৩. চিরদিনের নিয়মে

চিরদিনের নিয়মে মাঝে মাঝেই ব্যতিক্রম ঘটছে আজকাল। রত্নাকর চৌধুরীর প্রাতঃভ্রমণের সময় সবদিন ঠিকমতো গিয়ে দাঁড়ায় না শিলাকর।

যেন গেলেও হয়, না গেলেও হয়।

তার মানে ভিতরের ভাল ভাবগুলো চলে যাচ্ছে। তা নইলে আগে, অলকা যখন মাথা খুঁড়েছে, তখন তো একদিনের জন্যে নড়চড় হতে দেখা যায়নি?

বাপের উপর সেই যে ভয়ানক একটা ভক্তি ছিল, যার জন্যে অলকার রাগই হত, সেটাতে যেন ঘুণ ধরেছে। তার মানে ভক্তিটা অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে। মনের মধ্যে শান্তিও নেই তাই।

এই তো গতকাল রাত্রে?

মাঝরাত্রে উঠে জানলায় দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। কেন? ঘুম নেই কেন? এ সব তো ছিল না!

সকালে যখন অলকা বলল, মায়ের দিকে ভোগের প্রসাদ খাবে, না বাবার দিকে বাবুর্চিখানায় খাবে–তখন বলল কি না–যা হয় খেলেই হল।

অথচ আগে? অন্য বারে?

বলেছে, আমি শ্যাম কুল দুদিক রাখতে চাই। সকালে মায়ের ঘরে ভোগের খিচুড়ি, রাত্রে বাবার ঘরে মুরগির ঝোল। তারপর হেসে হেসে কত বলেছে, আচ্ছা আমাদের ঐশ্বর্যটা ভাবো! মা বৈষ্ণব, বাবা শাক্ত! মা তুলসী কাঠের ভক্ত, বাবা হাড়িকাঠের ভক্ত! মায়ের ঘরে হরি হরি,বাবার দিকে কালী করালী! ভাবো তো, কত ভাগ্যবান আমরা!

কথার জন্যেই কথা, আহ্লাদের জন্যেই আহ্লাদ!

আর কিছুই না।

এই যে আগে আগে, বিশেষ করে হিমাকর মারা যাবার পর থেকে, সত্যভামার ঠাকুরঘরে উঠে গিয়ে কত কথা বলেছে শিলাকর। ঠাকুর ননী চুরি করে খেয়েছেন কিনা, ঠাকুর নূপুর হারিয়ে ফেলেছেন কিনা, ঠাকুর নাড়ু ছোট দেখে রাগারাগি করেছেন কিনা, ইত্যাদি মজার মজার ঠাট্টা। কোথায় সে সব?

ইদানীং ওই কালসাপটাকে ফিরিয়ে আনার পর থেকে সব ঘুচেছে। কথার মধ্যে কথা ওই পাজিটার কথা।

ওঁকে এই অপমানের মধ্যে রাখা নিজেদেরই অপমান, ওঁকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার কোনও অধিকার নেই কারও, ওঁর ভদ্রতা আর সভ্যতার সুযোগে খুব হীনতা করা হচ্ছে–এই সব।

উনি!

উনি সভ্য, উনি ভদ্র।

বিধবা মেয়েমানুষ কুলে কলঙ্ক দিয়ে একটা ভাবের লোকের সঙ্গে লুকিয়ে পালিয়ে গিয়েও সে সভ্য, সে ভদ্র!

আর অসভ্য অভদ্র কে?

না, অলকারা!

 সত্যভামা আর অলকাকে এক দলে ফেলে বিচার করছে শিলাকর।

অলকা যে কী শাসনের নীচে, কী অসম্মানের মধ্যে আছে, তা তো কই নজরে পড়ে না? অলকা অবশ্য পাছে সেটা অন্যের নজরে পড়ে, তাই বেশি করে সত্যভামার আনুগত্য দেখায়, বেশি করে মনোরঞ্জন করে তাঁর। কিন্তু ভিতরটা খাক হয়ে যায় না? তবু কখনও বলেনি বরকে।

মনে করত পুরুষমানুষ ও সবের কী বুঝবে? রাজা জমিদারের রক্ত, ছোট কথা কানে নেবে কি? বুঝলে বুঝত, বোঝে না।

কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে, বেশ বোঝে।

মা তাঁর বিধবা বউকে কীভাবে রেখেছেন তা তুমি বুঝতে পারছ, আর সধবা যে বউটা তোমার মার ইচ্ছের জাঁতার তলায় পেষাই হচ্ছে? তার কথা ভেবেছ কোনওদিন? তার দুঃখ বুঝেছ?

ভাবতে পারে না আর অলকা।

ভাবতে গেলেও উছলে কান্না আসে।

মরবে সে!

নিশ্চয় মরবে।

ওই নিষ্ঠুর চরিত্রহীন লোকটাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাবে। শুধু সত্যভামার এই উৎসবটা হয়ে যাক। এখন তো মরবারও অবকাশ নেই, যাবতীয় তদারকির ভার অলকার উপর। তিন চার শো লোক খাবে, যাত্রা কীর্তনের দল তিনদিন ধরে থাকবে, গুরু আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা থাকবেন। কতদিকে কত ব্যবস্থা!

ঝি চাকর আছে সত্যি, আশ্রিতারাও আছেন। হাতে পায়ে ভারী কাজ করতে হয় না। কিন্তু ব্যবস্থাপনায়? সেখানে ত্রুটিমাত্র হলে?

সে তো ভাবাই যায় না।

তা ছাড়া একটু অপচয় হলে?

একটু বাড়তি খরচ হলে?

কোনও কিছু চুরি হলে?

 কে দায়ী?

এই অলকাই তো?

মরে দেখিয়ে দিয়ে যেতে হবে সবাইকেই।

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেলে অলকা। না মরলে তো বুঝতে পারবে না কেউ, কত দামি ছিল মানুষটা!

মরার চিন্তাই প্রবল হয় অলকার। শুধু এখন মরবার সময় নেই, তাই স্থগিত রাখতে হচ্ছে।

গতকাল রাত্রে বরের সঙ্গে কথা কাটাকাটির স্মৃতিতে মন আরও ভারাক্রান্ত। কথা কাটাকাটির কারণটাই যে যন্ত্রণার। প্রসঙ্গ ওই ছোট বউ!

অলকা বলেছিল, ভেবে পাচ্ছি না–লজ্জা বস্তুটা তোমার মধ্যে থেকে একেবারে চলে গেল কী করে?

শিলাকর তথাপি কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে বলেছিল, কিন্তু আমি তো ভেবে ঠিক করতে পারছি না, বস্তুটা আদৌ আমার মধ্যে ছিল কি না। থাকলে কি আর প্রাক্তন জমিদার রত্নাকর চৌধুরীর মোসাহেবি করে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম?

আগে জানতে পিতৃভক্তি এখন বলছ–মোসাহেবি। উন্নতিটা চমৎকার! কিন্তু এতই যদি যন্ত্রণা, ওটাকে আনলে কেন ফিরিয়ে?

সেটাই ভাবছি অহরহ।

তা ভাববে বইকী! ভাশুর তুমি, কুপথগামী ভাদ্দরবউকে তার ভাবের লোকের সঙ্গে ছেড়ে না দিয়ে ফিরিয়ে আনলে, সে আনাটা অন্যায় বইকী! তা এনেছিলে কি আর শুধু পিতৃ আদেশেই? আরও কী মনোভাব ছিল কে জানে!

শিলাকর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল, বলেছিল, তোমার সঙ্গে কথা কইতেও আর রুচি হয় না, এত নীচ হয়ে গেছ তুমি!

তারপর ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে আবার বলেছিল, আগে কখনও ভাবতাম না। অনেক ভাবছি আজকাল, ভেবে ভেবে দেখছি শুধু আমাদের দেশেই নয়, হয়তো সারা পৃথিবীতেই মেয়েরা মেয়েদের প্রতি যত অত্যাচার করে, পুরুষ-সমাজ তার শতাংশের একাংশও করতে পারে না। মেয়েদের হাত থেকেই মেয়েদের উপর আসে যত নির্যাতন, যত উৎপীড়ন, যত নিষ্ঠুরতা। মেয়েদের যে কেন হৃদয়বতী স্নেহময়ী ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়, তাই ভাবি।

অলকা বিদ্রুপের গলায় বলেছিল, সেটা বোধহয় সম্প্রতিই ভাবছ।

মিথ্যা নয়! সম্প্রতিই ভাবছি। ভাবার অভ্যাস ছিল না, গতানুগতিকতার পথ ধরে চলাটাই অভ্যাস ছিল। হঠাৎ ভাবতে অভ্যাস করে অনেক কিছু নজরে পড়ছে।

নজরে তো পড়বেই– অলকার রাগে গলা বুজে আসছিল, তবু বলেছিল, পুরুষেরা নিষ্ঠুরতা জানেই না, কেমন? তারা সবাই হৃদয়বান, কেমন? মেয়েদের উপর কোনও শাসন অত্যাচার করে না, কেমন?

তা বলছি না অলকা! পুরুষেরও তো নিষ্ঠুরতার শেষ নেই। তবু একটা জিনিস দেখা যায়, তারা যা কিছু করে প্রয়োজন ভেবে করে। হয়তো তাদের ভাবনাটায় ভুল আছে, কিন্তু তাদের কাছে সেটা অহেতুক নয়, দরকারি। পুরুষরা সমাজ বস্তুটাকে খাড়া রাখতে চায়, সেই খাড়া রাখার অনুকূলেই সবকিছু ভাবে। সমাজের ইমারতে মেয়েদের ভূমিকা হচ্ছে মশলার। ইটগুলোকে নকশামতো সাজিয়ে গড়ে তোলবার মশলা। তাই যখন যে বুদ্ধিতে সমাজ গড়া হয়, তখন সেইভাবে মশলাকে কাজে লাগানো হয়।

তাই নাকি?

তাই! সত্যিই তাই অলকা! দেশে যখন মাথা গুনলে মেয়ের সংখ্যা বাড়ে, পুরুষের সংখ্যা কমে, তখন বহুবিবাহ প্রথার প্রচলন করতে হয়। যখন পুরুষের সংখ্যা বাড়ে, মেয়ের সংখ্যা কমে, তখন পুরুষকে নারী নরকের দ্বার এই মন্ত্র দিয়ে নিরস্ত করবার চেষ্টা করতে হয়।

যখন দেশে জনসংখ্যা কমে, তখন মেয়েদের শতপুত্রের আশীর্বাদ করে উৎসাহ দেওয়া হয়, আর যখন দেশে জনসংখ্যা বেড়ে খাদ্যশস্যে ঘাটতি ঘটায়, তখন মেয়েদেরকে বন্ধ্যাত্বের সুখ সুবিধে বুঝিয়ে উৎসাহিত করা হয়। সমাজের ইমারতে মেয়েদের এই ভূমিকা। শুধু সেটা যে তাদের উপর অত্যাচার, সেটাই প্রথমটা বুঝতে দেওয়া হয় না। বাহবা দিয়ে এগিয়ে দেওয়া হয়।…মেয়েরাও তাই পুরুষ সমাজ যখন দেবী চায়, তখন দেবী হয়, যখন মানবী চায়, তখন মানবী হয়। হয়তো যদি পৃথিবীর এমন দুর্দিন আসে, পুরুষসমাজ পশুজীবনে ফিরে যেতে চায়, তখনও হয়তো মেয়েরা কিন্তু ও কথা না হয় থাক। আমি বলছি মেয়েরা সমাজচিন্তায় নেই। মেয়েরা যা করে সেটা অহেতুক। শুধু হিংসার জন্যেই হিংসা করে, অত্যাচারের জন্যেই অত্যাচার করে। নিজের নিপীড়িত হওয়ার স্মৃতি থেকে উদার না হয়ে আরও সংকীর্ণ হয়। অথচ তা না হলেও পারত। স্বজাতির স্বার্থরক্ষা হিসেবে দল গড়ে পুরুষের সঙ্গে লড়তে পারত। সমাজের বলি হিসেবে না থেকে সমাজের একজন বলে সহায়তা করে না। অন্য সম্পর্ক দূরস্থান, মা মেয়েকে, মেয়ে মাকে হিংসে করে।

গুছিয়ে গুছিয়ে এমনি অনেক কথা বলেছে শিলাকর, অলকা মাঝে মাঝে বাধা দেওয়া সত্ত্বেও।

কিন্তু সে কথা কি অলকার সঙ্গে? সে শোনানো কি অলকাকে শোনানো?

না, তা নয়।

অলকা কি সেটা টের পায়নি?

অলকা কি বুঝতে পারেনি নিজের সঙ্গেই কথা কইছিল ওর বর? নিজেকেই শোনাচ্ছিল। যুক্তিগুলো পাকা করছিল। নতুন করে যে সব কথা হঠাৎ ভাবতে শুরু করেছে, সেই কথাগুলোই ওর ভিতরে ওথলাচ্ছিল, তাই।

মাঝে মাঝে তাই শুনতে বিরক্তি লাগছিল অলকার। শেষ অবধি হাই তুলে পাশ ফিরে শুয়েছিল।

মাঝ রাত্রে উঠে দেখল, জেগে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা।

জীবনে আর ওর সঙ্গে কথা বলব না– এই প্রতিজ্ঞা করে মরেছিল রাত্রে, তবু সকালে উঠে প্রশ্ন করল, কোন দিকে খাবে?

যাক, এই উৎসবের গোলমালটায় যা হয় হোক।

তারপর তো হাতেই আছে মৃত্যু।

 স্নান করতে করতে কথাটা ভাবে অলকা। কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে, এবার আশ্বিনের প্রথম দিকেই পুজো।

পুজোতেও তো এই একই অবস্থা। অলকাকেই সব জলে ছাতি ধরতে হবে, সব দিকে বাঁধ দিতে হবে। তাতে আবার শাশুড়ি নিস্পৃহ, আর সেটা হচ্ছে শ্বশুরের ব্যাপার! এখন থেকে লাগলে তবে যদি ঠিকমতো হয়।

গতবার তিলের নাড়তে বালি ছিল বলে কী রাগই করেছিলেন শ্বশুর।

 কার ওপর রাগ?

এই অলকার।

বলেছিলেন, শুনতে পাই তোমার বাপের বাড়িতেও দোল দুর্গোৎসব সবই আছে, নেহাত হাঘরের মেয়ে নও, তবে?

বলেছিলেন, তুমিও বুঝি তোমার শাশুড়ির মতো ফোঁটা তেলক কেটে হরি হরি করছ বউমা? রক্তখাকী মার কাজে হাত লাগাবে না?

বলেছিলেন, কারুর দ্বারা যদি না হয়, আগে জবাব দিয়ে দিও। পুরুতবাড়ি থেকে করিয়ে নেব।

এই অপমান সয়ে আছে অলকা।

কাজেই এবারে একবার নিখুঁত করে পুজোর কাজ তুলে দিয়ে তবে ছুটি। এই শেষবার। পুজোর বিজয়া যাবে, অলকাও বিদায় নেবে! না, লক্ষ্মীপুজোর কথা ভাববে না আর। সে যা হয় তোক।

অলকার এই শেষ কাজ!

 জীবনে বীতস্পৃহ, মরণে কৃতসংকল্প, অলকা তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নেয়, ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে।

রত্নাকর বৈকালিক ভ্রমণের প্রস্তুতি করছিলেন। আজ বাড়ির যা অবস্থা তাতে রাত বারোটার আগে ফেরা নয়। যদি ততক্ষণে জগঝম্পটা কমে।

কীর্তনের পালাগান বরং সহ্য হয়, কিন্তু শেষের সেই হরিবোল অসহ্য!

সকাল থেকে বাড়িতে লোকে লোকারণ্য!

দীয়তাং ভোজ্যং!

ঠিক যেমনটি দুর্গাপুজোর নবমীর দিনে হয়ে আসছে এ বাড়িতে। তা তাতে তবু মহাপ্রসাদের আকর্ষণ আছে, এ তো স্রেফ মালসা। তবু আসছেও লোকে। উৎসব কাঙাল লোক উৎসবের জাত বাছে না।

সত্যভামার এসব রত্নাকরের সঙ্গে ঠাণ্ডা লড়াই!

ইচ্ছে করলেই বন্ধ করে দিতে পারেন রত্নাকর, কিন্তু তাতে নিজেরই মর্যাদাহানি। প্রমাণিত হবে রত্নাকরের স্ত্রী রত্নাকরের বাধ্য নয়, বশীভূত নয়। তাঁকে আয়ত্তে আনতে জোর প্রয়োগ করতে হয়। আসলে প্রথমেই শক্ত হওয়া উচিত ছিল।

মশা মারতে কামান দাগতে যাব না! বলে অগ্রাহ্য করে দেখছি মশাটি হাতি হয়ে উঠছে। বছরে বছরে বাড়াচ্ছেন সত্যভামা।

প্রশ্রয় দিলে পথের কুকুরও মাথায় ওঠে। আগে কী ভীরু, কী বাধ্যই ছিল! মেয়েমানুষ জাতটা হচ্ছে বেসহবতের জাত। চাবুকের আগায় রেখেছ, ঠিক আছে। চাবুক নামাও, মাথায় উঠবে। আসছে বছর থেকে–

হঠাৎ চিন্তায় এবং কাজে ছেদ পড়ল। আতরের শিশিটা হাত থেকে পড়তে পড়তে রয়ে গেল। রত্নাকর ভুরু কুঁচকে বললেন, তুমি এখানে? বৈঠকখানা বাড়িতে? ভিতরে যাও, ভিতরে যাও।

বেসহবত মেয়েজাতের একটি নমুনা কিন্তু এ নির্দেশে ভয় পেয়ে ভিতরে চলে গেল না। বলল, আপনাকে কিছু বলতে চাই।

এই কথা? তা সেটা পরে চাইলেও হবে। আমি এখন বেরুচ্ছি।

ও টলল না, বলল, দয়া করে আমার কথাটা শুনে যান।

তাই নাকি! শুনে তবে যেতে পাব? মন্দ নয়। তা বলে ফেলো, বলে ফেলল। বাড়ির বউয়ের কথা বলার জায়গা এটা নয়।

বাড়ির বউ পরিষ্কার গলায় বলে, আমার কথাও বেশি নয়। শুধু বলতে এসেছি আপনি আমায় ছেড়ে দিন।

রত্নাকর চমকালেন বইকী!

এ দাবির জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। ভেবেছিলেন আরাম আয়েসের কোনও ত্রুটি নিয়ে নালিশ করতে এসেছে।

ব্যঙ্গের গলায় বললেন, ছেড়ে দেব? বেশ যেন নাটক নাটক লাগছে কথাটা! ব্যাপারটা কী?

ব্যঙ্গে বিচলিত হয় না ঊর্মিলা।

দৃঢ় গলায় বলে, আমি আর এখানে থাকব না।

 থাকব না! একেবারে স্থির করে ফেলেছ? তবে তো আর ছেড়ে দেবার কথাই ওঠে না।

আপনার বাড়ির চারদিকে জেলখানার মতো পাহারা বসিয়েছেন আপনি

 রত্নাকর এই অবিশ্বাস্য দুঃসাহসের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলেন, এ বাড়িতে আগে বাড়ির বউদের শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলার রেওয়াজ ছিল না। আমিই সেটার প্রচলন করেছিলাম, বউরা শ্বশুরকে সেবাযত্ন করতে স্বাচ্ছন্দ্য পাবে বলে। মুখে মুখে কথা বলার জন্যে নয়।

মুখে মুখে কথা বলতে আমি আসিনি। শুধু মিনতি করতেই এসেছি। আপনি আমায় আটকে রেখে কী করবেন, আমাকে নিয়ে আপনার কী কাজ? বাড়ির বউয়ের মর্যাদায় যাকে রাখতে পারছেন না, তাকে রেখে লাভ কী?

থামো! গর্জে ওঠেন রত্নাকর, বড় বড় কথা বোলো না। মর্যাদায় তুমি ছিলে! যথেষ্ট মর্যাদায় ছিলে! সে মর্যাদা তুমি হারিয়েছ। দাসীবাঁদির মতোই থাকতে হবে এখন। যাও, ভিতরে যাও।

না, আমি আর ভিতরে যাব না-ঊর্মিলা বোধ করি মরিয়া হয়েই এসেছে, তাই মরিয়ার সুরেই বলে, আমি এ বাড়ির দেউড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে এসেছি। আপনি তো বেরোচ্ছেন, আমায় নিয়ে গিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দিন।

তোমায় নিয়ে গিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেব?

সহসা হা হা করে হেসে ওঠেন রত্নাকর। তাই বলো! হঠাৎ তুমি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করতে এসেছ? কিন্তু সম্পর্কটা তো ঠাট্টার নয় ছোটবউমা! মাথার কোনও গণ্ডগোল হয়নি তো?

ঊর্মিলার মাথার ঘোমটা খসে পড়েছে, ঊর্মিলা সেটা তুলে দেবার কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় এটা রত্নাকর চৌধুরীর বৈঠকখানাবাড়ি, আর তাঁর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সে।

যেন সাধারণ কাউকে কথা বলছে এইভাবে বলে, এ সব কথার জন্যে প্রস্তুত হয়েই এসেছিলাম আমি। আপনার দেউড়ি দিয়ে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলে আপনারই অগৌরব, তাই বলেছি ও কথা। আপনি না নিয়ে গেলে তাই যাব।

ছোট মুখে বড় কথা বলে একটা কথা আছে বউমা, সে কথার মানে কোনওদিন জানতে হয়নি। আজ হঠাৎ মানেটা জানলাম। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নতুন নতুন কথার মানে শেখবার ইচ্ছে আর সময়, কিছুই নেই আপাতত। বাড়ির মধ্যে যাও–এটাই এখন আমার আদেশ।

ঊর্মিলা বোধ করি সব কিছুর জন্যেই প্রস্তুত হয়ে এসেছিল, তাই মাথা নিচু করলেও স্পষ্ট গলায় বলে, আমি তো বলেছি আপনাকে, ভিতরে আর যাব না আমি।

তার মানে আমার আদেশ মানবে না?

ঊর্মিলা চুপ করে থাকে।

 রত্নাকর চৌধুরী গর্জনের সঙ্গে বলেন, আমি তোমায় হুকুম করছি, ভিতরে যাও। এটা চৌধুরী বাড়ির বৈঠকখানা, থিয়েটার-স্টেজ নয়।

ঊর্মিলা স্থির গলায় বলে, এত কথা বলবার ইচ্ছে আমার ছিল না, আপনিই বলতে বাধ্য করছেন। তবু আমি এখনও মিনতিই করছি, আপনি আমায় ছেড়ে দিন। আমাকে এই অপমানের মধ্যে রেখে আপনার লাভ কী?

লাভ!

রত্নাকর আবার হেসে ওঠেন, লাভটা ধরতে পারছ না বুঝি? রত্নাকর চৌধুরীর পুত্রবধূ রাস্তার একটা লোফারের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, কি লোকের বাড়ির বাসন মাজে, কিংবা সিনেমার উজ্জ্বল তারকা হয়, এটা আমার ইচ্ছে নয়, কাজেই সেটা বন্ধ করছি–এই লাভ! যাক, অনেকক্ষণ তোমার বাঁচালতা সহ্য করেছি, এবার অসহ্য লাগছে। বেরিয়ে পড়ার চেষ্টা করবে না আশা করি? বারেবারে একই ধৃষ্টতা সহ্য হবে না। তা ছাড়া পাহারার কথা তো তোমার জানা!

রত্নাকর আতর-মাখা রুমালটা পকেটে রাখেন। পাম্পশুটা পায়ে গলান।

কিন্তু ঊর্মিলার বুঝি মরণ-পাখা উঠেছে! তাই ঊর্মিলা বলে ওঠে, আমাকে এভাবে নজরবন্দি করে রাখাটা বেআইনি হচ্ছে। আমি নাবালিকা নই।

আশ্চর্য, তবু রত্নাকর পায়ের ওই সদ্য পরা জুতোটা খুলে ছুঁড়ে মারলেন না। তবু রত্নাকর হুঙ্কার দিয়ে দারোয়ান ডাকলেন না। শুধু বললেন, তাই তো! তুমি যে আবার উকিলের বেটি, মনে ছিল না। জন্মানোর আগে তো বাপ মরেছে, কুটকচালে রক্তটি দেখছি দিয়ে গেছে। তা আইনের কথাই যদি তুলতে সাধ হয় তোমার, তো ধীরেসুস্থে হবে। এখন কাজের সময় দিক কোরো না। হ্যাঁ, অন্দরে আর ঢুকবে না বলে যখন প্রতিজ্ঞা, তখন এখানেই থাকো। বই পড়ার শখ আছে, দু-একখানা পড়েও নিতে পারো, ফিরে এসে আইনের তর্কটার মীমাংসা হবে। আপাতত দরজাটায় তালা লাগানো থাকুক।

ঘরের দরজাটা আগলে দাঁড়ান রত্নাকর। দরজার কপাটে ভারী একটা তালা লাগানোই থাকে, রাত্রে বন্ধ করা হয়। তার চাবির ডুপ্লিকেট থাকে রত্নাকরেরই পকেটে।

রাখেন পকেটে, মাঝরাতে যদি এ-ঘরে আসতে ইচ্ছে হয়? এ-ঘরেই তো বই-বোতল-তানপুরা। রত্নাকর যে তিন রসেরই রসিক!

আপনি আমায় তালাচাবি দিয়ে রাখছেন?

বলেছিল ঊর্মিলা।

উদ্ভ্রান্ত হয়ে নয়, কেমন একরকম ব্যঙ্গের হাসি হেসে।

রত্নাকর কপাটটা টেনে ধরে তালা লাগাতে লাগাতে বলেছিলেন, দরকার বুঝলে হাতেপায়ে শিকল দিয়েও রাখতে হয় ছোটবউমা! তুমি বুদ্ধিমতী, আশা করছি চেঁচামেচি করবার মতো বোকামিটা করবে না?

পুরনো দিনের ভারী কপাটটা চেপে বসে গিয়েছিল গুহার মুখে পাথরের মতো।

ঊর্মিলা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

ঊর্মিলা এই অবিশ্বাস্য নীচতায় পাথর হয়ে গিয়েছিল।

 ঊর্মিলার মনে পড়ছিল হিমাকরের মুখে শোনা তার পূর্বপুরুষদের গল্প।

কবে নাকি তাদের কোন একজন একটা উদ্ধত চাকরকে থামের সঙ্গে বেঁধে তার উপরে দুদুটো বাঘা কুকুর লেলিয়ে দিয়ে তামাশা দেখেছিল।

কবে নাকি একজন বাড়ির একটা অসতী বউকে দেয়ালের সঙ্গে গেঁথে ফেলে, গাঁথুনির মিস্ত্রিটাকে নিরুদ্দেশ করে দিয়েছিল। আর কবে নাকি কে তার জামাইকে গুলি করে মেরেছিল, জামাই বিধবা বড় শালির দিকে কুচক্ষে তাকিয়েছিল বলে।

হিমাকর এসব গল্প করত গৌরবের সঙ্গে। বলত, এমন নইলে পুরুষ!

হিমাকরের বাপও হিমাকরের কাছে অনেকটা আদর্শ পুরুষ ছিল। হয়তো নিজেও সে তার আদর্শের পুরুষই হত, যদি না হঠাৎ অমন অসুখে পড়ে যেত!

ঊর্মিলার শ্বশুর প্রশংসাপত্র দিয়ে গিয়েছে ঊর্মিলাকে, বুদ্ধিমতী বলে।

 ঊর্মিলা অতএব চেঁচাবে না।

ঊর্মিলা ঘুরে ঘুরে দেখবে ঘরের মধ্যে বিষ আছে কিনা, ঝুলে পড়বার মতো কোনও জায়গা আছে কিনা। কাজটাকে নিতান্ত ঘৃণা করে ঊর্মিলা, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে রত্নাকর চৌধুরীর ওপর টেক্কা দিতে পারলে মন্দ হয় না। আর এটাই বোধ করি আপাতত একমাত্র উপায় টেক্কা দেবার।

.

কিন্তু এ সমস্তই তো ঊর্মিলার কথা।

ঊর্মিলার জীবন, ঊর্মিলার মরণ।

ঊর্মিলার সুখ, ঊর্মিলার দুঃখ।

কিন্তু সে কোথায় গেল?

সমুদ্র সেন নামের সেই মুখ অবোধটা? কবে যেন একদিন কোনও একটা রেলওয়ে স্টেশনের ধারে বড় একটা রাহাজানির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল যাকে? তারই মুঠোয় আসা কমলহিরেখানা মুঠো থেকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল একজন। আর মুখটা দাঁড়িয়ে থেকেছিল হাঁ করে।

তারপর?

আত্মধিক্কারে রেল লাইনে গলা পাতল নাকি ছেলেটা? না কি বাকি জীবনটা ব্যর্থ প্রেমের স্মৃতি সম্বল করে কাটিয়ে দেব এই সংকল্প করে বাড়ি ফিরে গেল?

বক্সারে শিবানী তাকে যেন তাই বলেছিল, তাই উচিত তোমার সমুদ্র, আর কিছু হবে না তোমার দ্বারা।…হাতছাড়া প্রেয়সীর একখানা ফটো জোগাড় করতে পারো তো আরও ভাল হয়। দুবেলা মালাচন্দন দিয়ে পুজো করতে পারবে।…

এতখানি ধিক্কারের পরও কি হতভাগার মতো ঘুরেই বেড়াতে লাগল সমুদ্র প্রমাণ সেই নির্বুদ্ধিতাটা?

না কি দেখতে, আর দেখাতে বেরুল, কাকে বলে চাওয়া!

কে জানে!

ঊর্মিলার সঙ্গে তো যোগাযোগই নেই।

 ঊর্মিলা তো জানেই না।

ঊর্মিলা বোধ করি ঠিক তখনই খুঁজে বেড়াচ্ছিল ঘরে খুব একটা কিছু ভারী জিনিস আছে কিনা।

.

ছাতে আসর বসেছে শামিয়ানা খাঁটিয়ে, কীর্তনের পালা শেষ হয়ে হরিবোলের পালা চলছিল। শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে ছিল এতক্ষণ, এখন এই ধ্বনির মাদকতায় চঞ্চল হচ্ছে, পুলকিত হচ্ছে, লজ্জা ভুলে দোয়ার দিচ্ছে।

সত্যভামা অবশ্য দোয়ার দিচ্ছেন না, তবে খঞ্জনি একজোড়া আছে তাঁর। সেটাই নাড়াচাড়া করছেন, হাতে নিয়েই ঘোরাঘুরি করছেন। এই ঘোরাঘুরির মধ্যেই বিহ্বল হয়ে বসে থাকা রমাকে কঠোর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, সে লক্ষ্মীছড়ি বুঝি ঘরেই বসে রইল?

রমাই যেন অপরাধিনী!

তা সেও অপরাধিনীর ভূমিকাই পালন করল। ক্ষীণস্বরে বলল, ডাকলাম তো, আসতে চাইল না!

 তা চাইবে কেন? হরিনাম শুনলেও যদি পাপ জন্মায়। বলি নীচতলা তো শূন্য, একা বসে আছেন বোধ করি?

ঘরে বসে বই পড়ছিল দেখে এসেছি।

দোরে দারোয়ান আছে?

রমা মৃদু হেসে বলে, আজ তো হাজার দারোয়ান। কত লোক আসছে যাচ্ছে—

তা সেটাই তো ভয়ের!

রমা ব্যস্ত হয়ে বলে, না, না, মামা আছেন বাইরে।

সত্যভামা ঈষৎ হৃষ্টচিত্তে বলেন, আছেন? তবু ভাল। ওনারও তো হরিনামে ছটফটানি লাগে, তাই ভাবছিলাম।

রমা মামির মনরক্ষার্থে বলে, ছোটবউদির মনমেজাজ বোঝা শক্ত। এই যে কেত্তন হচ্ছে, পাথরও গলে এর সুরে, অথচ কাঠ হয়ে বসে রইল।

সত্যভামা বিকৃতমুখে বলে যান, এই কাজটা উদ্ধার হয়ে যাক, ওর হেস্তনেস্ত দেখাচ্ছি আমি। ও বা কতবড় জাঁহাবাজ, আর আমিই বা কেমন মেয়ে!

চলে যান।

রমা মনে মনে বলে, এই তো লীলা! কে বড় কে ছোট দেখা যাক।

নীচের তলায় বসে ছিল শিলাকরও, বাগানে বেঞ্চে বসে ছিল, আর ভাবছিল, আশ্চর্য! একই বাড়িতে থেকে একটা মানুষকে আমি একবার একটা কথা বলতে পারছি না। অথচ না বললেও নয়।

পকেট থেকে একখানা ডাকের খাম বার করল। মুখবন্ধ খাম। চিঠিটা এসেছে এলাহাবাদ থেকে।

শিলাকরের হাতে পড়বার কোনও কারণ ছিল না, তবু ভাগ্যক্রমে পড়েছিল। কদিন আগে ঘটেছিল ঘটনাটা। শিলাকর বেরিয়েছিল, হঠাৎ রাস্তায় পোস্টম্যান সত্যভূষণের সঙ্গে দেখা।

সে বলল, এই যে দাদাবাবু চিঠি রয়েছে।

সহজ সরল মানুষ, করেই থাকে এ রকম। সেই চিঠি হাতে করেই অবাক হল শিলাকর।

সব চিঠিই তো আজকাল রত্নাকর নিজের হাতেই রাখেন, যদি কুলটা বউয়ের কোনও চিঠি থাকে। সেই রয়েইছে, শুধু এটাই হাতে পড়ল শিলাকরের!

ভগবানকে অস্বীকার করা যায় না।

শিলাকরও একটা আশ্চর্য চিঠি পেয়েছে কাল। আশ্চর্যই! সেই হতভাগা ছেলেটা যদি শিলাকরকে শাসিয়ে চিঠি লেখে, সেটাকে আশ্চর্যই বলতে হবে।

লিখেছে—

আকস্মিক একটা ধাক্কা দিয়ে আমাকে সেদিন বোকা বানিয়ে দিয়ে যাকে কেড়ে নিয়ে গেছেন, তাকে কেড়ে রেখে দেবার সাধ্য আপনাদের নেই। আইন আপনাদেরই বিপক্ষে। তবু তার আশ্রয় নিইনি এর আগে, তার কারণ সেই অসভ্য অবস্থাটা ঘটাতে ইচ্ছে ছিল না। তবে মনে হচ্ছে ঘটাতেই হবে, প্রস্তুত থাকুন।

অবশ্য সহজেই যদি অবস্থাকে মেনে নিতে চান তো ভালই।…ভেবে অবাক হচ্ছি, একজন সাবালিকা মেয়েকে মাত্র গায়ের জোরে আটকে রাখবার চেষ্টাটা কত খেলোমি, সেটা আপনাদের মনে আসছে না কেন!

নাম স্বাক্ষর করেনি, তবু বুঝতে আটকায়নি।

পড়ে একটু যে কৌতুক বোধ না হচ্ছে তা নয়, তবু চিন্তাও আসছে। পাখিকে ধরে নিয়ে এসে ফের খাঁচায় পুরে ফেলেই যে ব্যাপারটা মিটে যায়নি এটা তারই সূচনা।

অথচ যাকে নিয়ে ব্যাপার, তাকে এ সবের কিছুই জানানো যাচ্ছে না।

হঠাৎ খোলকরতালের উদ্দাম ধ্বনি আরও উদ্দাম হয়ে উঠল, আর–এই পরিচিত ব্যাপারটাই হঠাৎ ভারী অসহ্য ঠেকল শিলাকরের।

আর হঠাৎই ভারী হাসি পেল।

 ভাবল, বসে বসে এত যন্ত্রণা ভোগ করছি কেন আমি?

বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকটা দূরত্বে বেড়িয়ে বেড়ালে ক্ষতি কী? এখন মনে হচ্ছে এই হরিধ্বনি আর শেষ হবে না, কিন্তু হবে অবশ্যই। তখন ফেরা যাবে।

আজ গেট খোলা।

 শত লোক আসছে-যাচ্ছে।

দারোয়ান কালাচাঁদ শুধু সবাইকে একবার নিরীক্ষণ করে নিয়েই ছেড়ে দিচ্ছে।

 শিলাকরকে কিন্তু ছাড়ল না।

আটকে ফেলল। নিচু গলায় কী বলল।

শিলাকর চমকাল।

 বলল, বাবা ফেরেননি?

না হুজুর!

কই দেখি, কোথায়?

এমন কোথাও নয়, দারোয়ানেরই ঘরে। বুদ্ধি করে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিয়েছে কালাচাঁদ।

কিন্তু সন্দেহজনক ব্যক্তিটিকে দেখে যে এতখানিই চমকাতে হবে, তা কে ভেবেছিল?

কিন্তু ওকে দেখে ব্যঙ্গ করবেই শিলাকর।

ওই সমুদ্র-প্রমাণ নির্বুদ্ধিতাকে দেখে।

বেরিয়েই গেল মুখ দিয়ে, আরেকী ব্যাপার। আপনিই সেদিনের সেই শোচনীয় নাটকের নায়ক না? কিন্তু আজ আর কিছুতেই ভয় পাবে না স্থির করেই সমুদ্র বলে ওঠে, ব্যঙ্গ করুন, বিদ্রূপ করুন, পুলিশ ডাকুন, যা পারেন করুন, ঊর্মিলাকে আমি এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবই।

শিলাকর মৃদু হেসে বলে, তাই নাকি? প্রতিজ্ঞা? কিন্তু এটা তো রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে এসে বলবার কথা নয়? প্রকাশ্য দিবালোকে আসতে হয়।

সেটা হয়ে ওঠেনি! কিন্তু, সমুদ্র চড়া গলায় বলে ওঠে, দেখছি ব্যঙ্গটাই আপনার অস্ত্র। তবে জেনে রাখবেন, আমি ল-ইয়ারের সঙ্গে পরামর্শ করে এসেছি, আইন আমাদের পক্ষে।

শিলাকর যেন আরও কৌতুক বোধ করে।

সহাস্যে বলে, একশোবার! সে কথা কি আমিই অস্বীকার করছি। কিন্তু রত্নাকর চৌধুরীর এই নখদন্তহীন ছেলেটাকেই বারেবারে দেখছেন, স্বয়ং তাঁকে তো দেখাই হল না আপনার। তিনি ইচ্ছে করলে সামান্য একটা মেয়েকে অনায়াসেই হাওয়া করে দিতে পারেন। তখন আপনার ওই আইন আর পুলিশ কোন কাজে লাগবে বলুন?

সমুদ্র ছিটকে ওঠে!

 সমুদ্র প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে।

মেরে ফেলবেন তাকে? খুন করবেন?

এই মাটি করেছে, উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? হাওয়া করা মানে সবই হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। তার থেকে চলুন বৈঠকখানায় গিয়ে আরাম করে বসে দুটো পরামর্শ করা যাক। এ-ঘরে বড় মশা!

সমুদ্র আবার উত্তেজিত হয়।

আরক্ত মুখে বলে, তার মানে আমাকে আটক করে ফেলতে চান?

এই দেখুন, আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন! আটকই তো ছিলেন এতক্ষণ, মশার কামড়ে মারা যাচ্ছিলেন। চৌধুরীদের যে অতিথি-সজ্জনদের জন্যে ড্রইংরুম একখানা আছে, সেটা তো জানতেই পারেননি! চলুন, চলুন।

ঠিক আছে, চলুন! কী আর করতে পারবেন আমার? বড়জোর খুন করবেন, এই তো?

সমুদ্র সেন ওই তুচ্ছ ব্যাপারটাতে নির্ভয় হয়ে শিলাকরের পিছু পিছু অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে বৈঠকখানা বাড়ির দালানে ওঠে।

শব্দতরঙ্গে বিরক্ত শিলাকর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা চোর ধরা পড়ায় এতটা খুশি খুশি দেখায় কেন তাকে?

হেসে হেসে বলে সে, আপনার সাহস দেখে বড় সন্তুষ্ট হচ্ছি। শুধু ভাবছি–ঘরে ভাত আছে তো? যাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবার জন্যে কৃতসংকল্প, তাকে খেতে-টেতে দিতে পারবেন তো?

সে আমি বুঝব।

গোঁয়ারের মতো বলে সমুদ্র।

উঁহু

শিলাকর বলে, শুধু আপনার বুঝলে হবে না, আমাকেও কিছু বুঝতে দিতে হবে। আমাদের ঘরের লক্ষ্মীকে আপনার মতো একটা লক্ষ্মীছাড়ার হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা সম্ভব? আপনিই বলুন?

সমুদ্রও ব্যঙ্গ করতে জানে বইকী!

রূঢ় ব্যঙ্গের গলায় বলে, তা হলে? সমস্যার সমাধানটা কী? ঘরের লক্ষ্মীর নৈবেদ্য বাবদ মাসোহারা দেবেন?

আরে এই তো! শিলাকর নিতান্ত স্নেহ-পাত্রের মতো ওর পিঠটা ঠুকে দিয়ে বলে, ধরেছেন তো ঠিক! বুদ্ধিসুদ্ধি যে একেবারে নেই তা বলা যায় না। যাক, আপনাকে আমার ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কারণ আপনাকে বিশেষ দরকার ছিল! আপনাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম! বসুন আগে। কথা আছে। বিনা স্বাক্ষরিত চিঠিটা তো আপনিই দিয়েছিলেন? অতএব নামটাও জানতে পারিনি। এমন একজন হিরোর নামটা জানা দরকার বইকী!

সমুদ্র ক্রুদ্ধগলায় বলে, এমন কিছু দরকার দেখি না। তবে আপনাদের সেই ঘরের লক্ষ্মীটিকে ইতিমধ্যে খুনই করে ফেলেছেন কিনা সেটা জানা আমার দরকার।

নাঃ, একটা খুনের ব্যাপার দেখছি আপনার মাথায় আটকে বসেছে। দেখবেন যেন এ বেচারাকে খুন করে বসবেন না।

সমুদ্র উত্তেজিত হয়, বলে, সবাইকে নিজের মতো নীচ ভাববেন না!

 তা ভাবছি না।

আমার আর ভয় কী? জোরগলায় বলছি আপনি নীচ! নীচ, নিষ্ঠুর, কাপুরুষ, গ্রাম্য! এখনও সেই পুরনোকালের চশমা এঁটে বসে আছেন। বাড়ির বউয়ের একটা চিঠি লেখার পর্যন্ত স্বাধীনতা নেই।

আহা চিঠিখানা তো আমার পকেটে, জবাব আর দেবে কে? হেসে ওঠে শিলাকর।

সমুদ্র রুদ্ধকণ্ঠে বলে, জানি। জানতাম। চিঠিটা যে তার হাতে পড়বে না, সে সন্দেহ আমার হয়েছিল।

তবু লিখতেও সাধ হয়েছিল বোকার মতো! যাক জমিয়ে বসে একটু গল্প করা যাক।

পরিহাসের ভঙ্গি ত্যাগ করে সহজ গলায় ডাক দেয় শিলাকর, রঘু, বৈঠকখানা ঘরের চাবিটা খুলে দে তো

.

রাত বারোটায় ফিরবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারলেন না রত্নাকর। ক্লাবের আচ্ছা, গল্প, পানভোজন, সবই অসহ্য মনে হল।

একটা বন্ধ দরজার মোটা মোটা দুটো পিতলের কড়ায় লাগানো ভারী একটা তালা ঝোলার দৃশ্য বারবার চোখের সামনে ছায়া ফেলছে।

বেশ গোটা কয়েক দিন ওইভাবে বন্ধ রেখে দেওয়া যায় না? যেমন রাখতে পারতেন রত্নাকরের পূর্বপুরুষরা? যাঁরা নাকি ডাকাতে কালীর সাধক ছিলেন?

একালে অসুবিধার শেষ নেই।

একালে দেয়ালে গেঁথে দেওয়াটা রূপকথার গল্পের মতোই গল্পকথা। একালে একটা লাশ পাচার করতে–

অবিশ্বাস্য সেই ধৃষ্টতাকে আর একবার স্মরণ করলেন রত্নাকর, স্মরণ করলেন অবিশ্বাস্য সেই দুঃসাহসকে।

আইন দেখাতে এসেছিল না রত্নাকরকে?

নির্লজ্জ সেই মেয়েটা!

শ্বশুরের মুখের ওপর চোটপাট করছিল না কুলত্যাগ করে চলে যাবার ঘোষণা জানিয়ে? অসহ্য! অসহ্য! সেই মুহূর্তে সেই অবিশ্বাস্য ধৃষ্টতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আসতে পারলেন না রত্নাকর?

পূর্বপুরুষের রক্ত কি একেবারে শেষ হয়ে গেছে রত্নাকরের শিরা থেকে? যা আছে শুধু জল?

না, অনেকদিন শিকার করেননি বলে বন্দুক ধরতে ভুলে গেছেন?

 গাড়ির অন্ধকারে হঠাৎ নিজ মনে হেসে উঠলেন।

 ড্রাইভারটা কী ভাববে, ভাবলেন না।

সত্যভামা আজ হাজার কয়েক টাকা খরচ করে একটা অহিংস ব্রত উদ্যাপন করলেন না? বলির পুজোর দালান থেকে অনেক উঁচুতে, ছাতের উপর!

তা এটাও মন্দ নয়। বন্ধ দরজার মধ্যে বসে অনুভব করুক খানিকক্ষণ ধৃষ্টতা শব্দটার মানে কী!

বুঝুক, পৃথিবীর আলো বাতাসের মূল্য কী! আর বুঝুক কী কাজ সে করেছে!

 তারপর তো—

এটা যেন এক কোপে বলি হল না, হল জবাই!

.

দূর থেকে যেন একটা দৈত্যের মতো লাগছিল।

গানের আসর ভেঙে গেছে, শামিয়ানার নীচের আলো নিভেছে, বাইরের লোক বোধহয় সকলেই চলে গেছে। উৎসব-অন্তের ছমছমানি নিয়ে দৈত্যের মতো বাড়িখানা যেন ভয়ানক কিছু একটার প্রতীক্ষা করছে।

গেটের কাছে এসেই চোখটা বিস্ফারিত করলেন রত্নাকর, এত রাত্রে বড় ছেলে এখানে দাঁড়িয়ে কেন?

কিন্তু প্রশ্ন করা রত্নাকরের স্বভাব-বিরুদ্ধ।

 নিজে এসে কৈফিয়ত দেবে, এটাই নিয়ম।

আশ্চর্য, নিয়মটা মানতে ভুলে গেল শিলাকর। কৈফিয়ত দিল না।

শুধু ড্রাইভারকে ডেকে বলল, গাড়িটা এখুনি তুলো না সূর্য, আমি একবার বেরোব।

আর নিয়ম রাখা চলল না। রত্নাকরের কণ্ঠ উচ্চারণ করল, এত রাত্রে বেরোবে? আবার কাকে পৌঁছতে যেতে হবে?

শিলাকর খুব সহজের মতো করে বলে, দেব একজনকে। আপনাকে প্রণাম করে যাবে বলে এতক্ষণ বসে আছে।

আমাকে? প্রণাম করতে?

রত্নাকর গাড়ি থেকে নামেন।

উৎসবে আগত সত্যভামার বাপের বাড়ির সম্পর্কের কেউ হবে হয়তো। যা পছন্দ করেন না তিনি। গায়ে পড়ে আত্মীয়তা করতে আসা

কিন্তু সহসা যেন আর্তনাদ করে উঠলেন রত্নকর, কে? কে? কে এরা?

রত্নাকরের সত্তার ছায়া শিলাকর কি এর আগে কোনওদিন রত্নাকরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলেছে?

কী জানি!

 তবে আজ বলল।

বলল, একজনকে তো আপনি চেনেনই, আর–এ হচ্ছে সমুদ্র সেন, স্টেট ব্যাঙ্কে কাজ করে, কেরানি ছাড়া আর কিছু নয় অবশ্য। তবে চোরের মতো পালিয়ে যেতে রাজি নয়, বীরের মতো সামনে দিয়ে চলে যেতে চায়।…এই, হল তো প্রণাম? এবার তোমরা উঠে পড়ো, রাত হয়ে গেছে। চলো, আমি তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসি।…

হঠাৎ বাঘের মতো গর্জন ওঠে একটা।

যে গর্জনে একটাই শব্দ!

সে শব্দটা বোধ করি বন্দুক!

কিন্তু ততক্ষণে গাড়িও গর্জে উঠেছে।

শিলাকর চৌধুরীর পটু হাতে স্টিয়ারিং।

তবু ছুটে যান রত্নাকর চৌধুরী।

যাঁর পূর্বপুরুষরা উদ্ধত চাকরকে থামে বেঁধে কুকুর লেলিয়ে দিত।

বন্দুকটা বাগিয়ে ধরলেন রত্নাকর, গাড়ির চাকাটাকে লক্ষ্য করলেন। আগে চাকা ভেঙে অচল করে দেওয়া, তবে শাস্তি।

ভিতরে যারা উঠে বসেছে, অন্ধকারে তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না, দেখা যাচ্ছে না এ বাড়ির ছোটবউয়ের সেই নিখুঁত মুখটা কী চেহারা নিয়েছে।

মুখ দেখা গেল না, কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

পাখির মতো তীব্র তীক্ষ্ণ জোরালো, দাদা!

শিলার সাহস দেবার জন্যে মুখ ফেরালো।

শিলাকর স্পিড বাড়াল।

কিন্তু পিছনে গর্জে এল না শিকারির গুলি। শুধু একটা হা হা করা হাসি ঝোড়ো হাওয়ার মতো হা হা করে উঠল অন্ধকারের গায়ের উপর।

হলো না! গুলি নেই। রত্নাকর চৌধুরীর বন্দুকে গুলি নেই!

 হাসির মাঝখান থেকে বয়ে গেল কথাটা।

.

.

তবু আজো আছি

দক্ষিণ ভারতের ওই মিশন স্কুল বোর্ডিঙে গৌতম ছাড়া আর একটিও বাঙালি ছেলে ছিল না। কেন যে বাবা তাকে এখানে ভর্তি করেছে ভেবে পেত না গৌতম, ভেবে ভেবে ক্ষুণ্ণ হত! ছুটিতে যখন বাড়ি আসত, প্রশ্নে ভেঙে পড়ত বাবার কাছে, কেন? কেন ওখানে ভর্তি করেছ আমায়?

বাবা বলত, বাঃ করব না কেন? স্কুলটা ভাল, স্বামীজিরা ভাল

সব সময় ইংরেজি কথা বলতে হয়—

ভালই তো,–বাবা আরও পুলকিত হত। বলত, বেশ ইংরেজিটা রপ্ত হয়ে যাবে। তবে তোমাদের সুপারিন্টেন্ডেন্ট তো বাঙালি, তিনি বাংলায় কথা বলেন না?

কে? পরমপ্রেম মহারাজ? মোটেই না। মোটেই বাংলা বলেন না। আর কেনই বা বলবেন? সব ছেলেই তো না বাঙালি!

গৌতমের বাবা জ্ঞানদান করতেন গৌতমকে। বাঙালি অবাঙালি নিয়ে দুশ্চিন্তা করছ কেন? সবাই তো আমরা ভারতীয়। বলো, তা নয়?

নয়, সে কথা বলতে পারত না গৌতম।

আর ক্ষোভ প্রকাশ করতে লজ্জা পেত। তবু ক্ষোভটা থাকত ভিতরে।

.

এ বছরে একটি পরম আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে। একটি বাঙালি ছেলে এসেছে এখানে, এবং গৌতমের ক্লাসেই ভর্তি হয়েছে। তার জায়গাও হয়েছে গৌতমের ঘরেই।

অতএব বলাই বাহুল্য, ভাব জমে উঠতে এক বেলাও লাগেনি। ছেলেটা গৌতমকে প্রথমেই তুই সম্বোধনে আপ্যায়িত করে প্রশ্ন করেছিল, বাংলা কথা বলতে পারিস তুই? না ভুলেই গেছিস?

গৌতম আচমকা এই অবমাননাকর প্রশ্নে চটে ওঠা তো দূরের কথা, বিগলিত বিস্ময়ে বলে উঠেছিল, তুই বাঙালি?

হু তো! তুই কিন্তু বাঁকা বাঁকা বাংলা বলছিস!

যাঃ!

সত্যি রে!

গৌতম দুঃখের গলায় বলে, তা হতেই পারে। বাংলা তো বলতেই পাই না! এখানে আর একটাও বাঙালি ছেলে নেই। তোর নাম কী রে?

সুনন্দ। তোর বাবারও বুঝি বদলির চাকরি?

 গৌতম অবাক হয়।

বদলির চাকরি? বদলির চাকরি কী? বাবা তো ব্যবসা করেন, কারখানা-টারখানা কী সব যেন আছে। তোর বাবা বুঝি–

হু, সেইজন্যেই তো। বদলির চাকরি হলে মেয়ে-ছেলেদের স্কুল নিয়েই ভাবনা। দিদি তো কেবল হোস্টেলেই কাটিয়েছে। আর আমার এই। এত বিচ্ছিরি লাগছে এখানে। দিদি বলেছে আমি নাকি বাংলা ভুলে যাব। তবু তো এখানে মামা আছে আমার। তোর তো আবার তাও নেই।

মামা? মামা আছে তোর এখানে?

 আছেনা? ওই যে পরমপ্রেম মহারাজ? উনি তো আমার মামা! সেইজন্যেই তো মা বলল, কোথায় না কোথায় ভর্তি করে দেবে–একা ছোট ছেলে! তার থেকে দাদা যেখানে আছেন সেই বোর্ডিঙে দিয়ে দাও। মামাই তো আমায় বললেন, যাও ওই ছেলেটির সঙ্গে ভাব করো গে, ও হচ্ছে বাঙালি, ওর নাম গৌতম।

পরমপ্রেম মহারাজের নির্দেশে আলাপ!

ব্যস, তারপর থেকে গৌতম এবং সুনন্দও পরম প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ক্লাসের অন্যান্য ছেলেরা হাসে–দুটো বাঙালি একসঙ্গে জুটেছে বলে। সে হাসিতে এদের কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। সুনন্দ কিছু গল্পের বই এনেছে। তাই নিয়েই পঠন ও পাঠন চলছে। গৌতম প্রায় মানুষ হয়ে উঠেছে। অদ্ভুত একটা অবোধ অন্যমনস্কতা ছিল ওর, সেটা যেন কমে যাচ্ছে। প্রচুর কথা বলে সুনন্দ, জগতের সব যেন জেনে ফেলেছে ওই বাচ্চা ছেলেটা! শুনে শুনে জগৎ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছে গৌতমও।

সেই সচেতনতা ধরা পড়ল ছুটিতে বাড়ি ফেরার সময় হাওড়া স্টেশনে।

 হ্যাঁ, হাওড়া স্টেশনে নামার পরই প্রথম গৌতমের মনে পড়ে গেল তার জীবনের শূন্যতার দিকটা!

যতক্ষণ ট্রেনে ছিল, দুজনে একই পর্যায়ে ছিল। স্কুলের মতো একই শ্রেণীর গল্প করতে করতে আর গল্পের বই পড়তে পড়তে, খেতে খেতে, আর ঘুমোতে ঘুমোতে, এই দীর্ঘ পথটা অতিক্রম করে এল দুজনে একই ভাবে।

প্রভেদ দেখা গেল প্ল্যাটফর্মে নামতে না নামতে। ছন্দভঙ্গ হল, তাল কেটে গেল।

সুনন্দর বাড়ি থেকে সুনন্দকে নিতে এসেছে তার মা, বাবা, দিদি, আর গৌতমের বাড়ি থেকে শুধু শূন্যবক্ষ একখানা গাড়ি।

গাড়ি আর গাড়ির ড্রাইভার।

তাই আসে অবশ্য।

 যখনই গৌতম ছুটিতে বাড়ি আসে, এই ট্রেনেই আসে। বাবা তখন কাজে ব্যস্ত থাকেন। অনেক ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে, অথবা অনেক ছেলের সঙ্গে আসেন একজন শিক্ষক, সেই সঙ্গেই আসে গৌতম, যেমন এবারও এসেছে। কিন্তু হাওড়া পর্যন্ত কম ছেলেই আসে।

অনেক ছেলেই পথে নানান জায়গায় নামে। তাদের নামিয়ে নেবার লোক আর পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের।

গৌতম এতেই অভ্যস্ত।

গৌতমের শুধু গাড়ি আসে, গৌতম উঠে পড়ে, বাড়ি চলে আসে।

 কিন্তু এবারে সেই অভ্যস্ত নিয়মটা তার কাছে অনিয়ম লাগল। প্রশ্নের বাষ্প জমে উঠল মনের মধ্যে, প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল।

.

মা না হয় নেই গৌতমের, কিন্তু বাবা তো আছেন! বাবা আসতে পারেন না একবারও? সারা বছরই । তো কাজ করছেন বাবা, একদিন এক ঘণ্টা সময় গৌতমের জন্যে দেওয়া যায় না? সুনন্দর বাবারই বুঝি কিছু কাজ নেই? উনি কী করে এলেন?

নিজেকে ভারী অবহেলিত মনে হল গৌতমের এবার।

ওদিকে সুনন্দ যে গৌতমের জন্যে আসা প্রকাণ্ড গাড়িটা দেখে চোখ বড় করল, মনে মনে নিজেকে গৌতমের থেকে কিঞ্চিৎ খাটো ভাবল, তা জানতে পারল না গৌতম।

গৌতম দেখল, সুনন্দ তার মা, বাবা আর দিদির সঙ্গে হাসতে হাসতে বাসের দিকে চলে গেল, সারাক্ষণ এখন হাসতে হাসতে গল্প করতে করতে যাবে ওরা।

গৌতম একা এসে গাড়িতে উঠল।

সারাক্ষণ নীরবে বসে থাকবে সারা সিটটা জুড়ে হাত পা ছড়িয়ে। বড় জোর ড্রাইভার উদয় সিংকে জিজ্ঞেস করবে, বাবা বাড়িতে আছেন?

উদয় সিং খুব সম্ভ্রম দেখিয়ে বলবে, জি না।

বলবেই, কারণ এ সময়ে থাকেন না বাবা বাড়িতে। গৌতম বাড়ি পৌঁছবে। শুধু ঝি চাকর ভর্তি বাড়িতে।

সারাদিন একা একা ঘুরে বেড়াবে এ ঘরে, ও ঘরে, গল্পের বই পড়বে, দুপুরে হয়তো বা ঘুমিয়েই পড়বে ট্রেন জার্নির খেসারত দিতে। বিকেলে লনে নামবে, দারোয়ানের সঙ্গেই গল্প জুড়বে, তারপর সেই সন্ধ্যায় বাবা ফিরবেন।

খুব বেশি করলেন তো একবার বাড়িতে ফোন করলেন, খোকা ফিরেছ? গাড়িতে কষ্ট হয়নি তো? সাবধানে থেকো, কেমন? সন্ধ্যাবেলা দেখা হবে।

নিজেই কথা বলবেন।

গৌতমকে কথা বলার সুযোগ বিশেষ দেবেন না।

 গৌতম শুধু বসে বসে ঘণ্টা মিনিট গুনবে, কখন আসবে সুযোগ, কখন বাবা ফিরে আসবেন।

আশ্চর্য, গৌতমের একটি দিদিও নেই!

গৌতম তার স্কুল বোডিঙের ছেলেদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিজেকে, মিলিয়ে দেখে সুনন্দর সঙ্গে। কারও সঙ্গে মেলে না।

না, সত্যিই মেলে না।

 সকলের বাড়িতেই মেয়েমানুষরা থাকে। মা তো থাকবার জিনিস, থাকেই, যদি বা গৌতমের মতো কারও মা মারা গিয়ে থাকেন, তবে ঠাকুমা কি দিদিমা, পিসিমা কি জেঠিমা, দিদি কি বউদি, থাকেই কেউ। গৌতমের মতো ঝি চাকর ভর্তি বাড়ি নয় কারও। ওর মতো এমন শুধু ড্রাইভারের সঙ্গে বাড়িতে আসতে হয় না কাউকে।

আচ্ছা, একটা দাদা বা কাকাও তত থাকতে পারত? যে অন্তত স্টেশনে নিতে আসত গৌতমকে? নেই, তাও নেই। শুধু শূন্যবক্ষ ওই গাড়িটাই আসে। যেটাকে দেখে আজ গৌতম সহসা নিজের জীবনের শুন্যতাটা আবিষ্কার করে বসল।

.

সেই শূন্য মন নিয়ে বাড়ি এল গৌতম, দেখল যথারীতি দারোয়ান সেলাম করল, চাকর এসে দাঁড়াল, আয়া ছুটে এসে প্রশ্ন করল, কী খাবে?

বলল, সব রকম খাবার প্রস্তুত গৌতমের জন্যে, ভাত ঝোল, লুচি মাংস, টোস্ট ডিম, দুধ বিস্কিট, ফল মিষ্টি! যা গৌতমের অভিরুচি, যখন যেটা খেতে চায়। এইরকমই বলে। এযাবৎ এগুলিই স্বাভাবিক বলে মনে করত গৌতম, অন্যমনস্ক ঔদাসীন্যে যা হয় একটা নির্বাচন করত। কিন্তু আজ হঠাৎ মনে হল ওর, এগুলো বাড়াবাড়ি, এগুলো বাজে!

সুনন্দর সঙ্গে সারা গাড়ি গল্প তো কম হয়নি। সুনন্দ বলেছে, গিয়ে যা হবে বুঝতেই পারছি! মা বলবে, ওখানে মাছ খেতে পেতিস না, স্রেফ মাছের ঝোল ভাত খা। একবার বাবা একজায়গায় বদলি হয়েছিল, সেখানে পটল পাওয়া যেত না। পুজোর ছুটির সময় কলকাতায় মামার বাড়ি এসে মা কেবল পটল ভাজাই খাওয়াল দুদিন। আহা রে, পটল ভাজা ভালবাসে সুনন্দ!আমি যত বলি আর খাব না, মা ততই বলবে, খানা, ভালবাসিস তো? আমি যে কী ভালবাসি সে নিজেই জানি না ছাই, মা সব মুখস্থ করে রেখে দিয়েছে।

মা মা মা!

সুনন্দর কথার মধ্যে তিন ভাগ অংশ জুড়ে বসে আছেন শুধু মা! জগৎসংসারের এত কথা যে বলে, তার মাত্রাই হচ্ছে, মা বলেন

আবার হয়তো মা সুনন্দকে কী কী কারণে কত বকেন, তাই নিয়েই চালাল এক ঘণ্টা। মোট কথা, মা যেন ওর চিন্তার জগতের সবখানি। মা দিয়ে ওর প্রাণ ভরা!

গৌতমের মনে হয় এটা যেন একটা ঐশ্বর্য! সুনন্দ একটা বিরাট ঐশ্বর্যের মালিক। সুনন্দ সেই ঐশ্বর্যের ঝকমকানি দেখায় অন্যকে।

অথচ আবার সুনন্দ হয়তো জানেও না সে কতটা ঐশ্বর্যের মালিক। যা বলে, না বুঝে বলে। কিন্তু গৌতম তো বোঝে। বুঝছে আজকাল।

নিজেকে তাই দীন-দরিদ্র মনে হয় গৌতমের। অগাধ ঐশ্বর্যের মধ্যে বসে থাকা রিক্ত শূন্য একটা প্রাণী।

হয়তো ঠিক এইভাবে ভাবতে পারে না, তবে এমনি একটা অনুভূতি ভারাক্রান্ত করে রাখে একটা শিশুচিত্তকে।

এমনটা আগে কখনও হয়নি। অন্য অন্য বারে যখন এসেছে, এই শূন্যবক্ষ গাড়ি এবং শূন্যক বাড়ি যেন অনিবার্য অবধারিতের মতো তার মনের মধ্যে চারিয়ে থেকেছে, থিতিয়ে থেকেছে। এবারেই উথলে উঠতে চাইছে। আর সেই উথলে ওঠাকে প্রশমিত করতেই নিজেকে মনে হচ্ছে দীন-দরিদ্র!

গৌতম, নিজেকেই নিজে সম্বোধন করে সে, গৌতম, তোর শুধু মা নেই তা নয়, তোর কেউ নেই। তুই দুঃখী, তুই গরিব! বাবার উপর অভিমানটাই এমন তীব্র হয়ে বিদীর্ণ করতে থাকে গৌতমকে।

অথচ

হ্যাঁ, অথচ ওদিকে সুনন্দ তখন মহোৎসাহে তার দিদির কাছে গল্প করছে, খুব বড়লোকের ছেলে। বোর্ডিঙে ওর কম কষ্ট হয় না কি? তবু ওর বাবা ওকে ওখানে রেখেছেন! কে দেখবে! মা নেই তো ওর!

বসে টাইপ মেশিনে লিনের স্থান কোথায়?

দিদি বলে, বড়লোকের ছেলে, তা গাড়ি দেখেই বুঝেছি!

গাড়ি দেখেই বোঝা যায় বইকী! ওটাই তো তাপমান যন্ত্র! বাড়ি দেখেও বোঝা যায়। যদি সুনন্দর দিদি তার ছোটভাইয়ের বন্ধুর বাড়িটা দেখত, নিশ্চয় আরও মোহিত হয়ে যেত।

মোহিত হত, বিচলিত হত!

চোখ বড় করে বলত, বাব্বা তোর বন্ধুরা কত বড়লোক!

কিন্তু সুনন্দর সেই বন্ধু এখন সেই প্রাসাদটায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে নিজেকে দীন দুঃখী ভাবছে।

ভাবছে সুনন্দর মা কী সুন্দর দেখতে! কেমন হাসি হাসি মুখ, কেমন উজ্জ্বল চোখ! সুনন্দকে দেখেই কেমন জড়িয়ে ধরলেন! তারপর হাসি হাসি মুখ নিয়েই চশমাটা খুলে চোখের জলটা মুছতে লাগলেন। আনন্দের অশ্রু বলে না? সেই তাই। সুনন্দ বলে উঠল, মা, এই আমার বন্ধু গৌতম।খুব চেনার মতো বলল।

তার মানে চিঠির মধ্যে গৌতমের পরিচয় দেওয়া হয়ে গেছে মার কাছে।

গৌতম তার বন্ধুর কথা কাউকে কিছু লেখেনি কোনওদিন। কিন্তু বাবাকে কি চিঠি লেখে না গৌতম? লেখে। লিখতেই হয়। বাবার নির্দেশ আছে সপ্তাহে দুটো করে চিঠি লেখবার। ইংরেজিতে। হ্যাঁ, ইংরেজিতে লেখা চাই।

বিদ্যেটায় কতখানি রপ্ত হচ্ছে গৌতম, তার পরীক্ষা হয়তো এটা! নিজেও তিনি ইংরেজিতেই উত্তর দেন টাইপ করে! অফিসে বসে টাইপ মেশিনে লিখিয়েই নেন হয়তো ওঁর টাইপিস্টকে দিয়ে।

সেই চিঠির আদান-প্রদানের মধ্যে নবলব্ধ বন্ধুর বর্ণনার স্থান কোথায়?

সুনন্দ তার মার চিঠির মধ্যে ভরে দিয়েছে বন্ধুকে। তাই সুনন্দর মা কাছে এসে মিষ্টি গলায় বলেছেন, ও, তুমিই গৌতম। ভাগ্যিস তুমি ছিলে! তা নয় তো এই ভূতটা ঠিক বিদ্রোহ করে পালিয়ে আসত। তোমায় পেয়ে বর্তে গিয়ে রয়ে গেছে।

গৌতমের অভ্যাস নেই কোনও মহিলার সঙ্গে কথা বলার। বোর্ডিঙে ছেলেদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন বটে অনেক মহিলা, কিন্তু গৌতমের দিকে দৃকপাত করবার গরজ তাঁদের মধ্যে দেখা যায় না। তা ছাড়া সবাই তো অবাঙালি, মন থমকে থাকে।

গৌতমের তাই অভ্যাস নেই। গৌতম তাই লাজুক লাজুক মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। সুনন্দর মা বলেন, আচ্ছা একদিন আসতে হবে কিন্তু। গাড়ি রয়েছে তোমার বাবার। অসুবিধে তো নেই কিছু!

গৌতম এবার কথা বলে। বলে, বাড়িই জানি না।

ও হো হো, তাও তো বটে!

সুনন্দর বাবা বলে ওঠেন, আচ্ছা আমিই একদিন সুনন্দকে নিয়ে বেড়াতে যাব, আর তোমাকে নিয়ে আসব, কেমন? তা হলেই দুজনের চেনাচিনি হয়ে যাবে।

আপনিও তো চেনেন না!

চিনি না! কী চিনি না? ওঃ, তোমাদের বাড়িটা? আরে ঠিকানা তো জানি। সুনন্দর বাবা হেসে হেসে বলেন, ঠিকানা জানা থাকলে, পৃথিবীর যে কোনও শহরে, যে কোনও বাড়ি খুঁজে নেওয়া যায়। অবশ্য শহরে! গ্রামে নয়।

ব্যস্ত হচ্ছিলেন ওঁরা বাস ধরবার জন্যে।

তবু সুনন্দর মা আবার বললেন, বেশ, সুনন্দ একদিন তোমাদের বাড়িতে যাবে, তুমিও একদিন আমাদের বাড়িতে আসবে। অবশ্য অবশ্য! কেমন?

সুনন্দর মা হাসেন, যদিও তোমাদের মালীর ঘরের মতোও বাড়ি আমার নয়।

গৌতম এ কথায় এত লজ্জা পেয়েছিল যে, ওই কথার প্রতিবাদ করতেও পেরে ওঠেনি।

গৌতম তাই এখন ভাবছে, যদি তখন কথা বলতে পারতাম! যদি বলে উঠতাম, কী বলছেন? একদিন আসুন না। দেখুন না, মালীর ঘরের মতো কী আবার, কিছুই না। শুধু একটু ছোট হয়তো। তা ছোট বাড়িই ভাল লাগে আমার। বড় বাড়ি কী বিশ্রি ফাঁকা ফাঁকা!

বলত আরও কত কিছু, যদি কথা বলতে পারা যেত। কিন্তু কথা বলতে পারা যায়নি। সুনন্দর মার শাড়ি থেকে, চুল থেকে, গা থেকে এমন একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছিল যে, গৌতম যেন আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল।

তা ছাড়া লজ্জা!

লজ্জা, লজ্জাই গৌতমের চরিত্রের প্রধান গুণ বা দোষ।

সব কিছুতেই ওর লজ্জা।

ও যে বড়লোকের ছেলে, এতে যেন ওর লজ্জা, ওর বাড়িতে যে বাবা ছাড়া আর কেউ নেই, এতে ওর লজ্জা, স্টেশনে ওকে নিতে এল শুধু ড্রাইভার, সেটা হল লজ্জার।

অন্য আরও পাঁচজনের মতো না হওয়াটাই গৌতম লজ্জার মনে করে।

তবু তো একেবারে শৈশব থেকে সমাজ সংসার ছাড়া, বাংলাদেশ ছাড়া, একটা প্রায় আশ্রমে মানুষ হচ্ছে। দেখছেই বা কজনকে? যা কিছু ছুটির সময়। তাও কোনও আত্মীয়-টাত্মীয়ও দেখতে পায় না। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গেও বেশি মেশার উপায় নেই, ছকে বাঁধা নিয়মের মধ্যে থাকতে হয় তাকে ভৃত্য রাজ্যের শাসনতন্ত্রে। গৌতমের বাবা গাঙ্গুলী সাহেবের তাই নির্দেশ।

কিন্তু এগুলো যে বিরক্তির যোগ্য, সে খেয়াল ছিল না গৌতমের। জানল সুনন্দর কথায়।

দুটো বাঙালি ছেলে এক হয়ে যখন গল্প করে, তখন সুনন্দর প্রশ্নবাণে বিক্ষত হয়ে গৌতম তার জীবনযাত্রা প্রণালীর অনেক কিছু বলেছে। অথবা বলতে বাধ্য হয়েছে।

না বললে সুনন্দ বলে, বাবা তুই কী মুখচোরা!

মুখচোরা শব্দটা এই প্রথম জেনেছে গৌতম, জেনেছে তার অর্থ। জেনে মুখচোরা হওয়ার জন্যে লজ্জায় সারা হয়েছে। চেষ্টা করেছে সেই স্বভাবটা বদলাতে। সুনন্দও অবশ্য সাহায্য করেছে। গড়গড় করে নিজের বাড়ির কথা, মামার বাড়ির কথা, পিসি মাসির বাড়ির কথা, সব বলে গেছে।

অতএব গৌতমও মুখ খুলেছে।

আর সেই সূত্রেই সুনন্দ চোখ গুলি গুলি করে বলে উঠেছে, ও বাবা, তোর যে দেখছি লৌহ যবনিকার অন্তরালে বাস! এই বোর্ডিং আর সেই বাড়ি! আর কারও বাড়িতে যেতে পাস না?

গৌতম লাল লাল মুখে বলেছে, যেতে পাই না কি আবার? আত্মীয়-টাত্মীয় নেই তো কেউ।

আহা তোর বাবার কোন বন্ধুও কি নেই? বন্ধুর বাড়িও বেড়াতে যায় মানুষ। আমরা তো কত যাই!

বাবার বন্ধুও নেই, এ কথা কী করে বলবে গৌতম? বাবার গাড়িতে তো সর্বদাই বন্ধু। বাবাও অনেক সময় বন্ধুর গাড়িতে। বন্ধু নিয়েই বাবার কারবার।

কিন্তু তাদের সঙ্গে যে গৌতমের কোনও যোগ থাকা চলে, তা তোকই বাবা জানায় না!

কেন? কেন? কেন বাবা গৌতমকেও ওই লৌহ যবনিকা না কী, তার অন্তরালে রেখে দেবে?

সারাদিন এলোমেলো করে বেড়াবার পর দেখা হল সন্ধ্যায়। অবশ্য দুপুরে একবার ফোন করে ছেলের নিরাপদে পৌঁছনোর খোঁজটা নিয়েছিল নিশীথ গাঙ্গুলী। সংক্ষিপ্ত বাক্ বিনিময় হয়েছে।

সন্ধ্যায় ফিরে দেখল অন্যবারের মতো গৌতম বাবা বলে ছুটে এল না। কোথায় যেন বসে আছে। নিজেই গেল ছেলের ঘরে। বলে উঠল, কী রে, তুই যে আমায় চিনতেই পারছিস না! স্বামীজিদের দেখে দেখে পিতাজিকে ভুলে গেছিস বুঝি?

গৌতম একবার তার দামি পোশাকে সজ্জিত বাবাকে তাকিয়ে দেখল, আর নতুন একটা অভিমানে বুকটা উথলে উঠল তার।

বাবা নিজে বেশ সুন্দর ভাবে আছেন।

আছেন কলকাতায় বন্ধুদের নিয়ে সেজেগুজে।

আর গৌতমের জন্য নির্বাসন দণ্ড! গৌতমের জন্য কৃচ্ছ্বসাধন!

কেন, কলকাতায় কি স্কুল নেই? যে ছেলেদের মা নেই, তারা কলকাতায় থাকে না? মাদ্রাজে গিয়ে মিশনে থাকতে হয় তাদের?

সুনন্দও বলেছে সে কথা। আমার না হয় মামা আছে এখানে, তাই! তোর কি শুনি? কলকাতার কাছে কাছেই তো কত মিশন স্কুল আছে। সেখানে রাখেনি কেন রে তোর বাবা?

হঠাৎ বিনা ভুমিকায় সেই কথাটাই বলে বসল গৌতম। ভুলে গেলেই তো বাঁচো তুমি।

তুই আমায় ভুলে গেলে বাঁচি আমি? অবাক হয় ওর বাবা!

বাঁচোই তো! নইলে ইচ্ছে করে হাজার মাইল দূরে পাঠিয়ে দিয়েছ কেন? কলকাতার কাছে কি ওই রকম মিশন স্কুল নেই?

নিশীথ কি এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল? ছিল না।

কারণ পূর্ববারেও গৌতম বাবা বলে কত কথা বলেছে। তাতে বোর্ডিং বাসের কষ্টের উল্লেখ থাকে, বাবার উপরে অভিমানের জ্বালা থাকে না।

এবার ফুটে উঠেছে জ্বালা।

তার মানে, বড় হচ্ছে গৌতম।

কিন্তু নিশীথ তো চায়নি ছেলে বড় হয়ে যাক। তাই না সেই বড় হয়ে ওঠার প্রতিরোধকল্পে অনেক পরিকল্পনা করেছে সে। একটা মাতৃবক্ষচ্যুত শিশু কি সোজা সমস্যা?

মাসি পিসির শরণ নিয়ে কি হয়ে উঠত না এটা? তা ছাড়া বাড়িতে এত দাস-দাসী! বাপের টাকা রয়েছে প্রচুর! টাকা থাকলে কী না হয়?

তবু ওই হাজার মাইল দূরটাই বেছে নিয়েছিল নিশীথ। নিয়েছিল যাতে ছেলে না পাকা হয়ে যায়, বড় হয়ে যায়।

তবু কি তাই হয়ে যাচ্ছে? অনিবার্যকে নিবারণ করা যাচ্ছে না?

অভিমান জমে উঠছে ওর মনে? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে প্রশ্ন? কিন্তু তাকে কি বাড়তে দিতে হবে?

 নিশীথও অতএব প্রশ্নে তীক্ষ্ণ হয়।

কোথায় কী আছে নেই, হঠাৎ এ চিন্তাকে মাথায় নিচ্ছ কেন? আমি কি তোমার যাতে ভাল হয় তা না ভেবেই কিছু করেছি?

ভাল না ছাই! গৌতম জেদের গলায় বলে, ছাই ভাল হচ্ছে ওখানে আমার। একটা বোকা ভূত হয়ে বসে আছি। কলকাতায় এত স্কুল, শুধু শুধু তুমি আমায়

নিশীথ গম্ভীর হয়।

বলে, তার মানে, তুমি আমার উপর আস্থা হারাচ্ছ, আমাকে আর বিশ্বাস করছ না, কেমন?

এ কথার উত্তর দেবার ক্ষমতা অবশ্য আর থাকে না গৌতমের। মাথা তো তার টেবিলের উপর, আর সে টেবিল বর্ষণসিক্ত!

বাজে বাজে কথা ভেবে মাথাটা খারাপ কোরো না-নিশীথ বলে, তুমি আমার একমাত্র ছেলে। তোমার উপর আমি অনেক আশা পোষণ করছি। এখান থেকে স্কুলের পড়া শেষ হলেই তোমাকে আমি ফিরেনে পাঠিয়ে দেব উচ্চশিক্ষার জন্যে, সেইজন্যেই

গৌতম আবার তীব্র স্বরে বলে ওঠে, বিলেতে গিয়ে তো অনেক ছেলেই উচ্চশিক্ষা লাভ করে। তার জন্যে তারা লৌহযবনিকার অন্তরালে বাস করে বুঝি?

নিশীথ চমকে ওঠে। বলে, কী? কী বললে? কীসের অন্তরালে?

লৌহযবনিকার অন্তরালে! সেই রকমই তো রেখেছ তুমি আমাকে।

নিশীথ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বলে, এসব কথা তোমায় কে শেখাল?

কে আবার শেখাবে, নিজে নিজে বুঝি শেখা যায় না কিছু?

তা যায় বটে! নিশীথ এবার ব্যঙ্গের পথ ধরে, আর দেখছি সেটা বেশ ভালই শিখেছ তুমি! যাক আজ খাওয়া দাওয়া হবে তো? না কি অনশন ধর্মঘট? আমার তো খিদেয় প্রাণ যচ্ছে। বলো তা হলে খাওয়া বন্ধ?

গৌতম তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে।

গৌতম অপ্রতিভ হয়।

গৌতম অপ্রতিভ অপ্রতিভ গলায় বলে, বাঃ আমি যেন তাই বলেছি!

.

খাবার সময় অবশ্য আবহাওয়া একটু পালটায়। একটু হালকা হয়। নিশীথ খুব সন্তর্পণে প্রসঙ্গ আমদানি করে, গৌতম তার উত্তরদানের মধ্যে সহজ হয়।

তবু

রাত্রে বিছানায় আশ্রয় নেবার পর গৌতম আর একবার ভাবে, বাবা যেন ভয় পেয়েছে। বাবার মুখটা কীরকম যেন হয়ে গেল! বাবা এবার আর আমার বোর্ডিঙের খাওয়া দাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করল না। প্রশ্ন করল না, খেলাধুলোর ব্যবস্থা কী, পড়া ভাল হচ্ছে কিনা। বাবা বলল, কাল তোকে বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামে নিয়ে যাব। অদ্ভুত সব দৃশ্য! দেখলে অবাক হয়ে যাবি।

বলল, এর মধ্যে দু-একদিন দুর্গাপুর মাসানজোর এগুলো বেড়িয়ে এলে হয়।

অর্থাৎ ছেলেকে ভয় করছে বাবা, তাই ছেলের মন রাখতে চেষ্টা করছে। নইলে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবার দিকে তো উৎসাহ দেখা যায় না কখনও।

কিন্তু বাবা কেন গৌতমকে ভয় করল?

কেন অমন সাদাটে হয়ে গেল গৌতমের প্রশ্নে?

.

হ্যাঁ সাদাটেই হয়ে গিয়েছিল বইকী নিশীথ।

 নিশীথ ভাবছিল, ভেবেছিলাম হয়তো ওর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না কোনওদিন আমায়। ভেবেছিলাম, নিখুঁত আঁটসাঁট পরিকল্পনার মধ্যে মানুষ করে ফেলব ওকে। পাঠিয়ে দেব বাইরে। এমনকী যদি বাইরেই সেটল করে, আপত্তি করব না। সমাজ সংসার থেকে দুরেই থাক সে। হচ্ছে না তা।

কিন্তু কেন? কেন প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান গাঙ্গুলী অ্যান্ড কোং-এর ডিরেক্টর নিশীথ গাঙ্গুলীর এমন সমাজভীতি?

এ প্রশ্নের উত্তর চাইতে চলে যেতে হয় অনেকটা পিছিয়ে। যখন ওই গাঙ্গুলী কোম্পানির কোনও অস্তিত্ব ছিল না কোথাও, তখনকার পটভূমিতে।

তখন এই রাশভারী গাঙ্গুলী সাহেব ছিল একটা স্বপ্নবিলাসী নাটক-পাগল প্রায় বাউন্ডুলে ছেলে। বাপের পয়সা কিছু ছিল, আর ছিল দাদা আর বউদি। কিন্তু নিশীথ তাদের জগতের ছিল না।

নতুন এক নাট্যচিন্তায় দিশেহারা সে। সে নাকি এই মজে যাওয়া দেশে আনবে নতুন চিন্তার প্রবাহ, নতুন আঙ্গিক, নতুন চেতনা।

দাদার কাছে নিত্য তিরস্কার লাভ, নিত্য সদুপদেশ। তবু পাগলা ছেলেটা গড়ে তোলে দল, খুঁজে বেড়ায় অসাধারণ প্রতিভা। তাকে যাচাই করে নিতে চায় আপন ধ্যান-ধারণার কষ্টিপাথরে।

তেমনি এক যাচাই হয়ে পাশ করা মেয়ে অতসী।

গরিবের মেয়ে, নিতান্তই আর্থিক প্রয়োজনে অভিনয় করছিল এখানে ওখানে, শৌখিন নাট্য সংস্থায়, রিক্রিয়েশন ক্লাবের ফাংশানে। সহসা চোখে পড়ে গেল নিশীথের।

চোখে পড়ে গেল।

 চমকে উঠল নিশীথ! খেপে উঠল।

এই তো! এই মেয়েকেই তো এতদিন ধরে খুঁজছে সে! এই তো তার ধ্যানের নায়িকা। শুধুই কি অপূর্ব মুখশ্রী আর অনবদ্য গঠনভঙ্গি?

সেটা তো দ্বিতীয় গুণ!

কী অনিন্দনীয় বাচনভঙ্গি, কী মাত্রার বন্ধনীতে আটকে রাখা উচ্ছলিত আবেগ!কী অদ্ভুত প্রকাশভঙ্গি, আর ভাব প্রকাশ! আর সর্বোপরি যেটা পাগল করে তুলল নিশীথকে সেটা হচ্ছে তার যেন একটা অনৈসর্গিক আবেদন।

যেন রক্তমাংসের মানবী নয় সে।

যেন স্বচ্ছ স্ফটিকে গড়া অন্য আর এক জগতের প্রতিমা।

অন্তত অতসীর সেদিনের সেই কাব্যে উপেক্ষিতা নাটকের ঊর্মিলার অভিনয় দেখে তেমনি একটা ভাব এসেছিল নিশীথের মনে।

সেই ভাব থেকে ভাবের সৃষ্টি, ভালবাসার জন্ম!

ভালবাসা!

আজ এ কথা উচ্চারণ করতে গেলে মুখটা বোধ করি বেঁকে যাবে নিশীথ গাঙ্গুলীর।

কিন্তু তখন, সেই বড় বড় চুলওয়ালা গেরুয়া খদ্দরের পাঞ্জাবি আর মিহি তাঁতের ধুতি পরা ছেলেটা ভালবাসায় বিশ্বাসী ছিল। ভালবাসা শব্দটা সসম্ভমে উচ্চারণ করত, আবেগ দিয়ে উচ্চারণ করত।

.

ভালবাসার জন্ম হল।

মিল হল হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের, ধ্যানের সঙ্গে ধ্যানের। আর নিশীথ তার কল্পনার প্রতিমাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে যেন উন্মত্ত হয়ে গেল।

নতুন নাটক নামাবে অতসীকে নিয়ে। যা লাগে লাগুক। দাদার কাছে গিয়ে আবেদন করল, দাদা, শুনেছিলাম বাবার নাকি কিছু টাকাকড়ি বিষয় সম্পত্তি ছিল, জানি না তাতে আমার কোনও দাবি আছে কিনা, কারণ আমি তো বাবার নাম-ডোবানো ছেলে। যদি দাবি থাকে তো আমাকে সেই ভাগটা দিয়ে দাও, একটা নতুন নাটক নামাব।

দাদা কড়া গলায় বলল, বাবার বিষয়ের ভাগ দাবি করে নাটক নামাবে, তার মানে অধঃপাতের শেষ সীমায় নামবে! ঠিক আছে, বুঝে নিও তোমার ন্যায্য পাওনা। তবে এটাও বুঝো, এযাবৎ তুমি একটি পয়সাও ঘরে আনননি, অথচ অনেক পয়সা ঘরের বার করেছ। দাবিটা খুব বিস্তৃত হওয়া সম্ভব নয়।

নিশীথ দাদার এই ধিক্কার গায়ে মাখল না। উৎফুল্ল গলায় বলল, এইবার পয়সা আনব। দেখো কী একখানা কাজ করব! একেবারে নতুন একটা জিনিস দেশকে দেব!

উত্তম কথা, বলে দাদা হিসেব কষতে গেল। বলতে গেলে বাঁচল!

.

তারপর নামল সেই নাটক।

নিশীথের নিজের লেখা কাহিনী, পলাশকুঁড়ি।

 সাড়া পড়ে গেল দেশে!

বিচিত্র নাটক, বিচিত্র আঙ্গিক, বিচিত্র আলোকসম্পাত! আর অভাবিত অনবদ্য অভিনয়।

বিদগ্ধ-জন ধন্য ধন্য করতে লাগল, কাগজে অনুকুল সমালোচনা! নিশীথ অতসীকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমার স্বপ্ন, তুমি আমার স্বপ্নের সার্থক রূপ! কত ভাগ্যে তোমায় আমায় দেখা!

অতসী চোখ তুলে চায়, বলে, মনে হয় যেন কত জন্ম জন্মান্তর ধরে তোমার কাছে আসবার জন্যে তপস্যা করেছি। স্বপ্ন আর তপস্যা এই নৌকোয় চড়ে ভাসতে থাকে তারা।

কিন্তু এত হলেও দাদার কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা হল না।

টাকা ঘরে এল না।

বিদগ্ধজনের প্রশংসার মূল্য যে কানাকড়িও নয়, সেটা উপলব্ধি করল নিশীথ। তবু ধ্যানভ্রষ্ট হল না। বলল, ঠিক আছে, লাভ না হোক, বেশি লোকসানও তো হয়নি। লাভের জন্যে তো নাটক করছি না আমি, করছি আমার কল্পনাকে রূপ দিতে। ভেবো না দাদা, লাভও আসবে সফলতার পিছন পিছন।…দেশের হাওয়ার মোড় ঘুরে যাবে।

দাদা বলল, ভাবতে যাব কেন? পাগল! তোমার জন্যে ভাবনা? আর তোমার হিতাহিতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী? আমার ভাগ থেকে ধার চাইতে এলে তো দেব না এক পয়সাও। তা এবার বোধ করি ওই নায়িকাটিকে বিয়ে করে ঘরে আনবে?

নিশীথ মৃদু হেসে মাথা নিচু করে বলল, বউদি বলেছে বুঝি?

না, বউদি বলতে যাবে কেন? হাওয়া বলছে, বাতাস বলছে। তবে এখন থেকেই বলে রাখছি, ওই থিয়েটারে নাচা মেয়েকে বউ করে ঘরে আনতে আমি পারব না। বাড়িটাও অতএব ভাগ হয়ে যাক। ন্যায্যমতো ভাবে আপসে পাঁচিল তুলতে চাও, না মামলা চাও?

সেদিন কিন্তু চমকে উঠেছিল নিশীথ।

 দাদার অনেক কথাই সে গা থেকে ঝেড়ে দেয়। কিন্তু সেদিন অবাক হল। চমকে গেল। সর্পাহতের মতো বলল, মামলা চাইব? আমি?

তা কি জানি! ভবিষ্যতে যদি বলে বসো দাদা আমায় ঠকিয়েছে!

 বলব না গ্যারান্টি।

যাক ঠিক আছে। উত্তম কথা।

বউদি অবশ্য তার স্বামীকে বলেছিল, বাড়িটা ভাগ করবে? বড্ড বেশি আহত হবে না ঠাকুরপো?

দাদা ক্রুদ্ধ গলায় বলেছিল, হোক! আহত হলেই তো মঙ্গল। আঘাত পাওয়াই ওর দরকার। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছ?

তা টের কেউই পায়নি। নিশীথ নিজে তো নয়ই।

নিশীথ তখন আবার নতুন নাটক নামাবার তোড়জোড় করছে।

 আর সে নাটকের নায়িকা হচ্ছে তার নিজের বিবাহিতা স্ত্রী!

.