মুখোমুখি
আমি আর জিগি সাবধানে দরজা খুলে বের হয়ে এলাম। মাথার ওপরে কপোট্রনের ইন্টাফেসটা বসাতে বেশ কষ্ট হয়েছে। সত্যিকারের সাইবর্গের মাথার চুলগুলো ইলেকট্রোলাইসিস করে তুলে ফেলা হয়। করোটিতে ইন্টারফেসটা ক্রু দিয়ে আটকানো হয়–আমাদের সেরকম কিছু নেই বলে যে কোনো মুহূর্তে পুরোটা খুলে পড়ে যাবার একটা আশঙ্কা আছে। হাঁটতে হচ্ছে সাবধানে, এক হিসেবে ব্যাপারটি মন্দ নয় কারণ তার ফলে আমাদের দেখাচ্ছে সত্যিকারের সাইবর্গের মতো।
প্রথম কিছুক্ষণ আমরা ধরা পড়ে যাব সেরকম একটা আশঙ্কা আমাদের ভেতর কাজ করছিল। কিছুক্ষণের মাঝেই অবিশ্যি বুঝে গেলাম কেউ কিছু সন্দেহ করছে না। আমরা চোখে–মুখে সাইবর্গীয় একটা উদভ্রান্ত দৃষ্টি ফুটিয়ে হেঁটে যেতে থাকি। করিডরের এক মাথায় একটি লিফট। অন্যপাশে বিচিত্র একটি মহাকাশযান, তার ভেতরে কিছু কাজকর্ম করা হচ্ছে। আমি আর জিগি কাছাকাছি এসে দেখতে পেলাম বড় একটি গোলাকার মঞ্চের মতো জায়গা, সেখানে পাশাপাশি দুটি আসন, আসনগুলো খালি যারা এখানে বসবে তারা এখনো এসে পৌঁছায় নি।
কিছুক্ষণের মাঝেই অবিশ্যি তারা পৌঁছে গেল। নুরিগাকে তার খাঁচার ভেতরে করে এনেছে, সে খাঁচার গারদগুলো ধরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নুরিগার পেছনেই একটি অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে, তাকে দুপাশ থেকে দুটি শক্তিশালী সাইবর্গ ধরে রেখেছে। মেয়েটির চোখে–মুখে একটি বিচিত্র ধরনের আতঙ্ক, মনে হচ্ছে এখানে কী হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। এই মেয়েটি নিশ্চয়ই রিয়া–আমি তার সাথে কথা বলেছি। পরাবাস্তব জগতে আমার একটা অস্তিত্বের সাথে তার একটা অস্তিত্ব আটকা পড়ে আছে। হঠাৎ সম্পূর্ণ অপরিচিত এই মেয়েটির জন্যে আমি আমার বুকে গভীর মমতা অনুভব করলাম, আমার ইচ্ছে হল আমি তার কাছে ছুটে গিয়ে বলি, রিয়া তোমার কোনো ভয় নেই–আমরা তোমাকে রক্ষা করব।
কিন্তু আমি সেটা বলতে পারলাম না, রিয়ার ঠিক পেছনে খ্রাউস, তার আশপাশে অসংখ্য সাইবর্গ–তাদের অনেকে সশস্ত্র।
রিয়াকে দুই হাতে ধরে প্রায় টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তার মাঝে হঠাৎ করে সে থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে ঘুরে তাকাল। খ্রাউসের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে কী হচ্ছে। আমাকে বলবে?
খ্রাউস শীতল গলায় বলল, বিশেষ কিছু নয়।
অবিশ্যি বিশেষ কিছু। তোমরা আমার কাছে খবর পাঠিয়েছ যে আমার মাথার ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেসটা খুলে দেবে। আমি সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছি। এখানে হাজির হওয়া মাত্র আমাকে ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছ যেন আমি একটা খুনি আসামি। আমাকে এভাবে ধরে নিয়ে যাচ্ছ কেন?
কারণ আছে রিয়া।
কী কারণ–সেটাই আমি জানতে চাই।
খ্রাউস কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই রিয়া ক্রুদ্ধ গলায় বলল, তার আগে আমাকে আরো একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
কী প্রশ্ন?।
রিয়া খাঁচার ভেতরে আটকে থাকা নুরিগাকে দেখিয়ে বলল, এই মানুষটাকে তোমরা খাঁচার ভেতরে আটকে রেখেছ কেন? তোমরা বুঝতে পারছ না কাজটি কী ভয়ংকর অমানবিক?
খ্রাউস হা–হা করে হেসে বলল, তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ কাজেই তোমার মানবিক অনুভূতিগুলো অন্য দশজন থেকে ভিন্ন। সবকিছুতেই অমানবিক কারণ খুঁজে পাও।
তুমি বলতে চাও এটা অমানবিক নয়? অন্য দশজনের বেলায়
এটা হয়তো অমানবিক কিন্তু এর বেলায় নয়।
কেন?
খ্রাউস উত্তর দেবার আগেই নুরিগা বিচিত্র ভঙ্গিতে হেসে উঠে বলল, কারণ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ।
রিয়া অবাক হয়ে বলল, কী বললে? পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ?
হ্যাঁ। খুব একটা মজার কথা বলছে এরকম একটা ভঙ্গি করে নুরিগা বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ থেকে জিন্সগুলো নিয়ে আমাকে তৈরি করেছে। তাই আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ।
এটা কী ধরনের যুক্তি মানুষ খারাপ হয়ে যেতে পারে কিন্তু তার জিন্স কেমন করে খারাপ হয়? ছোট বাচ্চা বড় হলে কি তার জিন্স পাল্টে যায়? কখনো একটা ছোট শিশু দেখেছ যে অপরাধী? দেখেছ?
নুরিগা আবার হা–হা করে হেসে উঠে বলল, এটা তুমি ওদের বোঝাতে পারবে না।
রিয়া তীব্র দৃষ্টিতে ব্রাউসের দিকে তাকাল, কিন্তু খ্রাউস তার দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, চল, ওকে নিয়ে চল।
রিয়া ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে বলল, তুমি এখনো বলে নি কেন আমাকে নিয়ে যাচ্ছ।
বলি নি, কারণ সেটা শুনলে হয়তো তোমার ভালো লাগবে না।
রিয়া খানিকক্ষণ নিঃশব্দে খ্রাউসের দিকে তাকিয়ে থেকে কাঁপা গলায় বলল, তোমরা আমাকে আর নুরিগাকে নিয়ে নিশ্চয়ই কোনো একটা অন্যায় কাজ করতে যাচ্ছ। অমানবিক কাজ করতে যাচ্ছ।
ন্যায়–অন্যায় মানবিক–অমানবিক খুব আপেক্ষিক ব্যাপার।
রিয়া ভয়ার্ত মুখে বলল, তার মানে তোমরা সত্যি সত্যি আমাদেরকে নিয়ে ভয়ংকর কিছু করছ।
খ্রাউস রিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে সাইবর্গগুলোকে বলল, এদেরকে নিয়ে যাও ভেতরে।
রিয়া আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সাইবর্গগুলো তাকে সে সুযোগ দিল না– অত্যন্ত রূঢ়ভাবে তাকে ধরে টেনেহিঁচড়ে নিতে শুরু করল। আমার আবার ইচ্ছে করল রিয়ার কাছে ছুটে গিয়ে তাকে বলি, তোমার কোনো ভয় নেই রিয়া। আমরা তোমাকে রক্ষা করব–যেভাবে পারি রক্ষা করব। কিন্তু তাকে সেটা বলতে পারলাম না। সাইবর্গগুলোর পেছনে নিঃশব্দে হাঁটতে থাকলাম।
মহাকাশযানের ভেতরে যাবার আগে সবাইকে কোন ধরনের স্পেস সুট পরে নেবে বলে আমার একটা ধারণা ছিল কিন্তু দেখা গেল সেটি সত্যি নয়। সাইবর্গগুলো রিয়াকে তার আসনের কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে সরে গেল, খ্রাউস কোথাও কোনো সুইচ স্পর্শ করতেই অদৃশ্য কোনো একটি শক্তির ক্ষেত্র নিচে নেমে এসে রিয়াকে আটকে ফেলল। রিয়া সেই অদৃশ্য ক্ষেত্রকে আঘাত করে কিন্তু সেটাকে ছিন্ন করতে পারে না। আমি শুনতে পেলাম সে কাতর গলায় চিৎকার করে বলছে, আমাকে এখান থেকে বের হতে দাও। তোমরা এভাবে আমাকে আটকে রাখতে পারবে না।
খ্রাউস রিয়ার কাতর চিৎকারকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে নুরিগাকে ভেতরে নিয়ে আসার জন্যে ইঙ্গিত করল। সাইবর্গগুলো তাদের যান্ত্রিক ক্ষিপ্রতায় নুরিগাকে ধাক্কা দিয়ে তার খাঁচাসহ ভেতরে নিয়ে গেল। তার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গায় নুরিগাকে দাঁড় করিয়ে খ্রাউস কোথায় জানি স্পর্শ করতেই ওপর থেকে আবার এক অদৃশ্য শক্তি বলয় নিচে নেমে এসে নুরিগাকে তার ভেতরে আটকে ফেলল। খ্রাউস এবারে একটা সাইবর্গকে ইঙ্গিত দিতেই সে খাঁচার দরজা খুলে নুরিগাকে শক্তি বলয়ের মাঝে রেখে খাঁচাটা টেনে বের করে সরিয়ে নিল। মুরিগা পাথরের মতো মুখ করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, শক্তি বলয়টি স্পর্শ করে দেখারও তার কোনো কৌতূহল নেই। খ্রাউস চাৰ্বদিকে তাকিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বলল, চমৎকার!
রিয়া এতক্ষণে নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছে। হঠাৎ করে সে বুঝতে পেরেছে যে তার আর কিছু করার নেই। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তুমি এখন কী করবে?
খ্রাউস মহাকাশযানটির চারদিকে তাকিয়ে ভেতর থেকে বের হয়ে এল। হাতে একটা চতুষ্কোণ কন্ট্রোল প্যানেলের ওপরে সযত্নে হাত বুলিয়ে বলল, তোমরা নিজেরাই দেখবে। তবে মনে হয় এখন সময় হয়েছে তোমাদের বলে দেবার। খ্রাউস মুখে এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে গলায় খানিকটা নাটকীয়তা এনে বলল, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানবী রিয়া এবং সর্বনিম্ন মানব নুরিগা তোমাদের দুজনকে অভিনন্দন। কারণ তোমরা পৃথিবীর প্রথম মানব সন্তান যারা মহাজাগতিক অভিযান করে দূর কোনো একটি গ্যালাক্সিতে কোনো এক বুদ্ধিমান মহাজাগতিক প্রাণীর জগতে যাচ্ছ।
রিয়া আর্তনাদ করে উঠল, চিৎকার করে বলল, না!
হ্যাঁ। খ্রাউসের মুখে একটা পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে, সে চোখ নাচিয়ে বলে, বুদ্ধিমান একটি মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। তারা আমাদের দিয়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তি–তার বদলে আমরা তাদের দিচ্ছি দুটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ। সবচেয়ে নিখুঁত এবং সবচেয়ে বড় অপরাধী।
রিয়া শক্তি বলয়ে আটকা পড়ে থেকে রক্তহীন ফ্যাকাসে মুখে ব্রাউসের দিকে তাকিয়ে রইল। খ্রাউস হাতের চৌকোনা কন্ট্রোল প্যানেলের একটা বড় সুইচ স্পর্শ করতেই তীক্ষ্ণ এলার্মের শব্দ বেজে ওঠে। দেয়ালে হঠাৎ করে কিছু সংখ্যা ফুটে ওঠে। সংখ্যাগুলো প্রতি সেকেন্ডে একটি করে কমে কাউন্ট ডাউন ক্ষ হয়ে যায়। খ্রাউস মুখের হাসিকে আরো বিস্তৃত করে বলল, আজ আমার খুব আনন্দের দিন। মহাজাগতিক প্রাণীদের আমি কথা দিয়েছিলাম, আমি আমার কথা রেখেছি! তারাও তাদের কথা রেখেছে, আমাকে দিয়েছে অসাধারণ সব প্রযুক্তি!
রিয়া চিৎকার করে বলল, তুমি এটা করতে পার না। পৃথিবীর মানুষ তোমাকে ক্ষমা করবে না। এটা অন্যায়, এটা বেআইনি।
তুমি সত্যিই বলেছ। এটা বেআইনি। এটা অন্যায় কি না জানি না, কিন্তু এটা বেআইনি। কাজেই এটা কারো জানার কথা নয়। তাই আমার কাজে সাহায্য করার জন্যে আমি সাইবর্গ তৈরি করেছি। অসংখ্য সাইবর্গ। কাজ শেষ হলে তাদেরকে আমি ব্যাক্টেরিয়ার মতো মেরে ফেলব। এই দেখ–তাদেরকে আমি এখানে অচল করে রেখে যাব। এদেরকে নিয়ে এই পুরো এলাকাটা ধ্বংস করে দেওয়া হবে।
খ্রাউস তার হাতের কন্ট্রোল প্যানেলের কোনো একটা সুইচ স্পর্শ করতেই মহাকাশযানটিকে ঘিরে থাকা অসংখ্য সাইবর্গ পা ভেঙে একসাথে লুটিয়ে পড়ল। দুজন ছাড়া আমি এবং জিগি।
খ্রাউস সবিস্ময়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। আমি একটু এগিয়ে নিচে পড়ে থাকা একটা সাইবর্গের হাত থেকে একটা ভয়ংকর দর্শন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে উসের দিকে এগিয়ে গেলাম। নিচু গলায় বললাম, না খ্রাউস, তোমার যন্ত্র ঠিকই আছে। সেখানে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা অন্য জায়গায়। আমরা সাইবর্গ নই।
আমি মাথা থেকে কপোট্রনিক ইন্টারফেস খুলে ফেলতেই খ্রাউস বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল। বলল, তোমরা?
হ্যাঁ।
খ্রাউস হঠাৎ পাগলের মতো হেসে উঠে বলল, তোমরা একটু দেরি করে ফেলেছ! এই দেখ পৃথিবীর মানুষ কীভাবে দূর গ্যালাক্সিতে পাড়ি দেয়–
আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, দেবে না।
পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই যেটি এখন এই অভিযানকে থামাতে পারবে।
আছে।
খ্রাউস চিৎকার করে বলল, নেই।
তুমি নিজের চোখেই দেখো–
খ্রাউস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কাউন্ট ডাউন সংখ্যার দিকে তাকিয়ে রইল। এটি কমতে কমতে শূন্যতে এসে স্থির হতেই প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল। হঠাৎ করে সমস্ত জায়গাটা দুলে উঠল, তীব্র আলোর একটা ঝলকানি দেখতে পেলাম, শক্তি বলয় থেকে রিয়া এবং নুরিগা দুজন দুদিকে ছিটকে পড়ল। কর্কশ এক ধরনের এলার্ম বাজতে থাকে, আঁজালো পোড়া গন্ধ এবং ধোঁয়ায় হঠাৎ করে চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসে। খ্রাউস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। দেখতে দেখতে সেই মুখ ভয়ংকর ক্রোধে হিংস্র হয়ে ওঠে, হঠাৎ করে সে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি হাতের অস্ত্রটি দিয়ে তাকে গুলি করার চেষ্টা করলাম কিন্তু সে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় নিজেকে রক্ষা করে আমার টুটি চেপে ধরল। খাউসের শরীরে ভয়ংকর শক্তি–আমার মনে হল তার লোহার মতো হাত দিয়ে বুঝি আমার। ঘাড়টি একটি কাঠির মতো ভেঙে ফেলবে।
ঠিক তখন একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল এবং শক্তিশালী একটি অস্ত্রের গুলিতে খ্রাউসের পুরো মাথাটি উড়ে গেল। প্রায় সাথে সাথেই থ্রাউসের আঙুলগুলো আমার গলায় শিথিল হয়ে আসে। আমি নিজেকে কোনোভাবে মুক্ত করে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করতে থাকি এবং তখন আমি একটা আর্তচিৎকার শুনতে পেলাম। মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম রিয়া দুই হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে নিজের চিৎকার থামানোর চেষ্টা করছে। কী দেখে সে চিৎকার করছে আমি অনুমান করতে পারি, টলতে টলতে কোনোভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে খ্রাউসের দেহের দিকে তাকালাম। গুলির আঘাতে তার মাথাটি উড়ে গিয়েছে, গলার শূন্য স্থান থেকে প্যাঁচপেচে সবুজ এক ধরনের তরল বের হচ্ছে, তার মাঝে কিলবিলে এক ধরনের প্রাণী। নুরিগা অস্ত্র হাতে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে এইমাত্র গুলি করে খ্রাউসের মাথাটি উড়িয়ে দিয়েছে, কখনো কল্পনাও করে নি তারপর তাকে এই দৃশ্য দেখতে হবে।
আমি বুক ভরে নিশ্বাস নিতে গিয়ে খকখক করে কেশে ফেললাম। কোনোভাবে কাশি থামিয়ে বললাম, এত অবাক হবার কিছু নেই। খ্রাউস মানুষ নয়। মহাজাগতিক প্রাণীর ডিকয়।
নুরিগা মাথা নেড়ে বলল, আমার আনন্দটি পুরো হল না। আমি মানুষটি ভালো নই– মাথার ঘিলু উড়িয়ে দিলে এক ধরনের আনন্দ পাই। এটি তো দেখছি মানুষ নয়–এর মাথাও নেই, ঘিলুও নেই।
রিয়া খ্রাউসের ভয়ংকর পরিণতি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের রক্ষা করার জন্যে তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। আমার নাম রিয়া–
আমি জানি। আমি হেসে বললাম, আমার নাম ত্রাতুল। তোমার সাথে কথা বলেছিলাম মনে আছে?
রিয়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ অবিশ্যি মনে আছে। রিয়া আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু জিগি বাধা দিল, উত্তেজিত গলায় বলল, পাশের হলঘরে আগুন লেগে গেছে। আমাদের এক্ষুনি সরে পড়তে হবে। একটা একটা করে সাইবর্গকে চালু করে দাও। তাড়াতাড়ি। সবাই হাত লাগাও।
রিয়া জিজ্ঞেস করল, কেমন করে সাইবর্গ চালু করতে হয়?
এই দেখো–কানের নিচে একটা সুইচ আছে। দু সেকেন্ড চাপ দিয়ে ধরে রেখো, এরা চালু হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণের মাঝেই সবগুলো সাইবর্গ জেগে উঠে ছোটাছুটি শুরু করল। আমরা তাদেরকে লিফট দিয়ে উঠে যাবার নির্দেশ দিয়ে ছুটতে শুরু করি। করিডরের ভেতর দিয়ে ছুটে যাবার সময় হঠাৎ করে একটা করুণ আর্তনাদ শুনতে পেলাম। আমি থমকে দাঁড়িয়ে বললাম, সর্বনাশ!
রিয়া ভয়ার্ত মুখে বলল, কী হয়েছে।
এই হলঘরের ভেতরে আগুন লেগেছে। তোমাদের বাচানোর জন্যে যে কাজটা করেছি তাতে আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু–।
কিন্তু কী? ভেতরে দুজন আটকা পড়ে আছে। সাইবর্গের হোষ্ট। দুজন বুদ্ধিহীন মানুষ।
জিগি আমার দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকাল। আমি কানার সিকিউরিটি কার্ড দিয়ে করিডরের দরজা খুলতেই হলঘরের ভেতর থেকে প্রচণ্ড গরম একটা আগুনের হলকা যেন আমাদের ঝলসে দিল। আমি সাবধানে ভেতরে তাকালাম, দূরে একটা চতুষ্কোণ যন্ত্রের পাশে দাঁড়িয়ে সাইবর্গ দুটি ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করছে, তাদের চারপাশে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আমি চিৎকার করে হাত নেড়ে ডাকলাম, এস–এদিকে চলে এস।
বুদ্ধিহীন মানুষ দুজন আমার কথা শুনল কি না কিংবা শুনলেও বুঝতে পারল কি না জানি না। তারা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগল। আমি আবার হাত নেড়ে ডাকলাম, আমার দেখাদেখি জিগি আর রিয়াও হাত নেড়ে ডাকতে লাগল কিন্তু কোনো লাভ হল না।
নুরিগা একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, ডেকে লাভ নেই।
তা হলে?
গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তোমরা দাঁড়াও আমি যাচ্ছি।
তুমি যাচ্ছ? আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি এর ভেতরে যাচ্ছ? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
না। মাথা খারাপ হয় নি। কিন্তু কাউকে যদি ভেতরে যেতে হয় তা হলে কি আমারই যাওয়া উচিত না? কেউ যদি মারাই যায় তা হলে সবচেয়ে খারাপ মানুষটাই মারা যাক।
নুরিগার গলার স্বরে এক ধরনের জ্বালা ছিল সেটা আমাদের কানে স্পষ্ট ধরা পড়ল। আমি কিছু বলার আগেই রিয়া তার হাত স্পর্শ করে বলল, যে যাই বলুক, আমরা তোমাকে কখনো সবচেয়ে খারাপ মানুষ বলি নি।
নুরিগা মাথা নেড়ে বলল, এসব নিয়ে পরে কথা বলা যাবে, ভেতরে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি যাচ্ছি।
আমাদেরকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নুরিগা ছুটে ভেতরে ঢুকে গেল। আগুনের ভেতর দিয়ে ছুটে গিয়ে সে আতঙ্কিত দুজনকে ধরে টেনে নিয়ে আসতে থাকে। মানুষ দুটো তখনো কিছু বুঝতে পারছে না–একটানা চিৎকার করে যাচ্ছে। দরজার কাছাকাছি এসে একজনকে সে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়, দ্বিতীয় মানুষটা তার হাত থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিয়ে আবার ভেতরে ছুটে যাবার চেষ্টা করে। নুরিগা আবার তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে নিয়ে আসে। দরজার দিকে তাকে ঠেলে দিতেই হলঘরের ভেতরে প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল। আগুনের একটা জ্বলন্ত গোলা ছুটে এসে হঠাৎ করে নুরিগাকে গ্রাস করে নেয়, আমরা হতবাক হয়ে দেখলাম প্রচণ্ড আগুনে নুরিগার সমস্ত শরীর দাউদাউ করে জ্বলছে। নুরিগা টলতে টলতে কোনোভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না, হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল, কোনোভাবে মাথা তুলে আমাদের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু কথা শেষ হবার আগেই জ্বলন্ত একটি অগ্নিকূপ তাকে পুরোপুরি আড়াল করে ফেলল। চারদিকে শুধু আগুন আর আগুন। তার ভয়ংকর লেলিহান শিখা আর উত্তপ্ত বাতাসের হলকার মাঝে মনে হল আমরা শুনতে পেলাম নুরিগা চিৎকার করে বলছে, যাও! তোমরা যাও।
রিয়া দুই হাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু জিগি তার সুযোগ দিল না, বলল, পালাও, এক্ষুনি পালাও। পুরো এলাকাটি এক্ষুনি ধসে পড়বে।
আমি রিয়ার হাত ধরে টেনে ছুটতে থাকি। জিগি সাইবর্গ মানুষ দুটির হাত ধরে আমাদের পিছু পিছু ছুটতে থাকে। করিডরের শেষ মাথায় লিফটের ভেতরে ঢুকে সুইচ স্পর্শ করার সাথে সাথে পুরো এলাকাটা আরো একটি ভয়ংকর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল, ভয়ংকর আগুনের লেলিহান শিখা আমাদের দিকে ছুটে আসে কিন্তু তার আগেই লিফটটি উপরে উঠতে শুরু করেছে। জিগি ফিসফিস করে বলল, আমরা বেঁচে গেলাম।
এত নিশ্চিত হয়ো না। আমি জিগির দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললাম, আমরা এখনো এই কেন্দ্রের ভেতরে আটকা পড়ে আছি। এটা উসের আস্তানা। লিফট থেকে বের হওয়া মাত্রই আমরা ধরা পড়ে যাব।
জিগি এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে আমার দিকে তাকাল। রিয়া কাঁপা গলায় বলল, কিন্তু আমরা সত্যি কথাটি সবাইকে জানিয়ে দেব।
কেমন করে জানাবে?
রিয়া হতবুদ্ধির মতো আমার দিকে তাকাল, আমি বললাম, সবাইকে জানাতে হলে আগে এখান থেকে বের হতে হবে। কেমন করে বের হবে?
কেউ নেই সাহায্য করার?
আছে। আমি মাথা নাড়লাম, তার নাম হচ্ছে ক্রানা। ক্ৰানা সাহায্য করেছে বলে আমরা এত দূর আসতে পেরেছি। যেভাবেই হোক আমাদের ক্রানাকে খুঁজে বের করতে হবে।
ঠিক এই সময় লিফট থেমে গেল। লিফটের দরজা নিঃশব্দে খুলে যেতেই দেখি ঠিক আমাদের সামনে জানা উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে কানার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, তোমরা বেঁচে আছ তা হলে
আমি ক্ৰানাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, আমাদের যেভাবে হোক বের হওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দাও
প্রয়োজন নেই?
না।
কেন?
বাইরে সবাইকে বলতে হবে এখানে কী হচ্ছে।
ক্রানা শব্দ করে হেসে বলল, তার কোনো প্রয়োজন নেই।
কেন?
সারা পৃথিবীর সবাই এখন এটি জানে!
কেমন করে জানে?
এস আমার সাথে
ক্ৰানা আমাদের বড় একটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের সামনে নিয়ে গিয়ে বলল, এই দেখ, সারা পৃথিবীতে একটু পরে পরে এই বুলেটিনটি প্রচারিত হচ্ছে।
আমরা রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রইলাম, হঠাৎ করে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে একটি নারীমূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল, আমরা অবাক হয়ে দেখলাম সেটি রিয়া। তার মুখে এক ধরনের ব্যাকুল ভাব, চোখে শঙ্কা। অনিশ্চিতভাবে সামনে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, পৃথিবীর মানুষেরা, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই তোমরা আমাকে দেখতে পাচ্ছ কি না, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ কি না। আমার নাম রিয়া, পৃথিবীতে অনেকে আমাকে কৌতুক করে ডাকত রাজকুমারী রিয়া, কারণ আমাকে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করা হয়েছিল–বলা হয়ে থাকে আমি হচ্ছি পৃথিবীর নিখুঁত মানবী–যদিও আমি সেটা বিশ্বাস করি না, কোনো মানুষ সবচেয়ে নিখুঁত হতে পারে না, তা হলে মানুষের ভেতরের শক্তিকে ক্ষুদ্র করে দেখা হয়।
আমার মনে হয় পৃথিবীর অনেক মানুষই আমার কথা শুনেছে, সেটা নিয়ে খানিকটা কৌতূহল এবং অনেক ক্ষেত্রে কৌতুক অনুভব করেছে। কিন্তু আজ আমি তোমাদের সামনে বলতে এসেছি যে এটি কৌতূহল বা কৌতুকের ব্যাপার নয়। এটি একটি ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের ব্যাপার।
আমি নিশ্চিত তোমরা জান না আমাকে যেরকম পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত হিসেবে তৈরি করা হয়েছে ঠিক সেরকম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধী হিসেবে একজনকে সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। কাজটি করা হয়েছে গোপনে। সেই মানুষটি কখনো কোনো অপরাধ করে নি কিন্তু তবুও তাকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করে শিকল দিয়ে বেঁধে খাঁচার মাঝে আটকে রাখা হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম নিষ্ঠুরতার কথা কেউ শুনেছে বলে আমার মনে হয় না। পৃথিবীর মানুষেরা, তোমরা এখনো পুরোটুকু শুনো নি–আমি নিশ্চিত শুনলে তোমরা আতঙ্কে শিউরে উঠবে।
আমাদের দুজনকে তৈরি করার পেছনে একটি কারণ রয়েছে। কারণটি বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নয়। কারণটি বলা যায় এক কথায়, ব্যবসায়িক। আর সেই ব্যবসাটি হচ্ছে কোনো এক মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে। তারা পৃথিবীতে দেবে প্রযুক্তি তার বিনিময়ে পৃথিবী দেবে দুজন মানুষ। সবচেয়ে ভালো এবং সবচেয়ে খারাপ। একজন পুরুষ একজন মহিলা। আর এই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গোপনে। পৃথিবীর সকল মানুষের অজান্তে।
পৃথিবীর মানুষেরা–আমি জানি না, তোমরা আমার কথা শুনছ কি না। যদি শুনছ– আমি নিশ্চিত তোমরা নিশ্চয়ই ঘৃণা, আতঙ্ক এবং ক্রোধে শিউরে উঠছ। কিন্তু তোমরা এখনো পুরোটুকু শুনো নি।
এই যে আমাকে দেখছ, আমি কিন্তু সত্যিকারের রিয়া নই। সত্যিকারের রিয়া এখন কোথায় আছে আমি জানি না। সম্ভবত তাকে দূর কোনো এক গ্যালাক্সিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, ল্যাবরেটরিতে যেরকম করে গিনিপিগকে বিশ্লেষণ করা হত সেরকমভাবে বিশ্লেষণ করার জন্যে। আমি প্রকৃত রিয়ার একটি অস্তিত্ব। আমাকে একটা পরাবাস্তব জগতে তৈরি করা হয়েছে। আমার সাথে আরো অনেকে আছে। তারা আমাকে সাহায্য করেছে এই পরাবাস্তব জগৎটি দখল করে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে।
পৃথিবীর মানুষেরা। শুধু তোমরাই পারবে এই নিঃসঙ্গ ভয়ংকর পরাবাস্তব জগৎ থেকে আমাদের উদ্ধার করে আনতে। শুধু তোমরাই পারবে এই ভয়ংকর ষড়যন্ত্র রুখে দিতে। শুধু তোমরা। তোমাদের শুভবুদ্ধি আর তোমাদের ভালবাসা।
রিয়ার প্রতিচ্ছবিটি খুব ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে গেল। আমি রিয়ার দিকে তাকালাম, তার চোখে পানি টলটল করছে, আমি নরম গলায় বললাম, খুব সুন্দর করে বলেছ রিয়া।
রিয়া মাথা নাড়ল, বলল, আমি বলি নি। ও বলেছে।
ও আর তুমি এক রিয়া। তোমরা এখন দুজন দু জায়গায় আছ কিন্তু আবার তোমরা এক হবে।
ঠিক এই সময় সমুদ্রের গর্জনের মতো এক ধরনের শব্দ শুনতে পেলাম। আমি অবাক হয়ে বললাম, এটি কীসের শব্দ?
ক্রানা বলল, মানুষের। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ বাইরে এসে একত্র হচ্ছে। তারা সব ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইছে।
সত্যি?
হা সত্যি।
ক্রানা রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, মানুষ খুব খেপে উঠছে, তোমাকে একটু বাইরে গিয়ে তাদের শান্ত করতে হবে। তুমি ছাড়া আর কেউ পারবে না। রাষ্ট্রপতি আসছেন, বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতিও আসছেন। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানরা চলে এসেছেন।
রিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, ক্রানা হাত ধরে বলল, এস।
শেষ কথা
হ্রদের তীরে নৌকাটা পুরোপুরি থামার আগেই সবাই হৈ–হুঁল্লোড় করে নেমে এল। পানিতে ঝাপাঝাপি করে সবাই ভিজে গেছে কিন্তু কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই মিলে ছুটি কাটাতে এসেছে–আজ এখানে কারণে–অকারণে আনন্দ এবং হাসির মেলা।
ক্রানা তার দুই বছরের বাচ্চাটিকে ধরে রেখেছিল, সে নামার জন্যে আঁকুপাকু করতে থাকে। তাকে নামিয়ে দিতেই সে থপথপ করে দুই পা এগিয়ে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে হমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। সেভাবেই সে হামাগুড়ি দিয়ে একটা লাল কাঁকড়ার কাছে এগিয়ে যায়। তাকে দেখে কাকড়াটি বালুর ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল, শিশুটি তখন অবাক হয়ে চারদিকে দেখে, হাতের মুঠোর জিনিস যে হারিয়ে যেতে পারে এই অভিজ্ঞতাটুকু বুঝি এমন করেই মানুষের হয়।
ক্রানা হ্রদের উথাল–পাতাল বাতাসে তার উড়ন্ত চুলগুলো সামলানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, আচ্ছা রিয়া এবং ত্রাতুল, তোমরা প্রতি বছর এখানে বেড়াতে আস কেন?
রিয়া আদুরে মেয়ের মতো আমার হাত জড়িয়ে ধরে রহস্য করে বলল, ব্যাপারটা গভীরভাবে রোমান্টিক! আমার সাথে ত্রাতুলের দেয়া হয়েছিল এখানে।
জিগি গলা উঁচিয়ে বলল, বাজে কথা বলে না। তোমার সাথে ত্রাতুলের দেখা হয়েছিল পরাবাস্তব জগতে। একটা যন্ত্রের ভেতরে তার মেমোরি সেলে। তোমরা সত্যিকার মানুষ পর্যন্ত ছিলে না!
রিয়া তীক্ষ্ণ চোখে জিগির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে যে এই জগৎট সত্যি? তুমি সত্যি? তুমি কি বলতে পারবে যে তুমি এই মুহূর্তে অন্য কারো পরাবাস্তব জগতে বসে নেই?
জিগিকে খানিকটা বিভ্রান্ত দেখায়, সে দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, না, তা অবিশ্যি পারব না–কিন্তু
রিয়া মুখে কপট গাম্ভীর্য এনে বলল, কাজেই তুমি বড় বড় কথা বলো না। আমাদের কাছে আমাদের সেই জগৎটাই ছিল বাস্তব। তুমি যেটুকু বাস্তব দেখেছ তার চাইতেও বেশি বাস্তব।
রিয়া একটি গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, সেই জায়গাটা ছিল এরকম। পাহাড়ের পাদদেশে নীল হ্রদ, দীর্ঘ বালুবেলা, বালুবেলার কাছে ঘন অরণ্য। তার সাথে হু–হুঁ করে। উথাল–পাতাল বাতাস। এখানে এলে আমাদের সেই জায়গাটার কথা মনে পড়ে তাই আমরা এখানে আসি।
জিগি হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বলল, আমি ভাবতেও পারি না। একজন মানুষ তার পরাবাস্তব জগতের স্মৃতি নিয়ে এরকম বাড়াবাড়ি করতে পারে!
ক্রানা বলল, মনে আছে প্রথমবার যখন পরাবাস্তব জগৎ থেকে ত্রাতুল আর রিয়ার মাথায় স্মৃতি ফিরিয়ে নিয়ে আসা হল তখন কী হয়েছিল?
হ্যাঁ! জিগি চোখ বড় বড় করে বলল, স্মৃতি লোড করার আগে দুজন প্রায় অপরিচিত মানুষ। কিন্তু লোড করার পর চোখ খুলেই দুজন দুজনের কাছে ছুটে এসে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে সে কী হাউমাউ করে কান্না!
আমি দুর্বল গলায় আপত্তি করার চেষ্টা করে বললাম, আমার যতদূর মনে আছে কান্নাকাটির অংশটি ছিল রিয়ার।
রিয়া একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ছিলই তো! তা আমি কী করব? জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে আমাকে এমনভাবে তৈরি করেছে যে অল্পতেই আমার চোখে পানি এসে যায়।
জিগি চোখ ঘুরিয়ে বলল, তোমার ভারি মজা রিয়া। কিছু একটা হলেই জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে দোষ দিতে পার। আমাদের বেলায় যাই করি না কেন পুরো দোষটা হয় আমাদের নিজেদের!
জিগির কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে, জিগির চতুর্দশ নম্বর বান্ধবী তার মাথায় একটা হালকা চাটি দিয়ে বলল, নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করো না জিগি। তোমার বেলায় সব দোষ যে আসলেই তোমার সেটা আমার থেকে ভালো করে কেউ জানে না।
এই সাধারণ কথাটি শুনেই আবার সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
.
সূর্য ডুবে যাবার পর আমি আর রিয়া বালুবেলায় হাঁটতে বের হলাম। আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে। তার ম্লান আলোতে দূরের পর্বতমালাকে কেমন জানি অপার্থিব দেখায়। সন্ধ্যাবেলার উথাল-পাতাল বাতাসে হ্রদের পানি ছলাৎ ছলাৎ করে তীরে এসে আঘাত করছে। চারপাশে সুনসান নীরবতা, মনে হয় আমরা বুঝি কোনো একটি অতিপ্রাকৃত জগতে চলে এসেছি।
রিয়া আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে যেন আমাকে ছাড়লেই আমি অদৃশ্য হয়ে যাব। এই মেয়েটির সাথে পরিচয় না হলে আমি কখনোই সত্যিকার অর্থে ভালবাসা জিনিসটি কী সেটা বুঝতে পারতাম না। তার ভালবাসার ক্ষমতা এবং সেটা প্রকাশ করার ক্ষমতা দেখে আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই।
মাথার ওপর দিয়ে হঠাৎ করে একটা পাখি শব্দ করে ডেকে ডেকে উড়ে গেল, সেই ডাক শুনে কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যায়। রিয়া একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, মনে আছে ত্রাতুল?
কীসের কথা বলছ?
নুরিগার কথা।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, মনে নেই আবার?
আমি চোখের সামনে সেই দৃশ্যটি দেখতে পাই। পরাবাস্তব জগতে এরকম একটি বালুবেলায় নুরিগা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল। আমরা তখন জেনে গেছি সত্যিকারের পৃথিবীতে দুটি সাইবর্গকে বাঁচাতে গিয়ে সত্যিকারের নুরিগা মারা গেছে, তার এখন পৃথিবীতে ফিরে যাবার কোনো উপায় নেই। পরাবাস্তব একটি জগতে সে চিরদিনের জন্যে আটকা পড়ে থাকবে। গভীর বেদনায় তার ভেতরটা নিশ্চয়ই দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল কিন্তু আমাদের সামনে সেটা প্রকাশ করল না। আমাদের দুজনকে আলিঙ্গন করে সে ফিসফিস করে বলেছিল, বিদায় ত্রাতুল। বিদায় রিয়া। পৃথিবীতে তোমাদের জীবন আনন্দময় হোক।
আমরা কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। নুরিগা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, আমার জন্যে তোমাদের ভালবাসার কথা আমার মনে থাকবে। তোমাদের সাথে দেখা না হলে আমি ভাবতাম সত্যিই বুঝি আমার জীবনের কোনো মূল্য নেই। সত্যিই বুঝি আমি তুচ্ছ। আমি অপরাধী।
রিয়া কোনো কথা না বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। নুরিগা ফিসফিস করে বলেছিল, আমি কখনো ভাবি নি আমার জন্যে কেউ চোখের পানি ফেলবে। তুমি জান রিয়া, আজ আমার কোনো দুঃখ নেই?
তারপর নুরিগা হ্রদের বালুবেলায় বিষণ্ণ পদক্ষেপে হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিল। আমরা দেখেছিলাম তার দীর্ঘ অবয়ব সন্ধ্যার অন্ধকারে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোথায় আছে এখন সে? কেমন আছে?
আমি রিয়ার দিকে তাকালাম, তার চোখে পানি চিকচিক করছে।