চিড়িয়াখানা
তোমাকে দেখার আমার একটু কৌতূহল ছিল– বলে হাজীব কুন্তেরা রাহান জাবিলের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। হাজীব কুন্তেরার চেহারায় বিচিত্র একধরনের নিষ্ঠুরতা রয়েছে। এই হাসিটি হঠাৎ করে সেই নিষ্ঠুরতাটিকে কেন জানি খোলামেলাভাবে প্রকাশ করে দিল।
রাহান জাবিল হঠাৎ করে একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, এই মানুষটির আমন্ত্রণ রক্ষা করে এখানে আসা হয়তো খুব বুদ্ধিমানের কাজ হয় নি। সে বেশ চেষ্টা করে মুখে একধরনের বেপরোয়া এবং শান্ত ভাব ধরে রেখে জিজ্ঞেস করল, কেন? আমাকে দেখার তোমার কৌতূহল কেন?
আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ। ইচ্ছে করলে আমি মাঝারি একটা দেশের রাষ্ট্রপতি পাল্টে দিতে পারি। আমাকে নিয়ে খবরের কাগজে রিপোর্ট লেখে সেই মানুষটি কেমন দেখার কৌতূহল।
আমি একজন সাংবাদিক। সত্যকে প্রকাশ রাহানের বক্তৃতাটি মাঝপথে থামিয়ে হাজীব কুন্তেরা বলল, থাক।
রাহান খানিকটা অপমানিত বোধ করে কিন্তু হঠাৎ করে যে–কোনো মূল্যে সত্যকে প্রকাশ করার সাংবাদিকদের পবিত্র দায়িত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা দেওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
হাজীব কুন্তেরা টেবিলে তার আঙুল দিয়ে শব্দ করতে করতে বলল, আমি যা ভেবেছিলাম তুমি ঠিক তাই।
রাহান ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, সেটি কী?
কমবয়সী, অপরিপক্ক, নির্বোধ এবং আহাম্মক।
রাহান হতভম্ব হয়ে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। একজন মানুষ যত বিত্তশালীই হোক, যত ক্ষমতাবানই হোক, সে কি অন্য একজনের সাথে এই ভাষায় কথা বলতে পারে!
রাহান কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, হাজীব আবার হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল, বলল, রাগ করো না। তোমার বয়সে আমিও নির্বোধ এবং আহাম্মক ছিলাম।
রাহান ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমি নির্বোধ এবং আহাম্মক নই।
হাজীব রাহানের কথার উত্তর না দিয়ে অত্যন্ত বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল এবং হঠাৎ করে রাহান বুঝতে পারল সে আসলেই নির্বোধ এবং আহাম্মক। সে খানিকক্ষণ একধরনের অক্ষম আক্রোশ নিয়ে হাজীবের সবুজ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি কেন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছ?
কথা বলার জন্যে।
রাহান ভুরু কুঁচকে বলল, কথা বলার জন্যে?
হ্যাঁ। আমার আসলে কথা বলার লোক নেই।
কথা বলার লোক নেই?
না। যারা আমার কর্মচারী তারা কখনো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস পায় না। যারা পরিচিত তারা তোষামুদি করে।
তোমার আপনজন?
আমার কোনো আপনজন নেই।
রাহান ভুরু কুঁচকে বলল, আমি তোমার ওপর রিপোর্ট করেছি, আমি জানি তোমার দুইজন স্ত্রী আছে, তিনজন ছেলেমেয়ে আছে।
হাজীব এবারে শব্দ করে হাসল, এই হাসিটি হল শ্লেষে পরিপূর্ণ এবং সে-কারণে মানুষটিকে অত্যন্ত কুশ্রী দেখাল। রাহান মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে একধরনের ঘৃণা অনুভব করে। হাজীব হাসি থামিয়ে বলল, আমার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে প্রতিমুহূর্তে আমার মৃত্যু কামনা করে।
কেন?
তুমি সাংবাদিক, এটা তোমার জানার কথা।
রাহান কোনো কথা বলল না, সে আসলেই জানে। ছোটখাটো সম্পদ মানুষের জীবনে সুখ আনতে পারে, ভয়ংকর ঐশ্বর্যের বেলায় সেটি সত্যি নয়, পারিবারিক জীবনটিকে সেটি একটা কুৎসিত ষড়যন্ত্রে পাল্টে দেয়।
হাজীব বলল, আমি আমার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েকে নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে চাই না।
তাহলে কী নিয়ে কথা বলতে চাও?
তোমাকে নিয়ে।
রাহান অবাক হয়ে বলল, আমাকে নিয়ে?
হ্যাঁ।
আমাকে নিয়ে তুমি কী কথা বলতে চাও?
হাজীব তার ডেস্ক থেকে একটা খবরের কাগজ বের করে টেবিলে রেখে বলল, এখানে তুমি আমার সম্পর্কে একটা বিশাল আলোচনা ফেঁদেছ।
তাকিয়েও রাহান বুঝতে পারে হাজীব কোন লেখাটার কথা বলছে, একটি অত্যন্ত সম্ৰান্ত দৈনিক পত্রিকায় তার এই নিবন্ধটি ছাপা হয়েছিল। হাজীবের টাকার উত্স, তার নানা ধরনের অপরাধ, তার অমানবিক নৃশংসতা কিছুই সে বাদ দেয় নি। হাজীব চেষ্টা করে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, তুমি এখানে আমার চরিত্রটি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা। করেছ।
রাহান মাথা নাড়ল। হাজীব বলল, তুমি আমার সম্পর্কে কতটুকু জান?
পৃথিবীতে তোমার সম্পর্কে যত তথ্য আছে আমি তার সব যোগাড় করে বিশ্লেষণ করেছি।
আমি মানুষটা কেমন বলে তোমার ধারণা?
রাহান একটু ইতস্তত করে বলল, খারাপ।
কত খারাপ?
বেশ খারাপ।
সেটা কতটুকু সে সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে?
রাহান কোনো কথা না বলে হাজীবের দিকে তাকিয়ে রইল। হাজীব একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার ধারণা সে সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই।
হাজীব ঠিক কী বলতে চাইছে রাহান সেটা অনুমান করার চেষ্টা করল কিন্তু খুব একটা লাভ হল না। সে কিছু–একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই হাজীব উঠে দাঁড়াল, বলল, চল।
কোথায়।
এখানে আমার একটা চিড়িয়াখানা আছে, তোমাকে সেটা দেখাব।
চিড়িয়াখানা! রাহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেল করল, তোমার নিজস্ব চিড়িয়াখানা আছে?
হ্যাঁ। বড়লোকদের অনেক রকম খেয়াল থাকে। কেউ মূল্যবান রত্ন সগ্রহ করে, কেউ দুষ্প্রাপ্য ছবি সগ্রহ করে–আমি সেরকম দুষ্প্রাপ্য প্রাণী সগ্রহ করি।
দুষ্পপ্য প্রাণী?
হ্যাঁ।
কীরকম দুষ্প্রাপ্য?
আমার কাছে যেগুলো আছে, মনে কর সেগুলো পৃথিবীর কারো কাছে নেই!
সেটি কীভাবে সম্ভব রাহান বুঝতে পারল না। তাহলে কি সে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে নতুন ধরনের প্রাণী তৈরি করেছে? প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করতে গিয়ে সে থেমে গেল–এক্ষুনি হয়তো ব্যাপারটি সে নিজের চোখেই দেখতে পাবে।
হাজীবের পিছনে পিছনে রাহান বের হয়ে এল, পিছনে পিছনে কয়েকজন দেহরক্ষী বের হয়ে আসবে বলে রাহান অনুমান করেছিল কিন্তু সেরকম কিছু হল না। মানুষটি নিরাপত্তা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায় না, সম্ভবত নানা ধরনের গোপন ক্যামেরা দিয়ে তাদেরকে চোখে চোখে রাখা হয়েছে।
প্রাসাদের মতো দালানটির মারবেল-সিঁড়ি দিয়ে তারা নেমে এল। সিঁড়ির সামনে ছোট একটি গাড়ি রাখা আছে, পাশাপাশি দুজন বসতে পারে। হাজীব রাহানকে ইঙ্গিত করে নিজে অন্যপাশে বসে একটা সুইচ স্পর্শ করতেই গাড়িটি একেবারে নিঃশব্দে চলতে শুরু করল, রাহান কান পেতে অনেক চেষ্টা করেও গাড়ির ইঞ্জিন বা মোটরের শব্দ শুনতে পেল না। গাড়িটি খুব ধীরে ধীরে চলছে, কোন দিক দিয়ে যেতে হবে নিশ্চয়ই প্রোগ্রাম করে রাখা
আছে। গাড়িটির ছাদ নেই বলে খুব খোলামেলা, চারদিকে দেখা যায়। হাজীব সিটে হেলান দিয়ে বলল, সারা পৃথিবীতে আমার একচল্লিশটা দ্বীপ আছে, তবে এটা আমার সবচেয়ে প্রিয়।
এটা কত বড়?
খুব বেশি বড় নয়। এক শ বর্গ কিলোমিটার থেকে একটু ছোট।
এখানে তোমার নিজস্ব এয়ার স্ট্রিপ আছে?
হাজীব হাত নেড়ে বলল, সেজন্য এটি আমার প্রিয় নয়। আমার প্রিয় কারণ এই পুরো দ্বীপটি আসলে একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। হাজীব হাত দিয়ে দূরে দেখিয়ে বলল, ওপাশে গ্রানাইটের পাহাড়, ভারি চমৎকার।
বৃক্ষহীন গ্রানাইটের পাহাড় কেমন করে ভারি চমৎকার হতে পারে রাহান বুঝতে পারল, কিন্তু সে কোনো প্রশ্নও করল না। তবে জায়গাটি আশ্চর্য রকম নির্জন, কোথাও কোনো মানুষজন নেই। চিড়িয়াখানাটি কোথায় কে জানে! রাহান বিচিত্র এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে থাকে।
গ্রানাইটের পাহাড়ের খুব কাছাকাছি এলে হঠাৎ একটি সুড়ঙ্গ দেখতে পেল, ঘোট গাড়িটি সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে ভিতরে একটা খোলা জায়গায় এসে হাজির হয়। হাজীব তখন সুইচ টিপে গাড়িটি থামিয়ে দিয়ে বলল, এটা আমার চিড়িয়াখানা।
রাহান চারদিকে তাকিয়ে চিড়িয়াখানার কোনো চিহ্ন দেখতে পেল না। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে হাজীবের দিকে তাকাতেই হাজীব বলল, এদিকে এস।
রাহান হাজীবের পিছু পিছু একদিকে এগিয়ে যায়, উঁচু পাহাড়ের খাড়া দেয়াল উঠে গেছে, সেখানে হাত দিয়ে একটা পাথর সরাতেই উঁকি দেওয়ার মতো একটা জায়গা বের হয়ে গেল। হাজীব সেখানে উঁকি দিয়ে কিছু–একটা দেখে সরে গিয়ে বলল, দেখ। .
রাহান কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে চমকে ওঠে। বেশ খানিকটা দূরে নিচে খানিকটা সমতল জায়গায় বিচিত্র কয়েকটা প্রাণী একটি মৃত ছাগলের দেহ টানাটানি করে খাচ্ছে। কামড়াকামড়ি করে খেতে–খেতে হঠাৎ একটা অন্যটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তুলনামূলকভাবে দুর্বল প্রাণীটি চারপায়ে ছুটে দূরে চলে গিয়ে অক্ষম আক্রোশে গর্জন করতে লাগল। প্রাণীটির সিংহের মতো লম্বা কেশর এবং পিছনের দুই পা তুলনামূলকভাবে লম্বা। দেখে মনে হয় কোনো এক ধরনের অপুষ্টির কারণে দেহের লোম ঝরে গেছে। মুখমণ্ডল গোলাকার এবং বানর বা মানুষের সাথে মুখমণ্ডলের মিল রয়েছে। রাহান একটু অবাক হয়ে হাজীবের দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, এটি কোন প্রাণী?
হাজীব মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, মানুষ।
রাহান বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে ওঠে এবং আবার মাথা ঘুরিয়ে ছোট ফুটো দিয়ে উঁকি দিল এবং আতঙ্কে শিউরে উঠে আবিষ্কার করল সত্যিই এই প্রাণীগুলো মানুষ। সে ফ্যাকাসে মুখে হাজীবের দিকে তাকিয়ে বলল, এই মানুষগুলো এরকম কেন?
আমি আইডিয়াটি পেয়েছিলাম একটি বিশেষ ঘটনা থেকে। প্রাচীন ভারতবর্ষে একটি নেকড়ে বাঘের গর্তে দুটি মেয়ে পাওয়া গিয়েছিল। একটির বয়স ছিল সাত–আট, অন্যটি আরো একটু বড়, বারো–তের। নেকড়ে বাঘ তাদেরকে গ্রাম থেকে ধরে এনে বড় করেছিল। মানুষেরা তাদের উদ্ধার করে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু কোনো লাভ হয়। নি। শৈশব নেকড়ে বাঘের সাথে কাটানোর জন্যে তারা বন্য পশুর মতোই থেকে গিয়েছিল। মানুষের কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না। চারপায়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটত, কাঁচা মাংস খেত, গায়ে কাপড় রাখত না, তীক্ষ্ণ ছিল ঘ্রাণশক্তি–এক কথায় পুরোপুরি বন্য পশু!
হাজীব একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মানুষের বাচ্চা দুটিকে উদ্ধার করে তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল অমলা আর কমলা। কিন্তু ঐটুকুই ছিল তাদের একমাত্র মানুষের পরিচয়।
রাহান এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে হাজীবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাজীব মুখে তার সেই ভয়ংকর অস্পষ্ট হাসিটা ফুটিয়ে বলল, ঘটনাটি শুনে আমার মনে হয়েছিল ইতিহাসে যদি এরকম একটি ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে কি আমরা আরো তৈরি করতে পারি না?
রাহান হতচকিত হয়ে হাজীবের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি তুমি এদের তৈরি করেছ?
হ্যাঁ। হাজীব মাথা নাড়ল, বলল, কাজটি খুব সহজ হয় নি। অনেক শিশু নষ্ট হয়েছে। সব নেকড়ে–মাতাই যে মানবশিশুকে নিজের শিশু হিসেবে বড় করতে চায় সেটা সত্যি নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা পেরেছিএখানে পাঁচটি নেকড়ে–মানব আছে। দুটি ছেলে, তিনটি মেয়ে। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি এদের সন্তানেরা কীরকম হয় দেখার জন্যে।
রাহান ভয়ংকর একটি আতঙ্ক নিয়ে হাজীবের দিকে তাকিয়ে রইল। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি কি সত্যিই মানুষ নাকি একটি দানব হঠাৎ করে এই ব্যাপারটি নিয়ে তার সন্দেহ হতে থাকে।
হাজীব দুই পা হেঁটে বলল, আমার মনে হল, মানবশিশু যদি নেকড়েকে দিয়ে পালন করানো যায়, তাহলে অন্য পশু কেন নয়। তখন আমি পরীক্ষা শুরু করেছি। বাঘ, কুকুর, শিম্পাঞ্জি এমনকি ডলফিন।
ডলফিন?
হ্যাঁ। ঐপাশে পানির একটা ছোট হ্রদ আছে, সেখানে তিনজন ডলফিন শিশু থাকে। পানির নিচে সাঁতার কাটে, কাঁচা মাছ খায়। দেখে কেউ বলতেও পারবে না যে তারা আসলে ডাঙার প্রাণী। আমি পুরো বিবর্তনকে উল্টোদিকে প্রবাহিত করতে শুরু করেছি!
হাজীব শব্দ করে হাসল এবং রাহান হঠাৎ করে আবার আতঙ্কে শিউরে উঠল। হাজীব একটা বড় পাথরে বসে বলল, যাও রাহান, তুমি ঘুরে ঘুরে দ্যাখ। আমি এখানে অপেক্ষা করি। আমার মনে হয় শিম্পাঞ্জি–শিশুটিকে তুমি পছন্দই করবে–দেখে মনে হয় বিবর্তনের ফলে মাটিতে নেমে আমরা বুদ্ধিমানের কাজ করি নি। গাছটাই বুঝি ভালো ছিল?
রাহান শুষ্কমুখে বলল, আমার দেখার ইচ্ছে করছে না।
না করলে কেমন করে হবে? তুমি একজন অকুতোভয় ন্যায়নিষ্ঠ সাংবাদিক। তুমি এটি দেখবে না? যাও, দেখে আস। কারণ তুমি এই সবগুলো দেখে এলে আমি আমার সর্বশেষ আবিষ্কারটি দেখাব।
কী আবিষ্কার?
হাজীব মাথা নাড়ল, বলল, সেটা আমি আগেই বলব না। রাহান তুমি বুঝতে পারছ যে তুমি কতবড় সৌভাগ্যবান মানুষ। আমার এই চিড়িয়াখানায় এর আগে কোনো মানুষ আসে নি। এটি আমার খুব ব্যক্তিগত জায়গা। যখন কোনোকিছু নিয়ে আমার খুব মেজাজ খারাপ হয় তখন আমি এখানে আসি। এই পশু–শিশুগুলো দেখলে আমার স্নায়ুগুলো নিজে থেকে শীতল হয়ে আসে। আমি মাঝে মাঝে এসে এক সপ্তাহ–দুসপ্তাহও থাকি। ঐপাশে আমার একটা ছোট ঘর আছে। এটা হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত আনন্দভূমি। এখানে আজ আমি তোমাকে এনেছি তুমি উপভোগ না করলে কেমন করে হবে?
রাহান মাথা নাড়ল, বলল, না হাজীব–আমার পক্ষে এটা উপভোগ করা সম্ভব নয়।
কিন্তু তুমি সাংবাদিক আমার সম্পর্কে তুমি যদি পূর্ণাঙ্গ একটা রিপোর্ট লিখতে চাও তাহলে কি পুরোটা দেখা উচিত নয়?
হাজীবের কথায় শ্লেষটুকু ধরতে রাহানের কোনো অসুবিধে হল না এবং হঠাৎ করে সে এক অমানুষিক ধরনের আতঙ্কে শিউরে ওঠে। হাজীব রাহানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে। তুমি যদি দেখতে না চাও তোমাকে আমি জোর করে দেখাতে পারব না। তবে আমার শেষ আবিষ্কারটি তোমাকে দেখতে হবে।
তোমার আবিষ্কারটি কী?
বলতে পার এ ব্যাপারে আমরা গুরু হচ্ছে ড. ম্যাঙ্গেলা। নাৎসি জার্মানির একজন ডাক্তার। মানুষকে নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর পরীক্ষাগুলো করেছিলেন তিনি।
সুন্দর?
হ্যাঁ। সাধারণ মানুষ ভীতু। জৈব পরীক্ষাগুলো করে পশুপাখিদের ওপর। কিন্তু সরাসরি মানুষের ওপর পরীক্ষা করার মতো আনন্দ আর কোথায় পাবে। ড, ম্যাঙ্গেলা সেই পরীক্ষা করতেন। তাদের বিকলাঙ্গ করতেন, অত্যাচার করতেন। তার কোনো সংকোচ ছিল না।
রাহান নিশ্বাস আটকে বলল, তুমিও করেছ?
হ্যাঁ। আমি শুরু করেছি। প্রথম পরীক্ষাটি খুব সহজ। মানবশিশুদের যদি জন্মের পর থেকে অন্ধকারে রেখে দেওয়া হয় তাহলে কী হবে?
তুমি সেই পরীক্ষাটি করেছ?
হ্যাঁ! একডজন শিশুকে আমি পুরোপুরি অন্ধকারে বড় করেছি। আলো কী তারা জানে না–তারা কখনো সেটা দেখে নি।
তুমি তাদের কেমন করে দ্যাখ?
ইনফ্রারেড ক্যামেরা দিয়ে। এই দ্যাখ।
হাজীব একটু এগিয়ে গিয়ে একটা সুইচ স্পর্শ করতেই বড় একটা স্ক্রিনে কিছু ছবি ভেসে উঠল। বড় বড় চুল, বড় বড় নখ, বুনো পশুর মতো নানা বয়সী কিছু মানুষ ইতস্তত হাঁটছে, মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে খাবার খাচ্ছে, তাদের দৃষ্টিশক্তি নেই কিন্তু তারা সেটি জানে না।
এই মানুষগুলোর স্পর্শশক্তি ভয়ংকর প্রবল। ঘ্রাণশক্তিও অনেক বেশি। দৃষ্টিশক্তি ব্যবহার না করে থাকার মাঝে কোনো অসুবিধে আছে বলেই মনে হয় না।
রাহান হঠাৎ করে ঘুরে হাজীবের দিকে তাকাল, বলল, তুমি কেন আমাকে এসব দেখাচ্ছ?
কারণ আমি তোমাকে এখানে রেখে যাব।
রাহান বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, কী বললে!
হ্যাঁ।
এই অন্ধকারের মানুষের কাছে আমি তোমাকে রেখে যাব। আমার খুব কৌতূহল একজন নতুন অতিথি পেলে তারা কী করে সেটা দেখার।
তুমি কী বলছ এসব!
ঠিকই বলছি। নির্বোধ আহাম্মক একটা সাংবাদিককে একটা কাজে ব্যবহার করা যাক। কী বলো?
রাহান বিস্ফারিত চোখে দেখল হাজীবের হাতে ছোট একটি রিভলবার। হাজীব মুখে তার সেই ভয়ংকর হাসিটি ফুটিয়ে বলল, তোমাকে এখনই ঠিক করতে হবে তুমি কী করবে? একটু বাধা দিলেই আমি তোমাকে গুলি করব। এটি আমার জগৎ–এখানে আমি ছাড়া কেউ আসে না। কেউ জানবে না কী হয়েছে।
হাজীব কথা শেষ করার আগেই রাহান তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং হাজীব এতটুকু দ্বিধা না করে রিভলবারের পুরো ম্যাগজিনটি তার উপরে শেষ করল। গুলির শব্দ গ্রানাইটের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয় এবং পশু হিসেবে বেড়ে-ওঠা মানবশিশুগুলো আতঙ্কিত হয়ে ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। রাহানের দেহ একটা বড় পাথরের ওপর ছিটকে পড়ে।
হাজীব একটা নিশ্বাস ফেলে রিভলবারটি তার পকেটে রেখে গাড়ির কাছে ফিরে যায়। সেখানে এক বোতল উত্তেজক পানীয় রাখা আছে তার স্নায়ুকে শীতল করার জন্যে এখন সেটি দরকার। সে বহুদিন পর কাউকে নিজের হাতে খুন করল, একধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করল হত্যাকাণ্ডের প্রক্রিয়াটিতে সে একধরনের প্রশান্তি অনুভব করছে।
উত্তেজক পানীয়টির দ্বিতীয় ঢোক খাওয়ার পর হঠাৎ করে তার মনে একটি খটকা লাগল। রাহানের শরীরে ছয়টি গুলি লাগার পরও শরীরে সে পরিমাণ রক্ত বের হল না কেন। সন্দেহ নিরসনের জন্যে সে পিছনে ফিরে তাকাল–কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। রাহান নিঃশব্দে উঠে এসে তাকে পিছন থেকে আঘাত করেছে– এক টুকরো পাথর অত্যন্ত আদিম অস্ত্র, কিন্তু এখনো সেটি চমৎকার কাজ করে।
রাহান হাজীবের অচেতন দেহের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমাকে তুমি যত আহাম্মক ভেবেছিলে আমি তত আহাম্মক নই। আমার গায়ে ক্যাভলারের একটা বুলেটপ্রুফ ভেস্ট লাগানো আছে–তোমার সাথে এমনি দেখা করতে আমার সাহস হয় নি।
রাহান হাজীবের অচেতন শরীরটি টেনে অন্ধকার জগতের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। অন্ধকার-জগতের মানুষেরা নতুন অতিথি পেলে কী করে সেটি জানার হাজীবের খুব কৌতূহল ছিল। কিছুক্ষণেই তার জ্ঞান ফিরে আসবে–এই কৌতূহলটি সে মিটিয়ে নেবে তখন।
হাজীবের এই চিড়িয়াখানার কথা কেউ জানে না। তাকে উদ্ধার করতে কেউ আসবে না। নিজের সৃষ্টির সাথে সে তার জীবনের বাকি অংশটুকু কাটিয়ে দেবে।
কে জানে ড. ম্যাঙ্গেলাকে নিয়ে তার ধারণার পরিবর্তন হবে কিনা!