১৫. বৃহস্পতি, শ্রীকর, শ্রীনাথ ও রঘুনন্দন

বৃহস্পতি, শ্রীকর, শ্রীনাথ ও রঘুনন্দন

ধর্মের গৌরব, বিদ্যার গৌরব ও শিল্পের গৌরবে গৌরবান্বিত হইয়া বৌদ্ধগণ ও হিন্দুগণ বাংলা দেশে সুখে স্বচ্ছন্দে বাস করিতেছিলেন। বৌদ্ধেরা তিব্বতে গিয়া সেখানে আপনাদের প্রভাব বিস্তার করিতেছিলেন, ব্রাহ্মণেরাও বাংলায় নূতন সমাজের সৃষ্টি করিতেছিলেন। এমন সময় ঘোর বন্যার ন্যায় আফগান দেশ হইতে মুসলমানেরা আসিয়া উপস্থিত হইল। সে বন্যায় রাজা-প্রজা, বৌদ্ধ-হিন্দু, বজ্রযান-সহজযান, ন্যায়-স্মৃতি, দর্শন-বিজ্ঞান—সব ভাঙিয়া, ভাসিয়া গেল। বাঙালী ও বেহারী শিল্পের ভাল ভাল জিনিসগুলি, বড় বড় অট্টালিকা, বড় বড় মন্দির, দেবমূর্তি, মনুষ্যমূর্তি, ক্রোধমূর্তি, শান্তমূর্তি, হিন্দুমূর্তি, বৌদ্ধমূর্তি, তালপাতার পুঁথি, ভূর্জপত্রের পুঁথি, ছালের পুঁথি, তেড়েতের পুঁথি, নানারূপ চিত্র, নানারূপ কারুকার্য, সব নাশ হইয়া গেল। ওদন্তপুরে মুসলমানেরা সিপাই বলিয়া হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে মারিয়া ফেলিল, কেল্লা বলিয়া মহাবিহারটিকে সমভূম করিয়া দিল, বৌদ্ধমূর্তি ও যাত্রার সাজসজ্জা সব লুটিয়া লইয়া গেল, সোনারূপার মূর্তিগুলি গলাইয়া ফেলিল, পুঁথিগুলি পুড়াইয়া ফেলিল। প্রতি বিহারেই এইরূপ হইতে লাগিল। ওদন্তপুরের বিহার এখনও চেনা যায়, সে জায়াগাটা এখনও তিরিশ ফুট উঁচু; নালন্দার নাম পর্যন্ত লোপ পাইয়াছে, পাশের একটি ক্ষুদ্র পল্লীগ্রামের নামে তাহার নাম হইয়াছে ‘বড়গায়েঁর টিবি’; বিক্রমশীলার সন্ধানও পাওয়া যায় নাই; জগদ্দল খুঁজিয়া মিলিতেছে না; বিদেশীরা এমনি করিয়া নষ্ট করিয়াছে যে, তাহাদের স্মৃতি পর্যন্ত লোপ পাইয়াছিল। ভাগ্যে নেপাল ছিল, তিব্বত ছিল, তাই এত দিনের পর তাহাদের স্মৃতি আবার জাগিয়া উঠিয়াছে। এবং ইংরাজ-আমলে খুঁড়িয়া খুঁড়িয়া আমরা আমাদের পূর্বগৌরবের ধ্বংসাবশেষ দেখিতে পাইতেছি।

পুষ্যমিত্রের ঘোরতর হত্যাকাণ্ডেও যে ধর্মের কিছুমাত্র ক্ষতি হয় নাই, কুমারিল-শঙ্করের প্রাণপন চেষ্টাতেও যে ধর্ম পূর্বভারতে অক্ষুণ্ণ ছিল, ব্রাহ্মণদের নিরন্তর বিদ্বেষসত্ত্বেও যে ধর্ম চারি দিক ছড়াইয়া পড়িতেছিল, এক তুর্কী-আক্রমণেই সে ধর্ম শুধু যে ধ্বংস হইল তাহা নয়, বিস্মৃতিসাগরে ডুবিয়া গেল। লাভ হইল মঙ্গোলিয়ার, লাভ হইল তিব্বতের, লাভ হইল পূর্ব-উপদ্বীপের, লাভ হইল সিংহলের। তলোয়ারের মুখ হইতে যাহারা অব্যাহতি পাইয়াছিল, তাহারা ঐ সকল দেশে গিয়া আশ্রয় লইল। তাহাদিগকে পাইয়া ঐ সকল দেশ কৃতার্থ হইয়া গেল; তাহাদের বিদ্যা বৃদ্ধি হইল, ধর্ম বৃদ্ধি হইল, জ্ঞান বৃদ্ধি হইল, শিল্প বৃদ্ধি হইল; ক্ষতি যাহা হইবার তাহা বাংলারই হইয়া গেল।

দুই শত বৎসর পর্যন্ত বাঙালীরা প্রাণের ভয়ে অস্থির হইয়া আপন দেশে বাস করিতে লাগিল। এই সময় দেশের কি অবস্থা হইয়াছিল, কুলগ্রন্থই তাহার সাক্ষী। দুই শত বৎসর নিরস্তর মারামারি কাটাকাটির পর একবার একজন হিন্দু বাংলার রাজা হইয়াছিলেন। অমনি আবার হিন্দুসমাজে সংস্কৃতসাহিত্য বাংলাসাহিত্য জাগিয়া উঠিল। যে মহাপুরুষের একান্ত আগ্রহ, একান্ত যত্ন ও দূরদর্শিতার ফলে সংস্কৃতসাহিত্য আবার বাঁচিয়া উঠে তাঁহার নাম বৃহস্পতি, উপাধি রায়মুকুট। তিনি নিজে অনেক সংস্কৃত কাব্যের টিকা লিখিয়া, একখানি স্মৃতিনিবন্ধ রচনা করিয়া, অমরকোষের টিকা লিখিয়া, অনেক পণ্ডিতকে প্রতিপালন করিয়া আবার সংস্কৃতসাহিত্যের চর্চা আরম্ভ করিয়া দিলেন। এই কার্যে তাঁহার প্রধান সহায় ছিলেন শ্রীকর। ইনিও বৃহস্পতির ন্যায় নানা গ্রন্থ রচনা করেন এবং দুইজনে মিলিয়া অমরকোষের আর-একখানি টীকা লিখেন। শ্রীকরের পুত্র শ্রীনাথ পুরা এক সেট নিবন্ধ সংগ্রহ করিয়া আবার হিন্দুসমাজ বাঁধিবার চেষ্টা করেন। তিনি বিশেষরূপ কৃতকার্য হইতে পারেন নাই, কিন্তু তাঁহার শিষ্য রঘুনন্দন সমাজ বাঁধিয়া দিয়া গেলেন। তাঁহার বাঁধা সমাজ এখনও চলিতেছে। বৃহস্পতি, শ্রীকর, শ্রীনাথ ও রঘুনন্দন আমাদের সমাজ বাঁধিয়া দিয়াছেন বলিয়া আমরা আজিও হিন্দু বলিয়া পরিচয় দিতে পারিতেছি। ইঁহারা আমাদের পূজ্য, নমস্য এবং গৌরবের স্থল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *