কুমুরডাঙ্গায় শীঘ্র ভয়ানক কিছু হবে, কিন্তু কী হবে? যে-ভয়ঙ্কর বিপদ গুটিগুটি পায়ে কুমুরডাঙ্গার দিকে এগিয়ে আসছে, সে-বিপদের রূপটা কী রকম? তা কি এমন কোনো মহামারী যা সমগ্র শহর উজাড় করে দেবে? বা কোনো মহাপ্লাবন যা দুরন্তবেগে ছুটে এসে মানুষের ঘরবাড়ি গোলা-গোয়াল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে? অথবা কোনো প্রচণ্ড ভূমিকম্প যা নিমেষের মধ্যে পায়ের নিচের শক্ত জমিকে বিশালকায় কোনো জন্তুর মুখগহ্বরে পরিণত করবে? কী হবে তা কারো পক্ষে পরিষ্কারভাবে ভাবা সম্ভব হয় না, এবং হয় না বলে আশঙ্কাটি কোনো নির্দিষ্ট আকারের মধ্যেও ধরে রাখা সম্ভব হয় না; সে-আশঙ্কা সকলের মনে যে-গভীর ভীতির সৃষ্টি করে তার মধ্যে সমস্ত চেতনা শুষ্ক ছোবড়ার মতো নিষ্প্রাণ হয়ে ওঠে।
তারপর কেউ কান্নার কথাটি আর উল্লেখ করে নিঃ কেউ শুনে থাকলেও কথাটি গোপন করে রাখে। এক সময়ে যা শুনতে পাওয়া কারো-কারো নিকট সৌভাগ্যের বিষয় মনে হয়েছে, যা শুনলে গর্বের সঙ্গে সকলকে বলেছে, না শুনলেও শুনেছে বলে মিথ্যা দাবি জানিয়েছে-তা এখন গোপন করে রাখাই তাদের সমীচীন মনে হয়। কে শুনতে চায় সে-কান্নার কথা যে-কান্না কোনো অভাবনীয় প্রলয়কাণ্ডের অগ্ৰধ্বনি, কোনো ধ্বংসলীলার পূর্বাভাস? কেবল কান্নার কথা ঢেকেও কেউ ঢাকতে পারে নি, কারণ সবাই বুঝতে পারে সে-বিষয়ে আকস্মিক নীরবতার মানে এই নয় যে তা থেমে গিয়েছে : বস্তুত কান্নার বিষয়ে আকস্মিক নীরবতায় কান্নাটির আওয়াজ যেন আরো উচ্চতর হয়ে ওঠে, যা ছিল সবিরাম ধ্বনি, যা মধ্যে-মধ্যেই কেবল শোনা যেত, তা অবিরাম ধ্বনিতে পরিণত হয়।
কুমুরডাঙ্গায় ভয়ানক কিছু একটা ঘটবে এ-বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে পড়লে শহরবাসীরা আরো অনেক কিছুতে আসন্ন বিষম বিপদের পূর্বচিহ্ন দেখতে পায়, অনেক সাধারণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা তাদের চোখে বিশেষ অর্থ গ্রহণ করে। কারো হাতের চুড়ি ভেঙ্গে গেলে, কলসিটা উত্তরদিকে হেলে পড়লে, বা সহসা কোনো মৃত লোক স্বপ্নে দেখা দিলে মনে প্রশ্ন জাগে : এ-সবের অর্থ কী? পাশের বাড়িতে হয়তো একটি শিশু বায়ুশূলের বেদনায় তারস্বরে কাঁদতে শুরু করেছে। শিশুটি কেন এমনভাবে কাঁদে? সন্ধ্যাকাশে অশ্রান্তভাবে উড়তে থাকা এক ঝাঁক পাখি দেখা দিয়েছে। পাখিগুলি এমন অস্থির হয়ে উঠেছে কেন? গোয়ালের গরুর দুধ কমে গিয়েছে। তার কারণ কী? অনেক কিছু অস্বাভাবিকও মনে হয়। দূর আকাশে মেঘগর্জন শোনা গেলে মনে হয় এমনভাবে মেঘ কখনো ডাকে না। নিঃশব্দ নিথর হাওয়াশূন্য রাতে হঠাৎ গাছের শাখায় অস্ফুট মর্মরধ্বনি জাগলে সে-আওয়াজ কানে অপরিচিত ঠেকে; গাছের পাতা এমনভাবে কোনোদিন যেন শব্দ করে নি। কাছারি-আদালতের পাশে অবস্থিত ট্রেজারি থেকে ঢনঢন করে ঘন্টায় ঘণ্টায় সময় ঘোষণা করা হয়। সে-আওয়াজ আচম্বিতে কর্ণগোচর হলে মনে হয় সুপরিচিত ঘণ্টাটি কেমন বেসুরোভাবে বাজছে। গভীর রাতে নীরবতা প্রগাঢ় হয়ে উঠলে মনে হয় সে-নীরবতা নীরবতা নয়, অন্য কিছু হয়তো শ্বাসরুদ্ধ করা অপেক্ষা মাত্র। মানুষের কণ্ঠস্বর, চলাফেরার ধরন, তাকানোর ভঙ্গি-এ সব কেমন- কেমন ঠেকে।
কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের মতিভ্রমই হয়ে থাকবে, কারণ যারা কান্নার কথাটি পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যেও বিশ্বাস করে নি তারাও একটি অস্ফুট আশঙ্কার হাত থেকে রেহাই পায় নি। কোনো-কোনো সময়ে মানুষের কাছে যুক্তির অস্ত্র অকেজো মনে হয়। ভয়ানক কিছু-একটা ঘটবে-এমন একটি ধারণা যদি কারো মনে দেখা দিয়ে থাকে তা কোনো যুক্তির সাহায্যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেয়া যায় কি? সমস্ত সৃষ্টি কি একদিন অচিন্তনীয় একটি সংঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে না, সূর্যচন্দ্র তারানক্ষত্র নীহারিকার দল বিলুপ্ত হবে না একটি আকস্মিক তুমুল বিপর্যয়ের মধ্যে? আজ হবে না কাল হবে, কাল নয় সুদূর ভবিষ্যতে কোনো একটি দিনে কল্পনাতীত ঘটনাটি ঘটবে-এই বলেই কি মনকে প্রবোধ দেয়া যায়? অদৃশ্য ভবিষ্যতের বুকে যা লুক্কায়িত তার বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না : নিষ্ঠুর ভবিষ্যতের কার্যকলাপ নিতান্ত আকস্মিক, তার সম্মুখে মানুষ একেবারে অসহায়। স্নেহমমতা, সুখশান্তির পশ্চাতে ছুটে মানুষ ভবিষ্যতের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে, কিন্তু নির্মম ভবিষ্যৎ সে-সব বিনাখবরে বিনাকারণে নিমেষের মধ্যে ধ্বংস করে। বস্তুত, যারা বুদ্ধিমত্তা বা যুক্তির দ্বারা নিজেকে আশঙ্কামুক্ত করার চেষ্টা করে তাদের শীঘ্র মনে হয় সে-সব চেষ্টা বৃথা : দুর্বল-ডানা ক্ষীণশক্তি একটি পাখি অকূল সমুদ্র পাড়ি দিতে পারে না, একটি প্রদীপ অসীম অন্ধকার দূর করতে পারে না।
তবে কোনো আশা নেই বুঝলেও মানুষ আত্মরক্ষার জন্যে কিছু-না-কিছু করেই, বুদ্ধিতে যা কুলায় যা ভীতবিহ্বল মনে সমীচীন মনে হয় তা করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে। কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীরাও কিছু একটা করে।
একদিন সন্ধ্যার দিকে দর্জিপাড়ার রহমত শেখ একটি নবজাত বাছুরকে বুকে জড়িয়ে এবং হাতে একটি ধারালো ছুরি নিয়ে নদীর দিকে ছুটতে শুরু করে। রহমত শেখ চিরদুঃখী। বহুদিনের নৈরাশ্য এবং অর্থকষ্টের পর ইদানীং কাছারি-আদালতের কাছে সে একটি পানবিড়ির দোকান খুলতে সক্ষম হয়েছে,-যে, দোকান নিয়ে তার গৌরব এবং আশার অন্ত নেই। তবে কুমুরডাঙ্গা শহরে অজানিত ভয়টি নেবে আসার পর থেকে তার মনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে সে-দোকানটি সে হারাবে এবং তারপর আবার শুরু হবে তার অসহ্য অর্থকষ্ট, অন্তহীন কঠোর পরীক্ষা যার শেষে কোনো পুরস্কার বা প্রতিদান নেই।
লম্বা লম্বা পা ফেলে সে উধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে। পথে-ঘাটে তখন মানুষের। চলাচল কমেছে। যারা তাকে দেখতে পায় তাদের কেউ-কেউ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, ছুটতে-থাকা লোকটির দিকে বিস্মিতনেত্রে তাকিয়ে থাকে, কেউ-কেউ আবার সে কেন এমনভাবে ছুটছে তা জানবার জন্যে উদ্যম কৌতূহল বোধ করলে তার পিছু ধরে। কাজেই রহমত শেখ যখন নদীতীরে এসে উপস্থিত হয় ততক্ষণে ছোটখাটো একটি ভিড় জমে গিয়েছে তার চতুষ্পার্শ্বে । তবে তাদের বিষয়ে তাকে সচেতন মনে হয় না, যে উদ্দেশ্যে সে নদীতীরে উপস্থিত হয়েছে সে-উদ্দেশ্য কার্যকরী করার জন্যে উদ্যত হয় ক্ষিপ্ৰভঙ্গিতে। প্রথমে সে ধারালো ছুরি দিয়ে বাছুরটির গলা কাটে, ফিনকি দিয়ে তাজা উষ্ণ রক্ত উঠে তার দেহ এবং বস্ত্রের খানিকটা রঞ্জিত করে, যার উ রঙের তুলনায় সন্ধ্যাকাশের রক্তিমাভা ফিকা-পানসে মনে হয়। তারপর রহমত শেখ রক্তাক্ত, মস্তকছিন্নপ্রায় বাছুরটি আবার বুকে জড়িয়ে ধরে তীর বেয়ে নিচে নেবে যায়, চোখে মুখে নিথর ভাব। পানিতে নেবে সে হাঁটতে থাকে; হাঁটু, কোমর, তারপর বুক পর্যন্ত সে-পানি উঠে আসে। এবার সে বাছুরটিকে শ্লথগতি স্রোতে ছেড়ে দেয়, চতুর্দিকে নদীর পানি গাঢ় হয়ে ওঠে।
দর্জিপাড়ার রহমত শেখ যে-অদ্ভুত কাণ্ডটি করে বসে তার মর্মার্থ কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীরা প্রথমে বুঝতে পারে নি; শুরুতে কাজটি নিতান্ত অর্থহীন মনে হয়ে থাকবে তাদের কাছে। কিন্তু শীঘ্র তারা বুঝতে পারে। এবং একবার বুঝতে পারলে তাদের আর ধরে রাখা যায় না, কেউ ধরে রাখার চেষ্টাও করে না। দলে-দলে তারা নদীর তীরে উপস্থিত হতে শুরু করে, হাতে এটা-সেটা। যে যা পারে, যা যার কাছে মূল্যবান মনে হয়, তাই নিয়ে আসে : হাড়ি-পাতিল, জামা-কাপড়, চাল-ডাল, টাকা-পয়সা, এমনকি সোনা-রূপার গহনাও। এ-সব তারা নদীর পানিতে ছুঁড়তে শুরু করে।
এমনিতে দরিদ্র নিঃস্ব মানুষেরা দু-দিনে আরো দরিদ্র নিঃস্ব হয়ে পড়ে, তাদের নানা প্রকারের মূল্যবান অমূল্যবান দরকারি-বেদরকারি জিনিস মুরণোন্মুখ নদীর বুকে আশ্রয় গ্রহণ করে চিরতরে, অর্থহীনভাবে।
সহসা মুহাম্মদ মুস্তফার মনে এই বিশ্বাস জন্মে যে খোদেজা একটি প্রতিহিংসা পরায়ণ আত্মায় পরিণিত হয়েছে যে-আত্মা সারা জীবন তাকে পদে-পদে অনুসরণ করবে, অদৃশ্যভাবে, ছায়ার মধ্যে মিশে থেকে, হয়তো-বা তাকে এক সময়ে ধ্বংসও করবে। সেদিন রাতে সে যখন তন্দ্রাহীন চোখে বারান্দায় বসে ছিল তখন খোদেজারই উপস্থিতি অনুভব করেছিল। ভয়টাও তখন জেগেছিল-এমন ভয় যা মানুষের চোখের সামনে থেকে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সমস্ত কিছু নিমেষে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
প্রথমে মুহাম্মদ মুস্তফা বুঝে উঠতে পারে না কী করবে সে। প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মার বিরুদ্ধে কীই-বা করতে পারে মানুষ? জীবিত মানুষকে বোঝানো যায়, অন্যায় অবিচার করলে তার কাছে মাফ চাওয়া যায়, ক্ষতিপূরণ খেসারত দেয়া যায় তাকে, কিন্তু যে কায়াহীন আত্মায় পরিণত হয়েছে তার কাছে কী করে মাফ চাওয়া যায়, কী করেই বা ক্ষতিপূরণ-খেসারত পৌঁছানো যায়? জীবন্ত মানুষের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করাও সম্ভব কারণ তার শক্তি যতই দুর্দান্ত হোক-না কেন সে-শক্তি তার দেহের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু দেহহীন আত্মার শক্তির সীমা নেই। তার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া দুষ্কর।
দু-দিন পরে মুহাম্মদ মুস্তফা একটি ভয়ানক সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিন হয়তো রবিবার ছিল, হয়তো সে আপিসে যায় নি। সেদিনের কথা কিছু কিছু তার মনে পড়ে, কিছু কিছু একেবারেই মনে পড়ে না। এ-কথা বেশ মনে পড়ে, তবারক ভুইঞা বার বার এসেছিল সেদিন। হয়তো তার মনে কেমন একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছিল, এবং সে-জন্যে তার কৌতূহলও অদম্য হয়ে উঠেছিল। তবে তার কৌতূহল মুহাম্মদ মুস্তফাকে আর বিচলিত করত না। অন্য একটি অদৃশ্য দৃষ্টি কি সর্বক্ষণ তার ওপর নিবদ্ধ নয়, তার পদক্ষেপ কেই কি লক্ষ্য করে দেখে না প্রতিমূহুর্তে? শুধু তার প্রত্যেক বাহ্যিক আচরণ কার্যকলাপ নয়, মনের ক্ষীণতম আন্দোলন অস্কুট বাসনা-কামনাও সেই নিরন্তর দৃষ্টির হাত থেকে নিস্তর পায় না। সে-দৃষ্টির তুলনায় তবারক ভুইঞার দৃষ্টি তেমন কিছু নয়। তাছাড়া কতখানিই-বা সে দেখতে পায়? তার কৌতূহল অস্বাভাবিকও মনে হয় না। অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করবে কিনা এবং স্বীকার করবার পর তার মনে অনুতাপ অনুশোচনা বা ভীতি দেখা দেবে কিনা-এ-সব বিসয়ে কৌতূহল স্বাভাবিক। সাক্ষ্য প্রমাণের সাহায্যে বিচারক অপরাধীর অপরাধ সাব্যস্ত করে কেবল, অপরাধী তার মনের নিভৃতে অপরাধ স্বীকার করেছে কিনা, তার জন্যে অনুতপ্ত বা ভীত হয়েছে কিনা-সে জন্যে তার কৌতূহল নেই কারণ সে-সবের ওপর অপরাধ বা শাস্তির কমতি-বাড়তি নির্ভর করে না। কিন্তু সে-সবে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। বস্তুত সে আরো কিছু জানতে চায়। অনুতাপ, অনুশোচনা বা ভীতির কি একটি পরিণতি নেই? মেঘ জমলে বর্ষণ হয়, বীজ রোপণ করলে গাছ হয়, বাঁধ ভাঙ্গলে ধরে-রাখা পানি নিঃসৃত হয়; অনুতাপ অনুশোচনা ভীতিরও পরিণতি থাকে। তবারক ভুইঞা জানতে চায় এবার মুহাম্মদ মুস্তফা কী করবে, তার অনুতাপ অনুশোচনা বা ভীতি তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। কিন্তু শুধু সে নয়, অদৃশ্য দৃষ্টিও সে-সব জানতে চায়। তবারক ভুইঞা তাকে বিচলিত করবে কেন? তাছাড়া একবার রঙ্গমঞ্চে নাবলে দর্শক সম্বন্ধে অভিনেতা আর তেমন সচেতন থাকে না : দর্শক তখন ছায়ার মতো অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবারক ভুইঞা ছায়ার মতো কোথাও দেখা দিলেও তার বিষয়ে সে আর তেমন সচেতন হত না।
এক সময়ে মুহাম্মদ মুস্তফা বোধ হয় ঘুরঘুর করতে শুরু করে-এ-ঘরে, সে-ঘরে বারান্দায়। যে-কাজ করবার জন্যে মনস্থির করেছে তার জন্যে উপযুক্ত একটি জায়গা খুঁজছিল নিশ্চয়। এ-জীবনে সব কিছুর জন্যেই প্রথমে উপযুক্ত জায়গা ঠিক করতে হয় : কোথায় পুকুর খনন করতে হবে, কোথায় চারা লাগাতে হবে, কোথায় একটি শিশুর জন্ম হবে, কোথায় ঘর-সংসার পাতবে, কোথায় অন্তিম শয্যায় শায়িত হবে। তবে নিচের কোনো ঘর হয়তো পছন্দ হয় নি, কারণ সিঁড়ি ভেঙ্গে সে ওপরে চিলেকোঠায় উঠে আসে। খড়খড়ি-দেয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন চিলেকোঠায় সে কতক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে দৃষ্টি দেয়। ঘরটি নোংরা। মেঝেতে ছড়ানো কাগজপত্র, অনেকদিনের সঞ্চিত ধুলা, পাখির বিষ্ঠা বা পরিত্যক্ত পালক, এক কোণে কবে কার ছেড়ে যাওয়া অতিশয় পুরাতন ছেঁড়া জীর্ণ একটি তোশক। দেয়ালে দরজায় আগের বাসিন্দাদের ছেলে মেয়েদের কাঁচাহাতের হিজিবিজি লিখন, একটি মানুষের নকশা: গোলাকার মুখে মস্ত দুটি চোখ, নাকের দুটি ছিদ্র চোখের চেয়েও বড়, হাত-পা কিন্তু চারটি রেখা টেনে কোনো মতে শেষ করা। ঘরের অন্ধকারে চোখ অভ্যস্ত হলে এ-সব সে ধীরে-ধীরে দেখতে পায়।
চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এমন সময়ে মুহাম্মদ মুস্তফা সহসা খোদেজার উপস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন হয়। রাতদিনই সে তাকে অনুসরণ করে। এবারও তাকে অনুসরণ করে ওপরে উঠে এসেছে এবং পেছনে কোথাও ছায়ার মতো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে তাকে চেয়ে-চেয়ে দেখছে। একটু পরে সে চুড়ির ঝঙ্কারও শুনতে পায়, এবং সে আওয়াজ তেমন সুস্পষ্ট না হলেও তার শিরদাঁড়া শীতল হয়ে ওঠে। একবার ইচ্ছা হয় পেছনে তাকিয়ে দেখে, কিন্তু না-নড়ে সে পূর্ববৎ স্থির হয়ে থাকে। তবে না-তাকালেও সে খোদেজাকে যেন দেখতে পায়, যদিও তেমন পরিষ্কারভাবে নয়। তাছাড়া তার মুখটি যেন মোক্তার মোছলেহউদ্দিনের মেয়ের মতো-যাকে সেদিন পথে দেখেছিল। হয়তো সে-জন্যে সহসা ক্ষণকালের জন্যে কী-একটা ভাবে সে অভিভূত হয়ে পড়ে, কারণ তার মনে হয় খোদেজার মৃত্যু হয় নি, পথে-দেখা মেয়েটির মতোই সে জীবিত। তারপর ভাবে : খোদেজা তাকে দেখছে দেখুক। সে কি একটি ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নেয় নি? একসময়ে খোদেজা দেখতে পাবে, মনভরে প্রাণভরে দেখতে পাবে। সে সুস্থির হয়।
সে-বার হয়তো বেশিক্ষণ চিলেকোঠায় থাকে নি। হঠাৎ তার মনে হয়, তবারক ভুইঞা এসেছে। তখন সে দড়িটা লুকিয়ে ফেলে; সেটি ব্যবহার করবার সময় এখনো আসে নি। তবে তাড়াতাড়ি করে লুকিয়ে ফেলেছিল বলে খুঁজে বের করতে পরে কষ্টই হয়েছিল।
হয়তো দড়িটা যখন লুকাবার চেষ্টা করছিল তখনই নেহাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে কলিজাটির কথা মনে পড়েছিল। না, তখন নয়। যখন কলিজাটির চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখন সে শোবার ঘরে চৌকির ওপর চুপচাপ করে বসে, দৃষ্টি মেঝের। দিকে। বহুদিন আগে গ্রামের একটি মেয়েলোকের কাছে কলিজাটির কথা প্রথম শুনেছিল। মেয়েলোকটি বলত, খোদা কলিজার মতো দেখতে, কলিজার মতোই অবিরত থরথর করে কাঁপে। একবার তার কথা শুনে বড় চাচা বা বাপ খেদমতুল্লা আহত পশুর মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠেছিল। তারপর থেকে মেয়েলোকটি গোপনে-গোপনে। তাকে কলিজার কথা বলত, কারণ সে জানত ভয় পেলেও মুহাম্মদ মুস্তফা কলিজাটির কথা অনেক দিন ভুলতে পারে নি এবং কখনো-কখনো সেটি আপনা থেকেই কোত্থেকে। সহসা তার মনশ্চতে এসে দেখা দিয়ে থরথর করে কাঁপত। রঙটা লাল। তবে টাটকা লাল নয়; তাতে যেন কালচে ধরেছে। মানুষের মনে সত্য এবং অসত্য নির্বিবাদে পাশাপাশি বাস করতে পারে একবার যদি উভয়ের অস্তিত্ব গোপন করার কৌশলটা করায়ত্ত করে নেয়া যায়।
কলিজাটি বহুদিন পরে তার মনশ্চক্ষুতে ভেসে ওঠে বলে সে গভীর কৌতূহল বোধ করে, একটু ভয়-ভয়ও করে, এবং শীঘ্র এমনও মনে হয় সেটি যেন বাস্তবরূপ ধারণ করেছে, যেন সত্যি তা দেখতে পাচ্ছে : তার চোখের সামনে শূন্যে ঝুলে থাকা কলিজাটি কাঁপতে থাকে থরথর করে, অশ্রান্তভাবে, নির্দয়ভাবে। নির্দয়ভাবে কারণ সে কলিজার কম্পন কখনো যেন থামবে না, কখনো শান্ত হবে না; সেটি এমনই কিছু যার শেষ নেই, যা অমর।
সে যেন আবার সিঁড়ি ভেঙ্গে চিলেকোঠায় উঠে এসেছে। সে-বারই কি জানালার খড়খড়ি দিয়ে পেছনের বাড়ির উঠানের দিকে তাকিয়েছিল? ঠিক মনে নেই। প্রথমবার যখন সে-বাড়ির উঠানের দিকে তাকায় তখন রোদটা যেন পড়ে এসেছে। হয়তো সে বার দড়ির সন্ধানে ওপরে উঠে এসেছিল। তখনো খাওয়াদাওয়া করে নি, দ্বিপ্রহরের প্রখর রোদ নির্মমভাবে খাঁ খাঁ করছে। দড়িটা খুঁজে পায় নি। পরে একটু বিরক্ত হয়ে খেতে বসে পেছনের বারান্দায়, পাটির ওপর। ঝুঁকে পড়ে দ্রুতভাবে খায়, যেন খাওয়া শেষ হলে দূরে কোথাও যাবে। তাই অন্য দিনের তুলনায় গোগ্রাসে অনেক খায়। প্রথমে পুঁটিমাছগুলি মস্ত মস্ত লোকমার সঙ্গে গলাধঃকরণ করে, তারপর গোস্তের ছালন এবং ডালের সাহায্যে দু-তিন বাসন ভাত খতম করে। খাওয়া শেষ হলে ভরা পেটে বারান্দার প্রান্তে হাতমুখ ধুতে বসে অনেকক্ষণ সে স্তব্ধ হয়ে থাকে, কারণ সহসা বন্ধু তসলিমের চিঠির কথা তার মনে পড়ে। সে-চিঠির জবাব দেয় নি। চিঠির পর একটি তারও এসেছে; তার নীরবতায় বন্ধু তসলিম দু-চার দিনের মধ্যে খবরটা পাবে, তখন সব বুঝতে পারবে সে। হয়তো প্রথমে সে বড় দুঃখত হবে, আফসোসও হবে তার। সে ভাববে, এতদিন এত কষ্ট করে সে পড়াশুনা করেছিল এই জন্যেই কি? পরে সে বুঝবে। তবে তার চিঠি বা টেলিগ্রাম, তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব, এমনকি দেশের বাড়ি আপনজন সবই বহুদূরে মনে হয়; সে যেন কোথায় একটি নদী পেরিয়ে চলে এসেছে সে-সব পেছনে ফেলে।
না, অপরাহ্নের দিকেই চিলেকোঠার জানলার খড়খড়ি দিয়ে পেছনের বাড়ির উঠানের দিকে তাকিয়ে থাকবে। মনে পড়ে, সে-বাড়ির উঠানে তবারক ভুইঞাকে দেখতে পেলে সে ভয়ানকভাবে চমকে উঠেছিল। সে জানত পেছনে কোথাও তবারক ভূইঞা থাকে, কিন্তু তার বাড়ি যে সরকারি বাংলোর পেছনের দেয়াল ঘেঁষেই-তা কখনো ভাবে নি।
উঠানের একধারে নিমগাছের তলে খালি গায়ে হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি তুলে পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে বসে তবারক ভুইঞা কাঠি জাতীয় কিছু দিয়ে নতমাথায় মাটি খুঁড়ছিল। লেপ-জোপা তক্তকে পরিচ্ছন্ন উঠান। ছোটখাটো বাড়িটির ভেতরের বারান্দাও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বারান্দার প্রান্তে একটি সিঁড়ি, সিঁড়ির পাশে পেতলের বদনা। বদনাটাও মাজাঘষা, ঝকঝকে। ভেতরটা নজরে পড়ে না ঠিক, তবু মনে হয় সেটি স্বচ্ছ পানিতে ভরা। নিঃসন্দেহে সে-পানি উঠানের অন্যধারে কুয়াটি থেকেই এসেছে। কুয়াটি তেমন উঁচু নয়, তবু একপাশে একটা ধাপের মতো। কুয়ার ওপরে একটা বালতি। বালতিটিও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
পরে সে বাড়ির উঠানে বউটিকে দেখতে পায়। তাকে প্রথমে দেখে নি, তাই বুঝতে পারেনি কোত্থেকে সে এসেছে। মুহাম্মদ মুস্তফার বাড়ির দেয়ালের দিকে আরেকটা ছোট-খাটো ঘর, যার ছাদটাই কেবল নজরে পড়ে। বোধহয় রান্নাঘর। হয়তো সেই রান্নাঘর থেকে বউটা বেরিয়ে এসেছে। সে কি তবারক ভুইঞার স্ত্রী উঠানের মধ্যখানে এসে দাঁড়িয়ে সে থামে, তারপর এধার-ওধারে কিছু যেন খুঁজে হাত তুলে একবার ভোলা চুল ঝাড়ে। পিঠভরা চুল, ভেজা, রোদে তাই চিকচিক করে। এদিকে পেছন দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে মুখটা দেখা যায় না, তবে মেয়েটি স্বাস্থ্যবতী, নিটোল দেহের গঠনটা ভালো। পরনে ডোরাকাটা শাড়ি, পা খালি। কী কারণে নিস্পলক দৃষ্টিতে বউটির দিকে মুহাম্মদ মুস্তফা তাকিয়ে থাকে। তারপর ভেতর থেকে একটি বৃদ্ধ মানুষ ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে পিড়িতে বসে। তবারক ভুইঞা নড়ে না, কিন্তু মাথায় ঘোমটা টেনে বউটি কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায়।
তারপর থেকে সেদিন মুহাম্মদ মুস্তফা অনেকবার চিলেকোঠায় এসে জানলার খড়খড়ি দিয়ে সে-বাড়ির উঠানের দিকে তাকিয়ে থাকবে। পরে তবারক ভুইঞাকে দেখে নি, কিন্তু বউটিকে বার বার দেখেছে। মেয়েটির গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামল, দূর থেকেও কেমন মনে হয় মুখটা মন-খোলা মুখ। দ্রুতপায়ে হাঁটে, কিন্তু যখন দাঁড়ায় তখন এক পায়ে ভর করে দাঁড়ায় বলে মাজার এক পাশে খাজ পড়ে, দেহটা একটু বেঁকে যায়। তবে সে যেন সদা কর্মব্যস্ত। এই এসে উঠানে দেখা দেয়, এই আবার অদৃশ্য হয়ে যায় রান্নাঘরে বা বাসঘরে, আবার বেরিয়ে এসে কুয়ার ধারে যায়। যেন উদ্দেশ্যহীন ভাবেই ঘুরে বেড়ায়। তবে তেমনটা মনে হয় কারণ মুহাম্মদ মুস্তফা দেখতে পায় না বা বুঝতে পারে না কেন সে ঘোরাঘুরি করে। উদ্দেশ্য থাকলেও সে-উদ্দেশ্য কী তা জানবার জন্যে কোনো কৌতূহল বোধ করে না সে, মেয়েটির আসা-যাওয়াই সে কেবল লক্ষ্য করে দেখে। যখন মেয়েটিকে দেখতে পায় না তখন সে নিরাশ বোধ করে : সে অপেক্ষা করে। তাছাড়া তাকে দেখতে না পেলেও মনে হয় সে যেন অদৃশ্য হয়ে যায় নি, উঠানে, বাড়ির বারান্দায়, কুয়ার পাশে, নিমগাছের তলে-সর্বত্র তার স্পর্শ।
পরে একবার মনে হয়েছিল, পেছনের বাড়ির উঠানে ডোরাকাটা শাড়ি-পরা মেয়েটিকে দেখার পর একবারও সে চিলেকোঠার জানলা থেকে নড়ে নি। হয়তো ধারণাটি ভুল নয়। বউটির আকর্ষণেই সে যে অমনি করে জানলার পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিল তা ঠিক নয়, নিঃসন্দেহে প্রতিবেশীর বাড়ির তক্তকে উঠানে, ছোট কুয়াটিতে, নিমগাছের ছায়ায়, রান্নাঘরের ছাদে, এমনকি বারান্দায় পিড়ি-বদনায় সে এমন কিছু দেখতে পেয়েছিল যা তাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে থাকবে। সে জন্যে জানলা থেকে সে নড়তে পারে নি। হয়তো তাও সত্য নয়। সত্য এই যে, চিলেকোঠার জানলা দিয়ে একবার বাইরের দিকে তাকাবার পর যে-অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে সে দাঁড়িয়েছিল সে-ঘরের দিকে দৃষ্টি দিতে তার মন চায় নি। এবং সে-জন্যে নিদারুণ সিদ্ধান্তটি কার্যকরী করার চেষ্টায় বিলম্বও হয়েছিল।
তারপর কখন উঠানটি সহসা চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ে। রাত হয়েছে তা প্রথমে সে বুঝতে পারে নি কারণ ধীরে-ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসা, লেপাজোকা তকতকে উঠানে ছায়া জমে ওঠা-এ-সব লক্ষ্য করে নি। বিহ্বলতা কাটলে সে ভাবে, তবে রাত্রি নেবেছে, যে-রাত এমনিভাবে অন্যত্রও নেবেছে : তার দেশের বাড়ির সামনে ধানক্ষেতে, দূরে শান্ত খালটিতে, আরো দূরে চাঁদবরণঘাটের পাশে বড় নদীর বুকে। অকারণে এ-সময়ে মা আমেনা খাতুনের কথাও একবার তার মনে পড়ে, যার কথা কদাচিৎ মনে হয় তার মাতা-পুত্রের মধ্যে যদি স্নেহের ধারা প্রবাহিত হয়ে থাকে সে-ধারা ভূমিগর্ভস্থ ধারা মতোই অদৃশ্য-তা চোখে দেখা যায় না, তার কলতানও কানে পৌঁছায় না। তবে সে-ধারাটি দৃশ্যমান হলেও কয়েক মুহূর্তের জন্যেই হয় কেবল।
কখন চিলেকোঠা থেকে নেবে এসেছিল মনে নেই, যদিও চিলেকোঠা থেকে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে নেবে আসতে কিছু কষ্ট হয়ে থাকবে। যা মনে পড়ে তা এই : লণ্ঠনের পলতেটা উঁচিয়ে আলোটা বাড়িয়ে শোবার-ঘর এবং ভেতরের বারান্দার চৌকাঠের পাশে লণ্ঠনটি স্থাপন করে চৌকিতে এসে বসেছে, দৃষ্টি মেঝের দিকে। তবে দৃষ্টি মেঝের দিকে হলেও কলিজাটি সে সুস্পষ্টভাবেই দেখতে পাচ্ছে : কলিজাটি কাঁপছে থরথর করে, আগের মতোই অশান্তভাবে, তবে আগের চেয়ে আরো জোরে। কিছুক্ষণ চৌকির ওপর স্থির হয়ে বসে থাকার পর সে বুঝতে পারে কলিজাটির মতো চৌকিটিও যেন কাঁপতে শুরু করেছে, প্রথমে মৃদুভাবে, তারপর প্রবলভাবে।
চৌকিটা অবশেষে স্থির হয়। এবার সে ঘরের চতুর্দিকে দৃষ্টি দেয়, যেন সে-ঘর এবং সে-ঘরের জিনিসপত্র আগে দেখে নি। ঘরে বিশেষ কিছু নেই। চৌকিটা ছাড়া আসবাবপত্রের মধ্যে একটি ছোট টেবিল, ওধারে একটি আলনা যেখান থেকে কিছু কাপড়চোপড় ঝোলে। আলনার কাছে একজোড়া ইংরেজি জুতা। জুতাজোড়াটি নৃতন, কুমুরডাঙ্গায় আসার কিছুদিন আগে কিনেছিল, এখনো তা পরে হাঁটলে পায়ের গোড়ালির পেছনে ব্যথা করে। জুতাজোড়ার পাশে একটি গাঢ় খয়েরি রঙের চামড়ার সুটকেস। সেটিও নূতন। তার ভেতরে কী, সে জানে। একটি চারখানা নকশার লুঙ্গি, একটি শার্ট, একটি সবুজ রঙের আলোয়ান, এবং দু-একটা পুরাতন বই। একটি বই বেশ পুরাতন। সেটি ইংরেজি অভিধান, অনেকদিনের সম্পত্তি। মলাট ছেঁড়া, প্রথম দু-চারটি পাতা কবে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। তবে এখনো মনে পড়ে, একদিন অভিধানটির প্রথম কি দ্বিতীয় পাতায় সে একটি লম্বা ধরনের নাম সযত্নে বড় বড় অক্ষরে লিখেছিল। তার পিতৃদত্ত নাম মুহাম্মদ মুস্তফা, তবে সে যখন নবম শ্রেণীতে উঠছে তখন ঝোঁকের মাথায় নিজের নামে বাহার তুলে বই-খাতাপত্রে লিখতে শুরু করে : চৌধুরী আবু তালেব মুহাম্মদ মুস্তফা। তারা চৌধুরী নয়, আরবি শব্দ নিয়ে খেলা করার পাণ্ডিত্যও তার নেই, তাছাড়া এ-ও তার অজানা ছিল না যে অনেকে নামের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে নিজের দাম বৃদ্ধির চেষ্টা করলেও মানুষ আবার যা অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত তা দ্বিরুক্তি না করে প্রত্যাখ্যান করে বলে লম্বা নামধারী লোকেরা অতি সংক্ষিপ্ত, এমনকি দুদু মিঞা সোনা মিঞা এ-সব বাল্যকালের হাস্যকর উপনামেই পরিচিত হয়ে সমস্ত জীবন অতিবাহিত করে। তবে তাতে সে দমিত হয়নি।
সুটকেসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এমন সময় সেটি অকস্মাৎ কাঁপতে শুরু করে : সুটকেসটি যেন একটি শুষ্করক্ত গাঢ় রঙের কলিজায় পরিণত হয়েছে। সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। হয়তো এবার দরজার নিকটে স্থাপিত লণ্ঠনের দিকে তাকায়। তবে কলিজাটি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেখানেও হাজির হয় এবং আকারে সহসা ছোট হয়ে লণ্ঠনের গায়ে পতঙ্গের মতো ডানা ঝাপটাতে শুরু করে। মুহাম্মদ মুস্তফা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এই আশায় যে, পতঙ্গটি পুড়ে মারা যাবে, তার চঞ্চল ক্ষুধার্ত ডানা স্তব্ধ হবে, কিন্তু পতঙ্গটি স্তব্ধ হয় না। এবার মেঝের দিকে তাকালে সেখানেও কলিজাটি দেখতে পায়; মেঝের ওপর সেটি ডাঙায় তোলা মাছের মতো ধড়ফড় করছে যেন। সে আশা করে পানির অভাবে শীঘ্র মাছটির ধড়ফড়ানি শেষ হবে, তার দেহ স্থির হয়ে পড়বে, কিন্তু তাও হয় না, পতঙ্গের মতো মাছটিও ধড়ফড় করতে থাকে। বিচিত্র কলিজাটি সত্যই অমর : আগুনে তা দগ্ধ হয় না, দম বন্ধ হলেও তার শ্বসনকার্য থামে না।
হয়তো অমর কলিজাটির কথা ভুলবার জন্যেই এবার সে কিছু ভাববার চেষ্টা করে, যা মনে আসে তাই, অনির্দিষ্ট তুচ্ছ কথা। প্রতিবেশীর বাড়ির উঠানের কথা, সে-বাড়ির বউ-এর কথা, তার দাঁড়াবার ভঙ্গির কথা। তারপর গরুটির কথা ভাবে; সেদিন সকালে খুঁটিবাঁধা একটি গরু কী করে মুক্তি পেয়ে গলায় দড়ি নিয়েই পেছনের দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে এসে ঢুকেছিল। তার সে উকিলটিকে দেখতে পায় : শীর্ণ চোয়াল-উঁচু মুখ, কানের নিচে গলা পর্যন্ত মস্ত জন্মদাগ, চোখে অশ্রান্ত ধূর্ততা। এবার আরেকটি মানুষের মুখ দেখতে পায় যাকে সে চেনে না; পথেই তাকে দেখে থাকবে। লোকটির মুখভরা বসন্তরোগের চিহ্ন, চোখে হাবাগোবা ভাব, থুতনির নিচে হাল্কা দাড়ি। তবে যাই সে ভাবুক, যে-চিত্র বা দৃশ্য তার চোখে ভেসে উঠুক না কেন, থরথর করে কাঁপতে থাকা বস্তুটির হাত থেকে নিস্তার পায় না : সেটি যেন চোখের পর্দায় স্থান পেয়েছে। সেটি তার বুকেও স্থান পায় নি কি? মনে হয় কলিজাটি তার বুকের মধ্যে ধুকধুক করে। কাঁপতে শুরু করেছে; কলিজাটি তার হৃৎপিণ্ডকে আঁকড়ে ধরেছে। হয়তো অনেক রাত হয়েছে, চতুর্দিকে গভীর নীরবতা। সে-নীরবতার মধ্যে কলিজার স্পন্দন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে ওঠে, যেন একনাগাড়ে কেউ ঢেঁকি চালিয়ে যাচ্ছে। অদূরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে খোদেজা অপেক্ষা করে।
তখনই কি তাবিজগুলি খুলতে শুরু করে? সময়টা মনে নেই। তবে মনে পড়ে তাবিজগুলি খুলতে বেশ কষ্ট হয়েছিল। পুরাতন গিঠটা খুলতে পারে নি, কালো রঙের সূতাটা অনেক পুরানো হলেও তা লোহার শৃঙ্খলের মতো শক্ত মনে হয়েছিল। হাতের পেশিতে বিপুল শক্তি প্রয়োগ করে অবশেষে সূতাটি ছিঁড়ে ফেলতে সক্ষম হয়। তারপর আরেকটি দৃশ্য মনে পড়ে। শোবার ঘরের পাশের কামরায় ওপরে কড়িকাঠে লাগানো। হুকটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে-যে-হুঁ থেকে এ-বাড়ির আগের বাসিন্দারা শীতের দিন শেষ হলে লেপ-কম্বল বেঁধে ঝুলিয়ে রাখত। মনে হয় শোবার ঘর থেকে টেবিলটা এনেছিল, সে-টেবিলের ওপর একটি কাঠের চেয়ারও তুলেছিল। দড়িটার কথা মনে নেই। নিঃসন্দেহে দড়িটাও এনে থাকবে।
তবে সে-সময়েই সে ভীষণভাবে কাঁপতে শুরু করে। কী ভীষণ সে-কাঁপুনি। দেখতে-না-দেখতে সমস্ত দেহ একটি অদম্য কাঁপুনিতে পরিণত হয়-যে-কাঁপুনিতে প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্ত্র-তন্ত্র মাংসপেশি স্নায়ু শিরা-উপশিরা আলগা হয়ে পড়ে ভেসে যায়। তারপর সে আর কিছু করতে পারে নি, কিছু দেখতেও সক্ষম হয় নি।
পরদিন বেশ সকালে-সকালে সে কুমুরডাঙ্গা ত্যাগ করে।
তবারক ভুইঞা বলছিল : কখনো-কখনো মানুষের বিশ্বাসে পর্বত জাগে, মরুভূমিতে পদ্মা-যমুনার মতো বৃহৎ ধারার সৃষ্টি হয়। বাকাল নদীর বুকে নানা প্রকার মূল্যবান-মূল্যহীন জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলার কয়েক দিনের মধ্যেই শহরবাসীদের সহসা মনে হয়, ফাড়া কেটেছে। সঙ্গে-সঙ্গে যে-আশঙ্কায় ক-দিন ভীতবিহ্বল হয়েছিল সে আশঙ্কাও কমে। ধীরে-ধীরে কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীরা ভয়মুক্ত হয়, একটি কাল্পনিক বিপদের সম্ভাবনা তাদের মনে যে-ছায়ার সঞ্চার করেছিল, সে-ছায়া দূর হয়। তবু সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতিস্থ হতে তাদের কিছু সময় লাগে, যেন ঘটনাটি কোথাও একটি গভীর ক্ষত রেখে গিয়েছে। তারা নিস্পৃহ নিরানন্দ হয়ে থাকে, ভয় কাটলেও কোথাও আশার কিছু দেখতে পায় না, দুশ্চিন্তা দূর হলেও সুখচিন্তার কারণ খুঁজে পায় না।
তারপর নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে বন্ধ-হয়ে-যাওয়া স্টিমারঘাটের স্টেশনমাস্টার খতিব মিঞা কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের মধ্যে জীবনসঞ্চার করে।
একদিন খতিব মিঞা খবর পায়, কোম্পানির চাকুরি থেকে তাকে অবসর দিয়ে দেয়া হয়েছে। খবরটা তাকে গভীরভাবে বিচলিত করে। তবে শেষরাতে উঠে হুঁকা ধরিয়ে ভেতরের উঠানে বসে আপন মনে বিষয়টা ভেবে দেখে স্থির করে, সেটি তেমন দুঃখের কথা নয়। অবসরের সময় ঘনিয়ে এসেছিল, কেবল বছরখানেকের মতো বাকি ছিল চাকুরির মেয়াদ, যা কাল হত তা না-হয় আজ হয়েছে। বড় কথা এই যে, কোম্পানি শূন্য-হাতে বিদায় দিচ্ছে তা নয়, নিয়মমাফিক ক্ষতিপূরণ দেবে। বলতে গেলে ব্যাপারটি বেশ লাভজনকই। হাতে কিছু কাঁচা টাকা পাবে; এত টাকা একসঙ্গে জীবনে কখনো সে দেখে নি। তাছাড়া বিনাকাজে পাবে বলে তা মুফতে-পাওয়া টাকার মতোই মনে হবে। এত বছর ধরে যাদের খেদমত করেছে গভীর আনুগত্যের সঙ্গে, যাদের ননুও খেয়েছে, তাদের বিবেচনাজ্ঞান ন্যায়পরতার প্রমাণে খতিব মিঞার চোখ কৃতজ্ঞতায় একটু সজল হয়ে ওঠে।
তবে একটি বিষয় তাকে বড়ই চিন্তিত করে তোলে। এবার কোথায় যাবে, কোথায় তার জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি কাটাবে? সে জানে, তিন ঘাট দূরে তালগাছের পাশে ডোবার ধারে তার দেশের বাড়িতে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয়। সেখানে তার জায়গা কোথায়? গ্রামবাসী দুটি ভাই-এর ক্রমবর্ধমান পরিবার কোথাও একটু ফাঁক রেখেছে কি? তাছাড়া বহুদিন স্টিমার-কোম্পানির চাকুরির উপলক্ষে বাইরে-বাইরে জীবনযাপন করার ফলে পৈতৃক বাড়ির ওপর একদিন যে স্বত্বাধিকার ছিল তা যেন কী করে হারিয়ে ফেলেছে। তা দাবি করা যায় বটে কিন্তু দাবি করার সাহস হবে না। অবশ্য পৈতৃক ভিটার পাশে কিছু জমি কিনে আস্তানা গাড়ার চেষ্টা করা যায়, কিন্তু কী কারণে তাও সম্ভব মনে হয় না। আসল কথা, ভাইদের সঙ্গে কি পাশে বাস করতে পারবে না। কথাটি আগে পরিষ্কারভাবে ভেবে দেখার অবকাশ হয় নি, প্রয়োজনও পড়ে নি, কিন্তু আজ না-ভেবে উপায় নেই। ভাইদের সঙ্গে তেমন আর মিল কোথায়? এতদিন কোম্পানির চাকুরি করার ফলে তাদের রুচি আর এক নয়। তার বড় ছেলেটা বি.এ. ফেল হলেও পাটের কলে চাকুরি নিয়েছে, মেয়েটাও কিছু পড়াশুনা করেছে, ভাইদের ছেলেমেয়েদের মতো অজ্ঞ মূর্খ বা চাষাভুষা থেকে যায় নি। কয়েক বছর আগে বৃদ্ধা গর্ভধারিণীর মৃত্যু ঘটলে তার দাফন-জানাজার জন্যে খতিব মিঞা সেই যে একবার দেশে গিয়েছিল তারপর আবার যাবার সুযোগ হয় নি, প্রবৃত্তিও হয় নি। হয়তো সে বারই বুঝেছিল সেখানে আর কখনো ফিরে যেতে পারবে না। না, দেশের বাড়ি চিরতরেই ছেড়েছে।
কিন্তু কোথায় যাবে, কোথায়-বা জীবনের শেষ কয়েকটি দিন অতিবাহিত করবে? সে বেশ ভাবিত হয়ে পড়ে, কারণ সপ্তাখানেকের মধ্যে নদীর তীরে কোম্পানির যে বাড়িতে গত পাঁচবছর বসবাস করেছে তা ছেড়ে দেবার পর কোথায় যাবে তা বুঝে উঠতে পারে না। এবার অবসরপ্রাপ্তি ভয়াবহ রূপই ধারণ করে।
যখন খতিব মিঞার মনে হয় যাবার কোনো জায়গা নেই তখনই সহসা সে ভাবে, কোথাও যাবে না, কুমুরডাঙ্গাতেই থেকে যাবে। এ শহরে তার জন্ম হয় নি, বাড়িঘর নেই, আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব বলেও কেউ নেই, তবু একনাগাড়ে পাঁচ-পাঁচটি বছর কাটিয়েছে। এ-শহরে থেকে গেলে ক্ষতি কী?
রাতের গুমোট ভেঙে হঠাৎ ঝিরঝিরে হাওয়া বইতে শুরু করে, যে-হাওয়া চিন্তায় টা-হয়ে-থাকা কপালে এসে লাগলে সহসা খতিব মিঞার মনে হয় জ্বর ছেড়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আপন মনে বলে, না, কোথাও যাবে না, কুমুরডাঙ্গায় থেকে যাবে, এ-শহরেই কোথাও একটু জমি কিনে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করবে। পূর্বাকাশে যখন প্রত্যুষের ক্ষীণ ধূসর আলো দেখা দেয় তখন খতিব মিঞা মনে-প্রাণে শান্ত বোধ করে, অবসরপ্রাপ্তি আর ভয়াবহ মনে হয় না।
তখন বেশ বেলা হয়েছে। কী খেয়ালে ঈদ-মিলাদের জন্যে শোভনীয় পোশাক পরে, কানের পেছনে একটু আতর লাগিয়ে খতিব মিঞা বেরিয়ে পড়ে কাছারি-আদালত এবং বাজার অভিমুখে, মাথায় ছাতা, পদক্ষেপ ধীরস্থির; অবসরপ্রাপ্ত মানুষের আবার তাড়াহুড়া কিসের? নদীর ধার দিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পর পথটি নদীর তীর ছেড়ে হঠাৎ সোজা হয়ে পাকা সড়কের রূপ ধারণ করে, নদীর দিকে কয়েকটি বাড়িঘর দেখা দেয়। তবে কাছারি-আদালতের সামনে পৌঁছুলে সে-সব বাড়িঘর আবার অদৃশ্য হয়ে পড়ে; অদিগন্ত দৃষ্টি ছুটে যেতে আর বাধা থাকে না। তবে নদীর পানে সে তাকায় না; বহুদিন নদীর তীরে বসবাস করেছে বলে নদীতে তার কৌতূহল নেই। তাছাড়া নদীর সঙ্গে তার সম্বন্ধ কি চিরতরে ছিন্ন হয় নি? নদীর দিকে নয়, এবার যে-কাছারি-আদালত এবং তার সামনে যে মাঠটি দেখতে পায় সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে সে এটু ইতস্তত করে থেমে পড়ে, যেন এগুতে কেমন ভয় হয়। তবে শীঘ্র আবার হাঁটতে শুরু করে। মাঠে নাবার আগে আরেক দফা থেমে একটি পান-সিগারেটের দোকান থেকে পান কেনে, একটু ভেবে এক বাণ্ডিল বিড়িও খরিদ করে নেয়। এ-সময়ে সে কয়েক জোড়া কৌতূহলী দৃষ্টি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে, কিন্তু কেউ কিছু না বললে মাঠে নেবে কাছারি আদালতের দিকে রওনা হয়। সে জানে, কাছারি-আদালতের সামনে পরিচিত লোকের অভাব হবে না। এ-শহরে পাঁচ বছর কাটিয়েছে, কত লোক তার হাতে টিকিট কিনেছে, কত লোক তারই সঙ্গে স্টিমারের জন্যে অপেক্ষা করেছে। তবে সে যে-কোনো বিশেষ লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যে কোনো ইচ্ছা বোধ করে তা নয়। তার মনে হয় কুমুরডাঙ্গার যে-কোনো লোক হলেই চলবে, যা তার বলার সাধ জেগেছে তা কোনো বিশেষ কারো জন্যে নয়, সমস্ত শহরের জন্যে; এ শহরের সকলের মধ্যেই সে কি বাস করবে না? সে। আর কোম্পানির লোক নয়, বিদেশীও নয়, তাদেরই একজন।
বার-লাইব্রেরির নিকটবর্তী হলে খতিব মিঞা বুঝতে পারে তাকে দেখে অদূরে কে যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মুখ ফিরিয়ে দেখে, উকিল আরবাব খান। বয়স বেশি নয়, তবে ইতিমধ্যে আরবাব খান বিচক্ষণ উকিল হিসেবে নাম অর্জন করেছে। কেমন অন্তরবিদ্ধ-করা ধারালো দৃষ্টিতে উকিল তার দিকে তাকিয়ে, স্বাভাবিক নীরস গম্ভীর মুখে একটা বিরূপভাব সুস্পষ্ট। তাকে দেখেই যে উকিলের মুখে বিরূপভাব দেখা দিয়েছে সে-বিষয়ে খতিব মিঞার সন্দেহ থাকে না। স্টিমার-কোম্পানি তাদের প্রতি একটি গুরুতর অবিচার করেছে-এমন একটি ভুল ধারণার জন্যে স্টিমার-কোম্পানি এবং কোম্পানির কর্মচারীদের ওপর শহরবাসীদের মনে যে-রাগ দেখা দিয়েছিল সে-রাগ হয়তো সম্পূর্ণভাবে কাটে নি।
ছুটি পেলাম। হেসে তাড়াতাড়ি বলে খতিব মিঞা।
মানে?
আমার অবসর হয়ে গেল। স্টিমারঘাট বন্ধ হল, আমার চাকুরিজীবনও শেষ হল। এবার উকিল আরবাব খান কিছু না বললে আবার দ্রুতকণ্ঠে বলে, অবসর হত একদিন, তা হয়েছে। সে-কথা নয়। ঠিক করেছি কুমুরডাঙ্গায়ই থেকে যাব।
উকিল আরবাব খানের চোখে কী-একটি ছায়া দেখা দেয়। হঠাৎ খতিব মিঞা অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে। সে বুঝতে পারে, আজ সকাল থেকে নিজেকে সহসা কুমুরডাঙ্গার অধিবাসী বলে গণ্য করতে শুরু করলেও এ-শহরের অধিবাসীদের চোখে সে বিদেশী মাত্র। এ শহরে পাঁচ-পাঁচটি বছর কাটালেও এ-শহরে ঠিক বাস করে নি, কারণ ডাঙায় থেকেও সে ঠিক ডাঙায় থাকে নি। তাছাড়া এ-শহরের সমাজে যদি একটি ছোটখাটো স্থান দখল করেছিল, কিছু মানসম্মানের অধিকারী হয়েছিল, সে-সবের সূত্র ছিল স্টিমার-কোম্পানি; সে-সূত্র ছিন্ন হয়েছে। এখন কোম্পানির রক্ষাবর্ম ছাড়া শুধুমাত্র খতিব মিঞা হিসেবে একাকী কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের একজন বলে, তারা তাকে গ্রহণ করুক-এই প্রার্থনা নিয়ে। তার সহসা ভয় হয়, তারা কি তাকে আশ্রয় দেবে, তাদেরই একজন বলে গ্রহণ করবে?
উত্তেজিত হলে বা মনে কোনো আশঙ্কা দেখা দিলে খতিব মিঞার জবানে তোতলামির ভাব জাগে। তো-তত করে সে আবার বলে, বুঝলেন না, এ-শহরে মন পড়ে গিয়েছে। সেজন্যেই ঠিক করেছি এ-শহরে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব।
উকিল আরবাব খানের মুখভাবে কোনো পরিবর্তন হয় না, তবে ছায়াটি যেন কাটে হয়তো বিরূপভাবটি ঈষৎ নরম হয়।
কাছারি-আদালতের সামনে কিছু সময় কাটিয়ে খতিব মিঞা আবার বাজারের দিকে রওনা হয়। বাজারের পথে প্রবেশ করার আগে সে-ই থমকে দাঁড়ায়, কারণ সে দেখতে পায় ডাক্তার বোরহানউদ্দিন এগিয়ে আসছে। তাকে দেখে খতিব মিঞার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কারণ সে জানে লোক হিসেবে ডাক্তার বোরহাউদ্দিন বড় ভালো, তার মধ্যে কোনো কুটিলতা নেই, দেমাগ-অহঙ্কার নেই। তার সামনাসামনি হলে খতিব মিঞার মুখ দিয়ে অজস্র শব্দ বেরিয়ে আসে আথালি-বিথালিভাবে। তার অবসরপ্রাপ্তি, ক্ষতিপূরণের বিষয়ে বিবেচনাজ্ঞানশীল স্টিমার-কোম্পানির সিদ্ধান্ত, অবসরজীবন সম্বন্ধে নানা পরিকল্পনা, পাটকলের কর্মচারী-ছেলের ভবিষ্যৎ-কত কথাই-না সে বলে। হয়ত তার এই খেয়াল হয়, কুমুরডাঙ্গা শহরের অন্তরে স্থান পেতে চাইলে সে-শহরের অধিবাসীদের প্রথমে তার অন্তর উন্মুক্ত করে দেখানো দরকার। তবে কুমুরডাঙ্গার বিষয়ে বলতে গিয়ে সে সহসা বেসামাল হয়ে পড়ে।
প্রথম দিনই শহরটা ভালো লেগেছিল। বুঝলেন না, এ-শহরে বড় মায়া পড়ে গিয়েছে। কী করে কুমুরডাঙ্গা ছেড়ে যাই বলুন?
অবশেষে ডাক্তার বোরহানউদ্দিনকে রেহাই দিয়ে খতিব মিঞা বাজারের পথে পা বাড়ায়। ততক্ষণে মনে-প্রাণে বেশ উৎফুল্ল বোধ করতে শুরু করেছে, কী-একটা উত্তেজনায় পদক্ষেপ দ্রুত হয়ে উঠেছে। কয়েক পা এগিয়েছে এমন সময়ে কন্ঠের সম্ভাষণে ফিরে তাকিয়ে দেখে অপরিচিত একটি যুবক স্মিতমুখে তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে। যুবকটি তার পরিচয় দিলেও তাকে চিনতে পারে না, কিন্তু উচ্চকণ্ঠে বলে, কেন চিনব না, খুব চিনি আপনাকে। ধরতে গেলে আমি এ শহরেরই মানুষ। যা বাকি ছিল তা এবার পূর্ণ হল। বুঝলেন না, এ শহরেই থাকব ঠিক করেছি। যাবার জায়গার অন্ত নেই, তবে এ শহরে যেন শিকড় গজিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ থেমে অপ্রত্যাশিতভাবে যুবকটি জিজ্ঞাসা করে, এদিকে লোকেরা পানের বরজ করে নাকি?
প্রশ্নটি অপ্রত্যাশিত হলেও অর্থহীন নয়। বাল্যকাল থেকে পানের বরজের প্রতি খতিব মিঞার একটি দুর্বোধ্য আকর্ষণ। সময়-অসময়ে খবরাখবর নিয়ে কোমলপ্রাণ পানগাতার লালন-পালনের কলাকৌশল সম্বন্ধে বেশ কিছু জ্ঞান অর্জন করেছে এই আশায় যে একদিন সুযোগ পেলে বরজ দেবার স্বপ্ন কার্যে রূপান্তরিত করবে। হঠাৎ পুরাতন শখটি জাগে তার মনে। ভাবে, কুমুরডাঙ্গায় কিছু জমি নিয়ে বাড়ি করতে পারলে একটা পানের বরজ দেবে। বুঝলেন না, এ জমিতে যা লাগাবেন তাই ফলবে। সোনার জমি আর কি।
বাজারের পথের দুপাশে এ-দোকানে সে-দোকানে কিছু কিছু সময় কাটায় খতিব মিঞা, কিন্তু ছলিম মিঞার সাইকেলের দোকানেই আড্ডা জমে যায়; হয়তো দুজনেই অবিলম্বে পরস্পরের গাছ-লতাপাতা করবার শখটি আবিষ্কার করে। তবে শীঘ্র পানের বরজের কথা ভুলে গিয়ে খতিব মিঞা আবার কুমুরডাঙ্গা সম্বন্ধে উৎসাহিত হয়ে এমন সব কথা বলতে শুরু করে যা আগে কখনো তার মাথায় আসে নি, এবং যা বলতে গিয়ে নিজেই কী-একটা ভাগাবেগে অভিভূত হয়ে পড়ে।
বুঝলেন না, সারা জীবন এখানে-সেখানে ঘরছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি, এবার এক জায়গায় আরাম করে বসতে পারব। তবে সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা, যে জায়গায় একবার মানুষের মনে পড়ে যায় সে-জায়গায় বাস করার সুযোগ পেলে সে আর কিছু চায় না। কিন্তু যে-সে জায়গায় কি আবার মন পড়ে? জায়গা এমন হওয়া চাই যার মাটি মনে ভয় সৃষ্টি করে না। কুমুরডাঙ্গায় পা দিয়েই বুঝেছিলাম এ-মাটিতে ভয় নেই। মৃত্যুর পর এমন মাটির বুকে আশ্রয় নিতে পারা বড় সৌভাগ্যের কথা।
ছলিম মিঞার স্ত্রর মধ্যস্থ গভীর রেখাগুলি পূর্ববৎ জেগে থাকলেও তাদের গভীরতা হ্রাস পায় যেন। অল্পক্ষণ নীরবতার পর সে জিজ্ঞাসা করে,
কোম্পানির বাড়ি ছাড়ার পর কোথায় যাবেন?
খতিব মিঞা এ-পর্যন্ত সে-বিষয়ে একবারও ভাবে নি। কিছু অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দেয়, একটা ছোটখাটো বাড়ি ভাড়া করে নেব। বাড়ি তোলা পর্যন্ত–
মেঝের দিকে কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ছলিম মিঞা সহসা মুখ তোলে, যেন কোনো ব্যাপারে সে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মনের মতো ভাড়াটে বাড়ি যতদিন না পান ততদিন আমার ওখানেই থাকবেন। দুটিমাত্র প্রাণী, ছেলেপুলে নেই। আপনাদের কোনো তকলিফ হবে না।
অল্প সময়ের জন্যে অবসরপ্রাপ্ত স্টেশনমাস্টার খতিব মিঞা বাক্যহারা হয়ে পড়ে, তারপর তার চোখের প্রান্তে হয়তো অশ্রুর আভাস দেখা দেয় বলে সেখানে ঈষৎ উজ্জ্বল কিছু নজরে পড়ে। পরে একটু ভাঙ্গা গলায় উত্তর দেয়, তা আপনার ওখানেই থাকব। এবার তার চোখের পানি পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।
শুধু খতিব মিঞার নয়, শহরের অনেক লোকের চোখ সেদিন অশ্রুসজল হয়ে ওঠে, কারণ খতিব মিঞা কুমুরডাঙ্গা সম্বন্ধে তার মাটি সম্বন্ধে যে-সব কথা বলে বেড়ায় তা অবিলম্বে সকলের কর্ণগোচর হয়; কুমুরডাঙ্গা সম্বন্ধে এমন সব কথা কেউ কখনো বলে নি। সহসা সেদিন থেকে সকলের মধ্যে নূতনভাবে জীবনসঞ্চার হয়, নৈরাশ্য নিরানন্দভাব দূর হয়।
দূরে রাতের অন্ধকারে সহসা ঘাটের আলো জেগে ওঠে : অনেক নদনদী অতিক্রম করে এ-ঘাট সে-ঘাটে থেমে যে-স্টিমারটি সেই সকাল থেকে চলছে তার চলা শেষ হতে আর দেরি নেই। ঘাটে আলো দেখে যাত্রীরা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে, যেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন কারগারে অকস্মাৎ আলোকরশ্মি এসে পড়লে দরজা খুলে গিয়েছে বুঝে কয়েদিরা চঞ্চল হয়ে ওঠে। নিমেষের মধ্যে তাদের কণ্ঠস্বরে স্টিমারের এ-মাথা থেকে ও-মাথা মুখরিত হয়ে পড়ে, ব্যস্তসমস্ত হয়ে তারা স্থলে অবতরণ করার জন্যে তৈরি হয়। এবার তবারক ভুইঞা থামে, তারপর তার সামান্য তল্পিতল্পা গুছিয়ে নেবার জন্যে উদ্যত হয়।
আমি একটু নিরাশ হয়ে ভাবি : তবে মুহাম্মদ মুস্তফার নামটি একবারও উল্লেখ না করে তবারক ভুইঞা চলে যাবে। তার সঙ্গে হয়তো আবার কখনো দেখা হবে না; যে ঘাটে আমরা দুজনেই নাবব সে-ঘাটে শুধু মাত্র একটি দিন কাটিয়ে পরদিনই আমার ফিরে যাবার কথা।
মুহাম্মদ মুস্তফার বিষয়ে তার এই মৌনতার কারণ কী? কুমুরডাঙ্গা নামক শহরের যে বিচিত্র কাহিনী সে আমাদের বলে শুনিয়েছে তার সঙ্গে হয়তো মুহাম্মদ মুস্তফার কোনো যোগাযোগ ছিল না, তবু কোনোপ্রকারে তার নামটি কি একবার মুখে নিতে পারত না? সে কি তার কথা ভুলে গিয়েছে, না কোনো কারণে অসংখ্য লোকের নাম ধাম-বৃত্তান্তে পরিপূর্ণ স্মৃতিপটেও তাকে স্থান দেয় নি? ইচ্ছা হয় সরাসরি জিজ্ঞাসা করি। মুহাম্মদ মুস্তফার কথা তার মনে পড়ে কিনা, পড়লে কুমুরডাঙ্গা ছেড়ে যাবার পর তার কী হয়েছিল, সে কী করেছিল-তা জানে কিনা। তবে জিজ্ঞাসা করা হয় না, কারণ মনে হয় মুহাম্মদ মুস্তফার বিষয়ে তার মৌনতা অনিচ্ছাকৃত নয়। সে সব জানে এবং সব জানে বলেই, তার নাম নিতে পারে নি। হয়তো তার কথা সে ভালোভাবে বোঝেও না; মানুষ যা বোঝে না সে-বিষয়ে সে কিছু বলতে চায় না। হয়তো কে জানে, যা ঘটেছিল তার জন্যে সে নিজেকে কোনো প্রকারে দায়ী মনে করে।
মুহাম্মদ মুস্তফা কুমুরডাঙ্গা থেকে ঢাকা যায় নি, তার সুহৃদ বন্ধু তাসলিম বা আশরাফ হোসেন চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা করে নি, সোজা দেশের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিল-চোখে ঘুমাভাবের রুক্ষতা, মুখে কী-একটা উদ্ভ্রান্ত ভাব। বেশভূষায় নূতন হাকিমের কোনো চিহ্ন ছিল না : মাথার চুল উস্কখুস্ক, পরনের লুঙ্গির প্রান্তভাগ কর্দমাক্ত, ছাত্র বয়সে কখনো-কখনো যেমন হাতে জুতা নিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হত তেমনি হাতে একজোড়া নূতন জুতা। চেহারা দেখেই বুঝেছিলাম কিছু একটা হয়েছে। মা-জান পরে বলেছিল, সে যখন সন্ধ্যার কিছু আগে নিঃশব্দে উঠানের প্রান্তে দেখা দেয় তখন কী কারণে বুকটা ছাঁৎ করে উঠেছিল। তবে আমার বা বাড়ির অন্য কারো সাহসে কুলায় নি জিজ্ঞাসা করি তার কী হয়েছে, কেন এমন চেহারা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। তার মা আমেনা খাতুন সে-রাতেই তার জন্যে ভাপা পিঠা বানাতে বসে। তবে হাতে কেমন জড়তা বোধ করেছিল বলে সেবার তা তেমন মুখরোচক হয় নি।
আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করি। জানতাম, মুহাম্মদ মুস্তফা নিজে থেকে না বললে তার কাছ থেকে কিছু জানতে পারা সহজ নয়। এ-ও জানতাম, বলবার কিছু থাকলে বা বলবার ইচ্ছা হলে এক সময়ে আমাকেই বলবে।
হয়তো দ্বিতীয় দিন সে বলে। বলে ধীরে-ধীরে, একটু-একটু করে, এমনভাবে যেন অন্য কোনো মানুষের কথা বলছে, বা যা-বলছে তা নিজের কাছেই অসম্ভব মনে হয়। সে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল তা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারে নি। প্রথমে আমাকে আন্দাজ-অনুমান করতে হবে, পরে খণ্ড-খণ্ড কথা একত্র করে অত্যাশ্চর্য কথাটি বুঝতে সক্ষম হই। তবে তা সত্য মনে হয় নি, নিদারুণ ভীতির জন্যে কাজটি করতে পারে নি তাও বিশ্বাস করি নি; মূল কথায় বিশ্বাস না হলে আনুষঙ্গিক কথায় কি বিশ্বাস হয়? হয়তো-বা আমার মনে হয়, সে যদি আত্মহত্যার চেষ্টা করেও থাকে তাহলেও গোড়া থেকেই জানত শেষপর্যন্ত তাতে সফল হবে না কারণ তার উদ্দেশ্য ছিল যে-কাল্পনিক প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মা তাকে ভীতিবিহ্বল করে তুলেছিল তাকেই ফাঁকি দেয়া : ফাঁকি দেয়া কিছুতেই সম্ভব নয় জেনেও কোনোপ্রকারে ফাঁকি দিতে সক্ষম হবে-এমন একটা আশা মানুষ কখনো ছাড়তে পারে না!
তবে একটি কথায় বড়ই বিস্মিত হই। সেটি এই যে, খোদেজা তার জন্যে আত্মহত্যা করেছে-বাড়ির লোকেদের এই ভিত্তিহীন অমূলক ধারণাটি কী করে মুহাম্মদ মুস্তফা বিশ্বাস করে নিয়েছে। কিন্তু কেন বিস্মিত হয়েছিলাম? সে কি সব কথাই নির্বিবাদে মেনে নেয় না? সে যে তা অস্বীকার করার চেষ্টা করেছিল, তাই কি অস্বাভাবিক নয়? কে জানে, খোদেজা তার জন্যে আত্মহত্যা করেছে-এমন কথা সে বিশ্বাস করে তা আমার পছন্দ হয় নি।
আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম, তবে প্রথমে মুহাম্মদ মুস্তফার মনের অবস্থাটা ঠিক বুঝতে পারি নিঃ কারো চিন্তাধারা কোনো বিশেষ সীমানা অতিক্রম করে গেলে সে কীভাবে কেন ভাবে-এ-সব বোঝা দুষ্কর। আমি অনেক কথাই বুঝতে পারি নি। এ-কথাও বুঝতে পারি নি যে আমিই তাকে রক্ষা করতে পারব-এই বিশ্বাসে মরিয়া হয়ে সে আমার কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে।
আমার অবিশ্বাস্য মনে হলেও সে সত্যিই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল। এমন একটি নিদারুণ কাজ করতে বসেছিল তা নিজেই উপলব্ধি করলে সে ভয়ানকভাবে বিচলিত হয়ে পড়ে, এ-ও পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে যে তার মধ্যে সাংঘাতিক কিছু না-ঘটলে এমন একটি কাজ করার কথা ভাবতেও পারত না। কিন্তু তার মানসিক বিভ্রান্তি যদি ঘটে থাকে তার কারণ কী? সে কেবল একটি উত্তরই খুঁজে পায়। তার মনে হয় যে-মেয়েটি আত্মহত্যা করে একটি প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মায় পরিণত হয়েছে, তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতে শুরু করছে, সে-ই দায়ী তার বিভ্রান্তির জন্যে, সে ই তাকে মৃত্যুর দ্বারে নিয়ে গিয়েছিল; তার কার্যকলাপ আর তার ক্ষমতার অধীন নয়, মেয়েটির আত্মা তার মন দখল করে তার ইচ্ছাশক্তি কাবু করে ফেলেছে, তাকে পরিচালিত করেছে নির্দয় ধ্বংসকারিণীর রূপ নিয়ে। চমকিত হয়ে সে এবার অনেক কিছুর মধ্যে গুঢ় অর্থ দেখতে পায়। যে-দিন বিয়ে করার উদ্দেশ্যে কুমুরডাঙ্গা থেকে স্টিমারযোগে ঢাকা অভিমুখে রওনা হবে সে-দিনই কেন স্টিমার-চলাচল বন্ধ হবে, পরদিন কি বন্ধ হতে পারত না? তারপর সহসা তার জ্বরে পড়া, আরোগ্যলাভ করেও ঢাকা যাওয়ার বিষয়ে গড়িমিসি বা হচ্ছে-হবে ভাব, পরে তসলিমের চিঠি বা তারের জবাব না দেয়া। এ-সবের পশ্চাতে সেই প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মার ইচ্ছাই নিহিত : তার মনে হয় এ-সবের অন্য কোনো ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। যে-মেয়ে মৃত্যুর পর অবিমিশ্র জিঘাংসায় পরিণত হয়েছে, তার ক্ষমতা দেখে মুহাম্মদ মুস্তফা এবার অতিশয় ভীত হয়ে পড়ে। হয়তো এ-সময়ে সে কিছু সম্বিৎ ফিরে পায়, একটু সুস্থিরভাবে ভাবতে সক্ষম হয়। সে বুঝতে পারে তাকে কিছু করতেই হবে, যে করে হোক নিজেকে বাঁচাতে হবে। সহসা তার মনে হয়, আমার সঙ্গে দেখা করা একান্ত প্রয়োজন। আমি কী ভাবি? আমিও কি বিশ্বাস করি খোদেজা আত্মহত্যা করেছিল? আমাকে কথাটা আগে জিজ্ঞাসা করে নি, জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনও বোধ করে নি। হয়তো আমি জানি তা সত্য নয়। এবং আমি যদি বলি তা সত্য নয়, বাড়ির লোকেদের ধারণাটির পশ্চাতে উদ্ভট কল্পনা ছাড়া আর কিছু নেই, তবেই খোদেজার নামে কী-একটা দুরাত্মা যে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, তাকে কী একটা অতল গহ্বরের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে-তার হাত থেকে মুক্তি পাবে।
আমাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করার জন্যেই সে এমনভাবে কুমুরডাঙ্গা ছেড়ে বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিল।
তবে আমার যেন কী হয়েছিল, সত্য উত্তর মুখে এসেও মুখেই থেমে গিয়েছিল। কেবল বলেছিলাম,
কী করে বলি? আমি তখন বাড়ি ছিলাম না।
এমনভাবেই উত্তরটি দিয়েছিলাম যেন খোদেজা আত্মহত্যা করেছে তা আমি নিশ্চিতভাবে জানি, কিন্তু তা মুখ ফুটে বলা সম্ভব নয়।
কেন সত্য কথাটি বলিনি, যা একেবারে ভিত্তিহীন বলে জানতাম বা ভিত্তিহীন বলে দ্বিধাশূন্য কণ্ঠে ঘোষণা করিনি কেন? আমার মনেও কি অবশেষে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল? না, সন্দেহ নয়, মনে সহসা মুহাম্মদ মুস্তফার প্রতি ভয়ানক ক্রোধ বোধ করেছিলাম; তার প্রতি কখনো এমন ক্রোধ বোধ করি নি। ক্রোধ বোধ করেছিলাম এই দেখে যে খোদেজা আত্মহত্যা করেছে তেমন একটা বিশ্বাস হলেও মুহাম্মদ মুস্তফার মনে একটু অনুতাপ নয়, মৃত মেয়েটির প্রতি ঈষৎ স্নেহমমতা নয়, সামান্য বিয়োগশোক নয়, নিদারুণ ভীতিই দেখা দিয়েছে। হয়তো তাও সহ্য হত যদি সরলা নিষ্পাপ খোদেজা তার চোখে একটি প্রতিহিংসাপরায়ণ দুষ্ট আত্মায় পরিণত না হত। তা কিছুতেই সহ্য হয় নি। বোধ হয় সেজন্যেই সত্য কথা বলা সম্ভব হয় নি।
তবু বলতাম যদি জানতাম সত্য কথা না বললে কী পরিণতি হবে, যদি বুঝতাম ইতিমধ্যে মুহাম্মদ মুস্তফা একটি অতল গহ্বরের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে : যারা তেমন একটি গহ্বর থেকে বহুদূরে তারা তার অস্তিত্বের কথা ভাবতেও পারে না।
পরদিন তখনো সূর্য ওঠেনি, এমন সময়ে মুহাম্মদ মুস্তফার মা আমেনা খাতুনের মর্মান্তিক আর্তনাদ শুনতে পাই। তেমন একটি আর্তনাদ শুনেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে, চাঁদবরণ ঘাটে সেদিনও আমেনা খাতুনই আর্তনাদ করে উঠেছিল। আর্তনাদ শোনামাত্র বুঝতে পারি। তবে তখন আর করার কিছু ছিল না; কেউ আর কিছু করতে পারত না।
যখন বাড়ির পশ্চাতে উপস্থিত হই তখন দেখতে পাই, যে তেঁতুলগাছের তলে বাল্যবয়সে একটি অদৃশ্য সীমারেখা পেরিয়ে গিয়েছিল সে গাছ থেকে মুহাম্মদ মুস্তফার নিষ্প্রাণ দেহ ঝুলছে, চোখ খোলা। সে চোখ শ্যাওলা-আবৃত ডোবার মতো ক্ষুদ্র পুকুরে কী যেন সন্ধান করছে।
সহসা সচকিত হয়ে দেখি তবারক ভুইঞা উঠে পড়েছে। উঠে পড়েও কয়েক মূহূর্ত সে দাঁড়িয়ে থাকে, মুখে অন্যমনস্ক ভাব, চোখের কোণে ক্ষীণ হাসিটি আর নেই। তারপর গা-মোড়া দিয়ে আলস্য ভেঙে সে বলে, নদী কি তার নিজের দুঃখে কেঁদেছিল? নদী কেঁদেছিল তাদের দুঃখেই।
যাত্রীদের অনেকে নিচের পথ ধরেছে। আমিও তাদের দলে ভিড়ে পড়ি।
পরে স্টিমার ঘাটে ভিড়বার জন্যে অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে অপেক্ষা করছি তখন তবারক ভুইঞার শেষোক্তিটি সহসা মনে পড়ে। কিছুক্ষণ আগে ওপরে সে বলেছিল, নদী যদি কেঁদে থাকে তবে নিজের দুঃখে নয়, কুমুরডাঙ্গার অসহায় অধিবাসীদের দুঃখেই কেঁদেছিল। হয়তো সবই সে জানে, হয়তো কথাটি বলবার সময়ে মুহাম্মদ মুস্তফার কথাই সে ভেবেছিল।
স্টিমার ধীরে ধীরে ঘাটের পাশাপাশি হয়, তার চতুষ্পার্শ্বে উচ্ছৃঙ্খল পানি শতশত হিংস্র সরীসৃপের মতো গর্জন করে। তবে সহসা আমার মনে হয় নদী যেন নিষ্ফল ক্রোধেই কাঁদছে। হয়তো নদী সর্বদা কাঁদে, বিভিন্ন কণ্ঠে, বিভিন্ন সুরে, কাঁদে সকলের জন্যেই। মনে মনে বলি: কাঁদো নদী, কাঁদো।