০৪. বিরক্ত ও উদ্বিগ্ন লীনা

বিরক্ত ও উদ্বিগ্ন লীনা রাগের গলায় বলল, না, আমার পিস্তল নেই। কিন্তু আপনি কে? এ ঘরে

আপনার কী দরকার?

ছেলেটা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, পিস্তল আমারও নেই। কিন্তু আমার যা কাজ তাতে একটা পিস্তল থাকলে ভাল হত। আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ।

লীনা অবাক হয়ে ছেলেটাকে ভাল করে দেখল। বয়স পঁচিশের মধ্যেই। ছিপছিপে খেলোয়াড়োচিত মেদহীন চেহারা। তবে বুদ্ধির বিশেষ ছাপ নেই মুখে। মুখশ্রী বেশ ভাল। পরনে জিনস আর একটা সাদা কুর্তা।

লীনা টেবিল থেকে ইন্টারকম টেলিফোনটা তুলে নিয়ে বলল, আপনি যে-ই হোন, ট্রেসপাসার। আমি অফিস সিকিউরিটিকে ফোন করছি। যা বলার তাদের কাছে বলবেন।

প্লিজ! কথাটা শুনুন।

কী কথা?

আমি ট্রেসপাসার ঠিকই, কিন্তু আমার কোনও খারাপ মতলব ছিল না।

লীনা ভ্রু কুঁচকে বলল, আপনি অফিসের টপ সিকিউরিটি জোনে ঢুকেছেন। আপনি এ ঘরে ঢুকে সার্চ করছিলেন। আপনাকে পুলিশে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই।

ছেলেটা একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে কাহিল গলায় বলল, কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর কাজ করতেই যে আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছিল!

লীনা ভ্রু কুঁচকেই ছিল। গম্ভীর গলায় বলল, কী কাজ?

বলাটা কি ঠিক হবে?

তা হলে সিকিউরিটিকে ডাকতেই হয়।

বলছি বলছি। কিন্তু প্লিজ, আমাকে বিপদে ফেলবেন না।

লীনা ফোনটা রেখে দিয়ে বলল, যা বলার সংক্ষেপে বলুন।

ছেলেটা রীতিমতো ঘামছিল। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে বলল, আমি একজন লাইসেন্সড প্রাইভেট ডিটেকটিভ।

শুনেছি। তারপর?

আমার অফিসটা ত্রিশ নম্বর ধর্মতলায়।

লীনা একটা প্যাড টেনে চট করে নোট করে নিতে লাগল।

প্রায় এক বছর হল অফিস খুলে বসে আছি। মক্কেল জোটে না। বেকার মানুষ, কী আর করব! তবে বুঝতে পারছিলাম এ দেশে ডিটেকটিভদের ভাত নেই। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই ডিটেকটিভ হওয়ার বড় শখ ছিল। গাদা গাদা গোয়েন্দা গল্প পড়ে পড়ে–

আপনার জীবনটা সংক্ষেপ করে কাজের কথায় আসুন।

আসছি। বলছিলাম যে, অনেকদিন কাজকর্ম কিছু জোটেনি। হঠাৎ কাল সকালে অফিসে এসে একখানা খাম পেলাম। ভিতরে পাঁচটা একশো টাকার নোট। আমার নিজস্ব কোনও বেয়ারা বা অফিস বয় নেই। একজন ভাগের বেয়ারা জল-চা এনে দেয়। কে যে খামটা কখন রেখে গেছে তা সে বলতে পারল না।

খামের ওপর আপনার নাম লেখা ছিল?

ছিল। টাইপ করা।

তারপর?

কাল বিকেলের দিকে একটা ফোন এল। আমার নিজস্ব ফোনও নেই। পাশে একটা সাপ্লায়ারের অফিস আছে, তাদের ফোন। ফোন ধরতেই একটা গম্ভীর গলা বলে উঠল, টাকাটা পেয়েছেন? আমি বললাম, হ্যাঁ, কিন্তু কিসের টাকা? লোকটা বলল, আরও টাকা রোজগার করতে চান? বললাম, চাই। লোকটা তখন বলল, তা হলে একটা ঠিকানা দিচ্ছি। সেখানে কাল সকাল ন’টার মধ্যে চলে যাবেন। ববি রাষ নামে একজনকে খুব নিখুঁতভাবে খুন করতে হবে।

লীনার হাত থেকে ডটপেনটা খসে পড়ে গেল।

ছেলেটা আবার রুমালে কপাল মুছল। একটু কাঁপা গলায় বলল, ম্যাডাম, সবটা আগে শুনুন।

লীনা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, বলুন।

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, এ কাজ আমি পারব না। লোকটা বলল, পারতে হবে। নইলে বিপদে পড়বেন। কাজটা খুব সোজা। ন’টা থেকে দশটা অবধি ববি রায় একা থাকে। তার সেক্রেটারি আসে দশটায়। ঘরে ঢোকবার সময় দরজায় নক করবেন না। সোজা ঢুকে পড়বেন। তখন ববি রায় নিশ্চয়ই খুব মন দিয়ে কোনও কাজ করবে। আপনাকে লক্ষও করবে না। ববি রায়, বাস্তব জগতে কমই থাকে। একখানা ভাল ড্যাগার নিয়ে যাবেন, দুদিকে ধারওয়ালা। পেটে বা বুকে পুশ করবেন। বডিটা ডেস্কের তলায় ঢুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসবেন। হাতে অবশ্যই দস্তানা পরে নেবেন।

আপনি রাজি হলেন?

ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, না। রাজি হচ্ছিলাম না। কিন্তু লোকটা বলল, কাজটা আপনি করবেন বলে ধরে নিয়ে আমরা অলরেডি পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। টেবিলে ফিরে গিয়ে আপনি টাকাটা পেয়ে যাবেন। বলেই ফোনটা কেটে দিল।

পেয়েছিলেন?

ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, পেয়েছিলাম। সাদা খামে কড়কড়ে পাঁচ হাজার টাকা। বেয়ারা এবারও বলতে পারেনি খামটা কে রেখে গেল। বলা সম্ভবও নয়। ও বাড়িতে পায়রার খোপের মতো রাশি রাশি অফিস, হাজার লোকের আনাগোনা।

টাকাটা পেয়ে আপনি কী ঠিক করলেন?

কী ঠিক করব? আমি জীবনে কখনও খুনখারাপি করিনি। মিস্টার রায়কে খুন করার জন্য আমাকে কেন লাগানো হল আমি তাও বুঝতে পারছি না। তবে আমার কৌতূহল হয়েছিল। খুব কৌতূহল। আমি ঠিক করলাম, আজ এসে ববি রায়ের সঙ্গে দেখা করে যাব। লোকটা কে বা কী, কেন ওকে খুন করার জন্য এত টাকা কেউ খরচ করতে চাইছে তা জানার জন্যই আজ আমি এসেছিলাম। এসে শুনলাম উনি নেই। তাই–

তাই তাঁর ঘরে ঢুকে পড়লেন?

ছেলেটা একটুও লজ্জা না পেয়ে বলল, ওই একটা কাজ আমি খুব ভাল পারি। মশামাছির মতো যে-কোনও জায়গায় ঢুকে যেতে পারি। কেউ আমাকে আটকাতে পারে না।

বুঝলাম। কিন্তু এ ঘরে আপনি কী খুঁজছিলেন?

ওটা আমার একটা মুদ্রাদোষ। যেখানেই যাই সেখানেই কাগজপত্র নথি খুঁজে দেখা আমার স্বভাব। কী যে খুঁজছি তা ভাল করে জানিও না।

লীনা মাথা নেড়ে বলল, আপনার কথা আমি একটুও বিশ্বাস করছি না।

অবিশ্বাস্যই বটে। কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু এই আমার কার্ড দেখুন। খোঁজখবর নিন। আমি জেনুইন ইন্দ্রজিৎ সেন, প্রাইভেট ডিটেকটিভ।

আপনি অপেক্ষা করুন। সিকিউরিটি এসে আপনাকে সার্চ করবে।

সার্চ! সে তো আপনিই করতে পারেন। এই দেখুন না! বলে ইন্দ্রজিৎ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে পকেটের সামান্য কয়েকটা জিনিস বের করে টেবিলে রাখল। মানিব্যাগ, চাবি, রুমাল, নামের কার্ড, ডটপেন, আতস কাচ আর অ্যান্টাসিড ট্যাবলেটের একটা স্ট্রিপ।

এ ছাড়া আমার কাছে কিছু নেই। আপনি দেখতে পারেন খুঁজে।

পুরুষমানুষের বডি সার্চ করা মেয়েদের পক্ষে শোভন নয়।

তা অবশ্য ঠিক। তবে আমাকে বিশ্বাস করলে ঠকবেন না।

লীনা বিশ্বাস করল না। ইন্দ্রজিতের কার্ডে ছাপা ফোন নম্বরে ডায়াল করল।

ইউনাইটেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাপ্লায়ার্স।

লীনা শুনতে পেল একটা বেশ ভিড়াক্রান্ত অফিসের গণ্ডগোল ভেসে আসছে ফোনে। সে একটু উঁচু গলাতেই জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, মিস্টার ইন্দ্রজিৎ সেনকে একটু ডেকে দিতে পারেন?

ধরুন, দেখছি।

লীনা ফোন ধরে রইল।

একটু বাদেই গলাটা বলল, না এখনও আসেনি। কিছু বলতে হবে?

না, ধন্যবাদ। আপনাদের অফিসটা কত নম্বর ধর্মতলায়?

ত্রিশ নম্বর।

ধন্যবাদ।

লীনা ফোনটা রেখে দিল।

ইন্দ্রজিৎ তার দিকে চোরের মতো চেয়ে ছিল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, বিশ্বাস করলেন?

না। ওই ফোন নম্বরে হয়তো আপনার লোকই বসে আছে। অথবা ইন্দ্রজিৎ সেনের নাম ভাঁড়িয়ে আপনি অন্য কেউ হতে পারেন।

ছেলেটা বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, তা তো হতেই পারে। হয়ও।

লীনা মৃদু একটু হেসে বলল, তা হলে আমার এখন কী করা উচিত?

উচিত পুলিশে দেওয়া। কিন্তু আমি তো কিছুই লুকোইনি। ইচ্ছে করলে আপনি আমার সঙ্গে এখন আমার অফিসে গিয়ে ঘুরে আসতে পারেন। সেখানে অন্তত একশোলোক আমাকে জেনুইন ইন্দ্রজিৎ সেন বলে আইডেনটিফাই করতে পারবে।

নিতান্তই ছা-পোষা চেহারার এই লোকটাকে আর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে ইচ্ছে হল না লীনার। তবে সে একে একেবারে ছেড়েও দেবে না। লীনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে। আমি পরে খোঁজ নেব। আপনি আসুন।

লোকটা দরজা খুলে বেরিয়ে যেতেই লীনা সিকিউরিটিকে ফোন করল, ববি রায়ের সেক্রেটারি বলছি। জিনস আর সাদা কামিজ পরা একজন বছর পঁচিশের লোক এইমাত্র বেরিয়ে গেল। তাকে আটকান। সার্চ হিম, ক্রস একজামিন হিম প্রপারলি। আইডেনটিফাই করুন। ভেরি আর্জেন্ট।

লীনা উঠে দরজাটা লক করল। তারপর সুইচ টিপে ভিডিয়ো ইউনিটটা বের করে আনল গুপ্ত চেম্বার থেকে। তারপর কোড দিল, বয়ফ্রেন্ড।

পরদায় ফুটে উঠল, নো অ্যাকসেস। ট্রাই সেকেন্ড কোড।

লীনা চাবি টিপল, বার্থ ডে।

পরদায় ফুটল, নো অ্যাকসেস। ট্রাই থার্ড কোড।

লীনা আবার কোড দিল, আই লাভ ইউ।

পরদায় ফুটে উঠল, কনগ্রাচুলেশনস, ইউ হ্যাভ ডান ইট।

এর মানে কী কিছুই বুঝতে পারল না লীনা। দাঁতে দাঁত চেপে রাগে সে ফুঁসতে লাগল। ববি রায় কোনও প্র্যাকটিক্যাল জোক করে গেছেন কি?

নো অ্যাকসেস! লীনা টপ করে লেখাটা মুছে চাবি টিপল, নো অ্যাকসেস।

পরদায় ফুটে উঠল, দ্যাটস ক্লেভার অফ ইউ মিসেস ভট্টাচারিয়া!

লীনা দু’হাতে কপাল চেপে ধরে বলল, ও গড। লোকটা কী ভীষণ পাজি।

স্কাউন্ড্রেল! স্কাউন্ড্রেল!

ভিডিয়ো ইউনিটটা আবার যথাস্থানে নামিয়ে দিয়ে লীনা ববি রায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের চেম্বারে বসল। ভাবতে লাগল। মাথাটা গরম। কান ঝাঁ ঝা করছে।

ফোনটা বাজতেই তুলে নিল লীনা, হ্যালো।

সিকিউরিটি বলছি। লোকটার নাম ইন্দ্রজিৎ সেন। সার্চ করে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। বাড়ি পাইকপাড়ায়, অফিস ধর্মতলায়। লোকটার বিরুদ্ধে কোনও স্পেসিফিক চার্জ থাকলে বলুন, পুলিশে হ্যান্ডওভার করে দেব।

নেই। ওকে ছেড়ে দিন।

লীনা কিছুক্ষণ ভূতগ্রস্তের মতো বসে রইল। তারপর উঠে আবার ববি রায়ের ঘরে ঢুকল। দরজা লক করে ভিডিয়ো ইউনিট নিয়ে বসে গেল। বয়ফ্রেন্ড। বার্থ ডে। আই লাভ ইউ। নো অ্যাকসেস।

পরপর একই উত্তর দিয়ে গেল যন্ত্র।

শেষ উত্তরটার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল লীনা, দ্যাটস ক্লেভার অফ ইউ মিসেস ভট্টাচারিয়া।

একটু বিদ্রুপ আর তাচ্ছিল্য মেশানো মন্তব্যটা বিছের হুলের মতো বিধে রইল লীনার মনের মধ্যে। হামবাগ, ইনসোলেন্ট, মেগালোম্যানিয়াক।

বেশ কিছু চিঠিপত্র টাইপ এবং কয়েকটা মেসেজ পাঠানোর ছিল লীনার। বসে বসে চুপচাপ কাজ করে গেল। টিফিন খেল। এরই ফাঁকে একবার অ্যাকাউন্টসে ফোন করল। যে-কোনও অফিসারের গতিবিধি অ্যাকাউন্টসই দিতে পারে। ওদের কাছে সকলের টিকি বাঁধা।

মিস্টার রায় কি কলকাতায় নেই? উনি আমার জন্য কোনও মেসেজ রেখে যাননি।

হ্যাঁ, উনি আজ ভোরের ফ্লাইটে বম্বে গেছেন। তারপর ইউরোপে যাচ্ছেন আজ রাতে।

ইউরোপে কোথায়?

প্রথমে প্যারিস, তারপর আরও অনেক জায়গায়।

ধনাবাদ।

লীনা আরও কিছুক্ষণ কাজ করল। এক ফাঁকে ক্যাশ-কাউন্টার থেকে বেতন নিয়ে এল।

পাঁচটা বাজতে যখন পাঁচ মিনিট তখন রিসেপশন থেকে ফোন এল, দোলন এসেছে। অপেক্ষা করছে।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল লীনা। ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে নিয়ে উঠে পড়ল।

বেরোতে যাবে, ঠিক সেই সময়ে মারাত্মক ফোনটা এল।

হ্যাল্লো।

হ্যালো, আমি মিস লীনা ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

আমিই লীনা। বলুন।

আপনি ইন্দ্রজিৎ সেনকে চেনেন?

কে ইন্দ্রজিৎ?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ ইন্দ্রজিৎ সেন?

ওঃ হ্যাঁ। স্মল টাইম প্রাইভেট আই। কী ব্যাপার?

ব্যাপারটা সিরিয়াস। আমি ওর পাশের অফিসে কাজ করি। ইউনাইটেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাপ্লায়ার্স। আমি ওর বন্ধু। আজ দুপুরে অফিসে এসে ও আমাকে বলল, ওর যদি কিছু হয় তা হলে যেন আপনাকে একটা খবর দিই।

লীনা একটু শিহরিত হল, কী হয়েছে?

ইন্দ্র মারা গেছে।

হ্যাঁ।

দুপুরে কেউ এসে স্ট্যাব করে গেছে। দরজার তলা দিয়ে করিডোরে রক্ত গড়িয়ে আসায় আমরা টের পাই।

লীনার হাত কাঁপছিল। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। কোনওক্রমে জিজ্ঞেস করল, সত্যিই বেঁচে নেই?

না। অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছে। পুলিশ এসে একটু আগে ডেডবডি নিয়ে গেল। আপনি কি ওর কেউ হন?

না।

গলাটা একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল, আপনার সঙ্গে কোনও ইন্টিমেসি ছিল না?

মোটেও না। আজ সকালে মাত্র কয়েক মিনিটের আলাপ।

ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না। এগারোটা নাগাদ অফিসে এসে ও আমাকে করিডোরে ডেকে নিয়ে গিয়ে হাতে একটা চিরকুট দিয়ে বলে, আমার একটা বিপদ ঘটতে পারে। শোনো, যদি আমার কিছু হয় তা হলে এই চিরকুটে যার নাম আর ফোন নম্বর দেওয়া আছে তাকে একটা খবর দিয়ো। বোলো, উনি যেন আমার অফিসে একবার আসেন। কিন্তু কেন? আমি তো ওকে ভাল করে চিনতামও না।

জানি না, ম্যাডাম। তবে ও এমনভাবে কথাটা বলেছিল যাতে মনে হয়, আপনি ওর খুব কাছের কেউ। যাকগে, আপনি কি আসতে পারবেন?

লীনা অতি দ্রুত ভাবতে লাগল। কিন্তু কিছু স্থির করতে পারল না।

লোকটা নিজেই আবার বলল, শুনুন ম্যাডাম। আমি অফিসে সাড়ে ছ’টা অবধি থাকব। সাড়ে পাঁচটার পর অফিসে আমি ছাড়া আর কেউ থাকে না। ইন্দ্রজিতের ঘর পুলিশ সিল করে দিয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের অফিসের রেকর্ড-রুমের ভিতর দিয়ে ওর ঘরে যাওয়ার একটা ছোট ফোকব রয়েছে। পুলিশ ওটা দেখতে পায়নি।

কিন্তু আমি গিয়ে কী হবে তা তো বুঝতে পারছি না।

সে আপনি ঠিক করবেন। ইন্দ্রজিৎ আমার খুব বন্ধু ছিল। ওর শেষ অনুরোধ রাখতে আমি এই রিস্কটুকু নিতে পারি। যদি আপনি চান তা হলে ওর ঘরে ঢুকবার বন্দোবস্ত করে দিতে পারি।

আমি এখনই কিছু বলতে পারছি না।

ঠিক আছে। তবে জানিয়ে রাখলাম, আমি সাড়ে ছ’টা অবধি অফিসে থাকব। আমার নাম দুর্গাচরণ দাশগুপ্ত।

লীনা ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ অভিভূত হয়ে বসে রইল। এসব কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? সত্যিই মারা গেছে লোকটা? খুন!

লীনা টান হয়ে বসে কিছুক্ষণ নীরবে ব্রিদিং করল। তারপর উঠে পড়ল।

রিসেপশনে দোলন চোর-চোর মুখ করে বসে আছে। এই অফিসের ফান্ডা একটু বেশি। দোলন যখনই আসে তখনই অস্বস্তি বোধ করে। ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে সবসময়েই কাতর হয়ে থাকে। দোলন। ওই গহ্বর থেকে ওকে আজও টেনে বের করতে পারেনি লীনা।

দু’জনে নীরবে বেরিয়ে এল। বাইরে রোদ মরে আসছে। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে একটু।

দোলন।

উঁ!

একটা জায়গায় যাবে?

কোথায়?

ধর্মতলা স্ট্রিটের একটা অফিসে।

ধর্মতলায় আবার তোমার কী কাজ?

লীনা মাথা নেড়ে বলল, কী যে কাজ তা জানি না। কিন্তু চলোই না। তুমি থাকলে ভাল হবে।

আজ আমাদের কী প্রোগ্রাম ছিল, লীনা?

গঙ্গার ধারে বেড়ানো, পার্ক স্ট্রিটে ডিনার।

সেগুলো কি বাতিল করছ?

আরে না, বাতিল করব কেন? ধর্মতলায় আমার কয়েক মিনিটের কাজ। তুমি গাড়িতে বসে থেকো। আমি চট করে ঘুরে আসব।

তোমার ওই ভুতুড়ে গাড়িতে একা বসে থাকব! ও বাবা!

চাবি খুলে নিলে গাড়ি কোনও কথা বলবে না। ভয় নেই।

ত্রিশ নম্বর ধর্মতলা খুঁজে বের করতে কোনও অসুবিধে হল না লীনার। বাড়িটা পুরনো। ভারী ঘিঞ্জি। সরু সিঁড়ি উঠে গেছে ঊর্ধপানে।

তিনতলার ল্যান্ডিং-এ উঠে লীনা ঘড়ি দেখল। পৌনে ছটা। বেশির ভাগ অফিসই বন্ধ। করিডোর নির্জন। শুধু শেষ প্রান্তে একটা ঘরে আলো জ্বলছে। বাইরে সাইনবোর্ড। ইউনাইটেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাপ্লায়ার্স। তার আগে আর-একখানা ঘর। তার বাইরে টুলের ওপর একজন পুলিশ বসে আছে। পুলিশ দেখে একটু সাহস হল লীনার।

লীনা দরজায় দাঁড়াতেই একটা লোক চমকে মুখ তুলে তাকাল। বয়স বেশি নয়। ইন্দ্রজিতের মতোই। স্বাস্থ্যহীন, রুগ্ন চেহারা। মুখখানায় গভীর বিষাদ।

আপনিই কি মিস ভট্টাচার্য?

হ্যাঁ।

আসুন।–লোকটা উঠে দাঁড়াল।

লীনা ঘরে ঢুকে চারদিকটা দেখল। চেয়ার-টেবিলে ছয়লাপ। অনেক স্টিলের আলমারি। অফিস-টফিস যেমন হয় আর কী!

লোকটা একটু ভীত গলায় বলল, ধরা পড়লে আমার জেল হয়ে যাবে, তবু ইন্দ্রর কথাটা ফেলতে পারছি না। আসুন, রেকর্ড-রুম ওই পিছন দিকে।

লীনার হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। না জেনেশুনে সে বোকার মতো কোনও ফাঁদে পা দিচ্ছে তো!

লোকটা অফিসের চেয়ার টেবিল আলমারি ক্যাবিনেট ইত্যাদির ফাঁক দিয়ে গোলক ধাঁধার মতো পথে লীনাকে একদম পিছন দিকে আর-একটা ঘরে এনে হাজির করল। দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে বলল, এই ঘর।

লীনা অবাক হয়ে দেখল, একটা বদ্ধ কুঠুরি। মেঝে থেকে সিলিং অবধি শুধু স্টিলের তাক। আর তাতে রাশি-রাশি ফাইলপত্র।

আসুন। বলে লোকটা দুটো তাকের মাঝখানে সরু ফাঁকের মধ্যে ঢুকে গেল। তারপর খুব সাবধানে কাঠের পার্টিশান থেকে একখানা পাটা সরিয়ে আনল।

এই দরজা। যাবেন ভিতরে? ভয় করছে না তো! আমার কিন্তু করছে।

লীনা অবিশ্বাসের চোখে ফাঁকটার দিকে চেয়ে থেকে বলল, ডেডবডি তো ভিতরে নেই।

না। তবে রক্ত আছে। মেঝেময়।

ও বাবা!

মিস ভট্টাচার্য, আমি বলি কি আপনি তবু একবার ভিতরটা ঘুরে আসুন। মনে হয় আপনাকে খুব জরুরি কিছু জানানোর ছিল ওর।

লীনা চোখ বুজে কিছুক্ষণ দম ধরে রইল। তারপর ফাঁকটা দিয়ে ইন্দ্রজিতের অফিসে ঢুকল। ছোট্ট একখানা ঘর। ছয় বাই আট হতে পারে। লীনাদের বাথরুমও এর চেয়ে ঢের বড়। ঘরে একখানা ডেস্ক আর একটা স্টিলের আলমারি।

পিছন থেকে দুর্গাচরণ ফিসফিস করে বলল, সাবধানে পা ফেলবেন।

লীনা সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ঘরে একটা গা-গুলোনো গন্ধ।

প্লিজ, কোনও শব্দ করবেন না। ডেস্কের নীচের ড্রয়ারে একটা লেজার বই আছে। ওর যা কিছু ইনফরমেশন ওটাতেই থাকত।

লীনা নিঃশব্দে ডেস্কের নীচের ড্রয়ারটা খুলল। লেজার বইটা বের করে আনল। দুর্গাচরণের রেকর্ড-রুমে ফিরে এসে পাতা ওলটাতে লাগল।

দুর্গাচরণ পাশেই দাঁড়িয়ে। তার শ্বাস কাঁপছে, হাত কাঁপছে।

লেজার বইটা একরকম ফাঁকা। প্রথম পাতাতেই একটা এন্ট্রি। জনৈক বি রায়ের কাছ থেকে পারিশ্রমিক বাবদ পাঁচশো টাকা পাওয়া গেছে। পর পর বি রায়ের নামে আরও কয়েকটা এন্ট্রি।

দুর্গাচরণ বলল, বি রায় ছিলেন, বলতে গেলে, ইন্দ্রজিতের একমাত্র মক্কেল।

বি রায় কে?

দুর্গাচরণ মাথা নেড়ে বলল, চিনি না! কখনও দেখিনি। তবে পুরো নাম ববি রায়।

ববি রায়!–লীনা অবাক গলায় প্রতিধ্বনি করল।

দুর্গাচরণ মাথা নেড়ে বলল, সম্ভবত লীনা ভট্টাচার্য নামে কোনও এক মহিলার পেছনে গোয়েন্দাগিরির জন্য ববি রায় ওকে কাজে লাগিয়েছিলেন।

মাই গড!

বোধহয় আপনিই!লীনা জবাব দিতে পারল না।