৩০. আমি কি শিখিয়াছি ?

[স্বামীজী দ্বিতীয়বার প্রায় দেড় বৎসর পাশ্চাত্যে ধর্মপ্রচার করিয়া ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। এই সময় তীর্থদর্শনে বাহির হইয়া পূর্ববঙ্গে লাঙ্গলবন্ধ ও আসামে কামাখ্যা দর্শন করেন; পরে শিলং ও গৌহাটি হইয়া ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯০১ খ্রীঃ ১৯ মার্চ ঢাকা জগন্নাথ কলেজ-গৃহে প্রায় দুই সহস্র শ্রোতার সম্মুখে ইংরেজীতে এই বক্তৃতা দেনঃ]

আমি নানাদেশ ভ্রমণ করিয়াছি—কিন্তু আমি কখনও নিজের জন্মভূমি বাঙলাদেশ বিশেষভাবে দর্শন করি নাই। জানিতাম না, এদেশের স্থলে জলে সর্বত্র এত সৌন্দর্য; কিন্তু নানা দেশ ভ্রমণ করিয়া আমার এই লাভ হইয়াছে যে, আমি বাঙলার সৌন্দর্য বিশেষভাবে উপলব্ধি করিতে পারিতেছি। এইভাবেই আমি প্রথমে ধর্মের জন্য নানা সম্প্রদায়ে—বৈদেশিকভাববহুল নানা সম্প্রদায়ে ঘুরিতেছিলাম, অন্যের দ্বারে ভিক্ষা করিতেছিলাম, জানিতাম না যে, আমার দেশের ধর্মে, আমার জাতীয় ধর্মে এত সৌন্দর্য আছে।

আজকাল একদল লোক আছেন, তাঁহারা ধর্মের ভিতর বৈদেশিক ভাব চালাইবার বিশেষ পক্ষপাতী—তাঁহারা ‘পৌত্তলিকতা’ বলিয়া একটি শব্দ রচনা করিয়াছেন। তাঁহারা বলেন, হিন্দুধর্ম সত্য নয়, কারণ উহা পৌত্তলিক। পৌত্তলিকতা কি, উহা ভাল কি মন্দ—কেহ অনুসন্ধান করেন না, কেবল ঐ শব্দেরই প্রভাবে তাঁহারা হিন্দুধর্মকে ভুল বলিতে সাহস করেন। আর একদল আছেন, তাঁহারা হাঁচি-টিকটিকির পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বাহির করেন। তাঁহারা কোন দিন ভগবানকেই তড়িতের পরিণামবিশেষ বলিয়া ব্যাখ্যা করিবেন। যাহা হউক, জগন্মাতা ইঁহাদিগকেও আশীর্বাদ করুন। তিনিই ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির দ্বারা নিজ কার্য সাধন করিয়া লইতেছেন। ইহা ছাড়া আর একটি দল আছেন—প্রাচীন সম্প্রদায়; তাঁহারা বলেন, ‘অত শত বুঝি না, বুঝিতেও চাহি না, আমরা চাই ঈশ্বরকে—চাই আত্মাকে; চাই জগৎ ছাড়িয়া—সুখ-দুঃখকে ছাড়িয়া উহার পারে যাইতে।’ তাঁহারা বলেন, বিশ্বাসের সহিত গঙ্গাস্নান করিলে মুক্তি হয়; তাঁহারা বলেন, শিব রাম বিষ্ণু প্রভৃতি যাঁহার প্রতিই হউক না কেন, ঈশ্বরবুদ্ধি করিয়া উপাসনা করিলে মুক্তি হইয়া থাকে; আমি সেই বলিষ্ঠ প্রাচীন-সম্প্রদায়ভুক্ত।

আজকালকার এক সম্প্রদায় বলেন, ঈশ্বর ও সংসার একসঙ্গে অনুসরণ কর। ইঁহাদের মন-মুখ এক নহে। প্রকৃত মহাত্মাগণের উপদেশ এইঃ

জঁহা কাম তঁহা রাম নহিঁ, জঁহা রাম তঁহা নহিঁ কাম।
কবহুঁ ন মিলত বিলোকিয়ে রবি রজনী এক ঠাম॥৭৮

যেখানে ভগবান্ সেখানে কখনও সংসার-বাসনা থাকিতে পারে না। অন্ধকার ও আলোক কখনও এক সঙ্গে থাকিতে পারে না। এইজন্য ইঁহারা বলেন, যদি ভগবান্ পাইতে চাও, কামকাঞ্চন ত্যাগ করিতে হইবে। এই সংসারটা তো অনিত্য, শূন্য—কিছুই নয়। ইহাকে না ছাড়িলে কিছুতেই তাঁহাকে পাইবে না। যদি তাহা না পার, তবে স্বীকার কর যে তুমি দুর্বল, কিন্তু কোনমতেই আদর্শকে ছোট করিও না। গলিত শবকে সোনার পাত মুড়িয়া ঢাকিও না। এইজন্য ইঁহাদের মতে এই ধর্মলাভ করিতে হইলে, ঈশ্বরলাভ করিতে হইলে প্রথমে ‘ভাবের ঘরে চুরি’ ছাড়িতে হইবে।

আমি কি শিখিয়াছি? এই প্রাচীন সম্প্রদায়ের নিকট আমি কি শিখিয়াছি? শিখিয়াছিঃ দুর্লভং ত্রয়মেবৈতৎ দেবানুগ্রহহেতুকম্। মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাপুরুষসংশ্রয়ঃ।৭৯—প্রথমে চাই মনুষ্যত্ব—মানুষজন্ম, ইহাতেই মুক্তিলাভের বিশেষ সুবিধা। তারপর চাই মুমুক্ষুতা; সম্প্রদায় ও ব্যক্তি-ভেদে আমাদের সাধনপ্রণালী ভিন্ন ভিন্ন, বর্ণাশ্রম অনুযায়ী কর্তব্য ও অধিকার ভিন্ন ভিন্ন, তথাপি বলা যাইতে পারে যে, মুমুক্ষুতা ব্যতীত ঈশ্বরের উপলব্ধি অসম্ভব। মুমুক্ষুত্ব কি? মোক্ষের জন্য—এই সুখদুঃখ হইতে বাহির হইবার জন্য—প্রবল আগ্রহ, এই সংসারের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা। যখন ভগবানের জন্য এই তীব্র ব্যাকুলতা হইবে, তখনই জানিবে—তুমি ঈশ্বরলাভের অধিকারী হইয়াছ। তারপর চাই মহাপুরুষসংশ্রয়—গুরুলাভ; গুরূপরম্পরাক্রমে যে শক্তি আসিয়াছে, তাহারই সহিত নিজের সংযোগ-স্থাপন। তদ্ব্যতীত মুমুক্ষুতা থাকিলেও কিছু হইবে না, অর্থাৎ তোমার গুরুকরণ আবশ্যক। কাহাকে গুরু করিব?—শ্রোত্রিয়োঽবৃজিনোঽকামহতো যো ব্রহ্মবিত্তমঃ।৮০ তিনিই শাস্ত্রের সূক্ষ্ম রহস্য জানেন।

পোথি পঢ়ি তোতা ভয়ো পণ্ডিত ভয়ো ন কোয়।
ঢাই অক্ষর প্রেমসে পঢ়ে সো পণ্ডিত হোয়॥

শুধু বই-পড়া পণ্ডিত হইলে চলিবে না। আজকাল যে-সে গুরু হইতে চায়। ভিক্ষুকও লক্ষ মুদ্রা দান করিতে চায়। ‘অবৃজিন’—যিনি নিষ্পাপ; ‘অকামহত’—কেবল জীবের হিত ব্যতীত যাঁহার আর কোন অভিসন্ধি নাই, যিনি অহেতুক-দয়াসিন্ধু, যিনি কোন লাভের উদ্দেশ্যে অথবা নাম-যশের জন্য উপদেশ দেন না, আর যিনি ব্রহ্মকে বিশেষ করিয়া জানেন, যিনি তাঁহাকে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, যিনি তাঁহাকে ‘করতলামলকৎ’ দর্শন করিয়াছেন; তিনিই গুরু—তাঁহারই সহিত আধ্যাত্মিক যোগ স্থাপিত হইলে তবে ঈশ্বরলাভ, ঈশ্বরদর্শন সহজ হইবে। তারপর চাই অভ্যাস। ব্যাকুলই হও, আর গুরুই লাভ কর, অভ্যাস না করিলে, সাধন না করিলে কখনও উপলব্ধি হইতে পারে না। এই কয়টি যখন দৃঢ় হইবে, তখনই ঈশ্বর প্রত্যক্ষ হইবেন। তাই বলি হে হিন্দুগণ, হে আর্যসন্তানগণ, তোমরা এই আদর্শ কখনও বিস্মৃত হইও না যে, হিন্দুর লক্ষ্য এই সংসারের বাহিরে যাওয়া—শুধু এই জগৎকে ত্যাগ করিতে হইবে তাহা নয়, স্বর্গকেও ত্যাগ করিতে হইবে; মন্দকে ত্যাগ করিতে হইবে শুধু তাহা নয়, ভালকেও ত্যাগ করিতে হইবে—এই সকলের পারে যাইতে হইবে।