একটি মৃত্যুদণ্ড
রগারিজ ক্রুচিনকে বধ্যভূমিতে নিয়ে আসা হয়েছে। তার পরনে একটি ঢিলেঢালা সাদা শার্ট এবং কুঁচকে থাকা নীল ট্রাউজার। তার মাথার চুল অবিন্যস্ত এবং চোখের দৃষ্টি খানিকটা দিশেহারা। গ্রানাইটের দেয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে তার হাতকড়া খুলে দেওয়া হল। মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সময় তাকে পুরোপুরি মুক্ত করে রাখার এই প্রাচীন নিয়মটিকে এখনো মেনে চলা হয়।
একটু দূরেই প্রতিরক্ষা বাহিনীর দশজন মানুষ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে–তারা গুলি করে বগারিজ ক্রুচিনকে হত্যা করবে। একজন মানুষকে হত্যা করার মতো নৃশংস একটি ঘটনার জন্যে তাদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে, সম্ভবত সে কারণে তাদের মুখে কোনো ভাবাবেগের চিহ্ন নেই। তাদের মুখমণ্ডল কঠিন, চোখের দৃষ্টি নিস্পৃহ এবং ভাবলেশহীন।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডার রগারিজ ক্রুচিনের সামনে এসে দাঁড়াল। মানুষটি মধ্যবয়স্ক, মাথায় কাঁচাপাকা চুল এবং রোদেপোড়া চেহারা। মধ্যবয়স্ক কমান্ডারটি তার পকেট থেকে একটি ভাজ–করা কাগজ বের করে এবং রগারিজ ক্রুচিন একধরনের শূন্যদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কমান্ডারটি একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে কাগজটি পড়তে শুরু করে : রগারিজ ক্রুচিন, মানবতার বিরুদ্ধে তোমার সকল অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে বলে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তোমার অপরাধের শাস্তিস্বরূপ কিছুক্ষণের মাঝেই তোমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে পৃথিবীর মানুষ একটি বড় অপরাধের গ্লানি থেকে মুক্তি পাবে।
রগারিজ ক্রুচিনের ভুরু একটু কুঞ্চিত হল, মনে হল সে কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারছে না। তার নিচের ঠোঁট হঠাৎ একটু নড়ে উঠল, মনে হল সে কিছু একটা বলবে কিন্তু সে কোনো কথা বলল না।
মধ্যবয়স্ক কমান্ডার তার হাতের কাগজটির দিকে তাকিয়ে প্রায় আধা–যান্ত্রিক স্বরে আবার পড়তে শুরু করে : রগারিজ ক্রুচিন, তুমি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী একজন সৈনিক। তুমি একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলে কিন্তু তোমার কর্মদক্ষতা এবং চাতুর্যের কারণে খুব অল্পবয়সে সেনাবাহিনীতে খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তুমি সেনাবাহিনীতে তোমার প্রকৃত দায়িত্ব পালন না করে একটি সামরিক অ্যুথানের নেতৃত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছিলে। তুমি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের সকল সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলে। তুমি শুধু যে সরকারের সদস্যদের হত্যা করেছ তা নয়, তুমি তাদের পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করেছ, শিশু বা নারীরাও সেই হত্যাকাণ্ড থেকে মুক্তি পায় নি।
রগারিজ ক্রুচিন, তোমার জীবনের পরবর্তী তিরিশ বছরের ইতিহাস নৃশংসতা এবং পাশবিকতার ইতিহাস। তুমি তোমার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্যে সেনাবাহিনীর কয়েক হাজার সদস্যকে কারণে এবং অকারণে হত্যা করেছ। তাদের মৃতদেহ পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের হাতে হস্তান্তর কর নি, তাদের সবাইকে একটি চরম দুর্ভাগ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছ।
দেশে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার নাম দিয়ে তুমি দেশের বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়কে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছ। তাদেরকে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য করেছ। দেশের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে কনসেনট্রেশান ক্যাম্প স্থাপন করে এই জনগোষ্ঠীকে তুমি ক্রীতদাসের মতো ব্যবহার করেছ। তাদের শিশুদের তুমি পূর্ণাঙ্গ মানুষের মতো বেঁচে থাকার সুযোগ দাও নি। আহার বাসস্থান শিক্ষার সুযোগ না দিয়ে তুমি তাদের প্রতি ভয়ংকর অবিচার করেছ। অনাহারে রোগে শোকে অত্যাচারে তুমি কয়েক লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছ।
তোমার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠলে তুমি সেটি অমানুষিক নিষ্ঠুরতায় দমন। করেছ। তুমি দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছ এবং মুক্তিকামী মানুষদের হত্যা করে সমস্ত দেশে একটি অচিন্তনীয় বিভীষিকার সৃষ্টি করেছ। তুমি মৃত মানুষদের প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান প্রদর্শন না করে গণকবরে তাদের দেহকে প্রোথিত করেছ।
তুমি তোমার হাতকে শক্তিশালী করার জন্যে তোমাকে ঘিরে কিছু ক্ষমতালোভী নৃশংস মানুষ সৃষ্টি করেছ। তাদের অত্যাচার আর দুর্নীতির কারণে সমগ্র দেশ, দেশের মানুষ পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল।
মধ্যবয়স্ক কমান্ডার হাতের কাগজটির পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আবার পড়তে শুরু করল : এই দেশের মানুষের অনেক বড় সৌভাগ্য যে দেশের আইন শেষ পর্যন্ত তোমাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পেরেছিল। কোনো বিশেষ ট্রাইবুন্যালে নয়, প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় তোমাকে বিচার করা হয়েছে। মানবতার বিরুদ্ধে তোমার প্রতিটি অপরাধ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং মহামান্য আদালত তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে এই পৃথিবীর মানুষ মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি জঘন্য অপরাধের গ্লানি থেকে মুক্ত হবে।
প্রতিরক্ষাবাহিনীর কমান্ডার পড়া শেষ করে হাতের কাগজটি ভাজ করে তার পকেটে রেখে একপাশে সরে এল। সে একবার তার হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল, তারপর একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে আদেশ দিল। সাথে সাথে সুশৃঙ্খল প্রতিরক্ষাবাহিনীর দশজন সদস্যের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো উঁচু হয়ে ওঠে।
রগারিজ ক্রুচিনকে আবার এক মুহূর্তের জন্যে একটু অসহায় দেখায়। তার নিচের ঠোঁট আবার একটু নড়ে ওঠে, মনে হয় সে আবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে কিছু বলল না।
ঠিক সেই মুহূর্তে প্রতিরক্ষাবাহিনীর দশজন সদস্যের হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো ভয়ংকর শব্দ করে গর্জে উঠল। রগারিজ ক্রুচিনের দেহটি বুলেটের আঘাতে কয়েকবার কেঁপে উঠে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল। কয়েকবার কেঁপে উঠে দেহটি স্থির হয়ে যায়, তার ঢিলেঢালা সাদা শার্টটি রক্তে ভিজে উঠতে শুরু করে।
***
প্রবীণ সাংবাদিকের সাহায্যকারী কমবয়সী মেয়েটি ক্যামেরার বিভিন্ন অংশ স্টেনলেসের বাক্সে সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলল, তুমি কি একটা জিনিস লক্ষ করেছিলে?
কী জিনিস?
রগারিজ ক্রুচিনের নিচের ঠোঁটটি কয়েকবার নড়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল সে যেন কিছু–একটা বলতে চায়।
হ্যাঁ। প্রবীণ সাংবাদিক মাথা নাড়ল, আমি লক্ষ করেছিলাম।
সে কী বলতে চেয়েছিল বলে মনে হয়?
তার বলার কিছু নেই। প্রবীণ সাংবাদিক হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটিকে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, বিচার অত্যন্ত নিরপেক্ষ হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সবগুলো অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
তা ঠিক।
প্রবীণ সাংবাদিক একটি বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, রগারিজ ক্রুচিনের বিচার করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আসলেই আমরা একটা অনেক বড় আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি পেলাম।
তা ঠিক। মেয়েটি স্টেনলেস স্টিলের বাক্সটি বন্ধ করতে করতে বলল, এমন কি হতে পারে সে বলতে চেয়েছিল যেহেতু প্রকৃত বগারিজ ক্রুচিন আজ থেকে তিরিশ বছর আগে হৃদরোগে মারা গেছে সেহেতু এখন তার জন্যে আর কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না?
প্রবীণ সাংবাদিক অবাক হয়ে বলল, কেন সে এরকম একটা কথা বলতে চাইবে? সে তো অন্য কেউ নয়, সে রগারিজ ক্রুচিনের ক্লোন, সে এক শ ভাগ রগারিজ ক্রুচিন, তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্যেই আলাদা করে ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছে।
কমবয়সী মেয়েটি কিছু–একটা বলতে চাইছিল কিন্তু প্রবীণ সাংবাদিকটি তাকে বাধা দিয়ে বলল, এটি একটি নতুন পৃথিবী, এখানে অপরাধীরা মৃত্যুবরণ করেও পালিয়ে যেতে পারবে না।
কমবয়সী মেয়েটি পাথরের ওপর নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকা রগারিজ ক্রুচিনের রক্তাক্ত মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল।