০৫. চতুর্থ প্রস্তাব [ধর্ম বিষয়ক]

চতুর্থ প্রস্তাব
[ধর্ম বিষয়ক]

১। আল্লাহ মানুষকে পরিবর্তন না করিয়া ঝঞ্ঝাট পোহান কেন?
আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি ইচ্ছা করিলে অসম্ভবও সম্ভব করিতে পারেন। মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য যদি ইহাই হয় যে, মানুষ তাঁহার এবাদত বন্দেগী করিবে, তাহা হইলে তিনি সমস্ত মানবকে দিয়া তাঁহার উদ্দেশ্য পালন করাইতে পারেন না কি? পারিলে তাহা না করিয়া তিনি মানুষের দ্বারা হেদায়েতের ঝঞ্ঝাট পোহান কেন? ইহাতে কি তাঁহার আসল উদ্দেশ্যের ব্যাঘাত ঘটিতেছে না? হযরত ইব্রাহিম, মুসা, ও মোহাম্মদ (দ.)-কে কোন মানুষ হেদায়েত করে নাই, করিয়াছেন আল্লাহতায়ালা। কিন্তু নমরুদ, শাদ্দাদ, ফেরাউন, আবু জাহেল ইত্যাদি কাফেরদিগকে তিনি হেদায়েত করিলেন না কেন? তিনি স্বেচ্ছায় হেদায়েত করিলেন না, না, করিতে পারিলেন না?

২। ভাগ্যলিপি কি অপরিবর্তনীয়?
যদিও মানুষ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অজ্ঞ, তবু কর্মফলে বিশ্বাস আছে বলিয়াই সে জগতের সকল রকম কাজকর্ম করিয়া যাইতেছে্ সমাজ ও রাষ্ট্র কর্মফলকে ভিত্তি করিয়াই গঠিত হইয়াছে এবং ‘কর্মফল আছে’ বলিয়াই উহারা টিকিয়া আছে। রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষকে শিক্ষা দিতেছে – কর্ম কর, ফল পাইবে। কিন্তু ধর্ম শিক্ষা দিতেছে ইহার বিপরীত। ধর্ম বলিতেছে – কর্ম করিয়া যাও, ফল অদৃষ্টে (তকদীরে) যাহা লিখিত আছে, তাহাই পাইবে। এক্ষেত্রে মানুষ কর্ম করিল বটে, কিন্তু ফল রহিল ভগবানের কাছে ভাগ্যলিপিতে নিবদ্ধ। মানুষ জানিল না যে, সে তাহার কাজের ফল পাইবে কি না। কর্মফলের নিশ্চয়তা থাকিলে সন্দিগ্ধ মনেও কাজ করা চলে। যেহেতু তাহাতে মানুষ ভাবিতে পারে যে, হয়ত সে তাহার কাজের ফল পাইতেও পারে। কিন্তু ধর্ম বলে – কর্ম যা কিছুই কর না কেন, ফল নির্ধারিত যাহা আছে, তাহাই পাইবে, একটুও এদিক ওদিক হইবে না। তাহই যদি হয়, অর্থাৎ কর্মের দ্বারা ভাগ্যলিপি পরিবর্তিত না হয়, তবে কর্ম করিয়া লাভ কি? বিশেষত মানুষের কৃত ‘কর্মের দ্বারা ফলোৎপন্ন’ না হইয়া যদি ঈশ্বরের নির্ধারিত ‘ফলের দ্বারা কর্মোৎপত্তি’ হয়, তবে ‘সৎ’ বা ‘অসৎ’ কাজের জন্য মানুষ দায়ী হইবে কেন? মনে করা যাক – কোন এক ব্যক্তির ভাগ্যলিপিতে লেখা আছে যে, সে ‘নারকী’। এখন সে নির্ধারিত ঐ ফলোৎপাদক কার্য, যথা – চুরি, ডাকাতি, নরহত্যা ইত্যাদি করিবে না কি? যদি করে, তবে তাহা সে কাহার ইচ্ছায় করে? নিজের ইচ্ছায়, না ভগবানের ইচ্ছায়? আর যদি সে কোন পাপ-কর্ম না করিয়া পুণ্য কর্মই করে, তবে তাহার ভাগ্যলিপির ‘নারকী’ শব্দটি কাটিয়া, স্বর্গবাসী এই শব্দটি লেখা হইবে কি? যদি না-ই হয়, তবে হেদায়েতের তম্বিটি কি লৌকিক? আর যদি হয়, তবে ভবিষ্যৎজান্তা ভগবান এই পরিবর্তনের সংবাদ পূর্বাহ্নে জানিয়া প্রথমবারেই অকাট্য তালিকা প্রস্তুত করেন নাই কেন?

ভাগ্যলিপি অপরিবর্তনীয় হইলে স্বয়ং ভগবানও উহা মানেন কি না। যদি না মানেন, তবে তিনি উহা লিখিয়াছিলেন কেন? আর যদি মানেন, তবে তিনি লিপি প্রস্তুতির সময় স্বাধীন হইলেও বর্তমানে স্বাধীন হন কিরূপে? ভগবানের বর্তমান কর্তব্য কি শুধু তালিকা দেখিয়া দেখিয়া জীবকুলকে দিয়ে কার্য করান? তাহাই যদি হয়, তবে বিশ্বস্রষ্টার আশু কর্তব্য কিছুই নাই?

৩। আদমের পাপ কি?
আলেমগণ বলিয়া থাকেন যে, আদম সৃষ্টির উদ্দেশ্য হইল এই যে, আল্লাহ তাঁহার দ্বারা পৃথিবী মানুষপূর্ণ করিবেন এবং শেষপয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (দ.)-এর দ্বারা ইসলাম প্রচার করাইবেন ইত্যাদি। এই সমস্ত পরিকল্পনাই নাকি ভাগ্যলিপির অন্তর্ভুক্ত। আদমকে বেহেস্তে রাখিয়া তাঁহাকে গন্দম খাইতে যে নিষেধ করা হইয়াছিল, সে নিষেধ কি খোদাতা’লার আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল? আদম গন্দম খাইয়া প্রকারান্তরে আল্লাহর ইচ্ছাই পূর্ণ করিলেন। যে কাজ ভাগ্যলিপির অনুকূল এবং আল্লাহর ইচ্ছাকে পূর্ণ করে, তাহাতে পাপ কি? পক্ষান্তরে আদম যদি গন্দম না খাইতেন, তাহা হইলে মাহফুজের (লিপিফলকের) যাবতীয় লিপিই বরবাদ হইত না কি? অর্থাৎ পৃথিবীতে মানবসৃষ্টি, বেহেস্ত, দোযখ, হাশর ময়দান ইত্যাদির পরিকল্পনা সমস্তই মাঠে মারা যাইত না কি?

৪। শয়তান কি?
শয়তানের সহিত কোন মানুষের প্রত্যক্ষ পরিচয় না থাকিলেও তাহার নামটির সাথে যথেষ্ট পরিচয় আছে। ‘শয়তান’ – এই নামটি এত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হইতেছে যে, হাটে, মাঠে, কোর্ট-কাছারীতে, দোকান, স্কুল-কলেজ, ওয়াজের মাহফিল ইত্যাদির সবর্ত্র এবং নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, এমনকি অনেক হিন্দুও ‘শয়তান’ নামটি ব্যবহার করিয়া থাকেন। কেহ, কেহ, এমনও বলিয়া থাকেন যে, “ব্যাটা ভারী শয়তান”। ‘শয়তান’ কথাটির ধাতুগত অর্থ যাহাই হউক, উহাকে সমাজের যাবতীয় দুষ্কর্মের কারক হিসাবেই লোক ব্যবহার করিতেছে।

ধর্মাধ্যায়ীগণ বলিয়া থাকেন যে, শয়তান পূর্বে ছিল ‘মকরম’ বা ‘ইবলিস’ নামক বেহেস্তবাসী একজন প্রথম শ্রেণীর ফেরেস্তা এবং অতিরিক্ত মুসল্লি। মকরম সেখানে খোদাতালার হুকুমমত আদমকে সেজদা না করায় ‘শয়তান’ আখ্যা পাইয়া চিরকাল মানুষকে অসৎ কাজের প্ররোচনা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করিয়া পৃথিবীতে আসে এবং সে অদ্যাবধি নানাবিধ উপায়ে অসৎ কাজে প্ররোচনা বা দাগা দিয়া বেড়াইতেছে।

আদম ও বিবি হাওয়াকে দাগা দিয়াছিল শয়তান একা। কিন্তু আদমের বংশবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শয়তানেও কি বংশবৃদ্ধি হইতেছে? না হইলে দাগাকাজ সুচারুরূপে চলে কি রকম?

কেহ কেহ বলেন যে, শয়তানেও বংশবৃদ্ধি হয় এবং উহা মানুষের চেয়ে দশগুণ বেশী। কারণ প্রতিগর্ভে সাধারণত মানুষ জন্মে একটি, আর শয়তান জন্মে দশটি করিয়া। তাহাদের নাম হয় যথাক্রমে – জ্বলিতন, ওয়াছিন, নফছ, আওয়াম, আফাফ, মকার, মহুদ, দাহেম, ওল-হান ও বার্ ইহারা ক্ষেত্রবিশেষে থাকিয়া বিশেষ বিশেষ দাগাকার্য সম্পন্ন করিয়া থাকে। অধিকন্তু ইহাদের মানুষের মত মরণ নাই। কেয়ামতের দিন মানবজাতি যখন কায় পাইবে তখন ইহাদের মৃত্যু ঘটিবে।

জন্ম-মৃত্যুর ঠেকাঠুকিতেও বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষ টিকিয়া আছে প্রায় তিনশ কোটি। আর মানুষের চেয়ে দশগুন বৃদ্ধি পাইয়া শয়তানের সংখ্যা কত? আদম হইতে আজ পর্যন্ত যত লোক জন্মিয়াছে তাহারা যদি সকলেই জীবিত থাকিত, তাহা হইলে লোকসংখ্যা যত হইত, বোধ হয় যে, কোন ভাষার সংখ্যা দ্বারা তাহা প্রকাশ করা যাইত না। পৃথিবীতে বর্তমানে শয়তানের সংখ্যা তাহারই দশগুণ বেশী নয় কি? ইহাতে মনে হয় যে, পৃথিবীর জলে, স্হলে ও বায়ুমন্ডলে শয়তান গিজগিজ করিতেছে এবং প্রতিটি মানুষের পিছনে লাখ লাখ শয়তান দাগা দিয়া বেড়াইতেছে।

এত অসংখ্য শয়তান মানবসমাজকে পাপের পথে অহরহ প্ররোচিত করিতেছে, কিন্তু শয়তানের সংখ্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পাইলেও অসৎকাজের মাত্রা ঐ অনুপাতে বাড়িতেছে না, বরং মানবিক জ্ঞান ও সভ্যতা বৃদ্ধিরর সাথে সাথে অসৎকাজের মাত্রা ক্রমশ হ্রাস পাইতেছে। এখনও দেখা যায় যে, শিক্ষিতের সংখ্যা ও শিক্ষায়তনের সংখ্যা ক্রমশ বাড়িতেছে বৈ কমিতেছে না। ন্যায়নিষ্ঠ সাধুপুরুষদের সংখ্যাও নগণ্য নহে। লন্ডন শহরে নাকি এমন দোকানও আছে, যেখানে বিক্রেতা নাই। অথচ ক্রেতাগণ উচিত মূল্য দিয়াই জিনিসপত্র ক্রয় করিতেছে। আবার কোন রকম হারান জিনিস প্রাপ্ত হইয়াও কেহ তাহা আত্মসাৎ করে না। বরং লন্ডন ট্রান্সপোর্ট লস্ট প্রপার্টি অফিসে উহা জমা দিয়া থাকে, সেখান হইতে জিনিসের মালিক তাহা ফেরত পাইয়া থাকে।১০ সেখানে কি শয়তান কম?

ধর্মপ্রচারকদের বর্ণনা শুনিয়া মনে হয় যে, ফেরেস্তাগণ সবাই নপুংসক। মকরমও তাহাই ছিল ‘লানত’ বা অভিশাপ প্রাপ্তির সময়ও মকরম একাই ছিল এবং নপুংসক ছিল। তৎপর তাহার বংশবৃদ্ধির জন্য লিঙ্গভেদ হইল কখন? শুধু ইহাই নহে, শয়তানের বংশবৃদ্ধি সত্য হইলে, প্রথমত তাহার ক্লীবত্ব ঘুচাইয়া পুংলিঙ্গ গঠনাস্তে একটি স্ত্রী-শয়তানেরও আবশ্যক ছিল। বাস্তবিক কি শয়তানেও স্ত্রী আছে/ আর না থাকিলে্ই বা তাহার বংশবৃদ্ধির উপায় কি?

‘শয়তানের দাগা’ বলিতে কি শুধু রোজা-নামাজের শৈথিল্যই বুঝায়, না চুরি, ডাকাতি, বদমায়েশী, নরহত্যা ইত্যাদিও বুঝায়? যদি যাবতীয় অসৎকার্য শয়তান কর্তৃকই অনুষ্ঠিত হয়, তবে জাতিভেদে অসৎ কাজের মাত্রাভেদ হয় কেন? অর্থাৎ, যে কোন দেশের সম্প্রদায়সমূহের জনসংখ্যার অনুপাতে অপরাধী বা কারাবাসীর সংখ্যা হওয়া উচিত। কিন্তু তাহা না হইয়া সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষের মধ্যে কারাবাসীর সংখ্যাধিক্য কেন?

জীবজগতে দেখা যায় যে, মাংসাশীগণ উগ্রস্বভাববিশিষ্ট এবং নিরামিষাশীরা শান্ত। গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, হাঁস-মোরগ, কবুতর, ইত্যাদি প্রাণী মাংসাশী নহে, ইহারা শান্ত। অথচ ব্যাঘ্র, সিংহ, শৃগাল, কুকুর, কাক, চিল ইত্যাদি প্রাণীকূল মাংসাশী এবং উগ্রস্বভাববিশিষ্ট। এ কথাও স্বীকার্য যে, স্বভাবের উগ্রতায় নানা প্রকার অঘটন ঘটিয়া থাকে। ইহাও দেখা যায় যে, মানব সমাজের ভিতর যে জাতি অতিরিক্ত মাংসাশী, সেই জাতির মধ্যেই অতিরিক্ত দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও নরহত্যা অনুষ্ঠিত হয়। এই সকল গর্হিত কাজের উৎপাদক কি শয়তান, না মাংস আর উত্তেজক মসল্লা?

বলা যাইতে পারে যে, কোন কোন দেশের মানুষ মাংসাশী হইয়াও বেশ শান্ত-শিষ্ট ও সংযমী। ইহার কারণ এই নয় যে, সে দেশে শয়তানের উপদ্রব কম বা সে দেশের মাংসে উত্তেজনাশক্তি নাই। ইহার কারণ এই যে, এইরুপ কোন জাতি নিরক্ষাঞ্চলের অধিবাসী নহে। অধিকাংশই হিমাঞ্চলের বাসিন্দা। দেশের শীতকালই তাহাদের স্বভাবের উগ্রতা প্রশমিত করিয়া রাখে।

সুধীগণ বলেন যে, মানুষের মধ্যে ছয়টি আধ্যাতিক শত্রু আছে। উহারা ষড়রিপু নামে পরিচিত। যথা == কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। ইহাদের তাড়নায় মানুষ নানাবিধ অসৎকাজ করিয়া থাকে। যে কোন উপায়ে হউক, ইহাদিগকে দমন করিতে পরিলে মানুষ নিষ্পাপ হইতে পারে।

মানোবিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সভ্যতার ঊষালোক পইবার পূর্বে আহার-বিহারে মানুষ ও ইতর জীবের মনোবৃত্তির বিশেষ পার্থক্য ছিল না। সে সময়ের মানুষের মন ছিল কৃত্রিমতাহীন, সরল ও স্বাধীন। তখন মানুষ তাহার যে কোন ইচ্ছা বা প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করিতে পারিত। তখন প্রবৃত্তিই ছিল মানুষের যথাসর্বস্ব। জ্ঞান উন্মেষের সাথে সাথে মানুষ প্রথম দলবদ্ধ ও পরে সমাজবদ্ধ হইয়া বসবাস করিতে শুরু করে। এই দল বা সমাজকে রক্ষা করিতে আবশ্যক হইল ত্যাগ ও সংযমের। আদিতে এই ত্যাগ ও সংযম ছিল স্বেচ্ছাধীন। ক্রমে যখন সভ্যতা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, তখন তাহার দল বা সমাজের বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সংযমকে বাঁধিল নীতি ও নিয়মের শৃঙ্খলে। ইহাতে মানুষের সেই স্বাধিন প্রবৃত্তিগলিকে সু ও কু – এই দুইভাগে বিভক্ত করিয়া সু প্রবৃত্তিগুলিকে স্বাধীনই রাখা হইল, কিন্তু কু প্রবৃত্তিগুলিকে করা হইল কারারুদ্ধ। কারাবাসী কুপ্রবৃত্তিগুলিকে মনের অন্ধকার কারাকক্ষে ঘুমাইয়া রহিল। মনের যে অংশে সেই রুদ্ধপ্রবৃত্তি বাস করে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় তাহাকে বলা হয় অচেতন মন বা নির্জ্ঞান মন (Unconscious Mind)।

মানুষ তাহার জাতিগত জীবনের হাজার হাজার বৎসরের পুরাতন অচেতন মন স্বরুপ মূলধন (উত্তরাধিকার সূত্রে) লইয়া প্রথিবীতে জন্মগ্রহণ করে এবং ব্যক্তিগত জীবনে মানুষ যে সকল অশুভ কামনা সমাজের নীতি, ধর্মের বিধান ও রাষ্ট্রের শাসনের ভয়ে চরিতার্থ করিতে পারে না, তাহাও ক্রমে বিস্মৃতির অতুলগর্ভে ডুবিয়া গিয়া অচেতন মনে স্হান লয়। অচেতন মনে রুদ্ধপ্রবৃত্তিগুলি সময় সময় জাগ্রত হইয়া কারারক্ষীকে ফাঁকি দিয়া বাহিরে আসে এবং সুপ্রবৃত্তিগুলিকে যে শক্তি অবরুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহাকে কারারক্ষী (Censor) বলা হয়। কারাবন্দী কুপ্রবৃত্তিগুলি সময় সময় জাগ্রত হইয়া কারারক্ষীকে ফাঁকি দিয়া বাহিরে আসে এবং সুপ্রবৃত্তিগুলির সহিত মেলামেশা করিয়া তাহাদিগকে বিপথে চালিত করে। ইহা হইতে মানব সমাজের যত কিছু বিড়ম্বনা। মানুষের যাবতীয় অশুভচিন্তা ও অসৎকাজের উদ্যোক্তা এই অচেতন মন।

এতদ্বিষয পর্যালোচনা করিলে বুঝা যায় যে, যাবতীয় অসৎকাজের উদ্যোক্তা মানুষের অভ্যন্তরীণ রিপুসমূহ, বাহিরের কিছু নয়। তবে কি মানুষের কু-প্রবৃত্তিগুলিকেই শয়তান বলা হয়, না মানবদেহাতিরিক্ত স্বতন্ত্র সত্তাবিশিষ্ট শয়তান-এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়?

৫। উপাসনার সময় নির্দিষ্ট কেন?
দেখা যায় যে, সকল ধর্মেই কোন কোন উপাসনার জন্য বিশেষ বিশেষ সময় নির্দিষ্ট আছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে ঐ সকল উপাসনা করিলে বিশ্বপতি কে উহা মন্জুর করিবেন না, তাহার কোন হেতু পাওয়া যায় না। ইসলামিক শাস্ত্রে প্রত্যেহ পাঁচবার নামাজের ব্যবস্হা আছে। এই পাঁচবার নামাজের প্রত্যেকবারের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আদেশ আছে, আবার কোন কোন সময়ে নামাজ নিষেধ।

পৃথিবী আবর্তনের ফলে যে কোন স্হিরমুহূর্তে বিভিন্ন দ্রাঘিমার উপর বিভিন্ন সময় সূচিত হয় এবং প্রতি মুহূর্তেই কোন না কোন স্হানে নির্দেশিত উপাসনা চলিতে থাকে। অথচ সূর্য উদয়, সূর্য অস্ত এবং মধ্যাহ্নে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ (হারাম)। ইহার তাৎপর্য কি? এখানে যখন সূর্যোদয় হইয়াছে, তখন এখান হইতে পশ্চিমে কোনখানে সূর্যোদয় নাই এবং এস্হান হইতে পূর্বদিকে পুর্বেই সূর্যোদয় হইয়াছে। এখানে যখন নামাজ পড়া হারাম, ঠিক সেই মুহূর্তেই অন্যত্র হারাম নহে। উদাহারণস্বরুপ বলা যাইতে পারে যে, বরিশালে যখন সূর্যোদয় হইতেছে, তখল কলিকাতায় হয় নাই এবং চট্টগ্রামে কিছু পূর্বেই সূর্যোদয় হইয়া গিয়াছে। অর্থাৎ বরিশালে যখন নামাজ পড়া হারাম, তখন কলিকাতা বা চট্টগ্রামে হারাম নহে। তাহা হইলে নির্দিষ্ট সময়ে উপাসনা নিষিদ্ধ হওয়ার তাৎপর্য কিছু আছে কি?

নামাজের নিষিদ্ধ সময় সম্বন্ধে যে কথা, ওয়াক্ত সম্বন্ধে সেই একই কথা। পৃথিবীর কোনস্হানেই ওয়াক্ত নহে – এরুপ কোন স্হির মুহূর্ত আছে কি? যদি না থাকে, অর্থাৎ, প্রতি মুহূর্তেই যদি পৃথিবীর কোন না কোন স্হানে নামাজ পড়া চলিতে থাকে, তবে নামাজের সময় নির্ধারণের তাৎপর্য কি?

একসময় পৃথিবীকে স্হির ও সমতল মনে করা হইত। তাই পৃথিবীর সকল দেশে বা সকল জায়গায় একই রকম সময় সূচিত হইবে, বোধহয় যে এরূপ মনে করিয়া ঐসকল বিধি-নিষেধ প্রবর্তিত হইয়াছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রমাণিত হইয়াছে যে, পৃথিবী গোল ও স্হিতিশীল।

পৃথিবীর গোলকহেতু যে কোন স্হানে বিশেষত সাগর বা মরূভূমিতে দাঁড়াইয়া দৃষ্টিপাত করিলে নিজেকে ভূ-পৃষ্ঠের কেন্দ্রে অবস্হিত বলিয়া ভ্রম হয়। মনে হয় যে, এই কারণেই আরববাসীগণ পবিত্র মক্কা শহরকে পৃথিবীর (ভূ-পৃষ্ঠের) কেন্দ্রে অবস্হিত বলিয়া ভাবিতেন এবং ওখানের সকাল-সন্ধাকেই ‘সকল দেশের সকাল-সন্ধা’ বলিয়া মনে করিতেন। এই ভ্রমাত্মক ধারণার ফলে যে সকল সমস্যার উদ্ভব হইয়াছে, তাহার কিছু আলোচনা করা যাক।

মনে করা যাক – কোন ব্যক্তি বেলা দেড়টার সময় জোহর নামাজ আদায় করিয়া বিমান-যোগে প্রতি ঘন্টায় তিন হাজার মাইল বেগে চট্টগ্রাম হইতে পবিত্র মক্কা যাত্রা করিলেন। সেখানে পৌঁছিয়া তিনি দেখেন যে, ওখানে তখন দুপুর হয় নাই। ওয়াক্ত হইলে ঐ ব্যক্তির আর একবার জোহর নামাজ পড়িতে হইবে কি?

প্রতি ঘন্টায় ১০৪১২/৩ মাইল বেগে পশ্চিম দিকে বিমান চালাইলে (আপাতদৃষ্টিতে) সূর্যকে গতিহীন বলিয়া দেখা যাইবে। অর্থাৎ আরোহীর কাছে প্রাত:, সন্ধ্যা ও মধ্যাহ্ন কিছুই হইবে না; সূর্য যেন স্হিরভাবে একস্হানে দাঁড়াইয়া থাকিবে। এমতাবস্হায় আরোহীদের নামাজ ও রোজার উপায় কি?

পৃথিবীর শুধু বিষুব অঞ্চলেই বৎসরের কোন কোন সময় দিন ও রাত্রির পরিমাণ প্রায় সমান হয় না, ব্যবধান অল্প থাকে। কিন্তু উহা হইতে যতই উত্তর বা দক্ষিণে যাওয়া যায়, দিন ও রাত্রির সময়ের ব্যবধান ততই বাড়িতে থাকে। মেরু অঞ্চলের কোন কোন দেশের বৎসরের কোন কোন সময় দিন এত বড় হয় যে, ‘সন্ধা’ ও ‘ভোর’-এর মাঝখানে কোন রাত্রি নাই। সেখানে এশার নামাজের উপায় কি?

মেরু অঞ্চলে বৎসরে মাত্র একটি দিবা ও একটি রাত্রি হয় অর্থাৎ ছয় মাসকাল একাদিক্রমে থাকে দিন এবং ছয় মাসকাল রাত্রি। ওখানে বৎসরে হয়ত পাঁচবার (পাঁচ ওয়াক্ত) নামাজ পড়া যায়, কিন্তু একমাস রোজা রাখা যায় কি রকমে?

৬। নাপাক বস্তু কি আল্লাহর কাছেও নাপাক?
পৃথিবীর দ্রব্যাদির মধ্যে কতক দ্রব্য ধর্মীয় বিধানে নাপাক (অপবিত্র)। কিন্তু সে সকল কি আল্লাহর কাছেও নাপাক? যদি তাহাই হয়, তবে তাহা তিনি সৃষ্টি করিলেন কেন? আর যদি না হয়, তবে নাপাক অবস্হায় তাঁহার গুণগান করিলে তাহা তিনি অগ্রাহ্য করিবেন কেন? বলা হয় যে, আল্লাহ সর্বত্র বিদ্যমান। যদি তাহাই হয়, তবে নাপাক বস্তুর ভিতরে আল্লাহর অবস্হিতি নাই কি?

৭। উপাসনায় দিগনির্ণয় কেন?
সাকার উপাসকগণ তাঁহাদের আরাধ্য দেবতার দিকে মুখ করিয়া উপাসনা করিয়া থাকেন। যেমন কালী দেবীকে স্হাপন করা হয় দক্ষিণমুখী করিয়া এবং দুর্গাদেবীকে পশ্চিমমুখী। তাই পূজারীকে বসিতে হয় যথাক্রমে উত্তর ও পূর্বমুখী হইয়া। কিন্তু এই দিগনির্ণয় কেন, তাহা আমরা জানি না। বলা হইয়া থাকে যে, আল্লাহ নিরাকার এবং সর্বব্যাপী। তাহাই যদি হয়, তবে নিরাকার উপাসনায় কেবলার আবশ্যক কি এবং হাত তুলিয়া মোনাজাত কেন? ইহাতে আল্লাহর দিগবিশেষে স্হিতির সংকেত হয় কি না!

৮। ফেরেস্তা কি?
আমরা শুনিয়া থাকি যে, আল্লাহ নিরাকার। কিন্তু নিরাকার মাত্রই আল্লাহ নহে। বিশ্বব্যাপী ইথার (Ether) নিরাকার। কিন্তু ইথারকে কেহ ঈশ্বর বলে না। কেননা আকারবিহীন হইলেও ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় এবং উহার মধ্যে পদার্থের গুণও পাওয়া যায়। বিশেষত ইথার নিরাকার হইলেও চেতনাবিহীন। পদার্থ যতই সূক্ষাতিসূক্ষ হউক না কেন, উহার অস্তিত্ব এবং স্হিতি আছে। এমন কোন পদার্থ জগতে পাওয়া যায় নাই, যাহার অস্তিত্ব যন্ত্র বা ইন্দ্রিয়ানুভুতির বাহিরে। শোনা যায় যে, ফেরেস্তা নামক এক জাতীয় জীব আছে এবং উহারা স্বর্গ-মর্ত্য সর্বত্র, এমনকি মানুষের সহচররুপেও বিচরণ করে। অথচ মানুষ উহাদের সন্ধান পায় না। উহারা কি কোন পদার্থের তৈয়ারী নয়? যদি হয়, তবে কোন অদৃশ্য বস্তুর দ্বারা তৈয়ারী? তাহা কিন ঈশ্বর হইতেও সূক্ষ? হইলে তাহা কি? আর যদি কোন পদার্থের তৈয়ারী না হয়, তবে কি তাহারা নিরাকার?

আল্লাহ নিরাকার, চেতনাবিশিষ্ট ও কর্মক্ষম এক মহাশক্তি। পক্ষান্তরে নিরাকার, চেতনাবিশিষ্ট ও কর্মক্ষম আর একটি সত্তাকে ফেরেস্তা বলিয়া স্বীকার করিলে আল্লাহ অতুলনীয় থাকেন কিরূপে?

কেহ কেহ বলেন যে, ফেরেস্তারা নূরের তৈয়ারী। নূর বলিতে সাধারণত বুঝা যায় যে, আলো বা রশ্মি। সাধারণ আলো অদৃশ্য নয়, উহা দৃশ্যমান পদার্থ। কিন্তু বিশ্বে এমন কতকগুলি বিশেষ আলো বা রশ্মি আছে, যাহা চক্ষে দেখা যায় না। যেমন – আলফা রশ্মি, কসমিক রশ্মি ইত্যাদি। বিজ্ঞানীগণ নানা কৌশলে ইহাদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন এবং ইহাদের গুণাগুণও প্রমাণ করিতে সক্ষম হইয়াছেন্ কিন্তু বিজ্ঞানীগণ উহার কোন রকম রশ্মির দ্বারা তৈয়ারী ফেরেস্তার সন্ধান পাইতেছেন না। ফেরেস্তারা কোন জাতীয় রশ্মির (নূরের) দ্বারা তৈয়ারী?

৯। ফেরেস্তার কাজ কি?
পবিত্র কোরান ও বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনায় জানা যায় যে, স্বয়ং খোদাতা’লার হুকুমে সব সৃষ্টি হইয়া গেল। সৃষ্টিকার্য সম্পাদনে আল্লাহ কোন ফেরেস্তার সাহায্য লন নাই। যিনি সৃষ্টি করিতে পারেন, তিনি তাহা রক্ষা বা পরিচালনাও করিতে পারেন। কিন্তু বিশ্বসংসারের নানাবিধ কার্য সম্পাদন করিবার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বও খোদাতা’লা অসংখ্য ফেরেস্তা সৃষ্টি করিলেন কেন? শোনা যায় যে, ফেরেস্তাগণের নিজ ইচ্ছামত কাজ করিবার ক্ষমতা নাই। যদিও বিভিন্ন কাজ করিবার জন্য বিভিন্ন ফেরেস্তা নিযুক্ত আছেন তথাপি তাঁহার আল্লাহর আদেশ ভিন্ন কোন কাজই করিতে পারেন না। বিশ্বর যাবতীয় কার্য নির্বাহের জন্য প্রত্যেক ফেরেস্তাকেই যদি আল্লাহর হুকুম দিতে হয়, তবে তাঁহার ব্যস্ততা কমিল কি? কথিত হয় যে, অসংখ্য ফেরেস্তার মধ্যে প্রধান ফেরেস্তা চারিজন। যথা – জেব্রাইল, মেকাইল, এস্রাফিল ও আজ্রাইল। ইহাদের কার্যাবলী সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাক।

ক. জেব্রাইল
– এই ফেরেস্তা নাকি পয়গম্বরের নিকট খোদাতালার আদেশ পৌঁছাইতেন। হজরত মোহাম্মদ (দ.) দুনিয়ার শেষ পয়গম্বর। তাঁহার বাদে নাকি আর কোন নবী জন্মিবেন না। কাজেই জেব্রাইল ফেরেস্তাও আর দুনিয়ায় আসিবেন না। তবে কেন কেহ কেহ বলেন যে, নির্দিষ্ট কয়েকবার আসিবেন। সে যাহা হউক, জেব্রাইল ফেরেস্তা বর্তমানে কোন কাজ করেন কি? মনো বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, জেব্রাইল সম্মোহন বিদ্যা (Hyptonism) আয়ত্ত করিতে পারিলে তাহার দুরদুরান্তে অবস্হিত কোন বিশেষ ব্যক্তির সাথে মানসিক ভাবের আদান-প্রদান করা যায়। উহাকে (Telepathy) বলে। সর্বশক্তিমান খোদাতালা এই টেলিপ্যাথির নিয়মে নবীদের সাথে নিজেই কথাবার্তা বলিতে পারিতেন। কিন্তু তাহা না করিয়া তিনি ফেরেস্তা সৃষ্টি করিয়া তাঁহার মারফত নবীদের কাছে আদেশ পাঠাইয়াছেন কেন?

খ. মেকাইল
– শোনা যায়, মেকাইল ফেরেস্তা নাকি মানুষের রেজেক বা খাদ্য বন্টন করেন। ‘খাদ্যবন্টন’ বলিতে সাধারণ মানুষের খাদ্যই বোঝায়। কিন্তু অন্যান্য প্রাণী যথা – পশু, পাখী, কীট-পতঙ্গ ও বিভিন্ন জাতীয় জীবাণুদের খাদ্যবন্টন করেন কে, অর্থাৎ মেকাইল ফেরেস্তা না স্বয়ং খোদাতালা? অন্যান্য প্রাণীদের খাদ্যবন্টন যদি স্বয়ং খোদাতালাই করেন, তবে মানুষের খাদ্যবন্টন তিনি করেন না কেন? আর যদি যাবতীয় জীবের খাদ্যই মেকাইল বন্টন করেন, তবে জগতের অন্য কোন প্রাণীকে নীরোগ দেহে শুধু উপবাসে মরিতে দেখা যায় না, অথচ মানুষ উপবাসে মরে কেন? আর মেকাইল ফেরেস্তা যদি শুধু মানুষের খাদ্যবন্টন করেন তবে মানুষের মধ্যে খাদ্যবন্টনে এতোধিক পার্থক্য কেন? হয়ত কেহ নিয়মিত পক্ষামৃত (দুগ্ধ, দধি, ঘৃত, মধু, চিনি) আহার করেন, অন্যত্র কেহ জলভাতে শুধু লবণ ও লঙ্কাপোড়া পায় না। মেকাইলের এই পক্ষপাতিত্ব কেন? মেকাইল ফেরেস্তা নাকি বিশ্বপতির আবহাওয়া বিভাগও পরিচালনা করেন। কিন্তু এই বিভাগেও তাঁহার যোগ্যতা বা নিরপেক্ষতার পরিচয় পাওয়া যাইতেছে না। অতীতকালে যাহাই হইয়া থাকুক না কেন, বর্তমানে ব্যাপকভাবেই পৃথিবীতে খাদ্যসংকট দেখা দিয়াছে এবং বিভিন্ন দেশের নেতাগণ তাঁহাদের নিজ নিজ দেশের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত পতিত জমি আবাদ কর্মে মনোযোগ দিয়াছেন। কিন্তু সসীম ক্ষমতার জন্য সকল ক্ষেত্রে কার্যকৃত হইতে পারিতেছেন না। অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন মেকাইল ফেরেস্তার অসাধ্য কিছুই নই। পৃথিবীর উত্তরও দক্ষিণ মেরুদেশের সঙ্গে যদি সাহারা মরুপ্রদেশের তাপ বিনিময় করিয় যথারীতি বৃষ্টিপাত ঘটান যাইত, তাহা হইলে লক্ষ লক্ষ একর জমি চাষাবাদ ও ফসল উৎপাদনের যোগ্য হইত এবং তাহাতে দুনিয়ার খাদ্যসংকট কতকাংশে কমিয়া যাইত। মেকাইল ফেরেস্তা উহা করিতে পারেন কি না? যদি পারেন, তবে উহা তিনি করেন না কেন/

শোনা যায়, আরবদেশ বিশেষত মক্কা শহর নাকি খোদাতালার খুব প্রিয় স্হান। কেননা দুনিয়ার প্রায় যাবতীয় পয়গম্বর আরব দেশেই জন্মিয়াছিলেন এবং শেষ পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (দ.) পবিত্র মক্কা শহরে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। সেই আরবদেশে বৃষ্টিপাত ও চাষাবাদ নাই বলিলেই চলে। কিন্তু খোদাতালার অপ্রিয় দেশ ভারতবর্ষে বিশেষত আসামের চেরাপুন্জিতে অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয় কেন?

ভারত-বাংলার কথাই ধরা যাক। কাশী হিন্দু জাতির একটি তীর্থস্হান ও নানাবিধ দেবদেবীর প্রতিমার জাদঘর এবং চট্টগ্রামে মুসলিম বারো আওলিয়ার দরগাহ। এই কাশীর উপর না হইয়া চট্টগ্রামের উপর এতোধিক ঝড়-বন্যা হয় কেন? দেখা যায় যে, পৃতিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে তাপ, বায়ুপ্রবাহ, মেঘ-বৃষ্টির অত্যধিক পরিমাণে বৈষম্য আছে। ইহার কারণ কি ঐ সকল অঞ্চল ও তাহার নিকটবর্তী সাগর-পাহাড়ের ভৌগোলিক অবস্হান, না মেকাইলের পক্ষপাতিত্ব?

গ. এস্রাফিল
– এই ফেরেস্তা নাকি শিঙ্গা (বাঁশী) হাতে লইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। খোদাতালার হুকুমে যখন ঐ শিঙ্গায় ফুঁক দিবেন, তখনই মহাপ্রলয় (কেয়ামত) হইবে এবং পুন: যখন খোদাতালার হুকুমে ফুঁক দিবেন, তখন হাশর ময়দানাদি পুন: সৃষ্টি হইবে। আদিতে খোদাহালার হুকুমেই যদি বিশ্ব-সৃষ্ট হইতে পারিয়াছিল। কিন্তু তাঁহার হুকুমে ধ্বংস হইতে পারিবে না কেন? যদি পারে, তবে এস্রাফিলের শিঙ্গা ফুঁকিবার আবশ্যক কি? আবার – প্রথমবারে বিশ্বসৃষ্টি খোদাতালার হুকুমে হইতে পারিল, কিন্তু মহাপ্রলয়ের পরে পুন: হাশর ময়দানাদি সৃষ্টির জন্য শিঙ্গার ফুঁক লাগিবে কেন?

শোনা যায় যে, অনন্ত অতীতকাল হইতে এস্রাফিল ফেরেস্তা শিঙ্গা হাতে লইয়া দাঁড়াইয়া আছেন এবং শেষ দিন (কেয়ামত) পর্যন্ত দাঁড়াইয়া থাকিবেন। অথচ এত অধিককাল দাঁড়াইয়া থাকিয় শিঙ্গায় ফুঁক দিবেন মাত্র দুইটি। কেয়ামতের নির্দিষ্ট তারিখটি আল্লাহ জানেন না কি? জানিলে এস্রাফিল ফেরেস্তাকে এতকাল পূর্বে শিক্ষা হাতে দিয়া দাঁড় করিয়া রাখিবার প্রয়োজন কি?

ঘ. আজ্রাইল
– যমদূত জীবের জীবন হরণ করেন, এই কথাটি হিন্দুদের বেদে বর্ণিত আছে এবং উহারই ধর্মান্তরে নামান্তর ‘আজ্রাইল ফেরেম্তা’। আজ্রাইল ফেরেম্তা যে মানুষর জীবন হরণ করেন, তাহার পরিষ্কার ব্যাখ্যা শোনা যায ধর্মপ্রচারকদের কাছে। কিন্তু উহাতে মৃত্যু সম্পর্কে অনেক প্রশ্নই অজ্ঞাত থাকিয়া যায়। গরু, ঘোড়া, বাঘ, মহিষাদি, পশু, কাক, শকুনাদী, পাখি, হাঙ্গর-কুমিরাদী জলজ জীব ও কীট-পতঙ্গাদির জীবণ হরণ করাও কি আজ্রাইলের কাজ? নানাজাতীয় জীবদেহের ভিতরে ও পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এত অধিক ক্ষুদ্র জীবাণু বাস করে যে, তাহার সংখ্যা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই জানেন। বিশেষত ঐ সকল জীবের পরমায়ুও খুব বেশী নয়, কয়েক মাস হইতে কয়েক ঘন্টা বা মিনিট পর্যন্ত। উহাদের জীবনও কি আজ্রাইল হরণ করেন? আম, জাম, তাল, নারিকেলাদি উদ্ভিদের জন্ম-মৃত্যু আছে বলিয়া লোকে বহুকাল পূর্ব হইতেই জানিত। আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ বলেন যে, শুধু তাহাই নহে, উদ্ভিদের ক্ষুধা, পিপাসা, সুখ-দু:খ, স্পর্শানুভূতি, এমনকি শ্রবণশক্তিও আছে। বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মহাশয় যন্ত্র দ্বারা প্রমাণ করিয়া দেখাইয়াছেন যে, গাছের নিকট গান-বাজনা হইলে উহাদের মন প্রফুল্ল হয়। সুতরাং উদ্ভিদ ও অন্যান্য জীবের জীবন-এ কোন পার্থক্য নাই। এই গাছের জীবন হরণ করেন কে? ইহা ভিন্ন অতিক্ষুদ্র এক জাতীয় উদ্ভিদ আছে, উহাকে বীজাণু বলা হয়। ইহারা অতিশয় ক্ষুদ্র বলিয়া খালি চোখে দেখা যায় না। ইহারা বায়ুমন্ডলে ভাসিয়া বেড়ায় এবং উপযুক্ত পরিবেশ পাইলে নানারুপে আত্ম প্রকাশ করে। যেমন শেওলা, বাইছা, ব্যাঙের ছাতা, সিঁধুল ইত্যাদি। ইহাদের জন্ম এবং মৃত্যু আছে। ইহাদের জীবন হরণ করেন কে?

এমন অনেক জাতের জীবাণু বা বীজাণু আছে যাহার জীবদেহে বিশেষত মানুষের দেহে প্রবেশ করিয়া নানাবিধ রোগ সৃষ্টি করে। উহাদের আকার এত ক্ষুদ্র যে, রোগীর দেহের প্রতি ফোঁটা রক্তে লক্ষ লক্ষ জীবাণু ও বীজাণু থাকে এবং যথাযোগ্য ঔষধ প্রয়োগে অল্প সময়ের মধ্যেই উহারা মারা যায়। ইহাদের জীবন হরণ করেন কে?

মানুষা ভিন্ন অন্যান্য যাবতীয় জীবের জীবনে যদি আল্লাহতালার আদেশেই উড়িয়া যায়, তবে মানুষের জন্য যমদূত কেন? আর বিশ্বজীবের যাবতীয জীবন যদি আজ্রাইল একাই হরণ করেন, তবে তাঁহার সময় সংকুলান হয় কিরুপে? আজ্রাইলের কি বংশবৃদ্ধি হয়? অথবা আজ্রাইলের সহকারী (Assistant) আজ্রাইল আছে কি? থাকিলে – তাহার কি এককালীন সৃষ্টি হইয়াছে, না জগতে জীববৃদ্ধির সাথে সাথে নূতন-নূতন আজ্রাইল সৃষ্টি হইতেছে?

সর্বশেষ প্রশ্ন এই যে, যমদূতই যদি জীবনের হরণ করেন, তবে ‘কারণে মরণ’ হয় কেন? অর্থাৎ রোগ, দুর্ঘটনা ইত্যাদি কোন কারণ ব্যতীত জীবের মৃত্যু হয় না কেন?

প্রকাশ আছে যে, আলোচ্য ফেরেস্তা চতুষ্টয় ভিন্ন আরও চারিজন ফেরেস্তা আছেন, যাঁহারা প্রত্যেক মানুষের সহিত সংশ্লিষ্ট। উহারা হইলেন – কোরামান ও কাতেবীন এবং মনকির ও নকিন। উহাদের সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাইতেছে।

ঙ. কোরমান ও কাতেবীন
– ধর্মযাজকগণ বলিযা থাকেন যে, মানুষের সৎ ও অসৎ কাজের বিবরণ লিখিয়া রাখিবার জন্য প্রত্যেক মানুষের কাঁধের উপর কোরমান ও কাতেবীন নামক দুইজন ফেরেস্তা বসিয়া আছেন। উহাদের একজন লেখেন সৎকাজের বিবরণ এবং অপরজন অসৎ কাজের বিবরণ। এই ফেরেস্তাদ্বয়ের লিখিত বিবরণ দেখিয়া মানুষের পাপ ও পুণ্যের বিচার হইবে। মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়াই কোন শিশু পাপ-পুণ্যের অধিকারী হয় না। কেননা তখন তাহাদের ন্যায় বা অন্যায়ের কোন জ্ঞান থাকে না। বলা হইয়া থাকে যে, নাবালকত্ব উত্তীর্ন না হওয়া পর্যন্ত কোন মানুষের উপর নামাজ ও রোজা ফরজ হয় না।

মানুষ সাবালক হইবার নির্দিষ্ট কোন তারিখ নাই। শৈশব উত্তীর্ণ হইয়া কৈশোরে পদার্পণ ও কৈশোর পার হইয়া যৌবনে পদাপর্ণ, ইহার কোনটিই একদিনে হয় না। মানুষ সাবালক হইবার বয়স – কেহ বলেন ১২ বৎসর, কেহ বলেন নারীর ১৪ ও পুরুষের ১৮ বৎসর ইত্যাদি। এমতাবস্হায় কেরামান ও কাতেবীন ফেরেস্তাদ্বয় কাঁধে আসেন কোনসময়? শিশু ভূমিষ্ঠ হইবার পরমুহূর্তে না সাবালক হইবার পর? শিশুর জন্মমুহূর্তের পর হইতে আসিলে ফেরেস্তাদের বেশ কয়েক বৎসর কর্মহীন অবস্হায় বসিয়া দিন কাটাইতে হয়। পক্ষান্তরে মানুষ সাবালক হইবার সুনির্দিষ্ট কোন তারিখ নাই। ঐ বিষয়ে ঈশ্বরানুমোদিত সার্বজনীন কোন তারিখ আছে কি?

শোনা যায় যে, ফেরেস্তারা নাশাক ও দুর্গন্ধময় স্হানে থাকেন না বা উহা পছন্দ করেন না। তাই ফেরেস্তাদের মনোরন্জনের জন্য কেহ কেহ পাক সাফ থাকেন ও খোশবু ব্যবহার করেন। ধর্মীয় মতে অমুসলমান মাত্রই নাপাক। যেহেতু উহারা যথারীতি ওজু গোসল করে না, হারাম দ্রব্য ভক্ষণ করে, এমনকি কেহ কেহ মলত্যাগ করিয়া জলশৌচও কর না। আবার ডোম, মেথর ইত্যাদি অস্পৃশ্য জাতি নাপাক ও দুর্গন্ধেই ডুবিয়া থাকে। উহাদের কাঁধে ফেরেস্তা থাকেন কি না?

যে কোন মানুষের মৃত্যুর পর তাহার কাঁধের ফেরেস্তাদের কার্যকাল শেষ হইয়া যা। অত:পর তাঁহারা কি করেন? অর্থাৎ, কোন ঊর্ধ্বতন ফেরেস্তা বা আল্লাহতালার নিকট তাঁহার নথিপত্র বুঝাইয়া দিয়া অবসর জীবন যাপন করেন, না নিজ জিম্মায় কাগজপত্র রাখিয়া উহার হেফাজতে দিন কাটান, না অন্য কোন মানুষের কাঁধে বসিয়া কাজ শুরু করেন?

শোনা যায় যে, ফেরেস্তাদের নির্দিষ্ট সংখ্যা নাই এবং থাকিলেও তাহা আল্লাহ ব্যতীত আর কেহ জানে না। উহাদের মধ্য হইতে শুধুমাত্র কেরামন ও কাতেবীন ফেরেস্তাদ্বয় ব্যতীত আর কোন ফেরেস্তার সহিত মানুষের ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা নাই। বাকিদের মধ্যে মাত্র আজ্রাইল ফেরেস্তা কাছে আসেন একদিন, তাহা অন্তিমকালে এবং মনকির ও নকির ফেরেস্তাদ্বয় মানুষের চির সহচর। হাঁটিতে, বসিতে, ভোজনে, শয়নে সবসময়ই উহারা মানুষের পার্শ্বচর। বিশেষত উহাদের অবস্হান মানুষের চক্ষু ও কর্ণ হইতে চারি-পাঁচ ইঞ্চির বেশী দূরে নয়। অথচ মানুষ উহাদের গতিবিধি দেখিতে, শুনিতে, অথবা অস্তিত্বকেই অনুভব করিতে পারে না। ইহার কারণ কি?

মানুষের কার্যবিবরণী ফেরেস্তাগণ যে ভাষাতেই লিখুন না কেন, উহাতে কালি, কলম ও কাগজ বা অনুরূপ অন্য কিছু আবশ্যক। আলোচ্য বিবরণগুলি যদি বাস্তব হয়, তবে উহা লিখিবার উপকরণও হওয়া উচিত পার্থিব। অথচ মানুষ উহার কোন কিছুরই সন্ধান পায় না। উহার বাস্তবতার কোন প্রমাণ আছে কি? যদি না থাকে, তাহা হইলে – যখন ফেরেস্তারা অদৃশ্য, কালি অদৃশ্য, কলম এবং কাগজও অদৃশ্য, তখন বিবরণগুলি ঐরুপ নয় কি?

চ. মনকির ও নকির
কথিত হয় যে, মানুষ কবরস্হ হইবার কিছুক্ষণ পরই ‘মনকির’ ও ‘নকির’ নামক দুইজন ফেরেস্তা আসিযা মৃতকে পুনর্জীবিত করেন ও তাহাকে ধর্ম-বিষয়ে কতিপয় প্রশ্ন করেন। সদুত্তর দিতে পারিলে তাহার সুখের অবধি থাকে না। কিন্তু তাহা না পারিলে তাহার উপর হয় নানারুপ শাস্তি। গুজের (গদার) আঘাতে ৭০ গজ মাটির নীচে প্রৌথিত হয়ে যায়, আবার ঐ ফেরেস্তার নখর দ্বারা তুলিয়া তাহাকে পুনরাঘাত করিতে থাকেন এবং সুড়ঙ্গপথে দোজখের আগুন আসিয়া পাপাত্মা মৃতকে জ্বালাইতে থাকে ইত্যাদি। কোন বিশেষ কারণ না থাকিলে সচরাচর মৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টা সময়ের মধ্যেই কবরস্হ করা যায়। ঐ সময়ের মধ্যে মৃতদেহের মেদ, মজ্জা ও মাংসাদির বিশেষ কোন বিকৃতি ঘটে না। এই সময়ের মধ্যেই যদি সে পুনর্জীবন লাভ করিয়া সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হয়, তবে তাহার সেই নবজীবন হয় বিগত জীবনের অনুরূপ। কেননা দেখা যায় যে, সর্পঘাত, উগ্র মাদকদ্রব্য সেবন, ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ, কতিপয় রোগ, গভীর নিদ্রা ইত্যাদিতে মানুষের সংজ্ঞালোপ ঘটে। এইরুপ সংজ্ঞাহীনতা কয়েক ঘন্টা হইতে কয়েক দিন, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে সপ্তাহকাল স্হায়ী হইতে দেখা যায়। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই সংজ্ঞাপ্রাপ্তির পর কাহারো পূর্বস্মৃতি লোপ পাইতে দেখা বা শোনা যায় নাই। কেননা মগজস্হিত কোষসমূহে (Cell) বিকৃতি না ঘটিলে কোন মানুষের স্মৃতি বা জ্ঞানের ভাবান্তর ঘটে না। তাই কাহারো ভাষারও পরিবর্তন ঘটে না।

হৃৎপিন্ড, ফুসফুস ও মস্তিষ্ক – দেহের এই তিনটি যন্ত্রের সুষ্ঠু ক্রিয়ার যৌথ ফলই হইল জীবনীশক্তি। উহার যে কোন একটা বা দুইটির ক্রিয়া সাময়িক লোপ পাওয়াকে ‘রোগ’ বলা হয়। কিন্তু ঐ তিনটির ক্রিয়া একযোগে লোপ পাওয়াকে বলা হয় মৃত্যু। শরীর বিজ্ঞানীগণ দেখিয়াছেন যে, উক্ত যন্ত্রত্রয়ের একটি বা দুইটি নিষ্ক্রিয় (মৃত্যু) হইলে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত তাহাও সক্রিয় করা সম্ভব হইবে। তাহাই যদি হয়, তবে কোন মৃত বাঙ্গালী পুনর্জীবিত হইলে সে কি ফরাসী ভাষায় কথা বলিবে, না, বাংলা ভাষায়?

পৃথিবীতে প্রায় ৩৪২৪টি বোধগম্য ভাষা আছে এবং অধিকাংশ মানুষই মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষা জানে না। কাজেই কোন মৃতকে পুনর্জীবিত করা হইলে, অধিকাংশই তাহার মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোন ভাষায় কথা বলিবার বা বুঝিবার সম্ভাবনা নাই। এমতাবস্হায় মনকিন ও নকির ফেরেস্তাদ্বয় মৃতকে প্রশ্ন করেন কোন ভাষায় – ফেরেস্তী ভাষায়, না মৃতের মাতৃভাষায়?

কেহ কেহ বলেন যে, হাশর ময়দানাদি পরলৌকিক জগতের আন্তর্জাতিক ভাষা হইবে আরবী, বোধহয় ফেরেস্তাদেরও। হাশর, ময়দানাদি পরজগতেও যদি পার্থিব দেহধারী মানুষ সৃষ্টি হয়, তবে তাহা হইবে এক অভিনব দেহ। কাজেই তাহাদের অভিনব ভাষার অধিকারী হওয়াও অসম্ভব নহে। কিন্তু মৃতের কবরস্হ দেহ অভিনব নয়, উহা ভূতপূর্ব। এক্ষেত্রে সে অভিনব (ফেরেস্তী বা আরবী) ভাষা বুঝিতে বা বলিতে পারে কিভাবে?

পক্ষান্তরে, যদি ফেরেস্তারা আঞ্চলিক ভাষায়ই প্রশ্ন করেন, তাহা হইলে ভিন্ন ভিন্ন ৩৬২৪ টি ভাষাভাষী ফেরেস্তা আবশ্যক। বাস্তবিক কি তাহাই?

ধর্মীয় বিবরণ মতে, পরলৌকিক ঘটনাবলীর প্রায় সমস্তই মানুষের পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার বাহিরে। কিন্তু ‘গোর আজাব’ – এই ঘটনাটি যদিও পরলোকের অন্তর্ভূক্ত, তথাপি উহার অবস্হান ইহলোকে অর্থাৎ এই পৃথিবীতেই। বিশেষত উহা মানুষের অবস্হান হইতে বেশী দূরেও নয়। বড় বড় শহরের গোরস্হানগুলি ছাড়া গ্রামাঞ্চলের কবরগুলি প্রায়ই থাকে বাসস্হানের কাছাকাছি এবং উহার গভীরতাও বেশী নয়, মাত্র ফুট তিনেকের মত। ওখানে বসিয়া ফেরেস্হা ও পুনর্জীবিত ব্যক্তির মধ্যে যে সকল কথাবার্তা, মারধোর, কান্নাকাটি ইত্যাদি কাহিনী হয়, অতি নিকটবর্তী মানুষও তাহা আদৌ শুনিতে পায় না কেন?

দেখা যাইতেছে যে, হত্যা সম্পর্কিত মামলাদিতে কোন কোন ক্ষেত্রে মৃতকে কবর দেওয়ার তিন-চারদিন বা সপ্তাহকাল পরে কবর হইতে তুলিয়া নেওয়া হয় এবং উহা অভিজ্ঞ ডাক্তারগণ পরীক্ষা করিয়া থাকেন। কিন্তু যত বড় দুর্দান্ত ব্যক্তির লাশই হউক না কেন, কোন ডাক্তার উহার গায়ে গুর্জের আঘাতের দাগ বা আগুনে পোড়ার চিহ্ন পান নাই। অধিকন্তু খুব লক্ষ্য করিয়া দেখা গিয়েছে যে, মুর্দাকে যেইভাবে কবরে রাখা হয়েছিল, সেইভাবেই আছে, একচুলও নড়চড় হয় নাই। বিশেষত কবরের নিম্নদিকে ৭০ গজ গর্ত বা কোন পার্শ্বে (দোজখের সঙ্গে) সুড়ঙ্গ নাই। ইহার কারণ কি? গোর আজাবের কাহিনীগুলি কি বাস্তব, না অলীক?

এ কথা সত্য যে, কোন মানুষকে বধ করার চেয়ে প্রহার করা সহজ এবং সবল ব্যক্তির চাইতে দূর্বল ব্যক্তি বধ করা সহজ। রেল, জাহাজ, বিমান ইত্যাদির আকস্মিক দুর্ঘটনায় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এক মুহূর্তে শত শত সুস্হ ও সবল মানুষ বধ করেন আজ্রাইল ফেরেস্তা একা। আর রুগ্ন, দুর্বল ও অনাহারক্লিষ্ট মাত্র একজন মানুষকে শুধু প্রহার করিবার জন্য দুইজন ফেরেস্তা কেন? পক্ষান্তরে শুধুমাত্র মৃতকে প্রশ্ন করিবার জন্য দুইজন ফেরেস্তার আবশ্যিকতা কিছু আছে কি?

জেব্রাইল, মেকাইল, এস্রাফিল ইত্যাদি নামগুলি উহাদের ব্যক্তিগত নাম (Proper Noun)। কিন্তু কেরামন, কাতেবিন, মনকির ও নকির – এই নামগুলি উহাদের ব্যক্তিগত নাম নয়, সম্প্রদায় বা শ্রেণীগত নাম (Common Noun)। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ জীবিত আছে।* তাহা হইলে সমস্ত মানুষের কাঁধে কেরামন আছে ৩০০ কোটি এবং কাতেবীন ৩০০ কোটি, জানিনা মনকির ও নকির ফেরেস্তাদ্বয়ের সংখ্যাও ঐরুপ কিনা। সে যাহা হউক, উহাদের ব্যক্তিগত কোন নাম আছে কি? না থাকিলে উহাদের কোন বিশেষ ফেরেস্তাকে আল্লাহ তলব দেন কি প্রকারে?

১০. দূরত্বহীন যাতায়াত কি সম্ভব?
শোনা যায় যে, স্বর্গীয় দূত জেব্রাইল আল্লাহর আদেশ মত নবীদের নিকট অহি (বাণী) লইয়া আসিতেন এবং তাহা নাজেল (অর্পণ) করিয়া চলিয়া যাইতেন। আসা ও যাওয়া – এই শব্দ দুইটি গতিবাচক এবং গতির আদি ও অন্তের মধ্যে দূরত্ব থাকিতে বাধ্য। আল্লাহতালা নিশ্চয়ই নবীদের হইতে দূরে ছিলেন না। তবে কি জেব্রাইলের আসা ও যাওয়া দূরত্বহীন? আর দূরত্ব থাকিলে তাহার পরিমাণ কত (মাইল)?

১১. মেয়ারাজ কি সত্য, না স্বপ্ন?
শোনা যায় যে, হজরত মোহাম্মদ (দ.) রাত্রিকালে আল্লাহর প্রেরিত বোরাক নামক এক আশ্চর্য জানোয়ারে আরোহণ করিয়া আকাশভ্রমণে গিয়াছিলেন। ঐ ভ্রমণকে মেয়ারাজ বলা হয়। তিনি নাকি কোটি কোটি বৎসরের পথ অতিক্রম করিয়া আরশে পৌঁছিয়া আল্লাহর সহিত কথোপকথন করিয়াছিলেন এবং আল্লাহ তাঁহাকে ইসলামের দুইটি মহারত্ন নামাজ ও রোজা উপহার দিয়াছিলেন। ঐ রাত্রে তিনি বেহেস্ত-দোজখাদিও পরিদর্শন করিয়া গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন। ইহাতে নাকি তাঁহার সময় লাগিয়াছিল কয়েক মিনিট মাত্র। কথিত হয় যে, মেয়ারাজ গমনে হজরত (দ.)-এর বাহন ছিল – প্রথম পর্বে বোরাক ও দ্বিতীয় পর্বে রফরফ। উহারা এরুপ দুইটি বিশেষ জানোয়ার, যাহার দ্বিতীয়টি জগতে নাই। বোরাক – পশু, পাখী ও মানব এই তিন জাতীয় প্রাণীর মিশ্ররুপের জানোয়ার। অর্থাৎ তাহার ঘোড়ার দেহ, পাখীর মত পাখা এবং রমণীসদৃশ মুখমন্ডল। বোরাক কোন দেশ হইতে আসিয়াছিল, ভ্রমণান্তে কোথায় গেল, বর্তমানে কোথায়ও আছে, না মারা গিয়াছে, থাকিলে – উহার দ্বারা এখন কি কাজ করান হয়, তাহার কোন হদিস নাই। বিশেষত একমাত্র শবে মেয়ারাজ ছাড়া জগতে আর কোথাও ঐ নামটিরই অস্তিত্ব নাই। জানোয়ারটি কি বাস্তব না স্বপ্নিক?

হাজার হাজার বৎসরের পুরাতন স্হাপত্যশিল্পের নিদর্শন পৃথিবীতে অনেক আছে। খৃ.পূ. তিন হাজার বৎসরেরও অধিককাল পূর্বে নির্মিত মিশরের পিরামিডসমুহ আজও অক্ষত দেহে দাঁড়াইয়া আছে। হজরতের মেয়ারাজ গমন খুব বেশীদিনে কথা নয়, মাত্র খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকের ঘটনা। ঘটনাটি বাস্তব হইলে – যে সকল দৃশ্য তিনি মহাশূণ্যে স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন (আরশ ও বেহেস্ত-দোজখাদি), তাহা আজও সেখানে বর্তনান থাকা উচিত। কিন্তু আছে কি? থাকিলে তাহা আকাশ-বিজ্ঞানীদের দূরবীনে ধরা পড়ে না কেন?

মেয়ারাজ সম্বন্ধে পর্যালোচনা করিতে হইলে প্রথম জানা আবশ্যক যে, হজরত (দ.) –এর মেয়ারাজ গমন কি পার্থিব না আধ্যাত্মিক; অর্থাৎ দৈহিক না মানসিক। যদি বলা হয় যে, উহা দৈহিক, তবে প্রশ্ন আসে – উহা সম্ভব হইল কিভাবে?

আকাশবিজ্ঞানীদের মতে – সূর্য ও গ্রহ-উপগ্রহরা যে পরিমাণ স্হান জুড়িয়া আছে, তাহার নাম সৌরজগত, সূর্য ও কোটি কোটি নক্ষত্র মিলিয়া যে পরিমাণ স্হান জুড়িয়া আছে তাহান নাম নক্ষত্রজগত বা নীহারিকা এবং কোটি কোটি নক্ষত্রজগত বা নীহারিকা মিলিয়া যে স্হান দখল করিয়া আছে, তাহার নাম নীহারিকাজগত।

বিজ্ঞানীগণ দেখিয়াছেন যে, বিশ্বের যাবতীয় গতিশীল পদার্থের মধ্যে বিদ্যুৎ ও আলোর গতি সর্বাধিক। উহার সমতুল্য গতিবিশিষ্ট আর জগতে নাই। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৮৬ হাজার মাইল। আলো এই বেগে চলিয়া এক বৎসরে যতটুকু পথ অতিক্রম করিতে পারে, বিজ্ঞানীগণ তাহাকে বলেন এক আলোক বৎসর।

বিশ্বের দরবারে আমাদের এই পৃথিবী খুবই নগণ্য এবং সৌরজগতটিও নেহায়েত ছোট জায়গা। তথাপি এই সৌরজগতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্তে আলোক পৌঁছিতে সময় লাগে প্রায় ১১ ঘন্টা। অনুরূপভাবে, নক্ষত্রজগতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্তের দূরত্ব প্রায় ৪০০০ কোটি আলোক বৎসর।১১ এই যে বিশাল স্হান, ইহাই আধুনিক বিজ্ঞানীদের পরিচিত দৃশ্যমান বিশ্ব। এই বিশ্বের ভিতরে বিজ্ঞানীরা বেহেস্ত, দোজখ বা আরশের সন্ধান পান নাই। হয়ত থাকিতে পারে ইহার বহির্ভাগে, অনন্ত দূরে। হজরত (দ.)-এর মেয়ারাজ গমন যদি বাস্তব হয়, অর্থাৎ তিনি যদি সশরীরে একটি বাস্তব জানোয়ারে আরোহণ করিয়া সেই অনন্তদূরে যাইয়া থাকেন, তবে কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যে আলোচ্য দূরত্ব অতিক্রম করা কিভাবে সম্ভব হইল? বোরাকে গতি সেকেন্ড কত মাইল ছিল?

বোরাকের নাকি পাখাও ছিল। তাই মনে হয় যে, সেও আকাশে (শূণ্যে) উড়িয়া গিয়াছিল। শূণ্যে উড়িতে হইলে বায়ু আবশ্যক। যেখানে বায়ু নাই, সেখানে কোন পাখী বা ব্যোমযান চলিতে পারে না। বিজ্ঞানীগণ দেখিয়াছেন যে, প্রায় ১২০ মাইলের উপরে বায়ুর অস্তিত্ব নাই।১২ তাই তাঁহারা সেখানে কোনরুপে বিমান চালাইতে পারেন না, চালাইয়া থাকেন রকেট। বায়ুহীন মহাশূণ্যে বোরাক উড়িয়াছিল কিভাবে?

নানা বিষয় পর্যালোচন করিলে মনে হয় যে, হজরত (দ.)-এর মেয়ারাজ গমন (আকাশভ্রমণ) সশরীরে বা বাস্তবে সম্ভব নহে। তবে কি উহা আধ্যাত্মিক বা স্বপ্ন?

এ কথায় প্রায় সকল ধর্মই একমত যে, ‘সৃষ্টিকর্তা সর্বত্র বিরাজিত’। তাহাই যদি হয়, তবে তাঁহার সান্নিধ্যলাভের জন্য দূরে যাইতে হইবে কেন? আল্লাহতালা ঐ সময় কি হযরত (দ.)-এর অন্তরে বা তাঁহার গৃহে, মক্কা শহরে অথবা পৃথিবীতেই ছিলেন না?

পবিত্র কোরানে আল্লাহ বলিয়াছেন – তোমরা যেখানে থাক, তিনি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন।“ (সুরা হাদিদ – ৪)। মেয়ারাজ সত্য হইলে এই আয়াতের সহিত তাহার কোন সঙ্গতি থাকে কি?

১২. কতগুলি খাদ্য হারাম হইল কেন?
বিভিন্ন ধর্মমতে কোন কোন খাদ্য নিষিদ্ধ এবং কোন কোন দ্রব্য স্বাস্হ্য রক্ষার প্রতিকূল বলিয়া স্বাস্হ্যবিজ্ঞানমতেও ভক্ষণ নিষিদ্ধ। যে সকল দ্রব্য ভক্ষণে স্বাস্হ্যহানি ঘটিতে পারে, তাহা নিষিদ্ধ হইলে বুঝা যায় যে, কেন উহা নিষিদ্ধ হইল। কিন্তু যে খাদ্য ভক্ষণে স্বাস্হ্যহানির আশঙ্কা নাই, এমন খাদ্য নিষিদ্ধ (হারাম) হইল কেন?

১৩. এক নেকী কতটুকু?
স্হান, কাল, বস্তু ও বিভিন্ন শক্তি পরিমাপের বিভিন্ন মাপকাটি বা বাটখারা আছে। যথা – স্হান বা দূরত্বের মাপকাটি গজ, ফুট, ইঞ্চি, মিটার ইত্যাদি; সময় পরিমাপের ইউনিট ঘন্টা, মিনিট ইত্যাদি; ওজন পরিমাপের মণ, সের; বস্তু পরিমাপে গন্ডা, কাহন; তাপ পরিমাপে ডিগ্রি; আলো পরিমাপে ক্যান্ডেল পাওয়ার; বিদ্যুৎ পরিমাপে ভোল্ট, অ্যাম্পিয়ার ইত্যাদির ব্যবহার হয়। অর্থাৎ কোন কিছু পরিমাপ করিতে হইলেই একটি ইউনিট বা একক থাকা আবশ্যক। অন্যথায় পরিমাপ করাই অসম্ভব। কোন কোন ধর্মপ্রচারক বলিয়া থাকেন যে, অমুক কাজে ‘দশ নেকী’ বা অমুক কাজে ‘সত্তর নেকী’ পাওয়া যাইবে। এ স্হলে ‘এক নেকী’-এর পরিমাণ কতটুকু এবং পরিমাপের মাপকাটি কি?

১৪. পাপের কি ওজন আছে?
মানুষের মনের সুখ, দু:খ, ইচ্ছা, ঘৃণা, স্নেহ, হিংসা, দ্বেষ, অহঙ্কার ইত্যাদি কোন পদার্থ নহে, ইহারা মনের বিভিন্ন বৃত্তি মাত্র। ব্যক্তিভেদে এসবের তারতম্য লক্ষিত হয়। কাজেই বলিতে হয় যে, ইহাদেরও পরিমাণ আছে। কিন্তু পরিমাপক যন্ত্র নাই। কারণ ইহারা পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা আকৃষ্ট হয় না। যাহা কিছু পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতার বাহিরে, সেই সমস্ত তৌলযন্ত্র বা নিক্তি দ্বারা মাপিবার চেষ্টা বৃথা। মনুষ্যকৃত ন্যায় ও ‘অন্যায়’ আছে এবং ইহারও তারতম্য আছে। কাজেই ইহারও পরিমাণ আছে। কিন্তু উহা পরিমাপ করিবার মত কোন যন্ত্র অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই।

‘অন্যায়’-এর পরিমাপক কোন যন্ত্র না থাকিলেও বিচারপতিগণ অন্যায়ের পরিমাণ নির্ধারণকরত অন্যায়কারীকে যথোপযুক্ত শাস্তির বিধান করিয়া থাকেন। এ ক্ষেত্রে বিচারকগণ নান প্রকার সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণপূর্বক অন্যায়ের পরিমাণ নির্ধারণ করেন, কোনরুপ যনত্র ব্যবহার না বা করিতে পারেন না।

কঠিন ও তরল পদার্থ ওজন করিবার জন্য নানা প্রকার তৌলযন্ত্র ও বাটখারা আছে। বর্তমান যুগে তৌলযন্ত্রের অভাবনীয় উন্নতি হইয়াছে। লন্ডন শহরের বৃটিশ ব্যাঙ্কে একটি তৌলযন্ত্র আছে। ভষারা (?? আমার বইয়ে পরিষ্কার নয়) নাকি একবারে একশত আশি মণ সোনা, রুপা বা অনুরুপ অন্যান্য দ্রব্যাদি ওজনে উহার কাঁটা দশ ইঞ্চি হেলিয়া পড়ে। তৌলযন্ত্রের এরুপ উন্নতি হইলেও – তাপ, আলো, কাল, দুরত্ব, বিদ্যুৎ ইত্যাদি উহা দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। যেহেতু ইহারা পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা আকৃষ্ট হয় না। পূর্বেই বলিয়াছি যে, যাহা কিছু পৃথিবীর মধ্যাকর্ষন শক্তির আওতার বাহিরে, তাহা তৌলযন্ত্র বা নিক্তি মাপিবার চেষ্টা বৃথা।

‘অন্যায়’-এর নামান্তর পাপ বা অন্যায় হইতেই পাপের উৎপত্তি। সে যাহা হউক, কোনরুপ তৌলযন্ত্র বা নিক্তি ব্যবহার করিয়া পাপের পরিমাণ ঠিক করা যা কিরূপে?

১৫. ইসলামের সাথে পৌত্তলিকতার সাদৃশ্য কেন?

আমরা শুনিয়া থাকি যে, সুসংস্কৃত ইসলামে কুসংস্কারের স্হান নাই। বিশেষত নিরাকার-উপাসক হইতে সাকার-উপাসকগণই অত্যধিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। যদিও বেদ বিশেষভাবে পুতুল-পূজা শিক্ষা দেয় নাই, তথাপি পরবর্তীকালে পুরাণের শিক্ষার ফলে বৈদিক ধর্ম ঘোর পৌত্তলিকতায় পূর্ণ হইয়াছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বৈদিক বা পৌত্তলিক ধর্মের সহিত ইসলাম ধর্মের অনেক সাদৃশ্য দেখিতে পাওয়া যায়, যাহার ভাষা ও রুপগত পার্থক্য থাকিলেও ভাবগত পার্থক্য নাই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় বাদ দিলেও নিম্নলিখিত বিষয়সমূহে উভয়ত সাদৃশ্য দেখা যায়। যথা –

১. ঈশ্বর এক – একমেবাদ্বিতীয়ম (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)।
২. বিশ্ব-জীবের আত্মাসমূহ এক সময়ের সৃষ্টি।
৩, মরণান্তে পরকাল এবং ইহকালের কর্মফল পরকালে ভোগ।
৪. পরকালের দুইটি বিভাগ – স্বর্গ ও নরক (বেহেস্ত-দোজখ)।
৫. স্বর্গ সাত ভাগে এবং নরক সাত ভাগে বিভক্ত। (কেহ কেহ বলেন যে, ইহা ভিন্ন আর একটি স্বর্গ আছে, উহা বাদশাহ শাদ্দাদের তৈয়ারী।)
৬. স্বর্গ বাগানময় এবং নরক অগ্নিময়।
৭. স্বর্গ উর্ধদিকে অবস্হিত।
৮. পুণ্যবানদের স্বর্গপ্রাপ্তি এবং পাপীদের নরকবাস।
৯. যমদূত (আজ্রাইর ফেরেস্তা) কর্তৃক মানুষের জীবন হরণ।
১০. ভগবানের স্হায়ী আবাস ‘সিংহাসন’ (আরশ)।
১১. স্তব-স্তুতিতে ভগবান সন্তুষ্ট।
১২. মন্ত্র (কেরাত) দ্বারা উপাসনা করা।
১৩. মানুষ জাতির আদি পিতা একজন মানুষ – মনু (আদম)।
১৪. নরবলি হইতে পশুবলির প্রথা পচলন।
১৫. বলিদানে পুণ্যলাভ (কোরবাণী)।
১৬. ঈশ্বরের নাম উপবাসে পুণ্যলাভ (রোজা)।
১৭. তীর্থভ্রমণে পাপের ক্ষয় – কাশী-গয়া (মক্কা-মদিনা)।
১৮. ঈশ্বরের দূত আছে (ফেরেস্তা)।
১৯. জানু পাতিয়া উপাসনায় বসা।
২০. সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত (সেজদা)।
২১. করজোড়ে প্রার্থনা (মোনাজাত)।
২২. নিত্যউপাসনার নির্দিষ্ট স্হান – মন্দির (মসজিদ)।
২৩. মালা জপ (তসবিহ্ পাঠ)।
২৪. নির্দিষ্ট সময়ে উপাসনা করা – ত্রিসন্ধা (পাঁচ ওয়াক্ত)।
২৫. ধর্মগ্রন্হপাঠে পুণ্যলাভ।
২৬. কার্যারম্ভে ঈশ্বরের নামোচ্চরণ – নারায়ণৎ সমস্কতাং নবৈষ্ঞব নরোত্তমম (বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম)।
২৭. গুরুর নিকট দীক্ষা (তাওয়াজ্জ)।
২৮. স্বর্গে গণিকা আছে – গন্ধর্ব, কিন্নরী, অপ্সরা (হুর-গেলমান)।
২৯. উপাসনার পুর্বে অঙ্গ ধৌত রা (অজু)।
৩০. দিগনির্ণয়পূর্বক উপাসনায় বসা বা দাঁড়ান।
৩১. পাপ-পুণ্য পরিমাপে তৌলযন্ত্র ব্যবহার (মিজান)।
৩২. স্বর্গস্বামীদের নদী পার হওয়া – বৈতরণী (পুলছিরাত) ইত্যাদি।

ঐ সমস্ত ছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিধি-নিষেধেও অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায়, সে সকল বিষয়ে চিন্তা করিলে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, হয়ত ইসলাম হইতে বিষয়গুলি পৌত্তলিকগণ গ্রহণ করিয়াছেন, নচেৎ পৌত্তলিকদের নিকট হইতে ইসলাম উহা গ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু ইহা নিশ্চিত যে, পূর্ববর্তীগণের নিকট হইতে পরবর্তীগণ গ্রহণ করিয়াছে। পরবর্তী কাহারা?

 

টীকাসমূহ
১০. বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন, মু. আ. হাই, পৃষ্ঠা. ১৪১, ১৪২
১১. নক্ষত্র পরিচয়, প্রমথনাথ সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা. ১৪, ১৬
১২. মহাকাশের ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃষ্ঠা ৯৫

* মূল পান্ডুলিপির রচনাকাল ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ।