৮. মহাদেশনেত্রী যখন ফিরে আসেন

মহাদেশনেত্রী যখন ফিরে আসেন তার অপরূপ রূপ দেখে আমরা মুগ্ধ হই। মাথা ঘিরে কী চমৎকার আবায়া পরেছেন, কোনো শয়তান ঢুকতে পারবে না চুলে, কাঁধের নিচ দিকে কী যেনো ঝুলিয়ে দিয়েছেন, আমরা গরিব জনগণ, ধর্ম হজ ওমরা জানি না, আল্লা আমাগো মাফ করবেন, এইসব পোশাক আশাক জানবো কেমনে? আমরা মুগ্ধ হই, শিউরে উঠি, ধর্মে ভাসতে আর ডুবতে থাকি, এবং বিপদে পড়ে যাই–কে বেশি ধার্মিক, মহাজননেত্রী না মহাদেশনেত্রী, কারে ভোট দিলে আল্লা খুশি হইব ড্যামোক্রেসি রক্ষা পাইব এইটা ঠিক করতে পারি না। মহাবিপদের মইধ্যে পইড়্যা যাই আমরা, বিপদে পড়নই ত আমাগো কাম, আমরা গরিব জনগণ; আমাগো মনে হইতে থাকে আমাগো কঠিন পরীক্ষা করনের জইন্যেই আল্লাতাল্লা দুইজনরে পাঠাইছেন, আমাগো বাইর করতে হইব কার ধর্ম বেশি, আর ভোট দিতে হইব সেইভাবে। আমাগো খালি পরীক্ষা দিতে হইব, হাশরের মাঠ পর্যন্ত পরীক্ষা দিতে হইব–আমরা গরিব জনগণ।

শুরু হইছে রাজপুরুষগো ইন্টারভিউ, আর নমিনেশন দেওন।

দ্যাশ ভইর‍্যা আমরা পাগল হইয়া উঠছি এইটা দেখার জইন্যে যে জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশ কারে কারে নমিনেশন দেয়, আর শক্তির উৎসবাদী রাজবংশ নমিনেশন দেয় কারে কারে। রাজপুরুষেরা যখন নমিনেশন পাওয়ার জইন্যে দরখাস্ত করছিলেন, তখন আমরা গরিব পিপল হয়ে উঠেছিলাম পাগল পাগল, আর এখন নমিনেশন দেওনের আর পাওনের সময় আমরা হয়ে উঠি আস্ত পাগল। জনগণরে, আমাগো মতন গরিবগো, পাগল না করতে পারলে পলিটিক্স কিসের, ড্যামোক্রেসি হইছে আমাগো পাগল করনের মিঠা অমুদ, এমনভাবে খাওয়াইতে হয় যাতে আমরা পাগল হইয়া যাই, জিতলাম না ঠকলাম বুঝতে না পারি।

আমরা ত ভিতরের সব দেখি না, ছিটাফোঁটা শুনতে পাই, আর একেকজনের নমিনেশন পাওন দেখে ভাবতে থাকি কি হইছে ভিতরে। আমরা যেমন শুনছি তেমন বলতেছি; নিজের চোখে ত দেখি নাই, পরের মুখে শুনছি, দুই একটা ঘোড়ার মুখ থিকাও টুকরাটাকরি শুনছি।

জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশের ক্যান্ডিডেটদের ইন্টারভিউ চলতেছে। ইন্টারভিউ নিতেছেন প্রধান রাজপুরুষেরা; মহাজননেত্রী আছেন মাঝখানে, তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে, রিলিজিয়ন আর পলিটিক্সের মিলন ঘটলে যেমন দেখায়, তেমন দেখাইতেছে, তারে ঘিরে আছেন আবদুর রহমান, কলিমউদ্দিন মৃধা, নিজামউদ্দিন আহমদ, রজ্জব আলি, আবদুল হাই সাহেব।

মহাজননেত্রী তসবি পড়তে পড়তে বলেন, বিসমিল্লাহের রহমানের রাহিম, আল্লার কাছে মুনাজাত করি তিনি আমাদের দিকে মুখ তুইল্যা চান।

তারা সবাই মনে মনে মুনাজাত করে ওঠানো দুই হাত ভরে ভোট সংগ্রহ করে চোখ বন্ধ করেন, পবিত্রভাবে দুই হাত নিজেদের মুখে বুলান, মাথায় বুলান,বুকে বুলান। দুই একজনে বুকে ফুঁ দেন।

মহাজননেত্রী বলেন, ক্যান্ডিডেটগো ডাকনের আগে নীতিমালাটা আরেকবার ঠিক কইর‍্যা লই, তাইলে কাজ সহজে হবে। এইবার ক্ষমতায় আমাদের যাইতে হবেই, ঠিক ক্যান্ডিডেট দিতে হবে।

আবদুর রহমান বলেন, প্রথম নীতি হচ্ছে মহাজননেত্রী তিনটা কি চাইরটা। কসৃটিটিউয়েন্সি থিকা কন্টেস্ট করবেন, অই সিটগুলি আমাগো থাকবো, আমরা প্রধান ন্যাতারা সবাই নমিনেশন পাইবো, আমরা কয়জন দুইটা আসন থিকা ইলেকশন করবো।

নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, দুই চাইরটা সিটে এখন নমিনেশন দেয়া হইবো না, অইগুলি মহাজননেত্রী পরে নিজে বুঝে ঠিক করবেন, শ্যাষ মোমেন্টে অন্য বংশ থিকা কোনো সবচাইতে বেটার ক্যান্ডিডেট যদি আইস্যা পড়ে, তখন অইগুলিতে তাগো দার করান যাইব।

মহাজননেত্রী বলেন, আমিও এই নীতিটা ভাবতেছিলাম, আমার মনে হয় শক্তির উ ৎসআলাগো বংশ থিকা দুই একটা জ্যানারেল, দুই চাইরটা ভাল রাজাকার ভাইগ্যা। আসতে পারে, তখন তাগো নিতে পারবো।

রজ্জব আলি বলেন, আমি একটা জ্যানারেল আর দুই তিনটা ভাল রাজাকারের কথা ভাবতেছিলাম, অগো নিলে ভাল হইত।

মহাজননেত্রী বলেন, তাগো নাম কন, দেখি পছন্দ হয় কি না।

রজ্জব আলি নামগুলি বলেন।

মহাজননেত্রী বলেন, এই নামগুলি আমিও ভাবতেছিলাম, তাগো নিলে শিউর জিতবো, চিন্তা করতে হইব না।

আবদুল হাই বলেন, তয় এইগুলি খুব ডিজঅনেস্ট, পাশ কইর‍্যা সুবিধা পাইলে উৎসআলাগো লগে যোগ দিতে পারে, এইটা ভাইব্যা দেখেন।

আবদুর রহমান বলেন, ইনিরা ত নমিনেশন পাওয়ার লিগা দরখাস্তই করে নাই, আর ওই জ্যানারেল সাহেব উৎসআলাগো নমিনেশনের লিগা দরখাস্ত করছে, সেইখানে নমিনেশন পাওনের লিগা লাইগ্যা রইছে। আমাগো লগে কুঅপারেশন করে নাই, অনেক ডাকছি এই দিকে আসে নাই।

রজ্জব আলি বলেন, কুদরত আলি চৌধুরী রাজাকার আছিল, খোজাবংশে আছিল, উৎসআলাগো লগেও আছিল; তবে তিনি প্রবীণ অ্যাক্সপেরিয়েন্ড পলিটিশিয়ান, দ্যাশে অত্যান্ত শ্রদ্ধেয় মানুষ, সে এইবার কোনো দল থিকা নমিনেশন চায় নাই, তারে নিলে। আমাগো সুবিধা হইব।

মহাজননেত্রী বলেন, তার সঙ্গে আমার চাচা-ভাস্তির সম্পর্ক, এখনই তারে আমি টেলিফোন কইর‍্যা আমাগো দল থিকা দারাইতে রিকুয়েস্ট করি। আমার রিকুয়েস্ট চাচা ফেলতে পারবো না।

আবদুল হাই বলেন, তারে যেইখান থিকা দারাইতে দিবেন সেইখানে কফিলউদ্দিন মিয়া আমাগো অত্যান্ত ভাল ক্যান্ডিডেট, সে সব সময় আমাগো দল করে, দলরে সে অইখানে টিকাই রাখছে, কুদরত আলি চৌধুরী সাহেবকে সেইখান থিকা নমিনেশন দিলে কফিলউদ্দিন বিগড়াইয়া যাইতে পারে।

মহাজননেত্রী বলেন, দলের জইন্যে এইটুকু স্যাক্রিফাইস ত করতেই হবে, পাওয়ারে যাওয়ার জইন্য সব রকমের স্যাক্রিফাইসের জইন্যে রেডি থাকতে হবে। কফিলউদ্দিন মিয়ারে আমি বুঝ মানাই দিব, পাওয়ারে আসলে তারে বড় কিছু দিলেই হইবো।

আবদুর রহমান বলেন, টেলিফোন কইর‍্যা দেখি চৌধুরী সাবরে পাওয়া যায় কি না। পাইলে এখনই কথাটা ফাইনাল হইতে পারে।

সেলুলার টিপে টিপে সেলুলারটা তিনি মহাজননেত্রীকে দেন।

মহাজননেত্রী বলেন, আস্সালামাইকুম চাচা, আমারে চিনতে পারছেন? আপনের শরীরটা ভাল ত?

কুদরত আলি চৌধুরী বলেন, তোমার গলা চিনতে পারুম না অতটা বুড়া আইজও হয় নাই, আই অ্যাম নট সো আৌল্ড অ্যাজ আদার্স থিংক, তোমার পার্টি ত এইবার পাওয়ারে যাইব, তুমি প্রাইম মিনিস্টার হইবা, এইটা আমি তোমারে বইল্যা রাখলাম। আই কংগ্রেচুলেট ইউ।

মহাজননেত্রী বলেন, সেইটা আপনের দোয়া, চাচা। পাওয়ারে আমরা না গেলে দ্যাশটা আর ঠিক থাকবো না, তবে আপনেরে ছারা আমি পাওয়ারে কীভাবে যাই, আপনেরে লইয়াই পাওয়ারে যাইতে চাই, চাচা।

কুদরত আলি চৌধুরী বলেন, আমি ত এইবার পলিটিক্স থিকা দূরে আছি, আই এনজয় এনাফ পাওয়ার ইন মাই লাইফ, এখন মরনের আগে একটু রেস্ট লইতে চাই, পাওয়ার আর ভাল লাগে না।

মহাজননেত্রী বলেন, আপনে রেস্ট নিলে দ্যাশ চলবো কি কইর‍্যা, চাচা? আপনারে এইবার আমার দল থিকা ইলেকশন করতে হইব, আপনেরে ছারা আমাগো চলবো না। এইবার আমরা আপনেরে লইয়াই পাওয়ারে যাইতে চাই, আপনে না করলে হইব না।

কুদরত আলি চৌধুরী বলেন, আমি ত নমিনেশন পাওনের দরখাস্ত করি নাই, সময় ত শ্যাষ হইয়া গেছে।

মহাজননেত্রী বলেন, চাচা, আপনে রাজি হন, এখনই আমি আপনের কাছে ফর্ম পাঠাই দিতেছি, আপনের আসতে হইব না, খালি সই কইর‍্যা দিবেন, বাকিটা আমরাই করবো। খালি আপনের সাইনটা চাই, চাচা।

কুদরত আলি চৌধুরী বলেন, ঠিক আছে, তুমি যখন বলতেছ তখন আর না করি কেমনে। ফর্মটা পাঠাই দেও, আমি দারামু।

আস্‌সালামাইকুম বলে সেলুলার রেখে মহাজননেত্রী বলেন, আমরা একজন শিউর ক্যান্ডিডেট পাইলাম, পাওয়ারে যাইতে হইবই।

কুদরত আলি চৌধুরীর জন্যে একটি ফর্ম পাঠিয়ে দেয়া হয়, একটা সিট শিউর।

ক্যান্ডিডেটদের ইন্টারভিউ শুরু হয় এর পর। অই ইন্টারভিউ বোর্ডে যেই সব কথাবার্তা হয় সেই সব কথাবার্তা টপ সিক্রেট, বাইরে বলন যায় না। আমরা দূর থিকা যা শুনছি, জনগণ আমরা, আমাগো শুনায় ভুল হইতে পারে, বলনেও ভুল হইতে পারে, তার দুই একটা কথা বলন যায়। তবে এইটা খুব গোপন কথা, মনে করতে হইব। আমরা কিছু শুনি নাই আমরা কিছু বলি নাই, সব কিছু ভিতরে চাইপ্যা রাখছি।

ক্যান্ডিডেট আবদুল কাদের মিয়া নমিনেশন পাওয়ার জইন্যে ইন্টারভিউ দিতেছেন।

মহাজননেত্রী জিজ্ঞেস করেন, আপনের কল্‌টিটিউয়েন্সি থিকা আরও চাইরজন দারানের জইন্যে দরখাস্ত করছে, আপনে কি তাগো থিকা বেশি ভোট পাইবেন?

আবদুল কাদের মিয়া বলেন, আল্লার রহমতে নিশ্চয়ই আমি তাগো থিকা বেশি ভোট পামু, অই সিটে আমিই জিতুম, আমি পর পর তিনবার এমপি হইছি অই সিটে, আমার থিকা পপুলার পাওয়ারফুল আর কেহ নাই অইখানে। আমি মহাজননেত্রীকে আমার একমাত্র নেত্রী বলে অনেক দিন থিকাই মাইন্যা নিছি। মহাজননেত্রীই খালি দ্যাশরে ঠিক মতন চালাইতে পারেন।

আবদুর রহমান জিজ্ঞেস করেন, আইচ্ছা ভাই, আপনে খোজাবংশ থিকা এমপি হইছেন, উৎসআলাগো এমপি হইছেন, এইবার এইবংশে আসতে চাইতেছেন কেন? আপনে কি মনে করেন এইবার আমরা পাওয়ারে যামু?

আবদুল কাদের মিয়া বলেন, আমি জনগণমনবংশে আসতে চাই, কারণ এইটাই আসল বংশ, এই বংশ ফ্রিডম ফাইটিং করছে দ্যাশে স্বাধীন আনছে, এই বংশ না থাকলে বাংলাদ্যাশ আইজও পাকিস্থান থাকত, আমরা পাকিস্থানি থাকতাম, এই বংশ আমাগো বাঙ্গালি বানাইছে, আমরা বাঙ্গালি আমরা পাকিস্থানি না, পাঞ্জানিগো পায়ের তলে বাঙ্গালি থাকতে পারে না, আর মহাজননেত্রী দুনিয়ার এক নম্বর নেত্রী, তার পায়ে মাথা রাইখ্যা আমি বাকি জীবন পলিটিক্স করতে চাই, পিপলের স্যাবা করতে চাই। মাইনষেরই ভুল হয় আমারও ভূল হইছিল, সেই জইন্যে আগে আসতে পারি নাই, তয় এখন মহাজননেত্রীর পায়ে মাথা রাখতে চাই। এইবার আমরা পাওয়ারে যামুই, উৎস আলাগো কোনো চান্স নাই, আমি অই বংশরে ছাইরা দিছি, অই বংশ ড্যামোক্রেসিতে বিশ্বাস করে না, তারা ডিক্টেটরশিপে বিশ্বাস করে।

নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, কাদের মিয়ারে প্রশ্ন করনের দরকার পড়ে না; তার লগে আমাগো আগে থিকাই কথা হইয়া আছে। তিনি দশ পোনরো বছর ধইর‍্যা অইখানের সবচাইতে পাওয়ারফুল সবচাইতে পপুলার পলিটিশিয়ান, এইটা সারাদ্যাশের মানুষ জানে। তারে হারাইয়া উৎসআলারা হায় হায় করতেছে। এইবার তিনি আমাগো বংশে আসছেন এইটা আমাগো ভাইগ্য। তারে অরা মন্ত্রী করে নাই, করছে যার কোনো পপুলারিটি নাই, সেই মাতাল মমতাজ আলিরে; তিনি এইটা সইয্য করতে পারেন নাই, কোনো জেনুয়িন পলিটিশিয়ানই এইটা সইয্য করতে পারে না।

রজ্জব আলি বলেন, কাদের ভাইয়ের সব কথাই ত আমরা জানি, তার লগে সব কথাই আমাগো হইয়া আছে, আগে থিকাই ঠিক হইয়া আছে কাদের ভাই আমাগো ক্যান্ডিডেট হইবেন। তিনি উৎসআলাগো বংশে ভাঙ্গন ধরাই দিছেন, তার দিকে আর উৎসআলাগো ফিউচার নাই।

মহাজননেত্রী বলেন, কাদের ভাই, আপনের এলাকার সিচুয়েশন কেমন, একটুখানি বলেন ত।

কাদের মিয়া বলেন, আমার আর আমার পাশের তিনটা সিটে উৎসআলাগো এইবার রিটার্ন করার কোনো পসিবিলিটি নাই, কারণ আমরা যারা পাশ করতাম তারা মহাজননেত্রীর জনগণমনবংশে যোগ দিছি! আমাগো অইখানে পাশ করার লিগা তিনটা জিনিশ খুবই দরকার।

মহাজননেত্রী জিজ্ঞেস করেন, জিনিশগুলি কি?

কাদের মিয়া বলেন, প্রথম যেই জিনিশটা দরকার, সেইটা হইল ট্যাকা, ট্যাকা ছারা পলিটিক্স করন যায় না, ট্যাকা থাকলে ভোটার আছে ভোট আছে, তারপর দরকার হইল ক্যাডার, ট্যাকা থাকলে ক্যাডার পাওন যায় আর ক্যাডার থাকলে ভোট পাওন যায়, ক্যাডার ছারা ড্যামোক্রেসি চলে না পলিটিক্স চলে না, সব শ্যাষে দরকার হইল, পপুলারিটি, এইটাও থাকন দরকার। খোদার রহমতে এই তিনটা জিনিশই আমার আছে।

আবদুল হাই বলেন, কাদের ভাই সেইটা আমরা জানি। আপনেরে নমিনেশন আগে থিকাই আমরা দিয়া রাখছি। পার্টিরে আপনে যেই চান্দা দিছেন, তাতেই বুঝা যায় আপনে শিউর পাশ করবেন। তয় আরো কিছু চান্দা দরকার।

আবদুল কাদের মিয়া বলেন, না, বেশি আর কি দিছি, মাত্র পাঁচ কোটি, আরও পাঁচ কোটি টাকা আমি নিয়া আইছি পার্টির লিগা, আইজ বিকালেই জায়গা মতন নিয়া আসবো। পলিটিক্সে আসনের আগেই আমি বুঝছি ট্যাকা ছারা পলিটিক্স করন যায় না, অইটা দরকার আগে, তাইলেই পিপলের ন্যাতা হওন যায়।

এইরকম ইন্টারভিউ কয়েক দিন ধইর‍্যা চলতেছে। ওই দিকে শক্তির উৎসবাদী রাজবংশের নমিনেশন দেওনও শুরু হয়ে গেছে। আমরা বদ্ধ পাগল হয়ে উঠতেছি, নমিনেশনের চ্যাহারা দেইখ্যা বুঝতেছি এইবার রিয়েল পলিটিক্স হইতেছে, কে যে কোন জায়গায় নমিনেশন পাইব আল্লাও জানেন না। গুনা কইর‍্যা ফেললাম মনে হয়, তিনি নিশ্চয়ই জানেন, কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারতেছি না।

ইন্টারভিউর তিন না চাইর দিনের দিন সেলুলারে একটা চাঞ্চল্যকর খবর আসে মহাজননেত্রীর কাছে, তিনি আনন্দে কাঁপতে থাকেন।

মহাজননেত্রী সেলুলার আবায়ার নিচে কানের কাছে নিয়ে হাতে তসবি টিপতে টিপতে বলেন, হেলো।

ওই দিকের কণ্ঠ বলে, মহাজননেত্রী, বড় খবর আছে, উৎসআলাগো অফিসের গেইেটর কাছে থিকা বলতেছি, উৎসআলারা জ্যানারেল কামরুদ্দিন সাবরে নমিনেশন দেয় নাই, আমরা তারে রাস্তায় ধরছি, তারে আমরা লইয়া আসতেছি।

মহাজননেত্রী বলেন, তারাতারা লইয়া আসো, এইটাই আশা কইর‍্যা আছিলাম, সে শিউর পাশ করবো, তারাতারি লইয়া আসো।

তারা সময় নষ্ট না করে জেনারেল কামরুদ্দিনকে নিয়ে ইন্টারভিউ বোর্ডে উপস্থিত হয়, রাস্তায় ফুলের তোড়া আর মালা কিনতে যা দেরি হয়। মহাজননেত্রী ও রাজপুরুষেরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান।

মহাজননেত্রী বলেন, আপনে আমাগো এইখানে আগেই দরখাস্ত করলে আপনাকে এই কষ্টটা করতে হইত না। আমরা আপনের কথা অনেক দিন ধইরাই বলাবলি করতেছিলাম, এই জইন্যে প্রত্যেক দিন লোকও পাঠাই দিছি খবর নিতে আপনের কি হইল। আপনেরে আমাগো দল থিকা নমিনেশন দিলাম, আপনে শিউর পাশ করবেন, এইবার আমরা পাওয়ারে যাব, আমরা পাওয়ারে গেলে আপনে মিনিস্টার হবেন।

জেনারেল কামরুদ্দিন স্যালুট দিয়ে বলেন, আই অ্যাম রিয়েলি গ্রেইটফুল টু ইউ, আওয়ার মহাজননেত্রী, আই শ্যাল রিমেইন অবিডিয়েন্ট টু ইউ টিল মাই ডেথ। ইউ আর এ গ্রেট লিডার, এইবার আমরা পাওয়ারে যাবই। আই অ্যাম সরি ফর মাইসেল্ফ দ্যাট। আই অ্যাপ্লাইড ফর দেয়ার নমিনেশন, দে আর দি এনিমিজ অব দি কান্ট্রি, আমি এখন বুঝতে পারছি ইউ আর দি হার্ট অব দি কান্ট্রি, ইউ আর দি প্রিন্সেস হু উইল বি দি কুইন, আই শ্যাল সার্ভ ইউ অ্যাজ ইউর সার্ভেন্ট। আমি আপনার দোয়া চাই।

জেনারেল কামরুদ্দিন বাড়ি থিকা বাইর হইছিলেন মহাদেশনেত্রীর ওপর গভীর বিশ্বাস পোষণ করে, তাঁরে টিল ডেথ সার্ভ করার জইন্য, আর বাড়ির দিকে রওনা হলেন মহাজননেত্রীর ওপর গভীর আস্থা পোষণ করে, তারে টিল ডেথ সার্ভ করার পরতিগ্যা কইর‍্যা।

পলিটিক্সে ফাইনাল কথা বলে কিছু নাই, সকাল বিকাল পলিটিক্সে এক জিনিশ না। পলিটিক্স ডাইনামিক ব্যাপার, একখানে দাঁড়াই থাকে না।

এখন ইন্টারভিউ দিচ্ছেন আহমদ আলি পটন; তিনি দ্যাশের এক জেলার মহানেতা, টাকা আর ক্যাডারের অভাব নাই।

আবদুর রহমান বলেন, পটন ভাই, আমরা খবর নিছি যে ওইখানে আপনেই পাশ করবেন, তয় ট্যাকাপয়সা ক্যাডার কেমুন আছে আপনের? [ আহমদ আলি পটন বলেন, ট্যাকাপয়সা ক্যাডার ছাড়া পলিটিক্স হয় না, এই দুইটা আমার আছে, পপুলারিটিও আছে। ভোটার ভাইরা আমার নাম ছাড়া অন্যের নাম লয় না, লওনের সাহস নাই।

কলিমউদ্দিন মৃধা জিজ্ঞেস করেন, ভাই, তাইলে এইবার আপনে ক্যাডার ইউজ করবেন নি?

আহমদ আলি পটন বলেন, ক্যাডারের ইউজ নানা সময় নানা রকমের হয় আমরা পলিটিশিয়ানরা জানি। ক্যাডার থাকতে হয়, সময় বুইঝ্যা ইউজ করতে হয়, যখন যেই রকম দরকার হয়। এইবার হইল নিরপেক্ষ অবাধ ড্যামোক্রেটিক ইলেকশন, এইবার ক্যাডাররা কাটা রাইফেল নিয়া দৌড়াদৌড়ি করব না, ঠাস ঠাস কইর‍্যা লোক ফ্যালবো না, এইবার তারা ড্যামোক্রেটিক প্রসেসে কাজ করবো। সবার স্যাবা করবো, পিস কোরের মতো স্যাবা করবো, কিন্তু ক্যাডার থাকতে হইব, কখন কি হয় বলন ত যায় না।

রজ্জব আলি জিজ্ঞেস করেন, ইলেকশনে খরচ কেমুন করতে পারবেন, পার্টিরে কেমন চান্দা দিতে পারবেন ভাই, পাটি টাকার অভাবে কষ্টে আছে।

আহমদ আলি পটন বলেন, ইলেকশনের খরচের জইন্যে পাঁচ সাত কোটি ধইরা রাখছি, লাগলে আরও খরচ করুম, আর পার্টিরে পাঁচ সাত কোটি চান্দা দিমু বইল্যাঠিক কইর‍্যা রাখছি।

আবদুর রহমান বলেন, ভাই আপনের কথা শুইন্যা খুশি হইলাম, নমিনেশন আপনে পাইবেন। পার্টির ফান্ডের অবস্থা অইত্যান্ত খারাপ, আরও কিছু বাড়াই দিয়েন ভাই।

আহমদ আলি পটন বলেন, চাচা, আপনে যখন বলতেছেন তখন ত দিতেই হইব, তয় হাত পাও ধইর‍্যা রিকুয়েস্ট করতেছি আমারে নমিনেশন দিয়েন। পাশ ত আমি করবই, আমারে কেউ হারাইতে পারবো না।

মহাজননেত্রী বলেন, তা আমরা জানি ভাই, আপনে গিয়া ক্যাম্পেনের কাজ শুরু করেন, এইবার আমাদের পাওয়ারে যাইতে হবে।

এই রকমভাবে অত্যান্ত গোপনীয়তার সঙ্গে জনগণমন বংশের ইন্টারভিউ চলতে থাকে, আমরা গরিব জনগণরা শহরের অক্লান্ত কাকের মতো ছিটাফোঁটা খবর পাইয়া মেতে ওটতে থাকি।

ওই দিকে বসছে শক্তির উৎসবাদী রাজবংশের ইন্টারভিউর বোর্ড; সেইখানেও একই রকম ড্যামোক্রেটিক প্রসেসে নমিনেশন দেওয়া হইতেছে। সেইখানেও গমগমের শ্যাষ নাই, সেইখানেও সব কিছু কাঁপতেছে, পাওয়ার, পাওয়ার, পাওয়ার শব্দ হইতেছে, আগামী কাইলই পাওয়ারে যাইতে পারলে ভালো হইত, কিন্তু যাওন যাচ্ছে না, ইলেকশন কইর‍্যা যাইতে হবে।

আমরা গরিব জনগণরা কি কইরা জানবো সেইখানে কি হইতেছে? তবে আমরা কান খাড়া করে থাকি বলে দূরের শব্দও অল্পস্বল্প শোনতে পাই। সেই শোনা কথাই বলতেছি, দেখা কথা বলতেছি না। দেখনের ভাইগ্য কি আমাগো আছে? আমাগো কথায় একটু নিমক লাগাই লইতে হবে।

ইন্টারভিউ নিচ্ছেন মহাদেশনেত্রী, অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু, অবজেনারেল কেরামতউদ্দিন, সোলায়মান হাওলাদার, মোহাম্মদ কুদ্দুস চৌধুরী, ব্যারিস্টার কুদরতে খুদা, ডঃ কদম রসুল প্রমুখ রাজপুরুষেরা।

মহাদেশনেত্রী স্থির স্মিত বিষণ্ণ নিঃসঙ্গ সুদূর মহারানীর মতো বসে আছেন। তিনি চোখে কী যেনো দেখতে পাচ্ছেন, আবার পাচ্ছেন না, আবার দেখতে পাচ্ছেন, আবার পাচ্ছেন না; একবার কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। এই রকম সময় মানুষের এই রকমই হয়। চারপাশকে এক সময় তাঁর ধ্বসস্তূপ মলপের মতো মনে হয়, ঘুমিয়ে পড়তে তাঁর সাধ হয়; জেগে থাকতে তিনি ক্লান্তি বোধ করেন।

অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু বলেন, আমাগো নমিনেশন দিতে হইব ২৭০জন ক্যান্ডিডেটরে, তার মইধ্যে ২০০জনের নাম আমরা বইস্যা আগেই ঠিক কইর‍্যা রাখছি, মহাদেশনেত্রীর হাতে ১৫টা সিট রাইখ্যা দিছি, আমাগো আসলে পাঁচপান্নটা সিটের জইন্যে ক্যান্ডিডেট নমিনেশন দিতে হইব। আমাগো কম্পিটেন্ট ক্যান্ডিডেটের অভাব নাই, সংসদে ১০০০ সদস্য থাকলে ভাল হইত।

জেনারেল কেরামতউদ্দিন বলেন, ইটস রিয়েলি এ ভেরি ডিফিকাল্ট টাস্ক, দ্যায়ার আর সো মেনি ব্রাইট ক্যান্ডিডেটস, আমাদের ক্যান্ডিডেট অ্যাবাউট পাঁচ হাজার, তার মইধ্য থেকে ফিফটি ফাইভ ক্যান্ডিডেটকে নমিনেশন দেয়া রিয়েলি ভেরি ডিফিকাল্ট, বাট আই অ্যাম শিউর উই ক্যান ডু দ্যাট, মহাদেশনেত্রী উইল শো আস দি রাইট ওয়ে টু ডু দিস অ্যাজ শি হ্যাঁজ অলোয়েজ শৌন।

মহাদেশনেত্রী মিগ্ধভাবে হাসেন; রাজপুরুষেরা কেউ তা দেখতে পান না, তাঁর হাসি দেখার অধিকার তাদের নেই বইলাই শুনছি। দুনিয়ায় কত সৌন্দর্যই এইভাবে নষ্ট হইয়া যায়, আবর্জনার উপর শেফালি ঝইরা পড়ে, মলের টুকরার উপর আইস পড়ে চান্দের আলো, সুন্দরীরা ঘুমায় কোটিপতি কুষ্ঠরোগীর বিছনায়।

ডঃ কদম রসুল বলেন, এই ডিফিকাল্ট কাজ করনের জইন্যে আমরা আমাগো প্রিন্সিপালগুলি কাজে লাগাইব, তখন ইট উইল বি ইজি টু নমিনেট দি রাইট ক্যান্ডিডেটস্। এইর আগেও আমাগো ক্যান্ডিডেটের অভাব হয় নাই, ফিউচারেও অভাব হইব না, আমরা পাওয়ারে যাওনের পাটি।

অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু বলেন, ডাক্তার রসুল ভাই প্রিন্সিপালগুলির কথা মনে করাই দিয়া কাজ সহজ কইর‍্যা দিলেন। আমরা ক্যান্ডিডেটগো রিয়েল পাওয়ারগুলি দেখবো, টাকা আছে কি না, চান্দা কত দিবো, ক্যাডারের জোর কেমুন, আর দেখুম তার হিস্টরি, পাকিস্থানের জইন্য দরদ আছে কি না, ইসলামে বিশ্বাস কতখানি, ইন্ডিয়ার শত্রু কি না, আমাগো দলে কত বচ্ছর আছে, আগে কোন কোন দল করতে। এই পয়েন্টগুলা দেখলে ডিফিকাল্টি হইব না।

মহাদেশনেত্রী বলেন, পলিটিক্সে ডিফিকাল্টি বলে কোনো কথা নাই।

অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু বলেন, মহাদেশনেত্রীর কাছে আমি আমার নত কইর‍্যা কৃতজ্ঞতা জানাই তিনি আমাদের পলিটিক্সের একটা মূল প্রিন্সিপাল মনে করাই দিছেন বইল্যা, তিনি মনে করাই না দিলে আমরা বিষয়টারে ডিফিকাল্ট ভাইব্যা ডরাইতাম, এখন ডরানের কিছু দেখতেছি না।

সোলায়মান হাওলাদার বলেন, আমাদের রাজবংশের যিনি ফাউডার, তারে আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি, তিনিই আমাদের এই মূল প্রিন্সিপালটি দিয়া গেছেন, তার সামনে ডিফিকাল্ট বইল্যা কিছু ছিল না, পাঁচ দশ মাইল হাটন তার কাছে ডিফিকাল্ট ছিল না, যেইখানে আমরা আধমাইল হাটলেই প্যাটের ভারে বইস্যা পরি সেইখানে তিনি এক ঘন্টায় দশ মাইল হাঁটতেন, হেলিকাপ্টারে চরতে আমরা ডরাই তিনি ডরাইতেন না। মাটি কাটতে গাছ কাটতে আমরা ডরাই তিনি ডরাইতেন না, ডর বইল্যা তার কিছু ছিল না।

মোহাম্মদ কুদ্দুস চৌধুরী বলেন, আমাদের গ্রেট লিডার, গ্রেটেস্ট পলিটিশিয়ান অফ দি কান্ট্রি উইল লিড আস টু ভিক্টরি, হি ইজ উইথ আস, হি ইজ গিভিং আস অর্ডার ফ্রম অ্যাবাভ, তার প্রিন্সিপাল মাইন্যা চললে কিছু ডিফিকাল্ট হবে না।

এখন ইন্টারভিউ দিতেছেন মোহাম্মদ ইউসুফ আলি চৌধুরী।

অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু বলেন, ভাই, আপনের সব খবরই আমাগো জানা, আপনের পাওয়ার আর পপুলারিটির কথা দ্যাশের পিপল জানে, তবু কয়টা কথা কই, আপনের থিকা আবার জাইন্যা লই।

ইউসুফ আলি চৌধুরী বলেন, তা জানানের জইন্যেই ত আসছি মাননীয় মহাদেশনেত্রীর সামনে, তার সামনে আসতে পাইরা জীবন ধইন্য হইল, আপনেরা আমার সবই জানেন, আবার জানাইবার সুযোগ পাইলে আমি খুশি হব।

কেরামতউদ্দিন বলেন, মিস্টার চৌধুরী উই ওয়ান্ট টু নো ইউর রিয়েল পাওয়ারস, দ্যাট চান্দা কত দিতে পারবেন, ইউ নো আওয়ার পার্টি ফান্ড ইজ অলমোস্ট এম্পটি, ইলেকশনে খরচ কেমন করতে পারবেন, আর আপনার ক্যাডারদের অবস্থা কি? ক্যাডারস্ আর ভেরি ইম্পরটেন্ট। এইগুলি হচ্ছে একজন সাকসেসফুল পলিটিশয়ানের রিয়েল ফাউন্ডেশন অন হুয়িচ হি স্ট্যান্ডস্ লাইক এ জায়েন্ট। আমরা শিউর যে আপনে একজন পলিটিকেল জায়েন্ট।

ইউসুফ আলি চৌধুরী বলেন, আল্লার রহমতে আর আপনেগো দোয়ায় এইগুলির কোনোটারই আমার অভাব নাই, টাকা, ক্যাডার, পপুলারিটি সবই আমার আছে। পার্টিরে দশ পোনোরো কোটি চান্দা দেওনের জইন্যে আমি রেডি হইয়া রইছি, মানি ইজ নো প্রব্লেম, ইলেকশনে বেশি খরচ এইবার করন যাইবো না শুনছি, তয় দশ পোনোরো কোটির নিচে চলবো না। আমার ক্যাডাররা ট্রেইনিং পাওয়া ক্যাডার, তারা স্যাবা করনে যেমন এক্সপার্ট তেমনই একম্পার্ট আসল কাজে। এই সব দিকে কোনো প্রব্লেম নাই।

অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু বলেন, এই সবই আমি জানি ভাই, বেড়াইতে গিয়াই ত সব দেইখ্যা আসলাম। ভাই চান্দাটা কবে দিতে পারবেন?

ইউসুফ আলি চৌধুরী বলেন, দেশি কারেন্সিতে এইবার দিমু না ডলারে?

অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু বলেন, হাফ হাফ ভাই, দেশিতে হাফ ডলারে হাফ দিয়েন। পাওয়ারে আমরা অল্প দিনের মধ্যেই যাইতেছি, আমাগো ক্যান্ডিডেটগো খরচপাতি তখন উঠাই লওন যাইব। যান ভাই, চিন্তা কইরেন না, আপনে নমিনেশন পাইলেন।

আরেক ক্যান্ডিডেট সাক্ষাৎকার দিতেছেন, যেই সব কথা হইতেছে তার একটু আধটু আমরা শোনতে পাইতেছি।

সোলায়মান হাওলাদার জিজ্ঞেস করেন, আইচ্ছা, আপনের পাকিস্থান আর ইন্ডিয়া সম্পর্কে মত কি?

ক্যান্ডিডেট বলেন, পাকিস্থান আমাগো ফ্রেইন্ড ইন্ডিয়া আমাগো এনিমি। পাকিস্থান মুসলমানের দ্যাশ বাংলাদ্যাশও মুসলমানের দ্যাশ, মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই, ইন্ডিয়া পাকিস্থান ভাঙছে, পাকিস্থান ভাঙ্গনের লিগা ইন্ডিয়া সেভেন্টি ওয়ানে হেল্প করছিল। ইন্ডিয়ারে বিশ্বাস নাই। তবে ইন্ডিয়ার লগে মারামারি করন যাইব না, মোখে মোখে ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে কথা কইতে হবে, ভিতরে ভিতরে খাতির রাখতে হবে, এই পলিটিক্সে আমি বিশ্বাস করি।

ব্যারিস্টার কুদরতে খুদা বলেন, ইউ আর এ ভেরি নলেজেবল পলিটিশিয়ান, ইউর সেন্স অব হিস্ট্রি অ্যান্ড ফরেন পলিসি ইজ প্ৰফাউন্ড, ইউ শুড গো টু দি পার্লামেন্ট।

এইরূপে নমিনেশন দিতে দিতে উৎসবাদী বংশের নমিনেশন দেওনের কাজ শ্যাষ হয়, ডিফিকাল্ট কাজ তারা সহজেই শ্যাষ করেন। কোনো ডিফিকাল্টি হয় নাই, পথ দেখানের জইন্যে তাঁদের প্রদর্শক আছেন।

রাজাকার রাজবংশের কোনো ইন্টারভিউ হয় না। ড্যামোক্রেসি হইছে কুফরি, ড্যামোক্রেসি হইল নাছারা ইহুদিদের ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, এইটা তারা দ্যাশ থিকা দূর কইর‍্যা দিবে, একদিন যখন তারা তলোয়ার দিয়া দ্যাশ দখল কইর‍্যা ফেলবো তখন ড্যামোক্রেসির শুয়োরটারে শ্যাষ করবো; এখন উপায় নাই কুফরি ড্যামোক্রেসির পলিটিক্স তাগো করতে হইতেছে, ইলেকশন করতে হইতেছে, দারাইতে হইতেছে, আল্লার নামে তোট চাইতে হইতেছে, এইটা কুফরি, আল্লার ভোট চাইতে হইবো ক্যান? সব ভোটই ত আল্লার। তবু ইলেকশন করতে হইতেছে, কিন্তু ইন্টারভিউর দরকার নাই, আল্লার লোকজনের নাম আগে থিকাই ঠিক করা আছে, খালি গো নামগুলি জানাই দিলেই চলবে।

রাজাকার রাজবংশের শুরার মজলিস বসে।

এক নম্বর আমির, দুই নম্বর আমির, আর আর পবিত্র পলিটিশিয়ানরা টুপি আসকান আতর ইত্যাদির মইধ্যে সেজেগুঁজে বসেন।

আমির অধ্যাপক আলি গোলাম প্রথমে আল্লার সমস্ত প্রশংসা করেন, তারে ধইন্যবাদ দেন, তার দোয়া চান, আর নাছারাদের ইলেকশনে অংশ লওয়ার জইন্যে মাফ চান। নিশ্চয়ই তিনি মাফ করবেন, তিনি দয়ালু ও ক্ষমাশীল।

আমির বলেন, নাছারাদের ইলেকশন কুফরি, তবু এই ইলেকশনে আমরা অংশ নিতেছি কেননা আমরা আল্লা আর আবু আলার দ্যাশ স্থাপন করতে চাই, এখন দ্যাশে আমাদের পপুলারিটি বৃদ্ধি পাইয়াছে, পারায় পারায় মসজিদ উঠিছে, মানুষ দিনরাত সালাত পড়িছে, এইবার আমাদের অবস্থা অনেক ভাল। ইনশাল্লা আমরা একশো সিট পাইব, আর আগামী ইলেকশনে আমরা দুইশো সিট পাইব, তখন আমরা পাওয়ারে যাইয়া আবু আলার ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন করিব।

উপস্থিত সবাই বলেন, আলহামদুলিল্লা, আল্লার রাষ্ট্র স্থাপনে দেরি হইতেছে বলিয়া আমরা কষ্ট পাইতেছি, আল্লা আমাদের মাফ করিবেন।

আমির বলেন, ইলেকশন দিয়া আল্লার রাষ্ট্র স্থাপন করা ইমানের দুর্বলতা, এই রাষ্ট্র মানুষরে তোশামোদ কইর‍্যা স্থাপন করতে হয় না, আল্লার রাষ্ট্র আল্লার শক্তিতে জোর কইর‍্যা স্থাপন করিতে হয়, যাহারা বাধা দেয় তাহাদের মস্তক ছিন্ন করিতে হয়, কিন্তু আমাদের সেই শক্তি নাই, একদিন আল্লা শক্তি দিবেন।

সবাই হু হু করে কেঁদে ওঠেন, চোখ মুছতে মুছতে বলেন, হে আল্লা, আমাদের সেই শক্তি দান করুন, যাহাতে আমরা ইমানের জোরে তলোয়ারের জোরে আপনার রাষ্ট্র স্থাপন করিতে পারি। হে আল্লা, আমাদের তলোয়ার দান করুন, যেমন তলোয়ার আপনে দিয়াছিলেন তারেকরে, খালেদরে, কাশেমরে, বকতিয়ার খিলজিরে; যেই তলোয়ার আপনে দিয়াছেন তালেবানরে।

আমির বলেন, এইবার আমি সেই সব মমিন ন্যাতাদের নাম পড়িতে জনাব মওলানা রহমত আলি ভিস্তিরে আদেশ দিতেছি, যাহারা এইবার আল্লার নামে ইলেকশনে দারাইবেন।

সবাই বলেন, আলহামদুলিল্লা।

মওলানা রহমত আলি ভিস্তি আমির সাহেবের থেকে অনেক বলিষ্ঠ, তিনি এর আগে ভোট পেয়েছেন, আমির আলি গোলাম কখনো ভোট পান নাই। তাই তার গলায় জোর বেশি, ইমান বেশি।

রহমত আলি ভিস্তি বলেন, আমাদের ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হইবেই, কেহই তাহা থামাইয়া রাখতে পারিবে না, ইনশাল্লা এইবার ইলেকশনে আমরা একশো থিকা একশো তিরিশটা সিট পাইব।

সবাই বলেন, আলহামদুলিল্লা।

রহমত আলি ভিত্তি প্রার্থীদের নাম পড়তে শুরু করেন, মজলিশ ভরে মারহাবা মারহাবা আলহামদুলিল্লা আলহামদুলিল্লা ধ্বনি উঠতে থাকে।

ওই ধ্বনিতে চারদিকে মরুভূমি মরীচিকা জ্বলজ্বল করে ওঠে।

খোজাগণতান্ত্রিক রাজবংশের নমিনেশন লইয়া যেই সমস্ত মজার কাণ্ড হয়, তা আর বলনের দরকার নাই।

নমিনেশন হইয়া গেলে আবার মক্কাশরিফ যাওনের পালা আসলো।

আমাগো রাজাবাদশারা আইজকাল রিলিজিয়ন ছাড়া বাঁচতে পারেন না, পাজেরো চালাইয়া গিয়া তারা সালাত কইর‍্যা আসেন, তগো দমে দমে আল্লাহু। এই পচা মাটি ময়লা খাবড় এমন পাকপবিত্র আর আগে হয় নাই। একদিন এই খাল বিল নদী নালা তাগো সোয়াবে রুব-আল খালি হইয়া উঠবো, সেই দিন দেরি নাই। এমন যদি হইত তারা দিনে পাঁচবার মক্কাশরিফ মদিনাশরিফ জেদ্দাশরিফ রিয়াদশরিফ যাইতে আসতে পারতেন, সেইখানকার বালি কপালে মাথায় শরিলে লাগাইতে পারতেন, পাথরে চুমা খাইতে পারতেন, তাইলে খুব ভালো হইত, আমরা আরো ভোট দিতাম; কিন্তু আইজও সেই সুবিধা হয় নাই, যাইতে আসতে সময় লাগে, জিন নাই বিমানে যাইতে হয়। প্রত্যেক দিন তারা যাইতে পারেন না, পলিটিক্স করতে গেলেই একবার ওইখানে ঘুইর‍্যা আসেন, ড্রেস বদলিয়ে আসেন, চেহারায় নতুন মেকাপ লাগাইয়া আসেন, দ্যাশটারে তাক লাগাই দ্যান। আমাগো পলিটিক্স আর রিলিজিয়ন একই ব্যাপার, একটার লগে আরেকটার লাগালাগি নাই, দুইটার মইধ্যে গলাগলি ভাব।

ক্যাদামাটির দ্যাশের পলিটিক্স করনের জইন্যে যাইতে হয় বালির দ্যাশে। শ্যামলা দ্যাশে ভোট পাওনের লিগা ঘুইর‍্যা আসতে হয় মরুভূমি। পলিটিক্স! ড্যামোক্রেসি! একদিন দ্যাশটা রুব-আল খালি হইয়া উঠবো।

ইস্কুলে পড়নের কালে আমাগো বাঁশমওলানা সাব (তিনি একটা মোটা বড়ুরা বাঁশের আট হাতি লাঠি হাতে লইয়া আসতেন, মাটিতে ঢুশঢাশ শব্দ হইত, আমরা তারে বাশমওলানা সাব বলতাম) একটা মছল্লা বলছিলেন, সেইটা আমাগো মনে পড়তেছে। এক শহরে এক পরহেজগার বান্দা আছিলেন, তিনি দিনে পাঁচবার মক্কাশরিফ যাইয়া নামাজ পড়ে আসতেন, সবাই তাকে ধন্য ধন্য করতো।

তাঁর একটা জিন আছিল, জিনটা তারে লইয়া যাইতে লইয়া আসতো।

জিনটা একদিন তারে মহাসাগরের এক দ্বীপে নিয়া আটকাইয়া বলে, কেয়ামত পর্যন্ত আমি তোমার গোলাম হয়ে থাকবো, তবে আইজ আমারে সেজদা করো, নাইলে এই মহাসাগরের মইধ্যে তোমারে একলা ফেইল্যা যাবো।

জান  বাঁচানের জইন্যে ওই পরহেজগার জিনরে সেজদা করেন (হায়, হায়, তিনি কী করেন), জিন তার গোলাম হইয়া থাকে, পরহেজগার সাহেব জিনের কান্ধে চইর‍্যা পাঁচবার মক্কাশরিফ যাইয়া আইস্যা নামাজ পড়তে থাকেন। কিন্তু যা হইবার তা হইয়া গেছে, জিনরে সেজদা করায় তার সব শ্যাষ হইয়া গেছে।

তাঁর মাবুদ দুইটা, জিনটাও তাঁর মাবুদ। আমাগো তাগো মাবুদ কয়টা?

ওমরা করনের জইন্যে জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশের মহাজননেত্রী মক্কার উদ্দেশে ষাইটসত্তরজন লইয়া রওনা হইয়া গেলেন (এইবার পাওয়ারে যাইতে হইবো, এইবার পাওয়ারে যাইতে হইবো, আল্লা, আমাগো পাওয়ারে বসাও), আমরা তার মাথা দেখতে পাইলাম না, মাথার চুলে শয়তান থাকে, চুল ঢাইক্যা রাখতে হয়, মুখের একটুখানি মাত্র দেখলাম, মনে হইল ফেরেশতারা যাইতেছেন। তাঁরা সবাই ফিইর‍্যা আসলেন আরো বড়ো ফেরেশতা হইয়া, পোশাক বদলাইয়া, মরুভূমি হইয়া, হাতে তসবি লইয়া। তসবি টিপতে টিপতে তাঁরা কী বলেন, আমরা শোনতে পাই না (এইবার পাওয়ারে যাইতে হইবো, এইবার পাওয়ারে যাইতে হইবো, আল্লা, আমাগো পাওয়ারে বসাও)।

শক্তির উৎসবংশের মহাদেশনেত্রী আশিনব্বইজন লইয়া পবিত্র ওমরা করনের জইন্যে মক্কার উদ্দেশে রওনা হইয়া গেলেন (পাওয়ারে ফিরা যাইতে হইবো, পাওয়ারে ফিরা যাইতে হইবো, পাওয়ার ছারা বাচবো না, আল্লা, পাওয়ার দেও), তার পোশাক দেইখ্যাও আমরা তাজ্জব হইলাম, তার বিউটিশিয়ানরা ভালো মেকাপ দিয়াছে, শয়তান ঢোকনের পথ নাই, রিলিজিয়ন, পলিটিক্স ও স্টাইলরে সুন্দরভাবে মিলাইয়া দিয়াছে, আমরা তাঁর মুখ দ্যাখতে পাইলাম না, তবে যতটুকু দ্যাখলাম, তাতে ধর্মের দাগ দেইখ্যা খুশি হইলাম। তাঁর তসবি দেখা যায় না, তাঁরা কী বলেন শোনা যায় না (পাওয়ারে ফির‍্যা যাইতে হইবো, পাওয়ারে ফিরা যাইতে হইবো, পাওয়ার ছারা বাচবো না, আল্লা, পাওয়ার দেও)।

এই সময় হঠাৎ খুন হয়ে গেলো চৌদ্দগ্রামের ভালো ছেলেটি, যে রাজনীতির মতো ভালো কাজে কখনো ছিলো না বলেই জানতাম। সে ক্লাশে ফার্স্ট সেকেন্ড হতো, এইটা খুবই খারাপ, ফার্স্ট সেকেন্ড হলে কেউ পলিটিক্স করে না, পড়ে পড়ে নিজেকে নষ্ট করে, পলিটিক্স করলে কেউ ফার্স্ট সেকেন্ড হয় না, হওয়ার দরকার পড়ে না। তার বাবাটি গরিব, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মা আর বাবা একটু সুখ পেতো। সুখটুখ পাওয়া ঠিক নয়, একটু দুঃখে থাকা দরকার মানুষের, আর এই দুঃখের দেশে আবার সুখ কী; সে ইস্কুল থেকে ফেরার পথে খুন হয়ে গেলো। এটা তার দোষ, তাকে খুন করার কারো ইচ্ছে ছিলো না, কিন্তু সে খুন হয়ে গেছে। দু-চারটা খুন না হলে ইলেকশন জমে না। চৌরাস্তায় একটু গোলমাল হয়েছিলো, গোলমালটা চলছিলো দুই বড়ো রাজবংশের ক্যাডারদের মধ্যে, তখন ছেলেটি সেখান দিয়ে আসছিলো, বেশি নয়, কাটারাইফেলের একটা গুল্লি এসে তার মাথায় লাগে। ছেলেটি পড়ে যায়, তাকে কেউ টেনে তোলে না, হাসপাতালে পাঠায় না; পাঠালেও কোনো লাভ ছিলো, ডাক্তাররা কেউ ছিলেন না, তারা সবাই ঢাকায় প্র্যাকটিস করছিলেন। ছেলেটি মারা যায়। এটা কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয়, গুলিটুলি লেগে মৃত্যু আমাদের দেশে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।

আমরা আগে বুঝতে পারি নি যে গরিবগর্বার ওই ছেলেটি শহিদ অমর হওয়ার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলো। কিছুক্ষণ পরই আমরা জানতে পারি ছেলেটি শহিদ ও অমর; তার রক্ত দামি, তার রক্তের কণায় কণায় পলিটিক্স।  

সে উল্টেপাল্টে পড়ে গেলে আরো কিছুক্ষণ ফাটিয়ে ফুটিয়ে ঝাঁপিয়ে নড়িয়ে চারপাশ বন্ধ স্তব্ধ করে বীর ক্যাডাররা চলে যায়। একটা পড়ে গেছে, ফেলার ইচ্ছে তাদের ছিলো না, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের আগে তারা রক্ত ফেলতে চায় নি, কিন্তু পড়ে গেছে, এটা তাদের দোষ নয়। তাদের দোষ দিতে পারি না, তারা ছেলেটিকে খুন করতে চায় নি, ছেলেটিই খুন হওয়ার জন্যে সেখানে গিয়ে পড়েছিলো, ওর ভাগ্য খারাপ বা ভালো। ধর্মে আমরা বিশ্বাস করি, বরাতে বিশ্বাস করি, তার জন্যে সারা রাত জেগে থেকে কতো সোনাদানা চাই, পরের বছরই সেই সব সোনাদানায় আমাদের ঘররাড়ি ভরে ওঠে, রাখনের জায়গা পাই না, সেই স্বর্গীয় বিশ্বাস থেকে বলতে পারি আমরা দুঃখ করতে পারি না, আল্লা এটা তার নামে লিখে রেখেছিলো, তাই গুলি লেগে সে মরেছে। না মরলেই বরং বিশ্বাসে গোলমাল দেখা দিতো। ক্যাডারদের কোনো দোষ নেই, কাটারাইফেল তারা চালিয়েছিলো সেটা তাদের নামে লেখা ছিলো। মানুষের করার কিছু নেই, তিনি যা করান মানুষ তাই করে। তাই কাউকে দোষ দিতে পারি না।

ক্যাডাররা সিগারেট টানতে টানতে নিজ নিজ শিবিরে ফিরে গিয়ে দেখে তাদের নেতারা খুব উত্তেজিত হয়ে অপেক্ষা করছেন। নেতাগুলো কাটা চালাতে পারে না, পারে শুধু মিছে মিছে বক্তৃতা দিতে আর উত্তেজনায় টান টান থাকতো। তারা থানার নেতা, দেশেরও নেতা; ইলেকশনের আগে তাই তাদের উত্তেজনা স্বাভাবিক। ক্যাডাররা ঠাণ্ডা, ধীরস্থির, বরফের মতো প্রশান্ত, আর ভয়াবহ।

এক বংশের থানা-নেতা জিজ্ঞেস করেন, খবর কি, শোনলাম একটা লাছ পরছে? ঘটনা কি বুঝাই কও।

বেন্সন টানতে টানতে এক ক্যাডার বলে, হ, পরছে একটা, মাতায় গুলি লাগছে মনে হইতাছে। ফুরাই গ্যাছে লাগতেছে।

থানা-নেতা জিজ্ঞেস করেন, লাছটা কই, লাছটা আনলা না?

ক্যাডার বলে, লাছ দিয়া কি করুম? লাছ ত আনতে কন নাই।

থানা-নেতা বলেন, তোমরা করছো কি? একটা অ্যাছেট ফেইল্যা আসছে। ইলেকশনের আগে এমুন অ্যাছেট আর পামু কই?

ক্যাডার বলে, লাছ ত পুলিশভাইগো প্রপার্টি, সেইজইন্য রাইখ্যা আসলাম।

জ্যাকেটে রক্ত লাগাইতে ইচ্ছা হইল না।

থানা-নেতা বলেন, ইলেকশনের আগে একটা লাছ পাওন ভাইগ্যের কথা, অইটা আমাগো লাছ, আল্লায় দিছে। যাও, বাবারা, তরাতরি যাও, পোলাটার নামের লগে শহিদ আর জিন্দাবাদ লাগাইয়া শ্লোগান দিতে দিতে লাছটা লইয়া আসো। একটা শহিদ আমাগো দরকার।

ক্যাডাররা শ্লোগান দিতে দিতে লাশ কুড়োতে চলে যায়।

আরেক বংশের থানা-নেতা জিজ্ঞেস করেন, ইদ্রিস মোল্লার পোলাটা নাকি মাথায় গুল্লি লাইগ্যা পইর‍্যা গেছে?

বেন্সন টানতে টানতে এক ক্যাডার বলে, কার পোলা তা ত জানি না, তয় পোলাডার নাম শুনছি সিদ্দিক।

থানা-নেতা বলেন, সিদ্দিক এখন শহিদ সিদ্দিক, সে আমাগো দলের, তার রক্ত বৃথা যাইতে দেওন যায় না।

ক্যাডার বলে, অই ছামরারে কোনো দিন দলে দেখি নাই, শুনছি ক্লাশে ফাস্ট হইত। এই মাল দিয়া দলের কোনো গেইন নাই।

থানা-নেতা বলেন, সে ব্রিলিয়েন্ট ছাত্র, সিদ্দিক এখন শহিদ, তার লাছটা লইয়া আসো। বাবারা, যাও, শহিদ সিদ্দিক জিন্দাবাদ, শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দিব না, সিদ্দিকের রক্তে গণতন্ত্র আনবো বইল্যা শ্লোগান দিতে দিতে যাও, তার লাশ লইয়া মিছিল করুম। বিকালে জনসভা করুম। ফাস্ট বয়ের লাশটা এখন খুব কামে লাগবো। ইলেকশনের আগে একটা শহিদ পাওন ভাইগ্য।

এক ক্যাডার বলে, বাইচ্যা থাকনের সময় মনে হইত ও কোনো কামে লাগবো না, এখন দেখতেছি অর লাছটা কামে লাগবো।

শহিদ সিদ্দিক জিন্দাবাদ, সিদ্দিকের রক্তে গণতন্ত্র আনবো, শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দিব না শ্লোগান দিতে দিতে ক্যাডাররা শহিদ সিদ্দিকের লাশ আনতে যায়।

লাশ তাদের চাই, একটি শহিদ তাদের দরকার।

আবার কাটারাইফেল ফুটান শুরু হয়।

লাশ একটা হয়েই অসুবিধা হয়েছে, আরেকটা লাশ পড়ন উচিত আছিল; তাইলে দুই রাজবংশ দুটি অমর শহিদ পেতো, ভোটের বাক্সে ব্যালেন্স আসতো, ড্যামোক্রেসি থাকতো। লাশ একটা, অতিশয় মূল্যবান লাশ, তার মালিক দুই দল। ওই লাশ বোঝাই ভোটে লাশের উপর ড্যামোক্রেসির সিংগাসন।

রাজবংশগুলো এখন দেশ দখল করতে বেরিয়ে পড়েছেন।

মনে হচ্ছে মঙ্গোলিয়া উজবেকিস্থান কাজাকিস্থান মেসোপটামিয়া আরাবিয়া আফগানিস্থান খোরাশান বদকশান ইরান তুরান থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে তলোয়ার উঁচিয়ে গলা কাটতে কাটতে ছুটে আসছে প্রচণ্ড বীরেরা, চেঙ্গিশ হালাকু খানেরা, বিন কাশেম বখতিয়ার খিলজি তারিক খালেদরা; তবে এইটা আমাগো ভুল, দশ বারো শো বচ্ছর ধইর‍্যা ঘোম না হইতে হইতে চোখ ভইর‍্যা দুঃস্বপ্ন দ্যাখতে দ্যাখতে রাইতের বেলা দিনের বেলা মার মার কাট কাট শোনতে শোনতে আমরা এখন ঠিকটা দেখতে পাই না, ঠিকের ছায়াটা দেখি, মানুষ না দেখে তার প্রেতটা দেখি। এইটা আমাগো অসুখ। চোখ আর মগজ খারাপ হয়ে গেছে বইল্যা সত্য না দেখে মিথ্যা দেখি। যারা নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ইলেকশনের ক্যাম্পেইনে বাইর হয়ে পড়ছেন, তাঁরা কেউ অইসব দ্যাশ থিকা আসেন নাই, তাঁরা আমাগোই মানুষ, আমাগোই রাজপুরুষ, আমাগো পুকুরেরই পানি খান, আমাগো ধানেরই ভাত খান, তাগো দয়ার শরীর, তাঁরা জনসভার পর জনসভা মিটিংয়ের পর মিটিং করে আমাগো ভালোবাসা জানাইতেছেন, দ্যাশের সঙ্গে তারা প্রেম করতেছেন, তাঁরা ঘুমাইতে পারতেছেন না আর আমাগোও ঘূমাইতে দিতেছেন না; এইবার মরন বাঁচনের ইলেকশন। এইবার কিয়ামত ঘনাইয়া আসছে দ্যাশ ভইর‍্যা।

রাস্তায় রাস্তায় পথে ঘাটে মিটিংয়ে মিটিংয়ে জনসভায় জনসভায় খাঁটি প্রকত সেন্ট পার্সেন্ট মোলো আনা নির্ভেজাল নিশ্চিত বিশুদ্ধ আসল সাচ্চা ইমানদার মমিন মুসলমান দেখতে পাইতেছি আমরা। এতো আর একসঙ্গে কোনো কালে দেখি নাই, আমাগো পাপী বাবারা দেখে নাই পাপী দাদারা দেখে নাই। সাতশো বছর আগে দেখি নাই। তিনশো বছর আগে দেখি নাই একশো বছর আগে দেখি নাই মুগলগো আমলে দেখি নাই ইংরাজের রাজে দেখি নাই, যখন কালা কিস্তি টুপি মাথায় দিয়া ‘পাক সরজমিন সাদবাদ তুনিশানে আজমে আলিশানে’ মুখ দইয়ের মতন ফেনায় ভরে তুলতাম, তখনও দেখি নাই। আমাদের সব রাজপুরুষরা বড়ো বড়ো পরহেজগার মমিন মুসলমান সেজে মুখে আর বুকে আর মাথায় ইসলাম নিয়া ড্যামোক্রেসির ইলেকশনের ক্যাম্পেইনে নামছেন, লগে লগে আমরাও নামছি; মনে হইছে ইসলাম এত শ বছর পর খাঁটি অনুসারী পাইয়া জিন্দা হইয়া উঠছে, আমরাও জিন্দা হচ্ছি। ইসলামের এমন সুদিন আর আসে নাই, অন্যরা আনে নাই, আমাগো রাজারা আনছে, আমরা আনছি। রিলিজিয়নটা এই দ্যাশে নতুন কইর‍্যা পোরচার হচ্ছে; আগে ঠিক মতন হয় নাই, এইবার পোক্ত করা হচ্ছে। শুনছি ঠ্যাকলে নাকি শয়তান সবচাইতে বেশি কইর‍্যা আল্লার নাম লয়, মোখ থিকা অই নাম সরে না, আমরা সেইটা আমাগো চোখে দেখতে পাইতেছি। ভাত চাই না আমরা, ভাত খাইয়া বাইচ্যা থাইক্যা কি হয়; কাপড় চাই না আমরা, কাপড় পইর‍্যা কি সুখ, না পড়লে কি হয়; ইস্কুল চাই না আমরা, ইস্কুল দিয়া কোন খাট্টা হয়; হাসপাতাল চাই না আমরা, হাসপাতালে গিয়া বাইচ্যা থেকে গুনা বাড়াইয়া খালি দোজগের পথ বাড়ে; চাকরি চাই না আমরা, সৌদি গিয়া চাকর খাটলেই চলবো; কিছু চাই না আমরা; খালি তারে চাই; নিজেগো লিগা ঘর চাই না আমরা, তার লিগা ঘর বানাইলেই হইব।

আমাগো রাজবংশগুলি প্রচণ্ড তাণ্ডবে মহাগর্জনে ভৈরব হুংকারে আশমান জমিন কাঁপাইয়া ইসলাম প্রচার করতে লাগছেন, আমরা সাচ্চা মুসলমান হইয়া উঠছি, চোখে দিনরাইত ভেস্তদোজগ দেখতে পাচ্ছি, তবে আমরা বুঝতে পারছি না এইটা ড্যামোক্রেসির ইলেকশন না একটা নতুন ধর্ম প্রবর্তন। দুই নম্বরটা হইলেই উত্তম, ড্যামোক্রেসি দিয়া আমরা কি করুম? ড্যামোক্রেসি ধুইয়া খাইয়া কি আমরা ভেস্তে যাইতে পারুম? দুনিয়াটি কয় দিনের? পলিটিক্স, প্রধান মন্ত্রী, ড্যামোক্রেসি, ইলেকশন, এমপি, পার্লামেন্ট, পাজেরো, বনানী, গুলশান কয় দিনের?

আমাগো মনে হইছে দুনিয়ায় একটা নতুন রিলিজিয়ন আসছে, আর সেইটা নিয়া আসছেন আমাগো ড্যামোক্রেসির রাজপুরুষেরা।

যিনি কোনোদিন সালাত পড়ে নাই, দেখতে পাচ্ছি তিনি মসজিদে মসজিদে হাজার হাজার ভোটার লইয়া সালাত পড়ছেন। মসজিদ কাইপ্যা ওঠছে।

স্কচ, পান না করলে যিনি সুস্থ থাকেন না (স্বাস্থ্যগত কারণে অনেকেরই এইরূপ হইয়া থাকে), একটু আগে যিনি স্কচ টানছিলেন (না টানলে দেশপ্রেম সংহত হইয়া জমে না), দেখতে পাই মঞ্চে উইঠাই তিনি ধর্ম প্রচার শুরু করছেন।

আমরা খালি খুশি হইতে থাকছি, ভেস্তের কথা ভাইব্যা জার জার হইছি।

মহাজননেত্রী মাথাটিকে অদ্ভুতভাবে ঢেকে (শয়তান হইতে চুল সাবধান, মাইয়ালোকের চুলের ভিতর দিয়া শয়তান ভিতরে ঢোকে) মঞ্চে উঠইে বলছেন, প্রিয় ভাইসব, ভাইরা আমার, বোনরা আমার, দ্যাশে আল্লারে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিতে। হইবে, আমার বংশরে ভোট দ্যান, আমরা ছাড়া আর কোনো বংশ আল্লারে চায় না। আমরাই খালি তারে চাই।

মহাদেশনেত্রী স্টাইলে (তার স্টাইলে ডেভিল আকৃষ্ট হইতে পারে) মাথা ঢেকে মঞ্চে উঠেই বলেন, অরা পাওয়ারে আসলে দ্যাশ থিকা ইসলাম উঠে যাবে, বিসমিল্লা লাইলাহা থাকবো না, খালি উলুর শব্দ আর মন্দিরের ঘণ্টার শব্দ শোনা যাবে, পঞ্চাশ লক্ষ হিন্দু ইন্ডিয়া থিকা রওনা করছে।

অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু স্টেজে দাঁড়িয়েই বলেন, ভাইসব, আপনেরা কি চান, আমি জানি আপনেরা আল্লারে চান, নামাজ পরতে চান, রোজা রাকতে চান, ভেস্তে যাইতে চান। আমরা পাওয়ারে আসলে আপনেরা আল্লারে পাইবেন, নামাজ পরতে পারবেন, রোজা রাকতে পারবেন। অরা পাওয়ারে আসলে আপনাগো ধর্ম থাকবো না, আল্লা থাকবো না, লাইলাহা থাকবো না, হিন্দুরা আইস্যা ভগবান ভগবান কালি কালি দুর্গা দুর্গা বইল্যা পুজা করবো।

নিজামউদ্দিন আহমদ মঞ্চে উঠেই বলতে থাকেন, হে আল্লা, আপনের বাসনা পূর্ণ করার জইন্যই আমরা পলিটিক্স করি, ইলেকশন করি, এই জনগণ আপনের বান্দা, এই জনগণ আমাগো পাওয়ারে দ্যাকতে চায়। আল্লা, আপনেরে ছারা আমরা আর কিছু জানি না। আমরা পাওয়ার চাই না, আল্লারে চাই।

মনোয়ার হোসেন মোল্লা মঞ্চে উইঠাই বলেন, ভাইরা, আপনেরা নয় বচ্ছর ধইরা দেকছেন আমাগো মহাজননেতা ইসলাম ছারা আর কিছু বোজতেন না। ইসলামের জইন্যে তিনি আজ বন্দী হয়ে আছেন। তিনি স্বপ্ন দেখে মসজিদে গিয়া নামাজ পরতেন, তার মতন মুসলমান আর নাই। তিনি বাহির হইয়া আসলে দ্যাশে প্রকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হইবে।

মওলানা রহমত আলি ভিস্তি মঞ্চে উঠেই বলেন, মমিন মুসলমান ভাইরা, দ্যাশে ইসলাম আইজও প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, আমরা চাই দ্যাশে আল্লার রাজ্য স্থাপন করতে। কাফেরগো হাত থিকা দ্যাশ উদ্ধার করতে হইব, আল্লার দ্যাশ আল্লার হাতে তুলে দিতে হইব। আমরা পলিটিক্স করি না, ড্যামোক্রেসি চাই না, আল্লার শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই।

বিসমিল্লা আল্লা রসুল লাইলাহা বিসমিল্লা আল্লা রসুল লাইলাহা বিসমিল্লা আল্লা রসুল লাইলাহা বিসমিল্লা আল্লা রসুল লাইলাহা বিসমিল্লা আল্লা রসুল লাইলাহা বিসমিল্লা আল্লা রসুল লাইলাহা বিসমিল্লা আল্লা রসুল লাইলাহা বিসমিল্লা আল্লা রসুল লাইলাহা বিসমিল্লা আল্লা রসুল লাইলাহা বিসমিল্লা আল্লা রসুল লাইলাহা।

আর কিছু চাই না আর কিছু দরকার নাই।

আরেকটা জিনিশ লইয়া তাঁরা খোঁচাখুঁচি করতেছেন, সেইটা আমাগো কানা কড়ি, এক পয়সার মমবাতি, আমাগো ওই স্বাধীনতা, আমাগো ওই মুক্তিযুদ্ধ।

জিনিশটার কথা আমরা ভুইল্যা যাইতেছি, ভুইল্যা থাকলেই আমরা ভালো থাকি, তবে মাঝেমইধ্যে দুইটা লইয়া একটু আধটু শরিল আর মনটারে চুলকাইয়া তাজা করে তুলি, চাইরপাঁচ মিনিটের জইন্যে ভাল্লাগে।

মহাজননেত্রী মাঝেমইধ্যে বক্তৃতার শ্যাষে ভয়ে ভয়ে বলেন, আমরা স্বাধীনতা আনছি, আমরা ফ্রিডম ফাইটিং করছি, আমাগো বংশ ছারা দ্যাশ স্বাধীন হইত না।

তিনি তাকাইয়া দেখেন লোকজন কেমন নিতাছে, স্বাধীনতার কথায় আবার তারা ক্ষেইপ্যা ওঠতাছে কি না। তাইলে তিনি এই নিয়া কথা বলবেন না। একটু অন্য রকম দেকলে তিনি আল্লাতালার কথা বলতে শুরু করেন।

মহাদেশনেত্রী বক্তৃতার শ্যাষে উঁচা গলায় বলেন, আমরা স্বাধীনতা ডিক্লেয়ার করছিলাম, আমরা ফ্রিডম ফাইটিং করছিলাম, অরা কইলকাতা গিয়া নাটক সিনেমা দেখতেছিল, হিন্ধু মাইয়া লইয়া ঢলাঢলি করতেছিল।

মওলানা রহমত আলি ভিস্তি বক্তৃতার শুরুতেই বলেন, নাইন্টিন সেভেন্টি ওয়ানে আমরা ভুল করি নাই, ওই যুদ্ধ হইছিল ইসলাম নষ্ট করনের জইন্যে, আমরা ইসলাম বাঁচানের জইন্যে রাজাকার হইছিলাম। আমরা না থাকলে দ্যাশে ইসলাম থাকতো না, দ্যাশ হিন্দুগো হইয়া যাইত।

আমাগো দেশের এইখানে সেইখানে পশু না জিন না রাক্ষস না স্কন্ধনাইয়া না শয়তান না কিসের যেনো উৎপাত শুরু হইছে।

কিসের যে উৎপাত আমরা বুঝতে পারি না।

ওই আজব জিনিশগুলো খুবই রহস্যজনক, আমরা দেখতে পাই না, নীরবে নিঃশব্দে চলে যাওয়ার পর বিকট গন্ধ পাই, বিশ্রী গভীর পায়ের দাগ পাই, আর পড়ে থাকে তাদের ধ্বংসলীলার চিহ্ন।

অনেক সময় গন্ধেই আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে।

পার্বতীপুরে এক সন্ধ্যায় বিকট গন্ধে লোকজন পাগল হয়ে ওঠে। এইপাশে ধানক্ষেত আর ওইপাশে রেলের ইঞ্জিনের গন্ধেই তারা অভ্যস্ত ছিলো, ওই গন্ধ তাদের নিজেদের শরীরের গন্ধের মতো মধুর লাগতো, কিন্তু হঠাৎ অন্য রকম গন্ধে তারা আঁৎকে ওঠে। রাস্তায় ছিলো যারা মাঠে ছিলো যারা বাজারে ছিলো যারা রেলস্টেশনে ছিলো যারা তারা প্রথম গন্ধ পেয়ে দৌড়ে বাসায় ফিরতে থাকে, বাইরে থাকতে পারে না। বাসায় ফিরে সব দরোজা জানালা বন্ধ করে দেয়, ছিদ্রে ছিদ্রে তুলো ছেঁড়া কাপড় চট আর আর যা পায় ঢুকোতে থাকে, কিন্তু গন্ধ বন্ধ হয় না, চড়চড় করে গন্ধ ঢুকতে থাকে। তারা নাক চেপে বিছানায় মাটিতে সারারাত পড়ে থাকে, ব্যথায় নাক ফুলে ওঠে। সকালের দিকে দেখে কোনো গন্ধ নেই।

সবাই রাস্তাঘাটে বলাবলি করতে থাকে, রাইতভর কিসের গন্ধ পাইলাম?

কেউ ওই গন্ধের পরিচয় জানে না।

কেউ কেউ বলে, কোনো নতুন পশুর গন্ধ হইব। অই পশু আমরা কোনো দিন দেখি নাই।

কেউ কেউ বলে, আমাগো বাড়ির পিছনে একটা পায়ের দাগ দ্যাকলাম, এমন দাগ আগে দেখি নাই।

কেউ বলে, ইরিখেতে গিয়া দ্যাখলাম একটা প্যাচাইনা দাগ, খুড় আধ হাত মাটিতে ঢুইক্যা গ্যাছে।

এইটা কি কোনো পশুর পায়ে দাগ? কেউ জানে না।

এমন প্যাঁচাইনা আর গভীর কোন পশুর খুড়? কেউ জানে না।

এইটা কি জিন? রাক্ষস? শয়তান? কেউ জানে না।

তারা পুকুরপাড়ে ধানক্ষেতে মাঠে বাড়ির পেছনে পশু না জিন না রাক্ষস না। স্কন্ধনাইয়া না শয়তান না কিসের যেনো অদ্ভুত পায়ের দাগ দেখতে পায়, যেমন পায়ের দাগ আগে তারা দেখে নি।

শিক্ৰামপুরে আসে একটা অদ্ভুত পশু, তার স্বভাব অদ্ভুতভাবে অন্য রকম।

পশুটা রাতের বেলা আসে, কখন আসে কেউ দেখতে পায় না, রাতে সবার গভীর ঘুম পায়, একটা পাখিও জেগে থাকে না; ঘুমের মধ্যে শিক্রামপুরের মানুষ সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখে, সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখে শোচনীয় দৃশ্য।

পশুটার কাজ পুরোনো কবর ভেঙে লাশের হাড়গোড় খাওয়া। ওটি পুরোনো হাড়গোড় খেতেই বেশি পছন্দ করে। তারা জানে শেয়াল কবরে আসে নতুন লাশ খেতে, কিন্তু এই পশুটা অন্যরকম; যে-সব কবর বিশ পঞ্চাশ দশ পাঁচ বছরের পুরোনো, যে-সব কবরের কথা প্রিয়জনেরাও ভুলে গেছে, পশুটা সে-সব কবর খুঁড়ে তুলে আনে হাড়গোড়, রাতভর খায়, কিছু হাড় ফেলে রেখে যায়। সকালে লোকজন উঠে দেখে কয়েকটি কবরের পাশে পড়ে আছে পুরোনো অপরিচিত হাড়গোড়।

লোকজন ভয় পায়, যে-প্রিয়জনদের তারা ভুলে গেছে, তাদের জন্যে বেদনা জেগে ওঠে তাদের মনে; কিন্তু তারা কী করবে বুঝে উঠতে পারে না।

তারা নানা রকম খতম পড়ায়, কিন্তু পশুটা তার কাজ করে যেতে থাকে।

রসুল্লাগঞ্জের জনগণ একরাতে আক্রান্ত হয় ভয়ঙ্করভাবে।

সন্ধ্যার কাজকর্ম শেষ করে খেয়ে তারা শোয়ার আয়োজন করছে, স্বামীস্ত্রীরা ছোটোখাটো ঝগড়াঝাটিগুলো মিটিয়ে নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় তারা ভালুকের প্রচণ্ড গর্জনের শব্দ শুনতে পায়। ভালুকের গর্জনে ও গন্ধে তারা প্রথম ভয় পেয়ে যায়, এবং বিস্মিত হয় যে তাদের পল্লীতে ভাল্লুক আসার কথা নয়, কয়েক শো মাইলের মধ্যে কোনো বন নেই, ভাল্লুক এলো কোথা থেকে? একটা বাড়ি থেকে আর্ত চিৎকার উঠলে তারা বুঝতে পারে ওই বাড়িটা আক্রান্ত হয়েছে; তারা শরকি বর্শা ট্যাটা উঁতি যার যা ছিলো, সে-সব নিয়ে বেরিয়ে ওই বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে।

তারা এগোতে পারে না। পঞ্চাশটির মতো বিশাল বিকট লোমশ ভালুকের মুখোমুখি তাদের সমস্ত সাহস শক্তি শরকি বর্শা ট্যাটা উঁতি নিষ্ক্রিয় হয়ে ওঠে, তারা আক্রান্ত হতে থাকে, ভাল্লুকগুলো তাদের থাবায় তুলে তুলে ছিঁড়েফেড়ে ফেলতে থাকে। ঘন্টাখানেক ধরে সন্ত্রাস আর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ভাল্লুকগুলো দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে। লাশের পর লাশ পড়ে থাকে রসুল্লাগঞ্জ জুড়ে, সারা গ্রাম গোঙাতে থাকে কাঁদতে থাকে। সারা গ্রাম মরে যায়।

একরাতে বাঘ পড়ে আমাদের সারা দেশ জুড়ে।

সুন্দরবন না কোন বন থেকে দলে দলে নেমে আসতে থাকে ডোরাকাটা হলদে চকচকে প্রচণ্ড হিংস্র ভয়াবহ বাঘেরা, তারা ঢুকতে থাকে আমাদের পল্লীতে, নগরে, শহরে। তারা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আসে, ধানক্ষেত পাটক্ষেত সরষে আলু ক্ষেতের ওপর দিয়ে আসে, আমাদের আলপথ, রাজপথ, পুকুরপাড়ের পথ দিয়ে আসে, তারা নদী সাতরে আসে, বিলের জলাভূমির ওপর দিয়ে আসে, পুকুর খাল পার হয়ে আসে, বাঁশের পুলের ওপর দিয়ে, লোহার সেতুর ওপর দিয়ে তারা আসতে থাকে, দলে দলে আসতে থাকে। আমরা তখন ঘুমিয়ে ছিলাম, তখন গভীর রজনী নেমেছে, কোনো কোলাহল নেই, তখন বাঘেরা আসে। আমরা কখনো প্রস্তুত নই, প্রস্তুত হওয়ার কিছু ছিলো না। আমরা প্রথম তাদের গায়ের গন্ধ পাই, অজস্র বাঘের গায়ের বন্য আদিম রক্তমাখা গন্ধে আমাদের দেশ বমি করে ফেলতে চায়, আমরা বমি করে ফেলতে থাকি; তারপর আমরা তাদের পায়ের শব্দ পাই, আমাদের মনে হতে থাকে ক্রমশ মৃত্যু এগিয়ে আসছে। আমাদের দিকে, মৃত্যুর পায়ের শব্দে আমরা কুঁকড়ে যাই, আমাদের গলা থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না; তারপর তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে, তাদের মুখ দেখে নখ দেখে দাঁত দেখে থাবা দেখে আমরা আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। আমরা বল্লম শরকি জুতি ট্যাটা কোচের কথা মনে করতে পারি না, আমাদের মনে হতে থাকে বাঘের কাছে নিজেদের সঁপে দিলেই আমরা বাচবো, আমরা বাঘদের শিকার, আমরা বাঘদের খাদ্য। আমাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকে, আমরা গেঁথে থাকি তাদের দাঁতে, ঝুলতে থাকি, তারা আমাদের ছিঁড়তে থাকে চাটতে থাকে। হঠাৎ আমরা বাঘেদের বিকট মুখে কাদের যেনো মুখ দেখতে পাই, মুখগুলোকে চিনি আমরা, অনেকখানি চিনি, আবার মনে হয় চিনি না, অনেকখানি চিনি না। বাঘেদের মুখ থেকে মাঝেমাঝে মুখোশ সরে যেতে থাকে, মুখগুলোকে আমরা চিনি মনে হয়, তাদের দাঁত দেখি, দাতে রক্ত দেখি, কষ বেয়ে রক্ত ঝরতে দেখি, জিভ দিয়ে কষ চাটতে দেখি। তাদের মুখে দাঁতে কষে টসটসে রক্ত দেখি। ওই রক্ত কাদের? ওই রক্ত আমাদের রক্তের মতো লাল আর গরম। রক্তের দিকে তাকিয়ে আমরা হাহাকার করে উঠি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *