০৫. সামবেদীয় জাতকৰ্ম *
পুত্র ভূমিষ্ঠ হইবামাত্র পিতা “নাভিচ্ছেদন করিও না, স্তন্য দিও না” এই বলিয়া স্নান ও বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ সম্পাদন পূৰ্ব্বক ব্ৰহ্মচারী, কুমারী, গর্ভবতী অথবা শ্রুতস্বাধ্যায়শীল ব্রাহ্মণ দ্বারা প্রক্ষালিত শিলাতলে অনাবৃত্ত লোষ্ট্রযোগে পিষ্ট ব্রীহিযবচূর্ণ দক্ষিণ হস্তের অনামিকা ও অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা গ্রহণ করিয়া “ওঁ প্রজাপতিঋষিরন্নং দেবতা ব্রীহিযবচুর্ণেন কুমারস্য জিহ্বামার্জনে বিনিয়োগঃ। ওঁ ইয়মাজ্ঞেদমন্নমিদমায়ুরিদমমৃতং” এই মন্ত্রে অর্থাৎ “এই অন্নই প্রজ্ঞা, ইনিই আয়ুঃ, ইনিই অমৃত; তোমার ঐ সকল লাভ হউক্।” এই মন্ত্র পাঠ করির কুমারের জিহ্বা মার্জন করিবে।১।
অনন্তর তদ্রুপ স্বর্ণ দ্বারা ঘৃষ্ট ঘৃত লইয়া “ওঁ প্রজাপতিঋষিরনুষ্টুপ্ছন্দো মিত্রাবরুণাগ্ন্যশ্বিনো দেবতাঃ কুমারস্য সর্পিঃপ্রাশনে বিনিয়োগঃ। ওঁ মেধান্তে মিত্রাবরুণৌ মেধামগ্নির্দধাতু তে। মেধান্তে অশ্বিনৌ দেবাবাধত্তাং পুষ্করস্রজৌ স্বাহা।” এই মন্ত্রে অর্থাৎ “মিত্রাবরুণ দেবতাযুগল তোমাকে মেধা প্রদান করুন, অগ্নি তোমাকে মেধা প্রদান করুন এবং পদ্মমাল্যধারী অশ্বিনীকুমারদ্বয় তোমাকে মেধা দান করুন।” এই মন্ত্র পাঠ করিয়া পূৰ্ব্ববং কুমারের জিহ্বা মার্জনা করিবে । ২।
তৎপরে পুনৰ্ব্বার পূর্ববৎ স্বর্ণঘৃষ্ট ঘৃত লইয়া “প্রজাপতিঋষির্গায়ত্রীচ্ছন্দ ইন্দ্রো দেবতা কুমারস্য সর্পিঃপ্রাশনে বিনিয়োগঃ। ওঁ সদসম্পতিমদ্ভুতং প্রিয়মিন্দ্রস্য কাম্যং সনিং মেধা ময়াশিষং স্বাহা৷ ” এই মন্ত্রে অর্থাৎ “বৃহস্পতি ইন্দ্রের বিচিত্ররূপ প্রিয়পাত্র এবং তাঁহার বাঞ্ছিতার্থসাধক ও মেধাদাতা, তাঁহার নিকটেও প্রার্থনা করি, তিনি তোমাকে মেধা সমৰ্পণ করুন।” এই মন্ত্র পাঠ করিয়া পূৰ্ব্ববৎ কুমারের জিহ্বা মার্জন বা স্পর্শ করিবে। ৩। +
তৎপরে “নাভিচ্ছেদন কর, স্তন্য দেও” এই কথা বলিয়া পিতা পুনৰ্ব্বার স্নান সম্পাদন করিবেন।
ইতি সামবেদীয় জাতকৰ্ম্ম সমাপ্ত ।
——————
* শৈশব সংস্কারের প্রথম সংস্কারকে জাতকৰ্ম্ম কহে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হইবামাত্র এই সংস্কার সম্পন্ন করিতে হয়। এই সংস্কারের কার্য এই যে, পি্তা প্রথমতঃ যব ও ব্রীহিচূর্ণ দ্বারা পরে স্বর্ণ দ্বারা ঘৃষ্ট মধু এক ঘৃত গ্রহণ পূর্বক সদ্যোজাত সন্তনের জিহা স্পর্শ করিয়া থাকেন। তৎকালে যে মন্ত্র উচ্চৰ্য্য হয়, তাহার প্রকৃত মন্ত্র উচ্চার্য্য হয়, তাহার প্রকৃত মর্ম হৃদয়ঙ্গম করিলেই এই সংস্কারের আবশ্যকতা ও পবিত্র ভাব স্পষ্ট উপলব্ধি হইবে ।
+ এই যে মন্ত্র কথিত হইল, সূক্ষ্মরূপে বিবেচনা করিলে স্পষ্টই প্রতীয়মান হইবে যে, মন্ত্রের প্রথম ভাগে একটী বৈদিক বা সুগভীর বৈজ্ঞানিক তথ্যের পরম বিকাশ হইতেছে। শেষভাগ হইতে জনক, জননী ও গোষ্ঠ-সম্প্রদায় সকলেই জানিতে পারিলেন যে, বিপ্রসন্তানের পক্ষে ধন প্রভৃতির জন্য; প্রার্থনা নাই ; অধিকন্তু আয়ুর নিমিত্ত প্রার্থনাও একবারমাত্র ; কিন্তু মেধা বা ধারণাবতী বুদ্ধির নিমিত্ত প্রার্থনা পুনঃ পুনঃ হইতেছে। সুতরাং বিপ্রসন্তানের পালন যে উদ্দেশে হওয়া উচিত, তাহার সূচনা এই প্রথম সংস্কার হইতেই উপলব্ধি হইতেছে । আরও দেখ, এই সংস্কারে ভূমিষ্ঠ সন্তানের জিহ্বাতে স্বর্ণঘৃষ্ট ঘৃত এবং যব ও ব্রীহিচূর্ণ স্পর্শের নিয়ম নিদিষ্ট আছে। স্বর্ণঘৃষ্ট ঘৃতের যে বহুবিধ গুণ, তাহা আমাদিগের আয়ুৰ্ব্বেদেই দৃষ্ট হইতেছে। স্বর্ণ দ্বারা বায়ুদোষের দমন হয়, প্রস্রাব পরিস্কার হয় এবং উহা রক্তের উৰ্দ্ধগতিত্ব-দোষ বিনাশ করে। ঘৃত দ্বারা শৌচ পরিষ্কার হয়, বলাধান হয় এবং শরীরের তাপবৃদ্ধি হইয়া থাকে। এই সংস্কারে প্রায় সৰ্ব্বত্রই স্বর্ণঘৃষ্ট ঘৃত ও মধু সন্তানের জিহাতে স্পৃষ্ট হুইয়া থাকে। মধুতেও বহুবিধ গুণ বিদ্যমান আছে। মধু দ্বারা পিত্তকোষের ক্রিযা বর্দ্ধিত হয়; মুখে লালার সঞ্চার হয় এবং কফ-দোষের দমন হইয়া থাকে। সদ্যোজাত সন্তানের পক্ষে এই সকল দ্রব্য যে কতদূর উপকারী, তাহা সহজেই উপলব্ধি হইতে পারে। প্রসবযন্ত্রণাবশতঃ সদ্যোজাত সন্তানের শোণিত ঊর্দ্ধগামী হয়, দেহে কফাধিক্য জন্মে এবং অন্ত্রাভ্যন্তরে একরূপ কৃষ্ণমলের সঞ্চার হয়। যদি সেই মল নির্গত না হয়, তাহা হইলে অশেষবিধ রোগ জন্মিবার সম্ভব। স্বর্ণঘৃষ্ট মধু ও ঘৃত জিহ্বায় প্রদান করিলে উপরোক্ত দোষসমূহের বিদূরণ হয় এবং সন্তানের রোগ জন্মিবার আশঙ্কা থাকে না।