২. জলপাইগুড়ির থানা

এই তথ্যগুলো জলপাইগুড়ির থানায় বড়বাবুকে জানানো উচিত কিনা বুঝতে পারছিল না অর্জুন। শোনামাত্র বড়বাবু হাতকাটা পাঁচুকে আবার ধরবেন সাক্ষী করার জন্যে কিন্তু সে মুখ খুলবে না। আর চাপে পড়ে যদি মুখ খোলেও তা হলে পাণ্ডেজি প্রমাণ করে দেবেন সে মিথ্যে কথা বলেছে। অথবা সাক্ষী দেওয়ার জন্যে হাতকাটা পাঁচুকে বাঁচিয়ে রাখবেন না। রাত্রে বিছানায় শুয়ে অর্জুনের মনে পড়ল হরিপদ বক্সীর কথা। ভদ্রলোক তো চালসা থানায় আছেন। ভদ্রলোক তাকে খুব পছন্দ করেন। কিছুদিন উনি জলপাইগুড়ির থানাতেও ছিলেন। পুলিশ হলেও গল্পের বই পড়ার নেশা খুব। বিশেষ করে ক্রাইম থিলার।

কথা ছিল সকালে হাবু এসে মেজরের ব্রেকফাস্ট নিয়ে যাবে মায়ের কাছ থেকে। অর্জুন বেলায় গিয়ে দেখা করবে। ভোর হতে না হতে চা খেয়ে অর্জুন তার লাল মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তিস্তা ব্রিজ হয়ে দোখানির দিকে খানিকটা এগিয়ে বাঁদিকের রাস্তা ধরল সে। এটা শর্টকাট। লাটাগুড়ি হয়ে গোরুমারা জঙ্গলের গা দিয়ে যখন সে চালসায় পৌঁছাল তখন সকাল সাড়ে সাতটা। থানায় ঘুম ঘুম ভাব। খোঁজ নিয়ে সোজা হরিপদ বক্সীর কোয়ার্টার্সে পৌঁছে দেখল ভদ্রলোক বাড়ির সামনে জগিং করছেন। তাকে দেখে একই সঙ্গে অবাক ও খুশি হলেন হরিপদ বক্সী। ছিমছাম শরীর, মাথায় টাক না থাকলে ফিল্মস্টার বলে চালানো যেত।

আরে! কী সৌভাগ্য! সাতসকালে আপনি? এদিকে কবে এসেছেন? হরিপদ এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন।

এইমাত্র। কেমন আছেন?

আর কেমন আছি। ভাল থাকতে দেবে না এরা।

কারা?

গতকাল একটা হাতির ডেডবডি পাওয়া গিয়েছে। সন্ধের পর মালগাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগেই বোধহয় মরেছিল। খবর পেয়ে সকালে গিয়ে দেখি ওর দাঁতগুলো করাত দিয়ে কেটে নিয়ে গেছে কেউ। এখন তো প্রায়ই হাতি ট্রেনের ধাক্কায় মরছে। ওই মরার খবর আমরা পাওয়ার আগে চোরাকারবারীরা টের পেয়ে যায়।

ধরা পড়েছে?

দুর। কোনও প্রমাণ রাখেনি।

এই এলাকার চোরাকারবারীদের কাছে খোঁজ করেছেন?

রুই কাতলারা এদিকে নেই। ছিঁচকেরা এত সাহস পাবে না। হরিপদ বক্সী বললেন, আসুন। আমার বাড়িতে বসে চা খান একটু।

হরিবদ বক্সীর স্ত্রী-পুত্ররা শিলিগুড়িতে থাকে। চালসায় ভাল স্কুল নেই। পড়াশুনোর জন্যে তাদের নিয়ে স্ত্রী সেখানে থাকেন। কাজের লোক চা নিয়ে এলে হরিপদ বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, এবার বলুন তো, হঠাৎ এই সময়ে?

অর্জুন হেসে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আপনার সাহায্য চাই।

নিশ্চয়ই।

এখন তো মুক্তি নদীর ধারে প্রচুর গেস্ট হাউস তৈরি হয়েছে ট্যুরিস্টদের জন্যে। কিন্তু কেউ নিজের থাকার জন্যে বাংলো করেছে? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ কয়েকটা হয়েছে। বেশিরভাগই কলকাতার বড়লোক। বছরের খুব কম সময়ে তারা আসেন। কেয়ারটেকার রেখে দিয়েছেন। হরিপদ বক্সী বললেন, শীতকালটায় যা আসা যাওয়া হয়ে থাকে।

আমরা খুব শিগগির পাহাড়ে যাব। পাহাড় সম্পর্কে ভাল খোঁজখবর রাখেন এক ভদ্রলোক নাকি ওখানে বাংলো তৈরি করে আছেন। চেনেন?

বিলক্ষণ! ভদ্রলোকের নাম প্রাণকুমার পাণ্ডে। একটু রগচটা লোক, ওঁর বাউন্ডারির ভেতরে কাউকে অ্যালাউ করেন না। তবে আমার সঙ্গে হাসিমুখেই কথা বলেন। কিন্তু তাকে বছরের খুব কম সময়ে এখানে দেখা যায়।

আমার কাছে খবর আছে উনি এখন ওখানেই আছেন।

আচ্ছা! আপনি খবর নিয়ে এসেছেন অথচ দেখুন আমি এখানে বসে তা জানি না। কিন্তু ওঁর সম্পর্কে কিছু উড়ো কথা আমাদের কানে এসেছে। বড়কর্তাও জানেন। কিন্তু কোনও প্রমাণ না থাকায় আমরা চুপচাপ আছি।

আমার সেসব খবরে কোনও ইন্টারেস্ট নেই। আমি শুধু পাহাড় সম্পর্কে ওঁর কাছ থেকে কিছু তথ্য জানতে চাইছি। শুনেছি দার্জিলিং-এর পাহাড়টা হাতের রেখার মতো ওঁর কাছে পরিষ্কার।

বেশ। আপনি চাইছেন ওঁর সঙ্গে আমি আপনার পরিচয় করিয়ে দিই?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

দেখুন হুট করে যাওয়া ঠিক হবে না। আগে একটা ফোন করা যাক। চা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল, হরিপদ বক্সী উঠে দাঁড়ালেন।

ফোন নাম্বার থানায় ছিল। সেখনে গিয়ে নাম্বার দেখে ফোন করলেন হরিপদ বক্সী। প্রথমবার অনেকক্ষণ ফোন বাজল, কেউ ধরল না। অর্জুনের অনুরোধে দ্বিতীয়বার ফোন করলেন ভদ্রলোক। একটু পরে গলা পেয়ে নিজের পরিচয় দিলেন হরিপদ বক্সী। দেওয়ার পরে তার মুখে হাসি ফুটল। গুড মর্নিং মিস্টার পাণ্ডে। কেমন আছেন?

উত্তর এবং তার পরের প্রশ্ন শুনে হরিপদ বক্সী বললেন, আপনার মতো মানুষ এই অজ পাড়াগাঁয়ে এলে খবরটা চাউর হয়েই যায়। আমি বোধহয় আপনাকে বিরক্ত করছি না।

উত্তর শুনে আশ্বস্ত হয়ে তিনি বললেন, আমার এক ছোটভাই দার্জিলিং-এর পাহাড় সম্পর্কে জানতে খুব আগ্রহী। আপনি এখানে এসেছেন শুনে তাকে বললাম ঠিক মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারি। আপনি কি সময় দেবেন?

ওকে! ফোন নামিয়ে রেখে হরিপদ বক্সী বললেন, প্রাণকুমার পাণ্ডে আর এক ঘণ্টা বাদে বেরিয়ে যাবেন। এর মধ্যে গেলে দশ মিনিট কথা বলতে পারেন। চলুন।

পুলিশের গাড়িতে যাচ্ছিল অর্জুন। হরিপদ বক্সী স্টিয়ারিং-এ। বলল, লোকটা খুব সেয়ানা। আমি আপনাকে ছোটভাই বললেও ও যাচাই করে নেবে। আপনি নিজের নাম দয়া করে বলবেন না। এই জেলায় মুখে না চিনুক নামে তো অনেকেই চেনে।

ঠিক আছে। আমি শ্যামাপদ বক্সী, বর্ধমানে থাকি।

আরে! আপনি কী করে জানলেন আমার পৈতৃক বাড়ি বর্ধমানে।

অর্জুন হেসে ফেলল, একেবারেই কাকতালীয়।

বর্ধমানের স্টেশনের পাশেই আমাদের বাড়ি।

ঠিক আছে।

মুক্তি নদীটি খুব সুন্দর। এর আগেও অর্জুন দেখেছে, দেখে মনে হয়েছে। নদী না বলে বড় ঝরনা বললেই মানাত। নুড়ির ওপর দিয়ে তীব্রস্রোত বয়ে যাচ্ছে। এবার দেখল প্রচুর কটেজ তৈরি হয়ে গেছে ট্যুরিস্টদের জন্যে। মুক্তির একটা দিক এখন আর নির্জন নয়। হরিপদ বক্সী সেসব ছাড়িয়ে যেখানে গেলেন সেখানে একটা দোতলা বাড়িকে ঘিরে ফুলের বাগান আর বাগানের গায়ে পরপর পাঁচটা কাঁটাতারের উঁচু বেড়া। সামনে মুক্তি বয়ে চলেছে। গেটের সামনে গাড়ি রেখে নামতে ইশারা করলেন হরিপদ বক্সী। মাটিতে পা দিয়ে অর্জুনের নজর গেল বাংলোর ওপাশে একটা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে দু’জন মেকানিক কাজ করছে। সে অনুমান করল এইটে সেই গাড়ি যার খোঁজ করছিলেন জলপাইগুড়ির থানার বড়বাবু। একটি নেপালি যুবক এগিয়ে এল সামনে। এসে হরিবদ বক্সীকে সেলাম জানাল।

সাহেব কোথায়?

আইয়ে। যুবকটি বাংলোর দিকে ঘুরল।

প্রাণকুমার পাণ্ডের বয়স বোঝা প্রায় অসম্ভব। লম্বা, পেটানো শরীর, মুখে মঙ্গোলিয়ান ধাঁচ। চুলের ছাঁটে যত্ন আছে। দোতলার প্রথম ঘরে বসেছিলেন। ওদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন, আসুন আসুন বক্সীসাহেব। কী সৌভাগ্য আমার, বসুন।

এরকম বলছেন কেন? একটু লজ্জা পেলেন হরিপদ বক্সী।

দেখুন আমি হয় সত্যি বলি নয় মিথ্যে। অর্ধসত্য বা অর্ধমিথ্যা বলি না। বলেই তিনি অর্জুনের দিকে তাকালেন, ছোটভাই?

হরিপদ বক্সী বললেন, আমার কাকার ছেলে।

বাঃ! কী নাম?

শ্যামাপদ বক্সী। অর্জুন বলল।

বাড়ি?

বর্ধমান?

ওপর দিয়ে গিয়েছি অনেকবার, থাকিনি কখনও। হ্যাঁ, কী ব্যাপার ভাই?

আমরা কয়েকজন দার্জিলিং-এর পাহাড়ের সেইসব অঞ্চলে যেতে চাই যেখানে সাধারণ ট্যুরিস্টরা যায় না। আর তারা যেখানে যায় না সেইসব জায়গা সম্পর্কে ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট কিছুই জানে না। অর্জুন বলল।

ও আমাকে এই কথাটা বললে আমার মনে পড়ল আপনার কথা। হরিপদ বক্সী বললেন, তখনই জানতে পারলাম আপনি এখানে আছেন।

হুঁ। কিন্তু ভাই, সেসব জায়গায় তো গাড়ির রুট নেই। বাস দূরের কথা, ট্যাক্সিও যেতে পারবে না। ট্রেকিং-এর অভ্যেস না থাকলে যেতে পারবেন না। কথাগুলো বলতে বলতে একটা সোনালি কৌটো খুলে একটা লবঙ্গ তুলে মুখে পুরলেন প্রাণকুমার পাণ্ডে। তারপর বললেন, আপনাদের জন্যে চা বলি?

অনেক ধন্যবাদ, একটু আগেই চা খেয়েছি। হরিপদ বক্সী জানালেন।

আমার ট্রেকিং-এর অভিজ্ঞতা সমতলে আছে। তবে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে একবার উঠেছি।

কোন দিকটায় যেতে চান?

যেদিকে গেলে কাঞ্চনজঙ্ঘা আরও স্পষ্ট দেখা যায়।

তা হলে তো আপনাদের সান্দাকফু যেতে হয়।

ওখানে তো ট্যুরিস্টদের খুব ভিড়।

তা অবশ্য। এখন তো ফালুট পর্যন্ত ট্যুরিস্টরা চলে যাচ্ছে।

সেজন্যেই আপনার কাছে এসেছি। খুব নরম গলায় বলল অর্জুন।

তা হলে–। চোখ বন্ধ করলেন প্রাণকুমার পাণ্ডে। তারপর বললেন, ঘুম থেকে সুখিয়াপোখরি হয়ে মানেভঞ্জন আপনাদের যেতেই হবে। ওই অবধি আপনারা মিনিবাস বা ট্যাক্সি পাবেন। ওখান থেকে একটা পথ টংলু হয়ে সান্দাকফু চলে গিয়েছে। আপনারা সেই পথ ধরবেন না। দ্বিতীয় পথটা যেটা সুরভঞ্জন হয়ে রিয়াচক ভ্যালিতে গিয়েছে সেই দিকে যাবেন। রিয়াচক ভ্যালিতে পৌঁছাতে ওয়েদার ভাল থাকলে তিনদিন লাগবে। তার বেশি যাওয়ার দরকার নেই। প্রাণকুমার পাণ্ডে বললেন।

ওখানে ঠান্ডা কেমন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

তিন-চারের মধ্যে। তবে রাত্রে জিরোতে নেমে যায়। ঠান্ডার চেয়ে সমস্যা হয় ঝড়বৃষ্টির জন্যে। তৈরি হয়ে না গেলে বিপদে পড়বেন।

কোন সময়ে গেলে সুবিধে হয়? হরিপদ বক্সী প্রশ্নটা করলেন।

আই উইল সাজেস্ট এপ্রিল-মে। ওয়েল, এবার যে আমাকে উঠতে হবে।

হরিপদ বক্সী বললেন, এভাবে হেঁটে পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখার কী আনন্দ তা এরাই জানে। আপনি কি তখন ওদিকে থাকবেন?

এত আগে থেকে কী করে বলব? এই দেখুন, আজ আমাকে যে নেপালে যেতে হবে তা দু’দিন আগেও জানতাম না।

বিদায় নিয়ে ওরা বেরিয়ে এল। গেটের কাছে পৌঁছানো মাত্র শুনতে পেল প্রচণ্ড চিৎকার করে বকাবকি করছেন প্রাণকুমার পাণ্ডে। মেকানিক দুটো তটস্থ হয়ে একটা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছে। গাড়ি স্টার্ট করে হরিপদ বক্সী বললেন, যার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বললাম আর যে এখন চেঁচাচ্ছিল তার মধ্যে কোনও মিল দেখতে পেলেন?

অর্জুন মাথা নাড়ল, মুখোশ পরেছিলেন, পান থেকে চুন খসলেই খুলে ফেললেন।

তা হলে এপ্রিল-মে মাসে ওদিকে যাচ্ছেন?

না। অতদিন অপেক্ষা করলে যাওয়ার দরকার হবে না। অর্জুন বলল।

*

জলপাইগুড়িতে ফিরে নবগ্রন্থ কুটিরের জীবনদার কাছে গিয়ে দার্জিলিং জেলার অনেকগুলো ম্যাপ ছাপা বই কিনল অর্জুন। জীবনদা জিজ্ঞাসা করল, ওদিকে কোনও রহস্যের সন্ধানে যাওয়া হচ্ছে নাকি?

অর্জুন মাথা নাড়ল, পাশের জেলা সম্পর্কে একটু ওয়াকিবহাল হতে চাই।

থার্টি পার্সেন্ট লেস দাও। তোমার কাছ থেকে প্রফিট নেব না।

থ্যাঙ্ক ইউ।

অমল সোমের বাড়িতে গেট খুলে ঢোকামাত্র প্রচণ্ড চিৎকার কানে এল। অর্জুনের। ওটা যে মেজরের গলা তাতে সন্দেহ নেই। সে বারান্দায় পা। দেওয়ামাত্র হাবু দৌড়ে বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। ইশারায় কিছু বোঝাতে চাইল।

ঘর পেরিয়ে উঠোনে পা দিয়ে দৃশ্যটা দেখে হেসে ফেলল অর্জুন। বকফুলের গাছের নীচে মেজর দাঁড়িয়ে অনর্গল বকে যাচ্ছে, ওরে পাজির পা ঝাড়া, ওরে মাতৃজাতির কলঙ্ক, তুই মা হয়েছিস না ছাই হয়েছিস, ছ্যা ছ্যা ছ্যা। অর্জুন দেখল আশপাশের গাছের ডালে গোটাআটেক হনুমান বসে মেজরের দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে আছে। সে ডাকতেই মেজর ঘুরে পঁড়ালেন এবং তখন অর্জুন দেখতে পেল ওঁর হাতে সস্নেহে ধরা রয়েছে। একটি হনুমান-শিশু। প্যাট প্যাট করে সেটা মেজরকে দেখছে। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ওটাকে কী করে ধরলেন?

ধরলাম? আমি ধরেছি নাকি? ওর মা এত অপদার্থ যে বাচ্চাকে প্রোটেকশন দিতেই জানে না। এমন জোরে এই ডাল থেকে ওই ডালে লাফাল, বুঝতেই পারল না বাচ্চাটা পড়ে গেছে পিঠ থেকে। ভাগ্যিস এখানে নরম বালির স্তূপ ছিল নইলে কী হত ভাবো তো। হবেই না কেন, এরা তো মঙ্গোলিয়ান হনুমান। মেজর বলল।

হেসে ফেলল অর্জুন। কী করে বুঝলেন?

নাক দেখো, চেপটে বসে গেছে, চোখ যেন চেরা বাতাসা।

ওটাকে নীচে নামিয়ে সরে আসুন, ওর মা নিয়ে যাবে।

বলছ? কিন্তু আমার যে এর মধ্যে বেশ মায়া পড়ে গেছে! নাঃ। সত্যি কথাই, আমি কার কে আমার? বলে শিশু হনুমানকে বালির ওপর নামিয়ে মেজর সরে আসতেই মা হনুমান বিদ্যুতের বেগে নীচে নেমে সন্তানকে নিয়ে চলে গেল ওপরে।

মেজরের সঙ্গে আলোচনায় বসল অর্জুন। জন এবং তার মেয়ে ক্রিশ্চিনাকে খুঁজে বের করতে হবে। মেজর একটি বই বের করলেন। নিউইয়র্কে ছাপা। অতদূরে থেকেও ওখানে ভারতের পূর্বাঞ্চল নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা হয়েছে। দার্জিলিং জেলা চ্যাপ্টার বের করে মেজর বললেন, তুমি যদি কিছু বুঝে থাকো তা হলে সেটা তোমার কাছ থেকে জেনে নিতে চাই।

ম্যাপটা বের করলেন মেজর। অর্জুন কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে আঙুল রাখল, প্রথমে আমাদের যেতে হবে শিলিগুড়িতে। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে শুকনা, তিনধারিয়া হয়ে সোজা কার্শিয়াং শহরে। ওখানে যাওয়ার আর একটা রাস্তা আছে পাঙ্খবাড়ি দিয়ে। কিন্তু যতদূর জানি ওই রাস্তা পাহাড় থেকে নামার সময় ব্যবহার করা হয়।

শিলিগুড়ি গেলে কার্শিয়াং-এ যেতে কত সময় লাগে? মেজর জানতে চাইলেন।

আড়াই ঘণ্টার বেশি লাগা উচিত নয়।

ধরো আমরা সকাল দশটায় শিলিগুড়ি ছাড়লে কার্শিয়াঙে পৌঁছাব ঠিক দুপুর সাড়ে বারোটায়। আধ ঘন্টার জন্যে লাঞ্চ ব্রেক। একটায় রওনা হব আবার।

হ্যাঁ, ছটার মধ্যে ঘুমে পৌঁছে যাওয়া উচিত। এই দেখুন, ঘুম থেকে একটা পথ চলে গিয়েছে দার্জিলিং-এর দিকে, আর একটা গিয়েছে সুখিয়াপোখরি, মানেভঞ্জনের দিকে। আমাদের ওই দ্বিতীয় পথটায় যেতে হবে।

গুড। ম্যাপ দেখে মানেভঞ্জনের ওপর হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, সন্ধের মধ্যে কি আমরা এখানে পৌঁছাতে পারব?

পারব। কিন্তু সরাসরি ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না।

হোয়াই? মেজরের চোখ বড় হয়ে গেল।

মানেভঞ্জন থেকে টংলু হয়ে সান্দাকফু গেলে কোনও সরকারি অনুমতির দরকার হয় না। কিন্তু আমরা যে রাস্তায় যাচ্ছি, আপনি যেদিকে জন ও তার মেয়ে গিয়েছে বলে সন্দেহ করছেন সেদিকে যেতে হলে যদি সরকারি অনুমতির দরকার হয় তা হলে সেটা দার্জিলিং শহর থেকেই নিতে হবে। তা । ছাড়া ওই পথ তো সমতল নয়, চড়াই উতরাই ভাঙতে হবে, পাহাড়ে উঠতে হবে, খানিকটা গেলে বরফ না পেলেও তুষার পেতে পারেন। তা ছাড়া ঠান্ডা রাত নামলেই জিরো ডিগ্রির কাছে চলে যায়। এ ছাড়া বৃষ্টি এবং ঝড় তো আছেই। এগুলোর সঙ্গে লড়াই করার সরঞ্জাম না নিয়ে তো যাওয়া যাবে না। দার্জিলিং-এর যেসব সংস্থা পর্বত আরোহীদের সবরকম সরঞ্জাম ভাড়া দিয়ে সাহায্য করে তাদের কাছে যেতে হবে আমাদের।

এই রুটে কোনও গেস্ট হাউস বা সরকারি বাংলো নেই?

না। ওসব আছে সান্দাকফু বা টংলুতে। ফালুটেও আছে। ওদিকে ট্যুরিস্টরা বেশি যায় বলেই করা হয়েছে।

কিন্তু ওসব সরঞ্জাম বইবে কে? আমি অবশ্য পঞ্চাশ কেজি অনায়াসে বইতে পারি। ইন দি ইয়ার নাইনটিন সেভেনটি এইট–’হঠাৎ থেমে গেলেন মেজর, থাক সেকথা, কিন্তু তুমি তো বিশ কেজি জিনিস নিয়ে চল্লিশ পা হাঁটতে পারবে না।

আমাদের যা বোঝা হবে তা বইবার জন্যে মালবাহক ভাড়া করতে হবে। আপনি বলেছেন টাকার কোনও অভাব হবে না!

নো, নো প্রবলেম। মেজর মাথা নাড়লেন।

তা হলে আমরা দার্জিলিং-এর কাজ শেষ করে ঘুম হয়ে মানেভঞ্জন যাব?

ঠিক হ্যায়। লেটস স্টার্ট টুমরো। মেজর চেঁচিয়ে বললেন।

দার্জিলিং-এ পৌঁছেছিল ভরদুপুরে। প্ল্যান্টার্স ক্লাবে উঠেছিল ওরা। গত রাত্রে সুভাষিণী চা-বাগানের ম্যানেজার অন্বিন্দু রায়কে ফোনে অর্জুন অনুরোধ করেছিল ওখানে দুটো ঘরের ব্যবস্থা রাখতে। অন্বিন্দু কথা রেখেছিলেন।

প্রথমে ওরা গিয়েছিল পুলিশের বড়কর্তার অফিসে। মেজর নিজের পরিচয় দিয়ে ওদিকে যাওয়ার উদ্দেশ্য তাকে জানাতে ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, আমার কাছেও নির্দেশ এসেছিল। কিন্তু আমরা দু’জন বিদেশিকে খুঁজে পাইনি। তবে মানেভঞ্জন থেকে জানা গেছে একজন আমেরিকান এবং তার মেয়ে দু’জন মালবাহককে ভাড়া করে রিয়াচক ভ্যালির দিকে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে ওঁরা আমাদের কোনও অনুমতি নেননি। ট্যুরিস্ট স্পট ছাড়া বিদেশিদের ওই অঞ্চলে যাওয়া নিষেধ। তবু গিয়েছেন, কয়েকদিন পরে মালবাহকরা ফিরে এসেছিল। আমেরিকান ভদ্রলোকের মেয়ে নাকি তাদের সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করেছিলেন। ওরা নিখোঁজ হয়েছে জানার পর আমরা একটা সার্চপার্টি পাঠিয়েছিলাম কিন্তু তারা হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে।

অর্জুন এবার নিজের পরিচয় দিয়ে ভদ্রলোককে অনুরোধ করল জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপারকে ফোন করে তার সম্পর্কে যা জানার জেনে নিতে। ভদ্রলোক এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। কথা বলার পর রিসিভার রেখে হাসিমুখে হাত বাড়ালেন করমর্দনের জন্যে। বললেন, আপনি যে এত বিখ্যাত মানুষ ভাবতেই পারিনি, এত অল্পবয়সে কত সমস্যার সমাধান করেছেন। এসপি সাহেব খুব প্রশংসা করলেন। বলুন, কী করতে পারি?

কোথায় কোন সংস্থার কাছে গেলে তাবু, শীতবস্ত্র, জুতো থেকে শুরু করে পাহাড়ে ওঠার যাবতীয় উপকরণ ভাড়া পাওয়া যাবে জানিয়ে বড়কর্তা বললেন, আমি মানেভঞ্জনের থানায় ফোন করে দিচ্ছি। আপনারা ওখানে গিয়ে ওসির সঙ্গে দেখা করলে তিনি ভাল গেস্টারের ব্যবস্থা করে দেবেন। কবে যাবেন আপনারা?

কালই রওনা হতে চাই। অর্জুন বলল।

কোথায় উঠেছেন?

প্ল্যান্টার্স ক্লাবে।

আপনারা যেখান থেকে জিনিসপত্র নেবেন তাদের বলবেন আমাকে ফোন করতে। কাল সকাল নটায় আপনাদের আমি মানেভঞ্জনে পৌঁছে দেব?

কাজকর্ম শেষ করতে সন্ধে হয়ে গেল। মেজর বললেন, চলো, কোথাও গিয়ে কিছু খাওয়া যাক। পেটে ছুঁচো ডন মারছে?

লাডেনকা রোডে ছিল ওরা। অর্জুন মেজরকে নিয়ে এল ক্যাভেন্টার্স রেস্তোরাঁর ছাদে। সেখানে ছাতার তলায় চেয়ারে বলে, মেজর বললেন, ব্রাভো! দারুণ। এখান থেকে সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়?

জি! আপ উইন্টারমে আইয়ে, ফুল ভিউ মিল যায়েগা। বেয়ারা পাশ থেকে বলল।

আসতে হবে। ওঃ! পৃথিবীর কত সুন্দর জায়গা এখনও দেখা হল না! চিকেন স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে বললেন মেজর। তারপর চকো মিল্কশেক খেয়ে তো তিনি বিগলিত, এত ভাল শেক আমাদের ম্যাকডোনাল্ডও করতে পারে । অর্জুন বলল, ভাল করে খেয়ে নিন। কাল থেকে কী জুটবে কে জানে!

কেন? স্ম্যাশড প-টা-টো পেলেই আমার চলে যাবে।

সেটা কীরকম? বলেই খেয়াল হল অর্জুনের। হেসে ফেলল সে, বলুন, আলু সেদ্ধ।

খাওয়া যখন প্রায় শেষ তখন খুব স্মার্ট চেহারার একটি নেপালি যুবক সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাসল, আপনাদের সঙ্গে একটু দরকার ছিল, বসতে পারি?

অর্জুন দেখল ছেলেটির হাবভাব চেহারা ফিল্মস্টারের মতো, বয়স তিরিশের নীচে, মেজর বললেন, লুক ব্রাদার, আমরা ফিল্ম প্রোডিউস করি না। ওকে!

ছেলেটি বলল, আমি সেটা জানি। আপনারা অভিযাত্রী!

শুনে মেজর অর্জুনের দিকে তাকালেন, ইন্টারেস্টিং। কী বলো?

অর্জুন বলল, বসুন। চটপট যা বলার বলুন।

একজন পুলিশ অফিসারের কাছে জানতে পারলাম আপনারা আগামীকাল মানেভঞ্জনে যাচ্ছেন, সেখান থেকে সান্দাকফুতে না গিয়ে সুরভঞ্জনের দিকে যাবেন। আমার জিজ্ঞাস্য আপনারা কি এর আগে ওই দিকে গিয়েছেন? ছেলেটি বলল।

মেজর মাথা নাড়লেন, নো! যাইনি।

আপনাদের কি পাহাড়ে ওঠার ট্রেনিং আছে?

নো। নেই!

তা হলে বোধহয় যাওয়াটা ভুল হবে। ছেলেটি হাসল।

জীবনে অনেকবার ভুল যেমন করেছি তেমন সংশোধনও করে নিয়েছি, কিন্তু তোমার কী দায় পড়ল যে আমাদের সতর্ক করতে এসেছ?

একথা আপনি বলতেই পারেন। আমি নিজেও তাই দ্বিধায় ছিলাম, ভাবছিলাম কথাগুলো আপনারা ভালভাবে না নিতে পারেন। দেখুন, সুরভঞ্জন পর্যন্ত মোটামুটি ঠিক যাওয়া যায়। তারপরে রিয়াচক ভ্যালি পর্যন্ত রাস্তা খুব ভয়ংকর। কিন্তু সেটা ছাড়াও লোকে ওদিকে যেতে চায় না একটা বিশেষ কারণে। ছেলেটির গলার স্বর শেষের দিকে অন্যরকম শোনাল।

কারণটা জানানো সম্ভব? মেজর গম্ভীর হলেন।

অলৌকিক ব্যাপার ঘটে যায়। যারা ফিরে আসে তারা কোনও ব্যাখ্যাই দিতে পারে না। কিন্তু তারা ফেরে আহত হয়ে। ছেলেটি বলল।

অলৌকিক ব্যাপার? মেজর সোজা হলেন, ভূতপ্রেত আছে নাকি ওখানে?

আমি বিশ্বাস না করলেও আহত লোকগুলোকে বিশ্বাস করতে দেখেছি।

বাঃ! ওহে তৃতীয় পাণ্ডব, শুনেই আমার বেশ উত্তেজনা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল জায়গাটায় তো জনমানব না থাকার কথা, ঠান্ডাও বেশ জোরালো। অলৌকিক ব্যাপার যাঁরা ঘটান তাঁরা ওখানে থাকবেন কেন? তাদের তো মানুষ ছাড়া চলে না। কী নাম আপনার?

সুন্দর ছেত্রী।

ভাই সুন্দর, আমাদের ওখানে যেতেই হবে।

তা হলে আপনাদের সঙ্গে একজন ভালো গাইড থাকা দরকার? আপনারা যখন যাবেনই তখন আমি গাইডের কাজটা করতে পারি, আপনারা রিয়াচক পর্যন্ত যাবেন।

মেজর মাথা নাড়লেন, না, আরও এগোতে হবে।

পারবেন কি? তখন শুধু বরফ ছাড়া কিছু পাবেন না।

সেটা আমাদের সমস্যা।

ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। আপনাদের উপকার করতে চেয়েছিলাম। ওখানে এত ঝুঁকি নিয়ে কেন যাচ্ছেন জানতে পারি কি?

এতক্ষণ অর্জুন চুপচাপ বসে দু’জনের কথা শুনছিল। এবার বলল, আপনি কিছু শোনেননি?

না তো। সুন্দর মুখ ঘোরাল।

এখন স্যাটেলাইট সার্ভে করে যেসব তথ্য দেয় তা আগে মানুষ জানতে পারত না। ওরকম একটা সার্ভে থেকে বিজ্ঞানীরা কিছু তথ্য জানতে পেরেছেন। সেটা কতটা সত্যি তা জানতে চাইছি আমরা। সত্যি হলে এই অঞ্চল তো বটেই গোটা ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক চেহারা রাতারাতি বদলে যাবে। অর্জুন বলল।

তথ্যটা জানতে পারি স্যার?

আমাদের ওপর কড়া নিষেধ আছে বলে জানাতে পারছি না। শুধু বলছি আপনি যেখানে প্রচুর বরফ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না বলছেন সেটা ঠিক নয়। রাত্রে আকাশে মেঘ জমলে তার পেছনে সূর্য থাকে না কিন্তু দিনের বেলায় আকাশ যতই মেঘে ঢাকা থাক তার পেছনে সূর্য থাকবেই। ঠিক আছে, আপনার সাহায্য লাগলে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করব। কার্ড আছে? অর্জুন হাত বাড়াল।

সুন্দর পার্স খুলে একটা কার্ড বের করে এগিয়ে দিয়ে নীচে নেমে গেল।

অর্জুন কার্ডে চোখ রাখল, সুন্দর ছেত্রী, হিল গাইড, অ্যাটাচড উইথ পি কে পি কোম্পানি। কোনও ঠিকানা নেই কিন্তু দুটো মোবাইল নাম্বার দেওয়া। আছে। মেজর বললেন, লোকটা সন্দেহজনক।

কী করে বুঝলেন?

আমাকে তুমি কী ভাবো বলো তো? এই কয়বছরে গোয়েন্দাগিরির ওপর প্রচুর পড়াশুনা করেছি। তদন্তে নেমে মনে করতে হবে, কেউ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। মাঝে মাঝে আমি তো নিজেকেই বিশ্বাস করি না। বেয়ারা। শেষ শব্দটা চেঁচিয়ে বললেন তিনি। বেয়ারা ছুটে এল খাবারের বিল নিয়ে।

*

গাড়িটা পুলিশের নয়। বেশ বড় গাড়ির অনেকটাই মালপত্রে বোঝাই হয়ে গিয়েছিল। বেশ সস্তায় পাওয়া গিয়েছে পাহাড়ের থাকার উপযোগী জিনিসপত্র। ঘুম থেকে সুখিয়াপোখরির পথ ধরেছিল ড্রাইভার। ম্যাপ অনুযায়ী রামাম, রিম্বিক ছাড়িয়ে ওরা যখন মানেভঞ্জনে পৌঁছাল তখন দুপুর। ড্রাইভার ওদের সরাসরি সরকারি গেস্টহাউসের সামনে নিয়ে গেল। অর্জুন খোঁজ নিয়ে জানল এটা পুলিশের বড়কর্তাই ঠিক করে দিয়েছেন। ঘর বাথরুম দেখে মেজরের মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বললেন, এখানে সময় নষ্ট না করে চলো রওনা হওয়া যাক।

অর্জুন বলল, কষ্ট করে একটা রাত থাকুন এখানে। লোকজন ভাড়া করতে হবে। দেখতে হবে তারা কতটা দক্ষ। তা ছাড়া এখান থেকেই বাজারহাট করে নিয়ে যেতে হবে। বিকেলে বাজার খুলবে। সবকিছু শেষ করে সাতসকালে বের হব আমরা।

বিকেলের মধ্যে পূরণ বাহাদুরকে পাওয়া গেল। সে নিজেই তার দল তৈরি করে নিল। এই ব্যাপারে মানেভঞ্জনের ওসি সাহায্য করলেন। বিকেলে পূরণ বাহাদুররা বাজার করে নিয়ে এল। প্রচুর পরিমাণে আলু, পেঁয়াজ, শিম, বাঁধাকপি ছাড়া স্কোয়াশ কিনেছে অনেক। এরপর ডিম, তেল, মশলা তো রয়েছেই। পূরণ বাহাদুর জিজ্ঞাসা করেছিল, কতদিনের জন্যে যাওয়া হচ্ছে।

অর্জুন বলেছিল, আমরা দু’জন মানুষকে খুঁজতে যাচ্ছি। যতদিন না তাদের পাব ওখানে থাকতে হবে। পেলেই চলে আসব। তবু তিন সপ্তাহ ধরতে পারো।

চা-কফি-বিস্কুট ছাড়াও কিছু চকোলেট আর শুকনো ফল নেওয়া হল। সেইসঙ্গে পূরণ বাহাদুরের পরামর্শে থালাবাসন গ্লাস ছাড়া কয়েকটা ভোজালি নেওয়া হল। অর্জুন হিসেব রাখছিল। টাকার ব্যাপারে একটুও কার্পণ্য করলেন না মেজর। দার্জিলিং থেকে ইমার্জেন্সি লাইট ছাড়াও সূর্যশক্তিতে চলে এমন আলো আনা হয়েছিল। সন্ধ্যার আগে পূরণ বাহাদুর খবর দিল একটি অভিযাত্রী দল দুর্ঘটনার কারণে অভিযান বন্ধ করে একটু আগে মানেভঞ্জনে ফিরে এসেছে। তাদের কাছে প্রচুর টিনফুড, বিশেষ করে টিনের কৌটোয় সিল করা মাছ এবং মাংস রয়েছে। ওরা যেহেতু দেশে ফিরে যাচ্ছে তাই বিক্রি করে দিতে চাইছে। সাহেবরা চাইলে সস্তায় কেনা যেতে পারে। মেজর খুব খুশি হয়ে সম্মতি দিলেন। বললেন, ওগুলো থাকলে আমার স্ম্যাশড পটাটোর দরকার হবে না।

এখানে ভোর হয় সকাল সাড়ে ছ’টায়। ঠিক হল ভোর হলেই বেরিয়ে পড়বে সবাই। মালবাহকরা সবকিছু বহনযোগ্য করে নিল। রাত নটার মধ্যে চিকেন মোমো আর হরলিক্স খেয়ে যে যার ঘরে চলে গেল শোওয়ার জন্যে। বিছানায় শুয়ে সবকিছু ভাল করে ভেবে নিল অর্জুন। এখন অবধি সব ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু জন ও তাঁর মেয়ে ক্রিশ্চিনা ঠিক কোথা থেকে হারিয়ে গিয়েছেন তা মেজর বলতে পারছেন না। তিনি ম্যাপে যে জায়গাটা দেখিয়েছেন সেটা রিয়াচক ভ্যালির শেষ অংশ। এর চেয়ে খড়ের গাদায় লুকিয়ে থাকা উঁচ খোঁজা ঢের সহজ ব্যাপার। এখন পর্যন্ত তিনি ওদের ছবিও দেখাননি। অবশ্য ওই জনমানবহীন তুষারের পাহাড়ে সাদা চামড়ায় বয়স্ক পুরুষ আর অল্পবয়সি মেয়ে থাকলে তারা জন এবং ক্রিশ্চিনা হবেনই।

ঠিক তখনই সুন্দরের কথা মনে এল। লোকটা তাদের ভূতের ভয় দেখিয়ে গাইডের চাকরি চেয়েছিল। টাকা রোজগার করতে মানুষকে কত মিথ্যে বলতে হয়। হঠাৎ মাথায় অস্পষ্ট ভাবনা আসতেই সে বিছানা থেকে নেমে সুন্দর ছেত্রীর দেওয়া কার্ডটা বের করল। সুন্দর ছেত্রী, হিলগাইড। কোনও একটি পি কে পি কোম্পানির সঙ্গে সে যুক্ত। পুরো নাম লেখেনি, পি কে পি নিশ্চয়ই টাটা বিড়লা রিলায়েন্সের মতো বড় কোম্পানি নয়, তা হলে লেখেনি কেন? ঠিকানাও নেই, আবার শুয়ে পড়তেই ওর মাথায় এল পি কে পি মানে প্রাণকুমার পাণ্ডে নয় তো? শিরশিরে অস্বস্তি শুরু হল অর্জুনের, অনেকক্ষণ ঘুম এল না।

দরজায় প্রবল আওয়াজ হতে ঘুম ভেঙে গেল অর্জুনের। কিছুক্ষণ হকচকিয়ে থাকার পর মনে হল যেন মেজরের গলা শুনতে পাচ্ছে। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলতে মেজর দুদ্দাড় করে ভেতরে ঢুকলেন, নো, নেভার। ওই ঘরে আমি থাকব না।

কী হয়েছে? অর্জুন দেখল রাতপোশাকের ওপর শীতবস্ত্র পরেননি মেজর।

আমি তোমাকে বলেছিলাম হোটেলটা যাচ্ছেতাই। শ্যাবি। তুমি বললে একটা রাত কোনওভাবে কাটিয়ে দিন। কিন্তু ঘরে সাপ ঘুরলে কী করে কাটাব?

সাপ? আপনার ঘরে?

ইয়েস। মাই সন। একটা পাঁচ ফুট লম্বা কালো সাপ।

আপনি নিজের চোখে দেখেছেন?

দেখো মেজাজ আরও খারাপ করে দিয়ো না। মাঝরাত্রে আমি কি ইয়ারকি মারছি?

অর্জুন করিডরে গিয়ে চারপাশে তাকাল। ফ্যাকাশে আলো জ্বলছে? এই ঠান্ডায় মধ্যরাত্রে মেজরের হাঁকাহাঁকির আওয়াজেও কারও ঘুম ভাঙেনি। সে আবার ঘরে ঢুকে একটা টর্চ আর পরদাটাঙানো লাঠি খুলে নিয়ে মেজরের ঘরে গেল। মেজর বললেন, তোমার কীভাবে সাপ মারার অভিজ্ঞতা আছে?

না।

তা হলে চেষ্টা কোরো না।

ততক্ষণ অর্জুন ঘরের ভেতর টর্চের আলো ফেলেছে। মেঝেতে, খাটের নীচে কোনও সাপ নেই। এইসময় করিডর থেকে গলা ভেসে এল। ক্যা হুয়া সাব?

মেজর মুখ ফিরিয়ে ম্যানেজারকে দেখতে পেয়ে খিঁচিয়ে উঠলেন, ক্যা হুয়া? হোটেলমে সাপ ঘুমতা হ্যায় তুম নেহি জানতা?

ও। ঠিক হ্যায়। ছোড় দিজিয়ে। আপকো দোসরা কামরা দেতা হ্যায়।

ঠিক তখনই অর্জুন সাপটাকে দেখতে পেল, ওপাশের আধখোলা জানলা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে কুচকুচে কালো শরীরটা। সে দ্রুত ছুটে গেল আঘাত করতে কিন্তু ম্যানেজার চিৎকার করল, মৎ মারিয়ে সাব। মৎ মারিয়ে।

অর্জুন অবাক হয়ে পেছনে তাকাতেই সাপটা অদৃশ্য হয়ে গেল। সে ম্যানেজারকে বলল, কেন মারতে নিষেধ করলে?

ইয়ে বাস্তু সাপ হ্যায়। ইসকো মারনা নিষেধ হ্যায়।

ও কামড়ালে এতক্ষণে আমি ডেডবডি হয়ে যেতাম। মেজর বললেন, না। আজ পর্যন্ত ও কাউকে কামড়ায়নি। এবার বাংলায় বলল ম্যানেজার।

ও। তোমার সাপ ঘরে এসে খেলা করে কিন্তু কামড়ায় না?

না সাব। ও আজ পর্যন্ত কখনও ঘরে আসেনি।

তা হলে আজ এল কেন?

আপনি বোধহয় জানলা খুলে রেখেছিলেন।

হ্যাঁ। একটু খোলা না রাখলে দমবন্ধ হয়ে যায়।

ও বোধহয় ভেবেছিল এই ঘরে খাবার পাওয়া যাবে। কিন্তু–।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, বাকিটা বলো।

এখন মনে হচ্ছে ওটা বাস্তু সাপ নাও হতে পারে।

তার মানে এখানে আরও সাপ আছে। সর্বনাশ! মেজর চেঁচালেন।

না সাব। নেই। তবে এটার লেজের দিকে হলদে দাগ নেই। বাস্তুসাপের পুরোটা কালো হলেও লেজে হলদে দাগ থাকে।

অর্জুনের দিকে তাকালেন মেজর, আমি এই হোটেলে থাকব না।

এত রাত্রে আর কোনও হোটেল ভোলা পাবেন না। আমি আপনাকে ভাল ঘর দিচ্ছি, দরজা জানলায় কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দিলে কোনও ভয় নেই। আসুন আমার সঙ্গে’, ম্যানেজার ওপাশে এগিয়ে গেল।

নতুন ঘরে মেজরকে নিয়ে গেল অর্জুন। তার জিনিসপত্র নিয়ে আসা হল। কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দিয়ে ক্ষমা চেয়ে ম্যানেজার বিদায় নিলে অর্জুন বলল, আজ আর জানলা খুলবেন না।

মাথা খারাপ। সাপের কামড়ে মরার চেয়ে দমবন্ধ হয়ে মরা ঢের ভাল। মেজর বললেন, কিন্তু সাপটা নিজে থেকেই এসেছে নাকি কেউ ছুঁড়ে দিয়েছে?

কল্পনা করে কোনও লাভ নেই। দরজা বন্ধ করে দিন। অর্জুন বেরিয়ে গেলে মেজর দরজা বন্ধ করার আগে বললেন, আমাকে সাপ দেখাচ্ছে। কত সাপ দেখেছি!’ নিজের ঘরে ফিরে যেতে অর্জুন হাসল, অভিযানে বেরিয়ে দ্বিতীয় রাতে মেজর সাপ দেখে ভয় পেয়েছেন, ভাগ্যিস ভূত দেখেননি।

*

বাকি রাতটা নির্বিঘ্নে কেটে গেল। প্রচণ্ড শীতে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর শুয়েও কম্বল টেনে নিয়েছিল অর্জুন। তার তাপে ঘুমটা গাঢ় হয়েছিল। পূরণ বাহাদুরের ডাকে ঘুম ভাঙতেই মেজরের নাক ডাকার আওয়াজ কানে এল। পূরণ বাহাদুর বলল, সাব, চা–!

অর্জুন দেখল একটা কেটলি আর দুটো গ্লাস হাতে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। অর্জুন স্লিপিং ব্যাগ থেকে বের হতেই কেঁপে উঠল, তাড়াতাড়ি কম্বলটা শরীরে জড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ক’টা বাজে?

সাড়ে ছয়, আমাদের আর এক ঘণ্টার মধ্যে রওনা হওয়া উচিত।

ঠিক আছে। তুমি ওই বাক্সের ওপর চা রেখে দাও। আমরা তৈরি হচ্ছি।

পূরণ বাহাদুর বেরিয়ে যেতে মেজরকে তুলতে একটু সময় লাগল। বাসিমুখে চা খেয়ে নিয়ে মেজর বললেন, যাই, কাজটা শেষ করে আসি।

কী কাজ?

শরীরের ওজন কমানো, মুখ ব্রাশ করা তো বাদ দেওয়া যাবে না।

প্রথমটা কোথায় করবেন?

কেন? চারপাশে নির্জন প্রান্তর। একটু আড়াল বেছে নিলেই হল।

অর্জুন হেসে ফেলল, এককালে গ্রামের মানুষ এই কাজের জন্যে মাঠে যেত। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ওই ব্যাপারে অভ্যস্ত।

অফ কোর্স, নিউ ইয়র্কের ফ্ল্যাটে আমার টয়লেটে ঢুকলে তোমার মনে হবে ওবামাও এত ভাল টয়লেট ব্যবহার করেন না। কিন্তু সেই আমি পৃথিবীর নানান জঙ্গল, পাহাড়, গ্লেসিয়ারে যখন থাকি তখন একটুও অসুবিধে বোধ করি না।

দয়া করে বলবেন না নাইনটিন এইট্টি ওয়ানে নর্থ পোলে—।

মাই গড! তুমি জানলে কী করে? সেবার সবে বরফের খাঁজে বসেছি এমন সময় একটা স্নোবিয়ার ঠিক পেছনে গর্জন করে উঠল।

স্নোবিয়ার?

ইয়েস মাই বয়, মেরুর ভালুক ডেঞ্জারাস অ্যানিম্যাল।