১১. বাইভার্বালটি থামিয়ে রিরা বলল

বাইভার্বালটি থামিয়ে রিরা বলল, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না কুশান। তুমি দেখতে পাচ্ছ?

হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি।

চমৎকার। এই নাও-বাইভার্বালটা তুমি চালিয়ে নিয়ে যাও।

রিরা, আমি কখনো তোমাদের এই ভাসমান যান চালাই নি। কেমন করে চালাতে হয় আমি জানি না।

ঘুটঘুটে অন্ধকারে রিরা কুশানের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল, সে কখনো কল্পনা করে নি যে, একজন বলতে পারে যে সে বাইভার্বাল কীভাবে চালাতে হয় জানে না। মানুষ যেভাবে হাঁটতে শেখে, সেভাবে বাইভার্বাল চালাতে শেখে। রিরা ভুলে গিয়েছিল কুশান মানুষ নয়, কুশান নীলমানব। সে একটু অধৈর্য গলায় বলল, বাইভার্বাল চালানো খুব সোজা কুশান। হ্যান্ডেলটা টেনে ধরলেই চলে…।

জানি। তুমি চালিয়েছিলে, আমি লক্ষ করেছি। কিন্তু সবকিছুরই এক ধরনের ব্যালেন্স দরকার। আমি যদি চালাতে গিয়ে কোনো পাথরে ধাক্কা লাগিয়ে ফেলি খুব বড় বিপদ হয়ে যাবে।

তা হলে?

একটা ফেয়ার জ্বালানো যাক। ফেয়ারের আলোতে তুমি চালিয়ে নাও।

ঠিক আছে।

রিরা বাইভার্বালের জমাটবাধা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল এবং তার মাঝে বুঝতে পারল কুশান একটা ফ্লেয়ার এনে সুইচ টিপে ছেড়ে দিয়েছে। জ্বলন্ত আগুনের হলকা ছড়িয়ে ফ্লেয়ারটা আকাশে উঠে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর পুরো এলাকাটা তীব্র সাদা আলোতে ভরে গেল। অন্ধকারে এতক্ষণ থাকার পর হঠাৎ করে এই তীব্র আলোতে রিরার চোখ ধাধিয়ে যায়, সে দুই হাতে চোখ ঢেকে আলোতে অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করতে করতে হঠাৎ ঝড়ো বাতাসের মতো এক ধরনের শব্দ শুনতে পেল। ভয় পাওয়া গলায় বলল, ওটা কিসের শব্দ কুশান?

আমার মনে হয় মহাকাশের প্রাণী বের হয়ে আসছে। ভয়ংকর এক ধরনের আতঙ্কে হঠাৎ রিরার বুক কেঁপে ওঠে। সে কাঁপা হাতে বাইভার্বালের হ্যান্ডেলটা ধরে নিজের দিকে টেনে আনে, একটা ছোট ঝাকুনি দিয়ে বাইভার্বালটা উড়ে যেতে শুরু করে। রিরা তীব্র আলোতে চোখ দুটোকে অভ্যস্ত হতে দিয়ে বাইভার্বালটাকে নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখার চেষ্টা করে। ফ্লেয়ারের কৃত্রিম আলোতে পুরো এলাকাটা এখন অপরিচিত একটা জগতের মতো দেখাচ্ছে, রিরার হঠাৎ করে দিক বিভ্রম হতে শুরু করল। কোনদিকে যাবে সেটা নিয়ে হঠাৎ তার ভেতরে একটা বিভ্রান্তির জন্ম হয়ে গেল। ভয় পাওয়া গলায় বলল, কুশান!

কী হল?

আমি কোনদিকে যাব বুঝতে পারছি না।

তুমি ঠিক দিকেই যাচ্ছ রিরা। একটু বাম দিকে ঘুরিয়ে নাও-দশ ডিগ্রির মতো।

ফ্লেয়ারের আলোতে সবকিছু অন্যরকম লাগছে—আলোটা উপর থেকে আসছে, কোনো ছায়া নেই, তাই কোনো কিছুর গভীরতা বুঝতে পারছি না।

আমি বুঝতে পারছি রিরা। তুমি মাথা ঠাণ্ডা রাখ ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই।

পাথরগুলো কত উঁচুতে বুঝতে পারছি না—মনে হচ্ছে কোথাও ধাক্কা লাগিয়ে দেব।

না রিরা। কুশান শান্ত গলায় বলল, তুমি ধাক্কা লাগাবে না।

ফ্লেয়ারটা ধীরে ধীরে নেমে আসছে। এটা যত নিচে নামছে আলোর তীব্রতা তত বাড়ছে—শুধু যে আলোর তীব্রতা বাড়ছে তা নয়, ফ্লেয়ারটি নামছে সামনের দিকে, তাই রিরার চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে। পুরো এলাকাটি হঠাৎ মনে হতে থাকে একটা বিশাল সাদা পরদার মতো। রিরা দাতে দাঁত চেপে বলল, আর পারছি না, চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে।

কুশান কোনো কথা বলল না। রিরা জিজ্ঞেস করল, প্রাণীগুলো কোথায় আছে কুশান?

আমাদের ঘিরে রেখেছে। ফ্লেয়ারটা নিভে গেলেই ছুটে আসবে আমাদের দিকে।

সর্বনাশ!

হ্যাঁ রিরা, কাজেই যেভাবে হোক আমাদের মহাকাশযানে পৌঁছাতে হবে। বুঝেছ?

বুঝেছি।

রিরা সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে বাইভার্বালটা চালিয়ে নিয়ে যেতে থাকে, কয়েকবার বিপজ্জনকভাবে দুটি পাথরের সাথে ধাক্কা লাগতে লাগতে শেষমুহূর্তে নিজেদের বাঁচিয়ে নেয়। কুশান শান্ত গলায় বলল, মহাকাশযানটিকে দেখতে পাচ্ছি রিরা। আর মাত্র কিছুক্ষণ।

ঠিক আছে।

মাথা ঠাণ্ডা রাখ রিরা—

রিরা মাথা ঠাণ্ডা রাখল।

আজ ভাগ্য আমাদের পক্ষে, আজ আমাদের কোনো বিপদ হতে পারে না।

রিরা বিশ্বাস করতে চাইল আজ ভাগ্য তাদের পক্ষে। আজ সত্যিই বিপদ হবে না।

কিন্তু শেষমুহূর্তে ভাগ্য তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল। ফ্লেয়ারটি যখন খুব নিচে নেমে এসেছে, তীব্র আলোতে যখন কিছু দেখা যাচ্ছে না, তখন রিরা বাইভার্বালটিকে একটা বড় পাথরের পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে নিতে গিয়ে অনুমানে ভুল করে ফেলল, বাইভার্বালটিসহ রিরা আর কুশান আছড়ে পড়ল শক্ত মাটিতে। বাইভার্বালের যন্ত্রপাতি, ফ্লেয়ার, অস্ত্র, সার্চলাইট, ব্যাটারি সবকিছু ছিটকে পড়ল চারদিকে, ঢালু পাথরে গড়িয়ে যেতে থাকল সিলিন্ডারের মতো ফ্লেয়ারগুলো।

চাপা গলায় একটা গালি দিয়ে রিরা উঠে দাঁড়ায়, পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা লেগেছে, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না সে। কুশান কাত হয়ে থাকা বাইভার্বালটা ধরে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল, এক ধরনের হতচকিত দৃষ্টি দিয়ে চারদিকে তাকাল সে। রিরা কয়েক মুহূর্ত বেটার দিকে তাকিয়ে থাকে, তার ঔজ্জ্বল্য কমতে শুরু করেছে, বার কয়েক আলোটা কেঁপে কেঁপে উঠল, এটা নিভে যাবার সময় হয়েছে। রিরা ফিসফিস করে বলল, আমাদের ভাগ্যটুকু আমরা শেষ করে ফেলেছি কুশান।

কুশান চাপা গলায় বলল, ভাগ্য তৈরি করে নিতে জানলে কখনো শেষ হয় না।

তুমি জান তৈরি করতে?

জানতাম না। শিখছি।

কোথা থেকে শিখছ?

তোমার কাছ থেকে।

রিরা এত কষ্টের মাঝেও একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আশা করি তুমি ভালো করে শিখেছ কুশান। কারণ আমি কিন্তু শিখি নি।

কুশান বাইভার্বালটাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, এটা কি আর যাবে?

রিরা একনজর দেখে বলল, কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করতে পারলে আবার চালানো যাবে।

কুশান চারদিকে একবার তাকিয়ে বলল, আমাদের সেই কিছুক্ষণ সময় নেই। প্রাণীগুলো ঘিরে ফেলেছে।

আরেকটা ফ্লেয়ার জ্বালানো যায় না?

না। ফ্লেয়ারগুলো গড়িয়ে নিচে চলে গেছে-এখন খুঁজে বের করার সময় নেই।

তা হলে?

আমার মনে হয় সবচেয়ে ভালো হবে যদি দৌড়ে মহাকাশযানের কাছে চলে যাই।

রিরা ফ্লেয়ারটির দিকে তাকাল, সেটা প্রায় নিবুনিবু হয়ে এসেছে, যে কোনো মুহূর্তে নিবে যাবে। জিজ্ঞেস করল, পৌঁছাতে পারব মহাকাশযানের কাছে?

পৌঁছাতে হবে।

কুশান নিচু হয়ে একটা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বলল, দেরি করে লাভ নেই রিরা। দৌড়াও।

কিন্তু—

এখন কিন্তুর সময় নেই। কুশান রিরাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, দৌড়াও।

রিরা দৌড়াতে শুরু করেই হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। কুশান তার হাত ধরে বলল, কী হয়েছে রিরী?

কিছু না। পায়ে ব্যথা পেয়েছি।

রিরা আবার উঠে দাঁড়াল, পায়ের ব্যথা সহ্য করে সে কোনোভাবে দৌড়াতে চেষ্টা করতে থাকে, কুশান তার পিছু পিছু আসছে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে নিয়ে সে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে চারদিকে।

ফ্লেয়ারটা হঠাৎ দপ করে নিবে গেল; অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক—সাথে সাথে অসংখ্য প্রাণীর এক ধরনের হিংস্র ধ্বনি শুনতে পায় রিরা। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো এক ধরনের শব্দ ভেসে আসতে থাকে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু না দেখেও রিরা বুঝতে পারে ধারালো দাঁত বের করে অসংখ্য ক্লেদাক্ত প্রাণী হিংস্র নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে ছুটে আসছে তাদের দিকে।

রিরা ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমি কিছু দেখছি না কুশান।

আমি দেখছি। আমাকে ধর।

রিরা হাত বাড়িয়ে কুশানকে ধরার চেষ্টা করল, কুশান এগিয়ে এসে রিরার হাত ধরে তাকে টেনে নিতে থাকে। একটু পরে পরে সে হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে চায়, কিন্তু কুশান তাকে শক্ত করে ধরে রাখল, পড়ে যেতে দিল না। হিংস্র চিৎকার আর গর্জন বাড়ছে চারদিকে—পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট। অন্ধকারে একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে রিরা হঠাৎ পড়ে গেল নিচে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছোট একটা আর্তচিৎকার করে ওঠে সে দাতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাটা সহ্য করে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে আবার হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে। কাতর গলায় বলল, আমি আর পারছি না কুশান।

পারতে হবে। অন্ধকারে কুশানের চাপা গলার স্বর শোনা গেল, যেভাবে হোক। পারতে হবে।

আমাদের ভাগ্য আমরা খরচ করে ফেলেছি কশান।

এখনো খরচ হয় নি। রিরা হঠাৎ অনুভব করল, কুশান তাকে টেনে দাঁড় করিয়েছে, আমার অংশের ভাগ্যটুকু আমি তোমাকে দিচ্ছি। এখন তোমার কাছে দুজনের ভাগ্য।

কী বলছ তুমি?

ঐ যে সামনে তাকিয়ে দেখ—আমাদের মহাকাশযানটা দেখতে পাচ্ছ?

রিরা আবছাভাবে দেখতে পেল, বলল, হ্যাঁ।

তুমি সেদিকে যেতে শুরু কর। যেভাবে পার। দৌড়িয়ে হেঁটে হামাগুড়ি দিয়ে।

আর তুমি?

আমি আসছি তোমার পিছু পিছু তোমাকে কাভার দিয়ে।

তুমি কীভাবে কাভার দেবে?

আমার কাছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আছে। আমি আগুন জ্বালাব।

তুমি কীভাবে আগুন জ্বালাবে? এখানে অক্সিজেন নেই।

আছে, আমার কাছে অক্সিজেন আছে।

রিরা চমকে উঠে বলল, কিন্তু সেটা নিশ্বাস নেবার অক্সিজেন।

সেটা নিয়ে কথা বলার সময় নেই। প্রাণীগুলো চলে আসছে। আমি দেখতে পাচ্ছি রিরা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

না। আমি একা যাব না।

তোমাকে যেতে হবে। তোমাকে যেভাবে হোক বেঁচে থাকতে হবে। তোমাকে উদ্ধার করতে আসবে মনে নেই?

না–রিরা চিৎকার করে বলল, না।

হ্যাঁ। কুশান রিরাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, যাও। তাড়াতাড়ি।

রিরা কুশানের পদশব্দকে মিলিয়ে যেতে শুনল। কোথায় গিয়েছে সে?

ভয়ংকর হিংস্র শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। সমুদ্রের জলোচ্ছাসের মতো হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ প্রাণী ছুটে আসছে তাদের দিকে। রিরা আর চিন্তা করতে পারছে না। কোনোভাবে সে উঠে দাঁড়াল, তারপর একপায়ে ভর দিয়ে ছুটে যেতে শুরু করল মহাকাশযানের দিকে। পায়ের নিচে শক্ত পাথর, অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে এই পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে যায়। তাকে ঘিরে হিংস্র জন্তুগুলি ছুটে যাচ্ছে, খুব কাছে থেকে ভয়ংকর গলায় ডেকে উঠছে হঠাৎ হঠাৎ। রিরা কিছু দেখতে পাচ্ছে না, অন্ধকারে হঠাৎ কোথা থেকে তার উপরে কিছু ঝাঁপিয়ে পড়বে এরকম একটা আতঙ্কে তার সমস্ত মায়ু টানটান হয়ে আছে। যন্ত্রণা আর পরিশ্রমে তার সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে আসতে চাইছে। প্রচণ্ড তৃষ্ণয় বুকটা ফেটে যেতে চাইছে, তার মাঝে সে মহাকাশযানের দিকে ছুটে যেতে লাগল।

 

হঠাৎ করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির শব্দ শুনল সে ছাড়া ছাড়াভাবে, সাথে সাথে ভয়ংকর প্রাণীগুলোর হিংস্র চিৎকার বেড়ে গেল কয়েকগুণ হুঁটোপুটি শুরু হয়ে গেল কোথাও। রিরা নিজেকে টেনে নিতে থাকে সামনে, মহাকাশযানের একেবারে কাছাকাছি এসে গেছে সে, আর কয়েক পা গেলেই পৌঁছে যাবে রিরা।

আবার গুলির শব্দ শুনতে পেল, তাকে কাভার দিচ্ছে কুশান। বলেছিল তার ভাগ্যটুকু সে রিরাকে দিয়ে দিচ্ছে—সত্যিই কি একজনের ভাগ্য আরেকজনকে দেওয়া যায়? সত্যিই কি স্বার্থপরের মতো কুশানের ভাগ্যটুকু নিয়ে এসেছে সে? রিরা মহাকাশযানের দরজায় হাত দেয়, গোপন সংখ্যা প্রবেশ করাতেই ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে টেনে দরজাটা বন্ধ করে দিতেই মূল প্রসেসরের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, জীবাণুমুক্ত করার জন্য বাতাস শোধনের প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছি—

বাইপাস কর।

এটি হবে অত্যন্ত অযৌক্তিক নিরাপত্তাবহির্ভূত কাজ।

রিরা চিৎকার করে বলল, আমি যা বলছি তা-ই কর।

বাইরের বাতাস ভেতরে ঢুকে সমস্ত মহাকাশযান দূষিত হয়ে যেতে পারে, ভয়ংকর বিপর্যয় হয়ে যেতে পারে।

রিরা দরজায় লাথি দিয়ে বলল, আহাম্মক, খুন করে ফেলব আমি। দরজা খোল।

নিরাপত্তার সব নিয়ম ভঙ্গ করে, ঘরঘর করে মহাকাশযানের মূল দরজা খুলে গেল। রিরা মহাকাশযানের ভেতরে ঢুকে ছুটতে থাকে, তার এখন একটা ফ্লেয়ার দরকার, জরুরি নিরাপত্তার জন্য সে অনেকগুলো আলাদা করে রেখেছে।

ফ্লেয়ারটা হাতে নিয়ে রিরা যখন বাইরে ছুটে যাচ্ছিল, তখন সে আবার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির শব্দ শুনতে পেল, এবারে থেমে থেমে একটানা গুলি হতে লাগল। কুশানকে নিশ্চয়ই আক্রমণ করেছে প্রাণীগুলো নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে সে। দূরে একটা আগুন জ্বলছে আগুনটা নড়ছে ইতস্তত, কুশান আগুন দিয়ে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে প্রাণীগুলোকে, আগুনকে ঘিরে ছায়াকে সে ছুটোছুটি করতে দেখে, ভয়ংকর হিংস্র কিছু ছায়া।

ফ্লেয়ারটার সুইচ টিপে ছেড়ে দিতেই আগুনের একটা হলকা বের হয়ে গর্জন করে সেটা আকাশে উঠে গেল, মহুর্তে দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠল চারদিক। সাথে সাথে হিংস্র প্রাণীগুলো কাতর আর্তনাদ করে ছুটে পালিয়ে যেতে শুরু করে। ভয়ংকর হুঁটোপুটি শুরু হয়ে যায় চারদিকে। রিরা চোখ কুঁচকে তাকাল সামনে, একটা বড় পাথরে হেলান দিয়ে বলে আছে কুশান, নিজের কাপড় খুলে সেটাতে আগুন ধরিয়েছে, নিশ্বাস নেবার অক্সিজেন দিয়ে আগুনটা জ্বালিয়ে রেখেছে কোনোভাবে।

রিরা ছুটে গেল কুশানের কাছে, সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে, ধারালো দাঁত দিয়ে খুবলে নিয়েছে তার ডান হাতের একটা অংশ। নীল রক্তে ভিজে যাচ্ছে শুকনো পাথর। রিরাকে দেখে কুশান দুর্বলভাবে হাসল, বলল, তুমি এসেছ?

হ্যাঁ কশান, আমি এসেছি।

বেঁচে গেলাম তা হলে আমরা?

হ্যাঁ, কুশান। তোমার জন্য। তুমি তোমার ভাগ্যটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিলে বলে আমরা বেঁচে গেলাম।

ভাগ্য খুব বিচিত্র জিনিস কুশান নরম গলায় বলল, কাউকে দিয়ে দিলেও সেটা ফুরিয়ে যায় না।

রিরা নিচু হয়ে কুশানকে স্পর্শ করল, তারপর গভীর মমতায় তার মাথাটিকে নিজের বুকে চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলল, কুশান, আমার ভাগ্য ফুরিয়ে গিয়েছিল, আমার জীবনও ফুরিয়ে গিয়েছিল! তুমি সবকিছু ফিরিয়ে এনেছ। তুমি!

কুশান অবাক হয়ে দেখল রিরার চোখে পানি চিকচিক করছে। মানুষকে মনে হয় সে কখনোই পুরোপুরি বুঝতে পারবে না।