৯. শেষপর্যন্ত শিনা জয়সওয়াল

শেষপর্যন্ত শিনা জয়সওয়াল! তুমি ভাবতে পেরেছিলে অর্ণব!

অর্ণব আড়চোখে অধিরাজের দিকে তাকায়। বাইরে তখন বেশ জোরে বৃষ্টি পড়ছিল। সে পেছন ফিরে একদৃষ্টে সেই ধোঁয়াশা প্রেক্ষাপটের দিকেই তাকিয়েছিল। ড. চ্যাটার্জীর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল–আই হেট হার! আই জাস্ট হে–ট হার!

হেট শব্দটার ওপর একটু বেশিই জোর পড়ল। ড. চ্যাটার্জী ঠোঁট টিপে হাসলেন–সকাল থেকে এই নিয়ে আটবার বলল! মালটার ইগোতে হেবি লেগেছে। তারপরই গলাটা একটু চড়িয়ে বলেন–হেটটা একটু পরে কোরো ভাই। এদিকে আমাদের এখনও পেট গুড়গুড় করছে। একটু পরেই আবার আহেলিকে নিয়ে চাইনিজ খেতে যাবে। তার আগে একটু খোলসা করে বলবে প্লিজ?

অধিরাজ ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়। দুষ্ট হাসিটা আবার তার মুখে ঝিলিক মেরে উঠেছে–কোনটা খোলসা করে বলব উড় বি ড. নরমুন্ড?

ড. চ্যাটার্জী লাফিয়ে ওঠেন–হতভাগা, বাঁ—দ–র ছেলে! কুৎসিত কদাকার ডাইনোলোর কোথাকার! খবর্দার বলছি। ভদ্রমহিলার পদবি নিয়ে ফাজলামি করবে না! মেরে ফেলব, কেটে ফেলব, খু-উ-ন করে ফেলব!

এবার কার ইগোতে লাগল?

তার দুচোখে কৌতুক! সে ড. চ্যাটার্জীর সিগারেটের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়িয়েছে দেখে খপাৎ করে সেটাকে সরিয়ে নিলেন তিনি।

ওসব ধান্দাবাজি পরে করবে। ড. চ্যাটার্জী কড়া স্বরে বললেন–নো স্মোকিং! ফোঁকাঠুকি কেস এখন একদম চলবে না! ডাক্তারদের বারণ আছে।

বিরক্তিকর!

অধিরাজ আবার ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে-একটা সিগারেটও খেতে পারছি না! আর প্যাকেটটা আস্তে করে সরালেই তো চলত। হাত খামচে দেওয়া জরুরি ছিল?

ওটা ফাউ। তিনি গরগর করেন–শোনো ম্যান ইন ব্ল্যাক বদমাশ ছোঁড়া–আমার অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডিনারে নিয়ে যাচ্ছ যাও। কালো ব্লেজারে একটু বেশিই হ্যান্ডসাম আর ইয়ে লাগছে। তাও ঠিক আছে। কিন্তু দয়া করে আহেলিকে আস্ত ফেরত দিও। ওর মাথা ঘুরিয়ে স্পয়েল করবে না। তোমায় বিশ্বাস নেই। এই কেসে যা দেখলাম, জন্মজন্মান্তরে ভুলব না! কাল সকালে ল্যাবে অনেক কাজ। বাইরে বেশ বৃষ্টি পড়ছে। দুজনে আবার নার্গিস আর রাজকাপুর হয়ে যেও না! ফের জরে পড়ে যদি ভুলভাল বকো, আমি দেখতে যাব না।

অধিরাজ আবার ছেলেমানুষের মতো হাসল। এই পরিচিত হাসিটা শেষপর্যন্ত ফিরেছে। এবং বলাইবাহুল্য ডিপার্টমেন্টের সকলেই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। অফিসার ব্যানার্জীর তিরিক্ষি মেজাজ দেখতে কেউই অভ্যস্ত নয়। বেশ কয়েকদিন আগেই সে অফিসে জয়েন করেছে। সর্বনাশিনীর কেসফাইল ক্লোজড। সিআইডি এখন চার্জশিট তৈরি করছে। পাওয়া গিয়েছে উমঙ্গ অ্যান্ড্রু বাজাজের কঙ্কালটাও। ফরেনসিক সেটার ডিএন টেস্ট করে কঙ্কালটাকে উমঙ্গ অ্যান্ড্রু বাজাজের বলে কনফার্ম করেছে। প্রিয়া এস্থার বাজাজ সবই বলেছে। শুধু অ্যামাটক্সিন এক্স কোথায় পেল, সেই তথ্যটা কিছুতেই বলেনি। মিডিয়াও আপাতত গুণগান গাইছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।

কিন্তু আহেলিকে সরি বলাটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় বিপজ্জনক কাজ ছিল। বেচারি অধিরাজ একচোট ঘেমে-নেয়ে, লজ্জায় লাল হয়ে, কয়েক গ্যালন জল খেয়ে, মাথা চুলকে টুলকে শেষপর্যন্ত যেই তাকে সরি বলেছে, অমনি আহেলি একেবারে মিনি বিড়ালের মতো পিঠ বেঁকিয়ে, রোয়া ফুলিয়ে ফাস করে উঠল–আমায় পেয়েছেনটা কী? মন্দিরের ঘণ্টা? যে কেউ এসে যখন খুশি ঢং করে বাজিয়ে যাবে! যখন খুশি পাবলিকলি ইনসাল্ট করবেন! যখন খুশি সরি বলবেন!

সে ঘাবড়ে গিয়ে অস্থিরভাবে বুক পকেটে হাতড়াচ্ছে দেখে আহেলির কুটি আরও ভয়ংকর হলো–ওটা কী হচ্ছে? ওটা ওখানে নেই।

ওঃ! সরি! সরি! আই সিন্সিয়ারলি অ্যাপোলোজাইজ! অধিরাজ নার্ভাস হয়ে গিয়ে আরও ঘেঁটে ঘ হয়ে গেল–থ্যাঙ্কস ফর দ্য ফ্লাওয়ার! বলতে বলতেই অপরাধীর মতো মাথা হেঁট করে ফেলেছে–মানছি আমি আপনার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করিনি…মানে, খুবই খারাপ ব্যবহার করেছি…আমার উচিত হয়নি…আমি…মানে…যদি আপনার আপত্তি না থাকে…তবেই…।

তবেই কী?

যদি আপনাকে ডিউটি আওয়ার্সের পর একটা ট্রিট দিতে চাই…আপনি কী কিছু মনে করবেন?

ইউ মিন, ডিনার ডেট? আহেলির ভুরুটা ধনুকের মতো বেঁকে যায়।

ইয়েস! সে কথাটা বলে ফেলে সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারল কী ভুলটা করেছে–নো…আই মিন…, নো…!নট ডেট। আমি তা বলছি না!

ইয়েস… নো! বলতে চাইছেনটা কী আপনি?

বাপ্ রে! ড. চ্যাটার্জীর সুযোগ্য সহকারীই বটে। অধিরাজ কী বলবে ভেবে পেল না। সে অবিকল বকা খাওয়া শিশুর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আহেলি খানিকক্ষণ কড়া দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হেসে ফেলে বলল–ওকে। অ্যাপোলজি অ্যাক্সেল্টেড। চাইনিজ চলবে।

বলেই জুতো খটখটিয়ে চলে গেল আহেলি মুখার্জী। অধিরাজ এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে ধপ্ করে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল–উঃ! মা তারা!

আর আজকেই তাদের ডিনারে যাওয়ার প্রোগ্রাম। সকাল থেকেই পবিত্র আর ড. চ্যাটার্জী তার পেছনে লেগেছেন। এমনকি অর্ণবকেও ছাড়ছে না। পবিত্র তো বলেই দিল–রাজা আহেলিকে নিয়ে একা যাবে? তুমি পাহারা দিতে যাচ্ছ না! সে কী!

দেখো বস, আহেলিকে আমি তোমার কথামতো আধঘণ্টা আগে ছেড়েছি। একটুও ট্যা ফো করিনি। ড. চ্যাটার্জী বললেন–ও চেঞ্জ করতে গিয়েছে। আশা করি মাঞ্জা দিতে একটু সময় লাগবে। সেই ফাঁকেই একটু বুঝিয়ে বলো না ভাই যে ধরলে কী করে? আমাদের তো পুরো মাথার ওপর দিয়ে গেল! পুরো নরমান্ডিক্যালি গরমান্ডেড!

অর্ধেক কথা তো প্রিয়া বাজাজই বলে দিয়েছে। বাকিটা বলছি শুনুন। সে মৃদু হাসল–প্রিয়া বাজাজকে একদম শুরুতেই সন্দেহ করেছিলাম। ক্রাইমের প্যাটার্নটা দেখুন। টাকা-পয়সার কোনো গল্প নেই। একজন গুপ্ত প্রেমিকা আছেন ঠিকই কিন্তু তিনি প্রেমিকদের পকেট ফাঁকা করেননি। আর বেছে বেছে কাদের মারছে? যাদের ঘরে বৌ-বাচ্চা আছে, স্ত্রী কৃষ্ণবর্ণা বা অসুন্দর, ঠিক তাদেরই মারছে সে। কেন? এটা মোটেই কোনো প্রেমিকার কাজ নয়। বরং সাইকো কিলারের কাজ হতে পারে। কিন্তু মোটিভ কী?

এদিকে সর্বনাশিনীর প্রোফাইল থেকে দুটো কু পেয়েছিলাম। প্রথমত, কালো রঙ এবং নিগ্রোবটু চেহারা তার চূড়ান্ত অবসেশন! নয়তো সবাইকে ছেড়ে হ্যাঁলি বেরি, লুপিতা নঙিয়ো, জ্যানেট জ্যাকসন বা মেগান গুডই তার মনে এলো! সে নিজে কালো নয়। নয়তো কালো মেয়ের ছবি পোস্টই করত না। কিন্তু তার কোনো প্রিয়তম মানুষের গায়ের রং কালো হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। কোনো না কোনো কানেকশন তো আছেই। দ্বিতীয়ত তিনি বাংলা সাহিত্য পড়েন। আরও স্পেসিফিক্যালি বলতে গেলে তিনি ভৌতিক গল্প পড়তে খুব ভালোবাসেন।

ভৌতিক গল্প? ড. চ্যাটার্জী অবিকল গারফিল্ড নামক হুলো বিড়ালের মতো চোখ করেছেন–সেটা কী করে বোঝা গেল?

হরর স্টোরি পড়ে বলেই প্রোফাইলটার নাম সর্বনাশিনী রেখেছে। সে, বুঝিয়ে বলে–আমার মাথাতেই এই নামটাই প্রথমে স্ট্রাইক করেছিল। নামের পেছনে যে নারী আছেন তার যুবতী ও আধুনিকা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তার প্রোফাইল নেম কি না সর্বনাশিনী! আপনারা জানেন কি না জানি না, প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিক পাঁচকড়ি দের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ভৌতিক গল্পের নাম সর্বনাশিনী। আর আশ্চর্যের বিষয় যে সেই গল্পটিতেও একজন সুন্দরীর বিদেহী আত্মা প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে বিবাহিত পুরুষদের শেষপর্যন্ত খুন করে বা আত্মহত্যা করতে বাধ্য করায়। সেম প্যাটার্ন। আমি তখনই বুঝেছিলাম–এ মাল নির্ঘাৎ প্রচুর ভূতের গল্প পড়ে। নয়তো পাঁচকড়ি দের এই গল্পটা তার চোখে পড়ত না! কিন্তু নিঃসন্দেহে সে পড়েছে। সেইজন্যই প্রোফাইলটার নাম সর্বনাশিনী।

শুধুমাত্র একটা ফেক প্রোফাইলের নাম আর ছবি দেখেই এত কিছু বুঝলে! ড. চ্যাটার্জী বললেন–ধন্যি ছেলের অধ্যবসায়! ওটা তো পবিত্র, অর্ণব থেকে শুরু করে সবাই দেখেছে। এমনকি আমি আর এডিজি সেনও দেখেছি। আমরা তো কই বুঝলাম না? আমাদের তো মনে হচ্ছিল যেকোনো ব্লু-ই নেই! পুরো ব্লাইন্ড কে!

আপনি গল্পের বই পড়েন যে বুঝবেন? নেহাৎ এখন হাইভোল্টেজ মিস অগ্নিকুরে ঠ্যালায় পড়ে থ্রিলারপ্রেমী হয়েছেন! আর প্রেমে পড়লে লোকে ব্লাইন্ডই হয়!

ড. চ্যাটার্জী গরর ঘ্যাঁক ঘ্যাঁক মার্কা একটা শব্দ করে লাফিয়ে ওঠেন–ওঁর নাম মোটেই অগ্নিকুন্ড নয়। ওঁর নাম…!

আই নো! থ্যাঙ্ক ইউ। অধিরাজ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করে–আপাতদৃষ্টিতে দেখলে সত্যিই কোনো নেই। কিন্তু কোনো ক্রাইমই পারফেক্ট নয়। খুনির অবচেতন মন সবসময় নিজের অজান্তে কোনো না কোনো কু দিয়েই দেয়। যা সে সজ্ঞানে গোপন করছে, তা তার অবচেতন মন সবসময়ই প্রকাশ্যে আনতে চায়। আমি সেই অবচেতন মনকেই ট্র্যাক। করছিলাম। তাই হ্যাকারদের লিস্টে যখন রিয়া বাজাজের নাম এলো, তখনই প্রিয়ার ওপর সন্দেহ গেল। রিয়া হ্যাঁকিং এক্সপার্ট হলেও অ্যাবনর্মাল। কিন্তু তারও রাগের বহর কম নয়। তার ব্যাকগ্রাউন্ডের ট্র্যাজেডিটাও মারাত্মক। মায়ের গায়ের রঙ কালো হওয়ার জন্য কী পরিমাণ লাঞ্ছিত হয়েছেন তিনি তা সে শুনেছে মাত্র। তাতেই কী রি-অ্যাকশন হয়েছিল তা সর্বজনবিদিত। তাহলে একবার প্রিয়ার অবস্থা ভাবুন! কী প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল তা নিজের চোখেই দেখেছেন। কিন্তু তখন কিছু করতে পারেননি! তার দুজন প্রিয়তম মানুষ অহল্যা বাজাজ আর রিয়া বাজাজই নিগ্রোবটু চেহারার মালিক। আর যারা সর্বনাশিনীর ভিক্টিম হয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকের প্রোফাইল উমঙ্গ অ্যান্ড্রু বাজাজের সঙ্গে খাপ খায়! আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল যে এই সাইবার ক্রাইম, হত্যা এবং রিয়া বাজাজ ও প্রিয়া বাজাজের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা জোরালো। অন্তত স্পষ্ট একটা সাইকোলজিক্যাল মোটিভের প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছিল। অপরাধী যেভাবে একটার পর একটা চাল দিচ্ছিল, তাতে এটাকে ক্রাইম কম, দাবা খেলাই বেশি মনে হয়। অন্তত এর পেছনে কোনো ওস্তাদ দাবাড়ুর মস্তিষ্ক থাকার প্রব্যাবিলিটি ছিল। অ্যান্ড্রু বাজাজ অসাধারণ দাবাড়ু ছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে তার মেয়েদেরও দাবা খেলার টেন্ডেন্সি থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই প্রিয়া বাজাজই আমার প্রথম সাসপেক্ট ছিলেন। কিন্তু মাঝখানে বিজয় জয়সওয়াল আর মানসী জয়সওয়াল টকে পড়লেন। কেস এবার মানসীর দিকে ঘুরল। কিন্তু মানসীকে সন্দেহ করলেও ক্লিনচিট দিয়ে দিয়েছিলাম। কেন, সেটা আগেই বলেছি। অ্যাডেলিন বাজাজকেও ছাড়িনি। একেই বাজাজ, তার ওপর তার হাতে আবার মাকড়সার ট্যাটু। মাকড়সা মানেই জটিল মনস্তত্ত্ব! মহিলা তুখোড় দাবাড়ুও বটে। তাই অর্ণবকে বসিয়ে দিলাম তার সঙ্গে দাবা খেলতে। এবং তিনিও ক্লিনচিট পেলেন।

অর্ণব চোখ কপালে তুলে বলল–তিনি আবার কী করে ক্লিনচিট পেলেন। আমি তো কিছুই বুঝলাম না!

বুঝিয়ে দিলেই বুঝবে। অধিরাজ মৃদু হাসল–আমাদের সর্বনাশিনীর স্বভাবটা দেখো। কালো রঙের প্রতি যার এত অবসেশন সে কখনো সাদা ঘুটি নিয়ে খেলবে? কখনো না! লক্ষ্য করো, শেষে যখন ড. বিজয় জয়সওয়ালের বাড়ির চেসবোর্ডে ফিঙ্গারপ্রিন্ট খোঁজা হলো, তখন সাদা খুঁটি আর কালো খুঁটিতে মোটামুটি সবারই হাতের ছাপ পাওয়া গেল। ব্যতিক্রম শুধু অহল্যা আর শিনা। ওদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট শুধু কালো খুঁটিতেই আছে। অহল্যা আগেই বাদ গিয়েছেন। তার মানে শিনা কখনো সাদা খুঁটির পক্ষে খেলেননি, অলওয়েজ কালো যুঁটিতেই খেলেছেন।

এটা আমাদের মিসগাইড করার জন্যও তো হতে পারত।

পারত যদি তুমি পনেরোবারই না হারতে। যে কালো মেয়েদের উদ্ধার করার জন্য নেমেছে, কালো রঙ যার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে আছে সে কী কখনই কালো রানিকে হারতে দেবে? অ্যাডেলিন যদি সর্বনাশিনী হতেন তবে হয় সাদা খুঁটি নিয়ে খেলতেনই না, নয়তো প্রত্যেকবারই তোমাকেই জিততে দিতেন। কারণ তুমি কালো রানিকে নিয়ে খেলছিলে। জাস্ট সাইকোলজি বস্।

অর্ণব কপালে চোখ তুলে ফেলেছে! বাপ রে! কী ইকোয়েশন। ড. চ্যাটার্জী ত্যাগ করলেন–দম আছে।

সাসপেক্টদের মধ্যে দুজন কমল। এবার ড. বিজয় জয়সওয়ালদের দিকে তাকানো যাক। তাদের পরিবারে অলরেডি হয়তো একটা খুন হয়ে গিয়েছে। অহল্যা জয়সওয়াল কৃষ্ণাঙ্গী, তুঘোড় চেপ্লেয়ার, অসম্ভব ব্যক্তিত্ব, বাংলা সাহিত্য পড়েন, বটানিস্ট না হলেও ডাক্তার ছিলেন–তার ওপর গার্ডেনিং ও করেন! যদিও তখনও বিষটার নাম আমরা জানতাম না, কিন্তু সেটা অ্যাকর্ডিং টু ড. চ্যাটার্জী, ভেষজ বিষ হওয়ার চান্স ছিল। সবই ঠিক আছে, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল অহল্যা ঠান্ডা মাথার খুনি হতে পারেন–কিন্তু গৌরব জয়সওয়ালকে বিষ দিয়ে মারতে পারেন না। তাকে যথেষ্টই স্নেহময়ী বলে মনে হয়েছিল। লক্ষ্য করে দেখো, যে রাধিকার সঙ্গে তাঁর স্বামীর অবৈধ সম্পর্ক, যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী, তাকেও যথেষ্টই স্নেহ করেন। অর্থাৎ রাধিকাকে ক্ষমা করার শক্তি আছে তার। সেই ক্ষমাসুন্দর মহিলা কখনো বিষ দিয়ে ছেলেকে বা স্বামীকে মারবেন? বরং রাধিকাকে মারলে তবু সন্দেহ হয়। কিন্তু নিজেরই স্বামী ও ছেলে তার ক্ষমা পাবে না? পরে তো প্রমাণই হয়ে গেল যে তিনি কখনই তা পারতেন না।

শিনা জয়সওয়ালকে কখন সন্দেহ হলো?

প্রথম দেখাতেই। তিনি গোটা ঘটনায় চুপচাপ থাকলেও প্রথমেই মিস্ ঘোষকে বলে বসলেন–আইডি কার্ড আছে? বোঝে ঠ্যালা! সিআইডি থেকে আসছি বললেই বেশিরভাগ লোকের, বিশেষ করে মেয়েদের মুখ শুকিয়ে যায়। তারপর আর কোনো কথা বলার সাহস থাকে না। কিন্তু শিনা তো রীতিমতো পালটা টেনশন দিয়ে দিলেন। সাহসটা কোন লেভেলে একবার ভাবুন! তখনই বুঝেছি–এ পাবলিক পুরো আইসবার্গ! যতটা জলের ওপরে ঠিক ততটাই, বা তারও বেশি জলমগ্ন। ওদিকে আবার তিনি আবার ভূতের গল্প পড়তেও। ভালোবাসেন! সে অবশ্য রাধিকা আর অহল্যাও পড়েন। কিন্তু তারপরই চোখ পড়ল ওর হাতের ট্যাটুতে। রেড-ব্ল্যাক স্পাইডারম্যান। তখনই বুঝেছি এ বেটি সাংঘাতিক! সর্বনাশিনী হওয়ার প্রবল চান্স!

কেন? মাইলস্ মরালস কৃষ্ণাঙ্গ বলে? অর্ণব আবার অবাক–কিন্তু শিনা তো কমিকস পড়েন না বলেছিলেন। তবে কী স্টেটমেন্টটা মিথ্যে?

না। সত্যি। তোমরাও জয়সওয়ালদের বাড়ি সার্চ করেছ। শিনার ঘরও নিশ্চয়ই দেখেছ। সেখানে কোনো কমিকস পেয়েছিলে কী? আমি অন্তত লিস্টের মধ্যে মার্ভেল কমিকসের নাম পাইনি।

না। ছিল না। তার মানে শিনা সত্যিই মাইলস মরালস্কে চেনেনই না। তবে?

এইখানেই আসল পাঁচ! ফের অবচেতন মনের কারিকুরি। যে অবচেতন মন সবসময়ই জানান দেয়, তুমি আমায় চিনতে পারছ না ঠিকই, কিন্তু আমি এখানে আছি। আমিও ব্যাপারটা তখনই ধরতে পারিনি। কিন্তু যখনই মানসী আর অ্যাডেলিনের নাম কাটা গেল তখনই বুঝলাম। সেই মুহূর্ত থেকেই আমি নিশ্চিত হলাম যে শিনা জয়সওয়ালই আসলে সর্বনাশিনী।

সেটা বুঝলে কী করে?

অধিরাজ স্মিত হাসল–ইজি। শুধু কয়েকটা অঙ্ক মেলাতে হয়েছে স্টেপ বাই স্টেপ। প্রথমত, শিনা জয়সওয়াল মাইলস মরাসকে চেনেন না, তবে মাইলস মরালেসর লাল-কালো স্পাইডার অবতারের ট্যাটু করিয়েছেন কেন?

কেন? এবার অর্ণব আর ড. চ্যাটার্জী একসঙ্গে বলে ওঠেন।

একবার স্পাইডারম্যানের কনসেপ্ট থেকে বেরিয়ে আসুন তবেই বুঝবেন। স্পাইডার ম্যান সুপারহিরো। কিন্তু যদি তাকে নজর আন্দাজ করেন তবে কী পাবেন? একটা লাল কালো রঙের মাকড়সা! লাল কালো কম্বিনেশনের অনেক মাকড়সাই আছে। কিন্তু আমার পাপী মনে একটা বিশেষ মাকড়সার কথাই এলো। ব্ল্যাক উইডো স্পাইডার! এই জাতীয় ফিমেল মাকড়সারা পুরুষ মাকড়সাদের সঙ্গে সেক্স করে মেরে ফেলে! আমাদের সর্বনাশিনীও ঠিক সেই কাজটিই করছেন! তার প্যাটার্নও সেই এক। পুরুষদের সঙ্গে সেক্স–এবং খুন! ইঙ্গিতটা সরাসরি না হলেও আমার মাথায় ঢুকেছিল।

কী সাংঘাতিক! ড. চ্যাটার্জী হেঁচকি তুললেন–কী ভয়ংকর!

গোল্ডেন মুনে গিয়েও বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেল। যেমন কথাপ্রসঙ্গে মানসী জয়সওয়াল জানিয়েছিলেন–রিসোর্টে অনেক ছেলে ছেলেদের সঙ্গে ও অনেক মেয়ে মেয়েদের সঙ্গে রাত্রিবাস করতে আসে। তার এই কথাটাকেই আরও সূচীমুখ করে করোবরেট করলেন অ্যাডেলিন বাজাজ। তিনি জানালেন যে শিনা জয়সওয়াল লেসবিয়ান এবং কোনো মুসলিম মেয়ের সঙ্গে তাঁর অ্যাফেয়ার চলছে। প্রশ্ন হলো, অ্যাডেলিন এই তথ্যটা পেলেন কোথায়? তার মানে তিনি নিশ্চয়ই শিনাকে কোনো মেয়ের সঙ্গে রিসোর্টে ঢুকতে স্বচক্ষে দেখেছেন। কিন্তু মেয়েটি যদি সাধারণ পোষাকে থাকত তবে সে কোন ধর্মের তা অ্যাডেলিন বুঝলেন কী করে? ওঁদের তো কোনোরকম ডকুমেন্টসও মেইনটেইন করা হয়

। করলে তবু নাম দেখে ধর্ম বোঝা যেত। শুধু মুখ দেখেই কোনো মেয়ে হিন্দু, মুসলিম না ক্রিশ্চান তা বোঝা যায়? একটাই সম্ভাবনা! বোরখা বা হিজাব! অ্যাডেলিনের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই যে তিনি হিজাব সম্পর্কে রিসার্চ করবেন। তার মানে শিনার সঙ্গী যে ছিল সে বোরখা পরেই ছিল! আর বোরখার একটাই সুবিধা। তার নিচে নারী আছে না পুরুষ বোঝাই যায় না। শিনার সঙ্গে প্রত্যেকবারই পুরুষ সঙ্গীরা বোরখা পরে রিসোর্টে এন্ট্রি মেরেছিল। যখন পুলিশ সঞ্জীব রায়চৌধুরী ও অর্জুন শিকদার মৃত্যুর আগে কোথায় ছিলেন তা তদন্ত করে দেখার জন্য সব রিসোর্টে তাদের ছবি রোটেট করিয়েছিল, তখন গোল্ডেন মুন ক্লাব অ্যান্ড রিসোর্টেও সেই ছবি গিয়েছিল নিশ্চয়ই। তখন কেউ তাদের মেম্বার হিসেবে শনাক্ত করলেও বোর্ডার হিসাবে চিনতে পারেনি। কারণ তেনারা তো বোরখার তলায় পর্দানসীন ছিলেন! ইনফ্যাক্ট আমরা ড. বিজয় জয়সওয়াল ওখানে চেক ইন করেছেন কিনা সে প্রশ্ন করলেও কেউ বলতেই পারত না। কারণ ড. বিজয় জয়সওয়াল চেক ইন করেনইনি। চেক ইন করেছেন তো। লেসবিয়ান শিনা জয়সওয়াল উইথ বোরখাধারী বান্ধবী!

উঃ! পুরো জ্বালিয়ে দিয়েছে মেয়েটা। ড. চ্যাটার্জী বললেন–কী বদমায়েশি বুদ্ধি!

যে মাথা থেকে এই বুদ্ধিটা বেরিয়েছে সে মস্তিষ্কটাকে আন্ডার এস্টিমেট করবেন না ড.! পুরো কলকাতা পুলিশ, সিআইডি হোমিসাইডকে এরকমভাবে নাকে দড়ি দিয়ে আর কেউ ঘোরায়নি

তা বটে। তারপর?

তারপর অর্ণব কামাল করল। অর্জুন শিকদার আর অহল্যা জয়সওয়ালের ম্যাচের স্কোরশিটগুলো হাতসাফাই করে দিল। সেই স্কোরশিট দেখলেই বোঝা যায় যে অর্জুন শিকদার রীতিমতো ভালো খেলোয়াড় হয়েও পুরো উলটো-পালটা চাল খেলেছেন! গেমে মনই ছিল না। তবে মন কোথায় ছিল? সম্ভবত অহল্যা। জয়সওয়ালের পাশে যে সুন্দরীটি বসেছিলেন তার দিকেই নজর আর মন দুই-ই ছিল। সে সুপর্ণা জয়সওয়াল হতে পারে না। রাধিকাও না।

রাধিকা কেন নয়?

আবার অ্যাডেলিন বাজাজের কাছেই ফিরে যাই। তাঁর স্টেটমেন্ট অনুযায়ী অহল্যার বড় বৌ শ্বশুরের সঙ্গে ঘোরে। অর্থাৎ দুজনের সম্পর্ক সর্বজনবিদিত। এবার অহল্যার চরিত্র দেখুন। আপনার মনে হয়, যে বিশ্বাসঘাতিনী তারই স্বামীর সঙ্গে প্রেম করছে, তাকে টাকে করে তিনি ঘুরে বেড়াবেন? অহল্যা রাধিকাকে ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু তাকে নিজের আনন্দের সঙ্গী করতে পারেন না। তার ব্যক্তিত্বে আটকায়। সুতরাং রাধিকা নয়, তাঁর সঙ্গে যে সুন্দরী বসে অর্জুন শিকদারকে সম্মোহিনী হাস্যে, লাস্যে বিভ্রান্ত করছিলেন, তিনি শিনাই। একে তার শাশুড়ির নামও অহল্যা, তিনিও কৃষ্ণবর্ণা, তার ওপর কালো খুঁটি নিয়ে খেলছিলেন! তাঁকে কখনো হারতে দিতে পারেন শিনা! তাই অর্জুন শিকদারকে পটলচেরা চোখ দিয়ে এইসান চাকু মারলেন যে লোকটা দাবা খেলার বদলে লুডো খেলতে শুরু করে দিল!

আমার এদিকে তখন চাপের চোটে গলদঘর্ম অবস্থা! শিনা জয়সওয়ালকে সর্বনাশিনী মনে হচ্ছে তো মোটিভ পাচ্ছি না! অন্য দিকে প্রিয়া বাজাজের মোটিভ আছে, কিন্তু বাজাজ ফ্যামিলি হাওয়া! আবার অন্যদিকে আহেলি যে ডোরপেইন্টের লিডটা দিল, সেটা জুয়েলার বিজয় জয়সওয়ালের ঠিক উলটোদিকের ফ্ল্যাট! জনৈক অহনা ভট্টাচার্যের ফ্ল্যাট! এখানেও দেখো–অহনা নামটা অহল্যার খুব কাছাকাছি। আমার মনে হয়েছিল, মেরিলিন প্ল্যাটিনামের মধ্যেই কিছু গোলমেলে ব্যাপার আছে। সেইজন্যই সেদিন যখন অর্ণব আর পবিত্র মিলে গগনকে তাড়া করেছিল, তখনই বুঝেছিলাম সে ব্যাটা নির্ঘাৎ মেরিলিন প্ল্যাটিনামেই যাচ্ছে। তার পেছন পেছন গিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম ঠিক কার সঙ্গে ও দেখা করে। কিন্তু প্রিয়া বা শিনা সে সুযোগই দিলেন না। তিনি তখনই লোকটাকে শট করে দিয়ে কোথাও একটা লুকিয়ে বসেছিলেন। আমি তাকে ধরেও ফেলতাম। কিন্তু তার মধ্যেই বেচারি রিয়া তাকে খুঁজতে খুঁজতে অকুস্থলে পৌঁছল। লোকটাকে মরতে দেখল! এবং যখন আমি পৌঁছলাম, ও আমাকে মি. বাজাজ ভেবে ভয় পেয়ে আনতাবড়ি গুলি চালাল! আনতাবড়িই চালিয়েছিল! কারণ ও শুধু অ্যাকশনটা রিপিট করেছিল মাত্র। ওর এটাই সমস্যা! একই কাজ বারবার রিপিট করে। সেইজন্যই সম্ভবত প্রিয়া ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিচে নামিয়ে আনার পরও ফের ও আমার কাছেই ফিরে গিয়েছিল। নয়তো ওর কী দায় পড়েছিল বন্দুক হাতে নিয়ে পোজ মেরে বসে থাকার!

গুলিটা তোমাকে তবে রিয়াই মেরেছিল? ড. চ্যাটার্জী ভুরু কুঁচকে বললেন–কিন্তু আগে অস্বীকার করলে যে!

সে তো আমাকে কোর্টে দাঁড় করালেও অস্বীকার করব। রিয়ার সাইকায়াট্রিস্ট দরকার, শাস্তি নয়।

বেশ। তারপর?

আমি পড়ে যাওয়ার আগে রিয়া বাজাজকে চিনতে পেরেছিলাম। তখনই স্পার্ক করেছিল যে গোটা ঘটনার পেছনে কোথাও না কোথাও বিগ সিস্টারও আছেন। তারপর যখন হুঁশ এলো ততক্ষণে আপনি আর অর্ণব নিজেদের অজান্তেই অনেকটা এগিয়ে গিয়েছেন। আপনি অ্যামাটক্সিন-এক্সকে বের করতে পেরেছিলেন। বিষটা কী দেখুন! সায়ানাইড নয়, থ্যালিয়াম নয়, আর্সেনিক নয়, স্ট্রিকনিন্ ও নয়! অ্যামাটক্সিন এক্স! বিষটার হাপিশ হয়ে যাওয়া ছাড়া আরও একটা বৈশিষ্ট্য আছে। অ্যামাটক্সিন তিলে তিলে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দেয়। ওদিকে অহল্যা বাজাজের মৃত্যুটাও দেখুন। একটু একটু করে যন্ত্রণা পেয়ে মরেছিলেন তিনি। সেই যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর সমান যন্ত্রণা দিতে পারত অ্যামাটক্সিন এক্স। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হলো, এর মধ্যে কোথাও প্রিয়া বাজাজ তো আছেনই। এ তারই প্রতিশোধ। কিন্তু তখনও লিঙ্কটা বুঝিনি। অর্ণব আর পবিত্র যখন ইনভেস্টিগেশনকে এগিয়ে নিয়ে গেল। তখন বুঝলাম।

সেটাও দয়া করে বলবে প্লিজ? না প্রত্যেকবারই তোমাকে ইনভিটেশন লেটার দিতে হবে গল্প পাঠ করার জন্য?

ড. চ্যাটার্জী আবার অধৈর্য। অধিরাজ স্মিত হাসল–এর পেছনে খানিকটা আপনার অবদান আছে। আপনি অর্জুন শিকদারেরচামড়ায় যে বিশেষ ধরনের ল্যাভেন্ডার অয়েল পেয়েছিলেন, সেই অয়েল শুধুমাত্র মানসী জয়সওয়ালের ল্যাবে তৈরি হয়। গোল্ডেন মুনের স্পা স্যালুনেও ইউজড হয়। অন্যদিকে মৃত্যুর আগে অর্জুন শিকদার একটা ম্যাসাজ নিয়েছিলেন। আমি নিজে ম্যাসাজ নিতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছি সেখানে আর কী কী হতে পারে! অর্থাৎ, অর্জুন শিকদার বা সঞ্জীব রায়চৌধুরীর মতো লম্পটের হাত বাক্স ম্যাশ্যজকে আস্ত ছাড়বেন না! ওটাও সেক্সের আরেকটা আর্ট। সর্বনাশিনীও এই কাজে এক্সপার্ট। এখন প্রশ্ন হলো, সে নিশানের প্রোডাক্টটা পেল কোথা থেকে? ওটা বাইরে কিনতে পাওয়া যায় না। আর নিশান নিজেদের প্রোডাক্ট কাউকে দেয় না। তবে কন্যে সেটি জোটালেন কোথা থেকে? এর একটাই সহজ উত্তর। স্বয়ং মালকিনের ঘর, তথা ফ্ল্যাট থেকে। তিনি ম্যাসাজ দেওয়ার সময় কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন তার পাশের ফ্ল্যাটেই একটি গোয়ানিজ মহিলা থাকে। তিনি নিজের ম্যাসাজ আর স্পা ওকে দিয়েই করান। এত সুন্দর ম্যাসাজ করে যে ঘুম এসে যায়। প্রশ্ন হলো ওখানে একটিই গোয়ানিজ ক্রিশ্চানকে পেয়েছি আমরা। অ্যালিস! এবং তার ম্যাসাজের চোটে যখন মানসী ঘুমিয়ে পড়েন, তখন একটা ল্যাভেন্ডার অয়েল হাপিশ করে দেওয়া এমন কিছু ব্যাপারই নয়! এই স্কোপটা শুধু তারই ছিল। কিন্তু তার স্বার্থ কী! আমি তো শিনা জয়সওয়াল আর প্রিয়া বাজাজের মধ্যেই পিংপং বলের মতো লাফাচ্ছি। এবার অ্যালিসকে নিয়ে কী করব? আবার কনফিউশনে পড়লাম। কিন্তু অর্ণব আর পবিত্রর দেওয়া সমস্ত ফুটেজ দেখে বুঝলাম, খামোখাই ফুটেজ খাচ্ছি! অ্যালিস নামের কোনো ক্যারেক্টার বাস্তবে এক্সিস্টই করে না। তার গল্প প্রিয়ার ষোল বছর বয়েসেই শেষ।

হে ঈশ্বর! সেটাই বা কী করে বুঝলে! সবই কেন তুমি একাই বুঝবে! আশ্চর্য! ড. চ্যাটার্জী চটে লাল–আমরা কিছু বুঝব না কেন?

বুঝিয়ে বললে আপনিও বুঝবেন। প্রিয়ার ছবিটা দেখেছিলেন আপনি? তিনি একটা কালো ফ্রক পরে ক্রিশ্চিয়ান বারিয়াল গ্রাউন্ড-এর সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। ক্রিশ্চানরা কালো পোশাক পরে কখন? যখন সে মোর্নিং-এ থাকে। হয় কাউকে কবরস্থ করতে যায়, অথবা কারো কবরে ফুল দিতে। প্রিয়া তবে ক্রিশ্চিয়ান বারিয়াল গ্রাউন্ডের সামনে কালো পোষাকে দাঁড়িয়ে কী করছিলেন? কাকে কবরস্থ করতে বা কার কবরে শোকপ্রকাশ করতে গিয়েছিলেন তিনি? অ্যান্ড্রু বাজাজ তখনও জীবিত। আর মরলেও প্রিয়া তার কবরে থুতু ফেলতেও যাবেন না। তবে কে?

অহল্যা?

ওঃ! অর্ণব, তুমি কোনো কথাই ঠিকভাবে শোনো না। অহনা বলেছিলেন- শ্মশান থেকে ফিরে প্রিয়া সোজা পুলিশ স্টেশনে গিয়েছিল।

অর্থাৎ অহল্যাকে হিন্দুমতে দাহ করা হয়েছিল। তিনি ধর্মান্তরিত হননি।

অ্যান্ড্রু বাজাজের ধর্মপিতা?

এটা অবশ্য খানিকটা কাছাকাছি গেস্। কিন্তু তিনি চার্চের ফাদার ছিলেন। সচরাচর চার্চের ফাদাররা মারা গেলে চার্চের সংলগ্ন জমিতেই সমাধিস্থ করা হয় তাঁদের। একজন ফাদার খামোখা ক্রিশ্চিয়ান বারিয়াল গ্রাউন্ড-এর মতো পাবলিক বারিয়াল গ্রাউন্ডে থাকবেন কেন? এক্ষেত্রে আরেকজনই বাকি থাকে যে বাজাজ ফ্যামিলির অংশ ও একটি কবরের দাবিদার। অ্যালিস! প্রিয়া অ্যালিসের মৃত্যুর জন্যই মোনিংঙে ছিলেন। এবং সেজন্যই ব্যাকগ্রাউন্ডে ক্রিশ্চিয়ান বারিয়াল গ্রাউন্ড-এর দরজা দেখা যাচ্ছে। তার মানে অ্যালিসের মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই। তবে যিনি এখন আমাদের সামনে বসে আছেন, তিনি কে? একমাত্র তিনিই অ্যালিসের মতো সামলাতে পারেন রিয়াকে। রিয়ার মাসিও যা পারেন না, তিনি তা পারেন! রিয়াকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত এমন শুধু দুজনই আছেন। স্বয়ং অ্যালিস, আর প্রিয়া বাজাজ। অ্যালিসকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন প্রিয়া। দেখেছেন সে কীভাবে রিয়াকে ট্রিট করত। সবচেয়ে কথা এক অনন্ত স্নেহময়ীর জায়গা শুধু আরেক অনন্ত স্নেহময়ীই পূরণ করতে পারেন। অ্যালিসের শূন্যতা পূর্ণ করতে পারতেন একমাত্র প্রিয়া। এবং সম্ভবত তিনিই করেছেন।

এছাড়াও আরেকটা গোলমাল করেছিল অর্ণবরা। সমস্ত সন্দিগ্ধদের একটা ভাঙা চেয়ারে বসিয়ে ইন্টারোগেট করেছিল। আমিই ঐ চেয়ারটা প্রথম ভেঙেছিলাম। অধিরাজ হেসে ফেলল–ভেবে দেখুন ড., আমার ওয়েট প্রায় ছিয়াশি থেকে সাতাশি কেজি! চেয়ারটা সেই ভারটা নিতে না পেরে আমাকে নিয়েই এক পা ভেঙে উলটে পড়েছিল। অন্যান্য মহিলারা ক্ষীণাঙ্গী। কিন্তু অ্যালিস! আমার তিনগুণ চেহারা ওর! ওজনও আমার থেকে বেশিই হওয়া উচিত। অথচ চেয়ারটা ভাঙা তো দূর–একটুও নড়েনি চড়েনি! মানেটা কী! অ্যালিস আমার থেকে হালকা! ইম্পসিবল!

ব্রিলিয়ান্ট!

থ্যাঙ্কস। ড. চ্যাটার্জীর প্রশংসাবাক্য নম্রভাবে গ্রহণ করল অধিরাজ ব্যস্। তখন থেকেই বুঝলাম অ্যালিস আদৌ অ্যালিস নয়। তিনিই আসলে প্রিয়া বাজাজ! প্রিয়া বাজাজ যে একজন এক্সপার্ট হ্যাকার এবং মেরিলিন প্ল্যাটিনামে রীতিমতো সশরীরে উপস্থিত তারও কু ছিল।

কীরকম?

রিয়ার বাড়ি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সের বই, হ্যাঁকিং সম্পর্কে প্রচুর বই পাওয়া গিয়েছে। তার সঙ্গে ভৌতিক সমগ্র, থ্রিলারও আছে। সেগুলোর ওপরে রিয়া বাজাজের নামের স্টিকার সাঁটা। মজার কথা, কিছু বইয়ে রিয়ার আর-টা ক্যাপিটাল। কোথাও সেই আর স্মল লেটারে! কিন্তু বাজাজের বি-টা কনস্ট্যান্টলি ক্যাপিটাল। প্রথমে ভেবেছিলাম রিয়ারই বোধহয় মাথার ঠিক নেই। পরে বুঝলাম ওর মাথা যথেষ্টই ঠিক আছে। আমিই একখানা গবেট।

যা, তবু এতদিনে বোধোদয় হয়েছে। ড. চ্যাটার্জী ফোড়ন কাটলেন–কিন্তু তুমি যে গবেট সেটা প্রমাণ করল কে?

অধিরাজ মোলায়েম হাসল–স্মল লেটারের আর। রিয়া বাজাজ বি-টা কনস্ট্যান্টলি ক্যাপিটাল লিখল–অথচ আর একবার ক্যাপিটাল, একবার স্মল কেন? রিয়া বাজাজের স্টেটমেন্টের নিচে মেয়েটা যখন সাইন করেছিল, তখন আর এবং বি দুটোই ক্যাপিটালে ছিল। অর্থাৎ ওর এইটুকু সেন্স আছে। নামটা কীভাবে লিখতে হয়, তা ওর জানা। তবে আর বারবার ভ্যারি করছে কেন? এর একটাই উত্তর। যেগুলো স্মল লেটারের আর, সেগুলোর আর-এর আগে একটা ক্যাপিটাল লেটার ছিল। কেউ সেটা চালাকি করে কেটে সরিয়েছে বা তুলে নিয়েছে। কী লেটার হতে পারে? অবভিয়াসলি ক্যাপিটাল পি। ঐ বইগুলো রিয়ার নয়, প্রিয়ার ছিল। এবং সেগুলো যথেষ্ট আপডেটেড, নিউ এডিশনের! প্রিয়া বাজাজের নামওয়ালা নতুন বই যখন ওখানে আছে, তার মানে স্বয়ং প্রিয়া বাজাজও ওখানেই আছেন। তিনি কম্পিউটার সায়েন্স এবং হ্যাঁকিং সংক্রান্ত বই পড়েন! ফুল চান্স আছে যে তিনি রিয়ার থেকেও বড় হ্যাকার। আরও মজার কথা, ওখানেও ভূতের বই উপস্থিত!

বেশ। আগে?

সবই বোঝা গেল। কিন্তু শিনার সঙ্গে যোগসূত্র কোথায়? লক্ষ্য করে দেখো, গোটা ইনভেস্টিগেশনে আরেকটা প্যাটার্ন আছে। যতক্ষণ অ্যালিস আমাদের চোখের সামনে আছে, ততক্ষণ শিনা সিনে নেই। তিনি ট্যুরে গিয়ে বসে আছেন। যেই অ্যালিস সিন থেকে সরল অমনি শিনা জয়সওয়াল হাজির হলেন। তাছাড়া শিনা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হওয়ার দরুণ সকালে বেরিয়ে যান, অনেক রাতে ফেরেন। মাঝেমধ্যে ট্যুরেও চলে যান। এই পেশাটাই এমন যে গভীর রাতে বাড়ি ফিরলেও কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবে না। এখন যদি তার অফিসে গিয়ে খোঁজ নেওয়া হয় তবে জানা যাবে তিনি অফিসে ঠিকমতো যেতেনও না। ওদিকে অ্যালিসও একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর রিয়ার কাছে থাকে ণা। যদি থাকত তবে তার সতর্ক প্রহরার মধ্যে রিয়া মি. বাজাজের লাশ ভেবে ম্যানিকুইনটাকে টেনে বারবার ফেলে দেওয়ার মতো ব্লান্ডার করত না। কিন্তু সে করেছে। আর সবসময়ই অ্যাকশনটা রাতে হয়েছে। তার অর্থ সময়টা অ্যালিস ছিল না। ইনফ্যাক্ট রিয়াও কিন্তু বুঝতে পেরেছে যে অ্যালিস একটি মানুষ নয়, দুজন! সে পবিত্রকে কী বলেছিল মনে আছে। ওয়ান প্লাস ওয়ান ইকোয়ালটু ওয়ান। আর কত স্পষ্ট করে বলবে মেয়েটা?

অর্ণব স্তম্ভিত! তাই তো! সত্যিই এই কথাটাই বলেছিল রিয়া বাজাজ। কিন্তু তার মানে এই!

এরপর যখন লিখিত স্টেটমেন্ট দিতে বললাম–তখন অ্যালিস আর শিনা, দুজনেই বিজয়কে ভিজয় লিখল। এছাড়াও কিছু ইশারা ছিল। বাপের মতো দেখতে বলে প্রিয়া কসমেটিক সার্জারি করেছিল। উঁচু দাঁত সুন্দর করে সেট করেছিল। কিন্তু সে চশমা পরত। বড় হলে অনেকেই চেহারা পালটে যায়। কিন্তু যার অত ভারি পাওয়ারের চশমা, তাকে লেন্স পরতেই হবে। আর আমাদের সমস্ত সাসপেক্টদের মধ্যে একমাত্র শিনাই লেন্স পরেন! মনে আছে অর্ণব, ওর চাউনিটা একটু অদ্ভুত ছিল? দেখলে মনে হতো চমকে উঠেছেন বুঝি। আসলে ঐ চমকে ওঠা অভিব্যক্তিটাই লেন্সের সাইড এফেক্ট! লেন্স এদিক-ওদিক সরলে অনেকেই চোখটাকে বড় বড় করে লেন্সটাকে অ্যাডজাস্ট করে নেয়। শিনাও সেটাই করছিলেন। আর আমাদের মনে হচ্ছিল, চমকে উঠছেন বুঝি! ওদিকে অ্যালিস থাকতেই পারে না–অথচ আছে। প্রিয়ার থাকার সম্ভাবনা নেই, অথচ তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। স্রেফ দুয়ে দুয়ে চার।

ওঃ!

বিস্ময়ে অর্ণব কী বলবে বুঝে পায় না। কোনোমতে বলল–কিন্তু মি. বাজাজ মারা গিয়েছেন সেটা কী করে বুঝলেন?

রিয়ার কাণ্ডটা শুনে। মি. অ্যান্ড্রু বাজাজের চেহারা দেখেছ? রীতিমতো টল, হ্যান্ডসাম। লম্বা ও সুগঠিত চেহারা ছিল বলেই রিয়া ভুল করে আমাকেই গুলিটা করেছিল। আর প্রিয়ার চেহারা দেখো! রোগা-প্যাকাটি মার্কা। ঐ রকম একটা মেয়েকে অ্যান্ড্রু বাজাজ মাটিতে ঘষে, টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাবেন না! প্রিয়াকে একহাতে তুলে নিয়ে ডাম্প করার ক্ষমতা তাঁর ছিল। কিন্তু যদি প্রিয়া অ্যান্ড্রু বাজাজকে মারেন, একমাত্র তখনই ঐ ভারি বডিটাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে। আর রিয়া ম্যানিকুইনটাকে এত লোক থাকতে অ্যান্ড্রু বাজাজ ভাবত কেন? তাকে স্ট্যাবই বা করত কেন? কারণ সে স্বচক্ষে অ্যান্ড্রু বাজাজকেই খুন হতে দেখেছে। আর সেই অ্যাকশনটাকেই রিপিট করছে মাত্র। অ্যালিস ওরফে প্রিয়াও মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল–ভুল সময়ে ভুল জায়গায় পৌঁছে যাওয়া রিয়ার ব্যাডলাক। একবার তো আমার ক্ষেত্রে ও ভুল সময়ে ভুল জায়গায় পৌঁছেছিল। কিন্তু অ্যালিসের কথা শুনে মনে হয় না এর আগেও ও কখনো ভুল সময়ে ভুল জায়গায় পৌঁছেছে? সেটা কখন? অবভিয়াসলি অ্যান্ড্রু বাজাজের হত্যাকাণ্ডের সময়ে।

বুঝলাম। ড. চ্যাটার্জী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন–কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন এখনও আআনসার্ড রয়েছে। মি. বাজাজ তো আগেই টপকে গিয়েছিলেন। তবে তারপরে আবার কেন? মি, বাজাজকে মেরে শান্তি হয়নি?

হয়েছিল। সাময়িক শান্তি তিনি পেয়েছিলেন। অধিরাজ বলল–কিন্তু কপালে সুখ নেই মেয়েটার। বিয়ের পর ওর সামনে এসে দাঁড়ালেন অহল্যা জয়সওয়াল! প্রিয়া মাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। তার মায়ের নাম অহল্যা। কী কপাল দেখো, এবার ওর জীবনে আরেক অহল্যা এলেন। সেই একইরকম! ব্যক্তিত্বময়ী, কৃষ্ণাঙ্গী, গভীরমনস্ক, সুনিপুণ গৃহিণী। প্রিয়া বা শিনা জীবনে দুটি লোককে আপ্রাণ ভালোবেসেছিলেন। সেই ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। একজন ওর বোন রিয়া বাজাজ। অন্যজন অহল্যা বাজাজ। মাকে হারিয়েছিলেন। তখন তাকে বাঁচানোর জন্য কিছু করতে পারেননি। কিন্তু এবার ওর জীবনে তৃতীয় ভালোবাসার মানুষটি এলেন। ওর মায়ের সমনামী, সমগুণসম্পন্ন আরেকজনকে যখন দেখলেন–তখন মায়ের প্রতি যত সহানুভূতি, যত মমতা, যত ভালোবাসা ছিল, সব এসে পড়ল অহল্যা জয়সওয়ালের ওপরে। প্রিয়ার প্রকাশ কম ছিল। কিন্তু ভালোবাসার ক্ষেত্রে অসম্ভব প্যাশনেট। নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য সবকিছু করতে রাজি। আর কিছুদিনের মধ্যেই টের পেলেন যে এই অহল্যাও তার মায়ের মতই যন্ত্রণাভোগ করছেন। সেই একই ট্র্যাজেডি। এইবার তিনি ঠিক করলেন কিছুতেই সেই একই অন্যায় হতে দেবেন না। অহল্যা জয়সওয়ালকে অহল্যা বাজাজের নিয়তি যাতে না গ্রাস করে সেজন্যই আবার ঘাতকের রোলে ফিরে গেলেন প্রিয়া। ঠিক করলেন ড. বিজয় জয়সওয়ালকে মারবেন। কিন্তু তার আগেও আরেকটি অপরাধী ছিল। গৌরব জয়সওয়াল! তিনি বিজয়ের থেকেও বড় অপরাধী। সন্তান হয়ে মায়ের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তাই তার নম্বরই প্রথমে এলো। কী অদ্ভুত বুদ্ধি দেখো, প্রিয়া জানতেন-গৌরবের পরই যদি ড. বিজয় জয়সওয়াল মারা যান, তবেই সন্দেহ হবে ডাক্তারদের। তাই তৈরি হলো সর্বনাশিনীর প্রোফাইল! গোটা ব্যাপারটাকেই একটা সিরিয়াল কিলিংঙের রূপ দেওয়ার তালে ছিলেন। এবং সেটাই করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই যখন ড. বিজয় জয়সওয়ালের মতোই সঞ্জীব রায়চৌধুরী ও অর্জুন শিকদার একটি কালো মেয়েকে অপমান করলেন, তখনই তাদের ভাগ্য স্থির হয়ে গিয়েছিল। প্রিয়া ওখানেই ঠিক করেছিলেন এই দুটোকেই যমের বাড়ি পাঠাবেন। এর পেছনে তার পার্সোনাল ফিলিংসও ভীষণভাবে ছিল। তিনি অ্যান্ড্রু বাজাজের প্রায় নব্বই লাখ টাকা এবং গয়নাগাটিও হাপিশ করেছিলেন। তার টাকার অভাব কী? অতএব বোড়েও চলে এল। মেরিলিন প্ল্যাটিনামের গেট-কীপার ও গোল্ডেন মুনের রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার। তারপর আর কী? শুরু হয়ে গেল সর্বনাশিনীর সর্বনেশে খেলা! সুপর্ণা জয়সওয়ালের মতো ক্রাইম রিপোর্টার ননদ থাকার দরুণ ক্রিমিনাল কেস, তদন্ত পদ্ধতি সব গুলে খেলেন। সুপর্ণা জয়সওয়ালের সবই ঠিক আছে, কিন্তু চরম উদাসীন। তার ব্যাগ থেকে পুলিশ কেস ফাইল উড়িয়ে নিয়ে পড়ে ফেলা কোনো ব্যাপারই নয়। হয়তো অনেক ক্রাইম সিনে সুপর্ণার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। তাই এমনভাবেই এগিয়েছেন যাতে পুলিশ নর্মাল ইনভেস্টিগেশনে কোনো না পায়। এই প্ল্যান তার একদিনের নয়। বরং বহুদিন ধরে ভেবেচিন্তেই প্ল্যানটা ফুলপ্রুফ বানিয়েছেন। একজন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ বোটক্স থেকে শুরু করে রোহিপন অবধি সব কিছু সম্পর্কেই জানবে। সবই তার হাতের কাছেই আছে। তারপর কী হয়েছে তা তো জানোই। তবে ড. বিজয় জয়সওয়ালের ক্ষেত্রে পুলিশ আগেই স্টেপ নেবে সেটা জানতেন। তাই আমাদের ভুল দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গগনের সঙ্গে যোগসাজশ করে বেচারি জুয়েলার বিজয় জয়সওয়ালকে রোহিপনল দিয়ে নিজেদের ফ্ল্যাটের স্টোররুমে বন্দি করে রাখলেন। ড. বিজয় জয়সওয়াল এক পুত্রবধূর সঙ্গে অলরেডি চক্কর চালাচ্ছিলেন। আরেক পুত্রবধূ দুরন্ত সুন্দরী শিনা যখন তাঁকে সিডিউস করল তখন প্রেমে লাউঘন্ট হয়ে গেলেন। রাধিকার চেয়ে শিনা বেশি অ্যাগ্রেসিভ। বেশি সেক্সি। ছলা-কলায় এক্সপার্ট। সুতরাং তিনি স্বাভাবিকভাবেই রাধিকাকে ছেড়ে শিনার প্রেমে পাগল হলেন। বেচারা জুয়েলার বিজয় জয়সওয়াল! খায়া পিয়া কুছ নেহি, গ্লাস তোড়া চাল্লিস লাখকা কেস।

এত কাণ্ড হয়ে গেল অথচ অহনা জানতে পারলেন না?

অর্ণবের প্রশ্নের উত্তরে সে হাসল-কে বলেছে জানেন না? প্রিয়া অ্যামাটক্সিন-এক্স কোথা থেকে পেয়েছিলেন সেটা বলছেন না কেন? সিম্পল! তার মাউকে বিপদে ফেলতে চান না। অহনা গোটাটাই জানতেন। তাঁর সমর্থনও হয়তো ছিল। তিনি ছাড়া আরেকজনও অবশ্য জানেন। অন্তত আন্দাজ করতে পেরেছেন।

কে?

অহল্যা জয়সওয়াল। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা। আমার আগেই মনে হয়েছিল তিনি কিছু সন্দেহ করেছেন। ভদ্রমহিলা শিনার ঘরে চুপিচুপি সার্চ অপারেশন চালালেন। এবং অ্যামাটক্সিন-এক্স ও মাউথওয়াশটাও পেলেন। বুঝতে পারলেন– কে এবং কেন? ভালোবাসাটা একতরফা ছিল না। শাশুড়িও বউমাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু তার চরিত্রেও আতিশয্য জিনিসটা ছিল না। তিনি শিনাকে গার্ড করার জন্য নিজের ওপর দায় নিয়ে নিলেন। শিনা তখন অ্যালিসের ভূমিকায় রিয়াকে সামলাচ্ছিলেন। শাশুড়িকে ব্যুরোয় দেখে লজ্জায় মরে গেলেন। হয়তো তখনই আত্মহত্যা করতেন। ভাগ্যিস আমি অহল্যাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরত পাঠাতে পেরেছিলাম। নয়তো শিনা তখনই আত্মহত্যা করতেন।

তবে একমাস পরে ফের কেন?

প্ল্যানিং তেমনই ছিল। অধিরাজ বলল–কেন মরতে চেয়েছিলেন তা স্পষ্টই বলেছেন। সেখানে প্রশ্নের জায়গাই নেই। কিন্তু আবার আমাদের একটু ঘোল খাওয়ানোর লোভ সামলাতে পারেননি। এই ডেথ ফোরকাস্টের পেছনে যেমন সর্বনাশিনীকে প্রতিষ্ঠা করার তাগিদ ছিল, তেমনি পুলিশ প্রশাসনকে ঘোল খাওয়ানোর ইচ্ছেটাও প্রবল। শিনা বা প্রিয়া স্পষ্ট বলেছিলেন–আপনার আইন কী ছিঁড়েছে? দ্যাটস্ দ্য অ্যাটিটিউড! সত্যিই তো! তার সঙ্গে যা ঘটেছে সেটা অন্যায়। কিন্তু আইনের কিছু করার ছিল না। দশ বছরের এক মাইনর মেয়ে বারবার বলেছিল–এটা খুন। আইন তার কথা শোনেনি। আইন-পুলিশ প্রশাসনে তার ঘেন্না ধরে গিয়েছিল। এবার তিনিও সেই আইনকেই চ্যালেঞ্জ করলেন–দ্যাখ তোদের নাকের সামনে দিয়ে একটার পর একটা খুন করছি–কী ছিঁড়তে পেরেছিস তোরা? মরার আগেও সেই একই কাজ করলেন। কারণ আমি তাকে নিশ্চিন্ত করতে পেরেছিলাম যে আমরা কিছুই বুঝিনি। ভুল লিড দিয়ে আনন্দ বাজাজের দিকে দৌড় করানোর জন্য আনন্দ বাজাজের ফেরার অপেক্ষা করলেন। সম্ভবত মানসী জয়সওয়ালের কাছ থেকেই খবরটা পেয়েছিলেন। মানসী জয়সওয়ালের সঙ্গে অ্যালিসের ভালো সম্পর্ক। অতএব ওখান থেকেই খবরটা লিক হলো। এইবার তিনি আবার আমাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর জন্য আর আইপি পোস্ট মারলেন। কিন্তু এইবার প্যাঁচটা আমি বুঝেছিলাম। ইন ফ্যাক্ট, আর আইপি পোস্টটা ভীষণভাবে এক্সপেক্ট করছিলাম। কারণ তার হাতে আর কোনো চয়েজই ছিল না। কতদিন আর এই বিদ্বেষ বয়ে বেড়াবেন? তার ওপর অহল্যা তাকে স্বামী-পুত্রের হত্যাকারী হিসাবে শনাক্ত করে ফেলেছিলেন। আর বাঁচার অবলম্বন ছিল না। এ ফর আনন্দ বাজাজ নয় অ্যান্ড্রু বাজাজ। অ্যান্ড্রু বাজাজ স্বয়ং না থাকলেও প্রিয়া তার অস্তিত্ব বয়ে বেড়াচ্ছিলেন ভীষণভাবে। আর আইপি অ্যান্ড্রু বাজাজ মানে অ্যান্ড্রু বাজাজের চ্যাপ্টার ক্লোজড়! আর সেটা একমাত্র সম্ভব প্রিয়া ও রিয়ার মৃত্যুতে। গল্পটা যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেখানেই শেষ হতে যাচ্ছিল। আমি মাঝখানে পড়ে ভেস্তে দিলাম।

অর্ণবের প্রিয়ার শেষ কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল। কী ভয়ংকর বিদ্বেষ ছিল তার আইনের বিরুদ্ধে! সে কথা বলতেই অধিরাজ আবার জানলার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অস্ফুটে বলল–ভুল কী বলেছেন? ওর দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখলে সেটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক!

আমি রেডি।

মেয়েলি মিষ্টি স্বরে তিনজন পুরুষই সচকিত হয়ে ওঠে। আহেলি চেঞ্জ করে এসেছে। তার পরনে কালো রঙের শিফনের শাড়ি। গম রঙের মসৃণ বাহু দুটি নিরাভরণ, কিন্তু দারুণ অভিজাত। চুল ভোলা। বর্ষার জলভরা মেঘের মতো ঘন চুলে খালি একটি সাদা রঙের অর্কিড! চোখ দুটোয় বুদ্ধির দীপ্তি চকচক করছে। পানপাতার মতো মুখমণ্ডলে প্রজ্ঞা ও শান্তশ্রীর অপূর্ব মিশ্রণ। তার প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই যেন কোথাও বাঁশি বেজে উঠল।

ড. চ্যাটার্জীর চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তিনি অর্ণবকে ফিসফিস করে বললেন–এ মেয়েটা যে এত মিষ্টি দেখতে তা আগে জানতে?

অর্নব ততধিক চাপা কণ্ঠস্বরে বলল-ও যে একজন মেয়ে, সেটা এতদিন ধরে জানতেন আপনি!

ড. চ্যাটার্জী ফের চাপা স্বরে গরগর করলেন ঠিকই কিন্তু চেপে গেলেন।

যথেষ্ট হয়েছে। তিনি মুখ গম্ভীর করে বললেন–আহেলি, কাল সকাল আটটার মধ্যে ঢুকবে। আরেকটা কেস আসছে। রাজারই আন্ডারে পড়বে।

সে কী! অধিরাজ ড. চ্যাটার্জীর দিকে অবাক হয়ে তাকায়–কে বলল? এডিজি সেন তো বলেননি!

আজ বলেননি। কাল বলবেন। ড. চ্যাটার্জী জানালেন–তোমাকে একটু রেস্ট দিতে চেয়েছিলেন এডিজি সেন। কিন্তু উপায় নেই। বত্রিশ বছর আগের একটা আনসলভ মার্ডার মিস্ট্রির কেসফাইল রি-ওপেন্ড হচ্ছে। তখন কেসটা শহরের সবার ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল। মারাত্মক ঘটনা! পুলিশ, সিআইডির বাঘা বাঘা অফিসাররাও ফেল পড়েছিলেন। তৎকালীন ফরেনসিক এক্সপার্ট রিপোর্টে লিখেছিলেন এরকম ব্রুটাল মার্ডার তিনি সারাজীবনের ক্যারিয়ারে দেখেননি। সত্যি বলতে কী আমিও দেখিনি! এই কেসটা শহরকে ভয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য তোমার জানার কথা নয়। তখন তো তুমি বোধহয় হামাগুড়ি দিচ্ছ।

আজ্ঞে না! অধিরাজ শুধরে দেয়–আমার বাবা-মার তখনও বিয়ে হয়নি! আমার হামাগুড়ি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি ঠিক দু বছর পরে হামাগুড়ি দিয়েছি।

ভালো। এখন ফোটো তো! কাল তো ঘোড়ায় জিন চাপিয়ে এসে কোয়েশ্চেনেয়ার খুলে বসবে। আমি তার প্রস্তুতিটা করে রাখি।

তাহলে আমি কী এডিজি শিশির সেনের সঙ্গে আজই দেখা করে নেব? অধিরাজ চিন্তিত মুখে বলে–আমাকেও তো ডিটেলস্ জানতে হবে।

হ-ত-চ্ছা-ড়া! ড. চ্যাটার্জী দাঁত কিড়মিড় করে একখানা বীকার ঠাঁই করে ছুঁড়ে মারলেন তাকে লক্ষ্য করে–বেরোও এখান থেকে অসভ্য, পা-ষ-গু, ব—র্ব–র! মেয়েদের খাওয়াতে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবার এডিজি সেনের কাছে যাওয়ার তাল করা হচ্ছে। বদমাশ ছোঁড়া কোথাকার!

অধিরাজ দ্রুত ডাক্ করে সবিস্ময়ে বলল–আরে! কী করছেন! ড….!

আহেলি! এক্ষুনি এই অপদার্থটাকে এখান থেকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাও। নয়তো আমি ল্যাবের সমস্ত টেস্টটিউব-বীকার-বার্নার ওর মাথাতেই ভাঙব! এডিজি সেন কী তোমার প্রেমিকা যে এখনই তাঁর মুখ না দেখলে চলছে না তোমার! যেই এডিজির নাম শুনল, অমনি সব ভুলে সেদিকেই দৌড় মারল। গর্দভ, রামছাগল কোথাকার! ড. চ্যাটার্জী আবার একটা বীকার ছুঁড়লেন–ফোটো বলছি। শুঃ…শুঃ…!

অধিরাজ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই তার হাত ধরে টানল আহেলি–আসুন…শিগিগর চলে আসুন। পরে ঠিক করা যাবে কোথায় যাবেন।

কোথাও যাবে না। একদম ডাইরেক্ট চায়না টাউনে যাবে। সেখানে গিয়ে চাউমিন, চাউ চাউ, চিলি চিকেন সব খাবে। এটা আমার অর্ডার! বেরোও এখান থেকে।

অধিরাজ আর আহেলি প্রায় উদ্ধশ্বাসে পালাল সেখান থেকে। এক কথায়, ভ্যানিশ হলো!

হা-রা-ম-জা-দা! হাতের টেস্টটিউবটা যথাস্থানে রাখলেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ–এক নম্বরের তাড়! এত কিছু বুঝল, শুধু একটা কথাই বোঝেনি!

কী? অর্ণব কৌতূহলী।

প্রিয়া বাজাজের ভালোবাসা মারাত্মক। এবং তার জীবনে ভালোবাসার মানুষ এখন তিনজন নয়–চারজন! ড. চ্যাটার্জী লম্ফঝম্প করে হাঁফিয়ে গিয়েছিলেন। এবার চেয়ারে বসে পড়ে বললেন–গাধাটা যেটাকে ইনসাল্ট ভাবছে সেটা যে কী তা আমার নিরেট মাথাতেও ঢুকেছে। কিন্তু এই বাঁদরটা বুঝবে না! কেন থেকে থেকে নিজেই আই হেট হার, আই হেট হার বলছে, কেন ক্ষেপচুরিয়াস হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে অ্যালিসকে চেপে ধরল, তা বুঝতে গেলে আয়নার সামনে মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। এই গোঁয়ারটা জীবনেও প্রিয়ার শেষ কথাগুলোর মানে বুঝবে না! এডিজি শিশির সেনই ধ্যান-জ্ঞান-জীবনসর্বস্ব। আর প্রিয়ারই বা কী চয়েস? সব ছেড়ে শেষে এই আকাটটাকেই…!

অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার মনে পড়ে গেল একটা হিন্দি সিনেমার বিখ্যাত গানের লাইন!

কুছ রিশতোঁ কা নমক্‌ হি দূরি হোতা হ্যায়/ না মিল্‌না ভি বহোত জরুরি হোতা হ্যায়…!

(সমাপ্ত)

3 Comments
Collapse Comments
আমিনুল ইসলাম April 15, 2023 at 12:06 pm

সায়ন্তনী পূততুন্ডর ‘চুপি চুপি আসছে’ বইটি চাই।

তানজিলা March 14, 2024 at 7:58 pm

সায়ন্তনী পূততুন্ডের অধিরাজ সিরিজের সবগুলো বইয়ের পিডিএফ লিংক দিন,প্লিজ।

বাংলা লাইব্রেরি (Administrator) March 14, 2024 at 10:22 pm

আমরা তো পিডিএফ দিতে পারব না, বরং আপনারা ভাল পিডিএফের সন্ধান দিলে আমরা ওসিআর করে দিতে পারি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *