৩. মেয়েটা অতিকষ্টে

মেয়েটা অতিকষ্টে একটা বস্তাকে টেনে নিয়ে চলেছিল। তার গায়ে এত শক্তি নেই যে অত বড় একটা বস্তাকে ঘাড়ে করে টেনে নিয়ে যাবে। শুধু বড় নয়, বড় ভারিও বটে। সে সর্বশক্তি দিয়ে বস্তাটাকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু বারবার হাত ফসকে যাচ্ছে। কোমর টনটন করছে, বুক ধড়ফড়। হাত দুটোর পেশি ব্যথা করছে। তবু হাল ছাড়ছে না!

ওঃ!

তার নাকে একটা দুর্গন্ধ এসে ঝাপ্টা মারল! যেন ইঁদুর পচা গন্ধ। মেয়েটা একটু থমকে দাঁড়ায়। দুর্গন্ধের চোটে গা গুলিয়ে উঠেছে। ওয়াক তুলতে গিয়েও থেমে গেল। সন্তর্পণে চারদিকটা তাকিয়ে দেখছে। কেউ আছে? কেউ নেই তো? তার মিশমিশে কালো রং এখন অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। কোঁকড়া চুলগুলো যেন শান্ত অন্ধকারের সমুদ্রে ছোট ছোট তরঙ্গ। এখন কেউ এসে পড়লেও এত অন্ধকারে তাকে চট করে দেখতে পাবে না। কালো হওয়ার এই একটাই সুবিধা। কিন্তু বস্তাটা…?

গোটা পৃথিবীতে এখন অখণ্ড নীরবতা। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু তার চোখেই ঘুম নেই। বেশ কিছুদিন ধরেই ঘুমাতে পারেনি। যতবারই চোখ বুজেছে, ঠিক ততবারই চোখের সামনে ভেসে উঠেছে মি. বাজাজের ছুরি বিদ্ধ। লাশটা! লোকটা মরেছে ঠিকই, কিন্তু তাতেও শান্তি নেই। বিছানায় শুয়েও স্থির থাকতে পারছিল না মেয়েটা। বারবার মনে পড়ছিল, পাশের ঘরে মি. বাজাজের লাশটা পড়ে রয়েছে। সেই সাপের মতো ঠান্ডা, ফ্যাকাশে সাদা মুখ, বাদামি চোখের মালিক এখনও তার কাছেই আছে! মৃত্যু হলেও এখনও মি. বাজাজ তার থেকে মাত্র একটা দরজার তফাতে!

সে কথা মনে পড়তেই কেঁপে উঠল মেয়েটি। এখন তো প্রায়ই শুনতে পায় ও ঘরে নানারকম শব্দ হচ্ছে। কখনো মনে হয় কেউ যেন দাবা খেলছে! গম্ভীর অথচ ভীষণ ঠান্ডা স্বরে ঐ বুঝি কেউ বলে উঠল–চেক অ্যান্ড মেট। খুঁটির নড়াচড়ার আওয়াজ বেশ কয়েকবার শুনেছে। শুনেছে একটা পরিচিত খসখস্ শব্দ। যেন জুতো পরে একটানা পায়চারি করে চলেছে কেউ। দরজা বন্ধ থাকলেও স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল, দরজার পেছনে একটা দীর্ঘকায় ছায়ামূর্তি অস্থিরভাবে হলঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত হেঁটে বেড়াচ্ছে। আতঙ্কে একটা কথাও বলতে পারেনি সে। ঘুমের ঘোরেই নানারকমের অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেয়ে শিউরে উঠেছে। দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়মড় করে উঠে বসেছে। সারা রাত আর ঘুম হয়নি। কেঁদে উঠলে যদি সবাই জেনে যায়! তাই ভয়ের চোটে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে গিয়েছে একটানা। অ্যালিস সবই জানে। কিন্তু মাউ! তাকে কী বলবে সে? মাউ তাকে খুব ভালোবাসে। মাউ যদি জানতে পারে সে মি. বাজাজকে খুন করেছে, তবে তাকে ঘৃণা করবে। ছেড়ে চলে যাবে। যেমন মা ছেড়ে গিয়েছিল, তেমন মাউ ও…!

একটা শীতল হাওয়া মৃত মানুষের হাতের মতো ছুঁয়ে গেল তাকে। একটা শীতল নিঃশ্বাস যেন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল তার ঝামর চুল। মেয়েটা ভয়ে কেঁপে ওঠে। তার বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা যেন চারগুণ জোরে চলতে শুরু করেছে। একরাশ হাওয়া তার কান ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলে গেল

ই ফোর টু ডি ফোর!

মেয়েটির মুখ থেকে একটা আর্তচিৎকার প্রায় বেরিয়েই আসছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেই নিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে ফেলেছে। একটা ভয়, ভীষণ কান্না ভূমিকম্পের মতো তার সারা শরীর জুড়ে আন্দোলন তুলেছে। কে বলল? কে বলল শব্দগুলো? এই কথাগুলো কি কখনো তার পেছন ছাড়বে না? এই অভিশাপ কি সারাজীবন ধরে বয়ে বেড়াতে হবে?

কান্নাভেজা গলায় উত্তর দিল সে-ই সেভেন টু ই ফাইভ!

কিছুক্ষণের জন্য কোনো উত্তর নেই। হাওয়া নিরুত্তর হয়ে হুহু করে বয়ে যাচ্ছে। যেন রেগে গিয়ে কিছু বলতে চাইছে! মেয়েটির কপাল বেয়ে ঘামের ফোঁটা আস্তে আস্তে গড়িয়ে পড়ে। ভয়ার্ত চোখ দুটো পরম সন্দেহে এদিক ওদিক দেখে নিল। কোথায় একটা জুতোর হিলের খটখট শব্দ হলো না? কোথায়? অন্ধকারে কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। ওদিকে পচা গন্ধটা প্রবল হয়ে উঠছে! গন্ধেই বুঝি সবাইকে জানিয়ে দেবে–আমি এখানে আছি। এই বস্তার মধ্যে। এই অন্ধকারে।

তার কোমল মুখ শক্ত হয়ে ওঠে। না, ভয় পেলে চলবে না। এগোতে হবে। অসহ্য লাগছে এই দুর্গন্ধটা। তার হাতের পাতা ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছে। ঠিকমতো বস্তাটাকে ধরা যাচ্ছে না। তা সত্ত্বেও কোনোমতে আঁকড়ে ধরে প্রাণপণে টানতে লাগল সে। এত সহজে ছেড়ে দেবে না। অ্যালিস বলে, কিছুতেই হাল ছাড়লে চলবে না। ভয়ের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হবে। এখন ও অন্ধকারকে ভয় পাচ্ছে, তার চেয়েও বেশি ভয় পাচ্ছে এই বস্তাটাকে। তবু বাজি জিততে হলে ভয়কে মাত দিতে হবে।

সে দাঁতে দাঁত পিষল। এগোতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছে। তবু এগোচ্ছে!

এখন চতুর্দিকে কোনো শব্দ নেই। শুধু বস্তাটা ঘষা খেতে খেতে একটা প্রতিবাদী স্বর তুলছে–ঘস্…ঘস্…ঘস্…! বাইরে রাতের প্রেক্ষাপটে নীলাভ ধোঁয়াশার স্তর আস্তে আস্তে গোটা দৃশ্যপটকে আপাত অদৃশ্য একটা চাদরে ঢেকে দিচ্ছে। আজকাল মধ্যরাতের পরেই হিম পড়তে শুরু করে। আজও স্থিত নৈঃশব্দ্যের মধ্যে তার টুপ টাপ শোনা যায়। আকাশটা আজ ছায়া ছায়া। জ্যোৎস্নায় ঔজ্জ্বল্য নেই! মরা জ্যোৎস্না বিষাদ-বিধুর আলো ছড়িয়ে হয়তো বা কোনো ট্র্যাজেডির আভাস দেয়। একফালি চাঁদ বাঁকা রহস্যময় হাসি হাসছে। দূরে কোথাও একটা একলা কুকুর কেঁদে উঠল…!

কিংস বিশপ টু সি ফোর!

এবার আর মৃদু নয়! একদম স্পষ্ট ও জোরালো আওয়াজ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল তার চতুর্দিকে। মেয়েটা চমেক ওঠে। এক মুহূর্তের জন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার মুখ। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার ফলে ঠোঁটের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। গলা দিয়ে আওয়াজ প্রায় বেরোচ্ছে না। তবু কোনোমতে কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে বলল–কুইনস নাইট টু সি সিক্স!

এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। পরক্ষণেই আবার…

কুইন টু এইচ ফাইভ।

চো-ও-প!

এবার যেন আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটল। জ্বলন্ত লাভা উদগীরণের মতো একরাশ জ্বালাময়ী ক্ষোভ উগরে দিল মেয়েটা। পাগলের মতো চিৎকার করে উঠেছে সে–তুমি এফ সেভেনে ক্যাপচার পয়েন্ট বানিয়ে রেখেছ। কী ভাবো? আমি কিছু বুঝি না? দুনিয়ার সবকিছু একা তুমিই বোঝো! চেস, টর্চার, ট্রমা, ঘেন্না, রাগ, খুন–সব তুমি একাই পারো? না, আমিও পারি। রাজাকে এবার রানি মাত দিয়েছে। এবার চুপ করে থাকার পালা তোমার! চুপ একদম চুপ মি. বাজাজ! কি-প সা-ই-লেন্স!

কে? কে কথা বলছে রে?

মেয়েটা একটু বেশি জোরেই কথাগুলো বলে ফেলেছে! ফলস্বরূপ তার এই উন্মত্ত চিৎকার কারোর কানে গিয়েছে। সে শুনতে পেল একটা জোরালো বুটের এদিকেই ছুটে আসার শব্দ! সে কী করবে বুঝে ওঠার আগেই আচমকা বস্তার মধ্য থেকে ভেসে এল একটা হাসির আওয়াজ! সে হাসি আস্তে আস্তে রূপান্তরিত হচ্ছে অট্টহাস্যে। মনে হলো, সারা দুনিয়া কাঁপিয়ে কেউ হাসছে। সারা আকাশ, সারা পৃথিবী, গোটা মস্তিষ্কে সেই উন্মত্ত খখ হাসি অনুরণন তুলতে তুলতে ফাটিয়ে দিচ্ছে তার দেহের সব কয়টা কোষ। সব স্নায়ুতন্ত্রীকে ছিঁড়ে ফর্দাফাই করে দিচ্ছে সেই জ্বর, হিংস্র হাসি! সে হাসি মানুষের নয় হতে পারে না!

কিংকর্তব্যবিমূঢ় মেয়েটা স্তম্ভিত হয়ে কয়েক মুহূর্ত ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। আর কিছু বোঝার আগেই চোখের সামনে এক ঝলক তীব্র আলো! অন্ধকার যুঁড়ে এসে দাঁড়াল একটা অবয়ব।

কে?

মেয়েটা বস্তাটাকে ওখানেই ছেড়ে দিয়ে প্রাণপণে দৌড় লাগাল নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। সে এমনভাবে দৌড়াচ্ছে যেন তার পেছনে ধাওয়া করেছে কোনো ভয়াল মাংসাশী প্রাণী! তার কানের মধ্যে তখনও বাজছে সেই ব্যঙ্গ কুটিল হাসি…।

হাসতে হাসতেই কণ্ঠস্বরটা বলল–চেক মেট!

*

আহেলি মুখার্জী খুব মন দিয়ে বিজয় জয়সওয়ালের জামাকাপড় পরীক্ষা করছিল। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে সে কিছু একটা ক্ল বের করার চেষ্টা করছে, সে পরিস্থিতিতে আর যাই হোক্, কোনো কাজ করা যায় না!

কারণ সেই এক ও অদ্বিতীয় ড. অসীম চ্যাটার্জী। আহেলির ঠিক নাকের সামনে বসেই বোতাম মার্কা চোখ কটমটিয়ে তাকিয়েছিলেন। কোনোরকম টু শব্দটি না করে গুল্প গুলু চোখে তার কাণ্ডকারখানা দেখছেন। আর আহেলি ঘেমে নেয়ে একসা হচ্ছে। এরকম স্রেফ জ্বালিয়ে দেব মার্কা চোখের সামনে দাঁড়িয়ে শান্তিতে কাজ করা যায়? আহেলির মনে হচ্ছিল, সে বেচারি এক নিরীহ, শান্ত ছাগলছানা! দুমুঠো ঘাস খেতে চাইছে, কিন্তু নাকের সামনে থাবা গেড়ে বসে। আছে এক বিরাট কেঁদো বাঘ! আক্রমণ করছে না, গাঁক করে হাঁক দিচ্ছে না, থাবাও মারছে না–তবু ঐ চোখের দৃষ্টিতেই তার হার্টফেল হওয়ার উপক্রম!

ওদিকে ড. চ্যাটার্জী উশখুশ করতে শুরু করেছেন। তাঁর ধৈর্য আর উদোর বয়সের কেস প্রায় একই। কখনই বাড়ে না–সবসময়ই কমতির দিকে। প্রথমে হাইড্রোক্লোরিকের বোতল থেকে খানিকটা জল ঢকঢক করে খেলেন। তারপর এক কাপ চাকে ঠান্ডা করে রীতিমতো কোল্ডড্রিঙ্কস বানিয়ে ফেললেন। শেষ পর্যন্ত যখন একটা সিগারেটকে দুই টুকরো করে ধূমপান পর্বও সমাপ্ত হলো তখন আর থাকতে পারলেন না। রেগেমেগে বলেই ফেললেন–তুমি। কি প্রতিটা সুতো আলাদা করে ইতিহাস বের করতে চাও? এখানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট খোঁজা হচ্ছে, হরপ্পা-মহেঞ্জোদরোর ধ্বংসস্তূপ নয়।

আহেলি থতমত খেয়ে বলল–কিন্তু ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই যে!

নেই! ড. চ্যাটার্জী হুমহুম করে ওঠেন–তা সেটা বললেই তো ল্যাঠা চোকে। তারপরও কীসের ইনভেস্টিগেশন চালাচ্ছ! এখন কি আগে ফিঙ্গারপ্রিন্ট তৈরি করে, সেটাকে বসিয়ে রিপোর্ট দেওয়ার তাল করছ তুমি?

না, মানে…। সে আমতা আমতা করে বলে–তবু খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। যদি কোথাও পাওয়া যায় আর কী!

কোথাও পাওয়া যাবে মানে? এবার আক্ষরিক অর্থেই খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি-শার্টে যদি ফিঙ্গারপ্রিন্ট না থাকে তবে কি তুমি চাঁদে যাবে? সেখানে গিয়ে নীল আর্মস্ট্রং-এর ফিঙ্গারপ্রিন্ট আনতে তোমায় কে বলেছে?

আহেলি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বুকে মাথা গুঁজে বলল–ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই স্যার। তবে কিছু এমন আছে যা হয়তো দরকারি।

সেটা শোনার জন্য কি আমায় লম্বকর্ণের মতো কান হ্যাঁ হ্যাঁ করে নাড়াতে হবে?

আহেলি মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করে। লোকটা কি সবসময়ই করলা খেয়ে থাকে? একটা, দুটো মিষ্টি কথাও কি বলতে নেই! সবসময়ই এত মেজাজ করার কী আছে? যেমন মাথাটা ভোঁ ভা, তেমনই কাঠের মতো স্বভাব। শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠতি অঙ্গে! সব মিলিয়ে মানুষ তো নয়, শুষ্ক পর্ণমোচী গাছ!

মনে মনে লোকটার চৌদ্দ গুষ্টির তুষ্টি করতে করতে বলল সে–মি. জয়সওয়ালের শার্টে একটা লালচে ছোপ পাওয়া গিয়েছে। ওর মধ্যে ফেরিক অক্সাইডের ট্রেস পেয়েছি স্যার। অর্থাৎ মরচে। মি. জয়সওয়াল যেখানে ছিলেন, তার আশেপাশে কোনো মরচে পড়া লোহা গোছের কিছু ছিল। সেটা সবকিছুই হতে পারে। এক টুকরো লোহা থেকে শুরু করে আস্ত লোহার ফার্নিচার–সবকিছু হওয়া সম্ভব। সেই জং ধরা লোহার সঙ্গে ঘষা খেয়ে ওঁর শার্টে এই লাল দাগটা এসেছে।

হুম। আর কিছু?

হ্যাঁ। আহেলি এবার মি. জয়সওয়ালের বুট দুটো ড. চ্যাটার্জীর নাকের সামনে তুলে ধরল–এটা পাওয়া গিয়েছে।

কী! জুতো!

ব্যাস! আর যায় কোথায়! দুর্বাসা রেগে লাল হয়ে নাচতে শুরু করে দিলেন–এত সাহস তোমার! তুমি আমাকে জুতোবে বলছ!

যা ব্বাবা! কী কথার কী ইন্টারপ্রিটেশন! আহেলি সঙ্গে সঙ্গে জুতোজোড়া নামিয়ে রাখে। কোনোমতে প্রবীণ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে। অথচ তিনি কিছুই শুনবেন না। বুড়োর এই প্রবলেম! কী বললে যে কী বুঝে বসে থাকে তার ঠিক নেই। সে বলতে যাচ্ছিল যে জুতোতে কিছু পাওয়া গিয়েছে। অথচ সবজান্তা গেঞ্জিওয়ালা ভাবলেন আহেলি তাকে জুতোপেটা করতে চাইছে! কী বিপদ!

বস্কে জুতো দেখানো হচ্ছে। বেড়ে পাকা চুঁড়ি! তোমার নামে কমপ্লেন করবো…।

স্যার! দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল আহেলির। এবার সে অগ্রপশ্চাত বিবেচনা না করেই এক ধমকই দিয়ে বসল তাঁকে–আগে পুরো কথাটা শুনবেন তো! তারপর যা খুশি করুন।

ধমকটা দিয়ে ফেলেই জিভ কাটল আহেলি! এই রে! মাথা গরম করে সেও কথা শুনিয়ে দিয়েছে ড. চ্যাটার্জীকে। এইবার তো বুড়ো তার মুণ্ডু চিবোবে! আর বোধহয় রক্ষা নেই!

কিন্তু তেমন ভয়ংকর কিছুই ঘটল না। ড. চ্যাটার্জী কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি ভাবতেই পারছেন না যে চিরপরিচিত শান্ত, ঠান্ডা আহেলি এইমাত্রই তাকে রামধমক দিয়ে দিল! চিরদিন সবাইকে ধমকে ধামকে ঠান্ডা করে এসেছেন। এখন পালটা বকা খেয়ে অভিমানী ছোট বাচ্চাদের মতো কাঁদো কাঁদো মুখ করে মিনমিন করে বললেন–আচ্ছা, শুনছি।

আহেলি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। যাক্, ধমক খেয়েও ড. চ্যাটার্জী কিছু মনে করেননি। সে বুড়োকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তড়বড়িয়ে এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকে–মি. জয়সওয়ালের জুতোতে একটা পেইন্ট সামান্য লেগেছে। পেইন্টটার রং চেরি রেড। ঐ পেইন্টটায় একটা ইন-অর্গানিক পিগমেন্টের অস্তিত্ব আছে। হোয়াইট টাইটানিয়াম ডাই-অক্সাইড! সঙ্গে ভিনাইল। সচরাচর এই জিনিসটা সাধারণ পেইন্টে থাকে না। হোয়াইট টাইটানিয়াম ডাই-অক্সাইড যে পেইন্টে থাকে সেটা ভিনাইল স্যাটিন ফিনিশ ইমালশন পেইন্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

ভিনাইল স্যাটিন ফিনিশ ইমালশন্ পেইন্টটা কী? ড. চ্যাটার্জী টাক চুলকাতে চুলকাতে বললেন–স্যাটিন তো একজাতীয় কাপড়! রং কবে হলো!

স্যাটিন কাপড়ের মতোই মোলায়েম রঙ। আহেলি ড. চ্যাটার্জীকে বুঝিয়ে বলে–যতদূর জানি মোটামুটি দু ধরনের পেইন্ট ইউজ হয়। একটা অয়েল বেসড, আরেকটা ইমালশন্ বেসড। ইমালশন্ বেসড পেইন্টেরও নানা ভ্যারাইটি আছে। সিল্ক ফিনিশ পেইন্ট, স্যাটিন ফিনিশ পেইন্ট তার মধ্যে অন্যতম। দুটোই অত্যন্ত গ্লসি, চকচকে। স্যাটিন আর সিল্ক ফিনিশ পেইন্ট দেখতে ভীষণ সুন্দর হয়। খুব চকচকে, একদম ভেলভেটের মতো মসৃণ। ভিনাইল স্যাটিন, বা ভিনাইল সিল্ক ফিনিশ ইমালশন্ পেইন্ট এতটাই ঝকঝকে যে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

আপাতত কান আর প্রাণ জুড়াল। তারপর ড. স্যাটিন?

আহেলি খোঁচাটাকে পাত্তা দিল না–এই দুটো পেইন্টের মধ্যে মূলত ভিনাইল স্যাটিন উড বেস্ড জিনিসের ওপরে ইউড় হয়। কারণ সিল্কের চেয়েও স্যাটিন পেইন্ট অনেক বেশি হার্ডি। একবার পেইন্ট করালে অনেক দিনের জন্য নিশ্চিন্ত থাকা যায়। এর গ্রেজ, সৌন্দর্য বছরের পর বছর টিকে থাকে। এমনকি নোংরা পড়লেও মুছে দিলেই ফের আগের মতোই ঝকঝক করে। দেওয়ালেও স্যাটিন পেইন্ট করা যায় ঠিকই। কিন্তু এই বিশেষ পেইন্টটা দেওয়ালে ইউজড হয়নি।

সেটা আবার কে বলল? লেখা আছে নাকি?

কালারটা দেখুন স্যার। চেরি রেড! এই ধরনের অ্যাগ্রেসিভ কালার কেউ দেওয়ালে পেইন্ট হিসেবে ব্যবহার করবে না। দেওয়ালের রং যদি তেড়ে খেতে আসে, তবে ঘরের সৌন্দর্যই মাটি! তাছাড়া এই রং ব্রাইটনেস কমায়। স্যাটিন পেইন্ট অত্যন্ত দামি জিনিস। কেউ সেটার ভুলভাল শেড দেওয়ালে লাগিয়ে নিজের পয়সা, আর ঘরের বিউটি বরবাদ করবে কেন?

তবে?

আহেলির মুখের ওপরে একগোছা চুল এসে পড়েছিল। সে আঙুল দিয়ে অলকগুচ্ছ সরাতে সরাতে বলল–যেহেতু ভিনাইল স্যাটিন ফিনিশ ইমালশন পেইন্ট অত্যন্ত হার্ডি এবং বছরের পর বছর চলে, তাই মূলত কাঠের জিনিসের ওপরই এই পেইন্ট লাগানো হয়। আর রংটা চেরি রেড হওয়ার দরুণ বলতে পারি এই পেইন্টটা হয়তো দরজা, জানলার ওপরে লাগানো হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অত্যাচার দরজা-জানলার ওপরেই হয়। লোকে নিজের শখে কয়েক বছর অন্তর অন্তর ঘরের রঙ পালটাতে পারে। কিন্তু দরজা-জানলায় রেগুলার কেউ রং করায় না। তাই ভিনাইল সিঙ্ক ফিনিশ ঘরের দেওয়ালের জন্য, আর ভিনাইল স্যাটিন ফিনিশ দরজা-জানলার জন্য পার্ফেক্ট!

মি, জয়সওয়ালের জুতোয় এই পেইন্টটা আছে। অসীম চ্যাটার্জী বিড়বিড় করেন–তার মানে তিনি যেখানে ছিলেন সেখানে এই কালারটার কনটেনারও ছিল।

ইয়েস স্যার। আহেলি যোগ করল–আর সেখানে জং ধরা লোহাও কোনোভাবে উপস্থিত ছিল।

জং ধরা লোহা–মানে কোনো লোহার ফার্নিচারও হতে পারে। একটা রঙের কনটেনার…। ড. চ্যাটার্জী যেন অঙ্ক মেলাচ্ছেন–সিল্ড কনটেনার নিশ্চয়ই নয়। তাহলে পেইন্টটা বাইরে আসত না, ওঁর জুতোয় লাগত না। তার মানে পেইন্টটা ইউজড। মর্চে পড়া লোহার বাতিল ফার্নিচার, ইউজড় পেইন্ট এ দুটোই বাড়ির একটা জায়গাতেই একসঙ্গে থাকতে পারে…!

স্টোররুম স্যার। আহেলির চোখ সাফল্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে–মি. ব্যানার্জীর থিওরি যে মি. বিজয় জয়সওয়াল মেরিলিন প্ল্যাটিনামের মধ্যেই ছিলেন, বাইরে কোথাও যাননি। ওঁর আন্দাজ যদি সত্যি হয়, তবে ওঁদের শুধু হাউজিং কমপ্লেক্সের মধ্যে সেই নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটটা খুঁজে বের করতে হবে যেটার দরজা-জানলার রং চেরি রেড। সেই ফ্ল্যাটে যদি কোনো স্টোররুম থাকে, তবে হয়তো সেখানে কোনো কু পাওয়া যাবে।

হুম্। ড. চ্যাটার্জী তার দিকে আড়চোখে তাকালেন–ও কে। বুঝলাম। রাজাকে আমি বলে দেব। নাউ…শুঃ…!

আহেলি মুখ ব্যাজার করে চলে গেল। তার চলার ভঙ্গিতেই অসন্তোষ প্রকট। ড. চ্যাটার্জী একদৃষ্টে ওর গমনপথের দিকে তাকিয়েছিলেন। সে তার দৃষ্টিপথের বাইরে চলে যেতেই তাঁর প্রখরদৃষ্টি নরম হয়ে আসে। এবার ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ স্বভাববিরুদ্ধভাবে মৃদু হাসলেন! খুব নিচু স্বরে বললেন–

গুড জব গার্ল! ওয়েল ডান!

*

অবশেষে আরেক বিজয় জয়সওয়ালকে পাওয়া গেল!

এমনিতেই বিজয় জয়সওয়াল নামের লোক কলকাতা শহরে হাজারে হাজারে থাকার কথা নয়। বরং মুম্বাই বা দিল্লী হলে খুঁজে বের করা কঠিন ছিল। কিন্তু কলকাতায় বিজয় জয়সওয়াল নামের আর মাত্র দুটি লোকেরই খোঁজ পাওয়া গেল। অধিরাজ নির্দেশ দিয়েছিল, টেলিফোন ডিরেক্টরির বি আর ভি–দুটো অ্যালফাবেটের পেজই যেন ভালোভাবে দেখা হয়। অর্থাৎ বিজয় ও ভিজয়–দুটোই দেখতে হবে। শঙ্কা ছিল যে টেলিফোন ডিরেক্টরিতে হয়তো সব বিজয় জয়সওয়ালের ঠিকানা নাও থাকতে পারে। মোবাইল ফোনের দবদবার চোটে অনেকেই আজকাল ল্যান্ড লাইন রাখছেন না। সেজন্য ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম সহ সব সোশ্যাল নেটওয়ার্ক তোলপাড় করে খোঁজা হলো কলকাতাবাসী বিজয় জয়সওয়ালদের।

খুঁজে বের করতে খুব অসুবিধে অবশ্য হলো না। একটু সময় লাগলেও শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল অন্য দুই মি. বিজয় জয়সওয়ালের খোঁজ। সঙ্গে সঙ্গেই যোগাযোগ করা হলো তাদের। প্রথম বিজয় জয়সওয়ালকে নিয়ে বিশেষ টেনশন নেই। কারণ তিনি দুবছর আগেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে দেহ রেখেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিজয় জয়সওয়ালকে নিয়েই আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হলো। তিনি পেশায় ডাক্তার। ঠিক ছয়দিন আগেই ড. জয়সওয়াল কোনো মেডিক্যাল কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করতে গিয়েছেন। এখনও ফেরেননি। অবশ্য ফেরার সময় এখনও হয়নি। তাঁর স্ত্রী অহল্যা জয়সওয়ালকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানালেন যে প্রায়ই ড. জয়সওয়াল এরকম কনফারেন্সে গিয়ে থাকেন। তার ফোন সুইচড অফ থাকলেও তা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত নন তিনি। দেশের বাইরে গেলে তার ফোন সুইচ অফই থাকে। এই জাতীয় ট্যুরে তাঁর সঙ্গে সবসময়ই থাকেন জ্যেষ্ঠপুত্রবধূ রাধিকা যায়। এবার অবশ্য একাই গিয়েছেন। অধিরাজ সেদিনই অহল্যার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভদ্রমহিলা সবিনয়ে জানিয়েছেন যে তিনি এই মুহূর্তে দিল্লিতে নিজের এক আত্মীয়ের বাড়িতে আছেন। পরের দিন ভোরের ফ্লাইটে কলকাতায় ফিরবেন। ওরা যেন পরদিন সকাল দশটা নাগাদ ওঁর কলকাতার বাড়িতে চলে যায়।

মিসেস জয়সওয়ালের কথায় কোনো চিন্তা, কোনো টেনশনের ছাপ নেই। কিন্তু তার কথা শুনে অধিরাজের ব্লাড প্রেশার হাই হওয়ার উপক্রম। সেই একই প্যাটার্ন! লোকটা আগে বাড়ি থেকে চলে গেল। তার অব্যবহিত কিছুদিন পরেই ঐ নামে আরআইপি পোস্ট! ব্যাপারটা মোটেই সুবিধার ঠেকছে না।

অন্যদিকে তন্নতন্ন করে খোঁজা হচ্ছে স্বর্ণ ব্যবসায়ী বিজয় জয়সওয়ালের গাড়িটা। অধিরাজ সেটার হাপিশ হয়ে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। হিস্ট্রিশিটাররা কয়েক কেজি কাঁচা লঙ্কা ও কয়েক গ্যালন গরম দুধ খেয়েও নিজেদের বয়ান থেকে নড়ছে না। প্রত্যেকেরই বক্তব্য–এরকম কোনো সাদা এসইউভি তারা দশ-বারো দিন কেন, এক মাসেও চোখে দেখেনি! টর্চারের চোটে গড়াগড়ি দিচ্ছে, হাতে-পায়ে ধরছে আর বলছে–বিশ্বাস করুন স্যার! আমরা কিছু জানি না।

অধিরাজের মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তাও হাল ছাড়েনি সে। এইটুকু বলা যায় যে বিজয় জয়সওয়ালের এসইউভি গাড়িটা প্রধান সড়ক ধরে কোথাও যায়নি। তাহলে কোনো না কোনো সিসিটিভিতে ধরা পড়তই। সেজন্য সে মেরিলিন প্ল্যাটিনামের আশেপাশের সমস্ত রাস্তা, সমস্ত গলিখুঁজি খুঁজে দেখেছে। সমস্তরকম সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে এগোলেও শেষ পর্যন্ত সেই ডেড-এন্ডে গিয়েই পিঠ ঠেকে গেল। মেরিলিন প্ল্যাটিনামের সংলগ্ন এমন বেশ কয়েকটা কাঁচা রাস্তা আছে যেগুলো দিয়ে গাড়িটাকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সেই সমস্ত রাস্তাতে স্বয়ং অধিরাজ, অর্ণব, পবিত্র সহ গোটা টিম সারাদিন গাড়ির ফটো নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে বেড়াল। এমনকি আশেপাশে যে কয়টা গ্যারাজ চোখে পড়ল সেখানেও রীতিমতো তল্লাশি চলল। কিন্তু নিট ফল জিরো।

এই পরিস্থিতিতে সিআইডি হোমিসাইড টিম যখন হতাশার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখন স্থানীয় সমস্ত জলাশয়ে ডুবুরি নামানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। মেরিলিন প্ল্যাটিনাম যেহেতু একটু ভেতরের দিকে তুলনামূলক শহরতলির পরিবেশে অবস্থিত, সেহেতু আশেপাশে বেশ কয়েকটা বিশাল ঝিল, আর বিরাট বিরাট পুকুরও আছে। এমনকি মেরিলিন প্ল্যাটিনামের ঠিক পেছনেই একটা বড় পুকুর রয়েছে। কোনো গাড়িকে সেইসব ঝিল বা পুকুরে ডাম্প করা অসম্ভব নয়।

সেই পরিকল্পনামতোই চলে এল ডুবুরির দল। প্রত্যেকটা পুকুর এবং ঝিলে চিরুনি তল্লাশি চলল। ডাইভাররা অনেক চেষ্টা করেও কিছু পাচ্ছে না দেখে অধিরাজ নিজেই উত্তেজিত হয়ে দ্রুত হাতে শার্ট, বুট, বেল্ট, হাতের ঘড়ি খুলতে শুরু করে। অর্ণব তার কাণ্ড দেখে ঘাবড়ে গেল। পবিত্র সন্ত্রস্ত। কণ্ঠে বলল–রাজা, এটা কী হচ্ছে?

উত্তরে রাগী রাগী চোখে তার দিকে তাকায় অধিরাজ। তার চোয়াল শক্ত। মুখ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কোনো কথা না বলে শার্ট, বুট, রিভলভার সমেত বেল্ট ও ঘড়ি এগিয়ে দিল অর্ণবের দিকে! অর্ণব হতভম্বের মতো জিনিসগুলো ধরতে না ধরতেই সে বিদ্যুৎবেগে লাফ মেরে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

পবিত্র বিড়বিড় করে–একেই সর্দি লেগেছে, তার ওপর গোঁয়ারের মতো রেগেমেগে অবেলায় জলে নামল। কেস সত্ করতে গিয়ে নিউমোনিয়ায় না মরে! এ মাল কিছুতেই শুধরোবে না।

কিন্তু সেই তুমুল প্রচেষ্টাও ফলবতী হলো না। ডাইভাররা আর স্বয়ং অধিরাজ আপ্রাণ জল তোলপাড় করে খোঁজ চালাল। আক্ষরিক অর্থেই প্রচুর জল ঘোলা হলো। তবুও সে গাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল না। একটা একটা করে ঘন্টা কাটছে আর অর্ণবের বুকের ভেতরে ভয় বাড়ছে। অধিরাজও ক্রমশ উতলা হয়ে উঠছে। তার স্বভাবগত স্থৈর্যও জবাব দিচ্ছে। ওদিকে ড. বিজয় জয়সওয়াল হয়তো একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছেন, অথচ এদিকে কিছুতেই একটাও ক্ল পাচ্ছে না সিআইডি। চেষ্টার ত্রুটি নেই–কিন্তু সর্বত্রই অন্ধকার।

সারাদিন খানা-তল্লাশিতে কাটল। রাতে অধিরাজ অফিসে ফিরে আবার ট্র্যাফিক ডিপার্টমেন্টের দেওয়া সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে বসে গিয়েছিল। অর্ণবও তার সঙ্গে। কিন্তু ক্লান্তিতে তার চোখ ক্রমাগতই ভারি হয়ে আসছে দেখে অধিরাজই বলেছিল–আজ তুমি বরং বাড়ি চলে যাও। আমি আছি এখানে। কাল না হয় আটটায় রিপোর্ট কোরো। একসঙ্গেই মিসেস জয়সওয়ালের কাছে যাওয়া যাবে।

আপনি সারা রাত এখানে জেগে বসে থাকবেন?

আরেকবার এই ফুটেজগুলো দেখা দরকার। সে আপনমনেই বিড়বিড় করে বলে–হয়তো কিছু মিস্ করে যাচ্ছি। এমন কিছু জিনিস–হয়তো নিতান্তই সামান্য, কিন্তু ক্রু হিসাবে টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে।

কিন্তু আমরা তো অনেকবারই দেখেছি ফুটেজগুলো।

আরও একবার দেখে নিই। কোনোদিকেই যখন এগোনো যাচ্ছে না, তখন হাতের কাছে যা আছে সেটাও আরেকবার খুঁটিয়ে দেখে নেওয়া ভালো। তুমি বরং আজ রেস্ট নাও।

না স্যার। অর্ণব সজাগ থাকার চেষ্টা করে–আমি ঠিক আছি।

কিন্তু ঠিক আছি বললেই তো আর ঠিক থাকা যায় না। বেচারা নিজের অজান্তেই কখন যে চেয়ারে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই। যতবারই চোখ খুলেছে ততবারই দেখেছে ধূমায়িত কফির কাপ ও জ্বলন্ত সিগারেট হাতে অধিরাজ চুপ করে সিসিটিভি ফুটেজগুলো দেখছে। তার চোখের পলক পড়ছে না। দৃষ্টি প্রখর। স্থির মুখমণ্ডল। ধ্যানমগ্ন তপস্বীর মতো বাহ্যজ্ঞানহীন। শ্রান্তি নেই, ক্লান্তি নেই!

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই অর্ণব দেখল অধিরাজ টেবিলের ওপরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। সিসিটিভি ফুটেজের সিডিগুলো সব টেবিলের ওপরেই ছড়িয়ে আছে। অর্থাৎ সব দেখা হয়ে গিয়েছে। টেবিলে, মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে অজস্র কফির কাপ ও সিগারেটের টুকরো!

এখনও রীতিমতো ঘুম ঘুম পাচ্ছিল অর্ণবের। অহল্যার কথামতো সকাল দশটার অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করতে বেরিয়ে পড়েছে অধিরাজবাহিনী। সে আড়চোখে অধিরাজের দিকে তাকায়। সারারাত ঘুমায়নি লোকটা! অথচ কী ফ্রেশ লাগছে! এই লোকটার কি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি–কিছুই থাকতে নেই! অবশ্য সর্দি বেশ ভালোই লেগেছে। মাঝেমধ্যেই হেঁচে ফেলছে।

স্যার, এমনও তো হতে পারে যে ড. জয়সওয়াল সত্যিই কোনো কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করতে গিয়েছেন। গাড়িতে যেতে যেতে অর্ণব একটু হতাশ স্বরেই বলে ওঠে–তিনি হয়তো বিদেশে বসে লবস্টার আর রোস্টেড ল্যাম্ব খাচ্ছেন। আর আমরা তার জন্য হন্যে হয়ে খাবি খাচ্ছি!

অধিরাজ আজ ড্রাইভ করছে। সে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে একটা টার্ন নিতে নিতে বলল–খুব খিদে পেয়েছে নাকি অর্ণব? কিছু খেয়ে নেবে? ব্রেকফাস্টও তো করা হয়নি।

অর্ণবের সত্যিই খুব খিদে পেয়েছিল। প্রায় ছিয়ানব্বই ঘণ্টা হতে চলল সে বাড়ি ফেরেনি। এই ছিয়ানব্বই ঘণ্টায় কী খেয়েছে, কী না খেয়েছে মনেই নেই! গোটা সময়টা জুড়ে শুধু তুলকালাম হয়েছে। পাগলের মতো একবার এদিকে দৌড়চ্ছে তো আরেকবার ওদিকে। ড. চ্যাটার্জী তো একবার বলেই ফেলেছিলেন–সর্বক্ষণ পিংপং বলের মতো লাফিয়েই বেড়াচ্ছ দেখছি। কাজের কাজ তো কিছুই হলো না!

অধিরাজ একটুও রাগ করেনি। বরং তির্যক দৃষ্টিতে ড. চ্যাটার্জীর টাক আর ভুঁড়ির দিকে তাকিয়ে বলেছিল–পিংপং বলের মতো লাফানোর অভ্যেসটা ভালোই। নয়তো খোদ নিজেকেই ফুটবল হয়ে যেতে হয়।

এরপর ড. চ্যাটার্জী কী করেছিলেন সেটা বলাই বাহুল্য। যথারীতি তাঁর প্যান্ডা নৃত্য শুরু হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে এক ও অদ্বিতীয় হুমকি-হতভাগা, হতচ্ছাড়া, অলপ্পেয়ে ছোঁড়া! আমায় ফুটবল বলা! খুন করে ফেলব। একদম খু-উ–ন করে ফেলব!

এখন এত খিদে পেয়েছে অর্ণবের যে মাথা রীতিমতো বোঁ বোঁ করছে। আজ ব্রেকফাস্টও করতে পারেনি। আর ওপরওয়ালাও যেন তাকে দেখিয়ে দেখিয়েই রাস্তার দুধারে রেস্টুরেন্ট আর খাবারের দোকানের লাইন লাগিয়েছেন! কোথাও মিও আমোরে, কোথাও কেএফসি বা পিজা কর্ণার, কোথাও বা আরামবাগস চিকেন। রাস্তায় ফলের দোকান। তার পাশের ফাস্ট ফুড সেন্টার থেকে বিরিয়ানির কড়া সুগন্ধ ভেসে আসছে।

এবার অর্ণবের রীতিমতো রাগ হয়! এত খাবারের দোকান চারপাশে থাকার মানেটা কী! তার বদলে ওষুধের দোকান থাকলে ক্ষতি কী হতো? অথবা মোবাইল ফোনের শোরুমও তো থাকতে পারত! তা নয়, খালি খাবারের দোকান! যত্তসব! তার ওপর সামনে এক বাইকওয়ালা ঢিমে তালে চলেছে। কিছুতেই সাইড দিচ্ছে না!

স্যার, এই বাইকটাকে কাটান তো! সে বিরক্ত হয়ে বলে–কখন থেকে ঢিকিয়ে টিকিয়ে চলেছে। কিছুতেই নাকের সামনে থেকে সরছেই না!

অধিরাজ দেখল সামনে ফুড ডেলিভারির ব্যাগ নিয়ে এক ছোকরা বাইক চালিয়ে যাচ্ছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসল। পরক্ষণেই কথা নেই, বার্তা নেই ঘ্যাস করে ব্রেক!

অর্ণব ভয়ে ভয়ে জানতে চায়–কী হলো স্যার?

জাস্ট টু মিনিটস। ব্রেকফাস্ট টাইম।

কথাটা ছুঁড়ে দিয়েই গাড়িটাকে সাইড করে, সিটবেল্ট খুলে, এক দৌড়ে অধিরাজ চলে গেল উলটোদিকে। অর্ণব দেখল, সে সটান পিজ্জা কর্নারে ঢুকেছে। নিজের নির্বুদ্ধিতায় লাল হয়ে উঠল তার ফরসা মুখ। পাশে বসা টপনট বাঁধা কৃষ্ণাঙ্গী লেডি অফিসার মুচকি মুচকি হাসছে। ওদের টিমে খুব একটা লেডি অফিসারদের দরকার পড়ে না। তাই একটু অস্বস্তি বোধ করছিল অর্ণব।

দুই মিনিট হওয়ার আগেই অবশ্য অধিরাজ ফিরে এল। হাতে একটা বিরাট পিৎজার প্যাকেট। সেটা লেডি অফিসারের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে সে–প্লিজ মিস্ গুপ্ত!

অর্ণব এবার মোক্ষম একটা বিষম খায়। কাশতে কাশতেই কোনোমতে সামলে নিয়ে বলল–উনি মিস্ ঘোষ স্যার!

অধিরাজ কোমরে হাত রেখে সটান দাঁড়িয়ে তার দিকেই চোখ কুঁচকে দেখছে–কিন্তু তুমি যে সেদিন বললে তিনি মিস্ ঘোষ নন, মিস্ গুপ্ত!

সে কপাল চাপড়াতে গিয়েও সামলে নিল–যাকে আপনি ঘোষ বলেছিলেন, তিনি গুপ্তই ছিলেন। আর ইনি অরিজিনালি ঘোষ!

পিকিউলিয়ার প্রবলেম। অধিরাজ কাঁধ ঝাঁকায়। পরক্ষণেই মিস্ ঘোষের দিকে তাকিয়ে নম্র হাসল–সরি মাদমোয়াজেল!

মিস্ ঘোষ হাসতে হাসতেই মাথা নাড়ে–ইটস্ ও কে স্যার! আপনি বরং মাদমোয়াজেল বা শুধু মিস্টাই বলুন। ওটাই সেফ।

কোনোটাই সেফ নয়। অধিরাজ ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলল– এরপর হয়তো কাউকে মিস বলে ডাকলেই অর্ণব বলে বসে থাকবে–স্যার, তিনি তো মিস্ নন মিসেস! প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন দিতে ও ওস্তাদ!

অর্ণব ঢোক গিলল। লেডি অফিসার ফের হেসে ফেলল।

ড. বিজয় জয়সওয়াল কোনো কমপ্লেক্সে থাকেন না। নিউ আলিপুরে তাঁর নিজস্ব বিরাট বাড়ি আছে। সে তো বাড়ি নয়–অট্টালিকা! বিরাট সাদা ধবধবে তিনতলা বাড়ি, সামনের প্রাচীন গাড়িবারান্দা–এবং একপাশের লালে লাল প্রাচীন গুলমোহর গাছ রীতিমতো আভিজাত্যের প্রতীক। সামনে বিরাট লোহার দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে উর্দি পরা নেপালি গেটকিপার। স্পষ্ট বোঝা যায় যে এ বাড়ি আজকের নয়। এই অট্টালিকার পেছনে ড. জয়সওয়ালের পূর্বপুরুষদের অবদান আছে। অনেক প্রজন্মের ঘাম রক্ত মিশে আছে প্রত্যেকটা ইটে।

বাড়ির ভেতরেই গাড়ি রাখার বিরাট বাঁধানো জায়গা। গেটকিপারকে নিজেদের পরিচয় দিতেই লোহার দরজা সশব্দে খুলে গেল। অধিরাজ সেখানেই গাড়ি পার্ক করে নামতে নামতেই সাইড ভিউ মিররে দেখতে পায়, একজোড়া সুন্দর চোখ দোতলার জানলা দিয়ে উঁকি মেরে সকৌতূহলে তাদেরই দেখছে। সে ভদ্রতাবশত ওপরের দিকে তাকায় না। বরং গাড়ির পেছনের দরজা খুলে লেডি অফিসারকে সসমমে বলল–প্লিজ মিস!

মিস ঘোষের মুখে এবার একটু যেন অসন্তোষের ছাপ পড়ল। লেডি অফিসাররা এ ধরনের ট্রিটমেন্টে একেবারেই অভ্যস্ত নয়। এ যে একেবারে ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা! সে নিজে যথেষ্টই স্বয়ংসম্পূর্ণ। কেউ আজ পর্যন্ত তার জন্য এভাবে গাড়ির দরজা খুলে ধরেনি। সে মহিলা হতে পারে, তার মানে এই নয় যে তাকে সবসময়ই পুতুপুতু করতে হবে।

আপনি এখোন স্যার। আমি আসছি।

মেয়েটির কণ্ঠস্বরে সামান্য উম্মার আঁচ পেল অধিরাজ। সে মৃদু হেসে নিচু গলায় বলে–আপনাকে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে না মিস। আমি জানি আপনি নিজেই গাড়ি থেকে নামতে পারেন। আসলে দোতলার রাইট উইঙের জানলায় কোনো শ্রীমতী অত্যন্ত সন্তর্পণে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন। অর্ণব বা আমি তো তার দিকে প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে থাকতে পারি না। অতএব আপনিই একটু তার শ্রীমুখটা দেখে নিন। দরজা ধরে থাকার বাহানায় একথাটাই বলার ছিল। দূর থেকে চিৎকার করে তো বলতে পারি না–ওপরটা একটু দেখুন তো। ধীরে সুস্থে সময় নিয়ে নামুন। সেই ফাঁকে ভালো করে হুলিয়াটা দেখে নিন। বাট মেক ইট নর্মাল।

মিস ঘোষ এবার ব্যাপারটা বুঝল। সে ধীরেসুস্থে নেমে এল গাড়ি থেকে। তার অন্যমনস্ক দৃষ্টি তিনতলা বাড়িটাকে ছুঁয়ে গেল। খুব ক্যাজুয়ালি একবার দেখে নিয়ে দরজা ধরে শোফারের মতো অপেক্ষারত অধিরাজের দিকে তাকাল। সে মৃদু হেসে সামান্য ঝুঁকে দরজাটা বন্ধ করে দিতে যায়। সেই মুহর্তের ভগ্নাংশে তার কানের কাছে চাপা স্বরে বলল মিস ঘোষসুন্দরী। আটাশ থেকে তিরিশ মনে হয়। মাথায় সিঁদুর আর গলায় মঙ্গলসূত্র আছে।

অধিরাজ স্মিত হাসল–থ্যাঙ্কস।

বাড়ির দরজায় এসে অবশ্য কলিংবেল বাজাতে হলো না ওদের। ওপরে বসে যিনি সকৌতূহলে দেখছিলেন, সম্ভবত তিনিই ডোরবেল বাজানোর আগেই দরজা খুলে দিলেন। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চাইলেন আপনারা?

মেয়েটাকে দেখেই চোখ ঝলসে গেল অর্ণবের। এক কথায় অসহ্য সুন্দরী এবং তন্বী! এত সৌন্দর্য দর্শকের পক্ষে সহ্য করাও মুশকিল! কুচকুচে কালো রেশমি চুল সাবলীল জলপ্রপাতের মতো কোমরের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। গায়ের রং যেন আইভরি সাদা! হালকা বাদামি চোখের তারা দুটো কিঞ্চিত বিস্ফারিত। অপূর্ব চোখ দুটোর চারপাশে লম্বা ও ঘনকালো পাতা বুঝি কাকচক্ষু ঝিলের চারপাশে বেড় দেওয়া ঘন বৃক্ষশ্রেণি! দৃষ্টিতে একটু যেন চমকে ওঠা অভিব্যক্তি। লাল ঠোঁট দুটো দেখলে মনে হয় গুলমোহরের পাপড়ি খসে পড়েছে। আঁটোসাঁটো কমলা রঙের রাত পোশাক পরে থাকার দরুণ দেহের গড়নটাও বোঝা গেল। কন্যা দীর্ঘাঙ্গী, পীনপয়োধরা ও মধ্যক্ষামা! নিম্ননাভি এবং সুগভীর শ্রেণীর অধিকারিণীও বটে। চলার ছন্দে ছন্দে যেন যৌবন উপছে পড়ছে। প্রশ্নটা যখন করল মেয়েটি, তখন গুলমোহরের ফাঁকে সুডৌল ঝকঝকে মুক্তার দানা ঝলসে উঠল।

অধিরাজ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মিস ঘোষের দিকে তাকায়। সে অর্থপূর্ণ ভাবে মাথা ঝাঁকায়। অর্থাৎ তিনিই একটু আগে দোতলার জানলা দিয়ে উঁকি মারছিলেন। অর্ণব কিছু বলার আগেই মিস ঘোষ কেসটাকে টেক-ওভার করল। স্মার্ট ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে বলল–সিআইডি।

সিআইডি! মেয়েটি যেন আকাশ থেকে পড়ে–কেন?

আপনি…?

শিনা জয়সওয়াল। কিন্তু সিআইডি এখানে কেন? শিনার কণ্ঠে ভয়ের ছাপ প্রকট।

একটা কেসের ব্যাপারে মিসেস অহল্যা বিজয় জয়সওয়ালের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। মিস ঘোষের চটজলদি উত্তর–আমরা আগেই ফোন করে ওঁর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি জানেন।

কী প্রমাণ আছে যে আপনারা সিআইডি ব্যুরো থেকেই আসছেন? শিনা জয়সওয়াল ধনুকের মতো ভুরু কুঁচকে বলল–আইডি কার্ড আছে?

মিস্ ঘোষ নির্বিবাদে আইডি কার্ড দেখাল।

বেশ। আসুন।

শিনা বিনা বাক্যব্যয়ে দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে স্বাগত জানায়। ওদের তিনজনকেই সে নিয়ে গেল একটা বিরাট বিলাসবহুল হলঘরে। হলঘরটা অর্থের প্রাচুর্য ও রুচির মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছে। ধবধবে সাদা ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে, দেওয়ালের রঙ, পর্দার কভার থেকে শুরু করে সোফা, ঝাড়বাতি, বড় বড় অয়েল পেইন্টিং, শ্বেতপাথরের মূর্তি পর্যন্ত সবকিছু থেকেই সুশিক্ষা, শিল্প ও আভিজাত্যের গন্ধ আসছে। দেওয়ালের মাঝখানে বিরাট বইয়ের শোকেসে শেকসপিয়র, মপাসা, রবীন্দ্রনাথ, শরশ্চন্দ্র সহ আরও অনেক বরেণ্য সাহিত্যিক ঝলমল করছেন। আছে ইংরেজি থ্রিলার ও প্রচুর ভূতের গল্পের বই। শোকেসের নিচে একসাইডে পোর্সেলিন টবে পাতাবাহারের সারি অপূর্ব রঙের সন্নিবেশ ঘটিয়েছে।

আপনারা এখানে বসুন, আমি মাকে ডেকে দিচ্ছি।

শিনা জয়সওয়াল পিছন ফিরতেই স্পষ্ট দেখা গেল তার শ্বেতপাথরের মতো ধবধবে সাদা বাহুর একসাইডে লাল-কালো রঙের সুট পরা স্পাইডারম্যানের ট্যাটু জ্বলজ্বল করছে! চরম ফরসা হওয়ার দরুণ লাল-কালো রঙের কম্বিনেশনটা দুর্ধর্ষ লাগছে।

সে চলে যেতেই জোরে শ্বাস ছাড়ল অর্ণব। এতক্ষণ তার প্রায় দমবন্ধ হয়ে আসছিল। মহিলার উপস্থিতি যেন অসম্ভব শ্বাসরোধী। যেকোনো পুরুষের হৃৎস্পন্দন থামিয়ে দেওয়ার যোগ্যতা রাখে এই সুন্দরী!

আজকাল সব সুন্দরীই ট্যাটু করাচ্ছেন নাকি? অধিরাজ বিড়বিড় করে বলল–মিসেস মানসী জয়সওয়াল কাঁকড়াবিছের ট্যাটু করিয়েছেন দেখলাম, তিনি আবার স্পাইডারম্যান! কিন্তু স্পাইডারম্যানের সুট লাল আর নীল নয়? লাল-কালোর কম্বিনেশন কোথা থেকে এল! ইচ্ছেমতো রং করিয়েছেন নাকি?

না স্যার। অর্ণব মুচকি হাসল–ইচ্ছেমতো করাননি। তিনি মনে হয় মার্ভেল সুপার হিরো সিরিজের অত্যন্ত ভক্ত। আপনি দেখেননি? স্পাইডারম্যানের লাল কালো সুটও আছে।

সে কী! স্পাইডারম্যান তো জীবনে একবারই কালো সুট পরেছিল। এবার অবাক হওয়ার পালা অধিরাজের–সেখানেও তো শুধু কালো! লাল তো ছিল না!

স্যার, আপনি যার কথা বলছেন, বা যাকে স্পাইডারম্যান হিসেবে চেনেন সে পিটার পার্কার। অর্ণব বুঝিয়ে বলল–পিটার পার্কারই কিন্তু একমাত্র স্পাইডারম্যান নয়। আসলে মার্ভেল কমিকস একটু অন্য লেভেলের কনসেপ্টে খেলে। পিটার পার্কার প্ল্যানেট আর্থ, মানে পৃথিবীর স্পাইডারম্যান। কিন্তু কমিকস সিরিজটায় প্যারালাল ইউনিভার্সে একসঙ্গে অনেকগুলো স্পাইডারম্যান আছে। এমনকি একজন স্পাইডার-ওম্যানকেও পাবেন। যিনি লাল-কালো রঙের স্পাইডারম্যান তিনি এই প্যারালাল ইউনিভার্সেরই আরেকজন। স্পাইডারম্যান টু ও বলতে পারেন। তার আসল নাম মাইলস্ মরালস। আর্থ ফাইভের স্পাইডারম্যান। আলটিমেট ফল আউটে ফাস্ট অ্যাপিয়ার করে এই নতুন স্পাইডারম্যান। দি অ্যামেজিং স্পাইডারম্যানেও তিনি আছেন। ইনফ্যাক্ট এঁকে অ্যানিমেটেড আল্টিমেট স্পাইডারম্যান টিভি সিরিজেও দেখা গিয়েছিল।

তার মানে লাল-কালো স্পাইডারম্যান পিটার পার্কার নয়!

না। লাল-কালো সুটের হিরো মাইলস মরালস স্যার। সে জানায়–এছাড়া আরও একজন স্পাইডারম্যান আছেন। মিগুয়েল ও হারা। আমি তিনজনের কথাই জানি। কিন্তু সম্ভবত আরও আছে।

রক্ষে করো। অধিরাজ মাথা ঝাঁকায়–এর থেকে আমার কাকড়াবিছে সুন্দরীই ভালো। দ্য স্করপিয়ন কুইন।

অর্ণবের মনে হয়, অধিরাজের বোধহয় মানসী জয়সওয়ালকেই বেশি মনে ধরেছে। সে বলল–আরেকটা কথা। মাইলস মরালসের আরেকটা স্পেশ্যালিটি আছে। সব স্পাইডারম্যানদের মধ্যে ওই একমাত্র কালো মানুষ! নিগ্রোবটু।

সে কী!

অর্ণব প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। হলঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে তার ফের কণ্ঠরোধ হয়ে গিয়েছে। কোনোমতে ফিসফিস করে বলল–স্যার, আমরা কি মিসেস ইউনিভার্সের প্রতিযোগী খুঁজতে এসেছি!

কথাটা বলার কারণ আছে। এই মুহূর্তে হলঘরে এক বয়স্কা মহিলার সঙ্গে যে নারীটি ঢুকল, তাকে দেখলে এই কথাটাই মনে হয়। শিনা জয়সওয়াল অপূর্ব সুন্দরী। কিন্তু এখন যে সামনে এসে দাঁড়াল তাকে দেখলে মোটামুটি মমতাজমহল, পদ্মাবতী, হেলেন অব ট্রয়ের কথাই মনে পড়ে। শিনা যদি শ্বেতপদ্ম হয়, এ তবে ব্রহ্মকমল! কাঁচা সোনার মতো গায়ের রং যেন চতুর্দিক আলো করেছে। তপ্তকাঞ্চন বর্ণা! চেহারাটা অবশ্য ক্ষীণ নয়, একটু ভারির দিকেই। কিন্তু ভারি বা তথাকথিত কার্ভি চেহারা যে কত সুন্দর হতে পারে এই মহিলা তার জলজ্যান্ত নিদর্শন! অনেক জিরো ফিগারের হিরোইন তাকে দেখলে অজ্ঞান হয়ে যাবেন। শিনার সৌন্দর্য পুড়িয়ে দেয়। অথচ এই নারীর রূপ দর্শকের প্রাণে আরাম দেয়। দেবী মূর্তির মতো টানাটানা চোখ, চোখের তারা সামান্য নীলাভ এবং স্বচ্ছ, পাকা করমচার মতো লাল ঠোঁট। একপিঠ কোঁকড়া কোঁকড়া চুল ছড়িয়ে রয়েছে। একটা বন্য সৌন্দর্যের পাশাপাশি স্নিগ্ধ ভাবের বৈপরীত্য। একটা কালো শাড়ি এবং স্লিভলেস কালো ব্লাউজ পরেছে। শিনা যতটা তীক্ষ্ণ, সে ততটাই লাবণ্যময়ী। হাঁটার ধরণটুকুও লাস্যে ঢলটল করছে। উপস্থিত তিনজন অফিসারই মনে মনে স্বীকার করল-রূপসি বটে।

অধিরাজ মৃদু হেসে নিচু স্বরেই বলল-গুড ওয়ান অর্ণব।

বয়স্কা মহিলা সম্ভবত বাতব্যাধিগ্রস্ত। তাই তাঁর হাত ধরে সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি আসছে। অধিরাজ বয়স্কা নারীটিকেই নিবিষ্টমনে দেখছিল। তিনিই সম্ভবত অহল্যা জয়সওয়াল। আগের মেয়েটির নাম যদি শিনা হয়, তবে পাশের সুন্দরী তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ রাধিকা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। মেয়েটির কপালে সিঁদুর বিন্দু বা গলায় মঙ্গলসূত্র নেই! অহল্যার গাত্রবর্ণ বেশ কালো। চুল কাঁচা-পাকা। বয়েসের তুলনায় একটু বেশিই বুড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু মুখখানা অদ্ভুত। ভীষণ মমতামাখা অথচ দৃঢ়তার সঙ্গম। সবচেয়ে অদ্ভুত তার চোখ। এরকম চোখ অধিরাজ খুবই কম দেখেছে। কী যেন আছে অহল্যার চোখে! সেটা প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব, না অন্যকিছু বোঝা মুশকিল।

অহল্যা কিন্তু অর্ণব আর মিস ঘোষের দিকে ফিরেও তাকালেন না। সোজা অধিরাজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার বাংলায় বললেন- আপনিই মি. ব্যানার্জী তো? আমি অহল্যা জয়সওয়াল।

অধিরাজ মহিলার প্রতি একটা গভীর শ্রদ্ধা অনুভব করছিল। গলার স্বর তো নয়, যেন জলতরঙ্গ বাজছে। সে নমস্কার করে–আজ্ঞে। আমিই।

বসুন। অহল্যা সোফার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন। পাশের সুন্দরীর দিকে তাকিয়েছেন তিনিও রাধিকা। আমার বড় বউমা। স্কলার বায়োকেমিস্ট।

রাধিকা মৃদু হেসে নমস্কার জানায়। ওরা তিনজনেই তাকে প্রতি নমস্কার জানাল।

রাধিকা শুধু আমার বউমা নয়-ও আমার মেয়ের মতোই। আমার বড় ছেলে গৌরব অকালে ছেড়ে চলে গেলেও রাধিকা আমাদের ছেড়ে যায়নি। আমার নিজের মেয়ের তো আমাদের খেয়াল রাখার সময় নেই। রাধিকাই আমার আর বিজয়ের খেয়াল রাখে। এক হাতে ল্যাব সামলায়, অন্য হাতে সংসার। বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে সবসময়ই থাকে। এককথায় ও বিজয়ের ডান হাত। অহল্যা নিজেই এবার সোফায় আয়েশ করে বসে পড়েছেন–আপনারা দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসুন প্লিজ।

অহল্যার কথায় অধিরাজের আন্দাজটাই সঠিক প্রমাণিত হলো। রাধিকার সিঁথিতে সিঁদুর বিন্দুর অনুপস্থিতি এবং গলায় মঙ্গলসূত্রের না থাকাটাই তার ম্যারিটাল স্ট্যাটাস বলে দিয়েছিল। এখন স্পষ্ট হলো যে মেয়েটি বিধবা।

অধিরাজ অহল্যার প্রতিটি হাবভাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছিল। ভদ্রমহিলা বসুন প্লিজ কথাটা এমনভাবে বললেন যেন শুধু সামনের তিনজন নয়, গোটা দুনিয়াই তার অঙ্গুলিহেলনে বসে পড়তে বাধ্য! অদ্ভুত কম্যান্ডিং টোন। অনুরোধ নয়–অলঙ্ঘ্য আদেশ! ওরা আর কথা না বাড়িয়ে তাঁর মুখোমুখি সোফায় বসে পড়ল। অর্ণব লক্ষ করল অধিরাজ যেমন একদৃষ্টে অহল্যার দিকে তাকিয়ে আছে, তেমন অহল্যাও ওর দিকেই অনিমেষে দেখছেন। যেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরকে মেপে নিচ্ছে। মহিলা তিনজনকেই উদ্দেশ্য করে কথা বলছেন ঠিকই কিন্তু চোখ অধিরাজের ওপর থেকে সরছে না!

যে আপনাদের দরজা খুলে দিয়েছে, সে আমার ছোট বউমা শিনা। আমার ছোট ছেলে গৌতমের স্ত্রী। ও আপনাদের জন্য চা নিয়ে আসছে…।

থ্যাঙ্কস। অধিরাজ অহল্যার দিকে একটু ঝুঁকে বসে বলল–চায়ের দরকার নেই। আমরা একটু দরকারি কাজে এসেছি। কাজ হলেই চলে যাব।

অহল্যা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার কয়েকমুহূর্ত অধিরাজের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর শান্ত স্বরে বললেন–আপনার দৃষ্টিতে একটা সহানুভূতি আছে! আমার কেন মনে হচ্ছে যে আপনি কোনো দুঃসংবাদ শোনাতে যাচ্ছেন?

অর্ণব চমকে উঠল! মিস ঘোষও স্তম্ভিত। আপাতদৃষ্টিতে মহিলাকে অত্যন্ত শান্ত ও ঘরোয়া মনে হয়েছিল। অন্য পাঁচজন প্রৌঢ়ার থেকে বিন্দুমাত্রও আলাদা মনে হয়নি। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কথা শুনে প্রায় পিলে চমকে ওঠার উপক্রম।

অধিরাজ অবশ্য একটুও অবাক হয়নি। সে তখনও শান্ত, স্থির দৃষ্টিতে অহল্যার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবটা এমন–যখন বুঝেই ফেলেছেন, তখন আপনিই বলুন।

একটা পায়ের শব্দে সচকিত হয়ে অর্ণব দরজার দিকে তাকায়। শিনা একটা ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকছে। অহল্যাও তার দিকে একটা আলগা দৃষ্টিক্ষেপ করে বললেন–আমি রেগুলার টিভি দেখি। আমার একমাত্র মেয়ে সুপর্ণা ক্রাইম রিপোর্টার। তার দৌলতে সব খবরই আমরা জানতে পারি। সর্বনাশিনীর কেসটাও দেখেছি। এই মুহূর্তে তো ওটাই হেডলাইন! বিজয় জয়সওয়ালের ডেথ ফোরকাস্ট হয়েছে জেনে আমরাও শ হয়েছিলাম। কিন্তু সুপর্ণা বলেছিল যে ওটা অন্য বিজয় জয়সওয়াল। নিশান জুয়েলার্সের মালিক…! তিনি সামান্য একটু ছেদ দিয়ে ফের বলেন–তিনি বোধহয় নন্। তাই না?

অধিরাজ একটা গভীর শ্বাস টানল–না। হয়তো তিনি নন, অন্য কেউ।

উত্তরটা শুনে একটা বিষণ্ণ হাসি হাসেন অহল্যা। তাঁর দুই পুত্রবধূ রাধিকা ও শিনা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পরস্পরের মুখ দেখছে। তাদের মুখে চরম আশঙ্কার। ছাপ। অহল্যার মুখ কিন্তু অত্যন্ত শান্ত। অত্যন্ত নির্লিপ্তভাবে বললেন–আর আপনাদের সন্দেহ যে সেই অন্য বিজয় জয়সওয়াল আমার স্বামী? তাই তো?

আপনিও কি তাই সন্দেহ করেন না? সে সহানুভূতি মাখা কণ্ঠে বলে–আপনি বললেন না ডেথ ফোরকাস্ট শুনেই শ হয়েছিলেন? কেন? শহরে একাধিক বিজয় জয়সওয়াল থাকতেই পারে। তাই না? তবে শর্ল্ড হওয়ার কারণ কী?

কথা তো নয়, যেন দাবাখেলা চলছে! অন্তত অর্ণবের তাই মনে হচ্ছিল। অহল্যা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে অধিরাজের দিকে তাকিয়ে আছেন। অধিরাজ অত্যন্ত শান্ত, ধীরস্থির। সে ধৈর্য ধরে ভদ্রমহিলার উত্তরের অপেক্ষা করছে।

আপনি বয়সে আমার ছেলেদের থেকেও ছোট। হয়তো সেই কারণেই যা জানতে চাইছেন, তা জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত অহল্যাই মুখ খুললেন–আপনার প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তরই হলো না।

মানে?

বিজয় মদ্যপ লম্পট নন্। তাঁর সঙ্গে কারোর এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার ছিল না।

বিদ্যুতের মতো এসে পড়ল উত্তরগুলো। অর্ণব আর মিসেস ঘোষ হতভম্ব হয়ে তাকিয়েছিল তার দিকে। অধিরাজ মাথা নিচু করে একটু কী যেন ভাবল। তারপর বলল–তিনি তো পেশায় ডাক্তার। আপনি?

আমিও আগে ডাক্তারই ছিলাম। বিয়ের পর হাউস ওয়াইফ হয়েছি। অহল্যা সুমধুর হাসলেন–এ বাড়িতে একমাত্র বেকার লোক আমিই। রাধিকা আর সুপর্ণার কথা আগেই বলেছি। শিনা আর গৌতম–দুজনেই মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। গৌতম এখন এখানে নেই। কোম্পানির কাজে ইউ কে-তে গিয়েছে। শিনাও অষ্টপ্রহর ব্যস্ত থাকে। কখন বেরোয়, কখন ঢোকে–কিছুই ঠিক নেই। সবার মধ্যে একমাত্র আমারই কিছু করার নেই।

অধিরাজ স্পষ্ট বুঝতে পারে ঠিক যা যা সে জানতে চায় ভদ্রমহিলা সেগুলোই প্রশ্ন করার আগেই একদম নিখুঁত অঙ্ক কষে বলে গেলেন। সে হলঘরের টবের পাতাবাহারের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলে–খুব সুন্দর গাছগুলো। মেইনটেইন কে করে? মালি আছে?

না। প্রৌঢ়া মিটিমিটি হাসলেন–ওটা আমার অন্যতম শখ। গার্ডেনিং করা। দাতেও অনেক গাছ লাগিয়েছি।

সে এবার বই ভরতি শোকেসের দিকে তাকিয়েছে–বাংলা বই কে পড়ে?

ওটাও আমারই হবি। তিনি ফের অর্থপূর্ণ ভঙ্গিতে বলেন–বেকার লোকের বই আর দাবার চেয়ে ভালো সঙ্গী আর নেই। আমি অবশ্য ক্ল্যাসিক সাহিত্যই পড়ি। রাধিকা আর শিনা যত রাজ্যের ভূতের বই পড়তে ভালোবাসে। অবশ্য তেমন সময় পায় না। আমিও মাঝেমধ্যে পড়ি। আর সুপর্ণা ইংরেজি মার্ডার মিস্ট্রি ছাড়া আর কিছুই পড়ে না।

আপনি দাবা খেলেন?

হ্যাঁ। আমার ফেভারিট স্পোর্ট।

বাংলা সাহিত্য পড়েন যখন, তখন আপনি…।

অধিরাজের মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে নিয়ে বললেন তিনি বাঙালি। আমি একা নই–আমরা সকলেই বাঙালি। আমার বাপের বাড়ির টাইটেল সেনগুপ্ত। রাধিকা গুহ। আর শিনা মৈত্র। জয়সওয়ালরাও অবশ্য নামেই জয়সওয়াল। সকলেই বাঙালি হয়ে গিয়েছে। অহল্যা এবার একটু অধৈর্য–আপনাদের চা বোধহয় ঠান্ডা হয়ে গেলো।

তাঁর কথার মধ্যে আবার সেই কম্যান্ডিং টোন! অর্থাৎ এখানেই শেষ করে দিতে হবে পুলিশি জেরা। এর বেশি আর কিছু বলবেন না তিনি।

সরি। অধিরাজ অমায়িক হাসে–আজ অন ডিউটি। অন্য কোনোদিন এসে নিশ্চয়ই চা খেয়ে যাব। বলতে বলতেই সে উঠে দাঁড়ায়–ড. জয়সওয়ালের মোবাইল নম্বর আর একটা ছবি পেতে পারি কি? বুঝতেই পারছেন। জাস্ট রুটিন ফর্মালিটি।

নিশ্চয়ই। অহল্যা রাধিকার দিকে তাকিয়েছেন–তোমার বাবার ফোন নম্বর আর একটা ছবি দিয়ে দাও ওঁদের।

রাধিকা মৃদু হেসে হুকুম তামিল করতে চলে গেল। সে পেছন ফিরতেই অর্ণব ধরা গলায় বলল–ড্রাগন!

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে অধিরাজ দেখল রাধিকার পিঠের নিচে যেখানে কোমরটা চমৎকার একটা বাঁক নিয়েছে, সেখানে লাল রঙের জিভ বের করে আছে একটা ভয়ংকর ড্রাগন। বলাই বাহুল্য–ট্যাটু!

অধিরাজ হাসতেই যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই… এক্সকিউজ…ওঃ!

মোক্ষম একটা হাঁচি! সে সামলে ওঠার আগেই ফের আরেকটা! অহল্যা একটু হেসে বললেন-সর্দি লেগেছে দেখছি।

আজ্ঞে! অধিরাজ একটু বিব্রত, অপ্রস্তুত। রুমালে নাক মুছছে সে একটু ঠান্ডা লেগেছে।

একটু নয়, বেশ ভালোই। তিনি তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন–চোখ ছলছল করছে। একটু লালচে। জ্বর আসেনি তো?

না। সে সামলে নিল–ঠিক হয়ে যাবে। থ্যাঙ্কস।

অহল্যা জয়সওয়াল একটু হেসে চুপ করে গেলেন। তবু তার চোখ অধিরাজের মুখ থেকে সরল না। ভগবানই জানেন তিনি নিবিষ্ট মনে কী দেখে চলেছেন। অবশ্য অর্ণব জানে যেকোনো মেয়েই তার স্যারের দিকে তাকালে সহজে চোখ ফেরাতে পারে না। কিন্তু অহল্যার মতো প্রৌঢ়াও যে কাত হবেন সেটা জানা ছিল না।

অধিরাজের চোখ এবার শিনার দিকে সরেছে–আপনি খুব মার্ভেল কমিকস পড়েন না? সুপার হিরো ফিল্মও দেখেন নিশ্চয়ই?

প্রায় আকাশ থেকে পড়ল শিনা–না তো! কে বলল! কমিকস একদমই চলে না। সুপারহিরো ফিল্মও বোকা বোকা লাগে। তবে প্যারাসাইকোলজির ওপর খুব ইন্টারেস্ট আছে। তাই হরর ফিল্ম দেখি।

অহল্যা হাসলেন–আমাদের বাড়িতে সর্বক্ষণই হয় কনজুরিং নয় অ্যানাবেল চলছে! আর রাধিকার ফেভারিট টয় স্টোরি! ভয়ও পাবে, আবার দেখাও চাই।

অধিরাজ অর্ণবের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিপাত করল। শিনা আদৌ মাইলস মরালসকে চেনেই না! সুতরাং মাইলস মরালস্ যে কৃষ্ণাঙ্গ তা তার জানার কথাই নয়। এবং তার মুখ দেখলেই বোঝা যায় যে আদৌ সে অভিনয় করছে না।

একটু পরেই রাধিকা ড. জয়সওয়ালের ছবি ও মোবাইল নম্বর নিয়ে এল। শিনা তাদের রিসিভ করেছিল। রাধিকা তাদের বিদায় দিতে এল। অহল্যা শুধু অধিরাজকে একবার বললেন– পারলে ওষুধ খেয়ে নেবেন। জ্বর আসবে বলেই মনে হয়।

রাধিকা তাদের এগিয়ে দিতে বাড়ির বাইরে এসেছিল। অধিরাজ তাকে একা পেয়ে কোনোরকম ভণিতা না করেই জানতে চায় কিছু মনে করবেন না। আপনার হাজব্যান্ড ঠিক কীসে মারা গিয়েছিলেন?

রাধিকার সুন্দর মুখে বিষণ্ণতার ছাপ পড়ে। বুকে চিবুক ঠেকিয়ে বলল–অ্যাকিউট লিভার ড্যামেজ। অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু বাঁচানো যায়নি।

সঙ্গে রেনাল ফেইলিওরও ছিল? কিংবা মাল্টিপ্ল অর্গান ফেইলিওর?

তার স্বচ্ছ চোখের তারা একটু বিস্ফারিত হলো–আপনি কী করে জানলেন!

অধিরাজ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করে–আপনি তো সবসময়ই ড. জয়সওয়ালের সঙ্গেই থাকেন। তাঁর সমস্ত প্রোগ্রাম, মিটিং-শিডিউল সবই জানেন। তিনি ঠিক কোথায় কোথায় যেতেন? অবশ্যই হসপিটাল আর ক্লিনিক ছাড়া।

রাধিকা একটু ভেবে বলল–তেমন কোথাও তো যেতেন না। বেশিরভাগ সময়ই হসপিটাল আর ক্লিনিকেই কাটাতেন। তবে এছাড়া গোল্ডেন মুন ক্লাবে যেতেন। প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় ওখানেই কাটাতেন।

বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে?

বলতে পারব না। সে মুখ নিচু করেছে–আমি কখনো ওঁর সঙ্গে ক্লাবে যাইনি।

ড. জয়সওয়াল তো প্রত্যেক ট্যুরে আপনাকে নিয়ে যান। এবার নিয়ে যাননি কেন?

এবার রাধিকাকে একটু বিপন্ন লাগল। সে ফ্যাকাশে হেসে বলল–জানি না। বলতে পারব না!

ও কে। অধিরাজ হাসল–থ্যাঙ্কস আ লটু।

রাধিকা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। অধিরাজ আপনমনেই কিছু ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যাচ্ছিল গাড়ির দিকে। অর্ণবের তখন পেটে একরাশ প্রশ্ন গজগজ করছে। বিশেষ করে একখানা অবধারিত প্রশ্ন। সে আর থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই বসল–স্যার, তার মানে কি সর্বনাশিনীর প্রথম শিকার সঞ্জীব রায়চৌধুরী নয়? গৌরব জয়সওয়াল!

ব্রিলিয়ান্ট অর্ণব! ভেরি গুড থিঙ্কিং। সে প্রশংসামাখা দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকায়-নাইন্টিনাইন পার্সেন্ট চান্স আছে। কিন্তু ওয়ান পার্সেন্ট কো ইনসিডেন্স!

তবে? রিয়া বাজাজ বা প্রিয়া বাজাজ নয়? জয়সওয়াল ফ্যামিলির কেউ?

আমারও অবস্থা তোমারই মতো। অধিরাজ গাড়িতে ঠেস দিয়ে হাসছে–শ্রীরাধিকে চন্দ্রাবলী/ কারে রেখে কারে ফেলি! যে চারজন মিসেস জয়সওয়ালকে দেখলে তার মধ্যে সবচেয়ে কাকে অ্যাট্রাকটিভ মনে হলো?

এরকম একখানা বাউন্সারের জন্য তৈরি ছিল না অর্ণব। থতমত খেয়ে বলল–স্যার, এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ কে!

আমার কিন্তু অহল্যা জয়সওয়ালকে সবচেয়ে অ্যাট্রাকটিভ মনে হয়েছে।

অর্ণব বিস্ময়ে কী বলবে ভেবে পায় না! শেষপর্যন্ত অহল্যা জয়সওয়াল! এতগুলো অ্যাটম বোমা ছেড়ে শেষে কি না কালীপটকা!

অহল্যা সার্থক নামা। যা বলার সুন্দর বলে দিলেন। একেবারে পাথরের মতো ব্যক্তিত্ব! ড. জয়সওয়াল যে চূড়ান্ত মদ্যপ ও লম্পট ছিলেন তা তাঁর মতো কায়দা করে কেউ বলতে পারত না।

এবার মিস্ ঘোষ মুখ খুললেন–কিন্তু তিনি তো তেমন কিছুই বললেন না।

বলেছেন বইকি! অধিরাজ ঠোঁট টিপে হাসল–শুরুতেই তিনি দুঃসংবাদের আশঙ্কা করলেন। তারপর স্পষ্ট জানালেন যে টিভিতে বিজয় জয়সওয়ালের ডেথ ফোরকাস্ট শুনে তিনি শড হয়েছিলেন। সর্বনাশিনীর ভিকটিম কারা এবং তারা কী ধরনের সেটা তিনি জানেন। তাঁর স্বামী ধোয়া তুলসীপাতা হলে তিনি শল্ডই বা হবেন কেন? দুঃসংবাদের আশঙ্কাই বা করবেন কীসের জন্য?

তবে কি স্যার জয়সওয়াল ফ্যামিলির কেউ…?

অসম্ভব নয় হোরেশিও। অধিরাজ ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলল–কাউকেই ছাড়া যাচ্ছে না। গৌরব জয়সওয়ালের মৃত্যুটাও স্বাভাবিক কি না কে জানে! এখন সেটা আর বের করা যাবে না।

কথাটা বলতে বলতেই সে একটু অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায়। অর্ণব শুনতে পেল অধিরাজ আপনমনেই বলছে–খবরিদের অ্যালার্ট করে দাও অর্ণব। এই পরিবারটার ওপরে একটু নজর রাখা দরকার। আমার মনে হয় অহল্যা জয়সওয়াল একজন রীতিমতো প্রতিভাশালিনী খুনি হতে পারেন।

অর্ণব বিস্ময়ের ধাক্কায় কী বলবে ভেবে পায় না।

*

মিসেস অহল্যা জয়সওয়াল স্যার?

মিস ঘোষের বিস্ময়মাখা প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল অধিরাজ। তারপর বলল–কেন নয়? মহিলার রূপটাকে ইগনোর করে একবার তার চরিত্রটা দেখুন। অসম্ভব ঠান্ডা মাথার মানুষ। স্বামীর জন্য কোনো আশঙ্কা, কোনো ভয় তার মুখে দেখেছেন? তিনি বঙ্কিম, শরৎ, রবীন্দ্রসাহিত্য পড়েন। দাবাও খেলেন। অত্যন্ত চতুর। তিনি যে উত্তরগুলো দিয়েছেন সেগুলো একদম আগে থেকেই ভেবে রাখা। নিখুঁত অঙ্ক কষে তৈরি করা উত্তর। একটুও বেশি নয়, একটা শব্দও কম নয়। যেন আগে থেকেই জানতেন, আমি ঠিক কী জানতে চাইব। এরকম একজন মানুষকে সন্দেহ করব না?

বিজয় জয়সওয়ালের ঘর সার্চ করতে বললেন না তো! তার গাড়িটাকে কি খুঁজব না আমরা?

পণ্ডশ্রম। সে ভাসা ভাসা অন্যমনস্ক চোখে তাকায়–খুনি অত সহজে ধরা দেওয়ার লোক নয়। কাল সারাদিন বুনোহাঁসের পেছনে দৌড়ে দৌড়ে একটা কথা বুঝেছি। যিনি নেপথ্যে বসে এই কাণ্ডগুলো করছেন, তাঁর মস্তিষ্কটি বাঁধিয়ে রাখার মতো। নয়তো সঞ্জীব রায়চৌধুরী, অর্জুন শিকদার আর নিশান জুয়েলার্সের মালিক বিজয় জয়সওয়ালের গাড়ি অমন বেবাক ভ্যানিশ হয়ে যায়! আকাশে গেল না পাতালে–জানাই যাচ্ছে না! সুতরাং বাধা গতে তাকে ঘায়েল করা অসম্ভব।

লোকটাকে একবার দেখুন স্যার। কী বদখত দেখতে! এরকম লোকের মরাই উচিত।

গাড়িতে উঠে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিল অর্ণব। অহল্যা জয়সওয়াল সম্পর্কে অধিরাজের মন্তব্য শুনে কয়েকমুহূর্ত থম্ মেরে ছিল। এখন ড. বিজয় জয়সওয়ালের ছবিটা দেখে বলে ওঠে–ঠিক যেন একটা থলথলে সিল! ওর মুখ দেখলেই বোঝা যায়–লোকটা একনম্বরের বজ্জাত!

অধিরাজ গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল–তুমিও তো ড. চ্যাটার্জীর মতো কথা বলতে শুরু করলে দেখছি! লোকের মুখ দেখেই যদি চরিত্র বোঝা যেত তবে পুলিশের সবার আগেই ড. চ্যাটার্জীকে গ্রেফতার করা উচিত। কিন্তু সুন্দর মুখের পেছনেও একটা নৃশংস খুনি থাকতে পারে। অহল্যা জয়সওয়ালকে সন্দেহ করছি, তার মানে এই নয় যে তার সুন্দরী পুত্রবধূরা খুনি হতে পারে না।

অর্ণবের চোখের সামনে শিনা আর রাধিকার অপূর্ব সুন্দর মুখ ভেসে ওঠে। সে জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে অধিরাজের দিকে তাকায়।

আমরা রিয়া আর প্রিয়া বাজাজের অ্যাঙ্গেল নিয়ে আগেই ডিসকাস করেছি। এবার আরেকটা অ্যাঙ্গলও দেখে নাও। অধিরাজ গাড়িটাকে ড. জয়সওয়ালের বাড়ির লোহার গেটের বাইরে বের করে এনেছে–ড. জয়সওয়াল, যার রীতিমতো লম্পট হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাঁর বাড়িতে দু-দুটি যৌবনবতী নিখুঁত সুন্দরী পুত্রবধূ! তার মধ্যে একজন আবার বিধবা। আর কী অদ্ভুত ব্যাপার দেখো, সুন্দরী বিধবা পুত্রবধূটিকে নিয়েই তিনি আবার ট্যুরে যান! ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হয়নি তোমার?

রাধিকা জয়সওয়ালের সঙ্গে বিজয় জয়সওয়ালের কোনো সম্পর্ক? মানে শ্বশুর ও বউমার মধ্যে প্রেম?

এমনই হয়েছে তা বলিনি। তবে সম্পূর্ণ সম্ভাবনা আছে। আমি পসিবিলিটির কথা ভাবছি। এমনও হতে পারে রাধিকাকে ড. জয়সওয়াল ব্যবহার করছিলেন। সুতরাং সে বিরক্ত হয়ে শ্বশুর কে যমালয়ে পাঠাতে চাইতেই পারে। অধিরাজ অর্ণবের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল–ঠিক একই কারণে শিনা জয়সওয়ালও খুন করতে পারে। হয়তো ড. জয়সওয়ালের নাল্পে সুখমস্তি! রাধিকাকে ছেড়ে শিনার দিকে হাত বাড়াতে পারেন। খেপে গিয়ে হয়তো শিনাই শ্বশুশ্রমশাইকে একেবারে স্বর্গে ট্রান্সফার করার তাল করেছে। আবার দুই পুত্রবধূর সঙ্গে লম্ব করার জন্য অহল্যা জয়সওয়াল অসহ্য হয়ে স্বামীকে পটলক্ষেত দেখাতেই পারেন! সব মিলিয়ে এমনও হতে পারে যে এত কাণ্ড-কীর্তি শুধু বিজয় জয়সওয়ালকে মারার জন্যই করা হয়েছে! তিনিই আসল টার্গেট! তার আগে সঞ্জীব রায়চৌধুরী আর অর্জুন শিকদার শুধুমাত্র সর্বনাশিনীর সিরিয়াল কিলিং ইমেজকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই মারা পড়েছেন।

কিন্তু এরা কেউই বটানিস্ট নন।

তাতে কী? সে বলল–অহল্যা জয়সওয়াল অতীতে ডাক্তার ছিলেন। বিষ এবং তার প্রতিক্রিয়া, ডোসেজ- এসব জানেন নিশ্চয়ই। শিনা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। তারও নির্ঘাৎ ফার্মাসিতে ডিগ্রি আছে। এম ফার্ম বা বি ফার্ম। সেবিষ সম্বন্ধে জানতেই পারে। অন্তত রোহিপ্ন জাতীয় নানারকম ড্রাগের সম্বন্ধে ভালো জ্ঞান তো আছেই।

কিন্তু রাধিকা? সে তো বায়োকেমিস্ট!

বায়োকেমিস্ট ঠিকই। অধিরাজ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল–কিন্তু কোন ফিল্ডে কাজ করে সেটা জানো কি? অহল্যা বলেছিলেন রাধিকা ল্যাব সামলায়। কীসের ল্যাব সামলায় সে? বায়োকেমিস্ট্রিতেএকটা ফিল্ড আছে যাকে টক্সিকোলজি বলে। সেখানে নতুন নতুন বিষের ওপর ইনভেস্টিগেশন আর তার অ্যান্টিডোট তৈরি করা হয়। আমাদের কেসে বিষটা কী, এখনও ফরেনসিক বুঝতেই পারছে না! সুতরাং সেটা নতুন কোনো বিষ হওয়ার চান্সই বেশি। এক্ষেত্রে রাধিকা যদি টক্সিকোলজির সঙ্গে যুক্ত হয় তবে হাতের কাছে নিত্যনতুন বিষ পাওয়ার সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না।

অর্ণবের মাথা বো বো করতে শুরু করেছে। এরকম কনফিউশনে কনফুসিয়াস সে কখনো হয়নি। মানসী জয়সওয়াল বটানিস্ট, অহল্যা ডাক্তার, রাধিকা টক্সিকোলজিস্ট কি না কে জানে, শিনা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ! এরা সবাই খুনি হতে পারে। এদিকে রিয়া বাজাজ আর প্রিয়া বাজাজকেও ছাড়া যাচ্ছে না। তারাই বা কী খিচুড়ি পাকিয়ে বসে আছে কে জানে! অন্যদিকে ড. বিজয় জয়সওয়ালের টিকিটির খোঁজও পাওয়া যাচ্ছে না! লোকটা কি আদৌ বেঁচে আছে! তদন্ত যে এখনও সম্পূর্ণ অন্ধকারে।

তার মনের অবস্থা আন্দাজ করেই অধিরাজ রহস্যময় হাসল–সব গুলিয়ে যাচ্ছে নাকি অর্ণব? তাও তো আমাদের জয়সওয়াল ফ্যামিলির খুনি শ্ৰী উপাধি পাওয়ার যোগ্য আরেকটি দাবিদারকে এখনও দেখোনি!

অর্ণব আবার বিষম খেল–আরও একজন আছে!

অফকোর্স। ড. জয়সওয়ালের মেয়ে সুপর্ণা জয়সওয়ালকে তো আমরা দেখিইনি। তিনি আবার ক্রাইম রিপোর্টার! অপরাধীর কাজগুলো দেখো। স্পষ্টই বোঝা যায় যে পুলিশের প্রত্যেকটি পদক্ষেপ সে আগে থেকেই জানত। আমরা ডিপার্টমেন্টের লোকের কথা ভাবলাম, ক্রাইম শোর দর্শকের কথা ভাবলাম, কিন্তু ক্রাইম রিপোর্টারের কথা ভাবিনি! অথচ একজন ক্রাইম বিটের জার্নালিস্ট পুলিশের গতিবিধি, তদন্ত পদ্ধতি সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানে! নিজের পেশার খাতিরে প্রচুর কেস স্টাডি করেছে সে। পুলিশের প্রত্যেকটি পদক্ষেপ নিজের চোখে দেখেছে। ক্রাইম স্পটে সবসময়ই তার উপস্থিতি অনিবার্য। ক্রিমিনোলজি সে গুলে খেয়েছে। এইরকম একজনের সঙ্গে খুনির চরিত্র যথেষ্টই খাপ খায়।

তাহলে তার সঙ্গেও তো দেখা করা দরকার ছিল।

দরকার নেই। অধিরাজ সামনের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচায়–যদি আমার ভুল না হয় তবে ঐ তিনি আসছেন! সামনের সিংহবাহিনীকে দেখো।

গাড়িটা ড. বিজয় জয়সওয়ালের বাড়ি থেকে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল। অর্ণব দেখল উলটোদিক থেকে একটা সিংহের মতো তাগড়াই বাইক আসছে। তার ওপরে বসে আছে এক শক্তপোক্ত চেহারার কৃষ্ণাঙ্গী। সে চমকে ওঠে। এ তো সেই কৃষ্ণাঙ্গী রিপোর্টার! যে জিজ্ঞেস করেছিল–বিজয় জয়সওয়ালের ডেথ ফোরকাস্টটা প্র্যাঙ্ক কি না!

আরে! এই মেয়েটা! বিস্ময়ের পাহাড় ভেঙে পড়ল অর্ণবের মাথায়–এ তো সেই হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল না?

কোনো সন্দেহ নেই তিনিই। সে মুচকি হাসল–ড, বিজয় জয়সওয়ালের কন্যে। বাপের চেহারার সঙ্গে যথেষ্টই মিল আছে।

মিস্ ঘোষ উত্তেজিত–ধরব স্যার?

একদম না। সে গাড়িটাকে সাইড করতে করতে বলল–জাস্ট একটু দেখে আসুন তিনি কোথায় ঢুকছেন। অর্থাৎ ড. জয়সওয়ালের বাড়িতেই ঢুকছেন কি না।

ও কে স্যার।

বাইকটা সবেগে গাড়িটাকে কাটিয়ে গেল। মিস ঘোষ যেন সেই অপেক্ষাতেই ছিলেন। সে চলে যেতে না যেতেই তড়াক করে গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে চিতাবাঘের মতো ক্ষিপ্র গতিতে তার পেছনে দৌড়ালেন। অধিরাজ সামনের আয়নাতে তার চেজ দেখে প্রশংসায় চোখ নাচায়–একদম লেপার্ড! পুরো বাঘিনী!

কমপ্লিমেন্টটা শুনে অর্ণবের মুখ হাঁড়ি হয়ে যায়। অধিরাজ তার ভাবান্তরটা লক্ষ করে কুলকুল করে হেসে ফেলল। হাত বাড়িয়ে তার পিঠ চাপড়ে দিল সে তোমার চান্স এখনও আসেনি বস। নয়তো তুমিও কিছু কম যাও না।

অধিরাজের স্পর্শ পেয়ে অর্ণব আশ্বস্ত হওয়ার বদলে আঁতকে ওঠে–এ কী! আপনার তো জ্বর হয়েছে!

তা একটু হয়েছে। অধিরাজ হাত সরিয়ে নিয়ে বলল–চিন্তার কিছু নেই। দুই-একটা প্যারাসিটামল পড়লেই ঠিক হয়ে যাবে।

একটু জ্বর! যেভাবে শার্টের ওপর দিয়েই গায়ে হ্যাঁৎ করে উঠল, তাতে কমসে কম একশ দুই ফারেনহাইট তো হবেই। এমনকি তার চেয়েও বেশি হলেও অবাক হবে না অর্ণব। তার মুখে চিন্তার ছাপ পড়ে। যেভাবে কাল সারাদিন জল ঘেঁটেছে অধিরাজ তাতে পবিত্র আচার্যর কথাই না সত্যি হয়! সত্যিই মাঝেমধ্যে এমন কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে না লোকটা!

আপনি আজ রেস্ট নিন স্যার। অর্ণব সস্নেহে বলে–আমরা আপনার কথামতো তদন্ত চালিয়ে যাব।

হবে না। সে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল–রুটিন ইনভেস্টিগেশনে কিছু হবে না। কিছু হওয়ার নয়। প্রায় আটানব্বই ঘণ্টা হতে চলল আমরা ইনভেস্টিগেশন করছি। আটানব্বই ঘণ্টা অর্ণব! এর মধ্যে ঠিকুজি কুলুজি সহ ক্রিমিনাল ধরাও পড়ে যায়। কিন্তু আমরা একটা গাড়িই খুঁজে পাচ্ছি না!

নিশ্চয়ই পাবো। অর্ণব মৃদু স্বরে বলল–একটা আস্ত গাড়ি তো লোপাট হয়ে যেতে পারে না! অবশ্য যদি হিস্ট্রিশিটারগুলো মিথ্যে না বলে থাকে।

মিথ্যে বলছে না। অত টর্চারের পরও যখন মুখ খুলছে না, তখন হয়তো সত্যিই কিছু জানে না। অধিরাজ কী যেন ভাবছে–অন্য কিছু ভাবতে হবে। খুনি গাড়িগুলোকে ডাম্প করেছে তো বটেই। কিন্তু কোথায়? কোথায় হতে পারে? সে যেভাবে একটার পর একটা অদ্ভুত স্টেপ নিচ্ছে, নির্ঘাৎ ইউনিক কিছুই ভেবেছে। আমি এখানেও একটা চমক আশা করছি। কিছু টুইস্ট তো নির্ঘাৎ আছে।

অর্ণব অনেক ভেবেও বুঝতে পারল না যে এর মধ্যে কী টুইস্ট থাকতে পারে! গাড়ি ডাম্প করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো কোনো গ্যারাজে দিয়ে দেওয়া, অথবা মাঠেঘাটে ফেলে রাখা। শেষ সম্ভাবনা কোনো জলাশয়ে ফেলে দেওয়া।

সে কথা বলতেই অধিরাজ বলল–ওসব পরিচিত পাঁয়তারা কষেনি সে। এমন কিছু করেছে যেটা হয়তো সাধারণ ভাবনা চিন্তার বাইরে। আমি যদি তার জায়গায় থাকতাম তবে কী করতাম! তবে কী এমন করতাম যাতে পুলিশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও গাড়িটাকে পেত না! …কী করতাম…!

বলতে বলতেই সে চোখ বুজল। ড্রাইভারের সিটে দীর্ঘ দেহটাকে এলিয়ে দিয়েছে। অর্ণব দেখল তার কপালে চিন্তার রেখা। জ্বরের তাড়সে নাক আর গাল সামান্য রক্তাভ। চোখের দীঘল পল্লব গুচ্ছ স্থিরভাবে নেমে এসেছে। ঠোঁট দুটো অল্প অল্প নড়ছে, যেন কিছু বলছে। এই ভঙ্গি চিরপরিচিত অর্ণবের। অধিরাজ এখন মনে মনে কিছু ভাবছে। তার মন এখন অজ্ঞাত অপরাধীকে তাড়া করছে। তাকে বোঝার চেষ্টা করছে। একটা অধরা হিসাবকে মেলানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলছে তার মনে। কী ভাবে, কী করে, কোন প্রক্রিয়ায়–ইত্যাদি প্রশ্ন ক্রমাগতই উঠে আসছে। এতগুলো আস্ত গাড়ি লোপাট হয়ে যায় কী করে?…কোথায় থাকতে পারে…? মাটিতে নয়, জলে নয়, গ্যারাজে নয়, স্মাগ্লড় ও হয়নি–তবে?…কোথায় আছে…? কোথায়…?

ভাবতে ভাবতেই তার মস্তিষ্কের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যায়। সে ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসে উত্তেজিত স্বরে ডাকল–অর্ণব।

স্যার।

সে অর্ণবকে আরও কিছু বলার আগেই মিস্ ঘোষ দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরে এসেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–বাইকটা ড. জয়সওয়ালের বাড়িতেই ঢুকেছে। আপনার সন্দেহ সঠিক। তিনিই সুপর্ণা জয়সওয়াল।

অধিরাজ মাথা ঝাঁকায়। এই সন্দেহটা তার আগেই হয়েছিল। এখন দেখা গেল ধারণাটা সম্পূর্ণ সঠিক। এখন যে সন্দেহটা এই মুহূর্তে সে করছে, তাও

সঠিক প্রমাণিত হয় কি না সেটাই দেখার।

থ্যাঙ্কস্। অধিরাজ হাত বাড়িয়ে ডোর লক্‌ খুলে দেয়–উঠে আসুন। এখন আমাদের অনেক কাজ বাকি। মনে হচ্ছে সঞ্জীব রায়চৌধুরী আর অর্জুন শিকদারের গাড়ি খুঁজে না পেলেও দুই বিজয় জয়সওয়ালের গাড়ি খুঁজে পেলেও পেতে পারি।

অর্ণব কথাটা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। অধিরাজ এত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাটা বলল যে সে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে। এত খোঁজাখুঁজির পরও যা মিলল না–এখন তা পাওয়া যাবে! কিন্তু কী করে? আকাশ থেকে নেমে আসবে না পাতাল ফুড়ে?

অধিরাজ গাড়ি স্টার্ট করতে করতে আপনমনেই বলল–জিনিয়াস! জিনিয়াস!

কিছুই তো বুঝলাম না। অর্ণব অবাক–এখন কোথা থেকে পাওয়া যাবে গাড়িগুলো!

সে গাড়ি চালাতে চালাতেই মিটিমিটি হাসছে–এতক্ষণ সেই প্রশ্নটাই নিজেকে করছিলাম। গাড়িগুলো ঠিক কোথায় যেতে পারে! ইনফ্যাক্ট আমি তার জায়গায় থাকলে গাড়িগুলো কোথায় ডাম্প করতাম যাতে সেগুলো পুলিশ খুঁজে না পায়।

কোথায়? মিস্ ঘোষ কৌতূহলী–এমন কোনো জায়গা আছে?

আছে বইকি! সে হেসে বলে–ধরো পুলিশ কোনো ক্রিমিনালের জন্য উঠে পড়ে তল্লাশি চালাচ্ছে। লোকটা মৃত নয়। শহরের বাইরে কোথাও যায়নি। প্রতিটা টোল-নাকা, প্রতিটা ট্র্যাফিক সিগন্যালে পুলিশি পাহারা বসে গিয়েছে। বাসস্ট্যান্ডে, স্টেশনে, এয়ারপোর্টে সাদা পোশাকের পুলিশ রাউন্ড দিচ্ছে। প্রত্যেকটা লজে, প্রত্যেক হোটেলে পুলিশের শ্যেন চক্ষুর নজরদারি। খবরিরা তার ফটো সাকুলেট করে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তবুও লোকটাকে পাওয়া গেল না!

তা কী করে সম্ভব! অবশ্য যদি না লোকটা ইতোমধ্যেই ছাই হয়ে যায়, বা কয়েক ফুট মাটির নিচে কেত মেরে পড়ে থাকে!

অর্ণবের কথায় হেসে ফেলল অধিরাজ–সম্ভব। কারণ পুলিশ সর্বত্রই দেখেছে, শুধু একটি জায়গা ছাড়া।

কোথায়? অর্ণব ও মিস্ ঘোষ একসঙ্গেই প্রশ্নটা করে বসল।

স্বয়ং পুলিশের লক্-আপ! সে মাল হয়তো অন্য কোনো ছুটকো ছাটকা কেসে বেনামে গ্রেফতার হয়েছে। শুধু কলকাতা পুলিশেরই আন্ডারে প্রায় সত্তরটার মতো থানা! গোটা পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলায় কয়টা হবে ভাববা! এখন সমস্ত পুলিশ স্টেশনের পক্ষে তো আর সব রেকর্ড, সব আসামিকে মনে রাখা সম্ভব নয়। এক একদিনে গুচ্ছ গুচ্ছ ফাইল জমা পড়ছে। একসঙ্গে আর কত মনে রাখবে! সুতরাং মিস-কমিউনিকেশনের সম্ভাবনা প্রবল। হয়তো যে মুহূর্তে ব্যাটার হুলিয়া জারি হয়েছে, তার অনেক আগেই তিনি অন্য একটা কেসে, অন্য কোনো পরিচয়ে অন্য এরিয়ার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। পুলিশ যখন বাইরে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে, তখন তিনি শ্রীঘরে বসে মহা আরামে জেলের লাপসি খাচ্ছেন।

তার মানে গাড়িগুলো অন্য কোথায় যায়নি! অর্ণব চোখ কপালে তুলে ফেলেছে–খোদ পুলিশের হেফাজতেই আছে।

ব্রাভো অর্ণব। সে সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকায়–ব্রিলিয়ান্ট ডিডাকশন। পুলিশের হেফাজতে আছে বলেই পুলিশ খুঁজে পায়নি। তারা বাইরে খুঁজেছে। কিন্তু ভাবতেই পারেনি যে আসামি স্বয়ং তাদেরই ঘরে বসে আছে! তুমি নিশ্চয়ই জানো পুলিশ শহরের পঁচিশটারও বেশি অ্যাকসিডেন্ট প্রোন জায়গায় নাইট সার্জেন্ট সিস্টেম রিক্রুট করেছে। আজকাল রাত্রে ড্রিঙ্ক অ্যান্ড ড্রাইভের জ্বালায় কলকাতা পুলিশকে ঠিক রাত এগারোটা থেকে ভোর পাঁচটা অবধি নাইট সার্ভেইলেন্স অ্যাকটিভ করতে হয়েছে। আর লক্ষ করে দেখো, সঞ্জীব রায়চৌধুরী, অর্জুন শিকদারও রাতেই হাওয়া হয়েছেন। জুয়েলার বিজয় জয়সওয়ালের গাড়ি ঠিক চারটে নাগাদ গেট দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ড. বিজয় জয়সওয়ালও রাতেই বেরিয়েছিলেন। অহল্যা জয়সওয়ালের পার্সোনাল নম্বরটা আছে না? ফোন করে জেনে নাও যে ভদ্রলোক ঠিক কখন বেরিয়েছিলেন।

গাড়ির মডেল আর নম্বর? সে সোৎসাহে প্রশ্ন করে।

দরকার নেই। অধিরাজ একটা বাম্পারকে খুব মসৃণভাবে কাটাল– ছবিতে ভদ্রলোকের ঠিক পেছনেই গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্টিল কালারের হোন্ডা সিটি। নম্বরটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

ও কে।

অর্ণব তৎক্ষণাৎ অহল্যাকে ফোন করল। প্রশ্নটা শুনে তিনি বিস্মিত হয়েছেন কি না বোঝা গেল না। বরং বেশ নির্লিপ্তভাবেই জানালেন যে ড. জয়সওয়াল রাত বারোটায় বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর নাকি রাত তিনটের ফ্লাইট ছিল।

কথাটা অধিরাজকে বলতেই সে স্টিয়ারিঙের ওপর একটা চাপড় মেরে বলল–আই নিউ ইট! নিউ আলিপুর এরিয়ার মধ্যে ও আশেপাশে যতগুলো পুলিশ স্টেশন আছে, সবগুলোয় খুঁজব। আমার দৃঢ় ধারণা পাওয়া যাবে। সেম কেস জুয়েলার বিজয় জয়সওয়ালের ক্ষেত্রেও। বালিগঞ্জ এলাকার মধ্যে বা আশেপাশের কোনো পুলিশ স্টেশনেই নির্ঘাৎ দাঁড়িয়ে রয়েছে গাড়িটা। আমরা সব জায়গা খুঁজেছি, শুধু পুলিশ স্টেশনগুলোতেই খুঁজিনি।

কিন্তু রাতেই বেরোতে হবে কেন?

সিম্পল। রাতে লোকের চোখে ধরা পড়ার চান্স কম। অধিরাজ উত্তর দেয়–ধরো রাতের অন্ধকারে কোথাও একটা অ্যাক্সিডেন্ট হলো। অ্যাক্সিডেন্ট মানে কোনো মানুষ মারার কেস নয় কিন্তু। এমন অ্যাক্সিডেন্ট যেটা অন্য কারোর দেখার চান্স নেই। যেমন কোনো গাছে ঠুকে দেওয়া, বা ডিভাইডারে, ল্যাম্পপোস্টে জোরে ধাক্কা খাওয়া। এইরকম। কারণ গাছ বা ল্যাম্পপোস্ট তো সাক্ষী দিতে যাবে না। বলাই বাহুল্য সেখানে সিসিটিভি নেই বা সিসিটিভি থাকলেও তার রেঞ্জের সামান্য বাইরে অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটেছে। গাড়িটাকে ফেলে ভয়ের চোটে চালক ধা। সুনসান রাস্তায় কেউ দেখার বা শোনার নেই। এবার যেহেতু রাতের বেলায় ট্রাফিকের বালাই নেই–১১টা থেকে ৫টার মধ্যে নাইট সার্জেন্ট সিস্টেম আর নাইট সার্ভে ইলেন্স অ্যাকটিভ আছে, সেহেতু গাড়িটা খুব তাড়াতাড়িই পুলিশের নজরে পড়তে বাধ্য। এবার পুলিশ এসে দেখল যে একটা ড্যামেজ কার দাঁড়িয়ে আছে! চালক নেই, কাগজপত্র নেই, এমনকি হয়তো নাম্বারপ্লেটও নেই। পুরো বেওয়ারিশ! পুলিশ তখন কী করবে?

গাড়িটাকে তখনই সিজ করবে। নিয়ে থানায় দাঁড় করিয়ে রাখবে। ওটা আস্তে আস্তে গাড়ির ভিড়ে হারিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত যদি কেউ ক্লেম না করে তবে হয় বিদ্যাসাগর সেতুর কাছের ডাম্পইয়ার্ডে ডাম্প করবে, নয়তো একটু বেটার কন্ডিশনে থাকলে অকশনে বেচে দেবে…। অর্ণব বলতে বলতেই থেমে গেল–কী সর্বনাশ! এই তত মাসখানেক আগেই একটা অকশন করল কলকাতা পুলিশ! সেজন্যই আপনি বলছিলেন যে সঞ্জীব রায়চৌধুরী আর অর্জুন শিকদারের গাড়ি পাওয়া যাবে না!

দুরন্ত! একদম ঠিক রাস্তাতেই ভাবছ। অধিরাজ সপ্রশংস দৃষ্টিপাত করে–সম্ভবত ঐ অকশনেই বেরিয়ে গিয়েছে সঞ্জীব আর অর্জুনের গাড়ি। এখন ভোল-টোল পালটে, নম্বর পালটে অন্য কাউকে সার্ভিস দিচ্ছে গাড়িগুলো। ওগুলোকে আর পাওয়া সম্ভব নয়। তবে দুই বিজয় জয়সওয়ালের গাড়ি পাওয়া যাবে। এই জন্যই রাতের অন্ধকার দরকার ছিল। প্রথমত, অ্যাক্সিডেন্ট করে পালিয়ে যাওয়া সহজ। দ্বিতীয়ত, রাতের বেলায় পুলিশ খুব তাড়াতাড়িই গাড়িগুলোকে সিজ করে বিনা বাধায় থানায় পাঠিয়ে দেবে। দিনের বেলায় সেটা সম্ভব নয়। তখন ট্রাফিকের ভিড় থাকে। ঐ একটা গাড়ির জন্যই হয়তো অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে যাবে। তোক জানাজানি হবে। অনেক লোক গাড়িটাকে পড়ে থাকতে দেখত। সেটা সর্বনাশিনী কী করে হতে দিতে পারেন?

কিন্তু স্যার… অর্ণবের ধন্দ তখনও কাটে না–মানলাম গাড়িগুলো সিসিটিভির আওতায় আসার আগেই অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে। এখনও শহরের সর্বত্র সিসিটিভি নেই। জুয়েলার বিজয় জয়সওয়ালের বাড়ি থেকে ফার্স্ট সিসিটিভিটা বেশ দূরে। ড. বিজয় জয়সওয়ালের বাড়ি থেকেও যতখানি দূরত্ব, তার মধ্যেই অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া সম্ভব। কিন্তু পুলিশ তো গাড়িটাকে সিজ করে ব্রেক-ডাউন ভ্যানে করে টেনে নিয়ে তো যাবে। টেনে নিয়ে গেলে দেখতে পাব না? আমরা তো নাইট ফুটেজও দেখেছি।

দেখতে তখনই পাবো যখন গাড়িটা টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। অধিরাজের কপালের ওপরে একগোছা চুল এসে পড়েছিল। মাথা সামান্য ঝাঁকিয়ে সেটাকে যথাস্থানে পাঠিয়ে জবাব দিল সে–কিন্তু গাড়িটা তখনই টেনে নিয়ে যাওয়া হবে যখন ওর অন্তত দুটি চাকা অক্ষত থাকবে। আমার মনে হচ্ছে এক্ষেত্রে গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, বা টেনে নিয়ে যাওয়া হয়নি। ওর চারটে চাকাই পাংচার হয়ে গিয়েছিল। তাই ব্রেক-ডাউন ভ্যানে নয়, পাঞ্জাব বডি ভ্যানে তুলে ঢেকেঢুকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আরেকটা গাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে গেলে সিসিটিভি ধরবে কী করে? এবং যেখানে স্বয়ং পুলিশই গাড়িটাকে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে কারোর বাপের সাধ্য নেই যে সন্দেহ করে।

অর্ণবের মুখটা পুরো হাঁ হয়ে যায়! কী ভয়ংকর প্ল্যান বানিয়েছে অপরাধী। পুলিশের ঠিক চোখের সামনেই রয়েছে গাড়িটা। হয়তো গত কয়েকদিন ধরেই কোনো থানার বাইরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ পুলিশ সেই গাড়িটাকেই কী গরু খোঁজাটাই না খুঁজেছে! ভাবতেই পারেনি যে গাড়িটা আর কোথাও নয়–তাদের হেফাজতেই রয়েছে। সঞ্জীব রায়চৌধুরী এবং অর্জুন শিকদারের গাড়ি দুটো অজান্তেই হয়তো তারাই অকশনে তুলে দিয়েছে।

পুলিশেরও দোষ নেই! অধিরাজ অর্ণবের মনের কথা বুঝতে পেরে হাসল–ঐ যে বললাম, অনেক সময়ই মিস কমিউনিকেশনের কেস হয়। সঞ্জীব রায়চৌধুরী আর অর্জুন শিকদারের মৃত্যুর পর পুলিশ গাড়ি দুটোকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়েছে। কিন্তু মোস্ট ব্যাবলি তার অন্তত বারো থেকে তেরোদিন আগেই গাড়ি দুটো পুলিশি হেফাজতে চলে গিয়েছিল। তখনও সর্বনাশিনীর কেসটা ওদের চোখে পড়েনি। তাই তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এবারও জুয়েলার বিজয় জয়সওয়াল যেদিন নিখোঁজ হন, সম্ভবত সেদিনই তার গাড়িটা সিজড় হয়েছে। আমরা খবর পেয়েছি তার দশদিন পরে। স্বাভাবিকভাবেই তখন থেকেই পুলিশ অ্যালার্ট হয়েছে। বাইরে খুঁজেছে। তাদের মাথাতেই আসেনি অপরাধী এরকম ভয়ংকর চাল চেলে বসে আছে। শহরে প্রত্যেকদিনই গুচ্ছ গুচ্ছ গাড়ি সিজ করা হয়। সিজড় কার কলকাতা পুলিশের কাছে একরকম হেডেক। একটি বিশেষ গাড়িকে নিয়ে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। তারা স্বাভাবিকভাবেই সিজড় কারের মধ্যে খোঁজেনি। আর ড. বিজয় জয়সওয়ালের গাড়ির খোঁজও পড়েনি। আমরাও কি ভেবেছিলাম যে এরকম কিছুও হতে পারে!

এ তো সব ভাবনাচিন্তার ঊর্ধ্বে খেলছে স্যার! শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল অর্ণব-ইনফ্যাক্ট আমাদেরও মাথায় আসেনি!

জিনিয়াস লেভেলের অপরাধী। সে বিড়বিড় করে–সিমপ্ল জিনিয়াস। একদম দাবার মতো করে চাল দিচ্ছে। এ পাবলিক নির্ঘাৎ দাবা খেলে।

সেটা আবার কী করে বোঝা গেল! অর্ণব ও মিস ঘোষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। অধিরাজ মৃদু হাসল-একজন ভালো খেলোয়াড়ের নিয়ম হচ্ছে সবসময়ই প্রতিপক্ষের চাল বুঝে যাওয়া। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ কী চাল দিতে পারে, কোন স্ট্রাটেজিতে আক্রমণ করবে–সবটাই ভালো করে বুঝেশুনে খেলা। প্রতিপক্ষ কী ভাবছে, কী করতে পারে–সেটা আগে থেকেই বুঝে নিয়ে পরপর চাল রেডি করে রাখা। ক্রাইমের প্যাটার্নটা দেখো। অবিকল সেভাবেই এগোচ্ছে খুনি। আমি খুব আশ্চর্য হব না যদি খুনি একজন এক্সপার্ট দাবাড় হয়!

রিয়া বাজাজ বা প্রিয়া বাজাজ নিশ্চয়ই দাবা খেলতে জানে।

অর্ণব কোন লাইনে ভাবছে সেটা বুঝতে পেরেই শ্ৰগ করল সে–প্রখ্যাত দাবাড়ুর মেয়ে যখন, তখন সে সম্ভাবনাটাকেও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। বাপের গুণ মেয়ের মধ্যে থাকতেই পারে। আবার অহল্যা জয়সওয়ালও দাবা খেলেন! মানসী জয়সওয়ালের ঘরেও একটা চেসবোর্ড দেখেছি আমি।

অর্ণব বুঝল এবার আর ছড়িয়ে ছিয়াশি নয়–ছড়িয়ে ছশো হলো! কোথায় রিয়া বাজাজ বা তার দিদি প্রিয়া বাজাজ! কোথায় জয়সওয়াল পরিবার! আর কোথায় মানসী জয়সওয়াল! লিঙ্কের মা-মাসি এক হয়ে যাচ্ছে যে!

আরেকটা লিডও কিন্তু আছে অর্ণব। অধিরাজ রেড সিগন্যাল দেখে ব্রেক কষল–গোল্ডেন মুন ক্লাব। ড. জয়সওয়াল ওখানে যেতেন। আমাদেরও যেতে হবে। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে সঞ্জীব রায়চৌধুরী, অর্জুন শিকদার আর জুয়েলার বিজয় জয়সওয়ালও গোল্ডেন মুন ক্লাবের মেম্বার কি না। ক্লাবটা ঠিক কী ধরনের। মদ্যপান, পার্টি ছাড়া আর কী কী হয় ওখানে। কিন্তু তার আগে দেখি, যা গেস করছি তা ঠিক কি না।

ঠিক বলে ঠিক! এরপর যা ঘটল তা এককথায় ভোজবাজি! অর্ণব আর মিস ঘোষ ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গেল। ইনভেস্টিগেশন যেভাবে ইউ টার্ন মারল তাতে গায়ে রীতিমতো কাঁটা দিল তাদের। এত দিন যে গাড়ির খোঁজ মিলছিল না, সেটা খুঁজতে বেশি দূর ওদের যেতে হলো না। নিউ আলিপুরের পুলিশ স্টেশনেই পাওয়া গেল ড. বিজয় জয়সওয়ালের গাড়িটা! অনেক গাড়ির ভিড়ে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছিল সেই স্টিল কালারের হোন্ডা সিটি! অধিরাজের সন্দেহই ঠিক। তার চারটে চাকাই ধসে গিয়েছে। মাডগার্ডটা তোবড়ানো। যথারীতি নম্বরপ্লেট নেই! অর্ণবের মনে তবু সন্দেহ ছিল। কী করে জানা যাবে এটাই সেই গাড়ি! নম্বরপ্লেট নেই। তাছাড়া অন্য কোনো হোন্ডা সিটিও তো হতে পারে। ড. বিজয় জয়সওয়াল ছাড়া আর কি কেউ এই গাড়ি চড়ে না?

অধিরাজ মাথা নাড়ল-চান্স কম। তাছাড়া যেমন মানুষ ট্যাটু করায় তেমনই গাড়িতে স্টিকার লাগানো হয়। ড. বিজয় জয়সওয়ালের গাড়িতে দেখো স্টিকার আছে। সামনেই একটা কালো-হলুদ রঙের লাইটনিং স্টিকার। আর এটাতেও তাই।

সত্যিই তাই! ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেল অবিকল একই স্টিকার গাড়িটাতে জ্বলজ্বল করছে। কোনো সন্দেহই নেই যে এটা ড. বিজয় জয়সওয়ালের গাড়ি। থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার যা বললেন, তা অধিরাজেরই কথার পুনরাবৃত্তি। ছয় দিন আগে রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ নাইট সার্জেন্টরা এই গাড়িটাকে ড. জয়সওয়ালের বাড়ির কিছুটা দূরেই আবিষ্কার করে। দেখে মনে হয়েছিল অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। কোনো চালক ছিল না। কাগজপত্র এবং নম্বরপ্লেট না থাকার দরুণ পুলিশ গাড়িটাকে সিজ করে। গাড়িটার চলার অবস্থা ছিল না বলেই অন্য একটি গাড়িতে তুলে আনতে হয়েছিল। অফিসার

অসহায়ভাবে ত্যাগ করে বললেন–রোজ এরকম কত গাড়িই তো আসছে। স্যার। গুচ্ছ গুচ্ছ আনক্লেইমড় কার পড়ে আছে। এখন তো পুলিশ স্টেশনকে পুলিশ স্টেশন কম আর গাড়ির শোরুম বেশি মনে হয়! পুরো মগজমারি হয়ে গিয়েছে। কী করে বুঝব যে এর সঙ্গে সর্বনাশিনীর যোগ আছে?

সে অফিসারের সঙ্গে সহমত হয়ে বলল–ন্যাচারালি। তাছাড়া আপনারা জানতেনও না। এনিওয়ে, কাইন্ডলি গাড়িটাকে আমাদের ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়ে দেবেন? আমরা নিজেরাই নিয়ে যেতাম। কিন্তু তাতে অনেকটা সময় নষ্ট হবে। বুঝতেই পারছেন, হাতে সময় কম।

নিশ্চয়ই। ইমিডিয়েটলি পাঠিয়ে দিচ্ছি। অফিসার অধিরাজের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেই চমকে উঠলেন–এ কী! আপনার তো…।

আমি ঠিক আছি। সে কঠিন স্বরে বলল–গাড়িটা প্লিজ…।

হ্যাঁ স্যার।

সেখান থেকে সোজা বালিগঞ্জ চলে গেল ওরা। বালিগঞ্জ থানাতেই ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল জুয়েলার বিজয় জয়সওয়ালের গাড়ি। তার অবস্থাও একইরকম। গাড়ির সামনে গণপতির মূর্তি দেখেই চেনা গেল গাড়িটাকে। গল্পও সেই একই। কোনো হেরফের নেই। যে গাড়িটাকে এত খুঁজেও পাওয়া যায়নি সেটাকে পাওয়া গেল ঘণ্টাকয়েকের মধ্যেই। ভারপ্রাপ্ত অফিসার কথাও দিলেন। যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়িটাকে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়ে দেবেন।

অর্ণব আড়চোখে দেখল, এখানে অফিসারের সঙ্গে করমর্দন করল না অধিরাজ। তাকে দেখেও ঠিক লাগছিল না। চোখ দুটো বেশ রক্তাভ হয়ে উঠেছে। নাকের ডগা লাল। এখন যেন কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে তার। হাঁচি হচ্ছে না, কিন্তু নাক মুছছে ঘন ঘন। জ্বরটা বোধহয় ক্রমশ উঠছে।

আপনি এই ব্যাপারটা বুঝলেন কী করে স্যার! অর্ণব বিস্ময়াভিভূত– আপনি ঠিক যা বলেছেন, তেমনই ঘটেছে। মনে হচ্ছে আপনি যেন অ্যাক্সিডেন্ট স্পটে দাঁড়িয়েছিলেন!

সর্বনাশিনী যা করেছে, আমিও সেটাই করছি। সে যেমন আমাদের মনস্তত্ব বুঝে বুঝে এগিয়েছে। আমিও স্রেফ তাই করছি। ব্লাইন্ড গেম খেলছি। মহিলা কেমন নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে দেখেছ! অধিরাজ পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে একটু স্খলিত, ক্লান্ত গলায় বলল–এখন তার জন্য চাঁদেও যেতে হবে। তার ওপরে সোনালি চাঁদ! মিশন গোল্ডেন মুন।

অর্ণব প্রমাদ গুনল। কথাতেই স্পষ্ট, এ লোক থামার নয়। অথচ শরীরটা বোধহয় একটু বেলাগাম। নয়তো এত ক্লান্ত কখনই লাগে না তাকে।

স্যার, আজ কি যেতেই হবে? সে একটু আমতা আমতা করেই বলল–মানে, আমি আর মিস ঘোষ যাচ্ছি। আপনি বরং বাড়ি ফিরে যান। তাছাড়া লাঞ্চও তো হয়নি। আপনি কাল রাত থেকে না খেয়ে আছেন। আমাদের সঙ্গেও খাননি…।।

তাই তো অধিরাজ ঘড়ি দেখল–ছি ছি! খেয়ালই নেই। খালি পেটে কি তদন্ত চলে! তুমি আর মিস…। বলতে বলতেই হোঁচট খেল সে। একটু থেমে বিড়বিড় করে বলল–মিস্ কী যেন!

মিস কী যেন! এমনিতেই অধিরাজ মহিলা অফিসারদের নাম ভুলতে ওস্তাদ। কিন্তু একটু আগেও নামটা ঠিক বলছিল সে। এর মধ্যেই ভুলে গেল! অর্ণব বুঝল, লক্ষণ মোটেই ভালো নয়। সে শুধরে দেয়–মিস ঘোষ।

হ্যাঁ। তোমরা কোনো রেস্টুরেন্টে খেয়ে নাও।

আপনি?

আমার আজ উপোস! সে স্মিত হাসল–খেতে ইচ্ছে করছে না। তোমরা খেয়ে নাও।

অর্ণব বুঝল কিছুতেই এ লোককে বোঝানো যাবে না। অধিরাজ যখন ঠিক করেছে তখন সে গোল্ডেন মুন ক্লাবে গিয়েই ছাড়বে। এ বিষয়ে কারোর কোনো কথা শোনার লোক সে নয়।

আচ্ছা! বাধ্য হয়েই সে খুব নরম স্বরে বলল–ড্রাইভটা তবে আমি করি?

অধিরাজ তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। এককথায় অপূর্ব দৃষ্টি! খানিকটা ছেলেমানুষি, একটু কৌতুক আর অনেকটা স্নেহ তার চোখে চিকচিক করছে। যেন বুঝতে পেরেছে, দুনিয়ার সব লোককে ফাঁকি দিতে পারলেও অর্ণবকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল! কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে আলতো করে তার কাঁধে হাত রাখল সে। খানিকটা যেন আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতেই বলে–বেশ। তুমিই চালাও। আমারও শরীরটা একটু খারাপ লাগছে।

অর্ণব হেসে মাথা ঝাঁকালো। স্যারের সঙ্গে থেকে থেকে সে অধিরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমস্ত ঘেতঘাত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তার শরীরটা একটু খারাপ মানে, বেশ ভালোই খারাপ! কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করবে না!

তার আগে তোমরা খেয়ে নাও। সামনেই একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে। লাঞ্চ সেরে নাও। তারপর যাওয়া যাবে।

অর্ণব আর প্রতিবাদ করতে সাহস পেল না। একটি কথাও না বলে মিস্ ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে চলে গেল।

অধিরাজ গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আপনমনেই সিগারেট ধরায়। সিগারেটের ধোঁয়াটাও এখন ভালো লাগছে না। মুখটা বিস্বাদ। চোখ জ্বালা জ্বালা করছে। সিগারেটে একটা টান মারতেই বেদম কাশি উঠে এল ফুসফুস থেকে। সে কাশতে কাশতেই বিরক্ত হয়ে হাতের সিগারেটটা রাস্তাতেই ফেলে দিল। গা গুলাচ্ছে! এখন জ্বর কত কে জানে। খিদে পেয়েছে অথচ খেতে ইচ্ছেই কাছে না। কেমন যেন বমি বমি পাচ্ছে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা! নিঃশ্বাসে আগুনের হল্কা!

সে কাতর দৃষ্টিতে গাড়িটার দিকে তাকায়। খুব ইচ্ছে করছে পেছনের সিটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। মাথাটা এখন অল্প অল্প ঝিমঝিমও করছে। চূড়ান্ত ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসলেও সে সজাগ থাকার চেষ্টা করে। এখনই হাল ছেড়ে দিলে হবে না। দরকার হলে ওষুধ খেয়ে নিতে হবে। উলটোদিকের ফুটপাতেই পরপর বেশ কয়েকটা ওষুধের দোকান। জ্বরের ওষুধ খেয়ে নিলেই হয়। তার চোয়াল ফের শক্ত হয়ে ওঠে। একটা জোরে শ্বাস টেনে মনে মনে বলল–আমি ঠিক আছি…ঠিক আছি…!

অধিরাজ আর কিছু ভাবার আগেই পেটের ভেতরে তীব্র একটা মোচড়! অতর্কিতেই তীব্র বিবমিষা উঠে এল কণ্ঠনালি বেয়ে। ধাক্কাটা সামলাতে পারল

সে। ফলস্বরূপ …!

ওঃ! গ-ড!

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *