৩১-৪০. ধ্রুব সত্যের সামনে

৩১.

মাথা নিচু করবেই। ধ্রুব সত্যের সামনে মাথা নিচু করা ছাড়া উপায় কী? কোনও কিছুই স্থায়ী নয়, এর চাইতে ধ্রুববাক্য আর কি আছে? কিন্তু সত্য বস্তুটা বড় ভয়ংকর।

সে খোলা তলোয়ারের মতো, দুপুরের সূর্যের মতো, জ্বলন্ত আগুনের মতো।

তাই হঠাৎ সে খোলা চোখের সামনে এসে দাঁড়ালে সহ্য করা কঠিন।

মৃণাল যেন মালবিকার ওই সাধারণ কথাটার মধ্যেই সেই অগ্নিস্পর্শ অনুভব করল।

স্থায়ী নয়, কিছুই স্থায়ী নয়।

বস্তু নয়, দৃশ্য নয়, কাল নয়, জীবন নয়, শোক নয়, প্রেম নয়। তা নইলে আমি আবার হাসছি, খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, পাটভাঙা স্যুট পরে অফিস যাচ্ছি। আমার দৈনন্দিন জীবনের কোনওখানে কোনও ছন্দপতন নেই!

শুধু আমি আমার কর্মস্থলে খুব শান্ত আর স্তব্ধ হয়ে থাকি, হাসি না, কথা বলি না। সেটা পারি না বলে নয়, ভয় পাই বলে।

আমি আমার মুখের উপরকার ওই বিষণ্ণ গাম্ভীর্যের আবরণটা একটু সরিয়ে ফেললেই তো ওরা আমাকে পেড়ে ফেলবে, আর অন্তরঙ্গের গলায় প্রশ্ন করতে বসবে।

কী হয়েছিল বলুন তো? হঠাৎ এমন হল! আগে থেকে শরীর খারাপ ছিল? আশ্চর্য! মাত্র কটা দিনের ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে–বেশি জ্বর হল বুঝি? ডাক্তার পেলেন না সময়মতো? কদিন ভুগেছিলেন? কী মনে হল? ম্যালেরিয়া?

সুযোগ পেলেই এই প্রশ্নের ঝাঁক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওরা মৃণালের উপর। ওদের মুখের রেখায় রেখায় মুখর হয়ে আছে ওই প্রশ্নগুলো। বুঝতে পারছে মৃণাল। তখন হয়তো মৃণালকে আবার ওই পুকুরের গল্প বানাতে হবে। যেটা সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য।

তাই মৃণাল নিজের মুখের আবরণটা একবারও অসতর্কে খসে পড়তে দিচ্ছে না।

জানে, শুধু ওইটুকুইনয়, ওই ঝাঁকের প্রশ্নগুলোর উত্তরেই তো আশ মিটবেনা ওদের যে, গোঁজামিল চলবে। ওরা শুধোতে বসবে, ঠিক কোন অবস্থায়, কটা বেজে কমিনিটের সময় কীভাবে হল! তুলে আনার পর কী কী লক্ষণ প্রকাশ পেল, কী কী উপসর্গ দেখা দিল, ডাক্তার কী প্রেসক্রিপশন করল, ঠিকমতো ব্যবস্থা হল কিনা, এগুলো নিখুঁত ভাবে শুনে অবহিত হতে চাইবে তারা।

যেন তাদের এক সহকর্মীর স্ত্রীর মৃত্যুকালের সমস্ত ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ না শুনলে ভাত হজম হবে না তাদের।…তারপর সান্ত্বনা দিতে বসবে।

এই ভয়েই স্বাভাবিক হতে পারছি না আমি, ভাবে মৃণাল। না হলে মাঝে মাঝেই তো কথা কয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়।

ভয় বাড়িতেও কিছু আছে বইকী!

মার সামনে সহজ হতে হতে হঠাৎ কঠিন করে ফেলি আমি নিজেকে, ভাবল মৃণাল। পাছে মা ভাবেন আমি জ্যোতিকে ভুলে যাচ্ছি। পাছে মা মনে করেন আমার মধ্যে গভীরত্ব নেই।…আরআর পাছে অন্য কিছু সন্দেহ করে বসেন।

তাই আমি যখন হঠাৎ কোনও রান্নার প্রশংসা করে বসি, যদি মার ওই পাতানোনা মেয়ের প্রতি ভালবাসার আতিশয্য দেখে কৌতুক করে হেসে উঠি, সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে শক্ত করে নিই, নিজেকে গম্ভীর আর মলিন করে নিই।

তার মানে আমি শোকের অভিনয় করে প্রমাণিত করতে চেষ্টা করি, জ্যোতিকে আমি ভুলে যাচ্ছি না।

হঠাৎ ওই মেয়েটার উপর ভারী রাগ আসে মৃণালের।

ওই মেয়েটাই আমার জীবনের শনি!

ও যেন কোন অদৃশ্য আকাশ থেকে ওর অশুভ ডানার ঝাঁপটায় জ্যোতিকে সরিয়ে দিয়ে নিজে এসে সেই শূন্য স্থানটার মধ্যে জেঁকে বসেছে।

যেন ওর আসা আর জ্যোতির হারিয়ে যাওয়া একটাই ঘটনা।

 তারপর ও আস্তে আস্তে সব গ্রাস করছে।

 আমার শোক, আমার শুভ্রতা, আমার প্রেম।

ও আমার সংসারটাকেও গ্রাস করে নিয়েছে।

 আমার মাকে, আমার বাবাকে।

জ্যোতির জন্যে আর ওঁদের মনে এতটুকু শূন্যতা অবশিষ্ট নেই।

 জ্যোতির কাজগুলো হাতে তুলে নিতে নিতে অলক্ষ্যে জ্যোতির আসনটাও দখল করে নিচ্ছে।

অথচ ওর বিরুদ্ধে বলবার কিছু পাচ্ছি না আমি। সেই আসনটা মালবিকা চুরি-ডাকাতি করে নিচ্ছে না, নিচ্ছে না জাল-জোচ্চুরি কি কৌশল করে। প্রকৃতির চিরন্তন নিয়মে সে আসন আপনি এসে যাচ্ছে ওর অধিকারে।

অথচ আমি সেই অনিবার্যের দর্শক হয়ে বসে আছি, সেই অন্যায় দখলের প্রতিবাদ করছি না।

আমি পরমানন্দে দেখছি, লীলাবতীর শুধু উঠতে বসতে মালবি মালবি–

মালবি, আমার সেই কালোরঙের গরম চাদরটা কোথায় রে? মালবি, এবারে কি ধোবার বাড়ি থেকে আমার চওড়া সবুজ পাড়ের শাড়িটা এসেছে?..মালবি, মাছটা কী হবে বল তো, ঝাল না ঝোল?…মালবি, দুধ কি কিছু বেশি নেওয়া হবে, অনেকদিন পায়েস হয়নি।…মালবি, তোর আজকে ফিরতে একটু দেরি হবে বললি না? বিকেলে কী কুটনো হবে বলে দিয়ে যাস বাপু!

মালবিও সঙ্গে সঙ্গেই বলে, বিকেলের কুটনো আমি কুটে রেখেছি মা, খাবার ঘরের তাকে ঢাকা দেওয়া আছে। তুমি ব্যস্ত হোয়য়া না, আমি এলেই রান্না হবে। বলে, আজ আর পায়েস কেন মা? মাংস হচ্ছে। কাল হবে না হয়।বলে, ঝাল তো বাবার সহ্য হয় না, মাছের ঝোলই হোক মা!

হ্যাঁ, মা আর বাবা!

মা, মা, মা!

সবুজ পাড়ের শাড়িটা তো গতবারেই এসেছে মা, আপনার আলমারিতে রেখেছি। কালো চাদরটা কাঁচতে পাঠিয়েছি, বলেছে দেরি হবে, দু-একটা রিপু করতে হবে।

নিজে থেকেও বলে, মা, আজ আমার স্কুল নেই, প্রতিষ্ঠাতার জন্মদিবস। দোকানে যাবে বলছিলে না? আজ যাবে তো চলো।…মা, ছোটমাসির অসুখ বললে, দেখতে যাবে তো যাও না, আমি সব ঠিক করে নেব।

মাঝে মাঝেই লীলাবতীকে এখানে ওখানে বেড়াতে যাবার সুযোগ দেয়, আমি সব ঠিক করে নেব বলে।

ঠিক অতএব হচ্ছে।

ভক্তিভূষণেরও সমর্পিত-প্রাণ অবস্থা। যেন বিরূপতা কেটে যাচ্ছে। এত বেশি হুঁশিয়ার মেয়েটা যে, ওর হাতে সমর্পিত-প্রাণ হওয়া ছাড়া উপায় থাকেনি।

ভক্তিভূষণ কখন কখন ওষুধ খান, সেকথা ভক্তিভূষণ জানেন না, জানে মালবিকা। ভক্তিভূষণ কখন কোন কাপড়-জামাটা পরবেন সে নির্দেশ মালবিকার। ভক্তিভূষণ বর্ষার দিনে চান করবেন কিনা, এবং গরমের দিনে কতটা জোরে পাখা চালাবেন, সে খবরদারির দায়িত্ব মালবিকারই।

জ্যোতি এতটা পারত না।

জ্যোতির সমস্ত চিন্তা-চেতনা হিল্লোলিত হত আর একটি লক্ষ্যে। জ্যোতি কর্তব্যর থেকে আনন্দকে প্রাধান্য দিত। তাই জ্যোতির কর্মনিষ্ঠা মাঝে মাঝেই স্থিরবিন্দু থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ত। বার্ধক্যের অসহিষ্ণুতা যেটা সহজে ক্ষমা করতে নারাজ।

তাই জ্যোতির সঙ্গে তুলনা বন্ধ হয় না।

আর মালবিকাই যেন সে তুলনায় অতুলনীয় হয়ে ওঠে।

 কর্মনিষ্ঠা বড় ভয়ানক হাতিয়ার! মন জয় করে নেবার পক্ষে এর মতো অস্ত্র অল্পই আছে।

কর্মনিষ্ঠা, অনন্যচিত্ততা, সংযম, ধৈর্য!

 বয়স্ক মন এর কাছে আত্মসমর্পণ না করে পারে না।

 তাই ভক্তিভূষণের বিরূপ মন আস্তে আস্তে বশ্যতা স্বীকার করছে।

ভক্তিভূষণ যখন মালবিকাকে তাঁর পারিবারিক সম্ভ্রম রক্ষার উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তখন বিরূপ ছিলেন না। তখন বরং যেন হাতে চাঁদ পেয়েছিলেন।

কিন্তু ভক্তিভূষণ ধারণা করেননি কলকাতায় এসে লীলাবতী এতখানি করে তুলবেন। যে মেয়ের জাতকুল কিছুই জানা নেই, নিজের পরিচয়পত্রে স্বাক্ষর করবার জন্যে যে নিজেই কলম হাতে নিয়েছে, ত্রিসীমানায় একটা আত্মীয় বন্ধু দেখাবার ক্ষমতা যার নেই, তাকে একেবারে প্রাণের পুতুল করে তোলাটা বড় বেশি আতিশয্য ঠেকেছিল ভক্তিভূষণের।

আর নিতান্ত বিসদৃশ লেগেছিল মৃণালের কাছে ওই মেয়েটাকে এগিয়ে দেওয়া। লীলাবতী হয়তো তাঁর বিরহব্যথিত পুত্রের তাপিত চিত্তে একছিটে শীতল বারি নিক্ষেপ করতে একটা অসামাজিক কাজই করে বসছিলেন, কিন্তু ভক্তিভূষণ তাতে ক্রুদ্ধ হচ্ছিলেন।

পিতৃস্নেহ অনাবিল, পিতৃস্নেহ অতি-মাতৃস্নেহের মতো অনিষ্টকারী নয়।

আবার, যদি ভক্তিভূষণ ও ঘরে মৃণালের হঠাৎ হেসে ওঠার শব্দ পেতেন, রাগে জ্বলে যেতেন।

ভক্তিভূষণের মনে হত, ছেলেটা এত অপদার্থ? এত অসার? এত ভালবাসা ছিল, এত গলাগলি ছিল, দুদিনে উড়ে গেল সব! ছি ছি! ওই মেয়েটাও ঘুঘু, কেমন তুকতাক করে মা ও ছেলেকে মুঠোয় পুরে ফেলছে। আমার সেই লক্ষ্মীপ্রতিমার জন্যে এতটুকু হাহাকার নেই কারুর মধ্যে!

ছি ছি!

অনবরত ওই ছি ছি।

গোড়ায় গোড়ায় মালবিকাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখলে জ্বলে যেতেন। বলতেন, নিজে বলেছে মিত্তির, তো মিত্তির? ভগবান জানেন! ওকে দিয়ে ভাত না রাঁধালে হবে না?…তোমার গতরে কী হল?

লীলাবতী অবশ্য এ অপমান সহ্য করে নিতেন না। লীলাবতী চাপা ক্রোধের সঙ্গে বলতেন, আমার গতরে আগুন লেগেছে। প্রাণ বলে বস্তুটা থাকলে বুঝতে পারতে, কী হচ্ছে আমার ভিতর। আমার হাত পা উঠবে না আর।..ইচ্ছে হয় রাঁধুনি রাখো, ইচ্ছে হয় স্বপাক খাওগে। আমি ওর হাতেই খাব।

লোকে দেখলে বলবে, বিনি মাইনের একটা রাঁধুনি পেয়ে গেছ

লোকে বললে আমার গায়ে ফোঁসকা পড়বে না।

ও নিজেও ভাবতে পারে।

তোমার মতন কুটিল মন সবাইয়ের নয়।

 কিন্তু আস্তে আস্তে সেই কুটিল মন সরল হয়ে গেছে।

 বিরূপ চিত্ত বিগলিত চিত্তে পরিণত হয়েছে।

আর এও লক্ষ করেছেন ভক্তিভূষণ, মেয়েটাকে যা ভেবেছিলেন, তা নয়।

একটা তরুণী মেয়ে আপন হৃদয়ের বালাই না রেখে শুধু একান্তচিত্তে সেবা করে যাচ্ছে, এহেন দুর্লভ ঘটনাকে কতদিন অবহেলায় ঠেলে রাখা যায়?

ভক্তিভূষণের এখন উঠতে-বসতে মা মা!

মালবি নয়, শুধু মা।

লীলাবতী এখন ওই উপলক্ষে সরস কথার স্রোত বহান।

অ মালবি, দেখ তোর বুড়ো খোকা মা মা করে হাঁক পাড়ছে কেন?…অ মালবি, তোর ধাড়ি ছেলে কী বলছে শোন।…ওরে মালবি, শুনছিস তোর ছেলের নেমকহারামি কথা–আমার রান্না নাকি আর ওঁর মুখে রোচে না।

কথার লীলা!

 কথার মাধুরী!

 জ্যোতিকে নিয়ে এতটা হত না।

জ্যোতির হাতের রান্না দুদৈর্বে পড়ে ছাড়া গলা দিয়ে নামানো চলত না।

জ্যোতি সেবা যত্ন যা কিছুই করুক, তার মধ্যে পালাই পালাই ভাবটা স্পষ্ট হয়ে উঠত।

শুধু দুদণ্ড কাছে বসে থাকা জ্যোতির কোষ্ঠীতে লিখত না। কাজ সারা হলেই জ্যোতি ঘরে গিয়ে বই পড়ত, সেলাই করত, শুয়ে বসে থাকত।

 মালবিকার নিজস্ব কোনও ঘর নেই।

 মালবিকা তাই সর্বদাই কাছে কাছে।

মালবিকা স্কুলের চাকরিটা নিয়েছে বটে, তথাপি মনে হয় না সরে গেছে। যাবার সময় পর্যন্ত দেখে যায় কোথাও কোনও ত্রুটি রইল কি না। আবার এসেই কোমরে আঁচল জড়ায়।

লীলাবতী রেগে রেগে বলেন, আমি কি তোকে ঝি রেখেছি?

মালবিকা হেসে বলে, তাই তো! ঝি মানে কী, নিজেই বলো।

লীলাবতী বলেন, রোস একটা পাত্তর জুটিয়ে তোকে শ্বশুর-ঘরে পাঠিয়ে বাঁচি।

মালবিকা বলে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে মা! তবে দোহাই তোমার, ও শাস্তিটা মনে ভেঁজো না।

কেন ভাঁজব না? ভাঁজছি তো।

তা হলে পিটটান দেব। ওই ভয়ে কাকার বাড়ি ছেড়েছিলাম। কাকার শালার সঙ্গে বিয়ে দেবে বলে কাকি হেসে ফেলে মালবিকা, বুঝতেই পারছ পাত্রটি কেমন?

তা আমি কি তোকে ভাল বিয়ে দেব না? তেমনি পাত্রে ধরে দেব?

আমার ভালয় কাজ নেই মা! তোমার কাছে না রাখতে চাও তো ফুটপাথে ছেড়ে দাও।

তুমিই বলে।

নইলে লীলাবতী রাগারাগি করেন।

 লীলাবতী যেন এই মেয়েটাকে উপলক্ষ করে বাৎসল্যের লীলায় বিকশিত হতে চান, মেয়ে যে ছিল না, তার শোধ তোলেন।

আর মালবিকা সে লীলায় আড়ষ্ট হয় না, বিরক্ত হয় না।

তা হলে?

 কিন্তু এ তো গেল বয়স্ক দুই প্রাণীর চিত্তজয়ের ইতিহাস। তারা না হয় পরাভূত? কিন্তু এ সংসারের অল্পবয়স্ক সদস্যটির চিত্তের সংবাদ কী?

সেও কি ওই একই অস্ত্রে নিহত?

এমনিতে তো সে বলে, এ বাড়ির গৃহিণী শ্রীমতী লীলাবতী দেবী কত করে মাইনে দেন আপনাকে?

বলে, আত্ম-নির্যাতনেরও একটা সীমা থাকা উচিত। এটা হচ্ছে কী?…জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবকিছুর দায়িত্ব যে আপনারই, এটাই বা কোন চণ্ডীতে লেখা আছে বলুন তো?

আবার কখনও কখনও গাম্ভীর্যও দেখায়। বলে, আমার টেবিল কারুর সাফ করবার দরকার নেই, আমি নিজেই করে নেব। আমার ঘরের পরদা, বালিশ ঢাকা কে সাবান দিল? না না, আমি এ সব পছন্দ করি না।

আপনি বিরক্ত হন? মালবিকা বলে।

হ্যাঁ, হই। দস্তুরমতো হই–মৃণাল দৃঢ় হয়, এ ঘরের কোনও কাজ করবার দরকার নেই। আশ্চর্য! এ বাড়িতে তো আগে একটা ঝি ছিল দেখেছি, সেটা কোথায় গেল বলতে পারেন? ছেড়ে গেছে?

মালবিকা ওর ভঙ্গিতে হেসে ফেলে বলে, ছেড়ে যাবে কেন?

 যায়নি তো তার বাড় এত বেড়ে গেছে কেন যে, বাড়ির লোকে ঘর সাফ করবে, সাবান কাঁচবে?

বাড়ির লোক?

মালবিকা চোখ তুলে একবার তাকায়।

তারপর সে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলে, ওর কাজ বড় নোংরা।

হোক গে। তা বলে নিজের হাত নোংরা করতে হবে না।

হাতের কাজে হাত নোংরা হয় না–মালবিকা হেসে বলে, কোনও নোংরা কাজেই নয়।

মৃণাল ওই হাসির দিকে তাকিয়ে চোখ নামায়।

তা তিলে তিলে হয়তো এই অস্ত্রেই নিহত হচ্ছে এ বাড়ির তরুণবয়স্ক সদস্যটি। একটি বুদ্ধিমার্জিত মনের সঙ্গে কথা বলার সুখ, একটি শান্ত সভ্য ধৈর্যশীল প্রকৃতির সাহচর্যের সুখ, অহরহ একটি সুকুমার সুষমার দর্শক হওয়ার সুখ, অর্থহীন জীবনের ভারগ্রস্ত দিনগুলোকে কিছুটা হালকা করতে পাওয়ার সুখ, এগুলো কি সোজা মূল্যবান? এই মূল্যেই বিকিয়ে যাওয়া যায়।

তা ছাড়া হাল ভেসে যাওয়া সংসার-তরণীর সুশৃঙ্খল গতি, আর উদ্বেলিতচিত্ত প্রৌঢ় মা বাপের চিত্তের শান্তি, এ দুটোও তাকে জয় করার কাজে লেগেছি বইকী!

হয়তো বা ওইটাই প্রধান। পুরুষ হচ্ছে সুশৃঙ্খল সংসারযাত্রার কাঙাল। সেই পরম বস্তুটি যে তাকে দিতে পারে, পুরুষ মনে মনে তার কেনা না হয়ে পারে না।

.

কিন্তু মালবিকা?

এ বাড়ির ওই কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েটা?

সে তো এ সংসারকে অনেক দিচ্ছে।

তবে নিজে কেন সে কেনা হয়ে আছে?

কেন শত দাসত্বেও ক্লান্তি নেই তার? আর শুধু এই পাতানো মেয়ের চাকরিটুকুতেই বা এত কী সার্থকতা তার? সুখই বা কী? অথচ আছে সুখ, আছে সার্থকতা।

আছে যে, সেটা তার চোখে মুখে আঁকা হয়ে গেছে।

আশাহীন ভবিষ্যৎহীন এই জীবনের মধ্যেই যেন তার পরম পূর্ণতা।

.

আশাহীন বইকী!

ভবিষ্যৎহীনও।

যেখানে সে মনের নোঙর ফেলেছে, সেখানের মাটি আলগা, খুঁটি পোঁতবার ভরসা নেই।

অথচ সেই প্রথম দিন যখন অচৈতন্যের অন্ধকার থেকে উঠে এসে প্রথম চৈতন্যের দরজায় চোখ ফেলেছিল, তখনই জীবনকে বিকিয়ে বসেছিল। তারপর ধীরে ধীরে,কাজে অকাজে, আলাপে স্তব্ধতায়, ঔৎসুক্যে আর অবহেলায় ভরে উঠছে সেই মন।

মৃণাল যখন আগ্রহের চোখে তাকায়, তখন সুখে আনন্দে কৃতজ্ঞতায় মন ভরে। মৃণাল যখন অন্যমনস্কের মতো ওকে ভুলে গিয়ে আপন হৃদয়ভাবের মধ্যে নিমগ্ন থাকে, তখন শ্রদ্ধায় বিশ্বাসে মন ভরে ওঠে।

লোকটা বাজে নয়, অসার নয়, তরলচিত্ত নয়, সুযোগ-সন্ধানী নয়।

ভালবাসার পক্ষে এই তো অনেক।

তা ছাড়ালীলাবতীর ভালবাসা?

তাকেও কম মনে করে না মালবিকা। যদিও তার অনেকটাই আতিশয্যের ফেনা, অনেকটাই ধরে রাখবার আকুতি, অনেকটাই আত্মবিকাশের লীলা, তবু ভিতরের বস্তুটা খাঁটি বইকী!

মালবিকাও অনেক পেয়েছে।

পেয়েছে আশ্রয়, পেয়েছে স্নেহ, পেয়েছে সম্মান।

এবং আরও একটা দুর্লভ বস্তু!

সেটাও যে তিলে তিলে সঞ্চিত হচ্ছে মালবিকারই জন্যে, সেটাও টের পাচ্ছে মালবিকা।

মালবিকা লোভের হাত বাড়াবে না সেখানে, তবু তার জন্যেই যে জমা হচ্ছে ঐশ্বর্য সেটা জানাই কি কম সুখ?

.

বহু বিচিত্র অনুভূতির মধ্যে মালবিকার মন তৈরি হচ্ছে। একদিকে কুণ্ঠা, লজ্জা, অনধিকার প্রবেশের অপরাধী ভাব, আর ভালমন্দের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে গভীর চাঞ্চল্য, অপরদিকে অনাস্বাদিত এক স্বাদের তীব্র আকর্ষণ। জীবনে কবে ভাললাগার স্বাদ পেয়েছে মালবিকা? জীবনে কবে মালবিকা কারও কাছে মূল্যবান হয়েছে?

না, শৈশবে অনাথ মালবিকা ছিল মূল্যহীন।

তাই সে প্রতিদিন মনে করেছে, এবার মায়া কাটিয়ে চলে যাই, আর প্রতিদিনই আরও একপাক বন্ধনের গ্রন্থিতে আটকে গেছে।

কলকাতায় এসে পড়ে যখন তখুনি যেতে পেল না মালবিকা, তখন ভাবল, তা বেশ, চশমাটাই হোক। ওটা না হলে তো কিছুই হবে না। দয়ার দানই নিতে হবে।

মৃণাল হেসে বলেছিল, চক্ষুদান।

মালবিকা মনে মনে বলল, দৃষ্টিদান। পৃথিবীকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম তোমার মহত্ত্বে, তোমার সুষমায়।

চশমাটা যেদিন হল, সেদিন মৃণাল অফিসে জয়েন করেছে।

দুপুরবেলা খালি ঘরটা ঝাড়তে ঢুকল মালবিকা। আজই তো প্রথম স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছে, সেলফে কী কী বই, দেয়ালে কার কার ছবি, টেবিলে দাঁড় করানো স্ট্যান্ডটায় যে ছবি, তার মুখটা কেমন।

দেখল, দেয়ালে দেয়ালে শুধু একটি রমণীয় রমণীমূর্তির বহু ভঙ্গি। বিয়ের পর কিছুদিন ধরে চলেছিল ওই ফটোর মাতামাতি।

জ্যোতি বলত, এত ছবি দেয়ালে টাঙাবার দরকার কী? অ্যালবামে থাক না?

আহা, অ্যালবামে তো রয়েইছে–মৃণাল বলত, কত রয়েছে, এনলার্জডগুলো অ্যালবামের জন্যে নয়।

তোমার সারা দেয়ালে কেবল আমি, লজ্জা করে না বুঝি?

আমার সারা পৃথিবীতেই তো তুমি, লজ্জাটা তবে তুলে রাখবে কোথায়?

মা ঘরে ঢোকেন, ভারী ইয়ে হয়–

মা বাবার সামনে তুমি বেরোচ্ছ না? ঘুরছনা, ফিরছ না? হাসছনা, কাজ করছ না? তবে? ছবিগুলো দেখলেই দোষ?

ওটা একটা যুক্তি হল? আমি হলাম শুধু আমি, আর ছবিগুলো হল তোমার আমি।

মার যদি বাস্তব বুদ্ধি থাকে, তো বুঝবেন দুটোই এক। সব তুমিটাই আমার।

তা বলে কেউ বউয়ের এত ছবি তুলে দেয়ালে ঝুলোয় না। জানো, মা তোমায় বলেন, কী বেহায়া!

সব মায়েরাই বলে থাকেন। ছেলে বউকে ভালবাসলেই বেহায়া।

সে ভালবাসার ছবি তুলে রাখলে তবে কী হয় বলো?

বলে নিজেই নতুন করে ভালবাসার ছবি হয়ে যেত জ্যোতি।

নতুন চশমা পরে সেই বহু আলোচিত আর বহু ভঙ্গির ছবিগুলি দেখতে পেল মালবিকা। অবর্ণনীয় একটা যন্ত্রণাবোধ হতে লাগল। আস্তে টেবিলে রাখা শুধু একখানি মুখকে দেখতে লাগল অপলকে।

আস্তে আস্তে সেই মুখও যেন জীবন্ত হয়ে উঠে তাকিয়ে থাকে মালবিকার দিকে। কিন্তু সেই মুখটায় কোনও অভিযোগ নেই, বিদ্রূপ নেই, করুণার ভঙ্গি নেই। শুধু হাস্যোজ্জ্বল। শুধু সুখের সাগরে ভাসা রানি রানি ভাব।

অনেকক্ষণ দেখতে দেখতে হঠাৎ ওই রানি-রানি মুখটার প্রতিই করুণা এল মালবিকার।

মনে মনে বলল, কী দুঃখী তুমি, কী দুঃখী!

নিজের সেই যন্ত্রণা-যন্ত্রণা ভাবটা মুছে গেল, শুধু যেন একটা অপরাধিনী ভাব রয়ে গেল।

সেটাই রয়ে গেছে বুঝি আজও, অথবা বাড়ছে।

.

অথচ তারপর কত দিন চলে গেল, কত সান্নিধ্য আর সাহচর্যে সহজ হয়ে উঠল ব্যবহার। এখন এ বাড়ির কুড়নো মেয়েটাও এ বাড়ির মালিকের ছেলেকে বকতে পারে, শাসন করতে পারে।…

অনুক্ত বাণীতে কোথায় যেন একটা অধিকারের দাবি ঘোষিত হয়ে গেছে।

এখন আর মনে পড়ে না, ওই মালবিকা নামের মেয়েটা এ বাড়িতে কোনওদিন ছিল না।

এখন আর চোখে পড়ে না, এ বাড়ির একটা ঘরের দেয়াল জুড়ে জ্যোতি নামের একটা মেয়ের দেদার ছবি ঝোলানো রয়েছে।

এখন আর বোধহয় কোনওদিন সেই ছবি-ঝোলানো ঘরের মালিক ঘুম না হওয়া রাত্রে জানলায় দাঁড়িয়ে ব্যাকুল প্রশ্নে উত্তাল হয়ে ওঠে না, জ্যোতি, তুমি কি তা হলে সত্যিই হারিয়ে গেলে?…জ্যোতি, তুমি যেখানেই গিয়ে পড়ে থাকো, একটা চিঠিও তো দিতে পারতে?..জ্যোতি, তুমি তবে মারা গেছ? জ্যোতি, ওই আকাশের তারাদের সঙ্গে মিশে গেছ তুমি?

হয়তো এখন সে বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।

হয়তো আর কোনও মুখ তার স্বপ্নে ছায়া ফেলে, যে মুখ জ্যোতির নয়। সময়ের ধুলোয় জ্যোতির মুখ ক্রমশই ঝাপসা হয়ে আসছে।

.

৩২.

দিন যাচ্ছে, যাচ্ছে রাত্রি!

সূর্য আপন কক্ষে আবর্তিত হচ্ছে। নিত্যনিয়মে পৃথিবী তাকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে, ঋতুচক্রের আবর্তন অব্যাহত।

এই গতি রচনা করে চলেছে ধুলোর বৃত্ত। আর সেই ধুলোর স্তর পড়ে চলেছে জীবন, চিন্তা, ধ্যান-ধারণা, জগৎ-সংসারের সবকিছুর উপর। ঢাকা পড়ে যাচ্ছে নীচের ভূমি, ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে আগের রং।

জ্যোতি ক্রমশ শুধু একটি ফ্রেমে বাঁধা ছবি হয়ে যাচ্ছে।

মালবিকার মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে সেই ঝাপসার উপর। এখন শুধু একটি সমারোহময় অভিষেকের অপেক্ষা।

সে অভিষেকের প্রস্তুতি যবনিকার অন্তরালে কম্পমান।

 কিন্তু মৃণাল কি এতই অপদার্থ? এত শীঘ্র জ্যোতিকে ভুলে গেল? খুঁজল না তাকে ভাল করে? হারিয়ে ফেলে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে রইল?

জ্যোতির জন্যে কোনও কিছু ত্যাগ করল না? জ্যোতির ধ্যানে সমাহিত হয়ে রইল না? সাধারণ মানুষের মতোই খেল, ঘুমোল, কাজ করল, দোকান গেল, বই পড়ল, কথা বলল? তা হলে তো ধিক তাকে!

না, এতটা অবিচার করা চলে না মৃণালের উপর। করেছিল বইকী অনেক কিছু! হারিয়ে-যাওয়া মানুষকে খোঁজবার যা যা উপায়-পদ্ধতি আছে সংসারে, তার সবই করেছিল। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, পুলিশ-ঘর করেছিল, উড়ো-ভাসা কোনও খবর পেলেই ছুটেছিল সেখানে, চেষ্টার ত্রুটি করেনি।

তিন-তিনটে বছর তো কম নয়! কতই করল? এরপর আর কী করবে?

ক্রমশ মেনে নিয়েছে অমোঘ অনিবার্যকে।

যেমন মেনে নেয় মানুষ মৃত্যুকে। মৃত্যুর শূন্যতাকে।

অপূরণীয় ক্ষতিও যখন ঘটে, তখন করবার কিছু থাকে কী? পরম প্রিয়জন চলে যায়, হয়তো একে একে সবাই যায়, তবু তারপরও মানুষকে চলতে হয় সংসারপথে। আত্মহত্যা করে জীবনের শেষ করে না ফেললে, চলতেই হবে যথাযথ নিয়মে। দেহটাই যে প্রধান শত্রু, আর পরম প্রভু। দেহ থাকলে সবাইকে রাখতে হবে।

প্রথমটায় তো এ চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিল মৃণাল, ছেড়ে দিতে চেয়েছিল এই ফ্ল্যাট, এই পাড়া, এই শহর।

আত্মীয় বন্ধু পরিচিত সমাজ, ছাড়তে চেয়েছিল সবাইকে।

কিন্তু ভক্তিভূষণ একটি পরম প্রয়োজনীয় কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। স্থিরবুদ্ধি গৃহকর্তা ভক্তিভূষণ বললেন, এ বাসা ছেড়ে দিলে কোনওদিন আর তাকে পাবার আশা থাকবে না।

স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল মৃণাল। উপলব্ধি করেছিল এ কথার সত্যতা।

সত্যিই আশা থাকবে না। খবর যা-কিছু আসবে, এই ঠিকানাতেই আসবে।

চিঠি যদি কারও আসে, এই ঠিকানাতেই আসবে। আর–?

আর নিজে যদি কোনওদিন এসে হাজির হতে পারে সে, এই বাসার দরজাতেই আসবে। তবে? তবে আর কি, ছাড়া হল না বাসা। আর বাসাই যদি ছাড়া হল না তো কাজ ছাড়া চলে কী করে? অতএব দৃশ্যত ওই মৃত্যু-সংবাদটাই চালু করতে হল। খোঁজাখুঁজি চলতে লাগল তলে তলে।

আর বলতে গেলে তো মৃত্যুই।

 যাকে আর পাবার আশা নেই, সে মৃত ছাড়া আর কী? খোঁজটা আত্মমর্যাদা। নিশ্চেষ্ট থাকাটা নিজের কাছে নিজেকে ছোট করা। নিজের কাছে, সংসারের কাছে, আর বাড়িতে এসে পড়া ওই অতিথিটির কাছেও সম্ভ্রম বজায় রাখতে বহুদিনই চলল ব্যর্থ চেষ্টার পুনরাবৃত্তি।

সেই চেষ্টায় অংশগ্রহণ করেছে মালবিকাও।

মালবিকা কাগজের অফিসে গিয়েছে, মালবিকা মৃণালের সঙ্গে পুলিশ-অফিসে গিয়েছে।

লীলাবতী বলেছেন, ওই মন-ভাঙা ছেলে একা যায়, আর আরও মন ভেঙে বাড়ি ফেরে। এমন একটা কেউ নেই যে সঙ্গে সঙ্গে যায়। আমার ইচ্ছে করেই ওর সঙ্গে।

তখন মালবিকা বলেছে, আমি তত বেকার বসে আছি, যেতে পারি।

এতে কেউ আশ্চর্য হয়নি। কারণ, এ যুগে মেয়েতে ছেলেতে কাজের পার্থক্য নেই। লীলাবতীর যুগ নয় যে, ইচ্ছে নিয়ে ঘরের খাঁচায় পাখা ঝাঁপটাবে বসে বসে। এ যুগে মেয়ে যে মেয়ে, সেটা প্রমাণ হয় শুধু লুঠের সময়। রাবণের আমল থেকে এ ঐতিহ্যটা অব্যাহত আছে কিনা!

মালবিকা বলেছিল, যেতে পারি।

যেত। প্রায়ই যেত।

সেই একত্র যাওয়া-আসার সূত্রেই হয়তো অলক্ষ্যে একটি বন্ধন-সূত্র রচিত হতে থাকল। চাঁদের মা বুড়ি অবিরাম চরকা চালিয়ে যে সুতো বাতাসে উড়িয়ে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়, সেই সুতোই তো ওই। বন্ধনের কাজে লাগে।

বাঁধা যে পড়েছে, এ আর কারও অবিদিত থাকছে না। আর অবিদিত থাকছে না বলেই যেন সাহসটা যাচ্ছে বেড়ে, অধিকারবোধটা আসছে সহজে।

এখন মৃণাল অনায়াসেই বলতে পারছে, লাইট-হাউসে একটা ভাল ছবি এসেছে, চলো না দেখে আসা যাক।

তুমিই চলছে। লীলাবতীই বলে বলে ভয় ভাঙিয়েছেন। বলেছেন, হ্যাঁ রে, আমি মেয়ে বলি, আর তুই ওকে আপনি-আজ্ঞে করিস?

তখন মৃণাল উত্তর এড়িয়েছে। বলেছে, ভালই তো! মান্য-ভক্তি করি তোমার মেয়েকে।

থাম বাপু! না না, তুমি বলবি। বাড়ির মধ্যে ঘরের মেয়েকে আপনি-আপনি করিস, শুনতে ভাল লাগে না।

মৃণাল হাসত। মালবিকাকে উদ্দেশ করে বলত, এই শুনুন। মাতৃদেবীর আদেশ পালনার্থে আপনাকে তুমি বলতে হবে।

মালবিকা হাসত, ভালই তো।

এখন তো বলছেন ভাল। এরপর হয়তো মান্য-ভক্তি কমে যাচ্ছে ভেবে রাগ হবে।

 রাগতে দেখলে আবার না হয় আপনি ধরবেন।

এইভাবেই সহজ হওয়া। তুমিতে নেমে আসা।

তারপর নিত্যদিনের সাহচর্যে, কখনও চকিত একটু হাসির মধ্যে, কখনও গভীর একটু চাওয়ার মধ্যে, কখনও বেদনার মধ্যে সেই সহজ এসে দিয়েছে ধরা।

ক্রমশ বলা যাচ্ছে, লাইট-হাউসে একটা ভাল ছবি এসেছে, চলোনা, দেখে আসা যাক।বলা যাচ্ছে, এই, তুমি যে কী বইয়ের কথা বলছিলে সেদিন, চলো না কিনে আনা যাক।

মালবিকা যদি বলে, বই লাইব্রেরি থেকে এনে পড়ে নিলেই চলবে, মৃণাল তাকে ভাল বই কাছে রাখা সম্পর্কে যুক্তি দেখায়।

মালবিকা যদি বলে, থাক না, ছবি দেখে আর কী হবে, মৃণাল ছবিটার পাবলিসিটিতে পঞ্চমুখ হয়।

প্রথম প্রথম যখন সংসারের গুমোটটা হালকা হয়ে এসেছে, যখন চক্ষুলজ্জাটা কেটে আসছে, তখন মৃণাল বলত, মা, সন্ধ্যাটা তো তোমরা বাড়ি বসে কাটাও দেখি, একটা ছবি-টবি দেখে এলে পারো। যাবে তো বলো।

লীলাবতীরও এ ইচ্ছে হয়েছে কখনও।

নিজের জন্যে না হোক, মালবিকার জন্যে। কিন্তু চক্ষুলজ্জায় তুলতে পারেন না এ কথা। জ্যোতি যে সিনেমা-পাগল ছিল!

কিন্তু আরও অনেক জিনিসের মতো এতেও চক্ষুলজ্জা কাটানোয় মৃণালই সাহায্য করেছে। জ্যোতির বইয়ের আলমারির চাবি মালবিকার হাতে পড়েছে মৃণালের হাত থেকেই।

.

৩৩.

তা, প্রথম প্রথম লীলাবতীর সঙ্গে।

কিন্তু ওদের যে ইংরেজি ছবিতে মন।

লীলাবতী বলেন, ও বাপু তোরাই যা। আমি বুঝি-সুঝি না।

ভক্তিভূষণ মাঝে মাঝে এ ব্যবস্থায় প্রশ্ন তুলেছেন, লীলাবতী বলেছেন, তাতে আর কী হয়েছে? আজকাল কি আর ওসব শুচিবাইপনা আছে?

লীলাবতী তো বলবেনই। তিনি যে একটি গোপন ইচ্ছে লালন করছেন মনে মনে।

ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, বুকের মধ্যেটা মোচড় দিয়ে উঠছে, তবু ভাবছেন। ভাবছেন, সে তো আর আসবে না, ছেলেটা তবে সারাটা জীবন কাটাবে কী নিয়ে?

ভাবছেন, দ্বিতীয় পক্ষের বিয়ের নজির কি নেই?

এমনিতেই তো আত্মীয়-স্বজন সকলেই বলছে, এই বয়েস, একটা বাচ্চাকাচ্চা পর্যন্ত নেই, ছেলের আবার বিয়ে দিচ্ছ না কেন?

লীলাবতী তখন পৃষ্ঠবল পাচ্ছেন।

.

৩৪.

কিন্তু মালবিকা? তার কি চক্ষুলজ্জার বালাই নেই?

সে একদিন ঝড়ের মুখে ছেঁড়া পাতার মতো উড়ে এসে জুড়ে তো বসেছে অনেকখানি। আবার রাজসিংহাসনেও বসতে চায়?

সে কি এ বাড়িতে জ্যোতির সাম্রাজ্যের চিহ্ন দেখেনি? কোনও কোনও নির্জন মুহূর্তে বিষাদস্তব্ধ মৃণালের অনন্ত আকাশে হারিয়ে যাওয়া মুখ দেখেনি? দেখেনি জ্যোতির ভালবাসা-ভরা আর সুখে ভরা জীবনের অজস্র খুঁটিনাটির সঞ্চয়?

লীলাবতী কেঁদে কেঁদে বলেছেন, একটু ঝেড়ে-ঝুড়ে রাখো মা, যদি কখনও আসে। এইসব তুচ্ছ জিনিসে কী আগ্রহ ছিল তার!

বলেছেন অবশ্য সেই অনেকদিন আগে। এখন আর বলেন না।

এখন অবিরতই বলেন, জানতেই পারছি সে আর নেই। থাকলে কোনওমতে একছত্র চিঠিও কি দিত না? আমরা না হয় তার ঠিকানা জানি না, সে তো আমাদের ঠিকানা জানে!

এখন আর বলেন না, কিন্তু যখন বলতেন, রাখত মালবিকা তার জিনিস ঝেড়ে-ঝুড়ে। এখনও রাখে নিজে থেকে। আলমারি-ভর্তি জামাকাপড়, বাক্স-ভর্তি পুঁতির মালা, কৌটো-ভর্তি কাচের চুড়ি।…

আর–অবিরতই তো ঝাড়ছে জ্যোতির ছবি, জ্যোতির খেলনা পুতুল, জ্যোতির বইয়ের সংগ্রহ। এইসবের অধিকারিণী হয়ে বসতে লজ্জা হবে না তার? আর লজ্জা হবে না জ্যোতির বরকে নিয়ে নিতে?

.

৩৫.

তা, লজ্জা নেই বলা যায় কী করে?

সেদিন মৃণাল ওর মুখোমুখি বসে ছিল। আর ওর একটা হাত চেপে ধরে বলে উঠেছিল, এত ভার নিতে পেরেছ, আমার ভারটাও নাও এবার। আর বইতে পারা যাচ্ছে না।

পার্কের বেঞ্চে বসে ছিল দুজনে, সন্ধ্যা নেমে আসছিল পৃথিবীতে। সেই সন্ধ্যার চোখে তাকিয়ে ছিল মালবিকা।

বলেছিল, লজ্জা বলে একটা শব্দ কি নেই জগতে?

 আমার জগতে অন্তত আর নেই মালবিকা,বলেছিল মৃণাল, আমি এবার হার মেনেছি।

 কিন্তু আমি যে হার মানতে রাজি নই, আমার লজ্জা আছে।

তবু আমার অবস্থা ভাবো মালবিকা, আমি একটা রক্ত-মাংসের মানুষ, শুধু ছায়া নিয়ে আর কতদিন টিকে থাকব? আমাকে তো বাঁচতে হবে!

.

৩৬.

বাঁচতে হবে!

জগতের পরমতম এবং চরমতম কথা। বাঁচতে হবে। বাঁচতে হবে।

নিখিল বিশ্বের অণুপরমাণুটি পর্যন্ত এই কথাই বলে চলেছে। বাঁচতে হবে।

মৃণালকেই বা তবে লজ্জাহীন বলা চলে কী করে?

মৃণাল শুধু সেই চিরকালীন কথাটাই বলেছে। আর বাঁচতে হবে বলেই বলেছে, মালবিকা, তুমি আমার ভার নাও। আমি আর পারছি না।

মালবিকা আস্তে ওর হাতে হাত রেখে বলেছে, আমি যদি না আসতাম, আমি যদি নির্লজ্জের মতো, লোভীর মতো এখানে পড়ে না থাকতাম, হয়তো ওই ছায়া নিয়েই বেঁচে থাকতে পারতে তুমি!

সেটা আত্ম-প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছু হত না।

এখন তাই ভাবছ, তখন হয়তো তা ভাবতে না। ওই ছায়াই তোমার জীবনে চিরসত্য হয়ে থাকত।

কী হলে কী হত, সে কথা আর ভাবা যাচ্ছে না মালবিকা, এখন আমি জেনেছি মৃত্যুর চেয়ে জীবন অনেক বড়।

মৃত্যু মহান, মৃত্যু পবিত্র!

জীবন সুন্দর, জীবন ঐশ্বর্যময়!

কিন্তু বেশ তো চলে যাচ্ছে।

একে বেশ চলা বলে না মালবিকা! এই বেশ ভাবাটাও আত্মপ্রবঞ্চনা।

আমার ভয় করে। মনে হয় অন্যায় করছি।

ভয়ের কিছু নেই মালবিকা! সত্যকে স্বীকার করাই সততা।

আমি যদি চলে যাই, হয়তো আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।

সব ঠিক হয়ে যাবে? মৃণাল ওর হাতটা চেপে ধরে বলেছে, সেই ঠিকটা কী তুমি তা বলতে পারো? তুমি চলে গেলে জ্যোতি ফিরে আসবে?

মালবিকা মাথা নিচু করেছে।

তারপর আবার বলেছে, তা নয়। তবু তুমি হয়তো তোমার আসল মনকে ফিরে পাবে। এখন একটা ঝোঁকে পড়ে–

তিলে তিলে নিজেকে যাচাই করেছি মালবিকা! অহরহ অনন্ত শূন্যতায় মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে দেখেছি। আমার বাইরের চেহারাটাই দেখতে পেয়েছ, আমার ভিতরের যুদ্ধের চেহারাটা দেখতে পাওনি। কিন্তু আমি যুদ্ধে জয়ী হতে পারিনি।

পরাজয় তো লজ্জার।

পরাজয় স্বীকার করাটা গৌরবের।

লোকে কী বলবে?

লোক? লোকে কী বলবে? সেটাও ভেবেছি বইকী! লোকভয়েই তো আজকের পরিস্থিতির উদ্ভব।..কিন্তু এখন যদি শুধু এইভাবে বেশ আছি বলে কাটিয়ে দিতে যাই, লোকে সহ্য করবে না। লোকে আরও অনেক কিছু বলবে। তার চাইতে যা স্বাভাবিক, যা বাস্তব, তাই ধরে দেওয়া ভাল তাদের সামনে।

মালবিকা অনেকক্ষণ কথা বলেনি। তারপর ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলেছে, লোকে হয়তো বলবে–বিয়ে না করে উপায় ছিল না বলেই নিশ্চয়

মৃণাল ওর ধরে-থাকা হাতটায় চাপ দিয়ে বলেছে, তা যদি বলে, সেটা ভুল বলবেনা। সত্যিই আমার আর উপায় থাকছে না। অবিরতই এই অদ্ভুত অবস্থাটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রবল হয়ে উঠছে আমার মধ্যে।

মাকে তুমি বলবে কোন মুখে?

মুখে বলতে হবে না। আমার মুখেই সে কথা লেখা হয়ে চলেছে। সে লেখা পড়বার বিদ্যে মার আছে।

বাবা তা হলে আমার মুখ দেখবেন না।

সময়ে সবই হয়ে যাবে। মানুষ অবস্থার দাস।

আর যদি কোনওদিন তিনি

সে কল্পনা আর করি না মালবিকা! সব কিছুই বাস্তব বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করতে হয়।

আমার মনে হয় এত সুখ আমার কপালে সইবে না।

চুপ করো। ওই সব কথা বোলো না। মেয়ে জাতটারই দেখছি অকারণ অমঙ্গল চিন্তা করা স্বভাব। ওতে অমঙ্গলকে ডেকেই আনা হয়।

তা হলে তুমিও মেয়েদের মতো ওইসবে বিশ্বাসী।

বিশ্বাসী কিনা জানি না। তবু ও আমার ভাল লাগে না। আমরা পরস্পরকে চাই এ কথা আর অস্বীকার করবার জো নেই, তা তুমিও জানো আমিও জানি। তবে মিথ্যে কেন মরুভূমি সৃষ্টি করে বসে থাকব বলতে পারো?

তোমার কাছে কথায় কে পারবে?

 বলে মৃদু হাসির মুখ নিয়ে তাকিয়ে থেকেছে মালবিকা।

মৃণাল বলেছে, আমি যে রক্তমাংসের মানুষ এ কথা স্বীকার করতে পেরে আমি বেঁচেছি। বিবেকের হাত থেকে রেহাই পেয়েছি। আর ভীরুতা আমার স্বর্গীয় প্রেমের ছদ্মবেশ নিয়ে বসে থাকবে, এ অসহ্য!

কোনটা যে কী তা এখনই ঠিক বুঝতে পারছ?

পারছি বইকী! প্রতিনিয়ত পারছি।

দিনের পর দিন এমনি কথা গেঁথে গেঁথে চলেছে মাল্য রচনা।

তারপর একদিন মালবিকাকে বলতেই হয়েছে, নাঃ, লজ্জা শরম আর রাখতে দিলে না তুমি আমার।

.

৩৭.

লীলাবতীর চোখে জলের কণা ভাসছে, কিন্তু লীলাবতী আহ্লাদে ভাসছেন। আশা করেননি এ দিন আসবে তাঁর। আশা করেননি আবার তিনি সংসার পাবেন, আবার তাঁর মৃণাল জোড়া-গাঁথা হবে।

তা ছাড়া–দেখছেন তো! বুঝছেন তো, মেয়েটা মৃণালের জন্যে মরছে।

মৃণাল হেঁটে যায় তো ওর বুকে বাজে। মৃণাল কথা কয়, ও চেয়ে থাকে। আর ক্রমশই তো দুজনে দুজনের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠছে।

তবে আর দ্বিধা কীসের?

দিন একটা দেখাও এবার। স্বামীর কাছে এসে বললেন লীলাবতী।

ভক্তিভূষণ শুকনো গলায় বললেন, দিন দেখাদেখির কী আছে? আজকাল যা বিয়ে হচ্ছে, সেই বিয়েই হোক।

কেন, আমাদের দিশি বিয়ে হবে না?লীলাবতী ক্ষুণ্ণ হন।

ভক্তিভূষণ বলেন, তোমার দিশি বিয়েতে সম্প্রদানকর্তা নামের একটা লোক লাগে। তাকে পাচ্ছি কোথায়?

ওর তো কাকা আছে?

দোহাই তোমার! সেই কাকাকে পায়ে ধরে নিয়ে আসতে হুকুম কোরো না আমায়।

 লীলাবতী তীক্ষ্ণ গলায় বলেছেন, তোমার কি এ বিয়েতে মত নেই?

তা তো বলিনি–ভক্তিভূষণ বলেছেন, আমি শুধু বলেছি যেটা শোভন, সেটাই ভাল।

.

৩৮.

মালবিকাও তাই বলে, দোহাই মা, বেনারসি কিনতে বোসোনা আমার জন্যে, যেটা শোভন সেটাই ভাল।

আর দুজনে মিলে ননাটিস দিতে যাবার দিন সেই শোভন সাজই সাজতে বসেছে মালবিকা।

 শুধু চোখে-মুখে একটু প্রসাধনের ছোঁয়া, শুধু একখানি নতুন তাঁতের শাড়ি। আর কিছু না।

মৃণাল এসে দরজায় দাঁড়ায়। বলে, হল?

বাঃ, এক্ষুনি হবে? সাজব না?

তবু ভাল, তোমার মুখে শুনলাম একটা নতুন কথা। সেজো, সেই দিন খুব করে সেজো। আজ দেরি হয়ে যাচ্ছে।

মালবিকা আলোকোজ্জ্বল মুখে বেরিয়ে এল। লীলাবতীকে প্রণাম করল।

ভক্তিভূষণের সামনে যেতে লজ্জা করছে। আজ আর যাবে না, একেবারে সেই দিন যাবে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। ভাবল, আকাশে কত সোনা! তবু দরজা থেকে বেরিয়ে থমকে দাঁড়াল মালবিকা। বলল, লেটার বক্সে চিঠি এসে পড়ে রয়েছে, খামের চিঠি।

বটুয়া থেকে ছোট্ট তালার চাবিটা বার করল।

মৃণাল অসহিষ্ণু হচ্ছিল। বলল, ফিরে এসে বার করলেই হবে, দেরি হয়ে গেছে।

 আহা, এতে আর কত সময় যাচ্ছে–

চাবিটা খুলল। বলল, খুব দরকারি চিঠিও তো হতে পারে।

তারপর বার করল। একটা ইলেকট্রিক বিল, মৃণালের ক্লাবের কী একটা ফাংশনের কার্ড, আর একখানা ইনল্যান্ড লেটার।

সেটা হাতে করে স্তব্ধ হয়ে গেল মালবিকা। শূন্য সাদা চোখে তাকিয়ে চিঠিসুদ্ধ হাতটা বাড়িয়ে দিল মৃণালের দিকে। এ অক্ষর তার অপরিচিত নয়। এ বাড়ির সর্বত্র ছড়ানো দেখেছে এই অক্ষর। গানের খাতায়, ডায়েরির খাতায়, ধোবার খাতায়, গয়লার খাতায়।

.

৩৯.

অনন্তকাল পার হয়ে গেল।

তেমনি শূন্য সাদা চোখে তাকিয়ে রইল দুজনে পরস্পরের মুখের দিকে।

অনেকক্ষণ পরে শতাব্দীর ঘুম ভেঙে মালবিকা বলল, খুলে দেখো। হয়তো খুব দরকারি। দরকারি। সত্যিই দরকারি। কিন্তু সেটা কার?

.

৪০.

কার? কার চিঠি? অনেকদিন পরে আবার গলা ভাঙল লীলাবতীর। বললেন, কী লিখেছে?

মৃণাল খোলা চিঠিটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিল।

 লীলাবতী বললেন, আমি পড়তে চাই না। তোমরাই পড়ো।লীলাবতীর গলাটা কর্কশ শোনাল। ভক্তিভূষণ আস্তে তুলে নিলেন চিঠিটা, নিরুচ্চারে পড়লেন :

শ্রীচরণকমলেষু,
প্রেতলোক থেকে উঠে এসে এই চিঠি লিখছি। কত বছর হল? তিন বছর না? তিন বছরে তিনশো বছরের ইতিহাস উঠেছে জমে।

কিন্তু সে যাক, কোনওমতে আবার কলকাতায় এসেছি। বড্ড ইচ্ছে করছে একবার দেখি। সেটা সম্ভব করা কি একেবারেই অসম্ভব? যদি অসম্ভব হয় তো থাক। যদি সম্ভব হয়, সোমবার বিকেল পাঁচটার সময় একবার কলেজ স্ট্রিটে আমাদের সেই পুরনো বইয়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে।

ভয় নেই, তিনশো বছরের ইতিহাস শোনাতে বসব না, শুধু দূর থেকে একবার দেখব। প্রণাম নিয়ো। ইতি–
জ্যোতি।

আমাদের সেই বইয়ের দোকানের সামনে লিখে আবার আমাদেরটা কেটেছে। শুধু সেই বইয়ের দোকানের উল্লেখটা রেখেছে।

ভক্তিভূষণ চিঠিখানা আবার ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে অস্ফুটে বলেন, সোমবার মানে আজ।

তারপর দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলেন, এখন চারটে দশ।

মৃণাল কারও দিকে না তাকিয়ে যেন বাতাসকে বলল, যাচ্ছি।

যাচ্ছিস? হঠাৎ যেন ছিটকে উঠলেন লীলাবতী। তেমনি ভাঙা কর্কশ গলায় বলে উঠলেন, কোথায় যাচ্ছিস? কোথাও যাবি না। মনে কর এ চিঠি পাসনি তুই।

মৃণাল তবু যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে বলল, ওকে নিয়ে আসছি।

লীলাবতী বসে পড়লেন। বললেন, ওকে নিয়ে আসছিস?

মৃণালের প্রেতাত্মার গলা বলল, আসছি বইকী!

 তাকে তুই গ্রহণ করবি? কত তুচ্ছয় বউকে ত্যাগ করে লোকে—

মৃণাল দাঁড়াল। মার চোখের দিকে তাকিয়ে আস্তে বলল, যাকে রক্ষা করতে পারিনি, তাকে ত্যাগ করব কোন মুখে?

তা বলে সেই অশুচি অপবিত্রকে লীলাবতী কেঁদে ফেললেন, শত্রু, মহাশত্রু আমার! বারেবারে কেবল আমার ঘর ভাঙছে। ওকে এনে কী করবি? ওর হাতে আমি জল খাব?

খাবার জন্যে তোমায় জোর করবনা মা! মৃণাল মুখ ফেরায়। আবার পা বাড়ায়। এখানে আর কেউ আছে, দেখতে পায় না যেন।

চলে যাচ্ছে। আনতে যাচ্ছে এ সংসারের অধিকারিণীকে।

লীলাবতী ফেটে পড়েন, আর এর কী হবে? এই পোড়াকপালীর? ধর্মজ্ঞানী মহাপুরুষ, বলে যা সে কথা?

এতক্ষণ পরে নাটকের নীরব দর্শক মালবিকা এখন হঠাৎ একটু হেসে ফেলে কথা বলে ওঠে, কী মুশকিল, সেটা আবার একটা ভাবনা নাকি? বিশেষণটা তো মা দিয়েই দিলেন।

মৃণালের দিকে এগিয়ে যায় একটু, বলে, এই, তুমি নিশ্চয় ট্যাক্সি নেবে? দেরি হয়ে গেছে। ওদিকেই তো শেয়ালদা? আমাকে আমার সেই বান্ধবীর হোস্টেলে একটু নামিয়ে দিয়ে যেতে পারবে না?

প্রায় সহজ শোনাল ওর গলা। যেন মাত্র একটু বেড়াতে এসেছিল। যেন ট্যাক্সিতে ওই নামিয়ে দেওয়াটা খুবই সাধারণ ঘটনা।

মৃণাল ওই প্রায়-হাসির আভাস লাগানো মুখটার দিকে কয়েক সেকেন্ড নির্নিমেষে তাকিয়ে থেকে বলল, চলো।