২৫. বেদান্ত – (লাহোরে প্রদত্ত বক্তৃতা)

[লাহোরে প্রদত্ত তৃতীয় বক্তৃতা, ১২ নভেম্বর, ১৮৯৭]

আমরা দুইটি জগতে বাস করিয়া থাকি—বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ। অতি প্রাচীনকাল হইতেই মানুষ এই উভয় জগতেই প্রায় সমভাবে উন্নতি করিয়া আসিতেছে। প্রথমেই বহির্জগতে গবেষণা আরম্ভ হয় এবং মানুষ প্রথমতঃ বহিঃপ্রকৃতি হইতেই সকল গভীর সমস্যার উত্তর পাইবার চেষ্টা করিয়াছে। সে প্রথমতঃ তাহার চতুষ্পার্শ্বস্থ সমুদয় প্রকৃতি হইতে তাহার মহান্ ও সুন্দরের জন্য পিপাসা নিবৃত্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছে; নিজেকে এবং নিজের ভিতরের সমুদয় বস্তুকে স্থূলের ভাষায় প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিয়া সে যে-সকল উত্তর পাইয়াছে, ঈশ্বরতত্ত্ব ও উপাসনাতত্ত্বসমূহ সম্বন্ধে যে-সকল অতি অদ্ভুত সিদ্ধান্ত করিয়াছে, সেই শিবসুন্দরকে যে আবেগময়ী ভাষায় বর্ণনা করিয়াছে, তাহা অতি অপূর্ব। বহির্জগৎ হইতে মানুষ যথার্থই মহান্ ভাবসমূহ লাভ করিয়াছে। কিন্তু পরে তাহার নিকট অন্য এক জগৎ উন্মুক্ত হইল, তাহা আরও মহত্তর, আরও সুন্দরতর, আরও অনন্তগুণে বিকাশশীল। বেদের কর্মকাণ্ডভাগে আমরা ধর্মের অতি অদ্ভুত তত্ত্বসমূহ বিবৃত দেখিতে পাই, আমরা জগতের সৃষ্টিস্থিতিলয়কর্তা বিধাতার সম্বন্ধে অত্যন্ত বিস্ময়কর তত্ত্বসমূহ দেখিতে পাই; আর এই ব্রহ্মাণ্ডকে যে ভাষায় বর্ণনা করা হইয়াছে, তাহা স্থানে স্থানে অতিশয় প্রাণস্পর্শী। তোমাদের মধ্যে হয়তো অনেকেরই ঋগ্‌বেদ-সংহিতার প্রলয়বর্ণনাত্মক সেই অপূর্ব মন্ত্রটির কথা স্মরণ আছে। বোধ হয় প্রলয়াবস্থার এরূপ মহদ্ভাবদ্যোতক বর্ণনা দিতে এ পর্যন্ত কেহ চেষ্টা করেন নাই। তথাপি উহা কেবল বহিঃপ্রকৃতির মহান্ ভাবের বর্ণনা—উহা স্থূলেরই বর্ণনা, উহাতে যেন এখনও কিছু জড়ভাব লাগিয়া রহিয়াছে। উহা কেবল জড়ের ভাষায়, সীমার ভাষায় অসীমের বর্ণনা; উহা জড় দেহেরই বিস্তারের বর্ণনা—মনের নহে; উহা ‘দেশে’রই অনন্তত্বের বর্ণনা, মনের নহে। এই কারণে বেদের দ্বিতীয় ভাগে অর্থাৎ জ্ঞানকাণ্ডে দেখিতে পাই, সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রণালী অনুসৃত হইয়াছে। প্রথম প্রণালী ছিল—বহিঃপ্রকৃতি হইতে বিশ্বের প্রকৃত সত্য অনুসন্ধান করা। জড়জগৎ হইতেই জীবনের সমুদয় গভীর সমস্যার মীমাংসা করিবার চেষ্টা প্রথমে হইয়াছিল। ‘যস্যৈতে হিমবন্তো মহিত্বা’৫৬—এই হিমালয় পর্বত যাঁহার মহিমা ঘোষণা করিতেছে। এ খুব উচ্চ ধারণা বটে, কিন্তু ভারতের পক্ষে ইহা পর্যাপ্ত হয় নাই। ভারতীয় মন ঐ পথ পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিল। ভারতবাসীর গবেষণা সম্পূর্ণরূপে বহির্জগৎ ছাড়িয়া ভিন্ন দিকে গেল, অন্তর্জগতে অনুসন্ধান আরম্ভ হইল, জড় হইতে তাঁহারা ক্রমশঃ ‘চৈতন্যে’ আসিলেন। এই প্রশ্ন চতুর্দিক হইতে শ্রুত হইতে লাগিলঃ মৃত্যুর পর মানুষের কি হয়?—‘অস্তীত্যেকে নায়মস্তীতি চৈকে।’৫৭—কেহ বলে, মৃত্যুর পর মানুষের অস্তিত্ব থাকে; কেহ বলে, থাকে না। হে যমরাজ, ইহার মধ্যে সত্য কি? এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রণালী অনুসৃত হইয়াছে, দেখিতে পাই। ভারতীয় মন বহির্জগৎ হইতে যাহা পাইবার তাহা পাইয়াছিল, কিন্তু উহাতে সে সন্তুষ্ট হয় নাই, আরও গভীর অনুসন্ধানের প্রয়াসী হইয়াছিল, নিজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া আত্মার মধ্যে অনুসন্ধান করিয়া সমস্যা মীমাংসা করিবার চেষ্টা করিয়াছিল; শেষে উত্তর আসিল।

বেদের এই ভাগের নাম উপনিষদ্ বা বেদান্ত—আরণ্যক বা রহস্য। এখানে আমরা দেখিতে পাই যে, ধর্ম বাহ্য ক্রিয়াকলাপ হইতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। এখানে আমরা দেখিতে পাই, আধ্যাত্মিক তত্ত্বগুলি জড়ের ভাষায় নহে, চৈতন্যের ভাষায় বর্ণিত—সূক্ষ্মতত্ত্বসমূহ তাহার উপযুক্ত ভাষায় বর্ণিত হইয়াছে। এখানে আর কোনরূপ স্থূলভাব নাই, আমরা যে-সকল বিষয় লইয়া সচরাচর ব্যস্ত থাকি, সেই-সকল বিষয়ের সহিত জোড়াতালি দিয়া সামঞ্জস্য করিবার চেষ্টা নাই। উপনিষদের মহামনা ঋষিগণ অত্যন্ত সাহসের সহিত—এখন আমরা এরূপ সাহসের ধারণাই করিতে পারি না—নির্ভয়ে কোনরূপ জোড়াতালি না দিয়া মানবজাতির নিকট মহত্তর সত্যসমূহ প্রচার করিয়াছিলেন; এইরূপ উচ্চতম সত্য জগতে আর কখনও প্রচারিত হয় নাই। হে আমার স্বদেশবাসিগণ, আমি তোমাদের নিকট সেইগুলি বিবৃত করিতে চাই।

বেদের এই জ্ঞানকাণ্ড বিশাল সাগরের মত। উহার বিন্দুমাত্র বুঝিতে হইলেও অনেক জন্ম প্রয়োজন। এই উপনিষদ্ সম্বন্ধে রামানুজ ঠিকই বলিয়াছেন, বেদান্ত বেদের বা শ্রুতির শিরঃস্বরূপ,—আর সত্যই ইহা বর্তমান ভারতের বাইবেল-স্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বেদের কর্মকাণ্ডকে হিন্দুরা খুব শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিয়া থাকেন, কিন্তু আমরা জানি, প্রকৃতপক্ষে শত শত যুগ ধরিয়া ‘শ্রুতি’ অর্থে উপনিষদ্—কেবল উপনিষদ্ই বুঝাইয়াছে। আমরা জানি, আমাদের বড় বড় দার্শনিকগণ—ব্যাস, পতঞ্জলি, গৌতম, এমন কি দর্শনশাস্ত্রের জনকস্বরূপ মহাপুরুষ কপিল পর্যন্ত—যখন তাঁহাদের মতের সমর্থক প্রমাণের প্রয়োজন হইয়াছে, তখন তাঁহারা উপনিষদেই উহা পাইয়াছেন, অন্য কোথাও নহে; কারণ উপনিষদসমূহের মধ্যেই সনাতন সত্য অনন্তকালের জন্য নিহিত রহিয়াছে।৫৮

কতকগুলি সত্য আছে, যেগুলি কেবল বিশেষ দেশ-কাল-পাত্রে বিশেষ অবস্থায় সত্য। সেগুলি বিশেষ যুগের বিধান হিসাবে সত্য। আবার কতকগুলি সত্য আছে, সেগুলি মানবপ্রকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত। যতদিন মানুষের অস্তিত্ব থাকিবে, সেগুলিও ততদিন থাকিবে। এই শেষোক্ত সত্যগুলি সর্বজনীন ও সার্বকালিক; আর যদিও আমাদের ভারতীয় সমাজে নিশ্চয়ই অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছে, আমাদের আহার-বিহার পোশাক-পরিচ্ছদ উপাসনাপ্রণালী এ-সকলই যদিও অনেক বদলাইয়াছে, কিন্তু এই শ্রৌত সর্বজনীন সত্যসমূহ—বেদান্তের এই অপূর্ব তত্ত্বরাশি চিরকাল স্বমহিমায় অচল, অজেয় ও অবিনাশী।

উপনিষদের যে-সকল তত্ত্ব বিশেষভাবে পরিস্ফুট হইয়াছে, সেগুলির বীজ কিন্তু কর্মকাণ্ডেই পূর্ব হইতে নিহিত দেখিতে পাওয়া যায়। জগৎ-তত্ত্ব, যাহা সকল সম্প্রদায়ের বৈদান্তিকগণকেই মানিয়া লইতে হইয়াছে; এমন কি মনোবিজ্ঞানতত্ত্ব—যাহা সকল ভারতীয় চিন্তাপ্রণালীর মূলভিত্তিস্বরূপ, তাহাও কর্মাকাণ্ডে বিবৃত ও জগতের সমক্ষে প্রচারিত হইয়াছে। অতএব বেদান্তের আধ্যাত্মিক ভাগের বিষয় বলিবার পূর্বে আপনাদের সমক্ষে কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে কিছু বলা আবশ্যক, আর বেদান্ত-শব্দটি কি অর্থে আমি ব্যবহার করিতেছি, তাহা প্রথমেই আপনাদের নিকট পরিষ্কার করিয়া বলিতে চাই। দুঃখের বিষয়, আজকাল আমরা প্রায়ই একটি বিশেষ ভ্রমে পতিত হইয়া থাকি—আমরা ‘বেদান্ত’-শব্দে কেবল অদ্বৈতবাদ বুঝিয়া থাকি। আপনাদের কিন্তু এইটি সর্বদা মনে রাখা আবশ্যক যে, বর্তমান ভারতবর্ষে সকল ধর্মমত অধ্যয়ন করিতে ‘প্রস্থানত্রয়’ সমভাবে উপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমতঃ শ্রুতি অর্থাৎ উপনিষদ্, দ্বিতীয়তঃ ব্যাসসূত্র। আমাদের দর্শন-শাস্ত্রসমূহের মধ্যে এই ব্যাসসূত্রই সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য লাভ করিয়াছে, তাহার কারণ এই যে, উহা পূর্ববর্তী অন্যান্য দর্শনসমূহের সমষ্টি ও চরম পরিণতিস্বরূপ। এই দর্শনগুলিও যে পরস্পর-বিরোধী তাহা নহে, উহাদের মধ্যে একটি যেন অপরটির ভিত্তিস্বরূপ, যেন সত্যানুসন্ধিৎসু মানবের নিকট সত্যের ক্রমবিকাশ দেখাইয়া ব্যাসসূত্রে ঐগুলি চরম পরিণতি লাভ করিয়াছে। আর এই উপনিষদ্ এবং বেদান্তের অপূর্ব সত্যসমূহের প্রণালীবদ্ধ বিন্যাসরূপ ব্যাসসূত্রের মাঝখানে বেদান্তের টীকাস্বরূপ ভগবানের মুখনিঃসৃত ‘গীতা’ বর্তমান।

এই কারণেই দ্বৈতবাদী, অদ্বৈতবাদী, বৈষ্ণব—ভারতের যে-কোন সম্প্রদায়ই হউন না কেন, যাঁহারাই নিজদিগকে সনাতন-মতাবলম্বী বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চান, তাঁহারা সকলেই উপনিষদ্, গীতা ও ব্যাসসূত্রকে তাঁহাদের প্রামাণিক গ্রন্থরূপে ধরিয়া থাকেন। আমরা দেখিতে পাই, কি শঙ্করাচার্য, কি রামানুজ, কি মধ্বাচার্য, কি বল্লভাচার্য, কি শ্রীচৈতন্য—যিনিই নূতন সম্প্রদায়-গঠনের ইচ্ছা করিয়াছেন, তাঁহাকেই এই তিনটি ‘প্রস্থান’ গ্রহণ করিতে হইয়াছে এবং এগুলির উপর একটি করিয়া নূতন ভাষ্য রচনা করিতে হইয়াছে। অতএব উপনিষ‍দকে অবলম্বন করিয়া যে-সকল বিভিন্ন মতবাদের উৎপত্তি হইয়াছে, সেগুলির মধ্যে মাত্র একটি মতে ‘বেদান্ত’-শব্দটিকে আবদ্ধ করিয়া রাখা অন্যায়। বেদান্ত-শব্দে প্রকৃতপক্ষে এই দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ও অদ্বৈত—সবগুলি মতকেই বুঝায়। অদ্বৈতবাদীর যেমন ‘বেদান্তী’ বলিয়া পরিচয় দিবার অধিকার, রামানুজীরও সেইরূপ। আমি আর একটু অগ্রসর হইয়া বলিতে চাই, আমরা প্রকৃতপক্ষে ‘হিন্দু’-শব্দের দ্বারা বৈদান্তিকই বুঝিয়া থাকি।

আর এই বিষয়ে আমি তোমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চাই—এই তিনটি মত স্মরণাতীত কাল হইতেই ভারতে প্রচলিত। শঙ্কর অদ্বৈতবাদের আবিষ্কারক নহেন, শঙ্করের আবির্ভাবের অনেকদিন পূর্ব হইতেই উহা বর্তমান ছিল—শঙ্কর উহার একজন শেষ প্রতিনিধিমাত্র। রামানুজী মতও তাই—রামানুজের জন্মের অনেক পূর্ব হইতেই যে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বিদ্যমান ছিল, এ-কথা তাঁহার লিখিত ভাষ্য হইতেই আমরা জানি। অন্যান্য যে-সকল দ্বৈতবাদী সম্প্রদায় পাশাপাশি ভারতে রহিয়াছেন, তাঁহাদের সম্বন্ধেও এইরূপ। আর আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, এই-সকল মত পরস্পর-বিরোধী নহে। আমাদের ষড়‍্দর্শন যেমন মহান্ তত্ত্বসমূহের ক্রমবিকাশমাত্র, ইহা যেমন অতি মৃদুধ্বনিতে আরম্ভ করিয়া শেষে অদ্বৈতের বজ্রনির্ঘোষে পরিণত হইয়াছে, তেমনি পূর্বোক্ত তিনটি মতেও আমরা দেখিতে পাই, মানব-মন উচ্চ হইতে উচ্চতর আদর্শের দিকে অগ্রসর হইয়াছে—অবশেষে সবগুলিই অদ্বৈতবাদের সেই বিস্ময়কর একত্বে পর্যবসিত হইয়াছে। অতএব এই তিনটি পরস্পর-বিরোধী নহে।

অপর দিকে আমি বলিতে বাধ্য, অনেকে এই ভ্রমে পতিত হইয়াছেন যে, এগুলি পরস্পর-বিরোধী। আমরা দেখিতে পাই, যে শ্লোকগুলিতে বিশেষভাবে অদ্বৈতবাদের শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে, অদ্বৈতবাদী সেইগুলিকে যথাযথ রাখিয়া দিতেছেন, কিন্তু যেখানে দ্বৈতবাদ বা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের উপদেশ আছে, টানিয়া সেইগুলির অদ্বৈতবোধক অর্থ করিতেছেন। আবার দ্বৈতবাদী আচার্যগণ দ্বৈত শ্লোকগুলির যথাযথ অর্থ করিয়া অদ্বৈত শ্লোকগুলি টানিয়া দ্বৈতবোধক অর্থ করিতেছেন। অবশ্য ইঁহারা মহাপুরুষ—আমাদের গুরুপদবাচ্য। তবে ইহাও কথিত হইয়াছে যে, ‘দোষা বাচ্যা গুরোরপি’—গুরুরও দোষ বলা উচিত। আমার মত এই যে, কেবল এই বিষয়েই তাঁহারা ভ্রমে পড়িয়াছিলেন। শাস্ত্রের বিকৃত ব্যাখ্যা করিবার প্রয়োজন নাই, কোনরূপ অসাধুতার আশ্রয় লইয়া ধর্মব্যাখ্যার আবশ্যক নাই, ব্যাকরণের মারপ্যাঁচ করিবার দরকার নাই, যে-সকল শ্লোকের দ্বারা যে-সব ভাব কখনই উদ্দিষ্ট হয় নাই, সেই-সকল শ্লোকের ভিতর আমাদের নিজেদের ভাব প্রবেশ করাইবার কোন প্রয়োজন নাই। শ্লোকের সাদাসিধা অর্থ বুঝা অতি সহজ, আর যখনই তোমরা ‘অধিকারভেদে’র অপূর্ব রহস্য বুঝিবে, তখনই উহা তোমাদের নিকট অতি সহজ বলিয়া প্রতীয়মান হইবে।

ইহা সত্য যে, উপনিষদসমূহের লক্ষ্য একটিঃ কি সেই বস্তু, যাহাকে জানিলে সমুদয় জানা হয়—‘কস্মিন্নু ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতীতি।’৫৯ আধুনিক কালের ভাষায় বলিতে গেলে বলিতে হয়, উপনিষদের উদ্দিষ্ট বিষয় হইল—চরম একত্ব আবিষ্কার করিবার চেষ্টা। বহুত্বের মধ্যে একত্বের অনুসন্ধান ছাড়া জ্ঞান আর কিছুই নহে। সকল বিজ্ঞানই এই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত—সকল মানবীয় জ্ঞানই বহুত্বের মধ্যে একত্ব অনুসন্ধানের চেষ্টার উপর প্রতিষ্ঠিত। আর যদি কতকগুলি ঘটনাচক্রের মধ্যে একত্ব অনুসন্ধান করা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানবীয় জ্ঞানের কার্য হয়, তবে এই অপূর্ব বৈচিত্র্যপূর্ণ জগৎপ্রপঞ্চের মধ্যে—যাহা নামরূপে সহস্র প্রকারে বিভিন্ন, যেখানে জড় ও চৈতন্যে ভেদ, যেখানে প্রত্যেক চিত্তবৃত্তি অপরটি হইতে ভিন্ন, যেখানে প্রত্যেকটি রূপ অপরটি হইতে পৃথক্‌, যেখানে একটি বস্তুর সহিত অপর বস্তুর পার্থক্য বিদ্যমান—সেই জগৎপ্রপঞ্চের মধ্যে একত্ব আবিষ্কার করা যদি আমাদের উদ্দেশ্য হয়, তবে উহা কি গুরুতর ব্যাপার, ভাবিয়া দেখ। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন অনন্ত ‘লোকে’র মধ্যে—এই-সকল বিভিন্নতার মধ্যে একত্ব আবিষ্কার করাই উপনিষদের লক্ষ্য। আমরা ইহা বুঝি। অন্য দিকে আবার ‘অরুন্ধতী-ন্যায়ে’র প্রয়োগ করিতে হইবে। অরুন্ধতী-নক্ষত্র কাহাকেও দেখাইতে হইলে উহার নিকটস্থ কোন বৃহত্তর ও উজ্জ্বলতর নক্ষত্র দেখাইয়া উহাতে দৃষ্টি স্থির হইলে পর ক্ষুদ্রতর অরুন্ধতী দেখাইতে হয়। এভাবেই সূক্ষ্মতর ব্রহ্মতত্ত্ব বুঝাইবার পূর্বে অন্যান্য অনেক স্থূলতর ভাব বুঝাইয়া পরে ক্রমশঃ সূক্ষ্মতরভাবের উপদেশ দেওয়া হইয়াছে। আমার এই কথা প্রমাণ করিবার জন্য আর কিছু করিতে হইবে না—তোমাদিগকে কেবল উপনিষদ্ দেখাইয়া দিলেই হইবে, তাহা হইলেই তোমরা বুঝিতে পারিবে। প্রায় প্রত্যেক অধ্যায়ের আরম্ভেই দ্বৈতবাদ—উপাসনার উপদেশ। প্রথমতঃ জগতের সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়-কর্তারূপে তাহা নির্দেশ করা হইয়াছে। তিনি আমাদের উপাস্য, শাস্তা, বহিঃপ্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির নিয়ন্তা, তথাপি তিনি যেন প্রকৃতির বাহিরে রহিয়াছেন। আর একটু অগ্রসর হইয়া দেখিতে পাই, যে-আচার্য উক্ত প্রকার শিক্ষা দিয়াছেন, তিনিই আবার উপদেশ দিতেছেন, ঈশ্বর প্রকৃতির বাহিরে নহেন, প্রকৃতির ভিতরেই বর্তমান রহিয়াছেন। অবশেষে উভয় ভাবই পরিত্যক্ত হইয়াছে,—যাহা কিছু সত্য, সবই তিনি—কোন ভেদ নাই, ‘তত্ত্বমসি শ্বতকেতো’। যিনি সমগ্র জগতের অভ্যন্তরে রহিয়াছেন, তিনিই যে মানবাত্মার মধ্যে বিদ্যমান, ইহাই শেষে ঘোষণা করা হইয়াছে। এখানে আর কোন প্রকার আপস নাই, এখানে আর অপরের মতামতের অপেক্ষা বা ভয় নাই। সত্য—নিরাবরণ সত্য—এখানে সুস্পষ্ট নির্ভীক ভাষায় প্রচারিত হইয়াছে, এবং বর্তমানকালেও আমাদের সেইরূপ নির্ভীক ভাষায় সত্য প্রচার করিতে গিয়া ভয় পাইবার প্রয়োজন নাই; ঈশ্বরকৃপায় অন্ততঃ আমি এইরূপ নির্ভীক প্রচারক হইবার ভরসা রাখি।

এখন পূর্ব-প্রসঙ্গের অনুবৃত্তি করিয়া প্রথম জ্ঞাতব্য তত্ত্বগুলির আলোচনা করা যাক। প্রথমতঃ সকল বৈদান্তিক সম্প্রদায় যে-বিষয়ে একমত, সেই জগৎসৃষ্টিপ্রকরণ এবং মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে বুঝিতে হইবে। আমি প্রথমে জগৎসৃষ্টিপ্রকরণ সম্বন্ধে আলোচনা করিব। আধুনিক বিজ্ঞানের অদ্ভুত আবিষ্ক্রিয়াসমূহ যেন বজ্রবেগে আমাদের উপর পতিত হইয়া, যাহা আমরা কখনও স্বপ্নেও ভাবি নাই, আমাদিগকে এমন অদ্ভুত তত্ত্বসমূহের সম্মুখীন করিতেছে। কিন্তু এগুলির অধিকাংশ বহুযুগ পূর্বে আবিষ্কৃত সত্যসমূহের পুনরাবিষ্ক্রিয়ামাত্র। আধুনিক বিজ্ঞান এই সে-দিন আবিষ্কার করিয়াছে যে, বিভিন্ন শক্তিসমূহের মধ্যে একত্ব রহিয়াছে। বিজ্ঞান সবেমাত্র আবিষ্কার করিয়াছে যে, উত্তাপ তড়িৎ, চৌম্বকশক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন নামে পরিচিত সমুদয় শক্তিকেই একটি শক্তিতে পরিণত করা যাইতে পারে; সুতরাং লোকে যে-কোন নামেই অভিহিত করুক না কেন, বিজ্ঞান ঐগুলিকে একটিমাত্র নামের দ্বারাই অভিহিত করিয়া থাকে। কিন্তু অতি প্রাচীন হইলেও সংহতিতেও সেই শক্তির এরূপ ধারণা দেখিতে পাওয়া যায়। মাধ্যাকর্ষণই বল, উত্তাপই বল, তড়িৎই বল, চৌম্বক-শক্তিই বল অথবা অন্তঃকরণের চিন্তাশক্তিই বল—সবই এক শক্তির প্রকাশমাত্র এবং সেই এক শক্তির নাম ‘প্রাণ’। প্রাণ কি? প্রাণ অর্থে স্পন্দন। যখন সমুদয় ব্রহ্মাণ্ড লীন হইয়া যায়, তখন এই অনন্ত শক্তিসমূহ কোথায় যায়? এগুলির কি লোপ হয়, মনে কর? কখনই নহে। যদি বল, শক্তিরাশির একেবারে ধ্বংস হয়, তবে কোন্ বীজ হইতে আবার আগামী জগৎ-তরঙ্গ উদ্ভূত হইবে? কারণ, এই গতি তো চিরকাল ধরিয়া তরঙ্গাকারে চলিয়াছে—একবার উঠিতেছে, আর একবার পড়িতেছে; আবার উঠিতেছে, আবার পড়িতেছে। এমনি ভাবে অনন্তকাল ধরিয়া চলিয়াছে। এই জগৎপ্রপঞ্চের বিকাশকে আমাদের শাস্ত্রে ‘সৃষ্টি’ বলে। ‘সৃষ্টি’ আর ইংরেজী ‘creation’ শব্দ একার্থক নহে। ইংরেজীতে ভাব প্রকাশ করিতে পারিতেছি না, সংস্কৃত শব্দগুলির যথাসাধ্য অনুবাদ করিয়া বলিতে হয়। ‘সৃষ্টি’ শব্দের ঠিক অর্থ—প্রকাশ হওয়া, বাহির হওয়া। জগৎপ্রপঞ্চ প্রলয়ের সময় সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর হইয়া—যাহা হইতে উৎপন্ন হইয়াছিল—সেই প্রাথমিক অবস্থায় বিলীন হয়—কিছুকালের জন্য ঐ অবস্থায় শান্তভাবে থাকে,—আবার ক্রমশঃ প্রকাশোন্মুখ হয়। ইহাই সৃষ্টি। আর এই শক্তিগুলির—প্রাণশক্তির কি হয়? তাহারা আদি-প্রাণে পরিণত হয়; এই প্রাণ তখন প্রায় গতিহীন হয়—সম্পূর্ণরূপে গতিশূন্য কখনই হয় না, আর বৈদিক সূক্তের ‘আনীদবাতং’৬০—গতিহীনভাবে স্পন্দিত হইয়াছিল—এই বাক্যের দ্বারা এই তত্ত্বেরই বর্ণনা করা হইয়াছে। বেদের অনেক পারিভাষিক শব্দের অর্থ নির্ণয় করা অতিশয় কঠিন। উদাহরণস্বরূপ এই ‘বাত’ শব্দটি ধর। কখনও কখনও ইহার দ্বারা ‘বায়ু’ বুঝায়, কখনও গতি বুঝায়। লোকে অনেক সময় এই দুই অর্থ লইয়া গোল করিয়া থাকে। এই বিষয়ে সাবধান হইতে হইবে। আর তখন ‘ভূতের’ বা জড়পদার্থের কি অবস্থা হয়? শক্তি সর্বভূতে ওতপ্রোত রহিয়াছে। সেই সময় সকলই আকাশে লীন হয়—আবার আকাশ হইতে প্রকাশিত হয়। এই আকাশই আদিভূত। এই আকাশ প্রাণের শক্তিতে স্পন্দিত হইতে থাকে, আর যখন নূতন সৃষ্টি হইতে থাকে, তখন যেমন যেমন স্পন্দন দ্রুত হয়, অমনি এই আকাশ তরঙ্গায়িত হইয়া চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রাদির আকার ধারণ করে।

অন্যত্র৬১ আছে—‘যদিদং কিঞ্চ জগৎ সর্বং প্রাণ এজতি নিঃসৃতম্।’—এই জগতে যাহা কিছু আছে, প্রাণ কম্পিত হইতে থাকিলে সকলই বাহির হয়। এখানে ‘এজতি’ শব্দটি লক্ষ্য করিও—‘এজ্’ ধাতুর অর্থ কম্পিত হওয়া। ‘নিঃসৃতম্’ অর্থ বাহিরে প্রক্ষিপ্ত; ‘যদিদং কিঞ্চ’—জগতে যাহা কিছু।

প্রপঞ্চ-সৃষ্টির কিঞ্চিৎ আভাস দেওয়া হইল। বিস্তার করিয়া বলিতে গেলে অনেক কথা বলিতে হয়। কি প্রণালীতে সৃষ্টি হয়, কিভাবে প্রথমে আকাশের এবং আকাশ হইতে অন্যান্য বস্তুর উৎপত্তি হয়, আকাশের কম্পন হইতে বায়ুর উৎপত্তি কিভাবে হয় ইত্যাদি—অনেক কথা বলিতে হয়। তবে ইহার মধ্যে একটি কথা স্পষ্ট যে, সূক্ষ্ম হইতে স্থূলের উৎপত্তি হইয়া থাকে। স্থূল ভূত সর্বশেষে উৎপন্ন হয়। ইহাই সর্বাপেক্ষা বাহিরের বস্তু আর এই স্থূল ভূতের পশ্চাতে সূক্ষ্ম ভূত রহিয়াছে। এতদূর বিশ্লেষণ করিয়াও কিন্তু আমরা দেখিতে পাইলাম, সমুদয় জগৎ দুই তত্ত্বে পর্যবসিত করা হইয়াছে মাত্র, এখনও চরম একত্বে পৌঁছান যায় নাই। শক্তিবর্গ ‘প্রাণ’রূপ এক শক্তিতে এবং জড়বর্গ ‘আকাশ’রূপ এক বস্তুতে পর্যবসিত হইয়াছে। সেই দুইটির মধ্যে কি আবার কোনরূপ একত্ব বাহির করা যাইতে পারে? ইহাদিগকেও কি এক তত্ত্বে পর্যবসিত করা যাইতে পারে? আমাদের আধুনিক বিজ্ঞান এখানে নীরব—কোনরূপ মীমাংসা করিতে পারে নাই, আর যদি ইহার মীমাংসা করিতে হয়, তবে বিজ্ঞান যেমন প্রাচীনদের ন্যায় আকাশ ও প্রাণকেই পুনরাবিষ্কার করিয়াছে, সেইরূপ সেই প্রাচীনদের পথেই চলিতে হইবে। আকাশ ও প্রাণ যে এক তত্ত্ব হইতে উদ্ভূত, তিনি সেই সর্বব্যাপী সত্তা, যাঁহার পৌরাণিক নাম ব্রহ্মা—চতুর্মুখ ব্রহ্মা বলিয়া পরিচিত এবং মনোবিজ্ঞানে যাঁহাকে ‘মহৎ’ বলা যায়। এখানেই উভয়ের মিলন। দার্শনিক ভাষায় যাহা ‘মন’ বলিয়া কথিত হয়, তাহা মস্তিষ্করূপ ফাঁদে আবদ্ধ সেই ‘মহৎ’-এর কিয়দংশ। মস্তিষ্কের জালে আবদ্ধ ব্যষ্টি-মনের যোগফলকে ‘সমষ্টি মন’ বলা যায়।

কিন্তু বিশ্লেষণ এইখানেই শেষ হয় নাই, আরও দূর পর্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিল। আমরা প্রত্যেকে যেন এক একটি ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড, আর সমগ্র জগৎ একটি বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ড। আর ব্যষ্টিতে যাহা হইতেছে, সমষ্টিতেও তাহা ঘটিয়াছে—ইহা আমরা অনায়াসেই অনুমান করিতে পারি। যদি আমরা আমাদের নিজেদের মন বিশ্লেষণ করিতে পারিতাম, তবে সমষ্টি-মনে কি হইতেছে, তাহাও অনেকটা নিশ্চিতভাবে অনুমান করিতে পারিতাম। এখন প্রশ্নঃ এই মন কি? বর্তমানকালে পাশ্চাত্যদেশে জড়বিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শারীরবিজ্ঞান যেমন ধীরে ধীরে প্রাচীন ধর্মের একটির পর একটি দুর্গ অধিকার করিয়া লইতেছে, পাশ্চাত্যবাসীরা আর দাঁড়াইবার স্থান পাইতেছে না; কারণ আধুনিক শারীরবিজ্ঞান প্রতি পদে মনকে মস্তিষ্কের সহিত মিশাইতেছে দেখিয়া তাহারা অত্যন্ত নিরাশ হইয়াছেন। কিন্তু ভারতবর্ষে আমরা এ- সব তত্ত্ব বরাবর জানি। হিন্দু-বালককে প্রথমেই শিখিতে হয়, মন জড়পদার্থ—তবে সূক্ষ্মতর জড়। আমাদের এই দেহ স্থূল, কিন্তু এই দেহের পশ্চাতে সূক্ষ্ম শরীর বা মন রহিয়াছে; উহাও জড়, কিন্তু সূক্ষ্মতর; উহা আত্মা নহে।

এই ‘আত্মা’ শব্দটি আমি তোমাদের নিকট ইংরেজীতে অনুবাদ করিয়া বলিতে পারিতেছি না, কারণ ইওরোপে আত্মা-শব্দের প্রতিপাদ্য কোন ভাবই নাই; অতএব এই শব্দের অনুবাদ করা যায় না। জার্মান দার্শনিকগণ আজকাল এই আত্মা-শব্দটি Self-শব্দের দ্বারা অনুবাদ করিতেছেন, কিন্তু যতদিন না এই শব্দটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, ততদিন উহা ব্যবহার করা অসম্ভব। অতএব উহাকে Self-ই বল বা আর যাহাই বল, আমাদের ‘আত্মা’ ছাড়া উহা আর কিছু নহে। এই আত্মাই মানুষের অন্তরে যথার্থ মানুষ। এই আত্মাই জড় মনকে নিজের যন্ত্র, মনোবিজ্ঞানের ভাষায় অন্তঃকরণ-রূপে ব্যবহার করেন, আর মন কতকগুলি আভ্যন্তরিক যন্ত্রসহায়ে দেহের দৃশ্যমান যন্ত্রগুলির উপর কাজ করে। এই মন কি? এই সেদিন পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ জানিতে পারিয়াছেন যে, চক্ষু প্রকৃত দর্শনেন্দ্রিয় নহে, তাহারও পশ্চাতে প্রকৃত ইন্দ্রিয় বর্তমান; আর যদি উহা নষ্ট হইয়া যায়, তবে সহস্রলোচন ইন্দ্রের মত মানুষের সহস্র চক্ষু থাকিতে পারে, কিন্তু সে কিছুই দেখিতে পাইবে না।

তোমাদের দর্শন এই স্বতঃসিদ্ধ মানিয়া লইয়াই অগ্রসর হয় যে, দৃষ্টি বলিতে বাহ্য দৃষ্টি বুঝায় না। প্রকৃত দৃষ্টি অন্তরিন্দ্রিয়ের—অভ্যন্তরবর্তী মস্তিষ্ককেন্দ্রসমূহের; তুমি সেগুলির যাহা ইচ্ছা নাম দিতে পার, কিন্তু ইন্দ্রিয়-অর্থে আমাদের এই বাহ্য চক্ষু, নাসিকা বা কর্ণ বুঝায় না। এই ইন্দ্রিয়সমূহের সমষ্টি মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহঙ্কারের সহিত মিলিত হইয়াই ইংরেজীতে Mind নামে অভিহিত হয়। আর যদি আধুনিক শরীরতত্ত্ববিৎ আসিয়া বলেন যে, মস্তিষ্কই মন এবং ঐ মস্তিষ্ক বিভিন্ন যন্ত্র বা কারণসমূহে গঠিত, তাহা হইলে তোমাদের ভীত হইবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই; তাহাদিগকে অনায়াসেই বলিতে পার, ‘আমাদের দার্শনিকগণ বরাবরই ইহা জানিতেন।’ ইহা তোমাদের ধর্মের মূলসূত্র।

বেশ কথা, এখন আমাদিগকে বুঝিতে হইবে, এই মন বুদ্ধি চিত্ত অহঙ্কার প্রভৃতি শব্দের দ্বারা কি বুঝায়। প্রথমতঃ চিত্ত কি, তাহা বুঝিবার চেষ্টা করা যাক। চিত্তই প্রকৃতপক্ষে অন্তঃকরণের মূল উপাদান, ইহা ‘মহৎ’-এরই অংশ—মনের বিভিন্ন অবস্থাগুলির সাধারণ নাম। গ্রীষ্মের অপরাহ্নে বিন্দুমাত্র তরঙ্গরহিত স্থির শান্ত একটি হ্রদকে উদাহরণ-স্বরূপ গ্রহণ কর। মনে কর, কোন ব্যক্তি এই হ্রদের উপর একটি প্রস্তর নিক্ষেপ করিল। তাহা হইলে কি কি ঘটিবে? প্রথমতঃ জলে যে আঘাত করা হইল, সেইটিই যেন একটি ক্রিয়া, তারপরই জল উত্থিত হইয়া ঐ আঘাতের প্রতিক্রিয়া করিল, আর সেই প্রতিক্রিয়া তরঙ্গের আকার ধারণ করিল। প্রথমতঃ জল একটু কম্পিত হইয়া উঠে, পরক্ষণেই তরঙ্গাকারে প্রতিক্রিয়া করে। এই চিত্তটি যেন হ্রদ, আর বাহ্য বিষয় ও বস্তুগুলি যেন উহার উপর নিক্ষিপ্ত প্রস্তর। যখনই ‘চিত্ত’ এই ইন্দ্রিয়গুলির সহায়তায় কোন বাহিরের বস্তুর সংস্পর্শে আসে—বাহ্য বস্তুগুলির অনুভূতি ভিতরে বহন করিবার জন্য ইন্দ্রিয়গুলির প্রয়োজন—তখনই একটি কম্পন উৎপন্ন হয়. উহাই সংশয়াত্মক ‘মন’। তারপর একটি প্রতিক্রিয়া হয়—উহা নিশ্চয়াত্মিকা ‘বুদ্ধি’, আর এই বুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ‘অহং’ জ্ঞান ও বাহ্য বস্তুর জ্ঞান উদিত হয়। মনে কর, আমার হাতের উপর একটি মশা আসিয়া দংশন করিল। এই বাহ্য বস্তুজনিত বেদনা আমার চিত্তে নীত হইল, উহা একটু কম্পিত হইল—মনোবিজ্ঞানমতে উহার নামই ‘মন’। তারপরই একটি প্রতিক্রিয়া হইল এবং তৎক্ষণাৎ আমার ভিতর এই ভাবের উদয় হইল যে, আমার হাতে একটি মশা বসিয়াছে, সেটিকে তাড়াইতে হইবে। তবে এইটুকু বুঝিতে হইবে যে, হ্রদে যে-সকল আঘাত আসে, সেগুলি সবই বহির্জগৎ হইতে; কিন্তু চিত্তহ্রদে আঘাত বহির্জগৎ হইতেও আসিতে পারে, আবার অন্তর্জগৎ হইতেও আসিতে পারে। চিত্ত এবং উহার বিভিন্ন অবস্থার নাম ‘অন্তঃকরণ’।

পূর্বে যাহা বর্ণিত হইল, তাহার সহিত তোমাদিগকে আর একটি বিষয় বুঝিতে হইবে; তাহা হইলে ইহা দ্বারা অদ্বৈতবাদ বুঝিবার বিশেষ সাহায্য হইবে। তোমাদের মধ্যে সকলে নিশ্চয়ই মুক্তা দেখিয়াছ, এবং অনেকেই জান—মুক্তা কিভাবে নির্মিত হয়। শুক্তির মধ্যে একটু ধূলি ও বালুকণা প্রবেশ করিয়া উহাকে উত্তেজিত করিতে থাকে, আর শুক্তির দেহ উহার উপর প্রতিক্রিয়া করিয়া ঐ ক্ষুদ্র বালুকণাকে নিজ শরীরনিঃসৃত রসে প্লাবিত করিতে থাকে। উহাই তখন নির্দিষ্ট গঠন প্রাপ্ত হইয়া মুক্তারূপে পরিণত হয়। এই মুক্তা যেরূপে গঠিত হয়, ঠিক সেইভাবে আমরা আমাদের সমগ্র জগৎকে গঠন করিতেছি। বাহ্যজগৎ হইতে আমরা কেবল উত্তেজনা পাই, এমন কি সেই উত্তেজনার অস্তিত্ব জানিতে হইলেও আমাদিগকে ভিতর হইতে প্রতিক্রিয়া করিতে হয়; আর যখন আমরা এই প্রতিক্রিয়া করি, তখন প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের নিজ মনেরই কিছুটা সেই উত্তেজনার দিকে প্রেরণ করি; আর যখন আমরা উহাকে জানিতে পারি, তখন আমাদের নিজ মন ঐ উত্তেজনা দ্বারা যেভাবে আকারিত হয়, আমরা সেইভাবে আকারিত মনকেই জানিতে পারি। যাঁহারা বহির্জগতের বাস্তবতায় বিশ্বাস করিতে চান, তাঁহাদিগকে এ-কথা মানিতে হইবে, আজকাল শারীরবিজ্ঞানের এই উন্নতির দিনে এ-কথা না মানিয়া আর উপায় নাই যে, যদি বহির্জগৎকে আমরা ‘ক’ বলিয়া নির্দেশ করি, তবে আমরা প্রকৃতপক্ষে ক+মনকে জানিতে পারি, এবং এই জ্ঞানক্রিয়ার মধ্যে মনের ভাগটি এত অধিক যে, উহা ঐ ‘ক’-এর সর্বাংশব্যাপী, আর ঐ ‘ক’-এর স্বরূপ প্রকৃতপক্ষে চিরকালই অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়; অতএব যদি বহির্জগৎ বলিয়া কিছু থাকে, তবে উহা চিরকালই অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। আমাদের মনের দ্বারা উহা যেরূপ আকারে রূপান্তরিত হয়, উহাকে আমরা সেই ভাবেই জানিতে পারি। অন্তর্জগৎ সম্বন্ধেও ঐরূপ। আমাদের আত্মা সম্বন্ধে ঠিক ঐ কথা খাটে। আত্মাকে জানিতে হইলে উহাকেও আমাদের মনের মধ্য দিয়া জানিতে হয়, অতএব আমরা এই আত্মা সম্বন্ধে যতটুকু জানি, তাহা ‘আত্মা+মন’ ব্যতীত আর কিছু নহে। অর্থাৎ মনের দ্বারা আবৃত, মনের দ্বারা পরিণত বা গঠিত আত্মাকেই আমরা জানি। আমরা পরে এই তত্ত্ব-সম্বন্ধে বিশেষভাবে আলোচনা করিব। তবে এখানে যাহা হইয়াছে, তাহা মনে রাখা আবশ্যক।

তারপর আর একটি বিষয় বুঝিতে হইবে। এই দেহ এক নিরবচ্ছিন্ন জড়প্রবাহের নামমাত্র। প্রতিমুহূর্তে আমরা ইহাতে নূতন নূতন উপাদান দিতেছি, প্রতিমুহূর্তে আবার ইহা হইতে অনেক পদার্থ বাহির হইয়া যাইতেছে; যেন একটি সদা-প্রবাহিত নদী—উহার রাশি রাশি জল সর্বদাই এক স্থান হইতে অন্য স্থানে চলিয়া যাইতেছে, তথাপি আমরা কল্পনাবলে সমস্তটিকে একবস্তুরূপে গ্রহণ করিয়া উহাকে সেই একই নদী বলিয়া থাকি। কিন্তু নদীটি প্রকৃতপক্ষে কি? প্রতিমুহূর্তে নূতন নূতন জল আসিতেছে, প্রতিমুহূর্তে নদীর তটভূমি পরিবর্তিত হইতেছে, প্রতিমুহূর্তে তীরবর্তী বৃক্ষলতা এবং পত্রপুষ্পফলাদির পরিবর্তন ঘটিতেছে। তবে নদীটি কি? নদী এই পরিবর্তন-সমষ্টির নামমাত্র। মনের সম্বন্ধেও ঐ এক কথা। বৌদ্ধেরা এই ক্রমাগত পরিবর্তন লক্ষ্য করিয়াই মহান্ ‘ক্ষণিকবিজ্ঞানবাদ’ মতের সৃষ্টি করেন। উহা ঠিক ঠিক বুঝা অতি কঠিন ব্যাপার, কিন্তু বৌদ্ধ দর্শনে এই মত সুদৃঢ় যুক্তি দ্বারা প্রতিপাদিত হইয়াছে, আর ভারতে বেদান্তের কোন কোন অংশের বিরুদ্ধে এই মত উত্থিত হইয়াছিল। এই মতকে নিরস্ত করার প্রয়োজন হইয়াছিল, আমরা পরে দেখিব, কেবল অদ্বৈতবাদই এই মতকে খণ্ডন করিতে সমর্থ, আর কোন মতই নহে। আমরা পরে ইহাও দেখিব যে, অদ্বৈতবাদ-সম্বন্ধে লোকের নানাবিধ অদ্ভুত ধারণা সত্ত্বেও, অদ্বৈতবাদের নামে ভয় পাওয়া সত্ত্বেও বাস্তবিক ইহাতেই জগতের পরিত্রাণ; কারণ এই অদ্বৈতবাদেই সব কিছুর যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। উপাসনাপ্রণালী হিসাবে দ্বৈতবাদ প্রভৃতি খুব ভাল বটে, ঐগুলি মনের খুব তৃপ্তিকর বটে, হইতে পারে—ঐগুলি মনকে উচ্চতর পথে অগ্রসর হইতে সাহায্য করে, কিন্তু যদি কেহ একই সঙ্গে যুক্তিবিচারশীল এবং ধর্মপরায়ণ হইতে চায়, তবে তাহার পক্ষে অদ্বৈতবাদই একমাত্র পন্থা।

যাহা হউক, আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, মনও দেহের মত একটি নদীস্বরূপ—নিয়তই একদিকে শূন্য হইতেছে, অপরদিকে পূর্ণ হইতেছে; তবে সেই একত্ব কোথায়, যাহাকে আমরা ‘আত্মা’ বলিয়া অভিহিত করি? আমরা দেখি, আমাদের দেহে ও মনে এইরূপ ক্রমাগত পরিবর্তন হইতে থাকিলেও আমাদের মধ্যে এমন কিছু আছে, যাহা অপরিবর্তনীয়—যাহার জন্য আমাদের ধারণাগুলি অপরিবর্তনীয় বলিয়া মনে হয়। যদি বিভিন্ন দিক হইতে বিভিন্ন আলোকরাশি আসিয়া একটি যবনিকা বা দেওয়াল বা অপর কোন অচল বস্তুর উপর পড়ে, তখন—কেবল তখনই ঐগুলি এক অখণ্ড সমষ্টির আকার ধারণ করিতে পারে। মানুষের বিভিন্ন শারীরযন্ত্রসমূহের মধ্যে কোথায় সেই নিশ্চল অখণ্ড বস্তু, যাহার উপর বিভিন্ন ভাবরাশি পতিত হইয়া অখণ্ডত্বের ভাব প্রাপ্ত হইতেছে? অবশ্য মন কখনও সেই বস্তু হইতে পারে না, কারণ মনও পরিবর্তনশীল। অতএব এমন কিছু বস্তু অবশ্যই আছে, যাহা দেহও নহে, মনও নহে, যাহার কখনও পরিণাম হয় না, যাহার উপর আমাদের সমুদয় ভাবরাশি, সমুদয় বাহ্য বিষয় আসিয়া এক অখণ্ডভাবে পরিণত হয়,—ইহাই প্রকৃতপক্ষে আমাদের আত্মা। আর যখন দেখিতে, সমুদয় জড়পদার্থ—তাহাকে ‘সূক্ষ্ম জড়’ অথবা মন যে-নামেই অভিহিত কর না—এবং সমুদয় স্থূল, জড় বা বাহ্য জগৎ উহার সহিত তুলনায় পরিবর্তনশীল, তখন এই অপরিবর্তনীয় বস্তুটি কখনই জড় পদার্থ হইতে পারে না; অতএব উহা চৈতন্যস্বভাব অর্থাৎ উহা জড় নয়, উহা অবিনাশী ও অপরিণামী।

তারপর আর একটি প্রশ্ন আসে। অবশ্য বাহ্য জগৎ দেখিয়া ‘কে উহা সৃষ্টি করিল, কে জড় পদার্থ সৃষ্টি করিল?’—এইরূপ প্রশ্ন করিয়া ক্রমশঃ উদ্দেশ্যবাদ আনিবার যে পূর্বপ্রচলিত যুক্তি রহিয়াছে, আমি তাহার কথা বলিতেছি না। মানুষের অন্তঃপ্রকৃতি হইতেই সত্যকে জানা হইবে—আত্মা সম্বন্ধে যেমন প্রশ্ন উঠিয়াছিল, এ প্রশ্নও ঠিক সেইভাবেই উঠিয়াছিল। যদি স্বীকার করা যায় যে, প্রত্যেক মানুষেরই মধ্যে দেহ ও মন হইতে স্বতন্ত্র এক-একটি অপরিবর্তনীয় আত্মা আছেন, তথাপি ইহাও স্বীকার করিতে হয় যে, এই-সকল আত্মার মধ্যে ধারণা, ভাব ও সহানুভূতির ঐক্য বিদ্যমান। নতুবা কি করিয়া আমার আত্মা তোমার আত্মার উপর কাজ করিবে? কী সেই মধ্যবর্তী বস্তু, যাহার মধ্য দিয়া এক আত্মা অপর আত্মার উপর কাজ করিবে? তোমাদের আত্মা সম্বন্ধে আমি যে কিছু অনুভব করিতে পারি, কিরূপে ইহা সম্ভব হয়? এমন কী বস্তু আছে, যাহা তোমার ও আমার উভয়ের আত্মাকেই স্পর্শ করিয়া রহিয়াছে? অতএব অপর একটি আত্মা স্বীকার করিবার দার্শনিক আবশ্যকতা দেখা যাইতেছে—যে-আত্মা সমুদয় বিভিন্ন আত্মা ও জড় বস্তুর মধ্য দিয়া কাজ করিবে, যে-আত্মা জগতের অসংখ্য আত্মাতে ওতপ্রোতভাবে বিদ্যমান থাকিবে, যে-আত্মার সহায়তায় অপর আত্মাসমূহ প্রাণবন্ত হইবে, পরস্পরকে ভালবাসিবে, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি দেখাইবে, পরস্পরের জন্য কাজ করিবে। এই সর্বব্যাপী আত্মাই ‘পরমাত্মা’ নামে অভিহিত, তিনি সমগ্র জগতের প্রভু, ঈশ্বর। আবার আত্মা যখন জড়পদার্থনির্মিত নয়—চৈতন্যস্বরূপ, তখন উহা জড়ের নিয়মাবলী অনুসরণ করিতে পারে না, জড়ের নিয়মানুসারে উহার বিচারও চলিতে পারে না; অতএব আত্মা অবিনাশী ও অপরিণামী।

নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ॥
অচ্ছেদ্যোঽয়মদাহ্যোঽয়মক্লেদ্যোঽশোষ্য এব চ।
নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোহঽয়ং সনাতনঃ॥৬২

অগ্নি এই আত্মাকে দগ্ধ করিতে পারে না, কোন অস্ত্র ইহাকে ছিন্ন করিতে পারে না, বায়ু ইহাকে শুষ্ক করিতে পারে না, জল ইহাকে ভিজাইতে পারে না—এই মানবাত্মা নিত্য, সর্বব্যাপী, স্থির, নিশ্চল ও চিরন্তন।

গীতা ও বেদান্তমতে এই জীবাত্মা বিভু, কপিলের মতেও ইহা সর্বব্যাপী। অবশ্য ভারতে এমন অনেক সম্প্রদায় আছে, যাহাদের মতে এই জীবাত্মা অণু, কিন্তু তাহাদেরও মত এই যে, আত্মার প্রকৃত স্বরূপ বিভু, ব্যক্ত অবস্থায় উহা অণু।

তারপর আর একটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হইবে। ইহা সম্ভবতঃ তোমাদের নিকট অদ্ভুত বলিয়া বোধ হইতে পারে, কিন্তু এই তত্ত্বটিও বিশেষভাবে ভারতীয়—আর এটিই আমাদের সকল সম্প্রদায়ের সাধারণভাব। এই জন্য আমি তোমাদিগকে এই তত্ত্বটির প্রতি অবহিত হইতে এবং উহা স্মরণ রাখিতে অনুরোধ করিতেছি, কারণ ভারতীয় বলিতে যাহা কিছু—এই তত্ত্বটি সে-সকলেরই ভিত্তিস্বরূপ। জার্মান ও ইংরেজ পণ্ডিতগণ কর্তৃক পাশ্চাত্যদেশে প্রচারিত শারীর-পরিণামবাদের (doctrine of physical evolution) বিষয় তোমরা শুনিয়াছ। ঐ মতে সকল প্রাণীর শরীর প্রকৃতপক্ষে অভিন্ন; আমরা যে ভেদ দেখি, তাহা একই বস্তুর বিভিন্ন প্রকাশমাত্র, আর ক্ষুদ্রতম কীট হইতে মহত্তম সাধু পর্যন্ত সকলেই প্রকৃতপক্ষে এক; একটি অপরটিতে পরিণত হইতেছে, আর এইরূপ চলিতে চলিতে ক্রমশঃ উন্নত হইয়া পূর্ণত্ব লাভ করিতেছে। আমাদের শাস্ত্রেও এই পরিণামবাদ রহিয়াছে।

যোগী পতঞ্জলি বলিয়াছেন, ‘জাত্যন্তরপরিণামঃ প্রকৃত্যাপূরাৎ।’৬৩

অর্থাৎ এক জাতি অপর জাতিতে, এক শ্রেণী অপর শ্রেণীতে পরিণত হয়। তবে ইওরোপীয়দিগের সহিত আমাদের প্রভেদ কোথায়?—‘প্রকৃত্যাপূরাৎ’—প্রকৃতির আপূরণের দ্বারা। ইওরোপীয়গণ বলেনঃ প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রাকৃতিক ও যৌন-নির্বাচন প্রভৃতিই এক প্রাণীকে অপর প্রাণীর শরীর গ্রহণ করিতে বাধ্য করে। কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে এই জাত্যন্তরপরিণামের যে হেতু নির্দিষ্ট হইয়াছে, তাহা দেখিয়া মনে হয়, ভারতীয়েরা ইওরোপীয়গণ অপেক্ষা অধিক বিশ্লেষণ করিয়াছিলেন, তাঁহারা আরও ভিতরে প্রবেশ করিয়াছিলেন। এই প্রকৃতির আপূরণের অর্থ কি? আমরা স্বীকার করিয়া থাকি যে, জীবাণু ক্রমশঃ উন্নত ইহয়া বুদ্ধ-রূপে পরিণত হয়। আমরা ইহা স্বীকার করিলেও আমাদের দৃঢ় ধারণা যে, কোন যন্ত্রে কোন না কোন আকারে যদি উপযুক্ত পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ না করা যায়, তবে তাহা হইতে তদনুরূপ কাজ পাওয়া যায় না। যে আকারই ধারণ করুক না, শক্তিসমষ্টি চিরকালই সমান। একপ্রান্তে যদি শক্তির বিকাশ দেখিতে চাও, তবে অপর প্রান্তে শক্তি প্রয়োগ করিতে হইবে; হইতে পারে—উহা অন্য আকারে প্রকাশিত হইবে, কিন্তু পরিমাণ এক হওয়া চাই-ই চাই। অতএব যদি পরিণামের এক প্রান্ত বুদ্ধ হন, তবে অপর প্রান্তের জীবাণুও অবশ্য বুদ্ধতুল্য হইবে। বুদ্ধ যদি ক্রমবিকশিত জীবাণু হন, তবে ঐ জীবাণুও নিশ্চয়ই ক্রমসঙ্কুচিত বুদ্ধ। যদি এই ব্রহ্মাণ্ড অনন্ত শক্তির বিকাশ হয়, তবে প্রলয়কালেও সেই অনন্তশক্তি সঙ্কুচিতভাবে থাকিবে, ইহা স্বীকার করিতে হইবে। অন্য কোন ভাব সম্ভব নয়। অতএব ইহা নিশ্চিত যে, প্রত্যেক আত্মাই অনন্ত। আমাদের পদতলসঞ্চারী ক্ষুদ্রতম কীট হইতে মহত্তম সাধু পর্যন্ত সকলেরই ভিতর অনন্ত শক্তি, অনন্ত পবিত্রতা ও সমুদয় গুণই অনন্ত পরিমাণে রহিয়াছে। প্রভেদ কেবল প্রকাশ্যের তারতম্যে। কীটে সেই মহাশক্তির অতি অল্প পরিমাণ বিকাশ হইয়াছে, তোমাতে তাহা অপেক্ষা অধিক, আবার অতঃপর একজন দেবতুল্য মানবে তাহা অপেক্ষা অধিকতর শক্তির বিকাশ হইয়াছে—এই মাত্র প্রভেদ। কিন্তু সকলের মধ্যেই সেই এক শক্তি রহিয়াছে।

পতঞ্জলি বলিতেছেন, ‘ততঃ ক্ষেত্রিকবৎ’।৬৪

কৃষক যেরূপ তাহার ক্ষেত্রে জলসেচন করে। কৃষক তাহার ক্ষেত্রে জল আনিবার জন্য কোন নির্দিষ্ট জলাশয় হইতে একটি প্রণালী কাটিয়াছি, ঐ প্রণালীর মুখে একটি কপাট আছে; পাছে সমুদয় জল গিয়া ক্ষেত্রকে প্লাবিত করিয়া দেয়, এই জন্য ঐ কপাট বন্ধ রাখা হয়। যখন জলের প্রয়োজন হয়, তখন ঐ কপাট খুলিয়া দিলেই জল নিজশক্তিবলেই উহার ভিতরে প্রবেশ করে। জলের শক্তি বাড়াইতে হইবে না, জলাশয়ের জলে পূর্ব হইতেই ঐ শক্তি রহিয়াছে। এইরূপ আমাদের প্রত্যেকের পশ্চাতে অনন্ত শক্তি, অনন্ত পবিত্রতা, অনন্ত সত্তা, অনন্ত বীর্য, অনন্ত আনন্দের ভাণ্ডার রহিয়াছে, কেবল এই কপাট, দেহরূপ এই কপাট—আমাদের যথার্থ এবং পূর্ণ বিকাশ হইতে দিতেছে না। আর যতই এই দেহের গঠন উন্নত হইতে থাকে, যতই তমোগুণ রজোগুণে এবং রজোগুণ সত্ত্বগুণে পরিণত হয়, ততই এই শক্তি ও শুদ্ধত্ব প্রকাশিত হইতে থাকে; এই জন্যই আমরা পানাহার সম্বন্ধে এত সাবধান।

হইতে পারে, আমরা মূল তত্ত্ব ভুলিয়া গিয়াছি—যেমন আমাদের বাল্যবিবাহ-সম্বন্ধে; যদিও এ বিষয়টি এখানে অপ্রাসঙ্গিক, তথাপি দৃষ্টান্তরূপে আমরা উহা গ্রহণ করিতে পারি। যদি উপযুক্ত অবসর পাই, তবে আমি এই-সকল বিষয় বিশেষরূপে আলোচনা করিব। তবে ইহা বলিয়া রাখি যে, বাল্যবিবাহ-প্রথা যে-সকল ভাব হইতে উদ্ভূত হইয়াছে, সেই-সকল ভাব অবলম্বন করিয়াই প্রকৃত সভ্যতার সঞ্চার হইতে পারে, অন্য কিছুতেই নহে। যদি পুরুষ বা নারীকে অপর যে কোন নারী বা পুরুষকে পত্নী বা পতিরূপে গ্রহণ করিবার স্বাধীনতা দেওয়া যায়, যদি ব্যক্তিগত সুখ ও পাশবপ্রকৃতির পরিতৃপ্তি সমাজে অবাধে চলিতে থাকে, তাহার ফল নিশ্চয়ই অশুভ হইবে—দুষ্টপ্রকৃতি অসুরস্বভাব সন্তানসমূহের উৎপত্তি হইবে। একদিকে প্রত্যেক দেশে মানুষ এই-সকল পশু-প্রকৃতি সন্তান উৎপন্ন করিতেছে, অপরদিকে তাহাদিগকে বশে রাখিবার জন্য পুলিশ বাড়াইতেছে। এভাবে সামাজিক ব্যাধির প্রতিকারের চেষ্টায় বিশেষ ফল নাই, বরং কিভাবে সমাজ হইতে এই-সকল দোষ, এই-সকল পশুপ্রকৃতি সন্তানের উৎপত্তি নিবারিত হইতে পারে, তাহাই সমস্যা। আর যতদিন তুমি সমাজে বাস করিতেছ, ততদিন তোমার বিবাহের ফল নিশ্চয়ই আমাকে এবং আর সকলকেই ভোগ করিতে হয়, সুতরাং তোমার কিরূপ বিবাহ করা উচিত, কিরূপ উচিত নয়, এ-বিষয়ে তোমাকে আদেশ করিবার অধিকার সমাজের আছে। ভারতীয় বাল্যবিবাহ-প্রথার পশ্চাতে এই-সকল উচ্চতর ভাব ও তত্ত্ব রহিয়াছে—কোষ্ঠীতে বরকন্যার যেরূপ ‘জাতি’ ‘গণ’ প্রভৃতি লিখিত থাকে, এখনও তদনুসারেই হিন্দুসমাজে বিবাহ হয়। আর প্রসঙ্গক্রমে ইহাও বলিতে চাই যে, মনুর মতে কামোদ্ভূত সন্তান ‘আর্য’ নহে। যে-সন্তানের জন্মমৃত্যু বেদের বিধানানুযায়ী, সে-ই প্রকৃতপক্ষে আর্য। আজকাল সকল দেশেই এইরূপ আর্যসন্তান খুব অল্পই জন্মিতেছে এবং তাহার ফলেই কলিযুগ-নামক দোষরাশির উৎপত্তি হইয়াছে। আমরা প্রাচীন মহান্ আদর্শসমূহ ভুলিয়া গিয়াছি। সত্য বটে, আমরা এখন এই-সকল ভাব সম্পূর্ণরূপে কার্যে পরিণত করিতে পারি না; ইহাও সম্পূর্ণ সত্য যে, আমরা এই-সকল মহান্ ভাবের কতকগুলিকে লইয়া একটা বিকৃত হাস্যকর ব্যাপার করিয়া তুলিয়াছি। অতি দুঃখের বিষয়, আজকাল আর প্রাচীন কালের মত পিতামাতা নাই, সমাজও এখন পূর্বের মত শিক্ষিত নয়, আর পূর্বে যেমন সমাজভুক্ত সকল লোকের উপর একটা ভালবাসা ছিল, এখনকার সমাজে তাহা নাই। কিন্তু তাহা হইলেও কার্যকালে যে-রূপই গ্রহণ করুক না কেন, মূল তত্ত্বটি নির্দোষ, আর যদি ঐ তত্ত্ব ঠিকমত কাজে পরিণত না হইয়া থাকে, যদি প্রণালীবিশেষ বিফল হইয়া থাকে, তবে মূল তত্ত্বটি লইয়া যাহাতে উহা ভালভাবে কার্যে পরিণত হয়, তাহার চেষ্টা কর। মূল তত্ত্বটি নষ্ট করিয়া ফেলিবার চেষ্টা কর কেন?

খাদ্যসমস্যা সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। ঐ তত্ত্বও যেভাবে কাজে পরিণত হইতেছে, তাহা খুব খারাপ বটে, কিন্ত তাহাতে ঐ তত্ত্বের কোন দোষ নাই। উহা সনাতন, চিরকালই থাকিবে। তত্ত্বটি যাহাতে ভাল করিয়া কার্যে পরিণত হয়, তাহার চেষ্টা কর।

ভারতে আমাদের সকল সম্প্রদায়কে আত্মা সম্বন্ধে পূর্বোক্ত মহান্ তত্ত্ব বিশ্বাস করিতে হয়। শুধু দ্বৈতবাদীরা বলেন—পরে আমরা ইহা বিশেষভাবে দেখিব—অসৎকর্মের দ্বারা আত্মা সঙ্কোচপ্রাপ্ত হয়, উহার সমুদয় শক্তি ও স্বভাব সঙ্কুচিত হইয়া যায়, আবার সৎকর্মের দ্বারা সেই স্বভাবের বিকাশ হয়। অদ্বৈতবাদী বলেন, আত্মার কখনও সঙ্কোচ বা বিকাশ কিছুই হয় না, এরূপ হইয়াছে বলিয়া মনে হয় মাত্র। দ্বৈতবাদী ও অদ্বৈতবাদীর মধ্যে এইমাত্র প্রভেদ। তবে সকলেই এ-কথা স্বীকার করিয়া থাকেন যে, আত্মাতে পূর্ব হইতেই সকল শক্তি বিদ্যমান, বাহির হইতে কোন কিছু যে আত্মাতে আসিবে তাহা নহে, কোন জিনিষ যে উহাতে আকাশ হইতে পড়িবে, তাহা নহে। এইটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করিও যে, তোমাদের বেদসমূ্হ inspired—বাহির হইতে ভিতরে আসিতেছে এরূপ নহে, expired—ভিতর হইতে বাহিরে আসিতেছে, বেদসমূহ প্রত্যেক আত্মায় নিহিত সনাতন নিয়মাবলী। পিপীলিকা হইতে দেবতা পর্যন্ত সকলেরই আত্মায় বেদ অবস্থিত। পিপীলিকাকে শুধু বিকাশপ্রাপ্ত হইয়া ঋষিদেহ লাভ করিতে হইবে; তখনই তাহার ভিতর বেদ অর্থাৎ সনাতন নিয়মাবলী প্রকাশিত হইবে। এই মহান্ তত্ত্বটি বুঝা বিশেষ প্রয়োজন যে, আমাদের ভিতরে পূর্ব হইতেই শক্তি বিদ্যমান, মুক্তি পূর্ব হইতেই আমাদের ভিতরে রহিয়াছে। হয় বল, শক্তি—সঙ্কোচপ্রাপ্ত হইয়াছে, না হয় বল, মায়ার আবরণে আবৃত হইয়াছে, তাহাতে কিছু আসে যায় না। এইটুকু বুঝিতে হইবে যে, পূর্ব হইতেই উহা ভিতরে রহিয়াছে। তোমাদিগকে ইহা বিশ্বাস করিতে হইবে; প্রত্যেকের ভিতরে অনন্ত শক্তি যে গূঢ়ভাবে রহিয়াছে, তাহা বিশ্বাস করিতে হইবে—বিশ্বাস করিতে হইবে যে, বুদ্ধের ভিতর যে-শক্তি রহিয়াছে, অতি নিম্নতম মানুষের মধ্যেও তাহা রহিয়াছে। ইহাই হিন্দুদের আত্মতত্ত্ব।

কিন্তু এইখানেই বৌদ্ধদের সহিত মহা বিরোধ আরম্ভ। বৌদ্ধেরা দেহকে বিশ্লেষণ করিয়া বলেন, দেহ একটি জড়-স্রোত মাত্র; সেইরূপ মনকে বিশ্লেষণ করিয়া উহাকেও এইরূপ একটি জড়প্রবাহ বলিয়া বর্ণনা করেন। আত্মার সম্বন্ধে তাঁহারা বলেনঃ উহার অস্তিত্ব স্বীকার করা অনাবশ্যক। উহার অস্তিত্ব অনুমান করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। একটি দ্রব্য এবং ঐ দ্রব্যসংলগ্ন গুণরাশির কল্পনা করিবার প্রয়োজন কি? আমরা শুধু গুণই স্বীকার করিয়া থাকি। যেখানে একটি কারণ স্বীকার করিলেই সব কিছুর ব্যাখ্যা হয়, সেখানে দুইটি কারণ স্বীকার করা যুক্তিবিরুদ্ধ। এইরূপে বৌদ্ধদের সঙ্গে বিরোধ আরম্ভ হইল, আর যে-সকল মত দ্রব্যবিশেষের অস্তিত্ব স্বীকার করিত, বৌদ্ধেরা সেইসব মতই খণ্ডন করিয়া ফেলিয়া দিলেন। যাহারা দ্রব্য ও গুণ উভয়ের অস্তিত্ব স্বীকার করে, যাহারা বলে—তোমার একটি আত্মা, আমার একটি আত্মা, প্রত্যেকেরই শরীর ও মন হইতে পৃথক্‌ একটি একটি আত্মা আছে, প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব আছে, তাহাদের মতে বরাবরই একটু গলদ ছিল। অবশ্য দ্বৈতবাদের মত এ পর্যন্ত ঠিক; ইহা আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি যে, এই শরীর রহিয়াছে, এই সূক্ষ্ম মন রহিয়াছে, আত্মা রহিয়াছে, আর সকল আত্মার ভিতর সেই পরমাত্মা রহিয়াছেন। এখানে মুশকিল এইটুকু যে, এই আত্মা ও পরামাত্মা উভয়ই বস্তু, আর উহাদের উপর দেহ মন প্রভৃতি গুণরূপে লাগিয়া রহিয়াছে—স্বীকার করা হয়। এখন কথা এই—কেহই কখনও ‘বস্তু’ দেখে নাই, উহার সম্বন্ধে চিন্তাও করিতে পারে না। অতএব বৌদ্ধেরা বলেন, এই বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করিবার প্রয়োজন কি? ক্ষণিকবিজ্ঞানবাদী হইয়া বল না কেন যে, মানসিক তরঙ্গরাজি ব্যতীত আর কিছুরই অস্তিত্ব নাই? মানসিক তরঙ্গগুলি কেহই পরস্পরের সহিত সংলগ্ন নহে, উহারা মিলিয়া একটি বস্তু হয় নাই, সমুদ্রের তরঙ্গরাজির ন্যায় একটির পশ্চাতে আর একটি চলিয়াছে, উহারা কখনই সম্পূর্ণ নহে, কখনই উহারা একটি অখণ্ড একত্ব গঠন করে না। মানব কেবল এইরূপ তরঙ্গপরম্পরামাত্র—একটি তরঙ্গ চলিয়া যায়, যাইবার সময় আর একটির জন্ম দিয়া যায়, এইরূপ চলিতে থাকে; আর এই-সকল তরঙ্গের নিবৃত্তিকেই ‘নির্বাণ’ বলে।

তোমরা দেখিতেছ, দ্বৈতবাদ এই মতের নিকট নীরব; দ্বৈতবাদের পক্ষে ইহার বিরুদ্ধে আর কোন প্রকার যুক্তিতর্ক প্রয়োগ করা অসম্ভব; দ্বৈতবাদীর ঈশ্বরও এখানে টিকিতে পারেন না। সর্বব্যাপী অথচ ব্যক্তিবিশেষ, হস্ত বিনা যিনি জগৎ সৃষ্টি করেন, চরণ বিনা যিনি গমন করেন ইত্যাদি, কুম্ভকার যেমন ঘট প্রস্তুত করে, সেইরূপে যিনি বিশ্ব সৃষ্টি করেন—বৌদ্ধ বলেন, ঈশ্বর যদি এইরূপ হন, তবে আমি সেই ঈশ্বরের সহিত যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত, তাঁহাকে উপাসনা করিতে ইচ্ছুক নহি। এই জগৎ দুঃখপূর্ণ; ইহা যদি ঈশ্বরের কার্য হয়, বৌদ্ধ বলেন—তবে আমি এরূপ ঈশ্বরের সহিত যুদ্ধ করিব। আর দ্বিতীয়তঃ এইরূপ ঈশ্বরের অস্তিত্ব অযৌক্তিক ও অসম্ভব। তোমরা সকলেই ইহা অনায়াসে বুঝিতে পার। যাঁহারা জগতের রচনাকৌশল দেখিয়া উহার একজন পরমকৌশলী নির্মাতার অস্তিত্ব অনুমান করেন, তাঁহাদের যুক্তিসমূহের দোষ আলোচনা করিবার প্রয়োজন নাই—ক্ষণিকবিজ্ঞানবাদীরাই তাঁহাদের সমুদয় যুক্তিজাল একেবারে খণ্ডন করিয়াছিলেন। সুতরাং ব্যক্তিবিশেষ ঈশ্বর আর টিকিতে পারিলেন না।

তোমরা বলিয়া থাক যে, সত্য—শুধু সত্যই তোমাদের একমাত্র লক্ষ্য। ‘সত্যমেব জয়তে নানৃত্যং, সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ।’৬৫ সত্যেরই জয় হইয়া থাকে, মিথ্যা কখনও জয়লাভ করে না, সত্যের দ্বারাই দেবযানমার্গ লাভ হয়। সকলেই সত্যের পতাকা উড়াইয়া থাকে বটে, কিন্ত উহা কেবল দুর্বল ব্যক্তিকে পদদলিত করিবার জন্য। তোমাদের ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় দ্বৈতবাদাত্মক ধারণা লইয়া প্রতিমাপূজক গরিব বেচারার সহিত বিবাদ করিতে যাইতেছ, ভাবিতেছ—তোমার ভারি যুক্তিবাদী, তাহাকে অনায়াসে পরাস্ত করিয়া দিতে পার; আর সে যদি ঘুরিয়া তোমার ব্যক্তিবিশেষ ঈশ্বরকে একেবারে উড়াইয়া দিয়া উহাকে কাল্পনিক বলে, তখন তুমি যাও কোথায়? তুমি তখন বিশ্বাসের দোহাই দিতে থাক; অথবা তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ‘নাস্তিক’ নামে অভিহিত করিয়া চীৎকার করিতে থাক; দুর্বল মানুষ তো চিরকালই চীৎকার করিয়া থাকে; যে আমাকে পরাস্ত করিবে, সেই নাস্তিক!

যদি যুক্তিবাদী হইতে চাও, তবে বরাবর যুক্তিবাদী হও। যদি না পার, তবে তুমি নিজের জন্য যেটুকু স্বাধীনতা চাও, অপরকে সেটুকু দাও না কেন? এইরূপ ঈশ্বরের অস্তিত্ব তুমি কিভাবে প্রমাণ করিবে? অপর দিকে, প্রমাণ করা যাইতে পারে—ঈশ্বরের অস্তিত্ব নাই। তাঁহার অস্তিত্ব-বিষয়ে কোন প্রমাণ নাই, বরং অনস্তিত্ব-বিষয়ে কতকগুলি প্রমাণ আছে। তোমার ঈশ্বর, তাঁহার গুণ, অসংখ্য জীবাত্মা, আবার প্রত্যেক জীবাত্মাই ব্যক্তি—এই-সকল লইয়া তুমি কেমন করিয়া তাঁহার অস্বিত্ব প্রমাণ করিতে পার? তুমি ব্যক্তি কিসে? দেহরূপে তুমি ব্যক্তি নও, কারণ তোমরা আজ প্রাচীন বৌদ্ধগণ অপেক্ষাও ভালরূপে জান যে, এক সময় হয়তো যে পদার্থ সূর্যে ছিল, আজ তাহা তোমাতে আসিয়া থাকিতে পারে, আর হয়তো এখনই বাহির হইয়া গিয়া বৃক্ষলতাদিতে থাকিতে পারে। তবে তোমার ব্যক্তিত্ব কোথায়? মনের সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। তবে তোমার ব্যক্তিত্ব কোথায়? আজ তোমার এক রকম ভাব, আবার কাল আর এক ভাব! যখন শিশু ছিলে তখন যেরূপ চিন্তা করিতে, এখন আর সেরূপ চিন্তা কর না; যুবা-অবস্থায় মানুষ যেরূপ চিন্তা করিয়াছে, বৃদ্ধ হইয়া সেরূপ চিন্তা করে না। তবে তোমার ব্যক্তিত্ব কোথায়? জ্ঞানেই তোমার ব্যক্তিত্ব—এ-কথা বলিও না, জ্ঞান অহংতত্ত্বমাত্র, আর উহা তোমার প্রকৃত অস্তিত্বের অতি সামান্য-অংশব্যাপী। আমি যখন তোমার সহিত কথা বলি, তখন আমার সকল ইন্দ্রিয় কাজ করিতেছে, কিন্ত আমি সে-সম্বন্ধে জানিতে পারি না। যদি জ্ঞানই অস্তিত্বের প্রমাণ হয়, তবে বলিতে হইবে ইন্দ্রিয়সমূহ নাই, কারণ আমি তো উহাদের অস্তিত্ব জানিতে পারি না। তবে আর তোমার ব্যক্তিবিশেষ ঈশ্বর সম্বন্ধে মতবাদগুলি কোথায় দাঁড়ায়? এরূপ ঈশ্বর তুমি কিভাবে প্রমাণ করিতে পার?

আবার বৌদ্ধেরা উঠিয়া বলিলেনঃ ইহা যে শুধু অযৌক্তিক তাহা নহে, এরূপ বিশ্বাস নীতিবিরূদ্ধও বটে, কারণ উহা মানুষকে কাপুরষ হইতে এবং বাহিরের সাহায্য প্রার্থনা করিতে শিখায়—কেহই কিন্ত তাহাকে এরূপ সাহায্য করিতে পারে না। এই ব্রহ্মাণ্ড পড়িয়া রহিয়াছে, মানুষই ইহা এরূপ করিয়াছে। তবে কেন বাহিরের একজন কাল্পনিক ব্যক্তিবিশেষে বিশ্বাস কর, যাঁহাকে কেহ কখনও দেখে নাই বা অনুভব করে নাই, অথবা যাঁহার নিকট হইতে কেহ কখনও সাহায্য পায় নাই? তবে কেন নিজেদের কাপুরুষ করিয়া ফেলিতেছ, আর তোমাদের সন্তান-সন্ততিকেই বা কেন শিখাইতেছ যে, মানুষের সর্বোচ্চ অবস্থা কুকুরের মত হওয়া, এবং এক কাল্পনিক পুরুষের সম্মুখে নিজেকে দুর্বল, অপবিত্র ও জগতে অতি হেয় অপদার্থ মনে করিয়া হাঁটু গাড়িয়া থাকা?

অপর দিকে বৌদ্ধগণ তোমাকে বলিবেনঃ তুমি নিজেকে এইরূপ বলিয়া শুধু যে মিথ্যাবাদী হইতেছ তাহা নহে, পরন্তু তোমার সন্তানসন্ততিরও ঘোর অনিষ্টের কারণ হইতেছি। কারণ এইটি বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিও যে, মানুষ যেমন চিন্তা করে, তেমনই হইয়া যায়। নিজেদের সম্বন্ধে তোমরা যেমন বলিবে, ক্রমশঃ তোমাদের বিশ্বাসও তেমনি দাঁড়াইবে। ভগবান্‌ বুদ্ধের প্রথম কথাই এইঃ তুমি যাহা ভাবিয়াছ, তাহাই হইয়াছ; আবার যাহা ভাবিবে, তাহাই হইবে। ইহাই যদি সত্য হয়, তবে কখনও ভাবিও না যে, তুমি কিছুই নও; আর যতক্ষণ না তুমি এমন কাহারও সাহায্য পাইতেছ—যিনি এখানে থাকেন না, মেঘরাশির উপর বাস করেন—ততক্ষণ তুমি কিছু করিতে পার না, ইহাও ভাবিও না। ঐরূপ ভাবিলে তাহার ফল হইবে এই যে, তুমি দিন দিন অধিকতর দুর্বল হইয়া যাইবে। আমরা অতি অপবিত্র, হে প্রভো, আমাদিগকে পবিত্র কর—এইরূপ বলিতে বলিতে নিজেকে এমন দুর্বল করিয়া ফেলিবে যে, তাহার ফলে সকল প্রকার পাপের দ্বারা সম্মোহিত হইবে।

বৌদ্ধেরা বলেনঃ প্রত্যেক সমাজে যে-সকল পাপ দেখিতে পাও, সেগুলির শতকরা নব্বই ভাগ আসিয়াছে এই ব্যক্তিবিশেষ ঈশ্বরের ধারণা হইতে, তাঁহার সম্মুখে কুকুরের মত হইয়া থাকার ধারণা হইতে; এই অপূর্ব মনুষ্যজীবনের একমাত্র উদ্যেশ্য এইরূপ কুকুরের মত হইয়া থাকা—ইহা অতি ভয়ানক কথা! বৌদ্ধ বৈষ্ণবকে বলেনঃ যদি তোমার আদর্শ, জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এই হয় যে, ভগবানের বাসস্থান বৈকুণ্ঠনামক স্থানে গিয়া অনন্তকাল তাঁহার সম্মুখে করজোড়ে দাঁড়াইয়া থাকিতে হইবে, তবে তাহা অপেক্ষা বরং আত্মহত্যা শ্রেয়ঃ। বৌদ্ধ বলিতে পারেন, তিনি এইটি এড়াইবার জন্যই নির্বাণ বা বিলুপ্তির চেষ্টা করিতেছেন।

আমি তোমাদের নিকট ঠিক একজন বৌদ্ধের মত হইয়া এই কথাগুলি বলিতেছি, কারণ আজকাল লোকে বলিয়া থাকে যে, অদ্বৈতবাদের দ্বারা মানুষ দুর্নীতিপরায়ণ হয়। সেইজন্য অপর পক্ষেরও কি বলিবার আছে, সেইটিই তোমাদের নিকট উপস্থিত করিবার চেষ্টা করিতেছি। আমাদিগকে দুই পক্ষই নির্ভীকভাবে দেখিতে হইবে। প্রথমতঃ আমরা দেখিয়াছি, একজন ব্যক্তিবিশেষ ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন—ইহা প্রমাণ করা যায় না। আজকাল কি বালকও এ-কথা বিশ্বাস করিতে পারে—যেহেতু কুম্ভকার ঘট নির্মাণ করে, অতএব ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন? যদি তাহাই হয়, তবে কুম্ভকারও তো একজন ঈশ্বর!আর যদি কেহ তোমাকে বলে, মাথা ও হাত না থাকিলেও ঈশ্বর কাজ করেন, তবে তাহাকে পাগলা-গারদে পাঠাইতে পার। তোমার জগৎ-সৃষ্টিকর্তা এই ব্যক্তিবিশেষ—যাঁহার নিকট তুমি সারাজীবন ধরিয়া চীৎকার করিতেছ—তিনি কি কখনও তোমায় সাহায্য করিয়াছেন? যদি করিয়াই থাকেন, তবে তুমি তাঁহার নিকট হইতে কিরূপ সাহায্য পাইয়াছ? আধুনিক বিজ্ঞান তোমাদিগকে এই আর একটি প্রশ্ন করিয়া উত্তর দিবার জন্য আহ্বান করে। বৈজ্ঞানিক প্রমাণ করিয়া দিবে যে, এরূপ যাহা কিছু সাহায্য তুমি পাইয়াছ, তাহা তুমি নিজের চেষ্টাতেই পাইতে পার। পক্ষান্তরে, তোমার এরূপ বৃথা ক্রন্দনে শক্তিক্ষয়ের কোন প্রয়োজন ছিল না, এরূপ ক্রন্দনাদি না করিয়াও তুমি অনায়াসে ঐ উদ্দেশ্যসাধন করিতে পারিতে। অধিকন্তু আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি যে, এইরূপ ব্যক্তিবিশেষ ঈশ্বরের ধারণা হইতেই পৌরোহিত্য ও অন্যান্য অত্যাচার আসিয়া থাকে। যেখানেই এই ধারণা ছিল, সেইখানেই অত্যাচার ও পৌরোহিত্য রাজত্ব করিয়াছে, আর যতদিন না এই মিথ্যাভাবটি সমূলে বিনাশ করা হয়, বৌদ্ধগণ বলেন—ততদিন এই অত্যাচারের কখনও নিবৃত্তি হইবে না। যতদিন মানুষের এই ধারণা থাকে যে, অপর কোন অলৌকিক পুরুষের নিকট তাহাকে নত হইয়া থাকিতে হইবে, ততদিনই পুরোহিতের অস্তিত্ব থাকিবে। পুরোহিতেরা কতকগুলি অধিকার ও সুবিধা দাবী করিবে, যাহাতে মানুষ তাহাদের নিকট মাথা নোয়ায় তাহার চেষ্টা করিবে, আর বেচারা মানুষগুলিও তাহাদের কথা ঈশ্বরকে জানাইবার জন্য একজন পুরোহিত চাহিতে থাকিবে। তোমরা ব্রাহ্মণজাতিকে সমূলে বিনাশ করিয়া ফেলিতে পার, কিন্তু এটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করিও যে, যাহারা তাহাদিগকে নির্মূল করিবে, তাহারাই আবার তাহাদের স্থান অধিকার করিয়া লইবে, এবং তাহারা আবার ব্রাহ্মণদের অপেক্ষা বেশী অত্যাচারী হইয়া দাঁড়াইবে। কারণ ব্রাহ্মণদের বরং কতকটা সহৃদয়তা ও উদারতা আছে; কিন্তু এই ভূঁইফোড়েরা চিরকালই অতি ভয়ানক অত্যাচারী হইয়া থাকে। ভিখারী যদি কিছু টাকা পায়, তবে সে সমগ্র জগৎকে খড়কুটা জ্ঞান করিয়া থাকে। অতএব যতদিন এই ব্যক্তিবিশেষ ঈশ্বরের ধারণা থাকিবে, ততদিন এই-সকল পুরোহিতও থাকিবে, আর সমাজে কোন প্রকার উচ্চনীতির অভ্যুদয়ের আশা করা যাইতে পারিবে না। পৌরোহিত্য ও অত্যাচার চিরকালই এক সঙ্গে থাকিবে।

লোকে কেন এই ঈশ্বর কল্পনা করিল? কারণ প্রাচীনকালে কয়েকজন বলবান্ ব্যক্তি সাধারণ লোককে বশীভূত করিয়া বলিয়াছিল, তোমাদিগকে আমাদের হুকুম মানিয়া চলিতে হইবে, নতুবা তোমাদের সমূলে বিনাশ করিব। এইরূপ লোকই ব্যক্তিবিশেষ ঈশ্বরের কল্পনা করিয়াছিল—ইহার অন্য কোন কারণ নাইঃ ‘মহদ্ভয়ং বজ্রমুদ্যতম্’—একজন বজ্রহস্ত পুরুষ রহিয়াছেন, তাঁহার আজ্ঞা যে লঙ্ঘন করে, তাহাকেই তিনি বিনাশ করেন।

বৌদ্ধ বলিতেছেনঃ তোমরা যুক্তিবাদী হইয়া বলিতেছ, সবই কর্মফলে হইয়াছে; তোমরা সকলেই অসংখ্য জীবাত্মায় বিশ্বাসী, আর তোমাদের মতে এই-সকল জীবাত্মার জন্ম-মৃত্যু নাই। এ পর্যন্ত বেশ যুক্তি ও ন্যায়-সঙ্গত কথা বলিয়াছ, সন্দেহ নাই। কারণ থাকিলেই কার্য থাকিবে; বর্তমানে যাহা ঘটিতেছে, তাহা অতীত কারণের ফল; এই বর্তমান আবার ভবিষ্যতে অন্য ফল প্রসব করিবে। হিন্দু বলিতেছেনঃ কর্ম জড়, চৈতন্য নহে; সুতরাং কর্মের ফললাভ করিতে হইলে কোনরূপ চৈতন্যের প্রয়োজন।

বৌদ্ধ তাহাতে বলেনঃ বৃক্ষ হইতে ফললাভ করিতে গেলে কি চৈতন্যের প্রয়োজন হয়? যদি বীজ পুঁতিয়া গাছে জল দেওয়া হয়, তাহার ফল পাইতে তো কোনরূপ চৈতন্যের প্রয়োজন হয় না। বলিতে পার, আদি চৈতন্যের শক্তিতে এই ব্যাপার ঘটিয়া থাকে, কিন্তু জীবাত্মাগণই তো চৈতন্য, অন্য চৈতন্য স্বীকার করিবার প্রয়োজন কি? যদি জীবাত্মাদের চৈতন্য থাকে, তবে ঈশ্বর বিশ্বাসের প্রয়োজন কি? অবশ্য বৌদ্ধেরা জীবাত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নহেন; কিন্তু জৈনেরা জীবাত্মায় বিশ্বাসী, অথচ ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না।

তবে হে দ্বৈতবাদিন্, তোমার যুক্তি কোথায় রহিল, তোমার নীতির ভিত্তি কোথায় রহিল? যখন তোমরা অদ্বৈতবাদের উপর দোষারোপ করিয়া বল যে, অদ্বৈতবাদ হইতে দুর্নীতির সৃষ্টি হইবে, তখন একবার ভারতের দ্বৈতবাদী সম্প্রদায়ের ইতিহাস পাঠ করিয়া দেখ; আদালতে দ্বৈতবাদীদের নীতিপরায়ণতার কিরূপ প্রমাণ পাও, তাহাও আলোচনা করিয়া দেখ। যদি অদ্বৈতবাদী কুড়ি হাজার দুর্বৃত্ত হইয়া থাকে, তবে দ্বৈতবাদীও কুড়ি হাজার দেখিতে পাইবে। সাধারণভাবে দেখা যায়, দ্বৈতবাদী দুর্বৃত্তের সংখ্যাই অধিক; কারণ অদ্বৈতবাদ বুঝিতে উৎকৃষ্টতর চিত্তবৃত্তিসম্পন্ন মানুষের প্রয়োজন, আর তাহাদিগকে সহজে ভয় দেখাইয়া কোন কাজ করাইবার উপায় নাই। তবে তুমি যাও কোথায়? বৌদ্ধদের হাত এড়াইবার পথ নাই। তুমি শ্রুতিবচন উদ্ধৃত করিতে পার, কিন্তু বৌদ্ধ তো বেদ মানে না। সে বলিবেঃ আমার ‘ত্রিপিটক’ এ-কথা বলে না। ত্রিপিটক অনাদি অনন্ত—উহা বুদ্ধের লেখাও নহে; কারণ বুদ্ধ বলিয়াছেন, তিনি শুধু সনাতন সত্যেরই আবৃত্তি করিতেছেন। বৌদ্ধ আরও বলেন, ‘তোমাদের বেদ মিথ্যা, আমাদের ত্রিপিটকই যথার্থ বেদ, তোমাদের বেদ ব্রাহ্মণ পুরোহিতগণের কল্পিত—সেগুলি দূর করিয়া দাও।’ এ যুক্তি এড়াইবে কিরূপে?

বৌদ্ধদের যুক্তিজাল কাটিয়া বাহির হইবার উপায় প্রদর্শিত হইতেছে। দ্রব্য ও গুণ পরস্পর পৃথক্‌—ইহাই বৌদ্ধদের প্রথম আপত্তি, এবং ইহা একটি দার্শনিক আপত্তি। অদ্বৈতবাদী বলেনঃ না, উহারা পৃথক্‌ নয়; দ্রব্য ও গুণের মধ্যে কোন ভেদ নাই। তোমরা ‘রজ্জুতে সর্পভ্রম’-এর সেই প্রাচীন দৃষ্টান্ত অবগত আছ। যখন তুমি সর্প দেখিতেছ, তখন রজ্জু একেবারেই দেখিতে পাও না, রজ্জু তখন একেবারে অন্তর্হিত। কোন বস্তুকে দ্রব্য ও গুণ বলিয়া বিভক্ত করা দার্শনিকদের মস্তিষ্ক-প্রসূত ব্যাপার মাত্র, উহার কোন যথার্থ ভিত্তি নাই, দ্রব্য ও গুণ বলিয়া পৃথক্‌ দুইটি পদার্থের বাস্তবিক অস্তিত্ব নাই। তুমি যদি একজন সাধারণ ব্যক্তি হও, শুধু গুণরাশিই দেখিবে; আর যদি তুমি একজন শক্তিশালী যোগী হও, কেবল দ্রব্যই দেখিবে; কিন্তু একই সময়ে কখনও দ্রব্য ও গুণ দুই-ই দেখিতে পাইবে না। অতএব হে বৌদ্ধ, তুমি যে দ্রব্য ও গুণ লইয়া বিবাদ করিতেছ, তাহার বাস্তবিকভিত্তিই নাই; দ্রব্য যদি গুণরহিত হয়, তবে একটি মাত্র দ্রব্যের অস্তিত্বই সিদ্ধ হয়। যদি তুমি আত্মা হইতে গুণরাশি তুলিয়া লইয়া দেখাইতে পার যে, গুণরাশির অস্তিত্ব কেবল মনে—উহারা প্রকৃতপক্ষে আত্মায় আরোপিত, তাহা হইলে তো দুইটি আত্মারও অস্তিত্ব সিদ্ধ হয় না; কারণ গুণই এক আত্মা হইতে অপর আত্মার পার্থক্য সৃষ্টি করিয়া থাকে। এক আত্মা যে অপর আত্মা হইতে ভিন্ন, তাহা তুমি কিভাবে জানিতে পার?—কতকগুলি প্রভেদকারী চিহ্ন দ্বারা, কতকগুলি গুণের দ্বারা। আর যেখানে গুণের সত্তা নাই, সেখানে পার্থক্য কিরূপে থাকিতে পারে? অতএব দুই আত্মা নাই, এক আত্মাই বিদ্যমান; পৃথক্‌ পরমাত্মা স্বীকার করাও অনাবশ্যক, তোমার এই আত্মাই সেই পরমাত্মা। সেই এক আত্মাকেই ‘পরমাত্মা’ বলে, তাঁহাকেই ‘জীবাত্মা’ এবং অন্যান্য নামে অভিহিত করা হইয়া থাকে। আর হে সাংখ্যবাদী ও অন্যান্য দ্বৈতবাদিগণ, তোমরা বলিয়া থাক, আত্মা সর্বব্যাপী বিভু, অথচ তোমরা কিরূপে বহু আত্মা স্বীকার কর? অনন্ত কি কখনও দুইটি হইতে পারে? অনন্ত সত্তা একটিমাত্র হওয়াই সম্ভব। একমাত্র অনন্ত আত্মা রহিয়াছেন, আর সব তাঁহারই প্রকাশ।

বৌদ্ধ এই উত্তরে নীরব, কিন্তু অদ্বৈতবাদী শুধু বৌদ্ধকে নিরস্ত করিয়াই ক্ষান্ত নন। দুর্বল মতবাদসমূহের ন্যায় কেবল অপর মতের সমালোচনা করিয়াই অদ্বৈতবাদী নিরস্ত নন। অদ্বৈতবাদী তখনই অন্যান্য মতাবলম্বীদের সমালোচনা করেন, যখন খুব কাছে আসিয়া তাহারা অদ্বৈতমত খণ্ডন করিতে প্রবৃত্ত হয়। তিনি তাহাদিগকে দূরে সরাইয়া দেন, এই পর্যন্তই তাঁহার অন্যান্য মতাবলম্বীদের বাদখণ্ডন। তারপর তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত স্থাপন করেন। একমাত্র অদ্বৈতবাদীই শুধু পরমত খণ্ডন করিয়া এবং তজ্জন্য শাস্ত্রের দোহাই দিয়া নিরস্ত থাকেন না। অদ্বৈতবাদীর যুক্তি এইরূপ—তিনি বলেনঃ তুমি বলিতেছ—জগৎ একটি অবিরাম গতিপ্রবাহমাত্র। ভাল, ব্যষ্টিতে সবই গতিশীল বটে। তোমারও গতি আছে; এই টেবিলটি—ইহারও প্রতিনিয়ত গতি বা পরিবর্তন হইতেছে। গতি সর্বত্রই, তাই ইহার নাম ‘সংসার’; ‘সৃ’ ধাতুর অর্থ গমন, তাই ইহার নাম ‘জগৎ’—অবিরাম গতি। তাই যদি হইল, তাহা হইলে তো এই জগতে ‘ব্যক্তিত্ব’ বলিয়া কিছু থাকিতে পারে না; কারণ ব্যক্তিত্ব বলিতে অপরিণামী কিছু বুঝায়। ‘পরিণামশীল ব্যক্তিত্ব’ হইতে পারে না, এই বাক্যটি স্ববিরোধী, সুতরাং আমাদের এই ক্ষুদ্র জগতে ব্যক্তিত্ব বলিয়া কিছু নাই। চিন্তা ভাব, মন শরীর, জীব জন্তু—সকলেরই অহরহঃ পরিণাম হইতেছে। যাহা হউক, এখন সমগ্র জগৎকে একটি সমষ্টিরূপে ধর। সমষ্টিরূপে কি এই জগতের পরিণাম বা গতি হইতে পারে? কখনই নহে। কোন অল্প গতিশীল অথবা সম্পূর্ণ গতিহীন বস্তুর সহিত তুলনা করিয়াই গতির ধারণা সম্ভব। অতএব সমষ্টিরূপে জগৎ গতিহীন, পরিণামহীন। সুতরাং তখনই—কেবল তখনই তোমার প্রকৃত ব্যক্তিত্ব সম্ভব, যখন তুমি নিজেকে সমগ্র জগতের সহিত অভিন্নভাবে জানিতে পার। এই কারণেই বেদান্তী—অদ্বৈতবাদী বলেনঃ যতদিন দ্বৈত, ততদিন ভয় দূর হইবার উপায় নাই; মানুষ যখন অপর বলিয়া কিছু দেখে না, অপর বলিয়া কিছু অনুভব করে না, যখন একমাত্র সত্তা থাকে, তখনই তাহার ভয় দূর হয়; তখনই মানুষ মৃত্যুর পারে, সংসারের পারে যাইতে পারে। সুতরাং অদ্বৈতবাদ আমাদিগকে শিক্ষা দেয়—সমষ্টিজ্ঞানেই মানুষের প্রকৃত ব্যক্তিত্ব, ব্যষ্টিজ্ঞানে নহে। যখন তুমি নিজেকে সমগ্র জগৎ-রূপে অনুভব করিতে পারিবে, তখনই তোমার প্রকৃত অমৃতত্ব লাভ হইবে। যখন নিজেকে সমগ্র জগৎ-রূপে জানিবে, তখনই তুমি ভয়শূন্য ও অমৃতস্বরূপ হইবে, আর তখনই তোমার সহিত জগৎ ও ব্রহ্মের অভেদবোধ হইবে। এক অখণ্ড সত্তাকেই আমাদের মত মনোবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ এই চন্দ্রসূর্যতারকাদি-সমন্বিত ব্রহ্মাণ্ড-রূপে দেখিয়া থাকে। যাহারা আর একটু ভাল কাজ করে এবং সেই সৎকর্মবলে অন্যপ্রকার মনোবৃত্তিসম্পন্ন হয়, তাহারা মৃত্যুর পর ইহাকেই ইন্দ্রাদিদেবসমন্বিত স্বর্গাদিলোক-রূপে দর্শন করে। যাঁহারা আরও উন্নত, তাঁহারা সেই এক বস্তুকেই ব্রহ্মলোক-রূপে দেখেন, এবং যাঁহারা সিদ্ধ হইয়াছেন, তাঁহারা পৃথিবী স্বর্গ বা অন্য কোন লোক কিছুই দেখেন না, তাঁহাদের নিকট এই ব্রহ্মাণ্ড অন্তর্হিত হয়, তাহার পরিবর্তে একমাত্র ব্রহ্মই বিরাজমান থাকেন।

আমরা কি এই ব্রহ্মকে জানিতে পারি? সংহিতায় অনন্তের বর্ণনার কথা আমি তোমাদিগকে পূর্বেই বলিয়াছি, এখানে তাহার ঠিক বিপরীত—এখানে অন্তর্জগতের অনন্তজ্ঞানের চেষ্টা। সংহিতায় বহির্জগতের অনন্ত বর্ণনা; এখানে চিন্তাজগতের, ভাবজগতের অনন্ত বর্ণনা। সংহিতায় অস্তিভাবদ্যোতক ভাষায় অনন্তকে বর্ণনা করিবার চেষ্টা হইয়াছিল; এখানে সে-ভাষায় কুলাইল না, নাস্তিভাবের ভাষায় অনন্তের বর্ণনা করিবার চেষ্টা হইল। এই ব্রহ্মাণ্ড রহিয়াছে। স্বীকার করিলাম, ইহা ব্রহ্ম। আমরা কি ইহা জানিতে পারি? না, না। তোমাদিগকে আবার এই বিষয়টি স্পষ্টরূপে বুঝিতে হইবে। পুনঃ পুনঃ তোমাদের মনে এই সন্দেহ আসিবেঃ যদি ইহা ব্রহ্ম হয়, তবে আমরা কিরূপে উহাকে জানিতে পারি? ‘বিজ্ঞাতারমরে কেন বিজানীয়াৎ?’৬৬ বিজ্ঞাতাকে কিরূপে জানিবে? চক্ষু সকল বস্তু দেখিয়া থাকে, চক্ষু কি নিজেকে দেখিতে পায়?—পায় না, জানা-ক্রিয়াটিই একটি নিম্নতর অবস্থা।

হে আর্যসন্তানগণ, তোমাদিগকে এই বিষয়টি বিশেষভাবে মনে রাখিতে হইবে, কারণ এই তত্ত্বটির ভিতর অনেক জ্ঞাতব্য তথ্য আছে। তোমাদের নিকট যে-সকল পাশ্চাত্যদেশীয় প্রলোভন আসিয়া থাকে, সেগুলির একমাত্র দার্শনিক ভিত্তি এই যে, ইন্দ্রিয়জ্ঞান অপেক্ষা উচ্চতর জ্ঞান নাই। প্রাচ্যদেশের কিন্তু অন্য ভাব। আমাদের বেদ বলিতেছেনঃ বস্তুজ্ঞান বস্তু হইতে নিম্নস্থানীয়, কারণ জ্ঞান-অর্থে সর্বদাই একটা সীমাবদ্ধ ভাব বুঝিতে হইবে। যখনই তুমি কোন বস্তুকে জানিতে চাও, তখনই উহা তোমার মনের দ্বারা সীমাবদ্ধ হইয়া যায়। পূর্বকথিত দৃষ্টান্তে শুক্তি হইতে যেভাবে মুক্তা হয়, সেই কথা স্মরণ কর, তাহা হইলে বুঝিবে জ্ঞান-অর্থে সীমাবদ্ধ করা কিরূপ। একটি বস্তুকে আহরণ করিয়া তোমার চেতনায় আনিলে তাহার সমগ্র ভাবটি জানিতে পারিবে না। সকল জ্ঞান-সম্বন্ধেই এই কথা খাটে। তাই যদি হয়, জ্ঞান-অর্থে যদি সীমাবদ্ধ করা হয়, তবে অনন্তের জ্ঞান-সম্বন্ধে কি উহা কম প্রযোজ্য? যিনি সকল জ্ঞানের স্বরূপ, যাঁহাকে ছাড়িয়া তুমি কোন জ্ঞান লাভ করিতে পার না, যাঁহার কোন গুণ নাই, যিনি সমগ্র জগতের এবং আমাদের অন্তঃকরণের সাক্ষিস্বরূপ, তুমি কি তাঁহাকে এইভাবে সীমাবদ্ধ করিতে পার? তাঁহাকে তুমি কিরূপে জানিবে? কি উপায়ে তাঁহাকে বাঁধিবে?

সব কিছু—এই জগৎপ্রপঞ্চ এইরূপ বাঁধিবার বৃথা চেষ্টা। এই অনন্ত আত্মা যেন নিজের মুখ দেখিবার চেষ্টা করিতেছেন, নিম্নতম প্রাণী হইতে উচ্চতম দেবতা পর্যন্ত সব যেন তাঁহার মুখ প্রতিবিম্বিত করিবার দর্পণ; আরও কত আধার তিনি গ্রহণ করিতেছেন, কিন্তু কোনটিই পর্যাপ্ত নয়, অবশেষে মনুষ্য-দেহে তিনি বুঝিতে পারেন যে, এ-সবই সসীম—অনন্ত কখনও সান্তের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করিতে পারেন না।

তারপর শুরু হয় প্রত্যাবর্তন এবং ইহাই ত্যাগ বা বৈরাগ্য। ইন্দ্রিয় হইতে প্রত্যাবৃত্ত হও, ইন্দ্রিয়ের অভিমুখে যাইও না—ইহাই বৈরাগ্যের মূলমন্ত্র। ইহাই সর্বপ্রকার নীতির মূলমন্ত্র, ইহাই সর্বপ্রকার কল্যাণের মূলমন্ত্র, কারণ তোমাদিগকে অবশ্য মনে রাখিতে হইবে তপস্যাতেই জগতের সৃষ্টি—ত্যাগেই জগতের উৎপত্তি। আর যতই তুমি ক্রমশঃ ফিরিয়া আসিবে, ততই তোমার সম্মুখে ধীরে ধীরে বিভিন্ন রূপ—বিভিন্ন দেহ প্রকাশিত হইতে থাকিবে; এক এক করিয়া সেগুলি পরিত্যক্ত হইবে; অবশেষে তুমি স্বরূপতঃ যাহা, তাহাই থাকিবে। ইহাই মোক্ষ।

এই তত্ত্বটি আমাদিগকে বুঝিতে হইবেঃ ‘বিজ্ঞাতারমরে কেন বিজানীয়াৎ’—বিজ্ঞাতাকে কি করিয়া জানিবে? জ্ঞাতাকে কখনও জানিতে পারা যায় না, কারণ যদি তাঁহাকে জানা যাইত, তাহা হইলে তিনি আর জ্ঞাতা থাকিতেন না। দর্পণে যদি তোমার চক্ষুর প্রতিবিম্ব দেখ, তাহাকে তুমি কখনও চক্ষু বলিতে পার না; উহা অন্য কিছু, উহা প্রতিবিম্বমাত্র। এখন কথা এই, যদি এই আত্মা—এই অনন্ত সর্বব্যাপী পুরুষ সাক্ষিমাত্র হইলেন, তাহা হইলে আর কি হইল? ইহা তো আমাদের মত চলিতে ফিরিতে, জীবনধারণ করিতে এবং জগৎকে সম্ভোগ করিতে পারে না; সাক্ষিস্বরূপ যে কিরূপে আনন্দ সম্ভোগ করিতে পারে, লোকে সে-কথা বুঝিতে পারে না। ‘ওহে হিন্দুগণ, তোমরা সব সাক্ষিস্বরূপ,—এই মতবাদের দ্বারাই তোমরা নিষ্ক্রিয়, অকর্মণ্য হইয়া পড়িয়াছ’—এই কথাই লোকে বলিয়া থাকে। তাহাদের কথার উত্তর এই—যিনি সাক্ষিস্বরূপ, তিনিই প্রকৃতপক্ষে আনন্দ সম্ভোগ করিতে পারেন। কোন স্থানে যদি একটা কুস্তি হয়, তাহা হইলে ঐ কুস্তির আনন্দভোগ—বেশী করে কাহারা?—যাহারা কুস্তি করিতেছে তাহারা, না দর্শকেরা? এই জীবনে যতই তুমি কোন বিষয়ে সাক্ষিস্বরূপ হইতে পারিবে, ততই তুমি অধিক আনন্দ ভোগ করিবে। ইহাই প্রকৃত আনন্দ; আর এই কারণে তখনই তোমার অনন্ত আনন্দ সম্ভব, যখন তুমি এই ব্রহ্মাণ্ডের সাক্ষিস্বরূপ হও। তখনই তুমি মুক্তপুরুষপদবাচ্য। যে সাক্ষিস্বরূপ, সে-ই স্বর্গে যাইবার বাসনা না রাখিয়া, নিন্দাস্তুতিতে সমজ্ঞান হইয়া নিষ্কামভাবে কাজ করিতে পারে। যে সাক্ষিস্বরূপ সে-ই আনন্দ ভোগ করিতে পারে, অন্য কেহ নহে।

অদ্বৈতবাদের নৈতিক দিক আলোচনা করিতে গিয়া দার্শনিক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আর একটি বিষয় আসিয়া থাকে—উহা মায়াবাদ। অদ্বৈতবাদের অন্তর্গত এক-একটি বিষয় বুঝিতেই বৎসরের পর বৎসর কাটিয়া যায়, বুঝাইতে আবার আরও সময় লাগে। অতএব আমাকে ইহার সামান্য কিছু উল্লেখ করিয়াই নিরস্ত হইতে হইবে। এই মায়াবাদ বুঝা চিরকালই একটি কঠিন ব্যাপার। মোটামুটি আমি তোমাদিগকে বলিতেছি যে, ‘মায়াবাদ’ প্রকৃতপক্ষে বাদ বা মত বিশেষ নহে, দেশকালনিমিত্তের নাম ‘মায়া’—আরও সংক্ষেপে উহাকে ‘নামরূপ’ বলে। সমুদ্র হইতে সমুদ্রের তরঙ্গের প্রভেদ কেবল নামে ও রূপে, আর তরঙ্গ হইতে এই নামরূপের কোন পৃথক্ সত্তা নাই, নাম-রূপ তরঙ্গের সহিতই বর্তমান। তরঙ্গ অন্তর্হিত হইতে পারে; তরঙ্গের অন্তর্গত নাম-রূপ যদি চিরকালের জন্য অন্তর্হিত হইয়া যায়, তথাপি সেই একই পরিমাণ জল থাকিয়া যাইবে। অতএব এই মায়াই তোমার আমার মধ্যে, জীবজন্তু ও মানবের মধ্যে, দেবতা ও মানবের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে এই মায়াই যেন আত্মাকে লক্ষ লক্ষ প্রাণীর মধ্যে আবদ্ধ করিয়াছে, আর এই মায়া নাম-রূপ ব্যতীত আর কিছুই নহে। যদি ঐগুলিকে পরিত্যাগ কর—নাম-রূপ দূর করিয়া দাও, তবেই এ-সব পার্থক্য চিরকালের জন্য অন্তর্হিত হইবে, তখন তুমি প্রকৃতপক্ষে যাহা আছ, তাহাই থাকিবে। ইহাই মায়া। কোন মতবাদ নহে, উহা জগতের ঘটনাবলী বর্ণনামাত্র।

বাস্তববাদিগণ বলেন, এই জগতের অস্তিত্ব আছে। সেই বেচারারা অজ্ঞ, বালকবৎ; তাহারা যে বলে জগৎ সত্য—তাহা এই অর্থে বলে যে, এই টেবিলটি বা অন্যান্য বস্তুর নিরপেক্ষ সত্তা আছে, উহাদের অস্তিত্ব ব্রহ্মাণ্ডের অপর কোন বস্তুর অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে না, আর যদি এই সমগ্র জগৎ বিনষ্ট হইয়া যায়, তথাপি উহা বা অন্যান্য বস্তু যেমন আছে, ঠিক তেমনই থাকিবে। একটু সামান্য জ্ঞানলাভ করিলেই সে বুঝিবে, ইহা কখনই হইতে পারে না। এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সব কিছুই পরস্পরের উপর নির্ভর করে, সব-কিছুই আপেক্ষিক। আমাদের বস্তুজ্ঞানের তিনটি সোপান আছেঃ প্রথম—প্রত্যেক বস্তুই স্বতন্ত্র, পরস্পর পৃথক্‌; দ্বিতীয় সোপান—সকল বস্তুর মধ্যে পরস্পর সম্বন্ধ বিদ্যমান; আর শেষ সোপান—একটি মাত্র বস্তু আছে, তাহাকেই আমরা নানারূপে দেখিতেছি।

অজ্ঞ ব্যক্তির ঈশ্বর সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা—তিনি এই ব্রহ্মাণ্ডের বাহিরে কোথাও রহিয়াছেন, অর্থাৎ তখন ঈশ্বরধারণা খুব মানবভাবাপন্ন—মানুষ যাহা করে, তিনিও তাহাই করেন, তবে অপেক্ষাকৃত একটু বেশী করেন। আর আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, এরূপ ঈশ্বরকে অল্প কথায় কিরূপে অযৌক্তিক ও অপর্যাপ্ত বলিয়া প্রমাণ করিয়া দেওয়া যায়। ঈশ্বর সম্বন্ধে দ্বিতীয় ধারণা—একটি শক্তি রহিয়াছে, সর্বত্রই তাঁহার প্রকাশ। ইনিই প্রকৃতপক্ষে সগুণ ঈশ্বর, চণ্ডীতে ইঁহার কথা লিখিত আছে। কিন্তু ইহা লক্ষ্য করিও যে, এই ঈশ্বর কেবল কল্যাণকর গুণরাশির আধার নহেন। ঈশ্বর ও শয়তান—দুইটি ‘দেবতা’ থাকিতে পারে না, এক ঈশ্বরের অস্বিত্বই স্বীকার করিতে হইবে এবং তাঁহাকে—সাহস করিয়া ভালমন্দ দুই-ই বলিতে হইবে এবং ঐ যুক্তিসঙ্গত মত স্বীকার করিলে তাহা হইতে যে স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত দাঁড়ায়, তাহাও গ্রহণ করিতে হইবে।

যা দেবী সর্বভূতেষু শান্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥
যা দেবী সর্বভূতেষু ভ্রান্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥৬৭

যিনি সর্বভূতে শান্তি ও ভ্রান্তিরূপে অবস্থিত, তাঁহাকে বারংবার নমস্কার করি। যাহা হউক, তাঁহাকে শুধু শান্তিস্বরূপ বলিলে চলিবে না, তাঁহাকে সর্বস্বরূপ বলিলে তাহার ফল যাহাই হউক, তাহা লইতে হইবে।

‘হে গার্গী, এ জগতে যাহা কিছু আনন্দ দেখিতে পাও, সবই তাঁহার অংশমাত্র।’ তুমি উহাকে যেমন ইচ্ছা কাজে লাগাইতে পার। আমার সম্মুখবর্তী এই আলোকের সাহায্যে তুমি একজন দরিদ্র ব্যক্তিকে একশত টাকা দিতে পার, আর একজন লোক তোমার নাম জাল করিতে পারে, কিন্তু আলোক উভয়ের পক্ষেই সমান। ইহাই ঈশ্বরজ্ঞানের দ্বিতীয় সোপান।

তৃতীয় সোপানঃ ঈশ্বর প্রকৃতির বাহিরেও নাই, ভিতরেও নাই, কিন্তু ঈশ্বর, প্রকৃতি, আত্মা, জগৎ—এইগুলি একপর্যায়ভুক্ত শব্দ। প্রকৃতপক্ষে দুইটি বস্তু নাই, কতকগুলি দার্শনিক শব্দই তোমাকে প্রতারিত করিয়াছে। তুমি কল্পনা করিতেছ, তুমি শরীর—আবার আত্মা, তুমি একই সঙ্গে এই শরীর ও আত্মা হইয়া রহিয়াছ। তাহা কিভাবে হইতে পারে? নিজের মনের ভিতর পরীক্ষা করিয়া দেখ। যদি তোমাদের মধ্যে কেহ যোগী থাকেন, তিনি নিজেকে চৈতন্যস্বরূপ জ্ঞান করিবেন, তাঁহার পক্ষে শরীর-বোধ একেবারে অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে। যদি তুমি সাধারণ লোক হও, তবে তুমি নিজেকে দেহ বিবেচনা করিবে, তখন চৈতন্যের জ্ঞান একেবারে অন্তর্হিত। কিন্তু মানুষের দেহ আছে, আত্মা আছে, আরও অন্যান্য জিনিষ আছে—এই-সকল তত্ত্ববিষয়ক ধারণা থাকাতে তাহার মনে হয়, এগুলি একই সময়ে রহিয়াছে। এক-কালে একটি বস্তুরই ধারণা হয়। যখন তুমি জড়বস্তু দেখিতেছ, তখন ঈশ্বরের কথা বলিও না। তুমি কেবল কার্যই দেখিতেছ, কারণকে তুমি দেখিতে পাইতেছ না। আর যে-মুহূর্তে তুমি কারণকে দেখিবে, সে-মুহূর্তে কার্য অন্তর্হিত হইবে। এ জগৎ কোথায় গেল? কে ইহাকে গ্রাস করিল?

কিমপি সততবোধং কেবলানন্দরূপং নিরুপমমতিবেলং নিত্যমুক্তং নিরীহম্।
নিরবধি গগনাভং নিষ্কলং নির্বিকল্পং হৃদি কলয়তি বিদ্বান্ ব্রহ্ম পূর্ণং সমাধৌ॥
প্রকৃতিবিকৃতিশূন্যং ভাবনাতীতভাবং সমরসমসমানং মানসং বন্ধদূরম্।
নিগমবচনসিদ্ধং নিত্যমস্মৎপ্রসিদ্ধং হৃদি কলয়তি বিদ্বান্ ব্রহ্ম পূর্ণং সমাধৌ॥
অজরমমরমস্তাভাসবস্তুস্বরূপং স্তিমিতসলিলরাশিরপ্রখ্যামাখ্যাবিহীনম্।
শমিতগুণবিকারং শাশ্বতং শান্তমেকং হৃদি কলয়তি বিদ্বান্ ব্রহ্ম পূর্ণং সমাধৌ॥৬৮

জ্ঞানী ব্যক্তি সমাধি-অবস্থায় অনির্বচনীয়, কেবল আনন্দস্বরূপ, উপমা-রহিত, অপার, নিত্যমুক্ত, নিষ্ক্রিয়, অসীম আকাশতুল্য, অংশহীন ও ভেদশূন্য পূর্ণব্রহ্মকে হৃদয়ে অনুভব করেন। জ্ঞানী ব্যক্তি সমাধি-অবস্থায় প্রকৃতির বিকারহীন অচিন্ত্যতত্ত্বস্বরূপ, সমভাবাপন্ন অথচ যাঁহার সমান কেহ নাই, যাঁহাতে কোনরূপ পরিমাণের সম্বন্ধ নাই—যিনি অপরিমেয়, যিনি বেদবাক্যের দ্বারা সিদ্ধ এবং সর্বদা আমাদের—ব্রহ্মতত্ত্ব-অভ্যাসশীলগণের নিকট প্রসিদ্ধ—এইরূপ পূর্ণব্রহ্মকে হৃদয়ে অনুভব করেন। জ্ঞানী ব্যক্তি সমাধি-অবস্থায় জরামৃত্যুশূন্য, যিনি বস্তুস্বরূপ এবং যাঁহাতে কিছুই অভাব নাই, স্থিরজলরাশি-সদৃশ নামরহিত, সত্ত্ব রজঃ তমঃ—এই ত্রিবিধ গুণবিকার-রহিত, ক্ষয়হীন, শান্ত, এক পূর্ণ ব্রহ্মকে হৃদয়ে অনুভব করেন।—মানবের এমন অবস্থাও আসিয়া থাকে, তখন তাহার পক্ষে জগৎ অন্তর্হিত হইয়া যায়।

আমরা দেখিয়াছি, এই সত্যস্বরূপ ব্রহ্ম অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়—অবশ্য অজ্ঞেয়বাদীর অর্থে উহা ‘অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়’ নহে; ‘তাহাকে জানিয়াছি’ বলিলেই তাঁহাকে ছোট করা হইল, কারণ পূর্ব হইতেই তুমি সেই ব্রহ্ম। আমরা ইহাও দেখিয়াছি যে, এই ব্রহ্ম এক ভাবে এই টেবিল নন, আবার অন্য ভাবে ব্রহ্ম টেবিল বটে। নাম-রূপ তুলিয়া লও, তাহা হইলেই যে- সত্যবস্তু থাকিবে, তাহাই তিনি। তিনিই প্রকৃত বস্তুর ভিতর সত্যস্বরূপ।

ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত কুমারী।
ত্বং জীর্ণো দণ্ডেন বঞ্চসি ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ॥৬৯

তুমি স্ত্রী, তুমি পুরুষ, তুমি কুমার, তুমি কুমারী, তুমি বৃদ্ধ—দণ্ডহস্তে ভ্রমণ করিতেছ, তুমিই জাত হইয়া নানা রূপ ধারণ করিয়াছ।

তুমি সকল বস্তুতে বিদ্যমান, আমিই তুমি, তুমিই আমি—ইহাই অদ্বৈতবাদের কথা। এ সম্বন্ধে আর কয়েকটি কথা বলিব। এই অদ্বৈতবাদেই সকল বস্তুর মূলতত্ত্বের রহস্য নিহিত। আমরা দেখিয়াছি, এই অদ্বৈতবাদের দ্বারাই কেবল আমরা যুক্তি তর্ক ও বিজ্ঞানের আক্রমণের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াইতে পারি। এখানেই অবশেষ যুক্তি বিচার একটি দৃঢ় ভিত্তি পাইয়া থাকে, কিন্তু ভারতীয় বৈদান্তিক কখনও তাঁহার সিদ্ধান্তের পূর্ববর্তী সোপানগুলির উপর দোষারোপ করেন না, তিনি নিজ সিদ্ধান্তের উপর দাঁড়াইয়া পিছনের দিকে তাকান এবং ঐগুলিকে আশীর্বাদ করেন; তিনি জানেন সেগুলি সত্য, কেবল একটু ভুলক্রমে অনুভূত ও ভুলভাবে বর্ণিত হইয়াছে। একই সত্য—কেবল মায়ার আবরণের মধ্য দিয়া দৃষ্ট; হইতে পারে কিঞ্চিৎ বিকৃত চিত্র, তাহা হইলেও উহা সত্য—সত্য ব্যতীত মিথ্যা কখনই নহে। সেই এক ব্রহ্ম, যাঁহাকে অজ্ঞ ব্যক্তি প্রকৃতির বহির্দেশে অবস্থিত বলিয়া দর্শন করেন, যাঁহাকে অল্পজ্ঞ ব্যক্তি জগতের অন্তর্যামিরূপে দেখেন, যাঁহাকে জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের আত্মরূপে ও সমগ্র বিশ্বরূপে অনুভব করেন; এ-সকল একই বস্তু,—একই বস্তু বিভিন্নভাবে দৃষ্ট, মায়ার ভিন্ন ভিন্ন কাচের মধ্য দিয়া দৃষ্ট, বিভিন্ন মনের দ্বারা দৃষ্ট; আর বিভিন্ন মনের দ্বারা দৃষ্ট বলিয়াই এই-সব বিভিন্নতা। শুধু তাই নয়, উহাদের মধ্যে একটি আর একটিতে যাইবার সোপান। বিজ্ঞান ও সাধারণ জ্ঞানের মধ্যে প্রভেদ কি? অন্ধকারে রাস্তায় গিয়া যদি কোন অসাধারণ ঘটনা ঘটিতে দেখ, একজন পথচারীকে উহার কারণ জিজ্ঞাসা কর; দশ জনের মধ্যে অন্ততঃ নয় জন বলিবে, ভূতে এ ব্যাপার করিতেছি; সে সর্বদাই ভূত দেখিতেছে, কারণ অজ্ঞানের স্বভাব কার্যের বাহিরে কারণ অনুসন্ধান করা। একটা ঢিল পড়িলে সে বলে, ভূত বা দৈত উহা ফেলিয়াছে। বৈজ্ঞানিক বলে, ইহা প্রকৃতির নিয়ম—মাধ্যাকর্ষণ।

সর্বত্রই বিজ্ঞান ও ধর্মে কী বিরোধ? প্রচলিত ধর্মগুলি বহির্মুখী ব্যাখ্যায় এতদূর জড়িত যে, সূর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, চন্দ্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা এইরূপ অনন্ত দেবতার কল্পনা করে, আর ভাবে—যাহা কিছু ঘটিতেছে, সবই একটা না একটা দেবতা বা ভূতে করিতেছে। ইহার মোট কথাটা এই যে, ধর্ম—কোন কিছুর কারণ সেই বস্তুর বাহিরে অন্বেষণ করে, আর বিজ্ঞান তাহার কারণ সেই বস্তুর ভিতরেই অন্বেষণ করে। বিজ্ঞান ধীরে ধীরে যত অগ্রসর হইতেছে, ততই উহা প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা ভূত-প্রেতের হাত হইতে নিজের হাতে লইতেছে। যেহেতু ধর্মরাজ্যে অদ্বৈতবাদ এই কাজ করিয়াছে, সেই হেতু অদ্বৈতবাদই সর্বাপেক্ষা বৈজ্ঞানিক ধর্ম। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বাহিরের কোন ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট হয় নাই, জগতের বহির্দেশে অবস্থিত কোন দৈত্য ইহা সৃষ্টি করে নাই, ইহা আপনা-আপনি সৃষ্ট হইতেছে, আপনা-আপনি ইহার প্রকাশ হইতেছে, আপনা-আপনি ইহার প্রলয় হইতেছে, ইহা এক অনন্ত সত্তা—ব্রহ্ম ‘তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো’৭০ হে শ্বেতকেতো, তুমি সেই। এইরূপে তোমরা দেখিতেছ, অন্য কোন মতবাদ নয়, অদ্বৈতবাদই একমাত্র বৈজ্ঞানিক ধর্ম; আর বর্তমান অর্ধশিক্ষিত ভারতে আজকাল প্রত্যহ যে বিজ্ঞানের বুক্‌নি চলিতেছে, প্রত্যহ যেরূপ যুক্তির দোহাই শুনিতেছি, তাহাতে আমি আশা করি, তোমরা দলকে দল অদ্বৈতবাদী হইবে, আর বুদ্ধের কথায় বলিতেছি, ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ জগতে উহা প্রচার করিতে সাহসী হইবে। যদি তাহা না পার, তবে তোমাদিগকে কাপুরুষ মনে করিব।

যদি তোমার এইরূপ দুর্বলতা থাকে, যদি তুমি প্রকৃত সত্য স্বীকার করিতে ভয় পাও বলিয়া উহা অবলম্বন করিতে না পার, তবে অপরকেও সেইরূপ স্বাধীনতা দাও, বেচারা মূর্তিপূজককে একেবারে উড়াইয়া দিতে চেষ্টা করিও না. তাহাকে একটা পিশাচ বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিও না; যাহার সহিত তোমার মত সম্পূর্ণ না মিলে, তাহার নিকট তোমার মত প্রচার করিতে যাইও না। প্রথমে এইটি বুঝ যে, তুমি নিজে দুর্বল; আর যদি সমাজের ভয় পাও, যদি তোমার নিজ প্রাচীন কুসংস্কারের দরুন ভয় পাও, তবে বুঝিয়া দেখ—যাহারা অজ্ঞ, তাহারা এই কুসংস্কারে আরও কত ভয় পাইবে, ঐ কুসংস্কার তাহাদিগকে আরও কতদূর বদ্ধ করিবে। ইহাই অদ্বৈতবাদীর কথা। অন্যের উপর সদয় হও। ঈশ্বরেচ্ছায় কালই যদি সমগ্র জগৎ—শুধু মতে নয়, অনুভূতিতেও অদ্বৈতবাদী হয়, তাহা হইলে তো খুব ভালই হয়; কিন্তু তাহা যদি না হয়, তবে যতটা ভাল করিতে পারা যায়, তাই কর, সকলের হাত ধরিয়া তাহাদের সামর্থ্য অনুসারে ধীরে ধীরে লইয়া যাও; আর জানিও, ভারতে সকল প্রকার ধর্মের বিকাশই ধীরে ধীরে ক্রমোন্নতির নিয়মানুসারে হইয়াছে। মন্দ হইতে ভাল হইতেছে, তাহা নহে; ভাল হইতে আরও ভাল হইতেছে।

অদ্বৈতবাদের নীতিতত্ত্ব সম্বন্ধে আরও কিছু বলা আবশ্যক। আমাদের যুবকেরা আজকাল অভিযোগ করিয়া থাকে যে, তাহারা কাহারও কাছে শুনিয়াছে—ঈশ্বর জানেন কাহার কাছে—অদ্বৈতবাদের দ্বারা সকলেই দুর্নীতিপরায়ণ হইয়া উঠিবে, কারণ অদ্বৈতবাদ শিক্ষা দেয়—আমরা সকলেই এক, সকলেই ঈশ্বর; অতএব আমাদের আর নীতিপরায়ণ হইবার প্রয়োজন নাই। এ-কথার উত্তরে প্রথমেই বলিতে হয় যে, এ-যুক্তি পশুপ্রকৃতি ব্যক্তির মুখেই শোভা পায়, কশাঘাত ব্যতীত যাহাকে দমন করিবার অন্য উপায় নাই। যদি তুমি পশুপ্রকৃতি হও, তবে শুধু কশাঘাতে শাসনযোগ্য মনুষ্যপদবাচ্য হইয়া থাকা অপেক্ষা তোমার পক্ষে বরং আত্মহত্যা করাই শ্রেয়ঃ। কশাঘাত বন্ধ করিলেই তোমরা সকলে অসুর হইয়া দাঁড়াইবে। যদি এরূপ হয়, তবে তোমাদের এখনই মারিয়া ফেলা উচিত—তোমাদের ভাল করিবার আর উপায় নাই। চিরকালই তাহা হইলে তোমাদিগকে এই কশা ও দণ্ডের ভয়ে চলিতে হইবে, তোমাদের আর উদ্ধার নাই, তোমাদের আর পলায়নের পন্থা নাই। দ্বিতীয়তঃ অদ্বৈতবাদ—কেবল অদ্বৈতবাদের দ্বারাই নীতিতত্ত্বের ব্যাখ্যা হইতে পারে। প্রত্যেক ধর্মই প্রচার করিতেছে যে, সকল নীতিতত্ত্বের সার—অন্যের হিতসাধন। কেন অপরের হিতসাধন করিব? সকল ধর্মই উপদেশ দিতেছে—নিঃস্বার্থ হও। কেন নিঃস্বার্থ হইব?—কারণ কোন দেবতা ইহা বলিয়া গিয়াছেন। দেবতার কথায় আমার প্রয়োজন কি? শাস্ত্রে ইহা বলিয়া গিয়াছে। শাস্ত্রে বলুক না, আমি উহা মানিতে যাইব কেন? আর ধর, কতকগুলি লোক ঐ শাস্ত্র বা ঈশ্বরের দোহাই শুনিয়া নীতিপরায়ণ হইল—তাহাতেই বা কি? জগতের অধিকাংশ লোকের নীতি—‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’; তাই বলিতেছি—আমি যে নীতিপরায়ণ হইব, ইহার যুক্তি দেখাও। অদ্বৈতবাদ ব্যতীত ইহা ব্যাখ্যা করিবার উপায় নাই।

সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্।
ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্॥৭১

অর্থাৎ ঈশ্বরকে সর্বত্র সমভাবে অবস্থিত দেখিয়া সেই সমদর্শী নিজে নিজেকে হিংসা করেন না। সেই জন্য তিনি পরম গতি প্রাপ্ত হন।

অদ্বৈতবাদ শিক্ষা করিয়া অবগত হও যে, অপরকে হিংসা করিতে গিয়া তুমি নিজেকেই হিংসা করিতেছ—কারণ তাহারা সকলেই যে তুমি! তুমি জান আর নাই জান, সকল হাত দিয়া তুমি কাজ করিতেছ, সকল পা দিয়া তুমি চলিতেছ, তুমিই রাজারূপে প্রাসাদে সুখভোগ করিতেছ, আবার তুমিই রাস্তার ভিখারীরূপে দুঃখের জীবন যাপন করিতেছ। অজ্ঞ ব্যক্তিতেও তুমি, বিদ্বানেও তুমি, দুর্বলের মধ্যেও তুমি, সবলের মধ্যেও তুমি। এই তত্ত্ব অবগত হইয়া সকলের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হও। যেহেতু অপরকে হিংসা করিলে নিজেকে হিংসা করা হয়, সেইজন্য কখনও অপরকে হিংসা করা উচিত নহে। সেজন্যই আমি যদি না খাইয়া মরিয়া যাই, তাহাতেও আমি গ্রাহ্য করি না, কারণ আমি যখন শুকাইয়া মরিতেছি, তখন আমার লক্ষ লক্ষ মুখে আমিই আহার করিতেছি। অতএব এই ক্ষুদ্র ‘আমি-আমার’ সম্পর্কীয় বিষয় গ্রাহ্যের মধ্যেই আনা উচিত নয়, কারণ সমগ্র জগৎই আমার, আমি যুগপৎ জগতের সকল আনন্দ সম্ভোগ করিতেছি। আমাকে ও জগৎকে—কে বিনাশ করিতে পারে? কাজেই দেখিতেছ, অদ্বৈতবাদই নীতিতত্ত্বের একমাত্র ভিত্তি, একমাত্র ব্যাখ্যা। অন্যান্য মতবাদ তোমাদিগকে নীতিশিক্ষা দিতে পারে, কিন্তু কেন নীতিপরায়ণ হইব, ইহার কোন হেতু নির্দেশ করিতে পারে না। যাহা হউক, এই পর্যন্ত দেখা গেল—একমাত্র অদ্বৈতবাদই নীতিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করিতে সমর্থ।

অদ্বৈতবাদ-সাধনে লাভ কি? উহাতে শক্তি তেজ ও বীর্য লাভ হইয়া থাকে। শ্রুতি বলিতেছেন, ‘শ্রোতব্যো মন্তব্যো নিদিধ্যাসিতব্যো’৭২ প্রথমে এই আত্মতত্ত্ব শ্রবণ করিতে হইবে। সমগ্র জগতে তোমরা যে মায়াজাল বিস্তার করিয়াছ, তাহা সরাইয়া লইতে হইবে। মানুষকে দুর্বল ভাবিও না, তাহাকে দুর্বল বলিও না। জানিও, সকল পাপ ও সকল অশুভ— এক ‘দুর্বলতা’ শব্দ দ্বারাই নির্দিষ্ট হইতে পারে। সকল অসৎকার্যের মূল—দুর্বলতা। যাহা করা উচিত নয়, দুর্বলতার জন্যই মানুষ তাহাই করিয়া থাকে; দুর্বলতার জন্যই মানুষ তাহার প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ করিতে পারে না। মানুষ যে কি, এ তত্ত্ব সকলেই জানুক। দিবারাত্র তাহারা নিজেদের স্বরূপের কথা বলুক। ‘আমিই সেই’—এই ওজস্বী ভাবধারা মাতৃস্তন্যের সঙ্গে তাহারা পান করুক; তারপর তাহারা উহা চিন্তা করুক; ঐ চিন্তা—ঐ মনন হইতে এমন সব কাজ হইবে, যাহা পৃথিবী কখনও দেখে নাই।

কিভাবে উহা কার্যে পরিণত করিতে হইবে? কেহ কেহ বলিয়া থাকে—এই অদ্বৈতবাদ কার্যকর নয়, অর্থাৎ জড়-জগতে এখনও উহার শক্তি প্রকাশিত হয় নাই। এই কথা আংশিক সত্য বটে। বেদের সেই বাণী স্মরণ করঃ

এতদ্ধ্যেবাক্ষরং ব্রহ্ম এতদ্ধ্যেবাক্ষরং পরম্।
এতদ্ধ্যেবাক্ষরং জ্ঞাত্বা যো যদিচ্ছতি তস্য তৎ॥৭৩

ওঁ, ইহা মহারহস্য। ওঁ—ইহা আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পত্তি। যিনি এই ওঙ্কারের রহস্য জানেন, তিনি যাহা চান, তাহাই পাইয়া থাকেন।

অতএব প্রথমে এই ওঙ্কারের রহস্য অবগত হও—তুমিই যে সেই ওঙ্কার, তাহা জান। এই ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্যের রহস্য অবগত হও; তখনই—কেবল তখনই তোমরা যাহা চাহিবে, তাহা পাইবে। যদি জড়জগতে বড় হইতে চাও, তবে বিশ্বাস কর—তুমি বড়। আমি হয়তো একটি ক্ষুদ্র বুদ্বুদ্‌, তুমি হয়তো পর্বততুল্য উচ্চ তরঙ্গ, কিন্তু জানিও আমাদের উভয়েরই পিছনে অনন্ত সমুদ্র রহিয়াছে, অনন্ত ঈশ্বর আমাদের সকল শক্তি ও বীর্যের ভাণ্ডারস্বরূপ, আর আমরা উভয়েই সেখান হইতে যত ইচ্ছা শক্তি সংগ্রহ করিতে পারি। অতএব নিজের উপর বিশ্বাস কর। অদ্বৈতবাদের রহস্য এই যে, প্রথমে নিজের উপর বিশ্বাস স্থাপন করিতে হয়, তারপর অন্য কিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পার। জগতের ইতিহাসে দেখিবে, যে-সকল জাতি নিজেদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছে, শুধু তাহারাই শক্তিশালী ও বীর্যবান্ হইয়াছে। প্রত্যেক জাতির ইতিহাসে ইহাও দেখিবে, যে-সকল ব্যক্তি নিজেদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছে, তাহারাই শক্তিশালী ও বীর্যবান্ হইয়াছে। এই ভারতে একজন ইংরেজ আসিয়াছিলেন—তিনি সামান্য কেরানী ছিলেন; পয়সা-কড়ির অভাবে ও অন্যান্য কারণে তিনি দুইবার নিজের মাথায় গুলি করিয়া আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, এবং যখন তিনি অকৃতকার্য হইলেন, তাঁহার বিশ্বাস হইল—তিনি কোন বড় কাজ করিবার জন্যই জন্মিয়াছেন; সেই ব্যক্তিই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড ক্লাইভ। যদি তিনি পাদরীদের উপর বিশ্বাস করিয়া সারাজীবন হাঁটু গাড়িয়া বলিতেন, ‘হে প্রভু, আমি দুর্বল, আমি হীন’, তবে তাঁহার কি গতি হইত? নিশ্চয় উন্মাদাগারেই তাঁহার স্থান হইত। লোকে এই-সকল কুশিক্ষা দিয়া তোমাদিগকে পাগল করিয়া তুলিয়াছে। আমি সমগ্র পৃথিবীতে দেখিয়াছি, দীনতা ও দুর্বলতার উপদেশ দ্বারা অতি অশুভ ফল ফলিয়াছে, ইহা মনুষ্যজাতিকে নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছে। আমাদের সন্তান-সন্ততিগণকে এইভাবেই শিক্ষা দেওয়া হয়—এবং ইহা কি আশ্চর্যের বিষয় যে, তাহারা শেষে আধপাগল-গোছের হইয়া দাঁড়ায়?

অদ্বৈতবাদ কার্যে পরিণত করিবার উপায়—নিজের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। যদি সাংসারিক ধন-সম্পদের আকাঙ্ক্ষা থাকে, তবে এই অদ্বৈতবাদ কার্যে পরিণত কর; টাকা তোমার নিকট আসিবে। যদি বিদ্বান্ ও বুদ্ধিমান্ হইতে ইচ্ছা কর, তবে অদ্বৈতবাদকে সেই দিকে প্রয়োগ কর, তুমি মহামনীষী হইবে। যদি তুমি মুক্তিলাভ করিতে চাও, তবে আধ্যাত্মিক ভূমিতে এই অদ্বৈতবাদ প্রয়োগ করিতে হইবে—তাহা হইলে তুমি মুক্ত হইয়া যাইবে, পরমানন্দস্বরূপ নির্বাণ লাভ করিবে। এইটুকু ভুল হইয়াছিল যে, এতদিন অদ্বৈতবাদ কেবল আধ্যাত্মিক দিকেই প্রযুক্ত হইয়াছিল—অন্য কোন ক্ষেত্রে হয় নাই। এখন কর্মজীবনে উহা প্রয়োগ করিবার সময় আসিয়াছে। এখন আর উহাকে রহস্য বা গোপনীয় বিদ্যা করিয়া রাখিলে চলিবে না, এখন আর উহা হিমালয়ের গুহায় বন-জঙ্গলে সাধু-সন্ন্যাসীদের নিকট আবদ্ধ থাকিবে না, লোকের প্রাত্যহিক জীবনে উহা কার্যে পরিণত করিতে হইবে। রাজার প্রসাদে, সাধু-সন্ন্যাসীর গুহায়, দরিদ্রের কুটিরে, সর্বত্র—এমন কি রাস্তার ভিখারী দ্বারাও উহা কার্যে পরিণত হইতে পরে।

গীতায় কি উক্ত হয় নাই—‘স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ?’—এই ধর্মের অল্পমাত্রও আমাদিগকে মহৎ ভয় হইতে পরিত্রাণ করে। অতএব তুমি স্ত্রী হও বা শূদ্রই হও বা আর যাহা কিছু হও—তোমার কিছুমাত্র ভয়ের কারণ নাই, যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেন, এই ধর্ম এতই বড় যে, ইহার অতি অল্পমাত্র অনুষ্ঠান করিলেও মহৎ কল্যাণ হইয়া থাকে। অতএব হে আর্যসন্তানগণ, অলসভাবে বসিয়া থাকিও না—ওঠ, জাগো, যতদিন না সেই চরম লক্ষ্যে পৌঁছিতেছ, ততদিন নিশ্চিত থাকিও না। এখন অদ্বৈতবাদকে কার্যে পরিণত করিবার সময় আসিয়াছে—উহাকে এখন স্বর্গ হইতে মর্ত্যে লইয়া আসিতে হইবে, ইহাই এখন বিধির বিধান। আমাদের পূর্বপুরুষগণের বাণী আমাদিগকে অবনতির দিকে আর অধিকদূর অগ্রসর হইতে নিষেধ করিতেছে। অতএব হে আর্যসন্তানগণ, আর সে-দিকে অগ্রসর হইও না। তোমাদের সেই প্রাচীন শাস্ত্রের উপদেশ উচ্চ স্তর হইতে ক্রমশঃ নিম্নে অবতরণ করিয়া পৃথিবীর সকলের জীবনে প্রবেশ করুক, সমাজের প্রতি স্তরে প্রবেশ করুক, উহা প্রত্যেক ব্যক্তির সাধারণ সম্পত্তি হউক, আমাদের জীবনে অঙ্গীভূত হউক, আমাদের শিরায় শিরায় প্রবেশ করিয়া প্রতি শোণিতবিন্দুর সহিত উহা প্রবাহিত হউক।

তোমরা শুনিয়া আশ্চর্য হইবে, কিন্তু সত্য কথা বলিতে কি, আমাদের অপেক্ষা মার্কিনেরা বেদান্তকে অধিক পরিমাণে কর্মজীবনে পরিণত করিয়াছে। আমি নিউ ইউর্কের সমুদ্রতটে দাঁড়াইয়া দেখিতাম—বিভিন্ন দেশ হইতে লোক আমেরিকায় বাস করিবার জন্য আসিতেছে। দেখিলে বোধ হইত যেন তাহারা মরমে মরিয়া আছে—পদদলিত, আশাহীন। কেবল একটি কাপড়ের পুঁটলি তাহাদের সম্বল—কাপড়গুলিও সব ছিন্নভিন্ন, তাহারা ভয়ে লোকের মুখের দিকে তাকাইয়া থাকিতে অক্ষম। একটা পুলিশের লোক দেখিলেই ভয় পাইয়া ফুটপাতের অন্যদিকে যাইবার চেষ্টা করে। এখন দেখ, ছয়মাস বাদে সেই লোকগুলিই ভাল জামাকাপড় পরিয়া সোজা হইয়া চলিতেছে—সকলের দিকেই নির্ভীক-দৃষ্টিতে চাহিতেছে। এমন অদ্ভুত পরিবর্তন কিভাবে আসিল? মনে কর, সে-ব্যক্তি আর্মেনিয়া বা অন্য কোন স্থান হইতে আসিতেছে—সেখানে কেহ তাহাকে গ্রাহ্য করিত না, সকলেই পিষিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিত, সেখানে সকলেই তাহাকে বলিত—‘তুই জন্মেছিস গোলাম, থাকবি গোলাম, একটু যদি নড়তে চড়তে চেষ্টা করিস তো তোকে পিষে ফেলব।’ চারিদিকের সবই যেন তাহাকে বলিত, ‘গোলাম তুই, গোলাম আছিস—যা আছিস, তাই থাক্‌। জন্মেছিলি যখন, তখন যে-নৈরাশ্যের অন্ধকারে জন্মেছিলি, সেই নৈরাশ্যের অন্ধকারে সারাজীবন পড়িয়া থাক্।’ সেখানকার হাওয়া যেন তাহাকে গুনগুন করিয়া বলিত, ‘তোর কোন আশা নাই—গোলাম হয়ে চিরজীবন নৈরাশ্যের অন্ধকারে পড়ে থাক।’ সেখানে বলবান্ ব্যক্তি তাহাকে পিষিয়া তাহার প্রাণ হরণ করিয়া লইতেছিল। আর যখনই সে জাহাজ হইতে নামিয়া নিউ ইয়র্কের রাস্তায় চলিতে লাগিল, সে দেখিল—একজন ভাল পোশাক-পরা ভদ্রলোক তাহার করমর্দন করিল। সে যে ছিন্নবস্ত্র-পরিহিত, আর ভদ্রলোকটি যে উত্তমবস্ত্রধারী, তাহাতে কিছু আসে যায় না। আর একটু অগ্রসর হইয়া সে এক ভোজনাগারে গিয়া দেখিল, ভদ্রলোকেরা টেবিলে বসিয়া আহার করিতেছেন—সেই টেবিলেরই এক প্রান্তে তাহাকে বসিতে বলা হইল। সে চারিদিকে ঘুরিতে লাগিল, দেখিল—এ এক নূতন জীবন; সে দেখিল—এমন জায়গাও আছে, যেখানে আর পাঁচজন মানুষের ভিতরে সেও একজন মানুষ। হয়তো সে ওয়াশিংটনে গিয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেণ্টের সহিত করমর্দন করিয়া আসিল, সেখানে হয়তো সে দেখিল—দূরবর্তী পল্লীগ্রাম হইতে মলিনবস্ত্র-পরিহিত কৃষকেরা আসিয়া সকলেই প্রেসিডেণ্টের করমর্দন করিতেছে। তখন তাহার মায়ার আবরণ খসিয়া গেল। সে যে ব্রহ্ম—মায়াবশে এইরূপ দুর্বল দাসভাবাপন্ন হইয়াছিল! এখন সে আবার জাগিয়া উঠিয়া দেখিল—মনুষ্যপূর্ণ জগতে সেও একজন মানুষ।

আমাদের এই দেশে—বেদান্তের এই জন্মভূমিতে সাধারণ লোককে বহু শতাব্দী যাবৎ এইরূপ মায়াচক্রে ফেলিয়া এমন হীনভাবাপন্ন করিয়া ফেলা হইয়াছে। তাহাদের স্পর্শে অশুচি, তাহাদের সঙ্গে বসিলে অশুচি! তাহাদিগকে বলা হইতেছে, ‘নৈরাশ্যের অন্ধকারে তোদের জন্ম—থাক্ চিরকাল এই নৈরাশ্যের অন্ধকারে।’ ফল এই হইয়াছে যে, সাধারণ লোক ক্রমশঃ ডুবিতেছে, গভীর হইতে গভীরতর অন্ধকারে ডুবিতেছে, মনুষ্যজাতি যতদূর নিকৃষ্ট অবস্থায় পৌঁছিতে পারে, অবশেষে ততদূর পৌঁছিয়াছে। কারণ এমন দেশ আর কোথায় আছে, যেখানে মানুষকে গো-মহিষাদির সঙ্গে একত্র বাস করিতে হয়? আর ইহার জন্য অপর কাহারও ঘাড়ে দোষ চাপাইও না—অজ্ঞ ব্যক্তিরা যে ভুল করিয়া থাকে, তোমরা সেই ভ্রমে পড়িও না। ফলও হাতে হাতে দেখিতেছ, তাহার কারণও এইখানেই বর্তমান। বাস্তবিক দোষ আমাদেরই। সাহস করিয়া দাঁড়াও, নিজেদের ঘাড়েই সব দোষ লও। অন্যের স্কন্ধে দোষারোপ করিতে যাইও না, তোমরা যে-সকল কষ্ট ভোগ করিতেছ, সেগুলির জন্য তোমরাই দায়ী।

অতএব হে লাহোরবাসী যুবকবৃন্দ, তোমরা এইটি বিশেষভাবে অবগত হও যে, তোমাদের স্কন্ধে এই মহাপাপ—বংশপরম্পরাগত এই জাতীয় মহাপাপ রহিয়াছে। ইহা দূর করিতে না পারিলে তোমাদের আর উপায় নাই। তোমরা সহস্র সহস্র সমিতি গঠন করিতে পার, বিশ হাজার রাজনীতিক সম্মেলন করিতে পার, পঞ্চাশ হাজার শিক্ষালয় স্থাপন করিতে পার—এ-সবে কিছুই ফল হইবে না, যতদিন না তোমাদের ভিতর সেই সহানুভূতি, সেই প্রেম আবির্ভূত হয়. যতদিন না তোমাদের ভিতর সেই হৃদয় জাগ্রত হয়, যে-হৃদয় সকলের জন্য অনুভব করে। যতদিন না ভারতে আবার বুদ্ধের হৃদয়বত্তা দেখা দেয়, যতদিন না ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের বাণী কর্মজীবনে করা হয়, ততদিন আমাদের আশা নাই। তোমরা ইওরোপীয়দের এবং তাহাদের সভাসমিতির অনুকরণ করিতেছ, কিন্তু তাহাদের হৃদয়বত্তার অনুকরণ করিয়াছ কি? আমি তোমাদিগকে একটি গল্প বলিব—আমি স্বচক্ষে যে ঘটনা দেখিয়াছি, তাহা তোমাদের নিকট বলিব—তাহা হইলেই তোমরা আমার ভাব বুঝিতে পারিবে। একদল ইউরেশীয়ান কতকগুলি ব্রহ্মদেশবাসীকে লণ্ডনে লইয়া গিয়া, তাহাদের একটি প্রদর্শনী করিয়া খুব পয়সা উপার্জন করিল। টাকাকড়ি নিজেরা লইয়া তাহাদিগকে ইওরোপের এক জায়গায় ছাড়িয়া দিয়া সরিয়া পড়িল। এই গরীব বেচারারা কোন ইওরোপীয় ভাষার একটি শব্দও জানিত না। যাহা হউক, অস্ট্রিয়ার ইংরেজ কন্সাল তাহাদিগকে লণ্ডনে পাঠাইয়া দিলেন। তাহারা লণ্ডনেও কাহাকেও জানিত না, সুতরাং সেখানে গিয়াও নিরাশ্রয় অবস্থায় পড়িল। কিন্তু একজন ইংরেজ ভদ্রমহিলা তাহাদের বিষয় জানিতে পারিয়া এই বর্মী বৈদেশিকগণকে নিজ গৃহে লইয়া নিজের কাপড়-চোপড়, বিছানাপত্র, প্রয়োজনীয় সব দিয়া তাহাদের সেবা করিতে লাগিলেন এবং সংবাদপত্রে খবরটি পাঠাইয়া দিলেন। দেখ, তাহার ফল কী হইল! পরদিনই যেন সমগ্র জাতিটি জাগিয়া উঠিল, চারিদিক হইতে তাহাদের সাহায্যার্থে টাকা আসিতে লাগিল, শেষে তাহাদিগকে ব্রহ্মদেশে পাঠাইয়া দেওয়া হইল।

ইওরোপীয়দের রাজনীতিক ও অন্যপ্রকার সভাসমিতি যাহা কিছু আছে, সেগুলি এইরূপ সহানুভূতির উপর প্রতিষ্ঠিত। ইহা অন্ততঃ তাহাদের স্বজাতিপ্রীতির দৃঢ়ভিত্তি। তাহারা সমগ্র পৃথিবীকে ভাল না বাসিতে পারে, তাহারা আর সকলের শত্রু হইতে পারে, কিন্তু ইহা বলা বাহুল্য যে, তাহারা নিজেদের দেশ ও জাতিকে গভীরভাবে ভালবাসে, সত্য ও ন্যায়ের প্রতি তাহাদের গভীর অনুরাগ এবং তাহাদের দ্বারে সমাগত বৈদেশিকগণের প্রতিও তাহাদের খুব দয়া। পাশ্চাত্য দেশে সর্বত্র তাহারা কিভাবে অতিথি বলিয়া আমার যত্ন লইয়াছিল, এ-কথা যদি আমি তোমাদের নিকট বার বার না বলি, তাহা হইলে আমি অকৃতজ্ঞতাদোষে দোষী হইব। এখানে সেই হৃদয় কোথায়, যাহাকে ভিত্তি করিয়া এই জাতির উন্নতি প্রতিষ্ঠিত হইবে? আমরা পাঁচজন মিলিয়া একটি ছোটখাটো যৌথ-কারবার খুলিলাম, কিছুদিন চলিতে না চলিতে আমরা পরস্পরকে ঠকাইতে লাগিলাম, শেষে সব ভাঙিয়া চূরমার হইয়া গেল। তোমরা ইংরেজদের অনুকরণ করিবে বল, আর তাহাদের মত শক্তিশালী জাতি গঠন করিতে চাও, কিন্তু তোমাদের ভিত্তি কোথায়? আমাদের বালির ভিত্তি, তাহার উপর নির্মিত গৃহ অতি শীঘ্রই চুরমার হইয়া ভাঙিয়া যায়।

অতএব হে লাহোরবাসী যুবকবৃন্দ, আবার সেই বিশাল অদ্বৈতভাবের পতাকা উড্ডীন কর—কারণ আর কোন ভিত্তির উপর সেই অপূর্ব প্রেম প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না; যতদিন না তোমরা সেই এক ভগবানকে একভাবে সর্বত্র অবস্থিত দেখিতেছ, ততদিন তোমাদের ভিতর সেই প্রেম জন্মিতে পারে না; সেই প্রেমের পতাকা উড়াইয়া দাও। ওঠ, জাগো, যতদিন না লক্ষ্যে পৌঁছিতেছ, ততদিন নিশ্চিন্ত থাকিও না; ওঠ, আর একবার ওঠ, ত্যাগ ব্যতীত কিছুই হইতে পারে না। অন্যকে যদি সাহায্য করিতে চাও, তবে তোমার নিজের ‘অহং’ বিসর্জন দিতে হইবে। খ্রীষ্টানদের ভাষায় বলিঃ ঈশ্বর ও শয়তানের সেবা কখনও এক সঙ্গে করিতে পার না। বৈরাগ্যবান্ হও—তোমাদের পূর্বপুরুষগণ বড় বড় কাজ করিবার জন্য সংসার ত্যাগ করিয়াছিলেন। বর্তমানকালে এমন অনেকে আছেন, যাঁহারা নিজ নিজ মুক্তির জন্য সংসার ত্যাগ করিয়াছেন। তোমরা সব ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দাও, এমন কি নিজেদের মুক্তি পর্যন্ত দূরে ফেলিয়া দাও; যাও, অন্যের সাহায্য কর। তোমরা সর্বদাই বড় বড় কথা বলিতেছ, কিন্তু তোমাদের সম্মুখে এই কর্মপরিণতি বেদান্ত স্থাপন করিলাম। তোমাদের এই ক্ষুদ্র জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হও। যদি এই জাতি জীবিত থাকে, তবে তুমি আমি—আমাদের মত হাজার হাজার লোক যদি অনাহারে মরে, তাহাতেই বা ক্ষতি কি?

এই জাতি ডুবিতেছে! লক্ষ লক্ষ লোকের অভিশাপ আমাদের মস্তকে রহিয়াছে—যাহাদিগকে আমরা নিত্য-প্রবাহিত অমৃতনদী পার্শ্বে বহিয়া গেলেও তৃষ্ণার সময় পয়ঃপ্রণালীর জল পান করিতে দিয়াছি, সম্মুখে অপর্যাপ্ত আহার্য থাকা সত্ত্বেও যাহাদিগকে আমরা অনশনে মরিতে দিয়াছি, লক্ষ লক্ষ লোক—যাহাদিগকে আমরা অদ্বৈতবাদের কথা বলিয়াছি, কিন্তু প্রাণপণে ঘৃণা করিয়াছি—যাহাদের বিরুদ্ধে আমরা ‘লোকাচারের’ মতবাদ আবিষ্কার করিয়াছি, যাহাদিগকে আমরা মুখে বলিয়াছি—সকলেই সমান, সকলেই সেই এক ব্রহ্ম, কিন্তু উহা কার্যে পরিণত করিবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করি নাই। ‘মনে মনে রাখিলেই হইল, ব্যাবহারিক জগতে অদ্বৈতভাব লইয়া আসা যায় না!’—তোমাদের চরিত্রের এই কলঙ্ক মুছিয়া ফেলো। ওঠ, জাগো, এই ক্ষুদ্র জীবন যদি যায়, ক্ষতি কি? সকলেই মরিবে—সাধু-অসাধু, ধনী-দরিদ্র—সকলেই মরিবে। শরীর কাহারও চিরকাল থাকিবে না। অতএব ওঠ, জাগো এবং সম্পূর্ণ অকপট হও। ভারতে ঘোর কপটতা প্রবেশ করিয়াছে। চাই চরিত্র, চাই এইরূপ দৃঢ়তা ও চরিত্রবল, যাহাতে মানুষ একটা ভাবকে মরণকামড়ে ধরিয়া থাকিতে পারে।

‘নীতিনিপুণ ব্যক্তিগণ নিন্দাই করুন বা সুখ্যাতিই করুন, লক্ষ্মী আসুন বা চলিয়া যান, মৃত্যু আজই হউক বা শতাব্দান্তে হউক, তিনিই ধীর, যিনি ন্যায়পথ হইতে এক পাও বিচলিত হন না।’৭৪ ওঠ, জাগো, সময় চলিয়া যাইতেছে, আর আমাদের সমুদয় শক্তি বৃথা বাক্যে ব্যয়িত হইতেছে। ওঠ, জাগো—সামান্য সামান্য বিষয় ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মত-মতান্তর লইয়া বৃথা বিবাদ পরিত্যাগ কর। তোমাদের সম্মুখে খুব বড় কাজ রহিয়াছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্রমশঃ ডুবিতেছে, তাহাদের উদ্ধার কর।

এইটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করিও যে, মুসলমানগণ যখন ভারতবর্ষে প্রথম আসে, তখন ভারতে এখনকার অপেক্ষা কত বেশী হিন্দুর বসবাস ছিল, আজ তাহাদের সংখ্যা কত হ্রাস পাইয়াছে। ইহার কোন প্রতিকার না হইলে হিন্দু দিন দিন আরও কমিয়া যাইবে, শেষে আর কেহ হিন্দু থাকিবে না। হিন্দুজাতির লোপের সঙ্গে সঙ্গেই—তাহাদের শতদোষ সত্ত্বেও, পৃথিবীর সম্মুখে তাহাদের শত শত বিকৃত চিত্র উপস্থাপিত হইলেও এখনও তাহারা যে-সকল মহৎ ভাবের প্রতিনিধিরূপে বর্তমান, সেগুলিও লুপ্ত হইবে। আর হিন্দুদের লোপের সঙ্গে সঙ্গে সকল অধ্যাত্মজ্ঞানের চূড়ামণি অপূর্ব অদ্বৈতত্ত্বও বিলুপ্ত হইবে। অতএব ওঠ, জাগো—পৃথিবীর আধ্যাত্মিকতা রক্ষা করিবার জন্য বাহু প্রসারিত কর। আর প্রথমে তোমাদের স্বদেশের কল্যাণের জন্য এই তত্ত্ব কার্যে পরিণত কর। ব্যাবহারিক জগতে অদ্বৈতবাদ একটু কাজে পরিণত করা আমাদের যত প্রয়োজন, আধ্যাত্মিক জগতে ততটা প্রয়োজন নয়; প্রথমে অন্নের ব্যবস্থা করিতে হইবে, তারপর ধর্ম। গরীব লোকেরা অনশনে মরিতেছে, আমরা তাহাদিগকে অতিরিক্ত ধর্মোপদেশ দিতেছি! মত-মতান্তরে তো আর পেট ভরে না! আমাদের একটি দোষ বড়ই প্রবল—প্রথমতঃ আমাদের দুর্বলতা, দ্বিতীয়তঃ ঘৃণা—হৃদয়ের শুষ্কতা। লক্ষ লক্ষ মতবাদের কথা বলিতে পার, কোটি কোটি সম্প্রদায় গঠন করিতে পার, কিন্তু যতদিন না তাহাদের দুঃখ প্রাণে প্রাণে অনুভব করিতেছ, বেদের উপদেশ অনুযায়ী যতদিন না জানিতেছ যে, তাহারা তোমার শরীরের অংশ, যতদিন না তোমরা ও তাহারা, ধনী-দরিদ্র, সাধু-অসাধু সকলেই সেই অনন্ত অখণ্ডরূপ—যাঁহাকে তোমরা ব্রহ্ম বল, তাঁহার অংশ হইয়া যাইতেছ, ততদিন কিছুই হইবে না।

ভদ্রমহোদয়গণ, আমি আপনাদের নিকট অদ্বৈতবাদের কয়েকটি প্রধান প্রধান ভাব প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিয়াছি। এখন ঐগুলি কাজে পরিণত করিবার সময় আসিয়াছে—শুধু এ-দেশে নয়, সর্বত্র। আধুনিক বিজ্ঞানের লৌহমুদ্গরাঘাতে দ্বৈতবাদাত্মক ধর্মগুলির কাচনির্মিত ভিত্তি সর্বত্র চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া যাইতেছে। শুধু এখানেই যে দ্বৈতবাদীরা টানিয়া শাস্ত্রীয় শ্লোকের অর্থ করিবার চেষ্টা করিতেছে, তাহা নহে—এতদূর টানা হইতেছে যে, আর টানা চলে না, শ্লোকগুলি তো আর রবার নহে!—শুধু এদেশেই যে উহারা আত্মরক্ষার জন্য অন্ধকারে কোণে লুকাইবার চেষ্টা করিতেছে তাহা নহে, ইওরোপ-আমেরিকায় এই চেষ্টা আরও বেশী। আর সেখানেও ভারত হইতে এই তত্ত্বের অন্ততঃ কিছু অংশ প্রবেশ করা চাই। ইতঃপূর্বেই কিছু গিয়াছে—উহার প্রসার দিন দিন আরও বাড়াইতে হইবে। পাশ্চাত্য সভ্যতাকে রক্ষা করিবার জন্য উহা বিশেষ প্রয়োজন। কারণ পাশ্চাত্যদেশে সেখানকার প্রাচীন ভাবাদর্শ লোপ পাইতেছে, এক নূতন ব্যবস্থা—কাঞ্চনের পূজা চালু হইতেছে। এই আধুনিক ধর্ম অর্থাৎ পরস্পর প্রতিযোগিতা ও কাঞ্চনপূজা অপেক্ষা সেই প্রাচীন অপরিণত ধর্মপ্রণালী ছিল ভাল। কোন জাতি যতই প্রবল হউক, এরূপ ভিত্তির উপর কখনই দাঁড়াইতে পারে না। জগতের ইতিহাস আমাদিগকে বলিতেছে, যাহারাই এইরূপ ভিত্তির উপর তাহাদের সমাজ প্রতিষ্ঠা করিতে গিয়াছে, তাহাদের বিনাশ হইয়াছে। যাহাতে ভারতে এই কাঞ্চনপূজার তরঙ্গ প্রবেশ না করে, সেদিকে প্রথমেই বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে। অতএব সকলের নিকট এই অদ্বৈতবাদ প্রচার কর, যাহাতে ধর্ম—আধুনিক বিজ্ঞানের প্রবল আঘাতেও অক্ষত থাকিতে পারে। শুধু তাই নয়, অপরকেও তোমাদের সাহায্য করিতে হইবে, তোমাদের ভাবরাশি ইওরোপ-আমেরিকাকেও উদ্ধার করিবে। কিন্তু সর্বাগ্রে তোমাদের স্মরণ করাইয়া দিতেছি যে, এখানেই প্রকৃত কাজ রহিয়াছে, আর সেই কাজের প্রথমাংশ—দিন দিন গভীর হইতে গভীরতর দারিদ্র ও অজ্ঞানতিমিরে মজ্জমান ভারতের লক্ষ লক্ষ জনসাধারণের উন্নতিসাধন। তাহাদের কল্যাণের জন্য, তাহাদের সহায়তার জন্য বাহু প্রসারিত কর এবং ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণের সেই বাণী স্মরণ করঃ

ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ।
নির্দোষং হি সমং তস্মাদ্ ব্রহ্মণি তে স্থিতাঃ॥

যাঁহাদের মন সাম্যভাবে অবস্থিত, তাঁহারা ইহজীবনেই সংসার জয় করিয়াছেন। যেহেতু ব্রহ্ম নির্দোষ ও সমভাবাপন্ন, সেই হেতু তাঁহারা ব্রহ্মেই অবস্থিত।