মুহাম্মদ মুস্তফার শান্ত সশ্রদ্ধ-দারোগার ধর্মপরায়ণতা সম্বন্ধে সজ্ঞান হবার পর আপনা থেকেই তার প্রতি মুহাম্মদ মুস্তফার মনে শ্রদ্ধার ভাব জেগে উঠেছিল-চোখ নিবদ্ধ, থাকে পুলিশের কর্মচারীটির ওপর, মনোযোগসহকারেই তার মুখে সে কুমুরডাঙ্গার খবরাখবর শোনে। সে-শহরে কখনো যায় নি, সে-শহরে যাচ্ছে হাকিমগিরি করতে যে কাজও পূর্বে কখনো করে নি। বস্তুত, সে-শহরে তার জীবনের একেবারে নূতন একটি অধ্যায় শুরু হবে। তবু সে যে মনে কোনো উত্তেজনা বোধ করে তা নয়, বরঞ্চ জীবনের একটি নূতন অধ্যায় শুরু করবার জন্যে অজানা অপরিচিত একটি শহরের অভিমুখে যাওয়া তার কাছে নিতান্ত স্বাভাবিক মনে হয়। সবকিছু সে অতি সহজে গ্রহণ করে নেয়-ছোট-বড় ঘটনা, সাধারণ-অসাধারণ ঘটনা। সর্বদা সে ভাগ্যের নৌকায় একটি আরোহীর মতোই বোধ করে, যে-নৌকা সে চালনা করে না, যার দিক-গতিপথ স্থির করে না। সে যে একাকী কুমুরডাঙ্গা অভিমুখে চলেছে, তাও তার নিকট স্বাভাবিক মনে হয়। একা যাওয়ার কথা ছিল না, ব্যবস্থা হয়েছিল প্রথমে বিয়ে হবে, তারপর কুমুরডাঙ্গায় যাবে স্ত্রীকে নিয়ে। কিন্তু বিয়ে হয় নি, খোদেজার আকস্মিক মৃত্যুর জন্যে বিয়েটা কিছুদিনের জন্যে স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো তার প্রয়োজন ছিল না। তবু বিয়ের পাকা দিনটা না ভেঙে পারে নি। সে কি তবে বাড়ির লোকদের বিচিত্র, উদ্ভট কথায় তারই অজান্তে কিছু বিচলিত হয়ে পড়েছিলসে-সম্ভাবনা তাকে ক্ষণকালের জন্যে ঈষৎ চিন্তিত করে, কিন্তু ধারণাটি যে নিতান্ত অহেতুক তা বুঝে শীঘ্র তা মন থেকে তাড়িয়ে দেয়। না, সে যে সস্ত্রীক নয়, একাকীই কুমুরডাঙ্গার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, ব্যবস্থায় যে একটু গোলযোগ হয়েছে-তাও সে নির্বিবাদে গ্রহণ করে নিয়েছে। যা হবার হয়েছে, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা খেদ-দুঃখ করা বৃথা।
যা হয়ে গিয়েছে তা নিয়েই সত্যিই কখনো সে ভাবে না। মনে আছে, একবার বাড়ি থেকে চাঁদবরণঘাট পর্যন্ত তাকে পৌঁছিয়ে দিতে গিয়েছিলাম। গ্রীষ্মের ছুটির পর সে শহরে ফিরে যাচ্ছিল। খালের পথে নৌকায় করে কিছু দূর এগিয়ে গিয়েছি এমন সময় সহসা তার স্মরণ হয় একটি বড় দরকারি বই বাড়িতে ভুলে এসেছে। সারা ছুটিতে উঠানে গাছের তলায়, পুকুরের ধারে, ক্ষেতের পাশে বসে বা বিছানায় শুয়ে বইটি পড়েছে, এক মুহূর্তের জন্যেও হাতছাড়া করে নি, এমনকি শোবার সময়েও বইটি তার বালিশের নিচে রাখত যাতে সকালে ঘুম ভাঙলেই সেটি খুলে চোখের সামনে ধরতে পারে।
ছোট টিনের সুটকেসে বইটা নেই তা জেনেও সে ক্ষিপ্রহস্তে সেটি খুলে একবার তার ভেতরটা হাতড়ে দেখে, মুখে গভীর উৎকণ্ঠার ছায়া। তবে সুটকেসটি বন্ধ করেছে কি অমনি ছায়াটি মিলিয়ে যায়। সারা পথে বইটির কথা একবার বলেও নি, ভাবেও নি। যা হয়ে গিয়েছে তা নিয়ে ভেবে লাভ কী? তবে এটি একটি ছোট উদাহরণ। একবার তার বৃত্তি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন আমাদের দক্ষিণ-বাড়ি উত্তর-বাড়ি দুই বাড়িরই সংসারে বড় অনটন, একটি কলেজের ছাত্র পোষার সাধ্য কারো নেই। তার ওপর তখন আমার চাচা, অর্থাৎ মুহাম্মদ মুস্তফার বাপ, আর জীবিত নেই। সে বুঝতে পারে, পড়াশুনা চালানো সম্ভব নয়। এক রাত ভেবে পরদিন স্থির করে, আর কলেজে ফিরে যাবে না। কথাটি শান্তকণ্ঠে জানায়, মুখে কোনো রকম দুঃখ বা আফসোসের ক্ষীণতম চিহ্ন দেখা যায় না। অনেকে মনের কথা ঢাকে, সমগ্র হৃদয় দিয়ে যা কামনা করে তাতে বিফল মনোরথ হলেও তাদের দুঃখ প্রকাশ করে না। মুহাম্মদ মুস্তফা যে তার দুঃখ হতাশা ঢাকে তা নয়, অতি দুঃখের কথাও সম্পূর্ণচিত্তে গ্রহণ করে বলে দুঃখবোধের অবকাশই ঘটে না তার।
ভাগ্যবশত সেবার মুহাম্মদ মুস্তফাকে পড়াশুনা বন্ধ করতে হয় নি; বৃত্তির কর্তৃপক্ষ নামে ভুল করেছিল।
সহসা তীরের দিকে তাকিয়ে দারোগা বলে, এই যে, কুমুরডাঙ্গা এসে পড়েছে।
ঈষৎ ঔৎসুক্যের সঙ্গে মুহাম্মদ মুস্তফা দারোগার দৃষ্টি অনুসরণ করে তীরের দিকে তাকায়, কিন্তু কোথাও কোনো শহরের চিহ্ন দেখতে পায় না।
ঝাউগাছটি দেখতে পাচ্ছেন? খোলা দরজা দিয়ে হাত প্রসারিত করে দারোগা। জিজ্ঞাসা করে। ঝাউগাছটি কুমুরডাঙ্গার নিশানা। তারপর একটি বাঁক, বাঁকের পাশে কুমুরডাঙ্গা।
যথাসময়ে একটি বাঁক পেরিয়ে স্টিমার কুমুরডাঙ্গার নিকটবর্তী হয়। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। নদীর তীরে যে-স্টিমারঘাটটি সহসা দৃশ্যমান হয়, সে-ঘাট দিনান্তের ধূসর আলোয় বিষণ্ণ, একটু নিঃসঙ্গ দেখায়।
তবারক ভুইঞা (সে যে তবারক ভুইঞা সে-বিষয়ে সন্দেহের কোনোই কারণ দেখতে পাই না) বলছিল : যেদিন স্টিমার-চলাচল বন্ধ হয় সেদিন স্টিমারঘাটের ফ্ল্যাটের ওপর-তলায় নদীর ধারে তার ছোট আপিস-ঘরে স্টেশনমাস্টার খতিব মিঞা স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল, মুখে দুশ্চিন্তার রেখা। এ-সময়ে সূর্যের আলো নদীর পানি থেকে আপিস-ঘরের ছাদে প্রতিফলিত হয়ে নিঃশব্দে নৃত্য করে; তারই ছিটেফোঁটা তার মুখে। বস্তুত সে-আলোর ঝলকানি তার মুখের দুশ্চিন্তার রেখাগুলি নিয়ে নির্মমভাবে খেলা করে যেন।
ঘন্টাখানেক আগে কোম্পানির সদর দফতর থেকে যে-সংক্ষিপ্ত তার এসে পৌঁছেছে, সে-তারের সংবাদ অপ্রকাশিত না-হলেও তা স্টেশনমাস্টার খতিব মিঞাকে কেমন বিচলিত করে ফেলেছে। সংবাদটি এই যে, স্টিমার আসবে না। কেন আসবে না-তার কোনো উল্লেখ নেই সে-সংক্ষিপ্ত তারে।
স্টিমার আসবে না-সে-কথাই স্টেশনমাষ্টার বার বার ভাবে : নিত্য একবার উজানে একবার ভাটিতে দু-দুবার ঘাটে জীবন-স্পন্দন জাগিয়ে অব্যর্থভাবে যে-স্টিমার এসেছে সে-স্টিমার আসবে না। সুগম্ভীর সুরে বাঁশি বাজিয়ে দূরত্বের বিচিত্র আবহাওয়া সৃষ্টি করে স্টিমারের আগমন, ঢেউ-এর উচ্ছল নৃত্য, যাত্রীদের ব্যস্ত ওঠা-নাবা, লস্করদের কর্মতৎপরতা, অবশেষে স্টিমারের প্রস্থানের পর আকস্মিক নীরবতা, আরো পরে উল্টো পথের স্টিমারের জন্যে প্রতীক্ষা-এ-সব দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার পর নিতান্ত গতানুগতিক মনে হলেও খতিব মিঞার জন্যে একটি সত্যের পুনরোচ্চারণের মতোই: সে ঘাটের স্টেশনমাস্টার। তাছাড়া মানুষ জীবনের যে-ছন্দ শ্বসনের মতো স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে নেয় তাতে অকস্মাৎ বাধা পড়লে নিরাপত্তার শত আশ্বাস সত্ত্বেও তার মনের অতলে লুক্কায়িত যে-শঙ্কাভীতি চিরজাগ্রত, সে-শঙ্কাভীতি অকারণেই মাথা নাড়া দিয়ে ওঠে অস্বাভাবিক কোনো আওয়াজে বিবরবাসী জীব যেন সভয়ে আত্মপ্রকাশ করে।
খতিব মিঞা নিজেকে কিছু সংযত করে। তবু অনভিজ্ঞ শিক্ষানবিশীর মতো অসহায় বোধ না করে পারে না। সে বুঝতে পারে না কী করবে : সহসা যেন কিছু করার নেই। কবর কীই-বা রয়েছে? একটু আগে একবার নিচে গিয়েছিল। তখন সে অল্পবয়স্ক টিকিটকেরানিকে নোটিশ টাঙিয়ে দিতে বলেছে, অধিকাংশ যাত্রী নিরক্ষর হলেও লিখিত নোটিশ জারি করা একটি অলঙ্ঘনীয় আইন। তারপর অনির্দিষ্টভাবে নিচে কিছু ঘোরাঘুরি করে ওপরে উঠে এসেছে। আসবার সময় কী কারণে যাত্রীদের কথা নয়, মালঘরে স্তূপাকার করে রাখা চালানি কলার কথাই একবার তার মনে পড়েছিল। কুমুরডাঙ্গা থেকে রাশি-রাশি কলা চালান যায়, যার জন্যে মাল-ঘরে সে-ফলের গন্ধ ভারি হয়ে থাকে সর্বক্ষণ, নদী থেকে অনবরত ভেসে-আসা হাওয়ায়ও তা দূর হয় না। খতিব মিঞা মনে-মনে বলেছিল, কলাগুলো পচবে। তারপর সিঁড়িতে পা দিয়ে ইতিমধ্যে সমাগত কয়েকজন নিম্নশ্রেণীর যাত্রীদের প্রতি একবার দৃষ্টি দিয়েছিল, তবে তাদের ঠিক দেখতে পায় নি। হয়তো কেবল তার মনে হয়েছিল, যাত্রীরা আজ বেশ সকালে-সকালেই এসে পড়েছে। কোনো কোনোদিন তারা অসময়েই ঘাটে উপস্থিত হয়। অধিকাংশ লোক ঘড়ি দেখে স্টিমার ধরতে আসে না, মেঘশূন্য দিনে আকারে সূর্যের দিকে চেয়ে সময় নির্ণয় করে এবং ঝড়বাদলের দিনে সময়-আন্দাজ করে ঘাট অভিমুখে রওনা হয়। তবে সময়ের বিষয়ে কখনো নিশ্চিত হতে পারে না বলে বা যাত্রায় একবার মনস্থির করে ফেলার পর আর দেরি সয় না বলে আগে-ভাগেই এসে পড়ে। তাছাড়া শহরের বাইরে থেকে এ-গ্রাম সে-গ্রাম থেকে হেঁটে গরুগাড়ি করে নৌকায় নদী পাড়ি দিয়ে যারা আসে তারাও অসময়ে ঘাটে এসে উপস্থিত হয়। তারা যে এসে পড়েছে সে-কথা মাল-ঘরে বা ওপরের আপিস-ঘরে থাকলেও খতিব মিঞা বুঝতে পারে, কারণ নিত্য একইভাবে ঘাটে তাদের আগমন ঘোষিত হয় : সম্পূর্ণ নীরবতার মধ্যে হঠাৎ আতসবাজির মতো আকস্মিক হাঁক-ডাক শোনা যায়, যে-হাঁক-ডাক পরে একটি অস্পষ্ট গুনে, আরো পরে একটি অবিচ্ছিন্ন কোলাহলে পরিণত হয়। তবে সে কেবল প্রথম হাঁক-ডাকটাই শোনে, এবং তখন চমকিত হয়ে পকেট থেকে জেবঘড়ি বের করে সময়টা যাচাই করে নেয়, কিন্তু পরে যাত্রীদের কোলাহল আর তার গোচর হয় না : দূর থেকে শোনা স্টিমারের বংশীধ্বনি বা স্টিমার কাছে এলে তার পাখার আঘাতে নির্মমভাবে আন্দোলিত মথিত পানির আর্তনাদের মতোই যাত্রীদের কোলাহল ঘাটের অন্যতম সুপরিচিত আওয়াজ মাত্র।
ওপরে এসে আপিস-ঘরে প্রবেশ করার আগে নদীর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনেকক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল যদিও সে জানে নদীর বুকে যে-রহস্যময় লীলাখেলা চলে থাকবে তার কোনো চিহ্ন সেখানে নেই নদীর উপরিভাবে এখনো কিছু দৃশ্যমান হয় নি। তবু সামনে নদীর বুকে সে কী যেন দেখবার চেষ্টা করে। তার সে-চেষ্টা অর্থহীন বুঝে দূরে নদীর অপর তীরের দিকে দৃষ্টি দেয়। এ-ধারে কড়া রোদের বর্ষণ, কিন্তু ওপারে দিগন্তের কাছে আকাশ কালো করে মেঘ সঞ্চার হয়েছে। সে দাঁড়িয়েই থাকে, নদীর দিক থেকে যে-হাওয়া ভেসে আসে সে-হাওয়ায় তার পায়জামার নিম্নাংশ পতাকার মতো ফৎ করে আন্দোলিত হয়। খতিব মিঞা ছোটখাটো মানুষ, তবে চওড়া কপালের তলে অস্থিসব মুখটিতে দায়িত্বশীল মানুষের সহজ-গাম্ভীর্য : দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানি তার ওপর যে-আস্থা প্রদর্শন করেছে সে-আস্থা তার ব্যক্তিত্বে প্রতিফলিত হয়ে-হয়ে এক সময়ে সে-ব্যক্তিত্বের একটি অবিভাজ্য অংশে পরিণত হয়েছে যেন।
আপিস-ঘরে ঢুকে কিছু-ভাঙ্গা একটি কাঠের চেয়ারে বসে পিঠদাঁড়া খাড়া করে সামনের টেবিলের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর সে স্থির করে, না, কিছুই করবার নেই, অন্য দিন এ-সময়ে মল-ঘরে তালা দিয়ে টিকিট-ঘরে গিয়ে বসত, আজ মাল-ঘরে বা টিকিট-ঘরে কোনো কাজ নেই। স্টিমার আসবে না সে-খবর প্রচার করবার জন্যে টিকিট-ঘরের জানলার সামনে টাঙ্গানো নোটিশটি যথেষ্ট না হলে অল্পবয়স্ক কেরানিটি এবং হেঁড়ে-কণ্ঠ লস্কর-সর্দার বাদশামি রয়েছে। বাদশা মিঞার বয়স হয়েছে, কিন্তু তার গলা কমজোর হয় নি।
খতিব মিঞা যখন একবার স্থির করে তার কিছুই করবার নেই তখন তার দুশ্চিন্তাটা কিছু লাঘব হয়, এবং এ-সময়ে সহসা সে অনুভব করে হাওয়াটা আর্দ্র-শীতল হয়ে উঠেছে। পার্শ্ববর্তী জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখে, অদূরে নদীর বুকেও একটা কালো ছায়ার সঞ্চার হয়েছে। মেঘ এদিকে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে কতক্ষণ সে নিচে থেকে ভেসে-আসা কোলাহলের প্রতি কান দেয়। সে বুঝতে পারে, কোলাহলটি অন্য দিনের মতো নয়, কারণ তাতে যেন যাত্রা-উনখ লোকদের সুপরিচিত ব্যাকুলতা উত্তেজনা নয়, বিস্ময় বিহ্বলতার সঙ্গে মিশ্রিত একটি গভীর অসহায়তা প্রকাশ পায়; যেন যাত্রীর নয়, মানুষের অসহায়তাই। তবে কথাটি তার মনে স্পষ্ট রূপ ধারণ করে না : তেমন কোনো কথা স্পষ্টরূপে বুঝবার ক্ষমতা কোনোদিন সে রাখলেও আজ রাখে না। তাছাড়া, এ সময়ে হয়তো আর্দ্র-শীতল হাওয়ার জন্যে তার চোখটা লালচে হয়ে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেহে যে-আমেজ ধরে সে-আমেজের রস সন্ধানে সে মনোনিবেশ করে। নিন্দ্রা আলো-হাওয়ার মতো খোদাই নেয়ামত : সুযোগ-সুবিধা পেলে স্টেশনমাস্টার সে নেয়ামত উপভোগ করে থাকে। এবং নিশ্চিতভাবেই উপভোগ করে এই কারণে যে দরকার হলে নিমেষের মধ্যে সে পাখির মতো জড়তাশূন্য দৃষ্টি নিয়ে জেগে উঠতে পারে, সে-চোখে ঘুমের লেশ পর্যন্ত দেখা যায় না তখন।
তার নিদ্রাভঙ্গ হতে দেরি হয় না। বিলম্বিত ঢেউ-এ ভর করে লস্কর-সর্দার বাদশা মিঞার হেঁড়ে-গলা, তারপর তার পশ্চাতে আরেকটি গলা এবার সহসা তার কর্ণগোচর হয়। দ্বিতীয় গলা শহরের গণ্যমান্য উকিল কফিলউদ্দিনের হবে; উকিলের কণ্ঠস্বর ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সিঁড়ি থেকে একবার তার জুতার এবং লাঠির শব্দ আসে। নিঃসন্দেহে সে ওপরের দিকেই আসছে। তারপর আরো পদধ্বনি শোনা যায়; হয়তো কুমুর ডাঙ্গার গণ্যমান্য উকিলকে অনুসরণ করে অনেক লোক ওপরের পথ ধরেছে।
দীর্ঘাকৃতি বৃদ্ধবয়সী উকিল কফিলউদ্দিন অবশেষে ওপরে যখন দৃশ্যমান হয় তখন খতিব মিঞা সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে ভালো-মন্দ সর্বপ্রকারের পরিস্থিতির জন্যে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে, তার চোখ পাখির চোখের মতো জড়তাশূন্য।
স্টিমারের কী হল? উকিল সাহেব জিজ্ঞাসা করে। প্রশ্নে আশঙ্কা নয়, গভীর বিরক্তি প্রকাশ পায়।
খতিব মিঞা কয়েক মুহূর্ত নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন সে মুখের কথা হারিয়েছে। সে ভাবে, তারযোগে যে-সংবাদ এসেছে তার বেশি বলা উচিত হবে কিনা। কী উচিত কী উচিত নয়-সে-বিষয়ে কখনো সে মনস্থির করতে পারে না। কালেভদ্রে উচ্চপদস্থ কোনো কর্মচারী ঘাট পরিদর্শন করতে আসছে খবর পেলে সে কেমন বেসামাল হয়ে পড়ে। কখনো তার মনে হয়, পরিদর্শনকারী কর্মচারী ফ্ল্যাটটিকে নোংরা অবস্থায় পেলে তার মান-ইজ্জত যাবে। সবকিছু তুলে সে ফ্ল্যাটের পরিচ্ছন্নতার কাজে উঠে-পড়ে লেগে যায়, কতবার সে ওপরের অসমতল কালের হাওয়ায় বিবর্ণ, চামচিকা-বাদুড়ের মল বিষ্ঠায় চিত্রিত পাটাতনটি সাফ করায় তার ঠিক নেই; পরিদর্শকারী কর্মচারী এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ সচরাচর ওখানেই বসে। অন্যবার ফ্ল্যাটের স্বাভাবিক অপরিচ্ছন্নতার কথা ভুলে গিয়ে হিসাবপত্রের দিকে মন দেয়। আবার কোনোবার মালপত্রের দিকে তার দৃষ্টি যায়। সেবার তার মনে সন্ত্রাস উপস্থিত হয় এই ভেবে যে পরিদর্শনকারী কর্মচারী হঠাৎ আবিষ্কার করবে তার দায়িত্বে সোপদকরা কোনো জিনিস গুম হয়ে গিয়েছে। মান-ইজ্জত কীভাবে যায় সে-বিষয়ে প্রত্যেক মানুষ তার নিজস্ব মতামত পোষণ করে থাকে। তহবিল তছরূপ করেছে-এমন অভিযোগে যে-মানুষ বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না, সে আবার অধার্মিকতার অভিযোগে গভীরভাবে আহত হয়, যে-মানুষ চরিত্রহীনতার অপবাদে অবিচল থাকে সেই আবার মিথ্যাবাদের অভিযোগে ক্রোধে অপমানে আত্মহারা হয়ে পড়ে। হয়তো খতিব মিঞা কখনো বুঝে উঠতে পারে নি তার মান ইজ্জতটা ঠিক কোথায়। তবে বর্তমান ক্ষেত্রে সমস্যাটি বড়ই জটিল মনে হয় এই কারণে যে সে দেখতে পায় তার মান-ইজ্জত নয়, কোম্পানির মান-ইজ্জতই সঙ্কটাপন্ন। কোম্পানির নামে সে যদি অন্যায় কিছু বলে ফেলে তাহলে কোম্পানির মান-ইজ্জত যাবে কি?
খতিব মিঞা উত্তরের জন্যে অপেক্ষমান উকিল কফিলউদ্দিনের দিকে তাকায়, লোকটি বিশ্বাসযোগ্য কিনা তাই যেন জানবার চেষ্টা করে। তবে মানুষের স্বভাবচরিত্র বা অন্তরের কথা বোঝা তার পক্ষে সহজ নয়। বহুদিন হল তারই অজান্তে দুনিয়াটি কখন সঙ্কীর্ণ হয়ে কর্মজীবন ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং মানুষ এখন একটি রূপেই দেখা দেয় তার চোখে-যাত্রীর, এবং দুদণ্ডের জন্য দেখা সে-যাত্রীও ভালো-মন্দ আশা-নিরাশা সুখ-দুঃখ মিশ্রিত রক্তমাংসের মানুষে পরিণত হবার সুযোগ পায় না : যাত্রীরা ছায়া, উড়ন্ত পাখির ছায়া, যে-ছায়া দিনে দুবার দেখা দেয় তার কর্মজীবনের প্রাঙ্গণে; কে কী-রকমের লোক তা বোঝার ক্ষমতা সে সত্যিই হারিয়েছে। তবে সব ছায়া এক নয়, ছায়ার মধ্যেও প্রভেদ রয়েছে, সে-ছায়া শ্রেণীবিভক্ত-যে-কথা বুঝবার জন্য তাকে কারো চেহারা পোশাক-পরিচ্ছদ আচরণ-ব্যবহার লক্ষ করে দেখতে হয় না। হয়তো পায়ের শব্দে বা গলার আওয়াজেই সে বুঝে নেয় কোন যাত্রী উচ্চ শ্ৰেণীর, মধ্যম-শ্রেণীর বা নিম্ন-শ্ৰেণীর। এবং বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতি আপনা থেকেই তার আচরণ ভিন্নরূপ ধারণ করে। অতএব সে যখন উকিল কফিলউদ্দিনের দিকে তাকায় তখন সে তার সম্ভ্রান্ত চেহারা বা তার কপালে বিরক্তির রেখা ঠিক দেখতে পায় না, একথাই তার স্মরণ হয় যে সে উচ্চ-শ্রেণীতে ভ্রমণ করে, তার দাবিদাওয়া বেশি, তাকে হেলা করাও নয়। নিচে যে-নোটিশ টাঙ্গানো হয়েছে সে-নোটিশের শব্দগুলির পুনরাবৃত্তি করেই কি এ-যাত্রীকে সন্তুষ্ট করা যাবে?
খতিব মিঞা দ্রুতভাবে কিন্তু গোপনে একটি বড় ধরনের নিঃশ্বাস নেয়, তার নাসারন্ধ্র কেঁপে ওঠে। দ্রুতভাবে একবার ভাবে, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে ঝড়-তুফান বা কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনার জন্যে স্টিমার আসছে না, তা নয়। সে-সব কারণে ক্বচিৎ কখনো স্টিমার আসতে দেরি করে বৈকি। বছর তিনেক আগে কুমুরডাঙ্গা থেকে দশ। ক্রোশ দূরে উজানের স্টিমারে একবার আগুন ধরেছিল। আগুন ঠিক নয়, তার একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল মাত্র যা দমন করতে বেগ পেতে হয় নি। তবে মাঝ-দরিয়ায় দোজখি অগ্নিকাণ্ডে নির্মমভাবে প্রাণ যাবে এই ভয়ে দু-একজন যাত্রী তারস্বরে খোদার নাম নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লে তাদের আবার আশ্বাস দিয়ে তুলে নিতে কিছু সময় লাগে, তারপর একটি ভাসন্ত নারকেলকে মনুষ্যমস্তক বলে ভুল করে কেউ বেহুদা হুজুগ তুললে কল্পনার মানুষটির সন্ধানে আরেক দফা বিলম্ব হয়। তবে আজকার ঘটনা তেমন কিছু নয়, ঝড়-তুফান বা আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনার জন্যে যে স্টিমার আসবে না, তা নয়। তাছাড়া আসল কথা কি সে জানে না? গত এক মাসের মধ্যে কতবার সাদা-সবুজ রঙের লঞ্চটিকে সদরের দিক থেকে এসে বাঁক পেরিয়ে ঘাটের সামনে দিয়ে উজানের পথে যেতে দেখেছে, তার আওয়াজও শুনেছে; কর্কশ অমসৃণ আওয়াজ যেন, ইচ্ছা থাকলেও চলার ক্ষমতা নেই, আনুগত্যের অভাব না থাকলেও যৌবনের তেজশক্তি নেই নূতন করে রঙ-দেয়া সেই অতি পুরানো লঞ্চের। গতকাল লঞ্চটি আবার দেখা দিয়েছিল। সেটি যখন ফিরে যায় তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। কেন লঞ্চটি একমাস ধরে এ পথে আসা-যাওয়া করেছে তা অনুমান করা কঠিন নয়। তাছাড়া সেদিন দুপুরে সদরগামী স্টিমার এলে সারেঙ্গের মুখে শুনেছিল যে, কুমুরডাঙ্গা থেকে কিছু আগে উজানের পথে নদীর ধারা যেখানে বরাবর বেশ সঙ্কীর্ণ এবং যেখানে শীতের দিনে স্টিমারকে বড় হুশিয়ার হয়ে চলতে হয়, সেখানে সেই সঙ্কীর্ণ স্থানটিও নাকি মস্ত চড়ায় প্রায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে, যেটুকু এখনো স্টিমার গমনোপযোগী আছে সে-টুকুও শীঘ্র ঢেকে যাবে। সারেঙ্গ বলেছিল, ধাঁ-ধাঁ করে চড়াটা জাগছে। এ-সব কথা কি কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের কানে পৌঁছায় নি? নদীটি তাদেরই নদী।
স্টিমার আসবে না, নদীতে চড়া পড়েছে। খতিব মিঞা অবশেষে বলে। একটু থেমে, কোম্পানি যে সত্যিই নির্দোষ সে-বিষয়ে সর্ব সন্দেহ দূর করবার জন্যে আবার বলে, নদীর বুক জুড়ে মস্ত চড়া পড়েছে, নদীর শ্বাসরোধ হবার আর দেরি নেই।
একটি কথা লক্ষ্য করে বিস্মিত হই : তবারক ভুইঞা মুহাম্মদ মুস্তফার নাম উল্লেখ করে নি। অথচ সেদিন সে-ও ঘাটে উপস্থিত হয়েছিল স্টিমার ধরবার জন্যে, ধরতে পারে নি। যদিও সে-সময়ে তবারক ভুইঞা শ্যাওলা-আবৃত বদ্ধ ডোবার মতো পুকুরে খোদেজার মৃত্যুর কথা জানত না, তবু সে যে স্টিমারঘাটে মুহাম্মদ মুস্তফার আগমন, তারপর বিফল মনোরথ হয়ে ঘাট থেকে বাড়ি প্রত্যাবর্তন-এ-সব যে লক্ষ্য করে নি তা সম্ভব নয়। মুহাম্মদ মুস্তফা বেশ সময় হাতে নিয়ে ঘাটে উপস্থিত হয়েছিল; অন্ততপক্ষে তখনো উকিল কফিলউদ্দিন সেখানে দেখা দেয় নি। নিচে স্টিমার না আসার খবর পেয়ে ওপরেও এসেছিল, পাশে ছিল স্টেশনমাস্টার খতিব মিঞা। চড়ার কথা এবং স্টিমার -আসার কথা সে নির্বিবাদেই মেনে নিয়েছিল। সে স্বল্পভাষী মানুষ, বস্তুত বিশেষ প্রয়োজন না হলে কথা বলতে কদাচিৎ শোনা যায় তাকে। হয়তো নদীর দিকে চেয়ে চুপচাপ বসেছিল, তার নীরবতা লক্ষ্য করে খতিব মিঞাও হয়তো নীরব হয়ে পড়েছিল, এবং এমত অবস্থায় এক সময়ে কখন একটু তন্দ্রার ভাব এসে গিয়েছিল তার চোখে। তার তন্দ্রা ভাঙে তখন যখন সে উকিল সাহেবের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। তারপর, মুহাম্মদ মুস্তফা যখন প্রস্থান করে, সে-সময়েও তবারক ভুইঞা তাকে কৌতূহল ভরে চেয়ে-চেয়ে দেখে থাকবে : লম্বা কিন্তু শীর্ণ-পাতলা লোক, মাথাটি শরীরের তুলনায় একটু বড় যা দেহের শীর্ণতার জন্যে অযথাৰ্তভাবে বড় মনে হয়, নীরস মুখ, চোখে কেমন সতর্কতা, চলার ভঙ্গিতে একটু অনিশ্চিত ভাব যেন কোথায় যাচ্ছে তা ঠিক জানে না, বাঁ-হাতটা ঈষৎ ঘোরানো (সে যখন চেয়ারে-চৌকিতে বসে তখন সে-হাতেই ভর দিয়ে দেহটা একটু হেলিয়ে বসে যেন অদৃশ্য কোনো দেয়ালে ঠেস দিয়ে রয়েছে), অন্তরে-অন্তরে লাজুক প্রকৃতির মানুষ যে-লাজুকতা তার জীবনে আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে সাময়িকভাবে কিছু বৃদ্ধি পেয়েছিল এই কারণে যে তখনো সে তার নূতন এবং পুরাতন অবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করতে সক্ষম হয় নি; দুটির মধ্যে বিরোধিতা ছিল না, কেবল দুটি তখনো পৃথক সত্তাই ছিল। আরেক কারণেও ঘাটে তার আগমন এবং ঘাট হতে প্রস্থান তবারক ভুইঞা লক্ষ্য করে থাকবে। সাধারণ কোনো উপলক্ষে মুহাম্মদ মুস্তফা স্টিমার ধরতে আসে নি; যে-শুভকাজটি খোদেজার আকস্মিক মৃত্যুর জন্যে স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছিল সে-শুভকাজটি সম্পন্ন করবার উদ্দেশ্যেই স্টিমার ধরতে এসেছিল। সব বৃত্তান্ত না জানলেও সে-কথা তবারক ভুইঞা জানত। মুহাম্মদ মুস্তফার বন্ধু তসলিম লিখেছিল, আশারাফ হোসেন চৌধুরী সাহেব হজ করে নানা দেশে পীর-দরবেশের দরগাহ-মাজারে জেয়ারত করে দেশে ফিরেছেন, আর দেরি করা ঠিক হবে না। এমনিতে দেরি হয়ে গিয়েছে, খোদেজার মৃত্যুর জন্যে তখন বিয়েটা শোভনীয় হত না বলে পাকা দিনটা ভাঙতে হল, তারপর তোমার ভাবী শ্বশুরকেও হজে রওনা হতে হল। এবার তিনি ফিরেছেন, আর বিলম্ব নয়। তিনি একটু অধীর হয়েই পড়েছেন শুভকাজটি সম্পন্ন করবার জন্যে। বলছেন, আর বেশিদিন বাঁচবেন না। হজ-ওমরাহ দরগাহ-মাজার করার পর এমন ভাবটি অস্বাভাবিক নয়, মনে-প্রাণে শুদ্ধ পবিত্র বোধ করলে মানুষ মৃত্যু কামনা করে থাকে, কারণ এ-সময়ে বেহেস্ত সম্বন্ধে মানুষ যতটা নিশ্চিত বোধ করে অন্য কোনো সময় ততটা করে না। তবে মনের ইচ্ছা যাই হোক না কেন, তিনি বিদেশ থেকে বেশ উত্তম স্বাস্থ্য নিয়েই ফিরেছেন; বিদেশে সস্তায় ভালো ফলমূল পাওয়া যায়। লোকেরা এমনও বলে যে, কবরখানার দিকে নয়, শীঘ্র তিনি মন্ত্রীসভার দিকেই যাবেন। সেটা সম্ভব। অবসর গ্রহণ করলেও তার প্রভাব-প্রতিপত্তি যথেষ্ট, নানা উঁচু দরবারে তার অবারিত দ্বার, যাতায়াতও কম নয়। আর তোমার ভাবী স্ত্রীর কথা কী আবার বলতে হবে? এমন মেয়ে সত্যি দুটি হয় না-শিক্ষায় বল, দেখতে শুনতে বল, লেহাজ-নম্রতায় বল। আর যাতে দেরি না হয়, তোমাকে জিজ্ঞাসা করে আমি তাই নিজেই একটি দিন ঠিক করেছি, দিনটি তোমার ভাবী-শ্বশুরেরও পছন্দ। তারযোগে সম্মতি জানাও। মুহাম্মদ মুস্তফা অকারণে একদিন সময় নিয়ে তারযোগে তার সম্মতি জানিয়েছিল, তারপর নির্দিষ্ট দিনটি কাছে এলে ক-দিনের ছুটি নিয়ে ঢাকায় যাবার জন্যে স্টিমারঘাটে উপস্থিত হয়েছিল।
সে-কথা তবারক ভুইঞা উত্তমরূপেই জানত। সেজন্যেই কি সেদিন সন্ধ্যা বেলায় নৌকায় করে যাবার উপদেশ দেয় নি তাকে? ততক্ষণে মুহাম্মদ মুস্তফার কেমন খেয়াল হয়েছিল, হয়তো দু-একদিনের মধ্যে স্টিমার ফিরে আসবে। তবারক ভুইঞাকে জিজ্ঞাসা করেছি, স্টিমারঘাটে নূতন কোনো খবর এসেছে কিনা। তবারক ভুইঞা। বলেছিল, না, কোনো খবর নেই, তবে দু-একদিনের মধ্যে স্টিমার আসবে কিনা সন্দেহ। তখনই নৌকার কথা তুলেছিল। নৌকায় করে যেতে কষ্ট হবে, সময়ও নেবে। পথটা উজানের। স্টিমারে যে-পথ বারো ঘন্টার মাত্র, নৌকায় সে-পথ অতিক্রম করতে দু-দিন লাগবে। তবু বিলম্ব না করে সে যদি রওনা হয়ে পড়ে তবে সময়মতো ঢাকায় পৌঁছুতে পারবে।
কাল সকালের জন্যে একটি নৌকা ঠিক করে দেন, মুহাম্মদ মুস্তফা বলেছিল। তবে নৌকায় করেও তার যাওয়া হয় নি, সেদিন রাতে তার ভয়ানক জ্বর ওঠে। এবং দুদিন পরে তবারক ভুইয় খোদেজার মৃত্যুর কথা জানতে পায়।
কুমুরডাঙ্গায় আসার কিছুদিন আগে মুহাম্মদ মুস্তফার দেশের বাড়ির শ্যাওলা-আবৃত লতাপাতা জলজ-আগাছায় ভরা ডোবার মতো পুকুরে খোদেজার মৃত্যু ঘটে। তখন মুহাম্মদ মুস্তফার শিক্ষানবিশী সবেমাত্র শেষ হয়েছে।
খোদেজার মৃত্যুর খবর আসে গ্রামের চৌধুরীদের ছেলের হাতে লেখা একটি পত্রে; আমি বাড়ি না থাকলে বাড়ির লোকেরা তাকে দিয়েই পত্রাদি লিখিয়ে নিত। খোদেজার মৃত্যুর খবর ছাড়া সে-চিঠিতে আরেকটি কথা ছিল যা মুহাম্মদ মুস্তফা প্রথমবার লক্ষ্য করে নি, কী কারণে চিঠিটা আবার পড়ছে তখন তা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পত্ৰলেখক যার মুখের কথা অক্ষর-নিবদ্ধ করেছে তার উদ্দেশ্য হয়তো প্রথমে ঠিক বুঝতে পারে নি। পরে বুঝতে পারলেও লিখতে গিয়ে কেমন একটি লজ্জা বোধ করে থাকবে, কারণ দুবার লিখে দুবার কেটে হঠাৎ যেন লজ্জাশরম জয় করে দৃঢ়হস্তে বড়-বড় করে লিখেছে তা। তবে লজ্জাশরম সম্পূর্ণভাবে জয় করতে পেরেছিল কিনা সন্দেহ, কারণ ছোট বাক্যটি লিখতে গিয়ে সচরাচর যার বানানে ভুল হয় না তার বানান-জ্ঞান কেমন যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে।
বাক্যটি এবার মুহাম্মদ মুস্তফার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বটে কিন্তু তার অর্থ সে বুঝতে পারে না, দু-একবার অর্থোদ্ধার করার চেষ্টা করে স্থির করে অর্থহীন হবে; কখনো কখনো গ্রাম্য চিঠিতে অসংলগ্ন বা নিতান্ত অর্থহীন এক-আধটা বাক্য থাকা অস্বাভাবিক নয়, কারণ অন্যের মুখের কথা বুঝতে পারলেও ভাষার দীনতার জন্যে পত্ৰলেখক সে কথা যেভাবে প্রকাশ করে তাতে তা সব সময়ে বুদ্ধিগম্য হয় না।
দু-দিনের ছুটি নিয়ে মুহাম্মদ মুস্তফা যখন বাড়ি অভিমুখে রওনা হয় তখন দুর্বোধ্য বাক্যটি তো বটেই, যে-মৃত্যুর খবরে মনে একটু ঈষৎ আঘাত পেয়েছিল বা সামান্য ব্যথা বোধ করেছিল সে-মৃত্যু সম্বন্ধেও বিস্মৃত হয়ে পড়েছে : জীবন-মৃত্যু দুটিই সে অতি সহজে গ্রহণ করে। আলো-অন্ধকারের মতো জীবন এবং মৃত্যু পাশাপাশি বসবাস করে একই নদীতে মিলিত দুটি ধারার মতো গলাগলি হয়ে প্রবাহিত হয়; দুটিই বিনা বাক্যে গ্রহণ করা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় তার কাছে।
অন্যবারের মতো স্টিমারে করে প্রথম চাঁদবরণ ঘাটে, তারপর সে-ঘাটে স্টিমার ছেড়ে যথারীতি নৌকার পথ ধরে। ছোট খালের পথ। কখনো ঝুলে-পড়া গাছপালার শাখাপল্লবে ছায়াচ্ছন্ন কখনো উন্মুক্ত স্থানে মেঘনীলাম্বর-প্রতিফলিত স্রোতে হীনপ্রায় সে খাল মাঠক্ষেত জনপদের মধ্যে দিয়ে এঁকে-বেঁকে চলে, কখনো তীরের বেশ নিচে দিয়ে কখনো তীরের সঙ্গে সমতল হয়ে। পানিতে সোঁদালো গন্ধ, বদ্ধপ্রায় ধারায় নীরবতা, অন্যবারের মতোই লগির ধাক্কায়-ধাক্কায় ছাপরবিহীন খোলা নৌকা এগিয়ে চলে, প্রতিবারই পানিতে তরল আওয়াজ জাগে, প্রতিবারই গলুইর নিশানা কেমন দিগ্ভ্রষ্ট হয়ে আবার আপনা থেকেই সোঝা হয়ে পড়ে। নৌকার মাঝখানে কোনোদিন ছাতার তলে, কোনোদিন শূন্য মাথায় হাঁটু তুলে পিঠ খাড়া করে বসে মুহাম্মদ মুস্তফা এ-পথে কতবার গিয়েছে কোনো দিকে না তকিয়ে নৌকার গতি লক্ষ্য না করে, খাল থেকে যে সোঁদালো গন্ধ উঠে ধীরে-ধীরে তার নাসারন্ধ্র ভরে দিয়েছে সে-গন্ধ সম্বন্ধে সজ্ঞান না হয়ে, পানির রঙ হঠাৎ রৌদ্রদীপ্ত আকাশের তলে আকস্মিক উজ্জ্বলতায় ঝলমল করে উঠলেও তাতে চমকিত না হয়ে। সেদিনও সে কিছুই লক্ষ্য করে নি, কিছুই দেখে নি। শুধু তাই নয়। যে-বাড়ি অভিমুখে সে ধীরে-ধীরে এগিয়ে যায় সে-বাড়ির কথাও ভাবে নি।
খালের পর এবার পায়ের পথ। হাতে ছোট বাক্স, যে-বাক্সে অন্যবার বাপ-জান মা-জান তাদের আশ্রিতা বিধবা চাচী এবং চাচীর মেয়ে খোদেজা-সকলের জন্যেই কিছু-কিছু টুকিটাকি উপহার থাকত। কোনো-কোনোবার অর্থাভাবে বড়দের জন্যে কিছু না থাকলেও খোদেজার জন্যে কিছু থাকত। অনেক সময় বেশ ফ্যাসি ধরনের জিনিস : সখের রঙিন ফিতা বা চিরুনি, বা ছোট হাত-আয়না, কোনোদিন-বা সুগন্ধ তেলের শিশি। সেদিন কারো জন্যে কিছু ছিল না, খোদেজার জন্যেও নয়; মৃত মানুষের জন্যে কেউ উপহার বহন করে নিয়ে যায় না। পায়ের পথের পর আইলেন পথ, যে-পথ কোথাও শুষ্ক, কোথাও কর্দমাক্ত, কোথাও দলাবাধা। তারপর একটি বাঁশের পুল, শেষ অপরাহ্নের সোনালি আলোয় স্নাত তন্দ্রাচ্ছন্ন জনহীন একটা ঘাটলা। ঘাটলার পর নূতন ছাদের টিনে সুশোভিত ঝুনু মিাদের বাড়ি; তারপর পুকুর-মসজিদ, আবার ধানক্ষেত, আবার একটি পুকুর যার উত্তর পাড়ে বরকতপুরের হাট সেদিন শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে। হাটটি বসে সপ্তাহে দু-দিন : বুধবার আর শনিবার। কোনো-কোনোবার শহর থেকে খোদেজার জন্যে উপহার আনা সম্ভব না হলে এবং দিনটি হাটের দিন হলে সে হাট থেকেই কিছু কিনে নিয়ে গিয়েছে খোদেজার জন্যে। বস্তুত খোদেজার জন্যে কিছু-না কিছু নিয়ে যায় নি-এমন দিনের কথা মনে পড়ে না। ক্ষণকালের জন্যে তার কথা স্মরণ হয়, তবে শীঘ্র তা ভারহীন সারশূন্য তুলাসম মেঘখণ্ডের মতো মনাকাশে দেখা দিয়ে আবার উড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
পথ শেষ হয়ে এসেছে। আসফ তরফদারের কলাবাগানের পাশে অল্পক্ষণ হাঁটার পর হিজলগাছের দক্ষিণ দিকে সহসা বাড়িটা জেগে ওঠে।
মুরুব্বিদের সালাম কদমবুচি জানিয়ে সেদিন সে অন্যবারের মতো স্বাভাবিক শুষ্ক নিম্নকণ্ঠে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে নি, তবে অভ্যাসমত ঘর্মাক্ত শার্ট-গেঞ্জি এবং ধুলাচ্ছন্ন কর্দমাক্ত জুতো খুলে উঠানে হাত-পা ধুয়ে শীতল হয়। তারপর অন্যবারের মতো ডাবের পানি আসে। কেবল খোদেজা নয়, তার মা-ই আনে। সন্ধ্যা কাটলে অন্যবারের মতো তার আগমন উপলক্ষ্যে জ্বালানো বড় হ্যারিকেনের লণ্ঠনের আলোয় খেতে বসলে কেবল-দুই জোড়া চোখই তার খাওয়া পরিদর্শন করে-মা এবং চাচীর, পেছনে স্বল্প আলোকিত স্থানটি খোদেজার অভাবে শূন্য থাকে। খাওয়া শেষ হলে যে-উঠানের প্রান্তে তখন গাছগাছালি ঝোপঝাড়ের অন্ধকারে জোনাকিরা জ্যোতিষ্মন হয়ে বা অর্ধঘুমন্ত পাখিরা মধ্যে-মধ্যে অকস্মাৎ ডানা ঝাপটিয়ে প্রাণসঞ্চারের বৃথা চেষ্টা করেছিল সে উঠানে নেবে সজোরে গলা সাফ করে একাই হাতমুখ ধোয়, খোদেজা সে-রাতে বদনা থেকে পানি ঢেলে তাকে সাহায্য করে না। বাড়িতে ফেরা অবধি একবারও সে খোদেজার অনুপস্থিতি লক্ষ্য করে নি, এবারও করে না; ঘরে বা আঙ্গিনায় কোথাও যে মেয়েটির দেহ আর ছায়া ফেলে না, সে যে আর নেই, বাড়ি পৌঁছার পর যে-মাটির ঢিবির সামনে দাঁড়িয়ে দোয়া-দরুদ পড়ে তার রুহের জন্যে শান্তি কামনা করেছে সে মাটির তলে সে যে চিরনিদ্রায় শায়িতা-এসব কথা পত্রযোগে তার মৃত্যুর সংবাদটি যখন জানতে পায় তখনই মেনে নিয়েছিল। পরদিন সকালে বাড়ির পাতে শ্যাওলা-ঢাকা লতাপাতা-উদ্ভিদে সমাকীর্ণ ডোবার মতো পুকুরের পাড়ে যখন হাতমুখ দেবার জন্যে উপস্থিত হয় তখন সেখানে সে কিছু সন্ধান করে না; সেখানে যা ঘটে গিয়েছে তার কোনো চিহ্ন থাকার কথা নয় : একটি জীবন যেভাবেই শেষ হোক না কেন সে-জীবন, শেষ হয়ে গিয়েছে। তারপর পুকুরের পিছল ঘাটে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ফিরে নাস্তাপানি করে রীতিমাফিক উত্তর-ঘরে কথালাপের জন্যে উপস্থিত হয়। আমার মা, অর্থাৎ তার বড় চাচী পান সাজিয়ে তার সামনে ধরে, তারপর মুখে পান পুরে তা রসালো করে নেবার জন্যে তাকে একটু সময় দিয়ে সহসা কথাটি বলে-যে-কথা চৌধুরীদের ছেলে দু বার লিখে দুবার কেটে তৃতীয় বার বানানে গোলযোগ করে বড়-বড় সুস্পষ্ট অক্ষরে লিখেছিল। আমার মায়ের মুখটা সুচালো; তাই সে যখন কথা বলে তখন অনেক সময় মনে হয় সে বুঝি মস্করা করছে। তবে তার চোখের দিকে তাকালেই নিমিষে ভ্রম ভাঙে। সমস্ত জীবনের ব্যথা-বেদনা সে-চোখে যেন কেন্দ্রীভূত।
আমার মা বলে, মুহাম্মদ মুস্তফার জন্যে খোদেজা পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করেছে।
তবারক ভুইঞা (সে কি সত্যিই তবারক ভুইঞা? আমার ভুল হয় নি তো?) বলছিল : সুসংবাদের চেয়ে দুঃসংবাদে, সুখের চেয়ে দুঃখেই কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের বেশি বিশ্বাস। বস্তুত সর্বপ্রকার মছিবতের জন্যে তারা সদা-তৈরি, এবং একবার কোনো মছিবত এলে তার অস্তিত্ব বা ন্যায্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলে না। তারা এ-ও জানে যে বিভিন্ন উপায়ে কখনো ধ্বংসাত্মক ঝড়-তুফানের মতো সগর্জনে, কখনো ফসল পোড়ানো অনাবৃষ্টির মতো নিঃশব্দে, কখনো মহামারীর মতো অদৃশ্যভাবে, কখনো প্লাবনের মতো প্রকাশ্যভাবে, কখনো তৈলাক্তদেহ রাতচোরের বেশে, কখনো শস্ত্রসজ্জিত নিষ্ঠুর ডাকাতের মূর্তিতে। অতএব নদীতে চড়া পড়েছে এবং সে-জন্যে স্টিমার চলাচল বন্ধ হয়েছে-এ-সব ঘটনার মধ্যে সুপরিচিত মছিবতের চেহারাই দেখতে পায় তারা, তাদের অসহায়তা সম্বন্ধেও তাদের মনে কোনো সন্দেহ থাকে না। অবশ্য ঘটনাটি বড়ই দুঃখের, যারা স্টিমারে কখনো চড়ে নি তারাও স্টিমারঘাটের আকস্মিক নীরবতায় দুঃখবোধ করে; স্টিমারে চড়ে কোনোদিন কোথাও যাবার সৌভাগ্য না হলেও তারা আজীবন প্রতিদিন তার বংশীধ্বনি শুনেছে, ঘাটে উপস্থিত না থাকলেও জানতে পেরেছে কখন স্টিমার এসেছে, কখন যাত্রী নাবিয়ে যাত্রী তুলে আবার আপন-পথে চলে গিয়েছে: দিনের পর দিন বছরের পর বছর, বস্তুত যতদূর স্মৃতি যায় ক্ষতি পৌঁছায় ততদিন এমনি চলেছে, কখনো অন্যথা হয় নি। এবং যাদের জন্যে স্টিমারটি অপরিহার্য বস্তু, ব্যবসা-বাণিজ্য মামলা-মকদ্দমা এবং শতপ্রকারের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রয়োজনে তা ব্যবহার করে থাকে, তাদের কাছে ঘটনাটি নিতান্ত শোচনীয় বলে মনে হয়। তবু নদীতে চড়া পড়লে কী আর করা যায়, কপাল মন্দ হলে কাকেই-বা দোষ দেওয়া যায়?
তবে সে-বার একটি বিস্ময়কর কাণ্ড ঘটে, কারণ দু-দিন পরে সহসা কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীরা স্থির করে নদীতে চড়া পড়েছে তা সত্য নয়, অতএব স্টিমার না আসারও কোনো যুক্তি নেই। হয়তো শহরের নেতৃস্থানীয় প্রবীণ উকিল কফিলউদ্দিন সাহেব নিজেই এ-বিষয়ে নেতৃত্ব গ্রহণ না করলে এমনি ঘটত না; যা শহরের নেতৃস্থানীয় মুরুব্বি মানুষ বিশ্বাস করে না তা অন্যেরাই বা বিশ্বাস করবে কেন? এমন লোক রাতকে দিন বললে অনেকেই যে তমসাচ্ছন্ন রাতেও সূর্যালোক দেখতে পায়, তেমন দৃষ্টান্ত বিরল নয়।
সেদিন স্টিমারঘাট থেকে উকিল কফিলউদ্দিন সোজা বার-লাইব্রেরি চলে গিয়েছিল। ততক্ষণে স্টিমার না-আসার খবর সেখানে পৌঁছে গেছে এবং সে-বিষয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে আলাপ-আলোচনা চলছে। তাতে অল্পসময়ের জন্যে অন্যমনস্কভাবে যোগ দিয়ে উকিল সাহেব নীরব হয়ে পড়ে; আকস্মিক কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে সে-বিষয়ে প্রথমে আপন মনে ভেবে দেখতে সে ভালোবাসে, কারণ পরের বুদ্ধিমত্তা বা মতামতের ওপর তার বিশ্বাসটি কম। নীরবতার আরেক কারণ ছিল। সে বুঝতে পারে কুমুরডাঙ্গা শহরের বা তার অধীবাসীদের ক্ষতি-অসুবিধার কথায় নয়, নিতান্ত একটি ব্যক্তিগত কারণে সে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। স্টিমার-চলাচল যদি সত্যিই বন্ধ হয় তবে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে দেখা-সাক্ষাতের ব্যাপারে কি একটি বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি হবে না? সকলের পক্ষে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মিলিত হয়ে একই স্থানে বসবাস করা সম্ভব নয়, ঘটনাচক্রে কার্যোপলক্ষে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবু কোনো আপদ-বিপদ ঘটলে তারা মিলিত হয় এবং রেল-স্টিমার থাকলে সহজে এবং অবিলম্বেই পরস্পরের নিকটবর্তী হতে পারে। কুমুরডাঙ্গা থেকে স্টিমার উঠে গেলে সেটি কী একটি সমস্যায় পরিণত হবে না? এবং তেমন চিন্তা যে অহেতুক নয়, তার জ্বলন্ত প্রমাণও সে কি ইতিমধ্যে পায় নি কোনো জরুরি মামলা-মকদ্দমার কাজে যাচ্ছে-এ-কথা সকলকে বলে থাকলেও আসলে সে তার সদর শহরবাসিনী অতি আদুরে মেয়ে হোসনাকে দেখবার জন্যেই স্টিমার ধরতে গিয়েছিল। আসল কথা লুকিয়েছিল দুই কারণে। প্রথমত, যে-উকিল–স্থানে সে-স্থানে ছুটাছুটি করে, মক্কেলের চোখে তার দাম বেশি। দ্বিতীয়ত, স্নেহকাতর উকিলের ওপর মক্কেলদের বিশ্বাস কম হয়: উকিলের মধ্যে হৃদয়হীন চরিত্রের সন্ধান করে তারা। তবে শুধু মক্কেলদের কাছ থেকে নয়, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকেও সে মেয়েটির প্রতি তার গভীর স্নেহ-ভালোবাসার কথা সযত্নে লুকিয়ে রাখে : যে-স্নেহ পুষ্পের মতো পবিত্র এবং সৌরভময়, সে-স্নেহকে সূর্যালোকে প্রকাশ করতে নেই বলে তার বিশ্বাস।
বিয়ের পর থেকে আজ তিন বছর যাবৎ তার মেয়ে হোসনা স্বামীর সঙ্গে সদর শহরে বাস করে এবং এ-উছিলা সে-উছিলায় প্রায়ই উকিল কফিলউদ্দিন সেখানে হাজির হয় মেয়েটিকে দেখতে। ক-দিন ধরে কেমন খেয়াল, মেয়েটির বুঝি শরীরটা ভালো নয়। তেমন খেয়ালের কারণ নেই, তবু যে-কথা আপনা থেকেই মনে জাগে সে কথা সচরাচর সে হেলা করে না।
কী বলেন উকিল সাহেব? একজন অল্পবয়স্ক সহযোগী জিজ্ঞাসা করে।
ভাবছি। গলা কেশে, রহস্যময়ভাবে সে উত্তর দেয়!
দু-দিন পরে সন্ধ্যার পর উকিল কফিলউদ্দিন তার বাড়ির বৈঠকখানায় বসে ছিল, সামনে দু-চারজন মক্কেল।
উকিল কফিলউদ্দিনের নদীমুখো দোতলা বাড়িটি শহরের অন্যান্য বাড়ির তুলনায় মস্ত বড় মনে হয়, বাড়িটি নিয়ে উকিলের গর্বও কম নয়। বাড়িটি হালের নয়। সেটি যখন তৈরি হয় তখন দোতলা বাড়ি তো দূরের কথা, গুটি কয়েক সরকারি দালান-কোঠা ছাড়া সারা শহরে আর কোনো বে-সরকারি পাকা বাড়ি ছিল না। একদা শহরের একজন নামকরা হিন্দু উকিল বাড়িটি তৈরি করেছিল, বহুদিন তাতে বসবাসও করেছিল। বৃদ্ধ বয়সে সে-উকিলের মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী কলকাতায় চলে গেলে একটি দরিদ্র আত্মীয় পরিবার অনেকটা পাহারাদার হিসেবেই বাড়িটিতে বসবাস করে। তখন সে-বাড়িতে রাতের বেলায় আলো দেখা যেত না, দিনে বা রাতে সেখান থেকে কোনো সাড়াও আসত না। এ-সময়ে অনাদরে প্রেতপুরীসম বাড়িটির বাইরের আস্তর খসে পড়তে শুরু করে; যারা রাতে প্রদীপ জ্বালায় না তারা দেয়ালে কলি ফেরাবে কেন? তবে এ-সময়েই কফিলউদ্দিনের দৃষ্টি পড়ে বাড়িটির ওপর। তখন সে নবীন উকিল, মুখে দাড়ি নেই কিন্তু মস্ত বড় ঝুলে-পড়া কাস্তের মতো বাঁকা, গোঁফ, পরে কয়েক বছরের জন্যে যার বিপরীতটাই ঘটে; তার গোঁফ অদৃশ্য হয়ে যায় কিন্তু মস্ত একটি দাড়ি দেখা দেয় বুক জুড়ে। বর্তমানে তার মুখ দাড়িগোঁফ শূন্য। যুবক উকিলের চোখে বাড়িটি প্রাসাদের মতো ঠেকে। তাছাড়া তার মনে হয় বাড়িটির ক্ষুদ্র জানালাগুলি কী গভীর রহস্যের ইঙ্গিত দেয়, স্বল্পপরিসর বারান্দাটির সামনে গোলাকার স্কুল, উতুঙ্গ খামগুলিতে যেন আভিজাত্যের পরিচয়, আস্তর খসে পড়লেও দেয়ালের অনাবৃত অংশে অবিনশ্বরতার প্রমাণ। সে-পথে আসতে-যেতে প্রথমে সে কেবল বাড়িটি তাকিয়ে দেখ, ইতিমধ্যে মনের কোথাও অস্কুট কোনো আকাক্ষা দেখা দিয়ে থাকলে তা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে সাহস পেত না। তারপর একদিন দুস্থ বা কৃপণ পরিবারটির অভিভাবক স্থানীয় একমাত্র পুরুষটির মৃত্যুর পর অপেক্ষাকৃত সচ্ছল অন্য একটি পরিবার সে-বাড়িতে স্থান পায়। এ-সময়ে সন্ধ্যার পর আলো দেখা যেতে শুরু করে, কখনো-কখনো তার অভ্যন্তর থেকে বীণা-জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের ঝঙ্কারও শোনা যেতে থাকে। ততদিনে উকিল কফিলউদ্দিনের মনের অস্ফুট আকাভক্ষাটি স্পষ্টরূপ ধারণ করেছে, পসারও বেশ হতে শুরু করেছে। শীঘ্র তার মনে হয়, বাড়িটির অভ্যন্তর থেকে সন্ধ্যার পর যে-বাদ্যযন্ত্রের ঝঙ্কার ভেসে আসে তা যেন তাকে উপহাস করে : সুস্পষ্ট আকাক্ষাই কি স্বপ্ন চরিতার্থ করার জন্যে যথেষ্ট? সে-উপহাস বেশিদিন সে সহ্য করে নি, একদিন হেমন্তের অপরাহ্নে বাড়িটির স্বতাধিকার ক্রয় করে যে-ছায়াচ্ছন্ন রহস্য বহুদিন ধরে তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে সে-রহস্য ভেদ করে, বাদ্যযন্ত্রটিকেও নীরব করে। বাড়ির সঙ্গে আসবাবপত্রও কিনেছিল-সেকেলে আমলের দুর্জয় গোছের মজবুত কিন্তু অতিশয় ভারি আসবাবপত্র; সে যেন জিদ ধরেছিল সে-বাড়ি থেকে কিছুই হস্তান্তর : হতে দেবে না। সব কিছু মিলে বেশ দাম পড়েছিল, কিন্তু সে দ্বিরুক্তি করে নি। হয়তো তার মনে হয়েছিল, বাড়িটি কিনে, তারপর যে-সব আসবাবপত্র সুনামধারী উকিল একদিন ব্যবহার করেছিল সে-আসবাবপত্রের মালিক হয়ে সে-উকিলের যশ-ভাগ্যেরই অংশীদার হচ্ছে। লোকেরা বলে, উকিল কফিলউদ্দিন যখন জটিল কোনো মামলা নিয়ে কিছু মুশকিলে পড়ে, জয়ের পথ খুঁজে পায় না, তখন বাড়িটির প্রাক্তন মালিক যে বহুদিন হল ইহজগৎ ত্যাগ করে গেছে, সে তার স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাকে মন্ত্রণা দেয়, ধারা-উপধারা নজিরি আইন বাতলে দেয়। বাড়ি-আসবাবপত্রের জন্যে সে বেহুদা বেশি দাম দেয় নি।
সে-বাড়ির বৈঠকখানায় নথিপত্রে-ঢাকা টেবিলের ওপর স্থাপিত লণ্ঠনের পশ্চাতে বষে উকিল কফিলউদ্দিন কোনো মামলার জট খোলার চেষ্টায় রত ছিল, মুখে আত্মমগ্ন ভাব, মন স্টিমারঘাট নদনদী থেকে বহুদূরে। ভেতর থেকে হুঁকা আসে-মক্কেলদের জন্যে সাধারণ হুঁকা, তার জন্যে নলওয়ালা সুদৃশ্য গুড়গুড়ি। কিছুক্ষণের জন্যে ঘরটি হুঁকা-গুড়গুড়ির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে, ক্রমশ ধূমায়িতও হয়ে পড়ে, তার পশ্চাতে মানুষের মুখগুলি অস্পষ্ট দেখায়। পরে পান আসে; বড় পেতলের থালায় করে সাধারণ পান, রূপার পিরিচে সেজে সাচি পান। তারপর কখন উকিল কফিলউদ্দিন কথা বলতে শুরু করে। তবে জ্বর কণ্ঠে যেন ঘুমের আমেজ; সে-কণ্ঠ অবিরাম গুঞ্জনের মতো শোনায়। তারপর এক সময়ে সহসা সে এমনভাবে কেশে ওঠে যেন কাশিটি পূর্বাভাস না দিয়ে অকস্মাৎ তাকে অতিভূত করে ফেলেছে, এবং মুখে যা উঠে আসে তা নিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে হঠাৎ পাশে ঝুঁকে টেবিলের পশ্চাতে অদৃশ্য একটি পিদানিতে সশব্দে থুথু ফেলে। নিমেষের মধ্যে অদৃশ্য সে-পিানি থেকে এবার সচকিত একটি মাছি উঠে এসে অন্ধের মতো নিঃশব্দে ঘুরপাক দিয়ে পশ্চাতের দেয়ালে টাঙ্গানো ফ্রেমে বাঁধা সোনালি অক্ষরে লিখিত আল্লাহর নামের এক প্রান্তে আশ্রয় গ্রহণ করে; হয়তো . রূঢ়ভাবে ঘুমে ব্যাঘাত-পাওয়া ক্ষুদ্র জীবটির কাছে সমগ্র বৈঠকখানার মধ্যে সে-স্থানটিই। সবচেয়ে নিরাপদ মনে হয়। এবার ঘরে যে-আকস্মিক নীরবতা নাবে সে-নীরবতার মধ্যে সই দেখতে পায়, উকিল চোখ নিমীলিত করেছে।
উকিল কফিলউদ্দিনের চরিত্র অনেক দিন থেকে পরস্পরবিরোধী, যেন বার্ধক্যে উপনীত হয়েও তার আসল চরিত্রটি যে কী, বা কোন চরিত্র তার জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত এবং মানানসই-সে বিষয়ে এখনো মত স্থির করতে পারে নি। কখনো মনে হয় তার মধ্যে হীনতা-নীচতা কল্পনাতীত, এবং সে এমন মানুষ যাকে গভীরভাবে ভক্তি-শ্রদ্ধা না করে উপায় নেই কারণ তার দেহের প্রতি অন্ধ্ররন্ধ্র দিয়ে দয়ামায়া ক্ষমাশীলতাই নিঃসৃত হয়। আবার আকস্মাৎ সে-মানুষের মধ্যেই কুটিলতা-হিংস্রতা উৎকটভাবে আত্মপ্রকাশ। করে। হয়তো তখন তার সহসা মনে পড়ে মক্কেলরা উকিলের নিকট দয়ামায়া ক্ষমাশীলতা আশা করে না। তবু মক্কেলদের আশানুযায়ী আচরণের প্রয়োজন বুঝলেও আবার অন্তরে কোও মানুষের ভক্তিশ্রদ্ধার জন্যে একটি তীব্র বাসনাও বোধ করে থাকবে। হয়তো তার চরিত্রের মধ্যে পরস্পরবিরোধী ভাবের কারণ ও-দুটির মধ্যে দ্বন্দ্ব। তবে তার চরিত্র যে-রূপই ধারণ করুক না কেন, তার অন্তরে রাতের হাওয়ার মতো গুপ্তভাবে যে-চিন্তা-ধারা প্রবাহিত হয় তার আভাস কদাচিৎ বাইরে ধরা পড়ে, যদি-বা তার গোঙ্গানি শোনা যায় তার চেহারা দেখা যায় না, তার গতিবিধিও বোঝা যায় না। রক্তাক্ত চোখে বিষম ক্রোধ প্রকাশ করলেও সেটি সত্যিকার ক্রোধ না-ও হতে পারে, আবার যখন সে অমায়িকতায় নরম কোমল হয়ে ওঠে সে-সময়ে তার অন্তরে ক্রোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলা সম্ভব। হয়তো সবটাই অভিনয়, পরের সুখ-দুঃখ আপনার করে নিয়ে সে-সুখ-দুঃখের কাহিনী আবার ব্যক্ত করে বলে প্রত্যেক উকিলই এক রকমের অভিনেতা।
তবে কফিলউদ্দিন যখন হঠাৎ নীরব হয়ে পড়ে চোখ নিমীলিত করে তখন তা অভিনয় বলে মনে হয় না, বরঞ্চ মনে হয় সহসা বাহ্যিক জগৎ সম্বন্ধে বিস্মৃত হয়ে সে তার অন্তরের গুপ্ত হাওয়ার আওয়াজ শুনছে। জনবাদ এই যে, সে যখন চোখ নিমীলিত করে এমনিভাবে স্তব্ধ-নীরব হয়ে পড়ে তখন বিপক্ষ দলের উকিল তো বটেই জজ হাকিমও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এই কারণে যে তার অন্তরের অদৃশ্য হাওয়া তাকে কী পরামর্শ দেবে সে-বিষয়ে আগেভাগে নিশ্চিত হওয়া শক্ত।
অনেকক্ষণ উকিল কফিলউদ্দিন নিমীলিত চোখে নির্বাক হয়ে থাকে। তারপর সে অবস্থাতেই কী একটি দুর্বোধ্য প্রয়োজনে বা তাড়নায় ধীরে-ধীরে পা দুটি চেয়ারের ওপর তুলে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে বসে। এমনিভাবে চেয়ারে পা তুলে বসা তার অভ্যাস; প্রথমে পা ঝুলিয়ে বসেও তারই অজান্তে এক সময়ে সে তার পা দুটি তুলে নেয় চেয়ারের ওপর।
এবার টেবিলের পশ্চাতে লম্বা-চওড়া মানুষটিকে বিশালকায় দেখায়, এবং পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে বসার দরুন.দেহটা সামনের দিকে কিছু ঝুঁকে থাকে বলে তার সমগ্র ভঙ্গিতে একটি নিবিড় একাগ্রতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে; নিমীলিত চোখে সে যেন গভীর মনযোগ-সহকারে কিছু পরীক্ষা করে দেখে।
তারপর সহসা সে চোখ উন্মীলিত করে। সে-উন্মীলিত চোখে আকস্মিক ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ।
কোথায় চড়া পড়েছে, কেই-বা বলেছে চড়া পড়েছে? সে জিজ্ঞাসা করে।
চৌধুরীদের ছেলেকে দিয়ে লেখানো চিঠিতে যে-কথা তারা জানিয়েছিল বড় চাচী সে-কথারই পুনরাবৃত্তি করলে মুহাম্মদ মুস্তফা প্রথমে বিস্মিত হয়, তারপর বুঝতে পারে। যতই অর্থহীন হোক না কেন তা কানে না তুলে উপায় নেই। তবে সে কিছু বলে নি। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে নি। সে জানে, বাড়ির লোকেরা মধ্যে-মধ্যে এমন সব কথা বলে থাকে যা বুদ্ধি-যুক্তির দ্বারা সমর্থন করা যায় না, তবু প্রতিবাদে কিছু বলাও যায় না; বস্তুত যতই উদ্ভট রূপ ধারণ করে তাদের বক্তব্য ততই কিছু বলা দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। এ-জন্যেই বলা যায় না যে তখন মনে হয় তারা যা বলে তার পশ্চাতে অন্য কী-একটা অর্থ আছে, অন্যকিছু বলা তাদের উদ্দেশ্য, হয়তো সত্য কথা বলার সাহস নেই বলে হেঁয়ালি বা রূপক বাক্যের শরণাপন্ন হয়েছে। কখনো-কখনো মনে হয়, প্রতিবাদ করে লাভ কী, অন্য কেউ কি যথার্থ উত্তর জানে? ভাগ্যবির্যয়ের কারণ তল্লাশের প্রয়াসে তারা যতই গভীর পানিতে তলিয়ে যায় ততই তাদের দৃষ্টি পথে অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে ওঠে, কিন্তু যারা ওপরে ভেসে থাকে তারাই-বা কি তাদের চেয়ে বেশি দেখতে পায়? কখনো তারা দুটি সম্বন্ধশূন্য ঘটনার মধ্যে সম্বন্ধ খুঁজে পায়, ভাবে প্রথম ঘটনাটি না-ঘটলে দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটত না, কিন্তু দুটির মধ্যে কোনো সম্বন্ধ নেই বললেই কি দ্বিতীয় ঘটনাটি কেন ঘটেছিল তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে?