৪. ঈশ্বরী প্রিমা
রিহান হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। তার হাত দুটি পেছনে বাঁধা, দুপাশে দুজন কঠিন চেহারার মানুষ। একজন তার কাঁধের কাছে পোশাকটা খামচে ধরে রেখেছে, সে ছুটে যেন না যায় সেজন্যে নয়–সম্ভবত তাকে বোঝানোর জন্যে সে এখানে ঈশ্বরী প্রিমার কাছে নেহায়েত নগণ্য এবং তুচ্ছ একজন মানুষ।
বিহানের ভেতরে কোনো বোধ নেই। এই মুহূর্তে তার নিজেকে পুরোপুরি অনুভূতিহীন একটি যন্ত্র বলে মনে হচ্ছে। তার ভেতরে হতাশা এবং ক্ষোভ থাকার কথা, কিন্তু সেরকম কিছু নেই। তার ভেতরে বিস্ময় এবং আতঙ্কও থাকার কথা সেরকমও কিছু নেই। বরং সে। নিজের ভেতরে সূক্ষ্ম এক ধরনের কৌতূহল অনুভব করছে। ঈশ্বরী প্রিমা তাকে কী শাস্তি। দেবে সেটি নিয়ে কৌতূহল নয়, ঈশ্বরী প্রিমা দেখতে কেমন সেটি নিয়ে কৌতূহল। রিহান চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কখন আসবে ঈশ্বরী প্রিমা?
তাকে খামচে ধরে রাখা মানুষটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চাপা গলায় বলল, কোনো কথা নয়। চুপ, একেবারে চুপ।
রিহান চুপ করে গেল এবং প্রায় সাথে সাথেই সে ঘরের ভেতরে কাপড়ের খসখস একটা শব্দ শুনতে পায়। নিশ্চয়ই ঈশ্বরী প্রিমা এসেছেন, কারণ রিহানের দু পাশের দুজন মানুষ তখন তার মতোই মাথা নিচু করে উবু হয়ে বসে গেল। ঘরের ভেতরে কিছুক্ষণের জন্যে এক ধরনের অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। হঠাৎ ঈশ্বরী প্রিমার গলা শোনা গেল, এটিই তা হলে সেই মানুষ!
কেউ কোনো কথা বলল না, এটি ঠিক প্রশ্ন ছিল না, এটি ছিল এক ধরনের স্বগতোক্তি। তা ছাড়া কখনোই ঈশ্বরী প্রিয়ার সাথে সরাসরি কথা বলার অনুমতি নেই। রিহান আবার কাপড়ের মৃদু খসখস শব্দ শুনতে পেল, সম্ভবত ঈশ্বরী প্রিমা তাকে ভালো করে দেখার জন্যে আরো একটু কাছে এসেছেন। রিহান একটা নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল, অনেকটা দীর্ঘশ্বাসের মতো। তারপর ঈশ্বরী প্রিমা আবার বললেন, মানুষটা এখানে থাকুক। তোমরা দুজন যাও।
সাথে সাথে রিহানের দু পাশের দুজন মানুষ মাথা নিচু করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এখন এই ছোট ঘরটিতে রিহান এবং ঈশ্বরী প্রিমা ছাড়া আর কেউ নেই। রিহানের খুব ইচ্ছে। করছিল মাথা তুলে ঈশ্বরী প্রিমাকে দেখে, কিন্তু প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে যদি কোনো মানুষ ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরীর সত্যিকার চেহারা দেখে তা হলে সে বেঁচে থাকতে পারে না। যাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় শুধু তাদেরকেই ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরী তাদের নিজের চেহারা দেখতে দেন। রিহান এটি বিশ্বাস করে না, কিন্তু তবুও সে মাথা তুলে দেখার সাহস করল না।
রিহান হঠাৎ করে ঈশ্বরী প্রিমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, তুমি জান, তুমি খুব বড় অপরাধ করেছ?
রিহানের ঠিক কী হল কে জানে, সে মাথা নেড়ে বলল, না, আমার জানা নেই ঈশ্বরী প্রিমা।
ঈশ্বরী প্রিমা রিহানের কথায় খুব অবাক হলেন, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, পৃথিবীর সব কমিউনে ঈশ্বর এবং মানুষের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। তুমি সেটি অস্বীকার করেছ?
রিহান কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। মাত্র কয়েকদিন আগে হুবহু একই রকম কথা বলে প্রভু ক্লড তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। এখানে সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করে কী হবে? একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে?
ঈশ্বরী প্রিমা বললেন, যে কাজটি আমার করার কথা, তুমি কেন সেই কাজটি করছ?
রিহান কিছু বলল না।
ঈশ্বরী প্রিমা কঠিন গলায় বললেন, আমার কথার উত্তর দাও।
রিহান হঠাৎ মাথা তুলে তাকাল, সাথে সাথে ঈশ্বরী প্রিমা তার হাতে ধরে রাখা কারুকার্যখচিত একটি মুখোশে নিজের মুখ ঢেকে ফেললেন বলে রিহান ঈশ্বরী প্রিমার চেহারাটা দেখতে পেল না। ঈশ্বরী প্রিমার মাথায় কুচকুচে কালো চুল বেণি করে বেঁধে দু পাশ থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। শরীরে ধবধবে সাদা একটি পাতলা পোশাক, যার ভেতর দিয়ে আবছাভাবে দেহের অবয়ব দেখা যায়। রিহান শান্ত গলায় বলল, ঈশ্বরী প্রিমা, কোন কাজটি ঈশ্বরের এবং কোন কাজটি মানুষের সেই পার্থক্যটি খুব অস্পষ্ট। আমাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে যে কাজটি করার কথা ছিল সেটিই করেছি। অন্যকে করতে বলেছি।
তুমি ঈশ্বর এবং ঈশ্বরীর ক্ষমতায় বিশ্বাস কর না? তুমি নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়েছ? সিদ্ধান্ত নিয়েছ?
রিহান কোনো কথা না বলে ঈশ্বরী প্রিমার দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশ্বরী প্রিমা বললেন, আমার কথার উত্তর দাও।
রিহান নিচু গলায় বলল, অনুগ্রহ করে আমাকে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করবেন না। মহামান্য প্রিমা।
কেন নয়?
কারণ–কারণ– রিহান বুঝতে পারল তার কিছুতেই এই কথাটি বলা ঠিক হবে না কিন্তু তার পরেও সে বলে ফেলল, আমি ঈশ্বর এবং ঈশ্বরীর কোনো অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করি না।
ঈশ্বরী প্রিমা চমকে উঠে কারুকার্যখচিত মুখোশের ভিতর দিয়ে রিহানের দিকে তাকালেন। অস্পষ্ট এবং শোনা যায় না এরকম গলায় বললেন, তুমি কেন এ কথা বলছ?
কারণ–কারণ– এই কথাটিও নিশ্চয়ই কিছুতেই বলা উচিত নয়, তার পরেও রিহান বলে ফেলল, আমাকে একজন ঈশ্বর মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল কিন্তু আমি মরি নি!
রিহান দেখল ঈশ্বরী প্রিমা থরথর করে কেঁপে উঠলেন। মুখোশের আড়ালে তার মুখমণ্ডল দেখা যাচ্ছে না কিন্তু সেটি নিশ্চয়ই ভয়ংকর ক্রোধে কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। হঠাৎ করে রিহান ভয় পেয়ে গেল, সে মাঞ্জনিচু করে বলল, আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করুন ঈশ্বরী প্রিমা।
ঈশ্বরী প্রিমা কোনো কথা না বলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। রিহান আবার বলল, আমাকে আবার মৃত্যুদণ্ড দেবেন না ঈশ্বরী প্রিমা। আমি কারো কোনো ক্ষতি করতে চাই না–আমি শুধু বেঁচে থাকতে চাই। যেটুকু কৌতূহল নিয়ে মানুষের বেঁচে থাকা উচিত আমি শুধুমাত্র সেটুকু কৌতূহল নিয়ে–
ঈশ্বরী প্রিমা রিহানকে বাধা দিয়ে বললেন, তুমি একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরী সম্পর্কে কতটুকু জান?
রিহান থতমত খেয়ে বলল, আমি বেশি জানি না।
একজন সাধারণ মানুষ কেমন করে একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরী হয়?
রিহান কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
আমার কথার উত্তর দাও।
আমাকে ক্ষমা করুন মহামান্য ঈশ্বরী প্রিমা। আমি বলতে পারব না।
তোমার বলতে হবে, আমি জানতে চাই। বলো, সাধারণ মানুষ কেমন করে একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরী হয়?
হয় না ঈশ্বরী প্রিমা। সাধারণ মানুষ কখনো ঈশ্বর বা ঈশ্বরী হয় না।
তা হলে? তা হলে তারা কেমন করে সবাইকে রক্ষা করে।
তাদের কাছে নিশ্চয়ই কিছু তথ্য আছে যেটা অন্যদের কাছে নেই। সেই তথ্যটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কাউকে কাউকে ঈশ্বর করা হয়। আমার মনে হয়–
কী মনে হয়?
আমার মনে হয় একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরী খুব নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। খুব দুঃখী একজন মানুষ।
ঈশ্বরী প্রিমা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে রিহানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। রিহান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, আপনি কি আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন?
ঈশ্বরী প্রিমা ফিসফিস করে বললেন, হ্যাঁ, তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেবার কথা। কিন্তু
কিন্তু কী?
আমি তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেব না। ঈশ্বরী প্রিমা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি যাও, তুমি এখান থেকে যাও। চলে যাও।
রিহান উঠে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে তাকে অভিবাদন করে সে পিছিয়ে যেতে থাকে। দরজা ঠেলে ঘর থেকে বের হবার সময় আরো একবার মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল ঈশ্বরী প্রিমা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কারুকার্যখচিত মুখোশের আড়ালে ঈশ্বরী প্রিমার মুখমণ্ডলটি একবার দেখার জন্যে হঠাৎ করে রিহান এক ধরনের কৌতূহল অনুভব করে। অদম্য কৌতূহল। কিন্তু রিহান তার মুখমণ্ডল দেখতে পেল না।
ভোরবেলা খুট করে কন্টেইনারের দরজা খুলতেই রিহানের ঘুম ভেঙে গেল। সাধারণত বেশ বেলা হবার পর তার জন্যে ত্রানা একটা বাটিতে একটু খাবার নিয়ে আসে, এত সকালে কে এসেছে কে জানে। শিকল বাঁধা পাটা কাছে টেনে এনে শরীরে কম্বলটা জড়িয়ে রিহান বিছানায় উঠে বসল।
দরজা খুলে গ্রুস্তান এবং তার সাথে একজন মহিলা এসে ঢুকল। মহিলাটি মধ্যবয়স্কা, শক্ত সমর্থ চেহারা। রোদে পোড়া, নীল চোখ এবং কাঁচা-পাকা চুল। মহিলাটি কাছে এসে বলল, আমার নাম নীলন। আমি এই কমিউনের দায়িত্বে আছি। গ্রুস্তানের কাছে আমি তোমার কথা শুনেছি, কিন্তু তোমার সাথে আমার পরিচয় হয় নি।
রিহান বলল, তোমার সাথে পরিচিত হয়ে আমি খুশি হলাম নীলন।
নীলন তার পা থেকে বাধা দীর্ঘ শিকলটি দেখিয়ে বলল, তোমাকে দীর্ঘ সময় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ নিরাপত্তার কারণে আমরা কোনো ঝুঁকি নেই নি।
গলার স্বরে সূক্ষ্ম অপরাধবোধের ছোঁয়া আবিষ্কার করে রিহান একটু অবাক হয়ে নীলনের দিকে তাকাল। তবে কি এখন তার শেকল খুলে ফেলা হবে?
গ্রুস্তান বলল, তোমাকে আমরা যখন পেয়েছিলাম একবারও ভাবি নি তোমাকে বাঁচাতে পারব।
রিহান বলল, আমার জীবন বাঁচানোর জন্যে আমি সারা জীবন তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।
কিন্তু আমরা কেউ জানতাম না, তুমি কে, তুমি কোথা থেকে এসেছ কিংবা তোমাকে বিশ্বাস করা যায় কি না।
নীলন বলল, কিন্তু আমরা এখন জানি তোমাকে বিশ্বাস করা যায়।
রিহান অবাক হয়ে বলল, কেমন করে জান?
ঈশ্বরী প্রিমা আমাদের জানিয়েছেন। আমরা আজ তোমাকে মুক্ত করে দেব। এতদিন তোমাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার জন্যে তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব। আমরা তোমাকে
নীলন আরো কিছু বলতে চাইছিল, রিহান বাধা দিয়ে বলল, ঈশ্বরী প্রিমা কী জানিয়েছেন?
তিনি জানিয়েছেন আমরা যেন তোমাকে যথাযথ সম্মান দিয়ে আমাদের কমিউনে গ্রহণ করি। তোমাকে যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিই।
স্বাধীনভাবে?
হ্যাঁ। এটি খুব বিস্ময়কর নির্দেশ। তুমি নিশ্চয়ই জান কমিউনে ঠিকভাবে কাজ করার জন্যে আমাদের সবাইকে খুব কঠিন নিয়ম মেনে চলতে হয়। ঈশ্বরী প্রিমা তোমাকে সেই নিয়ম থেকে মুক্তি দিয়েছেন।
গ্রুস্তান তার পকেট থেকে ছোট একটা চাবি বের করে রিহানের পা থেকে শিকল খুলতে খুলতে বলল, তোমাকে গত রাতে আমরা একজন অপরাধী হিসেবে বিচারের জন্যে ঈশ্বরী প্রিয়ার কাছে পাঠিয়েছিলাম।
নীলন হেসে বলল, ব্যাপারটা চিন্তা করে আমার এখন খুব লজ্জা লাগছে।
গ্রুস্তান শিকলটা সরিয়ে বলল, আমার মেয়ে জানা অবিশ্যি তোমাকে খুব পছন্দ করে। এখন বোঝা যাচ্ছে ছোট শিশুরা মানুষকে ঠিকভাবে বুঝতে পারে।
রিহান বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল, পায়ে শিকল নেই, অনেক দিন পর স্বাধীনভাবে দুই পা হেঁটে রিহান গ্রুস্তানের কাছে গিয়ে তার কাধ স্পর্শ করে বলল, ধন্যবাদ গ্রুস্তান।
নীলন বলল, তোমাকে আমাদের কমিউনিএকটা থাকার জায়গা করে দিতে হবে। ট্রিশির লরিটি তুমি ব্যবহার করতে পার। তোমার আর কী কী লাগবে তার একটা তালিকা করে দিও।
রিহান বলল, আমার এখন আর কিছু লাগবে না। আমার দায়িত্বটি বুঝিয়ে দিও, যেন তোমাদের বোঝা না হয়ে যাই।
নীলন একটু হেসে বলল, তোমার কোনো দায়িত্ব নেই। ঈশ্বরী প্রিমা স্পষ্ট করে বলেছেন তোমাকে যেন স্বাধীনভাবে থাকতে দিই।
কিন্তু কিছু না করে আমি কেমন করে থাকব?
সেটি তোমার ইচ্ছে। তুমি কী করতে চাও সেটি তুমি ঠিক করবে।
রিহান একটু অবাক হয়ে নীলনের দিকে তাকাল, কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গিয়ে বলল, ঠিক আছে। ঠিক আছে নীলন।
নীলন রিহানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, রিহান, আমি এই কমিউনের দলপতি হিসেবে তোমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কমিউনে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
এখন এস, আমাদের লরিতে, তুমি আমাদের সাথে সকালের নাস্তা খাবে।
.
নীলনের লরি থেকে নাস্তা করে বের হয়ে রিহান এই ছোট কমিউনটি ঘুরে দেখতে বের হল। সে এখানে অনেক দিন থেকে আছে কিন্তু কমিউনটি সে দেখে নি। মানুষজন ঘুম থেকে উঠে দিন শুরু করতে যাচ্ছে। রিহানকে হেঁটে বেড়াতে দেখে সবাই একটু অবাক হয়ে তার। দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণেই নিশ্চয়ই খবরটি ছড়িয়ে গেছে কারণ তাকে দেখে সবাই হাসিমুখে সম্ভাষণ করতে শুরু করল। তাকে এভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখে সবচেয়ে বেশি খুশি হল ত্রানা, সে ছুটে এসে তার হাত ধরে বলল, রিহান! তুমি নাকি আমাদের নতুন দলপতি!
রিহান চোখ কপালে তুলে বলল, সে কী! তুমি কোথা থেকে এই খবর পেয়েছ?
সবাই বলছে! ঈশ্বরী প্রিমা বলেছেন তুমি এখানে যা খুশি করতে পার।
সবাই আর কী কী বলেছে?
বলছে তুমি নাকি সাহসী আর বুদ্ধিমান। তেজস্বী আর সুদর্শন।
রিহান হা–হা করে হেসে বলল, বিয়ে করার জন্যে আমার একটি বউ খুঁজে পেতে তা হলে কোনো সমস্যা হবে না।
ত্রানা মাথা নেড়ে বলল, উঁহু। বরং তোমার উল্টো সমস্যা হবে। আমাদের কমিউনে যত মেয়ে আছে সবাই তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে। কাকে ছেড়ে কাকে বেছে নেবে সেটা হবে তোমার সমস্যা।
এত বড় জটিল সমস্যা সমাধান করব কেমন করে? রিহান মাথা নেড়ে বলল, তখন তোমার কাছে পরামর্শের জন্যে আসতে হবে। কী বলো?
ত্রানা খুশিতে দাঁত বের করে হেসে বলল, আমি এখনই তোমাকে বলে দিতে পারি। ত্রানা এদিক–সেদিক তাকিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো গলা নামিয়ে বলল, লুকদের যে মেয়েটি আছে খবরদার তাকে বিয়ে করো না। সে দেখতে সবচেয়ে সুন্দরী কিন্তু সে সবচেয়ে বেশি হিংসুটে। গত ভোজের সময় কী করেছে জান?
কী করেছে?
জানা গলা নামিয়ে লুকদের পরিবারের সুন্দর মেয়েটি কী হিংসুটেপনা করেছে তার বর্ণনা শুরু করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই আশপাশের ট্রাক, লরি, কন্টেইনার থেকে ছোট ছোট বাচ্চারা এসে রিহানের আশপাশে ভিড় জমালো–কাজেই ত্রানাকে আপাতত তার গল্পটিকে স্থগিত করতে হল।
ছোট ছোট বাচ্চাদের বহরটি রিহানকে কমিউনের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতে থাকে। তাদের রান্নাঘর, পয়ঃশোধনাগার, পানি সরবরাহ কেন্দ্র, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, নিউক্লিয়ার রি–এক্টর, সৌরচুল্লি, অস্ত্রাগার শেষ করে তারা যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রে এসে হাজির হল। বড় একটা এলাকা জুড়ে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। ভাঙা এবং পুরোনো মোটরবাইক, ট্রাক এবং লরির ইঞ্জিন, নানা ধরনের অকেজো অস্ত্রপাতি ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রিহান তার স্বাভাবিক কৌতূহলে যন্ত্রপাতিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, ঘোট ছোট বাচ্চাগুলো খানিকটা দূরত্ব নিয়ে বেশ সম্ভ্রমের সাথে রিহান এবং যন্ত্রপাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।
রিহানকে দেখে যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মীরা এগিয়ে আসে–বেশিরভাগই অল্পবয়স্ক মেয়ে, ঈশ্বরী প্রিমার কাছ থেকে আসা তালিকা দেখে যন্ত্রপাতিগুলোর অকেজো অংশগুলোর সঠিক অংশগুলো পরিবর্তন করছে। রিহান একটা কাজুরা মোটরবাইক দেখে এগিয়ে গিয়ে বলল, বাহ! কী চমৎকার, এর ডুয়েল টার্বো ইঞ্জিন।
নিহানা নামে রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রের একটি মেয়ে কর্মী মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, এর ডুয়েল টার্বো ইঞ্জিন।
এটি অকেজো হয়েছে কেমন করে?
ডায়াগনষ্টিক মেশিনে ফিট করে রিপোর্ট পাঠিয়েছি ঈশ্বরী প্রিমার কাছে। ঈশ্বরী প্রিমা এখনো বলেন নি, কী করতে হবে।
আমি একটু দেখি
নিহানা কিছু বলার আগেই রিহান বিশাল মোটরবাইকটা টেনে এনে তার স্টার্টারে ঝাঁকুনি দেয়। মোটরবাইকটা গর্জন করে স্টার্ট হয়ে প্রায় সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল। রিহান কান পেতে ইঞ্জিনের শব্দ শুনে আবার স্টার্টারে ঝাঁকুনি দিতেই আবার ইঞ্জিনটা ঘরঘর শব্দ করে স্টার্ট নেয়, কয়েক সেকেন্ড চালু থেকে আবার সেটা বন্ধ হয়ে গেল। রিহান ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ল তারপর নিচু হয়ে ইঞ্জিনটার উপর ঝুঁকে পড়ল। ঘোট ছোট বাচ্চারা এবারে কৌতূহলী হয়ে ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসে, তারা সবিস্ময়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। রিহান ফুয়েল পাইপটা খুঁজে বের করে সেটা ধরে মৃদু একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মেয়ে কর্মীটিকে বলল, আমাকে সাইজ ফোর একটা প্লয়ার্স দেবে?
কিন্তু রিহান—
কী?
যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রটিতে সপ্তম মাত্রার নিয়মকানুন। সার্টিফাইড কর্মী ছাড়া অন্য কেউ এখানে কোনো কিছু স্পর্শ করতে পারবে না।
রিহান হা–হা করে হেসে বলল, আমার জন্যে কোনো নিয়ম নেই। ঈশ্বরী প্রিমা আমাকে যা খুশি তাই করার অধিকার দিয়েছেন।
মেয়ে কর্মীর একজন আরেকজনের দিকে তাকাল এবং একজন মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। এটা সত্যি কথা। নীলনের অর্ডারের কপি আছে আমার কাছে।
রিহান বলল, দেখেছ? এবারে একটা প্লায়ার্স দাও।
একজন মেয়ে কর্মী ওয়ার্কশপের ভেতরে ঢুকে একটা সাইজ ফোর প্লয়ার্স নিয়ে এল। রিহান প্লয়ার্স দিয়ে ঘুরিয়ে টিউবের একটা ছোট অংশ খুলে ভেতরে উঁকি দিতেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল, বলল, যা ভেবেছিলাম তাই!
নিহানা নামের মেয়ে কর্মীটি বলল, কী হয়েছে?
টিউবটি বালু দিয়ে বন্ধ হয়ে আছে। কাজুরা মোটরবাইকের এটা হচ্ছে সমস্যা। ফিল্টারটা ভালো না, ফুয়েল পাইপ বন্ধ হয়ে যায়। এটা পরিষ্কার করলেই ঠিক হয়ে যাবে। একটা চিকন তার আছে?
নিহানা একটু বিভ্রান্ত হয়ে বলল, চিকন তার?
হ্যাঁ। আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখি টিউব পরিষ্কার করার মতো কিছু পাওয়া যায় নাকি। রিহান টিউবটা ত্রানার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ত্রানা এটা ধর আমি একটা তার নিয়ে আসি।
ত্রানা এবং তার সাথে সাথে অন্য সবগুলো বাচ্চা সভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। ত্রানা মাথা নেড়ে বলল, না রিহান, আমাদের বাচ্চাদের যন্ত্রপাতি ধরার নিয়ম নেই। আমরা এখনো প্রার্থনা শিখি নি।
রিহান থতমত খেয়ে থেমে গেল, সে ভুলেই গিয়েছিল যে যন্ত্রপাতিকে এক ধরনের পবিত্র জিনিস বলে বিবেচনা করা হয়। কারা এটি স্পর্শ করবে, কারা এটি নিয়ন্ত্রণ করবে সেই বিষয় নিয়ে কঠোর নিয়মকানুন আছে। সে নিজে এই নিয়ম ভেঙে যন্ত্রপাতি নিয়ে খেলাধুলা করেছে, পরীক্ষা করেছে কিন্তু এই ছোট বাচ্চারা তো সেটি জানে না। রিহান একমুহূর্ত চিন্তা করল, তারপর বলল, ত্রানা তুমি এটি ধর, কিছু হবে না। তুমি দেখবে প্রার্থনা না করলেও যন্ত্রপাতি কাজ করে।
মেয়ে কর্মীরা এবং সবগুলো বাচ্চা একসাথে বিস্ময় এবং আতঙ্কের একটা শব্দ করল। রিহান আবার বলল, নাও। ধর।
ত্রানা সাবধানে কাঁপা হাত দিয়ে ফুয়েল টিউবটা ধরল এবং অন্য সবগুলো বাচ্চা এক ধরনের আতংক নিয়ে ত্রানার দিকে তাকিয়ে রইল। রিহান ওয়ার্কশপে খুঁজে খুঁচিয়ে পরিষ্কার করা যায় এরকম একটা চিকন তার এনে ত্রানার হাত থেকে টিউবটা নিয়ে সেটা পরিষ্কার করতে শুরু করে। টিউবটা আবার মোটরবাইকে লাগিয়ে সে বাচ্চাদের দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কী মনে হয়? মোটরবাইকটা কি এখন স্টার্ট নেবে?
বাচ্চারা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল, এক ভাগ মাথা নেড়ে বলল স্টার্ট নেবে। অন্যভাগ বলল। নেবে না। রিহান চোখ মটকে স্টার্টারে ঝাঁকুনি দিতেই বিশাল কাজুরা মোটরবাইকটি গর্জন। করে স্টার্ট নিয়ে নিল। এবং দুএক সেকেন্ড পরে বন্ধ হয়ে গেল না। ত্রানা এবং অন্য সব বাচ্চা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে এবং সেই আনন্দ ধ্বনির মাঝে রিহান মোটরবাইকটির উপর চেপে বসে। রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রের ফাঁকা জায়গাতে ধূলি উড়িয়ে সে মোটরবাইকটি ঘুরিয়ে আনল তারপর ইঞ্জিন বন্ধ করে মোটরবাইকটি দাঁড়া করিয়ে বলল, এই মোটরবাইকটি ঠিক করার জন্য এখন আর ঈশ্বরী প্রিমাকে বিরক্ত করতে হবে না।
নিহানা ইতস্তত করে বলল, কিন্তু—
কিন্তু কী?
কে কোন কাজ করবে সেটি তো নিয়ম করা আছে।
রিহান হেসে বলল, আমার জন্যে কোনো নিয়ম নেই।
কিন্তু এই বাচ্চারা? তাদের জন্যে
এরা যদি আমার সাথে থাকে তাহলে তাদের জন্যেও কোনো নিয়ম নেই।
নিহানা নামের মেয়ে কর্মীটি এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
.
রাতে রিহান তার নিজের লরিতে শোয়ার আয়োজন করছিল, তখন হঠাৎ করে দরজায় শব্দ হল। রিহান দরজা খুলে দেখে সেখানে নীলন এবং গ্রুস্তান দাঁড়িয়ে আছে। রিহান সপ্রশ্ন। দৃষ্টিতে তাকাতেই নীলন বলল, আমরা তোমার সাথে একটু কথা বলতে পারি রিহান?
অবশ্যই। ভেতরে এস।
নীলন এবং গ্রুস্তান ভেতরে এসে হাত দুটো ঘষে গরম করতে করতে বলল, রিহান তুমি আজকে যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রে একটি খুব অস্বাভাবিক কাজ করেছ।
রিহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমি জানি।
এই কমিউনের সব বাচ্চা এখন বলছে যন্ত্রপাতিকে সম্মান করতে হয় না। প্রার্থনা শেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সব নিয়মকানুন ভুল
সব নিয়মকানুন ভুল নয়। কিছু কিছু ভুল–
কিন্তু একটা কমিউনে যদি নিয়মকানুন খুব কঠোরভাবে মানা না হয় তার শৃঙ্খলা থাকে না। শৃখলা না থাকলে কমিউন টিকে থাকতে পারে না।
রিহান বলল, নীলন, আমার বয়স তোমার থেকে অনেক কম কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা তোমার থেকে অনেক বেশি! আমি কিছু জিনিস জানি যেটা অন্য মানুষ জানে না।
নীলন একটু অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকাল। রিহান বলল, আমি সেটা তোমাদের বলতে চাই না, কিন্তু একদিন বলতে হবে। একদিন সবাইকে জানতে হবে। তার জন্যে প্রস্তুতি নিতে হবে। সেজন্যে নিয়মকানুনগুলো নূতন করে লিখতে হবে।
গ্রুস্তান নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি আজকে যেটা করেছ সেটা ঈশ্বরী প্রিমাকে জানানো হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম তিনি অনুমোদন করবেন না কিন্তু ঈশ্বরী প্রিমা সেটা অনুমোদন করেছেন।
রিহান উজ্জ্বল মুখে বলল, আমি জানতাম তিনি করবেন।
নীলন নিশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু আমাদের ভয় করে। নিয়ম ভাঙতে আমাদের খুব ভয় করে।
রিহান নীলনের হাত স্পর্শ করে বলল, ভয়ের কিছু নেই নীলন। আমরা নিয়ম ভাঙছি, আমরা নূতন নিয়ম তৈরি করছি!