১৬. ন্যায়শাস্ত্র

ন্যায়শাস্ত্র

তুর্কি-আক্রমণে অন্যান্য শাস্ত্রের ন্যায়, দর্শনশাস্ত্রও লোপ পাইয়াছিল। রাজা গণেশের পর হইতে যে আবার সংস্কৃতচর্চা আরম্ভ হইল, তাহার ফলে ন্যায়ের চর্চা আরম্ভ হইল। এই চারিশত বৎসরের মধ্যে বাংলার ন্যায়শাস্ত্র ভারতবর্ষময় ছড়াইয়া পড়িয়াছে। ভারতবর্ষের যেখানেই চাও, যিনি নৈয়ায়িক তিনি কিছু না কিছু বাংলা কথা কহিতে পারেন। নবদ্বীপে না আসিলে তাঁহাদের চলে না। সুতরাং তাঁহাদের নবদ্বীপে আসিতেও হয়, বাংলা ভাষা শিখিতেও হয়। দেশে গিয়া যদিও বাংলা ভুলিয়া যান, তথাপি বাঙালী দেখিলেই আবার তাঁহাদের ফুটা বাংলা কথা কহিবার ইচ্ছা হয়। কাশ্মীর যাও, পাঞ্জাব যাও, নেপাল যাও, হিন্দুস্থান যাও, রাজপুতানা যাও, মাদ্রাজ যাও, মহিসুর যাও, ত্রিবাঙ্কুর যাও, নৈয়ায়িকের মুখে দুচারিটি বাংলা কথা শুনিতেই পাইবে। বাঙালীর এটা বড় কম গৌরবের কথা নয়। ভারতে বাঙালীর এই প্রাধান্য যাঁহারা করিয়া গিয়াছেন, তাঁহারা সকলেই আমাদেরপ পূজ্য ও নমস্য। তাঁহাদের মধ্যে প্রথমম বাসুদেব সার্বভৌম। তিনি কিন্তু কোন গ্রন্থ রাখিয়া যান নাই বা তাঁহার কোন গ্রন্থ চলিত হয় নাই। দ্বিতীয়, রঘুনাথ শিরোমণি। ইঁহার বুদ্ধি ক্ষুরের ধারের মত সূক্ষ্ম ছিল। তিনি ন্যায় ও বৈশেষিক সম্বন্ধে অনেক গ্রন্থ লিখিয়া গিয়াছেন। কিন্তু ইঁহার তত্ত্বচিন্তামণির টীকাই লোকে বেশী জানে। তিনি যে শুধু বাসুদেব সর্বভৌম ও পক্ষধর মিশ্রের নিকট পড়িয়াছিলেন এমন নহে—তিনি মহারাষ্ট্র দেশে যাইয়া রামেশ্বরের নিকট পড়িয়াছিলেন। তাঁহার ছাত্র যে শুধু বাংলা দেশেই ছিল এমন নহে—দ্বারবঙ্গের রাজার পূর্বপুরুষ মহে পণ্ডিতও তাঁহার ছাত্র ছিলেন। শিরোমণির পর আমাদের দেশের লোক হরিরাম, জগদীশ ও গদাধরকেই চিনে ও ইঁহাদের টীকাটিপ্পনী পাঠ করে। কিন্তু পশ্চিমাঞ্চলে এককালে ভবানন্দ সিদ্ধান্তবাগীশের বড়ই আদর হইয়াছিল। মহাদেব পুন্তামকর ভবানন্দের টীকারই টীকা লিখিয়াছিলেন ও সেই টীকা এখনও দুই-চারি জায়গায় চলে। ন্যায়-শাস্ত্রের গ্রন্থকারদিগের মধ্যে সকলের শেষ বিশ্বনাথ। তিনি কয়েকটি কারিকার মধ্যে ন্যায়শাস্ত্রের সমস্ত দুরূহ সিদ্ধান্তের যেরূপ সমাবেশ করেন, তাহা দেখিয়া সকল দেশেরই লোক আশ্চর্য হইয়া যায়। এখনও তাঁহার তিন শত বৎসর পূর্ণ হয় নাই, কিন্তু ভারতের সর্বত্রই তাঁহার কারিকা ও তাঁহার সিদ্ধান্তমুক্তাবলী চলিতেছে। বাংলায় তাঁহার টীকাকার কেহ জন্মে নাই; তাঁহার টীকাকার একজন মারহাট্টী, তাঁহার নাম মহাদেব দিনকর। এখন বলিতে গেলে, এই নৈয়ায়িকগণই এখনও ভারতে বাংলার নাম বজায় রাখিয়াছেন। কারণ বাংলার স্মার্তকে অন্য দেশের লোকের চিনিবার দরকার নাই, কিন্তু বাংলার নৈয়ায়িকদের না চিনিলে ভারতবর্ষে কাহারও চলে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *