গল্পগ্রন্থ

নিখোঁজ নকশার নারকীয় নাটক

নিখোঁজ নকশার নারকীয় নাটক
[ দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ব্রুস-পার্টিংটন প্ল্যান ]

১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে গাঢ় হলদে কুয়াশায় ছেয়ে গিয়েছিল সারা লন্ডন শহর। সোমবার থেকে বেস্পতিবার পর্যন্ত বেকার স্ট্রিটের ঘরের জানলা দিয়ে রাস্তার ওপারের বাড়ি পর্যন্ত দেখা যায়নি। প্রথম দিনটা হোমস ঘরে বসে কাটাল বিরাট একটা খাতায় রকমারি খবর আঠা দিয়ে সেঁটে সূচিপত্র তৈরি করার কাজ নিয়ে; দ্বিতীয় আর তৃতীয় দিনটা কাটল মধ্যযুগীয় সংগীত নিয়ে এটা ওর সাম্প্রতিক শখ; কিন্তু চতুর্থ দিনেও প্রাতরাশ খেয়ে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ানোর পর যখন দেখা গেল চটচটে ভারী বাদামি কুয়াশাবর্ত তখনও রাস্তা দিয়ে ভেসে চলেছে এবং তেলের মতো ফোঁটা ফোঁটা আকারে শার্সির কাচে জমছে, তখন শক্তি আর উদ্যমে ঠাসা শার্লক হোমসের মেজাজ ঠিক রাখা গেল না। অবদমিত এনার্জি যেন ফেটে পড়ল অসহিষ্ণু কথাবার্তায়, বসবার ঘরে অস্থির পদচারণায়। নখ কামড়ে ফার্নিচারে টরে টক্কা বাজনা বাজিয়ে সে এক কাণ্ড করে বসল বন্ধুবর।

আমাকে বলল, ওয়াটসন, খবরের কাগজে ইন্টারেস্টিং খবর-টবর আছে?

আমি তো জানি ইন্টারেস্টিং খবর মানে হোমস বোঝে কেবল অপরাধ সম্পর্কিত খবর। অনেক খবরই আছে খবরের কাগজে; যুদ্ধ লাগল বলে, সরকারের পতন ঘটতে পারে, এক জায়গায় বিপ্লবের সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে কিন্তু এসব খবরের কোনো আগ্রহই নেই বন্ধুবরের। তাই ফের অধীরভাবে গজগজ করতে করতে ঘরময় পা ঠুকেঠুকে বেড়াতে লাগল বেচারা।

স্পোর্টসম্যান যদি খেলার সুযোগ না-পায়, তার যা অবস্থা হয়–হোমসের অবস্থা এখন তাই। বকবক করতে লাগল আপন মনে, লন্ডন শহরটা দেখছি একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। কুয়াশায় ঢাকা এমন শহরেই তো দাপাদাপি করে বেড়ানো উচিত চোরডাকাত বদমাশদের। আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ে কাজ সেরেই লম্বা দেবে–কেউ টের পাবে না।

ছিঁচকে চুরি এন্তার হচ্ছে অবশ্য।

অবজ্ঞায় নাসিকাধ্বনি করে হোমস বললে, আরে ভায়া সমাজের কপাল ভালো আমি নিজে একটা ক্রিমিনাল নই। বিরাট এই স্টেজ সাজানো রয়েছে কি ছিঁচকে চুরির জন্যে? আরও বিরাট অপরাধের উপযুক্ত ক্ষেত্র কি এটা নয়? অপরাধীদের সুবর্ণ সুযোগ তো এখনই।

তা যা বলেছ।

ওয়াটসন, একঘেয়েমি কাটতে চলেছে মনে হচ্ছে।

টেলিগ্রাম নিয়ে ঘরে ঢুকল ঝি। খাম ছিঁড়ে অট্টহাসি হাসল হোমস।

আরে সর্বনাশ! শেষকালে মাইক্রফট দাদা আসছে ছোটো ভাইয়ের আস্তানায়।

এমনভাবে বলছ যেন তার আসাটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার।

বন্ধু, ট্রাম যদি বড়োরাস্তায় বাঁধা লাইন ছেড়ে হঠাৎ গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে, অবাক হবে তো? আমার এই দাদাটিরও বাঁধা লাইনে হল পলমল আস্তানা, ডায়োজিনিস ক্লাব আর হোয়াইট হল। এই লাইনেই চক্রবৎ সে ঘোরে–বেলাইন কখনো হয় না। জীবনে একবারই সে এসেছিল এখানে। আজ হঠাৎ লাইন ছেড়ে বেরিয়ে গেল কেন ভাবতে পারছি না।

টেলিগ্রামে তা লেখেনি?

টেলিগ্রামটা বাড়িয়ে দিল হোমস। আমি পড়লাম :

ক্যাডোগেনের ব্যাপারে এখুনি দেখা করব। মাইক্রফট।

ক্যাডোগেন ওয়েস্ট নামটা কিন্তু শুনেছি।

কিন্তু আমার কিছুই মনে পড়ছে না। অবাক হচ্ছি দাদার বেলাইন হওয়া দেখে। কক্ষপথ থেকে গ্রহ ছিটকে যাওয়া আর মাইক্রফট দাদার অন্য পথ পরিক্রমা করা একই ব্যাপার! ভালো কথা, মাইক্রফট কি চিজ তা জান তো?

গ্রিক দোভাষীর মামলা হাতে এলে সামান্য কিছু শুনেছি সরকারি চাকুরে, এই পর্যন্ত জানি!

খুকখুক করে হেসে উঠল, তখন তোমাকে ততটা চিনিনি বলে খুলে বলিনি। মাইক্রফট ব্রিটিশ সরকারের চাকরি করে ঠিকই কিন্তু মাঝে মাঝে ও নিজেই ব্রিটিশ সরকার হয়ে যায়।

কী আবোল-তাবোল বকছ ভায়া!

জানতাম অবাক হয়ে যাবে। মাইক্রফট বছরে মাইনে পায় মাত্র সাড়ে চারশো পাউন্ড। চিরকালই অন্যের অধীনে খেটে এসেছে, জীবনে কোনোরকম উচ্চাশা নেই, সম্মান বা উপাধি কখনোই পাবে না। তা সত্ত্বেও তাকে ছাড়া মাঝে মাঝে এদেশের চলে না–চলবে না।

কীভাবে শুনি?

ও-রকম একটা সাজানো ঝকঝকে তকতকে ব্রেন আর দুটি নেই বলে। ফলে নিজেই নিজেকে এমন একটা অবস্থায় এনে ফেলেছে যে পাল্লা দেওয়ার মতো দ্বিতীয় ব্যক্তি আর নেই। মগজের মধ্যে অজস্র ঘটনা ঠেসে রাখবার এমন আশ্চর্য ক্ষমতা জীবিত কোনো মানুষের মধ্যে দেখিনি। বিরাট যে ক্ষমতা আমি অপরাধী অন্বেষণে লাগিয়েছি, ও তা সরকারি কাজে লাগিয়েছে। বিপুল এই ক্ষমতার অধিকারী বলেই সব ডিপার্টমেন্ট থেকেই যেকোনো ব্যাপারে চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারটা ছেড়ে দেওয়া হয় ওর ওপর। ও হল সেন্ট্রাল এক্সচেঞ্জ, ক্লিয়ারিং হাউস ওর মগজ থেকে যে সিদ্ধান্ত মেজেঘষে বেরিয়ে যাবে, তাতে সব দিক রক্ষে হবেই। অন্যেরা শুধুই বিশেষজ্ঞ, ও কিন্তু সর্বজ্ঞ। ধরো কোনো মন্ত্রীমশায় কোনো একটা ব্যাপারে নৌবিভাগ, ভারতবর্ষ, কানাডা আর ধাতু সম্পর্কে পরামর্শ চান। এর জন্যে আলাদা দপ্তর আছে। সব দপ্তর থেকে আলাদাভাবে পরামর্শ নিতে পারেন। কিন্তু মাইক্রফটের ব্রেনে সব দপ্তরই ঠাসা। ও একাই সমস্যাটার সবরকম সম্ভাবনা ভেবে নিতে পারে মাথার মধ্যে সব খবর ফোকাস করে নিয়ে একই সমস্যার কতরকম প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে, চট করে বলে দিতে পারে। আগে এইজন্যই শর্টকাট পরামর্শদাতা হিসেবে কাজে লাগানো হত মাইক্রফটকে–এখন তাকে ছাড়া একদণ্ড চলে না। ওর ওই বিরাট ব্রেনে পায়রার খুপরির মতো ছোটো ছোটো খুপরিতে রাজ্যের খবর থরে থরে সাজানো থাকে বলেই চক্ষের নিমেষে ওর মতামত পেয়ে ব্রিটিশ সরকার বর্তে যায়। একাধিকবার জাতির নীতি নির্ধারিত হয়েছে ওর পরামর্শের ভিত্তিতে। এই নিয়েই আছে ও, এইসবই ওর ধ্যানধারণা, মানসিক ব্যায়ামের উপাদান। মাঝে মাঝে ছোটোখাটো সমস্যা নিয়ে আমি দ্বারস্থ হলে ছিটেফোঁটা বুদ্ধি বর্ষণ করেছে আমাকে কিন্তু আজকে যে দেখছি উলটো ব্যাপার। বিরাট বৃহস্পতি খুদে পৃথিবীর কাছে আসছে। কে এই ক্যাডোগেন ওয়েস্ট? তাকে নিয়ে মাইক্রফটের হঠাৎ মাথাব্যথা কেন?

সোফার ওপর থেকে কাগজের তাড়া হাঁটকাতে হাঁটকাতে উত্তেজিতভাবে বললাম–পেয়েছি, পেয়েছি! গত মঙ্গলবার সকালে পাতালরেলে একটা ছোকরার মৃতদেহ পাওয়া গেছে–নাম তার ক্যাডোগেন ওয়েস্ট।

সিধে হয়ে বসল হোমস, পাইপটা ঠোঁট পর্যন্ত আর পৌঁছোল না।

ওয়াটসন, ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে গুরুতর। সামান্য একটা মৃত্যু নিয়ে বেলাইনে চলার পাত্র নয় আমার এই দাদাটি। যদূর মনে পড়ছে ছোকরা ট্রেন থেকে পড়ে মারা গেছে। পকেট মারা যায়নি, কেউ ঠেলেও ফেলে দেয়নি–মারপিট বা চুরিডাকাতির নামগন্ধ নেই। এ-রকম একটা ভিজে ব্যাপারে মাইক্রফট মাথা ঘামাচ্ছে কেন? আশ্চর্য ব্যাপার তো!

তদন্তের ফলে বেশ কিছু আশ্চর্য খবর জানা গেছে। কেসটা কিন্তু অদ্ভুত।

নইলে আমার ভাই মাথা ঘামায়। আর্মচেয়ারে আড় হয়ে শুয়ে হোমস বললে, বলো ভায়া, আমি শুনছি।

ছোকরার বয়স সাতাশ, নাম আর্থার ক্যাডোগেন ওয়েস্ট, আইবুড়ো, উলউইচ আর্সেনালের কেরানি।

তার মানে সরকারি চাকুরে। মাইক্রফটের লাইনে এসে গেল দেখছি!

গত সোমবার রাত্রে হঠাৎ বেরিয়ে যায় উলউইচ থেকে। শেষ দেখেছে তার প্রণয়িনী মিস ভায়োলেট ওয়েস্টবুরি সন্ধে সাড়ে সাতটার সময়ে তার কাছ থেকেও হঠাৎ বিদায় নেয় ছোকরা। কারণটা মেয়েটাও বুঝতে পারনি কেননা কোনোরকম ঝগড়াঝাটি হয়নি দুজনের মধ্যে। মৃতদেহটা পায় ম্যাসোন নামে একজন রেলকর্মচারী। লাইনে প্লেট বসায় সে। দেহটা পাওয়া যায় লন্ডন পাতালরেলের আল্ডগেট স্টেশনের ঠিক বাইরে।

কখন?

মঙ্গলবার ভোর ছটায়। স্টেশনের কাছাকাছি রেললাইন যেখানে টানেলে ঢুকছে, সেইখানে পুবদিকে যেতে বাঁ-হাতি লাইনের বেশ খানিকটা তফাতে পড়েছিল দেহটা–মাথাটা এমনভাবে থেঁতলে গিয়েছে যে দেখলেই বোঝা যায় ট্রেন থেকে না-পড়লে লাইনের ধারে দেহটা ওভাবে পড়ে থাকতে পারে না। বাইরের রাস্তা থেকে ডেডবডি এনে ওখানে ফেলতে গেলে স্টেশনের টিকিট কালেক্টরের চোখে পড়ত।

বুঝলাম। জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ট্রেন থেকে হয় নিজে পড়ে গেছে, না হয় ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তারপর?

যে-লাইনের ধারে ডেডবডি পাওয়া গেছে, সেই লাইন দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্বে ট্রেন যায়। মাঝরাতে ছোকরা ট্রেন থেকে পড়ে মারা গেছে কিন্তু ট্রেনে উঠেছিল কখন ধরা যাচ্ছে না।

টিকিটটা দেখলেই তো ধরা যায়।

টিকিট-ফিকিট কিছুই পাওয়া যায়নি পকেটে।

টিকিট পাওয়া যায়নি! ওয়াটসন, এ তো ভারি আশ্চর্য ব্যাপার! আমি জানি টিকিট না-দেখিয়ে মেট্রোপলিটান ট্রেনের প্ল্যাটফর্মেই ঢোকা যায় না। টিকিটটা কি তাহলে পকেট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে পাছে টিকিট দেখে বোঝা যায় কোন স্টেশন থেকে উঠেছে বলে? খুবই সম্ভব। নাকি কামরার মধ্যে নিজেই ফেলে দিয়েছে? সেটাও সম্ভব। পয়েন্টটা কিন্তু রীতিমতো অদ্ভুত। চুরিডাকাতির নামগন্ধ তো নেই, তাই না?

সেইরকমই দেখা যাচ্ছে। পকেটে যা পাওয়া গেছে, তার ফর্দটা শোনো। দু-পাউন্ড পনেরো শিলিং ছিল মানিব্যাগে; ক্যাপিটাল অ্যান্ড কাউন্টিজ ব্যাঙ্কের একটা চেকবই–উলউইচ ব্রাঞ্চের; এই চেকবই থেকেই লোকটার ঠিকুজিকুষ্ঠি জানা যাবে। উলউইচ থিয়েটারের দুটো ড্রেস-সার্কল টিকিটও ছিল পকেটে–তারিখ ওই দিনের। ইভনিং শোয়ের টিকিট। আর ছোটো এক প্যাকেট টেকনিক্যাল কাগজপত্র।

খুশি হল হোমস দেখলে তো ওয়াটসন পর পর সব মিলে যাচ্ছে! ব্রিটিশ সরকার–উলউইচ অস্ত্রাগার টেকনিক্যাল কাগজপত্র–মাইক্রফট দাদা। ওই তো এসে গেছে মাইক্রফট।

ঘরে ঢুকলেন মাইক্রফট হোমস। দিব্য লম্বা-চওড়া চেহারা। বিরাট চেহারার মধ্যে শারীরিক শক্তি যেন একটু বেশিভাবে প্রকট অথচ ধড়ের বুদ্ধিসমুজ্জ্বল মুণ্ডখানা দেখলে ধড়ের কথা আর মনে থাকে না। ইস্পাত-ধূসর কোটরে বসানো ধারালো চোখ, কাঠের দৃঢ় ঠোঁট এবং কর্তৃত্বব্যঞ্জক ললাট–সব মিলিয়ে চেয়ে থাকার মতো। ধড়টার কথা ভুলে যেতে হয়–বিরাট ওই মস্তকের মধ্যে শক্তিশালী পর্দাটার কথাই কেবল মনে জেগে থাকে।

পেছনে পেছনে এল লেসট্রেড–স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ডিটেকটিভ। দুজনেরই মুখ গম্ভীর। ওভারকোট খুলে আর্মচেয়ারে বসলেন মাইক্রফট হোমস।

বললেন, শার্লক, কেসটা অতি যাচ্ছেতাই। রোজকার অভ্যেস পালটানো আমার ধাতে সয়! কিন্তু না-এসেও পারলাম না। শ্যাম দেশের অমন জরুরি সমস্যা ফেলে চলে আসতে হল প্রধানমন্ত্রীর ছটফটানি দেখে –নৌবিভাগের প্রশাসন দপ্তরে গেলে শুনবি যেন চাকভাঙা বোলতা গুনগুন করছে–উত্তেজনায় কেউ আর স্থির নেই। কাগজ পড়েছিস তো?

এইমাত্র পড়লাম। টেকনিক্যাল কাগজপত্রগুলো কীসের?

এই রে, ঠিক পয়েন্টে এসে গেলি দেখছি! কপাল ভালো কাগজে ওটা বেরোয়নি–বেরোলে ঢি ঢি পড়ে যেত। ছোকরার পকেটে পাওয়া গেছে ব্রুস-পার্টিংটন সাবমেরিনের নকশা। নামটা শুনেছিস নিশ্চয়?

শুধু নামই শুনেছি–তার বেশি নয়।

নকশাটা সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ। গুপ্ত রাখার সবরকম চেষ্টাই করেছিল সরকার। ব্রুস-পার্টিংটন সাবমেরিন জলে নামলে সে-তল্লাটে কোনো যুদ্ধজাহাজকেই আর যুদ্ধ করতে হবে না। তিরিশটা আলাদা পেটেন্ট নিয়ে তৈরি হয়েছে গোটা নকশাটা–প্রত্যেকটা পেটেন্ট সমান গুরুত্বপূর্ণ–কোনোটাকেই বাদ দেওয়া যায় না, দিলে প্ল্যান কেঁচে যাবে। প্ল্যানটা গুপ্ত রাখার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি হয়নি। অস্ত্রাগারের লাগোয়া গোপন চেম্বারে সিন্দুকের মধ্যে রাখা হয়েছে এবং সে-ঘরের দরজা জানলায় এমন ব্যবস্থা করা আছে যে চোর ডাকাতের চোদ্দোপুরুষের ক্ষমতা নেই ভেতরে ঢোকার। অফিস থেকে এ-নকশা বেরিয়ে যাওয়ার কোনোরকম সম্ভাবনা কল্পনাও করা যায় না। নৌবিভাগের চিফ কনট্রাক্টর যদি ইচ্ছে করেন নকশাটা দেখবেন, তাহলে তাঁকেও আসতে হবে ওই ঘরের মধ্যে। উলউইচ অফিসে। তা সত্ত্বেও লন্ডনের বুকে একজন জুনিয়ার ক্লার্কের মৃতদেহের পকেটে পাওয়া গেল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সাংঘাতিক গোপনীয় এই প্ল্যান। সমস্ত সরকারি মহল তাই এখন থরহরি কম্প এই ব্যাপার নিয়ে।

কিন্তু প্ল্যান তো পেয়ে গেছ?

না, শার্লক না! দশটা কাগজ সরানো হয়েছিল উলউইচ থেকে। তার মধ্যে সবচেয়ে দরকারি তিনটে কাগজ একদম বেপাত্তা–সাতটা পাওয়া গেছে ছোকরার পকেটে। বাকি তিনটে তাহলে গেল কোথায়? পুলিশ আদালতের ওইসব ছিঁচকে মামলা শিকেয় তুলে আদা জল খেয়ে লেগে পড়–দেশের কাজ কর–ইংলন্ড কৃতজ্ঞ থাকবে তোর কাছে। সমস্যাটা আন্তর্জাতিক, খেয়াল থাকে যেন ছিঁচকে কেস নয়। কাগজপত্র ক্যাডোগেন ওয়েস্ট সরাতে গেল কেন, তিনটে কাগজ এখন কোন চুলোয়, ক্যাডোগেন পরলোকে গেল কীভাবে, রেললাইনের ধারেই-বা নশ্বর দেহটা পৌঁছোল কী করে, শয়তানি চক্র ফাঁস করা যায় কীভাবে এতগুলো প্রশ্নের জবাব তোকে বার করতে হবে।

দাদা, তোমার চোখ আমার মতোই ধারালো। তুমি নিজে দেখছ না কেন।

তথ্য এনে দে–চেয়ারে বসে মাথা খাঁটিয়ে সমাধান বাতলে দেব। কিন্তু ছুটোছুটি করা আমার পোষায় না। রেলগার্ডকে গিয়ে জেরা করা, কি উপুড় হয়ে লেন্স নিয়ে মাটি পরীক্ষা করা–ওসব আমার কুষ্ঠিতে লেখা নেই। কাজটা তোর। বড়ো রকমের খেতাব-টেতাব পাওয়ার ইচ্ছে যদি থাকে তো—

হেসে উঠল শার্লক হোমস।

মাথা নেড়ে বললে, আমি খেলি, খেলতে ভালোবাসি বলে। কেসটা সত্যিই ইন্টারেস্টিং। কিন্তু আরও কিছু ঘটনা চাই যে।

এই কাগজটা রাখ–এতে দরকারি পয়েন্ট আর কিছুঠিকানা লিখে এনেছি। কাগজপত্র রাখার মূল দায়িত্ব স্যার জেমস ওয়ালটারের। ভদ্রলোকের মাথার চুল পেকেছে সরকারি কাজে, অসীম শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের পাত্র, ডিগ্রি লিখতে গেলে দু-লাইনেও ধরে না—এর দেশাত্মবোধ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। সিন্দুকের দুটো চাবির একটা থাকে এঁর কাছে। সোমবার অফিস টাইমে কাগজগুলো সিন্দুকেই ছিল। চাবি নিয়ে স্যার জেমস তিনটে নাগাদ লন্ডন রওনা হন। সন্ধের দিকে এ-ঘটনা যখন ঘটে উনি তখন বারক্রে স্কোয়ারে–অ্যাডমিরাল সিনক্লেয়ারের বাড়িতে বসে।

খবরটা যাচাই করা হয়েছে তো?

হয়েছে। স্যার জেমসের ভাই কর্নেল ভ্যালেনটাইন ওয়ালটার বলেছেন উলউইচ থেকে কখন বেরিয়ে গিয়েছিলেন স্যার জেমস। অ্যাডমিরাল সিনক্লেয়ার বলেছেন উনি লন্ডনে ছিলেন কখন। কাজেই এদিক দিয়ে স্যার জেমসকে ধাঁধা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে।

দ্বিতীয় চাবিটা কার কাছে থাকে?

মিস্টার সিডনি জনসনের কাছে একধারে সিনিয়র ক্লার্ক আর নকশা আঁকিয়ে লোকটা বিমর্ষ টাইপের, বয়স চল্লিশ, বিয়ে করেছে, ছেলে-মেয়ে পাঁচটি। কম কথা বলে, খাটে খুব, কাজের রেকর্ড ভালো, কিন্তু সহকর্মীদের কাছে অপ্রিয়। তার বউ বলেছে, সোমবার সন্ধেটা বাড়িতেই ছিল সিডনি জনসন–ঘড়ির চেনে ঝোলানো চাবি কাছছাড়া হয়নি এক সেকেন্ডের জন্যেও।

ক্যাডোগেন সম্বন্ধে এবার বলো।

ছোকরা চাকরিতে এসেছে বছর দশেক। মাথা গরম, কাজ ভালো, সোজা চরিত্রের লোক। ওর বিরুদ্ধে আমাদের বলার কিছু নেই। অফিসে সিডনি জনসনের ঠিক পরেই ওর স্থান। কাজের খাতিরে রোজই প্ল্যান নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। প্ল্যানে হাত দেওয়ার সুযোেগ আর কারো নেই।

রাত্রে প্ল্যান সিন্দুকে তুলেছিল কে?

সিনিয়র ক্লার্ক মিস্টার সিডনি জনসন।

জুনিয়ার ক্লার্ক ক্যাডোগেন ওয়েস্টের পকেটে যখন প্ল্যান পাওয়া গেছে, তখন চুরিটা সে-ই করেছে–এ নিয়ে দ্বিমত আছে কি?

নেই। কিন্তু শার্লক, জট তো তাতে পরিষ্কার হচ্ছে না বরং বাড়ছে। যেমন, কাগজপত্র ও নিতে গেল কেন?

বিনিময়ে টাকা পেত নিশ্চয়?

কয়েক হাজার পাউন্ড তো পেতই।

বিক্রি করার উদ্দেশ্য ছাড়া লন্ডনে কাগজ নিয়ে যাওয়ার আর কোনো উদ্দেশ্য আছে কি?

আমার মাথায় তো আসছে না।

তাহলে কাজ শুরু করার জন্যে এই উদ্দেশ্যটা ধরে এগোনো যাক। ওয়েস্ট ছোকরা কাগজ নিয়েছে নকল চাবি দিয়ে—

একটা নকল চাবিতে হত না, শার্লক। কয়েকটা লাগবে। সদর দরজা খুলতে হবে, ঘরের দরজা খুলতে হবে।

বেশ তো, বেশ কয়েকটা নকল চাবি নিয়ে কাগজ সরাল ছোকরা। লন্ডনে গেল বিক্রি করতে। মতলব ছিল ভোরের আগেই ফিরে সিন্দুকে ঢুকিয়ে রাখবে আসল প্ল্যান। কিন্তু লন্ডনে হাতে হাতে ফল পেল বিশ্বাসঘাতকতার।

কীভাবে?

উলউইচে ফেরার সময়ে ট্রেনেই তাকে খুন করা হয়–লাশ ফেলে দেওয়া হয় লাইনের ধারে।

লাশ পাওয়া গেছে আল্ডগেট স্টেশনের কাছে। স্টেশনটা লন্ডন ব্রিজ পেরিয়ে–উলউইচ যাওয়ার রাস্তায়।

লন্ডন ব্রিজ পেরিয়ে যাওয়ার কারণও নিশ্চয় আছে। কামরায় এমন কেউ ছিল যার সঙ্গে তন্ময় হয়ে কথা বলছিল ছোকরা। কথার শেষে বচসা, হাতাহাতি, খুন। অথবা হয়তো কামরা থেকেই নিজেই লাফিয়ে বাঁচতে গিয়ে মারা গেছে। সঙ্গে যে ছিল, দরজা বন্ধ করে ছিল। ঘন কুয়াশায় কেউ জানতেও পারল না কী ঘটে গেল।

কিন্তু তোর নিজের যুক্তিতেই ফাঁক থেকে যাচ্ছে, শার্লক। প্ল্যান বিক্রি করলেও যে-লোক সন্ধে নাগাদ লন্ডন যাবে, সে উলউইচ থিয়েটারে সন্ধের শোয়ের টিকিট কাটতে যাবে কেন? প্রণয়িনীকে মাঝপথে ফেলে লম্বা দেবে কেন?

লেসট্রেড এতক্ষণ ছটফট করছিল কথার যুদ্ধ শুনতে শুনতে। এবার দুম করে বলে উঠল, ধোঁকা দেওয়ার জন্যে।

খুবই অসাধারণ ধোঁকা সন্দেহ নেই। এই গেল ধোঁকা-তত্ত্বে আমার প্রথম আপত্তি। দ্বিতীয় আপত্তি হল এই : ভোরের আগেই কাগজ দশটা ফিরিয়ে না-আনলে কিন্তু চুরি ফাঁস হয়ে যাবে জেনেও সে পকেটে করে মাত্র সাতটা কাগজ নিয়ে ফিরছিল কেন? বাকি তিনটে গেল কোন মুলুকে? তা ছাড়া এত কাঠখড় পুড়িয়ে নকশা বেচতে যে লন্ডন গেল, নকশা-বেচার টাকাটা পকেটে না-নিয়েই-বা সে ফিরছিল কেন?

লেসট্রেড তৈরি হয়েই ছিল জবাব দেওয়ার জন্যে। বলে উঠল, এ আর এমন কী কঠিন ব্যাপার। বেচবে বলেই নিয়ে গিয়েছিল লন্ডনে। কিন্তু দরে পোষাল না বলে ফিরছিল যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে দেবে বলে। শত্রুর চর ছাড়বে কেন, পেছন পেছন এল, ট্রেনের মধ্যে খুন করল, সবচেয়ে দরকারি নকশা তিনটে পকেটস্থ করল, লাশ বাইরে ফেলে দিল, ল্যাটা চুকে গেল। কেমন? সব সমস্যার সমাধান পেয়ে গেলেন কি না?

কাছে টিকিট ছিল না কেন?

কোন স্টেশনের কাছে শত্রুর চর থাকে, পাছে তা ফাঁস হয়ে যায়, তাই খুনি নিজেই টিকিটটা সরিয়েছে পকেট থেকে।

তাহলে আর এত ঝঞ্ঝাট কেন? বিশ্বাসঘাতক প্রাণ দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছে, সাবমেরিনের নকশাও এতক্ষণে শত্রুর দেশে চলে গেছে। তাহলে আর খামোকা মাথা ঘামিয়ে দরকারটা কী?

তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে ষাঁড়ের মতো গাঁক গাঁক করে চিৎকার করে উঠলেন মাইক্রফট-গা তোল, শার্লক, গা তোল! আমার মন বলছে তোদের এ সব অনুমানই ভুল–গোড়া থেকেই ভুল। উঠে পড়ে কাজে লেগে যা, অকুস্থলে হানা দে, সংশ্লিষ্ট লোকজনদের ধরে জেরা করে নাস্তানাবুদ করে ছাড়। সাধ্যমতো যা করতে পারিস–কোনোটা বাকি রাখিসনি। দেশকে এভাবে সেবা করার এত বড়ো সুযোগ জীবনে তুই পাসনি।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে হোমস বললে, ঠিক আছে, ঠিক আছে। দেখি কী করা যায়! ওয়াটসন, উঠে পড়ো। লেসট্রেড, চলো আমার সঙ্গে আল্ডগেট স্টেশনে। মাইক্রফট, ঘরের ছেলে ঘরে যাও। সন্ধের মধ্যেই খবর দোব। তবে খুব একটা কিছু আশা করে থেকো না।

একঘণ্টা পরে আল্ডগেট স্টেশনের ঠিক আগে টানেল থেকে বেরিয়ে আসা পাতালরেলের ধারে এসে দাঁড়ালাম আমি, হোমস আর লেসট্রেড। রেল কোম্পানির তরফ থেকে একজন সদাশয় লালমুখো বৃদ্ধ ভদ্রলোক এলেন সঙ্গে।

লাইন থেকে ফুট তিনেক তফাতে একটা জায়গা দেখিয়ে ভদ্রলোক বললেন, লাশ পড়েছিল এইখানে। দেখলেই বুঝবেন ওপর থেকে পড়া সম্ভব নয়–ট্রেনের ভেতর থেকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। যদূর খবর পেয়েছি, সোমবার মাঝরাতে যে-ট্রেনটা গেছে এখান দিয়ে লাশ ফেলা হয়েছে সেই ট্রেন থেকেই।

কামরাগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে? মারপিটের চিহ্ন পাওয়া গেছে?

সে-রকম চিহ্ন বা টিকিট কিছুই পাওয়া যায়নি।

কোনো দরজা খোলা ছিল কি?

না।

লেসট্রেড বললে, আমরা অবশ্য একটা খবর পেয়েছি। আল্ডগেট স্টেশনে ট্রেন ঢোকবার ঠিক আগে সোমবার এগারোটা চল্লিশ নাগাদ ধপাস করে একটা ভারী জিনিস পড়ার আওয়াজ পায় একজন যাত্রী–ঘন কুয়াশার জন্যে কিছু দেখা যায়নি। আরে, আরে, মি. হোমস, ওটা কী করছেন?

নিঃসীম আগ্রহে উদ্দীপ্ত মুখে ইস্পাতের রেললাইনের পানে নিমেষহীন নয়নে চেয়ে ছিল শার্লক হোমস। রেললাইন যেখানে বেঁকে বেরিয়ে এসেছে টানেলের মধ্যে থেকে চেয়ে আছে ঠিক সেইদিকে। আল্ডগেট একটা জংশন স্টেশন, অনেক রেললাইনের কাটাকাটি চলেছে সেখানে হোমসের সাগ্রহ চাহনি নিবদ্ধ এইসব লাইনের কাটাকুটির দিকে। এ চেহারা, এ চাহনি–আমি চিনি। থিরথির করে কাপছে নাকের পাটা, বেঁকে শক্ত হয়ে গিয়েছে পাতলা ঠোঁট, বঙ্কিম চেহারা নিয়েছে ভুরু জোড়া।

বিড়বিড় করে বলল আপন মনে, পয়েন্টস!

কী বলছেন বলুন তো?

রেললাইনের এত পয়েন্ট আর কোথাও নেই, তাই না?

না।

সেইসঙ্গে একটা বাঁক। লাইনে লাইনে কাটাকুটি আর একটা বাঁক! আহারে, তাই যদি হত!

কী হত মি. হোমস? সূত্র পেয়েছেন মনে হচ্ছে?

একটা আইডিয়া পেয়েছি বলতে পার–অন্ধকারে একটা নিশানা দেখা যাচ্ছে যেন। সেটা ক্রমশই আরও বেশি ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠছে। লাইনে তেমন রক্ত পড়েনি দেখছি।

কিন্তু চোটটা জবর রকমের তাই না?

হাড় গুঁড়িয়ে গিয়েছিল–বাইরে চোট খুব একটা লাগেনি।

তা সত্ত্বেও রক্তপাতটা সবাই আশা করে। কুয়াশার মধ্যে যে-ট্রেন থেকে ভারী জিনিস পড়বার ধপাস আওয়াজ পাওয়া গিয়েছিল, সে-ট্রেনটা পরীক্ষা করার সুযোগ হবে?

সম্ভব নয়, মি. হোমস। কামরাগুলো সব খুলে ফেলে অন্য ট্রেনে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এতক্ষণে।

লেসট্রেড বললে, আমি নিজে সব কামরা দেখেছি। কিন্তু চোখে পড়েনি।

হোমসের চরিত্রে একটা দুর্বলতা আছে। কারো ভোতা বুদ্ধি একদম সইতে পারে না–ধৈর্যচ্যুতি ঘটে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে তিরিক্ষে গলায় বললে, কিন্তু আমি কামরা পরীক্ষা করার জন্যে ট্রেনটা দেখতে চাইনি। ওয়াটসন, চলো, এখানে আর কিছু দেখবার নেই। লেসট্রেড, তোমাদের আর কষ্ট দেব না। এবার উলউইচে গিয়ে তদন্ত আরম্ভ করতে হবে দেখছি।

লন্ডন ব্রিজ থেকে ভাইকে একটা টেলিগ্রাম পাঠাল হোমস :

অন্ধকারে আলোর নিশানা পাচ্ছি। তবে নিভে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। লোক মারফত বেকার স্ট্রিটের বাসায় বিদেশি স্পাই আন্তর্জাতিক গুপ্তচরদের লিস্ট পাঠিয়ে দাও–ইংলন্ডে যারা আছে সবার নাম আর ঠিকানা চাই–লোকটা যেন আমি না-ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করে, শার্লক।

উলউইচের ট্রেনে উঠে বসে হোমস, এতেই কাজ হবে। এইরকম একটা অতি আশ্চর্য কেসে নাক গলানোর সুযোগ দিয়ে মাইক্রফট যথেষ্ট উপকার করল আমার।

নিশ্চয় একটা অদ্ভুত রক্ত-চনমন করা চিন্তা ঢুকেছে হোমসের মগজে। চাপা, তীব্র প্রাণশক্তি যেন ফুটে ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ-মুখ থেকে। খাঁচায় বন্ধ ল্যাজঝোলা কানঝোলা ফক্স হাউন্ডের চেহারা একেবারে পালটে যায় শিকারের গন্ধ পেলে। অবিকল সেই পরিবর্তন দেখা দিয়েছে শার্লক হোমসের মধ্যে। মাত্র ক-ঘণ্টা আগে এই মানুষটাই কুয়াশা-পিঞ্জরে বন্দি অবস্থায় ঘরের মধ্যে ইঁদুর-রাঙা ড্রেসিং গাউন পরে অস্থির চরণে যেন লেংচে লেংচে পায়চারি করেছে দীর্ঘতনু নিয়ে কিন্তু এখন সে আর এক মানুষ।

শুধু বলল, উপাদান পাওয়া গেছে, ওয়াটসন। সুযোগ এখনও রয়েছে। আস্ত গাধা আমি তাই, সম্ভাবনাটা আগে বুঝিনি।

আমার কাছে কিন্তু এখনও সব অন্ধকার।

শেষটা এখনও অন্ধকার আমার কাছেও। তবে কি জান, একটা আইডিয়া মাথায় এলে তা থেকে আর একটা আইডিয়ায় যাওয়া যায়। ছোকরা মারা গেছে অন্য কোথাও, লাশটা রাখা হয়েছিল ট্রেনের ছাদে।

ছাদ!

ভায়া, লাশটা এমন একটা জায়গায় ঠিকরে পড়েছে যেখানে রেললাইনের কাটাকুটি থাকার দরুন আর বাঁক থাকার দরুন প্রত্যেকটা কামরাকে হেলেদুলে যেতে হবেই। কামরা যখন দুলতে থাকে ডাইনে বাঁয়ে, কামরার ভেতর থেকে কিছুই ছিটকে পড়ে না কিন্তু ছাদে কোনো বস্তু থাকলে, তা গড়িয়ে পড়বেই। তারপর দেখ, ও-রকম একটা মারাত্মক জখম হওয়া সত্ত্বেও তেমন রক্ত পড়ে নেই জায়গাটায়। তার মানে কি এই নয় যে ছোকরাকে পরলোকে পাঠানো হয়েছে অন্যত্র এবং লাশটাকে রেখে দেওয়া হয়েছিল ট্রেনের ছাদে? পয়েন্টস আর বাঁক পেরোনোর সময়ে আপনা থেকেই ঠিকরে পড়েছে লাইনের ধারে? পর পর দুটো অদ্ভুত ধাঁধার সমাধান দেখ এই একটা আইডিয়া থেকেই হয়ে গেল, তাই নয় কি?

শুধু কি তাই? পকেটে টিকিট না-থাকার কারণও তো স্পষ্ট হয়ে গেল! সোল্লাসে বললাম আমি।

ঠিক বলেছ। টিকিট কেন নেই, এবার তাও পরিষ্কার বোঝা গেল। সব সমস্যার সমাধান দেখ একে-একে পাওয়া যাচ্ছে, সঠিক আইডিয়াটি মাথায় আনতে পেরেছি বলে।

কিন্তু ভাই, রহস্য যে আরও গভীর হল এই আইডিয়ার ফলে।

হয়তো, বলে চিন্তাসাগরে ড়ুব দিল শার্লক হোমস–ট্রেন উলউইচে পৌঁছোনোর আগে আর একটি কথাও বলল না। প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে একটা ছ্যাকড়াগাড়িতে উঠে বসে পকেট থেকে বার করল মাইক্রফটের দেওয়া কাগজখানা।

বললে, সারাবিকেলটা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করে কাটাতে হবে। প্রথমেই যাব স্যার জেমস ওয়ালটারকে দর্শন করতে।

টেমসের ধারে বিখ্যাত ব্যক্তিটির সাজানো ভিলায় যখন পৌঁছোলাম, তখন কুয়াশা ফিকে হয়ে আসছে, আর্দ্র রোদ্র উঁকি দিচ্ছে। ঘণ্টা বাজাতেই খাস চাকর এসে দাঁড়াল দোরগোড়ায়।

বললে গম্ভীর মুখে, স্যার জেমসকে খুঁজছেন। তিনি আজ সকালে দেহ রেখেছেন।

সেকী কথা! আঁতকে উঠল হোমস, মারা গেছেন! কীভাবে?

ভেতরে আসুন। ওঁর ভাই কর্নেল ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে কথা বলে যান।

চলো।

বসবার ঘরে গেলাম। একটু পরেই উধ্বশ্বাসে এলেন একজন দীর্ঘকায় সুশ্রী ব্যক্তি। গালে হালকা রঙের দাড়ি। বয়স বছর পঞ্চাশ। চুল উশকোখুশকো। চোখ উল্লান্ত। সদ্য শোকের চিহ্ন সুস্পষ্ট। কথা পর্যন্ত বলতে পারছেন না–জড়িয়ে যাচ্ছে।

বললেন, বিশ্রী এই কেলেঙ্কারির ধাক্কা উনি সইতে পারলেন না। জীবনে যাঁকে কলঙ্ক স্পর্শ করতে পারেনি, বীভৎস এই ব্যাপারে তাঁর মন ভেঙে গিয়েছিল–তাই চলে গেলেন সবাইকে ছেড়ে।

ওঁকে কলঙ্ক মুক্ত করার জন্যেই এসেছিলাম। ওঁর মুখ থেকে ব্যাপারটা শুনলে রহস্য পরিষ্কার করতে পারতাম।

যা বলবার পুলিশকে উনি বলে গেছেন। ওঁর বিশ্বাস ক্যাডোগেন ওয়েস্ট ছোকরাই যত নষ্টের মূল। বাকিটুকু আরও গোলমেলে।

আপনার কী মনে হয়?

খবরের কাগজে যা পড়েছি আর দাদার মুখে যা শুনেছি তার বেশি কিছুই জানি না। মি. হোমস, যদিও ব্যাপারটা অভব্য দেখাচ্ছে তবুও বলি–এইরকম মানসিক অবস্থায় আপনি যত তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে বিদায় নেন, ততই ভালো।

বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসে হোমস বললে, এ-রকম একটা ঘটনা ঘটবে ভাবতেই পারিনি। আত্মহত্যা না হার্টফেল–সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। কর্তব্যে অবহেলা করার গ্লানি সইতে না-পেরে নিজেই নিজের জীবন শেষ করে দিলেন কি? পরে তা নিয়ে ভাবা যাবে। এখন যাওয়া যাক ক্যাডোগেন ওয়েস্টের বাড়ি।

শহরের প্রান্তে ছোটো একটা সাজানো বাড়িতে দেখা হল নিহত ছোকরার শোকবিহ্বল মায়ের সঙ্গে। তার কাছ থেকে বিশেষ কথা বার করা গেল না। তবে ছোকরার প্রণয়িনী মিস ভায়োলেট ওয়েস্টবুরি অনেক কথা বললে। মেয়েটির মুখ সাদা সোমবার রাত্রে শেষবার ক্যাডোগেনকে সে-ই দেখেছে।

বললে, মি. হোমস, দিনরাত কেবলই ভাবছি, ভাবছি আর ভাবছি–ঘুমাতেও পারছি না–কিন্তু কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না এ কী করে সম্ভব। আর্থার দেশকে ভালোবাসত প্রাণ দিয়ে। দেশের যাতে সর্বনাশ হয়, এমন কোনো কাজ ওকে দিয়ে সম্ভব নয়। নিজের হাত এক কোপে কাটতে রাজি সে, কিন্তু গুপ্ত কাগজ দেশের বাইরে সেই হাত দিয়ে পাচার করার পাত্র সে নয়। অসম্ভব, অবিশ্বাস্য আর্থারকে যারা জানে তারা কেউই বিশ্বাস করবে না।

কিন্তু ঘটনা যে অন্য কথা বলছে, মিস ওয়েস্টবুরি?

জানি, জানি, তাই তো সব গুলিয়ে যাচ্ছে।

টাকার দরকার হয়েছিল কি আর্থারের?

না। ওর চাহিদা কম, রোজগার ভালো। কয়েকশো পাউন্ড জমিয়েছিল। নতুন বছরেই বিয়ে হয়ে যেত দুজনের।

কোনোরকম মানসিক উত্তেজনা লক্ষ করেছিলেন কি? বলুন, মিস ওয়েস্টবুরি, আমাদের কাছে প্রাণ খুলে কথা বলুন।

মেয়েটির চোখ-মুখের চকিত পরিবর্তন হোমসের ধারালো নজরে ধরা পড়েছে। লাল হয়ে গেল মিস ওয়েস্টবুরি–দ্বিধায় পড়ল।

তারপর বললে, করেছিলাম। বুঝেছিলাম কী যেন ঘুরঘুর করছে ওর মনের মধ্যে।

অনেক দিন ধরেই কি তা লক্ষ করেছিলেন?

গত হপ্তায় লক্ষ করেছিলাম। সবসময়ে কী যেন ভাবত, যেন একটা উদবেগে পেয়ে বসেছিল। একবার চেপে ধরেছিলাম—কীসের এত ভাবনা বলার জন্যে। ও বললে—ব্যাপারটা অফিস সংক্রান্ত। অত্যন্ত গোপনীয়। আমাকেও বলা যাবে না।

গম্ভীর হয়ে গেল হোমস।

মিস ওয়েস্টবুরি, থামবেন না। আর্থার জড়িয়ে পড়তে পারে এমন কথাও যদি জানেন–তাও বলুন। বলা যায় না কী থেকে কী বেরিয়ে যায়।

নিশ্চয় বলব। বারদুয়েক বলি বলি করেও কী যেন চেপে গেছে। একবার শুধু বলেছিল, বিষয়টা অত্যন্ত গোপনীয় বিদেশি গুপ্তচররা দেদার টাকা ঢালবে যদি সন্ধান পায়।

আরও গম্ভীর হয়ে গেল হোমস।

আর কিছু?

আমরা নাকি বড়ো ঢিলে কড়াকড়ি মোটেই নেই–বিশ্বাসঘাতকের পক্ষে প্ল্যান হাতানো অত্যন্ত সোজা।

এ-কথা সম্প্রতি বলেছিল–না আগেও বলেছিল?

এই তো সেদিনের কথা আগে কক্ষনো বলেনি?

শেষ সন্ধের ব্যাপারটা বলুন।

থিয়েটারে যাব বলে বেরিয়েছিলাম। কুয়াশায় হেঁটে যাচ্ছিলাম। অফিসের কাছাকাছি এসে সাঁৎ করে মিলিয়ে গেল কুয়াশার মধ্যে।

কোনো কথা না-বলে?

খুব অবাক হয়ে একবার চেঁচিয়ে উঠেছিল–তার বেশি নয়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ও ফিরল না। বাড়ি চলে এলাম। পরের দিন সকালে অফিস খুলতে পুলিশ এল খোঁজ নিতে। দুপুর বারোটা নাগাদ শুনলাম ভয়ংকর খবরটা। মি. হোমস, মি. হোমস, কলঙ্কের হাত থেকে ওকে বাঁচান।

বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল হোমস।

বললে, এসো ওয়াটসন, এবার যাওয়া যাক অফিসে কাগজ হারিয়েছে যেখান থেকে।

গাড়ি চলতেই বললৈ, তদন্ত হাতে নিয়ে দেখেছিলাম ছোকরার কপাল মন্দ, এখন দেখছি একেবারেই জঘন্য। আসন্ন বিয়ের জন্যে টাকার দরকার হয়েছিল বলেই ভাবী জীবনসঙ্গিনীকে পর্যন্ত প্ল্যান হাতানোর প্ল্যান বলে তাকেও দুষ্কর্মের সঙ্গিনী করতে গিয়েছিল।

কিন্তু চরিত্র বলে জিনিসটা কি একেবারে ফেলনা? তা ছাড়া ভাবী জীবনসঙ্গিনীকে দুম করে রাস্তায় ফেলে পালাবে কেন?

তা ঠিক, তা ঠিক। কেসটা বড়ো ভয়ংকর হে, এ-রকম খটকা লেগে থাকবেই।

সিনিয়র ক্লার্ক সিডনি জনসন অফিসেই ছিল। সসম্মানে অভ্যর্থনা জানাল হোমসকে। চশমাপরা মাঝবয়েসি, পাতলা চেহারার মানুষ। গাল আর আঙুল থিরথির করে কাঁপছে স্নায়ুর ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ায়।

কী সাংঘাতিক কাণ্ড বলুন তো মি. হোমস? স্যার জেমসের মৃত্যুর খবর শুনেছেন?

সেখান থেকেই আসছি।

সোমবার সন্ধ্যাতেও কত নিখুঁত ছিল এই অফিস আর আজ? চিফ নেই, ক্যাডোগেন ওয়েস্ট খতম, নকশা উধাও। কী ভীষণ! কী ভীষণ! সব চাইতে ভীষণ হল ক্যাডোগেন ওয়েস্টের রাতারাতি চোর বনে যাওয়া।

আপনি ঠিক জানেন ক্যাডোগেন ওয়েস্ট চোর?

সে ছাড়া কে চুরি করবে বলুন? উঃ ভাবা যায় না!

সোমবার কখন বন্ধ হয়েছিল অফিস?

পাঁচটায়।

আপনি বন্ধ করেছিলেন?

আমিই সবশেষে অফিস ছেড়ে বেরোই।

নকশা ছিল কোথায়?

ওই সিন্দুকে। আমি নিজে রাখি ওখানে।

এ-বাড়ি পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে?

একজন বুড়ো যুদ্ধফেরত সৈন্য পাহারা দেয়। কিন্তু অন্যান্য অফিসও দেখতে হয় তাকে। লোকটা দারুণ বিশ্বাসী। সেদিন অবশ্য কুয়াশাও পড়েছিল প্রচণ্ড।

পাঁচটার পর এ-বাড়ি ঢুকতে গেলে নিশ্চয় তিনটে চাবির দরকার হত ক্যাডোগেন ওয়েস্টের?

তা হত। বাইরের দরজার চাবি, এই অফিসের দরজার চাবি, সিন্দুকের চাবি।

চাবি থাকত শুধু আপনার কাছে আর স্যার জেমস ওয়ালটারের কাছে?

আমার কাছে শুধু সিন্দুকের চাবি থাকে–দরজার নয়।

স্যার জেমস কি গুছোননা স্বভাবের মানুষ?

অত্যন্ত, তিনটে চাবিই একটা রিংয়ে রাখেন–আমি নিজে দেখেছি।

রিংটা নিয়েই লন্ডন গিয়েছিলেন?

তাই তো বলেছেন।

আপনার চাবি কাছছাড়া হয়নি তো?

কখনোই না।

অথচ ক্যাডোগোন ওয়েস্টের পকেটে নকল চাবিও পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া, কোনো ক্লার্ক যদি নকশা বিক্রির ফন্দি এঁটে থাকে, সে তা কপি করে নেয়–আসল নকশা লোপাট করতে যায় না। ঠিক কিনা?

নকশাগুলো এত টেকনিক্যাল, এত জটিল যে কপি করা মুশকিল।

কিন্তু আমি তো জানি আপনার, স্যার জেমসের আর ক্যাডোগেন ওয়েস্টের এ-ধরনের টেকনিক্যাল বিদ্যে আছে।

তা আছে। কিন্তু দোহাই আপনার, আমাকে এর মধ্যে টানবেন না–বিশেষ করে নকশা

যখন পাওয়া গেছে ওয়েস্টেরই পকেটে।

কিন্তু কপি করলেই যখন ঝঞ্ঝাট চুকে যেত, আসল নকশা নেওয়ার ঝুঁকি নিতে গেল কেন?

খুবই আশ্চর্য সন্দেহ নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও নিয়েছে।

এ-কেস অনেক ব্যাপারেই এমনি আশ্চর্য। যে কাগজ তিনটে এখনও নিখোঁজ, শুনলাম সেই তিনটেই নাকি গোটা নকশার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ?

তা ঠিক।

অন্য কাগজ হাতে না-রেখে এই তিনটে কাগজের সাহায্য নিয়ে ব্রুস পার্টিংটন সাবমেরিন তৈরি সম্ভব?

আগে সেইরকমই রিপোর্ট করেছিলাম অ্যাডমিরালটিকে। কিন্তু আজকে কাগজপত্র ফের দেখলাম। যে কাগজে ডবল ভালভের অটোমেটিক ব্যবস্থা আঁকা আছে, সেটা ফেরত এসেছে। এ জিনিস বিদেশিদের নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে–নইলে সাবমেরিন বানানো যাবে না। অবশ্য এ-অসুবিধে দু-দিনেই কাটিয়ে উঠবে ওরা।

কিন্তু নিখোঁজ কাগজ তিনটেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

নিঃসন্দেহে।

বাড়িটা এক চক্কর ঘুরে দেখতে চাই।

সিন্দুকের তালা, ঘরের দরজা আর জানলার লৌহকপাট খুঁটিয়ে দেখল হোমস। বাইরে এসে উত্তেজিত হল একটা লরেল ঝোপ দেখে। ডাল ভাঙা, পাতা ছেড়া–যেন তার ওপর হাঁটাচলা হয়েছে। লেন্স দিয়ে পরীক্ষা করল মাটির চেহারা। অস্পষ্ট পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। সিনিয়র ক্লার্ককে বললে ভেতর থেকে জানলার লৌহকপাট বন্ধ করতে। করার পর বাইরে দেখা গেল, কপাট পুরো বন্ধ হচ্ছে না–বাইরে থেকে কী ভেতরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।

বললে, তিন দিনে সব চিহ্ন মুছে গেছে। চলো ওয়াটসন, লন্ডনে যাওয়া যাক–উলউইচে আর কিছু পাব বলে মনে হয় না।

স্টেশনে গিয়ে কিন্তু একটা মনের মতো খবর পাওয়া গেল। টিকিট বিক্রেতা কেরানিটি বললে সোমবার রাতে ক্যাডোগেন ওয়েস্টের কম্পমান মূর্তি তার বেশ মনে আছে। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল–থার্ড ক্লাসের একটা টিকিট কেটে খুচরো পর্যন্ত তুলতে পারছিল না। খুব সম্ভব সোয়া আটটার ট্রেনে চেপেছিল–কেননা প্রণয়িনীর কাছ থেকে পালিয়ে এসেছিল সাড়ে সাতটা নাগাদ।

ওয়াটসন, বলল হোমস, ঘটনাগুলো এবার পর পর সাজানো যাক। উলউইচে তদন্ত করে মনে হয়েছিল, ওয়েস্ট নিজে হাতে সরিয়েছে নকশা। এখন দেখা যাচ্ছে, কোনো বিদেশি স্পাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কুয়াশা ঢাকা রাতে বান্ধবীকে নিয়ে থিয়েটার যাওয়ার সময়ে হঠাৎ সে দেখলে সেই স্পাইটি অফিসের দিকে যাচ্ছে। অবাক হয়ে তাই সে চেঁচিয়ে উঠেছে–তার বেশি বলতে পারেনি। কর্তব্য তার কাছে সবার ওপরে সিদ্ধান্তও নেয় ঝট করে। তাই প্রণয়িনীকে ফেলে দৌড়েছে লোকটার পেছনে, নিজের চোখে দেখেছে জানলার ফাঁক দিয়ে কীভাবে সাবমেরিনের নকশা নিয়ে বেরিয়ে এল সেই গুপ্তচর। এইজন্যেই নকশা নকল করা হয়নি–আসল নকশা খোয়া গেছে। এ-ধাঁধার এভাবে ছাড়া অন্য সমাধান আর হয় না।

তারপর?

তারপরেই একটু অসুবিধেয় পড়ছি। কেননা, চোখের সামনে গোপন দলিল লোপাট হতে দেখে বাধা দেওয়া উচিত ছিল ওয়েস্টের–কেন দেয়নি? ওপরওলা কাউকে দেখেছিল বলে কি? হয়তো তাই। নাকি, চোর মহাপ্রভু কুয়াশায় গা-ঢাকা দেওয়ায় পাগলের মতো তার বাড়ি থেকেই নকশা উদ্ধারের জন্যে দৌড়েছিল ওয়েস্ট? হাতে একদম সময় না-থাকায় প্রণয়িনীকেও কিছু বলে যেতে পারেনি? এইখানেই সব গুলিয়ে যাচ্ছে। মাইক্রফটের পাঠানো গুপ্তচরদের নাম-ঠিকানা হাতে এলে আবার উলটোদিক থেকে ভাবনা শুরু করব।

বেকার স্ট্রিটে গিয়ে পেলাম মাইক্রফটের চিঠি–একজন সরকারি কর্মচারীর হাতে পাঠিয়েছে। চোখ বুলিয়ে নিয়ে কাগজখানা আমার দিকে ছুঁড়ে দিল হোমস।

চুনোপুঁটি অনেকেই আছে। কিন্তু এ ধরনের বৃহৎ ব্যাপারে নাক গলানোর মতো বুকের পাটা আছে যে তিনটি রাঘব বোয়ালের, তাদের নাম-ঠিকানা দিচ্ছি। অ্যাডলফ মেয়ার, তেরো নম্বর, গ্রেট জর্জ স্ট্রিট, ওয়েস্ট মিনিস্টার; লুই লা রোথিয়েরে, ক্যামডেন ম্যানসন্স, নটিংহিলং হুগা ওবারস্টিন, তেরো নম্বর, কলফিল্ড গার্ডেন্স, কেনসিংটন। এদের মধ্যে শেষোক্ত ব্যক্তি সোমবার পর্যন্ত শহরে ছিল–তারপর কোথায় গেছে। অন্ধকারে আলো দেখতে পেয়েছিস শুনে খুশি হলাম। মন্ত্রীপার্ষদ উদবিগ্ন সুখবর শোনবার প্রতীক্ষায়। জরুরি তলব এসেছে আরও ওপরমহল থেকে। দেশের সমস্ত বাহিনী দরকার হলে তোর পেছনে গিয়ে দাঁড়াবে।–মাইক্রফট।

হোমস ততক্ষণে লন্ডনের একটা ম্যাপ বিছিয়ে বসে আপন মনে বকর বকর করে চলেছে। কারোরই নাকি তর সইছে না এতবড়ো একটা জটিল সমস্যায়। তারপরেই আচমকা চেঁচিয়ে উঠল সোল্লাসে।

পেয়েছি, ওয়াটসন, পেয়েছি, এবার ঠিক দিক ধরতে পেরেছি। বন্ধু, তুমি গাড়িতে বসে খাতা কলম নিয়ে লিখতে আরম্ভ করে দাও কীভাবে দেশসেবায় বুদ্ধি ব্যয় করেছি দুজনে। আমি চললাম একটু দেখেশুনে আসতে। ভয় নেই, আসল কাজে আমার জীবনীকার আর কমরেড পাশেই থাকবে। বলে সজোরে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে মহাউল্লাসে প্রায় নাচতে নাচতে উধাও হল বন্ধুবর।

হোমসকে আমি চিনি। চাপা প্রকৃতির মানুষ অকারণে এত উল্লাস দেখায় না। তাই বেশ ফুর্তি এল মনে। রাত ন-টার পর লোক মারফত পেলাম ওর ছোট্ট চিরকুট :

কেনসিংটনে গ্লসেস্টার রোড গোলডিনির রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খাব। তুমিও এসো। সঙ্গে একটা সিধকাঠি, একটা বাটালি, একটা চোরা লণ্ঠন আর একটা রিভলভার আনবে। শা. হো.।

কুয়াশা ঢাকা রাস্তায় এই ধরনের বস্তু নিয়ে কোনো ভদ্রলোক হাঁটে না। ওভারকোটের তলায় জিনিসগুলো লুকিয়ে নির্দিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে দেখলাম দরজার কাছে একটা গোলটেবিলের পাশে গ্যাঁট হয়ে বসে আমার বন্ধুটি।

খাবে কিছু? তাহলে কফি আর চুরুট খাও। যন্ত্রপাতি এনেছ?

ওভারকোটের পকেটে আছে।

চমৎকার। ওয়াটসন, সব ঘটনা শুনলে বুঝবে ক্যাডোগেন ছোকরাকে ট্রেনের ছাদেই রাখা হয়েছিল ওইজন্যেই ট্রেনটা আমি দেখতে চেয়েছিলাম–কামরা পরীক্ষা করতে চাইনি।

ব্রিজ থেকেও তো পড়তে পারে?

অসম্ভব। ট্রেনের ছাদে রেলিং থাকে না গড়ানে ঢালু ছাদে কিছু থাকলে দুলুনি ঝাঁকুনির সময়ে তা ঠিকরে পড়বেই। ক্যাডোগেন ওয়েস্টকেও ছাদে রাখা হয়েছিল।

কিন্তু রাখা হল কেমন করে?

সম্ভাবনা একটাই আছে। তুমি তো জান ওয়েস্ট এন্ডের কাছাকাছি পাতালরেল টানেল থেকে। সোজা বেরিয়ে এসেছে? আবছা মনে পড়ছে, টানেল থেকে বেরোনোর সময়ে মাথার ওপরে যেন বাড়ির জানলা দেখেছি। ধরো কোনো ট্রেন যদি এইসব জানলার তলায় দাঁড়িয়ে যায়, লাশটা ছাদে রেখে দেওয়া এমন কিছু কি কঠিন?

খুব সম্ভব।

তাহলে তোমাকে আমার একটা পুরানো তত্ত্ব ফের মনে করিয়ে দিই। সব পথ যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন সব চাইতে অসম্ভব পথটাই আসল পথ বলে ধরে নিতে হবে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সব লাইনের তদন্ত করে নাকের জলে চোখের জলে হওয়ার পর যখন ম্যাপ খুলে দেখলাম একজন আন্তর্জাতিক গুপ্তচর পাতালরেলের ধারের একটা বাড়িতে থাকে, তখন আর খুশি চাপতে পারিনি। আমার উল্লাস দেখে তুমিও ভড়কে গিয়েছিলে।

এইজন্যেই নাচতে নাচতে ছুটেছিলে?

আরে হ্যাঁ। তেরো নম্বর কলফিল্ড গার্ডেন্সের সুধীব্যক্তি হুগো ওবারস্টিনকে টার্গেট করে বেরিয়ে পড়লাম নাচতে নাচতে। রেলকর্মচারীদের নিয়ে প্রথমে গেলাম গ্লসেস্টার রোড স্টেশনে। লাইনের ধার বরাবর হাঁটলাম। কর্মচারীরাই দেখিয়ে দিলে তেরো নম্বর বাড়িটার পেছনের দরজা লাইনের ঠিক পাশেই আর দুটো বড়ো রেললাইন সেখানে কাটাকুটি হয়ে যাওয়ার ফলে হামেশাই পাতালরেলের ট্রেনে বেচারিদের মিনিট কয়েক ঠিক ওই জায়গাটিতে থেমে থাকতে হয়।

দারুণ আবিষ্কার হোমস! সত্যিই তুমি একটা জিনিয়াস!

ভায়া ওয়াটসন, আবিষ্কারের এখনও অনেক দেরি—এই তো সবে খেলা শুরু গোলপোস্ট এখনও অনেক দূরে। বাড়ির পেছনটা দেখবার পর এলাম সামনের দিকে। দেখেই বুঝলাম পাখি উড়েছে। আসবাবপত্র খুবই কম। একজনমাত্র চাকরকে নিয়ে ওপরতলায় থাকে ওবারস্টিন নিঃসন্দেহে চাকরটি তার অপকর্মের দোসর। ওবারস্টিন কিন্তু পালায়নি–সে জানে তার নামে শমন বেরোনোর কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাই চোরাই নকশা নিয়ে গেছে মহাদেশের বিভিন্ন দেশে খদ্দের খুঁজতে। এই সুযোগে তার ঘরদোর দেখে আসব ঠিক করেছি।

শমন বার করে ব্যাপারটা আইনসংগত করে নিলে হত না?

প্রমাণ কোথায় যে শমন বার করব?

কীসের আশায় তাহলে যাচ্ছ?

কত রকমের চিঠিপত্র পেতে পারি আগে থেকে কি বলা যায়?

হোমস, আমার কিন্তু এসব ভালো লাগছে না।

ভায়া, তুমি পাহারা দেবে রাস্তায়, অপকর্মটা করব আমি। এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাববার সময় এটা নয়। নৌদপ্তরের কথা ভাবো, চিন্তা করো কী দারুণ উদবেগে অপেক্ষা করছেন মন্ত্রীপার্ষদ, মাইক্রফটের চিঠিখানা মনে করো–যেতে আমাদের হবেই।

জবাবে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।

তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে আমার হাত ধরে জোর ঝাঁকুনি দিল হোমস।

আমি জানতাম, শেষ মুহূর্তে কেঁচোর মতো গুটিয়ে যাওয়ার পাত্র তুমি নও, মুহূর্তের জন্যে চোখের তারায় দেখলাম প্রীতি স্নিগ্ধ কোমল প্রতিচ্ছবি–পরমুহূর্তেই আবার ফিরে এল কর্তৃত্বময় বাস্তব-অনুগত নীরস সত্তা।

বললে, আধমাইল যেতে হবে। চলো হেঁটে যাই–তাড়াতাডির দরকার নেই। যন্ত্রপাতিগুলো যেন হাত ফসকে মাটিতে না পড়ে যায়–সিঁধেল চোর সন্দেহে তুমি গ্রেপ্তার হলে আমার পরিতাপের শেষ থাকবে না!

লন্ডনের ওয়েস্ট-এন্ডে চেপটামুখো থামওলা বারান্দা-ঝোলা সারি সারি বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে দেখলাম ভিক্টোরীয় যুগের সুশোভিত বাড়িগুলির একটিতে বাচ্চাদের পার্টি জমেছে কচিগলায় হুল্লোড় আর পিয়ানোর বাজনা শোনা যাচ্ছে। ঘন কুয়াশার মধ্যে লণ্ঠন জ্বালিয়ে একটা প্রকাণ্ড দরজার সামনে তুলে ধরল হোমস।

বললে, আরে সর্বনাশ! এ দেখছি কঠিন ব্যাপার। তালা আর খিল–দুটো খুলতে হবে। তার চাইতে চলো উঠোনে ঢুকে পড়ি পাশের খিলেন দিয়ে ঢোকা যাবে।

পাঁচিল টপকে উঠোনে ঢুকতে-না-ঢুকতেই মাথার ওপর কুয়াশার মধ্যে টহলদার চৌকিদারের ভারী বুটের আওয়াজ শুনলাম। ধীর ছন্দের পদশব্দ দূরে মিলিয়ে গেল আস্তে আস্তে। যন্ত্রপাতি নিয়ে হেঁট হয়ে দরজার সামনে বসল হোমস। কসরত করল কিছুক্ষণ। কটাং করে আওয়াজ হল একটা। পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকল ও পেছনে আমি। লণ্ঠন জ্বালিয়ে কার্পেটহীন সিঁড়ি বেয়ে এসে দাঁড়ালাম একটা নীচু জানলার সামনে।

ওয়াটসন, এই সেই জানলা,বলে দু-হাট করে খুলে দিল পাল্লা। ঠিক তখনই চাপা গুমগুম ঝনঝন আওয়াজ ভেসে এল দূর থেকে ক্রমশ কাছে এগিয়ে এল ছুটন্ত যন্ত্রযানের বিকট আওয়াজ উল্কাবেগে জানলার ঠিক নীচ দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল একটা ট্রেন। গোবরাটে লণ্ঠন রেখে জানলার ফ্রেম খুঁটিয়ে দেখল হোমস। ধোঁয়ার ভুসো লেগে কালো হয়ে গেলেও জায়গায় জায়গায় ঘষা লেগে ভুসো উঠে গেছে।

ওয়াটসন, এখন বুঝলে তো, লাশটা রাখা হয়েছিল এই জানলায়। আরে, আরে, এ যে রক্তের দাগ! কাঠের ফ্রেমের এক জায়গায় এক বিবর্ণ দাগ দেখিয়ে প্রায় লাফিয়ে উঠল হোমস। এই দেখ, সিঁড়ির পাথরের ওপর রক্তের দাগ। যাক, অনুমানটা হাতেনাতে প্রমাণ হয়ে গেল। এবার একটা ট্রেন জানলার তলায় না-দাঁড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক।

 

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। টানেলের মধ্যে থেকে গুড়গুড় গুমগুম শব্দে নক্ষত্ৰবেগে একটা ট্রেন বেরিয়ে এসেই গতি মন্থর করে দিলে এবং ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল জানলার নীচে। একটা কামরার ছাদ রইল জানলার ঠিক চার ফুট দূরে। আস্তে করে পাল্লা বন্ধ করে দিল হোমস।

ওয়াটসন, অভিযান তাহলে ব্যর্থ হল না বল?

দারুণ কাজ করলে! বুদ্ধি যুক্তির এতবড়ো চমক এর আগে কখনো দেখাওনি। আগের সব কীর্তি আজ তুমি ছাড়িয়ে গেলে!

উঁহু, ওই ব্যাপারটিতে এক মত হতে পারলাম না তোমার সঙ্গে। ওই লাশ ট্রেনের ছাদে ছিল, এই ধারণাটা মাথায় আনার পর থেকে বাকিটুকু ছবির মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল চোখের সামনে–তবে আসল কাজের এখনও বাকি। এসো।

রান্নাঘরের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম ওপরতলায়। খাবার ঘরটা ন্যাড়া বললেই চলে। আসবাবপত্র বিশেষ নেই। শোবার ঘরও তথৈবচ। পাশের ঘরটা পড়াশুনার ঘর–রাশিরাশি বই আর পত্রিকা ছড়ানো। হোমস ড্রয়ারের পর ড্রয়ার টেনে, কাগজপত্র হাঁটকে চলল এক মনে–একঘণ্টা পরে উঠে দাঁড়াল খালি হাতে।

বললে, পাক্কা শয়তান। চিঠিপত্র সব নষ্ট করে গেছে। এইটাই আমাদের শেষ ভরসা। লেখবার টেবিলে একটা ছোট্ট টিনের ক্যাশবাক্স তুলে নিয়ে বাটালির চড় মেরে খুলে ফেলল ডালাটা। কতকগুলো পাকানো কাগজ বেরোল ভেতর থেকে। কোনোটাতে লেখা জলের চাপ, কোনোটায় প্রতিবর্গ ইঞ্চিতে জলের চাপ–নিঃসন্দেহে ড়ুবোজাহাজ সম্পর্কিত কাগজপত্র। অসহিষ্ণুভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিল হোমস। একদম তলায় পাওয়া গেল একটা খাম। ভেতরের বস্তুগুলো টেবিলের ওপর ছেড়ে ফেলতেই আশার আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠল মুখখানা।

আরে, আরে, এ যে দেখছি হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ কলমে ছাপা কতকগুলো বিজ্ঞাপনের কাটিং। পর পর সাজানো–কিন্তু তারিখ নেই। ডেলি টেলিগ্রাফ কাগজ। পৃষ্ঠার ডান হাতি ওপরের কোণ। প্রথমটা এই :

শিগগিরই খবর শোনার আশায় রইলাম। শর্তে রাজি। কার্ডে লেখা ঠিকানায় বিশদ লিখুন।– পিয়েরট।

তারপর : বড়ো জটিল–বোঝা যাচ্ছে না। আরও ভোলা রিপোর্ট চাই। জিনিস পেলেই বিনিময়ে যা দেবার দেওয়া হবে। পিয়েরট।

এর পরে : পরিস্থিতি খুবই জরুরি। চুক্তি রক্ষে না হলে কথা ফিরিয়ে নেব। চিঠিতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করুন। বিজ্ঞাপনে জানাব রাজি আছি–পিয়েরট।

সবশেষে : সোমবার রাত নটার পর। দু-বার টোকা। শুধু আমরা। সন্দিগ্ধ হবেন না। জিনিস পেলে নগদ টাকা। পিয়েরট।

বাঃ, রেকর্ড তো দেখছি শেষ পর্যন্তই আছে! সবার শেষে আসল আদমিটাকে ধরতে পারলেই মণিকাঞ্চন যোগ হয়। বলে টেবিলে টকটক করে আঙুলের বাদ্যি বাজিয়ে কী যেন ভাবতে লাগল হোমস ঘাড় হেঁট করে। তারপর তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললে–ঠিক আছে। খুব একটা মুশকিল হবে না। ওয়াটসন, ডেলি টেলিগ্রাফের অফিসে ছুঁ মেরে যাই।

পরের দিন সকালে প্রাতরাশের টেবিলে নেমন্তন্ন রাখতে এলেন মাইক্রফট হোমস আর লেসট্রেড। গতকালের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করল শার্লক হোমস। চোরের মতো বাড়িতে ঢোকা হয়েছে শুনে ব্যাজার মুখে ঘাড় নাড়ল লেসট্রেড।

বললে, মি. হোমস, এইসব বেআইনি কাজ করেন বলেই টেক্কা মারেন আমাদের ওপর। একদিন কিন্তু আপনার এই বন্ধুটিকে নিয়ে ঝামেলায় পড়বেন বলে দিলাম।

কী হে ওয়াটসন? দেশের জন্যে না হয় শহিদই হওয়া গেল? মাইক্রফট তোমার কী মত?

চমৎকার কাজ করেছিস, শার্লক, অপূর্ব খেল দেখিয়েছিস। কিন্তু লাভটা কী হল?

টেবিল থেকে ডেলি টেলিগ্রাফটা তুলে নিয়ে হোমস বললে, আজকের কাগজে পিয়েরটের বিজ্ঞাপনটা দেখনি?

সেকী রে! আবার বিজ্ঞাপন দিয়েছে?

এই তো : আজ রাতে। একই সময়। একই জায়গায় দু-বার টোকা। খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনার নিরাপত্তা বিঘ্নিত। পিয়েরট।

লাফিয়ে উঠল লেসট্রেড, কেয়া বাত! এ-বিজ্ঞাপনের জবাবে শ্রীমান এলেই কাঁক করে ধরব আমি।

সেইজন্যেই তো বিজ্ঞাপনটা দিলাম খবরের কাগজে। তোমরা দুজনেই আজ রাত আটটায় এসো কলফিল্ড গার্ডেন্সে।

 

ভেবে যখন আর কোনো লাভ নেই, তখন ভাবনাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মনকে ছুটি করে দেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে শার্লক হোমসের। তখন সে ব্যস্ত থাকে–কূট সমস্যার ছায়াপাতও ঘটতে দেয় না মনের মধ্যে। ঝট করে ওভাবে নির্লিপ্ত হওয়ার অসাধারণ মনোেবল আমার নেই বলেই সমস্ত দিনটা অপরিসীম স্নায়বিক উত্তেজনায় ছটফট করলাম আমি। রাত আটটার সময়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম গ্লসেস্টার রোড স্টেশনে লেসট্রেড আর মাইক্রফটের সঙ্গে একত্র হয়ে। ওবারস্টিনের উঠোনের দরজা খুলে রাখা হয়েছিল গতরাতে। কিন্তু রেলিং টপকে ঢুকতে কিছুতেই রাজি হলেন না মাইক্রফট–বাধ্য হয়ে আমি ভেতরে গিয়ে হল ঘরের দরজা খুলে দিলাম। ন-টা নাগাদ চার মূর্তিমান ওত পেতে রইলাম পড়বার ঘরে।

একটা একটা করে কাটল দুটো ঘণ্টা। রাত এগারোটার সময়ে মনে হল, বৃথা চেষ্টা। মিনিটে দু-বার করে ঘড়ি দেখছেন মাইক্রফট আর লেসট্রেড। নিষ্কম্প নির্বিকারভাবে আধবোজা চোখে বসে হোমস–অনুভূতি কিন্তু তন্দ্রাচ্ছন্ন নয়–অত্যন্ত প্রখর। আচমকা এক ঝটকায় সিধে করল মাথা।

বলল, আসছে।

পা টিপেটিপে কে যেন চলে গেল দরজার সামনে দিয়ে। ফিরে এল একটু পরে। খসখস শব্দ শুনলাম দরজার সামনে। তারপরেইদু-বার কড়া বাজানোরতীক্ষ্ণআওয়াজ ভেসে এল কানে। হোমস আমাদের নিরস্ত করে নিজেই উঠে এল। টিমটিম করে গ্যাসের বাতি জ্বলছিল হল ঘরে। দরজা খুলে দিতেই সাঁৎ করে ভেতরে ঢুকল একটা কৃষ্ণমূর্তি দরজা বন্ধ করে দিল হোমস। শুনলাম চাপা গলায় বলছে, এদিকে। কৃষ্ণমূর্তি এসে দাঁড়াল আমাদের ঘরে পেছন পেছন ঘরে ঢুকেই ঝট করে দরজা বন্ধ করে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল হোমস। কৃষ্ণমূর্তি বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠে পেছন ফিরে দাঁড়াতেই হোমস খপ করে তার কলার চেপে ধরে আসুরিক শক্তিবলে ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘরের মেঝেতে। লোকটা টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। আছড়ে পড়ায় চওড়া কিনারা টুপি ঠিকরে গেল মাথা থেকে ঠোঁটের ওপর থেকে সরে গেল মাফলার। বেরিয়ে পড়ল একটা সুদর্শন মুখ—একগাল হালকা রঙের দাড়ি। কর্নেল ভ্যালেনটাইন ওয়ালটার।

বিস্ময়ে শিস দিয়ে উঠল শার্লক হোমস।

ওয়াটসন, কী গাধা আমি! এর কথা তো একদম ভাবিনি আমি।

কে এ? সাগ্রহে শুধোন মাইক্রফট।

সাবমেরিন ডিপার্টমেন্টের প্রধান কর্তা স্যার জেমস ওয়ালটারের ছোটোভাই। জ্ঞান ফিরে আসছে দেখছি। ওঁকে জেরা করার ভার আমার ওপর ছেড়ে দাও।

লম্ববান দেহটা তুলে নিয়ে শুইয়ে দিলাম একটা সোফায়। একটু পরেই উঠে বসলেন কর্নেল। ভয়-বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে এমনভাবে কপালে হাত দিলেন যেন স্বপ্ন দেখছেন কি না বুঝতে পারছেন না।

বললেন, এ আবার কী? আমি তো এসেছি মিস্টার ওবারস্টিনের সঙ্গে দেখা করতে।

হোমস বললেন, কর্নেল ওয়ালটার, হাটে হাঁড়ি ভেঙে গেছে আপনার। সব কীর্তিই আমরা জেনে ফেলেছি। একজন ইংরেজ ভদ্রলোক যে এত নীচে নামতে পারেন, ভাবাও যায় না। ওবারস্টিনের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কী ধরনের এবং কী জাতীয় চিঠি লেখালেখি করেছিলেন, সব আমরা জানি। ক্যাডোগেন ওয়েস্ট ছোকরা মারা গেছে কী পরিস্থিতিতে, তাও অজানা নয়। এখন একটু প্রায়শ্চিত্ত করুন। কুকর্ম স্বীকার করুন। কয়েকটা কথা আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই।

গুঙিয়ে উঠে দু-হাতে মুখ ঢাকা দিলেন কর্নেল। কথা বললেন না। আমরা উন্মুখ হয়ে রইলাম।

হোমস বললে, কর্নেল ওয়ালটার, বিশ্বাস করুন, আমরা সব জানি। আমরা জানি আপনার টাকার দরকার হয়েছিল, দাদার চাবি নকল করেছিলেন, ওবারস্টিনের সঙ্গে চিঠি লেখালেখি করেছিলেন–ওবারস্টিন আপনার চিঠির জবাব দিত ডেলি টেলিগ্রাফে বিজ্ঞাপন দিয়ে। আমরা জানি সোমবার রাত্রে কুয়াশায় গা ঢেকে আপনি অফিসে গিয়েছিলেন, ক্যাডোগেন ওয়েস্ট আপনাকে দেখে ফেলেছিল–কোনো কারণে আপনাকে আগে থেকেই ও সন্দেহ করেছিল। আমরা জানি, ও আপনাকে নকশা চুরি করতে দেখেছে কিন্তু বাধা দেয়নি খাঁটি ভদ্রলোকের মতোই এই ভেবে যে নকশা নিয়ে আপনি হয়তো লন্ডনে দাদার কাছে যাচ্ছেন। কিন্তু আপনার পেছন ছাড়েনি। আপনি যখন এ-বাড়িতে ঢুকলেন–তখন সে বাগড়া দিয়েছে। কর্নেল ওয়ালটার, তখন আর শুধু বিশ্বাসঘাতকতা নয়–আরও একটা বড়ো অপরাধে আপনি জড়িয়ে পড়লেন নররক্তে হাত রাঙালেন।

আমি না! আমি না। বিশ্বাস করুন আমি খুন করিনি! ককিয়ে উঠলেন কর্নেল।

তাহলে ক্যাডোগেনের লাশ ট্রেনের ছাদে শুইয়ে দেওয়ার আগে তাকে খুন করা হয়েছিল কীভাবে?

নিশ্চয় বলব। সব বলব। স্টক এক্সচেঞ্জের দেনায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। ওবারস্টিন আমাকে পাঁচ হাজার পাউন্ড দিতে চেয়েছিল। কিন্তু খুনটা আমি করিনি।

তাহলে?

ক্যাডোগেন আমাকে আগে থেকেই কেন জানি না সন্দেহ করে বসেছিল। ও যে আমার পেছন পেছন এ-বাড়ি এসেছে। আমি জানতামই না। দরজায় দু-বার টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই পেছন পেছন ঝড়ের মতো ক্যাডোগেন ঢুকে পড়ল—ভীষণ চেঁচামেচি জুড়ে দিল হল ঘরে। ওবারস্টিনের কাছে একটা পিস্তল থাকত। সেই পিস্তল দিয়ে ওর মাথায় মারতেই আছড়ে পড়ল মেঝেতে মারা গেল পাঁচ মিনিটের মধ্যে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম দুজনে। তারপর বুদ্ধিটা এল ওবারস্টিনের মাথায়। বললে, ট্রেনের মাথায় লাশ ফেলে দেব। তার আগে দেখে নিই কী-কী নকশা এনেছেন! দশটা নকশার মধ্যে তিনটে রেখে দিলে। বললে, বড্ড টেকনিক্যাল–কপি করা যাবে না। আমি বললাম, তা হবে না। আজ রাতেই সব কাগজ ফেরত দিতে হবে। নইলে কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না। ও বললে, কপি করা অসম্ভব। আমি বললাম, তাহলে দশটা কাগজই ফেরত নিয়ে যাব। ও তখন বললে, তার চাইতে এক কাজ করা যাক। সাতটা কাগজ এই ছোকরার পকেটে পুরে ট্রেনের ছাদে লাশ ফেলে দেওয়া যাক। পুলিশ জানবে ছোকরাই নকশা সরিয়েছে। রাজি হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। আধঘণ্টা অপেক্ষা করলাম। একটা ট্রেন দাঁড়াল জানলার তলায়। দারুণ কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছিল না। ক্যাডোগেনের লাশ শুইয়ে দিলাম একটা কামরার ছাদে। এ-ব্যাপারে এর বেশি আমি আর জানি না।

আপনার দাদা?

একটা কথাও বলেনি। তবে চাবি নেওয়ার সময়ে একবার আমাকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল। সন্দেহ করত তখন থেকেই। চোখ দেখে বুঝেছি এ ব্যাপারে ও আমাকে সন্দেহ করেছে। তাই আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি!

ঘর নিস্তব্ধ। তারপর মাইক্রফট হোমস বললেন, ক্ষতিপূরণ করুন। শাস্তির বহর কমে যাবে।

কী ক্ষতিপূরণ করতে হবে বলেন?

ওবারস্টিন নকশা নিয়ে এখন কোথায়?

জানি না।

ঠিকানা দেয়নি?

বলেছিল প্যারিসের হোটেল দ্য লুভরে চিঠি লিখলেই ওর কাছে পৌঁছে যাবে।

শার্লক হোমস বললে, ক্ষতিপূরণ করার সুযোগ তাহলে এখনও পাবেন।

যা করতে বলবেন, তাই করব। লোকটার ওপর আমার তিলমাত্র মমতা নেই। ওর জন্যেই আমার আজ এই অবস্থা।

বসুন এখানে। এই নিন কাগজ কলম। যা বলছি লিখে যান। খামের ওপর যে-ঠিকানা আপনাকে দেওয়া হয়েছে, সেই ঠিকানা লিখুন। ঠিক আছে। এবার লিখুন চিঠি, মহাশয় নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, কাগজপত্রের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল নেই। আমার কাছে নকলটা আছে। প্ল্যানটা নইলে সম্পূর্ণ হবে না। এর জন্যে নতুন ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাই আরও পাঁচ হাজার দিতে হবে। ডাকযোগে নকশা পাঠাতে ভরসা পাচ্ছি না–টাকাটা নোট বা গিনিতে নেব চেক নয়। এ সময়ে এদেশ ছেড়ে আপনার কাছে গেলে লোকের সন্দেহ হবে। তাই, শনিবার দুপুরে শেরিংক্রস হোটেলের ধূমপান করার ঘরে আপনার জন্যে বসে থাকব। ইংলিশ নোট বা গিনি নেব। অন্য দেশের নয়। ঠিক আছে, ওতেই হবে। এরপরেও যদি শয়তানটা না-আসে তো খুবই অবাক হব।

সত্যিই কাজ হল! সে এক ঐতিহাসিক কাণ্ড–গুপ্ত ইতিহাস যদিও। নকশা সম্পূর্ণ করার লোভে ফাঁদে পা দিলে ওবারস্টিন–এখন পনেরো বছরের মেয়াদে ঘানি ঘোরাচ্ছে ব্রিটিশ জেলখানায়। তার ট্রাঙ্কে পাওয়া গেছে ব্রুস-পার্টিংটন প্ল্যান ইউরোপের নানান দেশের নৌদপ্তরের কর্তাদের নিলাম ডেকে বিক্রি করবে বলে তুলে রেখেছিল।

কর্নেল ওয়ালটারকেও জেলে যেতে হয়েছিল–তবে বছর দুয়েক পরে জেলেই মারা যান। হোমস আবার তন্ময় হল প্রবন্ধ লেখা নিয়ে। মাঝে একটা দিন কাটিয়ে এল উইন্ডসরে। ফিরে এল একটা ভারি সুন্দর পান্না বসানো টাই-পিন নিয়ে। জিজ্ঞেস করতে মুচকি হেসে বললে, এক ভদ্রমহিলা দিয়েছেন তার নাকি একটা উপকার করেছে হোমস। এর বেশি কিছু না-বললেও ভদ্রমহিলার নামটা আঁচ করতে কষ্ট হয়নি আমার। এও জানি যে ওই টাই-পিন দেখলেই ব্রুস-পার্টিংটন নকশাঘটিত অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি জাগ্রত হবে বন্ধুবর শার্লক হোমসের স্মৃতিপটে চিরকালের জন্য।

———–

টীকা

নিখোঁজ নকশার নারকীয় নাটক : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ক্রস-পার্টিংটন প্ল্যানস স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের ডিসেম্বর ১৯০৮ সংখ্যায় এবং কলিয়ার্স উইকলির ১২ ডিসেম্বর ১৯০৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়।

ট্রাম : সেকালের ট্রাম ঘোড়ায় টানত।

জীবনে একবারই সে এসেছিল : সে-ঘটনা দ্য গ্রিক ইন্টারপ্রেটার গল্পের। তা ছাড়াও দ্য এমটি হাউজ গল্পের বর্ণনাতে মাইক্রফটের বেকার স্ট্রিটে হোমসের বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের খবর পাওয়া যায়।

উলউইচ আর্সেনাল : উলউইচের রয়্যাল আর্সেনাল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮০৫ সালে। রয়্যাল মিলিটারি অ্যাকাডেমি এবং রয়্যাল আর্টিলারি হল আর্সেনালের অংশ। আর্সেনালে বন্দুক, কার্তুজ, অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়া গান-ক্যারেজ এবং ওয়াগন নির্মিত হত।

কামরার মধ্যে নিজেই ফেলে দিয়েছে : হতেই পারে না। কারণ তৎকালীন নিয়মে যাত্রাশেষে যাত্রীকে টিকিট দেখাতে হত, জানিয়েছেন লেসলি ক্লিংগার এবং অন্য কয়েকজন।

ড্রেস-সার্কল : থিয়েটারে সর্বনিম্ন ব্যালকনির এই আসনের দর্শকদের সান্ধ্য-পোশাক পরিধান সেকালে বাধ্যতামূলক ছিল।

শ্যাম দেশ : সিয়াম-বা বর্তমান থাইল্যান্ড হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র দেশ যেখানে কোনো ইউরোপীয় উপনিবেশ কায়েম হয়নি।

প্রধানমন্ত্রীর ছটফটানি দেখে : ১৮৯৫-এ লর্ড সলসবেরি ছিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী।

সাবমেরিন : প্রথম সাবমেরিন নির্মিত হয় ১৬২০ সালে ইংলন্ডে। নির্মাতা এক ওলন্দাজ ব্যক্তি। এই জলযানকে আরও উন্নত রূপ দেন রবার্ট ফুলটন। ১৮৮০ সালে রবার্ট ডবলু, গ্যারেট নামে এক ইংরেজ কয়লার বয়লারের সাহায্যে চালিত সাবমেরিন তৈরি করেন। ইলেকট্রিক মোটরচালিত জলের নীচে চলবার যান নির্মিত হয় ১৮৮৬-তে। অ্যান্ড্রু ক্যাম্পবেল এবং জেমস অ্যাশ নামক দুই ইংরেজের নকশা মোতাবেক। ১৮৯৫ নাগাদ জন পি. হল্যান্ডের নকশায় প্লাঞ্জার নামক সাবমেরিন নির্মাণের পরিকল্পনা হলেও সেই নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। যেমন হয়নি ব্রুস-পার্টিংটনের নকশায় কোনো ড়ুবোজাহাজের নির্মাণ।

সমস্যাটা আন্তর্জাতিক : কয়েকজন গবেষক জানিয়েছেন ১৮৯০-এ জার্মান চ্যান্সেলর অটো ফন বিসমার্ককে বরখাস্ত করে কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়মের জার্মানির নৌশক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে ক্রস-পার্টিংটন নকশা চুরি যাওয়ার কিছু সম্পর্ক থাকতে পারে।

লা রোথিয়েরে : রোথিয়েরে এবং ওবেরস্টিনের উল্লেখ পাওয়া যায় দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য সেকেন্ড স্টেন গল্পে।

পর পর সাজানো : ডেলি টেলিগ্রাফের কাটিংগুলো রেখে দেওয়ার কোনো দরকার ছিল না ওবেরস্টিনের। তাহলে সে ওগুলো ওভাবে সাজিয়ে রাখল কি শার্লক হোমসের সুবিধার জন্য? প্রশ্ন তুলেছেন হোমস-গবেষক ডি মার্টিন ডেকিন।

পনেরো বছরের মেয়াদে : নৃশংস খুন এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার সাজা মাত্র পনেরো বছর হতেই পারে না বলে মত প্রকাশ করেছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।