাই যাচ্ছে। মৃতদেহকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মেজর বললেন, কোনও পাহাড়ি জন্তু যদি নিয়ে যায়। তা হলে দাগ থাকবেই। আর যদি বাঘের মতো মুখে করে নিয়ে যায় তা হলে কাপড়সুঘ্ন নিয়ে যাওয়ার কথা। তাই নয়?
অর্জুন মাথা নাড়ল। জিজ্ঞাসা করল, পূরণ বাহাদুর, এদিকের পাহাড়ে এমন কোনও বড় শরীরের জন্তু আছে যারা মানুষকে মুখে তুলে নিয়ে যেতে পারে?
না সাব। আমি শুনিনি। ভালুকরা এত ওপরে আসে না। এলে তারা নিয়ে যেত টেনে হিঁচড়ে। দাগ থাকতই। এখানে জল এত জমেনি যে দাগ ঢেকে যাবে। পূরণ বাহাদুর চিন্তিত গলায় বলল, এখন কী করব? ওর শরীর খুঁজে বের না করে গ্রামে খবরটা দিতেও পারব না। কিন্তু কোথায় খুঁজব?
এইসময় একজন মালবহনকারী উত্তেজিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞয় ভাষায় কিছু বলতে বলতে হাত নেড়ে ডাকল, পূরণ বাহাদুর, মালবাহকরা এবং অর্জুন লোকটির কাছে পৌঁছাতেই সে আঙুল তুলে দেখাল বেশ বড় পায়ের দাগ নীচ থেকে ওপরে উঠে এসেছে। পায়ের পাতা লম্বা নয়, আঙুলগুলোর ডগা মাটিতে বসে গেছে। আবার সেই দাগ যখন নীচে নেমে গিয়েছে তখন বেশ গম্ভীর হয়েছে। বোঝাই যায় প্রাণীটির ওজন বেড়েছে। অর্জুন উবু হয়ে বসে পরীক্ষা করল। যে এসেছিল তার পা দুটো। কোনও পাহাড়ের হিংস্র মাংসাশী প্রাণীর দুটো পা থাকে না। পূরণ বাহাদুরকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল সে তার বাপ-ঠাকুরদার কাছে শুনেছে অনেক ওপরে বরফের রাজ্যে নাকি দু’ পেয়ে প্রাণীকে কেউ কেউ দেখেছে। কিন্তু তারা কখনও এত নীচে নামেনি। মালবাহকরা স্বাভাবিক কারণেই খুব ভয় পেয়ে গেল।
অর্জুন ওদের নিয়ে আশেপাশের অনেকটা জায়গা খুঁজে দেখল। কিন্তু কোথাও মৃতদেহ পাওয়া গেল না। মালবাহকরা এবার ফিরে যেতে চাইল। শেষপর্যন্ত মেজর ওদের মজুরি বাড়িয়ে দিয়ে কোনওভাবে পরিস্থিতি ম্যানেজ করলেন।
একটু দেরি হয়ে গেল এসবের জন্যে। ম্যাপ দেখে আবার যাত্রা শুরু করল ওরা। কিছুক্ষণ পরেই আর মাটি দেখা গেল না। ধীরে ধীরে তুষার বরফে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এখন লাঠি হাতেও হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে। গতি কমে গিয়েছে অনেক। এর মধ্যে মেজর একবার আছাড় খেয়েছেন। অন্যদের পায়ের ছাপ অনুসরণ না করে দ্রুত যাওয়ার জন্যে নিজেই এগিয়েছিলেন। হঠাৎ নরম বরফে পা পড়ে যাওয়ায় শরীরের ভার রাখতে পারেননি। অর্জুন এবং একজন মালবাহক ওঁকে টেনে তোলার পর তিনি বললেন, এ কিছু নয়। অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম একটু।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, হাত পা ভাঙেনি তো? না না। একী দেখলে? একবার উত্তর মেরুতে, ইন দি ইয়ার নাইনটিন সেভেনটি এইটে পুরো শরীরটা প্রায় তিরিশ গজ স্কি করে যাওয়ার পর স্প্রিং এর মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে ছিল বিখ্যাত কোচ এডওয়ার্ড অ্যাব্রাহাম। সে মুগ্ধ হয়ে বলেছিল, তুমি ছয়মাস প্র্যাকটিস করলে উইন্টার অলিম্পিকে গোল্ড জিতবে।
বেলা দুটো নাগাদ সূর্য মেঘের আড়ালে চলে যেত। পূরণ বাহাদুর প্রস্তাব দিতেই মেজর এক কথায় হা বললেন। তিনি আর বলতে পারছিলেন না। দুটো বরফের টিলার মাঝখানে তাবু পাতা হচ্ছিল। জায়গাটা চওড়া নয় বলে টিলাদুটো প্রায় দেওয়ালের কাজ দেবে। অর্জুন লক্ষ করল, মালবাহকরা তাদের তাবু সামনে রেখে নিজেদের তিনটে পেছনে টাঙাল। টিলার ওপাশে খানিকটা গেলেই খাদ। ওদিক দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। অর্জুন মেজরকেও ব্যাপারটা জানাল না। এই দুর্গম জায়গায় মালবাহকদের সাহায্য ছাড়া এক পা-ও চলা সম্ভব নয়।
চারধার থম হয়ে আছে। এখানকার পৃথিবীর কোথাও এক ফোঁটা সবুজ নেই, কোনও মাটির কালো বিন্দু নেই, সর্বদা যে কী ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে এখানে না এলে বোঝা যেত না। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ জায়গার উচ্চতা মাত্র পনেরো হাজার ফুট। প্রায় এর দ্বিগুণ উচ্চতায় এভারেস্টের চুড়ো। এই সেদিনও দু’জন বাঙালি উঠে এলেন। আজ অর্জুনের মনে হল একশো মিটার দৌড়ে বিশ্বকাপ জয়ের চেয়ে ওঁদের কৃতিত্ব কোনও অংশে কম নয়।
তাবুর মধ্যে ঢুকে অর্জুন দেখল হাঁটার পোশাক পরেই মেজর হ্যামকে দোল খাচ্ছেন। তাকে দেখে বললেন, খালি পেটেই ব্যথার ওষুধ খেলাম।
সেকী! তখন পড়ে গিয়ে ব্যথা হয়েছে খুব?
নো। নট অ্যাট অল। যদি ভবিষ্যতে ব্যথা হয় তাই খেয়ে রাখলাম।
অর্জুন হেসে ফেলল।
সেটা না দেখার ভান করে মেজর বললেন, পূরণ বাহাদুরের সঙ্গে মিটিং করব।
কী ব্যাপারে?
আশ্চর্য! সেই সকালে চা দিয়েছিল। মাঝখানে একটু ড্রাইফুট। তার ওপর এই অবিরাম হাঁটা। না না, এভাবে চলবে না, আমাদের ভাল ব্রেকফাস্ট দরকার।
ঠিক আছে, কাল থেকে পাবেন।
তার মানে?
কাল থেকে আর এগিয়ে যেতে হবে না। ম্যাপ অনুযায়ী আমরা ঠিক সেখানেই পৌঁছে গেছি যেখানে জন তার মেয়ে ক্রিশ্চিনাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। আপনি খেয়াল করেননি। অর্জুন বলল।
উঃ, আঃ বলতে বলতে হ্যামক থেকে নামলেন মেজর। তারপর ম্যাপ বের করে কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে বললেন, ইউ আর রাইট। দক্ষিণ দিকে যতটা যেতে হত উত্তরদিকে ততটা দরকার হচ্ছে না। কিন্তু হতচ্ছাড়াটাকে দেখতে পেলাম না তো?
জন তো আপনাকে অভ্যর্থনা করার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন না। এই বিস্তীর্ণ বরফের রাজত্বের কোথায় তিনি এবং তার মেয়ে আছেন না খুঁজলে কি জানা যাবে? কিন্তু আমি ভাবছি এরকম জায়গায় ওঁরা আছেন কী করে?
অর্জুনের কথা শেষ হতেই পূরণ বাহাদুর ঢুকল খাবার নিয়ে। বলল, সার, একদম গরম খাবার খেয়ে নিন।
বহুত ধন্যবাদ পূরণ বাহাদুর। মেজর তড়িঘড়ি নিজের খাবারের কৌটো নিয়ে নিলেন। ঢাকনা খুলে বললেন, আঃ! দারুণ গন্ধ। চিকেন?
না সাব। মাটন।
আমার আবার রেডমিট খাওয়া উচিত নয়। ঠিক আছে, বিদেশে নিয়ম নাস্তি। এতে কী আছে? ভাত? মাংসের ঝোল আর ভাত! ভাবা যায়! কিন্তু বাবা পূরণ, রাত মে কী খাওয়াবে? খেতে খেতে চোখ বন্ধ হল মেজরের।
রুটি আর চিকেন।
সন্ধে সন্ধে দিয়ে যেয়ো বাবা।
পূরণ বাহাদুর জিজ্ঞাসা করল, আমাদের কাল কখন রওনা হতে হবে?
কাল আমরা ওপরের দিকে না এগিয়ে আশেপাশের জায়গায় সাহেবের বন্ধুদের ক’দিন ধরে খুঁজব। অর্জুন জানাল।
খুব ভাল। পূরণ বাহাদুর খুশি হল, আর দু’ ঘণ্টা হাঁটলেই দড়ি আর গাঁইতির দরকার হত। আমরা তো গাঁইতি আনিনি। আনলেও এই সাহেব পারতেন না। আচ্ছা–।
পূরণ বাহাদুর চলে গেলে মেজর হেসে বললেন, এরা আমাকে ভাবে কী বলো তো?
আমাকে সেটা বলেনি। খেতে খেতে অর্জুন বলল।
এরা জানে না, ইন দি ইয়ার নাইনটিন সেভেন্টি সিক্স আমি মাউন্ট অফ কিলিমাঞ্জারো এক্সপেডিশনের মেম্বার ছিলাম। তার আগে তিনমাসের ক্লাইম্বিং কোর্স করেছিলাম। এক্সপেডিশনের সময়ে উইলি ব্র্যাডম্যান বিশ্বাসই করেনি সেকথা। বাই দি ওয়ে, এই উইলির পুরো নাম উইলিয়াম ব্র্যাডম্যান। ক্রিকেটের রাজা ডন ব্র্যাডমানের খুড়তুতো ভাই। আমেরিকানরা অবশ্য তার নাম জানে না কারণ সেখানে ক্রিকেট হয় না। কথা বলার সময়ও খাওয়া থামাননি মেজর।
একজন মালবাহক কেটলিতে করে চা দিয়ে গেল। সেটা পান করে মেজর বললেন, যাই, একটু ঘুরে আসি। এই বোতলটা নিয়ে যাচ্ছি।
খেয়েই ছুটলেন? একটু সময় দিলে—
সময় তৈরি হয়েছে এখন, পরে থাকবে না।
*
বিকেল চারটের সময় পৃথিবী জুড়ে মরা আলো যেন চারপাশে বিষাদ ছড়াল। মিনিট দশেক ধরে মেজর দুরবিনে চারপাশ দেখে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বললেন, নাঃ! ওরা বোধহয় আর বেঁচে নেই। কোথাও কিছু নড়ছে না।
সামনেই অনেকগুলো বরফের টিলা, ওপাশটা তো দেখতে পাচ্ছেন না।
তা অবশ্য। আচ্ছা কাল যে ডেডবডি নিয়ে গেল সে নিশ্চয়ই শোকসভা করার জন্যে নিয়ে যায়নি। এতক্ষণে আত্মীয়স্বজন মিলে পুরোটাই সাবাড় করে দিয়েছে। তারা নিশ্চয়ই জ্যান্ত মানুষ পেলে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। সেক্ষেত্রে তো জনদের বাঁচার চান্স অনেক কমে গেল।
মেজরের কথার সত্যতা স্বীকার করতেই হল। এইসময় পূরণ বাহাদুরকে সঙ্গীদের নিয়ে অর্জুনদের তাবুকে আরও শক্ত করে বাঁধতে দেখা গেল। শেষে একটা বড় ত্রিপল তাঁবুর সামনের বরফের পাহাড়ের কোণে দড়ি দিয়ে বাঁধল ওরা। অর্জুন কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলল, যদি ঝড় ওঠে তা হলে তাঁবুর গায়ে বেশি ধাক্কা লাগবে না।
মেজর বললেন, কারেক্ট। আমাদের তাবু উড়ে গেলে তোমাদেরগুলোও যাবে।
সন্ধের একটু আগে জোরে হাওয়া বইতে লাগল। মেজর তার ব্যাগ থেকে একটা মোবাইল সেট বের করে অনেক খোঁজার পর বললেন, টাওয়ার নেই এখানে। দেখি তো!
একটু পরেই বিচিত্র সংগীত ভেসে এল ওই যন্ত্রটা থেকে। কিছুক্ষণ শোনার পর মেজর বললেন, চাইনিজ ফোক সং। কিছু বুঝতে পারছ?
না।
বোঝার কিছু নেই। সংগীত মানেই সংগীত। ভাষা প্রধান নয়। যাই বলল, এই বরফের রাজ্যে তোমাকে সংগীত শোনাচ্ছি, ইউ আর লাকি।
অর্জুন কিছু বলার আগেই পূরণ বাহাদুর তাঁবুতে ঢুকল, সাব, রাতের খাবার একটু তাড়াতাড়ি দেব। হাওয়াটাকে ভাল লাগছে না। আর আপনারা এই দুটো রাখুন, কাজে লাগতে পারে। দুটো ধারালো সরু ইস্পাতের ফলক এগিয়ে দিতে অর্জুন আর মেজর হাতে নিলেন। এই দুটোকে বল্লম বলা যাবে, তলোয়ারও নয়। কিন্তু অস্ত্র হিসেবে বেশ মজবুত এবং কাজের। মেজর অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করলেন, কখনও এরকম বস্তুকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছ? করোনি। অতএব যদি করতে হয় সাবধানে করবে।
মেজরের মোবাইলের গান আচমকা থেকে গেল। সেটা তুলে ঝাঁকিয়ে মেজর বললেন, যাঃ। সভ্য জগতের সঙ্গে শেষ যোগাযোগটাও চলে গেল।
অর্জুন হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিল। বেশ দামি মোবাইল। আঙুলের মৃদু স্পর্শেই চেহারা পালটায় স্ক্রিন। সে খেলনার মতো ব্যবহার করতে করতে ইন্টারনেটে গেল। টাওয়ার কাছাকাছি নেই তো বোঝা যাচ্ছে। তবু সে চেষ্টা চালিয়ে গেল। স্ক্রিন এখন সাদা। হঠাৎ মনে হল যন্ত্রটার ভেতরে যেন খুব নিস্তেজ আওয়াজ হচ্ছে। সে ওটা কানে চাপতেই স্পষ্ট শুনতে পেল, বিপ বিপ বিপ। একটানা শব্দটা বেজে যাচ্ছে। সে উত্তেজিত হয়ে তাঁবুর বাইরে। চলে আসতেই আওয়াজটা বেড়ে গেল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার জোর বাড়তেই স্তব্ধ হয়ে গেল যন্ত্রটা। অর্জুন মুখ তুলে তাকাল। দিগন্ত জুড়ে জমাট কালো মেঘ জমেছিল ইতিমধ্যে, এখন তারা গুঁড়ি মেরে আকাশের দখল নিতে চাইছে।
সে যন্ত্রটার দিকে তাকাল। সাধারণত কোনও নাম্বার ডায়াল করার পর তৎক্ষণাৎ যদি সংযোগ না তৈরি হয় তা হলে এই শব্দ শোনা যায়। মনে হয় নির্দিষ্ট নাম্বারটিকে সার্চ করা হচ্ছে। কিন্তু এখানে টাওয়ার নেই। যন্ত্রটিও মৃত। তা হলে শব্দ বাজবে কী করে! এবং এই শব্দের চলে যাওয়ার কারণ যে ওই মেঘ এবং ঝোড়ো বাতাস তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তা হলে কি মহাকাশের কোনও স্যাটেলাইট যে সাংকেতিক বার্তা পাঠাচ্ছে তাই মোবাইলে ঢোকার চেষ্টা করছিল। সাধারণ মোবাইল হলে তা সম্ভব ছিল না, কিন্তু মেজরের এই বস্তুটি তো সাধারণ নয়, একেবারে আধুনিক আবিষ্কার।
দ্রুত ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল পৃথিবী। এখন ঠান্ডা এত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে যে বাইরে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। অর্জুন তাবুর ভেতর ঢুকে দেখল মেজর ইমার্জেন্সি লাইট জ্বেলেছেন। অর্জুন বলল, বিশাল কালো মেঘ ধেয়ে আসছে। ভয়ংকর ঝড় হবে আজ।
একটা বড় বোতল থেকে ধাতবপাত্রে তরল পদার্থ ঢালতে ঢালতে মেজর বললেন, দেখো তৃতীয় পাণ্ডব, তুমি আমাকে ঝড়ের ভয় দেখিয়ো না। ইন দি ইয়ার নাইনটিন এইট্টি থ্রি, জুন মাসে অ্যাটলান্টিক ওশানে তিমি ধরতে গিয়েছিলাম। না না, ধরে ব্যাবসা করা বা মেরে খাওয়ার জন্যে নয়। তিমির ওপর গবেষণা করতে একটা দল গিয়েছিল, আমি তাদের সঙ্গী হয়েছিলাম। তোমার তখন আট বছর বয়স হবে, মনে থাকার কথা নয়। পৃথিবীর সব পত্রিকা, সব নিউজ চ্যানেলে খবরটা বেরিয়েছিল। এই শতাব্দির সবচেয়ে ভয়ংকর ঝড় উঠেছিল সমুদ্রে। জাহাজ ডুবে যাচ্ছে দেখে আমি একটা লাইফবোট নিয়ে সমুদ্রে নামতেই ঝড় আমাকে বোটসমেত উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমি রবারের বোটে বসে দেখলাম সমুদ্র থেকে অন্তত কুড়ি ফুট উঁচুতে উড়ে চলেছি। ভাগ্যিস ওটা রবারের বোট ছিল তাই আছড়ে পড়লেও ডুবে যায়নি। আমেরিকান নেভির একটা জাহাজ আমাকে উদ্ধার করে। ওরাও দূর থেকে আমাকে নৌকোসমেত উড়তে দেখেছিল। দুঃখের কথা, ওরা সে সময় ছবি তোলেনি। তুললে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে আমার নাম দেখতে পেত। অতএব আমাকে ঝড় দেখিয়ো না।
পূরণ বাহাদুর এল দৌড়ে। রাতের খাবার দিয়ে বলে গেল, তাবুর দরজা বন্ধ করে দিতে। মেজর ঘড়ি দেখলেন, এখনও লাঞ্চ হজম হয়নি। কিন্তু এবার না খেলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। কী দিয়েছে দেখো তো!
অর্জুন হটবক্সটার দিকে তাকাতেই শব্দটা বাজল। চমকে উঠল সে। খুব কাছাকাছি কোথাও যে বাজটা পড়ল তার আওয়াজ অতীতের সব অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে গেল। অর্জুন তাঁবুর দরজার দড়িগুলো বাঁধামাত্র শোঁ শোঁ শব্দে ঝড় আছড়ে পড়ল। আওয়াজ হচ্ছিল সামনের ত্রিপলের সঙ্গে ঝড়ের ধাক্কা লাগায় কিন্তু তার ফাঁক গলে আসা বাতাস তাবুটাকেও কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।
নিজের দুই কানে তুলো খুঁজতে খুঁজতে মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, নেবে?
না’
কী বললে বুঝতে পারছি না।
হাত নেড়ে না বলল অর্জুন। তারপর হটবাক্স খুলল। ঝড় চলছে সমানে। থরথরিয়ে কঁপছে তাবু। সামনে ত্রিপলের আড়াল না থাকলে এতক্ষণে হয়তো এটা আস্ত থাকত না। অর্জুন দেখল গোটাদশেক রুটি আর দুটো মাছের কৌটো দিয়েছে পূরণ বাহাদুর। মেজর এগিয়ে এসে একটা কৌটো তুলে নিয়ে আধখোলা মুখটাকে খুলে রুটির সঙ্গে খেতে লাগলেন। অর্জুন একটু জিভে দিয়ে মুখ বিকৃত করল। রাত্রে না খেলে সে অনেক ভাল থাকবে।
হ্যামকে শুয়ে ঘুম আসছিল না অর্জুনের। কেঁপেই চলছে তাবু, মনে হচ্ছিল যে-কোনও মুহূর্তে উড়ে যাবে। গেঞ্জির ওপর শার্ট, তার ওপর উলিকটের পুল ওভার, একটা হাফস্লিভ সোয়েটার, একটা ফুলহাতা সোয়েটারের ওপর মোটা উইন্ডচিটার থাকা সত্ত্বেও এখন কাঁপুনি হচ্ছিল। স্লিপিং ব্যাগে ঢোকার পর সেটা চলে গেল। আজ আলো নেভাতে দেননি মেজর। বলেছেন, সঙ্গে অনেক ব্যাটারি আছে। এই ভয়ংকর ওয়েদারে অন্ধকারে থাকা উচিত নয়।
এরপরে বৃষ্টি শুরু হল ঝড়ের সঙ্গে। পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল জল তুলে নিয়ে হাওয়ারা যেন তাবুর ওপর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছিল। মাঝে মাঝে তাবুর দড়ি প্রতিবাদ করছিল মচমচ আওয়াজ তুলে। আশ্চর্য ব্যাপার, এরই মধ্যে মেজর তার বিখ্যাত নাক ডাকা শুরু করে দিলেন।
হঠাৎ বৃষ্টি থেমে গেল। এবার ঝুপঝুপ শব্দ হচ্ছে। তাঁবুটা নড়ে উঠছে সেই শব্দের সঙ্গে। হাওয়া বন্ধ হয়ে গেলেও শব্দটা থামছে না। এরকম অনেকক্ষণ চলার পর অর্জুনের মনে হল তাঁবুটার ওপর যেন ওজন চেপে বসেছে। একটু নীচে নেমে এসেছে ওপরটা! সে হ্যামক থেকে বেরিয়ে লাঠি দিয়ে ওপরটা খোঁচাতেই চারপাশে শব্দ হতে থাকল এবং বোঝা গেল তাঁবুর ওপর জমা ওজন কমে গেল। তখনই অর্জুনের মনে হল জলবিয়োগ করা দরকার। শোওয়ার আগে পরিস্থিতি প্রতিকূল থাকায় চিন্তাটা মাথায় আসেনি। পুরো রাত সামনে পড়ে রয়েছে, মাঝরাতে উঠতে হলে খুব কষ্ট হবে। মেজরকে ডাকতে গিয়েও ডাকল না অর্জুন। মৃতদেহ নাক ডাকে না নইলে মেজরকে এখন মৃত বলা যেত।
তাবুর দরজার দড়ি খোলর আগে মাঙ্কি ক্যাপ পরে নিল অর্জুন। তারপর পূরণ বাহাদুরের দেওয়া অস্ত্র হাতে নিয়ে দড়িটা খোলা সত্ত্বেও দরজাটা আটকে গেল। কোনওরকমে সেটাকে সরাতেই তাজ্জব হয়ে গেল অর্জুন। তাবুর ইমার্জেন্সি লাইটের যেটুকু ওখানে এসে পড়েছিল তাতেই বোঝা যাচ্ছে নরম তুষারের স্তূপ হাঁটু অবধি উঁচু হয়ে আছে। বাইরে ঝড় বা বৃষ্টি নেই কিন্তু এখনও গুঁড়ি গুঁড়ি তুষার পড়েই চলেছে। হয়তো হাওয়াটা বন্ধ হয়েছে বলেই শীতও সামান্য কমে গেছে।
কোনওরকমে বাইরে বেরিয়ে এসেই মুগ্ধ হয়ে গেল অর্জুন। আকাশে এখন মেঘের আস্তরণ। কিন্তু প্রায় একপাশে সেই আস্তরণ যেন ফেটে গিয়েছে, আর তার ফাস গলে নানান রঙের আলো বেরিয়ে এসেছে। সেই আলোর এমন তীব্রতা নেই যে পৃথিবীকে আলোকিত করবে। বুঝতেই পারা যাচ্ছে ওই আলোর উৎস হল চাঁদ। কিন্তু চাঁদ দেখা যাচ্ছে না।
পেছনের দিকে তাকাল সে। তিনটে তাবুর চারপাশে প্রচুর তুষার অথচ ভেতর থেকে কোনও শব্দ ভেসে আসছে না। ওদের সতর্ক করে দিতে হবে। এভাবে তুষার পড়ে চললে তবু চাপ সহ্য করতে পারবে না। জলবিয়োগ করে ফেরার সময় ওদের ডেকে তুলবে বলে ঠিক করল অর্জুন।
ঠিক তাঁবুর কাছাকাছি জলবিয়োগ না করে বাঁদিকে খানিকটা এগিয়ে যেতেই পাহাড়ের সাদা খাঁজ দেখতে পেল সে। এইটুকু আসতেই তুষার ভাঙতে হল। এই তুষার সারারাত পড়লে সকালে বরফ হয়ে যাবে। তখন হাঁটাচলা বেশ ঝুঁকির ব্যাপার হবে। খাঁজের আড়ালে দাঁড়িয়ে জলবিয়োগ করল অর্জুন। তারপর ঘুরে দাঁড়াতেই সে চমকে উঠল। একটা কালো দাড়ির মতো কিছু এগিয়ে আসছে তুষার ভেঙে। ওর হাঁটতে অসুবিধে হলেও বোঝা যাচ্ছে তুষারে চলাফেরায় অভ্যেস আছে। আর একটু কাছে এলে অর্জুন আড়াল থেকে না বেরিয়ে অপেক্ষা করবে বলে ঠিক করল। যে আসছে। সে এখন মানুষের মতো হাঁটছে কিন্তু মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। অনেকটা গরিলার মতো মাথা নিচু করে দুই পায়ে হাঁটছে, হাত দুটো বুকের ওপর তোলা। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখে নিচ্ছে।
দৃষ্টিসীমায় পরিষ্কার হলে অর্জুন দেখল শীতবস্ত্রের বদলে ওর শরীরে বড় বড় লোম রয়েছে। কাঁধের গঠন বলে দিচ্ছে প্রচণ্ড শক্তি ধরে প্রাণীটা। মাথাটা মানুষের চেয়ে অনেক বড়। এটাই কি বরফ মানুষ? এভারেস্টজয়ী এডমন্ড হিলারি প্রকাণ্ড হিমালয়ে এসেছিলেন ইয়েতির সন্ধানে। তারপর বলা হয়েছিল ইয়েতি হল এক ধরনের প্রাণী যারা দু পায়ে হাঁটে, কুড়ি হাজার ফুটের কাছাকাছি থাকে। এটি কি সেই শ্রেণির একটি?
প্রাণীটি এবার তাবুর সামনে টাঙানো ত্রিপলের কাছে পৌঁছে গিয়ে সেটা ধরে টানাটানি করছে, হঠাৎ সে থেমে গেল। এক পা এগিয়ে এমনভাবে দাঁড়াল যেন কান পেতে কিছু শুনছে। তারপর হয়তো ভয় পেয়ে দ্রুত সরে গেল পেছনে। অর্জুনের বেশ মজা লাগল। মেজরের নাক ডাকার আওয়াজটায় ঘাবড়ে গিয়েছে। জন্তুটা। চিবুকে হাত দিয়ে ভাবল দাঁড়িয়ে। এইসময় আবার ঝুরঝুরু তুষার পড়তে লাগল। জন্তুটার শরীরে সাদা তুষার জমতে শুরু করল কিন্তু ওর কোনও ক্ষেপ নেই। এইসময় একটা সিটি বাজানোর আওয়াজ কানে এল।
অর্জুন আর দাঁড়াতে পারছিল না। তুষার পড়ার পর থেকে তার শরীরে ঠান্ডা বেশ বেড়ে গিয়েছিল। উইন্ডচিটারের ওপর সাদা তুষার জমছে। কিন্তু তাঁবুর দিকে গেলে জন্তুটা তাকে আক্রমণ করতে পারে। অর্জুনের সন্দেহ নেই মৃতদেহ চুরি করার পেছনে এটি বা এর কোনও স্বজাতি ছিল। অবশ্য যেখান থেকে মৃতদেহ চুরি গিয়েছে সেখানে বরফ পড়েনি, ওদেরও নীচে যাবার কথা নয়। কিন্তু এর স্বাস্থ্য বলছে, স্বচ্ছন্দে মৃতদেহ বহন করতে পারে।
অর্জুন নীচের দিকে তাকাল। ঝাপসা আলোয় একটা মাঝারি সাইজের বরফের টুকরো তুলে জোরে ছুড়ল প্রাণীটির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে মাথা চেপে ধরল ওটা। অর্জুন আর দেরি না করে চিৎকার করতে করতে পূরণ বাহাদুরের দেওয়া অস্ত্র শূন্যে ঘোরাতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে জন্তুটা ছুটতে লাগল যেদিক থেকে এসেছিল। খানিকটা গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল অর্জুন। জন্তুটা দৌড়াচ্ছিল। দৌড়াবার সময় তার দুটো পা একসঙ্গে পড়ছিল না। অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়ে মিলিয়ে গেল সেটা। অর্জুন দ্রুত তাঁবুর ভেতর ঢুকে টর্চ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। জন্তুটা যেখানে যেখানে পা ফেলেছে সেখানে ছাপ
স্পষ্ট হয়ে আছে। টর্চের আলোয় সেগুলো দেখে সে অবাক হল। আজ ভোরে নীচে যে এসেছিল তার পায়ের ছাপের সঙ্গে এর অনেক তফাত রয়েছে।
সে তাবুগুলোর দিকে তাকাল। মেজরের নাক ডাকা ছাড়া কোনও আওয়াজ নেই। এই যে সে অত জোরে চেঁচাল তাতেও কারও ঘুম ভাঙল না? মেজরের না ভাঙুক মালবাহকদের তো উঠে পড়া উচিত ছিল, তারপরই মনে হল এটা একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। মালবাহকরা নিশ্চয়ই খুব ভয় পেয়ে যেত। যতই মজুরি বাড়ান মেজর, কাল ভোরেই ওরা ফিরে যেত।
অর্জুন দ্বিতীয় তাবুর কাছে গিয়ে ডাকল, পূরণ বাহাদুর! পূরণ বাহাদুর।
জি সাব। লোকটার গলা ভেসে এল ভেতর থেকে।
তোমাদের তাবুর ওপর তুষার জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। ওগুলো ভেতর থেকে ঠেলে বাইরে ফেলে দাও, নইলে তাবু ভেঙে পড়বে।
ঠিক হ্যায় সাব।
তারপরেই তাঁবুগুলো থেকে তুষার ঝরে পড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। একটু অবাক হল অর্জুন, অন্য তাবুর লোকগুলো কি জেগে ছিল? নইলে তার কথা শোনামাত্র তাবুর ওপর জমে থাকা তুষার নীচে ফেলবে কী করে? তা হলে ওরা নিশ্চয়ই তার চিৎকার শুনেছে, শুনতে পাওয়া সত্ত্বেও তাবুর বাইরে যায়নি। তাকে যদি জন্তুটা আক্রমণ করত তা হলেও ওরা সাহায্য করার জন্যে বাইরে বের হত না। অর্জুনের মনে পড়ল, কোথায় যেন পড়েছিল, পাহাড়ের নিয়ম হল কেউ যদি চলতে চলতে পড়ে যায় তা হলে পাশের লোক তাকে সাহায্য করার জন্যে জীবনের ঝুঁকি নেবে না, এগিয়ে যাবে।
তাঁবুর ভেতর ঢুকল অর্জুন। শরীর থেকে তুষার ঝেড়ে ফেলে দিল নিজে। তারপরেই মনে হল এই বরফের রাজ্যে জন্তুটা নিশ্চয়ই একা থাকে না। ও যদি দলবল জুটিয়ে এসে আক্রমণ করে তা হলে তো ঘুমের মধ্যেই মরে যেতে হবে। এটা ঠিক জন্তুটা বেশ ভিতু। সে ভয় দেখাতেই পালিয়েছে। কিন্তু সংখ্যায় বাড়লে সাহসী হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অর্জুন মেজরের হ্যামকের পাশে দাঁড়িয়ে তিনবার ডাকল, কোনও সাড়া নেই। হাল ছেড়ে দিয়ে অস্ত্রটাকে কোলে নিয়ে ফোল্ডিং চেয়ারে বসল। এখন ক’টা বাজে? মেজরের আধুনিক মোবাইলটা, হাতে নিয়ে সময় দেখল সে, রাত নটা আঠাশ। ভাবা যায়? এসময় সে জলপাইগুড়ির কদমতলায় জগুদাদের সঙ্গে আড্ডা মারছে।
কী মনে হতে মোবাইল অন করল অর্জুন। কী আশ্চর্য ব্যাপার, বাঁদিকের ওপরে একটা কথা ফুটে উঠল এবং তখনই বিপ বিপ শব্দ শুরু হল। আঙুলের ডগায় ঈষৎ চাপ দিয়ে দিয়ে সে কমপিউটারের সেকশনে চলে এল। মেজরের পাসওয়ার্ড তার জানা নেই। থাকলে নেট খোলা যেত। সে উত্তেজিত হয়ে মেজরকে খোঁচা মারল, মেজর, শুনছেন। প্লিজ, মেজর।
আঃ। আমি কি ঘুমাচ্ছি? সব শুনতে পাচ্ছি। মেজর বললেন।
আপনার পাসওয়ার্ড কী?
মেজর, স্বাধীনতা–! আবার ঘুমিয়ে পড়লেন ভদ্রলোক।
অর্জুন পাসওয়ার্ড হিসেবে লিখল, মেজর, নাইনটিন ফর্টি সেভেন।
দুরুদুরু অপেক্ষার প্রায় মিনিট দুয়েক পরে মোবাইলের পরদায় ফুটে উঠল, মেসেজ। তারপর এক দুই তিন করে অনেকগুলো। অর্জুন পড়ল সেগুলো।
এক, ইন্ডিয়ার নর্থ বেঙ্গলে যাওয়ার পর তুমি আর যোগাযোগ করছ না কেন?
দুই, তুমি এখন কোথায়? রিয়াচক ভ্যালিতে পৌঁছেছ? আমাদের জানাও।
তিন, রিয়াচক ভ্যালির উত্তর দিকে মাটির তলায় কিছু নেই যার জন্যে জন যেতে পারে। অন্তত স্যাটেলাইট এই কথাই বলছে।
চার, স্যাটেলাইট যে ছবি দিয়েছে তা আমাদের বিভ্রান্ত করেছে। মানুষের মতো চেহারার কিছু প্রাণী ওখানে ঘুরছে। তোমরা কি তাদের দেখেছ?
পাঁচ, জন ও তার মেয়ে জীবিত আছে? ওরা কী করছে ওখানে?
শেষের মেইলটা এসেছে আজ বিকেলে। প্রতিটি মেইল করা হয়েছে নিউইয়র্ক থেকে। এখন কমপিউটারের দৌলতে পৃথিবীর যে-কোনও দেশের যে-কোনও শহরের যে-কোনও পাড়ার ছবি দেখতে পাওয়া যায়। কিছুদিন আগে অর্জুন নিজের বাড়ির ছবি এক বন্ধুর ল্যাপটপে ফেলেছে। নিউইয়র্কের ইন্টারন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কমিটির সদস্যরা নিশ্চয়ই আরও শক্তিশালী মাধ্যমের সুযোগ নিয়ে স্যাটেলাইটের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকেন।
অর্জুন দ্রুত লিখল, আজ রাত্রে আমরা একটি প্রাণীকে দেখেছি যার শরীরে প্রচুর শক্তি থাকা সত্ত্বেও খুব ভীরু।
এইটুকু লিখে পাঠানো মাত্র মোবাইল সাদা হয়ে গেল।
একটু ধন্দে পড়ল অর্জুন। তারপর তাবুর দরজা ফাঁক করে দেখল আবার মেঘের দল হানাদারের মতো ছুটে আসছে। তাঁবুর দরজা ভাল করে বন্ধ করে সে এবার মেজরের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চিৎকার করল, দয়া করে চোখ মেলুন।
ঘুম ভেঙে গেল মেজরের। স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকেই বিরক্ত-গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন?
এই ঘুমটা আপনি নিউইয়র্কেও ঘুমাতে পারতেন। রেগে গেল অর্জুন।
নো। পারতাম না। হ্যামকে এবং স্লিপিং ব্যাগে ঘুমানোর কথা কোনও কালে ওখানে ভাববে না। ওখানকার সামার কীরকম জানো তো! ব্যাগ থেকে কোনওমতে শরীর বের করে বসলেন মেজর, কী হয়েছে?
সংক্ষেপে সমস্ত ব্যাপারটা মেজরকে জানাল অর্জুন।
আশ্চর্য! এতসব ঘটে গেল আর তুমি আমাকে ডাকলে না?
ডাকলাম না? অর্জুন আপশোসে মাথা নাড়ল, আপনার নাক ডাকার আওয়াজে ওই জন্তুটাও ভয়ে সরে গিয়েছে। ঘুমালে আপনি কুম্ভকর্ণকেও হার মানান। এবার নেমে আসুন।
এখন নেমে কী করব? সে তো চলে গিয়েছে।
যদি দল বেঁধে ফিরে আসে তা হলে কী করবেন?
মাই গড! মেজর ধড়মড়িয়ে নীচে নেমে কয়েকটা শীতবস্ত্র অন্যগুলোর ওপরে চাপিয়ে নিলেন। তারপর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, হাইট কত? গরিলাদের মতো হলে তোমার চিন্তা নেই।
গরিলা নিয়ে কোনও গল্প শোনার আগে অর্জুন বলল, না। বড়সড় ভল্লুক দু’পায়ের ওপর ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়ালে যেরকম লাগে সেইরকম।
পূরণ বাহাদুররা জানে?
জানি না। না বলাই ভাল। শুনলে আর থাকতে চাইবে না।
কাওয়ার্ড! তাঁকে দেওয়া অস্ত্রটা হাতে নিয়ে মেজর বললেন, তাবুর, ভেতরে বসে থাকলে তো ওরা এলে তো বুঝতে পারব না। চলো, বাইরে গিয়ে পাহারা দিই।
প্রচণ্ড মেঘ জমেছে আবার, বৃষ্টিতে ভিজলে আর দেখতে হবে না। অর্জুন বলল, তবে ওর পায়ের ছাপ দেখে আসতে পারেন। যেভাবে তুষার পড়ছে। তাতে কাল সকালে আর দেখা যাবে না। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই।
ওরা বাইরে আসামাত্রই সামনের আকাশে এমনভাবে লম্বা আলোয় রেখা ফুটে উঠল যে মনে হবে ধারালো নখে আঁচড়াচ্ছে কেউ। আর তারপরেই শব্দ হল। মেঘ ডাকার শব্দটা গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেল বহুদূরে।
এত তাড়াতাড়ি পায়ের ছাপগুলো তুষারে চাপা পড়ে গেছে যে খোঁজাই সার হল। শেষে একটা ছাপ পাওয়া গেল যেখানে তুষার সরাসরি পড়ছে না। মেজর দেখলেন প্রায় মিনিটখানেক সময় নিয়ে, তারপর বললেন, জন্তুটাকে হাঁটতে দেখেছ?
অবশ্যই।
স্বাভাবিকভাবে হেঁটেছে।
না। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
ওর পা নর্মাল নয়। মেজর বললেন।
ওরা ফিরে এল তাবুর সামনে। সমানে তুষার পড়ছিল, আচমকা বন্ধ হল।
অর্জুন বলল, আমি ভাবতে পারছি না এই বরফের মধ্যে ওরা বেঁচে আছে কীভাবে। কোনও গাছও নেই যে বাতাসও খাবে। একমাত্র ওরা যদি মাংসাশী হয় আর এই বরফের রাজ্যে যদি শিকার করার মতো ছোট জানোয়ার পাওয়া যায় তা হলেই বেঁচে থাকা সম্ভব।
এখন পৃথিবী অন্ধকার। মেঘ আকাশ ঢেকে ফেলেছে। মেজর বললেন, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না আবার ভেতরে তো অসহায় হয়ে বসে থাকতে হবে। আমার মনে হচ্ছে যেটা এসেছিল সে শিকারি নয়। কোথায় শিকার পাওয়া যায় তার খবর জোগাড় করে দলকে দেয়। অতএব ওর খবর পেলে দল আমাদের আক্রমণ করবেই। মানুষের মাংস না খাওয়ার তো কোনও কারণ নেই। এখন কথা হল, কী দিয়ে ওরা আক্রমণ করবে?
নিশ্চয়ই পাথর বা লাঠি নিয়ে। নাঃ! এখানে থাকা যাচ্ছে না। বৃষ্টি পড়ছে। বলতে বলতে অর্জুন ভেতরে ঢুকল, পেছনে মেজর। এবার অর্জুন মোবাইলে পাওয়া মেইলগুলোর কথা বলল। সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে মোবাইলটা তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ চেষ্টা করে মেজর বললেন, আবার ডেড হয়ে গেছে?
আঃ! তখন আমাকে ডাকলে না কেন?
আপনার ঘুম ভাঙত না।
হুঁঃ। মেজর আবার এত রাত্রে ধাতবপাত্র বের করে গলায় ঢাললেন, তা হলে ওরা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জানতে পেরেছে যে জন এবং তার মেয়ে
জীবিত?
হ্যাঁ। ওরা জন্তুগুলোর কথাও লিখেছে।
জন্তুগুলো জনদের কিছু করছে না কেন?
জানি না।
এখানকার মাটির নীচে কিছু নেই লিখেছে।
হ্যাঁ। ওরাও ভাবছে জনরা এখানে কী করছেন?
এইসময় জোরে বৃষ্টি পড়তে লাগল। ঝড় নয় কিন্তু বৃষ্টির জলের ফোঁটা আগের থেকে অনেক বড় হওয়ায় তাবুর ওপর শব্দ হচ্ছিল।
মেজর আবার এক টোক খেয়ে বললেন, তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি?
কী কথা?
বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যখন শিলিগুড়ি বাইপাস ধরছি তখন ড্রাইভার আমাকে বলল, আপনার কি রিভলভার বা পিস্তলে শখ আছে?
বললাম নেই, এয়ারপোর্ট থেকে ভাড়া করেছিলাম গাড়িটা। সন্দেহ হল লোকটা আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল কেন? তাই জানতে চাইলাম, শখ থাকলে কী হত?
ড্রাইভার বলল, একজনের কাছে আমি টাকা পেতাম, শোধ করতে না পেরে রিভলভার দিয়ে বলেছে বিক্রি করে টাকা নেওয়ার জন্যে। খুব মডার্ন জিনিস। চাইনিজ।
সে কোত্থেকে পেল?
আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোক তো, সোর্স বলে না। কিন্তু কোনও কাগজপত্র নেই বলে আমি সঙ্গে রাখতে সাহস পাচ্ছি না। আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্য লোককে বিক্রি করতে চাইলে মুশকিলে পড়ব। গাড়ি চালাতে চালাতে বলল ড্রাইভার।
জিনিসটা দেখি!
সে গাড়ি থামিয়ে সামনের সিট তুলে একটা লম্বা বাক্স বের করে আমাকে দিল। দেখলাম তার ভেতরে সেলোফেন পেপারে মোড়া নতুন রিভলভার আর এক ডজন গুলি রয়েছে। রিভলভারের গায়ে চাইনিজ অক্ষরে কীসব লেখা। একসঙ্গে দশটা গুলি ভরা যায়। তখন গাড়ি একেবারে নির্জন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। ভাবলাম পরীক্ষা করে দেখি কিন্তু সাহস পেলাম না। শব্দ হবেই এবং তার ফলে বিপদে পড়ব। আমার নিজের অস্ত্র রাখার লাইসেন্স আছে। কিন্তু প্লেনে ওঠার সময় অনুমতি নিতে চাইলে প্রচুর ঝামেলায় পড়তে হয়। না বলে আনলে পাঁচ বছর জেলে থাকতে হবে। ভাবলাম যেখানে যাচ্ছি সেখানে স্বচ্ছন্দে নিয়ে যাওয়া যায়, প্রয়োজনে কাজে লাগবে। তাই দরাদরি করে আড়াই হাজারে কিনে নিলাম।
মেজর তাঁর রুকস্যাক থেকে বাক্সটা বের করলেন, খুলে দেখালেন রিভলভারটাকে।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, পুলিশ ধরলে কী বলবেন?
প্রথম কথা, আমার অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে লাইসেন্সও রয়েছে। সুতরাং খুব বেআইনি কাজ করছি না। দ্বিতীয়ত, এখানে কোনও পুলিশ কি দেখতে পাচ্ছ? ফেরার সময় বরফের তলায় রেখে যাব। মেজর হাসেন, মনে হয়, এটা তোমার কাছে থাকাই উচিত।
অর্জুন রিভলভার নিয়ে খুলে ঘরগুলো দেখল। তারপর একে একে গুলিগুলো ঢুকিয়ে দেওয়ার পরেও দুটো বাক্স পড়ে থাকল। সে জিজ্ঞাসা করল, এটা যদি কাজ না করে, তা হলে আপনার আড়াই হাজার টাকা জলে যাবে।
তা যাক। কিন্তু যাই বলো, অস্ত্রটা সঙ্গে থাকলে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।
বৃষ্টি চলছে সমানে। মেজর বলতেন, এবার মনে হয় তুমি শুতে পারো। ভোরের আগে আমি ডেকে দেব। কোনও অস্বাভাবিক আওয়াজ পেলে তোমাকে তুলে দেব। গুলি চালালে বাছাধনরা পালাবার পথ পাবে না।
যদি গুলি না চলে!’ অর্জুন বলল।
বিশ্বাস হারালে কিছুই পাওয়া যায় না অর্জুন।
*
মেজর জেগে থাকেননি। আধঘণ্টার মধ্যে বৃষ্টির আওয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অর্জুনও ঘুমিয়ে পড়েছিল কোনও এক সময়ে, ঘুম ভাঙতেই শুনল পূরণ বাহাদুরের গলা, চা নিয়ে এসেছে।
তাজ্জব কাণ্ড, সকালে সূর্যদেব দেখা দিলেন। আকাশে এক ফোঁটা মেঘ নেই। রোদ মেখে বরফ চকচক করছে। মেজর এবং অর্জুন তো বটেই, পূরণ বাহাদুরও চোখে কালো চশমা পরে নিল। বাকি মালবাহকেরা ক্যাম্পেই থেকে যাবে রান্নাবান্নার জন্যে।
ডাবল ডিমের ওমলেট আর চা খেয়ে ওরা তিনজন রওনা হল। অর্জুনের পরামর্শে যেদিকে জন্তুটা পালিয়ে গিয়েছিল সেদিকেই যেতে লাগল ওরা। গতরাতের তুষারপাত এবং পরে বৃষ্টির জন্যে তাঁবুর কাছাকাছি কোনও পায়ের ছাপ বেঁচে ছিল না। কিন্তু যেখান থেকে অদৃশ্য হয়েছিল জন্তুটা, সেখানে পৌঁছে পূরণ বাহাদুর উত্তেজিত হয়ে দেখল কয়েকটা টাটকা পায়ের ছাপ জমে যাওয়া তুষারের ওপর থেকে গেছে। বোঝা যাচ্ছে, বৃষ্টির পরে প্রাণীটি সেখানে আসায় ছাপটা থেকে গেছে।
অর্জুন চারপাশে তাকাল। চারপাশে বরফের ছোট ছোট টিলা, তুষার জমে গেছে অনেকটাই। সে দেখল পূরণ বাহাদুর পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। মেজর তার পেছনে, হাতে সেই ধারালো অস্ত্র যা কাল পূরণ। বাহাদুর দিয়েছিল। প্রায় মিনিট কুড়ি হাঁটার পর আচমকা ছাপ উধাও হয়ে গেল। অন্তত হাত দশেকের মধ্যে কোনও পায়ের ছাপ নেই, এই অবধি হেঁটে এসে প্রাণীটি নিশ্চয়ই আকাশে উড়ে যায়নি! তা হলে কোথায় গেল?
মেজরই রহস্যের সমাধান করলেন। তিন হাত দূরের তুষার এখনও নরম। বরফ হয়ে যায়নি। সেখানকার চেহারাটা চটকানো কাদার মতো। প্রাণীটি ওখানেই এগিয়ে পড়েছিল। নিশ্চয়ই ওর পা ঢুকে গিয়েছিল তুষারের ভেতরে তাই পায়ের ছাপ মুছে গেছে পা তুলে নিতেই। অর্জুন ওই জায়গায় লাফিয়ে নামল। তার হাঁটুর নীচে চলে এল তুষার। চারপাশে তাকাতেই সে সুড়ঙ্গটা দেখতে পেল। বাঁদিকের অনেকটা নীচে সুড়ঙ্গের মুখ। প্রাণীটি স্বচ্ছন্দে এখান থেকে সেখানে লাফিয়ে নেমে সুড়ঙ্গের ভেতরে চলে গিয়েছে।
বেশ কসরত করে ওপরে উঠে এসে মেজরকে সুড়ঙ্গের কথা জানাল সে। শুনে মেজর উত্তেজিত। তিনি এখনই অভিযান শুরু করতে চান।
অর্জুন মাথা নাড়ল, আপনার পক্ষে ওই সুড়ঙ্গ পর্যন্ত লাফিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
হোয়াই নট? ইন দি ইয়ার নাইনটিন সেভেনটি নাইন। হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল অর্জুন, আপনি ভুলে যাচ্ছেন তখন আপনার বয়স বত্রিশ বছর কম ছিল। নিশ্চয়ই শরীরের ওজন এখনকার অর্ধেক ছিল। নামতে চাইলে আপনার পা ভাঙবেই। মেরুদণ্ডেও চোট লাগতে পারে। তখন আপনাকে বয়ে নিয়ে যাবে কে? শুনেছেন তো, পাহাড়ে কেউ কারও জন্যে অপেক্ষা করে না।
এই প্রথম মেজর কথা হজম করলেন, হুম।
তা ছাড়া আপনি এখানে ওই অজানা প্রাণীর পিছনে ছোটার জন্যে আসেননি। আপনার উদ্দেশ্য জন এবং তাঁর মেয়ের সন্ধান করা। তাই না? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
অফ কোর্স। কিন্তু প্রাণীটি আমাকে খুব কৌতূহলী করছিল হে! এক কাজ করা যাক, আমরা আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে থাকি। ব্যাটা বের হলেই ধরব। মেজর কথাটা বলে খুশি হলেন।
অনেক তর্কবিতর্কের পর ঠিক হল মেজর একাই তার অস্ত্র নিয়ে এখানে অপেক্ষা করবেন। প্রাণীটি গুহা থেকে বের হলেই তিনি আক্রমণ করবেন কিন্তু কিছুতেই খুন করবেন না। অর্জুন এবং পূরণ বাহাদুর এই বরফের উপত্যকা খুঁজে চলে আসবে দুপুরের মধ্যেই। অন্য সময় হলে মেজর সঙ্গী হতে চাইতেন কিন্তু এখন বেশ শান্তভাবে মেনে নিলেন। পূরণ বাহাদুর তাঁর বসার জন্যে বরফের মধ্যেই ব্যবস্থা করে দিলে তিনি বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ।
প্রায় আধ মাইল বরফের ওপর দিয়ে হাঁটাহাঁটির পর পূরণ বাহাদুর ইশারায় তাকে দাঁড়াতে বলল। সামনের বরফের ওপর কিছু টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ রয়েছে, যাকে টানা হয়েছে সেটা যে প্রাণী তাতে সন্দেহ নেই কারণ বরফের ওপর রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে। বেশ বড় ফোঁটা পড়েছে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময়। অর্জুন বুঝতে পারল প্রাণীটির আয়তন বা ওজন বেশি নয় কারণ তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় দাগটা সওয়া দেড় ফুটের মতো থেকে গেছে এবং গম্ভীর হয়নি।
ওরা দাগ ধরে এগোতেই পূরণ বাহাদুর এবার পায়ের ছাপ দেখাল। যেখানেই তুষার না জমা অবস্থায় রয়েছে সেখানেই ছাপটা স্পষ্ট। একটু ঝুঁকে অর্জুন ভাল করে দেখে বুঝতে পারল এর আগে যে ছাপগুলো তারা দেখেছিল এটি তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বোঝাই যাচ্ছে মানুষটির পায়ে জুতো আছে। জুতোর সাইজ বেশ ছোট। দাগের গভীরতা বলছে, মৃত বা আহত প্রাণীটিকে যে টেনে নিয়ে গিয়েছে তার ওজন পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন কেজির মধ্যে। অর্থাৎ তাকে কিশোর বলা যাবে স্বচ্ছন্দে।
ওরা নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিল। এখানে জায়গাটা ঢালু। দ্রুত হাঁটলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একটা বরফের টিলার পাশ দিয়ে দাগটা ঘুরেছে। টিলার ওপাশটা দেখা যাচ্ছে না। ওরা দেখল টিলার ওপারে বরফের পাহাড়। অর্জুন আন্দাজ করল এখানেই দাগটা শেষ হয়ে যাবে। টিলার ধার দিয়ে একটু এগোতেই দৃশ্যটি দেখতে পেল ওরা। একটা লোমওয়ালা ছোট চেহারার প্রাণী উবু হয়ে বসে শিকার করে আনা জন্তুটির পেট কেটে ফেলেছে। এবার মাংস বের করে টুকরো করে বরফের ওপর রাখছে। কিন্তু প্রাণীটি মাংস কাটছে লম্বা ছুরি দিয়ে। বাঁদর বা হনুমান জাতীয় কোনও প্রাণী ছুরির ব্যবহার জানে না। তা ছাড়া, অর্জুন লক্ষ করল, ওর পায়ে বরফের ওপর চলার উপযোগী জুতো আছে। এইসময় ওপরে কয়েকটা বড় পাখিকে উড়তে দেখল ওরা। পরিচিত শকুনের চেহারা ওদের নয়। এত ওপরে, বরফের দেশেও পাখি থাকে? ওই পাখিদের লক্ষ যে পরিত্যক্ত জন্তুর শরীর তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
অনেকটা মাংস কাটা হয়ে যাওয়ার পর যে উঠে দাঁড়াল তার সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হল অর্জুন। এই প্রাণীটি মানুষ তো বটেই, মেয়েমানুষ, সম্ভবত মেজরের একদা বন্ধু জনের মেয়ে ক্রিশ্চিনা। সে এগিয়ে গিয়ে ডাকল, হ্যালো ক্রিশ্চিনা।
সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল মেয়েটি। কয়েক মুহূর্ত লাগল তার বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কারা? এখানে কোত্থেকে এলে? আমার নাম জানলে কী করে? বলার ভঙ্গিতে বেশ বুনো ছাপ।
আমি অর্জুন আর এই লোকটি আমার গাইড। কিন্তু এত মাংস নিশ্চয়ই কোথাও নিয়ে যেতে চাও। ঠিক আছে, কোনও প্লেট থাকলে নিয়ে এসো, আমি পাহারা দিচ্ছি। নইলে ওরা শেষ করে দেবে। আঙুল তুলে উড়ন্ত পাখিদের দেখাল সে।
ক্রিশ্চিনা জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কেন এখানে এসেছ? ট্যুরিস্টরা এদিকে আসে না। কোনও এক্সপেডিশন এদিক থেকে হয় না। শুধু মাঝে মাঝে স্মাগলারদের দল এদিক দিয়ে যাতায়াত করে। তোমরা কি স্মাগলার?
অর্জুন হাসল, না। আমরা তা নই। সত্যি কথাটা হল, আমি তোমাকে। খুঁজতে এসেছি। ভাগ্য ভাল যে শিকার টেনে আনায় জায়গাটা দেখতে পেয়েছিলাম।
আমাকে খুঁজতে? হোয়াই?
বাঃ! একটা মেয়ে আমাদের দেশে এসে হারিয়ে যাবে এটা কি মেনে নেওয়া যায়? তুমি থাকো কোথায়?
আমার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না।
ঠিক আছে। কিন্তু তোমারে শরীরে এটা কীসের চামড়া?
তোমার কোনও কথার জবাব দিতে আমি রাজি নই। এটা পরে কাজ করতে সুবিধে হয় তাই পরেছি। ক্রিশ্চিনা জেদি গলায় বলল।
কিন্তু তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। মহিলা বলে চিনতেই পারিনি।
খুব খেপে গেল ক্রিশ্চিনা, তুমি যদি এখান থেকে চলে না যাও তা হলে বিপদে পড়বে।
বেশ চলে যাচ্ছি। তার আগে মাংসগুলো তুমি নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাও নইলে তোমাকে অভুক্ত থাকতে হবে। এখানে সহজে খাবার পাওয়া যায় না। অর্জুন বলল।
ক্রিশ্চিনা একটু ভাবল, তারপর বলল, আমাকে সরিয়ে যদি তুমি মাংসগুলো নিয়ে পালাতে চাও তা হলে আমি তোমাকে মেরে ফেলব।
নিশ্চয়ই পালাব না, আচ্ছা, ক্রিশ্চিনা, এই সংলাপটা কি তুমি নিউইয়র্কে বলতে পারতে?
ক্রিশ্চিনার কপালে ভাঁজ পড়ল। কয়েক মুহূর্তের জন্যে দৃষ্টি ভাবলেশহীন। তারপর ঝট করে সে ওপাশের পাহাড়ের দিকে চলে গেল। ফিরে এল তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে। হাতে একটা বড় পিচবোর্ডের থালা। মাংসগুলোকে তার ওপর তুলে ক্রিশ্চিনা বলল, তুমি আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেই এখানে এসেছ। আমি জানি না কে তোমাকে পাঠিয়েছে। কিন্তু আমি চাই না কেউ আমাকে বিরক্ত করুক। বুঝতে পেরেছ? তুমি এখান থেকে চলে গেলে খুশি হব। কথাগুলো বলে ক্রিশ্চিনা পাহাড়ের দিকে চলে গেল।
অর্জুন পূরণ বাহাদুরকে নিয়ে একটু সরে আসতেই পাখিগুলো বিদ্যুৎ গতিতে নেমে এল। হাড়গোড়, চামড়া এবং অবশিষ্ট মাংস নিয়ে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করে খেতে লাগল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চামড়ার খানিকটা ছাড়া কিছু পড়ে রইল না।
অর্জুন দ্বিধায় পড়ল। সে পূরণ বাহাদুরকে নিয়ে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে গিয়ে ক্রিশ্চিনা যেখানে থাকে সেখানে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু ক্রিশ্চিনা তাকে একদম পছন্দ করছে না। ওখানে গিয়ে নতুন কথা সে কী বলবে? ক্রিশ্চিনা যদি এখানে থাকে তা হলে জনকে দেখতে পাচ্ছে না কেন? যদি ভেতরে থাকে তা হলে পিচবোর্ডের থালা নিয়ে আসার সময় ক্রিশ্চিনা জনকে নিশ্চয়ই বলবে তার কথা। শুনে বেরিয়ে আসা স্বাভাবিক হত জনের।
পূরণ বাহাদুর প্রশ্নটা করল, সাব, আপনারা এর খোঁজে এসেছেন?
হ্যাঁ।
তা হলে ওই সাব যার জন্যে অপেক্ষা করছেন সে কে?
উত্তরটা অর্জুনের জানা নেই। এখানে গরিলাদের চেহারার কোনও প্রাণী থেকে থাকে, এখন অবশ্য যদি বলার কোনও মানে হয় না, তাদের সঙ্গে ক্রিশ্চিনাদের সম্পর্ক ভাল হল কী করে? ভাল না হলে এখন বেঁচে থাকতে পারত না ক্রিশ্চিনা বা জন। যারা মৃতদেহ নিয়ে আসতে পারে! ভাবতেই মনে হল, এই প্রাণীরাই সেই গ্রামের যুবকদের মৃতদেহ চুরি করেছে কি না তার কোনও প্রমাণ নেই। যদি এরা মৃতদেহ খাওয়ার জন্যে চুরি করে থাকে তা হলে জীবন্ত মানুষকে খুশি হয়ে খাবে।
এইসময় আলো কমে আসতে লাগল। পূরণ বাহাদুর বলল, সাব, আবার মেঘ জমছে।
অর্জুন ওপরের দিকে তাকাল। সোঁ সোঁ করে দিগন্ত থেকে মেঘ ছুটে আসছে। অর্জুন ঠিক করল মেজরকে ক্রিশ্চিনার কথা বলে কী করবে তা ঠিক করবে।
দ্রুত ফেরা যাচ্ছিল না। আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে। মেজর যেখানে বসেছিলেন সেখানে পৌঁছে ওরা তাকে দেখতে পেল না। অর্জুন চিৎকার করল, মেজর! আপনি কোথায়? শেষ শব্দটি প্রতিধ্বনিত হল। পূরণ বাহাদুর বলল, সাব, বৃষ্টি এসে গেছে। এখানে নেমে পড়ুন। প্রথমে তুষারের কাদায়, সেখান থেকে অনেকটা নীচে লাফিয়ে নামতেই বৃষ্টির জল গায়ে লাগল। একটা চারফুট গর্তের মধ্যে ঢুকে গেল ওরা। গর্তটা গুহার মতো ভেতরে চলে গেছে এক বুক অন্ধকার নিয়ে। ওখানে ঢোকার পর গায়ে জল লাগছিল না। অর্জুন নিজের মনেই বলল, মেজর গেলেন কোথায়?
পূরণ বাহাদুর বলল, ওই সাব বোধহয় টেন্টে গেছেন?
.
বৃষ্টি থামল এক ঘণ্টা পরে। তখন আলো ফুটল আবার।
বেশ কসরত করেও ওদের ওপরে উঠে আসতে হল। হালকা আলোয় মেজরকে কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা যখন টেন্টের কাছে ফিরে এল তখন আড়াইটে বেজে গেছে।
মালবাহকেরা দাঁড়িয়ে ছিল। পূরণ বাহাদুরের প্রশ্নের জবাবে তারা জানাল মেজর টেন্টে ফিরে আসেননি। তবু, যদি ওদের অজান্তে টেন্টে ঢুকে থাকেন ভেবে ভেতরে উঁকি মারল অর্জুন। না, তার হ্যামকে দোল খাচ্ছেন না মেজর।
তা হলে কোথায় গেলেন তিনি? খিদে মাথায় উঠল, আর ঘণ্টাদুয়েকের পর অন্ধকার নেমে এলে কিছুই করা যাবে না। অর্জুনের মনে হল মেজর নিশ্চয়ই বীরত্ব দেখাতে নীচের গুহায় নামার চেষ্টা করেছিলেন। সেখানে আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে আছেন।
সে টর্চ এবং দড়ি নিতে বলল পূরণ বাহাদুরকে। আজ সকালে বের হওয়ার সময় মেজরের দেওয়া রিভলভার পকেটে রেখেছিল। সেই ধারালো অস্ত্র এবং আর একটা টর্চ নিয়ে মেজরকে খুঁজতে যাওয়ার কথা জানাল পূরণ বাহাদুরকে। ওই গুহার ভিতরটা দেখতে চাইছে।
অন্য সময় কী হত বলা যায় না, পূরণ বাহাদুর একসময় রাজি হল। একজনকে তাঁবুতে রেখে দু’জন মালবাহককে সঙ্গে নিয়ে এসে অপেক্ষা করতে বলল সে, মেজর যেখানে বসেছিলেন সেখানে। বলে দিল, সন্ধের অন্ধকার নামার আগে যদি সে ফিরে না আসে তা হলে তারা যেন টেন্টে চলে যায়।
দু’বার লাফিয়ে গুহার মুখটায় চলে এল ওরা। অর্জুন টর্চের আলো ফেলল ভেতরে। বেশ নিচু হয়ে আছে ওপরটা। রিভলভারটা রেডি করে ভাল করে হাতে ধরে প্রায় গুঁড়ি দিয়ে এগোতে থাকল সে। পেছনে টর্চ হাতে পূরণ বাহাদুর। ওপর থেকে বরফগলা জল শরীরে পড়ছে টপটপ করে। নীচের জমি অসমান। তার ওপর তুষারের স্তর। কোথাও পাথর বেরিয়ে আছে। অনেকটা যাওয়ার পর গুহাটা বাঁক নিতেই অদ্ভুত শব্দ কানে এল। টর্চের আলো নিভিয়ে কান পাতল সে। তাকে আলো নেভাতে দেখে পূরণ বাহাদুরও সুইচ অফ করল। খরখর শব্দ ভেসে আসছে সামনে থেকে। কিছুক্ষণ পরে অর্জুন বুঝতে পারল যেভাবে নিয়ম করে শব্দটা হয়ে যাচ্ছে তা একমাত্র নাক ডাকলেই সম্ভব হয়। মেজর তো বাঘের গর্জন করেন সেটা গুহার মধ্যে এত বদলে গেল কী করে?
টর্চ জ্বালল সে। তারপর আর একটু এগোতেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল। একটি বিশাল চেহারার মানুষ চিত হয়ে শুয়ে আছে। তার সমস্ত শরীর পশুর চামড়ায় ঢাকা কিন্তু মাথা মুখ বেরিয়ে থাকায় মানুষ বলে চেনা যাচ্ছে। লোকটা ঘুমাচ্ছে। লোকটির মুখের চামড়াটা তামাটে। পূরণ বাহাদুরও দেখতে পেয়েছিল লোকটাকে। সে দড়ির ফাস তৈরি করে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে লোকটির শরীরে ছুঁড়ে দিতেই হড়মড়িয়ে উঠে বসল। অর্জুন রিভলভার টর্চের আলোয় রেখে চাপা গলায় শাসাল, বাধা দিলেই গুলি করব। কে তুই? এখানে কেন এসেছিস? লোকটি হাত তুলতেই পূরণ বাহাদুর দড়ি এমন জোরে টানল যে হাতসুদ্ধ শরীরে চেপে বসল সেটা।
লোকটার শরীরে যত শক্তিই থাকুক হাত নাড়তে না পারায় পূরণ বাহাদুর ওকে কবজা করে ফেলল চটপট। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ওকে বসাবার পর ভেতরের দিকে টর্চের আলো ফেলে তাজ্জব হয়ে গেল অর্জুন। পূরণ বাহাদুর চিৎকার করে উঠল, রাক্ষস! রাক্ষস।
টর্চের আলোয় একটি নগ্ন মৃতদেহ দেখা যাচ্ছিল যার একটা হাত ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে। পাশেই পড়ে আছে চিবোনো হাড়-মাংস। মৃত মাংস ভক্ষণ করেছে এই লোকটি? পূরণ বাহাদুর লোকটির পায়ের ওপর টর্চের আলো ফেলে বলল, সাব, দেখিয়ে। অর্জুন তাকাল। লোকটির দুটো পায়ের আঙুলগুলো নেই। গোল হতে হতে ঈষৎ লম্বা হয়ে রয়েছে পায়ের পাতা। সন্দেহ থাকল না এর পায়ের ছাপ দেখেই সে বিভ্রান্ত হয়েছিল। লোকটার গলার কাছে রিভলভার ঠেকিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, সাহেব কোথায় বল? নইলে তোকে গুলি করে মারব।
লোকটা ততক্ষণে বোধহয় বুঝতে পেরেছে তার কী অবস্থা হয়েছে। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছিল দড়ির বাঁধন খুলতে। অল্প জোরে রিভলভারের বাঁট দিয়ে ওর মাথায় আঘাত করল অর্জুন, উঃ,’ বলে চোখ বন্ধ করল লোকটা।
অর্জুন আবার জিজ্ঞাসা করল, ওই সাহেব কোথায়?
এবার লোকটা চোখের ইশারায় গুহার ভেতরের দিকটা দেখাল।
প্রচণ্ড শক্তিশালী লোকটি যাতে দড়ির বাঁধন খুলতে না পারে তার ব্যবস্থা করে ওরা এগোল। খানিকটা যাওয়ার পর মানুষের কথা শুনতে পেল অর্জুন। তারপর আলো দেখতে পেল। গুহাটা শেষ হয়ে আসায় বাইরের আলো দেখা যাচ্ছে কিন্তু তাতে গুহার ভেতরটা আলোকিত হচ্ছে না।
কথাগুলো স্পষ্ট হল গুহার মুখে এসে। ইংরেজিতে বলছে লোকটা। তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বোঝার চেষ্টা করল অর্জুন, তুমি আমার খুব উপকার করলে বন্ধু। আমরা টিনফুড খেয়ে, ছোটখাটো পশু মেরে তার মাংসে বেঁচে থাকতে পারি কিন্তু ওর জন্যে খাবারের দরকার হয়, কাহাতক আর নীচের গ্রামগুলোতে গিয়ে গোরু ভেড়া মেরে নিয়ে আসা যায় ওর জন্যে। একটা গ্রাম্যলোককে একা পেয়ে ও শিকার করেছিল। তার শরীরের মাংসে ক’দিন চলে যেত। কিন্তু তুমি আসায় অন্তত দিন পনেরো ওর খাবারের অভাব হবে না। হা হা হা।
অর্জুন আরও একটু এগোল। এবার মেজরকে দেখতে পেল সে। পাহাড়ের গায়ে বরফের ওপর পড়ে আছেন। হাত-পা বাঁধা।
কিন্তু তার আগে আমাকে জানতে হবে তুমি কেন আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছ? হোয়াই?
মেজর জবাব দিলেন না।
দ্যাখো, তোমার সামনে দুটো রাস্তা খোলা আছে। যে লোকটা তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে তাকে ইশারা করলেই সে ঘাড় মটকে এখনই মেরে ফেলবে। তুমি যদি উত্তর দাও তা হলে ওর খাবার শেষ না হওয়া পর্যন্ত, ধরো আরও তিন-চারদিন তুমি বেঁচে থাকতে পারবে। পছন্দ তোমার?
তোমার মতো শয়তানের সঙ্গে কথা বলতে ঘৃণা হচ্ছে আমার। তুমি একটা হায়নার চেয়েও অধম।
হায়না। হা হা হা। আমি জানি তুমি একা আসেনি। তোমার সঙ্গীরা এসেছিল আমার মেয়েকে অনুসরণ করে। আমরা জানতাম এখানে কোনও মানুষ থাকে না তাই সতর্ক হইনি। তার ওপর আমার পা মচকে গিয়েছে। বলে অসুবিধায় আছি। কিন্তু আজ রাত্রে আমরা এখান থেকে অন্য জায়গায় চলে যাব যার হদিশ তোমার লোক পাবে না। তুমি আমাদের সঙ্গে হেঁটে যেতে পারো না হলে তোমার লাশ ও বয়ে নিয়ে যাবে। কেন এসেছ? তোমাদের সোসাইটি কী জানতে পেরেছে আমার সম্পর্কে? এবার লোকটিকে দেখা গেল। লম্বা রোগা প্রৌঢ়, মুখে লালচে দাড়ি। পায়ে মোটা ব্যান্ডেজ। লোকটি, যার নাম জন, লাঠির ওপর ভর করে মেজরের পাশে এসে দাঁড়াল।
তোমার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। এখানে এসে কোনও বিপদ হল কিনা তাই–!
মেজরকে থামিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল জন, মিথ্যে কথা। আমি আর তোমাদের সোসাইটির মেম্বার নই। আমার বিপদ ভেবে ছুটে আসোনি তুমি! কেন এসেছ?
মেজর জবাব দিলেন না।
এই সময় ক্রিশ্চিনা বেরিয়ে এল পাহাড়ের ভেতর থেকে। বোঝা গেল ওই গুহাতেই এরা আস্তানা করেছে। মেজরের দিকে একবার তাকিয়ে ক্রিশ্চিনা বলল, বাবা, তুমি মিছিমিছি সময় নষ্ট করে ফেলছ, আমি জিনিসপত্র প্যাক করে ফেলেছি।
থ্যাঙ্ক ইউ ডিয়ার। কিন্তু আমাকে জানতে হবে এরা কতটা জেনেছে?
যাই জানুক। ফিরে গিয়ে বলার সুযোগ তো পাবে না। গেট রিড অফ হিম।
লাঠিটা তুলে মেজরের পেটে বেশ জোরে খোঁচা মারল জন, শেষ সুযোগ দিচ্ছি, কী জেনেছ তোমরা?
আমরা কিছুই জানিনি। তবে তোমার মতো লোভী মানুষ নিজের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এই বরফের রাজ্যে দিনের পর দিন তো এমনি পড়ে থাকবে না। একটা গল্প চালু করেছিলে, তুমি এখানে তেলের সন্ধানে এসেছ। মিথ্যে কথা! স্যাটেলাইট বলছে এখানে এক ফোঁটাও তেল নেই। আর থাকলেই বা কী করতে? তার মালিক হত গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া। তা হলে কেন এখানে থেকে গেছ? মেজর মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
হা হা শব্দের ঝড় তুলল জন। তারপর মেয়েকে বলল, তোর লেটেস্ট পোশাকটা নিয়ে এসে দ্যাখা।
ক্রিশ্চিনা দ্রুত গুহার ভেতর থেকে একটা জন্তুর লোমশ চামড়া এনে দেখাল। জন বলল, এটা কীসের ছাল জানো? তুষারমানব। এখনও কোনও অভিযাত্রী যাদের জ্যান্ত ধরতে পারেনি।
ক্রিশ্চিনা বলল, মৃতদেহও দেখতে পায়নি। পায়ের ছাপ দেখেছে।
ইয়েস। জন মাথা নাড়ল। এই বরফের বিশাল চাঙড়ের নীচে চাপা পড়ে ছিল দুটো। মৃতদেহ বরফের ঠান্ডাতেও পচে গলে গিয়েছিল। ওদের নীচে নিয়ে গেলে কিছুই প্রমাণ করতে পারতাম না। আমরা চামড়া দুটো বের করে নিয়েছি। পরলে ঠান্ডা লাগে না। কিন্তু আমরা বুঝতে পারলাম দুটো তুষারমানব এখানে মৃত অবস্থায় ছিল মানে এই অঞ্চলে আরও অনেক থাকবেই। তাদের একটাকে জ্যান্ত অবস্থায় ধরে যদি আমেরিকায় নিয়ে যেতে পারি তা হলে–’ হাসল জন, বুঝতেই পারছ আমার শখ কোথায় পৌঁছাবে? ইন্টারন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি যা কল্পনা করতে পারে না, তাই করব আমি।
আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। মেজর মাথা নাড়লেন শায়িত অবস্থায়, যদিও স্যাটেলাইট বলছে এই অঞ্চলে কিছু অজানা প্রাণী আছে। আর–।
আর কী?
মেজর মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। ক্রিশ্চিনা বলল, বাবা, কেন সময় নষ্ট করছ?
ওকে!’ জন মাথা নেড়ে মুখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে সিটি বাজালেন। শব্দটা খুব জোরে না হলেও অনেকটা দূরে পৌঁছাবার পক্ষে যথেষ্ট।
ক্রিশ্চিনা বলল, কাউকে খুন করা দেখতে আমার একটুও ভাল লাগে । আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি। তোমরা তাড়াতাড়ি করো। ক্রিশ্চিনা পাহাড়ের আড়ালে চলে গেলে জন একটু উদ্বিগ্ন চোখে গুহার দিকে তাকাল। তারপর চাপা গলায় বলল, পেট ভরে খেয়ে ব্যাটা এখন ঘুমোচ্ছে।
ততক্ষণে চাঁদ উঠে গেছে। অন্ধকার আর আড়াল করতে পারেনি পৃথিবীকে। জন আবার সিটি বাজালেন। মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, এই রাক্ষসটাকে জোগাড় করলে কী করে?
এখানেই। নীচের গ্রামের লোকজন ওকে তাড়িয়ে দিয়েছিল কাঁচা মাংস খায় বলে। এই বরফের রাজ্যে লুকিয়ে থাকত ও। খিদে পেলে নীচে নেমে ভেড়া ছাগল চুরি করে আনত রাতের অন্ধকারে। বরফের কামড়ে ওর দু’পায়ে ঘা হয়ে গিয়েছিল। ওই গুহার মধ্যে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। ক্রিশ্চিনা ওর চিকিৎসা করে। এখানে আসার সময় ও এই ধরনের সমস্যার কথা ভেবে ওষুধ, ইনজেকশন এনেছিল। পায়ের যন্ত্রণাটা কমে যেতে লোকটা ক্রিশ্চিনার অনুগত হয়ে যায়। আমরা যা বলি তা নির্দ্বিধায় করে, কিন্তু কাঁচা মাংস, তা মানুষ বা পশুর হোক, খাওয়া বন্ধ করতে পারে না। কিন্তু ওর ঘুম ভাঙছে না কেন? জন ধীরে ধীরে গুহার মুখে এসে দাঁড়ালেন। তারপর তৃতীয়বার সিটি বাজালেন। এবার ভেতরে থেকে গোঙানির আওয়াজ ভেসে এল। পূরণ বাহাদুর ওর মুখ বেঁধে দেওয়ায় চিৎকার স্পষ্ট হচ্ছিল না। জন বিড়বিড় করল, কী হল? টর্চটা আনা দরকার।
অর্জুন আর সময় নষ্ট করল না করে দ্রুত বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল জনের ওপর। ছিটকে পড়ল জন। বোধহয় পায়ে চোট লাগায় সে ককিয়ে উঠল। ওকে উপুড় করে অর্জুন ইশারা করল পূরণ বাহাদুরকে। দ্রুত হাত চালাল পূরণ বাহাদুর। জনের ঘাড়ের নীচে হাতের পাশ দিয়ে একটা আঘাত করতেই অজ্ঞান হয়ে গেল সে। জনকে ভালভাবে বেঁধে ফেলে গুহার ভেতর টেনে নিয়ে যাওয়া হল। তারপর মেজরকে বাঁধনমুক্ত করল অর্জুন। দাঁড়াতেই কষ্ট হচ্ছিল মেজরের। তবু বললেন, আমি জানতাম তুমি আসবে তাই একটুও নার্ভাস হইনি।
বাবা!’ ক্রিশ্চিনার গলা ভেসে এল।
অর্জুন মেজরকে ইশারা করল চুপ করে থাকতে। ক্রিশ্চিনার গলার স্বরে এবার উত্তেজনা, বাবা, তাড়াতাড়ি এসো, বাইনোকুলারে দু’জনকে দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে ওরা তুষারমানব। ডু-কে বলো ওদের চেজ করতে।
অর্জুন নিঃশব্দে পাহাড়ের আড়ালে চলে এসে দেখল গুহার মুখে দাঁড়িয়ে ক্রিশ্চিনা বাইনোকুলারে চোখ রেখে পৃথিবী ভুলে তুষারমানব দেখছে।
সে পাশে গিয়ে বলল, ওটা দাও, আমি দেখব।
চমকে পাশে তাকাল ক্রিশ্চিনা, তুমি? তুমি কোত্থেকে এলে? বাবা!
ওর জ্ঞান ফিরতে একটু দেরি আছে? আর ওই রাক্ষসটার নাম বুঝি ডু? তার পক্ষেও আসা সম্ভব নয়। দাও ওটা। হাত বাড়িয়ে বাইনোকুলার কেড়ে নিল সে।
অর্জুন হাত বাড়ানোমাত্র ক্রিশ্চিনা দৌড়াতে লাগল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মেজর ততক্ষণে এসে গিয়েছিলেন, ওকে আটকাও। অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারে ওইভাবে দৌড়ালে।
অর্জুন বাইনোকুলারে ক্রিশ্চিনাকে দেখল। তার শরীরে এখন তুষারমানবের লোমশ চামড়া। ক্রমশ মিলিয়ে গেল সে, তারপরই ভয়ংকর আর্তনাদ শোনা গেল।
অর্জুন বলল, চলুন ফেরা যাক।
তার মানে? মেয়েটাকে খুঁজে বের করবে না?
যে আওয়াজ হল তারপর এই রাত্রে কোথায় ওকে খুঁজবেন?
পেছন থেকে পূরণ বাহাদুর বলল, সাব, আলো বেশিক্ষণ থাকবে না। দুরে মেঘ দেখা যাচ্ছে। ওরা তো গুহা থেকে বের হতে পারবে না। কাল সকালে যা করার করলে ভাল হয়।
অর্জুন আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। ঠিক কথা। আপনি হেঁটে যেতে পারবেন?
চেষ্টা করছি। মেজর বললেন, কিন্তু মেয়েটা যদি ফিরে এসে ওদের সাহায্য করে?
যে চিৎকারের ডাক এল তারপর ওর হেঁটে ফিরে আসা বোধহয় সম্ভব নয়। অর্জুন বলল, দ্রুত মেঘ বেড়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি চলুন।
মেজরকে ধরে ধরে নিয়ে আসতে হল। তাঁবুর ভেতরে ঢোকামাত্র বৃষ্টি নামল। পরীক্ষা করে অর্জুন বুঝল মেজরের হাড় ভাঙেনি, বাঁ হাঁটুতে চোট লেগেছে।
কী করে এটা হল?
আর বোলো না। বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে আমি নীচের ধাপটায় নেমে দেখতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ঠেলতেই তার নীচে আচমকা পড়ে গেলাম। চোটটা তখনই লেগেছে। ওই রাক্ষসটা আমাকে টানতে টানতে গুহার এপাশে নিয়ে চেঁচাতে লাগল, তখন জন বেরিয়ে এসে আমাকে বেঁধে ফেলল। কথা শেষ করে বললেন, বোতলটা দাও তো। গলায় ঢাললে ব্যথা কমে যাবে।
ওষুধের বাক্স খুলে ব্যথা কমার কিছু ওষুধ লাগিয়ে মেজর হ্যামকে শুয়ে পড়তেই খাবার নিয়ে ঢুকল পূরণ বাহাদুর। তার পরনে বর্ষাতি। অর্জুন ইমার্জেন্সি আলো জ্বেলে দিল। বলল, খুব খিদে পেয়েছে, খাওয়া শুরু করা যাক।
খেতে খেতে মেজর বললেন, সত্যি তুমি বাইনোকুলারে তুষারমানব দেখেছ?
দুটো কালো প্রাণীকে হাঁটতে দেখেছি। তারা তুষারমানব কিনা জানি না।
তা হলে আবার আসতে হবে হে, এবার প্রস্তুত হয়ে?
ওই দু’জনকে নিয়ে কী করবেন?
নীচে নামিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আচ্ছা মেয়েটা পালাল কেন? ওর বিরুদ্ধে তো কোনও চার্জ তৈরি করা যাবে না।
জনের বিরুদ্ধেও নয়।
তা হলে?
পরে ভাবা যাবে। এখন ভালভাবে খান।
*
সকালে আবার রোদ উঠল। মেজর অনেকটাই সুস্থ। চারজন মালবাহককে নিয়ে ওরা প্রথমে ক্রিশ্চিনার সন্ধানে গেল। ঘণ্টা আড়াই পরে তুষারে চাপা ওর শরীর পাওয়া গেল। ঠান্ডায় জমে মরে গেছে। আর আশ্চর্য ব্যাপার, ওর শরীরের সেই পশুর চামড়াটা নেই। অর্জুন বলল, জাতভাইয়ের চামড়া খুলে নিয়ে গেছে ওরা। গর্তে পড়ে নিশ্চয়ই পা ভেঙেছিল ক্রিশ্চিনার। সেই চিৎকার শুনে ওরা এসে চামড়াটাকে পেয়েছে।
মৃতদেহ তুলে গুহার কাছে এসে ওদের বের করা হল। মেয়ের মৃতদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল জন। মেজর যখন বললেন তুষারমানবরাই ওই চামড়া নিয়ে গিয়েছে তখন বিলাপ করতে লাগলেন, প্রতিশোধ নিল ওরা। আমরা তিনজন দুটোকে খুন করেছিলাম। ডু-এর শক্তির কাছে হেরে গিয়েছিল ওরা।
অর্জুন মেজরের দিকে তাকাল, যাক, জন যখন নিজে স্বীকার করল তখন ওর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনতে পারবেন।
মেজর বললেন, ভেরি স্যাড। পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য প্রাণীদুটোকে খুন করেছে এরা। তাই ডু একটা চামড়া নিয়েছে, অন্যটা ক্রিশ্চিনা। জনের ভাগ্যে জোটেনি। ইন দি ইয়ার নাইনটিন। মেজরকে এই প্রথমবার হাত তুলে থামাল অর্জুন, গল্পটা পরে শুনব। প্রথম ওদের নীচে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তখন বরফে নরম রোদের মাখামাখি, কী নিরীহ দেখাচ্ছে উপত্যকা!