৭. নমিনেশন পেপার জমা

নমিনেশন পেপার জমা দেওনের সময় আইসে গেছে, আর আমরা দেখতে পাচ্ছি তাগো মধ্যে, মায়ের পেটে থিকা যারা পলিটিশিয়ান হইয়া খালাস হইছিলেন, আর তাদের মধ্যে, যারা মায়ের পেট থিকা পলিটিশিয়ান হইয়া খালাস হন নাই, বলন যায় যারা বাপের প্যাট থিকা পলিটিশিয়ান হইছেন–ফাইলে সই করতে লেফরাইট করতে করতে পলিটিশিয়ান হইছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেছে, শহরের ফুলের দোকানে ফুলের টান পইড়া যাচ্ছে। তোড়া বানাতে বানাতে ফুলের দোকানের পোলাপানগুলির হাত বেদনায় টনটন করছে আঙুল পচে যাচ্ছে। একেক জ্যানারেল একেক কর্নেল ম্যাজর ব্রিগেডিয়ার একেক সেক্রেটারি বড়ো বড়ো ফুলের তোড়া নিয়া মহাজননেত্রী আর মহাদেশনেত্রীর কাছে হাজির হয়ে তাঁদের নীতিতে অবিচল আস্থা আনতেছেন। আরো মজার কাণ্ড হচ্ছে অনেক পুরানা মিনিস্টারমন্ত্রী, যারা রাজবংশ বদলাইয়া বদলাইয়া বড়ো হইছেন, তাঁরা আগের বংশ ছাইড়া মুখে বিরাট হাসি ঝুলাইয়া নতুন বংশে যোগ দিতেছেন। আমরা এইতে মনে কিছু করি না, বরং খুশি হই যে এইরা হইছে আসল পলিটিশিয়ান, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাদের জ্ঞানবুদ্ধি খালি বাড়তেছেই, তারা আগের বংশে গিয়া ভুল করছিলেন, প্রাণ ভরে জনগণের স্যাবা করতে পারেন নি, এইবার সেই ভুল বুঝতে পারছেন, তাই নতুন বংশে যোগ দিতেছেন। এইটা হইল খাঁটি পলিটিক্স। তাদের বড়ো বড়ো ছবি ছাপা হচ্ছে দেখে আমরা মূর্খ জনগণরা খুশিতে ভরে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে দ্যাশে মাস ভইর‍্যা ঈদ চলতাছে, আমাদের সুখের সীমা নাই।

অপসর নেয়া সেই আইনপতি বদিউজ্জামাল পাইকারকে আমরা রাজাকার বইল্যাই জানি, ওই যে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্থানিগো গোলাম আছিলেন; তারপর তিনি। শক্তির উৎসবাদীতে যোগ দিছিলেন, মিনিস্টার হইছিলেন, তারপর তিনি খোজারাজবংশে গিয়া আরো বড়ো মন্ত্রী হইছিলেন, আমরা তাজ্জব হইয়া দেখতে পাইলাম বদিউজ্জামাল পাইকার বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ উড়াইয়া ফুলের তোড়া বাড়াইয়া একেবারে স্বাধীনতার দলে জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশে গিয়া যোগ দিলেন। কাগজে সেই ছবি দেইখা আমদের চক্ষু বন্ধ হইয়া যাইতে চায়।

আমরা ভাবছিলাম জনগণের মহাজননেত্রী এইটারে নিবেন না।

কিন্তু মহাদেশনেত্রী হাসিতে বাংলাদেশ ভরাইয়া ফুলের তোড়া লইতে লইতে আমগো প্রাণের কথা বললেন।

তিনি বললেন, বদিউজ্জামাল পাইকার একজন মহান পলিটিশিয়ান, দ্যাশের স্যাবা করাই তার জীবনের ব্রত, আমাদের বংশ তাকে পাইয়া ধন্য হলো। এইবার আমাদের বিজয় নিশ্চিত, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জয় কেউ ঠ্যাকাইতে পারবে না। দ্যাশে ড্যামোক্রেসি আসতে দেরি নাই।

আমাদের প্রাণের কথা শুনে আমরা সুখী হইলাম।

দুই চাইরটা বরেণ্য বুদ্ধিজীবী মুখ খুলতে গিয়া মহাজননেত্রীর মুখের দিকে তাকাইয়া মুখ বন্ধ করে মুগ্ধ হয়ে রইলেন।

বদিউজ্জামাল পাইকার বললেন, যেই বংশ ফ্রিডম ফাইটিং করছে, দ্যাশে লিবারেশন আনছে, সেই বংশে আসতে পাইরা আমি খোদার কাছে শুকরিয়া জানাইতেছি। আমি মহাদেশনেত্রীর নীতিতে চিরকালই আস্থা পোষণ করি, তিনিই দ্যাশের সব, তার পিছনে দারাইতে পাইরা আমার জীবন ধন্য হইল।

আমরা বোঝতে পারি পলিটিক্স হইছে জীবন্ত ব্যাপার, তার বদল ঘটে; মানুষ আগে যা বোঝতে পারে নাই আজ তা বোঝাতে পারব না, সেইটা কোনো কথা না। পলিটিক্সে বারবার বোঝতে হয়, কবরে যাওনের আগেও বোঝতে হয়।

জ্যানারেল টিপ সুলতান খুব আপন লোক আছিলেন জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশের। ওই বংশ থিকা অনেক কিছু পাইছেন; এইবার তিনি রাজনীতি করবেন বইল্যা শোনতে পেলাম। আমরা ধইরাই নিছিলাম তিনি জনগণমনে যোগ দিবেন, মুক্তিযুদ্ধকে আগাই দিবেন। আমরা শোনতে পাই মুক্তিযুদ্ধ আইজও শ্যাষ হয় নাই, যুদ্ধ চলতেছে।

আমরা যা দ্যাখলাম তাতে খুশি হওন ছাড়া উপায় নাই।

তিনি ঢাকা ক্লাবের ফুলের দোকান থিকা দুই শো কেজি একখানা তোড়া নিয়া গিয়া শক্তির উৎসবাদী বংশের মহাদেশনেত্রীর নিকট হাজির হলেন। মহাদেশনেত্রী অতো ভারি তোড়া আগলাইতে পারছিলেন না বলে জনতিনেক রাজপুরুষ ফুলের তোড়া কান্ধে করে দাঁড়াইলেন। ফুলের জীবন ধন্য হইল।

তিনি মহাদেশনেত্রীর পায়ে হাত দিয়া সালাম করিলেন। এইটা পলিটিক্স।

মহাদেশনেত্রী বললেন, জ্যানারেল টিপ সুলতান দ্যাশের গৌরব, তিনি আমদের বংশেরও গৌরব, আমাদের ভিক্টরি কেউ আটকাইতে পারবে না। আমরা পাওয়ারে যাবই। পিপল আমাগো ভোট দেয়ার জইন্য ওয়েট করছে।

টিপ সুলতান বললেন, মহাদেশনেত্রীর পায়ে হাত দিয়া আমি আমার কান্ট্রির পায়ে হাত দিলাম, পিপলের পায়ে হাত দিলাম, আই অলোয়েজ সার্ভড় মাই কান্ট্রি, ফ্রম নাউ অন আই শ্যাল সার্ভ মাই মহাদেশনেত্রী অ্যান্ড মাই কান্ট্রি টুগেদার উই আর সার্টেন টু গো টু পাওয়ার, বাংলাদেশে উৎসবাদী বংশ ছাড়া পাওয়ারে যাওয়ার কারো রাইট নাই। মহাদেশনেত্রী জিন্দাবাদ।

আমরাও দূর থিকা জিন্দাবাদ দিতে থাকছি।

এইভাবে বর্ন পলিটিশিয়ানরা পিতার পেট থিকা খালাস হওয়া পলিটিশিয়ানরা পাঙ্গাশরা দ্যাশরে পলিটিক্সে মাতিয়ে তুলছেন, আমাদের ভাবনাচিন্তা একেবারে লোপ পেতে বসছে, আমরা যা ভাবি–মূর্খ আমরা, ভাবতে পারি না, গরিবের আবার ভাবনা কী–পলিটিশিয়ানরা তার উল্টো ভাবেন উল্টা করেন। এইখানে রাজা আর প্রজার চিন্তার ফারাক, রাজার চিন্তা আর কর্ম হচ্ছে রাজকীয়, প্রজার চিন্তা আর কাম হইছে প্রজাকীয়, দুইটা বিপরীত হইবই।

বাজারে খুব গুজব উঠছিলো যে অপসর পাওয়া বিখ্যাত সেক্রেটারি আলাউদ্দিন মিয়া শক্তির উৎসবাদী বংশে গিয়া যোগ দিবেন; ওই বংশ তার জইন্যে অনেক করছে, দুই তিনবার অ্যাক্সটেনশন দিয়া তারে বুড়া কইর‍্যা ফেলছে, কিন্তু তিনি বুড়া হন নাই, একেবারে তরতাজা আছেন, তিনিও তাগো জইন্যে অনেক করছেন, কিন্তু ঘুম থিকা উঠে কাগজে দ্যাখলাম তিনি জনগণমন গণতান্ত্রিক বংশে যোগ দিয়া বড় বক্তৃতা দিয়ে বসছেন।

তিনি বলছেন, উৎসআলার দ্যাশরে করাপশনে ভরে দিছে। অ্যাট দ্যাট টাইম আমি আটটা মিনিস্ট্রির সেক্রেটারি ছিলাম, দেখছি ওই দলের মিনিস্টার এমপিরা পুকুর থিকা কলসি ভরে পানি তোলার মতো ব্যাংক থিকা টাকা তুলে নিছে। দে আর এ প্যাক অফ করাপ্ট পিপল, দে আর রবার্স, যারা দেশরে ডুবিয়ে দিছে। দেশরে উদ্ধার করার জইন্যে মহাজননেত্রীর প্রিন্সিপালই আসল, তাই আমি এই বংশে জয়েন করে ধন্য হলাম। আমি, ফ্রিডম ফাঁইটার ছিলাম, মরা পর্যন্ত ফ্রিডম ফাঁইটার থাকব।

শুনে আমরা হাতে হাতে তালে তালে তালি দিতেছি।

মহাজননেত্রী বললেন, যেই বংশে আলাউদ্দিন মিয়া সাহেবের মত দশটা মিনিস্ট্রির সেক্রেটারি যোগ দিলেন, সেই বংশ জনগণের নিজের বংশ, এই বংশ পিপলের কথা চিন্তা করা ছারা আর কিছু চিন্তা করে না, পিপল এইবার আমাদের বংশরে পাওয়ারে। পাঠাইবই, ইনশাল্লা। তারা পাওয়ার কাইরা নিছিল, জনগণ তা এইবার নিয়া আসবে, আমরা দ্যাশে পিপলেল ড্যামোক্রেসি প্রতিষ্ঠা করব।

পাল্টা দিকে উল্টা কারবার করে বসছেন ছয় মিনিস্ট্রির অপসরআলা সেক্রেটারি মোহাম্মদ আজম সৈয়দ। তারে আমরা ভাবছিলাম জনগণমন বংশের লোক, সেই শুরুর সময় এক লাফে তিনি টংয়ের পর টংয়ে উঠছিলেন, গতবারও তারে দেখছি জনগণের রাজবংশে ফ্রিডম ফাইটিং আর আল্লতাল্লা নিয়ে লাফের পর লাফ দিতে, এইবার দেখি তিনি জয়েন করছেন শক্তির উৎসবাদী রাজবংশে, বড় বড় কথা বলছেন মহাদেশনেত্রী আর তার মহান স্বামী সম্পর্কে। তাঁর ফুলের তোড়াটার ওজন পাঁচ শো কেজি, পিপলেরও সাধ্য নাই ওই তোড়া তুইল্যা বুকের কাছে ধরে।

পলিটিক্স ব্যাপারটাই পলিটিকেল, জনগণের জনকেরও সাধ্য নাই বোঝে।

মহাদেশনেত্রী ওই তোড়ার ওপর দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশে বলছেন, মোহাম্মদ আজম সৈয়দ প্রমাণ করেছেন আমাদের বংশই আসল বংশ, পিপল আমাদের বংশরেই পাওয়ারে দেখতে চায়, তিনি অদের বংশ ত্যাগ করে আসছেন, কারণ পিপল ওই বংশরে চায় না, ওই বংশরা দ্যাশটারে সেল করে দিবে, দ্যাশের ফ্রিডম থাকবে না, দ্যাশটারে ভুটান কইর‍্যা তুলবে।

মোহাম্মদ আজম সৈয়দ বলেন, এই দ্যাশের অল টাইমের পলিটিশিয়ানদের মধ্যে মহাদেশনেত্রী একজন গ্রেট পলিটিশিয়ান, শি ইজ দি ওয়াইফ অফ দি গ্রেটেস্ট পলিটিশিয়ান এভার বর্ন ইন আওয়ার কান্ট্রি, তার পেছনে দারাতে পেরে আমি ধন্য হলাম, জনগনআলাজ আর বিট্রেয়ার্স, দে আর কাফে, পিপল তাদের ভোট দিবে না, তারা পাওয়ারে যেতে পারবে না। দে উইল ডেস্ট্রয় দি কান্ট্রি ইফ দে ক্যান গো টু পাওয়ার।

নমিনেশন পেপার জমা দেয়ার ধুম পড়ে গেছে দেশে।

দলে দলে সারা দ্যাশ থিকা পলিটিশিয়ানরা আইসা নমিনেশন পেপার জমা দিতেছে; বেশি নমিনেশন পেপার জমা পড়তেছে দুই বংশের বাক্সে, তারা একেকদিন একটা আরেকটাকে ছাড়াই যাইতেছে। হাজার হাজার পলিটিশিয়ান, হাজার হাজার নমিনেশন পেপার, হাজার হাজার ফুলের তোড়া, লাখ লাখ সাপোর্টার। দ্যাশে ড্যামোক্রেসির পৌষমাসের মেলা বসে গেছে। আমাদের দেশ হইল পৃথিবীর সবচেয় ঘন গণতন্ত্র ডেন্সেস্ট ড্যামোক্রেসি।

জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশের মহাজননেত্রী আর রাজপুরুষেরা বেশ খুশি; কিন্তু বেশি খুশি হতে পারছেন না।

শক্তির উৎসবাদী রাজবংশের মহাদেশনেত্রী ও রাজপুরুষেরা বেশ বিচলিত; কিন্তু বিচলিত খুশির মইধ্যে আছেন।

রাজাকার রাজবংশ বিসমিল্লা বলে আল্লার নামে সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

খোজাগণতান্ত্রিক রাজবংশ চুরমার, মাজা ভাঙা কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আর আর রাজবংশ পলিটিশিয়ান খুঁজে পাচ্ছে না।

মহাজননেত্রী রাজপুরুষদের নিয়ে বসেছেন; তাঁরা নমিনেশন পেপার জমা পড়নের তাৎপর্য আর সম্ভাব্য রেজাল্ট সম্পর্কে আলোচনা করছেন।

মহাজননেত্রী বলেন, আমাগো বংশের বাক্সেই এইবার সবচাইতে বেশি পেপার পড়ছে, কেভিডেটরাও ভাল, এইবার জনগণ যদি মুখ তুইল্যা চায়।

মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, অন্য বংশ থিকা ভাইগ্যাও আমাগো দলেই ক্যান্ডিডেট বেশি আসছে, এইটাও সুলক্ষণ, পলিটিক্সের টেন্ডেন্সিটা বুঝা যাইতেছে, এখন আল্লা আর জনগণ মুখ তুইল্যা চাইলেয় হয়।

কলিমউদ্দিন মৃধা বলেন, তয় তিন চাইরটা জ্যানারেল আর সেক্রেটারি বিট্রে করছে, এতবার প্রমিজ করল আমাগো কাছে যে আমাগো দলে জয়েন করবো, ক্যান্ডিডেট হইব, কিন্তু বিট্রে করলো।

মহাজননেত্রী বলেন, অইগুলি সবই কি উৎসআলাগো নমিনেশন পাইব? অগো বংশ ত আগে থিকাই জ্যানারেল আর সেক্রেটারিতে ভইরা আছে। অইগুলির উপর চোখ রাখতে হইব, দরকারে আসবে।

মোহাম্মদ রজ্জব আলি বলেন, অইটা হইল মেলিটারি আর আমলাগো দল, অই রকম ক্যান্ডিডেট তারা ছারব না, যত পাইব ততই লইব। সবগুলিরেই ননিনেশন দিব, জনগণরে অরা এইসব দেখাইয়া বুঝাইতে চায় যে উত্তর পারা অগো লগে আছে, আসল জায়গায় অগো পাওয়ার আছে।

মহাজননেত্রী একটু বিচলিত হন; একটু পর তিনি বলেন, চোখ রাখতে হবে জ্যানারেলগো মইধ্যে কে কে বাদ পড়লো, পছন্দ হইলে আমরা তাগো ধইর‍্যা আনুম। উত্তর পারা আমাগোও এইটা এইবার আমরাও দেখায়ে দিব। দুই একজনের কথা আমি ভাইব্যা রাখছি।

মোহাম্মদ আবদুল হাই বলেন, কারে কারে ধইরা আনতে হবে বইলেন, আমরা ধইর‍্যা আনুম। অগো নমিনেশনের দিন অগো অফিসের কাছে লোক দারা করে রাখুম, তারা ধইরা নিয়া আসবো।

নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, জংধরা কাচিহাতুড়িআলারা যে ধরাধরি করতেছে, এইবার তাগো কি করব?

মহাজননেত্রী বলেন, অই বেইমানগুলিরে এইবার দরজায়ও আসতে দিব না। গেলবার অইগুলিরে দিয়া ঠকছি, মোনাফেকের মতন গোপনে গোপনে আমাগো বিরুদ্ধে কেন্ডিডেট দিছে, উৎসআলাগো সঙ্গে প্যাক্ট করছে, আর কয়টা মোনাফেক বেইমান পাশ কইর‍্যা অগো লগে গিয়া যোগ দিছে। অইগুলির মুখে ঝারু মারি।

মোহাম্মদ আবদুল হাই বলেন, সারা দুইন্যা ভইর‍্যা অইগুলি বেইমানি করতেছে আর ডোবতেছে, দ্যাশের মানুষ অগো চায় না।

মোহাম্মদ রজ্জব আলি বলেন, নমিনেশন পেপার ত জমা পরলো, এইবার ওমরাটা কইর‍্যা আসন দরকার। আল্লার ঘরে গিয়া নামাজ পইরা কান্দনকাটন দরকার, রহমানুর রহিম এইবার যদি মুখ তুইল্যা চায়।

মহাজননেত্রী বলেন, পরশু দিনই ওমরা করতে চলেন, দিনটা ভাল আছে, ওমরাটা সাইর‍্যা এসে নমিনেশন দিব। আল্লারে ডাইক্যা আসলে তিনি মুখ তুইল্যা চাইবেন, জনগণও এইটা ভাল চোখ দেখব, তারাও মুখ তুইল্যা চাইব।

তাঁরা ঠিক করে ফেলেন পরশু দিনই ওমরা করতে যাবেন, চল্লিশজনের একটা বড়ো দল যাবেন, আল্লার আর জনগণের চোখে এইটা না পইড়্যা পারে না। এসে তাঁরা ক্যান্ডিডেটদের ইন্টারভিউ নেবেন, বাছাই করে নেবেন ঘেঁকে হেঁকে, দেখে দেখে, অনেককে এরই মাঝে দেখে রেখেছেন, বেস্ট ক্যান্ডিডেট নেবেন, যাদের নাম আছে ডাক আছে পপুলারিটি আছে ট্যাকা (এইটা এক নম্বর) আছে (আর হাতে ভাল ক্যাডার আছে, এইটা দরকার, নিউট্রাল পিসফুল ইলেকশনেও এইটা ছাড়া চলে না–এইটা চুপে চুপে আলাপ করা হয়)।

শক্তির উৎসবাদী গণতান্ত্রিক রাজবংশের বাক্সেও নমিনেশন পাওয়ার দরখাস্ত বোঝাই হয়ে উঠেছে, তবু তাদের চিন্তা যাচ্ছে না, শুধু চিন্তা করতে হচ্ছে; বৈঠকে বসে তাঁরা নানারূপ পলিটিকেল চিন্তাভাবনা করছেন।

মহাদেশনেত্রী বলেন, আপনাদের কি মনে হয়? ঠিক ক্যান্ডিডেটরা নমিনেশনের জইন্য দরখাস্ত করছে ত?

রুস্তম আলি পন্টু বলেন, ভাল দরখাস্ত পরছে, সবই পাওয়ারফুল পপুলার মানিড। ক্যান্ডিডেট, কারে রাইখ্যা কারে নমিনেশন দিব, তা ঠিক করাই ডিফিকাল্ট হইব। ভাল ক্যান্ডিডেট দিতে হইব।

অবজেনারেল কেরামতউদ্দিন বলেন, উই মাস্ট নমিনেট দি বেস্ট ক্যান্ডিডেটস্ হু হ্যাভ মানি, পাওয়ার, অ্যান্ড পপুলারিটি। ইলেকশনে উইন করতেই হবে।

রুস্তম আলি পন্টু বলেন, মহাদেশনেত্রী চাইরটা আসনেই দারাইবেন, অই সিটগুলি আমাগো সিউর সিট, পরেও আমাগো হইব, মহাদেশনেত্রীর ইমেজটাও ঠিক থাকবো; আর বংশের লিডাররা যারা চাইবেন তারা দুইটা কইর‍্যা আসনে দারাইবেন।

কেরামতউদ্দিন বলেন, দিস ইজ দি বেস্ট প্রিন্সিপাল ইন নমিনেটিং আওয়ার ক্যান্ডিডেট্র, আমাদের লিডারদের পপুলারিটি পিপলকে শো করা দরকার। ফরেন অ্যাজেন্টরাও বোঝতে পারবে আমাদের দল কত স্ট্রং।

মহাদেশনেত্রী বলেন, আপনারা বেস্ট প্রিন্সিপালই নিবেন, পাওয়ারে আমাদের যাইতেই হবে, অরা দ্যাশটারে সেল করবে, তা হইতে দিব না।

মোহাম্মদ কুদ্দুস চৌধুরী বলেন, পিপল অদের চায় না, দে আর ইন অ্যান ইলিউশন, পিপল লাভ আস, পিপল আমাদের ভোট দিবে।

মোহাম্মদ সোলায়মান হাওলাদার বলেন, ওমরা করার সময় এসে গেছে। আমাদের মাননীয় মহাদেশনেত্রীর পক্ষে কখন সময় হবে? ওমরার উপর ইলেকশন অনেকখানি ডিপেন্ড করে।

মহাদেশনেত্রী বলেন, ওমরা ত করতেই হবে। মহামান্য কিংয়ের সঙ্গেও মিট করার দরকার। সময়টা আপনেরা ঠিক করেন।

রুস্তম আলি পন্টু বলেন, জনগনআলারা কবে ওমরা করতে যাইতেছে, সেইটা দেখন দরকার। অগো পরে গেলেই পলিটিকেলি বেটার, আর অরা যতজন যাবে আমরা তার চাইতে বেশি যাব।

ব্যারিস্টার কুদরতে খুদা বলেন, ওমরায় যাওয়ার আগে পার্টি অফিসে একটা বড় মিলাদ মহফিল হওয়া নেসেসারি, পেপারগুলিতে তার ছবিও ছাপান দরকার। মিলাদের খুবই ইমপ্যাক্ট পিপলের উপর।

রুস্তম আলি পন্টু বলেন, খুব ভাল কথা, পরশুই অফিসে মিলাদ হবে। আল্লা রসুলের নাম নেয়া সব সময়ই ভাল, অন্যরাও ভাল চোখে দেখে।

ডঃ কদম রসুল বলেন, আমার মনে একটা চিন্তা আসছে, সেইটা করন যায় কি না একটু ভাইব্যা দেখনের জইন্যে রিকুয়েস্ট করতেছি। আমার মনে হয় এইতে আমাগো আরো ভাল হইব।

রুস্তম আলি পন্টু বলেন, ভাই, চিন্তাটা বইল্যা ফ্যালেন।

ডঃ কদম রসুল বলেন, অগো বান মারন যায় কি না একটু ভাইব্যা দেখন দরকার। একটা দোয়া আছে সেইটা দিয়া অগো আর পিপলের মইধ্যে চিরকালের জইন্যে শত্রুতা সৃষ্টি করনের তদবিরটা আমরা কইর‍্যা দেকতে পারি, আমি দোয়াটা আর ডিজাইনটা বই থিকা ফটোকপি কইর‍্যা রাখছি।

কথাটি শুনে সবাই বিব্রত হয়, মহাদেশনেত্রী তাঁর নখ দেখতে থাকেন।

রুস্তম আলি পন্টু বলেন, ইলেকশনে উইন করার জইন্যে সব কিছুই আমাগো করন দরকার, সব রকমের বানই আমাগো মারন দরকার; তবে কথাটা হইল এইটা বড় কঠিন কাজ। এইটা করনের লিগা বারো কোটি মাইনষের কেইশ ছিইর‍্যা আনতে হইব আর জনগনআলাগো মরা আর

সব লিডারের কেইশ ছিইর‍্যা আনতে হইব। এইটা করতে গেলে কয়েক বছর লাগবো।

কেরামতউদ্দিন বলেন, উই ক্যান ডু দ্যাট আফটার উই গো টু পাওয়ার। উই ক্যান ইস্টাবলিশ এ ন্যাশনাল হ্যাঁয়ার ব্যাংক, অ্যান্ড কালেক্ট পিপলস্ হ্যাঁয়ার। ইট উইল বি অ্যান অ্যাচিভমেন্ট।

তাঁরা আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পলিটিকেল আলোচনা ও ডিসিশন গ্রহণ করেন।

মহাজননেত্রী চল্লিশজনের একটি দল নিয়ে ওমরা করতে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় আমরা দেখতে পাই তার চেহারাই বদলে গেছে, বাঙালি বলে চিনুন যাচ্ছে না; আমরা ভয় পাইতে থাকি যখন তিনি ফিরবেন তখন তাঁকে আমরা একেবারেই চিনতে পারবো কি না। তিনি হয়তো খাঁটি মরুভূমি খাঁটি মুসলমান হয়ে ফিরবেন। জনগণ পছন্দ করবে। আমরা পিপলরা চিরকালই বিদেশি দেখলেই পাগল হই, মরুভূমি দেখলে মুগ্ধ হই।

ওমরাটা থাকায় খুব সুবিধা হইছে পলিটিশিয়ানগো, তাগো আর আরবি বছরের বারো নম্বর মাস আলহিজার জইন্যে বসে থাকতে হয় না। বসে থাকতে হইলে। ড্যামোক্রেসির পলিটিক্সে প্রাণ আসতো না, চামও থাকতো না। শুনতে পাই সত্য মিথ্যা আমরা গরিবরা জানি না, আমাগো অত ট্যাকা নাই যে হজও করবো আবার সোনাও। কিইন্যা নিয়া আসবো, আমরা শোনতে পাই পলিটিকেল ওমরার নিয়মকানুনও পলিটিকেলি আলাদা।

মহাজননেত্রী যেদিন ওমরা করনের জইন্যে গেলেন সেই দিন আমাগো সুফিয়া রিয়াদ থিকা ফিইর‍্যা আসলো। সে জীবিত আসে নাই, সুফিয়া ফিরে আসতে পারে নাই, সুফিয়ার লাশ ফিরে আসছে।

সুফিয়া ওমরা বা হজ করতে সেইখানে যায় নাই, সুফিয়া সেইখানে গেছিল চাকরানি হইয়া, বান্দি খাটতে। ফিরে আসলো লাশ হইয়া।

অমন মাইয়া লাশ হইব না ত কি হইব, অর জন্মই হইছিল লাশ হওনের জইন্যে। অর ভাইগ্য ভাল পবিত্র দ্যাশে গিয়া লাশ হইছে, ভেস্তে যাইব।

মাইয়ামানুষ কি আর মানুষ, যেই ভাইগ্য নিয়া আসছিল তা মানলে সুফিয়া দ্যাশেই থাকতে পারত, বাইচ্যাও থাকতে পারতো হয়তো।

তয় মাইয়ামানুষের বাচন মরনের মইধ্যে তফাৎ কি।

সুফিয়ার বাবা আমাগো মতই গরিব ছিলো, তবু অই মেয়েটাকে লেখাপড়া শিখাইতে সে চ্যাষ্টা করছিলো। আরেকটা খারাপ জিনিশ হইল মাইয়াটা সুন্দরও ছিলো, লোকটা মাইয়ার জইন্যে জান দিত। এইটে ওঠনের পর মাইয়াটা দেখতে এত সোন্দর হয় যে গ্রামের ড্যাকরাগুলি ইস্কুলে যাওয়া আসার পথে অর হাত ধইরা টানাটানি করত। কয়টারে ও চড়চাপড়ও দিছে। কিন্তু বাপটা কিছু না রেখে মইরা যায়। ড্যাকরাগো টানাটানি সইজ্য করতে না পেরে সুফিয়া ঢাকা চইল্যা আসে। সুফিয়া বুঝতে পারে তার লেখাপড়া আর হইব না, তার রুজি করতে হবে। নিজে খাইতে হবে, মারে আর দুইটা ভাইবোনরে খাওয়াইতে হবে।

ঢাকায় সুফিয়া গার্মেন্টসে একটা কাজ নেয়; কিন্তু সেইখানে অর যা বেতন তার চেয়ে প্রেমিক অনেক বেশি দেখা দেয়। সুফিয়া দেখতে পায় রাস্তাঘাট কল কারখানা মেশিন চেয়ার টেবিল সবই প্রেমিক, প্রেমে চাইরপাশ ভাইস্যা যাচ্ছে। সুফিয়া প্রেমিকদের প্রেমনিবেদন, টানাটানি, চিঠিপত্র, টিপন, জড়াই ধরন, বেড়ানের দাওৎ আর আর জিনিশে পাগল হয়ে উঠতে থাকে।

সুফিয়া ঠিক করে এইখানে আর থাকন যায় না। অর দেহটা কুকুর শিয়ালগো চোখে পড়ছে, তারা না খাইয়া ছাড়বো না।

সুফিয়া একদিন একটা বিজ্ঞাপনে দেখতে পায় যে রিয়াদে কিছু গৃহপরিচারিকা লাগবে, যারা গৃহপরিচারিকার কাজ করতে চায় তারা আবেদন করতে পারে। তরুণী হইলে ভাল হয়, সুন্দরী হইলে আরো ভাল হয়। অত্যন্ত ধনী পরিবার, বেতন মাসে দশ হাজার টাকা, যাওনের, আর তিন বছর পর পর দেশে আসার ফিরে যাওয়ার খরচ ওই পরিবার বহন করবে। অপূর্ব সুযোগ!

সুফিয়া সাথে সাথে আবেদনপত্র লিখে ওই ম্যানপাওয়ার এজেন্সিতে হাজির হয়। তার ইচ্ছে করছিলো এখনই রিয়াদে চলে যেতে, যাতে ওই গার্মেন্টসে আর যেতে না হয়। এজেন্সির এমডি সাহেব সুফিয়াকে দেখার সাথে সাথে তাকে নির্বাচন করেন, সুফিয়া তাঁর চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে। সুফিয়ার ভালোও লাগে, কিন্তু একটা ভয় সে নিজের ভেতরে টের পায়। এমডি সাহেব ঠিক করে ফেলেন, আরবরা এমন মালই চায়, বুক উচা, পাছা বড়, শরীর ঢলঢলে, তার উপর মুখটাও সোন্দর। এমডি সাহেব তিন দিন পর তার সাথে সুফিয়াকে দেখা করতে বলেন। সুফিয়া যখন বেরিয়ে আসছিলো এমডি সাহেব তার বুকে ও পাছায় হাত দিয়ে আদর করেন। সুফিয়া ভয় পায়, কেঁপে ওঠে।

তিন দিন পর সে কি যাবে এমডি সাহেবের কাছে? সুফিয়া ঠিক করতে পারে না; একবার মনে হয় যাবে না, আরেকবার মনে হয় যাবে, মাসে দশ হাজার টাকা তাকে রুজি করতে হবে, নিজে বাঁচতে হবে, মা ভাইবোনদের বাঁচাতে হবে। বুকে পাছায় এক আধটু হাত তো পড়বেই যেখানেই থাকি, এটা মেনে নিতে হবে। বুক আর পাছার এমন কি দাম।

তিন দিন পর সুফিয়া উপস্থিত হয় এমডি সাহেবের কাছে। এমডি সাহেব তাকে জানান তার মেইড সার্ভেন্টের চাকুরি হয়ে গেছে, সে খুব উপযুক্ত; পনেরো দিনের মধ্যে তাকে রিয়াদের উদ্দেশে বিমানে উঠতে হবে। এমডি সাহেব তাকে কাগজপত্র দেন, বাড়িতে সকলের সাথে দেখা করে আসতে বলেন। এমডি সাহেব তার বুক আর পাছায় একটু বেশি করে আদর করেন, কিন্তু চাকুরির আনন্দে সুফিয়ার তা খারাপ লাগে না, একটু ভালোই লাগে।

বিশ দিনের মধ্যে সুফিয়া রিয়াদে বান্দি খাটার জন্যে ঢাকা ছেড়ে যায়। নিজেকে তার আকাশের পাখি মনে হয়।

সে মনে মনে দেখতে পায় তার রিয়াদের মনিবের স্ত্রী কন্যারা তার জন্যে বিমানবন্দরে এসেছে; তারা দেখতে কি সুন্দর, সে তাদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করবে, তাকে দেখে তাদের পছন্দ হবে। প্রাণ দিয়ে সে সেবা করবে সকলের, দশ হাজার টাকা, মাসে দশ হাজার টাকা, দেশে সে কোনো দিন পাবে না। দেশে সে টাকা পাঠাবে, মা ভাইবোন ভালো থাকবে, এবং সে টাকা জমাবে।

বিমানবন্দরে সুফিয়া দেখতে পায় দুটি বিকট ইয়ামেনি চাকর তাকে নিতে এসেছে। বিকট, অত্যন্ত বিকট। তাদের হাতে ইংরেজিতে তার নাম লেখা একটি কার্ড। চাকর দুটিকে দেখেই সে ভয় পায়, সে কেঁপে ওঠে, চারদিকে সে মরুভূমি দেখতে পায়। তখন মধ্যরাত, রাত তাকে ঢেকে ফেলে। সে তাদের সাথে গাড়িতে উঠে বসে। অনেক রাতে সে মনিবের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে। বাড়ির সামনে কোনো আলো নেই, সামনে সে ভীষণ একটা দালানের ভুত দাঁড়ানো দেখতে পায়।

বাড়িতে তখন মনিবেরা নেই, তারা হজে গেছে।

অন্ধকার, অল্প আলো, অন্ধকার, বিকট কক্ষের পর কক্ষ পেরিয়ে একটি আরব বুড়ী সুফিয়াকে তার ভেজা স্যাৎসেতে রঙচটা কক্ষে নিয়ে আসে। সুফিয়া বারবার শিউরে উঠতে থাকে। সুফিয়া কিছুটা ইংরেজি জানে, বুড়ী জানে না; তাই তাদের কোনো কথা হয় না। বুড়ী তাকে কয়েকটি খেজুর আর বিস্কুট খেতে দেয়, চাও দেয়। সুফিয়া কিছুই খেতে পারে না; তার বমি পেতে থাকে। তার মনে হয় সারাটা বাড়ি, বিকট অন্ধকার, আর বিশাল মরুভূমি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সুফিয়া একবার তীব্র চিৎকার করে ওঠে, তার চিৎকার বিকট প্রতিধ্বনি হয়ে তার কানে ফিরে ফিরে আসতে থাকে। সুফিয়া বিছানায় বসে পড়ে, সে দুর্গন্ধ পায়, শোয়ার তার ইচ্ছে হয় না, ভোরে তার ঘুমঘুম চোখে আলো এসে ঢোকে।

তার ঘর, বিছানা, আর বালিশ দেখে সুফিয়া লাফিয়ে বিছানা থেকে নামে। বিছানার চাদরটা ঘিনঘিনে নোংরা, বালিশটা চিটচিটে; দূরে খেজুর আর বিস্কুটের থালায় কয়েকটি তেলাপোকা জটলা করছে। তেলাপোকা সে এভাবেই ভয় পায়, সে চিৎকার করে ওঠে। ভোরের আলো অন্ধকার হয়ে ঢুকছে ঘরটিতে, ওই ভোরের আলোর অন্ধকারে সুফিয়া ঘরের এক কোণে একটি বাথরুমের দরোজা দেখতে পেয়ে দরোজা খোলে। বাথরুমটার অর্ধেক ভরে নোংরা, ট্যাপ খুলে দেখে তিরতির করে পানি পড়ছে, আর জংধরা শাওয়ারটি দিয়ে কোনো পানি বেরোচ্ছে না। একটা ময়লা সাবান পড়ে আছে সিংকে, ওই সাবান আর তিরতির পানিতে সে মুখ ধুতে শরীর ধুতে চেষ্টা করে। সে আল্লা আল্লা করতে থাকে, কিন্তু সে শুনতে পায় তার বুক ধকর ধকর করছে।

তখন বুড়ী এসে তার বাথরুমের দরোজায় ঢু দিতে থাকে।

বুড়ী সুফিয়াকে তার পিছে পিছে যেতে ইঙ্গিত করে, সুফিয়া ভয়ে ভয়ে তার পেছনে হাঁটে। বুড়ী তাকে রান্নাঘরে নিয়ে যায়, ঘরটি দেখায়, এবং তার হাতে ভুল ইংরেজিতে লেখা কাজের একটি তালিকা তুলে দেয়। সুফিয়ার বেশ কাজ। সে রাধুনীকে সাহায্য করবে, বাড়িঘর পরিষ্কার করবে, শিশুদের দেখাশোনা করবে। বুড়ী তাকে ব্রেকফাস্ট বানানোর ইঙ্গিত করে, সুফিয়া ব্রেকফাস্ট তৈরি করে। সকালের খাওয়ার পর সুফিয়া হাঁড়িকড়াই পরিষ্কার করে, রান্নাঘর ঝাঁট দেয়, আরো কয়েকটি ঘর পরিষ্কার করে।

ওই বাড়িতে সে একাই বান্দী নয়, আরো তিনজন আছে। দক্ষিণ ভারতের একটি প্রৌঢ়া রাধুনী আছে, শ্রীলংকার একটি যৌবনবতী বান্দী আছে, ফিলিপাইনের একটি রোগা ফ্যাকাশে মেয়ে আছে। বুড়ী রাধুনীটা সব সময়ই বিরক্ত, সে কারো সাথে কথা বলে না, মাঝেমাঝে একা একা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে আর পাঁচ মাস, ফিলিপাইনের রোগা মেয়েটে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়, চোখ দুটি তার উন্মাদের চোখের মতো, সে মাঝেমাঝে এমনভাবে তাকায় যেনো সে খুব দূরে কিছু দেখছে পাচ্ছে। সুখী মনে হয় শ্রীলংকার যৌবনবতীকে, তার বিশেষ কোনো কাজ করতে হয় না, সে বেশি সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজ করতেই ব্যস্ত থাকে। সে ঢলঢল করে, পিঠ বাহু বুক থেকে কাঁপন ছড়ায়।

শ্রীলংকার যৌবনবতী সুফিয়ার কাছে এসে মাঝেমাঝেই বলে, মালিক আসছেন না, আমার ভালো লাগছে না।

সুফিয়া বুঝতে পারে না মালিক না এলে তার ভালো লাগবে না কেনো।

মেয়েটি বলে, মালিক আমাকে বহুত ভালোবাসেন, আমি মালিকের জান।

শুনে কেমন যেন লাগে সুফিয়ার।

মেয়েটি সুফিয়ার দিকে মাঝেমাঝে ঈর্ষার চোখে তাকায়।

মেয়েটি বলে, মক্কা থেকে ফিরে মালিক আমাকে সোনার হার কিনে দেবেন।

মালিক এতো ভালো? ভাবতে গিয়ে ভয় পায় সুফিয়া।

শ্রীলংকার যৌবনবতী সুন্দরী বাঁদিটি এক সময় সুফিয়াকে তার সামনে মডেলের মতো দাঁড়াতে বলে। মডেল? সুফিয়া প্রথম রাজি হয় না, কিন্তু তাকে দাঁড়াতেই হয়। মেয়েটি সুফিয়ার ঠোঁটে একটি আঙুল বুলিয়ে বলে, তোমার ঠোঁট পাতলা, মালিক পাতলা ঠোঁট পছন্দ করে না, তবে তার দুই ছেলে এমন ঠোঁট পছন্দ করে। সুফিয়া ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে বসে পড়তে চায়, পারে না; মেয়েটি তার বুকে ও পাছায় হাত দিয়ে দেখে বলে, মালিক তোমার বুক আর পাছা পছন্দ করবে। বড়ো বুক পাছা মালিকের পছন্দ। মেয়েটির চোখে সে ঈর্ষা দেখতে পায়। কিন্তু বড়ো বুক পাছা মালিকের পছন্দ–এর অর্থ কী, এর অর্থ কী, সুফিয়া বুঝতে পারে না; সে দৌড়ে তার ঘরে গিয়ে মেঝের ওপর বসে পড়ে।

তিনচার দিন পর মালিকের পরিবার ফিরে আসে।

মালিকের বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের মতো, দেখতে সে কদর্য, দেখেই ঘেন্না লাগে। এখানে আসার পর সুন্দর কিছু দেখতে পায় নি সুফিয়া, যা দেখে তাই কদর্য। মালিকের চার বউ। তাদের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে পঁচিশের মধ্যে। মালিকের অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। সুফিয়া বুঝতে পারে তারা হঠাৎ ধনী হয়েছে, কিন্তু নিচু জাতের লোক, এমন লোকেরা আমাদের দেশে বস্তিতে থাকে। সবাই দেখতে কদর্য, চিৎকার ছাড়া কথা বলে না, তাদের খুব অদ্র অসভ্য মনে হয় সুফিয়ার। কোরান পড়া ছাড়া তারা আর লেখাপড়া জানে না। তাদের টাকা আছে, কেমন টাকা আছে সুফিয়া বুঝতে পারে না, সুফিয়া দেখতে পায় তারা কোনো কাজ করে না। কাজ না করে টাকা আসে কোথা থেকে?

মালিক বিকেলেই সুফিয়াকে তার ঘরে ডাকে। সুফিয়া কাঁপতে কাঁপতে মালিকের সামনে উপস্থিত হয়। সুফিয়া দেখে মালিক ও তার দুই বউ বসে আছে। সে সালাম করতে যায়, মালিক তাকে ধরে শুয়োরের মতো দুটি ময়লা হাত দিয়ে তার ঠোঁট, বুক, পাছা টেপে। তার চামড়া ছিঁড়ে যেতে চায়। সুফিয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে, পারে না; সে চিৎকার করে কাঁদে, কিন্তু মালিকের বউ দুটিও তাতে বিচলিত হয় না।

মালিক বলে, তোমার দেহ আইচ্ছা কড়া, তুমি আইচ্ছা মাল, বাংলাদ্যাশেও এই রকম মাল আছে?

মালিকের ফাটা বাঁকা ঘিনঘিনে ঠোঁট নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। বউরা সুফিয়ার দিকে তাকায়, সুফিয়া পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে।

মালিক বলে, আইজ রাইতে তুমি আমার লগে শুইবা, আমার সাদ মিটলে সপ্তায় পাঁচ দিন আমার লগে আর দুই দিন আমার দুই পোলার লগে শুইবা। তুমি আইচ্ছা মাল, আমার সাদ মিটতে কয়েক মাস লাগবে।

মাথা ঘুরে সুফিয়া মাটিতে পড়ে যায়।

মালিক তার দুই ছেলেকে ডাকে। দুটি কুৎসিত ছেলে, পনেরো ষোলে বছরের মতো বয়স, মালিকের ডাকে উপস্থিত হয়।

মালিক বলে, মাইয়াটারে তগো লিগাই আনাইছিলাম, কিন্তু দেইখ্যা আমার পছন্দ হইয়া গেছে, মাইয়াটারে লইয়া আমিই শুমো, আমার সাদ মিটলে তরা পাবি, আইজ থিকা শ্রীলংকার মাইয়াটারে লইয়া তরা থাক। ওহাব তিন দিন নিবি, হাশেম তিন দিন নিবি, একদিন আমার লিগা রাকবি।

ওই রাতেই মালিক ধর্ষণ করে সুফিয়াকে। সুফিয়া ছিঁড়েফেড়ে যায়, রক্তে ভেসে যায়, ভেঙেচুরে যায়। ওটা ধর্ষণের প্রথম রাত, তারপর মালিক নিয়মিত ধর্ষণ করতে থাকে। সুফিয়াকে, সুফিয়া হতে থাকে ধর্ষিত, ধর্ষিত, ধর্ষিত, ধর্ষিত।

ওই অন্ধকারে ধর্ষিত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না সুফিয়ার। সুফিয়া পালানোর চেষ্টা করে, দেখে পালানোর কোনো উপায় নেই। কেউ তাকে সাহায্য করার জন্যে নেই, সবাই তাকে পাহারা দিচ্ছে আটকে রাখার জন্যে। শ্রীলংকার যৌবনবতী তার বিরুদ্ধে চলে গেছে, মেয়েটির মনে হচ্ছে তার কাছে থেকে মালিককে কেড়ে নিয়েছে সুফিয়া। মালিক তাকে সোনার হার দেবে বলেছিলো, ওই হার সে পায় নি। মেয়েটির মনে হয় মালিক সুফিয়াকে সেই হার দিয়েছে। বাড়ির পাহারাদারগুলো পাষণ্ড, তাদের পেরিয়ে বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। বাড়িটা একটা নোংরা দুর্গ। মালিকের চার বিবি সব সময় ব্যস্ত ঝগড়াঝাটিতে, তাদেরই কোনো সুখ নেই, সুফিয়ার কথা তারা ভাবতেও পারে না। সুফিয়া আটকে পড়ে মরুভূমির নোংরা অন্ধকার দুর্গে, যেখানে ধর্ষণই সত্য, আর কিছু সত্য নয়।

সে একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে বের হয়েছিলো, অল্প পরেই তাকে ধরে আনা হয়। পালিয়ে বেশি দূর কোনো মেয়ের পক্ষে যাওয়ার কোনো উপায় নেই সেখানে। ধরে এনে তাকে এমনভাবে মারা হয় যে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

একবার সে বাড়ির ছাদে উঠে ডাকাডাকি করেছিলো, কেউ তার ডাক শোনে নি। ছাদ থেকে চাবুক মেরে মেরে তাকে নামিয়ে আনা হয়। চাবুকে চাবুকে অজ্ঞান হয়ে যায় সুফিয়া, সাত দিনে জ্ঞান ফেরে নি।

কয়েক মাসের মধ্যেই সুফিয়ার একবার গর্ভপাত ঘটানো হয়। ভালোভাবে হয় না, তার ভেতর থেকে রক্ত তিরতির করে বেরোতেই থাকে। ঠিক হ’তে অনেক সময় লেগে যায়।

সুফিয়া শুকিয়ে যেতে থাকে, ফ্যাকাশে হয়ে যেতে থাকে, পাগল হয়ে যেতে থাকে, জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে থাকে।

কয়েক মাসের মধ্যে তার আরেকবার গর্ভপাত ঘটানো হয়। এইবার রক্ত আর থামতে চায় না, সুফিয়ার সালোয়ার সব সময় ভেজা থাকে।

পাগল হয়ে ওঠে সুফিয়া।

মালিক, আর তার দুই ছেলে নিয়মিত ধর্ষণ করে চলে সুফিয়াকে। সুফিয়া আর চিৎকারও করে না, শুকনো মরা পাগলির মতো পড়ে থাকে; তারা রাতের পর রাত। দিনের পর দিন ছিঁড়েফেড়ে ফেলতে থাকে সুফিয়াকে।

মাসে দশ হাজার রুজি করার জন্যে রিয়াদের উদ্দেশে যাত্রার কয়েক মাসের মধ্যেই সুফিয়া গলায় ফাঁসি দিয়ে মারা যায়।

মহাজননেত্রী যখন তার বিশাল পুণ্যবান দলবল নিয়ে ওমরা করার জন্যে বিমানে উঠছিলেন, তখন সুফিয়ার লাশ এসে বিমানবন্দরে নামে।

আমাগো সুফিয়া আমাগো মইধ্যে ফিইর‍্যা আসে।

কয়েক দিনের মধ্যেই মহাজননেত্রী পুণ্য অর্জন করে, মুখ আর পোশাক অদ্ভুত বদল করে, মাথায় আবায়া না কী সব বেঁধে, হাতে তসবি নিয়ে ড্যামোক্রেসির ইলেকশনের দ্যাশে ফিরে আসেন। তাঁর ছবি দেইখ্যা আমরা তাঁরে চিনতে পারি না, মনে হয় আমরা কী যেন দেখতেছি, কিন্তু আমরা খুশি হই যে তিনি এইবার ইলেকশনের এ টু জেড দেইখ্যা ছাড়বেন, আল্লা আর মানুষ তার দিকে মুখ তুইল্যা না চাইয়াই পারে না। মনে হয় আমাগো দ্যাশে এই ধর্ম আসলো, এর আগে খাঁটিভাবে আসে নাই, আটশো বছরে যা হয় নাই তিনি কয় দিনেই তা কইর‍্যা আসলেন।

সুফিয়ার কথা তিনি জানেন না, এইটা ভালো।

মহাজননেত্রী ফিরে আসলেন, আমরা তার নবরূপ দেখে আজ্জব তাজ্জব হচ্ছি, আর অমনি, দু-দিন পরেই, চললেন মহাদেশনেত্রী পঞ্চাশজন পুণ্যবান নিয়ে ওমরা করতে। ক্যাম্পেইন শুরু হইল। তিনি সঙ্গে বেশি লোক লইছেন, তাঁর ধর্মে ভক্তি আরো বেশি, তার পুণ্য আরো বেশি হইব, পলিটিক্সটাও বেশি হইব, ড্যামোক্রেসি আরো খুশি হইব, আমাদের এই মনে হইতে থাকে, আমরাও খুশি, খুশির ওপর খুশি। তিনি তার পোশাক বদল করে নিছেন, সোন্দর পলিটিকোরিলিজিয়াস রিলিজিওপলিটিকেল পোশাক। তার স্টাইল আছে, আমরা গরিবরা সব সময়ই দেখে মুগ্ধ হই, স্টাইল করে তিনি মাথাটারে সাজিয়েছেন, ধর্মও থাকলো স্টাইলও হইল। এইটা আমরা গরিবরা খুব পছন্দ করি।

মহাদেশনেত্রী যেই দিন গিয়া সেইখানে পৌঁছলেন সেই দিন সেইখানে একটা ঘটনা ঘটতেছিলো। ঘটনাটা তিনি জানতে পারেন নাই; তুচ্ছ ঘটনা।

সেই দিন সেইখানে চৌদ্দ বছরের একটি মেয়েকে পাথর ছুঁড়ে মারা হচ্ছিলো।

মেয়েটির নাম সারা। সারার অপরাধ সে জিনা করেছে, হুদুদ করছে, আল্লার বিরুদ্ধে পাপ করেছে; তাই তাকে পাথর ছুঁড়ে মারা হচ্ছে। যেই পুরুষরা এই কাজ করেছে, তারা ধরা পড়ে নাই।

সারা ধরা পড়েছে, প্যাটটা তার, ওই পেটে কে বা কারা কি ঢুকাইছে, তাগো সেইখানে কোন দাগ লাগে নাই, মজা কইর‍্যা তারা কাইট্যা পড়ছে, সারার মতন চিৎ আর অজ্ঞান হইয়া পইড়া থাকে নাই, মাসে মাসে তাগো সেই জায়গা ফুইল্যা ওঠে নাই। তাই তারা ধরা পড়ে নাই।

তার যখন প্যাট হয় তখনও সে তেরো বছরের আছিল, সাড়ে নয় মাসে তার চৌদ্দ বছর হয়েছে। এই মাসগুলি সে ধার কইরা বাইচ্যা আছিল।

যেই রাতে সেই ঘটনা ঘটে সেইটা ছিলো বৃহস্পতিবারের রাইত। বৃহস্পতিবার ওই দেশে ফুর্তির দিন, উইক এন্ড, দ্যাশে মজা করন যায় না, তাই ওই দিন তারা দলে দলে আমিরাতে যায় মজা করতে, শুক্রবারের ঝামেলায় পড়তে চায় না। মজা করে ফিরে। আসে শনিবার বিকেলে। সারার বাপ মা সেদিন আমিরাত চলে গিয়েছিলো; বাড়িতে সেই রাতে ছিলো মাত্র সারা, অনেক দূরের ঘরে বান্দীরা, আর ছিলো তার সতেরো বছরের ভাই করিম। ওই রাতে তার ভাই করিম পার্টি দেয়, প্রত্যেক বৃহস্পতিতেই সে পার্টি দেয়; ফুর্তির পার্টিতে আসে তার বয়সের ইয়ার দোস্তরা। সন্ধা থেকে নিচের তলায় শুরু হয় তাদের উদ্দাম পার্টি, মদ, মারিইউয়ানা, সাথে উদ্দাম পশ্চিমা সঙ্গীত; বারোটার দিকে তা উদ্দামতম হয়ে ওঠে, পশ্চিমা সঙ্গীতের তাণ্ডবে বাড়ির চারপাশ গমগম করতে থাকে। সারা নিজের ঘরে ঘুমোতে পারে না। সে বুঝতে পারে ভাই ও তার বন্ধুরা মদ খাচ্ছে, গাঁজা টানছে, আর নাচছে।

সঙ্গীতের সুরের তাণ্ডবে টিকতে না পেরে সারা পার্টির ঘরে গিয়ে উপস্থিত হয়, সে তাদের শব্দ কমানোর জন্যে চিৎকার করতে থাকে। নাচের ঘরটি আধো অন্ধকার, রঙিন আলোতে ভরপুর। সারার পরা তখন রাতের স্বচ্ছ পোশাক, ভেতরে না ঢুকে সে। দরোজায় মাথা ঢুকিয়েই ডাকাডাকি করে। কেউ তার ডাক শোনে না, তাই সে ভাইকে খোঁজার জন্যে ভেতরে ঢোকে। ভাইকে সে পায় না, ভাই হয়তো কোনো বাথরুমে বমি করছিলো। ভাইয়ের মাতাল বন্ধুরা তাকে দেখেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পোশাক ছিঁড়েফেড়ে তারা তাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে, একের পর এক সারাকে ধর্ষণ করতে থাকে। তার শরীর নানা জায়গায় ক্ষতবিক্ষত হয়; সারা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

ভোরবেলা ভাইয়ের ধর্ষণকারী বন্ধুরা তাকে চিনতে পেরে সবাই পালিয়ে যায়।

বাড়ির ড্রাইভার ও বান্দীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তার ঘটনাটি জানায় পুলিশকে, এবং ধর্মরক্ষাকারী মুতাওয়ারা সংবাদ পেয়ে ধর্ম রক্ষা করার জন্যে ছুটে আসে। মুতাওয়ারা ওই দেশের ধর্মীয় গেস্টাপো, তাদের ডরে রাজা রাজপুত্রকন্যারাও কাঁপে, শান্তিতে একটু আধটু টানতে পারে না। সারা তার ভাইয়ের বন্ধুদের কারো নাম জানে না, সে কখনো তাদের সামনে যায় নি, তাদের দেখে নি। তাই সে কারো নাম বলতে পারে না। সারার ভাইয়ের কাছে থেকে পুলিশ তার বন্ধুদের নাম বের করে, কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে, তারা এর মাঝে সুন্দর কাহিনী তৈরি করে ফেলেছে। বন্ধুরা পুলিশকে বলে, ওই সন্ধ্যায় কেউ মদ খায় নি, গাঁজা টানে নি, তার শুধু উচ্চ সঙ্গীত বাজিয়ে আনন্দ করেছে। তারা বলে, মেয়েটি স্বচ্ছ রাতের পোশাক পরে এসে তাদের সাথে ঢলাঢলি করতে শুরু করে, বারবার জেনা করার জন্যে জোর করতে থাকে। তারা প্রথম রাজি হয় নি, তখন মেয়েটি তাদের চুমো খেতে থাকে, তার শরীরের পোশাক খুলে নানা কিছু দেখাতে থাকে, তখন তারা আর নিজেদের দমন করতে পারে না। মেয়েটি সকলের সাথে জেনা করতে চায়, তাই তারা সবাই জেনা করতে বাধ্য হয়। তাদের কোনো দোষ নাই, তারা ফিত্নার পাল্লায় পড়েছিলো।

সারার বাপ আর মা আমিরাত থেকে ফিরে আসে। সারার মা মেয়ের যন্ত্রণা বুঝতে পারে, বিশ্বাস করে মেয়ের কথায়, কিন্তু তার করার কিছু নেই, সে তার মেয়ের মতোই শক্তিহীন। তার বাপ অত্যন্ত ক্ষেপে ওঠে, সে জানিয়ে দেয় জেনা করার জন্যে সারাকে শাস্তি পেতেই হবে। সে আল্লার বিরুদ্ধে হুদুদ করেছে, তারে বাঁচতে দেয়ন যায় না। তার শাস্তি হচ্ছে পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ড। সারার ভাই নিজে  বাঁচার জন্যে চুপ করে থাকে।

তাদের বাড়ি সব সময় ঘিরে থাকে মুতাওয়ারা। তারা অত্যন্ত শক্তিমান, ডালকুত্তার মতো তারা হানা দেয়। তারা সারার বাবার প্রশংসা করে, কেননা সে মেয়েকে শাস্তি দিয়ে ইসলাম রক্ষা করতে যাচ্ছে।

কয়েক দিনের মধ্যে দেখা যায় সারা গর্ভবতী, তাই তাকে অবিলম্বে পাথর ছুঁড়ে মারা যায় না, প্যাটেরটা বাঁচিয়ে রাখা দরকার, ওইটা যদি পুরুষ হয়, তাহলে ত সে মহান আরব হইতে পারে, একদিন দুনিয়া জয় করনের জইন্যে ঘোড়ায় চইড়া বাইর হইতে পারে। প্যাটেরটা তাকে আরো সাড়ে নয় মাস বাঁচিয়ে রাখে, প্যাটের জিনিশের দাম আছে, খালি প্যাটটা যার তার দাম নাই। প্যাট ত কতই আছে, দুই চাইরটা না থাকলেও চলে; তবে প্যাটের ভিতরে যা দিয়া ঢুকায় তার দামের শ্যাষ নাই। একটি মেয়ে জন্ম নেয়, আগে হইলে তারে পুঁইতে ফেলন হইত, এখন হইব না; তবে সারা জীবন ধইরা তারে বাঁচাইয়া রাইখ্যা পোতন যাইব। প্যাটলিগুলিরে জীবন ভইর‍্যাই পোতন যায়। ওই মাইয়াটা যদি পঞ্চাশ ষাইট বচ্ছর সারার প্যাটে থাকতো তাইলে ভালো হইত; কিন্তু সাড়ে নয় মাসে বাইর হইয়া সারাকে পাথর ছুঁড়ে মারার পবিত্র দিন ঠিক করে দেয়।

শহরের পরহেজগার সবাই খবর পেয়ে গেছে এক জেনাকারিণীকে পাথর ছুঁড়ে মারা হবে। তারা আগে থেকেই পাথর মারার সোয়বের জইন্যে অপেক্ষা করছিলো, প্যাটের জিনিশটা তাদের দেরি করিয়ে দেয়, তাতে তাদের জোশও বাড়ে; আর ওই দিন সকাল থেকেই অজু নামাজ করে তারা পবিত্র মৃত্যুদণ্ডের স্থানে ভিড় জমাতে থাকে। পবিত্র উন্মাদনায় তারা সবাই অধীর, তারা এক পাপিষ্ঠার মৃত্যু দেখে, তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে পুণ্য অর্জন করতে চায়। পুণ্যার্থী জনতা যখন তীব্র রৌদ্রে আর টিকতে পারছিলো না, ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলো, তখন পুলিশের গাড়ি এসে থামে। তারা শান্তি পায়, তারা সমস্ত প্রশংসাপ্রাপককে বারবার প্রশংসা করতে থাকে।

গাড়ি থেকে ভঙ্গুর কোমল চোখের জলের মতো সারাকে টেনে নামানো হয়।

সারা রূপসী হয়ে উঠেছে; মৃত্যুর কথা জেনেও কেমনে সে এমন সুন্দর হলো? প্যাটিলিগুলির স্বাভাবই এমন, কবরের কথা ভাবতে ভাবতেও তারা সুন্দর হয়ে ওঠে। জনতা তার নামে উচ্চস্বরে নিন্দা জানাতে থাকে, প্রশংসাপ্রাপকের প্রশংসা করতে থাকে, অল্পক্ষণের জইন্যে তার মুখ দেখে তারা নিশ্চিত হয় যে এমন রূপ যে মাইয়ার সে পাপ না কইর‍্যা থাকতে পারে না, সে ফিনা, সব নিয়মরে উল্টাইয়া সে দিবেই। তারে শাস্তি না দিলে ইসলাম টিকবো না।

সারার হাতপা শেকল দিয়ে বাঁধা, তার মাথা ঝুলে আছে নিচের দিকে। একজন মুতাওয়া সমস্ত প্রশংসাপ্রাপকের দীর্ঘ প্রশংসা করে সারার অপরাধের বিবরণ পড়তে থাকে, যাতে জনগণ ঠিক মতো শুনতে পায় সেজন্য সে উচ্চকণ্ঠে অসতী সারার জেনার বিবরণ পড়ে।

হুদুদের শাস্তি থেকে প্যাটলিগো বাঁচন নাই।

সারার মুখের ভেতরে ঠেসে একটা নোংরা চটের টুকরো ঢোকানো হয়, যাতে সে গোঙাতেও না পারে, তার মাথা একটা কালো আবরণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় চুলে। শয়তার থাকে, ওই চুলের ভেতর দিয়ে মাইয়ালোকের মাথার ভিতর ঢোকে লাখ লাখ ইবলিশ, তাই চুল খোলা রাখা পাপ। তাকে হাটু গেড়ে বসানো হয়, সারা বাধা দেয় না। জল্লাদ তার পিঠে একটি একটি করে পঞ্চাশ ঘা প্রচণ্ড চাবুক মারে। সারা লুটিয়ে পড়তে পড়তে পড়ে না। আহা, পেট থেকে বেরোনোর সময়ই যদি তাকে বালুতে পুঁতে ফেলা হতো!

পাথর বোঝাই একটি ট্রাক এসে সেখানে থামে। ট্রাক থেকে পাথর নামিয়ে এক জায়গায় স্থূপ করে রাখা হয়। ধন্য পাথরের টুকরো। যে-লোকটি সারার অপরাধের বিবরণ পড়েছিলো, সে জনতাকে পাথর ছোঁড়া শুরু করতে বলে।

জনতা সমস্ত প্রশংসাপ্রাপকের প্রশংসা করতে করতে পাথরের স্তূপের দিকে তীব্র বেগে ছুটে যায়।

এই পুণ্যের জন্যে তারা এতো মাস ধরে আর এতক্ষণ রোদের ভেতরে অধীর হয়ে। অপেক্ষা করছিলো, তারা পাথরের পর পাথর নিয়ে সারার দিকে ছুঁড়তে শুরু করে। সমস্ত প্রশংসা প্রশংসাপ্রাপকের। চার দিকে থেকে পাথর এসে লাগতে থাকে সারার মুখে মাথায় শরীরে, পাথরের ঘায়ে সারা এদিক সেদিক দুলতে থাকে, শেষে বালুর ওপর লুটিয়ে পড়ে।

সারাকে একটানা পাথর মারা হয় না। এইটা ত আর মইধ্যযুগ না, আইয়ামে জাহেলিয়া না, এইটা হইল আধুনিক যুগ (তয় মনে হয় ওইখান থিকা আইয়ামে জাহেলিয়া দূর হয় নাই, আরো জমা হইতেছে), মরুভূমিতেও একটু মানবতা আছে, তাই মাঝেমাঝে পাথর ছোঁড়া বন্ধ করা হয়, আমরিকার কায়দায় একজন ডাক্তার পরীক্ষা করে সে বেঁচে আছে কি না। সারা পাঁচ মিনিটে মরে গেলেই ভালো হইত, কিন্তু মাইয়ামানুষ সহজে মরতে চায় না; প্যাটলিরা পাথরের থেকেও শক্ত, পাথরের থেকেও প্রাণহীন, তাগো জন্মের সময় প্রাণই দেয়া হয় নাই, জানই দেয়া হয় নাই, তাই মরবো কেমনে? তাগো মারনের জইন্যে পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে পুরুষপোলাগো জান বাইর হইয়া যাইতেছে।

প্রথমবার ডাক্তার দেখে সারা মরে নাই। জনতা প্রশংসাপ্রাপককের প্রশংসা করে আবার পাথর ছুঁড়তে শুরু করে।

দয়াশীলেরা আবার পাথর ছোঁড়া বন্ধ করে, ডাক্তার সারার নাড়ি পরীক্ষা করে দেখে। না, সারা মরে নাই, পুইত্যা না ফেললে বোধ হয় মরবো না। খালাশের সময়ই বালিতে পুইত্যা ফেলা দরকার আছিল এইটারে।

আবার শুরু হয় পাথর ছোঁড়া, সমস্ত প্রশংসা প্রাপ্য প্রশংসাপ্রাপকের।

তবু সারা মরে না। কিন্তু এতো বিকট পাথরের মুখোমুখি কতক্ষণ টিকবে এই ভঙ্গুর তুচ্ছ পাপিষ্ঠ নিষ্পাপ সুন্দর? এই ফিত্নাটা কতক্ষণ লড়াই করবে পুণ্যবান হিংস্র পাথরের সঙ্গে?

মরতে তাকে হবেই, পাথর তাকে ক্ষমা করবে না, হুদুদের কোনো মাফ নাই। পাথরের থেকে সে বেশি শক্তিমান নয়। পাথরের ক্রোধে সে নিশ্চয়ই নিশ্চিহ্ন হবে, সমস্ত প্রশংসা প্রাপ্য প্রশংসাপ্রাপকের।

ঘণ্টা দুয়েক পর ডাক্তার জানায় সারা মারা গেছে। সফল ধার্মিক পুণ্যশীলেরা পাথর ছোঁড়া বন্ধ করে।

সমস্ত প্রশংসা প্রাপ্য প্রশংসাপ্রাপকের।

পাপিষ্ঠাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে, ধর্ম রক্ষা পেয়েছে। রুব আল-খালির সমস্ত বালু পবিত্র হয়েছে।

মহাদেশনেত্রী ওমরা করতে গেছেন, সারার সংবাদ তিনি পান নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *